KP Imon

Words Crafted

খুন

‘দোস্ত তুই তাড়াতাড়ি আয় আমার বাসায়।’

কম্পিত গলাটা সাকিবেরই তো? কন্ঠস্বর পুরোই পালটে গেছে।

‘কি হয়েছে তোর?’ জানতে চাই আমি।

‘আমার বাসায় আয়। তারপরে বলছি।’ গলার কাঁপা কাঁপা ভাবটা না গেলেও আগের চেয়ে শান্ত হয়েছে সাকিব।

সাড়ে আটটা বাজে। শীতের রাত। এই সময়ে কারণ দর্শানো ছাড়াই যখন ডাক পড়ে তখন মেজাজ খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। ধীরে সুস্থে বের হলাম। রেকর্ড পরিমাণ শীত পড়ার কথা আজ।

নয়টা বাজার আগেই এলাকা কুয়াশাঘেরা একটা অদ্ভুত আবরণে ডুবে আছে। আমার জুতোর সাথে রাস্তার ঘর্ষণের শব্দই যেন গোটা এলাকার একমাত্র শব্দ। কে বের হবে এই শীতের রাতে মরতে?

সাকিবের বাসায় গিয়ে কলিং বেলটা দিতেই দরজার অন্যপাশে কেউ এসে দাঁড়ালো বলে মনে হল। অটল দরজাটার দিকে তাকালাম। আরেকবার বেল টেপা যায়।

দরজার অন্যপাশে দাঁড়ানো মানুষটা দরজা খুলল না তবুও।

কান পাতি আমি। হালকা ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনা যাচ্ছে দরজার ওপাশ থেকে।

সাকিবের কি হয়েছে?

দরজা খোলে না কেন?

‘কে?’ দরজার ওপাশ থেকে কাঁপা গলাটা সাকিবেরই। তবে এতটা পালটে গেছে  চিনতে আমার রীতিমত কষ্টই হল।

‘আমি। সাব্বির। ’

দরজা একটু করে ফাঁক হয়ে যায় এবার।

‘তাড়াতাড়ি ঢুকে পর।’ এদিক ওদিক ইতি-উতি তাকায় সাকিব।

‘কারও আসার কথা নাকি?’ ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।

দ্রুত দরজা লাগিয়ে দেয় সাকিব।

জনপ্রিয় পত্রিকায় কয়েকদিন আগে একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে সাকিবের লেখা। বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের স্বার্থে ভালোই আঘাত হানার কথা। তাদের কেউই হয়ত হুমকি দিয়েছে সাকিবকে অনুমান করলাম। আলতো করে ছুঁলাম কোমড়ে আটকানো রিভলবারটা। আশা করি এটা ব্যাবহারের প্রয়োজন পড়বে না।

‘না। কিন্তু কেউ আসলে বিপদ হবে।’ সাকিব বলে।

‘দোস্ত তোকে কিছু খুলে বলিনি এখন বলব। তুই ঠান্ডা মাথায় শোন সব। প্লিজ তুই ভুল বুঝিস না -’

আরও কি কি জানি বলে যাচ্ছিল সাকিব।

আমার কানে সেগুলোর কিছুই ঢুকছে না।

আতঙ্কের একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে পিঠ বেয়ে।

ড্রইং রুমে সোফার ঠিক সামনে চিত হয়ে পড়ে আছে ফয়সাল।

চোখ দুটো বোজা। পাশেই পড়ে আছে একটা ফুলদানী।

মাথার পেছন থেকে রক্ত বেড়িয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঝে।

মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম।

প্রথমে ফয়সালের হাতের নার্ভ অনুভব করার চেষ্টা করলাম।

নেই।

রাগে চোখে অন্ধকার দেখছি। সাকিবের কলার ধরে টেনে আনলাম ওকে রুমের মাঝখানে। বর্জ্রমুষ্ঠিতে ওর কলার ধরে ঝাঁকালাম ওকে, ’শালা খুনই করে ফেললি ফয়সালকে? হারামজাদা!’

আছড়ে ফেললাম ওকে সোফার ওপর। ’ঠিক কি হয়েছিল আমাকে খুলে বল।’ হিসহিস করে বললাম ওর দিকে।

কাঁদছে সাকিব।

‘দোস্ত ভুল বুঝিস না আমাকে। আমি ইচ্ছা করে কিছু করি নাই। দোস্ত জেলে যাব আমি কিছু একটা কর

শালা একটা নরকের কীট। নিজের হাতে বন্ধুকে মেরে ফেলে এখনও নিজের চিন্তা। সে জেলে যাবে কি না তা নিয়ে ভাবছে নালায়েকটা। ওদিকে ফয়সালের রক্ত এখনও ঠান্ডা হয় নি।

‘শালা তোকে তো ফাঁসীতে লটকানো উচিত রে!’ হুংকার দিলাম। ’ধানাই পানাই রেখে আমাকে পুরোটা খুলে বল! তারওপর নির্ভর করছে কি করা উচিত তোকে। ’

‘আটটার দিকে ফয়সাল আসে বাসায়। মাতাল হয়ে ছিল।’ থরথর করে কাঁপে সাকিব।

‘আর সাথে সাথে মাথায় ফুলদানী বসিয়ে দিলি??’ হুংকার ছাড়লাম আবারও। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।

‘না না দোস্ত ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। মানে ওরকমই। ’

‘ঠিকমত বল ঠিক যা যা ঘটেছিল এখানে।’ রুমটা দেখালাম।

*

কলিং বেলের শব্দে উঠে কম্পিউটার স্ক্রীণ থেকে চোখ সরায় সাকিব।

‘কে আসল এই ঠান্ডায় মরতে?’ গজ গজ করতে করতে দরজা খুলে দেয় ও।

বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মুখটা ওর অতি পরিচিত।

স্কুল-কলেজে একসাথে পড়ে আসা বন্ধু ফয়সাল।

তার মুখ থেকে ভক ভক করে আসা মদের গন্ধটা বিচলিত করে সাকিবকে।

বাসায় ভাগ্যিস আর কেউ নেই। বাবা-মা দার্জিলিং ঘুরছেন।

‘দোস্ত তুই!’ অবশেষে বলে সাকিব। ’ভেতরে আয়। ’

ভূতের মত হেঁটে ভেতরে আসে ফয়সাল। ড্রইং রুমের সোফাতে বসে ওরা।

‘দার্জিলিং থেকে আংকেল আন্টি আসবে কবে?’ ঠান্ডা গলায় জানতে চায় ফয়সাল।

‘দেরী আছে। আরও এক সপ্তাহ।’ হঠাৎ এই প্রসংগ কেন ভেবে পায় না।

‘তোর এই অবস্থা কেন?’ সাকিব জানতে চায়।

‘খুব ভালো মতই জানিস আমার কোন অবস্থা কিভাবে হয়।’ সাপের মত বলে ফয়সাল। ’এখন ন্যাকা সাজার চেষ্টা করবি না। ’

‘না দোস্ত। সত্যিই বুঝতে পারছি না।’ এদিক ওদিক মাথা নাড়ায় সাকিব। ’খুলে বল আমাকে। ’

‘আজ বিকালে লিয়ার সাথে ছিলি না তুই?’

থমকে যায় সাকিব। ফয়সাল কিভাবে লিয়ার ব্যাপারে জানে?

লিয়া ফয়সালের গার্লফ্রেন্ড। তবে শুধুই ফয়সালের নয়।

লিয়া মেয়েটা চমৎকার দেখতে। কিন্তু অসাধারণ এই মেয়ের প্রেমিকের কোন সীমারেখা নেই।

সবাইকে কাছে আসতে দেয় ও।

যতক্ষণ ভালো লাগে রাখে সাথে যেদিন ভালো লাগে না , ’গুডবাই, হানি’।

সাকিব খুব ভালো মতই জানে বিষয়গুলো। ফয়সালকে বহুবার না করেছিল এই মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক না করতে।

ফয়সাল ভুল বোঝে ওকে।

ওর চোখে লিয়ার মত ভালো মেয়ে হয় না।

‘তোরও যদি লিয়াকে ভালো লাগে তাহলে তুই এগিয়ে যা। আমি সরে যাব তখন।’ ছয়মাস আগে সাকিবকে এটাই বলে ফয়সাল। সাকিবের মন খারাপ হয়ে যায় প্রিয় বন্ধু ভুল বোঝায়। লিয়াকে ভালো লাগায় না বোকা ফয়সালটা সিরিয়াস হয়ে গিয়ে যে সম্যক ছ্যাঁকা খেতে যাচ্ছে সেটা থেকে তাকে রক্ষা করার জন্যই বলে ও।

লিয়ার সাথে রিলেশনটা হয়ে যাওয়ার পর ফয়সাল কিছুটা আভাষ পায় না তা না।

কিন্তু লিয়ার সৌন্দর্য্যে ডুবে থাকা প্রেমিক ছেলেটা এতকিছুর দিকে খেয়াল করে না।

সাকিবের সাথে লিয়ার কথা হত মাঝে মাঝেই।

সাকিব-লিয়ার দুইবার দেখাও হয়েছে আগে। মোটামুটি ভাল বন্ধুই বলা যায় ওদের। ফয়সাল সাকিবকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। বন্ধুত্বে একটু দূরত্ব আসে তখন থেকে।

অথচ ফয়সাল জানে না ভার্সিটি ফ্রেন্ড নীরবের বাসায় গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়ে লিয়া মাঝে মাঝে  রাতে ফেরেই না।  দূর থেকে সবই দেখে সবই জানে সাকিব। এতদিনের পুরোনো বন্ধুকে ঠকে গিয়ে হেরে যেতে দেখতে পারছিল না ও আর।

আজ লিয়াকে ফোন করে দেখা করতে বলে সেন্ট্রাল পার্কে। পার্কটি তরুণ-তরুণীদের প্রেমের জন্য আদর্শস্থান। বিভিন্ন আড়ালে চলছে কপোত-কপোতীর গুঞ্জন; আশেপাশে কেউ না থাকলে গায়ে হাত দেয়া।

সাকিবের আগেই পৌঁছে গিয়েছিল লিয়া। হাতছানি দিয়ে ডাকে ওকে পার্কের এক কোণা থেকে।

সাকিবেরও যেন কি হয় আজ ফয়সালের ব্যাপারে কথা বলার জন্য আসলেও ওব্যাপারে মুখ খোলে না, হাসি-গল্পে মেতে ওঠে লিয়ার সাথে। এক হাত লিয়ার জড়িয়ে থাকা লিয়ার অপরূপ চোখ দুটোর ওর দিকে তাকিয়ে থাকা লিয়ার শরীরের মাতাল করা ঘ্রাণ হঠাৎ পাগল করে তোলে সাকিবকে। কথা থেমে যায় ওর।

ঠোঁট আলতো ফাঁক করে মেয়েটাও ওকে এক সেকেন্ড দেখে।

তারপরই ওরা পাগল হয়ে যায় একে অপরের ঠোঁটকে খেয়ে ফেলার ব্যর্থ  প্রচেষ্টায় মেতে ওঠে দু’জনে।

‘সাবাশ!’ তিক্ত গলায় বলে উঠি আমি কাহিনীর এই পর্যায়ে। ’মেয়ে তো পুরাই মিস বাংলাদেশ! তারপর?’

‘ফয়সালকে পার্কে টেনে আনার ব্যবস্থা আগেই করেছিলাম।’ মাথা নিচু করে বলে সাকিব। ’অন্তত নিজের চোখে দেখলে যাতে ওর ধারণা স্পষ্ট হয় লিয়ার ব্যাপারে। ’

‘হুম।’ মাথা ঝাঁকাই আমি। ’অথচ সব দেখে শুনে তোর ওপরই দোষ চাপালো ফয়সাল। ’

‘হুঁ।’ মাথা আরও নিচু হয় সাকিবের। ’ওর মতে আমার চাতুরী না বুঝে ফাঁদে পড়ে গেছে লিয়া। আমি ওকে ফুসলিয়ে নিজের দিকে নিয়ে এসেছি। ’

‘প্রেম অন্ধই হয়। ’

‘তারপর ফস করে একটা চাকু বের করে ফয়সাল আমাকে হুমকি দিতে থাকে আমি যেন লিয়ার কাছ থেকে সরে যাই। সেই সাথে ফয়সালের জীবন থেকেও। আমিও চাকুটা দেখে ভয়ে ফুলদানীটা তুলে নেই। ’

*

‘হাত থেকে চাকুটা সরা ফয়সাল।’ কোমল গলায় বলে সাকিব, ’পাগলামী করিস না। ’

ফেলে না ফয়সাল। চোখ বাঁকা করে জীঘাংসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।

‘তাহলে এই ছিল তোর প্ল্যান? মা-বাবা দার্জিলিং-এ জেনে বাসায় চলে এসেছিস নিজের হাতে আমাকে শেষ করে যেতে?’ চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে সাকিব। ’ফর গডস সেক একটা বার চোখ খুলে তাকা। ওই মেয়েটার স্বভাব নিয়ে তুই এখনও সন্দিহান? আমি মরে গেলেই ও তোর হয়ে যাবে সেটা ভাবছিস? মাই গড! তুই পুরাই পাগল হয়ে গেছিস!’

বাতাসে সাঁই করে ছুরি চালায় ফয়সাল।

কোনমতে এড়িয়ে যায় সাকিব। গোটা ব্যাপারটাই দুঃস্বপ্নের মত লাগে ওর কাছে।

আবার চাকু চালায় ফয়সাল। বাতাসে চাকুর ফলা কেটে যাওয়ার শব্দ ভয়ের একটা শিহরণ জাগায় সাকিবের মাঝে।

‘স্টপ ইট ফয়সাল।’ দুই পা পিছায় ও আরও। ’ফয়সাল আমি তোর সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু!’

‘ছিলি।’ আবারও লাফিয়ে সামনে এসে ছুরি চালায় ফয়সাল সাকিবের গলা বরাবর।

পিছলে ফয়সালকে পেরিয়ে যায় সাকিব। ওর পিছনে চলে আসে। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ফয়সাল ছুরি হাতে।

ফুলদানীটা দিয়ে গায়ের জোরে আঘাত হানে সাকিব।

মাথার চেটোয় আছড়ে পড়ে ফুলদানী। হাত থেকে ছুড়ি পড়ে যায় ফয়সালের।

তারপাশে অবসন্নের মত শুয়ে পড়ে সে।

‘সরি, দোস্ত।’ বিড়বিড় করে বলে সাকিব।

*

চোখ বন্ধ করি আমি। গোটা ব্যাপারটা ভাবছি।

এখন দায়িত্ব একাধিক। ফয়সালের শরীর এখানে থাকলে পুলিশ ব্যাপারটাকে খুনের পর্যায়ে দেখবে।

শরীরটা সরাতে হবে। তবে এমন কোথাও যাতে পরে সহজে ওকে খুঁজে পাওয়া যায়। কেবলমাত্র এভাবেই এখন সাকিবকে বাঁচানো যায়।

প্রাণখুলে গালাগাল করলাম দুনিয়ার তাবৎ মেয়েকে। যাদের জন্য আজ এক বন্ধুর লাশের পাশে বসে আরেক বন্ধুকে জেলের বাইরে রাখার প্ল্যান করা লাগছে আমার।

‘সাব্বির?’ সাকিবের ডাকে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলাম।

‘হু। ’

‘কোন প্ল্যান আসল মাথায়?’

‘ফয়সালের শরীরটা কোন পাবলিক প্লেসে রেখে আসব। এখন রাতে কেউ নাই। কাল ওকে পাওয়া যাবে। ওখান থেকে ওর ফ্যামিলিকে মানুষই পৌঁছে দিবে লাশটা। ’

‘তোর কি মনে হয় ওরা খুনীকে খোঁজার চেষ্টা করবে না?’ ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে সাকিব।

‘হু। তো? তোর কাছে ফিরে আসবে কি করে জিনিসটা?’

‘ভেবে দ্যাখ। পার্কের মাঝে পাওয়া গেল ফয়সালের শরীর। মৃত। ওর বাবার কথা ভুলে যাবি না। ওরকম প্রভাবশালী মানুষ সবভাবেই চেষ্টা করবে খুনীকে বের করার। খুনটা যে ওখানে হয় নি সেটা বুঝতে সমস্যা হবে না রক্তের পরিমাণ দেখেই বুঝে যাবে রক্তপাত ওখানে হয় নি।’ ঘাঘু অপরাধীর মত বলে যাচ্ছে সাকিব, ’তারপর? ওরা খুঁজবে ক্রাইম সীনটা কোথায় ছিল। লিয়া নিয়ে আমাদের ঝামেলার কথা অনেকেই জানে। প্রথম আঙ্গুলটা আমার দিকে উঠবে। লিয়া মাগীটাকেও বিশ্বাস নাই। দেখা যাবে আমার ব্যাপারে এমন কিছু বলে দেবে প্রাইম সাসপেক্ট আমিই হয়ে যাব। ’

‘তো?’ এখনও আমি ওর কথার মর্মার্থ বুঝি নি। ’কি করতে বলিস?’

‘দুইজন গোরখুঁড়েকে চিনি আমি।’ ধূর্ত গলায় বলে সাকিব।

‘কবর-খননকারী?’

‘হুঁ।’ গলা নামিয়ে বলে ও। ’ওদের মোটা টাকা দিলেই কোন প্রশ্ন করবে না ওরা। চুপচাপ একটা কবর খুঁড়ে দেবে। ’

‘তুই বন্ধুর লাশটা জন্তুর মত পুঁতে রাখতে চাস?’ মুখে বললেও বুঝতে পারি আমি এছাড়া আমাদের আর কোন উপায়ই নেই।

পুরো ঘটনার পর যা হয়েছে তাতে সাকিবের কোন দোষ দেওয়া যায় না আর। অন্তত, খুনীর পর্যায়ের দোষ ও করেনি।

নিজের মনের আদালতের কথা শুনি আমি।

ফয়সালের লাশটা গুম করে ফেলাই মনে হয় সবচেয়ে ভাল মধ্যম পন্থা এখন।

চরম পন্থায় যেতে হলে সাকিবকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে দিতে হয়!

‘আচ্ছা। ওদের নির্ভরযোগ্যতা কেমন? গোরখুঁড়ে দুইজনের?’

আমাকেও লাইনে আসতে দেখে হাসি ফোটে সাকিবের মুখে।

‘টাকা পেলে ওরা নিজের মাকেও গুম করে ফেলবে। কাকপক্ষীও টের পাবে না। ’

‘ডাক দে তাইলে ওদের। আর শুধু কবর খুঁড়ে রাখতে বল একটা। আমরা ওই কবরে যা করার করব। সে ব্যাপারে ওদের জানার দরকার নাই। ’

কালো কালো দুইটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ল্যাম্পপোস্টের নিচে। আমরা দুইজন এগিয়ে যাই সেদিকে।

‘ওস্তাদ। খুঁইড়া দিছি।’ ওদের লীডার বলে।

‘চমৎকার কাজ দেখিয়েছ, শম্ভু।’ ওর হাতে প্যাকেটটা তুলে দেয় সাকিব। ’কোথায়?’

‘আপনার দাদার কবরের উত্তর দিকে। তিনসারি পরে ছয় নম্বর কবরে। ’

‘মাই গড!’ আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। ’একেবারে কবরস্থানে? পাহাড়া থাকে না?’

‘থাকব না কেন দাদাবাবু?’ দ্বিতীয়জন বলে। ’তয় আজকে নাই। আমরা সরায় দিছি। চার হাজার পাইতেছে ওই হালায় এজন্য। আপনেরা শান্তিমত কাজ সারেন। ’

‘দুর্দান্ত।’ খুশি হয়ে বলে সাকিব। ’আসো তাহলে তোমরা। ’

বিশহাজার টাকার প্যাকেটটা নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ওরা। আমরা ফিরে আসি সাকিবের বাসায়। দেড় ঘন্টা লেগেছিল এই কবর খোঁড়া কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। এর মাঝে আমরা দুইজন মিলে ঘরের মধ্যে থেকে রক্তের শেষ চিহ্ণ পর্যন্ত সরিয়ে ফেলেছি। সবকিছু নিখুঁত ভাবে যাচ্ছে , এখন শুধু কবরে সুন্দর করে ফয়সালকে নামিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে।

হাত থেকে একমুহূর্তের জন্যও আমরা গ্লাভস খুলিনি ফয়সালকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার পুরোটা সময়। এখন ওকে একটা সানগ্লাস পড়াচ্ছে সাকিব। চমৎকার দেখাচ্ছে ফয়সালকে।

কে বলবে এই ছেলে গত তিনঘন্টা ধরে মৃত?

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। আমরা পরিস্থিতির শিকার বোঝাই নিজেকে।

‘গাড়িটা বের কর। ’

সবকিছু আরেকবার ভাবতে বসে যাই সবকিছু ঠিকই আছে।

আর যদি ঠিক নাও থাকে মাঝে কেউ ঝামেলা করতে আসলে তো আলতো করে রিভলবারটা ছুঁই আমি।

‘দোস্ত গাড়ি রেডি। বের করে রাস্তায় রেখেছি।’ আমাকে বলে সাকিব।

ওর কথার জবাব দেওয়া আগেই সুরেলা রিংটোন বেজে উঠে ঘরের মাঝখানে। থমকে যাই আমরা। এক মুহূর্তের জন্য আমাদের তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করে।

মোবাইলটা ফয়সালের।

রাত সাড়ে এগারটা বাজে। বাসা থেকে ফোন আসাটা স্বাভাবিক। রিংটোনের শব্দ থেমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এক পাও নড়তে পারি না। অবশেষে যেন একযুগ পরে থেমে যায় রিংটোন।

দুই জনই একসাথে নড়ে উঠি আমরা।

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সাকিব।

লাফিয়ে গিয়ে ফয়সালের পকেট থেকে মোবাইল আর মানিব্যাগটা বের করে নেই আমি।

‘কথা কম। কাজ বেশি।’ সাকিবকে উদ্দেশ্য করে বলি। ’তাড়াতাড়ি তুই ফসালের এক হাত কাঁধে নে। আমি অন্যটা নিচ্ছি। ওকে গাড়িতে তুলি আগে। ’

তাড়াহুড়ো করে ওকে গাড়িতে বসিয়ে দেই আমরা। ব্যাকসীটে সানগ্লাস পড়ে জানালায় ঠেস দিয়ে বসে থাকা ফয়সালকে দেখে মৃত মনে হওয়ার কোনই কারণ নেই।

আমাদের সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু তাই পেছনের বুটে ওর শরীর ভরে ফেলতে বাঁধছিল। সীটেই বসিয়েছি ওকে অনেক কসরত করে।

ড্রাইভ করছে সাকিব। ফয়সালের মোবাইলটা কেন জানি ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি আমি।

‘সাকিব!’ চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠি হঠাত।

‘কি হল?’ ঘন কুয়াশায় ড্রাইভিং এর ঝক্কি পোহাতে পোহাতে বলে ও।

‘তুই মনে করিস লিয়াকে ফাঁদে ফেলেছিস ফয়সালকে তোদের ঘনিষ্ঠতা দেখার সুযোগ করে দিয়ে? আসলে উল্টোটা। পুরো ফাঁদটা লিয়ার পাতা। লিয়াই খুন করিয়েছে ফয়সালকে!’

‘হোয়াট?’ এতটাই চমকে যায় সাকিব সামনে থেকে আসা গাড়িটাকে আর এড়াতে পারে না।

রীতিমত সশব্দে সংঘর্ষ লাগে গাড়ি দুটোর। আস্তে  করে বেরিয়ে আসি আমরা। তাছাড়া আর বিকল্পও ছিল না অবশ্য।

গাড়িটা পুলিশের।

‘মাল খেয়ে গাড়ি চালান?’ খেঁকিয়ে ওঠে ওদের চীফ।

সাকিবের দিকে আড়চোখে তাকাই আমি। শালা ভীতুর ডিম! অলরেডি কাঁপাকাঁপি লেগে গেছে। এভাবে কাঁপাকাঁপি করতে থাকলে আর দেখতে হবে না সাকিবের সাথে আমাকেও ঝুলে পড়তে হবে ফাঁসীর দড়িতে।

‘সরি, অফিসার।’ মুখ খুলি আমি। ’আমার ড্রাইভার দেখতে পায় নি। কুয়াশায় দৃষ্টিসীমা কমে গেছে তো। ’

‘এত তাড়াহুরো করে গাড়ি চালানোরই বা মানে কি?’ কৌতুহল ফোটে এবার পুলিশটার গলায়। ’কিসের সাপ্লাই যাচ্ছে? হেরোইন? না মারিজুয়ানা?’

গাড়ির ভেতরে আলো ফেলে লোকটা। সানগ্লাস ছুটে গেছে ফয়সালের লাশটার চোখ থেকে ঝাঁকুনির সময়ই। ওর মুখে আলো ফেলে পুলিশ। ’এই শালা ওঠে না ক্যান? মাল খেয়ে টাল, অ্যাঁ?’

সাকিবের কাঁপুনি দেখে কে!

মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করি আমি।

‘বাজে কথা বলে চাকরিটা খোয়াবেন না আশা করি। ’

‘মানে?’ চট করে টর্চের আলো ঘুরে আমার মুখে এসে পড়ে। ’কোথাকার নবাবজাদা তুমি? নাম কি?’

‘ফয়সাল আহমেদ। ’

‘আহমেদ?’ তিতা কিছু খেয়ে ফেলেছে এমন মুখ করে পুলিশটি। ’শিল্পপতি ইমতিয়াজ আহমেদের -’

‘ছেলে।’ ফয়সালের মানিব্যাগ বের করে আইডি কার্ড দেখিয়ে দেই একবার। এই এলাকায় অন্তত ইমতিয়াজ আহমেদ মানে সাতখুন মাফ। কথায় আছে পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা আহমেদ সাহেবে ছুলে বাহাত্তর ঘা। সব দিকে কানেকশন থাকায় এলাকায় সম্মান যেমন তাঁর আকাশ ছোঁয়া ভীতিও ছড়িয়ে থাকে মানুষের মাঝে।

‘সরি স্যার।’ খটাস করে অ্যাটেনশন হয়ে যায় এবার পুলিশটি। ’আসলে রাতের এই সময়টা খারাপ স্যার। ড্রাগসের একটা চালান যাওয়ার কথা। আপনাদের বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত স্যার। বোঝেনই তো স্যার

‘আপনাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।’ বিনয়ে আমিই বা কম যাব কেন?’আমরা কিছু মনে করি নি। তবে ভাষা সংযত করেও দায়িত্ব পালন করা যায় বলে মনে হয়। ’

‘মাফ করে দেন স্যার। ’

আত্মসম্মানহীন পুলিশটার দিকে একটা কড়া নজর দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম আমরা আবার।

মিনিট তিনেক একেবারে চুপচাপ।

‘উহুম উহ-হু।’ সাকিব গলা ঠিক করে কেশে, ’কি যেন বললি , লিয়ার প্ল্যান ছিল আমি ফয়সালকে খুন করব?’

‘উহু।’ মাথা নাড়ি আমি। ’উল্টোটা সম্ভবতঃ। লিয়া চাচ্ছিল তুই ফয়সালের হাতে খুন হয়ে যা। ’

একটা মেসেজ বের করে ওর হাতে ফয়সালের মোবাইলটা ওর হাতে দিলাম।

‘এখান থেকে কয়েকটা মেসেজ পর। ’

অবাক হয়ে সাকিব দেখে লিয়া ফয়সালের কাছে শুধু সাকিবের প্রশংসা করে যাচ্ছিল।

‘এ থেকে কি বুঝলি?’ সাকিব পালটা প্রশ্ন করে আমাকে।

‘লিয়া হল দশহাতের অধিকারিণী। ও দশটা প্রেমিককে একসাথে রাখে এভাবেই কারও সামনে কারও কথা মেনশন করে না। তোর ক্ষেত্রে উলটে গেল কেন? ও কেন ফয়সালের মাঝে হিংসার আগুন লাগাতে চাবে?’

‘বেশি ভাবছিস।’ মোবাইলটা ফেরত দেয় সাকিব।

‘আরও আছে। আজকে পার্কে যাচ্ছিলি তুই আর লিয়া সেটা তুই আভাষে বুঝিয়েছিলি ফয়সালকে। কিন্তু লিয়া সরাসরি জানিয়েছে ফয়সালকে। ও চাইছিল ফয়সাল তোদের ফলো করে দেখে আসুক। তোর সাথে চুমু খাওয়ার নাটকটাও ওর ইচ্ছে করেই করা। ’

‘বেশি গোয়েন্দা গল্প পড়ার ফল।’ মুখ বাঁকায় সাকিব। ’লিয়ার কি লাভ ফয়সাল আমাকে খুন করে ফেললে?’

‘কারণ, তখন ফয়সালের মাথায় লিয়ার সাথে ওর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওচিত্র পর্ণসাইটে দেওয়ার চেয়ে বড় কিছু নিয়ে চিন্তা থাকবে। খুনের আসামী ফয়সাল লিয়ার ক্ষতি করার সুযোগ আর পাবে না।’ আবারও মোবাইলটা ছুঁড়ে দিলাম সাকিবের দিকে।

‘ওহ মাই -!’ মেসেজগুলো দেখে আৎকে ওঠে সাকিব। ’ফয়সাল লিয়াকে হুমকি দিচ্ছিল?’

‘হুম। পাগলা প্রেমিক। ওকে লিয়া ছেড়ে গেলে ও কি করবে তার একটা বিশাল বিবরণ ও দিয়েই দিয়েছে ওই মেসেজে। ’

‘ফয়সাল কেমন আবেগপ্রবণ সেটা ও ভালো মতই জানত।’ সবকিছু পরিষ্কার হয় সাকিবের কাছেও। ’বাল্যবন্ধুকেও মেরে ফেলার মতই ডেয়ারিং ছিল ও। লিয়ার জন্য সবই পারত।’ বিষন্ন গলায় বলে ও। ’সেটাই কাজে লাগিয়ে ঝামেলা দূর করেছে মেয়েটা!’

কবরে মাটি চাপা দেওয়া শেষ।

ভেতরে শুয়ে আছে আমাদের প্রিয় বন্ধু।

দীর্ঘশ্বাস পড়ছে শুধু আমাদের দুইজনের বুক চিড়ে।

এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। তাও নড়তে পারছি কই?

‘দোস্ত -’ চোখ মুছে বলি আমি আধ-ঘন্টা পর। ’লিয়ার বাসার অ্যাড্রেসটা দে তো। ’

*

উপর হয়ে শুয়ে নীরবের সাথে মোবাইলে প্রেম করছিল লিয়া।

গাল আর কান লাল হয়ে আছে ওর নারীসুলভ লজ্জায়। এইসময় একটা বীপ শুনে ও।

‘এক সেকেন্ড, ডার্লিং -’ নীরবকে একটু থামায় ও। মেসেজ এসেছে। ফয়সালের।

‘বারান্দায় একটু বের হতে পারবে?’

নীরবের ফোনটা কাটে লিয়া। ফয়সালের ক্ষেত্রে আনাড়ির মত কাজ করে ফেলেছে। ভিডিওটা কিভাবে করল ফয়সাল সেটা রহস্য। কিন্তু গর্ধভটাকে সীন থেকে দূর করার আগ পর্যন্ত ওর কথা শোনাই লাগবে।

এই মুহূর্তে কেন বারান্দায় ডাকছে ফয়সাল ওকে খুব ভালো করেই জানে লিয়া। কারণ একটু আগে প্রিয় বন্ধু সাকিবকে খুন করে এসেছে ছেলেটা।

লিয়া জানে ওর আতঙ্কে থাকার দিন শেষ হতে চলেছে। দরজাটা খুলে দোতলার বারান্দাটায় বেরিয়ে আসে ও।

রাস্তায় মাত্র দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তো ফয়সাল নয়! কিছু একটা ভুল হচ্ছে বুঝতে পারে লিয়া। তবে ততক্ষণে বেশ দেরী হয়ে গেছে।

পর পর দু’বার গুলি করি আমি মেয়েটার বুকে।

ছিটকে আবারও ভেতরের দিকে গিয়ে পড়ে লিয়া।

দ্রুত পাশের গলিতে ঢুকে যাই আমি। রাস্তার পাশের ড্রেনে ফয়সালের মোবাইলটা আসতে করে ফেলে দেই।

ভেসে যাক বহুদূর।

সাকিবের দিকে আর কেউ খুনের আঙ্গুল তুলবে না। আমার দিকেও না। লিয়ার মৃত্যুর আগে ফয়সালের মেসেজ দেখায় ওকেই লিয়ার হত্যাকারী ভাবা হবে।

ফেরারী হত্যাকারী।

তবে লিয়ার এতটুকু প্রাপ্য ছিল। মাথাটা হুডের নিচে নিয়ে গন্তব্য ছাড়াই হেঁটে চলে সাব্বির।

জ্ঞান ফিরতেই অবশ করা আতঙ্ক চেপে ধরে ফয়সালকে।

শ্বাস নিতে পারছে না ও।

পারছে না হাত নড়াতে।

চোখ পর্যন্ত চাপা দিয়ে আছে মাটি।

চিৎকার দিতে চায় ও কিন্তু মুখ খুলতে পারে না।

কয়েক হাত মাটির নীচে অসহায়ের মত শুয়ে থাকে ফয়সাল।

অক্সিজেনের জন্য ওর ফুসফুসটা ধক ধক করতে থাকে!

— ০ —

জানুয়ারি ০২, ২০১৪ 

চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *