Skip to content
KP Imon
KP Imon

Words Crafted

  • গুহামুখ
  • সূচিপত্র
  • গল্প
    • রম্য
    • জীবনধর্মী থৃলার
    • সাইকোলজিক্যাল
    • রোমান্টিক
    • ক্রাইম
    • সাসপেন্স
    • জীবনধর্মী
  • নন-ফিকশন
    • থট প্রসেস
    • উচ্চশিক্ষা
    • আমেরিকা-নামা
    • জীবনোন্নয়ন
    • তাত্ত্বিক আলোচনা
    • ডায়েরি
  • প্রকাশিত বইসমূহ
    • প্রকাশিত বইসমূহ
    • যেসব গল্প সংকলনে আছে আমার গল্প
KP Imon
KP Imon

Words Crafted

হোয়াই ডু দে ডু ইট! 

Posted on May 5, 2018June 19, 2022

শেষ পর্যন্ত ছ্যাঁকা খেয়েই গেলাম। অথচ কয়েকদিন আগেও যারা প্রেমে পড়ে নানা রকম পাগলামি-ছাগলামি করে তাদের কী নোংরা নোংরা গালিই না দিয়েছি। ব্যাটারা প্রেমে পড়তে শিখিসনি তো প্রেমে পড়বি কেন? যেমন আমার কলেজের বন্ধু আশরাফ। পড়লো কার প্রেমে? প্রতিরক্ষা মন্ত্রির মেয়ের! এদিকে আশরাফের চালচুলা নাই, পকেটে এই ইয়া বড় একটা ফুটা। শিক্ষাগত যোগ্যতা? ঠনঠন। এভাবে কি আর হয়?

আশরাফকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম জাভিয়াস ডাইনে। কোণের এক টেবিল দখল করে বলেছিলাম, “উপমন্ত্রির মেয়ে পিক করলেও একটা কথা ছিলো। হাত বাড়িয়েছিস একেবারে মন্ত্রির মেয়ের দিকে! আইফেল টাওয়ারে হাত বাড়া। একেবারে চাঁদের দিকে কেন রে ভাই?”

আশরাফ বলেছিলো, “বন্ধু মদ খাবো।”

আমি এই বন্ধুটিকে অত্যন্ত স্নেহ করি। তারপরও যুক্তির বাইরে কথা বলতে শুনলে আমার রাগ হতে থাকে খুব। স্বাভাবিকভাবেই রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেলো একেবারে।

বললাম, “বোকাচোদার মতো কথা বলবি না। মদ খাবি মানে? মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে জানি। তাই বলে মদ খাওয়া কি করে যুক্তিপূর্ণ হয়? তুই তোর শরীরের ভেতরের রাসায়ানিক দ্রব্যাদির জন্য কষ্ট পাচ্ছিস। মাথায় নানা রকম কেমিকেল নড়াচড়া করছে এখন তোর। সেগুলোই আসলে তোর ইমোশন। ওরা কুড়কুড় করে তোকে কষ্ট দিচ্ছে। মাথার ভেতরের কেমিকেলের দোষে তুই লিভারের বারোটা বাজাবি কেন?”

আশরাফ বলেছিলো, “গাঁজাবাবা ইয়াসিরের নাম্বারটা তোর কাছে আছে?”

আমার মেজাজ উত্তোরত্তর গরম হতে থাকে। রেস্তোরার এই প্রান্তটা কাঁপিয়ে ওকে একটা’রাম’-ধমক দিলাম। 

“গাঁজা খাবি কোন সাহসে?” গর গর করে উঠলাম আহত বাঘের মতো, “গাঁজা খেলে কি আর মেয়েটা ফিরে আসবে? ব্যাটা গাণ্ডু! যুক্তিপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত…”

আশরাফ আমার দিকে লাল লাল চোখে করে বলেছিলো, “যুক্তিবুদ্ধি তোর হুজ্ঞির মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো। ইয়াসিরের নাম্বার দে।”

আমি সেদিন-ই বুঝেছিলাম আশরাফের মতো গাধা একটা ছেলেকে দিয়ে জীবনে কোনো উন্নতি হবে না। নয়তো প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে এমন পাগলামি কেন করবে বাইশ-তেইশ বছরের একটা ছেলে? এসব কাজ করবে পনেরো-ষোলো বছরের কিশোর। চুপচাপ গাধাটাকে ইয়াসিরের নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। তোর লিভার আর তোর ফুসফুস। গাঁজা খেয়ে খেয়ে চালুনি বানিয়ে দে। আমার কি আসে যায়!

আশরাফের মতো ছেলেরা মনে করে মেয়েদের প্রেমে ওই ব্যাটারা একলাই পড়ে। দুনিয়ার আর সবাই সমকামী। কেন, আমি প্রেমে পড়িনি? ছ্যাঁকা খাইনি? অবশ্যই খেয়েছি। যে মেয়েটার সাথে জীবনের প্রথম বিছানায় গেছিলাম সে-ই ছ্যাঁকা দিয়ে দিলো। আমার তেমন কিছু তো মনে হয়নি তখন। মন খারাপ হয়েছে। মন তো খারাপ হবেই। একটা মেয়ের সাথে প্রতিদিন এভাবে মিশতাম, আর কখনও মেশা হবে না। এটা তো মন খারাপের ব্যাপারই।

কিন্তু আমার শত্রুও বলতে পারবে না ছ্যাঁকা খেয়ে আমি গাঁজায় টান দিয়েছি। মদ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছি। অশ্লীল আর আপত্তিকর একটা গালি দিয়ে গেল আমার যে বন্ধুটি, ওই আশরাফও বলতে পারবে না এমন কথা। কারণ আমি জানি আমার ওই কষ্টগুলো এসেছে মস্তিষ্ক থেকে। মস্তিষ্কের খেলায় বিভ্রান্ত হয়ে নিজের জীবনটা শেষ করে দেওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। কোনই যুক্তি নেই!

১.

ঘাপলাটা বাঁধলো বইমেলায়।

স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। একজন দুইজন পাঠক এসে অটোগ্রাফ চাইলে সেটাও দিচ্ছি। জায়ীফ নামের ছেলেটার বই এই বছর প্রথম প্রকাশ হয়েছে। কাজেই ওকে সমানে ক্যালানো হচ্ছে। বেচারা মুখ খোলার চেষ্টা করলেই আমরা উচ্চারণ করছি’ট্রিট’। ফোন বের করলেই একটু আগে বিশালবক্ষা যে তরুণীটি তার অটোগ্রাফ নিয়ে নিজের নাম্বার লিখে ওর বুকপকেটে রেখে গেছে তার ব্যাপারে মনে করিয়ে দিতে ভুলছি না। জায়ীফ একেবারে লাল হয়ে আছে। দেখতে একটু সুন্দর আর লেখক হলে এই দেশে দুই হাতে ঠেলেও মেয়েদের ভিড় সরানো যায় না। জায়ীফ সেই মুহূর্তে এসব উপভোগ করছিলো। হাত দিয়ে ঠেলছিলো না অবশ্য, লেখকদের স্ক্যান্ডাল খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই অঞ্চলে।

সতেরোকে আমি প্রথম দেখেছিলাম সেই মুহূর্তে। আসলে আমি আজ নিশ্চিত না কিভাবে কি হয়েছিলো। একটা হুড়ুমধাড়ুম ধরণের শব্দ হলো। তারপর মাটিতে অতি রূপবতী এক মেয়েকে দেখলাম গড়াগড়ি করছে। মেয়েটির সঙ্গে স্বামীপ্রবর সটান দণ্ডায়মান। তিনিও পড়লেন, স্ত্রীকে তুলতে গিয়ে। একেবারে কুমড়োর মতোই গড়িয়ে গেলো ওরা।

প্রকাশনীর এডিটর মাশরুর ভাই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। একটু দুশ্চিন্তায় পড়লে ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে যায়। কপাল থেকেই এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে তিনি চিৎকার জুড়ে দিলেন, “কি হয়েছে! কি হয়েছে?”

আমি কেবল বললাম, “জায়ীফের জন্য হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে একটা মেয়ে পড়ে গেছে।”

জায়ীফ কটমট করে আমার দিকে একবার তাকালো। আমাকে শায়েস্তা করার জন্য যথেষ্ট সময় তার ছিলো না। অতি রূপবতী কোনো মেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে যাবে আর জায়ীফ তার অতিবিনয়ী সার্ভিস দিতে সেদিকে ভদ্রতার হাসি হেসে যাবে না? এমন দিনও বাংলাকে দেখতে হয়নি আজতক।

খাঁটি নারী-শিকারীর মতো ব্যাটাকে এগিয়ে যেতে দেখলাম। পড়ে থাকা মেয়েটির দিকে দু’হাত বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়লো তরুণ লেখক, “ইশ, খুব লেগেছে মনে হচ্ছে। দেখে শুনে পা ফেলবেন না? বইমেলার রাস্তাঘাট তো হাইওয়ে না, আপু। এখানে ওখানে ইট-মিট বের হয়ে থাকে।”

মুখে আপু ডাক, আর বইমেলাকে গালির তুবড়ি ছোটানো, সবই জায়ীফের প্লে-স্ট্র্যাটেজি। এর মধ্যে যা করার করে ফেলেছে সে। সুন্দরীকে আধেক জড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পেছনে সুন্দরীর স্বামীপ্রবর এখনও মাটিতে। ভদ্রলোক কোমরে দারুণ ব্যথা পেয়েছেন বলে মনে হলো। জায়ীফের দিকে সাহায্যের আশায় একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনিও। তরুণ লেখক তাকে পাত্তাও দিলো না।

ভদ্রলোককে তোলার সময় খেয়াল করলাম জিনিসটা। আমাদের প্রকাশনীরই একটা স্পুল। কিভাবে যেন তার বেরিয়ে পড়েছে, রাস্তায় কিছুটা ছড়িয়ে ছিলো তাতেই পা বেঁধে কেলেঙ্কারী। সাধাসিদে ধরণের একজন মানুষ, আমাকে হাত থেকে ছাড়া পেতেই গা ঝাড়া শুরু করলেন, “কোমরটা মনে হয় গেছে।”

ঠিক তখনই বইটা দেখতে পেলাম। ভদ্রলোকের পাছার তলে পড়ে ছিলো এতোক্ষণ। ’রক্তক্ষরণ’, আমার লেখা বই। গত বছর প্রকাশিত, নতুনটা নয়। মলাটের বারোটা বেজে গেছে একেবারে। রূপবতী তরুণী এই দফায় হাহাকার করে উঠলো, “শেষ করে দিয়েছো তুমি একেবারে!”

স্বামীপ্রবর লজ্জিত একটা হাসি হাসলেন। তরুণী জায়ীফের বাহুডোর থেকে প্রজাপতিদের মতো উড়ে উড়ে চলে এলো মাটিতে পড়ে থাকা বইটির দিকে। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলো তার। লাল হয়ে গেলো সাথে সাথে।

আমিও বরফের মতো জমে গেলাম। ঘটনা এখন পরিষ্কার। দাঁতে দাঁত চেপে কোনোমতে শুধু বলতে পারলাম, “মাইরালসে আমারে। এক্কেরে মাইরালসে।”

মেয়েটা এতো কিছু খেয়াল করলো বলে মনে হলো না। আমার দিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়েছে সে এরই মধ্যে, ক্ষমাপ্রার্থনাস্বরূপ কি কি জানি বলে যাচ্ছে এখনও। তার মধ্যে আমি কেবল কোনমতে কলম বের করে জানতে চাইলাম, “কি নামে হবে?”

মেয়েটা বললো, “সতেরো।”

সতেরো কি কোনো মানুষের নাম হয়? এতো একটা সংখ্যা। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকলো। অটোগ্রাফ দিতে দিতে পেছনে কি কথা বার্তা হচ্ছে আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।

আমাদের সহজ-সরল এডিটর মাশরুর ভাই এখনও গলা তুলে হম্বিতম্বি করছেন, “কি হয়েছে! হচ্ছেটা কি এখানে!”

জায়ীফ তার দিকে মিষ্টি করে হেসে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে উত্তর দিলো, “লিয়নের জন্য হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে একটা মেয়ে পড়ে গেছে।”

২. 

এক সপ্তাহ পর সতেরো আমাকে নক করলো। আর সবাই যেমন বলে তেমনটাই বললো প্রথমে, “কি লিখেছেন! ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম ছাই। এখন এখান থেকে বের হতে পারছি না আর।”

আমিও আর সবাইকে যেমন বলি, তেমনটাই বললাম। “মতামত জানানোর জন্য ধন্যবাদ। হেহে।”

শেষের’হেহে’টা একটা বোকাচন্দ্র ধরণের ভার্চুয়াল বিনয়ের হাসি। এটা দিতে হয়। সেই সঙ্গে একটা শুষ্ক ধন্যবাদ। ভুলেও এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না। বেশি কিছু বলতে গেলে এক কথা থেকে দুই কথা হবে। আর যে সুন্দর একটা মেয়ে, দুই কথা থেকে হয়ে যাবে প্রেম। আর প্রেম তো করাই যাবে না পাঠিকার সাথে। লেখকদের স্ক্যান্ডাল খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই অঞ্চলে। লেখালেখির জগতে স্ট্রিক্ট রুল আছে দুই একটা। অলিখিত নিয়ম।

তাদের মধ্যে পয়লাটা হলো : পাঠিকার সাথে প্রেমঘটিত সম্পর্কে জড়ানো যাইবে না।

এর তৃতীয় অনুসিদ্ধান্তে বলা আছে : তোমার রচনা পাঠ করিয়া থাকে না এহেন গণনাতীত মনোহারী দুহিতা রহিয়াছে দুনিয়ায়, তাহাদের লগে প্রেম করিতে পারো।

পঞ্চম অনুসিদ্ধান্তে বলা আছে : লেখনীর জোরে নহে, ব্যক্তিত্বের জোরে নারী হৃদয় জয় করো।

নবম অনুসিদ্ধান্তে বলা হয়েছে : লেখনীর জোরে নারীহৃদয় জয় করে কাপুরুষ।

দশম অনুসিদ্ধান্তটা ভয়াবহ রকমের অশ্লীল। তাই প্রকাশ করার চেষ্টাও করলাম না।

একেবারে অস্বিত্বের সঙ্কট। পাঠিকার সাথে প্রেম করে পুরুষত্ব বিসর্জন দেওয়া যাবে না। কাজেই আমি সতেরোর সাথে কথা বলতে চাইছিলাম না। তারপরও কথা কিছু থেকে যায়। মেয়েটা এতো আগ্রহজাগানিয়া একটা চরিত্র, আর আমিও এক রহস্যোপন্যাস লেখক। দুই একটা প্রশ্ন করা তো উচিত।

পাঠিকার সাথে চ্যাট শুরু হওয়ার দশ মিনিটের মাথায় প্রশ্নটা করে ফেললাম, “আপনার নাম কি আসলেই সতেরো?”

ওপাশ থেকে এলো একটা দীর্ঘশ্বাসের ইমো। তারপর উত্তর, “হ্যাঁ। মা রেখেছিলো।”

“আপনারা কয় ভাই বোন?”

“আমার ছোট আছে একটা।”

“ওটার নাম কি আঠারো?” না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না।

অনেকগুলো হাসির ইমো এলো এবার। কল্পনার চোখে পরিষ্কার দেখলাম ঘরোয়া পোষাকে নিজেকে জড়িয়ে রাখা মেয়েটা হাসিতে ভেঙ্গে পড়েছে। সমস্যাটা ওখানেই হলো। কল্পনাশক্তি যদি আরেকটু দুর্বল হতো তাহলে এই সমস্যা হতো না। এই প্রথমবারের মতো কোনো পাঠিকার সাথে চ্যাটে মজে গেলাম। দিন রাত একাকার হয়ে গেলো এবার। আর মেয়েটার সাথে সব কিছু নিয়ে আলোচনা করা যায়। সাধারণ বাংলাদেশি মেয়েগুলোর মতো মোটা মাথার না যারা ছোট্ট একটা গণ্ডির বাইরে আর কিছু চিন্তা করতে পারে না। এতো এতো অনুসিদ্ধান্ত আর নীতি-নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও একে অন্যের সঙ্গে একটা ঘণ্টাও কথা না বলে থাকতে পারলাম না আগামি কয়েকটা দিন। তারপর কয়েকটা সপ্তাহ।

সেদিন আম্মু ঘরে ঢুকে শয়তানের মতো হেসে জানতে চাইলো, “মেয়েটা কে, লিয়ন?”

আমি ক্ষেপে গেলাম, “কোন মেয়ে? কিসের মেয়ে?”

টেবিলে চা রেখে যাওয়ার সময় আম্মুও খোঁচা দিতে ভুললো না, “গত এক মাস ধরে দেখেই যাচ্ছি! বই পড়ছিস না। লেখালেখি থামিয়ে রেখেছিস। তোর কীবোর্ডের শব্দে বাসায় টেকা যেতো না দুইদিন আগেও। এমনি এমনি তো আর চুল পাকেনি আমার!”

দরজার বাইরে গিয়ে আবার ফিরে এলো আম্মু। চোখ পাকিয়ে গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মতো জানতে চাইলো, “হিন্দু মেয়ে? হিন্দু হলেও সমস্যা নাই। নিয়ে আয় একদিন বাসায়!”

আম্মুটা যে কি ফাজিল হয়েছে!

৩. 

সমস্যা হলো মেয়েটা হিন্দুও না।

আমরা ইদানিং চ্যাটের বাইরে চলে এসেছি। এদিক ওদিক আমরা ঘুরে বেড়াই। সতেরোর মধ্যে একটা অভিযানপ্রিয় মন আছে। এমনটা আমি এদেশি মেয়েদের মধ্যে দেখিনি। যেমন সেদিন ওর মাথায় ভূত চাপলো রাতের ঢাকায় ঘুরে বেড়াবে। তা বেড়াক, বেশ তো। কিন্তু সফরসঙ্গী হিসেবে ওর আমাকেই চাই! এ কী মহাবিপদ।

মাতাল ছোকরাদের দলটা যখন দামাদামি করার পর সতেরোকে নিতে পারলো না (কারণ, আমি ইচ্ছে করেই ওর শরীরের দাম বাড়িয়ে বলেছি, যেনো নিতে না পারে), পুলিশদের ছোট্ট গ্রুপটা যখন আমাদের পেছনে প্রায় লেগে গিয়েছিলো – তখন আমরা ইস্তফা দিয়েছিলাম নৈশভ্রমণের। ছুটতে ছুটতে কোনোমতে গাড়ির কাছে এসে পৌঁছেছি, হাসিতে ফেটে পড়লো সতেরো।

ওর দিকে রাগী রাগী মুখ করে তাকালাম, “আরেকটু হলেই তো রেপড হয়ে যেতি। এমন সব উদ্ভট সখ তোর, খোদা!”

এতে করে ওর হাসি কমলো তা নয়। ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো ড্রাইভিং সিটে উঠে। এই গাড়ি সতেরোর নিজস্ব। আমি হিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে ড্রাইভ করতে দেখি। গাড়ি চালানোটা শিখতে পারলাম না এখনও। অবশ্য শিখলেও লাভ হতো না তেমন। আমার তো গাড়িও নেই।

সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সতেরোর হাসি মিইয়ে এলো। আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকালো সে, “চল্‌আমরা সামনের সপ্তাহে বাংলামোটর যাই। ওখানে নাকি ছেলেদেরও ভাড়া পাওয়া যায়।”

আমার মুখ হা হয়ে গেলো এবার, “তুই সিরিয়াসলি আমাকে ভাড়া খাটাবি?”

অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত দেখলো সতেরো, “সমস্যা কি? আমার মনে হয় না তোর ডিমান্ড একেবারে কম হবে সেখানে। আর সমকামীরাও মনে হয়…”

দুম করে ওর কাঁধে একটা ঘুষি মেরে দিলাম, “চুপ!”

“এই! ড্রাইভ করছি তো!” মৃদু ধমক দিলো সতেরো, মুখে যদিও হাসি।

চুপচাপ কিছুক্ষণ চললাম আমরা, মসৃণ গতিতে। নীরবতার উপযুক্ত দাম দেওয়ার লক্ষ্যে একটা সিগারেটও ধরিয়ে ফেললাম। আমার দিকে খ্যাপাটে চাহনি উপহার দিলো সতেরো। কারণটা আমি জানি, মেয়েটা তার গাড়ির ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে। চায় না ভেতরে কেউ স্মোক করুক।

আরেকদিন আমরা হাতিরঝিলে স্টান্ট একটা দিলাম। ব্রিজের রেলিংয়ে কসরত করে উঠে গেলো সতেরো। জিন্স আর টিশার্টে ওকে দেখাচ্ছিলো হলিউডের টিনেজ রোমান্স ধরণের মুভিগুলোর নায়িকাদের মতো। সোজা হয়ে ব্রিজের রেলিংয়ে দাঁড়াতে ওকে বেগ পেতে হচ্ছিলো খুব, একটু দূরে দাঁড়ানো আমার বুক দুরু দুরু করতে থাকে। মনে হচ্ছিলো মেয়েটা ঝুপ করে পানিতে পড়ে যাবে। তারপর ডুবে মরে যাবে নিশ্চিতভাবেই। কারণটা ব্যাখ্যা করার জন্যই এই স্টান্টবাজির দরকার পড়েছিলো।

সতেরো এবার রেলিংয়ের ওপর থেকে উদাস কণ্ঠে বললো, “আমার পেটে শাহেদের বাচ্চা। আমি এই জীবন আর রাখবো না!”

প্রথম লাইনটা মেরে দিয়েছে আমারই লেখা এক গল্প থেকে। গল্পটার নাম ছিলো’সন্তান’। সিরিয়াস একটা মুহূর্তে দাঁড়িয়েও রাগে দাঁত কিড়মিড় করলাম। এতোগুলো লোক এখন ঘিরে দাঁড়িয়েছে সতেরোকে, কিন্তু কেউ একটু এগিয়ে গিয়ে ওকে রেলিং থেকে নামাচ্ছে না। কেউ কেউ মোবাইল তুলে ভিডিও করছে। আর বাকিরা সেই দৃষ্টি নিয়ে সতেরোর দিকে তাকিয়ে আছে যেমনটা এই দেশের সবাই করে থাকে ক্যানভাসওয়ালার কাছে “ঘছর ঘছর খাউজানি” ধরণের ভাষণ শোনার সময়। চিরায়ত বাঙালি দৃশ্য।

মিনিট দশেক পর সতেরোকে গণজাগরণ’সেতু’র কাছ থেকে উদ্ধার করে আনার সময় আমরা দু’জনই ক্ষেপে ছিলাম প্রচণ্ড। 

“শালারা আমাকে কেউ বাঁচাতে আসলো না।” মুখ কালো করে বলেছিলো ও। 

“পাবলিক এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে আসলে ঠিকই আছে। এমনটাই আসা উচিৎ ছিলো রেজাল্ট। কেউ বাঁচাতে আসতোও না আসলে তোকে। যখন কেউ কাওকে কুপিয়ে চলে যায় তখনই লোকজন এগিয়ে আসে না। এটা তো সামান্য আত্মহত্যার কেস।”

গাড়ির কাছে ফিরে এসেছিলাম কোনোরকম অঘটন ছাড়াই। ঝামেলাটা হলো তখন, যখন সতেরোর দক্ষ ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে সুযোগ পেলেই একে অন্যের হাত ধরে রাখছিলাম আমরা। এমনকি এই বিষয়ে আমাদের কখনও খোলামেলা আলাপও হয়নি। আমি ওকে কিংবা ও আমাকে ভালো লাগাও জানায়নি কখনও। ওকে ছুঁয়ে দেখতে আমার ভালো লাগে, এই ভালো লাগা অন্যরকম। ওর-ও ভালো লাগে আমি জানি। এমন ভালো লাগার সাথে হরমোনের ওতোপ্রোত সম্পর্ক আছে।

আমার মনে হচ্ছিলো বড় ধরণের কোনো সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। নিয়তির অমোঘ টানে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, এই সর্বনাশটার দিকে এগিয়ে যেতে আমার ভালোই লাগছিলো!

৪. 

সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হলো সতেরোর ফ্যাসিলিটির লিফটে। মেয়েটা বেসরকারী মেডিকেল কলেজের ছাত্রি। ইন্টার্নশিপে, মানবরক্ষার মহৎ ব্রতে ব্যস্ত। রাত তিনটার পর অনেকটা নিঝুম হয়ে যায় ওদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেদিনও আমরা বেরিয়েছিলাম কেলেঙ্কারি ঘটাতে, ইয়াবাখোরদের আখড়ায় গিয়ে ইচ্ছেমতো মদ খেয়েছিলাম দু’জন মিলে। কিছু গুটি কিনেও নিতে হয়েছে। নাহলে ইয়াসিরের মান আর থাকতো না, ওর মাধ্যমেই ঢুকেছিলাম তো। সতেরো তার স্বভাবসুলভ বদমায়েশি করেছে বরাবর। সুন্দর একটা মেয়ে বসে বসে নাক দিয়ে কি কি যেনো টানছিলো। ওই অ্যাডিক্টেডটাকে গিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে এসেছে বদ মেয়েটা। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, এই প্রস্তাবে ঐ অ্যাডিক্টেড মেয়েটারও আপত্তি ছিলো না কোনো। সতেরোকে নিয়ে কোণার এক ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। কোনমতে ওকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি।

লিফটে ঢুকেই আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম। রাতের এই সময়টায় লিফটগুলো নির্জন হয়। নির্জনতা তো কোনো নতুন ঘটনা না আমাদের জন্য। অথচ সেদিন আমাদের মনে হয় ভূতে ধরেছিলো। ভূতের দোষ অযথা দিয়ে লাভ নেই, সতেরোকে লিফটের দেওয়ালে চেপে ধরার দায়টা আসলে আমারই ছিলো। আমরা একে অন্যকে স্রেফ ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকলাম ওখানে। লিফট দশতলায় দাঁড়িয়েছে, খুলে গেছে দরজা। নির্জন করিডোরটা দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। যে কোনো সময় যে কেউ সেখানে বেরিয়ে আসতে পারে, অথচ আমরা নির্বিকারভাবে একে অন্যকে আঁচড়ে কামড়ে একাকার করে চলেছিলাম।

চুল ঠিক করতে করতে যখন করিডোরে পা রেখেছিলো সতেরো, দ্রুত হেঁটে ওর পাশে চলে আসি।

“এতোদিন এই বেহেশত সরিয়ে রেখে দূরে দূরে ছিলাম কেন আমরা?” বোকার মতো জানতে চাইলাম।

মুখ নিচু করে রেখেছে মেয়েটা, ওর মনের ভাব পড়তে পারলাম না। ছোট্ট করে কেবল বললো, “জানি না।”

নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের সামনে পৌঁছে আমাকে অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরলো ও। এক সেকেন্ডের জন্য কেবল। আমি পরিষ্কার টের পেলাম এক বিদায়ী বার্তা। মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার মতোই এক বিদায় আলিঙ্গন যেনো। 

“আর এসো না। বাই বলো আমাকে?” নিচু গলায় আমাকে বললো সতেরো।

মাথা দোলালাম। ওর চুলগুলো গুছিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম একবার, “বাই।”

আর কেন এগিয়ে দিয়ে আসা যাবে না আমি জানি। দরজার ওপাশে ওয়ার্ডের ভেতর আছে ডা. রিশান। বইমেলায় কোমর ভাঙার মাধ্যমে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয়। তবে মানুষটার আরও একটা পরিচয় আছে। সতেরোর বাগদত্তা তিনি। রাত তিনটার সময় বাগদত্তার সঙ্গে তার পছন্দের লেখককে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে দেখতে চাইবেন না নিশ্চয়। অগত্যা, আমার প্রস্থান নিশ্চিত করতেই হতো। অ্যাবাউট টার্ন করে লিফটের দিকে ফিরে আসছিলাম যখন, অজান্তেই বার বার পেছনের শুন্য করিডোরের দিকে তাকাচ্ছিলাম।

ওয়ার্ডের ভেতর সতেরো কি তাকিয়েছিলো দরজার দিকে? একবারের জন্যও?

আমি জানি না।

৫.

পরদিন ওর গাড়িতে বসেই আমরা একজন আরেকজনকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিলাম। ঘন নিঃশ্বাস আর চুম্বনের মিষ্টি শব্দ থেমে আসার পর অদ্ভুত এক বিষণ্নতা ঘুরে বেড়াচ্ছিলো জানালার কাঁচে। আমার গালে আর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো ও। তার মধ্যেই নিচু গলায় বললো, “এগুলো বন্ধ করতে হবে আমাদের।”

মাথা দোলালাম। এগুলো বন্ধ করতে হবে এটা আমিও জানি। দুইদিন পর মেয়েটার বিয়ে। বেচারা রিশানের সঙ্গে ওর পনেরো বছরের প্রেম। সেই শৈশব থেকেই একসাথে বেড়ে উঠেছে ওরা। পাশাপাশি বাড়ি গুলশানে। ওদের মতো জুটি আসলে এই সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার দিনে খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রথম প্রথম যখন আমাদের ফেসবুকে কথা হতো, আমি ওদের ভীষণ সম্মান করতাম এই রকম দীর্ঘ একটা ইনিংস খেলে আসার জন্য। ওদের পঞ্চদশ পরিচয়বার্ষিকীতে রিশান-সতেরোকে উৎসর্গ করে লিখেছিলাম গল্প। সুইট একটা কাপল।

মাঝ দিয়ে আমি সুড়ুৎ করে ঢুকে গেলাম, কোনো মানে হয় না। পনেরোটা বছর ধরে নির্বিঘ্ন প্রেম ওদের, ভাইরাসের মতো আমার এভাবে ঢুকে পড়া উচিত হয়নি। অথচ ভীষণ অনুচিত আরেকটা কাজ করে ফেললাম এসব ভাবতে ভাবতে। সতেরোর কোমল ঠোঁটজোড়ায় গভীরভাবে চুমু খেলাম।

আমার ঠোঁটে হাতচাপা দিলো মেয়েটা, “স্টপ। আমাদের উচিত কিছু দূরত্ব নিয়ে আসা। এগুলো একেবারেই উচিত হচ্ছে না।”

এসব বড় বড় কথা অবশ্য বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। ত্রিশ সেকেন্ড পর সতেরোকে দেখা গেলো আমার পিঠে ভয়াবহভাবে ওর সুতীক্ষ্ম নখগুলো অনেকটা দাবিয়ে দিয়ে হিংস্র বাঘিনীর মতো আমার ঠোঁটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে।

“উই শুডন’ট।”

“থামানো উচিত।”

এসব বলতে বলতেও রহস্যময়ভাবে আমরা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলাম সেইরাতে। এই এক রহস্য ভেদ করার ক্ষমতা আমার মতো মিস্ট্রি রাইটারকেও দেওয়া হয়নি। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো আমার। কিন্তু জানতাম না ওটা শেষ নয়। শেষের শুরু কেবল।

ভয়ঙ্কর অসহায়ত্বের পুরোটাই অপেক্ষা করছে সামনে!

৬.

সতেরো ধীরে ধীরে দূরত্ব ঠিকই আনতে পারলো। আমরা এখন আর আগের মতো রাতের বেলায় অভিযানে বের হই না। রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি না (রিশানের শিফট যখন চলে)। টেক্সট করার সময় “বাবু” “জান” এইধরণের কিছু শব্দমালাকে আর ব্যবহার করি না। সতেরো এখন আমার সাথে দেখা করার ক্ষেত্রে ওর গাড়ি কিংবা নির্জন লিফট – এই গোত্রের সবগুলো এলাকা এড়িয়ে চলে।

আগে আমাদের দেখা হতো প্রতিদিন, এখন সপ্তাহে এক কি দুইদিন। তাও জনাকীর্ণ কোনো রেস্তোরায়। টেবিলের ওপর আমাদের হাতে হাত ছুঁয়ে যেন না যায় সেজন্য ভীষণ সতর্ক থাকে মেয়েটা। যেনো ছুঁলেই ভীষণ কোনো মহামারী ওকেও গ্রাস করে নেবে। আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায় ওকে এভাবে সঙ্কুচিত হয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু এই একটা পরিস্থিতিতে লেখক নীরব। একটা মেয়ের অধিকার আছে নিজের সংসার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করার।

চব্বিশ বছরের দীর্ঘ জীবনে আবিষ্কার করলাম, আমার ভেতর কোথায় যেন একটা স্টকার লুকিয়ে ছিলো। এই বিরহ যাতনায় ওটা সুরসুর করে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোয় ওর সাথে দেখা হয় না। তখন আমি শিডিউল ধরে ওর মেডিকেল কলেজের সামনে চলে আসি। এখানে একটা চায়ের দোকান আছে রাস্তার অন্যপাশে। রাঘু মিয়ার দোকান। দোকানদারের সাথে আমার মামা-মামা সম্পর্ক হয়ে গেছে এতোদিনে। একটা দুটো বেনসন আমি নিজেই খাওয়াই তাকে। কাস্টোমারের ট্রিট। এমন কাস্টোমারকে ভালো না বেসে দোকানদাররা পারে না। আমার উদ্দেশ্য অবশ্য বদ। ওখানে বসে বসে আমি সতেরোর গাড়িটার জন্য অপেক্ষা করি। পার্কিং লটটা সামনের দিকে। ওখানে গাড়ি রেখে মেয়েটা বের হয়ে আসে। একটু দেখা যায়। দূর থেকে অতোটুকুই দেখি, এর চেয়ে বেশি আর কিছু করার ছিলো না আমার।

কখনও কখনও সতেরোর সঙ্গে থাকে তার ফিয়ান্সে। ডা. রিশানের সাথে ওকে দারুণ মানায়। ভদ্রলোকের চেহারায় প্রজ্ঞার ছাপ আছে। আমি জানি, এই মানুষটা যতোভাবে নিখুঁত হতে পারে সে তা-ই। ছেলেটি কখনও রাস্তার ছেলেদের সাথে মেশেনি নিশ্চয়, শৈশবে যৌন হয়রানির শিকার হয়নি, কৈশোরে সংসারের হাল ধরেনি, পরিবার থাকা সত্বেও ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেদের মতো মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠেনি, রাতের অন্ধকারে পরদিন কাকে শান্ত ভাবে ছুরি মারা হবে সেই আলোচনায় থাকেনি, এলাকার টপটেররের খুন করার একান্ত অভিজ্ঞতা শোনেনি, আমি বাজি ধরে বলতে পারবো এই ছেলেটির গলায় কেউ ব্লেড মারার চেষ্টা করেনি, তাকে ভবিষ্যতেও কেউ মেরে ফেলার জন্য খুঁজবে না।

ম্যারেজ ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ভদ্রলোক একেবারে পরিপাটি বলেই নয়, রাঘু মিয়ার দোকানের বসে বাগদত্তাটিকে দেখতে দেখতে আমার মন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে একেবারেই খারাপ হয়ে গেলো। সত্য থেকে যতোই দূরে থাকার অভিনয় করে যাই, ভদ্রলোকের মতো ফ্রেশ স্টার্ট আমি কখনোই পাবো না। স্বাভাবিকভাবে, সতেরোর মতো মেয়েরা আমাদের জন্য নয় কখনোই।

আমার মতো মানুষগুলো দুর্নিবার, ঝড়ের মতো। গতি আছে, পরিণতি নেই। দেখেছি আমার সঙ্গে মেলামেশার মুহূর্তগুলো প্রতিটা মেয়েই উপভোগ করে। কিন্তু সাময়িক সে আনন্দ। আমাকে জড়িয়ে ফেলার মতো ভুল তারা করে না। করার কথাও নয়।

রাঘু মিয়াকে চা আর সিগারেটের দামটা দিতে দিতে নিজেকেই কড়া করে ধমক দিলাম, “বাস্তবতা বুঝতে শেখ, গাধা কোথাকার।”

৭.

বাস্তবতা এখন আমার নাকের সামনে মনুষ্যমূর্তি হয়ে দণ্ডায়মান। 

এডিটর মাশরুর ভাই কুঁতকুঁতে চোখে জানতে চাইলেন, “কি বালটা ছিঁড়ছো, ঠিক করে বলো তো?”

এতো ভালোবেসে যখন কেউ কিছু জানতে চায়, তাকে হুট করে জবাব দিতে নেই। আমি কুকুরের মতো হাই তুলতে তুলতে একটা সিগারেটের খোঁজে ড্রয়ার-ম্রয়ার হাতড়ালাম। পেলাম, এমন না। উত্তরায় ঘুপচিমতো একটা একরুমের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেছি। এখানে একবার খুঁজে সিগারেট পাওয়া না গেলে বোঝা যাবে ঘরে সিগারেট আসলেই নেই। চিপাচুপায় একটা দুটো আবিষ্কার করার মতো বড় নয় এই ঘুপচি।

“ঐগুলো কি? বোতল নাকি?” নাক মুখ কুঁচকে আমার ঘরের ভেতর একেবারে ঢুকেই পড়লেন মাশরুর ভাই। বুঝতে পারলাম, ব্যাটাকে দরজা খুলে দেওয়াই ঠিক হয়নি।

“জ্বি ভাই।” বিনয়ের অবতার হিসেবে এমন উত্তরই আশা করা হয় আমার থেকে।

“মাল খাচ্ছো, অ্যাঁ?” দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক, “এইসব খালি শুনতেছিলাম। বিশ্বাস করি নাই। না, না, লিয়ন তো এমন পোলা না। আমি ভাত টিপলেই চাউল বুঝি। এইসব তুমি করবা সেইটা আমি বিশ্বাস করি নাই একদম। বলছি আমি জায়ীফকে, ওরে ফোন দিয়া জিগাও, বলি নাই?”

“এটা একটা ফ্যাক্ট যে বাংলাদেশের দশ শতাংশ জনগণ নিয়মিত মদ্যপান করে।” চিঁচিঁ করে যুক্তির ঝাঁপি খুলে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মাশরুর ভাইয়ের রক্তচক্ষু দেখে থমকে যেতে হলো।

“তুমি ওই দশ শতাংশের মধ্যে থাকবা, সেইটা তো মানা করি নাই। আমি আসলে বুঝতেছি না তুমি মাল-টাল খাইয়া কি বালটা ছিঁড়তেছো। এমন তো না এইসব ছাইপাশ খাইতেছো আর ক্রিয়েটিভ কিছুও চলতেছে লগে। কই? তোমার স্ক্রিপ্ট কতদূর?”

কুকুরের মতো বিশাল একটা হাই তুললাম আবার, এবার সশব্দে। বললাম, “লিখি নাই, বাল।”

বর্জ্রাহতের মতো ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন মাশরুর ভাই, “জাজ মাল্টিমিডিয়ার অফার ফালায় দিসো?”

অযথাই হাতড়ে হাতড়ে সিগারেট খুঁজলাম ঘরের মধ্যে। জানি পাবো না, তাও। পেলাম চশমাটা, পরার পর মনে হলো ভুল করে ফেলেছি।

মাশরুর ভাই ক্ষেপেছেন। সত্যিই ক্ষেপেছেন এবার। এগিয়ে এসে আমার কলার ধরে বার দশেক ঝাঁকালেন অসুরের শক্তিতে। লোকটা জিম-টিম করে জানি, তাই বলে আমাকে হ্যারাস করা কেন? 

“এইসব সুযোগ কেউ রোজদিন একটা দুইটা করে পায় না। একটা হিস্টরিক মুভি লিখার সুযোগ হইছিলো তোমার, ইউ ইডিয়েট। এই বয়েসে কারও এমন একটা সুযোগ হইতে দেখি নাই আমি। অ্যান্ড ইউ ডিডন্ট ইভেন ট্রাই!”

আমাকে ছোট্ট খাটটার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মাশরুর ভাই। ওই বিশাল শরীরের সাথে আমার মতো প্যাকাটি পারবে কেন? মাথায় বেশ জোরেই বাড়ি খেলাম। ওতেই মনে হয় নেশাটা টুটে গেলো। টেবিলে ঠিক মনিটরের সামনেই একটা সিগারেট পড়ে আছে, এতোক্ষণে খেয়াল করলাম। লাফিয়ে উঠে ওটা ধরালাম আগে, ফিল্টারে হাত বুলিয়ে দিলাম আলতো করে, “মাই প্রেসিয়াস।”

“কি কইলা?” রক্তচক্ষু মেলেই জানতে চাইলেন মাশরুর ভাই।

“ভাই, ডিস্টার্ব দিয়েন না তো বাসায় আইসা।” বিরক্ত হয়ে বলতেই হলো আমাকে, গল গল করে ধোঁয়া ছাড়লাম, “মুভি লিখে কি বালটা হইতো আমার?”

মাথা দোলালেন এডিটর সাহেব। এই ভঙ্গিমা আমার চেনা। তিনি নতুন আক্রমণে যাচ্ছেন। আমার অনুমান অবশ্য নির্ভুল। জানতে চাইলেন, “নভেলের কি হাল? লিখতেছো না আগামী বছরেরটা?”

মাথা নাড়লাম, “কিছুই লিখতেছি না আমি।”

“সেইটাই আমার পয়েন্ট। মুভি লিখলে তো কোনো বালটা হবে না, খুবই ভালো কথা। কিন্তু তার বদলে কোন বালটা করতেছো সেটা আমাকে দেখাও এখন।” এদিক ওদিক তাকালেন তিনি, সব রাগ গিয়ে মনে হয় পড়লো মদের নিরীহ বোতলগুলোর ওপর। বিকট শব্দ তুলে জুতো তুলে এক লাথি মেরে বসলেন ওদের ওপর। ঝন ঝন করে বোতলের মুখ ভাঙার শব্দে ভরে গেলো আমার ছোট্ট ঘরটা।

“ইউ আর আ ওয়েস্ট।” আমার মুখের সামনে আঙুল নেড়ে চোখমুখ লাল করে বললেন মাশরুর ভাই। আরেকটু হলেই সিগারেট উড়ে যাচ্ছিলো আমার। “আ কমপ্লিট, আটার ওয়েস্ট। ইউ ডোন্ট অ্যাফোর্ড দিস। ইউ ডোন্ট।”

লোকটা চলে যাওয়ার পর আমার হাড় জুড়ালো যেন। যেভাবে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিলো, তোষকের নিচের পিস্তলটা বেরিয়ে পড়তেও পারতো। ইদানিং একটা মেশিন রাখা লাগে সাথে, মাশরুর ভাই দেখে ফেললে মান-ইজ্জত আর কিছু থাকতো না। ফোনটা বের করে ইয়াসিরকে একটা কল দিলাম। এখন কাজ কারবার তেমন করি না কিছু। ইয়াবার ডিলার হয়ে গেছি। কাজটা খুব একটা কঠিন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড হওয়ায় কাজটা আরও সহজ হয়েছে। ইয়াসির মাঝে মধ্যে আমাকে কিছু প্যাকেজ এদিক থেকে ওদিক আনতে বলে। আমি আনি। এগুলো কোনো ঝুঁকির কাজই না। খরচাপাতি মোটামুটি চলে আসে মাসের। চলছে খারাপ না।

খাট থেকে নামতে গিয়ে কচ করে পায়ের পাতায় একটুকরো কাঁচ ঢুকে গেলো। টকটকে লাল রক্ত ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। ওদিকে তাকিয়ে মাশরুর ভাইকে গাল দিয়ে উঠলাম, “খানকির পোলা একটা। মাদারচোত।”

৮.

আশরাফ ফিচফিচ করে হাসছে। ধর্ষকদের মতো বিচ্ছিরি একটা হাসি, এভাবে হাসা এই হারামজাদা শিখলো কোথা থেকে? ঘরে মা-বোন সব মরেছে নাকি? আমার পিত্তি জ্বলে গেলো একেবারে।

বললাম, “মাল নিয়ে বিদায় হ। তোর মুখে বানচোতের মতো ওই হাসিটা আমার সহ্য হচ্ছে না।”

আশরাফ বাম হাত বাড়িয়ে আগ্রহের সাথে’মাল’ নিলো। কিন্তু হাসিটা মুখ থেকে সরিয়ে ফেললো না। বরং আরও বিস্তৃত হয়েছে ওটা। আমার মনে হচ্ছে এভাবে বানচোতটা আর বেশিক্ষণ হাসলে ওর নাকে আমি মেরে দিবো। খুব জোরেই মারবো। শেষে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। 

আশরাফ বললো, “চল চল। নিচে চল। চা-টা খাই।”

গাঁ-গাঁ করে শুধু বললাম, “হোগাটা তুলে বিদায় হ।”

আশরাফ আমার কোনো কথাই শুনলো না। একহাতেই টেনে আমাকে নিচে নিয়ে গেলো। রাজলক্ষী পর্যন্ত চলে গেলাম রিকশা নিয়ে। আশরাফ এক হাতে মানিব্যাগ বের করার কসরত করছিলো খুব। ওকে থামালাম। ইয়াবার ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে আমার ইনকাম একেবারে খারাপ না। একহাতী বন্ধুকে কষ্ট দেওয়ার প্রয়োজন দেখছি না। বাদল মামার দোকানে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম। দুই কাপ চা নাকের সামনে চলে আসলো। সিগারেট ধরালাম, আশরাফকেও একটা অফার করলাম। নিলো না, বললো, “মাঝে মধ্যে তোর ওটা নিয়েই দুই একটা টান দিবো।”

খুব অশ্লীল শোনালো কথাটা, তাই আর সাধলাম না। জানতে চাইলাম, “হাতটা হারালি কি করে?”

ফ্যাক ফ্যাক করে হাসলো আশরাফ, যেনো হাত একটা হারানোর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। চারপাশে একবার দেখে নিলো তারপর। পুলিশ-টুলিশই খুঁজলো মনে হয়। দেখা গেলো না ও জিনিস। গলা নামিয়ে উত্তর দিলো বন্ধুবর, “রেইডের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। বিড়াল মামারা গুল্লি মেরে দিলো।”

বিড়াল মামারা যে পুলিশ সেটা আমরা জানি। এরা কথায় কথায় গুলি চালানোর মতো প্রাণি না। আশরাফের মনে হচ্ছে কপালটাই খারাপ।

“গাঁজাবাবা ইয়াসিরের গায়ে ফুলের টোকাটাও লাগে নাই। শালার কপাল। আমার হাতটা ফালায় দিতে হইলো।”

মাথা দোলালাম। এমনি মাথা দোলানো, সহানুভূতি-ভূতি তেমন এলো না। আগেই বলেছিলাম শালাকে, উপমন্ত্রির মেয়েকে পছন্দ করতে। শোনে তো নি। এখন মায়া করার প্রশ্নই আসে না। কাঙালের কথা ফলে তখনই, যখন বাসী হয়।

“আগেই কইছিলাম প্রেমের যন্ত্রণা ঢাকার জন্য মদ-গাঁজার দিকে না যাইতে। এখন তো বাবাখোর হয়ে গেছিস। বাবা খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে হাত হারায় ফেললা। ভালো হইছে না?”

চোখ টিপ দিয়ে আরও কাছে এলো আশরাফ, “হাত না থাকায় সুবিধা আছে। সাহায্য টাহায্য তোলা যায়। ঐদিন এক অফিস যাওয়া লোককে গিয়া চোখমুখ কান্না-কান্না করে কইলাম, বাবার জন্য টাকা দরকার। বাবার এন্টিবায়োটিক কিনতে পারতেছি না, নীলক্ষেতের প্রেসক্রিপশনও দেখাইলাম। কইলাম যে কন্সট্রাকশন সাইটে কাম করতে গিয়া হাতটা গেছে। বোকাচোদা হাতটা দেখলো। বুঝলো যে মিথ্যা বলি নাই। টাকা দিয়া দিলো।” সিগারেটটা নিয়ে একটু টেনে আবার ফেরত দিলো আশরাফ, “মিথ্যা কিন্তু বলি নাই। বাবার জন্যই টাকা নিসিলাম।”

সন্দেহ কী তায়! আমার কাছ থেকেই তো নেয়। রোহিঙারাও এভাবে বাবা খায় বলে আমার মনে হয় না। ব্যাটা গাণ্ডু।

আশরাফ অবশ্য আমার দিকে গুটি চালিয়ে দিয়েছে এবার। ধর্ষকদের মতো হাসিটা তার মুখে ফিরে এসেছে বরাবর। বললো, “তুমি না আমারে কতো লেকচার চোদাইলা? নিজেই তো হইছো মালখোর। শুনলাম ভার্সিটি থেইকা বাইর হইয়া বাবার ডিলার হইছো। দেখতেছি তো। মাইয়াবাজি তো নিজেও করলা। অন্যরে বলার সময়…”

এবার আশরাফের হাসিটা আর ধর্ষকের মতো লাগলো না আমার কাছে। ঠিকই আছে। ফাঁদে পড়লে হাতিকেও লাথি মারে চামচিকা। আর এ তো এক আস্ত মানুষ। লাথি তো মারবেই।

বললাম, “আরে তখনও তো প্রেম-ট্রেম বুঝতে শিখি নাই। অল্পবয়েসে কি না কি বলছিলাম… ধইরা রাখার মতো কিছু তো না এসব। এখনও মনে রাখছিস। গাণ্ডুগিরির লিমিট নাই তোর।”

কান ঝাঁ ঝাঁ করার মতো হাসলো আশরাফ, “ঘটনা কি? তুমি হাত বাড়াইছিলা কিয়ের দিকে? চান্দে কুলায় নাই, এক্কেরে সূর্যের ভিতরে?”

এবার আমিও হাসলাম। হাসা ছাড়া আর করার আছেটা কি? সংক্ষেপে বললাম ঘটনা। বাবাখোরদের মধ্যে গোপনীয়তার বালাই কম। আসলে আমার সর্বনাশটা হয়েছে সতেরোর সাথে প্রেমটা হয়নি বলে। প্রেম হয়, প্রেম ভাঙে সেটা মেনে নেওয়াটা সহজ। দু’জনের আপত্তি না থাকার পরও প্রেমটা হয়নি, বাস্তবতার কাছে হেরে গেছি আমরা। এটা থেকে রিকভার করতে পারিনি আর। ভেসে গেছি গাঙের জলে।

শুনতে শুনতে আশরাফের মুখ থেকেও হাসি মুছে গেলো। উদাস হয়ে কিছুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো বেচারা। পুরোনো ক্ষতমুখ খুলে দেওয়ায় আমার জুড়ি নেই। তারপর আশরাফ আমাকে এক কাপ চা আর আরেকটা সিগারেট খাওয়ালো। আমরা দুইজন দুইদিকে কেটে পড়লাম। আজকে অবশ্য ওই ঘুপচি ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলো না আমার। অনেকদিন ধরে বাড়িও যাওয়া হয় না। প্রায় দুই বছর! অথচ বাড়ির দিকেও রওনা দিলাম না আমি।

কোনোরকম অসুখ করেনি, তবুও একটা সিএনজি নিয়ে ছুটে চললাম নির্দিষ্ট এক হাসপাতালের দিকে।

৯. 

হাসপাতালের রিসেপশনের সামনে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেলো। সদ্য কৈশোর পেরুনো একটা মেয়ে কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমার সামনে এসে হাঁফাতে শুরু করলো। উৎসাহে চোখ ঝলমল করছে তার। আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, “আপনি লিয়ন হাসান না?’রক্তক্ষরণ’, ’অবসাদ’-এর লিয়ন হাসান?”

মূর্তির মতো এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটা সময় এমন দিন ছিলো। টিএসসির মোড়ে গেছি অথচ অপরিচিত কেউ ছুটে এসে এই প্রশ্ন করেনি এমন হয়নি। নাজিমউদ্দিন রোড, মিরপুর দশ, শ্যামলী – ঢাকার এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে হতে হয়নি। অমনটাই স্বাভাবিক মনে হতো তখন আমার। অথচ আজ মনে হলো এই মেয়েটা খুব নিষিদ্ধ আর অশ্লীল কোনো প্রশ্ন করে বসেছে আমাকে।

মাথা নেড়ে কেবল তাকে জানালাম, “আমি লিয়ন হাসান না। আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে।”

মেয়েটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি সরে এলাম। নির্দিষ্ট করিডোরটায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো। বিকেলের এই সময়টায় চারপাশে প্রচুর মানুষ। এটা একটা হাসপাতাল, দারুণ ছোটাছুটি চারপাশে। আমাকে অবশ্য এসব ব্যস্ততা স্পর্শ করছে না। মনে হচ্ছে এখানে আমি একা, করিডোরের মাঝে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার মতোই একা।

লিফটটার ভেতর এখন একজন লিফটম্যান থাকে। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। এই ব্যাটার চাকরি দিলো কে? অবশ্য সময় তো কম গড়ায়নি। দুটো বছর পার হয়ে গেছে। গুটি গুটি পায়ে লিফটের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। লিফটম্যান প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে। বললাম, “নাইনথ।”

দশতলায় চলে এলাম। একদঙ্গল তরুণ-বুড়ো লিফট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। আমি মোহাবিষ্টের মতো স্পর্শ করলাম লিফটের নির্দিষ্ট দেওয়ালটি। এখানেই সতেরোকে চেপে ধরেছিলাম সে রাতে। 

সতেরো! নামটা মনে পড়তেই রক্ত সরে গেলো মুখ থেকে। দুটো বছর পার হয়ে গেছে। প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম, ওরা ভুল করেছে।

ওরা সবাই আমাকে বুঝতে ভুল করেছে।

মাশরুর ভাই, আশরাফ, নিচে রিসেপশনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই বোকা মেয়েটা। ওরা সবাই মনে করেছে আমি হারিয়ে গেছি! 

আমি হারিয়ে যাইনি। আমি শুধু আটকে গেছি একটা সময়ে। বাকিরা তাদের নির্দিষ্ট গতি ধরে এগিয়ে গেছে জীবনের পথ ধরে।

আমি আটকে আছি দুই বছর আগের একটা সময়ে!

হঠাৎ করেই লিফটের ভেতরটাকে আমার কাছে কারাগারের মতো মনে হতে থাকে। যেনো এখানেই গত দুটো বছর ধরে আটকে আছি আমি। এর মধ্যে একটা লাইনও লিখিনি, একটা অর্থবহ কাজও করিনি। চেষ্টা করেছি সময়কে থমকে দিতে, সময় থেমে থাকেনি। আমি একাই থমকে গেছি সময়ের সঙ্গে। লিফটম্যান আমাকে কি যেনো বলার চেষ্টা করছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি লোকটা একটা কিছু বলছে আমাকে, কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছি না আমি।

লোকটা কি আমাকে লিফট থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে? আমি তো এখান থেকে যাবো না।

বদ্ধ কুঠুরির মধ্যে এখনও পাচ্ছি সতেরোর চুলের মিষ্টি গন্ধ। একটা লিফটম্যানের কথায় আমি তো সতেরোকে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। 

কাঁধে লিফটম্যানের হাতটা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালাম। কোমর থেকে এক টানে বের করে আনলাম অস্ত্রটা। দেড় বছর ধরে আছে আমার সঙ্গে, একবারও ব্যবহার করতে হয়নি। পিস্তলটা কখন ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে গাঁজাবাবা ইয়াসিরের স্পষ্ট নির্দেশ ছিলো। টকটকে লাল চোখে ছেলেটা বলেছিলো, “পুঙ্গি মারা না খাইলে ইউজ করবি না।”

ওর কথা সম্পুর্ণভাবে অমান্য করলাম আমি। ট্রিগার টেনে ধরেছি। বদ্ধ জায়গায় গুলির শব্দ হচ্ছে প্রচণ্ড।

একটার পর একটা গুলির শব্দ শুনতে শুনতে আমি উদাস হয়ে গেলাম। মাথার ভেতরটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে।

লিফটটা ধীরে ধীরে নেমে চলেছে গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে। সেরাতের মতোই, নামার সময় লিফটের ভেতর আমি এখন সম্পূর্ণ একা।

যেন ফিরে এসেছি দুটো বছর পেছনে। ওপর থেকে সতেরো কি করিডোরের দিকে তাকাচ্ছে এখনও?

নিচতলায় যখন লিফটের দরজাটা খুলে গেলো, বাইরে হাসপাতালের নিজস্ব সিকিউরিটি বাহিনী অপেক্ষা করছিলো। খবরটা ওদের কানে পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। লিফটম্যান হতচ্ছাড়া নিশ্চয় বেরিয়েই ওদের কানে লাগিয়েছে। রক্তের ছোটখাটো এক পুকুরের ওপর বিহ্বলের মতো বসে রইলাম চুপচাপ।

পরিশিষ্ট 

ইন্টারভিউ বোর্ডের অন্যপাশ থেকে অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক বিচ্ছিরি অ্যাকসেন্টে প্রশ্ন করলেন, “প্রায় তিনটা বছর আপনি কিছুই করেননি।”

মৃদু হাসলাম। কিছু বললাম না। বলার আছেটাই বা কি?

অস্ট্রেলীয়টা শক্ত চিজের লোক। উত্তর না পেলে আমাকে ছেড়ে দেবে এমনটা মনে হলো না। 

আরও একবার প্রশ্নটা করলো সে, “ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলরস দুই হাজার আঠারোয় আর্ন করার পর আপনি ছিলেন কোথায় তিন বছর?”

এবার এড়ানোর চেষ্টা করলাম না, “আটকে ছিলাম আঠারোয়-ই।”

অস্ট্রেলীয়র চোখ সঙ্কুচিত হয়ে উঠেছে, “আপনার নামে তো ক্রিমিনাল রেকর্ডও আছে। দুই হাজার বিশের এপ্রিলে নিজের হাতে নিজেই গুলি করেছেন। আপনার ডিজেবিলিটি ওখান থেকেই।”

মাথা দোলালাম, “অবশ্যই।”

“রিটেনে আপনার মার্কস ভালো। কিন্তু এই ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকা কাওকে আমরা সুযোগ কেন দেবো বলতে পারেন? এটা কি আমাদের জন্য একটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে না?”

গুরুতর প্রশ্ন। আমার নষ্ট হয়ে ঝুলে থাকা বাম হাতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটার গুরুত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। মুখ তুলে দেখলাম ইন্টারভিউ বোর্ডের সাতজন ডাকসাইটে কর্মকর্তাই আমার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমার মতো ক্যান্ডিডেট মনে হয় প্রতিদিন আসে না এদের কাছে।

নির্মল একটা হাসি হাসলাম।

অস্ট্রেলীয়টার প্রশ্নের উত্তর আমি এখন জানি।

“কখনও কখনও সঠিক সিদ্ধান্তটাই মারাত্মক কোনো ভুল ছিলো বলে প্রমাণিত হয়, স্যার। আর ভুল সিদ্ধান্তটাই হয়ে যায় আর যে কোনো সিদ্ধান্ত থেকে সঠিক।”

ইন্টারভিউ বোর্ডের সাত সাতজন জাঁদরেল প্রফেশনালের মুখে বিরক্তির ছাপ দেখা গেলো। প্রকৌশলী নিয়োগ দিতে বসে দর্শন কপচানো ক্যান্ডিডেট পাওয়ার চেয়ে বিরক্তির কিছু নেই। তবে কেউ খুব ভালো করে তাকালে বুঝতে পারবে ওখানে বিরক্তির সঙ্গে মিশে ছিলো এক মুহূর্তের দ্বিধাও। আমার মনের ভেতরেও পাকিয়ে গেলো দ্বিধার নতুন জট। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা খোলার সাধ্য আমার নেই।

গল্প রোমান্টিক

Post navigation

Previous post
Next post

কিশোর পাশা ইমন

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Related Posts

চুইংগাম

Posted on December 7, 2013June 15, 2022

ছেলেটা বুঝে গেলেই তো শেষ। ছেলে জাতিটাকে চেনা আছে। বুঝিয়ে দাও তুমি দুর্বল – তোমার প্রতি আগ্রহ হাওয়া হয়ে যাবে সাথে সাথে। ভাব ধরে থাকতে হয়।

Read More

হোয়াট ইজ লাইফ

Posted on November 21, 2016June 24, 2022

“পড়াশোনা বাদ দিয়ে জীবনে আর কিছু করেছো?”
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো লোকটা।
“প্রেমও করো নাই? স্কুল কিংবা কলেজে?”
মাথা নাড়লো সে, “জ্বি না।”

Read More

খুন

Posted on January 2, 2014February 26, 2023

মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম।
প্রথমে ফয়সালের হাতের নার্ভ অনুভব করার চেষ্টা করলাম।
নেই।

Read More

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সর্বশেষ লেখাগুলো

  • ওয়ান ফর মাই সৌল
  • আমার যত প্রকাশক
  • কেপির সেরা লেখা কোনটি – জরিপ ২০২২
  • আন্ডারএইজের বই পড়া
  • অমুক পড়ে আসেন… সমস্যাবলী

Analytics

009435
Total Users : 9435
Total views : 23711
Who's Online : 0
Powered By WPS Visitor Counter
©2025 KP Imon | WordPress Theme by SuperbThemes