KP Imon

Words Crafted

ধৈর্য

১.
যে কোন কাজে সফলতার জন্য ধৈর্য অত্যন্ত জরুরী একটা জিনিস। এবং এই বস্তুটি অর্জন করা সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটা।

ধৈর্যের অভাবে যেসব কাজ করা যায় না তার তালিকা অনেক লম্বা। তবে সহজ করে বললে মুভি দেখা আর ফেসবুক, ইনস্টা, টিকটকসহ যাবতীয় সোশাল মিডিয়া সাইটের ইনফিনিট স্ক্রল করা ছাড়া আর সবকিছুতেই কম-বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন আছে।

ধৈর্যশীলতা যে কোন কাজের জন্য দরকার। আমার ক্ষেত্রে বই লেখার উদাহরণ দিতে পারি। আপনাকে ধৈর্য ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টাইপ করে করে বইটা লেখা লাগবে। এর সাথে আমাদের অ্যাটেনশন স্প্যানের একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ আছে।

এমন তো নিশ্চয় হয়েছে আপনার- কিছু একটা করছেন, এর মধ্যে একটু ফেসবুকে ঢুকে গেলেন। দুটো পোস্ট ঘুরে-ফিরে এসে আবার কাজে ফিরলেন। ভাবলেন, ৫ মিনিট ফেসবুকে ঘুরেছি তো এমন কী আর হয়েছে। কখনো হঠাৎ খেয়াল করলেন ৫ নয়, আপনি প্রায় ৪৫ মিনিট কিছু না করে ফেসবুকে ঘুরেছেন। এটা কীভাবে হলো?

এটা হলো আমাদের ধৈর্যহীনতার কারণে। আপনি একটু ধৈর্যশীল হলেই ফোনটা তুলে নিতেন না এবং সোশাল মিডিয়ায় ঢুকে পড়তেন না। এবং এই ধৈর্যহীনতা আসছে আমাদের মানব মস্তিষ্কের একটি সহজাত প্রবণতা থেকে।

আরামপ্রিয়তা।

মস্তিষ্ক যখন একটা মুভি দেখে, তখন যে কয়টি অংশকে সক্রিয়ভাবে ব্যস্ত থাকতে হয় তার তুলনায় একটা ফিজিক্স ফর্মুলা ডিরাইভ করতে অনেক বেশি অংশকে সক্রিয়ভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়।

পড়াশোনা বলুন, ব্যবসা বলুন, আর লেখালেখি-ছবি আঁকা- মস্তিষ্ককে আপনার ব্যস্ত করতে হচ্ছে। এবং প্রথম ৫ মিনিট কাজটা সহজ হলেও, বিশ কেজি ওজনের একটা ডাম্বেল আপনাকে একশ’বার তোলা লাগলে যেমন সময়ের সাথে হাত অসার হয়ে আসবে, তেমনই টানা ৭ ঘণ্টা পড়াশোনা করা, টানা ৭ ঘণ্টা একের পর এক ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়া, কিংবা টানা ৭ ঘণ্টা গল্প লেখার চেষ্টা করলে খেয়াল করবেন আপনার মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এবং এক সময় আপনার মনে হবে, “আপাতত থাকুক। একটু ফেসবুকে স্ক্রল করে আসি। তারপর আবার লিখবো।”

এইখানেই ঘটনাটা ঘটে আরকি।
আমি টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে একবার চোখের কোণ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অবজার্ভ করেছি। কোন কোন ছাত্র একটু পর পর ফোনে চলে যাচ্ছে। দশ মিনিট অঙ্ক কষার ধৈর্য হচ্ছে না ওদের। আবার একবার ফোনে চলে গেলে সহজে আর বেরিয়ে আসবে না তারা। বিশ মিনিট পর আবার দশ মিনিট অঙ্ক করছে। লাইব্রেরিতে ঝাড়া ৬ ঘণ্টা বসে থাকলো ওরা। কিন্তু পড়াশোনা করলো ১ ঘণ্টারও না। কেন?

ধৈর্যের অভাবে।

২.
এর প্রতিকার নিয়ে কথা বলবো, তবে আমার নিজস্ব প্রক্রিয়ায়। ধৈর্য বাড়াতে বা একটা কঠিন চিন্তা করার সময় বেশিক্ষণ কাজ করতে হলে কী করা উচিত – এই চিন্তা থেকে আমরা কেন অন্য কোথাও মনোযোগ দিয়ে ফেলি এই প্রশ্ন তুলেছিল মনোবিদরা অনেক আগেই। প্রাচীন ধারণাদের একটা ছিল “আমাদের মানসিক চাপ নেবার একটা ফুয়েল থাকে। ওটা শেষ হয়ে গেলে আমরা আর নিতে পারি না ও জিনিস। ওটা আবার ভর্তি হলে তবেই নিতে পারি।”

অনেকে পরামর্শ দেন যে বিষয়ে আপনার মস্তিষ্ক দ্রুত ক্লান্ত হয় তা বেশি করে করতে। যেমন অঙ্ক করতে গেলে হাঁপিয়ে ওঠেন ও ঘন ঘন ফেসবুকে যান? তো বেশি বেশি অঙ্ক করতে হবে যেন তা সহজাত প্রক্রিয়া হয়ে যায়।

ঠিক ঐ বিশ কেজি ওজনের ভার একশ’বার তোলার মতোই। প্রথমদিন আপনি ২৫ বার তুলতে পেরেছেন, কিন্তু যদি আগামিকালও একই সময়ে এসে আপনি ওটা ১০০ বার তোলার চেষ্টা করেন, তবে ২৫ বারই তুলতে পারবেন। কিন্তু এরপরদিন হয়তো ২৭ বার। তারপর দিন এসে দেখলেন আজ পারছেন ৩২ বার। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একদিন ১০০ বার তুলতে শিখবেন হয়তো।

কাজেই একটা মেথড হচ্ছে অঙ্ক করতে কষ্ট হলে অঙ্ক বার বার বেশি বেশি করা, অঙ্ক নিয়ে ভিডিয়ো দেখা, অঙ্ক নিয়ে বই পড়া, অঙ্কের গ্রুপে ঢুকে বসে থাকা, ইত্যাদি।

আমার পদ্ধতিটা আরও ফান্ডামেন্টাল। আমার অবজারভেশন ছিল, অঙ্ক নিয়ে কম প্যারা খেতে তো অঙ্ক বেশি করতে হবে এটা গুড আইডিয়া। কিন্তু আমরা কি আগের লুপে ঢুকে যাচ্ছি না? আপনি তো অঙ্ক করতে পারেন না টানা বিশ মিনিট। মন বসে না পড়ার টেবিলে। তাহলে বেশি অঙ্ক করবেন কী করে? ঐ ৫ ঘণ্টায় ইফেক্টিভলি ১ ঘণ্টা অঙ্ক করে শুয়ে পড়বেন? তাহলে আপনার বেশি অঙ্ক করার সুযোগও হচ্ছে না আর বার বার অঙ্ক করে আর্যভট্টকে টেক্কা দেয়ার স্বপ্ন দেখাও সার হচ্ছে।

এজন্য আমি ফান্ডামেন্টাল সমস্যাটি চিহ্নিত করেছি। আপনারা সবাই জানেন খুব বিরক্তিকর বা কষ্টসাধ্য চিন্তা অনেকক্ষণ ধরে করলে কীভাবে আমাদের “মস্তিষ্ক এলিয়ে” যায়, ঠিক না? এটি এড়ানোর একটা বড় সমাধান হতে পারে ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি করা। সেটি করার জন্য আমরা কথা বলবো আরামপ্রিয়তা নিয়ে।

৩.
আরামপ্রিয়তা আমাদের সব ধরনের প্রবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় শত্রু। খেয়াল করলে দেখবেন আমরা যখন গরমের দিনে বাইরে যাই, তখন প্রচুর রোদ বা গরম থাকলে চেষ্টা করি দ্রুত একটা ছায়ায় চলে যেতে কিংবা ছায়া দিয়ে হাঁটতে। ঠাণ্ডা লাগলে আমরা চেষ্টা করি গরম কোথাও চলে যেতে। এগুলো আমরা চিন্তা-ভাবনা না করেই করি। জীব নিজেকে রক্ষা করতে এধরনের অনেক কিছু করে থাকে।

এই কাজ আমরা মানসিক কষ্টের সময়ও করি। যে মেয়ের বা ছেলের চেহারা দেখলে আপনার দুঃখ হয়, তার প্রোফাইল ব্লক করে দেন। ব্লক যদি নাও করেন তবুও ইচ্ছে করে তার টাইমলাইনে ঢুকেন না আর। ব্রেকআপের কথা বলছি, যদি তা অন্যদিক থেকে হয়ে থাকে! কেন? কারণ আপনার মানসিক কষ্ট যেটায় হয় সেটাও আপনি নেন না। ওটাও ওই বিবর্তনের সুফল বা কুফল। কষ্ট থেকে আপনাকে রক্ষা করে আপনারই সিস্টেম।

তবে এক্ষেত্রে আমরা সচেতনভাবে উল্টোটা করবো। যা করতে আমাদের অধৈর্য লাগে, তা বেশি বেশি প্র্যাকটিস করবো। দৈনিক এক ঘণ্টা করে আপনি যা পছন্দ নয় তা সহ্য করা শিখবেন।

ঢাকার জ্যাম আমাকে এটায় অনেক সহায়তা করেছে। ঢাকার জ্যামের ব্যাপারে নতুন কিছু বলার নেই। খুব বিরক্তিকর একটা ঘটনা। প্রায়ই দেখবেন জ্যামের মধ্যে যাত্রীরা উশখুশ করছে। কারো সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিংবা ফোন বের করে ফেসবুক স্ক্রল করছে, যেন বিরক্তিকর সময়টা কেটে যায়। বিশেষ করে তীব্র দাবদাহের সময় এই ঘটনা ঘটলে তো কথাই নেই।

খুব জ্যাম যেদিন, সেদিন যাত্রী তুলতে বাস একটু থামলেই কেউ না কেউ ধমকে উঠে, “মামা, সবখানে থামো কেন? কী লাগাইলা, মামা?”
কিংবা জ্যাম ছাড়ার পর, “মামা, জোরে টানো না কেন?”

এসব ক্ষেত্রে আমি ফোন বের করতাম না প্রায়ই। চুপ করে বসে থাকতাম। অসহ্য লাগার অনুভূতিটাকে পুরোপুরি অনুভব করতাম। ফোন বের করা, পাশের যাত্রীর সাথে কথা বলা, গান শোনা হচ্ছে মনকে অসহ্য অনুভূতি থেকে ব্যস্ত রাখা। কিন্তু আমরা যদি তা না করে চুপ করে বসে থাকি, শান্তভাবে তাকিয়ে থাকি সামনের সিটের দিকে, যন্ত্রণাটা অনুভব করি ও সহ্য করার চেষ্টা করি – দ্রুত বৃদ্ধি পায় ধৈর্যশক্তি। প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছু অসহ্য অনুভূতির মধ্যে পড়ি।

যেমন ধরুন একটা ক্লাস করার পর অন্য ক্লাসটা ৩৫ মিনিট পর। এই ৩৫ মিনিট চুপ করে বসে থাকা খুব বিরক্তিকর নয়? আড্ডাবাজি করে পার করে ফেললেই তো হয়। আপনি তখন ঐ কিছু ঘটতে না থাকা ৩৫ মিনিট ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন। কল্পনার জগতেও পালানো যাবে না। টর্চারটা সহ্য করতে হবে। ধৈর্য বাড়বে।

অথবা কাউকে আপনার একেবারেই সহ্য হয় না। তার সাথে ৫ মিনিট কথা বলতে গেলে মনে হয় ৫০ ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষের সাথে আড্ডা দিয়ে আসুন ৩০ মিনিট। সহ্য করা শিখুন।

মোট কথা, যেটাই আমাদের পছন্দ নয়, সে পরিস্থিতিতে নিজেকে ফেলুন দিনে এক ঘণ্টা করে (সম্ভব হলে, প্রতিদিন পাবেন না)।

পড়ার টেবিলে বসলে দেখবেন আগের মতো কোন কিছু বুঝতে কষ্ট হলেই আপনার হাত পকেটে চলে যাচ্ছে না ফোনটা বের করার জন্য। ধৈর্যশক্তি বাড়ার আরও অনেক উপকার আছে।

(১) ভালো শ্রোতা হতে পারবেন। মানুষ কথা বলতে ভালোবাসে। আপনিও হয়তো বাসেন। কিন্তু যেহেতু আপনার পছন্দের কাজটি না করার ট্রেনিং হয়েছে, মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারবেন। সামাজিকতায় অনেক উপকার হবে।

(২) প্রবৃত্তির বশে কিছু করে ফেলা থেকে বাঁচবেন। যেমন ধরুন কোন বোকাচন্দ্রের নাকবরাবর ঘুষি চালিয়ে দেয়ার মতো একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। কিন্তু যেহেতু আপনার ইরিটেশন সহ্য করার প্রশিক্ষণ হয়েছে, অনায়াসে নাকটিকে না ভেঙেই বেরিয়ে আসতে পারবেন। থানা-পুলিশ কম হবে।

(৩) ব্যবসা দাঁড় করানো থেকে শুরু করে পড়াশোনা, লেখালেখি, আঁকাআঁকি, সবখানেই এই যোগ্যতা কাজে দেবে আপনার।

(৪) সংসারজীবন সুখের হবে। আপনার পার্টনার যত যা-ই করুক না কেন তুলকালাম করবেনই না আপনি। কারণ বিরক্তি, যন্ত্রণা, অসহ্য বিষয়বস্তু গ্রহণ করার “ধৈর্য” আপনার হয়েছে।

মনে রাখবেন, ধৈর্যধারণ আমাদের নানা সময় করতে হয়। সামাজিক পরিবেশে মারামারি না করার জন্য বা ক্রোধ সামলাতে ধৈর্যধারণ করতে হয়, প্রেমিকার সাথে ঝগড়া না করার জন্য তথা বিরক্তি ঠেকাতে ধৈর্যধারণ করতে হয়, পড়াশোনা করার জন্য তথা বিবমিষা আসার মতো বিষয় পড়তে গিয়ে ধৈর্যধারণ করতে হয়, ব্যর্থতার পর হতাশা ঠেকাতে ধৈর্যধারণ করতে হয় –

তবে জাদুটা হলো ধৈর্যের প্রকৃতি একটাই। যে কোন উপায়ে আপনি প্র্যাকটিস করলেই সব ধরণের আবেগ অর্থাৎ ক্রোধ, বিরক্তি, অধ্যবসায়, হতাশা, দুঃখ, কিংবা আর কোন নেতিবাচক অনুভূতি সামলে ফেলার মতো দক্ষতা আপনার হয়ে যাবে।