KP Imon

Words Crafted

মানুষ জিতবেই

“মাগিবাজি করার জায়গা এটা না।” পিচিক করে মাটিতে থুতু ফেলতে ফেলতে বললো ছেলেটা। তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো শায়লা।
চোখ দিয়ে তাকে একবার মাপলো তপু। এই ছেলের বয়স বেশি হবে না। টিনএজ কোনমতে পার করেছে। নিয়মিত শেভ করে করে দাঁড়ির একটা চিরস্থায়ী রূপ গালে আনতে পেরেছে বটে, কিন্তু তাতে করে কৈশোরের ছাপ মুছে ফেলতে পারেনি। টিশার্টটা কালো, সাদা কলার। কলারের রঙটা স্পষ্ট, কারণ এই ছেলে কলারটা নব্বই ডিগ্রি করে তুলে রেখেছে। গলায় ভারী চেইন, দেখে মনে হবে সাইকেলের স্প্রোকেট থেকে খুলে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিন বোতামের টিশার্ট, তিনটাই খোলা। একটা বিষয় এই ছেলে স্পষ্ট করে দিতে চায়, অন্য কারও আধিপত্য সে সহ্য করবে না।
“এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়।” বলে চললো ছেলেটা, “এখানে যে কেউ মাগি নিয়া ঢুইকা গেলে সেইটা আমরা মাইনা নিমু না।”
এক পা এগিয়ে এলো তপু, “তুমি কি জানো কার সাথে কথা বলছো?”
পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দলের বাকিদের দিকে তাকালো ছেলেটা, “তোরা দাঁড়ায় দেখতেছোস কি? স্যালুট কর, প্রেসিডেন্টরে স্যালুট কর!” তারপর তপুর দিকে ফিরলো, “তুমি দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও চুদি না, ভাই।”
অল্পবয়েসী ছেলেটার স্পর্ধা দেখে তপু ভাষা হারিয়ে ফেললো। শায়লা-তপুর অ্যানিভার্সারি আজ। প্রেমিকাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসেছে। এখান থেকেই প্রেমটার শুরু, তাই। তেমন কোনও গ্র্যান্ড প্ল্যান ছিলো না। এখানে একটু হাঁটাহাঁটি করবে। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন হবে খানিকটা, তারপর ধানমণ্ডিতে রিকশা ট্যুর। সেখানে লাঞ্চটা করে মেয়েটাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসা। ওদের আয়োজনগুলো সব সময় এমন আড়ম্বরহীন হয়ে থাকে। কলাভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো যখন, চারপাশে এমন কিছু ছেলেকে আচমকা আবিষ্কার করতে পারলো ওরা। এদের মধ্যে নেতাগোছের ছেলেটা এগিয়ে এসেছিলো, তারপর শায়লাকে বজ্রাহতের মতো থমকে দিয়ে প্রথম কথাটা উচ্চারণ করেছিলো চরম অসম্মানের সঙ্গে।
“হাত ধরে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হাঁটলে সেটা মাগিবাজি হয়ে যাবে?”
পিচিক করে আরেকবার থুতু ফেললো ছেলেটা, “প্রেম করার জায়গা এইটা না। হাত ধরাধরি করতে হইলে লিটলের ফ্ল্যাটে গিয়া করবা।”
তপু আরেক পা এগিয়ে এলো। চট করে মেজাজ গরম হয়ে গেছে তার। খুব কাছ থেকে চোখে চোখ রাখলো প্রতিপক্ষের, “এটা প্রেম করার জায়গা না? খানকির পোলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় কি ছেলেরা এসএসসির সার্টিফিকেটের সাথে নুনুটাও রেজিস্ট্রি অফিসে জমা রেখে আসে? নাকি এই এলাকা হিজরা-অনলি?”
তপুর চেহারাটা জ্বলজ্বল করছে। যেমন কুকুর, তেমন মুগুর। এমন ছেলের সাথে ভদ্রতা চলে না। রাস্তার ছেলেদের সাথে কথা বলতে হয় রাস্তার ভাষায়। অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের জন্য কোনওরকম আক্ষেপ অনুভব করছে না সে।
অল্পবয়স্ক ছেলেটার চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল চমকেছে ভালোই। সাতজন সঙ্গী নিয়ে একা একটা ছেলেকে মেয়েসহ ঘিরে ফেলার পর এরকম একটা বাক্য সে আশা করেনি। এক মুহূর্ত পরই হতচকিত ভাবটা সরে গিয়ে সেখানে স্থান নিলো অকৃত্রিম ক্রোধ। সাঁই করে হাত চালালো সে। পলিথিনে বাতাস ভরে থাবা মেরে ফাটালে যেমন শব্দ হয় – তেমন এক শব্দে তপুর কানের ওপর আছড়ে পড়লো থাপ্পড়টা।
তপুর চশমা উড়ে গেছে। তার মধ্যেই চেইনওয়ালার কলার খামচে ধরে তাকে শুন্যে তুলে ফেললো সে। চোখের কোণে দেখা যাচ্ছে সঙ্গী সাথীরা ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসছে এখন। তাদের অগ্রাহ্য করে তরুণটির ফুলে ওঠা নাকের দিকে তাকিয়ে বলে গেল, “আইনস্টাইন থিওরি ডেরাইভেশনের মধ্যে সেক্স করে একাকার করে ফেলতো। তারপর আবার বসতো কলম নিয়ে। বাঙালির মতো না। মাথায় থাকবে মেয়ে, হাতে থাকবে ধোন, আর কাজের বেলায় ঠন ঠন। রিয়েল জিনিয়াসরা পড়াশোনা এভাবে করে না। তাদের মাথায় থাকে কাজ, হাতে থাকে কলম, আর ধোনটা থাকে মেয়ের ভেতরে। এইভাবেই প্রোডাক্টিভ কাজগুলা হয়…”
তপুর বর্ষসেরা ভাষণের দৈর্ঘ্য অতোখানিই ছিলো। এমন খোলামেলা ভাষণের তোড়েই হয়তো ইচড়ে পাকা ছেলেটির সঙ্গী সাথীরা এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছিলো। পরমুহূর্তেই তেড়ে এলো তারা। প্রথম ঘুষিতেই মৃদু এক মট শব্দের সাথে ভেঙ্গে গেলো তপুর নাকের হাড়। আরেকটা ছেলে একই সাথে ডান দিক থেকে লাথি মেরেছে, পাঁজরের সবগুলো হাড় মট মট করে উঠলো ওর। ফুসফুস থেকে প্রতিটি আউন্স বাতাস বেরিয়ে গেছে। দলনেতাও মুঠো থেকে ছুটে গেলো এই লাথির তোড়ে, তবে তপুর হাতে তার কলারটা ছিঁড়ে চলে এসেছে। সাদা একটা কলার আর রক্তাক্ত নাক নিয়ে দুই পাক ঘুরে মাটিতে পড়ে গেলো সে। নাকের রক্ত সাদা কলারে লেগে মাখামাখি হয়ে গেলো। দৃষ্টিসীমার মধ্যে এখন অনেকগুলো জিন্সের প্যান্ট, তার ফাঁকফোকড়ে শায়লার সুন্দর মুখটাকে ছুটে আসতে দেখলো ও।
“মাদারচোদরে মার। সাহস কতো খানকির পোলার…” একটা ইট তুলে নিতে নিতে বললো তাদের একজন।
“বিচিতে মার। বিচিতে। দেহি হালার ধোন কতো বড় হইছে। রেজিস্ট্রি অফিসে জমা দিসে কি না।”
শায়লা এসে ক্ষ্যাপা মোষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের ওপর। দৃশ্যটার মধ্যে আলাদা রকমের একটা সৌন্দর্য আছে। সাহসিকতার সৌন্দর্য। এমন সাহস মেয়েটা হয়তো কোনদিনও দেখাতে পারতো না। কোনদিনও না। মিরপুরে বাসা ওর, রোডের শেষ মাথায় কয়েকটা টিনশেড আছে। রিকশাওয়ালা গোছের মানুষরা থাকে। এদের বউরা সারাদিন একে অন্যের উদ্দেশ্যে খিস্তিখেউর করে। মাঝে মধ্যে তুমুল আকার ধারণ করে তাদের তর্ক। ওদের ঝগড়া শুনে শায়লার বুক মুরগির বাচ্চার হৃৎপিণ্ডের মতো ধুকপুক ধুকপুক করে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঐদিন দেখলো এলাকার তিনটা ছেলে মিলে একটা ছেলেকে খুব মারলো। শায়লার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছিলো। তেমন কিছু করেনি ওরা সেদিন। কিছু চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলো। ওটুকুই সহ্য করার ক্ষমতা শায়লার নেই। সে ভায়োলেন্স একেবারেই নিতে পারে না। হাত ঠাণ্ডা হয়ে যায়, বুকে জমাট বাঁধে রক্ত। রাস্তাঘাটে মারামারির মতো ঘটনা দেখলে আতঙ্কে নীল হয়ে যায় সে। এমন একটা মারামারির জায়গায় শায়লা কোনদিনও ঢুকতে পারতো না। অথচ আজ কেমন অবলীলায় ছুটে এসে আট জনের দলটার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়লো সে।
দৃশ্যটা ছিলো ভয়ঙ্কর সুন্দর। সেজন্যই হয়তো চারপাশে উপস্থিত পথচারী আর ছাত্রছাত্রীরা হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো ব্যাপারটা। এক পা-ও নড়লো না কেউ। সাহায্য করতে এলো না। এগিয়ে আসার কথাটা তাদের কারও মাথাতেই আসেনি যেন!
“ছেড়ে দাও ওকে তোমরা, ওহ খোদা…” সবুজ গেঞ্জি পরা একটা ছেলেকে টেনে সরানোর চেষ্টা করতে গিয়ে কেঁদে দিলো শায়লা, “ওহ খোদা…”
খোদা শায়লার জবাবে কান দিলেন বলে মনে হলো না। কারণ, এই সবুজ গেঞ্জির ছেলেটার হাতে একটা আধলা ইট। বন্ধুরা হাত আর পায়ের সুখ মিটিয়ে ‘মাগিবাজ’টাকে মারছে। কেবল অতোটুকুতে ওর হচ্ছিলো না। তাই একটা আধলা ইট খুঁজে নিয়েছে। প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে ফোর্থ ইয়ারে কিছু না কিছু উদ্ভাবন তো করতেই হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মানেই গবেষক, উদ্ভাবক। সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য উদ্ভাবন-কর্ম ঘটানোর প্রয়োজন এখানে রাখা হয়েছে। সিলেবাসটা এভাবেই সাজানো হয়। সবুজ গেঞ্জিও প্রয়োজনের তাগিদে ইটটা খুঁজে নিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এতোটুকু যোগ্যতা না থাকলে ভর্তি পরীক্ষায় আর টিকেছে কিভাবে?
শায়লার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গায়ের জোরে ইটটা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে তপুর মাথায় মারলো ছেলেটা। সোলের ওপর আশি কেজির চাপ, মেয়েটার পা কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। তবে তপুর মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে যেমনটা বেরিয়ে এসেছে তার তুলনায় এটা কিছুই না। অথচ কি আশ্চর্য, তপুর চোখে ক্ষমাপ্রার্থনার দৃষ্টি নেই। সেখানে প্রবল ক্রোধ আর হার না মানা উজ্জ্বলতা।
তীব্র চোখে সবুজ গেঞ্জির দিকে তাকালো সে, “খানকির পোলারা, পুরুষ মানুষ হইলে এতোজন মিলে…”
আর কিছু বলার আগেই আটজন মানুষকে দেখা গেল ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে একজন নিরস্ত্র মানুষের ওপর উঠে যেতে। দূর থেকে শুয়ে থাকা মানুষটিকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না এখন। দেখা যাবে কেবল আটজন তরুণের হাত আর পায়ের নাচের ছন্দে ওঠানামা। তাদের একজনের পেছনে প্রায় ঝুলে থাকা মায়াবতী চেহারার মেয়েটি দৃশ্যটিকে নিয়ে গেছে পরাবাস্তবতার জগতে।
২.
চায়ের দোকানে মৃদু টুংটাং শব্দ। টঙের ব্যাপারটাই এমন। মন ভালো করে দেওয়ার জন্য আলাদা কিছুর দরকার হয় না। এখানে মাজহার আর তার বন্ধুরা নিয়মিতই আসে। দেওয়াল ঘেষে এই টঙ। পাশে একটা ছোট গেট। উটকো লোকজনের ঝামেলা নেই। বন্ধু কাঞ্চন তখন কেবল মাত্র পুনমের পাছা নিয়ে উচ্চমার্গীয় এক কৌতুক করেছে। ওরা না হেসে পারলো না।
পুনম ওদের সাথেই পড়ে। কাঞ্চনের সাথে তার যে দূরের সম্পর্ক তা নয়। ওরা বেশ ভালো বন্ধু। পুনমের বার্থডে পার্টিতে বাসায় দাওয়াত পাওয়ার মতো ভালো বন্ধু। ছেলেদের আড্ডায় অবশ্য এগুলো খুব বড় ব্যাপার নয়। কাছের বান্ধবীর পাছা নিয়েও সরস মন্তব্য করা যায়। তেমন করাটা উৎসাহের চোখেই দেখা হয় ক্যাম্পাসে। না করাটাই বরং ‘গাণ্ডু’র মতো কাজ। বান্ধবীগুলো ভাগ্যিস জানে না বয়েজ জোনে তাদের নিয়ে কি কি কথা বার্তা হয়। জানলে খবর হয়ে যেতো। যেমন, এই মাত্র তরিকুল তাদের ডিপার্টমেন্টের বান্ধবী মিল্কির সাথে দুধ নিয়ে একটা অশালীন কৌতুক করলো। এটার ব্যাপারে জানলে মিল্কি কি আর কোনদিন তরিকুলের বাসায় গ্রুপ স্টাডিতে আসবে?
“খবর শুনসোস না?” হাসতে হাসতেই পরের কৌতুকের টান ধরলো তরিকুল, সেই সাথে টানটা দিয়েছে হাতের বেনসনেও, “ফিজিক্সের কোন পোলা য্যান চোদাচুদি করতে গিয়া ধরা খাইছে। এক্কেরে হাতেনাতে কট। হায়রে চুদসে ওদের পোলাপান!”
এবার হাসার পালা মাজহারের, “তুই তো শালা কিছুই জানোস না। ঘটনা আরও বিশাল। পুরা নিউক্লিয়ার বোমা ব্যাটা।”
কাঞ্চনের প্রশ্ন থেকে বোঝা গেলো নিউক্লিয়ার বোমার ব্যাপারে সে-ও জানে না, “ক্যামনে?”
“ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের পোলা না। ফিজিক্সের টিচার ধরা খাইছে চোদাচুদি করতে গিয়া। আমাদের থিকা চাইর বছরের সিনিয়র পোলাটা। এইবার জয়েন করলো আরকি। সাত-আটদিন হইছে কেবল। কেউ চেনে না তার ডিপার্টমেন্টের পোলাপান ছাড়া। এইখানেই ফ্যাকরাটা বাঁইধা গেছে। শালা টিচার হইয়া গেলা, এখনও মাগিবাজির অভ্যাসটা যায় নাই। বুঝো চোদন।”
মন খুলে হাসলো বন্ধুদের দলটা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে তাদের মধ্যে অনেকদিনের জমে থাকা রাগ। এরা ক্লাসে ভালোমতো পড়ায় না। প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোয় গিয়ে কনসাল্ট ‘মারায়’। কথায় কথায় ছাত্রদের তাচ্ছিল্য করে। নিয়মনীতি দেখায় এমন ঢঙে যেন নিজেরা সাচ্চা মহাপুরুষ। এদের একজন ‘অসামাজিক কাজ’ করতে গিয়ে ধরা খেলে বাকিদের মন ভালো হয়ে যাওয়ারই কথা। বারুদে আগুন ধরানোর জন্য মাজহার পরের তথ্যটা দিলো, অবশ্যই গলা নামিয়ে।
“মাইয়াটাও আমাগো ভার্সিটির। শায়লা নাম। শুনছিলাম ক্যারেক্টার নাকি সুবিধার না। মাগির বিশাল বুক দেখে আমি অবশ্য বুইঝা লইছি, যা রটে তার কিছুটা তো…”
মাথা নাড়তে নাড়তে সিগারেটে টান দিলো তরিকুল, “ভালো ক্যারেক্টারের মাইয়া চোদাচুদি করতে গিয়া ধরা খায় না।”
মাথা দুলিয়ে তার কথায় সায় দিলো কাঞ্চন।
“এইসব কইরা আমাগো ভার্সিটির ইজ্জতটাই কিন্তু ডুবাইতেছে।” বিরক্ত মুখে বললো সে, “আমাদের একটা কিছু করা দরকার। সিক্রেট গ্রুপে পোস্ট চালাচালি কইরা লাভ হইছে কিছু? দুই দিন পর পর ক্যাম্পাস নিয়া নতুন স্ক্যান্ডাল। এইসব থামাইতে হইবো।”
মাজহার তরিকুলের হাত থেকে সিগারেটটা নিতে নিতে একমত হলো, “থামাইতে তো হইবোই। ভার্সিটি চোদাচুদির জায়গা না।”
ওরা কেউ লক্ষ্য করলো না, সামান্য দূরে পাতলা টি শার্ট পরা একটা ছেলে পায়ের ওপর পা তুলে চা খাচ্ছে। অন্য হাতে সিগারেট। এই ছেলের চোখ দেখা যাচ্ছে না। চোখ আর চশমা ঢেকে গেছে লম্বা চুলে। চোখ আর চশমা না দেখা গেলেও এই ছেলেকে ক্যাম্পাসের অনেকে চেনে। চেনে তার অদ্ভুত নামটির জন্য, কিংবা গিটার-গড পরিচয়ের কারণে। লুসিফ্যান নামক ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা এবং ভোকাল সে। নিজেকে পরিচয় দেয় ‘আব্যাডন’ বলে। তার আসল নাম ভার্সিটির ছেলে মেয়েরা অনেক আগেই ভুলে গেছে।
সিগারেটে চুপচাপ টান দিতে থাকা গিটার-গডের মাথাতেও তখন একই চিন্তা চলছে, “কিছু একটা করতে হবে।”
***
“শালার পুতেরা, মোনাজাত ধর।” ক্যান্টিনে ঢুকে জানালার ধারে টেবিলেটায় আছড়ে পড়লো মিথুন, “মোনাজাত ধর, শালার পুতেরা!”
হেসে ফেললো বর্ষা, “কি রে? কি হইলো আবার?”
“এক্কেবারে মার্ডার হইয়া গেছে ঘটনা। মোনাজাত ধর সবাই।” উজ্জ্বল একটা হাসি হেসে বর্ষা-শাফিনের সামনে এঁটে বসলো। নির্লজ্জের মতো ভাগ বসালো সামনের সিঙ্গারায়। “পুরা ক্যাম্পাসে যা যা চলতেছে রে ভাই, পুরা ড্রামা। পুরাই ড্রামা। বার্নার্ড শ’ ফেল!”
“তপু স্যার আর শায়লা ম্যামের ঘটনাটা তো?” উৎসাহ দেখালো না শাফিন, “নোংরা একটা ব্যাপার। শুনতেছি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে একটা স্টেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলতেছে। ফ্যাকাল্টিরে মাইরা বসলো ফার্স্ট ইয়ারের পোলাপান…”
“কি বলো!” প্রতিবাদ করলো বর্ষা, “শুধু ‘মাইরা বসলো’? যেমন তেমন মেরেছে? চড়-থাপ্পড়? স্যার এখনও আইসিইউ-তে। এভাবে কেউ কাওকে মারে নাকি স্রেফ হাত ধরার অপরাধে? আমি বুঝি না, এই ছেলেগুলো নাকি আমাদের ভার্সিটিতে পড়ে! ছিহ!”
“বর্ষার ধারণা, অ্যাডমিনস্ট্রেশন থেকে কোনও স্টেপই নেওয়া হবে না।” মাথা নাড়তে নাড়তে সিঙ্গারায় কামড় বসালো শাফিন। তার কণ্ঠ অস্পষ্ট শোনায়, “ছেলেগুলো জাস্টিস লীগ করে তো। ওদের ক্যামনে আর শাস্তি দেয়।”
জাস্টিস লীগ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী এক ছাত্র সংগঠন। আগে অন্য নাম ছিলো। বড় বড় অর্জন ছিলো। মহান নেতারা ছিলেন। দলটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিলো। নামটা শুনলেই বাঙালির মাথা নত হয়ে আসতো শ্রদ্ধায়। সত্যিকারের গ্রীক দেবতারা ছিলেন তাদের নেতা-কর্মী। সময়ের সাথে বিবর্তন ঘটেছে দলটির। এখন তারা নিজেদের নাম পাল্টে রেখেছে জাস্টিস লীগ। প্রতীকও পাল্টেছে। হাতুড়ি। স্টুডেন্ট ইউনিয়নে নির্বাচনের সময় পোস্টার অনেক দেখা যায় আজকাল, হাতুড়ি মার্কায় ভোট দিন। এই বিষয়টা এক ঘোরতর রহস্য। নতুন খোলা ক্রিমিনোলজির বাঘা বাঘা প্রফেসররাও এই রহস্যের সমাধানে অপারাগ। জাস্টিস লীগে থরের প্রতীক হাতুড়ি কি করে? থর তো জাস্টিস লীগের কেউ না! অবশ্য এর পেছনে লম্বা এক ইতিহাস আছে। সেই প্রসঙ্গ ভিন্ন। এই মুহূর্তে মিথুনের মুখে হতাশার ছায়া পড়ে।
“জাস্টিস লীগ হইছে তো কি হইছে? টিচার কোপাবে তাই বলে?”
“আরে,” মিথুনের অজ্ঞতায় বিরক্ত দেখায় শাফিনকে, “কয় বছর আগে বুয়েটেই তো মারলো প্রফেসররে ধইরা। জাস্টিস লীগের বিবৃতিতে বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা খর্ব করায় প্রফেসরকে মারা হয়েছে। জাস্টিস লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কোনও আপোষ করতে পারে না। ব্যাস, সব ঠাণ্ডা। হইছে কারও বিচার? ছাত্রত্ব গেছে কারও? ঐ ছাত্রদের একজন সামনে নাকি এমপি হইতেছে। এই এদের থেকেও দেখবি দুই চারজন পলিটিক্সে ভালো শাইন করবে।”
বর্ষা যোগ করলো, “সেইটা যেন করতে পারে তাই তারা একটা পলিটিকাল ফ্লেভার ঢুকায়া নিবে। এটা কোনও ব্যাপার না। তপু স্যারের ব্যাপারে যা শুনলাম, বামপন্থী লোক। মুক্তমনা ধরণের আরকি। ঐদিকে স্টুডেন্ট ইউনিয়নে তো বামঘেঁষা লোকজন ভালো ফর্মে আছে। এই সব ঘোঁট পাকায়া একটা পলিটিকাল কিছু তারা বানায় নিবে। গাধা পানি খায় ঘোলা করে। আর জাস্টিস লীগ খায়…”
সভ্য সমাজে বলা যাবে না এমন একটা নোংরা বাক্যাংশ বেরিয়ে এলো বর্ষার মুখ থেকে। মিথুনের মতো সহজ সরল ছেলেটির কানও গরম হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করলো সে, “এতো সহজ হবে না রে এইসব ধামাচাপা দেওয়া। খুব বাজেভাবে মেরেছে। আর শায়লা ম্যামেরও গায়ে হাত দিয়েছে। পোলাপান অনেকেই ক্ষেপে আছে। এরা নাকি এর একটা উপযুক্ত বিচার চাবে।”
হাত নেড়েই কথাটা উড়িয়ে দিলো শাফিন, “বিদ্যাসাগর হলের একটা ছেলেও ঐ আন্দোলনে যাবে না। ঐখানকারই পোলাপান তো সব। তারপর আছে ক্যাম্পাসের বুক-পাছা দেখে বেড়ানি জনগণ। এই শালারা এই ঘটনা থেকে মজা নিবে। পিয়ার প্রেশার ফিল করবে না। তাই নামবেও না। কারণ পাছা দেখা অনেক ছেলে আছে এখানে। নিজেদের নোংরা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ব্যক্তিগত জীবনে একটা প্রেমিকা জোটাতে পারেনি, অন্যদের প্রেম দেখলে এদের গা জ্বালা করে। নারী-পুরুষ ইস্যু না? এরা অনেকদূর নিয়া যাবে জিনিসটাকে। আর তারপর পাবে সেক্সের গন্ধ। সেক্সের গন্ধ পেলে এরা রাস্তায় নামবে না। অন্য ইস্যু হলে নামতো। দেখবা হাতে গোণা কয়টা গিয়া খাড়ায়া আছে। জাস্টিস লীগ এগোরে পিডায়া খেদাইবো। হাতুড়ি প্রতীকের জন্মের সময়কার কথা মনে আছে না?”
“এইটা একটা ভালো সমস্যা।” একমত হলো মিথুন, “কথা ঠিক। ছেলে মেয়ে একসাথে মিশা নিয়া, প্রেম নিয়া ঝামেলা হইলে পোলাপান হোগার মতো দুই ভাগ হইয়া যায়, বাল। আমি আশা করতেছি যে ঘেরাও হইলে যামু। আর কেউ না আসুক।”
শাফিন-মিথুনের এই বিশাল লেকচারের ফাঁকে বর্ষা তার স্মার্টফোনে ঘাঁটতে শুরু করেছিলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ওদের আলোচনা টুটিয়ে দিয়ে চিল-চিৎকার করলো সে, “মোনাজাত ধর, শালার পুতেরা। এইটা কি ছিলো রে ভাই!”
“কি হইছে, কি হইছে?” করে দু’জনই মাথা ঢুকিয়ে দিলো ওর স্ক্রিনের দিকে।
বর্ষার চোখ তখন ভাসা ভাসা হয়ে উঠেছে, “লাভ ইউ, আব্যাডন। লাভ ইউ।”
প্রেমিকার মুখে অন্য ছেলেকে নিয়ে এমন সরল স্বীকারোক্তি শুনেও আপত্তি জানালো না শাফিন। আসলে আপত্তি তোলার মতো অবস্থাই নেই তার। চোয়াল ঝুলে পড়েছে রীতিমতো। মিথুনের চোয়াল কেবল ঝুলেছে তাই নয়, মৃদু একটা চিৎকার করে উঠলো সে, “ওহ মাই… ফাক!”
জ্বলজ্বলে অক্ষরগুলো স্ক্রিন থেকে সরাসরি তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। একটা ইভেন্ট।
হোস্ট, আব্যাডন। সময়, আগামিকাল সকাল দশটা।
স্থান, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র।
“প্রকাশ্যে আলিঙ্গন ও চুম্বন অনুষ্ঠান – প্রতিবাদটা হোক এভাবেই।”
৩.
“মুরতাদ। মুরতাদ।” খুব শান্ত কণ্ঠে বললো মাজহার। মনোযোগ দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে, “আব্যাডন হইলো গিয়া মুরতাদ। নামটা কি রাখসে খেয়াল করো নাই?”
মুখ বাঁকালো কাঞ্চন, “আসলে নাম হয়তো ছিলো আবেদীন কিংবা আব্বাস উদ্দীন। সেইটা এডিট মারাইছে আরকি। এইটা সবাই করতাছে আজকাল। নামটা লইছে পশ্চিমা।”
“আরে সেটা সমস্যা না। পশ্চিমা হইলে আর এমন কি হইতো? এখানে ঘাপলা আরও বড়। ওয় তো ব্যান্ড করে একটা। লুসিফ্যান। এরা হইলো শয়তানের ভক্ত। সে বাজায় গিটার। আবার তারে লোকজন কয় গিটার-গড। এইসব দেইখা আমার খটকা লাগছিলো। আব্যাডন নামটা নিয়া গুগল কইরা দেখলাম।”
“কি পাইলি?” নিজের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জানতে চাইলো তরিকুল।
“আব্যাডন হইলো শয়তানের একটা নাম। লুসিফার কিংবা মর্নিংস্টারের মতোই। শালার কারবারটা দেখসো? প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়া বেড়াইতেছে সে শয়তানের ফ্যান। নাম নিসে শয়তানের। নিজেরে কয় গড। এখন দ্যাখো, ধর্ম আর কালচারটারে নষ্ট করার জন্য আইসা পড়ছে ওপেনে কিস করার ইভেন্ট নিয়া। খানকির পোলা একটা।”
বাকি দুই বন্ধু একমত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের দেখা গেলো নতুন নতুন সিগারেট ধরাচ্ছে। মামার কাছে চায়ের আবদার করছে। কাঞ্চন তার বান্ধবীর স্তন নিয়ে কৌতুক করছে। এসবের মধ্যে তারা খেয়াল করতে ভুলে গেলো, ওদের কেউ-ই খুব বড় রকমের ধার্মিক নয়। কোনও কিছু ঘটানোর মতো ক্ষমতাও তাদের নেই। চায়ের দোকানে বসে পরিচিত মেয়েদের নিপল বা ব্রায়ের ফিতা নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে অবশ্য ওরা বেশ দক্ষ। সুরসুরিটা বেশি আসে। একটা অন্যায় ঘটে গেলে সেটায় চরিত্রের দোষ খোঁজাই তো ভালো। তাহলে এ নিয়ে কোনও সত্যিকারের কাজ করতে হচ্ছে না তাদের। ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে ডাক দেওয়া মানুষটার নাম আর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে মন্তব্য করাই সহজ। তাহলে ওদের আর রাস্তায় নামতে হচ্ছে না।
“মামা, আরেকটা বেনসন দাও।” টঙওয়ালার উদ্দেশ্যে বললো মাজহার।
***
“অসম্ভব!” ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে বসে তীব্রবেগে মাথা নাড়লো বর্ষা, “পাবলিক প্লেসে আমি তোমাকে চুমু খেতে পারবো না।”
“খাওয়া উচিত আমাদের।” বর্ষার হাত ধরে চাপ দিলো শাফিন, “আড়ালে যেমন ক্ষ্যাপাটেদের মতো খাও তেমনটা না হোক-” প্রেমিকার দৃষ্টি দেখে দ্রুত জিভ কাটলো শাফিন, “বলছি না যে অমনটা আমার খারাপ লাগে। জানোই তো তোমার এই ব্যাপারটা আমার কতো পছন্দের। এমন লুক দাও কেন?”
মাথা নাড়লো বর্ষা, “লোক দেখানোর জন্য প্রেম? ক্যামেরা কতো থাকবে জানো? দেখে ফেলবে সবাই, রেকর্ড হয়ে থাকবে -”
হাত নেড়ে উড়িয়ে দিলো শাফিন, “ধুর। সংবিধানবিরোধী কিছু করছি নাকি আমরা? সফট কিস। ওরকম এক্সাইটেড কিস করতে বলছি না তো। আব্যাডন ভালো একটা ইভেন্ট করছে। এটার সাথে আমাদের থাকা উচিত। হাত ধরে দলে দলে যাওয়া উচিত। সবার সামনে, ক্যাম্পাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরা উচিত গার্লফ্রেন্ডকে, চুমু খাওয়া উচিত। এর চেয়ে বড় জবাব আর হতে পারে না ওদের অন্যায়ের। এই যুদ্ধ হাতুড়ি-চাপাতির না। এই যুদ্ধ ভালোবাসার। ব্যক্তির স্বাধীনতায়।”
চুপ করে থাকলো বর্ষা।
“দেখো। আমাদের এখানে কোনও দাবী নেই। আমরা কোটার সংস্কার চাইছি না। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির জবাব চাইছি না। সরকার বা জাস্টিসলীগের কারও কোনও কাজ বাড়াচ্ছি না। আমরা চাইছি আমাদের হাত আর ঠোঁট কোথায় থাকবে সেই ব্যক্তিগত অধিকারটা আমাদের হাতেই রাখতে। জাস্টিসলীগ ক্যাম্পাসের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে এখন। ওরা যেন আমাদের হাত আর ঠোঁটটাও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।”
“কিন্তু বাসায় দেখে ফেলবে যে?” মিনমিনে কণ্ঠে বললো বর্ষা।
“দেখুক। অস্তিত্বের প্রশ্ন এটা। ছোটখাটো বিষয় তো স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। এই প্রতিবাদটার মতো ভালো আইডিয়া বাংলাদেশে অনেকদিন আসেনি। ভাগ্য ভালো আমাদের একজন অ্যাবাডন ছিলো। এই সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে।”
কোথা থেকে যেন মিথুন এসে হাজির। ওদের দেখে মলিন মুখে হাসলো, “বল তো এখন এক রাতের মধ্যে গার্লফ্রেন্ড পাই কই? কথা দিলাম যে অ্যাডমিন বিল্ডিং ঘেরাও হইলে আমিও যামু। সেইখানে আব্যাডন কয় এইটুকুয় হইবো না। চুম্মাচাটি করা লাগবো। কি জ্বালা।”
হাসলো শাফিন, “চুম্মাচাটিই ক্যান করা লাগবো? কোনও ফ্রেন্ডকে জড়ায় ধরিস। কেয়া সিঙ্গেল তো। ওরে পার্টনার হিসাবে চুজ কইরা নিয়া যা। নাহলে বয়ফ্রেন্ডের দৌড়ানিতেই আন্দোলন ছুটে যাবে। জাস্টিস লীগকে আর হাতুড়ি মার্কা নিয়া আসতে হইবো না।”
“কেয়া কি রাজি হইবো! আরে বাল, সমস্যা হইলো গিয়া, আব্যাডনের আইডিয়া সবার কাছে জোস লাগছে। কিন্তু মাইয়াগুলা রাজি হইতেছে না। চিপাচুপিতে গিয়া বয়ফ্রেন্ডের ঠোঁট কাইটা ফেলবে, কোনও সমস্যা নাই। একটা ভালো উদ্দেশ্যে এখন পাবলিকে আলতো চুমু খাওয়া লাগবে, এতে করে সবার জাত-ধর্ম সব যাইতেছে। নো অফেন্স, বর্ষা।”
“না, সমস্যা আছে আমাদের কিছু। তুই বুঝবি কি? তুই কি মেয়ে? আমরা একটা সোসাইটির মধ্যে চলি। সোসাইটিতে আমাদের ফ্যামিলি মেম্বাররা চলে-”
“সোসাইটির পুটকি মারার আয়োজন করাই হইতাছে। সোসাইটি মারাইতে গিয়াই বহিরাগত খেদাও, মাইয়া-পোলারে একসাথে ঘুরা ঠেকাও কার্যক্রম শুরু হইছিলো। হেই কাম করতে গিয়া তোমরা আবার সোসাইটি টানলে কেমনে হইলো? মানে, জাস্টিস লীগের দেওয়া শাহবাগী বিরিয়ানি খাইয়া জাস্টিস লীগের কামের প্রতিবাদ করবা? এইটা কেমনে?”
একটু এগিয়ে এসে গলা নামালো মিথুন, “আরে ভয় পাইতেছিস, শাফিনের লগে ব্রেক আপ হইয়া গেলে তোদের কিসের ভিডিও নিয়া ঝামেলা হবে? পরে আর বয়ফ্রেন্ড পাবি না? আমার কাছে আইসা পড়িস। মেয়ে আগে কারে কই কিস করলো এইটা নিয়া ভাবে না এমন কয়েক হাজার পোলা চিনি আমি।” চোখ টিপলো ও।
পিত্তি জ্বলে গেলো বর্ষার, শাফিনের হাত খামচে ধরলো মেয়েটা, “আমাদের ব্রেকআপ হবে না, গাধাচোদা। কালকে যাইতেছি আমি, দেখিস। ক্যামেরার সামনে চুমু হয়তো খাইতে পারবো না, কিন্তু শাফিন ঠিকই বলসে, চুম্মাচাটিই ক্যান করা লাগবো? আমি ওকে জড়ায় রাখবো। দেখি কোন শালা আমাদের ছুটাইতে আসে।”
“দ্যাটস দ্য স্পিরিট!” দুই হাত দিয়ে শাফিন-বর্ষার দুই কাঁধে চাপড় দিয়ে সোল্লাসে বলে উঠলো মিথুন।
কিন্তু ঘটনা এতো সহজে ঘটানো গেলো না পরদিন।
৪.
“হ্যাঁ, অনেকেই বলবে এটা একটা মুসলিমপ্রধান দেশ। হিন্দুরাষ্ট্র ভারতের উদাহরণ টানাটা বাড়াবাড়ি।” চুল আর চশমার ওপাশ থেকে টিভি রিপোর্টারের ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো অ্যাবাডন, “কিন্তু আমি ভারতের উদাহরণই টানবো। কারণ, মুখে যতো যাই বলুক, আমাদের সাথে ওদের লাইফস্টাইল আর বিশ্বাসে তেমন একটা পার্থক্য নেই। যেটা আমি করতে চাইছি – তা ওরা করে দেখিয়েছে। দমদম স্টেশনের কথা বলছি।”
রাত নেমে এসেছে বাইরে। আগামিকাল বিগ ইভেন্ট। আব্যাডনের এই ঘরটিকে স্টুডিওর রূপ দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। আব্যাডন যখন বিরতি নিলো, সাংবাদিকদের কেউ তাকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করার চেষ্টা করলো না। ছেলেটার বয়স কম, কিন্তু কেমন যেন প্রবীণ প্রবীণ একটা ভাব তার মধ্যে আছে। দরকারের বেশি একটা শব্দ করে না সে। এই এক বৈশিষ্ট্যের কারণেই তার সঙ্গে পরিচয়ের পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাইকে শ্রোতার ভূমিকায় চলে যেতে হয়। এই সাংবাদিকও তার ব্যতিক্রম নয়।
“৩০শে এপ্রিল রাত দশটার ঘটনা, ২০১৮-এরই। ট্রেনের প্রেমিক-প্রেমিকার এক জুটি যাচ্ছিলো। ওরা একে অন্যকে জড়িয়ে রেখেছিলো বলে বুড়োদের কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হয়। বাঙালি কালচার না তো এমনটা!” তিক্ত হাসি হাসলো আব্যাডন, রাত সাড়ে দশটায় যখন প্রচার করা হবে ভিডিওটি- এই হাসি অনেকের বুকে গিয়ে বিঁধবে। “ওরা সেই প্রেমিক-প্রেমিকাকে খুব মেরেছিলো। কথা কাটাকাটি থেকে শুরু, তারপর মারধোর। কলকাতা তোলপাড় হয়ে গেছিলো সেই ঘটনায়। কলকাতাবাসী কি করেছিলো আপনারা জানেন? তাঁরা কি হাইকোর্ট ঘেরাও করেছিলেন? উঁহু।”
সাংবাদিকদের কাজই সংবাদের কাছাকাছি থাকা। এই ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকেই জানেন দমদম স্টেশনের সেই জড়িয়ে ধরার ঘটনার পর ঘটা অন্যায় মারধোরের প্রতিবাদ কিভাবে হয়েছিলো। কিন্তু তারা কথা বললেন না। আব্যাডন খুব এনগেজিং ভঙ্গিতে কথা বলছে। এই প্রশ্নটাও সে ধারারই ছিলো, উত্তরের আশায় এই প্রশ্ন সে করেনি। এই ভিডিও ভাইরাল হবে, ছেলেটা কথা বলতে জানে। সেই সাথে এক্সপ্রেশন! সাংবাদিকদের টিম লিডার জিভ দিয়ে নিজের লিপস্টিক চাটলেন। এটা একটা সফল কাজ হতে যাচ্ছে।
“পরদিনই তারা প্রতিবাদে নামে। শিরোনাম ওভাবে ঠিক করা হয়নি, আবার হয়েছিলোও। এটাকে এখনও মানুষ মনে রেখেছে ‘হোক আলিঙ্গন’ নামে। ওখানে পাবলিক প্লেসে প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরার জন্য সবাইকে আহ্বান করা হয়েছিলো। মানুষ সাড়া দিয়েছিলো। স্লোগান উঠেছিলো – ‘আমার শরীর, আমার মন, দূরে হঠো রাজ শাসন।’ আপনারা কি জানেন যারা নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে অন্যকে বাঁধা দেয় তাদের একটা সুন্দর নাম আছে?”
সাংবাদিকদের দলটা এবারও কোনও কথা বললো না। টিম লিডার খেয়াল করলেন এবার তিনি অজান্তেই লিপস্টিক চেটে ফেলেছেন। এই ছেলেটার কি গার্লফ্রেন্ড আছে? থাকার কথা। এমন জিনিস ফাঁকা পাওয়া কপালের ব্যাপার। কিন্তু মিউজিশিয়ান মানুষ। হতে পারে গ্রুপিজদের সাথে রাত কাটায়। ধরাবাঁধা কেউ থাকে না সাধারণত এদের। বিষয়টা দেখতে হবে, মনে মনে ভাবলেন তিনি।
“যে কোনও ধরণের নৈতিকতা নিয়ে যারা শাসনে নামে, তাদের একটা নাম আছে। ‘নীতিপুলিশ।’ কেউ হয়তো আপনাকে বলবে, বইপত্রে পা লাগিও না। এতে করে বইয়ের অসম্মান হয়। ইনি একজন নীতিপুলিশ। যে কাজে অন্য একটা মানুষকে অসম্মান করা হচ্ছে না, স্রেফ প্রথাগত কারণে তিনি আপনাকে বাঁধা দিতে এলেন। এরা সবাই নীতিপুলিশ। বইয়ে পা লাগাতে নিষেধ করা উজবুকটি হলেন সামাজিক নীতিপুলিশ। আবার দেখবেন কেউ কেউ আজ রাতে পোস্ট লিখবে, টকশোয় যাবে। বলবে, ইসলামের চোখে বেগানা নারীকে জড়িয়ে ধরা হারাম। তাই এটা করা যাবে না। ইনিও নীতিপুলিশ। ধর্মীয় নীতিপুলিশ। এসব নীতিপুলিশদের আমরা কাল সকালে দেখিয়ে দিতে চাই, তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী আমরা চলবো না।”
“নীতিপুলিশদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে কি? কারণ, আমার মনে হয় আগামিকাল তারা আপনাদের বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করবে।”
হাসলো আব্যাডন। ছেলেটার হাসিটাও সুন্দর। তলপেটে শিরশির করে উঠলো টিম লিডারের।
“নীতিপুলিশরা নিজেদের নীতি নিয়ে নিজেরা থাকুন। বইয়ে পা লাগালে যদি অসম্মান মনে হয়, তাহলে আপনি বইয়ে পা লাগাবেন না। আমি চাইলে বই নিয়ে ফুটবল খেলবো। আমাকে এটা বলতে আসার অধিকার আপনাদের নেই। পাবলিক প্লেসে কোনও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে যদি আপনার খারাপ লাগে, আপনি না খেলেন। আমার ইচ্ছে হলে আমি শালীনতার মধ্যে থেকে আমার প্রেমিকার সঙ্গে চুমু খাওয়া থেকে শুরু করে যা ইচ্ছে করতে পারি। আপনি আমাকে কিছু বলতে আসার অধিকার রাখেন না। ধর্মের দোহাই দিয়েও না। ইসলামে নিষেধ তো? আপনি মানুন। জান্নাতবাসী হোন। সবাই জান্নাতে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রেমিকার হাতে হাত রাখে না, ঠোঁটে চুমু খায় না। তাদের লক্ষ্য তাদের কাছে। ও নিয়ে তাদেরই ভাবতে দিন। আজ থেকে বাংলার মাটিতে নীতিপুলিশদের আর বরদাস্ত করা হবে না।”
সর্বশেষ প্রশ্নটা করার জন্য ছেলেটাকে থামালেন টিম লিডার। উত্তেজিত হয়ে বেশি কথা বলছে সে। পরে অনেক কিছু এডিট করতে হবে। সাড়ে দশটায় এটা একটা বোমার মতো যাবে।
“পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হচ্ছে। অনেকে এই আন্দোলনকে বলছেন প্রেম-আন্দোলন। ইতিবাচক মনোভাবও কিন্তু আমরা সোশাল মিডিয়াগুলোয় দেখছি। কিন্তু আপনি, এই আইডিয়ার জন্মদাতা, এবং আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, আপনি এই আন্দোলনটি থেকে কি অর্জন করতে চাইছেন?”
“আমি আসলে এই আইডিয়ার জন্মদাতা নই। দমদম স্টেশনের ঘটনা থেকেই বিষয়টা লক্ষ্য করেছি আমি। এটা স্রেফ একটা সফল পদ্ধতি। প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। আমি সফল এক পদ্ধতিতে হাঁটছি কেবল।” বড় করে দম নিলো আব্যাডন, “অর্জন? ভারতের আদালত থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, জানেন তো? প্রকাশ্যে একটা ছেলে একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে পারবে – সেই ঘোষণা। এটা কোনও অপরাধ নয়। রাষ্ট্র এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। অন্য নাগরিকরাও নয়। আমরা যদি আগামিকাল ঠিকমতো আন্দোলনটা করতে পারি, এমন একটা ঘোষণা বাংলাদেশেও হবে। আসবে সর্বোচ্চ আদালত থেকে। এটা বাংলাদেশি কালচারে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় পজেটিভ চেঞ্জ হবে। আমাদের অর্জন কি হতে পারে টের পাচ্ছেন তো?”
সাংবাদিকদের দলটা চলে গেলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বেডরুমের দিকে রওনা দিলো আব্যাডন। মোবাইলটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে। নিয়ে দেখলো ছত্রিশটা মিসড কল। রেজিন।
রেজিন মেয়েটা আব্যাডনের সিক্রেট গার্লফ্রেন্ড। মিউজিশিয়ান হিসেবে আন্ডারওয়ার্ল্ড ব্যান্ডগুলোর মধ্যে তার একটা সুনাম আছে। এই সুনাম বাড়িয়ে তোলার জন্য প্রকাশ্যে প্রেমিকা রাখা নিরাপদ নয়। সিঙ্গেল ভোকাল; গিটার-গড; আব্যাডন; লুসিফ্যান; — গুড ফর বিজনেস। একটা উপাদান নষ্ট হয়ে গেলে ব্যবসায়িক ক্ষতি। এই এক কারণে আজকে রাতের জন্য রেজিনকে তার হোস্টেলে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। টিভি সাংবাদিকদের সামনে পড়ে গেলে সমস্যা ছিলো।
টিভির ব্যাপারটা বুঝতে সময় লেগেছে আব্যাডনের। এই এক ইভেন্টের জন্য ক্যামেরাসহ জার্নালিস্টরা চলে এলো? একেবারে তার বাসা পর্যন্ত! এতোটা আশা করেনি আব্যাডন। কিন্তু সে জানে মিডিয়া কেন তার প্রচারে এমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ওরা বুঝতে পারছে এটা মনোযোগ পাবে। কিন্তু কেউ না জানলে কিভাবে মনোযোগ পাবে? তাই আগের রাতে এই স্পেশাল ইন্টারভিউ। স্পেশাল পাবলিসিটি। ওরা আসলে ঢাক পিটিয়ে আব্যাডনকে বন্দুকের সামনে পাঠাতে চায়। তাহলে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়তে থাকা আব্যাডনকে আরও বেশি মানুষ দেখতে পাবে। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে, যেখানে অডিয়েন্স আগে থেকে নার্চার করা যায়?
রেজিনকে কল ব্যাক করলো ও, “কি হয়েছে, বাচ্চা?”
বেবি বলে ডাকার থেকে ‘বাচ্চা’ বলে ডাকাটা ওদের কাছে বেশি রোমান্টিক মনে হয়েছে। শুরু থেকেই বাচ্চা বলে একে অন্যকে ডেকে এসেছে ওরা। অভ্যাসটা দুই বছর পরও রয়ে গেছে অদ্ভুতভাবে।
রেজিনের মিষ্টি গলাটা একটু কেঁপে গেল যেনো, “কই ছিলা তুমি?”
“ঐ জার্নালিস্টগুলো। এসে গেছিলো হুটহাট, যাকগে। কি হয়েছে বলো তো? এতোগুলো মিসড কল…”
“ওরা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে, বাচ্চা। এখন আমি কি করবো?”
আব্যাডনের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। রেজিনকে ওরা খুঁজে বের করে ফেলেছে! তা কি করে সম্ভব? হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না ওরা লিভ টুগেদার করে যাচ্ছে একটা বছর ধরে। কি আশ্চর্য!
“তুমি শিওর কি করে? ভুল হচ্ছে মনে হয় তোমার। আমাদের কথা জানার কথা না কারও।”
“এক ঘণ্টা আগে সাদা একটা মাইক্রো এসে থেমেছে আমার জানালা বরাবর রাস্তায়। দুটো লোক ওখান থেকে বের হলো। আমার জানালার দিকে সরাসরি তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। তারপর একজন ঢুকে গেছে ভেতরে। আরেকজন এখনও তাকিয়ে আছে। আমি লাইট নিভিয়ে বসে আছি। এখন আমি কি করি, বলো তো, বাবু?” মনে হলো রেজিন কেঁদে ফেলবে।
“বাচ্চা? আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো।” বলেই থেমে গেলো আব্যডন। ভেবে নিচ্ছে। “তোমার হোস্টেলে বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না। কাজেই ওরা আসতে পারবে না ভেতরে। আসলে ওরা তোমার রুমে আসতে চাইছে এমনও না। ওদের উদ্দেশ্য ভিন্ন।”
ওদের উদ্দেশ্য, আগামীকাল তোমাকে বেরিয়ে আসতে না দেওয়া। আন্দোলনে যাওয়া থেকে ঠেকানো। আমার জন্য তাহলে আরও ভালো ব্যবস্থা ওরা করে রেখেছে! — তবে এসব কথা মেয়েটিকে বললো না আব্যডন।
“তুমি স্রেফ ঘর থেকে বের হয়ো না। আগামিকাল আসার দরকার নাই। আমার মনে হয় কালকে এগারোটা-সাড়ে এগারোটার মধ্যে ওরা তোমার ওখান থেকে চলে যাবে। তারপর বেরিও।”
এগারোটা-সাড়ে এগারোটার ব্যাপারে আন্দাজে ঢিল মারেনি আব্যাডন। এক ঘণ্টা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে কাটাতে পারলেই ও একটা শক্ত অবস্থান গড়ে নেবে। তখন ঐ জমায়েতের জন্য হাতুড়ি নিয়ে আসতে হবে কাওকে। এমন দু’জন হাতুড়ি বাহক এখন রেজিনের জানালার নিচে বসে আছে। এই জনশক্তিকে কাল লাগবে। সেই সময় তাই তারা রেজিনের হোস্টেলের সামনে থাকতে পারবে না। ওদের আসতে হবে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রেই।
“নড়বে না। কালকে সকালের আগে বের হবে না। বাবু, বুঝতে পারছো আমার কথা?”
রেজিনকে শান্ত করে আরেকটা নাম্বারে ডায়াল করলো আব্যাডন।
“মিস অদিতি? একটু আগে আমার ইন্টারভিউ নিয়েছেন আপনি। প্লিজ যদি এখনও গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে না থাকেন তো একটা রিকোয়েস্ট… আমাকে ছোট্ট এক লিফট দিতে হবে…”
৫.
ছাদের ওপর থেকে মাথা বের করে নিচের ভিড়টাকে দেখলো ওরা দুইজন। একজনের পরণে নীল শার্ট। তিন দিন আগে সন্ধ্যায় এই ছেলেটা একটা সবুজ শার্ট পরেছিলো। হাতে ছিলো আধলা ইট। তপুর মাথার ভেতর খারাপ রকমের ইন্টারনাল ব্লিডিং হওয়ার পেছনে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব এর। বন্ধুরা একে চেনে রাহাত নামে।
একটা মানুষ তার কারণে মরে যেতে পারে, তা নিয়ে রাহাতকে মোটেও বিচলিত হতে দেখা গেলো না। ছাদের ওপর পিচিক করে থুতু ফেললো তার বন্ধু। তার দিকে তাকানোর সময় চোখে ফুটে উঠলো উদ্বেগ, তবে এই উদ্বেগ হাসপাতালে শুয়ে থাকা কোনও মানুষের জন্য না।
“এই ধরণের মাতারিদের আমার পছন্দ না।” শক্ত মুখে বললো রাহাত।
“কোন ধরণের মাতারিদের তোর পছন্দ?” মুখ বাঁকিয়ে জানতে চাইলো জয়নাল। জয়নালের নামের মধ্যে প্রাচীনত্ব থাকলেও কাজকর্মে সে আধুনিক। টিশার্ট পরলে সেটার কলার কখনও ফেলে রাখে না। সাইকেলের স্প্রোকেট থেকে খুলে আনা চেইনের মতো দেখতে অলংকার তার পরণে থাকে। তপুকে প্রথম চ্যালেঞ্জ সে-ই করেছিলো।
“ঐবারের ঘটনা ভালো হইছিলো। ভর্তির প্রথা সংস্কারের একটা আন্দোলন হইলো না? লোকে চাইছে ‘সংস্কার।’ আন্দোলনে আইসা কইছে ‘সংস্কার।’ মনে যা, মুখে তা। এমন প্রতিপক্ষ হইলো গিয়া দুর্বল প্রতিপক্ষ। আমাদের সময় সেইরকম দুবলা লোকজন আন্দোলন চালাইবো ক্যান? আমাদের কপালে আছে আব্যাডনের মতো খানকি।”
“আব্যাডন ব্যাপার না। শালার আন্দোলন ঘুরায় প্যাঁচায়, মুচড়ায় মুচড়ায় তারই হোগা দিয়া ঢুকানির ব্যবস্থা কইরা ফেলছি। অলরেডি বায়তুল মোকাররমের ইমামের বাসায় উট পাঠানো হয়া গেছে। সারা দেশের মসজিদগুলায় ঝড় উইঠা যাবে। পিছের কারণটা ইসলামিক ভাবার কোনও কারণ নাই। পাবলিকের সাইকোলজিতে হাল্কা দোলা মাইরা রাখা আরকি।”
রাহাত একটা সিগারেট ধরালো, “বিপদটা বুঝতেছিস না তুই। আব্যাডন মোটা সুতা না। এ হইলো গিয়া চিকণ সুতা। ভর্তি প্রথা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা ছিলো মোটা সুতা। তাদের মতো করে এরে ট্যাকল করা যাইবো না। খেয়াল কইরা দ্যাখ, আব্যাডন একবারও আমাদের বিচার চায়া দাবী তোলে নাই। একটা বারও না। অথচ তার ধান্ধা ওটাই। এই শালা বিপদজনক। চাইতেছে আমাদের চুইদা দিতে, কিন্তু মুখে কইতাছে আরেকটা কথা। এই ধরণের মাতারি আমার পছন্দ না।”
“তাইলে তার লাভটা কি? এইখানে চুম্মাচাটির শো কইরা?”
“কালচার।”
“কালচার?”
“হ, কালচারটা পাল্টাইতেছে। যেই কালচারে মানুষ অটোমেটিক ধইরা নিবে যে এমন কাজ করলে বিচার হইতে হয়। তারপর নিজেদের পাছা বাচাইতে আমাদের খবর হইয়া যাবে।”
একটা সিগারেট এবার জয়নাল ধরালো। হাত যেভাবে চলে, সেভাবে তার মাথা চলে না। বন্ধুর বিভ্রান্তি বুঝতে পারলো রাহাত। ছাদের ওপরই বসে পড়লো একটা পাইপের ওপর।
“দ্যাখো, আজকে একটা বাচ্চারে তার বাপ-মাও যদি মাইরা ফালায়, এই ঘটনার বিচার চাইতে লোকজন লুঙ্গি খুইলা রাস্তায় নামবে। কোনও মাইয়ারে অ্যাসিড মারলে লুঙ্গি খুইলা রাস্তায় নামবে। অ্যাসিড প্রতিরোধের কালচার অবশ্য সরকারই গইড়া দিসিলো। কিন্তু কথা সেইটা না। সমাজের কিছু মূল্যবোধ থাকে। সেগুলা লঙ্ঘন করা যায় না। করলে আর কিছু করা লাগে না, এমনেই সমাজ পাছা মাইরা দেয়। তুই দরকারেও মসজিদ ভাঙ্গতে পারবি না। রেপ করতে পারবি না। এগুলা স্বীকৃত অন্যায়। কেউ করলে সহজে জনমত গইড়া তোলা যায়। দেশের বিশ কোটি লোক কইবো, হ, কামডা অন্যায়। কিন্তু কালচার না বানাইতে পারলে জড়াজড়ি, হাত ধরাধরির অধিকার বিশ কোটি লোক দিবো না। এইখানে এক কোটি লোক আইসা আমাদের বিচার চাইলেও বাকি উনিশ কোটির অসন্তোষের ভাইবে সেইটা না মানলেও চলবো। সব আন্দোলনে প্রেশারটা আসে যারা উপস্থিত নাই, কিন্তু সমর্থনে আছে – তাদের পক্ষ থেকে। বুঝতেছো রাজনীতিটা?”
মাথা দোলালো জয়নাল। কথা তার মাথার ওপর দিয়েই যাচ্ছে আসলে।
“বুঝলা না? আজকে এইখানে আব্যডন প্রেমিকারে জড়াইয়া দেখাবে এইখানে তারা এইটুকুই করতে চাইছে, তার বদলে মাইরা এদের মেডিকেলে পাঠানো হইছে। এইটা পুরা সোসাইটির জন্য বড় একটা ধাক্কা। ওপেনে চুম্মাচাটি এই দেশে আজও হয় নাই। মাঠ ফাঁকা। ফাঁকা মাঠে বল জড়ায়া দিতেছে আব্যাডন। চেঞ্জ আইবোই। এই কাহিনির পর সোসাইটিতে বড় একটা চেঞ্জ আইবো। সেইটার সুযোগ নিতে পারলে পরিস্থিতিত আব্যাডনের পক্ষে যাইবো, নাইলে আমাগো পক্ষে। ব্যাটা সোসাইটির নৌকায় ঢেউ তুলতেছে। মানে, এই শালা শক্ত চুতিয়া। এই ধরণের মাতারি আমার পছন্দ না।”
বন্ধুর কাঁধে দুইবার টোকা দিলো জয়নাল, “রিল্য্যক্স। নিচের ফ্লোরে চল্লিশজন পোলাপানরে গাঁজা আর মদ দিয়া বসায় দিসি। দরকার হইলেই এরা বাইর হইবো। টাল হইয়া আছে সব, বোধবুদ্ধি থাকবো না তখন। মাইরা যারে যেখানে পাইবো শোয়ায় ফালাইবো। সবার আগে শোয়ানো হবে আব্যাডনরে। দরকার হলে সেইটা আমরা করুম। এলাকায় অশ্লীলতার অভিযোগ আনুম মিডিয়ার সামনে। জাস্টিসলীগ তো আর হবায় বইয়া থাকবো না। ওদিকে মোল্লারা সমর্থন দিবে। পলিটিকাল কারণেই দিবে, অবশ্য লোকজন ভাববে ধর্ম রক্ষায় হুজুরেরা এসব কইতেছে। তারা সহমত পোষণ করবে। যা ভাবে তারা ভাবুক। সমর্থন পাইলেই হইলো আমাদের।”
উঁকি দিয়ে আরেকবার নিচের মঞ্চটাকে দেখে নিলো রাহাত। ওখানে এখন মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছে আব্যাডন। ছেলেটা আজ ব্যাকব্রাশ করে বেরিয়েছে। এই প্রথম ছেলেটার কপাল দেখতে পেলো কেউ। গ্রীক দেবতাদের মতো দেখাচ্ছে তাকে।
কালো টিশার্ট আর কালো জিন্সের গ্রীক দেবতার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো রাহাত। গতকাল রাতে একে আর এর প্রেমিকাকে সরিয়ে র্যাবের কাস্টোডিতে রাখার কথা ছিলো। কিভাবে যেনো ফস্কে গেছে এটা। তাও ভালো, এর প্রেমিকাকে আসতে দেওয়া হয় নাই। দেখা যাক শালা কাকে জড়িয়ে ধরে।
***
নিচে তখন অনেকগুলো মাইক্রো আর কাভার্ড ভ্যান। এরা নানা চ্যানেলের প্রতিনিধি। ক্যামেরার সংখ্যা মনে হয় মানুষের থেকে বেশি। সবার দৃষ্টি মঞ্চের ওপরের গ্রীক দেবতার ওপর নিবদ্ধ। আব্যাডন আজকে যেমন আগুনের হল্কার মতো তীব্র গলায় মানুষের উদ্দেশ্যে কথা বলছে, তেমনটা বলতো বটে কেউ। বলতো অনেকগুলো বছর আগে একজন। তখনও জাস্টিস লীগের নাম ছিলো আগেরটাই। গ্রীক দেবতাদের মতো নেতা ছিলেন। তাদেরই একজন বলে আব্যাডনকে ভুল হতে পারে।
“পাছায় কাপড় দিতে না পারেন, পাছাটা কই ফালামু সেইটা ঠিক করতে আইসেন না।” তর্জনী উঁচিয়ে মাইকে হুঙ্কার ছাড়লো আব্যাডন, “দেশের অর্থনীতি, শাসননীতি আর শোষণনীতি নিয়া আমি দুই ঘণ্টা কথা বলতে পারি। কিন্তু সেইটা আমি করুম না। আমরা চাকরির অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকারের মতো ভারী ভারী জিনিসে যাইতে চাই না। আপনাদের ভোট দিয়া নির্বাচিত করা হইছে, অর্থাৎ এইসব জিনিস নিয়া আমরা আপনাদের ওপর আস্থা রাখছি। আপনারা যেইভাবে মন চায় দেশটা চালান।” আচমকা গলার লয় উঠে গেলো তার, “দেশ চালানোর স্বাধীনতা যেই রকম আপনাদের দিতেছি, তেমন আমরাও আমাদের জীবন চালানোর স্বাধীনতা নিমু। আপনারা দেশটা চালাইতে অধিকার পাইছেন, আমাদের চালানোর অধিকার কেবল আমাদেরই।”
লোকজন কোথা থেকে যেন আসছে। সাড়ে নয়টা বাজে। এর মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে মানুষ গিজগিজ করছে। এদের অনেকেই ছাত্র না। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের জুটিকেও দেখা যাচ্ছে। শাফিনের মন ভালো হয়ে গেলো। বর্ষাকে আজ শাড়িতে সুন্দর লাগছে। ওর আচল ধরে হাল্কা টান দিলো সে, “এই, দেখো। আংকেল-আন্টিরা পর্যন্ত চলে এসেছে। আমার কি যে ভালো লাগছে!”
বর্ষার রূপ বদলে গেলেও বক্তব্য পাল্টায়নি। মুখ বাঁকালো সে, “যে কোনও সময় দেখবা হাতুড়ি নিয়া আইসা পড়ছে জাস্টিস লীগের লোকজন। আন্টিরা তখন কি ঝামেলায় একটা পড়বে বুঝতেছো?”
“এই রিস্ক আছে জেনেই আসতেছে। সেজন্যই ভালো লাগতেছে।”
ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে যে কাজটা কখনও করা হয়নি, আজকে তাই করলো শাফিন। পরম মমতায় প্রেমিকার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলো। ঘটনা দেখে ত্রিশ ফিট দূরে দাঁড়ানো মিথুন মুচকি হাসলো। তার হাতে একটা সিগারেট। কেয়ার দিকে তাকালো সে, মেয়েটার মধ্যে কোমল এক স্নিগ্ধরূপ আছে। এটা সে আগে কেন কখনও খেয়াল করেনি? আজকের আগুনঝড়ানো কঠিন এক দিনে কেয়ার কোমল রূপ তার চোখে ধরা পড়ে কিভাবে? মানুষের মনস্তত্ত্ব কতোই না বিচিত্র উপায়ে কাজ করে। সিগারেটটা মিথুন ধরিয়েছে এই মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার মতো যথেষ্ট সাহস বুকের মধ্যে আনার জন্য।
সামান্য দূরে মাজহার আর তার দুই বন্ধুও সিগারেট ধরিয়েছে। ওরা এখানে আন্দোলনে যোগ দিতে আসেনি। ‘লাইভ’ কিস করার দৃশ্য দেখতে এসেছে। পরিচিতদের কেউ কেউ করবে। সেই দৃশ্য তো আর রোজ দেখা যাবে না। এমন অনেকেই এসেছে।
তরিকুল বললো, “মিল্কিকে স্লিভলেসে কি যে সেক্সি লাগতেছে। আমার উচিত ছিলো কালকে ওকে কিস-পার্টনার হওয়ার জন্য বলা। মাঝ দিয়া ছাগল তুহিন এসে ফ্লোর নিয়া গেলো।”
কাঞ্চন একমত হলো, “পাছাটা জোস।”
ওদের কেউ মনে করিয়ে দিলো না, এমন মন্তব্য ছুঁড়েই ওদের জীবন কেটে যাবে। অন্যদের নিয়ে গল্প করার অপার ক্ষমতা ছাড়া বিধাতা তাদের আর কোনও যোগ্যতা দেননি। চাইলে ওরা মিল্কি কিংবা পুনমের প্রেমিক হতে পারতো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারতো। মানুষকে ভালোবাসার, ভালোবাসা পাওয়ার মতো সুন্দর একটা ব্যাপারের সংস্পর্শে আসতে পারতো। প্রয়োজন ছিলো অন্যকে শ্রদ্ধা করার সামান্য এক গুণ। কিন্তু ভাগ্যদেবতা তাদের কপালে এই ছোট্ট গুণটুকু রাখেননি।
সাড়ে এগারোটায় শুরু করা গেলো আসল অনুষ্ঠান। অনেকে প্ল্যাকার্ড এনেছে। প্রেমিকার এক হাত, প্রেমিকের এক – দুই হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে অন্য দুই হাতে একে অন্যকে আলিঙ্গন করলো তারা। আজ বাংলাদেশ এমন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলো যা আগে কখনও ঘটেনি এই আকাশের নিচে। এটিএন বাংলার ক্যামেরাটা একেবারে নাকের সামনে, অথচ শাফিনকে আজ বড় মায়াময় মনে হলো বর্ষার। আঙুলের ডগায় ভর করে প্রেমিককে চুমু খেলো সে, চারদিকে তখন বৃষ্টির মতো নেমে এসেছে রৌদ্রচ্ছটা।
মাইকে আব্যাডনের বক্তব্য থেমে গেছে। ওপর থেকে এই অপরূপ দৃশ্যটি চোখ ভরে দেখতে থাকলো সে। সব বয়েসী জুটি একে অন্যকে আলিঙ্গন করছে। অতি সাহসীরা চুমু খাচ্ছে একে অন্যকে। মিথুন আর কেয়াকে দেখে ওর ভ্রু সামান্য উঁচু হলো। শালারা সুযোগে চুমু খেয়ে নিচ্ছে দেখা যায়! তাতে আব্যাডনের কিছু না। ওদের যদি ইচ্ছে করে একে অন্যকে খেতে, তো খাক। রিলেশনশিপে গিয়েই এসব করা লাগবে এমনটা কোন পাঠ্যবইয়ে লিখা আছে? সম্পর্ক সেন্সর করার সে কে? করলে তার সঙ্গে জাস্টিসলীগের পার্থক্য থাকলো কোথায়?
টিভি চ্যানেলগুলো পাগল হয়ে গেছে। তারা কোনটা ফেলে কোনটা কাভার করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আব্যাডন। কাজ হয়ে গেছে। এটা এখন থেকে পার্ট অফ দ্য কালচার। এর বিরুদ্ধে অনেক অনেক কথা হবে। তবে নতুন কিছু কালচারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য “বিরুদ্ধে অনেক অনেক কথা”ই প্রথম সাফল্য। যতো নিন্দিত হবে এই ইভেন্ট, ততোই সফল হয়ে উঠবে এটা।
পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম সেভাবেই সফল হয়েছে। কালচারে ঢুকেছে। সমাজের চোখে নিন্দিত হয়েই ঢুকেছে কালচারে। তারপর জনপ্রিয় হয়েছে সেই কালচার। এই ইভেন্টও হবে।
এই মতবাদে বিশ্বাসীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা যতো বেশি করা হবে, ততো দ্রুতই ছড়াবে এই বিশ্বাস। বড় বড় ধর্মগুলো ছড়িয়েছে অনুসারীরা পিটুনি খাওয়ার কারণে। আব্যাডন মানব মনস্তত্ত্বের গোড়ায় কুড়াল চালিয়েছে। এখন জাস্টিস লীগ তাদের ঠেকাতে পারবে না। কেউ পারবে না। এটা আপন গতিতে চলতে শুরু করলো এখানে, এই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে।
মঞ্চের ওপর থেকে সবকিছুই ভালো মতো দেখা যায়। খানিকটা পেছনে, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের দরজায় চোখটা পড়ে গেল তাই। অগোছালো ভঙ্গিতে কয়েকজন তরুণ বেরিয়ে এসেছে সেখান থেকে। আলিঙ্গনে ব্যস্ত ছেলেমেয়েরা এগুলো খেয়াল করেনি এখনও। আব্যাডনের মনে বিপদঘণ্টা ঢঙ ঢঙ করে বেজে উঠলো। ওটা কে? রাহাত না? নিষ্ঠুরতায় এই ছেলের জুড়ি মেলা ভার। শোনা যায় তপু স্যারের মাথা সে-ই ফাটিয়েছে। পুরো এলাকাটা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আব্যাডনের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো!
তার নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে নয়!
অনেকটা দূরে রিকশা থেকে নামছে একটা মেয়ে। টিশার্ট আর জিন্সে পরীর মতো লাগছে তাকে দেখতে। রেশমি চুলগুলো উড়ছে এলোমেলো বাতাসে। রেজিনের কয়েকটা চুল সাদা। রোদের উজ্জ্বলতা সাদা চুলগুলোয় সোনালি প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই মঞ্চ থেকে নেমে এলো আব্যাডন। পেছনে সারমেয় বাহিনী বিষয়টা লক্ষ্য করলো। তাদের হাঁটার গতি বেড়েছে। মূল লক্ষ্য শয়তানের পূজারিটা। শিকার পালিয়ে যাচ্ছে। রাহাত হুঙ্কার ছেড়ে তার কর্মীদের কিছু একটা বলছে। এতো কিছু শোনার সময় আব্যাডনের নেই। সামনে সময় টিভির একটা মাইক্রোফন, রিপোর্টারকে ধাক্কা দিয়ে নিজের পথ করে নিলো ও। কখন হাঁটার গতি বেড়ে দৌড়ে পরিণত হয়েছে নিজেও খেয়াল করেনি।
চুম্বনরত জুটিগুলোকে ব্যস্তভঙ্গিতে পার করলো সে। দৌড়ের গতিতে ব্যাকব্রাশের বাঁধন হারিয়ে কতোগুলো চুল নেমে এসেছে চোখের ওপর। কপাল আর গলার রগ ফুলে উঠেছে দুশ্চিন্তায়। গ্রীক দেবতারাও আব্যাডনের এই রূপ দেখলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। বয়ফ্রেন্ডের দিকে চোখ পড়ার পর চোখ নামিয়ে নিতে পারলো না রেজিনও। কিন্তু তার চোখে মুখে এমন আতঙ্ক ফুটে উঠেছে কেন?
প্রায় উড়ে গিয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো আব্যাডন। ঢুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো নিজের বুকের নিরাপদ আশ্রয়ে। রাহাতের হাতের হাতুড়িটা প্রায় সাথে সাথে সজোরে আছড়ে পড়লো গ্রীক দেবতার মাথায়। সময় টিভির লাইভ ফিডে বিশ কোটি মানুষ দেখতে পেলো গ্রীক দেবতারাও রক্তাক্ত হতে পারে!
একটার পর একটা হাতুড়ির বাড়ি এসে পড়ছে আব্যাডনের শরীরে। নড়ে নড়ে উঠছে লুসিফ্যান ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা। যন্ত্রণায়, কিংবা তাকে ছাপিয়ে একটা টোকাও যেন বুকের মধ্যে থাকা মেয়েটির শরীরে স্পর্শ না করে সেই লক্ষ্যে। রেজিনের পিঠের দিকে ছুটে আসা হাতুড়ির আঘাতটা ঠেকানোর জন্য ডান হাত বাড়িয়ে দিলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
গিটার-গডের চারটা আঙুল এতো বাজেভাবে ভাঙলো, ছেলেটা মনে হয় না আর কোনওদিন গিটার বাজাতে পারবে।
= পরিশিষ্ট =
স্টেশনে একটা ছেলে শক্ত করে জড়িয়ে আছে ছোট্ট গড়ণের এক মেয়েকে। ভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। মেয়েটি বাড়ি চলে যাচ্ছে। আসন্ন বিরহের আশঙ্কা তাদের দু’জনকেই আবেগাক্রান্ত করে ফেলেছে।
যত্ন করে কেয়ার চুলগুলো তার কানের পাশে গুঁজে দিলো মিথুন, “ভালোভাবে যেও।”
“তুমি সাবধানে থেকো, মিথ। পিঠের কি অবস্থা?”
গা ঝাড়লো মিথুন, “অতো জোরে লাগেনি। আব্যাডনকে নিয়ে ভয়ে আছি। অবশ্য শালার শরীর লোহা দিয়ে বানানো। ঠিক সেরে উঠবে।”
“জানি না রে। ভয় করে। চৌদ্দটা হাড় ভেঙ্গেছে ওর। চৌদ্দটা!”
“আব্যাডনের স্যাক্রিফাইসের জন্য আন্দোলনটা সফল হয়েছে, কেয়া। ঐ চৌদ্দটা হাড়ের মূল্য দিয়েই সে আমাদের স্বাধীনতা কিনে নিয়েছে। স্বাধীনতা কেনার জন্য মূল্য চুকাতে হয়। রক্তের, অস্থির।”
চোখ মুছলো কেয়া, “জানি।”
বিশ্বব্যাপী আব্যাডন-রেজিনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিলো। রেজিন পুরোপুরি সুস্থ আছে। তাকে নিজের সবটুকু দিয়ে রক্ষা করতে পেরেছিলো আব্যাডন। তার ওপর এমন অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে পারেনি প্রকাশ্যে আলিঙ্গন বিরোধী মানুষগুলোও। মিথুন যখন মার খাচ্ছিলো, দুই চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে সে দেখেছে কিভাবে মাজহারের মতো মেরুদণ্ডহীন একটা মানুষ তার আক্রমণকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মাজহারের জন্যই আজ স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সে। নয়তো মাজহারের মতোই পাঁচটা ভাঙা হাড় নিয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হতো!
দুঃসময় মানুষকে পাল্টে দেয়। অথবা, মূল্যবোধের ঠিক জায়গাটিতে কুঠারাঘাত।
সঠিক জায়গাটিতে কুঠারাঘাত করতে পেরেছিলো আব্যাডন।
গতকাল আদালত থেকে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে এই দেশে প্রকাশ্য চুম্বন আর আলিঙ্গনকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। একে অন্যের হাত ধরার অপরাধে আজ থেকে এই বাংলার মাটিতে কাওকে লাঞ্ছিত হতে হবে না।
অ্যাবাডনের জন্য নয়, ব্যাপারটা সম্ভব হয়েছে সময়ের দাবী পূরণ করার মাধ্যমে। নতুন একটা কালচার সৃষ্টি হোক, নষ্ট কালচার ভেঙ্গে ফেলা হোক – এমনটাই ছিলো সময়ের দাবী। সময় গড়ে নিয়েছে আব্যাডনের মতো একজন নেতা। আরেকজন গ্রীক দেবতা।
কেয়ার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হলো মিথুন। গভীর ভালোবাসায় এক স্টেশনভর্তি মানুষের সামনে চুমু খেলো তার ঠোঁটে।
“কি করছো?” চোখ মুছে জানতে চাইলো মেয়েটি।
“বিজয়ের চিহ্ন এঁকে দিলাম।” ওর চুল এলোমেলো করে দিয়ে মিথুন বললো।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে বাহনটিকে দূরে সরে যেতে দেখলো মিথুন। ও জানে, সংস্কৃতির এই ট্রেনের মতোই। এগিয়ে যাবে সব সময়। স্থির হয়ে রইবে না। যখনই তা অকার্যকর হয়ে উঠবে, তপুর মতো কেউ মার খাবে, জন্ম নেবে আব্যাডনের মতো গ্রীক দেবতারা।
মানুষ জিতবেই!
#মানুষ_জিতবেই
রচনা : ১৫ই জুলাই, ২০১৮
(কিশোর পাশা ইমন)

** পরে এই গল্পের ছায়া অবলম্বনে আরো ৪টি গল্প, আমার জানামতে অন্যরা লিখেছেন, গল্পটা তাদের এতই ভালো লেগেছিলো। আমি এই গল্পটি এখনো কোনো বইয়ে ছাপাইনি, তবে তারা তাদের ওসব গল্প নানা বইপত্রে ছাপিয়েছেন। কেউ কেউ ক্রেডিট দিতেও ভুলে গেছেন।

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *