KP Imon

Words Crafted

Chapter II. HEROES & VILLAINS | Evolution from Hate to Acceptance of Israel

অধ্যায় ০২ নায়ক ও খলনায়কেরা

পত্রিকায় দেখলাম ইয়াসির আরাফাত বলে কেউ একজন মারা গেছে। খুব হা-হুতাশ পড়ে গেল পরিচিতদের মধ্যে। ইয়াসির আরাফাত নামটা প্রথম শুনলাম। তিনি নাকি নোবেলও জিতেছিলেন। কেউ কেউ নাক সিঁটকে বললো নোবেল তারাই পায় যারা মুনাফেক এবং ভণ্ড। ইয়াসির আরাফাত অনেকের কাছে নায়কের মর্যাদা পেলেও কেউ কেউ তাকে খলনায়ক মনে করেন বলে জানলাম।

একটা মানুষ যে একই সাথে নায়ক ও খলনায়ক হতে পারে তেমন বুদ্ধি আমার ঐ বয়সে ছিল না। ইয়াসির আরাফাত থেকেই তা জানতে পারলাম। মুসলমানদের অনেকের মুখে কালো কালো ছায়া। তাদের বদ্ধমূল ধারণা ইজরায়েল তাকে মেরে ফেলেছে। ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করার আগে তিনি শেষ দুটো বছর একরকম ইজরায়েলের চব্বিশঘণ্টা নজরদারীতেই ছিলেন।

ইয়াসির আরাফাত নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার সময় অবশ্য মুসলিম উম্মাহর তখন ছিল না। ইরাকে আমেরিকার যুদ্ধের কথা আমার মনে আছে। পত্রিকায় আরেকটি নাম ঘন ঘন দেখা যেতে থাকলো। নামটি হচ্ছে সাদ্দাম হুসাইন।

একটি ছবি আমার মনে দাগ কেটেছিল। বাগদাদে একের পর এক বোমা আছড়ে পড়ছে। অন্ধকার, বোমার আলো, আর তাতে পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়া ছিল সেখানে। খুব মন খারাপ করানো একটি দৃশ্য। ইরাকে আমেরিকা যে উইপন অফ মাস ডেসট্রাকশনের কথা বলে আক্রমণ করেছিল তা বিশ্বাস করার মতো মানুষ তেমন পাওয়া গেল না। আল-কায়েদা, যারা টুইন টাওয়ার ধ্বংস করেছিল – তাদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে সাদ্দাম হুসাইনকে দোষী ঠাউরানো হলো, তাও খুব একটা ভরসাযোগ্য ছিল না।

বাগদাদের ওই মন খারাপ করিয়ে দেয়া ছবিটির সময় জানতাম না, তবে ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা জানতে পারি সেই তিন সপ্তাহব্যাপী ভয়ানক আক্রমণে আমেরিকা ২৯ হাজার ১৬৬টি বোমা ও রকেট ইরাকে ফেলেছিল। আক্ষরিক অর্থেই তামা তামা করে দিয়েছিল শহর-নগর-বন্দর। সাত হাজারের বেশি সিভিলিয়ান মারা যায় ঐ অল্প সময়ে। আমেরিকা যে কিলিং মেশিন হিসেবে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন এটা মানুষ জানে এবং মনে রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এতগুলো বছর পরও তাদের চর্চায় মরচে ধরেনি, বরং আরও দক্ষ হয়েছে – এমনটাই প্রমাণিত হলো। এই যুদ্ধটি আমেরিকার মানসিক জোর অনেক বাড়িয়ে দিলেও আমার বিশ্বাস সৈনিকদেরটা কমিয়েছিল ততোধিক। যে কারণে আফগানিস্তানে তাদের পরাজয়টা চূড়ান্ত হয় আরও বিশটি বছর পর।

নির্মোহভাবে দেখলে ইরাকে আমেরিকার মিশন শতভাগ সফল, আফগানিস্তানেও। তবে ইরাকে আক্রমণের পেছনে আমি জোরদার কারণ ঐ বয়সেও দেখিনি, এখনো দেখি না। আমার চিন্তাধারায় পরিবর্তন হয়েছে অনেক, তবে ইরাকে আমেরিকার আগ্রাসী আক্রমণটিকে আমি একটি অন্যায় আগ্রাসন বলেই আজও মনে করি। ওই সময়ের আরেকটি ঘটনা আমার মনে আছে। আপনাদের কারো কারো মনে থাকতে পারে। আলপিন ইরাক যুদ্ধকে কেন্দ্র করে একটি খেলা বের করলো। লুডুর ছক্কা দিয়ে খেলাটি খেলতে হতো। সাপ-লুডুর মতো বিভিন্ন সংখ্যা দেয়া ছিল ওখানে। আপনি ছয় তুলতে পারলে অমুক করবেন, নয়তো পিছিয়ে যাবেন তমুক শহরে। যতদূর মনে পড়ে খেলাটি ইরাকের পক্ষেই ছিল এবং আপনি শেষমাথা পর্যন্ত যেতে পারলে ইরাক জিতবে এমন কিছু ছিলো।

আমেরিকা তাকে বলেছিল ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালাতে, নয়তো ইরাক তামা তামা করা হবে। তারা আরও যোগ করেছিল সাদ্দাম চলে গেলেও, নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত করার এবং ‘উইপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশন’ খোঁজার মহৎ(!) স্বার্থে তাদের ইরাকে আসতেই হবে। তবে যুদ্ধসহ তারা ঢুকবে নাকি যুদ্ধ ছাড়া এটির সিদ্ধান্ত সাদ্দাম হুসাইনের। তখন সাদ্দাম একটি বীরোচিত কাজ করলেন। শক্ত গলায় বললেন প্রাণপ্রিয় ইরাককে তিনি বিদেশী শক্তির হাতে ছেড়ে দেবেন না। পারলে যেন আমেরিকা এসে গায়ের জোরে নিয়ে যায়। এই দৃঢ়চেতা মনোভাব তাকে রাতারাতি বিশ্বের সামনে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, ঠিক যেমনটা অনেকগুলো বছর পর করেছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে। তাছাড়া রকেট লঞ্চার হাতে সাদ্দাম হোসেনের একটি ছবি সেই যুগেও ভাইরাল হয়েছিল। তাকে নায়কের বেশে এবং নায়কের অস্ত্রেই আমরা তখন দেখতে পাই। কিন্তু সাদ্দাম হোসাইনের হুংকার ফাঁকাতে গেল না, বুশ প্রশাসন তার এই আহ্বানে পাই পাই করে সাড়া দিলো।

ইরাকে আমেরিকা মে মাসের ২০ তারিখে তীব্র আক্রমণ করে। সাদ্দাম হোসেন তার স্বভাবসুলভ লড়াকু ভঙ্গিতে আঙুল উঁচিয়েই বললেন ইরাকের জনতা, তোমরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমেরিকা এবং ব্রিটিশদের এই বাহিনীকে সাইজ করে দাও। ইরাক বাইরের কেউ নেবে না। তিনি তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গেলেন। কুয়েত এবং জর্দানের সাথে পাছা মারামারির যে ব্যয়বহুল ব্যর্থ খেলায় তিনি কিছুদিন আগে মেতে উঠেছিলেন তা যেন সবাই ক্ষমা করে দিতে একেবারেই প্রস্তুত। কিন্তু পাশার দান উল্টে যেতে বেশিক্ষণ লাগলো না।

বিশ্বের সামনে সাদ্দাম হুসাইন ধূমকেতুর মতো ঈশাণকোণে নায়কের ভূমিকায় এলেন এবং বিজলীর চমকের থেকেও দ্রুততার সাথে কেবলমাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে হম্বিতম্বি বাদ দিয়ে জান নিয়ে ভাগলেন। তাকে শেষটায় আমেরিকা ধরে ফেলে এবং ফাঁসীতে ঝোলায়। ২০০৬ সালে ঐ ঘটনাটিও বেশ আলোড়ন তোলার মতো ছিল। বিশ্বকাপ ফুটবল জ্বর ছাপিয়ে বছরের শেষটা এই বিষয়েই আলোচনা হলো। যতদূর মনে পড়ে সাদ্দাম হুসাইনের ফাঁসীটি টেলিভিশনে প্রচারিতও হয়েছিল, তবে একেবারে ঝুলিয়ে দেয়ার মুহূর্তটি তারা আর দেখায় না।

স্কুলে তখন নানা রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আমরা ছেলেরা বের করতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল আমেরিকা প্রকৃত সাদ্দামকে ধরতে পারেনি। যে আমেরিকার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে, সাহস দেখিয়ে লড়তে পারে, তাকে ধরে ফেলা এত সহজ কাজ নয় তা আমরা মনে করতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল সাদ্দামের ‘বডি ডাবল’কেই ওরা ঝুলিয়েছে।

সাদ্দাম হুসাইন যখন অনেকের কাছে প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছে, তখন দেখলাম একশ্রেণির মানুষ কানাকানি করে কিছু একটা বলতে চায়। তাদের কথা হচ্ছে, সাদ্দাম যতই যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিক সে তো নাস্তিক প্রকৃতির লোক। বামপন্থী মানসিকতা আর সেকুলারিজম তার মধ্যে ছিল। ভালো মুসলমান সেকুলার কেন হবে? তাছাড়া দাড়ি নেই যার সে আবার কেমন মুসলমান নেতা? সে তো ভণ্ড – এই ছিল সেসব বাঙালির চূড়ান্ত রায়।

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমেরিকা সেকুলার। সাদ্দামও সেকুলার। তাহলে এরা একজন আরেকজনের মাথা ফাটালো কেন তা ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া আমি আর বুঝে উঠতে পারি না। সব কিছু আমার কাছে ঘোলাটে মনে হয়। তবে তখন আমি বা আমার বয়েসী অধিকাংশ ছেলেমেয়ে যে তত্ত্বটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলাম তা হলো – আমেরিকা তেলের লোভেই সাদ্দাম হুসাইনকে তাক করে এমন একটি অন্যায় যুদ্ধ করেছে। এত বছর পরও আমেরিকার সেই যুদ্ধটি যে অন্যায় ছিল তা নিয়ে আমার কোন সংশয় নেই। তবে ক্লাস সেভেনের আমি হতবাক হয়ে দেখলাম আরও একবার একই মানুষের সাথে এমনটা হচ্ছে।

মানুষকে নায়ক বানিয়ে দেয়া হচ্ছে, আবার চটজলদি তাকে অনেকে খলনায়কের কাতারে ফেলতে মোটেও কসুর করছে না। এসব কীসের আলামত! আমার চিন্তার জগত এলোমেলো হয়ে যায়।

তারপর আমি বুঝতে পারলাম নায়ক আর খলনায়কের ভূমিকাটি কেবলমাত্র চলচ্চিত্রের পর্দায় গ্রহণযোগ্য। বাস্তবজীবনে কেউ কখনো কেবল নায়ক বা খল-নায়ক হতে পারেন না। কিছু করলে দুটোই হয় তারা, নির্ভর করে কোন দলটি তার ব্যাপারে কথা বলছে। তখনও আমি ‘প্রতি-নায়ক’ বলে যে একটি শব্দ আছে সে ব্যাপারে একেবারেই ওয়াকিবহাল নই। কাজেই সঠিক শব্দের অভাবে আমি খাবি খেতে থাকলাম।

বাংলাদেশের মানুষ অবশ্য একটি বিষয় নিয়ে একেবারেই দ্বিমত রাখতো না। তাদের বিশ্বাস ছিল সাদ্দাম হুসাইন দেশপ্রেমিক হোক আর আমেরিকার দালাল হোক, সেকুলার হোক চাই কি না হোক, নায়ক হোক কিংবা খলনায়ক হোক; প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যে খলনায়ক এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

মানুষ গায়েব জানে না। কাজেই মাত্র পনেরোটি বছর পর আমি যে টেক্সাসে পা রাখবো এবং টেক্সান বুশ পরিবার এখানে কী পরিমাণ জনপ্রিয় তা ধীরে ধীরে জানতে শিখবো, গভর্নর হিসেবে জর্জ ডব্লিউ বুশকে অস্টিনের ক্যাপিটলের ভেতরে ঝুলতে দেখবো ছবি হয়ে এবং জানবো তিনি যতজনের কাছে না খলনায়ক ছিলেন, তার থেকে অনেকগুণ বেশি মানুষের চোখে ছিলেন নিরেট নিপাট একজন নায়ক, সে অনেক পরের গল্প।

আমার কিশোর চোখের সামনে তখন বাংলাদেশের মানুষ আরও একবার রঙ বদলাতে শুরু করেছে। আমাদের সামনে আবির্ভূত হলেন আরেকজন নায়ক কিংবা খলনায়ক। হয়তো প্রতি-নায়ক। তবে এবার ঘটনাটি কি না ঘটলো খোদ আমেরিকা থেকে!

(চলবে) 

Chapter I. HATRED | Evolution from Hate to Acceptance of Israel

অধ্যায় ০১ ঘৃণা

বয়স তখন খুব অল্প। একজন কাশ্মিরের কিশোরের জীবনের ওপর ভিত্তি করে লেখা গল্প পড়লাম। পড়ে আমার গায়ের ভেতর জেহাদের লহু টগবগ করে বইতে থাকলো। খুব ইনিয়ে-বিনিয়ে লেখা হয়েছিল কীভাবে অমুসলিমরা মুসলমানদের মেরে ফেলেছে। কিশোরের পরিবারের সবাইকে খুন করে ফেলেছিল তারা। এদিকে কিশোর তখন প্রতিশোধের জন্য ক্ষেপে আছে। সে যুদ্ধ করবে। এবং খুব সম্ভবতঃ মারেও কিছু ভারতীয় সেনাকে। খুব গর্বের বিষয় হিসেবে দেখানো হয় সেই হত্যাকাণ্ড, এই কারণে নয় যে বাংলাদেশ আক্রান্ত। বরং বাংলাদেশে ঐ ১৯৯৯-২০০০ সালে এসব লেখালেখি খুব খোলামেলাভাবে চলতো। ভারতের সেনা মারা পুণ্যের কাজ ইসলামী কারণে – এমন একটি ন্যারেটিভ দাঁড়া করানো ছিলই। বিডিআর যখন কোন সীমান্ত সঙ্ঘাতে বিএসএফকে ঢিঁট করে দিতো, জনপদে একটা চাপা উল্লাস দেখা যেত। এই কারণে নয় যে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করছে। বরং এ কারণে – ভারতকে ইসলামের দুশমন হিসেবে একটা সলিড ব্যাকগ্রাউন্ড দেয়া হয়েছিল।

এরপর মাসুদ রানার একটা বইতে পড়লাম সে তেল আবিবে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। একজন ইজরায়েলি সৈন্য তার খোঁজ নিতে আসে। এবং আরেকজন গার্ডকে প্রশ্ন করে বন্দি মুসলমান কি না। সে ইতিবাচক উত্তর দিলে সৈন্যটি মাসুদ রানাকে পিটিয়ে আধমরা করে তার মুখে থুতু ফেলে বলে, “আই হেইট মু(লিমস।” বিষয়টি চিন্তা করে আমার মাথায় আগুন ধরে যায়। ইজরায়েলের লোকজন এত খারাপ তা আমার জানা ছিল না। আমার মনে হলো, আমিও তো একজন মুসলমান। তাহলে আমাকেও কি ওরা এভাবে মারবে? স্রেফ আমি মুসলমান বলে? ব্যাপারটি আমার কাছে কোনভাবেই ন্যায় মনে হলো না। এরকম খারাপ মানুষরা পৃথিবীতে কী করছে তা ভেবে পেলাম না।

এরপর আরেকটা গল্প পড়েছিলাম যেখানে বলা হয়েছে ফিলিস্তিনের ওপর ইজরায়েল কী ভীষণ অত্যাচার করছে। বোমা মারছে। বাচ্চা মরছে। ইত্যাদি। ইজরায়েলের প্রতি একটা যুগপৎ ঘৃণা সৃষ্টি হলো। মনে হলো, ক্ষমতা থাকলে আমি একদিন ইজরায়েলে গিয়ে এই জালেমদের শেষ করে ফেলবো। কুকুর মনে করতাম। আর ধর্মমতে কুকুরকে খুব জঘন্য প্রাণী মনে করার ব্যাপার ছিল। কুকুর নাপাক। কুকুর একটি খারাপ প্রাণি – এটিই ছিল আমার ধর্মের শিক্ষা। মনে হলো ইজরায়েলিরাও নাপাক। তারাও খারাপ প্রাণি। তারা তো কুকুরই হবে।

আমার মনে হয় আর যে কোন মুসলিম দেশে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা শিশুর মনে একই রকম চিন্তাধারা দোলা দিয়েছে। প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে বড় হওয়ার পেছনে আমাদের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে কিংবা এহেন আর সব বইতে আমি পড়েছি ইহুদিদের সাথে বন্ধুত্ব নয়। তারা মুসলমানদের শত্রু।

এর পাশাপাশি মনে পরে ধারাবাহিকভাবে পড়েছিলাম ‘ষড়যন্ত্রের কবলে ইসলামি দুর্গ’, খুব সম্ভবতঃ আলতামাশের লেখা, মানে যিনি সম্ভবতঃ সাইমুম সিরিজ লিখেছেন। তো পড়ে আমার মাথামুথা তো চুদে গেল। খ্রিস্টান আর ইহুদিদের আস্পর্ধা দেখে মেজাজটাই খাপ্পা হয়ে গেল আমার। এরা তো মহা বদমাশ! সালাউদ্দিন আইয়ুবি আমার কাছে তখন বিশাল হিরো। তখনও আমার বয়স দশ বছর হয়নি। বয়সের হিসাব করছি কোন বাড়িতে কোন জিনিস পড়েছি সে হিসেবে। যে বাসায় এই বইগুলো আমি পড়তাম সেখানে এসেছিলাম যখন আমার বয়স সাড়ে ছয়। এরপরের ঘটনা আরকি। ওই বাসাতেই ‘আদর্শ নারী’ পত্রিকা আমি বেশি পড়েছি। সাধারণতঃ বাসায় ‘আদর্শ নারী’ ম্যাগাজিনটি দিতে এলে আমি-ই তা রিসিভ করতাম। মূল্য ছিল দশ টাকা। যতদূর মনে পড়ে এর আগের বাসায়, অর্থাৎ জিয়া সারকারখানা হাউজিংয়ের সি-৪-এমেও আমি আদর্শনারী দেখেছি, পড়েছি। মানে চার-পাঁচ বছর বয়সের চিন্তা এসব।

সচরাচর বাচ্চারা এই বয়সে যা শেখে, যা শুদ্ধ বলে জানে – তা বাকি জীবন বয়ে বেড়ায়। আজকে ফেসবুকের কমেন্টবক্সে যেসব যোদ্ধা ও বোদ্ধাদের দেখা যায় তারাও ঐ বয়সেই জেনেছেন ইজরায়েল খারাপ, খুবই খারাপ। ইহুদি আর খ্রিস্টানরা সব সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বিন লাদেন একজন বিশাল হিরো। তারা হবে তালেবান, বাংলা হবে আফগান। টুইন টাওয়ার হামলা যখন হলো তখন আমি দুধের শিশু। অতটুকু বয়সের বাচ্চার খুব বেশি ন্যারেটিভ জানার কথা নয়। অথচ বইপত্র পড়ার কল্যাণে আমার মনে হলো, এ একটা বীরোচিত জবাব মুসলমানরা দিয়েছে। লাদেন রাতারাতি হিরো হয়ে গেল এলাকায়। ঈদের সময় ছোট পটকাগুলোকে বিক্রি করা হতো ‘লাদেন বোমা’ বলে। কারণ বাংলাদেশে অনেক পরিবারের কাছেই তখন লাদেন একজন বিশাল হিরো।

আমি বইপত্র পড়ে যতদূর বুঝেছি, ইহুদি আর খ্রিস্টানরা আমাদের ক্ষতি করেছে অনেক। প্রচুর মুসলমান মেরেছে তারা। কাজেই তাদের যে কোন উপায়ে ঢিঁট করাটি ঠিক আছে – এটাই আমার বুদ্ধির দৌড়। পাঁচ-ছয় বছরের একটা বাচ্চার চোখে বিষয়টা তার পড়া বইপত্র থেকে এমন হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। সেটিকে আমি খুব কড়াকড়িভাবে বিচার করি না। কিন্তু লজ্জা পেয়ে যাই যখন দেখি পঁচিশ-ত্রিশ বছরের দামড়া যুবকও ঐ পাঁচ বছরের বাচ্চাটির ন্যারেটিভ নিয়ে চলাফেরা করছে। তাকে আমি বোঝাবো কী? তার থেকে আমি বোধহয় বোধগম্যতার দিক থেকে পঞ্চাশ বছর এগিয়ে আছি। চট করে তাকে কিছু বললেই যে তার মাথায় ঢুকবে এমন নয়।

ঐ বয়সে আমার কিছু যুক্তি ছিল। পাঁচ থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত আমি এসব যুক্তি ধীরে ধীরে পেয়েছি, দাঁড় করিয়েছি। ক্লাস নাইনে থাকতে তা ব্যবহার করে নাস্তিকদের সাথে নিয়মিত তর্ক করি। নাস্তিকরা লা-জওয়াব হয়ে যায়। বিবর্তনের একটা কুরআনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বের করে নাস্তিকদের আসরে প্রশ্ন করলাম। মডারেটর আমার কমেন্টই ডিলেট করে দিলেন। আমার মেজাজ খাপ্পা হয়ে গেল। জবাব না থাকলে ওভাবেই মুখ লুকিয়ে চলে যায় মূর্খের দল – বন্ধুদের বললাম।

আজ আমি জানি কত বড় স্টুপিড ছিলাম আমি। ইডিয়টের মতো কথা বলেছিলাম। তবে তের-চৌদ্দ বছরের ছেলেরা স্টুপিডের মত কথা বলতেই পারে। আমার মাথা হেঁট হয়ে যায় যখন দেখি ফুলি-গ্রৌন মানুষ তেমন কথা বলছে। অর্থাৎ এদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি আর তেমন হয়নি। আমার আর্লি টিনেজ বয়সে যেমন মূর্খতা ছিল, ইনাদের এই বুড়ো বয়সেও সেই একই মূর্খ অবস্থান।

তবে একই কারণে আমি কাউকে ব্লক করি না সহজে। কারণ এই যে তর্ক করতে আসছে, ঘৃণা করছে, এটাই প্রসেস। এভাবে তারা তর্ক করবে, যেভাবে আমি করেছিলাম। তারপর তারা বুঝতে পারবে, দেখতে পাবে সত্যটা।

সত্যটা আমি আবিষ্কার করলাম ইন্টারনেট আসার পর। ধীরে ধীরে আমার সামনে জগত উন্মোচিত হচ্ছিল। ভিয়েতনামী একটা মেয়ের সাথে খুব ভাব হয়েছিল আমার। ওকে আমি একটি নাম দিয়েছিলাম। আজ, দু’হাজার তেইশ সালে, প্রায় পনের বছর পরও ও তার ফেসবুকে সেই নামটিই ব্যবহার করে। বন্ধুদের সেই নাম বলেই পরিচয় দেয়। ওর সাথে আমার তখন নিয়মিত কথা হতো। আমরা দু’জনই এমা ওয়াটসনের দারুণ ভক্ত ছিলাম। পরিচয়টা হয়েছিল এমা ওয়াটসন ডট নেট নামক একটি ওয়েবসাইট থেকে। সেখানে তখন চ্যাট করার ব্যবস্থা ছিল। অ্যাডমিনের নাম ছিক ডুক। ইউজারনেম ডুক_ডুক। এই প্ল্যাটফর্মে নানা দেশি বন্ধুদের সাথে আমার পরিচয় হতে থাকে।

ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, যে পৃথিবী আর যে সত্য আমাকে ছোটবেলার ইসলামী বইপত্র শিখিয়েছে, বড় বড় দাড়িওয়ালা আলেম-ওলামা বুঝিয়েছে – সব ভুল। সব ভ্রান্ত। সবই মিথ্যে মায়াকান্না। সত্যের লেশমাত্র নেই অধিকাংশ বক্তব্যে। যতখানি আছে, তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এরা বানিয়েছে প্রায়-মিথ্যে। ঠিক যেভাবে শিশুহত্যার ধুন তোলা হয় আজকের দিনে এবং ন্যারেটিভটি বদলাতে বদলাতে এতই বদলে ফেলা হয় যেন ইজরায়েলকে দানব ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।

তখনও আমার বইপত্র পড়া অব্যহত আছে। পত্রিকা তেমন পেতাম না। তবে পেলেই পড়তাম।

এমন একটা দিন পত্রিকা খুলে আমার চোখ একটি নামে আটকে গেল।

ব্রেইন ড্রেইন, বহুগামিতা, এবং চুদির ভাই কথন

১.

উদ্ভট এই শিরোনামের লেখাটি শুরু করতে হবে রসালো আলাপ দিয়ে। আইডির রিচ সুবিধের নয়, যাবেই দশজনের কাছে। তারমধ্যে আবার রসালো আলাপ না হলে লোকে যে ভেগে যাবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কাজেই শুরু করা যাক আমার সাথে অসংখ্য মেয়ের নাম জড়িয়ে থাকার রহস্য নিয়ে।

এই রহস্য আমি কখনো খোলাসা করি না। আজকেও করবো এমন নয়। তবে হাল্কা আলাপ করতে হবে। ব্রেইন ড্রেইনের সাথে এর আলাপ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

এটা খুবই সত্য কথা যে আমি সমকামী নই। এটাও খুব সত্য কথা যে আমি অবিবাহিত। কাজেই মেয়েদের প্রতি আমার আগ্রহ থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ঢাকা থেকে টেক্সাস – যতজন মেয়ের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং যতজনের সাথে সম্পর্কটা ‘ইয়ে’ টাইপের গন্ধ পাওয়ার মতো, তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটা হচ্ছে এমনটা আমি-ই চেয়েছিলাম। এটাও খুব সত্য কথা, তাদের প্রায় সবার সাথেই আমার ন্যুনতম ডেটটাও হয়নি, হবে এমন পরিকল্পনাও নেই। আমার চারপাশে থাকে তিনটি অদৃশ্য দেয়াল। বড়জোর সে দেয়ালগুলোর দুটো তারা ভাঙতে পারেন। তৃতীয় দেয়ালের ভেতরে কেবল আমি একাই।

এর পেছনে একমাত্র কারণ হচ্ছে মানব মনস্তত্ত্ব। যে পথ আমি আমার জন্য বেছে নিয়েছি তাতে করে আসলে চব্বিশ ঘণ্টায় একটি দিন পার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কখনো কখনো মাসের পর মাস আমি উধাও হয়ে যাই। এটা পরিবারের জন্যও সত্য। এমনটা আইনস্টাইনের সাথে হতো, নিকোলা টেসলার সাথে হতো, এমনকি কোন একটা কিছুতে যে ডেডিকেটেড তাদের সবার সাথেই হয়ে থাকে। এই দেড়টি মাস আমার কাছে একটি দিনের মতো মনে হয়। যারা এই জিনিসের ভেতর দিয়ে যাননি তাদের বোঝার কোন কারণ নেই। কিন্তু আর সবার কাছে তেমন নয় ব্যাপারটা। তাদের কাছে প্রতিদিন সূর্য ডোবে এবং পরদিন আবার সূর্য ওঠে। অতি সাধারণভাবেই আর কেউ যে আমার জন্য দুই মাসের দিন পার করবে এমনটা আমি মনে করি না, এমনটা আশা করাও সঙ্গত নয়। দুই একবার চেষ্টা করে দেখেছি এবং আমার ধারণার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি।

কাজেই আমার অবচেতন অলটারনেট গিয়ারে চলে গেছে। সে চায় মানুষ তার জন্য কেয়ার করুক। ভালোবাসুক। তবে দূর থেকে। ওই হেলদি বা আনহেলদি ডিসট্যান্স ধরে রাখাটা আমার সহজাত একটি ঘটনা হয়ে গেছে। আমি চাই তারা আমাকে ভালোবাসুক, তবে বেশি কাছে আসার দরকার নেই। কাছে এলেই তারা আশা করবে প্রতিদিন আমাকে পাওয়া যাবে। আমার একটি দিন যে তিন মাসে হচ্ছে তা তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না।

কাজেই, মাসুদ রানা হয়ে গেলাম। টানলাম অনেককেই, কিন্তু বাঁধনে জড়ালাম না। তা আপনি যতই সুন্দর, হট, আর সৃজনশীল হোন না কেন। বাঁধনে জড়িয়ে হোগামারা খাবো নাকি? আমার তো সেই তিন মাসে দিন। নয় মাস যাবার আগেই তারা হয়ে যাবে ক্র্যাক, তারপর আমি হয়ে যাবো সেই গল্পের ভিলেন। অন্য কোন মেয়ের ত্বক স্পর্শ না করেও।

এবার আপনার ভ্রু কুঁচকে যাবে। আমার কলারটা চেপে ধরে বলবেন, “এই লুচ্চা। এর সাথে ব্রেইন ড্রেইনের সম্পর্ক কোথায়?”
সম্পর্ক আছে ভাই। এজন্যই তো এত ভূমিকা।

২.
বাংলাদেশ থেকে দুই ধরণের ব্রেইন ‘ড্রেইন’ হয়।
প্রথম যে শ্রেণিটিকে আমরা অনারেবল মেনশন দেবো, তাদের আমি ডেকে থাকি ‘খাইঞ্চোদ।’
খাইঞ্চোদ নামটা বন্ধু আসাদের দেয়া। সে এই নামটি দিয়েছিল বন্ধু অনিককে। কারণ অনিক কিছু দেখলেই বলতো, “খাবো।”

কিছু দেখামাত্র ‘খাবো’ বলে ওঠার রুহানিয়াত চালু আবার করেছিলাম আবার আমি। রুয়েটে একদিন কাফিদের রুমের মেঝেতে ঘুমাচ্ছি। সূর্যমামা উঠে গেছে। আলোর প্রতাপে টেকা যাচ্ছে না। কাজেই কম্বলে মাথাটা ডুবিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু শালারা এত হট্টগোল করছে যে ঘুমটা সকাল দশটার দিকে টুঁটে গেছে। মটকা মেরে পড়ে আছি, যদি আবার ঘুমানো যায়। জেগে গেছি বুঝে গেলে ওরা আমাকে একেবারে তুলে দেবে।

ওদিকে হেঁড়ে গলায় কোন স্যারের যেন পিন্ডি চটকাচ্ছে সবাই। কিন্তু সেসব নয়। আমার কানে আটকে গেল অন্য একটা শব্দ।

কাফি বললো, “এই, সিঙ্গারা নিয়ে আসি। কে কে খাবি?”
আমি তখনো মটকা মেরে পড়ে আছি। কিন্তু পেটের ভেতর একটা গণ্ডার ডেকে উঠলো।
কাফি বললো, “কেপি তো ঘুমাচ্ছে। আর রাইয়ান খাবে না বলেছে। কে কে খাবি না আর?”

আমি আধো-ঘুম থেকে বললাম, “খাবো।”
ঘরের যাবতীয় আলোচনা ও হট্টগোল নিমেষে থেমে গেল।
কাফি জানতে চাইলো, “কিছু একটা শুনলাম মনে হলো।”

কম্বলের তলা থেকে আমি কোনমতে আবার বললাম, “খাবো।”
পুরো বাক্য বলার মতো জাগিনি তখনও।
ফারহান বললো, “কেপির বাচ্চা কিছু বললো মনে হয়। ঘুমাচ্ছে, আবার খাওয়ার বেলায় আছে।”

কাফি এসে হাসি কোনমতে চেপে ধরে আমার কম্বলটা তুলে কনফার্ম করলো, “খাবি?”
আমি চোখ না খুলেই বললাম, “খাবো।”

এটা ট্রেডমার্ক হয়ে গেল। সবাই হয়তো কাউন্টার স্ট্রাইক খেলছি। আসাদ ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে এসে আমাদের বার বার ডেকে গেছে, “ভাই, খাইতে চল ভাই। মরে গেলাম।”
নড়ার নাম লক্ষণ কারো নাই।
বিশ মিনিট পর এসে আসাদ হয়তো বললো, “খাবো।”

সাথে সাথে খেলা বন্ধ। কেউ যদি পুরো বাক্য না বলে ‘খাবো’ বলে, তার অর্থ সে ডেড। তাকে খাবার দিতেই হবে এখন। কিন্তু অনিকের হিসাব আলাদা। সে একদিন এসে বললো, “খাবো।”

আসাদ এক্সেল প্রজেক্টে কী যেন মেলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। মিলছে না। তখনও তাই চেষ্টা করছিল। মেজাজ-মর্জি যথেষ্ট খারাপ ছিল তার। টেবিল থেকেই হুঙ্কার ছাড়লো সে, “কী বললি? কী বললি তুই?”
অনিক আরও করুণ গলায় বললো, “খাবো।”
আসাদ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো, “এই তোর আর কাজ নাই। সব সময় খাবো, খাবো। এই শালা তো দেখছি একটা খাইঞ্চোত।”

হয়ে গেল। আসাদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করলো নতুন একটি শব্দ যুক্ত করে।
কাফি বোধহয় একবার জানতে চেয়েছিল, “ভাই, বাই*নচোত তো বুঝি। মা*রচোতও বুঝি। কিন্তু এই খাইঞ্চোতটা কী? এর অর্থ কী, ভাই?”
আসাদ তখন কাউন্টার স্ট্রাইকে ঠা-ঠা গুলি করতে করতে নির্বিকার মুখে উত্তর দিলো, “খাওন চোদে যে।”

তো, ব্রেইন যখন ড্রেইন হচ্ছে, একটা শ্রেণি যাচ্ছে যারা – তারা আসলে খাইঞ্চোত। যেখানে খাবার সেখানেই তারা। লয়ালটির বালাই নেই। আমেরিকায় চাকরি আছে, ওটাই যথেষ্ট। পড়ার নাম করে এসে চাকরি করে সিটিজেনশিপ নিয়ে একাকার অবস্থা। তাদের হিসাব এই আলোচনায় হবে না। এজন্যই তাদের অনারেবল মেনশন দেয়া হলো।

দ্বিতীয় শ্রেণিটি দেশপ্রেমিক। সব সময় দেশে ফিরে আসতে চায়। জ*ঙ্গি থাকুক আর স্বৈরাচার থাকুক, ফিরে এসে সবার মাজা ভেঙে দিতে চায় তারা। এদের ব্যাপারেই আলোচনা হবে। এর সাথে প্রথম অংশের মেয়েদের আলাপ সঙ্গতিপূর্ণ।

৩.
রুয়েট একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। ওখান থেকে সার্টিফিকেট আজও তুলতে পারিনি। যখন জরুরী কাগজপত্র তুলতে যাই, শিক্ষাশাখার একজন মহামান্য খাইঞ্চোত আমাকে বললেন, “রেজিস্ট্রার স্যার এলে সাইন করবেন। তার আগে তো কাগজ পাবেন না। আপনার কাগজে সাইন হয়নি।”
আমি জানতে চাইলাম, “স্যার কি অফিসে নেই?”
তিনি বললেন, “এখন নেই, উনি আসবেন হয়তো একটার দিকে।”
ঘড়িতে তখন সকাল দশটা।

আমি জাঁকিয়ে উনার টেবিলের সামনে বসে বললাম, “অসুবিধা নেই। আমি আছি। যখন স্যার আসবেন তখন সাইন এনে দেবেন। তাহলেই হবে।”

আমি ওখানে একটা শকুনের মতো বসে থাকলাম। টানা সাড়ে তিন ঘণ্টা। আড়াইটার দিকে আমার ঢাকার ফ্লাইট। তবুও দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকলাম গ্যাঁট মেরে। একটার দিকে একবার জানতে চেয়েছিলাম, “স্যার আসেননি?”
মহামান্য খাইঞ্চোত বললেন, “আসবে। আসলেই আমি আপনার সাইন এনে দেব।”

দেড়টার দিকে আবার বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম, “স্যার আসেননি?”
মহামান্য খাইঞ্চোত বললেন, “আসবে। আসলেই আমি আপনার সাইন এনে দেব।”

আমি পৌনে দুটোয় আবার বললাম, “একটু দেখবেন কি, স্যার এসেছেন কি না? আধঘণ্টা পর আমার ফ্লাইট।”
চার ঘণ্টা হয়ে গেছে প্রায় তখন। একটা জায়গায় গ্যাঁট মেরে বসে আছি। মহামান্য খাইঞ্চোত বুঝলেন মরে যাবো, তাও উনাকে একটা ফুটা পয়সাও আমি দেব না।

তিনি চেয়ারে বসেই উলটোদিকে ঘুরে পেছনের একটা ফাইল হাতে নিলেন। বললেন, “আপনার ব্যাচ তো ওয়ান টু?”
আমি বিনয়ের অবতার। বললাম, “জ্বি।”
উনি বললেন, “রোলটা বলুন তো?”
বললাম।

উনি আমার কাগজটি বের করে দিলেন।
অর্থাৎ পুরো চারটি ঘণ্টা ওখানেই ছিল। তিনি চাইলে সকাল দশটা পনেরর মধ্যে আমাকে কাগজটা দিতে পারতেন। দিলেন না।
আমি কাগজটা হাতে নিয়ে ওখানেই উনাকে একবার সেজদা করলাম। সশব্দে তসবীহ পাঠ করলাম, “সুবহা’না রাব্বি আল আ’লা। সুবহা’না রাব্বি আল আ’লা। সুবহা’না রাব্বি আল আ’লা।”

তারপর বেরিয়ে একটা অটো নিয়ে কোনমতে গিয়ে প্লেন ধরলাম।

৪.
প্রেমে মারা যাচ্ছি তখন। “দ্য ওয়ান” শ্রেণির প্রেমিকা আবার ইউরোপ চলে যাচ্ছে। আলবিদা।
এমনই ছ্যাঁকা খেলাম যে আমার আর ওর প্রেমকাহিনী নিয়ে লিখে ফেললাম, “জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে।”
প্রেমকাহিনী অমর হলো।

তবে প্রেমকাহিনী শেষ হবার শেষ পেরেক, ওর ইউরোপ ভেগে যাওয়ার প্রসেসের একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তলা থেকে ওর সাইন করা কাগজ নিয়ে আসতে হবে। যথারীতি আমরা গেছি। ওর কাগজটা নিয়েছে মন্ত্রীমহোদয়ের না সচিবের সাইন করিয়ে নেবার কথা বলে। আমাদের হাতে একটা রিসিটমার্কা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেছে। নিচু গলায় বললো, “আজকে দেবার কথা নয়, তবে আপনাদের দেব। চারটার দিকে আসবেন। নইলে কাল পাবেন।”
আমরা বললাম, “আমাদের তো আজই লাগবে।”
লোকটা চোখ টিপে বললো, “তবে ব্যবস্থা করবো।”
চোখ টেপার অর্থ আমি বুঝলাম। তবে না বোঝার ভান করলাম।

তারপর আর দিচ্ছে না। আমরাও খিঁচ খেয়ে দাঁড়িয়ে। সাড়ে চারটা বেজে গেছে। একটু পর পাঁচটা বেজে গেলে অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। ওর হাতে একেবারেই সময় নেই তখন। দেশ ছাড়বে। আগামিকাল আবার এ নিয়ে সময় দেবার কথা ছিল না। আজকেই কাজ উদ্ধার করতে হবে। এদিকে চারটা বেজে যাচ্ছে দেখে আর কেউ আসছে না। আমরাই আছি।

মেয়েটি আমাকে বললো, “বোধহয় পাঁচশটা টাকা দিলে দেবে। আমি ওই ছেলেটাকে পাঁচশ টাকা দিয়ে আসি।”
আমার হাতে তখন ওর রিসিট। ওখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সীল। বাংলাদেশের পতাকাটা মনোগ্রামের মতো ঝাপসা করে বসানো। জলছাপ। ওটার দিকে একবার তাকালাম। তারপর মাথায় আগুন ধরে গেল। শালার পুতেরা, আমি বাংলাদেশের নাগরিক। তুমি বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়ে কাজ করো। টাকা তুমি নিবা মানে!

ওর হাত ধরে বললাম, “নড়বা না। আমরা একটা ফুটা পয়সা না দিয়ে কাগজ উদ্ধার করবো। তারপর ওই পাঁচশ’ টাকা দিয়ে পাবুলামে গিয়ে বার্গার খাবো। কিন্তু ওদের এই টাকা দিবো না। মরে গেলেও দিবো না।”

ও জানতে চাইলো, “কীভাবে?”
আমি বললাম, “তোমার নিষ্পাপ মুখটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে। তবে দাঁড়াবো দরজার সামনে।”

দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওর হাতটা ছেড়ে দিতে হল। এখন আমরা ভিক্টিম কার্ড খেলবো। বিশ্ববোকাচোদার চরিত্রে অভিনয় করবো। প্রেম করতে করতে ও চরিত্রে অভিনয় করা যাবে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পূর্ণ মনোযোগ আমাদের গেটের দিকে। হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছি বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত সীলযুক্ত রিসিট। মুখে তুলে ধরেছি রাজ্যের সারল্য। আর আমরা এত কিউট যে বেড়ালরাও লজ্জা পেয়ে আমাদের মঞ্চ ছেড়ে দিত।

সেখানে মানুষরা তো কিছুতেই আমাদের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারছিল না। প্রতিটা মানুষ ও বেড়ালের দেখবার মতো করে হাতে আমি পতাকার মতো ধরে রাখলাম রিসিটটা। এদিকে যে লোকটা আমাদের দেবে বলেছিল সে খুব ধৈর্য ধরে আছে কখন আমরা গিয়ে ওদের টাকা দেব। কিন্তু টাকার কথা আমি মুখের ফাঁক দিয়েও বলছি না। ও ব্যাটাও সরাসরি চাইতে পারছে না।

পাঁচটা প্রায় বাজে। এবার স্যুট-বুট পরা লোকজন বের হচ্ছে মন্ত্রণালয় থেকে। আমরা এত কিউট, আর এত সুন্দর করে কলাপসিবল গেটের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি যে আমাদের সাথে ধাক্কা খেতে খেতে যেতে হচ্ছে সবাইকে। দুইজন জানতে চাইলো, “এই উনাদের কাগজ দিয়ে দিচ্ছো না কেন?”

শয়তানটা ডেস্কের পেছন থেকে গজ গজ করলো।
কিন্তু বের হলো না।

এরপর একজন মাঝবয়েসী লোক নেমে এসে আমাদের দেখে জানতে চাইলেন, “আপনারা কি কিছু খুঁজছেন?”

আমি ভেজা বেড়ালের মতো বললাম, “উনি তো বললো সাড়ে চারটার সময় আমাদের কাগজটা দেবে। তাই একটু অপেক্ষা করছি। উনি ব্যস্ত বোধহয়। তাই দিচ্ছেন না।”

শয়তানটা তখন ডেস্কে বসে বসে মাছি মারছে।
তার কাছে গিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “এই, উনাদের বিদায় করছো না কেন? অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।”

শয়তানটা আমাদের ডাকলো। তারপর বললো, “কী যন্ত্রণা। একটু পর একটা ছেলে আসবে, তার সাথে একটু কথা বলে নেবেন।”

ছেলেটা আসলো। এসে আমার হাফ-গার্লফ্রেন্ডকে কাগজ দিলো। তারপর আমাকে বললো, “স্যারকে একেবারে শেষ মুহূর্তে ধরে সাইন করাইছি, স্যার। একটু চা-নাশতার টাকা যদি দেন।”
আমি তখন অস্কার পাওয়ার মতো অভিনয় করে যাচ্ছি। আঁতকে উঠে বললাম, “চা-নাশতার টাকার জন্য তো প্রস্তুত হয়ে আসিনি। চা-নাশতার জন্য কত টাকা চাইছেন?”

ছেলেটা বললো, “এই হাজার দিলেও হবে।”
আমি বললাম, “এক হাজার টাকা থাকলে কি আর আমাদের এখানে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো? ড্রাইভার পাঠিয়ে দিতাম। ঠিক কি না?”
ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, “পাঁচশ টাকা?”
আমি বললাম, “মানিব্যাগে একশ টাকার মতো আছে, ভাই। যদি এটা আপনাকে দেই, তাহলে বাসায় হেঁটে যেতে হবে আমাদের। বাসভাড়া আর থাকবে না। এতদূর হেঁটে গেলে ওর পায়ে ফোস্কা পড়ে যাবে। এত সুন্দর একটা মেয়ের পায়ে ফোস্কা পরে যাওয়া টাকা দিয়ে কেনা চা কি আপনি খেতে পারবেন?”

ছেলেটা চোর হলেও মানবতা আছে। বললো, “ভাই, কী যে মুসিবতে ফেললেন। এভাবে বললে আর কীভাবে চাই। মন্ত্রণালয়ের কাজ, প্রিপারেশন নিয়ে আসবেন না?”

আমি দাঁত কিড়মিড় করে ওর হাত ধরে বেরিয়ে আসলাম। প্রথম মোড়ে প্রথম সিএনজিওয়ালা পাওয়া মাত্র আমরা গুলির মতো তাতে ঢুকে পড়লাম। আমার কাছে একশ টাকার মতো থাকলেও, ওর কাছে টাকা ছিল। এই টাকাটি আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চোরকে না দেয়ার কারণে রয়ে যাওয়া টাকা।

৫.
দ্বিতীয় যে শ্রেণিটি বিদেশে ভেগে গেছে, তারা দেশে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু আমার তরুণীভাগ্যের মতোই, তাদের কপালে আসলে দেশের প্রেম নেই। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা আছে। আমি যেমন মেয়েদের সাইকোলজি জানি। তারাও দেশের সাইকোলজি জানে। গাছের পাতা যেমন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের বাইরে নড়বে না, ওটাও বদলাবে না।

গত দেড়টা বছর ধরে আমার ওয়েবসাইটে একটা হ্যাকারগোত্র বার বার আক্রমণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে এ ব্যাপারে একাধিকবার জানিয়েছি। আমার নিজস্ব গোয়েন্দাগিরির ফলাফল হিসেবে তাদের বাংলাদেশে বসে অপারেট করা ৭ জনের ফোন নাম্বার সহ দিয়েছি। এদের থ্রুতে তারা যে সম্ভাব্য জ*ঙ্গিসদস্য ও তাদের দেশের ভেতরে থাকা সাইবার সেল পাবেন ও কেঁচো থেকে অজগর বের করতে পারবেন তা জানিয়েছি। তারা আমার মেসেজ সিন করেছেন। কিন্তু এত গোয়েন্দাগিরি করে জোগাড় করা ফোন নাম্বার পর্যন্ত থাকার পরও তারা কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

আমার প্রথম রিপোর্ট করার পর বাংলাদেশের সাইবার ক্রাইমের করিৎকর্মা সদস্যরা বোধহয় ৬ জনকে ধর্ম অবমাননার অপরাধে(!) গ্রেফতার করেছে, প্রধানমন্ত্রীকে গালি দেবার অপরাধে(!) গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের নাগরিকদের, বঙ্গবন্ধুকে ব্যাঙ্গ করায় করেছে গ্রেফতার। কিন্তু আমি, একজন বাংলাদেশি নাগরিক, তাদের কাছে যে সহায়তাটা চেলাম, যা আমাকে তাদের করে দেয়ার কথা – তা করে দেয়নি।

চিন্তা করে দেখুন। আমি যদি আজকে আমেরিকার একজন লেখক হতাম আর কোন উজবুক দুবাই থেকে আমেরিকার মাটিতে বসে থাকা চ্যালাচামুণ্ডা নিয়ে আমার ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে আক্রমণ করতো – দুবাইবাসিন্দাকে পুলিশ ধরতে না পারলেও – আমেরিকার মাটিতে বসে থাকা চ্যালাচামুণ্ডা সব গ্রেফতার হয়ে যেত কয়েক মাসের মধ্যে। এর ওপর আমি যদি ওসব লোকের ফোন নাম্বার সহ রিপোর্ট করতাম, দ্রুত হতো কাজ। অন্তত পুলিশ না দেখার ভান করতো না। এবং মিডিয়া এটাকে ফলাও করে প্রচার করতো।

আমি আজ ইংল্যান্ডের নাগরিক হলে, ইংলিশ একজন লেখক হিসেবে আক্রমণ হয়েছে শোনা মাত্র মিডিয়া আর পুলিশ হ্যাকারদের পোঁ-দ চুলকে নিমেষেই ঘা করে দিতো।

আমি বাংলাদেশের একজন লেখক, যে এখনো আগামি তিন বছর বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারবে, সে বয়স ও যোগ্যতা আছে – এবং যে এরই মধ্যে ২১টি বই লিখেছে –

তাকে চোদার টাইম বাংলাদেশ সরকারের নাই। বাংলাদেশের পুলিশের সাইবার ডিভিশনের নাই।
কিন্তু আমি জানি, এই আগামি তিন বছরে যদি বিসিএস দেই ও পাশ করি, নিমেষে আমার কেস হয়ে যাবে টপ প্রায়োরিটি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পতাকাটার প্রতীক দেখে আমি আর আমার এক্স-হাফ-গার্লফ্রেন্ড যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম, সেই রক্ত আমাদের ভেতর এখনো আছে। বাংলাদেশের সাথে বাংলাদেশের ড্রেইনড ব্রেইনরা গাদ্দারি করছে না। বরং আমাদের সাথে গাদ্দারি করেছো তোমরা, সরকারি লোকজন, রাষ্ট্র।

ভালোবেসে যেমন আমার শিক্ষা হয়েছে। ভালোবেসেছি, ভালোবাসা নিয়েছি, কিন্তু আর জড়াবার চেষ্টা করি না কাউকে।
তেমনই তোমার সূর্যসন্তানদেরও শিক্ষা হয়েছে ভালোবেসে।

তারা বাংলাদেশকে ভালোবেসেছে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভালোবেসেছে। কিন্তু বাংলাদেশকে জড়াবার চেষ্টা করেনি তারা আর।

রুয়েটের সার্টিফিকেট নেবার জন্য আমার চার ঘণ্টা বসে থাকতে হয় পাঁচশ টাকা দেব না বলে।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সামনে প্রেস্টিজাস স্কলারশিপ পাওয়া আমার সূর্যসন্তান প্রেমিকাকে চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দেশের পতাকার সাথে গাদ্দারি করে পাঁচশ’টা টাকা দেবে না বলে।

আর তোমরা আমাদের সাথে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ চোদাও?
কোন অধিকারে?
পাবলিক ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে – এই অধিকারে?

ওরে ভাই, আপনি খান কি?

(শেষ লাইনটায় স্পেস ভুল জায়গায় পড়ে গেছে।)

লেখকদের উদ্দেশ্যে একটা ট্রিক

নতুন ও পুরাতন লেখকদের দেখেছি একটা ভুল পথে তাগ করতে। সেটা হচ্ছে বেচাবিক্রি বাড়াতে হবে – তবেই তো নেট ভ্যালু বাড়বে। এটা উলটো চিন্তা আসলে। এভাবে কাজ করে না জিনিসটা শো বিজে, কিংবা বুক ইন্ডাস্ট্রিতেও।
 
লেখকের নেট ভ্যালু বাড়াতে হবে তার মার্কেট প্রাইসের থেকে বেশি। মানে এই মুহূর্তে একজন লেখকের বাজারে থাকা সব বই বিক্রি করে ফেললে যদি সেটার অর্থমূল্য তিন কোটি টাকা হয়, তাহলে লেখকের কাজ হচ্ছে নিজের গুডউইল আট-নয় কোটি টাকায় তোলা।
 
সহজ ভাষায়, আপনার ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের চেয়ে ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের ভ্যালু বেশি রাখতে হবে সব সময়। আরও সহজ একটা উদাহরণ দেই, ইলন মাস্কের টেসলার প্রতিটা নাটবল্টু খুলে বিক্রি করে দিলে যত টাকা পাওয়া যাবে, লায়াবিলিটি অ্যাসেট হিসাব করে যত টাকার ওর্থ ওর কোম্পানির, বর্তমানে তার কোম্পানির দাম অনেক বেশি। এইটা কী করে হলো? সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, অনেক মানুষ বিশ্বাস করে ইলন যা করবে তার একটা ভ্যালু আছে। কাজেই ফাটাফাটি সায়েন্স নিয়ে আসা দুই যুবক যদি ওর থেকে ভালো ইভি মানে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বানায়, তাও ওকে কেউ টাকা দেবে না। ইলন যতই ভুল করুক, ওকে টাকা দেবে। ওর শেয়ার কিনবে লোকে। এটাকে বলা হয় ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট। সুনাম বা দুর্নাম। গুডউইল।
 
ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ডে এটা কেমন গুরুত্বপূর্ণ আমি জানি না, তবে অ্যাবস্ট্রাক্ট জায়গায় এটাই সব। অ্যাবস্ট্রাক্ট মানে সাবজেক্টিভ জিনিসে – আর্ট, লিটারেচার, ভিজুয়াল কন্টেন্ট ইত্যাদিতে। এই জগতে আপনি যতই চেষ্টা করেন ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের দাম কখনো ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের ওপরে তুলতে পারবেন না। যার ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট দশ কোটি টাকার, তার বাস্তব অ্যাসেট আনা সম্ভব দশ কোটি টাকার। উলটাটা অকার্যকর – মানে বই বিক্রি করে নিজের দাম আপনি বাড়াতে পারবেন না।
 
এজন্য পিআর এত ইম্পর্ট্যান্ট এই জগতে। গুড পিআর ছাড়া কাউকে আপনি চেনেন না। এমনকি নিভৃতচারী লেখক বলে যাদের চেনেন তাদের মার্কেটিং টুল হলো ওই “নিভৃতচারী” শব্দটা। এটা কোন নির্দোষ শব্দ নয়।
 
কাজেই লেখকভ্রাতা ও ভগিনীরা, কেপি-প্রণীত নিম্নলিখিত অভিজ্ঞতা পাঠ ও বিবেচনা করলে আপনাদের উপকার বই ক্ষতি নাই মনে হয়।
 
(১) নিজেকে ব্যাখ্যা করা বন্ধ করুন। খুবই বাজে কাজ পিআরের জন্য। আপনার কর্মকান্ড নিয়ে যদি লোকে দশ রকম ব্যাখ্যা দেয়, দিক। লেখক, গায়ক, চিত্রকর, নায়ক – ইত্যাদি হবার পার্ট অফ দ্য গেম হচ্ছে আপনি হবেন ওয়াইডলি মিসআন্ডারস্টুড। সবার আগে এইটার সাথে নিজের পিস করতে হবে। বাপে ভুল বুঝবে, বন্ধু ভুল বুঝবে, বউয়ে ভুল বুঝবে। কারো ভুল ভাঙাতে যাবেন না। চ্যারিটি যেমন হোমে বিগিন হয়, তেমন পাবলিকের কাছে যাওয়ার আগে ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলির মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং প্রত্যক্ষ ও হজম করার অভ্যাস করতে হবে। তখন পাবলিক কী ভুল বুঝলো তা গায়ে লাগবে না। এটা বলার কারণ হচ্ছে প্রায়ই দেখি লেখকরা নিজের কর্মকাণ্ড জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে। করবেন না।
(২) সস্তা আবেগ মারানো বন্ধ করুন। এটা ফেসবুকের থেকেও দ্রুত ফেলতে পারে আপনার ইনট্যাঞ্জিবল ভ্যালু। ধরেন অমুক বন্ধু আপনার গাঁড় মেরেছে। আপনি এসে এমন একটা হাহাকার করলেন যেন গাঁড় মারা যে হয় তাই জানতেন না। এটা আপনাকে মাস অডিয়েন্সের চোখে ভালো কোন অবস্থান এনে দেবে না। এটা বাংলাদেশে প্রচুর হয়। প্রতিদিনই হোমপেজে দেখি কোন না কোন লেখক ভেগলি আরেক লেখক বা প্রকাশক নিয়ে বলছেন, “কিছু কিছু মানুষ অমুক করে থাকেন।” – এতে করে ওই লেখক বা প্রকাশকের মান পড়ে না, আপনার মান পড়ে। কিছু বলার থাকলে সরাসরি বলুন, নয়তো পেটের মধ্যে রেখে দিন।
 
(৩) নিজের কিছু ট্রেইট ও আদর্শ ঠিক রাখুন। কোন স্পেসিফিক ট্রেইট না থাকাও ট্রেইট। এই ব্র্যান্ডিং লোকের আছে। তাতে তাদের ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট বেড়েছে। এই ট্রেইটকে বলা হয় “আনপ্রেডিক্টেবল ট্রেইট” – আমাদের দেশে ও বাইরে কিছু লোক এই ট্রেইটের কারণে বিখ্যাত হয়েছে। ঠিক নিভৃতচারীর মতোই। কিন্তু থাকতে হবে আপনার কিছু চরিত্র। জেলিফিশ হবেন না। জেলিফিশ মানে হচ্ছে আপনার নিজের কোন সে নাই – পপুলার অপিনিয়নে সব সময় মাথা দোলান বা কিছুই বলেন না।
 
(৪) কিছু গুজব বাতাসে ভাসতে দিন। আপনার নামে জলজ্যান্ত মিথ্যা পাবলিকলি ছড়িয়ে পড়েছে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে ওটাকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করবেন না। ৩ দ্রষ্টব্য। আপনি যদি নিজের একটা সলিড প্রোফাইল বানাতে পারেন তাহলে লং রানে এইসব ব্যাপার হবে না।
 
(৫) যা করেননি তার জন্য কখনো নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না। কেউ একজন এসে যদি বলে “এই আমার পেটে তো আপনার বাচ্চা” – আপনি যদি জানেন এইটা হাইলি আনলাইকলি, তাকে বলতে দেন। আদালত পর্যন্ত যা গড়াচ্ছে না তা নিয়ে কোন ফাইট করার দরকারই নাই। বরং দৃশ্যের পেছনে আপনি আপনার সৈনিক ডিপ্লয় করে দেন যাতে গুজবটাকে নিজের কাজে লাগানো যায়। আমি এইটা অনেকবার করেছি। ভুয়া আলাপ কেউ করলে আমি এটাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা না করে তলে তলে ওটাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের নামে কয়েকটা মিথ ও লিজেন্ড তৈরি করে দেই। এটা বোধহয় সান জুর বইয়ের একটা কৌশলও। যদি পরিস্থিতিকে নিজের কাজে লাগাবার মতো কিছু না থাকে, তাহলেও বইতে দেন বাতাস। মিথ্যা অপবাদের থেকে ভালো গুডউইল আর কিছু আনতে পারে না, কারণ আপনি এটা সময়মতো সলিড খণ্ডাতে পারবেন আর ভিক্টিম হিসেবে প্রচুর সমর্থন ও সুনাম কুড়াবেন। খণ্ডানোর সময় বি লাইক আ বস, একটা পোস্ট দেন ক্যাজুয়ালি। যেন এসব আপনি অতিকায় হস্তী আর এসব সামান্য বিষয়ে বিচলিত নন।
 
(৬) আপনার সামর্থ্য সম্পর্কে মানুষ যেন জানে, বই পড়ুক আর না পড়ুক। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ। আমার সবচেয়ে বড় অ্যাসেট কয়টা বই বিক্রি হলো আর কয়জন পাঠক আছে তার থেকে বেশি হচ্ছে এর দশ থেকে বিশগুণ মানুষ চায়ের আড্ডা থেকে ফেসবুক কমেন্টে বলে থাকেন, “এখনো উনার বই পড়ি নাই তবে শুনেছি বেশ ভালো লিখেন।”
 
(৭) এটা আমি সরাসরি পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ানের লাইন থেকে মেরে দিবো –
কমোডোর নরিংটন জ্যাক স্প্যারোকে প্রথম যখন ধরে, তখন বলে, “সন্দেহ নাই, যত পাইরেটের নাম শুনি, সবচেয়ে বোকচোদ পাইরেট তুমি, মিয়া।”
জ্যাক স্প্যারো মানে জনি ডেপ তখন একটা সরল হাসি হেসে বলে, “কিন্তু আমার নাম তুমি শুনেছো ঠিকই।”
 
আপনাকে লোকে সঠিকভাবে চিনুক বা ভুলভাবে চিনুক, চিনে – এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। কাজ করতে থাকলে যারা ভুলভাবে বা নেগেটিভভাবে চেনে তারা আগামিকাল পজেটিভভাবে চিনবে। আমার সাথে এটা অসংখ্যবার হয়েছে। ইনবক্সে লোকে জানিয়েছেন ৩টি বছর আগে আমাকে যুগপৎ ঘৃণা করতে করতে চিনেছেন। তারপর এখন আমাকে কিছুটা বোঝেন এবং পছন্দ করেন। এখানে ট্রিকটা হচ্ছে নিজেকে বাইরের জগতে ছুঁড়ে ফেলুন। আপনার ভেতর মাল থাকলে লোকে সময়মতো দাম দেবে। না থাকলে তো নাই-ই।
 
(৮) নিজের নাম কলুষিত করতে ভয় পাবেন না কখনো। সেটাও আসলে ওই নিভৃতচারী প্যারাডক্সের মতো একটা প্যারাডক্স। মনে রাখতে হবে যেই পেন্সিল কোন কাজ করে নাই ওটাই চকচক করে। কাজ করতে গেলে আপনি ভচকায়ে যাবেন, দেখতে সুন্দর লাগবে না আপনারে, আপনার নামে নানা বাজে কথা বলা হবে – সেটাই স্বাভাবিক।
 
(৯) স্ট্যান্ড ফর সামথিং। সামথিং বিগার দ্যান ইউ। যে কিছুর জন্য স্ট্যান্ড করেছে তার বন্ধু কী বললো, প্রকাশক কী বললো, সহলেখকরা কী বললো – এসব তুচ্ছ আর ফালতু জিনিস নিয়ে পক পক করার সময় নাই। আবার লোক দেখানো স্ট্যান্ড নিয়েন না। লোক দেখানো স্ট্যান্ড আপনার ইন্ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট এমনভাবে ধ্বংস করবে যেভাবে ধ্বংস হয়নি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিও! আপনি কিছু নিয়ে স্ট্যান্ড করলে তা নিয়ে লিখে আর ভিডিয়ো বানিয়েই কূল পাবেন না, চোগলখোরি করবেন কখন? চোগলখোর মানুষ দেখলে জনগণ বুঝে যায় এই লোকটা শ্যালো। এর কাছে কে কাকে সালাম দিলো তাই ইম্পর্ট্যান্ট। খুবই বাজে রেপুটেশনের জন্য।
 
(১০) ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট প্রমোট করতে শিখুন। আমার একটা স্কিল হচ্ছে জিনিস প্রমোট করতে জানা। একটা উদাহরণ দেই। অনার সোসাইটি ফাই কাপ্পা ফাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ টেন পার্সেন্টকে দাওয়াত দেয়া হয়। আমি এখানে আসার পর থেকে দেখেছি বড় ভাই, আপুরা সেটার দাওয়াত পেয়েছেন। ফেসবুকে, লিংকডইনে লিখেছেন “আমাকে ফাই কাপ্পা ফাই ওদের সোসাইটিতে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে!” আমি এ বছর ওদের থেকে আমন্ত্রণ পাওয়ার পর লিংকডইনে লিখেছি, “আমার হিরো জন গ্রিশাম আর স্টিভেন স্পিলবার্গ যে সোসাইটির সদস্য, তা থেকে দাওয়াত পেয়ে নিদারুণ গর্বিত! সংশয় ছাড়াই ফাই কাপ্পা ফাইয়ের দাওয়াত কবুল করলাম।” আপনার অ্যাচিভমেন্ট আপনি কীভাবে প্রেজেন্ট করেন তা ইম্পর্ট্যান্ট। একই অভিজ্ঞতা থেকে আমি এপিক লিখে ফেলতে পারি, অন্যরা মনে করেন এটা তো একটা স্বাভাবিক ঘটনা – এটাই তো আর্ট।
 
এত আলাপের মূল কারণ হচ্ছে, দয়া করে নিজেদের গুডউইলের বারোটা বাজানো একে অন্যকে চুলকানো পোস্ট দিয়ে নিজের ক্ষতি করবেন না। ফর্ম আর ক্লাস দুটোই পার্মানেন্ট। ফেসবুকে গালাগালি করেও ক্লাসি একটা পার্সোনা বানানো যায়, আবার সব সময় ভদ্র আলাপ করেও ওইসব চুলকা-চুলকির কারণে থার্ড ক্লাস পার্সোনা হয়ে যায় কারো কারো। এসব আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও এর একটা ফিনান্সিয়াল ক্ষতিও আছে লং রানে। ছ্যাচরামি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
 
বিষয়টা মনে করিয়ে দেয়া ফেলো রাইটার হিসেবে জানানো দরকার ছিলো, তাই জানালাম।

রিপ্রেজেন্টেশন

টুকটাক অর্জন তো জীবনে কিছু ছিলো, কিন্তু আমি আমার সবচেয়ে গর্বের মুহূর্তগুলো যদি মনে করি সেটা আসলে এসেছে রিপ্রেজেন্টেশন থেকে। রুয়েট লাইফে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে কোন একটা সংখ্যার নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রী আমাকে বলেছে, তারা কুয়েট ও চুয়েটেও চান্স পেয়েছিল, রুয়েট বেছে নিয়েছে কারণ তারা জানে কেপি ভাই এখানে পড়ছে। আমাকে তেল দিতে বলেছে? আমার মনে হয় না। আমি র‍্যাগ দেয়া সিনিয়র ছিলাম না যে আমাকে তেল দিতে হবে। ওটা বলেছে কারণ আমি রুয়েটকে রিপ্রেজেন্ট করেছি।

 
অগমেডিক্সে কিছু সংখ্যক ব্রাদার-সিস্টার জয়েন করেছে, আমি থাকাকালে এবং চলে যাওয়ার পরও – কারণ কেপি ভাই এখানে কাজ করে গেছে। অগমেডিক্স ছিল আমেরিকান একটা প্রতিষ্ঠান, তেলবাজির কালচারই নেই। ওটা ওরা করেছে স্রেফ আমার রিপ্রেজেন্টেশন অনুসারে। স্মোকিং জোনে মজা করে শাফকাত ভাইকে বোধহয় বলেছিলাম, “এই সবগুলো পোলাপানের রেফারেল বোনাস আমার পাওয়া উচিত না? পাওয়া তো উচিত। হাহা।”
 
টেক্সাসে পা রাখার পর কিছু ছোটখাটো ব্যক্তিগত অর্জন হয়েছে। কোনটাই আমাকে তেমন গর্বিত করতে পারেনি। তবে আমেরিকান কোন ছেলে-মেয়ে যখন আমার কারণে বাংলাদেশ নিয়ে ভালো কথা বলে, তখন ভালো লাগে। সচরাচর আমাদের কমিউনিটির একটা ভিক্টিম প্লে কার্ড আছে, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়ার ছেলেমেয়েরা এসে মাঝে মাঝে বলে, ❛আরে ওরা বাইরের লোকজনকে গুরুত্ব দেয় না।❜
 
গুরুত্ব দেয়ানোর জন্য যে আমাদেরকেও ইম্প্যাক্ট ফেলতে হবে, তা আর তারা বলে না। পরীক্ষায় ছয় মারলে কোন ইম্প্যাক্ট পড়ে না। পারফর্ম্যান্সে ছয় মারলেও না। সেক্ষেত্রে একটা স্টেরিয়োটাইপ আসে কেবল, ❛ইন্ডিয়ানরা অঙ্কে ভালো❜ কিংবা ❛চাইনিজরা অনেক খাটে।❜ ওটা দিয়ে মিউচুয়াল রেসপেক্ট আদায় করা যায় না। সেটা আদায় করার জন্য চারিত্রিক ক্যারিজমা দেখাতে হয়, যেন আমাদের পার্সোনাল লেভেলে গিয়ে তারা ফিল করতে পারে।
 
এক লোকাল ছেলে যখন জানতে পারে বাংলাদেশে কাকের থেকে কবির সংখ্যা বেশি এবং জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য মানুষ সাহিত্যিক – সে নিজে নিজে গুগল টুগল করে এসে পরে বলে ❛তোমাদের মধ্যে ট্যাগোর নামে একজন দেখি নোবেলও পেয়েছে। তোমরা দেখি ভাই জিনিস। বই-টই অনুবাদ করো দ্রুত। পড়বো।❜
 
তখন ভালো লাগে। ওকে ট্যাগোর চিনতে আমি বন্দুক তাক করি নাই। বাংলাদেশ নিয়ে গুগল করতে প্যারা দেই নাই। আমার লেখালেখি নিয়েও আলাপ করি নাই আসলে। স্রেফ থেকেছি নিজের মতোই, তার কাছে আমার ক্যারেকটারটা ক্যারিজমাটিক মনে হয়েছে, সে আমার ব্যক্তিগত জীবন ও দেশ নিয়ে আগ্রহী হয়েছে। এটাই রিপ্রেজেন্টেশন।
 
লোকাল কোন মেয়ে যখন একেবারে নিজে থেকেই ব্যাপক আগ্রহী হয়ে যায়, ❛তোমার দেশ কোনটা যেন?❜ বাংলাদেশ জানার পর দ্রুত বলে, ❛দাঁড়াও দাঁড়াও, জিওগ্রাফির ক্লাস তো করেছিলাম, আগেই বলো না ওটা কোথায়। গ্লোবাল ম্যাপ মুখস্থ আছে কি না দেখি।❜ তারপর বাতাসে মানচিত্র এঁকে বাংলাদেশ খোঁজার চেষ্টা করে, ❛এইখানে আমেরিকা। সাগর টপকালে ইউরোপ। ওদিকে রাশিয়া, নিচে এই কোণে অস্ট্রেলিয়া। এই পাশে বিশাল আফ্রিকা। ইউরোপের নিচে তোমরা। ঠিক কি না?❜
আমি হাসি, ❛ইউরোপের নিচে মিডল ইস্ট। আমরা মিডল ইস্ট ডরাই, ভাই।❜
তখন প্রবল আগ্রহে সে যখন গুগল ম্যাপস বের করে খুঁজে বের করে বাংলাদেশ।
 
তারে কেউ বন্দুক দিয়ে বাংলাদেশ বের করতে বলে নাই। আমি বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ করার চেষ্টাও করিনি। এই আগ্রহ জেনুইন। তখন আমার গর্ব কিছু হয়েছে।
 
আমি যখন এখানে হাঁটি, আমি যা তা-ই বাংলাদেশ। আমার চোখেই ওরা বাংলাদেশ দেখে। বাংলাদেশকে রেসপেক্ট করে। আবার উলটো দৃশ্যও আছে, বাংলাদেশের ছেলে এসে যদি এখানকার মেয়ের পাছা দেখার চেষ্টা করে তখন দেশের ইজ্জতটা যায়। এমন মানুষও পেয়েছি যে বলেছে ❛কিছু মনে করো না, তোমার সাথে পরিচয়ের আগে আমার ধারণা ছিলো বাংলাদেশীরা স্বার্থপর টাইপের হয়ে থাকে।❜
 
কী মুশকিল।
এজন্য আমি হুমায়ূন ফরিদীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলে থাকি, ❛লাখ টাকার বাগান খায় এক টাকার ছাগলে।❜ মানুষকে মানুষের মতো দেখতে পয়সা লাগে না। মেয়েদের বুকের বা হাতের দিকে না তাকিয়ে তাদের স্রেফ মানুষ ভেবে চোখের দিকে তাকাতেও পয়সা লাগে না। স্রেফ কাজের কথা না বলে দুটো কৌতুক করতে, দুটো সাধারণ আলাপ করতেও পয়সা লাগে না। কিন্তু কেউ কেউ সেটা করবেন না। কীসের যেন এক জাতিগত বিদ্বেষ! লাখ টাকার বাগান খেয়ে দেবেন এক টাকার ছাগলের ভূমিকায় অভিনয় করে।
 
অনেক আগে বলেছিলাম, প্রতিষ্ঠান ছাত্রের বা কর্মীর ব্র্যান্ডিং করে না। ছাত্র বা কর্মীই প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং করে।
 
আমি ভালো একটা বই লিখলে যদি পশ্চিমবঙ্গের কোনও এক র‍্যান্ডম পাঠক কমেন্ট করেন (কিছু দেখেছিলাম এমন) “ভদ্রলোক রুয়েটে যন্ত্রকৌশল পড়েন,” (তখন পড়তাম) রুয়েটের নামটা ওখানে গেল আমার ব্র্যান্ডিংয়ে। নট দ্য আদার ওয়ে অ্যারাউন্ড।
 
রুয়েটের নাম শুনে কেউ হুড়হুড় করে আমার জন্য মাঠ খালি করে দেবে না।
কাজেই প্রতিষ্ঠানের নাম ধরে গর্ব করা মোটামুটি গাধা পর্যায়ের মানুষের কাজ।
 
“আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা এনেছে, আমি গর্বিত সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়ে” ধরণের বাণী অকার্যকর। তোমার ব্র্যান্ডিং আওয়ামী লীগ করছে না, বরং তুমিই আওয়ামী লীগের ব্র্যান্ডিং করছো।
 
তুমি কি করছো সেটাই ব্যাপার।
 
তুমি চুপ থাকো সব অন্যায়ে, বেশ, তোমার দল খারাপ। খারাপ কিছু করলে তো কথাই নাই। স্বাধীনতায় তোমার দলের অবদান দেখার দরকার কারও পড়ছে না।
 
ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যাপারটাও তাই। ইসলাম কেমন মহৎ ধর্ম এইটা কোনও ব্যাপারই না। ইসলাম তোমার ব্র্যান্ডিং করে না। তুমিই ইসলামের ব্র্যান্ডিং করো। তোমার কাজ খারাপ তো তোমার ধর্মও খারাপ।
 
সব প্রতিষ্ঠানের, সব ধর্মেরই মূলনীতিতে ভালো ভালো কথা লেখা থাকে। এটা দিয়ে প্রমাণ হয় না একটা রাজনৈতিক দল ভালো কি না, একটা ধর্ম ভালো কি না, একটা দেশ ভালো কি না।
 
আগে কি কি ফাটাফাটি কাজ করে এসেছে তা দিয়েও প্রমাণ হয় না একটা রাজনৈতিক দল ভালো কি না, একটা ধর্ম ভালো কি না, একটা দেশ ভালো কি না।
প্রমাণ হয় তাদের প্রোডাক্টদের আচরণ থেকে।
 
একটা দেশের মানুষ, একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী, একটা ধর্মের অনুসারীরা কি করছে তা থেকেই বোঝা যায় সেই দেশ, সেই প্রতিষ্ঠান, সেই ধর্ম ভালো না খারাপ।
আজকে যে জিনিস খারাপ, তা যে কালকে ভালো হবে না তেমন নয়। অধিবাসী বা অনুসারীর ব্র্যান্ডিং থেকেই ভালো-খারাপ নির্ধারিত হবে।
 
আমরা গর্বিত হতে পারি রিপ্রেজেন্ট করে।
স্রেফ বাংলাদেশে জন্মেছি বলে ফাউ গর্ব যেটা সেটা লজ্জার। এ নিয়ে আমার অরিজিনাল থিংকিং শেখাবার বই ❛থট প্রসেস❜-এ যা লিখেছিলাম তার মূলভাব এমন – ❛আপনি কিচ্ছু না করেই গর্বিত যার জন্য তার কোনটাই গর্বের কিছু নয়। যেমন বাংলাদেশি হয়ে যদি মনে করেন আপনি গর্বিত আপনি বাংলাদেশি, তাহলে সমস্যা। বরং বাংলাদেশি হয়ে এমন কিছু করুন যেন বাকিরা বাংলাদেশকে হাততালি দেয় এবং তারপর গর্বিত হওয়ার অধিকার আপনার। মুসলমান বলে গর্বিত হলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বরং আগে মুসলমান হয়ে এমন কিছু করুন যেন সবাই মুসলমানদের হাততালি দেয়, তারপর আপনি গর্বিত হওয়ার অধিকার অর্জন করলেন। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হিসেবেও গর্ব করার কিছু নাই। আপনার বাবা যুদ্ধ করেছে। আপনি কী করেছেন? আগে এমন কিছু করুন যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লোককে উদ্বুদ্ধ করে। তারপর আপনি গর্বিত হবেন। স্রেফ বার্থরাইট হিসেবে গর্ব করা যায় না কিছু নিয়ে।❜
 
মজার ব্যাপার হচ্ছে ওপরের সবাই হিন্দুধর্মের যারা বর্ণপ্রথা মানেন তাদের নিয়ে হাসাহাসি করেন। বাংলাদেশি হয়ে গর্ব, মুসলমান হয়ে গর্ব, বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে গর্ব করা ওই বর্ণপ্রথাই।
 
স্রেফ জন্মেছে কী হিসেবে তা নিয়ে গর্ব করার থেকে লজ্জার কিছু নেই।
 
বরং এমন কিছু করার চেষ্টা করা উচিত যেন আপনার জাতির, ধর্মের, মতবাদের লোক আপনাকে দেখিয়ে আপনাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।
তবে তবুও নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারবে না কিন্তু, কারণ নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে হলে তাদেরও এমন কিছু করতে হবে যা নিয়ে তাদের জাতি গর্ব করবে।
 
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমি গর্বিত, তবে মুক্তিযুদ্ধের দেশে জন্মেছি বলে কিন্তু আমি গর্বিত নই। আমি গর্বিত নই বাংলাদেশি হিসেবে। নিজের ধর্ম ছিলো ইসলাম – গর্ব দূরে থাকুক, এই ধর্মের লোকজন এত লজ্জার কাজ করেছে যে একসময় ভুল বুঝে এ থেকে দূরে সরেছি। নিজের পরিচয়ে এই পরিচয় বহনের মতো লজ্জা আমি নিতে রাজি নই।
 
আপনাদের কারোই বাংলাদেশি হিসেবে গর্বিত হওয়া উচিত নয়, যতক্ষণ না একজন বাংলাদেশি হিসেবে এমন কিছু করছেন যেন ঢাকার একটা ফকির মনে করতে পারে, ❛আমার দেশের লোক তো ভালো রে!❜
 
বা, একজন ভারতীয় মনে করতে পারে, ❛বাংলাদেশিরা রেসপেক্টেবল।❜
 
কিংবা একজন আমেরিকান একেবারে নিজের আগ্রহে বাংলাদেশ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে, যদিও আপনি বাংলাদেশ নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি।
 
আমি সেই চেষ্টাই করি। দেশের জন্য ভালো কথা বলার উপলক্ষ্য হতে চাই।
দিল্লী যদিও বহুদূর।
 
আমাদের গর্বিত আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী কি এভাবে চিন্তা করেন কি না তা জানতে খুব ইচ্ছে করে!

রিহিউম্যানাইজিং স্টেম কমিউনিটি

স্টেম কমিউনিটিকে রিহিউম্যানাইজ করা দরকার। স্টেম বলতে বোঝানো হয় science, technology, engineering and math (STEM) –
 
আমি পঞ্চাশভাগ এই পরিবারে বিলং করি বলে কিছু আত্মসমালোচনা করি। স্টেম কমিউনিটির মধ্যে যান্ত্রিকতা যে শুধু আষ্টেপৃষ্ঠে ঢুকে পড়েছে তা না, এই যান্ত্রিকতা নিয়ে আবার গর্ববোধ আছে সবার। এঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসে “এটা তো লিবারেল আর্টসের ক্লাস না” জাতীয় কথা দেশে তো অহরহ বলা হয়। আরেকদল মাতবরকে দেখবেন পহেলা বৈশাখে এসে কলাবিজ্ঞানী বলে লিবারেল আর্টসকে অপমান করার চেষ্টা করবে।
 
আমার কথা হলো, লিবারেল আর্টসের পোলাপান চিল হয়ে পড়াশোনা করতে পারলে স্টেম কেন পারবে না? এটা কি একটা এলিটীয় ব্যাপার যে ফাইজলামি না করাই ক্রেডিট? সিরিয়াস হয়ে থাকাই ক্রেডিট? ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ইলেকট্রিকাল, ম্যাথ, মেশিন পড়বে বলে সিরিয়াস হয়ে থাকতে হবে? আমি এই ফ্যালাসিটাই বুঝি নাই কখনো।
 
পড়াশোনার প্রেশারের আলাপ করছি না এখানে। স্টেম ফিল্ডে খুব কম মানুষের রিপ্লাইয়ে কোনধরণের প্রাণ দেখবেন। অথচ একটা মার্কেটিং মেজরের মানুষের সাথে আলাপ করতে গেলেই দেখবেন একটা প্রাণচাঞ্চল্য, হাসিখুশি ভাব। এইটা পড়াশোনার চাপের ব্যাপার না, কালচারের সমস্যা। স্টেম কালচার খুব ভয়ঙ্কর হয়ে আছে অনেকগুলো বছর ধরেই। এই দেয়াল ভাঙার চেষ্টা আমি করি, হালে পানি পাই না। ফেসবুকের আলাপ করছি না, ক্লাসরুমে আলাপের টোনটা লাইট রাখার চর্চা, সারকাজমের চর্চার কথা বলছি। কিন্তু পুরো বিষয়টা এঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ডের জন্য এতই আচানক যে অনেকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। কিন্তু আমাদের এটা শুরু করতে হবে। রামগড়ুরের ছানা হওয়ার শর্ত তো নাই যতই কঠিন সাবজেক্ট হোক।
 
লিবারেল আর্টস, মার্কেটিং, মাস কমিউনিকেশন যেমন চিল থাকে, এঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথ ঠিক তেমনই চিল থাকবে। এমন বেশি কিছু চাওয়া নয়। কালচার ফিক্স করতে হবে।
 
এই আলাপের শানে নুজুলটা বলে ফেলি, গতকাল একটা পোস্ট দেখলাম একজন সাহায্য চেয়েছেন জিআরই দেবার ব্যাপারে, তার অ্যাংক্সাইটি অ্যাটাক হয়। পরীক্ষার আগে যেতে হয় ডাক্তারের কাছে। পরীক্ষা খারাপ হলে কতটা খারাপ করা যাবে এ নিয়ে চিন্তায় আছেন বোঝা যাচ্ছে। স্টেম ফিল্ডের জনগণ সেখানে একেবারে মেশিনের মতো গিয়ে বললো, “ভয়ের কিছু নেই।” “সাহস রাখুন।” “পেরে যাবেন।” “দিয়ে ফেলুন, পারবেন” ধরণের কথা। (এসব নয়, তবে মূলভাব এমনই। তবে আমি কমেন্ট কপি করবো না, কে কোনদিক থেকে অফেন্ড হয়!)
 
আরে ভাই একটা মানুষের পরিষ্কার মেডিকেল কন্ডিশন দেখা যাচ্ছে। এমন রেয়ার কিছু নয়। অ্যাংক্সাইটি ম্যানেজমেন্টের কত্তো ট্রিটমেন্ট! অথচ স্টেমবাসী শুরুতেই লাফ দিয়ে চলে গেছে “চ্যালেঞ্জ উতরাতে হবে না? জীবন কি ছেলেখেলা?” মুডে।
 
উনাদের দোষ এমন নয়, এটা স্টেম কালচারে সমস্যা।
এই কালচার ফিক্স করতে হবে।

সন্তানগ্রহণের চরম বিরোধী আমি

বাংলাদেশের মাটিতে সন্তানগ্রহণের চরম বিরোধী আমি।

এই সমাজ, এই দেশ নতুন প্রাণের জন্য সেফ নয়। আপনি সাকিব আল হাসান হলেও নয়। আপনার ব্যাংকে দুশো কোটি টাকা থাকলেও নয়। দেখা যাক আমার একটি কন্যা সন্তান হলে তার সাথে ভবিষ্যতে কী ঘটবে।

তাকে আমি অবশ্যই দারুণ সিকিউরিটির বলয়ে দশ-বারো বছর পর্যন্ত বড় করতে পারবো। তবে তারপর তাকে আর স্বাভাবিক জীবন আমি দিতে পারবো না। স্বাভাবিক জীবনে একজন মানুষ মুক্ত জীবন যাপন করতে পারে। মনের খুশিতে হাঁটতে পারে। আমার মেয়ে মনের খুশিতে হাঁটতে পারবে না এদেশে। মানুষ তার পাছা দেখার চেষ্টা করবে মাথাটা বাড়িয়ে। রাস্তায় নামলে ৮০% পুরুষ তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে। অপলক। যোম্বিদের মতো। রিকশাওয়ালা মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাবে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। ওটা কোনও সুস্থ পরিবেশ নয় হাঁটার জন্য।

গাড়িতে বন্দী জীবন আমার মেয়ে কেন যাপন করতে বাধ্য হবে?

চমৎকার কিছু ছেলের সাথে আমার মেয়ের প্রেম হবে। তারা হয়তো তাকে দুঃখ দেবে, কিংবা সে দেবে তাদের দুঃখ। তার বন্ধুচক্র তাকে ডাকবে “মাগি” কিংবা “বারোভাতারি।” টক্সিক এই পরিবেশটি তাকে পেতেই হবে। বন্ধুরা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র হলেও, বাংলা ভার্সনের ছেলে হলেও। এই টক্সিসিটি থেকে মেয়েকে কীভাবে রক্ষা করবেন? “মেনে নাও? লোকে তো বাজে বলবেই-” বলে? না, আমার মেয়েকে আমি মেনে নেয়ার শিক্ষা দিয়ে তো বড় করিনি, সে পালটা গর্জে উঠবে নিজের অধিকার বুঝে নিতে। লোকে আরও আক্রমণ করবে। এই যে একটা টক্সিক পরিবেশ, বাড়তি প্রেশার, তার মধ্য দিয়ে কেন যেতে হবে আমার মেয়েকে?

আমার মেয়ে নতুন একটা ড্রেস পরেছে, সেই আনন্দে নিজের একটা সেলফি তুলে পোস্ট করবে। রাজ্যের পর-অধিকার চর্চায় ব্যস্ত মানুষ এসে কমেন্ট করবে, “বুক দেখিয়ে কী প্রমাণ করতে চান?” “হেদায়াত হোক।” “নারীর জন্য পর্দা করার আয়াত ও হাদীস এই, রেফারেন্সসহ।” “এমন উলঙ্গ থাকার কারণেই ধর্ষণ বেড়েছে” ইত্যাদি।

কেন? আমার মেয়েকে কেন এই বিচ্ছিরি দুঃখগুলো, অপমানগুলো ফেস করতে হবে? কেন তাকে ড্রেসটা কতটা মানিয়েছে তা নিয়ে ভদ্রগোছের আলোচনা তার টাইমলাইনে হবে না?

আমার মেয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারবে না। আমার মেয়ে বন্ধু বা ক্লাসমেটদের কাছে সম্মান পাবে না। আমার মেয়ে নিজের একটা ছবি পোস্ট করেও শান্তিতে থাকতে পারবে না।

এই হিংস্র সমাজে কোন দুঃখে আমি তাকে জন্ম দেব? দুশো কোটি টাকা থাকুক, পাঁচটা ল্যান্ড রোভার থাকুক, আপনার মেয়েকে, আপনার সন্তানকে আপনি এই টক্সিসিটি থেকে বাঁচাতে পারবেন না।

বাংলাদেশের মাটিতে সন্তানগ্রহণের চরম বিরোধী আমি। আমি চাই আমার সন্তান একটি সুস্থ পরিবেশে বড় হবে। মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচবে। সেক্স ডল হয়ে নয়, আল্লাহর দাস হিসেবে নয়। দাসত্ব আমার সন্তানদের জন্য না। তেমন পরিবেশ বাংলাদেশে নেই।

কাজেই আমি লড়ি। আমি লড়ি তাবৎ পর-অধিকার চর্চার বিরুদ্ধে। নিজের জন্য নয়।
আমাদের অনাগত সন্তানদের জন্য।
এবং আমি মনে করি যে মতবাদ ও বিশ্বাসের লোকই আপনি হয়ে থাকুন না কেন, অনাগত বা আগত সন্তানদের জন্য এই লড়াইটি আপনারও।

এই সমাজটা আমাদের পরিষ্কার করতে হবে। Cool হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে হবে বাউন্ডারির ভেতরে থাকা, তা চর্চা করাকে। কেউ নিজের বাউন্ডারি ক্রস করা কথা বললেই তাকে যেন “খ্যাত” হিসেবে দেখা হয় সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আমাদেরই। সমাজ-সংস্কার করে তবেই না সন্তানগ্রহণ। মাথায় মাল উঠে গেল আর পয়দা করে ফেললাম তা তো কোনও বিবেকবান নাগরিকের কাজ হতে পারে না।

নইলে আমাদের জেনারেশনের মতো, আপনার সন্তান যখন তার বন্ধুদের খেদ নিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, “এই বালের পরিবেশে জন্ম দিলে কেন?”
কী জবাব দেবেন?

সাইকিয়াট্রিস্ট নোরা এবং অন্যান্য

দুই বছরের বেশি সময় আমি ঘুমাতে পারিনি কখনো, চার ঘণ্টার বেশি। কখনো সেটা দুই ঘণ্টা। কখনো পাঁচ মিনিট।

ট্রমা কী জিনিস বোঝার জন্য, কিংবা আমাকে বোঝার জন্য এই ব্যাপারটা জানা থাকা বিশেষ দরকার ফর ফিউচার রেফারেন্সেস। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যারা চেনেন তারা আমার যতখানি দেখতে পান, তার সাথে প্রকৃত আমার একটা পার্থক্য তো আছেই, এটা এমন ইউনিক কিছু নয়। সবারই থাকে। আর সবার মতো আমিও আমার এই দিকটা যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি অন্য যে কারো থেকে। তবে জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার মনে হচ্ছে এটা পাবলিক করে দেয়া দরকার। কারণ, আমার ভোকাল হবার জায়গাগুলোর সাথে এর সম্পর্ক আছে।

ওই সময়টায় আমি যখনই ঘুমিয়েছি, প্রতিবারই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে উঠেছি। খুব কালেভদ্রে, প্রতি দুই সপ্তাহে হয়তো একবার দুঃস্বপ্ন ছাড়া ঘুম হয়েছে, সেসব রাত বা দিনকে আমার মনে হয়েছে ব্লেসিং। বেশিরভাগ স্বপ্নেই আমি অপঘাতে মরেছি। স্বপ্নে অপঘাতে মরা এমন কোন বড় ব্যাপার নয়, তবে ঘুমালেই যদি মরেন তাহলে একটু বিপদ তো বটেই। আশ্চর্যের বিষয়টা হলো এর মধ্যে লুসিড ড্রিম খুব কম, অর্থাৎ স্বপ্নে আমি কখনো টের পাইনি যে এটা স্বপ্ন। কাজেই প্রতিবারই ওই একটা হরর, একটা অবর্ণনীয় আতঙ্ক আমাকে হজম করতে হয়েছে।

আমার এই ট্রমার পেছনে বাস্তবজীবনের ট্র্যাজেডিরা ছিল। এটা একটা কারণ আমি দুঃখের গল্প লিখি না। এই ধারার গল্পের খুব চাহিদা দেশে। হুমায়ূন আহমেদ পড়ার পর চোখ ভিজিয়েছেন বলে অনেকে বলে থাকেন, কারণ তাদের দুঃখ হয়েছিল। দুঃখবোধকে গল্পে রাখা আমার পছন্দ নয়, কারণ জীবনে ও জিনিস অনেক আছে। আমার কল্পনার জগতে তার খুব একটা ভূমিকা না থাকলেও চলবে। তবে, স্বপ্নের একটা গতি করতে হতো আমাকে। নানা মানসিক সমস্যার মধ্যে এই ঘুমহীনতা নেয়া যাচ্ছিল না।

আমার ভাইয়ের অনুরোধে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালাম কয়েকবার। ভদ্রমহিলার নাম মেখলা সরকার। আপনারা অনেকে হয়তো চিনে থাকবেন। তার সাথে আমার অদ্ভুত কথোপকথন হতো। আমার ব্যাপারে বলতে গিয়ে আমি কারণও ব্যাখ্যা করতাম। বলতাম “অমুক যে আমার সাথে হচ্ছে তার পেছনে খুব সম্ভবতঃ তমুক কারণ আছে বলে আমার র‍্যাশনালি মনে হয়। তবে আমি সেটা ফিল করি না। র‍্যাশনালি বোঝা আর ফিল করা দুই ভিন্ন জিনিস, কাজেই আমি এটাকে ডিল করতেও পারছি না।” 

তিনি আমাকে এক পর্যায়ে একটা কথা বলেছিলেন, “আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। হয়তো আমার হেল্প ছাড়াই আপনি এসব ফিগার আউট করতে পারবেন। তখন আর আপনাকে এখানে আসতে হবে না।”

তবে আমাকে যেতে হতো প্রেসক্রাইবড ড্রাগসের কারণে। অ্যান্টি-সাইকোটিক আর অ্যান্টি-ডিপ্রেসিভ ওষুধপত্র আমার নামে প্রেসক্রাইবড ছিল। ওসব খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম এরা আমার ডিলিউশনাল দিকটিকে কমিয়ে দেয়। এটা আমার পোষাতো না। কারণ, আমি লিখি গল্প। এই মানসিক জটিলতার কারণেই কি না জানি না, আমার ক্ষেত্রে গল্প লেখা ঠিক কল্পনার বিষয় নয়। গল্প আমার কাছে মেমরি। বিষয়টা লিখে বোঝানো কঠিন। তবে ধরুন আপনি একটা গাছের নিচে বসে থাকা কিশোরীকে নিয়ে গল্প লিখবেন, সেটা আপনি কল্পনা করতেই পারেন। তবে আমি যদি লিখি তবে আমার মনে হয় আমি ওখানে আসলেই ছিলাম। সত্যি ঘটেছে ঘটনাটা, আমার জীবনে। একারণে হয়তো অনেকে মনে করেন আমার লেখায় একটা আকর্ষণ আছে, যেটা খুব বেশি লেখকের মধ্যে পাননি। কাজেই ওষুধ ছাড়তে হলো। তার বদলে আমাকে সৃষ্টি করে নিতে হলো নতুন রেজিমেন। আমি তখন আর আমার ইন্দ্রীয়দের বিশ্বাস করতে পারি না।

এক দুপুরে জানলাম আমাকে হত্যা করার জন্য এলাকার কুখ্যাত জঙ্গিসংগঠন আনসার-আল-ইসলাম এবং লোকাল হিজবুত তাহরি নাকি টর্চ জ্বালিয়ে আমাকে খুঁজে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আমার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো কিছু হলো না। ঘুমের অবস্থা অবশ্যই খারাপ হলো। যখন কেউ জানে তার যে কোন মুহূর্তে মরে-টরে যাওয়ার কথা, তাকে অবশ্যই আপনি মানসিকভাবে চাঙ্গা দেখবেন না।

আমার ট্রমাদের উৎপত্তি জঙ্গিবাহিনী নয়। ভিন্ন সব ঘটনা। তবে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য মূলতঃ দায়ী। যারা অত্যন্ত নিম্নচিন্তাসম্পন্ন মানুষ, তারা মনে করেন অমুক ক্ষতিটা তমুক মানুষ করেছে, অমুক দুঃখটা তমুক মানুষ দিয়েছে। তারপর তারা তাদের শত্রুজ্ঞান করেন। সত্যিকারের শত্রু তাদের চোখে আর ধরা দেয় না।

আমি বুদ্ধিশুদ্ধি কোন শিক্ষক বা ইমামের কথায় খুইয়ে আসিনি, তাদের বর্গাও দেইনি চিন্তা করার ক্ষমতা। কাজেই চিন্তা করে দেখলাম আমার যাবতীয় যন্ত্রণার জন্য দায়ী ভিন্ন একটি বিষয়। 

আমাদের ভুল চিন্তা দায়ী। যেভাবে আমরা চিন্তা করি ন্যায় কিংবা অন্যায়, যেভাবে আমরা দেখি প্রেম, যেভাবে আমরা দেখি জীবন এরাই আমার সমস্ত ট্রমার জন্য দায়ী, সমগ্র মানসিক অশান্তির জন্য, যন্ত্রণার জন্য। এবং এটা আমার জন্য নয় কেবল আপনাদের জন্যও সত্য।

যেভাবে আমরা আমাদের জগতকে স্বাভাবিক ধরে নেই তার জন্য আমাদের যন্ত্রণা পেতে হয়। আমি এখানে সিস্টেম চেঞ্জ করে উলটে দেবার কথা বলছি না। যে কোন সিস্টেমে, যে কোন পরিবেশ, যে কোন দেশ বা সমাজে আমার ফাইন্ডিংস অ্যাপ্লিকেবল। চেঞ্জ করতে হবে আমাদের দেখার ভঙ্গিটা।

যেভাবে আমরা দেখি সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা। যেভাবে আমরা দেখি প্রেমের বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। যেভাবে আমরা ডিফাইন করি লয়ালটি, কিংবা ট্রাস্ট। এগুলো আমাদের সাথে অপটিমাইজড নয়। 

মানুষ একটা বায়োলজিকাল বিইং। একটা প্রাণী। যেভাবে আমরা সমাজের ধারণা কিংবা নৈতিকতার ধারণা নিয়ে এসেছে, তা ফান্ডামেন্টালি আমাদের সত্তার সাথে যায় না। একটা সিংহকে যদি ধরে নিয়ে এসে আপনি প্রতিদিন দুই কেজি ঘাস দেন, তাহলে সিংহের কিছু সমস্যা হবে। আমাদের, অ্যাজ আ হোল, মানবজাতির এখন হয়েছে সেই সমস্যা। 

যেসব সিংহ চারপাশে তাকিয়ে আর দশটা সিংহকে ঘাস খেতে দেখে ভাবছে এটাই সত্য, তাদের জন্য কষ্ট করে চিবিয়ে ঘাসটা খেয়ে ফেলা সহজ। তারা চাকরি না পেলে মনে করে, “আরে ব্রিলিয়ান্ট ফার্স্ট বয়ের মতো পড়লে পাইতাম।” কিংবা তাদের গার্লফ্রেন্ড অন্য কারো সাথে প্রেম করলে তারা ভাবে, “আরে শালী একটা মাগী। চিট করলো আমাকে, সে খারাপ। তারে জীবন থেকে বের করে দেয়াই সমাধান।” এবং বন্ধু একটা বালের আলাপ করলে, সে ভাববে, “ওয়ান ফর অল, অল ফর ওয়ান।”

এই ধরণের যাবতীয় মুল্যবোধ আমাদের যন্ত্রণার এবং শান্তিধ্বংসের কারণ। আমার জীবনের ট্র্যাজেডিরা আমাকে প্রথমবারের মত এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, সত্য, তবে তারপর আমি নিজেকে ছাড়িয়ে আরও ব্রডার সেন্সে ব্যাপারটা ভাবতে শুরু করলাম। দেখলাম ঘটনা সত্য। ছেলেবেলা থেকে আমাদের অনেক ভুল মূল্যবোধ শিক্ষা দেয় ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র, যার কারণে আমরা জীবনের বড় একটা সময় বাজে কিছু ট্রমা নিয়ে যাই এবং নিজেরাও সে দিয়ে ড্রিভেন থাকি, যে কারণে করি ধ্বংস।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক, প্রায় সবার জীবনে খুঁজলে প্রেমঘটিত একটা বেদনার জায়গা পাওয়া যাবে। যেখানে তার পার্টনার তাকে হতাশ করেছে কিংবা অন্য কারো সাথে শুয়ে-টুয়ে পড়েছে। যাদের নেই তারা তো সৌভাগ্যবান, তবে যাদের আছে, তারা কিন্তু এটাকে প্রায় জীবনভর বয়ে বেড়ান। কেন? 

কারণ সমাজ তাকে ছোটবেলা থেকে মনোগ্যামাস সম্পর্ক দেখিয়েছে। ওর বয়স যখন দুই তখন সে দেখেছে সবার একটা আব্বু আর একটা আম্মু। একে অন্যের সাথে জীবন পার করে দিচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা ভাবেন ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের সমস্যা হয়। কেন হয়? কারণ তারা মনোগ্যামাস ফ্যামিলির জন্য ফিটেড একটা সমাজে বড় হয়েছে। ব্রোকেন ফ্যামিলি ডাল-ভাত হলে তাদের কোনরকমের বাড়তি মানসিক সমস্যা হতো না, কারণ তখন তাদের জন্য একটা সিস্টেম, সোশাল ইকুইলিব্রিয়াম দাঁড়াতো। অথচ তর্কসাপেক্ষে মানুষ একটা পলিগ্যামাস প্রানি। ব্রোকেন ফ্যামিলিই হওয়ার কথা মেজরিটির। সেটা আমরা আরোপিক সামাজিক স্ট্রাকচারের কারণে হতে দেইনি বলে পরবর্তীতে, আমাদের অ্যাডাল্ট লাইফে আমরা যে কোনও পলিগ্যামাস ইন্সিডেন্স খুব ডিপলি নেই। অথচ একটা চাকরির ইন্টারভিউয়ে রিজেকশন হলে যতখানি, ততখানিই আপনার অনুভূতি হওয়ার কথা ছিল প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে। তা হচ্ছে না কিন্তু। 

তারপর বন্ধুত্বের সম্পর্কে দেখুন। একই অবস্থা। অ্যানিমল কিংডমে মানুষের মতো যেসব প্রাণিরা আছে, যেমন বানর তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আর ছ্যাঁকা নিয়ে এত নাটক আপনি দেখবেন না। অ্যাসাইনড রোল নিয়েও না, মানে আমাদের ক্ষেত্রে যেটা চাকরি-বাকরি আরকি। কারণ হচ্ছে, আমরা আমাদের ওপর এমন জিনিস চাপিয়েছি যা আসলে হবার কথা নয়। আর এসবই আমাদের ধ্বংস করেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে অনেকগুলো বাড়তি ঝামেলা।

ঝামেলাবিহীন জীবন আপনি পাবেন এমন নয়। তবে অদরকারি ঝামেলা আমরা ছেঁটে ফেলতে পারি সহজেই। কাজেই আমার লক্ষ্যবস্তু হলো না কিছু মানুষ, যার আমাকে হার্ট করেছিল। বরং আমার লক্ষ্যবস্তু হলো সেই মানুষগুলো কেন অন্যদের হার্ট করছে তার মূল কারণটা। 

তিনটি কারণ পাওয়া গেল। 

(১) সমাজ শিখিয়েছে

(২) ধর্ম শিখিয়েছে 

(৩) রাষ্ট্র শিখিয়েছে 

কাজেই আমি এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলাম যে কোন অনাকাঙ্খিত ঝামেলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে। অতি সহজ তিন উদাহরণ দেয়া যাক  

আপনি নিজের পয়সায় কেনা সিগারেট ক্যাম্পাসে ঢুকে সিনিয়রের বা স্যারের মুখের সামনে ধরাতে পারছেন না, কারণ ওটা একটা সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই অদরকারি বাঁধা আপনার জন্য আনফেয়ার। এসব অন্যায় সমাজ আপনার সাথে করছে, যার চেইন-অফ-ইভেন্টে আপনার সাথে ট্রমাটিক কিছু ঘটতে পারে। খেতে পারেন র‍্যাগ। পরদিন ক্লাসে যেতে ভয় পেতে পারেন। এসব দরকারি। এদের মুছে ফেলতে হবে। 

আপনি আর পাশের বাসার ছেলে/মেয়ের সাথে খুব জমিয়ে ভাব হয়ে গেছে। প্রেম করতে পারছেন না, কারণ সে হিন্দু আপনি মুসলমান। এসব অদরকারি ট্রমা, যন্ত্রণা ধর্ম সৃষ্টি করেছে, কাজেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দরকার আছে। 

রাষ্ট্র আপনাকে বলেছে সমকামী হলে আপনি অপরাধী। দুইজন দুইজনকে পছন্দ করছেন, কারো পাকা ধানে মই দিচ্ছেন না, তাও কি না আপনি আছেন ট্রমায়, যাতনায়। একারণে রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধঘোষণা করার দরকার আছে।  

তার মানে এই নয় যে আমি সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে বিলীন করে দেবার মিশনে আছি। বরং আমি, আপনাদের আর যে কারো মতই, এই তিন শত্রুর কিছু অন্যায় নিয়ম আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি। আপনারা জানেন ও বোঝেন কিন্তু তাও পালন করেন, আমি করি না। অন্যায় আবদার সেটা সমাজের মুরুব্বির মতামত হোক, কুরআনের বাণী হোক, কিংবা সংবিধানের ধারা আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যেসবের ডমিনো ইফেক্ট আমার দুঃস্বপ্নের কারণ হয়েছে তা অন্যদের যাতনার কারণ অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু সবাই সাফার করছে বিনা কারণে। এইসব ঠুনকো মূল্যবোধের কারণে মানুষকে সাফার করতে যেন না হয় তা নিশ্চিত করতেই আমার নানা বিষয়ে ভোকাল হওয়া। আয়রনি হচ্ছে, আপনি যদি আমার বিরুদ্ধমত ধারণ করেন, আপনারও সাফারিংস আছে। এবং এই সাফারিংস থেকে আপনাকে কুরআন বা সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারবে না। আপনারা যদিও বা ওদুটোকে আরও আঁকড়ে ধরতে চান মুক্তির নেশায়। অথচ তারা আপনার যন্ত্রণার মূল কারণ ইন দ্য ফার্স্ট প্লেস। 

আমি এ থেকে মানবজাতির মুক্তির পথ খুঁজি। তবে ধর্মগ্রন্থ বা সামাজিক মূল্যবোধ যে সে পথ নয় তা যেমন আমার জানা হয়েছে, আপনারাও তা জানেন। আমি নতুন কিছু বলছি না। যা বলছি এখানে তার সবই আপনি জীবনে একবার হলেও ফিল করেছেন, সচেতনভাবে কিংবা অবচেতনে।

আমি যে একজন ডিলিউশনাল মানুষ তা আপনাদের কারো সামনে লুকাবার চেষ্টা আমি করি না, তবে র‍্যাশনালি চিন্তা করার দিকটা যে অক্ষত আছে তা আমার একাডেমিক কিংবা ক্যারিয়ারের ফলাফল দেখলে বোঝা যায়। কাজেই আমার এই মতামতকে স্রেফ পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে যে পারবেন না তা আশা করা যায়। এ পর্যন্ত যারা পড়েছেন তারা অন্তত অবচেতনে এতখানি ফিল করেছেন যে, “ইট ডাজ মেক সেন্স।” অথচ স্বীকার করবেন কি না বা একেবারেই না দেখার ভান করে কেটে পড়বেন কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তা যেদিকেই যান না কেন, ক্ষতি নেই। আমি বহুমাস ধরে এমনিতেও এক পরাজিত সৈনিক। ইতিহাসে থাকে বিজেতার হুঙ্কার। 

ইদানিং স্বপ্ন দেখি বিশাল বিশাল সব গল্পাকারে। তাদের শুরু থাকে, শেষ থাকে। তাতে ভালোলাগা, দ্বেষ থাকে। মাঝের ছয়-সাত মাস আমার ছিলো এক ইমাজিনারি ফ্রেন্ড। সাইকিয়াট্রিস্ট নোরা। এই চরিত্রটি পরে “এইখানে জাদুঘর পাতা আমাদের” বইয়ের ভেতরে ঢুকে গেছিল। সাইকিয়াট্রিস্ট নোরার কাজ হচ্ছে রিয়েলিটি চেক দেয়া।

কখনো হয়তো দেখলাম, ঘুম ভাঙার পর থেকে আমার মাঝে বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আর অবশিষ্ট নেই। 

নোরা আমাকে বললো, “খুঁজো, কাহিনীটা কী।”

খুঁজলাম। পেয়েও গেলাম। 

নোরা শুধু কনফার্ম করলো, “ট্রিগারটা হচ্ছে স্বপ্ন থেকে। স্বপ্ন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করে নাকি তোমার মস্তিষ্ক স্বপ্নকে?”

নোরা সত্য বলেছে। অবশ্য নোরার পক্ষে মিথ্যে বলা সম্ভব নয়। সে আমারই মস্তিষ্কের অংশ। তবে কখনো কখনো আমি মিথ্যা বলি, নিজের সাথে। ওটা নোরা ধরে ফেলে। তারপর মুখের ওপর বলে দেয় তা।

পাঠকের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন রাখবো।

সুস্থ-স্বাভাবিক একটা মানুষ থেকে যখন আপনি দুই বছরের দুঃস্বপ্ন আর ইমাজিনারি সাইকিয়াট্রিস্ট নোরাকে নিয়ে কোনমতে টিকে যাবেন, আপনার এই পরিণতির জন্য যারা দায়ী তাদের প্রতি আপনার মনোভাব কী হবে? 

না, ওই লোকের ওপর নয় যে আমার নামে কিল স্যাংকশন করেছিল। কিংবা ওই মেয়েটাকে নয় যে আমাকে বিশাল ছ্যাঁকা দিয়েছে, অথবা ওই বন্ধুকে নয় যে আমার বিশ্বাস রাখতে পারেনি, সেইসব আত্মীয়স্বজনকেও নয় যারা আমাকে হতাশ করেছে। তারা স্রেফ পুতুল। 

আসল সমস্যা আমাদের চিন্তার ভেতর, এবং আক্রমণ করতে যদি হয় কিছুকে, 

সেটা এই চিন্তাকেই  

সামাজিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাকে। 

আপনার যাবতীয় দুঃখদুর্দশার পেছনে বড় অংশে এই তিনটাই দায়ী।

এর বাইরেও নানা যাতনা আছে। ক্যান্সার হলে কী করবেন, কিংবা রোড অ্যাকসিডেন্ট? কিন্তু আমার মনে হয় যতখানি যাতনা আমরা নেই, তার অনেকটুকুই আমাদের নিতে হতো না। এ থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। 

আর যারা আমার বিরোধীতা করেন, কিংবা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান না, কথা বলেন না নিজের সার্কেলের ভেতর আয়রনিকভাবে তারা তাদের যন্ত্রণার মূল কারণকে আরও খাবার দেন।

একবার একটা ভদকার বোতলের ছবি পোস্ট করায় অত্যন্ত ধার্মিক লোক আমাকে খুব রোষ নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “নেশা করিস আর মেয়েমানুষ নিয়ে থাকিস!”

সামান্য একটা ভদকার বোতলের ছবি দেখে তার মাথায় নেশা এবং মেয়ে মানুষ চলে এসেছে, কারণ সে বেচারা হয়তো এসব করতে চায় কিন্তু পারে না। ধর্মে নিষেধ আছে যে, তাই।

সে যে নেশা করতে পারছে না বা মেয়ে মানুষের সাহচর্যে যেতে পারছে না, তার পেছনে শত্রু কিন্তু ওই ধর্ম। ধর্ম তাকে অহেতুক যন্ত্রণায় রেখেছে। কিন্তু তার রাগটা দেখুন। আমার ওপর।

সাকিবের বউ পর্দা করে না, হট অভিনেত্রী ছবি দেয় এসব নিয়ে বাঙালির রাগ কেন জানেন? কারণ সে মনে করে তার এমন হট বউ হবে না কখনো। এটা মনে করার পেছনে তার ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স। আমি চেষ্টা করি তাদের মনস্তত্ত্ব বদলে দিতে, এবং এই বদলটা এলে তারাও এই হট মেয়েদের সমাজে সমাদৃত হবে। কিন্তু তারা আমার পরামর্শ নেবে না, মানসিকতার উন্নয়ন না ঘটিয়ে মেয়েটার পেছনে লেগে থাকবে। কারণ সে জানে তার অতৃপ্তি পূরণের জন্য তাকে প্রথমে সংস্কার থেকে বের হতে হবে। সমাজ, ধর্ম, ইত্যাদি। কিন্তু সে সমাজের মূল্যবোধ আর ধর্মের শেকল ভাঙ্গতে পারছে না বলে তার পছন্দের মেয়েগুলো নাগালের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। ধর্ম বা সমাজকে গালি না দিয়ে সে এখন গালি দিচ্ছে ওই বেচারি মেয়েটাকে। “খানকি মাগী, হিজাব কই?”

যা অত্যন্ত স্বাভাবিক কার্যকলাপ এবং আপনার মনেও চায়, অথচ তা করতে পারেন না যখন খেয়াল করুন আক্রমণ সঠিক শত্রুকে করছেন কি না। যা-ই আপনাকে অস্থির করে, বিচলিত করে, যন্ত্রণা দেয়, বা দেয় অতৃপ্তির অনুভূতি তার পেছনের কারণটা খুঁজে বের করুন। কিশোর পাশা ইমন? সুন্দরী মডেল? মিয়া খলিফা? 

নাকি আপনার সামাজিক মূল্যোবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস? 

তারপর আক্রমণ করুন ওটাকে।