KP Imon

Words Crafted

গোয়েন্দাগিরি

বিরক্তির সাথে চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।
“কখনও কি ভেবেছ বন্ধুর চেয়ে একটুখানি –”
ব্যাস! শেষ।
আর কিছু নেই লেখা।
বন্ধুর চেয়ে একটুখানি কি? বেশি নাকি কম?
ভ্রু কুঁচকে ও দু’সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে আরও। তারপর পাশে বসা জুয়েলের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়।
‘গুতাস ক্যারে?’ মোটাসোটা শরীরটা আরেকটু দুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে জুয়েল।
‘আরে কান্ডটা দ্যাখ!’ ওর হাতে গুঁজে দেয় কাগজের টুকরোটা।
‘কোথায় পাইলি?’
‘ব্যাগের মধ্যে ঢুকানো ছিল। কলম রাখি যে পকেটে।’
‘কে পাঠাইছে লেখা নাই তো।’
‘তুই বের করতে পারবি না?’
‘খাড়া খাড়া জিনিসটা বুইঝা লই।’ মোটা শরীরটা একটু ঘুরিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে জুয়েল।
বেশ কিছুক্ষণ কুঁতকুঁতে চোখ মেলে তাকিয়ে মিনিট পাঁচেক দেখে মাথা নাড়ে। আগ্রহের সাথে এই পর্যবেক্ষণ দেখছিল তাহমিদ। আর ধৈর্য রাখতে পারে না ও।
‘কিছু পেলি?’
‘হুম!’ মাথা তুলে জুয়েল।’ কিন্তু আগে বলুম না। তুইও দেখ। তারপর একলগে।’
তাহমিদও ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে আটকে দেখতে যাবে – এই সময় ক্লাসে ঢুকে পড়লেন দেবনাথ স্যার। ইনি ইংরেজী পড়ান। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়ে আবার বসে পড়ে।
কলেজে আধ-ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকের পর এই প্রথম ক্লাস। লাঞ্চ ব্রেকের আধ-ঘন্টার মাঝেই কেউ চালিয়ে দিয়েছে এই চিরকুট। দেবনাথ স্যার এখন অ্যাটেনডেন্স নেবেন।
নিজের রোলটা পার হয় যেতেই আবারও ঝুঁকে পড়ে তাহমিদ কাগজটার ওপর। হাতে আতশী কাচ। পাশের সারি থেকে ওদের ভাব ভঙ্গী দেখে মুচকি হাসে প্রিয়াংকা আর কেয়া।
‘উমম…’ মাথা তোলে এবার তাহমিদ।’ যদিও তুই-ই ক্লাসের একমাত্র গোয়েন্দা। তবুও আমিও চেষ্টা করে দেখি… ম্যাটাডোর কলমে লেখা, উমম… কাগজটা কাটা হয়েছে হাতে ছিড়ে… উহু, থুতুতে ভিজিয়ে, আর্দ্র কাগজের কোণা শক্ত হওয়ার লক্ষণ থেকে যায়… আর এইটা ডাক্তারী প্যাড থেকে ছেঁড়া একটা কাগজ। অ্যাম আই রাইট?’
‘সাবাশ!’ গোবদা হাত দিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দেয় জুয়েল।’ প্রায় সবকিছুই ধইরা ফেললি! আরেকটা জিনিস বাকি – লেখাটা একটা মাইয়ার। সম্ভবতঃ – হাতের লেখা পাল্টাইছে যে লেখছে। মানে তোর পরিচিত ওই মাইয়া। আর না পাল্টাইলে অন্য কাওরে দিয়ে লেখাইছে।’
জুয়েল কলেজে গোয়েন্দা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
একমাস আগে চুরি হয়ে যাওয়া মকসুদের মোবাইলটা বের করতে জুয়েলের লেগেছিল সাড়ে তেতাল্লিশ ঘন্টা। আর আড়াই দিন আগে বোর্ডে লেখা অশ্লীল বাক্যের রচয়িতাকে ওর বের করতে লেগেছিল আড়াই মিনিট। কিন্তু বেচারার ওজন একশ দশ কেজি। কলেজ শুরুর প্রথম কয়েক সপ্তাহে ওর নিকনেইম ‘ভোটকা’ হয়ে গেছিল, তবে কেসগুলো সমাধানের পর থেকে সবাই ওকে সমীহের চোখে দেখা শুরু করেছে। এই পর্যন্ত কলেজের সাতটি রহস্যের সমাধান করেছে সে। সমাধানের হার শতভাগ।
সেই জুয়েলের পাশে বসে তাহমিদের ব্যাগে অপরিচিত নোট লিখে যাবে কোন একজন – জুয়েলের ভাষায় – ‘মাইয়া’ – আর কালপ্রিটকে ধরতে পারবে না ওরা – এ তো সাংঘাতিক লজ্জার কথা। কিন্তু এই দফায় চ্যলেঞ্জ করতে বাধ্য হয় তাহমিদ।
‘কোন মেয়ের লেখা – আর তাও সেটা হাতের লেখা পাল্টে? এগুলো কিভাবে বললি?’
‘খেয়াল করলে তুইও পারতি।’ মামুলি কাজ করে ফেলেছে – এরকম ভাবে নাক-মুখ কোঁচকায় জুয়েল।’ হাতের লেখার ধাঁচ ওরকম মাইয়াগোরই হয়। লেখা নিয়ে সৌখিনতা পোলারা করে না এত… মানে, সাধারণতঃ। মাইয়াগো লেখা জঘন্য হলেও দেখবি একটা সাজানো-গোছানো ধরণ আছে। ওইটা দিয়া বোঝা যাইতেছে লেখছে একটা মাইয়া। আর অপরিণত ভাবটা খেয়াল কর – হয় ছোট বাচ্চায় লেখছে – অথবা মাইয়া নিজেই নিজের লেখা পাল্টানোর চেষ্টা করছে। শিওর!’
এবারে কিন্তু তাহমিদই অভিভূত হয়ে যায়।
‘সাবাশ দোস্ত!’ জুয়েলের পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলে ও।’ বেশ উন্নতি হয়েছে রে তোর -’
‘চমৎকার!’ দেবনাথ স্যারের গলায় প্রশংসার চাইতে ব্যাঙ্গই বেশি প্রকাশ পেল।’ ক্লাস শুরু হতেই পিঠ চুলকে দিচ্ছ একে অন্যের! কি মোহাব্বত! দাঁড়িয়ে থাক তোমরা দুইজন।’
‘ওহ শিট!’ বিড় বিড় করে তাহমিদ।
হেসে কুটি কুটি হয় প্রিয়াংকা আর কেয়া।

কলেজ থেকে বের হয়ে জুয়েলের হাতে কাগজটা তুলে দেয় তাহমিদ।
‘দোস্ত এভিডেন্সটা তুই বাসায় রাখ। পরে কাজে লাগতে পারে।’
‘আমার কিন্তু এরই মধ্যে একজনরে সন্দেহ হয় দোস্ত।’
‘আরে আরও তথ্য প্রমাণ দরকার।’ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তাহমিদ।’ ওই যে প্রিয়াংকা চলে এসেছে। যা তুই। কাল দেখা হবে।’
হতাশায় মাথা নাড়ায় জুয়েল। জুয়েলের বাসা একদিকে আর বন্ধুবরের আরেকদিকে। আবার ওদিকে তাহমিদের পাশের বাসায় থাকে প্রিয়াংকা। কলেজে যাওয়া আসাটা তাই একসাথেই হয়। বাসে উঠে পাশাপাশি বসল ওরা। এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে খোঁচাতে ছাড়ে না প্রিয়াংকা।
‘ক্লাসে দেখলাম কি একটা কাগজ নিয়ে শার্লক হোমসগিরি ফলাচ্ছিস তোরা।’
‘কই না তো!’ আপত্তি করার চেষ্টা করে তাহমিদ।
‘কি ছিল রে? কেউ প্রেমপত্র দিয়েছে নাকি? বেনামী?’ মজা পায় প্রিয়াংকা ওকে বিব্রত হতে দেখে।
‘এক রকম। লাঞ্চ-টাইমে কেউ আমার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল।’ স্বীকার করতে বাধ্য হয় তাহমিদ। তারপরই লাফ দিয়ে সোজা হয়ে বসে।’ তুই জানলি কি করে? তোর কাজ এইটা?’
‘তোকে প্রেমপত্র দিতে বয়েই গেছে তো আমার!’ চোখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা চলে যায় প্রিয়াংকার।’ জানব কি করে? গেস করেছি। যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলি। তাছাড়া লাঞ্চ-টাইমের বেল বাজতেই ক্লাস থেকে কেয়ার সাথে বেরিয়ে যাই আমি।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, ‘তাইলে তো তোর এবার হয়েই যাবে।’
‘মানে কি! কি হবে আমার?’ সপ্তম আসমান থেকে পড়ে যেন তাহমিদ।
‘ওই চিঠি তোকে দিলে তো ক্লাসের কোন মেয়েই দিয়েছে তাই না? প্রেম হবে তোর।’
‘শোন!’ জোর গলায় বলে তাহমিদ, ‘যেই মেয়ের সামনে এসে বলার সাহস নাই – এরকম মুরগির কলিজাওয়ালা মেয়ের সাথে আমি প্রেম-ট্রেম করতে পারব না। আমার প্রেমিকা হবে অনেক সাহসী। হুহ!’
‘এহহ!’ তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ জানায় প্রিয়াংকা।’ যেই না উনার সাহস। আর চায় সাহসী প্রেমিকা!’
প্রিয়াংকাকে কিল দেয় তাহমিদ।
‘আবার মারেও অবলা একটা মেয়েকে।’ অভিমানী গলায় বলে ও।
আরেকটা কিল দেয় তাহমিদ।
বাস ছুটে চলে।

পরদিন লাঞ্চ-টাইম থেকে ফিরে এসে ব্যাগ খুলে এবার রীতিমত আর্তচিৎকার করে ওঠে তাহমিদ।
‘ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন?’ বিরক্ত হয় জুয়েল।
‘আমি মোটেও চেঁচাচ্ছি না!’ ষাঁড়ের মতই চেঁচিয়ে বলে এবার তাহমিদ।’ এইটা দ্যাখ!’
বেশ বড় একটা খাম। তার মাঝে একটা মাত্র পাতার চিঠি। সেটা বড় কথা না। চিঠিটা রক্তে লেখা।
‘তাহমিদ,
এতদিন ধরে পাশে রেখেছ। বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবোনি কোনদিন। হয়ত বড়জোর আরও একটা বছর পাশে পাব তোমায়। কিন্তু আমি যে তোমায় বন্ধু ভাবতে পারি না আর। ভালোবাসি তোমায় এতটা। মুখে বলে বন্ধুত্বটা নষ্ট করে ফেলতে চাই না। তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। বন্ধুর থেকে বেশি না ভাব – আমি ভালোবেসে যাব তোমায় – আজীবন।’
‘আমি তো মাননীয় স্পীকার হইয়া গ্যালাম!’ নিজ ভাষায় বিড় বিড় করে জুয়েল। মোটাসোটা শরীরটা একেবারে পাথর হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়।
‘নাম নেই।’ চোখ তোলে তাহমিদ।’ কে হতে পারে।! কে? জানাটা দরকার। এত পাগলামী কেন করবে?’ একসেকেন্ড ভেবে ডাক দেয়, ‘মাননীয় স্পীকার!’
‘হ!’ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয় জুয়েল।
‘এই চিঠিকে এভিডেন্স ধরে কি পাচ্ছিস? আমাকে জানা।’
চিঠি ধরে উলটে পালটে দেখে জুয়েল। তারপর নিরাশ হয়ে মাথা নাড়ে।
‘ডিএনএ টেস্ট করা লাগব!’
‘বসে আছিস কেন? করে আন!’ তাড়া দেয় তাহমিদ।
‘আমারে কি তোর সিআইডির লোক মনে হয় দেইখা?’ ঝাড়ি মারে ওকে জুয়েল। হঠাৎ আগ্রহের সাথে খামটা তুলে নেয়।’ তয় – এই খাম আমগোরে লীড দিবার পারে।’
‘খামে কোন ঠিকানা ছিল না, মি. স্পীকার।’
‘ওই আমারে স্পীকার কইবি না। হইয়া গেছিলাম। এখন নাই আর।’ বলে জুয়েল গোবদা হাত দিয়ে পিঠে একটা চাপড়ও দেয় তাহমিদকে।
আবার বলে তারপর, ‘ঠিকানা নাই – কথা সত্য। কিন্তু খামে গন্ধ থাইকা যায়। শুইকা দেখ!’ তাহমিদের দিকে আগ্রহের সাথে খামটা বাড়িয়ে দেয় ও।
‘আমি বাবা রক্তের গন্ধ-টন্ধ শুঁকতে পারব না।’ নাক মুখ কোঁচকায় তাহমিদ।’ তোর মন চাইলে তুই নাক ডুবিয়ে বসে থাক!’
অক্ষরে অক্ষরে তাহমিদের নির্দেশ পালন করে জুয়েল। নাকটা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকে মিনিট তিনেক। তারপর মুখ তোলে।
‘একটা বডি পারফিউমের গন্ধ পাইছি। তুই শুইকা দেখ।’
‘মরলেও না!’ তারস্বরে প্রতিবাদ জানায় তাহমিদ।
হাতির পায়ের মত হাত দিয়ে ওকে চাপড়িয়ে উৎসাহ দেয় জুয়েল। শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই খামের গন্ধ শোঁকা উত্তম – হাত বাড়ায় তাহমিদ। একমিনিট পর মাথা তোলে।
‘গন্ধটা আমার পরিচিত। দোস্ত – কালকে তুই কাকে যেন সন্দেহের কথা বলছিলি?’
‘কইতাম কিন্তু রাগ করতে পারবিনা কইলাম!’ গ্যারান্টি চায় জুয়েল।
‘না করব না। বল?’
‘আমার তো প্রিয়াংকারে ধুমাইয়া সন্দেহ হইতেছে।’
‘আরে নাহ।’ আপত্তি জানায় তাহমিদ নিজেই।’ কাল ওকে চার্জ করেছিলাম। কিন্তু ও সবার আগেই লাঞ্চ করতে বের হয়ে যায়। আজও আমার সন্দেহ যায়নি – তাই খেয়াল করেছি – সবার আগে ও আর কেয়া বেড়িয়ে যায় ক্লাস রুম থেকে।’
‘আরে বলদা রে!’ তাহমিদের বুদ্ধির প্রশংসা করে জুয়েল।’ এরা বাইর হইয়া বাইরে ছিল কোথাও আশে পাশেই – আমরা বাইর হতেই আবারও লাফায়া ঢুকছে! ‘
‘হুম…’ টোকা দেয় তাহমিদ টেবিলে, ‘লাফিয়ে না ঢুকলেও – আমরা যাওয়ার পরে ঢুকতেই পারে…’
হঠাৎ জুয়েলের পাহাড়ের মত শরীরটা শক্ত হয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে, ‘তাহমিদ, দ্যাখ!! প্রিয়াংকার ডান হাতের দিকে তাকা!’
তাকিয়ে চমকে যায় তাহমিদ। প্রিয়াংকার ডান হাতের তর্জনী পেঁচিয়ে আছে ব্যান্ডেজে। হাত কেটে গেছে?
নাকি নিজে থেকে কেটে চিঠিটা লিখেছে ও?

‘আজ পারলে প্রিয়াংকারে একটু গুঁতায়া বাইর করার চেষ্টা কর দোস্ত।’ সাজেশান দেয় জুয়েল ওকে।’ মুখে কইব না যখন তখন গুতাইন্নাই লাগব। হুদাই কষ্ট পাইব ক্যান?’
‘হুঁ।’ সায় দেয় তাহমিদ।
‘রক্তের চিঠিটাও কি আমি নিয়া যামু? এভিডেন্স তো।’
‘না। ওটা আমার কাছেই থাকুক।’
‘মাইয়াটারে আবার বাসে বেশি জেরা করিস না। যদি আমাদের সন্দেহ ভুল হয় তাইলে কিন্তু ইজ্জত মার্ডার।’
‘আচ্ছা।’ তাহমিদের গলার স্বর আজ পরিবর্তিত।
দেখে সন্তুষ্ট হয় জুয়েল। ছেলে প্রিয়াংকাকে জেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেসটা আনসলভড থেকে যাবে এই ভয়টা ছিল ওর। বাসে উঠে ওই ব্যাপারে প্রিয়াংকাকে খোঁচানোর কোন সুযোগই পেল না আজ তাহমিদ।
‘অ্যাই তোর হাত কিভাবে কেটেছে?’ সরাসরি প্রশ্ন করে ওকে।
‘কাল রাতে মাছ কাটতে গিয়ে। কাটাকাটি পারি না তো!’ হাই চেপে বলে মেয়েটা।
‘ওহ।’ কি বলবে ভেবে পায় না তাহমিদ।
‘কাল সারা রাত ঘুমাইনি রে।’ চোখ বোজে ও।’ আমি চোখ বন্ধ করে থাকি একটু।’
প্রিয়াংকার চোখ খোলার অপেক্ষায় থাকে তাহমিদ। কিন্তু কিসের কি! বলতে বলতেই পাঁচ মিনিটের মাঝেই ঘুম!
‘স্বাভাবিক। সারা রাত কেটেছ হাত।’ মনে মনে বলে তাহমিদ।’ গতকাল আমার সাহসী প্রেমিকা লাগবে বলাই উচিত হয় নাই।’
মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর। বাস তখন দাঁড়িয়ে জ্যামে। দশ মিনিটের দূরত্ব পার হতে এভাবেই লাগায় আধঘন্টা। আলতো করে প্রিয়াংকার ঘুমন্ত মাথাটা ঢলে পড়ে তাহমিদের কাঁধে।
সরাতে গিয়েও সরায় না ও।
খামের মধ্যে পাওয়া সুগন্ধটা তীব্রভাবে নাকে আসে ওর।
ঘুমন্ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ বড় মায়া হয় তাহমিদের। মুখ ঢেকে দেওয়া এক গুচ্ছ চুল সরিয়ে দেয় ও পরম মমতার সাথে।

পরদিন সকাল।
লাইব্রেরীর এক নির্জন কোণা বেছে নিয়েছে প্রিয়াংকা আর তাহমিদ। আজ যা বলে ফেলতে চায় তাহমিদ ওকে। জুয়েলটাকেও আসতে বলেছে। কিন্তু হোৎকাটা দেরী করছে। অস্বাভাবিক কিছু না অবশ্য। “যতই স্থুল হবে তুমি – গতিবেগ ততই কমবে তোমার” – নীতিতে বিশ্বাসী তাহমিদ; জুয়েলের দেরী গ্রাহ্য না করে তাই আসল কথায় চলে এলো।
‘প্রিয়াংকা – তোর সাথে কিছু কথা ছিল।’
‘আমারও।’ কেমন যেন নিস্তেজ গলায় বলে প্রিয়াংকা আজ।
নিশ্চিত হওয়ার এই সুযোগ ছাড়ে না তাহমিদ। সন্দেহ ভুল হলে; অর্থাৎ প্রিয়াংকা ওই চিঠিগুলো না পাঠালে বেশ লজ্জার একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। তাহমিদ যে মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে – নিজের কাছে তো আর লুকাতে পারছে না। গতকাল বাসে বসে অনুভূতিটা বুকের ভেতর একেবারে লাফালাফি শুরু করেছিল। ভাগ্যিস – ঘুমাচ্ছিল প্রিয়াংকা। নইলে কেলেংকারী হয়ে যেত!
‘বল তাহলে।’ প্রিয়াংকাকে আগ বাড়িয়ে চাল দেবার আহবান জানায় তাহমিদ।
‘তোর দিকে আজকাল অনেক মেয়ে নজর দেয়।’ শ্রাবণের মেঘ জমে প্রিয়াংকার মুখে।’ আমার এসব একেবারে সহ্য হয় না।’
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।
‘তোকে ভালোবাসি আমি, তাহমিদ!’ মুক্তোর মত একফোঁটা পানি পড়ে প্রিয়াংকার গাল বেয়ে।
‘অ্যাই বোকা মেয়ে! কাঁদছিস কেন?’ তাড়াতাড়ি ওর হাত ছোঁয় তাহমিদ।’ তোকে এটা বলতেই আজ এখানে এনেছি। কখন জানি তোর প্রেমে পড়ে গেছি আমিও। দেখ তো কি রকম গাধা আমি!’
চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলে প্রিয়াংকা। এই সময় লাইব্রেরীতে ঢোকে জুয়েল। প্রিয়াংকার কান্না-হাসির সাথে ওদের হাতে হাত ধরে রাখা দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেলে ও। বিশাল শরীরের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র দাঁতগুলো ঝিলিক মারে। গোয়েন্দা জুয়েলের এতটা আনন্দিত চিত্র আগে কখনও দেখেনি কেউ।
‘তুই একটা পাগলি, প্রিয়াংকা!’ এবার আলতো ধমক দেয় ওকে তাহমিদ।’ আমাকে সরাসরি বলতেই পারতি। নোট রেখে গেছিস তাও মানা যায়। তাই বলে হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে চিঠি লিখাটা বাড়াবাড়ি করেছিস! এরপর যদি আর…’
প্রিয়াংকার মুখে নিখাদ বিস্ময় দেখে থেমে যায় তাহমিদ।
‘তুই ভাবিস আমি ওই চিঠি রেখে তোকে মিথ্যা করে বলেছি? আর কিসের রক্ত মাখা চিঠি?’
‘তুই লিখিসনি বলতে চাস…’ এক সেকেন্ড ভাবে তাহমিদ।’ তাই তো! আমি আগে কেন বুঝিনি?! স্বস্তি লেখা ছিল চিঠিতে।’ পকেট থেকে বের করে চিঠিটা।
“…তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না…” লাইনটা দেখায় প্রিয়াংকাকে ও।
‘কলম দিয়ে ‘স্বস্তি’ লেখাটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে। কিন্তু কেউ হাত কেটে স্বস্তি লিখবে না। প্যাঁচ দেখেছ? এরচেয়ে প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। এইটা এই মোটকুর কাজ। নির্ঘাত!’
একটা কলম বন্দুকের মত তাক করে ও জুয়েলের দিকে।
‘আরে আরে চ্যাতস ক্যারে?’ হাহাকার করে ওঠে জুয়েল।’ দেখলাম তোগোর ভিতরে ভালোবাসা পাঙ্খা মেলতেছে কিন্তু কইতেছস না একজন আরেকজনরে তাই ক্যাটালিস্ট দিছি জাস্ট।’
‘দাঁড়া বলিস না।’ হাত তুলে ওর দিকে তাহমিদ।’ আমার পিছে বের হওয়ার সময় তুই ভেতরে খাম ঢুকাইছিস এইটা তো পানির মত সোজা। আর লিখাইছিস তোর ছোটবোনকে দিয়ে, প্রথম চিঠিটা। আর রক্ত… উমম রক্তের ব্যাপারটা নিশ্চয় আঙ্কেলের কাছে ব্লাডব্যাগ হাতাইছিস। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। খামের মধ্যে বাসা থেকে পারফিউম মেরে এনেছিলি সেটা তো বোঝা সহজ। অ্যাম আই রাইট?’
‘পুরাই।’ মাথা নাড়ায় জুয়েল। ওর বাবা একজন বায়োলজিস্ট।’ ব্লাড ব্যাংকের কিছু নষ্ট হওয়া স্যাম্পল নিয়া বাবা কাজ করতাছিল। ওইদিন গেলাম দ্যাখা করতে। দেখি একটা থাইকা গেছে কাজ শেষেও। নিয়া আইতে চাইলাম। দিয়া দিল। তখন থেকেই মাথায় ঘুরতাছে প্ল্যানটা।’
‘ইয়াহ!’ আনন্দে মাথা ঝাঁকায় তাহমিদ। ‘এইটা আট নম্বর।’
‘দাঁড়া দাঁড়া!’ ধরে ফেলে প্রিয়াংকা, ‘কলেজ কেসগুলো তুই সব সলভ করেছিলি, তাই না তাহমিদ? তারপর জুয়েলকে দিয়ে বলাইছিলি? কেন?… ওহ!’ নিজেই ধরতে পারলো প্রিয়াংকা এই প্রশ্নের উত্তর, ‘ওকে যাতে সবাই সমীহ করতে বাধ্য হয় তাই–’ এক মুহূর্ত থেমে নতুন দৃষ্টিতে দেখে আজ প্রিয়াংকা তাহমিদকে। তবে ওই একমুহূর্তই।
‘তুই একটা ইবলিশ রে!’ প্রিয়াংকা তাহমিদকে কিল দেয় এবার।
‘তোর মাথা।’ এড়িয়ে যাতে চায় তাহমিদ।
আবার কিল দেয় ওকে প্রিয়াংকা।
এই দুইটা এইভাবে আজীবন খুনসুটি করুক।
একমুখ হাসি নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে আসে জুয়েল। বুকে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি।

রচনাকাল – ২৯শে ডিসেম্বর, ২০১৩

ত্রাণকর্তা

নির্জন গলিটায় ঢুকে তৃষ্ণার গা ছমছম করে উঠলো আজ। অথচ এখানে সে প্রতিদিনই আসে। গলির শেষ মাথায় তার গন্তব্য। কেমিস্ট্রি পড়তে এ গলিতে পা রাখতে হয় সপ্তাহে তিনদিন। মাত্র তিনমাস পর ওর এইচএসসি পরীক্ষা।

আজও পাঁচ মিনিট লেট! প্রতিদিন লেট করার ব্যাপারে তৃষ্ণার খ্যাতি আকাশছোঁয়া। অনেকক্ষণ ধরেই দ্রুত পা চালাচ্ছে, তবে এখন আরও জোরে ছুটলো। তখনই প্রথমবারের মত খেয়াল করল, গলিটা পুরোপুরি নির্জন নয়! পা চালিয়ে সামনের আড্ডারত তিন যুবকের পাশ কাটানোর চেষ্টা করতেই পাশ থেকে ঠান্ডা কন্ঠস্বরটা শোনা যায়।

‘তাড়া কিসের, সুন্দরী?’

ইভটিজারদের মুখের ওপর কিছু একটা না বলে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে – এমনটা তৃষ্ণার শত্রুও বলতে পারবে না। কড়া একটা জবাব দিতে ওদের দিকে ফিরেছিল সে, পরমুহূর্তে থমকে গেল। হ্যাংলা ধরণের যুবকের হাতে একটা পিস্তল।

‘ভ্যানিটিব্যাগটা আমাদের দিয়ে যেখানে খুশি যেতে পার। আমাদের সাথে আসলেও আপত্তি করব না।’ মিটি মিটি হাসে যুবক। পেশাই নয় শুধু – ছিনতাই এর নেশা – চোখই বলে দিচ্ছে।  দ্বিধা করল তৃষ্ণা। ব্যাগের ভেতর আড়াই হাজার টাকা আছে – সেজন্য নয় – ভেতরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে ওর গ্যালাক্সি এস-থ্রি।

ক্রিক ক্রিক করে কাগজ কাটার ছুড়ি বের করে আরেক যুবক। ‘মনে হচ্ছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়নি এখনও আপনার কাছে, আপু।’

আলতো করে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামায় বেচারি। কিন্তু ‘হ্যান্ডওভার’ করার লক্ষণ দেখা যায় না। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে কিনেছিল ও স্মার্টফোনটা। চোখে পানি চলে আসে তৃষ্ণার।

কাঁধের কাছে ভরাট একটা কন্ঠ শুনতে পায় এই সময়।

‘এখানে কোন সমস্যা?’

চারজনই ঘুরে তাকায় শব্দের উৎসের দিকে। পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে এক তরুণ। এলোমেলো সিল্কি চুল কপাল ঢেকে রেখেছে। চোখ দুইটায় শিশুর সারল্য। নির্ভীক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

‘কেটে পড় ছোকরা! তোমার মাথা ঘামানোর মত কিছু নয়।’ পিস্তল নাচায় প্রথম যুবক।

‘প্রাইভেট প্রোপার্টিতে দাঁড়িয়ে নাকি আমি?’ খুবই অবাক হয়েছে এমন ভাবে বলে তরুণ। ভয়ানক আত্মবিশ্বাসটা খুবই আকর্ষণীয় লাগে তৃষ্ণার, ‘কই? কোন সাইনবোর্ড তো দেখলাম না।’

এক পা আগায় পিস্তলধারী। চোখমুখ বিকৃত করে অনুচ্চস্বরে বলে, ‘হিরো দেখা যায়!’ তারপর হাত বাড়িয়ে পিস্তলটা তাক করে তরুণের মাথায়, “চান্দু – তোমার মানিব্যাগটাও বের কর। মেয়েদের সামনে তারপর যত মন চায় স্মার্টনেস দেখাতে পারবে। নাহলে আল্লাহর কসম – গুলি করব আমি।’

‘প্রথমতঃ আমি চান্দু নই–’ দুই পা আগায় ছেলেটা। একটু বামে সরে তৃষ্ণাকে আড়াল করল। ‘দ্বিতীয়তঃ-’ হঠাৎই পা চালাল সে ওপরের দিকে। পিস্তলধারীর হাতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানে ছেলেটার জুতোর ডগা, সেই সাথে হাতও চালিয়েছে তরুণ। পেটের নিচে বেমক্কা এক ঘুষিতে বাঁকা হয়ে গেছে হ্যাংলা পিস্তলধারী। তার সামনেই ঠকাস করে পরে গেল আগ্নেয়াস্ত্রটা। নিখুঁত এক লাথিতে ওটাকে খোলা ম্যানহোলের দিকে পাঠিয়ে দিল তরুণ – তারপর শেষ করল বাক্যটা, ‘পিস্তল থাকলে তো গুলি করবে।’

সবটা এত দ্রুত ঘটে গেল, তৃষ্ণা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

কলিগের(!) দুরবস্থা দেখে লাফিয়ে এগিয়ে আসে ছুরিধারী। বাতাসে সাঁই করে চালায় ছুরি। চোখ বন্ধ করে ফেলল ও।

কিন্তু একটুও ঘাবড়ায় না তরুণ। একটু সরে গিয়ে ব্যর্থ করে দেয় ছুরিধারির প্রচেষ্টা। গলায় মাপমত একটা কোপ দেয় ডান হাত বাড়িয়ে। ছুরি ফেলে দিয়ে নিজের গলা চেপে ধরে দ্বিতীয় ছিনতাইকারী। রীতিমতো ককাচ্ছে। তৃতীয়জনের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে ততক্ষণে। গলির শেষমাথা যেদিকে কাছে সেদিকে দুই পা খুলে ছুট লাগিয়েছে সে। তাকে রেসে হারানোর জন্য মরিয়া হয়ে ছোটে বাকি দুইজনও।

‘অ্যামেচার সব।’ হাসিতে ফেটে পড়ে তরুণ। পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করেছে সে – বোঝাই যায়।

‘থ্যা- মেনি মেনি থ্যাংকস!’ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে তৃষ্ণা। ‘আপনার কোথাও লাগে নি তো?’

‘আরে নাহ। দারুণ মজা পেলাম। আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’

‘সামনেই। রিয়াজ স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়ি।’

‘আপনি চাইলে পৌঁছে দিতে পারি।’ প্রস্তাব দেয় ছেলেটা।

‘আসবেন? আসুন।’ ভয় যায় না তৃষ্ণার।

চুপচাপ হাঁটে ওরা কিছুক্ষণ , ‘ফিরে যাব কিভাবে ভাবছি।’

‘ব্যাচমেটদের সাথে বেরিয়ে পড়বেন। একা কাওকে ধরে না ওরা। ভয় পাবেন না।’

‘ওহ – পরিচয়ই দেওয়া হয় নি আপনাকে। আমি তৃষ্ণা।’

‘নাফীস। এটাই উনার বাসা?’

‘হু। মেনি মেনি থ্যাংকস ভাইয়া। আপনি না থাকলে কি হত ভাবতেও ভয় হচ্ছে।’

‘আরে ধুর। এত থ্যাংকস বলার মত কিছু না।’ হাসে নাফীস। ‘চলি তাহলে, ভালো থাকবেন।’

*

তিনদিন পর।

সানগ্লাসে চোখের সাথে মুখেরও অর্ধেকটা ঢেকে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে তৃষ্ণা।

কানে ইয়ারফোনে ফুল ভলিউমে গান চলছে। এই অপেক্ষার মুহূর্তগুলো রীতিমত বিরক্ত লাগে ওর কাছে। 

সোজা ওর দিকে ছুটে আসা মোটরসাইকেলটা চোখে পড়েনি ওর। রাস্তার মানুষের সতর্ক চিৎকারও কানে আসে না, চাপা পড়ে গেছে গানের বিকট শব্দে। শেষ মুহূর্তে তাকিয়ে দেখতে পায় মাথার-স্ক্রু-খুলে-যাওয়া বাইকারের ওর দিকে ছুটে আসা। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকে ও।

বলিষ্ঠ একটা হাত টান দিয়ে সরিয়ে নেয় ওকে। কান থেকে ইয়ারফোন সরিয়ে দিয়ে ধমকের সুরেই বলে, ‘বিপদের দিকে আপনার আকর্ষন একটু বেশি-ই মনে হয়?’

নাফীসকে চিনতে পারে এতক্ষণে তৃষ্ণা। মাত্র একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ায় শরীরের কাঁপুনি লুকোয় ও কোনমতে।

‘আরে আপনি!’

‘সৌভাগ্যক্রমে।’

‘বিপদগ্রস্থের পাশে গায়েব থেকে চলে আসার ক্ষমতাও আপনার অসাধারণ।’ অপ্রতিভ ভাবটা কমাতেই তৃষ্ণা হাসে একটু, ‘দিন দিন আপনার প্রতি ঋণ আরও বেড়ে যাচ্ছে আমার।’

‘একটু সাবধানে চলা ফেরা না করলে তো সামনের জন্মদিন আর চোখে দেখবেন না।’ ভৎর্সনার সুরেই বলে নাফীস। ‘এখন যাচ্ছিলেন কোথায়? ফিজিক্স প্রাইভেট?’

‘না। পাইকপাড়ায়  আপুর বাসায় যাচ্ছিলাম।’ হেসে ফেলে তৃষ্ণা। ‘আপনি?’

‘সনি সিনেমা হলে বন্ধুরা ডাকল বলে বের হলাম। কিন্তু মাঝপথে আপনার সুইসাইড অ্যাটেম্পট দেখতে হবে ভাবিনি।’

‘অনেক রেগে আছেন মনে হচ্ছে। এই যে প্রমিজ করলাম, আর কোনদিন কানে ইয়ারফোন নিয়ে রাস্তাঘাটে বের হব না।’

একটা ভ্রু উঁচু করে নাফীস।

‘আচ্ছা – নির্জন গলিতে ছেলেদের জটলাও এড়িয়ে চলব। প্রমিজ।’

‘গুড। আপনার সামনের জন্মদিন দেখার ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বাস এসে পড়েছে। চলুন উঠা যাক।’

বাসে উঠে সমানে বকবক করে যায় দুইজনই। কথার ধাক্কায় কখন ‘আপনি’ থেকে দুইজনই ‘তুমি’তে নেমে এসেছে সেটা অবশ্য খেয়ালই করে  না কেউ।

এরই মধ্যে তৃষ্ণার জানা হয়ে গেছে নাফীসরা দুই ভাই। নাফীসের বাবা পিডিবির সিনিয়র অফিসার। নাফীস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নাফীসের প্রিয় রঙ কি – কোথায় ওর স্কুল কলেজ ছিল – কোথায় কোথায় ওর বাবা ট্রান্সফার হয়েছে – এখন কোথায় থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। নাফীসের জ্ঞানভান্ডারও যে কিছুটা সমৃদ্ধ হয়নি – তা নয়! নাফীসের একদম মামুলি কথাগুলোও তৃষ্ণার কাছে অনেক ইন্টারেস্টিং লাগে। অকারণেই হেসে কুটি কুটি হয় ও।

‘আপনার মোবাইল নম্বরটা দেওয়া যাবে? যদি সমস্যা না থাকে কোন?’ পাইকপাড়ার কাছাকাছি এসে জানতে চায় তৃষ্ণা।

‘ইন কেস ইউ আর ইন ট্রাবল।’ নম্বরটা বলে চোখ টিপ দেয় নাফীস।

*

সনিতে পৌঁছে লাফিয়ে নামে নাফীস। মৌরীতে বসে ছিল হামীম আর রিয়াদ।

বসে পড়ে নাফীসও। ‘ফয়সাল কোথায়?’

‘ঘুরপথে আসছে।’

বলতে বলতেই বাইক নিয়ে উপস্থিত ফয়সাল।

‘মামা – কাজ হয়ে গেছে।’ চোখ টিপ দেয় নাফীস। ‘তৃষ্ণা নম্বর দিয়ে গেছে বাসে।’

‘হুফফ!’ আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ে ফয়সাল। হাত তুলে দেয় হাই-ফাইভের জন্য। ‘আমাদের খাওয়ানোর পালা এইবার তোর! কেএফসির নিচে কথা নাই।’

*

তিনদিন আগে।

তৃষ্ণার বাসার দুই রোড পরে আড্ডা দিচ্ছিল ওরা।

‘নাফীস – তোর জান বাইর হয়ে যাচ্ছে।’ হঠাৎ হামীম বলে।

‘আমার জান আমার ভেতরেই আছে।’ মুখ বাঁকায় নাফীস।

‘মানে, তোর তৃষ্ণা বাইর হয়েছে।’ শয়তানী হাসি ফোটায় মুখে হামীম।

‘তুই আর কয় দিন দূর থেকে দেখবি!’ বিরক্ত হয় ফয়সাল। ‘এভাবে দেখতে থাকলে জুনিয়র তৃষ্ণাও দেখা লাগবে তোর। না বললে কিভাবে বুঝবে?’

‘ফার্স্ট ইম্প্রেশনই সব রে। সেইটা হঠাৎ করা উচিত না। প্ল্যান করা লাগবে।’ হঠাৎ চোখ জ্বলে ওঠে নাফীসের। ‘হু – প্ল্যান …’

‘কি হল?’ কৌতুহলী হয় ফয়সাল।

ব্যাকপ্যাক থেকে ছোটভাইটার জন্য কেনা খেলনা পিস্তলটা বের করে ওর দিকে ছুড়ে দেয় নাফীস। নিজেকে জেমস বন্ড ভাবে পিচ্চিটা। পিস্তলের কালেকশন কম না তার কাছে। ‘উড়াল দে বাইক নিয়ে। তৃষ্ণার কেমিস্ট্রি স্যারের রোডে গিয়া ওকে হাইজ্যাক কর।’ আরেকটা কাগজ কাটার ছুরি বের করে হামীমের দিকে ছুঁড়ে মারে ও। বাতাসের লুফে নেয় ওরা ওগুলো। ‘আমি আসছি ওকে উদ্ধার করতে।’

‘কিন্তু তোর ছোট ভাইয়ের পিস্তল – ’

‘আরে ওকে আরেকটা কিনে দেব।’ কথা শেষ করতে দেয় না রিয়াদকে।

তিনজন বাইক নিয়ে উধাও হয়ে যায়।

ছুট লাগায় নাফীস।

*

ফয়সালের উঠিয়ে রাখা হাতে হাই-ফাইভ দেয় নাফীস, ‘সিওর দোস্ত! কেএফসি কোন ম্যাটার না।’

হাসিতে ফেটে পড়ে চারজনই।

রচনাকাল – ১৪ই ডিসেম্বর, ২০১৩

নিশি-হণ্টক

আকাশে একটা নিঃসঙ্গ চাঁদ।

ওকে কি নিঃসঙ্গ বলা যায়? ছাড়া ছাড়া মেঘ ওটাকে সঙ্গ দিচ্ছে।

মেঘ আর চাঁদের দূরত্ব তো কম না। তাহলে নিঃসঙ্গ বলা কি চলে না ওকে?

হিসেব মেলাতে পারলাম না। মেলাতে চাচ্ছি তেমনটাও না।

এই মুহূর্তে চাঁদ ব্যাটা নিঃসঙ্গ থাক বা না থাক আমার নিঃসঙ্গতার একটু দরকার ছিল। রাস্তাঘাট রাতের এই সময়টায় ফাঁকাই থাকে। বারোটা বেজে পাঁচ। ভ্যাম্পায়ার গোত্রের মানুষ বাদে কাওকে দেখতে পাওয়ার কথা না।

আমি ভ্যাম্পায়ার গোত্রের মানুষ না। তবে বাবার শেষ উপদেশ আমি মেনে চলি।

মৃত্যুশয্যায় একজন বাবা ছেলেকে উপদেশ দিয়ে যেতে চান। যাতে তাঁর প্রস্থানের পর সন্তানের জীবন একটা সরলরেখায় চলে। এটা করবে, সেটা করবে না, অমুককে দেখবে, তমুককে ওটা দেবে হাবিজাবি। আর আমার বাবা চেয়েছিলেন বক্রপথের সন্ধান দিতে।

আমার উদ্দেশ্যে বাবার শেষ কথা ছিল, ’রাত বারোটার পর কখনও বাসায় থাকবি না। ’

বাবার শেষ ইচ্ছে আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি।

তিন মাস সাত দিন ধরে সারারাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। শহরের কোনও রাস্তা বাকি নেই যেখানে আমার পা পড়েনি।

এমন কোন ওভারব্রীজ নেই যেটার ওপর আমি উঠিনি।

সব হয়েছে রাতের বেলায়।

কম ঘটনার মুখোমুখী হতে হয় নি এজন্য। নৈশজীবনে অভ্যস্ত পঙ্কিল জীবনে ডুবে থাকা অসংখ্য মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে তাদের অনেকেই বিশাল হৃদয়ের উপস্থিতির পরিচয় দিয়েছেন।

পুলিশেও ধরেছে আমাকে এজন্য, ছয়বার।

প্রতিবারই ভোরের দিকে ছেড়ে দিতে দিতে সহকর্মীকে পেটমোটা পুলিশটা বলেছে, ’পাগল ছাগল মানুষ। অযথা আমাদের হয়রানী। ’

আর আমিও হয়রান পুলিশটির দিকে চমৎকার একটি হাসি দিয়ে বেড়িয়ে এসেছি।

‘তুর্য! অ্যাই তুর্য!’ নারীকন্ঠের চিৎকারে বাস্তবে ফিরলাম।

শব্দের উৎসের দিকে ফিরে তাকিয়ে ফারিহাকে দেখতে পাই। দাঁড়িয়ে আছে ফুটপাথের ওপরে। গাছের ছায়াতে।

পৃথিবীর সব শক্তিমান’ভালোমানুষেরা’ দিনের বেলায় গাছের নীচে ছায়া খোঁজে। আর ফারিহারা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় রাত হলে। যন্ত্রণা লাঘবের জন্য না। নতুন যন্ত্রণাকে আলিঙ্গন করে নিতে। মেয়েটার আসল নাম কি কে জানে? আমাকে অন্তত ওই নামই বলেছে।

নাম কি?

পরিচয় বই তো নয়! কাজেই আমিও ঘাটাঘাটি করিনি। করে কাজ কি?

‘হাঁটতে বের হয়েছ আজও?’ আমি কাছে যেতে মুক্তোর মত দাঁতগুলো বের করে বলে ফারিহা।

মেয়েটার হাসি এত প্রাঞ্জল ওকে এই পরিবেশে মানাচ্ছে না।

‘হুঁ। তোমার খবর কি?’ পাল্টা হাসি দিলাম। যদিও ব্যাঙের মত লাগল হাসিটা।

‘আজকে আমার ছুটি।’ লাফিয়ে ফুটপাথ থেকে নামে ফারিহা।

‘মানে?’ অবাক হলাম। রাতের বেলাতে ওদের ছুটি থাকে না কোনদিনই। বিশেষ সময় ছাড়া।

‘নিজেকে নিজেই ছুটি দিলাম।’ মুক্তোর মত দাঁতগুলো আরেকবার দেখায় ফারিহা।

‘জমা দেবে কি তাহলে?’ বিষন্ন মনে জানতে চাই। এদের জীবনের পরিণতি আমি মেনে নিতে পারি না।

‘আছে কিছু জমানো। দেব নাহয়।’ আমার দিকে সরাসরি তাকায় ফারিহা, ’কই, হাঁটো?’

একটা কুকুর এসে আমাদের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটার সারা শরীরে লোম নেই।

কমেডির হাস্যকর একটা দৃশ্যের মত দেখাচ্ছে নিশ্চয় আমাদের?

সরাসরি তাকাই আমিও, ’তুমিও আজকে আসছ নাকি?’

‘হুম। সমস্যা?’ কোমরে হাত রেখে জানতে চায় ফারিহা।

‘সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।’ ভ্রু কুঁচকে ভাবতে ভাবতে বলি আমি।

‘পিতৃদেবের কথা ভাবছ তো? তিনি তোমাকে রাতের বেলাতে হাঁটতে বলেছেন। একাকী হাঁটতে হবে সেরকম শর্ত ছিল বলে মনে করি না। ’

অকাট্য যুক্তি।

কাজেই ফারিহাকে পাশে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটির কৌতুহলের শেষ নেই। কোন গাছের পাতা না থাকলেও অপার আগ্রহে আমাকে প্রশ্ন করছে। আবার পাতা থাকলেও সম-আগ্রহেই প্রশ্ন করছে।

ফারিহার প্রশ্নগুলোর উত্তর মনের মত করে দিচ্ছি। শুন্য রাস্তায় আমাদের গলার শব্দ অদ্ভুত রকমের ভূতুড়ে শোনাচ্ছে মনে হয়। সেদিকে আমাদের নজর নেই। ফারিহা ডুবে আছে আমার কন্ঠনিসৃত ব্যখ্যার জন্য। আর আমি মনে মনে খুঁজছি ফারিহার লাইফস্টোরি।

মেয়েটা এই পেশাতে এল কি করে? কথাবার্তা শুনলে মনে হয় সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে।

প্রতিটি ট্র্যাজেডির পেছনেই কাহিনী থাকে। ফারিহার কাহিনী আমি কিছুতেই মেলাতে পারি না।

ও ঠিক এই পরিবেশের সাথে যায় না।

ফারিহার প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলাম , ’তুমি কি নিজেকে হিমু মনে কর?’

‘হিমুটা আবার কে?’ গলায় কৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়ে জানতে চাই আমি।

‘উফ! কোন দুনিয়ায় থাকো? হিমু আমার প্রিয় চরিত্র। যে কারণে তোমার প্রেমে পড়েছি আমি সেই কারণটার নামই হিমু। ’

ফারিহার এই ব্যাপারটাও আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগে। কি অবলীলাতেই না স্বীকার করে নিচ্ছে সবকিছু। পেশাগত জটিলতার কারণে কাজটা হয়ত ওদের জন্য সহজ। সমাজসিদ্ধ পরিবেশে বড় হওয়া মেয়েদের ক্ষেত্রেই’বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ নিয়ম প্রযোজ্য। ওদের জন্য নয়।

‘তা এই হিমুটা কি করে?’ প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাই আমি।

‘ও অনেক কিছুই করে।’ মুখ ভার করে বলে ফারিহা। আমি হিমুকে চিনি না ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না ও মোটেও।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলাম আমরা।

একটা নিঃসঙ্গ প্যাঁচাকে উড়তে দেখলাম আমি ঠান্ডা চোখে। পাথর মেরে ব্যাটাকে নামাতে পারলে হত।

উড়ার বেলাতে আছে! কি জটিলতাবিহীন একটা শান্ত জীবন তাদের!

হিংসাতে আমার চোখ মুখ কুঁচকে যায়।

ফারিহা ব্যাপারটাকে অন্য অর্থে নিল।

‘হিমু একজন মানুষ নয়। হিমু একটা আদর্শ বলতে পারো। এটা প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটি চরিত্র। আমার ফেভরিট। ’

‘ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে।’ মাথা দোলাই আমি, ’ব্যাটা খালি হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে হেঁটে বেড়ায়। আর পায়ে জুতো পড়ার বালাই রাখে না এই তো? বাবা তাকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিল। অথচ ও প্রমাণ করে দেখিয়েছে প্রতিটি মানুষের ভেতরেই একটি মহাপুরুষ বাস করে। তাই না?’

‘প্রতি মানুষের ভেতরে মহাপুরুষ প্রমাণ করল কবে হিমু?’ আকাশ থেকে পড়ে ফারিহা।

আকাশ থেকে তো আমিও পড়েছি। এই মেয়ে দেখা যায় বই-টইও ভালোই পড়ে। আবার পেশায় যৌনকর্মী।

মেয়েটিকে দেখে আমার বিস্মিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমি বিস্মিত হই না। আমার ভেতর যে অনুভূতিটা কাজ করছে তাকে মুগ্ধতা বলা যেতে পারে।

ফারিহা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লাইটপোস্টের হাল্কা আলোতে দেখতে পেলাম লালচে একটা আভা ওর গালে। আমার দৃষ্টিতে লেগে থাকা মুগ্ধতা নিশ্চয় ধরে ফেলেছে?

মেয়েদের ইন্দ্রীয় বোধহয় সাতটা।

‘হিমু নিজে মহাপুরুষ ছিল না। কিন্তু অনেক অনেক কাজ তার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যা মহাপুরুষ ছাড়া করা সম্ভব ছিল না। আমাদের এখানে দুটো সিদ্ধান্তে আসার উপায় আছে। এক, মহাপুরুষের সংজ্ঞা পাল্টে ফেলা। দুই, হিমু প্রমাণ করেছে প্রতিটি মানুষের মাঝেই একজন মহাপুরুষ বাস করে। ’

আমার কাছে কেউ বাংলা দ্বিতীয় পত্রের উত্তর আশা করবে এমনটা নয়। অমুক রচনার সারমর্ম লিখ, পূর্ণমান ১০। কাজেই দশটা সেকেন্ড চুপ করে থাকে ফারিহা। আমার মনে হল মেয়েটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছে।

কিন্তু তা না করে পাল্টা প্রশ্ন করল ও, ’তুমি কি হিমু গোত্রের?’

মাথা নাড়লাম, ’আমি হিমুগোত্রের না। আমার পায়ে জুতো আছে। গায়ে সাতদিনের পুরোনো একটা গেঞ্জিও আছে। বাবা আমার মহাপুরুষ সন্তান চাননি। তবে চেয়েছেন সন্তান রাতের বেলায় ঘর থেকে লম্বা দিক। ’

ফারিহা একটু সাহস পেল মনে হল এবার, ’তোমার হাতটা ধরা যাবে?’

মাথা নেড়ে ওকে’না’ বলতে যাব এই সময় সামনের মোড়ে সিগারেট হাতে আড্ডা দিতে থাকা দুর্বিনীত চেহারার তিন যুবককে আমাদের দুইজনেরই চোখে পড়ে।

অশ্লীল একটা দৃষ্টি চোখে নিয়ে আমাদের দেখছে নেতাগোছের মানুষটা। ফারিহার হাঁটার গতি আপনা থেকেই শ্লথ হয়ে গেল।

সরু চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। লিডারকে এবার আমার একটু চিন্তিত বলেই মনে হতে থাকে!

যুবক তিনজন উঠে পড়ল সাথে সাথে। আমাদের দিকে ধীর কিন্তু দৃঢ়পায়ে এগিয়ে আসছে তারা।

ফারিহার সাথে সাথে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার দিকে সামান্য ঘেঁষে এসেছে মেয়েটা।

হেডলাইটের তীব্র আলো এই সময় রাস্তার এই অংশটা আলোকিত করে দেয়।

গুন্ডাত্রয় থেমে গেছে।

পাঁচ সেকেন্ডের মাঝেই একটা গাড়ি আমাদের ঠিক পাশে এসে ব্রেক কষল। আমার দৃষ্টি ছিল গুন্ডাত্রয়ের দিকে। গাড়ির দিকে ফেরার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পুলিশের গাড়ি হলে বেশ বিরক্তিকর ব্যাপার হবে।

সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মত হাজতে বসে মশার কামড় খেতে হলে আমার জন্য জরুরী ভিত্তিতে দুই ব্যাগ বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা আছে!

গাড়িটিকে দেখার পর রক্তের প্রয়োজনীয়তা কেটে গেল। একটা সাদা রঙের গাড়ি। ড্রাইভিং সীটে মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। দাঁত কেলিয়ে বিশ্রী একটা হাসি দিচ্ছেন। চোখ ফারিহার দিকে নিবদ্ধ। তবে মুখের দিকে নয়।

‘তোমাকে কত খুঁজেছি, ফারিহা। তোমার জায়গায় আজ ছিলে না কেন?’ ফাঁটা বাঁশের মত গলা করে জানতে চান তিনি।

‘বন্ধুর সাথে হাঁটতে আসলাম তো, তাই।’ নিঃসংকোচে উত্তর দেয় ফারিহা।

‘যাবে? নাকি এরই মধ্যে নিয়ে নিয়েছে?’ আমার উদ্দেশ্যে অশ্লীল ইঙ্গিতটা দিয়ে হাহা করে হাসলেন ভদ্রলোক।

‘তোমার সাথে যেতে আপত্তি নেই।’ ঝকঝকে হাসি দিয়ে বলে ফারিহা, ’পরে দেখা হবে, তুর্য!’

লাফিয়ে তো ফ্রন্ট সীটে উঠে গেল মেয়েটা গাড়িটাও হুশ করে বেড়িয়ে যায় চোখের সামনে দিয়ে। আর আমার মনোযোগ ফিরে যায় গুন্ডাত্রয়ের দিকে।

বেশ হেলেদুলে এগিয়ে আসছে ওরা। আমার সামনে এসে লিডার মানুষটা থেমে গেল।

‘ভাই, আপনাকে কত খুঁজছি কইবার পারুম না।’ কটকটে গলাতে বলে’ট্যামা মিলন’। শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তার খ্যাতি আছে।

বিনয়ের হাসি দেই আমি, ‘সঙ্গী নিখোঁজ?’

মিলনের দুই পাশের সহচররা চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখছে। আগেই কিভাবে জেনে ফেললাম সেটা ভাবছে হয়ত।

এমনিতেই মিলনের ভ্রান্ত একটি বিশ্বাস আছে, আমার মাঝে অলৌকিক কিছু ক্ষমতা থাকার ব্যাপারে। ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হল, এবার লাই পেয়ে বিশ্বাসটা একেবারে চাঁদিতে উঠবে! এই লোকের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় একটা ধাওয়া দৃশ্যে।

মোড় ঘুরেই আজব দৃশ্যটা আমার চোখে পড়েছিল সেরাতে।

হাত পা নেড়ে দৌড়াচ্ছে মিলন। পেছনে ছয় ছয়জন তাগড়া জওয়ান। প্রত্যেকের হাতে কিরিচি। এবং একজনের হাতে কাটা রাইফেল।

কাটা রাইফেল দিয়ে ‘ট্যামা মিলন’কে পাখির মত গুলি করে নামিয়ে না দিয়ে কেন উর্ধ্বশ্বাসে তাড়া করছে সেই প্রশ্ন আজও আমার মনের মধ্যে আছে। কিন্তু আমি এত বাছাবাছির মধ্য দিয়ে গেলাম না।

মিলন আমার দিকেই ছুটে আসছিল। আমার থেকে যদিও ওরা পঞ্চাশ গজ মত সামনে।

কাজেই আমার পাশে পৌছানো পর্যন্ত সময়টুকু কাজে লাগালাম। প্যান্টের নিচের অংশটা গুঁজে বেল্ট টেনে ওপরে তুললাম।

তারপর ট্যামা মিলনের পাশে পৌঁছানো মাত্র তার পাশে পাশে প্রাণপণে আমিও দৌড়াতে থাকি!

মিলন দৌড়ের মাঝেই চোখের সাহায্যে একটা ‘?’ সাইন দিল আমার দিকে।

আমি তাকে পাল্টা ‘!’ সাইন দেই।

তীরের মত ছুটছি আমরা পেছনের জোয়ান ছয়জন দূরত্ব ক্রমশ কমিয়ে আনছে ঠিক এই সময়ে বড় রাস্তাতে উঠে আসতে পারলাম।

সামনে ঘ্যাচাং করে পুলিশের গাড়িটা ব্রেক কষতেই পেছনের ছয় জোয়ান একেবারে চিমশে যায়।

তারা কোথায় উধাও হল জানি না পুলিশ ব্যাটারা আমাদের চটপট গাড়িতে তুলে ফেলে।

হাজতে বসে মশার কামড় খাচ্ছি আমরা তারমাঝে মিলন একবার বলে, ’সারাজীবন আপনার সাগরেদ এই ট্যামা মিলন। সারা জীবন।’

তার দিকে ফিরে আমি মৃদু হাসি, ‘ব্যাটারা কি আপনাকে জবাই করে ফেলার জন্য তাড়ছিল নাকি? দৃশ্যটা চমৎকার ছিল, যা হোক।’

মিলন বিষণ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়।

রুটিনমত আমার থানায় প্রবেশের পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাঝেই ইউসুফ মামার ফোনকল। প্রভাবশালী এই মামার জন্য পুলিশ বাহিনী একদিন আচ্ছা করে আমাকে প্যাঁদানোর স্বপ্নটাকে স্বপ্নেই পূরণ করে থাকে।

এমপির কোঁদানি খেতে চায় কে সখ করে?

এবারে অবশ্য আমি গোঁ ধরলাম, ‘ট্যামা মিলনও আমার সাথে বের হচ্ছে।’

পুলিশটি হাহাকার করে ওঠে, ‘এই শালা মিলইন্যা একটা টপ টেরর। আপনারে ছাড়তে পারি হ্যারে ছাড়তে পারি না।’

আমি আয়েশ করে হাজতের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বলেছিলাম, ‘তাহলে আমিও থাকছি। কয়েল-টয়েল থাকলে দিন তো। মশারা বড্ড জ্বালাচ্ছে!’

মিলন বের হয়ে আসল আমার সাথে এবং তারপরই আমার অলৌকিক ক্ষমতার ব্যাপারে সে নিঃসংশয় হয়ে যায়!

‘আপনে জানতেন ঠিক ওই জায়গা দিয়াই পুলিশের গাড়ি যাইব! আপনে ক্যামনে জানেন?’

‘গত তিনমাসের প্রতিটা রাত আমি রাস্তায় পাক খাই। ব্যাটাদের টহল রুটিন আমার মুখস্থ।’ গোমর ফাঁস করে দেই আমি।

‘ঠিক সময়ে আইয়া পড়ছিলেন। আপনে জানতেন। আপনে অনেক ব্যাপার জানেন।’

মিলনকে আর তার ধারণা থেকে টলানো যায়নি। আমিও চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এই মুহূর্তে মিলনের মতই বিস্ময়াভূত হয়ে থাকতে দেখছি তার দুই সাগরেদকে।

আমিও বেশ বুঝতে পারছিলাম ঠিক জায়গাতেই টোকা দিয়েছি। তাই আবার জানতে চাইলাম, ’ঝামেলা তো খুলে বলবে। ’

মিলন আমাকে পাশের গলির দিকে নিতে থাকে, ’আপনারে আগে এক কাপ চা খাওয়াইতে দ্যান। খাইতে খাইতে শোনেন। জবরদস্ত চিপায় পড়ছি। এক্কেরে মাইনকার চিপা। ’

কাজেই রাত একটায় খোলা থাকা বিখ্যাত দোকান’মফিজ চা স্টল’-এ সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে গেলাম আমরা চারজন। ট্যামা মিলনকে দেখে মফিজ মিয়া তার শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থান চুলকাতে থাকে।

পরক্ষণেই মিলনের ধমকে একেবারে অ্যাটেনশন হয়ে যায়, ’ভাইরে ভালো করে পাত্তি দিয়া এক কাপ চা বানায় দে!’

সিগারেট থেকে আমি আজীবনই দূরে আছি। সেটা মিলন জানে। আমাকে অফার না করেই নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল।

এই কাজটা থেকেও ব্যাটা দূরে থাকত, ’আপনের সামনে সিগ্রেট ধরামু, কি কন এইটা, বস?’ প্রথম প্রথম এটাই বলত।

ধমকে লাইনে এনেছি।

আমার হাতে চা চলে আসল। মিলনের হাতে’সিগ্রেট’। আর বাকি দুই চ্যালার হাতে বাতাস।

পরিবেশটা বেশ থমথমে হয়ে যায় হঠাৎ করেই।

‘ডেলিভারীর একটা ব্যাপার ছিল, ভাউ।’ শুরু করে মিলন, ’এক ব্যাগ ভর্তি হিরোইন। ডেলিভারি দেবে তোতা মিয়া। শালাকে লোকেশন জানানো হইছে। কিন্তু, পাসকোড নিয়া একটা ক্যাচাল লাইগা গেছে, বস!’

‘বস’ তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে তাড়াতাড়ি যোগ করে মিলন, ’মাঝখানে পাসকোড পালটায় ফেলা হইছে। পুলিশে নাকি সাদা পোশাকে ফেউ লাগাইছে। পাসকোড হালারা জানে। ’

চারপাশে সুশীতল বাতাস বইছে। তার মাঝে আমি আরাম করে একবার চায়ের কাপে চুমুক দেই।

‘তোতা মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাউ কোথাও।’ ঠান্ডা গলায় বললেও তার উদ্বেগটা টের পাই , ’মোবাইল তো শালার বন্ধই তার উপ্রে কেউ কই পারে না হেয় কই। এখন পাসকোড জানাইতে পারতেছি না। হিরোইন চালান নেয়ার আগেই ব্যাটা আটকা পড়ব। ’

নিঃশব্দে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিলাম, ’নামেই তো গন্ডগোল। ’

ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তিন মাস্তান।

বিরক্তিতে মাথা দোলালাম, ’পাখির নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে কেন? উড়ে গেছে ব্যাটা। ’

‘গাদ্দারি করছে?’ ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা চোখ নিয়ে জানতে চায় মিলন।

‘না।’ মাথা নেড়ে একটা মুহূর্ত থম মেরে বসে থাকলাম, তারপর আবার বলি, ’খাঁচায় আটকেছে তোতাকে। ’

‘পুলিশ!’ হাহাকার করে ওঠে ওরা।

মাথা ঝাঁকাই আমি, ’পাসকোডটা আমাকে বল। আমি তোতাকে জানিয়ে দেব। ’

একটু দ্বিধায় পড়ে যায় এবার ওরা। আফটার অল, আমাকে মিলন গুরু মানলেও বাকি দুটো তো আর মানে না। মিলন আমাকে আরও এক ডিগ্রী বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এখন কিন্তু তোতার পুলিশের খাঁচায় থাকার হিসেবটা সহজ।

ট্যামা মিলনকে বেইমানী করার জন্য সাহসের দরকার। তোতা মিয়ার নামে মাঝে তেমন কিছু দেখলাম না। হিসেবে বলে, ব্যাটার যোগাযোগ না করার কারণ একটাই পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। যেহেতু’ফেউ’ লেগেছে এটা আরও স্বাভাবিক।

‘ফেসবুক।’ ফিস ফিস করে আমাকে জানায় মিলন।

‘পাসওয়ার্ড?’ নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘জ্বে।’ নির্মল হাসি দিয়ে বলে শীর্ষসন্ত্রাসী।

‘সব ঠিক আছে। তোতাকে বলে দেব।’ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিই আমি, ’এবার আমাকে একটা পিস্তল ম্যানেজ করে দাও তো। ’

ট্যামা মিলনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

‘কি করবেন ভাউ?’

‘মার্ডার করব।’ ঠান্ডা গলায় বলি আমি, ’বেশি না। একটা। এক বিচিতেই কাজ হয়ে যাবে। ’

চোখ ছানাবড়া অবস্থাতেই সম্মতি জানায় ও, ’ফুল লোড কইরাই দিমু নে। কিন্তু, কোন হারামজাদারে মার্ডার করা লাগব কন! লাশ ফালায় দিমু না। আপনার লগে ঘিরিঙ্গিবাজি!’

একটু হাসি আমি, তিক্ততার ছাপ পড়ে কি তাতে?

‘আমার সাথে না। এক বন্ধুর সাথে। তোমার কিছু করা লাগবে না। যা করার আমিই করব। ’

*

সকাল নয়টা।

ধবধবে সাদা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

ব্যাটা বাসায় আছে তো?

চারপাশটা বেশ ফাঁকা। বাড়িগুলো এখানে বেশ পরিকল্পনা করে বানানো হয়েছে।

আবাসিক এলাকা। কাজেই চারপাশে যেখানে সেখানে দোকানপাট আর মানুষের ভিড়ের ঝামেলাই নেই। গাছপালাও ভালই আছে। সবই পরিকল্পনামাফিক লাগানো বোধহয়।

বিভিন্ন জাতের পাখির ডাক আমাকে উদাস করে ফেলে। আর সব রাতের মত বাসাতে ফিরে এসে ঘুম দেইনি আমি। বরং সরাসরি চলে এসেছি এখানে। তিথি আমাকে এখানে দেখে ফেললে কি মনে করবে কে জানে?

তবে আমার হিসেবের মাঝে সবকিছু ঠিক থাকলে ওর আমাকে দেখতে পাওয়ার কথা না।

এই সময় দূর থেকে দেখতে পেলাম, সদর দরজা খুলে যাচ্ছে। চমৎকার স্যুট-টাই পড়ে ভদ্রলোক বের হচ্ছেন।

তিথিকেও চোখে পড়ল। বিদায় দিতে এগিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। এক মাসেই যথেষ্ট পতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে দেখা যাচ্ছে!

তিথি আমাকে বিয়ের আগের রাতে বলেছিল পালিয়ে যেতে। শুনিনি আমি। একবার স্ট্রোক করা তিথির বাবার ওপর জুয়ো খেলতে পারিনি। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।

বাড়িটা থেকে গ্যারাজের দুরত্ব বিশ ফিট। ভদ্রলোক সেদিকে হাঁটছেন।

ইনি চলে গেলে পুরো বাসাটায় শুধু তিথি একা থাকে। দোতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। এরকম প্রাচুর্য্যের মাঝে আমি কি কোনদিন তিথিকে রাখতে পারতাম?

উত্তরটা সহজ, পারতাম হয়ত, কিন্তু ততদিনে মেয়েটার স্বামীর সমান বয়স আমার হয়ে যেত!

গাড়িটা বের হয়ে আসছে। রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাখি দেখছি আমি।

আমার সামনে এসে বার দুই হর্ন দিতেই হয়। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। মেইন রোডের মত বড় রাস্তা তো আর নয় যে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে!

শান্ত ভাবে হেঁটে গাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। পিস্তলটা বের করে এনেছি।

প্রথমবারের মত টার্গেট করতেও আমার হাত একটুও কাঁপে না।

মাঝবয়েসী ভদ্রলোকের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ট্যামা মিলনের মতই।

বার দুই গুলি করলাম। পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে গুলির শব্দে।

ভদ্রলোকের চোখ এখনও বড় বড় হয়ে আছে। সেখানে প্রাণের চিহ্নটুকু ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

পাশের সীটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ফারিহা বসেছিল মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই সেখানে।

এই মাত্র প্রথমবারের মত মানুষ খুন করে আমার অবশ্য একটুও খারাপ লাগছে না।

ঘরে মাসখানেক আগে বিয়ে করা নতুন বউ, তিথির মত মিষ্টি একটা মেয়ে রেখে যেই স্বামী পতিতার কাছে ছোটে রাতের বেলায় সে কি আসলে মানুষ?

মেইন রোডের দিকে আগালেও উঠতে পারলাম না।

পুলিশের গাড়িটা কোথা থেকে এসে জানি আমাকে তুলে নিল। কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে নেওয়ার সময় চিকণ পুলিশটা একটা থাপ্পড় মারে ডান কানে।

মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল আমার।

*

চারজন মানুষ হাজতে ঘুমুচ্ছে। তাদের মাঝে আমাকে নিতান্ত অবহেলার সাথে ছুঁড়ে ফেলা হল।

কোনমতে সোজা হয়ে বসে শিস বাজাচ্ছি শুনতে পেয়ে কাছে থাকা পুলিশটা অশ্লীল একটা গালি দিয়ে উঠল। থানার সবার জানা হয়ে গেছে এই নিরীহ দর্শন বর্বর ছেলেটা এই মাত্র  একজন সভ্য নাগরিককে খুন করে এসেছে। হত্যাকান্ডের আসামীর চেয়ে ঘৃণ্য আর কি হতে পারে?

কে হতে পারে?

কিছুক্ষণ আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেছি। চোখে রাজ্যের ঘুম। অথচ ঘুম আসছে না।

ঘুমাতে থাকা মানুষ চারজনের শান্তি এখন আর সহ্য হচ্ছে না। কাজেই উঠে দাঁড়ালাম। দেওয়ালের দিকে পড়ে থাকা মানুষটাকেই পছন্দ হল।

এই ব্যাটার সারা শরীরে পুলিশী টর্চারের চিহ্ন স্পষ্ট।

ঠ্যাং লম্বা করে ঝেড়ে ব্যাটার পাছাতে একটা লাথি মারতেই ছটফট করে উঠে দাঁড়ায় মানুষটা।

‘তুই আবার কোথাকার গান্ডু?’ কোমরে হাত রেখে চট করে প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দেয় লোকটা।

‘তোতা মিয়া?’ সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করি আমি।

লোকটার মুখে এবার একটা সতর্ক ভাব ফুটে ওঠে, ’হুম। তো?’

‘পাসকোড পাল্টেছে। নতুন পাসকোড, ফেসবুক। ’

তোতা মিয়ার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টিটা মুখের ওপর টের পাচ্ছি, কিন্তু আমার চোখ আটকে আছে হাজতের গেটের দিকে।

চিকণ পুলিশটা ফিরে এসেছে।

এবং গেটের তালা খুলতে খুলতেই দ্রুত জানায়, ’সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে স্যার। ’

আমি ফেরেশতার মত মুখ করে হাসলাম, ’ইটস ওকে। ’

হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে লোকটা হাজতেই, ’বের হয়ে আসেন স্যার। ওসি স্যার আপনার সাথে চা খাবেন। ’

মাথা নেড়ে আস্তে করে হাজতের দেওয়ালে হেলান দেই আমি।

তারপর মুখ তুলে বললাম, ’তোতা মিয়াও আমার সাথে বের হচ্ছে। ’

 

রচনাকাল – মে ২, ২০১৪

ধাওয়া

“কস কী!” একেবারে আঁতকে উঠলো মাসুদ, “এগারো ঘণ্টা পরেই জমা দিতে হবে, আর তুই বলতেসস এখনও রিপোর্টের কাজ ধরাই হয় নাই?”
যার উদ্দেশ্যে কথাটা বলা হলো তার মধ্যে কোন অনুভূতি দেখা গেল না। তারেক সরাসরি তাকিয়ে আছে রাস্তার অন্যপাশে। হাতের সিগারেট পুড়ে যাচ্ছে অবিরাম।
“হাওয়ার নাতি, তোমাকে একটা কিছু বলা হয়েছে।” মনে করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো জাবেদ। হাতও বাড়িয়ে দিয়েছে সেই সাথে। “বিড়িটা না টানলে, টানার মতো আরও অনেক লোক আছে।”
মাথা নাড়লো তারেক, “রিপোর্টের কাজ করার দায়িত্ব আমার একার ছিলো এমন তো না। হুদাহুদি আমার সাথে ক্যাচাল করার মানে দেখি না।”
মুখ বাঁকালো মাসুদ, “বুঝতে পেরেছি। এখান থেকে গিয়ে সারারাত ধরে কাজ করা লাগবে।”
নাকের ভেতরে ভর ভর জাতীয় একটা শব্দ করলো জাবেদ।
আগামিকাল বর্তমান সেমিস্টারের রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। মোতালেব স্যারের মতো কড়া কোর্স টিচার গত দুই বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তারা দেখেনি। তার রিপোর্ট আগামীকাল জমা না দেওয়া হলে সেমিস্টারের রেজাল্টে ভাল রকম প্রভাব পড়বে সেটা জানা কথা। তাই বলে দলবদ্ধভাবে তারেককে দোষারোপ করার মতো অবস্থা মাসুদ না জাবেদের নেই। তারাও তারেকের গ্রুপমেট। অথচ গত সপ্তাহ ‘অত্যন্ত ব্যস্ত’ থাকার অজুহাতে তাদের কেউই রিপোর্টে হাত দেয়নি।
“পুরা সপ্তাহ রিফার সাথে ঘোরাঘুরি না করলে আজকে রাতেও আরামের ঘুম দিতে পারতি।” তারেক মনে করিয়ে দিলো। তারপর জাবেদের হতাশ চোখের সামনেই টেনে নিলো সিগারেটের ধোঁয়া।
“তা অবশ্য ঠিক।” অগত্যা একমত হতে হলো জাবেদকেও।
“তুমি বেশি কথা কম বলো।” খেঁকিয়ে উঠলো মাসুদ, “তোমারে যে ড্রইংগুলা করতে বলা হইছিলো তাও তো করো নাই। মারতেছিলা টাংকি।”
ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ালো তারেক, “একে অন্যেরটা চুষে দিতে চাইলে মেসে ফিরে দিস। এখানে হাউকাউ না করে কাজ ভাগাভাগি করে নে। ড্রইংটা জাবেদই করবি। একটা ভুল থাকলে তোর কান-টান একটাও জায়গামতো থাকবে না বলে দিলাম।”
“অকা।” মন খারাপ করে উত্তর দিলো জাবেদ। তারপর শফিক মামার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো, “মামা, একটা বেনসন।”
“আর আমি স্ট্যাটিসটিকসগুলো সাজিয়ে ফেলবো। তুই লেখার কাজটা করে রাখিস।” চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে বললো মাসুদ।
“তা করবো। আসলে লেখার কাজ আমার ফিফটি পার্সেন্ট শেষ। কুত্তার মতো খাটনি দিলে কালকে সকালের আগেই সবকিছু কমপ্লিট হয়ে যাবে।”
শফিক মামার দোকানটা ধোঁয়াচ্ছন্ন করে দিতে দিতে তারেকের চায়ের কাপটা ডাকাতি করে নিলো জাবেদ, “আজ রাতে ‘সাডেন হাইক’ সিরিয়ালটা দেখার ইচ্ছে ছিলো…”
দ্রুত হাত চালিয়ে তার সিগারেট নিয়ে নিলো মাসুদ, “এই কথাটা বলার অপরাধেই তোর সিগারেট বাজেয়াপ্ত করা হল। সিরিয়াল দেখবেন! এহ্! মেয়েমানুষের মতো স্বভাব হয়েছে এটার!”
আবারও অন্যমনস্ক হয়ে গেছে তারেক। রাস্তার অন্যপাশে তাকিয়ে আছে সে। অস্পষ্ট কোন এক শব্দ পেয়েছে বলে মনে হয়েছে তার। একটু আগে একবার পেয়েছিলো এমন। জাবেদের হাহাকারের অবশ্য ছুটে গেল সে ভাবনা।
“শালার শীতের রাতে একটা বিড়িও শান্তিমতো খাইতে দিলি না আমারে। বালামার।” গাঁক গাঁক করে বললো সে।
“চুপ থাক। কুকুরের মতো চিৎকার পাড়িস না।” এক হাত তুলে বললো তারেক।
মাসুদ কোন মন্তব্য করলো না। ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে সে। ফক ফক করে টেনে মি. বেনসনের কোম্পানি প্রোডাক্টের দফা রফা করে ফেলেছে।
সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে উঠে পড়লো তারেক। ধীরস্থির পায়ে এগিয়ে গেল রাস্তার অন্যপাশে পার্ক করে রাখা গাড়িটার দিকে। পেছনে পেছনে হাল্কা পায়ে এগিয়ে আসে জাবেদও। তারেক যে কিছু একটা সমস্যা টের পেয়েছে তা বুঝতে তার সমস্যা হয়নি।
“কিছু শুনেছিস?” ফিসফিস করে বললো সে, “ট্রাংকের ভেতরে কাওকে আটকে রাখেনি তো?”
“শসস…” আরেকবার তাকে থামিয়ে দিলো তারেক, “শুনতে দে।”
গাড়ির কাছে কান পেতে আছে ওরা, মাসুদকে দেখা গেল বেনসনের অবশিষ্টাংশ আঙুলে দুমড়ে ফেলতে ফেলতে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।
“কি রে? ভূতে পাইলো নাকি তোদের দুটোকে?” হাঁক ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে এলো সে।
ঠোঁটের কাছে আঙুল তুলে তাকে সাবধান করে দিলো জাবেদ। তবে তার কোন দরকার ছিলো না।
ওদের ঠিক সামনের একতলা বাড়ির ভেতর থেকে অস্ফূট গোঙ্গানির শব্দটা এবার তাদের তিনজনের কারও কানই এড়ায়নি।
“হোয়াট দ্য ফাক!” সরলভঙ্গিতে নিজের বিস্ময় প্রকাশ করে ফেললো মাসুদ।
গোঙ্গানির কণ্ঠটা একজন নারীর।
১.
রাত এখন দশটা। আধঘণ্টা ধরে আলোচনা করেছে ওরা তিনজন। রিপোর্ট আর ভয়াবহ মোতালেব স্যারকে শিকেয় তুলে রেখেছে এখন। গোঙ্গানির শব্দ নিয়ে ওদের মনে এখন কোন সন্দেহ নেই। ওই সময় পাঁচ মিনিট মতো গোঙ্গানি অবিরত ছিলো। তারপর মৃদু খটাখট শব্দ শুনেছে। এরপর দশ মিনিট নীরবতা, তারপর আরও মিনিট পাঁচেকের মতো চাপা গোঙ্গানি।
“কিডন্যাপ কেস।” সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলো মাসুদ।
“খুব সম্ভব।” তারেক বলেছিলো, “তবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় কি?”
একটু রেগে যায় অবশ্য জাবেদ, “নারীকণ্ঠের গোঙ্গানির শব্দ। আধঘণ্টাতে দুইবার। কিডন্যাপ কেস ছাড়া আর কি হবে?”
ঠোঁট উল্টালো তারেক, “নববিবাহিত দম্পতিও তো হতে পারে, তাই না?”
অকাট্য যুক্তি। এর ওপর আর কোন কথা হতে পারে না। কাজেই জাবেদকে পাহারা দেওয়ার জন্য পেছনের রাস্তাতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। একা একা শীতে কাঁপার জন্য সে দাঁড়াতে রাজি হতো না হয়তো। তবে গোটা ছয়েক বেনসন তার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পর রাজি হয়েছে।
প্রথমে সামনের দরজায় কয়েকবার নক করেছিলো ওরা। তবে খুলতে কেউ আসেনি। একটা টিনশেড বাড়ির ভেতরে নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে আসা, আর তারপর ভেতরে কারও সাড়াশব্দ না পাওয়ার অর্থ আর যাই হোক, ভাল কিছু নয়। পেছনের দেওয়াল বেয়ে টিনশেডের ভেতরে ঢুকে পড়াই ওদের লক্ষ্য ছিলো তারপর। পুলিশে ফোন করার কথা জাবেদ বার কয়েক মিন মিন করে বলেছিলো। নাকচ করে দেওয়া হয়েছে সেটা। চাপা গলার গোঙ্গানির সাথে নববিবাহিত দম্পতির সমীকরণ মেলানোর পর পুলিশে ফোন করা যায় না।
এই মুহূর্তে টিনশেডের এক ইটের দেওয়ালে ব্যাঙের মতো বসে আছে ওরা দুইজন। তারেক আর মাসুদ। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে নামার ইশারা করছে তারা। ইঙ্গিতটা সবারই চেনা। “আগে তুই-ই নাম?” প্রজাতির মধ্যে এটাকে ফেলা যেতে পারে।
মিনিট দুয়েক নীরব যুদ্ধের পর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভেতরে লাফ দিলো তারেক। পেছনে পেছনে দিব্যি নেমে এসেছে মাসুদ। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুইপাশের দরজাগুলো দেখলো ওরা। চার দু’গুণে আটটা দরজা। অর্থাৎ এই টিনশেড একসময় আট পরিবারকে ভাড়া দেওয়া হতো।
এখন অবশ্য তাদের কেউ নেই এখানে। একেবারেই পরিত্যক্ত এক টিনশেড বাড়ি। এমনটা ওরা কখনও দেখেনি। তারেককে গুঁতো দিলো মাসুদ, “ডাক দিবো নাকি একটা?”
থুতনি চুলকালো তারেক, “ডাকা তো যায়। বিসমিল্লাহ পড়ে নে আগে।”
দুই সেকেন্ড নীরবতা।
“কই, ডাক?” মনে করিয়ে দিলো তারেক। এখনও ফিসফিস করে কথা বলছে।
“কিডন্যাপাররা যদি এখানেই থাকে?” হাঁসের মতো গলায় পাল্টা জবাব দিলো মাসুদ।
“নাই মনে হচ্ছে। ডেকে ফেল।”
“আউজু শরীফটা পড়ে নেই আগে?” ঢোক গিলে জানতে চাইলো মাসুদ।
পেছনে তাকিয়ে প্রাচীরটাকে অতিরিক্ত উঁচু মনে হতে থাকে ওদের। গলা খাকারি দেয় তারেক। ভেতরে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে ফেলার পর ঘটনা না দেখে ফিরে যাওয়া উচিত হবে না।
এই সময় আরেকবার শব্দটা শোনা গেল। মাত্র তিন দরজা সামনে। হাতের ডানদিকে। রাস্তাতে দাঁড়িয়ে যেমনটা শুনেছিলো তেমন না। বেশ জোরেই চিৎকার করার চেষ্টা করছে কেউ। তবে পারছে না। মুখ বাঁধা আছে ভেতরের মানুষটার।
“কিডন্যাপারের মায়েরে বাপ।” বিড়বিড় করে বললো তারেক। তারপর গোটা ব্লকের মানুষের ঘুম হারাম করার মতো বর্জ্র্য নিনাদে বললো, “জয় বাংলা! লুঙ্গি সামলা।”
পরক্ষণেই এক লাথিতে ছুটে গেল দরজার কব্জা। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো ওরা দুইজন।
গোঙ্গানির শব্দ বেড়েছে।
দরজার ভেতরে ঢুকেই হাতড়ে লাইটের সুইচ খুঁজছে মাসুদ। পেয়েও গেল।
চেপে দিতেই নরম আলোতে ভরে গেল ঘর।
মেঝের দিকে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলো ওরা।
হাত-পা বেঁধে ঠাণ্ডা মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে একজন মানুষকে।
“সো লং ফর মোতালেব স্যার’স ল্যাব!” হতাশ সুরে বললো মাসুদ।
২.
তরুণীর চুলগুলো আধ-কোঁকড়া। পাতলা ভ্রু। পটলচেরা চোখ। গোলাপি গাল কেঁদে কেটে ভিজিয়ে ফেলেছে একেবারে। এখন ফোঁত ফোঁত করে ফোঁপাচ্ছে মেঝেতে বসে। দুই হাঁটু এক করে বসে আছে। পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। কতোটা আক্ষরিক হতে যাচ্ছে কথাটা, তা বোঝার জন্য আরও তথ্য দরকার ওদের।
“থ্যাংকস।” ফোঁতফোঁতানির মধ্যেই বললো সে।
“আপনি এখানে এলেন কি করে?” জানতে চাইলো মাসুদ।
তবে তারেক অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটির শরীরের শীতকালের উপযোগী কোন পোশাক নেই। পাতলা একটা ফতুয়ার সঙ্গে নীল রঙের জিন্স। কাঁপাকাঁপি স্বাভাবিক। নিজের জ্যাকেটটা খুলে এগিয়ে দিলো সে, “আমরা বের হয়ে কথা বলতে পারি। এটা পরে ফেলুন।”
ভ্রু সামান্য কুঁচকে তার দিকে তাকালো বন্দিনী। তারপর হাত বাড়িয়ে জ্যাকেটটা নিলো। চোখের তারায় কৃতজ্ঞতা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো সে, তারপর তারেককে অনুসরণ করে বের হয়ে এলো ঘরটা থেকে। মাসুদ অবশ্য বের হওয়ার কথা শুনেই সামনের দরজা দেখে এসেছে। ফিরে এলো সে। তার কাছে নতুন খবর।
“ভেতর থেকে তালা মারা।” জানালো সে।
“কিন্তু ভেতরে তো আর কাওকে দেখলাম না…” প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো তারেক, তাকে থামিয়ে দেয় মাসুদ।
“ফোকড় কাটা আছে। বাইরে থেকে হাত ভরে দিয়ে অনায়াসে তালা খুলে ফেলতে পারবে যে কেউ।”
“প্লিজ, আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে।” প্রথমবারের মতো কথা বললো মেয়েটা, খুব সুললিত কোন কণ্ঠ না। ফ্যাঁসফ্যাঁস করছে। সন্ধ্যার পর থেকে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকার ফলাফল খুব সম্ভব। “আমাকে রেখে যাবেন না প্লিজ।”
তার দিকে ঘুরে তাকালো তারেক, “আপনাকে ফেলে যাওয়ার কথা আমরা ভাবছি না।”
দ্রুত একবার চারপাশের অবস্থা দেখে নিলো সে, “দেওয়াল টপকেই বের হতে হবে। ভয় পাবেন না, ওপাশে আমাদের বন্ধু অপেক্ষা করছে।”
সম্মতি দিয়ে মাথা দোলালো মাসুদ।
“আমি যে দেওয়াল বাইতে শিখিনি!” ককিয়ে উঠলো তরুণী। যেন এটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোর ক্রেডিটের কোর্স করে শেখার বা শেখানোর জিনিস!
“শিখবেন আজ। এতো ব্যস্ততার কি আছে?” মুখ বাঁকিয়ে বললো তারেক। “মাসুদ, বসে পড় তো, তোর পিঠে করে উঠতে দে উনাকে।”
“হুঁ, আমাকে তো ঘোড়া মনে হয় তোর!” গজ গজ করে বললো মাসুদ।
“বসলি তুই?” গর গর করে উঠে তারেক।
“মরে গেলেও না। আমার পিঠ কোন টেবিল না। তুই বস। উনি তোর পিঠে পা দিয়ে দেওয়াল টপকাতে শিখুক। আমাকে হুকুম দিচ্ছিস কেন?”
দুইজনের মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকাতে থাকে বন্দিনী, যে কোন সময় আবারও কেঁদে দেবে হয়তো। গরম চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে দুই উদ্ধারকর্তা। যে কোন মুহূর্তে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়েই হয়তো পড়তো, পেছনে শোনা গেল চাবির ঝংকার।
গেটের ফোকড় দিয়ে একটা হাত ঢুকে গেছে, তালাতে লাগানোর চেষ্টা করছে চাবি, তারেক আর মাসুদ দুইজনই ঝটপট বসে পড়লো দেওয়ালের সামনে। দুটো ঘোড়া।
“উঠে পড়ুন। দেওয়ালে উঠে পড়ুন!” চাপা কণ্ঠে বললো একসাথে।
ওদের দুইজনের পিঠে দুই পা চাপিয়ে তরতর করে দেওয়ালের ওপর উঠে গেল তরুণী।
অন্যপাশ থেকে হাহাকারের শব্দ ভেসে আসলো। তারপর একাধিক মানুষের মাটিতে গড়াগড়ির শব্দ। অচেনা বন্দিনী নির্ঘাত ঝাঁপিয়ে পড়েছে জাবেদের পিঠের ওপর। কান পেতে ওই শব্দ শোনার মত অবস্থায় অবশ্য তারেক অথবা মাসুদ নেই।
পেছনের দরজার কাছে চাবির ঝুনঝুনানি থেমে গেছে একেবারে। তার বদলে ভেসে আসছে হুড়কো সরানোর শব্দ। এক মুহূর্ত পরেই দু’ দুটো ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠলো পেছন থেকে। সরাসরি এসে পড়লো তারেক আর মাসুদের ওপর। একে অন্যের দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো তারা।
“এরা আবার কারা?” পরিষ্কার বাংলাতে পেছন থেকে শব্দ তিনটা ভেসে আসতেই ওদের চটকা ভেঙ্গে যায়।
“দুই এক্কে দুই!” অস্বাভাবিক চিকণ আরেকটা কণ্ঠ পেছন থেকে আবৃত্তির সুরে বললো। পরমুহূর্তেই কাটা রাইফেলের ঠা-ঠা শব্দ।
ডারউইনের বহুল বিতর্কিত তত্ত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টাতেই যেন তড়াক করে লাফ দিলো ওরা দুইজন। মুহূর্তখানেক পরেই দুই দু’গুণে চার পা প্রাচীরের ওপর উঠে গেল।
প্রাচীরের অন্যপাশে একাধিক মানুষের মাটিতে গড়াগড়ির শব্দ পেল হামলাকারীরা।
৩.
প্রাণপনে ছুটছে ওরা চারজন। একে অন্যের দিকে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্যও তাকাচ্ছে না। নাক বরাবর নজর তাদের। পায়ের সর্বশক্তি নিংড়ে দিয়ে ছুটছে তারা। পেছনে একাধিক মানুষের মাটিতে গড়াগড়ির শব্দ।
“অস্ত্রধারী ওই আসছে তেড়ে।” মোটা শরীর নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে বললো জাবেদ।
“আজরাইল আজ নেবে মোরে।” তাল দিলো মাসুদ।
“স্টপ দিস ননসেন্স!” ধমক দিলো তারেক।
“হেল্প! হেল্প! লিফট, রাইড, ফ্রি কিস।”
দুই হাত মাথার ওপর তুলে মেইন রোড দিয়ে ছুটে চলা গাড়ির উদ্দেশ্যে বললো অদ্ভুত তরুণী। প্রথম চারটা শব্দ গাড়ির গতিপথে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে না পারলেও শেষ দুটো কাজ উদ্ধার করে দিলো। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো কালো টয়োটা। তারপর ব্যাক গিয়ার দিয়ে পিছিয়ে এলো।
“লিফট লাগবে?” হোৎকা চেহারার একজন মানুষ তার ভোঁতা নাকটা বের করে দিলো।
“গিফটের প্রসঙ্গ যখন আসছে না তখন…” বলতে বলতেই পেছনের দরজা খুলে উঠে পড়লো জাবেদ। তাকে ধাক্কা দিয়ে গাদাগাদি করে উঠে পড়লো মাসুদ আর তারেকও।
ড্রাইভার ততক্ষণে সামনের প্যাসেঞ্জারস ডোর খুলে দিয়েছে। নাকি গলাতে বললো, “গিফটের একটা অফারও শুনেছিলাম বটে।”
হোৎকার দৃষ্টি সরাসরি তরুণীর দিকে নিবদ্ধ।
ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেতরে ঢুকে গেল সে, দরজা লাগাতে লাগাতে বললো, “সব হবে, সবই হবে… জাস্ট ড্রাইভ।”
আরাম করে হেলান দিলো ড্রাইভার। ড্রাইভ করার কোন ইচ্ছে তার মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। বরং কোটের কাপড় সামান্য সরিয়ে দিয়ে ভেতরের এক চকচকে হোলস্টার দেখিয়ে দিলো।
“আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। রাত এগারোটার সময় আমি কেন চার অচেনা পাবলিক নিয়ে লিফট দেব বলতে পারো তোমরা? গিফটের প্রসঙ্গটা থাকলে ভেবে দেখার সম্ভাবনা থাকতো একটা।”
“বাংলাদেশ সরকার প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাইসেন্স দেয় না।” গাঁ গাঁ করে বললো তারেক, “আপনাকে আমরা বিশ্বাস করলাম না।”
“বাংলাদেশ সরকার গত ফেব্রুয়ারী থেকেই লাইসেন্স দিচ্ছে। তোমরা হয়তো জানো না।” সবগুলো দাঁত বের করে দিয়ে বললো হোৎকা ডিটেকটিভ, “কই? তোমাদের লিফট দেওয়ার মতো কোন কারণ তো দেখছি না।”
কোঁকড়ামতো চুল মুখের ওপর থেকে সরিয়ে তার দিকে তাকালো তরুণী, চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। কিছু একটা বলার জন্য মুখ সামান্য খুলেছিলো, কিন্তু কষ্টটুকু তাকে করা লাগলো না।
পেছন থেকে কাটা রাইফেলের ঠা-ঠা গুলির শব্দ নতু উদ্যমে ভেসে আসলো।
“ওহ মাই ফাক!” হাহাকার করে গাড়ি স্টার্ট দিলো ডিটেকটিভ।
“না না, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।” অবশেষে বললো তারেক, “গিফটের আলোচনাটা সেরে নেওয়া যাক আগে, কি বলেন?”
ততক্ষণে অ্যাকসিলারেটরে পা পুরোপুরি দাবিয়ে দিয়েছে লোকটা। কার্বুরেটর তার কাজ যা করার করে ফেলেছে। সাঁই সাঁই করে ছুটে চললো গাড়ি।
“বাই দ্য ওয়ে,” মেয়েটি বললো, “আমার নাম লিনা।”
৪.
“কাম অন ইন!” হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে গ্যারেজ থেকে বের হয়ে এলো ডিটেকটিভ দবির। পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলেছে তারা ততক্ষণে। বুলেটের বেগে গাড়ি ছুটিয়ে লোকটা তাদের যে বিল্ডিংয়ে নিয়ে এসেছে, এতেই নাকি তার অফিস। ফোরথ ফ্লোরে।
“প্লিজ, হারি!” আরেকবার ওদের দিকে তাকিয়ে বললো দবির। মোটাসোটা শরীর নিয়ে হাস্যকর ভঙ্গিতে ছুটে যাচ্ছে লিফটের দিকে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটছে জাবেদও। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের দুইজনকে ওভারটেক করে লিফটে ঢুকে পড়লো বাকি তিনজন।
“হাঁফ … হাঁফ … এবার বলেন, আপনাদের ঘটনা কি?” লিফটের দরজা লেগে যেতে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো দবির, “আপনাদের ওরা কারা মারতে চাইছে? লিনা ম্যাডামকেই বা কিডন্যাপ করেছিলো কেন?”
কিডন্যাপের ঘটনাটা সামান্য বলা হয়েছে তাকে। তার বেশি কিছু নয়। তবে লিনার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার পেছনে সেটা নয়, দবির ডিটেকটিভের অতিবিনয়।
দুই সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যাপারটা বুঝে নিলো দবির, “গিফটের ব্যাপারে আমার মতামত পাল্টেছে কি না তা জানতে চাইছেন তো? আসলে আপনি আমার সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট। আর ক্লায়েন্টের সঙ্গে প্রফেশনাল সম্পর্ক রক্ষা করাই আমাদের নিয়ম। নতুবা লাইসেন্স হারানোর একটা সম্ভাবনা থাকে।”
লিনার চোখ অবশ্য ভ্রুর নিচে নেমে আসে না, “সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট?”
“অবশ্যই।” গম্ভীর একটা ভঙ্গি দেখা যাচ্ছে এখন তার মধ্যে। আগের মত সস্ত্রস্ত দেখাচ্ছে না আর। “আপনাকে অপহরণ করা হয়েছিলো। তারপর হত্যার প্রচেষ্টাও করা হয়েছে।”
একটা হাত তুললো তারেক, “এক্সিউজ মি, আমার মনে হয় আপনার ইনিশিয়াল গেসে ভুল হচ্ছে। এভাবে অংক করে গেলে গস-সাইডেল মেথডে ইকুয়েশন সলভ করতে গেলে সারা বছর লেগে যাবে আপনার। আমার মনে হয় হত্যার প্রচেষ্টা মিস লিনাকে করা হয়নি। ওটা আমাদের করা হয়েছে। আমাদের হত্যা করে মিস লিনাকে পুনরায় কিডন্যাপিত অবস্থাতে ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে তাদের ছিলো বলেই মনে হলো আমার।”
“কিডন্যাপিত!” বিড়বিড় করে বললো মাসুদ।
“আপনি বলতে চাইছেন, ওরা আপনাদের হত্যা করার চেষ্টা করেছিলো?” একটা ভ্রু উঁচু করে বললো দবির।
“আমারও তেমনটাই মনে হয়।” জাবেদ বললো।
“দ্যাটস গুড।” একবার গম্ভীর মুখে মাথা দোলালো লোকটা, “থ্রি মোর ক্লায়েন্টস। দ্যাটস গুড ফর মি।”
একে অন্যের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালো ওরা তিনজন। তারপর অগত্যা মাথা দোলালো। রিপোর্ট লেখার প্ল্যান করার জন্য চায়ের দোকানে বসার সময় কে ভাবতে পেরেছিলো এমন একটা ফ্যাচাঙ্গে পড়ে যেতে হবে? এখন এই মুহূর্তে অভিজ্ঞ কারও সাহায্য ওদের দরকার হতেই পারে। পেশাদার কারও। তারেক এগিয়ে এলো সামনে।
“আপনাকে হায়ার করার আগে আমাদের জানতে হবে, এমন একটা পরিস্থিতিতে কেন আপনার ওপর ভরসা করবো আমরা? সরাসরি পুলিশের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইতেই তো পারি, তাই না?”
“পুলিশ ফেলবে আপনার বালটা।” চটপটে উত্তর দিলো প্রাইভেট গোয়েন্দা।
“আ লেডি ইজ প্রেজেন্টেড হিয়ার।” কটমটে সতর্কতা জানালো জাবেদ।
“ল্যাঙ্গুয়েজ!” সায় দিলো মাসুদও।
“সরি।” হার মানলো দবির, “আসলে, পুলিশ আপনাদের স্টেটমেন্ট নিয়ে ডায়েরী করাবে। তারপর সেটাকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পাঠিয়ে দেবে। আপনাদের নাতিপোতারা হয়তো ওই কেসের উত্থান দেখে যেতে পারবে…” একটু কাশলো লোকটা, “মানে, যদি নাতি-পুতি জন্মানোর মতো ঘটনা ঘটানো পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন আপনারা।”
কথায় যুক্তি আছে বলে ওরা তিনজন মাথা দোলালো এমনটা না। ক্লায়েন্টে পরিণত হওয়ার সাথে সাথে ডিটেকটিভ দবির তাদের “তুমি” থেকে “আপনি”তে প্রমোশন দিয়েছে। এটা একটা মাথা দোলানোর মতোই সন্তুষ্টির ব্যাপার।
“আপনার কাজটা কোথা থেকে শুরু করতে চাইছেন তাহলে?” লিনা জানতে চাইলো।
“কাজটা? কাজ দুটো।” শুধরে দিলো গোয়েন্দা, “আপনার কিডন্যাপার আর উনাদের হত্যার প্রচেষ্টাকারীদের পরিচয় বের করার কেস। দুটো কেস।”
“বেশ, বেশ। কেসদুটো সলভ করতে আপনার প্ল্যান কি?”
“সিম্পল।” দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো এক দেরাজের দিকে এগিয়ে গেল গোয়েন্দা, “প্রথম প্ল্যান এখান থেকে প্রাণটা নিয়ে বের হয়ে যাওয়া। তারপর দ্বিতীয় স্টেপ। আপনাদের স্টেটমেন্ট নেওয়া। মিস লিনার পারিবারিক পরিচয়টাও জানা দরকার আমার।”
“এক সেকেন্ড।” আমসি হয়ে গেল জাবেদের মুখ, “এখান থেকে প্রাণটা নিয়ে বের হয়ে যাওয়া? মানে আমরা এখনও সেফ না?”
“অবশ্যই না। অর্ধেকের বেশি রাস্তা ওরা আমাদের ফলো করেছে। তারপর তাদের দেখিনি অবশ্য। তার মানে এই না খসাতে পেরেছিলাম।” দেরাজ খুলে ফেলেছে ডিটেকটিভ, “আমার একজন সাইড কিক দরকার। এখানে অস্ত্র চালানোর মতো সাহস আছে কার?”
গোয়েন্দার ছুঁড়ে দেওয়ার এক্সট্রা পিস্তলটার দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকলো ওরা চারজন।
৫.
“এই বাড়াটা চালায় কিভাবে?” সংক্ষেপে জানতে চাইলো তারেক। পিস্তলটা ওর হাতেই। সঙ্গে তিনটা এক্সট্রা ম্যাগাজিন।
“ল্যাঙ্গুয়েজ!” সাবধান করে দিলো জাবেদ।
“ঘোড়া টিপে দেবেন। আর কিছু করার নেই।” বললো ডিটেকটিভ।
“টেপাটেপির প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আপনারা কি ঘর থেকে বের হবেন?” লিনা বললো, “এমনিতে দুই দিন ধরে কিছু খেতে পাইনি। আপনাদের সার্কাস দেখার মতো ধৈর্য্য আমার হচ্ছে না।”
“রাইট!” ওদের জন্য চারকপি কাগজ বের করে ধরিয়ে দিলো দবির, “আমার ইনিশিয়ালস অ্যান্ড চার্জ। আপনারা পড়ে নেবেন পরে। এখন এখান থেকে বের হওয়া যাক।”
সুড়সুড় করে হলওয়েতে বের হয়ে এলো ওরা। লিফটের সামনে মাত্র পৌঁছেছিলো ওরা, গ্যারেজের দিক থেকে চাকার কর্কশ শব্দ ভেসে এলো।
“শিট!” হতাশ হয়ে বললো দবির, “চলে এসেছে ওরা।”
“এবার কি?” ফ্যাকাসে হয়ে গেছে লিনার মুখটা।
“সিঁড়িঘর। কুইক। লিফটে ওঠা যাবে না।” মোটাসোটা মুখটা এখন সংকল্পবদ্ধ।
বিনাবাক্যব্যয়ে সেদিকে রওনা দিলো ওরা। দবির গোয়েন্দাকে গুরু মেনে নিয়েছে দিব্যি। পিস্তল হাতে নিয়েও তারেকের নিজেকে শিকার মনে হচ্ছে এখন। বাকিরা তো এরই মধ্যে খরচের খাতায় নিজেদের ধরে রেখেছে। লিনা মেয়েটাও স্বার্থপর আছে। গোয়েন্দা আর তারেকের মধ্যে ঢুকে হাঁটছে দিব্যি।
পা টিপে টিপে নামছে ওরা। বিল্ডিংটা বেশ বড়। একেক তলার ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছালে দেখা যাচ্ছে দুই পাশে যথেষ্ট লম্বা করিডোর চলে গেছে। লিফট থেকে অবশ্য সিঁড়ির দূরত্ব কম না। হুট করে কারও সামনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দোতলা পর্যন্ত কারও সাড়াশব্দ পেল না ওরা। পাঁচজনের কানই অবশ্য খাড়া হয়ে আছে তখন থেকে।
আচমকা দুটো ধাতব ঠং ঠং শব্দের সাথে সাথে হিসহিসে আওয়াজ। ওদের পাঁচজোড়া চোখের সামনে রীতিমতো ধোঁয়াচ্ছন্ন হতে শুরু করলো করিডোর। তারেকের এক হাত খামচে ধরলো লিনা। আরেকটু হলেই মেয়েটার পিঠে গুলি করে দিচ্ছিলো ও।
“একেবারে ফিল্মি কায়দায় আক্রমণ করছে দেখি শালারা।” ফিসফিস করে বললো মাসুদ।
ভূতের মতো বের হয়ে আসলো ওরা দুইজন, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা দুইজন আক্রমণকারী। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠা-ঠা করে কাটা রাইফেল দিয়ে গুলি করতে শুরু করলো তারা। পাঁচজনের কেউ কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই আ-আ-আ-আ-আ করে চিৎকার করে উঠলো গোয়েন্দা দবির।
আবছা আলোতেও পরিষ্কার দেখতে পেলো ওরা, লোকটার শার্টের সামনের দিক থেকে কয়েক দফায় ধোঁয়া উড়লো। তারপর দড়াম করে সিঁড়িতে পড়ে গেল সে। দেহটা ঠোকর খেতে খেতে নেমে গেল নিচের দিকে।
“ফাক! গেট ডাউন!” শক্ত হাতে পিস্তলটা চেপে ধরে সিঁড়ির রেলিংয়ের আড়ালে বসে পড়লো তারেক।
“ম্যান… হি’জ ডেড!” অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বললো লিনা।
সামনে থেকে ডিটেকটিভ সরে গেছে, হামাগুড়ি দিয়ে তারেকের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করলো মেয়েটা। ওর শরীর থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ পেল তারেক।
রেলিংয়ের আড়াল থেকে কব্জি বের করে নিচের সিঁড়িমুখ বরাবর ম্যাগাজিন খালি করে দিলো ও। একটা আর্তনাদ, তারপর আরেকটা শরীরের সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ার শব্দ শোনা গেল।
“কুইক। নেমে যেতে হবে আমাদের।” ফিসফিস করে বললো তারেক।
“লি…না …”
সিঁড়ির নিচ থেকে দুর্বল গলাতে কেউ বললো।
দ্রুত নেমে এলো ওরা। এখনও মারা যায়নি দবির। তবে রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে।
“আমার গাড়ির…” কিছুক্ষণ দম নেওয়ার চেষ্টা করলো সে, “…চাবিটা নিয়ে বের হয়ে যাও। ইউ আর… ”
“আপনাকেও নিয়ে যাচ্ছি আমরা।” দবিরের একটা হাত শক্ত করে ধরে বললো মেয়েটা।
“…টু বিউটিফুল টু ডাই…”
তারেক কথাতে সময় নষ্ট করতে নারাজ। পকেট হাতড়ে চাবিটা বের করে নিলো ও।
“লেট’স গো! দবির ঠিকই বলেছে। ওর এখানে আর কোন চান্স নেই।” লিনার কাঁধ ধরে টানলো মাসুদ। এখনও মৃতপ্রায় লোকটার হাত ধরে বসে আছে সে।
নামতে গিয়ে গরম রক্তে পা পিছলে গেল জাবেদের। ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে থেমে গেল সে। হড়হড় শব্দ হচ্ছে।
বমি করে করিডোরের একাংশ ভাসিয়ে ফেললো জাবেদ।
শত্রুপক্ষ থেমে নেই। নিচ থেকে কাটা রাইফেলের গুলির শব্দ ভেসে এলো। করিডোরে কয়েকটা ছুটন্ত বুলেট ঢুকে এ দেওয়াল ও দেওয়ালে আঘাত হেনে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল কোথাও। মাথা নিচু করে ফেললো ওরা অজান্তেই। দবিরের হাত ছেড়ে দিয়েছে লিনা। নিচের দিকে ছুটলো আবারও।
থেমে নেই তারেকও। রেলিংয়ের কাভার নিয়ে আছে এখনও।
নতুন ম্যাগাজিন থেকে প্রথম ফায়ার করলো নিচের ওদের লক্ষ্য করে।
৬.
“সরে আসা দরকার। সিঁড়ি দিয়ে নামা যাবে না।” একটু পর পিছিয়ে এসে বললো মাসুদ। “আমরা লিফটের শ্যাফট ব্যবহার করবো। কুইক।”
নিচের গুলির শব্দ কিছুটা থেমে এসেছিলো। আবারও তারস্বরে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল ওদিক থেকে। মাসুদের কথাতে যুক্তি আছে। সবাই আবারও উঠে এলো দোতলায়। লিফটের দরজার দিকে শত্রুপক্ষের কারও মনোযোগ নেই। এই সুযোগটা ওরা ইচ্ছে করলে নিতে পারে।
জাবেদ নড়াচড়া করতে পারছে না। ওকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে লিনা।
সেদিকে একবার তাকিয়ে চাপা গলাতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো তারেক, “ঘটনা কি? তোমাকে ধরার জন্য এতো ব্যস্ততা কিসের ওদের? শিল্পপতির মেয়ে কিডন্যাপারের মতো সহজ কিছু তো মনে হচ্ছে না আমার আর।”
বাগড়া দিলো মাসুদ, “আমার আঙুল ঢুকছে না। লিফটের দরজা তো খোলা লাগবে আগে? লিনা, তোমার হাত চিকণ সবার চেয়ে। চেষ্টা করে দেখবে প্লিজ?”
তারেকের দিকে বক্র দৃষ্টি হেনে এগিয়ে গেল লিনা। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে সামান্য ফাঁকা করতে পারলো দরজা। তারেক আর মাসুদ টান দিয়ে যথেষ্ট ফাঁকা করে ফেললো। ওপরের দিকে তাকিয়ে লিফটের আবছা অবয়বটা দেখা গেল। পাঁচতলাতে আটকে আছে। মেইনটেনেন্সের জন্য কিছু কেবল ঝুলছে। তা ধরে নিচের দিকে নেমে যেতে হবে ওদের।
কাটা রাইফেলের শব্দ থেমে গেছে নিচ থেকে। ওরা পাল্টা গুলি না পেয়ে অপেক্ষা করছে। সবাই মারা গেছে কি না তা পরীক্ষা করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে আসতে পারে তারা। কালিঝুলি হাতে মাখাতে মাখাতে লিফটের কেবল ধরে ঝুলে পড়লো ওরা।
একের পা অন্যের মাথাতে লাগিয়ে নেমে আসতে শুরু করলো চারজন। অদ্ভুত এক অনুভূতি। ওদের মনে হতে থাকে ওদের চারজনের চাপে লিফটটা যে কোন সময় ওপর থেকে খসে পড়বে। গতি কমালো না ওরা অবশ্য। সাবধানে নেমে চললো। শেষ দিকে এসে হাত ফস্কালো জাবেদ।
লিনার ঘাড়ে এসে পড়তেই হুড়মুড় করে মাসুদ আর তারেকের ওপর এসে পড়লো ওরা। নিজেদের সামলে উঠে বসলো প্রথমে। তারপর আবারও লিনার দিকে সাহায্যের আবেদন মেলে দেওয়া হলো। নিচতলার লিফটের দরজা খুলে দিতে হবে। তাহলেই অনায়াসে গ্যারেজে বের হয়ে আসবে ওরা।
ভোটকা জাবেদ ছিটকে পড়ায় ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছে লিনা। আনমনে ডলছিলো, ভঙ্গিটায় তাকে অপরূপা দেখাচ্ছে। তবে এখন ঠিক সৌন্দর্য প্রদর্শনীর সময় না। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলতেই হলো তারেককে, “লিনা, দরজাটা খুলতে হতো।”
আবারও একই পদ্ধতিতে দরজা খুলে বের হয়ে এলো ওরা। গ্যারেজের শেষ মাথায় সিঁড়িঘর। সেখানে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন মানুষ। তাদের হাতের কাটা রাইফেল ওপরের দিকে তাক করা আছে। একজন রেডিওতে কাকে যেন রিপোর্টও করছে, “না স্যার! এখনও শালীকে রিট্রিভ করতে পারি নাই … না স্যার… এদিকে একটা ঝামেলা হয়ে গেছে… জ্বি স্যার, কোন এক শালার সঙ্গে গিয়ে জুটেছে মেয়ে, ধুমিয়ে গুলি করতেছে বস…”
চাটুকারিতায় পটে গেল তারেক। ধুমিয়ে আরেকদফা গুলি করলো ওদের উদ্দেশ্যে।
নিমেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো দেহদুটো। পেছন থেকে ওদের গুলি করে মারার জন্য কোনরকম অপরাধবোধ কাজ করলো না ওর মধ্যে। মনে পড়ে গেছে প্রাইভেট ডিটেকটিভ দবিরের কথা।
ছুটে গিয়ে দবিরের গাড়িতে উঠে পড়লো ওরা। এবার চারজনের জন্য একটা করে সীট বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো ওরা। মাসুদ ড্রাইভিং করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোমোবাইল কম্পিটিশনের কল্যাণে গাড়ি নির্মাণ আর চালনার অভ্যাস তার আছে। ড্রাইভ করাটা সমস্যা হবে না। ভেতরে ভেতরে এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার তাড়া অনুভব করছে তারেক। জাবেদের অবস্থা ভাল না। মনে হচ্ছে যে কোন সময় জ্ঞান হারাবে।
“ওদের আরও লোক বাইরে আছে মনে হয়। মুভ! ফাস্ট!” তাড়া দিলো লিনা।
গ্যারেজ থেকে বের হওয়ার সময় তারেক দেখলো শত্রু দুইজনের বুকের নিচ থেকে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে গ্যারেজের ফ্লোর। লোক দুটোর পরিচয় আর জানা হলো না।
৭.
ছিটকে বের হয়ে এলো ওদের গাড়ি। আশে পাশে কোন গাড়ি ওদের ধাওয়া করে আসছে না। তারপরও ঝুঁকি নিতে রাজি হলো না মাসুদ। পূর্ণগতিতে গাড়ি ছোটাচ্ছে সে। এই ক্ষমতা তার আছে। ছুটিতে বাড়ি যখন যায়, বাবার গাড়ি সে-ই ড্রাইভ করে। অভিজ্ঞতাটা কাজে লেগে যাওয়াতে মনে মনে নিজেদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো তারেক।
“সেফ লোকেশন দরকার আমাদের একটা।” বিড়বিড় করে বললো জাবেদ। অনেকক্ষণ পর কথা বললো ছেলেটা। তার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলালো মাসুদ।
পেছনের সীটে বসেছে তারেক আর লিনা। মেয়েটার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে একবার তাকালো তারেক। একটা কিছু ভাবছে সে। তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো মাসুদ, “কই যাবো রে? একটা লোকেশন দে।”
“লোকেশন … ” বিড়বিড় করলো তারেক।
“কি?”
“নাথিং। চালিয়ে যা। আশে পাশে কোন পুলিশ স্টেশন দেখলেই দাঁড়িয়ে যাবি।” বললো তারেক।
“পুলিশ এমন ম্যাস মার্ডারারের সঙ্গে লড়াই করেছে বলে শুনিনি। আমার মনে হয় পুলিশের কাছে যাওয়া হলে আমার আর কোন চান্স থাকবে না।” হতাশ কণ্ঠে বললো লিনা।
“তোমার সমস্যা কোথায় আমি ঠিক জানি না।” তিক্ত কণ্ঠে বললো তারেক, “তোমার ব্যাপারে কিছুই জানি না আমরা। ইলিগাল কিছুর সাথে জড়িত নও তো? তোমার কোন কথা আমি শুনতে পারবো না। মাসুদ, সরাসরি পুলিশ স্টেশন।”
অসহায়ের মতো তার দিকে তাকালো লিনা। তারপর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তবে সময় মিললো না। আচমকা চারপাশে নরক ভেঙ্গে পড়লো যেন। রাইফেলের গুলির পরিচিত শব্দ ভেসে আসলো পেছন থেকে।
পেছন থেকে ছুটে আসছে নীল রঙের একটা জিপ। জানালার একপাশ থেকে শরীরের অর্ধেকটা বের কর গুলি করছে একজন মানুষ।
“আই ক্যান্ট বিলিভ দিস!” ক্ষোভে চিৎকার করে উঠলো মাসুদ।
“পুলিশ…” বিড়বিড় করে উঠলো জাবেদ।
“পুলিশ আমার বালটা করবে।” গজ গজ করে উঠলো তারেক, “ফিল্মি স্টাইলেই হামলা চালাচ্ছে দেখছি শালারা।”
নিজের মাথা খামচে ধরে বসে আছে লিনা। শরীরটাকে যথাসম্ভব ছোট করে ফেলেছে সে। চিৎকার করে উঠলো এবার, “ডু সামথিং! তারেক!”
পেছন থেকে আবারও ভেসে এলো কাটা রাইফেলের গুলির শব্দ। গর্জন করছে জিপের ইঞ্জিন। খুব দ্রুত দূরত্ব কমে আসছে ওদের।
“ড্যাম ইট!” শরীরের একাংশ বের করে দিলো তারেকও। শেষ ম্যাগাজিন থেকে সাবধানে ছুঁড়তে থাকলো একটার পর একটা গুলি।
“খসাতে পারবো না মনে হচ্ছে ওদের।” হতাশ কণ্ঠে বললো মাসুদ।
“হোয়াই!” দুটো গুলি আছে চেম্বারে, গাড়ির ভেতর শরীর টেনে আনলো তারেক, “ট্রাই প্লিজ! আমার গুলিও শেষ প্রায়।”
“ট্রাই করার কিছু নাই। হঠাৎ করেই গতি উঠাতে পারছি না। চল্লিশ কিলোমিটার উঠছে সর্বোচ্চ।”
জানালা দিয়ে শরীর বের করে দিয়ে শেষ দুটো গুলিও ছুঁড়ে দিলো তারেক। তারপর ফিরে আসলো ভেতরে। দুই সেকেন্ড লেগে গেল তার কথাটা বুঝতে, “গতি উঠাতে পারছিস না?”
“না… ম্যান, আমি জানি না প্রবলেমটা কোথায়…”
“বা-আ-আ-আ-আল!” হতাশ কণ্ঠে বললো তারেক, “গাড়ি থামা মাসুদ। কুইকলি!”
“হোয়াট! নো!” আঁতকে উঠলো জাবেদ।
“পাগল হয়েছিস? আত্মহত্যা করবো না আমি।” মাথা নাড়লো মাসুদ।
“প্লিজ…” কাতর কণ্ঠে বললো লিনা।
“গাড়ি থামা মাসুদ। ট্রাস্ট মি অন দিস।”
“প্ল্যানটা কি তোর? পিস্তলে গুলি আছে কয়টা?” জাবেদ জানতে চাইলো।
সাবধানে ম্যাগাজিন বের করে চেক করলো তারেক। একটা গুলিও নেই ভেতরে।
“একটাই গুলি আছে।” মিথ্যা বললো ও, “গাড়ি থামা। ক্লিয়ার শট নিতে হবে আমাকে।”
ইতস্তত করলো মাসুদ। পেছনে জিপের দূরত্ব কমে আসছে।
“নাউ! মাসুদ!!” চিৎকার করে উঠলো তারেক।
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো মাসুদ।
সাথে সাথে দরজা খুলে বের হয়ে এলো তারেক। এক হাতে টেনে নামিয়েছে লিনাকেও।
তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটার ঠোঁটজোড়া নিজের মুখে পুড়ে নিলো নিমেষে।
৮.
“ফাক!” চিৎকার করে উঠলো পালের গোদা শাহেদ রহমান। “গাড়ি থামাও। বুঝে গেছে ওরা।”
নীল রঙের জিপটা থেমে গেল মাসুদদের গাড়ির দশ হাত দূরে। কাটা রাইফেলধারী তিনজন মানুষ যখন এগিয়ে আসছে ওদের দিকে, তখনও একে অন্যের সঙ্গে চুম্বন প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে তারেক আর লিনা।
একটু দূর থেকে গলা খাকারি দিলো মাসুদ, “হোয়াট দ্য ফাক ইজ গোইং অন?”
“এহেম এহেম।” বললো শাহেদ রহমান। তিন কাটা রাইফেলধারী বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো তার পেছনে।
লজ্জিত ভঙ্গিতে সরে এলো লিনা, “টেস্টস গুড!” বললো তারেককে।
“কি হচ্ছে রে ভাই!” বের হয়ে এলো মাসুদও।
“শালারা স্রেফ বোকা বানিয়ে ছেড়েছে আমাদের।” হুঙ্কার দিয়ে বললো তারেক, “ফাকিং রিয়েলিটি শো! রিয়েলিটি শো চলছে এখানে, মাসুদ। অথবা তেমন কিছুই… শালারা…”
“আমরা দুঃখিত-” শুরু করতে যাচ্ছিলো শাহেদ রহমান, তবে তার দিকে ফিরেও তাকালো না তারেক।
“দুঃখিত শিকেয় তুলে রাখেন।” গর্জন করে উঠলো এবার মাসুদ, “ঘটনা খুলে বলেন আমাদের।”
একে অন্যের দিকে তাকালো তিন রাইফেলধারী। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে যেমনটা হয় তেমনই হয়েছে তাদের চেহারা।
“ছোটখাটো একটা টেলিভিশন শো আছে আমাদের।” মিনমিন করে বললো শাহেদ, “বাংলাদেশের সর্বাধিক দর্শিত শো। দেশে প্রতিটি শো-র টেলিভিশন ভিউ চার কোটির ওপরে। ভারতেও এই শো দেখে মানুষ। আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেল ও দেশেও অ্যাভেইলেবল। সেখানে এই শোর ভিউয়ার্স তিন কোটির ওপরে।”
“বা-আ-আ-আ-আল!” এবার বললো জাবেদ। গাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে সে, “আমরা এতোক্ষণ ছিলাম ‘সাডেন হাইক’-এ। আমরা এতক্ষণ এই বালের প্রোগ্রামে ছিলাম!”
তার দিকে ঘুরে তাকালো মাসুদ, “ওহ! বালের প্রোগ্রাম? আজ রাতে রিপোর্ট না দেখে এই সিরিয়াল দেখার প্ল্যান তোমার ছিলো। তারমানে তুইও ওদের রেগুলার ভিউয়ার। অথচ গাড়ল এতোক্ষণে ধরতে পারলি ব্যাপারটা? আরেকটু হলে হার্টফেল করতাম আমি।”
“ওরা থ্রিলার অথবা অ্যাকশন রিয়েলিটি শো করেনি এতোদিন। মূলতঃ প্র্যাংক করে থাকে তারা, তবে এত এক্সট্রিম পর্যায়ের না।” শাহেদের দিকে এগিয়ে গেল জাবেদ, “হঠাৎ সাসপেন্স শো করছেন যে?”
“এটা এপিক লেভেলের হবে।” মাথা দুলিয়ে বললো তরুণ ডিরেক্টর, “স্রেফ ফেটে পড়বে বাংলাদেশ এবার, দেখবেন। আপনারা হিট খেয়ে যাবেন অচিরেই। ফাটাফাটি পারফর্ম্যান্স! আমি কখনোই ভাবি নাই ওই বিল্ডিং থেকে বের হতে পারবেন আপনারা। দবিরের মার্ডারের সাথে সাথে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো ব্যাপারটা। ওখানেই হাল ছেড়ে দেবেন বলে ভেবেছিলাম। আমাদের দর্শকরা এসএমএসে ভোটও দিয়েছিলো ৬৭%, আপনারা ওই পর্যায়েই পর্যুদস্ত হয়ে যাবেন…” দীর্ঘশ্বাস ফেললো শাহেদ, “তবে আপনাদের বিচি আছে বলতেই হবে।”
“কিন্তু কিভাবে!” মাসুদ বুঝতে পারে না, “কিভাবে এটা রিয়েলিটি শো হল? রাস্তাতে এসে গোলাগুলি করছেন আপনারা, পুলিশ ঝামেলা করলে কি করতেন?”
“করতো না। আমাদের সাথে লোকাল থানার ডীল আছে।” হাসিমুখে বললো শাহেদ, “আর কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন। জানি অনেক প্রশ্ন জমে থাকার কথা আপনাদের মনে।”
“লাইভ দেখাচ্ছিলেন প্রোগ্রামটা?” রক্তচক্ষু মেলে বললো তারেক।
“ওরা সব প্রোগ্রামই লাইভ দেখায়।” ফস করে বলে বসলো জাবেদ।
“আরে ধ্যাত! ইজ্জত তো ফালুদা রে!” মাথায় হাত দেওয়ার জোগাড় হল তারেকের।
মাসুদ কৌতূহলী হয়ে আছে এখনও, “কিন্তু, ঘটনাগুলোর সাথে শো-র সম্পর্ক কিভাবে হল? আপনাদের কাছে ক্যামেরা ছিলো ধরে নিলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তো ছিলো না।”
“ভুল বললে।” মাথা নাড়লো তারেক। “অবশ্যই ক্যামেরা ছিলো সবখানে। শফিক ভাইয়ের দোকান। তারপর আমরা ঢুকেছিলাম অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা টিনশেড বাড়িতে। অন্ধকার কোণে শক্তিশালী ক্যামেরা বসালেও আমাদের দেখার উপায় ছিলো না। তারপর তাড়া করে এনে ফেললো ভোটকা ব্যাটার গাড়ির ওপর। সবকিছুই পারফেক্ট টাইমিং। আমরা যখন রাস্তা ধরে এই নকল কিডন্যাপড মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছিলাম, তখন পেছনের ওরা গুলি করছিলো না। কারণ আমাদের চোখ তখন নাকের বরাবর। দমটা নাকের ফুটা দিয়ে বের করে দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম একেকজন। আশে পাশে আমাদের যে ফিল্মিং চলছে সেটা টের পাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা কি আমাদের ছিলো?”
মাথা দোলালো ‘সাডেন হাইক’-এর নিদারুণ ভক্ত জাবেদ, “ঠিক। তারপর ওই অ্যাকটর হারামজাদাও আমাদের লিফট দিলো। ক্যামেরা নিশ্চয় ওই গাড়িতেও আছে। এরপর তো সরাসরি তার ‘অফিসে’ ঢুকে পড়লো। তারপর পিস্তল-টিস্তল বের করে একাকার করে দিলো পরিস্থিতি। এরপর বের হওয়ার সময়ই মরার আর গুলি খাওয়ার পারফেক্ট ডেমো দিলো সে।”
“এমন টাইট করে রেখেছিলো পরিস্থিতি যাতে আমরা লিনার অভিনয়ের ব্যাপারটা ধরতেই না পারি। সময় দিলেই আমাদের চোখে অসঙ্গতিগুলো ধরা পড়ে যাওয়ার উপায় ছিলো বলে সময় তারা দিতে চায়নি। ক্যামেরার ব্যাপারটা ওখানেও ছিলো নিশ্চয়। তবে আমরা লিফট ব্যবহার করবো এটা মনে হয় তারা কল্পনা করতে পারেনি।” তারেক বলে যায়, “যে কারণেই প্রথম ভুলটা করে ফেললো ওরা। ফটাফট পাছাতে গুলি খেয়েই মরার ভান করতে হলো সিঁড়িঘরের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সৈনিককে।”
“এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।” ‘মৃত’ দুই সৈনিকের একজন আপত্তি জানিয়ে বললো।
“অপমান হচ্ছে? হলেও আমার কিছু করার নেই।” সোজাসাপ্টা বলে দিলো তারেক।
“তুমি থামো।” ধমক দিয়ে সৈনিককে থামালো শাহেদ, “মি. তারেক কি বলবেন, ঠিক কিভাবে আপনি শো-র ব্যাপারটা বুঝলেন?”
মুচকি হাসলো তারেক, “প্রথমে বুঝিনি। প্যানিকড মাইন্ড। গাড়িতে করে পালানোর সময় আমার হিসেবে ঠিক মিলছিলো না। একটা কিছু ভুল হচ্ছে আমি বুঝতে পারছিলাম। তবে কিছু একটাতে গড়বড় ছিলো সেটা সবারই মনে হয়েছে। এতো ফিল্মি স্টাইলে আক্রমণ! আমার ফিলিংটা শুধু অতটুকু ছিলো না। সাঙ্ঘাতিকভাবে ফিজিক্সের সূত্র ভায়োলেট করা হয়েছে কোথাও- এমনটা মনে হচ্ছিলো। জীববিজ্ঞানের সূত্রও লঙ্ঘিত হয়েছিলো সেখানে।”
“জিনিসটা কি ছিলো?” অধৈর্য্য হয়ে জানতে চাইলো শাহেদ।
“সিম্পল। লিফট থেকে বের হয়ে যখন ওদের পিঠ বরাবর গুলি চালিয়ে দিলাম, ওরা মরলো ঠিকই।” বললো তারেক।
“এতে সমস্যাটা কি?” বুঝেনি শাহেদ।
“রক্ত বের হলো যে বুক থেকে! পিঠে কোন ছিদ্র নেই, রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো গ্যারেজ!”
“শিট!” নিজের ভুল বুঝতে পেরে আফসোস করে উঠলো শাহেদ, “আপনাদের ফেক বুলেট দিয়ে করা গুলির সামনে সবাই বুক চিতিয়ে পড়বে এটাই প্ল্যান ছিলো। পিঠের দিকে মেকানিজম কাওকে দেওয়া হয়নি। তবে, আমাদের পরের প্রোগ্রামগুলো ঠিকমতো করার জন্য একটা ছোটখাটো তথ্য আমাদের দরকার ছিলো। পিঠে ছিদ্র নেই, এটা আপনি কখন টের পান?”
“খটকা লেগেছিলো, প্রথমেই খটকা লেগেছিলো। তবে শিওর হতে দেরি হয়েছে। যখন জিপ নিয়ে ধাওয়ার সাথে সাথে গাড়ির স্পিড ৪০ কিলোর ওপরে গেল না আর, বুঝে গেলাম।” বললো তারেক, “সেফটি ফার্স্ট। তাই না? চাননি শো-র কোন ভলান্টিয়ার মরে-টরে যাক। আপনাদের ভয় পাওয়ার কারণ ছিলো না। বরং জেনে রাখতে পারেন, আমাদের মাসুদ একজন আন্ডারগ্রাউন্ড রেসার। স্পিডোমিটার নিয়ে কাহিনী না করলে আপনার জিপের কপালেই খারাবী ছিলো।”
“আর তারপর…”
“কুত্তাপাগল করা দৌড় দৌড়িয়েছেন আমাদের। ভেবেছেন ফ্রি ফ্রি করিয়ে নেবেন? ফ্রি কিসার লিনার অফারটা আমিই নিলাম। ভাল কথা, তোমার আসল নামটা কি জানা যাবে এখন?” লিনার দিকে ঘুরে তাকালো ও।
“জেনি। তবে একটা তথ্য তোমার জানা উচিত, আমরা পার্টিসিপ্যান্টদের দশ হাজার করে দেই। আমাদের শো-টা বেশ লাভজনক। আজকেরটা গ্রেটেস্ট সাকসেস এখন পর্যন্ত। আজকের শো-র পার্টিসিপ্যান্টদের দেওয়া হবে পঞ্চাশ হাজার করে। কংগ্র্যাচুলেশনস!”
“একটা ব্যাপার, আমাদের কেউ যদি ফেইল করতো? আমরা যদি টিনশেডের মধ্যেই না ঢুকতাম আজ?”
হাসলো শাহেদ, “ব্যাকআপ ভিডিও রেডি ছিলো। আমাদের অভিনেতাদের অভিনয় করা। তবে লোকে ধরেই নিতো সব ঘটছে লাইভ…”
“আপনাদের টাকা-পয়সা রাখেন।” ঘেউ ঘেউ করে উঠলো তারেক, “কাল সকালে রিপোর্ট জমা দিতে হতো আমাদের। সেটার কি হবে অ্যাঁ? নিজেদের আখের তো গুছিয়েছেন। টাকাও নাহয় আমরা পেলাম, তবে আগামীকাল যে মারাটা খাবো তার ফলাফল আপনি জানেন না।”
“কিসের রিপোর্ট?” হা হয়ে গেছে শাহেদ।
“মোতালেব স্যারের রিপোর্ট।” ফস করে বলে ফেললো জাবেদ, “পারবেন তাঁকে বোঝাতে কেন আজ আমরা রিপোর্ট রেডি করিনি?”
শাহেদ এখনও ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি, “লোক কি খুব ভয়ঙ্কর নাকি?”
“ভয়ঙ্কর শব্দটা তার জন্যই বানানো হয়েছিলো।”
“তাহলে আপনারা চাইছেন এই লোকের হাত থেকে নিস্তার পেতে?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো শাহেদ।
“অবশ্যই!” কটমট করে তাকালো তারেক, তারপর ঘুরে দাঁড়ালো জেনির দিকে, “অ্যাই তোমার নাম্বারটা দাও।”
একটু ভেবে হাসলো শাহেদ, “ব্যাটার বাসার ঠিকানা দেন। বাকিটা দেখিচ্ছি।”
_পরিশিষ্ট_
সকাল সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে বের হওয়াটা প্রফেসর আব্দুল মোতালেব হাসান চৌধুরীর পুরাতন স্বভাব। তাঁর ডেসিগনেশনের অনেক শিক্ষকই ল্যাব-ট্যাব জুনিয়র শিক্ষকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা আরও গুরুভার বহন করে থাকেন। অথচ মোতালেব স্যার এদিক থেকে কড়া। প্রতিটা ক্লাস আর ল্যাব তিনিই নেন। শত হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও এর ব্যত্যয় ঘটে না।
আজকেও এমন এক ল্যাব নিতে হবে, সকাল আটটায় ল্যাব। ছাত্ররা আজকে তাদের সেমিস্টারের ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেবে। ষাটজন ছাত্র-ছাত্রীর রিপোর্ট আজকের মধ্যেই দেখে ফেলতে হবে তাঁকে। কোন সময় কাজটা করবেন তা মনে মনে ছক কেটে নিচ্ছিলেন তিনি।
তিন রাস্তার মোড়ে এসে থমকে গেলেন তিনি।
প্রচুর কুয়াশা চারপাশে।
শীতের সকাল।
মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে।
দশটার আগে সূর্য এদিকে ওঠে না কোন শীতে।
শব্দটা আবার শুনলেন কি তিনি?
একটা নারীকণ্ঠের গোঙ্গানি?

— ০ —

শানে নুজুলঃ
মেকানিক্যালের জন্য বরাদ্দ ক্লাসরুমগুলোর সংখ্যা চার। ৩০১, ৩০২, ৩০৩, ৩০৯।
এদের মধ্যে ৩০২ এবং ৩০৯ নম্বরের পেছনে দরজা আর তা দিয়ে ক্লাস চলাকালীন অবস্থায় জান নিয়ে ভেগে যাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। থার্ড আর ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট হিসেবে ভাইয়ারা ৩০৯ আর আমরা ৩০২ দখল করে অভ্যস্ত। স্বাভাবিক, জুনিয়রদের ক্লাস পালানো তো মোটেও উচিত নয়। আমাদের ছোট ভাই-বোনেরা নষ্ট হয়ে যাক তা কি আমরা চেয়েছিলাম?
সেদিন সম্ভবতঃ মাসুদ স্যারের ক্লাস। স্যার এলেন না। প্রক্সি টিচার হিসেবে পাঠালেন এক ম্যাডামকে। ম্যাডামের নাম ভুলে গেছি। জন কেনেডির সাথে তাঁর নামের মিল আছে। JFK। ম্যাডাম এসে ক্লাস নিলেন, এমনটা না। সবার অ্যাটেনডেনস নিয়ে চলে গেলেন।
এ ধরণের টিচাররা আমাদের খুব প্রিয়। ৫০ মিনিটের ক্লাসে অ্যাটেনডেন্স নিয়ে ছেড়ে দেওয়া, অনেক সময় পাওয়া যায় ‘মগা’ নেওয়ার জন্য। এসব ক্ষেত্রে ম্যাডাম বের হয়ে যাওয়ার পর আমরা হুড়হুড় করে বের হয়ে যাই। এবং বের হওয়ার আগে উচ্চস্বরে বার কয়েক হাঁক ছাড়া হয়, “বিড়ি খাইতে যাবি না?”
অনেককেই সায় দিতে দেখা যায় ব্যাপারটায়। ক্লাসরুমে দেখা যায় কিছু মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাকি সবাই গন উইথ দ্য বিড়ি।
সেদিন সম্ভবতঃ ক্লাসরুমের ভেতরে কুস্তি লড়ার আয়োজন করা হয়েছিলো। এ তাকে, এবং সে ওকে পেটানোর পর আমাদের মনে হল, এবার আসলেই “বিড়ি খাইতে” যাওয়া উচিত। যথারীতি আমরা বের হয়ে এলাম মার্চ করে। ৩০১ পার করছি, তখন বন্ধু আসাদ ষড়যন্ত্রকারীর মতো বললো, “দ্যাখ দ্যাখ, সেলফি তুলছে।”
তাকিয়ে দেখা গেল ক্লাসের মেয়েরা সেলফি তুলছে সামনের দরজার বিপরীতে। লিজা, সন্ধি, মোনা আর আরেকটা মেয়ে। যে গাছের সামনে এত ঢঙ করে ছবি তোলা হচ্ছে, সেখান থেকে একবার একটা জ্যান্ত ডেয়োপিঁপড়া ধরেছিলাম। সাইজে দেড় ইঞ্চি। তারপর ওটাকে জ্যামিতিবক্সে ভরে নিয়ে এসেছিলাম ক্লাসে। মনোযোগী ছাত্র তুহিনের মাথাতে ওটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। সেই পিঁপড়াদের নিয়ে সেলফি তোলা হচ্ছে? স্বভাবতঃই সবার পিত্তি জ্বলে গেল।
আসাদ বললো, “সিঁড়ি পর্যন্ত চল। তারপর সবাই ঘুরে আসবি। সিরিয়াস মুখ নিয়ে ক্লাসে ঢুকে যাবি আবার। ভাবটা করবি এমন, যেন ম্যাডাম আসতেছে।”
আমি আপত্তি জানালাম, “একটু আগে ম্যাডাম এসে অ্যাটেনডেন্স নিয়ে গেছে, এতো তাড়াতাড়ি কথাটা ভুলবে না ওরা। বুঝে যাবে যে আমরা ব্লাফ দিতেসি।”
আসাদ বললো, “আরে দ্যাখ না কি হয়!”
আমরা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। বিশাল এক দল। এতোই বিশাল যে সবার হাতে একটা করে হকি ব্যাট থাকলে রুয়েট ফাঁকা হয়ে যেত আতঙ্কে। এবং সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে ইউ টার্ন মেরে দ্রুত গতিতে ক্লাসের দিকে ফিরে আসতে শুরু করলাম। শেষ কয়েক পা ফেলতে হলো দৌড়ের ভঙ্গিতে।
পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকার আগে আড়চোখে দেখলাম। ডেয়োপিঁপড়াদের গাছের সামনে দৃশ্যটা হয়েছে দেখার মতো। চারটা মেয়ে ওদিক থেকে প্রাণপনে দৌড়ে আসছে :v যে কেউ বলবে, ওদিক দিয়ে নির্ঘাত ISIS এর ট্রুপ ঢুকতে শুরু করেছে!
উর্ধ্বশ্বাসে তাদের পালানোর দৃশ্য দেখার পর আমরা সফল যুবসঙ্ঘ আবারও বের হলাম। এবার ফর রিয়েল। অ্যাডবিল্ডিংয়ের তলায় পৌঁছানোর পর যখন আমাদের হাসির ভলিউম মোটামুটি কমে এসেছে, তখন আবারও যুক্তিবাদী সত্তা জেগে উঠলো ভেতরে।
বললাম, “বুঝলাম না, ম্যাডাম তো এসে আমাদের অ্যাটেনডেন্স নিয়ে গেছিলো। তারমানে এই ৫০ মিনিটের মধ্যে আর কারও আসার কথা ছিলো না। কিন্তু ওরা পালালো কেন?”
“ওরা পালালো কেন”র উত্তর দিলো কাফি।
সে বললো, “এটা হল প্যানিক। আমাদের দৌড়াতে দেখে ওরা প্যানিকে পড়ে গেছিলো। প্যানিকে পড়ে গেলে লজিক কাজ করে না আর।”
আমরা একমত হলাম, প্যানিকে পড়ে গেলে লজিক কাজ করে না। তাহলে গার্মেন্টস ইত্যাদিতে আগুন ধরে যাওয়ার পর হতাহতের সংখ্যা অনেকটা কমে আসতো।
তবে, আমার মধ্যে “প্যানিকে পড়ে গেলে লজিক কাজ করে না” লাইনটা ভাল রকম প্রভাব রাখলো। প্র্যাক্টিক্যাল উদাহরণ পেয়েছি, মানব মনস্তত্ব।
মাথা থেকে ওই লাইনটা আজও বের হয়নি। গল্প লিখে তাকে বের করা হল।
ধাওয়া পরিকল্পনাকারী আসাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা 3:)

রচনাকাল : ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৫।

(আমার জন্মদিন। নিজের জন্মদিন, ঈদ, কিংবা অন্য কোনও বন্ধে আমি নিজেকে ছুটি দিয়েছি বলে মনে পড়ে না।)

পোয়েটিক জাস্টিস

‘সিরাজ সাহেব!’

সিরাজ সাহেবের কলিগ এই নিয়ে ষষ্ঠবারের মত সিরাজ সাহেবের মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। সহকর্মীর ডাকে হঠাৎ-ই যেন নিজের মাঝে ফিরে আসেন সিরাজ আকবর।

‘জ্বী ভাই। বলেন।’
‘তো – যা বলছিলাম!’ বেশ বিরক্তির সাথে একবার সিরাজের দিকে তাকিয়ে বলেন রিজওয়ান রহিম , ‘ইয়ে – কি জানি বলছিলাম?’
‘আপনার ছোটভাইয়ের বিয়েতে আপনার স্ত্রীর মধ্যে একটি বানর ঢুকে পড়েছিল।’ চটপট রিজওয়ান সাহেবকে মনে করিয়ে দেন সিরাজসাহেব।
মহা খাপ্পা হয়ে তার দিকে তাকান রিজওয়ান, ‘এতক্ষণ এই শুনছিলেন? আমি বলেছিলাম আমার স্ত্রীর ছোটভাইয়ের বিয়ের মধ্যে একটি বানর ঢুকে পড়ে।’
‘ওহ!’ নিজের ভুলটি বুঝতে পেরে বলেন সিরাজ সাহেব। ‘তারপর?’
‘তারপর তো বোঝেনই – কি একটা হুলুস্থুল কান্ড বলুন দেখি…’

রিজওয়ান সাহেব তাঁর শ্যালকের বিয়েতে ঘটে যাওয়া হুলুস্থুল কারবারের ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সিরাজ সাহেব। এই মহাবাচাল কলিগ নিয়ে হয়েছে সমস্যা। সারাদিন অফিসে বসে বসে উষ্ঠুম ধুষ্ঠুম গল্প ছাড়া! কাজের বেলায় ঠন ঠন। সরকারী চাকরি – একটু ঢিমে তালে কাজ করলে কারই বা আসে যায়? তাই বলে তাকে জোর করে সেসব শোনাবার দরকারটা কী সেটাও তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। প্রবল বিরক্তি নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি।

এমন সময় জানালায় জিনিসটা দেখতে পেলেন সিরাজ সাহেব। একটা মানুষের মাথা, গলা, তারপর গোটা ধড়!
চোরের মত নিচ থেকে দেওয়াল বেয়ে বেয়ে উঠে এসেছে কেউ এই চারতলায়! আঁতকে ওঠেন সিরাজ সাহেব। জানালাতে কোন গ্রীল নেই। চোরটা ভেতরে ঢুকে যাবে তো!

কোন কথা না বলে সিরাজ সাহেব অফিসের জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন।
জানালা খুললেন।
এবং এক ধাক্কাতে চোরটাকে ছিটকে ফেলে দিলেন চারতলা থেকে নিচের দিকে।
হাহাকার করে উঠলেন রিজওয়ান সাহেব, ‘করলেন কি! করলেন কি!! মেরে ফেললেন তো মানুষটাকে!’

*
জানালা থেকে উঁকিঝুঁকি মারছেন দুইজন মাঝবয়েসী মানুষ।
নিচে একেবারে তিনভাঁজ হয়ে পড়ে আছে একটা চোর। সেটা দেখে সাত দিন কালোপতাকা উত্তোলনের ঘোষণা দিলেন রিজওয়ান সাহেব।

‘খুনই করে ফেললাম দেখছি!’ বেশ অবাক হয়ে বলেন সিরাজ সাহেব।
‘চমৎকারভাবে!’ তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন রিজওয়ান সাহেব, ‘আর বলবেন না, সেবার হয়েছিল বটে এমন একটা দুর্ঘটনা। রাতের বেলায় চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি নিয়ে ফিরছিল আমার বড় ছেলে। হঠাৎ দেখতে পায় – রাস্তার মাঝে এক নিঃসঙ্গ মেয়ে ওকে গাড়িটা থামানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে! বুঝলেন সিরাজ সাহেব – অন্ধকার রাস্তায় কখনও কারও কথায় গাড়ি থামাবেন না। আরে, আপনি তো জানেন না পথচারীটির মনে কি আছে – তাই না? ’

সিরাজ সাহেবের ইচ্ছে করছিল বাচালটার মুখ চেপে ধরতে।
শালার মুখ কয়টা? সারাদিন বক বক করেও কি এর মুখ ব্যথা করে না? নিচে একটা লাশ পড়ে আছে – ওটার ব্যবস্থা কি করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি – আর আরেকজন আছে ঢাকা-চিটাগং রোডের নিঃসঙ্গ মেয়ে নিয়ে!

ভাগ্য ভালো একটা কাভার্ড ভ্যানের ওপর পড়েছে মরাটা। নাহলে এতক্ষণে রাস্তার লোকজনের ত্রাহি ত্রাহি চিৎকারে এলাকা প্রকম্পিত হত!

পিয়ন তসলিমের ডাকে দুইজনই বাস্তব জগতে ফিরে আসেন।
‘স্যার? ভেতরে আসতে চান উনি।’
চট করে ঘুরে দাঁড়িয়েই জানতে চান সিরাজ সাহেব, ‘উনিটা কে?’
‘পুলিশের গোয়েন্দা স্যার। কী নাকি কইব আপনাদের।’

“ওরে খাইছে!” – হার্টবীট মিস করেন সিরাজ সাহেব। এরই মাঝে পুলিশের লোকও চলে এল!
এবার সব শেষ!
নিজ নিজ চেয়ারে ধপাধপ বসে পড়েন দুইজনই।

‘সিরাজ সাহেব, ধাক্কাখান কিন্তু আপনি দিয়েছেন। জানি না কিন্তু কিছু আমি।’ স্বার্থপরের মত বলেন রিজওয়ান।
‘কিয়ের ধাক্কা! বাইরে উনি খাড়ায়া আছেন। ডাকুম না?’ জানতে চায় পিয়ন।
‘আসতে বল।’ দুর্বল গলায় বলেন সিরাজ সাহেব। এখন একে ঢুকতে না দিলে আরও প্যাঁচগি লাগবে পরে – কোন সন্দেহ নেই।

দেখা গেল অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ভেতরে চলে এলো লোকটা। চোখ দিয়ে এঁকে মাপেন সিরাজ সাহেব। ছয়ফিটের কম হবে না লম্বায়। তারওপর দশাসই শরীর। সিরাজ সাহেব চোরের বদলে একে ওই অবস্থায় ধাক্কা মেরে ফেলতে পারতেন না জীবনেও। উল্টো নিজেই ছিটকে পড়তেন ভেতরে। সেই সাথে এর কুঁতকুঁতে চোখজোড়া। অফিসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেবারে লেজার টার্গেটের মত।
পুরাই পেশাদার! খুনের গন্ধেই চলে এসেছে!

‘ডিটেক্টিভ নিয়াজ। পুলিশের গোয়েন্দা আমি।’ নিজের পরিচয় দেন গোয়েন্দা মহাশয়।
‘জ্বি জ্বি!’ বলেন সিরাজ সাহেব।
‘আপনাদের অফিসেই এসেছে পেশাদার খুনী কিসমত। এটা আমাদের বিশ্বস্ত সূত্রের খবর।’
‘জ্বি জ্বি!’ এবার বলেন রিজওয়ান সাহেব।
‘ঘাবড়াবেন না। এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল। আমিও ওই ব্যাটার পিছু পিছু এসে পড়েছি না? দেখলাম দেওয়াল বেয়ে টপাটপ উঠে পড়ছে!’
‘জ্বি? জ্বি?’ এবার ভড়কে যাওয়া গলায় বলেন দুইজনই।

ব্যাটা দেখা যাচ্ছে আস্ত খুনী। চোর ভেবেই ভুল করেছিলেন ওঁরা।
ভেতরে ভেতরে বেশ স্বস্তি অনুভব করেন সিরাজ সাহেব। আগাগোড়া এক খুনী মানুষকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলাটা খারাপ কি? মরেছে বেশ হয়েছে!
তবে ডিটেক্টিভের ঠান্ডা চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের ফাঁসীর দড়ি দেখতে পান উনি।

নিয়াজ কিন্তু এর মাঝেই একটা ছবি বের করে ফেলেছে।
‘একে দেখেছেন? এ-ই হচ্ছে পেশাদার খুনী কিসমত। ডেঞ্জারাস লোক!’

ছবি দেখে চেনেন না অবশ্য দুইজনের কেউই। এত সময় পেয়েছেন নাকি তাঁরা? উঠতে না উঠতেই তো ব্যাটাকে এক ঝটকায় নিচে ফেলে মেরে ফেলেছেন।

‘দেখিনি একে।’ নিরুত্তাপ গলায় বলেন সিরাজ সাহেব।
‘দেখলে আপনাকে জানাব। খুনীটি যে এ বিল্ডিংয়েই ঢুকেছে তা আপনি একেবারে নিশ্চিত?’ আগ বাড়িয়ে জানতে চান রিজওয়ান সাহেব। বিস্ময়ের ধাক্কাটা কিছুটা হলেও সামলে নিয়েছেন ইনি।
‘হুঁ। আমার ফোর্সকে ডেকেছি অবশ্য। বিশ মিনিটের মাঝেই চলে আসবে আশা করি। বিল্ডিং ঘেরাও করে আজ ওকে খুঁজে বের করব। তবে এর মাঝে সে কেটে পড়লে তো সমস্যা। কাজেই আপনাদের ডিস্টার্ব দিচ্ছি।’ উঠে দাঁড়ায় গোয়েন্দা, বের হতে হতে আবার মাথা ঘুরায়, ‘সাবধানে থাকবেন। ওই চেহারার কাওকে দেখলে সাথে সাথে জানাবেন পুলিশকে। আমি অন্য রুমগুলো খুঁজে দেখি।’

ডিটেক্টিভ বের হয়ে যেতেই হুড়মুড় করে টেলিফোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন সিরাজ সাহেব।

‘ওপরের লেভেলে লোক আছে নাকি আপনার?’ অবাক হয়ে জানতে চান রিজওয়ান সাহেব।
‘না।’ স্বীকার করেন সিরাজ সাহেব, ‘তবে নিচের লেভেলে আছে!’

*
মিসেস সিরাজ চোরের মত পুরাতন ফ্রিজ থেকে একগাদা গরুর গোশত নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন। উদ্দেশ্য – আজকের রান্না তিনিই করবেন। কাজের বুয়াকে তো খেদিয়েছেনই – কাজের একটা ছেলে ছিল ; তাকেও বলে দিয়েছেন রান্না ঘরে ঘুর ঘুর না করতে। কাজেই কাজের ছেলেটা ডোরেমন দেখতে লেগে গিয়েছে মনের সুখে। আর মিসেস সিরাজ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রান্না নিয়ে।

ডোরেমনের এই এপিসোডটা আবার লুৎফরের দেখা।
প্রতিটি ক্যারেকটারের মুখ থেকে ডাবিংকৃত হিন্দী বের হচ্ছে – তার সাথে তাল দিচ্ছে সিরাজ সাহেবের বিশ্বস্ত কাজের ছেলে।
মনোযোগটা ধরে রাখতে পারলে তার আজকে আরও কিছু নতুন হিন্দী শব্দ শেখা হত – জানে লুৎফর ; কিন্তু ম্যাডামের চিৎকারে ধ্যানটা ভেঙে গেল তার।

‘ভিনেগারের বোতলটা ফ্রিজ থেকে নিয়ে আয় তো লুৎফর!’
বাংলাতে ‘চুল’ শব্দটাকে হিন্দীতে তিনবার ডাবিং করে হাঁটা দেয় ও। এই বাসার সবাই পেয়েছে একটা নাম – লুৎফর! কাজের বুয়া রহিমা পর্যন্ত কারণে অকারণে ওকে ডেকে ফরমায়েশ খাটায়। আরে – ছোট ছোট কাজ নিজে করে নিলে কি এমন ক্ষতি, অ্যাঁ? ভিনেগারের বোতল ফ্রিজ থেকে নিজে আনতে পারে না?
একদিন এই মহিলার ফ্রিজে আস্ত একটা লাশ ভরে রাখবে – প্রতিজ্ঞা করল চৌদ্দ বছরের লুৎফর।

ফ্রিজের ডালা তুলেই অবাক হয়ে যায় ছেলেটা! আবার দড়াম করে নামায় ওটা।
‘আম্মা!!’

ম্যাডামও দৌড়ে আসেন রান্নাঘর থেকে।
‘চিক্কুর পাড়স ক্যান?’ বিরক্তির চোটে খাস ভাষায় বলেন তিনি।
‘ঘরত চোর ঢুকছে!’
‘কি বলিস?’ হাতের কিচেন নাইফ দুলিয়ে বলেন মিসেস।
‘ফ্রিজের ভেতর!’
আর শুনতে চাইলেন না মিসেস সিরাজ, চট করে ছুরিটা লুৎফরের হাতে দিয়ে বললেন, ‘গেঁথে দে! গেঁথে দে! ফেঁড়ে ফেল ব্যাটাকে!’
*

ড্রাইভার মফিজ মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে স্যারের হাতের দশ হাজার টাকার নোটের বান্ডিলের দিকে।
তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা নেয় ও।

‘শুধু এটুকুই করন লাগবো আমার?’ অবাক হয়ে জানতে চায় মফিজ।
‘হ্যাঁ। এখন ভাগো তো!’ মহাবিরক্ত হয়ে বলেন সিরাজ সাহেব।
মাথা নিচু করে নিজের ট্রাকটা ছেড়ে চলে যেতে থাকে ড্রাইভার।

স্মরণশক্তিকে ধন্যবাদ দেন সিরাজ সাহেব। সকালেই মফিজের ট্রাকটাকে ওখানে দাঁড় করতে দেখেছিলেন বলে খোঁচা দিচ্ছিল তাঁর ব্রেইন। স্মৃতিটুকু ঠিকই ছিল। যেই ট্রাকের ওপর লাশটা পড়েছিল সেটা মফিজের ট্রাকই ছিল বটে। দ্রুত ওকে ফোন দিয়ে ট্রাক নিয়ে দুই ব্লক দূরে কেটে পড়তে বলেন তিনি – তবে ধীর গতিতে ড্রাইভ করে।
চাননি লাশের বাচ্চা লাশ পড়ে যাক মাটিতে।

তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে সেদিকে হাঁটা ধরেন সিরাজ সাহেব। এবং ড্রাইভার মফিজকে টাকাটা তুলে দেয়ার সময় বুঝতে পারেন ব্যাটা টেরই পায় নি কিছু। যদি জানত ছাদের ওপর একটা মরা নিয়ে যাচ্ছে, দশ হাজারে কখনোই রফা করত এই লোক! ড্রাইভিং সীটে উঠে বসে ট্রাকটা চালু করেন সিরাজ সাহেব। বাসায় নতুন কেনা ডীপ ফ্রিজটা একেবারে খালি।

ঠেলেঠুলে চেপে ঢুকালে এই মরাটা আঁটবে না?
আঁটা তো উচিত!

শান্তমুখে ড্রাইভ করতে বাসায় পৌঁছে গেলেন সিরাজ সাহেব।
ছাদের ওপর থেকে মরাটাকে নামানোটা এখন সময়ের দাবী। সেই সাথে ঝুঁকিপূর্ণও বটে।
তবুও বহু কসরত করে মরাটাকে নামালেন তিনি। চেহারা দেখে শীতল একটা অনুভূতি হয় তাঁর। একে চেনেন তিনি।
গোয়েন্দা নিয়াজ সকালে যার ছবি দেখিয়েছিল অফিসে – এই সেই লোক! কোন সন্দেহ নেই!

ডীপ ফ্রিজটার কানেকশন গতকালই দিয়েছিলেন। তবে ইচ্ছে করেই খালি রেখেছিলেন। আগে একদিন তো যাক!
একদিন যেতে না যেতেই উদ্বোধন হয়ে গেল অবশ্য! আস্ত একটা খুনীর খুন হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে।
ডীপ ফ্রিজে মরাটাকে পুঁতে কিছুক্ষণ ব্যাপারটার কাব্যিক দিকটা ভাবলেন তিনি।

তারপর সুড়ুৎ করে আবারও ট্রাকের ভেতর সেঁধিয়ে গেলেন। মফিজ এই ট্রাকের ড্রাইভার – মফিজকে ফেরত দিতে হবে গাড়িটা। ব্যাটাকে এত টাকা না দিলেও চলত!

সিরাজ সাহেব বাড়ি থেকে বের হতেই যে ঘটে গেল আরেক নাটক সেটা তিনি জানতেই পারলেন না!

*
‘হইন্নির ঘরের হইন্নি!’

এই নিয়ে দশবার মত বললেন মিসেস সিরাজ। মাথা নিচু করে শোনে লুৎফর।
‘হইন্নির পুতে কামটা করছে কি দেহ! এক্কেরে মাইরা ফালাইছে! হইন্নির ঘরের হইন্নি! খুন করে ফালাইলি যে এক্কেরে?’

মিসেস সিরাজের এহেন মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে পারে না লুৎফর, প্রতিবাদ জানায়, ‘আপনেই না কইলেন একেবারে গাঁইথা ফেলতে?’
‘না। আমি কই নাই।’ বেমালুম অস্বীকার করে বসেন এবার সিরাজ গিন্নী। সখ করে খুনের আসামী কে-ই বা হতে চায়? লুৎফরের হাতে খুন করা ছুরিটা – জেলে যাবে লুৎফর। তাঁর এতে মাথা ব্যাথা কি?

আহত দৃষ্টিতে মালকিনের মুখের দিকে তাকায় লুৎফর। এই শালি তাকে ডুবাবে জানলে এখানে কাজ করতে কে আসত? নেহায়েত একটা মাঝারি মানের বেতন পাওয়া যায় আর ডোরেমনটা দেখা যায় রেগুলার – তাই এখানে কাজ করতে আসা।
এখন দেখা যাচ্ছে এরা ভীষণ পল্টিবাজ মানুষ!

‘আঁই কি করতাম এহন?’ অবশেষে দিশেহারার মত বলে লুৎফর।
‘লাশটারে গুম কর, হইন্নির ঘরের হইন্নি!’ এমন চিৎকার ছাড়েন মিসেস সিরাজ যে আরেকটু হলেই ঘুম ভেঙ্গে যেত এমনকী মরাটারও!
ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে লুৎফর। লাশ গুম করার এতশত টেকনিক ও কি আর জানে?
এর চেয়ে এই ‘হইন্নি’ মালকিনকে খুন করে ফেলাটাই সহজ মনে হচ্ছে। শালির মুখের গর্ত বেশি বড় হয়েছে। খুন করিয়ে বলে কিছু করে নি! ‘হইন্নি’ কোথাকার!

হাত নিশপিশ করলেও নিজেকে ধরে রাখে লুৎফর। এই মহিলাকে গেঁথে ফেললে নির্ঘাত ওকে পুলিশ খুঁজবে। তার চেয়ে মালকিনের কথামত শালার লাশটা গুম করতে পারলে কাজ হয়ে যাবে, জ্বালাবে না কেউ সহজে।
ডেডবডি নাই মানে খুনও হয় নি। সোজা হিসেব।
কিন্তু এখন এই মরাটাকে ফেলা যায় কোথায়? দুইজন বেকুব মানুষ মগজের ধীরগতির কোষগুলো খাটিয়ে উপায় খুঁজতে থাকে!

*
সালাউদ্দীন বেশ রাত করে আজ বাড়ি ফিরল।
আজকের কাজটাতে আরেকটু হলেই ঘাপলা লেগে যাচ্ছিল! কোনমতে ফাঁড়া কেটে বেড়িয়ে এসেছে!

সালাউদ্দীন পেশায় খুনী। টাকা পেলেই লাশ নামিয়ে দেয়। এতদিন বেশ সফলতার কারণে মাছি মারতেও ওকে ভাড়া করা হয় – হাতি মারতেও ওকে ভাড়া করা যায়! তবে ও টার্গেটের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না – যতদিন টাকার অংক ঠিক থাকে।

আজ সরকারী কার্যালয়ের এক কর্মকর্তাকে ‘ফেলতে’ গিয়ে ধরা প্রায় পড়েই গেছিল আর কি!

সকাল সকাল ওখানে ঢুকে পড়তে কোন সমস্যা হয় নি। তিনতলায় টার্গেটের অফিস – কিন্তু ঝামেলা একটা ছিল। ওকে বাইরের পার্সোনাল সেক্রেটারির নাকের সামনে দিয়েই ঢুকতে হবে এবং বেরুতেও হবে। ঢোকা তো সমস্যা না – কিন্তু বের হলে একটা সমস্যা থেকেই যায় – দেখা যাবে ও বের হতেই কোন কাজে লাফিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল সেক্রেটারি মেয়েটা।
কিন্তু তাহলে খুনের মিনিট দুইয়ের মাঝেই বুঝে ফেলতে পারে ঝামেলা কিছু একটা হয়েছে!

আবার সালাউদ্দীন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর যদি সেক্রেটারি মেয়েটা ও ঘরে ঢোকে, তবে কোন সমস্যা নেই তার। ততক্ষণে সে পগার পার হয়ে যাবে। কিন্তু ও বেরিয়ে যাওয়ার দুই মিনিট পর যে ঢুকবে না তারই বা গ্যারান্টি কি? তখন চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলবে না? বিল্ডিং থেকে বেরুনো কঠিন হয়ে যাবে না সালাউদ্দীনের?

কাজেই হেভী পেপারওয়েট মেরে টার্গেটের মাথা অর্ধেক দাবিয়ে দেয়ার পর গ্রীলবিহীন জানালা দিয়ে ভেগে যাওয়ার প্ল্যানটা করে ফেলেছিল টার্গেটের রুমে ঢোকার পর। সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে ঢুকেছে – কাজেই টার্গেট ওকে মোটেও সন্দেহ করেনি। এবং তারপরেই হয়ে গেল ঝামেলা!
মাঝারি স্বাস্থ্যের মানুষটার চাঁদিতে পেপারওয়েটটা বসিয়ে দিতেই ব্যাটা দুটো লাফ দিয়ে জানালা গলে নিচের দিকে পড়ে গেল। উঁকি দিয়েই সালাউদ্দীন বুঝে যায় – ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে গেছে! খুন হয়ে মানুষটা পড়েছে একটা কাভার্ড ভ্যানের মাথায়!

পরিকল্পনা ঠিক রেখে তিনতলার জানালা দিয়ে টিকটিকির মত চারতলার দিকে উঠতে থাকে ও। উদ্দেশ্য – একটা ফাঁকা জানালা পেলেই ভেতরে ঢুকে যাবে এবং সেক্রেটারি মেয়েটাকে বুঝতে না দিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাবে ও। ওর অন্তর্ধান বুঝতে বুঝতে এক মাইল দূরে সটকে পড়তে পারবে সালাউদ্দীন।

তবে চারতলায় উঠেছে কি ওঠেনি – বেদম এক ধাক্কায় কার্নিশ থেকে হাতই ছুটে যায় বেচারার!

*
মফিজ কথা শুনেছে। কারও কাছে মুখ খুলবে না ছোকড়া।
ত্রিশ মিনিটের জন্য ট্রাক থেকে দূরে থাকলে যদি স্যার দশ হাজার টাকা দেয় তাহলে মন্দ কি? এই পরিমাণ টাকা তো ও ত্রিশ মিনিট ট্রাক চালিয়ে কোনদিনও রোজগার করেনি!

বেশ খুশি মনে একটা রিকশা নেন সিরাজ সাহেব। বাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত মাথাটার ছুটি। ওখানে দিয়েই ব্রেনটাকে দ্বিগুণ উৎসাহে খাটাতে হবে। একটা খুনীর খুন হয়ে যাওয়া শরীর সরাতে হবে ফ্রিজ থেকে!
রিকশাওয়ালাকে দশটা টাকা বেশিই ভাড়া দেন আজ।
মুখে গানের কলি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন। দীর্ঘাঙ্গী অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে একগাল হেসে শুভেচ্ছাবাচক কিছুও বলেন।

প্রতিউত্তরে হাসেন স্ত্রীটিও। জানান, ‘গরুর গোশত রাঁনছি। খাবা আসো।’
‘তুমি যাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’ স্ত্রীকে এটা বললেও খটকা লাগে সিরাজ সাহেবের।
আজ তাঁর কোট খুলে নিয়ে কোটস্ট্যন্ডে না রেখে চট করে আয়েশার মুখে খাবারের কথা কেন? কিছু টের পেয়ে গেছে কি?

ফ্রিজের ডালা উঠাতেই উনার মেজাজ উঠে গেল তুঙ্গে! শালার মরাটা গেল কোথায়?
‘আয়শা!’ বিল্ডিং কাঁপিয়ে ডাকলেন সিরাজ সাহেব।
স্বামীপ্রবরের হুংকারে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন মিসেস সিরাজ। এবং ডালা তুলে কিছু খুঁজতে থাকা স্বামীটির দিকে একনজর তাকিয়েই যা বোঝার বুঝে ফেলেন তিনি।
‘আরে আরে চিল্লাও কম। হইন্নির পুতে চোর আছিল।’

অবাক হয়ে তাকান সিরাজ সাহেব। স্ত্রীটি ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে বোঝাচ্ছে – নতুন ডীপ ফ্রিজের ভেতর জমাট বাঁধা রক্ত দেখে অশান্ত হওয়ার কিছু নেই। এক চোর ভেতরে ঢুকে বসে ছিল বলেই তাকে লুৎফর ছুরি গাঁথিয়ে দিয়েছে! নিজেই যে ছেলেটাকে হুকুম করেছিলেন সে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ চেপে যান আয়েশা স্বামীর কাছে!

সিরাজ সাহেবও বেশ তিরস্কার করেন সবটা ‘শুনে’ – এবং নিজেই যে ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে চারতলা থেকে মেরে ফেলে এখানে এনে গুম করেছেন সে ব্যাপারেও চেপে যান।

‘লাশটা কোথায়?’ খাবার টেবিলে বসে ভয়ে ভয়ে জানতে চান সিরাজ সাহেব।
তাঁর প্লেটে বড় দেখে একটুকরো গোশত তুলে দেন মিসেস সিরাজ। আর মিটি মিটি হাসেন শুধু।
এক কামড় দিয়েই ওদিকে সিরাজ সাহেবের সন্দেহ হতে শুরু করেছে ওই ব্যাটা খুনীকে নির্ঘাত রেঁধে ফেলেছে আয়েশা! ভালো রান্না পারার ব্যাপারে মহিলার সুখ্যাতি আছে।

ছোট ছোট পিস করে মানুষটাকে হাঁড়িতে চাপিয়ে দিলে কি সিরাজ সাহেব ধরতে পারবেন আসলেই? পারার তো কথা না। কাটার পর সব এক। কী মানুষ আর কী গরু!
সিরাজ সাহেব টের পেলেন তাঁর গলা দিয়ে ভাত নামছে না। তিনি ওই অবস্থাতেই আরেকবার ভাঙ্গা গলায় জানতে চান, ‘লাশটা কোথায়? আর লুৎফরকেও দেখছি না অনেকক্ষণ! ও কোথায়?’
‘লুৎফরকে ছাদে পাঠিয়েছি।’ মিটি মিটি হাসিটা ধরে রেখেই বলেন মিসেস সিরাজ।

*
সালাউদ্দীন বেশ আয়েশ করে পোশাক ছাড়ে।

কাঁধের কাছে ছড়ে গেছে। এটা কিভাবে হল সেটাও ভালো করেই জানে সালাউদ্দীন। চারতলা পর্যন্ত কোনমতে উঠতেই মোটকা এক লোক এসে চট করে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় নিচে!
বিশফিট নেমে গেছিল সালাউদ্দীন সাথে সাথেই! কোনমতে দোতলার কার্নিশটা ধরে রক্ষা পায় বটে ও – তবে নিচের লাশটা সরানোর বুদ্ধি তার মাথাতেও একটা চলে আসে ঝটপট!

বরাবর সেই দোতলার রুমে কেউ ছিল না তাই রক্ষে। সেখান দিয়ে বের হয়ে সোজা চারতলায় চলে আসে সালাউদ্দীন।
বাইরে এক পিয়নকে দেখা গেল, তাকে থামিয়ে নিজের গোয়েন্দা পরিচয় দেয় সালাউদ্দীন। ভেতরে ঢুকে অবশ্য বেশ মজাই পায়! লোক দুটো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে!
লোকদুটো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কেন ভয় পেয়ে গেছে বুঝে ও। ওরা ভেবেছে ধাক্কা দিয়ে সালাউদ্দীনকেই নিচে ফেলে মেরে ফেলেছে!

ভয়টা কাজে লাগিয়ে বেশ ভড়কে দেয় সালাউদ্দীন দুই সরকারী চাকুরিজীবিকে। টার্গেটের ছবি সাথে ছিল – ওটাও কাজে লাগায়!
ফলাফলও আশানুরূপ ছিল। ট্রাকটা চালিয়ে সরে যায় ড্রাইভার এভিডেন্স নিয়ে।
খুনটা কল্পনাতীতরকম সফল হল অবশেষে! লাশ গুমের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় আর কেউ নিয়ে নিয়েছে!

কড়মড় শব্দে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। লাফিয়ে উঠতে যাবে সালাউদ্দীন – ঘাড়ের ওপর জগদ্দল পাথরের মত পড়ে থাকা দেহটা নিয়ে নড়তেও পারে না!
ঘাড়ের ওপর থেকে মানুষটাকে নামিয়ে আঁতকে ওঠে সালাউদ্দীন। ওপরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায় টিনশেডের চালা ফুটো হয়ে গেছে একেবারে – সে পথেই নেমে এসেছে ওর ঘাড়ে পড়া লোকটা।

লোকটাকে ও চেনে। আজ সকালেই মেরে রেখে এসেছে ওর অফিসে গিয়ে।
মরাটা এখানে এল কিভাবে?
আতঙ্কে চোখে অন্ধকার দেখে সালাউদ্দীন।

*
রাত দুটো বাজে।
থানায় ঢিমে তালে কাজ চলছে। টহল ভ্যানগুলো আজ যেন কোন রিপোর্ট দিচ্ছে না। একেবারেই অপরাধশূন্য এই রাতটা।

ওসির রুমে এসে স্যালুট ঠুকল একজন কন্সটেবল। ‘স্যার?’
‘হুঁ?’ ভারিক্কী চালে বলেন ওসি।
‘বাইরে একজন লোক ছিল, স্যার!’
‘তাতে আমাদের কি? বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র!’ একটু বিরক্ত হন ওসি মানুষটা।
‘লোকটার কাঁধে একটা খুন করা ডেডবডি স্যার।’
‘হাজতে ঢোকাও নি এখন?’ লাফিয়ে দাঁড়ায় ওসি।
‘ঢুকিয়েছি।’
‘চলো, আমি দেখব ওকে!’

হাজতের সামনে এসে হতাশ হন ওসি। একেবারেই সাধারণ একটা মানুষ।
বিড় বিড় করে কি জানি বলছে!

কাছে এসে কান পাতেন ওসি, শুনতে পান একটা কথাই, ‘স্যার, আমারে ফাঁসী দেন স্যার! আমারে রহমতুল্লাহর ভূতে মাইরা ফালাইব স্যার। আমি ভূতের হাতে মরতে চাই না। আমারে ফাঁসী দেন স্যার!’

ঘাড়ের কাছে শির শির করে ওঠে ওসির।

===

রচনাকাল ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৪ 

ফ্লেমথ্রোয়ার

শোভনের হাত সুড় সুড় করছে সামনের মেয়েটার ব্যাগে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার জন্য।

মেয়েটা একেবারেই নিরপরাধী সেটাও না। কাজেই আগুন লাগানোর পরে কোন ধরণের  অনুশোচনা অনুভব করবে কি না সে ব্যাপারে পঞ্চম বার নিজেকে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হল অনুশোচনার ভয় এখানে নেই। বিবেক গ্রীণ সিগন্যাল দিচ্ছে।

বিবেককে একটা স্যালুট ঠুকে দিয়ে শোভন আস্তে করে ফ্লেমথ্রোয়ারটা বের করে।

নিজস্ব সৃষ্টি। কাজেই নিরাপদেই আগুন জ্বলে।

সুন্দরী হয়েছে বলে আর কাওকে মানুষ মনে না করার শিক্ষা এই মেয়েকে হাতেনাতে দেওয়া হবে।

ঘটনা আর কিছুই না। বাসে উঠে শোভন বাম দিকের নারী,শিশু আর প্রতিবন্ধিদের সীটগুলো সবসময়ই এড়িয়ে চলে। আজও সেই ধারা বজায় রেখে ডান দিকের একটি সীটে ভদ্র ছেলের মত বসে ছিল শোভন। মেয়েটা উঠেছে ওরও আগে। পাবলিক বাস কাজেই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুড়হুড় করে যাত্রী বেড়ে যেতে লাগল।

তিন স্টপেজে যেতে না যেতেই বাসে লোক আর বসার জায়গা পাচ্ছে না। নতুন যারা উঠেছে সবাই দাঁড়িয়ে।

‘ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন? ঘরে কি মা-বোন নাই?’

নারীকন্ঠের সুতীক্ষ্ণ কন্ঠে শোভনের দুই কান থেকে বেশ কিছু পোকা একেবারে মিলিটারি স্টাইলের স্যালুট ঠুকতে ঠুকতে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে নিচু কন্ঠে একবার’হাস্তালা ভিস্তা’ বলে যেতে ওরা ভোলে না।

পরিস্থিতি বেশ কৌতুহলকর। কাজেই শোভন তাকায় এবার চিৎকারের মূলকারণ খুঁজে বের করতে।

শোভনের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা সম্ভবতঃ কলেজে পড়ে। একেবারেই আঁতেল প্রজাতির। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানো এর কাজ না। অহেতুক সুন্দরীটা গোবেচারা ছেলেটাকে বকে দিয়ে বাসভর্তি লোকেদের জানালো ’আমার দিকে কিন্তু ছেলেরা তাকায়! হুঁ হুঁ। কেউ বাকি আছ নাকি আমাকে দেখতে? দেখে নাও তবে!’

তার ধারণা নির্ভুল। বাসের প্রত্যেকেই কম হলেও একবার করে তাকিয়েছে। শোভনই বা বাদ যাবে কেন?

হুঁ দুধে আলতা চামড়া, কুচকুচে কালো চোখ আর সেই সাথে মানিয়ে গেছে কুচকুচে কালো চুল। মুখের গড়নটাও দেখার মত। অদ্ভুত সুন্দর।

মাথা দোলায় শোভন। আরে তুমি নাহয় বেশ দেখতে। তাই বলে আঁতেল সমাজের পেছনে লেগে নিজের খ্যাতি বাড়াবে নাকি? দুধে আলতা রঙের চামড়া নিয়ে বাহাদুরীর কি আছে? এই তো গত ঈদেই শোভনরা একটা গরু কোরবানী দিল দুধে আলতা তার রঙ ছিল। একেবারে উড়ে গেছে না মুন্ডু? কোথায় ছুটে যাবে ভাব তখন!

সুযোগ পেতেই শোভন সুড়ুৎ করে মেয়েটার পেছনের সীটে চলে আসে। যাত্রীটি নেমে যাওয়ার জন্য উঠতে উঠতেই একলাফে সীট দখল।

ব্যাগের মাঝে ঘুমিয়ে আছে পিচ্চি একটা ফ্লেমথ্রোয়ার। আসলে কি জিনিস কে জানে? শোভন ওটাকে ওই নামেই ডাকে। বাকিদের নামকরণের দিকে এত কান দিলে হয়?

বন্ধু তন্ময় তো এক কথায় ওকে বলেই দিয়েছিল, ’তুই তো একটা কেশের হিন্দীরূপ বানিয়েছিস। একেবারেই সে জিনিস। ’

কিন্তু ওই নামকরণে তো আর ডাকা যায় না। তাই না? তাছাড়া যন্ত্রটা সাবলীলভাবে আগুনও মারতে পারে। কাজেই ফ্লেমথ্রোয়ার বলাই যায়। মাত্র তেইশ ইঞ্চি সামনে মেয়েটার হাতব্যাগ তার পাশেই পড়ে আছে সীটের ওপর।

ফস করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় শোভন। ব্যাগের মাঝে ফ্লেমথ্রোয়ার লুকিয়ে দিব্যি বাইরের প্রকৃতি উপভোগ করতে থাকে। শহরের মাঝে আর প্রকৃতি কোথায় ওই আর কি!

‘গরম লাগছে।’ সুন্দরীর বান্ধবী বলে।

‘হুঁ মেকাপের ভাজে চেহারা লুকিয়ে ফেলেছিস তাই গরম লাগছে!’ চট করে তার বান্ধবীকেও ধমকে ওঠে সুন্দরী! অথচ নিজেই মেরে এসেছে দুই কেজি ময়দা, সে খেয়ালই নেই।

পরমুহূর্তেই দুইজন চেঁচিয়ে ওঠে ’আগুন। আগুন!’

বাসের মাঝে এই চিৎকারের প্রতিক্রিয়া হল দেখার মত!

ঘ্যাঁচ করে এক ব্রেকে বাস থামিয়ে দিল ড্রাইভার সাহেব। এবং পরক্ষণেই লুঙ্গি মালাকোচা করে ড্রাইভারের পাশের ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে একেবারে ব্যাঙের মত ঝাঁপ দিলেন ইনি বাইরের দিকে।

শোভন অবাক হয়ে লক্ষ্য করে ফেসবুকে থাকুক আর না থাকুক বাস্তব জীবনে বাসড্রাইভারের ফলোয়ারের সংখ্যা নেহায়েত মন্দ নয়। বেশ কিছু জানালা খুলে গেল এবং বীরত্বের সাথে ফ্রি ফলের জন্য অনেকেই ডাইভ দিয়ে জানালা পেরুলেন। শুভ কাজে দেরী করতে নেই কি না!

সামনের সুন্দরী তরুণী যার জন্য জাতির এই দুর্দশা এখন, সে অবশ্য জানালা মেথডে গেল না। একছুটে একেবারে দরজার দিকে। যাওয়ার সময় খামচি দিয়ে জ্বলন্ত ভ্যানিটিব্যাগটা নিতে ভোলেনি! বান্ধবীটির সাহস আছে। ইনিও জানালা দিয়ে গেলেন।

আগুন যখন ফ্লেমথ্রোয়ারের মাথা থেকে বের হয় ভালোবাসা তখন জানালা গলে পালায়। কথাটার সত্যতা আজ হাড়ে হাড়ে প্রমাণিত। বেস্ট ফ্রেন্ডদুইজন কি না দুই ডিরেকশনে ছি ছি!

অগত্যা শোভন পিছু নেয় অগ্নী-তরুণীর। নিজেকে পোড়ালেও ব্যাগ ছাড়বে বলে তো মনে হয় না। মানুষ হত্যার দায় তো নিতে পারবে না শোভন। উদ্দেশ্য পঙ্কিল হলেও ততটা পঙ্কিল নয়। কাজেই ঝড়ে বক মেরে দেওয়ার ইচ্ছে আপাতত স্থগিত রেখে মেয়েটার পিছে পিছে নেমে আসে ও বাস থেকে।

বহুদূরে লুঙ্গি খুলে দৌড়াতে দেখা যাচ্ছে বাসড্রাইভারকে। সাহসিকতার জন্য উনার নিশ্চয় ঘরভর্তি মেডাল আছে!

এক থাবা দিয়ে মেয়েটার হাত থেকে ব্যাগটা ফেলে দিয়ে সেটার ওপর ট্যাংগো নাচা শুরু করে শোভন। মেয়েটা তো বটেই রাস্তার অন্যেরাও সেদিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে ওর নাচ দেখে। শোভন হাত নাড়িয়ে’কাম অন’ টাইপ একটা ভঙ্গি করলেও কেউ যোগ দেয় না তার সাথে। তবে তরুণীর দিকে আগ্রহ ভরে অনেকেই তাকায়। এই মেয়ে যোগ দিলে তারাও ট্যাংগো নাচে যোগ দেবে এটাই যে তাদের মনের ইচ্ছে সেটা বুঝে নিতে মাইন্ড রিডার হওয়া লাগে না!

অবশেষে নাচ থামে শোভনের। মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায় ও ব্যাগের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে।

‘ট্যাংগো নাচা উদ্দেশ্য ছিল না। আগুনটা নেভাতে একটু দাঁপাদাঁপি করতে হল আর কি।’ বিনয় প্রকাশ করে শোভন।

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। তারপর হুট করে কেঁদে ফেলে।

পোস্ট-ট্রমা শক। মাত্র ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার আকস্মিকতার ফসল ভাবল শোভন।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। চোখ থেকে পানি মুছে খেঁকিয়ে ওঠে মেয়েটা, ’খুব পাড়িয়েছেন! আমার আয়না আর সানগ্লাসটা ছিল না ব্যাগে?’

‘কিনে দেব আপনাকে। কথা দিলাম।’ ঝটপট বলে শোভন। চারপাশের জনতা একেবারে ক্ষেপে আছে নাচ দেখার জন্য। পায়নি। এখন মেয়ে ক্ষেপালে তো কথাই নেই। একেবারে পাটকাঠি বানিয়ে ফেলবে ওরা শোভনকে!

কিনের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পেলে আর কি চাই? একটা নির্মল হাসি ফুটে ওঠে মেয়েটার মুখে,হাত বাড়িয়ে আস্তে করে বলে, ’জুঁই। ’

হাত মেলায় ও, ’শোভন। আপনার বান্ধবী কোথায়?’

পিট পিট করে আসে জুঁই, ’আছে নাকি এতক্ষণে এখানে? বাসায় গিয়ে ডোরেমন দেখছে। যে মেয়ে তেলাপোকার বিষ্ঠা দেখলেই ভয় পায় সে আগুন দেখেও থাকে?’

চারপাশে খেয়াল করে শোভন। জনতা নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে।

‘তাহলে, ’ আসল প্রসঙ্গে চলে যায় জুঁই, ’কবে কিনে দিচ্ছেন?’

‘যেদিন বলবেন।’ দরাজ গলাতে বলে শোভন।

‘নম্বরটি দিন। এবং আমার কল যাওয়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকুন। পালাবেন উল্টোপাল্টা নাম্বার দিয়ে সেটি হচ্ছে না। ’

বিরক্তিকর বালিকা! তবুও ধৈর্য সহকারে নম্বর দেয় শোভন এবং দাঁড়িয়ে থাকে কলটা আসার আগ পর্যন্ত।

তারপর দুইজন দুইপথে।

কালো রঙের গাড়িটা পার্ক করা। ওটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে সন্দেহের দৃষ্টিতে একবার তাকায় শোভন।

সকালে বাসার পাশে এই গাড়িটাই ছিল না?

*

‘শোভন?’ অনেক দূর থেকে কেউ ডাকছে।

‘উম’ ঘুম ঘুম চোখে বলে শোভন।

‘শোভন!’ এবার কানের পাশে একেবারে হাঁকের মত শোনায় ডাকটা।

চোখ মেলেই আৎকে ওঠে ও একজন উল্টো হয়ে ঝুলছে সিলিং থেকে। দুই পা শক্ত করে বাঁধা। ঝলমলে চুলগুলো দুলছে মাথা থেকে কিন্তু এ অবস্থাতেও চোখে হাসি।

‘ডোন্ট ওরি। তোমাকে তুলে এনেছে ভুল করে। ’

নড়ার চেষ্টা করে শোভন স্পষ্টই বুঝতে পারে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ওর  না ঝুলন্ত বাবুর আছে।

একটু ডানে নড়তে গিয়ে অবশ্য ঝুলন্ত বাবুর কথার সার্থকতাও টের পায়। হাত পেছনে চেয়ারের সাথে বাঁধা ওর। শোভনকে ধরে এনে বেঁধে ফেলার মানে কি?

ধীরে ধীরে অবশ্য সব মনে পড়ে ওর। বাসার দিকে ফিরে যাচ্ছিল পড়ন্ত বিকেলে। গলিটা ছিল নির্জন। চট করে গাড়িটা থেমে ওর ঘাড় বরাবর এক বাড়ি দিয়ে সমবেগেই তুলে নিয়েছিল ভেতরে। একেবারেই আচমকা এই ঘটনার ব্যাখ্যা ও পায়নি। অবশ্য ব্যাখ্যা খোঁজার সময়ই বা পেল কোথায়?

সামনের ঝুলন্ত মানুষটার দিকে তাকিয়ে তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাসল অযথাই। নিজেরই উড়ে গেছে আত্মা, আরেকজনকে আশ্বস্ত করবে কি? ব্যাঙাচির মত দেখালো হাসিটা।

তারপর প্রশ্ন করল, ’আমরা কোথায়?’

‘জানি না। ’

‘কারা আমাদের ধরে এনেছে?’ আবার জানতে চায় শোভন।

‘জানি না। ’

সব প্রশ্নের একই উত্তর নাকি? ত্যক্ত শোভন এবারে জানতে চায়’ঝুলতে কেমন লাগছে আপনার?’

‘ওহ! চমৎকার! চমৎকার!’ এক কথায় জানায় অচেনা মানুষটা।

কিছুক্ষণ দুইজনই চুপ। শোভনের ব্যস্ত চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা ধারালো কিছুর জন্য। হাত কেটে সোজা ভেগে যেতে হবে এখান থেকে। কালো গাড়ি নিয়ে ফুটানি দেখানোর কিছু নাই। শোভনের বাবারও আছে একটা। কালো গাড়ি থাকলেই চটপট মানুষকে তুলে নিতে হবে এটা কোন কাজের কথা নয়।

‘লাভ নেই হে!’ শোভনের মতিগতি বুঝে নেয় ঝুলতে থাকা মানুষটা, ’কিছুই পাবে না যেটাতে তোমার উপকার হবে। এরা কাঁচা কাজ করে না। ’

‘কারা এরা?’ জানতে চায় শোভন দ্বিতীয়বারের মত।

‘যারা কাঁচা কাজ করে না।’ বলে লোকটা।

‘কারা কাঁচা কাজ করে না?’

‘প্রফেশনালস। ’

এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে শোভনেরও, গলা একটু চড়ে যায় ’সেটা আমি জানি। কিন্তু এদের তো নিজেদের একটা পরিচয় আছে?’

কথার জবাব না দিয়ে নিজের শরীর দোলাতে থাকে ঝুলে থাকা মানুষটা।

কচ জাতীয় একটা শব্দের সাথে সাথে দড়াম করে ওপর থেকে আছড়ে পড়ে নিচে। তারপর উঠে ঝেড়েঝুড়ে নিজের শরীর পরিষ্কার করতে থাকে। সেদিকে সরু চোখে তাকিয়ে থাকে শোভন।

‘নিজেকে অ্যামেচার বলে লোক হাসাবেন না প্লিজ।’ এর চেয়ে বেশি কিছু আসে না শোভনের মুখে।

‘না। তা বলব না। আমি রানা। মাসুদ রানা।’ শোভনের হাতের গিট্টু খুলে দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতে আসতে বলে রানা।

চোখ বড় বড় হয়ে যায় এবার শোভনের, ’বিসিআই?’

নাক কোঁচকায় রানা, ’কাজী আনোয়ার হোসেন। উফ!’

এবার অবাক হওয়ার পালা শোভনের, ’উনি আবার কি করলেন?’

‘লোকটার জ্বালায় আর পারা গেল না। কোথাও গেলেই হয়েছে। পরিচয় দিতেই ঝট করে জানতে চাইবে আমি বিসিআই কি না। আরে না বাবা। আমি শুধুই বিএটিএ। বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সী। ’

‘আগে নিশ্চয় বিসিআই-এ ছিলেন?’ চকচকে চোখে জানতে চায় শোভন।

‘আমি এখান থেকে বেড়িয়েই কাজী আনোয়ারের নামে মামলা করছি।’ ঘোষণা দিয়েই দেয় রানা।

‘ফাঁসালেন দেখি কার পক্ষ নেব’ বিড় বিড় করে বলতে বলতে শোভন দেখে রানা ঘরের একমাত্র দরজাটা পরীক্ষা করছে। মাছি বের হতে পারুক আর না পারুক ইনি বের হচ্ছেন এখান থেকে খুব শীঘ্রই, এটা স্পষ্ট।

কয়েক পা পিছিয়ে আসে রানা। শোভনের দিকে ফিরে বলে, ’একপাশে সরে থাকো। ’

একছুটে কাঁধের প্রকান্ড ধাক্কায় দরজা কাঁপিয়ে দেয় রানা। তবে ভাঙ্গে না!

সাথে সাথেই দড়াম করে দরজা খুলে যায় চামচিকের মত লোকটা ঢুকে আস্তে করে শুধু জানতে চায়, ’শব্দ কিসের? আর অ্যাই ছেলে তুমি নেমেছ কেন! ঝুলিয়ে না রেখেছিলাম?’

মাথা চুলকায় রানা, ’ইয়ে ঝুলে থাকতে ভালো লাগছিল না। অনেকক্ষণ হল তো। ’

একটু দ্বিধান্বিত হয় চামচিকেও, ’ও হ্যাঁ। তাও ঠিক। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। তা দরজা ধাক্কাচ্ছিলে কেন? আমার এককান ভর্তি গৃহপালিত পোকার যে ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছিল সে খবর আছে? ওদের আবার সাইনাসের ব্যাথা ওঠে রীতিমত!’

‘হেহে’ জাতীয় একটা দুঃখপ্রকাশের শব্দ করে রানা। এত মিষ্টিমধুর কথোপকথন হওয়ার পেছনে কাজ করে চামচিকেমুখোর ডান হাতে থাকা ভীমদর্শন পিস্তলটা।

রানার থেকে চারফুট দূরে দাঁড়িয়ে নিষ্কম্প হাতে অস্ত্রটা তুলে রেখেছে ওরই দিকে। একচুল ত্যাড়ামির লক্ষণ দেখলেই সোজা ওপরে তুলে দেবে মই ছাড়াই।

‘সময় হয়েছে। বস আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। এবার শান্ত শিশুর মত আমার পেছনে পেছনে চলে আসুন। ’

মাসুদ রানা আর শান্ত শিশু! শোভন আর কিছু বলে না। ভাষা হারানোর জন্য ওকে সাহায্য করে আরও ছয়জন গার্ড চামচিকে আর ওই ছয়গার্ডের মাঝে স্যান্ডউইচ হিসেবে প্রেজেন্ট করা হয় রানা আর শোভনকে।

হাত কচলাচ্ছে রানা। এত বিনয় ও ধরে কোথা থেকে?

অবাক হয়ে একবার ওর দিকে তাকিয়ে শোভনও হাত কচলাতে থাকে। দুইজন মিলে এগিয়ে যায় একটা বিশাল বদ্ধ দরজার দিকে।

*

মোটাসোটা নিতম্বটা বেশ ডাঁটের সাথেই চেয়ার থেকে তুলে এগিয়ে আসে মানুষটা।

‘আমি কর্ণেল রুস্তম। ’

‘সন্দেহ কি তায়!’ পাহলোয়ান মার্কা দেহটা দেখে শোভন আর কিছু বলতে পারে না।

এগিয়ে এসে হাত মেলায় রানা, ’আমি মেজর রানা। বাংলাদেশ আর্মি। কিন্তু আপনি কোন আর্মি?’

রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে যায় বিপ্লবী নেতার। সরাসরি অপমান করছে ওকে বন্দী। তবুও বুক উঁচিয়ে ঘোষণা দেয়, ’সর্বহারা বিপ্লবী বাহিনীর উচড়িঙ্গে রেজিমেন্টে ছিলাম হে! ছোট করার কিছু নেই!’

‘তা তো বটেই। তা তো বটেই।’ মাথা দোলায় রানা, ’সোলজার টু সোলজার। ’

উত্তরটা শুনে এতই খুশি হয়ে গেলেন কর্ণেল একটা ক্ষুদ্র ইশারা দিতে দেরী করলেন না মোটেও।

আর ছয় গুন্ডার জন্য দেখা গেল ইশারাই কাফি! কর্ণেলের সামনে রাখা দারুণ সাইজের টেবিলটার দুইপাশে ওদের বসিয়ে  চটপট করে বেঁধে ফেলা হল হাত দুটো টেবিলের সাথে। দশটা আঙ্গুল যখন টেবিলের সারফেসে আলতো করে পড়ে থাকে ওদের অজান্তেই আঙ্গুলে একটা শিহরণ আসে। ওদের কব্জির ঠিক ওপর দিয়ে স্ট্র্যাপ আটকেছে কর্নেল বাবু। তারপর টেবিলের সাথে ওদের পাও বাঁধা হয়।

শোভন ভয়ে ভয়ে রানার দিকে একবার তাকায়। ভেঙ্গে পড়ল নাকি?

নাহ একেবারে সটান বসে আছে যেন বুদ্ধদেব ধ্যানের বসেছেন! শোভনের মনটা চাইল প্রাণের সুখে রানার পায়ে একটা লাথি মেরে ধ্যানটা ছোটায়। কিন্তু পা তো একেবারে জগদ্দল পাথর হয়ে গেছে মানে, বানানো হয়েছে। অগত্যা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না ওর।

‘জুনিয়র এজেন্ট শোভন। অ্যাম আই রাইট?’ হাতের গরুর হাড্ডি কোপানোর মীট ক্লীভারটা নিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গীতেই জানতে চান কর্ণেল।

‘হোয়াট দ্যা টুট!’ একটা টুট দিয়েই মনের ভাবটাকে সেন্সর করে শোভন। একে তো কর্ণেল মানুষ তার ওপর আবার গরু-কোপানি দা নাড়াচ্ছে! কাজেই সব কথা বলাটা তো উচিত না।

‘ও আমাদের এজেন্ট নয়, কর্ণেল রুস্তম। আমি আমাদের এজেন্সীর সবাইকে চিনি। ’

‘একটা সত্য কথার সাথে একটা মিথ্যা কথা বলে দিলে চমৎকারভাবে।’ খ্যাক খ্যাক করে হাসেন কর্ণেল বেজায় ফুর্তিতে।

তারপরই দা ধরে থাকা হাতটা উঠে গেল চট করে এবং নেমেও এল প্রচন্ড জোরে। আতঙ্কে চোখ প্রায় বন্ধই করে ফেলে শোভন। দড়াম শব্দটার পরেও যখন কেউ’আআআআআআআ’ জাতীয় চিৎকার দেয় না তখনও চোখ খুলতে বেশ বেগ পেতে হয় শোভনকে। ’কল্লা’ উড়িয়ে দিল নাকি মাসুদ ভাইয়ের?

‘তাকাও হে ভীতুর ডিম। টেবিল ছাড়া আর কারও লাগেনি।’ হোৎকা নিতম্ব কাঁপিয়ে হাসলেন কর্ণেল।

তাকিয়ে সেটাই দেখে শোভন। টেবিলের দফারফা করে দিয়েছেন এক কোপে। বোঝাই গেল দশ আঙ্গুলের কি হবে ইনাকে তথ্য দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারলে!

‘জুনিয়র এজেন্ট শোভন!’ আবার আলোচনা শুরু করেন কর্ণেল।

‘আবারও বলছি ও শোভন নয় -’ এবার আর রানাকে কথা শেষ করতে দেওয়া হয় না ছয় গার্ডের একজন প্রাণের সুখ মিটিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত হানে রানার মুখে। ঠোঁট কেটে বেশ কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে নেমে আসতেই রানার জবান একেবারে বন্ধ!

তবুও তার দিকে খেঁকিয়ে ওঠে কর্ণেল, ’এই শালার বার্থ সার্টিফিকেট পর্যন্ত ম্যানেজ করে স্টাডি করা হয়েছে আর লিজেন্ড মাসুদ রানা ফট করে বলে ফেলল ও শোভন না। মীরাক্কেল পেয়েছ?’

‘আমি শোভন তবে জুনিয়র এজেন্ট নই।’ শান্ত কন্ঠে কর্ণেলের রাগ প্রশমনের চেষ্টা করে ও।

‘একই কথা।’ ফড়াৎ করে নাক টেনে বলেন কর্ণেল।

‘গরুর ডিম দেখেছেন কখনও?’ আগ্রহের সাথে জানতে চায় শোভন।

‘কেন?’ জানতে চেয়েই বুঝতে পারে কর্ণেল অযথা সময়ক্ষেপণ করছে ছেলেটা ওর।

সরাসরি কাজের কথায় চলে আসে কর্ণেল, ’ফ্লেমথ্রোয়ার কোথায়?’

‘ও জানে না কিছু।’ চট করে টেবিলের অন্যপাশ থেকে বলে বসে রানা।

আরেক পাশ থেকে রাইফেলের বাটের বাড়ি মারে দ্বিতীয় সৈনিক। রানা আবারও স্পিকটি নট।

‘ফ্লেমথ্রোয়ারের সাথে আমাকে ধরে আনার সম্পর্ক কি?’ বেশ অবাক হয়েই জানতে চায় শোভন।

‘আহা! ন্যাকা আর কি! ফ্লেমথ্রোয়ার কি জানে আর তাকে ধরে আনার সম্পর্ক জানে না!’ মুখ বাঁকান কর্ণেল।

‘ভণিতা না করে খুলে বলুন।’ শোভন বেশ আগ্রহই দেখালো এবার।

কিছুক্ষণ ওদের দিকে হতাশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কর্ণেল।

তারপর মুখ খোলেন, ’লরা নামে একটা মেয়ে ছিল আমাদের সাথে। পাঁচ বছর টানা সার্ভিস দিয়ে গেছে আমাদের জন্য। পদোন্নতিটা খুব দ্রুত হয় ওর। জেনারেল সোহরাবের শয্যাসঙ্গীনি হওয়াটা এর একটা কারণ হতে পারে। তবে আসলে আমরা তাকে চিনতে ভুল করি। ’

একটা মেয়েকে চিনতে ভুল করার লজ্জায় মারা যাওয়ার মত চেহারা করে আবার বলতে শুরু করেন কর্ণেল, ’পাঁচ বছরে আমাদের সব ডাটা কালেক্ট করে ভেগে গেছে লরা। তাকে ধরে আনতে পাঠিয়েছিলাম আমাদের বেস্ট দুইজন এজেন্টকে এবং তারা চমৎকার ভাবে কাজটা সম্পন্ন করেছে এতটাই চমৎকারভাবে, আমাদের বেশ ঝামেলায় পড়ে যেতে হল। ’

‘কেমনভাবে?’

‘ওরা মেরে এনেছিল লরাকে। বেশ একটা যুদ্ধ করে এক এজেন্টকে ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছিল লরা মেয়েটা কোন মই ছাড়াই! তারপরে দ্বিতীয়জন পারেনি নিজেকে সংবরণ করতে। লরার সাথে থাকা আমাদের সেই ডাটা থেকে গেছে এখনও আমাদের নাগালের বাইরে। আর কারও হাতে পড়ে গেলে আমাদের আন্দোলনের সখ করে আর কাজ হবে না। কুয়োর ইঁদুরের মত অবস্থা এখন আমাদের বুঝতে পারছ? কাজেই অ্যানিহাও আমাদের দরকার ফ্লেমথ্রোয়ার। ’

‘একটা প্রশ্ন-’ মুখ খোলে আবার শোভন, ’এর মাঝে ফ্লেমথ্রোয়ার আসল কি করে? নেহায়েত খেলনা বই তো নয়। ’

‘মাথামোটা ছোকড়া!’ কটমট করে তাকায় তার দিকে কর্ণেল রুস্তম, ’ওই ডাটা ভর্তি ড্রাইভটাকে লরা ফ্লেমথ্রোয়ার বলেই ডাকত। এখন আমরাও তাই ডাকি। ’

*

চমৎকার একটা ভুল বোঝাবুঝির মাঝে পড়ে গেছে শোভন। পরিষ্কার বুঝতে পারে। নিজস্ব ফ্লেমথ্রোয়ার আবিষ্কারের ঝক্কি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন অ্যাংগেল থেকে পোহাতে হচ্ছে। কোথায় কাঁচা ভুট্টা পুড়িয়ে পপকর্ন বানিয়ে খেতে একটা জিনিস বানালো সেটার দিকেও সবার চোখ!

‘এখন চুপ করে আছ কেন? বল যে তুমি জুনিয়র এজেন্ট নও!’ দা এর আরেক কোপে টেবিল কাঁপান কর্ণেল।

‘আমি জুনিয়র এজেন্ট নই। ’

‘কিন্তু তোমার কাছে ফ্লেমথ্রোয়ার আছে। ’

‘না।’ অস্বীকার করে শোভন।

‘আমি নিশ্চিত।’ কর্ণেল কিন্তু শোভনের যুক্তিতে বিশ্বাস করেন না এত সহজে।

‘মারা খান।’ বেশ বিনয়ের সাথেই বলে শোভন।

এবার কর্ণেল একটা রেকর্ডার প্লে করে দেন।

শোভনের গলা ভেসে আসে ফোনে।

‘তন্ময়। কাজ শেষ। ’

‘কস কি? কোন কাজ?’

‘আরে ফ্লেমথ্রোয়ার। ’

‘ওহ! চরম দোস্ত। কাওকে বলার দরকার নাই। আগে আমার এখানে নিয়ে আয় একসাথে জিনিসটা টেস্ট করি। ’

‘না। আগে আমি শিওর হয়ে নেই। ’

‘ওকে। ’

লাইন কেটে গেল।

‘চব্বিশ ঘন্টার সার্ভেইলান্সে রাখা হয়েছিল তোমাকে বাছা। এত সহজে পার পাওয়ার তো কথা না। তোমার ফোন ট্যাপ করা ছিল মোবাইলের আরকাইভস লুট করা হয়েছে তোমার কল হিস্টরি জানতে।’ কটমট করে তাকান কর্ণেল।

‘আপনি ভুল বুঝছেন। এই ফ্লেমথ্রোয়ার আর আপনার ফ্লেমথ্রোয়ার আলাদা জিনিস।’ শান্ত থেকেই কর্ণেলকে বোঝানোর চেষ্টা করে শোভন, ’এটা আমার একটা আবিষ্কার। আগুন মারা যায়  লিমিটেড আকারে। ’

‘বিজ্ঞানী, অ্যাঁ?’ ভারী দাটা বাড়িয়ে আস্তে করে কনুই আর কব্জির সংযোগস্থলে রাখেন কর্ণেল। লাল একটা রেখা জন্মায় ওখানে তারপর গড়িয়ে পড়তে থাকে।

দাঁতে দাঁত চেপে সেটা সহ্য করে শোভন।

‘আমি কিছুই জানি না আপনাদের ক্যাচাল নিয়ে। আমার সায়েন্স প্রজেক্টের জন্য একটা ফ্লেমথ্রোয়ার বানিয়েছি সেটা নিয়েই কথা বলেছি বিভিন্ন জায়গাতে। ’

‘একটা আঙুল কম থাকলেও মানুষ সহজেই বেঁচে থাকতে পারে। কি বল?’ মতামতের আশায় ওর দিকেতাকায় কর্ণেল।

চুপ করে থাকে শোভন।

‘বিয়োগ অংক কেমন পারো?’ ষড়যন্ত্রকারীর গলায় জানতে চান কর্ণেল।

এবারও চুপ থাকে শোভন।

‘আমি এরপর একটাই প্রশ্ন করব। প্রশ্নটা উচ্চারণের পর তিন সেকেন্ডে কোন উত্তর না পেলে তোমাকে আমি বিয়োগ অংক শেখাব। আঙুলের।’ আবারও ভারী নিতম্ব দুলতে থাকে কর্ণেলের হাসির দমকে।

তারপর একেবারেই হঠাৎ সবাই চুপ হয়ে যায়।

রুমের মাঝে কোন শব্দ নেই।

প্রশ্নটা করে ফেলল কর্ণেল, ’তোমার সারা শরীর চেক করা হয়েছে। যেটা খুঁজছিলাম সেটা পাইনি। ফ্লেমথ্রোয়ার কোথায়?’

‘একটা হাত খুলে দিলে দেখাতে পারি কোথায় আছে।’ বলে শোভন, তিন সেকেন্ডের আগেই। আঙুলের মায়া বড় মায়া।

‘ওটী হচ্ছে না। হাত খুলে দেই আর পাখি পগারপার?’ চোখ লাল করে বলেন কর্ণেল।

‘ইডিয়টের মত কথা বলছেন। ছয়টা রাইফেল তাক করে রেখেছেন। এত ভীতু হয়ে কর্ণেল পদ পেলেন কিভাবে!’

আঁতে ঘা লাগল বোধহয় কর্ণেলের এবার।

ঝট করে এক গার্ডকে আদেশ দেয় কর্ণেল, ’এই ব্যাটার এক খুলে দাও। ’

ছুরির এক আচড়েই হাতের দড়ি কেটে ফেলা হয় শোভনের।

আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকে কর্ণেল, শোভন ফ্লেমথ্রোয়ারের লোকেশন জানাতে চলেছে!

কিন্তু নিরাশই হতে হয় তাঁকে। ঝট করে মাঝখানের আঙ্গুলটা সোজা করে দেখিয়ে দেয় ও কর্ণেলকে।

তারপর সাবটাইটলস্বরূপ মুখেও বলে, ’মারা খান। ’

প্রচন্ড ক্রোধে দা উঠাচ্ছে কর্ণেল, আলাদা করে দেবে শোভনকে একেবারে  এক সেকেন্ডে ঘটে যায় অনেক কিছু।

গার্ড মাত্র দূরে সরে যাচ্ছিল এক ঝটকায় তার ছুরিটা নিজের জিম্মায় নিয়ে এল শোভন কর্ণেলের ডান কাঁধের তলে একটা উপর্যুপরী খোঁচা দেয় একই সাথে। বিভ্রান্ত কর্ণেলকে মারাত্মক আঘাতটা সহ্য করার সময় দিয়ে অন্য হাতটা কেটেই রানার দিকে ছুরিটা পাঠিয়ে দেয় ঝটপট পুরো কাজটায় সময় লেগেছে এক সেকেন্ডের ষোল ভাগের এক ভাগ  মাত্র।

পরক্ষণেই দুই পা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় উল্টোদিকে পড়ে যেতে থাকে শোভন। ওদিকে রাইফেল তুলছে প্রত্যেকে।

দড়াম করে মেঝেতে আছড়ে পড়ার সাথে সাথে টেবিলের কাভারটাও পেয়ে যায় শোভন। বুলেটগুলো অল্পের জন্য ওকে মিস করেছে। তবে এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। টেবিল ঘুরে এসে গুলি করলেই কাজ হয়ে যাবে।

তবে মাগনা পাওয়া বুলেটের সদ্ব্যবহার যখন গার্ডেরা করছিল রানা ডান হাতে ছুরির হাতল ধরে বাম হাতের স্ট্র্যাপ কেটে হাত পালটে ডানহাতকেও মুক্ত করে ফেলেছে। সব গর্দভ শ্রেণীর গার্ড রাখাটা বোধহয় কর্ণেল রুস্তমের ট্রেডিশন! বা হাতে একটা ডেজার্ট ঈগল হাতিয়ে নেয় রানা বাম পাশে বীর বিক্রমে শোভনের দিকে গুলি চালাতে থাকা মানুষটার কোমর থেকে।

‘ঠুঘুম’ জাতীয় ছয়টা বুলেট বেড়িয়ে যাওয়ার শব্দের সাথে সাথে পৃথিবী জনসংখ্যা সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হল বলে রানা মনে করে। একই সাথে ক্লিক জাতীয় শব্দ করে ডেজার্ট ঈগল জানান দেয় ওর পেট খালি হয়ে গেছে। রিলোডের অভাব নেই। আরেক মৃত গার্ডের কোমর খালি করে দেয় রানা।

কর্ণেল রুস্তম কিঞ্চিৎ কাঁপছেন।

মানুষটার রামদা বরাবর একটা মাত্র বুলেট পাঠিয়ে ওটা হাতছাড়া করে দেয় রানা। তারপর এগিয়ে যায় পড়ে থাকা শোভনের দিকে। পা দুটো চেয়ারের থেকে মুক্ত করে একহাত বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে।

তারপর কর্ণেলের মাথায় এসে পিস্তল ঠেকায় রানা, ’চলুন বস। আপনিই এখন আমাদের ফ্লেমথ্রোয়ার। ডাটা আপনার মাথায় কম আপলোড করেন নি এতদিন। আমাদের’প্যাদানী ডাউনলোড ম্যানেজার’ দিয়ে ওগুলো নামিয়ে নেব এখন। কাম অন। ’

বন্দীকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যায় ওরা বাইরের দিকে।

*

তন্ময়ের ভ্রু কুঁচকে আছে।

শোভন ওকে এতদিনের কষ্ট করে বানানো ফ্লেমথ্রোয়ারটা রাখতে দিয়েছে। বাড়ি ফেরার পথে বাবার দোকানে একবার থেমেছিলো ছেলেটা আজ, তখনই রেখে গেছে যন্ত্রটা। সেটা অবশ্য ভ্রু কুঁচকানোর কারণ নেই।

ফ্লেমথ্রোয়ারটা নিয়ে খুটখাট করছিল। তবে হাতলের নিচে হাল্কা একটা রাবার তুলে সুই ঢোকানোর মত একটা বিন্দু দেখে পাশেই আম্মুর সেলাই মেশিন থেকে একটা সুই বের করে খোঁচা মেরে দিয়েছিল ও। ঝট করে ফ্লেমথ্রোয়ারের হাতলের নিচের অংশ সরে যায় বের হয়ে আসে কিছু পয়েন্ট। একেবারে এসডি কার্ডের মতই সেটা।

পরীক্ষা করতে ল্যাপটপে লাগাতেই একের পর এক ফোল্ডার খোলা শুরু করেছে।

সেই থেকে কুঁচকে আছে ওর ভ্রু।

ঝটপট ফাইলগুলো কপি করে রাখে ও আরেক জায়গাতে।

তারপর ধীরে সুস্থে ফোন দেয় শোভনকে, ওপাশ থেকে শোভনের গলা শোনা যায়, ’দোস্ত, বল। ’

‘ওই তোর ফ্লেমথ্রোয়ার নিবি না? সারাজীবন কি আমার কাছেই রেখে দেব নাকি?’

‘আরে আমি এখন জুঁইয়ের সাথে ব্যাটা। পরে ফোন দে ব্যাটা!’ চাপা ঝাড়ি মারে  শোভন।

‘মারহাবা। মারহাবা।’ গলায় পিন রেখেই বলে তন্ময়।

‘আর ফ্লেমথ্রোয়ার নিতে রানা ভাই যাবে। উনারে দিয়া দিস। ’

তুমি মেয়ে নিয়ে মাস্তি করছ কর! ভাবে তন্ময়। কিন্তু এই ডাটার মূল্য কতটুকু সেটা চেক করে দেখবে ও।

তেমন মূল্যবান হলে নির্দিষ্ট অংকের টাকাতে বিক্রি করেও দিতে পারবে।

সেটা পরে দেখা যাবে!

কলিং বেলের  শব্দে সম্বিত ফিরে পায়। শোভনের রানা ভাই নাকি?

ফ্লেমথ্রোয়ারটাকে আগের মত চেহারাতে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যায় ও।

দরজা খুলতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ছয়ফিট লম্বা সুঠামদেহী যুবকের দিকে। চোখের মাঝে একই সাথে দুইটি অনুভূতি কাজ করছে। এতক্ষণ কোমল ছিল দৃষ্টি এই মাত্র কঠোর হয়ে গেল।

‘তন্ময়?’

‘রানা ভাই?’

দুইজনই একই সাথে প্রশ্ন করে ফেলায় হাসে একটু।

তন্ময় হাত বাড়িয়ে ফিরিয়ে দেয় ফ্লেমথ্রোয়ারটা। হাতে নিয়েই ঘুরে দাঁড়ায় রানা।

‘ধন্যবাদ, চলি তাহলে। ’

‘জ্বি, ভাইয়া।’ কোনমতে দরজা লাগাতে পারলে বাঁচে আরকি তন্ময়।

তবে আবার ঘুরে দাঁড়ায় রানা।

‘ওহ! টেস্ট তো করা হল না। ’

তন্ময়ের অনুমতির তোয়াক্কা না করে সোজা ঢুকে পড়ে ও ভেতরে। পেছন থেকে হাহাকার করে ওঠে তন্ময়। বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে না এমনও নয়। কিন্তু একটা ট্রেনের সাথে ও পারবে কেন?

ছুটে ওর নিজের রুমে এসে দেখে রানা ফ্লেমথ্রোয়ার টেস্ট করছে।

ওর ল্যাপটপে।

তবে মেমরি কার্ডটা দিয়ে নয়। আক্ষরিক অর্থেই ফ্লেম বের করেছে এবার।

চোখের সামনেই নিজের ল্যাপটপের পুড়ে গলে যাওয়া দেখতে দেখতে সেই ধোঁয়াতেই কাশে তন্ময়।

রানার শাপশাপান্ত করে চলেছে সেই সাথে।

বিএটিএ এজেন্টের মুখে তখন একচিলতে হাসি। একটু আগেই কাজী আনোয়ার হোসেন নামক লোকটার নামে মামলা ঠুকে দিয়েছে সেটা কি একটা কারণ হতে পারে?

হবে হয়ত!

ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪ 

ভালো বাসা

বাড়িওয়ালার ড্রইং রুমে বসে আছি।

ভাড়ার টাকাটা দেওয়াই উদ্দেশ্য।

টেলিভিশনে টম এন্ড জেরীর কার্টুন চলছে। পিচ্চি একটা জেরী ফিজিক্সের সমস্ত আইন-কানুনের মাঝে নিউক্লিয়ার অ্যাটাক করে  বিভিন্ন কাজ করে বেড়াচ্ছে। বাড়িওয়ালার দেখা নেই কাজেই আমি মহানন্দে ফিজিক্সের টান্ডি বাজানো দেখছি।

একগাল পান নিয়ে বাড়িওয়ালা আংকেলকে দোড়গোড়ায় দেখা গেল মিনিট পাঁচেক পর।

‘ইবা কন?’ রীতিমত অবাক হয়ে বলেন বাড়িওয়ালা। ’তুমি কে?’

‘আমাদের দেখা হয় নি আগে আংকেল।’ উঠে দাঁড়াই আমি, ’আপনাদের তিনতলায় ভাড়া থাকি আমরা। আমি মি. আহমদ শফিকের  বড় ছেলে -’

‘ও’ হঠাৎই সব বুঝে ফেলেন যেন, ’উনার যে ছেলে রাজশাহীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে?’

‘জ্বী আংকেল। ’

অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দেওয়ার আগেই যে চিনে ফেলেছেন সেজন্য একটা স্বস্তির পরশ অনুভব করলাম শরীরে। আড়চোখে টমের অবস্থানটা দেখে নিলাম। এই পর্বটা আমি দেখিনি আগে। বেশ মজাদারই আছে। না দেখে যাওয়াটা উচিত হবে না।

‘বস বাবা।’ বিনয় উপচায় বাড়িওয়ালার গলায়, প্রথম পরিচয়ে এমন বিনয়’ডেলিভারী’  দেওয়াটা ইনার বৈশিষ্ট্য বটে। জেনেশুনেই কাজে নেমেছি কি না!’বাসা পছন্দ হইছে আশা করি। এই তো সিঁড়ি ঘরের ফিনিশিং দিলাম কয়দিন হল। ’

‘ওহ,আংকেল, ভাড়াটা নিয়ে এসেছিলাম।’ হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এভাবে বললাম তিরিশ সেকেন্ড পর। এভাবে আর তিনটে মিনিট পার করে দিতে পারলে আমার এই পার্টটা দেখা হয়ে যায়।

ঐ যে গেল ফিজিক্সের আরেকটা সূত্র! একটা চিঠির খাম ব্যবহার করে উড়ে যাচ্ছে জেরী। নিস্ফল টম তাকিয়ে আছে সেদিকে!

‘আংকেল’ ভাড়াটা গুণে গুণে নিলেন।

‘তুমি বাবা ফিজিক্সের সূত্রের উর্ধ্বে না’ মনে মনে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ’প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে হুঁ হুঁ। ’

এবার বাসায় এসেই শুনলাম গত কয়েকদিন ধরে বাড়িওয়ালার স্ত্রী আমার ছোট ভাইকে সামনে পেলেই অভিযোগ করছে ও নাকি রাতে শব্দ করে। আর আমাদের বাসা সরাসরি বাড়িওয়ালার ওপরের ফ্লোরেই।

আমিও বড়ভাই-য়ত্ব ফলিয়ে ওকে বেশ করে বকে দিলুম।

ছোটভাইটা মর্মাহত হল, ’না জেনে আমাকে বকলা তুমি? এরা এরকমই খারাপ। কিছু না করলেও অভিযোগ করে। ’

‘খারাপ-বাড়িওয়ালা’ নিয়ে অনেক গল্প শুনলেও এতদিন চোখের দেখা দেখিনি একজনকেও। তিনটি বাসাতে থেকে এসেছি আমরা তবে বাড়িওয়ালাগুলো ছিলেন মাটির মানুষ একেবারে। কাজেই কৌতুহলী না হয়ে পারলাম না।

‘কেন? কেন?? কিছু না করলে অভিযোগ করবে কেন?’

‘নিজেরা যে এই বিল্ডিং-এর সর্বেসর্বা সেটাই দেখায় আরকি। ’

‘আর সব ভাড়াটেদের সাথেও কি বাজে ব্যবহার করেছে?’

‘রোজ করছে! সেদিন পাশের বাসার তমা আপুকে অনেক করে বকল ও নাকি খুব জোরে গান বাজায়! অথচ আপুটা অনেক ভালো। মোটেও জোরে গান বাজায় না। বাজালে তো আমাদের কানেই আগে আসত তাই না?’

‘হুঁ’ কথা সত্য ভাবলাম।

‘আরও আছে -’ থামে না অপু। ’সেদিন রিয়া আপু ছাদে উঠতে চেয়েছিল। ওরা ছাদে সবসময় তালা দিয়ে রাখে। তাই ওদের কাছে চাবি চাওয়াতে বাড়িওয়ালী কি বলেছে জানো?’

‘কি?’

‘আমরা তোমাদের ঘর ভাড়া দিয়েছি ছাদ ভাড়া দেই নি। ’

‘এইটা কোন ধরণের ভদ্রতা?’ আমার চোখ কপালে উঠে গেল। ’উঠতে দেবে না ভালো কথা বলার তো ধরণ আছে একটা নাকি?’

‘বোঝ তাহলে!’ আমার সাথে তাল মেলায় অপু। ’ইদানিং লেগেছে আমার সাথে। আমি নাকি রাতে শব্দ করি!’

‘হুম ’ ওকে বলেছিলাম, ’দাঁড়াও, আমি এসে যখন পড়েছি এই সাতদিনেই একেবারে সিধে করে দিয়ে যাব। ’

অপুর চোখের দৃষ্টিতে তেমন ভরসা দেখলাম না।

পরদিন সকালে নীচতলা থেকে মেশিনগানের গুলির শব্দে ঘুম ভাঙ্গল।

ঘুমের রেশ একটু কাটতে বুঝলাম ওটা মানুষেরই গলা।

আরও ভালো করে শুনে বুঝলাম, স্বয়ং বাড়িওয়ালার গলা’উহা’ কিন্তু এ কী এলিয়েনটিক ভাষা রে বাবা! একটা শব্দের মানে আমি বুঝলাম না।

আমাদের এই বাড়িওয়ালা চট্টগ্রামের মানুষ। ক্ষেপে গেলে খাস ভাষা বেরিয়ে আসবে সেটাও স্বাভাবিক অবশ্য। দরজায় অপুকে দেখতে পেলাম এই সময়।

‘লোকটা চেঁচাচ্ছে ওর বাসাতে বেড়ালের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে তাই।’ আমাকে তর্জমা করে দিল ও।

‘তুমি কিভাবে জানো?’ আমার মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে যায়।

‘কয়েক মাস ধরে আছি না? একটু-আধটু বুঝি। ’

আরও এক পশলা গুলির শব্দ বাড়িওয়ালা এলিয়েনের ভাষায় আরও কিছু বলল।

‘ওটা কি বলল?’ অপুই আমার ভরসা এখন।

‘যে বিড়াল পোষে তার আম্মুকে’ হঠাৎ থেমে যায় অপু। ’সরি ভাইয়া, এইটা আমি বলতে পারব না। ’

উধাও হয়ে যায় ছোটভাইটা।

নিজের মাথায় হাত বোলালাম কাহিনী দেখি সিরিয়াস।

অথচ বাসার ভিউ একেবারে সেই রকম। একপাশে তাকালে বেশ দূরে সমুদ্র দেখা যায়। আরেকপাশে একটা স্নিগ্ধ বাগান তার মাঝে সুন্দর একটা পুকুর। এত সুন্দর বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। অথচ বাড়িওয়ালাটাকে লাইনে আনতে না পারলে তাই করা লাগবে মনে হচ্ছে।

হাত মুখ ধুয়ে সোজা দুইতলায় নেমে গেলাম। নক করতেই বাড়িওয়ালী, যিনি অপুর ভাষায়’ডাইনি’ দরজা খুলে দিলেন।

‘ইয়ে আন্টি, ছাদে ওঠা যায় না?’ মুখে সরল একটা ভাব ফুটিয়ে রেখেছি, ’গিয়ে দেখলাম দরজায় তালা। ’

আসলে ডাহা মিথ্যা কথা। ছাদে উঠে কে? জানাই তো আছে দরজায় তালা।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হুট করে বাজে কথা বলতে বাধল মনে হয় ডাইনি বুড়ির। তাছাড়া আমার সাথে তাদের দেখা একবারই হয়েছে এবং সেই সাক্ষাতে আমার হাত থেকে অনেকগুলো কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোট তাদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে কাজেই আমার প্রতি মন কিছুটা প্রসন্ন থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

এসব সাত-পাঁচ ভেবেই হয়ত চাবিটা আমাকে এনে দিল। ওটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার ভান করতেই হল।

বাড়িওয়ালার দরজা লেগে যেতেই ছুটে নিচে নেমে পড়লাম।

আধ ঘন্টার মাঝেই ডাইনির কাছে চাবি ফেরত দিয়ে ডুপ্লিকেট ছয়টা চাবী নিয়ে ডিং ডং করতে করতে আমি বাসায় হাজির।

কিন্তু বিকেলেই পরিস্থিতি আবারও ঘোলাটে।

স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে অপু রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করল।

‘আকাশ ভাইয়া!’ অপুর রণহুংকার শুনে ঘাবড়েই গেলাম।

‘কি হয়েছে?’

‘ডাইনি বলে আমি নাকি কাল রাতেও শব্দ করেছি!’

‘কি! বুড়ির আম্মুকে আমি আন্টিও ডাকি না!’ মেজাজ এবার আমারও খারাপ হয়ে গেল। কাল রাতে আমি বাসাতেই ছিলাম। অপু যে শব্দ করেনি শুধু তাই নয় কোন বিকট শব্দই শুনিনি আমি।

মিথ্যামিথ্যি অপবাদ দিয়ে ওদের কি লাভ সেটাই বুঝলাম না। কিছু মানুষের মনে হয় মস্তিষ্কই বিকৃত থাকে।

রাত দশটাতে রান্নাঘর থেকে একটা খালি বিস্কুটের টিন চুরি করতে হল।

দশ মিনিট ঠুক ঠুক করে টিনের ওপরের অংশটা কেটে এটাকে একটা ইস্পাতের বালতি বানিয়ে ফেললাম।

সদ্য করা ফুটো দিয়ে দড়ি বেঁধে আমি প্রস্তুত। শব্দ কাকে বলে কতপ্রকার ও কি কি  আজ দেখাচ্ছি!

কানে হেডফোন লাগিয়ে মহানন্দে ফেসবুকে চারঘন্টা বন্ধুদের সাথে চ্যাট করতে করতে দিব্যি রাত দুইটা বাজালাম।

‘এবার তোমাকে নিউটনের থার্ড ল’র একটা ব্যাবহারিক উদাহরণ দেওয়া যায়’ বাড়িওয়ালা পরিবারের উদ্দেশ্যে বললাম মনে মনে।

আমার ট্রাভেলিং ব্যাগ থেকে দশ ইঞ্চি লম্বা আর সেই অনুযায়ী চওড়া পটকাটা বের করলাম। ভেবেছিলাম নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ফাটাব তা আর ডাইনি ফ্যামিলি হতে দিল কই?

দীর্ঘশ্বাসটা চাপলাম।

বারান্দায় এসে সুতোতে আগুন দিয়ে বিস্কুটের টিনে নামিয়ে দিলাম পটকাটাকে। দড়ি ঝুলিয়ে বাড়িওয়ালা আংকেলের বেডরুম সংলগ্ন বারান্দার সামনে এনে পাঁচ সেকেন্ড অপেক্ষা করতেই

প্রথমে শীতের রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আমার কানেরই পর্দা ঝালাপালা করে একটা বিকট শব্দ।

তারপর তড়িঘড়ি করে নিশব্দে টিন তুলে নিয়ে রুমে ফেরার আগেই সকালের মত দোতলা জুড়ে মেশিনগানের গুলি শুরু হয়ে গেল।

খাটের নীচে ’এভিডেন্স’ চালান করে মনিটরের পাওয়ার সুইচ অফ করে আমি লেপের তলায়।

তবে আজকের’শব্দ’টা অতিরিক্ত ছিল। বাবা-মাও জেগে গেছে শব্দের তীব্রতায়।

হুড়মুড় করে সিঁড়িঘরের দিক থেকে শব্দ এবং পরমুহূর্তেই বাসায় কলিং বেলের মুহুর্মুহু শব্দে বাবা গেলেন দরজা খুলতে।

‘হতরত খতরম ভতরত অওয়জ হিকিরিক ’ বা এজাতীয় কিছু প্রাণপণে উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন বাড়িওয়ালা স্বয়ং।

‘আপনাদের ওখানে কি হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে বাবাও প্রশ্ন করলেন।

বাংলা ভাষা কানে পড়তে বাড়িওয়ালার খেয়াল হয়। ইনিও বাংলাতেই হুংকার ছাড়েন এবার ’আপনার ছোট ছেলে রোজ শব্দ করে আপনি কিছু বলতে পারেন না তাকে? এই রাত দুটোতে এমন বিকট শব্দ

‘আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন।’ ঠান্ডা মেজাজের বাবাও রেগে যান এবার, ’আমি স্পষ্ট শুনেছি শব্দটা নীচ থেকে এসেছে।

‘আমিও স্পষ্ট শুনেছি  শব্দটা ওপর থেকে এসেছে!’ সমানে গলা মেলায় বাড়িওয়ালা।

এলোমেলো চুল আর ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে আমি এই পর্যায়ে এসে থামলাম ড্রইং রুমের দরজায়।

‘নীচে কি কোন টায়ার ফেটেছে? শব্দ শুনলাম একটা।’ সাধুর মত জানতে চাই আমি।

এবার দুইজনেই চুপ হয়ে যান।

বাবা নিশ্চিত শব্দটা নীচ থেকে হয়েছে। বাড়িওয়ালাও নিশ্চিত শব্দের উৎস ওপরে। আমার কথায় বাড়িওয়ালা এতক্ষণে যেন কিছুটা কনফিউজড হয়ে গেল।

‘কিছু ন বুজ্জুম ’ বাড়িওয়ালা বিড় বিড় করে এরকম কিছুই বলল।

‘কিছু বুঝবেন না মানে!’ মনে মনে বলি আমি। ’আরও বোঝার বাকি আছে তো আপনার। ’

বাড়িওয়ালা নিজের বাসায় ফিরে যেতেই আবারও লাফ দিয়ে মনিটরের সুইচ অন করে ফেসবুকে ফিরে গেলাম আমি।

আরও দুই ঘন্টা মহাসমারোহে চ্যাট করে রাত চারটা বাজতেই সংগ্রহে রাখা দ্বিতীয় পটকাটা  বের করলাম।

কত সখ ছিল এটাকেও নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ফাটাব!

ইস্পাতের টিনটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দ্বিতীয়বার পটকাটা ফাটাতেই রাস্তার তিন চারটা নেড়ি কুকুর প্রবলবেগে প্রতিবাদ জানিয়ে একসাথে ডেকে ওঠে।

*

রাত সোয়া চারটা।

আগের চেয়েও অগোছালো চুল নিয়ে আমি সন্তের [saint] মত বসে আছি ড্রইং রুমে। বাবা-মা আর বাড়িওয়ালা আংকেলও উপস্থিত।

রোজ রোজই বাড়িওয়ালার স্ত্রী শব্দ পেতেন আর আমরা পেতাম না।

আজ তো উৎপাত আরও বেড়ে গেছে।

‘এগুলো কি হচ্ছে রে,আকাশ?’ মা উদ্বিগ্ন গলায় আমার কাছে উত্তর খোঁজেন।

‘আমার মনে হয় বাসার ইলেক্ট্রিক্যাল লাইনটা একবার চেক করা দরকার আপনার।’ বাড়িওয়ালাকে পরামর্শ দেন বাবা।

‘হুজুর ডেকে বাড়ি বন্ধ করা লাগবে।’ আমার মুখ দিয়ে বের হতেই বাড়িওয়ালা আংকেল খুশি হয়ে গেলেন।

‘এই পুয়া একেবারে ঠিক বলছে। ইঞ্জিনিয়ার পুয়া মাথাত বিরেন আছে। জিনত ঘরৎ [ঘরে] ইন্দি-উন্দি [এদিকে ওদিকে] শব্দ করবে জিনক আঁতুর[খোঁড়া] ন করি তো আমি বাপের পুয়া না।’ চট্টগ্রামের ভাষা আর চলিত ভাষার জগাখিচুরী মেশিনগান চালিয়ে দিলেন।

বাবা মোটেও এই সমস্যার পক্ষপাতিত্ব করতে পারলেন না। মা অবশ্য আপত্তি করছেন না। হুজুর বাড়ি বন্ধ করলে ক্ষতিই বা কোথায়? আর বাড়িওয়ালা আংকেল তো রীতিমত উৎসাহিত এই সমাধানে।

আমিও শত্রুপক্ষের সাথে তাল মেলালাম।

আজ রাতের মত এটাই মীমাংসা হল পরদিন জুম্মার পরে ইমাম সাহেবকে আসতে বলে দেবেন বাড়িওয়ালা আংকেল।

আপদটা বিদেয় হতেই বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই আমি।

পরের দিন সকালে ছাদে উঠে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে মুখে দেশাত্মবোধক গান নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খোলা ছাদে।

সকালের মিষ্টি রোদে সমুদ্র দেখার মজাই আলাদা।

ভিউটা ছাদ থেকে এতই মাথা নষ্ট করা ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম। মনটা আজ ফুরফুরে। বাড়িওয়ালার হম্বিতম্বি শোনা যায় নি আজ সকাল থেকে।

বুড়োটাকে ভয় দিতে পেরে বেশ শান্তি লাগছে মনে।

‘ম্যাচ হবে আপনার কাছে?’

কানের কাছে নারী কন্ঠটা এতই চমকে দিল আমাকে গলায় ধোঁয়া আটকে কেশে ফেললাম।

সাদা টি-শার্টে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে আমার দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

অভিজ্ঞ চোখ একনজর দেখেই বলে দিল ঠোঁটে ওটা ডানহিল। বাতাসে সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে চোখদুটো ভীষণ কালো। ফরসা গাল দুটোতে কোন দাগের চিহ্নও নেই। খাড়া একটা নাকের সাথে গোলাপী ঠোঁটদুটো একেবারে মানিয়ে গেছে।

কাল রাতে জ্বীন জাতির সাথে ফাজলেমী করার জন্যই কি রিয়েল জ্বীনের পাল্লায় পড়লাম নাকি রে বাবা? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ম্যাচটা তুলে দিলাম মেয়েটার হাতে।

আগুনটা ধরিয়ে রেলিং-এ দুই হাত আড়াআড়ি করে রেখে দাঁড়ায় মেয়েটা।

‘আপনি নিশ্চয় আকাশ?’ সুন্দর ভ্রু দুইটা কুঁচকে জানতে চায় আমার কাছে।

‘ঠিক ধরেছেন।’ কিছুটা বিস্মিত না হয়ে পারি না। ’আপনি?’

‘আমি মিথিলা।’ ছাই ফেলে দক্ষ স্মোকারের মত রেলিং এর ওপাশে। ’আপনি রুয়েটে পড়ছেন?’

‘হুম।’ এতকিছু জানে কি করে- শুষ্ক গলায় ভাবি আমি। এই মেয়ে জ্বিন না হয়েই যায় না। ’আপনি?’

‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী নিয়ে পড়ছি।’ আমার গলার অবাক ভাবটা হয়ত এতক্ষণে খেয়াল করে মিথিলা, ’আমি দোতলায় থাকি। ’

এই মেয়ে জ্বীন হলেও এতটা আশ্চর্য হতাম না আমি। এইরকম রুক্ষ বাড়িওয়ালার এত ভদ্র আর সুন্দরী মেয়ে কিভাবে থাকে? তবে জ্বীনের সঙ্গ থেকে মানুষের সঙ্গ নিশ্চিত হতেই দ্রুত সিগারেটে টান দিলাম কয়েকটা। পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম এতক্ষণের’ক্ষতি’।

‘আচ্ছা!’ অবশেষে মুখ খুললাম, ’ছাদে স্মোক করেন সমস্যা হয় না?’

‘উঁহু বাবা ছাদে কখনই ওঠেন না। আর ভাড়াটেদের চাবি দেওয়া হয় না সাধারণতঃ কে আসবে ছাদে আর?’

‘আমাকে ছাদে দেখে অবাক হলেন না যে তাহলে?’

আমার দিকে তাকায় মিথিলা, ’আচ্ছা, আমাকে দেখে কি আপনার নির্বোধ মনে হয়?’

‘বাপের মত হয়ে থাকলে শতভাগ নির্বোধই হতে পার হে!’ মনে মনেই বললাম কথাটা। মুখে বললাম, ’এ প্রশ্ন কেন?’

‘গতকাল চাবি নিয়েছিলেন নির্ঘাত ডুপ্লিকেট বানিয়েছেন। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না।’ সিগারেটে ধীরে-সুস্থে টান দেয় মেয়েটা। ’এই বাসায় জ্বীন আছে বলে আপনার মনে হয়?’

‘হুম।’ আর কিছু বললাম না। মেয়ে যথেষ্ট চালাক। এর বাপটা এরকম হলেই গেছিলাম আমি।

‘তারমানে পটকা ফাটানোটাও আপনার কাজ। জ্বীনে এত দৃঢ় বিশ্বাস থাকার আর কোন কারণ থাকতে পারে না। ’

এই রে এই মেয়ে তো রীতিমত গোয়েন্দা। বিমর্ষ হয়ে সিগারেটে চুপচাপ টান দিতে থাকলাম। প্ল্যান সব ভেস্তে গেল।

মেয়ে যখন বের করে ফেলেছে বাড়িওয়ালা বাবা কি আর জানবে না?

আড় চোখে মেয়েটাকে একবার দেখলাম।

কালো থ্রি-কোয়ার্টার আর সাদা টি-শার্ট পরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে এই অসাধারণ পরিবেশে একটা সুন্দরী মেয়ে ডানহিল খাবে আর আমি আড়চোখে তাকাব না এতটা মহাপুরুষও হইনি এখনও!

মেয়েটার মুখে কৌতুকের আভাস তখনই খেয়াল করলাম।

‘ভাবছেন কেন বলছি না বাবাকে?’ আমার দিকে ফেরে মিথিলা। ’আপনাকে সিএনজি থেকে নামতে দেখলাম যখন জানালা দিয়ে তখনই মনে হচ্ছিল এরকম কিছু করতে যাচ্ছেন আপনি। বাকি ধারণাগুলো মেলে কি না দেখার আগ্রহ আছে। ’

‘আর কি কি ধারণা?’ টোকা দিয়ে সিগারেটের গোড়াটাকে চোখের সামনে দূর করলাম।

‘সেটা কি আমার বলার কথা?’ মিথিলার ডানহিলের গোড়াটাকে টোকা মারে ও-ও। আমারটার চেয়েও দূরে গিয়ে পড়ে ওটা।

‘না।’ তাড়াতাড়ি বললাম, ’আমার ধারণা, আপনি চান এই বাসার ভাড়াটে-বাড়িওয়ালা দূরত্ব কমে আসুক। ’

‘হয়তো। চলুন নামা যাক। ’

নামাজ পড়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে বাসার সামনের রাস্তায় নজর রাখছি। বন্ধু নুরূলকে ফোনে ঘটনার গুরুত্ব বুঝিয়ে আসতে বলেছি সেই সকালে। হঠাৎ ইমাম সাহেবকে দেখতে পেলাম সরাসরি বাসার দিকেই আসছেন।

নামার জন্য প্রস্তুত হলাম।

ইমাম সাহেব বাউন্ডারীর গেইটে পা রাখার সাথে সাথে উনার গায়ে আছড়ে পড়লাম আমি।

ভুঁড়ি দুলিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন হুজুর জাপ্টে ধরে উনার পতন রোধ করে গলায় ব্যাগ্রতা ঢেলে বললাম, ’ঢুকছেন কোথায়?? সময় থাকতে কেটে পড়ুন!’

‘কেন বাবা?’ আকাশ থেকে পড়েন হুজুর। ’এই বাড়ি আজ আমার বন্ধ করার কথা। ’

‘তিনতলার পাগলি মেয়েটা নেমে আসছে -’ গলায় ব্যাস্ততা বাড়িয়ে তুললাম, কিন্তু হুজুরের চেহারায়’কত পাগলি সারাইলাম’ ভাব দেখা গেল। ’-জামাকাপড় খুলে ফেলার হুমকি দিতে দিতে।’ বাক্য শেষ করলাম আমি।

‘আস্তাগফিরুল্লাহ!’ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুট লাগালেন হুজুর। ’নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক!’

ছুটন্ত হুজুরের পাশ দিয়ে একটা রিকশা এসে থামে বাসার সামনে।

‘ওই টা কে ছিল?’ গুরুগম্ভীর চেহারায় বলে নুরুল।

‘ঝামেলা। তবে দূর করা হয়েছে।’ সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওর মুখে লাগানো নকল দাঁড়ির দিকে তাকালাম। ’ভালোই ফিট করেছে তোকে। মনে আছে সিচুয়েশন কি?’

‘আরে পানির মত।’ হাসে নুরুল। ’সিরাজ-উদ-দৌলার রোল সামলে ফেলতে পারলাম আর এইটা সামান্য এক বুড়োকে পটানো! চল তো!’

*

‘ইমাম হুজুর ব্যস্ত তাই আমাকে পাঠিয়েছেন।’ বড় বড় চোখ মেলে বলে ইমাম সাহেবের রিপ্লেসমেন্ট।

খুশি মনেই তাকে বিশ্বাস করে বাড়িওয়ালা আংকেল। চট্টগ্রামের ভাষার মেশিনগান ছুটিয়ে পরিস্তিতি ব্যাখ্যা করেন নুরুলের কাছে।

‘ছাদ বন্ধ থাকায় জ্বীন বাসায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ গম্ভীর গলায় রায় দেয় হুজুর। ’ছাদের দরজা সবসময় খুলে রাখতে হবে। ’

‘কিন্তু, আমার মেয়েটা যে ছাদে উঠতে পছন্দ করে!’ বাড়িওয়ালার মোটেও পছন্দ হয় না এই রায়।

‘উঠবে।’ বিরক্তিভরে বলে হুজুর। ’তবে মেয়েছেলের বেশি ছাদে বের না হওয়াই ভালো। ’

কটমট করে তাকায় মিথিলা।

‘জ্বীনেরা সব বাসায় আসর করে না।’ এইমাত্র মিথিলার আম্মুর বানিয়ে দেওয়া পানটা মুখে পুড়ে নিয়ে একগাল হাসে নুরুল, ’যেসব বাসায় শান্তি থাকে সেখানে জ্বীন দেখবেন না কেউ। এই বাসায় নিশ্চয় ঝগরা বিবাদ লেগেই থাকে। না সাহেব?’ কড়া দৃষ্টিতে বাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকে নুরুল।

‘জ্বী হুজুর।’ পর্দার আড়াল থেকে বলে বাড়িওয়ালি, ’ মিথিলার আব্বু তো সারাদিন ক্যাটক্যাট করতেই থাকে ভাড়াটেদের সাথে। ’

‘আর তুমি?’ ক্ষেপে যান আংকেলও, ’তুমি তো রোজ রোজ বাচ্চা ছেলেটাকেও মিথ্যাই দোষ চাপাও!’

‘থামুন থামুন!’ হাত তোলে নুরুল, ’গোস্বা নেককাজসমূহ ধংস করে। রাগ করতে নেই। বাসাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাটা বাঞ্ছনীয়, সাহেব। একই কথা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বিবিসাহেবা। আর শরীয়াতের মতে বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে সুপাত্র দেখে দিয়ে দেওয়াটা জরুরী। ’

এবার আমি কটমট করে তাকাই নুরুলের দিকে। ভেবড়ে যায় বেচারা।

‘থাক সে কথা। এখন আমি ঘর বন্ধ করব। আপনারা দোয়া দরুদ পড়ুন। আর আপনি আমার সঙ্গে আসুন।’ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে ও।

দরজা দিয়ে বেড়িয়েই ওর পশ্চাদ্দেশে দুটো লাথি ঝাড়লাম। ’শালা তুই মিথিলার বিয়ের কথা বলিস কোন সাহসে?’

পেছন থেকে ছোট্ট একটা কাশির শব্দে তৃতীয় লাথিটা দিতে গিয়েও থেমে যাই।

চৌকাঠে হেলান দিয়ে আমাদের দেখছে এবং শুনছে মিথিলা।

মুখে মিষ্টি একটা হাসি।

সে হাসিতে সম্মতির লক্ষণ!

মনটা ভালো হয়ে গেল আমার।

আমি আর নুরুল ছাদের দিকে রওনা হলাম বাড়ি’বন্ধ’ করার উদ্দেশ্যে

 

রচনাকাল – ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩ 

গরু

গরু ম্যানেজ হয়নি। খবর পেতেই আর বিন্দু মাত্র দেরী না করে আনন্দস্পটে চলে আসলাম। সেখানে যুবরাজ সিং-এর মত করে নাকটা আকাশের দিকে তুলে দাঁড়িয়ে ছিল ফারহান। মনটা চাইল নাকের ওপর একটা বিরাশি ছক্কার ঘুষি বসিয়ে ফারহানটাকে চ্যাপ্টা করে ফেলতে। কিন্তু আজকের এই বিশেষ আনন্দের দিনটা নষ্ট করতে চাইলাম না।
‘ফান্ডের টাকা দিয়ে গ্যালাক্সি এস-ফোর কে কিনেছিল চাঁদ?’ মনে মনেই হুঙ্কার ছাড়লাম।
তবে এখন আত্মকলহের সময় নয়। সামনে ঘোরতর সমস্যা। একেবারে ইজ্জাত কি সাওয়াল!
দেখলাম কসাইও প্রস্তুত। আট দশেক রকমের ছুড়ির মাথা ধারালো করছে কসাই মামা আর তার অ্যাসিস্ট্যান্টদ্বয়।
আস্ত গরু জবাই করে প্রেমসে খাওয়া-দাওয়ার আমেজটা নষ্ট হয়ে গেল দিনের শুরুতেই!
আজ আমাদের ক্লাবের বর্ষপূর্তি।
জিনিসটা শুরু হয়েছিল ঠিক এক বছর আগে।

রাজশাহী জুড়ে রাস্তার পাশে আড্ডা দিতে দিতে ক্লান্ত তখন আমরা সবাই।
‘দেশ রসাতলে গেল!’ বিজ্ঞের মত বলে উঠেছিল কাফি।
‘বলে যা… বলে যা… ’ টিটকিরির সুরে তাল মিলিয়েছিল ফারহান। ‘সবার অভিযোগ দেশ রসাতলে গেল। কিন্তু এক পা আগানোর বেলায় সব অকর্মার ঢেঁকি।’
‘ছেড়ে দে।’ মধ্যস্থতায় আসতেই হল আমাকে, ‘ছেলেমানুষ। কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছে!’
‘ছেলেমানুষ!’ হুংকার দিয়ে উঠল কাফি, ‘এই বছরেই সবাই তো রীতিমত আঠারোয় পা দিয়েছিস! তবুও ছেলেমানুষ?’
‘তো কি হয়েছে?’ পাশ থেকে মিনমিন করে বলল রাইয়ান, ‘মেয়েমানুষ তো বলেনি।’
‘তোদের জন্যই দেশের আজ এই দশা।’ দেশমাতৃকার প্রেমে বিগলিত তখন কাফি, ‘আজ এই টগবগে তরুণদের রক্ত যদি শীতল না হত – বয়লারের মুরগি খেতে খেতে যদি এরা মুরগি না হত – তবেই বুঝত এরা – এই দেশের জন্য তাদেরও দায়িত্ব আছে বৈকি! যুবসমাজ – এই মুহূর্ত থেকে দেশসেবায় নিয়োজিত হও। আহ্বান জানালাম উদারচিত্তে।’
‘উদরপূর্তির পরে এ নিয়ে আলোচনা করলে আমাদের মাথা খুলবে ভালো।’ একমত হয়ে গেলাম নিমেষেই। ‘ওই যে একটা চটপটির দোকান।’
‘হ্যাঁ, ওইটা একটা চটপটির দোকান।’ সায় জানাল কাফি। ‘সে তো আমিও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু খাওয়াচ্ছেটা কে, শুনি?’
‘নির্ঘাত তুই।’ সমঝোতা করে দিল ফারহান, ‘উদারচিত্তে এবার চটপটির দোকানের দিকে হাঁটা দাও বাছা।’
দোকান থেকে আধ ঘন্টা পর যখন আমরা চলে যাচ্ছি কাফির পকেটের দীর্ঘশ্বাস এতদূরে থেকেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম বলে মনে হল।
ওর উদার মন রাতারাতি সংকীর্ণ হয়ে গিয়ে দেশসেবার ভূত বেড়িয়ে যাবে বলেই ভেবেছিলাম।

কিন্তু না।
দমে যাওয়ার ছেলেই সে নয়।
রীতিমত একটা ঘর ভাড়া নিয়ে খুলে ফেলল মিরবাগ সমাজসেবী যুবসংঘ। আর আমাদের সেখানে চাঁদা দিয়ে মেম্বার হতেই হল। ভেবেছিলেম পাড়ায় রীতিমত টিটকিরি পরে যাবে এই নিয়ে।
কে বলেছে ‘মানুষ ভাবে এক – আর হয় আর এক?’
সেদিন স্বঘোষিত ইতিহাসবেত্তা জহির চাচাকে দেখে বেশ লম্বা একটা সালাম ঠুকে দিতেই একগাল হাসলেন তিনি।
‘আরে ইমন যে!’ একপাশে পানের পিক ফেলে আবারও তরমুজের বিচির প্রদর্শনী মেলে দিলেন তিনি। ‘সমাজসেবা কেমন হচ্ছে?’
‘ভালই চলছে চাচা।’ মুখ রক্ষার খাতিরে বলতেই হল।
হচ্ছে তো ঘোড়ার ডিম। কাফি রোজ এক থেকে দেড় ডজন করে আইডিয়া বের করে কি করলে আজ জাতির মুক্তি হবে। কিন্তু কাজের বেলায় ঠনঠন। হবেই বা না কেন? কর্মসূচীর বেশির ভাগই অনন্ত জলীলের কাজ। যেমন : একটি কর্মসূচি হল পার্লামেন্টের সামনে আমরণ অনশনে নামা। যতদিন গার্মেন্টস শ্রমিকদের মর্যাদাপূর্ণ বেতন দেওয়ার অঙ্গীকার না করা হবে ততদিনের জন্য আহার-পানীয় নিষিদ্ধ। এদিকে বাহিনীতে আমরা পাঁচ জন। বলিহারী যেতেই হল।
‘সে তো বুঝতেই পারছি বাছা।’ আনন্দে মাথা দোলালেন জহির চাচা। ‘যতই দিন যাচ্ছে তোমার চেহারাগুলো চেঙ্গিস খানের মত হচ্ছে। চেন তো? ইতিহাস বিখ্যাত সমাজসেবক। ইতিহাস পড়বে, বুঝেছ? অনেক কিছু জানার আছে। শেখার আছে।’
চেঙ্গিস খান আর সমাজসেবা!
আমাদের ক্লাবের প্রতি সমাজের ধারণায় কোনদিক থেকেই উৎফুল্ল হতে পারলাম না।
তবে কাফির একটা প্ল্যান অন্তত হিট!
‘সুস্বাস্থ্য এবং সুন্দর মনের জন্য চাই খেলাধুলো এবং ব্যায়াম।’ একদিন এই অভিনব সমীকরণ আসে ওর মাথায়।
ক্লাবে ক্যারাম বোর্ড, কার্ড জোন আর জিম সংযোজন করতেই হুড়হুড় করে পাড়ার ছেলেপিলের আগমন ঘটতে থাকল এবং তাদের পকেট থেকে চাঁদার টাকাও বের হতে থাকল বৈকি!
মেম্বারশিপ ছাড়া কাওকেই ক্লাবের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয় এবং মেম্বারশিপ মানেই মাসিক চাঁদার অব্যাহত ধারা – সুস্পষ্ট কথা কাফির।
তরুণ সমাজের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল আমাদের ক্লাব। সমাজসেবা বলে কথা!
তবে সমাজে নিন্দুক থাকবেই।
‘পাড়ার ছেলেপুলেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে’ আমাকে শুনিয়েই চায়ের দোকানে দোকানদারের সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন জহির চাচা, ‘তায় আবার নেপোলিয়ন আর চেঙ্গিস এক হয়েছে! সারাদিন আমার পল্টুটা ক্লাবে গিয়ে পড়ে থাকে। দিন দিন ব্যায়াম করে করে গুন্ডা হচ্ছে!’
এরপর আর বসা চলে না। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে উঠে পড়লাম।
‘চেঙ্গিস আর নেপোলিয়ন? গুন্ডা হচ্ছে? নাহয় পাড়ার ছেলেগুলো এখন চিত্তাকর্ষতা ধাপে আছে – তাতেই নিন্দুক এতবড় অপবাদ রটালো?’ চোখমুখ লাল করে বলল কাফি, ‘দ্বিতীয় আনন্দমেলা ধাপের পরই তো আমরা সমাজসেবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যাব সে কি তারা বোঝে না!’
ফারহান একটা করে সবাইকে আইসক্রীম কিনে খাইয়ে পরিবেশ ঠান্ডা করল – অবশ্যই মেম্বারের চাঁদার টাকায়। সমাজসেবীদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হয় বৈকি!

বন্যার বেগে মেম্বারদের সংখ্যা বাড়তে থাকল। ততদিনে মেম্বারদের জন্য অন্য যেকোন জায়গা থেকে হাফ-চার্জে একটা সাইবার ক্যাফেও খোলা হয়েছে কি না! পাড়ার সীমা লংঘন করে আশেপাশের এলাকার ছেলেছোকড়ারাও দিব্যি জুটে গেল মিরবাগ সমাজসেবী যুবসংঘে। আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে আট মাসেই একশ ছাড়িয়ে গেল মেম্বারদের সংখ্যা!
ততদিনে এক বছরও হয়ে গেছে প্রায়।
এক বছর পূর্তির জন্য একটা ছোটখাট ভোজের ব্যবস্থা করা আমাদের নীতিগত দায়িত্ব মনে করলাম।
রীতিমত হই-হুল্লোড় কারবার করতেই হবে।
গরু থেকে মুরগি সবই স্পট ডেড বানিয়ে রান্না হবে। মানে ঘটনাস্থলেই জবেহ।
সবই ঠিক ছিল।
ফান্ডের টাকা কোথায় যায়? এই নিয়ে মেম্বারদের মনের চাপা অসন্তোষও ঘুঁচিয়ে দেওয়া যেত এই সুযোগে।
ফান্ড উলটে পালটে দেখা গেল ভালোই আছে। অনুষ্ঠানটা করা যাবে। তাক লেগে যাবে এবার এলাকার মুরুব্বিদের। দাওয়াত সবাইকেই করা হবে বৈকি।
ফারহান ছিল তখন ঢাকায়। প্ল্যান সামলে আমরা সবাই দুইদিনের ছুটি নিলাম। সামনে বড় প্ল্যান-প্রোগ্রামের ব্যাপার-স্যাপার আছে। ব্যস্ততম এক বছর শেষে অবশ্যই আমাদের দেহ ছুটির দাবীদার। ফারহানকে ফোনে জানানো হল, ‘সারপ্রাইজিং খবর আছে।’
ওপাশ থেকে সেও গর্বের সাথেই জানাল ‘আমার কাছেও একই জিনিস আছে।’
প্রত্যেকেই নতুন কিছু করার আনন্দে তখন উৎফুল্ল।

পরবর্তী কার্যদিবসে উপস্থিত হয়েই রাইয়ান জানাল, টাকা গন।
আমরা সবাই বর্জ্রাহত হতেই ফারহান হাস্যোজ্জ্বল মুখে জানাল , ‘নট গন। ইনভেস্টেড। ’
টেবিলের ওপর একটা গ্যালাক্সি এস-ফোর রেখে বলল, ‘আমাদের ক্লাবের জন্য একটা মোবাইলফোন দরকার ছিল। বার বার সিম খুলে চিমটিয়ে আর কতদিন?’
সবসময় মাথা গরম কাফির হাত চলে গেল হোলস্টারে। পিস্তলটা বের করেই ম্যাগাজিন খালি করে দিল ও ফারহানের বুকে। অবশ্য কল্পনাতেই। মেজাজ খারাপ হলেই হোলস্টারে হাত দেয়ার মত একটা মুভ দিলেও সেখানে তার কোনকালেই হোলস্টার ছিল না।
‘ওহে শ্যালক!’ মধুর সম্বোধন করল রাইয়ান। ‘আমাদের প্ল্যান ছিল আরেকটা।’
পুরো প্ল্যান খুলে বলা হল ওকে। রীতিমত ঠোঁট বাঁকিয়ে আমির খান মার্কা গলায় ফারহান তার মূল্যবান মন্তব্য জানাল, ‘ইগনার কার। ইগনার কার!’
‘সম্ভব না শ্যালিকার স্বামিপ্রবর!’ পুনরায় মধুর ভাষা প্রয়োগ করল রাইয়ান। ‘সবাইকে গত অধিবেশনেই নিমন্ত্রণ করে দেওয়া হয়েছে।’
‘হেহ – ফোনের পেছনে মাত্র ষাট হাজার তো গেছে! ফান্ডে আরও আছে না? সমস্যা কী? বল দেখিনি কী বাদ যাচ্ছে খাবারের আইটেম থেকে তাহলে?’
‘গরু!’ একযোগে হাঁক ছাড়লাম আমরা ক্ষোভে।
‘চিল, ম্যান।’ আকাশে ইদানিং চিল না থাকলেও আমাদের ম্যানদের এই কথা বলেই থাকে ফারহান। ‘গরু আমি ম্যানেজ করব।’
তবে গরু বেশ ভালোভাবেই ম্যানেজ হয়েছে দেখলাম। গরুর বাজেটের সাথে সাথে আমাদের ইজ্জতও ‘গন’।
যুবরাজ সিং-এর মতই, যার ভাব দেখলে নাক-মুখ সমান করার অভিপ্রায় জেগেই থাকে – সানগ্লাস চোখে নাক আকাশের দিকে দিয়ে এখন সামনেই ফারহান।
‘কাফি জানে?’ ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম।
‘হুঁ!’ এক কথায় জবাব দিল ফারহান।
‘তোর ভূত ছুটায়নি গালি দিয়ে?’
‘না’ আবারও এককথায়। যেন ল্যাবের কুইজ দিচ্ছে। না-বাচক উত্তর দিলেও কুইজ কুইজ ভাব দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেললাম।
চারপাশে তাকালাম। মেম্বারদের ছড়াছড়ি সবখানেই। পরিস্থিতি মাথা কাটার মত হওয়ার আগেই কেটে পড়তে হবে এখান থেকে। সোজা নানার বাড়ি।
কসাই মামা এখনও ছুরি ধার দিচ্ছে। গরুর লোভে অনেকেই এসেছে আজ এখানে। মেম্বারশিপের চাঁদার একটা গতি হল ভেবেই তারা খুশি। আর আজ যদি গরু না পায় তবে ওই ছুরির ব্যবহার কোথায় হতে পারে অনুমান করে হনুমান হয়ে গেলাম।
আফটার অল, জিম করে করে এদের গুন্ডাসদৃশ বডি-বিল্ডিং-এর পথ আমরাই দেখিয়েছি বৈকি। এই প্রথমবারের মত জহির চাচার কথা সত্য বলে মনে হচ্ছিল একটু একটু।
ভাবনার ছেদ কেটে গেল কারও হুংকারে–
‘আরে ধর! ধর! কাট! কেটে ফেল!’
এবং সেই সাথে ঘোড়ার খুরের টগবগানি।
তাজ্জব কান্ড! এখানে ঘোড়া আসবে কোত্থেকে!
আমাদের চিটিং বাজি তাহলে মেম্বাররা টের পেয়ে গেলই শেষ পর্যন্ত?
একেবারে ঘোড়সওয়ার হয়ে আমাদের কাটতে এসেছে নিশ্চয়?

লেজ উড়িয়ে – শিং নাড়িয়ে ছুটে আসা গরুটাকে দেখেই আমার ভুল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। মুহুর্তের জন্য জনতা থমকে গেলেও একযোগে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল গরুর ‘পোলার’ ওপর।
গরু নিমেষেই ধরাশায়ী।
কসাই আর তার অ্যাসিস্টেন্টদ্বয় এতক্ষণে হাত চালানোর সুযোগ পেয়ে আর দেরী করল না।
কেবল আমারই একটু খটকা লাগল, কাফির পাশে দিয়ে বিড় বিড় করে বললাম, ‘গরুটা অনেকটা জহির চাচার কালো গাইটার মত না?’
আগুন চোখ নিয়ে কাফির হুংকার, ‘আরে কাটলে সব এক! কাট! কাট! থমকে গেলি ক্যান তোরা? আল্লাহু আকবর!’
সেটাই! ভাবলাম। চেঙ্গিস খান আর নেপোলিয়ন? দাঁড়াও তোমাকে ইতিহাসের প্রায়োগিক শিক্ষা দিচ্ছি। চেঙ্গিসের স্বভাব কেমন ছিল জেনে নাও … হুঁ হুঁ!

সেদিনই সন্ধ্যা। মেম্বাররা সব তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে বাসায়।
আমরা পাঁচজনই কেবল অফিসে।
‘গরু ম্যানেজ করলি কি করে?’ চোখ আকাশে তুলে জানতে চাইল রাইয়ান।
‘রাস্তার পাশে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। দেখেই প্ল্যানটা মাথায় আসে। বাইরের পাড়ার দুই চারজন মেম্বারের কাছে ছড়িয়ে দিলাম গরু গেছে ছুটে। ত্রিমুখী ধাওয়া দিয়ে বাকিটুকু করা তো সহজ। ’
‘বাবারা ব্যস্ত? ’ ভূত দেখার মত চমকে দেখলাম স্বয়ং জহির চাচা উপস্থিত! নির্ঘাত বুঝে নিয়েছে!
পকেট থেকে ফোন বের করে অযথায় রিসিভ করার ভান করে চেঁচিয়ে উঠল রাইয়ান, ‘কি বললা? ভাইয়া অ্যাকসিডেন্ট করেছে? আমি এক্ষুণি আসছি। ’
অতঃপর ঝড়ের বেগে প্রস্থান।
‘আমি একটু বাথরুমে…’ বাক্য শেষ না করেই হাওয়া ফারহানও।
দুই গোবেচারা বান্দা আমি আর কাফি তখন।
‘বসুন। বসুন!’ হঠাতই ব্যগ্র হয়ে উঠলাম আমরা।
‘ইয়ে…’ করুণ কন্ঠে শুরু করলেন জহির চাচা। ‘সমাজসেবার নামে খাওয়া দাওয়া ফূর্তি করে তোমাদের হাড়ে মরচে পড়ে গেছে বুঝতে পারছি। তাই আমার গরুর…’
‘আমরা দাম দিয়ে দেব!’ হড়বড় করে বললাম আমরা।
‘কি হল তোমাদের?’ ভুরু কুঁচকালেন চাচা, ‘বলছিলেম আমার গরু আজ রাতে বাসায় ফেরেনি। তোমরা কি একটু কষ্ট করে খুঁজে দেখবে? কিসের দাম দিতে চাচ্ছিলে তোমরা?’
‘না চাচা , মানে সমাজসেবা -’ আমতা আমতা করলাম আমি।
‘- সমাজসেবার নামে খাওয়া দাওয়ার মূল্য আমরা শোধ দেব আপনার উপকারে এসে।’ বাক্য সম্পূর্ণ করে দিল কাফি। ‘চল বেরোই…’ আমাকে টান দিল ও। ‘আপনি চিন্তা করবেন না চাচা। গরু আশেপাশেই আছে হয়ত।’
অমায়িক হাসি দিলেন জহির চাচা।
আর আমার পেট রীতিমত গুড়গুড় করে উঠল।
আশে পাশেই বৈকি! আমার আর কাফির পেটেই আছে বেশ একটা অংশ। আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই দুই কিলোমিটারের মধ্যেই বাসায় বাসায় তরুণসমাজের পেটে আছে বাকি গরু।
‘ইয়ে চাচা?’ ডাক না দিয়ে পারলাম না , ‘আপনার তথ্যে একটা ভুল ছিল।’
‘কি ভুল বাবা?’
‘চেঙ্গিস খান ইতিহাসের পাতায় অমর বটে। তবে নৃশংসতার জন্য। সমাজসেবার জন্য নয়।’
জহির চাচার মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
এর দুই মাসের মধ্যেই রীতিমত ব্যস্ততার সাথেই তুলে ফেলা হল গর্বিত মিরবাগ সমাজসেবী যুবসংঘকে।

শানে নুযূল :
রাজশাহীতে আনন্দের সাথে ঘুরে বেড়ায় বেশ কিছু গরু। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে এরা দুলকি চালে। মামার সাথে অটোয় যেতে যেতে মনে হল – এদের সেফটি বলতে কিছু কি আছে? উত্তরটা সহজ – না। চাইলেই খেয়ে ফেলা যায়। শুধু ধরো আর জবাই করো। কাটার পর সব এক। সেখান থেকেই কল্পনাপ্রসূত এই কাহিনীর জন্ম।
রচনাকাল : ২৫শে নভেম্বর, ২০১৩।

এই গল্পটা অনলাইনে পাবলিশড প্রথম কোনও ছোটগল্প। বলা যায় এই লেখাটার মাধ্যমেই নিজেকে প্রকাশ করা শুরু আমার। নভেম্বরে টেনিদা রিভাইজ দিয়েছিলাম। রচনায় নারায়ণদার প্রভাব সুস্পষ্ট। এটা স্বীকার করতে কোনও কার্পণ্য নেই আমার। তাই ফুটনোট যোগ করা হলো।
– লেখক