KP Imon

Words Crafted

অনিকেত মানব

অদ্ভুত রকমের নীরবতার শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।

বিছানায় উঠে বসে চারপাশে তাকাই। চকচকে দেওয়ালগুলো দেখে প্লাস্টিকের এক জগের কথা মনে পড়ে গেল। বিজ্ঞাপনটা সম্ভবতঃ আরএফএল প্লাস্টিক পণ্যের। খাটের দিকে তাকিয়েও একই জিনিস দেখে না হেসে পারলাম না।

‘প্লাস্টিকেই খেতে হবে!’ বিড় বিড় করে শুয়ে পড়ি আবার।

বুঝতে এখন সমস্যা হচ্ছে না, ঘুম এখনও ভাঙ্গেনি। সম্ভবতঃ পাতলা হয়ে গেছে। স্বপ্নের একটা স্তরে মানুষ বোঝে সে স্বপ্ন দেখছে। আমিও বুঝতে পারলাম।

প্লাস্টিকের দেওয়ালে ঢুকে পড়ার কোন কারণ নেই। আমার ঘর কেমন, তা আমার জানা আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার ঘর ওটা।

এবং সবচেয়ে নোংরা।

চোখ খুলে আমার ঘরের সিলিংয়ে ঝুলতে থাকা নোংরা ফ্যানটাকে দেখবো আমি। ঘাড় ঘোরালে দেখতে পাবো তার থেকেও নোংরা পড়ার টেবিলটা। একমাত্র চকচকে বস্তুটা দেখে আমার মুখে একটা হাসিও ফুটবে।

আমার ল্যাপটপ।

তারপর আর সব দিনের মতই উঠে বসে একটা সিগারেট বের করে আনবো প্যাকেট থেকে। গতকাল রাতে খাওয়ার পর প্যাকেটে আরও তিনটা সিগারেট থাকার কথা।

ওটায় আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে ল্যাপটপটাকে টেনে আনবো বিছানার ওপর। তারপর ঘরের দ্বিতীয় চকচকে বস্তু বাংলালায়নের মডেমখানা ওতে লাগিয়ে লগ ইন করবো ফেসবুকে।

রাজাকারদের ফাঁসী দিতে সরকারের বেশ অনীহা – বিষয়টা বেশ গরম হয়ে উঠেছে এতদিনে। ইভেন্ট খোলা হয়েছে, তার কার্যক্রমও বেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। শাহবাগ জাগরণ নয়, নতুন ইভেন্টের দিকেই এখন তরুণসমাজ চলে গেছে।

কোনরকম স্বার্থ ছাড়া এখানে কাজ হচ্ছে এবার, সরকার ও অন্যান্য পক্ষ যেন প্রভাবিত করতে না পারে সেজন্য বেশ কিছু স্তরের নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। কাজেই আমার আশা করতে বাঁধা নেই, সবকিছু এবার ঠিক করা যাবে। আগামীকাল থেকে আমরণ অনশন শুরু। ঘুম থেকে উঠে একবার শেষবারের মত অনলাইনটা দেখে আমি চলে যাবো ওদিকে। কাজেই এখন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখাটা একেবারেই ছেলেমানুষী হতে যাচ্ছে।

বিনা শব্দে এই সময় প্লাস্টিকের দেওয়ালের একটা অংশ খুলে যেতে শুরু করলো।

দৃশ্যটা স্বপ্নের হতে পারে, তবে এতটাই বাস্তব – লাফিয়ে উঠে বসলাম খাটে। তারপর তড়াক করে নেমে পড়লাম। দুই চোখ দরজামত ফোকরটার দিকে নিবদ্ধ। ও আবার খুলছে কেন?

উত্তেজনায় প্রথমে খেয়াল করিনি, এবার করলাম। মেঝেতে খালি পায়ে নেমে পড়েছি, কিন্তু আরামদায়ক একটা উষ্ণতা পায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। শীতল কোন মেঝে এটা না।

সতর্ক চোখে একবার মেঝেটাকে দেখলাম। এটাকে দেখেও উজ্জ্বল সাদা প্লাস্টিকের মত লাগছে। বাম দিকে তাকিয়ে এবার আয়নাটার দিকে চোখ পড়লো। আগে তো ছিল না?

ঘুম ঘুম চোখে সুদর্শন এক তরুণ আয়নার ভেতর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে ভীতি।

নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, ‘কাম অন, জাস্ট আ ড্রীম।’

বিড় বিড় করে কথাটা বলেই, লম্বা পায়ে হেঁটে যাই ফোকড়ের দিকে।

বের হতেই দেখতে পেলাম ওটাকে।

প্রথমবারের মত।

স্ফটিক স্বচ্ছ একটা প্রাণি, মানুষের মত দুটো হাত আর দুটো পা আছে এটার। চুলগুলো ফ্যাকাসে ধূসর।

চোখের মণিদুটো কুচকুচে কালো।

দ্বিতীয়বার তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম, শরীরটা স্ফটিকের নয় এর, প্রায় স্বচ্ছ হলেও ওটা চামড়া। রোমকূপগুলো পর্যন্ত ভালো করে তাকালে দেখা যাচ্ছে।

এতক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, এবার আমার দিকে অবিচল পায়ে হেঁটে আসতে শুরু করল।

আমার ঠিক দুই ফিট সামনে এসে থেমে গেল প্রাণিটা। চোখের মণির ভেতরের ছোট বৃত্তাকার পিউপিল দুটো নিমেষে সংকুচিত হয়ে যেতে থাকে।

আঁতকে উঠে পিছিয়ে যাই আমি আরও দু’পা।

শান্ত ভঙ্গীতে আমার চোখে চোখ রাখে স্ফটিকস্বচ্ছ জীবটা।

তারপর হাল্কা করে ঠোঁট নাড়ল, ‘পূজনীয় তরিকুল ইসলাম রাতুল, আপনার বিশেষ ক্ষমা অনুগ্রহ করছি। আপনার ভাবনা সঠিক নয়। আপনি স্বপ্ন দেখছেন না।’

১.

শরীরের শক্তির শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত খরচ করে ছুটছি সামনের দিকে।

খালি পায়ে আছি, কাজেই হাল্কাতম শব্দও হচ্ছে না। তবে আমার পা থেকে শব্দ না হলেও পেছনের একজোড়া পদশব্দ কানে আসে। অদ্ভুত ধরণের জীবটা আমার পেছনে পেছনে ছুটে আসছে।

ওটাকে আমি মানুষ বলতে পারতাম, তবে মানুষের ত্বক এরকম স্ফটিকের মত হয় না। এবং অবশ্যই, তারা কখনই এধরণের প্লাস্টিক সদৃশ দেওয়ালের খোপে থাকে না।

স্বপ্ন হোক আর বাস্তব, যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা একটাই, এখন আমি কোন এক এলিয়েন স্পেসশিপের ভেতর আছি।

এতক্ষণ পালাতে পালাতে যেসব যন্ত্র আমি এখানে দেখেছি, তাতে আর কোন ধারণা আসার সুযোগই পায়নি। মানুষের মত দেখতে স্ফটিকের প্রাণিটার বংশপরিচয়ও এখন স্পষ্ট।

নিজেকে কয়েকবার জোর গলায় বলি, ‘আমি জেগে উঠতে চাই! জেগে উঠবো এখন আমি। আমার আর এই স্বপ্নটা দেখতে ভালো লাগছে না।’

শরীর ঘেমে যাচ্ছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তবে ঘামের কোন অস্তিত্ব অনুভব করছি না। হিউমিডিটি নিয়ে এদের প্রযুক্তি কি অনেক উন্নত?

জবাব পাওয়ার জন্য এলিয়েনের ছেলের কাছে ধর্ণা দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই।

তবে আমি জাগতে পারলাম না। বরং প্রথমবারের মত পা পিছলালাম।

পতনটা চারপাশের নীরবতার মাঝে প্রচণ্ড শব্দের সাথেই হল। দড়াম করে পড়ে গিয়ে প্রায় সাড়ে সাত ফিট পিছলে চলে গেলাম। দেওয়ালগুলো মেঝের সাথে কিছুটা কার্ভড – এরকারণে শরীরের কোথাও তেমন লাগল না।

তবে উঠে বসে আমি হাঁফাতে থাকি, ব্যথাটা স্পষ্ট অনুভব করেছি।

স্বপ্নে ব্যথা পাওয়া যায় না – কথাটার সত্যতা কতটুকু?

আচমকা সচেতন হলাম।

ঘরের মাঝে আমার নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

পৃথিবীতে একটাই শব্দ যেন, আমি হাঁফাচ্ছি সেটা। আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না কোথাও।

পেছনে ছুটে আসা ত্রাসটার অবস্থান সম্পর্কে জানার কোন উপায় নেই। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম।

চারপাশে তাকিয়ে একবার নিজের অবস্থান দেখি। আরেকটা ঘর, তবে এখানে কোন আসবাব নেই। বরাবরের মত হাল্কা বাঁকানো প্রতিটা দেওয়ালের সংযোগগুলো। এখানেও প্লাস্টিক আবরণের মত একটা আভা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে চশমা রাখার কোন বাক্সের ভেতর ভুলক্রমে ঢুকে পড়েছি।

পেছনের দেওয়ালটা নিঃশব্দে খুলে যেতেই পড়ে গেলাম। মাথা মেঝেতে ভালো করে ঠুকে যেতে পারত, তবে কানের কাছে বাতাস কেটে একটা হাত চলে যায়, খপ করে আমার শার্টের কলার ধরে একটানে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাকে।

ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাই। এক ফিটের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত প্রাণিটা।

স্বচ্ছ চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ।

‘ভীত হবার কিছু নেই। আপনার কোন ক্ষতি হবে না।’ জন্তুটার ঠোঁট সামান্য বাঁকল বলে মনে হল।

এক পা পিছিয়ে যাই আমি, ‘আমি কোথায়?’

‘গ্রাহেম কিরণের বাগানবাড়িতে।’

‘গ্রাহেম?’

‘আপনাদের শিক্ষাব্যবস্থাতে এটাকে ‘ডক্টর কিরণ’ বলা হত হয়ত। তবে একজন গ্রাহেম সেসব ডক্টরদের থেকে অনেক বেশি জ্ঞান রাখেন।’

শান্ত হওয়ার চেষ্টার অংশ হিসেবে পকেটে হাতজোড়া পুরে দিলাম, ‘আমি কি তাহলে গ্রাহেম কিরণের সাথে কথা বলছি?’

মাথা নাড়ে লোকটা, ‘আমি তার মিনিওন।’

বিদ্রুপ করার সুযোগ পেয়ে ছাড়লাম না, ‘দাসপ্রথা আপনাদের গ্রহে চালু আছে নাকি? সভ্যতার হিসেবে তাহলে মানুষই এগিয়ে আছে। দাসব্যবস্থা অনেক কাল আগেই তুলে দিয়েছি আমরা।’

‘গ্রহটা আপনার নিজেরও। সভ্যতার দিকে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন ভুল ছিলো না। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে গত কয়েক হাজার বছরে দাস হিসেবে দেখেনি। বর্ণবৈষম্য দূর করা সম্ভব হয়েছিল – তারপরও পেরিয়ে গেছে কয়েক হাজার বছর।’

সাবধানে তাকালাম এবার আগন্তুকের দিকে, ‘বলতে চাইছেন, আমি পৃথিবীতেই আছি। কয়েক হাজার বছর এগিয়ে গেছি শুধু? আর মানুষ যদি মানুষকে দাস হিসেবে না দেখেই থাকে, আপনি কিভাবে গ্রাহেম কিরণের মিনিওন হতে পারেন?’

আমার মতই নিজের পকেটে হাত ঢোকায় অদ্ভুত লোকটা, তারপর একঘেয়ে কণ্ঠে বলে, ‘আমি একজন FDR 2iX DNMstrFFP শ্রেণির রোবট। গ্রাহেম কিরণের সর্বশেষ আবিষ্কার।’

ঠোঁটদুটো একটা আরেকটার ওপর চেপে ধরে মাথা দোলালাম দুইবার, ‘মেকস সেন্স। রোবট। বাই দ্য ওয়ে, কত সাল এটা?’

‘৬০৭৮।’

বিস্ময়ের ধাক্কাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরব করে দেয় আমাকে।

দুইজন চুপ হয়ে যেতেই অদ্ভুত নীরবতাটুকু ফিরে আসে কানে। নীরবতা আমার পছন্দ। তবে এটা একটু অতিরিক্ত।

পাখির ডাক থেকে দূরে মানুষের কোলাহল – কোন কিছুই নেই। এখন পর্যন্ত একটা জানালাও দেখিনি।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভীতিকর রকমের সুন্দর একটা রোবট যেন বেশ মানিয়ে গেছে এই নীরবতায়।

হাল্কা করে গাল চুলকালাম, ‘মিনিওন বলেই ডাকবো তাহলে তোমাকে?’

একটা রোবটের সাথে আপনি-আত্তি করার কোন কারণ দেখলাম না। চট করে এক ধাপ ডিমোশন দিতে আমার বিবেকে কোনরকম খোঁচা অনুভব করলাম না এক-ই কারণে।

মাথা হাল্কা দোলালো মিনিওন, ‘আপনি আমাকে যে কোন কিছু বলে ডাকতে পারেন।’

‘তোমাকে তোমার মডেল নাম্বার ধরে ডাকতে পারবো না। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা আমি বুঝি।’ বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘যতদূর মনে পড়ে, গতকাল ঘুমাতে যাওয়ার সময় আমি ২০১৪ সালেই ছিলাম। সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ ছিলো সেটা, যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে। তাহলে, চারহাজার চৌষট্টি বছর ভবিষ্যতে আমি এখন।’

মাথা নাড়ে মিনিওন, মানুষের মত অভিব্যক্তি এ দিতে পারে, বেশ কয়েকবার দেখলাম, ‘পূজনীয় রাতুল, তথ্যটি সঠিক নয়। আপনি যদি আপনাদের ৩৬৫ দিন ছয় ঘন্টাতে এক বছরের হিসেবে বলে থাকেন, তাহলে আপনি আছেন চারহাজার চারশ ছাব্বিশ বছর ভবিষ্যতে।’

উত্তরটা আমার পছন্দ হল না, সাফ সাফ জানিয়ে দিলাম, ‘রোবট না হলেও অংক পারি আমি।’

রোবটটা লজ্জাতে এতটুকু হয়ে যায় সাথে সাথে, ‘ক্ষমা করবেন, পূজনীয় রাতুল, আমি আপনাকে অপমান করার উদ্দেশ্যে কথাটি বলিনি।’

একবার ওটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ব্যাখ্যা কর।’

‘পৃথিবী গত ১৮৯২ বছর ধরে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টার পরিবর্তে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে ৪৩৫ দিন ৬ ঘণ্টাতে। কক্ষপথগুলো ৪১৮৬ সালে দূরে দূরে সরে গেছে। সৌরজগত টিকে থাকলেও পৃথিবীতে আগের মত ঋতু পরিবর্তন এখন হয় না।’

‘একটা প্রাণিরও বেঁচে থাকার কথা না।’ একটু না হেসে পারলাম না, ‘কারণ, সূর্যের থেকে এতটা দূরে চলে আসলে একটা গাছও বাঁচবে না। ফুড সার্কেল ধরে প্রতিটা প্রাণি মারা যেতে বাধ্য। এর চেয়ে ভালো সাই-ফাই ড্রীম আশা করেছিলাম আমার মস্তিষ্ক থেকে।’

কিছুক্ষণ পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে রোবটটা। তারপর আবারও বিশ্লেষণী গলাতে বলা শুরু করে, ‘আপনি সঠিক তথ্য দিয়েছেন। তবে, এই বিপর্যয়ের ব্যাপারে সাড়ে তিনশ বছর আগেই পৃথিবীবাসী অবহিত ছিলো। বিজ্ঞানী মেরদশ এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে দ্বিতীয় সূর্য সৃষ্টি করেন।’

‘বালের প্যাচাল পাইড়ো না মিয়া!’ হঠাৎই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় আমার, ‘দ্বিতীয় সূর্য না যুবকের পেটে বাচ্চা! তোমার গ্রাহেম কিরণকে ডাকো। আইনতঃ দন্ডনীয় একটা কাজ করছ তোমরা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে নিয়ে এসেছ এখানে।’

‘ক্ষমা করবেন পূজনীয় রাতুল, পুরুষ প্রজাতির পেটে সন্তানধারণ সম্ভব নয়।’ মিন মিন করে বলে রোবট।

ব্যাটার কানপট্টি এক থাপ্পড়ে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমার হাত নিশপিশ করতে থাকে।

তবে পাঁচ সেকেন্ডের মাঝেই ওটা মাথা চলে গেল। আরও বড় একটি সমস্যা এই মাত্র সৃষ্টি হল।

মিনিওন অবিকল মানুষের মত শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।

‘তাছাড়া পূজনীয় কিরণের সাথে আপনি কথা বলতে পারবেন না। তিনি মারা গেছেন ৫৪৯৮ সালে।’

পরের বাক্যটা বলতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার গলা অত্যাধিক শীতল হয়ে গেছে, ‘তাহলে যে মানুষটি এখানের চার্জে আছেন তাঁর সাথে কি কথা বলতে পারি?’

অন্যদিকে তাকালো মিনিওন। মানুষের স্বভাবসুলভ অভিব্যাক্তি।

আমার দিকে না তাকিয়েই বলে ওটা, ‘আরেকটি তথ্য আপনি জানেন না। পৃথিবীতে আর কোন মানুষ বেঁচে নেই। আপনিই মানব প্রজাতির সর্বশেষ প্রাণি।’

২.

দুই হাতে মাথা খামচে ধরলাম আমি, স্বপ্ন ভাঙ্গছে না কেন আমার?

তবে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলাম।

‘বুঝিয়ে বলো।’ ঝাড়া ত্রিশ সেকেন্ড পর প্রশ্নটা করলাম আমি।

‘পাঁচশ আশি বছর আগের এক বিপর্যয়ে মানব প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।’

‘আমাকে বাইরে নিয়ে চলো। এখান থেকে বের হব আমি।’ কর্তৃত্ব ধরে রেখে জানালাম মিনিওনকে।

একঘেয়ে কণ্ঠে বলে মিনিওন, ‘বাইরে যেতে হলে এপথে বেরুতে হবে। অনুগ্রহ করুন।’

হাতের কাছে কোন বেসবল ব্যাট থাকলে হতচ্ছাড়া এই রোবটকে এখানেই পিটিয়ে ট্যামা বানিয়ে ফেলতাম। সেখানে বলছে অনুগ্রহ করতে।

মানবীয় সব গুণাবলী কাজে লাগিয়ে রাগ দমন করে রোবটের পেছন পেছন হাঁটি এবার।

‘আপনি মুক্ত, পূজনীয় রাতুল। তবে আপনার সাথে সর্বক্ষণ থাকার ব্যাপারে আমার প্রতি আদেশ করে গেছিলেন পূজনীয় কিরণ।’

‘সেটার কারণ?’

‘আপনি মানব প্রজাতির শেষ স্যাম্পল। আপনার কোনরকম ক্ষতি হলে এই গ্রহটিতে মানুষ থাকার আর কোন সম্ভাবনা থাকবে না।’

হতাশ হয়ে তাকালাম রোবটের দিকে, ‘ওহ, মানব সন্তান আশা করছ কিভাবে? আমরা সেলফ প্রোডাক্টিভ কোন স্পিসিস না। ছিলাম না কখনও আরকি। এ যুগের কথা বলতে পারবো না।’

হাঁটতে হাঁটতেই আমার দিকে ফিরে তাকায় মিনিওন, ‘এযুগেও মানব প্রজাতি একক প্রচেষ্টাতে সন্তান জন্ম দিতে পারে না।’

‘আর তুমি বলেছ, পৃথিবীর শেষ মানুষ এখন আমি। মানব কন্যার কথা শুনিনি। রোবট হিসেবে লজিক দিয়ে বিচার করে দেখার কথা। তাহলে বুঝতেই পারছ, পৃথিবীতে আমি যদি শেষ মানুষ হয়ে থাকি, তাহলে একজন মানবী ছাড়া মানবপ্রজাতির আসলেই কোন উপায় থাকার কথা না। আছে নাকি?’

‘নেই। তবে আমার ভেতর আশাবাদী একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সেজন্য পূজনীয় কিরণের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

জানালার মত ছাতের কাছে থাকা ফোকড়গুলো দিয়ে হাল্কা আলো আসছে। সেদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তা ঠিক। মানব প্রজাতির শেষ সীমাতে চলে আসলে আশাবাদী রোবট বানানোর দরকার থাকবেই।’

‘প্রস্তুত হন, পূজনীয় রাতুল। এই দরজার ওপাশেই আপনার গ্রহ পৃথিবীতে পা রাখতে পারবেন।’

মিনিওনের কথা শুনে দাঁড়িয়ে যাই।

নিজেকে কয়েকবার চিমটি দিলাম। ব্যথা তো করে। স্বপ্ন যদি এটা না হয়ে থাকে, তাহলে হাজার হাজার বছর পেরিয়ে কিভাবে চলে এলাম এখানে? কোন যুক্তিতে সেটা সম্ভব?

শুধু আমি কেন?

পৃথিবীবাসী মারা গেছে, তার অর্থ একটাই, বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছিলো পুরো গ্রহটা। তাহলে আমি বেঁচে আছি কিভাবে?

প্রশ্নগুলো করার আগেই মিনিওন হাল্কাভাবে দেওয়াল স্পর্শ করে পাতলা একটা প্যানেল খুলে ফেলেছে।

বাইরে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি আমি। এটা আমি কি দেখছি?

চারপাশে শুধু বালি এবং বালি। বিশাল কোন একটা মরুভূমির মাঝে যেন আটকে গেছি আমরা। যে মরুভূমির শুরু আছে, শেষ নেই।

ঠিক মাঝখানে এই বড় বাড়িটা। ভেতর থেকে যেমন চশমার বাক্স মনে হয়েছিল বাইরে থেকে মোটেও সেরকম কিছু নয়। বাড়িটার ডিজাইন ভেতরে যেমনই হোক, বাইরে স্থাপত্যশিল্পের অসামান্য নৈপুন্য দেখানো হয়েছে। তাকিয়ে আমি আর চোখ ফেরাতে পারলাম না।

চকচকে কাঠামোটা কোন ধাতুর হতে পারে, আমি জানি না। তবে বাড়ি না ভেবে এটাকে প্রথমবার দেখলে স্পেসশিপ বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখান থেকে দেখেই একটা ধারণা চলে আসে- সূর্য থেকে অবিরাম তাপ শুষে চলেছে ওটা।

পরক্ষণেই পাঁই ঘুরে যাই আকাশের দিকে মুখ করে।

মাথার ওপর একটা সূর্য আছে। আর – আমার মুখ থেকে বিস্ময়ে চিৎকারটা বের হয়েই আসে।

‘ওহ মাই … কথা দেখছি ঠিকই বলেছিলে, মিনিওন।’

দিগন্তের কাছাকাছি আরেকটা সূর্য দেখা যাচ্ছে। অনেকটা চাঁদের মত দেখাচ্ছে ওটাকে এখান থেকে, তবে সূর্য যদি পৃথিবী থেকে আরও দূরে চলে যায়, এমনটাই দেখানোর কথা ওটাকে।

দ্বিতীয় সূর্যটাই এখন ইফেক্টিভ সূর্য হিসেবে কাজ করছে।

‘কিন্তু … কিভাবে?’ ফিস ফিস করে জানতে চাই আমি।

‘৩৮৪১ সালে নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল পাওয়া যায় পৃথিবীতে। আফ্রেনিয়াম। ফিশন নয়, ঘন ঘন ফিউশনের মাধ্যমে সূর্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যেটাকে মাথার ওপর দেখতে পাচ্ছেন- ‘ অনায়াসে মুখ তুলে সূর্যের দিকে চোখ রাখে মিনিওন, ‘ওখানে বার বার নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন ঘটছে। প্রয়োজনীয় আফ্রেনিয়াম ওখানে পাঠানো হয় প্রতি দুইশ বছরে একবার। রকেটের মাধ্যমে।’

‘নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন এড়িয়ে অক্ষত যায় ওটা?’

‘৩৭৬৫ সালেই আবিষ্কার হয়েছে কনডেরিয়াম – ধাতুটির গলনাংক সর্বোচ্চ। স্ফূটনাংক এখনও বের করা যায়নি। কনডেরিয়ামকে গলানো সম্ভব হয়েছে অষ্টম মাত্রার নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশনের মাধ্যমে। ফুটানো আদৌ সম্ভব হবে বলে ধারণা করা যায়নি। কনডেরিয়ামের স্বয়ংক্রিয় রোবটিক পার্টস আমাদের দ্বিতীয় সূর্যকে বাঁচিয়ে রাখছে।’

‘রেডিয়েশন?’

‘আফ্রেনিয়াম এজন্যই ব্যবহার করা হয়েছে। পরিবেশ বান্ধব নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন এটা।’

কিছু বললাম না।

পরিবেশবান্ধব নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন শেখাচ্ছে আমাকে! মানবজাতি কিভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে মোটামুটি বুঝে ফেললাম।

তবুও জানতে চাই, ‘পরিবেশের প্রেমে উথলাতে উথলাতেই কি মানবজাতি উধাও হয়ে গেছে?’

আমার ভাষা ধরতে গিয়ে রোবটটার কষ্ট হচ্ছে বলে মনে হল, এক সেকেন্ড দেরী হয় এবার তার উত্তর দিতে, ‘না, পূজনীয় রাতুল। পৃথিবী সহ সৌরজগতের গতিপথ ধীরে ধীরে সরে যায়। একই জায়গাতে এরা নড়াচড়া করছে বলে মনে হলেও একটু একটু করে ঘুরছে বিশ্ব। ৫৪৯৮ সালে এভাবেই ফ্রিটজ ওয়েভের সাগরে ডুবে গেছিলো পৃথিবী। প্রতিটি প্রাণি মারা গেছে তখনই।’

শুন্য দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে, ‘তারা আগে থেকে জানতো না?’

মাথা নাড়ে মিনিওন, ‘আক্রান্ত হওয়ার পর বিষয়টা ধরা গেছিলো। পাহাড়ী মানুষ দ্রুত মারা যাচ্ছিল। সেই সাথে মানবসহ সকল প্রাণী হারিয়েছিল প্রজননক্ষমতা। নিচু এলাকাতে গবেষণা করে কারণটা বের করতে পারলেও শেষ রক্ষা হয়নি।’

‘গাছ?’

‘গাছদের কোন ক্ষতি হয়নি। উদ্ভিদ জগত টিকে আছে। তবে ভূগর্ভীয় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখানে যেমনটা দেখছেন, মরুকরণ হয়েছে। আগে এমনটা ছিলো না। আবার মরুভূমিতে গাছের জন্ম হয়েছে। সম্ভবতঃ বায়ু-পরাগায়নের ফসল।’ জানায় মিনিওন।

আড়চোখে মাথার ওপর সূর্য দুটোকে দেখলাম আরেকবার। অদ্ভুত রকম একটা শুন্যতা চেপে ধরছে আমাকে।

পৃথিবীতে আসলেই আর কেউ বেঁচে নেই? আমিই শেষ মানুষ?

খাঁ খাঁ করছে মরুভূমি।

এই নিয়ে পঞ্চাশবারের মত নিজেকে বললাম, ‘জেগে ওঠো, রাতুল! জেগে ওঠো!’

‘আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?’ এক পা এগিয়ে এসে জানতে চায় মিনিওন, ‘প্রাতরাশ সারতে হবে আপনাকে। সকালের নাস্তা টেবিলে সাজানো আছে। চলুন।’

ক্ষ্যাপাটে ভঙ্গীতে রোবটটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম পরমুহূর্তে। আমাকে পাল্টা আঘাত করলে কি আমার ঘুমটা ভাঙ্গবে না?

‘হারামজাদা, এত মানুষ থাকতে আমি কেন আটকে গেছি ছয় হাজার আটষট্টিতে? কে তুলে এনেছিলো আমাকে?’

প্রচণ্ড জোরে রোবটটাকে ঘুষি মারার সময় ভেবেছিলাম ধাতব কোন কিছুতে হাত বাধা পাবে। কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম একটা মানুষকে মারার মতই অনুভূতি হল।

হিউম্যান অ্যানাটমির দিকে চোখ রেখেই রোবট প্রস্তুত করতেন এই সময়ের বিজ্ঞানীরা?

না, হয়তো। এটা স্বপ্ন – আর স্বপ্নে সবই সম্ভব!

পরের ব্যাখ্যাটা ঠিক ধরে নিয়ে মিনিওনের বুকে জোরে লাথিটা চালাই।

এবার রোবটটা প্রস্তুত ছিলো। নিমেষে সরে যায় আমার সামনে থেকে।

‘রেগে যাবেন না। আপনাকে আমিই তুলে এনেছিলাম আপনাদের সময় থেকে।’ আমার পরের ঘুষিটা এড়িয়ে গিয়ে জানায় মিনিওন বিনয়ের সাথে, ‘তাছাড়া, আমাদের জন্ম হয় না ঠিক। কাজেই হারামজাদা শব্দটা আমার ক্ষেত্রে ব্যবহার করাটা ভাষা ব্যবহারের নিয়ম অনুযায়ী সঠিক নয়।’

আমার ভবিষ্যত এই ভবিষ্যতে ডুবিয়ে দিয়ে রীতিমত ব্যকরণ আর ভাষাতত্ত্ব শেখাচ্ছে?

ক্রোধে আমার চোখ লাল হয়ে আসে।

তৃতীয়বারের মত ঝাঁপিয়ে পড়লাম রোবটটার ওপর। একটু সরে সহজেই আমার আঘাত এড়ায় ওটা আবার।

তারপর সাড়াশির মত একটা হাত দিয়ে চেপে ধরে আমার ঘাড়।

প্রচন্ড চাপে জ্ঞান হারাচ্ছি, তার মাঝেই দূর থেকে শোনা যায় মিনিওনের একঘেয়ে কণ্ঠস্বর, ‘অনুগ্রহ করবেন, আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ছোট একটা …’

আর কিছু শুনতে পেলাম না। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যায়।

৩.

ঘুম থেকে উঠেই মিনিওনের ভচকানো মুখটা দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

‘পূজনীয় রাতুল, আপনার ট্রেইনিংয়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।’ দরজাতে এসে দাঁড়িয়ে বলে রোবটটা।

হাই তুলতে তুলতে উঠলাম। তারপর ড্যাব ড্যাব চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা মিনিওনকে কষে একটা ধমক লাগালাম।

‘এটা অভদ্রতা, মিনি! আধ-নেংটো একটা লোকের দিকে তাকিয়ে আছো।’

‘মানব সমাজের রীতিনীতি একজন রোবটের জন্য -’

‘শাট আপ অ্যান্ড গেট লস্ট। নাস্তা পাঠাও। খেয়ে ট্রেইনিং রুমে চলে আসবো আমি। তোমাকে আর স্নিফ স্নিফ করতে হবে না।’

মিনিওন একদিকে চলে গেল।

জানালার কাছে গিয়ে আস্তে করে বললাম, ‘খোলো!’

বিনা শব্দে জানালাটা খুলে যায়। চারপাশে ধূসর মরুভূমি দেখতে দেখতে আমি এখনও ক্লান্ত হইনি। আজীবন বাংলাদেশের মত সবুজে বেড়ে ওঠা একটা ছেলের জন্য মরুভূমি এত দ্রুত ক্লান্তিকর কিছু হতে পারে না।

তাছাড়া আমি জানি এই মরুভূমিতে বেশিদিন নয়। বাইরের পৃথিবীর দিকে রওনা দেবো আমি আর কয়েকদিনের মাঝেই। তবে সেজন্য প্রস্তুতি নিয়েই বের হতে হবে আমাকে।

ট্রেইনিং সেন্টারের দরকার আসছে এখানেই।

আরেকবার হাই তুললাম বাইরের দ্বিসূর্য সৌন্দর্য দেখতে দেখতে।

প্রথম যেদিন জেগে উঠেছিলাম, সেদিনের কথা মনে পড়লে তিক্ত হাসি ফোটে মুখে। শুধু স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল তখন।

সাতটি দিন পেরিয়ে গেছে।

এখন আমি জানি কতটা বাস্তব এই জগত।

মানবজাতি ৫০০০ সালে পা রেখেছিল যখন, তখনও টাইম মেশিন জিনিসটা বাস্তব প্রয়োগযোগ্য করা সম্ভব হয়নি । সময়ের সাথে ধানাই পানাই করাটা এত সহজ ছিলো না।

সময়ের সাথে স্পেসের সম্পর্ক ঠিক করা যেতে পারে, ৬০ কিলোমিটার দূরে যেতে যদি ৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতি ব্যবহার করা হয়, তখন আমরা এক ঘন্টাতে সেখানে যেতে পারি।

৬০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড গতিবেগে যেতে পারি এক সেকেন্ডে।

তাহলে, যদি সময়ের ক্ষুদ্রতম অংশে যদি সে স্থানে যাওয়ার মত গতিবেগ কারও থাকে, সে ০ সেকেন্ডে পৌঁছে যাবে ৬০ কিলোমিটার দূরে।

স্পেস স্টেশনে টাইম ডাইলেশন হয়, পৃথিবীর এক বছরের তুলনায় ০.০০৭ বছরের মতো সময়ের পার্থক্য। তবে এতে করে আদতে সময়ে ভ্রমণ করা যায় না, বরং উভয় পক্ষই সময় ভেদ করে সামনের দিকে আগাচ্ছে, ভিন্ন গতিতে কেবল। এই গতি এমন আহামরি কিছু তফাত নয়।

এই তত্ত্বলে যদি-কিন্তু-দিয়ে অতীতে অনায়াসে যাওয়া যায়, শুধুই তাত্তিকভাবে। ভবিষ্যতে যাওয়াটা সম্ভব করতে গিয়ে আরও অনেক বিজ্ঞানীর চুল পেকেছে।

গ্রাহেম কিরণের ছবি দেখলাম, ইনি হয়েছেন টাক। চুল পেকেই ক্ষান্ত দেয় নি, সব একে একে পড়েও গেছে টাইম মেশিন আবিষ্কারের জন্য।

এবং টাইম মেশিন আবিষ্কার করে তিনি প্রথমেই যে সমস্যাটা অনুভব করেছিলেন, অতীতে সাধারণভাবে এই মেশিনকে পাঠানো গেলেও ভবিষ্যতে একবার ট্রাভেল করার পর চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো সব বিপরীতমুখী হয়ে কাজ করতে শুরু করবে।

যার অর্থ সহজ, একবারের বেশি ট্রাভেল করতে পারবে না একটা মেশিন। কেন, তা তিনি বের করতে পারেননি। সময়ে কুলোয়নি।

৫৪৩৭ সালে মানব ইতিহাসে প্রথম টাইম মেশিন আবিষ্কার করা হলেও একবারের বেশি ব্যবহারে অক্ষম এই যন্ত্রটার সঠিক ব্যবহার কখন করা যেতে পারে তা নিয়ে সন্দেহ ছিলই। আর কোন বিজ্ঞানী না জানে, যতক্ষণ না সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে – কোন যন্ত্রকে “আবিষ্কৃত” ঘোষণা করা যায় না। তিনি অনেকগুলো বছর ব্যস্ত ছিলেন ঐ একবার-ভ্রমণ তত্ত্বের সমাধান করার জন্য। কেন? ততদিন পর্যন্ত গ্রাহেম কিরণ ভেবেছিলেন প্রথম টাইম ট্রাভেল তিনি নিজেই করবেন। ৫৪৯৭ সালে এসে দ্বিধা কাটিয়েছেন গ্রাহেম কিরণ। পৃথিবী ততদিনে ঢুকে পড়েছে ফ্রিটজ ওয়েভের মহাসমুদ্রে।

মানবজাতির নিশ্চিহ্নকরণ ঘটতে যাচ্ছে নিশ্চিতভাবেই। গ্রাহেম কিরণ মিনিওনকে অতীতে পাঠালেন একজনকে নিয়ে আসার জন্য। নিজের কিংবা মানবজাতির অন্য কাউকে পাঠাবার বিলাসীতার সময় তখন নেই।

তার আগে নিখুঁতভাবে হিসেব করলেন ফ্রিটজ ওয়েভ থেকে পৃথিবীর বের হতে কত বছর লাগবে। তাঁর হিসেবে সময়টা চারশ আশি বছর।

তবে মিনিওন কোন ঝুঁকি নেয় নি, একজন মানুষ নিয়ে সে আরও একশ বছর সতর্কতা সময় রেখে ৬০৭৮ এ ফিরে এসেছে সময় ধরে।

দুঃখজনকভাবে, ফ্রিটজওয়েভের প্রভাবে গ্রাহেম কিরণও মারা যাচ্ছিলেন। আরেকটি টাইম মেশিন তৈরি করে আর বিশ-পঁচিশজন অতীত থেকে আনার ব্যবস্থা করার সময় তিনি পাননি। শোনা যায় এ নিয়ে একটি প্রজেক্ট শুরু করেছিলেন বটে, তবে শেষ করা হয়নি। আগেই অক্কা পেয়েছেন।

’৩৭ সালে গ্রাহেম কিরণ যখন টাইম মেশিন আবিষ্কার করেন, তাঁর মেশিনের গঠনটা ছিলো একজন মানুষের জন্য। টাইম মেশিন ভ্রমণ করার সময় যে অভ্যন্তরীণ গতিবেগ পেয়ে থাকে, তা একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট হতে পারে। কাজেই তাকে এই সময়টা ফ্রিজিং রুমে ঘুমিয়ে কাটাতে হয়।

সময়ে প্রতিভ্রমণ শেষে আবার জেগে উঠতে পারলেই অভিযান হবে সফল। মাঝপথে মরে গেলে আদিম মানুষের মাথার ওপর টাইমমেশিন আছড়ে পড়া ছাড়া আর কোন কাজের কাজ হবে না।

কিন্তু যখন ’৯৭ সালে একজন মানুষকে পৃথিবীর বুকে নিয়ে আসার দরকার দেখা পড়ল, গ্রাহেম কিরণ নিজে না গিয়ে মিনিওনকে পাঠালেন আর কাওকে নিয়ে আসার জন্য।

প্রথমে শুনে অবাক হয়েছিলাম।

‘গ্রাহেম নিজেও টাইম মেশিন নিয়ে পাঁচশ বছর সামনে চলে যেতে পারতেন। তাহলেই তিনি আবারও শুরু করতে পারতেন সবকিছু, তাই না?’ জানতে চেয়েছিলাম মিনিওনের কাছে।

‘বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে চলে এসেছিলেন তিনি। ভাবেননি কাজটা শেষ করে যেতে পারবেন।’

‘সেক্ষেত্রে ’৯৭ সালের কোন মানুষকে তিনি নির্বাচন করে যেতে পারতেন। তাঁর যুগের প্রতিভাবান কোন তরুণকে।’

‘পেছনে কারণ আছে। তবে আপনার জানার সময় হয়নি এখনও।’

স্পর্ধা দেখ! উত্তরটা জানে, কিন্তু বলবে না!

মিনিওনের এধরণের বিশ্বাসঘাতকতায় তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম।

এখন ছুরি দিয়ে নাম না জানা খাবারটা কেটে ফেলতে ফেলতে আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দেই। খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য গ্রাহেম কিরণকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই হবে। আমার নাহলেও তিনশ বছর চলে যাবে এই খাবারে। যদিও অতদিন বাঁচবো না। বাড়ির পেছনে যে চারতলা বিল্ডিংটা আছে ওটার মাটির নিচে আছে পনেরতলা।

ফুড স্টোরেজ।

শান্তিমত নাস্তা সারা গেল না অবশ্য, মিনিওনের দীর্ঘদেহী শরীরটা আবার দরজার কাছে দেখা যায়, ‘পূজনীয় রাতুল, আপনার ট্রেইনিং সময়ে পিছিয়ে সাঁইত্রিশ মিনিট চুয়াল্লিশ সেকেন্ড।’

‘তাতে কার কি আসে যায়?’ কাঁটাচামচে অচেনা আরেকটা খাবারের টুকরো তুলে নিতে নিতে জানতে চাইলাম।

‘আপনাদের সময়ে মানুষের গড় আয়ু ষাট বছরের। সতর্কতা সময় বিশ বছর ধরলে মারা যাবেন চল্লিশে। এখন আপনার বয়েস বিশ। আপনার হাতে প্রতিদিন সাঁইত্রিশ মিনিট সময় নষ্ট করার মত নেই। বিশ বছরের জীবন সেক্ষেত্রে আপনার নেমে আসবে ১৯.৪৯ বছরে। অর্ধবছর নষ্ট করবেন না আপনি, অনুগ্রহ করুন।’

কাঁধ ঝাঁকালাম, ‘তোমাদের যে আঠারো মাসে বছর – অর্ধেক বছর নষ্ট করলেই বা কি আসে যাচ্ছে?’

‘মানবজাতির নিশ্চিহ্নকরণ ঠেকাতে আপনাকে প্রয়োজন।’

‘জেগে ওঠো রোবট বয়, একটা মেয়ে ছাড়া বাচ্চা পয়দা করতে পারবো না। আর এখানে মেয়ে তো দেখি না। কাজেই, শান্তিপূর্ণভাবে আমাকে খেতে দাও।’

বিশাল লেকচারটা পানিতে পড়লো বুঝতে পেরে মিনিওনের চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে যায়।

কাজেই অন্য কথা পাড়লাম, খাওয়ার সময় চুপচাপ থাকতে আমার ভালো লাগে না।

‘তোমার বাংলার এই দশা কেন?’

‘আমি সাবলীল ও সঠিক বাংলা বলতে সক্ষম।’ জানায় মিনিওন।

‘কাম অন!’ হেসে ফেললাম, ‘বাংলাতে কিছু ইংরেজী শব্দ এখন ঢুকে গেছে বেশ স্বাভাবিকভাবেই। তোমার কাছে একটা ইংরেজী-মিক্স বাংলা পেলাম না। খাঁটি বাংলাতে কথা বলতে গিয়ে হাস্যকর করে ফেলছ।’

‘উদাহরণ দিলে ভালো হয়।’

‘পূজনীয় রাতুল! অনুগ্রহ করুন! – এভাবে মানুষ কথা বলে না, মিনি। তোমার মাঝে কি নিজে থেকে শেখার মত কোন অপশন আছে?’

রোবটটার চেহারাতে এখন ফুটে উঠেছে দুঃখের অভিব্যক্তি। আমাকে সে কিভাবে ডাকে সেটাও আমার পছন্দ নয়, এটা বোঝার পর দুঃখ পাওয়া স্বাভাবিক। তবে আমি জানি রোবটের দুঃখ নেই। এটা শুধুই গ্রাহেম কিরণের দান। চেহারাতে ‘যুক্তিযুক্ত’ অভিব্যক্তি তাদের ফুটে ওঠে এখন। অন্তত এই মিনিওনের ক্ষেত্রে অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষমতা আছে।

‘আপনার মতামত গ্রহণ করা হল। তবে সম্বোধনের ক্ষেত্রে পূজনীয় রাতুলের কি পছন্দ?’

‘স্যার – বললেও চলবে। আর প্লিজ, এই শুধু বাংলা ব্যবহারটা বন্ধ কর। ইংরেজী ব্যবহারে স্বাভাবিক শোনাবে যেখানে সেখানে ইংরেজী ব্যবহার করবে। ওকে?’

মাথা দোলায় রোবট।

কৌতূহলী না হয়ে পারলাম না, ‘এখানে বাংলা বা ইংরেজী ভাষা প্রচলিত ছিলো না। তাই না?’

স্বীকার করে মিনিওন, ‘না। রেতালিয়েতরে ভাষাতে কথা বলত মানুষ। তবে আমার মাঝে পৃথিবীর সকল ভাষা ইন্সটল করা আছে। এই গৃহের সিস্টেমেও। একারণেই, আপনি বাংলাতে আদেশ করলেও দরজা খোলে, জানালা খোলে, মিউজিক প্লেয়ার চালু হয়।’

‘গ্রাহেম কিরণ হয়তো আগে থেকেই সাবধান ছিলেন। এরকম একটা পরিস্থিতির জন্য।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, ‘চলো ট্রেইনিং সেন্টারের দিকে যাওয়া যাক। তোমার ভাষা নিয়ে আর একটা কথাও নয়, ভাষাটির নাম শুনেই আমার বাঙ্গালী দাঁত কয়েকটা নড়ে গেছে। ধন্যবাদ।’

৪.

দেড় মাস পেড়িয়ে গেছে। খাই দাই আর পড়াশোনা করি। বর্তমান পৃথিবীর ব্যাপারে যত সম্ভব জেনে নেওয়া আর কি।

দিন দিন ভোটকা হচ্ছি।

তাছাড়া এখানে পানিও সুন্দর। আমার চুল চক চক করে সারাক্ষণ। ত্বক দিন দিন হচ্ছে উজ্জ্বল।

অবশ্য মিনিওন বলেছে, সূর্যের অতিমাত্রায় পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্য ত্বকের ঔজ্জ্বলতা বাড়ায়।

বুঝলাম আমিও, মিনিওনের শরীরের চামড়া স্ফটিকের মত কেন। গ্রাহেম কিরণও এমন ছিলেন। মানুষ নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগে যে সৌন্দর্যে পৌঁছেছিল, আজকের দিনের কেউ ওদের দেখলে সোজাসুজি ফেরেশতা ভেবে বসবে।

মানুষের মত করে সৃষ্টি করা হয়েছে মিনিওনকে। তার শরীরের লুব্রিকেন্টগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে প্লাজমার ত্বকের আড়ালে। ভেদনযোগ্যতা আর কোমলতাতে তা মানুষের ত্বকের মতই। প্রথমে আমার যে ধারণা ছিল, মিনিওন রোবট বলে তার গঠন এমন, সেটা ভুল।

আসলে, এখনকার মানুষরা ওরকম দেহগঠনের বলেই মিনিওনের চেহারাও ওরকম করে বানানো হয়েছে।

ট্রেইনিং নেওয়া লাগছে বলে দিন দিন চর্বির ব্যালান্সও হচ্ছে। এই একটা কারণেই সম্ভবতঃ ব্যাঙের মত গোল হয়ে যাইনি।

সার্ভাইভাল ট্রেইনিং সিমুলেটর ওখানে আমাকে শেখায় কিভাবে দুর্গম পরিবেশে টিকে থাকতে হবে। ইন্সটিংক্ট গঠন করার জন্য মানুষকে এখন আর বাস্তব পরিবেশে পড়তে হয় না।

সিমুলেটরে সিমুলেশন নিতে নিতে এক ধরণের ব্রেইন ওয়েভ পাঠিয়ে শুধু মস্তিষ্কের মাঝে একটা নতুন ইন্সটিংক্ট তৈরী করে দেওয়া হয়।

এখন আমি জানি ছোট একটা পাথরের গড়িয়ে পড়া দেখার সাথে সাথে কোন কিছু না বুঝেই কোনদিকে ছুটে গেলে সম্ভাব্য এক পাহাড়ধ্বস থেকে বেঁচে যেতে পারবো। আমি জানি, হাল্কা একটা পাতার নড়াচড়া দেখেই কোন দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লে মাংসখেকো উদ্ভিদ আমাকে এক ইঞ্চির জন্য মিস করবে। আমি আরও অনেক কিছুই জানি। তবে প্র্যাকটিক্যাল লাইফে সেটাড় প্রয়োগ করার ভাগ্য এখনও হয়নি।

মিনিওন অবশ্য কথা দিয়েছে, এখানে যতটা ভালো দেখিয়েছি কাজ, ওখানেও – মানে, বাস্তব জগতেও, তা-ই করতে পারবো।

এছাড়াও আমাকে সপ্তাহে দুই দিন লড়াইয়ের ট্রেইনিং দেওয়া হয়। আনআর্মড কমব্যাট আমি ভালোই পারি। এ যুগের অস্ত্রগুলোর ব্যবহারও একে একে শিখে নিয়েছি।

অথচ লড়াই করার জন্য কোন প্রতিপক্ষ নেই!

কি হাস্যকর!

মিনিওন বার বার আমাকে মনে করিয়ে দেয় অবশ্য, আপাতদৃষ্টিতে অদরকারী মনে হলেও শেষ মানুষ হিসেবে আমাকে সব ধরণের বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকা লাগবে।

পৃথিবীর ভেতর পা রাখাটা আমার জন্য জরুরী। আমাকে প্রতিটা কোণা খুঁজে ফেলতে হবে আরেকজন মানুষের জন্য। তবে প্রস্তুতি না নিয়ে বের হওয়াটা ঠিক হবে না।

যদিও এখন কারও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দেখছি না। তবুও আশা করতে দোষ নেই। তাছাড়া, পৃথিবীতে কেউ বেঁচে নেই – কথাটা নিশ্চিত হতে হলে আমাকে অবশ্যই নিজের চোখে একবার দেখে আসতে হবে। এসব বুদ্ধি অবশ্য আমার মাথায় ঢোকাচ্ছে প্রচণ্ড আশাবাদী মনস্তত্ত্ব দিয়ে তৈরি করা মিনিওন।

প্রতিদিন আমি আগের চেয়েও প্রস্তুত হয়ে উঠছি। আগের চেয়েও হয়ে উঠছি বাইরের পৃথিবীতে টিকে থাকার উপযোগী।

কেউ বেঁচে থাকলে কি বিশ্বাস করতে পারত, মাত্র দুই মাস আগেই এই ছেলে ভার্সিটির অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেম আর ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকতো?

প্রেমের কথা মনে হতেই বুকের মাঝে আরেকবার খোঁচা দিয়ে উঠলো একটা প্রাচীন বেদনা।

অংকনা মেয়েটা আমার রহস্যময় অন্তর্ধানে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলো?

খুব ভালোবাসতো ও আমাকে। প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে নিয়ে ভাবত। ওর এই রাতুল-অবশেসন দেখে আমার ভয় হত, এই গভীর ভালোবাসা কোন একদিন অন্য কোন অনুভূতিতে পালটে না যায়!

অবশ্য ওর অনুভূতি পাল্টানোর আগেই আমি পাল্টে গেছি। অংকনা এতদিনে মরে গেছে – এটা খুবই স্বাভাবিক সত্য।

শুধু মরেছে তাই না, তার ভূতেরও এতদিনে মরে টরে যাওয়ার কথা!

কিন্তু আমার কাছে তো মরেনি ও।

কাজেই একদিন মিনিওন যখন আমার ঘরে মাথা গলিয়ে বলল, ‘স্যার, সময় হয়েছে।’

আমি দ্বিধা না করে উঠে পড়ি।

চতুর্থ তলায় যেতে হবে। বাড়িটার টপ ফ্লোর একটা হোভারক্র্যাফট। উড়ে বেড়ানো যাবে ওটায় অনায়াসে।

মিনিওন কন্ট্রোল সেন্টারে বসে আছে। ওকে নেমে আসতে বললাম না, যদিও ট্রেইনিং শেষে আমি অনায়াসে এরকম একটা হোভার ক্র্যাফট চালাতে পারি।

শুধু জানতে চাইলাম, ‘প্রথমে কোথায় যাবো আমরা?’

‘মিশর। একটা সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে ওখানে। দেখে আসা দরকার।’ যান্ত্রিকতা আগের চেয়ে কমেছে মিনিওনের উচ্চারণভঙ্গীতে। লক্ষ্য করে আমার ভালো লাগলো।

বড় স্ক্রিনটায় বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। মরুভূমির দিকে একটা চোখ রেখে বসে পড়ি আমি চেয়ারে।

ধীরে ধীরে বাড়িটার তৃতীয়তলা থেকে বিচ্চিন্ন হতে থাকে আমাদের বাহনটা।

একটা সময় পুরোপুরি আলাদা একটা অংশে পরিণত হল এই চতুর্থ তলা। মাটি থেকে এখন আমরা আশি ফুট ওপরে। ধীরে ধীরে উচ্চতা বাড়ছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। একবার সবকিছু চেক করে আসা যেতে পারে। মিশরে যেতে বেশি সময় লাগার কথা অবশ্য না।

চারঘন্টার রাস্তা মাত্র।

*

মাথা বুকের কাছে হেলে পড়তেই বুঝলাম ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

একটু আগে দেখা স্বপ্নটা এখনও তাজা। ২০১৪ সালের বন্ধুদের অনেককেই দেখলাম। ভাবতেও অবাক লাগে, এরা হাজার হাজার বছর আগে মারা যাওয়া কয়েকজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই না।

মহাকালের কাছে ওদের মূল্য এতটুকুই ছিলো।

মিনিওনের দিকে চোখ পড়তে হাসলাম। রোবট হওয়ার সুবিধে আছে। ঠিক যেমন ভাবে দেখেছিলাম ওকে ঘুমানোর আগে – এখনো সেভাবেই আছে।

‘ঘুম ভালো হয়েছে, স্যার?’ আমার দিকে না তাকিয়েই জানতে চায় রোবটটা।

‘চমৎকার হয়েছে। আমরা কোথায়?’ বাইরের অন্ধকারে চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলি আমি।

‘বিকনের ওপরে চলে এসেছি প্রায়। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে ওটাকে।’

দ্রুত নাইটভিশন পড়লাম চোখে। মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় বাইরের পৃথিবী।

দেখা যাচ্ছে ওটাকে। সিগন্যাল যেটা দিচ্ছে।

একটা স্যাটেলাইট। ওপর থেকে আছড়ে পড়েছে হয়ত কোনভাবে।

হতাশ হয়ে চেয়ারের ওপর নিজেকে এলিয়ে দিলাম। আশা করেছিলাম, একটা স্যাটেলাইট ছাড়া আরও কিছু পাওয়া যাবে।

‘পড়ল কি করে?’ মিনিওনের দিকে হতাশ দৃষ্টি মেলে জানতে চাই।

জবাবটা মিনিওন দিতে পারে না।

বাইরের অন্ধকারে চোখ ধাঁধানো আলো চমকে ওঠে মাটির কাছে। বেশ কয়েকবার।

সেই সাথে ভীষণভাবে কেঁপে ওঠে আমাদের হোভার ক্র্যাফট।

‘উই আর আন্ডার ফায়ার, স্যার।’ নিচু গলাতে জানায় মিনিওন।

৫.

পাক খেতে খেতে নিচের দিকে রওনা হয়ে গেছে আমাদের বাহন।

কিছুক্ষণের মাঝে পাক খাওয়ার গতি এতই বেড়ে যায়, আমার মনে হতে থাকে পৃথিবীটা ঘুরছে, একই সাথে আমার মাথাও ঘুরছে, সেই সাথে ঘুরছে এই কন্ট্রোল প্যানেলের প্রতিটা ঘর।

দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করি মিনিওনের উদ্দেশ্যে, ‘ডু সামথিং!’

বেশ দুরের একহাজার বিরাশি তলার বিল্ডিংটা প্রতি সেকেন্ডে আমাদের দিকে ছুটে আসছে যেন।

মিনিওন কিছু বলছে না। খুবই শান্ত একটা মুখভঙ্গী ওর, দুই হাতে ধরে আছে কন্ট্রোল প্যানেলের হুইলগুলো। সেই সাথে বাম হাতে একের পর এক কমান্ডের ওপর টাচ করছে টাচ স্ক্রিণে।

হোভারক্র্যাফট নিয়ন্ত্রণ হারানোর সাথে সাথেই ‘সেফটি গ্র্যাব’ অন হয়ে গেছে।

মেঝের দিক থেকে ভয়ানক একটা অভিকর্ষণ বল কাজ করছে। কাজেই এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই, যদিও বনবন করে শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে যানটি। এভাবে কত হোভারক্র্যাফটের কত যাত্রী যে নিজেদের ঘাড় বাঁচিয়েছে – কে মনে রেখেছে?

বাইরের দিকে না তাকিয়ে আমি আর্মোরির দিকে ছুটে যাই। ‘রিদমিক জ্যাকব’ নামক বন্ধুটিকে খামচি দিয়ে ধরেছি একহাতে, অন্যহাতে একটানে তুলে নেই নিউক্লিয়ার রিফিল। তারপর কন্ট্রোল প্যানেলে ফিরে আসার সাথে সাথেই প্রথম ধাক্কাটা অনুভব করলাম।

বিশাল বিল্ডিংটার মাঝ বরাবর ধাক্কা খেয়েছে আমাদের হোভারক্র্যাফট। গতির তোড়ে সেঁধিয়ে যেতে থাকে ভেতরের দিকে।

প্রচণ্ড এক শব্দের সাথে সাথে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় কন্ট্রোল প্যানেল। বাইরের দিকে থাকা বিশাল স্বছ গ্লাসটাও ভেঙ্গে গেল এক মুহূর্তের মাঝে। তারপর বিল্ডিংটার ভাঙ্গা অংশগুলো ছুটে আসে আমার দিকে বুলেটের মত।

মিনিওনের গতিবেগ তার থেকেও বেশি। ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে নিয়ে মেঝেতে পড়ে যায় ও, তারপর নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে আমাকে।

আমদের হোভারক্র্যাফট এখনও বিল্ডিংটাকে চিরে দিয়ে ঢুকছে। ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে সবার সামনের ঘর কন্ট্রোল প্যানেলটাকে নিতে হচ্ছে টন টন চাপ।

যেটার মাঝে আটকে গেছি আমরা।

মিনিওন তার দুই হাত দিয়ে অন্যপাশের দেওয়াল চেপে রেখেছে। আমাকে স্পর্শ না করেই আমার চারপাশে একটা মিনিওন-ময় দেওয়াল গড়ে তুলেছে ও। চারপাশে উদ্ভ্রান্তের মত তাকাই। একের পর এক নতুন ধ্বংসাবশেষ আর বিল্ডিং-টুকরো ছুটে আসছে এই ঘরের দিকে।

আসলে, আমাদের হোভারক্র্যাফটই পূর্ণগতি নিয়ে এর দিকে ছুটে এসেছিল। গতির এখনও কিছুটা রয়ে গেছে।

একেবারে হঠাৎ থেমে যায় সবকিছু।

গতি ঘর্ষণের ফলে কমতে কমতে একেবারেই থেমে গেছে এখন। বিশটা সেকেন্ড ওভাবেই থাকে সবকিছু। তারপর উল্টো দিকে ধীরে ধীরে যেতে থাকে আমাদের হোভারক্র্যাফট।

প্রতি সেকেন্ডের সাথে পেছন দিকে পিছলে যাওয়ার গতি বাড়ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বিল্ডিংটার মাঝে গেঁথে থাকার কথা না এটার আর। পাঁচশতলা ওপর থেকে খসে পড়তে যাচ্ছি আমরা!

‘স্যার, আমি ধরে থাকছি।’ পেছনে জমে থাকা টন টন চাপের দিকে ইঙ্গিত করে বলে মিনিওন, ‘আপনি প্যারাস্যুট নিয়ে বাইরের দিকে ঝাঁপ দেবেন।’

হাল্কা করে মাথা দোলাতে দোলাতে উঠে বের হয়ে যায় মিনিওন বৃত্ত থেকে। পেছনের ঘরগুলোতে বিল্ডিং-ধ্বংসাবশেষ চাপ দিতে পারেনি। বাইরের দিকে কন্ট্রোল রুম থাকায় যা যাওয়ার ওদিক দিয়েই গেছে।

তবে একটা অসুবিধে এখন আছে, সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে। অভিকর্ষজ ত্বরণের সেফটি গ্র্যাবও। কাজেই, পতনের সাথে সাথে ত্বরণটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

দেওয়াল থেকে একটা প্যারাসুট খামচে ধরে জানালার দিকে ছুটে যাই, চিৎকার করেছি একই সাথে, ‘খোলো।’

ব্যাকআপ জেনারেটর জানালা আর দরজাগুলোকে মেইন পাওয়ার চলে গেলেও সাপোর্ট দেয়, জানা ছিলো – কাজেই জানালা আমার আদেশ মোতাবেক খুলে গেল বলে মোটেও অবাক হলাম না।

প্রাণপণে লাফ দিলাম বাইরের দিকে।

বের হয়েই বুঝতে পারলাম অন্তত তিনশ তলা ওপর থেকে পড়েছি। কিছুক্ষণ নিজেকে ভাসিয়ে রাখি একটা বুলেটের মত আকৃতি দিয়ে। বাতাস কেটে নেমে যাওয়াটা এভাবে সহজ। ঝাড়া দুইহাজার ফিট নেমে এসে সাবধানে প্যারাসুটটা খুলে দিলাম।

হ্যাঁচকা টানে ওপরে তুলে নেয় আমাকে পিঠের বস্তুটা। তারপর ধীরে ধীরে নামতে থাকি আমি আর আমার প্যারাসুট।

সাবধানে কাঁধের ওপর ঝুলে থাকা রিদমিকটা ঠিক আছে কি না দেখলাম। রাইফেল ওটা একটা, সাড়ে ছয়শ রাউন্ড ফায়ার করতে পারে। এই শতাব্দীর একমাত্র রাইফেল যেটা এখনও বুলেট ব্যবহার করে। তবে বুলেট শেষ হয়ে গেলে অনায়াসে নিউক্লিয়ার মোডে পাল্টে ফেলা যাবে এটাকে।

আমি কয়েক হাজার বছর আগের মানুষ। কাজেই বুলেট দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে গেছিলাম। অন্য সব রাইফেলের প্রধান নিক্ষেপণ ম্যাটেরিয়াল হল রশ্মী, এই রশ্মী, সেই রশ্মী হল এখন যুদ্ধের সহায়ক। তবে আমি ওল্ড স্কুল মানুষ। আমার জন্য বুলেটই উপকারে এসেছে। ট্রেনিংয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছিলাম এই অস্ত্রটা। আমার প্রিয়। মনের ওপর কথা চলে না।

বিকট একটা শব্দ নিচের দিক থেকে ভেসে আসার সাথে সাথে আমার হৃদস্পন্দন যেন করেক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে যায়!

হোভারক্র্যাফটটা মাটিতে আছড়ে পড়েছে এতক্ষণে।

*

কাঁধ থেকে প্যারাসূট ছাড়িয়ে নেওয়াটাই মাটিতে নামার সাথে সাথে আমার প্রথম কাজ ছিলো। তারপর ছুটলাম রাস্তা ধরে।

কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই থমকে যাই।

রাস্তাগুলো আমার মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে। কি দিয়ে এদের তৈরী করা হয়েছে তা আমি জানি না, তবে একফোঁটা খুঁত এখানে নেই। একটা ক্র্যাক নেই, একটুও পার্থক্য নেই কোন অংশে। পায়ের নিচে এক বর্গফুট অংশ নিলে ঠিক যেরকম গঠন পাওয়া যাবে , আমি নিশ্চিত, একশ ফিট সামনের থেকে এক বর্গফিট নিলেও একই রকম অনুপাতে পাওয়া যাবে সবকিছু।

একটু পরই আমার ঘোর কেটে যায়। ওপর থেকে দেখেছি, মোটামুটি তিনশ গজ দূরে নেমেছি আমি হোভারক্র্যাফট থেকে। ওখানে পৌঁছতে হবে যতদ্রুত সম্ভব।

খাবারের মজুদ থেকে বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার – সবই আছে ওখানে, এই নতুন ধরণের পুরাতন গ্রহে একটা সপ্তাহও টিকতে পারবো না আমি ওসব ছাড়া।

ছুটতে থাকি আমি আবারও। দুই হাতে তুলে রেখেছি অস্ত্রটা।

বিশ মিনিটের মাথাতে দেখতে পেলাম ওটাকে। ধোঁয়া বের হচ্ছে হাল্কা হাল্কা।

ভেবেছিলাম দুমড়ে মুচড়ে যাবে, কিন্তু হাল্কা কিছু কার্ভ ছাড়া আর কোন ডিফেক্ট দেখলাম না। তবে, হোভারক্র্যাফটটা এখন একপাশে কাত হয়ে আছে। সহজে আবার উড়বে বলে মনে হচ্ছে না।

সব দরজা জানালা খুলে আছে ওটার। ইমার্জেন্সী সিচুয়েশনে এমনটা হয় – জানা আছে আমার। দরজা দিয়ে নিজেকে ঢোকানোটা কঠিন। যখন একটা হোভারক্র্যাফট কাত হয়ে থাকে – তখন কঠিন হওয়াটা স্বাভাবিক।

একপাশের জানালা দিয়ে হাঁচড়ে পাচড়ে উঠে পড়লাম।

গলা ফাটিয়ে ডাকি, ‘মিনিওন!’

প্রায় সাথে সাথেই উত্তর পেলাম, ‘আমি এদিকে, স্যার।’

কাত হয়ে থাকা হোভারক্র্যাফটের দেওয়ালে পা রেখে হাঁটতে হচ্ছে। মিনিওনকেও দেখতে পেলাম ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে।

রোবটটা নিজেকে টন টন চাপ থেকে কিভাবে মুক্ত করল?

সম্ভবতঃ ঝাঁকুনির সময় এমনিতেই সরে গেছে ওগুলো তার ওপর থেকে। ক্লান্ত ভঙ্গীতে হেঁটে গেলাম আমি ওর দিকে।

‘কিছু একটা আমাদের দিকে গুলি করেছে। অর্থটা বুঝতে পারছো তো?’

হাল্কা মাথা দোলায় মিনিওন, ‘জ্বি, স্যার।’

‘পৃথিবীতে আমি একাই মানুষ নই।’ জ্বল জ্বলে চোখে বলি আমি, ‘কোন রোবট নিশ্চয় আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়বে না?’

‘তা ছুঁড়বে না। তবে আপনি সম্ভবতঃ দেখতে পাননি। আক্রমণকারীকে আমি চিনেছি।’

‘মানে?’ প্রায় চিৎকার করে উঠি আমি।

‘আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল নয়, আক্রমণ করেছিলো কোন প্রাণি। তবে প্রাণিগুলো মানুষ ছিলো না। এদের ব্যাপারে আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেক আগে আবিষ্কার করেছেন। তবে আজকের আগে চোখে দেখিনি এখন পর্যন্ত একটাকেও।’

দুই সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলাম আমি মিনিওনের দিকে।

‘তারমানে, তুমি বলতে চাইছ, ভিনগ্রহবাসী কোন প্রাণির আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে আমাদের হোভারক্র্যাফট?’

মিনিওনও আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দেয়, ‘আমার ভয় হচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে আমাকে পজিটিভ অ্যানসার দিতে হবে, স্যার।’

৬.

‘ViRa – 5 গ্রহতে ওদের অস্তিত্ব টের পেয়েছিলেন প্রথমে বিজ্ঞানী নিওলা ম্যাগী। প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজছিলো মানুষ অনেক বছর ধরেই। তবে এই প্রথম তারা পেয়েছিলো সফলতা।’ আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে মিনিওন, ‘এই প্রাণিগুলো বুদ্ধিমত্তায় এগিয়ে আছে অন্য যে কোন প্রাণিদের ক্ষেত্রে। তবে মানুষের চেয়ে তাদের বুদ্ধিমত্তা নিম্নশ্রেণির। ওরা আমাদের চোখে পড়ে ৪৭৬৯ সালে। কিন্তু তখন তাদের সভ্যতার যে বিস্তার তা ছিলো মানুষের ১০০০ সালে যে সভ্যতা ছিলো সেরকম। স্পেস নিয়ে তাদের খুব একটা পরিষ্কার ধারণা ছিলো বলেও মনে হয় না।’

হাত তুললাম আমি, ‘দুইহাজার তিনশ বছর পেরিয়ে গেছে, মিনিওন, আজকের দিন আসতে আসতে। এর মাঝে তাদের ওই পরিমাণ জ্ঞান থাকা অস্বাভাবিক নয়, বিবর্তন তো তাদের হয়েছে। ১০০০ সালের মানুষ কখনোই জানতো না ২০১০ সালে মানুষ কতগুলো উপগ্রহ আর গ্রহে স্পেসশিপ পাঠাবে। ভালো কথা, তাদের স্টাডি করার জন্য মানুষ পাঠানো হয়নি? তোমার ডেটাবেজ কী বলে?’

কাঁধ ঝাঁকায় মিনিওন, ‘টুয়েনটি জেনারেশনস প্ল্যান পাঠানো হয়েছিলো একটা।’

‘মানে, যাদের পাঠানো হচ্ছে তাদের বিশ প্রজন্ম পরের ব্যাক্তিত্বরা ছিলো প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য? এটা তো ব্যর্থ হওয়ার কথা। হতাশার সুরে বলি আমি।’

জেনারেশন প্রজেক্টে, প্রথমে স্পেসশীপে তুলে দেওয়া হয় কিছু মানুষকে। এদের প্রত্যেকে নির্দিষ্ট দায়িত্বে থাকে।

এবং স্বাভাবিকভাবে যখন স্পেসশীপ ছুটে যেতে থাকে এত দূরের লক্ষ্যে যেখানে পৌঁছানোর জন্য এক লাইফটাইম যথেষ্ট নয়, যাত্রীরা প্রেম করে, সন্তান জন্ম দেয়। নতুন সন্তানদের ধীরে ধীরে বড় করে, শিক্ষা দেয় নিজেদের স্থান নেওয়ার জন্য। তারপর একসময় মারা যায় তারা।

এই সন্তানেরা এগিয়ে যায়, নিজেদের বয়স বাড়ানো ঠেকাতে ঘুমিয়ে থাকে ফ্রিজিং রুমে, যতদিন পারা যায়, তারপর এরাও সন্তানদের জন্ম দেয়, তাদের শিক্ষা দেয় এবং নিজেদের স্থান দখল করার জন্য তাদের প্রস্তুত করে দিয়ে যায়।

এই প্রক্রিয়াটা খুবই স্বাভাবিক মানবধর্ম মেনে এগিয়ে চলে বলে ব্যবস্থায় কোন খুঁত থাকে না। তবে কিছু ঝামেলাও থাকে।

নতুন শিশুদের অনেককে ঠিক যে পদটা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করানো হচ্ছিলো, তা শিখে নিতে পারে না। দেখা গেলো, যাকে মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার হতে হত, সে ওই বিষয়ে খুবই খারাপ করলো। তখন একজন মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার পড়ে যায় শর্ট।

আর স্পেসে হুট করে কোন পদের জন্য লোক পাওয়া সম্ভব নয়। তিন চার জেনারেশনের ক্ষেত্রে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। তবে বিশ প্রজন্ম?

সফল না হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ার কথা অনেক খানি।

‘তারা সম্ভবতঃ সফল হয়ওনি। সফল হলে এত দিনে আমরা খবর পেতাম।’ জানায় মিনিওন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলি আমি, ‘তাহলে , এই ভিরা গ্রহবাসীদের সম্পর্কে কিছু জানা নেই আমাদের। তারা আমাদের দিকে প্রথমেই গুলি ছুঁড়ে যেটা প্রমাণ করেছে – তাদের মনের ভেতরে বন্ধুত্ব বলে কোন অংশ নেই।’

দুইজনই চুপ হয়ে থাকি আমরা।

‘মিনিওন, পৃথিবীতে আমি শেষ মানুষ হলে আমার কোন আপত্তি নেই, তবে গ্রহটা ফাঁকা পেয়ে ভিরাবাসীদের বিনাপরিশ্রমে দখল করতে দেবো – এমনটা আমি ভাবছি না।’

‘যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত। আমাদের উচিত তাদের আক্রমণ করা।’ সাফ সাফ জানিয়ে দেয় মিনিওন নিজেও। মানুষের কোনরকম ক্ষতি করতে তার ভেতরে প্রোগ্রাম আছে। কিন্তু অন্য যে কোন প্রাণী মানুষের জন্য ক্ষতিকারক হলে সে খুনোখুনি করতে পারে। রোবটিক্সের আইনে এসব আছে আজও।

‘প্রথম কথা হল, আমাদের পৃথিবী থেকে যদি তাদের গ্রহের এতই দূরত্ব হয়ে থাকে – কিভাবে তারা এখানে চলে আসল? জেনারেশন প্রজেক্ট?’

অন্যরকম সাজেশন দেয় মিনিওন, ‘সম্ভবতঃ তাদের আয়ু অনেক বেশি আমাদের থেকে।’

‘সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা হচ্ছে অনেক বেশি কঠিন কেউ। তোমার সময়ের মানুষদের জন্য হয়তো নয়, তারা অনেক অ্যাডভান্সড ছিল। কিন্তু আমি ২০১৪ সালের একজন মানুষ। ভিরাগ্রহের বাসিন্দারা হয়তো আমার থেকেও উন্নত।’ চারপাশে তাকালাম আমি, ‘দ্রুত এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত আমাদের। ওপর থেকে খসে পড়েছি – সেটা তারা দেখেছে। দলে দলে চলে আসবে ওরা কিছুক্ষণের মাঝে।’

ঠং ঠং – জাতীয় শব্দ ভেসে আসে এই সময় বাইরের দিক থেকে।

বিষন্ন কণ্ঠে বলে মিনিওন, ‘খুব বেশি দেরী হয়ে গেছে স্যার। চলে এসেছে ওরা।’

*

প্রতিটা দরজা জানালা খোলা – তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

একটা কাত হয়ে থাকা হোভারক্র্যাফটে।

কাজেই প্রথমে যেটা করা দরকার ছিলো সেটাই করলাম। ঝাঁপিয়ে আড়াল নিলাম একটা জানালার নিচে।

কৃত্রিম পদ্ধতিতে গড়ে তোলা আমার ইন্সটিংক্টের ওপর সন্তুষ্ট না হয়ে পারলাম না। ব্রেইন ওয়েভ তার কাজ ঠিকমতই করেছে।

নিজেকে আবিষ্কার করলাম দুই হাতে শক্ত করে রিদমিক জ্যাকবকে চেপে ধরা অবস্থাতে।

‘মিনিওন, ওদের অ্যামুনেশন টাইপ কি? লেজার অর বুলেট, মানে, প্রজেক্টাইল?’

আরেক জানালার নীচ থেকে মাথা বের করে মিনিওন, ‘প্রজেক্টাইল, স্যার।’

‘গ্রেট। তুমি আর্মোরি রুমে চলে যাও। উই নীড সাম গ্রেনেডস। অ্যান্ড প্লিজ, কাভার মাই অ্যাস।’

চোখের সামনে থেকে মিনিওন দূর হতেই মাথা তুললাম একটু করে।

প্রথমবারের মত দেখতে পেলাম ওদের।

আমাদের মতই দুটো পা ওদের। তবে হাত তিনটে করে। তৃতীয় হাতটা বের হয়ে এসেছে বুকের ঠিক মাঝখান থেকে। সেই সাথে পেছনে পতাকার মত দুলছে একটা করে লেজ।

আর কিছু দেখার সুযোগ আমাকে দেওয়া হয় না। সাঁই সাঁই করে জানালা দিয়ে বুলেটের পর বুলেট ঢোকাতে থাকে তারা।

ভেতর থেকে কেউ একজন বলল, ‘সরে যাও, রাতুল!’

সাথে সাথে পিছিয়ে আসি আমি। পেছনের দরজাটা এখন অনেকটা হাইজাম্পের ব্যারিয়ারের মত হয়ে আছে। কারণ, হোভারক্রাফট আছে নব্বই ডিগ্রী অ্যাংগেল হয়ে। ঝাঁপিয়ে দরজাটা পেরিয়ে যেতেই পেছলে ঠং ঠুং করে কিছু একটা আছড়ে পড়ে।

আড়চোখে বিদঘুটে এলিয়েনটিক গ্রেনেডটা দেখেই মাটির সাথে মুখ লুকালাম।

পাশের ঘরে বিকট শব্দে ফাটে গ্রেনেড।

আর বাইরে রীতিমত কিচিরমিচির জুড়ে দেয় যোদ্ধা এলিয়েনগুলো।

নাইটগ্লাসটা চোখে ঠিকমত লাগিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াই। ধোঁয়া একটু পাতলা ওপরের দিকে। সেদিকে দুটো এলিয়েনকে দেখলাম পজিশন নিয়ে বসে আছে। আমার উচ্চতা বেশি হওয়ায় মাথা দেখা যাচ্ছে দুটোরই।

একবার করে গুলি করতেই তরমুজের মত বিস্ফোরিত হয় ওদের মাথাগুলো।

বাইরের কিচিরমিচির পাল্টে গেছে রণ হুংকারে।

আমার পিত্তি জ্বলে যায়। যুদ্ধ শেখোনি আর চেঁচাচ্ছো?

আরেকবার উঠে কয়েকটা গুলি করলাম। সবুজ রঙের বিদঘুটে একটা প্রাণির বুকে বেশ বড় একটা গর্ত সৃষ্টি হতেই চিৎ হয়ে গেল লোকটা। পাশের জন আরও নিরাপদ কাভার খুঁজে বের করে সেদিকে পালাচ্ছিলো।

যুদ্ধে নেমে কাভার খোঁজা, অ্যাঁ? তোমার কাভারিং ফায়ার কে করে দেবে? ওই গ্রহটাতে কি যুদ্ধ শেখানোর কেউ-ই নেই নাকি?

পিঠ ফুটো করে ফেলে দিলাম।

তারপর নিজেকে দ্রুত লুকিয়ে ফেলি কাভারের আড়ালে। ওপাশ থেকে গুলির বন্যা।

পেছনে টং জাতীয় একটা শব্দ শুনতেই ঘুরে তাকাই।

এই মাত্র কপালে গুলি খেয়েছে মিনিওন। চামড়া ফুটো হয়ে মেটাল দেখা যাচ্ছে – এমন নয়। টকটকে লাল রক্ত গড়িয়ে এসেছে ওখান থেকে।

তবে টলেও ওঠে না রোবটটা। দুই হাত ভর্তি গ্রেনেডের পরিবর্তে একটা গ্রেনেড লঞ্চার খুঁজে এনেছে ও। আর দুই সুতো গ্রেনেড।

কপালের রক্ত এক হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললো, তারপর আমার দিকে তাকায় মিনিওন, ‘লুব্রিকেন্ট। ঘাবড়াবেন না। ধরুন।’

গ্রেনেড লঞ্চার ধরে সাবধানে আবার আগের ঘরে ফিরে আসলাম। একটু আগে এখানেই গ্রেনেড ফেটেছিলো। এখন অবশ্য একেবারে সুনসান নীরবতা। এলিয়েনরা একপশলা গুলি চালিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের তরফ থেকে কোন হামলার।

কাজেই সাবধানে জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেই।

কাওকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই ভালোই কাভার নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

উবু হয়ে পশ্চাদ্দেশ লুকোতে একজনকে ব্যর্থ হতে দেখলাম তার মাঝেই।

সমস্যা কি তার? মাদী এলিয়েন নাকি? ডিম পাড়বে?

এলিয়েনটার পাছার তলে একটা গ্রেনেড চালান করে দিলাম গ্রেনেড লঞ্চার থেকে। ফলাফল দেখার জন্য অপেক্ষা করে লাভ হবে না। মিনিওনের দিকে একবার চিৎকার দেই, ‘পেছনের দিক দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। মোটরসাইকেলগুলো বের কর।’

মিনিওনও ‘আজ্ঞে হুজুর’ – টাইপ কোন উত্তর দিতে চাইছিলো হয়তো।

পেছনের বিকট শব্দের গ্রেনেড বিস্ফোরণে তার কথাটি হারিয়ে যায়।

৭.

তীব্র বেগে মটরসাইকেলটা ছোটাচ্ছি।

গতিপথটা একরকম বৃত্তাকার। পড়ে থাকা স্যাটেলাইটটার উত্তর দিয়ে যদি মিনিওন ঢুকে, আমি ঢুকব দক্ষিণ দিক থেকে।

এলিয়েনের গুষ্টি আমাদের দিকে ধেয়ে আসার আগে স্যাটেলাইটের পাশে ‘মাস্তি’ করছিলো। সেখান থেকেই আমাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়েছিল ওরা। কেন – তা জানাটা দরকার।

পার্টি করার জন্য কি এর চেয়ে ভালো কোন জায়গা আমাদের সুন্দর গ্রহটাতে ছিলো না?

কানে আটকে থাকা চোখে পড়ে না এমন একটা ইয়ারফোন থেকে মিনিওনের গলাটা ভেসে আসে তখনই, ‘ইন পজিশন, স্যার।’

‘গ্রেট। অপেক্ষা কর। আমি পজিশনে পৌঁছে জানাবো। কি দেখতে পাচ্ছো?’

‘এদিকে বারোজন টার্গেট। পেছনের দিকে আরেকটু কম হবে হয়ত।’

‘স্যাটেলাইটটা কোন ধরণের?’

‘ডিফেন্সিভ। এলিয়েন অ্যাটাক থেকে রক্ষা করার জন্য এমন বেশ কিছু স্যাটেলাইট ছিলো নেয়ার স্পেসে।’

‘খুব একটা কাজে লেগেছে বলে তো মনে হয় না।’

মিনিওন আর কিছু বলল না। প্রতি কথার জবাব দেওয়ার জন্য তার রোবট মেমরি বানানো হয়নি মনে হয়।

আমিও মনোযোগ দেই মটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে। জিনিসগুলো দুর্দান্ত। এখন এগুলোকে মটরসাইকেল আর বলে না অবশ্য – বিদঘুটে একটা নামে ডাকা হয়। রেতালিয়েতরে ভাষাটা খুব একটা পছন্দ হয়নি আমার। কাজেই আমি সে ভাষা প্রত্যাখ্যান করেছি।

মিনিওনকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি, এগুলো আমার কাছে ‘মটরসাইকেল’ আর তাদের নাম ‘মটরসাইকেল’-ই থাকবে।

বরাবরের মত শেষ মানুষের জন্য যে কোন কিছু করতে রাজি রোবটটা টু- শব্দটা না করে রাজি হয়ে গেছে।

একটা সুইচ চাপ দিয়ে মটরসাইকেলটাকে ‘স্টেলথ মুডে’ নিয়ে গেলাম।

ওদের ভাষাতে ‘সিঁয়াত্যোরে দেয়াং’।

এখান থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটারের মাঝে আমার টার্গেট। শব্দ করে পাড়া জাগানোর কোন মানে দেখি না।

বিশাল শহর মিশরের। কিন্তু একটা আলোও জ্বলছে না কোথাও।

বিশ্বাস করতে আমার রীতিমত কষ্ট হয় এত বড় বড় জনপদে একটা মানুষও বেঁচে নেই!

একজনও না!

কিছু মানুষকে স্পেসশিপে করে আউটার স্পেসে পাঠিয়ে দেওয়া কথা কেন বিজ্ঞানীরা ভাবেননি? ফ্রিটজ ওয়েভ থেকে দূরে পালিয়ে যেতে যারা তারা পারে?

প্রশ্নটা আমার মনে জেগেছিল। তবে মিনিওন উত্তর দিয়েছে, তাদের মাথায়ও এটা এসেছিলো। তবে ফ্রিটজ ওয়েভ এত দ্রুত এগিয়ে এসেছিলো, কোন স্পেসশীপই পালাতে পারতো না সেটার হাত থেকে। অধিবাসীদের সবাই মারা যাচ্ছে কয়েক দিনের মাঝে। স্পেসশিপে করে বাইরে বেরিয়ে যাবার পরও সেই মৃত্যুই অবধারিত। সেল ডিজেনারেশনের কারণ কিংবা সমাধান কিছুই বের করা তখনও সম্ভব হয়নি।

মিনিওন আরও জানিয়েছে অনেক বিজ্ঞানীর মতে এটা প্রকৃতির ইচ্ছে। তবে গ্রাহেম কিরণ সেটা ভাবেননি।

হেডলাইটও নিভিয়ে দিলাম এবার। গতিবেগ ছয়শ কিলোমিটার পার আওয়ার থেকে কমিয়ে আনলাম আশিতে।

হাইওয়ে মোটামুটি শেষ এখানে। এবার সাইড রোড ধরে নেমে যেতে হবে ক্র্যাশ সাইটে।

মিনিওন আমার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। তবে আমি এই ছোটখাট এলিয়েন সমস্যা পেয়ে খুবই আনন্দিত।

চিরটা কাল একা একা বেঁচে থাকার চেয়ে আমার গ্রহ থেকে অনাহূত বিধ্বংসী আগন্তুকদের সরিয়ে দিতে পারলেই আমি খুশি।

এতে নিজে মরে গেলে আরও ভালো। একা একা বেঁচে থাকার মাঝে গর্ব করার কিছু দেখি না।

মিনিওনকে একটু আগে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আর রোবট তো থাকার কথা। তুমি নিশ্চয় একা নও?’

মিনিওন জবাব দিয়েছিল, ‘আছে। রোবট অনেক আছে। তবে এদের রিচার্জিং করার কেউ ছিলো না গত কয়েকশ বছর ধরে। সব অকেজো এখন।’

আমার নতুন বন্ধু মিনিওন অবশ্য সেলফ-রিচার্জিং রোবট। ওয়ান অফ আ কাইন্ড। গ্রাহেম কিরণ ওকে সব ধরণের সম্ভাব্যতা ভেবেই প্রস্তুত করেছেন। কাজেই মিনিওন সহজে নষ্ট হবে বলে মনে হয় না।

তাছাড়া তাকে হাজার হাজার বছর বাঁচতে হয়নি একা একা। টাইম মেশিনে করে দ্রুত সময়টা জাম্প করেছে সে আমাকে নিয়ে।

প্রশ্নটা আমার মাথাতে অনেকবার খোঁচা মেরেছে।

পৃথিবীতে ২০১৪ সালে ছয়শ কোটি মানুষ ছিলো। এত থাকতে আমি কেন?

দূরে আলো দেখা যাচ্ছে।

আগুন।

ভিরাবাসীরা ক্যাম্প ফায়ার করেছে। মোটর সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়লাম।

সময় হয়েছে।

এই এলিয়েনগুলোর প্রতি আমার কোন শত্রুতা ছিলো না। বুদ্ধিমান প্রাণি এরা। একসাথে কাজ করতে পারলে বেশ হত।

কিন্তু প্রথমেই শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক দেখানোর জন্য আমিও তো ওদের আবেদন জানাই নি! কাজটা ওরা খুবই ভুল করেছে। এখন তার মাশুল তাদেরই দিতে হবে।

‘মিনিওন, আমি পজিশনে।’

‘আক্রমণ করব?’ রোবটটা কনফার্মেশনের জন্য জানতে চায়।

কাঁধ ঝাঁকালাম, ‘নয়ত কি ভিরাবাসী কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে?’

‘স্যার, রোবট প্রজাতি কাম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, আমাদের -’

‘জাস্ট শাট আপ অ্যান্ড অ্যাটাক।’

জীরুৎ ওয়েভকে ধন্যবাদ দিতে দিতে [১৯৫২ দ্রষ্টব্য] মনোযোগ দিচ্ছি আগুনের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণিগুলোর দিকে।

ওরা এত সবুজ কেন? আমার জানার খুব বেশি ইচ্ছে হয় না। তার আগেই ওপাশ থেকে লেজারের বন্যা শুরু হয়ে যায়।

মিনিওনকে আমার লোকেশন বলিনি। তবে আমার একটু আগে যোগাযোগ করাটাই যথেষ্ট হবে, জানি। আমার লোকেশন তার জানা আছে। ওপাশ থেকে আমার দিকে লেজার মেরে আমাকে যে সে পুড়িয়ে দেবে না সেটার ওপর নির্ভর করলাম।

বিদঘুটে ভাষাতে নিজেদের মাঝে চেঁচামেচি করতে করতে বাকিরা পজিশন নিতে শুরু করে।

কাভার নিচ্ছে ওরা। মিনিওনের দিকে মুখ করে। অর্থাৎ পেছন থেকে আমি প্রত্যেকটা ভিরাবাসীর চওড়া পিঠ দেখতে পাচ্ছি।

পেছন থেকে আক্রমণ আসতে পারে – সে ব্যাপারে তারা আগেই সতর্ক হবে না? যুদ্ধ তো কিছুই শেখেনি বলে মনে হচ্ছে।

অবশ্য কিছুক্ষণের মাঝেই একদল ভিরাবাসীকে এদিকেই ছুটে আসতে দেখে বুঝলাম, সব প্যারামিটারেই ওয়াচ বসানোর ইচ্ছে তাদের।

আলতো করে গ্রেনেড লঞ্চার তুলে নিয়ে একবার ওদের মাঝে গ্রেনেড মারলাম।

ছিন্নভিন্ন সবুজ দেহগুলো থেকে সবুজ রক্ত বের হয়ে সয়লাব হয়ে যায় চারপাশটা। একই সাথে ডিগবাজি দিয়ে সরে গেছি আমিও।

চওড়া পিঠ নিয়ে মিনিওনের কাছ থেকে কাভার নিয়ে থাকা এলিয়েনগুলো আমার দিক থেকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত।

দ্রুত রাইফেলের মাইক্রোপিক স্কোপ চোখে ঠেকালাম। তারপর সাইট অ্যাডজাস্ট করেই ট্রিগার টানতে থাকি।

রিদমিক জ্যাকবের ভারী গর্জনে এলাকা গরম হয়ে গেল।

সেই গরমের ধাক্কায় তিনজনের ছোট একটা বাহিনীকে আড়াল থেকে বের হয়ে আমার আর মিনিওনের জনয সমস্যার কারণ হতে পারে – এমন একটা পজিশন নেওয়ার পাঁয়তারা করতে দেখা গেল। তারা এখন বুঝে ফেলেছে আক্রমণকারী এখানে দুইজন!

বড় দেখে একটা স্যাটেলাইট-ধ্বংসাবশেষের আড়ালে বসে পড়লাম। গুলি খেয়ে আমি এখানে ফুটো হয়ে গেলে এদের বাঁধা দেওয়ার মত আর কেউ থাকবে না। মানবিকতার কোন দাম এদের কাছে আছে বলে মনে হল না।

শক্তিশালী একটা হাত আমাকে টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় ঠিক তখনই।

ক্ষীপ্রতার সম্পূর্ণ অংশটুকু নিয়ে তার দিকে রাইফেল ঘোরাচ্ছিলাম – এক লাথিতে সেটা দশ ফিট দূরে পাঠিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ।

মাটিতে মাথা ঠেকে আছে, দুই চোখে অবিশ্বাস নিয়ে দেখতে পারলাম, আমার ঠিক ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী একজন ভিরাবাসী।

টকটকে সবুজ চামড়ার সাথে একেবারেই বেমানান লাল চোখদুটো আমার দিকে এক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়। তারপরই প্রাণিটা কোমর থেকে লম্বা একটা ছুরি জাতীয় অস্ত্র খুলে আনতে থাকে!

যা দেখার দেখে ফেলেছি – চোখ দুটোতে দয়ামায়ার লেশমাত্রও নেই !

৮.

দুই হাত দিয়ে মাটিতে জোরে ধাক্কা দিয়ে শরীরটা পিছলে পার করে দেই এলিয়েনটার পায়ের ফাঁক দিয়ে।

ছুরিটা এত জোরেই নামিয়েছে ভিরাবাসী এক মুহূর্ত আগে – মাটিতে হাতল পর্যন্ত ঢুকে গেছে ওটা। সড়াৎ করে বের করে এনে আমার মুখোমুখী হয় ভিনগ্রহের বিভীষিকা।

লাফিয়ে উঠে পড়েছি তখন আমিও। ছুরি ধরা হাতটা আমার দিকে এর পর এগিয়ে আসতেই পেছনের দিকে দ্রুত বাঁকিয়ে যাই, পেটের সামান্য ওপর দিয়ে চলে গেল লম্বা ছুরিটা।

মিনিওনের দিক থেকে লেজার নির্গত হওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওদিকে তীব্র যুদ্ধ সামলাতে হচ্ছে নিশ্চয় রোবটটাকে। আমাকে রক্ষা করতে আগামী আধ ঘন্টার মাঝে আসতে পারবে বলে মনে হয় না।

কাজেই এলিয়েনের ছুরি আমার ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার সাথে সাথে সুযোগটা নেওয়ার চেষ্টা করলাম।

ভিরাবাসী তার প্রত্যাশা অনুযায়ী টার্গেটকে পায়নি। একারণে কিছুটা বেসামাল এখন। গতি জড়তায় সামনে ঝুঁকে গেছে খানিকটা। চট করে মাটিতে দুই হাত বাঁধিয়ে কোমরের সহায়তায় দড়াবাজের মতো উল্টোদিকে ব্যাঙের মতো চলে যাওয়ার পথে পা জোড়া নাড়িয়ে মনের সুখে একটা লাথি মারলাম প্রাণিটার হাতে।

ছুরিটা ছিটকে গিয়ে পাশের এক গাছে গেঁথে যায়।

লাল চোখ গুলো জ্বলে ওঠে মহামান্য এলিয়েনের। আমার কাছে মনে হল, ক্রোধ নয়, অপমান। আমার কাজটা সম্ভবতঃ তাদের গ্রহের নিয়ম অনুযায়ী বেয়াদবীর কাতারে পড়ে।

কোমর থেকে লাল রঙের ছোট ছোট তিনটা প্ল্যাটিনাম টুকরো ছুঁড়ে দেই। খ্যাঁচাখ্যাচ গেঁথে গেল ভিরাবাসীর বুকে।

গর্জে উঠে এগিয়ে আসে প্রাণিটা। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে। সমানে চালাচ্ছে তিনহাত।

উচ্চতাতে আমার থেকেও তিন ফিট বেশি। সহজে তার সাথে আমার পারার কথা নয়।

আঘাত ঠেকাতে ঠেকাতে আড়াল থেকে বের হয়ে আসতেই হয় আমাকে। সাথে সাথে প্রাণের সুখ মিটিয়ে গুলি চালায় তিন ভিরাবাসী। ওদের দিকে দ্রুত একবার ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে পরের গাছের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

আনআর্ম কমব্যাটে ইচ্ছুক ভিরাবাসী বিশাল এক লাফে আমার সামনে আবারও চলে আসে। দুই হাতে তার দুটো পাঞ্চ ঠেকানোর সাথে সাথে নাকের ওপর তৃতীয় হাতটা আছড়ে পড়লো।

এক ঘুষিতেই চিত হয়ে গেলাম।

মাটিতে দড়াম করে পড়ে গেছি, লম্বা পা বাড়িয়ে প্রকাণ্ড এক লাথি মেরে বসে প্রাণিটা। উড়ে গিয়ে শক্ত কিছুর ওপর পড়তেই মনে হয় পাজরের হাড় তিনটে ভেঙ্গে গেলো।

বিকট শব্দে চেঁচাতে চেঁচাতে এগিয়ে আসছে বিশালদেহী ভিরা – তার দিকে দেহটা সোজা করে শুয়ে শুয়েই গুলি করলাম। পর পর তিনবার।

ছিটকে মাটিতে পড়ে যায় অসহ্যকর প্রাণিটা।

একপাশে কাত হয়ে তিন বীরপুঙ্গবের একজনকে দেখতে পাই – দ্রুত অস্ত্র ঘোরাচ্ছে আমাকে আরও একবার আড়ালের বাইরে পেয়ে।আমার তরফ থেকে বার্স্ট ফায়ার করতেই মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে এলো এই যোদ্ধার। দ্বিতীয়জনকে প্রায় সাথে সাথে দেখতে পেলাম।

মাঝের হাতটা তুলছে ওটা – সেই হাতে ধরে রেখেছে একটা গ্রেনেড।

দ্রুত রাইফেল ঘোরাচ্ছি সেদিকে – লেজার এসে তৃতীয় হাতটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ওর – নিশ্চয় মিনিওন! তবুও কিভাবে জানি গ্রেনেডটা ছুটে গড়িয়ে গড়িয়ে আসতে থাকে আমার দিকে।

বুকের ভেতর অসহ্য ব্যথা। তবুও গড়িয়ে গাছের আড়ালে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছি – জানি না সময় থাকতে থাকতে আড়াল পাবো কি না।

এই সময় ফেটে গেলো গ্রেনেডটা।

*

‘নড়বেন না।’ , চোখ মেলতেই মাথার কাছে মিনিওনের কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেলাম।

না নড়ে পারলাম না অবশ্য। পাজরের ভাঙ্গা হাড়গুলো তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে আমার ওপর বিরক্ত হয়ে ।

‘আমরা কোথায়?’

‘বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’

‘হোভারক্র্যাফট?’

‘মিশর থেকে একটা তুলে নিয়েছি। পূজনীয় কিরণের হোভারক্র্যাফটের ব্যাটারী লাগিয়ে সচল করা গেছে।’

‘ফাইন।’

ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। কন্ট্রোল রুমেই আমাকে একটা খাটে শুইয়ে রেখেছে মিনিওন। নিশ্চিত চায় না দ্বিতীয়বারের মত আমার জীবনের ওপর কোন ঝুঁকি নিতে।

‘আপনার কি হয়েছিল? গ্রেনেড থেকে সময় মত সরতে পারতেন। কিন্তু সরেননি।’

‘শালাবাবু ভিরাবাসী লাথি মেরে আমাকে আমার রাইফেলের ওপর ফেলে দেয়। পাজরের হাড় ভেঙ্গেছি মন হয় দুই-তিনটে।’

‘চারটা। এক্সরে করেছি।’

‘আজকের প্রযুক্তিতে কি ভাঙ্গা হাড় দ্রুত জোড়া লাগানো যায় না?’ কোঁকাতে কোঁকাতে জানতে চাইলাম।

‘পূজনীয় কিরণের বাড়িতে গেলে সম্ভব হতেও পারে। আপাতত বিশ্রাম নিন।’

মিনিওনের কথা গায়ে মাখলাম না। চারপাশে তাকিয়ে আমার রাইফেলটা খুঁজি। সব সময় হাতে রাখা দরকার এসব জিনিস।

গতবারের মত আচমকা আক্রান্ত হলে কাজে দেবে। ওটা দেখতে পেলাম না কোথাও।

মিনিওনের দিকে তাকাই, ‘আমার রিদমিক কোথায়?’

‘আর্মোরিতে রেখে এসেছি।’

‘ভিরাবাসী আবার হামলা চালাতে পারে। তোমার মনে রাখা দরকার ছিলো – হাতের মাঝে অস্ত্র নিয়ে ঘুরি না আমরা, মানুষরা, তোমাদের মত।’

বের হয়ে যাচ্ছিলাম ব্যথাতে কোমর বাঁকা করে, পেছন থেকে মিনিওন আবার বলে ওঠে, ‘দুইজন যাত্রী নিয়ে ফিরে যাচ্ছি আমরা। তাদের ঘাঁটাবেন না প্লিজ।’

আবারও কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে ফিরে আসিলাম শান্ত ভঙ্গীতে, ‘দুইজন যাত্রী? মানে?’

‘পড়ন্ত স্যাটেলাইটের কাছে ক্যাম্প করেছিলো ভিরাবাসীরা। আমাদের খন্ড যুদ্ধে প্রতিটি সৈনিক মারা গেছে ওখানে। তবে কমান্ডার একজনকে পেয়ে যাই যুদ্ধ শেষে। আপনি তখন জ্ঞান হারিয়েছেন।’

‘লোকটাকে বন্দী করেছ তাহলে তুমি। ওটা কি একমাত্র বাহিনী? না বাইরে আরও লোক আছে ওদের?’

ধীরে ধীরে আমাদের হোভারক্র্যাফটকে ওপরের দিকে তুলে ফেলে মিনিওন। সামনের বড় পাহাড়টা দেখে কারণটা বুঝি আমি।

আস্তে করে আবার খাটের ওপরে বসে পড়লাম। এখানে প্রতিটা ঘরেই চাইলেই খাট বা চেয়ার বের করা আনা যায়। পার্শ্বদেওয়ালগুলোতে থাকে প্রয়োজনীয় মেকানিজম। চাইলেই আবার উধাও করে দেওয়া সম্ভব ওগুলোকে দেওয়ালের মাঝে।

‘এখানে ওরা একটা শিপ নিয়ে আসেনি। পুরো এক ফ্লীট ভিরাবাসী আছে এখন পৃথিবীতে।’

‘ড্যাম! কথা বলতে পেরেছো তাহলে কমান্ডারের সাথে?’

‘আকারে ইঙ্গিতে। ভাষাটা অচেনা। আমার ডাটাবেজে কোন তথ্য নেই ও ভাষার ব্যাপারে।’

‘কতগুলো শিপ?’

‘কমান্ডারের দাবী অনুযায়ী, আঠারোটি।’

স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। আঠারোটা শিপের বিরুদ্ধে লড়াইটা হবে একতরফা।

যুদ্ধ-বিগ্রহে নেহায়েত কাঁচা ভিরাবাসী – সেকারণেই তাদের সাথে লড়াই করে কোনমতে পার পাওয়া গেছে প্রথম বারের মত।

তাছাড়া সারপ্রাইজিং এলিমেন্ট ছিলো। তারা প্রানের আলামত না দেখেই মিশরে নেমেছিলো হয়ত। আমরা আচমকা এসে হামলা করে ঝামেলা করে দিয়েছি।

কিন্তু জেনেশুনে আঠারোটি স্পেশশিপ আমাদের আক্রমণ করলে পৃথিবীতে আসলেই মানবপ্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যুদ্ধবিদ্যায় মানুষ যতই এগিয়ে থাকুক, পাঁচ-ছয় হাজার ভিরাবাসীর বিরুদ্ধে একজন মানুষ কখনোই পেরে উঠবে না।

কেউ একজন ঘরে ঢুকছে, খেয়াল করে সেদিকে মুখ ঘোরালাম।

দমকা হাওয়ার মত কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়া প্রাণিটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি আমি।

মিনিওন অবশ্য স্বাভাবিকভাবে তার দিকে ঘুরে তাকায়, ‘ফ্রেয়লিন সিখিনিকুয়াস জিজিন রাতে, দ্রানিয়াল তিতিনা।’

প্রাণিটি আমার দিকে ঘুরে তাকায়, ‘দেনামি হায়রাতিন কিলিমনাজির?’

মিনিওন হাসার মত একটা শব্দ করল, ‘সারিফিনি ফ্রাতিন ভাবার।’

তারপর আমার দিকে ফিরে ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে জানালো, ‘দুঃখিত, আপনাকে উনি নিম্নপ্রজাতির রোবট ভেবেছিলেন।’

আস্তে করে উঠে দাঁড়াই আমি, পাজরের ব্যথাকে আমলেই নিচ্ছি না এখন আর।

প্রাণিটা এই গ্রহের – বিষয়টা আমাকে স্রেফ নির্বাক করে দিয়েছে।

ভিরাবাসী কমান্ডার বাদে এ-ই তাহলে আমাদের দ্বিতীয় যাত্রী?

একজন মানবী!

৯.

গ্রাহেম কিরণের বাগানবাড়িতে ফিরে এসেছি আমরা আবারও।

চারপাশের মরুভূমিকে এখন কতই না আপন লাগছে!

ধীরে ধীরে চতুর্থ তলা হিসেবে মিশরীয় হোভারক্র্যাফটটাকে বসানো হচ্ছে।

প্রতিটি বাড়ির ছাদটাকেই এভাবে হোভারক্র্যাফট ল্যান্ডজোন রাখা হয়। আমার মনে পড়ে যায় একবিংশ শতাব্দীর কথা। ছাদে ছাদে হেলিকপ্টার থাকতো তখন খুব বেশি হলে।

সেটারই কি উন্নত রূপ না এটা?

আড়চোখে পাশে বসে থাকা স্ফটিকের মত স্বচ্ছ চামড়ার তরুণীকে দেখলাম একবার।

মানুষের চামড়া মিনিওনের মত হবে ভেবে ভুল করেছিলাম। মিনিওনের থেকেও চমৎকার দেখতে হয় প্রকৃত ত্বক। রোবট মিনিওনকে সম্পূর্ণ মানুষের আকৃতি দিতে চাইলেও দেওয়াটা সম্ভব হয়নি। কিছুটা পার্থক্য তো থাকবেই।

অবশ্য আমাদের মাঝে ভাষার পার্থক্যের কারণে তরুণীর সাথে কথা বলা হয়নি এখন পর্যন্ত। মেয়েটি শুধু জানাতে পেরেছে, তার নাম তিতিনা।

আমিও জানাতে পেরেছি, আমাকে জীবিত লোকজন রাতুল বলে ডাকে।

হোভারক্র্যাফটটা থেমে যেতেই মিনিওনের পেছনে পেছনে বের হয়ে আসলাম কন্ট্রোল রুম থেকে।

সময়ের অভাব। আমরা জানি না, কমান্ডারকে হারিয়ে তার বাহিনীর লোকজন আমাদের দিকে ছুটে আসবে কি না। অথবা, কমাণ্ডারকে উদ্ধার না করতে এসে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে পড়বে কি না।

আমাদের কিছুই জানা নেই।

কাজেই সবচেয়ে ভালো উপায় এখন লোকটাকে চিৎ করে ফেলে একটা ডিলে রাজি করানো।

‘যোগাযোগ করব কি ভাবে?’ হাঁটতে হাঁটতেই জানতে চাই আমি।

‘সহজ, ব্রেইন-কানেক্টর বলে একটা যন্ত্র আছে। ওটাতে দুইজনকে কানেক্ট হতে হবে আপনাদের।’

‘নামটা কি ইংরেজীতেই ছিলো?’ চোখ কুঁচকে যায় আমার।

‘না, তবে অনুবাদ করে বললাম।’

‘শর্ট ভার্সন নেই এর কোন? হেঁটে হেঁটে কথা বলার মত?’ আড়চোখে আরেকবার তিতিনাকে দেখলাম আমি।

‘না, স্যার। বেশ বড় যন্ত্রটা। দুইজন মানুষের ব্রেইনকে একত্র করাটা সহজ কোন কাজ নয়। আর সবচেয়ে ভালো দিকটি হল, ব্রেইন অনুভব করতে বা বোঝাতে কোন ভাষার ব্যবহার করে না। কাজেই যে যার মাতৃভাষাতে শুনতে পান অপরজনের কথা। আসলে, শুধু নিজের ভাব বোঝায় অপরজন। কোন ভাষার সাহায্যে না। ব্রেইনওয়েভের সাহায্যে। আপনি যদিও মস্তিষ্কের ভেতর মনে করবেন ভাষা দিয়েই কথা হচ্ছে। কাজেই আপনার সবচেয়ে আরাম যে ভাষায়, তাতে শুনতে পাবেন অন্যজনকে।’

‘চলবে। কমান্ডারকে যত্ন তো করেছ?’

‘খাইয়ে তাঁকে ফুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছেন। ঘরটা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যেতে হবে ব্রেইন-কানেক্টরের কাছে।’

আর্মোরি থেকে একটু আগে বের করা রাইফেলে হাল্কা চাপড় দিলাম।

পরক্ষণেই পাজরের ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে উঠি!

*

‘আমার লোক মোটেও আপনাদের ক্ষতি চায়নি। তারা শুধু ঘাবড়ে গিয়ে ফায়ার ওপেন করেছিলো আপনাদের হোভারক্র্যাফট দেখে।’

কমান্ডারের কথা আমি গায়েই মাখলাম না।

চারপাশটা অন্ধকার। এটা একটা সমস্যা। একে অন্যের মুখ দেখতে দেখতে কথা বলা যায় না ব্রেইন কানেক্টরে এসে।

‘আপনি এখন আমাদের হাতে বন্দী। এটা কি বুঝেছেন?’ জন্তুটাকে প্রশ্ন করলাম আমি।

‘আমি আগেই বলেছি, আপনাদের কাছে আমাদের আতিথেয়তা ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই।’

‘আপনাদের স্থান হওয়ার কথা একটি কারাগারে। আমাদের গ্রহের নিরীহ অধিবাসীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন আপনারা।’

এক মুহূর্ত নীরবতার পর শক্ত হয়ে যায় কমান্ডারের গলা, ‘আমরা গত বারো প্রজন্ম ধরে আপনাদের একটা স্পেসশিপ ট্র্যাক করেছি। কাছে পেয়ে ছেড়ে দেবো, সেটা ভাবলেন কি করে?’

মস্তিষ্ক কাঁপিয়ে হেসে ফেললাম, আমার বিকট হাসির শব্দে কমান্ডার চুপ হয়ে যায়।

‘তাহলে, আপনাদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে বেচারা মানুষগুলো। আপনি কি জানেন আপনাদের চেনার জন্যই তারা আপনাদের গ্রহে গেছিলো। কোনরকম আক্রমণ করতে নয়?’

‘জেনে আমাদের কাজ কি? আমরা যেকোন অ্যাপ্রোচিং শিপকে তো অবশ্যই ধরে নেবো শত্রু হিসেবে। আপনারা হলে কি করতেন?’

‘মানুষদের কেউ কি আপনাদের হাতে বন্দী আছে?’ পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি।

‘না। একজনই ছিলো। তবে এখন আর নেই বলে মনে হচ্ছে।’

‘আপনাকে নিয়ে আমি কি করবো, বলুন তো।’ হাসি হাসি কণ্ঠে বললাম কমান্ডারকে।

কমান্ডার আবারও চুপ হয়ে যায়।

এবার কথা বলতে বেশ সময় লাগলো তার। নিশ্চয় ঘাবড়ে গেছে।

‘আমি মৃত্যুর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’ শান্ত কণ্ঠে জানায় লোকটা।

মুচকি হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বুঝলাম শরীরটা নেই আমার এখানে। শুধুই ব্রেইন। হাসিটা জমল না।

‘আপনাকে হত্যা করার কথা আমি ভাবছি না, কমান্ডার। বরং আপনাকে আর আপনার বাহিনীকে একটা সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছি। আপনাদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে আপনাদের আবাসের দিকে। ভিরাতে চলে যাবেন আপনারা। অথবা আপনাদের পরবর্তী প্রজন্ম। তবে এতে আপনাদের লাভটা কি হচ্ছে বুঝতে পারছেন তো?’

‘আমরা জীবিত এই গ্রহ ছাড়তে পারব, তাই বলছেন?’

শব্দ করে হাসলাম আমি, ‘ঠিক ধরেছেন। তবে এজন্য আপনাকে আর আপনার বাহিনীকে আমাদের নির্দেশনা শুনতে হবে। নতুবা আমাদের সেনাবাহিনী আপনাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে স্রেফ খড়কুটোর মতই উড়ে যাবেন আপনারার।’

‘শুনছি আমি।’

কমান্ডার তো শুনছে ঠিকই। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।

যদি ঘুণাক্ষরেও এই প্রাণিটা টের পেয়ে যায় – আমাদের পুরো গ্রহে একটা মানুষও নেই। একজনও না!

নিশ্চয় হামলা চালিয়ে দখল করে ফেলবে গোটা একটা গ্রহ? সময় নষ্ট করার তো কথা না। সে ঠিক বলেছিল একটা কথা, তার বদলে আমি যদি নতুন কোন গ্রহে গিয়ে দেখতাম কেবল একটি প্রাণী সেখানে, আমিও ঐ গ্রহ দখল করতাম।

‘আপনাদের প্রথম স্পেসশিপ যখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকেছে – তখনই আপনাদের আগমন টের পেয়ে গেছি আমরা। কাজেই, জনগণকে নিরাপত্তার স্বার্থে মাটির নিচে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

কমান্ডার কিছু বলে না এবারও।

‘আমাদের নিজেদের গ্রহে পৃথিবীর অধিবাসী নিজেদের গর্তে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য না। আপনার বাহিনী পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাওয়ার কথা যেন ভুলেও না ভাবে। প্রত্যেকে যদি আমাদের নির্দেশিত স্থানে অবস্থান নেয়, তাহলেই কেবল আপনাদের একটা স্পেসুশিপ ধার দিতে আমরা পারবো। আপনারা আমাদের কথা শুনে যদি পুরো বাহিনীকে জনপদ থেকে সরিয়ে নেন, তাহলে আপনাদের বিশ্বস্ততার ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে আমাদের সমস্যা হবে না।’

‘আর আমরা আপনাদের কিভাবে বিশ্বাস করছি?’গম গমে কণ্ঠে বলে ওঠে নাফরমান কমান্ডার।

আমি উত্তর দিতে সময় নিলাম না, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর কাওকে আপনাদের ধারে কাছেও দেখবেন না। আপনাদের বাহিনীকে আমাদের ঠিক করে দেওয়া রঁদেভু পয়েন্টে চলে যেতে বলবেন। পথিমধ্যে একটা মানুষও আপনাদের সামনে পড়বে না। সবাইকে এলাকা থেকে সরিয়ে দেবো আমরা। আর রঁদেভু পয়েন্টে অপেক্ষা করবে আপনাদের স্পেসশিপ। ওটাতে চড়ে চাইলে জাহান্নামে যাবেন আপনারা,তবে এখানে থাকতে পারবেন না। এটা ডীল হিসেবে কেমন?’

‘মানে -’ দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে জানতে চায় কমান্ডার, ‘আপনার কোন সেনাবাহিনী সদস্য আমাদের চোখে পড়লেই গুলি করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিচ্ছেন আপনারা। আর আমরা গতিপথ ধরে না এগিয়ে গেলে আমাদের আক্রমণ করার অধিকারও আপনাদের থাকছে। কিন্তু, একে অন্যের বিশ্বাস রক্ষা করলে আমরা সবাই নিরাপদ?’

‘ঠিক তাই।’

কমান্ডার চুপ হয়ে যায়। ভাবছে।

আমার মনে হয় দীর্ঘ এক ঘন্টা পর তার গলা আবারও শোনা গেল, ‘আমি রাজি, পৃথিবীর মানুষ।’

১০.

‘মিনিওন। শুনতে পাচ্ছ তুমি?’

প্রায় সাথে সাথে ওপাশ থেকে উত্তর পেলাম, ‘স্যার। পজিশনে চলে এসেছি।’

‘ফাইন। জিনিসপাতিগুলো কাজ করে তো?’

‘করছে স্যার।’

‘কো অর্ডিনেট দিচ্ছি। লিখে নাও … সরি, তোমার তো আবার লেখার প্রয়োজন হয় না, যা বলি তাই মনে থাকে। হা হা হা।’

‘আপনাকে বেশ আনন্দিত বলে মনে হচ্ছে।’

‘তা বটে। যা হোক, লিখে নাও।’

পেছনের দরজাতে দুমাদুম লাথি মারার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

তিতিনা মেয়েটাকে ধরে রেখেছি একটা ঘরে। মেয়েটি এখন আমার বন্দিনী। মিনিওন আমার কথা শুনতে বাধ্য, তিতিনার নয়। গ্রাহেম কিরণের নির্দেশনা সেটাই।

তিতিনা অনেক ভবিষ্যতের মানুষ। তারা কীভাবে চিন্তা করে জানি না। তার সাথে কথা বলার সুযোগ আমার হয়নি। কাজেই শেষ মুহূর্তে পাগলামী করে পুরো জাতিটাকে বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারে – এই আশঙ্কা সরাতে পারিনি আমি। কাজেই বন্দিনী হয়েই থাকতে হবে তাকে। সাবধানে চারতলার দিকে পা বাড়ালাম।

হোভারক্র্যাফটটা নিয়ে একটু উড়ে আসা যেতে পারে।

বিশাল একটা স্পেসশিপ মরুভূমির মাঝেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভিরাবাসীর মাথাতে যদি সামান্য পরিমাণ বুদ্ধি থাকে, ওটা পরীক্ষা করার দুই ঘন্টার মাঝেই বুঝে যাবে তারা স্পেসশিপটা গত দেড় হাজার বছর ধরে নষ্ট পড়ে আছে। ওটা ওদের নিয়ে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরেও যাবে না। তাদের গ্রহ দূরে থাকুক।

ছোট একটা ক্যাপসুলে করে মিনিওনকে পাঠিয়ে দিয়েছি এজন্য সাবমেরিন নিউক্লিয়ার স্টেশনে। ওখানে নিউক্লিয়ার বোমাকে অক্ষত এবং সক্রিয় অবস্থাতেই পেয়েছে ও।

বোমাটা কোথায় ফেলতে হবে সেটাও এখন সে জানে।

আর আমার হিসেব অনুযায়ী ত্রিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। ভিরাবাসী এখনও কিছু সন্দেহ করেনি।

আর ত্রিশ মিনিট পর করবে। তাদের ইঞ্জিনিয়ার যদি একটা নিরেট গর্দভ হয়ে না থাকে।

তিতিনা মেয়েটার কথা মনে হতে মনের ভেতর অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করে যায়। ওদের পরিবারের গল্প আমার কাছে স্পষ্ট এখন।

এরাই সেই রিসার্চ শিপ। যেটাকে পাঠানো হয়েছিল ভিরার দিকে। গবেষণা করা ছাড়া যাদের আর কোন উদ্দেশ্য ছিলো না।

তবে ভিরাদের চোখে ওরা পড়ে যায়, তারপর থেকে দুইহাজার বছর তারা টিকে আছে স্পেসে সেটা আমার মনে হয়নি।

মিনিওন অবশ্য বলেছে, তারা মোটেও স্পেসে দুইহাজার বছর ধরে ছিলো না। কোন একটা ব্ল্যাকহোলে ডাইভ দিয়েছিলো তারা। এভাবে দ্রুত ফিরে এসেছে পৃথিবীর কাছে। তবে সময়ের গ্যাপটা হয়ে গেছে অনেক বড়।

যে কারণে এতদিন পর ফিরে আসতে পেরেছে শিপটা।

পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসার পর ভিরাবাসী বোঝে এখন আক্রমণ করতে না পারলে আর কখনই তারা পারবে না। আঠারোটা শিপ নিয়ে আস্ত একটা গ্রহের সাথে পারা যাবে না।

কাজেই হামলা চালায় ওরা।

তিতিনাদের শিপ দ্রুত একটা ডিফেন্সিভ স্যাটেলাইট স্টেশনে নিজেদের থিতু করার চেষ্টা করে। এতে করে ফাইটটা তাদের পক্ষে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ওরা মৃত একটা স্যাটেলাইট পায় ওখানে। একটা অস্ত্র কাজ করে নি, একটা যন্ত্র চালানো যায়নি।

শুধু পৃথিবীর আকর্ষণে ঝুলে আছে নিঃসঙ্গ প্রতিরক্ষামূলক উপগ্রহ!

ফলাফলটা হল মারাত্মক। গতকাল রাতে ওখানেই মারা যায় ৫৭ জন মানুষ। এবং পুরো স্যাটেলাইটটা বোমার আঘাতে আঘাতে খসে পড়ে পৃথিবীর বুকে।

একমাত্র তিতিনাকে ধরে ফেলতে পারে ভিরাবাসী – জীবিত।

কাজেই পরিস্থিতি তখন পাল্টে যায়। তিতিনাকেই ভিনগ্রহের প্রাণি হিসেবে ধরে ফেলে ভিরাবাসীরা। তাকে নিয়ে আবারও নিজেদের গ্রহে ফিরে যাবে – এসময় আমাদের হোভারক্র্যাফট আচমকা উদয় হয়েছিলো আকাশে।

এই মুহূর্তে আমার হোভারক্র্যাফট নিয়ে আমি উড়ছি পৃথিবীর অন্যপাশে আরেকটি মরুভূমির ওপরে।

মিনিওনের কাছে আরেকবার জানতে চাইলাম, ‘পাঠিয়েছিলে তো ঠিকমত?’

জবাব ওপাশে কি দেওয়া হল শুনতে পেলাম না ঠিক – দিগন্ত রেখার কাছে কিছু একটা খুব দ্রুত উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে।

ধীরে ধীরে একোটা ছাতার আকৃতি পেল ওটা। আকাশের দিকে এখনও উঠছে ধীরে ধীরে। সেই সাথে বড় হচ্ছে ছাতাটা।

আকাশ ছুতে চাইছে যেন ভয়ানক হলদে ওই অগ্নি শিখা।

হোভারক্র্যাফট ভাসিয়ে রাখলাম এক জায়গাতে। কিছুক্ষণ পর কাছে গিয়ে দেখে আসবো একবার।

তবুও দুইশ কিলোমিটার দূরে থাকবো অবশ্যই। শেষ মানব সন্তান হিসেবে নিজের জীবনের ওপর কোনরকম ঝুঁকি নিতে পারবো না।

দূর থেকেই স্ক্যান করে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে পৃথিবীতে আর কোন ভিরাবাসী জীবিত আছে কি না।

মানব সভ্যতা নিশ্চিত করার জনই আমাকে নিষ্ঠুর হতে হয়েছে। সাড়ে তিনশ ভিরাবাসী আর একটা দিন কাটালেই বুঝে যেত পৃথিবীটা একটা ফাঁকা মাঠ।

তারপর তাদের নিজের গ্রহে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যস্ত হবার কিছু ছিল না অবশ্যই।

এতগুলো বুদ্ধিমান প্রাণি হত্যার কারণে মনের ভেতর যে অপরাধবোধটা আসতে যাচ্ছিল – সেটাকে গলা চাপা দিয়ে মেরে সামনে এগিয়ে যাই।

স্ক্যান করে ফিরে যাবো বাসাতে। তিতিনার মিষ্টি মুখটা মনে করার চেষ্টা করলাম।

ব্রেইন-কানেক্টরে একবার ওর সাথে কথা বলতে হবে ফিরে গিয়ে।

ছাতাটা এখনও উঠছে ওপরের দিকে!

_ পরিশিষ্ট _

ফুরুফুরে মেজাজে ছাদের ওপর নামিয়ে রাখলাম হোভারক্র্যাফটটা।

তারপর নেমে আসি নিচের দিকে।

মানবজাতির নিশ্চিহ্ন হওয়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই। তিতিনা আর আমি মিলে নতুন প্রজন্মকে জন্ম দেব।

তিতিনা হয়ত এখন আমার সাথে কোন রকম শারীরিক সম্পর্ক করতে রাজি হবে না, তবে আমার হাতে এখনও অনেকগুলো বছর আছে।

মিনিওন আমাকে হাসিমুখেই গ্রহণ করল আজ।

‘আপনার সময় হয়েছে।’

হাসি আমার মুখেও আজ লেগেই আছে, ‘কিসের, মিনি?’

‘কেন আপনাকে নির্বাচন করেছিলেন পূজনীয় কিরণ – সেটা জানার।’

হাল্কা গলাতেই বললাম, ‘আমাকে জানিয়ে ধন্য করে দাও।’

‘পূজনীয় কিরণ ছিলেন আপনার বংশধর।’

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে আমি, ‘এতে করে আমাকে বাছাই করার কি হল?’

‘আপনাদের বংশগতিতে প্রসিদ্ধ বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এসেছেন। বিজ্ঞানী অ্যারনশিংক, রিতরমিয়াক, সারেঞ্জক সহ মোট বারো জন বিজ্ঞানীর নাম নিতে পারি, যাদের জন্য সভ্যতা এত দ্রুত এগিয়ে এসেছে। পূজনীয় কিরণ মনে করেছেন, প্রকৃতি বিজ্ঞানের বাড়াবাড়ি সহ্য করেনি। কাজেই সব কিছু প্রথম থেকে শুরু করার জন্য সে পাঠিয়েছে ফ্রিটজ ওয়েভ।’

‘আমাকে সরিয়ে ফেলার কারণে, পৃথিবী এই বিজ্ঞানীগুলোকে আর পাচ্ছে না। নতুন ধরণের ইতিহাস লেখা হবে পৃথিবীতে। আর স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাতে প্রকৃতি হবে না ক্ষুব্ধ। এটাই কি গ্রাহেম কিরণের মত ছিল? যত্তসব কুসংস্কার।’ নাক কুঁচকে ফেললাম আমি।

তিনতলার দরজাটাতে চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লাম এক সেকেন্ডের জন্য।

তিতিনাকে এখানেই রেখে গেছিলাম। খুলে দিলো কে?

মিনিওনের দিকে তাকাতেই উত্তরটা আমি পেয়ে যাই।

‘আমি বলেছিলাম, তিতিনা এখন আমার বন্দী! কোন আক্কেলে খুলে দিয়েছ তুমি দরজা?’

মিনিওন কিছু বলল না।

ছুটে যাই আমি ঘরটার দিকে।

মিনিওন পেছনে পেছনে এসেছে। একঘেয়ে কণ্ঠে বলতে থাকে রোবটটা, ‘নিশ্চিত করে বলার কিছু নেই। তবে ধারণা করছি, ভিরাবাসীর কমান্ডার নিজের হার্টের সাথে কানেক্ট করে দিয়েছিলেন তিতিনাকে । নিরাপত্তার জন্য খুব সম্ভব। খুব একটা স্মার্ট মুভ হয়তো ছিলো না আপনার শেষ পরিকল্পনাটি, পূজনীয় রাতুল।’

দেওয়াল খামচে ধরে আমি শুধু তাকিয়ে থাকি পড়ে থাকা শরীরটার দিকে।

তিতিনার বুকের বাম দিকটি উড়ে গেছে। আস্ত একটা বোমা ওখানে ভিরাবাসীর কমান্ডার রেখে দিতে পারে ইন্সুরেন্স হিসেবে – একথা আমার মাথায় কেন আগে আসেনি?

‘আপনি উত্তেজিত হবেন না। স্নায়ুগুলো অতিরিক্ত গতিতে কাজ করছে। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন।’

মিনিওনের কথাগুলো আমার কানে ঢোকে না।

হাটুগেড়ে বসে পড়েছি আমি। দুই হাতে আকড়ে ধরেছি তিতিনার মৃত একটি হাত।

সাড়ে তিনশ ভিরাবাসীর মৃত্যুর পর এই প্রথম আমার মনে হল, প্রকৃতি বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না।

মিনিওন চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অনবরত বলে যাচ্ছে এখন আমার কি করা উচিত।

বার দুয়েক জানতে চাইলো অযথা একজায়গাতে কেন আমি দুই ঘন্টা ধরে বসে আছি।

মৃত একজন মানবীর হাত ধরে অনিকেত মানব কেন বসে আছে সেটা একটি রোবটের বোঝার কথা নয়।

— ০ —-

রচনাকাল – ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪