আর না দেখার দিন
দুটো ইঁদুর আমার চোখ খেয়ে ফেলছে।
ইঁদুরগুলো নোংরা দেখতে। গোঁফগুলো কত মাস যে পানির চেহারা দেখেনি কে জানে! শুকিয়ে কাঠির মত খাড়া হয়ে আছে ওদের মুখের কাছে। তবে সময়ের সাথে ওরা হচ্ছে আর্দ্র।
আমার অ্যাকুয়াস হিউমার ইঁদুরগুলোর গোঁফ ভেজাচ্ছে।
খুশিতে ডানদিকের ইঁদুরটা আমার চোখে সদ্য করা গর্তটা থেকে মুখ তুললো। ডাকলোও একবার।
চিঁ চিঁ শব্দ শুনে আরও কয়েকটা ইঁদুর চলে আসে। কামড়ে খাবে ওরা।
ওরা আমার চোখ কামড়ে খাবে।
ছটফট করছি – অন্তর থেকে চেষ্টা করছি হাত দিয়ে ওদের সরাতে।
কিন্তু হাত নড়াতে পারছি কই?
প্রচণ্ড আতংকের সাথে লক্ষ্য করলাম আমার হাত দুটো নেই। কেটে কাঁধের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে তাদের। বাতাসে খামচানোর চেষ্টা করতে থাকি আমি প্রাণপণে। আমার মস্তিষ্ক অনুভূতিটা চেনে। এই কমান্ড দিলে আমার হাত নড়ার কথা।
কিন্তু প্রোগ্রাম ঠিক থাকলেও ‘মিসিং ডিভাইসে’র জন্য শরীরে কোন কাজ হচ্ছে না।
আমি চিৎকার করতে চাই। লাফিয়ে উঠতে চাই।
কিন্তু কিছুই করতে পারি না। দর দর করে ঘামছি শুধু। বার বার নিজেকে বলে যাই, স্বপ্ন, এ নিশ্চয় স্বপ্ন!
তবুও কি বাস্তব অনুভূতিগুলো –শব্দহীন চিৎকার করতে করতে গলা ভেঙ্গে ফেললাম। কাঁদতে চাইছি – কিন্তু চোখ কোথায়?
ইঁদুরের সংখ্যা এখন দুই নয়। আরও কতগুলো এসেছে। কোথা থেকে এই পাল-টা আসল আমি জানি না।
কিন্তু এদের কারও মধ্যেই ধৈর্যের লেশমাত্র নেই – যে যার মত আমার চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। একজন আরেকজনকে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। আমার মুখের ওপর ওদের উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়েছে স্পষ্ট অনুভব করতে পারি।
ওরা নখ কাটে না – আঁচরে আঁচরে মুখটা ক্ষত বিক্ষত করে দিলো। আমি অশ্রুবিহীন এক কান্না কাঁদলাম। কেউ আমাকে কি এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি দেবে না?
চিৎকার দিয়ে উঠে বসলাম। জোরে জোরে হাঁফাচ্ছি।
দুই হাত নাড়ালাম মনের মত করে। ঠিক আছে!
হাত ঠিক আছে!
মুখে হাত রেখে চমকে উঠি – শুকনো রক্ত আর খসখসে সেই ভাব ওখানে। আঁচরে মুখের চামড়া আসলেই উঠিয়ে নিয়েছিলো কেউ!
তবে সেটা আমাকে বিচলিত করে না। আরও বড় অসুবিধেটা অনুভব করতে পেরেছি একেবারে আচমকা।
ধাক্কাটা ছিলো যথেষ্ট জোরালো – আমার চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়।
কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি। চোখে খুলে রেখেও কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!
চোখের পাতা কয়েকবার জোরে জোরে নাড়ালাম – পৃথিবীটাকে আরেকবার দেখবো!
কিন্তু নেই – অসীম কালো এখন আমার চোখে।
কিছুক্ষণ পর সবকিছু মনে পড়ে যায়।
তাই তো! কিছু দেখতে পাওয়ার তো কথা না আমার!
আমি অন্ধ হয়ে গেছি।
দুই দিন হল।
১.
হাত বাড়িয়ে হাঁটছি।
ঘরগুলো আমার পরিচিত। মাঝখানের বেডরুমটা আমার।
বের হলে সরাসরি ডাইনিংয়ে পড়া যাবে। ওটা হাতের ডানদিকে রেখে সামনে এগিয়ে সামান্য বামদিকে গেলে আরেকটা বেডরুম। আর হাতের বামে রেখে এগিয়ে গেলে তিন নম্বর গেস্ট-বেডরুমটা পড়বে।
তবে কোনদিকেই গেলাম না।
ডাইনিংটা পার হলাম। এখানে একটা পাল্লাবিহীন দরজা আছে।
এটাই কিচেন। সাবধানে ঢুকি। র্যাক বা মীটসেফে বাড়ি খাওয়া চলবে না।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কান পাতলাম। এখন রাত?
নাকি খুব সকাল?
আমার কাছে সব সময়ই রাত। আলো নেই তো!
কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বুঝতে পারলাম, এখন রাত।
পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না। শুনশান নীরবতাতে টপ টপ করে সিংকে পড়া ফোঁটা ফোঁটা পানির শব্দ শুধু।
সিংক কোথায় সেটা বুঝতে পারছি। এটা একদিক দিয়ে ভালো। পা টিপে টিপে আবারও এগিয়ে যাই।
বিশ বাই পনের স্কয়ার ফিট একটা রান্নাঘর আমাদের। অনায়াসে ইনডোর ক্রিকেট খেলা যাবে। কাজেই দূরত্ব নিয়ে ভুল একটা ধারণা থাকা অসম্ভব কিছু নয়। অবাক হয়ে ভাবি, এই বাসাতে সবচেয়ে কম সময় আমি কাটিয়েছি এই রান্নাঘরে।
অন্য কোন ঘর হলে শব্দ না করেই চলা ফেরা করতে পারবো। আসবাবপত্রগুলো সরিয়ে ফেলা না হলে। কিন্তু রান্নাঘরের জন্য ব্যাপারটা আলাদা।
সিংক পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য বেশি কষ্ট করতে হল না। এবার বাম দিকের র্যাকটা কোথায়?
ছোট একটা র্যাক ছিল। ওয়ালের সাথে ঝুলতো। আমার স্পষ্ট মনে আছে। হাতড়ে ওটা ওখানে পাচ্ছি না কেন?
চোখ নষ্ট হয়ে গেছে ঠিকই – স্মৃতিশক্তিতে কোন রকম ধাক্কা তো লাগে নি।
নিষ্ফল হয়ে আরও কয়েকবার হাতড়ে মরলাম – কিন্তু ওটাকে তবুও পেলাম না।
কি সর্বনাশ!
ওই র্যাকে সবসময় তিন চারটা ছুরি থাকতোই। আমার যে খুব দরকার ছিলো একটা!
ছুরি না পেয়ে প্রচণ্ড রাগে আমার মাথার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। কে করল এই অকাজটা?
ছুরি সরালো কে ওখান থেকে?
শুধু ছুরি না – পুরো র্যাকটা সরিয়ে ফেলেছে। কাঁটাচামচটা পর্যন্ত পাচ্ছি না এখন।
কিচেনের পেছনের দিকে বড় একটা শোকেস আছে। ওদিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই। হাত সামনে বাড়িয়ে রেখেছি।
রিজার্ভ কাঁটাচামচ আর ছুরি এখানেই থাকে। কাঁচ সরানোর চেষ্টা করলাম। খুলতে হবে পাল্লাটা।
কিন্তু এক চুল নড়ে না পাল্লা। মুসীবত!
আঙ্গুল বাঁধিয়ে বাঁধিয়ে দেখলাম – একটা নতুন লক দেওয়া হয়েছে ওখানে। আগে তো ছিলো না!
বাসার সবাই বুঝে ফেলল নাকি?
‘ধারালো কিছুই খুঁজে পাবি না তুই এখানে।’, গমগমে কণ্ঠটা ভেসে আসে কাছ থেকেই, ‘চল, নিজের ঘরে ফিরে যাবি।’
ভাইয়া!
কাজটা তাহলে সেই করেছে? ছুরি সরিয়েছে আমার নাগাল থেকে?
প্রচণ্ড ক্রোধে ঘুষি মারলাম শোকেসের গ্লাসে। কাচ ভেঙ্গে হাত ভেতরে ঢুকে গেল। নিজের ডান হাতের জ্বলুনি টের পাচ্ছি ভালোই – সেসব এড়িয়ে আঁতিপাঁতি করে হাতড়াতে থাকি কাচের একটা বড় টুকরোর জন্য।
ধরে দ্রুত বাম হাতের শিরা কেটে ফেলতে হবে।
একটা পেয়েও গেলাম। একেবারে আমার মনের মত।
যত তাড়াতাড়ি বের করে করা সম্ভব বের করে ফেলেছি – বাম হাতে জায়গামত একটা পোঁচ মেরে দিতে পারলেই মুক্তি আর কেউ ঠেকাতে পারবে না!
খপ করে কেউ আমার হাতটা ধরে ফেলল।
জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম – পারলাম না। ভাইয়ার শরীরে আমার থেকে বেশি জোর। তাছাড়া ঠিক দেখতেও পাচ্ছি না কোথায় আছে ও।
ধ্বস্তাধস্তি না করে হাল ছেড়ে দিলাম – একাধিক জোড়া পায়ের ছুটে আসার শব্দ পাই রান্নাঘরের দিকে।
পরমুহূর্তেই আম্মুর কাঁপা গলাটা শুনতে পেলাম, ‘কি হয়েছে? ওমা! হাত কাটলো কি করে ও? ইমন!’
আমি কিছু বললাম না।
ভাইয়া চুপ করে থাকে না অবশ্য, ক্ষেপাটে গলাতে বলে, ‘ঠিক যেরকমটা বলেছিলাম – তোমার ছেলে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে জ্ঞান ঠিকমত ফিরে পেতেই।’, আমার হাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দেয় ও, ‘শোন ইমন, আরেকবার যদি দেখি তুই এই কাজ করার চেষ্টা করেছিস – লেখার ব্যাপারে কোন হেল্প আমি করব না। বুঝতে পেরেছিস তুই?’
আমি এবারও কিছু বললাম না।
কেন জানি মনে হল, আম্মু কাঁদছে। আব্বুর গলাটা শুনতে পেলাম, ‘নাটক না করে ওর হাতে ব্যান্ডেজ তো বাঁধবে। এদিকে নিয়ে আসো।’
ওরা আমাকে ভালোবাসে – অনুভূতিটা প্রথমবারের মত বেশ তিক্ত একটা রেশ ফেলল আমার মনে।
কেন বাসে?
বুঝতে পারছে না কেন ওরা – আমি এখন বের হয়ে গেছি। এই জগতের মাঝে আমি নেই – আমার মাঝে আমি নেই!
হেরে গেছি আমি। একেবারেই হেরে গেছি!
২.
ভাইয়া আমেরিকা থেকে চলে এসেছে।
ব্যাপারটা আমি জেনে একটু অবাকই হলাম।
মাত্র তিন মাস আগেই মিনেসোটা স্টেটে পাড়ি জমিয়েছিলো ভাইয়া। পিএইচডি হল লক্ষ্য। এক বছরের আগে তো আসার কথা নয়।
আমার দুর্ঘটনার কথা শুনে দৌড়ে আসার তো কারণ দেখলাম না। এখানে ভাইয়া থাকলেই কি আর আমি দেখতে পাবো?
কথাটা ভাইয়াকে বলেও ফেলেছিলাম, হাল্কা হাসির শব্দ শুনে বুঝলাম, ঠোঁটের কোণে পরিচিত সেই হাসিটা ও ঝুলিয়ে রেখেছে। আমাকে শুধু বলল, ‘আমি না থাকলে এতক্ষণে নিজের পেটে ছুরি মেরে পড়ে থাকতি। ভাগ্যিস আমার আসতে যে সময় লেগেছে – তার মাঝে জ্ঞান ফেরেনি তোর!’
তর্ক করলাম না। আর কেউ এ বিষয়ে কিছু বলে নি। ডক্টরও না।
ভাইয়া নিজে থেকেই কিভাবে জানি বুঝে নিয়েছিলো আমার চিন্তা একটু পরিষ্কার হলেই আত্মহত্যার চেষ্টা করব আমি। ঠোঁট বাঁকিয়েই মনে হয় বলেছিল, ‘আমার এখানে আসাটা তোর সার্ভাইভালের জন্য প্রথম শর্ত – এইটা আমি নিশ্চিত।’
আমি সারাদিন বিছানাতে শুয়ে থাকি।
ছোটভাইটা আমার চারপাশে সব সময় পোষা বিড়ালের মত ঘুর ঘুর করে। একটু সাহায্যে লাগতে পারলে খুব খুশি হয়।
আমি বুঝতে পারি – প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছে ও আমার এই হাল দেখে। যতক্ষণ ও থাকে – বেদনাতুর দৃষ্টিটা আমি সব সময় অনুভব করতে পারি আমার শরীরের ওপর।
স্কুলে যখন ও চলে যায় তখনই কেন জানি স্বস্তি লাগে একটু।
নিজেকে মানুষের সাইকোলজি দিয়ে বুঝিয়েছি – ‘এটা সিমপ্যাথি স্টেজ’। এটা পার হলে ওরা আর এমন করবে না।
এই স্টেজ পার করার জন্য একটু বেশিই ব্যস্ত আমি। মানুষ সবসময় যদি মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে থাকে – কেমন লাগে?
এখন শুয়ে শুয়ে লিংকন পার্ক শুনছি। মাহীটা হয়েছে আমার ডিজে। যখন যেই গান দিতে বলছি সেটা প্লে করে দিচ্ছে।
মাঝে মাঝে আমার অগোছালো এবং সম্পূর্ণ ভর্তি এক টেরাবাইটের হার্ডডিস্কে কাঙ্ক্ষিত ফাইলটা খুঁজে পাচ্ছে না। তখন আমি তাকে বলে দিচ্ছি কিভাবে কিভাবে যেতে হবে।
আমাকে সব সময় ওয়াচে রাখার ব্যবস্থা করেছে ভাইয়া।
চিরকাল ও এখানে থাকবে না। আমেরিকাতে ফিরে যেতে হবে ওকে। ইতস্তত করছিলো ও – তবে আমিই জোর করছি। ভাইটার স্বপ্নপূরণের মাত্র একটা ধাপ বাকি। নিজের জন্য ওটা আটকে দেবো নাকি?
কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে সম্পুর্ণ নিরাপদ দেখে যেতে চায় ও। আর অবশ্যই চোখের ব্যাপারে আরও আশাব্যঞ্জক কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে ও পাগলের মত।
কিন্তু আমার কেসটা হতাশাজনক।
এই চোখ দুটো আর ভালো হওয়ার নয়।
ডক্টর বলেছে, মাথার ভেতরে যে ইনফেকশন হয়নি এটা একটা বিস্ময়। আরও বড় বিস্ময় আমার বেঁচে থাকাটা। একে তো এই পর্যায়ের এক ব্লান্ট ট্রমা তার ওপর পেনিট্রেটিং ইনজুরি। বেড়ালের জান কি না কে জানে – তবে আমার জন্য অন্তত এই বেঁচে থাকাটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। যেটা আমি পারছি না।
মানুষ তো – আশা আকাঙ্ক্ষা একটু বেশিই।
ভাইয়ার কাশি শুনলাম।
নিজের উপস্থিতি বোঝাতে ইদানিং নতুন ঢং শুরু করেছে। কাশে।
বিরক্তমুখে জানিয়ে দেই, ‘যক্ষ্মা রোগীর মত কাশবি না। দরকার হলে গলা ফাটিয়ে বলবি, এসেছিস।’
ভাইয়া আমার কথার জবাব না দিয়ে জানতে চাইলো, ‘কেমন বোধ করছিস?’
হেসে ফেললাম। অদ্ভুত রকমের এই বাক্যটা মানুষ কথা বলার সময় সাধারণতঃ ব্যবহার করে না।
কিন্তু ভাইয়া করে।
আমাকে অসুস্থ দেখলে আগেও জানতে চেয়েছে কতবার – ‘কেমন বোধ করছিস?’
সে জ্বর, সর্দি, কাশি বা বাসের দুলুনিতে হাল্কা অসুস্থ বোধ করাই হোক।
আমি বললাম, ‘আগের চেয়ে ভালো। গানটা বন্ধ কর তো।’
আর কিছু না বলে ভাইয়া গান পজ করে দেয়। স্পেস বাটন চাপার শব্দটা খাট থেকে স্পষ্ট পেলাম।
তারপর কোমল গলাতে বলে, ‘এখন তোর টাইপিস্ট হতে আমার কোন আপত্তি নেই।’
আমি উত্তেজনাতে লাফিয়ে উঠি একেবারে। বসে পড়ে হাতড়ে হাতড়ে একটা বালিশ নিয়ে এসে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলাম।
‘মাইক্রোসফট ওয়ার্ড বের কর।’
ভাইয়া তিন সেকেন্ড পরই জানালো, ‘করেছি।’
‘তুই রেডি?’, অস্বস্তিতে জানতে চাই আমি।
ভাইয়া জানালো, ‘হুঁ।’
আটকে গেলাম হঠাৎ!
আজ আমার মাথাতে গল্পের কোন প্লট নেই! আছে আছে – মনে হচ্ছে। কিন্তু ধরা দিচ্ছে না তারা।
দুই হাতে মাথা খামচে ধরি আমি অল্প সময়ের মাঝেই। অক্ষমতাটা কোথায় বুঝতে পারছি!
গল্প আমি তাৎক্ষণিকভাবে টাইপ করে লিখতে পারি। কিন্তু বলতে তো পারি না। অভাবে আমার লেখালেখির অভ্যাস তো আর গড়ে ওঠেনি।
এষার রাত তিনটার সময় করা আবদারগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।
পরিবারের পর যদি কেউ আপন হয়ে থাকে – তবে সেটা এই মেয়ে। রোজ রাতে ওর সাথে কথা হত আমার। ভোরের কাছাকাছি সময়ে মেয়েটার উঠতো গল্প শোনার সখ। আমাকে বলত, ‘অ্যাই, আমায় একটা গল্প শোনা।’
প্রতিবারই আমি উৎসাহের সাথে শুরু করতাম। কিন্তু তারপর দেখতাম প্লটগুলো আমি কী-বোর্ডের সামনে এসে বসলে যেভাবে ডালপালা মেলে দেয় – এখান তা হচ্ছে না।
আমি গল্প লিখতে পারি – বলতে পারি না!
জানি আমার চোখের দৃষ্টি যথেষ্ট শূন্য এখন – তার পরও মস্তিষ্ক জানালো এই মুহূর্তে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি। অঙ্গটা নেই দেখে সেটা হয়তো তেমন দেখাচ্ছে না!
ভাইয়ার গলাটা শুনতে পেলাম, ‘থাক, নিজেকে ফোর্স করিস না। আরেকদিন হবে।’
আমি বিড় বিড় করে শুধু বললাম, ‘আমি আর কোনদিনও লিখতে পারবো না!’
৩.
নতুন একটা সানগ্লাস কিনে দিয়েছে আব্বু আমাকে।
ওটা পড়ে থাকি না বাসাতে। দরজা লাগিয়ে বসে থাকি। প্রায় সারাদিনই।
বুকপকেটে রাখি সানগ্লাস। যখন দরকার হবে যাতে পাওয়া যায়।
সানগ্লাস কিনে দেওয়ার পরই হাল্কা পাতলা বুঝতে পেরেছি চেহারাটা আমার কেমন হয়েছে। ভয়ানক নিশ্চয়। চোখের জায়গায় অমন ক্ষত কে সহ্য করতে পারে! এরপরে তো আর ওদের সামনে বের হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বাইরে একবার বের হয়েছিলাম হাসপাতাল থেকে বের হয়ে। মাত্র একবার।
বাসার সামনের মাঠটাতে আমার ছোটভাই আমাকে হাঁটতে নিয়ে গেছিল। সমস্যা হল, চোখ নষ্ট হওয়ার পর থেকে আমার কান আগের তুলনায় বেশি কাজ করছে। বলা চলে কান আর নাকের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছি আমি। পঞ্চইন্দ্রীয় আস্তে করে হয়ে গেছে ‘চৌঠা-ইন্দ্রীয়’। দিন দিন সাপ হচ্ছি। শব্দ শুনেই যা বোঝার বুঝতে হয়।
মাঠে হাঁটতে নেমে সেরকম একটা শব্দই শুনলাম।
একটা কণ্ঠ, মেয়ে কণ্ঠ। গলার শব্দ শুনে মেয়েদের বয়স বোঝা কঠিন। তবে অনুমান করলাম চৌদ্দ হবে। তাছাড়া এটা একটা হাউজিং ব্যবস্থা। এখানে যারা থাকে সবাই স্কুল অথবা কলেজের ছাত্র। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়ে যারা আছে তাদের বেশিরভাগই থাকে নিজ নিজ ইউনিভার্সিটির কাছে। কাজেই মেয়েটার বয়েস চৌদ্দ হতেই পারে।
ও বলেছিল, ‘দ্যাখ, এত ভয়ঙ্কর দেখতেও হয় মানুষ!’
কাকে বলেছিলো আমি জানি না। জানতে চাই নি।
সোজা বাসায় চলে এসেছি।
ইদানিং আরেকটা অনুভূতি খুব ভোগাচ্ছে। অন্ধ হওয়ার পর থেকে দেখলাম পৃথিবীতে আর কোন কাজ নেই আমার – যেটা আমি পারি! আগে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হত। দিনে দু-তিন ঘণ্টা ঘুমাতে পারলে খুশি হয়ে যেতাম।
কারণ, ওটুকুই জুটতো না কোন কোন দিন।
আর এখন বলতে গেলে সারাদিন ঘুমাই। মানে, জেগে থাকা আর ঘুমানোর মাঝে তেমন পার্থক্য তো দেখি না।
অবসর কাটানোর প্রিয় উপায় যে ছেলের বই পড়া – তার চোখ নষ্ট হয়ে গেলে আর কিভাবে সময় কাটাতে পারে সে?
ভাইয়া আমাকে বই পড়িয়ে শোনাবার চেষ্টা করেছিল। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছিল। প্রতি পনেরো সেকেন্ডে একটা পৃষ্ঠা পড়ি আমি, সেখানে ধীরে ধীরে দুই মিনিট ধরে ওইটুকু পড়ে শোনাবে আমাকে ভাইয়া?
মজা কোথায় তাহলে বইয়ের? মেশিনগানের মত মাথার মাঝে শব্দগুলো যখন নাই খেলল?
ঝোঁকের মাথাতে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম। ভাইয়াকে একবার ডাক দিতেই বাসার অন্যপাশ থেকে সাড়া দিলো।
তারপর কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আমার ঘরে এসে জানতে চায়, ‘বলে ফেল।’
বললাম, ‘মোবাইলটা অন কর।’
অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে মোবাইল অন করি নি। শত মানুষের সিমপ্যাথির শোনার কোন ইচ্ছে আমার ছিলো না।
আজকে মনে হচ্ছে, একটা অন্তত ফোনকল কেউ পায় আমার কাছ থেকে।
ভাইয়া জানালো, মোবাইল অন হয়েছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
‘টু স্কয়ার ইজ ইকুয়াল টু থ্রি স্কয়ার নামে একটা নাম্বার আছে। বের কর।’
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে ভাইয়া, ‘কি?’
আরও থেমে থেমে উচ্চারণ করি আমি, ‘থ্রি লেখে সার্চ দিলেই পাবি।’
দ্রুত বলে ও, ‘পেয়েছি।’
হাত বাড়িয়ে দিলাম, ‘কল কর। তারপর আমাকে মোবাইল দিয়ে বেড়িয়ে যা এই ঘর থেকে।’
হাতের ওপর মোবাইলটা ফেলে শুকনো হেসে ভাইয়া চলে যায়।
টাচ স্ক্রিন ফোনের প্রথম সমস্যা টের পাই আমিও। চোখ না থাকলে ব্যবহার প্রায় অসম্ভব। ভয়েস কমান্ড আমার ফোনে নেই। বাটন হলে মুখস্থ চেপে ফোন চালাতে পারতাম। কানে ফোনটা ঠেকাতে শুনতে পাই – ওপাশে রিং হচ্ছে।
দম বন্ধ করে আমি অপেক্ষা করতে থাকি মিষ্টি একটা গলা শুনতে।
একদম শিশুদের মত কণ্ঠটা শোনার অপেক্ষাতে আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক ধ্বক করতে থাকে!
৪.
‘কেমন আছিস?’, প্রশ্নটা করে ফেললাম আগুপিছু না ভেবেই।
এষার গলাটা শুনতে পেলাম না ওপাশে। একেবারে চুপ চাপ।
ফোন ধরার আগেই কেটে যায় নি তো? কেটে গেলে তো একটা ব্লিপ দিতো। নাকি দিয়ে ফেলেছে, আমি শুনতে পাই নি?
দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে আরেকবার বললাম, ‘হ্যালো?’
ওপাশে হাল্কা নাক টানার শব্দ শুনলাম মনে হয়, এষার কাঁপা কণ্ঠটা শুনতে পাই তারপরই, ‘বল। শুনছি।’
বিব্রত বোধ করি হঠাৎই, ‘কাঁদছিস কেন?’
‘খুব পর হয়ে গেছি আমি? খুব বেশি পর?’
মেয়েটা আচমকা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। আমি এবার চুপ হয়ে যাই।
‘সেদিনের পর আজ কত দিন পার হয়েছে জানিস?’
আমতা আমতা করি এবার, ‘ইয়ে, দিনতারিখের হিসেব তেমন রাখি না। ক্যালেন্ডার দেখি না তো।’
‘তেইশ দিন! তেইশটা দিন পার হয়েছে – তোর নাম্বারে কত বার ফোন করেছি আমি সেটা কি একবারও বুঝতে পেরেছিস? কম করে হলেও দশ হাজার বার ফোন করেছি আমি তোকে!’
‘তেইশ দিন, না?’, উদাস হয়ে যাই আমি, ‘তাহলে আজ অক্টোবরের তের? পরশু রুয়েট খুলে যাবে।’
এষা কিছু না বলে আরেকবার নাক টানলো।
‘আমার ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার এখানেই শেষ!’ কথাটা মনে মনেই বললাম। মুখে বলে এষাকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। এমনিতেই খুব রেগে আছে। মোবাইল একেবারে বন্ধ করে রাখার আগে আমার ওর সাথে কথা বলে উচিত ছিলো – সেটাই তার ধারণা।
তখন তো ছিলাম সুইসাইড স্কোয়াডে। ফোন-টোনের চিন্তা মাথায়ই ছিলো না। এ কথা তো আর এষাকে বলা চলে না।
‘কেন ফোন দিয়েছিস এখন, হুঁ?’, বলে এষা, ‘এখন তো আর আমাকে চিনিস না। ডায়লগ ছাড়? কই, ছাড়বি না?’
‘কোন ডায়লগ?’, অবাক হলাম।
‘বল – তোর মত অন্ধ একটা ছেলের সাথে আমার থাকা উচিত হবে না। আমার জন্য আরও ভালো ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আমার উচিত তোকে ভুলে যাওয়া – বল এসব?’
মেয়েটা একেবারে গ্রেনেড হয়ে আছে, প্রমাদ গুনি আমি, ‘যুক্তি তো তাই বলে। আমি তো বলিনি আমার সাথে থাকতে তোকে। এই পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব না – সেটা আমি জানি। তাছাড়া আমি নিজেই তোকে আর আমার জীবনে দেখতে চাই না।’
‘তা চাবি কেন? আমি তো এখন পর।’ হাল্কা ধরে যায় এষার গলাটা।
‘তা না। কিন্তু বন্ধুত্বের বেশি কিছু আর থাকা উচিত না এখন। অথর্বের ঘাড়ে ঝোলাতে তোর আপত্তি না থাকতে পারে – তোর ওরকম একটা ভবিষ্যৎ দেখতে আমার আপত্তি আছে।’
ওপাশে এষার দীর্ঘশ্বাসটা শুনতে পেলাম স্পষ্ট, ‘শুরু হয়ে গেলো। সেজন্যই তো বলেছিলাম, ডায়লগ দে! আরও বেশি করে দে!’
‘এর পরে চোখ নষ্ট হলে সবার আগে তোকে ফোন দেব। প্রমিজ।’ রাগ করে বললাম।
এষা নিজেকে সামলে নেয়। বুঝতে পারছে এখন ঠিক ঝাড়ি খাওয়ার মুডে আমি নেই।
‘আমি চট্টগ্রামে আসবো। তোর ঠিকানা দে।’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘আম্মু বাসাতে আমার নারীসঙ্গ অ্যালাউ করবে না।’
‘আমাকে দূরে রাখার চেষ্টা করবি না, খবরদার! হোটেলে উঠবো আমি, ঠিক আছে? ঠিকানা দে!’
পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘তুই কি ঢাকায়? নাকি রাজশাহী চলে গেছিস?’
এষার গলার পর্দা আরেকটু উঠল, ‘তা জেনে তোমার দরকার কি?’
খুব রেগে গেলে অথবা আমার জন্য খুব মায়া হলে ও আমাকে ‘তুমি’ করে বলে। এখন মায়ার কিছু দেখলাম না। তারমানে রেগে আছে।
আস্তে করে বললাম, ‘ঠিকানা ল্যাখ। আমাকে জানাইস কয়টায় বাস। ভাইয়াকে পাঠিয়ে দেব তোকে নিয়ে আসতে। আমিই যেতাম – কিন্তু -’
এষার গলা নরম হয়ে আসে, ‘তোমাকে আসতে হবে না। ভালো ছেলের মত শুয়ে থাকো। আসছি আমি।’
আমি কিছু বলতে চাইছিলাম, এষাই বাঁধা দেয়, ‘এখন আটটা বাজে। তুই ফোন রাখ তো। দেখি আজ রাতের বাস পাওয়া যায় কি না।’
‘এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?’, তাড়াতাড়ি বললাম, ‘ধীরে সুস্থে আয় তো।’
‘ফোন রাখ তুই। বাসে উঠে আমি জানাবো। আর যদি আবার ফোন বন্ধ পেয়েছি – খুন করে ফেলবো একেবারে!’
‘খুন করার সখ থাকলে চাকু-টাকু নিয়ে আসিস। এ বাসাতে কিছুই পাবি না।’
গর গর করে উঠল ও, ‘তোকে খুন করতে আমার চাকু লাগে না। ফোন রাখ হারামি।’
আমি বাধ্য ‘হারামি’র মত ফোন রাখলাম। মেয়েটা এরকমই, খুবই শান্ত।
আবার খুবই হিংস্র।
হিংস্র ভাবটা কৃত্রিম। কাছের মানুষগুলোর সাথেই এই রূপটা দেখায় ও। আর এজন্যই আমার ওকে এত ভালো লাগে।
মিষ্টি মিষ্টি গলাতে কিছু স্বান্তনার বাণী শোনানোর মত মানুষ ও না। একসাথে থেকে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী।
এত বড় ঝামেলাতে পড়ে গেলাম, অথচ সে গুণটাই বের হয়ে আসছে তার মাঝ থেকে।
ভাইয়ার হাসি হাসি গলাটা শুনতে পেলাম, ‘মেয়েটার নাম কি?’
খারাপ লোক!
সব কথা শুনে নিয়েছে!
কেন জানি আজ একটুও রাগ করতে পারলাম না ওর ওপর। হেসে ফেললাম।
বললাম, ‘এষা।’
৫.
ঘরে আমি আর এষা।
আর কেউ নেই।
আমি সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারতাম না। এষা নিশ্চিত করেছে। জানি মন খারাপ করে এখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কাল রাতে ছোটভাই মাহীকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আমাকে দেখতে কুকুরের মত লাগছে এখন। তাই না?’
ও অপরাধী অপরাধী একটা কণ্ঠে বলেছিল, ‘আরে নাহ। একদম আগের মত লাগছে তোমাকে। শুধু চোখে সানগ্লাস।’
আমি জানি, কথাটা মিথ্যা। নিজের গালে হাত দিয়েই বুঝতে পেরেছি – রোজ কয়েকবার রোলার চালালেও ওই চেহারা আর মসৃণ হবে না আমার। কিন্তু কিছু বলি নি।
মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় তো ওর ছিলো না।
ও তো আর বলতে পারে না, ‘তোমাকে স্রেফ যোম্বিদের মত লাগছে ভাইয়া! পার্থক্য হল যোম্বিদের একটা চোখ ফাটা থাকে – আর তোমার দুই চোখই ফাটা!’
‘সানগ্লাস খোল তো। আমার সামনে ঢং করতে হবে না।’, ক্যাটক্যাট করে ওঠে মেয়েটা, ‘তুই যেভাবে আছিস তোকে সেভাবে দেখতে চাই আমি।’
‘কিন্তু-’, কিছু বলার আগেই চট করে সরিয়ে নিলো ও সানগ্লাসটা। বাতাসে খামচি দিয়েও আটকাতে পারলাম না।
‘চোখ অপারেশন করে পাল্টে দেওয়া যায় না রে?’ দুঃখী গলাতে জানতে চায় এষা। এর মাঝে বাসার সবার সাথে পরিচয়পর্ব ওর শেষ হয়েছে। বাসা থেকে একরকম যুদ্ধ করেই একা এসেছে ও। ওর আম্মু আসতে চেয়েছিলো সাথে, নেয়নি।
আমি মাথা নাড়ি, ‘টিস্যু ফেঁড়ে ফুঁড়ে গেছে। কার সাথে কানেক্ট করবে নতুন চোখ?’
‘উন্নত মানের অনেক চিকিৎসা-’
‘টিস্যু বানাতে হবে আমার জন্য নতুন করে। তাও আমার কনফিগারেশনে। তারপরে সেখানে আবার চোখ লাগাতে হবে। আমেরিকাতে মিলিটারিদের কাছে এ প্রযুক্তি আছে হয়ত। আমার জন্য না সেটা।’
এষা বুঝতে পারে। এবার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে তাড়াতাড়ি।
‘তোর টাইমলাইন ভেঙ্গে ফেলছে পাবলিক। ভাইয়াকে দিয়ে শেষ স্ট্যাটাস দিয়েছিলি – এর পর তো আর কিছু জানাস নি। সবাই অস্থির হয়ে আছে তোর খবর জানার জন্য।’
ভাইয়াকে দিয়ে নিজের টাইমলাইনে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম বর্তমান অবস্থার কথা বলে। সেই কবেকার কথা!
এষাকে ইঙ্গিতে কম্পিউটারটা দেখালাম। নিজের ঘরের সবকিছু কোথায় আছে তা জানা আছে আমার। চোখ না থাকলেও স্পর্শ করতে সমস্যা হয় না।
‘তুই আমার আইডিতে ঢোক। পাসওয়ার্ড মনে আছে?’, আগে ওকে পাসওয়ার্ড একবার দিয়েছিলাম। কাজেই জানতে চাই।
‘আছে। ঢুকছি।’, ঘাড় কাত করেছে ও নিশ্চয়? দেখতেই পাচ্ছি না ছাই কিছু!
কতদিন এষার মিষ্টি মুখটা দেখি না? ভাইয়ার মুখ? ছোটভাই বা আম্মু-আব্বুর মুখ?
কত কাছে ওরা! অথচ কত দূরে!
‘মনে আছে – একদিন তোকে বলেছিলাম, তোর প্রতি মেন্টালি তো বটেই – ফিজিকালি অ্যাট্রাক্টেড আমি?’
নিশ্চয় লাল হয়ে গেছে মেয়েটা, গোঁ গোঁ করে বলল, ‘স্বভাব তোর এখনও ঠিক হল না!’
‘তুই জানতে চেয়েছিলি আমি তোর দিকে তাকিয়ে থাকি কি না।’ আমি ওর কথা না শোনার ভান করে বলে যাই, ‘আমি বলেছিলাম, মাঝে মাঝে তাকাই। তুই বলেছিলি, “চোখ উপরে ফেলবো তোর ”।’
‘আমি সত্যি মীন করে বলি নি রে।’ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে ও।
‘আমি তোকে দোষ দেই নি, পাগলি। শুধু বলছি, দেখ – ব্যাপারটা আয়রনিক। তাই না?’
এষা আমার কথার জবাব দিলো না। বলল, ‘ঢুকেছি। কি স্ট্যাটাস দিবো?’
‘লেখ-’, ওকে বলি, ‘চোখ হারিয়েছি। লেখালেখি আমার এখানেই শেষ। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। যাঁরা পাশে ছিলেন আর যাঁরা ছুরি মেরেছিলেন – সবাইকেই। জীবনের প্রাপ্তিগুলোর মাঝে আপনাদের ভালোবাসা আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটা প্রাপ্তি । দুঃখিত, ইরফান সিরিজ শেষ করে যেতে পারলাম না। আর “মিথস্ক্রিয়া” উপন্যাসটা ছেড়ে দিলাম প্রকাশকের ইচ্ছের ওপর। ১৭২ টা গল্প রেখে গেলাম, তাই আইডি ডিঅ্যাক্টিভ করবো না। লেরকের কাজ শেষ করে যেতে পারলাম না। এজন্য আমি দুঃখিত। আমি সত্যিই দুঃখিত।’
কিছুক্ষণ পর জানতে চায় ও, ‘আর কিছু?’
‘নাহ। পোস্ট করে দে।’ ভাবলাম, এখন লম্বা সাহিত্য লেখার সময় না। আর কি বলার থাকে একজন অন্ধ লেখকের?
একটু পর বিছানা শব্দ করে ওঠে। বুঝলাম, খাটে উঠে বসেছে ও। তারপর আমার হাত টেনে নেয় নিজের কাছে।
‘আবার লিখতে পারবি – দেখিস। একটা কাজ কর। কী বোর্ডে এসে বস। এতদিন ধরে লেখছিস – না দেখে টাইপ করতে পারবি না?’
অবসন্নের মত মাথা নাড়লাম, ‘জানি না রে। না দেখে টাইপ করা সমস্যা নয়, তবে একবার কার্সর অন্য কোথাও চলে গেলে এরপরের এক-দুই ঘণ্টা যা লিখবো সবই উল্টোপাল্টা জায়গায় টাইপ হবে।’
আমি নড়ছি না দেখে ও আবার বলে, ‘আমাকে নিয়ে আরেকটা গল্প ল্যাখ। আমি একা – সিরিজের আরেকটা গল্প?’
‘আমি একা – ০৯!’, ফিস ফিস করে বললাম।
আমার ক্ষত বিক্ষত গাল ছুঁয়ে দেয় মেয়েটা, ‘চাইলে আমি দোকা – ০২ ও লেখতে পারিস। আমার কোন আপত্তি নাই।’
হাতড়ে হাতড়ে উঠে পড়লাম। চেয়ারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি – অনুভব করি এষা আমাকে ধরে পথ দেখাচ্ছে। চেয়ারে বসার পর হাতড়ে কী-বোর্ডটার অবস্থান বের করলাম।
পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এষা, ফিস ফিস করে বলে, ‘কীবোর্ড তোর শরীরের একটা অংশ। এমনই না বলেছিলি আমাকে? ফীল কর ওটাকে। ওটা তোর শরীরের একটা অংশ।’
অনুভব করি আমি প্রতিটা কী-কে। আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেই সবগুলোকে। ওই ছোট ছোট চারকোণা কী-গুলো আমার কত আপন!
আমি ভালোবাসি ওদের। ছোঁয়ার সাথে সাথে আঙুল চালানোর জন্য আমার হাত নিশপিশ করতে থাকে।
এষাকে বললাম, ‘মাইক্রোসফট ওয়ার্ড খুলে দে।’
আমিও চেষ্টা করতে পারতাম, তবে কী হবে যদি কোন এক পপ-আপ খুলে থাকে আর আমি মনে করি ওটা বোধহয় এডিটরে চলে এসেছে? পণ্ডশ্রম হবে এরপর যা লিখবো সব-ই।
আমার কাঁধের ওপর দিয়ে মাউসটা ধরল ও, একবার ক্লিকের শব্দ শুনলাম। টাস্কবারের সাথে লাগানো আছে ওটা। চার সেকেন্ড পর এষা বলল, ‘রেডি। ট্রাই কর।’
আলতো করে হাত নাড়াই আমি। F12 তে একবার চাপ দিতেই ‘বাংলা’ হয়ে গেল অভ্র। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছি। ঘাড়ের কাছে এষার নিশ্বাস এখন রীতিমত বিরক্তিকর লাগছে। ওকে একটু রুক্ষ গলাতেই বললাম, ‘যা, আম্মু আব্বুর সাথে গল্প কর। কেউ থাকলে লিখতে পারি না।’
‘যাই। তুমি চেষ্টা কর।’ বলেই গালে টুক করে একটা চুমু খায় ও।
আমি ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকি – কেউ দেখে ফেললে কি হবে!
ঘাড়ের পেছন থেকে মেয়েটা দূর হতেই মনে মনে কী-বোর্ডকে একবার বললাম, ‘জান, বিট্রে কইরো না আমাকে এই সময়। প্লিজ।’
আমার পৃথিবী এখনও অন্ধকার। কালো– নিকশ কালো আমার সামনে। ডেস্কটপের মনিটরের উজ্জ্বল প্যানেল দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে পাচ্ছি না আলোর ছোট কোন বিন্দু।
আলোকিত ঘরে চোখ বুজলে তো তাও একটা আভা দেখা যায়। আমি তাও দেখি না আজ কতদিন!
শিউরে উঠলাম বাকি জীবন এভাবে থাকতে হবে ভেবেই। কুয়োর অন্ধকার চারপাশে – কেন এমন হল আমার সাথেই?
আজকে আমি ‘আমি একা -০৯’ লেখব। পার্থক্য এটুকুই হবে – এটা বিভ্রক থাকছে না।
এষাকে মনে পড়তে আমার রক্তগুলো আলোড়িত হয়। মেয়েটা না থাকলে ওই ১৭২ গল্প আমাকে লেখতে হত না। তুচ্ছ ব্যাপারে ঝগড়া করে আমরা আলাদা হয়ে না গেলেও পারতাম চার সপ্তাহ আগে!
একসাথে বাসে করে ঢাকা আসার কথা ছিলো আমাদের। তারপর সেখান থেকে আমি চলে যেতাম চট্টগ্রাম।
হল কোথায়? ঝগড়া করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওর সাথে যাবো না। মেয়েটা কত করে বলেছিলো আমাকে – টিকেট কেটে ফেলেছিলো দু’জনের।
তবুও আমি যাই নি।
খুব বড় গলায় ওকে শুনিয়ে দিয়েছিলাম, ‘কেপিকে লোকজন এমনি এমনি সাইকো ডাকে না। দেখতে চাও তুমি, কেন বলে? তোমার সাথে আর জীবনে যাচ্ছি না আমি কোথাও। আর ফোন-টোনও দিও না প্লিজ। একবার যা বলি, আমি তা করি।’
তারপর নিজের জন্য আলাদা করে চট্টগ্রামের জন্য বাসের টিকেট কেটে নেই আমি। সেদিন রাতে এই শক্ত মেয়েটা কেঁদেছিল। আমি পাত্তাই দেই নি। আরেকটা গল্প লেখার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম।
ফালতু আবেগে কাজ কি?
ঠিকমত ঢাকাতে পৌঁছায় এষা। কিন্তু আমার বাসটা কুমিল্লা পার হয়েই অ্যাকসিডেন্ট করল।
আমার শুধু মনে আছে জানালার ঠিক পাশে বসেছিলাম। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। এটা স্বাভাবিক। আমি চট্টগ্রামে গেছি আর বৃষ্টি পড়েনি এমনটা কখনও হয়নি। ঠাট্টা করে নিজেকে কতবার ডেকেছি ‘ওয়েদারম্যান’ বলে!
আমাদের বাসটা পিচ্ছিল রাস্তাতে ছুটছিলো বেপরোয়া ভাবে।
অন্ধকার আমাদের চেপে ধরেছিলো ভারী একটা চাদরের মত।
পুরো বাসটা কেঁপে উঠেছিলো তারমাঝেই। আমার পাশের জানালার কাচটা ভেঙ্গে কুচি কুচি হয়ে যাচ্ছে – এমন একটা দৃশ্যই আমার দেখা শেষ কিছু।
এর পরেই চোখে খুব জোরে কিছু ঢুকে গেল। দুইবার লাফিয়ে ওঠে আমার চোখের ভেতরটা। তারপর ভেতরে অদ্ভুত রকম গরম একটা অনুভূতি। এর একসেকেন্ড পরেই আসলো ওটা।
অমানবিক একটা যন্ত্রণা!
চোখের যন্ত্রণাতে পাগল হয়ে গেছিলাম। কতক্ষণ অসহ্য যন্ত্রণাতে চিল্লিয়েছি মনে নেই। অথচ এই আমিই কি না ভাবতাম – যত যন্ত্রণাই হোক – মুখ বুজে সহ্য করতে পারি আমি! গাল বেয়ে না – কপাল বেয়ে চোখের গলিত তরলগুলো পড়ছিলো আমার। কারণ বাসটা ততক্ষণে উল্টে গেছে!
সম্ভবতঃ এর পরেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি।
“নিজেকে গুরুত্ব দেওয়ার মত মানুষ আমি মনে করি না।
কারণ, আমি একা।”
লাইন দুটো লেখে হাঁক ছাড়লাম, ‘এষা?’
হুড়মুড় শব্দ শুনে বুঝলাম বাসার সবাই চলে এসেছে এবার। বদ মেয়েটা নিশ্চয় বলেছে ওদের আমি আবার লিখছি?
ভাইয়ার খনখনে হাসির সাথে উপহাসের ছায়াও খুঁজে পেলাম না। ওতে স্বস্তি-ই আছে শুধু।
‘প্রতি দুই শব্দে একটা করে বানান ভুল। কিন্তু, লেখেছিস তাহলে!’
আমি সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলাম। অতো খারাপ করিনি নিশ্চয়, ইচ্ছে করে পচাচ্ছে।
আম্মু বলতে শুনি, ‘কি আশ্চর্য – না দেখেই লিখে ফেলেছে! বানান আমরা ঠিক করে দেবো। অসুবিধের কি আছে? তুমি দেখবা পড়াশোনাও করতে পারবা। ব্রেইলী রিডিং শিখতে হবে তোমাকে শুধু। পারবা তো।’
আমি ওদের মাঝে নতুন করে আশা জন্মাতে দেখেও শান্তি পাই না। আমার মাঝে কি আর কিছু বাকি আছে পৃথিবীকে দেওয়ার মত? আমার মনে হয় না।
অনুপম রায়ের গলাটা আমার কানে বেজে ওঠে যেন –
হিসেবের ভীরে আমি চাই না ছুঁতে
যত শুকনো পেঁয়াজগুলি ফ্রিজের শীতে
আমি ওবেলার ডালভাত ফুরিয়ে গেছি …
৬.
সারাদিন ঘরেই বসে থাকি। জোর করে এষা আমাকে একবার বাইরে নিয়ে গেছিল।
আধঘণ্টা পর ফিরে চলে এসেছি। দেখতে পাই না কিছু – বের হয়ে আমার কাজ কি?
মেয়েটাও হয়েছে একগাদা পচা। ওদিকে রুয়েটে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ও যাবে না।
যতই গালি দেই আর ঝাড়ি দেই, একেবারে সুপারগ্লু হয়ে আছে।
‘দুই সেমিস্টার ক্লাস করবো না। তোর কোন সমস্যা?’, সোজাসাপ্টা আমাকে প্রশ্ন করে মেয়েটা। আমি অবাক হয়ে যাই।
‘এরকম করিস না। এমনিতেই আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন লাগে – তারমাঝে তোর আর ভাইয়ার ক্ষতি করছি ভাবলেই মরে যেতে ইচ্ছা করে।’
আমাকে ধরে ধরে টিলাতে তুলেছে ও, এবার আমাকে বসায় ধীরে ধীরে, ‘যেখানে অর্ধেক মানুষ আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না সেখানে যাওয়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না।’
এষার বেপরোয়া চলাফেরার কারণে রুয়েট ক্যাম্পাস, যাকে আমরা আদর করে মাদ্রাসা ভার্সন অফ ইউনিভার্সিটি বলে ডাকি, তাকে খুব একটা সমাদর করেনি।
‘আমিও তোকে দুই চোখে দেখতে পাচ্ছি না।’ মুচকি হেসে বললাম।
‘বেশি কথা বলতে হবে না। শোন তোকে আমি লাইভ কমেন্ট্রি দেই। তুই আমার চোখ দিয়ে দেখ চারপাশটা।’
কোনরকম আহ্লাদ ছাড়া বলে গেল ও কথাগুলো। তবুও আমার কানে বাজতে থাকে ‘তুই আমার চোখ দিয়ে দেখ চারপাশটা। তুই আমার চোখ দিয়ে দেখ চারপাশটা!’
হাতড়ে হাতড়ে ওর হাত খুঁজে নিলাম।
আঙুলের ফাঁকে আঙুল আটকাই, ঠিক যেভাবে প্রথমদিক ওর হাত ধরেছিলাম।
দুটো মাত্র চোখ নিয়ে নীরব বসে থাকি আমরা দুইজন মানব-মানবী।
*
ভেবেছিলাম আম্মু-আব্বু কি মনে করে – এষা বাসায় এসে উঠেছে আজকে নিয়ে দশদিন হয়ে গেলো।
ভাইয়া আমাকে চুপিসারে জানিয়ে গেলো, তারা মেয়েটার প্রতি অনেক বেশি কৃতজ্ঞ এজন্য। কারণটা আমি স্পষ্ট বুঝি।
এষা আমাকে লিখতে শিখিয়েছে আবারও। দুটো ছোটগল্প লিখেছি আমি এই দশদিনে।
বানানে হাজারো ভুল থাকে। এষা বা ভাইয়া ঠিক করে দেয় ওগুলো। তারপর আমাকে পড়ে শোনায়।
আমি অবশ্য বুঝে গেছি এই সখ করে দুই এক পাতাই লেখা লাগবে আমাকে। প্রফেশনাল রাইটার আর হতে হচ্ছে না। সেই যখন আমার বয়েস ছয় কি সাত – তখন থেকে আমার স্বপ্ন, বড় হয়ে প্রফেশনাল রাইটার হওয়া – সব এক মাস আগেই শেষ।
এর মাঝে আমি ব্রেইল পদ্ধতির পেছনেও পড়েছিলাম । তবে তেমন উৎসাহ পেলাম না। এসব স্পর্শের অনুভূতি দিয়ে পড়ার মাঝে কোন প্যাশন কাজ করে না।
বাঁচার প্রেরণা এষা আমাকে দিয়েছে – এমনিটাই ভাবছে ওরা। আমি আর কিছু বলিনি।
ভাইয়াকে প্রশ্ন করেছি, ‘তুই মিনেসোটা ফিরছিস কবে?’
ও হাসি হাসি গলাতে বলল, ‘এই তো। যাবো আর কি। ওদিকে কাজ তেমন নাই। কিছু ক্লাস মিস হলে আসবে যাবে না। এটা তো আর বুয়েট না। প্রফেসরদের ইমেইল করে ঘটনা বলা আছে। অনলাইনে হোমওয়ার্ক, টিএ-র কাজ সাবমিট করে যাচ্ছি, এখানে থাকলে আপাতত সমস্যা নেই।’
সত্য বলল না মিথ্যে – ঠিক বুঝলাম না।
আগে আগে শুতে যাই। চেষ্টা করি বেলা গড়িয়ে গেলেও ঘুম থেকে না ওঠার।
ঘুমাতে আমার খুব ভালো লাগে।
স্বপ্ন দেখি তো!
কত কিছু দেখি আমি ওখানে! এষাকে রোজ দেখি। মেয়েটা আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে দেখলাম।
ঢাকাতে থাকা একগাদা বন্ধুদের দেখি স্বপ্নে। রাজশাহীর বন্ধুদের দেখি। মুখগুলো দিন দিন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে – এটা আমাকে কষ্ট দেয়।
কয়েকদিন পর হয়ত ওদের নিয়েই স্বপ্ন দেখবো – বুঝতে পারবো কোনটা কে। কিন্তু ওদের চেহারা আর দেখতে পাবো না।
স্বপ্ন ছাড়া আমার আছেই কি এখন! ওটা চলে গেলে কি করব আমি জানি না।
লাইট বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম ঘরে। আমার জন্য অবশ্য সবই সমান।
এখন আমাকে সারারাত পাহারা দিয়ে রাখে না ওরা। জানে, আত্মহত্যার ভূত মাথা থেকে একেবারেই বের হয়ে গেছে।
সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছে করছে এখন। রাত কয়টা বাজে কে জানে?
হাতড়ে হাতড়ে অ্যানালগ ক্লকটা নিলাম। আমার জন্য এটা কেনা হয়েছে। তারপর সেফটি গ্লাসও ভাঙ্গা হয়েছে।
স্পর্শ করে আমি কাঁটাগুলোর অবস্থান বুঝি। সময় জানতে পারি।
ছুঁয়ে দেখলাম – রাত দুইটা। সবার ঘুমিয়ে পড়ার কথা।
এক মাস ধরে সিগারেট না খেয়ে আছি। এষাকে দিয়ে তাই গতকাল একটা প্যাকেট কিনিয়েছি। বাসাতে জানে না আমার স্মোকিংয়ের কথা। ওদের জানিয়ে কষ্ট দিতে চাই নি আগেও। এখনও ইচ্ছে করে না। এমনিতে আমার অবস্থা নিয়ে তাদের চিন্তার সীমা নেই।
মেয়েটাকে বলেছিলাম আমার খাটের নিচে কম্পিউটার টেবিলের গা ঘেঁষে রেখে যেতে। রেখেছে কি না কে জানে!
নড়তে যাবো – খস খস একটা শব্দ হল ঘরের মাঝে।
ভাইয়া না তো? স্পাইং হচ্ছে? এখনও ভাবে পাগলামি করব?
সিগারেট নিয়ে ওর হাতে ধরা খেতে চাইলাম না। কাঠ হয়ে শুয়ে থাকি চাদরের নিচে।
মশারী তুলছে কেউ –টের পেলাম।
চোখ বলে তো কিছু নেই – তবে চোখ টিপে বন্ধ রাখার জন্য যেরকম কমান্ড আগে মস্তিষ্ককে দিতাম – আবারও দেওয়ার চেষ্টা করি।
আমাকে চমকে দিয়ে গরম একটা শরীর আমার চাদরের ভেতরে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ে। তুলোর মত নরম শরীরটার স্পর্শ পেয়ে আমার বুঝতে বাকি থাকে না এটা কে।
‘এষা! তুই উঠে এসেছিস কেন!’ ফিস ফিস করে ঝামটা দেই ওকে।
‘চুপ করে শুয়ে থাক। তোর সাথে ঘুমাবো।’ ফিস ফিস করেই উত্তর দেয় মেয়েটা।
‘ধরা পড়ে যাবি তো!’ আমার জগত অন্ধকার। তাও ওকে হাতড়ে হাতড়ে ধরলাম।
‘যাবো না। সাড়ে চারটাতে ভাইব্রেশন অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি। উঠে চলে যাবো।’
অ্যাকুয়াস হিউমার আর জন্মায় না আমার। তাই চোখ এখন শুকনো খটখটে। অবাক হই আরও একবার – এই মেয়েটা আমাকে এত ভালোবাসে কেন?
‘শক্ত হয়ে থাকবি না। আমাকে জড়াবি?’
মিষ্টি কণ্ঠটা আমাকে ভুলিয়ে দেয় মেয়েটার সাথে আমার থাকা উচিত না। আমার সাথে ওর কোন ভালো ভবিষ্যৎ নেই।
মিষ্টি কণ্ঠটা আমাকে ভুলিয়ে দেয় আমি আর কোনদিনও মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবো না। আমি কোনদিনও হতে পারবো না বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ থ্রিলার রাইটার।
মিষ্টি কণ্ঠটা আমাকে ভুলিয়ে দেয় সব কিছু।
আমি আলতো করে করে ছুঁয়ে দেখলাম ওর মুখ, গাল, কপাল, চোখের পাপড়ি, কানগুলো আর ছোট্ট নাকটা।
তারপর বুকে চেপে ধরি ওকে, ফিস ফিস করে শুধু বললাম, ‘জড়াবো।’
৭.
‘আমি ওকে বিয়ে করবো। নিষেধ করে লাভ নাই। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’ আমার পাশেই কথাগুলো বলে ফেলে এষা।
আমার নিঃশ্বাস আটকে যায় আজ।
আন্টিকে এসব কি বলছে মেয়েটা? কি ভয়ানক!
আমি তো গেছিই – একেবারে অথর্ব হয়ে গেছি। শুধু শুধু আমার জন্য নিজের দুর্গতি ডেকে আনছে মেয়েটা। হাতড়ে হাতড়ে ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কখন সরে গেছে ও আগের অবস্থান থেকে।
বাসার সাথে ফোনে কথা বলছে আর হাঁটছে মেয়েটা।
বিকেলে ভাইয়া আমাকে আরও স্পষ্ট করে দেয় সবকিছু, ‘এষা তোকে বিয়ে করতে চায়। তোর কি মতামত?’
আমি টেংরা মাছের মত হা হয়ে গেলাম, ‘আব্বু আম্মু? এষার ফ্যামিলি? আমার মত খোঁড়া কুত্তার কাছে তো এই প্রশ্ন করার মানে নাই। ফুটা পয়সা পরিমাণ দাম নাই আমার।’
‘ওসব দিক দেখাটা আমার দায়িত্ব। আমি জানি মেয়েটাকে তুই ভালোবাসিস।’ অস্থির শোনায় ভাইয়ার কথাটা।
‘সেজন্যই তো স্বার্থপরের মত সিদ্ধান্ত নিতে আমি পারি না, ভাইয়া।’ না বলে পারলাম না।
‘স্বার্থপরের মত মানে? এষা তোকে করুণা করছে না। মেয়েটা সত্যি তোকে ভালোবাসে। আমি শুধু বলব, তুই সারা জীবন বালময় কাজ করে এসেছিস বটে, তবে এই একটা জায়গাতে খুবই লাকি। এষার মত পরিচ্ছন্ন মনের মেয়ে আজকে আরেকটা খুঁজে আনতে পারলে বলিস।’
আমি মাথা নাড়লাম, অনুমান করে ভাইয়া যেদিকে থাকার কথা সেদিকে তাকিয়ে আছি।
‘তুই আমাকে বুঝতেই পারছিস না। এষাকে বিয়ে করাটা আমার পক্ষে সম্ভব না। মেয়েটার লাইফ আমি হেল করে দেব রে!’
বাধা দেয় ভাইয়া, ‘দিবি না। ও সব জানে। না জেনে তুই ওকে ঠকাচ্ছিস না।’
‘গুড গড! বুঝতে পারছিস না কেন? আমি এখন লিখতে পারি না!’ ভাইয়া চুপ করে আছে দেখে বলেই ফেললাম, ‘আর আমি লিখতে না পারলে, কাজকর্ম কিচ্ছুটা করতে না পারলে, আমার প্রতি ওর ভালোবাসা থাকবে কয় দিন?’
থাপ্পড়টা খেয়ে মাথা ঝিম ধরে গেল।
বহুদিন কেউ এত জোরে মারেনি আমাকে। কিছু দেখতে পাচ্ছি না তো – তাই বুঝলাম না ঠিক কোনদিক দিয়ে আসলো।
মাথা চক্কর দিচ্ছে। চোখে কিছু দেখতে না পেলে মাথা চক্কর দেওয়াটা খুবই অস্বস্তিকর।
‘শোন, তুই লেখালেখি শুরু করার আগ থেকে এই মেয়েটার সাথে তোর পরিচয়। লেখালেখি শুরু করার আগ থেকে তোরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করিস। কথা দুইটা কতটা সত্য তুই খুব ভালো করে জানিস। বিয়ে এড়াতে এষার ভালোবাসাকে ছোট করে আর একটা কথাও বলবি না।’
ভাইয়াকে এষা পুরোদস্তুর ঘটক বানিয়ে ফেলেছে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।
বুঝলাম আপত্তি করে লাভ নেই। বিয়েটা ওরা দেবেই।
এষা ছাড়া কেউ আমাকে কন্ট্রোল করতে পারবে না এখন – এটাও আমি জানি। কিন্তু নিজের সুবিধে দেখতে গিয়ে তো আর মেয়েটার বারোটা বাজাতে পারি না। অন্ধ স্বামী নিয়ে ঝোঁকের মাথাতে পাঁচ দশ বছর সংসার করল নাহয়। তারপর কি ওর মনে হবে না – সিদ্ধান্তটা নিয়ে পস্তাচ্ছে?
ভাইয়া আমাকে ঠাণ্ডা গলাতে বলল, ‘এখন ড্রইং রুমে একটা মিটিং ডাকছি। এষা থাকবে ওখানে। আব্বু আম্মুকে আমি লাইনে আনবো। তুই যদি এখান থেকে নড়েছিস – কেটে ফেলবো একেবারে। তোর লাইফ চুলোয় যাবে – সেটা দেখতে আমি আমেরিকা থেকে উড়ে আসিনি। আর এষাকে ছাড়া – বরাবর ওখানেই যাবে ওটা।’
মার খেয়ে চুপচাপ বসে থাকি।
ড্রইং রুমে নিচু গলাতে কথা বার্তা হচ্ছে। বুঝলাম ওখানে এখন মাথা ঢুকিয়ে ‘আমি বিয়ে করে এই মেয়ের লাইফ চুলোয় দিতে পারবো না’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে পারবো না। চেঁচালে ভাইয়া আমাকে আমার এতদিনের থ্রিলারের কোন এক মেথডে স্রেফ খুন করে ফেলবে।
ঝিম মেরে বেশিক্ষণ বসে না থেকে চোরের মত উঠে দাঁড়াই। ওরা মিটিং করছে করুক। আমার আরেকটা কাজ বাকি থেকে গেছে। পা টিপে টিপে ডাইনিং রুমে বের হয়ে আসলাম। বাইরে যাওয়ার জন্য এদিকে একটা দরজা আছে।
সাবধানে নবটা ঘুরিয়ে বের হলাম। সিঁড়ির দিকে এগুচ্ছি, পাশেই চাপা গলাতে সবধরনের সম্ভাবনা নিয়ে ভাইয়া কথা বলছে আব্বু আম্মুর সাথে। সোজা বাংলাতে ‘পটাচ্ছে’।
আমার জীবনটা ওদের সবাইকে একটা ঝামেলাতেই ফেলে দিয়েছে।
ভাইয়া তার মাস্টার্স – পিএইচডি ফেলে আমার নার্সিংয়ে লেগে গেছে। বুঝতেই পারছি স্কলারশিপটা চুলোতে দিয়ে আমার লাইফ চুলো থেকে বের করতে সে এখানে এসেছে।
এষা রুয়েটের সেকেন্ড ইয়ারে এসে রুয়েট-লাইফ প্রত্যাখ্যান করেছে। এটাও স্পষ্ট – নিজের বিএসসি ক্যারিয়ারকে পানিতে ফেলে এই মেয়ে আমার জীবনটাকে পানি থেকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছে।
ওদের ভালোবাসা আমি হৃদয়ের গভীরে অনুভব করতে পারলাম অনায়াসে।
সেই সাথে অনিবার্য প্রশ্নটা চলে আসল আমার মনে, ‘এত স্যাক্রিফাইস তারা কার জন্য করছে?’
উত্তরটা পেতে আমার দেরী হয় না এবার।
এত স্যাক্রিফাইস তারা করছে গুড ফর নাথিং একটা অথর্বের জন্য।
চোখ থাকা অবস্থাতে আমার দাম হয়ত ছিলো কিছু। এখন একটা ফুটো পয়সাও না সেটা।
অন্যের কাছে আমার কতটুকু দাম – সেদিক থেকে নিজের চিন্তা ঘুরিয়ে নেই দ্রুত।
আমার কাছে আমার দাম কতটুকু?
যেই আমি ঘণ্টায় ২,০০০ শব্দ করে লিখতে পারতাম – সেই আমি লিখছি দশদিনে দুটো গল্প?
মেকানিক্যালের ল্যাবগুলোতে ঈগল দৃষ্টি দিয়ে কাজ শিখে নিতাম যে আমি – সে আমি ব্রেইল রিডিংয়ের একেবারে প্রাথমিক ধাপে আছি! আর শিখতে পারলেই বা কি?
অন্ধ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কার কি কাজে আসতো?
খোলা ছাদে উঠে এসে নিজেকেই বলি, ‘কারও কাজে আসতো না।’
বাতাস সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মনে হয়। আমার চুলগুলো উড়ছে আগের মতই। শুধু অন্ধকার এই দিনের বেলাতেও।
রেইলিংয়ের ধারে গিয়ে হাসলাম, সারাজীবনই নিজের জীবনটাকে একটা যুদ্ধক্ষেত্র ভেবে এসেছি আমি।
মনে হচ্ছে, আমার জন্য যুদ্ধটা শেষ।
অন্ধ সৈনিকের কানাকড়িও দাম নেই যুদ্ধক্ষেত্রে।
তাই বলে সামান্য একটা ইচ্ছে পালন করার অধিকার তার থাকতেই পারে। আমার অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিলো প্যারাসুট দিয়ে গ্লাইড করে ওপর থেকে নামার।
বিশেষ কোন কারণে না, পাখিদের মত আকাশে ভাসতে আমার খুব সখ। সেই ছোটবেলা থেকেই।
বড় করে একবার নিঃশ্বাস নেই।
রেইলিং টপকে গিয়ে আজ আমি পাখি হলাম।
— ০ —
রচনাকাল – সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪
Leave a Reply