KP Imon

Words Crafted

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ১০ – বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকরণ

অরূপ কিছুটা আফসোস নিয়ে বললো, “বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করতে কিছুটা ভুল করে ফেলেছিলাম ভাই। নইলে অমুক (বেশ নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়) জায়গায় আমার হয়ে যেত।”
যাচ্ছিলাম মারিয়া আপু-জাভেদ ভাইদের বাড়ির পার্কিং এরিয়াতে। ওখানে গিয়ে আমি বিড়ি খাবো। অরূপ ঈমানদার মানুষ। আমার সাথে আড্ডা দিতে এসে মাঝে মাঝে বারে ঢুকে পরে, তবে কখনো সিগারেট বা মদ ছুঁয়েও দেখেনি। আড্ডা দিতে এলে ওর ঈমানের পরীক্ষা হয়। কারণ, মদ ও সিগারেট বাদেও নানা বয়সের উদ্ভিন্নযৌবনা যুবতীরা চারপাশে ঘুরঘুর করে। ওকে ওসব জায়গা থেকেও ‘নজরের হেফাজত’ করতে হয় বৈকি। ঈমান রক্ষার এই অগ্নিপরীক্ষায় সম্মানের সাথে সে প্রতিবারই উত্তীর্ণ হয়। তবে আমার সাথে আলাপ করতে এলে তাকে একটু হেঁটে জাভেদ ভাইদের এই চিপায় চলে আসতে হয় মাঝে মাঝে। সে জান্নাতের টিকেট নিচ্ছে বলে আমিও নিচ্ছি এমন নয়। কয়েক ঘণ্টার ব্রেইনস্টর্মিং শেষে এই সামান্য সিগারেটটা আমাকে ধরাই হতো, নইলে দম আটকে মারা যেতাম। ভবিষ্যতে একই কারণে মরবো ক্যান্সারে, তবে সে তো আজকের সমস্যা নয়!
স্রেফ তাল মেলাতেই তাকে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, ইউনিভার্সিটি সিলেকশন জিনিসটা আসলেই ইম্পর্ট্যান্ট। ভালো কথা মনে করালে, এই টপিকের ওপর একটা চ্যাপ্টার রাখবো।”
ইউনিভার্সিটি সিলেকশন নিয়ে অনেকে মাথাব্যথা হয়তো অন্যদের করতে দেখেছেন, একটুও অমূলক নয় সে হৈ-হট্টগোল। পুরো আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্যে “বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকরণ” একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এর ওপর নির্ভর করবে আপনার সমস্ত পরিশ্রম জলে গেলো কি না। একই সাথে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত যেতে আপনার সব মিলিয়ে কতো খরচ পড়লো – সেটা অনেকাংশে নির্ভর করছে এই ইউনিভার্সিটি সিলেকশনের ওপর। হয়তো অনেক ভর্তিযোদ্ধাকেই কোনও এক জুলাই মাসে বসে হা-হুতাশ করতে আপনারা – কেন সঠিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাছাই করতে পারলেন না। কারণ, বছর হারানোর পেছনে আপনার ভুল ইউনিভার্সিটি সিলেকশনও একটি কারণ হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি সিলেকশনের জণ্য বেশ কিছু পথ আছে। একটা মাত্র পথে আটকে থাকাটা সুইসাইডাল হতে পারে। সবাইকে একটা কথা প্রায়ই বলতে শুনবেন – অমুক ও তমুক সাইট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং দেখে দেখে তারা অ্যাপ্লাই করছেন। আসলে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং দেখে কখনো অ্যাপ্লাই করা উচিত নয়। কারণ, আপনি ত্তো আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবখানে পড়াশোনা করতে পারবেন না। আপনাকে নেবে একটি স্কুল, কিংবা কলেজ, কিংবা একটি ডিপার্টমেন্ট। হতে পারে আপনার বিশ্ববিদ্যালয় মাশা-আল্লাহ দেশের মধ্যে ৩৫ তম, তবে আপনার ডিপার্টমেণ্ট সেরা এমন না-ও হতে পারে; হয়তো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিকাল এঞ্জিনিয়ারিং দেশে ৬,০০০ তম। এটা হয়তো একটু বেশি বলে ফেললাম, তবে আইডিয়াটা পরিষ্কার করার জন্য বলতেও হতো।
তাহলে কি ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিং দেখবেন না? অবশ্যই দেখবেন। দেখে সেরে তারপর নেক্সটপ-ইউএসএ কিংবা এমন আর কোনও ফেসবুক গ্রুপে সেইসব ইউনিভার্সিটির লিস্ট দিয়ে পোস্ট করে বলবেন – অমুক ডিপার্টমেন্টের জণ্য কিংবা তমুক প্রোগ্রামের জন্য আমি নিচের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিক করেছি। আমার সিদ্ধান্ত ‘কতো-আনাই মিছে’ তা যদি বড় ভাইয়া আপুরা একটু কষ্ট করে বলে দিতে পারেন তাহলে অনেক উপকার হয়, দাদা/দিদিরা। হেহে।
ইত্যাদি।
এটা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা, কারণ তাদের থেকে আর কে ভালো জানবে ভেতরের হাঁড়ির খবর, যারা অলরেডি সেখানে পড়াশনা করছে কিংবা পার্সোনালি কোনও না কোনওভাবে তাদের ব্যাপারে জানে, কারণ হয়তো একটা সময় আপনার মতো তারাও চেষ্টা করছিলো একই ধরণের লিস্ট করতে। ঠেকে শিখেছে। আপনার ক্ষেত্রে আমি একটা জিনিসই গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি – ঠেকে শেখার থেকে দেখে শেখা অনেক ভালো। কাজেই দেখেই শিখুন।
এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশনের জন্য জেলারালাইজড আলোচনা, এবার আরেকটু পার্সোনালাইজ আলোচনাতে ঢোকা যাক। বলছি আপনারই কথা, প্রত্যেকেরই আলাদা ধরণের প্রোফাইল, আলাদা ধরণের ইন্টারেস্ট। তার ওপর ভিত্তি করে আপনাকে নেবে এমন বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে বের করাই মূল লক্ষ্য, বিভিন্ন গ্রুপে বিভিন্ন মানুষ যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা মেরে দিচ্ছে তাদের বেদবাক্য হিসী নিয়ে নেবন না। অবশ্যই নিজের বিভাগের অন্য ছাত্রদের দেয়া তালিকার ওপর চোখ বোলাবেন, তবে তারপর তাদের ফিল্টার করাও আপনার দায়িত্ব। এই ফিল্ট্রেশনের জন্য আপনি একটা জিনিস খুঁজতে পারেন। একে বলা হয় “অ্যাকসেপ্টেন্স রেট।” যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করছেন তাদের নাম লিখে গুগলে তাদের অ্যাকসেপ্টেন্স রেট সার্চ করুন। দেখুন কতো জিআরই থাকলে তাদের ওখানে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হচ্ছে, কেমন সিজিপিএ-র ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেখানে। এক্সেল ফাইলে তার তালিকা করতে থাকুন। আপনার যদি সিজিপিএ থাকে ৩.৩০ আর এমআইটিতে যদি ৩.৯৩ বা তদূর্ধ্ব ছেলেমেয়েরা চান্স পেয়ে থাকে বেশি তবে তাদের দিকে খুব বেশি ভরসা না করাই ভালো। (তার অর্থ এই নয় যে আপনি ধরে নেবেন আপনাকে ওখানে নেবেই না। যদি রিসার্চ থাকে আপনার সিমিলার, বা ভালো জ্ঞান থাকে তাদের কোনও ল্যাবের তৎকালীন কাজের সাথে, অবশ্যই অ্যাপ্লাই করবেন। আমার সার্বজনীন পরামর্শ হচ্ছে – কোনও কিছুকেই ‘অসম্ভব’ হিসেবে দেখা যাবে না। সবকিছুই সম্ভব, তবে সম্ভাব্যতা কম বা বেশি হতে পারে। অসম্ভব কিছুই নয়। এক্ষেত্রে আমরা সম্ভাব্যতা বেশিতে অ্যাপ্লাই করার আলাপ করছি যেন আপনার খরচা কম হয়, এই যা।)
নিজের সাথে যাবে এমন রেঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের অ্যাকসেপ্টেন্স রেট আর আপনার পছন্দের তালিকার মধ্যে সমন্বয় করে বের করুন। এতে করে প্রফেসর ফান্ড দেবার আশ্বাস দেবে এর অপেক্ষায় বসে না থেকে আপনি সরাসরি অ্যাপ্লাই করে ফেলতে পারবেন।
এভাবে অ্যাপ্লাই করার পরের ধাপ বেশ সহজ। বিশ লাখ প্রফেসরকে ইমেইল করার তুলনায় অবশ্যই অনেক সহজ। আপনাকে এই ৫ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩ থেকে ৫টিই অ্য্যডমিশন অফার করবে, যদি আপনার রিসার্চ (ইউনিভার্সিটি সিলেকশনের গুগলীয় রিসার্চ, গবেষণামূলক কাজ নয়) ঠিক থাকে। তখন আপনি তাদের আপনা-লোক। ছাত্র। কিংবা ছাত্রী। তখন আপনি অ্যাডমিশন নিয়ে কাজ করা গ্র্যাজুয়েট কলেজের নির্দিষ্ট বিভাগে ইমেইল করে প্রশ্ন রাখবেন, ফান্ডিংয়ের উপায়টা কী তা যদি তারা জানাতো, তবে বেশ উপকার হতো। আপনি যদি পিএইচডির জন্য অ্যাপ্লাই করে থাকেন তাহলে কিছুটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় ফান্ড আপনি পাবেন। তবে সরাসরি যদি ফান্ড না পান, যেমন তাদের থেকে উত্তর আসতে পারে “ফল ২২ এর জন্য আমাদের হাতে আর কোনও ফান্ড নেই। দুঃখিত।”
কী ভাবছেন, খেলা শেষ?
আরে নাহ। আপনি তো এখন আর হেঁজিপেজি লোক নন। আপনি ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা লোক। আপনি এখন অ্যাডমিটেড স্টুডেন্ট। আপনি বলবেন, “তবে আমার এই অফার ডিফার করে দাও হে, স্প্রিং ২৩ এ। আমি দেখি এর মধ্যে তোমাদের কোনও প্রফেসর ফান্ড দেয় কি না।”
ডিফার-ডিফার খেলা চালিয়ে যাবেন, যতক্ষণে না কোনও প্রফেসর বা সেন্ট্রাল থেকে ফান্ড না পাচ্ছেন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বছর পর্যন্ত ডিফার করা যায় বা অন্তত দুটো সেমিস্টার। অন্ধকারে ঢেলাঢেলির চেয়ে অনেক সহজ এই কর্মটি। যারা ডিফার করা কী বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য বলে রাখি, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর চাইলে সেমিস্টার ডিফার করতে পারেন। নানা কারণে ছাত্রছাত্রীরা বলে থাকেন, “এ সেমিস্টার নয়, পরের সেমিস্টারে ভর্তি হবো।” এই দিকটি নিয়ে তেমন আলাপ হয় না বলে অনেকের কাছে নতুন ঠেকতে পারে, তবে ওদের কাছে এটি নতুন কোনও ঘটনা নয়, একমেবাদ্বিতীয়ম নয়, ইউনিক তো নয়ই। ওরা এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকরণের আরো ট্রিকস আছে। এ লেখাটি চূড়ান্ত হবার আগে তাদের নিয়ে এখানে আরেকটু আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তবে এই মুহূর্তে এটুকু যথেষ্ট হবে বলে আশা করি।

নির্দেশনা –
সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করা অ্যাডমিশন প্রসেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যজ্ঞ। এটি সঠিকভাবে করুন। নিজের প্রোফাইলের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসেপ্টেন্স রেট মিলিয়ে নিন।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৯ – ভর্তি প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে

“আমার পঁচিশ হাজার ডলার সারপ্লাস ছিলো, তাও ভিসা রিজেক্ট করে দিয়েছে!”

অবাক হয়ে এমন কিছুই বলছিলেন এক ভাই। তার এই অবাক হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সারপ্লাস মানে, আপনাকে ইউএস-এর কোনও একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নিতে চেয়েছে, শুধু তা-ই নয় আপনার এতোই ঝলমলে রেজাল্ট ও ক্যারিয়ার যে আপনাকে ওরা প্রচুর টাকা অফার করেছে। এতো বেশি সে টাকার পরিমাণ যে আপনার থাকা খাওয়ার খরচ, টিউশন ফি, বইপত্র-ল্যাঙট-সেক্সটয় কেনার পয়সা পেরিয়েও আপনাকে তারা আরো কয়েক হাজার ডলার বেশি দেবে! যাদের আই-টোয়েন্টি এমন ঝলমলে তাদের ভিসা সহজে রিজেক্ট হয় না। তারাই তো আমেরিকার ভবিষ্যত গর্ব, তাই না? তবুও কেউ কেউ খেয়ে যান। কারণ আমাদের চিন্তা হয়ে থাকে আত্মকেন্দ্রিক। অর্থাৎ ভিসার ইন্টারভিউতে যাওয়ার আগে মানুষ মনে করে, “আমার তো এসব এসব বলতে হবে, আমার তো এই এই হাল।” কিন্তু এটা ভাবার অবকাশই রাখেন না তারা যে ভিসা ইন্টারভিউ যিনি নিচ্ছেন, সেই ভিসা অফিসারের দিক থেকে জিনিসটা কেমন, তিনি কী ভাবছেন! কাজেই,রেয়ার কেস হলেও চকচকে প্রোফাইল নিয়ে ইন্টারভিউয়ে রিজেক্ট খাওয়া লোক আছেন। একই ভুল অনেকেই করে থাকেন পুরো অ্যাডমিশন প্রসেসটা নিয়েও!  

আপাতদৃষ্টে খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার মনে হতে পারে এই ব্যাপারটা, তবে আমার মনে হয় উচ্চশিক্ষার দিকে আসার সময় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে আপনি নিজের পাশাপাশি এই সম্পর্কিত অন্যান্য বিভাগগুলো কীভাবে কাজ করে তার ব্যাপারে কতোখানি স্বচ্ছ ধারণা রাখতে পারলেন তার ওপর। যেমন ধরা যাক ভিসা ইন্টারভিউ। সাধারণতঃ মানুষ ভিসা ইন্টারভিউয়ের আগে চিন্তা করে থাকেন তার কী কী বলার আছে। কী বললে তাকে ভিসাটা সহজে দেবে। কোন কোন দিকগলো কাভার করতে না পারলে সমস্যা, ইত্যাদি। 

এই ঘোরচক্করে পড়ে অনেকেই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ভুলে যান। সেটা হচ্ছে পার্সপেক্টিভ বদলে চিন্তা করার যে একটা দরকার আছে তার সেটা। এই দিকটা আসলে ভিসা ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে অ্যাডমিশন প্রসেসে সবখানেই জরুরী। আপনি যখন ধরে নেবেন ভিসা ইন্টারভিউয়ার কী কী পেলে আপনাকে সহজে ছেড়ে দিতে পারে, তখন আপনার পথটাও চেনা হয়ে যাবে। নইলে অকূল পাথারে পড়বেন। মনে হবে, যে কোনও প্রশ্নই তো করতে পারে কীভাবে সবটা কাভার করা সম্ভব হবে! 

সম্ভব হবে। যদি আপনি তাদের জুতোর মধ্যে ঢুকে কাজটা করতে চেষ্টা করেন। ভিসা ইন্টারভিউয়ের গল্পটা অন্য এক চ্যাপ্টারে বলবো। তবে আগে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলে ফেলা যাক ভর্তি পরীক্ষার প্রতিটি ধাপকে আমি কীভাবে ‘তাদের’ চোখ থেকে দেখেছিলাম। এখানে মনে রাখতে হবে, অবশ্যই আমি প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন কমিটির মধ্যে ঢুকে বসে থাকতে পারবো না। তাছাড়া এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাও অতি-ক্ষীণ যে আপনার পরিচিত কেউ ইউএসএ-র কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন কমিটির মধ্যে বসে থাকবে আর আপনি তার থেকে প্র্যাকটিকাল জ্ঞান ধার করতে পারবেন্। বরং আপনাকে অনেকক্ষেত্রেই করতে হবে এজুকেটেড গেস। 

আমার ক্ষেত্রে এজুকেটেড গেসটা ছিলো নিম্নরূপ (কাল্পনিক, বাস্তব ভিত্তি নেই, আমি বিশ্ববিদ্যালয় চালালে কীভাবে চালাতাম তার ওপর ভিত্তি করে চিন্তা করা। কাজেই প্রকৃত চিত্রের সাথে নাও মিলতে পারে)  

ধরা যাক, আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। আমার কাছে অনেক ছেলে-মেয়ে প্রতিবছর পড়তে চায় অর্থাৎ, প্রতিবছর লাখে লাখে অ্যাপ্লিকেশন এসে আছড়ে পড়ে আমাদের দোরগোড়ায়। কাজেই আমার কী করতে হবে? একটা অ্যাডমিশন কমিটি বানিয়ে দিতে হবে, যেহেতু একটা প্রসেস ছাড়া আসলে এতো বড় একটা প্রক্রিয়া চালনা করা কঠিন। এই অ্যাডমিশন কমিটিতে কারা কারা থাকবে? অবশ্যই মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি পিপল। নইলে দেখা যাবে সবগুলো ইঞ্জিনিয়ার বসে যা মনে চায় করে ফেলছে। সব শেয়ালের এক রা তো আছেই। তাছাড়া কেবল একটা ডিপার্টমেন্ট যেভাবে দুনিয়াটাকে দেখে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। আপনি একটা সিভিলের প্রফেসরকে কোনভাবেই বোঝাতে পারবেন না ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের স্বার্থে অমুক বা তমুক থাকাটা কেন জরুরী। তার কাছে এসবই বাহুল্য মনে হতে পারে। অপরদিকে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছে সিভিলের অনেক কর্মকাণ্ড বাড়তি খরচ বা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনও কমিটির মধ্যে যতখানি ডাইভার্সিটি রাখা সম্ভব ততো ভালো। এদের কাছে কী আসবে? কিছু অ্যাপ্লিকেশন। এবং ভর্তি কাকে নেয়া যাবে আর কাকে নেয়া যাবে না সে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য যথেষ্ট তথ্য। এই তথ্যটি আদতে যা, আমেরিকার প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তা হলো এসওপি (SOP) তথা স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ। এগুলোর পাশাপাশি বাইরের দেশের ছাত্রদের জণ্য আমাদের দরকার হবে ভর্তিচ্ছুক ছাত্র বা ছাত্রী ইংরেজি কেমন পারে সে বিষয়ক পরীক্ষা আর সেই সাথে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা যদি বিশ্বাস করতে না চাই তবে একটা জিআরই বা সমমানের পরীক্ষা।

এবার পুরো প্রক্রিয়াটি সামলে ফেলার জন্য আমরা খুলে দেবো একটা ওয়েবসাইট। সেটা ডিজাইন করার জন্য মোটা টাকা সম্মানী দেয়া হবে কোনও প্রফেশনালকে এবং আমরা ধরে নেবো কাজ হয়ে গেছে। তারা আমাদের করে দিয়েছে বিশ্বমানের একটা ওয়েবসাইট –  যদিও কথাটা সব সময় সত্য হবে না। আমি প্রায়ই দেখছি অনেক বালের ওয়েবসাইটে আবেদন নেয়ার চেষ্টা করছে।

এবং এরপর আমরা আশা করববো যারা যারা অ্যাপ্লাই করছে সবাই এই প্রসেসে ঢুকে পড়তে পারবে। তাতে করে তাদের জন্যও সুবিধা হলো। আমাদের জন্যও হলো। একটা সিস্টেমে আসলো সবকিছু।

এটুকুই বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের কাজ। তারপর ওদিকে ছাত্র বা ছাত্রী কী করছে তা আমাদের আর দেখার কথা নয়। তারা সারা বছর কোনও না কোনও প্রফেসরের কাছে ফান্ডিংয়ের জন্য ইমেইল চালাচালি করতে পারে। আবার তারা চাইলে আমাদের দেখানো পথে অ্যাপ্লাই করে চুপ করে বসে থাকতে পারে। তারপর তারা আশা করবে আমরা তাদের ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেবো কিংবা দেবো না। সেটা আমরা করতে পারবো কিংবা পারবো না, তবে সেটা অনেক দূরের “হোয়াট-ইফ”। 

যারা নতুন অ্যাপ্লাই করছেন, তাদের মধ্যে পুরো প্রসেসটা এবং গোটা সিস্টেমটাই অবহেলার চোখে দেখে সরাসরি চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায় ফান্ড হবে কি হবে না প্রশ্নের মধ্যে। বলাই বাহুল্য এমনটা দেখার সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যায় চোখ এবং জাল যখন মারছেন তখন জালটা হয়ে যায় অনেকটা ছোট।

আমার মনে হয় বাংলাদেশ থেকে যারা অ্যাপ্লাই করছেন তাদের ক্ষেত্রে সেন্ট্রালি অ্যাপ্লিকেশন করার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়া উচিত। প্রফেসরের সাথে আলাপ করে সাবজেক্ট অ্যালাইন করার বিষয়টার দিকে যে ভয়ানক গুরুত্ব দেয়া হয় তার পেছনে কারণগুলো কী কী তা নিয়ে একটু চিন্তা করার মতো পরিস্থিতি আছে এখানে। অর্থাৎ যদি আপনাকে আমি প্রশ্ন করি, “অ্যাপ্লাই না করে প্রফেসরকে ইমেইল করে যাচ্ছেন কেন?”

উত্তরে আপনি হয়তো নিচের কথাগুলো বলবেন, 

(১) অ্যাপ্লিকেশনের পুরো প্রসেসটা ব্যায়বহুল।

(২) নিশ্চিত না হয়ে এই ব্যয়বহুল পথে কেউ নামতে চান না। 

করণীয় কী হতে পারে তা আলাপ করার আগে চলুন দেখে আসা যাক ওপরের দুই পয়েন্টের সাথে আমি একমত কেন হতে পারি না। 

(১) অ্যাডমিশনের পুরো প্রসেসটা ব্যয়বহুল হলেও একে ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে নিতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি ৫ টা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করেন, এতে আপনার খরচ পড়ার কথা জিআরই এবং টোফেলের খরচ ও ৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন ফি। ধরে রাখতে হবে পুরো টাকাটাই জলে দিচ্ছেন। সে নিয়তে নেমে পড়া ছাড়া আসলে গতি নেই।

(২) ফান্ডিং পাবেন কি না তা নিশ্চিত হতে হতে একটা বছর হারিয়ে ফেলেছেন এমন অনেক মানুষ আছেন। তাদের দিকে তাকিয়ে আমি মনে করি, নিশ্চিত না হয়েই এ পথে নেমে পড়াটা বেশি দরকার। কারণ, একটা বছর আপনার জীবন থেকে ছেড়ে দেয়ার থেকে বরং ঐ ক’টি টাকা (টাকার পরিমাণ যতই হোক না কেন, আপনার এক বছরের থেকে কম, কারণ আপনার হায়াত সীমিত) পানিতে ফেলা ভালো। ওর্থ আ ট্রাই। 

অর্থাৎ, প্রথমেই প্রফেসরের সাথে রিসার্চ অ্যালাইন করে তারপর ফান্ডিংয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে অ্যাপ্লাই করার থেকে আমার মনে হয় সেন্ট্রালি অ্যাপ্লাই করার চর্চাটা বাড়িয়ে তোলা দরকার। এই চর্চাটা আমাদের দেশে এই মুহূর্তে ভীষন কম। সবাই চান নিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা। সেন্ট্রালি অ্যাপ্লাই করার জন্য কিছু টিপস ও ট্রিকস কাজে লাগালে আমার মনে হয় নিরাপত্তার দিকটাও কম বেশি কাভার করা যাবে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার উপায় আপনার প্রফেসরকে ঢিল মেরেও তো নেই। কারণ অনেক সময় আপনাকে কোনও প্রফেসর আশা দেবার পর পরে বলতে পারেন এ বছর তিনি আসলে আপনাকে নিতে পারবেন না, এমনটা এ গ্রুপেও অনেক জায়গায় আপনারা পড়ে থাকবেন। তাছাড়া এভাবে এক হাজার দুই হাজার ইমেইল করাটা আমার কাছে অত্যধিক সময় নষ্ট বলে মনে হয়। উভয়পক্ষেরই। অনেকেই বছর ছেড়ে দেন কারণ মনোঃপূত রিপ্লাই তিনি এ বছর পাননি বলে এমনটা আমি একা নই, আপনারাও দেখেছেন। তারপরও আমার মনে হয় না প্রফেসরকে সরাসরি যোগাযোগ করার পথটাকে আমি অ্যাডভোকেট করতে পারবো।

আমি বরং চাইবো আমাদের ছেলেমেয়েরা সরাসরি অ্যাডমিশন পোর্টাল থেকেই অ্যাপ্লাই করুক। যদি তাকে অ্যাডমিশন কমিটি ভর্তির জন্য গ্রহণ করে, তখন সে ফান্ডের জন্য আলাপ শুরু করুক। 

অ্যাডমিশন কমিটি যখন আপনাকে অফার লেটার দিয়ে ফেলবে, তখন আপনার ফান্ড চাইবার গলা অনেকটা বড় হয়ে যাবে তা নিয়ে সন্দেহ নাই। কারণ তখন আপনি আর হেঁজিপেজি লোক নন। একেবারে তাদের অ্যাডমিটেড স্টুডেন্ট। রকেটের বেগে রিপ্লাই পাবেন। এবং আমার মনে হয় এখন প্রফেসররাও সরাসরি ইমেইলে আলাপ করার আগে চান আপনি সেন্ট্রালি অ্যাপ্লাই করবেন। কারণ আগের থেকে অনেক বেশি জেনেরিক রিপ্লাই আমি দেখেছি যেখানে প্রফেসর বলে থাকেন “তোমার প্রোফাইল দেখে আমি ইম্প্রেসড। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করো। আমার নামটা চাইলে দিতে পারো অ্যাপ্লিকেশনের সাথে।” 

এর অর্থ আপনাকে দেখে ওই প্রফেসর মোটেও ইমপ্রেসড না, তবে আপনার প্রোফাইল দেখে তার মনে হয়েছে এ ধরণের প্রোফাইল অ্যাডমিশন কমিটির সামনে দিয়ে পার পেয়ে যেতেই পারে। কাজেই, এমন মেসেজ যাদের থেকে পেয়েছেন তাদের ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করা সেইফ।

জেনেরিক রিপ্লাই হলেই হতাশ হয়ে যান অনেকে। তারা আসলে হিন্টটা নিতে শেখেন নাই। এ ধরণের জেনেরিক রিপ্লাই পজেটিভ। ফান্ডের আলাপ বাদ দিয়ে এসব জায়গায় অ্যাপ্লাই অবশ্যই করবেন। ভর্তিটা হয়ে গেলে আপনার ফান্ডিং পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে। 

(তবে অ্যাপ্লাই করার আগে একটু জেনে নিতেই পারেন ওখানকার বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা কেমন ফান্ড পেয়ে থাকেন, সেটা করতে খুব একটা বাঁধা নেই। তাই না?)

এমনও তো হতে পারে আপনাকে কোনও প্রফেসর জেনেরিক রিপ্লাই পর্যন্ত দিচ্ছেন না। আমার ক্ষেত্রে আমি ইউনভার্সিটি অফ টেক্সাস স্যান অ্যান্টোনিওতে ইমেইল করে কোনও উত্তর পাইনি। অথচ সেন্ট্রালি অ্যাপ্লাই করার পর তারা আমাকে অ্যাডমিশন অফার দিয়েছেন। অর্থাৎ আমার পয়েন্ট হচ্ছে, প্রফেসররা যদি আপনাকে উত্তর না দেয় তার অর্থ এই নয় যে আপনাকে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় একেবারেই নেবে না বা ফান্ড একেবারেই পাবেন না। এমন যদি হয় কেস, তবে আপনার অবশ্যই অ্যাপ্লাই করা বন্ধ করে দিয়ে পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। বরং যেটি করতে হবে তা হচ্ছে, সতর্ক বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই কিংবা ইউনিভার্সিটি সিলেকশন। 

নির্দেশনা –
প্রফেসরদের ইমেইল করতে থাকা এবং ফান্ডিং নিশ্চিত করে তবেই অ্যাপ্লাই করা ইউএস-এ ফান্ডিং নিয়ে পড়তে আসার একমাত্র উপায় নয়।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ১০ – বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকরণ

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৮ – আমার প্রোফাইল

আগের এক অধ্যায়ে আমি বলেছিলাম ছাত্র ভালো নই বলে চারতলা থেকে এককালে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলাম। তা দেখে অনেকে ভাবতে পারেন বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। এমন অনেকেই থাকেন, যারা আসলে ছোটবেলা থেকে সবখানে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে থাকেন এবং তারপর পত্রপত্রিকায়, বইয়ের পাতায় এমনভাবে নিজেদের শিক্ষাজীবনের কথা বলেন যে তারা ছিলেন ফেলটু, ব্যাকবেঞ্চার। কিন্তু আসলে তা নয়। এতে করে অনেক ব্যাকবেঞ্চার মিথ্যে আশা পেয়ে থাকেন। তবে আমার ক্ষেত্রে আপনারা মিথ্যে আশা পাবেন না। ছাত্র হিসেবে আমার থেকে ‘ওঁচা’ মানুষরাই সাধারণতঃ পড়াশোনা করতে আমেরিকায় আসেন, ফুল ফান্ডিং জনগোষ্ঠী আরকি।

আমার সিজিপিএ ছিলো মাত্র ৩.১০। পড়াশোনা ছিলো রুয়েটের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে। ৪র্থ ও ৫ম সেমিস্টারে এমন ধ্বস নেমেছিলো সিজিতে, তা বলার মতো নয়। ৩য় সেমিস্টারের পরও আমার বাস্তব লক্ষ্য ছিলো একে তুলে ৩.৫০ এ নিয়ে যাওয়া। সেখান থেকে আমার সিজি নামতে নামতে প্রায় তিনের নিচে চলে যাচ্ছিলো। ওদিকে বইপত্র লিখে যাচ্ছি। সেই সাথে এই ঐ ভেজালে ঢুকে যাচ্ছি যেটা আমার নিয়মিত কাজ। ভেজাল করতে থাকা। সব মিলিয়ে আমার সিজিপিএ ৩.১০ নিয়ে আমি একরকম সন্তুষ্ট ছিলাম। কারণ, ১০টা বই বেরিয়ে গেছে গ্র্যাজুয়েশনের সাথে সাথে। আমি এতখানি জানতাম এই দুটো ক্যারিয়ার টানতে হলে লগলেস ৩.১০ ধরে রাখাও অনেক তৎকালীন ৩.৮০ এর পক্ষে সম্ভব হতো কি না তা প্রশ্নাধীন। আমি জীবনে সবই চেয়েছিলাম আবার কিছুতেই পরাজিত হতে চাইনি। অর্থাৎ মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ারের জন্য আমি চাইনি আমার ভালো লাগার জায়গা থেকে লেখালেখি করাটুকু স্রেফ “সখ” হয়ে থাকুক। কাজেই কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে যেমন হয়, তেমন আমিও ছেড়েছিলাম কিছুটা সিজিপিএ।

যখন জিআরই দিচ্ছি, টোফেল দিচ্ছি, তখনও একই অবস্থা। কেবলই নতুন চাকরি শুরু করেছি। ট্রেইনিং ফেজও পার হয়নি। কাজেই হয় আমাকে জিআরই দেয়াটা পিছিয়ে দিতে হতো নইলে চাকরির ট্রেইনিংয়ে কিছুটা খারাপ করতে হতো। একইভাবে আমি কিছুই ছাড়তে চাইনি। প্রায় রেকর্ড পরিমাণ কন্টেন্ট ক্যাপচার করেছিলাম সে ট্রেনিংয়ের ফাইনালে, ৯২%, আমেরিকা বাংলাদেশ মিলিয়ে তখনকার রেকর্ড ছিলো ৯৩%। সেই সাথে জিআরই এবং টোফেল দিয়েছিলাম, কিছুটা স্কোর ত্যাগ করতে করতে। আমার জিআরই স্কোর ছিলো ৩০৭। কোয়ান্টে ১৫৭, ভার্বালে ১৫০। অ্যানালিটিকাল রাইটিংয়ে ৩.৫। টোফেলে ছিলো ১০০, মোট নম্বর থাকে ১২০। রাইটিংয়ে পেয়েছিলাম ২৭, রিডিংয়ে ২৬, লিসেনিংয়ে ২৪, স্পিকিংয়ে ২৩। উল্লেখ্য, অগমেডিক্স ট্রেনিং থাকার কারণে টোফেল নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কনফিডেন্স গজিয়েছিলো। সারাদিন কানের মধ্যে থাকে আমেরিকান ডাক্তার ও রোগিদের কনভার্সেশন। টাইপিং স্পিড আমার ১২০ ওয়ার্ড পার মিনিট। কাজেই টোফেলের জন্য আলাদা প্রস্তুতি তো নেই-ইনি, এমনকি জানতামও না টোফেলের পরীক্ষাপদ্ধতি কেমন। কেবল জানতাম এই রিডিং রাইটিং, স্পিকিং লিসেনিং থাকে। কীভাবে থাকে, কয়টি থাকে, কতক্ষণের জন্য থাকে? আমার কোনও ধারণা ছিলো না।

পাবলিকেশন? শুন্য। জব এক্সপেরিয়েন্স? পৌনে তিন বছরের মতো ছিলো, তবে এর মধ্যে মাত্র চারটি মাস প্রকৌশলী হিসেবে। তিন মাস মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে এগিয়ে চলো ম্যাগাজিনের হয়ে। আর দুটো বছর অগমেডিক্সের হয়ে মেডিকেল স্ক্রাইব। 

সব মিলিয়ে, আমার প্রোফাইল দেখে কোনও মার্কিন প্রফেসর মূর্ছা যাবেন এই সম্ভাবনা ছিলো না। একই কারণে আমাকে আপনারা আইভি লীগের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখছেন না। বিশ্বের টপ ফিফটি বিশ্ববিদ্যালয়ও এড়িয়ে চলেছি। সেসব জায়গাতে অ্যাপ্লাইও করিনি, কারণ অ্যাপ্লিকেশন ডেডলাইনগুলো যখন হুড়হুড় করে চলে আসছিলো তখনও আমার ফুল-টাইম জব চলছে। এবং তখন আমি কাজ করছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টের হয়ে। আমার কাজ সে কারণে শিফটে ভাগ হয়ে গেছিলো। কোনদিন অফিস শুরু হচ্ছে সকাল এগারোটায়। কোনদিন শুরু হচ্ছে রাত সাতটায়। কোনদিন রাত বারোটায়। কোনদিন ভোর পাঁচটায়। ঠিক নেই। আমাকে বেদম খাটিয়ে নিচ্ছে, এমন নয় বিষয়টা। আমি যে ডক্টরের (জেফরি ডেভিস, এমডি, ডিও, এমএস) সাথে কাজ করছি, তিনিও ওসব সময়ে এসে কাজ শুরু করছেন বলেই আমাকে অমনটা করতে হচ্ছে। অভিযোগের কিছু নেই। তবে এমন ভয়ানক জীবনযাপনের কারণে রীতিমতো সাইজ হয়ে যেতে হবে তা বলাই বাহুল্য। এর মধ্যে খুব হিসাব নিকাশ করে যে অ্যাপ্লাই করা যাবে এমন নয়। আমিও পারিনি। নইলে টপ ফিফটি এক-দুটো ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করতাম অবশ্যই। যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তাদের অনুরোধ জানাবো আপনাদের প্রোফাইল যা-ই হোক, দারুণ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করতে ভুলবেন না। অন্তত দুটো। এতে করে আপনার দুশো ডলার মতো খরচ যদি হয়, হতে দিন। তবে অবশ্যই, খুব সময় দিয়ে যাচাই করে নেবেন। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রোগ্রামটি যেন আপনার একাডেমিক রেজাল্টের জন্য না হলেও জেনুইন আগ্রহের জায়গার সাথে সমন্বয় করে। তাদের জন্য SoP তথা স্টেটমেন্ট অফ পারপাজটিও লিখবেন বুঝেশুনে। ওখানে চান্স পেলে আপনার স্টেটমেন্ট অফ পারপাজের জন্যই পাবেন, যদি আমার মতো ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক হয়ে থাকেন।

এর বাইরে আমার নন-একাডেমিক পারফর্ম্যান্স যা ছিলো তাকেও ঠিক প্রোফাইলে বড় করে উল্লেখ করিনি কোথাও। কারণ তারা খুঁজছে একজন সম্ভাবনাময় মেকানিকাল এঞ্জিনিয়ার। থৃলার লেখক নয়। কাজেই এক লাইনে, দু’লাইনে তাদের সেরে ফেলতে হয়েছিলো। 

আমার প্রোফাইল ব্যাখ্যার ফাঁকে আমি এখানে আমার রেজুমে শেয়ার করবো। এতে করে আপনারা একটি ডেমো রেজুমে দেখে নিতে পারবেন। একই সাথে শেয়ার করবো আমার স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ। বিশ্ববিদ্যালয় অনুসারে কিছু পরিবর্তন তাতে ছিলো অবশ্যই। তবে আমি এখানে কেবল রাখছি টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির জন্য লেখা রেজুমে আর স্টেটমেন্ট অফ পারপাজ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ডকুমেন্টসগুলো সম্পাদনা করেছে আমার ভাই ইব্রাহীম আহমেদ। তার প্রতি সেজন্য গভীর কৃতজ্ঞতা। 

সঙ্গতকারণে, রেজুমে থেকে ঠিকানা ইত্যাদি মুছে দিচ্ছি। স্টেটমেন্ট পারপাজের ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যেন ডিপার্টমেন্টের নাম, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোযোগের জায়গাটি এডিট করতে ভুল না হয়। অর্থাৎ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট অ্যারোস্পেস নিয়ে কাজ করছে তাদের গিয়ে আপনি যদি বলেন, “আপনারা গাড়ি নিয়ে ফাটাফাটি কাজ করছেন বলে অ্যাপ্লাই করছি” ওরা বুঝে যাবে আপনি কোনও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লেখা পত্রটিকে এডিট করে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। তারপর কী হবে তা তো বুঝতেই পারছেন।

Statement of Purpose 

Resume

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৯ – ভর্তি প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৭ – উচ্চশিক্ষা কাদের দরকার

ক্যামেরনকে প্রশ্ন করলাম, “আন্ডারগ্র্যাড শেষ হলে হায়ার স্টাডির দিকে ঝুঁকবে নাকি?”
গত রাতে প্রবল ঝড় আর বৃষ্টি হয়েছে। আকাশে যে দারুণ বিদ্যুতের ঝলক আমি দেখেছি, এমনটা আমি দেশে কখনো দেখিনি। ভয়ানক সেই আকাশ আর তুমুল সেই বর্ষণের সাথে সাথে ফোনে এসেছে ওয়েদার অ্যালার্ট। ফ্ল্যাশ ফ্লাড হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে আমাদের। এই ফ্ল্যাশ ফ্লাডগুলোর ছবি দেখিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা ঢাকার জলাবদ্ধতাকে ডিফেন্ড করতে চান। বলতে চান, “আমেরিকাতেই রাস্তায় পানি ওঠে আর আমাদের দেশে উঠলেই দোষ।”
তবে তাদের এমন কথা সত্য নয়। ফ্ল্যাশ ফ্লাডে পানি ওঠে যেমন, পানিদের অপসারণের জন্য ব্যবস্থা থাকে ডিজাইনে, কাজ করতে মাঠে নেমে যায় ইরিগেশন টিম, তাদের সাদা রঙা গাড়ি মিস করার কারণ থাকবে না আপনার। এবং পানি যদি উঠেও থাকে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ফেলতে পারে তারা দ্রুত। ওয়েদার অ্যালার্টে যদিও বলেছে ফ্ল্যাশ ফ্লাড নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে, বলেছে একমাত্র এক কারণেই বাড়ি থেকে বের হতে পারি আমরা – যদি প্রাণ রক্ষার্থে অন্য কোনও এলাকায় সরে পড়ার দরকার হয়, তবেই।
পরদিন ছিলো অ্যাডভান্সড রোবটিকসের মিডটার্ম। উচ্চশিক্ষা জীবনের প্রথম পরীক্ষা। অঙ্কই করছিলাম, বিদ্যুত চমকাচ্ছিলো ওয়েল্ডিং শপের থেকেও ভয়াবহভাবে। আবহাওয়া দেখে বই-খাতা-ল্যাপটপ সরিয়ে রেখে আস্তে করে বেরিয়ে এলাম কিচেনে। এক মগ গরম চা বানিয়ে সোজা বেলকনিতে থেমে ধরিয়ে ফেললাম সিগারেট। বৃষ্টি নামলো এর ঠিক পয়তাল্লিশ মিনিট পর। চললো প্রায় সারারাত। পরদিন সকাল ৯ টায় সিনিয়র ডিজাইন টিমের সাথে দেখা করতে গিয়ে বুঝলাম, ফাঁকি সবাই মারে। ওদের শিক্ষক এখনো আসেননি। ডালাসের মেয়ে ক্যাথারিন আমাদের ঐ টেবিল থেকে জানালো, “উনি আমাকে ইমেইল করে বলেছেন, দশটার আগে পৌঁছাতে পারবেন না।”
ক্যাথারিনরা এরোজিস্টিকসের হয়ে ড্রোনের উন্নয়নে কাজ করছে ফাইনাল ইয়ারে। আমার কাজ অবশ্য শেলবি-স্টিভেন-ক্যামেরনের সাথে। কাজেই আমি তাদের টেবিল থেকে নড়লাম না। একটা ঘণ্টা বাড়তি পাওয়ার কারণে বরং তুমুল আড্ডা জুড়ে দিলাম আমরা। শুরু হলো অ্যাকসেন্ট দিয়ে, সে থেকে গুহামানব, বাইসন শিকার, শেলবির স্ট্রিপার ফ্রেন্ডের সাপ্তাহিক ইনকাম থেকে সে আলোচনা অবশেষে এলো উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে নবাবজাদার মতো বসে ক্যামেরনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আন্ডারগ্র্যাড শেষ হলে হায়ার স্টাডির দিকে ঝুঁকবে নাকি?”
তুমুল বেগে মাথা নাড়লো ক্যামেরন। বললো, “পয়সা দরকার।”
ওদিকে মিশিগানে আন্ডারগ্র্যাড করে আসা আমাদের বন্ধু রিজুলকে আমি একই প্রশ্ন করেছিলাম, “চাকরি তো করছো ধুমসে। এখানে উচ্চশিক্ষার দরকার কী ছিলো?”
রিজুল বলেছিলো, “রেজুমেতে দেখাতে ভালো লাগবে। দরকারও আছে ক্যারিয়ার সামনে আনার জন্য। আমি তো তাই পার্ট-টাইম প্রোগ্রামে ঢুকেছি। সময় কিছু লাগলে লাগুক। সমস্যা নেই।”
অন্যদের মধ্যে যারা এসেছে, তাদের থেকে একেকরকমের উত্তর পাওয়া যাবে। এদের মধ্যে অনেক শুনতে পাবেন নিচের উত্তরগুলো –

১। দেশে যোগ্যতার মূল্যায়ন নাই।
রাইট রিজন। আমি দেশের পে-গ্রেড নিয়ে অভিযোগ করবো না। আমেরিকায় ফুলি-ফান্ডেড একটা ছেলে পার্টটাইম একাডেমিয়ার কাজ করেই আড়াই-তিন লাখ টাকা পেয়ে যান মাসে। দেশে ফুলটাইম ইন্ডাস্ট্রি জব করেও ষাট হাজার টাকার স্যালারিতে যেতে কতোদিন লাগে ঠিক নেই। সেজন্য আমি এটাকে সঠিক কারণ বলছি না। আমেরিকায় একটা কোকের ক্যানের দাম ১৮০ টাকা। একটা মোটামুটি মানের এয়ারফোনের দাম ৫,০০০ টাকা, একটা ৫ কিলোমিটার দূরের উবার রাইডের দাম ১০০০ টাকা। মোটামুটি একটা জায়গায় দুজনের একটা ডিনারের পর আপনাকে মূল্য চুকাতে হবে মিনিমাম ৪,৫০০ টাকা, ধইঞ্চা এক টিশার্ট কেনার পর তার জন্য গুণতে হবে ৩,০০০ টাকা। জীবনযাত্রার মান এখানে বেশি। তাই এখানে যিনি বাংলাদেশি হিসেবে দেড় লাখ টাকা পান, তিনি নিতান্তই গরিব এক লোক। অর্থাৎ দেশে আপনার যোগ্যতার মূল্যায়ন নেই বলতে আমি পে-গ্রেডের কথা বলছি না। বলছি আপনার অধিকারের কথা। দেশে আপনার অধিকারের মূল্যায়ন কেউ করছে না, এটা সত্য। ফ্রেশার এক মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারকে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার স্যালারি অফার করা একধরণের ফাইজলামো। এটি তারা এজন্য করে না যে বাংলাদেশের টাকার দাম কম হলেও জীবনযাত্রার মানের কারণে অল্প টাকায় সুবিধেও বেশি পাওয়া যায়। বরং তারা এটা করে ভিন্নভাবে। কোম্পানি একজন ফ্রেশারকে ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে নিয়োগ দিতে পারলেও দেয় না, কারণ এই নয় যে তাদের বাজেটে টাকাটা নেই। বরং কারণটা হচ্ছে, ২০ হাজার টাকায় কেউ না কেউ চলে আসবে। আপনি হয়তো অপমানবোধ থেকে কাজটা না করে ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বেরিয়ে এলেন, আপনার পরের ক্যান্ডিডেটের হয়তো তিন মাস আগে বাবা মারা গেছে, সংসারের অবস্থা কাহিল, সে ঐ ২০ হাজারের চাকরি নেবে। এটা কোম্পানিরা জানে। তাই তারা আপনাকে মূল্যায়িত করছে না। তাদের থেকে কোনো ফ্রেশার দেড় লাখ টাকার বেতন চায়নি, অধিকারটুকু চেয়েছে। সেটি আপনাকে তারা দিতে নারাজ। এমনকি, তারপর তারা আপনাকে সপ্তাহে ৪৫ ঘণ্টার বদলে ৮৪ ঘণ্টা খাটাবে। কারণ ঐ একই। আপনার ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স থাকতে দেবে না, এবং সে অনুপাতে টাকাও দেবে না। এখানেও সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা খাটা লাগতে পারে ধরণের জব অফার আছে, বিনিময়ে আপনি মাথা ঘুরিয়ে দেয়া টাকা পাবেন। ওখানে তা নয়। এই যে মূল্যায়নের অভাবের আলাপ, তা আমি এখানেই করতে চাই। আপনি অধিকারবঞ্চিত। কারণ আমাদের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর প্রায় সবাই (দুএকটা ব্যাতিক্রম বাদে) খাইঞ্চোদ। মানে তারা কেবল খেতে চায়। আপনাকে ফিরিয়ে দিতে নারাজ।

২। অমুক ফিল্ডে কাজ করার ইচ্ছে, ভাই।
রাইট রিজন, যদিও দিনশেষে দেখা যেতে পারে আপনি ভিন্ন এক ফিল্ডে কাজ করছেন, তবে ইনিশিয়ালি আপনার সিদ্ধান্তের পেছনে কার্যকারণটা যোগ্য। পছন্দের ফিল্ডে কাজ করার সুযোগ সব সময় নাও পেতে পারেন, কারণ আমাদের হৃদয় অনেক কিছুই চায়। তবে হৃদয়ের চাওয়ার সাথে বাস্তবে সে প্রসঙ্গে কাজ হতে হবে, ফান্ড থাকতে হবে, এবং আপনাকে যেখানে যেখানে ফান্ড আছে সেখানেই গিয়ে ঢুকতে হবে। আর কোথাও ঢুকলে হয়তো কাছাকাছি কিছু নিয়ে কাজ করতে পারবেন, তবে ও নিয়ে নয়।

৩। শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম, দেশে কেবল ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ডকে শিক্ষক হিসেবে নেয়। আর কোনও যোগ্যতা দেখে না।
যথাযথ কারণ! উচ্চশিক্ষা আপনার জন্য, আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য। এই প্রেম অমর। হয়তো আন্ডারগ্র্যাডে আপনার ডিপার্টমেন্টে ১৬ তম ছিলেন। একাডেমিয়াতে থাকার ইচ্ছে ছিলো, তবে এই পোড়া দেশে কেবল ১,২,৩ কেই শিক্ষক হিসেবে নেবে। আপনাকে নেবে না। তাই উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষকতায় ঢোকাই আপনার একমাত্র পথ।

৪। টেকা ভাই। টেকাই জীবনের সবকিছু। দেশের থেকে বিদেশে টেকা বেশি।
এটাও রাইট রিজন, অনেকের চোখে তা না হলেও। কারণ আপনি যদিও বলছেন টাকার কথা, তবে সেটা কেবল মোটিভেশন। টাকার মোটিভেশনেও যদি আরো পড়াশোনা করে নিজেকে জ্ঞানপাহাড়ের শীর্ষে নিতে চান, তাতে ক্ষতির কিছু দেখি না। টাকার জন্য আপনি তো আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের নতুন ত্রাস হচ্ছেন না। অর্থাৎ মোটিভেশন টাকা হলেই খারাপ তা নয়, কারণ আপনার উদ্দেশ্য নিজের বিষয়ে আরো জানা-ই। টাকার জন্য হোক আর গ্লোরির জন্য হোক।

৫। মাস্টার্স/পিএইচডিটা নর্থ আমেরিকা থেকে হলে দেশে ও বিদেশে কর্মক্ষেত্রে বেশি মুল্যায়িত হবো।
ভালো কারণ, ক্যারিয়ারের জন্য তথা ইন্ডাস্ট্রিতে উচ্চশিক্ষার, উচ্চশিক্ষিত লোকের দরকার আছে।

৬। অমুকে আমেরিকায়/ইউরোপে মাস্টার্স পিএইচডি করতেছে, আমিও করুম।
ভুল কারণ। এখানে আপনার নিজস্ব মোটিভেশন কোথায়? জেলাসি? যথেষ্ট নয়। লোকের দেখাদেখি কিছু করতে যাবেন না। বরং এতে করে কাক আর খঞ্জনা পাখির মতো কিছু হয়ে যেতে পারে। শোনেননি? শোনাচ্ছি।
খঞ্জনা পাখি দারুণ নাচতে জানতো। তাকে দূর থেকে কাক দেখে। পিপিং টম কিংবা এক প্রোফেশনাল পার্ভার্টের মতো পর্দার ফাঁকে ফোকড়ে উঁকি দেয়। একদিন খঞ্জনা বিষয়টা দেখে ডাকলো, “অ্যাই কাক! ওখানে কী? ইদিক আয়! এক্ষুণি আয় বলচি!”
বেচারা কাক মাথা নিচু করে হেঁটে এলো। স্বীকার করলো, “যা নাচো দিদি। একটু যদি শেখাতে।”
খঞ্জনা বললো, “ভেবে বলছিস? হাঁটিস তো দারুণ। গেল বছর হাঁটার ওপর ‘অল বার্ডস ওয়াক, বাট সাম আর প্রো’স’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিস। তোর আবার নাচ শেখার দরকার কী?”
কাক জানালো, “তোমাকে নাচতে দেখে আমার মনে হয়, ইশ আমিও যদি পারতাম।”
“হুঁ। আচ্ছা, আয়, তোকে শিখিয়ে দেই। তবে লোকের বেডরুমে আর উঁকি মারিসনে যেন।”
পরবর্তী তিন ঘণ্টায় কাকের ওপর দিয়ে চললো সাঁড়াশি ট্রেনিং। তিন ঘণ্টা পর সে হয়ে গেলো পেশাদার নর্তক। খঞ্জনার সাথে তাল, লয়, ছন্দ, সবই মিলে যাচ্ছে এখন। সে কী নাচ!
মনে আনন্দ নিয়ে কাক নিজের ডেরায় ফিরে এলো সে রাতে। ঘুমটা হলো ফাটাফাটি। কিন্তু পরদিন উঠতেই –
ঘুম থেকে উঠে কাক বুঝতে পারলো কিছু একটা ঠিক নেই। গতকালের নাচটা সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। উঁহু। একটা মুদ্রাও নয়। এবং বিষয়টা বোঝার সাথে সাথেই গড়িয়ে পড়ে গেলো সে।
কাক তার নিজস্বতা, অর্থাৎ হাঁটাও যে ভুলে গেছে! হাঁটতে কীভাবে হয়? সে কিছুতেই মনে করতে পারলো না। কোনমতে লাফাতে লাফাতে চলে এলো খঞ্জনার বাড়িতে।
তাকে দেখেই একগাল হাসলো খঞ্জনা। বললো, “কী? নাচও ভুলেছিস, হাঁটাও ভুলেছিস? আগেই নিষেধ করেছিলাম।”
কাক বললো, “দিদি, হাঁটার ক্ষমতাটা অন্তত ফিরিয়ে দাও। আর কোনদিন তোমার লেজের দিকে তাকাবো না। বোনের মতো দেখবো আজ থেকে।”
খঞ্জনার হাসি আরেকটু চওড়া হলো কেবল, “আমি তো আর ডাইনি নই যে তোর ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছি। নিজের সর্বনাশ তুই নিজেই ডেকেছিস। ভালো হাঁটতে পারতি, সেই হাঁটাকে শানিয়ে না নিয়ে আমার দেখাদেখি নাচে এসেছিস। এই সর্বনাশের দায় আমাকে দিস নে। আর হ্যাঁ, কার্মা বলেও তো একটা কিছু আছে। লোকের বেডরুমে তাকিয়ে থাকবি তো…”
সেই থেকে কাক একমাত্র পাখি যে হাঁটতে পারে না। খেয়াল করলে দেখবেন কাক সব সময় লাফিয়ে চলে। সে লাফাতে পারে। দাঁড়াতে পারে। আর পারে উড়তে। তবে হাঁটতে পারে না। শালিক দোয়েল সুন্দর হাঁটে। কাক পারে না।
এটা অনেক প্রচলিত একটা গল্প। অনেকেই হয়তো আগেই জেনেছেন। ঈশপের গল্পের মতো বাংলার এইসব গল্পে আসলে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, আপনার স্ট্রং স্যুট খুঁজে বের করুন। অন্যের স্ট্রং স্যুট দেখে তার দিকে দৌড়াবেন না। নিজেকে অ্যানালাইসিস করুন।
আপনি হয়তো অমুকে চ্যাম্পিয়ন, অথচ তমুক করতে দেখলেন কাউকে, আর সেদিকে লেগে পড়লেন, তাহলে কিন্তু হবে না। উচ্চশিক্ষায় আসার জন্য সঠিক মাইন্ডসেট থাকা জরুরী, সঠিক মাইন্ডসেট থাকাই একমাত্র যোগ্যতা। আপনার বিএসসির সার্টিফিকেট কিংবা রেজাল্ট শিট নয়। আপনাকে কে কেমন ছাত্র হিসেবে জানে তাও নয়। সঠিক কারণে যিনি উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ রাখেন, তাদের সবারই এই লাইনে আসা উচিত। ভুল কারণে যারা এমনটা চাইছেন, তাদের জন্য এই রাস্তা নয়। তার কারণ উচ্চশিক্ষার কঠিন দিক আছে বেশ কিছু। নিচে তাদের নিয়ে হাল্কা আলাপ করার চেষ্টা আমি করবো।

• যাত্রাটা কিছুটা নিঃসঙ্গ। চারপাশে লাখো লোক থাকার পরও, তাদের অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যাবার পরও – নিঃসঙ্গ, আন্ডারগ্র্যাড কিংবা দেশের মাস্টার্সের মতো নয়। সঠিক মোটিভেশন না থাকলে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তা ক্ষতির হবে, এবং এর প্রভাব আপনার রেজাল্টে পড়তে পারে।
• অনেকেই জীবনযাত্রার মান নিয়ে অত্যাধিক খুঁতখুতে। সঠিক সময়ে ঘুমানো, ওঠা, খাবারের স্বাদ নিয়ে উনিশ-বিশ হলেই খেতে না পারা, বিশ টাকার রিকশাভাড়া দূরত্বে হাঁটতে না চাওয়া, কাপড় কাচার দায়িত্ব নিজের না নিতে চাওয়া – ধরণের নানা রকম লাক্সারি দেখানোর ইতিহাস আমাদের দেশে বড় হওয়া শিশুদের থাকে। ননীর পুতুলদের জন্য উচ্চশিক্ষাটি ঠিক সঠিক রাস্তা নাও হতে পারে। আপনার লাইফস্টাইল এখানে পুরোপুরি ত্যাগ করতে হবে। সেটি করতে গিয়ে যদি আপনার মনে হয় এই জীবন আপনাকে হতাশ করছে, সেটা আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ এবং তার প্রভাব রেজাল্টে এসে পড়তে পারে। (উল্লেখ্য, আমার পশুবত জীবনযাপন আর তেলাপোকার মতো সর্বভূক স্বভাব আমাকে এখানে বিশাল প্লাস পয়েন্ট দিয়েছিলো। সার্ভাইভ করতে পারলেই আমার কাছে মোর দ্যান এনাফ, অতীত ইতিহাস আমাকে এই পরিণতবোধটা দিয়েছে। অনেককে তা দেয়নি। তারা খাবার, কালচার, পরিশ্রম নিয়ে যাতনায় থাকেন। একে বলা হয় কালচার শক এবং এটি রিয়েল। এ থেকে রক্ষার জন্য নানারকম কাউন্সেলের ব্যবস্থাও আছে। তবে আপনি যদি ভুল কারণে, যেমন কেবল শো-অফের জন্য উচ্চশিক্ষায় আসেন, তাহলে সেসব কাউন্সেলও আপনাকে রক্ষা করতে পারবে কি না আমার সন্দেহ আছে।)
• ইনসিকিউরিটি। হতে পারে আপনি বুয়েটে ৭ম ছিলেন। এখানে ফুল ফান্ড পেয়েছেন। তার অর্থ এই নয় যে এখানে আপনি সিকিউরিটি পাচ্ছেন আজীবনের। অ্যাট সাম পয়েন্ট অফ অ্যানি গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টস, তাদের মনে হয় যে “গেলুম, এবার বোধহয় যা লক্ষ্য নিয়ে এসেছি তা পূরণ না করেই দেশে ফিরতে হবে” – এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সবাই ওভারকাম করেন। এই বিপদের গন্ধ, এই চ্যালেঞ্জ তাদের আরো অনেক শক্ত করে তোলে মানসিকভাবে। তবে আপনি যদি ভুল কারণে আসেন, তাহলে আপনাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে এমন অনুভূতি। প্রতিটি দিন একভাবে যাবে না। প্রচণ্ড পরাজয়ের অনুভূতি, গ্লানি নিয়ে কোন কোন রাতে ঘুমাতে যাবেন আপনি। কেবলমাত্র সঠিক কারণে এখানে আসাই আপনাকে পরদিন সকালে নতুন এক মানুষের মতো উজ্জিবীত করে তুলবে। আপনি নাকের পাটা ফুলিয়ে বলবেন, “আয় শালা, কতো আসবি চ্যালেঞ্জ। আমি রেডি।” ভুল কারণে এলে পালটা ফাইট না করে দিন দিন আরো তলিয়ে যেতে পারেন।
আরো অনেক আলোচনা এই বিষয়ে আছে। তবে তাদের হয়তো ওয়েবসাইটে চূড়ান্ত পোস্ট করার সময় উল্লেখ করবো। মূল কথা হচ্ছে, আমাদের কার্যকারণের পেছনের কারণটাকে right reason এ হওয়া খুবই জরুরী। রাইট রিজনে একজন ডক্টরের ওয়ালটনে মেকানিক হিসেবে যোগ দেয়াও উচিত কাজ। রং রিজনে একজন বিএসসির টেসলার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেওয়া ভুল কাজ। আধ্যাত্মিক এই আলাপ আসলে আধ্যাত্মিক নয়, বাস্তব। কীভাবে বাস্তব তা হয় আপনি এই লেখা থেকে জানবেন, নয়তো জীবনে মারা খেতে খেতে শিখবেন। তবে আমি শুভাকাঙ্খী হিসেবে এই দিকটি কেবল মনে করিয়ে দিতে চাই।
অধ্যায়ের শুরুতে আমি বলেছি আমার আন্ডারগ্র্যাডের ছাত্র ক্যামেরন জানতো তার কোনও রাইট রিজন নেই উচ্চশিক্ষার, তাই সে তা করবে না। আবার এখানকারই নাগরিক, বন্ধু রিজুল উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, কারণ তার ক্যারিয়ারের জন্য দরকার (রাইট রিজন)। তাদের মতো সেন্সিবল আপনাদেরও হতে হবে। নিজেকে জানতে হবে। সাফল্য আনতে হবে।
সপ্তম অধ্যায়ে কেন এই বিষয়ে আলাপ করছি? এমন আলাপ তো লেখার শুরুতেই করা উচিত ছিলো, তাই না? আমার তা মনে হয় না। আমি মনে করি সবটা রাস্তা মোটামুটি জেনে আপনি যদি এই কথাগুলো পড়েন, তখন আপনার হাতে pros and cons অ্যানালাইসিসের জায়গাটি থাকবে। নইলে শুরুতেই বিরক্ত হবেন, নয়তো পিছিয়ে যাবেন অবচেতনে (মনে মনে যদিও বলছেন “এইসব কেপি ইমন আর কী বাল জানে, দেখায়া দিবো এইসব আমার কাছে কিছু নয়” তবে অবচেতনের গল্পটা আলাদা।) যা আমি চাইনি।

নির্দেশনা –
উচ্চশিক্ষা করতে দেশের মেধাবীরা আসুক তা আমি চাই। তবে আমি এটা আরো বেশি করে চাই যে তারা আসুক ‘কেন আসতে চাই?’ প্রশ্নটির উত্তর সঠিকভাবে জেনে। সৌল সার্চিংয়ের সময় হয়েছে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি ঠিক কেন আসতে চান? সেই কারণটা কী যথাযোগ্য? নাকি নয়?

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৮ – আমার প্রোফাইল

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৬ – এই পথ যদি না শেষ হয়

এমন একটি গান ছিল বটে, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?
কিছু পথ এমন আছে বটে। যেমন কিছু রোড ট্রিপে বের হলে আপনার মনে হবে এই পথ আর শেষ না হোক। চলতে থাকুক। ভালোই তো লাগছে। (যতক্ষণ না আপনাকে ড্রাইভ করতে হচ্ছে)। তবে সব পথ এমন নয় মোটেও। যেমন হায়ার স্টাডির অ্যাপ্লিকেশন এবং তার আনুষঙ্গিক আর যতোসব বিপদের কাজ।
তবে সবকিছুর শুরু থাকলেই, শেষও থাকবে। এরও আছে। আমরা এই পুরো জার্নিটিকে দেখবো একটা বাস্তব জীবনের ভ্রমণের মতোই। এমন হয়েছে না, যে আপনার অনেক সখের এক ট্যুরে গিয়ে দেখলেন অতি প্রয়োজনীয় অথচ খুবই পরিচিত কিছু জিনিস সঙ্গে আনতে ভুলে গেছেন। যেমন ধরুন – টুথব্রাশ। কারণ এটা এতই “অবভিয়াস” ছিল যে আপনি ভাবেন-ই নি একে প্যাক করার কথা। এটা হওয়া খুব-ই স্বাভাবিক। সচরাচর আমরা যে সব জিনিস ভুল করে নিয়ে যাই না, কিংবা হারিয়ে আসি, তারা হয়ে থাকে এমন-ই কিছু জিনিস। ঠিক একই ঘটনা আপনার সাথে ঘটতে পারে হায়ার স্টাডির যাত্রাতেও। এজন্যই এ নিয়ে আলাদা করে আলাপ করে রাখা হলে তা পরে আপনাকে হেল্প করতে পারবে। শেষ না হওয়ার মতো দীর্ঘ পথটিকেও হয়তো প্রায় বাঁধাবিঘ্ন ছাড়াই পার করে দিতে পারবেন।

এ তো “অবভিয়াস”
প্রথমেই আমরা আলোচনা করে নেবো অবভিয়াস সব জিনিসের ব্যাপারে। দেখে নিন এরা সবাই ঠিক আছে কি না।
১। পাসপোর্ট ও তার মেয়াদ : আপনার পাসপোর্ট কি ইস্যুড? তার মেয়াদ আছে তো, অন্তত ছয় মাস? দেখে নিন।
২। তারপর আছে আপনার একেবারেই “এও কী বলা লাগে?” ধরণের ডকুমেণ্টস – যেমন আপনার এসএসসির সার্টিফিকেটস, এইচএসসির সার্টিফিকেট, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডকুমেন্টস, বার্থ সার্টিফিকেট, ইত্যাদি। কখন কোনটা দরকার হবে কেউ বলতে পারবে না। এটা মেনশন করার কারণ হচ্ছে, আমার বাবা-মায়ের নাম তাদের এনআইডিতে যা আছে তা থেকে আমার সার্টিফিকেটসে একটু আলাদা ছিল। এসব ঠিক করতে আমার প্রায় ৬ মাস গেছে।
৩। আরও কিছু অবভিয়াস আছে। যেগুলো এতো সহজে মানুষ ভুলে যেতে পারে যে আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। মনে পড়া মাত্র এদের এখানে যোগ করে দেয়া হবে। (যখন ফাইনাল প্রোডাক্ট যোগ করতে পারবো ওয়েবসাইটে)

এবার অবভিয়াসদের মধ্যে আলোচনা করার চেষ্টা করবো আরেকটা জিনিস নিয়ে। অনেক সিনিয়র, বুড়ো লোকজনই এই অংশটি এড়িয়ে যেতে পারেন, কারণ তাদের কাছে এটা এটি অবভিয়াস যে মেনশন করার দরকার অনুভব করবেন না, তাই আমি একি ভুল করার আগেই গোড়া থেকে শুরু করার চেষ্টা করবো।

অ্যাপ্লিকেশন প্রসেস
১। অ্যাপ্লিকেশন করার সময় সবাই আপনাদের বলতে পারে যেন প্রফেসরদের ইমেইল করতে থাকেন, অথচ সেটি অফিশিয়াল অ্যাপ্লিকেশনের ধাপ হিসেবে প্রথম নয়। প্রথম ধাপটি হচ্ছে আপনাকে একটি পৃষ্ঠায় যেতে হবে (application page), যার মাধ্যমে আপনি নিজেকে নিবন্ধিত করতে পারবেন তাদের ওয়েবসাইটে, একজন নতুন অ্যাপ্লাই করা জনতা হিসেবে। এমন একটি স্ক্রিনশট আমি এই পোস্টের সাথে দিয়ে দিবো, যদি না হতচ্ছাড়া লোকেরা আমার ওয়েবসাইটটিকে বাকিদের জন্য বিপদজনক বানিয়ে না রাখতো, আমি এখানেই ওটা দিতাম। তবে মূল আলোচনা অনেকেই শুরু করেন কীভাবে আপনি আপনার পছন্দের ইউনিভার্সিটি পাবেন তার ওপর ভিত্তি করে। আমি তা করতে চাই না। বরং আমি বলবো যা যা অত্যন্ত অবভিয়াস আর সেজন্য বাকিরা সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন।
২। আমার মতো অনেক নতুন অ্যাপ্লিক্যান্টই জানেন না যে, আপনাকে প্রফেসর ইমেইল করার থেকেও ঝামেলার কাজ করতে হবে। আর তা হলো তাদের অ্যাপ্লিকেশন পোর্টালের সাথে নিজেকে আপডেট করা। এটা বরং আপনার জন্য বেশি দরকারি। কারণ আপনি কোনও এক ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লিকেশন পোর্টালে না থাকলে বা সময়মত সবকিছু জমা দিতে না পারলে আপনার জন্য কেউ কিছু করতে পারবে না। এবং এই কাজটি ঝামেলার কারণ এই কাজটি বেশ দীর্ঘ কিছু ফর্ম পার করে আসার। অনেকগুলো তথ্য আপনাকে দিতে হবে। যদি একাধিক ইউনিভারসিটিতে অ্যাপ্লাই করেন (যা আপনাদের প্রায় সবাই করবেন) তখন এটা লিটারেলি একটি “পেইন ইন দ্য অ্যাস” হবে।
৩। এই ধরণের আলোচনা আমরা আগেও করেছি, তবে এটা জরুরি বলেই বার বার বলতে হচ্ছে। অ্যাপিকেশন প্রসেস আসলে নিচের কিছু ধাপের মতো। ধরে নিচ্ছি, এমন কারো সাথে আমার আলাপ হচ্ছে যার ন্যুনতম আইডিয়াও নেই কীভাবে কী করতে হবে।
সংক্ষেপে ধাপসমূহ
১) বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকা (অ্যাডমিশন পাওয়া)
২) টাকাপয়সার ব্যাপারটা সর্ট করা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে নেবার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। তবে আমেরিকায় পড়াশোনার খরচ অতি-উচ্চ। যে কারণে আমেরিকান নাগরিকরাও এই পথে পা বাড়াবার সাহস করতে চায় না। সেই টাকা-পয়সার বিষয়টা সর্ট-আউট করার জন্যই আপনার দরকার প্রফেসর কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড। প্রায় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ই ফুল-ফ্রি স্কলারশিপ দিয়ে থাকে, তবে তা অতিমাত্রায় কম্পিটিটিভ। দারুণ প্রোফাইল থাকার পর তা না পেতে পারেন। তবে যদি আপনার ফ্যান্টাস্টিক প্রোফাইল থাকে, তবে চেষ্টা করতে পারেন। পেলে তো খুব-ই ভালো, আপনাকে অনেক আলবাল নিয়ে ভাবতে হবে না, একাডেমিকভাবে দারুণ কিছু করবেন তা গ্যারান্টিড; আর না পেলে, তা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। ফান্ডিংয়ের ব্যাপারটা অনেক দিক থেকেই আসতে পারে। যেমন তা আপনাকে পাইয়ে দিতে পারে স্কলারশিপ, তেমন-ই তা আসতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ড থেকে – যেটি তারা সেন্ট্রাল অ্যাডমিশনের সাথেই আপনাকে অফার করবে। আর তাছাড়া থাকতে পারে প্রফেসরদের গ্র্যান্ট, তারা নানা দিক থেকে নানা কাজ বাগিয়ে রাখেন সচরাচর এবং আপনি যদি তাদের হয়ে তাদের রিসার্চে সহযোগিতা করেন, তবে সম্ভাবনা আছে আপনাকে ওরা তা থেকে কিছুটা দেবে, যা আমাদের মতো ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট থেকে আসা ‘কিড’দের জন্য যথেষ্ট, বা যথেষ্ট না হলেও সার্ভাইভ করার মতো। এবং একারণেই একটি পপুলার মিথ হচ্ছে “প্রফেসরদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং এটি-ই একমাত্র পথ” – আসলে এটি পথদের মধ্যে একটি, তবে সবচেয়ে সহজে (যদি আদতে তা অতোটা সহজ নয়, প্রয়োজন পড়বে এক্সটেনসিভ রিসার্চের, এই রিসার্চ প্রফেসরদের তালিকা বানাবার এবং তাদের পটাবার) পাওয়ার মতো কিছু।
৩) আপনার “পাছাটা” – যেমনরা আমেরিকানরা বলে থাকে – বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া; কোভিডের সময় যা খুব ‘ইজি বিজনেস’ নয়।
ধাপসমূহ – আরেকটু বিস্তারিতভাবে বললে –
(১) পাসপোর্টের জন্য অ্যাপ্লাই করা
(২) GRE এবং TOEFL দেয়া
(৩) ইউনিভার্সিটি নিয়ে নিজস্ব রিসার্চ করা – এক্ষেত্রে আপনাকে সহায়তা করতে পারে ফেসবুকের কিছু গ্রুপ, সিনিয়র ভাই-ব্রাদার, ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট
(৪) প্রফেসরদের ইমেইল করা, যেন কেউ একজন আপনাকে তাদের ল্যাব/রিসার্চের জন্য মনোনয়ন করতে পারেন আর তাদের দেয়া ফান্ডিং দিয়ে আপনারা আপনাদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে পারেন।
(৫) ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ঢোকা এবং – University web > Apply > Graduate Study
(৬) অ্যাডমিশন কমিটি আপনার অ্যাপ্লিকেশন পড়ে দেখবে, বাকি অ্যাপ্লিক্যান্টদেরও, তারপর তারা সিদ্ধান্ত জানাবে (অথবা জানাবে না, অনেকসময় তারা চুপ করে বসে থাকে আপনাকে বাদ দিয়ে, কাজেই যদি ৬ সপ্তাহের মধ্যে কোনও রেসপন্স না পেয়ে থাকেন, ধরে নিতে পারেন আপনাকে তারা নিচ্ছে না); এমনটা ঘটবে অ্যাপ্লিকেশন ডেডলাইন শেষ হয়ে যাওয়ার পর কিছু সপ্তাহ পরে। সচরাচর ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে তারা একটি ফলাফল জানিয়ে থাকেন।
(৭) অ্যাডমিশন লেটার – যদি আপনাকে তারা তাদের ভার্সিটিতে নেবার উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে আপনার ইমেইলে আসবে একটি অ্যাডমিশন লেটার।
(৮) ভিসা প্রসেসিং –
ভুলে ভাববেন না এবার আপনার যাত্রা শেষ। অ্যাডমিশন লেটার নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করতে পারেন, তবে তা দু’মিনিটের বেশি হলে সমস্যা। সামনে এখনো বহু রাস্তা পড়ে আছে; বিশেষ করে আপনি যদি কোভিড সময়ের একজন যাত্রী হয়ে থাকেন!
এরপরের ধাপগুলো নিম্নরূপ –
✍ ৮ (ক) I-20 request করা; I-20 কী জিনিস তা নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারটি আলাপ করা হবে, তবে এটা আপনার পাসপোর্ট থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ – আপাতত এটাই মনে রাখতে পারেন
✍ ৮ (খ) ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া
✍ ৮ (গ) ভিসা অফিসারকে পটানো
✍ ৮ (ঘ) ভিসা পেয়ে গেলে প্লেনের টিকেট করা
✍ ৮ (ঙ) উদ্বাহু নৃত্য করা – এবার আপনি এলিজিবল; তবে একটি ঝামেলা সেখানেও আসতে পারে, কোভিডের কারণে যে কোনও সময় আপনার এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের সকল ফ্লাইট বাতিল করে দিতে পারে। আমার ক্ষেত্রে তা হয়েছিলো। পরবর্তীতে আরেকটি এয়ারলাইন্সে টিকেট কেটে আসতে হয়েছে। আপনাদের ভয় দেখাবার জন্য বলছি না, তবে এটাই বাস্তবতা, যে কারণে অনেক মানুষকে আমি এমনকি জানাতে পারিনি যে এ বছর আমি হায়ার স্টাডির জন্য দেশ ছাড়ছি।

নির্দেশনা –
পথটা সম্পুর্ণ জানুন। ওপরে যা বললাম তা মোটামুটি এই অংশটাকে কাভার করে, তবে অবশ্যই বিস্তারিতভাবে নয়। আগামী অধ্যায়গুলোতে বিস্তারটি লেখা হবে। এখানে যে তালিকাটি দেয়া হয়েছে তা ভালোমতো বোঝার চেষ্টা করুন, এটি একটি পাথওয়ে।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৭ – উচ্চশিক্ষা কাদের দরকার

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৫ – হোঁচট খাওয়ার মানেই, হেরে যাওয়া নয়

বাজে ছাত্র আমি, এই হতাশা থেকে একবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। চারতলার ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে।
ক্লাস নাইনে পড়ি। ফিজিক্সে ফেল করলাম। আমার পরিবার তখন ঢাকায় মুভ করেছে দুবছর হলো। বাবার চাকরির উদ্দেশ্যে নয়, আমাদের পড়াশোনার জন্য। সবাই কম বেশি স্ট্রাগল করছে। লক্ষ্য একটাই, আমাদের জীবনে যেন আসে সফলতা। আর এদিকে আমি কী না মেরে বসলাম ফেল! টিনেজ বয়স, মাথা গরম। মনে হলো পরিবারকে ব্যর্থ করে দিয়েছি। স্কুলের রেজাল্ট আসার আগেই ফেল যে মেরেছি তা জেনে ফেললাম। বিসিআইসি স্কুলে আমাদের পদার্থবিজ্ঞান তখন পড়াতেন ফারুক স্যার। আমি তার কাছে প্রাইভেট পড়তাম না। তবে যারা পড়তো তারা ৫০ এ আমার ৮ পাওয়ার খবরটি নিয়ে এলো (মোট ৪৪ পেয়েছিলাম, তবে সব অংশে আলাদা করে পাশ করতে হবে। এটাই নিয়ম)। আমার একমাত্র প্রাইভেট তখন ম্যাথ, আযম স্যারের দরকারে। আমাকে ফেল করার খবরটি বন্ধুরা সেখানেই দিলো। তারপর সেদিন আমরা চারতলা বিল্ডিংটির ছাদে উঠেছিলাম। রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ালাম। নিচের দিকে তাকিয়ে মাটিকে বড় আপন মনে হলো। আমার মনে হচ্ছিলো, সঙ্গে আর কেউ না থাকলে আমি নির্ঘাত এখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তাম নিচে। ভবলীলা সাঙ্গ হতো।
আমেরিকায় মুভ করার পর স্যান মার্কোসে নতুন বাসায় উঠেছি। চারটি বেডরুম, প্রত্যেকের সাথে অ্যাটাচড বাথ। মাঝে সুবিশাল লিভিং রুম। সামনের ব্যালকনি থেকে পাওয়া যায় পুলের ভিউ। বেহেশতি পরিবেশ। চারতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালাম। কী আশ্চর্য! অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যটি নয় – আমার মাথার ভেতর দোলা দিয়ে গেলো ১২ বছর আগের কিছু স্মৃতি। ঠিক এই উচ্চতায় দাঁড়িয়েই আমার মনে হয়েছিলো ঝাঁপ দেয়া উচিত। আমি আমার পরিবারকে ফেইল করেছি। বাজেভাবে ফেইল করেছি! অথচ, আজ?
আজ আমার মন কানায় কানায় পরিপূর্ণ সফলতার স্পর্শে, কারণ আমি সঠিক দিকটিতেই এগুচ্ছি, যে যা-ই বলুক না কেন। চার বছরের পড়াশোনা আর তারপর নিরলস দক্ষতা-অর্জনের পর আমেরিকান এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাকে এখানে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে, সেই সাথে দিয়েছে চাকরি। চারতলার রেলিঙয়ে দাঁড়িয়ে লাফ দেবার বদলে আমি খুঁজে পাচ্ছি জীবনে এগিয়ে যাবার শক্তি! বিড়বিড় করে বললাম, “আই মেড ইট।”
গত বারোটি বছরে আমার সাথে যা যা হয়েছে তা বাংলাদেশে জন্মানো ও বড় হওয়া অনেক ছেলেমেয়ের সাথেই হয়নি। জীবনে কেবল পড়াশোনা, সংসার, পিচ্চি-উৎপাদন, ও মৃত্যু থাকবে – এমনটা আমি মেনে নিতে পারিনি। ফিজিক্সে ফেল করে আসা ছেলেটা বুয়েটের ওয়েটিং লিস্টে টিকলো, অগত্যা পড়তে শুরু করলো রুয়েটে। আট বছর আগে লেখালেখিটাকে সিরিয়াসলি নিলাম। লোকে বলে, গল্প আমি ভালোই লিখি। আন্ডারগ্র্যাডের চার বছর লেখালেখির পেছনে ভয়ানক পরিশ্রম করেছি, বিএসসিটা পাশ করে যখন বেরুচ্ছি – ১০টি বই প্রকাশিত হয়ে গেছে আমার। ফেল করিনি কোথাও, কোন কোর্সে। ভালো পারতাম ক্যাড ডিজাইন, আগ্রহ ছিল ইঞ্জিনে। হাড়ভাঙা এক প্রজেক্ট করার চেষ্টা করেছিলাম আন্ডারগ্র্যাডে, যেটা আমার মনমতো করতে পারিনি পয়সার অভাবে। এরপর একটি ফার্মের হয়ে সাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কিছুদিন কাজ করলাম পার্টেক্স পেট্রো লিমিটেডের এক প্রজেক্টে। তবে আমাদের প্রাইভেট ফার্মটি খুব একটা ওয়ার্ক রেগুলেশন মানতো না। অধিকার-সচেতন, বিদ্রোহী আমি ছেড়ে দিলাম ওটা।
তারপর প্রকৌশলবিদ্যা একেবারেই সরিয়ে রেখে ঢুকে পড়লাম হেলথকেয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে। ৪ মাস কড়া বায়োলজি পড়ানো হলো। পাশ করতে হলো ৯০% নম্বর নিয়ে। মানবদেহ নিয়ে দারুণ জ্ঞান নিয়ে শুরু করলাম মেডিকেল স্ক্রাইবের চাকরি। টাইপিং স্পিড ছিল ৬৭ শব্দ প্রতি মিনিট – সেখান থেকে উন্নীত হলো ৯০-১১০ শব্দ প্রতি মিনিটে। এরপর খেলাম নিদারুণ ছ্যাঁকা। একেবারে পাশা উল্টে গেলো। তারপর সোশাল মিডিয়াতে আমার একান্ত নিজস্ব মতামত অনেক উগ্রবাদী সংগঠনের পছন্দ হলো না। তারা আমাকে মেরে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লাগলো। দু’বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো আমাদের চৌকস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারণে।
ওরকম একটা সময়ে যদি আপনি আমার জীবনের দিকে তাকাতেন, হয়তো বলতেন, “তুমি তোমার জীবন নিয়ে আসলে কী করছ?”
কেউ কেউ বলেছিলো।
আমি বলেছিলাম, “যাপন করছি। শিখছি, যা শিখতে ভালো লাগে। বলছি, যা বলতে ভালো লাগে। বাংলাদেশে ক’জনের সে সৌভাগ্য হয়?”
সৌভাগ্যের ব্যাপার আসলে নয়, এটা আদায় করে নেবার ব্যাপার। আসল কোথায় আসি। বাংলাদেশে বড় হতে থাকা একটি ছেলে বা মেয়ের জন্য তার পছন্দের সাবজেক্ট পড়া কঠিন বিষয়। আপনার বাবা-মা হয়তো চাবেন আপনি দারুণ অঙ্ক শিখবেন, ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিংবা ডাক্তার। সমাজের পছন্দে প্রেম করতে হবে, সমাজেরই পছন্দে বিয়ে। চাকরিটাও করতে হবে সমাজের দিকে তাকিয়ে। আপনার যদি দমকলকর্মী হওয়ার সখ ছেলেবেলা থেকে থাকে, হতে পারবেন না। মানুষ হাসবে পিছে। বলবে, “ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে দমকল হয়েছে।”
মানে, তাদের সখটি দেখুন। আমার মস্তিষ্কের ওপরও যেন তাদের একচেটিয়া অধিকার। লে বাবা। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আইকিউ যে ভদ্রলোকের ছিল, ধারণা করা হয় – আইনস্টাইনের থেকে স্মার্ট তিনি; একাডেমিক ও নন-একাডেমিক সবকাজেই শাইন করছিলেন তিনি। শিক্ষকদের থেকে বেশি জানতেন, “স্লো পড়াশোনা”র ওপর বিরক্ত হয়ে সেলফ-স্টাডির কারণে। তাঁকে নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি কেবল শুরু হয়েছিলো। অথচ ত্রিশ পার করেই ছেড়ে দিলেন সবকিছু। অনেকদিন পর এক বইয়ের দোকানে তাকে একজন চিনে ফেলে। জানতে চায়, “আপনার ঐ সুপার জিনিয়াস মাথাটা দিয়ে ইদানীং কী করছেন?”
তিনি তাকে জানিয়েছিলেন, “দমকলবাহিনীতে যোগ দিয়েছি।”
অবাক হয়ে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করেছিলো, “কিন্তু আপনাকে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে চাইছে শুনেছিলাম।”
কাঁধ ঝাঁকিয়েছিলেন তিনি, যার অর্থ – বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাঁপিয়ে দিতে পারার মতো একটা মাথা থাকলেই যে তা করতে হবে এমন তো নয়। দমকলকর্মী হতে পারার মধ্যেও সার্থকতা আছে যদি কেউ তা-ই হতে চান।
আসল কথাটি এটাই। এমন নয় যে আমার এই যেমন-ইচ্ছে-বাঁচার-অধিকার তত্ত্ব খুব দুর্বল হৃদয়ের কেউ নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারবেন। না। আপনাকে সমাজ আঘাত করবে। বক্সের ভেতরের যে কোন মানুষ এবং সিস্টেম আঘাত করবে। পরিবারের দুশ্চিন্তা থাকবে। সমাজের ভ্রুকুটি থাকবে। জঙ্গিদের হুমকি থাকবে। মেয়েদের তাচ্ছিল্য থাকবে। যে কোন সময় কোন এক মাথা গরম উগ্রবাদীর কোপে মরে-টরেও যেতে পারেন। তবে এই প্রাইস আপনাকে পে করতে হবে। তবেই পাবেন স্বাধীন জীবন। যা চাইবেন জীবনে তা-ই পাবেন। আবার অপরদিকে, গৎবাঁধা নিয়মনীতিতে থাকলে পাবেন সেটাই যা আপনার দাদা পেয়েছিলো, কিংবা তারও দাদা। ইউ হ্যাভ টু ব্রেক ফ্রি।
এবং এই মূল্যগুলো চুকাতে হবে যখন, হোঁচট খাবেন। হোঁচট খেতে থাকবেন। তবে, যেমনটা চমক হাসান বলেছিলেন – “হোঁচট খাওয়ার মানেই, হেরে যাওয়া নয়।”
যিনি জীবনে ঝুঁকি নিতে চান না। খারাপ কোনও কিছু হবে এই ভয়ে একশ’টা কাজ করেন না, ব্যর্থ হবেন এই ভয়ে জীবনটিকে যাপনই করেন না, জাহান্নামে যাবেন এই আতঙ্কে এতোই তটস্থ থাকেন যে “ভুল” করতে চান না – নিজের মাথাটা খাটাতে চান না – কেবল তাই করেন যা তাকে বলে দেয়া হয়েছে, এ-প্লাস ছুটে যাবে এই ভয়ে ভালো গানের গলা থাকার পরও গাইতে সময় দিতে চান না, সিজিপিএ কমে যেতে পারে সেই আতঙ্কে দারুণ লেখার হাত থাকলেও লিখতে বসেন না – এইসব মানুষকে অনুসরণ করবেন না। এরা ঝুঁকি নিতে চায় না, সেইফ খেলতে চায়, আবার রিটার্নও চায়। মনে রাখবে, ঝুঁকি ছাড়া রিটার্ন আসে না। অনুসরণ করবেন সবটুকু বাজি ধরে যারা বাঁচতে চায়, সেই হিম্মত যাদের আছে, তাদের। কারণ দিনশেষে, এদের পায়ের কাছেই এসে ধরা দেবে দুনিয়া।
হোঁচট খাওয়ার ভয়ে পথটা হাঁটা বন্ধ করলেই আপনার জীবন শেষ। ৩,০০০ বছর আগের লাইফস্টাইল ফলো করতে চায় যারা, তাদের অনুসরণ করতে গেলেই আপনার জীবন সফলভাবে ৩,০০০ বছরের আগের মানুষদের মতো ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। শেষ কথা হচ্ছে, জীবন একটু যুদ্ধ, আর প্রতিটি জয় বা পরাজয় সেই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নয়। কেবল একেকটি লড়াইয়ের জয় বা পরাজয়। নেভার বি অ্যাফ্রেইড টু লুজ সাম ব্যাটলস, টু উইন দ্য ওয়ার।
মোটিভেশনাল স্পিচ লেখার দরকার অধ্যায় পাঁচে ছিল। এই লেখাটিকে আমি সতর্কভাবে সাজিয়েছি। আগের অধ্যায়েই পুরো প্রসেসটা নিয়ে ঝাপসাভাবে আলোচনা করেছি। নতুন কাউকে ঘাবড়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। তার ওপর আমি আরও যোগ করতে চাইছি, এই এতো ধাপ পার করেও অসংখ্য ব্যর্থতার জায়গা এখানে আছে।

ব্যর্থতার জায়গা ০১ : আপনি ৩০০ প্রফেসরকে ইমেইল করেছেন, একজনও রিপ্লাই দেননি। ৪/৫ জন জেনেরিক রিপ্লাই দিয়েছেন, যা রিপ্লাই না দেবার থেকে বাজে।
ব্যর্থতার জায়গা ০২ : ৩/৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করে ফেলেছেন। কেউ ডাকলো না। মনে হচ্ছে এসব করে লাভ নেই। আপনাকে দিয়ে হবে না হায়ার স্টাডি।
ব্যর্থতার জায়গা ০৩ : যেসব জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছেন তাদের একটি উত্তর দিয়েছে। বিনীতভাবে জানিয়েছে, আপনাকে তারা নেবে না। এমন ইমেইল পাওয়ার পর অনেকেরই মনে হয় “এসব বাল করে ৫০-৬০ ঘণ্টা হুদাই নষ্ট করলাম। বালের জীবন।”
এমন অবস্থা যদি আসে, হাল ছাড়া যাবে না। যা করছিলেন, তা করে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করতে থাকা, অ্যাপ্লাই করতে থাকা। মনে রাখতে হবে, যে সহে, সে রহে

(আমার ক্ষেত্রে ১০ টি আবেদনের জবাবে ৫ টি ইতিবাচক উত্তর এসেছিলো, ৫ টি নেতিবাচক। এদের মধ্যে দুটো আমি গ্রহণ করি। একটিতে ক্লাস শুরু করেছি। অপরটি আগামী সেমিস্টারের জন্য ডিফার করা, সেটি নিলে আগামী সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয় বদলে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, স্যান অ্যান্টনিও-তে পিএইচডি করতে চলে যাবো।)

 🇺🇸 নির্দেশনা 🇺🇸 
এই পথে নামলে আগে হোক আর পরে, আপনাকে কিছু সময় হোঁচট খেয়ে পার করতে হতে পারে। সেটি সবাইকেই খেতে হয়। এরপর লেগে থাকলো যে, সেই সুযোগ পায়। আর যে লেগে থাকলো না, সে বাদ পড়ে। হোঁচট খাওয়া সমস্যা নয়, বরং হোঁচট খেয়ে হাল ছেড়ে দেয়া সমস্যা। এটা খুব ক্যাজুয়ালি বলছি, তবে এই অধ্যায়টি, এই কথাগুলো সামগ্রিকভাবে পুরো লেখাটির থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এটার ওপর ভিত্তি করেই মানুষ আমেরিকা-ইংল্যান্ড যায় পড়াশোনা করতে, নয়তো যায় না। ট্রাস্ট মি অন্য দিস।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৬ – এই পথ যদি না শেষ হয়

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৪ – পথটা

টেক্সাসে প্রথম একলা বের হলাম। পুরো স্টেটটিই প্রাইভেট। অর্থাৎ সরকারি কিছু নেই। পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন সংখ্যা শূন্য। সবার-ই আছে গাড়ি, নইলে মারতে হচ্ছে উবার। যারা হোমলেস, অর্থাৎ দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন – তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে হাইওয়েতে, একটি আঙুল উঁচিয়ে – অবশ্যই সেটি মধ্যমা নয়, বৃদ্ধাঙ্গুলি; যেন কেউ তাদের লিফট দেয়।
পথটা সহজ নয়, নতুন কারো জন্য চট করে চিনে নেয়া তো প্রায় অসম্ভব। ভাইয়া প্রায় এক বছর হয়ে গেলো এখানে আছে, তবু তাকে গুগল ম্যাপস গাড়িতে সেট করে ড্রাইভ করতে হয়। সেই পথে আমি একা নেমে এলাম। আমার গাড়ি নেই, টেক্সাসে এসেছি মাত্র কয়েকদিন হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার প্রশ্নই আসে না যে ভাইয়ার কোন এক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বো। বাস-রুটগুলোও এমন যে তাদের দিয়ে রাউন্ড রক (যে শহরে আমি ছিলাম) থেকে স্যান মার্কোস (আরেকটি শহর) পর্যন্ত তা দিয়ে যাওয়া যায় না। প্রতিটা শহর থেকেই যাওয়া যায় টেক্সাসের ক্যাপিটাল অস্টিনে। তবে সকালের একটি বাসে করে যদি আপনি অস্টিনে চলে যান, সেখানে যখন পৌঁছাবেন তখন দেখবেন স্যান মার্কোজের সকালের সব বাস এরই মধ্যে ছেড়ে গেছে। বিকালে আরেকটি বাস আছে হয়তো। তবে বিকালদিকে স্যান মার্কোজ নিয়েই বা আমার কাজ কী? ওখানে তো আমার কাজ সকালে – যতক্ষণ আমার ইউনিভার্সিটির অফিস খোলা আছে ততক্ষণ। অগত্যা উবারে প্রায় ৫০ ডলার দিয়ে যেতে হলো অস্টিন, সেখান থেকে একটি প্রাইভেট বাস (গ্রেহাউন্ড) ধরে স্যান মার্কোস।
বাস পরিবহণ ব্যবস্থাগুলো নিয়ে কিছু আলাপ করা যায়। এটি বাংলাদেশের মতো কোনোভাবেই নয়। তাদের বাস ট্রান্সপোর্টেশনের মধ্যে হাল্কা আছে এয়ারপোর্টগুলোর ছাপ, তবে “way বদখত”! অর্থাৎ তারা আপনাকে ঠিকমতো একটি টিকেট দেবে, যেখানে লেখা আছে কোন কাউন্টার থেকে উঠবেন এবং কোন সময় আপনাকে বোর্ডিং করতে হবে। একই সাথে অনলাইনে টিকেট কাটলে সেটা অথবা তার ছবি আপনার বোর্ডিং পাস হিসেবে ব্যবহৃত হবে। লাইনে দাঁড়াবেন। বাস আসলে তার জন্য গেটের সামনে লাইন দিবেন। তারপর যথারীতি অপেক্ষা করবেন কখন ড্রাইভার মহাশয় এসে কাউন্টারের সামনে গিয়ে নিজের চেহারা দেখিয়ে আসেন। তারপর লাইন ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবেন। সেই সাথে অপেক্ষা করবেন ড্রাইভার মহাশয়ের অ্যাপ্রুভালের। আনলাইক প্লেনস, যে কোন বাসে সর্বেসর্বা হলেন ড্রাইভার মহাশয়। তাকে মহাশয় বলার কারণটা আশা করি স্পষ্ট হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই নাইটহুড-প্রাপ্ত কিংবা সমপর্যায়ের কিছু একটি।
আমার প্রথম বাস জার্নির অভিজ্ঞতাতে আমার কপালে পড়লো আটফিট উঁচু এবং সমপরিমাণ চওড়া একজন আফ্রিকান আমেরিকান ভদ্রলোক। তিনিই ড্রাইভার। স্যার। মহাশয়। সর্বেসর্বা। অথরিটি। গুরুজন। সেনাপতি। প্রশাসন। তিনি টিকেট চেক করে সবাইকে তুললেন। ভদ্রলোককে সবগুলো দাঁত বের করে বললাম, “শুভ সকাল, স্যার।”
তিনি আমাকে চুদলেনও না।
বাসে উঠে একটা সীটে বসে পড়েছি। সাউন্ডবক্স ধরে ভেসে এলো মহাশয়ের কণ্ঠস্বর। তিনি সবাইকে সাধারণ ভদ্রতাবোধ বজায় রাখতে বললেন। সেই সাথে যোগ করে দিলেন, “পাশের যাত্রীর সাথে পিরিতের আলাপ চোদাইবা না কিন্তু, আগেই কইয়া রাখলাম। আর যদি মাতলামি করেছো দাদারা, গোয়া মেরে বাস থেকে নামিয়ে দেবো। হিসাব পরিষ্কার হয়েছে?”
কারো উত্তরের আশায় না থেকে তিনি বললেন, “নেক্সট স্টপ : স্যান মার্কোস।”
পরে নেট ঘেঁটে আর ইউটিউবারদের কাছে শুনলাম, এমনটা হয়ে থাকে। বাসে কেউ তেড়িবেড়ি করলে খোলা মাঠে তাদের নামিয়ে দেন ড্রাইভাররা। সবার সাথে যাওয়ার সুযোগ তোমাকে দেয়া হয়েছিলো। নিতে তো পারোনি। কাজেই, একলা চলো রে। পলকা বাস ড্রাইভার এজন্যই স্টেটসে খুব একটা দেখবেন না। দরকার হলে আপনাকে চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলতে পারে এমন লোকজনই সেখানে আছেন।স্যান মার্কোসে নেমে আসার পর আমার যেটা মনে হলো – এখানে ছোটবেলা থেকে যারা বড় হয়েছে তাদের জন্য বাসযাত্রা নিশ্চয় আমার মতো এতো অনিশ্চিত আর অস্বস্তিকর হবে না। কারণ, তারা জানে।
উচ্চশিক্ষার আবেদন করাও অনেকটা অমনই। শুরুতে একজন বিএসসি পাশ করা ছাত্র বা ছাত্রীর এ বিষয়ে কিছুই জানার কথা নয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এই জিনিস শেখায় না কেউ। অথচ রকেট সায়েন্স, এমন নয়। এখানে কেবল আছে পথটা চেনার একটিমাত্র ওয়েবসাইট বা সিলেবাসে অভাব। যে কারণে বিষয়টা সহজ হলেও, হতে পারে অনেকটা বিভ্রান্তিকর।
কখনো একশ’টি পথ থাকার কারণেই সমস্যা হতে পারে পথিকের।
তাই সবার আগে আমি আপনাদের একটা পথ দেখাবার চেষ্টা করবো। তবে পথিকের বিভ্রান্তি এড়াতে সেই একটি পথও সহায়ক হতে পারে!

সংক্ষেপে নিচে তালিকার মাধ্যমে পথটা দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি –
(এ কেবল একমাত্র পথ নয়, আরও পথ আছে, তবে একটি চেনা থাকলে বাকিদের চেনা সহজ হবে)
১। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে যাওয়া
২। যে প্রোগ্রামটিতে অ্যাপ্লাই করতে চাইছেন তার রিকুয়ার্মেন্টস পড়া। যদি আপনাকে নেবে মনে হয়, তাহলে অ্যাপ্লাই করা। যদি মনে হয় আপনার ব্যাকগ্রাউন্ডের থেকে বেশি চাইছে তাহলে ওদের গ্র্যাজুয়েট স্কুলের যার নাম পাওয়া যাবে, তাকে ইমেইল করে নিজের প্রোফাইল পাঠিয়ে বলা “অ্যাপ্লাই করবো নাকি এখানে পয়সা নষ্ট করা উচিত হবে না?”
(২) ক : অ্যাপ্লিকেশন করতে গেলে বেশ কিছু জিনিস আপনাকে সাবমিট করতে হবে। তাদের তালিকা দেয়া হলো নিচে –
১। ঠিকানা (বর্তমান ও স্থায়ী, বিস্তারিত জেনে রাখুন)
২। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, বিষয়, ঠিকানা, ফোন নাম্বার (শেষ দুটো প্যারাময়)
৩। চাকরির অভিজ্ঞতা (প্যারার, যদি একাধিক চাকরি করে থাকেন, সব সুপারভাইজারদের, এবং কোম্পানির নাম ও ঠিকানা/ফোন নাম্বার দিতে হবে)
৪। জিআরই (কয় তারিখে দিয়েছেন? কোন অংশে কতো পেয়েছেন? পার্সেন্টাইল? সব লাগবে)
৫। টোফেল (ঐ)
৬। দুনিয়ার রেজাল্ট (বেশিরভাগ জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়েরগুলোই চায়, তবে কেউ কেউ আদি থেকে অন্ত চেয়ে বসতে পারে, ফর্মের ধরণটাই অমন, কিছু করার নাই)
৭। রেকমেন্ডশন লেটার যাদের থেকে আসবে তাদের নাম, তাদের কর্মরত প্রতিষ্ঠানের নাম, তাদের ইমেইল অ্যাড্রেস, তাদের ফোন নাম্বার
৮। স্টেটমেন্ট অফ পারপাস তথা এসওপি (কখনো এর সাথে যুক্ত হতে পারে ব্যক্তিগত বয়ানের এক পত্র, তবে রেয়ার)
৯। আর যা যা আছে তা একেবারেই ব্যাসিক, হয়তো আপনাকে কোন ডকুমেন্টসও ফলো করতে হবে না। সরাসরি থাকবে মাথাতেই। যেমন আপনার ফার্স্ট নেইম, লাস্ট নেইম, ফোন নাম্বার, ইমেইল অ্যাড্রেস, ইত্যাদি ইত্যাদি, শতেক জিনিস। ওপরের আটটা আসল যোগাড়যন্ত্রের জায়গা, আমি বলতে চাইছি আপনাকে আপনার স্থায়ী ঠিকানার ওয়ার্ড নম্বর পর্যন্ত জেনে রাখতে হবে (যেটা সম্ভবতঃ ভিসা অ্যাপ্লিকেশনের সময় লাগে, না কই যেন, তবে আমাকে একবার দিতে হয়েছিলো), জেনে রাখতে হবে কোন মাসে এইচএসসির রেজাল্ট দিয়েছে। ওপরের যে ৮ টি বস্তু, তাদের সম্পর্কিত প্রতিটি খুঁটিনাটি আপনাকে জেনে রাখতে হবে

টিপস –
* আপনি একটি গুগল ডক খুলে রাখতে পারেন। যার ভেতর এই তথ্যগুলো সাজিয়ে রাখবেন। যখন অ্যাপ্লাই করবেন তখন চটপট এখান থেকে কপি করে করে ফর্মে পেস্ট করতে থাকবেন। হয়ে গেল। তাছাড়া একসাথে ৫-১০ জায়গায় অ্যাপ্লাই করতে হবে যখন, এটা দারুণ কাজে দেবে।
* এই দরকারি বিষয়গুলো থেকেই বোঝা যায় কেন কোন জিনিসটি লাগবে।
* সময়ের ব্যাপারটি এখান থেকে বোঝা সহজ হয়। অনেক সময় দেখা যায় অ্যাপ্লিকেশন ডেডলাইন পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ আপনি কথাই বলেননি কোন কোন স্যার বা ম্যাম আপনাকে রেকমেন্ডেশন দেবেন। এখন ফর্মটি পূরণ করার সময় আপনি কাদের নাম লিখবেন? তারা যদি পরে দিতে না চান?
* ঐ ডেডলাইনের মধ্যে ১-৮ আপনার নখদর্পণে না থাকলে কিংবা যোগাড় না হলে আপনি অ্যাপ্লাই করতে পারবেন না। কাজেই এদের সবগুলো কাভার করতে হবে। আর এদের কাভার করার জন্য আপনাকে কাভার করতে হবে GRE score, TOEFL score (or IELTS), রেডি রাখতে হবে পাসপোর্ট, এবং কেবলমাত্র প্রফেসরের রেকমেন্ডেশন নেয়া বাদে আর সবি আপনার নিজের কাজ। এদের এগিয়ে রাখুন। একি সাথে মাথায় রাখুন, প্রফেসরদের সাথে আলাপ করা ও রেকমেন্ডেশন নেয়া যেহেতু আপনাকে একা করতে হচ্ছে না, আপনার প্রফেসরও ইনভলড সেখানে, কাজেই অনেক বাড়তি সময় লাগবে। আপনি ইমেইল করলেন, হয়তো প্রফেসর রিপ্লাই দিলেন ৮ দিন পর। তার জবাবে আবার ইমেইল করলেন, তিনি জবাব দিলেন আর ৮ দিন পর। রেকমেন্ডেশন লেটার আপলোড করতে ভুলে গেলেন। আবার ইমেইল করলেন, আবার উত্তর পেলেন ৮ দিন পর। তাই ডেডলাইন যে তারিখে লেখা আছে তার অন্তত ২-৩ মাস আগে ব্যাচেলরের প্রফেসরদের সাথে যোগাযোগ করে ফেলুন, যেন সময়ে রেকমেন্ডেশন পাওয়া যায়।
* এই এক-ই কারণে আমি বলে থাকি, আপনার উচিত সঠিকতম ও নিখুঁততম GRE বা TOEFL এর জন্য অপেক্ষা না করা এবং দিয়ে ফেলা। কারণ ও ছাড়াও আপনার অ্যাপ্লিকেশন কীভাবে কমপ্লিট করবেন? অনেকেই প্রফেসরদের কাছে ইমেইল পাঠাতে এতই ব্যস্ত হয়ে যান যে এসেনশিয়াল অনেক কিছু মিস করতে থাকেন। এটি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা – আপনাকে যদি প্রফেসর ফুল ফান্ডিংয়ের প্রতিজ্ঞা করে, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই না করলে আপনাকে তিনি নিতে পারবেন না।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৫ – হোঁচট খাওয়ার মানেই, হেরে যাওয়া নয়

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৩ – শুরু থেকে শেষটা ঝাপসা জানা

প্রথম রাতেই বেড়াল মারার যে আলাপ বাঙালি করেন, তা সব সময় সত্য হয় না। ঠিক যেমনটা করতে গিয়ে লটকে গেলো আমার রুমমেট উইল।
তখন আমেরিকায় আসার ৩ সপ্তাহ হয়ে গেছে আমার। এই ৩টি সপ্তাহ আমি একেবারেই বেকার কাটিয়েছি। উম, না। একেবারে বেকার কাটিয়েছি তা বলা যাবে না হয়তো। করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু আগের মতো নেই। আমাকে দুটো দফায় ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। সিভিএস ফার্মেসি থেকে প্রথম ডোজ নেয়ার জন্য যখন গেছিলাম, আমার ধারণা ছিলো লোকের ভিড় থাকবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া থাকলেও, আগের লোকেরা হয়তো দেরি করিয়ে দেবে কিছু। আর যদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিকভাবে রক্ষাও করতে পারে ওরা, কিছু লোকজন তো দেখবোই।
আমাকে হতাশ হতে হলো, কিংবা আনন্দিত। ভেতরে লোক ছিলো না একজনও। আমি একেলা। আমাকে বসিয়ে রাখলো উলটো ৪৫ মিনিট। তারপর আরেকজন আফ্রিকান-আমেরিকান ভদ্রমহিলা এলেন। মনে হলো দুটো অ্যাপয়েন্টমেন্ট এমন ছাড়া ছাড়াভাবে আছে বলেই উনারা মিলিয়ে নিলেন। “গুঁতো” খেয়ে ফিরে আসছি, ভাইয়া ড্রাইভ করছে, জিজ্ঞাসা করলাম, “এত কম কেন লোক? আমি তো ভেবেছিলাম এলাকা কাঁপিয়ে দেবে।”
ভাইয়া হাসলো। সে হাসিতে তিক্ততা। বললো, “গোঁড়ামি, উগ্রতা আমেরিকানদের মধ্যে আমাদের দেশের থেকে কম নয়, বরং বেশিও কিছু ক্ষেত্রে। রিপাবলিকানদের নিয়ে এই সমস্যা। তারা ভ্যাকসিন নেবে না। এজন্যই তোর ইউনিভার্সিটি রিমোট ক্লাস নিতে পারছে না। টেক্সাস ওদের এলাকা, আর তা যদি ওরা নেয়ার ঘোষণা দেয়, অনেকগুলো ভ্রু কুঁচকে যাবে। তারা ধরে নেবে এই প্রতিষ্ঠানের লোকজন ডেমোক্র্যাটদের ভক্ত। ভ্যাকসিন নিচ্ছে, অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। এটা এক ধরণের রাজনৈতিক ঝুঁকি। তুই বোধহয় জানিস না, এই কিছুদিন আগেও ওরা অনেকগুলো ভ্যাকসিন ফেলে দিয়েছে। ডেট এক্সপায়ারড হয়ে গেছিলো। কেউ নেয়নি।”
বুঝলাম। অকারণ এক দুঃখবোধ আমাকে ঘিরে ধরলো। এর একদিন আগেই খবরে পড়েছি ভ্যাকসিন নেবার জন্য আমাদের দেশে লোক হামলে পরেছিলো, কেলেঙ্কারিও হয়েছে কিছু। এত আগ্রহ নিয়ে এসেও সবাই ভ্যাকসিন পায়নি। আর এদের আছে, কিন্তু নেবে না। ফেলে দিচ্ছে। দেশের কথা ভেবে, দেশের মানুষের কথা ভেবে, আর এই এখানকার ওদের বিলাসীতা দেখে অক্ষম এক ক্রোধে মন বিষিয়ে উঠলো।
ভ্যাকসিন নেয়া হয়ে গেছে আমার দুটো। ইফতি ভাইদের সাথে সেদিন দেখা করার কথা। তারা মাত্রই নিউইয়র্ক ট্যুর সেরে এলো। সে কী আড্ডা, সিপ সাম থাই রেস্তোঁরায়। খেলামও চুটিয়ে। ২০শে আগস্ট, ২০২১। আমার সেদিন অ্যাপার্টমেন্টে উঠে যাবার কথা ছিলো। অথচ ভাইয়াদের এখানে বেসুমার খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি। ২৩ তারিখে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা, কাজেই তাড়াহুড়ো নেই। তবে আমার আর ৩ অ্যাপার্টমেন্ট-মেট তো আছে, তাদের একজন হচ্ছে উইল ক্র্যাগিট। ফিম্ল নিয়ে পড়াশোনা করছে টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। একদিন হলিউডে বড় বড় সিনেমা বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে চায় সে। এদিকে আমি লিখি উপন্যাস। একবারও দেখা না হওয়া সত্ত্বেও একে অন্যকে দারুণ পছন্দ করে ফেললাম। বেশ কিছু টেক্সট আদান প্রদান হয়েছিলো রুমসিংক অ্যাপে, কে কবে উঠছি ইত্যাদি নিয়ে হাল্কা আলোচনা করে ফেলা।
মনে পড়লো, আজ উইলেরও তো মুভ-ইনের ডেট। একটা টেক্সট দিয়ে দেখি তার কী খবর।
জানতে চাইলাম, “কী হে। উঠলে নাকি?”
জবাব এলো, “এখনো দু’ঘণ্টা দূরে আছি।”
বললাম, “দারুণ এগিয়ে আছো। আমি এখনো ১৭ ঘণ্টা দূরে আছি।”
নিউ ইয়র্কের চমৎকার বর্ণনা চাঁদনী আপু আর ইফতি ভাই আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাচ্ছি। তবে একটু পর তারা লুপে পরে গেলেন। কারণ, নিউইয়র্কের যাত্রা-বিবরণীতে নিউইয়র্কের বর্ণনা ২০ শতাংশ, আর খাবারের বর্ণনাই সিংহভাগ। আমাদের জন্যও হিসাব রাখা সুবিধে হয়ে গেল। যদি এক খানা থেকে আরেক খানার মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এই “নিউ-ইয়র্কনামা”কে আমরা একটি করে চ্যাপ্টার হিসেব করি, তবে তখন আমরা ছিলাম ১১৪ তম চ্যাপ্টারে। তেমনই এক গুরুতর মুহূর্তে উইল বললো, “ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়।”
জানতে চাইলাম, “মারাটা খেলে কোথায়?”
ফিল্মের ছাত্র ফিল্মি স্টাইলে বললো, “অফিস বন্ধ হইয়া গেছে মিয়া। মাল-সামানা নিয়া খোলা আকাশের তলে বন্দী হয়া আছি।”
এ দেখি আকাশ ভরা তারা, উইলের হোগা মারা সারা! নতুন একটি শহরে একজন ছাত্র এসেছে, যে এখানকার কাউকে চেনে না। এবং বাইরে আটকে আছে, এটা একটা বড় সমস্যা। কারণ একা নিজে রাস্তায় বাইরে আটকে গেলে কোনভাবে হয়তো পার করে দেবেন রাতটা। তবে এটা মুভ-ইন। অর্থাৎ ছাত্রটি তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নিয়েই এসেছে। এত দামী ও সস্তা জিনিস নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাত কাটানোটা খুব স্বস্তির ঘটনা হওয়ার কথা নয়।
বললাম, “অফিসে ফোন দিয়ে দেখো।”
উইল জানালো, ফোন দিয়েছে, তারা আবার তাকে আরেকজনের নাম্বার দিয়ে বলেছে কল করতে। ইনিও স্টাফ। তবে সে কল ধরছে না। কেন ধরছে না তা অনুমেয়। রাত প্রায় ১২ টা বাজে। আর টেক্সাসে লোকে ৮ টার দিকেই খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে। ১২ টা মানে তাদের কাছে গভীর রাত।
আমি তাকে দ্রুত নবীজির ফোন নাম্বার দিলাম। লিজ সাইন করার সময় যে কাগজটি ছিলো তা অনুসারে এরাই আমাদের ফ্ল্যাটমেট হওয়ার কথা। নবীজি শুনে নাক কোঁচকাবেন না, এই ছেলের নাম প্রফেট। বাবা-মা রেখেছে এমন নয়, বংশগত নাম। মানে আব্রাহামের বংশ। যে বংশের সবাই নবী। রাজতন্ত্রের সিলসিলা। নবী কেবল এক বংশেই আসবে। যত্তোসব!
খানিকবাদে উইল বললো, “নবীজিকে ফোন দিলাম। পেয়ারা নবী বলছেন ওদের অন্য রুম দিয়েছে। ওরা আমাদের রুমমেট না।”
দ্রুত পোর্টালে লগ ইন করে দেখলাম, রুমমেট বদলেছে। নবীজি এখন আলাদা রুমে। তার সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হলো না। নতুন সব রুমমেটদের তালিকা ঝুলছে এখন লিজ ডকুমেন্টসের নিচে।
সেখানেই পাওয়া গেল ইস্টনকে, টেক্সাস ষ্টেটের আরেকজন গর্ব। ছোকরার নাম্বার উইলকে দিলাম। নিজেও কল করলাম। রিসিভ কেউ করার নেই। রাত বারোটায় ছাত্ররা ঘুমিয়ে না পড়লেও “মাস্তি” নিশ্চয় করে। কল দিলেই ধরবে এমন হওয়ার সম্ভাবনা কম। মাস্তি যদি নাও করে, কুত্তার মতো পড়ছে তা নিয়ে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। ভয়েস মেসেজে বললাম, “দ্যাখো বাপু, আমি তোমার ফিউচার রুমমেট, আর দরজার বাইরে ভেটকি মেরে আছে আমাদের আরেকজন ফিউচার রুমমেট। তারে উদ্ধার করো। না না, ‘করোহ’।”
কানটা খাড়া করে শুনলাম ইফতি ভাইদের নিউ-ইয়র্ক কাহিনী তখন ১২৮ তম চ্যাপ্টারে। তারা এখন জানাচ্ছেন মার্কামারা এক ভারতীয় ডিশের কথা, নিউ ইয়র্কে গিয়ে তা ট্রাই না করলে নাকি জীবনই বৃথা। আমিও ধরেই নিলাম ইস্টন আর কল ব্যাক করছে না। হয় মুভ-ইনের ধকলে বিশাল ঘুম দিচ্ছে, নয়তো মদ খেয়ে চুর হয়ে আছে। অগত্যা মধুসূদন। উইলকে বললাম আপডেট জানাতে, এবং নিউইয়র্কের গল্পে মনোনিবেশ করলাম। ইফতি ভাইকে দেখলাম ১২৯ তম চ্যাপ্টারের দিকে মোড় নিচ্ছেন।
কে যেন জিজ্ঞাসা করলো, “ভাই, ছিলেন তো কেবল চারদিন। এতো খাইলেন কখন?”
প্রশ্নটিকে না শোনার ভান করে ইফতি ভাই তাদের দুর্ধর্ষ খাদক-অভিযানের কথা বলে যেতে লাগলেন। নিউ ইয়র্কবাসীর অবস্থা ছিলো এমন, “পড়েছে ইফতি পরিবারের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।” এসব বাজে প্রশ্নে মনোযোগ না দিয়ে আমিও কানটি খাড়া করে শুনে নিলাম যা শোনা যায়। ট্রাভেল ব্লগ না লিখলেও, কোনও এক গল্পে তো মেরে দেওয়াই যাবে তাদের অভিজ্ঞতা।
ইফতি দম্পতি যখন ১৩৫তম অধ্যায়ে, আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ইস্টন গিল।
ধরতেই হাহাকার করে উঠলো সে, “দরজা তো খুলে দেখলাম, বাইরে নেই কেউ।”
আমিও হাহাকার করে বললাম, “বাইরে মানে ঠিক বাইরে এমন তো নয়, এলাকাতেই আছে। দাঁড়াও আমি তাকে এখনই তোমাকে ফোন করতে বলছি।”
সৌভাগ্যক্রমে বিশ মিনিট পর উইল অন্তত আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে পেরেছিলো। তবে রুম পর্যন্ত নয়। রুমের চাবি তার কাছে নেই। তাকে ঘুমাতে হয়েছিলো লিভিং রুমের কাউচে।
উইল ক্র্যাগিট প্রথম রাতে বেড়াল মারতে পারেনি। বরং বেড়ালই উইল ক্র্যাগিটকে প্রথম রাতে মেরে দিয়েছে।
এই ঘটনাটির সাথে উচ্চশিক্ষার যে পথ, তার কিছু মিল আছে। উইল বিপদে পরেছিলো, কারণ সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারণা রাখেনি। সে শুধু জানতো ২০ তারিখ তাকে পৌঁছাতে হবে এখানে। তারপর যা করার অফিসই করবে। তবে পুরো প্রসেসটা সম্পর্কে ধারণা থাকলে সে জানতে পারতো কোন কোন গর্তে সে পড়তে পারে। যেমন – একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য : অফিস কয়টার সময় বন্ধ হয়ে যায় তা। আর আগে থেকেই সেসব গর্ত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সম্ভাবনা থাকতো।
উচ্চশিক্ষার পথটি বিশাল ও বিস্তৃত। তাই অনেকেই মনে করেন এতো দীর্ঘ পথে আমার খবর রেখে কাজ কী? বরং ওয়ান স্টেপ অ্যাট আ টাইম।
এটি চমৎকার চিন্তা। ওয়ান স্টেপ অ্যাট আ টাইম অবশ্যই ভাবা উচিত। তবে সঠিক চিন্তার প্রথম ধাপ এটা। তার আছে দুটো ধাপ। যে কোনো একটি ধাপ যদি মিস করেন, অনেক অকারণ ঝামেলায় সামনে পড়বেন। ঠিক বন্ধু উইলের মতো।

সঠিক চিন্তার ধাপ দুটো –
১। ওয়ান স্টেপ অ্যাট আ টাইম : বিস্তারিত জানার দরকার নেই সব ধাপ, তবে যখন যে ধাপে আছেন তার আদ্যোপান্ত জেনে নিন।
২। সব জানুন : সবগুলো ধাপ সম্পর্কে জানতে হবে, তবে প্রথমে কেবল ঝাপসা জানলেই চলবে। শুধু চলবে তাই নয়, এটিই ভালো। নতুবা আপনি হয়ত এতো এতো কাজ দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারেন।
এই দুটো ধাপের যে কোনো একটিতে আপনি যদি ঢুকতে যান, এবং অপরটিকে গুরুত্ব না দেন, তাহলে পুরো জার্নিটা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে আপনার। এমনকি মাঝপথে ডিমোটিভেটেড হয়ে ছেড়েও দিতে পারেন। বেশিরভাগই তাই করেন। যে কারণে প্রথম রাতে বেড়াল মারতে যাবেন না, বেড়াল-ই আপনাকে মেরে দেবে।

 🇺🇸 নির্দেশনা 🇺🇸 
পুরো প্রসেসটির আদ্যোপান্ত জেনে নিন, তবে সংক্ষেপাকারে। এতে করে অন্তত পাথওয়েটা সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকবে। দরকার হলে ৩ ধাপ সামনের কিছু করা লাগলে আগেভাগে করে রাখতে পারবেন। শুরুতেই আপনার কী কী জানার দরকার পড়বে তা নিয়ে আগামি অধ্যায়ে আলোচনা হবে।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৪ – পথটা

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০২ – জিআরই এবং IELTS/TOEFL

জর্জ বুশ ইন্টারকন্টিনেন্টাল এয়ারপোর্ট, হিউস্টন।
কাঁচের ওপাশে বসে থাকা কাস্টোমসের নীলচোখের ভদ্রলোক আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন। সরু চোখে তাকিয়ে থাকার পেছনে তার যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। যতোই চেষ্টা করি, সামনের প্যানেলে আমার ফিঙারপ্রিন্ট মিলছে না। এর দুটো অর্থ হতে পারে – যন্ত্রটি নষ্ট, নইলে, আমি একজন ফ্রড। ভুয়া নাম পরিচয় দিয়ে আমেরিকায় ঢোকার চেষ্টা করছি। এবং তিনি জানেন যন্ত্রে কোনরকম ত্রুটি নেই।
দেশের বাইরে এই প্রথম ভ্রমণ আমার, পা রাখতে যাচ্ছি বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় মাটি থেকে সরাসরি আমেরিকান সয়েলে। কিছুটা নার্ভাস তো বটেই। এখানে আমাকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস দেখাতে হবে যেন ওরা আমাকে গ্রহণ করে। বেমক্কা প্রশ্নও করতে পারে। ভুল হলে ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন। তারওপর গায়ে আছে ২৩ ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তি। তার সাথে যোগ দিয়েছে কাস্টোমসের দীর্ঘ লাইন। করোনাভাইরাসের কারণেই কি না জানি না, ৪০ মিনিটের বেশি সময় গেছে সর্পিল এই লাইন ধরে ধরে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াতে। ক্লান্তির পাশাপাশি আছে ভারী ব্যাকপ্যাকটার ওজনের ধাক্কা। আঙুলের ছাপ না মেলা একটা চিন্তার ব্যাপার বটে।
নীলচোখের ভদ্রলোক অগত্যা করোনাভাইরাসের গুল্লি মারলেন। একটা হাত কাচের ভেতর থেকে বের করে আমার হাতের ওপর রেখে চেষ্টা করলেন আঙুলগুলোকে জায়গামতো বসাতে। তৃতীয়বারের মাথায় মনে হয় কিছু পাওয়া গেল।
উত্তেজনাহীন কণ্ঠে বললেন, “নাউ দ্য থাম্ব, প্লিজ। ট্রাই টু কিপ ইয়োর এলবো দিস ওয়ে।”
নিশ্চয়! প্রতিবন্ধিদের মতো কনুই না বাঁকালে আঙুলের ছাপ যন্ত্রটি পাচ্ছে না। এ দফায় একাধিক চেষ্টাতে আঙুলের ছাপগুলো বসানো গেল বটে, একটু হেসে বললাম, “তোমাদের এই যন্ত্রটা আমার উচ্চতার তুলনায় একটু ছোট।”
কাস্টোমসের অফিসারটি হাসলেন। বললেন, “তুমি আসলে অ্যাভারেজের থেকে বেশি লম্বা।”
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। দেশের ভেতর তো বটেই, আমেরিকায়ও এরপর যেখানেই গেছি, মানুষ আমাকে নিয়ে প্রথম যে মন্তব্যটি করেছে তা আমার উচ্চতা নিয়ে। এর কিছুদিন বাদে ইফতি ভাই, চাঁদনী আপুদের সাথে দেখা হয়েছিলো ভেরাইজনের কাস্টোমার কেয়ারে। চাঁদনী আপু বলেছিলেন, “তুমি দেখি সেই লম্বা।”
আমি হেসে বলেছিলাম, ‘ছয় বছর আপু। শেষ ছয় বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি প্রথম দেখায় কেউ আমাকে এই কথাটি ছাড়া অন্য কিছু বলবে।”
মজার ব্যাপার হচ্ছে এর ঠিক ৩৫ মিনিট পর আমরা পাশের Rooms to Go ফার্নিচার শপে যাই। ভেতরে ঢুকতেই একজন টাকমাথার ভদ্রলোক এসে আমাদের ধরলেন, “কোনও বিশেষ কিছু দেখতে চান কি না?”
ভাইয়া বললো, “না, আমরা একটু ঘুরে দেখি আরকি।”
“তা বেশ। তা বেশ, তা বেশ।” তা যে বেশ নয় তা নিশ্চিত করতে করতেই যেন রুমস টু গো-র ভদ্রলোক বললেন। তারপর আমার দিকে ফিরে আরেকটি কথা তিনি বলেছিলেন। “আরে আরে, তুমি দেখি আমার থেকেও লম্বা।”
চোখ মটকে চাঁদনী আপুকে বললাম, “ছয় বছর, আপু।”
কাস্টোমসের অফিসার ফিঙারপ্রিন্টগুলো নেয়ার পর আমার পাসপোর্ট ও আই-২০ ফেরত দিলেন। ওটা ডান হাত দিয়ে নিতে নিতে বড় করে শ্বাস নিলাম। তাকালাম আমার ডানদিকে। ওদিকেই মুক্তির পথ। আমেরিকায় ঢোকার পথ।
জানতে চাইলাম, “আর কিছু কি করার আছে এখানে আমার?”
তিনি বললেন, “না। ওয়েলকাম টু আমেরিকা।”
হাসলাম চওড়া, যতখানি হাসা যায়। তারপর কাস্টোমসের ভদ্রলোককে বললাম, “থ্যাংক ইউ। হ্যাভ আ গ্রেট ডে অ্যাহেড।”
বিশ মন ওজনের ব্যাকপ্যাকটা আবার পিঠে তুলে নিলাম। ডান হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছি স্ট্র্যাপ, বাঁ হাতে পাসপোর্ট আর আই-২০। বুক চিতিয়ে হাঁটা দিলাম ব্যাগেজ কালেকশনের জন্য।
মিনিট তিনেক পর যখন দু’হাতে দুটো ব্যাগ হাঁটিয়ে (চাকায়) বেরিয়ে আসছি, লাগেজ চেক হওয়ার কথা থাকে সাধারণতঃ, অথচ ছয়জন কালো পোষাকের অফিসার আমাকে নিরাসক্ত চোখে যেতে দেখলেন। আমেরিকায় কেউ আমার ব্যাকপ্যাকও স্ক্যানারে পাঠায়নি। একেবারে বিনা চেকাপে (যেটা আইডিয়াল নয়, আমি করোনাভাইরাসের কারণে হাল্কা চেকআপে পড়া সৌভাগ্যবান ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একজন) বেরিয়ে এলাম ইন্টারন্যাশনাল অ্যারাইভালস লবিতে। অনেকেই হাতে নানা নাম ও প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের অগ্রাহ্য করে খোলামেলা একটি জায়গায় এসে থামলাম। বসে পড়লাম খালি দেখে, এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই ব্যবহার করে ফোন দিলাম আমার ভাইকে। এই মুহূর্তে সে কর্মরত অ্যাপলে, বুয়েটের ছাত্র ছিলো একসময়। পিএইচডিটা করেছিলো ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটায়, বব ডিলানের বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তার ফোনে রিং হচ্ছে, আমি যেন পরিষ্কার শুনতে পেলাম তার সাথে হওয়া দেড় বছর আগের কনভার্সেশন। এমনই এক হোয়াটসঅ্যাপ কলে তখন কথা হয়েছিলো আমাদের। আমি আমেরিকাতেই পড়তে যেতে চাই, কাজেই আমার লক্ষ্যের ব্যাপারে ভাইয়ার জানা ছিলো। তবে আমার ঢিলেমি তাকে যথেষ্ট বিরক্ত করেছিলোও মনে হয়। বারান্দায় বসে আমি জানতে চেয়েছিলাম, “এখনই জিআরই দেবো? আমার প্রিপারেশন কিন্তু নেই।”
ভাইয়া বলেছিলো, “এখনই রেজিস্ট্রেশন করবি। আজকে কালকের ডেট তো আর নিচ্ছিস না। ২-৩ মাস পরের ডেট রাখ। তারপর এর মধ্যে প্রিপারেশন নিবি।”
আমি মিন মিন করে বলেছিলাম, “নতুন অফিসে জয়েন করলাম, ট্রেনিংয়ের শো-ডাউনেই তো দাঁড়াতে পারছি না অফিসে। তারওপর একটা বই লিখছি। এতো কিছুর মধ্যে প্রিপারেশন নিলেও তা ভালো কিছু হবে না।”
ভাইয়া আমাকে তখনই রেজিস্ট্রেশন করে ফেলায় জোর দিলো।
বিষয়টা আমি সেই ফোনকল রাখার কিছুক্ষণ পরই বুঝেছিলাম। আসলে মানুষের জীবন এমনই। সব সময়ই কিছু না কিছু চলবে। আমি ৫০০ পৃষ্ঠার বিশাল উপন্যাস সব সময়ই লিখবো। আমার অফিসে ট্রেনিং থাকবে, নইলে থাকবে নতুন কোনও প্রজেক্ট। এসবের কারণে GRE কিংবা TOEFL/IELTS দেয়া পিছিয়ে লাভ নেই। অনেকেই তা করেন। ভাবেন “আরেকটু স্টেবল হয়ে প্রিপারেশন নিয়ে ফাটায়া দিবো হে জনতা। দেখায়া দিবো আমি কি জিনিস!”
কিছু ছাত্রছাত্রী দারুণ ব্লেসিং পান, কিছুই করেন না, বিএসসি-র পর তারা চাকরিও খোঁজেন না, বইপত্র লেখা তো রেয়ার কেস, কাজেই তারা ফুল-টাইম হায়ার স্টাডির জন্য রিসার্চ করেন। অ্যাপ্লাই করেন। প্রফেসরদের ইমেইল করেন। GRE এর জন্য পড়েন। TOEFL এর জন্য পড়েন। আমার কপাল তেমন নয়। আমি জীবনযুদ্ধে থাকা অবস্থাতেই সব করতে হবে। এক হাতে ছয় পেটাতে হবে অফিসে, অন্য হাতে ছয় পেটাতে হবে উপন্যাসে, একই সাথে ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে গিয়ে হিট করতে হবে GRE এবং TOEFL এ।

 🇺🇸 অল্প সময়ে ভালো প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলাম? উত্তরটা হচ্ছে না। GRE তে আমি প্র্যাক্টিস টেস্টে ৩২০ এর মতো তুলেছি তবে আসল টেস্টে পেয়েছিলাম ৩০৭। TOEFL এ ১২০ এ ১০০ পাই, ঠিক জানতামও না কেমন পরীক্ষা প্রশ্ন আসে, স্যাম্পলও দেখিনি। তবে মাইন্ডিং ইউ, আপনি একটা চাকরি যদি করেও থাকেন, আশা করি আমার মতো বিশাল বই লেখারও বাড়তি চাপ নেই। দুটো ক্যারিয়ার একসাথে টানা না লাগলে হয়তো প্রস্তুতি আরেকটু ভালো হতো। আপনাদেরটাও হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে নিচের প্যারাগ্রাফে আমি ব্যাখ্যা করবো কেন এই কাজটি সবার আগে করে ফেলা, পুরোপুরি রেডি না থাকলেও, এত গুরুত্বপূর্ণ।
🇺🇸 আমেরিকায় পড়তে হলে প্রায় সবখানেই আপনাকে GRE স্কোর সাবমিট করতে হবে, প্রফেসর ইমেইল করতে গেলেও তা করতে পারলে ভালো। এবং IELTS/TOEFL তো বাধ্যতামূলক (প্রায় সবখানেই)। আপনি অ্যাপ্লাই করতে গেলে আপনার হাতে যে তিনটি বিষয় প্রথমেই প্রস্তুত থাকতে হবে তা নিম্নরূপ –
১। আপনার বিএসসির সার্টিফিকেট
২। লেটার অফ রেকমেন্ডেশন
৩। GRE/TOEFL স্কোর

এর বাইরে ফান্ডিং নিয়ে প্রফেসরের সাথে মুলামুলি, যত মন চায় করুন, ওপরের তিনটা ফরজে আইন। কাজেই সবার আগে এই তিনটি প্রস্তুত করতে আমি জোর দেবো। যদিও লোকে সচরাচর এদের বাদ দিয়ে প্রফেসর ইমেইল করতে বলে থাকেন আগে। আমার মনে হয় প্রফেসর ইমেইলের থেকে বেশি গুরুত্ব ওপরের তিন জিনিস রেডি করতে দিন। সেই সাথে তা-ও করতে থাকুন। তবে প্রায়োরিটিতে ইমেইলিং এদের পর। আপনি যদি অ্যাপ্লাই করতে না পারেন, ডেডলাইন মিস করেন, তাহলে প্রফেসরের সাথে আলাপ দিয়ে কিছু আসে যাবে না। প্রায়োরিটি স্ট্রেইট করতে হবে হবে সেজন্য।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৩ – শুরু থেকে শেষটা ঝাপসা জানা

 

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০১ – রেকমেন্ডেশন

প্লেনে ওঠার পর থেকে দারুণ সুন্দর একজোড়া চোখ আমাকে দেখছিলো। অথচ আমি তখন গুম হয়ে বসে আছি নিজের সিটে। রাগে কান লাল হয়ে আছে। এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম সামনের দেয়ালের দিকে। ওখান একটা স্ক্রিন ঝুলছে। সেখানে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ভিডিয়ো চলছে। অসাধারণ সৃজনশীলতার ছাপ সেই ভিডিয়োতে, ফুটবল ও ফুটবলারদের দিয়ে প্লেনের সাধারণ নিয়মনীতি ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তাতে। পাশে বসে থাকা আকর্ষণীয় তরুণীর মতোই, দেয়ালের ঐ স্ক্রিনের সৃজনশীলতাও আমার মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারলো না। সুতীব্র একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ফোঁস করে শব্দ হলো একটা।
সুন্দর চোখজোড়া আমাকে কেন দেখছিল তাও বুঝতে পারলাম। আমার হাবেভাবেই একটা ক্ষ্যাপা জন্তুর অভিব্যক্তি। নির্ঘাত ভাবছে, যে কোনও সময় তাকে ঘ্যাক করে কামড়ে দেবো কি না। তবে আমাকে এখানে একতরফা দোষারোপ করলে চলবে না। প্যান্টের বেল্ট ছিঁড়ে যাওয়ার পর পকেটের ভারী ফোন, মানিব্যাগ, পাওয়ারব্যাংকের চাপে তার নিচে নেমে যাওয়ার অনভূতি হয়েছে কখনো? তাহলেই বুঝতে পারবেন আমার রাগের উৎসটিকে।
ভাবছেনে মেটাফোর দিচ্ছি? চমৎকার কোনও রূপক বলে যাচ্ছি একটি পয়েন্ট মেক করার আশায়? না হে। ঘটনা ঠিক তা-ই ঘটেছিলো।
দেশের বাইরে আমার প্রথম ফ্লাইটটিকে ঠিক সময়ে ধরে ফেলার কথা ছিলো, আমিও এসেছিলাম সময়মতোই, তবে দেখা গেল আমি যখন এসেছি তখনই এসেছে বাকি যাত্রীরাও। পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় মোটেও যথেষ্ট হলো না, বিশেষ করে বোর্ডিংয়ের আগে যে নিদারুণ চেকিংটি হয়ে থাকে, তাতেই সময় শেষ হয়ে পেরিয়ে গেল আরো ৪টি মিনিট। যারা জানেন না তাদের জন্য বলে রাখি, এই পর্যায়ে এসে আপনার ব্যাগে থাকা যে কোনও ইলেকট্রিক ডিভাইস – যেমন আমার ক্ষেত্রে, দুটো পাওয়ারব্যাংক, দুটো মোবাইলফোন, একটি ব্লু-টুথ এয়ারফোন, একটি ভেপিং ডিভাইস, একটি ক্যামেরা, এক গিম্বলের ব্যাটারি ও চার্জার, ইত্যাদি আলাদা আলাদা করে ট্রে-র ওপর রাখতে গিয়েই দেখলাম দুটো ট্রে ভরে গেছে। (ব্যাটারি সম্বলিত কোনো ডিভাইস লাগেজে দেয়া নিষেধ, তাই এই হ্যাপা) তার ওপর ওখানে আপনাকে বেল্ট আর জুতো খুলে ট্রে-তে রাখতে হবে। এসেছেন ন্যাংটো, যাবেন ন্যাংটো – এয়ারলাইনসের হিসাব পরিষ্কার। এত রঙঢঙ যে আমি একাই করছি তা তো নয়। উপস্থিত আপামর জনতাও তা করছে। এবং সব মিলিয়ে দেরি হয়ে গেল। গেট দিয়ে ঢুকে দেখলাম, সাড়ে চারটা বেজে গেছে প্রায়, অথচ ৪.২৫ এ ফ্লাইট!
জুতো পরার কিংবা বেল্ট পরার ন্যুনতম চেষ্টা না করে ছুটলাম। বোর্ডিং পাসটি পাঞ্চ করলেন এক ভদ্রলোক, এবং তা কাজ করলো না। অতি স্বাভাবিক একটি ঘটনা, একে বলার হয় মার্ফির সূত্র। যখন একটি কিছু ভুল হবে, সবই ভুল হবে। পাশের টেবিলে বোর্ডিং পাস চালান করে দিলেন অগত্যা, সময় এখানেও লাগবে। অযথা। আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, এটাই সুযোগ, দ্রুত বেল্টটা পরে ফেলা যাক!
পাবলিকলি বেল্ট পরার চেষ্টা করেছেন কখনো? আমি বলবো, না করে থাকলে, করতে যাবে না। বাড়তি প্রেশার কিংবা হিউমিলিয়েটির কারণে জোরেই টান দিয়েছিলাম বোধহয়, যতটা দরকার তার বেশি, পটাং করে ছিঁড়ে গেল! একটু পেছনে বসে থাকা স্থুলকায় এক আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণী হাসি হাসি চোখে আমার কাণ্ড দেখে যাচ্ছে, মনে মনে হাসছে বোধহয়। কটমট করে তাকাতেই দেখলাম দ্রুত চোখ সরিয়ে নিজের ফোন দেখছে। ওদিকে পিসির সামনে বসে থাকা ভদ্রলোক বোর্ডিং পাস ফেরত দিয়ে বলছেন, “ক্লিয়ার। উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন।”
তখনও আমি খালি পায়ে আছি, উঠে আর পড়বো কোথায়। কাছের এক বেঞ্চে বসতে গিয়ে বুঝলাম, আজ নেংটু না হয়ে প্লেনে ওঠা সম্ভব হবে না। উঁহু। সরসর করে নেমে যাচ্ছে প্যান্ট-ব্যাটা। পকেটে লাখো জিনিস। তাদের বের করার উপায় নেই। চেকিংয়ের সময় বের করবেন কিছু? হয়ে গেল। ওদের বাড়ি থেকে গুছিয়ে ঢুকিয়ে এনেছেন, ব্যাগে পর্যাপ্ত জায়গা ছিলো বলে তখন মনে হয়েছে। অথচ প্লেন ছেড়ে দেবে – এমন চাপে যখন তাদের পুনরায় ঢোকাবেন, ব্যাগে অর্ধেক ঢুকিয়েই দেখবেন বাকিদের আর জায়গা নেই। চিন্তা না করে জুতো দুটো পায়ে গলালাম। একটা ফিঁতেও বাঁধলাম। তবে তারপর বুঝতে পারলাম আমি হচ্ছি শেষ যাত্রী। আর সব উঠে যাচ্ছে। স্থুলকায় তরুণীও লাইনের ভেতরে। অন্য ফিতেটাকে সরি বলতে বলতে এক হাত পকেটে রেখে (পড়ুন, এক হাত দিয়ে প্যান্ট খুলে যাওয়ায় নয়া কোনও ক্রাইসিস যেন না আসে তা সামলানোর চেষ্টা করতে করতে) দ্রুত লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উঠে পড়লাম প্লেনে, সর্বশেষ ৩ যাত্রীর একজন হিসেবে।
নিজের সিটটা খুঁজে যাচ্ছি, চোখ পড়লো দারুণ মায়াবী একজোড়া চোখের ওপর। প্লেনে উঠে প্যান্ট নিয়ে গবেষণা শুরুর যে ইচ্ছেটি ছিলো তাকে গলা টিপে মারতে হলো। ছেলেদের ঐ এক দুর্বলতা। সুন্দর মেয়েদের সামনে তারা নিজেদের পাছা বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন কোনও গবেষণা করবে না।
ধপ করে বসলাম তো বটেই। গরম চোখে তাকিয়ে থাকলাম সামনের দেয়ালের দিকে। এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না। আজকের দিনটার জন্য আমি গত দেড়টি বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আজ এমন হওয়া একেবারেই অনুচিত।
উচ্চশিক্ষার জন্য আমার প্রথম পছন্দ ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম কারণ, এখানে দুনিয়ার অনেকগুলো ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় আছে এবং তারা আর যে কারো থেকে সহজে চড়াই পাখির মতো এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়াউড়ি করতে দেয় বলে জনশ্রুতিও আছে। অর্থাৎ আপনি যদি মনে করেন আপনার জন্য ‘অমুক পথ’টি সঠিক নয়, তবে সেখানে দেড়টি বছর দিয়ে ফেলেছেন, সম্ভাবনা আছে দ্রুতই তা সংশোধন করে নিজের পছন্দের বিষয়ে সরে আসতে পারবেন, কোনওরকম হ্যাসল ছাড়াই, যেহেতু প্রচুর অপশন আছে এবং কম-বেশি একই সিস্টেম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফলো করছে। দ্বিতীয় কারণটি একান্তই ব্যক্তিগত, এবং আমার লেখক ক্যারিয়ারের সাথে এর সম্পর্ক আছে। যেহেতু উপন্যাস আমার শক্তির জায়গা, কালচারাল ডাইভার্সিটি দেখতে পারা ও অনুভব করা আমার জন্য অপরিহার্য একটি দায়িত্ব। অধিকাংশ গ্রেট রাইটারই নিজের কুয়ো থেকে বেরিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে এসেছেন, সেটা তাদের একটি আলাদা এজ দিয়েছে। আর আমেরিকার থেকে ভালো জায়গা আর কোথায় আছে দুনিয়াতে, যেখানে সব সংস্কৃতির মানুষের মিশেল আমরা দেখতে পারবো?
কাজেই, ২০১৮য় গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করার পরই ইচ্ছে ছিলো উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা করলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্র। নিজেকে গুছিয়ে অ্যাপ্লাই করতে করতে ২০১৯ সাল হয়ে যায় অবশ্য, এবং ডেডলাইনগুলো তখন প্রায় শেষদিকে। ২০১৯ সালে আমি একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করার চেষ্টা করেছিলাম, আর সেটি ছিলো ডার্টমাউথ। আইভি লীগ রিসার্চ ইউনিভার্সিটি। অ্যাপ্লাই করলেও ওখান থেকে ডাক আসতো বলে আমার মনে হয় না, তবে আমি সেটাও করতে পারিনি। প্রফেসরদের রেফারেন্স নেয়ার ক্ষেত্রেও দেরি করে ফেলেছিলাম।
ওটা ছিলো আমার পয়লা ভুল।

🇺🇸 নির্দেশনা 🇺🇸
প্রথম পরামর্শ – সবার আগে রেকমেন্ডেশন কাদের থেকে নেয়া হবে তা ঠিক করতে হবে। তখনও হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ও ঠিক করা হয়নি, কীভাবে অ্যাপ্লাই করতে হয় তাও জানা হয়নি, এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিও হয়নি কিছু, তবে সেসব পরে। সবার আগে আন্ডারগ্র্যাডের প্রফেসরদের ইমেইল/সরাসরি সাক্ষাত করে জানান যে আপনি এবার অ্যাপ্লাই করতে চলেছেন। খেজুরে আলাপ করুন বা না করুন, ভদ্রভাবে জেনে নিন তারা আপনাকে রেকমেন্ড করতে চায় কি না।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০২ – জিআরই এবং IELTS/TOEFL