আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ১০ – বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকরণ
অরূপ কিছুটা আফসোস নিয়ে বললো, “বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করতে কিছুটা ভুল করে ফেলেছিলাম ভাই। নইলে অমুক (বেশ নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়) জায়গায় আমার হয়ে যেত।”
যাচ্ছিলাম মারিয়া আপু-জাভেদ ভাইদের বাড়ির পার্কিং এরিয়াতে। ওখানে গিয়ে আমি বিড়ি খাবো। অরূপ ঈমানদার মানুষ। আমার সাথে আড্ডা দিতে এসে মাঝে মাঝে বারে ঢুকে পরে, তবে কখনো সিগারেট বা মদ ছুঁয়েও দেখেনি। আড্ডা দিতে এলে ওর ঈমানের পরীক্ষা হয়। কারণ, মদ ও সিগারেট বাদেও নানা বয়সের উদ্ভিন্নযৌবনা যুবতীরা চারপাশে ঘুরঘুর করে। ওকে ওসব জায়গা থেকেও ‘নজরের হেফাজত’ করতে হয় বৈকি। ঈমান রক্ষার এই অগ্নিপরীক্ষায় সম্মানের সাথে সে প্রতিবারই উত্তীর্ণ হয়। তবে আমার সাথে আলাপ করতে এলে তাকে একটু হেঁটে জাভেদ ভাইদের এই চিপায় চলে আসতে হয় মাঝে মাঝে। সে জান্নাতের টিকেট নিচ্ছে বলে আমিও নিচ্ছি এমন নয়। কয়েক ঘণ্টার ব্রেইনস্টর্মিং শেষে এই সামান্য সিগারেটটা আমাকে ধরাই হতো, নইলে দম আটকে মারা যেতাম। ভবিষ্যতে একই কারণে মরবো ক্যান্সারে, তবে সে তো আজকের সমস্যা নয়!
স্রেফ তাল মেলাতেই তাকে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, ইউনিভার্সিটি সিলেকশন জিনিসটা আসলেই ইম্পর্ট্যান্ট। ভালো কথা মনে করালে, এই টপিকের ওপর একটা চ্যাপ্টার রাখবো।”
ইউনিভার্সিটি সিলেকশন নিয়ে অনেকে মাথাব্যথা হয়তো অন্যদের করতে দেখেছেন, একটুও অমূলক নয় সে হৈ-হট্টগোল। পুরো আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্যে “বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকরণ” একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এর ওপর নির্ভর করবে আপনার সমস্ত পরিশ্রম জলে গেলো কি না। একই সাথে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত যেতে আপনার সব মিলিয়ে কতো খরচ পড়লো – সেটা অনেকাংশে নির্ভর করছে এই ইউনিভার্সিটি সিলেকশনের ওপর। হয়তো অনেক ভর্তিযোদ্ধাকেই কোনও এক জুলাই মাসে বসে হা-হুতাশ করতে আপনারা – কেন সঠিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাছাই করতে পারলেন না। কারণ, বছর হারানোর পেছনে আপনার ভুল ইউনিভার্সিটি সিলেকশনও একটি কারণ হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি সিলেকশনের জণ্য বেশ কিছু পথ আছে। একটা মাত্র পথে আটকে থাকাটা সুইসাইডাল হতে পারে। সবাইকে একটা কথা প্রায়ই বলতে শুনবেন – অমুক ও তমুক সাইট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং দেখে দেখে তারা অ্যাপ্লাই করছেন। আসলে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং দেখে কখনো অ্যাপ্লাই করা উচিত নয়। কারণ, আপনি ত্তো আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবখানে পড়াশোনা করতে পারবেন না। আপনাকে নেবে একটি স্কুল, কিংবা কলেজ, কিংবা একটি ডিপার্টমেন্ট। হতে পারে আপনার বিশ্ববিদ্যালয় মাশা-আল্লাহ দেশের মধ্যে ৩৫ তম, তবে আপনার ডিপার্টমেণ্ট সেরা এমন না-ও হতে পারে; হয়তো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিকাল এঞ্জিনিয়ারিং দেশে ৬,০০০ তম। এটা হয়তো একটু বেশি বলে ফেললাম, তবে আইডিয়াটা পরিষ্কার করার জন্য বলতেও হতো।
তাহলে কি ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং দেখবেন না? অবশ্যই দেখবেন। দেখে সেরে তারপর নেক্সটপ-ইউএসএ কিংবা এমন আর কোনও ফেসবুক গ্রুপে সেইসব ইউনিভার্সিটির লিস্ট দিয়ে পোস্ট করে বলবেন – অমুক ডিপার্টমেন্টের জণ্য কিংবা তমুক প্রোগ্রামের জন্য আমি নিচের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিক করেছি। আমার সিদ্ধান্ত ‘কতো-আনাই মিছে’ তা যদি বড় ভাইয়া আপুরা একটু কষ্ট করে বলে দিতে পারেন তাহলে অনেক উপকার হয়, দাদা/দিদিরা। হেহে।
ইত্যাদি।
এটা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা, কারণ তাদের থেকে আর কে ভালো জানবে ভেতরের হাঁড়ির খবর, যারা অলরেডি সেখানে পড়াশনা করছে কিংবা পার্সোনালি কোনও না কোনওভাবে তাদের ব্যাপারে জানে, কারণ হয়তো একটা সময় আপনার মতো তারাও চেষ্টা করছিলো একই ধরণের লিস্ট করতে। ঠেকে শিখেছে। আপনার ক্ষেত্রে আমি একটা জিনিসই গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি – ঠেকে শেখার থেকে দেখে শেখা অনেক ভালো। কাজেই দেখেই শিখুন।
এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশনের জন্য জেলারালাইজড আলোচনা, এবার আরেকটু পার্সোনালাইজ আলোচনাতে ঢোকা যাক। বলছি আপনারই কথা, প্রত্যেকেরই আলাদা ধরণের প্রোফাইল, আলাদা ধরণের ইন্টারেস্ট। তার ওপর ভিত্তি করে আপনাকে নেবে এমন বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে বের করাই মূল লক্ষ্য, বিভিন্ন গ্রুপে বিভিন্ন মানুষ যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা মেরে দিচ্ছে তাদের বেদবাক্য হিসী নিয়ে নেবন না। অবশ্যই নিজের বিভাগের অন্য ছাত্রদের দেয়া তালিকার ওপর চোখ বোলাবেন, তবে তারপর তাদের ফিল্টার করাও আপনার দায়িত্ব। এই ফিল্ট্রেশনের জন্য আপনি একটা জিনিস খুঁজতে পারেন। একে বলা হয় “অ্যাকসেপ্টেন্স রেট।” যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করছেন তাদের নাম লিখে গুগলে তাদের অ্যাকসেপ্টেন্স রেট সার্চ করুন। দেখুন কতো জিআরই থাকলে তাদের ওখানে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হচ্ছে, কেমন সিজিপিএ-র ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেখানে। এক্সেল ফাইলে তার তালিকা করতে থাকুন। আপনার যদি সিজিপিএ থাকে ৩.৩০ আর এমআইটিতে যদি ৩.৯৩ বা তদূর্ধ্ব ছেলেমেয়েরা চান্স পেয়ে থাকে বেশি তবে তাদের দিকে খুব বেশি ভরসা না করাই ভালো। (তার অর্থ এই নয় যে আপনি ধরে নেবেন আপনাকে ওখানে নেবেই না। যদি রিসার্চ থাকে আপনার সিমিলার, বা ভালো জ্ঞান থাকে তাদের কোনও ল্যাবের তৎকালীন কাজের সাথে, অবশ্যই অ্যাপ্লাই করবেন। আমার সার্বজনীন পরামর্শ হচ্ছে – কোনও কিছুকেই ‘অসম্ভব’ হিসেবে দেখা যাবে না। সবকিছুই সম্ভব, তবে সম্ভাব্যতা কম বা বেশি হতে পারে। অসম্ভব কিছুই নয়। এক্ষেত্রে আমরা সম্ভাব্যতা বেশিতে অ্যাপ্লাই করার আলাপ করছি যেন আপনার খরচা কম হয়, এই যা।)
নিজের সাথে যাবে এমন রেঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের অ্যাকসেপ্টেন্স রেট আর আপনার পছন্দের তালিকার মধ্যে সমন্বয় করে বের করুন। এতে করে প্রফেসর ফান্ড দেবার আশ্বাস দেবে এর অপেক্ষায় বসে না থেকে আপনি সরাসরি অ্যাপ্লাই করে ফেলতে পারবেন।
এভাবে অ্যাপ্লাই করার পরের ধাপ বেশ সহজ। বিশ লাখ প্রফেসরকে ইমেইল করার তুলনায় অবশ্যই অনেক সহজ। আপনাকে এই ৫ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩ থেকে ৫টিই অ্য্যডমিশন অফার করবে, যদি আপনার রিসার্চ (ইউনিভার্সিটি সিলেকশনের গুগলীয় রিসার্চ, গবেষণামূলক কাজ নয়) ঠিক থাকে। তখন আপনি তাদের আপনা-লোক। ছাত্র। কিংবা ছাত্রী। তখন আপনি অ্যাডমিশন নিয়ে কাজ করা গ্র্যাজুয়েট কলেজের নির্দিষ্ট বিভাগে ইমেইল করে প্রশ্ন রাখবেন, ফান্ডিংয়ের উপায়টা কী তা যদি তারা জানাতো, তবে বেশ উপকার হতো। আপনি যদি পিএইচডির জন্য অ্যাপ্লাই করে থাকেন তাহলে কিছুটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় ফান্ড আপনি পাবেন। তবে সরাসরি যদি ফান্ড না পান, যেমন তাদের থেকে উত্তর আসতে পারে “ফল ২২ এর জন্য আমাদের হাতে আর কোনও ফান্ড নেই। দুঃখিত।”
কী ভাবছেন, খেলা শেষ?
আরে নাহ। আপনি তো এখন আর হেঁজিপেজি লোক নন। আপনি ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা লোক। আপনি এখন অ্যাডমিটেড স্টুডেন্ট। আপনি বলবেন, “তবে আমার এই অফার ডিফার করে দাও হে, স্প্রিং ২৩ এ। আমি দেখি এর মধ্যে তোমাদের কোনও প্রফেসর ফান্ড দেয় কি না।”
ডিফার-ডিফার খেলা চালিয়ে যাবেন, যতক্ষণে না কোনও প্রফেসর বা সেন্ট্রাল থেকে ফান্ড না পাচ্ছেন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বছর পর্যন্ত ডিফার করা যায় বা অন্তত দুটো সেমিস্টার। অন্ধকারে ঢেলাঢেলির চেয়ে অনেক সহজ এই কর্মটি। যারা ডিফার করা কী বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য বলে রাখি, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর চাইলে সেমিস্টার ডিফার করতে পারেন। নানা কারণে ছাত্রছাত্রীরা বলে থাকেন, “এ সেমিস্টার নয়, পরের সেমিস্টারে ভর্তি হবো।” এই দিকটি নিয়ে তেমন আলাপ হয় না বলে অনেকের কাছে নতুন ঠেকতে পারে, তবে ওদের কাছে এটি নতুন কোনও ঘটনা নয়, একমেবাদ্বিতীয়ম নয়, ইউনিক তো নয়ই। ওরা এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকরণের আরো ট্রিকস আছে। এ লেখাটি চূড়ান্ত হবার আগে তাদের নিয়ে এখানে আরেকটু আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তবে এই মুহূর্তে এটুকু যথেষ্ট হবে বলে আশা করি।
নির্দেশনা –
সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করা অ্যাডমিশন প্রসেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যজ্ঞ। এটি সঠিকভাবে করুন। নিজের প্রোফাইলের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসেপ্টেন্স রেট মিলিয়ে নিন।