১.
উদ্ভট এই শিরোনামের লেখাটি শুরু করতে হবে রসালো আলাপ দিয়ে। আইডির রিচ সুবিধের নয়, যাবেই দশজনের কাছে। তারমধ্যে আবার রসালো আলাপ না হলে লোকে যে ভেগে যাবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কাজেই শুরু করা যাক আমার সাথে অসংখ্য মেয়ের নাম জড়িয়ে থাকার রহস্য নিয়ে।
এই রহস্য আমি কখনো খোলাসা করি না। আজকেও করবো এমন নয়। তবে হাল্কা আলাপ করতে হবে। ব্রেইন ড্রেইনের সাথে এর আলাপ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এটা খুবই সত্য কথা যে আমি সমকামী নই। এটাও খুব সত্য কথা যে আমি অবিবাহিত। কাজেই মেয়েদের প্রতি আমার আগ্রহ থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ঢাকা থেকে টেক্সাস – যতজন মেয়ের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং যতজনের সাথে সম্পর্কটা ‘ইয়ে’ টাইপের গন্ধ পাওয়ার মতো, তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটা হচ্ছে এমনটা আমি-ই চেয়েছিলাম। এটাও খুব সত্য কথা, তাদের প্রায় সবার সাথেই আমার ন্যুনতম ডেটটাও হয়নি, হবে এমন পরিকল্পনাও নেই। আমার চারপাশে থাকে তিনটি অদৃশ্য দেয়াল। বড়জোর সে দেয়ালগুলোর দুটো তারা ভাঙতে পারেন। তৃতীয় দেয়ালের ভেতরে কেবল আমি একাই।
এর পেছনে একমাত্র কারণ হচ্ছে মানব মনস্তত্ত্ব। যে পথ আমি আমার জন্য বেছে নিয়েছি তাতে করে আসলে চব্বিশ ঘণ্টায় একটি দিন পার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কখনো কখনো মাসের পর মাস আমি উধাও হয়ে যাই। এটা পরিবারের জন্যও সত্য। এমনটা আইনস্টাইনের সাথে হতো, নিকোলা টেসলার সাথে হতো, এমনকি কোন একটা কিছুতে যে ডেডিকেটেড তাদের সবার সাথেই হয়ে থাকে। এই দেড়টি মাস আমার কাছে একটি দিনের মতো মনে হয়। যারা এই জিনিসের ভেতর দিয়ে যাননি তাদের বোঝার কোন কারণ নেই। কিন্তু আর সবার কাছে তেমন নয় ব্যাপারটা। তাদের কাছে প্রতিদিন সূর্য ডোবে এবং পরদিন আবার সূর্য ওঠে। অতি সাধারণভাবেই আর কেউ যে আমার জন্য দুই মাসের দিন পার করবে এমনটা আমি মনে করি না, এমনটা আশা করাও সঙ্গত নয়। দুই একবার চেষ্টা করে দেখেছি এবং আমার ধারণার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি।
কাজেই আমার অবচেতন অলটারনেট গিয়ারে চলে গেছে। সে চায় মানুষ তার জন্য কেয়ার করুক। ভালোবাসুক। তবে দূর থেকে। ওই হেলদি বা আনহেলদি ডিসট্যান্স ধরে রাখাটা আমার সহজাত একটি ঘটনা হয়ে গেছে। আমি চাই তারা আমাকে ভালোবাসুক, তবে বেশি কাছে আসার দরকার নেই। কাছে এলেই তারা আশা করবে প্রতিদিন আমাকে পাওয়া যাবে। আমার একটি দিন যে তিন মাসে হচ্ছে তা তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না।
কাজেই, মাসুদ রানা হয়ে গেলাম। টানলাম অনেককেই, কিন্তু বাঁধনে জড়ালাম না। তা আপনি যতই সুন্দর, হট, আর সৃজনশীল হোন না কেন। বাঁধনে জড়িয়ে হোগামারা খাবো নাকি? আমার তো সেই তিন মাসে দিন। নয় মাস যাবার আগেই তারা হয়ে যাবে ক্র্যাক, তারপর আমি হয়ে যাবো সেই গল্পের ভিলেন। অন্য কোন মেয়ের ত্বক স্পর্শ না করেও।
এবার আপনার ভ্রু কুঁচকে যাবে। আমার কলারটা চেপে ধরে বলবেন, “এই লুচ্চা। এর সাথে ব্রেইন ড্রেইনের সম্পর্ক কোথায়?”
সম্পর্ক আছে ভাই। এজন্যই তো এত ভূমিকা।
২.
বাংলাদেশ থেকে দুই ধরণের ব্রেইন ‘ড্রেইন’ হয়।
প্রথম যে শ্রেণিটিকে আমরা অনারেবল মেনশন দেবো, তাদের আমি ডেকে থাকি ‘খাইঞ্চোদ।’
খাইঞ্চোদ নামটা বন্ধু আসাদের দেয়া। সে এই নামটি দিয়েছিল বন্ধু অনিককে। কারণ অনিক কিছু দেখলেই বলতো, “খাবো।”
কিছু দেখামাত্র ‘খাবো’ বলে ওঠার রুহানিয়াত চালু আবার করেছিলাম আবার আমি। রুয়েটে একদিন কাফিদের রুমের মেঝেতে ঘুমাচ্ছি। সূর্যমামা উঠে গেছে। আলোর প্রতাপে টেকা যাচ্ছে না। কাজেই কম্বলে মাথাটা ডুবিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু শালারা এত হট্টগোল করছে যে ঘুমটা সকাল দশটার দিকে টুঁটে গেছে। মটকা মেরে পড়ে আছি, যদি আবার ঘুমানো যায়। জেগে গেছি বুঝে গেলে ওরা আমাকে একেবারে তুলে দেবে।
ওদিকে হেঁড়ে গলায় কোন স্যারের যেন পিন্ডি চটকাচ্ছে সবাই। কিন্তু সেসব নয়। আমার কানে আটকে গেল অন্য একটা শব্দ।
কাফি বললো, “এই, সিঙ্গারা নিয়ে আসি। কে কে খাবি?”
আমি তখনো মটকা মেরে পড়ে আছি। কিন্তু পেটের ভেতর একটা গণ্ডার ডেকে উঠলো।
কাফি বললো, “কেপি তো ঘুমাচ্ছে। আর রাইয়ান খাবে না বলেছে। কে কে খাবি না আর?”
আমি আধো-ঘুম থেকে বললাম, “খাবো।”
ঘরের যাবতীয় আলোচনা ও হট্টগোল নিমেষে থেমে গেল।
কাফি জানতে চাইলো, “কিছু একটা শুনলাম মনে হলো।”
কম্বলের তলা থেকে আমি কোনমতে আবার বললাম, “খাবো।”
পুরো বাক্য বলার মতো জাগিনি তখনও।
ফারহান বললো, “কেপির বাচ্চা কিছু বললো মনে হয়। ঘুমাচ্ছে, আবার খাওয়ার বেলায় আছে।”
কাফি এসে হাসি কোনমতে চেপে ধরে আমার কম্বলটা তুলে কনফার্ম করলো, “খাবি?”
আমি চোখ না খুলেই বললাম, “খাবো।”
এটা ট্রেডমার্ক হয়ে গেল। সবাই হয়তো কাউন্টার স্ট্রাইক খেলছি। আসাদ ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে এসে আমাদের বার বার ডেকে গেছে, “ভাই, খাইতে চল ভাই। মরে গেলাম।”
নড়ার নাম লক্ষণ কারো নাই।
বিশ মিনিট পর এসে আসাদ হয়তো বললো, “খাবো।”
সাথে সাথে খেলা বন্ধ। কেউ যদি পুরো বাক্য না বলে ‘খাবো’ বলে, তার অর্থ সে ডেড। তাকে খাবার দিতেই হবে এখন। কিন্তু অনিকের হিসাব আলাদা। সে একদিন এসে বললো, “খাবো।”
আসাদ এক্সেল প্রজেক্টে কী যেন মেলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। মিলছে না। তখনও তাই চেষ্টা করছিল। মেজাজ-মর্জি যথেষ্ট খারাপ ছিল তার। টেবিল থেকেই হুঙ্কার ছাড়লো সে, “কী বললি? কী বললি তুই?”
অনিক আরও করুণ গলায় বললো, “খাবো।”
আসাদ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো, “এই তোর আর কাজ নাই। সব সময় খাবো, খাবো। এই শালা তো দেখছি একটা খাইঞ্চোত।”
হয়ে গেল। আসাদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করলো নতুন একটি শব্দ যুক্ত করে।
কাফি বোধহয় একবার জানতে চেয়েছিল, “ভাই, বাই*নচোত তো বুঝি। মা*রচোতও বুঝি। কিন্তু এই খাইঞ্চোতটা কী? এর অর্থ কী, ভাই?”
আসাদ তখন কাউন্টার স্ট্রাইকে ঠা-ঠা গুলি করতে করতে নির্বিকার মুখে উত্তর দিলো, “খাওন চোদে যে।”
তো, ব্রেইন যখন ড্রেইন হচ্ছে, একটা শ্রেণি যাচ্ছে যারা – তারা আসলে খাইঞ্চোত। যেখানে খাবার সেখানেই তারা। লয়ালটির বালাই নেই। আমেরিকায় চাকরি আছে, ওটাই যথেষ্ট। পড়ার নাম করে এসে চাকরি করে সিটিজেনশিপ নিয়ে একাকার অবস্থা। তাদের হিসাব এই আলোচনায় হবে না। এজন্যই তাদের অনারেবল মেনশন দেয়া হলো।
দ্বিতীয় শ্রেণিটি দেশপ্রেমিক। সব সময় দেশে ফিরে আসতে চায়। জ*ঙ্গি থাকুক আর স্বৈরাচার থাকুক, ফিরে এসে সবার মাজা ভেঙে দিতে চায় তারা। এদের ব্যাপারেই আলোচনা হবে। এর সাথে প্রথম অংশের মেয়েদের আলাপ সঙ্গতিপূর্ণ।
৩.
রুয়েট একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। ওখান থেকে সার্টিফিকেট আজও তুলতে পারিনি। যখন জরুরী কাগজপত্র তুলতে যাই, শিক্ষাশাখার একজন মহামান্য খাইঞ্চোত আমাকে বললেন, “রেজিস্ট্রার স্যার এলে সাইন করবেন। তার আগে তো কাগজ পাবেন না। আপনার কাগজে সাইন হয়নি।”
আমি জানতে চাইলাম, “স্যার কি অফিসে নেই?”
তিনি বললেন, “এখন নেই, উনি আসবেন হয়তো একটার দিকে।”
ঘড়িতে তখন সকাল দশটা।
আমি জাঁকিয়ে উনার টেবিলের সামনে বসে বললাম, “অসুবিধা নেই। আমি আছি। যখন স্যার আসবেন তখন সাইন এনে দেবেন। তাহলেই হবে।”
আমি ওখানে একটা শকুনের মতো বসে থাকলাম। টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা। আড়াইটার দিকে আমার ঢাকার ফ্লাইট। তবুও দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকলাম গ্যাঁট মেরে। একটার দিকে একবার জানতে চেয়েছিলাম, “স্যার আসেননি?”
মহামান্য খাইঞ্চোত বললেন, “আসবে। আসলেই আমি আপনার সাইন এনে দেব।”
দেড়টার দিকে আবার বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম, “স্যার আসেননি?”
মহামান্য খাইঞ্চোত বললেন, “আসবে। আসলেই আমি আপনার সাইন এনে দেব।”
আমি পৌনে দুটোয় আবার বললাম, “একটু দেখবেন কি, স্যার এসেছেন কি না? আধঘণ্টা পর আমার ফ্লাইট।”
চার ঘণ্টা হয়ে গেছে প্রায় তখন। একটা জায়গায় গ্যাঁট মেরে বসে আছি। মহামান্য খাইঞ্চোত বুঝলেন মরে যাবো, তাও উনাকে একটা ফুটা পয়সাও আমি দেব না।
তিনি চেয়ারে বসেই উলটোদিকে ঘুরে পেছনের একটা ফাইল হাতে নিলেন। বললেন, “আপনার ব্যাচ তো ওয়ান টু?”
আমি বিনয়ের অবতার। বললাম, “জ্বি।”
উনি বললেন, “রোলটা বলুন তো?”
বললাম।
উনি আমার কাগজটি বের করে দিলেন।
অর্থাৎ পুরো চারটি ঘণ্টা ওখানেই ছিল। তিনি চাইলে সকাল দশটা পনেরর মধ্যে আমাকে কাগজটা দিতে পারতেন। দিলেন না।
আমি কাগজটা হাতে নিয়ে ওখানেই উনাকে একবার সেজদা করলাম। সশব্দে তসবীহ পাঠ করলাম, “সুবহা’না রাব্বি আল আ’লা। সুবহা’না রাব্বি আল আ’লা। সুবহা’না রাব্বি আল আ’লা।”
তারপর বেরিয়ে একটা অটো নিয়ে কোনমতে গিয়ে প্লেন ধরলাম।
৪.
প্রেমে মারা যাচ্ছি তখন। “দ্য ওয়ান” শ্রেণির প্রেমিকা আবার ইউরোপ চলে যাচ্ছে। আলবিদা।
এমনই ছ্যাঁকা খেলাম যে আমার আর ওর প্রেমকাহিনী নিয়ে লিখে ফেললাম, “জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে।”
প্রেমকাহিনী অমর হলো।
তবে প্রেমকাহিনী শেষ হবার শেষ পেরেক, ওর ইউরোপ ভেগে যাওয়ার প্রসেসের একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তলা থেকে ওর সাইন করা কাগজ নিয়ে আসতে হবে। যথারীতি আমরা গেছি। ওর কাগজটা নিয়েছে মন্ত্রীমহোদয়ের না সচিবের সাইন করিয়ে নেবার কথা বলে। আমাদের হাতে একটা রিসিটমার্কা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেছে। নিচু গলায় বললো, “আজকে দেবার কথা নয়, তবে আপনাদের দেব। চারটার দিকে আসবেন। নইলে কাল পাবেন।”
আমরা বললাম, “আমাদের তো আজই লাগবে।”
লোকটা চোখ টিপে বললো, “তবে ব্যবস্থা করবো।”
চোখ টেপার অর্থ আমি বুঝলাম। তবে না বোঝার ভান করলাম।
তারপর আর দিচ্ছে না। আমরাও খিঁচ খেয়ে দাঁড়িয়ে। সাড়ে চারটা বেজে গেছে। একটু পর পাঁচটা বেজে গেলে অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। ওর হাতে একেবারেই সময় নেই তখন। দেশ ছাড়বে। আগামিকাল আবার এ নিয়ে সময় দেবার কথা ছিল না। আজকেই কাজ উদ্ধার করতে হবে। এদিকে চারটা বেজে যাচ্ছে দেখে আর কেউ আসছে না। আমরাই আছি।
মেয়েটি আমাকে বললো, “বোধহয় পাঁচশটা টাকা দিলে দেবে। আমি ওই ছেলেটাকে পাঁচশ টাকা দিয়ে আসি।”
আমার হাতে তখন ওর রিসিট। ওখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সীল। বাংলাদেশের পতাকাটা মনোগ্রামের মতো ঝাপসা করে বসানো। জলছাপ। ওটার দিকে একবার তাকালাম। তারপর মাথায় আগুন ধরে গেল। শালার পুতেরা, আমি বাংলাদেশের নাগরিক। তুমি বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়ে কাজ করো। টাকা তুমি নিবা মানে!
ওর হাত ধরে বললাম, “নড়বা না। আমরা একটা ফুটা পয়সা না দিয়ে কাগজ উদ্ধার করবো। তারপর ওই পাঁচশ’ টাকা দিয়ে পাবুলামে গিয়ে বার্গার খাবো। কিন্তু ওদের এই টাকা দিবো না। মরে গেলেও দিবো না।”
ও জানতে চাইলো, “কীভাবে?”
আমি বললাম, “তোমার নিষ্পাপ মুখটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে। তবে দাঁড়াবো দরজার সামনে।”
দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওর হাতটা ছেড়ে দিতে হল। এখন আমরা ভিক্টিম কার্ড খেলবো। বিশ্ববোকাচোদার চরিত্রে অভিনয় করবো। প্রেম করতে করতে ও চরিত্রে অভিনয় করা যাবে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পূর্ণ মনোযোগ আমাদের গেটের দিকে। হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছি বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত সীলযুক্ত রিসিট। মুখে তুলে ধরেছি রাজ্যের সারল্য। আর আমরা এত কিউট যে বেড়ালরাও লজ্জা পেয়ে আমাদের মঞ্চ ছেড়ে দিত।
সেখানে মানুষরা তো কিছুতেই আমাদের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারছিল না। প্রতিটা মানুষ ও বেড়ালের দেখবার মতো করে হাতে আমি পতাকার মতো ধরে রাখলাম রিসিটটা। এদিকে যে লোকটা আমাদের দেবে বলেছিল সে খুব ধৈর্য ধরে আছে কখন আমরা গিয়ে ওদের টাকা দেব। কিন্তু টাকার কথা আমি মুখের ফাঁক দিয়েও বলছি না। ও ব্যাটাও সরাসরি চাইতে পারছে না।
পাঁচটা প্রায় বাজে। এবার স্যুট-বুট পরা লোকজন বের হচ্ছে মন্ত্রণালয় থেকে। আমরা এত কিউট, আর এত সুন্দর করে কলাপসিবল গেটের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি যে আমাদের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে যেতে হচ্ছে সবাইকে। দুইজন জানতে চাইলো, “এই উনাদের কাগজ দিয়ে দিচ্ছো না কেন?”
শয়তানটা ডেস্কের পেছন থেকে গজ গজ করলো।
কিন্তু বের হলো না।
এরপর একজন মাঝবয়েসী লোক নেমে এসে আমাদের দেখে জানতে চাইলেন, “আপনারা কি কিছু খুঁজছেন?”
আমি ভেজা বেড়ালের মতো বললাম, “উনি তো বললো সাড়ে চারটার সময় আমাদের কাগজটা দেবে। তাই একটু অপেক্ষা করছি। উনি ব্যস্ত বোধহয়। তাই দিচ্ছেন না।”
শয়তানটা তখন ডেস্কে বসে বসে মাছি মারছে।
তার কাছে গিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “এই, উনাদের বিদায় করছো না কেন? অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।”
শয়তানটা আমাদের ডাকলো। তারপর বললো, “কী যন্ত্রণা। একটু পর একটা ছেলে আসবে, তার সাথে একটু কথা বলে নেবেন।”
ছেলেটা আসলো। এসে আমার হাফ-গার্লফ্রেন্ডকে কাগজ দিলো। তারপর আমাকে বললো, “স্যারকে একেবারে শেষ মুহূর্তে ধরে সাইন করাইছি, স্যার। একটু চা-নাশতার টাকা যদি দেন।”
আমি তখন অস্কার পাওয়ার মতো অভিনয় করে যাচ্ছি। আঁতকে উঠে বললাম, “চা-নাশতার টাকার জন্য তো প্রস্তুত হয়ে আসিনি। চা-নাশতার জন্য কত টাকা চাইছেন?”
ছেলেটা বললো, “এই হাজার দিলেও হবে।”
আমি বললাম, “এক হাজার টাকা থাকলে কি আর আমাদের এখানে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো? ড্রাইভার পাঠিয়ে দিতাম। ঠিক কি না?”
ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, “পাঁচশ টাকা?”
আমি বললাম, “মানিব্যাগে একশ টাকার মতো আছে, ভাই। যদি এটা আপনাকে দেই, তাহলে বাসায় হেঁটে যেতে হবে আমাদের। বাসভাড়া আর থাকবে না। এতদূর হেঁটে গেলে ওর পায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে। এত সুন্দর একটা মেয়ের পায়ে ফোস্কা পরে যাওয়া টাকা দিয়ে কেনা চা কি আপনি খেতে পারবেন?”
ছেলেটা চোর হলেও মানবতা আছে। বললো, “ভাই, কী যে মুসিবতে ফেললেন। এভাবে বললে আর কীভাবে চাই। মন্ত্রণালয়ের কাজ, প্রিপারেশন নিয়ে আসবেন না?”
আমি দাঁত কিড়মিড় করে ওর হাত ধরে বেরিয়ে আসলাম। প্রথম মোড়ে প্রথম সিএনজিওয়ালা পাওয়া মাত্র আমরা গুলির মতো তাতে ঢুকে পড়লাম। আমার কাছে একশ টাকার মতো থাকলেও, ওর কাছে টাকা ছিল। এই টাকাটি আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চোরকে না দেয়ার কারণে রয়ে যাওয়া টাকা।
৫.
দ্বিতীয় যে শ্রেণিটি বিদেশে ভেগে গেছে, তারা দেশে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু আমার তরুণীভাগ্যের মতোই, তাদের কপালে আসলে দেশের প্রেম নেই। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা আছে। আমি যেমন মেয়েদের সাইকোলজি জানি। তারাও দেশের সাইকোলজি জানে। গাছের পাতা যেমন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের বাইরে নড়বে না, ওটাও বদলাবে না।
গত দেড়টা বছর ধরে আমার ওয়েবসাইটে একটা হ্যাকারগোত্র বার বার আক্রমণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে এ ব্যাপারে একাধিকবার জানিয়েছি। আমার নিজস্ব গোয়েন্দাগিরির ফলাফল হিসেবে তাদের বাংলাদেশে বসে অপারেট করা ৭ জনের ফোন নাম্বার সহ দিয়েছি। এদের থ্রুতে তারা যে সম্ভাব্য জ*ঙ্গিসদস্য ও তাদের দেশের ভেতরে থাকা সাইবার সেল পাবেন ও কেঁচো থেকে অজগর বের করতে পারবেন তা জানিয়েছি। তারা আমার মেসেজ সিন করেছেন। কিন্তু এত গোয়েন্দাগিরি করে জোগাড় করা ফোন নাম্বার পর্যন্ত থাকার পরও তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
আমার প্রথম রিপোর্ট করার পর বাংলাদেশের সাইবার ক্রাইমের করিৎকর্মা সদস্যরা বোধহয় ৬ জনকে ধর্ম অবমাননার অপরাধে(!) গ্রেফতার করেছে, প্রধানমন্ত্রীকে গালি দেবার অপরাধে(!) গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের নাগরিকদের, বঙ্গবন্ধুকে ব্যাঙ্গ করায় করেছে গ্রেফতার। কিন্তু আমি, একজন বাংলাদেশি নাগরিক, তাদের কাছে যে সহায়তাটা চেলাম, যা আমাকে তাদের করে দেয়ার কথা – তা করে দেয়নি।
চিন্তা করে দেখুন। আমি যদি আজকে আমেরিকার একজন লেখক হতাম আর কোন উজবুক দুবাই থেকে আমেরিকার মাটিতে বসে থাকা চ্যালাচামুণ্ডা নিয়ে আমার ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে আক্রমণ করতো – দুবাইবাসিন্দাকে পুলিশ ধরতে না পারলেও – আমেরিকার মাটিতে বসে থাকা চ্যালাচামুণ্ডা সব গ্রেফতার হয়ে যেত কয়েক মাসের মধ্যে। এর ওপর আমি যদি ওসব লোকের ফোন নাম্বার সহ রিপোর্ট করতাম, দ্রুত হতো কাজ। অন্তত পুলিশ না দেখার ভান করতো না। এবং মিডিয়া এটাকে ফলাও করে প্রচার করতো।
আমি আজ ইংল্যান্ডের নাগরিক হলে, ইংলিশ একজন লেখক হিসেবে আক্রমণ হয়েছে শোনা মাত্র মিডিয়া আর পুলিশ হ্যাকারদের পোঁ-দ চুলকে নিমেষেই ঘা করে দিতো।
আমি বাংলাদেশের একজন লেখক, যে এখনো আগামি তিন বছর বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারবে, সে বয়স ও যোগ্যতা আছে – এবং যে এরই মধ্যে ২১টি বই লিখেছে –
তাকে চোদার টাইম বাংলাদেশ সরকারের নাই। বাংলাদেশের পুলিশের সাইবার ডিভিশনের নাই।
কিন্তু আমি জানি, এই আগামি তিন বছরে যদি বিসিএস দেই ও পাশ করি, নিমেষে আমার কেস হয়ে যাবে টপ প্রায়োরিটি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পতাকাটার প্রতীক দেখে আমি আর আমার এক্স-হাফ-গার্লফ্রেন্ড যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম, সেই রক্ত আমাদের ভেতর এখনো আছে। বাংলাদেশের সাথে বাংলাদেশের ড্রেইনড ব্রেইনরা গাদ্দারি করছে না। বরং আমাদের সাথে গাদ্দারি করেছো তোমরা, সরকারি লোকজন, রাষ্ট্র।
ভালোবেসে যেমন আমার শিক্ষা হয়েছে। ভালোবেসেছি, ভালোবাসা নিয়েছি, কিন্তু আর জড়াবার চেষ্টা করি না কাউকে।
তেমনই তোমার সূর্যসন্তানদেরও শিক্ষা হয়েছে ভালোবেসে।
তারা বাংলাদেশকে ভালোবেসেছে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভালোবেসেছে। কিন্তু বাংলাদেশকে জড়াবার চেষ্টা করেনি তারা আর।
রুয়েটের সার্টিফিকেট নেবার জন্য আমার চার ঘণ্টা বসে থাকতে হয় পাঁচশ টাকা দেব না বলে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সামনে প্রেস্টিজাস স্কলারশিপ পাওয়া আমার সূর্যসন্তান প্রেমিকাকে চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দেশের পতাকার সাথে গাদ্দারি করে পাঁচশ’টা টাকা দেবে না বলে।
আর তোমরা আমাদের সাথে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ চোদাও?
কোন অধিকারে?
পাবলিক ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে – এই অধিকারে?
ওরে ভাই, আপনি খান কি?
(শেষ লাইনটায় স্পেস ভুল জায়গায় পড়ে গেছে।)