KP Imon

Words Crafted

গোয়েন্দাগিরি

বিরক্তির সাথে চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।
“কখনও কি ভেবেছ বন্ধুর চেয়ে একটুখানি –”
ব্যাস! শেষ।
আর কিছু নেই লেখা।
বন্ধুর চেয়ে একটুখানি কি? বেশি নাকি কম?
ভ্রু কুঁচকে ও দু’সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে আরও। তারপর পাশে বসা জুয়েলের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়।
‘গুতাস ক্যারে?’ মোটাসোটা শরীরটা আরেকটু দুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে জুয়েল।
‘আরে কান্ডটা দ্যাখ!’ ওর হাতে গুঁজে দেয় কাগজের টুকরোটা।
‘কোথায় পাইলি?’
‘ব্যাগের মধ্যে ঢুকানো ছিল। কলম রাখি যে পকেটে।’
‘কে পাঠাইছে লেখা নাই তো।’
‘তুই বের করতে পারবি না?’
‘খাড়া খাড়া জিনিসটা বুইঝা লই।’ মোটা শরীরটা একটু ঘুরিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে জুয়েল।
বেশ কিছুক্ষণ কুঁতকুঁতে চোখ মেলে তাকিয়ে মিনিট পাঁচেক দেখে মাথা নাড়ে। আগ্রহের সাথে এই পর্যবেক্ষণ দেখছিল তাহমিদ। আর ধৈর্য রাখতে পারে না ও।
‘কিছু পেলি?’
‘হুম!’ মাথা তুলে জুয়েল।’ কিন্তু আগে বলুম না। তুইও দেখ। তারপর একলগে।’
তাহমিদও ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে আটকে দেখতে যাবে – এই সময় ক্লাসে ঢুকে পড়লেন দেবনাথ স্যার। ইনি ইংরেজী পড়ান। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়ে আবার বসে পড়ে।
কলেজে আধ-ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকের পর এই প্রথম ক্লাস। লাঞ্চ ব্রেকের আধ-ঘন্টার মাঝেই কেউ চালিয়ে দিয়েছে এই চিরকুট। দেবনাথ স্যার এখন অ্যাটেনডেন্স নেবেন।
নিজের রোলটা পার হয় যেতেই আবারও ঝুঁকে পড়ে তাহমিদ কাগজটার ওপর। হাতে আতশী কাচ। পাশের সারি থেকে ওদের ভাব ভঙ্গী দেখে মুচকি হাসে প্রিয়াংকা আর কেয়া।
‘উমম…’ মাথা তোলে এবার তাহমিদ।’ যদিও তুই-ই ক্লাসের একমাত্র গোয়েন্দা। তবুও আমিও চেষ্টা করে দেখি… ম্যাটাডোর কলমে লেখা, উমম… কাগজটা কাটা হয়েছে হাতে ছিড়ে… উহু, থুতুতে ভিজিয়ে, আর্দ্র কাগজের কোণা শক্ত হওয়ার লক্ষণ থেকে যায়… আর এইটা ডাক্তারী প্যাড থেকে ছেঁড়া একটা কাগজ। অ্যাম আই রাইট?’
‘সাবাশ!’ গোবদা হাত দিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দেয় জুয়েল।’ প্রায় সবকিছুই ধইরা ফেললি! আরেকটা জিনিস বাকি – লেখাটা একটা মাইয়ার। সম্ভবতঃ – হাতের লেখা পাল্টাইছে যে লেখছে। মানে তোর পরিচিত ওই মাইয়া। আর না পাল্টাইলে অন্য কাওরে দিয়ে লেখাইছে।’
জুয়েল কলেজে গোয়েন্দা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
একমাস আগে চুরি হয়ে যাওয়া মকসুদের মোবাইলটা বের করতে জুয়েলের লেগেছিল সাড়ে তেতাল্লিশ ঘন্টা। আর আড়াই দিন আগে বোর্ডে লেখা অশ্লীল বাক্যের রচয়িতাকে ওর বের করতে লেগেছিল আড়াই মিনিট। কিন্তু বেচারার ওজন একশ দশ কেজি। কলেজ শুরুর প্রথম কয়েক সপ্তাহে ওর নিকনেইম ‘ভোটকা’ হয়ে গেছিল, তবে কেসগুলো সমাধানের পর থেকে সবাই ওকে সমীহের চোখে দেখা শুরু করেছে। এই পর্যন্ত কলেজের সাতটি রহস্যের সমাধান করেছে সে। সমাধানের হার শতভাগ।
সেই জুয়েলের পাশে বসে তাহমিদের ব্যাগে অপরিচিত নোট লিখে যাবে কোন একজন – জুয়েলের ভাষায় – ‘মাইয়া’ – আর কালপ্রিটকে ধরতে পারবে না ওরা – এ তো সাংঘাতিক লজ্জার কথা। কিন্তু এই দফায় চ্যলেঞ্জ করতে বাধ্য হয় তাহমিদ।
‘কোন মেয়ের লেখা – আর তাও সেটা হাতের লেখা পাল্টে? এগুলো কিভাবে বললি?’
‘খেয়াল করলে তুইও পারতি।’ মামুলি কাজ করে ফেলেছে – এরকম ভাবে নাক-মুখ কোঁচকায় জুয়েল।’ হাতের লেখার ধাঁচ ওরকম মাইয়াগোরই হয়। লেখা নিয়ে সৌখিনতা পোলারা করে না এত… মানে, সাধারণতঃ। মাইয়াগো লেখা জঘন্য হলেও দেখবি একটা সাজানো-গোছানো ধরণ আছে। ওইটা দিয়া বোঝা যাইতেছে লেখছে একটা মাইয়া। আর অপরিণত ভাবটা খেয়াল কর – হয় ছোট বাচ্চায় লেখছে – অথবা মাইয়া নিজেই নিজের লেখা পাল্টানোর চেষ্টা করছে। শিওর!’
এবারে কিন্তু তাহমিদই অভিভূত হয়ে যায়।
‘সাবাশ দোস্ত!’ জুয়েলের পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলে ও।’ বেশ উন্নতি হয়েছে রে তোর -’
‘চমৎকার!’ দেবনাথ স্যারের গলায় প্রশংসার চাইতে ব্যাঙ্গই বেশি প্রকাশ পেল।’ ক্লাস শুরু হতেই পিঠ চুলকে দিচ্ছ একে অন্যের! কি মোহাব্বত! দাঁড়িয়ে থাক তোমরা দুইজন।’
‘ওহ শিট!’ বিড় বিড় করে তাহমিদ।
হেসে কুটি কুটি হয় প্রিয়াংকা আর কেয়া।

কলেজ থেকে বের হয়ে জুয়েলের হাতে কাগজটা তুলে দেয় তাহমিদ।
‘দোস্ত এভিডেন্সটা তুই বাসায় রাখ। পরে কাজে লাগতে পারে।’
‘আমার কিন্তু এরই মধ্যে একজনরে সন্দেহ হয় দোস্ত।’
‘আরে আরও তথ্য প্রমাণ দরকার।’ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তাহমিদ।’ ওই যে প্রিয়াংকা চলে এসেছে। যা তুই। কাল দেখা হবে।’
হতাশায় মাথা নাড়ায় জুয়েল। জুয়েলের বাসা একদিকে আর বন্ধুবরের আরেকদিকে। আবার ওদিকে তাহমিদের পাশের বাসায় থাকে প্রিয়াংকা। কলেজে যাওয়া আসাটা তাই একসাথেই হয়। বাসে উঠে পাশাপাশি বসল ওরা। এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে খোঁচাতে ছাড়ে না প্রিয়াংকা।
‘ক্লাসে দেখলাম কি একটা কাগজ নিয়ে শার্লক হোমসগিরি ফলাচ্ছিস তোরা।’
‘কই না তো!’ আপত্তি করার চেষ্টা করে তাহমিদ।
‘কি ছিল রে? কেউ প্রেমপত্র দিয়েছে নাকি? বেনামী?’ মজা পায় প্রিয়াংকা ওকে বিব্রত হতে দেখে।
‘এক রকম। লাঞ্চ-টাইমে কেউ আমার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল।’ স্বীকার করতে বাধ্য হয় তাহমিদ। তারপরই লাফ দিয়ে সোজা হয়ে বসে।’ তুই জানলি কি করে? তোর কাজ এইটা?’
‘তোকে প্রেমপত্র দিতে বয়েই গেছে তো আমার!’ চোখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা চলে যায় প্রিয়াংকার।’ জানব কি করে? গেস করেছি। যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলি। তাছাড়া লাঞ্চ-টাইমের বেল বাজতেই ক্লাস থেকে কেয়ার সাথে বেরিয়ে যাই আমি।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, ‘তাইলে তো তোর এবার হয়েই যাবে।’
‘মানে কি! কি হবে আমার?’ সপ্তম আসমান থেকে পড়ে যেন তাহমিদ।
‘ওই চিঠি তোকে দিলে তো ক্লাসের কোন মেয়েই দিয়েছে তাই না? প্রেম হবে তোর।’
‘শোন!’ জোর গলায় বলে তাহমিদ, ‘যেই মেয়ের সামনে এসে বলার সাহস নাই – এরকম মুরগির কলিজাওয়ালা মেয়ের সাথে আমি প্রেম-ট্রেম করতে পারব না। আমার প্রেমিকা হবে অনেক সাহসী। হুহ!’
‘এহহ!’ তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ জানায় প্রিয়াংকা।’ যেই না উনার সাহস। আর চায় সাহসী প্রেমিকা!’
প্রিয়াংকাকে কিল দেয় তাহমিদ।
‘আবার মারেও অবলা একটা মেয়েকে।’ অভিমানী গলায় বলে ও।
আরেকটা কিল দেয় তাহমিদ।
বাস ছুটে চলে।

পরদিন লাঞ্চ-টাইম থেকে ফিরে এসে ব্যাগ খুলে এবার রীতিমত আর্তচিৎকার করে ওঠে তাহমিদ।
‘ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন?’ বিরক্ত হয় জুয়েল।
‘আমি মোটেও চেঁচাচ্ছি না!’ ষাঁড়ের মতই চেঁচিয়ে বলে এবার তাহমিদ।’ এইটা দ্যাখ!’
বেশ বড় একটা খাম। তার মাঝে একটা মাত্র পাতার চিঠি। সেটা বড় কথা না। চিঠিটা রক্তে লেখা।
‘তাহমিদ,
এতদিন ধরে পাশে রেখেছ। বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবোনি কোনদিন। হয়ত বড়জোর আরও একটা বছর পাশে পাব তোমায়। কিন্তু আমি যে তোমায় বন্ধু ভাবতে পারি না আর। ভালোবাসি তোমায় এতটা। মুখে বলে বন্ধুত্বটা নষ্ট করে ফেলতে চাই না। তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। বন্ধুর থেকে বেশি না ভাব – আমি ভালোবেসে যাব তোমায় – আজীবন।’
‘আমি তো মাননীয় স্পীকার হইয়া গ্যালাম!’ নিজ ভাষায় বিড় বিড় করে জুয়েল। মোটাসোটা শরীরটা একেবারে পাথর হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়।
‘নাম নেই।’ চোখ তোলে তাহমিদ।’ কে হতে পারে।! কে? জানাটা দরকার। এত পাগলামী কেন করবে?’ একসেকেন্ড ভেবে ডাক দেয়, ‘মাননীয় স্পীকার!’
‘হ!’ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয় জুয়েল।
‘এই চিঠিকে এভিডেন্স ধরে কি পাচ্ছিস? আমাকে জানা।’
চিঠি ধরে উলটে পালটে দেখে জুয়েল। তারপর নিরাশ হয়ে মাথা নাড়ে।
‘ডিএনএ টেস্ট করা লাগব!’
‘বসে আছিস কেন? করে আন!’ তাড়া দেয় তাহমিদ।
‘আমারে কি তোর সিআইডির লোক মনে হয় দেইখা?’ ঝাড়ি মারে ওকে জুয়েল। হঠাৎ আগ্রহের সাথে খামটা তুলে নেয়।’ তয় – এই খাম আমগোরে লীড দিবার পারে।’
‘খামে কোন ঠিকানা ছিল না, মি. স্পীকার।’
‘ওই আমারে স্পীকার কইবি না। হইয়া গেছিলাম। এখন নাই আর।’ বলে জুয়েল গোবদা হাত দিয়ে পিঠে একটা চাপড়ও দেয় তাহমিদকে।
আবার বলে তারপর, ‘ঠিকানা নাই – কথা সত্য। কিন্তু খামে গন্ধ থাইকা যায়। শুইকা দেখ!’ তাহমিদের দিকে আগ্রহের সাথে খামটা বাড়িয়ে দেয় ও।
‘আমি বাবা রক্তের গন্ধ-টন্ধ শুঁকতে পারব না।’ নাক মুখ কোঁচকায় তাহমিদ।’ তোর মন চাইলে তুই নাক ডুবিয়ে বসে থাক!’
অক্ষরে অক্ষরে তাহমিদের নির্দেশ পালন করে জুয়েল। নাকটা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকে মিনিট তিনেক। তারপর মুখ তোলে।
‘একটা বডি পারফিউমের গন্ধ পাইছি। তুই শুইকা দেখ।’
‘মরলেও না!’ তারস্বরে প্রতিবাদ জানায় তাহমিদ।
হাতির পায়ের মত হাত দিয়ে ওকে চাপড়িয়ে উৎসাহ দেয় জুয়েল। শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই খামের গন্ধ শোঁকা উত্তম – হাত বাড়ায় তাহমিদ। একমিনিট পর মাথা তোলে।
‘গন্ধটা আমার পরিচিত। দোস্ত – কালকে তুই কাকে যেন সন্দেহের কথা বলছিলি?’
‘কইতাম কিন্তু রাগ করতে পারবিনা কইলাম!’ গ্যারান্টি চায় জুয়েল।
‘না করব না। বল?’
‘আমার তো প্রিয়াংকারে ধুমাইয়া সন্দেহ হইতেছে।’
‘আরে নাহ।’ আপত্তি জানায় তাহমিদ নিজেই।’ কাল ওকে চার্জ করেছিলাম। কিন্তু ও সবার আগেই লাঞ্চ করতে বের হয়ে যায়। আজও আমার সন্দেহ যায়নি – তাই খেয়াল করেছি – সবার আগে ও আর কেয়া বেড়িয়ে যায় ক্লাস রুম থেকে।’
‘আরে বলদা রে!’ তাহমিদের বুদ্ধির প্রশংসা করে জুয়েল।’ এরা বাইর হইয়া বাইরে ছিল কোথাও আশে পাশেই – আমরা বাইর হতেই আবারও লাফায়া ঢুকছে! ‘
‘হুম…’ টোকা দেয় তাহমিদ টেবিলে, ‘লাফিয়ে না ঢুকলেও – আমরা যাওয়ার পরে ঢুকতেই পারে…’
হঠাৎ জুয়েলের পাহাড়ের মত শরীরটা শক্ত হয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে, ‘তাহমিদ, দ্যাখ!! প্রিয়াংকার ডান হাতের দিকে তাকা!’
তাকিয়ে চমকে যায় তাহমিদ। প্রিয়াংকার ডান হাতের তর্জনী পেঁচিয়ে আছে ব্যান্ডেজে। হাত কেটে গেছে?
নাকি নিজে থেকে কেটে চিঠিটা লিখেছে ও?

‘আজ পারলে প্রিয়াংকারে একটু গুঁতায়া বাইর করার চেষ্টা কর দোস্ত।’ সাজেশান দেয় জুয়েল ওকে।’ মুখে কইব না যখন তখন গুতাইন্নাই লাগব। হুদাই কষ্ট পাইব ক্যান?’
‘হুঁ।’ সায় দেয় তাহমিদ।
‘রক্তের চিঠিটাও কি আমি নিয়া যামু? এভিডেন্স তো।’
‘না। ওটা আমার কাছেই থাকুক।’
‘মাইয়াটারে আবার বাসে বেশি জেরা করিস না। যদি আমাদের সন্দেহ ভুল হয় তাইলে কিন্তু ইজ্জত মার্ডার।’
‘আচ্ছা।’ তাহমিদের গলার স্বর আজ পরিবর্তিত।
দেখে সন্তুষ্ট হয় জুয়েল। ছেলে প্রিয়াংকাকে জেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেসটা আনসলভড থেকে যাবে এই ভয়টা ছিল ওর। বাসে উঠে ওই ব্যাপারে প্রিয়াংকাকে খোঁচানোর কোন সুযোগই পেল না আজ তাহমিদ।
‘অ্যাই তোর হাত কিভাবে কেটেছে?’ সরাসরি প্রশ্ন করে ওকে।
‘কাল রাতে মাছ কাটতে গিয়ে। কাটাকাটি পারি না তো!’ হাই চেপে বলে মেয়েটা।
‘ওহ।’ কি বলবে ভেবে পায় না তাহমিদ।
‘কাল সারা রাত ঘুমাইনি রে।’ চোখ বোজে ও।’ আমি চোখ বন্ধ করে থাকি একটু।’
প্রিয়াংকার চোখ খোলার অপেক্ষায় থাকে তাহমিদ। কিন্তু কিসের কি! বলতে বলতেই পাঁচ মিনিটের মাঝেই ঘুম!
‘স্বাভাবিক। সারা রাত কেটেছ হাত।’ মনে মনে বলে তাহমিদ।’ গতকাল আমার সাহসী প্রেমিকা লাগবে বলাই উচিত হয় নাই।’
মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর। বাস তখন দাঁড়িয়ে জ্যামে। দশ মিনিটের দূরত্ব পার হতে এভাবেই লাগায় আধঘন্টা। আলতো করে প্রিয়াংকার ঘুমন্ত মাথাটা ঢলে পড়ে তাহমিদের কাঁধে।
সরাতে গিয়েও সরায় না ও।
খামের মধ্যে পাওয়া সুগন্ধটা তীব্রভাবে নাকে আসে ওর।
ঘুমন্ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ বড় মায়া হয় তাহমিদের। মুখ ঢেকে দেওয়া এক গুচ্ছ চুল সরিয়ে দেয় ও পরম মমতার সাথে।

পরদিন সকাল।
লাইব্রেরীর এক নির্জন কোণা বেছে নিয়েছে প্রিয়াংকা আর তাহমিদ। আজ যা বলে ফেলতে চায় তাহমিদ ওকে। জুয়েলটাকেও আসতে বলেছে। কিন্তু হোৎকাটা দেরী করছে। অস্বাভাবিক কিছু না অবশ্য। “যতই স্থুল হবে তুমি – গতিবেগ ততই কমবে তোমার” – নীতিতে বিশ্বাসী তাহমিদ; জুয়েলের দেরী গ্রাহ্য না করে তাই আসল কথায় চলে এলো।
‘প্রিয়াংকা – তোর সাথে কিছু কথা ছিল।’
‘আমারও।’ কেমন যেন নিস্তেজ গলায় বলে প্রিয়াংকা আজ।
নিশ্চিত হওয়ার এই সুযোগ ছাড়ে না তাহমিদ। সন্দেহ ভুল হলে; অর্থাৎ প্রিয়াংকা ওই চিঠিগুলো না পাঠালে বেশ লজ্জার একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। তাহমিদ যে মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে – নিজের কাছে তো আর লুকাতে পারছে না। গতকাল বাসে বসে অনুভূতিটা বুকের ভেতর একেবারে লাফালাফি শুরু করেছিল। ভাগ্যিস – ঘুমাচ্ছিল প্রিয়াংকা। নইলে কেলেংকারী হয়ে যেত!
‘বল তাহলে।’ প্রিয়াংকাকে আগ বাড়িয়ে চাল দেবার আহবান জানায় তাহমিদ।
‘তোর দিকে আজকাল অনেক মেয়ে নজর দেয়।’ শ্রাবণের মেঘ জমে প্রিয়াংকার মুখে।’ আমার এসব একেবারে সহ্য হয় না।’
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।
‘তোকে ভালোবাসি আমি, তাহমিদ!’ মুক্তোর মত একফোঁটা পানি পড়ে প্রিয়াংকার গাল বেয়ে।
‘অ্যাই বোকা মেয়ে! কাঁদছিস কেন?’ তাড়াতাড়ি ওর হাত ছোঁয় তাহমিদ।’ তোকে এটা বলতেই আজ এখানে এনেছি। কখন জানি তোর প্রেমে পড়ে গেছি আমিও। দেখ তো কি রকম গাধা আমি!’
চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলে প্রিয়াংকা। এই সময় লাইব্রেরীতে ঢোকে জুয়েল। প্রিয়াংকার কান্না-হাসির সাথে ওদের হাতে হাত ধরে রাখা দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেলে ও। বিশাল শরীরের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র দাঁতগুলো ঝিলিক মারে। গোয়েন্দা জুয়েলের এতটা আনন্দিত চিত্র আগে কখনও দেখেনি কেউ।
‘তুই একটা পাগলি, প্রিয়াংকা!’ এবার আলতো ধমক দেয় ওকে তাহমিদ।’ আমাকে সরাসরি বলতেই পারতি। নোট রেখে গেছিস তাও মানা যায়। তাই বলে হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে চিঠি লিখাটা বাড়াবাড়ি করেছিস! এরপর যদি আর…’
প্রিয়াংকার মুখে নিখাদ বিস্ময় দেখে থেমে যায় তাহমিদ।
‘তুই ভাবিস আমি ওই চিঠি রেখে তোকে মিথ্যা করে বলেছি? আর কিসের রক্ত মাখা চিঠি?’
‘তুই লিখিসনি বলতে চাস…’ এক সেকেন্ড ভাবে তাহমিদ।’ তাই তো! আমি আগে কেন বুঝিনি?! স্বস্তি লেখা ছিল চিঠিতে।’ পকেট থেকে বের করে চিঠিটা।
“…তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না…” লাইনটা দেখায় প্রিয়াংকাকে ও।
‘কলম দিয়ে ‘স্বস্তি’ লেখাটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে। কিন্তু কেউ হাত কেটে স্বস্তি লিখবে না। প্যাঁচ দেখেছ? এরচেয়ে প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। এইটা এই মোটকুর কাজ। নির্ঘাত!’
একটা কলম বন্দুকের মত তাক করে ও জুয়েলের দিকে।
‘আরে আরে চ্যাতস ক্যারে?’ হাহাকার করে ওঠে জুয়েল।’ দেখলাম তোগোর ভিতরে ভালোবাসা পাঙ্খা মেলতেছে কিন্তু কইতেছস না একজন আরেকজনরে তাই ক্যাটালিস্ট দিছি জাস্ট।’
‘দাঁড়া বলিস না।’ হাত তুলে ওর দিকে তাহমিদ।’ আমার পিছে বের হওয়ার সময় তুই ভেতরে খাম ঢুকাইছিস এইটা তো পানির মত সোজা। আর লিখাইছিস তোর ছোটবোনকে দিয়ে, প্রথম চিঠিটা। আর রক্ত… উমম রক্তের ব্যাপারটা নিশ্চয় আঙ্কেলের কাছে ব্লাডব্যাগ হাতাইছিস। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। খামের মধ্যে বাসা থেকে পারফিউম মেরে এনেছিলি সেটা তো বোঝা সহজ। অ্যাম আই রাইট?’
‘পুরাই।’ মাথা নাড়ায় জুয়েল। ওর বাবা একজন বায়োলজিস্ট।’ ব্লাড ব্যাংকের কিছু নষ্ট হওয়া স্যাম্পল নিয়া বাবা কাজ করতাছিল। ওইদিন গেলাম দ্যাখা করতে। দেখি একটা থাইকা গেছে কাজ শেষেও। নিয়া আইতে চাইলাম। দিয়া দিল। তখন থেকেই মাথায় ঘুরতাছে প্ল্যানটা।’
‘ইয়াহ!’ আনন্দে মাথা ঝাঁকায় তাহমিদ। ‘এইটা আট নম্বর।’
‘দাঁড়া দাঁড়া!’ ধরে ফেলে প্রিয়াংকা, ‘কলেজ কেসগুলো তুই সব সলভ করেছিলি, তাই না তাহমিদ? তারপর জুয়েলকে দিয়ে বলাইছিলি? কেন?… ওহ!’ নিজেই ধরতে পারলো প্রিয়াংকা এই প্রশ্নের উত্তর, ‘ওকে যাতে সবাই সমীহ করতে বাধ্য হয় তাই–’ এক মুহূর্ত থেমে নতুন দৃষ্টিতে দেখে আজ প্রিয়াংকা তাহমিদকে। তবে ওই একমুহূর্তই।
‘তুই একটা ইবলিশ রে!’ প্রিয়াংকা তাহমিদকে কিল দেয় এবার।
‘তোর মাথা।’ এড়িয়ে যাতে চায় তাহমিদ।
আবার কিল দেয় ওকে প্রিয়াংকা।
এই দুইটা এইভাবে আজীবন খুনসুটি করুক।
একমুখ হাসি নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে আসে জুয়েল। বুকে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি।

রচনাকাল – ২৯শে ডিসেম্বর, ২০১৩

সন্দেহ

নাকের সামনে পেপারটা ধরে মনযোগের সাথে পড়ার ভান করে রিয়াজ। ওর সন্দেহ শেষ পর্যন্ত সত্যি হতেই যাচ্ছে!
আড়চোখে তাকায় কিছুটা দূরে পার্কের বেঞ্চে বসে থাকা উর্মিলার দিকে। উর্মিলাকে ফলো করতে করতেই যত্ত ঝক্কি!

উর্মিলা রিয়াজের বোন। পিঠাপিঠি। ক্লাস টেনে পড়ে উর্মিলা। রিয়াজ কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে।
গত কয়েক দিন ধরেই বোনের গতিবিধি অত্যন্ত সন্দেহজনক ঠেকছে। রাত্রিবেলায় উর্মিলার ঘর থেকে ওর গলা শুনতে পায় প্রায়। তার ওপর সারাদিন মোবাইলে উর্মিলার টেপাটেপি। যে মেয়ে আগে স্কুল থেকে সঠিক সময়ে ফিরে আসত তারই এখন কখনো এক কখনো দেড় ঘন্টা লেট হয়।
‘নিশ্চয় কোন দুষ্ট ছেলের মিষ্টি কথায় ভুলে – উর্মিলা গেছে ঝুলে!’ প্রাণের দোস্ত ফরহাদকে বিষয়টা জানাতে গিয়ে এমনই উত্তর পেলো রিয়াজ।
‘তুই শিওর?’
‘সাতানব্বই শতাংশ।’ মাথা দোলায় ফরহাদ।
ফরহাদ ফালতু কথা বলার মানুষ না। অসম্ভব ট্যালেন্ট একটা ছেলে – পড়াশোনায় যেরকম এগিয়ে তেমনি তার উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা। কাজেই সাড়ে সর্বনাশের গন্ধ পায় রিয়াজ।
ভাই মাত্রই ছোটবোনের নিরাপত্তা চিন্তায় থাকে অতিমাত্রায় শঙ্কিত। আর আজকাল বাংলাদেশে বাটপার তো অপ্রতুল। শেখ মুজিবের যুগেও কম ছিল – তাই বা কে বলবে? সাধে কি আর উনি আক্ষেপ করে গেছেন –’অন্য দেশের কত কিছু থাকে – আর আমার দেশভর্তি চোর। চোর এক্সপোর্ট করতে পারলে আমাদের আর অভাব থাকত না…’
এক্সপোর্ট কোয়ালিটির বাটপারের হাতে উর্মিলা পড়ে গেলে সেই ছেলেকে উর্মিলার স্বপ্নের রাজপুত্র লাগা স্বাভাবিক। এই রাজকুমারের সাথেই বাংলা সিনেমার উড়ুক্কু ভিলেন রিয়াজের লড়াই হবার কথা। তবে ইনার খোঁজ পাওয়ার উপায় কী? মেয়ের ভাইয়ের সামনে পড়ার জন্য ব্যগ্রতা দেখিয়েছে এমন বাঙালি প্রেমিক তো মেলা ভার। তবে উপায়?
এবার মাথায় সহজ এক সমাধান চলে এল রিয়াজের। উর্মিলা প্রতিদিন দেরি কেন করে? সেই ছেলের সাথে দেখা করার জন্য নিশ্চয়? তাহলে সমাধানটা জলবৎ তরলং। উর্মিলাই তাকে বয়ফ্রেন্ড বাবাজির কাছে নিয়ে যাবে।
উর্মিলার স্কুল ছুটির পর ওকে স্রেফ ফলো করা লাগবে।
পরদিনই কাজে নেমে পড়ল রিয়াজ। স্কুলের মোটামুটি দূরত্বে চায়ের দোকানে বসে সিগারেট ধরায় একটা। সিগারেটের অভ্যাস হয়েছে বেশিদিন হয়নি। খুব বেশি খায় এমন নয়, তবে টেনশনে থাকলে জিনিসটা ম্যাজিকের মত কাজ করে। স্কুল ছুটির দশ মিনিট মত আছে। এই সময় আরও ভয়ানক একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল রিয়াজের মাথায়।
ওই ছেলেটার সাথে দেখা করার উন্মাদনায় উর্মিলা একেবারেই স্কুল মিস দেয় না তো? হয়তো বাসা থেকে বেরিয়ে ঐ ছেলের হাত ধরে অজায়গায়-কুজায়গায় চলে যায় বোনটা। সেক্ষেত্রে এখানে এসে বসে থেকে লাভ কি?
হার্টবিট বেড়ে যায় রিয়াজের। অপরিচিত একটা ছেলের সাথে ওর বোনের অতিক্রান্ত সময় দেড় ঘন্টা থেকে সাড়ে সাত ঘন্টা হয়ে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে, এই দীর্ঘ সময়ে ওরা কি করে কে জানে!
সিগারেটের ধোঁয়া নাক মুখের সাথে সাথে যেন কান থেকেও বের হতে থাকে রিয়াজের।
স্কুল ছুটির ঘন্টা কানে এল এ সময়।
দোকানদার মামাকে বলে আরেকটা সিগারেট ধরাল রিয়াজ। ওর ছোট্ট বোনটা কখন কখন যে এতবড় হয়ে গেল – ও টেরই পেল না। হঠাৎ – একেবারেই হঠাৎ ওদের মাঝে দূরত্ব বেড়ে গেছে অনেকখানি। উর্মিলার নতুন জগতে ওর আর ঢোকার সুযোগ নেই। আজ যখন ও বোনের বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাবে তখনও তার কথা আর কানে তুলবে না মেয়েটা।
এ সময় উর্মিলাকে বেরিয়ে আসতে দেখল রিয়াজ। সাথে আর দুইটা মেয়ে।
সরাসরি ওদিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। চোখ এবার অন্যদিকে সরাল রিয়াজ।
চোখের কোণ দিয়ে খেয়াল করতে থাকলো বোনকে। নিজে দোকানের অন্ধকার একটা কোণে বসে আছে। যাতে হঠাৎ করে তাকালেও উর্মিলা ওকে দেখতে না পায়। তবুও স্বস্তির একটা পরশ বুলিয়ে দেয় কেউ রিয়াজের হৃৎপিন্ডে। মেয়েটা অন্তত স্কুলে ঠিকই আসে। এখন বাকি সময়টা কোন ‘বেজন্মা’র সাথে কাটায় তা বের করে ‘বেয়াদব’টাকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিতে পারলেই রিয়াজের কাজ শেষ।
উর্মিলারা যথেষ্ট এগিয়ে গেলে সিগারেটের গোড়াটা ফেলে উঠে দাঁড়ায় রিয়াজ।

উর্মিলার বান্ধবী দুইজন দুই পথে চলে গেল। একটা রিকশা নিলো মেয়েটা। পরের খালি রিকশা থামিয়ে পিছে লেগে থাকে রিয়াজ।
ফলো করতে করতে অবশেষে যখন এই পার্কে এসে থামে উর্মিলার রিকশা – বদ্ধমূল হয় রিয়াজের ধারণা। পার্কটা তরুণ-তরুণীদের উদ্ভট ভঙ্গিমায় প্রেম করার দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত। রিয়াজের মাথায় প্রতিহিংসার আগুন এখন। নিজের বোনকে স্কুল থেকে সরাসরি এখানে আসতে দেখলে কোন ভাই কি পারবে শান্ত থাকতে?
পেপারওয়ালা দেখা গেল একজন। গেটের পাশে বসে আছে। অলস ভঙ্গিতে মাছি তাড়াচ্ছে একটা ন্যাকরা দিয়ে। পেপার বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপনের দরকার নেই, এই প্রেমভূমিতে কেউ খবর পড়ার জন্য পেপার কেনে না – পশ্চাদ্দেশ স্থাপন করে বসে পড়ার জন্য কেনে! রিয়াজও একটা কিনলো, তবে চেহারাটা ঢাকার জন্য।
উর্মিলা অলরেডি বসে পড়েছে। কারও জন্য অপেক্ষা করছে সেটা পরিষ্কার। মাঝারি দূরত্বের একটা বেঞ্চে বসে থাকা উর্মিলার দিকে নজর রাখে পেছন থেকে। চোয়াল শক্ত করে সরাসরি উর্মিলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকা ছেলেটাকে দেখল এবার রিয়াজ। স্কুলের ছাত্রই হবে। বয়স উর্মিলার থেকে বেশি হবার কথা নয়।
বিনাদ্বিধায় উর্মিলার পাশে বসে পড়লো হারামজাদা। কী যেন একটা বলতেই শুনে হেসে কুটি কুটি হয় উর্মিলা। উঠে পড়তে যাচ্ছিল রিয়াজ – মাথায় আগুন ধরে গেছে ওর। স্কুলের একটা বাচ্চার সাথে প্রেম?
পরমুহূর্তে নিজেকে থামাল ও, বয়ফ্রেন্ডের সামনে ‘সীন ক্রিয়েট’ করলে মেয়েটা বিগড়ে যাবে আরও বেশী। একে টাইট দিতে হবে – তবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বের করে। নিউট্রাল গ্রাউন্ডে নিয়ে।
‘তুমি আজ বাসায় আসো’ – দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে রিয়াজ।
ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায় ও পার্কটা থেকে।
আরও কিছু দেখতে গেলে আর নিজেকে আটকাতে পারবে না – জানে।

হাসিমুখে উর্মিলা ঘরে ঢুকতেই রিয়াজের শীতল কন্ঠস্বর শোনে বেচারি, ‘তুই আমার রুমে আয়। এখনই!’
পাঁচ মিনিট পর অপরাধীর মত মুখ করে রিয়াজের সামনে দাঁড়ায় মেয়েটি।
‘স্কুল ছুটির পর বাসায় আসতে প্রতিদিন দেড় ঘন্টা করে লেট হয় কেন তোর?’ ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে রিয়াজ।
‘কাজ ছিল।’ মিনমিন করে কৈফিয়ত দেয় উর্মিলা।
‘কি কাজ?’
‘ছিল একটা।’ এড়িয়ে যায় উর্মিলা।
‘রোজ তোর কি কাজ থাকে?’ এবার ল্যাপটপের ডালা নামিয়ে বোনের দিকে ঘুরে তাকায় রিয়াজ। ’কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’
‘আমাদের ক্লাব থেকে শীতার্তদের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহের কাজ করছি। গত কয়েকদিন তাই একটু দেরী হচ্ছে। ’
‘মিথ্যা বলতেও শিখিস নাই ঠিকমত। আমি যদি বলি তুই পার্কে ছিলি?’
‘ছিলামই তো!’ অকপটে স্বীকার করে উর্মিলা। ‘রাশেদের কাছে সংগ্রহের সব টাকা ছিল। ওখান থেকেই আজ চাদরের বিল পরিশোধ করে দিয়ে আসলাম।’
দ্বিধায় পরে গিয়ে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রিয়াজ। পার্স থেকে একটা স্লীপ বের করে দেয় তখন উর্মিলা।
‘বিশ্বাস করছিস না – তাই তো? এই যে দেখ। ’
স্লীপটা যেন উর্মিলার কথার সত্যতা ঘোষণা করছে।
‘কিন্তু – ’ মানতে পারে না রিয়াজ।
‘কেনই বা রাতে আমার রুমে কথা শুনতে পাস আর মোবাইলে এত সময় কেন দেই ইদানিং – সেই সাথে আমার দেরী করে বাড়ি ফেরার একটা সম্পর্ক খুঁজে নিয়েছিস – তাই না?’
রিয়াজ বোঝার চেষ্টা করে ব্যাপারটা ঠিক কোনদিকে এগুচ্ছে।
‘আসলে – আমার ভাইটা কখন কখন যে এতবড় হয়ে গেল –টেরই পেলাম না। হঠাৎ – একেবারেই হঠাৎ তুই কেমন যেন দূরে সরে গেলি। তোর নতুন জগত – ওই জগতে ওর আমার ঢোকার সুযোগ নেই। তাই একটু স্পাইং করতে হল বাধ্য হয়ে। ’
‘আমার ওপর স্পাইং করেছিস – মানে? কি বলতে চাস?’
‘জানতাম আমার মধ্যে ঠিক কি কি বৈশিষ্ট্য দেখতে পেলে তুই টেনশনে পড়ে যাবি – তারপর ক্লাবের কাজে একটু দেরী তো হচ্ছেই – দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ঠিক আমাকে ফলো করতে বের হবি।’
‘তাতে তোর কি লাভ?’
‘নিশ্চিত হওয়া দরকার ছিল। টেনশনে থেকে তোর রিঅ্যাকশন দেখে।’ সরাসরি ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায় উর্মিলা, ’তুই সিগারেট খাস কেন, ভাইয়া?’
বিচারকের আসন থেকে নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দেখতে পেয়ে বেকুব বনে যায় রিয়াজ …

রচনাকাল : ২০শে ডিসেম্বর ২০১৩

 

ট্রিপল এ

হাঁটুর ভেতর থেকে লম্বা পিনটা খুলে ফেলার সময় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সশব্দে হাঁফাচ্ছি আমি।
মুখ থেকে লালা ঝড়ছে তীব্র ব্যাথা সহ্য করে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করার ফলে। তবুও টানতে থাকি পিনটা ধরে। অবশেষে! সড়াৎ জাতীয় একটা শব্দ করে হাঁটু থেকে খুলে গেল যন্ত্রণাদায়ক জিনিসটা।
চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তেই টের পেলাম বাম কাঁধে বসে থাকা দ্বিতীয় পিনটার অস্তিত্ব। ওহ খোদা – চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে আমার। একই সাথে ডান হাতে চেপে ধরেছি ওটাকে।
হাতে খুব একটা জোর পাচ্ছি না। পিনগুলো এমনিতেও সুবিধের নয়। চার ইঞ্চির মত হবে একেকটা লম্বায়। এসব দিয়ে আস্ত গরুকেও বসিয়ে দেওয়া যাবে। সেখানে আমার মত একজন মানবসন্তান মোচড়ামুচড়ি করছে, পিনের সাথে লড়াইয়ের চেষ্টা করছে। লড়াইটা একতরফা হতে চলেছে এখন।
এক হাত দিয়ে জোর-ই পাচ্ছি না। হাঁটুর পিন বের করার সময় বাম হাতের সাহায্য কিছুটা পেয়েছিলাম, এখন আর পাচ্ছি কোথায়?
তবুও ডান হাত দিয়ে টানাটানি করতে থাকি। এগুলোকে বের করতেই হবে।
হাঁটুর দিকে তাকাচ্ছি না ভুলেও।
রক্তগঙ্গা এখন আমার তালিকার শেষ বস্তু – যেটা দেখতে চাবো এই স্নায়বিক দুর্বলতার সময়। তবুও একবার চোখ পড়ে গেল।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাঁটুটা।
আমার হাঁটু।
আমার ডান হাঁটু!
জ্ঞান ফেরার পর প্রবৃত্তি থেকে দুটো চিন্তা মাথায় একেবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসেছিল –
১. প্রথমে হাঁটু থেকে পিন খুলে ফেলো
২. এবার কাঁধের পিনটা বের করো
তৃতীয় চিন্তাটা মাথাতে আসতেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে!
শহর জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে বেড়ানো সিরিয়াল কিলার ট্রিপল-এ কি এবার আমাকেই তার পঞ্চম ভিক্টিম হিসেবে বেছে নিয়েছে?

 

১.
কুল কুল করে ঘামছি।
ছোট একটা ঘরে বসে আছি এই মুহূর্তে। চারপাশে এক নজর দেখেই বুঝে গেছি, ঘরটা মাটির নিচে। স্রেফ কোন জানালা দেখছি না বলে এই সিদ্ধান্তে চলে এলাম এমন নয়। বাতাসটা বদ্ধ।
টলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। এখানে কিভাবে এসেছি মনে নেই। সম্ভবতঃ ট্রিপল-এ ভিক্টিমদের সেটা মনেও থাকে না। তবে যে করেই হোক এখনই এখান থেকে বের হতে হবে!
তারপর হাত-পা জমে গেল আরেকটা বিষয় মনে আসতে। বের হয়ে যেতে পারলে সম্ভবতঃ আমিই ট্রিপল-এর প্রথম ভিক্টিম, যে বেঁচে ফিরতে পারবে!
নিরাশ হলাম। এখনও দাঁড়াতে পারিনি। হাঁটুর যন্ত্রণা প্রচণ্ড কষ্ট দিচ্ছে আমাকে। দাঁড়াবার মতো যথেষ্ট পেশি কি অক্ষত আছে? জানি না। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিদ্যাদিগগজ ছিলাম না কখনও। সেই সাথে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে আছে কাঁধের ক্ষতটা।
তাছাড়া খুনি আশেপাশেই কোথাও আছে হয়ত। একটু খেয়াল হতেই ফিরে আসবে ও। এবং তার বাকি থাকা কাজটুকু শেষ করে দেবে। বেঁচে যাচ্ছি বা যাবো – এমন কিছু মনে করার কারণ দেখলাম না।
চকিতে মনে পড়ে যায়, প্রথম আঘাত যখন এই খুনি হেনেছিল, তখন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মৃতের প্রতি কি টিটকিরিই না মেরেছিলাম আমরা!
ভার্সিটি থেকে মাত্র বের হয়ে মনের সুখে সিগারেট খাচ্ছিলাম আমরা চারজন।
ছোট সার্কেল। সুখী সার্কেল।
প্রীতি আমাদের মাঝে নতুন সিগারেট খেতে শিখেছে। মেয়েটা দুই টান দেয় আর তিনবার করে কাশে।
একটা সময় বেশ বিরক্ত হয়ে সোহান বলে ফেলল, ‘বারবি ডল হয়ে সিগারেট টানতে কে বলেছিলো তোকে? জুস চুষতি, ওটাই ঠিক ছিল।’
প্রীতি একবার হাল্কা ‘ইয়াক’ শব্দ করে নাক মুখ কুঁচকে আরেকটা টান দেয়।
তারপর নীতি মেনে কেশে ফেলেছিল, আমি বললাম, ‘ধারাটা দেখো। খক খক, খক খক খক।’
রাগ করে প্রীতি সিগারেটই ছুঁড়ে মেরেছিল। এভাবে খেয়ে ওর পোষাবে না, বেশ বুঝতে পারি।
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ‘লুকিয়ে টানিস। বাসাতে প্যাকেট নিয়ে যা। অভ্যাস হলে পাবলিকলি, ওকে?’
মেয়েটা আমার দিকে একটা কৃতজ্ঞ দৃষ্টি দিয়েছিলো শুধু। তখনই কাপ পিরিচ ভাঙ্গার শব্দে চোখ ফেরাতে হয় আমাদের।
যে ছেলেটা এই মাত্র টঙের সাধারণ টেবিলটার ওপর থেকে কোমরের ধাক্কায় একটা গ্লাস আর একটা পিরিচ ফেলে দিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছে– সে আমাদের দিকে তাকিয়ে একটা ভদ্রতার হাসি হাসে। তারপর দ্রুত ভাঙ্গা গ্লাসের দেহাবশেষ তুলতে গিয়ে পাছার ধাক্কায় পেছনের কাস্টোমারের হাতের চায়ের কাপও দেয় ছলকে।
ছটফটে ছেলেটার কাণ্ড দেখে আমরা হাসলাম। এই মানুষটা আমাদের মাঝে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট।
তারেক।
হন্তদন্ত হয়ে সব সময় ছোটাছুটি সে করে না। তবে উত্তেজিত হয়ে গেলে এমনটা সে করবেই। এতদিনে আমরা তাকে যথেষ্ট চিনেছি।
কাজেই সোহান হাল্কা ভ্রু নাচালো, বাড়িয়ে দিয়েছে সিগারেট, ‘নিতম্ব সামলাও, বৎস। টান মেরে গান গাইতে শুরু করো। কিসের জন্য উত্তেজনা এত? নতুন কোন ডাউনলোড?’
বাতাসে অজ্ঞাত কাওকে খামচিয়েছিল তারেক, ‘আরে না! লিতিসার বয়ফ্রেন্ড গন!’
আমরা সবাই লাফিয়ে উঠলাম এ কথাতে।
তারেক আজকে থেকে লিতিসাকে ভালোবাসে না। সেই ক্লাস সেভেন থেকে সে এই মেয়ের প্রতি দুর্বল। এখন একেবারেই ‘অথর্ব’ হয়ে গেছে সে এই মেয়ের প্রেমে। কিন্তু সমস্যা আর সব ‘প্রেমের টান’-এর মত এখানেও ছিল।
লিতিসার একজন বয়ফ্রেন্ড আছে।
নাম জিহান , লোক খারাপ। চরিত্র একেবারেই পবিত্র।
যতটা হলে আমাদের নাক কুঁচকাতে পারতো, ঠিক ততটাই।
এবার প্রীতির গলা থেকে গদ গদ কথা বের হয়ে আসে, ‘লিতিসার ব্রেক আপ? তোর রাস্তা ক্লিয়ার?”
আমার মুখ থেকে বের হয়ে গেল, “এখনই লাফ দিসনে। দুই দিন পর এসবের প্রেম আবার উথলে ওঠে। দেখা যাবে, প্যাচ আপ করে আবার ঘুরে বেড়াচ্ছে কপোত-কপোতী। শালা ফেরত আসলে?’
শার্টের হাতা গোটাতে গিয়ে সোহান ছিঁড়েই ফেলল, ‘আসুক, এবার শালার পুতকে দুই টুকরো করে দেব না?’
বসতে গিয়ে পেছনের টেবিল কাঁপিয়ে ফেলল তারেক, তবে বড় কোন কেলেঙ্কারী না ঘটিয়েই বসতে পারলো এবার। এতক্ষণে বোমাটা ফাটালো সে।
‘শালার পুত একরকম দুই টুকরোই হয়ে গেছে। মরে পড়ে ছিলো ওদের বাগানে। কে যেন দুই হাঁটুতে আর দুই কাঁধে পিন পুঁতে দিয়েছিল। তারপর বুক ফেঁড়ে দিয়েছে। ব্যাঙদের মতো। একেবারে শেষ।’
আমাদের চা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
আমরা তিনজনই একবার করে প্রশ্নটা করি, ‘তুই শিওর?’
আমাদের প্রত্যেককে নিশ্চিত করে তারেক, ‘শতভাগ।’
প্রীতি চট করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলে এই আনন্দে, ‘আজকে সিগারেট পার্টি হবে, ব্রাদার!’
সোহান এবার উত্তেজনাতে নিজের পিরিচেই ফাটল ধরিয়ে দেয়। চায়ের কাপ নামানোর সময় হাতের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না বোকাটার।
তারপর ওদিকে তাকিয়েই বলে ফেলে, ‘একেবারে ঠিক হয়েছে। লুচ্চামির শাস্তি। কেউ না কেউ জেনে গেছিলো হয়ত চরিত্রটা কেমন ছিলো ওর।’
আমিও সায় দিলাম, ‘ঠিকই আছে, লুচ্চামির কারণে ওকে আরও ভালো শাস্তি দেওয়া তো দরকার। ফাঁসী দিতে হবে। তবে গলাতে বেঁধে নয়। লাশটা ঝোলানো যাবে এখন?’ জবাবের আশাতে তারেকের দিকে তাকালাম।
চায়ের দোকানদার মামা আমাদের দিকে তেরছা দৃষ্টি দেয়। কারও মৃত্যুতে এমন আনন্দিত মানুষ সে আগে দেখেনি মনে হয়! সে তো আর জিহানকে চেনে না!
মাথা নেড়ে আস্তে করে বলেছিলো তারেক, ‘খুশি হওয়ার কিছু নাই। লিতিসাকে খুনের সন্দেহে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।’

 

২.
তৃতীয়বারের মত হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম।
এবার একটা চেয়ারসহ পড়েছি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছিলাম ঠিক মতই। তারপর দাঁড়ানোর অযথা চেষ্টা করতে করতে একবার মাটিতে গড়িয়ে এসেছি। চারপাশটা অন্ধকার ছিল। সুস্থ স্বাভাবিক লোকের জন্যই উষ্ঠা খাওয়া স্বাভাবিক। সেখানে আমি একজন সিরিয়াল কিলারের ভিক্টিম!
দ্বিতীয়বার মাটিতে পড়িনি। একটা বাক্সের ওপর ডিগবাজি খাচ্ছিলাম বলা চলে। রক্তমাখা হাতটা দিয়ে ডালা তুলে দেখেছি, ভেতরে বিভিন্ন মাপের পিন আছে।
সাইজে তারা এমনই – এদের ঠিক গজাল বলা চলে না। পিন বললে আবার বেশি ছোট মনে হয়। ওগুলো কোন মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে ব্যবহার করা হয় সেটা বোঝার জন্য আমার কোন সুপারন্যাচারাল ক্ষমতার দরকার ছিলো না।
কাজেই, আরেকবার নিজেকে তুলে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বাইরে যেতে হবে। পুলিশে জানাতে হবে। বাঁচাতে হবে প্রাণ।
হলঘরটার মাঝে এসেই ব্যালান্স হারিয়ে হুড়মুড় করে তৃতীয়বারের মত মাটিতে ছিটকে পড়ে গেলাম। এবার সাথে একটা চেয়ার নিয়ে।
বার দুয়েক ওঠার বৃথা চেষ্টা করে পারলাম না। শুয়ে শুয়ে ছাদের কাছে পুরোনো আমলের ঝাড়বাতি দেখতে থাকি। খুনি সিরিয়াল কিলার হোক আর যাই হোক, নবাব পরিবারের বংশধর বলেই মনে হচ্ছে। হারামজাদার দাদা জমিদার ছিলো নাকি?
অত্যাধিক রক্তক্ষরণের কারণেই হয়তো, একটু বিশ্রাম পেলেই আমার মাথায় এসব হাবিজাবি চিন্তা চলে আসছে। জোর করে খুনির সাথে নবাব পরিবারের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা বাদ দিলাম।
মাথা খাটানোর চেষ্টা করছি, এখানে আমি এলাম কিভাবে? স্মৃতি সব মুছে গেছে। পরিচিত কেউ কি নিয়ে এসেছিলো? নাকি অজ্ঞান করে ট্রিপল-এ এনেছে আমাকে?
খুনিটার চেহারা মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা আমি করতে থাকি।
মানুষটা দেখতে কেমন? আমার পরিচিত?

দূরে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পাই এ সময়।
নাকি, পেলাম না?
আমার কাছে তো মনে হয়েছে কেউ শব্দ করেছে। বুটজুতো?
নড়তে গিয়ে ডান হাঁটুতে বেশি চাপ ফেলেছি বোধহয়। আবারও কুল কুল করে রক্ত বের হওয়া শুরু করেছে ওখান থেকে। দাঁতে দাঁতে চেপে গোঙ্গানিটা আটকালাম।
আরেকটুক হলেই মুখের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল ওটা।
আর এখানে, খুব কাছে দেশের সবচেয়ে ভয়ংকর খুনিটা লুকিয়ে আছে। তার জুতোর শব্দও পাচ্ছি আমি! যখন পালাবার জন্য হামাগুড়ি দিচ্ছেন, গোঙ্গানির জন্য খুব দারুণ সময় এটা নয়।
পায়ের শব্দ আরও এগিয়ে আসছে। উঠে বসার চেষ্টা করলাম। বাম কাঁধটা চির চির করে ওঠে। যেন বেশ কয়েকটা হাড় ওখানে এই মাত্র কুচি কুচি হয়ে গেল!
অনুভূতিটা আমার চেনা আছে। ফুটবল খেলতে গিয়ে একবার ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের হাড় ফাটিয়েছিলাম। অর্থাৎ আমার ডান কাঁধের হাড় ভাঙ্গে নি।
ফেটেছে।
আর প্রথমবারের মত হাল্কা গুঙ্গিয়ে ফেলেছি আমি!
সাথে সাথে ঘরের দরজাটার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে পায়ের শব্দ।
নিজের অবস্থা দেখে চোখে পানি আসার জোগাড় হয় আমার।
এক কাঁধ আর এক হাঁটু নড়াতে পারছি না, একেবারেই বাজে অবস্থা আমার। এর মাঝে দৌড়াদৌড়ি করার চেষ্টা করা উচিতই হয়নি।
তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার মনে হতে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়! আমি কোনভাবেই ট্রিপল-এর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া প্রথম ভিক্টিম নই!
এই উন্মাদ সিরিয়াল কিলারের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ বাঁচে নি।
আর সমীকরণের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমার বাঁচার কোন সম্ভাবনাও দেখি না।
তার মোডাস অপারেন্ডি বা এম.ও. এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেছে সন্দেহাতীতভাবে। দুই কাঁধে আর দুই হাঁটুতে পিন ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে হত্যা করে ট্রিপল-এ! আমার জন্য তার ‘স্পেশাল গেস্ট লিস্ট’ খুলে দেওয়া হয়েছে তা তো না।
এর অর্থ একটাই। আমার ক্ষেত্রে কাজে(!)র মাঝখানে উঠে যেতে হয়েছে বেচারাকে। এক হাঁটু আর এক কাঁধে গাঁথানোর পরই তাকে কোন দরকারে উঠে পড়তে হয়েছে। তাই এখন পর্যন্ত এখানে টিকে গেছি।
লিতিসার কথা মনে পড়ে আমার এই পর্যায়ে। মেয়েটাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে গেছিলো ঠিকই। তারপর সে বাসাতে ফিরে আসেনি আর।
ট্রিপল-এর দ্বিতীয় শিকার ছিলো লিতিসা।
খুনি কে হতে পারে, সে প্রশ্নটা নিজেকে আর করা লাগে না এবার আমার।
মনের পর্দায় কেঁপে ওঠে একটা চেহারা। মানুষটা না লিতিসাকে সেদিন থানা থেকে উদ্ধার করে আনতে গেছিলো?
তারেক?

৩.
‘জাহান্নামে যাক সবাই!’, গর্জে ওঠে সোহান।
জবাবে বিকট লাথিটা মেরে দেই আমি, টি-টেবিলের ওপরের গ্লাসটা ঘরের অন্য কোণে গিয়ে পড়ে ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে যায়!
‘লিতিসার লাশ?’ প্রীতি আরও একবার জানতে চাইলো।
মাত্রই সোহান এসে খবরটা দিয়েছে। এখনো আমরা কেউ হজম করতে পারিনি।
গর্জে ওঠে সোহান জবাবে, ‘ডেফিনিটলি! মেয়েটার শরীরে ছিলো চারটা পিন, কাঁধে দুটো এবং হাঁটুতে দুটো! এবার বোঝ!’
‘এটা কি? সিরিয়াল কিলার? একদিনে দুইজনকে …’ ফিস ফিস করে শুরু করা বাক্যটা শেষ করতে পারলো না প্রীতি।
বিকেলে আড্ডা দিতে এসেছিলাম আমরা। সোহান খবরটা নিয়ে ঢুকেছে একটু আগে। আমাদের মুড নষ্ট হয়ে গেল। প্রীতির দিকে তো একেবারেই তাকানো যাচ্ছে না। কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে তার মুখ।
সোহান আরও বাজে একটা খবর আমাদের জন্য তুলে রেখেছিল, ‘তারেককে ওরা গ্রেপ্তার করেছে। লিতিসাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সে, বিষয়টা জানতে তো আর কারো বাকি নেই। প্রথমে বয়ফ্রেন্ড তারপর লিতিসা – পুলিশ কানেকশনটা এভাবেই দেখছে।’
‘তারমানে, তাদের ধারণা, তারেক প্রথমে বয়ফ্রেন্ডকে সরিয়ে দিয়েছে, তারপর লিতিসাকে প্রপোজ করেছে বা এজাতীয় কিছু? মেয়েটা না রাজি হওয়ায় তাকেও খুন করে ফেলেছে?’ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাই আমি।
‘তাদের তাই ধারণা।’ স্থির হয়ে যায় সোহান।
দুই হাতে মুখ ঢাকে প্রীতি, ‘এটা তো সম্ভব না! তারেকের মত একটা ছেলে – কিভাবে সম্ভব? ওহ গড!’
কাঁধ ঝাকালাম আমি আর সোহান। বিষয়টা প্রীতির মত ‘ওহ গডে’ সীমাবদ্ধ রাখার মত অবস্থাতে নেই।
খতিয়ে দেখতে হবে সব ধরণের সম্ভাবনা।
মুখে কেবল বললাম, “পুলিশ সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখার মানেই তো আর অপরাধী নয়। হতে পারে কালই তাকে ছেড়ে দেবে। সত্যিকারের খুনি ধরা পড়লেই সবটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।”
গাড়িতে করে যখন থানার দিকে যাচ্ছিলাম, সোহান জানতে চেয়েছিল, ‘পুলিশ শালারা ঘাঘু আছে। দেখা করতে না দিলে কিভাবে কথা বলবি?’
জবাবটা সরাসরি না দিয়ে আমি একটু করে মানিব্যাগটা দেখিয়ে দেই।
তারপর দুইজনে শুকনো হাসলাম। বাংলাদেশ।
সোহানের কাছে জানতে চাই, ‘তারেক কাজটা করেছে বলে কি তোর মনে হয়? মোটিভ দেখ, মেলে। এই দুইজন মারা গেলে তার লাভ আছে।’
মাথা নাড়ে অবশ্য সোহান, ‘এই এক মেয়েকে ভালোবাসার জন্য দুটো খুন করবে না তারেক। খুন করা কি মুড়ি-মুড়কি খাওয়ার মতো ব্যাপার? আমার কথা ভুলে যাচ্ছিস? লিতিসাকে আমিও তো ভালোবাসতাম? আমি কি তাই বলে খুন করে বেড়াবো এখন?’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে ফেলি, ‘আরে তুই তো আর অল্পে মাথা গরম টাইপ না।’
কথাটা বলেই গাড়ির মাঝে থমকে গেলাম।
সোহান স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। শরীর একেবারে শক্ত হয়ে থাকে ওর, যখন ড্রাইভ করে। সতর্ক শয়তান। এই মুহূর্তে ওকে দেখে একটু উদ্বিগ্ন না হয়ে পারলাম না। ছেলেটা ঠাণ্ডা মাথাতে একবার দুই বছরের সিনিয়র এক ছেলের পা ভেঙ্গে দিয়েছিল।
কেন জানি দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে বার বার। লিতিসাকে সোহানও ভালোবাসতো!
আমি কি করে ভুলে গেলাম?
থানার সামনে থেমে যেতে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্নটা আসে, ‘সোহান দৌড়াদৌড়ি করে থানাতে কেন আসছে? তৃতীয় শিকার তারেককে সরিয়ে দিতে? না তাকে সাহায্য করতে?’
উত্তরটা নিশ্চিত করে পাইনি।
এবং আমরা সেরাতে থানাতে পাই নি তারেককেও।
তার মামা এসে হাজত থেকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। প্রথমে ব্যাটার মোবাইলে, এবং তারপর বাসায় ফোন দিয়ে তাকে পেলাম না।
সোহান আমাকে বলল, ‘তুই বাসায় যাবি?’
মাথা নাড়লাম।
‘তাহলে প্রীতির বাসায় একবার যা পারলে। লিতিসার খবরটা শোনার পর কী অবস্থা হয়েছিল ওর মনে আছে? একা থাকতে দেয়া উচিত হবে না এখন ওকে।’
সোহানের কথায় যুক্তি আছে। তবে আমার মনটা খচ খচ করতে থাকে। জানতে চাইলাম, ‘তুই কী করবি?’
স্টিয়ারিংটা ধরলো সোহান, ‘গাড়িটা আছে যখন, আমি দেখি তারেককে খুঁজে পাওয়া যায় কি না!’
আমার বুক ধক ধক করছিল।
যদি তারেক খুনি হয়ে থাকে, তাহলে তার লিস্টে নিশ্চয় আছে সোহান। বন্ধুকে ‘সাবধানে থাকিস’ বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না।
কারণ, যদি সোহান খুনি হয়ে থাকে, তাহলে তার লিস্টে নিশ্চয় আছে তারেক!
প্রিয় দুই বন্ধুকেই সন্দেহের তালিকায় দেখতে ভালো লাগছিল না আমার। তবে উপায় কী? মানুষের মন তো এভাবেই কাজ করে!
প্রীতিকে অবশ্য রাতে স্বান্তনা ভালো মতই দিয়েছিলাম। ওকে সব কিছু ভোলাতে এবং নিজের মাথা থেকেও আজকের স্মৃতিগুলো দূর করার জন্য প্রথমবারের বিছানাতে উঠে এসেছিলাম আমরা।
গতকাল সারারাত ও আর আমি ছিলাম আবেশে। প্রীতি মেয়েটা এরকম তৃপ্তিদায়ক হবে জানলে আরও আগেই ওকে গার্লফ্রেন্ডের কাতারে টেনে নিতাম। বোকার মত বন্ধুত্ব করেছি এতদিন ধরে!
পরের চিন্তাটা আমাকে থমকে দেয়!
এবার সবটা মনে পড়েছে।
সবকিছুই।
প্রীতির সাথে উদ্দাম রাতের পরই আমি এখানে জেগে উঠেছি!
দুটো পিন শরীরে নিয়ে!
এখন আমি জানি ট্রিপল-এ নামের সিরিয়াল কিলারটি আসলে কে!

৪.
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে মানুষটা। আর সেই সাথে থেমে যায় তার পদশব্দ।
চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখেই চিনতে পারলাম।
শুকনো গলায় বলি, ‘হাই, দোস্ত!’
কাঁধ ঝাঁকাল সোহান, কিছু বলে না।
আমাকে পড়ে থাকতে দেখে তার চেহারার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি। যেন এমনটাই হওয়ার কথা!
সোহানের হাতের হাতুড়িটা তখনই চোখে পড়ে আমার। চকিতে ঘরের একপ্রান্তের বড় বাক্সটার দিকে তাকাই , হাতুড়ির সাথে লম্বা পিনের সম্পর্ক সবাই জানে।
শুয়ে থেকেই বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠি আমি, ‘শুরু থেকেই তাহলে তুই আর প্রীতি একসাথে কাজ করেছিস? ওহ মাই … আমি ভেবেছিলাম ট্রিপল-এ একজন মানুষ! লোন উলফ!’
কোন মন্তব্য করে না সোহান এবারও। ঠান্ডা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দরজা থেকে।
‘ওহ গড! তারেক … তারেক কোথায়?’
মুখ বাঁকায় সোহান, ‘রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে তাকে গতকাল রাতে। গেস হোয়াট? শরীরে চারটা পিন ছিলো ছেলেটার।’
মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় আমার, ‘তারমানে, তারমানে যখন আমি প্রীতির বাসাতে – আর তুই খোঁজ করার নাম করে বের হয়ে গেলি … তারেককে ঠিকই খুঁজে বের করেছিস তুই!’
একটু হাসে সোহান, ‘খুঁজে বের করতে আমি দক্ষ। দেখ, সময়মত কাওকে পাওয়া যায় না!’
ঢোক গিলি আমি, ‘কেন? লিতিসা আর জিহানের ব্যাপারটা বুঝলাম। ওদের রিলেশন ছিল। ওদের খুন করেছিস সেটাই যথেষ্ট ছিল। আবার তারেককে কেন মারতে হলো তোর? লিতিসাকে ভালোবাসে বলে?’
‘কাউকে খুন করার কথা তো মনে করতে পারি না। হয়তো করেছি, অজান্তে। তবে জানি না আসলেই করেছি কি না!’ বিড় বিড় করে বলে সোহান।
ফিস ফিস করলাম , ‘তুই … পাগল হয়ে গেছিস!’
মুচকি হাসে সোহান, ‘কথাটা আমার না। কেনেথ এরকসাইনের। তাকে মানুষ চিনতো স্টকওয়েল স্ট্র্যাংগ্লার নামে।’
আমি এবার আর কিছু বললাম না, শুনছি।
‘বেচারা এখন জেলখানায়। ৭ থেকে ১১ জনকে খুন করেছিলো এই সিরিয়াল কিলার। সবাই ছিল প্রাপ্তবয়স্ক। অ্যান্টি-সোশিয়াল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগছিলো লোকটা। সেই সাথে ছিলো সিজোফ্রেনিয়া।’
মাথা নাড়ি আমি, চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
‘হাহ!’ অবাক হয় সোহান। তোকে আরেকটা উক্তি শোনাই, ‘ “দানবটা আমার মাথাতে যখন ঢুকে গেল, আমি জানি এটা থাকতেই এসেছে! নিজেকে কিভাবে চিকিৎসা করব আমি? আমি তাকে থামাতে পারি না। দানবটা তার কাজ করেই যায়! আমাকেও কষ্ট দেয়, সমাজকেও। হয়তো তোমরা একে থামাতে পারো। আমি পারবো না!” বলেছিলো ডেনিস রেডার। একে অনেকে দ্য বিটিকে কিলার বলে থাকেন। ’
‘আই জাস্ট ক্যান্ট বিলিভ দিস! চার চারটা খুন হয়ে গেছে আর তুই আমাকে এখানে বসে বসে সাইকো কিলারদের ইতিহাস শোনাচ্ছিস? নট দ্য টাইম নর দ্য প্লেস, সোহান!’
চোখ সরু হয়ে যায় সোহানের, ‘চারটা?’
গর্জে উঠি আমি, ‘ন্যাকা আর কি? জানিস না ট্রিপল-এ চারবার হিট নিয়েছে এখন পর্যন্ত!’
‘আর কাকে মেরেছিস, রাতুল? প্রীতিকে? ওহ গড!’, হাতুড়িতে হাত শক্ত করে চেপে ধরে সোহান, ‘প্রতিটা খুন তুই করেছিস, গর্দভ! আর তোর প্রতিবারই মনে হয়েছে আর কেউ খুনগুলো করছে! ঠিক ডেনিস রেডার অথবা কেনেথ এর্কসাইনের মত!’
চোখ বাষ্পারুদ্ধ হয়ে আসে আমার, ‘না। এসব আমি করিনি।‘
সোহান কিছুই বলল না। তীব্র দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
‘মারবি তো আমাকে, মার। কিন্তু এসব বাজে কথা শোনাতে আসিস না।’
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে সোহান, দুই চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।
‘শহরের সবাই জানে তিনটা খুন হয়েছে। কিন্তু কেউ জানে না সিরিয়াল কিলারটি কে, অথবা তার নাম কি। এই মাত্র জানলাম আমাদের খুনি নিজেকে ট্রিপল-এ বলে ডাকতে পছন্দ করছে।’
চট করে নিজের হাঁটুর দিকে তাকাই। এক ফোঁটা রক্ত নেই ওখানে এখন।
নেই কোন ক্ষতও।
কাঁধের কাছটাও ঠিক হয়ে গেছে।
‘তিনজন ভিক্টিম – লিতিসা, জিহান আর তারেক। তোর মুখেই শুনলাম সিরিয়াল কিলার মহাত্মা চতুর্থ কাওকে খুন করেছে। চারটা শিকার, না?’
সোহান আমার কাছে থেকে কাছে চলে আসছে।
ডান হাতে ধরে থাকা পিন দুটো দেখলাম একবার। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে ওরা। একটু আগেই আমার কাঁধ আর হাঁটু থেকে টেনে তুলেছি। রক্ত থাকবেই।
খুনিটার হাত থেকে বাঁচতে হবে! মাথাতে আর কিছু কাজ করে না এই মুহূর্তে!
সোহান সতর্ক পায়ে আরেকটু এগিয়ে এসেছে। হাতে তার প্রস্তুত হাতুড়ি।
চোখের পলক ফেলার আগে উঠে আসলাম আমি। একটা পিন সজোরে গাঁথিয়ে দিয়েছি সোহানের ডান কাঁধে। অপর পিনটা বুকের পাঁজর ভেদ করে ভরে দিলাম হৃৎপিণ্ড বরাবর। নিজের দ্রুতগতি দেখে এবার আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই!
সোহানের দুই চোখে ফুটে উঠেছে অবিশ্বাস। আমার দিকে বার কয়েক চোখের পাতা ফেলে দড়াম করে মাটিতে পড়ে যায় ও।
হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেছে হাতুড়ি। আমার সখের ফ্লাওয়ার ভাসটা তিন টুকরো হয়ে যায় সেই সাথে।
চারপাশে তাকিয়ে জায়গাটা আর অচেনা লাগে না। আমার বাসারই নিচের দিকে এই ঘরটা।
বিষয়টা বুঝতেই আমার ভয় কেটে গেছে। প্রাণপণে ছুটলাম বেজমেন্টের দিকে।
ছোট একটা ঘর তো ওখানে ছিলো?
এক ধাক্কাতে দরজাটা খুলে ফেলেই প্রীতিকে দেখতে পেলাম।
বড় বড় সুন্দর চোখগুলো খোলা। সোজাসুজি তাকিয়ে আছে ওগুলো ছাদের দিকে।
বাম হাঁটু আর ডান কাঁধে রক্ত ভরে আছে। তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে পিন দুটো। বড় একটা হাতুড়ি তার পাশেই পড়ে আছে।
বাম কাঁধ আর ডান হাঁটু অবশ্য পিনমুক্ত। পিনদুটো আমার হাতে ছিল।
একটু আগেই টেনে বের করি নি আমি?
পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে আমার।
প্রাণপনে আমি চেষ্টা করতে থাকি ঘোলা হয়ে আসা চোখগুলো খুলে রাখতে।

পরিশিষ্ট
বুকের ভেতর থেকে লম্বা পিনটা খুলে ফেলার সময় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সশব্দে হাঁফাচ্ছি আমি।
তীব্র ব্যাথা সহ্য করে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করার ফলাফল হিসেবে মুখ থেকে লালা ঝড়ছে। তবুও টানতে থাকি পিনটা।
সড়াৎ জাতীয় একটা শব্দ করে হাঁটু থেকে খুলে গেল যন্ত্রণাদায়ক বস্তুটি। হৃৎপিণ্ডের খুব কাছে গেঁথেছিলো! এখনও বেঁচে আছি ভেবেই আশ্চর্য লাগলো।
চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তেই টের পেলাম ডান কাঁধে বসে আছে আরেকটি পিন।
ওহ খোদা – চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে আমার। বাম হাতে একই সাথে চেপে ধরেছি ওটাকে।
হাতে খুব একটা জোর পাচ্ছি না। পিন জিনিসটা এমনিতেই সুবিধের নয়। চার ইঞ্চির মত হবে একেকটা লম্বায়। এসব দিয়ে আস্ত গরুকেও বসিয়ে দেওয়া যাবে। সেখানে আমার মত একজন মানবসন্তান মোচড়ামুচড়ি করছে, পিনের সাথে লড়াইয়ের চেষ্টা করছে।
লড়াইটা একতরফা হতে চলেছে এখন।
এক হাত দিয়ে জোর খাটাতেই পাচ্ছি না। বুকের পিন বের করার সময় ডান হাতের সাহায্য কিছুটা পেয়েছিলাম, এখন আর পাচ্ছি কোথায়?
তবুও বাম হাত দিয়ে টানাটানি করতে থাকি। পিনগুলো বের করতেই হবে।
বুকের দিকে তাকাচ্ছি না ভুলেও।
রক্তগঙ্গা এখন আমার তালিকায় শেষ বস্তু – যেটা দেখতে চাবো এই স্নায়বিক দুর্বলতার সময়।
তবুও একবার চোখ পড়ে গেল।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুক।
আমার বুক!

জ্ঞান ফেরার পর ইন্সটিংক্ট প্রথম দুটো চিন্তা মাথাতে একেবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনে দিয়েছিল –
১. প্রথমে বুক থেকে পিন খুলে ফেলো
২. এবার কাঁধের পিনটা বের করো
তৃতীয় চিন্তাটা মাথাতে আসতেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে!
শহর জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে বেড়ানো সিরিয়াল কিলার ট্রিপল-এ কি এবার আমাকেই তার ষষ্ঠ ভিক্টিম হিসেবে বেছে নিয়েছে?

— ০ —

রচনাকাল : ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৪

সে ছিল

রাত বারোটাতে আবারও দেখা গেল তাকে। ঠাঁয় মাঠটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।

তিনতলা বাসাটার বারান্দা থেকে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি।

মেয়েটির চুল বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। কি ভয়ংকর বিষন্ন একটা ছবি!

রাত বারোটাতে এই মেয়ে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেন থাকে?

এখানে মাত্র কয়েকদিন হল এসেছি আমি। আগে ঢাকায় থাকতাম – ওখান থেকেই রাজশাহী চলে গেলাম রুয়েটে চান্স পেয়ে। আম্মুরা চলে আসল তখন চট্টগ্রামে। প্রথমবার এখানে পা রেখেছি – মাত্র সাতদিন হয়েছে সেটার।

এটা একটা হাউজিং ব্যবস্থা। উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এলাকাটাতে তারাই থাকে – যারা চট্টগ্রাম ইউরিয়া সারকারখানাতে কোন না কোন পদে কাজ করে। অফিসার থেকে কর্মচারী – সবাই তাদের র‍্যাংকের ক্যাটাগরি অনুযায়ী একটা করে বাসা পায়। চমৎকার বাসাগুলো, খেলার জন্য যথেষ্ট জায়গা রাখা হয়েছে এখানে, এদের একটাই আমার বাসার সামনে থাকা এই মাঠটা।

রাত বারোটাতে এখানে মেয়েরা বের হতে পারে, পুরো হাউজিংটিতেই টহল দেয় সিকিউরিটি গার্ডেরা। কাজেই নিরাপত্তা নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকার কথা না। তাই মেয়েটিকে এত রাতে দেখে আমি মোটেও অবাক হই না।

আমি অবাক হই তার নিঃসঙ্গতার গভীরতা আমার বুক ছুঁয়ে চলে যায় বলে। গতকাল যখন এখানে বসে ছিলাম আমি ঠান্ডা মেঝেতে – হতাশা আর নিঃসঙ্গতার তুঙ্গে আমার অনুভূতি – তখন ওকে প্রথমবার দেখি।

হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাওয়াটা নতুন কিছু না। আমি মানুষের মন নিয়ে খেলি। যখন মনে হয় মন নিয়ে খেলার ক্ষেত্রে আমি হেরে যাচ্ছি – তখন আমাকে হতাশা গ্রাস করে।

উঁহু, নিম্নমানের প্রতারক ভাববেন না আমাকে – টুকটাক গল্প লেখি। আর গল্প লেখার একটাই অর্থ – মানুষের মন আমাদের হাতের মুঠোতে থাকে। ওটা নিয়ে আমরা খেলার চেষ্টা করি, ওই মনে রোমাঞ্চের অনুভূতি জাগানো অথবা প্রবল ঝড়ো হাওয়ার মত মন খারাপ করিয়ে দেওয়া কোন অজানা অনুভূতি!

গতকাল রাতে আমার হতাশার পেছনে কাজ করছিল ‘চমকে দেওয়া’ বিষয়টার অনুপস্থিতি। সব ছিল নতুন লেখতে থাকা – রোমাঞ্চ, তথ্য, যুক্তি – কিন্তু কথা হল সবকিছু চলে যাচ্ছিল একটা নির্দিষ্ট দিকে। এভাবে চললে যেকোন নবীন পাঠকও ধরে ফেলবে আগেই – ঘটনা কি ছিল। সেটা হতে দিতে পারি না। কাজেই বারান্দাতে ছিলাম তখন।

ভাবার জন্য এই বারান্দা চমৎকার একটি স্থান। এখানে আজকের বাড়িগুলোর মত হাঁটু পর্যন্ত দেওয়াল তোলা নয় সামনের দিকে। বারান্দার তিনদিকে দেওয়াল থাকলে একদিক পুরোই খালি। যদিও শিক দিয়ে ওটাকে নিরাপদ বানানো হয়েছে – যাতে কেউ পড়ে না যায়। কিন্তু মেঝেতে বসে থাকলেও সামনের খোলা মাঠটা আমার চোখে পড়ে। দুটো ল্যাম্পপোস্ট আছে মাঠের কাছে পৌঁছানোর আগেই – এদের একটা কি অসাধারণ আর নরম হলুদ আলোই না দেয়! তারপর আছে একটা নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোস্ট।

গতকাল রাতে আমার হতাশাপূর্ণ গল্পটাকে আশার দিকে সরানোর জন্য যখন বারান্দাটাতে ছোট হয়ে বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছি – চোখে পড়ে ল্যাম্পপোস্টের পাশে ওই নারীমূর্তি। একাকী মেয়েটা ওখানে কি করছে? একাকী একজন মানুষকে যখনই আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি – আমার মাঝে প্রথমেই যেই অনুভূতিটা আসে – মানুষটির মন এখন প্রচন্ড খারাপ – আর তাই সে একা থাকতে চাচ্ছে।

এজন্যই দরজা খুলে সিঁড়িঘরের সিঁড়িগুলো ভেঙ্গে তার কাছে পৌঁছে গেলাম না। তবে ধোঁয়া ভেদ করে মেয়েটিকে বার কয়েক দেখেছি সেরাতে।

পরদিন সকালে আম্মুকে ধরলাম, ‘সামনের মাঠে একটি মেয়ে যে দাঁড়িয়ে থাকে – ব্যাপার কি?’

আম্মু যারপরনাই অবাক হয়, ‘কোন মেয়ে?’

মাথা চুলকালাম, ‘মোটামুটি লম্বা একটা মেয়ে, অনেক সিল্কি চুল, বাতাসে ওড়ে।’

আম্মু মুখ টিপে হাসলো, ‘ও তো মিথিলা। B4 এ থাকে।’

‘রাতের বেলাতে বের হওয়ার অভ্যাস কি আছে তার?’ জানতে চেলাম। পাগলামী কারও থাকলে গোটা হাউজিং বাসী জেনে যায় কিভাবে জানি। কাজেই সোর্স হিসেবে আম্মু মোটেও খারাপ হবে না।

মাথা নাড়ে আম্মু, ‘মেয়েটা তো অনেক ভদ্র। রাতে কেন বের হবে? ওকে দেখাই যায় না বাইরে!’

মেনে নিতে পারি না আমি, ‘আমার তো মনে হল গতকাল রাতে দেখলাম ওকে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে!’

আম্মু আবার হেসে ফেলে, ‘মিথিলার প্রেমে পড়েছ তুমি।’

এরপর আর এই বিষয়ে আলোচনা করা চলে না। আমি চুপচাপ একদিকে সরে পড়লাম।

*

আজকে রাতে আবারও বারোটা বাজার অপেক্ষাতেই আমি থাকি। গল্পের প্লটে আজ কোন ভুল নেই – তবুও সাবধানে বের হয়ে আসি বারান্দাতে। মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল না কাওকে।

গতকাল কি আমি তাহলে ভুল দেখেছি? ভুল হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। আমি আগে কখনও মিথিলার সাথে দেখা করিনি। যদি আমি আগে মিথিলার সাথে দেখা না করেই তাকে মাঠের মাঝে দেখে ফেলি – তার অর্থ মেয়েটা ওখানে দাঁড়িয়েছিল।

এই মুহূর্তে মাঠে কাওকে দেখা না গেলেও আস্তে করে সিগারেট ধরালাম একটা। আমার হাতে অফুরন্ত সময়। ভার্সিটি এখন বন্ধ। বাসাতে থাকা মানে দুই হাত এবং দুই পা আমার খালি। খালি হাতে সিগারেট ভালো মানায়, আর মানায় কী-বোর্ড। এই মুহূর্তে চোরের মত মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি প্রথমটাকে বেছে নিলাম।

সিগারেটটা আমাকে বেশ চুরি করেই খাওয়া লাগে। পাশের ঘরেই আছে আব্বু আর আম্মু। ধোঁয়ার গন্ধ আস্তে করে ওদিকে চলে যেতেই পারে। প্রতিপক্ষ আছে আমার। বাতাস।

ওরা সিগারেটের ঘোরতম বিরোধী। কাজেই ব্যাপারটা জানিয়ে তাদের মনে কষ্ট দিতে চাই না। প্রতিটি কুলাঙ্গারতম সন্তানেরও এতটুকু করাটা তো দরকার।

কাজেই লুকিয়ে নিজেকে একেবারে ছোট করে ফেলতে হল। বাতাসের গতিবিধি কয়েকদিন আগেও আমি কিছুই বুঝতাম না। এখন মোটামুটি গবেষণা করেই নিজের অবস্থান ঠিক করি – যাতে বাতাস আমার অনুকূলে কাজ করে।

তৃতীয়বার ফুস ফুস ভর্তি ধোঁয়া ছাড়ার সময় থমকে গেলাম। আম্মুদের রুম থেকে কাশির শব্দ আসছে।

সর্বনাশ করেছে! আম্মুর নাক খুবই তীক্ষ্ণ! ঢাকাতে থাকা অবস্থাতে একদিনের কথা মনে পড়ে গেল।

কলেজে পড়তাম। সিগারেট গুণে রাখার বাতিক আমার প্রথম থেকেই। তখন মোটে পাঁচশ মত টেনেছি। এমনই একদিন বাসাতে ঢোকার একঘন্টা আগে সর্বশেষ সিগারেট পুড়িয়ে হেঁটে যাই এক বন্ধুর সাথে।

বাসাতে ঢোকার আগে হারামজাদা আরেকটা ধরিয়ে ফেলল, আমি গায়ে মাখলাম না। একটু দূরে থাকলাম তার। তারপর ভদ্রসন্তানের মত বাসাতে ঢুকতেই আম্মুর নাক কুঁচকে গেল।

‘তুমি সিগারেট খেয়ে এসেছ নাকি?’ খটাস করে প্রশ্নটা করে ফেলেছিল আম্মু।

সেদিন আসলেই সিগারেট খেয়ে আসিনি, কাজটা করেছে কাছের বন্ধুটা, তার পিন্ডি চটকাতে চটকাতে মাথা নেড়ে তীব্র অসম্মতি জানালাম। অসম্মতিটাতে সত্য ছিল। কাজেই মেনে নিয়েছিল আম্মু।

আজও জেগে গেছে দেখা যাচ্ছে! কাশি দিচ্ছে! খবর আছে দরজাটা খুলে এখানে ঢুকলেই! নবে লক করে দিয়েছি ঠিকই – তবে চাবি তো আম্মুর কাছেই!

কি ভাবছেন? আহা – জানিয়ে সিগারেট খেতে না পারলে খাওয়ার দরকারটাই বা কি? আর খেতেই হলে জানিয়ে দেওয়াটাই ভালো না?

ওই যে বললাম – পরিবারকে কষ্ট কে দিতে চায়? আবার সিগারেট ছাড়াটাও সম্ভব না। বায়োলজিকালি সিগারেট ক্রিয়েটিভ কাজ করার ক্ষেত্রে সহায়ক। অনেকেই জানেন না হয়ত, চা মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোকে যতটা অনুরনণ দেয়, সিগারেট দেয় তার থেকেও ৭ গুণ বেশি!

উদ্দীপনার দরকার আছে কাজের ক্ষেত্রে। আমি সিগারেট খেতে কাওকে উৎসাহিত করছি না। তবে মানুষের মত বায়োলজিকাল একটি মেশিনের জন্য নিকোটিনের যে আসলেই একটা পজেটিভ ভূমিকাও আছে – সেটাই জানিয়ে রাখলাম।

এই মুহূর্তে আমার দ্বি-মুখী তত্ত্ব মাঠে মারা পড়তে যাচ্ছে ওই নিকোটিনের গন্ধেই। পাক মেরে সিগারেট ফেলে দিলেও বারান্দা জুড়ে থেকে যাওয়া গন্ধটা তো যাবে না। মনে মনে আমি যতই ধমক দেই ওদের, ‘ব্যাপন হ! ব্যাপন হ!!’ – কাজ কি দেবে সেটা?

দেবে না।

কাজেই ঠান্ডা হয়ে সিগারেটের ওপরই থাকি আমি। আর খেয়াল রাখি কখন দরজাটা খুট করে খুলে যায়। তখন হাত থেকে সিগারেটের পতন অবিশ্যম্ভাবি।

কাশির শব্দ আবার  হল। আমি মনে মনে প্রার্থনা জানিয়ে চলেছি – ওই ঘরে আম্মু যাতে ঘুমিয়ে পড়ে সুন্দর করে।

কিন্তু ঘুমানোর কোন লক্ষণ কি আছে? কাশির শব্দ মাঝে মাঝেই হচ্ছে ।

ছেলে হিসেবে আমার এই মুহূর্তের করণীয় পাশের ঘরে গিয়ে মায়ের খোঁজখবর নিয়ে আসা। কিন্তু তা না করে আমি ঠাঁয় বসে থাকলাম। এই ধোঁয়ার গন্ধ নিয়ে আমি দরজা দিয়ে ঢুকলে আমাকে আম্মু জানালা দিয়ে বের করে দেবে।

সিগারেটের ৭৩% শেষ হয়ে গেছে – অনুমান করতে করতে বাকিটুকু শেষ করে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করছি – এই সময় ল্যাম্পপোস্টটার দিকে অনেকক্ষণ পর চোখ পড়ল আমার। কিছুটা চমকে উঠলাম। জানা ছিল এমনটা হবেই – তবুও।

কালো জামা পড়ে মেয়েটা আজও দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ঠিক যেখানে গতকাল রাতে আমি ওকে দেখেছিলাম!

রাতের বেলাতে এলাকা অন্ধকার হয় না কখনও। অসংখ্য ল্যাম্পপোস্টে অসংখ্য লাইট এই হাউজিংয়ে।

তারপরও মেয়েটিকে ছায়া ছায়া লাগছে। ফর্সা হাতদুটো কালো জামা থেকে বের হয়ে আসাতেই তাকে মানুষ বলে চেনা যায়। আমি সিগারেটের অবশিষ্ট ২৭% শেষ করলাম খুবই তাড়াতাড়ি, বাসা থেকে বের হলাম খুবই নিঃশব্দে।

বাসা থেকে নেমে পঁয়তাল্লিশ ফিট লম্বা রাস্তাটাকে আজ মনে হচ্ছে কতই না দূরের পথ! মাঠে এখনও মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, এটা একটা স্বস্তি। খুবই সাবধানে এগিয়ে যাই ওদিকে। এই রহস্য উদঘাটন করতে না পারলে আমার আর নতুন কোন গল্প লেখা লাগবে না।

*

‘ঘুম আসছে না?’ খুব কাছ থেকে প্রশ্নটা করি আমি।

ভেবেছিলাম চমকাবে, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ফিরে তাকায় মেয়েটা আমার দিকে, ‘জানতাম আপনি নেমে আসছেন।’

অবাক হলাম। এতটাই অবাক হলাম – হাতে বের করা নতুন সিগারেট স্টিকটাতে আগুন জ্বালানোর কথা ভুলে গেছি একেবারেই। ওটা হাতে নিয়েই তাকিয়ে থাকি মেয়েটির দিকে। চোখগুলো টানা টানা না, কিন্তু অসম্ভব মায়াবী ওদুটো। আমি নিশ্চিত, এই রাত বারোটাতে এই মেয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এক সেকেন্ডও ব্যায় করেনি – কিন্তু চোখের পাপড়িগুলো কি গভীর কালো!

ছোট্ট নাকটা যেন ওর চেহারাকে পূর্ণতা দিয়েছে। আরেকটু বড় হলে নির্ঘাত ডাইনীদের মত লাগত ওকে দেখতে। এখন পাতলা ঠোঁটদুটোর একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে ওই নাকটা। গালদুটো মোটেও চ্যাপ্টা নয় – আবার গোলও না। মেয়েটাকে দেখে একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করবে যে কোন ছেলের, ‘আপু, আপনার একটা ছবি তুলতে পারি?’

আমি ওটা বললাম না। কর্কশ কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লাম।

‘কিভাবে জানলেন?’

প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করে ও, ‘আপনি লেখালেখি করেন রাত জেগে, তাই না?’

এটাও তার জানার কথা না, গম্ভীর মুখে তবুও বললাম, ‘হুম।’

কিছুটা ধারণা আমি পেয়ে গেছি এতক্ষণে। আম্মুর কারসাজি সব। নির্ঘাত মিথিলার আম্মুর সাথে গল্পোচ্ছলে কিছু কথা লাগিয়েছে। যা থেকে এই মেয়ের কানে চলে গেছে। এই ছোট্ট কলোনীতে সবাই সবার ব্যপারে জানে। জানাটাই নিয়ম।

কিন্তু তাতে মেয়েটার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? রাত বারোটাতে এখানে দাঁড়ালে আমি দেখে ফেলব আর দেখে ফেলে নিচে নামব – এটা নিশ্চয় যুক্তি দিয়ে বুঝে সে বলেছে। কিন্তু জানা থাকার পরও সে দাঁড়াবে কেন?

‘এখানে যে কয়দিন আছেন, একটা কাজ কি করতে পারবেন?’ আমার দিকে আবেদনময় চোখদুটো মেলে তাকায় মিথিলা।

ওই চোখকে নেতিবাচক উত্তর দেওয়া অসম্ভব একটা কাজ, আস্তে করে জানালাম, ‘পারব।’

‘রাতগুলো জেগে থাকবেন, প্লিজ। ঘুমাবেন না।’

মিথিলা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওর বাসার দিকে চলে যাচ্ছে এখন। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

শেষ কথাটা কিসের জন্য বললো ও আমাকে? এটা কি আমাকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য বলা হল?

রাতে ঘুমালে কি হবে?

সন্নিগ্ধ ভঙ্গীতে আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে ফেলতে হল ওখানেই। সামনে খালি একটা মাঠ। মাঠের চারপাশের ল্যাপপোস্টগুলো মাঠের ঠিক মাঝখানে আলো দিতে পারে না। ওখানে একটা গর্ত আছে বলে মনে হতে থাকে।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ওই গর্তটা দেখি। তারপর ঘুরে বাসাতে চলে আসলাম। মিথিলা মেয়েটা আসলেই রহস্যময়ী। কিন্তু কোন জায়গাতে তার রহস্য তা আমি ধরতে পারছি না কোন কারণে।

সিগারেটটা মাঠের মাঝে ফেলে দিয়ে যখন বাসাতে ফিরে আসছি – ঘড়িতে তখন দুইটা বাজে। আর কিছুক্ষণ পর সাহরীর সাইরেন দেবে মসজিদ থেকে।

সাইরেনের শব্দটা শুরু হল আড়াইটা থেকে। নাজি বাহিনীর অ্যালার্মের মত কর্কশ না হলেও একটা মন খারাপ করা গন্ধ ওই শব্দ দেবেই। মন খারাপ করা গন্ধটাকে পাত্তা না দিয়ে ঝড়ের বেগে লেখে যাই আমি। কী-বোর্ড আমাকে ভুলিয়ে দেয় মিথিলার কথা, সামনে থাকা একটা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ফাইল ভুলিয়ে দেয় একটু আগে রহস্যময়ী কোন এক মেয়ের সাথে ব্যাখ্যার অযোগ্য কথা বার্তা বলে এসেছি আমি।

সব কিছু অতীত হয়ে যায় – আমি আর আমার কম্পিউটার আর আমার আঙুলগুলোর প্রজাপতির মত কী-বোর্ডের ওপর উড়ে বেড়ানো –

‘খেতে আসো।’ আম্মুর গলা শুনলাম দরজার কাছে।

*

বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। আম্মু আর আমার ছোটভাই এসে আমার ঘরে ঘুকে পড়ে।

কান থেকে হেডফোন নামালাম।

‘আমরা পাশের বাসাতে যাচ্ছি। ওই আন্টির সাথে কথা বলে আসি একটু।’

হেসে মাথা কাত করলাম। ইফতারী শেষ – এখন আম্মুর একটু ছুটি। আব্বুও বের হয়ে গেছে তারাবী পড়তে।  আমি কুলাঙ্গার শ্রেণির ফাঁকি মারছি ঘরে বসে।

ওরা দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে যেতে আবার ঝুঁকে পড়ি আমি। হিব্রু ভাষা নিয়ে একটা অদ্ভুত রকমের ঝামেলাতে পড়ে গেছি এরই মাঝে।

আর যেকোন ভাষাকে ট্রান্সলেট করতে দিলে গুগল ট্রান্সলেটর সেটা ট্রান্সলেট করে দেয় – সাউন্ড ফাইল সহ। অথবা একটা অপশন থাকেই, ‘Read Phonetically’ – যাতে যিনি অর্থ খুঁজছেন তিনি একটা উচ্চারণও জানতে পারেন। অথচ হিব্রুর ক্ষেত্রে এটা নেই। অদ্ভুত না?

আছিউ গুগল ট্রান্সলেটে – যেটা ইহুদীদের সম্পত্তি। আর সেই গুগলে হিব্রু ভাষার উচ্চারণ জানার উপায় কেন থাকবে না?

ইন্টারনেটে সার্চ দিলাম। গুগল, ইয়াহু, বিং – একটা ডিকশনারীও নেই অনলাইনে যেখানে হিব্রু শব্দের উচ্চারণ সব অনুবাদ করে দেওয়া হয়!

ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা না আর কিছু আছে?

দরজাতে আলতো করে একবার কলিং বেল পড়তে উঠে দাঁড়ালাম। আম্মুরা এত তাড়াতাড়ি তো আসার কথা না। রাত নয়টার আগে আম্মুদের আড্ডা শেষ হবে বলে মনে হয় না। কে আসতে পারে ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে দেই।

একহাতে একটা বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিথিলা। হাতকাটা একটা জামা পড়েছে এখন। এগুলোকে কি বলে আমি জানি না – তবে এই মুহূর্তে মিথিলাকে ডানাকাটা পরীদের মত লাগছে – এতটুকু আমি জানি।

ডানাকাটা পরীটা এদিক ওদিক তাকায় বাসার ভেতর, ‘আন্টি নেই?’

‘ওহ -’ সম্বিত ফিরে পাই আমি, ‘ভেতরে আসুন। আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসছি আমি।’

ওকে ড্রইং রুমে বসাচ্ছি, মিষ্টি করে হাসে ও, ‘আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আপনার চেয়ে দুই বছরের ছোট আমি।’

আমিও একটু হাসলাম, ‘আচ্ছা, আর বলব না।’

চারপাশটা কিভাবে জানি দেখে মিথিলা আমাদের বাসাতে ঢুকেই। আমার মনে হয় ও স্মৃতিরোমন্থন করছে।

আমার দিকে তাকিয়ে পরের যে কথাটা বলে তাতে আমার ধারণা নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়, ‘এখানে আমরা থাকতাম। আপনারা ওঠার আগে। তারপর পাশের বিল্ডিংয়ে চলে যাই।’

কৌতুহল হয় আমার, ওর সামনের সোফাতে বসে পড়লাম, ‘বি-টাইপ বাসাতেই তো ছিলে তাহলে। কেন? বাসা পাল্টালে কেন? তোমাদের B4 এর চেয়ে তো এই B3 এর ভিউ বেশি সুন্দর।’

মাথা নীচু করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মিথিলা। কিছু বলে না।

প্রশ্নটা করা আমার হয়ত উচিত ছিল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে পড়ি, ‘থাকো, আমি ডেকে আনছি আম্মুকে।’

ঝট করে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা, আমার গলা সমান হবে ও, ‘আপনাদের গেস্ট রুমটা একটু দেখতে পারি?’

এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলাম, তারপর মাথা ঝাঁকাই, ‘শিওর।’

গেস্ট রুমটাতে তেমন কিছু নেই। একটা বুক সেলফ, একটা খাট, দেওয়াল জুড়ে বড় একটা আয়না। আর ঘরের কোণে আইপিএস সেটা করাই আছে। যদিও এই হাউজিংয়ে নিজস্ব বিদ্যুতে চলে সব – কখনই কারেন্ট যায় না। ওটা কেনা হয়েছিল ঢাকাতে থাকতে।

আগে ঢুকল মিথিলা পরে আমি। ধীরে ধীরে একমাত্র খাটটির পাশের জানার গ্রিলে হাত রাখে ও। এখান থেকেও মাঠটা দেখা যায়। পাশের দেওয়াল সরিয়ে ফেললেই আমার ঘরের সাথে থাকা বারান্দাটাতে যাওয়া যাবে।

চারপাশে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছি – মিথিলাকে স্মৃতিচারণ করতে দেওয়া দরকার। ZFCL হাউজিংয়ের একটা বাসাতে পাঁচ বছর ছিলাম আমরা। ওতে আবার যদি ঢুকতে পারি – আমিও একটু একাকীত্ব চাবো।

দরজা পর্যন্ত পৌঁছতেই হাতে কারও হাত অনুভব করি। ফিরে তাকিয়ে মিথিলাকে দেখতে পেলাম। কিছুটা চমকাই –  আমার খুব কাছে এসে গেছে ও এখন।

‘আই লাভ ইউ!’ ফিস ফিস করে বলল মেয়েটা।

ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে – নির্ঘাত! টেনে হাতটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম আমি , পারি না। এতটুকু একটা মেয়ে এত শক্তি পায় কোথা থেকে?

ধীরে ধীরে আমাকে জানালার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মিথিলা – কোনমতেই এড়াতে পারি না আমি সেটা।

টান দিয়ে আমাকে খাটের ওপর ফেলে দেয় মেয়েটা – গড়িয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম প্রাণপণে – পারি না। শক্ত করে আমাকে ধরে রেখেছে ও। জোর করেই আমার বাম হাতটা ওর বুকের ওপর রাখে মিথিলা।

ডানহাত দিয়ে সর্বশক্তিতে ওর গালে মারি আমি, অন্যহাতটাকে মুক্ত করতে চাই নরম কিন্তু অবৈধ একটা স্পর্শ থেকে।

‘তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, মিথিলা!’ ধমক উঠি আমি, ‘শান্ত ভাবে খুলে বলো কি হয়েছে?’

কিছু না বলে আমাকে নিচে ফেলে দেয় ও, তারপর চেষ্টা করতে থাকে ঠোঁটে কামড়ে ধরার – মাথা এপাশ থেকে ওপাশে সরিয়ে কোন মতে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি।

দুই হাতে আমার মাথা চেপে ধরে ও বুঝতে পেরে। তারপর কামড়ে ধরে আমার ঠোঁট। ব্যাথা পাচ্ছি আমি – কেটে ফেলেছে নিশ্চয় আমার নিচের ঠোঁট – কিন্তু নিস্তার পাই না।

ঠিক এই সময়ে আমার গলাটা চেপে ধরে ও মাথা ছেড়ে।

ধীরে ধীরে চাপ বাড়ছে ওই দুই হাতে

শক্ত মেঝেতে নিজের শরীর চেপে ধরে আমাকে আটকে রেখেছে ও – ঠোঁট নড়াতেও পারছি না – কাজেই চিৎকার দেওয়ার কোন উপায় নেই।

চাপ বাড়াতে থাকে মিথিলা – গলার আকছে তীব্র একটা খিঁচুনির মত অনুভব করি আমি। চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে মিনিটখানেক পরই। দুই হাত মেঝেতে ছুঁড়ি আমি তীব্র যন্ত্রণাতে – উঠে বসার শেষ চেষ্টা করলাম – মেয়েটাকে দুই হাতে আমার ওপর থেকে নামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু শরীর দিয়ে আমাকে বন্দী করে রেখেছে মেয়েটা – একচুল নড়ানো গেল না তাকে।

চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঘোলা হয়ে যাচ্ছে আমার। কিন্তু কি আশ্চর্য! কানের শ্রবণশক্তি আরও অনেক বেড়ে গেছে!

বাইরে বৃষ্টির শব্দ মৃদু ঝিম ঝিম শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি, ছোট্ট ঝিঁ ঝিঁদের ডাক শুনতে পাচ্ছি – আর এর মাঝেই – নিজের ঘরেই খুন হয়ে যাচ্ছি আমি।

আরও মিইয়ে আসে আমার দৃষ্টিশক্তি – আরও বেড়ে যায় শ্রবণশক্তি – নিজের ঠোঁটে মিথিলার দাঁত ঢুকে যাওয়ার মৃদু কচ কচ শব্দও যেন আমি শুনতে পাই!

কলিং বেলের প্রচণ্ড শব্দটা আমার কানের পর্দা যেন ফাটিয়ে দেবে। কখন যেন মিথিলার শরীর আমাকে মুক্তি দেয় – গড়িয়ে সরে যাই আমি মেঝে থেকে। টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছি। এই মাত্র কি হল তার কোন ব্যাখ্যা আমার হাতে নেই। মিথিলার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার কিছুও নেই। গলাথেকে চাপ সরে যেতেই পাগলের মত কেশে উঠি আমি। দুনিয়ার সব বাতাস বুকে ঢুকিয়ে নিতে পাগল হয়ে উঠেছি!

দরজার ঠিক বাইরে আম্মু দাঁড়িয়ে আছে। দেরী করা যাবে না।

কোনমতে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে ওটা খুলে দেই আমি। আম্মুর আর ছোটভাই ফিরে এসেছে। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মিথিলাকে দেখে আম্মুর ভ্রু কুঁচকে যায়।

বইটা বাড়িয়ে দেয় মিথিলা, ‘আন্টি, বইটা দিতে এসেছিলাম। আপনাকে পেলাম না।’

একহাতে বইটা নেয় আম্মু। একবার ওর লাল হয়ে যাওয়া গাল আর একবার আমার রক্তাক্ত ঠোঁট দেখে চুপচাপ।

তারপরও ভদ্রতা বজায় রেখে আম্মু বলে, ‘এটা দিতে বৃষ্টিতে আসার কি দরকার ছিল? পরে দিতে। ঠান্ডা লাগবে তো।’

‘না, ঠিক আছে আন্টি!’

 উড়ে পালালো মিথিলা।

একবার আমার ঠোঁটে স্পষ্ট কামড়ের দাগের দিকে বাঁকা চাহনী দিয়ে আম্মুও ঢুকে যায় ঘরের মাঝে।

*

ছোট ছোট পায়ে হাঁটছে মিথিলা। বিকেল এখন। আরেকটু পর সবাই যার যার ঘরে ঢুকে যাবে – ইফতারের সময় কাছিয়ে আসলেই।

বারান্দা দিয়ে ওকে দেখি আমি। আমার দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে তাকায় মেয়েটা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি আমিও।

‘জানি, একসাথে একটু হাঁটতে চাবেন এখন।’ আমার দিকে না তাকিয়েই বলে মেয়েটা।

টিশার্ট আর জিনসে চমৎকার লাগছে তাকে।

‘হাঁটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। কিছু কথা বলার ছিল।’ জানালাম।

দাঁড়িয়ে পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মিথিলা। ওর সুন্দর মুখটার দিকে তাকালাম, বাম গালে দাগ বসে গেছে আমার আঙুলের। সেজন্য অনুশোচনা হয় না অবশ্য। আরও কয়েকটা দেওয়া উচিত ছিল। নিজেও একটা ব্যান্ডেজ ঠোঁটে নিয়ে ঘুরছি।

‘কাল রাত নিয়ে প্রশ্ন করতে চান তো?’ , জানতে চায় ও।

‘না।’ দূরে তাকিয়ে দেখি, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাউজিং পরিবেশ এমনই, আবার তাকাই মিথিলার দিকে, ‘বাসাটা সম্পর্কে জানতে চাই। কেন বাসাটা ছেড়ে গেলে তোমরা?’

‘কেন?’ সরু চোখে তাকায় ও আমার দিকে।

‘কারণ, প্রতিরাতে কাশির শব্দ শুনতে পাই আমি। ঠিক যেভাবে কেশেছিলাম গতকাল -’ বাকিটা বললাম না, মেয়েটার ওপর রাগ উঠছে প্রচন্ডভাবে, ‘গতকাল রাতে, বারান্দাতে আমার ঠিক পাশে শুনেছি ওই শব্দটা। কেন? কাশির শব্দ হবে কেন একটা বাসাতে?’

কাঁধ ঝাঁকায় মিথিলা, ‘তার আমি কি জানি? আমি তো কাশি না।’

রাগ সামলাতে পারলাম না, ওর দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেই প্রচণ্ডভাবে, ‘বলতে হবে। আর তোমাকেই বলতে হবে সেটা! কারণ, আমি মনে করি আমার সাথে যে কাজটা তুমি শেষ করতে পারো নি – ওই একই রুমে অন্য কোন ছেলের ক্ষেত্রে সেটা করেছ!’

‘ছাড়ুন, মানুষ দেখছে।’ অনুনয় করে মিথিলা।

ওকে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসলাম আমি, রাগে জ্বলছে দুই চোখ, ‘ইউ কিলড সামবডি ইন দ্যাট রুম! তারপর বাসা পাল্টেছে আংকেল। তাই না?’

গলা থেকে একটা রূপোলি চেইন খুলে দেয় আমাকে ও, ‘এটা আপুর গলাতে ছিল। এখন আমি পড়ে থাকি।’

হাতে নিলাম ওটা আমি, ‘আপু?’

‘নিহিলা আপু। আপনাদের ব্যাচের। আমার থেকে দুই বছরের বড় ছিল ও।’

‘আপু এখন কোথায়?’

আমার হাত থেকে আবার চেইনটা নিয়ে নেয় ও, ‘নেই তো। মরে গেছে সাত মাস আগে।’

অবাক হয়ে তাকাই আমি, ‘কিভাবে?’

আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার গলাতে পড়ে ফেলে ও চেইনটা, ‘আপু চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিল। বায়োকেমিস্ট্রি। আপুর মত ভালো মেয়ে হয় না জানেন? এত কিছু পারত ও, দারুণ ছবি আঁকত, গান করত অনেক সুন্দর করে। আপুকে মডেলিংয়ের অফারও দিয়েছিল বাংলালিংক। আব্বু রাজি হয়নি।’

কিছু না বলে শুনে যাই আমি। এবার অনেককিছুই স্পষ্ট হয়ে আসছে।

‘রিহান নামে এক ছেলেকে ভালোবাসত আপু। অথচ ছেলেটা প্লেবয় প্রজাতির। প্রতারক। যখন যে মেয়েকে ভালো লাগে তার সাথে থাকে। জিতে ফেলতে পারলেই চলে যায় তাকে ছেড়ে। আমরা জানতাম না। হাউজিংয়ের কোন মেয়ের দিকে সে আগে হাত বাড়ায় নি – সেজন্যই জানতাম না। ছেলেটার চোখ পড়ল আপুর দিকে।’

আমি শুধু শুনতে থাকি। মিথিলার চোখে ধীরে ধীরে পানি জমছে।

‘ছেলেটা বুয়েটে পড়ে। এখানে খুব কমই আসত। আপুর থেকেও এক বছরের সিনিয়র। যে কয়দিন আসত আপু পাগল হয়ে থাকত ওর সাথে সময় কাটানোর জন্য। আমিও সাহায্য করতাম। এরকম এক  বন্ধ পেয়ে গেছিল রিহান সাত মাস আগে। কোন এক আন্দোলনে তাদের ক্লাস ছিল বন্ধ। আব্বু আম্মু শহরে গেছিল চেক-আপ করাতে। আপু আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে বলল, “তোর রিহান ভাই আসবে। আমাদের একটু সময় দিবি, বোন?” অন্য দিনের মত আমিও বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে। C-2 তে আমার বান্ধবী রিয়ারা থাকে। ওদের বাসাতে অযথাই গেলাম ক্লাস নোট তুলতে।’

চুপ হয়ে যায় মিথিলা এবার। বিষণ্ণ চোখ দুটো ফাঁকা মাঠটা দেখছে আর ওই মাঠের প্রতিবিম্ব এসে পড়ে ওর চোখের মণিতে। সাবধানে চোখ মুছে ফেলে ও।

‘তারপর?’ জানতে চেলাম আমি।

‘ফিরে এসে দেখি -’ থেমে যায় ও আবার, আরেকবার চোখ মুছতে হল ওকে এখানে, ‘ফিরে এসে দেখি দরজা খোলে না কেউ। একটা এক্সট্রা চাবি আমি সাথেই রাখি – ওটা দিয়ে সাবধানে মেইন গেট খুলে ফেললাম। গেস্ট রুমে পড়ে ছিল আপুর লাশ। শরীরে একটা সুতোও নেই – ব্লেড দিয়ে কেউ আপুর বুক পেট উরুতে ইচ্ছে মত কেটেছে। গলাতে রুমাল পেঁচিয়ে খুন করেছে কেউ তাকে।’

আমি চুপ হয়ে থাকি তবুও।

‘আব্বু সব জানল। কিন্তু রিহানের বিরুদ্ধে একটা আঙুল তুলল না। হাউজিংয়ের সবাই জানে এখানে সবার গল্প। নিহিলা আপু মরে গেছে – তবে মরেছে অসম্মানে। সেই সামাজিক অসম্মানকে অস্বীকার করে মৃতাকে সম্মান দেওয়া সাহস আব্বু-আম্মুর ছিল না, ইমন ভাইয়া।’ আমার দিকে হতাশ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় মিথিলা, ‘তাই কেসও করেনি তারা ওর নামে।’

‘প্রশ্নের জবাব তো পাইনি। বাসা ছাড়লে কেন?’ নির্বিকার ভঙ্গীতে জানতে চাই আমি।

‘আপুকে আমি দেখতে পাই ওই বাসাতে। আপুর সাথে কথা বলতাম। আপু শুধু কাশে। আমাকে বলে, “গলায় অনেক ব্যাথা রে।  দ্যাখ গলাতে দাগ ফেলে দিয়েছে।” আমি দেখি। আদর করে দেই ওখানে হাত বুলিয়ে। কি ঠাণ্ডাই না হয়ে থাকে আপুর শরীর!’

‘আংকেল আন্টি তোমার কথা বলা মেনে নিল?’

‘না, বাসা পাল্টে ফেলল ওরা। আপনারা উঠলেন সেখানে। মাঠটা আপুর প্রিয় ছিল। এখানে আমরা দুইবোন ঘুরতাম। ঘাস ছিঁড়ে আমার জামার পিঠে ভরে দিত আপু দুষ্টুমি করলে। এখনও রাতে এখানে আমি আপুকে দেখতে পাই। আপুর সাথে কথা বলি।’

‘সেদিন যে আমি নেমে আসব সেটা -’

‘-আপু আমাকে বলেছিল। আপুকে তো জেগে থাকতে হয়। ঘুমুতে তো ও পারে না! আপনি জেগে জেগে গল্প লেখেন – সেগুলো ও পড়ে। আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে ওই সময়টাতে। এখন সময়গুলো ওর আগের চেয়ে ভালো কাটে। অনেক ভালো। আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’

‘সেজন্যই বলেছিলে রাতে জেগে থাকতে, তাই না?’

মাথা ঝাঁকায় মিথিলা, ‘আরেকটা কথা, গেস্ট রুমে রাতে ঢুকবেন না। আপু এরকম ক্ষেপে উঠবে জানলে আমিও যেতাম না।’

মাথা নাড়ি এবার আমি, ‘আমার মনে হয়, মিথিলা, আপু এমনিতে কাওকে স্পর্শ করতে পারে না। গেস্ট রুমে রাতে আমি আগেও ঢুকেছি। কিছু হয়নি। তোমার শরীরটাকে মিডিয়াম বানিয়ে আপু গতকাল আমাকে হামলা করেছিল – কারণ কাকতলীয়ভাবে রিহান আর আপুর মতই দৃশ্যপট সাজানো হয়ে গেছিল, যখন ঘরটাতে শুধু আমি আর তুমি ছিলাম।’

মাথা নাড়ে মিথিলা, ‘হয়ত। আমি দুঃখিত, ভাইয়া। ইচ্ছে করে -’

‘জানি।’ ওকে থামিয়ে হেঁটে আসি ওখান থেকে।

রিহান – রিহান ছেলেটা থাকে কোথায়?

*

C-1 বিল্ডিংটা রাস্তার পাশেই। তবে ভেতরের দিকে চলে আসলে সরাসরি কাওকে দেখা যায় না। আমি একেবারে সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে আছি।

এই জায়গাতে একজন সারাদিন লুকিয়ে থাকলেও তাকে দেখতে পাওয়ার কথা না কারও। কেউ সিঁড়ির নিচে এসে উঁকি দেয় না এই দেশে।

রিহান নামের ছেলেটা আমার পেছনেই ছিল। বাসার দিকে আগাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। গত পাঁচদিন ধরে একে ফলো করে গেছি আমি। আমার চেয়ে ভালো আর কে জানবে?

নিহিলার ছবি আমাকে একদিন দেখিয়েছিল মিথিলা। ওর থেকেও কয়েকগুণ বেশি সুন্দর মেয়েটা। বয়েসে আমার সমানই হবে। ছবিটার একটা কপি চেয়েছিলাম আমি। দিয়ে দিয়েছে মিথিলা।

একবার মোবাইল বের করে নিহিলাকে দেখলাম। এত মায়াবতী একটি মেয়েকে যে খুন করতে পারে সে কি মানুষ?

পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। একজন অমানুষের পায়ের শব্দ।

হাতে ধরে রাখা আটইঞ্চি ফলার ছুরিটাকে আদর করে দেই আমি অন্য হাত দিয়ে।

পায়ের শব্দ আরও কাছে আসছে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল রিহান?

ঝট করে নিচ থেকে বের হয়ে আসি আমি।

— ০ —

 

মানুষ জিতবেই

“মাগিবাজি করার জায়গা এটা না।” পিচিক করে মাটিতে থুতু ফেলতে ফেলতে বললো ছেলেটা। তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো শায়লা।
চোখ দিয়ে তাকে একবার মাপলো তপু। এই ছেলের বয়স বেশি হবে না। টিনএজ কোনমতে পার করেছে। নিয়মিত শেভ করে করে দাঁড়ির একটা চিরস্থায়ী রূপ গালে আনতে পেরেছে বটে, কিন্তু তাতে করে কৈশোরের ছাপ মুছে ফেলতে পারেনি। টিশার্টটা কালো, সাদা কলার। কলারের রঙটা স্পষ্ট, কারণ এই ছেলে কলারটা নব্বই ডিগ্রি করে তুলে রেখেছে। গলায় ভারী চেইন, দেখে মনে হবে সাইকেলের স্প্রোকেট থেকে খুলে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিন বোতামের টিশার্ট, তিনটাই খোলা। একটা বিষয় এই ছেলে স্পষ্ট করে দিতে চায়, অন্য কারও আধিপত্য সে সহ্য করবে না।
“এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়।” বলে চললো ছেলেটা, “এখানে যে কেউ মাগি নিয়া ঢুইকা গেলে সেইটা আমরা মাইনা নিমু না।”
এক পা এগিয়ে এলো তপু, “তুমি কি জানো কার সাথে কথা বলছো?”
পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দলের বাকিদের দিকে তাকালো ছেলেটা, “তোরা দাঁড়ায় দেখতেছোস কি? স্যালুট কর, প্রেসিডেন্টরে স্যালুট কর!” তারপর তপুর দিকে ফিরলো, “তুমি দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও চুদি না, ভাই।”
অল্পবয়েসী ছেলেটার স্পর্ধা দেখে তপু ভাষা হারিয়ে ফেললো। শায়লা-তপুর অ্যানিভার্সারি আজ। প্রেমিকাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসেছে। এখান থেকেই প্রেমটার শুরু, তাই। তেমন কোনও গ্র্যান্ড প্ল্যান ছিলো না। এখানে একটু হাঁটাহাঁটি করবে। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন হবে খানিকটা, তারপর ধানমণ্ডিতে রিকশা ট্যুর। সেখানে লাঞ্চটা করে মেয়েটাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসা। ওদের আয়োজনগুলো সব সময় এমন আড়ম্বরহীন হয়ে থাকে। কলাভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো যখন, চারপাশে এমন কিছু ছেলেকে আচমকা আবিষ্কার করতে পারলো ওরা। এদের মধ্যে নেতাগোছের ছেলেটা এগিয়ে এসেছিলো, তারপর শায়লাকে বজ্রাহতের মতো থমকে দিয়ে প্রথম কথাটা উচ্চারণ করেছিলো চরম অসম্মানের সঙ্গে।
“হাত ধরে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হাঁটলে সেটা মাগিবাজি হয়ে যাবে?”
পিচিক করে আরেকবার থুতু ফেললো ছেলেটা, “প্রেম করার জায়গা এইটা না। হাত ধরাধরি করতে হইলে লিটলের ফ্ল্যাটে গিয়া করবা।”
তপু আরেক পা এগিয়ে এলো। চট করে মেজাজ গরম হয়ে গেছে তার। খুব কাছ থেকে চোখে চোখ রাখলো প্রতিপক্ষের, “এটা প্রেম করার জায়গা না? খানকির পোলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় কি ছেলেরা এসএসসির সার্টিফিকেটের সাথে নুনুটাও রেজিস্ট্রি অফিসে জমা রেখে আসে? নাকি এই এলাকা হিজরা-অনলি?”
তপুর চেহারাটা জ্বলজ্বল করছে। যেমন কুকুর, তেমন মুগুর। এমন ছেলের সাথে ভদ্রতা চলে না। রাস্তার ছেলেদের সাথে কথা বলতে হয় রাস্তার ভাষায়। অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের জন্য কোনওরকম আক্ষেপ অনুভব করছে না সে।
অল্পবয়স্ক ছেলেটার চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল চমকেছে ভালোই। সাতজন সঙ্গী নিয়ে একা একটা ছেলেকে মেয়েসহ ঘিরে ফেলার পর এরকম একটা বাক্য সে আশা করেনি। এক মুহূর্ত পরই হতচকিত ভাবটা সরে গিয়ে সেখানে স্থান নিলো অকৃত্রিম ক্রোধ। সাঁই করে হাত চালালো সে। পলিথিনে বাতাস ভরে থাবা মেরে ফাটালে যেমন শব্দ হয় – তেমন এক শব্দে তপুর কানের ওপর আছড়ে পড়লো থাপ্পড়টা।
তপুর চশমা উড়ে গেছে। তার মধ্যেই চেইনওয়ালার কলার খামচে ধরে তাকে শুন্যে তুলে ফেললো সে। চোখের কোণে দেখা যাচ্ছে সঙ্গী সাথীরা ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসছে এখন। তাদের অগ্রাহ্য করে তরুণটির ফুলে ওঠা নাকের দিকে তাকিয়ে বলে গেল, “আইনস্টাইন থিওরি ডেরাইভেশনের মধ্যে সেক্স করে একাকার করে ফেলতো। তারপর আবার বসতো কলম নিয়ে। বাঙালির মতো না। মাথায় থাকবে মেয়ে, হাতে থাকবে ধোন, আর কাজের বেলায় ঠন ঠন। রিয়েল জিনিয়াসরা পড়াশোনা এভাবে করে না। তাদের মাথায় থাকে কাজ, হাতে থাকে কলম, আর ধোনটা থাকে মেয়ের ভেতরে। এইভাবেই প্রোডাক্টিভ কাজগুলা হয়…”
তপুর বর্ষসেরা ভাষণের দৈর্ঘ্য অতোখানিই ছিলো। এমন খোলামেলা ভাষণের তোড়েই হয়তো ইচড়ে পাকা ছেলেটির সঙ্গী সাথীরা এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছিলো। পরমুহূর্তেই তেড়ে এলো তারা। প্রথম ঘুষিতেই মৃদু এক মট শব্দের সাথে ভেঙ্গে গেলো তপুর নাকের হাড়। আরেকটা ছেলে একই সাথে ডান দিক থেকে লাথি মেরেছে, পাঁজরের সবগুলো হাড় মট মট করে উঠলো ওর। ফুসফুস থেকে প্রতিটি আউন্স বাতাস বেরিয়ে গেছে। দলনেতাও মুঠো থেকে ছুটে গেলো এই লাথির তোড়ে, তবে তপুর হাতে তার কলারটা ছিঁড়ে চলে এসেছে। সাদা একটা কলার আর রক্তাক্ত নাক নিয়ে দুই পাক ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলো সে। নাকের রক্ত সাদা কলারে লেগে মাখামাখি হয়ে গেলো। দৃষ্টিসীমার মধ্যে এখন অনেকগুলো জিন্সের প্যান্ট, তার ফাঁকফোকড়ে শায়লার সুন্দর মুখটাকে ছুটে আসতে দেখলো ও।
“মাদারচোদরে মার। সাহস কতো খানকির পোলার…” একটা ইট তুলে নিতে নিতে বললো তাদের একজন।
“বিচিতে মার। বিচিতে। দেহি হালার ধোন কতো বড় হইছে। রেজিস্ট্রি অফিসে জমা দিসে কি না।”
শায়লা এসে ক্ষ্যাপা মোষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। দৃশ্যটার মধ্যে আলাদা রকমের একটা সৌন্দর্য আছে। সাহসিকতার সৌন্দর্য। এমন সাহস মেয়েটা হয়তো কোনদিনও দেখাতে পারতো না। কোনদিনও না। মিরপুরে বাসা ওর, রোডের শেষ মাথায় কয়েকটা টিনশেড আছে। রিকশাওয়ালা গোছের মানুষরা থাকে। এদের বউরা সারাদিন একে অন্যের উদ্দেশ্যে খিস্তিখেউর করে। মাঝে মধ্যে তুমুল আকার ধারণ করে তাদের তর্ক। ওদের ঝগড়া শুনে শায়লার বুক মুরগির বাচ্চার হৃৎপিণ্ডের মতো ধুকপুক ধুকপুক করে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঐদিন দেখলো এলাকার তিনটা ছেলে মিলে একটা ছেলেকে খুব মারলো। শায়লার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছিলো। তেমন কিছু করেনি ওরা সেদিন। কিছু চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলো। ওটুকুই সহ্য করার ক্ষমতা শায়লার নেই। সে ভায়োলেন্স একেবারেই নিতে পারে না। হাত ঠাণ্ডা হয়ে যায়, বুকে জমাট বাঁধে রক্ত। রাস্তাঘাটে মারামারির মতো ঘটনা দেখলে আতঙ্কে নীল হয়ে যায় সে। এমন একটা মারামারির জায়গায় শায়লা কোনদিনও ঢুকতে পারতো না। অথচ আজ কেমন অবলীলায় ছুটে এসে আট জনের দলটার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়লো সে।
দৃশ্যটা ছিলো ভয়ঙ্কর সুন্দর। সেজন্যই হয়তো চারপাশে উপস্থিত পথচারী আর ছাত্রছাত্রীরা হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো ব্যাপারটা। এক পা-ও নড়লো না কেউ। সাহায্য করতে এলো না। এগিয়ে আসার কথাটা তাদের কারও মাথাতেই আসেনি যেন!
“ছেড়ে দাও ওকে তোমরা, ওহ খোদা…” সবুজ গেঞ্জি পরা একটা ছেলেকে টেনে সরানোর চেষ্টা করতে গিয়ে কেঁদে দিলো শায়লা, “ওহ খোদা…”
খোদা শায়লার জবাবে কান দিলেন বলে মনে হলো না। কারণ, এই সবুজ গেঞ্জির ছেলেটার হাতে একটা আধলা ইট। বন্ধুরা হাত আর পায়ের সুখ মিটিয়ে ‘মাগিবাজ’টাকে মারছে। কেবল অতোটুকুতে ওর হচ্ছিলো না। তাই একটা আধলা ইট খুঁজে নিয়েছে। প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে ফোর্থ ইয়ারে কিছু না কিছু উদ্ভাবন তো করতেই হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মানেই গবেষক, উদ্ভাবক। সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য উদ্ভাবন-কর্ম ঘটানোর প্রয়োজন এখানে রাখা হয়েছে। সিলেবাসটা এভাবেই সাজানো হয়। সবুজ গেঞ্জিও প্রয়োজনের তাগিদে ইটটা খুঁজে নিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এতোটুকু যোগ্যতা না থাকলে ভর্তি পরীক্ষায় আর টিকেছে কিভাবে?
শায়লার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গায়ের জোরে ইটটা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে তপুর মাথায় মারলো ছেলেটা। সোলের ওপর আশি কেজির চাপ, মেয়েটার পা কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। তবে তপুর মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে যেমনটা বেরিয়ে এসেছে তার তুলনায় এটা কিছুই না। অথচ কি আশ্চর্য, তপুর চোখে ক্ষমাপ্রার্থনার দৃষ্টি নেই। সেখানে প্রবল ক্রোধ আর হার না মানা উজ্জ্বলতা।
তীব্র চোখে সবুজ গেঞ্জির দিকে তাকালো সে, “খানকির পোলারা, পুরুষ মানুষ হইলে এতোজন মিলে…”
আর কিছু বলার আগেই আটজন মানুষকে দেখা গেল ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে একজন নিরস্ত্র মানুষের ওপর উঠে যেতে। দূর থেকে শুয়ে থাকা মানুষটিকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না এখন। দেখা যাবে কেবল আটজন তরুণের হাত আর পায়ের নাচের ছন্দে ওঠানামা। তাদের একজনের পেছনে প্রায় ঝুলে থাকা মায়াবতী চেহারার মেয়েটি দৃশ্যটিকে নিয়ে গেছে পরাবাস্তবতার জগতে।
২.
চায়ের দোকানে মৃদু টুংটাং শব্দ। টঙের ব্যাপারটাই এমন। মন ভালো করে দেওয়ার জন্য আলাদা কিছুর দরকার হয় না। এখানে মাজহার আর তার বন্ধুরা নিয়মিতই আসে। দেওয়াল ঘেষে এই টঙ। পাশে একটা ছোট গেট। উটকো লোকজনের ঝামেলা নেই। বন্ধু কাঞ্চন তখন কেবল মাত্র পুনমের পাছা নিয়ে উচ্চমার্গীয় এক কৌতুক করেছে। ওরা না হেসে পারলো না।
পুনম ওদের সাথেই পড়ে। কাঞ্চনের সাথে তার যে দূরের সম্পর্ক তা নয়। ওরা বেশ ভালো বন্ধু। পুনমের বার্থডে পার্টিতে বাসায় দাওয়াত পাওয়ার মতো ভালো বন্ধু। ছেলেদের আড্ডায় অবশ্য এগুলো খুব বড় ব্যাপার নয়। কাছের বান্ধবীর পাছা নিয়েও সরস মন্তব্য করা যায়। তেমন করাটা উৎসাহের চোখেই দেখা হয় ক্যাম্পাসে। না করাটাই বরং ‘গাণ্ডু’র মতো কাজ। বান্ধবীগুলো ভাগ্যিস জানে না বয়েজ জোনে তাদের নিয়ে কি কি কথা বার্তা হয়। জানলে খবর হয়ে যেতো। যেমন, এই মাত্র তরিকুল তাদের ডিপার্টমেন্টের বান্ধবী মিল্কির সাথে দুধ নিয়ে একটা অশালীন কৌতুক করলো। এটার ব্যাপারে জানলে মিল্কি কি আর কোনদিন তরিকুলের বাসায় গ্রুপ স্টাডিতে আসবে?
“খবর শুনসোস না?” হাসতে হাসতেই পরের কৌতুকের টান ধরলো তরিকুল, সেই সাথে টানটা দিয়েছে হাতের বেনসনেও, “ফিজিক্সের কোন পোলা য্যান চোদাচুদি করতে গিয়া ধরা খাইছে। এক্কেরে হাতেনাতে কট। হায়রে চুদসে ওদের পোলাপান!”
এবার হাসার পালা মাজহারের, “তুই তো শালা কিছুই জানোস না। ঘটনা আরও বিশাল। পুরা নিউক্লিয়ার বোমা ব্যাটা।”
কাঞ্চনের প্রশ্ন থেকে বোঝা গেলো নিউক্লিয়ার বোমার ব্যাপারে সে-ও জানে না, “ক্যামনে?”
“ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের পোলা না। ফিজিক্সের টিচার ধরা খাইছে চোদাচুদি করতে গিয়া। আমাদের থিকা চাইর বছরের সিনিয়র পোলাটা। এইবার জয়েন করলো আরকি। সাত-আটদিন হইছে কেবল। কেউ চেনে না তার ডিপার্টমেন্টের পোলাপান ছাড়া। এইখানেই ফ্যাকরাটা বাঁইধা গেছে। শালা টিচার হইয়া গেলা, এখনও মাগিবাজির অভ্যাসটা যায় নাই। বুঝো চোদন।”
মন খুলে হাসলো বন্ধুদের দলটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে তাদের মধ্যে অনেকদিনের জমে থাকা রাগ। এরা ক্লাসে ভালোমতো পড়ায় না। প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোয় গিয়ে কনসাল্ট ‘মারায়’। কথায় কথায় ছাত্রদের তাচ্ছিল্য করে। নিয়মনীতি দেখায় এমন ঢঙে যেন নিজেরা সাচ্চা মহাপুরুষ। এদের একজন ‘অসামাজিক কাজ’ করতে গিয়ে ধরা খেলে বাকিদের মন ভালো হয়ে যাওয়ারই কথা। বারুদে আগুন ধরানোর জন্য মাজহার পরের তথ্যটা দিলো, অবশ্যই গলা নামিয়ে।
“মাইয়াটাও আমাগো ভার্সিটির। শায়লা নাম। শুনছিলাম ক্যারেক্টার নাকি সুবিধার না। মাগির বিশাল বুক দেখে আমি অবশ্য বুইঝা লইছি, যা রটে তার কিছুটা তো…”
মাথা নাড়তে নাড়তে সিগারেটে টান দিলো তরিকুল, “ভালো ক্যারেক্টারের মাইয়া চোদাচুদি করতে গিয়া ধরা খায় না।”
মাথা দুলিয়ে তার কথায় সায় দিলো কাঞ্চন।
“এইসব কইরা আমাগো ভার্সিটির ইজ্জতটাই কিন্তু ডুবাইতেছে।” বিরক্ত মুখে বললো সে, “আমাদের একটা কিছু করা দরকার। সিক্রেট গ্রুপে পোস্ট চালাচালি কইরা লাভ হইছে কিছু? দুই দিন পর পর ক্যাম্পাস নিয়া নতুন স্ক্যান্ডাল। এইসব থামাইতে হইবো।”
মাজহার তরিকুলের হাত থেকে সিগারেটটা নিতে নিতে একমত হলো, “থামাইতে তো হইবোই। ভার্সিটি চোদাচুদির জায়গা না।”
ওরা কেউ লক্ষ্য করলো না, সামান্য দূরে পাতলা টি শার্ট পরা একটা ছেলে পায়ের ওপর পা তুলে চা খাচ্ছে। অন্য হাতে সিগারেট। এই ছেলের চোখ দেখা যাচ্ছে না। চোখ আর চশমা ঢেকে গেছে লম্বা চুলে। চোখ আর চশমা না দেখা গেলেও এই ছেলেকে ক্যাম্পাসের অনেকে চেনে। চেনে তার অদ্ভুত নামটির জন্য, কিংবা গিটার-গড পরিচয়ের কারণে। লুসিফ্যান নামক ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা এবং ভোকাল সে। নিজেকে পরিচয় দেয় ‘আব্যাডন’ বলে। তার আসল নাম ভার্সিটির ছেলে মেয়েরা অনেক আগেই ভুলে গেছে।
সিগারেটে চুপচাপ টান দিতে থাকা গিটার-গডের মাথাতেও তখন একই চিন্তা চলছে, “কিছু একটা করতে হবে।”
***
“শালার পুতেরা, মোনাজাত ধর।” ক্যান্টিনে ঢুকে জানালার ধারে টেবিলেটায় আছড়ে পড়লো মিথুন, “মোনাজাত ধর, শালার পুতেরা!”
হেসে ফেললো বর্ষা, “কি রে? কি হইলো আবার?”
“এক্কেবারে মার্ডার হইয়া গেছে ঘটনা। মোনাজাত ধর সবাই।” উজ্জ্বল একটা হাসি হেসে বর্ষা-শাফিনের সামনে এঁটে বসলো। নির্লজ্জের মতো ভাগ বসালো সামনের সিঙ্গারায়। “পুরা ক্যাম্পাসে যা যা চলতেছে রে ভাই, পুরা ড্রামা। পুরাই ড্রামা। বার্নার্ড শ’ ফেল!”
“তপু স্যার আর শায়লা ম্যামের ঘটনাটা তো?” উৎসাহ দেখালো না শাফিন, “নোংরা একটা ব্যাপার। শুনতেছি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে একটা স্টেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলতেছে। ফ্যাকাল্টিরে মাইরা বসলো ফার্স্ট ইয়ারের পোলাপান…”
“কি বলো!” প্রতিবাদ করলো বর্ষা, “শুধু ‘মাইরা বসলো’? যেমন তেমন মেরেছে? চড়-থাপ্পড়? স্যার এখনও আইসিইউ-তে। এভাবে কেউ কাওকে মারে নাকি স্রেফ হাত ধরার অপরাধে? আমি বুঝি না, এই ছেলেগুলো নাকি আমাদের ভার্সিটিতে পড়ে! ছিহ!”
“বর্ষার ধারণা, অ্যাডমিনস্ট্রেশন থেকে কোনও স্টেপই নেওয়া হবে না।” মাথা নাড়তে নাড়তে সিঙ্গারায় কামড় বসালো শাফিন। তার কণ্ঠ অস্পষ্ট শোনায়, “ছেলেগুলো জাস্টিস লীগ করে তো। ওদের ক্যামনে আর শাস্তি দেয়।”
জাস্টিস লীগ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী এক ছাত্র সংগঠন। আগে অন্য নাম ছিলো। বড় বড় অর্জন ছিলো। মহান নেতারা ছিলেন। দলটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিলো। নামটা শুনলেই বাঙালির মাথা নত হয়ে আসতো শ্রদ্ধায়। সত্যিকারের গ্রীক দেবতারা ছিলেন তাদের নেতা-কর্মী। সময়ের সাথে বিবর্তন ঘটেছে দলটির। এখন তারা নিজেদের নাম পাল্টে রেখেছে জাস্টিস লীগ। প্রতীকও পাল্টেছে। হাতুড়ি। স্টুডেন্ট ইউনিয়নে নির্বাচনের সময় পোস্টার অনেক দেখা যায় আজকাল, হাতুড়ি মার্কায় ভোট দিন। এই বিষয়টা এক ঘোরতর রহস্য। নতুন খোলা ক্রিমিনোলজির বাঘা বাঘা প্রফেসররাও এই রহস্যের সমাধানে অপারাগ। জাস্টিস লীগে থরের প্রতীক হাতুড়ি কি করে? থর তো জাস্টিস লীগের কেউ না! অবশ্য এর পেছনে লম্বা এক ইতিহাস আছে। সেই প্রসঙ্গ ভিন্ন। এই মুহূর্তে মিথুনের মুখে হতাশার ছায়া পড়ে।
“জাস্টিস লীগ হইছে তো কি হইছে? টিচার কোপাবে তাই বলে?”
“আরে,” মিথুনের অজ্ঞতায় বিরক্ত দেখায় শাফিনকে, “কয় বছর আগে বুয়েটেই তো মারলো প্রফেসররে ধইরা। জাস্টিস লীগের বিবৃতিতে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা খর্ব করায় প্রফেসরকে মারা হয়েছে। জাস্টিস লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কোনও আপোষ করতে পারে না। ব্যাস, সব ঠাণ্ডা। হইছে কারও বিচার? ছাত্রত্ব গেছে কারও? ঐ ছাত্রদের একজন সামনে নাকি এমপি হইতেছে। এই এদের থেকেও দেখবি দুই চারজন পলিটিক্সে ভালো শাইন করবে।”
বর্ষা যোগ করলো, “সেইটা যেন করতে পারে তাই তারা একটা পলিটিকাল ফ্লেভার ঢুকায়া নিবে। এটা কোনও ব্যাপার না। তপু স্যারের ব্যাপারে যা শুনলাম, বামপন্থী লোক। মুক্তমনা ধরণের আরকি। ঐদিকে স্টুডেন্ট ইউনিয়নে তো বামঘেঁষা লোকজন ভালো ফর্মে আছে। এই সব ঘোঁট পাকায়া একটা পলিটিকাল কিছু তারা বানায় নিবে। গাধা পানি খায় ঘোলা করে। আর জাস্টিস লীগ খায়…”
সভ্য সমাজে বলা যাবে না এমন একটা নোংরা বাক্যাংশ বেরিয়ে এলো বর্ষার মুখ থেকে। মিথুনের মতো সহজ সরল ছেলেটির কানও গরম হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করলো সে, “এতো সহজ হবে না রে এইসব ধামাচাপা দেওয়া। খুব বাজেভাবে মেরেছে। আর শায়লা ম্যামেরও গায়ে হাত দিয়েছে। পোলাপান অনেকেই ক্ষেপে আছে। এরা নাকি এর একটা উপযুক্ত বিচার চাবে।”
হাত নেড়েই কথাটা উড়িয়ে দিলো শাফিন, “বিদ্যাসাগর হলের একটা ছেলেও ঐ আন্দোলনে যাবে না। ঐখানকারই পোলাপান তো সব। তারপর আছে ক্যাম্পাসের বুক-পাছা দেখে বেড়ানি জনগণ। এই শালারা এই ঘটনা থেকে মজা নিবে। পিয়ার প্রেশার ফিল করবে না। তাই নামবেও না। কারণ পাছা দেখা অনেক ছেলে আছে এখানে। নিজেদের নোংরা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ব্যক্তিগত জীবনে একটা প্রেমিকা জোটাতে পারেনি, অন্যদের প্রেম দেখলে এদের গা জ্বালা করে। নারী-পুরুষ ইস্যু না? এরা অনেকদূর নিয়া যাবে জিনিসটাকে। আর তারপর পাবে সেক্সের গন্ধ। সেক্সের গন্ধ পেলে এরা রাস্তায় নামবে না। অন্য ইস্যু হলে নামতো। দেখবা হাতে গোণা কয়টা গিয়া খাড়ায়া আছে। জাস্টিস লীগ এগোরে পিডায়া খেদাইবো। হাতুড়ি প্রতীকের জন্মের সময়কার কথা মনে আছে না?”
“এইটা একটা ভালো সমস্যা।” একমত হলো মিথুন, “কথা ঠিক। ছেলে মেয়ে একসাথে মিশা নিয়া, প্রেম নিয়া ঝামেলা হইলে পোলাপান হোগার মতো দুই ভাগ হইয়া যায়, বাল। আমি আশা করতেছি যে ঘেরাও হইলে যামু। আর কেউ না আসুক।”
শাফিন-মিথুনের এই বিশাল লেকচারের ফাঁকে বর্ষা তার স্মার্টফোনে ঘাঁটতে শুরু করেছিলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ওদের আলোচনা টুটিয়ে দিয়ে চিল-চিৎকার করলো সে, “মোনাজাত ধর, শালার পুতেরা। এইটা কি ছিলো রে ভাই!”
“কি হইছে, কি হইছে?” করে দু’জনই মাথা ঢুকিয়ে দিলো ওর স্ক্রিনের দিকে।
বর্ষার চোখ তখন ভাসা ভাসা হয়ে উঠেছে, “লাভ ইউ, আব্যাডন। লাভ ইউ।”
প্রেমিকার মুখে অন্য ছেলেকে নিয়ে এমন সরল স্বীকারোক্তি শুনেও আপত্তি জানালো না শাফিন। আসলে আপত্তি তোলার মতো অবস্থাই নেই তার। চোয়াল ঝুলে পড়েছে রীতিমতো। মিথুনের চোয়াল কেবল ঝুলেছে তাই নয়, মৃদু একটা চিৎকার করে উঠলো সে, “ওহ মাই… ফাক!”
জ্বলজ্বলে অক্ষরগুলো স্ক্রিন থেকে সরাসরি তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। একটা ইভেন্ট।
হোস্ট, আব্যাডন। সময়, আগামিকাল সকাল দশটা।
স্থান, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র।
“প্রকাশ্যে আলিঙ্গন ও চুম্বন অনুষ্ঠান – প্রতিবাদটা হোক এভাবেই।”
৩.
“মুরতাদ। মুরতাদ।” খুব শান্ত কণ্ঠে বললো মাজহার। মনোযোগ দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে, “আব্যাডন হইলো গিয়া মুরতাদ। নামটা কি রাখসে খেয়াল করো নাই?”
মুখ বাঁকালো কাঞ্চন, “আসলে নাম হয়তো ছিলো আবেদীন কিংবা আব্বাস উদ্দীন। সেইটা এডিট মারাইছে আরকি। এইটা সবাই করতাছে আজকাল। নামটা লইছে পশ্চিমা।”
“আরে সেটা সমস্যা না। পশ্চিমা হইলে আর এমন কি হইতো? এখানে ঘাপলা আরও বড়। ওয় তো ব্যান্ড করে একটা। লুসিফ্যান। এরা হইলো শয়তানের ভক্ত। সে বাজায় গিটার। আবার তারে লোকজন কয় গিটার-গড। এইসব দেইখা আমার খটকা লাগছিলো। আব্যাডন নামটা নিয়া গুগল কইরা দেখলাম।”
“কি পাইলি?” নিজের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জানতে চাইলো তরিকুল।
“আব্যাডন হইলো শয়তানের একটা নাম। লুসিফার কিংবা মর্নিংস্টারের মতোই। শালার কারবারটা দেখসো? প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়া বেড়াইতেছে সে শয়তানের ফ্যান। নাম নিসে শয়তানের। নিজেরে কয় গড। এখন দ্যাখো, ধর্ম আর কালচারটারে নষ্ট করার জন্য আইসা পড়ছে ওপেনে কিস করার ইভেন্ট নিয়া। খানকির পোলা একটা।”
বাকি দুই বন্ধু একমত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের দেখা গেলো নতুন নতুন সিগারেট ধরাচ্ছে। মামার কাছে চায়ের আবদার করছে। কাঞ্চন তার বান্ধবীর স্তন নিয়ে কৌতুক করছে। এসবের মধ্যে তারা খেয়াল করতে ভুলে গেলো, ওদের কেউ-ই খুব বড় রকমের ধার্মিক নয়। কোনও কিছু ঘটানোর মতো ক্ষমতাও তাদের নেই। চায়ের দোকানে বসে পরিচিত মেয়েদের নিপল বা ব্রায়ের ফিতা নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে অবশ্য ওরা বেশ দক্ষ। সুরসুরিটা বেশি আসে। একটা অন্যায় ঘটে গেলে সেটায় চরিত্রের দোষ খোঁজাই তো ভালো। তাহলে এ নিয়ে কোনও সত্যিকারের কাজ করতে হচ্ছে না তাদের। ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে ডাক দেওয়া মানুষটার নাম আর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে মন্তব্য করাই সহজ। তাহলে ওদের আর রাস্তায় নামতে হচ্ছে না।
“মামা, আরেকটা বেনসন দাও।” টঙওয়ালার উদ্দেশ্যে বললো মাজহার।
***
“অসম্ভব!” ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে বসে তীব্রবেগে মাথা নাড়লো বর্ষা, “পাবলিক প্লেসে আমি তোমাকে চুমু খেতে পারবো না।”
“খাওয়া উচিত আমাদের।” বর্ষার হাত ধরে চাপ দিলো শাফিন, “আড়ালে যেমন ক্ষ্যাপাটেদের মতো খাও তেমনটা না হোক-” প্রেমিকার দৃষ্টি দেখে দ্রুত জিভ কাটলো শাফিন, “বলছি না যে অমনটা আমার খারাপ লাগে। জানোই তো তোমার এই ব্যাপারটা আমার কতো পছন্দের। এমন লুক দাও কেন?”
মাথা নাড়লো বর্ষা, “লোক দেখানোর জন্য প্রেম? ক্যামেরা কতো থাকবে জানো? দেখে ফেলবে সবাই, রেকর্ড হয়ে থাকবে -”
হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলো শাফিন, “ধুর। সংবিধানবিরোধী কিছু করছি নাকি আমরা? সফট কিস। ওরকম এক্সাইটেড কিস করতে বলছি না তো। আব্যাডন ভালো একটা ইভেন্ট করছে। এটার সাথে আমাদের থাকা উচিত। হাত ধরে দলে দলে যাওয়া উচিত। সবার সামনে, ক্যাম্পাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরা উচিত গার্লফ্রেন্ডকে, চুমু খাওয়া উচিত। এর চেয়ে বড় জবাব আর হতে পারে না ওদের অন্যায়ের। এই যুদ্ধ হাতুড়ি-চাপাতির না। এই যুদ্ধ ভালোবাসার। ব্যক্তির স্বাধীনতায়।”
চুপ করে থাকলো বর্ষা।
“দেখো। আমাদের এখানে কোনও দাবী নেই। আমরা কোটার সংস্কার চাইছি না। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির জবাব চাইছি না। সরকার বা জাস্টিসলীগের কারও কোনও কাজ বাড়াচ্ছি না। আমরা চাইছি আমাদের হাত আর ঠোঁট কোথায় থাকবে সেই ব্যক্তিগত অধিকারটা আমাদের হাতেই রাখতে। জাস্টিসলীগ ক্যাম্পাসের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এখন। ওরা যেন আমাদের হাত আর ঠোঁটটাও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।”
“কিন্তু বাসায় দেখে ফেলবে যে?” মিনমিনে কণ্ঠে বললো বর্ষা।
“দেখুক। অস্তিত্বের প্রশ্ন এটা। ছোটখাটো বিষয় তো স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। এই প্রতিবাদটার মতো ভালো আইডিয়া বাংলাদেশে অনেকদিন আসেনি। ভাগ্য ভালো আমাদের একজন অ্যাবাডন ছিলো। এই সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে।”
কোথা থেকে যেন মিথুন এসে হাজির। ওদের দেখে মলিন মুখে হাসলো, “বল তো এখন এক রাতের মধ্যে গার্লফ্রেন্ড পাই কই? কথা দিলাম যে অ্যাডমিন বিল্ডিং ঘেরাও হইলে আমিও যামু। সেইখানে আব্যাডন কয় এইটুকুয় হইবো না। চুম্মাচাটি করা লাগবো। কি জ্বালা।”
হাসলো শাফিন, “চুম্মাচাটিই ক্যান করা লাগবো? কোনও ফ্রেন্ডকে জড়ায় ধরিস। কেয়া সিঙ্গেল তো। ওরে পার্টনার হিসাবে চুজ কইরা নিয়া যা। নাহলে বয়ফ্রেন্ডের দৌড়ানিতেই আন্দোলন ছুটে যাবে। জাস্টিস লীগকে আর হাতুড়ি মার্কা নিয়া আসতে হইবো না।”
“কেয়া কি রাজি হইবো! আরে বাল, সমস্যা হইলো গিয়া, আব্যাডনের আইডিয়া সবার কাছে জোস লাগছে। কিন্তু মাইয়াগুলা রাজি হইতেছে না। চিপাচুপিতে গিয়া বয়ফ্রেন্ডের ঠোঁট কাইটা ফেলবে, কোনও সমস্যা নাই। একটা ভালো উদ্দেশ্যে এখন পাবলিকে আলতো চুমু খাওয়া লাগবে, এতে করে সবার জাত-ধর্ম সব যাইতেছে। নো অফেন্স, বর্ষা।”
“না, সমস্যা আছে আমাদের কিছু। তুই বুঝবি কি? তুই কি মেয়ে? আমরা একটা সোসাইটির মধ্যে চলি। সোসাইটিতে আমাদের ফ্যামিলি মেম্বাররা চলে-”
“সোসাইটির পুটকি মারার আয়োজন করাই হইতাছে। সোসাইটি মারাইতে গিয়াই বহিরাগত খেদাও, মাইয়া-পোলারে একসাথে ঘুরা ঠেকাও কার্যক্রম শুরু হইছিলো। হেই কাম করতে গিয়া তোমরা আবার সোসাইটি টানলে কেমনে হইলো? মানে, জাস্টিস লীগের দেওয়া শাহবাগী বিরিয়ানি খাইয়া জাস্টিস লীগের কামের প্রতিবাদ করবা? এইটা কেমনে?”
একটু এগিয়ে এসে গলা নামালো মিথুন, “আরে ভয় পাইতেছিস, শাফিনের লগে ব্রেক আপ হইয়া গেলে তোদের কিসের ভিডিও নিয়া ঝামেলা হবে? পরে আর বয়ফ্রেন্ড পাবি না? আমার কাছে আইসা পড়িস। মেয়ে আগে কারে কই কিস করলো এইটা নিয়া ভাবে না এমন কয়েক হাজার পোলা চিনি আমি।” চোখ টিপলো ও।
পিত্তি জ্বলে গেলো বর্ষার, শাফিনের হাত খামচে ধরলো মেয়েটা, “আমাদের ব্রেকআপ হবে না, গাধাচোদা। কালকে যাইতেছি আমি, দেখিস। ক্যামেরার সামনে চুমু হয়তো খাইতে পারবো না, কিন্তু শাফিন ঠিকই বলসে, চুম্মাচাটিই ক্যান করা লাগবো? আমি ওকে জড়ায় রাখবো। দেখি কোন শালা আমাদের ছুটাইতে আসে।”
“দ্যাটস দ্য স্পিরিট!” দুই হাত দিয়ে শাফিন-বর্ষার দুই কাঁধে চাপড় দিয়ে সোল্লাসে বলে উঠলো মিথুন।
কিন্তু ঘটনা এতো সহজে ঘটানো গেলো না পরদিন।
৪.
“হ্যাঁ, অনেকেই বলবে এটা একটা মুসলিমপ্রধান দেশ। হিন্দুরাষ্ট্র ভারতের উদাহরণ টানাটা বাড়াবাড়ি।” চুল আর চশমার ওপাশ থেকে টিভি রিপোর্টারের ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো অ্যাবাডন, “কিন্তু আমি ভারতের উদাহরণই টানবো। কারণ, মুখে যতো যাই বলুক, আমাদের সাথে ওদের লাইফস্টাইল আর বিশ্বাসে তেমন একটা পার্থক্য নেই। যেটা আমি করতে চাইছি – তা ওরা করে দেখিয়েছে। দমদম স্টেশনের কথা বলছি।”
রাত নেমে এসেছে বাইরে। আগামিকাল বিগ ইভেন্ট। আব্যাডনের এই ঘরটিকে স্টুডিওর রূপ দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। আব্যাডন যখন বিরতি নিলো, সাংবাদিকদের কেউ তাকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করার চেষ্টা করলো না। ছেলেটার বয়স কম, কিন্তু কেমন যেন প্রবীণ প্রবীণ একটা ভাব তার মধ্যে আছে। দরকারের বেশি একটা শব্দ করে না সে। এই এক বৈশিষ্ট্যের কারণেই তার সঙ্গে পরিচয়ের পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাইকে শ্রোতার ভূমিকায় চলে যেতে হয়। এই সাংবাদিকও তার ব্যতিক্রম নয়।
“৩০শে এপ্রিল রাত দশটার ঘটনা, ২০১৮-এরই। ট্রেনের প্রেমিক-প্রেমিকার এক জুটি যাচ্ছিলো। ওরা একে অন্যকে জড়িয়ে রেখেছিলো বলে বুড়োদের কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হয়। বাঙালি কালচার না তো এমনটা!” তিক্ত হাসি হাসলো আব্যাডন, রাত সাড়ে দশটায় যখন প্রচার করা হবে ভিডিওটি- এই হাসি অনেকের বুকে গিয়ে বিঁধবে। “ওরা সেই প্রেমিক-প্রেমিকাকে খুব মেরেছিলো। কথা কাটাকাটি থেকে শুরু, তারপর মারধোর। কলকাতা তোলপাড় হয়ে গেছিলো সেই ঘটনায়। কলকাতাবাসী কি করেছিলো আপনারা জানেন? তাঁরা কি হাইকোর্ট ঘেরাও করেছিলেন? উঁহু।”
সাংবাদিকদের কাজই সংবাদের কাছাকাছি থাকা। এই ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকেই জানেন দমদম স্টেশনের সেই জড়িয়ে ধরার ঘটনার পর ঘটা অন্যায় মারধোরের প্রতিবাদ কিভাবে হয়েছিলো। কিন্তু তারা কথা বললেন না। আব্যাডন খুব এনগেজিং ভঙ্গিতে কথা বলছে। এই প্রশ্নটাও সে ধারারই ছিলো, উত্তরের আশায় এই প্রশ্ন সে করেনি। এই ভিডিও ভাইরাল হবে, ছেলেটা কথা বলতে জানে। সেই সাথে এক্সপ্রেশন! সাংবাদিকদের টিম লিডার জিভ দিয়ে নিজের লিপস্টিক চাটলেন। এটা একটা সফল কাজ হতে যাচ্ছে।
“পরদিনই তারা প্রতিবাদে নামে। শিরোনাম ওভাবে ঠিক করা হয়নি, আবার হয়েছিলোও। এটাকে এখনও মানুষ মনে রেখেছে ‘হোক আলিঙ্গন’ নামে। ওখানে পাবলিক প্লেসে প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরার জন্য সবাইকে আহ্বান করা হয়েছিলো। মানুষ সাড়া দিয়েছিলো। স্লোগান উঠেছিলো – ‘আমার শরীর, আমার মন, দূরে হঠো রাজ শাসন।’ আপনারা কি জানেন যারা নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে অন্যকে বাঁধা দেয় তাদের একটা সুন্দর নাম আছে?”
সাংবাদিকদের দলটা এবারও কোনও কথা বললো না। টিম লিডার খেয়াল করলেন এবার তিনি অজান্তেই লিপস্টিক চেটে ফেলেছেন। এই ছেলেটার কি গার্লফ্রেন্ড আছে? থাকার কথা। এমন জিনিস ফাঁকা পাওয়া কপালের ব্যাপার। কিন্তু মিউজিশিয়ান মানুষ। হতে পারে গ্রুপিজদের সাথে রাত কাটায়। ধরাবাঁধা কেউ থাকে না সাধারণত এদের। বিষয়টা দেখতে হবে, মনে মনে ভাবলেন তিনি।
“যে কোনও ধরণের নৈতিকতা নিয়ে যারা শাসনে নামে, তাদের একটা নাম আছে। ‘নীতিপুলিশ।’ কেউ হয়তো আপনাকে বলবে, বইপত্রে পা লাগিও না। এতে করে বইয়ের অসম্মান হয়। ইনি একজন নীতিপুলিশ। যে কাজে অন্য একটা মানুষকে অসম্মান করা হচ্ছে না, স্রেফ প্রথাগত কারণে তিনি আপনাকে বাঁধা দিতে এলেন। এরা সবাই নীতিপুলিশ। বইয়ে পা লাগাতে নিষেধ করা উজবুকটি হলেন সামাজিক নীতিপুলিশ। আবার দেখবেন কেউ কেউ আজ রাতে পোস্ট লিখবে, টকশোয় যাবে। বলবে, ইসলামের চোখে বেগানা নারীকে জড়িয়ে ধরা হারাম। তাই এটা করা যাবে না। ইনিও নীতিপুলিশ। ধর্মীয় নীতিপুলিশ। এসব নীতিপুলিশদের আমরা কাল সকালে দেখিয়ে দিতে চাই, তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা চলবো না।”
“নীতিপুলিশদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে কি? কারণ, আমার মনে হয় আগামিকাল তারা আপনাদের বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করবে।”
হাসলো আব্যাডন। ছেলেটার হাসিটাও সুন্দর। তলপেটে শিরশির করে উঠলো টিম লিডারের।
“নীতিপুলিশরা নিজেদের নীতি নিয়ে নিজেরা থাকুন। বইয়ে পা লাগালে যদি অসম্মান মনে হয়, তাহলে আপনি বইয়ে পা লাগাবেন না। আমি চাইলে বই নিয়ে ফুটবল খেলবো। আমাকে এটা বলতে আসার অধিকার আপনাদের নেই। পাবলিক প্লেসে কোনও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে যদি আপনার খারাপ লাগে, আপনি না খেলেন। আমার ইচ্ছে হলে আমি শালীনতার মধ্যে থেকে আমার প্রেমিকার সঙ্গে চুমু খাওয়া থেকে শুরু করে যা ইচ্ছে করতে পারি। আপনি আমাকে কিছু বলতে আসার অধিকার রাখেন না। ধর্মের দোহাই দিয়েও না। ইসলামে নিষেধ তো? আপনি মানুন। জান্নাতবাসী হোন। সবাই জান্নাতে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রেমিকার হাতে হাত রাখে না, ঠোঁটে চুমু খায় না। তাদের লক্ষ্য তাদের কাছে। ও নিয়ে তাদেরই ভাবতে দিন। আজ থেকে বাংলার মাটিতে নীতিপুলিশদের আর বরদাস্ত করা হবে না।”
সর্বশেষ প্রশ্নটা করার জন্য ছেলেটাকে থামালেন টিম লিডার। উত্তেজিত হয়ে বেশি কথা বলছে সে। পরে অনেক কিছু এডিট করতে হবে। সাড়ে দশটায় এটা একটা বোমার মতো যাবে।
“পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হচ্ছে। অনেকে এই আন্দোলনকে বলছেন প্রেম-আন্দোলন। ইতিবাচক মনোভাবও কিন্তু আমরা সোশাল মিডিয়াগুলোয় দেখছি। কিন্তু আপনি, এই আইডিয়ার জন্মদাতা, এবং আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, আপনি এই আন্দোলনটি থেকে কি অর্জন করতে চাইছেন?”
“আমি আসলে এই আইডিয়ার জন্মদাতা নই। দমদম স্টেশনের ঘটনা থেকেই বিষয়টা লক্ষ্য করেছি আমি। এটা স্রেফ একটা সফল পদ্ধতি। প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। আমি সফল এক পদ্ধতিতে হাঁটছি কেবল।” বড় করে দম নিলো আব্যাডন, “অর্জন? ভারতের আদালত থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, জানেন তো? প্রকাশ্যে একটা ছেলে একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে পারবে – সেই ঘোষণা। এটা কোনও অপরাধ নয়। রাষ্ট্র এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অন্য নাগরিকরাও নয়। আমরা যদি আগামিকাল ঠিকমতো আন্দোলনটা করতে পারি, এমন একটা ঘোষণা বাংলাদেশেও হবে। আসবে সর্বোচ্চ আদালত থেকে। এটা বাংলাদেশি কালচারে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় পজেটিভ চেঞ্জ হবে। আমাদের অর্জন কি হতে পারে টের পাচ্ছেন তো?”
সাংবাদিকদের দলটা চলে গেলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বেডরুমের দিকে রওনা দিলো আব্যাডন। মোবাইলটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে। নিয়ে দেখলো ছত্রিশটা মিসড কল। রেজিন।
রেজিন মেয়েটা আব্যাডনের সিক্রেট গার্লফ্রেন্ড। মিউজিশিয়ান হিসেবে আন্ডারওয়ার্ল্ড ব্যান্ডগুলোর মধ্যে তার একটা সুনাম আছে। এই সুনাম বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রকাশ্যে প্রেমিকা রাখা নিরাপদ নয়। সিঙ্গেল ভোকাল; গিটার-গড; আব্যাডন; লুসিফ্যান; — গুড ফর বিজনেস। একটা উপাদান নষ্ট হয়ে গেলে ব্যবসায়িক ক্ষতি। এই এক কারণে আজকে রাতের জন্য রেজিনকে তার হোস্টেলে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। টিভি সাংবাদিকদের সামনে পড়ে গেলে সমস্যা ছিলো।
টিভির ব্যাপারটা বুঝতে সময় লেগেছে আব্যাডনের। এই এক ইভেন্টের জন্য ক্যামেরাসহ জার্নালিস্টরা চলে এলো? একেবারে তার বাসা পর্যন্ত! এতোটা আশা করেনি আব্যাডন। কিন্তু সে জানে মিডিয়া কেন তার প্রচারে এমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ওরা বুঝতে পারছে এটা মনোযোগ পাবে। কিন্তু কেউ না জানলে কিভাবে মনোযোগ পাবে? তাই আগের রাতে এই স্পেশাল ইন্টারভিউ। স্পেশাল পাবলিসিটি। ওরা আসলে ঢাক পিটিয়ে আব্যাডনকে বন্দুকের সামনে পাঠাতে চায়। তাহলে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়তে থাকা আব্যাডনকে আরও বেশি মানুষ দেখতে পাবে। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে, যেখানে অডিয়েন্স আগে থেকে নার্চার করা যায়?
রেজিনকে কল ব্যাক করলো ও, “কি হয়েছে, বাচ্চা?”
বেবি বলে ডাকার থেকে ‘বাচ্চা’ বলে ডাকাটা ওদের কাছে বেশি রোমান্টিক মনে হয়েছে। শুরু থেকেই বাচ্চা বলে একে অন্যকে ডেকে এসেছে ওরা। অভ্যাসটা দুই বছর পরও রয়ে গেছে অদ্ভুতভাবে।
রেজিনের মিষ্টি গলাটা একটু কেঁপে গেল যেনো, “কই ছিলা তুমি?”
“ঐ জার্নালিস্টগুলো। এসে গেছিলো হুটহাট, যাকগে। কি হয়েছে বলো তো? এতোগুলো মিসড কল…”
“ওরা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে, বাচ্চা। এখন আমি কি করবো?”
আব্যাডনের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। রেজিনকে ওরা খুঁজে বের করে ফেলেছে! তা কি করে সম্ভব? হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না ওরা লিভ টুগেদার করে যাচ্ছে একটা বছর ধরে। কি আশ্চর্য!
“তুমি শিওর কি করে? ভুল হচ্ছে মনে হয় তোমার। আমাদের কথা জানার কথা না কারও।”
“এক ঘণ্টা আগে সাদা একটা মাইক্রো এসে থেমেছে আমার জানালা বরাবর রাস্তায়। দুটো লোক ওখান থেকে বের হলো। আমার জানালার দিকে সরাসরি তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। তারপর একজন ঢুকে গেছে ভেতরে। আরেকজন এখনও তাকিয়ে আছে। আমি লাইট নিভিয়ে বসে আছি। এখন আমি কি করি, বলো তো, বাবু?” মনে হলো রেজিন কেঁদে ফেলবে।
“বাচ্চা? আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো।” বলেই থেমে গেলো আব্যডন। ভেবে নিচ্ছে। “তোমার হোস্টেলে বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না। কাজেই ওরা আসতে পারবে না ভেতরে। আসলে ওরা তোমার রুমে আসতে চাইছে এমনও না। ওদের উদ্দেশ্য ভিন্ন।”
ওদের উদ্দেশ্য, আগামীকাল তোমাকে বেরিয়ে আসতে না দেওয়া। আন্দোলনে যাওয়া থেকে ঠেকানো। আমার জন্য তাহলে আরও ভালো ব্যবস্থা ওরা করে রেখেছে! — তবে এসব কথা মেয়েটিকে বললো না আব্যডন।
“তুমি স্রেফ ঘর থেকে বের হয়ো না। আগামিকাল আসার দরকার নাই। আমার মনে হয় কালকে এগারোটা-সাড়ে এগারোটার মধ্যে ওরা তোমার ওখান থেকে চলে যাবে। তারপর বেরিও।”
এগারোটা-সাড়ে এগারোটার ব্যাপারে আন্দাজে ঢিল মারেনি আব্যাডন। এক ঘণ্টা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে কাটাতে পারলেই ও একটা শক্ত অবস্থান গড়ে নেবে। তখন ঐ জমায়েতের জন্য হাতুড়ি নিয়ে আসতে হবে কাওকে। এমন দু’জন হাতুড়ি বাহক এখন রেজিনের জানালার নিচে বসে আছে। এই জনশক্তিকে কাল লাগবে। সেই সময় তাই তারা রেজিনের হোস্টেলের সামনে থাকতে পারবে না। ওদের আসতে হবে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রেই।
“নড়বে না। কালকে সকালের আগে বের হবে না। বাবু, বুঝতে পারছো আমার কথা?”
রেজিনকে শান্ত করে আরেকটা নাম্বারে ডায়াল করলো আব্যাডন।
“মিস অদিতি? একটু আগে আমার ইন্টারভিউ নিয়েছেন আপনি। প্লিজ যদি এখনও গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে না থাকেন তো একটা রিকোয়েস্ট… আমাকে ছোট্ট এক লিফট দিতে হবে…”
৫.
ছাদের ওপর থেকে মাথা বের করে নিচের ভিড়টাকে দেখলো ওরা দুইজন। একজনের পরণে নীল শার্ট। তিন দিন আগে সন্ধ্যায় এই ছেলেটা একটা সবুজ শার্ট পরেছিলো। হাতে ছিলো আধলা ইট। তপুর মাথার ভেতর খারাপ রকমের ইন্টারনাল ব্লিডিং হওয়ার পেছনে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এর। বন্ধুরা একে চেনে রাহাত নামে।
একটা মানুষ তার কারণে মরে যেতে পারে, তা নিয়ে রাহাতকে মোটেও বিচলিত হতে দেখা গেলো না। ছাদের ওপর পিচিক করে থুতু ফেললো তার বন্ধু। তার দিকে তাকানোর সময় চোখে ফুটে উঠলো উদ্বেগ, তবে এই উদ্বেগ হাসপাতালে শুয়ে থাকা কোনও মানুষের জন্য না।
“এই ধরণের মাতারিদের আমার পছন্দ না।” শক্ত মুখে বললো রাহাত।
“কোন ধরণের মাতারিদের তোর পছন্দ?” মুখ বাঁকিয়ে জানতে চাইলো জয়নাল। জয়নালের নামের মধ্যে প্রাচীনত্ব থাকলেও কাজকর্মে সে আধুনিক। টিশার্ট পরলে সেটার কলার কখনও ফেলে রাখে না। সাইকেলের স্প্রোকেট থেকে খুলে আনা চেইনের মতো দেখতে অলংকার তার পরণে থাকে। তপুকে প্রথম চ্যালেঞ্জ সে-ই করেছিলো।
“ঐবারের ঘটনা ভালো হইছিলো। ভর্তির প্রথা সংস্কারের একটা আন্দোলন হইলো না? লোকে চাইছে ‘সংস্কার।’ আন্দোলনে আইসা কইছে ‘সংস্কার।’ মনে যা, মুখে তা। এমন প্রতিপক্ষ হইলো গিয়া দুর্বল প্রতিপক্ষ। আমাদের সময় সেইরকম দুবলা লোকজন আন্দোলন চালাইবো ক্যান? আমাদের কপালে আছে আব্যাডনের মতো খানকি।”
“আব্যাডন ব্যাপার না। শালার আন্দোলন ঘুরায় প্যাঁচায়, মুচড়ায় মুচড়ায় তারই হোগা দিয়া ঢুকানির ব্যবস্থা কইরা ফেলছি। অলরেডি বায়তুল মোকাররমের ইমামের বাসায় উট পাঠানো হয়া গেছে। সারা দেশের মসজিদগুলায় ঝড় উইঠা যাবে। পিছের কারণটা ইসলামিক ভাবার কোনও কারণ নাই। পাবলিকের সাইকোলজিতে হাল্কা দোলা মাইরা রাখা আরকি।”
রাহাত একটা সিগারেট ধরালো, “বিপদটা বুঝতেছিস না তুই। আব্যাডন মোটা সুতা না। এ হইলো গিয়া চিকণ সুতা। ভর্তি প্রথা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা ছিলো মোটা সুতা। তাদের মতো করে এরে ট্যাকল করা যাইবো না। খেয়াল কইরা দ্যাখ, আব্যাডন একবারও আমাদের বিচার চায়া দাবী তোলে নাই। একটা বারও না। অথচ তার ধান্ধা ওটাই। এই শালা বিপদজনক। চাইতেছে আমাদের চুইদা দিতে, কিন্তু মুখে কইতাছে আরেকটা কথা। এই ধরণের মাতারি আমার পছন্দ না।”
“তাইলে তার লাভটা কি? এইখানে চুম্মাচাটির শো কইরা?”
“কালচার।”
“কালচার?”
“হ, কালচারটা পাল্টাইতেছে। যেই কালচারে মানুষ অটোমেটিক ধইরা নিবে যে এমন কাজ করলে বিচার হইতে হয়। তারপর নিজেদের পাছা বাচাইতে আমাদের খবর হইয়া যাবে।”
একটা সিগারেট এবার জয়নাল ধরালো। হাত যেভাবে চলে, সেভাবে তার মাথা চলে না। বন্ধুর বিভ্রান্তি বুঝতে পারলো রাহাত। ছাদের ওপরই বসে পড়লো একটা পাইপের ওপর।
“দ্যাখো, আজকে একটা বাচ্চারে তার বাপ-মাও যদি মাইরা ফালায়, এই ঘটনার বিচার চাইতে লোকজন লুঙ্গি খুইলা রাস্তায় নামবে। কোনও মাইয়ারে অ্যাসিড মারলে লুঙ্গি খুইলা রাস্তায় নামবে। অ্যাসিড প্রতিরোধের কালচার অবশ্য সরকারই গইড়া দিসিলো। কিন্তু কথা সেইটা না। সমাজের কিছু মূল্যবোধ থাকে। সেগুলা লঙ্ঘন করা যায় না। করলে আর কিছু করা লাগে না, এমনেই সমাজ পাছা মাইরা দেয়। তুই দরকারেও মসজিদ ভাঙ্গতে পারবি না। রেপ করতে পারবি না। এগুলা স্বীকৃত অন্যায়। কেউ করলে সহজে জনমত গইড়া তোলা যায়। দেশের বিশ কোটি লোক কইবো, হ, কামডা অন্যায়। কিন্তু কালচার না বানাইতে পারলে জড়াজড়ি, হাত ধরাধরির অধিকার বিশ কোটি লোক দিবো না। এইখানে এক কোটি লোক আইসা আমাদের বিচার চাইলেও বাকি উনিশ কোটির অসন্তোষের ভাইবে সেইটা না মানলেও চলবো। সব আন্দোলনে প্রেশারটা আসে যারা উপস্থিত নাই, কিন্তু সমর্থনে আছে – তাদের পক্ষ থেকে। বুঝতেছো রাজনীতিটা?”
মাথা দোলালো জয়নাল। কথা তার মাথার ওপর দিয়েই যাচ্ছে আসলে।
“বুঝলা না? আজকে এইখানে আব্যডন প্রেমিকারে জড়াইয়া দেখাবে এইখানে তারা এইটুকুই করতে চাইছে, তার বদলে মাইরা এদের মেডিকেলে পাঠানো হইছে। এইটা পুরা সোসাইটির জন্য বড় একটা ধাক্কা। ওপেনে চুম্মাচাটি এই দেশে আজও হয় নাই। মাঠ ফাঁকা। ফাঁকা মাঠে বল জড়ায়া দিতেছে আব্যাডন। চেঞ্জ আইবোই। এই কাহিনির পর সোসাইটিতে বড় একটা চেঞ্জ আইবো। সেইটার সুযোগ নিতে পারলে পরিস্থিতিত আব্যাডনের পক্ষে যাইবো, নাইলে আমাগো পক্ষে। ব্যাটা সোসাইটির নৌকায় ঢেউ তুলতেছে। মানে, এই শালা শক্ত চুতিয়া। এই ধরণের মাতারি আমার পছন্দ না।”
বন্ধুর কাঁধে দুইবার টোকা দিলো জয়নাল, “রিল্য্যক্স। নিচের ফ্লোরে চল্লিশজন পোলাপানরে গাঁজা আর মদ দিয়া বসায় দিসি। দরকার হইলেই এরা বাইর হইবো। টাল হইয়া আছে সব, বোধবুদ্ধি থাকবো না তখন। মাইরা যারে যেখানে পাইবো শোয়ায় ফালাইবো। সবার আগে শোয়ানো হবে আব্যাডনরে। দরকার হলে সেইটা আমরা করুম। এলাকায় অশ্লীলতার অভিযোগ আনুম মিডিয়ার সামনে। জাস্টিসলীগ তো আর হবায় বইয়া থাকবো না। ওদিকে মোল্লারা সমর্থন দিবে। পলিটিকাল কারণেই দিবে, অবশ্য লোকজন ভাববে ধর্ম রক্ষায় হুজুরেরা এসব কইতেছে। তারা সহমত পোষণ করবে। যা ভাবে তারা ভাবুক। সমর্থন পাইলেই হইলো আমাদের।”
উঁকি দিয়ে আরেকবার নিচের মঞ্চটাকে দেখে নিলো রাহাত। ওখানে এখন মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছে আব্যাডন। ছেলেটা আজ ব্যাকব্রাশ করে বেরিয়েছে। এই প্রথম ছেলেটার কপাল দেখতে পেলো কেউ। গ্রীক দেবতাদের মতো দেখাচ্ছে তাকে।
কালো টিশার্ট আর কালো জিন্সের গ্রীক দেবতার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো রাহাত। গতকাল রাতে একে আর এর প্রেমিকাকে সরিয়ে র্যাবের কাস্টোডিতে রাখার কথা ছিলো। কিভাবে যেনো ফস্কে গেছে এটা। তাও ভালো, এর প্রেমিকাকে আসতে দেওয়া হয় নাই। দেখা যাক শালা কাকে জড়িয়ে ধরে।
***
নিচে তখন অনেকগুলো মাইক্রো আর কাভার্ড ভ্যান। এরা নানা চ্যানেলের প্রতিনিধি। ক্যামেরার সংখ্যা মনে হয় মানুষের থেকে বেশি। সবার দৃষ্টি মঞ্চের ওপরের গ্রীক দেবতার ওপর নিবদ্ধ। আব্যাডন আজকে যেমন আগুনের হল্কার মতো তীব্র গলায় মানুষের উদ্দেশ্যে কথা বলছে, তেমনটা বলতো বটে কেউ। বলতো অনেকগুলো বছর আগে একজন। তখনও জাস্টিস লীগের নাম ছিলো আগেরটাই। গ্রীক দেবতাদের মতো নেতা ছিলেন। তাদেরই একজন বলে আব্যাডনকে ভুল হতে পারে।
“পাছায় কাপড় দিতে না পারেন, পাছাটা কই ফালামু সেইটা ঠিক করতে আইসেন না।” তর্জনী উঁচিয়ে মাইকে হুঙ্কার ছাড়লো আব্যাডন, “দেশের অর্থনীতি, শাসননীতি আর শোষণনীতি নিয়া আমি দুই ঘণ্টা কথা বলতে পারি। কিন্তু সেইটা আমি করুম না। আমরা চাকরির অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকারের মতো ভারী ভারী জিনিসে যাইতে চাই না। আপনাদের ভোট দিয়া নির্বাচিত করা হইছে, অর্থাৎ এইসব জিনিস নিয়া আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখছি। আপনারা যেইভাবে মন চায় দেশটা চালান।” আচমকা গলার লয় উঠে গেলো তার, “দেশ চালানোর স্বাধীনতা যেই রকম আপনাদের দিতেছি, তেমন আমরাও আমাদের জীবন চালানোর স্বাধীনতা নিমু। আপনারা দেশটা চালাইতে অধিকার পাইছেন, আমাদের চালানোর অধিকার কেবল আমাদেরই।”
লোকজন কোথা থেকে যেন আসছে। সাড়ে নয়টা বাজে। এর মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে মানুষ গিজগিজ করছে। এদের অনেকেই ছাত্র না। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের জুটিকেও দেখা যাচ্ছে। শাফিনের মন ভালো হয়ে গেলো। বর্ষাকে আজ শাড়িতে সুন্দর লাগছে। ওর আচল ধরে হাল্কা টান দিলো সে, “এই, দেখো। আংকেল-আন্টিরা পর্যন্ত চলে এসেছে। আমার কি যে ভালো লাগছে!”
বর্ষার রূপ বদলে গেলেও বক্তব্য পাল্টায়নি। মুখ বাঁকালো সে, “যে কোনও সময় দেখবা হাতুড়ি নিয়া আইসা পড়ছে জাস্টিস লীগের লোকজন। আন্টিরা তখন কি ঝামেলায় একটা পড়বে বুঝতেছো?”
“এই রিস্ক আছে জেনেই আসতেছে। সেজন্যই ভালো লাগতেছে।”
ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে যে কাজটা কখনও করা হয়নি, আজকে তাই করলো শাফিন। পরম মমতায় প্রেমিকার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলো। ঘটনা দেখে ত্রিশ ফিট দূরে দাঁড়ানো মিথুন মুচকি হাসলো। তার হাতে একটা সিগারেট। কেয়ার দিকে তাকালো সে, মেয়েটার মধ্যে কোমল এক স্নিগ্ধরূপ আছে। এটা সে আগে কেন কখনও খেয়াল করেনি? আজকের আগুনঝড়ানো কঠিন এক দিনে কেয়ার কোমল রূপ তার চোখে ধরা পড়ে কিভাবে? মানুষের মনস্তত্ত্ব কতোই না বিচিত্র উপায়ে কাজ করে। সিগারেটটা মিথুন ধরিয়েছে এই মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার মতো যথেষ্ট সাহস বুকের মধ্যে আনার জন্য।
সামান্য দূরে মাজহার আর তার দুই বন্ধুও সিগারেট ধরিয়েছে। ওরা এখানে আন্দোলনে যোগ দিতে আসেনি। ‘লাইভ’ কিস করার দৃশ্য দেখতে এসেছে। পরিচিতদের কেউ কেউ করবে। সেই দৃশ্য তো আর রোজ দেখা যাবে না। এমন অনেকেই এসেছে।
তরিকুল বললো, “মিল্কিকে স্লিভলেসে কি যে সেক্সি লাগতেছে। আমার উচিত ছিলো কালকে ওকে কিস-পার্টনার হওয়ার জন্য বলা। মাঝ দিয়া ছাগল তুহিন এসে ফ্লোর নিয়া গেলো।”
কাঞ্চন একমত হলো, “পাছাটা জোস।”
ওদের কেউ মনে করিয়ে দিলো না, এমন মন্তব্য ছুঁড়েই ওদের জীবন কেটে যাবে। অন্যদের নিয়ে গল্প করার অপার ক্ষমতা ছাড়া বিধাতা তাদের আর কোনও যোগ্যতা দেননি। চাইলে ওরা মিল্কি কিংবা পুনমের প্রেমিক হতে পারতো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারতো। মানুষকে ভালোবাসার, ভালোবাসা পাওয়ার মতো সুন্দর একটা ব্যাপারের সংস্পর্শে আসতে পারতো। প্রয়োজন ছিলো অন্যকে শ্রদ্ধা করার সামান্য এক গুণ। কিন্তু ভাগ্যদেবতা তাদের কপালে এই ছোট্ট গুণটুকু রাখেননি।
সাড়ে এগারোটায় শুরু করা গেলো আসল অনুষ্ঠান। অনেকে প্ল্যাকার্ড এনেছে। প্রেমিকার এক হাত, প্রেমিকের এক – দুই হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে অন্য দুই হাতে একে অন্যকে আলিঙ্গন করলো তারা। আজ বাংলাদেশ এমন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলো যা আগে কখনও ঘটেনি এই আকাশের নিচে। এটিএন বাংলার ক্যামেরাটা একেবারে নাকের সামনে, অথচ শাফিনকে আজ বড় মায়াময় মনে হলো বর্ষার। আঙুলের ডগায় ভর করে প্রেমিককে চুমু খেলো সে, চারদিকে তখন বৃষ্টির মতো নেমে এসেছে রৌদ্রচ্ছটা।
মাইকে আব্যাডনের বক্তব্য থেমে গেছে। ওপর থেকে এই অপরূপ দৃশ্যটি চোখ ভরে দেখতে থাকলো সে। সব বয়েসী জুটি একে অন্যকে আলিঙ্গন করছে। অতি সাহসীরা চুমু খাচ্ছে একে অন্যকে। মিথুন আর কেয়াকে দেখে ওর ভ্রু সামান্য উঁচু হলো। শালারা সুযোগে চুমু খেয়ে নিচ্ছে দেখা যায়! তাতে আব্যাডনের কিছু না। ওদের যদি ইচ্ছে করে একে অন্যকে খেতে, তো খাক। রিলেশনশিপে গিয়েই এসব করা লাগবে এমনটা কোন পাঠ্যবইয়ে লিখা আছে? সম্পর্ক সেন্সর করার সে কে? করলে তার সঙ্গে জাস্টিসলীগের পার্থক্য থাকলো কোথায়?
টিভি চ্যানেলগুলো পাগল হয়ে গেছে। তারা কোনটা ফেলে কোনটা কাভার করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আব্যাডন। কাজ হয়ে গেছে। এটা এখন থেকে পার্ট অফ দ্য কালচার। এর বিরুদ্ধে অনেক অনেক কথা হবে। তবে নতুন কিছু কালচারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য “বিরুদ্ধে অনেক অনেক কথা”ই প্রথম সাফল্য। যতো নিন্দিত হবে এই ইভেন্ট, ততোই সফল হয়ে উঠবে এটা।
পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম সেভাবেই সফল হয়েছে। কালচারে ঢুকেছে। সমাজের চোখে নিন্দিত হয়েই ঢুকেছে কালচারে। তারপর জনপ্রিয় হয়েছে সেই কালচার। এই ইভেন্টও হবে।
এই মতবাদে বিশ্বাসীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা যতো বেশি করা হবে, ততো দ্রুতই ছড়াবে এই বিশ্বাস। বড় বড় ধর্মগুলো ছড়িয়েছে অনুসারীরা পিটুনি খাওয়ার কারণে। আব্যাডন মানব মনস্তত্ত্বের গোড়ায় কুড়াল চালিয়েছে। এখন জাস্টিস লীগ তাদের ঠেকাতে পারবে না। কেউ পারবে না। এটা আপন গতিতে চলতে শুরু করলো এখানে, এই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে।
মঞ্চের ওপর থেকে সবকিছুই ভালো মতো দেখা যায়। খানিকটা পেছনে, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের দরজায় চোখটা পড়ে গেল তাই। অগোছালো ভঙ্গিতে কয়েকজন তরুণ বেরিয়ে এসেছে সেখান থেকে। আলিঙ্গনে ব্যস্ত ছেলেমেয়েরা এগুলো খেয়াল করেনি এখনও। আব্যাডনের মনে বিপদঘণ্টা ঢঙ ঢঙ করে বেজে উঠলো। ওটা কে? রাহাত না? নিষ্ঠুরতায় এই ছেলের জুড়ি মেলা ভার। শোনা যায় তপু স্যারের মাথা সে-ই ফাটিয়েছে। পুরো এলাকাটা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আব্যাডনের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো!
তার নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে নয়!
অনেকটা দূরে রিকশা থেকে নামছে একটা মেয়ে। টিশার্ট আর জিন্সে পরীর মতো লাগছে তাকে দেখতে। রেশমি চুলগুলো উড়ছে এলোমেলো বাতাসে। রেজিনের কয়েকটা চুল সাদা। রোদের উজ্জ্বলতা সাদা চুলগুলোয় সোনালি প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই মঞ্চ থেকে নেমে এলো আব্যাডন। পেছনে সারমেয় বাহিনী বিষয়টা লক্ষ্য করলো। তাদের হাঁটার গতি বেড়েছে। মূল লক্ষ্য শয়তানের পূজারিটা। শিকার পালিয়ে যাচ্ছে। রাহাত হুঙ্কার ছেড়ে তার কর্মীদের কিছু একটা বলছে। এতো কিছু শোনার সময় আব্যাডনের নেই। সামনে সময় টিভির একটা মাইক্রোফন, রিপোর্টারকে ধাক্কা দিয়ে নিজের পথ করে নিলো ও। কখন হাঁটার গতি বেড়ে দৌড়ে পরিণত হয়েছে নিজেও খেয়াল করেনি।
চুম্বনরত জুটিগুলোকে ব্যস্তভঙ্গিতে পার করলো সে। দৌড়ের গতিতে ব্যাকব্রাশের বাঁধন হারিয়ে কতোগুলো চুল নেমে এসেছে চোখের ওপর। কপাল আর গলার রগ ফুলে উঠেছে দুশ্চিন্তায়। গ্রীক দেবতারাও আব্যাডনের এই রূপ দেখলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। বয়ফ্রেন্ডের দিকে চোখ পড়ার পর চোখ নামিয়ে নিতে পারলো না রেজিনও। কিন্তু তার চোখে মুখে এমন আতঙ্ক ফুটে উঠেছে কেন?
প্রায় উড়ে গিয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো আব্যাডন। ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো নিজের বুকের নিরাপদ আশ্রয়ে। রাহাতের হাতের হাতুড়িটা প্রায় সাথে সাথে সজোরে আছড়ে পড়লো গ্রীক দেবতার মাথায়। সময় টিভির লাইভ ফিডে বিশ কোটি মানুষ দেখতে পেলো গ্রীক দেবতারাও রক্তাক্ত হতে পারে!
একটার পর একটা হাতুড়ির বাড়ি এসে পড়ছে আব্যাডনের শরীরে। নড়ে নড়ে উঠছে লুসিফ্যান ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা। যন্ত্রণায়, কিংবা তাকে ছাপিয়ে একটা টোকাও যেন বুকের মধ্যে থাকা মেয়েটির শরীরে স্পর্শ না করে সেই লক্ষ্যে। রেজিনের পিঠের দিকে ছুটে আসা হাতুড়ির আঘাতটা ঠেকানোর জন্য ডান হাত বাড়িয়ে দিলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
গিটার-গডের চারটা আঙুল এতো বাজেভাবে ভাঙলো, ছেলেটা মনে হয় না আর কোনওদিন গিটার বাজাতে পারবে।
= পরিশিষ্ট =
স্টেশনে একটা ছেলে শক্ত করে জড়িয়ে আছে ছোট্ট গড়ণের এক মেয়েকে। ভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। মেয়েটি বাড়ি চলে যাচ্ছে। আসন্ন বিরহের আশঙ্কা তাদের দু’জনকেই আবেগাক্রান্ত করে ফেলেছে।
যত্ন করে কেয়ার চুলগুলো তার কানের পাশে গুঁজে দিলো মিথুন, “ভালোভাবে যেও।”
“তুমি সাবধানে থেকো, মিথ। পিঠের কি অবস্থা?”
গা ঝাড়লো মিথুন, “অতো জোরে লাগেনি। আব্যাডনকে নিয়ে ভয়ে আছি। অবশ্য শালার শরীর লোহা দিয়ে বানানো। ঠিক সেরে উঠবে।”
“জানি না রে। ভয় করে। চৌদ্দটা হাড় ভেঙ্গেছে ওর। চৌদ্দটা!”
“আব্যাডনের স্যাক্রিফাইসের জন্য আন্দোলনটা সফল হয়েছে, কেয়া। ঐ চৌদ্দটা হাড়ের মূল্য দিয়েই সে আমাদের স্বাধীনতা কিনে নিয়েছে। স্বাধীনতা কেনার জন্য মূল্য চুকাতে হয়। রক্তের, অস্থির।”
চোখ মুছলো কেয়া, “জানি।”
বিশ্বব্যাপী আব্যাডন-রেজিনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো। রেজিন পুরোপুরি সুস্থ আছে। তাকে নিজের সবটুকু দিয়ে রক্ষা করতে পেরেছিলো আব্যাডন। তার ওপর এমন অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে পারেনি প্রকাশ্যে আলিঙ্গন বিরোধী মানুষগুলোও। মিথুন যখন মার খাচ্ছিলো, দুই চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে সে দেখেছে কিভাবে মাজহারের মতো মেরুদণ্ডহীন একটা মানুষ তার আক্রমণকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মাজহারের জন্যই আজ স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সে। নয়তো মাজহারের মতোই পাঁচটা ভাঙা হাড় নিয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হতো!
দুঃসময় মানুষকে পাল্টে দেয়। অথবা, মূল্যবোধের ঠিক জায়গাটিতে কুঠারাঘাত।
সঠিক জায়গাটিতে কুঠারাঘাত করতে পেরেছিলো আব্যাডন।
গতকাল আদালত থেকে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে এই দেশে প্রকাশ্য চুম্বন আর আলিঙ্গনকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। একে অন্যের হাত ধরার অপরাধে আজ থেকে এই বাংলার মাটিতে কাওকে লাঞ্ছিত হতে হবে না।
অ্যাবাডনের জন্য নয়, ব্যাপারটা সম্ভব হয়েছে সময়ের দাবী পূরণ করার মাধ্যমে। নতুন একটা কালচার সৃষ্টি হোক, নষ্ট কালচার ভেঙ্গে ফেলা হোক – এমনটাই ছিলো সময়ের দাবী। সময় গড়ে নিয়েছে আব্যাডনের মতো একজন নেতা। আরেকজন গ্রীক দেবতা।
কেয়ার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হলো মিথুন। গভীর ভালোবাসায় এক স্টেশনভর্তি মানুষের সামনে চুমু খেলো তার ঠোঁটে।
“কি করছো?” চোখ মুছে জানতে চাইলো মেয়েটি।
“বিজয়ের চিহ্ন এঁকে দিলাম।” ওর চুল এলোমেলো করে দিয়ে মিথুন বললো।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে বাহনটিকে দূরে সরে যেতে দেখলো মিথুন। ও জানে, সংস্কৃতির এই ট্রেনের মতোই। এগিয়ে যাবে সব সময়। স্থির হয়ে রইবে না। যখনই তা অকার্যকর হয়ে উঠবে, তপুর মতো কেউ মার খাবে, জন্ম নেবে আব্যাডনের মতো গ্রীক দেবতারা।
মানুষ জিতবেই!
#মানুষ_জিতবেই
রচনা : ১৫ই জুলাই, ২০১৮
(কিশোর পাশা ইমন)

** পরে এই গল্পের ছায়া অবলম্বনে আরো ৪টি গল্প, আমার জানামতে অন্যরা লিখেছেন, গল্পটা তাদের এতই ভালো লেগেছিলো। আমি এই গল্পটি এখনো কোনো বইয়ে ছাপাইনি, তবে তারা তাদের ওসব গল্প নানা বইপত্রে ছাপিয়েছেন। কেউ কেউ ক্রেডিট দিতেও ভুলে গেছেন।

মিথরাস 

বিশাল বাড়িটার সদর দরজাতে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখে চারপাশটা একবার দেখে ক্রিশ্চিনা।

ঘন কালো চুল ওর তবে ছোট করে কাটা কোঁকড়া চুলগুলো ফর্সা কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ডান হাতটা একবার ওই চুলে চালিয়ে ফিরে তাকায় ও জারাফের দিকে।

‘তুই শিওর?’ কটমট করে বয়ফ্রেন্ডের দিকে তাকায় ও।

জবাব না দিয়ে এক পা এগিয়ে বাড়িটায় ঢুকে পড়ে জারাফ। বিশাল বাসাটা এখন শুধুই ওদের। অন্তত উপস্থিতির দিক থেকে।

পোড়োবাড়ি বলে খ্যাতি আছে এই জায়গাটার। ঠান্ডা দৃষ্টিতে চারপাশে তাকায় জারাফ। শুভ্র মুখটা এখন বরফের মত চকচক করছে। দস্তানা পড়া হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসে ওর। ফিরে তাকায় ক্রিশ্চিনার দিকে।

‘বাচ্চাটাকে নিয়ে আয়। কুইক!’

বাড়িটার সামনে থেমে আছে কালো গাড়িটা। ওটার ট্রাংকে আটকে রাখা হয়েছে তিন বছরের একটা খ্রিস্টান মেয়েকে। পাঁচ মিনিটের মাঝেই ওকে নিয়ে ফিরে আসে ক্রিশ্চিনা। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে শিশুটি। মার্গারেট এর নাম জানে ওরা। তবে এখানে তার উপস্থিতিকে গায়ে লাগায় না জারাফ।

পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করেছে ওপরের দিকে। পিছু নেয় ক্রিশ্চিনা। একহাতে ধরে আছে মার্গারেটের একটা হাত।


এক

ক্লাসরুমে বসে দুই হাতের তালু ঘষছে নীরব। এসির ঠান্ডা বাতাস তার সহ্য হয় না।

সহপাঠীদের বলে লাভ নেই। সবগুলোর গন্ডারের চামড়া। ভবিতব্য ধরে নিয়েই এখানে বসে আছে ও।

প্রতিদিন তাই করে।

সহপাঠীদের দিকে এক ঝলক তাকায়। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ফারহা আর ইকরাকে দেখা যাচ্ছে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে কথা বলছে। এই মাত্র রোকনকে আঁচড়ে দিল প্রিয়াংকা। শাহেদ যথারীতি এই হট্টগোলেও একটা বই খুলে বসে আছে। ছেলেটা গল্পের বইয়ের পোকা একেবারে!

মৃদু হাসে নীরব ওদিকে তাকিয়ে।

তারপরই ওর চোখ পড়ে ক্রিশ্চিনার দিকে। মেয়েটা অসাধারণ দেখতে। ওকে দেখলেই বুকের ভেতরে একটা হাহাকার বয়ে যায় নীরবের। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে অন্যদিকে তাকায় ও।

ক্রিশ্চিনার বয়ফ্রেন্ড জারাফ মেয়েটার চুলে মুখ ডুবিয়ে কিছু বলছে, ক্লাসের মধ্যেই। গা জ্বলে যায় নীরবের।

তবে এখানে নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া নীরবের আর কি-ই বা করার আছে?

ও কিছু করেও না। হেলান দেয় নিজের সীটে। স্যার আসুক। ক্লাস শুরু হোক। তারপর হতচ্ছাড়া ইউনিভার্সিটিটা থেকে বের হয়ে যেতে পারলে হয়। এখানে আর মন টেকে না নীরবের।

আস্তে করে ওর পাশে চলে এসেছে দিনার। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ও।

ওর পিঠ চাপড়ে দেয় দিনার, ’খবর কি, ফ্রেন্ড?’

‘ভালো। খুব ভালো। তোমার?’ ভদ্রতা করে জানতে চেতেই হয় নীরবকে।

‘জোসিলা। দারুণ একটা জিনিস নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। আগের দিনই বলতাম কিন্তু কি একটা ঝামেলা শুরু হয়ে গেল দেখলেই তো!’

একটু বিব্রত বোধ করে এবার নীরব। গতকালকের ঘটনাটা খুব একটা গর্ব করার মত কিছু না।

ক্লাসমেট একটা ছেলের নাক-মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে নীরব। সুইমিং পুলের ধারে।

বিষয়টা কেউ তুলবে আজ ক্লাসে আসলে এটা আশা করেছিল ও। তবে ছেলেটা যে দিনার হবে সেটা আশা করেনি। এটা একটা কারণ বটে আজ একটু বেশিই চুপচাপ সবাই ওর প্রতি।

সায়েম ছেলেটা একেবারে নিখুঁত একজন প্লে বয়। ভার্সিটির মেয়েদের মাঝে একটা লিস্ট আছে তার। চার বছর পার হওয়ার আগে এদের সাথে সে অন্তত তিনবার করে বিছানাতে শোবে।

তেইশ জনের লিস্টের পনেরজনকে জিতে ফেলেছে সে।

অদ্ভুত ব্যাপার হল মেয়েগুলো জানত সায়েমের বেডলিস্টের কথা। তবুও তারা না করেনি। স্বেচ্ছায় এসেছে। ওদের চিন্তাভাবনা ছিল এক কাঠি সরেশ। তাদের প্রত্যেকের আত্মবিশ্বাস ছিল সায়েম তাদের সাথে একবার অন্তরঙ্গ হলে আর অন্য দিকে মন দিতেই পারবে না!

প্রত্যেকের ধারণাই ছিল ভুল।

‘কাজ’ হয়ে গেলে সায়েম নিত্যনতুন টার্গেট ধরে গেছে।

এবারের টার্গেট তার ভার্সিটির হটেস্ট মেয়েটাকে। মেয়েটির নাম ক্রিশ্চিনা। নীরব যার ওপর প্রথম দিন থেকে ক্রাশ খেয়ে বসে আছে।

সুইমিং পুলের ওখানে সায়েম যখন ক্রিশ্চিনার শরীর নিয়ে বাজে রসিকতা করে শোনাচ্ছিল তার বন্ধুদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল নীরব। বন্ধু কিরণকে খুঁজতেই পুলের এদিকে আসা। এসময় তার কানে চলে আসে সায়েমের রসিকতা।

নীরব ঠান্ডা চোখে একবার তাকিয়েছিল সায়েমের দিকে। দৃষ্টিটা খেয়াল করে উঠে এসেছিল সায়েমও। ঠাট্টার সুরে জানতে চেয়েছিল, নীরব এখনও অন্যের গার্লফ্রেন্ডের পেছনে ঘুর ঘুর করে কি না।

তারপর হাসিমুখেই ক্রিশ্চিনার সাথে মেলে এমন একটা নোংরা জোকস শুনিয়ে দেয় নীরবকে।

মাত্র দুইবার মেরেছিল নীরব ওকে প্রথমে পেটে তারপর মুখে। এতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় সায়েম।

সায়েমের সার্কেল এগিয়ে আসতে চাইলেও পরক্ষনেই থমকে যায়। নীরবের মত একটা ছেলে সায়েমকে দুই ঘুষিতে নক আউট করে দেবে এটা তারা ভাবেনি।

তবুও লাফিয়ে এসেছিল মিফতাহ একহাতে টেনে ধরে ছিল চলে যেতে থাকা নীরবের শার্ট বাম হাতটা ছিঁড়ে তার হাতে চলে গেছিল তখন।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর বুকে একটা ঘুষি বসাতেই নিঃশ্বাস আটকে যায় মিফতাহের। মারামারির সখ উধাও হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে।

কোনদিকে না তাকিয়ে চলে এসেছিল নীরব।

তবে দূর থেকে অনেকেই এটা দেখেছে। তাদের মাঝে যে দিনারও ছিল সেটা জানত না ও। এখন জানল।

ঝুঁকে পড়ে ও দিনারের দিকে।

‘লিসেন, সায়েমের মুখ ফাটানোর জন্য আমার কোন অনুশোচনা নেই। ওটা যদি জানতে চাও এটাই বলব।’

হাসে দিনার, ’আমারও নেই। আমার পছন্দের মেয়েটার সাথে একাধিকবার শুয়েছে বাস্টার্ডটা।’

অন্যদিকে তাকায় নীরব রাগত মুখ নিয়ে।

আঙুল ফোটায় দিনার, ’যাই হোক। আমি এখানে এসেছি তোমার সাথে ক্রিশ্চিনা মেয়েটাকে নিয়ে কথা বলা দরকার। তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন। গতকাল বাম হাতে একটা উল্কি দেখেছিলাম। আশা করছি তোমার থেকেই সাহায্য পাবো আমি।’

‘ক্রিশ্চিনা?’ চোখ কুঁচকে তাকায় নীরব।

‘হুঁ। ওর বাসায় গেছিলাম আমি কয়েকদিন আগে। একটা অদ্ভুত বিষয় দেখে এসেছি। একটা রহস্য তো আছেই। মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডকেও সুবিধের কেউ বলে মনে হয় না।’

একবার জারাফ আর ক্রিশ্চিনাকে দেখে নীরব। নিজেদের নিয়ে একেবারেই মেতে আছে ওরা। কোন দিকেই খেয়াল নেই তাদের!

দিনারের দিকে তাকায় আবার, ’এই যদি হয় তোমার মন্তব্য আমি বলব, আমি আগ্রহ বোধ করছি। কথা তো আর ক্লাসরুমে বলা যায় না। কোথায় বলবে?’

ইতস্তত করে দিনার, ’আমাদের একটা সোসাইটি আছে। সিক্রেট সোসাইটি। আসলে শুধু আমি না ওদের একজনের চোখেই প্রথমে অসঙ্গতি চোখে পড়ে। আমরা সেখান থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। তদন্ত চলছে। তোমাকে এর সভ্য করা যাবে?’

‘কেমন সোসাইটি?’ চোখ বাঁকা করে জানতে চায় নীরব।

‘এ-এম-এস। অ্যান্টি ম্যাজিকাল সোসাইটি। আমরা যাদুবিদ্যার বিরুদ্ধে। তবে ক্লাসের সবাই তা না। পৃথিবীতে এখন তো ওই দিকে ঝুঁকে পড়া মানুষের সংখ্যাই বেশি!’

ধীরে ধীরে মাথা দোলায় নীরব।

‘এই যদি হয় তোমাদের উদ্দেশ্য তাহলে আমি খুবই আগ্রহী। তোমাদের সাথেই আছি। কিভাবে সভ্য হতে হবে?’

‘হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবো তোমাকে আজ রাতে। প্রতিজ্ঞা করতে হবে ওখানে।’

‘অলরাইট।’ মেনে নেয় নীরব, ওদিকে ক্লাসে স্যার ঢুকে পড়েছেন।

সেদিকে মনোযোগ দেয় ওরা।


দুই

‘তোমার হাতের উল্কিটা দেখাও ওদের।’ হেডকোয়ার্টারে বসে হাসিমুখে বলে দিনার।

বাম হাতা গুটিয়ে সবাইকে দেখায় ওটা নীরব।

সবাই বিস্ময়সূচক একটা শব্দ করে।

ব্যাখ্যা দেয় দিনার, ’চমৎকার একটা উল্কি। এটাতে কিছু  ল্যাটিন আর কিছু সিম্বল আছে। এক কথায় যদি বলি, এখানে বলা হয়েছে, “যাদুবিদ্যার বিরুদ্ধে অশান্তির উর্ধ্বে”। আমার এরকম একটা উল্কি করানোর ইচ্ছে ছিল তবে সঠিক মাপ পাইনি। শুধু ইন্টারনেটে দেখেছিলাম এ জিনিস। প্রাচীন পুঁথিতে আঁকা, অ্যাকুরেট নয় কোনটাই।’

নীরব এসব শুনছে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের তিনজনের দিকে।

চঞ্চল প্রিয়াংকা, ভদ্র দিনার আর বইপড়ুয়া শাহেদ! এরা মিলেই কি না সিক্রেট সোসাইটি এ-এম-এস খুলে বসে আছে!

‘আমাদের কাজের কথাতে যাওয়া উচিত।’ বলে নীরব। একটু আগে সভ্য হয়েছে ও এই সংঘের।

‘হুঁ। প্রিয়াংকা, প্রথমে তুই বল। ক্রিশ্চিনা সম্পর্কে কি কি জানিস?’

ক্রিশ্চিনার নাম শুনেই বুকের কোথাও হাল্কা একটা খোঁচা অনুভব করে নীরব। মেয়েটাকে ও কতটা ভালোবাসে সেটা ও নিজে জানে। অন্য কেউ কি বুঝতে পারবে সেটা?

ক্রিশ্চিনার নামে ম্যাজিকের অভিযোগ শোনা যখন যাচ্ছে এখন নীরব আরও বেশি আগ্রহী। মেয়েটাকে রক্ষা করতে হবে।

‘ক্রিশ্চিনা মেয়েটা খ্রিস্টান। অথচ আচার আচরণে তাকে খ্রিস্টান বলে মনে হবে না। এই যুগে ধর্মকর্ম কেউই মানতে চায় না। আমি সে কথা বলিনি। সেটা বোঝাতেও চাইনি। বলছি যদি সে খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন হত তাহলে  মেনে নেওয়া যেত। তাকে অন্য কিছু নিয়ে উৎসাহী দেখা যায়। সেটা খ্রিস্টধর্ম না।’

দুই হাত এক করে নীরব, ’সেটা কি?’

শুন্য দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়াংকা, ’আমি জানি না ঠিক। তবে সূর্যের প্রতি মেয়েটার দুর্বলতা আছে। সবার চোখের আড়ালে তাকে স্যালুট করতে দেখেছি। সূর্যের দিকে মুখ করে।’

‘আচ্ছা।’ মাথা দোলায় নীরব।

বাকিরা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আগে থেকেই জানে ওরা এসব বুঝতে পারে নীরব।

তবে ওদের কাছে খুব সম্ভব কোন ব্যাখ্যা নেই।

‘আরও কিছু আছে তো মনে হয়। ব্যাখ্যা দেবে এবার দিনার। তুমি বলেছিলে, ক্রিশ্চিনার বাসাতে গিয়ে এমন কিছু দেখে ফেলেছ যা তোমার মাঝে সন্দেহের উদ্রেক ঘটিয়েছে?’

নড়ে বসে দিনার, ’হুঁ। ক্রিশ্চিনা আর আমার বাসা পাশাপাশি। ছোটবেলা থেকেই আমি ওকে চিনি। তবে সেরকম বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতা কোনদিনই গড়ে ওঠেনি। সেদিন তার কাছে আমাকে যেতে হয়েছিল কারণ রাত তখন আটটা। আমার ইন্টারনেট কানেকশন কাজ করছিল না। পরের দিনের অ্যাসাইনমেন্টের অনেক কাজ পড়ে ছিল।’

মনোযোগ দিয়ে শোনে নীরব, ’তারপর?’

‘তারপর আমাকে দেখে ওর আম্মু খুশি হয়ে গেলেন। ওদের বাসাতে খুব কম যাই আমি। আর আমাকে কেন জানি আন্টি বিশেষ পছন্দ করেন। সোজা আমাকে ক্রিশ্চিনার রুমে চলে যেতে বললেন উনি। আমিও গেলাম। রুমটা চিনি। নক করেছিলাম কয়েকবার।’

‘দরজা খুলল না?’ জানতে চায় নীরব।

‘না। খুলল না। তখন বাধ্য হয়েই আস্তে করে নব ঘুরিয়ে খুলে ফেলি আমি দরজা। দেখলাম -’

দিনার থেমে গেছে।

ওর চোখ দেখে বোঝা যায় যে কথাটা বলতে চাইছে সে সেটা নিজেই বিশ্বাস করে না।

‘একটা পেন্টাকল আঁকা ঘরের মাঝে। সেখানে হিবিজাবি অনেক কিছু লেখা ছিল ল্যাটিনে। আর পেন্টাকলের ঠিক মাঝে একটা কালো ছায়া। পুরো ঘরে আর কেউ নেই। শুধু ওই ছায়াটা। ছায়াটা মোটেও মানুষের মত কিছু না। আকৃতিতে একটা পিলারের মত বলা চলে। গোল, আর লম্বা এক পিলার। সেখান থেকে আমি স্পষ্ট শুনলাম ক্রিশ্চিনার গলা, অসন্তোষ সেখানে, “দূরে সরে দাঁড়াও, দিনার!” তারপর হঠাৎ সব কালো অন্ধকার হয়ে যায়। আমার মনে হয় আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।’

ঢোক গেলে দিনার সেদিনের অভিজ্ঞতা মনে পড়াতে।

তারপর আবার বলে যায়, ’মেয়েটাকে আমি পরের সেকেন্ডে দেখি। ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একই ঘরে। তবে কোন পেন্টাকল সেখানে নেই। আমাকে একটা পেনড্রাইভ ধরিয়ে দেয় ও তাড়াহুড়ো করে, শুধু একবার বলল, “অ্যাসাইনমেন্টের পুরোটাই আছে। নিজের মত এডিট করে নাওগে।” অথচ ওকে আমি তখনও বলি নি আমার অ্যাসাইনমেন্ট দরকার।’

সবাই চুপ হয়ে যায়, মাথা দোলায় নীরব।

‘ইন্টারেস্টিং। বুঝতে পারলাম।’

একসাথে প্রশ্ন ছুটে আসে ওর দিকে, ’কি?’

‘ক্রিশ্চিনা।’ উঠে দাঁড়ায় নীরব, ’নিজেও একটা সিক্রেট সোসাইটির সাথে যুক্ত। তোমাদের কথা যদি ঠিক হয়ে থাকে মেয়েটা একসাথে দুই নৌকাতে পা রেখেছে। আমি জানি না এর পরিণাম কি হতে পারে। হয়ত একেবারেই উন্নতির শীর্ষে চলে যাবে ও পাবে প্রচন্ড ক্ষমতা। অথবা টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে ও।’

‘আমাদের কি জানাবে ঠিক কি নিয়ে কথা বলছ তুমি?’ অধৈর্য হয়ে যায় সদানিশ্চুপ শাহেদও।

ওর দিকে তাকায় নীরব, ’মিথরাস। সিক্রেট সোসাইটি মিথরাসের নাম শুনেছে এখানে কেউ?’

সুন্দর চুলগুলো দোলায় প্রিয়াংকা, ’আমি শুনেছি। সূর্যদেবতা। তাই না?’

প্রশংসার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় নীরব, ’ঠিক সূর্যদেবতা বলেই রেখে দিলে হবে না মিথারাসের পরিধি অনেক বিস্তৃত। প্যাগানিজম নিয়ে জানো তোমরা?’

ক্লাস নেওয়ার মত করে সবার দিকে তাকায় নীরব।

‘পেগানিজম আর খ্রিস্টধর্ম একে অপরের সাথে কিছুটা জড়িত, ডিয়ার ফেলোস। পেগানিজম হল সেই বিশ্বাস যেখানে একেশ্বরবাদকে সম্পূর্ণ বিরোধীতা করা হয়। পেগানিজমে বিশ্বাসীদের বলা হয় পেগান। এরা যে কোন শক্তিকেই তাদের প্রভু হিসেবে বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল। বহু-ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলেও এদের ঈশ্বরদের কিন্তু সনাতন ধর্মের মানে, হিন্দুদের দেবতাদের মত নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। পেগানরা ক্ষণে ক্ষণে তাদের ঈশ্বর পাল্টে ফেলত। যখন যা তাদের প্রভাবিত করছে সেটাকেই তারা দেবতা বলে মেনে নিত। কারণটা সহজ, ওরা পাগল ছিল না। তবে ওদের ধারণা ছিল ঈশ্বর নিজেকে পাল্টে ফেলেন তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী। এজন্যই অকুন্ঠ শ্রদ্ধা ওরা দিত তাদের প্রয়োজনে আসা সব প্রভাব রাখার মত বস্তুকেই।’

মাথা চুলকায় দিনার, ’পেগানদের রোমের শাসকরা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিয়েছিল না? খ্রিস্টধর্মে নবদীক্ষিত সম্রাটদের মতে বহু-ঈশ্বরে পূজো করা স্রেফ ভন্ডামি। এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড এরকম কঠোর হস্তে তাদের দমন করা হয়েছিল। দলে দলে লোকেরা গ্রহণ করেছিল খ্রিস্ট ধর্ম। তাই না?’

মাথা দোলায় নীরব, ’বন্দুকের নল সব সময় ক্ষমতার উৎস হয় না হে। পেগান থেকে খ্রিস্টান হয়েছিল এমন সবাই সম্ভবতঃ খ্রিস্টান বলে নিজেদের মানেনি। শুধু ভেক ধরেছিলেন নিজেদের খ্রিস্টান পরিচয় দিয়ে। মনেপ্রাণে থেকে গেছিলেন পেগান। পরবর্তীতে এদের অনেকের বংশধররাই খ্রিস্টধর্মকে মেনে নেয়। কারণ, বাবাদের বা দাদাদের মনের মাঝে কেনই বা পেগানিজম লুকিয়ে আছে তার তাৎপর্য তাদের জানার কথা নয়। চারপাশে খ্রিস্টান পরিবেশ। কেনই বা পেগান হবে তারা? জেনারেশন বাই জেনারেশন খাঁটি খ্রিস্টান হয়ে ওঠে তারা। যদি খ্রিস্টধর্মকে খাঁটি বলা যায় আর কি!’ মুখ বাঁকায় নীরব।

‘কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছ?’ পাশ থেকে জানতে চায় শাহেদ।

‘পেগানদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে বড় ধরণের ভুল করেছিলেন সম্রাটরা। খ্রিস্টধর্মে পেগান বিশ্বাস চলে এসেছে অনেকগুলোই। তাদের মাঝে অনেকগুলো আজ প্রতিষ্ঠিত।’

হাত তোলে দিনার, ’আমি যতদূর জানি, ঈসা(আঃ) যাকে খ্রিস্টানরা যীশু খ্রিস্ট বলে তাঁর জন্ম এপ্রিলে। অথচ পেগান উৎসবের তারিখ ২৫ শে ডিসেম্বর মেনে নিয়ে তারা সেটাকেই আজও ক্রিসমাস ডে বলে বিবেচনা করে। পেগান ক্রস একটু পাল্টে ক্রিস্টানদের ক্রসে পাল্টে গেছে আজ। খ্রিস্টানদের প্রার্থনাভঙ্গী আসলে পেগানদের প্রার্থনাভঙ্গীই। পেগানদের অনেক কিছু এক অর্থে আজকের খ্রিস্টধর্মে ঢুকে গেছে পুরোপুরি।’

মাথা নাড়ে নীরব, চেহারাতে স্পষ্ট বিরোধীতার ভাব, ’এখানেই মাই ডিয়ার দিনার, ভুল করে সবাই। পেগানদের দিকে সবার নজর। কিন্তু আসলে, পেগান নয় খ্রিস্টধর্মে ঢুকে গেছে মিথরাসের বিশ্বাস।’

চমকে ওঠে প্রিয়াংকা, ’মিথরাস?’

সম্মতিসূচক মাথা দোলায় নীরব, ’মিথরাস।’


তিন

মৃদু আলোতে তিনজোড়া চোখের আগ্রহী দৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে নীরবের।

‘মিথরাস আগেই বলেছিলাম, সূর্যের দেবতা বলা যায় একে। পেগান সভ্যতার ধর্ম পেগানিজম ছিল না। ধর্মটা ছিল মিথরাস। ইন্দো-ইরানিয়ান সূর্য দেবতা। পারসিয়ানদের মাঝে এই ধর্ম প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে। বুঝতেই পারছ পেগানদের উৎস কোনটা? এই মিথরাস। পারসিয়ানরা বল একে’মেহের’। মেহের ছিল তাদের রক্ষাকর্তা। অসীম ক্ষমতা ছিল মেহেরের অন্তত পারসিয়ান ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী।’

ওদের শ্বাস টেনে নেওয়ার শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোন শব্দ নেই। সবাই কান পেতে শুনছে নিরবের কথা।

‘হিন্দু ধর্মের দিকে যদি চোখ ফেরাই এবার আমরা, ’মিত্রা’ বলে একজন দেবতাতে তারা বিশ্বাস রাখে। যদিও’বরুণ’ দেবতার সাথে একে স্মরণ করা হত। এজন্যই বরুণের ছায়াতে ধীরে ধীরে কালক্রমে ঢেকে গেছে মিত্রা। তবে এই মিত্রাটি হল সেই সূর্যদেবতা যেটা কিনা পারসিয়ানদের মেহের। ঋদ্বেগে আছে মিত্রাকে নিয়ে স্তুতিবাক্য। পারসিয়ানরা যখন নিজেদের ধর্ম থেকে সব দেবতাদের অস্বীকার করছিল তখনও মিথরাসকে তারা রেখে দেয়। তাকে ওরা মেহের বলে যার অর্থ হল বন্ধুত্ব, ভালোবাসা এবং সূর্য। মজার ব্যাপার হল মিশরীয়দের সূর্যদেবতা “হোরাস” কিন্তু অনেকটা এমনই ছিলেন।’

বাঁধা দেয় প্রিয়াংকা এবার,

‘মিথরাস নিয়ে জানাটা দরকার কেন? ক্রিশ্চিনা সেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারে? আমার জানা মতে মিথরাস শয়তানের বিরোধী সত্ত্বা বলে বিশ্বাস করা হয়। আর এদিকে দিনার যা দেখে এসেছে তা কিন্তু স্পষ্ট করে আমাদের ক্রিশ্চিনা শয়তানের পূজো করে।’

ওর দিকে তাকায় নীরব, ’পেন্টাকল আর ল্যাটিন প্রমাণ করে না ক্রিশ্চিনা শয়তানের পূজারী। আমাকে একবার দেখতে হবে ওটা। তবে সেটা তো সম্ভব না। এখানে বসে যদি আমাকে অনুমান করতে বল তোমরা আমি অনুমান করব ক্রিশ্চিনা শয়তানের পূজারী।’

অবাক হয় প্রিয়াংকা, ’এই মাত্র না বললে, তুমি পেন্টাকল আর ল্যাটিন দেখে মানতে চাওনা ক্রিশ্চিনা শয়তানের পূজারী।’

হাসে নীরব, ’না। মানা উচিতও না। তবে আমার বিশ্বাস ও শয়তানের পূজো করছে কারণ, ওই মিথরাস।’

‘মিথরাস শয়তানের বিরোধী সত্ত্বা।’ আবার বলে প্রিয়াংকা। শক্ত হয়ে আছে মুখ।

‘চাইনিজ মিথোলজী তাই বলে। মিথরাস শয়তানের হাত থেকে ত্রাণকর্তা। তবে শয়তান আসলে কে? শয়তান কাকে বলা হচ্ছে এখানে? আবার ফিরে যাই যদি আমরা ভারতীয় ’মিত্রা’র দিকে? বরুণ আর মিত্রার মিলিতরূপ হল অসুর। এখানেই আসছে শয়তান।’

হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে শাহেদ আর দিনার। প্রিয়াংকা একটু কষ্ট করে মেনে নেয় ওর কথাগুলো এতক্ষণে।

‘এবার মাই ডিয়ার ফেলোস, আরেকটা চমকের জন্য অপেক্ষা কর। পেগানদের কথা বলেছিলাম। তবে তারা কিন্তু শুধুই মিথরাসদের শাখা বা বিবর্তিত রূপ বলা চলে। অনেকে মনে করে পেগান উৎসবের তারিখ ২৫ শে ডিসেম্বর? আরে না মিথরাস দেবতার জন্মদিন ২৫ শে ডিসেম্বর। সূর্যদেবতা। মনে আছে? ২৫ শে ডিসেম্বরই পৃথিবী সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করে। শীতের চরম রূপ। এরপর ধীরে ধীরে সূর্যের দিকে এগিয়ে আসে পৃথিবী। শীত দূর হয় ল, গ্রীষ্ম আসে। সূর্যের কাছে এগিয়ে আসাটাই কি সূর্যের জন্মদিন নয়? সেখান থেকেই খ্রিস্টধর্ম প্রভাবিত। মিথরাস দেবতার জন্ম ভার্জিন মাতা থেকে। মিথরাস  রবিবারকে পবিত্র মনে করে। ওদের হতে হয় ব্যাপ্টাইজড। যেটা খ্রিস্ট ধর্মে ঢুকে গেছে ওতোপ্রোতভাবে। তারপর মিথরাস ফাদার আর ক্যাথলিক ফাদারদের মাঝে মিল তো আছেই। খেয়াল করে দেখ পেগানদের সাথে মিল খুঁজলে পাবে কিছু, তবে সবটা নয়। অথচ মিথরাসের সাথে খুঁজলে সব বের হয়ে আসছে ওদের সদৃশ।’

একটু কেশে নেয় এবার শাহেদ, ’তাহলে, মিথরাস হল খ্রিস্টধর্মের ভেতর পর্যন্ত প্রভাব রাখা একটা ধর্ম। তারওপর শয়তানের রাস্তা এর থেকে খুবই কাছে? ক্রিশ্চিনার ব্যাপারটা তাহলে কি?’

‘ক্রিশ্চিনা দুই নৌকাতে উঠছে। ওকে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কি চোখে রোদ না পড়ে এমন করতে দেখেছিলে? নাকি স্যালুট করছিল?’

কাঁধ ঝাঁকায় প্রিয়াংকা, ’স্যালুট করছিল। আর্মিদের মত।’

‘মাই গড!’ বিড় বিড় করে নীরব।

ধরে ফেলে ওটা দিনার, ’কি হয়েছে? স্যালুট করাটা কি বিশেষ অর্থ?’

তার দিকে না তাকিয়েই বলে নীরব, ’অবশ্যই। ধারণা করা হয় রোমান মিথরাসের কাছ থেকেই আসে স্যালুট আর হ্যান্ডশেকের ধারণা। মুসলমানরা এজন্য হ্যান্ডশেকের ঘোর বিরোধী তারা করে মুসাফাহা। খ্রিস্টান প্রথাতে ওটা আছে আবার। মিথরাসরা সূর্যের দিকে তাকিয়ে স্যালুট দেয়। এটাই ওদের প্রথা। প্রথার বাইরে যায় নি ক্রিশ্চিনা। আমার ধারণা ক্রিশ্চিনার পরিবার মানে, ওর পূর্বসূরীদের কেউ ছিলেন মিথরাস। আজকের যুগে তারা ক্রিস্টান নাম নিয়ে চলছে কারণ তাঁদেরও কেউ জোরপূর্বক চাপে এনে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করিয়েছে।’

মাথা চুলকায় শাহেদ, ’এখানে শয়তানের সম্পর্কটা ঠিক বুঝলাম না।’

হাসে নীরব, হাসিতে তিক্ততা, ’বলেছিলাম না আরেকটা চমক আছে তোমাদের জন্য? পেগানদের বিশ্বাস ছিল আগুন,মাটি, পানি, বাতাস মানে ইলুমিনেটাস নিয়ে। আর আসলে ওটা ছিল মিথরাস ধর্ম মিথরাস বিশ্বাস। মিথরাসদের আরও দুটো শাখার নাম শুনবে? নাইট টেম্পলার এবং ফ্রি-মেসনারী।’

এবার তিনজনই প্রায় লাফিয়ে ওঠে।

চিৎকার দিয়ে ওঠে দিনার, ’ফ্রি মেসন? ফ্রিমেসনরা এসেছে মিথরাস থেকে? এরাই কি তারা না যারা শয়তানের পূজো করে দাজ্জালকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য? শয়তানের একনিষ্ঠ পূজারী তারা! ধারণা করা হয় আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের প্রত্যেকেই এর সদস্য ছিলেন। পৃথিবীটাকে যদি কেউ গ্রাস করে নেয় তবে এই ফ্রি মেসন। ক্রিশ্চিনাও ফ্রিমেসনের সদস্য?’

‘সম্ভবতঃ।’ মাথা দোলায় নীরব, ’আমেরিকার প্রতিটি প্রেসিডেন্ট ফ্রিমেসন  ছিলেন কিনা তা হয়ত বলা যাবে না। তবে বিশতম প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড যে নিঃসন্দেহে এজকন ফ্রিমেসন ছিলেন তা সন্দেহের উর্ধ্বে। এটাই ফ্রি-মেসনের সাথে মিথরাসের সম্পর্কের অকাট্য দলীল। ১৮৭০ সালে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে একেবারেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল ডকুমেন্টে কি লেখা ছিল জানো?’

একবার দম নেয় নীরব, ’Garfield, James Abram,. Address at the Mitharas Lodge of Sorrow, Washington, November 10, 1881’

মিথরাস লজ অফ সরো!

ওদের পিঠের শীতল একটা অনভূতি হয়। শয়তানের পূজারির আধিক্য অবশ্যই অ্যান্টি-ম্যাজিকাল সোসাইটির বিরুদ্ধে যায়।

সেই সাথে যাচ্ছে পৃথিবীর বিরুদ্ধেও।

‘আরও আছে ব্রিটিশ জাদুকর অ্যালিস্টার ক্রউলি বিখ্যাত তিনি। ইনি মিথারাস কাল্টের প্রধান ছিলেন সম্ভবত ১৯২২ সালে। এত সাল তারিখ মনে থাকে না। ওদিকেই কিছু একটা হবে। তবে কথা হল ইনি ফ্রিমেসন হিসেবেও নিজেকে পরিচয় দিতেন। শয়তানের কট্টর উপাসক ছিলেন এই লোক।’

শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করে দিনার, ’ক্রিশ্চিনার হতে বাধা কোথায় তাহলে?’

প্রিয়াংকার চেহারাও ফ্যাকাসে হয়ে আছে, ভয় পেয়েছে মেয়েটা।

মৃদুস্বরে বলে ও, ’ক্রিশ্চিনার ছোটবোনটা কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ, পুলিশ অনেক খুঁজেছে। দুঃখ পেয়েছিলাম তখন শুনে। পরে দেখলাম ক্রিশ্চিনার মধ্যে বিকার নেই। ক্লাসে ধুমিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে জারাফের সাথে। এখন তো মনে হচ্ছে কাজটা ক্রিশ্চিনারই।’

ঝট করে ঘুরে তাকায় নীরব, ’কি বললে?’

‘ক্রিশ্চিনার ছোটবোন কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ। কেউ জানিস না?’ অবাক হয় প্রিয়াংকা এবার।

‘ম্যাগাস! ড্যাম ইট!’

নীরবের শান্ত চেহারা থেকে এরকম একটা চিৎকার বের হতে পারে ওরা না দেখলে বিশ্বাসই করত না।

চোখ দুটো জ্বলছে নীরবের প্রচন্ড রাগে। দরজার দিকে রওনা দেয় ও।

খপ করে ওর হাত আটকে ফেলে দিনার, ’কি হয়েছে? যাচ্ছ কোথায়?’

হাতটা ছাড়িয়ে নেয় নীরব, ’ক্রিশ্চিনার বাসাতে।’

‘কেন?’ এবার পথরোধ করে প্রিয়াংকা।

‘ম্যাজিস্টার টেমপ্লি ধাপে ছিল ক্রিশ্চিনা শয়তান সাধনাতে। এটা এখন সুনিশ্চিত! এরপর  একটি শিশুর বলী দিতে হয় পরের ধাপে উঠতে। ম্যাগাস স্তর। সেখানে উঠেছে বদ মেয়েটা। নির্ঘাত বলী দিয়েছে নিজের ছোটবোনকেই! পিশাচিনী!’

ক্রোধে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যায় শাহেদের হাতও, ’এখন ওর বাসাতে গিয়ে কি লাভ?’

‘অর্ডার অফ দ্য সিলভার স্টার!’ ব্যস্ত স্বরে বলে নীরব, ’ম্যাজিস্টার টেমপ্লি হল অষ্টম স্তর। নবম হল ম্যাগাস। আরেকটা ধাপ পিছিয়ে দশম আর সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছতে ওর! ইপসিসিমাস স্তরে একবার পৌঁছে গেলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে মেয়েটা। স্রেফ শয়তানের পূজারী থেকে শয়তানের বন্ধুতে রূপান্তরিত হবে ও! যেখানে সেখানে নিমেষে চলে যাওয়ার ক্ষমতা সে পাবে! আর ঠেকানো যাবে না ওকে!’

ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে নীরব, ’তাছাড়া, এই কাজে সফলতার জন্য একজন কুমারী মেয়েকে বলী দিতে হবে ওর। আসছ তোমরা?’


চার

চারজনের ছোট্ট দলটা যখন গাড়িতে করে এসে থামে ক্রিশ্চিনাদের বাসার সামনে চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

দিনার যেহেতু আন্টির কাছে পরিচিত ওকেই ভেতরে পাঠায় ওরা।

একটু পরেই হতাশ হয়ে ফিরে আসে ও।

‘কি হল?’ জানতে চায় নীরব।

‘আন্টি বলল, আজ রাতে বাইরে থাকবে ক্রিশ্চিনা। আন্টির মন মেজাজ ভালো দেখলাম না। ছোট্ট মার্গারেটকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও।’

ড্যাসবোর্ডে ঘুষি মারে শাহেদ, ’বদ মেয়েটা বলী দিয়েছে নিজের বোনকে! মার্গারেটের মত ফুটফুটে একটা মেয়েকে জবাই করতে ওর হাত কাঁপে নি?’

ওকে স্পর্শ করে শান্ত করে নীরব। একবার তাকায় দোতলা বাড়িটার দিকে।

‘দিনার, আমাকে তথ্য দাও। কোন ঘরটা ক্রিশ্চিনার?’

ভ্রু কুঁচকে তাকায় দিনার, ’তুমি নিশ্চয় ভাবছ না -’

অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নীরব।

আর বাক্যবিনিময় না করে দোতলার একটা ঘর দেখিয়ে দেয় এবার দিনার।

কোনদিকে  না তাকিয়ে একটা পাইপ বেছে নেয় নীরব। তারপর বেয়ে বেয়ে উঠতে থাকে।

দশ মিনিটের মাঝেই অবশ্য যে পথে গেছিল সেপথেই নেমে আসে নীরব।

‘পেয়েছি। একটা ঠিকানা। পরিত্যক্ত এই বাসাটার ছবি আর ডিটেইলস কেন রাখবে ক্রিশ্চিনা তার ল্যাপটপে?’

একটা ঠিকানা দেখায় নীরব তার স্মার্টফোনে। ঝুঁকে আসে সবাই।

‘চলো, যাওয়া যাক।’ গাড়ি স্টার্ট দেয় শাহেদ।

‘খালি হাতে? সম্ভবতঃ ওখানে আজ কুমারী বলী দিতেই গেছে ক্রিশ্চিনা।’ বিড় বিড় করে বলে নীরব।

‘তাহলে?’ শুকিয়ে যাওয়া গলা নিয়ে তাকায় প্রিয়াংকা।

‘একটা কাজ কর তোমরা পুরো শহরকে জাগিয়ে নিয়ে আসো ওখানে। সবাই যাতে হাত মশাল আর পবিত্র পানি রাখে। ঠিক আছে? একটি প্রাণ হয়ত বাঁচবে। শুধু দিনার আসো আমার সাথে। আমরা আগে গিয়ে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করব ওদের।’

মেনে নেয় ওরা। গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে চলে দিনার আর নীরব।

উদ্দেশ্য শয়তানের আখড়াতে ঢোকা।

*

বিশাল বাড়িটার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখে চারপাশটা একবার দেখে দিনার। ছেলেটা ভয় পাচ্ছে।

ওর কাঁধে দুইবার চাপড়ে দেয় নীরব।

‘কি?’ প্রশ্ন করে দিনার।

‘দিনার, ছেলে হিসেবে খুব একটা মন্দ নও তুমি। তোমাকে আমি ভেতরে ঢুকতে দিতে পারি না। প্রাণ হারাবে নিঃসন্দেহে।’

নীরবের চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে দিনারের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। অশুভ একটা দৃষ্টি ফুটে আছে নীরবের চোখে। যেন বহুদিনের ক্ষুধার্ত।

সেই সাথে হাতে বের হয়ে এসেছে একটা পিস্তল। নীরব পিস্তল সাথে রাখে কবে থেকে?

‘আমি কি করব তাহলে?’ শুকিয়ে যাওয়া গলা দিয়ে কোনমতে বলে দিনার।

‘এখানে অপেক্ষা কর। এলাকাবাসী আসলে একসাথে ঢুকবে। আমি ঢুকছি এখনই। তবে আমাকে ফলো করার চেষ্টা করবে না।’

মাথা ঝাঁকায় দিনার। নীরবের যে চেহারা সে দেখছে তাতে আর ফলো করার ইচ্ছে থাকার কথাও না।

দিনারের বড় বড় হয়ে যাওয়া চোখের সামনে দিয়ে অন্ধকারে ঢুকে যায় নীরব।

ঠক ঠক করে কাঁপে দিনার এতক্ষণে। কেন জানি তার মনে হয় হঠাৎ করেই তাপমাত্রা কমে গেছে এলাকার।

এর একটা কারণ হতে পারে পুরোনো এই বিল্ডিংটা থেকে ভেসে আসছে একটা গমগমে শব্দ। ভেতরে কেউ মন্ত্র পড়ছে।

নির্ঘাত বলী দেওয়া হবে এখানে আজকে। কেউ মারা যাচ্ছে আজ রাতে যদি না নীরব সেটা ঠেকায়। অথবা এলাকাবাসীকে নিয়ে প্রিয়াংকা ঢুকে পড়তে পারে সময়মত।

পরমুহূর্তেই একটা প্রশ্ন ধাক্কা দেয় দিনারকে, নীরব এত দ্রুত কিভাবে ক্রিশ্চিনার ল্যাপটপ হ্যাক করে ঠিকানা পেয়ে গেল?

তাও হাজার হাজার মেগাবাইটের ভেতরে ঠিক ওই তথ্যটাই? এই বাসার ঠিকানা?

নীরবের মাথায় এখন প্রশ্ন আসার সম্ভাবনাই নেই। খুব সাবধানে একটা একটা পা ফেলছে ও। হাতে তুলে রেখেছে উদ্যত পিস্তলটা।

ছাদের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ও। সিঁড়িঘর থেকে হাল্কা উঁকি দিয়ে দেখে ছাদটা।

চকচকে পরিষ্কার একটা ছাদ। ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল বৃত্ত এঁকে রাখা হয়েছে। বৃত্তটার আশেপাশে রক্তের ছাপ।

যদিও এখানে মৃত বা আহত কেউ নেই। ধরে নেয় নীরব, এসব মার্গারিটের রক্ত। ক্রিশ্চিনার ছোটবোনের।

এই মুহূর্তে ছাদের মাঝে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পড়ছে একজন মানুষ।

আর বৃত্তে বেঁধে রাখা হয়েছে একটি মেয়েকে। অসামান্য সৌন্দর্য্য এখন হয়ে গেছে ম্লান।

ছাদের মাঝে উঠে আসে নীরব। ঘুরে তাকাচ্ছে মন্ত্র পড়তে থাকা মানুষটা টের পেয়ে গেছে পেছনে কারও উপস্থিতি!

একটি মাত্র গুলির সাহায্যে তার মাথাটা বিস্ফোরিত করে দেয় নীরব।

বিড় বিড় করে বলে, ’টোমা মি রিগ্যালো!’

গুলির শব্দটা দূর থেকে দূরে প্রতিধ্বনীত হয়। সেই সাথে দূরে কোথাও হৈ হৈ শব্দ শোনা যায়। ছুটে আসছে এলাকাবাসী।

গুলির শব্দ তাদের কানে গেছে!

চক্রের মাঝে হাত পা বাঁধা মেয়েটা কাঁদছে। চাঁদের আলোতে ফিরে তাকায় নীরব ওর দিকে।

‘ডিয়ার ক্রিশ্চিনা! তুমি ভার্জিন!’ কৃত্রিম বিস্ময়টা ফুটিয়ে তোলে নীরব।

তারপর ফেটে পরে হাসিতে। যেন এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কিছুই হতে পারে না!

পড়ে থাকা জারাফের শরীরটাকে জোরে লাথি দেয় নীরব।

চিত হয়ে যায় মানুষটা।

‘তোমাকে কেন বের করছি না আমি এখান থেকে? সেটাই ভাবছ তো? না না নিজের বোনকে জবাই করে ম্যাগাস স্তরে ওঠার জন্য তোমাকে আমি দোষ দেই না। এই কাজ আমাকেও করতে হয়েছে একদিন।’

হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ক্রিশ্চিনা। হাসে নীরব সুন্দর করে।

‘আমি একজন ফ্রিমেসন, ক্রিশ্চিনা। এবং মিথরাস। ঠিক তোমারই মত। তোমার সাথে আমার জমত ভালো! তবে কুমারী পাওয়া তো আর চারটি খানি কথা না। এলাকায় তোমাকে শয়তানের পূজারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিতও করেছি। আমাকে আগেও কেউ খোঁজেনি। এখনও খুঁজবে না।’

আস্তে করে জারাফের লাশের হাতে ধরে রাখা ছুরিটা তুলে নেয় নীরব। ক্রিশ্চিনার চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে।

মন্ত্র পড়ছে নীরব। এলাকাবাসীর হুংকার আরও কাছে এখন।

দরজা থেকে যখন আর মাত্র বিশ গজ দূরে জনতার কোলাহল মন্ত্র আবৃত্তি শেষ হয় নীরবের।

ছুরিটা তুলে ধরে ও।

কোমল গলাতে বলে, ’একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। আমিও ম্যাগাস স্তরে। তবে আর কয়েক মুহূর্তের জন্য! দশম স্তর ইপসিসিমাস না আমি চলে যাব একাদশ স্তরে আজ রাতে যেটার কথা কেউ জানেই না। তোমার গাধা বয়ফ্রেন্ড জারাফকে ধন্যবাদ। নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে ও। জোড়া বলী দিতে পেরেছি আমিও। ধন্যবাদ, ক্রিশ্চিনা।’

তীব্রবেগে নামিয়ে আনে নীরব ছুরিটা।

একবার মুচড়ে উঠে স্থির হয়ে যায় ক্রিশ্চিনা। সুন্দর চোখ দুটোতে বেদনার চেয়ে বেশি কাজ করছে বিস্ময়!


পরিশিষ্ট

কাঁপা গলাতে শুধু বলতে পারে দিনার, ’ভেতরে। ও ভেতরে।’

প্রিয়াংকা এক হাত খামচে ধরে ওর। তারপর এলাকার সবার সাথে ঢুকে পড়ে ওরাও বাসাটাতে। সবার হাতে জ্বলছে মশাল। আগুণের সামনে দুর্বল হবে প্রতিপক্ষ!

দিনার নিজেকে দোষারোপ করে যাচ্ছে।

মনে মনে।

একটা উল্কি দেখে কিভাবে ও বিশ্বাস করতে পারল নীরবের মত একটা উচ্চপর্যায়ের সাধককে?

সবার সাথে টলতে টলতে ছাদে যাচ্ছে ও ঠিকই জানে ওখানে কি পাওয়া যাবে।

কানে বাজছে নীরবের কথা, ’অর্ডার অফ দ্য সিলভার স্টার! ম্যাজিস্টার টেমপ্লি হল অষ্টম স্তর। নবম হল ম্যাগাস। আরেকটা ধাপ পিছিয়ে দশম আর সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছতে ওর! ইপসিসিমাস স্তরে একবার পৌঁছে গেলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে মেয়েটা। স্রেফ শয়তানের পূজারী থেকে শয়তানের বন্ধুতে রূপান্তরিত হবে ও! যেখানে সেখানে নিমেষে চলে যাওয়ার ক্ষমতা সে পাবে! আর ঠেকানো যাবে না ওকে!’

ছাদে উঠে সবাই চুপ হয়ে যায়।

পড়ে আছে দুটো মৃতদেহ।

কোথাও চিহ্নও নেই নীরবের।

রচনাকাল – জুলাই ০৩, ২০১৪ 

শামান

এক

‘শামান পেলি কোথায় এই বাংলাদেশে?’ ফিস ফিস করে জানতে চায় বৃষ্টি।

ক্লাস চলছে। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের একটা মেয়ে ক্লাসের মাঝে এই কথাটা চিৎকার করে পাশের বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতে পারে না। তাই ফিস ফিস করাটা এখন বাধ্যতামুলক।

চোখের ওপর এসে পড়া চুলগুলোর ফাঁক দিয়ে তাকায় ইমরান, ‘লম্বা কাহিনী আছে। তবে ভাগ্য ভালো লোকটাকে পাওয়া গেছে।’

বৃষ্টির সুন্দর ভ্রু দুটো কুঁচকে যায়, ‘এই লোক কি বাংলাদেশী?’

ইমরানের চোখে রাগ দেখা যায় এবার, আজগুবী প্রশ্ন বান্ধবীর কাছ থেকে পাওয়ার আশা সে করেনি।

‘এই পোড়া দেশে দেশী শামান পাওয়াই কঠিন আর তুই এনেছিস বিদেশী শামানের ডিমান্ড? খোঁজগে যা! বের করে আন একটা শামান।’

আফজাল স্যার বোর্ড থেকে মুখ তুললেন এসময়। পুরো ক্লাসের দিকে একবার কড়া নজর বুলিয়ে দেন। কুঁকড়ে যায় ইমরান আর বৃষ্টি।

নির্ঘাত ওদের কথাবার্তার গুন গুন শব্দ চলে গেছে স্যারের কানে?

স্যার আবার বোর্ডের দিকে ঝুঁকতেই মুখ ঝামটা দেয় বৃষ্টি,’আমি বলি নি বিদেশী শামান লাগবে। কিন্তু এই বাংলাদেশে শামান পেয়েছিস নাকি ভন্ড? সে খেয়াল আগে রাখিস। শামানরা ছিল তুর্কি আর মঙ্গল আবিষ্কার। তা থেকে আমেরিকা আফ্রিকাতে ছড়িয়েছে জানি – তাই বলে বাংলাদেশে?’

শেষ শব্দটা দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করে বৃষ্টি। এই দেশে শামান পাওয়া যাবে না এটাই জানে ও।

কাঁধ ঝাঁকায় ইমরান,’আগামীকাল কলেজ বাংক দিবি তাহলে তুই। আমার সাথে নরসিংদী যাবি। শামানকে দেখবি। তারপর বিশ্বাস না হলে আর কাওকে খুঁজব।’

সামনের খাতাতে দ্রুত তুলতে থাকে বৃষ্টি বোর্ডে করা ইন্ট্রিগেশন। তার মাঝেই বলে,’নরসিংদীর কোথায়?’

‘শিবপুর উপজেলাতে। বাঘাবা।’

‘বাঘাবা?’ চোখ কুঁচকে যায় বৃষ্টির নাম শুনেই।

অন্য দিকে তাকায় ইমরান,’জায়গার নাম। ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?’

‘চুপ করে থাক। তোর কথা বার্তাতে আমার মেজাজ গরম হচ্ছে। ক্লাস শেষে কথা বলব। দাঁড়াস। একসাথে যাবো।’

কাজেই ইমরান চুপ করে থাকে। তারপর আনমনে তাকায় একটু দূরের বেঞ্চটার দিকে।

জায়গাটা এখন খালি। ওখানে বসত রুদ্র। এখন কেউ বসে না।

রুদ্র কার অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে নয় দিন আগে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বোর্ডের দিকে তাকায় ইমরান। শালার ম্যাথ সাবজেক্টটা আবিষ্কার করেছিল কোন হতচ্ছাড়া?

*

এক কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে ইমরানকে দৌড়ে ধরে বৃষ্টি।

‘বলেছিলাম না একসাথে যাবো? একা একা হাঁটা দিয়েছিস কেন? খুব লায়েক হয়েছিস?’

মাথা চুলকায় ইমরান,’না-লায়েক হয়েছি।’

‘ফালতু কথা রাখ। এবার বল শামানের উৎপত্তি কোথায়? বাঘাবার মত অজ পাড়াগাঁয়ে শামান আসবে কোথা থেকে? বাংলাদেশের ঐতিহ্য কিছু ওঝা আছে না – ওদের কাওকে ধরে এনে শামান বলে চালানোর ইচ্ছে বলে মনে হচ্ছে তোর।’

ওর দিকে সরাসরি তাকায় ইমরান,’বাঘাবা অজ পাড়াগাঁ – সেটাই বা কে বলল তোকে? চল না আগামীকাল। দেখতেই তো পাবি।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটে ওরা। তারপর চিন্তিত মুখে তাকায় বৃষ্টি,’আচ্ছা, আমাদের শামান কেন লাগবে? প্ল্যানচেট নিয়ে পড়াশোনা করতে বলেছিলাম। তুই সেসব বাদ দিয়ে শামানের দিকে ঝুঁকছি কেন? যদি পরে সব ভেস্তে ফেলে ওই ব্যাটা শামান? অথবা – যদি ব্যাটা ভন্ড হয়?’

দাঁড়িয়েই যায় এবার ইমরান,’শোন – আমার ওপর ভরসা রাখ – প্রতি পদে পদে বাঁধা দিচ্ছিস কেন? শামান পেয়েছি – এই খুশিতে তোর আমাকে চুমু খাওয়া উচিত! সেখানে উল্টাপাল্টা ধমকাচ্ছিস। আমার কিন্তু মেজাজ খারাপ হচ্ছে!’

বিড় বিড় করে বৃষ্টি,’বয়েই গেছে তোকে আমার চুমু খেতে!’

দূরের ইলেক্ট্রিক পোলের দিকে তাকায় ইমরান,’শামান আমাদের দরকার ছিল। ঠিক এটাই দরকার ছিল রে। ভাগ্যিস আমার কাজিনকে বলতে ও খুঁজে বের করে দিয়েছে। নরসিংদীতে থাকে ও নিজেও – জানত এদিকে একজন শামান থাকে। তবুও ঝাড়া তিনদিন খুঁজে তবেই পেয়েছে ও লোকটাকে। থাকে দুর্গম এক জায়গাতে।’

স্বভাবসুলভ প্রতিবাদ করে বৃষ্টি আবারও,’শামানের সুবিধাটা কি? থার্ড পার্টি ঢুকছে না? প্ল্যানচেটে আমাদের সাথে আর কারও নাক গলানোর দরকার হত না। তাছাড়া নিজেরা করলে বুঝতে পারতাম বিষয়টা।’

হাত উল্টে দেখে ইমরান, মেজাজ খারাপ হচ্ছে ওর আবারও,’আগেই বলেছিলাম বার বার একপ্যাচাল না পাড়তে! শামানরা হল আত্মাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনকারী মানুষ। আমাদের আর আত্মিক জগতের মাঝে ওরা হল ব্রীজ। একজন শামান দুই জগতেই বিচরণ করতে পারেন – সেই সাথে বিভিন্ন ডাইমেনশনের জগতে চলে যেতে পারে তাঁর আত্মা। সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে ওসব স্থানের অধিবাসীদের সাথে। ওরা রোগীকে সুস্থ করতে পারে, অন্য জগতের আত্মার সাথে যোগাযোগ করতে পারে, দুষ্ট আত্মাকে ধরে জোর করে কাজ করিয়ে নিতে পারে, ধ্বংস করে দিতে পারে অসুস্থ আত্মাদের। প্রচন্ড ক্ষমতাধর হয় একজন শামান। আর আমাদের কাজের জন্য একজন শামান-ই দরকার। প্ল্যানচেটে আর কতটুকু করা যাবে? এই দুই চারটা কথা বলা তো? শামান একটি আত্মাকে নিজের চোখে দেখে আসতে পারেন।’

ইমরানের বিশাল লেকচার শুনে মনে হয় কিছুটা হলেও প্রভাবিত হয় বৃষ্টি। এবার আর তর্ক করছে না।

পরের যে বাক্যটা ওর মুখ থেকে বের হয় – তাতে ইমরান সন্তুষ্ট না হয়ে পারে না।

‘একটা কাজ করব ভাবছি। আগামীকাল একেবারেই ভাগব ঢাকা থেকে। তিনদিনের জন্য নরসিংদী চলে যাবো। সাথে থাকবি তুই। তোর শামানকে ওখানে আমরা দেখব। তারপর যদি ব্যাটাকে কাজের বলে মনে হয় – তাহলে আমরা তাকে ভাড়া করব। ওখানেই আমাদের রিচুয়াল বা যাই বল এটাকে – শেষ করতে হবে। তারপর ফিরে আসব আমরা। একবারে সব কাজ শেষ করে।’

খুশিতে ইমরান এবার বৃষ্টির হাতে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়,’যাক – কাজের কথা বলেছিস এবং ভেবেছিস।’

বৃষ্টি অবশ্য চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকে ইমরানের দিকে,’তোর কি মনে হয়? রুদ্রকে আবার পাবো আমরা? কথা বলা সম্ভব ওর সাথে?’

হাসিটা মুছে যায় ইমরানের মুখ থেকেও,’আমাদের চেষ্টা করে যেতেই হবে। ছেলেটাকে জানাতে হবে তো। নাহলে শান্তি পাবে না ও যেখানেই থাকুক। তাছাড়া – রুদ্রের হেল্প আমাদের লাগবে। শুধু নিজেদের জন্য তো আর না। মানবজাতির জন্য। ওকে ছাড়া হবে না।’

বিষন্ন কন্ঠে একমত হয় বৃষ্টি,’সেটা তো জানি। ভয় করছে আসলেই ইন্টারস্পিরিচুয়াল কানেকশন ঘটানো সম্ভব কি না সেটা ভেবে।’

বড় করে একবার নিঃশ্বাস নেয় ইমরান। কানেকশন ঘটাতে না পারলে যে সমূহ বিপদ সেটা ও জানে। একটা জায়গাতেই আটকে থাকতে হবে ওদের।

‘আমরা পারবো। শামান ব্যাটা ফেল মারলে আর কোন উপায় বের করে নেব।’ স্বান্তনা দেয় ও বৃষ্টিকে।

ওদিকে চমৎকার সাদা গাড়িটা চলে এসেছে। সেদিকে তাকায় বৃষ্টি,’আমার গাড়ি চলে এসেছে। বাসায় যাই রে। কাল পালাচ্ছি তোর সাথে।’

একটু হাসে ইমরান,’বাসায় চলে আসিস। সেখান থেকে সোজা নরসিংদী।’

মাথা ঝাঁকায় বৃষ্টি,’শামানের কাছে।’

বৃষ্টি গাড়িতে উঠে যেতে ঘুরে দাঁড়ায় ইমরান, কলেজ থেকে ওর বাসাটা বেশি দূরে না। বিড় বিড় করে বলে,’হুঁ – শামানের কাছে!’

দুই

ট্রেনের নির্ধারিত সীটে বসে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাসে ইমরান।

রাগত চোখে ওর দিকে তাকায় বৃষ্টি।

‘হাসছিস যে?’

‘জীবনে সেকেন্ড ক্লাসে চড়েছিস কি না – ভেবে দেখলাম। সম্ভাব্যতা বলল, চড়িসনি। তাই হাসলাম। বেচারী তুই।’

জানালা পুরোপুরি খুলে দেয় বৃষ্টি,’উপপাদ্যটা প্রমাণ করার জন্য থার্ড ক্লাসে বা ফোর্থ ক্লাসে চড়তেও আমার আপত্তি নেই।’

‘হয়ে যাবে। একবার রুদ্রকে পেলেই আমাদের কাজ অর্ধেক শেষ। নাহলে নিজেদের ঘাঁটতে হবে আর কি।’

সুন্দর মুখটা ইমরানের দিকে ফেরায় বৃষ্টি এবার,’আমাদের গত ছয়মাসের খাটুনীর কথা মনে করে দেখ। ভালো জায়গাতে আটকেছি আমরা। এখান থেকে রুদ্র কিভাবে বের হল সেটা আমি জানি না। কিন্তু ওটা জানা দরকার।’

চিন্তাতে ডুবে যায় ইমরান।

নতুন একটা গাণিতিক উপপাদ্য নিয়ে কাজ করছিল ওরা। সেটা প্রমাণের চেষ্টা করছিল।

বিষয়টা টেনসর অ্যানালাইসিস সম্পর্কিত। টেনসর অ্যানালাইসিস দারুণ একটা জিনিস – আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রি, বলবিদ্যা, স্থিতিস্থাপকতা, তড়িৎচৌম্বক থিওরিতে এর প্রয়োগ সম্ভব।

তিন মাত্রার জন্য বিষয়টা কাজ করে।

রুদ্র, ইমরান আর বৃষ্টি যা করছিল – সেটা চতুর্মাত্রিক জগতের জন্য। মাত্রা যদি চারটি হয়ে তাহলে টেনসর অ্যানালাইসিস কি ধরণের হতে পারে – সেটা। কো-অর্ডিনেট বের করার জন্য চতুর্থ মাত্রাটাকে সর্বজনীন ধরেই এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা।

মাঝে ফেঁসে গেল।

এখানে ছয় মাস ধরে আটকে থাকাটা স্বাভাবিক। কলেজের পড়াশোনাই কম না – তারওপর তারা গবেষণা করছে হায়ার লেভেলের ম্যাথ নিয়ে। সময় তেমন পেত না – তবে যতটুকু পেয়েছে – পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে ওদিকে।

রুদ্র যেদিন হঠাৎ করে জানালো আটকে থাকা সমীকরনটা ভেদ করতে পারবে ও – সেদিন রাতেই ফিরে আসতে গিয়ে কার অ্যাকসিডেন্ট করে।

প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছিল ওরা। তবে আরও বেশি হতাশ হয়েছিল হাতের কাছে এসেও উপপাদ্য প্রমাণের উপায়টা ফস্কে যাওয়াতে।

রুদ্র ওদের মাঝে সবচেয়ে ব্রাইট ছিল। ওরকম ভাবে চিন্তা করতে হয়ত বা আরও দুই-তিন বছর লেগে যাবে বৃষ্টি বা ইমরানের। কাজেই এখন শর্টকাট খুঁজছে ওরা।

ওদের তিনজনের মাঝে একটা মিল আছে – পুরো জীবনটাকেই হিসেবের আওতাতে ফেলে নিয়ে এসেছে ওরা।

এজন্যই কলেজে একত্র হয়ে গণিতের দিকে উৎসাহের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছে অনায়াসে।

আর চিন্তাধারার এই দিকটাই ওদের সাহায্য করছে প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে শোকাতুর না হয়ে আরেকটা পদ্ধতি বের করে নিতে।

প্ল্যানচেটের চিন্তাই তারা করেছিল প্রথমে। পরে ও একজন শামান পেয়ে যাওয়াতে কাজটা হতে যাচ্ছে সহজ।

ভাবতে ভাবতে কখন চোখে ঘুম নেমে এসেছে ওর – খেয়ালও করেনি।

*

‘অ্যাই! ওঠ! ইমরান?’

কেউ ওর সিল্কি চুলগুলো ধরে টানছে – টের পেয়ে মেজাজ খাপ্পা হয়ে যায় ইমরানের। উঠে পড়ে ধরমর করে।

‘চলে এসেছি আমরা। পোটলা নিয়ে নেমে পড়! বদ পোলা। ঘুমাচ্ছিস একেবারে মরার মত!’

লাফিয়ে উঠে ব্যাগ নামিয়ে বৃষ্টির সাথে নেমে আসে ও প্লাটফর্মে।

একপাশ থেকে গলাটা শুনতে পায় ওরা,’ইমরান! চলে আসতে পেরেছ তাহলে?’

হাসিমুখে এগিয়ে আসে ওদের বয়েসী একটা ছেলে, তারপর বাড়িয়ে দেয় হাত,’তুমি নিশ্চয় বৃষ্টি? আমি ইমরানের কাজিন, তুর্য।’

একটু হেসে হাত মেলায় বৃষ্টি,’হোটেল আছে এখানে? থাকার ভালো জায়গা দরকার একটা।’

ওদিকে দুই কাজিন তখন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছে।

‘বহুদিন পর তোর সাথে দেখা, তুর্য!’

‘তা তো হবেই। ভূতের গন্ধ না পেলে কি তুই আসবি আমাদের এই পোড়া শহরে?’

হাসে দুইজনই। হঠাৎ মনে পড়ে তুর্যের,’হোটেলে ওঠার কথা ভুলেও চিন্তা করবে না। আমাদের বাসাতে অনেকগুলো রুম আছে।’

বাঁধা দেয় ইমরান,’আমরা বাঘাবা যাবো। ওখানে তো আর হোটেলও থাকবে না – তোদের বাসাও থাকবে না। মনে কর তোদের বাসাতে আধঘণ্টা থেকেই বাঘাবার দিকে রওনা হতে হবে আমাদের।’

‘নো প্রবলেম! যাওয়ার সময় তোদের সাথে আমিও ঢাকাতে যাব। কাজ আছে।’ কাঁধ ঝাঁকায় তুর্য,’ভালো কথা – বৃষ্টির বাবা-মা আপত্তি করেনি এই অভিযানে?’

ঠোঁট উল্টে ফেলে মেয়েটা,’বলে এসেছি নাকি? ফিরে গিয়ে জানিয়ে দেব ছিলাম বয়ফ্রেন্ডের সাথে। মাম্মি আর কিছু বলবে না। দিন কি আর সে পার করেনি?’

হেসে ফেলে ওরা।

‘আংকেল আন্টি কেমন আছে?’ জানতে চায় ইমরান।

বাসার খবর দিতে থাকে তুর্য। একটা সিএনজি ঠিক করে ফেলে ওদের নিয়ে উঠে যায় ভেতরে।

*

বাঘাবা পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল।

ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারে যখন ভুটভুটি নামক আজব বাহনটা ওদের নামিয়ে দিয়ে গেল – তখন রাস্তাগুলোতে নেমে এসেছে অদ্ভুত এক ছায়া।

একটা ল্যাম্পপোস্টেও লাইট নেই। তবে ল্যাম্পপোস্ট আর তাতে ঝুলে থাকা কারেন্টের তার দেখে কিছুটা স্বস্তি ওরা পায়।

অন্তত বিদ্যুতের সাপ্লাই আছে এখানে।

দোকানঘরগুলোতে টিমটিমে আলো জ্বলছে। তাছাড়া পুরো এলাকাটাই অন্ধকার।

এই প্রথমবারের মত বৃষ্টির মনে হতে থাকে – শামানের উপস্থিতি যদি বাংলাদেশে কোথাও থেকে থাকে – তাহলে এই বাঘাবাই হতে পারে সেই জায়গা।

কেমন যেন অদ্ভুত রকমের এক অশুভ ছায়া বিছিয়ে রাখা হয়েছে পুরো বাঘাবাতে। আধুনিক এই যুগেও এখানে দাঁড়িয়ে ওদের মনে হয় – মধ্যযুগের কোন এক চলচিত্রের দৃশ্যে ঢুকে গেছে ওরা।

ঘাড়ের পেছনে মৃদু টিংটং শব্দ শুনে ওরা ফিরে তাকায়, টানা-রিকশা নিয়ে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।

ওদের জন্য আরও অবাক হওয়ার পালা। এই আমলে এরকম রিকশার প্রচলন কি এখনও আছে?

‘শহর থেকে এসেছেন?’ যথেষ্ট ভদ্রভাষাতে শব্দগুলো উচ্চারণ করে রিকশাওয়ালা।

মানুষটাকে অন্ধকারে দেখে মুখ বাঁকায় বৃষ্টি। রীতিমত ভয়ানক একটা চেহারা। চোখগুলো বড় বড়। কিন্তু কোন পাপড়ি নেই ওগুলোর ওপরে।

নাকটা বেকায়দা রকম ভেঙ্গে বাঁকিয়ে আছে একদিকে। কপালে ভালো রকম ভাঁজ পড়েছে। যেন তীব্র বিরক্তি নিয়ে লোকটা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

সেই সাথে মাথার চুল – একগোছা চুল ছাড়া আর কিছু নেই মাথাতে।

একজন মানুষ কিছু জানতে চাইছে – তাকে তো উত্তর দেওয়া লাগে।

তুর্য মুখ খোলে,’জ্বি চাচা। ঢাকা থেকে এসেছে আমার বন্ধুরা।’

তুর্যের মাথাতে ঘুরছে অন্য চিন্তা। শামান মানুষটার ডেরা কোথায় জানতে পারলে ভালো হত।

এই লোক যেহেতু স্থানীয় – একেই প্রশ্নটা করা যেতে পারে।

কিন্তু কষ্ট করে প্রশ্নটা তুলতে হয় না আর তুর্যকে, রিকশাওয়ালাই জানতে চায়,’শব বাবাকে খুঁজছেন তো?’

‘প্রখ্যাত শামান যিনি?’ চট করে জানতে চায় বিস্মিত ইমরান।

‘যাক – আপনারা তাঁর আসল পরিচয় জানেন। এখানে বেশিরভাগ অশিক্ষিত লোক, মশাই। শামান কি তা জানে না। তবে শব বাবা বললে নিমেষে চিনে ফেলে। অদ্ভুত রকমের পাবলিক, ব্রাদার!’

টানা-রিকশাওয়ালার বাচনভঙ্গীও ওদের আশ্চর্য করে। কিছু একটার হিসেব মিলছে না মোটেও।

‘আমরা ওখানে যাবো – তা আপনি বুঝলেন কি করে?’ সন্দেহবাতিক বৃষ্টি প্রশ্নটা না করে পারে না।

হাসে রিকশাওয়ালা,’কারন – শহর থেকে এখানে যে কয়জন আসে – তারা ওখানেই যেতে চায়। গেলে চলুন, রিকশাতে করে পৌঁছে দোব।’

রিকশাওয়ালার কথাতে কেমন জানি কলকাতা এবং বাংলাদেশী – মিশ্র টান – অদ্ভুত রকমের মিষ্টি লাগে ওদের শুনতে।

একে অন্যের দিকে তাকায় ওরা। অচেনা মানুষ – রিকশা চালাচ্ছে আবার টানা। প্রস্তর যুগে ফিরে গেলেও একটা কথা ছিল – কথা বলছে আবার আধুনিক বাংলাতে!

‘এসেছি অ্যাডভেঞ্চারে। এত দেখলে হয়? চল উঠি।’ বৃষ্টিই লাফিয়ে উঠে বসে ওপরে।

রিকশাটা অনেকটা চওড়া। পেছনের দিকে লম্বা কিছু একটা র‍্যাপিং করা – মাল পত্র কিছু হবে হয়ত।

ওটার ওপর বসে পড়ে তুর্য আরাম করে। ইমরানও বসে তুর্যের পাশে।

রিকশা চলতে শুরু করে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে টানা-রিকশাওয়ালা।

একবার ফিরে তাকায়,’লাশের মুখের ওপর বসবেন না, দাদাবাবুরা। ভচকে যাবে। বুকেই বসুন।’

‘ল-লাশ?’ চমকে নিজেদের পশ্চাদ্দেশ যেখানে ঠেকেছে – সেই র‍্যাপিং করা বস্তুটার দিকে তাকায় ওরা।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। শব বাবার জন্য যাচ্ছে। শক্ত হয়ে বসুন, দাদা – রাস্তা ভালো না।’

মুখ টিপে হাসে বৃষ্টি। আর শুকনো মুখে বৃষ্টির পাশে চলে আসে ওরা দুইজন। লাশ থেকে নেমে গেছে।

বিরক্ত হয় বৃষ্টি,’কোলে এসে বসছিস কেন? দেব এক থাপ্পড়! তিনজনের জায়গা হয় এখানে? যা একজন লাশের কাছে!’

নড়ে না  ইমরান।

বৃষ্টির কোলে বসতে রাজি – কিন্তু লাশের কোলে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে ওর নেই।

কিছুক্ষণ পর প্রায় ভাঙ্গা একটা কুটির চোখে পড়ে ওর।

সামনে অপেক্ষা করছে এক দঙ্গল লোক।

শব-বাবার আস্তানা।

শামান!

তিন

ধীরে ধীরে জনতাকে পাশ কাটায় টানা-রিকশাওয়ালা। তাকে দেখে অনেকে দাঁড়িয়ে যায়।

যারা দাঁড়ায় নি তখনও – লাফিয়ে উঠে খেয়াল করতেই।

সবাই অধোমুখে দাঁড়িয়ে আছে দেখে মাথা নাড়ে রিকশাওয়ালা মানুষটা।

‘নির্বোধ সব শালারা। দাঁড়িয়ে সম্মান দেখানোর কিছু নেই। দেখাতে চাইলে সেটা আমাদের চারপাশে বিচরণ করতে থাকা জ্ঞানী আত্মাদের দেখানো উচিত!’

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায় ইমরান।

বেশিক্ষণ পারে না – বৃষ্টি ওকে কোল থেকে সরানোর জন্য ঠেলাঠেলি লাগিয়েছে এরই মাঝে।

‘আপনারা দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন – লাইনে দাঁড়াবার দরকার নেইকো। আমার সাথে সাথে চলে আসুন।’

আস্তে করে ওর পাশে নেমে আসে ইমরান। হাঁফ ছাড়ার মত শব্দ করে বৃষ্টি।

‘আপনিই শামান?’ হাত বাড়িয়ে দেয় ইমরান,’আমি ইমরান। আপনার খোঁজ দিয়েছে কাজিন তুর্য। আর ও আমার বান্ধবী বৃষ্টি।’

হাত মেলায় শামান ইমরানের সাথে। ইমরানের অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। কেউ যেন ওকে টেনে তুলে নিয়ে যাচ্ছে শুন্যে – ওপরে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ঠান্ডা – সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!

দ্রুত হাত ছেড়ে দেয় শামান, নিজের পরিচয় দেয় নি হাত মেলালেও। সম্ভবতঃ নামটি নিজেই বিস্মৃত হয়েছে।

“শব-বাবা” বা “শামান. পরিচয়টাতেই হয়ত এখন মানুষটা অভ্যস্ত।

‘ভেতরে চলুন।’, হাসিমুখে বলে শামান,’রুদ্র!’

ভীষণভাবে চমকে ওঠে ইমরান আর বৃষ্টি। রুদ্রকে ডাকছেন কেন শামান?

বৃষ্টি তার অবিশ্বাসী চেতনা খুঁজে পাচ্ছে না অনেকক্ষণ ধরেই। প্রথমতঃ শামান মানুষটার জানার কথা না ওরা এখানে এসেছে তারই কাছে। অথচ এখানে নামার তিন মিনিটের মাথায় শামান তাদের কাছে টানা রিকশা নিয়ে পৌঁছে গেছে।

আগে থেকে না জানলে সম্ভব ছিল না সেটা কোনভাবেই।

ব্যাখ্যা খুঁজতে এখানে অবশ্য আসে নি ওরা। এসেছে ব্যাখ্যাতীত কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। সেই সাথে টেনসর অ্যানালাইসিস সলভ করতে।

তবে ওদের নিরাশ হতে হয়। কুটিরের ভেতর থেকে ওদের মৃত বন্ধু রুদ্র বের হয়ে আসে না। বরং বের হয়ে আসে অতিকায় স্বাস্থ্যের একজন লোক।

ওদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে শামান,’ঘাবড়াবেন না। আপনাদের মৃত বন্ধুর সাথে আমার শিষ্যের নাম মিলে গেছে। আমার ফুট-ফরমাস খাটে এই রুদ্রই। চলুন ভেতরে। রুদ্র লাশটা নামিয়ে নেবে।’

আগে থেকে শামান কিভাবে সব জেনে ফেলে তা নিয়ে আর চমকায় না ওরা। গায়ে সয়ে গেছে!

শামানের সাথে ওদের আগে আগে ঢুকে যেতে দেখে এতক্ষণ লাইনে অপেক্ষা করতে থাকা লোকগুলোর নাক-মুখ হিংসাতে কুঁচকে উঠে।

সেদিকে মোটেও ইন্দ্রীয়ের মনোযোগ না দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় ওরা।

ওরা ঢুকতেই চমকে ওঠে – কুটিরের মাঝখানটা খুবই সাধারণ। মেঝেতে খড় বেছানো। আর কিছুই নেই – চারধারে চারটা মোমবাতিকে বাদ দিলে।

একজন অতিক্ষমতাধর শামান একেবারেই ফকিরের মত আছেন এটা ওদের আশ্চর্যান্বিত করে না। বরং এটাই স্বাভাবিক।

তবে চমকে ওঠার কারণ হল মেঝেতে শুয়ে থাকা লাশটা।

অন্তত তিনদিনের পুরোনো একটা লাশ। হাল্কা হাল্কা পচা গন্ধ বের হয়ে আসছে ওটা থেকে।

ঘরের অন্য কোণে দাঁড়িয়ে পড়ে ওরা।

ভৃত্য রুদ্র ঢুকে পড়ে পরের মুহূর্তেই, চ্যাংদোলা করে পুরোনো পচা লাশটা বের করে নিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওরা।

তবে স্বস্তি টেকে না বেশিক্ষণ। নতুন একটা লাশ নিয়ে ফিরে আসে লোকটা। নির্ঘাত এই লাশটাই এসেছে ওদের সাথে রিকশাতে!

দড়াম করে ফেলে দেয় ওটাকে আগের লাশের জায়গাতে।

শামান এবার দুই পা তুলে আরাম করে পদ্মাসনে বসে পড়লেন লাশটার ওপর।

তারপর কোমরের কাছ থেকে একটা সিগারেট বের করলেন। ঘরের এক পাশ থেকে একটা মোমবাতি নিয়ে এগিয়ে আসে রুদ্র। লোকটা প্রকান্ড। তার শরীরের ছায়াতেই সব অন্ধকার হয়ে আসে।

শামান আলতো করে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে তাকালেন ওদের দিকে।

‘লাশের ওপর বসতেই হয় আমাকে। যার লাশ তার আত্মা আমাকে সব সময় রাখে আপডেটেড। অনেকটা ইন্টারনেট কানেকশনের মত।’ ব্যাখ্যা দেন তিনি।

সরু চোখে তাকায় ইমরান,’লাশ তো পচে যাওয়ার আগেই পাল্টে ফেলেন দেখলাম। এত লাশ পান কোথায়?’

জবাবে উত্তর না দিয়ে রহস্যময় একটা হাসি দেন শামান। চুপ হয়ে যায় ইমরান তা দেখে।

‘রুদ্র – আপনাদের সহপাঠি। তার সাথে আমাকে যোগাযোগ করতে হবে। তাই তো? জানতে চাইতে হবে তার শেষ চিন্তা কি ছিল?’

গড় গড় করে সব বলে দিচ্ছেন শামান – চোখ কপালে উঠে যায় ওদের। কপালে চোখ থাকা অবস্থাতেই এক হাত তোলে ইমরান।

‘শেষ চিন্তা না ঠিক। আমাদের উপপাদ্য নিয়ে তার চিন্তা।’

‘বেশ তো। দক্ষিণার ব্যাপারে তাহলে আপনাদের জানাই আমি?’ ভারিক্কি চালে বলেন শামান।

‘বলেন, প্লিজ।’ মানিব্যাগ হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে ইমরান।

‘আত্মার সাথে যোগাযোগ – দশ হাজার টাকা প্রতি আত্মা।’ পাশ থেকে গমগমে স্বরে বলে রুদ্র।

মানিব্যাগ পকেটে ঢুকে যায় ইমরানের। ছয়হাজার ক্রস করলে টাকাটা দেবে বৃষ্টি – কথা হয়েই আছে।

বৃষ্টি ভ্যানিটিব্যাগ খালি করে দশ হাজার দেয় তখনই।

টাকা পেয়ে শামানের মুখের হাসিখুশি ভাব আরও বেড়ে যায়।

চট করে একটা ছুরি বের করে ফেলে লোকটা। আৎকে ওঠে বৃষ্টি।

তবে ওদের দিকে না – ছুরিটা সজোরে গাঁথিয়ে দেন তিনি বসে থাকা লাশটার শরীরেই।

তারপর আঙুলের ডগা থেকে রক্ত নিয়ে নিজের কপালে ঠেকান। চোখ বন্ধ হয়ে আছে।

নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যায় ওরা।

শামান দুলছেন। সেই সাথে দুলছে তাঁর চার কোণের মোমবাতিতে উৎপন্ন চারটি ছায়া। ঘরের প্রতিটি দেওয়ালে শুধু দুলন্ত শামান!

ইমরানের মনে হয় গোটা ঘরটাই দুলতে শুরু করেছে। শামানের ঠোঁটদুটো চেপে বসেছে একে অন্যের সাথে।

তবুও কোথা থেকে জানি মৃদু একটা গুঞ্জন শুনতে পায় ও – কেউ মন্ত্র পড়ছে?

বৃষ্টি খপ করে ওর হাত চেপে ধরলে ও বুঝতে পার – একই অনুভূতি হচ্ছে মেয়েটারও।

তুর্যের দিকেও আড়চোখে তাকায় ইমরান, ছেলেটার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে একেবারে।

শামান দুলতে দুলতে কেঁপে গেলেন একেবারে। তারপর আস্তে করে শুয়ে পড়লেন মাটিতে।

থর থর করে কাঁপছে শামানের শরীর। সেই সাথে গ্যাজলা বের হতে শুরু করে মানুষটার মুখ থেকে।

হতভম্ব হয়ে একে অন্যের দিকে তাকায় ওরা। শামানের কি সাহায্যের প্রয়োজন?

শামান-ভৃত্য রুদ্র ঘরের এক কোণেই বসে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে হাল্কা।

অর্থ সম্ভবতঃ “কিছু করার প্রয়োজন নেই। অপেক্ষা করুন।”

শামান মানুষটা তড়পে উঠছেন। চার হাত-পা ছুটছে তাঁর মেঝের দিকে – যন্ত্রণাতে মুচড়ে মুচড়ে উঠছে শামানের শরীর।

তারপর একেবারেই হঠাৎ চিত হয়ে থাকা শরীরটা উল্টে গেল। তড়পানির পরিমাণ বাড়ছে।

ঘরের মাঝে গুঞ্জনের শব্দ বেড়ে গেল অনেক। কেঁপে কেঁপে উঠছে ঘরটা।

অশুভ একটা শক্তি যেন দুই হাতে  ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে ছোট্ট ঘরটাকে!

‘ঠাস’ জাতীয় শব্দের সাথে কড়িকাঠের একটা বর্গাতে ফাটল ধরে ছাতে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় ওরা। ঘরটা ভেঙ্গে পড়বে না তো?

সাথে সাথে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে উঠে বসেন শামান।

‘প্রতিশোধপরায়ণ আত্মা। খুন করা হয়েছে রুদ্রকে। নিজের খুনীর মৃত্যু দেখতে চায় ও। দুঃখিত, ইমরান, তবে উপপাদ্য নিয়ে তার আগে কথা বলানো যাবে বলে মনে হয় না একে দিয়ে।’

চার

‘খুন?’ চমকে ওঠে ওরা।

প্রতিবাদও করে ইমরান,’না, গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে রুদ্র। ব্রেক ফেল। নিজে ড্রাইভ করছিল। অ্যাকসিডেন্ট। ওর সাথে আর কেউ ছিল না।’

চোখ বন্ধ করে দম নেন শামান।

কৈফিয়ত দেন,’আত্মাদের জগতে বিচরণ করাটা বেশ পরিশ্রমের কাজ। তবে আমি ভুল শুনিনি। আত্মারা আমাদের থেকে বেশি জানে, ইমরান। খুন হয়েছিল রুদ্র।’

‘খুনীর নাম কি সে বলেছে?’ জানতে চায় বৃষ্টি।

হাসে শামান,’নিশ্চয়। তার চাচাতো ভাই জামিল। আর বৃষ্টি, তোমার ওপরও রুদ্র রেগে আছে। কোন কারণে।’

ফ্যাকাসে হয়ে যায় বৃষ্টির মুখটা,’অ্যাকসিডেন্টের আগে আমাদের ঝগড়া হয়েছিল, শামান। রুদ্র ছিল আমার বয়ফ্রেন্ড।’

*

ফোন দিয়ে নিশ্চিত হয়েছে ইমরান, আসলেই জামিল বলে একজন চাচাতো ভাই আছে রুদ্রের।

মানে, ছিল।

ছেলেটা তাকে দেখতে পারত না কেন সেটা এখন বুঝে উঠতে পারছে না। কোন কারণে তাদের মনোমালিন্য ছিল – এতটুকু বলতে পারে রুদ্রের বড় ভাই তিয়াস।

মানুষটা এমনিতেই ভাই হারানোর বেদনাতে মুষড়ে আছে – ইমরান ফোনে আর বেশি কথা বলে না। পকেটে নিয়ে ফিরে আসে আবার কুটিরে।

‘কথা সত্য। জামিলের সাথে  ঝামেলা ছিল ওর। প্রতিশোধ না নিলে রুদ্র মুখ খুলবে না বলেছেন তো?’ জানতে চায় ইমরান আবারও।

মাথা ঝাঁকান শামান,’ছেলেটা বলেছে, খুনের বদলে খুন।’

বৃষ্টির গলাটা এবার কেঁপে ওঠে,’কিন্তু কিভাবে? আমরা এখানে কেউ-ই খুনী নই।’

তুর্য ঠান্ডা আছে এখনও, শামানের দিকে ঝুঁকে যায় ও,’আপনি ওদের সাহায্য করতে পারবেন?’

‘খুন? ও তো খুবই সহজ কাজ। এখানে বসেই করতে পারব। তবে দক্ষিণা লাগবে।’ শর্ত জুড়ে দেন শামান।

একে অন্যের দিকে তাকায় ওরা। খুন করতে শামানের শক্তি কি তারা ব্যবহার করতে চায়?

আসলেই কি তাতে পৃথিবীর বুকে ওদের থেকে অনেক দূরে থাকা একটা মানুষ খুন হয়ে যাবে?

এতে কি পরে ওদের অনুশোচনা হবে?

রুদ্র কি আসলেই খুন হয়েছিল?

খুন না হলে কিভাবে শামান রুদ্রের একজন কাজিনের নাম ঠিক ঠিক ভাবে বলতে পারলেন – যার সাথে তার আগে থেকেই ঝামেলা ছিল?

এসব প্রশ্ন ওদের মাথাতে ঘুর ঘুর করছে।

মৃদু হাসেন শামান,’দ্বিধা থাকলে থাকুক। আর দক্ষিণাটা এবার অর্থের না। শামানদের ব্যাপারে কতটুকু জানেন আপনারা? আমাদের কাজের ধারার ব্যাপারে? বসুন, বসে পড়ুন।’

বসে পড়ে ওরা।

‘আমরা, শামানরা যখন একটা ডেস্ট্রাকশন চালাই – তখন আমাদের অন্য কোন জীবন্ত বস্তু থেকে ধার নিতে হয় জীবনীশক্তি।’

‘আরেকটু স্পষ্ট করে বলবেন কি?’ ইমরান বিড় বিড় করে বলে।

‘মানে, আপনাদের দক্ষিণা দিতে হবে আপনাদের আয়ু থেকে কিছু অংশ। যদি একটা হত্যাকান্ড চালাতে চান – আমাকে অবশ্যই আরেকটি জীবিত বস্তু থেকে আয়ু নিতে হবে। শক্তির নিত্যতা সূত্র তো পড়েছেন?’

‘আপনিও দেখছি রীতিমত লেখা পড়া জানা মানুষ। এখানে পড়ে আছেন কেন?’ প্রশ্নটা না করে পারে না এবার ইমরান।

‘সভ্য জগত আমাকে দূরে ঠেলে দেবে। শামানিজম আমার প্যাশন, ফ্রেন্ড।’ হাল্কা হাসেন শামান।

অধৈর্য্য হয়ে ওঠে বৃষ্টি,’এখন কাজের কথায় আশা যাক। আমাদের আয়ু নেবেন মানে?’

গম্ভীর মুখে তাকায় শামান,’মানে তো সহজ। আপনারা যখন মারা যাওয়ার কথা – তার আগে মারা যাবেন।’

‘কয় বছর? কয় বছর আয়ু চান আপনি?’ শুকিয়ে যাওয়া গলা নিয়ে বলে ইমরান।

‘কয়েক দিন। এত চমকে ওঠার মত কিছু না। হাল্কা আর কি। আর আপনারা তিনজন আয়ু দিলে সেটা ভাগ হয়ে যাবে তিনভাগে। আরও কম করে যাবে একেকজনের আয়ু।’

‘তুর্য এখানে আয়ু দেবে না। শুধু আমাদের দুইজনের।’

রেগে ওঠে তুর্য,’আমিও দেব। এসেছি না একসাথে? তুই চুপ করে থাক।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন শামান,’সেক্ষেত্রে আপনাদের হয়ত এক বা দুইদিন আয়ু কমবে। সবার জন্যই তেমন ব্যাপার না। তাই না?’

একটু ভেবে একমত হয় সবাই।

‘শুধু রুদ্রের খুনী যেন প্রাণ নিয়ে না যায়, শামান। ওটা দেখবেন।’ গড় গড় করে ওঠে ইমরান।

ওর ইচ্ছে করছে নিজ হাতেই জামিল ব্যাটাকে খুন করে আসতে। ব্রেক নিশ্চয় কেটে রেখেছিল। রাস্তায় বের হওয়ার পর পুরোটা গেছে। আর তাতেই মৃত্যু হয়েছে বেচারা রুদ্রের।

আর ওরা আটকে আছে টেনসর অ্যানালাইসিসস নিয়ে!

শালার ব্যাটা!

‘তা যাবে না। তবে কিছু যোগাড় যন্ত্র আছে। একটা লাশ দরকার।’ ঠান্ডা গলাতে বলেন শামান।

‘স্বাভাবিক।’ মাথা দোলায় ইমরান,’তবে লাশটা তো হতে হবে বদ আত্মার। সেটা পাবো কোথায়?’

‘কবরস্থান আছে এদিকে একটা। নুরু মুচি মারা গেছে দিন দুয়েক হল। ব্যাটা অন্যের জমি কেড়ে নিয়ে দশ বছর থেকেছে। আত্মা পংকিল। ওর লাশেই কাজ হবে।’

‘মুচির হাতে জামিলের মৃত্যু – খারাপ না।’ বিড় বিড় করে বলে ইমরান,’আয় তোরা। লাশ চুরি করতে হবে।’

পাঁচ

‘স্বাভাবিক?’ রাগে গড় গড় করে বলে বৃষ্টি,’শামান বলে দিল লাশ লাগবে আর তুই বলে দিলি স্বাভাবিক? বারগেইন করা যেত না? লাশ ছাড়া পারবে না সে কাজটা করতে?’

অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। কবরস্থানের লোকেশন শামান জানিয়ে দিয়েছেন। জানিয়েছেন কবরের লোকেশনও।

নির্দ্বিধায় সেদিকে রওনা দিয়েছে ওরা।

বৃষ্টির কথা শুনে একটু হাসে ইমরান।

‘শামানিজম নিয়ে তোর আরও পড়াশুনা করা উচিত ছিল। তাহলেই এসব আজগুবী কথা বলতি না। শামানরা মৃতকে তার আত্মা ফেরত দিতে পারেন কিছু সময়ের জন্য। মৃতকে করতে পারেন জীবিত। আমাদের এই শামানের সত্যতা সম্পর্কে আমাদের কারই এখন সন্দেহ নেই। কাজেই ইনিও সেটা করতে পারবেন। তবে প্রতিশোধ যদি নিতেই হয়ে তাঁকে – তাহলে অবশ্যই একটা দুষ্ট আত্মা আর তার শরীর লাগবে। শুধু প্রতিশোধের জন্য না। যেকোন কাজ করিয়ে নেওয়া যায় এই বদ আত্মা দিয়ে।’

তুর্য এখানে প্রশ্ন করে,’কেন, দুষ্ট আত্মা কেন?’

‘শামান আর ভুডুদের মাঝে পার্থক্য এখানেই, বস।’ জানায় ইমরান,’ভুডুরা আত্মা নিয়ে অনেক কিছু করতে পারে – তবে তারা আত্মার বিচারে ভালো আত্মা – খারাপ আত্মা দেখে না। যেটা দিয়ে ইচ্ছে কার্যউদ্ধার করে। শামানরা যথেষ্ট ভালো। তারা ঘাঁটে শুধু মন্দ আত্মাদের। ব্যবহার করে মন্দ আত্মাগুলোকেই। তাদের দিয়েই ওরা বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেয়। ভুলেও ভালো আত্মাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে না তারা।’

‘হুম, লোক ভালো।’ মাথা ঝাঁকায় তুর্য,’ভালো কথা – রুদ্রের আত্মা বৃষ্টির ওপর ক্ষেপে আছে কেন?’

হাত নাড়ে বৃষ্টি,’ওটা আমিও বুঝলাম না। আমার ভালো লাগত রুদ্রকে। ভালো লাগে ইমরানকেও। সেটা রুদ্র নিজেও জানত। রাগ করে থাকার মত তো না।’

‘বাদ দে।’ বলে ইমরান।

যদিও ছেলে হিসেবে রুদ্রের রাগের কারণটা বুঝতে পারছে। ওর সাথে রিলেশন থাকা অবস্থাতে কয়েকবার বিছানাতে গেছে ইমরান বৃষ্টির সাথে। তবে ইমরান এতে খারাপ কিছু দেখেনি।

আফটার অল – অন্যের গার্লফ্রেন্ডকে ফ্রিতে পাওয়া গেলে কোন ছেলে আপত্তি করতে পারে?

তবে বিষয়টা রুদ্রের গায়ে লাগার কথা।

ভাবনাকে থামায় ও ওখানেই,’কবরস্থানে এসে গেছি।’

মাথা ঝাঁকিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে বাকি দুইজন।  শামানের কাছ থেকে ধার করে আনা শাবল আর বেলচা গুলো ওদের হাতে দুলছে ঘন ঘন।

নিজের শাবলটা শক্ত করে চেপে ধরে সামনে চলে যায় ও নিজেও।

টর্চের আলোতেই এতক্ষণ পথ চলেছে – তবে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ওই আলো মোটেও অন্ধকার কাটতে পারছে না এখানে। কবরের সারি চলে গেছে দুইপাশে। গ্রামে মানুষজন তেমন দেখেনি ওরা।

তবে মরার বেলাতে এরা আছে!

একেবারে সাফ হয়ে গেছে নাকি? নাহলে এত কবর আসল কোথা থেকে?

বেশিক্ষণ গবেষণা করে না অবশ্য ওরা। মুচির কবরটা পেয়ে যেতেই খোঁড়া শুরু করে দেয়।

বৃষ্টিকে দাঁড় করিয়ে রেখে ওরা দুইজন খুঁড়ছে। সোৎসাহে একবার বৃষ্টি এগিয়ে এলেও আরেকটু হলেই ইমরানের পা কেটে ফেলেছিল ও শাবল মেরে! তারপর তাকে আবার দূরে দাঁড় করানো হয়েছে।

শান্তিতে দাঁড়াতে পেরেই হয়ত প্রশ্নটা আসে ওর মাথাতে।

‘আচ্ছা, তাহলে এই লাশটাকে তার আত্মার সাথে যোগাযোগ ঘটিয়ে শামান আত্মাটাকে বশে আনবে? তারপর তাকে লেলিয়ে দেবে জামিলের ওপর?’

কপাল থেকে ঘাম মুছে ইমরান,’ঠিক তাই। এভাবেই কাজ করে শামান। আর শুধু এসবই করে তাও না, ভালো কাজও – যেমন রোগীকে সুস্থ করতে পারে। আত্মা দিয়ে অনেক কিছুই করা যায়। তবে এই প্রতিশোধের মত ব্যাপার আসলে আমাদের আয়ু নিতে হবেই তাকে। কারণ, সে যদি না জানে কার আয়ু যাচ্ছে – তাহলে ফাঁক থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিছু করতে হলে অবশ্যই লিভিং পার্টস নিতে হবে। এটা অনেকটা রিসোর্সের মত। সব বুঝেই মেনে নিয়েছি আমি।’

‘এহ হে! আমি মনে হয় শালার পায়ে বেলচা লাগিয়েছি। থলথলে হয়ে আছে লাশটা মরে ফুলে!’  বিরক্তির সাথে বলে তুর্য।

‘দুইদিনের মরা। থলথলে তো হয়ে থাকার কথা না।’ মাথা নাড়ে ইমরান। দ্রুত সরাচ্ছে মাটি।

আরেকটু সরাতেই মরদেহটাকে পাওয়া গেল। শক্ত হয়ে আছে চামড়া আর মাংস। মোটেও থলথলে না।

‘পা ধর। আমি কাঁধ ধরছি। টেনে তোল।’ তুর্যকে বলে ইমরান।

বৃষ্টি চকচকে চোখে তাকিয়ে দেখে লাশটাকে। টেনে তুলছে ইমরান আর তুর্য।

একেবারেই হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে মেয়েটা।

থমকে গেছে ইমরান আর তুর্যও। কোন রকম আগাম সংকেত না দিয়ে চোখ মেলেছে মুচি। তারপর ওদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ায়।

চোখের সামনে মরদেহটা উঠে দাঁড়াতে দেখে তীব্র আতঙ্কে থমকে যায় ওরা।

নুরু মুচি হাঁটছে। থপ থপ শব্দ হচ্ছে কবরস্থানের মাঝে। কোনদিকে না তাকিয়ে সরলরেখা ধরে হেঁটে যাচ্ছে লাশটা।

লক্ষ্য ওরা সবাই বোঝে।

শামানের কুটির!

কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফলো করে ওরাও। লাশ যেখানে যাবে ওদের গন্তব্যও তো সেখানে!

*

নতুন পাওয়া লাশটার ওপর আয়েশ করে বসেছেন শামান। কুটিরে ঢুকেই দড়াম করে পড়ে গেছে মরদেহটা।

আর তাতে চড়ে বসতে বেশ আরামই লাগার কথা শামানের।

‘কাজ শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই মারা পড়বে জামিল ছেলেটা।’ গম্ভীর মুখে জানান শামান।

হা করে তাকিয়ে থাকে ইমরান,’এত দ্রুত?’

‘অবশ্যই। আর কত সময় লাগার কথা? আত্মাদের গতি আলোর থেকেও বেশি হয়। শুধু নিজের করে নেওয়া। এই মুচি -’ আঙুল দিয়ে খোঁচা দেন শামান লাশের গায়ে,’এখন আমার।’

মৃদু কেঁপে ওঠে ঘরটা।

‘আপনাদের কাজ আমি করে দিয়েছি। আয়ু কমার জন্য দুঃখ পাবেন না। স্বার্থ তো উদ্ধার হচ্ছে। তাই না?’ চকচকে হাসি দেন শামান।

‘তারপর আপনাকে আরেকবার যোগাযোগ করতে হবে রুদ্রের সাথে। উপপাদ্যের প্রমাণটুকু জেনে ফিরতে হবে।’ অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে ইমরান,’আরও দশ হাজার পাবেন।’

মধুর হাসি দেন শামান ছেলেটার ব্যগ্রতা দেখে।

‘আগে আরেকটা কাজ করে আসুন। আমার শিষ্য রুদ্রের সাথে যাবেন গিয়ে দেখুন পেছনের ঘরে একটা আলমারী আছে। ওতে থাকা কলসীতে তিনজনই হাত ধুয়ে আসুন। পরে কাজে দেবে।’

বিশালদেহী রুদ্রের পেছন পেছন হেঁটে যায় ওরা।

কুটিরের পেছন দিকে যে আরেকটা ঘর আছে – এই প্রথম টের পায় ওরা।

ঘরের এক প্রান্তে আছে একটা সিঁড়ি। মাটির নীচে নেমে গেছে ওটা।

ধীরে ধীরে রুদ্রের সাথে নেমে আসে ওরাও।

অন্ধকার ঘরটাতে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকায় বৃষ্টি, এখানে কলসি কোথায়?

শামানের কোন ধরণের চাল?

মৃদু কন্ঠ ভেসে আসে শামানের আচমকাই,’প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আপনাদের আয়ু নিতে হল আমাকে। নাহলে জামিলের হত্যাকান্ড সম্ভব না। দুঃখিত।’

ঘুরে ঘুরে কোথাও দেখে না ওরা শামানকে। নিশ্চয় লাশের ওপর বসেই এই কথা বলেছে লোকটা!

ওদিকে শামান-ভৃত্য রুদ্রের হাতে বেড়িয়ে এসেছে চকচকে ছুরিটা। ওদিকে তাকিয়ে ঢোক গেলে ইমরান।

এই বিশাল লোকটার সাথে পারবে কেন ওরা?

মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে বৃষ্টি,’আপনি বলেছিলেন – দুই-একদিন কমবে আমাদের আয়ু। আমরা তিনজন দিয়েছি আপনাকে আমাদের আয়ু। খুবই সামান্য কমার কথা না?’

জবাব আসে না।

ছুরি চালিয়েছে রুদ্র দুই হাতে। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘরটা ঘরঘরে একটা শব্দে ভরে যায়।

তিনজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ জবাই হয়ে পড়ে থাকলেই শুধু তাদের কেটে যাওয়া শ্বাসনালী থেকে এরকম শব্দ হতে পারে।

শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিল ইমরান, শামান এত লাশ পান কোথা থেকে!

পরিশিষ্ট

দুইদিন পর।

স্টেশনের মাত্র তিন মাইল দূরে দাঁড়িয়ে আছেন শামান।

ট্রেনটা উল্টে পড়ে আছে ওখানে। চারপাশে ধোঁয়া। আগুন লেগে গেছে বগিগুলোতে।

খালি চোখে দেখে শামান যা বুঝলেন – ঢাকাগামী এই ট্রেনটাতে অন্তত শ’দুয়েক মানুষ মারা গেছে। আহতদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে এখনও।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফিরে তাকান তিনি।

প্রকৃতি কেন ঠিক মুহূর্তেই চেয়েছিল ওদের মৃত্যু সেটা এখন বুঝেছেন।

প্রকৃতির হিসেব ভুল হয় না।

এই ট্রেনে করেই ফেরার কথা ছিল ওদের। আয়ু দুই দিন কমে যাওয়াতে বাঘাবাতেই মরতে হবে তাদের – এতে আর আশ্চর্যের কি?

প্রতারক ছিল মানুষগুলো। মেয়েটি ঠকিয়েছিল বয়ফ্রেন্ডকে। ছেলেটি বেস্ট ফ্রেন্ডকে।

আত্মাগুলো ভালো নয়। মন্দ।

বেশ কাজে দেবে ওরা।

আলতো একটা হাসি ফোটে শামানের মুখে।

— ০ —

আলকেমি

এক

‘লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি আর আইজ্যাক নিউটনও চর্চা করেছেন আলকেমির।’ স্পষ্ট স্বরে বলে উজ্জ্বল।

চিন্তিত মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধ।

‘তাঁরাও বিশ্বাস করতেন এসব গাঁজাখুরীতে?’ না বলে পারে না ও।

একমত হয় না উজ্জ্বল, ’গাঁজাখুরী বলা তো ঠিক না। এই আলকেমি না থাকলে আজকের দিনে রসায়ন শাস্ত্র বলেই কিছু থাকত না। ’

এটা অবশ্য মানতেই হয় স্নিগ্ধকে, ’তা ঠিক। জাবির বিন হাইয়্যানকে আগে রাখতেই হবে। তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ আলকেমিস্ট তবুও রসায়নশাস্ত্রের জন্ম দিয়েছেন ওসব থেকেই। ফিনিক্স পাখির ছাই যেন। ’

সরু চোখে তাকায় উজ্জ্বল এবার বন্ধুর দিকে, ’তবুও কিভাবে আলকেমিদের ব্যাপারে অবিশ্বাস তোর? এটা তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। ’

বড় করে নিঃশ্বাস নেয় এবার স্নিগ্ধ।

‘দ্যাখ আলকেমিস্টদের ব্যাপারে কম বেশি আমিও জানি। ঠিক আছে? জ্ঞান দেওয়ার দরকার নেই। আলকেমির শুরুটা জানিস তো? সক্রেটিসের যুগ বলা চলে ওটাকে। জ্ঞান বিজ্ঞান ছিল মাত্রাতিরিক্ত পিছিয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কারা ছিল তখন জানিস? দার্শনিকরা। তাহলে বোঝ প্রাকৃতিক দর্শন যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন প্রকৃত বিজ্ঞানের শাখাগুলো যেমন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এদের অবস্থানটা কোন পর্যায়ে ছিল?’

উঠে দাঁড়ায় উজ্জ্বল, জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকায়, ’তোর কথা ঠিক আছে। এই যুগে দাঁড়িয়ে সেটাকে নিতান্তই গাধামী বলে মনে হবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের ওই পাগলামীগুলো না থাকলে আজকের বিজ্ঞান তো পেতি না। এটাও সত্য। জ্ঞানেরও বিবর্তন ঘটে। ’

ক্ষেপে ওঠে স্নিগ্ধ, ’তুই নিজেই খেয়াল করে দেখ আলকেমিতে বিশ্বাস করার কিছু নেই। রসায়নে আছে। আলকেমির বিবর্তিত রূপ এটা অলরাইট। মানলাম। এটাতে আমি বিশ্বাস করি। আলকেমিতে না। শব্দটার উৎপত্তি আর সংজ্ঞাতেই তো আছে ভুল। এসেছে আরবী’আলকিমিয়া’ থেকে অর্থ হল কালোমাটি। ব্ল্যাক ম্যাজিকের গন্ধ নামেই। তারপরে আছে সংজ্ঞা! ’

পকেটে হাত রেখেই ঘুরে দাঁড়ায় উজ্জ্বল, ’ভালোই ঘেঁটেছিস দেখা যায় আলকেমি নিয়ে। সংজ্ঞাটা আমারও জানা আছে। আলকেমি হল সেই শাস্ত্র যার শেখার উদ্দেশ্য হল পরিপূর্ণতা লাভ করা। আধ্যাত্মিক ভৌতিক। এই শাস্ত্র ধাতু থেকে সোনা প্রস্তুত করতে শেখায়, মানুষের অমরত্ব লাভের কৌশল আছে এই শাস্ত্রেই। কেন? এতে অবিশ্বাসের কি আছে? লোহা থেকে সোনা নির্মানের কাহিনী তোর কাছে আজগুবী লাগছে? অথবা, অমরত্ব?’

‘অফকোর্স!’ হাতে কিল দিয়ে বলে স্নিগ্ধ।

হেসে ফেলে উজ্জ্বল, ’ধর্মপ্রাণ হিসেবে তোর খাতি আছে। তোকে এক ওয়াক্ত নামাজও কেউ মিস দিতে দেখেনি মসজিদে। রোজাও মিস করিস না কোনদিন। প্রেম করিস যদিও তাছাড়া তোর মত ধর্মের পথে আমরা কেউই থাকতে পারি না এতটা। আর সেই তুই কি না অবিশ্বাস করবি অমরত্বকে?’

‘বিশ্বাস করার কারণ কি আছে?’ কটমট করে তাকায় স্নিগ্ধ।

‘অবশ্যই। আলকেমিদের নিয়ে ঘাঁটতে গেছিলি ইসলাম ধর্ম যে একে সম্পূর্ণ সাপোর্ট দেয় তা তো জানিস। ’

‘জানি, ’ মাথা ঝাঁকায় স্নিগ্ধ, ’আলকেমির জন্য শুধু জ্ঞানই যথেষ্ট না। এমনকী পরীক্ষাতে আলকেমি বিশ্বাসী না। তারা যাদুবিদ্যা আর অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী। এখানেই কেমিস্ট্রি আর আলকেমির মাঝে পার্থক্য। জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন খাঁটি মুসলমান। তিনি নিজেই ছিলেন আলকেমিস্ট। শিখেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধর জাফর সাদিকের কাছ থেকে। এবং পজিটিভ-নেগেটিভ শক্তির কোন একটা ব্যবহার করা ছাড়া আলকেমির কাজ হবে না এটা তাঁরও বিশ্বাস ছিল। নেগেটিভ শক্তি যে নিচ্ছে যে চালাচ্ছে ব্ল্যাক ম্যাজিক। আর পজেটিভ শক্তি নিয়ে আল্লাহর অনুগ্রহে রসায়নের গবেষণা হল আলকেমি। ’

‘এক্স্যক্টলি।’ সাপোর্ট দেয় উজ্জ্বল, ’আর আলকেমির উদ্দেশ্যই হল ফিলোসফার স্টোন আর এলিক্সির অফ লাইফ প্রস্তুত করা। হ্যারি পটার লেখার সময় লেখিকা জে. কে. রোলিং কিন্তু এগুলোই বেছে নিয়েছিলেন বিষয় হিসেবে। নিকোলাস ফ্লামেলকে তিনি উপন্যাসে একটা চরিত্র দিয়েছিলেন। তবে মানুষটা কিন্তু আসলেই ছিলেন। ’

‘ছিলেন নাকি?’ এই তথ্যটা ধাক্কা দেয় স্নিগ্ধকে।

‘অবশ্যই। প্যারিসে ছিলেন তিনি। বইয়ের দোকান ছিল তাঁর। শুরুটা ওভাবেই। পরে এই স্কলার আলকেমি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন। সোনা তৈরী করার জন্য তাঁর প্রচেষ্টার সীমা ছিল না। সোনা প্রস্তুত করাটা কিন্তু সব না। আসল চ্যালেঞ্জ হল একটা মৌল থেকে অন্য মৌলে পরিবর্তন করাটা। অতটুকু করতে পারলে সাধনা দিলেই হয়ে যাবে সোনার প্রস্তুতি। ’

‘তাহলে, সোনা তিনি বানিয়েছিলেন?’ ভ্রু কুঁচকে আছে স্নিগ্ধ। আলকেমিদের নিয়ে বেশ পড়াশোনা করলেও এই দিকটা সে জানত না।

মাথা ঝাঁকায় উজ্জ্বল, ’প্রথমে সাফল্য পেয়েছিলেন ইতিহাস যদি ঠিক থাকে ১৩৭৯ সালে প্রথমবারের মত দুইশ ত্রিশ গ্রাম পারদকে রূপাতে রূপান্তর করেছিলেন নিকোলাস ফ্লামেল। তিন বছর পর ওই পরিমাণ পারদকে তিনি সোনাতে পরিণত করতে সম্পূর্ণ সক্ষম হন। আর প্রসেসটা ছিল যতদূর বোঝা যায় বার বার পারদের হীটিং আর কুলিং দিয়ে। তবে যাই হোক পৃথিবীতে প্রথম মানুষ সম্ভবতঃ তিনিই যিনি আলকেমিতে সাফল্য পেয়েছিলেন। কাজেই অবিশ্বাসের কিছু নেই। ’

থতমত খেয়ে গেছে এবার স্নিগ্ধ। দেখে মায়া হল উজ্জ্বলের।

এবার ছেলেটাকে আরেকটু ডোজ দিতে হবে। আলকেমিতে অবিশ্বাসীদের একেবারেই সহ্য হয় না তার।

‘ইসলাম কি বলে? আলকেমি আছে নাকি নেই?’, আবারও নিজের টপিকে ফিরে আসে উজ্জ্বল।

‘আলকেমি ইসলামের সমর্থন না পেলে জাবির ইবনে হাইয়ান ওই পথে যেতেন না। তবে আরও কিছু প্রমাণ দরকার আমার।’ ঘুরিয়ে জবাব দেয় স্নিগ্ধ, ’রসায়নবিদ্যা তো ঠিক আছে। আমি সেটা বিশ্বাস করি আলকেমিতে বিশ্বাস রেখে অনেক কিছু আবিষ্কার করেছেন জাবির। যেমন হাইড্রোক্লোরিক এসিড। আরও কত যৌগ যে তিনি উৎপন্ন করেছেন যেগুলো ছাড়া আজকের রসায়নের মুখ দেখতে হত না আর। তবে কিভাবে বিশ্বাস করতে পারি আমরা লোহাকে সোনা বানাতে পারব কি না? অথবা অমরত্ব? এগুলো কি বিশ্বাস করার মত?’

‘কেন নয়?’, এবার হেসে ফেলে উজ্জ্বল, ’খিজির (আঃ) এর কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ? উনি কিন্তু মুসা(আঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেছেন। আবার পড়েছেন হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর জানাজা। তিনি কিন্তু মারা যাননি। এখনও পৃথিবীর কোথাও আছেন। কিভাবে সম্ভব?’

চমকে ওঠে স্নিগ্ধ, ’ওহ তাই তো। উনি’আবে হায়াত’ ঝর্ণার পানি খেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন অমরত্ব। ’

‘কাজেই মাই ডিয়ার স্নিগ্ধ, অমরত্বের অবিশ্বাসের কোন মানে আমি দেখি না। অন্তত তোমার মত ছেলের জন্য। আর অবিশ্বাসের কারণ দেখি না আলকেমিস্টদের নিয়েও। জাবির ইবনে হাইয়ান তো আছেনই। আরও আছে বয়েল আর নিউটন। কেমিস্ট্রি পড়তে গিয়ে বয়েলের সূত্র পড়েনি কে? দুইজনই ছিলেন আলকেমিস্ট। নিউটন তাঁর জীবনের একুশ থেকে সাতাশের মাঝেই যা বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করে গেছেন। আজও আমরা তাই পড়ি। তারপর বাকি জীবন তিনি লাগিয়েছিলেন আলকেমি নিয়ে। বয়েলের সাথে তিনি শেয়ারও করতেন এসব ব্যাপার। তারপর আছেন জাবির ইবনে হাইয়ান ইনি তো সঞ্জীবনী সুধা বা এলিক্সির অফ লাইফের ব্যাপারে নামকরণই করেছেন। আল-ইকসির। যেটা খেলে অমরত্ব পাবে মানুষ। যেটাকে এখন পশ্চিমারা বলে এলিক্সির। ’

অবশেষে পরাজয় মেনে নেয় স্নিগ্ধ, ’আমি এসব জানি। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই আলকেমির সত্যতা এখানে একটা প্রশ্ন চলেই আসে। জাবির ইবনে হাইয়ান বা নিউটনের মত বড় ধরণের মগজ আমাদের নেই। জ্ঞান তো ধরিনা তেমন। তাঁদের তৈরী করা পান্ডুলিপিও আমাদের হাতে নেই। এখানে আমাদের সোনা বানানোর প্রসংগ উঠালেই বা কি? সফলতা তো পাবো না। ’

এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই এত নাটক করেছে উজ্জ্বল। চমৎকার একটা হাসি ফোটে ওর মুখে, পকেট থেকে বের করেছে একফালি কাগজ।

‘পান্ডুলিপি নেই তবে ফিলোসফার স্টোন তৈরীর জন্য একটা ফর্মুলা পেয়েছি। এর ওপর ভিত্তি করেই এগিয়ে যাবে আমাদের কাজ। ’

 

দুই

‘ধ্যাত!’ হাতের ট্রেটা ছুঁড়ে মারে স্নিগ্ধ ঘরের এক কোণে।

ঘর না বলে এটাকে একটা ল্যাবরেটরি বলা যায়। পার্সোনাল ল্যাব। গত কয়েকদিন ধরে দুই বন্ধুর দিন রাত এখানেই অতিবাহিত হচ্ছে। কয়েকদিন বলাটা বোধহয় ভুল হবে। গত ছয় মাস ধরে দিনে অন্তত বারো ঘন্টা দিচ্ছে ওরা এখানে। ভার্সিটির হলে থাকার এই এক সুবিধে। বাসাতে গুতোগুতি করবে এমন কেউ আশেপাশে নেই।

মুক্ত একটা জীবন। একেবারে যথার্থ ব্যবহার করছে ওরা। একটা আলাদা বাসাতে ওরা কাজ করে ল্যাব হিসেবে। যন্ত্রপাতি সেই কবেই কিনেছে। স্পন্সরশীপ করে উজ্জ্বল। টাকার অভাব নেই ওর। শেয়ারমার্কেটে ভালো কিছু কোম্পানির শেয়ার কেনা আছে তার নামে। আর বাসাটাও নির্ঝঞ্ঝাট। স্নিগ্ধর গার্লফ্রেন্ড মহুয়ার মামার বাসা। মামা-মামী একেবারে আমেরিকা চলে গেছেন চিরতরে।

একই শহরে ভার্সিটি মহুয়ার ওদের সাথেই একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে মেয়েটা। কাজেই মামাটি তাকে দিয়ে গেছেন বাসা সামলানোর ভার। এই বিশাল বাসায় মেয়ে হয়ে একা তো আর থাকতে পারে না মহুয়া। তাই ও হলে উঠে আছে। আর চাবি দিয়েছে আপাতত উজ্জ্বল আর স্নিগ্ধকে।

বিজ্ঞানের একটা বিরল ধারাতে কাজ করছে ছেলে দুটো এতটুকুই জানে মেয়েটি। সব জানিয়ে নিজেদের পাগল প্রমাণের চেষ্টা করতে চায় নি ওরা কেউ। এই মুহূর্তে ট্রে রাগের চোটে ছুঁড়ে মারার কারণ আছে। প্রায় একমাস ধরে ওরা আটকে আছে এখানে। গবেষণার অগ্রগতিই নেই। প্রথম পাঁচমাসে তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছিল।

ধাপে ধাপে।

উজ্জ্বলের জোগাড় করা প্রসেসটার ব্যাপারে আগে থেকেই জানত স্নিগ্ধ। শুধু ও-ই নয় আলকেমি নিয়ে ঘাঁটে এমন প্রতিটা মানুষই জানে সে ব্যপারে। কিন্তু উজ্জ্বলের কাছে আরও কিছু ছিলো। এই প্রসেসকে বলা হয় ম্যাগনাম ওপাস। জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ নয়, আলকেমিস্ট যে পদ্ধতি অনুসরণ করেন তাকে ম্যাগনাম ওপাস বলা হয় টেকনিকাল টার্ম ধরে। এতটা ডিটেইলস পাবে সেটা আগে ভাবেনি স্নিগ্ধ , আর দেরী না করে গার্লফ্রেন্ডকে পটিয়ে বাসাটা ধার চেয়েছে।

ওদের দরকার নীরবতা। উটকো লোকের যন্ত্রণাতে কাজ করতে না পারলে কারোই লাভ হত না।  মহুয়ার মামা-মামীকে একেবারে সময়মত আমেরিকা ভেগে যাওয়ার জন্য ভাগ্যকে তখন ধন্যবাদ দিয়েছিল স্নিগ্ধ। এখন অবশ্য ভাগ্যের প্রতি ততটা সন্তুষ্ট না ও।

‘মাথা ঠান্ডা রাখ। মাথা গরম করলে ভাবতে পারবি না তো।’ পাশ থেকে বিড় বিড় করে বলে উজ্জ্বল।

‘মাথা ঠান্ডা! একটা মাস ধরে আটকে আছি এখানে। এই বালের ধাপে। তারপরও কি মনে হয়? ঠান্ডা থাকার কথা মাথা?’

স্বান্তনা দেয় উজ্জ্বল, ’নিকোলাস ফ্লামেল একুশ বছর ধরে শুধু কয়েকটা পৃষ্ঠার মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের মাত্র একমাস একটা ধাপে আটকে থাকাটা হতাশার কিছুই না। ’

চোখ গরম করে তাকায় স্নিগ্ধ, ’১৩৫০ সালের প্যাচাল আমার সামনে পাইড়ো না। তখন ইন্টারনেট ছিল না। রসায়নের কোন অগ্রগতি ছিল না। এখন আমাদের হাতে সব আছে। আমরা প্রাচীন আলকেমিস্ট না, উজ্জ্বল। আমরা এই শতকের আলকেমিস্ট। আমরা সব দিক থেকে সাহায্য নেব। নিচ্ছিও। রসায়ন আমাদের সাহায্য করছে দুই হাত ভরে। নাহলে কি তোর মনে হয় পাঁচ মাসে আটটা ধাপ পা হতে পারতাম আমরা?’

কিছু বলে না উজ্জ্বল। স্নিগ্ধের কথাতে যুক্তি আছে।

‘শোন, তোর আসলে নরটনের পদ্ধতি অনুসরণ করাই উচিত হয়নি। ধাপ এখানে ১৪টা। এর চেয়ে রিপলির পদ্ধতি ভালো ছিল। মাত্র বারো ধাপ। ’

বিরক্ত হয় উজ্জ্বল, ’আরে, ওর ধাপ কম দেখে তো ঝামেলা বেশি। জটিলতা বেশি। এরচেয়ে নরটনেরটাই ভালো। দেখ তুই এখানে আমাদের আটটা ধাপ পার হতে সমস্যা হয়নি। আটকেছি আমরা পিউট্রেফ্যাকশন স্টেজে। রাইট?’

‘তো? বালের ধাপ আমার। এখানে কি পচাচ্ছি আমরা? সালফারের সাথে? আমার মাথাতে আসছে না কিছু। এর পর বডিলি সালফারের সলিউশন পাওয়ার কথা। তারপর হোয়াইট লাইটের। আমরা পাচ্ছি কিছু?’

‘এটা নরটনের প্রসেস বলেই তবুও নবম ধাপে আমরা এসেছি, স্নিগ্ধ। রিপলির প্রসেস দেখতে পারিস ওখানে পিউট্রেফ্যাকশন পঞ্চম ধাপ। ক্যালসিনেশন, ডিসলিউশন, সেপারেশন আর কনজাংকশনের পরেই এই পিউট্রেফ্যাকশন। তারপরে আছে আরও ঝামেলা। আমাদের করতে হত কনজেলেশন। মানে, ঘনভবন আর কি। আমাদের সাবস্ট্যান্সটাকে গাঢ় করতে হবে, ভিসকোসিটি বাড়াতে হবে তাও এই পরিমাণে যাতে ক্রিস্টালাইজ বা সলিডিফিকেশন করা যায়। এখানে আমাদের পরশপাথর বা ফিলোসফার স্টোনের কঠিন অবস্থা পাওয়া যাবে। আরও আছে এটা হল তোর রিপলির প্রসেস। এর চেয়ে ধাপ বেশি হলেও কম ঝামেলার না এই নরটনের প্রসেসটা?’

স্বীকার করতে যাচ্ছে স্নিগ্ধ এই সময় পকেটে ফোন বেজে ওঠে ওর। বিরক্ত মুখে বের করে ওটা স্নিগ্ধ।

মহুয়ার ফোন পেলে ওকে এতটা বিরক্ত হতে আগে কোনদিনই দেখেনি উজ্জ্বল।

‘হ্যাঁ, মহুয়া, বল।’ গরম কন্ঠে বলে স্নিগ্ধ।

ওপাশ থেকে মহুয়ার গলাও শোনা যায়, ’তোমার না বিকেলে আসার কথা ছিল চিলিজ-এ? আমি বসে আছি কতক্ষণ ধরে!’

প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধ, ’ক্যানসেল ইট! আমার এখন বের হওয়ার মুড নাই। ’

‘স্নিগ্ধ! প্রমিজ করেছিলে তুমি! আমরা দুইমাস কোথাও বের হই না!’ আর্দ্র হয়ে আসে মহুয়ার গলা।

‘দরকার হলে আরও দুইমাস বের হব না। আমি চিন্তাতে আছি, মহুয়া। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। তোমার মত শুধু মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স করি না আমি। সাথে এদিকে আমাদের গবেষণা নিয়ে বাড়তি সময় দিতে হয়। তোমার মত অবসর পাই না আমি দিনে। দুই দিক সামলাতে গিয়ে ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাই না। পরে কোনদিন বের হব, আজ না। ’

মহুয়াকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ দেয় না স্নিগ্ধ। ছুঁড়ে ফেলে মোবাইলটা একদিকে।

ট্রে-টার পথেই গেল জিনিসটা। বাড়ি লেগে ভেতরের কলকব্জা সব বের হয়ে যায় ফোনটা থেকে।

এতে দুঃখ পায় না স্নিগ্ধ মোটেও। যদিও আটষট্টি হাজার টাকা ছিল ওটার দাম অনেক সখ করে দেড় বছর ধরে টাকা জমিয়ে কিনেছিল।

‘মোবাইলটা ভেঙ্গে ফেললি? তুই যেতে পারতি মহুয়ার সাথে দেখা করতে। আমি তো এখানে আছি। ল্যাব নিয়ে আমি ভাবতাম। ’

‘শাট আপ!’ হুংকার দেয় স্নিগ্ধ, ’এই স্টোন বানানোর আগে একচুল ডিস্ট্র্যাকশন যেন না আসে। মোবাইল ভেঙ্গে ঠিক কাজ করেছি। চাইলেও কেউ পাবে না আমাকে। অযথা সময় নষ্ট। মেয়েদের প্যানপ্যানানি শোনার চেয়ে অনেক জরুরী কাজ পড়ে আছে এই পৃথিবীতে। ’

একটু হাসে উজ্জ্বল, ’নিউটন কেন বিয়ে করেন নি বোঝাই যায় এখন তোকে দেখে। ’

‘শুধু আমার কথা বলিস না। নিজেকে জিজ্ঞাসা কর তোর কি এখন প্রেম, মেয়ে এসব নিয়ে ভাবার মুড আছে?’

গম্ভীর হয়ে যায় উজ্জ্বল, ’না, নাই। ক্লোরিনের সাপ্লাই আছে আমাদের? বের কর তো?’

‘সালফিউরিক এসিড দে ওই তিন নম্বর বিকারে।’ এগিয়ে দেয় স্নিগ্ধ।

‘কতটুকু?’

‘আড়াইশ মিলি। সামান্য বেশিও যেন না পড়ে। সাবধান। এবার আমার দিকে পার করে দে বিকারটা। ’

‘দাড়া যায়মান ক্লোরিন বানিয়ে রেখেছিলাম। ওটা কই? এদিকে পাঠা। ’

‘রেডিমেড কেনা লাগবে। বানিয়ে নিলে ঘনত্ব ঠিক থাকে না। ’

দূরের মসজিদে আজান দিচ্ছে। মাগরিবের আজান।

আড়চোখে একবার স্নিগ্ধকে দেখে উজ্জ্বল। ছেলেটা এক ওয়াক্ত নামাজও মিস দিত না একসময়।

এখন সে আলকেমি ছাড়া কিছু বোঝে না।

কিচ্ছু না।

 

তিন

সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকায় স্নিগ্ধ। বসে আছে লেডিস হোস্টেলের সামনের পুকুরের পাড়ে। এই জায়গাটা নির্জন থাকে। ভাবতে সুবিধে।

পেছনে আরেকটা লাইটার জ্বালানোর শব্দ শোনা যায়, তাকিয়ে উজ্জ্বলকে দেখতে পায় ও।

‘কি রে? এখানে এসে কি করিস? আর দশ মিনিট পর আমাদের মেশিন শপ।’ উজ্জ্বলের প্রশ্নটা হাসি ফোটায় স্নিগ্ধের মুখে।

‘দশ মিনিট পর তোরও মেশিন ওয়র্কশপ। এখানে কি করছিস? একই পথের তো পথিক আমরা। ’

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উজ্জ্বল, ’চলে যেতে ইচ্ছে করছে আমাদের আলকেমি ল্যাবে রে। এখানে কি আর মন টেকে? মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে কেমিস্ট্রি অনেক আগ্রহের একটা সাবজেক্ট। ’

‘একেবারে মনের কথা বলেছিস। আরেকবার যদি অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে পারতাম, ভার্সিটিগুলোতে কেমিস্ট্রির জন্য টার্গেট করতাম। বালের ইঞ্জিনিয়ারিং!’

‘ওই শব্দটা সব জায়গায় ব্যবহার করা বন্ধ কর।’ স্নিগ্ধের প্রতি বিরক্ত হয় উজ্জ্বল, ’তোর মেজাজ দিনকে দিন গরম হচ্ছে। হতেই আছে। সমস্যা কি তোর? ঠান্ডা মাথাতে ভাবতে না পারলে আমাদের সফল হওয়া লাগবে না। এটা তোর কল অফ ডিউটি না। মাথা গরমের কাজও এটা না। ’

উজ্জ্বলের ধমকে কিছুটা ঠান্ডা হয় স্নিগ্ধ।

‘পিউট্রেফ্যাকশন তো বা’ বলতে যেয়ে থেমে যায় স্নিগ্ধ, ’পিউট্রেফ্যাকশন তো আমার চুল! এখানেই আটকে আছি আজও। আমার মনে হয় না এই জীবনে এখান থেকে বের হতে পারব আর। দেড় মাস হয়ে গেল। কতভাবে ট্রাই করেছি আমরা তুই নিজেই বল?’

মাথা চুলকায় উজ্জ্বল, ’আমার মনে হয় আমাদের থামতে হবে। ’

উত্তেজনাতে লাফিয়ে ওঠে এবার স্নিগ্ধ, ’প্রশ্নই আসে না! সাতটা মাস! প্রায় সাত মাস ধরে কাজ করছি আমরা। দিন রাত এক করে দিয়ে। শেষ কবে শান্তিতে ঘুমিয়েছি জানি না। এখানে এসে কাজ থামিয়ে দেব? মাথা নষ্ট আমার?’

ওর কাঁধে হাত রাখে উজ্জ্বল, ’বোঝার চেষ্টা কর, স্নিগ্ধ। আমার হাতে থাকা টাকা শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। ফান্ড না থাকলে ল্যাবের ইকুয়েপমেন্ট আর সাবস্ট্যানস  কিনব কিভাবে?’

স্নিগ্ধের মুখটা ধীরে ধীরে হতাশাতে ঢেকে যায়।

‘আর কয় মাস চলতে পারবি এই রেটে খরচ হলে?’ জানতে চায় ও।

‘এক মাস। তারপর আমি ফুরুৎ।’ মন খারাপ করেই বলে উজ্জ্বল।

‘সরি দোস্ত রেজাল্ট দিতে না পারলে তোর টাকাগুলো স্রেফ পানিতে যাবে। আর রেজাল্ট দিতে পারিনি আমি। ’

‘তোর একার কোন কিছু না। ব্যর্থতা আমারও। আমরা একসাথে কাজ করছি। মনে আছে তোর সেটা?’

কিছু না বলে মাথা নীচু করে স্নিগ্ধ।

তারপর দূরে একবার তাকায়।

‘ফাক দিস নরটন’স প্রসেস। আমরা অন্য কোন ভাবে চেষ্টা করব। এভাবে কাজ হচ্ছে না। ’

‘আয়, বসি।’ পুকুরপাড়ের সিমেন্টের বেঞ্চটা দেখিয়ে বলে উজ্জ্বল।

সিমেন্ট খোদাই করে ১৯৯৩ সালে কেউ একজন ডেট লিখে রেখেছে। ২৭ জুন। কে লিখেছে কেনই বা লিখেছে সেটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায় না ওরা। এটা দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে। বরং নিতম্ব চাপা দিয়ে লেখাটা ঢেকে ফেলল ওরা।

স্নিগ্ধের কাঁধে হাত রাখে উজ্জ্বল, গলা নামিয়ে বলে, ’শোন, তোকে এখন যা যা বলব, সেগুলো প্রাচীনতম আলকেমির ধাপ। এগুলোর সাথে রিপনি বা নরটনের থিওরির মিল তুই পাবি না। কারণ সম্পূর্ণ অন্য লেভেলের আলকেমির কথা বলতে যাচ্ছি তোকে আমি। ’

‘আমি প্রবল আগ্রহ বোধ করছি।’ সংক্ষেপে জানায় স্নিগ্ধ।

‘খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সেই সময়ে আলকেমিস্টদের ভালো প্রভাব ছিল, জানিস সেটা। জনগণ এদের শ্রদ্ধা করত যতটা তারচেয়ে বেশি পেত ভয়। কাঁপাকাঁপি লেগে গেলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। যাদুবিদ্যার সাথে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত ছিল সেই আমলের আলকেমি। অন্তত সাধারণ জনতা সেটাই ভাবত। আর সেজন্যই ভয়টা একেবারে অমূলক না। ’

অধৈর্য্যের মত মাথা দোলায় স্নিগ্ধ, ’তা তো বুঝলাম। তবে  তখনকার আলকেমিস্টদের ব্যাপারে আমাদের জানাশোনা কম। তাদের মাঝে কেউ কেউ ছিলেন যারা পরশপাথর বানাতে পেরেছিলেন। সন্ধান পেয়েছিলেন এলিক্সির অফ লাইফের। তবে সেসব তাদের আয়ু বাড়িয়েছিল। অমর করতে পারেনি। দীর্ঘজীবন পার করেছেন এমন একটা গোত্রই ছিল তখন। বাকিরা তাদের করত সম্মান, ভয়ও পেত। মানে, আমরা ধরেই নিতে পারি আলকেমিস্ট ছিলেন তাঁরা। আর কোন ব্যাখ্যা নেই। তবে তাদের প্রসেস তো জানা সম্ভব না। প্রসেস না জানলে আমাদের কল্পকাহিনী শুনে উপকার হবে না কিছু। ’

স্নিগ্ধ এখন বলতে গেলে উজ্জ্বলের চেয়েও বেশি জানে বিষয়টা লক্ষ্য করে খুশি হয় স্নিগ্ধ। ছেলেটা যত জানবে ততই সুবিধে হবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে। আর এখানে বকতে হবে কম। এখানে ইন্ট্রো না দিলেও চলছে। ওদিকে মেশিন শপ শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল নাহলে।

‘যদি তাদের মেথড জানা যায়?’ প্রশ্ন করে উজ্জ্বল।

অর্থবহ প্রশ্নটা গুরুত্বের সাথে নেয় স্নিগ্ধ, ’সেটা কিভাবে জানা সম্ভব? নিউটন আর বয়েলকে নিয়ে ঘাটতে গিয়েই আমাদের দম বের হয়ে যাচ্ছে। এরা ঈসা(আঃ) এর জন্মের পরের মানুষজন। উনার জন্মের আগের মানুষের জীবন ঘাটতে গেলে আমার যৌবন পেরিয়ে যাবে নিশ্চিত থাক!’

হাসে উজ্জ্বল, ’তাহলে বলি তোকে, আলকেমিস্টদের একাধিক গ্রুপ হয়ে গেছিল পরবর্তীতে। একদল মূল বিষয়, আধ্যাত্মিক দিকে থাকলেন। আরেকদল চলে গেলেন ভৌত দিকে। আধ্যাত্মিক আলকেমিস্টরা গবেষণা করতেন কিভাবে আত্মাকে সামান্য আত্মাকে বানানো যায় সোনার মত মূল্যবান সততা আর ন্যায়ের পথে দৃঢ়। আর ওদিকে ভৌতবিদরা সোজা নিমগ্ন হলেন ধাতু থেকে সোনা বানাতে। কিভাবে ফিলোসফার স্টোন বানাবে সেটা তাদের চিন্তা ছিল না, খেয়াল কর্‌। ’

বোকা বোকা দৃষ্টি দেয় স্নিগ্ধ, ’আচ্ছা, তারা ছিল সোনা বানানোর চিন্তাতে। পরশপাথর তাদের টার্গেট ছিল না। তাদের টার্গেট ছিল ট্রান্সমিউটেশন। এক পদার্থ থেকে অন্য পদার্থের রূপান্তর। সেটার জন্য পরশপাথর লাগবে তা কে বলেছে?’

‘রাইট!’ জ্বল জ্বলে চোখে বলে উজ্জ্বল।

‘তাহলে আমাদের জানার কথা কিভাবে সেই আদিযুগের ব্যাপারে? এটা ঠিক তোর কথা থেকে বুঝতে পারছি আমাদের পদ্ধতিতে ভুল আছে। আমাদের চিন্তা করা উচিত ট্রান্সমিউটশন নিয়ে। ’

উজ্জ্বল হাল ছাড়ে না, পানির দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে, ’তখন আমাদের আধ্যাত্মিক আলকেমিরা একটা সময় বুঝলেন এলিক্সির অফ লাইফ ছাড়া আত্মার উন্নয়ন সম্ভব না। তাঁরা মনোযোগ দিলেন ওদিকে। কিন্তু ভৌতবিদ্যাতে আগ্রহীরা বার বার ব্যর্থ তখন স্টোন তৈরীতে। ব্যর্থ এলিক্সির অফ লাইফ পেতেও। তখনই জনশ্রুতি ছড়ালো আধ্যাত্মিক বিদ্যাতে মগ্ন আলকেমিস্টরা চিরযৌবনে যাওয়ার সুধা পেয়েছেন, একই সাথে পেয়ে গেছেন পরশ পাথর। ’

‘ভৌতবিদেরা মেনে নিলেন সেটা?’ আগ্রহের সাথে জানতে চায় স্নিগ্ধ।

‘জানতে পারলেন। তারপর একে একে ধরে আনলেন আধ্যাত্মিক বিদ্যাতে পারদর্শীদের। চালিয়েছিলেন অবর্ণনীয় অত্যাচার। সহজে সোনা তৌরীর পদ্ধতিটা শেখার জন্য। প্রাণ গেলেও মুখ খোলেননি অনেকে। খুলেছিলেন একজন। আলকেমিস্ট ব্যাবেল। তিনি একটা পদ্ধতি দিয়েছিলেন বটে। ’

স্নিগ্ধ হা করে তাকিয়ে থাকে উজ্জ্বলের হাতে থাকা পুরোনো একটা কাগজের দিকে।

‘ব্যাবেল’স মেথড?’

একটু হাসে উজ্জ্বল, ’ব্যাবেল’স মেথড। অলৌকিকত্ব ছিল আলকেমি আর কেমিস্ট্রির মাঝে পার্থক্য। মনে আছে? আমাদের ঝামেলা হল এই অলৌকিক পথে হাঁটতে গেলে আমাদের নিতে হবে ঝুঁকি। ফলাফল আমি জানি না। ’

হাতের সিগারেটটা পানিতে ছুঁড়ে মারে স্নিগ্ধ।

ছোঁ মেরে কাগজটা নেয় ও তারপর, ’বিশ্বাস করবি না আমি কতটা মরিয়া। আমি নেব এই ঝুঁকি। চল, মেশিন শপের দেরী হয়ে যাচ্ছে। ’

 

চার

অন্ধকার ঘরে বসে আছে উজ্জ্বল আর স্নিগ্ধ।

স্নিগ্ধের হাতে সিগারেট। উজ্জ্বলও একটা ধরায়। উত্তেজনাতে ওদের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে আজ।

বার বার!

এখন ওরা আছে মহুয়ার মামার পরিত্যাক্ত বাসাতেই। বাড়িটার চমৎকার একটা বেজমেন্ট ওদের জন্য একেবারে মানানসই পরিবেশ এনে দিয়েছে। এখানে বড় একটা চৌবাচ্চা সেট করেছে ওরা গত পনের দিন ধরে। সেটাতে রোজ ফুটিয়েছে সালফিউরিক এসিডের দ্রবণ। সব মিলিয়ে উজ্জ্বলের ফান্ড শেষ হয়ে গেছে এর মাঝেই। ত্রিশ দিন হয়ত এমনিতে চলত তবে এই পনেরদিনে ম্যাসিভ খরচ হচ্ছে ওদের।

‘অলৌকিক শক্তির সাহায্য আমাদের দরকার। অবশ্যই দরকার। এই পয়েন্টটা আমাদের মাথাতে আগে কেন আসেনি?’, আবার উজ্জ্বলকে বলে স্নিগ্ধ। আসলে আজকের দিনে ব্যর্থ হলে ওদের গবেষণা একেবারে পানিতে যাবে সেটা ও জানে। সেজন্য নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছে বলা যায়।

‘প্রসেস মনে আছে?’ জানতে চায় উজ্জ্বল।

‘আছে, ইনগ্রিডিয়েন্ট সব জোগাড় হয়েছে।’ টেবিলের দিকে ইঙ্গিত দেয় স্নিগ্ধ, ’আজ রাতেই আমরা অনেক অনেক সোনা নিয়ে ফিরতে পারব ঘরে। আমাদের গবেষণা সফল হলে আরও লার্জ স্কেলে চালাবো আমরা এটা। ’

‘প্রথমে কি করবি? আমাকে শোনা। সব পেঁচিয়ে ফেলিস না। সুযোগ একটাই। আর স্যাক্রিফাইসটাও বিশাল। ভুল করা যাবে না।’ গম্ভীর কন্ঠেই বলে উজ্জ্বল।

‘চার বার আউড়াতে হবে হিব্রু শ্লোক। যেটা তোর পার্চমেন্টে লেখা ছিল। পরিষ্কারভাবে লেখা ছিল আমিও মুখস্থ করেছি ঠোঁটের আগাতে এনে একেবারে। তারপর আছে মটরের দানা ছিটিয়ে দেওয়া। আড়াইশ গ্রাম মটর দানা এনেছি। লাশের শরীরের বাম হাতের কানি আঙুল জোগাড় করেছি গোরখুঁড়েদের টাকা দিতে হইয়েছে যদিও। কালো মুরগীটা প্রস্তুত। আছে বাদুরের পা। আর তারপর আবারও হিব্রু শ্লোক আছে ছয়টা। ঠিকমত উচ্চারণ করতে হবে ওগুলোকেও। তারপর স্যাক্রিফাইস। ’

সন্তুষ্ট হয় উজ্জ্বল, ’সব  ঠিক আছে। শ্লোকগুলো মনে আছে তো?’

বড় করে নিঃশ্বাস নেয় স্নিগ্ধ, ’আছে। সব ঠিক আছে। ’

‘হুম। অপেক্ষা করছি আমরা ওর জন্য?’ ইঙ্গিত দেয় উজ্জ্বল।

ধরতে পারে স্নিগ্ধ, ’হুম, আর লাগবে হয়ত কয়েক মিনিট। চলে আসবে যেকোন সময়। আমি ভেবেছিলাম তুই বাঁধা দিবি আমাকে এই সিদ্ধান্তে। মহুয়া তোর স্কুল জীবনের বান্ধবী ছিল। আমার সাথে তো এই ইউনিভার্সিটিতে এসে পরিচয়। ’

একটু হাসে উজ্জ্বল, ’তারপর প্রেম। ’

‘হুঁ, প্রেম।’ উদাস হয়ে যায় স্নিগ্ধ, মনে পড়ছে মহুয়ার সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো, ’অর্থহীন সব। একেবারেই অর্থহীন। এর চেয়ে ওই সময়গুলো আলকেমিতে লাগালে ভালো কাজে দিত। একটা রেজাল্ট পেতাম হয়ত নরটনের প্রসেস ধরেই!’

‘অলৌকিক শক্তির প্রভাব যদি আমাদের স্পর্শ না করে? সোনা যদি না পাই?’ বিড় বিড় করে বলে উজ্জ্বল।

রাম ঝাড়ি মারে ওকে স্নিগ্ধ, ’এখানে এসে পিছিয়ে যাবি? মোটেও না। আমরা এখানে আজ রাতেই সোনা বের করব। প্রথমে সোনা বানাব আমার আইফোনটাকে। ভাঙ্গা আইফোন। ’

চৌবাচ্চাটাতে তরলের মিশ্রণ টগবগ করে ফুটছে। সেদিকে তাকায় ওরা। প্রসেসের ধাপ গুলো ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে এখানে যা দেবে ওরা তাই সোনা হয়ে ভেসে উঠবে। ওদের শুধু তুলে নিতে হবে।

আলকেমি। দারুণ একটা বিদ্যা।

ওপরে কোথাও একটা বেল বাজার শব্দ শুনতে পায় ওরা।

‘মহুয়া এসে গেছে। ’, ফিস ফিস করে বলে উজ্জ্বল।

‘আনছি ওকে আমি। ’, একবার ওর দিকে তাকিয়ে ছুটে যায় স্নিগ্ধ।

দরজা খুলতেই মহুয়াকে দেখতে পায় স্নিগ্ধ। চমৎকার লাগছে ওকে নীল রঙের ফতুয়া আর জিন্সে।

চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। বড় বড় চোখ দুটোতে শুধুই ভালোবাসা। চোখ দুটো দেখছে স্নিগ্ধকে।

পরমুহূর্তেই জড়িয়ে ধরে মেয়েটা ওকে, ’ওহ! কতদিন পর তোমার সাথে ক্যাম্পাসের বাইরে দেখা। বল তো? কি না তুমি! গবেষণা শুধু!’

স্নিগ্ধের বুকে মুখ ডুবিয়ে ওর ঘ্রাণ নেয় মহুয়া। ওকে টেনে তোলে স্নিগ্ধ পরমুহূর্তেই।

‘চলো দেখবে। ’

বাধ্য মেয়ের মত পিছু নেয় ওর মহুয়া, ’আজ যদি রেজাল্ট না পেয়েছ পিট্টি দেব তোমাকে। বুঝেছ? গত কয়েক মাস ধরে আমার সাথে দেখা করার সময় পাও না এই গবেষণার জন্য। আজ দেখব কি এমন কাজ তোমরা কর। ’

ঠোঁট বাঁকা করে হাসে স্নিগ্ধ।

দেখবেই তো। মহুয়াই তো দেখবে। আর কে?

একেবারেই হঠাৎ মহুয়াকে ধরে নিজের দিকে ফেরায় স্নিগ্ধ। তারপর প্রচন্ড জোরে নিজের দুই আঙ্গুল ভরে দেয় মেয়েটার সুন্দর চোখ দুটোতে।

এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না মেয়েটা। সুন্দর বড় বড় চোখ দুটো থেকে পিচকিরির মত ছুটে বের হয়ে আসা সাদা আর লালচে তরলে মাখামাখি হয়ে যায় স্নিগ্ধের মুখ। ওই অবস্থাতেই টান দিয়ে আঙ্গুল দুটো বের করে ও মেয়েটার চোখে  থেকে। আর

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে মহুয়া প্রচন্ড যন্ত্রণাতে। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ও! গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তরল সেটা টের পাচ্ছে। তবে চোখের পানি নয় সেগুলো।

অ্যাকুয়াস হিউমার বলে কিছু অবশিষ্ট নেই তো আর ওর। সব গেলে দিয়েছে নিষ্ঠুর স্নিগ্ধ।

দুই হাত চোখে চলে যাচ্ছে এক হাতে হাত দুটো চেপে ধরে স্নিগ্ধ। অন্য হাতে আটকে ধরে মেয়েটার মুখ। একে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলতে দেওয়া যাবে না।

শক্ত হাতে ওকে ধরে বেজমেন্টের দিকে নিয়ে যেতে থাকে স্নিগ্ধ। আজ রাতের মাঝেই ওর সোনা চাই। হাতের মাঝে ছটফট করতে থাকা মেয়েটার আর কি দাম ওর গবেষণা সফল না হলে?

রেজাল্ট চাই স্নিগ্ধের।

ল্যাবে ঢুকে ভারী দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এক পাশ থেকে লোহার দন্ডটা তুলে নেয় স্নিগ্ধ। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না মহুয়া তাই কোন প্রতিরক্ষা করতেই পারে না। কড়াৎ করে মেয়েটার বাম পায়ের ওপর আঘাত হানে স্নিগ্ধ লোহাটা দিয়ে।

পৈশাচিক একটা ক্রোধ অনুভব করে ও তারপর। এই মেয়েটা বার বার কাজের সময় ফোন দিয়েছে ওকে। সময় করেছে নষ্ট।

মহুয়ার যন্ত্রণাতে কাঁপতে থাকা মাথার ওপর সজোরে চালিয়ে দেয় ও লোহার দন্ডটা। মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝেতে পড়ে যায় মেয়েটা।

হাতের রডটা তুলে রাখে স্নিগ্ধ। এটাকে ও কাজে লাগাবে। পরে। এটাকে চৌবাচ্চাতে রেখে দিলেই লোহা থেকে এটাও হবে সোনা।

উজ্জ্বল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অজ্ঞান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। তাকে পাশ কাটিয়ে চৌবাচ্চার সামনে আসে স্নিগ্ধ।

মুখ থেকে অনবরত বের হচ্ছে হিব্রু শ্লোকের গুরুগম্ভীর ধ্বনী। ছোট্ট ঘরটা গম গম করে ওঠে ওর গলার শব্দে।

চারবার উচ্চারণ করে মটরের দানাগুলো ছুঁড়ে দেয় ও চৌবাচ্চাতে। ফুঁসে ওঠে ওগুলো ওখানে পড়েই।

তারপর দ্বিধা ছাড়াই মানুষের কাটা একটা আঙ্গুল তুলে ছুঁড়ে দেয় ও চৌবাচ্চাতে। শ্লোকের আবৃত্তি চলছেই।

আরেকবার ফুঁসে ওঠে চৌবাচ্চাটা।

ওখানে মুরগীটাকে ধরে এনে নির্বিকার হয়ে জবাই করে দেয় ও পাশ থেকে ছুরিটা এনে। তারপর মুরগীর দেহটা ছুড়ে ফেলে।

ছয়বার আবারও শ্লোক উচ্চারণ করে তুলে নেয় বাদুরের পা। তারপর সেটাকেও চৌবাচ্চার গভীরে পৌঁছে দেয় ও।

চৌবাচ্চাটা যেন ফুলে ফেঁপে উঠছে। মেয়েটের কাঁধের নিচে হাত আটকে শরীরটাকে তুলে আনে চৌবাচ্চার কিনারে। গুঙিয়ে ওঠে মহুয়া। বেঁচে আছে এখনও।

চেহারাতে সেই লাবণ্য আর নেই। এক হাত বাড়িয়ে আবার ছুড়িটা তুলে নেয় স্নিগ্ধ। মহুয়ার গলাটা ঠেসে রেখেছে চৌবাচ্চার একপাশের বেড়ায়।

মুখে হিব্রু শ্লোকের আবৃত্তির বিরাম নেই।

আস্তে করে মেয়েটার গলার নিচে ছুরিটা ধরে চালিয়ে দেয় ও ছড় ছড় করে রক্ত ছুটে পড়ে চৌবাচ্চাতে। সেই সাথে প্রাণপণে হাত পা ছুড়ছে মহুয়া। চেষ্টা করছে আরেকবার নিঃশ্বাস নেওয়ার।

পারে না।

কন্ঠনালী নেই তো।

কেটে দিয়েছে স্নিগ্ধ।

এবার এক ধাক্কা দিয়ে মহুয়ার শরীরটাকে ফেলে দেয় ও এসিডের দ্রবণে। জ্বলে যেতে থাকে মেয়েটার শরীর। সেই সাথে অবিরাম হাত পা ছুড়ছে এখনও মেয়েটা।

যন্ত্রণা!

তবে অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে এসেছে ও।

কপালের ঘাম মুছে স্নিগ্ধ।

হাসিমুখে ফিরে তাকায় উজ্জ্বলের দিকে, ’এবার একটা কিছু ফেল চৌবাচ্চাতে। সোনা হবেই। আলকেমি ভুল নয়। ভুল হতে পারে না। ’

এক পা এগিয়ে আসে উজ্জ্বল। একটা কিছু তো ফেলতেই হবে।

টেস্ট করা তো দরকার।

বুকের ঠিক মাঝখানে উজ্জলের প্রচন্ড ধাক্কাটা খেয়ে ছিটকে ফুটন্ত চৌবাচ্চার মাঝে পড়ার পরও তিন সেকেন্ড পেরিয়ে যায় স্নিগ্ধের বুঝতে   চারপাশে আসলে কি হচ্ছে!

চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করতে চায় ও কিন্তু কঙ্কালসার একটা হাত চেপে বসেছে ওর মুখের ওপর ততক্ষণে।

কে ওটা?

মহুয়া না?

 

পরিশিষ্ট

তালাটা আবার ঠিকমত লাগিয়ে বের হয়ে আসে উজ্জ্বল।

মহুয়াকে স্নিগ্ধ আগেই বলেছিল ওদের গবেষণাটা গোপনীয়। মহুয়া, উজ্জ্বল আর স্নিগ্ধ ছাড়া কেউ জানত না এটার কথা। কাজেই খুনের অপরাধে কেউ উজ্জ্বলকে খুঁজবে বলে মনে হয় না। চাবিটা ড্রেনে ফেলে দেয় ও আস্তে করে।

মহুয়াকে স্কুলজীবন থেকে ভালোবেসেও বন্ধুত্ব ছাড়া আর কিছু পায় নি ও। সেই মহুয়া  কি না গবেষণা-পাগল বলে খ্যাত স্নিগ্ধের প্রেমে পড়ে গেল? স্নিগ্ধও যদি মেয়েটাকে গুরুত্ব দিত একটা কথা ছিল। কাজ-ই সব তার কাছে।

কোন অধিকার রাখে সে এরপরও মেয়েটাকে নিজের করে রাখার? বা ভাবার? ওদের একসাথে দেখতে বুকে কাঁটা বেঁধার মত যন্ত্রণা হত উজ্জ্বলের তবুও কোনদিন কিছু বলেনি। প্রায় একবছর ধরে প্ল্যান করতে হয়েছে ওকে চোখের সামনে থেকে দুই আপদকে সরিয়ে দিতে। একবছরের প্ল্যানিং সফল হয়েছে আজকে।

স্নিগ্ধকে সোনা বানানোর জন্য ক্ষেপিয়ে তোলার পর বাকি কাজ ছিল সহজ!

তবে পরাজয়ের গ্লানি মুছে যায় নি উজ্জ্বলের। ধীরে ধীরে সেটা বাড়ছে আরও।

গাল চুলকে নিজের মেসের দিকে হাঁটা দেয় ছেলেটা। আগামীকাল পরীক্ষা আছে।

*

সার্চ পার্টি যখন মহুয়ার দেহটা খুঁজে পেল চৌবাচ্চার দিকে এগিয়ে আসার সাহস তাদের কারই হচ্ছিল না।

ঘরের মাঝে পাঁচজোড়া চোখ সেঁটে থাকে একটা প্রমাণ সাইজের পুরুষ মূর্তির দিকে।

চেঁচানোর ভঙ্গীতে চৌবাচ্চার মাঝে শুয়ে থাকা মূর্তিটি সোনার।

খাঁটি সোনার।

— ০ —

রচনাকাল জুলাই ০২, ২০১৪ 

ইলিউশন সাইকিয়াট্রিস্ট 

মেয়েটা সুন্দরী, কিন্তু একা দাঁড়িয়ে আছে। পড়নের পোশাক আর অভিব্যক্তিতে আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে। সন্ধ্যাও নেমে আসছে চারপাশটা অন্ধকার করে দিতে দিতে।

এরকম একটা মালকে ছেড়ে দেওয়া যায় না।

চুপচাপ গিয়ে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। একটু বিরক্ত হয় যেন ও। ভ্রু হাল্কা বাঁকিয়ে আরেকটু দূরে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দেয়। অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। ক্লান্ত হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কারও জন্য অপেক্ষা করছে? তাই হবে হয়ত। মোবাইলটা বের করে ঝড়ের বেগে ডিসপ্লেতে টাচ করতে শুরু করল এই মাত্র। নিশ্চয় যার আসার কথা তার পিন্ডি চটকাচ্ছে?

এগিয়ে গিয়ে কোন কথা না বলে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলাম।

এতটাই হতচকিত হয়ে যায় মেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া করতে পারে না। মেয়েটার নিশ্বাস আমার গলায় অনুভব করতে পারছি স্পষ্টভাবে। বেশ ভারী নিশ্বাস পড়ছে এখন আতঙ্ক? একমুহূর্ত পরেই সম্বিত ফিরে পায় অবশ্য কিন্তু তখনও প্রতিক্রিয়া করে না।

আমার বাম হাতে বেড়িয়ে আসা ছুরিটাই যে এর কারণ সেটা বুঝে উঠতে বেশী জ্ঞানের দরকার নেই। একেবারে পেটের সামান্য ওপরে ধরেছি মুখ দিয়ে কিছুই বলতে হয় না আমার হাতটা চলে যায় তরুণীর হাতব্যাগের দিকে।

‘প্লিজ ব্যাগটা নেবেন না।’ মিষ্টি অথচ ভয়ার্ত কন্ঠে প্রথমবারের মত মুখ খোলে মেয়েটা।

টান দিয়ে ব্যাগটা মেয়েটার হাত ছেড়ে ছাড়িয়ে নিতে হল। এমনিতে দেবে না যখন কি আর করা? গোলাপী ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরে সে হতাশায়। আস্তে করে ওর ওপর থেকে সরে আসি আমিও। চটপট আমার ব্যাকপ্যাকে গায়েব হয়ে যায় মেয়েটার হাতব্যাগ। একরাশ অপমান চোখে নিয়ে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

অতশত ভাবি না আমি। আমার ইয়াবার সাপ্লাই শেষ। অন্তত তিনহাজার টাকা পেলে তো দশটা কেনা যায়!

তিনদিনের জন্য একেবারে নিশ্চিত।

গলি ছেড়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছি তখন একটু খটকা লাগে।

মেয়েটার দৃষ্টিতে কি আমি অপমান দেখে এসেছিলাম? নাকি ব্যর্থতা?

দুই

বাসে করে মিরপুর-১২ যাচ্ছি।

শফিক মামাকে পেলে হয়। আমার সাপ্লাই সেই কখন থেকে বন্ধ! ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে বেশ।

পাশের ঘাড়ে গর্দানে চেহারার লোকটা গল গল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। সে যে একটা পাবলিক বাসে আছে কে বলবে এই লোককে দেখলে? ইচ্ছে করেই ভোটকাটার পা মাড়িয়ে দেই আমি। বাসের মাঝে বসে সিগারেট খাচ্ছে! আনন্দের তো সীমা থাকা উচিত একটা!

কড়া চোখে একবার তাকায় শুধু মোটকু। কিন্তু কিছু বলে না।

তারপর একেবারে হঠাৎ গলা নামিয়ে জানতে চায়, ’সঙ্কেত দেওয়া লাগবে না। রেশমা কোথায়?’

এবার আমার ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। রেশমা কে? যার ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে সটকে পড়েছি তার নাম নাকি? এই ভোটকার সাথে তার সম্পর্ক কি? জানলই বা কি করে আমার কাছে মেয়েটার ব্যাগ আছে? কিন্তু, কিছু তো বলা লাগে।

বাসভর্তি মানুষের গণপিটুনী খেতে চাই না।

ভেবেচিন্তে গলা নামালাম আমিও, ’রেশমা আটকে গেছে।’

চুক চুক করে দুঃখপ্রকাশের শব্দ করল লোকটা, তারপর আমার দিকে না তাকিয়েই আস্তে করে আবার জানতে চায়, ’প্যাকেজ কার কাছে তাহলে?’

কোনকিছু না ভেবেই বলে দিলাম, ’আমার সাথেই।’

লোকটাও একথায় আশ্বস্ত হয় বেশ। আমার দিকে একটু ঘুরে জানায়, ’সামনের স্টপেজে নেমে যাব আমরা। রিফাজের লোকেরা পিছু নিয়েছে। একেবারে গলা ফাঁক করে দেবে নাগালে পেলে।’

এ তো দেখছি রীতিমত ঝামেলায় ফেলে দিল আমাকে! গলা কাটাকাটি কেন বাবা এর মাঝে আবার? আমি নিরীহ মানুষ। নেহায়েত ইয়াবার টাকাটার জন্যই মেয়েটাকে লুট করতে হল।

মেয়েটা কে ছিল?

সুবিধের কেউ ছিল না সেটা নিশ্চিত অন্তত। আগেই সন্দেহ হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন দাঁড়াবে ওভাবে? মেয়ের মাথায় কুচিন্তা না থেকেই যায় না!

মাফিয়াদের লোক?

পেছনে আবার জনৈক রিফাজের উপস্থিতি আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয় বৈকি!

‘কাম অন!’ বাস থেমে যেতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় লোকটা।

দুইজনই সুড় সুড় করে নেমে পড়লাম। এই লোককেও খুব একটা সুবিধের লাগছে না। কিন্তু অন্তত এই মুহূর্তে এ আমার গলার প্রটেক্টর।

বাস থেকে নেমে পড়তেই গলা খাদে নামিয়ে বলে লোকটা, ’তাড়াতাড়ি আমার হাতে প্যাকেজটা দাও। রিফাজের ওরা তোমাকে দেখলেই হামলা করবে। প্যাকেজ যে বাগিয়েছো, পিঠে টার্গেট মার্ক পড়ে গেছে তোমার। কিন্তু আমার দিকে লক্ষ্য করবে না।’

সখটা একবার দেখ! আমার গলা কেটে ফেলবে রিফাজবাহিনী তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই উনার। আছেন প্যাকেজ নিয়ে! চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। এলাকা সুবিধার না। চারপাশে মেইনরাস্তা থেকে ঢুকে যাওয়া গলিগুলো বেশ চিপা চিপা।

তারওপর নেমে এসেছে রাত।

বাবাটা ইয়াবার কথা জেনে ফেলার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই হ্যাপা! টাকার উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কোন স্যারের প্রাইভেট না পড়েও টাকা মারি জেনে ফেলেছে। নয়তো জীবনের প্রথম ছিনতাইটা করা লাগত না আজ আমার। আর ওরকম ঝামেলায় পড়তেও হত না।

বিমর্ষ মুখে লোকটার হাতে আমার ব্যাকপ্যাক তুলে দিতেই চটপট পড়ে ফেলল ওটা। ভালুকের মত শরীরের মানুষটার গায়ে আমার ব্যাকপ্যাক নেহায়েতই ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে!

‘ফলো মি! ফাইলটা নিতে পারলেই রিফাজবাহিনী একেবারে থেমে যাবে!’ বলে একটা কানাগলিতে ঢুকে যায় অদ্ভুত মানুষটা।

প্যাকেজ নিরাপদে রাখতে যাচ্ছে নিশ্চয়? আর ফাইলটা নিতে?

ভালো কথা, ফাইলটা কিসের?

আধো-অন্ধকারে গলির মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে থাকা ষন্ডামার্কা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলতে গিলতে ভালুকটার পেছন পেছন গলিতে ঢুকে পড়লাম আমিও।

তিন

আমার ব্যাগটা কাঁধে নেওয়া মানুষটা একজন ষাঁড়।

তবে গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর প্রত্যেকে দেড়জন ষাঁড়। কিন্তু তৃতীয়জন, এঁদের দলনেতা লোকটি বেশ প্যাকাটি গড়নের। প্যাকাটিটা সামনে আসল।

‘চমৎকার আব্রাহাম! নিজেই চলে এসেছ দেখছি!’ চিকণ মানুষটার মুখ থেকে কামানের গোলার মত গর্জন বের হয়ে আসে।

‘কি আর করা! ফাইলের তো আর পা নেই। তাই আমারগুলোকে ধার চেয়েছে কিছুক্ষণের জন্য।’ বেশ হাসিমুখেই বলে আব্রাহাম পিঠে ঝোলানো আমার ব্যাগটার একটা স্ট্র্যাপ ধরল একহাতে।

‘কোন ফাইল?’ চোখ সরু সরু করে জানতে চায় চিকণা।

‘আহা! ন্যাকা আরকি!’ দাঁত খিঁচায় আব্রাহাম, ’তোমাদের বস ভেতরে আছে?’

এ কথায় পেছনের তিন দেড়জন করে সাড়ে চারজন ষাঁড় এগিয়ে আসে কিছুটা।

‘বস কারও সাথে দেখা করবেন না।’  চাছাছোলা গলায় জানিয়ে দেয় ভদ্র চেহারার একজন’বস’-এর বডিগার্ড।

চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে একবার ঘাড় মটকালো শুধু আব্রাহাম। আমি পিছিয়ে আসি দুইপা। ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই দূরে সরে দাঁড়াই।

এবার প্যাকাটি দলপতি নিজেই এগিয়ে আসে।

‘গেট লস্ট, আব্রাহাম। ভাইয়ের সাথে দেখা করার আসা ছেড়ে দাও। আর যা ক্ষতি হয়েছে মেনে নাও। সাথে করে বাচ্চা পোলাপান নিয়ে এসেছ আমাদের ঘাঁটিতে সরাসরি? তোমার সাহস আছে বলতেই হচ্ছে।’

বাচ্চা পোলাপাইন আমার ঘাড় হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমাকেও দেখছি ওরা গোণায় ধরেছে! তিন ষন্ডার গঠন দেখে হাঁটুতে জোর পাচ্ছি না আর।

আল্লাহর কাছে একবার প্রার্থনা করলাম এখান থেকে জ্যান্ত পালাতে পারলে ইয়াবার জগত ছেড়ে চলে আসব। এরই মাঝে দেখি আব্রাহাম প্যাকাটির পেট বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে!

প্যাকাটি-টাইপ মানুষটা উড়ে গিয়ে এক ষন্ডাকে সাথে নিয়েই মাটিতে পড়ে।

রইল বাকি দুই।

চমৎকার মুখভঙ্গী করে ছুটে আসছে ওই ষন্ডাদ্বয় আমার নিজেরই গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হল, ’ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে!’

আব্রাহাম আমার ব্যাকপ্যাক এক ষন্ডার মুখের ওপর দড়াম করে ফেলে দিতেই’উহা’র গতিবেগ রহিত হয়ে গেল! অপর ষন্ডার মুখে আব্রাহাম আর ব্যাগ নয়   নিজের ছয়মনি হাতই ফেলে দিচ্ছে দেখতে পেলাম। একপাক ঘুরে এক ষন্ডার পতনের সাথে সাথেই আমার ব্যাগ একপাশে ফেলে দ্বিতীয় ষন্ডা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আব্রাহামের ওপর।

আব্রাহাম একটু কায়দা করে সরে যেতেই টার্গেটকে মিস করে সোজা আমার দিকেই ধেয়ে আসে দ্বিতীয় ষন্ডা। তবে কৌতুকপূর্ণ মুখ নিয়ে পেছন থেকে পা বাঁধিয়ে দেয় আব্রাহাম।

আমিও আব্রাহামের কাছে এইমাত্র শেখা  কায়দাটা করে একটু সরে যেতেই ঝপাত করে একেবারে নর্দমার মাঝে আছড়ে পড়ল ষাঁড়টি।

তৃতীয় ষাঁড়ের দিকে নজর ফেরাতেই দেখতে পেলাম প্যাকাটি-দলপতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে এখনও  ছেলে! আব্রাহাম সেদিকে নজর দিতেই দড়াম করে সামনের বাসাটার দরজাটা খুলে যায়। প্যাকাটি-দলনেতার’এল্ডার-ভার্সন’ বেড়িয়ে আসে ভেতর থেকে।

‘বাইরে এত হট্টোগোল কিসের, অ্যা?’ সরু গলা দিয়ে সিংহের মত গর্জন করে বলল লোকটা।

চার

এই মানুষটাই যে ওই প্যাকাটি ছোকড়ার ভাই এটা বোঝার জন্য আমার তৃতীয়শ্রেণীর ঘিলুই যথেষ্ট। এর কাছেই তাহলে আছে একটা টপ সিক্রেট ফাইল! যেটা দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে পুরো রাফিজ বাহিনীকে। তবে এই লোক আমাদের ঠেকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করল না।

‘আরে আব্রাহাম যে! এতদিন পর হঠাৎ কি মনে করে?’

‘ফাইলটা লাগবে আমার। দিয়ে দাও। চলে যাই।’ ঝটপট দরখাস্ত করে ফেলে আব্রাহাম।

‘তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না।’ গম্ভীর মুখে বলে দরজা লাগাতে শুরু করল প্যাকাটির বড় ভাই।

ঝট করে একটা পা বাড়িয়ে দরজার শেষ মাথা আটকে ফেলে আব্রাহাম, ’এত সহজে না, মাহমুদ। ভেতরে আসছি আমরা।’

মাহমুদের আপত্তি মোটেও কানে তোলা হল না।

বাইরের তৃতীয় ষন্ডা একেবারে থার্ড আম্পায়ারের মতই বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিতেই মাহমুদের কলার ধরে একটা ঝাঁকুনী দেয় আব্রাহাম।

‘সেনের ফাইলটা। কুইক!’

‘ওই ফাইল আমি পাবো কোথায়?’ অবাক হওয়ার ভান করতে করতে বলে মাহমুদ।

আমি শুধু নাটক দেখছি। আব্রাহামের মত বডি বিল্ড করতে পারলে হত। একাই দুটো ভোটকাকে শুইয়ে দিতে পারলে আমার ইয়াবার টাকার অভাব হত না আর।

পরক্ষণেই একটু আগে করা প্রার্থনার কথা মনে হতেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটলাম।

ফাঁড়া কেটেছে এই ঢের! এবার এখান থেকে বেরিয়েই বাবাকে বলে একটা রিহ্যাবে ঢুকে যাবো। রোজ রোজ মেয়েদের সম্পদ লুট করতে গিয়ে প্যাঁচে পড়ব নাকি?

‘আমি জানি না ওই ফাইল কোথায় গেছে। বহুদিন ধরেই মিসিং শুনেছি।’ বিড় বিড় করে বলে মাহমুদ।

‘তুমি ডিপার্টমেন্ট ছাড়ার পরদিন থেকেই মিসিং ওটা, মাহমুদ! বন্ধুত্বের খাতিরে তোমার দিকে নজর দেইনি এতদিন। কিন্তু এখন ফাইলটা আমার দরকার। আর একটা গান। নাহলে মারা পড়বে আরেকটা নিরপরাধ মেয়ে! মাস্টার তিরমিজির কথা মনে আছে নিশ্চয়? আর তাঁর ছোট মেয়ে ফাল্গুনীর কথা?’

ওদের কথা শুনে এবার আমার কান খাড়া হয়ে যায়। কাহিনীর প্যাঁচ ঘোরতর!

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহমুদ।

‘ফাইলটা নিতে পার। তবে মনে রেখ দিচ্ছি কেবল মাস্টার তিরমিজির কথা ভেবেই। আমার প্রাণরক্ষক তিনি।’

‘এখন তাঁর মেয়ের প্রাণভক্ষক হতে যেও না। রাফিজের চোখ কোনদিকে পড়েছে বুঝতে পারছ? ডাটা সব চলে যাবে একেবারে জায়গা মত। তুমি আমি অথবা মাস্টার তিরমিজি কেউই রক্ষা পারবে না সেটা হলে।’

ভেতরে ঢুকে পড়ি আমরা মাহমুদকে ফলো করে। রান্নাঘরে এনে একটা মাটির নিচে যাওয়ার রাস্তা বের করে ফেলে মাহমুদ মেঝের এক অংশ সরিয়ে।

তারপর নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়।

একটু পর বের হতেই হাতের ঢাউস ফাইলটা চোখে পড়তে আমিও ভড়কে যাই।

‘পদ্মার বুকে মাস্টার তিরমিজি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন সেই ম্যাসিভ গানফাইটের মাঝেও। সেই ঋণের কিছুটা শোধ দেয়ার প্রচেষ্টা শুধু, আব্রাহাম। তবে লড়াইটা তোমার। আমি আর ফোকাসে আসতে চাই না।’

কোমর থেকে খুলে একটা পিস্তলও বাড়িয়ে দেয় মাহমুদ আব্রাহামের দিকে।

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখি শুধু আমি।

পাঁচ

কোনমতে হেঁটে চলেছি আমি আব্রাহামের সাথে।

দুইজনেই চুপ একেবারে।

আমার মাথায় কিছুরই হিসেব মিলছে না। কোথা থেকে কি হয়ে গেল!

একটা মাত্র ভ্যানিটিব্যাগ চুরি করতে গিয়ে এত বড় ঝামেলায় পড়া লাগবে জানলে কি আর আগাই?

‘কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেওয়াই যায় তোমাকে।’ মুখ খোলে আব্রাহাম, ’ঘটনার সাথে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে জড়িয়ে পড়েছ তুমি। আমি, মাহমুদ দুইজনই ছিলাম বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সীর সাথে। কিন্তু আর সবার মতই আমাদেরও একটা কালো অধ্যায় আছে। আমাদের সুপিরিয়র ছিলেন মাস্টার তিরমিজি। উনার প্ল্যান অনুযায়ী আমরা কাজ করতাম যাকে বলে ইয়ে আইনে অবৈধ।’

তাকিয়ে থাকি আমি।

‘যেসব অপরাধীদের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব থাকত, যাদের জেলে ভরে রাখা সম্ভব নয় তাদের মাথাতে সোজা বুলেট ঢুকিয়ে দিতাম আমরা। অ্যারেস্ট করার ঝামেলায় যেতাম না।’

বলে কি! আমার তো রীতিমত গা গুলাচ্ছে। এই মানুষ এতবড় খুনী সেটাই বা কে জানত!

‘জেনে ফেলে শেষ শিকার অভিজিৎ সেন। পালটা আঘাত হানে সে তার লোকেদের নিয়ে। লোকটা ভূতের মত। ডিপার্টমেন্টের এজেন্টরা সিরিয়ালি মারা পড়ছিল মরিয়া হয়ে আমরাও ডাটা কালেক্ট করতে শুরু করি। কিন্তু তার আগেই কাজ হয়ে যায় মাস্টার তিরমিজির বাসায় হামলা চালিয়ে পার্সোনাল ড্রাইভ কেড়ে নেয় কেউ যেটায় আমার আর মাহমুদের সিক্রেট কিলিং মিশনের ডাটাগুলো সবই আছে।’

‘তারপর?’ গোগ্রাসে আব্রাহামের কাহিনী গিলছি আমি।

‘প্রাণপনে হামলা চালাই আমরা সেনের ঘাঁটিতে। সেনকে হত্যা করে উদ্ধার করে আনি হার্ডড্রাইভটা। কিন্তু ততদিনে ডিপার্টমেন্ট সন্দেহ শুরু করেছে। আমাদের তিনজনই চাকরিচ্যুত হতাম ফাঁসী-টাসীও হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র ছিল না। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে আমাদের খুনগুলোর বিচার ঠিকমত হল না। আমাদের ফিল্ড থেকে সরিয়ে ডেস্কজব দেওয়া হল। কিন্তু অফিস ছেড়ে চলে গেল মাহমুদ এরপর, রেজিগনেশন দিয়ে। সেই সাথে কারও চোখে না পড়লেও আমার চোখে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে সেনের ফাইল।’

‘ওই ফাইলের সাথে আজকের ছোটাছুটির সম্পর্ক কি?’ না জানতে চেয়ে পারলাম না।

‘সেনের ডানহাত রাফিজ এখন ক্ষমতায়, বাঁধন।’ হাঁটতে হাঁটতেই আমার নাম জেনে নিয়েছে আব্রাহাম।’গতপরশুই মাস্টার তিরমিজির মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে ওরা। আজ জমা দেয়ার কথা ছিল হার্ডড্রাইভটা। তবেই জীবিত ফিরে পাওয়ার কথা ছিল ফাল্গুনীকে। শর্ত একটাই ফাল্গুনীর বোন অহনাকে নিয়ে যেতে হবে হার্ডড্রাইভ।’

‘কিডন্যাপাররা তাহলে মোবাইলে টেক্সটের মাধ্যমে যোগাযোগ করছিল?’ এবার বলি আমি। সবকিছু এখন স্পষ্ট।

যেই মেয়েকে ছিনতাই করেছি আমি, সে দেখা যাচ্ছে কিডন্যাপড ফাল্গুনীর বোন অহনা ছিল!

‘চালাক ছেলে। ঠিকই ধরে ফেলেছ।’

‘আপনাদের ডুবিয়ে দিয়ে কি লাভ রাফিজের?’

‘প্রতিশোধ! আমাদের কারণে ওদের অনেক সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। রাফিজের বড় ভাই রিয়াদও মারা যায় মাহমুদের হাতে। যে করেই হোক আমাদের ডুবাবে ওরা। এর আগেই আমাদের ফাল্গুনীকে খুঁজে বের করতে হবে।’

‘আগাচ্ছেন কিভাবে?’ সন্দেহভরা কন্ঠে জানতে চাই আমি।

‘ফাইলের সব পৃষ্ঠার ছবি অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। যথেষ্ট তথ্য আছে। মাহমুদ অহেতুক ভয় পেয়েছিল। সেনের ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে আমাদের কুকীর্তির কথা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য ফাইল সহই কেটে পড়েছিল ও। এখন দেখা যাক অফিস থেকে কোন লিড পাওয়া যায় কি না!’

‘ডেস্ক থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি করছেন কিভাবে?’ জানতে চেতেই হল।

‘স্পেশাল কোয়ালিফিকেশনের জন্য আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এই মিশনে। আমাদেরই কো-ওয়ার্কারের মেয়ের কিডন্যাপিং দেখে ডিপার্টমেন্ট তেঁতে রয়েছে। অবশ্য কিডন্যাপিংয়ের পেছনে কি রহস্য সেটা ওরা জানে না।’

‘তারমানে মুক্তিপণ হার্ডড্রাইভটা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল অহনা। ব্যাকআপ হিসেবে ছিলেন আপনি। তারমাঝেই হামলে পড়েছি গিয়ে আমি?’

‘হুঁ। শুধু তাই না আস্ত হার্ডড্রাইভ নিয়ে সটকে পড়েছ। কাজেই তোমাকে ফলো করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার। আর বাসে একটু রহস্যের গন্ধ দিতেই একা একাই চলে আসলে সাথে। ধন্যবাদ তোমাকে।’

মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে আব্রাহামের।

‘গট দ্যা লোকেশন। তোমার ব্যাকপ্যাকটা ধার নিতে পারি? শেষ অ্যাকশনে যাচ্ছি। আশা করি ফাল্গুনীকে নিয়ে বের হয়ে আসতে পারব।’

‘আমি যাচ্ছি না সাথে?’ আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে তাকালাম আমি।

‘তোমার এসবে ট্রেইনিং নেই, বাঁধন। মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট করেছ তুমি। এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।’

রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকি আমি।

সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকা মানুষটা আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে।

বুঝিয়ে দিয়ে গেছে একটা ব্যাপার হয়ত তাঁর নিজের অজান্তেই!

জীবন মোটেও হেলাফেলায় কাটানোর মত জিনিস না। জীবন একটাই।

নিজের জীবনকে ঘুরিয়ে ফেলব আমি।

আর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সীতে গিয়ে ঢোকার একটা ভালো চেষ্টা দিতেই হবে!

ইয়াবার গুষ্টি আমি কিলাই। আজই বাবাকে বলে সোজা রিহ্যাব!

ছয়

ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন লিয়াকত হোসেন।

কুঞ্চিত ভ্রুর পেছনে অষ্টম স্কেলের কারণ বিদ্যমান। একটু পর তিনি রেজাল্ট পাবেন।

লিয়াকত হোসেনের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তবে তিনি কোন মেডিকেল চেক-আপের রেজাল্টের অপেক্ষাতে নেই। একমাত্র ছেলে শরীফ হোসেন বাঁধনের রেজাল্টের অপেক্ষায় আছেন। ছেলের বয়স কম মাত্র কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে  তবে এরই মাঝে ইয়াবা ধরে ফেলেছে!

ইলিউশন-সাইকিয়াট্রিস্ট ফারদিন আহমেদ চৌধুরী তাঁর বাল্যজীবনের বন্ধুর ছেলে। এই একটা কারণেই তাকে একটা সুযোগ দিয়েছেন। কারণ ইলিউশনিস্ট মনোরোগ বিজ্ঞান বলে কোন বিজ্ঞান এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এটা ফারদিনের নিজের আবিষ্কার। আর তাতেই কি না নিজের ছেলেকে গিনিপিগ বানাতে সম্মত হয়েছেন লিয়াকত সাহেব!

বয়েসের সাথে কি তার বুদ্ধিশুদ্ধিরও লোপসাধন হচ্ছে?

‘নেশাগ্রস্থ ছেলেরা হতাশার আড়ালে লুকিয়ে আসলে অ্যাডভেঞ্চার খোঁজে।’ ফারদিন বলেছিল সেদিন, ’যদিও এই অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপারে তারা নিজেও জানে না। অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকে সেটা। অথচ অ্যাডিক্টের কোন আইডিয়াই নেই ঠিক কোন কারণে নেশার অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে সে। জানতে চাবেন আপনি ফট করে বলে দেবে, “আমার জীবন নিয়ে আমার অনেক হতাশা।” যতসব ফালতু কথা বার্তা। এই ছেলেকেই নিয়মিত হান্টিং রাইফেল দিয়ে শিকারে পাঠান ঝটপট কমে যাবে ড্রাগস নেওয়ার পরিমাণ।’

‘তুমি সাজেস্ট করছ বাঁধনকে আমি শিকারে পাঠাই?’ সামনে বসে থাকা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মনে রোগ আছে কি না সে ব্যাপারেই সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পরেন লিয়াকত সাহেব।

‘না, স্যার!’ হেসে ফেলে ফারদিন, ’এখানেই কাজ করব আমি। বাঁধনকে একটা চমৎকার ইলিউশন দেব। প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারের। এতে ও জীবনের বিস্তৃতিটা বুঝতে পারবে। আশা করি কাজ হয়ে যাবে। আমাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেন।’

‘তোমাদের মানে?’ ভারী গলায় জানতে চান লিয়াকত হোসেন।

‘আমাদের টিম আছে একটা। এটা নিয়ে কাজ করছি আমরা। আমি ছাড়া আরও পাঁচজন আছি। ইলিউশন দিতে হলে লোক তো কিছু লাগেই। আপনি শুধু বাঁধন বের হবে যখন আমাকে একটা মেসেজ দেবেন। বাকিটা আমরা দেখব।’

ভরসা রেখে তো ভুল করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। সারাদিন বাঁধনের কোন পাত্তা নেই। যত্তসব অহেতুক তত্ত্ব!

উঠে দাঁড়ালেন লিয়াকত হোসেন। ছেলেটাকে রিহ্যাবে দেওয়াটা দরকার। কিন্তু নিজের ইচ্ছে না থাকলে দিয়ে কাজ হবে না। আবার বের হয়েই নেশাতে ডুবে যাবে!

খুট করে একটা শব্দ হয় পেছনে।

লিয়াকত হোসেন ঘুরে দেখতে পান তাঁর একমাত্র ছেলেকে। আজ ওর চোখে অন্যরকম একটা আভা বাঁধন জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে!

*

পার্সটা উল্টে পালটে দেখছে ফারদিন। মেয়েটার নাম-ঠিকানা কিছু পাওয়া যায় কি না বের করা দরকার। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁধন ছেলেটার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে আছে ও। তবুও হাতের কিছু কাজ শেষ করতে হল।

রাত অনেক হলেও আজকের এক্সপেরিমেন্টটার রিপোর্ট লিখে ফেলেছে ও। প্রথম পরীক্ষাতেই সাফল্য!

বাঁধনের বয়েসী ছেলেদের জন্য বেশ কাজের হবে প্রক্রিয়াটা। এখন শুধু ছিনতাই করা পার্সটার মালিককে খুঁজে বের করলেই ওর কাজ শেষ। ভেতরে হাত দিতেই একটা হার্ডড্রাইভ উঠে আসে ওর হাতে।

সরু চোখে সেদিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ফারদিন। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে ও একটা নামের জন্য।

ছোট একটা কাগজে নাম ঠিকানা আটকানো আছে ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতরের পিচ্চি পার্সটায়।

সেদিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় ফারদিন আহমেদ চৌধুরী।

‘অহনা তিরমিজি’ নামটা যেন জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে!

 

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪