KP Imon

Words Crafted

সামাজিক হিপনোটিজম

এক.
অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে আসার পর থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তিথির। শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রিদের বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কালচারাল শো ছিলো। সেখানে টানা তিনটি হিন্দী গান তোলার পর আর নিতে পারেনি সে। সোজা বের হয়ে চলে এসেছে। এয়ার কন্ডিশনড রুম থেকে আচমকা কড়া রোদে বেরিয়ে আসার কারণে সামান্য অস্বস্তিও হচ্ছে। গায়ে মাখলো না ওটুকু, তবে সামনের দৃশ্যে কিছু একটা ভুল রয়েছে এটা বুঝতে পারছে। এই বিষয়টা গায়ে না মেখে উপায় রইলো না তিথির।

বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে যাত্রিদের বসে থাকার জন্য রাখা হয়েছে সিমেন্টের সীট। তাতেই বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে একটা ছেলে। বসার জায়গাটায় পিঠ দিয়ে লটকে আছে, হেলান দেওয়ার অংশ বরাবর দুটো পা বাড়িয়ে দিয়েছে আকাশের দিকে। এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায় না। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে পা বাড়ালো তিথি।

আরেকটু কাছাকাছি আসতে ছেলেটাকে চিনতে পারলো ও, মেকানিক্যালের শুভ্র। সাধারণতঃ চশমা পরে, চশমা খোলা রাখায় একটু অদ্ভুত লাগছে তাকে। প্রথমে চেনা যায়নি তাই। ছেলেটা একটু পাগলাটে টাইপের। রোবোটিক্সের বিভিন্ন কম্পিটিশনে ধারাবাহিকভাবে পুরষ্কার পেয়ে এসেছে বলে কেউ তার পাগলামি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। কথায় আছে, জিনিয়াসেরা একটু পাগলাটে গোছের হয়। সেই তকমাটাই পিঠে নিয়ে মহানন্দে ক্যাম্পাসের এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে শুভ্র। বেশিদিন আগে নয়, জুনিয়র একটা মেয়েকে চলন্ত সাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। এরকম একটা মানুষকে সহজে কেউ ঘাঁটাতে চায় না। তারপরও তার পাশে গিয়ে বসে পড়লো তিথি।

শুভ্রের ঝলমলে চুলগুলো মধ্যাকর্ষণের টানে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, চোখ সরাসরি নিজের উর্ধ্বগামী পায়ের দিকে নিবদ্ধ।
তিথির দিকে একবারও না তাকিয়ে বললো, “তুমি তিথি না? ইলেক্ট্রিক্যালের।”

জিনিয়াস পাগল তাকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছে সেটা ভালো খবর কি খারাপ তা তিথি জানে না। কাজেই সামান্য ভ্রু নাচিয়ে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। চিনলে কিভাবে? আমাদের আগে দেখা হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না।”

চুলগুলোয় ঘূর্ণি তুলে সোজা হয়ে বসলো শুভ্র, বাদুড়ঝোলা অবস্থা থেকে সোজা হতে যথেষ্ট কসরত করা লাগলো তাকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা দু’জন স্কুলছাত্রি ফিকফিক করে হাসতে হাসতে চলে গেলো।
“আমাকে চেনো তুমি?” শুভ্র জানতে চাইলো।
একটা কাঁধ তুলে ছেড়ে দিলো তিথি, “তোমাকে ক্যাম্পাসের সবাই চেনে।”
হাসলো ছেলেটা, তিথি লক্ষ্য করলো তার হাসির মধ্যে ভালো লাগার মতো কিছু নেই। হয়তো অবজ্ঞা বা আত্মদম্ভের ভাবটুকু বোঝা যায় বলে এমনটা মনে হলো ওর। নিশ্চিত হতে পারলো না সে।
তিথির কথাটাকেই অবশ্য প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স ধরে নিলো শুভ্র। বললো, “এইটাই পয়েন্ট। এই ক্যাম্পাসের সবাই সবাইকে চেনে।”

ঠোঁটদুটোকে চেপে বিজ্ঞের মতো মাথা দোলালো তিথি। একমত হয়ে যাওয়াটাই হয়তো এখানে তার জন্য ভালো।

বুক পকেট থেকে চশমাটা বের করলো শুভ্র। বেশ মোটা কাঁচের চশমা। চোখটাকে ছেলেবেলা থেকেই খেয়েছে সে, তবে বাদুড় ঝোলার সময় অজ্ঞাত কোনো কারণে চশমা খুলে রেখেছিলো। চশমা চোখে দিতে দিতে বললো, “তবে তোমাকে চশমা ছাড়াও চিনতে পেরেছি অন্য একটা কারণে।”

আগ্রহ নিতে তার দিকে তাকালো তিথি।
“কোন কারণে?”
একটু কাশলো শুভ্র, “আসলে, ফার্স্ট সেমিস্টারে তোমার ওপর ক্রাশ খেয়েছিলাম।”
মৃদু হাসলো তিথি, “কিউট তো!”
“প্রোগ্রামে যাওনি?” প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো শুভ্র।
“গেছিলাম। একটার পর একটা-”
“হিন্দী ঝাড়ছে, তাই তো?” মিটিমিটি হাসে শুভ্র, “আমিও সেজন্য বেরিয়ে এসেছি। দেশে মনে হয় ভাষার খুব আকাল পড়েছে! নোয়াখালি, চিটাইঙ্গা, বরিশাইল্যা বা সিলেটিতে গান করলেও মেনে নিতাম। তারা বর্ডার পেরিয়ে যাবে। একেবারে সীমানা পেরিয়ে, ভারতমাতার আঁচল তলে।”

ক্ষুব্ধ শুভ্রকে ভালো লেগে যায় তিথির, একটু আগের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। খোলা মনের ছেলে, ক্রাশ খাওয়ার কথাটা ক্রাশের সামনে চটপট বলে ফেলে না নাহলে কেউ। তারওপর হিন্দী সহ্য করতে পারে না। রক্তাক্ত বায়ান্নোর পর বিজাতীয় ভাষাকে বাংলার ওপর প্রাধান্য দিলে কোনো সচেতন বাংলাদেশিই তার নিন্দা না করে পারে না। ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই।

“ভাবছি এই প্রোগ্রামই বর্জন করবো নাকি।” শুভ্রকে বললো ও।
ছেলেটা অবশ্য কোনো মন্তব্য করলো না। তিথির কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নজর বোলাচ্ছে। একটু অস্বস্তিই হলো ওর। পরক্ষণেই কেটে গেলো শুভ্রের কথাটা শুনতে পেয়ে,

“ধ্যাত, জিন্স পরোনি। নাহলে তুমিও বাদুড় হয়ে থাকতে পারতে এখানে।”
উঠে দাঁড়িয়ে ওপরে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গলো শুভ্র। পাশেই চা-সিগারেটের দোকান পেতে বসে আছেন রইসুদ্দি মামা। ভার্সিটির সবার প্রিয় মুখ। ব্রেক টাইমে অনেকেই এই কাউন্টারের সিটগুলোতে বসে আড্ডা দেয়। সেই সাথে রসদ নেয় রইসুদ্দি মামার দোকান থেকে। তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই একটা মার্লবোরো আর লাইটার হাতে চলে এলো শুভ্রর।

রোদের আক্রমণ থেকে চোখ বাঁচাতে অযথাই খানিক পিটপিট করলো সে। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে পরিমিত টান দিলো বারকয়েক। তাতেই এলাকা ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। তিথির দিকে তাকিয়ে মুখ নাচালো তারপর।
“প্রোগ্রাম বর্জন করবে যখন, চলো।” আবারও চোয়াল বাঁকিয়ে মুখ ঝাঁকালো শুভ্র, “বাসায় চলো।”
“ও হ্যাঁ, তুমি তো আবার লোকাল।” এতটুকুই বললো তিথি। ছেলেটার স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথা বার্তায় রীতিমতো স্তব্ধ সে।

একটু আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় হয়েছে তাদের। এর মধ্যে অনায়াসে তাকে জানিয়ে দিয়েছে একটা সময় (কিংবা হয়তো এখনও) তার প্রতি দুর্বল ছিলো সে। তারপর তাকে রীতিমতো ‘স্ক্যান’ করেছে। এবং এখন প্রস্তাব দিচ্ছে তার বাসায় যাওয়ার জন্য। শুভ্রের পরের কথাটা আরও চমকে দিলো তাকে।

“কই, চলো?” হাত বাড়িয়ে কাওকে ডাকলো সে, “একটা রিকশা নেই।”
রিকশাওয়ালা এসে গেছে, তিথি এখনও কিছু বলার সুযোগই পায়নি। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে তিথির সামনে এসে দাঁড়ালো শুভ্র। ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, “এসো। খুব দূরে না আমার বাসা।”

“তোমার বাসায় যাবো কি করতে?” না বলে আর থাকতে পারলো না তিথি, “এখানে থাকতেই ভালো লাগছে আমার।”
বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠলো শুভ্রের মুখে, “বুঝেছি। বাসায় গিয়ে তোমার সাথে কি করবো সেটা ভাবছো তো? আরে সেই ভয় নাই। একদম খালি বাসা। মম-ড্যাড গ্রামের দিকে গেছে। দুই তিন দিন পর আসবে হয়তো।”

রীতিমতো ক্ষেপে উঠলো তিথি। তবে কিছু বলতে পারলো না। শুভ্রের চোখে চোখ পড়তে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। ওর সাথে মজা করছে ক্যাম্পাসের জিনিয়াস পাগল! পিত্তি জ্বলে গেলো তিথির।

ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ালো এবার, “চলো।” রিকশাতে উঠে গেলো সরাসরি, “তোমার বাসাতেই যাবো এখন।”
ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে আর ফক ফক করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রিকশাতে উঠে পড়লো শুভ্রও।

দুই.
তিনতলা বাড়িটার সামনে থেমে গেলো রিকশা। ক্যাচ ধরে ধরে চাবির গোছাটা নিয়ে খেলছে শুভ্র। পাশে হেঁটে আসা তিথির দিকে যেনো কোনো নজরই নেই। বিশাল গ্যারেজের দরজার এক কোণে ছোটো দরজা, সেটা খুলে ফেললো নির্দিষ্ট চাবি ব্যবহার করে। তারপর ধরে থাকলো কিছুক্ষণ, তিথিকে ঢোকার সুযোগ করে দিচ্ছে। ভেতরে পা রেখে একটু চমকালো ও, গ্যারেজে যে চারটা গাড়ি আছে, তার তিনটার কোনটাই কয়েক কোটির কম দামের নয়। রেসিং কারই দুটো।

শুভ্রদের টাকা আছে, ভাবলো তিথি।

সিঁড়িঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুভ্র, তাকে একটু জোরে পা চালিয়ে ধরে ফেললো তিথি।
“তোমাদের গ্যারেজের ভেতরে যা যা আছে তা বিক্রি করে দিলেই তো আরেকটা অডিটোরিয়াম বানাতে পারবে ভার্সিটি।” কথার কথা হিসেবেই বললো যেনো তিথি।
হাহা করে হাসলো শুভ্র, “ফুটানি দেখানোর জন্য কিনেছিলো বাবা। এখন পড়ে আছে। ওই টাকাটা আমাকে দিলে দুনিয়ার স্যাটেলাইট হিস্টোরিই পাল্টায়ে দিতাম।”

আর কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিলো তিথি। দোতলার দরজায় এসে আরেকটা চাবি বের করলো শুভ্র। বড় একটা তালা ঝুলছে ওদের দরজায়। খটকা লাগলো তিথির। এতো মূল্যবান গাড়িগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য নিচে একজন মানুষও নেই। কেনো? দারোয়ান তো একজন রাখাই যেতো। তাছাড়া এই গাড়িগুলো বের করার সময় গ্যারেজের দরজা খোলা আর লাগানোর জন্য হলেও একজন গেট ম্যানের তো দরকার। কিন্তু কেউ ছিলো না নিচে। কেনো ছিলো না? আবার এখানে শুভ্র তার বাড়ির দরজা থেকে তালা খুলছে।

তাহলে, আসলেই তার বাসায় কেউ নেই।
ফাঁকা বাসায় তিথিকে নিয়ে এসেছে শুভ্র। কি তার উদ্দেশ্য?

এক পা পিছিয়ে গেলো তিথি। “তোমার বাসায় কেউ নাই?”
অবাক হতে ওর চোখে চোখ রাখলো শুভ্র, “তোমাকে না বললাম, বাসার সবাই গ্রামে গেছে?”
দুই হাত বুকের কাছে বাঁধলো তিথি। এবার সত্যিই রাগ হচ্ছে ওর।
“খালি বাসায় আমাকে আনলে কেনো?”
মুচকি হাসলো শুভ্র, “তোমার পর্ন ভিডিও বের করার জন্য। আমি এটাই করি। একা একটা মেয়েকে নিজের বাসায় এনে তার সাথে অনৈতিক কাজ কর্ম করি। আমার ক্ষুদে রোবটেরা তা ভিডিও করে। তারপর সেই সব ভিডিও চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়। আমার উদ্দেশ্য তোমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে?”

থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিথি। গনগনে আঁচ বের হচ্ছে যেনো মুখ থেকে। ফর্সা মুখটা এখন টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তিথির নিজেরই মনে হচ্ছে তার কান গরম হয়ে গেছে। রাগে না লজ্জায় তা সে বুঝতে পারছে না। সিঁড়িঘরের ভেতরটা খানিক অন্ধকার। কিন্তু কেনো জানি বন্দীত্বের অনুভূতি হচ্ছে না তার।

“চলে এসো ভেতরে।” ঢুকে পড়লো শুভ্র, তিথির ওপর আক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে, “আগেই তো বলেছি তোমার ওপর ফার্স্ট সেমিস্টারে ক্রাশ খাওয়া আমি। ভয় পাচ্ছো কেনো? খুব বেশি কিছু হলে জাপ্টে ধরে চুমু-টুমু খেয়ে ফেলতে পারি, এর বেশি আর কিছু ক্রাশের সঙ্গে করা যায় নাকি? তোমার ভয় পাওয়ার কিছু তো দেখি না।”

বিষয়টা তিথির কাছে ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। শুভ্রর মতো ছেলে সে জীবনে একটাও দেখেনি। তার ব্যাপারে অনেক প্রশংসা শুনেছে এতোদিন, তবে ব্যক্তিগতভাবে শুভ্রকে চেনে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ব্যক্তি শুভ্রকে চিনতে তিথির কেমন লাগছে সেটা সে বুঝতে পারছেন না। কখনো মনে হচ্ছে শুভ্রকে জানতে পারাটা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। আবার কখনো মনে হচ্ছে এটা আর এগিয়ে যেতে না দেওয়াটাই উচিত।

সামনে শুভ্রের বাসায় ঢোকার মূল দরজা হা করে খোলা। তাকে হাতছানি দিয়েছে শুভ্রও, তবে এর ভেতর ঢুকে পড়া উচিত হবে কি না তা সে বুঝতে পারছে না। ধীর ও কম্পিত পায়ে ঢুকে পড়লো তিথি। শুভ্রের হাতে মোবাইলফোন। একটা কিছু করতেই পেছনে দড়াম করে দরজাটা লেগে গেলো।

“অ্যান্ড্রয়েড একটা অ্যাপ বানিয়ে নিয়েছি। আমাদের সিকিউরিটি খুবই স্ট্রং।” সগর্বে বললো শুভ্র, “কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারবে না, যদি আমি না চাই।”
“তাহলে বাইরে পুরাতন আমলের অ্যানালগ লক ঝোলানোর দরকার কি ছিলো?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো তিথি।
“ওল্ড ইজ গোল্ড।” ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলো সে। তিথি কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা কাঁচের বোতল তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে সে। শুন্যে খপ করে ধরে ফেলতে ফেলতেও ফেলে দিচ্ছিলো তিথি, আরেকটু হলেই মেঝে ভেসে যেতো কোক আর কাঁচের টুকরোয়। অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে গেলো তার মুখ থেকে।
“আমার রুমে চলো।” সরসরি সামনে হাঁটা দিলো শুভ্র।

বদ্ধ এই দরজাটাও মোবাইলের সাহায্যে খুললো সে। তারপর সরে জায়গা করে দিলো তিথির ঢোকার জন্য। ছিমছাম ঘর। একটা ডাবল বেড, কম্পিউটার টেবিল আর একটা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। দেওয়ালের সাথে লাগিয়েই বানানো হয়েছে বইয়ের তাক। সেগুলোতে ঠাসা নানা ভাষার বই। ডাবল বেডের ঠিক মাথার কাছে দেওয়াল জুড়ে সাঁটা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ নগ্ন নারীদেহের ছবি। নারীটির মাথায় ঘন সোনালিচুল, দৃষ্টিনন্দন দেহসৌষ্ঠব। চেনা চেনা মনে হলেও তিথি নিশ্চিত হতে পারলো না।

“কিসা সিনস।” শুভ্র বললো খাটের পাশে দাঁড়িয়ে, “আমার প্রিয় পর্ন তারকা। জনি সিন্সের ওয়াইফ।”
মাথা দোলালো তিথি, “জনি সিন্স কে?”
“আরেকজন পর্ন স্টার।” অবাক হয়ে উত্তর দিলো শুভ্র, এতো সহজ প্রশ্ন যেনো জীবনে শোনেনি, “কিসা সিন্সের হাজব্যান্ড।”
“ও।” এতটুকুই বললো তিথি। স্কুলটা নদীর সামনে, আর নদীটা স্কুলের পেছনে জাতীয় উত্তর দেওয়া হলে আর কি বলার থাকে?
“তুমি বসো। আমার পিসিটা অন করি।” দেওয়ালের সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো সে। এর সঙ্গে মনে হয় অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সংযোগ রাখা যায়নি।

ডাবল বেডে বসে তিথির দেহে চনমনে একটা ভাব চলে আসলো। ঝকমকে ঘর, দেওয়ালে উত্তেজক পোস্টার আর শুভ্রের খোলামেলা কথা, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণ। তিথির মনে হলো সে সামান্য সম্মতি দিলেও এই ঘরে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে আজ। শুভ্র জানে, সে-ও জানে এমন কিছু আজ এখানে হবে না। অথচ সম্ভাবনা তো রয়েছে। বিন্দুমাত্র হলেও! সেটাই চনমনে অনুভূতিটার পেছনে কাজ করছে।

অবাক হয়ে তিথি লক্ষ্য করলো, শুভ্রকে সে বিশ্বাস করে। কেনো? এটা সে জানে না।

“আংকেল আন্টি কিছু বলে না?” গলা খাকারি দিয়ে জানতে চাইলো তিথি।
“কি বলবে?” সেই চিরায়ত অবাক অবাক দৃষ্টি এখন শুভ্রর চেহারায়। ও আবিষ্কার করলো এই অভিব্যক্তিতে ছেলেটাকে বেশ সুন্দর দেখায়।
“এই যে…” আরেকবার কাশলো তিথি, “কিসা সিনসের ন্যুড ফটোগ্রাফ বেডরুমে রেখেছো।”
কাঁধ ঝাঁকালো শুভ্র, “আরে আমার পেশাই তো ওই। মেয়েদের ধরে এনে এনে তাদের পর্ন ভিডিও বের করা। ওই খাটে কতোজনের ইজ্জত গেছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”

ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিথি, “সিরিয়াসলি? এসব লো ক্লাস জোকস ছেড়ে কি লাভ হচ্ছে, শুভ্র?”

ঝট করে মাথা ঘুরালো শুভ্র।
এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো তিথির চোখে চোখ রেখে। শিউরে উঠলো ও, অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা অনুভূতি হচ্ছে। এক সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে অনন্ত কাল। কালো চোখের তারায় অশুভ কিছু আছে ছেলেটার। সে যা বলছে সবই কি মীন করে বলেছে? তিথির এতো অনিশ্চিত লাগছে, এমন আগে কখনও হয়নি। অথচ চলে যেতে ইচ্ছে করছে না। ছেলেটা অন্যরকম। তার সান্নিধ্য ভালো লাগছে ওর।
ভীতিকরও লাগছে!

“এগুলো জোকস মনে করছো কেনো, তা কি তোমার জানা আছে তিথি?” কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র। অজান্তেই হাতে ধরে রাখা ঠাণ্ডা বোতলটা চেপে ধরলো ও। কিন্তু তার দিকে আসছে না ছেলেটা, দেওয়ালের কাছে একটা তাকের সামনে দাঁড়ালো। বটল ওপেনার বের করলো একটা। নিজের কোকটা খুলে তিথির দিকে ছুঁড়ে দিলো। এবার অল্পের জন্য কপাল কাটা থেকে রক্ষা পেলো ও।

“জিনিস ছুঁড়ে দেওয়ার অভ্যাসটা খুব খারাপ তোমার।” ঝাঁঝিয়ে উঠে কোকটা খুললো তিথি।
“আসলে, তুমি সামাজিক হিপনোটিজমে আটকে গেছো। দ্যাটস অল।” নিজের কথার খেই ধরলো শুভ্র, “সেজন্য আমি যাই বলি তোমার কাছে অন্যরকম লাগে। নতুবা ধরে নাও স্রেফ জোকস ছাড়ছি।”

খাটে উঠে তিথির মুখোমুখি বসলো সে। বোতলটা একটু সামনে এনে ঠুকে দিলো মেয়েটার বোতলে, “চিয়ার্স।”
শুভ্রের শরীরে গন্ধ পেলো ও, এখনও মাংসপেশি টান টান হয়ে আছে তিথির। সাবধানে চুমুক দিলো বোতলে।

হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলো শুভ্র, “ফাইন। আমি পর্ন-টর্ন বানাই এসব সত্যি না। ওসব লো ক্লাস জোকস-ই ছিলো।” তারপরই তিথির পিত্তি জ্বলে যাওয়ার মতো হাসি হাসলো সে, “কিন্তু সেই লো ক্লাস জোকসেই তোমার চেহারার যে দশা হয়েছিলো!” মেয়েটার উরুতে মাঝারি এক চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র, “টেনশনের কিছু নাই। কোকটা শেষ করো। আমি লাঞ্চের ব্যবস্থা করি। বিফে তোমার প্রবলেম আছে?”

কটমট করে তার দিকে তাকালো ও, “হ্যাঁ। আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে, জানো না?”
গাল চুলকাতে চুলকাতে কিচেনের দিকে চলে গেলো অদ্ভুত ছেলেটা।

তিন.
ক্লাস থেকে বের হতেই নেহালের সাথে দেখা হয়ে গেলো তিথির। কাঁধে ব্যাগ আর হাতের বোঝা সদৃশ খাতা নিয়ে হাঁসফাঁস করছে। ওদের সিআর (ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ)দ্বয়ের একজন এই ছেলেটা, তবে কাজের সময় তার আশেপাশে কাওকে দেখা যায় না। মায়াই হলো তিথির।

“দে, আমার হাতে দে কিছু।” এগিয়ে গিয়ে বললো ও।
করুণ একটা হাসি হাসলো নেহাল, একটা বান্ডিল ওর হাতে তুলে দিলো, “থ্যাংকস। কি খবর তোর?”
“তোর চেয়ে ভালো, যা দেখতে পাচ্ছি।” চোখ টিপলো তিথি।
“গর্তে পড়লে হাতিকে চামচিকাও লাথি মারে। পরীক্ষিত।” হতাশ কণ্ঠে বললো নেহাল।
“নিজেকে চামচিকা প্রমাণের চেষ্টা না করে অন্য সিআরটাকে একটু ঝাড়ি-টারি দিস। সব দায়িত্ব তো তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিদেয় হয় দেখি।” কপট রাগের সাথে বললো তিথি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলো ওরা। গন্তব্য, ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং। স্যারের রুমে সব খাতা জমা দিয়ে এসে শান্তি। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গতে মুখ খুললো নেহালই।
“শুভ্রর সাথে তো তোকে রেগুলার দেখা যাচ্ছে শুনলাম।” অর্থবোধক উচ্চারণে বললো নেহাল।
“তো? একসাথে রেগুলার বের হলে তো রেগুলারই দেখতে পাবি। অবাক হচ্ছিস যে?”
“অবাক হবো কি আর? জানতে চাইলাম, প্রেম ট্রেম করছিস কি না, তাই আরকি। করলেই আমাদের লাভ, স্বীকার করতে বাঁধা নাই।”
“আমি প্রেম করলে তোদের কি লাভ?”
“ট্রিট পাবো যে। গ্র্যান্ড ট্রিট।”

ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং থেকে ফেরার সময় ক্যাম্পাসের আগুন ধরানো সুন্দরী মেহজাবিনের সাথে দেখা হয়ে গেলো তিথির। মডেলিং-টডেলিংও করছে আজকাল। তিথিকে দেখতে পারে না এই মেয়ে, কেনো কে জানে। অবশ্য মেহজাবিন ক্যাম্পাসের কোনো সুন্দরী মেয়েকেই দেখতে পারে না। মুখে প্রকাশ না করলেও তার আচরণ তেমনটাই বলে। বরাবরের মতো তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিলো তিথি, পারলো না।

আগ্রহী মেহজাবিন গায়ে পড়ে কথা বলতে এলো আজ। “কি রে সুন্দরী, কি খবর তোর? তোকে কয়েকদিন ধরে খুঁজছি আমি।”
“আমাকে খুঁজছিস?” অবাক হয়ে গেলো তিথি। “কেনো?”

মেহজাবিন ওকে একটা কারণেই খুঁজতে পারে। হয়তো কোনো প্রতিযোগিতায় দুইজনই অ্যাটেম্পট নিয়েছিলো, তাতে তিথি বাদ পড়েছে তবে মেহজাবিন টিকে গেছে। তেমন কোনো খবর জানানোর জন্যই কেবল এই মেয়ে অন্য কোনো সুন্দরীকে খুঁজে। এসব তিথির জানা আছে। মনে করার চেষ্টা করলো, এর মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলো কি না। মনে তো হয় না।

“আরে, শুভ্র তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না?” শুরু করলো মেহজাবিন। একটু আগেই তিথির খবর জানতে চেয়েছিলো এবং তিথি যে সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি সেদিকে তার আর নজর নেই এখন। আসল কথা পাড়তে পারলে ফরমালিটিতে সময় নষ্ট করে কে? “শুভ্রর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তোকে। পরিচয় মানে ডেট। একটা ডেট ম্যানেজ করে দিবি তুই আমাকে। পারবি না?”
মুচকি হাসলো তিথি, “শুভ্র তোর সাথে ডেট করতে রাজি হবে কেনো?”
“হবে নাই বা কেনো? ভালো ছেলে ও, ফ্রি মাইন্ডেড। অরাজি হওয়ার তো কিছু দেখি না। অবশ্য তোকে এসব বলে কি লাভ? তুই ওকে আমার চেয়ে ভালো চিনিস।” তিথির হাতে চিমটি কাটলো মেহজাবিন, ন্যাকামি দেখে তিথির গা জ্বলে যেতে থাকলেও কিছু বলতে পারলো না।

মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললো মেহজাবিন, “পারবি তুই, আমি জানি। আর শোন্, ওকে কিন্তু ভালোমতো বানিয়ে দিতে হবে। বুঝিয়ে দিস আমি ওর ওয়ান নাইটার হতে চাইছি। সেক্স-টেক্স নিয়ে আমার কোনো বাড়তি কুসংস্কার নাই। এটা যেনো সে জেনে রাখে।”
তিথি কিছুই বুঝতে পারছে না এখন, “ওকে এক রাতের জন্য বিছানায় তুলে তোর কি লাভ?”
“তুই গাধা নাকি? ওর ডিজাইন করা স্যাটেলাইট যে ইউরেনাস যাচ্ছে সামনের বছর তা জানা আছে তোর?”
কাঁধ ঝাঁকালো তিথি, “জানবো না কেনো? দারুণ কাজ করেছে ও। বাংলাদেশের জন্য গর্বের হবে এটা।”
“সেইজন্যই ওকে আমার লাগবে রে। প্লিজ দোস্ত, ম্যানেজ করে দে না?” মেহজাবিন পারলে তিথির পায়ে পড়ে যায়, “অবজার্ভার টিভিতে কাজ করার সুযোগ পেতে যাচ্ছি আমি, শুনেছিস? আমার প্রোগ্রামে একবার শুভ্রকে নিয়ে যেতে পারলে কি হিট হবে চিন্তা করে দ্যাখ? ক্যারিয়ার আমার রকেটের বেগে ওপরের দিকে ছুটবে।”

আচ্ছা! এবার সবটা স্পষ্ট হলো তিথির কাছে। এখন শুভ্রর সাথে একরাত কাটাতে পারলে তার সঙ্গে একটা ইন্টিমেসি হবে। এরপর এক বছর পর শুভ্র হয়ে যাবে ন্যাশনাল হিরো। সঠিকভাবে বললে ইন্টারন্যাশনাল হিরো। গোটা দুনিয়ায় তাকে নিয়ে মাতামাতি হবে। এই ছেলে নাসাতে ঢুকে যাবে এটাও অনেকে নিশ্চিত। বাংলাদেশের সবাই ডক্টর ইউনুসের পর পরই চিনবে তাকে। বলাবলি করবে, ইউরেনাসকে চক্কর দিতে থাকা স্যাটেলাইটটা বানিয়েছে আমাদের একজন। একজন বাংলাদেশি। তখন সেই বাংলাদেশিকে নিয়ে স্টুডিওতে যাবে মেহজাবিন। একবছর পর। মেয়েটার দূরদর্শিতা দেখে চমৎকৃত হলো তিথি।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অবশ্য উল্টোটা বুঝলো মেহজাবিন, “কিরে, তোদের মধ্যে কি প্রেম চলে? তোর আর শুভ্রর?”
মাথা নাড়লো তিথি, “না রে। ও মুসলিম না? আমার সাথে প্রেম কিভাবে?”
“আরে বাদ দে। হিন্দু মুসলমান সে দেখে বলে মনে হয় না। আমার কি ধারণা জানিস? শুভ্র নাস্তিক। তুই জিজ্ঞাসা করে দেখিস একদিন। যাই হোক, প্রেম করছিস না দেখে ঝামেলা কমলো। নাহলে ওর সাথে শোয়ার জন্য তোর অনুমতিও লাগতো।”
মুচকি হাসলো তিথি, “এর আগে এই কাজ যাদের সাথে করেছিস সবার গার্লফ্রেন্ডের অনুমতি নিয়েছিলি?”
মাথা নাড়লো মেহজাবিন, “তাদের গার্লফ্রেন্ডদের কেউ আমার ফ্রেন্ড তো ছিলো না। অবশ্য শুভ্রকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না। এক রাত ওকে পেলে, ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবো একেবারে। এর পর আরও অনেকবার সে নিজে থেকেই আমার কাছে আসবে। ছেলেরা কি পছন্দ করে আমার জানা আছে। তুই শুধু ফার্স্ট নাইটের সেটআপটা করে দে। বাকিটা দেখছি। শুভ্রকে আমি হিট করে দেবো।”

সেই সাথে নিজেও হিট হবা, মনে মনেই বললো তিথি। সব কথা মেহজাবিনের মুখের ওপর বলতেই হবে এমন তো না। আরও কিছুক্ষণ বক বক করলো মেহজাবিন। পুরোটা সময় অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখলো তিথি। বিদায়ের সময়ও আদিখ্যেতার চূড়ান্ত করলো সে। ক্যাম্পাসের মাঝখানেই বেস্ট ফ্রেন্ডদের মতো তিথির গালে চুমু খেলো, তারপর দুই আঙুল নেড়ে টাটা দিলো তাকে। মেহজাবিনের সব কাজের পেছনেই স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। ক্যাম্পাসের কেউ এসব কাজে এখন আর পাত্তা দেয় না। তারপরও আড়ালে হাসলো কেউ কেউ।

সেদিন হলে ফেরার সময় শুভ্রের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটা মনে করলো তিথি, প্রায় একবছর হয়ে গেলো!
হ্যাঁ, খুব নার্ভাস ছিলো সে ওইদিন। অসহায়ও ছিলো। শুভ্রের সুরক্ষিত বাড়ির ভেতরে একদম কোণার ঘরে শুভ্রর সঙ্গে বন্দী। বাসায় আর কেউ ছিলো না। শুভ্র তার সঙ্গে যা ইচ্ছে করতে পারতো। কোনো সাক্ষী ছিলো না সেদিন। কিন্তু কিছুই করেনি সে। দু’বার ওকে স্পর্শ করেছে কেবল। হাসিচ্ছ্বলে একবার উরুতে চাপড় দিয়েছে ওকে বোকা বানিয়ে, আরেকবার ফিস্ট বাম্প করেছে, বিদায়ের সময়। আর কিচ্ছুটি না।

শুভ্র জানে না, ওই দুটো স্পর্শের সময়ই তিথির বুকে ঝড় উঠেছিলো।

চার.
মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কাজ করছে শুভ্র। মনিটরে দেখা যাচ্ছে অসম্পূর্ণ একটা ডিজাইন। কিসের, তা আরও অস্পষ্ট। তবে সেটা বোঝার চেষ্টাও করলো না তিথি। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রকে।

“তিথি নাকি?” মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই জানতে চাইলো শুভ্র, “তোকে খুব খুশি খুশি লাগছে মনে হচ্ছে।”
ওকে ছাড়লো না তিথি, “খুশি হওয়ার কারণ আছে। তোর কাজটা শেষ কর, আমরা বাইরে ডিনার করছি আজ।”
মাউস থেকে হাত সরিয়ে তিথির দিকে মুখ ফেরালো শুভ্র, নাকে নাক ঠেকে গেলো ওদের, “বাইরে কেনো রে? ঘরে অনেক খাবার আছে, মম রাতে স্পেশাল আইটেম করছে আজ। বাইরে যাওয়াই যাবে না।”

শুভ্রের কথা শেষ হওয়ার আগেই “মম” ঢুকে গেলেন ভেতরে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হবে ভদ্রমহিলার। দেখতে একেবারে বলিউডের কোনো বর্ষীয়ান হিরোইন। তিথি যতবার তাঁকে দেখে, ওর মনে হয় শুভ্রের চেহারার সৌন্দর্যটা হয়তো মায়ের দিক থেকেই এসেছে।

“কি? আমাকে নিয়ে কি ব্যাকটকিং করছিস তোরা?” হাসিমুখে জানতে চাইলেন তিনি।
শুভ্রকে জড়িয়েই রাখলো তিথি, “না আন্টি, তোমার প্রিন্সকে বাইরে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সে তো যেতেই চাইছে না। কি করা যায় বলো তো।”
“যাবে কি রে?” অবাক হয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি এখন মহিলার মুখে, ঠিক শুভ্রের মতো। তিথির হাসি পায় খুব, “আমি রান্না করছি আজ কতোদিন পর, আর তোরা বাইরে যাবি মানে? কোথাও যাওয়া চলবে না।”

আলতো করে মাথা ঝাঁকালো তিথি, এটা কোনো সমস্যা না। অন্য কোনোদিন গেলেই চলবে। মুখে শুধু বললো, “ওকে, আন্টি।”
বের হওয়ার সময় কিসা সিন্সের পোস্টারটার দিকে চোখ পড়লো আন্টির, “আর শুভ্র, তুই এই এক মেয়ের মধ্যে কি এমন পেয়েছিস রে? দেখতে দেখতে আমারই চোখ পচে গেলো। বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখেছিস, যত্তোসব! দুনিয়ায় আর মেয়ে নাই?”

গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি। হেসে ফেললো তিথি, কিসা সিন্সের যে পোস্টারটা এখন পুরো একটা দেওয়াল জুড়ে আছে তা অবশ্যই এক বছর আগের ছবিটি নয়। এর মধ্যে খুব সম্ভবতঃ সাতবার পোস্টার পাল্টেছে শুভ্র। প্রতিবারই কিসা সিন্সের ছবি ঝুলিয়েছে এবং প্রতিবারই সম্পূর্ণ নগ্ন সে ছবিগুলো। তবে এসবে ওদের পরিবারের কারও চোখ বা ভ্রু কুঁচকে যায় না। এগুলো তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবে নেন। আন্টির আপত্তি কিসা সিন্স নিয়ে। তার শরীর চোখের সামনে এতোবার পড়েছে তিনি আর মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারছেন না।

তিথি প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে পারতো না। একটু অস্বাভাবিক মনে হতো ওদের পরিবারটিকে। তবে এখন আর তেমনটা লাগে না। মনে হয় এটাই হয়তো সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি। ওরা সমাজে নিষিদ্ধ আর ‘অ’নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে একই পর্যায়ের খোলামেলা আলোচনা করেন। এজন্য তাদের সামনে তাদের ছেলেকে ছেলের বান্ধবী জড়িয়ে ধরতে পারে, নগ্ন পোস্টার দেখলে তাঁরা চোখ কপালে তুলে ফেলেন না। শুভ্রকে কখনও মেয়েদের প্রতি বাজে কোনো ধারণা রাখতে দেখেনি তিথি। তাদের ছোটো করতেও দেখেনি। পজেটিভ চিন্তাভাবনা গুলো হয়তো পরিবারের সুশিক্ষার কারণেই সে পেয়েছে। এখন আন্টি আর আংকেলের কাজটাকেই ঠিক মনে হয় তিথির।

“নতুন কিছু পেয়েছিস মনে হচ্ছে। আমাকে শোনাবি দেখে চলে এসেছিস। আর সেইটা বাইরে নিয়ে বলার জন্য ডিনার বাইরে করতে চাইছিস।” কম্পিউটার ছেড়ে সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে তিথির মুখোমুখি হলো শুভ্র, “তাই না?”
“তুই তো জিনিয়াস পাগল। তোর কাছে লুকানো সম্ভব না কিছু।” হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো তিথি।
“তাহলে বলেই ফ্যাল, এবারের হট নিউজটা কি?” চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো শুভ্র।

একটু পিছিয়ে গিয়ে ধপাস করে শুভ্রের খাটে শুয়ে পড়লো তিথি। দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে দুই পাশে, চুল এলিয়ে দিয়েছে পেছনে। পালকের তোষকের এই খাট খুবই আরামদায়ক। শুলেই ঘুম পায় ওর। আরামে চোখ বন্ধ করে বললো, “নিউজটা হট-ই। মেহজাবিন রিলেটেড।”
“কোন মেহজাবিন, আইপিই’র? প্র্যাক্টিক্যাল একটা মেয়ে। ভালো মেয়ে।” শুভ্র বললো।
চোখ খুলে গেলো তিথির, “কি রে? এতো অ্যাডজেক্টিভস? প্র্যাক্টিক্যাল, ভালো? আরে ব্যাটা ওই মেয়ে তোর সাথে একরাত কাটাতে চাইছে। পবিত্র মেয়ে তোমার, কুমারী নাম্বার ওয়ান।”

চোখ পিট পিট করলো শুভ্র, “তাতে কি হলো? অবজার্ভারে কাজ পেয়েছে ও, একটা সায়েন্স রিলেটেড শো-র অ্যাংকর। আমার সাথে মনে হয় ঐ স্যাটেলাইটের ব্যাপারটার জন্য রাত কাটাতে চাইছে। আগামী বছর লঞ্চ করবে স্যাটেলাইট, এটা নিয়ে সারা পৃথিবীতে খুব হই চই হবে। অবশ্য লাইম লাইটটা আমারও দরকার, বাংলাদেশের সোসাইটি নিয়ে আমার প্ল্যান আছে। দেশের মিডিয়া কাভারেজের একটা অংশ যদি মেহজাবিন দেয়, তাহলে খারাপ কি? ওর প্রস্তাবটা আমি ফেলবো না।”

উঠে বসলো তিথি, “মানে তুই ওর সাথে শুবি? ওরকম নষ্টা একটা মেয়ের-”
“ওকে নষ্টা বলছিস কেনো?” এক হাত তুলে তিথিকে থামিয়ে দিলো শুভ্র, “অনেকের সাথে সেক্স করে এসেছে এটাই তো অভিযোগ? একটু আগে ওকে অপবিত্রও বললি। আচ্ছা, একটা মেয়ে কয়েকজনের সাথে সেক্স করলেই কি সে অপবিত্র হয়ে যায়?”

তিথির চোখমুখ কঠিন হয়ে গেছে, “অবশ্যই হয়।”
“কেনো হয়? তার দেহের কোনো উপাদানে তো পরিবর্তন আসে না। তাহলে কেনো তাকে অপবিত্র ঘোষণা করা হয়?”
তিথি এর জবাব দিতে পারলো না। কিন্তু হার মানতে চাইলো না সে, জোর গলায় প্রতিবাদ করলো, “অবশ্যই কোনো না কোনো পরিবর্তন আসে। নাহলে বেশি মানুষের সাথে শুলে ছেলে বা মেয়ের যৌনরোগ হয় কেনো?”
“প্রটেকশন নেয় না তাই।” মুচকি হেসে বললো শুভ্র, তিথির কাছে বিষয়টা যতো সিরিয়াস, তার কাছে এটা ততোই হাস্যকর। একটি কৌতুক ছাড়া আর কিছু তো নয়। “প্রটেকশন থাকলে কোনো রোগও হয় না। অর্থাৎ প্রটেকশন থাকলে পবিত্রতা নষ্ট হয় না।”

“একটা মেয়ে তার সবকিছু আরেকজনকে এক রাতের জন্য দিয়ে দেবে অথচ তার পবিত্রতা নষ্ট হবে না?” ক্ষেপে উঠলো এবার তিথি, “ওই মেহজাবিন তো একটা মাগি। মাগির সাপোর্টে কতো কথা তোর! ওর সাথে শোয়ার খুব ইচ্ছা থাকলে শো না, যা। সেইটাকে পবিত্র করতে চাইছিস কেনো?”
“একরাতের জন্য তার সঙ্গে আমি যদি থাকি, কি হবে তুই জানিস তো?” মৃদু হাসিটা এখনও ধরে রেখেছে শুভ্র, “আমি তার সবকিছু দেখতে পাবো, স্পর্শের অধিকার পাবো, তার সঙ্গে সেক্সুয়াল ইন্টারঅ্যাক্ট হবে। এই দুটো ছাড়া আর কিছু তো নয়। একটা মানুষের লুকিয়ে রাখার আছেই বা কি। এতে করে তার দেহের গঠন পাল্টে যাচ্ছে না যেহেতু, আমার সাথে কাটানো রাতটার আগের দিন সে যতোটুকু পবিত্র ছিলো, পরের দিনও ততোটুকুই থাকবে। অন্য কারও সাথে রাত কাটানোয় একটা মেয়ের চরিত্র নষ্ট হয় না। পবিত্রতাও নষ্ট হয় না।”

লাল হয়ে এসেছে তিথির মুখ, “একটা কথা ঠিক বলেছিস অন্তত। মেহজাবিনের পবিত্রতা তোর সাথে শোয়ার আগে যা ছিলো পরেও তা থাকবে। আগাগোড়াই নষ্টা যে, তার পবিত্রতা তো নতুন করে যাওয়ার নাই। কিন্তু তোর মতামতে যদি এটা চরিত্র নষ্ট না করে, কোনটা করবে আর? কাকে তুই দুশ্চরিত্রা বলিস?”
খুব সহজ প্রশ্ন করা হয়েছে এভাবে তার দিকে তাকালো শুভ্র, “যে তার ম্যারেজ পার্টনারকে চিট করে সে-ই দুশ্চরিত্র। ধর, মেহজাবিন কাওকে বিয়ে করলো। তারপর সে আমার সাথে ওয়ান নাইটার হলো হাজব্যান্ডকে না জানিয়ে, তখন সে দুশ্চরিত্রা বলেই আমার কাছে পরিচয় পাবে। কারণ, তার ম্যারেজ পেপারে এ বিষয়ে একটা চুক্তি সে করে এসেছে। আদারওয়াইজ, শি ইজ আ নাইস গার্ল। প্র্যাক্টিক্যাল অ্যান্ড রেসপেক্ট্যাবল।”
“রেসপেক্ট্যাবল!”
“হুঁ।”
“জানিস ও কি বলেছিলো আমাকে? আমার সাথে তোর প্রেম চলে কি না তা জানতে চাইছিলো। আমাদের রিলেশন থাকলে সে আমার পারমিশন নিয়ে তোর সাথে শোবে, তাই।”
মাথা দোলালো শুভ্র, “এজন্যই তো আমি ওকে আর ওর মতো মানুষগুলোকে সম্মান করি। ওরা দারুণ মানুষ। মোটেও দুশ্চরিত্রা না। এটাই তোকে বোঝানো যায় না। এক বছরে কিচ্ছুটা শিখতে পারিসনি আমার কাছে।”

ছুটে আসা বালিশটা কোনোমতে এড়ালো শুভ্র। মুখ থেকে হাসি মোছেনি এখনও। ক্ষেপে বোমা হয়ে থাকা এলোমেলো চুলের তিথিকে দেখতে তার ভালোই লাগছে। রীতিমতো চিৎকার করছে এখন মেয়েটা।
“তুই যা। আজ রাতেই মাগির সাথে শুয়ে পর। পা ফাঁক করেই আছে মেহজাবিন মাগি। আমি এখনই ফোন করে বলে দিচ্ছি তুই রাজি। শালা…”

আরও কি কি জানি বলতে বলতে দরজার দিকে রওনা দিলো তিথি।
গলা চড়িয়ে ডাকলো শুভ্র, “আরে কই যাস? মম রান্না করছে। খেয়ে তো বের হ!”
কোনোভাবেই থামানো গেলো না তিথিকে। ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলো সে।
পেছন থেকে শুভ্রর গলায় শেষ যে কথাটা শুনতে পেয়েছিলো তা ওকে এই প্রথমবারের মতো শুনতে হয়নি।

“হিপটোনাইজড শালী!”

অন্ধকারে হলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটা লক্ষ্য করেছিলো, গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার।

পাঁচ.
আজ রাতেই ওরা শোবে।

বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে তিথি। ঘুম আসছে না। রুমমেট নাবিলা ওকে এরকম করতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছে। “কি রে, তোর শরীর খারাপ করছে নাকি?” বলে কপালে হাত বুলিয়েও দেখেছে। কিন্তু তিথির পড়ে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়ার রহস্য ভেদ করতে পারেনি। তিথির চোখে আজ ঘুম নেই কারণ আজ রাতেই ওরা শোবে। শুভ্র আর মেহজাবিন। শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য।

শুভ্রর সাথে পরিচয়ের পর পর ওর সাথে সামাজিকতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হতো তিথির। বাংলার সমাজ তার সদস্যদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, তার মধ্যে বড় একটা অংশ “সে নো টু…” দিয়ে পরিপূর্ণ। এটা করা যাবে না, ওটা করা খারাপ, এটা অপরাধ, ওটা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞাসমূহের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এমন সব কর্মকাণ্ডের তালিকা যেগুলো যথারীতি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতির কারণ নয়। তারপরও তারা অপরাধ।

“মূল্যবোধ আর নৈতিকতা কি?” জানতে চেয়েছিলো শুভ্র, “স্রেফ কতোগুলো ধ্যানধারণা। আর সেগুলো এসেছে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। অর্থাৎ, পূর্বপুরুষেরা যা করা সঠিক মনে করেছে তাই তারা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের চোখে যা করা ভুল, তা আমাদের চোখেও যেনো ভুলই হতে হবে। এর বাইরে তুমি যেতে পারবে না। গেলেই নৈতিকতা আর মূল্যবোধের প্রশ্ন আনা হবে।”

তখনও তিথির সঙ্গে শুভ্রর তুই-তোকারি শুরু হয়নি। শুভ্রের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলো ও। কিছু বুঝতে পারছিলো। আর কিছু বুঝতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো মানব সমাজের হাজার বছরের কুসংস্কার।

“আমার কাছে নৈতিকতা দুই রকমের,” বলে গেছিলো শুভ্র, “প্রকৃত নৈতিকতা, আর বানোয়াট নৈতিকতা। প্রকৃত নৈতিকতার মধ্যে পড়বে এমন সব কিছুই, যা অন্য কারও ব্যক্তিঅধিকারে প্রভাব ফেলে। ধরো, আমি একজনের ফাইলটা আটকে রাখলাম যেটা ছেড়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। সেটা নৈতিকতার অবক্ষয়। কারণ একজন মানুষ ন্যায্যভাবে যেটা পেতে চলেছিলো তা সে পাচ্ছে না। তাকে সেজন্য কেনো ঘুষ দিতে হবে? অথবা, ধরো আমি পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোনো মেয়েকে টিজ করে বসলাম। এটা নৈতিকতার অবক্ষয় হিসেবে আমি মেনে নেবো। এটা কিন্তু পূর্বপুরুষেরাও মানতেন, তাও আমি মানবো। কারণ কারও সঙ্গে কথোপকথনের গভিরতা দুই পক্ষের সম্মতিতে নির্ধারিত হয়। টিজিং এই ব্যক্তিঅধিকার লঙ্ঘন করে। তুমি আমাকে এধরণের যতো নৈতিকতা মেনে নিতে বলবে, আমি সহমত প্রকাশ করবো।”

“তাহলে সমাজের সঙ্গে তোমার সমস্যাটা কোথায়?” বিষয়টা স্পষ্ট করার জন্য জানতে চেয়েছিলো তিথি।

“ধরো, তুমি আজ সিগারেট খেতে খেতে ফুটপাতে হাঁটছো। কি দেখবে?”
“রাস্তার অর্ধেক লোক আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কানাঘুষো হবে। দুটো কথা শোনাতেও কেউ ছাড়বে না।” বিন্দুমাত্র দেরি না করে বলে ফেললো তিথি।
“অর্ধেক নয়, সবগুলো লোকই তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তোমাকে সদুপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব হবে না। এমনকি পুলিশি হ্যারাসমেন্টের শিকারও হতে পারো।”
“হ্যাঁ। কারণ, একটা মেয়ে ফুটপাতে হাঁটবে আর সিগারেট ফুঁকবে সেটা আমাদের সমাজে অ্যাকসেপ্টেড না।”
“অথচ পুরুষেরা এই কাজ অহরহ করে। কেউ চোখের পাতাটাও ফেলে না।” যোগ করলো শুভ্র, “তাহলে ভেবে দেখো, পুরুষ সিগারেট খেতে পারবে প্রকাশ্যে। অথচ নারী পারবে না। এই কুসংস্কার জন্ম নিলো কোথা থেকে?”

কাঁধ ঝাঁকালো তিথি, “এভাবে দেখলে তো হবে না। নারীরা সব কিছু পুরুষদের মতো করতে পারে তাই? তোমরা গরমের সময় খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে পারো। একটা মেয়ে কি জামা খুলে হাঁটতে পারবে?”
নিজের পায়ে থাপ্পড় দিয়ে উঠলো শুভ্র, পয়েন্টটা তিথি ধরে দেওয়াতে বেজায় খুশি হয়েছে সে, “এইটাকেই আমি বলি সামাজিক হিপনোটিজম, সিস্টার। সমাজ তোমাকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। সমাজ এই কোটি কোটি মানুষকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। তুমি একটা মেয়ে হয়েও সিগারেট খেতে না পারার ব্যাপারে মেয়ে সমাজের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে সমর্থন করতে পারছো না। ছেলেরা কি করে পারবে? ফুটপাতে সিগারেট খাওয়ার প্রসঙ্গ তুমি ডিফেন্ড করছো প্রকাশ্যে জামা খুলে ফেলার প্রসঙ্গ দিয়ে। কারণ, তুমি সমাজের হিপনোটিজমে পড়ে গেছো। ইউ আর হিপনোটাইজড, তিথি। ইউ অল আর।”

“তাহলে তুমি চাইছো সিগারেট খাওয়াটা সবার জন্য বৈধ হোক। এটা কি স্মোকিংকে উৎসাহ দিচ্ছে না? দেখো, পুরুষেরা স্মোক করলেও নারীরা করতে পারছে না। বা করলেও তাদের কম করতে হচ্ছে। এটা তো অনেকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হচ্ছে। পুরুষ আর নারীর সংখ্যা প্রায় সমান ধরা হয়। অর্থাৎ সমাজের অর্ধেক সদস্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা পাচ্ছে।” যুক্তি দেখিয়ে গেছিলো তিথি।

“আরেকটা হিপনোটাইজড উত্তর দিলে, সিস্টার।” হাসিমুখে বলেছিলো শুভ্র, “তোমার কি মনে হয় ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে একটা মেয়ে সিগারেট খেলে সেটার প্রতিবাদে এগিয়ে আসা পুরুষ এবং নারীদের প্রথম মাথাব্যথার কারণ নারীর স্বাস্থ্য হয়? স্বাস্থ্যরক্ষায় স্মোকিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, পুরুষ হোক আর নারী হোক, প্রকাশ্যে স্মোকিংয়ে বাঁধা দাও, আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকবো। এ বিষয়ে কিন্তু জরিমানার আইনও আছে। কিন্তু যতোক্ষণ ছেলেরা সিগারেট খাচ্ছে, কিছুই আসে যায় না কারও। কিন্তু একটা মেয়ে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলেই সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। এর পেছনে শুধুমাত্র আছে তোমাদের পুরুষশাষিত সমাজের ইগো। সমাজের হিপনোটিজম। মেয়েরা খেতে পারবে না সিগারেট। মেয়েরা খেলতে পারবে না খোলামেলা শরীরে খেলা কোনো খেলা। তাও মার্গারিটা মামুন নিয়ে মাতামাতি কম হয়নি। যাহোক, কারণ হিসেবে সমাজের হিপনোটিজমের অংশ হিসেবে দেখাবে ধর্মের অনুশাসন। কিন্তু ফুটবল খেলায় পুরুষের সতর ঢাকা না হলেও কেউ প্রতিবাদ করবে না, অথচ ধর্মে পুরুষের হাঁটু পর্যন্ত না ঢাকা আর নারীর স্লিভলেস পরা একই জিনিস। তাও শুধুমাত্র মেয়েদের দলকে হাফপ্যান্টে নামাতে গেলেই প্রচুর কথা আসবে। তোমরা মা বোনদের ন্যাংটা করে মাঠে নামাচ্ছো। ধর্মের অনুশাসনের দিক থেকে দেখলেও দুই পক্ষ করছে আইন ভঙ্গ। অথচ সমাজের চোখে পুরুষের সাত খুন মাফ। যতো সমস্যা তোমাদের মেয়েদের নিয়ে। এমনকি ক্রিকেটেও প্র্যাকটিসে হাফপ্যান্ট পরে পুরুষ ক্রিকেটারগণ নামলে কারও জাত যায় না। মেয়ে ফিজিও হাফপ্যান্ট পরে মাঠের মাঝে গেলে দর্শকদের উত্তেজিত শিসের শব্দ শোনা যায়। এখানেই আমার সমস্যা, পুরুষের ক্ষেত্রে সমান প্রতিবাদ আসলে আমি এগুলোকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে ধরে নিতাম। কিন্তু এখন আমি এই সব প্রথাকেই মনে করি সামাজিক অবক্ষয়। বুঝতে পারছো, সামাজিক হিপনোটিজমে আমরা সমাজের নৈতিকতাকে মানদণ্ড ধরে নিয়ে কতো বড় ভুল করেছি? এটা আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করেছে। নিরীহ নারীদের প্রকাশ্যে কুপিয়ে ফেলে যাচ্ছে ব্যর্থ প্রেমিক। একা পেলেই একটা মেয়ের শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করছে পুরুষ। ভরা রাস্তায়ও করছে, ভিড়ের সুযোগে। হিজাব করে আসা মেয়ে হোক আর না হোক, ছাড় কিন্তু কাওকে দেওয়া হচ্ছে না। একটা মেয়ে হাফপ্যান্ট আর টপস পরে রাস্তায় জগিং করতে নামলো বাংলাদেশের রাস্তায়। প্রতি পঞ্চাশ ফিটের মধ্যে একবার তাকে টিজ করা হবে। সবাই চেষ্টা করবে তার ভাঁজগুলোয় চোখ বোলানোর। ভুল কিছু বললাম?”

“কিছু পুরুষের জন্য সবার দোষ হতে যাবে কেনো?” তিথি গতানুগতিক সব যুক্তিই সেদিন চেষ্টা করেছিলো।

“সামাজিকভাবে হিপনোটাইড একটা মানুষ তুমি। এই ধরণের ডিফেন্স যারা দাঁড় করায় তাদের সবাই সামাজিক হিপনোটিজমের শিকার। তুমি কি জানো, এই ‘কিছু’ পুরুষের প্রকৃত সংখ্যাটা কতো?” তিক্ত একটা হাসি ফুটে উঠেছিলো শুভ্রের মুখে, “দুই কোটি মাত্র। মোট জনসংখ্যার আটভাগের একভাগ। মোট পুরুষ জনসংখ্যার ওয়ান-ফোর্থ। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ জনসংখ্যার অর্ধেক।”

“হোয়াট! এতো বেশি হতেই পারে না-” প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো তিথি। তাকে একটা হাত তুলে থামিয়ে দিলো শুভ্র।

“এরচেয়েও বেশি হতে পারে। এরা সবাই টিজ করে না, কিন্তু বন্ধুর আড্ডায় হলেও মেয়েদের খেলো করে দেখে। পরিচিত মেয়েদের অঙ্গ প্রতঙ্গ নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করে। সবই ব্যক্তিঅধিকার লঙ্ঘন। আর দুই কোটি মানুষ এরকম নারীদেহ ভোগের জন্য ব্যক্তিঅধিকার ছাড়িয়ে যাওয়া আচরণ করছে কেনো জানো তুমি?”
তিথি এবার কোনো কথাই বললো না।
“কারণ, সমাজ আমাদের হিপনোটাইজ করে এমন কিছু বিষয়কে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছে যেগুলো আমাদের মূল্যোবোধের বারোটা বাজিয়েছে। সমাজ আমাদের ব্যক্তিঅধিকারকে সম্মান করতে না শিখিয়ে শুধু শিখিয়েছে সংখ্যালঘুদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অসম্মান করতে। একজন স্বাধীনচেতা মেয়ে এদেশে বিকিনি পরে সুইমিংপুলে নিজের মোটরসাইকেল ড্রাইভ করে যেতে পারবে না। সমাজ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। কারণ, তারা ওই মেয়েটির দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দেখাতে প্রস্তুত নয়। কারণ সে সংখ্যালঘু। সমস্যাটা তুমি বুঝতে পারছো?”

“তুমি তাহলে সমাজের থেকে কি আশা করো?” হাল ছেড়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিলো তিথি।
“সিম্পল। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিঅধিকারকে সম্মান করতে শেখা হোক। ফালতু সব বিষয় থেকে ট্যাবু উঠিয়ে দেওয়া হোক। তুমি কি জানো, এদেশের পুরুষেরা স্লিভলেস জামা পরা মেয়ে দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যায় কেনো? এমনটা গোটা দুনিয়ার কোথাও দেখবে না তুমি। আমি চাই সমাজ এইসব সমস্যার সমাধান গোড়া থেকে করুক। অকাজের কিছু মূল্যবোধ ধরিয়ে তা চর্চা করে এইসব সমস্যা আরও বাড়িয়ে না তুলুক।”

“এসব সমস্যার গোড়া বলতে কি বোঝাচ্ছো?”
“ট্যাবু। মূল্যবোধ আর নৈতিকতার নাম করে একপালা আজাইরা ট্যাবুতে ভরে আছে সমাজ। এই ট্যাবুগুলো তুলে ফেলতে হবে। নারী অধিকার এদেশে সবখানে খর্বিত এইসব ট্যাবুর জন্য।”

“এদেশেও প্রচুর সফল নারী রয়েছেন।” যথারীতি দ্বিমত পোষণ করলো তিথি।

“আর সেসব প্রতিটি সফল নারী হাজারো টিজ হজম করে, হাজারো নারীত্বের অপমানের শিকার হয়ে, হাজারো পিছুকথার প্রসঙ্গ হয়ে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লাখ লাখ মানুষের চোখে স্রেফ একজন মাগি হয়েই সেই সফলতার চূড়োয় উঠেছেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো, তাঁকে লাখ লাখ মানুষের কাছে মাগি হতে হলো কেনো? তোমার আর তোমার মতো হিপনোটাইজড মানুষগুলোর জন্য। একদিন তুমিও সমাজে সফল একজন নারীকে মাগি বলে গালি দেবে। সেদিন হয়তো বুঝবে আমার কথার সার্থকতা। সফল সাংবাদিক, সফল আর্কিটেক্ট, সফল অভিনেত্রি, সফল চিকিৎসক, কোন নারীচরিত্রটিকে যুবসমাজের বড় একটা অংশ চরিত্রহীন মনে করে না?”

“ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেকেই চরিত্র খুঁইয়ে আসেন।” সোজাসাপ্টা বললো তিথি, “তো কি মনে করবে তাদের?”
“চরিত্র খুইয়ে আসে কিভাবে একজন মানুষ? বড়জোর আরেকজনের সঙ্গে শোয় কিংবা মিডিয়ার সামনে খোলামেলা হয়ে আসে, তাই তো? এটা কি করে চরিত্র খোয়ানো হলো? এখানে আরেকটা বড় প্রশ্ন চলে আসে, আসলেই যারা টাকার বিনিময়ে যৌনতায় অংশ নেয়, অর্থাৎ পতিতারা, তাদের কেনো সমাজ সম্মান করে না? মানুষের সম্মান তাদের কেনো দেওয়া হবে না?”
“এসব তর্ক অর্থহীন।” মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছিলো তিথির।
“না, হিপনোটাইজড মানুষগুলো এসব এড়িয়ে যায়। সবশেষে ক্ষতিটা হয় সমাজের। আরও একজন অসহায় নারীকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়। আরও একজন মানুষের পর্ন ভিডিও নিয়ে মানুষ মাতামাতি করে, আরও একজন মানুষকে মানুষ মাগি পরিচয় দিয়ে সমাজে অচ্ছুত করে দেয়। এটা সলিউশন না, আলোচনাটা এড়িয়ে যাওয়া কখনোই সমাধান না, তিথি।”

“সলিউশন তাহলে কি?”
“অকারণ ট্যাবু সরিয়ে ফেলা। দেশে কো-এডুকেশন কয়টা প্রতিষ্ঠানে হয় বলো তো? ছেলে আর মেয়েকে আলাদা জায়গায় রেখে পড়াশোনা করানোর অর্থটা পরিষ্কার। দুই লাখ বখাটে আর নারীলোলুপের জায়গায় দুই কোটি বখাটে এবং নারীলোলুপ জনসংখ্যার জন্ম দেওয়া।”
“তোমার মনে হয় এরা ছেলেমেয়ে একসাথে বড় হলে নারীদের প্রতি-”
“হ্যাঁ, তারা নারীদের সম্মান দিতে শিখতো। জানতো মেয়েরা তাদের মতোই মানুষ। জানতো মেয়েদের শরীর আর তাদের শরীরের বিশেষ পার্থক্য নেই। একটা মেয়ের কনুই দেখেই মাথা ঘুরে যেতো না তাদের। তারা জানতো একটা মেয়েকে যৌনতা ছাড়াও ছুঁয়ে দেওয়া যায়, যেভাবে একটা ছেলেকে ছোঁয়া যায় যৌনতা ছাড়া। বন্ধুর সঙ্গে হাত মেলানো যায়, জড়িয়ে ধরা যায় যেমন, তা বান্ধবীকেও করা যায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরার সঙ্গে কামুকতার সম্পর্ক নেই তাও তারা শিখতো। কিন্তু তারা শিখেনি কিছুই। হয় তারা তাদের দেবী বানিয়েছে, নয়তো বানিয়েছে সেক্স ডল। মানুষ হিসেবে নারীকে দেখেনি ওরা। তুমি জানো আমার প্রতিটা শব্দ সত্যি। শুধুমাত্র সামাজিক হিপনোটিজমের প্রভাবে স্বীকার করতে বাঁধবে তোমার।”

ছয়.
তিথি খেয়াল করলো চোখের পানিতে কখন বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে সে। হ্যাঁ, সেদিনই ও মেহজাবিনকে মাগি বলেছে। নিজে একজন মেয়ে হয়েও তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দিতে শেখেনি। তিথি মনের ভেতরে কোথাও জানে শুভ্রের প্রতিটা কথা সত্য। তুখোড় বুদ্ধিমত্তা দিয়ে হাজারবার এই দর্শনটাকে যাচাই করে তবেই সে মেনে নিয়েছে। স্রেফ আবেগের বশে অথবা কিছু নব্য সমাজবিরোধীদের মতো প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে এসব বুলি সে আওড়ায় না। তার কথা শুনে প্রাথমিকভাবে তিথি মনে করতো ছেলেটা মনে হয় ফ্রি-সেক্স প্রতিষ্ঠা করতে চায় এদেশে, হয়তো নিজের সুবিধার্থেই। একবছর তার সাথে থেকে এটুকু বুঝেছে, সেক্স নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণে অকারণে তিথিকে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টাও সে কখনো করেনি।

হ্যাঁ, তিথিকে শুভ্র ছুঁয়ে দেয় মাঝে মাঝে। তবে সেটা ঠিক ততোটাই যতোটা সে কোনো ছেলে বন্ধুর সঙ্গে করে। মেকানিক্যালের নাফিসকে সে যেভাবে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়, যেভাবে তার সঙ্গে হাই ফাইভ বিনিময় করে, তিথির সাথেও ততোটাই। শুভ্রের মধ্যে কামুক কোনো স্বভাব নেই। রয়েছে শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত মূল্যায়ন। ব্যক্তিজীবনের মূল্যহীন ট্যাবু এড়িয়ে চলা। তাই সে বাকিদের মতো লুকিয়ে পর্ন দেখে না। সাউন্ডবক্সে পর্ন প্লে করতে তার আপত্তি নেই, সঙ্কোচ নেই বেডরুমে কিসা সিন্সের নগ্ন ছবি টাঙ্গিয়ে রাখতে। এবং তার পরিবার হিপনোটিজম থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারাও এমনটাই আশা করে তার থেকে। যৌনতা আর ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ট্যাবু করার কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের এতো অবক্ষয় তা তারা মানে, তবে এর যথেচ্ছ প্রয়োগ কখনোই করে না। তারা যৌনতার লোকদেখানো স্বাধীনতা চায়নি কখনো, বরং সহজাত মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো লুকিয়ে রেখে সামাজিক অপরাধ প্রবণতা প্রকট করাতেই তাদের আপত্তি।

তিথি এখনও জানে না, এটাই এই ঘুণে ধরা সমাজের একমাত্র চিকিৎসা কি না। বাংলাদেশের আর সব মানুষের মতো তারও ধারণা ছিলো কেবলমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনই পারে সমাজকে সবার জন্য সহনীয় একটা স্থানে পরিণত করতে।

শুভ্র বলেছিলো, “এটা তুমি ঠিক বলেছো। ধর্ম সমাজটাকে সবার জন্য শান্তিপুর্ণ একটা স্থান বানাতে পারে। যখন প্রতিটা মানুষ ধর্মীয় অনুশাসণ মেনে চলতে প্রস্তুত, তখন। যখন মানুষ হৃদয়ে ধর্মকে ধারণ করে, আবেগে নয়, তখন। বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখো। কতোজন হৃদয়ে ধর্মকে ধারণ করে? চার শতাংশও কি হবে?”

একশ জনে চারজন? তিথি এটা মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদ করে বলেছিলো, “আমাদের দেশটা ধর্মপ্রাণ হিসেবে পরিচিত কিন্তু।”

“আবেগে আর কথায়। কাজে নয়। এটা এখনও এদেশি জনগণ বুঝে উঠতে পারেনি। এটা খুব খুবই হতাশাজনক।” বলেছিলো ও, “তুমি কি জানো, ইসলামে গান শোনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, গাইরে মাহরাম (বিয়ে নিষিদ্ধ) সম্পর্কের সব মেয়েদের দিকে তাকানো নিষিদ্ধ, বিবাহপূর্ব যৌনমিলনের শাস্তি আবশ্যকীয় ভাবে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড?”
“তো?”
“এদেশে কয়জন রাস্তায় বের হলে সামনে মেয়ে পড়লে চোখ সরিয়ে নেয়? তাকায় পর্যন্ত না তাদের দিকে? এদেশে কতোজন মানুষ গান শোনা ছেড়েছে ধর্মীয় কারণে? এদেশে কতোজন মানুষ বিয়ের আগে প্রেম করেনি? একশতে চারজন কি খুব বেশি হয়ে গেলো না? একশ’তে একজনও কি পাবে তুমি এমন?”
“মানছি, এতো সাধু সন্ত আমরা এক হাজারে একজন পাবো। কিন্তু তুমি ধর্মকে দায় দিচ্ছো কেনো? ধর্ম না মানা তো ব্যক্তির ব্যর্থতা।”

হেসে ফেললো শুভ্র, “আমি ধর্মকে দায় দিচ্ছি না। বরং সব সময় বলে এসেছি ধর্মীয় অনুশাসন একটি সমাধান। তুমি একটা সমাজে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে কোনো অনাচার চলবে না। পারফেক্ট সমাজ ব্যবস্থা সেটা।”
“তাহলে একটু আগে যে বললে-”
“আমি দায় দিচ্ছি বাংলাদেশের মানুষের। আমরা ছিলাম বৌদ্ধ, হয়েছি পরে পৌত্তলিক, তারপর হয়েছি মুসলিম, এরপর খেয়েছি ইংরেজের ধাতানি। আমাদের হৃদয়ে ধর্ম নেই, তিথি। বাংলাদেশের মানুষ হৃদয়ে ধার্মিক নয়, তারা কথায় বুলি ফোটায়। আবেগে জেহাদী জোশ দেখায়। হৃদয়টা ফাঁকা। একারণেই এদেশে জঙ্গি রিক্রুট করা এতো সহজ।”
“তুমি আশা করতে পারো না একটা প্রগতিশীল দেশের একশ জন মানুষের মধ্যে আশিজনই প্রবলভাবে ধার্মিক হবে।”

হেসেছিলো শুভ্র, “তুমি আমার কথার মূলভাবটাই ধরতে পারোনি। বেশিরভাগ মানুষই পারে না। এর পেছনেও আছে সামাজিক হিপনোটিজম। আমার বক্তব্যের একটা স্পষ্ট উদাহরণ দেই তোমাকে। কাল থেকে ঘোষণা করা হলো, কারও বাড়ির ভেতর থেকে গান-বাজনার আওয়াজ পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করে দশ বছরের জেল দেওয়া হবে। কেউ প্রেমিকার সাথে বিছানায় গেলে সেটা যদি ধরা পড়ে, প্রেমিক-প্রেমিকাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। চুরি করে কেউ ধরা পড়লেই তার হাত কেটে দেওয়া হবে। এগুলো কিন্তু এই ক্রাইমগুলো ঠেকাতে খুব কার্যকর। আমি এই আইনগুলোর প্রশংসা করি, কারণ এগুলো প্রচণ্ড ভীতি ছড়াতে পারে। অপরাধ কমে আসতে পারে এভাবে। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিলো, বাংলাদেশের মানুষ এটা নিতে পারবে কি না সেই প্রশ্নের ওপর। বাংলাদেশিরা কি রাজি হবে গান শুনতে ধরা খেলেই কারাগারে গিয়ে ঢুকতে? কিংবা প্রেমিকার সাথে শুয়ে মুণ্ডু হারাতে? তারা রাজি হবে না। একশজনের মধ্যে চারজনকেও এর সপক্ষে পাবে না তুমি। বাংলাদেশিরা বলবে, এসবই লঘু পাপে গুরু দণ্ড। যদি মুখে ধর্মীয় অনুশাসনের ভয়ে নাও বলে, বাংলাদেশি হৃদয় এসব আইন মেনে নিতে চায় না। তুমিই বলো, তোমার রুমমেটকে যদি পুলিশ এসে নিয়ে যায় তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে শোয়ার অপরাধে তারপর তাকে মেরে ফেলা হয়, তোমার মুসলিম বন্ধুদের কারও হৃদয় কি মেনে নেবে সেটা?”
মাথা নাড়লো তিথি, “না মনে হয়। ধর্মে আছে বলে হয়তো কিছু বলবে না, তবে মেনেও নিতে পারবে না।”
“আর তুমি মনে করছো ইসলামী অনুশাসন এই দেশের সমাজের জন্য অ্যাপ্লিকেবল? তুমি যেটা অ্যাপ্লাই করতেই পারবে না সেটা কি করে সামাজিক সমস্যার সমাধান হবে? সমাজ তো মানবগোষ্ঠী নিয়েই গঠিত। মানুষ যদি প্রস্তুত না থাকে তাহলে কি করে তুমি সেই সমাজে একটা সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধরে নেবে?”

“সেজন্য ধর্মীয় অনুশাসন সঠিক পদ্ধতি হলেও বাংলাদেশের জন্য কোনো সমাধান নয়।” মাথা দোলালো তিথি, “কথাগুলো তুমি সঠিক বলেছো, অন্তত।”

শুভ্র একটা সিগারেট ধরিয়েছিলো, “অথচ তুমি চাইলেই এদেশি জনগোষ্ঠীকে কো-এডুকেশনে পাঠাতে পারো। অযথা ট্যাবুগুলো তুলে ফেলতে পারো। মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নেওয়ার চেয়ে বেশি প্রস্তুত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে। বাংলাদেশের সমাজ থেকে নারীত্বের অবমাননা সরিয়ে নিতে এর চেয়ে নিখুঁত আর প্রয়োগযোগ্য আর কোনো সমাধান আমার চোখে পড়ে না। ধর্মীয় সমাজব্যবস্থাগুলো নিখুঁত, তবে বাংলাদেশি সমাজে প্রয়োগের অযোগ্য।”

এপাশ ওপাশ করতে শুভ্রের সঙ্গে হয়ে যাওয়া কথাগুলোই বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছে তিথি। ছেলেটার মাথা পরিষ্কার। বাংলাদেশী সমাজকে মেয়েদের জন্য সহনশীল করে তুলতে চেয়েছিলো ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান দেওয়ার মাধ্যমে। এর চেয়ে সহজ সমাধান আসলেই আর হয় না। শুধু প্রয়োজন প্র্যাকটিস। কোনো বাড়তি আইন মানার চাপ নয়, প্রাণ খোয়ানোর ভয়ে নতুন বিশৃঙ্খলা নয়, শুধু অপরজনকে সম্মান করতে শেখা। সহজাত মানববৃত্তীয় আচরণগুলোকে লুকিয়ে না রেখে প্রকাশ্য করে ফেলা। লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে দুই জাতির মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা।

তিথি কখনোই সেগুলো মেনে নিতে পারেনি।
হাজার বছরের হিপনোটিজম সে এড়িয়ে যেতে পারেনি। আজকে রাতে শুভ্র মেহজাবিনের সঙ্গে শুতে চলেছে সেটা সে একেবারেই মেনে নিতে পারছে না।

ফোনের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গলো ওর। চোখ মুছে হাতে তুলে নিলো যন্ত্রটিকে।
শুভ্র!

পরিশিষ্ট.
বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে এসে তিথিকে কিছু খুঁজতে হলো না। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে বসার জায়গায় পিঠ দিয়ে আকাশ পানে পা দুটো তুলে মূর্তিমান বাদুড় হয়ে আছে। প্রকাশ্য দিবালোকে এই পাগলামি, তিথির রাগ না উঠে কেনো জানি হাসি আসে। হারামজাদা সমাজের বিরুদ্ধে একেবারে মূর্তিমান এক বিদ্রোহ!

“তিথি।” চশমা ছাড়াই বললো শুভ্র, মুখে হাসি।
ওর পাশে ধপ করে বসে পড়লো ও, “খুব কেলাচ্ছিস? করলি না কেনো?”
চশমা পরলো না ছেলেটা, ঝলমলে চুল মধ্যাকর্ষণ শক্তিবলে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, “কি করলাম না?”

শুভ্রের চেহারায় এই অবাক হয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি দেখতে অসাধারণ লাগে তিথির। হা করে সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ও।

“মেহজাবিনের সাথে কালকে রাতে ডিনারে তো গেছিলিই, করলি না কেনো?”
হেসে ফেললো শুভ্র, “গাধীটা তোকে বলে দিয়েছে, তাই না?”
“আরে আমাকে দোষ দিয়ে গেছে সে। আমার দোহাই দিয়ে নাকি এড়িয়ে গেছিস। ছি ছি, তোর দর্শনের উল্টোদিকে গেলো না এসব?”
“কোথায়? আমি কি করবো তা তো আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় পড়ে। আমি আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা খাটিয়েছি।”
“মেহজাবিন তো বললো অন্য কথা।” হাত বাড়িয়ে শুভ্রের রেশমি চুল ছুঁয়ে দিলো তিথি, “তুই নাকি ওকে বলেছিস, অ্যানিথিং ফর তিথি’স ফ্রেন্ড।”
চোখ বন্ধ করে ফেললো শুভ্র, “হ্যাঁ। তিথির ফ্রেন্ড আমার ইন্টারভিউ নেবে, এতে আপত্তির কি আছে। যতোবার ডাকবে যাবো। এজন্য ওর সাথে বিছানায় যাওয়ার দরকার কি আমার ছিলো, বল্?”

একটু হেসে হাতব্যাগটা পাশে রেখে দিলো তিথি। শুভ্রের চোখ খুলে গেলো আবার। ঘোলা চোখেই তিথির কোমর থেকে পা পর্যন্ত চোখ বোলালো।

“জিন্স পরেছিস মনে হচ্ছে?”
“চুপ করে শুয়ে থাক। এতো পর্যবেক্ষণে কাজ কি তোর?”
দুষ্টু হাসি শুভ্রের মুখে, “বাদুড় হবি?”
“বাদুড় হওয়ার অধিকারই বা একলা তোকে দিয়েছে কে? প্রেসিডেন্ট স্যার ইস্যু করেছেন?”

খানিক বাদেই এলাকাবাসী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বাইশ-তেইশ বছরের দুই তরুণ তরুণী সিমেন্টের সিটের বসার জায়গায় পিঠ দিয়ে দুই জোড়া পা সরাসরি আকাশ পানে তুলে শুয়ে আছে।

মুখ ফিরিয়ে শুভ্রের দিকে তাকালো তিথি। ছেলেটাও তার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে, চশমা নেই চোখে। চুলগুলো চোখে এসে পড়ছে। হতাশ হলো তিথি, ছেলেদের এতো রেশমি চুল থাকতে নেই। অপার্থিব মায়ার জন্ম দেয় তারা।

“মেহজাবিনের সাথে তুই শুলে সেটা আমার সামাজিক হিপনোটিজমের জন্য খারাপ লাগতো না রে।” ফিসফিস করে বললো তিথি।
“জানি।” নির্বিকারভঙ্গিতে বললো শুভ্র।
তিথির সুন্দর ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেছে, “কিভাবে জানিস?”
“কারণ, মেহজাবিনের সাথে আমিও শুতে পারিনি অন্য একটা কারণে। সেই কারণটাও সামাজিক হিপনোটিজম না।”
“বাসিস?” কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে তিথির গলা।
“বাসি।”

কি সুন্দর পিটপিট করে তাকাচ্ছে এখন জিনিয়াস পাগলটা! তিথির ভেতরে গিয়ে লাগে চোখজোড়ার মায়া।

“ট্যাবু ভাঙ্গতে শুরু করি, চল্।” দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে উঠলো মেয়েটির চোখের তারায়।

অবাক বিস্ময়ের যেসব এলাকাবাসী এতোক্ষণ তাদের লক্ষ্য করছিলো, তাদের চোখগুলো কপালে তুলে দিতেই যেনো আরও কাছে চলে এলো বাদুড় হয়ে থাকা মানুষদুটোর মাথাজোড়া।
তারপর টুপ করে ডুবে গেলো একে অন্যের ঠোঁটের অতল গভিরতায়!

— ০ —

রচনাকাল – নভেম্বর ২২, ২০১৬

ইরোনিয়াস

১.
দরজা খোলার সাথে সাথে মধ্যবয়েসি ভদ্রলোকের মুখে হতাশার ছাপ পড়ল।
এমনটা দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেছে – রায়হান স্বাভাবিকভাবেই তাকায় মানুষটার দিকে। চোখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি ঝুলিয়ে রাখতে ভোলেনি।

‘মি. রায়হানের কাছে এসেছি আমি। আবু মোহাম্মদ রায়হান।’ ভদ্রলোকের চোখগুলো ব্যস্ত হয়ে ঘরের এদিক থেকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে।

আলতো করে মাথা দোলায় রায়হান, এই মানুষটি ক্লায়েন্ট সেটা ও দরজা খোলার সাথে সাথেই বুঝে ফেলেছিলো। হতাশার দৃষ্টি এই গোত্রটির চোখেই ফোটে – কারণ, এরা আসেন বড় কোন প্রত্যাশা নিয়ে।

‘আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। প্লিজ, ভেতরে বসুন।’ সাদরে আমন্ত্রণ জানায় রায়হান।

ইতস্তত পায়ে ভদ্রলোক ঢুকে পড়লেন। নোংরা সোফা সেটটার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেন তিনি। দামী পোশাকে ময়লা লেগে যাবে না কি – তাই ভাবছেন হয়ত। সেই সাথে হাল্কা কুঁচকে যাওয়া নাক দেখেই রায়হান বুঝতে পারে – এঁকে চা বা কফি সাধা চলে। কঠিন বা তরলেই এর সীমাবদ্ধতা। ধূমপান ইনি সহ্যই করতে পারেন না।

‘চা অথবা কফি?’ জানতে চায় রায়হান।
পাল্টা প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক, ‘মি. রায়হান কি ঘরে নেই? আমার আসলে তাড়া ছিলো।’
স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘আগেই খোলাসা করা উচিত ছিলো। আমিই আবু মোহাম্মদ রায়হান।’
হতাশার চিহ্নগুলো আরও প্রকটভাবে ফুটে উঠল এবার ভদ্রলোকের চেহারায়। তবুও হাত মেলালেন ভদ্রতার খাতিরে।
‘আমার নাম মোস্তফা কামাল। আপনাকে আরও বয়স্ক কেউ হবেন ভেবেছিলাম।’

রায়হান সামান্য হাসলো। কথাটার পিঠে কোনরকম মন্তব্য না করে আবার জানতে চাইলো, ‘তাহলে কফি চলতে পারে? আপনি কি কফিতে দুধ নেন?’
কাঁধ ঝাঁকান মোস্তফা, ‘দুটোই চলে।’

রান্নাঘরে ঢুকে তাকের দিকে এগিয়ে যায় ও। তিনটি ফ্লাস্কে ভর্তি করাই আছে এখানে চা আর কফি। সারা দিনে প্রচুর চা পান করে রায়হান। মাঝে মাঝে স্বাদ পাল্টাতে কফির দিকে ঝুঁকে যায়, তবে সেটা সচরাচর সকালের দিকে। কফির ফ্লাস্কটা হাতে নিতে নিতে এপর্যন্ত ভদ্রলোক থেকে যা জানা গেছে তা একবার ভাবে ও।
এঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, টাকার খুব একটা অভাব তার নেই। তবুও বিশেষজ্ঞের কাছে না গিয়ে রায়হানের কাছে এসেছেন। অর্থাৎ এমন কিছু ঘটে গেছে যেটা তিনি গোপন রাখতে চান। সম্মানরক্ষার অদ্ভুত এক ধারণা এই উচ্চশ্রেণির মানুষগুলো ধারণ ও বহন করেন।

আরেকটি ঘটনা হতে পারে, বিশেষজ্ঞ দিয়ে ইনার কাজ হয়নি। ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো হিসেবে রায়হানের কাছে এসে ধর্ণা দিয়েছেন।

বয়েস চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ – যে কোন একটা হতে পারে। কোন ধরনের সমস্যা সমাধান করতে এসেছেন বলাটা শক্ত। এই বয়েসের মানুষদের যে কোন মানসিক সমস্যা থাকতে পারে। অল্পবয়েসীদের কেসগুলো ধরাবাঁধা ছকের মধ্যে পড়ে। এদেরগুলো নয়। তবে সম্মানরক্ষার ব্যাপারটি এলে, খুব সম্ভব নিজের জন্য নয় সেই নাটক।

দুটো কাপ ট্রে-তে সাজানোর ফাঁকে রায়হানের মনে হলো, সমস্যাটা এই ভদ্রলোকের ছেলে অথবা মেয়ের হতে পারে। এঁর বয়েস থেকে অনুমান করা চলে, ছেলেটি বা মেয়েটি হবে একজন টিন এজার।

ট্রে-টা সামনের টি-টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে জানতে চায় রায়হান, ‘আপনার কি একটাই সন্তান?’

মোস্তফা কামাল হাল্কা চমকেছেন। মুখের ভাবটা গোপন করার চেষ্টা না করে উত্তর দিলেন, ‘না। দুইজন।’
একটা কাপ তুলে নেয় রায়হান হাতে, ‘চমৎকার। আপনার সমস্যাটি নিয়ে তাহলে আলাপ করা যায় এখন।’

দেখাদেখি কফির কাপ হাতে নিলেন মোস্তফা কামালও, ‘তার আগে আপনার ব্যাপারে বলুন। আপনি কি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ?’
মাথা নাড়ে রায়হান, ‘উঁহু। নিজেকে আমি বলে থাকি সাইক-ইনভেস্টিগেটর। মনোরোগ নিয়ে আমার কোন একাডেমিক পড়াশোনাই নেই। ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি। দুই বছর পর ছেড়ে দিয়েছি – আগ্রহ পাচ্ছিলাম না।’

‘সে থেকেই এই শহরে চলে এসেছেন?’ সন্দিহান কণ্ঠে বলেন ভদ্রলোক, ‘আপনার গল্পটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।’

‘কাওকে খুন টুন করে ভার্সিটি থেকে বের হয়ে আসিনি আমি – যদি তাই জানতে চেয়ে থাকেন।’ মুচকি হেসে মানুষটার প্রশ্ন আন্দাজ করে নেয় রায়হান, ‘বাবার টাকা পয়সার অভাব ছিলো না – এই বাড়িটা দেখতেই পাচ্ছেন। ও ছাড়াও শেয়ারগুলো থেকে প্রচুর টাকা আসে। কাজেই আমার অপছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ার কোন মানে খুঁজে পাই নি।’
‘সাইকোলজি নিয়ে পড়লেই পারতেন। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট যখন – সাবজেক্ট চয়েজে ওটা নেওয়া খুব কঠিন কিছু হওয়ার তো কথা না।’
‘নিতে পারি নি সে সময়। আমার মা চান নি ওটা আমি নেই। বয়েস কম ছিল, বাবা-মা যেদিকে চালিয়েছে সেদিকে ঘোড়া দাবড়েছি।’ কাটা কাটা ভাবে জবাব দেয় রায়হান।

এই লোককে নিজের ব্যাপারে বলতে হচ্ছে দেখে বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। একটা কেস একজনের হাতে তুলে দেওয়ার আগে তার ব্যাপারে জানতে চাইবে ক্লায়েন্ট এটা খুবই স্বাভাবিক।

‘এ বাসায় তাহলে আপনি মায়ের সাথেই থাকেন?’ মোস্তফা কামালের প্রশ্ন শেষ হয় না।
‘না। একাই থাকি।’ শান্তভাবেই বলে রায়হান, ‘বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই আমার।’
‘কিভাবে মারা গেলেন তাঁরা?’ হাল্কা চালে জানতে চাইলেন তিনি।

‘এ নিয়ে কথা বলি না আমি। কেসটা যদি আমাকে না দিতে চান – সেক্ষেত্রে কফিটা শেষ করে আসতে পারেন।’ উঠে দাঁড়ায় রায়হান। মেজাজ একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে ওর।

মোস্তফা কামাল একটু হাসলেন।
‘বসুন, প্লিজ। আপনার ওপর ভরসা করা ছাড়া আমার আসলে উপায়ও নেই। বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর।’

‘আপনার মেয়ের বয়েস কত?’ চট করে জানতে চায় রায়হান।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল মোস্তফা কামালের মুখ, ‘কিভাবে জানলেন-’
‘বয়েস কত?’
‘এগারো।’
‘আপনার ছোট মেয়ে।’
ফ্যাকাসে মুখটা আরেকটু বাড়ে ভদ্রলোকের, তারপর হেসে ফেললেন, ‘মাহফুজ আমার ব্যাপারে বলেছে আপনাকে ফোনে? তাই না? আর সেসব তথ্য গড় গড় করে বলে চমকে দিতে চাইছেন আমাকে?’
অবাক হয় রায়হান, ‘ওয়েস্ট-ইস্ট ইউনিভার্সিটির লেকচারার মাহফুজ? তার সাথে গত কয়েক মাসে আমার যোগাযোগ হয়নি। আপনার ব্যাপারে যা বলেছি সেটা আপনিই আমাকে জানিয়েছেন। মুখে না জানালেও আপনাকে হাল্কা পর্যবেক্ষণ করলে এটা অনুমান করতে পারবে যে কেউ।’
থমথমে মুখে মাথা দোলালেন মোস্তফা, ‘অর্থাৎ আপনি নিজের কাজে আসলেই ভালো। আপনাকে আমার সমস্যা খুলে বলবো। তবে প্রতিজ্ঞা করতে হবে, কাওকে এ বিষয়ে সামান্যও জানাতে পারবেন না। আপনার বন্ধু মাহফুজকেও না।’
‘আমার ক্লায়েন্টের ব্যাপারে আমি কাওকে কিছু জানাই না।’

বুঝতে পারছে, মাহফুজের সাথে কোনভাবে এই ভদ্রলোকের পরিচয় আছে। তিনি হয়ত ব্যতিক্রমী কোন সাইকিয়াট্রিস্ট খুঁজছিলেন – বেচারাকে সে রায়হানের ঠিকানা ধরিয়ে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই মাথা দোলালো একবার ও।
পুলিশ বাদে এই প্রথম মালদার পার্টি এভাবেই ওর কাছে এসেছে একারণেই!

‘সফল কেসের ক্ষেত্রে আপনাকে কত দিতে হয়?’ আত্মবিশ্বাস নিয়ে জানতে চাইলেন মোস্তফা কামাল।
‘ত্রিশ হাজার। কেস শেষে লিখে দেবেন । কেস ব্যর্থ হলে কোন টাকা-পয়সা আমি নেই না।’
‘ফাইন। আমার কোন আপত্তি দেখছি না।’ ঘাড় কাত করে বলেন তিনি, ‘তাহলে সরাসরি আমাদের সমস্যাতে চলে আসতে পারি?’
কিছু না বলে মাথা দুলিয়ে সায় দেয় রায়হান।

‘নতুন ডক তৈরী হয়েছে এদিকে একটা। জানেন বোধহয়, কৈলাকুটিরে। ওটা আমাদের।’ গলা খাঁকারি দেন তিনি, ‘মানে, মালিকানা আমাদের পাঁচজনের। ওখান থেকে ভালো লাভ আসতে যাচ্ছে – আর আমার পূর্বপুরুষের অঢেল জমি আছে এদিকে। কাজেই ঢাকা থেকে চাকরী ছেড়ে পরিবার নিয়ে আপনাদের শহরে চলে এসেছি আমি – মাস দুয়েক হল। উদ্দেশ্য – এখানে আরও কিছু বিজনেস সেক্টর বের করে নেওয়া।’

কফিতে চুমুক দিতে বিরতি নিলেন তিনি, তারপর আবার শুরু করলেন, ‘আমিও আপনার মত কিছুটা। পূর্বপুরুষের অঢেল সম্পত্তির বদৌলতে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু তাদের সম্পত্তির পরিমাণ আমি ভোগ করে ফুরিয়ে দিতে চাই না – বরং চাই আরও বেড়ে যাক ওটা। তাছাড়া শুয়ে বসে খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই। তাই দশ বছর শুধু চাকরী করে গেছি এক কোম্পানিতে।’
কথা কেড়ে নেয় রায়হান, ‘অবশেষে ইচ্ছে হয়েছে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে আরও ভালো কিছু বের করা সম্ভব কি না – সেটা খতিয়ে দেখতে। এটুকু আমি বুঝতে পারছি, মি. কামাল। আপনি আসল কথাতে চলে আসুন।’

একটু বিভ্রান্ত মনে হয় এবার তাঁকে, ‘এ শহরে আমাদের পুরোনো বাড়িটিতেই উঠেছি আমরা। বাড়িটাকে নিয়ে অনেক গুজব আছে । গুজবটা মূলতঃ আমার প্র-পিতামহ মানে আমার দাদার বাবাকে নিয়ে।’
‘উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের কথা তারমানে। বলে যান।’ তেমন আগ্রহ দেখা যায় না রায়হানের ভেতরে।
‘প্রচণ্ড নিষ্ঠুর ছিলেন তিনি। জমিদারী প্রথার প্রচলন তখন ছিলো। সমুদ্রের কিনারে এ এলাকাতে তেমন কেউ মনোযোগ দিতো না। এখানকার প্রজাদের হর্তাকর্তা ছিলেন আমার গ্রেট গ্রান্ডফাদার।’
সোফাতে হেলান দেয় রায়হান আরাম করে, ‘তাকে নিয়ে গুজবটা ঠিক কি ছিলো?’
‘গুজবটা তাকে নিয়ে নয়। ওটা আমাদের বাড়িটি নিয়ে। কয়েকবার ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমি ঢাকা থেকে। কিন্তু পারিনি। প্রতিটা পরিবার সরে গেছে। তাদের অভিযোগ – বাড়ির নারীসদস্যরা অস্বস্তি অনুভব করেছে সব সময়।’
‘নারী-প্রজাদের ওপর জমিদারবাবুর নিষ্ঠুরতার পরিমাণ কি পুরুষের চেয়েও বেশি ছিলো নাকি?’

মাথা নাড়লেন মোস্তফা কামাল, ‘পুরুষের ওপর অত্যাচারের কোন মাত্রা ছিলো না আমার গ্রেট গ্র্যান্ডফাদারের। খাজনা দিতে একদিন দেরী হলেই প্রজাদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার অভিনব নজির তিনি রেখেছিলেন। তবে বাড়ির গুজব পুরুষাঙ্গ নিয়ে নয়।’
বুঝতে পারল রায়হান, তবে একমত হল না। বরং মাথা হাল্কা দুলিয়ে প্রশ্ন করল, ‘পুরুষাঙ্গবিহীন প্রজাদের স্ত্রীরা ঠিক কোথায় থাকতো তখন?’

গম্ভীর হয়ে যান কামাল, ‘গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার স্ত্রীদের দিকে চোখ দিতেন ঠিকই – তবে রতিক্রিয়াতে মেতে উঠতেন কন্যাদের সাথে। তাঁর পদ্ধতি ছিলো খুবই অভিনব। মা-মেয়েকে নিয়ে এসে মেয়ের ওপর চড়াও হতেন তিনি মাকে বেঁধে রেখে। ধর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে নিজের যৌনসঙ্গীর মাকে ছুরি দিয়ে বার বার আঘাত করতেন। এটাই ছিলো উনার রুচি।’
“যে নারীর মেয়ে নেই?”
“তাদের মাকে ধরে আনা হতো, বয়েস যতই হোক।”
“যার মা এবং মেয়ে কোনটাই নেই?”
“স্বামীর পুরুষাঙ্গের সাথে যেত তাদের গর্দানখানাও।”
সামনের টেবিলে কাপ নামিয়ে রাখল রায়হান, ‘কাজেই – অসহায় সেসব নারী মারা পড়েছিলো আপনাদের ওই বাড়িতে। গুজবের শুরু ওখানে হওয়া মোটেও বিচিত্র নয়। কিন্তু ইতিহাস নিশ্চয় সমস্যা নয় আমাদের জন্য? আজ আমার বাড়িতে আপনি এসেছেন বাস্তব কিছু নিয়ে আলোচনা করতে। সে প্রসঙ্গে চলে আসতে পারেন।’

‘কিন্তু ইতিহাসের একটা ভূমিকা আছে। জমিদার-পূর্বপুরুষটি সব বয়েসী নারীদের সাথে বিছানাতে যেতেন না। শিশু আর কিশোরীদের সাথেই তিনি মিলিত হতেন।’ শান্ত কণ্ঠে আগের প্রসঙ্গেই ফিরে যান মোস্তফা কামাল, ‘আমার মেয়েটির বয়েস এখন ওই বয়েসসীমার ভেতরে।’
‘আপনি আপনার মেয়ের নাম এখনও বলেন নি।’ হঠাৎ বাঁধা দেয় রায়হান।
‘ঈপ্সিতা।’
‘কি ধরনের আচরণ করেছে আপনার মেয়ে?’

এক মুহূর্ত ইতস্তত করেন মোস্তফা কামাল। রায়হানকে বিশ্বাস করা যায় কতটুকু তা ভাবছেন।
তারপর গলা খাঁকারি দিলেন একবার।

‘কাজের ছেলে ছিলো একজন আমার বাসাতে। বয়েস বেশি না।’ চোখ পিট পিট করে তাকালেন ভদ্রলোক, ‘তিন রাত আগে ছেলেটির পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়েছে ঈপ্সিতা।’

২.
‘এই ঘরে থাকতেন আফনে।’

যোবাইদা নামের কাজের মেয়েটা দেখিয়ে দিতে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে রায়হান। শহরের একেবারে অন্যপাশে এই বাড়িটা। ছোট একটা টিলার ওপরে। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়।
নিঃশব্দে যোবাইদা বের হয়ে গেছে – রায়হান ধীরে সুস্থে নিজের কাপড়গুলো বের করে করে খালি আলনাতে তুলে রাখে। বাইরের ঘরের মত এই ঘরের দেওয়ালেও ঝুলছে ছবি। ছবিগুলোর ভেতরের নারীরা প্রত্যেকে নগ্ন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাটে এসে বসে রায়হান। এই ছবিগুলো দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন মোস্তফা কামাল আজও? দুইজন আন্ডারএজড ছেলে মেয়ে এখানে বাস করে!

প্রশ্নটা ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলেই জেনে নেওয়া যাবে।
গতকাল তাঁর সাথে তেমন কথা হয়নি। শুধু ঈপ্সিতার সমস্যাগুলো শুনেই আগ্রহী হয়ে উঠেছে ও কেসটার ব্যাপারে। কাজের ছেলেটার মৃত্যুর কথা একেবারেই চেপে যাওয়া হয়েছে। সবাই জানে, ছেলেটি বিশ হাজার টাকা সাথে নিয়ে পালিয়ে গেছে। পুলিশ জমিদারের বাড়িতে ঢুকে তদন্ত করবে না। তাদের কাছে বড়লোকের মুখের কথাই কাফি।

মোস্তফা কামাল থানায় ওই গল্পটিই জানিয়েছেন। যে কোন মূল্যে যেন ছোকরাকে গ্রেফতার করা হয়। নিজের মেয়ের কীর্তি ঢাকতে এটুকু তাঁকে করতেই হত – এ বলে কৈফিয়ত দিয়েছেন তিনি রায়হানকে। ও অবশ্য তেমন একটা গায়ে মাখে নি বিষয়টা। মানসিক কোন রহস্য থাকলে সেটা সমাধানে রায়হান আগ্রহী। কে কোথায় খুন হলো না পুরুষাঙ্গ হারালো তা দিয়ে তার কিছু এসে যায় না। পুলিশ মাঝে মাঝে তার সাহায্য নিয়ে থাকে – তার মানে সে ওদের একজন নয়। কাজেই আইনের দিক থেকে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা নিয়ে চিন্তা করার প্রশ্নই আসে না।

ঘরের প্রতিটা আসবাবই জমিদারবাড়ির সমান বয়স্ক। অথবা ওরকম বলেই মনে হচ্ছে। এমনও হতে পারে মোস্তফা কামালের বাবার সময়কার এসব। আর ওটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। স্বাভাবিকের চেয়ে আকারে বড়। প্রাচীন যে কোন কিছুর মতই।

ভালো করে তদন্ত করে দেখার জন্য রায়হান তিনদিন এই বাড়িতে থাকতে চেয়েছে। ঈপ্সিতা তার কর্তন-কর্ম সেরেছে রাতের বেলাতে। কাজেই রাতে থাকাটা বিশেষ জরুরী। আর একটা কেস নিলে সাবজেক্টের মানসিক অবস্থা কী থেকে প্রভাবিত হতে পারে, তা জানা রায়হানের দরকার। সে জন্য সাবজেক্টের পরিবেশে দুই একদিন কাটানোটা দরকার। সতর্কতার জন্য একদিন বেশি নিয়েছে ও। তিন দিন তিনরাতের মাঝেই এই কেসটা সমাধান করা সম্ভব হতে পারে।

একটা ভাঁজ করার মত টেবিল নিয়ে যোবাইদা ঢুকে পড়ল। তার দিকে মুখ তুলে তাকালো রায়হান। মেয়েটা একবারও এদিকে নজর দিল না, চুপচাপ টেবিলটা ঘরের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে বের হয়ে যায়।
ঘরটার বিশালত্ব প্রথমবারের মত চোখে পড়ে ওর এবার। খাট, কাপড় রাখার বিশাল আলমারি, আয়না সহ একটা বড় ড্রেসিং টেবিল, আলনা আর বুক সেলফ রাখার পরও অনায়াসে ইনডোর ক্রিকেট খেলা যাবে। কাজের মেয়েটা এরই মাঝে আবার ফিরে এসেছে। হাতে বড় একটা ট্রে, নাস্তাগুলো টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল।

‘আমি নাস্তা করেই এসেছিলাম।’ মৃদু কণ্ঠে বলে রায়হান।
মুখ ফিরিয়ে তাকালো যোবাইদা, তবে সরাসরি ওর দিকে নয়, কেমন অস্বস্তিকর একটা ভঙ্গী যেন – রায়হান ঠিক ধরতে পারে না, ‘সাহেবে বলছেন আপনের লগে নাস্তা বইবেন।’
মাথা দোলায় ও , ‘ঠিক আছে।’

প্রায় সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে পড়লেন মোস্তফা কামাল। চমৎকার চুলগুলো আজ ব্যাকব্রাশ করা, গাল হাল্কা নীলাভ হয়ে আছে। সম্ভবতঃ সদ্য শেভ করেছেন। চুল আর ত্বক দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই গোসল করে এসেছেন। রায়হান বোঝে সাত সকালে এঁর গোসলের অভ্যাস আছে।
উঠে দাঁড়ায় ও, হাত বাড়িয়ে দেয় – নিঃসংকোচে হাত মেলালেন মোস্তফা।

‘আপনাকে খুব বেশি সময় বসিয়ে রাখিনি তো? গোসলে একটু দেরী হয়ে গেল।’ দুঃখপ্রকাশের ভঙ্গীতে নয়, যেন বলার জন্য বলছেন এভাবে বলেন তিনি।
‘না না, মাত্রই এলাম।’ আশ্বস্ত করে রায়হান।
চেয়ার এনেছে যোবাইদা একটা, ওটা টেনে নেন মোস্তফা, ‘হাত ধুয়ে বসে পড়ুন। আর বেলা করে কাজ নেই।’

কাজেই বসে পড়ে ও। ঢাকনা সরাতেই দেখা গেল মিহিভাবে বেলা রুটি আর নাম না জানা অসংখ্য পদের রান্না পরিবেশন করা হয়েছে।
‘চিনতে পারছেন না?’ রায়হানের বিভ্রান্ত দৃষ্টি লক্ষ্য করে হেসে ওঠেন মোস্তফা, ‘কচ্ছপের মাংস।’
চোখ কুঁচকে গেছে ওর, লক্ষ্য করে দ্রুত আবার বলেন তিনি, ‘স্যামন ফিশ। টিনে করে আনা। ডক কাছে হওয়াতে হয়েছে সুবিধে। সবকিছুই সামুদ্রিক। ওই মাছগুলো কেমন অদ্ভুত রকমের সুস্বাদু হয় খেয়াল করেছেন?’
একটু হাসে রায়হান, ‘কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে এদের। মিঠেপানির মাছ থেকে আলাদা লাগে খেতে। ভালোই।’

মোস্তফা কামাল চরিত্রটাকে ঠিক বুঝে উঠে না ও, গতকাল ছিলেন নিখুঁত ভদ্রলোক। ময়লা সোফাতে বসতে চাইছিলেন না। তারপর আজকে আতিথেয়তার চূড়ান্তে এসে মেহমানের ঘরে এসে একসাথে নাস্তা করতে চাইলেন এবং একেবারেই হঠাৎ খাবারের সময় বাজে রসিকতা – ঠিক শোভন নয় সেটা। স্বাভাবিক মোস্তফা কামালের সাথে যাচ্ছে না।
এক মানুষের ভিন্নরূপ দেখতে পেলে সেটা মাথার ভেতর নোট করে রাখতে হয় – অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানে রায়হান।

মোস্তফা কামাল সম্ভবতঃ রায়হানের অস্বস্তির কারণটা বুঝলেন। চট করে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেন তিনি।

‘আপনাকে কেন ডেকেছি তা আশা করি বুঝতে পারছেন?’
রুটির টুকরোটা গিলে ফেলার আগে রায়হান উত্তর দেয় না, ‘আপনি চাইছেন ঈপ্সিতার ব্যাপারটা একটা সমাপ্তিতে আসুক। নিজের মেয়েকে চিনতে পারছেন না আপনি। হঠাৎ করে তার অচেনা হয়ে যাওয়ার কারণটাও ঠিক বুঝতে পারছেন না। কাজেই এখানে আমাকে দরকার হয়েছে।’
মাথা নাড়লেন মোস্তফা, ‘সেটা বড় ব্যাপার না। বড় কথা হল ঈপ্সিতা একজন মানুষ খুন করেছে। সে আবারও আঘাত হানবে কি না আমি জানি না। আপনার কথা সত্য – আমার মেয়েকে আমি চিনতে পারছি না। কিন্তু আমার চোখ থেকে দেখুন – আমার মেয়ে একজন খুনী। এই অনুভূতিটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। তার বিচারের জন্য পুলিশের কাছে আমি যাবো না। তার কারণ এই না, ঈপ্সিতা আমার মেয়ে। তার কারণ এটাও না, ঈপ্সিতার বয়েস মাত্র এগারো। আমি পুলিশের কাছে বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাই নি – কারণ আমার মনে হয়, বিষয়টা একেবারেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে নি, মানে-’

শব্দের অভাব বোধ করছেন মোস্তফা কামাল, বোঝে রায়হান, তাঁর কথাটা সে নিজেই শেষ করে দেয়, ‘আপনি ভাবছেন এখানে অতিলৌকিক কিছু একটা আছে। নিজের জমিদার পূর্বপুরুষের বিদেহী আত্মা এই বাড়িতে আটকে গেছে এরকম কিছু একটা ভাবছেন আপনি।’
হাল্কা মাথা দোলান মোস্তফা কামাল, ‘বলতে পারেন। আসলে, আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছি না এমন কিছু। নিজেকে বাস্তববাদী মানুষ হিসেবেই চিনি। আবার উড়িয়েও দিতে পারছি না একেবারে।’
পানির গ্লাসটা টেনে নেয় রায়হান, ‘আপনার পূর্বপুরুষটি সম্পর্কে বলুন। আগে তেমন বিশদ জানা হয় নি।’

‘রুদ্রপ্রতাপ রায়। নামের প্রতি তিনি অবিচার করেন নি। জীবনটা কাটিয়েছেন প্রতাপের সাথে। রুদ্রমূর্তি ধারণে ইনার জুড়ি ছিলো না।’ মৃদু হাসলেন মোস্তফা কামাল, হাসিটা তিক্ততার, ‘হাল্কা ভাবে বলছি বটে, তবে নিজের পূর্বপুরুষের আচরণ নিয়ে আমি মোটেও গর্ব করার মত কিছু দেখি না। নিজের বংশ তো আর পাল্টানো যায় না। তাই না?’
‘তা বটে। জমিদারবাবুই কি এই বাড়ির পত্তন ঘটিয়েছেন?’
‘হুঁ। তার এই একটা কাজই লজ্জা পাবার মত নয়। আর সবই -’

এই বাড়ি তৈরি করতে যে পয়সা আর শ্রম নেয়া হয়েছে তা যে তার লজ্জাস্কর কর্মকাণ্ডের ফলাফল তা রায়হান মনে করিয়ে দিল না আর। যার বাড়িতে দাওয়াত, তাকে চটানো স্বাস্থ্যের জনয সব সময় উপকারী নয়।

‘স্বভাবের দিকে এঁর মৌলিক দিকগুলো তুলে ধরতে পারবেন? খেয়ালী হন এঁরা। ইনার খেয়ালটা কোনদিকে ছিলো?’
একটু ভাবলেন মোস্তফা কামাল, ‘আলাদা করে এভাবে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিন প্রজন্ম আগের কথা – বুঝতেই পারছেন। তবে পারিবারিক ডায়েরী থেকে যা জানতে পেরেছি – ইনার খেয়ালের অভাব ছিলো না। তীর ধনুক দিয়ে মানুষ শিকার করতেন ইনি। অযোগ্য বলে প্রমাণিত চাকর বাকর আর প্রজাদের হতে হত শিকার। ময়দানে তাদের পালানোর সুযোগ দেওয়া হত। ঘোড়া চড়ে একে একে সবাইকে শিকার করতেন। খাওয়ার ব্যাপারেও তাঁর খামখেয়ালীপনা ছিলো। মাসে একদিন রাজভোজ হত। সে ভোজে তিনি মেয়ে মানুষের বুকের মাংস খেতেন। অবশ্যই রান্না করা হত সেটা। কাঁচা মাংস আবার উনার পছন্দ ছিলো না।’
‘প্রজাদের ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু ভাবেন নি দেখছি ইনি!’ তিক্ত কণ্ঠে বলল রায়হান, ‘আপনাদের পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো কবে?’
‘আমার দাদা করেছিলেন।’

চুপচাপ খাওয়াতে মন দেয় ওরা আবার।
রায়হানের মাথাতে নতুন তথ্যগুলো ঘুরছে। পারিবারিক ডায়েরীর কথা উল্লেখ করেছেন মোস্তফা কামাল। তবে সেটা রায়হানকে পড়তে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। অথচ ও জানে, সমস্যাটার গোড়া রুদ্রপ্রতাপ রায়ের ইতিহাসে থাকলে ওই ডায়েরী পড়া লাগবে ওকে। তবে এই মুহূর্তে ওটা না হলেও চলবে।

‘ঈপ্সিতাকে বলেছি আজ স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই।’ খেতে খেতে জানালেন মোস্তফা।
‘তা কেন?’ অবাক হয় রায়হান, ‘ওর স্বাভাবিক জীবনে বাঁধা দেওয়া যাবে না। ওকে অবশ্যই স্কুলে পাঠান।’
‘কিন্তু ভেবেছিলাম তার সাথে আপনি কথা বলতে চাবেন।’ অবাক হন মোস্তফা।
‘তা অবশ্যই বলবো।’ একমত হয় রায়হান, ‘তবে স্কুল থেকে ও ফিরে আসার পরও তা বলা যাবে। নয় কী?’
“অবশ্যই। সে কথাই রইলো তবে। তবে দয়া করে আপনি নিজের সত্যিকারের পরিচয় দেবেন না। আমি চাই না মেয়েটা জানুক আপনি তাদের পাগলামি সারাতে এসেছে। বিগড়ে যেতে পারে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন?”
মাথা দোলালো রায়হান, “অবশ্যই। চিন্তা করবেন না এ নিয়ে।”

আর কিছু বলল না ও। ঈপ্সিতা নামক সাবজেক্টটার রুমে একবার ঢুঁ মারতে হবে ওকে যখন সে তার ঘরে থাকবে না। স্কুলে গেলে সেই টাইম গ্যাপটা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। মূল লক্ষ্য ওটাই ছিল রায়হানের। মেয়ে স্কুলে গিয়ে বিদ্যাবাগীশ হবে এমন সদিচ্ছা থেকে স্কুলে পাঠাতে তোড়জোড় করেনি সে।

৩.
ছোট্ট মেয়েটা দুই হাত সামনে ছেড়ে দিয়েছে। ও অবস্থাতেই একে অপরের সাথে আটকে রেখেছে ওদের।
মুখটা একেবারেই নিষ্পাপ – এগারো বছরের শিশুদের মাঝে যেটা থাকে। চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে – কাঁধের ওপর এলিয়ে আছে ওগুলো। চোখের মাঝে নিরীহ একটা দৃষ্টি। বাবা যখন বলেছিল তার বন্ধু কথা বলবে ওর সাথে, ভেবেছিল অনেক বয়স্ক কেউ হবে। রায়হানকে দেখে অবাক হয়েছে। এরপর এরকম একটা নিরীহ দৃষ্টিই ফুটে উঠেছে ঈপ্সিতার মুখে।
অস্বাভাবিক কোন আচরণ রায়হান এখন পর্যন্ত দেখেনি।

‘দাঁড়িয়ে কেন? বস তুমি।’ একটু হাসে রায়হান, ‘তোমার নাম তো ঈপ্সিতা, তাই না?’
মাথা দোলায় মেয়েটা। কথা বলে উত্তর দেয় না, অথবা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
‘আগে ঢাকার কোথায় থাকতে তোমরা?’ ঘরোয়া আলাপের ভঙ্গিতে জানতে চায় ও।
প্রথমবারের মত কথা বলে ঈপ্সিতা, ‘ধানমন্ডি। তুমি চেন?’
‘হুঁ। সুন্দর জায়গা। ওখান থেকে এখানে এসে তোমার মন খারাপ করে না?’
চুল দুলিয়ে মাথা নাড়ে বাচ্চা মেয়েটা, ‘না। এ জায়গাটা আরও ভালো।’
‘পুরোনো বাড়ি ভালো লাগার কথাই অবশ্য। তোমাদের এই বাড়িটা বিশাল। তাই না?’
চোখ সরু হয়ে যায় ঈপ্সিতার, এতটাই আচমকা রায়হানও প্রস্তুত ছিলো না, ‘আপনি আমাকে কেন প্রশ্ন করছেন? আমি কি কিছু করেছি?’

রায়হান চাইলে বলতে পারতো, ‘প্রশ্ন নয়, ঈপি, তোমার সাথে এমনি আলাপ করছি।’ তবে এসব ভুজুং ভাজুং দিয়ে এই মেয়েকে ভোলানো যাবে না। মোস্তফা কামালের ধারণা ছিলো কাজের ছেলের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার ঘটনাটা ঈপ্সিতার মনে নেই। শকে চলে গেছিলো তখন মেয়েটা।
তবে এই মুহূর্তে রায়হানের মনে হয়, পুরো বিষয়টা সে মনে রেখেছে। কাজেই, বিপদের সম্ভাবনা দেখা মাত্র আক্রমণে চলে গেছে। মেয়েটি বয়সে ছোট বলে ওকে হাল্কাভাবে নেওয়ার কোন কারণ নেই আর। একে মুখ খোলাতে ভালো বেগ পেতে হবে।

কাজটা করার সময় কি এই ভূতুড়ে মেয়েটা ব্যাপারটিকে উপভোগ করেছিলো? ভাবনাটা মাথাতে আসতেই রায়হানের মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে শীতল প্রবাহ টের পায় ও।

‘তোমাকে প্রশ্ন করছি, কারণ – তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন, ঈপ্সিতা।’ সোজাসাপ্টা কথা বলছে এভাবে জবাব দেয় রায়হান, ‘আমি একজন লেখক। আর এবারে যে উপন্যাসটা লিখতে চলেছি – সেটা একটা পুরোনো বাড়ি নিয়ে। তোমাদের বাড়িটার মতই। আরও মজার ব্যাপার কি জানো? ’
ঈপ্সিতাকে দেখে মনে হয়, এই ব্যাখ্যাতে সে সন্তুষ্ট হয়েছে, জানতে চায়, ‘কী?’
‘গল্পের নায়িকা তোমার মত ছোট্ট একটা মেয়ে। কাজেই – তোমার সাথে কথা বললে মেয়েটাকে চেনা আমার জন্য সহজ হবে।’

মাথা দোলায় ঈপ্সিতা, যেন বুঝেছে সবই। রায়হান প্রশ্ন চালিয়ে যায়, ‘কাজেই, আমার জানা দরকার – বড় একটা শহর থেকে আমার নায়িকাটি যখন প্রাচীন এই জায়গাতে আসল, তখন তার ঠিক কেমন লেগেছে। মন খারাপ কতটুকুই লেগেছে পুরোনো জায়গা ছেড়ে আসতে, কতটুকু ভালো লেগেছে নতুন জায়গাতে আসতে। অথবা -’
‘আমি এখানে আমার পরিবারকে ফীল করি।’ উদাস একটা ভঙ্গীতে বলে মেয়েটা।
একটু গভীরভাবে ভাবে রায়হান, ‘পরিবার মানে, তুমি তোমার পূর্বপুরুষের কথা বলছ?’
‘ভালোবাসে আমাকে ও। অন্যরকম ভালোবাসা। জায়গাটা আমার খুব পছন্দ।’ মুচকি হাসে ঈপ্সিতা।

হাসির ধরন দেখে ভেতরটা কেঁপে ওঠে রায়হানের।
চারপাশে একবার তাকায় দ্রুত। দিনের আলো স্পষ্ট। তারওপর কথা বলছে একজন বাচ্চা মেয়ের সাথে। আচমকা কেন নার্ভাস লাগছে ওর – সেটা বুঝতে পারে না সে।
তবে একটা ভালো দিক হল, হঠাৎ নিজেকে খুলে দিয়েছে সাবজেক্ট। একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে অল্প সময়েই ক্লু দিয়েছে। এটুকু পেতে কারও কারও পেছনে সপ্তাহখানেক ব্যায় করা লাগে।

ও তাকে ভালোবাসে। ওকে মেয়েটা ফীল করে! ও হল পরিবার।

“ও” টা কে?

‘জায়গাটা আমারও ভালো লেগেছে।’ একটু হাসে রায়হান, ‘ও তোমাকে অন্যরকম ভালোবাসে – ব্যাপারটা ভালো।’
চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ঈপ্সিতার, যদিও কণ্ঠে রুক্ষতা এনে ফেলেছে, ‘আপনি কিছুই জানেন না।’
‘ওর নামটা বলবে আমাকে?’
‘তা দিয়ে আপনার দরকার কী?’ একেবারে হঠাৎ আক্রমণে চলে গেলো আবার ঈপ্সিতা।
‘তোমাকে বলতেই হবে, এমন কিছু না। ইচ্ছে না হলে থাকুক। তবে আমার গল্পের মেয়েটাও পরিবারের একজনের বিশেষ ভালোবাসা পায়। সেজন্য জানতে চেয়েছিলাম।’
সরু চোখে মেয়েটা তাকায় ওর দিকে, ‘আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না। ওর নাম বলতে পারি – তবে ভবিষ্যতে আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না, এই কথা আপনাকে দিতে হবে।’
একটু ভেবে রাজি হয়ে যায় রায়হান, ‘কথা দিলাম।’
‘আমার বাবাকে বলে আমাকে কথা বলতে বাধ্য করাবেন না?’
‘করাবো না। তোমাকে আর ঘাঁটাবো না আমি।’ একটু হাসে রায়হান, ‘জোর করার মত মানুষ বলে ভাবছ হয়তো, আমি ওরকম নই।’

জ্বলন্ত চোখে চেয়ে থাকে মেয়েটি। ঠোঁটদুটো একে অন্যের সাথে চেপে বসেছে।
রায়হানের মনে হল এখনই চেয়ার থেকে উঠে বেড়িয়ে যাবে মেয়েটা, তাকে বিশেষ ভালোবাসতে থাকা মানুষটির নাম না বলেই।

ওর ধারণা সত্য প্রমাণ করার জন্যই উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা। চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় একপাশে। ঢোকার সময় যে শান্ত মূর্তি নিয়ে ঢুকেছিলো ও – তার ছিঁটেফোঁটাও এখন অবশিষ্ট নেই। চরিত্র যেন আচমকাই পাল্টে গেছে ওর।

দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে ফিরে তাকায় ঈপ্সিতা।
হিস হিস করে হিংস্র একটা কণ্ঠে উচ্চারণ করে, ‘ওর নাম রুদ্র।’

৪.
বাগানের এক কোণে বসে সবুজ রঙের পেয়ালা থেকে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন মোস্তফা কামাল। সেদিকে এগিয়ে যায় রায়হান।
মোস্তফার সঙ্গে অসামান্যা সুন্দরী এক মহিলা আছে এখন। আর আছে চৌদ্দ-পনের বছরের এক কিশোর।
কাছাকাছি গিয়ে মুখে হাসি ফোটায় রায়হান।

‘যাক, আসতে পারলেন তাহলে।’ বিশাল এক হাসি দিয়ে রায়হানের হাসির জবাব দেন মোস্তফা, ‘বসুন। বসে পড়ুন। নিজে না গিয়ে যোবাইদাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি বলে কিছু মনে করেননি তো?’
হাসিটা মোছে না রায়হানের মুখ থেকে, ‘আমি বাঙালী অতিথেয়তার চেয়ে ইংরেজ আতিথেয়তাকে বেশি পছন্দ করি। এটাই ঠিক আছে। নিজের বিকেল বেলার জগিং বাদ দিয়ে যদি আমার ঘরে গিয়ে ডেকে আনতেন– তবেই বিরক্ত হতাম।’
সোজা হয়ে বসেন মোস্তফা, ‘দারুণ লাগলো আপনার এই চিন্তাটা। আমিও এভাবেই ভাবি, বুঝলেন। অথিথিপরায়ণতার নাম করে আমরা আসলে পর-অধিকারচর্চা করে থাকি। তবে বাংলাদেশি সবাই এরকম ভাবে না। মানে ভাবতে চায় না… পরিচয় করানো হয় নি – মাফ করবেন।’
মহিলার দিকে ফিরলেন তিনি, ‘দিস ইজ মাই বিউটিফুল ওয়াইফ, রাইসা।’
মাথা দোলায় রায়হান, ‘প্লেজার টু মীট ইউ, মিসেস কামাল। ’
‘আর এ হল আমার বড় ছেলে, জাহিদ। জাহিদ, উনি হলেন মি. আবু মোহাম্মদ রায়হান, এসেছেন ঈপ্সিতার চিকিৎসার জন্য।’

ছেলেটা ভদ্র আছে, নিজের সীট থেকে উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘আপনার ব্যাপারে শুনেছি, স্যার। মাহফুজ ভাইয়া বলেছে, নিজের কাজে আপনার মত দক্ষ আর কেউ নেই।’
হাত মেলায় রায়হান, মুখে হাসি, ‘বন্ধুর ব্যাপারে যখন কোন বন্ধু প্রশংসা করে – হয়তো চাপাবাজি সেটা নয়, তবে বেচারা বন্ধুর প্রতি তার উচ্চধারণা থাকতে পারে। কাজেই সবকিছু বিশ্বাস করতে নেই।’
‘আপনার বিনয়ের ব্যাপারেও বলেছেন তিনি।’
‘আমাকে স্যার বলে ডাকবে না আশা করি। নাম ধরেই ডাকতে পারো। ওই যে বলেছিলাম – বাংলাদেশি-’
‘বুঝেছি।’ হেসে ফেলে জাহিদ, ‘আ’ম ওকে উইথ রায়হান।’
‘ঈপ্সিতার ব্যাপারে কি দেখলেন, মি. রায়হান?’ জানতে চাইলেন মোস্তফা কামাল।

মিসেস কামাল এক কাপ চা বাড়িয়ে দিয়েছেন ওটা হাতে তুলে নেয় রায়হান, ‘মেয়েটির ব্যাপারে আমার পক্ষে এখনও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব না। তবে তার মুড ডিজঅর্ডার আছে। ঠিক কোনদিকে যাবে তা বের করতে সময় তো লাগবেই, এখনতক আমার বেট, ডিপ্রেশন।’
‘এগুলো কি খারাপ কিছু?’ শঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মিসেস কামাল।
‘খুব গুরুতর কিছু হতেই হবে এমন নয়। মেয়েদের পিএমএস থেকে শুরু করে সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার সবই এর মধ্যে পড়তে পারে। আগেই ভয় পাবার কিছু নেই। তবে ঈপ্সিতার কয়েকদিন আগের ইতিহাস যেহেতু আমরা জানি, হাল্কা করে নেবার উপায়ও থাকছে না। তবে এই মুহূর্তে আমি জানি না, এই মুড ডিজঅর্ডার ঠিক কি মীন করছে।’

পাশ থেকে প্রশ্ন করে জাহিদ, ‘এতে কি হয়, মুড পাল্টে যায় বার বার সাবজেক্টের?’
‘মুড স্বাভাবিক মানুষেরও পাল্টে যায়। তবে মুড ডিজঅর্ডার বলতে আরও স্পেসিফিক কিছু বোঝানো হয়। এটা বেশ ধ্বংসাত্মকও হতে পারে। ধর এই যে তুমি শান্ত ভঙ্গীতে চা খাচ্ছো – হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ উঠলো তোমার – আমার মাথাতে চায়ের কাপটা আছড়ে ভেঙ্গে ফেললে। এটাই হল-’
‘মুড ডিজঅর্ডার।’ মাথা দোলায় জাহিদ, বোনকে নিয়ে বেশ চিন্তিত – বোঝাই যাচ্ছে।
‘কপাল খুব ভালো হলে ঈপ্সিতার কেসটা হল সিজো-অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার। কিন্তু এভাবে হুট করে রোগ নির্ধারণ করাটা আমার নীতি বিরুদ্ধ – তবুও এটা জানিয়ে রাখছি, কারণ আপনারা যতটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন তা থেকে সরে আসতে হবে। নিজেরা সুস্থ না থাকলে অসুস্থ মেয়েকে কীভাবে সহায়তা করবেন?’

ভ্রু কুঁচকে গেছে মোস্তফা সাহেবের, ‘তারমানে ও সিজোফ্রেনিক?’
মাথা নাড়ে রায়হান, ‘না। সিজো-অ্যাফেকটিভ। অর্থাৎ সিভিয়ার বাইপোলার ডিজঅর্ডার এবং মাইল্ড সিজোফ্রেনিয়ার মিশেল। বাইপোলার ডিজঅর্ডার থাকলে সাবজেক্টের মুড ম্যানিয়া আর ডিপ্রেশনের মাঝে সুইচ করে বার বার। সেই সাথে সিজোফ্রেনিয়ার হাল্কা উপসর্গ – প্যারানয়া, মিডিয়া অবসেশন, নিজের সম্পর্কে শারীরিক ভুল ধারণা আর ভিজুয়াল এবং অডিটরি হ্যালুসিনেশন। সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ বলতে অনেকেই শুধু এই হ্যালুসিনেশনটুকুকেই ধরে নেয় – অজ্ঞতা। যাই হোক, এই ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে চাই একান্তে। যদি সম্ভব হয়।’

ইঙ্গিতটা সাথে সাথে বুঝে যায় জাহিদ, ক্লাস এইটে পড়ে ও, একেবারে শিশু নেই এখন। বড়রা একা একা কথা বলতে চাইতে পারে। তখন ওদের থেকে দূরে চলে যাওয়া নিয়ম।

আস্তে করে উঠে দাঁড়ায় ও, হেসে জানালো, ‘আমার একটু ঘরে যেতে হচ্ছে। ডাউনলোড করতে দিয়েছিলাম একটা ফাইল – হয়ে গেছে বোধহয়। আপনারা কথা বলুন।’
রায়হান মাথা কাত করে সায় দিলো। ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগেছে ওর। এই বয়েসেও ভদ্রতাবোধ শিখেছে বেশ।

চোখের সামনে থেকে জাহিদ দূর হতেই মোস্তফা কামালকে প্রশ্ন করে, ‘ঈপ্সিতা রুদ্রপ্রতাপ রায়ের ব্যাপারে কতটা জানে?’
‘ও ব্যাপারে খুব বেশি আলোচনা ছেলেমেয়ের সামনে তো করি নি।’ অবাক হয়ে যান মোস্তফা কামাল, ‘কেন?’
‘বাইরের মানুষ কেউ জানে?’
‘অনেক পুরোনো অধিবাসী যারা আছে। আর যারা আমার বাসায় ভাড়া থাকতে গিয়ে সাফার করেছে। তবে তাদের সাথে তো আমার ছেলে-মেয়েদের দেখা হয়নি। তখন ওরা ঢাকায় ছিল।’ অস্থির হয়ে উঠলেন মোস্তফা, ‘ঈপ্সিতা রুদ্রপ্রতাপের কথা জানে?’
‘শুধু জানে না। মেয়েটা ওকে দেখতেও পায় – যতদূর বুঝলাম।’

ঈপ্সিতার সাথে যা কথা বার্তা হয়েছে খুলে বলে রায়হান ওদের।
শুন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন দম্পতি। মেয়ের সমস্যাটা কোনদিকে গেছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না এখনও।

‘তা কি করে সম্ভব? আপনি নিশ্চিত ঈপ্সিতা রুদ্র বলতে আমাদের পূর্বপুরুষকে বুঝিয়েছে?’
‘জমিদারবাবু ছাড়া আপনাদের পরিচিত আর কোন রুদ্র কি আছে?’ পাল্টা প্রশ্ন করে রায়হান, ‘তাছাড়া সে শুধু রুদ্রের কথাই বলেনি – বলেছে এ বাড়িতে এসে সে তার পরিবারকে ফিরে পেয়েছে। এর অর্থ একটাই – ঈপ্সিতা রুদ্রকে দেখতে পায়।’

কেঁপে উঠলেন মিসেস মোস্তফা, ‘লোকটা একশ আগে মারা গেছে!’
হাসল রায়হান, ‘এবং মরেই আছে। ঈপ্সিতা দেখতে পায় বলে আমি বোঝাইনি সে মানুষটি এখনও হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। অথবা তার আত্মা এই বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব আজগুবি কিছু দেখিনি আমি আজতক। কাজেই – সমাধানটা সহজ, মেয়েটির ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।’

‘এ থেকে ওকে কিভাবে বাঁচাবো, মি. রায়হান!’ প্রায় কেঁদে ফেলেন মিসেস মোস্তফা।
‘শান্ত হও।’ পাশ থেকে আলতো করে বলেন মোস্তফা সাহেব।

দুইজনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রায়হান, ‘ওকে সুস্থ করতে হলে আমাকে তার সমস্যাটা পুরোপুরি জানতে হবে। ঈপ্সিতা যখন স্কুলে ছিলো ওর ভেন্টিলেটরের কিছু অংশ ভেঙ্গে ফোকরটা বড় করেছি।’
‘আপনি নিশ্চয় আমার মেয়ের ওপর –’
‘জ্বি, নজর রাখতেই চাইছি।’ মেয়ের বাবার আপত্তিকে দুই পয়সার মূল্যও না দিয়ে বলল রায়হান, ‘পেরিস্কোপের সাহায্যে। ওকে টের পেতে দেওয়া যাবে না। রাতের বেলাতে যেহেতু পাগলামি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিলো ওর – কাজেই ওকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে তখনই।’

৫.
আড়াল থেকে একজন মানুষের দিকে তার অনুমতি ছাড়া তাকিয়ে থাকার চেয়ে অসভ্য কাজ আর নেই। আর যদি সেটা কোন মেয়ের দিকে তাকানো হয় – মানসিক রোগী হোক আর যাই হোক – সেটি আরও বিতৃষ্ণার। তার ওপর সে তাকাচ্ছে একজন মেয়ে-শিশুর দিকে। এগারো বছর বয়স যার। এর থেকে খারাপ আর কিছু হতে পারে না।

রায়হানের ভদ্রতাবোধ বাংলাদেশীদের মত না হতে পারে – অন্যের ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে সে একটু বেশিই সচেতন। কাজেই যখন পেরিস্কোপে রাত সাড়ে বারোটার সময় ও চোখ রাখল, ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘কাজটা ঠিক করছো না, রায়হান।’

অস্বস্তিটা কিছুক্ষণের মাঝেই কাটিয়ে ফেলা যায়। পেরিস্কোপে চোখ রাখাটা একটা সময় স্রেফ দায়িত্ব বলে মনে হতে থাকে।
মেয়েটা অসুস্থ। তাকে তোমার সাহায্য করতে হবে!

প্রথম এক ঘণ্টাতে ঈপ্সিতার মাঝে কোন অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করে না রায়হান। ছোট্ট একটা মেয়ে যেভাবে ঘুমায় ঠিক সেভাবেই ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। বুকের কাছে চেপে রেখেছে একটা পুতুল।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল কবে থেকে ঈপ্সিতা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমায় – সেটা তার বাবা-মা লক্ষ্য করেননি। হঠাৎ এটা শুরু হয়েছে। একদিক দিয়ে এটা ভালো হয়েছে। তার অজান্তে তার ওপর চোখ রাখা যাচ্ছে। তবে এগারো বছরের একটা বাচ্চার কাছ থেকে এই দরজা লাগিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস ও আশা করে নি।

কিশোরীর কোন বৈশিষ্ট্য তার শরীরে ফুটে ওঠেনি এখনও। ঘুমালে ঈপ্সিতার মুখে নিষ্পাপ একটা ভঙ্গী ফুটে ওঠে – ওদিকে পেরিস্কোপ ঘুরিয়ে তাকাতে রায়হানের ভীষণ মায়া হয়। এই মেয়েটি একজন পুরুষের গোপন অঙ্গ কেটে নিয়েছে এটা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না। কোন পর্যায়ের মানসিক চাপে থাকলে কোন শিশু এই কাজটি করতে পারে?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, হাতের কাছে ছুরিই বা সে পেল কোথায় প্রয়োজনের সময়? এমন হতে পারে – কাজের ছেলেটা এখানে ভিক্টিম নয়, হয়তো মেয়েটিকে একা পেয়ে কোন কু-ইচ্ছে চরিতার্থ করতে চেয়েছিল সে। কাজেই প্রতিরক্ষার জন্য মেয়েটিকে কাজটা করতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। কিন্তু ও ব্যাপারে পরে ঈপ্সিতা কিছুই মনে করতে পারে নি। ব্যাপারটা পোস্ট-ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার হতে পারে।

নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। আরও কিছু থাকার সম্ভাবনা দেখে বলেই আজকে পেরিস্কোপে এসে দাঁড়াতে হয়েছে ওকে। মোস্তফা কামাল অবশ্য তাকে বসার জন্য একটা চেয়ার দিয়ে গেছেন।

একেবারেই হঠাৎ চোখ মেলে উঠে বসে ঈপ্সিতা এসময়। এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে হল ব্যাপারটা – চমকে উঠল রায়হান। সাধারণতঃ ঘুম থেকে উঠলে একজন মানুষ কিছুক্ষণ সময় নেয় নড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। আর সাথে সাথে নড়ে উঠলেও এক ধরনের জড়তা কাজ করে। ঈপ্সিতার মাঝে কোনটাই কাজ করে না। সে এমনভাবে উঠে বসেছে – যেন চোখ বন্ধ করে গত দুই ঘণ্টা শুয়ে ছিলো। এখন শুধু তাকিয়েই উঠে পড়েছে।

ঘড়ি দেখে রায়হান – রাত তিনটা বাজে প্রায়।
বিষয়টা ডানহাতের কাছে রাখা নোটবুকে টুকে রাখল ও। ঈপ্সিতার দিকে মনোযোগ দিল আবার, ভূতে পাওয়া মানুষের মত বিছানা থেকে নেমে পড়েছে মেয়েটা। বিড় বিড় করছে – এখান থেকে তাই মনে হয় রায়হানের। ও ঠিক করে রেখেছে, মেয়েটা দরজার দিকে এগিয়ে আসলেই পেরিস্কোপ নিয়ে সটকে পড়বে পাশের বাথরুমে। যত দ্রুত সম্ভব। দরজা খুলতে ওর একটু সময় লাগার কথা। সেই সময়ের মধ্যে পগার পার হয়ে যেতে পারবে।

ভেন্টিলেটরের খুব কাছ দিয়ে পায়চারী করে যায় মেয়েটা।
ঠিক তখনই স্পষ্ট শুনতে পায় রায়হান, মেয়েটা বলছে, ‘রুদ্র! অ্যাই রুদ্র। আজ আসবে না তুমি। রাগ করেছ, না? অ্যাই, রুদ্র ডাকছি তো তোমাকে -’

অতিপ্রাকৃত কিছুতে বিশ্বাস করে না রায়হান – তবে এই মুহূর্তে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। রোজ কি এসময় আসে ঈপ্সিতার ‘রুদ্র’? আজ ও নজর রাখছে বলে আসতে পারছে না?
মৃত্যুর পর কি যোগাযোগ করা সম্ভব এই জগতের সাথে? আসলেই সম্ভব?

ঘাড়ের কাছে কাঁপা দীর্ঘশ্বাসটা শোনার সাথে সাথে জ্ঞান হারায় রায়হান।

৬.
চোখ মেলতেই রায়হান দেখতে পেল, ঠাণ্ডা একটা মেঝেতে শুয়ে আছে ও। দেওয়ালের কাছে ঝুলছে ওর ডিজিটাল পেরিস্কোপ। অন্যমাথা ভেন্টিলেটরের সাথে আটকানো।

এক মুহূর্ত লেগে যায় একটু আগে ঠিক কি হয়েছে সেটা মনে করতে – তবে মনে পড়তেই লাফিয়ে ওঠে ও। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার সময় হাত থেকে ছুটে গিয়ে দেওয়ালের সাথে বাড়ি খেয়েছে – ডিসপ্লের কাছে কিছু আঁচরের দাগ – এছাড়া ঠিক আছে যন্ত্রটা। পেরিস্কোপের নজর ঘুরে আছে ছাদের দিকে।

দ্রুত হাতে ওটাকে সরিয়ে আনতে থাকে রায়হান, খাটে দৃষ্টি দিতে ঈপ্সিতাকে ওখানে দেখা যায় না। ব্যস্ত হাতে ঘোরায় ওটা আবার। দূরবর্তী দেওয়ালের কাছে পড়ে আছে শরীরটা – দেখেই কেঁপে ওঠে রায়হান।
ঈপ্সিতার শরীরে একটি সুতোও নেই।

হাত থেকে পেরিস্কোপটা ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠেছে ও – দরজাটা ভাঙ্গতে হবে।
তখনই প্রথমবারের মত লক্ষ্য করে – খুলে আছে ওটা। ভেতর থেকে এখন লাগানো নেই।

ছুটে ঘরে ঢুকে পড়ে রায়হান, ব্যস্ত পায়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। শ্বাস ফেলছে এখনও।
তলপেটের নীচটা ভিজে আছে। বোঝা যাচ্ছে সামান্য সময় আগে যৌনসংগম করা হয়েছে মেয়েটার সাথে। জামা কাপড়গুলোকেও এবার দেখতে পায় রায়হান। কাছেই পড়ে আছে।

আচমকা ওর নিজেকে হতবুদ্ধি লাগে। এ অবস্থাতে মোস্তফা কামাল ওকে দেখতে পেলে তিনি কি ভেবে বসবেন না – রায়হান নিজেই অপকর্মটা করে বসেছে মেয়ের একাকীত্ব আর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে? আর যদি এখান থেকে ও বের হয়ে গিয়ে মোস্তফা সাহেবকে খুলে বলে ঘটনাটা – তাতেই কি তাঁকে বিশ্বাস করানো যাবে আর কিছু?

ঈপ্সিতাকে নজরে রাখছিলো রায়হান – তাকে চোখ এড়িয়ে আর কারও ঢোকার কথা নয় ভেতরে। রায়হান নিশ্চিত – অন্যকোন মানুষ ওই ঘরের সামনে আসে নি। চোখ পেরিস্কোপের ডিসপ্লের দিকে থাকলেও সামান্য নজর ও রেখেছিলো আর কেউ আসে কি না দেখার জন্য।

যে বা যা তাকে অজ্ঞান করেছে সে কী কোন বাস্তব কিছু? না – হলে ও দেখতে পেতো। আবার সেটা যদি সত্য হয়, সে কীভাবে অজ্ঞান হতে পারে? মানসিক কোন জটিলতা?

যদি মানসিক কোন সমস্যা তাকে ‘ব্ল্যাক আউটে’ নিয়ে যায় সেটাও ভালো কোন লক্ষণ নয়! প্রথমতঃ রোগির চিকিৎসা করতে এসে নিজের রোগ নিয়ে লড়াই করার মুডে ছিল না সে।

দ্বিতীয়তঃ ব্ল্যাকআউটে থাকা অবস্থাতে সাবজেক্ট অনেক কিছু করে আসতে পারে। সেটা তার স্মৃতিতে থাকে না।

এমন কি হতে পারে – অচেতন রায়হান হয় নি – বরং ওখানে সে অন্য একটা সত্ত্বাতে ঠিকই কর্মক্ষম ছিলো? ছোট্ট মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে, নিজেকে পরিষ্কার করে বাইরে গিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে? বাবা-মার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কথা ওর মনে পড়ে।
ঘাড় ঝাঁকিয়ে চিন্তাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে ও, এখন নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ের সময় নয়।

ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে বাড়ির অন্য কোণে ছোটে ও – মোস্তফা কামাল নিশ্চয় স্টাডি রুমে আছেন। মেয়ের কর্তন-কর্মের পর থেকে তিনি ঘুমাতে পারেন না। রায়হানের সাথে তিনিও বসতে চেয়েছিলেন, তবে তাকে মানা করে দিয়েছিল সে। রোগির আত্মীয়স্বজন তদন্তে নামলে বায়াস বাড়ে। কাজের কাজ কিছু হয় না, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানে।

স্টাডিরুমের দরজা ধাক্কিয়ে যখন ভেতরে ঢুকে ও – লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

রায়হানকে ব্যকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কি হয়েছে? কোন প্রগ্রেস?’
ও এবার চুপ হয়ে যায় , একজন বাবাকে কিভাবে সে বলবে, ‘আপনার মেয়েকে একটু আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমি দেওয়ালের ওপাশে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। তাই কিছুই করতে পারিনি।’

চুপ থাকতে দেখে মোস্তফা কামালের মুখ প্রথমে দুশ্চিন্তার ছাপ– তারপর আতঙ্ক এসে ভর করে। কিছু একটা বলা দরকার, রায়হান শুধু বলে, ‘চলুন, আপনি দেখতে চাবেন এটা।’

মোস্তফা সাহেব ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হলেন। তারপরই জোরে পা চালালেন মেয়ের ঘরের উদ্দেশ্যে। তাঁকে হেঁটে অনুসরণ করতে গিয়ে হাঁফ ধরে যায় রায়হানের। বুকের ভেতরটা দুপ দাপ লাফাচ্ছে।

আরও জটিল হয়েছে রহস্য। আর বলা চলে ঈপ্সিতার বলা কথাগুলোর অর্থ ও খুঁজে পেয়েছে।

এজন্য জায়গাটাকে তার ভালো লাগে। রুদ্রের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে সে নিজের ঘরে। এই রুদ্র তার কল্পনার অংশ হতে পারে – তবে রতিক্রিয়ার চরম পুলকে এই কল্পনাটি নিয়ে যেতে পেরেছে ঈপ্সিতাকে। বিষয়টাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।

এমন একটা অবস্থা হয়েছে – রায়হান নিজেই বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কি স্বতঃমিলন ছিলো? নাকি একজন সঙ্গী ছিলো ওখানে মেয়েটির? ও নিজেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলো কেন?
নাকি ওটা অজ্ঞান ছিলো না? নিজেই সে ধর্ষণ করে বসেনি তো ছোট্ট মেয়েটাকে?

ওর ভেতরে কি রুদ্রের আত্মা ভর করেছিলো?

জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল রায়হান। এখন রুদ্রের প্রেতাত্মা-কাহিনী বিশ্বাস করার অর্থ এই রহস্যের সমাধান কখনোই হবে না।

মোস্তফা কামাল থেকে বেশ পিছিয়ে গেছে রায়হান। আগে ভাগে পৌঁছে গেছেন তিনি পেরিস্কোপের কাছে। ডিসপ্লেতে চোখ রাখছেন।
রায়হান তাঁকে বলতে গেছিলো, ‘দরজা খোলাই আছে।’

থেমে যায় ও দরজার দিকে চোখ পড়তেই।
অনড় দরজা একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে। একটা ধাক্কা দিয়ে দেখে রায়হান। একচুল নড়ল না বিশাল পাল্লা।

‘মি. রায়হান?’ গমগমে কণ্ঠে ডাকলেন মোস্তফা কামাল। ‘এসব কী? কোন ধরনের প্র্যাংক?’

চমকে ওঠে রায়হান। মেয়ের অবস্থা তিনি দেখে ফেলেছেন, এবং বিশ্বাস করতে পারছেন না? তাঁর দিকে এগিয়ে যায় ও। আস্তে করে ওর হাতে ডিসপ্লেটা ধরিয়ে দেন মোস্তফা।

চোয়াল ঝুলে পড়ে রায়হানের।
ঈপ্সিতা বুকের মাঝে একটা পুতুল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। চোখে মুখে নিষ্পাপ একটা ছাপ।
পোশাক সব পরেই আছে মেয়েটা। এটা স্বস্তি দেয় রায়হানকে।

কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়।
রুদ্রপ্রতাপ রায় তার ট্রেস মুছে ফেললেও – রায়হান জানে, একটু আগে ও ভুল দেখেনি।

৭.
ডায়েরীর পাতা খুলে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে রায়হান। এখন ওর ঘুমানো উচিত। ভোর হতে শুরু করেছে। মোস্তফা কামাল তাঁর ঘরে ফিরে গেছেন।

ইতস্তত হলেও মোস্তফা কামালকে সবকিছু খুলে বলেছে ও। শুনে তিনি মুখে কিছু না বললেও রায়হান জানে এক বর্ণও বিশ্বাস করেন নি তিনি। ধরেই নিয়েছেন ওই ভাড়া নিতে আসা বেকুবগুলোর মতো মাথা গেছে এই ছেলেরও। রায়হান জানে না, তবে মোস্তফা কামাল ওই মুহূর্তেই ঠিক করে ফেলেছেন, এই ছেলেকে তিনদিনের বেশি প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। বাঁদরকে কোলে বসতে দিলে ঘাড়ে উঠে বসে। বাঁদর বিদেয় করতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। নিজের এগারো বছরের মেয়েকে নিয়ে রতিক্রিয়ার বাজে গল্প শোনার জন্য একে তিনি ভাড়া করেন নি।

এ বাসাতে ঢোকার পর থেকে দুটো চরিত্র রায়হানকে ভাবাচ্ছে। ডায়েরীতে সাবধানে কলম চালায় ও।

মোস্তফা কামালঃ
শুচিবায়ু। সৌখিন। মেয়েকে ভালোবাসেন। কুসংস্কারে বিশ্বাসী, তবে স্বীকার করেন না। পারিবারিকভাবে সুখী। পারিবারিক তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে স্পর্শকাতর। দরকার ছাড়া বহিরাগত কাউকে বলতে অনাগ্রহী। জমিদার রুদ্রপ্রতাপের ডায়েরিতে কি এমন কিছু ছিলো যা বাইরের কেউ পড়লে মোস্তফা কামালের পরিবারকে ঘৃণা করবে? তিনি ঠিক কি লুকোচ্ছেন?

ঈপ্সিতাঃ
কল্পনাবিলাসী। অতিকল্পনার ফলে হ্যালুসিনেশনের শিকার।
ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। শ্রেণিতে প্রথম।
বয়ঃসন্ধিকাল পেরুচ্ছে, শারীরিকভাবে এ বয়েসেই সক্ষম।

দুই সেকেন্ড লেখাটির দিকে তাকিয়ে থাকে রায়হান। একটু ভেবে বাকিদের ব্যাপারেও তুলে ফেলে।

রাইসা (মিসেস মোস্তফা কামাল)ঃ
সাধারণ গৃহিণী। স্বামীর প্রতি অন্ধবিশ্বাস আছে। ছেলের সাথে একটা কথাও বলেননি বিকেলে। অর্থাৎ মেয়েকে নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় আছেন। নিশ্চয় তাকে অতিমাত্রায় ভালোবাসেন। অতি ভালোবাসা সাবজেক্টের ক্ষতির কারণ?

জাহিদঃ
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছেলে। পারিবারিক মায়া-মমতা প্রবল। খোলা মনের। বন্ধু মাহফুজের সাথে এর সম্পর্ক ভালো।

কলম থামায় রায়হান। মনে পড়ে একবার মাহফুজের সাথে দেখা করাটা দরকার। শহরের এপ্রান্তে এসেছে, তার রেকমেন্ডেশনেই এই কেস পেয়েছে, এরপর তার সাথে দেখা না করা অভদ্রতা হবে। কেসটা সলভ করেই দেখা করবে – ঠিক করল।

বিছানাতে পিঠ ঠেকানোর সাথে সাথেই ঘুমের অতলে চলে যায় রায়হান। তারমাঝেই যেন মনে পড়ে কিছু একটা নেই – কিছু একটা নেই –

*
মাত্র এক ঘণ্টা পর ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর। এখন সে কোথায়? বুঝতে কিছুক্ষণ লাগলো রায়হানের। তারপর আরও গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নটা জাগল, ঘুম ভাঙ্গল কেন?

দরজার নকটা শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠে ও। দরজা খুলে যোবাইদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। চোখের নিচে আচরের দাগ।

‘সাহেব অপেক্ষা করতেছেন। খাওয়ার টেবিলে।’ শুকনো কণ্ঠে জানায় মেয়েটা।
‘চোখে কি হয়েছে?’ জানতে চায় ও ভদ্রতার খাতিরে।
‘রান্নাঘরে কাজ করতে গিয়া কাটছে একটু।’

মেয়েটা একদিকে রওনা হয়ে গেলো। আর কথা বলার ইচ্ছে নেই। অদ্ভুত প্রশ্নটি রায়হানের মাথাতে আচমকাই উদয় হয়, ‘ভাড়াটেদের মাঝে নারী সদস্যারা অস্বস্তি বোধ করত।’ – বলেছিলেন মোস্তফা কামাল।
ঈপ্সিতাকে কেমন অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে সেটা দেখেছে ও। যোবাইদাও কি এরকম কোন সমস্যায় ভুগছে?

প্রশ্ন করলে জবাব মেলার সম্ভাবনা নেই। এই মেয়ে মুখে তালা মেরে রাখবে সেটা তাকে স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছে।
একটু প্রস্তুত হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে রওনা দেয় ও। বাইরের রোদটা আজকে কড়া।
ডাইনিং টেবিলে ভেজা চুলে মোস্তফা কামালকে বসে থাকতে দেখা গেলো। রায়হানকে দেখে আগের দিনের মত হাসলেন না তিনি। চারপাশে তাকিয়ে মিসেস কামালকে খুঁজল রায়হান। তাঁকে দেখা গেলো না।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে টেবিলে বসে পড়ে ও, ‘গুড মর্নিং, মি. কামাল।’
মোস্তফা চোখ তুলে তাকালেন, দায়সারা ভাবে বললেন, ‘গুড মর্নিং।’
‘আর কাওকে দেখছি না।’
‘ওরা দেরী করে নাস্তা করে।’ আগের ভঙ্গীতেই বললেন ভদ্রলোক।
‘বেশ।’ রায়হান বসে পড়ল।

গতকাল রাতের কথা মনে পড়তে ভদ্রলোকের অস্বস্তির কারণ বুঝতে পারে ও। মেয়ের ব্যাপারে ওভাবে বলার পর যে কোন বাবাই স্বাভাবিকভাবে নেবেন না, যে বলেছে তাকে যত দ্রুত সম্ভব চিরস্থায়ীভাবে খেদাতে চাইবেন। কাজেই বিষয়টা এখানেই চাপা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হল রায়হান।

‘মি. কামাল, একটা বিষয় আমি খোলাখুলি জানিয়ে দিতে চাই।’ শুরু করল ও, ‘আপনার যদি আমার ওপর আস্থা না থাকে – আমাকে কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন। আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল জন্মেছে এই কেসটা নিয়ে। তার অর্থ এই না – এই কাজটা আমি করতে বাধ্য। আপনি সাবজেক্টের বাবা এবং আমার কেসের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আপনার সাথে মন কষাকষি করে এই কেসটা সলভ করার ক্ষমতা আমার নেই। আসলেই নেই। এখন আপনার বিবেচনা।’

মোস্তফা কামাল ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকালেন। সময়ের সাথে সাথে সেই দৃষ্টি উষ্ণ হয়। অবশেষে একচিলতে হাসি ফোটে তাঁর মুখে।
‘সত্যিই দুঃখিত। আসলে, বাবা হলে বুঝতে পারবেন। গতকাল রাতটা ছিলো আমার জন্য শকিং।’
এবার একটু হাসে রায়হানও, ‘আপনার মেয়ে একটা সমস্যায় আছে। যতই ঝামেলার হোক, যতই অস্বস্তির হোক, এই সমস্যাটা আমরা সমাধান করব। কিন্তু সেজন্য আপনাকে শক্ত হতে হবে।’

মোস্তফা কামাল এই স্বল্প পরিচিত যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকেন এক মুহূর্তের জন্য। নেহায়েতই তরুণ একজন মানুষ। জাহিদের চেয়ে দশ বছরের বড়ও হবে না। সুদর্শন বলা চলে একে অনায়াসে। তবে সেটা নয় – যে কারণে এই ছেলেকে ঈপ্সিতার কেসটা দিয়েছেন তিনি, সেটা এর চোখ।

ছেলেটা জানে তার কোন অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট নেই, তবুও সে যে কাজটা করেছে তাকে অনেকটা জীবনে মেডিকেল কলেজে না গিয়ে ক্লিনিক খুলে ডক্টর হিসেবে বসার মত বলা চলে। তার পরও তার পসার হয়েছে যথেষ্ট। তিন দিনের জন্য সে ত্রিশ হাজার দাবী করে নিঃসংকোচে। পুলিশ যখন কোন অপরাধীকে ধাওয়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায় এর কাছেই তারা আসে। সাসপেক্টের নেক্সট মুভ এই ছেলে অনায়াসে বলে দেয়।
এই সাফল্যের পেছনে আছে ওই চোখ দুটো। ওখানে জ্বল জ্বল করছে আত্মবিশ্বাস। এ জানে কোনদিন পরাজিত হবে না সে। এবং সম্ভবতঃ এখন পর্যন্ত হয়ওনি।

এই মুহূর্তে ওই চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়, আসলেই মেয়ের সমস্যা তেমন কিছু তো নয়! দুইজনে একসাথে কাজ করলে কি এর সমাধান করা যাবে না?

মৃদু কণ্ঠে মোস্তফা কামাল শুধু বললেন, ‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মি. রায়হান। ঈপ্সিতার মেন্টাল সাপোর্ট দরকার। আর আপনাকে সে জিনিস দিতে হচ্ছে তার বাবাকে। আমি দুঃখিত। এরপর থেকে বাস্তববাদী আচরণই পাবেন আমার কাছ থেকে।’

পরিবেশ হাল্কা হয়ে যেতে রায়হান হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। খাওয়ার ব্যাপারে দুইজনই মন দিতে পারে এবার।
সুযোগটা দেখতে পেয়ে ছাড়ে না ও, দৃঢ় গলাতে বলে, ‘আপনাদের পারিবারিক ডায়েরিটা আমাকে পড়তে হবে। রাত ছাড়া ঈপ্সিতা কিছু করবে না। কাজেই দিনের বেলাটা সময় পাচ্ছি। রুদ্রপ্রতাপ সম্পর্কে ভালোমত না জানতে পারলে আমার কিছুই করার থাকবে না। ঈপ্সিতা তাকে দিয়ে ভয়াবহভাবে প্রভাবিত।’
শান্তভাবে পানি খেলেন মোস্তফা কামাল, ‘আমি দুঃখিত। ডায়েরিটা আপনাকে দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। আমাকে প্রশ্ন করবেন। আমি আপনাকে জানিয়ে দেবো যা জানতে চান।’

রায়হান এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। প্রচণ্ড রাগে চোখ কুঁচকে উঠেছে ওর। এই লোক কি পারিবারিক ইতিহাস লুকিয়ে রাখার জন্য নিজের অসহায় মেয়েটির চিকিৎসাতেও অসহযোগিতা করবে নাকি? প্রাচীন ইতিহাস গোপন করা তার কাছে বেশি জরুরী নাকি বর্তমান সময়ের নিজের সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষা?

‘আমার ডায়েরিটা দরকার।’
‘আপনাকে আমি অযথা হয়রানি করছি না, মি. রায়হান।’ মোস্তফার গলা এখনও শান্ত, ‘ডায়েরিটা আমার কাছে গত কয়েক মাস ধরেই নেই। হারিয়ে ফেলেছি।’

রায়হানের মাথা যেভাবে হুট করে গরম হয়ে গেছিলো – সেভাবেই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মিথ্যে বলছেন মোস্তফা কামাল? চুরি হয়ে গেলে আগের বার কেন উল্লেখ করেননি?

মোস্তফা সাহেবের চেহারাতে অবশ্য শঠতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অসহায় একটা অনুভূতির ছাপ ওখানে। সম্ভবতঃ এই মুহূর্তে ডায়েরিটা দিতে পারলে রায়হানের তথা তাঁর মেয়ের কাজে আসতো। দিতে না পারার কারণে তিনি দুঃখিত?

নাকি ডায়েরি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করার পরও বার বার রায়হান ওটা চাইছে দেখে অসহায় লাগছে তাঁর নিজেকে?

কোন একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারে না রায়হান। তবে আপাতত এই তথ্যটিকে সত্য ধরেই এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল সে। মাথা দোলাল নিজের অজান্তেই।

‘চমৎকার। খেয়ে চলুন বের হই। আপনাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি দেখা যাক। সেই সাথে ডায়েরির যা মনে আছে – আমাকে শোনাবেন।’

৮.
তবে বের হতে হতে বিকেল হয়ে গেলো।

ডক থেকে জরুরী ভিত্তিতে ফোন এসেছিলো। কাজেই নাকে মুখে নাস্তাটা ঠেসে ছুটতে হয়েছিলো কামালসাহেবকে। দুপুরে খাওয়ার পর রোদের তেজ কমে আসার জন্য ঘণ্টাদুয়েক অপেক্ষা করেছে ওরা। জমিদার রুদ্রপ্রতাপ রায়ের সম্পত্তির পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। রোদে রোদে ঘুরে দেখতে হলে বাষ্প হয়ে যেতে হবে।

শহরের শেষ প্রান্তে ওদের এলাকাটা। এখনও মফস্বলের কাতার থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি পুরোপুরি। দূরে শুধুই পাহাড় আর পাহাড়। এদিকটাতেও টিলার অভাব নেই। মাটি এখানে পাথুরে। শক্ত মাটির সাথে পাকা রাস্তার তেমন কোন পার্থক্য নেই।

দূরের পাহাড়গুলর মাথায় থাকা গাছগুলোর গোড়া কোনটার কোথায় – বোঝার বৃথা চেষ্টা করল রায়হান। অন্যপাশে সমুদ্রের দিকে তাকায় চোখ কুঁচকে। সূর্য ওই বিশাল জলাধারে ডুব মারতে যাচ্ছে। রায়হানের প্রিয় দুটো প্রাকৃতিক উপহার এই সমুদ্র আর ওই পাহাড়। সেই সাথে চলছে প্রিয় বিষয় সাইকোলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন।

এই মুহূর্তে মন মেজাজ খাসা হয়ে আছে। মোস্তফা কামালের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল হুট করে। এ বাড়িতে আসার পর থেকে সিগারেট তেমন খাওয়া হয়নি।

‘রুদ্রপ্রতাপ রায়ের ইতিহাসে রক্ত আর প্রজাদের চোখের পানির পরিমাণটাই বেশি। একটা ব্যাপার জেনে অবাক হবেন, একবার এই জমিদার প্রজাসংকটে পড়ে গেছিলেন।’ নাক কুঁচকে ফেললেন মোস্তফা কামাল সিগারেটের ধোঁয়া নিজের দিকে আসতে দেখে, ‘কয়েক বছরে এত পরিমাণ নরহত্যা চালিয়েছিলেন তিনি, চাষবাসের জন্য প্রজা পাওয়া যাচ্ছিলো না।’
‘এই সমস্যার সমাধান কিভাবে হল?’ চোখ কুঁচকেছে রায়হানেরও, তবে প্রবল বাতাসে। সিল্ক সুতোর মত উড়ছে চুল।
‘তাঁর এলাকাতে যত নারীপ্রজা ছিলো তাদের মাঝে পুরুষালি বৈশিষ্ট্য যাদের আছে – তাদের বেছে নিলেন তিনি। পুরুষের সমান মাঠে খাটতে বাধ্য করলেন নিজের বাহিনীকে দিয়ে।’
‘এমনটাই ভেবেছিলাম।’ মুখ বাঁকায় রায়হান, এই জমিদারের ব্যাপারে যতই শুনছে ততই বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে ওর।

‘আরেকটা দিক ছিলো ডায়েরীতে।’ বলে চললেন মোস্তফা কামাল, ‘তিনি নিজের বাদে আর সব ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন। গোঁড়া হিন্দু ছিলেন তিনি। দেবতাদের সবাইকে না মানলেও কারও কারও প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ছিলো নজর কাড়ার মত।’
‘এলাকাতে অন্য ধর্মের কারা ছিলো?’
‘মুসলমান ছিলো কিছু। ওই যে ওই দিকে।’ হাত বাড়িয়ে দেখালেন মোস্তফা কামাল, ‘আর বৌদ্ধদের একটা মঠ ছিলো ওদিকে।’
‘মঠ গেছে কোথায়?’ চোখ কুঁচকে বিরানভূমিটার দিকে তাকায় রায়হান।
‘আগুন লাগিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিলেন তিনি সবাইকে। মঠের ভেতরে। তারপর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন ওটা।’
সিগারেট বাতাসের কারণে দ্রুত শেষ হয়ে গেছে, প্যাকেট থেকে আরেকটা বের করতে করতে জানতে চায় রায়হান, ‘কেন?’
‘মঠপ্রধান এই বিপুল পরিমাণ নরহত্যা দেখে বিচলিত হয়েছিলেন। নিজে এসে জমিদারবাবুকে আহ্বান জানিয়েছিলেন নৃশংসতা বন্ধের জন্য।’
তিক্ত হাসিটা ফিরে আসে রায়হানের মুখে, ‘এহেন ঔদ্ধত্য দমন করতে জমিদারবাবুর তো তৎপর হওয়ার কথা ছিলোই।’

‘মঠের চেয়ে এলাকাবাসী মুসলমানদের ভাগ্যই ভালো বলতে হয়।’
‘এঁরা জমিদারবাবুর মতিগতি বুঝে আগে থেকেই ‘ভদ্র’ হয়ে গেছিলেন নিশ্চয়?’ অনুমান করে রায়হান সিগারেটে টান দিতে দিতে।
‘ঠিক তা নয় – গোপনে কোরবানীর সময় গরু জবেহ করেছিলেন মুসলিমদের মাঝে কয়েকজন। কিভাবে জানি খবরটা চাউর হয়ে গেছিলো।’

উঁচু আরেকটি ঢিপির কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন মোস্তফা কামাল – ‘এই জায়গাটাকে বলা হত দেবীকাঠ। এখানে নাকি কাঠের তৈরী একটা মঞ্চ ছিলো সে সময়। মুসলিম সেসব প্রজাদের ধরে আনেন জমিদার রুদ্রপ্রতাপ রায়। মুসলমানদের মাঝে সবাই পশু জবাইয়ে দক্ষ ছিলেন না। পাঠা বলির মত মাথা কেটে ফেলাটা তো আর ইসলাম ধর্মের নিয়ম না। গলা কাটার সময় পশুর সুবিধার্থে সর্বোচ্চ আরামের মৃত্যুর ব্যবস্থা করার কথা কোরবানীর সময়। বুড়ো এক কসাই ছিলেন মুসলিমপাড়ায় – তাকে নিয়েই পড়লেন জমিদারবাবু।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেটে লম্বা টান দেয় রায়হান। পরের ঘটনা কেমন হবে সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে।
‘বুড়ো কসাইকে উলঙ্গ করে দেবীকাঠে বাঁধেন জমিদার। একে একে দুটো পা-ই কেটে নেন বড় একটা ছুরি দিয়ে। অত্যাধিক রক্তক্ষরণে লোকটা মারা যাওয়ার আগে হাত দুটোও কেটে নেন মাংসের তালের মত করে। গোটাগ্রামবাসীকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য করা হয়েছিলো দৃশ্যটা। রক্তক্ষরণে সামান্য সময় পরই মারা যায় বুড়ো। তখন শুরু হয় জমিদারের আসল খেলা। হাড্ডি কোপানোর দা দিয়ে মৃত কসাইয়ের শরীরটা কেটে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেন তিনি। ডায়েরি লেখেছিলেন আমার দাদা – তাঁর মতে, লাশটার প্রতিটা টুকরোই ছিলো হাতের মুঠোর চেয়েও ছোট। অসংখ্য টুকরো নিজ হাতে করে দেবীকাঠের ওপর সেগুলো সাজিয়ে রাখেন তিনি। একতাল মাংসের মতো।’
‘ভয়ংকর প্রতিশোধ।’ মন্তব্য করে রায়হান।
‘শেষ হয় নি তো।’ মাথা নাড়েন মোস্তফা কামাল, ‘পুরো গ্রাম ওখানে উপস্থিত ছিলো – জমিদার বলী কাঠে দাঁড়িয়ে জানতে চান সবচেয়ে সমর্থ পুরুষদের ভেতর থেকে আটজনকে এগিয়ে আসতে। স্বাভাবিকভাবেই আটজন যোগাড় হয়ে যায়। বুড়ো কসাইয়ের মাঝবয়েসী স্ত্রীকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করতে হুকুম করেন তিনি। মহিলা গর্ভবতী ছিলো। আটজন পালাক্রমে ধর্ষণ শুরু করলে ঘণ্টা দেড়েক পর ওখানেই অত্যাধিক রক্তক্ষরণে মারা যায় মহিলা।

জমিদারের খেলা সেদিন তখনও শেষ হয় নি – কোরবানীর সাথে জড়িত থাকা আরও নয়জন পুরুষ ছিলো বলীকাঠের সাথে বাঁধা। প্রত্যেকে ভয়ে কাপড় খারাপ করে ফেলেছে। দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে আমার দাদা নাক চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাছেই।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকটা সিগারেট ধরায় রায়হান। বাংলাদেশের জমিদারদের ইতিহাসে এরকম নিষ্ঠুর জমিদারের কথা আগে সে কখনও শোনেনি। ডায়েরিটা উদ্ধার করা গেলে অবশ্যই এটা প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।

‘জমিদার এবার একজন একজন করে উলঙ্গ করলেন। তারপর আধহাতি একটি চাকু দিয়ে একজন একজন করে পুরুষাঙ্গ কাটা শুরু করেন আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর। আগের মতই আটজন করে সমর্থ পুরুষ এনে পুরুষাঙ্গ কাটা স্বামীর সামনে জমিদারের শিকারের স্ত্রী অথবা কন্যাকে ধর্ষণ করা হয় ওখানে। গ্রামবাসীরা আতংকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিলো।’

‘একেবারে ডিটেইলস মুখস্থ করে রেখেছেন। কতবার পড়েছেন?’ প্রশ্নটা করেই ফেলে রায়হান।

‘গুণিনি। শ’খানেকবার হবেই।’ নির্লজ্জের মত হাসলেন মোস্তফা কামাল, ‘যে কোন হরর বইয়ের চেয়ে ওই ডায়েরি আপনার কাছে বেশি ভয়ংকর লাগবে। কারণ ওসবই ঘটেছিলো বাস্তব জীবনে। যাই হোক, এ ঘটনার পর থেকেই মুসলমানদের প্রতি একটা আগ্রহ জন্মে আমার দাদার ভেতরে। পরে ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি।’
‘ধর্ম সম্পর্কে আপনার মতামত কি?’ রায়হান জানতে চায়।
‘আমি নাস্তিক।’ সংক্ষেপে জানালেন মোস্তফা সাহেব। একটু বিরতি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই যে, এটা হল গোলা-ঘর। গুদামও বলতে পারেন। শুনেছি ওই সময় আস্তাবল ছিলো এখানে একটা। এখন এই আধ-ধ্বংস বাড়িটাই দাঁড়িয়ে আছে।’

রায়হান ভালো করে তাকাল। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছে ওরা। এদিকে কোন বাড়ি ঘর নেই। ঘন ঘন গাছপালা চলে গেছে এখান থেকে পাহাড়ের দিকে। মোস্তফা কামালের দিকে একবার তাকায় ও, চকচকে চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি বাড়িটার দিকে। একটা প্রায় ভেঙ্গে পড়া বাড়ি। এখানে সারা বছরের খাদ্য মজুদ রাখা হত এক সময়। এখন পুনর্নির্মাণ আবশ্যক।

‘নিশ্চয় এখানেও অসংখ্য অত্যাচারের কাহিনী আছে। আমরা জানি না হয়ত, তবে আছে, নিশ্চয় আছে!’ লোভীর মত একবার তাকালেন তিনি রায়হানের দিকে।

রায়হান সতর্কভাবে তাকায় তার দিকে। ভদ্রলোকের মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না। যেরকম দৃষ্টি তার মাঝে ফুটে উঠেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে পূর্বপুরুষের আচরণ তাকে ভালোই প্রভাবিত করেছে। লোকটা কি ছুরি-টুরি নিয়ে বের হয়েছে নাকি? রায়হানকে এতদূরে নিয়ে এসেছে কেন? এখানে নিজেকে রুদ্রপ্রতাপের মত খেলিয়ে দেখতে চায়?

মোস্তফা কামাল চকচকে চোখে আরেকবার রায়হানকে দেখে একধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন। ভেতরের অবস্থা বাইরের মতই করুণ। পেছনের দিকের দেওয়ালের বড় একটা অংশ তো ধ্বসেই পড়েছে। স্মাগলারদের জন্য স্বর্গ হতে পারে। বর্ডারও তো মাত্র ছিয়াশি কিলোমিটার দূরে!

বাইরের আকাশে আরেকবার চোখ বোলায় রায়হান। রাত প্রায় নেমে এসেছে। গোধূলির আলো চারপাশে। এসময় একজন মুড ডিজঅর্ডার সাবজেক্টের সাথে পরিত্যক্ত গোলাঘরে ঢুকে পড়াটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে সেটা ভেবে দেখল। খুব একটা নয়।

তবে উপায় কী? এই চরিত্রটিকে চূড়ান্তভাবে জানার জন্য কাজটা করতেই হবে ওকে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে সিগারেটটা ফেলে দেয় রায়হান।

মোস্তফা সাহেব মাথা ঘুরিয়ে ডাক দিয়েছেন, ‘কই আসুন?’
এর পরে আর দাঁড়িয়ে থাকা চলে না।

ভেতরে অন্ধকার বেশ। কালিগোলা। চৌবাচ্চায় দুই পিঁপে আলকাতরা ছুঁড়ে মারার মতো। এই আধবুড়ো লোকের মাথায় কি ধরনের সমস্যা থাকলে সে এই অন্ধকার এক পুরোনো গোলাবাড়িতে ঢুকতে পারে? অন্তত সাপের ভয় তো থাকা উচিত।

মুখ ফুটে কথাটা বলতে যাবে ও মোস্তফা কামালকে – ঠিক তখনই হোঁচট খেলেন তিনি। তারপর সড়াৎ-জাতীয় একটা শব্দের সাথে সাথে দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়লেন।

দ্রুত তার দিকে এগুতে যাবে রায়হান – পা পিছলে গেল তারও। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পায় নি ও – কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলো, পা কিসে পিছলেছে।
রক্ত!
মানুষের রক্ত!

গুঙিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছেন মোস্তফা কামাল – রায়হান পকেট থেকে মোবাইলটা দ্রুত বের করল। পিছলে গেলেও মাটিতে আছড়ে ও পড়েনি। ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালিয়েছে কাঁপা হাতে।

আলোটা প্রথমে পড়ল যোবাইদার বিস্ফোরিত দুই চোখের ওপর। তারপর কেটে আলাদা করে ফেলা স্তনদুটোতে সরে আসে আলো। রক্তে গোলাঘরের মেঝে একেবারে ভিজে চুপসে আছে এদিকটা।

হেঁচকি তোলার মত একটা শব্দ করে বমি করে দিলেন মোস্তফা কামাল।

৯.
বুম বুম বুম।

দ্বিতীয়বার দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিলেও কেউ খুলে দিলো না। মোস্তফা কামালের চেহারা হয়েছে দেখার মত। কাতল মাছের মত হাঁফাচ্ছেন তিনি। একটু আগে অতি সাহসী আর যন্ত্রণার রসালো বর্ণনা দিতে থাকা মানুষটা সত্যিকারের নৃশংসতার একটিমাত্র দৃশ্য দেখেই চুপসে গেছেন।

বাড়িটাতে এখনও সব জায়গাতে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়া হয়নি। কলিংবেল এখনও বসাতে পারেননি। দরজার ওপরের কড়া আবার জোরে জোরে নাড়েন মোস্তফা কামাল।

গোলাঘরের লাশটা আবিষ্কারের পর প্রথম যে কাজটি রায়হান করেছে তা হল – টেনেহিঁচরে ওখান থেকে ভদ্রলোককে বের করে এনেছে। তারপর গোলাঘর থেকে সরেও এসেছে যত দূরে পারে, খুনী অন্ধকারে ওত পেতে বসে থাকতে পারতো। না জেনে নিজেদের নিরাপত্তার ওপর ঝুঁকি নেওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।

তারপর মূল বাড়িতে ফিরে এসে পাগলের মতো দরজায় থাবাথাবি শুরু করেছে ওরা।

দরজা খুলে গেল তৃতীয় ধাক্কার পর। সব মিলিয়ে হয়ত মিনিটখানেক দেরি হয়েছে। বড় বাড়ি। এটা স্বাভাবিক সময়। কিন্তু ওদের মনে হয় কয়েক যুগ লেগে গেছে ওটা খুলতে।

জাহিদের মুখটা দেখা যায় মৃদু আলোতে, পিটপিট করে তাকিয়ে ওদের একবার দেখে সরে ঢোকার জায়গা করে দেয়। পেছনে আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগিয়ে আসছিলেন মিসেস কামাল – রায়হানকে দেখে সামলে নিলেন।

‘কি হয়েছে – তোমার এই রকম চেহারা কেন?’ রীতিমত আঁতকে উঠলেন পরের মুহূর্তেই। স্বামীপ্রবরের জামায় লেগে থাকা রক্ত দেখে ফেলেছেন।

মোস্তফা সাহেবকে একটা শব্দ উচ্চারণেরও সময় দেয় না রায়হান, বোমা ফাটানোর মত জোরালো কণ্ঠে জানতে চায়, ‘ঈপ্সিতা কোথায়?’
বিভ্রান্ত দেখায় মহিলাকে, ‘ওর ঘরেই তো ছিলো।’
‘যোবাইদার সাথে আজ বিকেলে বের হয়ে ছিলো ও?’ দ্রুত জানতে চায় ও, কপালের শিরা ফুলে উঠেছে একটা।
‘প্রতিদিনই তো বের হয়।’ সমস্যাটা কি হয়েছে এতে বুঝলেন না মিসেস কামাল। যোবাইদা ছেলেও নয় যে মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে ভাববেন।

যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে ওর। ছুটে যায় ঈপ্সিতার ঘরের দিকে।
পেছনে হাহাকার করে ওঠেন মোস্তফা কামাল, ‘যাবেন না! শেষ হয়ে যাবেন, ওদিকে যাবেন না!’

নিজের মেয়েকে কি পরিমাণ ভয় পেয়ে মানুষটা একথা বলছে বুঝতে পেরে মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর। বিন্দুমাত্র গতি না কমিয়ে ঈপ্সিতার বদ্ধ ঘরের দরজাতে ধাক্কা দেয় ও।
ভেজানো ছিলো। ভেতর থেকে ছিটকিনি তোলা ছিলো না। হা হয়ে খুলে যায় দরজাটা। মুখ ঘুরিয়ে পড়ার টেবিল থেকে ওর দিকে তাকায় মেয়েটা। চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।

‘আপনাকে বলেছিলাম – আর কখনও আমাকে প্রশ্ন করতে আসবেন না।’ চোখ পাকায় সে।
গায়েই মাখে না রায়হান, হুংকার দিয়ে ওঠে, ‘বিকেলে কোথায় ছিলে তুমি?’
‘তা দিয়ে তোমার দরকার কি?’ আচমকা গম্ভীর হয়ে ওঠে মেয়েটা। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলো সে।

পেছন থেকে ওকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়েছেন মিসেস কামাল, মেয়ের দিকে ছুটে যান তিনি, ‘কোথায় ছিলে তুমি?’
মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঈপ্সিতা, ‘আম্মু দেখো, ভদ্র মেয়ের মত হোমওয়ার্ক করছি না আমি? ওই লোকটাকে সরাও তো এখান থেকে। অসহ্য লাগছে আমার ওকে।’

আস্তে করে বের হয়ে যায় রায়হান। এখানে থেকে এখন কোন লাভ হবে না। হয়ত মেয়েটা কিছু জানেই না। সত্ত্বার পরিবর্তনের সাথে সাথে সবকিছু ভুলে যায় ও। অথবা, জেনে শুনেও না বোঝার ভান করছে!
মনে মনে শুধু মেয়েটাকে বলল ও, ‘যতই চালাক হও তুমি, বিচ্ছু মেয়ে! কাল রাতের মাঝেই এর সমাধান করে তারপর এই বাড়ি থেকে বের হবো আমি।’

*
আধশোয়া হয়ে নিজের ডায়েরিটা খুলেছে রায়হান – দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিলো জাহিদ।

‘রায়হান ভাই, আপনি নাকি রাতে খাবেন না? আরেকবার ভেবে বলেন। আম্মু পাঠালো জানার জন্য।’
হাসে রায়হান ছেলেটার দিকে তাকিয়ে, ‘ধন্যবাদ তোমাদের। আসলেই খাবো না। খিদে নেই।’
জাহিদ ভেতরে ঢুকে পড়ে, ‘এগুলো রাখেন। কারেন্ট গেলে কাজে দেবে।’

মোমবাতির মত কিন্তু কাঠের দুটো জিনিস টেবিলে নামিয়ে রাখে ও। অবাক হয় রায়হান, ‘আগুন জ্বলবে কিসে?’
লাইটারটা বের করে মুখের কাছে ধরতেই আগুন জ্বলে ওঠে ওপরে, ঝকঝকে হাসি দেয় জাহিদ, ‘টেকনিকটা আমাদের বিজ্ঞান স্যারের শেখানো। দাহ্য কেমিকেল আছে ভেতরে। ওটাই জ্বলে। তারপর শেষ হয়ে গেলে রিফিল করে নেওয়া যায়।’
‘কাঠে আগুণ ধরে না কেন?’
‘অদাহ্য পদার্থের প্রলাপ আছে ওখানে। জটিল ব্যাপার স্যাপার। ক্লাসে বসে তিনদিন চেষ্টা করে দুটো করে বানিয়েছি আমরা।’

দেশের এই কোণে এমন অভিনব বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হচ্ছে জেনে মন ভালো হয়ে গেল রায়হানের। বাংলাদেশে স্কুল লেভেল থেকে প্র্যাকটিকাল শিক্ষাটা হওয়া প্রয়োজন। বই পড়ে পড়ে ছাইপাশ বিদ্যে অর্জনে দেশের বা জাতির কোন উন্নতি ঘটার প্রশ্নই আসে না।

মোস্তফা কামাল ঢুকলে এসময় ঘরে। বাবার দিকে একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় জাহিদ।

মোস্তফা সাহেবও বলে দিলেন এর ফাঁকে, ‘বেশি রাত জেগো না, জাহিদ।’

জাহিদকে যোবাইদার কথা জানানো হয় নি। আড়ালে ডেকে শুধু রাইসাকে বলেছেন মোস্তফা সাহেব। সব শুনে সিঁটিয়ে গেছেন মহিলা। রাতে না খাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে রায়হান। তবে মোস্তফা সাহেবকে ডেকে পাঠিয়েছে খাওয়া হয়ে গেলে।

এই মুহূর্তে খাটে আয়েশ করে বসলেন তিনি। মুখে এখনও রঙ ফিরে আসে নি।
অনুমতির তোয়াক্কা না করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলে রায়হান। মোস্তফা কামাল কিছু বললেন না। ভাষা ইনি হারিয়েছেন।

‘আমার মেয়েটা কি এরকম দানব হয়েই থাকবে, মি. রায়হান?’ একেবারেই ভেঙ্গে পড়া একজন মানুষের মত মনে হয় তাঁকে এই মুহূর্তে।
‘আপনার মেয়ের সমস্যাটা আমি ধরতে পেরেছি খুব সম্ভব।’ ধীরে ধীরে বলে রায়হান, ‘মন্দের ভালো নয়। বেচারির কপাল মন্দ। সিজোফ্রেনিয়াতেই আক্রান্ত হয়েছে সে।’
‘রুদ্রপ্রতাপ বলে কাওকে দেখতে পাচ্ছে, তার কথা শুনতে পাচ্ছে তাহলে আমার মেয়ে।’ চোখ বড় বড় করে ফেলেন মোস্তফা সাহেব।
‘শুধু তাই নয়, নিজেকে সক্ষম একজন নারী বলে মনে করছে সে। নিয়মিত তার কল্পনার সাথে যৌনমিলন ঘটাচ্ছে।’ বাবার সামনে মেয়েকে নিয়ে এভাবে বলতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই রায়হানের, বলে যায় ও, ‘রুদ্রপ্রতাপ রায়ের চুরি হয়ে যাওয়া ডায়েরিটা আপনার মেয়ের ঘরের কোথাও আছে – এ ব্যাপারে দুইশভাগ নিশ্চিত হতে পারেন। মেয়েটি ওই ডায়েরি চুরি করে নিয়ে পড়েছে। তারপর সেখানে লেখা কথাগুলো তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। যে মেয়ের বয়েস মাত্র এগারো তাকে ওরকম কথা প্রভাবিত করবেই। আপনার মত বয়স্ক লোককেও প্রভাবিত করতে পেরেছে সেটা। তাছাড়া যতটা বুঝতে পেরেছি বেশ রসিয়ে রসিয়ে ঘটনাগুলো লিখেছেন আপনার দাদা।’

প্রতিবাদ করলেন না মোস্তফা কামাল। রায়হান বোঝে ওর অনুমান এক্ষেত্রেও সত্য হতে যাচ্ছে।

‘কাজেই – ঈপ্সিতা লক্ষ্য করল, ডায়েরির সাথে একটা বিষয়ে তার মিল আছে। রুদ্রপ্রতাপ দশ থেকে বারো বছরের সুন্দরী মেয়ে পেলে তার সাথে সঙ্গম করেই ছাড়তেন। তখন একজন পূর্ণবয়স্কা নারীকে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করতেন, কন্যাসন্তানের মাকে। কারণ, আপনিই বলেছেন – ডায়েরি অনুযায়ী ওটাই ছিলো জমিদারবাবুর রুচি। বিষয়টা ঈপ্সিতাকে আকৃষ্ট করলো।’

মোস্তফা কামাল হাল্কা হাল্কা কাঁপছেন। গোটা বিষয়টাই তাঁর কাছে দুঃস্বপ্নের মত লাগছে।
সিগারেটের গোড়ায় বার দুয়েক জোরে টান দেয় রায়হান।

‘ঈপ্সিতা রুদ্রকে তার কাল্পনিক প্রেমিক বানিয়ে ফেলে। রাত হলেই নিজের কাল্পনিক প্রেমিকের সাথে রতিলীলাতে মেতে ওঠে সে। প্রাথমিকভাবে ব্যাপারটা এরকমই ছিলো। কিন্তু এতে করে রুদ্রপ্রতাপের ব্যাপারটা সে ঠিকমতো উপভোগ করতে পারল না। রুদ্র ছিলেন নিষ্ঠুর। নিজের সাথে নিজে সঙ্গম করলে নিষ্ঠুরতা করা যায় না। এখানেই আসল বাদল নামের কাজের ছেলেটি। আবার বলুন, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে তাকে আক্রমণ করে ঈপ্সিতা?’

‘চা বানাতে দেরী করে ফেলেছিলো ছেলেটা। ভুলে গেছিলো আসলে। রান্নাঘরে গিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে ওকে ঈপ্সিতা। আমরা গিয়ে দেখতে পাই ছুরি নিয়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে ও, তার পায়ের কাছে ছটফট করছে বাদল।’
‘নিজে সে আক্রমণ করেনি – এমনটাই তার ধারণা।’ হাল্কা ভাবে বলে রায়হান, ‘এজন্যই তার মাঝে অপরাধবোধ দেখিনি কখনও। ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন দিয়ে সে দেখেছিল তার প্রেমিক, পূর্ণবয়স্ক এক পুরুষ, রুদ্রপ্রতাপ আক্রমণ করছে তার শিকারকে। ঠিক যেভাবে রুদ্র আক্রমণ করেছিলো তার প্রজাদের। কাজের ছেলেটির পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার পেছনে একটাই যুক্তি – আপনার ডায়েরি মেয়েটির হাতে আছে।’
‘তাহলে, নিজেকে রুদ্রের প্রেমিকা মনে করছে ও। রুদ্র চরিত্রটাকে বাস্তব করে তোলার জন্য সে যা করেছে তা নিজেই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে?’
‘কিন্তু -’ মোস্তফা কামালকে সায় দেয় রায়হান, ‘-সে নিজেও জানে না কাজগুলো তার করা। ও দেখতে পায় রুদ্র ছুরি তুলছে। রুদ্র আক্রমণ করছে।’
শুনতেই পেলেন না যেন মোস্তফা, ‘রুদ্রের কাছাকাছি নিয়ে গেছে সে তার কাল্পনিক মানুষটিকে। বয়েসে তার চেয়ে বড় যোবাইদাকে ভিক্টিম বানিয়েছে গোলাঘরে। নির্ঘাত তখন তার মনে হয়েছে জমিদারবাবু তার সাথে যৌনসঙ্গমের ফাঁকে পূর্ণবয়স্ক যোবায়দাকে হত্যা করেছে?’
‘এক্স্যক্টলি।’ মাথা দোলায় রায়হান।
‘এর সমাধান কি, মি. রায়হান?’ প্রায় ফিস ফিস করে জানতে চাইলেন মোস্তফা।

‘অবশ্যই – মেয়েটির কাছ থেকে ডায়েরিটা উদ্ধার করা। তবে সেটা আগামীকালের কাজ। আজ রাতে আমরা আবার চোখ রাখবো ঈপ্সিতার ওপর।’
‘আমরা? গতকাল আমাকে স্টাডিরুমে বসিয়ে রেখেছিলেন।’ মুখ বাঁকান তিনি।
‘গতকালের মত অদ্ভুতভাবে জ্ঞান হারাতে আমি চাই না। আমি চাই আজ আপনি আমার দিকে একটা চোখ রাখবেন। তবে একটু দূরে থেকে। ডাইনিং রুম থেকে চেষ্টা চরিত্র করলে তো ঈপ্পির দরজাটা দেখা যায়। ওখানেই থাকবেন আপনি। আমি হুঁশ হারালে আপনি ইন করবেন। সারা রাত অবজার্ভে রাখতে হবে ওকে। ’

এক মুহূর্ত ভাবলেন মোস্তফা কামাল, তারপর মাথা ঝাঁকালেন, ‘ফাইন।’

১০.
ভদ্রলোককে তার পজিশন বুঝিয়ে দিয়ে ঈপ্সিতার ঘরের কাছে চলে আসে রায়হান। দরজা আজকেও ভেতর থেকে বন্ধ। পেরিস্কোপটা ভেন্টিলেটরের ওপরে জায়গা মত লাগায় ও চেয়ারে দাঁড়িয়ে। তারপর চোখ রাখে আবারও।

গতকালের মতই শান্ত মেয়ের মত ঘুমুচ্ছে মেয়েটা। বুকের কাছে তার প্রিয় পুতুলটাকে ধরে রেখেছে।

দৃশ্যটা দেখে মন খারাপ হয়ে যায় রায়হানের। মেয়েটা নিজেও জানে না তার জীবনটা স্বাভাবিক নয়। ও জানে না সে এমন কিছু দেখতে পায় যার কোন বাস্তবতা নেই। চোখের সামনে সে একটা মানুষকে দেখতে পায়, তাকে স্পর্শ করতে পারে, তাকে আদর করতে পারে, তার সাথে কথাবার্তা বলতে পারে – অথচ তার কোন অস্তিত্বই নেই – এটা সে কিভাবে মেনে নেবে?
রায়হান জানে তাকে সব কিছু খুলে বলা হলেও সে মেনে নেবে না। এখন মোস্তফা কামালকে যদি বলা হয়, ‘আপনার জীবনে কোনদিনও রাইসা বলে কেউ আসে নি। ছেলে মেয়েগুলো আপনার নয়, আপনি তাদের কল্পনা করে এসেছেন আজীবন।’
মোস্তফা নিঃসন্দেহে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। একই ব্যাপার ঘটবে ঈপ্সিতাকে বোঝাতে গেলেও। কাজেই এখন তার ওপর চোখ রাখাটা দরকার।

আজকে এখানে এসেছে গতকাল অদ্ভুতভাবে জ্ঞান হারানোর ব্যাখ্যা খুঁজে পেতে।
ঈপ্সিতা কি করবে সে ব্যাপারে ধারণা হয়ে গেছে ওর। রাত তিনটের সময়ই উঠে বসবে কি না তা ও জানে না। তবে আজকেও রুদ্রকে কল্পনা করবে মেয়েটা। তার সাথে বিছানাতে বা মেঝেতে রতিক্রিয়াতে লিপ্ত হবে। তারপর বেহুঁশের মত ঘুমাবে কিছুক্ষণ। এরপর ঘোর কেটে যেতে পোশাক পরে আবার বিছানাতে ফিরবে সে।
গতকাল এটাই হয়েছে – জানে রায়হান। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। চোখে যা দেখেছে তা ভুল কিছু ছিলো না। যদিও মোস্তফা কামাল পুরোপুরি কথাগুলো বিশ্বাস করেছেন বলে মনে হয় না। তাঁকে রায়হান দোষ দেয় না। নিজের এগারো বছর বয়েসের মেয়েটির ব্যাপারে আজেবাজে কিছু ভাবার ব্যাপারে কোন বাবাই শতভাগ নিশ্চিত হতে পারবেন না।

তিনটার দিকে যতই এগিয়ে আসছে ঘড়ির কাঁটা – ততই উত্তেজনা বোধ করছে রায়হান। আজও কি আগের মতই আচরণ করবে মেয়েটা? নাকি ওকে ভুল প্রমাণ করে স্বাভাবিক একটা রাত কাটাবে সে? চোখ আটকে রাখে ও পেরিস্কোপের ডিসপ্লেতে।

তিনটা বাজলো।
নড়ল না মেয়েটা। দম বন্ধ করে তাকিয়ে থাকল রায়হান।
দুই মিনিট পেরিয়ে গেল।
তিন।

ঝট করে চোখ দুটো খুলে গেল মেয়েটার। আগের রাতের মতই স্বাভাবিকভাবে উঠে বসে ও। আগেও দেখেছে – তবুও দৃশ্যটা মেরুদণ্ড শীতল করে দেয় রায়হানের।
মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করে না মেয়েটা – সোজা হেঁটে যায় টেবিলের দিকে। তারপর এগিয়ে আসতে থাকে দরজার দিকে।
পিলে চমকে গেছে রায়হানের – মেয়েটা ঘুম থেকে উঠেই এভাবে বের হয়ে আসতে চাইবে – এটা তার মাথাতে একবারের জন্যও আসে নি।
সরে যাওয়ার সুযোগ ও পায় না – খট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ পায়। নিজের জায়গাতে জমে যায় রায়হান।

এলোমেলো চুলে হেঁটে বের হয়েছে ঈপ্সিতা, এই ঘুম ঘুম অবস্থাতেও পরীর মত লাগছে মেয়েটাকে।
‘আড়াল থেকে নজর রাখছিলেন!’ ফেটে পড়ে মেয়েটা।
সাবধানে এক পা পিছিয়ে যায় রায়হান, ঈপ্সিতার রুদ্রমূর্তি নয়, তার হাতের ছুরিটা দেখে পেছানো ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না ওর।

ছুরিটা সামনে তুলে ধরে না মেয়েটা । আলগোছে ধরে আছে এমনভাবে – বোঝা যায়, আগেও ব্যবহার করেছে অস্ত্রটা এই মেয়ে।
‘ঈপ্সিতা, তুমি ঘুমের ঘোরে আছো।’ শান্ত কণ্ঠে বলে রায়হান, কে জানতো টেবিলে একটা ছুরি লুকিয়ে রেখেছে এ?
চোখ জ্বলে ওঠে ওর, ‘নজর রাখার জন্য তোমাকে ফল পেতে হবে, রায়হান!’
‘আজ বিকেলে যোবাইদাকে খুন করেছো কেন?’ সরাসরি প্রশ্ন করে রায়হান।

মেয়েটা চমকে গেছে।
থমকে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে পড়ল ও, ‘আমি কাওকে খুন করিনি।’
‘প্রথমে বাদল। পরে যোবাইদা।’ মেপে মেপে শব্দ গুলো উচ্চারণ করে রায়হান।
বিস্ময়ের ভাব ফুটে ওঠে ওর মুখে, ‘আমি তো ওদের ছুঁইনি।’
‘তবে কি রুদ্র করেছে খুনগুলো?’ ঠাণ্ডা গলাতে জানতে চায় রায়হান, জানে উত্তরটা কি হবে।

ঝাঁঝিয়ে ওঠে মেয়েটা, ‘রুদ্র তার কাজের জন্য কাওকে জবাব দিতে বাধ্য না। তোরা সবাই ওর কুকুর। পোষা কুকুর। কথাটা মনে রাখবি!’

চোখ সরায় না রায়হান, কড়া করে তাকায় মেয়েটার দিকে। ঈপ্সিতাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে সরাসরি। এবার গলার সুরটাই পাল্টে যায় ওর, ‘আমাকে বিছানায় নিয়ে যাবি তুই এখন। সুখ দিবি। যেভাবে দিতো রুদ্র। তোর জন্যই আজকে আমার কাছে আসতে পারেনি ও। চল, ঘরের ভেতরে চল। আমার জামা খুলবি।’

রায়হান থমকে গেছে একেবারে। শরীরের প্রতিটা পেশী প্রস্তুত একটা আক্রমণের জন্য। যে কোন সময় ছুরি চালাবে মেয়েটা। আর কেটে নিতে চেষ্টা করবে ওর পুরুষাঙ্গ। এটুকু বুঝতে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই! সরে যাওয়ার সময় নেই, এখনও ঈপ্সিতার নাগালের ভেতরেই আছে সে। ওরকম মতলব টের পেলেই হামলা করতে পারে মেয়েটা।

বাদলকেও কি একই প্রস্তাব দিয়েছিলো মেয়েটা?
বাদল কি জবাব দিয়েছিলো?
“হ্যাঁ” বলায় আক্রমণ করেছিল ঈপ্সিতা?
নাকি “না” বলায়?

রায়হান আর কিছু ভাবার সময় পায় না। ডাইনিং রুমের অপর প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন মোস্তফা কামাল। মেয়ের প্রতিটা কথা কানে গেছে তার। রায়হানের প্রতি যেটুকু অবিশ্বাস ছিলো – সবটুকু সরে গেছে তাঁর ভেতর থেকে।

‘হারামজাদী! তোর মুখ থেকে এধরনের কথা কিভাবে বের হল?’ ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে হুংকার ছাড়েন তিনি।
সমান তেজে জবাব দেয় ঈপ্সিতা, ‘তুই চুপ থাক, কুত্তার বাচ্চা!’
‘ঈপ্সিতা!’ মোস্তফা কামালের চিৎকার বোধহয় ছাদ উড়ে যাবে, ‘মুখ সামলিয়ে কথা বল তুই! আমি তোর বাবা!’

দূরে খটাখট আরও দুটো দরজা খুলে যায়। ঘুম ঘুম চোখে বের হয়ে আসেন মিসেস কামাল আর জাহিদ।
ছুরি নিয়ে ঈপ্সিতার একক প্রদর্শনী দেখে প্রত্যেকেরই ঘুম ছুটে যায়। ছুটে আসছে ওরা। ঈপ্সিতার নাম ধরে ডাকছে। বার বার বলছে ছুরিটা ফেলে দিতে।
মেয়েটার মনোযোগ সরে যেতেই দুই পায়ের সব শক্তি একত্র করে দৌড় দেয় রায়হান – ঝড়ের বেগে সরে গেছে ঈপ্সিতার নাগালের বাইরে।

ছুটতে ছুটতেই চিৎকার দেয় ও, ‘জাহিদ, মাই বয়, বোনের হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নাও তো। সবাইকে নিয়ে ড্রইং রুমে বস। ঈপ্সিতার ছুরি সরানো হলে আমাকে ডাক দেবে! কেসটার সমাধান করে ফেলেছি আমি।’

সামনে যে ঘরটা পেলো তাতে বুলেটের মত সেঁধিয়ে যায় ছেলেটা। দড়াম করে দরজা লাগিয়ে ছিটকিনি তুলে দিয়েছে।
রায়হানের গমনপথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন মোস্তফা কামাল, ছেলেটাকে অনেক কিছুই ভেবেছিলেন তিনি।

কাপুরুষ ভাবেননি।

১১.
ড্রইং রমে যখন ফিরে আসে রায়হান – প্রত্যেকের চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেছে।

ঈপ্সিতা ভদ্রসমাজে শোনার তো দূরে থাকুক – পড়ার অযোগ্য গালি গালাজ ছুড়ছে সবাইকে। বাকি সবাই চুপচাপ তা শুনছে। মেয়েটার হাত থেকে জাহিদ চাকুটা সরিয়ে নিয়েছে। কাজেই আপাতত তার গালি শোনার ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই।

মোস্তফা কামাল রায়হানকে দেখেই লাফিয়ে উঠলেন, ‘প্লিজ বলবেন এর কোন সলিউশন আছে? সমস্যাটা আমরা জানি এখন। আমাদের সলিউশন দরকার – প্লিজ!’
ঈপ্সিতা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চোখের সামনে থেকে দূর হ, বাইনচোদ!’
মিসেস কামাল কেঁদে ফেললেন।

রায়হান বসল না, দাঁড়িয়ে থেকেই মিসেস কামালের দিকে তাকায় ও। মোস্তফা কামালই বরং বসে পড়লেন দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা দেখে।
‘কান্না করার অধিকার এখানে সবার আছে। আপনার নেই, মিসেস কামাল। আপনার উচিত ছিলো আমাকে সহযোগিতা করা – সন্তানের মঙ্গল চাইলে। অথচ তথ্য লুকিয়ে রেখেছিলেন আপনি।’
মোস্তফা সাহেব অবাক হয়ে তাকাচ্ছেন দেখে তার দিকে তাকায় রায়হান, প্রথমবারের মত রীতিমত গম্ভীর এখন ও।
‘আপনার জন্য শকিং কিছু ব্যাপার জানবেন এখন, মি. কামাল। কাজেই মানসিক প্রস্তুতি নিন, আপনি ছাড়া এই সিচুয়েশনটা কেউ হ্যান্ডল করতে পারবে না।’

ঈপ্সিতাও গালি দিতে ভুলে গেছে। রায়হানের এই মূর্তিটা একেবারেই অন্যরকম। তেমন কিছুই বলে নি ও – কিন্তু ঘরের সবার ওপর একটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে হেঁটে আসে রায়হান। দুই হাত পেছনে বেঁধে রেখেছে।

‘রুদ্রপ্রতাপ রায় – আপনাদের পূর্বপুরুষ। মানুষটির জমিদারি ছিলো। সেই সাথে ছিলো নিষ্ঠুরতার ক্ষেত্রে নামডাক। এঁর ছেলে বাস্তবজীবনে নিষ্ঠুরতা পছন্দ না করলেও – কল্পনা করতে ভালো বাসতেন সেসব। এই মানুষটি হলেন আপনার দাদা, মি. কামাল। রসিয়ে রসিয়ে তা লিখেছিলেন তিনি। আর বলতে হচ্ছে, বংশগত ভাবে নিষ্ঠুরতার এই অংশটা আপনিও পেয়েছেন। আপনি বাস্তবজীবনে কাওকে নিষ্ঠুরের মত কষ্ট দেওয়ার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। তবে এসব নৃশংসতা কল্পনা করতে আপনার অসম্ভব ভালো লাগে। ঠিক যেমনটা লাগত আপনার দাদার। তিনি সেজন্য তেল-ঝাল-মশলা দিয়ে বাবার কুকীর্তির কথা লেখে গেছেন। প্রতিটা শব্দ লেখার সময় তিনি উপভোগ করেছেন বিষয়গুলো। আর আপনি উপভোগ করেছেন প্রতিটা লাইন পড়ে পড়ে।’

মিসেস কামাল একটা তেরছা দৃষ্টি দেন এবার মোস্তফা কামালের দিকে। ওদিকে রায়হান বলে চলেছে-

‘আপনার কাছ থেকে পূর্বপুরুষের ডায়েরিটা হাতছাড়া হয়ে গেলো কয়েক মাস আগে। এ বাসার কেউই চুরি করল সেটা। তার পূর্বপুরুষও রুদ্রপ্রতাপ রায় – কাজেই বিষয়টাকে ঠিক চুরি বলা চলে না অবশ্য। রুদ্রের জীবনকাহিনী খুব বেশি আকর্ষণীয় মনে হল তার কাছে। বংশধারাতে আপনার এই সন্তানও নিষ্ঠুরতার ব্যাপারটা পেয়েছেন, মি. কামাল। আপনাদের মাঝে কমন একটা মেন্টাল ডিজঅর্ডার আছে। অ্যান্টিসোশিয়াল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার।’

সবার মুখের দিকে তাকায় রায়হান, ‘অ্যান্টিসোশিয়াল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারদের একাংশকে সাইকোপ্যাথ বা সোশিওপ্যাথ বলা হয়। এরাই মানসিক রোগের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়ংকর। কারণ এদের মাঝে এমপ্যাথির ব্যাপারটাই নেই। আর সহানুভূতি না থাকলে যা হয়, একটা অন্যায় আচরণ দেখলে আপনাদের মনে অনুকম্পার সৃষ্টি হয় না। অন্যায় ভাবনাতেও আপনাদের মনের কোন ধরনের অনুশোচনা আসে না। মিসেস কামালের ব্যাপারে জানি না – তবে আপনারা তিনজনই এই বৈশিষ্ট্য পেয়েছেন।’

গুষ্টিশুদ্ধ দোষারোপ করে যাচ্ছে ভেবে রায়হানের কানেই কেমন জানি ঠেকে কথাগুলো। কিন্তু কিছু করার নেই – এখানে একটা দায়িত্ব নিয়ে এসেছে ও আর তা শেষ না করে যাবার উপায় নেই।

‘মি. কামাল শতবার ডায়েরি পড়েছেন আনন্দ পেতে। বিকৃতিরুচির একজন মানুষের ডায়েরি শতবার পড়ে আনন্দ পায় কে? আরেকজন বিকৃতরুচি। তবে যোবাইদার লাশ দেখার পর আপনার প্রতিক্রিয়া আমি দেখেছি। আপনি শুধু কল্পনাতেই নিষ্ঠুর। বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ করার মত নার্ভই আপনার নেই।’
‘কিন্তু ঈপ্সিতার আছে।’ থমথমে গলাতে বলেন মোস্তফা, ‘আগেই সব নিয়ে কথা হয়েছে আমাদের। সিজোফ্রেনিয়া আছে আমার মেয়ের। এর চিকিৎসা কিভাবে করা যেতে পারে – সেটা বলুন।’

পেছন থেকে হাত সামনে আনে রায়হান। মাঝখানে রাখা টি-টেবিলটার ওপর দড়াম করে আছড়ে ফেলে একটি পুরোনো ডায়েরি।

‘চন্দ্রপ্রতাপ রায়ের ডায়েরি।’ ঘোষণা দেয় রায়হান, ‘এই বাড়িতে একজন সিজোফ্রেনিয়ার রোগীও নেই, মি. কামাল।’
‘আপনি আজ রাতেই বলেছিলেন -’
‘আমার ভুল হয়েছিলো।’ শান্ত কণ্ঠে স্বীকার করে ও।

‘ডি আই ডি। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার। এ রোগটাও ভয়ংকর। রোগী নিজেকে দুটো বা তার চেয়ে বেশি চরিত্র হিসেবে কল্পনা করে এখানে। নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কোন মানুষ ভেবে বসে এবং সেভাবেই চালিয়ে চায় কর্মকান্ড। দেখা যাবে একজন বৃদ্ধ মানুষ নিজেকে পাশের বাসার শিশুটি মনে করছেন – এবং সেরকম আচরণই করছেন। তাকে বোঝাতে পারবেন না আপনি যে সে ঠিক ওই চরিত্রটি নয় – কারণ যখন সে একটি চরিত্রের মাঝে থাকে – অন্য চরিত্রগুলো সে হয়েছে, এমনটা মনেই করতে পারে না ও।’

‘একে তো মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বলা হত?’ ভ্রু কুঁচকে ফেলেন মোস্তফা কামাল।

‘এখন আর বলা হয় না। ডিআইডিই বলে একে। যা হোক, আপনাদের সমস্যা এখানেই। আপনার মাঝে পর্যাপ্ত নিষ্ঠুরতা না থাকলেও ডায়েরি-চোরের মাঝে ছিলো। সে বাস্তবেও প্রয়োগ করে দেখাতে পেরেছে সবকিছু – কারণ সে পরিমাণ নার্ভ ছিলো তার। যদিও তার কিছুই মনে পড়বে না এখন – কারণ, যখন ও রুদ্র হয়, তখন অন্য চরিত্রটার কথা তার মনেই থাকে না। আবার যখন যে জাহিদ হয় – সে মনে করতে পারে না কোনদিনও নিজেকে রুদ্র বলে পরিচয় দিয়েছিলো সে।’

জাহিদ এবার ভয়ানক চমকে গেছে, ‘আমি – আমি রুদ্র বলে নিজের পরিচয় দেব কেন – এসব কি বলছেন?’

ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় রায়হান, ‘ডায়েরিটা তোমার টেবিলের ড্রয়ারের ফলস বটমে পেয়েছি, জাহিদ। ঈপ্সিতা নয় – চুরিটা করেছিলে তুমি। আমাদের রোগী ঈপ্সিতা নয়, এ বাড়িতে মূল সমস্যা তোমার। রোগি নির্ণয়ে ভুল করেছি আমি প্রথমেই, রোগ নির্ণয়ে নয় – কাজেই সবকিছু ঘোলাটে মনে হচ্ছিলো। ঈপ্সিতার একটি মানসিক সমস্যা এখন হয়েছে বটে– তবে সেসবই তোমার আচরণের রেজাল্ট।’
অবাক হয়েছেন মোস্তফা কামালও, ‘ও কিভাবে -’
‘গত কয়েক মাস ধরে ডায়েরি ওর কাছে। রুদ্রপ্রতাপের চরিত্র জাহিদকে শিহরিত করে ও। চৌদ্দ বছর বয়স ওর – মানসিক অস্থিরতার জন্য সময়টা একেবারে নিখুঁত। কাজেই পা পিছলালো জাহিদ, তাছাড়া জেনেটিক কারণে ভেতরে তার নিষ্ঠুর সত্ত্বাটা লুকিয়ে ছিলোই। এবার সেটা আত্মপ্রকাশ করলো। বয়েসটা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল টান আসার – জাহিদ ডায়েরির যৌনতার অংশগুলোকে প্রাধান্য দিলো সবার প্রথমে।’

কপালে ঘাম জমেছে রায়হানের, একহাতে মুছে নেয় ও সেটা, ‘সবার সামনেই বলছি – কারণ এখন আর লুকোছাপার কারণ নেই কোন। ডায়েরি থেকে জাহিদ জেনেছে রুদ্রপ্রতাপের সদ্য বালিকা শয্যাসঙ্গীনি হিসেবে বিশেষ পছন্দ। জাহিদ নিজেকে ততদিনে রুদ্র আর জাহিদের মাঝে গুলিয়ে ফেলছে। সে নিজেও জানে না কোন সময় নিজের মাঝে আরেকটা আইডেন্টিটি তৈরী করে ফেলেছে ও – রুদ্র! আর তারপর সদ্য বালিকাকে সঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার জন্য রুদ্ররূপ একেবারে উন্মাদ হয়ে ওঠে। হাতের কাছেই সমাধান পেয়ে সেদিকেই এগিয়ে যায় জাহিদের ‘রুদ্র’ ভার্সন। ঈপ্সিতার বয়েস মেলে সেসব মেয়েদের সাথে।’

‘ওহ গড!’ বিড় বিড় করেন মোস্তফা কামাল।
‘ঈপ্সিতার বয়েস কম, মেয়েটা ভালোমত এসব বোঝেও না। জাহিদ তাকে বোঝায় সে জাহিদ নয়, সে রুদ্র। রুদ্রের হাতের মুঠোতে সব কিছু। প্রতিটা মানুষ তার পোষা কুকুরের অধম। আর মেয়েরা রুদ্রের কথামত মরতেও রাজি থাকবে – এটাই স্বাভাবিক। ঈপ্সিতার সাথে নিয়মিত সঙ্গম করতে থাকে জাহিদ।’

মুখ চেপে ধরেছেন মোস্তফা কামাল, দুই চোখে স্রেফ অবিশ্বাস।

‘মেয়েটা প্রথমে এটা একটা খেলা হিসেবেই নিয়েছিলো। ধীরে ধীরে বাচ্চাটার মস্তিষ্কে চাপ পড়ে – দিনের বেলাতে জাহিদকে জাহিদ, নিজের ভাই হিসেবে দেখতে পায়। রাত হলেই জাহিদকে সে ‘রুদ্র’ নামে চেনে। ফলে বাস্তবতা আর কল্পনার মাঝে হারিয়ে যেতে শুরু করে ঈপ্সিতাও। কয়েক মাস ধরে নিয়মিত সঙ্গমের ফলে বিষয়টা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ততদিনে দুইজনের। কিন্তু এবার রুদ্ররূপের মনে হতে শুরু করে – কিছু একটা মিসিং। রুদ্রপ্রতাপ রায়ের চরিত্রটা নিয়েছে সে – অথচ শুধু নারীসঙ্গের দিকেই মনোযোগ দিয়েছে।’
‘অতি সামান্য কারণে বাদলের পুরুষাঙ্গ কেটে নেয় এবার জাহিদ। রুদ্রের মত আচরণ করার প্রবণতা বেড়ে যায় ওর। ভুল সময়ে পৌঁছেছেন আপনারা – ছুরিটা তুলে নিয়ে অপরাধীর নজরে পড়ে যায় বেচারি ঈপ্সিতা। নিষ্ঠুরতার আনন্দ ওদিকে জাহিদ পেয়ে গেছে ততদিনে। রতিলীলাতে নিষ্ঠুরতা আনতে পারে নি তখনও – তৃতীয় বলী সঙ্গী যোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাতের জাহিদ। ধারণা করছি – সম্ভবতঃ এই স্টেজে এসেই নিজের মায়ের সাথে অশালীন আচরণ করে বসে ও। প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়ের দুশ্চিন্তাতে তিনি ছেলের সাথে কথা বলছেন না। তবে ডিআইডির ব্যাপারে নিশ্চিত হতেই জাহিদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার কারণ আমি বুঝে ফেলি। যেটার কথা মিসেস কামাল চেপে গেছেন।’

মিসেস কামাল এবারও কোন কথা বললেন না। সন্তানের মুখ থেকে অশ্লীলতা শোনার একটা সীমা আছে । তার বাইরে কিছু শুনলে মুখ থেকে কথা বের হওয়ার কথা নয়।

‘মায়ের কাছ থেকে সাহায্য না পেয়ে যৌনসঙ্গী হিসেবে যোবাইদাকে বেছে নেয় জাহিদরূপী রুদ্র। মেয়েটা গ্রুপ সেক্সে রাজি হয় নি বলে মারধর করে রাজি করায় তাকে। সম্ভবতঃ মোটা অংকের টাকার অফারও দিয়ে থাকবে সে। এরপরে যোবাইদা ঈপ্সিতাকে নিয়ে গোলাঘরের দিকে গেলে ছুরি নিয়ে চলে আসে জাহিদও। ওরা তিনজন মিলে ওখানে যা ইচ্ছে তাই করে – তারপর যোবাইদাকে আক্রমণ করে জাহিদ – ঠিক রুদ্রের মতই। মেয়েটিকে হত্যা করে রেখে ওরা দুইজনে ফিরে আসে বাড়িতে।’

‘আমি -’ দুই হাতে চুল খামচে ধরেছেন মোস্তফা কামাল। কিছু বলতে পারলেন না।
জাহিদের মুখ মেঝের দিকে এখন। ঈপ্সিতাও চুপচাপ তাকাচ্ছে সবার দিকে। সব কথা মেয়েটা বুঝেছে বলে মনে হয় না।
আর মিসেস কামাল কাঁদছেন। রায়হান সবার দিকে তাকায় একবার।

‘রোগটা মূলতঃ জাহিদের মাঝে ছিল। তবে দিনের পর দিন তার এধরনের বিকৃত রুচির শিকার হয়ে ঈপ্সিতার ওপরও বাজে প্রভাব পড়েছে। মেয়েটা এখন জানে না সে যে পৃথিবীতে আছে তাতে এটা স্বাভাবিক নয়। ভাইবোনের সম্পর্কের ব্যাপারে গভীর ধারণা আসার আগেই একটা বড় ক্ষতি হয়ে গেছে ওর।’
‘এর উপায় কি, কিভাবে ওদের নরমাল লাইফে ফিরিয়ে আনবো আমি?’ চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি বেয়ে পড়ে মোস্তফা কামালের।
‘সাইকোলজিক্যাল থেরাপিস্টের কাজ এটা। হয়তো কগনিটিভ বিহ্যাভিয়রাল থেরাপি বা সিবিটি দেয়া লাগবে ওদের। আমি সমস্যা কোথায় ধরিয়ে দিতে পারি – তবে ভুলে যাচ্ছেন, ডাক্তার নই আমি। থেরাপিস্ট তো নই-ই। একজন স্বঘোষিত সাইক-ইনভেস্টিগেটর মাত্র।’

‘এক সেকেণ্ড – মি. রায়হান, আপনাকে তাহলে অজ্ঞান করেছিলো কে? আমি?’ প্রশ্ন করে জাহিদ শান্ত গলাতেই, ‘কিভাবে?’
‘কেমিস্ট্রিতে তুমি একজন জিনিয়াস, জাহিদ। মোমবাতির বিকল্প আবিষ্কার – বাংলাদেশের স্কুলের ক্লাস এইটের বাচ্চাদের কোন শিক্ষকই ক্লাসরূপে করতে দেবেন না, তাও তিনদিন ধরে। কাজটা তোমার নিজের করা। তোমার ঘরে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম একটু আগে – সবার বিমূঢ় ভাবটা কাজে লাগাতে হয়েছিলো। অনুমতি তুমি দিতে না আমাকে কখনই। ঘরভর্তি কেমিক্যালের মজুদ দেখে বুঝেছি – ও ব্যাপারে তোমার প্যাশন আছে। আমাকে কোনধরনের কেমিক্যালের সাহায্যে অজ্ঞান করেছ তুমি, খুব কাছে থেকে স্প্রে করে। এটাও অনুমান।’
‘চমৎকার।’ উঠে দাঁড়ায় জাহিদ, আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই এখন ওর মাঝে, ‘এই মুহূর্তে বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে এবার।’

অবাক হয়ে তার দিকে তাকান মোস্তফা কামাল, তাকে ইশারাতে কিছু বলতে মানা করে রায়হান।

শান্ত গলাতে জাহিদের উদ্দেশ্যে বলে ও, ‘তুমি মরে গেছ, রুদ্র। মরে গেছ ১৯০৩ সালে। প্রজাদের একাংশ তোমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলো, মাই ডিয়ার।’
‘আমি বাঁচতে এসেছি, মি. ইনভেস্টিগেটর।’ হাল্কা চালে হাসে জাহিদ। পেছনের পকেটে হাত দিয়েছে।

এক সেকেন্ড লেগে যায় রায়হানের ব্যপারটা বুঝতে – তবে এর মাঝেই ভাঁজ করা ছুরিটা এক ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলেছে ছেলেটা। তারপরই নাক মুখ কুঁচকে ছুটে আসতে থাকে নরকের পিশাচটা। গর্জন ছেড়েছে, ‘হারামজাদা, তোর মুখে মুখে তর্ক আমি -’

অন্যপাশের সোফা থেকে জোরে টি-টেবিলের ওপর লাথি কষালেন মিসেস কামাল – মেঝের ওপর বিশ্রী শব্দ করে পিছলে এগিয়ে এল ওটা জাহিদের গতিপথে – হাঁটুর নীচে খারাপভাবে বেঁধে গেল।

কোনমতে সরে গেছে রায়হান – বাতাসে উড়ে ওর পাশ দিয়েই চলে যায় ছেলেটা। এর মাঝেই দুর্বলভাবে কোপ বসাতে চেষ্টা করে ওর শরীরে। বাম হাতের বাহু চিরে গিয়ে টপাটপ রক্ত গড়িয়ে আসে – সেটা অগ্রাহ্য করে রায়হান এগিয়ে যায় ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে মাত্র পড়ে যাওয়া ছেলেটার দিকে।
এক লাথিতে ছুরিটা সরিয়ে দিয়েছে – ওর টুঁটি লক্ষ্য করে ঝাঁপ দেয় জাহিদ। ডান হাত মুষ্ঠিবদ্ধই ছিলো – এবার প্রকাণ্ড ঘুষিটা বসিয়ে দেয় রায়হান। মেঝেতে ফিরে গেল জাহিদ।

‘ক্লিনিকে নিয়ে যাবার আগতক বেঁধে রাখুন ওকে। সবার নিরাপত্তার জন্য এটি জরুরী।’ দম্পতির দিকে তাকিয়ে বলল ও, ‘থ্যাংকস, মিসেস কামাল।’
বাচ্চা ছেলেটাকে আঘাত করার জন্য খারাপই লাগছে ওর।

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ঈপ্সিতা ভাইয়ের দিকে, ফিস ফিস করে বলল, ‘রুদ্র! আমার রুদ্র!’

_ পরিশিষ্ট _
‘চলে যাচ্ছেন?’ বিষন্ন গলাটা শুনে তাকিয়ে মিসেস কামালকে দেখতে পায় রায়হান।
মৃদু হাসে ও, ‘তিনদিনের আল্টিমেটাম নিয়ে এসেছিলাম। এর মাঝে কাজও শেষ হয়েছে। কাজেই -’

জিনিসপত্র গুছানো হয়ে গেছে। এক হাতে তুলে নেয় রায়হান বড় ট্রাভেল ব্যাগটা।

রাইসার দিকে তাকায় ও, ‘আপনাদের জীবনটা হয়ত তছনছ করে দিয়ে গেলাম। সেজন্য দুঃখপ্রকাশ করছি না। সবকিছু ভালোর জন্যই হয়েছে।’
সামনে এগিয়ে আসে মহিলা, চোখে স্পষ্ট কৃতজ্ঞতা।
‘আপনার কাছে আমরা চিরঋণী হয়ে থাকলাম, মি. রায়হান। দুঃখপ্রকাশের কোন দরকার দেখি না।’

চোখ দিয়ে মহিলাকে মাপে রায়হান। বয়েস ত্রিশের বেশি হবে না। মোস্তফা কামাল বিয়ের সময় বয়েসের ভালো ব্যবধান রেখেছিলেন মনে হয়। বিয়ে করেছিলেন এক কিশোরীকে! সন্তানও নিয়েছিলেন ঐ বয়সেই। রুদ্রপ্রতাপ রায়ের প্রভাব কি তাঁর মাঝেও ছিলো?

কাঁধ ঝাঁকায় রায়হান নিজের অজান্তেই – হয়ত। এখন গুরুত্ব দেওয়ার মত ব্যাপার ওটা নয়।

‘একটা কথা, মিসেস -’
‘আমি বাঙ্গালী অতিথেয়তার চেয়ে ইংলিশ আতিথেয়তাকে বেশি পছন্দ করি। আমাকে মিসেস কামাল বলে ডাকবে না আশা করি। নাম ধরেই ডাকতে পারো।’ একটু হেসে রায়হানের অনুকরণ করেন তিনি।
হেসে ফেলে রায়হান, ‘ঠিক আছে, রাইসা, এসব নোংরা ছবি সরিয়ে ফেললে ভালো হয়।’ ঘরের চারপাশটা দেখিয়ে বলে ও, ‘আন্ডারএজড দুটো বাচ্চা আছে এ বাড়িতে।’
‘সরিয়ে ফেলবো।’ বিষন্নতা নেমে আসে চোখদুটোতে, ‘আরেকবার বলছি – তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই।’

পরক্ষণেই এগিয়ে আসলেন দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। দুই হাতে আলিঙ্গন করলেন রায়হানকে। ও কিছু বোঝার আগেই নিজের ঠোঁটে ভদ্রমহিলার ঠোঁট অনুভব করে। ভিজিয়ে ছেড়ে দিলেন একেবারে।

তারপর রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যান মিসেস মোস্তফা কামাল।

মিনিট দুয়েক নিজের জায়গাতে স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে থাকে রায়হান।
ঘটনার আকস্মিকতাতে হতভম্ব।
এক মুহূর্ত পরেই মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে ওঠে ওর। মহিলাটি ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। ডিজঅর্ডার এঁর মাঝেও আছে। ঠিক কি ডিজঅর্ডার সেটাই ধরতে পারছে না ও – কাজেই হাসিটা ফুটেছে।
সহজে বোঝা যায় না – এমন কোন কেস পেলে এধরনের একটা হাসিই ফুটে ওঠে আবু মোহাম্মদ রায়হানের ঠোঁটে।

এলোমেলো চুলগুলোতে একবার হাত চালিয়ে দুই হাতে ব্যাগগুলো তুলে নেয় ও। তারপর লম্বা পায়ে বেড়িয়ে যায় ঘরটা থেকে।

— ০ —

রচনাকাল : অক্টোবর ০৩, ২০১৪

ট্রিপল এ

হাঁটুর ভেতর থেকে লম্বা পিনটা খুলে ফেলার সময় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সশব্দে হাঁফাচ্ছি আমি।
মুখ থেকে লালা ঝড়ছে তীব্র ব্যাথা সহ্য করে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করার ফলে। তবুও টানতে থাকি পিনটা ধরে। অবশেষে! সড়াৎ জাতীয় একটা শব্দ করে হাঁটু থেকে খুলে গেল যন্ত্রণাদায়ক জিনিসটা।
চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তেই টের পেলাম বাম কাঁধে বসে থাকা দ্বিতীয় পিনটার অস্তিত্ব। ওহ খোদা – চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে আমার। একই সাথে ডান হাতে চেপে ধরেছি ওটাকে।
হাতে খুব একটা জোর পাচ্ছি না। পিনগুলো এমনিতেও সুবিধের নয়। চার ইঞ্চির মত হবে একেকটা লম্বায়। এসব দিয়ে আস্ত গরুকেও বসিয়ে দেওয়া যাবে। সেখানে আমার মত একজন মানবসন্তান মোচড়ামুচড়ি করছে, পিনের সাথে লড়াইয়ের চেষ্টা করছে। লড়াইটা একতরফা হতে চলেছে এখন।
এক হাত দিয়ে জোর-ই পাচ্ছি না। হাঁটুর পিন বের করার সময় বাম হাতের সাহায্য কিছুটা পেয়েছিলাম, এখন আর পাচ্ছি কোথায়?
তবুও ডান হাত দিয়ে টানাটানি করতে থাকি। এগুলোকে বের করতেই হবে।
হাঁটুর দিকে তাকাচ্ছি না ভুলেও।
রক্তগঙ্গা এখন আমার তালিকার শেষ বস্তু – যেটা দেখতে চাবো এই স্নায়বিক দুর্বলতার সময়। তবুও একবার চোখ পড়ে গেল।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাঁটুটা।
আমার হাঁটু।
আমার ডান হাঁটু!
জ্ঞান ফেরার পর প্রবৃত্তি থেকে দুটো চিন্তা মাথায় একেবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসেছিল –
১. প্রথমে হাঁটু থেকে পিন খুলে ফেলো
২. এবার কাঁধের পিনটা বের করো
তৃতীয় চিন্তাটা মাথাতে আসতেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে!
শহর জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে বেড়ানো সিরিয়াল কিলার ট্রিপল-এ কি এবার আমাকেই তার পঞ্চম ভিক্টিম হিসেবে বেছে নিয়েছে?

 

১.
কুল কুল করে ঘামছি।
ছোট একটা ঘরে বসে আছি এই মুহূর্তে। চারপাশে এক নজর দেখেই বুঝে গেছি, ঘরটা মাটির নিচে। স্রেফ কোন জানালা দেখছি না বলে এই সিদ্ধান্তে চলে এলাম এমন নয়। বাতাসটা বদ্ধ।
টলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। এখানে কিভাবে এসেছি মনে নেই। সম্ভবতঃ ট্রিপল-এ ভিক্টিমদের সেটা মনেও থাকে না। তবে যে করেই হোক এখনই এখান থেকে বের হতে হবে!
তারপর হাত-পা জমে গেল আরেকটা বিষয় মনে আসতে। বের হয়ে যেতে পারলে সম্ভবতঃ আমিই ট্রিপল-এর প্রথম ভিক্টিম, যে বেঁচে ফিরতে পারবে!
নিরাশ হলাম। এখনও দাঁড়াতে পারিনি। হাঁটুর যন্ত্রণা প্রচণ্ড কষ্ট দিচ্ছে আমাকে। দাঁড়াবার মতো যথেষ্ট পেশি কি অক্ষত আছে? জানি না। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিদ্যাদিগগজ ছিলাম না কখনও। সেই সাথে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে আছে কাঁধের ক্ষতটা।
তাছাড়া খুনি আশেপাশেই কোথাও আছে হয়ত। একটু খেয়াল হতেই ফিরে আসবে ও। এবং তার বাকি থাকা কাজটুকু শেষ করে দেবে। বেঁচে যাচ্ছি বা যাবো – এমন কিছু মনে করার কারণ দেখলাম না।
চকিতে মনে পড়ে যায়, প্রথম আঘাত যখন এই খুনি হেনেছিল, তখন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মৃতের প্রতি কি টিটকিরিই না মেরেছিলাম আমরা!
ভার্সিটি থেকে মাত্র বের হয়ে মনের সুখে সিগারেট খাচ্ছিলাম আমরা চারজন।
ছোট সার্কেল। সুখী সার্কেল।
প্রীতি আমাদের মাঝে নতুন সিগারেট খেতে শিখেছে। মেয়েটা দুই টান দেয় আর তিনবার করে কাশে।
একটা সময় বেশ বিরক্ত হয়ে সোহান বলে ফেলল, ‘বারবি ডল হয়ে সিগারেট টানতে কে বলেছিলো তোকে? জুস চুষতি, ওটাই ঠিক ছিল।’
প্রীতি একবার হাল্কা ‘ইয়াক’ শব্দ করে নাক মুখ কুঁচকে আরেকটা টান দেয়।
তারপর নীতি মেনে কেশে ফেলেছিল, আমি বললাম, ‘ধারাটা দেখো। খক খক, খক খক খক।’
রাগ করে প্রীতি সিগারেটই ছুঁড়ে মেরেছিল। এভাবে খেয়ে ওর পোষাবে না, বেশ বুঝতে পারি।
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ‘লুকিয়ে টানিস। বাসাতে প্যাকেট নিয়ে যা। অভ্যাস হলে পাবলিকলি, ওকে?’
মেয়েটা আমার দিকে একটা কৃতজ্ঞ দৃষ্টি দিয়েছিলো শুধু। তখনই কাপ পিরিচ ভাঙ্গার শব্দে চোখ ফেরাতে হয় আমাদের।
যে ছেলেটা এই মাত্র টঙের সাধারণ টেবিলটার ওপর থেকে কোমরের ধাক্কায় একটা গ্লাস আর একটা পিরিচ ফেলে দিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছে– সে আমাদের দিকে তাকিয়ে একটা ভদ্রতার হাসি হাসে। তারপর দ্রুত ভাঙ্গা গ্লাসের দেহাবশেষ তুলতে গিয়ে পাছার ধাক্কায় পেছনের কাস্টোমারের হাতের চায়ের কাপও দেয় ছলকে।
ছটফটে ছেলেটার কাণ্ড দেখে আমরা হাসলাম। এই মানুষটা আমাদের মাঝে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট।
তারেক।
হন্তদন্ত হয়ে সব সময় ছোটাছুটি সে করে না। তবে উত্তেজিত হয়ে গেলে এমনটা সে করবেই। এতদিনে আমরা তাকে যথেষ্ট চিনেছি।
কাজেই সোহান হাল্কা ভ্রু নাচালো, বাড়িয়ে দিয়েছে সিগারেট, ‘নিতম্ব সামলাও, বৎস। টান মেরে গান গাইতে শুরু করো। কিসের জন্য উত্তেজনা এত? নতুন কোন ডাউনলোড?’
বাতাসে অজ্ঞাত কাওকে খামচিয়েছিল তারেক, ‘আরে না! লিতিসার বয়ফ্রেন্ড গন!’
আমরা সবাই লাফিয়ে উঠলাম এ কথাতে।
তারেক আজকে থেকে লিতিসাকে ভালোবাসে না। সেই ক্লাস সেভেন থেকে সে এই মেয়ের প্রতি দুর্বল। এখন একেবারেই ‘অথর্ব’ হয়ে গেছে সে এই মেয়ের প্রেমে। কিন্তু সমস্যা আর সব ‘প্রেমের টান’-এর মত এখানেও ছিল।
লিতিসার একজন বয়ফ্রেন্ড আছে।
নাম জিহান , লোক খারাপ। চরিত্র একেবারেই পবিত্র।
যতটা হলে আমাদের নাক কুঁচকাতে পারতো, ঠিক ততটাই।
এবার প্রীতির গলা থেকে গদ গদ কথা বের হয়ে আসে, ‘লিতিসার ব্রেক আপ? তোর রাস্তা ক্লিয়ার?”
আমার মুখ থেকে বের হয়ে গেল, “এখনই লাফ দিসনে। দুই দিন পর এসবের প্রেম আবার উথলে ওঠে। দেখা যাবে, প্যাচ আপ করে আবার ঘুরে বেড়াচ্ছে কপোত-কপোতী। শালা ফেরত আসলে?’
শার্টের হাতা গোটাতে গিয়ে সোহান ছিঁড়েই ফেলল, ‘আসুক, এবার শালার পুতকে দুই টুকরো করে দেব না?’
বসতে গিয়ে পেছনের টেবিল কাঁপিয়ে ফেলল তারেক, তবে বড় কোন কেলেঙ্কারী না ঘটিয়েই বসতে পারলো এবার। এতক্ষণে বোমাটা ফাটালো সে।
‘শালার পুত একরকম দুই টুকরোই হয়ে গেছে। মরে পড়ে ছিলো ওদের বাগানে। কে যেন দুই হাঁটুতে আর দুই কাঁধে পিন পুঁতে দিয়েছিল। তারপর বুক ফেঁড়ে দিয়েছে। ব্যাঙদের মতো। একেবারে শেষ।’
আমাদের চা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
আমরা তিনজনই একবার করে প্রশ্নটা করি, ‘তুই শিওর?’
আমাদের প্রত্যেককে নিশ্চিত করে তারেক, ‘শতভাগ।’
প্রীতি চট করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলে এই আনন্দে, ‘আজকে সিগারেট পার্টি হবে, ব্রাদার!’
সোহান এবার উত্তেজনাতে নিজের পিরিচেই ফাটল ধরিয়ে দেয়। চায়ের কাপ নামানোর সময় হাতের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না বোকাটার।
তারপর ওদিকে তাকিয়েই বলে ফেলে, ‘একেবারে ঠিক হয়েছে। লুচ্চামির শাস্তি। কেউ না কেউ জেনে গেছিলো হয়ত চরিত্রটা কেমন ছিলো ওর।’
আমিও সায় দিলাম, ‘ঠিকই আছে, লুচ্চামির কারণে ওকে আরও ভালো শাস্তি দেওয়া তো দরকার। ফাঁসী দিতে হবে। তবে গলাতে বেঁধে নয়। লাশটা ঝোলানো যাবে এখন?’ জবাবের আশাতে তারেকের দিকে তাকালাম।
চায়ের দোকানদার মামা আমাদের দিকে তেরছা দৃষ্টি দেয়। কারও মৃত্যুতে এমন আনন্দিত মানুষ সে আগে দেখেনি মনে হয়! সে তো আর জিহানকে চেনে না!
মাথা নেড়ে আস্তে করে বলেছিলো তারেক, ‘খুশি হওয়ার কিছু নাই। লিতিসাকে খুনের সন্দেহে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।’

 

২.
তৃতীয়বারের মত হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম।
এবার একটা চেয়ারসহ পড়েছি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছিলাম ঠিক মতই। তারপর দাঁড়ানোর অযথা চেষ্টা করতে করতে একবার মাটিতে গড়িয়ে এসেছি। চারপাশটা অন্ধকার ছিল। সুস্থ স্বাভাবিক লোকের জন্যই উষ্ঠা খাওয়া স্বাভাবিক। সেখানে আমি একজন সিরিয়াল কিলারের ভিক্টিম!
দ্বিতীয়বার মাটিতে পড়িনি। একটা বাক্সের ওপর ডিগবাজি খাচ্ছিলাম বলা চলে। রক্তমাখা হাতটা দিয়ে ডালা তুলে দেখেছি, ভেতরে বিভিন্ন মাপের পিন আছে।
সাইজে তারা এমনই – এদের ঠিক গজাল বলা চলে না। পিন বললে আবার বেশি ছোট মনে হয়। ওগুলো কোন মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে ব্যবহার করা হয় সেটা বোঝার জন্য আমার কোন সুপারন্যাচারাল ক্ষমতার দরকার ছিলো না।
কাজেই, আরেকবার নিজেকে তুলে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বাইরে যেতে হবে। পুলিশে জানাতে হবে। বাঁচাতে হবে প্রাণ।
হলঘরটার মাঝে এসেই ব্যালান্স হারিয়ে হুড়মুড় করে তৃতীয়বারের মত মাটিতে ছিটকে পড়ে গেলাম। এবার সাথে একটা চেয়ার নিয়ে।
বার দুয়েক ওঠার বৃথা চেষ্টা করে পারলাম না। শুয়ে শুয়ে ছাদের কাছে পুরোনো আমলের ঝাড়বাতি দেখতে থাকি। খুনি সিরিয়াল কিলার হোক আর যাই হোক, নবাব পরিবারের বংশধর বলেই মনে হচ্ছে। হারামজাদার দাদা জমিদার ছিলো নাকি?
অত্যাধিক রক্তক্ষরণের কারণেই হয়তো, একটু বিশ্রাম পেলেই আমার মাথায় এসব হাবিজাবি চিন্তা চলে আসছে। জোর করে খুনির সাথে নবাব পরিবারের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা বাদ দিলাম।
মাথা খাটানোর চেষ্টা করছি, এখানে আমি এলাম কিভাবে? স্মৃতি সব মুছে গেছে। পরিচিত কেউ কি নিয়ে এসেছিলো? নাকি অজ্ঞান করে ট্রিপল-এ এনেছে আমাকে?
খুনিটার চেহারা মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা আমি করতে থাকি।
মানুষটা দেখতে কেমন? আমার পরিচিত?

দূরে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পাই এ সময়।
নাকি, পেলাম না?
আমার কাছে তো মনে হয়েছে কেউ শব্দ করেছে। বুটজুতো?
নড়তে গিয়ে ডান হাঁটুতে বেশি চাপ ফেলেছি বোধহয়। আবারও কুল কুল করে রক্ত বের হওয়া শুরু করেছে ওখান থেকে। দাঁতে দাঁতে চেপে গোঙ্গানিটা আটকালাম।
আরেকটুক হলেই মুখের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল ওটা।
আর এখানে, খুব কাছে দেশের সবচেয়ে ভয়ংকর খুনিটা লুকিয়ে আছে। তার জুতোর শব্দও পাচ্ছি আমি! যখন পালাবার জন্য হামাগুড়ি দিচ্ছেন, গোঙ্গানির জন্য খুব দারুণ সময় এটা নয়।
পায়ের শব্দ আরও এগিয়ে আসছে। উঠে বসার চেষ্টা করলাম। বাম কাঁধটা চির চির করে ওঠে। যেন বেশ কয়েকটা হাড় ওখানে এই মাত্র কুচি কুচি হয়ে গেল!
অনুভূতিটা আমার চেনা আছে। ফুটবল খেলতে গিয়ে একবার ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের হাড় ফাটিয়েছিলাম। অর্থাৎ আমার ডান কাঁধের হাড় ভাঙ্গে নি।
ফেটেছে।
আর প্রথমবারের মত হাল্কা গুঙ্গিয়ে ফেলেছি আমি!
সাথে সাথে ঘরের দরজাটার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে পায়ের শব্দ।
নিজের অবস্থা দেখে চোখে পানি আসার জোগাড় হয় আমার।
এক কাঁধ আর এক হাঁটু নড়াতে পারছি না, একেবারেই বাজে অবস্থা আমার। এর মাঝে দৌড়াদৌড়ি করার চেষ্টা করা উচিতই হয়নি।
তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার মনে হতে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়! আমি কোনভাবেই ট্রিপল-এর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া প্রথম ভিক্টিম নই!
এই উন্মাদ সিরিয়াল কিলারের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত কেউ বাঁচে নি।
আর সমীকরণের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমার বাঁচার কোন সম্ভাবনাও দেখি না।
তার মোডাস অপারেন্ডি বা এম.ও. এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেছে সন্দেহাতীতভাবে। দুই কাঁধে আর দুই হাঁটুতে পিন ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে হত্যা করে ট্রিপল-এ! আমার জন্য তার ‘স্পেশাল গেস্ট লিস্ট’ খুলে দেওয়া হয়েছে তা তো না।
এর অর্থ একটাই। আমার ক্ষেত্রে কাজে(!)র মাঝখানে উঠে যেতে হয়েছে বেচারাকে। এক হাঁটু আর এক কাঁধে গাঁথানোর পরই তাকে কোন দরকারে উঠে পড়তে হয়েছে। তাই এখন পর্যন্ত এখানে টিকে গেছি।
লিতিসার কথা মনে পড়ে আমার এই পর্যায়ে। মেয়েটাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে গেছিলো ঠিকই। তারপর সে বাসাতে ফিরে আসেনি আর।
ট্রিপল-এর দ্বিতীয় শিকার ছিলো লিতিসা।
খুনি কে হতে পারে, সে প্রশ্নটা নিজেকে আর করা লাগে না এবার আমার।
মনের পর্দায় কেঁপে ওঠে একটা চেহারা। মানুষটা না লিতিসাকে সেদিন থানা থেকে উদ্ধার করে আনতে গেছিলো?
তারেক?

৩.
‘জাহান্নামে যাক সবাই!’, গর্জে ওঠে সোহান।
জবাবে বিকট লাথিটা মেরে দেই আমি, টি-টেবিলের ওপরের গ্লাসটা ঘরের অন্য কোণে গিয়ে পড়ে ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে যায়!
‘লিতিসার লাশ?’ প্রীতি আরও একবার জানতে চাইলো।
মাত্রই সোহান এসে খবরটা দিয়েছে। এখনো আমরা কেউ হজম করতে পারিনি।
গর্জে ওঠে সোহান জবাবে, ‘ডেফিনিটলি! মেয়েটার শরীরে ছিলো চারটা পিন, কাঁধে দুটো এবং হাঁটুতে দুটো! এবার বোঝ!’
‘এটা কি? সিরিয়াল কিলার? একদিনে দুইজনকে …’ ফিস ফিস করে শুরু করা বাক্যটা শেষ করতে পারলো না প্রীতি।
বিকেলে আড্ডা দিতে এসেছিলাম আমরা। সোহান খবরটা নিয়ে ঢুকেছে একটু আগে। আমাদের মুড নষ্ট হয়ে গেল। প্রীতির দিকে তো একেবারেই তাকানো যাচ্ছে না। কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে তার মুখ।
সোহান আরও বাজে একটা খবর আমাদের জন্য তুলে রেখেছিল, ‘তারেককে ওরা গ্রেপ্তার করেছে। লিতিসাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সে, বিষয়টা জানতে তো আর কারো বাকি নেই। প্রথমে বয়ফ্রেন্ড তারপর লিতিসা – পুলিশ কানেকশনটা এভাবেই দেখছে।’
‘তারমানে, তাদের ধারণা, তারেক প্রথমে বয়ফ্রেন্ডকে সরিয়ে দিয়েছে, তারপর লিতিসাকে প্রপোজ করেছে বা এজাতীয় কিছু? মেয়েটা না রাজি হওয়ায় তাকেও খুন করে ফেলেছে?’ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাই আমি।
‘তাদের তাই ধারণা।’ স্থির হয়ে যায় সোহান।
দুই হাতে মুখ ঢাকে প্রীতি, ‘এটা তো সম্ভব না! তারেকের মত একটা ছেলে – কিভাবে সম্ভব? ওহ গড!’
কাঁধ ঝাকালাম আমি আর সোহান। বিষয়টা প্রীতির মত ‘ওহ গডে’ সীমাবদ্ধ রাখার মত অবস্থাতে নেই।
খতিয়ে দেখতে হবে সব ধরণের সম্ভাবনা।
মুখে কেবল বললাম, “পুলিশ সন্দেহভাজনের তালিকায় রাখার মানেই তো আর অপরাধী নয়। হতে পারে কালই তাকে ছেড়ে দেবে। সত্যিকারের খুনি ধরা পড়লেই সবটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।”
গাড়িতে করে যখন থানার দিকে যাচ্ছিলাম, সোহান জানতে চেয়েছিল, ‘পুলিশ শালারা ঘাঘু আছে। দেখা করতে না দিলে কিভাবে কথা বলবি?’
জবাবটা সরাসরি না দিয়ে আমি একটু করে মানিব্যাগটা দেখিয়ে দেই।
তারপর দুইজনে শুকনো হাসলাম। বাংলাদেশ।
সোহানের কাছে জানতে চাই, ‘তারেক কাজটা করেছে বলে কি তোর মনে হয়? মোটিভ দেখ, মেলে। এই দুইজন মারা গেলে তার লাভ আছে।’
মাথা নাড়ে অবশ্য সোহান, ‘এই এক মেয়েকে ভালোবাসার জন্য দুটো খুন করবে না তারেক। খুন করা কি মুড়ি-মুড়কি খাওয়ার মতো ব্যাপার? আমার কথা ভুলে যাচ্ছিস? লিতিসাকে আমিও তো ভালোবাসতাম? আমি কি তাই বলে খুন করে বেড়াবো এখন?’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে ফেলি, ‘আরে তুই তো আর অল্পে মাথা গরম টাইপ না।’
কথাটা বলেই গাড়ির মাঝে থমকে গেলাম।
সোহান স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। শরীর একেবারে শক্ত হয়ে থাকে ওর, যখন ড্রাইভ করে। সতর্ক শয়তান। এই মুহূর্তে ওকে দেখে একটু উদ্বিগ্ন না হয়ে পারলাম না। ছেলেটা ঠাণ্ডা মাথাতে একবার দুই বছরের সিনিয়র এক ছেলের পা ভেঙ্গে দিয়েছিল।
কেন জানি দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে বার বার। লিতিসাকে সোহানও ভালোবাসতো!
আমি কি করে ভুলে গেলাম?
থানার সামনে থেমে যেতে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্নটা আসে, ‘সোহান দৌড়াদৌড়ি করে থানাতে কেন আসছে? তৃতীয় শিকার তারেককে সরিয়ে দিতে? না তাকে সাহায্য করতে?’
উত্তরটা নিশ্চিত করে পাইনি।
এবং আমরা সেরাতে থানাতে পাই নি তারেককেও।
তার মামা এসে হাজত থেকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। প্রথমে ব্যাটার মোবাইলে, এবং তারপর বাসায় ফোন দিয়ে তাকে পেলাম না।
সোহান আমাকে বলল, ‘তুই বাসায় যাবি?’
মাথা নাড়লাম।
‘তাহলে প্রীতির বাসায় একবার যা পারলে। লিতিসার খবরটা শোনার পর কী অবস্থা হয়েছিল ওর মনে আছে? একা থাকতে দেয়া উচিত হবে না এখন ওকে।’
সোহানের কথায় যুক্তি আছে। তবে আমার মনটা খচ খচ করতে থাকে। জানতে চাইলাম, ‘তুই কী করবি?’
স্টিয়ারিংটা ধরলো সোহান, ‘গাড়িটা আছে যখন, আমি দেখি তারেককে খুঁজে পাওয়া যায় কি না!’
আমার বুক ধক ধক করছিল।
যদি তারেক খুনি হয়ে থাকে, তাহলে তার লিস্টে নিশ্চয় আছে সোহান। বন্ধুকে ‘সাবধানে থাকিস’ বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না।
কারণ, যদি সোহান খুনি হয়ে থাকে, তাহলে তার লিস্টে নিশ্চয় আছে তারেক!
প্রিয় দুই বন্ধুকেই সন্দেহের তালিকায় দেখতে ভালো লাগছিল না আমার। তবে উপায় কী? মানুষের মন তো এভাবেই কাজ করে!
প্রীতিকে অবশ্য রাতে স্বান্তনা ভালো মতই দিয়েছিলাম। ওকে সব কিছু ভোলাতে এবং নিজের মাথা থেকেও আজকের স্মৃতিগুলো দূর করার জন্য প্রথমবারের বিছানাতে উঠে এসেছিলাম আমরা।
গতকাল সারারাত ও আর আমি ছিলাম আবেশে। প্রীতি মেয়েটা এরকম তৃপ্তিদায়ক হবে জানলে আরও আগেই ওকে গার্লফ্রেন্ডের কাতারে টেনে নিতাম। বোকার মত বন্ধুত্ব করেছি এতদিন ধরে!
পরের চিন্তাটা আমাকে থমকে দেয়!
এবার সবটা মনে পড়েছে।
সবকিছুই।
প্রীতির সাথে উদ্দাম রাতের পরই আমি এখানে জেগে উঠেছি!
দুটো পিন শরীরে নিয়ে!
এখন আমি জানি ট্রিপল-এ নামের সিরিয়াল কিলারটি আসলে কে!

৪.
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে মানুষটা। আর সেই সাথে থেমে যায় তার পদশব্দ।
চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখেই চিনতে পারলাম।
শুকনো গলায় বলি, ‘হাই, দোস্ত!’
কাঁধ ঝাঁকাল সোহান, কিছু বলে না।
আমাকে পড়ে থাকতে দেখে তার চেহারার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি। যেন এমনটাই হওয়ার কথা!
সোহানের হাতের হাতুড়িটা তখনই চোখে পড়ে আমার। চকিতে ঘরের একপ্রান্তের বড় বাক্সটার দিকে তাকাই , হাতুড়ির সাথে লম্বা পিনের সম্পর্ক সবাই জানে।
শুয়ে থেকেই বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠি আমি, ‘শুরু থেকেই তাহলে তুই আর প্রীতি একসাথে কাজ করেছিস? ওহ মাই … আমি ভেবেছিলাম ট্রিপল-এ একজন মানুষ! লোন উলফ!’
কোন মন্তব্য করে না সোহান এবারও। ঠান্ডা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দরজা থেকে।
‘ওহ গড! তারেক … তারেক কোথায়?’
মুখ বাঁকায় সোহান, ‘রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে তাকে গতকাল রাতে। গেস হোয়াট? শরীরে চারটা পিন ছিলো ছেলেটার।’
মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় আমার, ‘তারমানে, তারমানে যখন আমি প্রীতির বাসাতে – আর তুই খোঁজ করার নাম করে বের হয়ে গেলি … তারেককে ঠিকই খুঁজে বের করেছিস তুই!’
একটু হাসে সোহান, ‘খুঁজে বের করতে আমি দক্ষ। দেখ, সময়মত কাওকে পাওয়া যায় না!’
ঢোক গিলি আমি, ‘কেন? লিতিসা আর জিহানের ব্যাপারটা বুঝলাম। ওদের রিলেশন ছিল। ওদের খুন করেছিস সেটাই যথেষ্ট ছিল। আবার তারেককে কেন মারতে হলো তোর? লিতিসাকে ভালোবাসে বলে?’
‘কাউকে খুন করার কথা তো মনে করতে পারি না। হয়তো করেছি, অজান্তে। তবে জানি না আসলেই করেছি কি না!’ বিড় বিড় করে বলে সোহান।
ফিস ফিস করলাম , ‘তুই … পাগল হয়ে গেছিস!’
মুচকি হাসে সোহান, ‘কথাটা আমার না। কেনেথ এরকসাইনের। তাকে মানুষ চিনতো স্টকওয়েল স্ট্র্যাংগ্লার নামে।’
আমি এবার আর কিছু বললাম না, শুনছি।
‘বেচারা এখন জেলখানায়। ৭ থেকে ১১ জনকে খুন করেছিলো এই সিরিয়াল কিলার। সবাই ছিল প্রাপ্তবয়স্ক। অ্যান্টি-সোশিয়াল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগছিলো লোকটা। সেই সাথে ছিলো সিজোফ্রেনিয়া।’
মাথা নাড়ি আমি, চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
‘হাহ!’ অবাক হয় সোহান। তোকে আরেকটা উক্তি শোনাই, ‘ “দানবটা আমার মাথাতে যখন ঢুকে গেল, আমি জানি এটা থাকতেই এসেছে! নিজেকে কিভাবে চিকিৎসা করব আমি? আমি তাকে থামাতে পারি না। দানবটা তার কাজ করেই যায়! আমাকেও কষ্ট দেয়, সমাজকেও। হয়তো তোমরা একে থামাতে পারো। আমি পারবো না!” বলেছিলো ডেনিস রেডার। একে অনেকে দ্য বিটিকে কিলার বলে থাকেন। ’
‘আই জাস্ট ক্যান্ট বিলিভ দিস! চার চারটা খুন হয়ে গেছে আর তুই আমাকে এখানে বসে বসে সাইকো কিলারদের ইতিহাস শোনাচ্ছিস? নট দ্য টাইম নর দ্য প্লেস, সোহান!’
চোখ সরু হয়ে যায় সোহানের, ‘চারটা?’
গর্জে উঠি আমি, ‘ন্যাকা আর কি? জানিস না ট্রিপল-এ চারবার হিট নিয়েছে এখন পর্যন্ত!’
‘আর কাকে মেরেছিস, রাতুল? প্রীতিকে? ওহ গড!’, হাতুড়িতে হাত শক্ত করে চেপে ধরে সোহান, ‘প্রতিটা খুন তুই করেছিস, গর্দভ! আর তোর প্রতিবারই মনে হয়েছে আর কেউ খুনগুলো করছে! ঠিক ডেনিস রেডার অথবা কেনেথ এর্কসাইনের মত!’
চোখ বাষ্পারুদ্ধ হয়ে আসে আমার, ‘না। এসব আমি করিনি।‘
সোহান কিছুই বলল না। তীব্র দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
‘মারবি তো আমাকে, মার। কিন্তু এসব বাজে কথা শোনাতে আসিস না।’
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে সোহান, দুই চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।
‘শহরের সবাই জানে তিনটা খুন হয়েছে। কিন্তু কেউ জানে না সিরিয়াল কিলারটি কে, অথবা তার নাম কি। এই মাত্র জানলাম আমাদের খুনি নিজেকে ট্রিপল-এ বলে ডাকতে পছন্দ করছে।’
চট করে নিজের হাঁটুর দিকে তাকাই। এক ফোঁটা রক্ত নেই ওখানে এখন।
নেই কোন ক্ষতও।
কাঁধের কাছটাও ঠিক হয়ে গেছে।
‘তিনজন ভিক্টিম – লিতিসা, জিহান আর তারেক। তোর মুখেই শুনলাম সিরিয়াল কিলার মহাত্মা চতুর্থ কাওকে খুন করেছে। চারটা শিকার, না?’
সোহান আমার কাছে থেকে কাছে চলে আসছে।
ডান হাতে ধরে থাকা পিন দুটো দেখলাম একবার। রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে ওরা। একটু আগেই আমার কাঁধ আর হাঁটু থেকে টেনে তুলেছি। রক্ত থাকবেই।
খুনিটার হাত থেকে বাঁচতে হবে! মাথাতে আর কিছু কাজ করে না এই মুহূর্তে!
সোহান সতর্ক পায়ে আরেকটু এগিয়ে এসেছে। হাতে তার প্রস্তুত হাতুড়ি।
চোখের পলক ফেলার আগে উঠে আসলাম আমি। একটা পিন সজোরে গাঁথিয়ে দিয়েছি সোহানের ডান কাঁধে। অপর পিনটা বুকের পাঁজর ভেদ করে ভরে দিলাম হৃৎপিণ্ড বরাবর। নিজের দ্রুতগতি দেখে এবার আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই!
সোহানের দুই চোখে ফুটে উঠেছে অবিশ্বাস। আমার দিকে বার কয়েক চোখের পাতা ফেলে দড়াম করে মাটিতে পড়ে যায় ও।
হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেছে হাতুড়ি। আমার সখের ফ্লাওয়ার ভাসটা তিন টুকরো হয়ে যায় সেই সাথে।
চারপাশে তাকিয়ে জায়গাটা আর অচেনা লাগে না। আমার বাসারই নিচের দিকে এই ঘরটা।
বিষয়টা বুঝতেই আমার ভয় কেটে গেছে। প্রাণপণে ছুটলাম বেজমেন্টের দিকে।
ছোট একটা ঘর তো ওখানে ছিলো?
এক ধাক্কাতে দরজাটা খুলে ফেলেই প্রীতিকে দেখতে পেলাম।
বড় বড় সুন্দর চোখগুলো খোলা। সোজাসুজি তাকিয়ে আছে ওগুলো ছাদের দিকে।
বাম হাঁটু আর ডান কাঁধে রক্ত ভরে আছে। তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে পিন দুটো। বড় একটা হাতুড়ি তার পাশেই পড়ে আছে।
বাম কাঁধ আর ডান হাঁটু অবশ্য পিনমুক্ত। পিনদুটো আমার হাতে ছিল।
একটু আগেই টেনে বের করি নি আমি?
পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে আমার।
প্রাণপনে আমি চেষ্টা করতে থাকি ঘোলা হয়ে আসা চোখগুলো খুলে রাখতে।

পরিশিষ্ট
বুকের ভেতর থেকে লম্বা পিনটা খুলে ফেলার সময় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, সশব্দে হাঁফাচ্ছি আমি।
তীব্র ব্যাথা সহ্য করে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করার ফলাফল হিসেবে মুখ থেকে লালা ঝড়ছে। তবুও টানতে থাকি পিনটা।
সড়াৎ জাতীয় একটা শব্দ করে হাঁটু থেকে খুলে গেল যন্ত্রণাদায়ক বস্তুটি। হৃৎপিণ্ডের খুব কাছে গেঁথেছিলো! এখনও বেঁচে আছি ভেবেই আশ্চর্য লাগলো।
চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তেই টের পেলাম ডান কাঁধে বসে আছে আরেকটি পিন।
ওহ খোদা – চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে আমার। বাম হাতে একই সাথে চেপে ধরেছি ওটাকে।
হাতে খুব একটা জোর পাচ্ছি না। পিন জিনিসটা এমনিতেই সুবিধের নয়। চার ইঞ্চির মত হবে একেকটা লম্বায়। এসব দিয়ে আস্ত গরুকেও বসিয়ে দেওয়া যাবে। সেখানে আমার মত একজন মানবসন্তান মোচড়ামুচড়ি করছে, পিনের সাথে লড়াইয়ের চেষ্টা করছে।
লড়াইটা একতরফা হতে চলেছে এখন।
এক হাত দিয়ে জোর খাটাতেই পাচ্ছি না। বুকের পিন বের করার সময় ডান হাতের সাহায্য কিছুটা পেয়েছিলাম, এখন আর পাচ্ছি কোথায়?
তবুও বাম হাত দিয়ে টানাটানি করতে থাকি। পিনগুলো বের করতেই হবে।
বুকের দিকে তাকাচ্ছি না ভুলেও।
রক্তগঙ্গা এখন আমার তালিকায় শেষ বস্তু – যেটা দেখতে চাবো এই স্নায়বিক দুর্বলতার সময়।
তবুও একবার চোখ পড়ে গেল।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুক।
আমার বুক!

জ্ঞান ফেরার পর ইন্সটিংক্ট প্রথম দুটো চিন্তা মাথাতে একেবারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনে দিয়েছিল –
১. প্রথমে বুক থেকে পিন খুলে ফেলো
২. এবার কাঁধের পিনটা বের করো
তৃতীয় চিন্তাটা মাথাতে আসতেই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে!
শহর জুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে বেড়ানো সিরিয়াল কিলার ট্রিপল-এ কি এবার আমাকেই তার ষষ্ঠ ভিক্টিম হিসেবে বেছে নিয়েছে?

— ০ —

রচনাকাল : ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৪

রিপুচক্র

১.

সাদাতের ডানহাতের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো পলাশ। চোখের পাতা না নড়িয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকা পলাশের জন্য বিরল। কখনোই সে নিজের দৃষ্টি একদিকে বেশিক্ষণের জন্য ধরে রাখতে পারে না। দীর্ঘদিন নিয়মিত ইয়াবা সেবনের ফলে তার দৃষ্টি সব সময় থাকে চঞ্চল। আড়ালে আবডালে পলাশকে এজন্য “ছুপা পলাশ” নামেও ডাকা হয়।

ছুপা পলাশের দৃষ্টি আজ থেমে গেছে। কয়েক সেকেন্ড তার উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকল সাদাতও। তবে নীরবতা ভাঙ্গে পলাশই, “কিভাবে হলো?”

রুমাল দিয়ে রক্তপাত বন্ধের বৃথা চেষ্টা করতে করতে উদাসী কণ্ঠে উত্তর দিলো সাদাত, “লামিয়া কামড়ে দিয়েছে।”

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো পলাশ, “টিটেনাস শেষ কবে নিয়েছিলি?”

“দুই বছর আগে। কেন?” অবাকই হলো সাদাত।

“ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে কিন্তু।” জবাব দিলো পলাশ।

এবার নিঃশ্বাস ফেললো সাদাত, “লামিয়া কুকুর না।”

হাত নেড়ে ওর কথা উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলো পলাশ, “কামড়ালো কেন?”

গুম হয়ে বসে থাকলো সাদাত। উত্তর দিলো না।

“লামিয়া যাকে তাকে কামড়ানোর মেয়ে না।” আবারও বললো পলাশ।

“তাই তো দেখলাম।” হতাশ ভঙ্গিতে বললো সাদাত, “আর কাওকে না কামড়ালেও আমাকে ঠিক ঠিক কামড়ে দিয়েছে।”

“করেছিলি কি?”

এবারও পলাশের প্রশ্ন না শোনার ভান করে এড়িয়ে গেল সাদাত। লামিয়া পলাশেরই খালাতো বোন। প্রশ্ন শোনার প্রশ্নও আসে না। তবে বিনা ব্যাখ্যায় পলাশকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার চেয়ে টাইটানিকের আইসবার্গ এড়ানোর প্রচেষ্টা বেশি সফল ছিলো। এক সুদীর্ঘ হাই তুলে প্রশ্নটাকে দমিয়ে দেওয়ার এক শেষ চেষ্টা করতে সাদাতকে অবশ্য দেখা যায়।

“কুকুরের মতো হা করে না থেকে ঘটনা খুলে বল্!” সাদাতকে উৎসাহ দিতে বললো পলাশ।

“আরে ওই যে!” এতটুকু থেকেই যেন সবটা বুঝে ফেলবে পলাশ।

“কোন যে?”

“প্রেমে পড়ার চেয়ে ঝামেলার কিছু নাই।”

ধীরে ধীরে মাথা দোলালো পলাশ। ঘটনা সে যেমনটা ভেবেছিলো, তেমনই ঘটতে যাচ্ছে। সাদাত-লামিয়ার প্রেমকাহিনী এলাকাতে বিখ্যাত। বিখ্যাত ঘটনাবলীর কিছু সাইড ইফেক্ট আছে। সাইড ইফেক্টের আবর্তনে পড়ে গেছে সাদাত। লামিয়া তাকে কামড়ে দিয়েছে।

“বুঝতে পেরেছি। আবারও মারামারি করে এসেছিস।” পলাশও একমত হল, “তবে এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল না। কি এমন করেছিলি যে মারামারি বাঁধলো? এটা ছিলো আমার প্রশ্ন।”

“ওই যে।”

“প্রেমের ঝামেলা?”

“হুঁ।”

“আগেও একবার বলেছিস। ঘটনা পরিষ্কার হয়নি। প্রেম করলে ঝগড়া কিছু হবেই। অযথা ভূমিকা দীর্ঘায়িত করছিস।”

“ভূমিকার কি হলো?” বিষণ্ন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো সাদাত, “প্রেমে পড়েছি। তাই লামিয়া রেগে গেছে।”

“প্রেমে পড়লে লামিয়া রাগবে কেন? ও কি তোকে ভালবাসে না?”

পলাশের চোখ এখন আগ্রহের আতিশয্যে জ্বল জ্বল করছে। যেন লামিয়া সাদাতকে ভাল না বাসলেই সে খুশি হয়! সন্দেহের দৃষ্টিতে পলাশের দিকে তাকালো সাদাত। বছর তিনেক আগে লামিয়ার সঙ্গে প্রেমের সূত্রপাত তার। তখন পলাশকে নিয়ে বাজারে গুজব ছিলো। বাজার মানে এলাকার একমাত্র ক্ষুদে বাজার। হাশেম চাচার চায়ের দোকানে রোজ বিকেলে আসর বসতো। সেখানে সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটা ছিলো পলাশ-লামিয়ার। পলাশ নাকি তের বছর বয়সে লামিয়াকে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলো। একবস্ত্রে ইলোপ। গন্তব্য ঢাকা শহর। নতুন সংসার, সুখ, ইত্যাদি। দিন দিন লামিয়া সুন্দর হচ্ছিলো দেখেই ওই গল্পের ঘন ঘন অবতারণা। চায়ের সাথে সিগারেটের ধোঁয়া মিশে একাকার, সেই সাথে একাকার হতো কৌতুক আর ঈর্ষা। 

কথাটা অবশ্য মিথ্যা না। পলাশও কোনদিন অস্বীকার করেনি। এ নিয়ে একবার পলাশের উপস্থিতিতে কথা হচ্ছিলো। ও শুধু বলেছিলো, “আরে ব্যাটা, রাজ্জাক-শাবানার ছায়াছবি দেখে আমার মাথা আউলা হয়ে গেছিলো। মাথা আউলা বুঝিস?”

সাদাত মাথা আউলা বুঝে। এই মুহূর্তে পলাশের মাথা ঠিক আছে। তারপরও তার চোখ জ্বল জ্বল করে উঠবে কেন? মুখে এসব কথা অবশ্য বলা গেল না। ছুপা পলাশের সাথে ইয়ার্কি চলে কম। ইয়ার-দোস্তদের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য।

সুতরাং উদাস ভঙ্গিতে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে সত্য কথাটাই বলে দিলো সাদাত, “প্রেমে তো পড়েছি ব্যাটা আরেক মাইয়ার।”

২.

তানিশা মেয়েটা এলাকাতে নতুন এসেছে। শহরের শেষ মাথার হলদে দোতলা বাড়িতে এসে উঠেছে তারা। বাবা রিটায়ার্ড কর্ণেল। সুতরাং নো ধানাই-পানাই। বাজারে নতুন গুজব এসেছে। কর্ণেল সাহেব নাকি বাড়ির লকারে বন্দুক রাখেন। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে এসে পরিবারের শহর পরিবর্তনের ঘটনার সঙ্গে লকারের বন্দুকের যোগাযোগ আছে। আগের শহরের জনৈক ছুপা সালমানের চোখ পড়েছিলো মেয়ের ওপর। কর্ণেল সাহেব গুড়ুম করে দিয়েছেন। আইনী ঝামেলা সামলাতে শহর পরিবর্তন।

গুড়ুম তত্ত্বে বিশ্বাস করতে পারেনি সাদাত। তার ধারণা এই ঘটনাটা ছড়িয়েছে লুচ্চা শফিক। লুচ্চা শফিকের নামের পেছনে লুচ্চা টাইটল এমনি লাগেনি। যথেষ্ট আস্থা আর দক্ষতা ধরে রেখে চারটি বছর ধরে টানা করে যাওয়া লুচ্চামির ফসল হিসেবে নামের পেছনে চিরস্থায়ী এক পদ বাগিয়েছে সে। গত তিন বছর ধরে আটকে আছে এইচএসসির ফাঁদে। একবার দিয়ে ফেল মেরেছে। এবার আবার দিবে। 

লুচ্চা শফিকের নজর থেকে তার ছোটবোন কেয়াও বেঁচেছে বলে নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। শফিকের জনপ্রিয়তার পেছনে কারণটা সহজ। ছেলেটা ক্ষতিকর নয়। নজর দিয়েই ক্ষান্ত দেবে সে। কোনদিনও কাওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে বলে শোনা যায়নি। রূপসী কাওকে রাস্তাতে দেখলে সেকেন্ড দশেক তাকিয়ে থাকবে। তারপর বলবে, “পাছাটা জোস!”

শফিককে সন্দেহ করার পেছনে সাদাতের কারণটা যৌক্তিক। ছুপা পলাশ একবার তাকে পিটিয়েছিলো। পাছা থিওরি তখন সে কাজে লাগিয়েছিলো লামিয়া সম্পর্কে। পলাশের কানে উঠে গেছিলো অচিরেই। বাজারের সেই ইলোপ কাহিনী এর পেছনে ভূমিকা রেখে থাকবে। তবে লামিয়ার যে অঙ্গ নিয়ে তার মহামূল্যবান মন্তব্য রেখেছিলো শফিক, একই অঙ্গে হকিস্টিক দিয়ে গোটা ছয়েক ঘা বসিয়ে দেওয়ার নজির পলাশ রেখেছিলো। কাজেই, আচমকা শহরের নতুন সুন্দরীর পুরোনো ইতিহাসের চরিত্র সালমানের পেছনে পরিচিত এক “ছুপা” টাইটল দেখা গেলে শফিককে সন্দেহ না করে উপায় থাকে না।

লুচ্চা শফিক গত সপ্তাহের প্রতিটি দিন নতুন মেয়েটিকে নিয়ে বয়ান ছাড়ছে শিডিউল ধরে। এসব বয়ান সব হাশেম চাচার দোকানে হচ্ছে না। বিভিন্ন জনপ্রিয় ভেন্যু ধরে ধরে বয়ানের শিডিউল ঠিক করছে সে। তার কোন এক ফাঁকেই ছুপা পলাশের ডুপ্লিকেট ক্যারেকটার ছুপা সালমানের কাহিনী পয়দা করে ফেলেছে সে।

তানিশাকে প্রথমবার সাদাত দেখেছিলো শহরের একমাত্র শপিং মলের সামনে। ফ্যাকাসে নীল জিন্সের সাথে গোলাপী ফতুয়া। গোলাপী রঙ দেখলেই ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে যায় সাদাতের। গোলাপী আবার একট রঙ হলো নাকি? সেদিন অবশ্য তার মুখ বাঁকিয়ে যায়নি, হয়ে গেছিলো হা। মেয়েটার চুল তাকে পাগল করেছিলো, রেশমী আর কোকড়ার মাঝামাঝি কিছু। সাদাতের মনে হয়েছিলো এই ত্রিশ মিটার দূরে দাঁড়িয়েও ওই চুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। পোড় খাওয়া চেহারার এক প্রৌঢ় তাকে নিয়ে বের হয়ে আসছিলো। শপিং মলের সামনে রাখা সবুজ রঙের এক পাজেরোতে উঠে গেছিলো তারা।

নাকের সামনে দিয়ে পাজেরো চলে যাওয়ার পর সম্বিত ফিরে পেয়েছিলো ও। ততক্ষণে কাজ যা হওয়ার হয়ে গেছে। দুই লাফে হাশেম চাচার দোকানে এসে একটা সিগারেট কিনে নিয়েছিলো সাদাত। সিগারেটটা ধরেছে নতুন। নতুন সিগারেট ধরা তরুণের জীবনের প্রায় সব কিছুতেই সিগারেট ভাল ভূমিকা রাখে।

পরীক্ষায় বাঁশ খাওয়া থেকে শুরু করে কাজিনের বিয়েতে হাঁস খাওয়া, সবকিছুর পরই তাদের একটা সিগারেট ধরাতে হয়। এই আইনের বাইরে যেতে পারেনি সাদাতও। নিয়মিত টানছে। দিনে দুইবার করে লামিয়ার সঙ্গে লাগছেও তার।

সেদিন প্রথমবারের মতো সিগারেটে টান দিয়েছে, কোথা থেকে হেলেদুলে এসে উপস্থিত হলো লুচ্চা শফিক। লুচ্চা শফিক সাদাতের মত নতুন “খোড়” না। স্টিমারের মতো ধোঁয়া ছাড়ার জন্য এলাকাতে তার একটা আলাদা সম্মান আছে। একই বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে দেখেই সাদাতের মনটা খারাপ হয়ে গেল। শফিক জীবনেও একটা সিগারেট কিনে খেয়েছে বলে শোনা যায়নি।

“আরে ছোটভাই!” অবাক হয়ে যাওয়ার ভান করতে করতে বললো লুচ্চা শফিক, “ভর দুপুরে বিড়ি ধরাইলা কি মনে করে? সর্বনাশ কইরা দিলা তো মিয়া।”

সর্বনাশের বৃত্তান্ত জানতে চাওয়ার ইচ্ছে শফিকের ছিলো না। এসব ঢঙের মানে তার জানা আছে। ধীরে ধীরে সিগারেট দখলের একটা প্রক্রিয়া শুরু করবে শফিক, এটা তারই সূচনা।

“বদর বদর কইরেন না তো, শফিক ভাই।” বিরক্ত মুখে বলে দিলো সাদাত, “স্কুল ছুটির সময় হয়ে গেছে। গিয়ে মেয়েদের পাছা দেখেন গা। এইখানে বদর বদর কইরেন না।”

লুচ্চা শফিকের চোয়াল ফাঁক হয়ে গেছে। সাদাতের মত জুনিয়র একটা ছেলে তার সাথে এমন ভাষাতে কথা বলবে এটা সে ভাবতেও পারেনি। অন্য কোন সময় হলে এখানেই একটা কেলেঙ্কারী হয়ে যেত। তবে সাদাতের সঙ্গে ছুপা পলাশের আত্মীয়তার সম্পর্ক তার জানা আছে। কষ্ট করে হলেও নিজের জ্বিহ্বা সংযত রাখলো সে।

“বউয়ের লগে ঝগড়া করে আসছো নাকি, মিয়া? মেজাজ এতো উঁচুতে ক্যান?” সরু চোখে জানতে চাইলো শফিক, “অবশ্য যে মাইয়ার সাথে সম্পর্ক করতে গেছো, ঝগড়াঝাঁটি তো কিছু লাগবোই। মাথা গরম ফ্যামিলি।”

পিচিক করে চায়ের দোকানের মাটিতে থুতু ফেললো লুচ্চা শফিক। আড়চোখে দূরে হেঁটে যাওয়ার একটা মেয়ের পেছনে তাকিয়ে নিলো। হাশেম চাচা অবশ্য ব্যাপারটা সমর্থন করতে পারলেন না। বললেন, “কতবার বলছি মিয়া, দোকানের ভিতরে থুতু ফেলবা না! আজকালকার পোলাপাইনরে এক কথা দশবার বললেও মনে রাখে না।”

হাশেম চাচার দিকে গরম চোখে তাকালো শফিক। হাশেম চাচাই বা কম যাবেন কেন? পাল্টা তাকিয়ে রইলেন তিনিও। চোখে  সাদাতের কাজ অবশ্য সাদাত করে যাচ্ছে। লুচ্চা শফিকের হাত বাঁচিয়ে যতটা সম্ভব সিগারেট টেনে নিচ্ছে সে। শেষ রক্ষা অবশ্য হল না। ধপ করে সাদাতের পাশে বসে পড়লো লুচ্চা শফিক, তারপর হাতটা আনমনে বাড়িয়ে দিলো, “দাও, বিড়িটা দাও। মন মেজাজ ভাল নাই।”

বিড়ি দেওয়ার ইচ্ছা সাদাতের ছিলো না। কাজেই আবারও জানতে চাইলো, “কি হইছে ভাই?”

“কেয়া প্রেম করতেছে।” উদাস হয়ে বললো শফিক।

“ফাটাফাটি খবর।” হাসিমুখে বললো সাদাত, সিগারেট টেনে নিলো আরেকবার, “আপনার বোনটা দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেল।”

নিজের বোন সম্পর্কে এমন মন্তব্য কোন বড় ভাইয়ের সামনে করাটা নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নের দাবিদার। তবে লুচ্চা শফিকের ব্যাপারটাই আলাদা। ক্লাস থ্রিতে থাকতে সে কেয়ার সঙ্গে যা করেছিলো, তা জনগণের সামনে প্রকাশ করার মতো ঘটনা না। হাশেম চাচার দোকানে বসেই সে ঘটনা অবশ্য সে গর্বের সঙ্গে সবাইকে শুনিয়েছিলো।

কেয়ার বড় হয়ে যাওয়ার খবর দিয়ে লুচ্চা শফিককে বেশিক্ষণ প্রভাবিত করে রাখা গেল না। হাত বাড়িয়ে আবারও নড়াতে থাকলো সে, যেন অস্কার দোলানো হচ্ছে সামনে। বললো, “বিড়িটা জোস।”

চোখ কুঁচকে যায় সাদাতের। ঘটনা মনে হচ্ছে সিরিয়াস। লুচ্চা শফিক তার উক্তির প্যারোডি বানানোর মতো মানূষ না। এখন সেটাই ঘটছে। অর্থাৎ, প্রথমবারের মতো সে উদাসী হয়ে এসেছে। সাদাতকে জানতে চাইতেই হলো, “ঘটনা কি ভাই?”

সিগারেটটা একরকম কেড়েই নিলো শফিক, তারপর বললো, “কেয়ার বয়ফ্রেন্ডকে তুমিও চিনবা। হানিফ। বর্ষার ছোটভাই হানিফ। পাছাটা জোস।”

লুচ্চা শফিকের এই আরেক বিরল বৈশিষ্ট্য। যে কোন মানুষের পরিচয় তার কাছে এভাবেই জমানো থাকে। অনেকটা মোবাইলের সেভড কন্ট্যাক্টের মতো।

হানিফ, বর্ষার ছোটভাই। পাছাটা জোস।

তারেক, কৃষ্ণার বড়ভাই। পাছাটা জোস।

জামশেদ, কুলসুমের কাজিন। পাছাটা জোস।

ইত্যাদি ইত্যাদি।

সাদাত অবশ্য অন্য একটা কারণে থমকে গেছে। হানিফকে সে চেনে। টিঙটিঙে এক ছেলে। কেয়ার মতো দামাল মেয়েকে সে কিভাবে সামলাবে তা একটা প্রশ্ন হতে পারে। এ তো আর ক্লাস সেভেনের ইংলিশ প্রাইভেট টিউটরের বাড়িতে গিয়ে সহপাঠিনীর সঙ্গে প্রেম নয়। কলেজ ফার্স্ট ইয়ারের উদ্দাম প্রেম। হানিফ ছিবড়ে যাবে একেবারে!

“বলেন কী ভাই!” সিগারেট হারানোর দুঃখেই হোক আর খবরের প্রচণ্ডতায়, সাদাতের মুখ থেকে এটুকুই বের হলো।

“তুমি চিঙড়ির মতো দাঁপাচ্ছো কেন?” প্রচণ্ড বিরক্ত হলো লুচ্চা শফিক, “আসল খবরটাই তো বলিনি তোমাকে!”

“কোন হাসপাতালে?” দ্রুত উপসংহারে চলে এলো সাদাত।

“কোন হাসপাতালে মানে!”

“না কিছু না।” দ্রুত কথা গিলে ফেললো ও, “বলেন ভাই।”

“হানিফ কি বলেছে জানো?” গরগর করে উঠলো শফিক।

“কি ভাই?”

“আমি নাকি সুযোগ পেলেই কেয়ার পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকি! ভাবা যায়?”

মাথা চুলকালো সাদাত। ঘটনা পুরোপুরি অবিশ্বাসের উপায় কী? লুচ্চা শফিকের রেপুটেশন তল্লাটের সবারই জানা আছে। সেদিন মেথরপট্টির মর্জিনাকে দেখেছিলো শফিকের সামনে পড়ে যেতে। দ্রুততার সাথে কোমর তোয়ালে দিয়ে ঢেকে নিয়েছিলো সেদিন মর্জিনা। আর কেয়ার মতো আকর্ষণীয়া মেয়ে লুচ্চা শফিকের নাগাল থেকে ফস্কে যাবে?

মুখে অবশ্য বললো, “শালার সাহস তো কম না!”

“বোঝ একবার!” লাই পেয়ে মাথায় উঠে গেল শফিক, “শালা আমার বোনের সাথে প্রেম করে, আর সামান্য কিছু ব্যাপার চেপে যেতে পারে না!”

হাশেম চাচার কাছে আরেকটা সিগারেট চাইবে কি না তা মনস্থির করার চেষ্টা করছে তখন সাদাত। লুচ্চা শফিকের সঙ্গে বেশিক্ষণ বসার আগেই কান ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু করে ওর।

“ঠিক করছিলাম আজ বিকালে শালাকে ক্যাচকা ধোলাই লাগাবো। তোমারেও ডাকতাম।”

লুচ্চা শফিকের কথা শুনে প্রমাদ গুণলো সাদাত। এর মধ্য আবার ওকে টানা কেন? কিন্তু তখনও শফিকের কথা শেষ হয়নি। বলে ফেললো, “শপিং মলে গিয়া মাথাটা কিছু ঠাণ্ডা হইলো। তানিশারে দেখলাম বাপের লগে ঘুরতাছে। টাইট জিন্স পড়ছে, মামা! চোখ ফেরানোর মতো না শালী! পাছাটা জোস!”

পিচিক করে চায়ের দোকানের মাটিতে থুতু ফেললো সাদাত।

৩.

তানিশার সঙ্গে প্রথমবার কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল কেমিস্ট্রি ল্যাবের বাইরে। মেয়েটা মিশুক আছে। প্রথম তিন দিনের ক্লাস শেষে জুটিয়ে ফেলেছে একগাদা বান্ধবী। আর মেয়েগুলোও বেহায়ার মতো মিশছে ওর সাথে। যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোনকে খুঁজে পাওয়া গেছে।

ব্যতিক্রম লামিয়া। ক্লাসের কোণে গুম হয়ে বসে ছিলো সে। সাদাত এখনও তানিশার ব্যাপারে কিছু বলেনি তাকে। তবে আড়চোখে প্রেমিকের দৃষ্টি ফেলা কোন ছেলেকে ধরে ফেলা কঠিন কিছু নয়। আজকে সাদাতের চোখের প্রেম লামিয়ার জন্য নয়।

“শালার মাল একটা। পুরাই মাল।” নিঃসঙ্কোচে ঘোষণা দিলো পলাশ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে সে এখন।

“সরাসরি তাকাসনে। ধরা পড়ে যাবি।” সাবধান করে দিয়েছিলো সাদাত।

“ধরা পড়লেই বা! ওটাই তো ভাল হবে আরও। মাইয়া জানতে পারবে আমার চোখে সে আগেই পড়সিলো।”

“একই কারণে তোরে ছ্যাচড়া এক পোলা ছাড়া আর কোন কিছু ভাববে না সে।”

“আমাকে প্রেম শেখাতে আসবি না।” লাল চোখে বললো ছুপা পলাশ।

পলাশকে সেদিন প্রেম শেখাতে যায়নি সাদাত। তবে কেমিস্ট্রি ল্যাবের পর কলেজ গেটের দিকে এগুতে গিয়ে বাঁধাগ্রস্থ হয়েছিলো সে। দেখতে পাচ্ছিলো লুচ্চা শফিক দূরে একটা কিছু করছে। কাছাকাছি তানিশাকেও দেখা যায়। মসুরের ডাল তো কিছু কাল হয়েছেই। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে হলো সাদাতকে।

কাছে পৌঁছতে লুচ্চা শফিকের গলা পরিষ্কারভাবে কানে এলো ওর। নিজের নাম্বার অত্যন্ত উৎসাহের সাথে দিচ্ছে সে। ততোধিক উৎসাহের সাথে চেয়ে বসেছে মেয়েটির নাম্বার। সেই সাথে কলেজে তার প্রভাব প্রতপত্তি কেমন তা খুব ভাল করে বুঝিয়ে বর্ণনা দিয়ে ছাড়ছে সে। কয়েক সপ্তাহ আগে প্রতিপক্ষের বড় ভাইকেও হাসপাতালে পাঠায়নি কী সে? নিজে যে তিন বছরের সিনিয়র হয়েও একই ক্লাসে পড়ছে আজ, সে খবরটা তানিশার কাছে বেমালুম চেপে গেল মানুষটা। মনে মনে বেদম হাসলো সাদাত।

তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “শফিক ভাই, টুর্নামেন্ট নিয়ে একটা কথা ছিলো।”

অচিরেই হতে যাচ্ছে আন্তঃকলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। তাতে কোন দায়িত্বই লুচ্চা শফিককে দেওয়া হয়নি। সে দলের একজন ডানহাতি স্পিনার। আর কিছু নয়। অথচ এই মুহূর্তে তাকে দেখে সে কথা কে বলবে?

সবগুলো দাঁত বের করে তানিশার দিকে তাকালো সে, “আরে আমরা পরে কথা বলবো, ঠিক আছে? জরুরী একটা আলাপ সাইরা লই। বোঝই তো, আমাকে ছাড়া একদম চলতে পারে না পোলাপাইন, হেহে।”

ব্যস্ততার ভঙ্গিতে করে সাদাতের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই তাকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল সে। তারপর , বললো, “মাহতাব স্যার তো বললো আপনাকে ইমিডিয়েটলি ক্যাপ্টেনের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। স্পিনার নিয়ে কি একটা ঝামেলা যেন হয়েছে। স্কোয়াড চেঞ্জ হবে খুব সম্ভব।”

দলে স্পিনার রাখার সিদ্ধান্তই হয়েছে একজন। তার ওপর স্কোয়াড স্পিনারের জন্য চেঞ্জ হলে লুচ্চা শফিক দল থেকে বিতারিত হবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েই বলা চলে। নিমেষেই তার মাথা থেকে তানিশার কথা চলে গেল। হন্তদন্ত হয়ে বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সাদাত গেটের দিকে হাঁটা দিলো আনমনে।

রাস্তাতেই ওভারটেক করা হলো তানিশাকে, তবে ব্যাপারটা যে ইচ্ছাকৃত তা তো আর মেয়েটির জানার কথা নয়। লুচ্চা শফিক কানের যথেষ্ট দূরে চলে গেছে। নরোম গলায় ডাকলো তানিশা, “হ্যালো?”

ফিরে তাকালো সাদাত, “আমাকে কিছু বললে?”

“থ্যাংকস।” ছোট করে বললো সে।

“আরে ও কিছু না। ওইটা শফিক ভাই। ফাঁপড়ে বস। মেয়েদের সাথে উনার এই রেপুটেশন আছে…”

“রেপুটেশন?”

সাদাত আবিষ্কার করলো, চমকে গেলে এই মেয়েকে সুন্দর লাগে। বিস্ময়ে সামান্য হা হয়ে যাওয়া সাধারণ কিশোরীর সৌন্দর্য্য নয়, এখানে আরও কিছু আছে। অপার্থিব কিছু। তানিশার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন একসাথে চমকে উঠেছে। এমনকী চুলও। যেন পুকুরের ঠিক মাঝখানে আছড়ে পড়েছে উল্কাপিণ্ড। নারীর এমন রূপ সাদাত আগে কখনও দেখেনি। লামিয়ার কথা উল্কার বেগেই মাথা থেকে বেরিয়ে গেল তার।

চমকে ওঠার উপযুক্ত কারণও অবশ্য তানিশার ছিলো। রেপুটেশনের মানে সবাই জানে। জাহাঙ্গীরনগরের এক পরাক্রমশালী ছাত্রনেতার ১০০ মেয়ে ধর্ষণের পর কেক কাটার খবর সবাই পড়েছে।

সচকিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি হাসলো সাদাত, “যা ভাবছো তেমনটা না। তিনি কাণ্ড ঘটান না কোন।”

“তাহলে তো ভালই।” হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তানিশা, “রেপুটেশনের প্রসঙ্গ এলো কেন তাহলে?”

“ওহ… ওটা…” বলবে কি না তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগলো সাদাত, তারপর বলেই ফেললো, “আসলে, উনি মেয়েদের পাছা দেখে বেড়ান।”

এবার তানিশা হা হয়ে গেছে। বিস্মাভূত তরুণীর অপরূপ রূপ। ঠিক যতটুকু রূপ ঠিকরে বের হলে এক গোবেচারা ছেলেও তার চুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য হাত তুলতে পারে, ততটাই। সাদাত হাত তুলেও ফেলেছিলো, তানিশার পরের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার নামিয়ে ফেলে অবশ্য।

“কী!”

“মানে, উনি মেয়েদের…”

“হয়েছে, থাক!” দ্রুত বললো তানিশা, “আমি বুঝেছি।”

“সরি।”

এখনও হাঁটছে ওরা, তার মধ্যেই কয়েকবার সাদাতের দিকে তাকালো তানিশা। তবে ঘুরে তাকায় না সাদাত, ক্ষমাপ্রার্থনা ব্যাখ্যার কোন ইচ্ছে তার মধ্যে আছে বলে মনে হচ্ছে না। দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে মনোযোগের সাথে হাঁটছে গেটের দিকে। বের হবে ওরা।

“সরি কেন?” অবশেষে মুখ ফুটে জানতে চাইলো ও।

“আরে, সব কথা শুনতে নেই।” মাথা নেড়ে বললো সাদাত। “বাদ দাও।”

সবুজ পাজেরো চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলো সাদাত।

মেয়েটার মাথায় যথেষ্ট মশলা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। লুচ্চা শফিকের কপালে এবার খারাপী আছে।

৪.

তানিশার সঙ্গে বিকেলে বের হওয়ার ফন্দীটা কাজে লাগাতে সাদাতের অপেক্ষা করতে হলো দুই সপ্তাহ। ঝাড়া দুই সপ্তাহ অপেক্ষার ইচ্ছে ওর ছিলো না। তবে তানিশা মেয়েটা পিচ্ছিল আছে। প্রতিদিন বিকেলে বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্রিকেট খেলা দেখবে, ওপর থেকে হাতও নাড়াবে সাদাতের দিকে লক্ষ্য করে, কিন্তু নিচে নামবে না। ভেতরে ডাকার তো প্রশ্নই আসে না।

এমনটা ঘটবে তা অবশ্য আগেই অনুমেয় ছিলো। শেষ যে ছেলেটা তানিশাদের বাড়িতে ডুকেছিলো, তার নাম ছুপা সালমান। একদম গুড়ুম করে দেওয়া হয়েছে তাকে। খুপড়ি উড়ে গেছে। সাদাতের খুপড়ি সংখ্যা এক। এক খুপড়ি নিয়ে তানিশাদের বাড়িতে ঢোকা চলে না।

সাদাত সময়টা কাজে লাগিয়েছে বেশ। কয়েকবারই কথা হয়েছে তার সাথে তানিশার। প্রতিবারই বোমা ফাটিয়ে দিয়েছে। স্ট্রেটকাট কথা বলা ছাড়া মেয়ে পটানোর আর কোন অস্ত্র সাদাতের ছিলো না কখনও। লামিয়া ওর প্রেমেও পড়েছিলো স্ট্রেটকাট কথার ধাক্কায়। ও জানে, তানিশাও পড়বে। এই মুহূর্তে লামিয়া নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা তার নেই। জগত জুড়ে আছে তানিশা। শেষ তিনদিন লামিয়ার সাথে ঘুরতেও যায়নি। ফোনে বাজে ব্যবহার করেছে। তারপর লামিয়ার কান্না শুনে শুধু বলেছে, “মেয়েমানুষের মত ফোঁত ফোঁত করবা না।”

তানিশা মাঝে মাঝে বিকেলে সাইকেল নিয়ে বের হয়। সপ্তাহে দুইদিনের বেশি না। ক্যাচ মিস করে সাদাত তানিশার পা দেখে। লুচ্চা শফিক বলে, “শালা গাণ্ডু! এমন ক্যাচ মিস করে কেউ?”

তবে ব্যাপারগুলো লুচ্চা শফিক বোঝে না তেমন নয়। নিতম্ব দর্শনের জন্য নতুন মেয়ে সে খুঁজে নিয়েছে। শুধু বোঝেনি ছুপা পলাশ। পলাশের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলার মতো সাহস সাদাতের ছিলো না। একে তো লামিয়ার ভাই, তার ওপর লামিয়া-তানিশা দুটোর ওপরেই ক্রাশ খেয়ে বসে থাকা আরেক মানুষ ওই পলাশ। তাকে সব খুলে বললে পানি যে কোথা থেকে কোথায় গড়াবে তা কে জানে?

কাজেই অগ্রগতি চালাতে হচ্ছে সাদাতকে, তবে পলাশ থাকছে অন্ধকারে। রাতের বেলায় ওরা মাঝে মাঝে টঙে এসে দেখা করে। টাকা পয়সার কমতি যাচ্ছে দুইজনেরই। একটা সিগারেট ভাগ করে খাওয়ার সময় পলাশ সাদাতকে প্রায় কিছুই দেয় না। ফোঁস ফাঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই অবিবাহিত তরুণ।

তানিশার সঙ্গে প্রথম ব্রেকথ্রুটা ঘটে গেল এক সোমবারে। যথারীতি কলেজে এসেছে সাদাত। দূর থেকেই দেখা গেল লুচ্চা শফিক পেছনের বেঞ্চ থেকে তাকিয়ে আছে আড্ডারত তিন মেয়ের দিকে। ধ্যানের ভঙ্গিতে দুলছে মাথা। সাদাত পরিষ্কার বুঝতে পারলো, বন্যার নিতম্ব লক-ডাউনে এনেছে শফিক। সাদাতের দিকে তাকিয়ে একবার তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে গোল করে বোঝালো, “জোস!”

তেতো মুখ নিয়ে শফিকের দুই বেঞ্চ সামনে গিয়ে বসে পড়লো সাদাত। মোবাইল কিছুক্ষণ গুঁতোগুতি করলো। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সামনে থেকে লামিয়া বার বার রিপ্লাই দিচ্ছে। তাকে হুঁ-হাঁ করে পাশ কাটানো যাচ্ছে না। তোমার কি হয়েছে? তুমি আমাকে ইগনোর করছো কেন? ভালবাসো না আর আমাকে? ইত্যাদি ইত্যাদি রাজ্যের বালছাল। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে গেল সাদাতের।

পেছন থেকে কেউ মাথায় টোকা দিতেই দ্রুত ঘুরে তাকালো ও, মুখের আগায় চ-বর্গীয় এক গালি এসে গেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তবে গালিটা ঝাড়া গেল না।

পেছনে উজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে তানিশা। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকেছে ক্লাসে। বললো, “প্রেম হচ্ছে? আজকে ক্লাসে পর থাকিস তো একটু।”

প্রেম যে হচ্ছে না, সেটা বোঝানোর জন্য বিস্তৃত এক হাসি উপহার দিলো সাদাত। সামনের বেঞ্চ থেকে কটমট করে তাকিয়ে আছে লামিয়া। তার দিকে তাকিয়ে পিত্তি জ্বালানো হাসি দিলো তানিশা। লামিয়া-সাদাতের প্রেমের কথা সে জানে। তবে থোরাই পরোয়া করে। সাদাতের সঙ্গে তার কোন বিশেষ সম্পর্ক নেই। পরোয়া করার মানে হয় না। লামিয়া অবশ্য ডালের রঙ যে কালো হয়েছে তা বুঝতে পেরে গেছে।

তানিশা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, রীতিমতো আঁতকে উঠলো লুচ্চা শফিক।

তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জানতে চাইলো সাদাত, “কি হলো, ব্রাদার?”

শফিক এবার কিছু বললো না। কটমট করে সে-ও তাকালো সাদাতের দিকে।

একটা উলের জ্যাকেট উল্টো করে কোমরে বেঁধে রেখেছে তানিশা। দেখাচ্ছে একদম টম বয়ের মতো। লুচ্চা শফিক বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো। পাত্তাই দিলো না সাদাত।

নিজের মন্তব্য জানিয়ে শুধু বললো, “জ্যাকেটটা জোস!”

**

কলেজ ছুটির পর নিজে থেকেই এগিয়ে আসলো তানিশা। বিল্ডিং থেকে মেইনগেটের দূরত্বটুকু পার হতে হতেই কথা যা হওয়ার হয় ওদের মধ্যে। আজকে তানিশাকে স্বপ্রতিভ দেখাচ্ছে। সাদাতের ডানহাতের কনুইয়ের কাছে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে সে। কলেজের ছেলেরা ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকাচ্ছে। মেয়েরা বিরক্তিতে কুঁচকাচ্ছে নাক। ভাগ্যিস আশেপাশে লামিয়া ছিলো না। শেষ ক্লাসটা না করেই মন খারাপ করে বের হয়ে গেছে সে। সাদাতের সাথে ছুটির পর ঘুরতে যেতে চেয়েছিলো। সাদাত বলেছিলো, “মেয়েমানুষের মতো খালি ‘ঘুরতে যাবো-ঘুরতে যাবো’ করবা না।”

গেটের কাছে এসে তানিশা ওর কনুই ছেড়ে দিলো। মেয়েটার মনে কি চলছে বোঝা দায়। এগিয়ে যাওয়ার কোন ইঙ্গিত সে দেয়নি। সম্ভবতঃ “ঝুলিয়ে রাখা” হয়েছে সাদাতকে। ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট। সাদাত কিছু মনে করছে না। তানিশার কাছাকাছি থাকতে পারলেই সে খুশি। কোকড়া-রেশমি ওই চুলের পরশ মাঝে মাঝে গালে পেলেই তার চলে যাবে। লামিয়া নরকের অনন্ত আগুনে জ্বলে মরুক। কোন আক্কেলে যে ওই মেয়ের সাথে প্রেম করতে গেছিলো সে!

তানিশার সঙ্গে কথা বলার নমুনা মোটামুটি এরকম।

“দ্যাখ দ্যাখ, আম গাছে মুকূল ধরেছে।”

সাদাত জবাব দেবে, “আমের সিজনে আম ধরবে না তো কি লিচু ধরবে রে?”

“তাও ঠিক। এই আমগুলো কি কলেজ অথরিটি মেরে খেয়ে ফেলে?”

“সম্ভবতঃ। পেটুক শালারা।”

“ওই দ্যাখ, তরুর সাথে নতুন একটা ছেলে। খিক খিক খিক।”

“তাই তো দেখছি। শালী ভালোই ছেলে পটাচ্ছে।”

“আমাকে পটাবি তুই?”

“মানে কি?”

“কিছু না।”

সাদাত জানে এসবই তানিশার কাছে খেলা। সাদাতের ভেতরে তার জন্য দুর্বল কোন কোণ আছে, এটা সে জানে। সুবিধাটা পুরোদমে ব্যবহার করছে মেয়েটা। সাদাত জানে এই মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া চলবে না। সোজা খুপড়ি উড়ে যাবে। মেয়ে নিজেও ওড়াতে পারে সেটা।

সামনে তাকাতেই জমে যেতে হলো সাদাতকে।

সবুজ পাজেরোর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রিটায়ার্ড কর্ণেল। সরাসরি তাকিয়ে আছেন সাদাতের চোখের দিকে।

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে সাদাতের হাত ছেড়ে দিলো তানিশা। কর্ণেলের দৃষ্টি সেজন্য বিন্দুমাত্র নরোম হলো না।

মেঘগর্জনের সুরে বললেন, “ছেলে, গাড়িতে ওঠো!”

ছেলের হাঁটুতে তখন জোর নেই!

৫.

কখনও কখনও মনের গহীন থেকে সতর্কবার্তা শোনা যায়। “করো না, এই কাজ ভুলেও করো না!” তারপরও শুধুমাত্র এড়িয়ে যাওয়ার সৎসাহসের অভাবে ঠিক সে কাজটাই করা হয়ে যায়। যেমন এই মুহূর্তে কর্ণেলের ডাককে উপেক্ষা করতে সাদাত পারলো না। টুক করে গাড়ির ভেতরে বসে পড়লো। প্যাসেঞ্জারস সিটে। ড্রাইভ করছেন কর্ণেল স্বয়ং।

ভয়ে ভয়ে ভেতরটা একবার দেখে নিলো সাদাত। আগ্নেয়াস্ত্রের অনুপস্থিতি স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিলো তার মনে। খুপড়ি নিয়ে আপাতত চিন্তার কিছু নেই দেখা যাচ্ছে। তবে ভদ্রলোকের মেজাজ খুব একটা প্রসন্ন বলেও মনে হচ্ছে না। বিষয়টা চিন্তাতে ফেলার মতো। তানিশা বসেছে পেছনের সিটে। রিয়ার ভিউ মিররে তার চেহারা ঠিক অ্যাঙ্গেলে আসছে না। আবার কর্ণেলের সামনেই তার মেয়ের দিকে ঘাড় ঘুররিয়ে তাকানো ঠিক হবে কি না সাদাত বুঝতে পারলো না।

“তানিশার ক্লাসেই পড়ো তুমি?” মেঘগর্জন শোনা গেল আবার।

“জ্বি।”

“বাবা কি করে?”

“শিপ… মানে শিপিং বিজনেস।” গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো সাদাত।

তারপর আরও কিছুক্ষণ নীরবতা। গাড়ির ভেতরে কোন শব্দ নেই। সাদাতের আজ লুচ্চা শফিকের কথা বার বার মনে পড়ে। ও ব্যাটাকে তানিশার সাথে ঝুলিয়ে দেওয়া গেলেই বোধহয় ভাল হতো। এখন জাঁদরেল এক কর্ণেলের সঙ্গে বসে থাকতে হতো লুচ্চা শফিককে। তার জায়গাতে বসে আছে সাদাত। সব বিপদ কেন যেন ভাল মানুষগুলোর সঙ্গেই ঘটে থাকে। খারাপ লোকেরা বেঁচে যায় দিব্যি।

“তানিশাকে ভালবাসো?”

এবার সাদাত ঢোক গিললো। বুড়ো বলে কি এসব? ছুপা সালমানকে কোনদিনও দেখেনি সাদাত, তবে আজ বেচারার জন্য বড় মায়া হলো তার।

“একটা প্রশ্ন করেছি তোমাকে। উত্তর দাও।”

“অ্যাঁ?”

“বাসো তাহলে! তা আমি তোমার চোখ দেখেই বুঝেছিলাম। দেখা হি পেহলি বার, ছোকড়া তোর আখে উয়ো পেয়ার।”

“জ্বি, জ্বি।” বিনয়ের অবতার ঘোষণা করলো।

“তানিশা, ওকে কি এখনও সত্যটা জানিয়েছো?” গরগর করে উঠলেন রিটায়ার্ড কর্ণেল।

বুকটা ধ্বক করে উঠলো সাদাতের। সত্যটা! এহেন সত্য কোনদিনই ভাল কিছু হয় না।

কি সত্য?

তানিশার সঙ্গে কর্ণেলের সম্পর্ক কি ভুল জানানো হয়েছে সবখানে? কর্ণেল আর তানিশা স্বামী-স্ত্রী নয় তো? এমনটা কিন্তু ঘটেছিলো শার্লকের সাথে। ওরা জানতো “বাস্কারভিলের” মিস্টার স্টেপলটন আর মিস স্টেপলটন ভাই-বোন। এলাকার সবাই তাই জানতো। তারপর তলা দিয়ে বের হলো কি? তারা আসলে জামাই-বউ। ঠ্যালাটা বোঝ!

“না, বাবা।” পেছনের সিট থেকে বললো তানিশা।

গলায় আর্দ্রতা।

তাও ভাল, সম্পর্কটা এখনও বাবা-মেয়ের আছে! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সাদাত।

“কি সত্য?” সাহস করে জানতে চাইলো ও।

“হ্যাঁ, তানিশা, বলো বলো!” আবারও উৎসাহ দিলেন কর্ণেল।

“কি বলো, বাবা! প্লিজ!” তানিশার গলা আরও ভারী হয়ে এসেছে এখন।

বিব্রত বোধ করলো সাদাত। বিড়বিড় করে বললো, “থাক নাহয়।”

“থাকবে কেন? আরে থাকবে কেন! তানিশা, তুমি বলবে না আমি বলবো?” রিয়ার ভিউ দিয়ে মেয়ের দিকে কড়া করে নজর দিলেন তিনি।

“প্লিজ…”

তানিশা এবার সত্যি কেঁদে ফেললো। দুই গাল রাঙা হয়েছে। লজ্জা আর অপমান।

“আমি শুনতে চাইছি না, আংকেল। থ্যাংকস।” বললো সাদাত।

“শুনবে না মানে? অবশ্যই শুনবে।” গরগর করে উঠলেন তিনি, “তানিশার প্রিম্যাচিউর মেনোপজ ঘটেছে। এর অর্থ তুমি জানো, ছেলে?”

“জ্-জ্বী!” মেয়ের সম্পর্কে এমন অবলীলায় কথাটা বলে ফেলতে দেখে অবাক হয়ে গেল সাদাত।

তানিশা কোনদিনও মা হতে পারবে না!

সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন রিটায়ার্ড কর্ণেল, “ইঁচরে পাকা ছেলেপেলে সব। এরপর আর কোনদিন তানিশার আশেপাশে তোমাকে দেখলে পাছার চামড়া তুলে ফেলবো। বোঝা গেলো?”

“জ্বি?”

“এরপর আর কোনদিন তানিশার আশেপাশে তোমাকে দেখলে পা-”

“জ্বি জ্বি।” দ্রুত বললো সাদাত। কার? এটা জানতে চাওয়ার সাহস তার আর নেই এখন।

তানিশাদের বাড়ির সামনে এসে থেমেছে সবুজ পাজেরো। আশা নিয়ে কর্ণেলের দিকে তাকালো সাদাত।

ভদ্রলোক শুধু বললেন, “গেট লস্ট।”

 ৬.

বাড়ি ফেরার পথে বাগানের দিকে চোখ পড়লো সাদাতের। পার্কটা ছোট। তার মধ্যে আছে সিমেন্টের চেয়ার। তার একটায় বসে আছে মেয়েটা। হলুদ রঙের জামা পরেছে। এদিকে পিঠ ফিরিয়ে রাখলেও মেয়েটিকে চিনতে ভুল হয়নি সাদাতের।

বাড়ির দিকে না এগিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল সে।

বড় বড় চোখ মেলে তার দিকে তাকায় সে, “তাই, না?”

“লামিয়া।” বিড়বিড় করে বললো সাদাত, আজকের দিনটায় কুফা লেগেছে, “এখানে কি করছো তুমি?”

জবাবটা এলো না। লামিয়ার চোখ ফুলে গেছে। মনে হচ্ছে কান্নাকাটি হয়েছে একটু আগে। এখন সেকেন্ড স্টেজ চলছে।

“তানিশার শরীর আমার চেয়ে ভাল।” মন্তব্য করার ভঙ্গিতে বললো লামিয়া।

প্রমাদ গুণলো সাদাত, “এসব কি হচ্ছে, লামিয়া?”

“চেহারাও।”

“আজব কথাবার্তা বলছো তুমি!”

“দুনিয়ার যে কেউ তোমাকে দেখলেই বলতে পারবে, শালীর প্রেমে পড়েছো তুমি। সেখানে আমি তোমাকে আর যে কারও থেকে ভাল চিনি।”

“এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে!” সাদাত নিজেই গলাতে জোর পেলো না।

“শাট আপ!”

লামিয়া কাঁদছে। লামিয়ার কান্না দেখতে সাদাতের বরাবরই সুন্দর লাগতো। ঠোঁট দুটো কিভাবে ফুলে যেত, তারপর পানি পড়তো চোখ থেকে মুক্তোর মতো। শুধু এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই কতোবার মেয়েটিকে কাঁদিয়েছে সাদাত। তবে আজকে লামিয়ার কান্না দেখে তার কাছে সুন্দর কিছু মনে হলো না।

কুৎসিত!

অত্যন্ত কুৎসিত দেখায় মেয়েটি কাঁদলে।

অঝোরে কাঁদছে লামিয়া। এখনও। কাঁদতে কাঁদতেই কিছু একটা বললো সে। সাদাত ঠিক বুঝতে পারলো না।

“কী!”

“তুমি নাকি … তুমি নাকি প্রথমদিন ক্লাস শেষেই তানিশাকে বলেছো…”

“কি বলেছি?” অবাক হয়ে গেল সাদাত।

লামিয়ার কান্নার দমক বেড়ে গেল আরও, নিজের কথাটা শেষ করতে পারলো কোনমতে, “…ওর পাছাটা জোস!”

ধপ করে ওর পাশে বসে পড়লো সাদাত। তালগোল পাকিয়েছে সব। ভালোই পাকিয়েছে!

খবর রিলে করার মানুষটা কে হতে পারে? লুচ্চা শফিক ছাড়া আর কে হবে!

লামিয়াকে দেখে হঠাৎ মায়া হলো সাদাতের। মেয়েটা ভুল তথ্য পেয়ে মন খারাপ করেছে।

হাত বাড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলো সাদাত।

মেয়েটার কান্না থেমে গেছে। দূরে কোথাও একটা কোকিল ডাকলো বলে মনে হলো সাদাতের।

ওর ডান হাতটা নিয়ে নিজের গাল ঠেকালো লামিয়া। নরোম একটা হাত।

পরমুহূর্তে বত্রিশটা দাঁত ঢুকে যাওয়ার তীক্ষ্ণ ব্যথা টের পেল সাদাত।

হাতের তালুতে খুব জোরে কামড়ে ধরেছে লামিয়া!

৭.

দুর্দিনেও সাদাতের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের হতে দেখে খুশিতে আজ ছুপা পলাশের মুখ উজ্জ্বল হলো না। ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো, “আরেক মেয়ের মানে?”

ফস করে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালো সাদাত, “তানিশা।”

চোখ কুঁচকে গেছে পলাশের, “ওই মাগির ঘরের মাগি?”

“হোয়াট? মুখ সামলে কথা বলবি, পলাশ!” ঝাঁ করে মাথাতে রক্ত উঠে গেল সাদাতের।

“তাতে করে কি ওর পরিচয়টা মিথ্যা হয়ে যাবে?” খুব অশ্লীলভাবে হাসলো পলাশ, “ওই ব্যাটা কর্ণেলের চরিত্র সুবিধার না।  তানিশার মাকে ফাটিয়ে দিয়েছিলো। মেয়েটা সিলেটের কোয়ার্টারে দুধ বিক্রি করতো। সু্যোগের সদ্ব্যবহার। তেজ তো দেখছিস লোকের। একদম ছিবড়ে বানিয়ে দিয়েছে ওই মাইয়াকে। এরপর দুধওয়ালী নাকি তিন মাস পা ফাঁক করে করে হেঁটেছে। নয় মাসের মাথায় বাচ্চা পয়দা সারা।”

সাদাতের পৃথিবীটা দুলে উঠলো হঠাৎ। পলাশ তার সাথে ট্রিকস খাটাচ্ছে? তানিশার দিকে তারও চোখে পড়েছে নাকি!

পলাশ কেন মিথ্যা বলতে যাবে!

“ছুপা সালমানের কাহিনী লুচ্চা শফিক বানায় কয় নাই।” বিষণ্ন কণ্ঠে বললো পলাশ, “সালমান নামে একজন ছিলো ঠিকই। তানিশাদের বাড়ি গিয়ে তার জন্ম পরিচয় সম্পর্কে যা-তা বলার পর কর্ণেল তার মাথায় গুলি করে।”

সাদাতের কান ভোঁ ভোঁ করছে। সিগারেটের ধোঁয়াগুলোকে আজ বড় বিষাক্ত মনে হচ্ছে তার।

“আমি ভাবছিলাম, সব লুচ্চা শফিকের বানোয়াট গল্প। সেজন্য সিলেটে খোঁজ লাগায়া দেখি কাহিনী সেই লেভেলের হিন্দী সিরিয়াল।”

“খুনের মামলায় ফাঁসলেন না যে কর্ণেল?” জানতে চাইলো সাদাত।

“হোম ডিফেন্স বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে ওটাকে। প্রোপার্টি তো কর্ণেলের। তাছাড়া সালমানের রেপুটেশন ভাল ছিলো না। অ্যাটেম্পট টু রেইপ বলতেই সব ঠাণ্ডা।”

“তানিশার মা…”

হাহা করে হাসলো আবারও পলাশ, “বললাম না, কর্ণেলের তেজ ছিলো। একদম ফাটিয়ে দিয়েছিলো মাগিকে। মেয়ে জন্মাইছিলো, সেই সাথে মারা গেছিলো মা। পিউর চোদন! জাউরা-চোদা…”

পলাশের হা হা করে হাসতে থাকা দেখে সাদাতের আজ যোগ দিতে ইচ্ছে হয় না তার সাথে। বরং ঘৃণায় তার শরীর রি রি করে ওঠে।

মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটা পলাশের নাকে এসে আছড়ে পড়তেই হাড় ভাঙ্গার ভোঁতা শব্দটা শোনা যায়।

_ পরিশিষ্ট _

সবুজ পাজেরোর ড্রাইভিং সীটের দরজা সশব্দে লাগানো হলো। কর্ণেল আর তানিশা চলে যাচ্ছে।

কোথায়, তা কেউ জানে না। কর্ণেল জানাননি।

কর্ণেল চাননি তাঁদের গন্তব্য আর কেউ জানুক।

পেছনের সিটে বসে আছে তানিশা। তাকে দেখাচ্ছে ফুটফুটে এক পরীর মতো। মন-খারাপ-করা পরী।

সামান্য মাথা নিচু করে বসে আছে মেয়েটা। এখান থেকে পরিষ্কার দেখতে পায় সাদাত।

মেয়েটার মাথা ছুপা পলাশ নিচু করে দিয়েছে। এলাকার সবাই এখন জানে, তানিশার মা ছিলেন একজন দুধওয়ালী। যার সাথে কর্ণেলের অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ছিলো। পথে, কলেজে, মার্কেটে, সবখানেই এখন তানিশার জন্মকাহিনী লেটেস্ট মুখরোচক ঘটনা। বিষয়টা মাটিতে পড়তে না দিয়ে সবাই এ নিয়ে আলাপে মগ্ন। তানিশাকে দেখলে এদের অনেকেই টিটকিরির হাসি হাসে।

তানিশার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু হয়ে গেছে সাদাতের। বিয়ে ছাড়াই মহিলার সঙ্গে কর্ণেলের প্রেমকে কেউ মেনে নিতে পারছে না দেখে সে বাকরুদ্ধ। সমাজের নিজস্ব নিয়ম এড়িয়ে গেলে সমাজ ভাল কিছুকেও প্রাপ্য সম্মান দেয় না। অমর্যাদার সঙ্গে ছুঁড়ে দেয় মাটিতে।

সমাজ মনে রাখেনি কর্ণেল ভদ্রলোকের নিষ্কলুস প্রেমকাহিনী। মনে রাখেনি প্রেমের টানে প্রেয়সীর মৃত্যুর পরও সন্তানের দায়িত্ব এড়িয়ে না যাওয়া একজন সংগ্রামী মানুষকে। সমাজ বিয়েহীন এক যৌনসংস্রবকে মনে রেখেছে শুধু।

জানালা দিয়ে বাইরে থুতু ফেললো সাদাত। ঘৃণার ঘ্রাণ লেগে আছে সে থুতুতে।

তানিশার জন্মটা হয়তো পাপের সমীকরণের একপ্রান্তে।

হয়তো, জন্মের পরও সমীকরণ মেলেনি মেয়েটির, সৃষ্টিকর্তা কেড়ে নিয়েছেন তার সন্তান জন্মদান ক্ষমতা।

হয়তো লামিয়া এখনও তাকে প্রচণ্ড ভালবাসে!

সেজন্য তানিশাকে জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না সাদাত।

লুচ্চা শফিকের গাড়িটা একদিনের জন্য ধার করে নিয়েছে ও।

আস্তে করে ইগনিশন কী ঘোরালো সাদাত। পিছু নিলো সবুজ পাজেরোর।

— ০ —-

** কিছু বাস্তব চরিত্র অবলম্বনে [শফিক, তানিশা, পলাশ, সাদাত। ছদ্মনাম।]

ঐক্য

হলের ভেতর গুমোট একটা পরিবেশ। আজকে রাতে মনে হয় ঝামেলা হবে। এই হলের কাকে যেনো শাহ্‌ কুতুব হলের ছেলেরা টর্চ মেরে খুঁজছে। পেলেই ‘খিঁচে দেবে’। চারদিন পর সেমিস্টার ফাইনাল, পড়ার টেবিলে অযথাই কিছুক্ষণ উশখুস করলাম। দুটো দিন পড়ার টেবিলে জুত করে বসার আশা না করাই ভালো। ফিস্টের রাতে, আর যেদিন হলের মধ্যে কাওকে ‘খিঁচে দেওয়ার’ সম্ভাবনায় পরিবেশ গুমোট থাকে। সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে আজকে দুটো উপলক্ষ্যই ঘটেছে। রাতে ফিস্টের রমরমা খাওয়া সেরে এসে কান নেওয়া কথায় কান দিলাম। তারপর কি আর টেবিলে বসে থাকা যায়?

জানালার সামনে এসে একটা পাল্লা খুলে দিলাম। আতিকের টেবিলে পড়ে থাকা সিগারেটটা তুলে নিয়ে ধরিয়ে ফেললাম চট করে। হাহাকার করে উঠলো রুমমেট, বিড়ি-কিপটা বলে তার সুখ্যাতি ধরে রাখতে অতটুকু হাহাকার সে করেই থাকে, পাত্তা না দিয়ে বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পুকুরের পাড়ে কারও উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিপক বাহিনীর গুপ্তচর হতে পারে। আজকে রাতে হলের চারপাশে অদৃশ্য চোখের আনাগোনা না থাকলেই অবাক হতে হতো।

অর্ধেক হয়ে আসা সিগারেটটা কিপ্টা-আতিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে লম্বা পায়ে বের হয়ে আসলাম রুম থেকে। পড়াশোনা এখন হবে না। সময়টা অন্য কোনোভাবে কাজে লাগানো উচিত। তিনশ’ ছয়ে ঢুকেই গুলির প্রচণ্ড আওয়াজে বুকে থুতু দিয়ে বের হয়ে আসতে হলো। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ঢুকেই পড়লাম, চারটা পিসিতে পুরোদমে চলছে যুদ্ধ। কাউন্টার স্ট্রাইকের প্রকোপে টেকা দায়। সিআর শাফকাতকে এর মধ্যেই বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দেখা গেলো। মোবাইলটা রুমে রেখে আসার জন্য এক আইসবার্গ পরিমাণ আক্ষেপ হলো এবার। এই একটা ছবি তুলে ফেলতে পারলেই পৃথিবীবিখ্যাত ট্রল বানিয়ে ফেলা যেতো। “সার্কেলের যেই বন্ধুটি কেয়ামত নেমে এলেও বই থেকে ওঠে না” – জাতীয় কিছু। সুড়ুৎ করে নাইন-গ্যাগে চলে যেতো!

শাফকাতের কানের পাশে গিয়ে হাঁক ছাড়লাম, “পড়ে তো ফাটায়া ফেলতেছোস, শাআআআলা!”

ধড়মড় করে সোজা হয়ে গেলো ছোকরা, তবে আমার হুঙ্কার এই প্রতিক্রিয়ার পেছনে দায়ী না। বইয়ের পাশে রাখা মোবাইলের আলো জ্বলে উঠেছে। আলো জ্বালানোর পেছনে কে আছে তা জানতে চাইলে আমরা কেউ বলতে পারবো না। শাফকাতের সাথে পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। কিন্তু ইদানিং ফেসবুকের হোমপেজে গেলেই স্কুল জীবনের বান্ধবীদের প্রোফাইল পিকচারেও তার লাইক-কমেন্ট দেখা যায়। বিশাল নেটওয়ার্ক।

“দাঁড়া।” আমাকে পজ করে দিয়ে মোবাইলে হামলে পড়লো শাফকাত।

ঘাড় বাঁকা করে মেসেজের সেন্ডারের নামটা দেখার চেষ্টা করলাম। পরশু আমার ছোটোবোন শ্রাবন্তীর ছবিতেও হারামজাদার লাইক দেখেছি, যদা সতর্ক তবঃ শয়তানমঃ। তবে বেশি সুবিধে করা গেলো না। নিপুণ দক্ষতার সাথে স্ক্রিণ বাঁকা করে মেসেজের রিপ্লাই দিলো ইবলিশটা। তারপর বিগলিত হাসি হেসে বললো, “কিরে? অবস্থা কী?”

সন্দেহটুকু গিলে ফেলে জানতে চাইলাম, “ষোলো নাম্বার চ্যাপ্টারটা তো স্যার টাচ করে নাই, তাই না?”

মাত্রই মরে যাওয়া গেমার বন্ধু দূর থেকে হাঁক ছাড়লো, “আসছে আরেক কেল্টু-চো*(পাবলিশ করার অযোগ্য)। ষোলো নাম্বার চ্যাপ্টার চো*(পাবলিশ করার অযোগ্য)ইতেছে। ওইদিকে দ্বিপকের গুষ্টি হলের সিঁড়িঘরে আইসা বইসা আছে আর তোমরা পড়াশোনা চো*(পাবলিশ করার অযোগ্য)।”

মহাবিরক্ত হলে জানতে চাইলাম, “আর তোমরা কি চো*(পাবলিশ করার অযোগ্য)তেছো?”

এখনও বেঁচে থাকা গেমার বন্ধুটি শুধু জানালো, “ওয়ার্ম আপ।”

বাকি দুইজন নিবিষ্ট মনে শত্রু খুঁজছে। তাদের মধ্য থেকে রাতুল শুধু বললো, “বিড়ি-টিড়ি থাকলে দে তো।”

দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বের হয়ে এলাম। নেহায়েত ল্যাপটপটা নষ্ট বলে, সার্ভিসিংয়ে দিয়ে এসেছি। নাহলে আজকে এহেন অপমানের শোধ গেমের স্ক্রিনে ঠিকই নিতাম।

করিডোরের শেষ প্রান্তে নির্ঝরের রুমের সামনে একটা ছায়া দেখা গেলো। ডাক দিলাম, “নির্ঝর!”

নির্ঝর থেমে গেছে। ঘুরে আমার জন্য অপেক্ষা করলো কতোক্ষণ, তারপর ঢুকে গেলো ভেতরে। তবে দরজায় ছিটকিনি তোলেনি। ওদিকে ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেলাম। নির্ঝরের রুমে আমি কদাচিৎ ঢুকি। হোমড়াচোমড়াদের আবাস। হাইপ্রোফাইল ছাত্রনেতা কনক ওই রুমেই থাকে।

আমার যতোদূর সন্দেহ আজকে রাতে দ্বীপক বাহিনী কনকের জন্যই হলে আক্রমণ করবে। ‘খিঁচে দেওয়ার’ মতো বিশিষ্ট প্রাণি এই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েই বা আছে কয়টা? কনক ছেলেটা আমাদের জুনিয়র, তবে “বিশ্ব–বেয়াদব” খেতাবপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ। ক্যাম্পাস সিনিয়র-জুনিয়র দূরে থাকুক, রাজনৈতিক অঙ্গনেও সিনিয়রদের পাত্তা দেয় না। এসব জারিজুরি অবশ্য পাতিনেতাদের সাথেই। ওপরমহলকে আবার ঠিকই দাঁড়িয়ে স্যালুট দেয় ছেলেটা। নির্ঘাত দ্বিপকের সাথে বড় ধরণের কিছু ঘটিয়েছে। যাকে তাকে খিঁচে দেওয়ার মানুষই দ্বিপক না।

নির্ঝর ঘরে একা ছিলো। চারজনের রুম, থাকে ওরা কেবল দুইজন। নির্ঝর আর বিশ্ববেয়াদব কনক। নির্ঝরের সাথে কথা বলতেও সঙ্কোচ হয় এখন। অথচ ওকে সেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ থেকে চিনি আমি। কলেজটা আলাদা ছিলো, তারপর আবার একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়। আগের সেই নির্ঝর কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে এর মধ্যে। সুদীপ্তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নির্ঝর আর ছাত্রনেতা নির্ঝরের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। উঠতে বসতে সালাম পায় তামাম ক্যাম্পাসের। শিক্ষকরাও সমীহ করে চলেন বলে জেনেছি। তবে ওর ঘরে কনককে না দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ব্যাটা গেছে কোথায় কে জানে? দ্বিপক বাহিনীর ভয়ে গিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকেনি তো?

“দরজাটা লাগিয়ে দিস।” সম্ভাষণ না, প্রথমেই একটা আদেশবাক্য ছুঁড়ে দিলো নির্ঝর।

কথাটা শুনলাম।

“কি খবর তোর?” পরিচিত হাসিটা ফিরে এসেছে নির্ঝরের মুখে, “দেখা সাক্ষাত নাই অনেকদিন।”

কথাটা সত্য। তবে আমরা এক হলেই থাকি এখন। নেতাদের চিরন্তন সমস্যা, অতিব্যস্ত মানুষ।

“খবর তো কনস্ট্যান্ট। তোর খবর কি?” ইঙ্গিতপূর্ণভাবে পাশের খাটটা দেখিয়ে দিলাম, “ঘটনা কতোটা ঘোলা?”

হাসলো নির্ঝর, হাসলে ওকে বেশ ভালোমানুষের মতো দেখায়।

“ভালোই ঘোলা। আজকে রাতে গোলাগুলি হবে। ঘর থেকে বের হইস্‌ না বারোটার পর।”

নির্ভয় মুখটার দিকে তাকালাম, “ওরা কনককে খুঁজছে, তাই না?”

কাঁধ ঝাঁকালো প্রাচীনতম বন্ধু। তারপর বদ্ধ দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বালিশের ভেতর থেকে বের করে আনলো চকচকে একটা রিভলভার। দেখেই মনে হয় ওজনদার জিনিস।

“খুঁজলেই পাবে, তা তো না। আমি রেডি আছি।”

“লুতফুর ভাই কনককে শেলটার দিচ্ছেন তাহলে।” খেদযুক্ত হাসি হাসলাম।

“দিচ্ছেন না, বল্‌ দিয়েছেন। ঝামেলা কিছু হলে সেটা ভাইকে বললেই চলতো। ভাইকে ডিঙিয়ে হলে অ্যাটাক করবে মানে? শুয়োরের বাচ্চাগুলার একটারেও আজকে বাঁইচা ফিরতে দিমু না।” উত্তেজনায় আঞ্চলিক ভাষা বের হয়ে গেলো ওর মুখ থেকে। “জানোস তো, দ্বিপক লুতফুর ভাইয়ের চেয়ে পদের দিক থেকে পিছায়। এইসব বেয়াদবী না?”

দুর্বোধ্য একটা মুখভঙ্গি করলাম, যার অর্থ বেয়াদবটাকে উচিত সাজা দেওয়ার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে দুটোই হতে পারে।

“কনক কোথায়?”

আমার দিকে তাকালো নির্ঝর, অবিশ্বাসের ছোঁয়া তার চোখে। তারপর বললো, “ঠিক কোথায় আছে তা তোকেও বলা যাবে না। কিন্তু হলে নাই। সিস্টেম করে বের করে দিয়েছি।”

“তাহলে তোর ওপর দিয়ে যাবে পুরা ব্যাপারটা।” চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের ভর্তির পর থেকে এই ক্যাম্পাসে চার-চারটা লাশ পড়ে গেছে। আজ রাতে লাশের সংখ্যা দু’-একটা বাড়া অস্বাভাবিক কিছু হবে না।

“তা তো যাবেই।” অমায়িক হাসি হাসলো নির্ঝর, “বললাম না, আজ রাতে গোলাগুলি হবে।”

“হলের সামনে তো পুলিশের গাড়ি দেখলাম।” বলেই ফেললাম।

“ওইটা দ্বিপকই এনে রেখেছে। হল তো আমাদের, এখানে মাইর খেয়ে গেলে পুলিশ সামলাতে পারবে। নাহলে তো যা করার করেই ফেললো।”

ছোটো মাথাটা গ্যাঞ্জামের মতো বড় কিছুতে না ঢোকানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

“তোর থাকার দরকার কি, তুইও-”

আমার মুখের কথাটা মুখেই থেকে গেলো বদ্ধ দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেলো।

“কিরে নির্ঝর, ঘরে আছোস নাকি?”

ঘরের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত আছে, অথচ আমার হাত-পা জমে বরফ হয়ে আসে! ওই গলাটা আমি চিনি। সুজনের গলা ওটা। দ্বিপকের গ্রুপের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছেলে ওই সুজন!

২.

হলের প্রতিটা ঘর একই আকারের, তবে নির্ঝরের ঘরটা বেশ বড় বড় দেখায়। চারজনের জায়গায় দুইজন থাকে তো, খোলামেলা থাকার কারণে আকার খানিকটা বেড়ে যায় যেনো। তবে এই মুহূর্তে ঘরটা যেনো ছোটো হয়ে এসেছে।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছয়জন ভয়াল দর্শন তরুণের মাঝখানে একেবারে মধ্যমণি হয়ে আছি আমরা দু’জন। দেওয়ালে হেলান দিয়ে খাটে বসে আছে নির্ঝর, দরজা খোলার আগে ওই অবস্থানে চলে গেছে সে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, সামান্য অসতর্কতার সুযোগে বালিশের নিচ থেকে রিভলভারটা বের করে গুলি করবে। ডাবল অ্যাকশন রিভলভারে হ্যামার টানার ঝামেলা নেই। ঘোড়া টিপলেই কাজ হয়ে যাবে।

“কনক কোথায়?” কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইলো বেঁটেমতো এক ছেলে। এই ছেলে কনকের ব্যাচের। আমাদের জুনিয়র।

তার দিকে শান্তভঙ্গিতে মুখ ফেরালো নির্ঝর, “থার্ড ইয়ারে উঠ্‌সো, আদব-কায়দা তো শেখো নাই কিছু।”

বলার ভঙ্গিতে একটা কিছু ছিলো, দুর্ধর্ষ ছেলেটাও কেমন যেনো কাচুমাচু হয়ে গেলো।

সুজন আরও এক পা এগিয়ে গেলো খাটের দিকে, পরিস্থিতি সামলে নিচ্ছে দ্রুত, “দ্যাখ নির্ঝর, ঢঙ মারাস না। তুইও জানিস, আমরাও জানি এখানে আমরা কি করতে আসছি। কনক কই আছে কইয়া দে, যাইতেছি আমরা। তোর সাথে আমাদের কোনো সমস্যা নাই।”

হাসলো নির্ঝর, যেনো সে-ই ছ’জন সঙ্গি নিয়ে কথা বলছে সুজনের সাথে, “এবার একটা কাজের কথা বললি দোস্ত। চেয়ার নিয়ে বসে পড়। তোর সাথে আমার এই বিষয়ে কথা আছে। কনকের ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বল্‌ তো।”

সুজনের মুখের কৃত্রিম হাসিটা ধীরে ধীরে মুছে গেলো, রাতারাতি কুৎসিত হয়ে গেছে তার চেহারা, ক্রোধ আর জীঘাংসা সেখানে। “তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করতেছোস্‌-”

“তাই?” সবার মুখের দিকে একে একে তাকালো নির্ঝর, ভয়ের চিহ্নও নেই সেখানে, “আমার হলে ঢুকে মাঝরাতে আমার ঘরে তোরা ছয়জন দাঁড়াইয়া আছিস, আর বাড়াবাড়ি করতেছি আমি?”

বাম দিকের ছেলেটাও জুনিয়র, আচমকা এগিয়ে এসে নির্ঝরের মুখের ওপর চড়াৎ করে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো সে, “খানকির পোলা, কাহিনী প্যাঁচাও? কনককে কই লুকায় রাখছিস সেইটা ক, মাদার-”

মারলো নির্ঝর। অন্তত আমার মস্তিষ্ক তেমনটাই ব্যখ্যা দিলো ঘটনাটার। জুনিয়র ছেলেটার মাথা আচমকে পেছনে ছিটকে গেলো, তারপর ঘরের পেছনের দেওয়ালের কাছে টলোমলো পায়ে পিছু হটলো সে। দেওয়ালে আছড়ে পড়ে বসে পড়লো মাটিতে। অথচ নির্ঝর এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি, কেবল ওঠার উপক্রম করছে।

একসঙ্গে বাকি পাঁচজনের হাত নড়ে উঠতে দেখলাম, তারা কেউ নির্ঝরের গায়ের দিকে হাত বাড়ালো না। এক মুহূর্ত পর চকচকে কুৎসিতদর্শন কিছু অস্ত্র এনার্জি লাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করতে শুরু করলো। এদের মধ্যে দুটো সরাসরি আমার মাথার দিকে তাক করে রাখা হয়েছে, আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো আমার। পেটের মধ্যে এখনও না হজম হওয়ার ফিস্টের খানাখাদ্য আলোড়ন তুলছে। নির্ঝরের বিশাল রিভলভারটা একেবারে সুজনের কপালে লাগানো। নিষ্ঠুরতম যুবক এখনও পিস্তলটা পজিশনে আনতে পারেনি।

এক মুহূর্তের জন্য ঘরটার ভেতরে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো।

ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলাম আমি। যে কোনো সময় একাধিক গুলির আওয়াজ পাবো, জানি। আজ রাতে প্রথমবারে শোনা গেমিংয়ের আওয়াজ নয় সেটা। সত্যিকারের বুলেট উড়িয়ে নিয়ে যাবে আমার সত্যিকারের খুলি।

নির্ঝর খুব শান্তিতেই মরবে বোঝা যাচ্ছে, প্রাণের শত্রু সুজনকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে তো। আমারই থেকে যাবে একবুক আক্ষেপ আর হতাশা। আগামীকাল প্রখ্যাত ছাত্রনেতাদের কাতারে আমারও নাম উঠে যাবে। পত্রিকাগুলোর যে বিচারবিবেচনা!

নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো বাইরে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়িটা। রাতের আকাশ চিরে দিয়ে তীক্ষ্ণ শব্দে সাইরেন দিতে দিতে ছুটে গেলো ওটা। দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সাইরেনের শব্দ। অদ্ভুত এক হাহাকারে ভরে উঠছে রাতের আকাশ।

চারপাশে অনেকগুলো দরজা খুলে যাওয়ার শব্দ শোনা গেলো তারপর। উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে হলের সব ছাত্র। দরজায় কড়া নাড়লো কেউ, গলাটা এবারও চিনলাম। পলাশ, গোবেচারা ধরণের এক ছেলে। এই অসময়ে মরতে এলো কেনো নির্ঝরের রুমে?

“দরজা খোল্‌ নির্ঝর, শিঘ্রি!”

জমে গেলাম ভেতরের আটজন মানুষ।

“ভিসি স্যারের বাসায় অ্যাটাক করছে জঙ্গিরা। সবাই হোস্টেজ, দারোয়ান স্পটডেড! দরজা খোল প্লিজ, জলদি!”

একে অন্যের দিকে তাকালো দুই পক্ষ। মেঝেতে পড়ে থাকা জুনিয়রটা একবার বসার চেষ্টা করে আবারও পড়ে গেলো। গালের একদিক ফুলে উঠেছে তার।

“বাইক নিয়া আসছিস না?” সুজনকে প্রশ্ন করলো নির্ঝর।

“হ।”

“চল, কুইক।” কোমরের পেছনে রিভলভারটা ঢুকিয়ে ফেললো সে, “কুইক!”

ভূতের মতো সবাই সবার অস্ত্র নামিয়ে ফেললো। দরজা খুলে বের হয়ে গেলো ওরা। হতভম্বের মতো পেছনে পেছনে বের হয়ে এলাম আমিও।

হলগুলো যেনো জ্বলছে, ফেটে পড়ছে। ক্রোধে দিশেহারা সবাই। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে জিম্মি করার ঘটনা তাদের ভেতরে ক্রোধের আগ্নেয়গিরি জন্ম দিয়েছে।

নির্ঝরকে তীব্র গলায় বলতে শুনলাম, “আজকের কাহিনী ভুলে গেলাম, এমন না। কিন্তু এইটা আমরা পরে সেটল করবো।”

কাঁধ ঝাঁকালো সুজন। ওদের গতি এখন এতো বেশি, তাল মেলাতে আমার দম বেরিয়ে যাচ্ছে।

প্রথমে বেয়াদবী করেছিলো যে বেঁটে ছেলেটা, তার দিকে ঘুরে তাকালো এবার নির্ঝর, “আর তুমি! দৌড় দিয়া চারতলায় যাওগা। চারশ সাতে কনক আছে, ওরে ডাক দিয়া নিয়া আসো ভিসি স্যারের বাসার সামনে। ওকে?”

মাথা দুলিয়ে দৌড় দিচ্ছিলো দ্বিপকের চ্যালা, তাকে থামিয়ে আবারও বললো নির্ঝর, “ওরে কইয়ো, খালি হাতে যেনো না আসে।”

রচনাকাল – আগস্ট ১৭, ২০১৬

শানে নুজুল – জুলাইয়ে গুলশান অ্যাটাকের পর আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। এরপর ফারাজকে নিয়ে বানানো আমার কন্টেন্ট নাইন গ্যাগে যায়। প্রথম আলোর আগে আমি-ই শুরু করেছিলাম ফারাজকে হিরো বানাবার ক্যাম্পেইন। জানতাম, এটা আদর্শের সাথে আদর্শের লড়াই। সন্ত্রাসের গল্পের বদলে আমরা যদি ছড়িয়ে দেই সাহসের গল্প, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জঙ্গিদের সবটা পরিকল্পনাই বানচাল করে দেবে। পরের মাস আগস্টে লেখা এই গল্পে আমার সেইসব উপলব্ধির অনেকটাই ফুটে উঠেছিল।

আত্মহত্যা

‘আত্মহত্যা করার জন্য ভালো দেখে একটা তারিখ তো ঠিক করা উচিত।’

রায়হানের কথা শুনে দ্বিমত দেখতে পায় না শাওন। আত্মহত্যা একটা মানুষ রোজ রোজ করতে পারবে না। কাজেই ভালো দিনক্ষণ দেখেই ঝুলে পড়া উচিত। অবশ্য ঝুলে পড়বে কি না তা এখনও ওরা জানে না।

এতটুকু অন্তত জানে, মরাটা দরকার। যত দ্রুত মরতে পারবে ততই ভালো – এমনটাও না। কিছু কাজ বাকি আছে। কর্মই জীবন – কথাটার সত্যটা এখন ওরা বোঝে, এবং বেশ ভালোই বোঝে।

রায়হান এখন হাতের ছুরিটা নাচাচ্ছে। ওটা দিয়েই ভবলীলা সাঙ্গ করার খায়েশ ছেলেটার। তাকে এজন্য কোনরকম দোষ দেয় নি শাওন। বরং একারণে তাকে কিছুটা শ্রদ্ধা করে শাওন। নিজের নার্ভ অতটা শক্ত না তো!

শাওন বেছে নিয়েছে আরও সহজ পদ্ধতি। বারোতলা বিল্ডিংটাতে ওরা থাকে, ওটার ছাদ থেকে লাফ দেবে।

দুই বন্ধুর বন্ধুত্বটা আজকের না। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে একসাথে আছে তারা। কাজেই একে অন্যের সাথে বেঈমানী না করে একই দিনে মরতে চাওয়াটা নিশ্চয় দোষের না? সেজন্যই এখন আসছে দিন তারিখ ঠিক করার কথা।

‘খুনটা কালকে করে ফেলা যাক, নাকি?’ ঠাণ্ডা গলাতে বলে রায়হান।

স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় শাওন। নিজেকে কাটতে খারাপ লাগলেও মানুষ কাটতে তার কোনদিনও খারাপ লাগেনি। সায় দেয় একবার হাল্কা মাথা নাড়িয়ে।

‘শিওর।’

১.

স্মৃতিদের বাড়িটা বিশাল। ও বাড়িতে পা রেখে আমজাদ সাহেবের সাথে কথা বলার সাহস বা ইচ্ছে – কোনটাই তেমনভাবে অনুভব করে নি শাওন আগে। এমনকি, এখন বেশ একটা গ্যাড়াকলে পড়ে আছে, তাও খুব একটা তাড়না তো টের পাওয়া যাচ্ছে না! সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। মেয়ের বাবা এবং তার সাথে আলোচনার আগ্রহ সব সময়ই ছিলো বর্গের ব্যস্তানুপাতিক অবস্থানে।

মেয়েটার সাথে শাওনের প্রেম চলছে আজকে থেকে ছয় বছর আগ থেকেই। শুরু থেকেই জানতো ফকিরের মত হালচাল থাকা নিজের সাথে স্মৃতির বিয়েতে ঝামেলা আসবে। কিন্তু দুইজনই, ‘পরে দেখা যাবে’ নীতিতে বিশ্বাস করে চালিয়ে গেছে ওদের সম্পর্কটা।

‘পরে’ অবশ্য ‘দেখা যায়’নি। আমজাদ সাহেবের লাইসেন্স করা একটা দোনলা বন্দুক ছিল। আর ছিল ট্রেসপাসিং করতে থাকা যে কাওকে গুলি করার অধিকার।

ওটা আইনী অধিকার যতটুকু – তার থেকেও বেশি অর্থনৈতিক অধিকার।

আমজাদ সাহেবদের মত মানুষ দুই চারটা লাশ পুঁতে রাখতেই পারেন। কেউ কিছু মনে করে না সাধারণতঃ।

কাজেই শাওন নিজের ব্যাপারে কথা বলার সাহস অর্জন করতে পারেনি। কথা যা বলার বলেছিল স্মৃতি।

তবে এতে করে মেয়েটার বিয়ের ব্যাপারে হাল্কা প্রভাবও ফেলা যায়নি।

সেদিনই প্রথম বোঝা গেছে, ভদ্রলোক দুটো অ্যালশেসিয়ানকে এমনি এমনি পোষ মানাতে পারেননি। বরং কুকুরদুটো তাঁর একরোখামির কাছে হার মেনেই পোষ মেনেছিল। স্মৃতিকে পোষ মানানোটা সেখানে একরকম ছেলেখেলাই।

কাজেই খেলাটিতে জিতেছেন আমজাদ সাহেব। এরপর থেকে স্মৃতি একেবারেই হঠাৎ অচেনা মানুষের মত ব্যবহার শুরু করল শাওনের সাথে। কী এক ভানুমতি! কাজেই এবার আমজাদ সাহেবকে নিজেই ফোন দেয় ছেলেটা।

আলোচনাটা দীর্ঘ হয়নি। পয়তাল্লিশ সেকেন্ড যাবার আগেই তিনটি পরিচিত ইংরেজী গালি এবং ছয়টি না শোনা ফ্রেঞ্চ গালি শুনে ফোন রেখে দিয়েছিল বেচারা। এমন মানুষের সাথে কথা বলা চলে না। মেয়েটার বিয়ের দিন দূর থেকে একবার দেখে বাসাতে ফিরে যায় ও। তারপর বন্ধু রায়হানকে ফোন দেয়।

রায়হান খুশিতে একেবারে বাকবাকুম করে উঠেছিল, ‘তুইও মরবি নাকি? সাবাশ! আমি তো ভেবেছিলাম আজ রাতেই নিজেকে একেবারে শেষ করে দেব। তাহলে ডেট কিছুটা পেছানোই যাক, নাকি?’

শাওন আস্তে করে শুধু বলেছিল, ‘এক ভোটকা ধনীকে খুন করে তারপর মরবো। তোর ততদিন ধৈর্য্য হবে তো? একসাথে মরতাম।’

রায়হান এক বাক্যে রাজি হয়ে যায় তখনই।

রায়হানের কেসটা আলাদা। তার মরার ‘পিনিক’ আজকের না। এক সপ্তাহ ধরে টানাপোড়নের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে বেচারা। বয়েস মাত্র একুশ – এর মাঝেই বিশ লক্ষ টাকার দেনাতে আছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট পড়তে গিয়েই এই ঝামেলার শুরু।

একটা বিশ লক্ষ টাকার বন্ড হারিয়ে ফেলার সাথে সাথে সব দায় তার ওপর এসেই পড়েছে। বন্ডটা গেছে কার পকেটে সে ব্যাপারে রায়হানের যদিও বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই। একই সাথে তার ধারণা নেই পনেরদিনের ডেডলাইনের মাঝে কিভাবে বিশ লক্ষ টাকা ম্যানেজ করা যেতে পারে। ছাপোষা পরিবার থেকে এসেছে, আগামি তিন বছর খুঁজলেও তাকে বিশ লাখ টাকা ম্যানেজ করে দেবার মত লোক খুঁজে পাবে না। জেলে তাকে যেতেই হবে এবং যেতে হবে লম্বা সময়ের জন্য।

ছেলেটার জন্য আসলে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন অপশন খোলাও ছিল না।

এই মুহূর্তে দুইজনই শপিং মলটার কাছেই ঘাপটি মেরে পড়ে আছে তার কারণটা সহজ। আমজাদ সাহেবকে ফলো করে এখানে আসতে দেখা গেছে। বুড়ো ভাম বের হয়ে এলেই গাড়ি থেকে চট করে নামবে রায়হান। তারপর ছুরি মেরে ব্যাটার ভুড়ি দেবে ফাঁসিয়ে। স্টার্ট দিয়ে অপেক্ষাতে থাকবে শাওন। বন্ধু লাফিয়ে গাড়িতে গিরে এলে পাগলা ঘোড়ার মত ছোটাবে সেটা। ছুরি রায়হানকেই মারতে হবে, কারণ শাওনকে এলাকার ত্রিসীমানাতে দেখামাত্র জলহস্তিটা একটা সিন-ক্রিয়েট করে ফেলবে।

এই গাড়িও ওদের না। বন্ধু রাশেদ দিয়েছে দুই ঘন্টার জন্য। লাইসেন্স প্লেটটা পাল্টে নকল একটা ঝুলিয়ে দিতে সে ভোলেনি।

‘হারামজাদা বের হচ্ছে।’ ফিস ফিস করে বলে শাওন। ‘থরহরিকম্প!’

মোটাসোটা আমজাদ সাহেব আসলেই একজন চলন্ত ভূমিকম্পের মত দুলছেন। এই মোটকার মত বিদঘুটে লোকের ভেতর থেকে এত সুন্দর মেয়ে কিভাবে জন্মালো? শাওন ভেবে পায় না।

রায়হান ভাবছে না। দরজা খুলে শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছে মিস্টার অ্যান্ড মিসেসের দিকে। মহিলাও আছেন সাথে। বিষয়টা নিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যে আগেই কথা হয়ে গেছে। মহিলার ওপর বিশেষ কোন রাগ নেই শাওনের।

শাওন আস্তে করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রায়হানকে পুরোটা সময় নজরের মধ্যে রেখেছে।

আমজাদ সাহেব দেখলেন অদ্ভুত রকম একটা ছেলে হেঁটে এসে কোন কথা না বলে তাঁর পায়ের ফাঁকে লাথি মেরে দেয়। ব্যথাতে তিন চোখে অন্ধকার দেখছেন – ঠিক পেছনে লিমার চিৎকার শোনা যাচ্ছে – এর মাঝেই ছেলেটা লম্বা একটা ছুরি বের করে।

রায়হান মোটা লোকটার মাথা গাড়ির দরজার সাথে চেপে ধরে কচ কচ করে গলাটা কেটে দেয়। পিচকিরির মত ছিটকে আসতে থাকা রক্তগুলোকে অগ্রাহ্য করে ছিন্নভিন্ন গলা দিয়ে ছুরি চালাতে থাকে বার বার।

কিছুক্ষণের মাঝেই মাথাটা কেটে দুই টুকরো হয়ে গেল।

মহিলা হিস্ট্রিয়াগ্রস্থদের মত চেঁচাচ্ছে। তার দিকে বিরক্তির সাথে তাকায় রায়হান। তারপর আস্তে করে মাঝবয়েসী মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে বার দুয়েক ছুরি বসায় তার পেটে।

চিৎকার থেমে গেছে। শপিং মল থেকে একজন গার্ডও বের হয়ে আসছে প্রাণপনে।

তীরের মত গাড়ির দিকে ছোটে রায়হান। শাওন তার উঠে পড়া নিশ্চিত হতেই ছুটিয়ে দেয় গাড়ি।

‘এবার নিজেদের জবাই করাটা বাকি থাকলো ।’ বিড় বিড় করে বলে রায়হান।

২.

কর্মটি সে রাতে করতে চাইলেও সম্ভব হল না।

রাশেদের গাড়ির লাইসেন্স প্লেট নম্বর পাল্টে ঝামেলা এড়ানো যায়নি। বরং কয়েক ডিগ্রী বেড়েছে। এখন প্রতিটি রেজিস্ট্রি করা এক মডেলের গাড়ির পেছনে লেগে গেছে পুলিশ। অ্যাড্রেস ধরে ধরে খুঁজছে। ঘটনা ওদের আগে বোঝা উচিত ছিল।

আমজাদ সাহেব ফালতু কোন নাগরিক নন।

ঘটনাচক্রে রাশেদের লিংকের অভাব ছিল না। পুলিশের তৎপরতার কথা সে আগেই জেনে ফেলেছে। এই মুহূর্তে রায়হান আর শাওনের দায়িত্বটি সহজ। গাড়িটা ডাম্প করার সুযোগ পাওয়া যাবে না, কাঁচকি মাছ ধরার মতো সুক্ষ্ম জাল পেতেছে পুলিশ। অন্য কোন বাসাতে এই গাড়ি কিংবা এভিডেন্স ভরে ফেলতে হবে। পুলিশ পুরো ঢাকা শহরের সব গ্যারেজ খুঁজতে পারবে না। পারলেও, আজকে রাতে নয়।

‘গাড়ি নিয়ে এত মাথাব্যথার দরকার ছিল না।’ বিড় বিড় করে বলে রায়হান।

মাথা নাড়ে শাওন, ‘দরকার তো আছে। পুলিশের ক্যাচালে পড়ে যাওয়া লাগতে পারে।’

‘আমাদের জন্য সেটা সমস্যা না। এক কোণে মরে পড়ে থাকবো। ক্ষতি কি?’

‘রাশেদ তো আর মরছে না। শালাকে একেবারে চ্যাপ্টা করে দেবে পুলিশ।’ ব্যাখ্যা দেয় শাওন।

চুপচাপ ড্রাইভ করে ও কিছুক্ষণ। রায়হানের বাড়িয়ে দেওয়া সিগারেটটা নেয় না। অলিগলি ধরে বের হয়ে যেতে হবে যতদূর সম্ভব। তারপর বড় রাস্তায় দশ মিনিট থেকে আবার নেমে যাবে গলিতে। কাফরুলে একটা বাসা আছে রাশেদের খালাতো ভাইয়ের। সেখানে গাড়ি ফেলে আসলেই আপাতত কাজ শেষ।

চিপাগলি দিয়ে পরের মোড়টা নেওয়ার সাথে সাথে কেঁপে ওঠে গাড়ি। পা একেবারে গাড়ির মেঝের সাথে দাবিয়ে দিয়ে ব্রেক কষে শাওন।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।

‘মাল খাইয়া চালাইতেছস গাড়ি?’ হুংকার দিয়ে ওঠে রায়হান।

‘কাকে পিষলাম আবার বাল!’ দরজা খুলতে খুলতে এতটুকুই বলে শাওন।

গাড়ির সামনে পড়ে থাকা মানুষটাকে দেখে আঁতকে ওঠে ওরা।

তরুণীর বয়স খুব বেশি হলে বিশ হবে। না খেয়ে না খেয়ে জিরো ফিগার বানিয়েছে নিজের। সেই ফিগার নিয়েই পড়ে আছে এখন মাটিতে। উঠে পড়বে খুব শীঘ্রই সে সম্ভাবনা দেখে না ওরা।

এদিক ওদিক তাকায় ওরা। এলাকা বড়ই নির্জন। কাওকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

‘শালীকে ট্রাংকে তুলে ফেল। চিপা দেখে ফেলে দেওয়া যাবে।’ দ্রুত পরামর্শ দেয় রায়হান।

গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় শাওন, ‘হু কেয়ারস? এখানেই থাকুক।’

‘পুলিশ ধারণা করতে পারে একই গাড়ির কাজ এটা। পরে কাফরুলও সেফ হবে না। আমরা খুব কাছে এখন। সন্দেহজনক গাড়ির কথা কেউ তুললে আমাদের ঝামেলা হয়ে যাবে।’ বন্ধুকে বোঝানোর চেষ্টা করে রায়হান।

চ্যাংদোলা করে রক্ত মাখা তরুণীকে ট্রাংকে ভরে ফেলতে এর পর বেশি সময় লাগে না। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বড় নিঃশ্বাস ফেলে ওরা। আত্মহত্যার আগে আর কয়টাকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবে – তাই ভাবছে হয়ত।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ে রায়হান, ‘চল, যাওয়া যাক।’

ধীরে ধীরে গাড়ি চালায় এবার শাওন। সাবধানে থাকার জন্য যেটুকু সতর্কতা না নিলেও হয়, তাও নিচ্ছে এখন। আর কোন ঝামেলাতে জড়াতে চায় না। বড় রাস্তায় ওঠার সাথে সাথে চারপাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। সামনের দিক থেকে অনেক গাড়ি ছুটে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। ডিভাইডারের ওপাশের গাড়িগুলোর আলো ওদের চোখে আজ একটু বেশি পরিমাণেই লাগে।

‘লাইটস … আর দেখতে হবে না এসব যন্ত্রণা কিছুক্ষণ পর।’ মন্তব্য করে শাওন।

কিছু বলে না রায়হান। সামনে ঝামেলা দেখতে পাচ্ছে। অনেকগুলো গাড়ি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকার চিরায়ত জ্যাম।

‘ড্যাম!’ স্টিয়ারিংয়ে থাপ্পর দিয়ে বলে শাওন।

কিছু করার নেই। ধীরে ধীরে গাড়ি থামিয়ে ফেলে ও। শেষ গাড়িটার এক ফুট দূরে এসে থেমে যায় এই গাড়ির বাম্পার। জানালার কাচ পুরোপুরি নামিয়ে মাথা বের করে সামনে তাকায় শাওন। বোঝার চেষ্টা করছে কতদূরে গেছে সামনের লাইনটা। খুব লম্বা হওয়ার অর্থ যে কোন সময় ছেড়ে দেবে জ্যাম ওদের।

ঝট করে মাথা আবার ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় ও পরক্ষণেই।

বিড় বিড় করে একটা  শব্দই উচ্চারণ করে ও, ‘ক্র্যাপ!’

কারণটা জানতে চেয়ে মাথা সরাচ্ছিল রায়হান, থেমে যায় মাঝপথেই। দেখতে পেয়েছে কারণটা। কালো রঙের একটা গাড়ি পাশে থেমেছে ওদের।

গাড়িটা র‍্যাবের।

এতটুকু হলেই যথেষ্ট হত। ড্রাইভিং সীটের পাশে বসে থাকা র‍্যাবটি একটা টর্চ জ্বালিয়ে ওদের মুখের ওপর ফেলে।

‘কোথায় যাবে এই গাড়ি?’

মিথ্যা বললে এমনভাবে বলতে হয় – যাতে সেটা সত্যের কাছাকাছি পড়ে। আর সেই সাথে হতে হয় তাৎক্ষণিক। চট করে জবাব দিতে না পারলে অবশ্যই কেউ মিথ্যাটাকে সত্য হিসেবে ধরে নেবে না।

কাজেই উত্তরটা সাথে সাথেই দেয় শাওন, ‘পল্লবী।’

র‍্যাব মানুষটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কিছুটা।

এবার সে গলা নামিয়ে আবদারটা জুড়েই দিলো, ‘একজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে যেতে পারবেন? আমাদের টহল লাইনের বাইরে চলে যাচ্ছে তো জায়গাটা। আসলে, একজন ভিআইপি যাচ্ছিল আমাদের সাথে। অসুবিধে?’

একে অন্যের দিকে তাকায় ওরা, গলা শুকিয়ে গেছে। এটা কি গাড়ির মডেল দেখে র‍্যাবের সন্দেহ থেকে বলা হচ্ছে, নাকি আসলেই প্যাসেঞ্জার যাবে ওদের সাথে?

এই সময় পেছন থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলো। ট্রাঙ্কের ভেতর কে যেন ধুপ ধুপ করে শব্দ করছে। মেয়েটা মরেনি নাকি?

ওরা দেখেছিল রক্তে ভিজে আছে তার সারা শরীর। এরকম একটা ধাক্কা খাওয়ার পরও হারামজাদী বেঁচে গেল কি করে?

এখন প্রাণের সুখে লাথি মারছে। বের হতে চাইছে আধমরা প্রাণিটা ট্রাংক থেকে!

অপ্রতিভ ভঙ্গীটা সরিয়ে র‍্যাবের দিকে তাকায় শাওন। মুখে চওড়া একটা হাসি ধরে রেখেছে। লোকটার মনোযোগ ট্রাংকের দিকে যাওয়ার আগেই রাজি হয়ে যাওয়া উচিত। সামনে জ্যাম ছুটে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

‘পাঠিয়ে দেন আপনার প্যাসেঞ্জারকে। আমরা নামিয়ে দেবো।’ ভাঙ্গা গলাতে বলে ও।

৩.

উঠে বসে হাঁফায় শাওন। চারপাশে অসংখ্য মনিটরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে আবারও ব্যর্থ হয়েছে ও।

পরিচিত জায়গাতেই পাওয়া গেল পানির বোতলটা। এক ঢোকে অর্ধেকের বেশি শেষ করে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। তারপর একটু ফিরে তাকায় একপাশে। রায়হান শুয়ে আছে এখনও। চোখ দুটো বন্ধ।

মাথার পেছনে হাত দিয়ে যন্ত্রাংশগুলো খুলে ফেলে হেঁটে বের হয়ে আসে শাওন ঘরটা থেকে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পোশাক পড়ে থাকা মেয়েটা ইঙ্গিতে বোঝায় তিনটা ঘর পরে চলে যেতে।

তার দিকে ভ্রু কুঁচকে একবার তাকিয়ে হেঁটে যায় ও।

দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন ড. রাশেদ। ইঙ্গিতে দেখালেন চেয়ারে বসে পড়ার জন্য। কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে শাওন। মনিটরে চোখ রাখতে দেখতে পায় সেখানে অভাবনীয় নাটকের জন্ম দিয়েছে রায়হান।

*

দুইপা-তে যতটা শক্তি আছে সব ঝেড়ে দিয়ে দৌড়াচ্ছে রায়হান এখন।

র‍্যাব তুলে দিয়েছে যাকে সে পুলিশের এক্স-কমিশনার। তাঁকে ডেকে আনা হয়েছিল একটা কাজে সাহায্যের জন্য আর সেকারণেই ফিরিয়ে দেওয়াটা র‍্যাবের দায়িত্বের মাঝেই পড়ে গেছে – এটা ওরা বুঝতে পারে। একই সাথে ওরা বুঝতে পারে, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর কেমন ঢোড়া সাপ হয়ে পড়েন। এই লোকটা যদি এখনো চাকরিতে থাকতো, তাকে একজন সিভিলিয়ানের গাড়িতে তুলে দিয়ে জ্যাম ঠেঙানোর কষ্ট এড়াবার চেষ্টা র‍্যাব কখনোই করতো না। স্যার ডাকতো এবং বাড়ির গেটে নামিয়ে দিয়ে আসতো। অবসরের পর সবাই বাতিল মাল।

তবে, আমজাদ সাহেবের মৃত্যুর সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না পুরো ঘটনাটার।

পল্লবীতে লোকটাকে নামিয়ে দেওয়ার পর পরই বিকট লাথি মেরে ট্রাংক কাঁপিয়ে দিয়েছিল হতচ্ছাড়া মেয়েটা।

আরোহী লোকটা পুলিশ কমিশনার ঘাস খেয়ে হননি। তিনি এক লাফে বের হয়ে এসেছিলেন গাড়ি থেকে। চিৎকার করে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ট্রাংকে কি নিয়ে যাচ্ছেন, অ্যাঁ? খুলুন এখনই!’

অন্যদরজা খুলে নেমে এসেছিল রায়হান। ট্রাংক খোলার চেয়ে লোকটার গলা খুলে দেওয়াই সহজ কাজ মনে হচ্ছিল তখন ওর, কাজেই একটানে চিড়ে দিয়েছে ওটা। ঝর ঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ার সময় প্রথমবারের মত খেয়াল করে ও – কাছের চায়ের দোকানের প্রতিটা মানুষ ড্যাব ড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে!

বিন্দুমাত্র সময়ক্ষেপণ না করে ছুটে আসে ওরা। রায়হান আর শাওনকে নিয়ে তাদের কি পরিকল্পনা সেটা বোঝার জন্য মাইন্ড রীডার হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। খুনি পেটাবে। এদেশের মানুষ ছিনতাইকারী পেলেই যে মারটা দেয়, আজকে ওদের কীভাবে মারবে তা বুঝতে দেরি হয়নি কারোই। বনেটের ওপর দিয়ে পিছলে গাড়ির অন্যপাশে চলে যায় রায়হান। ছুরিটা শক্ত করে ধরে আছে এখনও। প্রাণপনে ছোটে অন্য পাশের গলিটা ধরে।

ঘাড়ের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বুঝতে পারে ওদিকে শাওনকে চেপে ধরেছে চারজন মানুষ। ড্রাইভিং সীটে বসে ছিল ও। সময়ই পায় নি বের হওয়ার। ছেলেটার নাক মুখ এরই মাঝে ফাটিয়ে দিয়েছে ওরা।

তীরের মত ছোটে রায়হান। মাথাতে বার বার একটা প্রশ্নই আসছে ঘুরে ফিরে।

বার বার!

একটু পর যখন মরেই যাবে – তখন কেন নিজেকে বাঁচানোর এত প্রচেষ্টা?

জবাবটা পাওয়ার আগেই সামনে মোটা লোকটাকে দেখতে পায় ও। দাঁড়িয়ে আছে ওকে বাঁধা দেওয়ার জন্য। পেছনে ছুটন্ত জনতা আর সামনে ছুটতে থাকা এক তরুণকে বাঁধা দিতে চিকণ লোকরাও দাঁড়িয়ে যায় – সেখানে ইনার স্বাস্থ্য মাশাআল্লাহ।

ছুটতে ছুটতেই একবার ছুরি চালায় রায়হান। রক্তমাখা হাত নিয়ে ককিয়ে উঠে বসে পড়ে বাধার বিন্ধ্যাচল। জবাবটাও পেয়ে গেল ও।

পেছনের ওরা ধরে ফেললে ওকে মেরে ফেললে তো বেশ, তবে সম্ভাবনা আছে এক পর্যায়ে থানায় নিয়ে যাবে ওকে। ঠিক যে কারণে ও সুইসাইড করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে – জীবনটা অবশ্যই ও কাটাতে চায় নি একটা বদ্ধ জায়গাতে। বিশ লাখ টাকা হারানোর পর ওখানেই থাকা লাগত ওকে। বিশ বছরের জেল কোন মানুষের জীবন হতে পারে না। কাজেই জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিল।

খুনের অপরাধে যদি ফাঁসীও দেওয়া হয় ওকে – সেই বোরিং জেল লাইফ তাকে পার করা লাগবে। সেটি আসলেই রায়হানের সহ্য হবে না।

কাজেই – ছুটতে হবে ওকে। পালিয়ে যেতে হবে যে করেই হোক!

*

‘ব্যাপার কি?  আত্মহত্যা করতে চাইছে না কেন সাবজেক্ট?’ বিড় বিড় করে জানতে চায় শাওন। জনতার ধোলাইয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেছে ওর। রায়হানের পথ আলাদা হয়ে যাওয়ায় তার স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটেনি।

‘জানি না। আমাকে তো বেশ একটা চরিত্র দিয়েছেন আপনারা স্বপ্নে। বন্ধু রাশেদ! হাহ!’ তিক্ত হাসি দিয়ে বলেন ডক্টর।

‘কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?’ জানতে চায় শাওন।

‘দুই ঘন্টা। স্বপ্নের ডিউরেশন ত্রিশ মিনিট।’

‘অনেক সময়। কয়েক দিন পার হয়ে গেছে। তাও আমরা কেউ আত্মহত্যা করি নি এখনও। কেন, ডক্টর?’

ডক্টর রাশেদ প্রশ্নটার উত্তর সাথে সাথে দেন না।

ড্রীম সিমুলেটর নামক নিওরোলজিক্যাল মেশিনটা বেশ কাজের। কাজের – সমাজের ঋণাত্মক মানসিক কারণগুলোর চিকিৎসা করতে। রেপিস্টদের নিয়ে একটা টেস্ট আগে করা হয়েছে। রেপ সিমুলেটরে সাধারণ মানুষদের পাঠিয়ে দেখা গেছে তারা অনায়াসে স্বপ্নের মাঝে ধর্ষণ লীলাতে মেতে উঠেছে।

ফলাফলস্বরুপ একদম নিখুঁত একটা পরিবেশে সাবজেক্টকে পেয়েছেন ডক্টর।

ঠিক কোন কোন পরিবেশ উদ্ভূত হলে রেপ কেসে সাবজেক্ট লেগে যাচ্ছে তা এ থেকে বোঝা গেছিল। সেই সাথে পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে স্নায়ুগুলোর পরিবর্তন দেখে অনায়াসে বোঝা গেছিল এর প্রতিকার কি হতে পারে। রাষ্ট্রব্যাপী কৃত্রিম মেঘ জরো করে নিউরন-উদ্দেপক মেডিসিনের বৃষ্টি ফেলার পর থেকে রেপ কেসের  সমাপ্তি ঘটেছে বাংলাদেশে। রাস্তায় বের হলে আর কেউ মেয়েদের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে না আজ।

২০৭৮ সালে এটা কঠিন কিছু নয়।

কিন্তু প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল আত্মহত্যার হার। এই সমস্যা ঠেকাতে নিউরো-রিসার্চার ডক্টর রাশেদের সাহায্যপ্রার্থী হয়েছে সরকার আরও একবার। এক্ষেত্রে ডক্টর ছয় মাস লাগিয়েও কোন সমাধান বের করতে পারেননি। এমনটা ডক্টর রাশেদের প্রসঙ্গে বিরল ও আশ্চর্যজনক।

প্রধান দুই সাবজেক্ট শাওন আর রায়হান ছিল শ্রেষ্ঠ সিলেকশন। সাড়ে তিন লাখ মেজর ডিপ্রেশন ডিজঅর্ডারের রোগির ভেতর থেকে এদের দু’জনকে বাছাই করা হয়েছে। কিন্তু এদের সুইসাইড সিমুলেটরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলেও তারা আত্মহত্যা করছে না।

শাওনের দিকে ফিরে তাকালেন ডক্টর, ‘আপনারা যে কাজটি করছেন – বার বার নতুন নতুন ঘটনা ঘটিয়ে পিছিয়ে দিচ্ছেন আত্মহত্যার ঘটনাটা। এতে দেরী হচ্ছে। এবং আত্মহত্যা করা থেকে বিরত থাকার নতুন নতুন উপায় আপনারা পাচ্ছেন। যেমন ধরুন, প্রথমেই আপনাদের আত্মহত্যার পদ্ধতি খুঁজে বের করার কথা – সেখানে আপনারা দিন ঠিক করছেন। শুভদিনের সিলেকশন করতে গিয়ে আসলে স্রেফ পেছাচ্ছেন ব্যাপারটা।’

‘এবং তারপর আমি প্রতিশোধ নিতে ব্যস্ত হয়ে আরও পেছালাম আত্মহত্যা। তারপর অযথাই কল্পনা করে ফেললাম কাওকে গাড়ি চাপার ঘটনা। এতে আরও পেছালো। এরপর র‍্যাবের গাড়ি এবং ডেসটিনেশনের পরিবর্তন।’ মাথা দোলায় শাওন। বুঝেছে।

‘ধ্যাত!’

ডক্টর রাশেদের মুখ থেকে শব্দটা বের হতে না হতেই দেখতে পায় শাওন বীভৎস দৃশ্যটা। কোথা থেকে লম্বা কুড়াল নিয়ে এক লোক ছুটে এসেছে। বসিয়ে দিয়েছে রায়হানের পেটে।

ছেলেটার চোখ দিয়েই ওরা দেখছে মনিটরে। এই মুহূর্তে ওটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। পেটে গেঁথে যাওয়া লম্বা ফলাটা আঁকড়ে ধরে বের করার চেষ্টা করছে। দুই হাত মাখামাখি হয়ে আছে রক্তে। টান দিয়ে কুড়াল বের করা ফেলে আক্রমণকারী লোকটা।

তারপরের কোপ দেওয়ার সাথে সাথে ওরা দেখে রায়হানের মাথাটা আলাদা হয়ে পড়ে যায়।

‘স্বপ্নের এরকম অংশগুলোতে ড্রীমার নিজের মাথা নিজেই দেখে থাকে তাই হয়তো দেখা সম্ভব হয়েছে বিষয়টা।’ মন্তব্য করে শাওন।

‘রায়হান কুড়ালধারীকে ইমাজিন করে এনেছে। ওটা স্বাভাবিক প্যাটার্ন না। রাস্তাঘাটে কুড়াল নিয়ে মানুষ দৌড়ায় না।’ বিড় বিড় করেন ডক্টর, ‘ছেলেটা আত্মহত্যা না করে অন্যের হাতে মৃত্যুকে কেন বেছে নিলো?’

_ পরিশিষ্ট  _

‘স্যার – আর তিনমাস সময় দরকার। কেসটা আসলেই জটিল।’ বিজ্ঞানকেন্দ্রের প্রধানকে বোঝানোর চেষ্টা করেন ডক্টর রাশেদ।

গুরুগম্ভীর কণ্ঠটা ভেসে আসে ওপাশ থেকে, ‘এই প্রজেক্ট তো এরই মধ্যে দুই মাস এক্সটেন্ড করা হয়েছিল। কোন রিপোর্ট তো দেখলাম না। চারমাসের প্রজেক্টে আপনার জন্য মাস দুয়েক সময় বাড়ানো হয় নি?’

‘ইটস কমপ্লিকেটেড। প্লিজ, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।’ দ্রুত আওড়ান ডক্টর।

‘এটাই তো সমস্যা, ডক্টর রাশেদ। আমি আসলেই বুঝতে পারছি না। আসলে আমরা কি ঠিক মানুষটার হাতে দায়িত্বটা দিয়েছিলাম? আমার তো এখন মনে হচ্ছে দেইনি। তরুণ কাওকে সামলাতে দিলেই হয়ত ভাল করতাম।’

‘স্যার – প্লিজ, অন্তত আর দুটো মাস -’

‘সাত দিন।’ বিজ্ঞানকেন্দ্রের প্রধান সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, ‘এর মাঝে একটা রিপোর্ট না পেলে আপনার ফান্ড বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আমার উপায় থাকবে না আর। পাইপলাইনে অসংখ্য নতুন নিউরো-সায়েন্টিস্ট আছে, ওদের কারো হাতে প্রজেক্ট ছেড়ে দিলেই বরং ভালো হবে। ইয়াং ব্লাড কাজ দেখাবার জন্য মুখিয়ে থাকে। আমাকে হতাশ করবেন না এবার।’

ফোনের ওপাশে লাইনটা কেটে গেছে। কিছুক্ষণ ওটার দিকে বিহ্বলের মত তাকিয়ে থাকেন ডক্টর ।

সাতদিনে কিচ্ছু হবে না। অন্তত আরও দুটো মাস তাঁর দরকার ছিল। সুইসাইড প্যাটার্ন বোঝা সম্ভব নয় যদি সাবজেক্ট সেটাকে ডিনাই করে। আর এখানে সাবজেক্টকে যতই হতাশার আর সুইসাইডাল সিমুলেশনের মাঝ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে – তারা সুইসাইড করছে না।

বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি সবার আগে কাজ করছে মানুষগুলোর।

নতুন কোন স্যাম্পল নিয়ে এলে তার এই ড্রিম-সিমুলেশনে মানিয়ে নিতেই লাগবে মাস দেড়েক। অর্থাৎ রায়হান আর শাওনকে দিয়েই প্রজেক্টটা সফল করতে হবে। কিন্তু এরা সুইসাইড করবে বলে মনে হচ্ছে না। ফলাফলটা সহজ, ফান্ডের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে গবেষণা। ডক্টর রাশেদ আর কিছু ভাবতে পারেন না। পুরোটা জীবন ড্রিম-রিসার্চার হয়ে থাকার জন্য দিয়েছেন তিনি। টাকার জন্য নয়, প্যাশনের জন্য কাজ করছেন। ইচ্ছে নেই এর বাইরে আর কিছু করার। গত পঞ্চাশটা বছর ধরে তিনি এই একটা বিষয়কেই ধ্যান-জ্ঞান মেনেছেন। এ ছাড়া বেঁচে থাকার মানে তিনি খুঁজে পেলেন না।

স্ক্যালপেলটা নিজের গলায় চালিয়ে দেওয়ার সময় ডক্টর বুঝতে পারলেন, সিমুলেশন দিয়ে একজনকে আত্মহত্যা করানো আসলেই সম্ভব না।

আত্মহত্যার মত পরিস্থিতি উদ্ভব হওয়ার জন্য প্রয়োজন বাস্তব এক পরিস্থিতি।

নিওরনের সাথে দেহের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে ডক্টরের মাথাতে শেষ চিন্তা যেটা খেলে যায় – রায়হান বা শাওনের জায়গাতে নিজেকে সিমুলেট করলে কি একটা রেজাল্ট পাওয়া যেত না?

শেষবারের মত নড়ে ওঠে ডক্টর রাশেদের দেহটি।

আর নড়বে না।

আনফিক্সেবল

শান্ত দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে দূরের সাদা বাড়িটার দিকে। ওটার ভেতরই আটকে আছে লিতিসা।

মেয়েটির সর্বশেষ ফোনালাপের কথাগুলো এখনও কানে বাজে ওর। মনে পড়ে শেষ বিকেলে নিজেদের মাঝে হারিয়ে যেতে থাকা মুহূর্তগুলোকে। অথবা নীল শাড়িতে পরীর মত লাগতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকা শান্তের ঘোরলাগা দৃষ্টি!

প্রেমটি হয়েছিল নাটকীয়ভাবে। আর লিতিসার বিয়েটা আগামী তিনদিনের মাঝে হয়ে যেতে চলেছেও নাটকীয়ভাবে!

তবে শান্তর সাথে নয়।

ঠেকাতে হবে বিয়েটা। উদ্ধার করতে হবে লিতিসাকে। আর কিছু মাথায় কাজ করে না শান্তর।

পরিকল্পনা দরকার একটা।

নিখুঁত পরিকল্পনা!

*

‘বৃষ্টি পড়ার আর সময় পেল না!’ সখেদে বলেছিল তানজিল।

মাত্র কোচিং সেন্টার থেকে বের হয়েছিল ওরা। আর বাইরে নেমে গেছে ঝুম বৃষ্টি। ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করার উদ্দেশ্যে রোজ এভাবে ফার্মগেটে যেতে এবং আসতে হয় তানজিল আর শান্তকে। এইচএসসির রেজাল্ট হয়ে গেছে কয়েকদিন হয়ে গেল। এখন আর সময় নেই হাতে বেশি। কাজেই’লাফাংরামি’ করতে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরাও একেবারে সিধে হয়ে গেছে। দম নাকের ফুটোতে তুলে পড়াশোনায় ডুবে গেছে সবাই।

পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলোর কোন একটাতে নিজেদের স্থান করে নেওয়ার স্বপ্ন বুকে দেখেনি ওদের ব্যাচে এমন একটি ছেলেও নেই এখন সারাদেশে। প্রত্যেকের মাথাতে হিমালয়ের সমান চাপ! আর এদের এখন বৃষ্টির মর্জির ওপর নির্ভর করার মত মানসিকতা থাকার কথাও না। শান্ত ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে দেয়। ঝুম বৃষ্টির মাঝেই নেমে পড়ে রাস্তাতে।

পেছন থেকে তানজিল লাফিয়ে ওঠে, ’ভিজে যাবি তো!’

‘বৃষ্টিতে ভিজলে কেউ মরে না।’ বিরক্ত মুখে উত্তর দেয় শান্ত।

কাজেই লাফিয়ে শান্তর পাশে চলে আসা ছাড়া তানজিলের কোন উপায় থাকে না।

বন্ধুর এহেন পাগলামীর কারণটা বুঝতে পারছে ও। এইচএসসিতে চমৎকার রেজাল্ট করেছে ছেলেটা। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষাতে অংশ নিতেও পারবে। কিন্তু কোচিংয়ে এতদিনের প্রিপারেশন বলতে কিছুই নেই তার। কোচিংয়ের টেস্টগুলোতে এতদিন ১০০ তে ১২ এর ওপরে তুলতে পারেনি একদিনও। নিজের অবস্থান না বোঝার মত মানুষ ও নয়।

শান্ত বেশ বাস্তববাদী ছেলে। প্রতিযোগীতাতে বাকিরা যে এগিয়ে আছে ওর চেয়ে অনেকখানি সেটা বুঝতে ওর কষ্ট হয় না। নিজের পরাজয় যে সুনিশ্চিত সেটাও ও স্পষ্ট বুঝতে পারে।

এই সামনে থাকা পঁচিশ দিনের মাঝে এত বিশাল সিলেবাস কাভার করা সম্ভব না আর।

‘ভাবিস না। হাতে এখনও তো কয়েকটা দিন আছে। ঠান্ডা মাথাতে শুরু কর এক পাশ থেকে।’ শান্তের মনের কথা যেন পড়তে পারে তানজিল।

মাথা নাড়ে ও, ’ধ্যাৎ! ওসব নিয়ে চিন্তা করছে কে? বুয়েটে হবে না। এটাই মেনে নিয়েছি। ’

মুখে সেটা বললেও ভেতরে ভেতরে জানে, শেষ একটা ফাইট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ও।

চোখ আড়াল করে তানজিল প্রবল বৃষ্টির আক্রমণ সামলাতে, ’ফেসবুকে তুই চব্বিশ ঘন্টা থাকিস। এটা কমিয়ে ফেল। পারিস না কেন নিজেকে কন্ট্রোল করতে?’

মাথা নাড়ে শান্ত আবারও, ’আজ থেকে আর বসব না। ’

বলার পরই আবারও দ্বিধাতে পড়ে যায় শান্ত ফেসবুক অ্যাডিকশন থেকে কি সরে আসতে পারবে ও আসলেই? HSC পরীক্ষার পর থেকে ফেসবুকে এত বেশি সময় দিয়েছে আজ হয়ে গেছে এটা নেশা। এই ভয়ানক ওয়েবসাইটটা যে ওকে ডোবাবে একেবারে সেটা বুঝতে পারছে ও ভালোমতই। ছুটতে থাকা নিউ ভিশনটাকে চোখে পড়ে এই সময় তানজিলের। ঝট করে শান্তের দিকে ফেরে ও।

বৃষ্টির পানি চারপাশে ছিটকে পড়ে মাথার সাথে ওর চুলের ঝাঁকুনীতে।

‘কাম অন, দোস্ত! পাওয়া যখন গেছে ছাড়া যাবে না!’

আর সব সময় চলন্ত বাস দেখলে যে দুটো শব্দ উচ্চারণ করতে অভ্যস্ত শান্ত এবারেও তার ব্যাতিক্রম হল না, ’রান রান!’

বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ভেদ করে তীরের মত ছুটছে দুটো ছেলে কাঁধের ব্যাগ থেকে পায়ের জুতো সব কিছু ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে।

নিউ ভিশনের গেটের সামনে বিশাল ভীড়।

সবাই নিজেদের মাথা বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে উঠার চেষ্টা  করছে ভেতরে। তানজিল একটু এগিয়ে থাকাতে আগে আগেই পৌঁছে গেল ওখানে।

লাফিয়ে তানজিলকে ঢুকতে দেখে শান্ত। কিন্তু প্রাণপনে চেষ্টা করেও পা রাখার স্পেসটুকু পায় না বেচারা।

আরও অন্তত ছয় জন ঝুলছে গেট থেকে। আর সীটিং সার্ভিস নিউভিশনও যেন লোকাল হয়ে গেছে! ধীরে ধীরে ঝুলন্ত মানুষগুলোকে বুকে নিয়ে ছেড়ে দেয় গাড়িটা। আর ভেতরে থাকা তানজিল চাইলেও নেমে আসতে পারে না বন্ধুর পাশে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোই প্রতিবন্ধকতা।

শান্তও তাকায় একবার বাসটার দিকে।

যাহ শালা! মিস হয়ে গেল!

প্রায় শুন্য রাস্তাতে একা একা ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চলে ও। আজকের দিনটাই কুফা!

আজকের মডেল টেস্টেও বাঁশ। মাত্র আটটা পারত ও। বাকি বত্রিশটা ফাঁকা রেখে চলে এসেছে। জানে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষাতেও এমন কিছুই হতে যাচ্ছে! হতাশায় রাস্তায় জমে থাকা পানিতে জোরে লাথি মেরে ভাসিয়ে দেয় পানিগুলোকে।

কানের পাশে তীক্ষ্ণ হর্ণের শব্দ জ্বলজ্বলে হেডলাইটের আলো রাস্তায় উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত!

চমকে ফিরে তাকায় শান্ত।

বিশাল ডাবল ডেকার বাসটি সোজাসুজি এগিয়ে আসছে ওর দিকেই।

মুহূর্তখানেক পরই পিষে দেবে ওকে মাটির সাথে!

দুই

কোমরের কাছে হ্যাচকা টান তারপরেই নিজেকে আবিষ্কার করল রাস্তার কোণে।

দূরে চলে যাচ্ছে বিআরটিসি বাসটি। আর এই প্রবল বর্ষণেও হেল্পারের মুখখিস্তি কান এড়ায় না শান্তর।

‘গরুর মত রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে কি করছিলেন?’ ধমকে ওঠে মেয়েটা।

এবার ভালোমত তাকিয়ে আর চোখ ফেরাতে পারে না শান্ত। নীল শাড়িতে মেয়েটিকে এমনিতেই চমৎকার লাগার কথা। অসাধারণ একটি মুখাবয়ব মেয়েটির। তার সাথে তীক্ষ্ণ চোখদুটোতে বুদ্ধির ছাপ। তারওপর বৃষ্টি এসে শাড়িটিকে শরীরের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। চমৎকার দেহকাঠামোটি ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে।

‘থ্যা- থ্যাংকস।’ এতক্ষণে যেন গলাতে শব্দ ফিরে পায় শান্ত।

‘হা করে তাকিয়ে না থেকে যেখানে যাচ্ছিলেন যান। ভিজিয়ে দিলেন আমার সব।’ দূরে রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে আটকে থাকা ছাতাটার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বলে মেয়েটা।

ঘটনা বুঝতে পারে এবার সহজেই। ছাতার নীচেই ছিল এই সুন্দরী এবং শান্তর দ্বিতীয় জীবনদাত্রী। তবে শান্তকে সোৎসাহে ডাবল ডেকারের সামনে লাফিয়ে পড়তে দেখে ছাতা ফেলে উড়ে এসে ওকে সরিয়ে নিয়ে যায় ও। আর ছাতা হারিয়ে এই মুহূর্তে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে যাচ্ছে মেয়েটা।

ফার্মগেটের মত ব্যস্ত একটা জায়গাতে একটি মেয়ে সারা শরীর ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর লোকজন সেটা গোগ্রাসে গিলবে না তা কি হয়?

বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব মোটেও অস্বাভাবিক কোন ঘটনা হতে যাচ্ছে না।

হাত বাড়িয়ে দেয় শান্ত, ’আমি শান্ত। ’

ওটা ধরে হাল্কা চাপ দেয় তরুণী, ’লিতিসা। ’

হেঁটে দ্রুত ওভারব্রীজটার নিচে চলে আসে ওরা। বৃষ্টির ছাঁট থেকে সাময়িক মুক্তি!

‘আপনি এখানে দাঁড়ান। আমি ছাতা উদ্ধার করে আসি।’ বলেই রাস্তার মাঝে আটকে থাকা ছাতাটাকে আনার জন্য পা বাড়াতে চায় শান্ত।

খপ করে ওর হাত আবার ঠিক সময়ে ধরে ফেলল লিতিসা। শান্তের নাকের সামনে দিয়ে বিকল্প পরিবহণের বাসটা বুলেটের মত বের হয়ে যেতে বরফের মত ঠান্ডা হয়ে যায় ও। আরেকটু হলেই দ্বিতীয়বারের মত জানটা খোয়াতে গেছিল!

হয়েছেটা কি আজকে ওর?

‘আপনি কি হিজবুত তাহিরির সুইসাইড ফোর্সের সদস্য?’ কৌতুক ভরে জানতে চায় তরুণী।

ফ্যাকাসে মুখে রঙ ফিরে আসে শান্তের। পাল্টা হাসল ও। আর কি বলবে?

‘ছাতা আনার দরকার নেই। আপনি এই মাঝ রাস্তায় আত্মহত্যার পর্যায়ক্রমিক প্রচেষ্টা বাদ দিন। তাতেই চলবে। ’

‘দেরী হয়ে যাচ্ছে নিশ্চয় আপনার। আমার জন্যই -’

ওকে থামিয়ে দেয় লিতিসা, ’কোচিং থেকে বাসার দিকে যাচ্ছি দেরী হলেও কোন সমস্যা নেই। ’

ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় শান্ত, ’আপনি কি এবার এইচএসসি দিলেন নাকি?’

‘ইয়েপ। আপনিও?’

‘তুমি করে বলতে পারো। আমরা সেম ব্যাচ।’ আবার হাসে শান্ত।

ওভারব্রীজে দুই ঘন্টা আটকে পড়াটাই সব কিছু পাল্টে ফেলে ওদের জীবনের। দুটো জীবনের নাটকের নির্মাতা ওপর থেকে দেখে হাসেন। তারপর টুক করে মিলিয়ে দেন ওদের।

*

শান্তর পাশে বসে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে তানজিল।

বাসার কাছে চায়ের দোকানে বসে আছে ওরা।

হারামজাদা একটা সপ্তাহ ধরে কোচিং আসে না। এমনিতেই পাচ্ছে শ’য়ে ডজনখানেক নাম্বার। বাহাদুর হয়েছে খুব! কোথায় জীবন মরণ এক করে পড়বে তা না আরও অবহেলা চলছে!

অবশেষে বোধ হয় এক যুগ পর সাড়া পাওয়া যায় মাথা তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত।

ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তানজিল।

রেগুলার বারো পার্সেন্ট করে নাম্বার পেতে পেতেও যখন একটা ছেলে কোচিংয়ে আসা ছেড়ে দেয় এবং তারপর কাছের বন্ধুকে ডেকে এনে পাঁচ মিনিট বসিয়ে রেখে একটা বেনসন খাইয়ে চমৎকার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন ছেলেটির সমস্যা কোথায় সেটা বোঝার জন্য আর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।

সরাসরি কাজের কথাতে চলে আসে তানজিল, ’মেয়েটাকে জুটালি কোথায়?’

লাই পেয়ে মুখ খুলে যায় শান্তের। সেদিনের কোচিংয়ের কাহিনী থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব কিছু খুলে বলতে থাকে তানজিলকে। ওভারব্রীজের নিচেই নাম্বার নিয়েছিল ওরা একে অন্যের। তারপর থেকে শুরু হয় ম্যারাথন চ্যাট।

লিতিসা মেডিকেলের জন্য কোচিং করছে। প্রাইমেটে।

মাত্র একদিনের মাঝেই একে অন্যের নাড়ি নক্ষত্র জেনে যায় ওরা। লিতিসার বাবা ফর্মার মিলিটারি অফিসার। তিন ভাই এক বোন। ভাইয়েরা কোথায় কি করছে। লিতিসার স্কুল আর কলেজ কোনটা ছিল। সেখানকার ফ্রেন্ড সার্কেল কারা ছিল কিভাবে টাইফয়েডের মাঝে সে তার এইচএসসি দিয়েছিল কিভাবে সারাজীবনের স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ারিংকে বিসর্জন দিয়ে মেডিকেলের জন্য কোচিংয়ে ভর্তি হতে হয় ওকে কেন রেটিনা জামায়াতী ইসলামের প্রতিষ্ঠান বলে ভালো কোচিং সেন্টার হলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে প্রাইমেটে ভর্তি হয়েছিল সব গল্পই জানা হয়ে যায় শান্তের এই কয়দিনে।

কাহিনী শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় চায়ের দোকানদারেরও। অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে লোকটা।

মনোযোগ দিয়ে সব শুনে হুংকার ছাড়ে তানজিল, ’তাই বলে শালা কোচিং মিস দিচ্ছিস?’

একটু মাথা নাড়ে শান্ত, ’লিতিসা আমাকে ফেসবুকের নেশা থেকে বের করে এনেছে দোস্ত! বিলিভ ইট অর নট!’

‘দেখা যাবে। নেক্সট উইকের পরীক্ষাগুলো দিবি। দেখা যাক কপালে কি আছে। মাত্র আছেই আর আঠারো দিন!’ হতাশাতে নিজের পায়ে চাপড় মারে তানজিল।

‘তুই কি সাজেস্ট করিস?’ জানতে চায় শান্ত।

সাথে সাথেই উত্তর দেয় তানজিল, ’এই আঠারোটা দিন ডুব মেরে থাক। তারপর মেয়ে নিয়ে ভাবিস। ’

মাথা চুলকায় শান্ত, ’আমার বেটার একটা প্ল্যান আছে, দোস্ত। ’

ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে পরের সিগারেটটা ধরায় তানজিল।

‘বাসার ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে লিতিসা আমাকে। আজ ওকে ওর বাসার নিচেই প্রপোজ করব। আসবি আমার সাথে?’

তিন

লিতিসাদের বাসার নীচে সেদিন প্রপোজটা যদি না করত শান্ত তাহলে অনেক কিছুই হারাতে পারত ও।

কিন্তু তানজিলের বিস্ফোরিত চোখের সামনে শান্তের প্রপোজালকে হাসিমুখে শুধু গ্রহণই করে না লিতিসা আনন্দের আতিশয্যে রাস্তার মাঝেই তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ফেলে!

লজ্জায় লাল-টাল হয়ে অন্যদিকে তাকিয়েছিল তানজিল। একই সাথে ভাবছিল বন্ধুভাগ্যের কথা। রাজকন্যার মত মেয়েটিকে কি নাটকীয় ভাবেই না পেয়ে গেল ও!

তারপরই তাড়া দেয় লিতিসা, বাসার কাছে থাকাটা নিরাপদ ছিল না।

সাদা বাড়িটা চমৎকার।

তবে ভেতরে আছেন একজন এক্স-মিলিটারি, তাও আবার একমাত্র কন্যসন্তানের বাবা। কাজেই বাঘের খাঁচার চেয়ে এই স্থান ভয়ঙ্কর বলে ঘোষিত হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর মেয়ে কোন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুমু-টুমু খাচ্ছে এটা জানতে পারলে তানজিলের খুলি পর্যন্ত উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

লিতিসা ট্র্যাকে তুলে দেয় শান্তের জীবনটিকে।

তার মাঝে চমৎকারভাবে ভিসির পদত্যাগের দাবীতে মুখর হয়ে ওঠে বুয়েট। আর ভর্তি পরীক্ষাটাও একমাস পিছিয়ে যায়।

একটি মাস পর ৩৪ তম করে শান্তের বুয়েটে চান্স পাওয়ার খবর শুনে আনন্দে বন্ধুকে বুকে পিষে ফেলেছিল তানজিল।

তবে মুহূর্তের জন্যই।

মেডিকেলে চান্স পায় নি লিতিসা। বাবার জেদের কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্ন দেখতে থাকা মেয়েটা ব্যর্থ হয়ে গেল সারা জীবনের জন্য! তানজিল নিজেও চান্স পায়নি কোথাও। তখনও।

সামনে মাত্র চারটা পরীক্ষা বাকি ছিল। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তার মাঝে একমাত্র পরীক্ষা যেটাতে অংশ নেয় তানজিল।

একেবারে তূণের শেষ তীর দিয়েই গাঁথিয়ে নেয় তানজিল। ময়মনসিংহে চলে যায় ভর্তি হয়ে। শান্ত বুয়েটে ক্লাস শুরু করে। লিতিসার জীবনে অনিশ্চিয়তা নেমে আসে।

এভাবেই পার হয়ে যায় দুটো বছর। আর আজকে হেঁটে যাচ্ছে শান্ত পকেটে হাত দিয়ে।

পরিকল্পনা দরকার একটা।

নিখুঁত পরিকল্পনা!

*

ফোনটা ভাইব্রেট করছে। পড়ার বই থেকে মুখ তুলে সেদিকে তাকায় তানজিল।

শান্তর নাম্বার।

এত রাতে ফোন দিচ্ছে কেন? নির্ঘাত কোন সমস্যায় আছে। সমস্যাটা মানসিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর আগেও মেন্টাল স্ট্রেসে থাকলে ফোন দিয়ে তানজিলকে সেটা বলে কষ্ট লাঘব করেছে শান্ত। আজও তেমন কোন কেস?

‘দোস্ত, কেমন আছিস?’ ফোনটা রিসিভ করেই পূর্ণ উচ্ছ্বাসের সাথে জানতে চায় তানজিল।

ওপাশ থেকে শান্তের মনমরা কন্ঠটা ভেসে আসে, ’আমি শেষ রে। এবার আর কোন আশা নাই। ’

আস্তে করে উঠে দাঁড়ায় তানজিল, বারান্দাতে এসে দাঁড়ায়, ’কি হয়েছে? খুলে বল। ’

ঘটনা তেমন কিছু নয়।

প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় লিতিসাকে। বাবার ইচ্ছে মেয়ে ডাক্তারই হবে! পাবলিক আর প্রাইভেট!

তবে লিতিসার নিজস্বতা বলে আর কিছু থাকে না এবার। বাবার লাখ লাখ টাকা ধ্বংস করে পড়ছে ব্যাপারটা ওকে মানসিকভাবে ছোট করে রাখে সব সময়।

ওর স্বপ্ন ঠিকমত এগুলে পাবলিক মেডিকেল কলেজে ঢুকে যেতে পারত হয়ত। আর সেখানে নিজের সিদ্ধান্তগুলো বলার জন্য একটু হলেও বল পেত ও বুকে। যেটা প্রাইভেটে পড়ে আর পায় না লিতিসা।

যেকারণে বাবার পছন্দ করা ছেলেটি আমেরিকা থেকে আসছে শুনেও কিছু বলার ভাষা যোগাড় করতে পারেনি লিতিসা। ছেলেটির নাম রাশা এবং সে আসছে বিয়ে করে বউ নিয়ে আবার আমেরিকাতে ভেগে যেতে। শান্তকে আশার কোন বাণী শোনাতে পারে নি মেয়েটা।

‘তারপর?’ কানে ফোন চেপে ধরে জানতে চায় তানজিল, ’তুই ওকে পালিয়ে চলে আসতে বলিসনি?’

‘বলেছি তো।’ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায় শান্ত।

‘কি বলল ও?’ উদগ্রীব হয়ে জান্তে চায় তানজিল।

‘কিন্তু’ ইতস্তত করে শান্ত, ’বাবা শেষ জীবনের সব সম্পত্তি উড়িয়ে ওর মেডিকেল কলেজের খরচ জোগাড় করেছেন। ওর পক্ষে এখন কিভাবে চট করে না করা সম্ভব?’

‘কেন? দুই বছর প্রেম করার সময় মনে ছিল না?’ গর্জে ওঠে তানজিল।

‘না, মানে ও আমাকেই বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তের অমতে যাওয়ার সাহস অর্জনই করতে পারছে না বেচারি।’ মিন মিন করে উত্তর দেয় শান্ত।

‘তুই লিতিসার পক্ষ নিবি না। একদম চুপ করে থাক!’ ধমকে ওঠে তানজিল আবারও।

‘ওর ফোনটা কেড়ে নিয়েছে বাসা থেকে।’ আসল উদ্বেগটা কোথায় জানিয়ে দেয় শান্ত, ’আমার সাথে কনট্যাক্ট নাই গত কয়েকদিন ধরে। ’

এক মুহূর্ত দুইজনেই চুপ হয়ে যায়।

তারপর আবার মুখ খোলে তানজিলই, ’বাবার সিদ্ধান্তের অমতে যাওয়ার জন্য ওকে সাহস দেব আমরা। দেব প্রয়োজনীয় মশলা। ’

‘কিভাবে?’ জানতে চায় শান্ত।

জানত বন্ধুও এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছাবে।

কিন্তু কিভাবে?

এই প্রশ্নটা করার জন্যই রাতের বেলাতে ফোনটা দেওয়া।

‘কয়দিন পর বিয়ে?’ পাল্টা প্রশ্ন করে তানজিল।

‘তিন দিন!’ হাহাকারের মত শোনায় শান্তের উত্তর।

‘লিতিসাকে বাসা থেকে বের করে আনব আমরা। ও রাজি থাকুক আর না থাকুক। ’

*

পুরোনো সেই চায়ের দোকানে এসে বসে পড়ে তানজিল।

দোকানি দোকানটা বন্ধ করে রেখেছে এটা ওদের জন্য একটা প্লাসপয়েন্ট। তানজিলের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে শান্ত। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বন্ধুর হাতের চটের ব্যাগের দিকে।

শান্তের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তানজিল। তারপর ঝটপট খুলে ফেলে ব্যাগটা। শান্তের চোখ ছানা বড়া হয়ে যায়। দুটো পিস্তল চমৎকার ভাবে শুয়ে আছে চটের ভেতর।

দাঁত কেলিয়ে হেসে ব্যাখ্যা দেয় তানজিল, ’ময়মনসিংহে ছাত্র সংগঠনে জোস জোস সব ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি। সিচুয়েশন বোঝাতেই দিয়ে দিল। একেবারে নিজের লোক আমার। ’

‘এসবের দরকার কি ছিল?’ মিন মিন করে জানতে চায় শান্ত।

‘অবশ্যই! ঝামেলা হতে পারে। গার্ড তো থাকে একটা। ওই ব্যাটাকে ঠান্ডা করতে হবে এটা দেখিয়ে। তারপর থাকে লিতিসার এক্স-মিলিটারি বাবা

কড়া চোখে তানিজিলের দিকে তাকায় শান্ত।

‘শ্বশুর মানুষ। উনাকে গুলি করলে আজীবন হেট করবে আমাকে লিতিসা। ’

‘চিল, ম্যান! উনার ক্ষতি করার ইচ্ছে নাই আমার।’ ওকে আশ্বস্ত করে তানজিল।

চোখ সরু করে তাকায় শান্ত, ’দুই দুটো পিস্তল নিয়ে যাচ্ছিস কেন তাহলে?’

‘এক্স-মিলিটারীর কাছে একটা হ্যান্ড গান থাকতেই পারে উনি সেটা নিয়ে অতিরিক্ত দুঃসাহসী না হয়ে যান সেটা দেখতে হবে আমাদের। ’

‘তাও ঠিক।’ বিড় বিড় করে শান্ত।

একটা পিস্তল বের করে বাড়িয়ে দেয় তানজিল শান্তের দিকে।

হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে গিয়েও হাত সরিয়ে নেয় শান্ত, ’ফিলিং বেটার উইদাউট দিস। ’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে চটের বস্তায় ওটা রেখে দেয় তানজিল।

‘গাড়িতে চল।’ শান্তের হাত ধরে টান দেয় অন্য হাতে পিস্তলটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে।

‘গাড়ি?’ অবাক হয়ে তাকায় শান্ত।

‘খালি পায়ে পালানো যাবে না ওখান থেকে। উই’ল নীড আ কার। ম্যানেজ করে রেখেছি আগেই। ’

আধঘন্টা পর তেরপল সরিয়ে কালো গাড়িটা বের করে ঝকঝকে হাসি দেয় তানজিল।

‘লেটস গো।’ লাফিয়ে উঠে পড়তে পড়তে বলে ও।

চার

রাত অনেক হয়েছে। গ্যারাজটা বিশাল এবং শুন্য। দূরে একটা টিমটিমে আলো ছাড়া আর কিছু নেই। এক্স-মিলিটারির তুলনায় বেশ হাল্কা নিরাপত্তা ব্যবস্থা! বুড়োর হাড়ে মনে হয় বয়েসের সাথে সাথে মরিচা পড়েছে!

শুন্য গ্যারেজে পা রেখে শিউরে উঠলো শান্ত।

কেন জানি চারপাশের গাঢ় ছায়া দেখে অদ্ভুত একটা অনুভূতি ছেয়ে ফেলে ওদের। মনে হচ্ছে আড়াল থেকে কেউ ওদের দেখছে! একই রকম অনুভূতি হচ্ছে তানজিলেরও। আড়ালের ছায়ার ভেতরে ওদের দৃষ্টি যায় না। কাজেই ভয়টা মানসিক। অজানা কিছুকে মানুষের ভয় এমনিতেই সহজাত। তারওপর এখানে এমনিতেই বিপদের আশঙ্কা আছে।

সবচেয়ে বড় কথা সিকিউরিটি গার্ডটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ব্যাটা ওত পেতে নেই তো কোথাও?

সাবধানে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে নেয় তানজিল। এখানে বিন্দুমাত্র অসতর্ক হয়ে তীরে এসে তরী ডোবাতে চায় না ও।

উদ্যত পিস্তলের পেছনে ওর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখটা উঁকি দেয়। আবছা আলোয় পা রেখে একটা টর্চ ছাড়াই এমন অভিযানে চলে আসার জন্য নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেয় তানজিল।

শান্ত বেশ উদ্বেগশুন্য মুখ নিয়েই হেঁটে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। আগের দিন রেকি করে গেছে, জানে এ বিল্ডিংয়ে এলিভেটর নষ্ট। কাজেই সিঁড়ি ছাড়া গতি কি?

চারপাশে শরীর তিনশ ষাট ডিগ্রী অ্যাংগেলে ঘোরাতে ঘোরাতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসে তানজিলও। অতিরিক্ত সতর্কতার প্রয়োজন আছে। শান্ত একটি সুযোগই পেতে যাচ্ছে এই এক্স-মিলিটারী  ম্যানের মেয়েকে উদ্ধার করার। এই সুযোগটা ওদের ভুলের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেলে স্রেফ পানিতে যাবে দুই বছরের প্রেম!

একেবারে আচমকাই বের হয়ে আসে লোকটা ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তীরবেগে ছুটে আসতে শুরু করেছে তবে দেখে ফেলল শান্ত।

‘তানজিল, সাবধান!’ হুংকার ছাড়ে ও। বদ্ধ গ্যারাজে গল গল করে ওঠে তার কন্ঠ!

ঝট করে ফিরে তাকায় তানজিল আর একই সাথে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গার্ড। গার্ডের হাতের ধাক্কায় পিস্তলটা উড়ে যায় ওর হাত থেকে। সেই সাথে শক্ত মেঝেতে আছড়ে পড়ে দুইজনই।

গার্ডটি অল্পবয়স্ক। পেশির সমাহার। চাপা কলার সমান আঙ্গুলগুলো মুঠো করে তীব্রবেগে নামিয়ে আনতে যাচ্ছে তানজিলের মাথার ওপর। একটা আছড়ে পড়লেই আর দেখতে হবে না!

তড়িৎ রিফ্লেক্সের সাহায্যে কোনমতে আঘাতটা এড়ায় তানজিল। দ্রুত সরে গেছে একফিট ডানে।

তানজিলের নড়াচড়াতে ওর ওপর থেকে নড়ে যায় গার্ড একই সাথে কাতরে ওঠে শক্ত মেঝের সাথে মোটা ঘুষিটা আছড়ে পড়াতে।

শেষ মুহূর্তে মাথা সরিয়ে নেওয়াতে তানজিলের মাথা খুঁজে না পেয়ে মেঝেতেই আছড়ে পড়েছে হাতটা।

এই ফাঁকে সাপের মত পিছলে বের হয়ে আসে তানজিল। গার্ড ওর অভিসন্ধি বুঝতে বেশি সময় নেয় না। চট করে এক পা বাড়িয়ে দেয়।

মাত্র দাঁড়িয়ে সরে যাচ্ছিল তানজিল গার্ডের নাগালের বাইরে দড়াম করে আবার আছড়ে পড়ে বেচারা মাটিতে।

এই সময়ে দ্বিতীয় গার্ডকে এগিয়ে আসতে দেখে ও।

একসাথে দুইজনকে সামলাতে পারবে না স্পষ্ট বুঝতে পারে তানজিল। ওদিকে শান্ত গাধাটা মারামারি দেখে ঘাবড়ে গেছে।

সিঁড়ির গোড়ায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে ও।

আচমকা ঝাঁপাঝাঁপিতে হতভম্ভ!

চেঁচিয়ে উঠে তানজিল, ’শান্ত, হেল্প!’

দ্বিতীয় গার্ড চোখের ইশারায় প্রথম গার্ডের অনুমতি চায় শান্তকে সামলানোর জন্য। ইশারাতে তাকে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় প্রথমজনও।

তারপর আবার ঝুঁকে পড়তে যাচ্ছে এই মাত্র পড়ে যাওয়া তানজিলকে শায়েস্তা করতে ব্যাঙের মত সামনের দিকে লাফ দেয় ও। তারপর হাতটা সোজা করতেই পিস্তলের বাঁটটা নাগালে পেয়ে যায়।  চট করে ওটা তুলে নিয়েই প্রথম গার্ডের মোটা মাথার দিকে কোনমতে তাক করে ও টিপে দেয় ট্রিগার।

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে সেই শব্দে।

টার্গেট পুরোপুরি সফল হয় নি কপালের ওপরের দিকে একাংশ উড়িয়ে নিয়ে গেছে গার্ডের। সেই সাথে প্রাণবায়ু বেড়িয়ে গেছে তার।

দ্বিতীয় গার্ড এখন শান্তর খুব কাছে, গুলির শব্দে হতভম্ভ হয়ে চট করে ফিরে তাকায় সে। বিন্দুমাত্র দেরী না করে আরও দুইবার গুলি চালায়। একবার পেটে আরেকবার বুকে।

ছিটকে মাটিতে পড়ল আরেকটা নিথর দেহ।

‘লেটস গো!’ হতভম্ভ শান্তের দিকে তাকিয়ে চিৎকার ছাড়ে তানজিল।

শান্তর চেহারা দেখে ওর মনে কথা পড়তে পারে তানজিল। এখানে কোন খুন হওয়ার কথা ছিল না।

সেখানে দুই দুইটি খুন হয়ে গেছে!

মাথা নেড়ে শান্তকে পাশ কাটিয়ে উঠতে থাকে তানজিল। ঘাপলাটা ও নিজেও বুঝতে পারছে। প্ল্যানের বাইরে চলে গেছে সবকিছু। এবার দ্রুত মেয়েটাকে নিয়ে কেটে পড়তে হবে। দুরদার করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে এসেছে ওরা তিনতলার বাসার দরজাটাই লক্ষ্য। গুলির শব্দ শহরের সবখানে চলে গেছে হয়তো! কাজেই কলিং বেল দিয়ে দরজা খোলানোর কথা স্বপ্নেও ভাবে না তানজিল।

এক গুলিতে দরজার নব উড়িয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে ভেতরে।

ড্রেসিং গাউন পড়া মানুষটা ছুটছিলেন বেডরুমের দিকে। এক্স-মিলিটারি আর কোথায় হ্যান্ডগান রাখে?

তবে ঘর কাঁপিয়ে হুংকার দেয় তানজিল, ’স্টপ দেয়ার, মিস্টার!’

কাজ হয় এতে থেমে যান ভদ্রলোক।

‘লিতিসা চল বেড়িয়ে যাই!’ বেডরুমের দরজাতে মাত্র উপস্থিত হওয়ার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে নিষ্কম্প কণ্ঠে বলল শান্ত। নড়লও না মেয়েটা। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। যেকোন সময় থানায় খবর চলে যাবে!

ধমকে ওঠে তানজিল, ’কথা কানে যায় না? বেরিয়ে আসো, মেয়ে!’

মেয়ে বের হয়ে এল, পিস্তলের নলটার দিকে ইতস্তত তাকাচ্ছে। দরকারে তাকে বন্দুকের ভয় দেখিয়েই বের করে নিতে হবে, এ নিয়ে শান্তর সাথে আলোচনা হয়ে গেছে ওর।

‘কোন কথা নয় নীচে চল।’ আরেক ধমক দিয়ে বলল তানজিল।

শান্তের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তার প্রেমিকা। কিন্তু এখন এসব আবেগ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। দুই বছর ধরে প্রেম করার সময় মনে ছিল না? দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে ওরা।

পেছনের সীটে বসিয়েছে ও শান্ত আর লিতিসাকে। মান অভিমান করুন প্রেমিকযুগল!

ছুটছে গাড়ি।

‘সাবাস ব্যাটা, আমরা না শুধু আমাদের নেক্সট জেনারেশনও তোর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে!’ পেছন থেকে বলে ওঠে শান্ত।

মুচকি হাসে তানজিল, ’আমাকে থ্যাংকস দেবে না, লিতিসা?’

একটা সেকেন্ড গাড়ির ভেতরটা চুপ হয়ে যায়।

তারপরই লিতিসার খনখনে কন্ঠটা কেঁপে ওঠে ভেতরে, ’ প্রথমতঃ কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে আবার থ্যাংকস চাচ্ছিস হারামজাদা? দ্বিতীয়তঃ ভালো করেই জানা আছে তোদের আমার নাম লিতিসা নয়! ঊর্মি!’

পাঁচ

ড. মাজেদুর রহমানের চেম্বার।

চিন্তিত মুখে বসে আছে তানজিল। প্রিয় বন্ধুর মাঝে এরকম একটা সমস্যা দেখা দিলে চিন্তাতে পড়ে যাওয়ার কথাই। লিতিসা বলে কেউ নেই! কোনদিন ছিলও না!

মাজেদুর রহমান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। ইনার খ্যাতি আছে। বাংলাদেশের বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্টও বলা হয়ে থাকে তাঁকে। এই কেসটা ইচ্ছে করেই নিজে হ্যান্ডেল করতে চেয়েছেন তিনি। এমন কেস খুব একটা পাওয়া যায় না এদেশে।

একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে মুখ খোলে তানজিল।

‘আমার বন্ধুটির ব্যাপারে যা বলার আপনাকে বলতে হবে আমাকেই। আর কেউ নেই তার জন্য আসার মত।’ নড়েচড়ে বসে ও। শান্তের মাথায় আগাগোড়াই সমস্যা ছিল কে জানত?

‘ওর সিজোফ্রেনিয়া ছিল, তাই নয় কি ডক্টর? যেকারণে কাল্পনিক একটা মেয়েকে ভেবে তার সাথে প্রেম করে এসেছে ও পুরোটা সময়?’

সরাসরি তানজিলের দিকে তাকান ডক্টর। চোখে বিষাদের ছায়া।

‘সিজোফ্রেনিয়া। একটি বিরল রোগ। এবং জটিলতম বলব আমি এটাকে। সব মনোরোগের মাঝে। ’

টেবিল থেকে পানির গ্লাসটি তুলে একচুমুক খেয়ে নামিয়ে রাখে তানজিল। ডক্টরের পরের কথাগুলো শোনার জন্য উদগ্রীব।

‘রোগটা এমন, রোগী বুঝতে পারে না বাস্তব কোনটা আর কল্পনা কোনটা। একই সাথে তার মাঝে দেখা দেয় অডিটরী অ্যান্ড ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন। এখানেই আসে প্যাঁচটা। রোগী দেখতে থাকে এবং শুনতে থাকে তারই মস্তিষ্কের একটি অংশের সৃষ্ট কাল্পনিক কোন চরিত্রকে। তার পক্ষে উপেক্ষা করার মত ব্যাপার এটা নয়। আপনি জানেন নিজের চোখ আর কানকে প্রাধান্য দেবে যে কোন মানুষ। আপনি যদি বলেন “তুমি যা দেখছ সবই ভুল ” সে বিশ্বাস করবে না। কারণ সে দেখে এসেছে মানুষটিকে। কথা শুনেছে তার। আপনার কথা সে কেন বিশ্বাস করবে?’

মাথা দোলায় তানজিল। মনে পড়ে যায় বন্ধু শান্ত কিভাবে দেখা করেছিল লিতিসার সাথে। বাসে উঠে যায় তানজিল তারপর একাকী দেখা হয় শান্তের সাথে লিতিসার। অর্থাৎ কোন লিতিসা ছিল না সেখানে। নিজেই ছুটে আসা বিআরটিসি বাসের পাশ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেছিল ও। এবং মস্তিষ্কের একাংশ কল্পনা করে নিয়েছিল মেয়েটিকে।

ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল ছেলেটা। স্বাভাবিক আর দশটা ছাত্রের চেয়ে অনেকগুণ বেশি চাপ নিয়েছিলো সে। ফেসবুক থেকে বের হওয়ার জন্য খুঁজছিল অনুপ্রেরণা। কাজেই অবচেতন মন নিজেকে রক্ষা করতে এনে দেয় ডাইভার্সন। লিতিসা নামক চমৎকার একটি নারী চরিত্র সৃষ্টি করে দেয় ওকে। কাজে দেয় সেটা ফেসবুক থেকে সরে যায় শান্ত বুয়েটে চান্সও পেয়ে যায়! কিন্তু রোগটা ততদিনে তাকে পেয়ে বসেছে!

ফোনে কথা বলে ও দিনরাত লিতিসার সাথে। আসলে মস্তিষ্কের একাংশ ওকে সাহায্য করছিল এই কাজটা করতে। তারপর বাসার একটি ঠিকানাও বানিয়ে নেয় নিজে নিজেই যেখানে লিতিসা থাকে! তবে দীর্ঘ দুই বছর পর নিশ্চয় খেলাটা খেলে যেতে যেতে তার মস্তিষ্কের অবচেতন অংশও ক্লান্ত হয়ে গেছিল হয়তো। সে চাইছিলো মুক্তি।

লিতিসাকে’ডিলেট’ করে দিতে নতুন ধরণের হ্যালুসিনেশন দেখে ও লিতিসার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! আর বন্ধুর ফোনটা পেয়ে লাফিয়ে ওঠে তানজিলও। ওর বোঝার কথা নয় লিতিসা কেবলই শান্তের অবচেতন মনের সৃষ্টি! বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে ঠেকাতে সর্বোচ্চ রিস্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে উদ্ধার করতে! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তানজিল। তারপর হেলান দেয় ও চেয়ারে।

‘ডক্টর, আমার ফ্রেন্ড শান্তকে কি রিকভার করার কোন উপায় নেই? সিজোফ্রেনিক হয়েই কি তাকে দিন কাটাতে হবে বাকি জীবন?’

মাথা নাড়েন ডক্টর, ’আপনাকে বুঝতে হবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন যে চরিত্রটিকে সিজোফ্রেনিক বাস্তব বলে ভাবছে তাকে কিভাবে মুছে ফেলতে পারে কেউ? সে দেখতে পায় মানুষটিকে। শুনতে পায় তার কথা। যদিও এগুলো মস্তিষ্কের একটা ইমপালস ব্যাতীত আর কিছুই নয় কিন্তু আপনি তাকে কিভাবে বোঝাবেন এসবই ভড়ং?’

‘চেষ্টা করতে হবে। আমার মনে হয় আমি শান্তের সাথে কথা বললে সে বুঝবে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানজিল।

‘রোগীকে অবশ্যই নিজে থেকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। নাহলে যতই উদ্দীপনা দেই আমরা বাইরে থেকে কাজ হবে না তাতে!’

আবারও আশ্বস্ত করে তানজিল, ’শান্তের সাথে আমি কথা বলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করব ব্যাপারটা, ডক্টর। ’

আস্তে করে উঠে দাঁড়ান এবারে ডক্টর, ধীর পায়ে দেওয়াল পর্যন্ত হেঁটে যান তিনি, তারপর ঘুরে সরাসরি তাকান তানজিলের দিকে।

‘দেয়ার ইজ নো শান্ত, মাই বয়। ’

শুন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তানজিল।

‘শান্ত নামের বন্ধু তোমার ছিল না কোনদিনও। শান্ত একটি হ্যালুসিনেশন, তানজিল। ’

দড়াম করে ঘুষি মারে তানজিল টেবিলের ওপর।

‘স্টপ ইট, ডক্টর। মজা করছেন আপনি আমার সাথে?’

‘শান্ত চরিত্রটি সম্ভবতঃ তুমি বানিয়েছ ক্লাস ফাইভে থাকতে। পাশের সাদা বাড়িটাতে শান্ত নামের একটা ছেলে কারেন্টের শক খেয়ে মারা যায় ছেলেটা তোমার সমবয়েসীই ছিল তার ব্যাপারে ভুলতে পারো নি তুমি। ওকে ধীরে ধীরে করে নিয়েছ একটি বন্ধু চরিত্র। শান্ত তোমার সাথে বড় হতে থাকে!’

‘না, বানিয়ে বলছেন আপনি বেশি বুঝে ফেলেছেন’ বিড় বিড় করে বলে তানজিল।

তানজিলের কথা শুনতেই পাননি এভাবে বলতে থাকেন ডক্টর মাজেদুর রহমান। ’ধীরে ধীরে শান্ত চরিত্রটি ডাল পালা মেলতে থাকে তোমার ভেতর। বয়ঃসন্ধিতে চলে আসার সাথে সাথে তোমার মনে হতে থাকে শান্তের একটা গার্লফ্রেন্ড তো দরকার! কাজেই এখানেই আনলে তুমি লিতিসাকে। বাসে ছুটে উঠে পড়লে সেদিন, কল্পনা করে নিলে কিভাবে ওদের প্রেম শুরু হল! তারপর শান্ত এসে তোমাকে একই কাহিনীর রিপিটেশন শোনাল আরেকদিন। যদিও ওখানে কেউ ছিল না। তুমি একাই বসে ছিলে। তবে নিজের কাছে চরিত্রের বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে এই কাজটা মস্তিষ্ক করেই থাকে!’

মনে পড়ে যায় তানজিলের, দোকানদার মামা প্রত্যেকবার কিভাবে তাকিয়ে থাকতেন যখন ও শান্তের সাথে কথা বলত। কেন?

ও একা থাকত ওখানে, তাই?

‘সিজোফ্রেনিয়ার মজা হল যতদূর সম্ভব বাস্তব করে তোলে এটা চরিত্রগুলোকে। কাজেই তোমার মস্তিষ্কপ্রসূত শান্ত বুয়েটে চান্স পাওয়ার পর তুমি কিছুদিনের জন্য ওকে আর দেখতে পেলে না। কারণ তুমি তখন ময়মনসিংহে। ’

‘দুই বছর, ’ বিড় বিড় করে তানজিল, ’দুই বছর আমি দেখিনি ওকে। ’

‘দীর্ঘ এই সময়টা না দেখে থাকা চরিত্রটিকে ফিরিয়ে আনতে চাইল তোমার অবচেতন মন আবার। ’

‘ফোন দেয় ও আমাকে সেরাতে’ মেলানোর চেষ্টা করছে তানজিল। ডক্টরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

‘কাজেই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা ফিরে আসো তুমি পিস্তল দুটো আনলেও ধরিয়ে দিতে পারো না শান্তকে। পুরো সময়টাতে সে ছিল প্যাসিভ ক্যারেকটার। সবকিছু করতে হয়েছে তোমাকেই

ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে কাচের গ্লাসটি ডক্টরের দিকে ছুঁড়ে মারে তানজিল।

আগেই প্রত্যাশিত ছিল ব্যাপারটা চট করে সরে গিয়ে আঘাত এড়ান তিনি।

‘ইউ লায়ার! আমাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণের চেষ্টা করবেন না ডক্টর! শান্ত ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অ্যান্ড হি ইজ রিয়েল। আপনি আমার হ্যালুসিনেশন হতে পারেন কিন্তু ও না!’

দুইজন রক্ষী এসে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায় তানজিলকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ডক্টর।

পরিশিষ্ট

একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে মুখ খুললো তানজিল।

‘আমার বন্ধুটির ব্যাপারে যা বলার আপনাকে বলতে হবে আমাকেই। আর কেউ নেই তার জন্য আসার মত।’ নড়েচড়ে বসে ও। শান্তের মাথায় আগাগোড়াই সমস্যা ছিল কে জানত?

‘ওর সিজোফ্রেনিয়া ছিল, তাই নয় কি ডক্টর? যেকারণে কাল্পনিক একটা মেয়েকে ভেবে তার সাথে প্রেম করে এসেছে ও পুরোটা সময়?’

সরাসরি তানজিলের দিকে তাকান ডক্টর। চোখে বিষাদের ছায়া।

এই ছেলেটিকে প্রতিদিন তিনি বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন শান্ত বলে কেউ ছিল না কোনদিনই!

কিন্তু কোন ইম্প্রুভমেন্ট নেই।

আড়চোখে একবার টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা দেখেন তিনি। রোগীর ভায়োলেন্স বোঝার জন্য এটা রাখা। ক্ষেপে উঠলে এটা ছুঁড়ে মারবে সে, তখনই তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হবে।

তানজিল ছেলেটার সিজোফ্রেনিয়া এতটাই গভীরে চলে গেছে একটি নয় একাধিক চরিত্র কল্পনা করতে শুরু করেছিল ছেলেটা। উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর। জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালেন। ভুল ভাবে কল্পনা করার জন্য দুই দুইটি খুন করে এসেছে এই নিষ্পাপ চেহারার ছেলেটি।

বিশ্বাস করা যায়?

ওদিকে চেয়ারে বসে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তানজিল। তারপর হেলান দেয় ও চেয়ারে।

‘ডক্টর, আমার ফ্রেন্ড শান্তকে কি রিকভার করার কোন উপায় নেই? সিজোফ্রেনিক হয়েই কি তাকে দিন কাটাতে হবে বাকি জীবন?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ডক্টর মাজেদুর রহমানও।

— ০ —

রচকানাল – এপ্রিল ২২, ২০১৪ 

ইলিউশন সাইকিয়াট্রিস্ট 

মেয়েটা সুন্দরী, কিন্তু একা দাঁড়িয়ে আছে। পড়নের পোশাক আর অভিব্যক্তিতে আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে। সন্ধ্যাও নেমে আসছে চারপাশটা অন্ধকার করে দিতে দিতে।

এরকম একটা মালকে ছেড়ে দেওয়া যায় না।

চুপচাপ গিয়ে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। একটু বিরক্ত হয় যেন ও। ভ্রু হাল্কা বাঁকিয়ে আরেকটু দূরে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দেয়। অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। ক্লান্ত হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কারও জন্য অপেক্ষা করছে? তাই হবে হয়ত। মোবাইলটা বের করে ঝড়ের বেগে ডিসপ্লেতে টাচ করতে শুরু করল এই মাত্র। নিশ্চয় যার আসার কথা তার পিন্ডি চটকাচ্ছে?

এগিয়ে গিয়ে কোন কথা না বলে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলাম।

এতটাই হতচকিত হয়ে যায় মেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া করতে পারে না। মেয়েটার নিশ্বাস আমার গলায় অনুভব করতে পারছি স্পষ্টভাবে। বেশ ভারী নিশ্বাস পড়ছে এখন আতঙ্ক? একমুহূর্ত পরেই সম্বিত ফিরে পায় অবশ্য কিন্তু তখনও প্রতিক্রিয়া করে না।

আমার বাম হাতে বেড়িয়ে আসা ছুরিটাই যে এর কারণ সেটা বুঝে উঠতে বেশী জ্ঞানের দরকার নেই। একেবারে পেটের সামান্য ওপরে ধরেছি মুখ দিয়ে কিছুই বলতে হয় না আমার হাতটা চলে যায় তরুণীর হাতব্যাগের দিকে।

‘প্লিজ ব্যাগটা নেবেন না।’ মিষ্টি অথচ ভয়ার্ত কন্ঠে প্রথমবারের মত মুখ খোলে মেয়েটা।

টান দিয়ে ব্যাগটা মেয়েটার হাত ছেড়ে ছাড়িয়ে নিতে হল। এমনিতে দেবে না যখন কি আর করা? গোলাপী ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরে সে হতাশায়। আস্তে করে ওর ওপর থেকে সরে আসি আমিও। চটপট আমার ব্যাকপ্যাকে গায়েব হয়ে যায় মেয়েটার হাতব্যাগ। একরাশ অপমান চোখে নিয়ে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

অতশত ভাবি না আমি। আমার ইয়াবার সাপ্লাই শেষ। অন্তত তিনহাজার টাকা পেলে তো দশটা কেনা যায়!

তিনদিনের জন্য একেবারে নিশ্চিত।

গলি ছেড়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছি তখন একটু খটকা লাগে।

মেয়েটার দৃষ্টিতে কি আমি অপমান দেখে এসেছিলাম? নাকি ব্যর্থতা?

দুই

বাসে করে মিরপুর-১২ যাচ্ছি।

শফিক মামাকে পেলে হয়। আমার সাপ্লাই সেই কখন থেকে বন্ধ! ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে বেশ।

পাশের ঘাড়ে গর্দানে চেহারার লোকটা গল গল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। সে যে একটা পাবলিক বাসে আছে কে বলবে এই লোককে দেখলে? ইচ্ছে করেই ভোটকাটার পা মাড়িয়ে দেই আমি। বাসের মাঝে বসে সিগারেট খাচ্ছে! আনন্দের তো সীমা থাকা উচিত একটা!

কড়া চোখে একবার তাকায় শুধু মোটকু। কিন্তু কিছু বলে না।

তারপর একেবারে হঠাৎ গলা নামিয়ে জানতে চায়, ’সঙ্কেত দেওয়া লাগবে না। রেশমা কোথায়?’

এবার আমার ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। রেশমা কে? যার ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে সটকে পড়েছি তার নাম নাকি? এই ভোটকার সাথে তার সম্পর্ক কি? জানলই বা কি করে আমার কাছে মেয়েটার ব্যাগ আছে? কিন্তু, কিছু তো বলা লাগে।

বাসভর্তি মানুষের গণপিটুনী খেতে চাই না।

ভেবেচিন্তে গলা নামালাম আমিও, ’রেশমা আটকে গেছে।’

চুক চুক করে দুঃখপ্রকাশের শব্দ করল লোকটা, তারপর আমার দিকে না তাকিয়েই আস্তে করে আবার জানতে চায়, ’প্যাকেজ কার কাছে তাহলে?’

কোনকিছু না ভেবেই বলে দিলাম, ’আমার সাথেই।’

লোকটাও একথায় আশ্বস্ত হয় বেশ। আমার দিকে একটু ঘুরে জানায়, ’সামনের স্টপেজে নেমে যাব আমরা। রিফাজের লোকেরা পিছু নিয়েছে। একেবারে গলা ফাঁক করে দেবে নাগালে পেলে।’

এ তো দেখছি রীতিমত ঝামেলায় ফেলে দিল আমাকে! গলা কাটাকাটি কেন বাবা এর মাঝে আবার? আমি নিরীহ মানুষ। নেহায়েত ইয়াবার টাকাটার জন্যই মেয়েটাকে লুট করতে হল।

মেয়েটা কে ছিল?

সুবিধের কেউ ছিল না সেটা নিশ্চিত অন্তত। আগেই সন্দেহ হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন দাঁড়াবে ওভাবে? মেয়ের মাথায় কুচিন্তা না থেকেই যায় না!

মাফিয়াদের লোক?

পেছনে আবার জনৈক রিফাজের উপস্থিতি আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয় বৈকি!

‘কাম অন!’ বাস থেমে যেতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় লোকটা।

দুইজনই সুড় সুড় করে নেমে পড়লাম। এই লোককেও খুব একটা সুবিধের লাগছে না। কিন্তু অন্তত এই মুহূর্তে এ আমার গলার প্রটেক্টর।

বাস থেকে নেমে পড়তেই গলা খাদে নামিয়ে বলে লোকটা, ’তাড়াতাড়ি আমার হাতে প্যাকেজটা দাও। রিফাজের ওরা তোমাকে দেখলেই হামলা করবে। প্যাকেজ যে বাগিয়েছো, পিঠে টার্গেট মার্ক পড়ে গেছে তোমার। কিন্তু আমার দিকে লক্ষ্য করবে না।’

সখটা একবার দেখ! আমার গলা কেটে ফেলবে রিফাজবাহিনী তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই উনার। আছেন প্যাকেজ নিয়ে! চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। এলাকা সুবিধার না। চারপাশে মেইনরাস্তা থেকে ঢুকে যাওয়া গলিগুলো বেশ চিপা চিপা।

তারওপর নেমে এসেছে রাত।

বাবাটা ইয়াবার কথা জেনে ফেলার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই হ্যাপা! টাকার উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কোন স্যারের প্রাইভেট না পড়েও টাকা মারি জেনে ফেলেছে। নয়তো জীবনের প্রথম ছিনতাইটা করা লাগত না আজ আমার। আর ওরকম ঝামেলায় পড়তেও হত না।

বিমর্ষ মুখে লোকটার হাতে আমার ব্যাকপ্যাক তুলে দিতেই চটপট পড়ে ফেলল ওটা। ভালুকের মত শরীরের মানুষটার গায়ে আমার ব্যাকপ্যাক নেহায়েতই ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে!

‘ফলো মি! ফাইলটা নিতে পারলেই রিফাজবাহিনী একেবারে থেমে যাবে!’ বলে একটা কানাগলিতে ঢুকে যায় অদ্ভুত মানুষটা।

প্যাকেজ নিরাপদে রাখতে যাচ্ছে নিশ্চয়? আর ফাইলটা নিতে?

ভালো কথা, ফাইলটা কিসের?

আধো-অন্ধকারে গলির মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে থাকা ষন্ডামার্কা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলতে গিলতে ভালুকটার পেছন পেছন গলিতে ঢুকে পড়লাম আমিও।

তিন

আমার ব্যাগটা কাঁধে নেওয়া মানুষটা একজন ষাঁড়।

তবে গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর প্রত্যেকে দেড়জন ষাঁড়। কিন্তু তৃতীয়জন, এঁদের দলনেতা লোকটি বেশ প্যাকাটি গড়নের। প্যাকাটিটা সামনে আসল।

‘চমৎকার আব্রাহাম! নিজেই চলে এসেছ দেখছি!’ চিকণ মানুষটার মুখ থেকে কামানের গোলার মত গর্জন বের হয়ে আসে।

‘কি আর করা! ফাইলের তো আর পা নেই। তাই আমারগুলোকে ধার চেয়েছে কিছুক্ষণের জন্য।’ বেশ হাসিমুখেই বলে আব্রাহাম পিঠে ঝোলানো আমার ব্যাগটার একটা স্ট্র্যাপ ধরল একহাতে।

‘কোন ফাইল?’ চোখ সরু সরু করে জানতে চায় চিকণা।

‘আহা! ন্যাকা আরকি!’ দাঁত খিঁচায় আব্রাহাম, ’তোমাদের বস ভেতরে আছে?’

এ কথায় পেছনের তিন দেড়জন করে সাড়ে চারজন ষাঁড় এগিয়ে আসে কিছুটা।

‘বস কারও সাথে দেখা করবেন না।’  চাছাছোলা গলায় জানিয়ে দেয় ভদ্র চেহারার একজন’বস’-এর বডিগার্ড।

চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে একবার ঘাড় মটকালো শুধু আব্রাহাম। আমি পিছিয়ে আসি দুইপা। ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই দূরে সরে দাঁড়াই।

এবার প্যাকাটি দলপতি নিজেই এগিয়ে আসে।

‘গেট লস্ট, আব্রাহাম। ভাইয়ের সাথে দেখা করার আসা ছেড়ে দাও। আর যা ক্ষতি হয়েছে মেনে নাও। সাথে করে বাচ্চা পোলাপান নিয়ে এসেছ আমাদের ঘাঁটিতে সরাসরি? তোমার সাহস আছে বলতেই হচ্ছে।’

বাচ্চা পোলাপাইন আমার ঘাড় হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমাকেও দেখছি ওরা গোণায় ধরেছে! তিন ষন্ডার গঠন দেখে হাঁটুতে জোর পাচ্ছি না আর।

আল্লাহর কাছে একবার প্রার্থনা করলাম এখান থেকে জ্যান্ত পালাতে পারলে ইয়াবার জগত ছেড়ে চলে আসব। এরই মাঝে দেখি আব্রাহাম প্যাকাটির পেট বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে!

প্যাকাটি-টাইপ মানুষটা উড়ে গিয়ে এক ষন্ডাকে সাথে নিয়েই মাটিতে পড়ে।

রইল বাকি দুই।

চমৎকার মুখভঙ্গী করে ছুটে আসছে ওই ষন্ডাদ্বয় আমার নিজেরই গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হল, ’ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে!’

আব্রাহাম আমার ব্যাকপ্যাক এক ষন্ডার মুখের ওপর দড়াম করে ফেলে দিতেই’উহা’র গতিবেগ রহিত হয়ে গেল! অপর ষন্ডার মুখে আব্রাহাম আর ব্যাগ নয়   নিজের ছয়মনি হাতই ফেলে দিচ্ছে দেখতে পেলাম। একপাক ঘুরে এক ষন্ডার পতনের সাথে সাথেই আমার ব্যাগ একপাশে ফেলে দ্বিতীয় ষন্ডা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আব্রাহামের ওপর।

আব্রাহাম একটু কায়দা করে সরে যেতেই টার্গেটকে মিস করে সোজা আমার দিকেই ধেয়ে আসে দ্বিতীয় ষন্ডা। তবে কৌতুকপূর্ণ মুখ নিয়ে পেছন থেকে পা বাঁধিয়ে দেয় আব্রাহাম।

আমিও আব্রাহামের কাছে এইমাত্র শেখা  কায়দাটা করে একটু সরে যেতেই ঝপাত করে একেবারে নর্দমার মাঝে আছড়ে পড়ল ষাঁড়টি।

তৃতীয় ষাঁড়ের দিকে নজর ফেরাতেই দেখতে পেলাম প্যাকাটি-দলপতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে এখনও  ছেলে! আব্রাহাম সেদিকে নজর দিতেই দড়াম করে সামনের বাসাটার দরজাটা খুলে যায়। প্যাকাটি-দলনেতার’এল্ডার-ভার্সন’ বেড়িয়ে আসে ভেতর থেকে।

‘বাইরে এত হট্টোগোল কিসের, অ্যা?’ সরু গলা দিয়ে সিংহের মত গর্জন করে বলল লোকটা।

চার

এই মানুষটাই যে ওই প্যাকাটি ছোকড়ার ভাই এটা বোঝার জন্য আমার তৃতীয়শ্রেণীর ঘিলুই যথেষ্ট। এর কাছেই তাহলে আছে একটা টপ সিক্রেট ফাইল! যেটা দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে পুরো রাফিজ বাহিনীকে। তবে এই লোক আমাদের ঠেকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করল না।

‘আরে আব্রাহাম যে! এতদিন পর হঠাৎ কি মনে করে?’

‘ফাইলটা লাগবে আমার। দিয়ে দাও। চলে যাই।’ ঝটপট দরখাস্ত করে ফেলে আব্রাহাম।

‘তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না।’ গম্ভীর মুখে বলে দরজা লাগাতে শুরু করল প্যাকাটির বড় ভাই।

ঝট করে একটা পা বাড়িয়ে দরজার শেষ মাথা আটকে ফেলে আব্রাহাম, ’এত সহজে না, মাহমুদ। ভেতরে আসছি আমরা।’

মাহমুদের আপত্তি মোটেও কানে তোলা হল না।

বাইরের তৃতীয় ষন্ডা একেবারে থার্ড আম্পায়ারের মতই বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিতেই মাহমুদের কলার ধরে একটা ঝাঁকুনী দেয় আব্রাহাম।

‘সেনের ফাইলটা। কুইক!’

‘ওই ফাইল আমি পাবো কোথায়?’ অবাক হওয়ার ভান করতে করতে বলে মাহমুদ।

আমি শুধু নাটক দেখছি। আব্রাহামের মত বডি বিল্ড করতে পারলে হত। একাই দুটো ভোটকাকে শুইয়ে দিতে পারলে আমার ইয়াবার টাকার অভাব হত না আর।

পরক্ষণেই একটু আগে করা প্রার্থনার কথা মনে হতেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটলাম।

ফাঁড়া কেটেছে এই ঢের! এবার এখান থেকে বেরিয়েই বাবাকে বলে একটা রিহ্যাবে ঢুকে যাবো। রোজ রোজ মেয়েদের সম্পদ লুট করতে গিয়ে প্যাঁচে পড়ব নাকি?

‘আমি জানি না ওই ফাইল কোথায় গেছে। বহুদিন ধরেই মিসিং শুনেছি।’ বিড় বিড় করে বলে মাহমুদ।

‘তুমি ডিপার্টমেন্ট ছাড়ার পরদিন থেকেই মিসিং ওটা, মাহমুদ! বন্ধুত্বের খাতিরে তোমার দিকে নজর দেইনি এতদিন। কিন্তু এখন ফাইলটা আমার দরকার। আর একটা গান। নাহলে মারা পড়বে আরেকটা নিরপরাধ মেয়ে! মাস্টার তিরমিজির কথা মনে আছে নিশ্চয়? আর তাঁর ছোট মেয়ে ফাল্গুনীর কথা?’

ওদের কথা শুনে এবার আমার কান খাড়া হয়ে যায়। কাহিনীর প্যাঁচ ঘোরতর!

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহমুদ।

‘ফাইলটা নিতে পার। তবে মনে রেখ দিচ্ছি কেবল মাস্টার তিরমিজির কথা ভেবেই। আমার প্রাণরক্ষক তিনি।’

‘এখন তাঁর মেয়ের প্রাণভক্ষক হতে যেও না। রাফিজের চোখ কোনদিকে পড়েছে বুঝতে পারছ? ডাটা সব চলে যাবে একেবারে জায়গা মত। তুমি আমি অথবা মাস্টার তিরমিজি কেউই রক্ষা পারবে না সেটা হলে।’

ভেতরে ঢুকে পড়ি আমরা মাহমুদকে ফলো করে। রান্নাঘরে এনে একটা মাটির নিচে যাওয়ার রাস্তা বের করে ফেলে মাহমুদ মেঝের এক অংশ সরিয়ে।

তারপর নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়।

একটু পর বের হতেই হাতের ঢাউস ফাইলটা চোখে পড়তে আমিও ভড়কে যাই।

‘পদ্মার বুকে মাস্টার তিরমিজি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন সেই ম্যাসিভ গানফাইটের মাঝেও। সেই ঋণের কিছুটা শোধ দেয়ার প্রচেষ্টা শুধু, আব্রাহাম। তবে লড়াইটা তোমার। আমি আর ফোকাসে আসতে চাই না।’

কোমর থেকে খুলে একটা পিস্তলও বাড়িয়ে দেয় মাহমুদ আব্রাহামের দিকে।

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখি শুধু আমি।

পাঁচ

কোনমতে হেঁটে চলেছি আমি আব্রাহামের সাথে।

দুইজনেই চুপ একেবারে।

আমার মাথায় কিছুরই হিসেব মিলছে না। কোথা থেকে কি হয়ে গেল!

একটা মাত্র ভ্যানিটিব্যাগ চুরি করতে গিয়ে এত বড় ঝামেলায় পড়া লাগবে জানলে কি আর আগাই?

‘কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেওয়াই যায় তোমাকে।’ মুখ খোলে আব্রাহাম, ’ঘটনার সাথে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে জড়িয়ে পড়েছ তুমি। আমি, মাহমুদ দুইজনই ছিলাম বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সীর সাথে। কিন্তু আর সবার মতই আমাদেরও একটা কালো অধ্যায় আছে। আমাদের সুপিরিয়র ছিলেন মাস্টার তিরমিজি। উনার প্ল্যান অনুযায়ী আমরা কাজ করতাম যাকে বলে ইয়ে আইনে অবৈধ।’

তাকিয়ে থাকি আমি।

‘যেসব অপরাধীদের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব থাকত, যাদের জেলে ভরে রাখা সম্ভব নয় তাদের মাথাতে সোজা বুলেট ঢুকিয়ে দিতাম আমরা। অ্যারেস্ট করার ঝামেলায় যেতাম না।’

বলে কি! আমার তো রীতিমত গা গুলাচ্ছে। এই মানুষ এতবড় খুনী সেটাই বা কে জানত!

‘জেনে ফেলে শেষ শিকার অভিজিৎ সেন। পালটা আঘাত হানে সে তার লোকেদের নিয়ে। লোকটা ভূতের মত। ডিপার্টমেন্টের এজেন্টরা সিরিয়ালি মারা পড়ছিল মরিয়া হয়ে আমরাও ডাটা কালেক্ট করতে শুরু করি। কিন্তু তার আগেই কাজ হয়ে যায় মাস্টার তিরমিজির বাসায় হামলা চালিয়ে পার্সোনাল ড্রাইভ কেড়ে নেয় কেউ যেটায় আমার আর মাহমুদের সিক্রেট কিলিং মিশনের ডাটাগুলো সবই আছে।’

‘তারপর?’ গোগ্রাসে আব্রাহামের কাহিনী গিলছি আমি।

‘প্রাণপনে হামলা চালাই আমরা সেনের ঘাঁটিতে। সেনকে হত্যা করে উদ্ধার করে আনি হার্ডড্রাইভটা। কিন্তু ততদিনে ডিপার্টমেন্ট সন্দেহ শুরু করেছে। আমাদের তিনজনই চাকরিচ্যুত হতাম ফাঁসী-টাসীও হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র ছিল না। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে আমাদের খুনগুলোর বিচার ঠিকমত হল না। আমাদের ফিল্ড থেকে সরিয়ে ডেস্কজব দেওয়া হল। কিন্তু অফিস ছেড়ে চলে গেল মাহমুদ এরপর, রেজিগনেশন দিয়ে। সেই সাথে কারও চোখে না পড়লেও আমার চোখে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে সেনের ফাইল।’

‘ওই ফাইলের সাথে আজকের ছোটাছুটির সম্পর্ক কি?’ না জানতে চেয়ে পারলাম না।

‘সেনের ডানহাত রাফিজ এখন ক্ষমতায়, বাঁধন।’ হাঁটতে হাঁটতেই আমার নাম জেনে নিয়েছে আব্রাহাম।’গতপরশুই মাস্টার তিরমিজির মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে ওরা। আজ জমা দেয়ার কথা ছিল হার্ডড্রাইভটা। তবেই জীবিত ফিরে পাওয়ার কথা ছিল ফাল্গুনীকে। শর্ত একটাই ফাল্গুনীর বোন অহনাকে নিয়ে যেতে হবে হার্ডড্রাইভ।’

‘কিডন্যাপাররা তাহলে মোবাইলে টেক্সটের মাধ্যমে যোগাযোগ করছিল?’ এবার বলি আমি। সবকিছু এখন স্পষ্ট।

যেই মেয়েকে ছিনতাই করেছি আমি, সে দেখা যাচ্ছে কিডন্যাপড ফাল্গুনীর বোন অহনা ছিল!

‘চালাক ছেলে। ঠিকই ধরে ফেলেছ।’

‘আপনাদের ডুবিয়ে দিয়ে কি লাভ রাফিজের?’

‘প্রতিশোধ! আমাদের কারণে ওদের অনেক সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। রাফিজের বড় ভাই রিয়াদও মারা যায় মাহমুদের হাতে। যে করেই হোক আমাদের ডুবাবে ওরা। এর আগেই আমাদের ফাল্গুনীকে খুঁজে বের করতে হবে।’

‘আগাচ্ছেন কিভাবে?’ সন্দেহভরা কন্ঠে জানতে চাই আমি।

‘ফাইলের সব পৃষ্ঠার ছবি অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। যথেষ্ট তথ্য আছে। মাহমুদ অহেতুক ভয় পেয়েছিল। সেনের ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে আমাদের কুকীর্তির কথা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য ফাইল সহই কেটে পড়েছিল ও। এখন দেখা যাক অফিস থেকে কোন লিড পাওয়া যায় কি না!’

‘ডেস্ক থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি করছেন কিভাবে?’ জানতে চেতেই হল।

‘স্পেশাল কোয়ালিফিকেশনের জন্য আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এই মিশনে। আমাদেরই কো-ওয়ার্কারের মেয়ের কিডন্যাপিং দেখে ডিপার্টমেন্ট তেঁতে রয়েছে। অবশ্য কিডন্যাপিংয়ের পেছনে কি রহস্য সেটা ওরা জানে না।’

‘তারমানে মুক্তিপণ হার্ডড্রাইভটা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল অহনা। ব্যাকআপ হিসেবে ছিলেন আপনি। তারমাঝেই হামলে পড়েছি গিয়ে আমি?’

‘হুঁ। শুধু তাই না আস্ত হার্ডড্রাইভ নিয়ে সটকে পড়েছ। কাজেই তোমাকে ফলো করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার। আর বাসে একটু রহস্যের গন্ধ দিতেই একা একাই চলে আসলে সাথে। ধন্যবাদ তোমাকে।’

মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে আব্রাহামের।

‘গট দ্যা লোকেশন। তোমার ব্যাকপ্যাকটা ধার নিতে পারি? শেষ অ্যাকশনে যাচ্ছি। আশা করি ফাল্গুনীকে নিয়ে বের হয়ে আসতে পারব।’

‘আমি যাচ্ছি না সাথে?’ আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে তাকালাম আমি।

‘তোমার এসবে ট্রেইনিং নেই, বাঁধন। মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট করেছ তুমি। এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।’

রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকি আমি।

সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকা মানুষটা আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে।

বুঝিয়ে দিয়ে গেছে একটা ব্যাপার হয়ত তাঁর নিজের অজান্তেই!

জীবন মোটেও হেলাফেলায় কাটানোর মত জিনিস না। জীবন একটাই।

নিজের জীবনকে ঘুরিয়ে ফেলব আমি।

আর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সীতে গিয়ে ঢোকার একটা ভালো চেষ্টা দিতেই হবে!

ইয়াবার গুষ্টি আমি কিলাই। আজই বাবাকে বলে সোজা রিহ্যাব!

ছয়

ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন লিয়াকত হোসেন।

কুঞ্চিত ভ্রুর পেছনে অষ্টম স্কেলের কারণ বিদ্যমান। একটু পর তিনি রেজাল্ট পাবেন।

লিয়াকত হোসেনের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তবে তিনি কোন মেডিকেল চেক-আপের রেজাল্টের অপেক্ষাতে নেই। একমাত্র ছেলে শরীফ হোসেন বাঁধনের রেজাল্টের অপেক্ষায় আছেন। ছেলের বয়স কম মাত্র কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে  তবে এরই মাঝে ইয়াবা ধরে ফেলেছে!

ইলিউশন-সাইকিয়াট্রিস্ট ফারদিন আহমেদ চৌধুরী তাঁর বাল্যজীবনের বন্ধুর ছেলে। এই একটা কারণেই তাকে একটা সুযোগ দিয়েছেন। কারণ ইলিউশনিস্ট মনোরোগ বিজ্ঞান বলে কোন বিজ্ঞান এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এটা ফারদিনের নিজের আবিষ্কার। আর তাতেই কি না নিজের ছেলেকে গিনিপিগ বানাতে সম্মত হয়েছেন লিয়াকত সাহেব!

বয়েসের সাথে কি তার বুদ্ধিশুদ্ধিরও লোপসাধন হচ্ছে?

‘নেশাগ্রস্থ ছেলেরা হতাশার আড়ালে লুকিয়ে আসলে অ্যাডভেঞ্চার খোঁজে।’ ফারদিন বলেছিল সেদিন, ’যদিও এই অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপারে তারা নিজেও জানে না। অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকে সেটা। অথচ অ্যাডিক্টের কোন আইডিয়াই নেই ঠিক কোন কারণে নেশার অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে সে। জানতে চাবেন আপনি ফট করে বলে দেবে, “আমার জীবন নিয়ে আমার অনেক হতাশা।” যতসব ফালতু কথা বার্তা। এই ছেলেকেই নিয়মিত হান্টিং রাইফেল দিয়ে শিকারে পাঠান ঝটপট কমে যাবে ড্রাগস নেওয়ার পরিমাণ।’

‘তুমি সাজেস্ট করছ বাঁধনকে আমি শিকারে পাঠাই?’ সামনে বসে থাকা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মনে রোগ আছে কি না সে ব্যাপারেই সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পরেন লিয়াকত সাহেব।

‘না, স্যার!’ হেসে ফেলে ফারদিন, ’এখানেই কাজ করব আমি। বাঁধনকে একটা চমৎকার ইলিউশন দেব। প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারের। এতে ও জীবনের বিস্তৃতিটা বুঝতে পারবে। আশা করি কাজ হয়ে যাবে। আমাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেন।’

‘তোমাদের মানে?’ ভারী গলায় জানতে চান লিয়াকত হোসেন।

‘আমাদের টিম আছে একটা। এটা নিয়ে কাজ করছি আমরা। আমি ছাড়া আরও পাঁচজন আছি। ইলিউশন দিতে হলে লোক তো কিছু লাগেই। আপনি শুধু বাঁধন বের হবে যখন আমাকে একটা মেসেজ দেবেন। বাকিটা আমরা দেখব।’

ভরসা রেখে তো ভুল করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। সারাদিন বাঁধনের কোন পাত্তা নেই। যত্তসব অহেতুক তত্ত্ব!

উঠে দাঁড়ালেন লিয়াকত হোসেন। ছেলেটাকে রিহ্যাবে দেওয়াটা দরকার। কিন্তু নিজের ইচ্ছে না থাকলে দিয়ে কাজ হবে না। আবার বের হয়েই নেশাতে ডুবে যাবে!

খুট করে একটা শব্দ হয় পেছনে।

লিয়াকত হোসেন ঘুরে দেখতে পান তাঁর একমাত্র ছেলেকে। আজ ওর চোখে অন্যরকম একটা আভা বাঁধন জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে!

*

পার্সটা উল্টে পালটে দেখছে ফারদিন। মেয়েটার নাম-ঠিকানা কিছু পাওয়া যায় কি না বের করা দরকার। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁধন ছেলেটার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে আছে ও। তবুও হাতের কিছু কাজ শেষ করতে হল।

রাত অনেক হলেও আজকের এক্সপেরিমেন্টটার রিপোর্ট লিখে ফেলেছে ও। প্রথম পরীক্ষাতেই সাফল্য!

বাঁধনের বয়েসী ছেলেদের জন্য বেশ কাজের হবে প্রক্রিয়াটা। এখন শুধু ছিনতাই করা পার্সটার মালিককে খুঁজে বের করলেই ওর কাজ শেষ। ভেতরে হাত দিতেই একটা হার্ডড্রাইভ উঠে আসে ওর হাতে।

সরু চোখে সেদিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ফারদিন। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে ও একটা নামের জন্য।

ছোট একটা কাগজে নাম ঠিকানা আটকানো আছে ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতরের পিচ্চি পার্সটায়।

সেদিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় ফারদিন আহমেদ চৌধুরী।

‘অহনা তিরমিজি’ নামটা যেন জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে!

 

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪ 

মনস্তত্ত্ব

রাহাত বহু কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে আর বেশিক্ষণ পারবে না। মেয়েদের সাথে অশ্লীল ব্যাবহার তার মোটেই পছন্দ নয়।
পাশে দাঁড়ানো লোকটার মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তার বহুক্ষণ ধরেই হচ্ছে।
বাসে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত। ঢাকায় সিটিং সার্ভিস কয়টা আর কাজে সিটিং? দিনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলোয় – যখন চেকার বাসে উঠে – তখনই এরা ভদ্র হয়ে যায়। বাকি সময়গুলো হেল্পারদের ধান্ধা থাকে ড্রাইভারের কোল পর্যন্ত একটা মানুষ তোলার।
ভাগ্যকে মেনে নিয়ে রাহাতও দাঁড়িয়ে ছিল।
এক তরুণীকে রাহাতের মতই বাধ্য হয়ে দাঁড়াতেই হয়েছে। রাহাত সীট পেলে নিশ্চয় ছেড়ে দিত। পাশের লোকটা ভীড়ের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছে করেই মেয়েটার কোমরে হাত দিচ্ছে। যদিও মুখে ফুটিয়ে রেখেছে রাজ্যের সারল্য। আর ওদিকে লজ্জায়-অপমানে মেয়েটা লাল হয়ে আছে।
হঠাৎ বাসের রড বাম হাতে ধরে ব্যালেন্স ঠিক করে ডান হাতে সপাটে ঘুষি চালায় ও অভদ্রটার মুখ বরাবর। মটমট করে একটা শব্দের সাথে মুখ থেকে রক্তের সাথে বেড়িয়ে আসে দুটো দাঁত। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা।
‘ঘরে তোর মা-বোন ছিল না কখনও?’ দাঁতে দাঁত পিষে বলে রাহাত। ‘মেয়েদের সম্মান করতে শেখ, ****(প্রকাশের অযোগ্য)।’
বাসজুড়ে হট্টগোল পড়ে যায়। অন্যান্য যাত্রীরা উঠে সরিয়ে দেয় রাহাতকে। হেল্পার এগিয়ে আসে।
‘তুমি হালার পো কোন এলাকার মাস্তান?’ রাহাতের বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে। ‘নিরীহ একটা মানুষের মুখে এভাবে মারো?’
তাকে সায় দিয়ে ঘিরে ধরে আরও কয়েকজন।
*
মাঝপথে থেমে যায় বাসটা। ছুঁড়ে ফেলা হয় রাহাতকে।
রাস্তা থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় রাহাত। নাক থেকে গড়িয়ে আসা দু’ ফোঁটা রক্তের ফোঁটা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছে ফেলে।
নিস্ফল আক্রোশে লাথি দেয় রাস্তায়।
স্রেফ একটা মেয়েকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। অথচ কেউ সেটাকে পাত্তাই দিল না। তার কথা কেউ শোনার প্রয়োজনও মনে করল না! কোট-টাই পড়া অমানুষটাকেই সবার ভদ্রলোক বলে মনে হল?
আর মেয়েটা পুরো সময় ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ওই শালী কিছু বলতেই পারত! ‘যার জন্য করলাম চুরি – ’ বিড়বিড় করে রাহাত।
কটমট শব্দে ডানে বামে ঘাড় মটকে চায়ের দোকানে আসে ও। বড্ড লেগেছে। চলন্ত বাস থেকে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়া কোন ছেলেখেলা নয়।
‘মামা, পানি দেন একগ্লাস।’
পানি রুমালে ঢেলে নাক থেকে রক্ত মোছে রাহাত। এই সময়ই প্রথম শোনে ও সুরেলা কন্ঠটা।
‘আপনার কি বেশি লেগেছে?’
ঘুরে দাঁড়িয়ে ও দেখতে পায় সেই তরুণীকে। ওকে বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলার সময়ই নিশ্চয় নেমে এসেছে! মেজাজ টং হয়ে যায় রাহাতের। ‘বাস ভর্তি মানুষ যখন আমাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছুঁড়ে ফেলছিল তখন একটা শব্দও মুখ থেকে বের হয়নি আর এখন এসেছ পিরীতির আলাপ করতে!’ মনে মনেই খেদ ঝাড়ে ও, সব কথা মুখে বলতে নেই।
‘না।’ কিছু একটা বলা লাগে তাই এতখানি বলল।
‘আমি খুবই দুঃখিত।’ আবার ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়েটা। ভাল ছিচকাঁদুনের পাল্লায় পড়া গেছে – ভাবে রাহাত।
‘আপনার দুঃখ নিয়ে আপনার পথে চলে গেলেই আমি খুশি হতাম।’ বেশ জোরেই বলে রাহাত, ‘প্লিজ!’
চায়ের দোকানদার আর কাস্টোমাররা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ভাল তো!
রাস্তায় তরুণ-তরুণীকে দেখলেই বিশেষ লুক দেওয়া হয় এই দেশে। আর এ তো নাক থেকে রক্তের ফোঁটা মুছতে থাকা তরুণের হুংকার। তাকাবে – সন্দেহ কি তায়!
গ্লাসটা দোকানে ফেরত দিয়ে সামনে হাঁটা দেয় রাহাত। ভয়ে ভয়ে গ্লাস ফেরত নেয় দোকানীও।
মেয়েটার দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে রিকশা নেয় ও।
বাসায় যাওয়ার পথে একদফা নাটক হয়ে গেছে। আরেকবার বাসে উঠে ঝামেলায় যেতে চাইল না। একদিনের জন্য বাসে যথেষ্ট ওঠা হয়েছে!
*
কলিংবেলের শব্দ শুনেও পাত্তা দেয় না রাহাত। এই রাতের বেলা কারও আসার কথা না।
আর কেউ আসলেও সে এমন লাটসাহেব হয়ে যায়নি যে কলিং বেলের শব্দ শুনেই ছুটতে হবে।
এমনিতেই বাসায় কেউ নেই।
বাবা-মা আর ছোটভাইকে কয়েক মাস থেকে করা প্ল্যান অনুযায়ী গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ও। রাহাতেরও যাওয়ার কথা ছিল – হরতালে পিছিয়ে যাওয়া সেমিস্টার ফাইনালের জন্য আটকে গেল। মা ওই অজুহাতেই বার বার গ্রামের বাড়ি যাওয়া পিছাচ্ছিল, এবার রাহাতের জোরাজুরিতে আর পারেনি। ও তো আর স্কুলের কচি খোকাটি নয় যে তার পরীক্ষার জন্য বাবা-মাকে বাড়ি বসে পাহারা দিতে হবে!
আধঘন্টা পর আবারও কলিং বেল।
এবার একটানা চারবার।
এবার টেবিল থেকে মুখ তোলে রাহাত। ঘড়ি দেখল, যথেষ্ট রাত হয়েছে। বাবার ব্যবসায়ী সুনাম এলাকার চোর-ছ্যাচ্চড়ের জানতে নিশ্চয় বাকি নেই। তিন বছর আগে ওরা সপরিবারে থাইল্যান্ড ট্যুরে যেবার গেল, চুরি হয়েছিল বাসায়।
পঞ্চমবার কলিং বেলটা বাজলো, দ্বিধা ছেড়ে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ায় রাহাত। বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকে আলমারির নিচের দেরাজটায় হাত দিতেই পাওয়া গেল ওটা।
বাবার পিস্তল!
জিনিসটা ও চালাতে জানে। বাবা-ই শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “অস্ত্র আমি ঘৃণা করি। তবে ব্যবসায়ীর ছেলে হিসেবে তোকে এই বাজে জিনিসটা শিখিয়ে রাখাই ভালো। নানা দিকে শত্রু। এদেশে খেটেখুটে কিছু করবি, তাতে শান্তি নেই। অন্যরা চেষ্টা করবে মুফতে তা নিয়ে যেতে!”
সেফটি ক্যাচ অফ করে রাহাত। সাবধানের মার নেই। রাতের বেলা এ এলাকায় ডাকাতি আগেও হয়েছে। দরজা খুলে হাল্কা ফাঁক করে রাহাত।
বিকালের সেই সমস্ত গন্ডগোলের হোতা মেয়েটা দাঁড়িয়ে।
‘আমার বাসা খুঁজে পেলে কি করে?’ কোমরের পিছে পিস্তলটা লুকোয় রাহাত। বেশ রুক্ষস্বরেই প্রশ্নটা করল এবার। বিষয়টা এবার হ্যারাসমেন্টের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
‘আপনাকে ফলো করেছিলাম। আই অ্যাম সরি। আজ আপনার সাথে যা হল সেজন্য সত্যিই খুব খারাপ লাগছে আমার। তাও আবার আমার জন্য।’ চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খুবই ভয়ে আছে মেয়েটা, ‘আপনি ক্ষমা না করলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।’
‘আদর্শবতী!’ – রাগে দাঁত কিড়মিড় করে রাহাত। মুখে যদিও বলে ভিন্ন কথা –
‘আমি কিছু মনে করিনি। ওদের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ছিল। তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝি। পাবলিকলি কিছু বলতে পারনি। এটা নিয়ে প্লিজ আর চিন্তা করবে না। উই আর ইভেন।’
‘আসি তাহলে?’
‘জ্বী – আসতে পারেন।’ ‘তুমি’ থেকে আবার ‘আপনি’তে ডাইভার্ট হয়ে গেল রাহাত। একে খ্যাদানোটা প্রথম কথা।
‘ওহ – বাই দ্য ওয়ে, আমি তন্বী।’
‘আমি রাহাত।’ ভদ্রতা করেও ভেতরে ডাকে না রাহাত ওকে। কাজ পড়ে আছে।
‘আসি রাহাত ভাই। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব আমি।’
দরজা লাগায় রাহাত।
*
গত কয়েকদিন ধরে সাইকোলজির ওপর একটা নতুন থিওরি নিয়ে গবেষণা করছে রাহাত। যদিও ও কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র – সাইকোলজি বিষয়টা ওর প্যাশন।
তন্বীকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানানোটা হয়ত ভদ্রতার দাবী রাখত – কিন্তু সারাদিনের অভিজ্ঞতা এবং নতুন গবেষণার ব্যাপারটা মিলিয়ে এতদিকে খেয়াল ছিল না ওর। প্রচুর পুরোনো পেপার পড়তে হচ্ছে ওকে। নিজেও সাক্ষাতকার নিচ্ছে বেশ কিছু মানুষের। সেসবের রেকর্ডিং থেকে করতে হচ্ছে ট্রান্সক্রাইব। বেশ সময়ের ব্যাপার। মনোসংযোগেরও!
আবার দ্রুত ফিরে এল রাহাত ওর রুমে। চিন্তা যেখানে থেমেছিল, সেখানে নিজেকে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করল তারপর। একবার মনোযোগ নিয়ে এসে ভেঙ্গে গেলে আবার ফিরিয়ে আনাটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
বেশ কয়েক মিনিট পর নিজের চিন্তায় ঢুকে পড়তেই খুট করে একটা শব্দ হয় ঘরের দরজার কাছে।
সেদিকে তাকিয়েই চমকে যায় রাহাত।
তন্বী এলোমেলো চুলে দাঁড়িয়ে আছে।
ও কোনদিক দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল?
‘তুমি এখানে কি করছ?’ কঠোর কন্ঠে বলতে গিয়েও থেমে যায় রাহাত।
শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাপড় ছেঁড়া মেয়েটার।
হাতে একটা কিচেন নাইফ।
মুখ দিয়ে একটা জান্তব শব্দ করে রাহাতের ওপর ছুরি বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটা।
বিদ্যুতবেগে গড়িয়ে সরে যায় রাহাত। বিছানায় গেঁথে যায় ছুরির ফলা।
টান দিয়ে বের করে আবার রাহাতের দিকে এগিয়ে আসে তন্বী।
লাথি দিয়ে চেয়ারটা ওর দিকে পাঠিয়ে দেয় রাহাত।
অপার্থিব একটা লাফ দিয়ে ওর সামনে চলে আসে তন্বী। কোন বাধা না পেয়ে খাটের সাথে ধাক্কা খায় চেয়ারটা।
এই প্রথমবারের মত আতঙ্ক অনুভব করে রাহাত।
মেয়েটা কি মানুষ? একটা আহত মেয়ে কিভাবে এক লাফে চারফুট ওপরে ওঠে?
জীবনবাজি রেখে ছুটে ঘর থেকে বের হয় ও।
পেছনে জান্তব শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসে তন্বী, যেন সাক্ষাৎ পিশাচিনী!
ডাইনিং টেবিল থেকে একটা গ্লাস ছুঁড়ে মারে রাহাত ওর দিকে।
স্রেফ বাতাসে ভেসে এড়িয়ে যায় মেয়েটা। বিকট শব্দে গ্লাসটা ভাঙ্গল দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে।
আর একমুহূর্ত নষ্ট না করে ছুট লাগায় রাহাত।
বাবা-মার ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকায়। ওখানেই রেখছিল তো?
হ্যাঁ। ভদ্র ভঙ্গীতে শুয়ে থাকা পিস্তলটার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাহাত।
হাতে ঠান্ডা – মসৃণ বাটটার ছোঁয়া পেতেই পেছনে দড়াম করে পুরোপুরি খুলে যায় দরজা।
মেয়েটার চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে , মুখ বেয়ে কষ গড়িয়ে পড়ছে।
পরের সেকেন্ডেই উদভ্রান্তের মত রাহাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তন্বী।
পাগলের মত গুলি চালায় রাহাত।
তিনটি গুলি বেরিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করে সবগুলো মিস করেছে তাড়াহুড়োয়।
ছুরি ধরা হাত মাথার ওপর তোলে মেয়েটা মরণ আঘাত হানতে।
পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে দুইবার গুলি করে রাহাত।
ছিটকে পেছনের দিকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যায় মেয়েটা। এবং পড়েই থাকে।
রক্তের ক্ষীণ একটা স্রোত বয়ে যায় রুমের মেঝেতে – তরলের নিম্নগামীতার সূত্র মেনে নিয়ে।
*
রাত ১২টা।
রাহাতদের রোডেই খালি একটা প্লট।
বেলচা দিয়ে যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে কবর খোঁড়ে রাহাত।
আলতো করে শুইয়ে দেয় মেয়েটাকে।
খুনটা করে ফেলার পরই তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করেছিল ওকে।
স্রেফ আত্মরক্ষার খাতিরেই কাজটা করতে হয়েছে ওকে – অথচ শান্তভাবে কিচ্ছুটি ভাবতে পারছিল না। কখনো একটা পিঁপড়েও মারেনি সে। সেখানে জ্বলজ্যান্ত একজন মানুষ…
আর কিছু ভাবতে পারেনি। লাশটাকে ঢেকে এখানে নিয়ে এসেছে।
নির্জন ছিল পুরো গলি। ডাকাতদল তো আর বিনা কারণে এই এলাকাকে বার বার তাক করে না! মনে হয় না কেউ গুলির শব্দ শুনেছে বা শুনলেও তা চিনতে পেরেছে। এলাকা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ।
ও ছাড়া কোন সাক্ষী নেই, কেন ‘জলবৎ তরলং’ একটা ব্যাপারকে থানা-পুলিশের পর্যায়ে নিয়ে যাবে?
লাশটাকে মাটিচাপা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয় রাহাত। এই প্লটে আগামী বছরের আগে কাজ শুরু হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই – জানে রাহাত। সুলায়মান আংকেলের প্লট। বাবার সাথে তার খাতির বেশ। বছরখানেক পর এই লাশ কন্সট্রাকশনের লোকজন পেয়ে যাবে, তারপর কঙ্কাল উদ্ধার করে ছাই করে ফেলবে পুলিশ।
বাসার দিকে ক্লান্ত পায়ে ফিরে চলে ও। রক্তের দাগ পরিষ্কার করতে হবে।
*
এখানেই পুরো ঝামেলা শেষ হতে পারত – কিন্তু শেষ হওয়ার পরিবর্তে বেড়েই চলল তা।
পরদিন সকালে নাস্তা করতে বের হয়েছিল রাহাত। বাবা-মা না থাকলে নাস্তাটা বাইরেই সারে ও। সকাল সকাল রান্না করার ঝামেলায় যেতে কারই বা ভালো লাগে!
রাস্তায় পা রাখতেই ওপাশ থেকে হেঁটে এল তন্বী।
তীব্র আতঙ্কে জায়গাতে জমে যায় রাহাত।
হাসিমুখে ওকে পাশ কাটিয়ে রাস্তা দিয়ে মেয়েটা হেঁটে যায় উল্টোদিকে।
মাথা দুই হাতে ঢেকে বসে পড়ে রাহাত।
চারদিকে ঝলমলে দিনের আলো। এর মাঝে এসব ব্যাখ্যাহীন কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না ও মোটেও।
আধঘন্টা পর নিজেকে বোঝায় ও – তন্বীর মত দেখতে কেউ ছিল ওটা। মনের জোর একত্র করে নাস্তা সেরে আসে।
রোডের শেষ মাথায় স্পষ্টই তন্বীকে দেখে রাহাত। ছুটে যায় এবার ও বেপরোয়া হয়ে।
কিন্তু আগেই সরে গেছে মেয়েটা, যেন স্রেফ মিলিয়ে গেল বাতাসে! রোডের শেষ মাথায় পৌঁছে দুইপাশে কাওকে দেখে না ও।
*
এক মাস পেরিয়ে গেছে।
প্রথমদিকে দূরে দূরে দেখত ও মেয়েটাকে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে কাছে আসছে ওটা।
রাতে কিংবা দিনে এখন বাড়ির ভেতর দেখতে পায় তাকে।
সেদিন স্বপ্নে দেখে ওর সাথে তন্বীর বিয়ে হয়ে গেছে।
থাইল্যান্ডে ঘুরতে এসে নৌকা ভ্রমণে বেড়িয়েছে ওরা। হাসিতে মুখর নবদম্পতির প্রমোদতরী।
পাশ দিয়ে আরেকটা নৌকা চলে যায় – তাতে এক মা দাঁড়িয়ে আছে তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। স্বামীপ্রবর কিন্তু ঠিকই হাত নাড়ে। রাহাতও হাত নেড়ে সায় দেয়।
হিস হিস শব্দে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয় রাহাত, ‘আমার ওরকম একটা বাচ্চা থাকতে পারত। তোর জন্য শুধু …’ জান্তব শব্দ করে এরপর মেয়েটা। নৌকার একাংশ ভেঙ্গে তার সাথেই পানিতে তলিয়ে যায় ওরা।
নৌকার বাকি অংশও ডুবে গেলে পানিতে পড়ে বৃথায় হাত-পা ছুঁড়ে রাহাত। সাঁতার পারে না ও।
দম আটকে আসায় হাত পা ছোঁড়ে – আর ঘুমটা তখনই ভেঙ্গে যায় ওর।
চোখ খুলতেই দেখতে পায় তন্বীকে। ওর গলা দুই হাতে টিপে ধরেছে।
জিহবা কিছুটা বের হয়ে আছে ওর। দুই চোখে জীঘাংসা।
হঠাৎ মা লাইট জ্বালান।
‘কি হয়েছে বাবা তোর? চিৎকার করছিস কেন?’ লাফ দিয়ে বসে রাহাত।
তন্বী নেই কোথাও।
*
তন্বীর সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা থেকে সব কিছুই খুলে বলে রাহাত একনাগাড়ে।
ড. সাদেক মন দিয়ে শোনেন। ভদ্রলোক সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টাল হেড। বাংলাদেশের সেরা সাইকোলজিস্টদের মধ্যে অন্যতম।
রাহাতের এখন ফাঁসীর দড়ি গলায় নিতেও আপত্তি নেই – ও শুধু মুক্তি চায় এই বিভীষিকার হাত থেকে।
সব শুনে রাহাতের চোখের দিকে তাকান ড. সাদেক।
‘রাহাত – তোমার ব্যাচমেট মিথিলার সাথে তোমার ঠিক কি ধরণের সম্পর্ক ছিল?’
‘স্যার?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রাহাত।
‘আমার কাছে লুকালে তোমাকে আমি কিভাবে সাহায্য করব বল?’
কিছুক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে রাহাত। তারপর মুখ খোলে, ‘আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম।’
‘মিথিলার সুইসাইডের কারণ তুমি জানতে রাহাত?’ তীরের মত পরের প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন ড. সাদেক।
চুপ করে থাকে রাহাত।
বাধ্য হয়ে আবারও মুখ খোলেন ড. সাদেক –
‘দেখ, বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সাইক্রিয়াস্টিক বলা হয় আমাকে। কেন, জানো? আমি প্রতিমুহূর্তে দেখা মানুষের মনের অবস্থা নিয়ে ভেবে যাই। এখন অনেক কিছুই বুঝে ফেলাটা আমার মুদ্রাদোষ হয়ে গেছে। তুমি বা মিথিলা কাওকে কিছু না বললেও অনেক কিছুই আমি জানি – যেটা আর কারও জানার কথা না। কিন্তু বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হলে আমার তোমার সাহায্য দরকার। এবং কেবল এভাবেই তোমাকে সাহায্য করা সম্ভব আমার পক্ষে।’
মিনিট দুয়েক চুপ থেকে তাকায় রাহাত, ‘মিথিলা অন্ত্বঃসত্তা ছিল। আমার সন্তান নিয়ে। ওটা ছিল একটা অ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু তখন আমরা কেবল সেকেন্ড ইয়ারে। বিয়ের ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য বলে মিথিলা আমাকে। আমি …’ চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি মোছে রাহাত।
‘আমি ফিরিয়ে দেই ওকে সেদিন। পরদিন শুনি আত্মহত্যা করেছে মিথিলা।’
‘তোমার বাসায় যাওয়া যাবে এখন, রাহাত?’ প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে ফেললেন ড. সাদেক।
*
বাবা-মা দুইজনই অফিসে। ছোট ভাইটা স্কুলে।
বাসা খালি দেখে স্বস্তি পায় রাহাত।
‘তোমার বাবা-মার ঘরে নিয়ে চল আমাকে।’ ভেতরে ঢুকেই বলেন ড. সাদেক।
ঘরটায় ঢুকে চারপাশে তাকান তিনি। বুকশেলফটা দেখেন। দেওয়ালগুলো খেয়াল করেন কাছ থেকে। তারপর ফিরে আসেন ড্রইং রুমে।
‘রাহাত – তোমার সিজোফ্রেনিয়া আছে। এটা অডিটরি এবং ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশনের সমন্বয়। যা আসলে ঘটছে না – এমন কিছু দেখতে পাও তুমি – শুনতে পাও। তোমার মস্তিষ্কের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করে এটা। তোমার অতীত ইতিহাস আরও ইন্ডিকেট করছে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারের, সেই সাথে প্রেমিকা তোমার সন্তান নিয়ে আত্মহত্যা করলে সেটা তোমার মানসিক স্বাস্থ্যের কোন উপকারে আসেনি। রোগটা ধীরে ধীরে ডেভেলপ করেছে হয়তো-’
‘স্যার আমি জানি সিজোফ্রেনিয়া কীভাবে ডেভেলপ করতে পারে। কিন্তু আপনি কিভাবে -’
‘মিথিলার ঘটনায় তুমি ভয়ানক আপসেট ছিলে। নিজেকে শাস্তির যোগ্য মনে করেছিলে। মিথিলা কোন নোট রেখে যায়নি। পোস্ট মর্টেমে তার পরিবার রাজি হয়নি। তুমিও মুখ খোলনি। কেউ জানে না আসলে মিথিলার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী, বরং তোমাকে সবাই সহানুভূতি জানিয়েছে। এজন্যই তন্বী নামের কাল্পনিক মেয়েটা তোমাকে স্বপ্নে সন্তানের কথা বলে অভিযোগ করেছে, এখন পর্যন্ত তোমাকে বিরক্ত করে আসছে। এটা তোমার নিজেকে দেওয়া নিজের পক্ষ থেকে শাস্তি।’
‘আমি নিজের হাতে গুলি করি তন্বীকে। ওকে একটা পশুর মত পুঁতে রাখি খালি প্লটে। ওর মৃত্যুর পর আমি যা দেখি তা সিজোফ্রেনিয়া হতেই পারে। কিন্তু স্যার আমি তন্বীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। হয়তো… হয়তো ওই মেয়েটাকে মেরে ফেলার পর আমার ব্রেকডাউন-’
‘না, রাহাত। তন্বী বলে কোন মেয়ের সাথে তোমার পরিচয় হয়নি। বাসের কেউ তোমার কথায় কান দেয়নি। চায়ের দোকানদার তোমার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। কারণ – তুমি বাতাসের সাথে কথা বলছিলে তখন।’
‘অসম্ভব – আমি ওকে গুলি করি…’
‘তুমি বলেছ – তুমি গুলি করেছিলে পাঁচবার। শেষ দুইবার লাগাতে পেরেছ। ’
‘এক্স্যাক্টলি, স্যার!’
‘অথচ বুকসেলফে পাঁচটা বুলেটই গেঁথে থাকতে দেখলাম আমি। বলতে চাও দুইটা গো-থ্রু উয়ন্ড একটা মেয়েকে ইন্সট্যান্টলি মেরে ফেলতে পারে? বুলেটে কথা বাদ দাও – তোমার ছোঁড়া গ্লাস অথবা চেয়ার কোনটাই নাগাল পায়নি মেয়েটার।’
‘তাহলে স্যার – আমি তন্বী – মানে খুনটা করিনি?’ বিশাল বোঝা নেমে যায় রাহাতের বুক থেকে।
‘না।’ মুচকি হাসেন ড. সাদেক, ‘আর মিথিলার ব্যাপারে তুমি যথেষ্ট অনুতপ্ত। কোন শাস্তি পাওয়ার মতো কাজ করেছ বলে আমি মনে করি না, তবে তুমি যতখানি অনুশোচনায় ভুগছো তাতে করে তোমার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাওয়ার কথা। আমি মনে করি সত্যটা আমাদের দুইজনের মধ্যেই চাপা থাকতে পারে।’
*
রাত ১২টা।
কোথাও একটা প্যাঁচা ডাকলো।
এই গলিটা আসলেই ভীষণ নির্জন!
রাহাতের বর্ণনা অনুযায়ী খালি প্লটটায় দাঁড়িয়ে আছেন ড. সাদেক।
কৌতুহলই তাকে টেনে এনেছে আজ এখানে। সকালে রাহাতকে দেওয়া ব্যাখ্যাটার সত্যতা জানার একটাই উপায়। বেলচা চালিয়ে নিঃশব্দে খুঁড়ে যান ড. সাদেক।
নরম কিছুতে বেলচা পড়তেই থমকে গেলেন ডক্টর।
আধপচা মেয়েলি একটা হাতের দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি।

৩রা ডিসেম্বর, ২০১৩