ফ্রি-মিক্সিং সমস্যা নয়, ফ্রি-মিক্সিংই সমাধান

২২শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬

২৬শে মার্চ, ২০১৮
২৬ শে মার্চ, ২০১৮
৯ই জুলাই, ২০২০

৮ই ডিসেম্বর, ২০২২

Friends at the Tre Cime di Lavaredo
Words Crafted
Friends at the Tre Cime di Lavaredo
১.
যে কোন কাজে সফলতার জন্য ধৈর্য অত্যন্ত জরুরী একটা জিনিস। এবং এই বস্তুটি অর্জন করা সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটা।
ধৈর্যের অভাবে যেসব কাজ করা যায় না তার তালিকা অনেক লম্বা। তবে সহজ করে বললে মুভি দেখা আর ফেসবুক, ইনস্টা, টিকটকসহ যাবতীয় সোশাল মিডিয়া সাইটের ইনফিনিট স্ক্রল করা ছাড়া আর সবকিছুতেই কম-বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন আছে।
ধৈর্যশীলতা যে কোন কাজের জন্য দরকার। আমার ক্ষেত্রে বই লেখার উদাহরণ দিতে পারি। আপনাকে ধৈর্য ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টাইপ করে করে বইটা লেখা লাগবে। এর সাথে আমাদের অ্যাটেনশন স্প্যানের একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ আছে।
এমন তো নিশ্চয় হয়েছে আপনার- কিছু একটা করছেন, এর মধ্যে একটু ফেসবুকে ঢুকে গেলেন। দুটো পোস্ট ঘুরে-ফিরে এসে আবার কাজে ফিরলেন। ভাবলেন, ৫ মিনিট ফেসবুকে ঘুরেছি তো এমন কী আর হয়েছে। কখনো হঠাৎ খেয়াল করলেন ৫ নয়, আপনি প্রায় ৪৫ মিনিট কিছু না করে ফেসবুকে ঘুরেছেন। এটা কীভাবে হলো?
এটা হলো আমাদের ধৈর্যহীনতার কারণে। আপনি একটু ধৈর্যশীল হলেই ফোনটা তুলে নিতেন না এবং সোশাল মিডিয়ায় ঢুকে পড়তেন না। এবং এই ধৈর্যহীনতা আসছে আমাদের মানব মস্তিষ্কের একটি সহজাত প্রবণতা থেকে।
আরামপ্রিয়তা।
মস্তিষ্ক যখন একটা মুভি দেখে, তখন যে কয়টি অংশকে সক্রিয়ভাবে ব্যস্ত থাকতে হয় তার তুলনায় একটা ফিজিক্স ফর্মুলা ডিরাইভ করতে অনেক বেশি অংশকে সক্রিয়ভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়।
পড়াশোনা বলুন, ব্যবসা বলুন, আর লেখালেখি-ছবি আঁকা- মস্তিষ্ককে আপনার ব্যস্ত করতে হচ্ছে। এবং প্রথম ৫ মিনিট কাজটা সহজ হলেও, বিশ কেজি ওজনের একটা ডাম্বেল আপনাকে একশ’বার তোলা লাগলে যেমন সময়ের সাথে হাত অসার হয়ে আসবে, তেমনই টানা ৭ ঘণ্টা পড়াশোনা করা, টানা ৭ ঘণ্টা একের পর এক ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেয়া, কিংবা টানা ৭ ঘণ্টা গল্প লেখার চেষ্টা করলে খেয়াল করবেন আপনার মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এবং এক সময় আপনার মনে হবে, “আপাতত থাকুক। একটু ফেসবুকে স্ক্রল করে আসি। তারপর আবার লিখবো।”
এইখানেই ঘটনাটা ঘটে আরকি।
আমি টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে একবার চোখের কোণ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অবজার্ভ করেছি। কোন কোন ছাত্র একটু পর পর ফোনে চলে যাচ্ছে। দশ মিনিট অঙ্ক কষার ধৈর্য হচ্ছে না ওদের। আবার একবার ফোনে চলে গেলে সহজে আর বেরিয়ে আসবে না তারা। বিশ মিনিট পর আবার দশ মিনিট অঙ্ক করছে। লাইব্রেরিতে ঝাড়া ৬ ঘণ্টা বসে থাকলো ওরা। কিন্তু পড়াশোনা করলো ১ ঘণ্টারও না। কেন?
ধৈর্যের অভাবে।
২.
এর প্রতিকার নিয়ে কথা বলবো, তবে আমার নিজস্ব প্রক্রিয়ায়। ধৈর্য বাড়াতে বা একটা কঠিন চিন্তা করার সময় বেশিক্ষণ কাজ করতে হলে কী করা উচিত – এই চিন্তা থেকে আমরা কেন অন্য কোথাও মনোযোগ দিয়ে ফেলি এই প্রশ্ন তুলেছিল মনোবিদরা অনেক আগেই। প্রাচীন ধারণাদের একটা ছিল “আমাদের মানসিক চাপ নেবার একটা ফুয়েল থাকে। ওটা শেষ হয়ে গেলে আমরা আর নিতে পারি না ও জিনিস। ওটা আবার ভর্তি হলে তবেই নিতে পারি।”
অনেকে পরামর্শ দেন যে বিষয়ে আপনার মস্তিষ্ক দ্রুত ক্লান্ত হয় তা বেশি করে করতে। যেমন অঙ্ক করতে গেলে হাঁপিয়ে ওঠেন ও ঘন ঘন ফেসবুকে যান? তো বেশি বেশি অঙ্ক করতে হবে যেন তা সহজাত প্রক্রিয়া হয়ে যায়।
ঠিক ঐ বিশ কেজি ওজনের ভার একশ’বার তোলার মতোই। প্রথমদিন আপনি ২৫ বার তুলতে পেরেছেন, কিন্তু যদি আগামিকালও একই সময়ে এসে আপনি ওটা ১০০ বার তোলার চেষ্টা করেন, তবে ২৫ বারই তুলতে পারবেন। কিন্তু এরপরদিন হয়তো ২৭ বার। তারপর দিন এসে দেখলেন আজ পারছেন ৩২ বার। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একদিন ১০০ বার তুলতে শিখবেন হয়তো।
কাজেই একটা মেথড হচ্ছে অঙ্ক করতে কষ্ট হলে অঙ্ক বার বার বেশি বেশি করা, অঙ্ক নিয়ে ভিডিয়ো দেখা, অঙ্ক নিয়ে বই পড়া, অঙ্কের গ্রুপে ঢুকে বসে থাকা, ইত্যাদি।
আমার পদ্ধতিটা আরও ফান্ডামেন্টাল। আমার অবজারভেশন ছিল, অঙ্ক নিয়ে কম প্যারা খেতে তো অঙ্ক বেশি করতে হবে এটা গুড আইডিয়া। কিন্তু আমরা কি আগের লুপে ঢুকে যাচ্ছি না? আপনি তো অঙ্ক করতে পারেন না টানা বিশ মিনিট। মন বসে না পড়ার টেবিলে। তাহলে বেশি অঙ্ক করবেন কী করে? ঐ ৫ ঘণ্টায় ইফেক্টিভলি ১ ঘণ্টা অঙ্ক করে শুয়ে পড়বেন? তাহলে আপনার বেশি অঙ্ক করার সুযোগও হচ্ছে না আর বার বার অঙ্ক করে আর্যভট্টকে টেক্কা দেয়ার স্বপ্ন দেখাও সার হচ্ছে।
এজন্য আমি ফান্ডামেন্টাল সমস্যাটি চিহ্নিত করেছি। আপনারা সবাই জানেন খুব বিরক্তিকর বা কষ্টসাধ্য চিন্তা অনেকক্ষণ ধরে করলে কীভাবে আমাদের “মস্তিষ্ক এলিয়ে” যায়, ঠিক না? এটি এড়ানোর একটা বড় সমাধান হতে পারে ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি করা। সেটি করার জন্য আমরা কথা বলবো আরামপ্রিয়তা নিয়ে।
৩.
আরামপ্রিয়তা আমাদের সব ধরনের প্রবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় শত্রু। খেয়াল করলে দেখবেন আমরা যখন গরমের দিনে বাইরে যাই, তখন প্রচুর রোদ বা গরম থাকলে চেষ্টা করি দ্রুত একটা ছায়ায় চলে যেতে কিংবা ছায়া দিয়ে হাঁটতে। ঠাণ্ডা লাগলে আমরা চেষ্টা করি গরম কোথাও চলে যেতে। এগুলো আমরা চিন্তা-ভাবনা না করেই করি। জীব নিজেকে রক্ষা করতে এধরনের অনেক কিছু করে থাকে।
এই কাজ আমরা মানসিক কষ্টের সময়ও করি। যে মেয়ের বা ছেলের চেহারা দেখলে আপনার দুঃখ হয়, তার প্রোফাইল ব্লক করে দেন। ব্লক যদি নাও করেন তবুও ইচ্ছে করে তার টাইমলাইনে ঢুকেন না আর। ব্রেকআপের কথা বলছি, যদি তা অন্যদিক থেকে হয়ে থাকে! কেন? কারণ আপনার মানসিক কষ্ট যেটায় হয় সেটাও আপনি নেন না। ওটাও ওই বিবর্তনের সুফল বা কুফল। কষ্ট থেকে আপনাকে রক্ষা করে আপনারই সিস্টেম।
তবে এক্ষেত্রে আমরা সচেতনভাবে উল্টোটা করবো। যা করতে আমাদের অধৈর্য লাগে, তা বেশি বেশি প্র্যাকটিস করবো। দৈনিক এক ঘণ্টা করে আপনি যা পছন্দ নয় তা সহ্য করা শিখবেন।
ঢাকার জ্যাম আমাকে এটায় অনেক সহায়তা করেছে। ঢাকার জ্যামের ব্যাপারে নতুন কিছু বলার নেই। খুব বিরক্তিকর একটা ঘটনা। প্রায়ই দেখবেন জ্যামের মধ্যে যাত্রীরা উশখুশ করছে। কারো সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিংবা ফোন বের করে ফেসবুক স্ক্রল করছে, যেন বিরক্তিকর সময়টা কেটে যায়। বিশেষ করে তীব্র দাবদাহের সময় এই ঘটনা ঘটলে তো কথাই নেই।
খুব জ্যাম যেদিন, সেদিন যাত্রী তুলতে বাস একটু থামলেই কেউ না কেউ ধমকে উঠে, “মামা, সবখানে থামো কেন? কী লাগাইলা, মামা?”
কিংবা জ্যাম ছাড়ার পর, “মামা, জোরে টানো না কেন?”
এসব ক্ষেত্রে আমি ফোন বের করতাম না প্রায়ই। চুপ করে বসে থাকতাম। অসহ্য লাগার অনুভূতিটাকে পুরোপুরি অনুভব করতাম। ফোন বের করা, পাশের যাত্রীর সাথে কথা বলা, গান শোনা হচ্ছে মনকে অসহ্য অনুভূতি থেকে ব্যস্ত রাখা। কিন্তু আমরা যদি তা না করে চুপ করে বসে থাকি, শান্তভাবে তাকিয়ে থাকি সামনের সিটের দিকে, যন্ত্রণাটা অনুভব করি ও সহ্য করার চেষ্টা করি – দ্রুত বৃদ্ধি পায় ধৈর্যশক্তি। প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছু অসহ্য অনুভূতির মধ্যে পড়ি।
যেমন ধরুন একটা ক্লাস করার পর অন্য ক্লাসটা ৩৫ মিনিট পর। এই ৩৫ মিনিট চুপ করে বসে থাকা খুব বিরক্তিকর নয়? আড্ডাবাজি করে পার করে ফেললেই তো হয়। আপনি তখন ঐ কিছু ঘটতে না থাকা ৩৫ মিনিট ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন। কল্পনার জগতেও পালানো যাবে না। টর্চারটা সহ্য করতে হবে। ধৈর্য বাড়বে।
অথবা কাউকে আপনার একেবারেই সহ্য হয় না। তার সাথে ৫ মিনিট কথা বলতে গেলে মনে হয় ৫০ ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষের সাথে আড্ডা দিয়ে আসুন ৩০ মিনিট। সহ্য করা শিখুন।
মোট কথা, যেটাই আমাদের পছন্দ নয়, সে পরিস্থিতিতে নিজেকে ফেলুন দিনে এক ঘণ্টা করে (সম্ভব হলে, প্রতিদিন পাবেন না)।
পড়ার টেবিলে বসলে দেখবেন আগের মতো কোন কিছু বুঝতে কষ্ট হলেই আপনার হাত পকেটে চলে যাচ্ছে না ফোনটা বের করার জন্য। ধৈর্যশক্তি বাড়ার আরও অনেক উপকার আছে।
(১) ভালো শ্রোতা হতে পারবেন। মানুষ কথা বলতে ভালোবাসে। আপনিও হয়তো বাসেন। কিন্তু যেহেতু আপনার পছন্দের কাজটি না করার ট্রেনিং হয়েছে, মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারবেন। সামাজিকতায় অনেক উপকার হবে।
(২) প্রবৃত্তির বশে কিছু করে ফেলা থেকে বাঁচবেন। যেমন ধরুন কোন বোকাচন্দ্রের নাকবরাবর ঘুষি চালিয়ে দেয়ার মতো একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। কিন্তু যেহেতু আপনার ইরিটেশন সহ্য করার প্রশিক্ষণ হয়েছে, অনায়াসে নাকটিকে না ভেঙেই বেরিয়ে আসতে পারবেন। থানা-পুলিশ কম হবে।
(৩) ব্যবসা দাঁড় করানো থেকে শুরু করে পড়াশোনা, লেখালেখি, আঁকাআঁকি, সবখানেই এই যোগ্যতা কাজে দেবে আপনার।
(৪) সংসারজীবন সুখের হবে। আপনার পার্টনার যত যা-ই করুক না কেন তুলকালাম করবেনই না আপনি। কারণ বিরক্তি, যন্ত্রণা, অসহ্য বিষয়বস্তু গ্রহণ করার “ধৈর্য” আপনার হয়েছে।
মনে রাখবেন, ধৈর্যধারণ আমাদের নানা সময় করতে হয়। সামাজিক পরিবেশে মারামারি না করার জন্য বা ক্রোধ সামলাতে ধৈর্যধারণ করতে হয়, প্রেমিকার সাথে ঝগড়া না করার জন্য তথা বিরক্তি ঠেকাতে ধৈর্যধারণ করতে হয়, পড়াশোনা করার জন্য তথা বিবমিষা আসার মতো বিষয় পড়তে গিয়ে ধৈর্যধারণ করতে হয়, ব্যর্থতার পর হতাশা ঠেকাতে ধৈর্যধারণ করতে হয় –
তবে জাদুটা হলো ধৈর্যের প্রকৃতি একটাই। যে কোন উপায়ে আপনি প্র্যাকটিস করলেই সব ধরণের আবেগ অর্থাৎ ক্রোধ, বিরক্তি, অধ্যবসায়, হতাশা, দুঃখ, কিংবা আর কোন নেতিবাচক অনুভূতি সামলে ফেলার মতো দক্ষতা আপনার হয়ে যাবে।
একটা তসবি কিনুন। তারপর প্রতিদিন নিচের প্যারাটি একশ’বার জপুন।
আপনি যার যোগ্য তা পাবেন না। দুনিয়া এভাবে চলে না। আপনি যা পাইছেন তাই পাইছেন। এ নিয়ে আমি আগেও আলাপ করেছি, ইউ গেট হোয়াট ইউ গেট। ইউ ডোন্ট গেট হোয়াট ইউ ডিজার্ভ।
হোমপেজ স্ক্রল করতে গিয়ে দেখলাম হাহাকার। প্রায় দেখি। অমুক দেখতেছেন তমুক তার থেকে কম যোগ্যতা নিয়ে ভালো কোথাও চলে গেল। চমুক দেখতেছেন জমুক ডিজঅনেস্টি দিয়ে ভালো করে ফেলতেছে। তারপর তারা ভাবতেছেন, তাহলে আমার সততার মূল্য কই থাকলো? বা, আমার যোগ্যতার মূল্যায়ন কী হলো!
সারাটা জীবন আপনি এমনই দেখবেন। এবং এটা ডিল করার উপায় হচ্ছে একটা তসবি কেনা। এবং জপতে থাকা – ইউ গেট হোয়াট ইউ গেট।
তাহলে আপনি সৎ থাকবেন কেন, বা স্কিল আর্ন করবেন কেন?
কারণ আপনার ভালো লাগে তাই। সততা বা স্কিল আর্নিং যে আপনার ক্যারিয়ার বানাতে বা টাকার পাহাড় বানাতে করতে হবে এমন না। ইট ইজ হু ইউ আর। আপনার চেয়ে অসৎ কেউ সফল হলেই কি আর না হলেই কি? আপনার চেয়ে কম স্কিলড কেউ বেশি অর্জন করলেই বা আপনার কি?
দুনিয়া কোন ফেয়ার জায়গা নয়।
তসবি টিপে একশ’বার যখন “ইউ গেট হোয়াট ইউ গেট” পড়া হয়ে যাবে, তখন পরের একশ’বার জিকির করবেন এই লাইনটা – “দুনিয়া কোন ফেয়ার জায়গা নয়।”
ছোট্ট উদাহরণ দেই, আমার ৮ বছরের পরিশ্রম ও সততা আমাকে যা এনে নিতে পারে নাই, র্যান্ডম রাস্তার মোড়ে র্যান্ডম মানুষের সাথে পরিচয় থেকে ইনফরমেশন শেয়ারিং হলো – আমি একটা জব পেয়ে গেলাম এবং তা ২ বছর করলাম রাজকীয়ভাবে – আমার সবচেয়ে সুখী ক্যারিয়ার মোমেন্ট। এই জব পাওয়ার পেছনে আমার গত ৮ বছরের স্কিল ছিলো, তবে জবের খবরটা পাওয়ার জন্য ছিলো একটা দৈবঘটনা, ওই র্যান্ডম রাস্তায় ওই র্যান্ডম মানুষের সাথে ওই র্যান্ডম দিনে দেখা না হলে আমি জীবনেও জানতাম না ওই জব আছে।
লাইফ এরকম আনপ্রেডিক্টেবল।
আমার স্কিল আর্নিং অ্যালোন কিচ্ছু মীন করে না, যদি না ওরকম একটা লাক থাকে।
** লাক মানে তকদীর নয় **
লাকের আলাপ করলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ ভাবে তকদীরের আলাপ করছি। লাক বা ভাগ্য বলতে কী বোঝাচ্ছি? পৃথিবীতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন র্যান্ডম ক্যাওটিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এই ক্যাওসের সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপস্থিত হয়ে যাওয়ার ঘটনাও একটা প্রোবাবিলিটি যেহেতু কয়েক লাখ ভুল সময় ও ভুল জায়গার পাশাপাশি ওসবও ঘটনা, আর আপনারা সবাই জানেন সম্ভাব্যতা = সমস্ত সম্ভাব্য অনুকূল ঘটনার সংখ্যা ÷ সমস্ত নমুনাবিন্দুর সংখ্যা।
ভাগ্য উন্নয়নে আপনি কেবল চেষ্টা করতে পারেন অনুকূল ঘটনা বৃদ্ধি করতে। মানে আপনি খাটের চিপায় পড়ে না থেকে বাইরে যত বের হবেন, সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকার সম্ভাব্যতা বাড়বে। তবে তাও আপনার জীবনে ভাগ্যবান হবার মত কিছু না আসতে পারে। কারণ সম্ভাব্য অনুকূল ঘটনার সংখ্যা হয়তো ৩,৫০০ এবং অনুকূল ও প্রতিকূল ঘটনার সংখ্যা হয়তো ৩,০০,০০০! আপনি দেড় বছরে র্যান্ডম লোকের সাথে আলাপ করে, র্যান্ডম সিচুয়েশনে নিজেকে ফেলে হয়তো ১৮,০০০ ঘটনা ঘটাইছেন কিন্তু সেই আঠারো হাজারের কোনটাই অনুকূল সাড়ে তিন হাজারের অংশ নয়!
এজন্য পৃথিবী আপনার যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে না।
আমাদের নিজেদের আইডেন্টি ধরে রাখতে হবে। আপনি যদি সৎ হতে ভালোবাসেন, হবেন। আপনি যদি কাজ করতে ভালোবাসেন, করবেন। কিন্তু সততা ∝ সফলতা বা, পরিশ্রম ∝ সফলতা – এমন ভাবার মতো ভুল করবেন না।
আবার অনেক সৎ ও পরিশ্রমী লোক জীবনে অনেক উন্নতি করেন, কারণ তার ক্ষেত্রে সবকিছু ব্যাটে বলে হইছে। একই সমান সৎ, একই সমান পরিশ্রমী, একই সমান যোগ্য লোক আবার ওই পরিমাণ উন্নতি করতে পারে নাই দেখবেন। কারণ ক্যাওটিক ওয়ার্ল্ডে তার অ্যালাইনমেন্ট অতোটা ফেভারেবল হয় নাই।
তাইলে করবেন কি?
এসব নিয়ে মাথাটারে বেশি চাপ না দিয়ে স্কিল শিখতে থাকেন। এটাই ইম্পর্ট্যান্ট। কারণ আপনার র্যান্ডম রাস্তার র্যান্ডম মানুষ হয়তো কোথাও আছে। তার লগে আপনি ধাক্কা খাবেন একদিন। ওইদিন ধাক্কাটা খেয়ে আপনার কোন লাভ হবে না যদি না আপনি আগে থেকে স্কিল ডেভেলপ করে রাখেন।
জেলিকসের বাইরে মাঝে মাঝে একটা রোলস রয়েস দাঁড়িয়ে থাকে। তিন গোয়েন্দা পড়ার সুবাদে আমাদের জানা আছে এই জিনিস কিশোর পাশা জিতেছিল দানা গুণে। আমার এক ইরানী বন্ধু একবার রোলস রয়েস দেখে বলেছিল, “ভাই, এটার সামনে একটা ছবি তুলে দিবা? এর সামনে ছবি না তুললে আমার জীবনই বৃথা।”
তুলে দিয়েছিলাম।
কালের পরিক্রমায় রোলস রয়েসের মালিক জন এখন আমার খুব কাছের বন্ধু। বয়েস তার ৬৫। জেলিকস বারে আমি ড্রিংক করেছি অন্তত ৪০০০ ইউএস ডলারের সমমূল্যে। কিন্তু আমার পকেট থেকে গেছে ২০০ ডলারও না। কারণ আমার একজন অসমবয়েসী বন্ধুর আছে দুটো রোলস রয়েস, আরেকজন হলো রিজুল কালা। নামে কালা হলেও ছেলে ধলা। এমপ্যাথ। তার সামনে মানিব্যাগ বের করলে পারলে ধরে মারে। ওদিকে জোড়া রোলস রয়েসের মালিকও রীতিমতো অফেন্ডেড হয়ে যায় কেউ বিল দেবার চেষ্টা করলে। এমন নয় যে আমি চেয়ে নিচ্ছি, কিছু বোঝার আগেই জিনিস হাজির। কী একটা বিপদ।
জেলিকস বারে এটা হচ্ছে আমার “দ্য বয়েজ” সার্কেল। মজার ব্যাপার হলো জন এতো লোককে এখানে চেনে, বলার মতো না। তবে সবাইকে ও টেবিলে ডাকে না। আমাকে পেলে কোথাও যেতে দেবে না। কারণও আছে অবশ্য।
কঠিন ঠাণ্ডার এক রাত ছিল ওটা, যেদিন জোড়া রোলস রয়েসের মালিক জনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম শালার পুত এক ভ্যাগাবন্ড। বোকাচোদার মতো জামাকাপড় পরে বসে ছিল এক কোণে । আমার সাথে দেখা হয়েছিল স্থানীয় ইয়ে-মানে-নাম-বলা-যাবে-না সংস্থার একজন অপারেটিভের সাথে। চৌকস সেই অপারেটিভ সাত ঘাটের জল ঘোলা করে আসা মানুষ। আমরা প্রায়শঃই বিশ্বরাজনীতি নিয়ে আলাপ করি। একদিন দেখলাম জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমার। পরিচিত হতে আমার আপত্তি নেই, হয়েছিলাম।
জন বোধহয় ট্রিলিয়নিয়ার। এই স্যান মার্কোসে কী করে জানি না। ওর এতোগুলো গাড়ি যে গোটা স্যান মার্কোসকে বিক্রি করে দিলেও তার দাম উঠবে না। আমি অতোকিছু জানতাম না তখন। সে রাতে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে অপারেটিভের মাধ্যমে। সে ভেগে যেতে চাইলো রাত দশটায়, অথচ ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে নয়টা। তারপর আমার সাথে পরিচয় হয়ে গেল বেচারা টেক্সান ‘শেখ’-এর। আর যাবে কোথায়।
দশটা পেরিয়ে এগারোটা, তারপর বারোটা।
অপারেটিভ বললো, “ভাই, যেতে হবে। কাল কাজ আছে।”
ও যখন বলে কাজ আছে, আমাদের কারো এত বড় বিচি নেই যে কাজটা কী জানতে চাইবো। হি ইজ আমেরিকান গভর্নমেন্ট হিমসেলফ। মাইক্রফট হোমসের মতো। আমরা জানতে চাইলাম না। কিন্তু জন বললো, “আমি আরেকটু থাকি। কেপির সাথে আরেকটু আলাপ করে যাই। ব্যাটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার।”
সেই রাতে যখন প্রায় দেড়টা বাজে, আমাকে বললো, “ভাই, তুমি বারে গেলে কি আমার জন্য একটা শাইনার বক আনতে পারবা?”
তারপর মানিব্যাগ বের করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
আমার তো বাঙালি হৃদয়। আমি ওকে চিনিও না। ভেবেছি কোন না কোন চুদির ভাই। হবে হয়তো হোমলেস কোন বোকাচোদা। কাজেই হা হা করে বললাম, “আরে ভাই, তোমাকে টাকা দিতে হবে না। আমি তোমার ড্রিংক নিয়ে আসছি।”
ঐ মুহূর্তে আমরা এতো দারুণ আলাপ করছিলাম মুভি আর লিটারেচার নিয়ে, যে বলার মতো না। আড্ডা যদি হোমলেসের সাথে হয় তো হলো, এটা মিস করা যাবে না। অথচ আমার ব্যাংকে তখন ১,৫০০ ডলারের ঋণ। ক্রেডিট। ফকিরেরও অধম। তাও আমি ওকে বিয়ার কিনে দেবো। নিতানত অপারগ না হলে একটা মানুষ কিছু চেলে তা দেব, এটাই আমার বাঙালি শিক্ষা।
দিলাম।
ও বললো, “ভাই, তুমি তো রেকর্ড করে ফেললা।”
আমি বললাম, “আরে ভাই, তোমাকে অফেন্ড করলাম নাকি, বাড়া? এটা আমার ধান্ধা ছিল না।”
জন বললো, “আমাকে কেউ কখনো ড্রিংক কিনে খাওয়ানোর সু্যোগ পায়নি। তোমার কাছে তো ঋণী হয়ে গেলাম।”
আমি পুরো বোকচোদ হয়ে গেছি। এ দেখি হেঁজিপেঁজি লোক নয়। বললাম, “আরে ভাই, এটা স্রেফ একটা শাইনার বক। এমন কিছুই না।”
পরের দিন দেখি ও দুটো রোলস রয়েসের মালিক।
ট্রিলিয়নিয়ার গাই। মলাট দেখে বই বিচার না করার শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল। আমাকে বারের আশেপাশে দেখলে যদি ধরে নিয়ে এসে নিজের পাশে না বসিয়েছে তো মদ-ই হজম হবে না তার।
যাকেই দেখবে তাকে ডেকে নিয়ে এসে বলবে, “হি ইজ ফ্রম ব্যাংলা-ফাকিং-ড্যাশ! সেরা মাল। কঠিন মাল, ভাই।”
এক রাতে ৬ ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে কেউ আমাকে এত পছন্দ করে ফেলতে পারে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। মাঝে মাঝে মন খুব ভালো হয়ে যায় বাংলাদেশের নামে সে এত ভালো ভালো কথা লোককে বলে তা দেখে।
মাঝে মাঝে চোখে পানি চলে আসে।
নিজেকে বলি, “চুদির ভাই, তুই না জাতীয়বাদে বিশ্বাস করিস না। ফোঁত ফোঁত করবি না। একেবারে ফোঁত ফোঁত ফোঁত করবি না।”
কিন্তু খুব একটা সুবিধে করা যায় না।
২.
আজকে বন্ধু রিজুল আমাকে পাছা থেকে গলা পর্যন্ত মদ খাইয়ে দিয়েছে। একটা পয়সাও খরচ করা গেল না। দিতে চাইলেও নেবে না। বললো, “বিজনেস মিটিং তো। পাঁচ বছর পর আমরা এই জেলিকস-ই কিনে নেবো। তখন সব টাকা উঠে আসবে।”
রিজুলের সাথে আমার রোজকার আড্ডায় একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আমরা একটা বিজনেস প্ল্যান করে ফেলেছি। ধান্ধা, পয়ত্রিশ বছরের মধ্যে নিজেদের কোম্পানি খুলে ফেলতে হবে। এতো শুয়োর চোদা যাবে না। অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করে আর যা-ই হওয়া যাক, বড়লোক হওয়া যায় না। বাড়ি-টাড়ি কেনার ধৈর্য বা প্রোফাইল আমাদের নাই। কাজেই আমরা সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে সেফ কিন্তু কার্যকর পথটা বেছে নিলাম। কুত্তার মতো পড়া লাগবে বটে, তবে একটা লাইসেন্স পাশ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। নিজেদের বিজনেস খুলে আমেরিকার পাছা মেরে দেবো। এই হলো ধান্ধা।
সেই থেকে সে আমাকে একটা পয়সাও খরচ করতে দেবে না। অবশ্য জানে আমার কী অবস্থা। দেড় হাজার ডলারের ঋণ এতো সোজা ব্যাপার নয়। আমি তো বাইরে কোথাও বসতেই চাই না আর, কিন্তু আমার সাথে আলাপের সুযোগ সে ছাড়বে না। কাজেই বারে না এলে মাথায় বন্দুক ধরে আনবে।
আজকেও ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে আলাপ করতে হলো। আগামি বছর এই সময়ের মধ্যে আমার পরীক্ষায় বসতে হবে। পাশ করলেই এলাকা প্রকম্পিত করে ব্যবসা খুলে ফেলবো আমরা। তারপর ঘণ্টায় ৯০ ডলার। এ কেবল শুরু, ব্যবসা বড় হলে মাসে হান্ড্রেড থাউজ্যান্ড হয়ে যাবে নির্ঘাত। তবে সেটা হতে হতে আরও ৭ বছর লাগবে।
আমরা দুইজনই ঘাউড়া। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে অভ্যস্ত, তবে শর্ট টার্মে আমাদের দেখলে যে কেউ মনে করবে ভ্যাগাবন্ড। ঠিক ঐ জনের মতো। একই সাথে এটাও নির্ঘাত যে কোন কোম্পানিতে চাকরি করে কখনোই ৭ বছরের ব্যবধানে প্রতি মাসে হান্ড্রেড থাউজ্যান্ড কামানো যাবে না। জিন্দেগিতেও না।
রিজুল বিদায় হলো বটে, তারপর বাসায় ফিরে এলাম। বাজে মাত্র সাড়ে সাতটা। এপাশ ওপাশ করে বুঝলাম ঘুমের ঘ-ও আসবে না। ওদিকে এই শহরে যত মেয়ে আমার প্রতি আগ্রহী আছে সবাইকে ভূত দেখানো হয়েছে। এরা বলে ঘোস্টিং। কাজেই কাউকে নক-টক দেয়ার ঝামেলায় না গিয়ে কাঁধে ল্যাপটপটা নিয়ে ফিরে এলাম জেলিকসে। একটা বিয়ার নিয়ে বসে পরের উপন্যাসের পরের চ্যাপ্টারটা লিখে ফেলবো।
মন মেজাজ আজ বেশ ভালো।
প্রফেসরের সাথে গ্রুপ মিটিংয়ে তিনি বলেছেন, “আরেব্বাস, এটা তো একটা ব্রেকথ্রু!”
ওটা আসলে বালের ব্রেক-থ্রু। তবে প্রফেসর জানেন কচুটা। আমি জানি রিসার্চ কই যাচ্ছে। সামনে কী কী ঝামেলা হবে অক্ষরে অক্ষরে জানি আমি। আমার বোকাচোদা প্রফেসর তার বালও জানে না। তবে আজকের জন্য এটা একটা উইন।
কাজেই কাঁধে ফুলি চার্জড ল্যাপটপ নিয়ে বারে ফিরে আসলাম। গল্প লেখা যাক।
৩.
বেশিদূর যাওয়ার কপাল আমার ছিল না। কেউ একজন ডাকলো। তাকিয়ে দেখলাম জন নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে একটা বাঁদরের মতো লাফাচ্ছে। ডাকছে, “এই কেপি। আরে কেপি, এইদিকে!”
কী বিপদ। এগিয়ে গিয়ে ওর সাথে কোলাকুলি করতেই হলো। ট্রিলিয়নিয়ার মানুষ। উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। তাছাড়া লোকটাকে আমার পছন্দ। টেক্সাসের পোলাপানের মতো ছাগল না। বয়স হয়েছে, তার সাথে মুভি, বই, মনস্তাত্ত্বিক আলাপ করা যায়। এসবে ছোকরাদের মধ্যে খুব বেশি মানুষের আগ্রহ নেই। মেয়ে কিছু আমার আশেপাশে থাকলেও কারো সাথে ঝুলে পড়ি না একই কারণে। আমি বরং রিজুল বা জনের সাথে দশ ঘণ্টা আড্ডা দেব, কিন্তু কোন বোকাচোদা মেয়ের সাথে আমি এক মিনিটও কথা বলবো না। যতই সুন্দর হোক আর হট।
কেউ আমাকে বোর করলেই আমি “বিদায়। খোদা হাফেজ। আলবিদা। গুড নাইট।” বলে উধাও হয়ে যাই।
জন এক ইন্টারেস্টিং চরিত্র। ডাকলো যখন, গেলাম। ওর সামনে বসে আছে দুই মেয়ে। ট্রিলিয়নিয়ারের সামনে মেয়ে থাকবে না তো জোকারের সামনে থাকবে? ওদের সাথে হাত মেলালাম।
জন বললো, “কোন চিপাচুপায় ভাইগা যেয়ো না। বিয়ারটা নিয়ে এইখানে ফিরে আসো। আলাপ করা দরকার।”
এলাম। ওদিকে জনের এক বন্ধু এসে হাজির। এই নতুন লোকটার বয়স ৬২ বছর। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো টেক্সান শেখ। যথারীতি প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বাকিদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, “হি ইজ ফ্রম ব্যাংলা-ফাকিং-ড্যাশ! সেরা মাল। কঠিন মাল, ভাই।”
আমি ভাবলাম, শালার এই কথাটা শুনতে এত ভালো লাগে কেন! কেন লাগে? বাংলাদেশ কিংবা ভারত, আমেরিকা কিংবা কানাডা – সব বর্ডারকেই তো আমি অস্বীকার করি। কেন লাগবে!
তার থেকেও ভয়ানক কথা, কোন দুঃখে এই এতগুলো মানুষ আমাকে এমন করে ভালোবাসবে? কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ ছাড়া আর কী দিয়েছি আমি তাদের? কিচ্ছু না। অথচ আমাকে ফিরে আসতে হলো একটা বিয়ার নিয়ে। আমার খুব ভালো মতো জানা আছে বন্দুক তাক করলেও রোলস রয়েসের মালিক আমাদের কাউকে আর কিছু আনতে দেবে না। ইনার সার্কেলে যে ঢুকেছে তার বিল বারের কেউ নিলে তার গর্দান যাবে।
কিন্তু তার বন্ধুর সাথে আলাপ হওয়ার সাথে সাথে সে বললো, “বাংলাদেশ? তোমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলে না?”
আমি কোনরকম আমেরিকান ভব্যতার ধার না ধেরে বললাম, “তা ছিলাম। তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পুটকি মেরে বেরিয়ে গেছি ভাই। লম্বা ইতিহাস।”
জনের বন্ধুটি দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললো, “তা জানি। তুমি নাকি বইপত্র লেখ? কী ধরণের?”
দেখলাম আসলেই জানে, ভূগোল নিয়ে তার ধারণা আমার থেকে বেশি টনটনে। কথা এখান থেকে উঠে আসলো উপন্যাস লেখা থেকে শুরু করে আমার আবিষ্কৃত যাবতীয় লিটারেরি টুলের ব্যাপারে। আমার বইগুলো ৪০০ পৃষ্ঠা বা ৬০০ পৃষ্ঠার বেশি হয় শুনে বললো দুইশ পৃষ্ঠার বই লিখতে আমেরিকানদের জন্য। বড় বই নাকি এই পোলাপানের মনোযোগ আর রাখতে পারে না।
একটা মানুষ ১০০০ পৃষ্ঠার বই আর পড়ে না এখন প্রসঙ্গে বললাম, “আমি জানি, পড়ার কথা নয়। তাই আমি একটা নতুন লিটারেরি টুল ব্যবহার করি। এই জেন জি কিংবা ফেসবুক-টিকটকের যুগে অ্যাটেনশন স্প্যান যখন ছোট হয়ে এসেছে, আমাকে কিছু করতে হতো। আমার টুল বেশ কাজ করেছে বটে, এখন এই জেন জি আমার ১০০০ পৃষ্ঠার জাদুঘর সিরিজ পড়ে ফেলেছে।”
তারপর তাকে খুব ভালো মতো বুঝিয়ে বললাম এই টুলটার ব্যাপারে। এর সর্বোচ্চ প্রচার করা যাবে না বলে স্ট্যাটাসে অবশ্যই লিখবো না।
কথা প্রসঙ্গে চলে এলো জাদুঘরের ব্যাপারটা। আমাকে জন প্রশ্ন করলো, “বইটার নাম কী?”
খাস বাংলায় বললাম, “‘জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে’। দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে ‘এইখানে জাদুঘর পাতা আমাদের’।”
জনের বন্ধু জানতে চায়, “ইংরেজি করলে কী হবে?”
বললাম, “এটার ইংরেজি করা সহজ নয় এতো। এটা একটা নার্সারি রাইম থেকে নেয়া, প্যারোডি-”
শওকত আল বাশারের সাধারণ ছাত্র থেকে ভয়ঙ্কর এক চরিত্রে পরিণত হওয়ার গল্পটা বললাম তখনই। মনোযোগ দিয়ে শুনলো ওরা, আঁতকে উঠলো কখনো, কখনো চমৎকৃত হলো।
আমার মনে হলো, বইপত্র লেখা বাদ দিয়ে স্টোরিটেলার হয়ে গেলেই হতো। আমেরিকানদের সাথে প্রায় দুই বছর মিশে যাচ্ছি। স্রেফ আমেরিকায়-থাকা-মার্কা মেশা না, প্রতিদিনই ক্যাজুয়াল আর সোশাল এলাকায় দেখা হচ্ছে কয়েক ঘণ্টার জন্য। ক্লাসরুম আর ল্যাবের বাইরেও আমি অনেক কিছু করে থাকি। ওদের সত্যিকারের আঁতকে ওঠা আর স্রেফ উৎসাহ দিতে হ্যাঁ-হু করার পার্থক্য আমি বুঝি।
রাত তখন বাজে নয়টা, তবে আমি জানতাম, জেলিকস থেকে আজ আর রাত ২ টার আগে কেউ উঠতে দেবে না আমাকে। উঁহু, সম্ভবই না।
জনের বন্ধুর কাছে জানলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেনে। তার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আরেকজন বিখ্যাত ক্যারিবিয়ান লেখক। গীতাঞ্জলি কিনে রেখেছে। নামটা বললো অবশ্য ‘গিতালি?’
ঠিক করে দিলাম, “গীতাঞ্জলি। তবে কাছাকাছি গেছ। জন কিটস অনুবাদে সহায়তা করেছিলেন।”
সে চেনে সত্যজিত রায়কেও। ফেলুদার ব্যাপারে জানে। ফেলুদাকে মনে করতে পারছিল, কিন্তু সত্যজিতকে না। গুগল করে দেখাতেই হাততালি দিয়ে উঠলো। অরুন্ধতী রায়কেও চেয়ে সে। আমাকে একটা কাগজে তার নাম লিখে দেখানোর চেষ্টা করছিল। গুগল করে বের করে দিলাম। দ্য গড অফ স্মল থিংস।
আমি বললাম, “রবী ঠাকুর আর সত্যজিত রায় দু’জনেই বাঙালি ছিলেন। একজন জিতেছিলেন নোবেল প্রাইজ, আরেকজন অস্কার। বাঙালির ক্যালিবার ওটাই। তবে গত কয়েক দশকে অলসতার দরুণ আমরা বাইরের দেশে তেমন একটা আসতে পারিনি। এটা সমাধান করতেই আমি আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছি।”
জনের বন্ধুটি বিদ্যাবাগীস বটে। নোবেল উইনার ওলগা তোকারচুকের একটা বই আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। বইটা পড়তেই আসলে বারে এসছিল সে, কিন্তু আমাদের পেয়ে আড্ডায় ঢুকে গেছে। বললো, “ভাই আমি সপ্তাহে পাঁচটা করে বই পড়ি। আমার এই রুটিনের কোন ব্যত্যয় হয়নি গত ৪০ বছরে।”
জানলাম। শিখলাম। ওর কাছে আরও পেলাম তাহির শাহের লেখা কিং সলোমন মাইনস। এই তাহির শাহের বাবা আবার বিখ্যাত ইরানি সুফি লেখক। তারপর ও দিলো আমাকে উত্তর আমেরিকার লেখক রবার্তো বোলানোর খবর। সবচেয়ে বিখ্যাত লেখা তার “দ্য স্যাভেজ ডিটেকটিভস”, তবে রেকমেন্ড করলো “২৬৬৬” বইটা। ওটা নাকি তার খোপরিই উড়িয়ে দিয়েছে! আরও বললো, “ভাই তোমার বইগুলোর কাহিনী শুনে আমার মনে হলো এর থেকে রিলেটেবল কাউকে পাবে না।”
রবার্তো বোলানোর ব্যাপারে এরপর বললো ত্রিশ মিনিট। আমি যত শুনছি ততো মনে হচ্ছে চিলির এই লেখক আমার কার্বন কপি। আর কিছু হতেই পারে না। এর মধ্যে আমাদের বের করে দেয়ার সময় হয়ে গেছে। প্রায় দুটো বাজে। দুটোয় এটা বন্ধ হবেই।
জন আমাদের বিদায় দিয়ে রোলস রয়েস ড্রাইভ করে চলে গেল। ওদিকে সেই রাত নয়টা থেকেই স্যামকে দেখতে পাচ্ছি। আমাকে দেখে একবার এগিয়ে এসে কথা বলেও গেছে। কিন্তু মেয়েটাকে পাত্তা দেবার মতো অবস্থায় আমরা কেউ নেই। এখন সাহিত্য নিয়ে কথা হচ্ছে, বয়েজ ব্যান্ড থেকে আমাকে কেউ হাতি দিয়েও তুলতে পারবে না। এই মুহূর্তে আমরা শুধু তাকেই গ্রহণ করবো যার সাহিত্যে দখল যথেষ্ট।
আমরা কথা বললাম ক্যাপোটি থেকে ম্যানসন ফ্যামিলি, কিছু সিরিয়াল কিলার, তা থেকে তারান্তিনো, ইয়ান ফ্লেমিং থেকে রবার্ট লুই স্টিভেনসন নিয়ে, বললাম জোনাথন সুইফট থেকে এরিক মারিয়া রেমার্ক নিয়ে। তারপর এলো বোলানো, এলো তোকারচুক, এলো গ্রেগরি ডেভিড রবার্টস।
গ্রেগরির ওপর আর কথা হতেই পারে না। অস্ট্রেলিয়ান লেখক। মুম্বাই নিয়ে খুঁটিনাটি সব জানেন। “শান্তারাম” নামে এক বই লিখে ফেললেন তিনি। মুম্বাইয়ের মাফিয়া নিয়ে তার থেকে ভালো কেউ জানে না। সে জিনিস নিয়ে নেটফ্লিক্সে নাকি মুভি না ওয়েব সিরিজও যেন চলে এসেছে, তবে সেটা নাকি ‘বাল’। পড়তে হবে বইটা, সেটিই সেরা।
কাহিনী যতই বলে যাচ্ছে জনের বইপড়ুয়া বন্ধু, আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠছে। এক পর্যায়ে মুম্বাই অ্যাটাকে চলে এল ওর আলাপ। এবার আর থাকতে না পেরে গুগল বের করে বললাম, “যে মাফিয়ার গল্প দিচ্ছ, দাউদ ইব্রাহিম এটা। এর লাইফ থেকে ইন্টারপ্রিট করেছে ওর গল্প।” তারপর বের করলাম সঞ্জয় দত্তের পেইজ, “আর এই সুপারহিট ভারতীয় নায়কের এখানে জড়িয়ে যাওয়ার কাহিনী-”
এই কাহিনীটা আমি জেনেছিলাম এক ভারতীয়র কাছ থেকে। ওকে ওটা আমার বলতেই হতো।
এই পর্যায়ে এসে আমাদের সামনে বসে থাকা মেয়ে দুটো বিদায় নিলো। বারে এসে বহু মাতাল দেখেছে, বহু ক্রিপ দেখেছে, আমাদের দুটোর মতো মাদারচোদ দেখেনি – যারা মেয়ে-মদ সব বাদ দিয়ে বই নিয়ে ফটর ফটর করে যাবে পাঁচ-ছয় ঘন্টা।
শুধু ওরা কেন? এক ঘণ্টা পার হয়েছে কি হয়নি, আরেক আপদ এসে হাজির!
কানের কাছে গেট কিপার এসে বললো, “কেপিদা, পায়ে পড়ি, বিদায় হও। বার তো বন্ধ করে দেবো।”
আমি আর জনের বন্ধু হা হা করে উঠলাম, বললাম, “অবশ্যই। এই যে যাচ্ছি।”
গেলাম ঠিকই। খিদেয় মারা যাচ্ছিলাম। রাত বাজে দুইটা পনেরো। বাসায় ঢোকার সময় মনে হলো ট্রিলিয়নিয়ারের বন্ধুটির নাম জানা হলো না।
নামে কী এসে যায়?
এমন বইপড়ুয়া কাউকে পাওয়া গেল এটাই অনেক। নামে কিছু এসে যায় না। নইলে আমার নাম কিশোর পাশা ইমন থেকে বদলে রাখতে পারতাম ভারিক্কী কিছু।
কিন্তু নয়।
নাম যা-ই হোক না কেন, গ্রেট থিংস করলে সেটা নিয়েই সেজদার পর সেজদা পড়ে যাবে।
আর কাজের কাজ কিছু করতে না পারলে নাম হুমায়ূন আহমেদ রেখেও লাভ নেই।
এখানের ৫% লোকও আমার নাম জানে না। কিন্তু ওরা আমাকে ভালোবেসেছে, জায়গা দিয়েছে ইনার সার্কেলে। এভরি সিঙ্গেল ওয়ান অফ দেম। যে কোন বয়েসের, যে কোন লিঙ্গের, যে কোন আগ্রহের লোকের সাথে কথা বলতে পেরেছি কয়েকমিনিট আর তার আমার সাথে ৫ ঘণ্টার আড্ডা জুড়ে দেয়নি এমন হয়নি।
তাই তো!
নামে কী এসে যায়!
** যারা মনে করে আমেরিকান মানেই রিটার্ড, বইপত্র পড়ে না, উচ্ছনে গেছে সব– তাদের জন্য এটা লেখা দরকার ছিল। আমেরিকানদের মধ্যে এমন এমন বইপোকা আছে, আমাদের ঢাকার ২০ জন বইপোকা জোড়া দিলেও তাদের একটার সমান হবে না।
স্মৃতিকথা – আমেরিকা-নামা
রচনা ও ঘটনাপ্রবাহ – ৮ই মার্চ, ২০২৩
এক বেচারি মেয়েকে লাগানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে ছিল এক লোক। মেয়েটা ত্রিশ মিনিট আগে আমার কাছে এসে একটা সিগারেট চেয়েছে, ওকে বললাম, “যদি পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারো, তোমাকে সিগারেট এনে দিচ্ছি।”
সিগারেট আমারও লাগতো। কাজেই আমাকে ওটা আনতে হতোই। এনে দেখি ঐ লোক বেচারির পিছে লেগে আছে। লাগানোর ধান্ধা।
ওকে সিগারেটটা দিয়ে বললাম, “খাও ভাই যতো ইচ্ছে।”
একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আমার নাম জেনিফার।”
হ্যান্ডশেক করে বললাম, “বন্ধুরা আমাকে কেপি বলে ডাকে। সমস্যা হচ্ছে তোমার নামটা বিপদজনক। আমার এক্সের নামও ছিল জেনিফার।”
ওদিকে লোক তো লেগে আছেই। মেয়ে না লাগিয়ে যাবে না। আমাকে এড়িয়ে ফিসুরফাসুর করে ফেললো। তারপর গেল ড্রিংকস আনতে। আমি বললাম, “আমি খুবই দুঃখিত যদি আমি তোমাদের কাউকে অফেন্ড করে থাকি। আসলে ও কী বললো তা শুনতে পাইনি।”
জেনিফার ফিকফিক করে হেসে বললো, “আরে, ওই ব্যাটা লাগানর ধান্ধায় আছে। আমি ওকে না করলাম। তবে ছাগলটা বুঝলো কি না বুঝলাম না।”
পরের ত্রিশটা মিনিট আমরা থিওলজি আর অরিজিনাল থিংকিং নিয়ে আলাপ করলাম। বিদায় হবার আগে জেনিফার আমার ফোন নাম্বারটা নিলো। স্টকারের মুখটা কালো হয়ে গেল, কারণ মেয়েটা চালাক। জীবনেও নিজের নাম্বার আমাকে বলবে না। বরং আই-ফোনটা বাড়িয়ে দিলো যেন আমি আমার নাম্বার তাকে সেভ করে দিতে পারি আর নিজেকে পাঠাতে পারি একটা মেসেজ।
তারপর বেচারি উঠলো, “অস্টিনে থাকি। ড্রাইভ করতে হবে। যাইগা।”
রাত তখন বাজে দেড়টা। আমি আমার পাছার একটা মাসলও নড়াতাম না ওর এই কথায়। কিন্তু স্টকার লোকটা ঘ্যা ঘ্যা করে বললো, “চলো চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই। কী বলো?”
সব আমেরিকান সিটিজেন। আমি এক খানকির ছেলে। বহিরাগত। কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা খসে পড়লো আমার।
আমার সামনে মেয়ে স্টক করা হচ্ছে? বাঙালি চেননি, অ্যাঁ?
মেঘের মতো গলায় বললাম, “জেনি, তোমাকে গাড়িতে পৌঁছে দেব?”
ভীত সন্ত্রস্ত একটা মুখ একবার, তারপর কয়েকবার মাথা নাড়লো। শয়তানটা আমাকে বললো, “তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমি ওকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
ঘাউড়াটাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম, “চলো।”
গাড়ির কাছে এসে ওকে বললাম, “কিছু মনে করো না। আমি এসেছি স্রেফ যেন তোমাকে কোন ক্রিপ গাড়ির সামনে এসে চাপাচাপি করতে না পারে, তাই।”
জেনিফার বললো, “থ্যাংকস।”
আমি হাসলাম। বললাম, “আই উইশ, আমাকে কোন মেয়ে এভাবে অন্য মেয়েদের থেকে বাঁচাতো। বহু গোয়ামারা খেয়েছি ভাই। তোমাদের প্যারাখানা বুঝি।”
ফিরে এসেছি। গেটকিপার আমাকে পেয়েই থামালো। বললো, “আরে ভাই, তোমারেই তো খুঁজি। লিগ অফ লেজেন্ডস খেলো না? তুমি তো ক্যাপ্টেন টিমো নিয়ে খেলো? টপ গাই?”
আমি জোরদার মাথা দোলালাম, “আমি-ই সেই মাদারচত। ঘটনা কী?”
সে বললো, “এই ক্যারেকটারটা দ্যাখো। টপের জন্য পারফেক্ট।”
তারপর একটা ইউটিউব ভিডিয়ো ধরিয়ে দিলো। আমি চোদনা হয়ে গেলাম। লেভেল-ই আলাদা।
গেটকিপার জানতে চাইলো, “ফিরে আসলে যে?”
আমি বললাম, “জেনিকে এক ক্রিপ তাড়া করেছিল। মেক শিওর করলাম নটির ছেলে ওকে আর জ্বালাবে না। চিন্তার কিছু নেই, শি ইজ সেইফ নাও।”
এর মধ্যে এক মেয়ে এসে আমার ছয় ইঞ্চির মধ্যে থেমেছে। বললো, “তোমার কী অবস্থা? কেমন আছো?”
আমি হাসলাম। বললাম, “বেঁচে আছি। নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এর বেশি আর কী দরকার, বলো?”
ও হেসে ফেললো। একটা হাত বাড়িয়ে বললো, “আমি স্যাম। তোমার নামটা তো জানা হলো না।”
বললাম, “বন্ধুরা আমাকে কেপি বলে ডাকে। এই নামে উপন্যাস লিখে থাকি তো। ইনিশিয়ালস।”
এর মধ্যে দুই চুদির ভাই লাইনটা দখল করে ফেলার পাঁয়তারা কষছে। স্যামের হাতটা ছেড়ে বললাম, “ইয়ে, কিছু যদি মনে না করো – ইনকামিং। চুদিরভাই।”
স্যাম আর গেট কিপার হেহে করলো। দৌড়ে গিয়ে নিজের স্পট ধরলাম। ফিরে এসে অনেকক্ষণ পর ফোনটা বের করেছি। দেখছি কে কীভাবে আমার গোয়া মারছে। দুই একটা কমেন্টের রিপ্লাই দিচ্ছি। লোকজন আমাকে বোকাচোদা বলে গালাগাল করছে কারণ আমার গার্লফ্রেন্ড বা বউ অন্য কাউকে চুদে দিলে আমার দিক থেকে কোন রাগ বা ঝগড়া তারা দেখবে না। আমি মুচকি হাসছি আর রিপ্লাই দিচ্ছি। এর মধ্যে সামনে বেশ সুন্দর একটা মেয়ে এসে ধপ করে বসে পড়লো। আজকে মনে হয় আমার সুন্দরী ভাগ্য ভালো। এক রাতে তিন সুন্দরী আমাকে খুঁজে বের করছে এটা বিরল। খুব সম্ভবতঃ আমার চুলের বর্তমান স্টাইলের কারণে।
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম। মেয়ে বললো, “শুনলাম, তুমি নাকি স্যান মার্কোস থেকে যাবাগা?”
আমি বললাম, “একটা সম্ভাবনা আছে। আমার ইউনি অবশ্য বেটার অফার দিচ্ছে অন্য শহর থেকে। লাথিগুঁতো খেলে থেকে যেতেও পারি। কিন্তু তোমাকে তো চিনলাম না।”
হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আমি এরিকা। তোমার নামটা ভুলে গেছি।”
বললাম, “বন্ধুরা আমাকে কেপি বলে ডাকে। এই নামে লেখালেখি করি তো টিনেজ বয়েস থেকে।”
মেয়েটা হাসলো, তারপর বললো, “তাহলে তুমি আমাকে তোমার বন্ধুরা যে নামে ডাকে সে নামে ডাকতে অনুমতি দিচ্ছো? এটা এত সুন্দর!”
আমি হেহে করলাম। বললাম, “যতক্ষণ পিঠে ছুরি মেরে না দিচ্ছো ততক্ষণ বন্ধু তো বটেই। এর বেশি কিছু এক্সপেক্ট করি না। তবে তোমার নামটা আমাকে ট্রিগার করছে।”
মেয়েটার চোখেমুখে অপার বিস্ময়, “কীভাবে?”
আমি বললাম, “ডিট্যাচমেন্ট মুভিটা দেখেছ?”
ও বললো, “না। ঘটনাটা কী?”
আমি কথা হারিয়ে ফেললাম। আমি, কিশোর পাশা ইমন, যে খোদা কেয়ামত ঘটিয়ে দিলেও দমটা নাকে তুলে বসে থাকবো যেন শেষ কথাটি আমিই বলতে পারি। সেই আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি!
বললাম, “ইয়ে, মুভিটা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমার সাথে এতো রিলেটেবল। তো, ওখানে একটা মেয়ে থাকে এরিকা নামে। মাথায় যদি তোমার বিয়ারের বোতলটা না ছুঁড়ে মারো, তো বলি-”
এরিকা আমাকে আশ্বস্ত করলো ও আমার মাথায় বিয়ারের বোতলটা ছুঁড়ে মারবে না।
বললাম, “মেয়েটা একজন যৌনকর্মী। টিনেজার। রানঅ্যাওয়ে। কিন্তু প্রোটাগনিস্ট ওকে নিজের বাসায় ডেকে আনে। কিন্তু অন্য কোন উদ্দেশ্যে না। ও চায় সবাইকে রক্ষা করতে। সেজন্য যে কোন কিছু করতে সে প্রস্তুত। তবে-”
এরিকা আমাকে থামিয়ে দেয়, “মুভিটার নাম কী বললে?”
বললাম, “ডিট্যাচমেন্ট।”
ওর চোখেমুখে কেমন এক পরিবর্তন এলো। খুব খারাপ একটা প্রশ্ন করে ফেললো সে, “তুমি বললে মূল চরিত্রের সাথে তোমার মিল পেয়েছো। তুমি কী সবার থেকে ডিট্যাচড থাকো?”
এমন বেকায়দায় শেষ পড়েছিলাম যখন আনসার আল ইসলাম আমার মাথাটা কেটে ফেলার চেষ্টা করেছিল। আমতা আমতা করে বললাম, “আমি এখানে ইম্পর্ট্যান্ট না। কথা হচ্ছিল তো ডিট্যাচমেন্ট মুভি নিয়ে-”
এরিকা আমার হাতে একটা বাড়ি দিয়ে বললো, “না। এখানে তুমিই ইম্পর্ট্যান্ট। বলো।”
বড় করে শ্বাস নিলাম, “আমি যদি কারো সাথে কথা বলি তাহলে আমি কথা বলি এআই-এর মতো। এআই বোঝ?”
ও বললো, “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ। আমি কথা বলি ওভাবেই। ছেলে-মেয়ে কিংবা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ফারাক করি না। আমি দূরত্ব রাখি।”
এরিকা জানতে চাইলো, “কেন?”
ভাষা হারিয়ে ফেললাম। এত বড় প্রশ্ন আমাকে কেউ করেনি। এই টেক্সাসে জন্মানো, বড় হওয়া, ফার্স্ট ইয়ারের নাই-ইভ একটা মেয়ে কীভাবে আমাকে এমন একটা প্রশ্ন করে ফেললো!
এরিকা বললো, “তোমার অরিজিনাল থিংকিং নিয়ে লেকচার শুনে ফেলেছি। ওটার জন্য তোমাকে ডিটাচড থাকতে হবে? কারো কাছে যেতে পারবে না?”
আমি কিছুই বলতে পারলাম না।
মেয়েটা আবারও জানতে চাইলো, “কী হবে কারো কাছে গেলে?”
সবটুকু শক্তি একত্র করে ফিসফিস করে বললাম, “বিকজ আই কেয়ার টু মাচ। আই ক্যান্ট অ্যাফোর্ড ইট। আই ক্যান্ট।”
এরিকার চোখেমুখে যে পরিবর্তনটা দেখলাম, তা কোন ভালো লক্ষণ নয়। কুকুরের মতো হেসে বললাম, “কথা সেটা না। তুমি ডিট্যাচমেন্ট মুভিটা দেখবে। এটা তোমাকে দেখতেই হবে।”
ও বললো, “দেখবো। অবশ্যই দেখবো। এরা আমাদের এখন বের করে দেবে। কিন্তু তুমি আমাকে সব সময় এখানে পাবে। আমি এখানেই পড়ে থাকি। দয়া করে এরপর যখন আমাকে দেখতে পাবে ডিট্যাচমেন্ট প্র্যাকটিস না করে একটু ডেকো।”
সুন্দরীর কাছ থেকে এমন একটা অফার পেয়েও আমার মুখে কোন শব্দ এলো না। ভুতের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছি। এই অচেনা অজানা মেয়েটা আমার সবটুকু ভালনারেবিলিটি কীভাবে ধরে ফেললো!
লম্বা করে আমার বিয়ারে একটা চুমুক দিলাম।
চেষ্টা করলাম চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকা এক অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়ের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে।
এভাবে ধরা কেন পড়ে গেলাম!
“নিরাপদে থাকবে কেবল যীশুর অনুসারীরা। সত্যিকারের বিশ্বাসীরা।”
ত্রিশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচালো আমেরিকানটা।
আমি আর সুমিত দাঁড়িয়ে আছি জ্যাক ইন দ্য বক্সের সামনের পার্কিং লটে। আমার পকেট গড়ের মাঠ। সুমিত আমাকে একটা বার্গার খাওয়াচ্ছিল। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে আছি সুমিতের উবার আসার অপেক্ষায়। তখনই একটা লোক একটা কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমাদের দেখে বললো, “আশা করি তোমরা পানি জমিয়ে রেখেছ!”
বালটাও বুঝলাম না। তবে সচরাচর যা করে থাকি, জ্যাকি চ্যানের মতো একটা ভদ্রতাসূচক হাসি হাসলাম।
কাজ হয়ে গেল।
লোকটা ওখানে একটা খাম্বার মত দাঁড়িয়ে গেল। ভ্রু কপালে তুলে বললো, “তুমি হাসছো, অ্যাঁ? টেক্সাসের গভর্নর বলেছে আগামি নয় মাস কারেন্ট থাকবে না। পানি থাকবে না সেজন্য। বাড়িতে আমি নয় মাস একটা গোটা ফ্যামিলিকে খাওয়ানোর মতো খাবার জমিয়ে রেখেছি। জানো এটা কেন হবে? কারণ এরপর যে সমস্যাটা আসবে পৃথিবীতে তা হচ্ছে খাবারের সমস্যা। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ খাবার না পেয়ে মরবে। এটার শুরুটা কোথায় হবে, জানো?”
এতক্ষণে আমি ঘটনা বুঝে গেছি। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা একজন মস্ত বেকুব, রিপাবলিকান, ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান, এবং একজন কনজার্ভেটিভ। সচরাচর এগুলো একটা প্যাকেজ হিসেবেই আসে। মোট আটটি বৈশিষ্ট্য আছে যাদের যে কোন একটা পাওয়া গেলেই ধরে নিতে পারেন বাকি সাতটা তাদের মধ্যে থাকবে এই সম্ভাবনা ৮৯%।
(১) বেকুব কিন্তু নিজেকে জ্ঞানী মনে করে
(২) প্রো-গান
(৩) প্রো-গড
(৪) প্রো-লাইফ
(৫) রিপাবলিকান
(৬) ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান
(৭) কনজারভেটিভ
(৮) সায়েন্স এবং তার লোকজনকে দেখতে পারে না।
ঘটনা বুঝে ফেলার কারণে আমি বললাম, “না, এর শুরু কোথায় হবে তা তো জানি না।”
লোকটা তড়পে উঠলো। বললো, “আমি চৌদ্দ বছর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করেছি। আমি স্মার্ট লোক, বুঝলে? এর শুরুটা হবে টেক্সাসে। রক্ষা পাবে কারা এ থেকে জানো? শুধুমাত্র খ্রিস্টানরা।”
ওদিকে সুমিতের উবার চলে এসেছে। সে ওদিকে রওনা দিলো। কিন্তু একটা হাতি দিয়ে বেঁধে টান দিলেও আমি এখন এই পার্কিং লট থেকে নড়বো না। এরকম প্রতিটা মানুষ পাওয়া মাত্র খুঁটি গেড়ে আমি দাঁড়িয়েছি। কান পেতে শুনেছি তাদের কথা। ক্ষেত্রবিশেষে বাচাল হলেও, বিরুদ্ধমতের কারো সামনে আমার থেকে ভাল লিসনার আর কোথাও পাবেন না আপনি।
লোকটা আমাকে জুতমতো জ্ঞান দেয়া শুরু করলো, “ইউনিভার্সিটিতে পড়া বুড়োখোকাদের ব্যাপারে তোমাকে একটা কথা বলে যেতে পারি। এরা সব প্রতিবন্ধি, ভাই। বোকাচোদা। এরকম চার-পাঁচ জনের সাথে কথা বলেছি আমি। আমার কোন কথাই তাদের ভালো লাগে নাই। ভেবেছে সব গুজব। আমি তো আর বোকা না। ফ্লোরিডায় আমার পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বাড়ি আছে। সেখানে না থেকে আমি টেক্সাসে থাকি। কারণ যুদ্ধটা শুরু হবে এখান থেকেই।”
বিড়বিড় করে আমি বললাম, “গাজওয়ায়ে হিন্দ আরকি।” মুখে বললাম, “যুদ্ধ?”
বোকাচোদাটা বললো, “ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের যুদ্ধ। খাবারের ক্রাইসিস শুরু হলেই আমরা যুদ্ধে নেমে যাবো। আমেরিকা সরকারের তখন প্রচুর যোদ্ধার দরকার হবে। তোমার কি মনে হয় এই যে তোমাদের বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে, মেধার জন্য আনছে? না, আনছে কারণ তাদের যুদ্ধের জন্য লোক দরকার হবে। তখন আমেরিকার মাটিতে যারা থাকবা সবাইকে যুদ্ধে যেতে হবে।”
আমি তখন তাকে লাই দিলাম, “অবশ্যই যাবো। আমার তো আজন্ম স্বপ্ন আমেরিকার হয়ে যুদ্ধ করার।”
লোকটা খুশি হয়ে বললো, “তুমি সত্যিকারের পুরুষ। আজকালকার চ্যাংড়াদের মধ্যে এমন বেশি দেখা যায় না। আর তোমাকে একটা সত্য কথা বলি – যখন তুমি বুঝে ফেলবা একজন পুরুষ হিসেবে তোমার সত্যিকারের ক্ষমতা কতখানি তখন আর মেয়েদের অধিকারের নাটক তোমার ভালো লাগবে না। গর্ভপাতের অধিকার চায়। মজাটা বুঝেছ? পুতিন কী বলেছে শোননি? বলেছে পশ্চিমাবিশ্ব তার শত্রু নয়। তার শত্রু হচ্ছে ওক কমিউনিটি। এরা ওক কমিউনিটির নামে যা শুরু করেছে তা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত কেড়ে নেয়ার পায়তারা। মেয়েদের অধিকার, সমকামীদের অধিকার। ছোহ।”
একটা গাড়ি তখন পার্কিং লট থেকে বেরুতে গিয়ে ওর কুকুরকে মাড়িয়ে দিয়েছিল প্রায়।
কুকুরটা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আমি তাকে দেখতে দেখতে ভাবলাম, কুকুরটাও কি রিপাবলিকান?
কুকুরটাও কি প্রো-গড, প্রো-গান, প্রো-লাইফ? কুকুরটা তো ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান হবার কথা নয়। কিন্তু কে জানে! হতেও পারে।
লোকটা কুকুর সামলে আবার শুরু করলো, “টেক্সাস হবে যুদ্ধের শুরু। কারণ এখানে তখন এগিয়ে আসবে মেক্সিকান কার্টেলগুলো। বন্দুক তোমরা দেখবে। আমরা তখন যুদ্ধে নেমে দক্ষিণে পুশ করবো। এই যুদ্ধ কোথায় শেষ হবে জানো?”
আমি বললাম, “না। আমি একটু মূর্খ এবং বোকাচোদা, স্যার। দ্বীন-দুনিয়ার খবর তেমন রাখি না। আমাকে ক্ষমা করবেন। বরং আমার জ্ঞাননেত্র বিকশিত করে দিন। বলুন, যুদ্ধটি কোথায় শেষ হবে?”
বলদটা বললো, “আর্জেন্টিনা। কারণ আমাদের পুরো মহাদেশটাই দখল করতে হবে। মারতে হবে সবাইকে। আর খাবারের সংকট বাড়লে গোটা আমেরিকার লোকই ছুটে আসবে টেক্সাসের দিকে। আমরা তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবো। শেষ মাটিটা পর্যন্ত দখল করবো আমরা।”
আমি বললাম, “ওয়াও।”
মূর্খটা নিজের বুকে টোকা দিয়ে বললো, “আমি একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। বাকিদের মত দুর্বল নই। মানুষ খুনে আমার হাত কাঁপবে না, কারণ আমি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য খুন করায় খারাপ কিছু দেখি না।”
তারপর আরও দশ-পনেরো মিনিট আমাদের আলাপ হলো। লোকটা আমাকে খুব যত্নের সাথে বোঝালো আগামি ২৮ বছরে কোথায় কী হবে। বিশ্বের কোন জায়গা কেমন থাকবে। এটাও বললো ভারত একমাত্র জায়গা হবে যেখানে খাবারের সঙ্কটে লোক মরে সাফ হবে না। ঠিক কখন ডেমোক্রেট খানকিরা (এর থেকেও কিছু বাজে বিশেষণ সে ব্যবহার করলো, বন্দুক নিয়ে প্রথমে এ কাদের শিকার করবে তা আমার বোঝা হয়ে গেল) তাদের প্রকৃত চেহারা দেখানো শুরু করবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। (হানিফ সঙ্কেত)
তারপর সে বিদায় নিলো অবশেষে।
আমি বললাম, “আপনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ, স্যার।”
লোকটা খুশি হয়ে বললো, “তোমার মতো ছেলে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই ওক পোলাপান। দিনটি চমৎকার কাটাও।”
আমি বললাম, “আমি বাড়ি ফিরেই পানি জমানো শুরু করবো। চিন্তার কোন কারণ নেই।”
বাড়ি ফেরার সময় চিন্তা করছিলাম, আমাদের জেনারেশনের সবার উচিত টেক্সাসে এসে কয়েক মাস কাটানো। রিপাবলিকান হেভি যে কোন আমেরিকান স্টেটে তাদের কিছু সময় কাটিয়ে যাওয়া উচিত অন্তত। তাহলেই বুঝতে পারবে ঈমানী জোসে তারা যা যা ভাবে সবই কেমন বুলশিট। এবং ঠিক একইভাবে চিন্তা করে কীভাবে গোটা বিশ্বের নিম্নোক্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের লোকজন
— ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান/মুসলিম/হিন্দু/যে কোন ধর্ম
— কনজারভেটিভ
— বিজ্ঞান বলে কিছু নাই, সব পশ্চিমাদের/ডেমোক্রেটিক ষড়যন্ত্র
— মেয়েদের কিংবা সমকামীদের অধিকার দেবার তেমন কিছু নাই
আপনারা অক্ষরে অক্ষরে একইরকম চিন্তা করেন। প্লট সবার সেইম। শুধু কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে গড। কেউ গর্বিত মুসলিম। কেউ গর্বিত খ্রিস্টান। কেউ গর্বিত হিন্দু।
অথবা, এই আমেরিকান লোকটিকে আমি যদি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারতাম, তবেও দারুণ হতো।
নিমেষেই নিজের বলদামি ধরা পড়তো তার চোখে। ঠিক যেমন ধরা পড়তো আপনাদের বলদামি আপনাদের চোখে।
দুনিয়া বিচিত্র এবং মজার।
বাংলাদেশে বেড়ে ওঠায় আমি অনেকবারই কৃতজ্ঞ বোধ করেছি। টেক্সাসের ছাগ*লদের সাথে যতবার কথাবার্তা হয়েছে আমাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি, তিনটি বাক্য শোনার আগেই আমি স্বজাতিদের চিনতে পেরেছি। কারণ চায়ের দোকানে, রাস্তায়, বাসের পাশের সিটে আমি এমন স্বদেশী ছা*গলের সাথে অনেকবার বিশ মিনিট, আধঘণ্টা, এক ঘটণা আলাপ করেছি। প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনেছি।
এই আমেরিকানের কপিক্যাট আলাপই তারা করেছে। ফ্রেজগুলো বদলে গেছে খাদ্যসঙ্কট>ইমাম মাহদি, খ্রিস্টান>মুসলিম, ওক>নাস্তিক, গড>আল্লাহ, ডেমোক্র্যাট>আওয়ামীলীগ, যুদ্ধ>গাজওয়ায়ে হিন্দ প্রভৃতিতে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে মালিবাগের মোড়ের ধর্মপ্রাণ মুসলিম আর টেক্সাসের ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান কিছু কিছু শব্দ একেবারে হুবহু ব্যবহার করেছে। এরা প্রত্যেকেই নিজেদের ‘রিসার্চ’ করেছে। অ্যাপারেন্টলি, মূর্খতার নিজস্ব ভাষা আছে।
আপনি ভাবেন, আপনি স্পেশাল? আপনি সিরাতুল মুসতাকিমে আছেন?
আপনি আছেন বালের ওপর।
আমি কেবল আশা করি, এই জেনারেশনের পোলাপান অন্তত বিষয়টা নিজে নিজে দেখতে পাবে।
নভেম্বর ২৫, ২০২২
মসীহ ঈশার মতোই আমার নীতি হচ্ছে, আমি সব মানুষের সাথে চলি। টেক্সাসে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং দুই বান্ধবীর পার্সপেক্টিভ জানার সুযোগ এভাবেই হলো।
বান্ধবীর আলাপ আসছে, কারণ প্রেগন্যান্সি নিয়ে যে নাটক আমেরিকায় হয়েছে তা অনেকেই জেনে থাকবেন। বন্ধুর থেকে বান্ধবীর মতামত প্রকাশ বেশি জরুরী। ইউএসএ-তে মিড টার্ম ইলেকশন হলো। বিশেষ করে বেশিরভাগ মেয়ে দম আটকে দেখছিল এই ভোটে জনগণের মতামত কোনদিকে যায়।
প্রথম বান্ধবী হচ্ছে যীশুর মেয়ে। ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। আমাকে টেনে-হিঁচরে একদিন চার্চে নিয়ে গেল। এতগুলো ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানের মধ্যে জমপেশ একটা নাটক হয়ে গেল তারপর। গসপেল পাঠ করছিল যে ছেলেটা – তরুণদের ধর্মগুরু, তার পাশেই বসার জায়গা হলো আমার। সব রিচুয়াল শেষে সে আমাকে বললো, “কেমন বোধ করছো? তোমাকে বেশ চুপচাপ মনে হচ্ছে।”
আমি ওকে বললাম, “ইয়ে, আমার দুটো দোষ আছে।”
পুরো ঘরের স্পটলাইট দেখলাম আমার ওপর। সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
ব্লন্ড যে মেয়েটা বাইবেল পাঠ শেষ হওয়া মাত্র গিটারটা নিয়ে টুংটাং যীশুর বন্দনা শুরু করেছিল, তার গিটারও বন্ধ হয়ে গেল।
ধর্মগুরু শুধালেন, “আহা। কী সেটা?”
আমি বললাম, “আমার মুখের গর্তটা ফাঁকা হলে অনেকসময় সেটাকে মানুষ ভালোভাবে নেয় না।”
ধর্মগুরুর সাথে ঘরের সবাই হা হা করে উঠলো। বললো, “কোন চিন্তা নেই। এইখানে তুমি যা ইচ্ছে তাই বলতে পারো। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। সব মতামতই স্বাগত।”
আমি বিনয়ের সাথে তাদের ধন্যবাদ জানালাম।
ওদিকে বান্ধবী আমার ইন্ট্রোডাকশন করিয়ে দিয়েছে, “বাংলাদেশি” এবং “এই প্রথম চার্চে ঠ্যাং রেখেছে” হিসেবে। ঘরের পরিবেশ অত্যন্ত অনুকূল। সবার মাথায় কী চলছে তা আমার কাছে সুস্পষ্ট। যীশুর লুঙির তলে আমি ঢুকে পড়বো আজ অথবা কাল – এটাই তাদের চোখেমুখে পরিষ্কার।
ধর্মগুরু জানতে চাইলেন, “তা তুমি নিশ্চয় আমাদের ধর্মে বিশ্বাস করো না?”
আমি বললাম, “আজ্ঞে না। আমি অ্যাগনস্টিক।”
ধর্মগুরু এবার সুঁইয়ের মতো মিহি গলায় প্রশ্ন রাখলেন, “তা যীশুকে তোমার কেমন লাগে?”
আমি আরও বিনয়ের সাথে বললাম, “আমার দ্বিতীয় দোষটি আগে শুনুন, স্যার।”
ধর্মগুরুর সাথে ঘরের সবাই আবারও স্পটলাইট আমার দিকে ফেললো। কোনও লোক তার দোষ স্বীকার করছে এটার চেয়ে বিনোদন আর কিছু হতে পারে না চার্চে।
ধর্মগুরুর অশেষ ধৈর্য। তিনি জানতে চাইলেন, “বলে ফেল বাছা। বলে ফেল।”
আমি বিনয়ে নুয়ে পড়তে পড়তে বললাম, “জীবন-মরণ সমস্যা না থাকলে, কিংবা দেশের স্বার্থে না হলে আমি কখনো মিথ্যা বলি না।”
সবাই বা-বা করে উঠলো। ধর্মগুরু বললো, “একে দোষ বলছো কেন? এ তো ভালো জিনিস।”
আমি যথাসম্ভব নরম গলায় বলে ফেললাম, “এরকম একটা সেটিংয়ে যীশুকে আমার কেমন লাগে প্রশ্ন করা হলে এই ভালো জিনিসটা দোষ বৈকি।”
অনেকে একটু অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসলো। ওই ব্লন্ড যে আমাকে তার গিটার বাজিয়ে জীবনেও শোনাবে না তা আমি লিখে দিতে পারতাম তখন।
ওইখানে পরের ত্রিশটা মিনিট খুব মিনিংফুল আলাপ হলো আমার। থিওলজি, সাইকোলজি নিয়ে তুমুল আলোচনা। চার্চ থেকে বেরুবার সময় আমার খেয়াল হলো, এই কথা কোন বাংলাদেশের মসজিদে বললে মাথা আর জায়গামতো থাকতো না।*
তো এই হচ্ছে আমার ধার্মিক বান্ধবীর সার্কেল। এরকম আরও অসংখ্য সার্কেলে আমি ওর সাথে গেছি। ধর্মপ্রাণ মুসল্লি দিয়ে ভর্তি। এবং তাদের মাঝে গিয়ে বসে তাদের মেকানিজম আর সাইকোলজি বোঝাই আমার লক্ষ্য। টেক্সাসের এমন এমন ধার্মিক কমিউনিটির সাথে আমার ওর থ্রুতে পরিচয় হয়েছে যারা আমার মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে। ঈশ্বরের নাম নিতে নিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলা জনতা আরকি। কী যে ভয়ানক ভয়ানক কুসংস্কার বিশ্বাস করে বললে ভাববেন গুল মারছি। অথচ এখানে যা বলেছি তা অক্ষরে অক্ষরে ঘটেছে। বাঙালির খ্রিস্টান ভার্সন – সোজা বাংলায়। যীশুর সন্তানেরা।
তো টেক্সাসে নির্বাচনে জিতেছে গ্রেগ অ্যাবট। লোকটা এমনই এক বদমাশ যে মেয়েদের মানুষ মনে করে না। অ্যাবরশন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সে এমন সব কথাবার্তা বলে থাকে যা শুনলেই বোঝা যাবে মেয়েরা তার কাছে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন। একেবারে খাটি ওয়াজি। সে আবার টেক্সাসের গভর্নর। এখানে তো ধর্মান্ধ লোকে ভর্তি, কাজেই উপযুক্ত লোকের হাতেই উঠেছে ঝাণ্ডা।
অ্যাবটের খুঁটিনাটি জানার ভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল ইলেকশনের রাতে। যে দুই বান্ধবী আজকের আলোচনায় মুখ্য তাদের দ্বিতীয়জন রাত তিনটায় আমাকে বেহুদা মেসেজ দিচ্ছিল। মেসেজের হালচাল দেখে বুঝলাম, ক্ষেপে আছে। ক্ষেপে আছে বললে কম হবে, আসলে বোমা হয়ে আছে। নির্বাচন নিয়ে চিন্তায় মারা যাচ্ছে। আবার ওদিকে তখন ভোট গোণা হচ্ছে। সবার গলার কাছে উঠে আছে হৃৎপিণ্ড। টেক্সটে কুলাচ্ছিল না, ও আমাকে ফোন দিলো। ধরামাত্র বুঝলাম অন্তত আটটা মদ পেটে চালান করে দিয়েছে। পুরা চোদ।
ফোন ধরা মাত্র ও একটা হুঙ্কার দিলো, “খানকির পোলা কী বলসে তোমারে বলি –”
যীশুর মেয়ের একদম একশ’ আশি ডিগ্রি দূরে ওর প্রোফাইল। ধর্ম গোণার সময় তার নাই, মদে আপত্তি নাই (ও-ই তো আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে খাঁটি স্যান মার্কোসের সন্তানেরা ডাউনটাউন হিট করে, এবং সেই রাতে আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে বাসায় ফেরা লেগেছে), কনজারভেটিভ দেখতে পারে না, আদর্শ লিবারেল। পরের পঞ্চাশটা মিনিট অ্যাবট কেমন হারামজাদা তার ফিরিস্তি আমাকে বর্ণনা করলো ও। খুঁটিনাটি বোঝালো টেক্সাসের ভোটের। বর্ন অ্যান্ড রেইজড ইন টেক্সাস। সে ভোট দিতেই গেছে ওরা যেন অ্যাবরশন নিয়ে অত্যাচারী আইন বন্ধ করা যায় এবং মেয়েদের স্বাধীন করা যায় তাই।
টেক্সাসে যারা আছে সবাই ওই রাতে উৎকণ্ঠা নিয়ে জেগে ছিল। আমার মাথায় ইলেকশনের ব্যাপারটা থাকলেও তারিখটা ছিল না অবশ্য, তারিখ তো মনে থাকে না। তবে ওই রাতে আমরা বসে বসে ভোট গুণলাম। বান্ধবী একটার পর একটা বোতল খুলে গেল ওদিকে। অথচ পরে খারাপ মানুষটাই জিতে গেল। মদারুদের দোয়া কী আর কবুল হবে? কবুল হয়েছে খ্রিস্টানদের দোয়া। ৫১% এর ওপরে উঠে যাওয়ার পর আমরা আর নিতে পারলাম না। পরিষ্কার বুঝলাম ফোনের ওপাশে মেয়েটা আরেকটা বিয়ারের ক্যান খুলে ফেলেছে। খুব স্বাভাবিক। মানুষের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে তাদের সবার মন মেজাজ বিলা হয়ে গেছিল সে রাতে।
পরদিন যীশুর মেয়ের সাথে সন্ধ্যার দিকে দেখা হয়েছে। আমি নির্বাচনের কথা আর তুললামই না। ছুরি মোচড়াবার দরকার নেই ভাবলাম। একই সাথে যীশুর যে কোন সন্তানই নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হতে পারে এবং হবে – এই আশঙ্কা ছিল। বাংলাদেশে তো তাই। প্র্যাক্টিসিং মুসলমান মানেই নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী না। কারণ ধর্মেই বলা আছে পর্দা করতে হবে, স্বামীকে অমুক স্থান দিতে হবে, পিতার সম্পদের ভাগে ভাইয়ের অর্ধেক নিতে হবে, ইত্যাদি। কেউ প্র্যাকটিসিং মুসলমান হলে আর নারীকে স্বাধীনতা দূরে থাকুক, সমান অধিকার দিতে পারবে না। কেউ নারীর সমান অধিকারে বিশ্বাস করলে সে অবশ্যই মুরতাদ। ইসলামের আকিদা না মানা এক জিনিস আর অবিশ্বাস করা আরেক জিনিস। নারীর সমান অধিকার বিশ্বাস করার অর্থ আপনার ঈমান নেই। খ্রিস্টানরা এর থেকে ভালো হবে নাকি? আর যীশুর মেয়েকে তো আমি চিনি ভালোমতো।
রাত দেড়টার দিকে বাসায় ফিরছি। পুরোটা সময় ইলেকশনের ব্যাপারে আলাপ হয়নি। এখন ও বিদায় হবে, পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে দিচ্ছি কেবল। যীশুর মেয়ের সাথে মারামারি বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো গেছে ভেবে কেবল স্বস্তির নিঃশ্বাসটা ফেলবো, এমন সময় ও বলে ফেললো, “খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম গতকাল রাতে, বুঝলে?”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আরে, চার্চগোইং লিবারেল নাকি?
তারপর সে তার বাক্যটা শেষ করলো, “অ্যাবট হারলে সর্বনাশ হয়ে যেত।”
মনে মনে কেবল বললাম, “চুদসে আমারে।” মুখে বললাম, “কেন?”
ও জানালো, “ওর অফিসে আমার পীসতুতো ভাই কাজ করে তো। ভাইয়া তো ভদ্রলোকের ডানহাত। ওর চাকরিটা যেত হয়তো। যে গাড়িটা হাঁকাচ্ছে তার খরচা আর দেয়া লাগতো না পরের মাসে।”
আমার কান থেকে তখন ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
এবার কথাটা শেষ করলো সে, “তাই আমরা সবাই অ্যাবটকে ভোট দিয়েছি। তাছাড়া ভাইয়ার সুবাদে গেছি তো উনার অফিসে। দেখাসাক্ষাত হয়েছে বার কয়েক। উনারা জোস মানুষ।”
আমি বললাম, “ওই যে তোমার গাড়ি। গুড নাইট।”
এর বেশি কিছু বলতে গেলে আমার মুখ থেকে যা বের হবে তা যীশুর ক্ষমাশীল সন্তানরাও নিতে পারবে বলে আমার মনে হলো না।
টেক্সাসের লিবারেল আর কনজারভেটিভদের সাথে এবং তাদের সার্কেলে আমি যথাসম্ভব নিউট্রাল হয়ে মেশার চেষ্টা করেছি এতগুলো মাস। আগে থেকে কোন কিছুই ধরে নিতে চাইনি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে আসলেই ধর্মটা যতো নষ্টের গোড়া। ধার্মিক মানেই সে প্রো-গড, প্রো-গান, প্রো-লাইফ। এই তিন একেবারে প্যাকেজ, এবং সব্বোনাশ! মানে বন্দুক ছোঁড়ার জন্য চেঁচাবে, মেয়েদের অ্যাবরশন নিষিদ্ধ করার জন্য চেঁচাবে। যারা একটু নাস্তিক গোছের তারা বন্দুক ব্যান করার জন্য এবং মেয়েদের স্বাধীনতা দেয়ার জন্য চেঁচাবে।
দূর থেকে এমনটাই সবার ধারণা হয়। আমি তাই কাছে গিয়ে মিশেছি। মিশছি।
দেখছি আসলেও তাই।
বাংলাদেশেও তাই। যে ব্যাটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা ধার্মিক তার কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতার ভ্যালু নাই, সে অন্যের ওপর অত্যাচারী আইন-কানুন চাপাতে সব সময় ব্যস্ত। যারা মডারেট মুসলিম বা ধর্মচ্যুত – তারাই ভালো মানুষ। মডারেট খ্রিস্টান এবং মডারেট মুসলমান একই কাতারের লোক। বিবেকবুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে।
যারা প্রবল বিশ্বাসী তারা প্রত্যেকে এমপ্যাথিলেস, থটলেস, ডাম্ব।
আমি এই সমাজটাকে আরও কয়েকটা মাস দেখার সুযোগ পেলে হয়তো এর উলটো উপসংহারে পৌঁছাবো।
হয়তো আমি ভুল ভাবছি।
হয়তো আমি ভাবছি উলটো।
হয়তো যারা এমপ্যাথিলেস, থটলেস, ডাম্ব, তারাই প্রবল বিশ্বাসী!
* ধর্মগুরুর সাথে আমার পরে আরও আলাপ হয়েছে কফি শপে। ফ্রি হলেই ভদ্রলোক আমাকে টেক্সট করে ডাক দেয়। বলে, “এসো, আড্ডা হয়ে যাক।” মনের গহীনে সে হয়তো আমাকে কনভার্ট করার জন্য ডাকে, তবে আমাদের কানেকশনটা ভিন্ন। আমরা আদতে প্রিচার। সে যীশুর বানী প্রচার করে। আমি ভিন্ন বাণী প্রচার করি। কাজেই আমরা আলাপ করি জনতা কীভাবে কোন জিনিসটা নেয়, কী টেকনিক ব্যবহার করলে লোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে ইত্যাদি। সে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অ্যাঙ্গেল থেকে প্রিচিং নিয়ে আলাপ করে, আমি ‘জীবনবাদ’ প্রচারের লক্ষ্য থেকে প্রিচিং নিয়ে আলাপ করি। ও একমত হয় প্রচারের অনেক টেকনিক নিয়ে, অনেক সময় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলে কেমন ঝামেলা তমুক টেকনিকে আছে। এবং যেহেতু লম্বা একটা সময় সে জনতা নাচিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। নিজের ধর্ম প্রচার করার সময় এসব আমার কাজে লাগবে। প্রিচিং হলো গিয়ে প্রিচিং। আর লোকটা বেশ ভালো প্রিচার। গতকাল কয়েকশ ছেলেমেয়ের সামনে সে আগুনঝড়া সাইকোএনালিটিকাল বক্তব্য রেখে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেছে শুনলাম অন্যদের থেকে। আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল, আমি যেতে পারিনি। রিপোর্ট লিখতে বেশি ব্যস্ত ছিলাম। তবে এসব প্রিচার কীভাবে লোকের মাথা খায় তা শেখার প্রয়োজন আমার আছে।
সকালের প্রথম টেক্সট এলো কেইলিনের কাছ থেকে, “এই, বোমার ঘটনা শুনেছো? ক্যাম্পাসে নাকি আজ বোমা মারবে। তুমি কই?”
আমি তখন হিমশিম খাচ্ছি প্রপোজালের প্রেজেন্টেশন তৈরির চাপে। আজকে আমার ডেমো প্রেজেন্টেশন দেয়ার কথা প্রফেসর, এবং তার ল্যাবের জনগোষ্ঠির সামনে। এর মধ্যে বোমা এল কোত্থেকে!
আমি এক হাতে পাওয়ারপয়েন্টের স্লাইড বানাতে বানাতে অপর হাতে ওকে রিপ্লাই দিলাম, “কোন বোমা? কীসের বোমা?”
তখন ও আমাকে একটা স্ক্রিনশট পাঠালো। টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমেইল। কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিটি দালান বোমা মারিয়া উড়াইয়া দেবার হুমকি দিয়া কে বা কাহারা লিফলেট বিতরণ করিয়াছে। দালানগুলো হইলো হাওয়ার্স, থিয়েটার, কেমিস্ট্রি, আর এজুকেশন বিল্ডিং। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সশস্ত্র অবস্থান নিয়াছে এবং প্রতিটি দালানের কোনাকাঞ্চিতে উঁকি মারিয়া দেখিতেছে। চিন্তার কোন কারণ নাই, আমাদের পুলিশের সঙ্গে আরও কাজ করিতেছে নিয়াছে এটিএফ, ইউটি অস্টিন পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং এফবিআই।”
এটিএফ, হোমল্যান্ড, আর এফবিআই। কর্ম সেরেছে!
জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে!
কেইলিন জানালো একটু পর ওর ক্লাস আছে বটে, তবে ওসব কোন বিল্ডিংয়ে নয়। জানালো, “পুলিশ তো কুকুর নিয়ে ঘুরঘুর করছে সবখানে। শুনলাম ফিজি ফ্র্যাটারনিটির দুটো ছেলে এই ঘটনার পেছনে নাটের গুরু।”
ওর কাছে ভেতরের খবর থাকা স্বাভাবিক। থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। ক্যাম্পাসে কে কোথায় পাদ মারলো তার বিশদ তথ্য ওদের কাছে থাকে। আন্ডারগ্র্যাডে থাকা অবস্থায় আমরাও তাই করতাম। বলতাম, ক্যাম্পাসে দেয়ালেরও কান আছে।
ভেতরের তথ্য জানামাত্র লক্ষ্য করলাম আমার বুকের গভীর থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেছে। অথচ তখনো বোমা খুঁজে পাওয়ার বা না পাওয়ার কোন খবর পুলিশ দিতে পারেনি।
স্বস্তির মূল কারণ হচ্ছে বোমার হুমকি দেবার ঘটনাটি ঘটিয়েছে যারা তাদের কেউ বাংলাদেশি নয়, এবং আগামী দিনগুলোতে স্রেফ বাংলাদেশি বা ভারতীয় চেহারার অধিকারী হওয়ার কারণে আমাকে কারও লাথি খেতে হবে না।
কিছুদিন আগে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল লাইব্রেরির ফার্স্ট ফ্লোরে। এক ছেলে এক মেয়েকে যৌন হয়রানি করে পালিয়ে গেছিল। তার ছবি সাথে সাথে সিসি ক্যামেরা থেকে বের করে টেক্সাস স্টেটের প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রীকে পাঠানো হয়েছে এক ঘণ্টার মধ্যে। আমি যুগপৎ ক্রোধ নিয়ে শুয়োরটিকে দেখলাম। আমাদের জাতিগোষ্ঠীর লোক। ভারতীয়, বাংলাদেশি, কিংবা শ্রীলঙ্কান। লজ্জায় মারা গেলাম।
বদমাশটিকে টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির পুলিশ সে রাতেই গ্রেফতার করতে পেরেছিল। ছবি ছড়িয়ে যাওয়ার পর তাকে ধরিয়ে দিতে বেশি সময় লাগেনি। ভূত থেকে ভূতের চাইতেও বেশ কার্যকর পদ্ধতি ওটা। ব্যাটাকে গ্রেফতারের পর স্বস্তি পেয়েছি ঠিক, একই সাথে মনের ভেতর খচ খচ করাটা থামেনি। আমি জানি আমাদের সাউথ এশিয়ানদের মধ্যে মেয়েদের কীভাবে দেখার প্রবণতা আছে – তারা মেয়েদের সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন মনে করে অভ্যস্ত। সেটা রাষ্ট্র হয়ে গেল যা হোক। স্রেফ সাউথ এশিয়ান বলে আমার চেহারাটা দেখা মাত্র আমার ক্যাম্পাসের মেয়েরা মনে করবে আমি সুযোগ পেলেই তার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকবো! কী একটা লজ্জার ব্যাপার।
এটা যে বাড়িয়ে বলছি এমন নয়। আমাদের যে মেয়েদের না দেখার ভান করা সমস্যা আছে, এবং দেখলে আবার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকার দোষটি আছে – এমনটা ওরা ফিল করেছে তা সরাসরি এখানকার এক মেয়ের সাথে আলাপ করে আমি জেনেছিলাম। তাকে ছাত্রী না, ‘স্রেফ একজন মেয়ে’ ফিল করিয়েছিল আমারই গর্বিত দেশবাসীরা। তারা বাংলাদেশের নাম রওশান করায় আমার মনে হয়েছিল একটা গর্ত করে মাটিতে ঢুকে যাই। সেদিন আমি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক একটি কাজ করেছিলাম। বাংলাদেশের ছেলেদের ব্যাপারে সুগারকোট করে অনেক কিছু বলেছিলাম। বলতে পারিনি, “বইন গো, বেশিরভাগই বাইনচোদ। তোমার পিছে তোমারে নিয়া নোংরা কথা বলে।”
এই জাতির একজন হয়ে জন্মেছি যখন, এমন কিছু জাতিগত ট্যাগ তো পড়বেই আগে কিংবা পরে।
বোমা হামলাকারীদের প্রসঙ্গে তাই সবার আগে চলে এসেছিল সেই উদ্বেগ।
ইসলামফোবিয়ার সময় এসেছিল যখন নাইন এলিভেনের পর পর, তাদের অনুভূতি কেমন ছিল তা চিন্তাও করা যায় না। ভালো মানুষরা বিব্রত হয়েছিলেন এমন, তবে ওটা ছিল আরও সিভিয়ার। হামলাও হয়েছে তখন। কিন্তু খারাপ মানুষরা তখনও ইনিয়ে বিনিয়ে মুসলমান সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে সাফাই গেয়েছিলেন।
আমার জাতির লোক আছে এমন। যারা খারাপ। তারা বলে ফেলে, “তাকানোর মতো জামা পরলে তো তাকাবই।”
মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশিদের জন্য যে সম্মানটা কিছু মানুষ অর্জন করেছিল, তা দুই সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংস করেছে অন্য বাংলাদেশিরা। লাখ টাকার বাগান খেয়েছে এক টাকার ছাগলে। বোমাবাজির হুমকি দেয়া লিফলেটের পর কেইলিন যখন আমাকে বলেছিল এটা ফিজি ফ্র্যাটের তথা ফাই গামা ডেলটার কাজ – স্বস্তির নিঃশ্বাস কেন ফেলেছিলাম তা হয়তো এখন স্পষ্ট হয়েছে।
২.
বোমার হুমকির পর কর্তৃপক্ষের যে দিকটা সবচেয়ে চোখে পড়েছে, তা হল – এরা কোনরকম টেরোরিজমের সাথে কম্প্রোমাইজ করেনি। একটা বিল্ডিংও বন্ধ করে দেয়নি, করেনি ইভ্যাকুয়েট। তাদের কথা হচ্ছে, স্রেফ হুমকি দিলেই বাড়ি বন্ধ করে দেব – এমন দিন আজও আসেনি। এই মনোভাবকে আমি দাঁড়িয়ে স্যালুট দেই। গোটা জীবন আমি এটাই ধারণ ও প্রচার করে এসেছি।
কেউ এসে আমাকে ‘মাথা ফেলে দেব’ বলা মাত্র সব বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যাবো এমন শিক্ষা আমি পাইনি। আমি জেনেছি, সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বড় কাপুরুষ। কারণ তারা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে অস্ত্র ও বোমা দিয়ে ভয় দেখায়। তাদের কাছে নতি স্বীকার করার প্রথম ধাপটা হচ্ছে তাদের ভয় পাওয়া। অধিকাংশ মানুষ তাদের ভয় পেয়ে থাকেন। সেটা ছাত্রলীগ হোক কিংবা জ’ঙ্গিবাহিনী।
জ’ঙ্গিবাহিনী অমুক বাড়ি উড়িয়ে দেব বলামাত্র ভিডিয়ো ডিলেট করা কাপুরুষ আমরা দেখেছি। অন্তত আমি খুশি, টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটি আজ তেমন কিছু করেনি। সত্য কথাটা হচ্ছে, সত্যিকারের বোমা যদি থেকেও থাকতো আর তাতে আমিসহ উড়ে যেতাম – সেটা টেন টাইমস বেটার, সন্ত্রাসীর হুমকি পাওয়া মাত্র টিভি থেকে শো নামিয়ে ফেলা, ইউটিউব থেকে ভিডিয়ো নামিয়ে ফেলা, ফেসবুক থেকে পোস্ট ডিলেট করে ফেলা, কর্মীকে ছাটাই করে দেয়া ইত্যাদির থেকে।
বোমায় ২০০ জনের মৃত্যু হলে তা অপূরণীয় ক্ষতি, বিশেষতঃ অসম্ভব সম্ভাবনাময় ছাত্র-ছাত্রীরা মারা গেলে তো আরও। কিন্তু এই ক্ষতি একটি সিস্টেমের, একটি দেশের, একটি প্রকাশনীর, একটি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি হয়ে যাওয়ার থেকে অনেক অনেক কম ক্ষতি।
কাজেই, টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আজ আমরা শিক্ষা নেবো।
প্রাণ গেলে যায় যাক, কখনোই সন্ত্রাসীদের হুমকির কাছে মাথা নত করবো না আমরা।
** পরিস্থিতি সন্ধ্যা পাঁচটা চল্লিশের দিকে স্বাভাবিক হয়ে আসে, যখন পুলিশ সবগুলো বিল্ডিং সুইপ করে নিরাপদ ঘোষণা করে। তবে আগামি কিছুদিন পুলিশি তৎপরতা থাকবে ক্যাম্পাসে।
১৫ই নভেম্বর, ২০২২
টেসলায় আমন্ত্রণ পাওয়া আর ওদের হেডকোয়ার্টারে ঠ্যাঙ রাখার সৌভাগ্য হলো। মনে রাখার মতো একটা অভিজ্ঞতা, অথচ এটা কোনও “কনগ্র্যাচুলেশনস” মার্কা খবর না। ঘটনা হলো, টেসলা এমন একটা গুপ্ত ইভেন্ট চালু করেছিল, যেখানে কেবলমাত্র টেক্সাসের ছাত্রছাত্রীদের আবেদন করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল (সিক্রেট ইন্টারনাল লিংক, গুগলে এসব আসে নাই)। সেই আবেদনকারীদের মধ্যে একাংশকে তারা এই ঘরোয়া পরিবেশের বিয়ে(!)তে দাওয়াত দিয়েছে।
অ্যাটেন্ডি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমেই সাইন করেছি আমরা NDA তথা নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্টে। কাজেই ভেতরে গিয়ে কী দেখেছি, কী আলাপ হয়েছে, বা কী করেছি তা বলাটা নীতিগতভাবে ঠিক হবে না (যদিও ফেসবুকে আমি নিশ্চয় তাদের টেকনিকাল আর অর্গানাইজেশনাল ফাইন্ডিং নিয়ে আলাপ করতাম না। তাও।)
এখানে সাফল্য বা ব্যর্থতার বিষয় নেই। তবুও দিনটা আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন হয়ে থাকবে, কারণ ইলন মাস্কের জার্নিটা আমার অনেক দারুণ পছন্দের একটা জার্নি। এই ঘাড়ত্যাড়া এবং একরোখা ভদ্রলোকই আজকের দিনটা এত দারুণ লাগার কিংবা উপভোগের মূল কারণ। টেসলার যে জিনিসটা আমার ভালো লাগে, প্রত্যেকটা কর্মী প্যাশনেট – কিছু না কিছু নিয়ে, সেটা তার নিজের কাজ করার জায়গা হোক বা না হোক, অনেকে একটু আউট অফ দ্য বক্স। এলন মাস্ক আউট অফ দ্য বক্স পছন্দ করেন, অ্যাজ আ কোম্পানি টেসলাও।* পাগলাচোদাদের আড্ডাখানা। এদের আমি বুঝি। এদের চারপাশে কিছুটা ‘অ্যাট হোম’ ফিল পাওয়া যায়।
ভেতরের খবর বলা যাচ্ছে না ঠিক, তবে আজকের দিনে টেসলা-কর্মী এবং বাকিদের সাথে যে কৌতুকটা প্রায়ই করতে হয়েছে –
“আমরা ভেবেছিলাম এসে দেখবো ইলন মাস্ক হচ্ছে এলিয়েন। সৌরজগতের বাইরে থেকে তিনি এসেছেন, আর NDA সাইন এজন্যই করতে হয়েছে আমাদের। ভদ্রলোকের শুঁড় দেখতে পারবো কিন্তু বাইরে এসে আর বলতে পারবো না।”
(কাল যদি আমাকে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মামলা খেতে দেখেন, বুঝবেন তিনি আসলেই এলিয়েন, আর ব্যাপারটা ফাঁস করায় আমার মুন্ডুটা গেছে।)
এই কৌতুকটা যে ভদ্রলোকের দিকে ছুঁড়লাম, তিনি ৮ বছর ধরে টেসলার সাথে আছেন। জাতীয়তায় ইরানী ছিলেন এককালে। ছাত কাঁপিয়ে হাসলেন বটে, তারপর যোগ করলেন, “আসলে টেসলায় যারা কাজ করে, সবাই-ই ভাই এলিয়েন। আমরা সবাই। যে টাইট স্কেজিউল সামলিয়ে যাচ্ছি আমরা বছরের পর বছর, ও ছাড়া সম্ভব ছিল না।”
টেসলা থেকে দেয়া স্যুভনির মডেল কার
টেসলা যাদের ড্রিম কোম্পানি তাদের জন্য টেক্সাসে পড়তে আসা একটা ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। টেসলা গিগাফ্যাক্টরি, টেক্সাস হচ্ছে বিশ্বব্যাপী টেসলার হেডকোয়ার্টার। কিছুদিন আগে পালো অ্যাল্টো, ক্যালিফোর্নিয়া (মজার ব্যাপার হচ্ছে পালো অ্যাল্টো আমার আগের অফিস অগমেডিক্সের অপারেশন রিজিয়ন ছিলো, আমি যে গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের সাথে ৪ মাস কাজ করেছি, ভদ্রলোক ওখানেই প্র্যাকটিস করতেন) থেকে সরিয়ে টেক্সাসের অস্টিনে নিয়ে এসেছেন মাস্ক। এখন টেক্সাসের অস্টিনে দুটো গ্রেট কোম্পানির হেডকোয়ার্টার – ডেল এবং টেসলা। সামনে আরও আসবে। আমি টেক্সাসের মোটামুটি ভক্ত নানা কারণে, তাদের মধ্যে এটা একটা কারণ নয় যে কোম্পানিদের হেডকোয়ার্টার এখানে, আমি ভক্ত কারণ এখানকার আবহাওয়া আমার বেশ পছন্দের। সেই সাথে ক্যালিফোর্নিয়ায় রূপান্তরিত হবার পথে হাঁটছে টেক্সাস এই সময়টায়, উত্থানটা দেখতে ভালো লাগছে। ভালো লাগার কারণ, এখনো ক্যালিফোর্নিয়া হতে পারেনি এই স্টেট, অন্তত ২০-৩০ বছর তো লাগবেই, এবং সেই সুবাদে আমরা একটু কম খরচে বেঁচে থাকতে পারছি এখানে। 😛
যাই হোক, নন-ডিসক্লোজার না ভেঙে কিছু আলাপ করা অন্তত যায়। প্রথমতঃ গিগাফ্যাক্টরি তো এমনি এমনি বলা হচ্ছে না। এটি তো আর কিলো-ফ্যাক্টরি নয়। মেগা-ফ্যাক্টরিও নয়। গিগা। এতো বড়, যেটা চোখের সামনে না দেখলে কল্পনাতে কুলায় না, যতই ভিডিয়ো দেখুন না কেন ইউটিউবে কিংবা এরিয়াল শট থেকে।
দ্বিতীয়তঃ ওটা গিগাফ্যাক্টরি তো বটেই, দুর্গও বটে। এমপ্লয়ী ছাড়া আর কেউ ওখানে মাথাটা গলাতে পারবেন না। আমাদের ওরিয়েন্টেশনের জন্য ওরা একটু পাশে কিছু ট্রেইলার জড়ো করেছিল, নইলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসপিওনাজে ছেয়ে যেত হয়তো দুনিয়া। যাতায়াতের খরচ টেসলা বহন করেছিল আমাদের, উবার-ভাউচার, দুটো রাইডের জন্য, টু-অ্যান্ড-ফ্রম গিগাফ্যাক্টরি।
গিগাফ্যাক্টরির বিশালত্ব প্রকাশে একটা কথোপকথনই মনে হয় যথেষ্ট। আমাদের ওই মাগনা (টেসলার পয়সায়) উবার রাইডে সাথে ছিলো ঋভু ভাই (চুয়েট ’১০) আর জাবেদ ভাই (রুয়েট ’০৮) – আমি উনাদের দিকে ঘুরে কেবল বললাম, “ভাই, যদি ওয়েলকাম সেন্টারে পৌঁছাবার পর যদি দেখি টেসলার পোলাপান বলতেছে আমাদের ফ্যাক্টরির অন্যপ্রান্তে হেঁটে যেতে হবে, আমি ভাই সোজা দুসরা ভাউচার বের করে বাড়ি ফিরে যাবো। লাগবে না ডেমো দেখা।”
ম্যাসিভ!
দারুণ উপভোগ্য দিনটা আসলে উপভোগ্য হয়েছে মূলতঃ কথোপকথনের জন্য। প্রচুর আলাপ করেছি প্রচুর মানুষের সাথে। কিন্তু সেসব আলাপের টুঁ শব্দটাও বাইরে বলা যাচ্ছে না, এনডিএ। সঙ্গে পেলাম টেসলার মডেল কার, দারুণ একটা স্যুভনির। জীবন ভবিষ্যতে আমাকে যেখানেই নিয়ে যাক, দারুণ একটা দিন হিসেবে স্মৃতির পাতায় এই ২১শে এপ্রিল থাকবে বহুদিন।
টেসলাকে ধন্যবাদ।
* তবে সমস্যা হচ্ছে, কোনটা রাইট কাইন্ড অফ আউট অফ দ্য বক্স, আর কোনটা রং – তা জানা কঠিন। আউট অফ দ্য বক্স জিনিসটা অনেকটা হিট অ্যান্ড মিস।
** টেসলার ভেতরে হুদাই গুঁতাগুঁতি করার সুযোগ আমরা সবাই পেয়েছিলাম, সেই মুহূর্তের ছবি স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন ঋভু ভাই।