আর কিছু বলবে?
‘আর কিছু বলবে?’ হাতঘড়ি দেখে জানতে চায় ইভা।
মাথা নাড়লাম আমি। মেয়েটার একটা ডায়েরী আমার কাছে ছিল। ওটা দিতে এসেছি। আর কিছু বলার থাকে কিভাবে?
ভাষা জিনিসটাকেই কেউ কেড়ে দিয়েছে আমার। কই? ইভা তো আজ আমার চোখ দেখেই সব বুঝে ফেলল না!
কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়।
⚝
ভর্তি পরীক্ষার সময় আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল একবার। ছোট ছোট পা ফেলে প্রথম দিন হাঁটছিলাম সারাদিন। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিলাম।
অভিমান!
বাসার ওপর অভিমান, ভর্তি পরীক্ষাতে কোথাও চান্স না পেলেই বের করে দেবে কেন? সীট কয় হাজার আর পরীক্ষার্থি কয় লক্ষ সে খেয়াল খবর তো রাখে না তারা কিছু। দোষ কি আমার, না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার?
জীবনের ওপর অভিমান, কেন এরকম একটা অসম প্রতিযোগীতার মুখোমুখি আমাকে সে দাঁড় করাবে?
আপন বড় ভাইয়ের ওপর অভিমান, বুয়েটে প্রথম একশ’ জনের মধ্যে চান্স পেয়ে যে আমার জন্য অলিখিত একটা পথ-ব্যবস্থাতে যে পরিণত হয়েছিল আম্মুর চোখে।
কোচিং সেন্টারের ওপর অভিমান, যারা মেরিট লিস্টে তিনটি মাস ধরে আমাকে রেখে এতটা আশা দিয়েছিল!
সব ছাড়িয়ে যায় কারও কাছে শোনা একটা ছোট্ট বাক্য মনে পড়তে, ‘ভর্তি পরীক্ষা ৯৯% যোগ্যতার খেলা। আর বাকি ১% হল লাক।’
লাকের কথা দূরে থাকুক – এখন আমাকে ভাবতে হবে লাখের কথা।
প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপার তো সহজ কিছু নয়। লাখ লাখ টাকা দরকার হবেই।
অবশ্য মেধার বিবেচনাতে এটা খুবই সহজ, অন্তত আমার জন্য, ঐ যে – কোচিং সেন্টারে বাংলাদেশ জুড়ে দেওয়া মেরিট লিস্ট কাঁপিয়ে এসেছিলাম। সেই তুলনাতে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা আমার জন্য কোন ব্যাপার নয়। টাকাটাই যত ঝক্কি!
রাতেও রাস্তায় থাকলাম। আমাদের এলাকাতেই ফিরে এসেছিলাম। অচেনা এলাকাতে রাস্তাতে রাতে থেকে পুলিশের ধাওয়া খাওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। এখানে অন্তত কিছু জায়গা আমি চিনি, যেখানে ঘুমিয়ে না কেবল, মরে পড়ে থাকলেও কেউ মাইন্ড করবে না।
চমৎকার একটি ঘুম হল সেরাতে।
সকালে জ্ঞান হতে দেখলাম আমার পেটের ওপর মাথা রেখে কে জানি ঘুমাচ্ছে। ছেলেটা আমার থেকে এক বছরের জুনিয়রই হবে। মুখ থেকে গাঁজার গন্ধ ভক ভক করে বের হচ্ছে। ওর মাথাটা একটা থান ইটের ওপর রেখে আবার হাঁটা ধরলাম।
প্যান্টের পায়ের গোড়ালির কাছে, ভেতরের দিকে থাকা গুপ্ত পকেট থেকে মোবাইল আর মানিব্যাগটা বের করলাম। প্রতিটি প্যান্ট আমাকে বানিয়ে নেওয়া লাগে। উচ্চতা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি আমার – সেজন্যই এই ফ্যাকরাটা বাঁধে। তবে কিছু পার্শ্ব-সুবিধেও আছে। যেমন এই পকেট। প্রতি প্যান্টেই এরকম সিক্রেট পকেট আছে। আমার নির্দেশে বানিয়ে দিয়েছে টেইলার্স। মানিব্যাগ আর মোবাইল যে এখনও গাঁজাখোরের পকেটে না গিয়ে আমার কাছেই আছে – তার কারণও ওই একটা।
মোবাইল অন করে রাখলাম। মনের ভেতরে বাসায় ফিরে যাওয়ার সুপ্ত একটা ইচ্ছে কোথাও থেকে থাকবে হয়ত।
মানিব্যাগ খুলে উল্টে ধরতেই দুটো দশ টাকার নোট বের হল। দুটো কাজ এ দিয়ে করা যায় –
১। তিনটি পরোটা আর এক বাটি ভাজি কিনে চমৎকার নাস্তা সেড়ে ফেলা যায় ধারে কাছের কোন দোকানে। দেড়দিন ধরে না খেয়ে আছি।
২। ৫+৫ করে দশ টাকার বাস ভাড়া খরচ করে ইভাদের বাসার কাছে চলে যাওয়া যায় – তারপর বাকি দশ টাকা মোবাইলে রিচার্জ করে ইভাকে একটা ফোন দেওয়া যায়। ফিরে আসতে হবে অবশ্য হেঁটে। ওতে মন খারাপের কিছু দেখলাম না। একবার ইভাকে দেখলে আমার বিশ টাকার বাসভাড়া পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার এনার্জি চলে আসে। মানে, একবার ওখান থেকে নিজের বাসাতে ফিরে এসে আবারও ওর বাসা পর্যন্ত যাওয়ার।
দ্বিতীয়টা বেছে নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেই।
ইভাদের বাসাতে পৌঁছাতে পারলাম না। তার আগেই মোবাইলে ফোন আসতে শুরু করল।
প্রথমটা আম্মু। দ্বিতীয় ফোন ভাইয়ার।
ধরলাম না। থাকো এখন!
নিজের ছেলেকে তো খুব বের করে দেওয়া যায়! পরে মায়াকান্না করার মানেও তো দেখি না।
তৃতীয় ফোনটা আসতেই ধরতেই হয়, ইভা।
‘ফোন অফ কেন? আবার অন করে বিজি। কোন সমস্যা হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন গলাটা শুষ্ক গলাতে বলার চেষ্টা করে।
এই ছিল আমার ইভা।
অন্য কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের মত সন্দেহবাতিক সে ছিল না। সব সময়ই ছিল বাস্তববাদী। এখন আর কেউ হলে মহা ঝগড়া বাঁধিয়ে দিত। ইভাকে সবকিছু জানালাম না। শুধু বললাম, ‘তোমার বাসার কাছে আমি। নামতে পারবে?’
অন্যবারের মতই ও বলেছিল, ‘দশ মিনিট।’
যেখানে আমি সবসময় থাকি – সেই দেওয়ালের ওপর পা দুলিয়েই বসে ছিলাম। ইভা এসে আমাকে দেখল। তারপর একনজর দেখেই বলে দিল, ‘বাসার বাইরে ছিলা, তাই না? দেড় দিন খাওনি কিছু মনে হচ্ছে। চলো, খাবে।’
কি অদ্ভুত না?
একবার দেখেই সব বুঝে ফেলত ও কিভাবে?
যখন নাস্তা করছিলাম সেদিন সকালে, ওকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আমাকে এত ভালো বোঝ কিভাবে তুমি?’
লাজুক হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে।’
⚝
এখন ও আমার চোখের দিকে সম্ভবতঃ তাকায় না আর। তাই বোঝেও না কিছু।
ডায়েরীটা সুন্দর করে হাতব্যাগে ঢোকায় মেয়েটা। অন্যদিনের মত ওর চকচকে চোখের প্রবল মায়া আমাকে স্পর্শ করে না। কোমল ঠোঁটদুটো ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য ভেতরে কোথাও ব্যকুলতা অনুভব করি না। আজকে ও আমার ইভা নয়।
শুধু ইভা।
কোন এক ডাক্তারের সাথে জানি গভীর প্রেম চলছে ওর এখন। কাজেই অন্যের সম্পত্তি।
‘যাই তাহলে। ডায়েরীর জন্য থ্যাংকস।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় ও।
ওই ডায়েরী কোথায় যাবে আমি জানি। চুলোতে।
আমাকে নিয়ে তার নিজের হাতে লুতুপুতু সব লেখা ছিল ওতেই। এখন যেটা বিভীষিকা ওর জন্য।
আমি বসেই থাকলাম। দুই পা গিয়েও ফিরে তাকালো ইভা, চুল সরায় একহাতে। আমি মাছের মত স্থির চোখে ওই অপরূপ দৃশ্যটা একবার দেখলাম। এই মেয়েটার সিগনেচার মুভ হল ওই চুল সরানোটা।
একবার দেখলে যেকোন আঁতেল-যুবকও প্রেমে পড়ে যাবে ওর। তবে এই মুহূর্তে আঁতেল-বাতেলের ব্যাপারটাই সরে গেল আমার মাথা থেকে।
‘শুকিয়ে গেছ দেখছি।’ ধীরে ধীরে বলে মেয়েটা, ‘অবশ্য শুকানোরই কথা। তবে, চেষ্টা করবে নিজের যত্ন নেওয়ার।’
আমার কাছ থেকে কোন শব্দ আশা না করেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল মেয়েটা একটু একটু করে, দূরে থেকে দূরে। ওকে আর দেখতে পাবো না।
মাছের মত নিষ্প্রাণ এখন আর নেই আমার চোখ। হাল্কা একটা উপহাসের চিহ্ন সেখানে ফুটে ওঠেনি?
শুকিয়ে যাওয়ার তো কথাই আমার! তাই তো!
কি সহজেই না বলে দিল মেয়েটা! আবার বলেও গেল যত্ন করতে নিজের।
মীরাক্কেলে গেলেও পারতো।
উঠে দাঁড়িয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি যখন, তখন একটা প্রশ্ন মনের মাঝে অযথাই খোঁচাতে থাকে।
আমার চোখে কি ওটা উপহাস ছিল? না বেদনা?
⚝
ল্যাবে আজকের মত কাজ শেষ। আমারই সবচেয়ে দেরী হল। ইন্সট্রুমেন্টগুলো জমা দিয়ে যখন বের হলাম ঠিক বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি আইরিনকে।
ঝলমলে পোশাকে ঘন কালো চুলের মেয়েটাকে এখন দেবীর মত লাগছে। একটু ইতস্তত করে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।
ইউনিভার্সিটিতে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে এই মেয়েটিই আমাকে এখনও একটু আধটু পাত্তা দেয়। ক্লাসরুমেও আমার আশেপাশে কোন ছেলেকেও খুঁজে পাওয়া এখন ভার। ল্যাবে আজ দেরী হওয়ার কারণও ওটা। আমার ল্যাবমেট হতে চায়নি কেউ। আইরিন এক সেকশনের হলেও অন্য গ্রুপে। তাই ওকে ল্যাবে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। শুধু ল্যাবে না, ক্লাসের মাঝেও হাল্কা কাশি দিলেও সবাই আমার দিকে এমন ভাবে তাকায় যেন ভীষণ মাত্রার কোন পাপ করে ফেলেছি!
পাপ অবশ্য আমি করেছি। তবে সেটা ভিন্নমাত্রার।
আইরিনের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলাম, ‘এই যে। সামনের সপ্তাহে তোদের গ্রুপকে এটাই করাবে। দেখে রাখ ভাইভায় কি কি ধরতে পারে – লিখে দিয়েছি নিচে।’
ল্যাব নিয়ে আমার বলা কথাগুলো আইরিন খুব গুরুত্ব দিয়ে শোনে তা না।
‘আমার সাথে নদীর ধারে যাবি?’ জানতে চায় ও।
নদী আর পাবে কোথায় – লম্বা লেকটাকেই আমরা আদর করে নদী বলে ডাকি।
ওখানে কত আড্ডা দিয়েছি একসাথে আমি, আইরিন, রিতিশা, ইউসুফ, মিনহাজ আর তুরাশ মিলে!
ইউসুফ-রিতিশাকে সবাই ইউসুফ-জোলেখা বলেই খেপাতাম আমরা। মিনহাজটা ছিল গাধা প্রকৃতির। সার্কেলের ভেতরে থাকলেও ওর কথা কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনত বলে মনে হয় না। আমার সন্দেহ হত এখানে ইউসুফকে। সার্কেলে মিনহাজকে সে-ই ঢুকিয়েছিল।
ব্যাপারটা ব্যক্তিগত হতে পারে। মিনহাজ রিতিশাকে প্রাণপণে ভালোবাসে। আমরা না, পুরো ক্যাম্পাসই জানে কথাটা। গাধা মিনহাজটা ভাবে সেটা কেউ জানে না। এদিকে রিতিশার সাথে ইউসুফের ‘আন্ডারকাভার রিলেশন’ শুরু হয় তাদের ফ্রেন্ডশীপের তিনমাস যখন। প্রায় একই সময় মিনহাজকে সার্কেলে টেনে এনেছিল ইউসুফ। আমার মনে হয়েছিল ব্যাপারটা শুধুই এক অন্ধ প্রতিশোধের।
তুরাশের ধ্যানধারণা সব ছিল গান নিয়ে। গিটার সাথে করে ঘুরত। কবে বড় শিল্পী হবে সে – এই স্বপ্নে সবসময় বিভোর। সুমন ভাইয়ের সাথে ওর এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা – ওর গিটার বাজানোর সখ আছে শুনে বেজবাবা বলেছিলেন, ‘দারুণ সখ! ক্যারি অন, কখনও ছেড়ে দেবে না।’
এতেই তুরাশের কি খুশি! আমাদের একটা করে কোল্ড ড্রিংকস খাইয়েছিল ওই আনন্দে।
আইরিনের দিকে তাকালাম, ‘যেতে পারব না রে অতদূর। শক্তি পাই না। শহীদ মিনারের সামনে বসবি একটু?’
অবসাদ যেন চেপে ধরছে আমাকে চারপাশ থেকে। শহীদ মিনারকেও অনেক দূরের পথ বলে মনে হতে থাকে!
বন্ধুদের আড্ডা দেওয়ার জন্য চমৎকার জায়গা এই শহীদ মিনারের সামনের জায়গাটুকু। আমাদের ব্যাচেরই কতজনকে দেখলাম ওখানে। তাকালাম না ভালো মত। আমি তাকালেও ওরা কুঁচকে উঠতে পারে। অনেক বিষাক্ত প্রাণি এখন আমি – অন্তত ওদের দৃষ্টিতে।
ছোট্ট শফিকুল কোথা থেকে দৌড়ে আসে এদিকে। এই ছেলে আইরিনের চেয়ে চার ইঞ্চি ছোট সাইজে। কিন্তু এই মেয়েটাকেই সে ভালোবাসে। কেন বাসে – তা কে বলবে?
আমাদের পুরো সার্কেলটাকেই ঘৃণা করত ও। কারণটা সহজ, সার্কেলটা আইরিনের, আমাদের সাথে আইরিন সবচেয়ে সহজভাবে মেশে। এর ওপর সার্কেলের প্রায় সবাই আইরিনের প্রেমে ডুবে আছে। এখন ওর আশেপাশে শুধু আমাকে দেখে সাহস পেয়েছে হয়ত। আইরিনকে হয়তো কিছু বলবে, আমি একটু দূরে সরে গেলাম।
শফিকুল আইরিনকে পার করে আমার দিকে এগিয়ে আসে, ‘কি রে – সরে যাচ্ছিস কোথায়?’
অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে, অপ্রতিভ হয়ে বলি, ‘আরে না। সরছি না। বল।’
আমার হাতে একটা চাপড় দেয় শফিকুল, ‘শরীর কেমন তোর? কিছু মেডিকেশনস না নিচ্ছিলি? ইম্প্রুভমেন্ট?’
মাথা নাড়লাম। আর তাই দেখে কালো হয়ে গেল শফিকুলের মুখটা।
খুব ভালো করে দেখলাম ওকে, অভিনয় না তো? নাহ, খাঁটি দুঃখের ছাপ ওই চেহারাতে এখন।
‘শোন, ‘ কেমন জানি বসে যাওয়া গলা নিয়ে আমাকে বলে ও, ‘তুই লিখছিস তো? নাকি ওটাও থামিয়ে দিয়েছিস?’
অভয়ের হাসি দেই আমি, ‘না, তা কেন? লিখি তো। আগের মত জোর পাই না অবশ্য। ক্লান্তি লাগে অল্পেই।’
‘এভাবে লিখি তো – বলবি না – শেষ করে আমাকে পড়তে দিস। এক কপি দিলে কোন ভয় নেই তোর। আমি আর কাওকে দেব না। ভাবিস না – বই বের হলে ওটাও কিনবো।’
হেসে ফেললাম, ‘শেষ করতে পারলে ওটাই হবে আমার ম্যাগনাম ওপাস।’
আমার মুখে হাসি দেখে শফিকুলের মুখেও হাসি ফোটে, আমার হাতে আরেকটা চাপড় দিয়ে বলে, ‘জানি। সেজন্যই পাগল হয়ে আছি ওটা পড়ার জন্য। কোনদিকে না তাকিয়ে লিখে যা, কেপি। তোর দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা অনেকেই।’
শফিকুল আজ আইরিনের দিকে একবারও না তাকিয়ে চলে গেল।
আমি আর আইরিন আবার একটা খালি জায়গার দিকে বসার জন্য এগিয়ে যাই। মনে মনে হাসছি।
আমাকে আজীবন ঘৃণা করতে থাকা শফিকুল আজ আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাচ্ছে। আমার একটা লেখাও ইউনিভার্সিটির কেউ পড়ে না। অনেকটা ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ – এর মত। তবুও বলে গেল “তোর দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা অনেকেই “ – কি হাস্যকর। আমাকে কি ও একটা শিশু ভাবে? যে কিছুই বোঝেনা?
লেখালেখিতে মনোযোগ সরিয়ে রাখতে পারলে আমার জন্য ভালো হবে এটা অনেকেই বলেছে – কিন্তু পরিণতি জেনে তো আর লেখালেখি চলে না!
আইরিন ব্যাগ থেকে দুটো চকলেটের প্যাকেট বের করে। এখনও ঠান্ডা হয়ে আছে। আমাকে একটা ধরিয়ে দেয় ও।
‘ঠাণ্ডা রাখলি কিভাবে এতক্ষণ?’ অবাক হই আমি।
কিছু না বলে মৃদু হাসে আইরিন। আমিও দুই কামড়ে একেবারে অর্ধেক করে দেই ওটাকে।
একটু পর জানতে চাইলাম, ‘ইউসুফরা সবাই কেমন আছে রে?’
‘এই তো। আছে আর কি। কেন তোর সাথে কথা হয় না?’ বিস্ময় প্রকাশের ভঙ্গী করে আইরিন।
মনে মনে হাসলাম আবারও, আমাকে আঘাত পেতে দিতে চায় না মেয়েটা। তাই না জানার ভান করছে।
মুখে বললাম, ‘ফোন দিলে তো ধরে না। ব্যস্ত মনে হয় খুব ইদানিং?’
মাথা জোড়ে জোরে দোলায় আইরিন, ‘তা ঠিক। তুরাশ তো ডাক পেয়েছে একটা ইন্টার-ডিভিশন কম্পিটিশনের জন্য। সারাদিন প্যাডে পড়ে থাকে ও। তাই পাবি না ওকে। ইউসুফ আর রিতিশা কি জানি একটা রোবটিক প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। তাই দেখা যায় না মনে হয় – মিনহাজও ওদের সাহায্য করে।’
রোবট নিয়ে প্রজেক্ট হলে সবার আগে আমাকেই ডাকার কথা ওদের। কথাটা আইরিন ঠিকমত বানিয়েও বলতে পারেনি। ওকে কিছু বললাম না। আসল কারণ তো আমি জানি। অন্তত অনুমান করতে পারি।
তবুও সামান্য একটা কথা আমার জানা দরকার, কানের কাছে মুখ নিয়ে যাই আইরিনের, ‘আমাকে একটা নাম দে শুধু। সবার ব্যাপারে আমি বিশ্বাস করি না।’
গাঢ় দুটো চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আইরিন নিষ্পলক। কি গভীর বেদনা সেখানে! আমার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। বেদনাটুকু আমার জন্য – সেটা জেনেই যেন আরও বেশি হাহাকার করে ওটা!
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে আরও আস্তে করে বলি, ‘কেউ জানবে না। শুধু আমার জানাটা দরকার। জানার জন্য খুব সময় আমার নেই রে। বলে ফেল।’
‘রিতিশা – রিতিশার বিশ্বাস –’ বলার সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার দ্বিধায় ভুগে ও, ‘ওর বিশ্বাস – কোন খারাপ মেয়ের কাছ থেকে পেয়েছিস তুই এটা।’
‘ভালো। এরা শিক্ষিত সমাজ আমাদের।’ মন্তব্য করলাম।
অন্যদিকে তাকায় আইরিন, ‘রিতিশার যুক্তি – এজন্যই ইভা ব্রেকআপ করেছে তোর সাথে।’
‘বাহ।’ নিজের বান্ধবীর বিচারবুদ্ধিতে চমৎকৃত না হয়ে আমিও পারলাম না, ‘আর বাকি তিনটা? তারা লাইন দিয়ে বিশ্বাস করে নিল সেটাই? আর করে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলল – এরকম দুশ্চরিত্র লোককে আমাদের সার্কেলে রাখা সম্ভব না!’
হাত দুটো আটকায় আইরিন, ‘ঠিক তা না – তবে রিতিশার জন্য ইউসুফ তোর সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারে না। আর মিনহাজ তো – কি বলব, মেরুদণ্ড আছে নাকি ওটার? তুরাশও বাতাসের সাথে সাথে গেছে ওদিকে। তা নাহলে সার্কেল থেকে তাকে বের করে দেওয়ার কথা ভাবছিল ওরা। জানিস তো তুরাশ ছেলেটা সবার সাথে মিশতে পারে না। রাগ করিস না ওদের ওপর।’
আমার দিকে অনুনয় ভরা চোখ নিয়ে তাকায় ও। আমি একটু হাসলাম।
কি বোকা আমার এই বান্ধবীটা! আমি কি আমার একমাত্র আপনজনদের ওপর রাগ করে থাকতে পারি? তারা নাহয় ভুল বুঝলই আমাকে!
ক্যাম্পাসের মাঝে বসে আছি আমরা – আশেপাশে সিনিয়র ভাইয়া, স্যাররা আসা-যাওয়া করেন এদিক দিয়ে। শহীদ মিনারটা একেবারে সামনের দিকে।
তারমাঝেই আলতো করে আমার হাতে হাত রাখে আইরিন।
⚝
বাসাতে ফেরার তেমন তাগিদ নেই। দুইজন বন্ধুর সাথে উঠেছিলাম ছোট্ট দুইরুমের বাসাটাতে।
আব্বু-আম্মুরা তো চট্টগ্রামে চলে গেছে। ট্রান্সফার।
এখন অবশ্য গোটা ফ্ল্যাটটা আমার। রিদওয়ান আর ফরিদ – এই তো দুই সপ্তাহ হল ছেড়ে দিয়েছে তাদের রুম। ওরা ইলেক্ট্রিক্যালের তো। তাই একজন মেকানিক্যাল স্টুডেন্টের সাথে না থেকে আরও কিছু ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রদের কাছে থাকাটা তাদের পড়াশোনার জন্য সুবিধের হবে।
আমি মুচকি হেসে মেনে নিয়েছি।
সারা মাস জ্বর হয়ে থাকে এমন একজনের সাথে থাকতে চাবে কেন তারা? তাছাড়া তখন নিঃশ্বাসের সাথে অদ্ভুত একধরণের গন্ধ নাকি পায় ফরিদ। সেদিন মুখের ওপরই বলে দিল ছেলেটা।
রিদওয়ানের মেডিকেল থিওরি আছে। তার থিওরিতে ওটা হল আমার ভেতরে থাকা ভাইরাস। ভাইরাসের গন্ধ পায় ফরিদ।
আসল ঘটনা ওরা জানে না অবশ্য। জানাইনি। আমার মুখের ওপর ঘায়ের মতো কিছু দাগ, অথবা আমার নিঃশ্বাসের গন্ধ, দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড ব্যথা – যা মাঝে মাঝে তুলে ফেলে জ্বর, কিংবা খানিক হাঁটলেই হাঁপিয়ে যাওয়া, এসব ভাইরাসের কারণে নয়। কেএসের কারণে। কাপোশি’স সারকোমা। ১৮৭২ সালে হাঙ্গেরিয়ান ডারমাটোলজিস্ট মরিজ কাপোশি প্রথম এ বস্তু আবিষ্কার করেছিলেন, তাই। কিন্তু ওদের আমার এত কথা বলতে ইচ্ছে করেনি।
কাজেই যখন ‘পড়াশোনার ক্ষতি’ ঠেকাতে ওরা চলে যেতে চাইল কাছের ‘রাইয়ান টাওয়ার’-এ, মানা করিনি তো।
ওদের শুধু বলেছি, ‘ভালো থাকিস।’
এই মুহূর্তে যে বিল্ডিংটার সামনে ক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছি – এটা আমাদের ইউনিভার্সিটির শরীরচর্চার জন্যই প্রতিষ্ঠিত। বোর্ড ভাইভার দিনে এখানে ভূত এফএমের নোংরা একটা অডিও ওদের শুনিয়েছিলাম। বরিশালে বাড়ি এমন একজন বন্ধুই আমাকে দিয়েছিল রেকর্ডিংটা। বরিশাল থেকে আগত একজন মানুষ ভূত এফএমে এসেছেন – সাথে আছেন আরজে রাসেল এবং সুমন ভাই। এটা ছিল ওই রেকর্ডিংয়ের প্রতিপাদ্য বিষয়।
সিঁড়ির ওপর বসেছিলাম আমরা। নিজের খাতা থেকে ছিঁড়ে দিয়েছিলাম পৃষ্ঠা যাতে ওদের গায়ে ধুলো না লাগে। ওই তো – ওখানেই হেসেছিল তুরাশ সেদিন। ইউসুফ হাসির দমকে উঠে গেছিল ওই গাছটা পর্যন্ত। আইরিন-রিতিশা এখানে ছিল না। মেয়েদের সামনে শোনানোয় আমার সংস্কার ছিল না, আলাদা করে ওদের আমি নিজেই শুনিয়েছি অডিওটা। তবে আমার মত ‘অশ্লীল’ না সবাই। ভদ্রতা মেইনটেন করতে ছেলেদের সবাই খুবই সচেতন থাকত।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। স্মৃতিগুলোও আর থাকবে না কোন একদিন।
সম্ভবতঃ দিনটি বেশি দূরে নয়।
বাসার দরজার সামনে এসে লক্ষ্য করলাম হাত কাঁপছে তালা খুলতে গিয়ে। নিজের ওপর প্রচন্ড বিরক্তি ধরে যায় এবার।
আবারও জ্বর এসেছে বুঝতে পারছি। সবগুলো হাড় পেটানোর মতো ব্যথা ছিল সারাদিন, তার ভেতর এতদূর হাঁটা উচিত হয়নি। এদিকে আগামীকাল অ্যাসাইনমেন্ট আছে এত্তগুলো। শেষ করতে হবে সব একে একে।
দাঁতে দাঁত চেপে জীবনের প্রতি একটা হুঙ্কার ছাড়লাম মনে মনে, ‘আয় শালা – শেষবারের মত ফাইট দিয়ে যা আমার সাথে!’
ক্লিক করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়ে ডেস্কটপটা অন করি। মাস্টারক্যামে একটা রাফ মডেলিং করতে হবে। পুরোটা আঁকা সম্ভব নয়। একজায়গাতে ভালোই আটকেছি। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো উচিত ছিল আমাদের। তাহলেই আর সাত ফিট রেডিয়াসের পাইপে পনের ফিট ডায়ামিটারের রিংটা ঢোকার চেষ্টা করত না। জিনিসটা হবে ইন্টারনাল। হিসেবে তো ভুল আছেই কিছু – কাল দেখা যাবে ’খন।
যেরকম উৎসাহ নিয়ে নেমেছিলাম সেই উৎসাহ ধরে রাখা গেল না। কখন চেয়ার থেকে উল্টে খাটে শুয়ে পড়েছি – নিজেও জানি না।
চারপাশে তীব্র ঠান্ডা। শীতকাল নাকি এখন? কি অদ্ভুত রকম ঠান্ডা পড়েছে আজ!
বিড় বিড় করতে করতে বলি কয়েকবার, ‘ম্যাগনাম ওপাস … ম্যাগনাম ওপাস …’
⚝
দরজায় প্রচন্ড শব্দ। কে এল এই রাতের বেলায়? কোন রকমে চোখ মেলে উঠে এলাম কাশতে কাশতে।
বাইরে দিনের আলো ফুটে আছে স্পষ্টভাবে। দেখে ধন্ধে পড়ে যাই – আসলেই কি দিন নাকি?
দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম। আইরিন!
শুধু আইরিন নয় – তার সাথে একটা বড় আকারের ট্রাংক আছে। আর একটা লাগেজ।
এতসব নিয়ে তিনতলাতে উঠল কিভাবে এতটুকু মেয়েটা?
কিছু না বলে আবার ভেতরে ঢুকে গেলাম। কখনও কখনও কথা সমাধান হতে পারে না। তখন নীরবতা ভালো কাজে দেয়। ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে নিজের সম্পত্তি নিয়ে ঢুকে পড়ে আইরিন ওই ফাঁকে।
‘হল ছেড়ে দিয়েছি। তোর সাথে থাকব।’ চমৎকার একটা হাসি দেয় মেয়েটা।
একফোঁটা শক্তি নেই শরীরে, খাটে শুয়ে পড়লাম, ‘তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে যা তো তুই-’
বললাম না ঠিক – দাঁড়ি কমা ছাড়া উচ্চারণ করলাম শুধু।
‘রিদওয়ান আর ফরিদ যে চলে গেছে আমাকে তো জানাস নাই।’ ধমক দেয় আইরিন উল্টো।
‘থাকবে কেন? জানের মায়া তো আছে সবারই। তাই না? তুই এসেছিস কেন?’ কপাল টিপে ধরে বলি আমি।
থমকে জায়গায় দাঁড়ালো আইরিন। তারপর কটমট করে তাকালো আমার দিকে।
‘জানিস, গত দশ দিন তুই ক্যাম্পাসে নাই? জানিস এই দশদিন তোকে ফোন দিয়েছি কতবার? জানিস তুই যে মাত্র দুইবার ধরেছিস কল? আর ফোন ধরেই কি বলেছিস সেটা জানিস?’
জেগে ওঠার চেষ্টা করতে করতে তাকালাম ওর দিকে। রাগে লাল হয়ে আছে মেয়েটা।
‘কি বলেছিলাম?’ কপাল আর চোখ থেকে চুল সরাতে সরাতে জানতে চাইলাম।
‘ম্যাগনাম ওপাস। বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধু এটাই বলে গেছিস। আমার কি ভয় লাগে না? আমি তোর সাথে থাকব এখন থেকে। ভাবিস না, ভাড়ার অর্ধেক শেয়ার করব। রাজি?’
‘কেউ থাকলে লিখতে পারব না-’ ঘরের এক কোণে থাকা ডেস্কটপটার দিকে তাকালাম, টলতে টলতে উঠি আমি।
‘কই যাস? আমি তোকে জ্বালাবো না। তোর ঘরেই আসব না। তুই লেখিস ইচ্ছেমত?’
‘ম্যাগনাম ওপাস। আমার উপন্যাসটা লেখে শেষ করতে হবে।’
চেয়ারে বসে পড়েছিলাম। পেছন থেকে আমার কপালে হাত রেখেই আঁতকে ওঠে আইরিন।
‘জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আর লেখা!’ টেনে হিচড়ে আমাকে আবার বিছানাতে শুইয়ে দেয় মেয়েটা, ‘সকালে খেয়েছিস কী?’
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বুঝে ফেলে ও, ‘খাবি কেন? খেয়ে কি উদ্ধার হবে? তোর তো ম্যাগনাম ওপাস শেষ করতে হবে। হারামজাদা, মরার আগে একজনের ম্যাগনাম ওপাস বলা যায় না কিছুকেই – জানিস না? মরার ব্যাপারে খুব নিশ্চিত হয়েছিস, না?’
তবুও চুপচাপ থাকি। আসলে, খুবই ক্লান্তি লাগছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
‘চাবি দে।’ একটু পর আমার কাছে এসে বলে আইরিন, পোশাক পাল্টালো কখন? কমলা রঙের জামাতে তো ওকে একেবারে পরীদের মত লাগে দেখছি। আগে খেয়াল করি নি তো!
আঙুল দিয়ে ইশারা করে টেবিলটা দেখিয়ে দেই আমি।
‘বাজারে গেলাম। ঘরে কিছুই তো নাই। সামান্য কিছু রান্না করার জন্য একটা পাতিলও দেখলাম না কোথাও। লঙ্গরখানা নাকি?’
ওকে বলার চেষ্টা করলাম, ‘আমরা ছেলে। আমাদের ছোট বড় পাত্র নিয়ে মাথাব্যথা তেমন নেই।’
কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। ঘুমের রাজ্যে চলে গেছি আমি।
⚝
‘তোর অবস্থা উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে।’
কি সুন্দর করেই না হাসে আইরিন – আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।
‘সারাদিন শুয়ে বসে খেলে অবস্থার উন্নতি হবেই।’ একটু হেসে জানালাম, ‘তুই এত কেন করছিস বল তো? গাঙ্গের মরাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস যে! শোধ করতে পারব আমি? না সে সময় আমার আছে?’
আমার ঠোঁটে আঙুল রাখে আইরিন, ‘চুপ।’
কপালে হাত রেখে আরেকটু হাসে, ‘আজ তোর সারাদিন জ্বর নাই।’
দূরের আয়নাতে চোখ পড়তে ভয়ের সাথে তাকিয়ে থাকি। ওটা আমি? ওই কঙ্কালের মত দেখতে ছেলেটা?
যে ছেলেটা রিভার্স সুইপ করে ছক্কা মারতে পারত সে এরকম শুকিয়ে গেছে কবে?
পরের প্রশ্নটা আমাকে আরও জোরে আঘাত করে, ‘আমি কত দিন আয়না দেখি না?’
পাশে বসে আছে আইরিন, আমার পাটকাঠির চেহারা পাওয়া চুলগুলোতে হাত ডুবিয়ে দেয় ও।
‘কেপি?’
আলতো করে ডাকল না? সাড়া দেই আমি, ‘হুঁ।’
‘এইচআইভি ভাইরাস তোর শরীরে কিভাবে আসল জানাবি?’
প্রশ্নটা অবাক করে না আমাকে, অবাক করে এতদিন পরে প্রশ্নটা আসাতে, ‘কোনদিনও তো আগে জানতে চাসনি।’
‘আজ চাচ্ছি।’
‘কলেজ লাইফের শেষ দিকের কথা এসব। তখনও তোর সাথে পরিচয় নেই। ভার্সিটিতে ঢুকিনি। ইভেন কোথাও চান্সই পাইনি। তীব্র মানসিক হতাশাতে ভুগছিলাম।’
‘তারপর?’
‘ক্যাটামিনের নাম শুনেছিস?’ আইরিনকে প্রশ্ন করি।
‘না।’
‘হিংস্র পশুকে বশ করে এই মেডিসিন দিয়ে। ডার্ট গানের সাথে ক্যাটামিন মিশিয়ে দেওয়া হয়। অথবা সিরিঞ্জে। রক্তের সংস্পর্শে আসলে পৃথিবী ঘোলা হয়ে আসে। পশু ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের রাজ্যে কোন কষ্ট নেই। তীব্র হতাশ আমি আত্মহত্যা করতে পারলাম না। ক্যাটামিন নিলাম নিয়মিত। ঘুমিয়ে থাকলাম। ঘোর লাগা জগতের ঘুম। স্বাভাবিক ঘুম ওটা না।’
‘সিরিঞ্জ দিয়ে নিতি ওটা?’
‘হুঁ। বিশ্বাস কর – কোন ধরণের খারাপ মেয়ের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না।’
আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে আস্তে করে আমার ঠোঁটে চুমু খায় আইরিন, ‘জানি। কথা বলিস না, রেস্ট নে। হাগ দিলে নিবি?’
মায়া ভরে তাকাই ওর দিকে, ‘দে।’
চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে আইরিন। সে-ও ভালো। এরপর যদি এইচআইভি ভাইরাসের সাথে কাপোশি’স সারকোমার সম্পর্ক জানতে চাইতো তো এই ঘরে মেডিকেল স্কুলের ক্লাস শুরু করতে হতো আমাকে।
নিচু গলায় বললাম, ‘কেন এমন করছিস, আইরিন? আমার সাথে তো থাকতে পারবি না। তুই নিজেও জানিস। ইভাও জানতো।’
‘পারব। চুপ।’ চোখ মুছে বলে মেয়েটা।
‘পারবি না। আমি বেঁচে থাকলাম মনে কর – তবুও তো আমার-তোর বিয়ে সম্ভব না। এইচআইভি পজিটিভকে বিয়ে করার মত বোকামি করার মত গাধা তুই?’
‘আমি বিয়ে করবো তোকে।’ আমার কপালে কপাল ঠেকায় আইরিন।
‘জানিস, কোন বাবু তুই পাবি না – তাও? তোর না ছোট্ট একটা মেয়ে বাবুর কত সখ ছিল?’
শক্ত করে আমাকে ধরে রাখে আইরিন, ‘লাগবে না আমার বাবু। চুপ করে থাক তো। বেশি বলিস তুই!’
ওর কথা মত চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ। ঠাণ্ডা ঘরটা। আমার নাক ডুবে আছে আইরিনের সুন্দর চুলগুলোর মাঝে। মেয়েটার শরীর কাঁপছে টের পাই।
কাঁদছে ও। কিন্তু কেন? পৃথিবী থেকে একদিন সবাইকেই কি চলে যেতে হবে না?
ওকে স্বান্তনাসূচক কিছু বলতে গেলাম – কিন্তু কথা বের হয় না আমার মুখ থেকে।
হড় হড় করে আইরিনের শরীরেই বমি করে দিলাম। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকি সেদিকে।
টকটকে লাল রক্ত বের হয়ে এসেছে বমির সাথে!
⚝
বুকে মাথা ঠুকে কে? এই মানুষ তো শার্ট আজ ভিজাবে দেখছি।
ধীরে ধীরে চোখ মেললাম। অনেক ওপরে একটা ফ্যান।
হাসপাতাল তো!
আমার নতুন ঠিকানা এখন এটাই। রোজ এ দেখেই ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু বুকে এটা আবার কোন আপদ?
‘ওই ছাগল!’ মিন মিন করে বললাম। আমার গলা থেকে এখন আর বাঁজখাই শব্দ বের হয় না। ওই দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই।
ছাগলটা মুখ তুলে তাকিয়েছে। কেঁদে-কেটে চোখের জল-নাকের জল এক করেছে গাধাটা।
‘ছেলে মানুষের এত কাঁদলে চলে? কাঁদিস কেন?’ সরাসরি প্রশ্ন করলাম মিনহাজকে।
কান্নার বদলে ধমক দেয় এবার ছেলেটা, ‘তোর এমন দশা হইছে তুই জানিস? আয়না দেখছিস? এইটা তুই না তোর কঙ্কাল?’
‘যাহ শালা। এতটাও না। বাড়ায় বলিস।’
মুখে বললেও জানি ওর কথাগুলো কি নির্মম সত্য!
‘ইউসুফরা এসেছিল। তুই ঘুমাচ্ছিলি তখন। ইউসুফ-রিতিশার ব্রেকআপ হইয়া গেছে।’ আনন্দে ঝিকমিক করতে করতে বলে মিনহাজ।
ওর পথের কাঁটা দূর হয়েছে তাই – নাকি যে মানুষটার বিশ্বাসঘাতকতায় আমাদের সবার বন্ধুত্বে চিড় ধরেছিল সে সরে যাওয়ায় সেটা ঠিক বুঝলাম না।
‘দোয়া করি রে তোদের জন্য।’ বললাম ঠিকই – আমার কান পর্যন্তও গেল না।
মনে হচ্ছে একটা মাইক কিনতে হবে। মাইকের বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকা উচিত আমার।
বাম হাতের তালুতে আলতো চাপ অনুভব করতে অনেক কষ্টে মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাই আইরিনের দিকে।
চোখ দুটো গালে বসে গেছে মেয়েটার। গত কয়েক মাস আমার পিছে জীবনটা দিয়ে দিয়েছে ও। ওকে আমি কি করে কৃতজ্ঞতা জানাই এখন?
‘আংকেল আন্টি আসছেন। রাত হয়ে যাবে পৌঁছাতে। আজই দেখতে পাবি ওদের।’ ফিস ফিস করে বলে মেয়েটা।
বাসাতে এতদিন আমিই জানাতে দেইনি। গত তিনদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম – এই ফাঁকে আইরিন কাজটা করে ফেলেছে মনে হচ্ছে।
ওকে আর বকলাম না আজ। আম্মু-আব্বু আসুক। আমার এই চেহারা দেখে খুব কষ্ট পাবে তো ওরা – এটাই খারাপ লাগে।
ভেবেছিলাম একটু সুস্থ হয়ে জানাবো ওদের আমার এইডসের কথা। কাপোশি’স সারকোমা লেট স্টেজের কথা। ডাক্তারের বেঁধে দেয়া চার থেকে ছয় মাসের কথা। তা আর হল কই? শরীরের অবস্থা আগের মত ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই এখন।
‘রাত হবে বললি না?’ মিন মিন করে জানতে চাইলাম।
‘হ্যাঁ। আর কয়েক ঘন্টা।’ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে মেয়েটা।
গালে এক ফোঁটা গরম পানি অনুভব করলাম। কি দ্রুতই না ঠাণ্ডা হয়ে গেল পানির ফোঁটাটা!
বাম হাতে যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে আইরিনের হাতটা ধরলাম, ‘তাহলে ওদের সাথে দেখা হল না রে আর। দ্যাখ – ম্যাগনাম ওপাস যেই উপন্যাসটাকে বানাতে চেয়েছিলাম সেটাও শেষ করতে পারলাম না।’
অধৈর্য্য হয়ে আমাকে ঝাঁকুনি দেয় আইরিন, ‘চুপ। ভাববি না। মাথাটাকে বিশ্রাম নিতে দে। অনেক খাটিয়েছিস।’
আমি চুপ হয়ে যাই।
অনেকদিন আগে ইভা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আর কিছু বলবে?’
ফ্যানটা ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের সামনে ধীরে ধীরে। আজ ইভাকে আমি উত্তর দিতে পারি।
না, ইভা। আর কিছু বলব না আমি।
— ০ —
Leave a Reply