হোয়াট ইজ লাইফ
ড্রয়ারে একটা পিস্তল লুকিয়ে রেখেছি। খেলনা না, আসল পিস্তল। কালোবাজার থেকে দশ হাজার টাকা দিয়ে কেনা। পিস্তলটা অবশ্য আমি কিনিনি, আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োজন পড়ে এমন কার্যক্রমে কখনোই জড়িত ছিলাম না। এটা কিনেছে বন্ধু শওকত। বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে ধার নিতে হয়েছে কেবল।
রাত সাড়ে চারটা বাজে, একটু পর ভোর হয়ে যাবে। সিঙ্গেল খাটটার দিকে একবার তাকালাম। রাত অনেক হলেও ওই খাটে পিঠ ছোঁয়াতে স্পৃহা হয়নি। ওখানে এখনও নাবিলার ঘ্রাণ লেগে আছে। কি দরকার শুধু শুধু মিষ্টি গন্ধটা নষ্ট করার? এরচেয়ে শক্ত এই চেয়ারটাই ভালো। সিগারেটের প্যাকেটের সাথে পাল্লা দিয়ে শেষ হচ্ছে রাত।
নাবিলা আমার প্রেমিকার নাম। মানে, প্রেমিকার নাম ছিলো। সম্পর্কটা শেষ হয়েছে ঠিক এগারো ঘণ্টা চৌত্রিশ মিনিট আগে। আমিও করিৎকর্মা মানুষ। এর মধ্যেই পিস্তল জোগাড় করে ফেলেছি। টানা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি ঠিক, তবে এর সঙ্গে বিরহী যুবক মনস্তত্বের সম্পর্ক কম। পরিকল্পনার ছক কাটতে কাটতে সিগারেট খাওয়া আমার পুরানো অভ্যাস।
প্যাকেট খুলে একটু দেখলাম। একটা মাত্র সিগারেট পড়ে আছে। উঠে বিছানা পর্যন্ত গেলাম, হাঁটু গেড়ে ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে একটু গন্ধ নিলাম। তামাকের কটু গন্ধ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। বালিশের মধ্যে নাক ডুবিয়ে দিতে অবশ্য নাবিলার চুলের পরিচিত গন্ধটা পাওয়া গেলো।
এগারো ঘণ্টা আগে ওর গলার সামান্য নিচে চুমু খেয়ে জানতে চেয়েছিলাম, “এই শেষ। তাই তো?”
অভ্যাসের বশেই হয়তো, আমাকে জাপ্টে ধরে কোমল গলায় বলেছিলো, “হুঁ।”
নাবিলার বুকে মাথা রেখে হঠাৎই আবেগাক্রান্ত হয়ে গেছিলাম তখন। বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলাম, “যেও না। এখানেই থেকে যাও। যাওয়ার কি দরকার?”
আমার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ও। এটুকু নিশ্চিত, মেয়েটার চোখে পানি দেখেছিলাম আমি।
কিছুই বলেনি, বা বলতে পারেনি। শুধু মাথা নেড়েছিলো আলতো করে।
একরুমের বাসাটার ভেতর অস্থির হয়ে পায়চারি করতে করতে মাথা থেকে স্মৃতিগুলো দূর করে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এসব এখন ভাবাই যাবে না। দুর্বলতার সুযোগ নেই আর, যে কাজটা করতে যাচ্ছি তার জন্য হলেও শক্ত হতে হবে আমাকে।
নাবিলার বিয়ে ঠিক করে ফেলা হয়েছে। বাবা-মা সন্তানকে সামান্য হলেও চেনেন। নাবিলার মন যে উড়ু উড়ু সেটা বোঝার জন্য অবশ্য বাবা অথবা মা হওয়ার দরকার ছিলো না। এই মেয়ে অভিনয়ে একেবারেই কাঁচা। কাজেই দায়িত্বশীল বাবা-মার যা করা উচিত তাই করেছেন।
পাত্র পক্ষের সঙ্গে কথা পাকা করে বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে সেই কার্ড বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। নাবিলার পাত্রভাগ্য ভালো। বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রকে বর হিসেবে পাচ্ছে। নামকরা এক কোম্পানিতে আছে ওই ছেলে। পাঁচ বছর আগে পাশ করেছে, এখনই নাকি বেতন লাখের ওপরে।
বাইরে ভোরের আলো ফুটেছে, জানালা ভেদ করে আভা টের পাওয়া যায়। ড্রয়ার থেকে পিস্তলটা বের করলাম। একটা বাদে আর সব বুলেট রেখে দিলাম ওখানেই। পিস্তলটা যত্ন করে কোমরে গুঁজে নিচ্ছি। আমার পরিকল্পনা সহজ এবং সাধারণ।
একজন এক্স-বুয়েটিয়ানকে খুন করে লাশটা গুম করে ফেলা।
২.
কিছু কিছু মানুষ ইঁদুরের মতো হয়। গর্তে ঢুকে বসে থাকে। গর্ত থেকে বের হলে দুই পা খুলে চলাফেরা করে। চোখের পলক ফেলার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যায়। সেই গন্তব্যও হয় আরেক গর্ত। খোলামেলা জায়গায় এদের পাওয়াই যায় না।
নাবিলার হবু বরটাও এরকম একজন ইঁদুর। বাড়ি থেকে বের হয়, তিন মিনিটের মধ্যে মাঝারি আকারের এক রাস্তায় চলে আসে। ওই মোড়ে সব সময় রিকশা থাকেই, লাফিয়ে এক রিকশায় উঠে যায়। তারপর লোকাল বাস ধরে। বাস তাকে অফিসের সামনে নামিয়ে দেয়। সুড়ুৎ করে অফিসে ঢুকে পড়ে সে। একবারের জন্যও এসি রুম থেকে বের হয় না। অফিস টাইম শেষ হতেই পুরানো রুটিন মেনে আবারও বাড়ি। মানুষটা এতোই বোরিং, চায়ের দোকানে-টোকানেও যায় না। আনমনে ঘর থেকে বেরও হয় না। রাস্তায় হাঁটার সময় ফেসবুক ব্রাউজও করে না। পুরোপুরি নিরামিষ।
নিরামিষটাকে তিনদিন ধরে ফলো করলাম। এর পর এক শুক্রবারও পড়লো। ইঁদুরটা গর্ত থেকে মাথা বের করলো না। কপালফেরে তার বাড়ির দশ গজ দূরেই মসজিদের দরজা। দুপুরে একবার সুড়ুৎ করে নামলো। চোখের পাতা ফেলার আগেই মসজিদে ঢুকে গেলো। কিছুক্ষণ পর চোখের পাতা ফেলার আগেই ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন। একজন মানুষ বিয়ের মাত্র এক মাস আগেও এমন ডালভাতের মতো জীবন যাপন করতে পারে এই লোককে না দেখলে আমার বিশ্বাসই হতো না।
শওকতের সাথে আরেকবার দেখা করতে হলো। নতুন একটা লাইসেন্সপ্লেট কিনে দিতে হলো, সেটা নিজ হাতে ওর গাড়িতে সেট করতে হলো, এতোকিছুর পর গাড়িটা ব্যবহারের অনুমতি দিলো আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। এরচেয়ে তার ড্রাইভারকে পাওয়াই সহজ হলো বেশি। ড্রাইভার ইউনুস শওকতের প্রায় সব অকাজ-কুকাজের সাক্ষী। ধার করা এই পিস্তলটা দিয়ে সে যেসব মহান কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছে, বেশিরভাগ সময় ড্রাইভ করে তাকে সেসব জায়গায় এই ইউনুসই নিয়ে গেছে। কাজেই বিশ্বস্ত লোক।
শুভ কাজে নাকি দেরি করতে নেই। নাবিলার হবু বরই সেটা করছে না। আমি কেনো করবো?
রবিবার সন্ধ্যায় কালো রঙের একটা গাড়ি মোটামুটি নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো এক্স-বুয়েটিয়ানের রোডে। সামনে ড্রাইভারের সিটে বসে ফক ফক করে ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত ইউনুস হঠাৎ বললো, “বেয়াদবি না নিলে একটা কথা কইতাম ভাই।”
আমিও উদার কণ্ঠে বললাম, “বলে ফেলো। কথা কখনো জমায়া রাখবা না। চাপা স্বভাবের মানুষের প্রেশারের রোগ হয় বেশি।”
অভয় পেয়েও বার কয়েক গলা খাঁকারি দিলো ইউনুস। তারপর বললো, “কেসটা ভাই মশা মারতে কামান দাগার মতো হইয়া যাইতেছে। আমারে কইলেই ভাবীর বাপ-মায়েরে টাইট দেওনের ব্যবস্থা কইরা দিতাম। দুইদিনের মধ্যে বাপ বাপ কইয়া আপনারে প্রস্তাব দিতে আইতো।”
ইউনুসের কথা অযৌক্তিক না। শওকতের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। ভবিষ্যতে এমপি-টেমপি হয়ে যেতে পারে। উঠতি রাজনীতিবিদের সকল কুকর্মের সাক্ষী ড্রাইভারের হাতে খানিকটা ক্ষমতা থাকবে না এটা কি করে হয়? কিন্তু তার দরদকে আমি পাত্তাই দিলাম না। বরং গরম হয়ে গেলাম।
“এইটা তুমি বেয়াদবের মতো একটা কথা কইলা, ইউনুস। বিশাল একটা বেয়াদবী কইরা ফালাইলা।”
আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে আমার দিকে তাকালো ইউনুস, “সরি ভাই-”
“তুমি নাবিলার বাপ-মারে অপমান করবা, আর সেইটা আমি তোমারে করতে দিবো ভাবলা ক্যামনে?”
“পোলাটার বাড়িতে একটা ফোন দিলেই তো-”
“আরে তুমি কেসটা বুঝোই নাই। তোমার মাথায় এইসব ঢুকবো সেইটা অবশ্য আশা করিও নাই।”
ইউনুস চুপ হয়ে গেলো।
“নাবিলার বাপের তিনটা ইন্ডাস্ট্রি আছে, সেইটা তো জানো।”
ইউনুস এবারও কোনো কথা বললো না।
“তার বিয়ের খবরটা মনে হয় ইন্ডিয়া আমেরিকা সব জায়গায় চইলা গেছে। দাওয়াত পাইয়া অনেকে প্লেনের টিকেটও কাইটা ফালাইছে। এইখান থেকে বিয়ে ক্যানসেল করার প্রশ্নই আসে না। ক্যানসেল হইলে নাবিলার মান সম্মান যাইবো না? ওর পরিবারের ইজ্জত যাইবো না? বুঝলা তো?”
ইউনুস শুধু মাথা দোলালো।
বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে আবারও বললাম, “তা বুঝবা ক্যামনে? নিজের পরিবারের তো চালচুলা নাই।”
ইউনুসের শরীর শক্ত হয়ে গেছে। আমার অপমানটা গায়ে না মেখে শুধু বললো, “হালার ভাইরে দেখতে পাইছি ভাই।”
বিশ সেকেন্ডের মাথায় জনৈক প্রকৌশলী মাহবুব চৌধুরীর সামনে কালো রঙের একটা গাড়ি থামলো। দরজা খুলে ভীষণদর্শন এক যুবক চকচকে এক পিস্তল নিয়ে নেমে তাকে খুব কাছে থেকে তাক করে বললো, “গাড়িতে উঠে পড়ুন।”
বার দুই ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকালো মাহবুব। গলিটা সন্ধ্যার আঁধারে ঢাকা পড়েছে। মানুষও তেমন দেখা যাচ্ছে না। দৌড় দেওয়ার ইচ্ছেটা ক্ষণিকের জন্য মাথায় এসেছিলো, তবে সেই সাহসটাও করতে পারলো না সে।
আরও দুইবার ঢোক গিলে ভয়ঙ্কর লোকটার সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসলো মাহবুব চৌধুরী।
গাড়ির ভেতরে ঢুকে একবার জানতে চাইলো, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
কোনো কথা না বলে ঠোঁটের কাছে আঙুল তুলে দেখালাম, ’চুপ!’
ইউনুস ডাকাত ডাকাত একটা অভিব্যক্তি মুখে ফুটিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে এখন। পেছনের সিটে মাহবুবের পাশে পিস্তল বাগিয়ে বসে আছি আমি। রীতিমতো গুরুগম্ভীর পরিবেশ। তার মধ্যেই বেরসিক লোকটা বলে উঠলো, “ভাই, আমাকে ছেড়ে দেন। যতো টাকা লাগে আপনাদের দিয়ে দিবো। কসম খোদার।”
এই উজবুকের সাথে নাবিলা ঘর করতো কি করে?
শক্ত গলায় শুধু বললাম, “আরেকবার কথা বললে টাকা তোমার হুজ্ঞির মধ্য দিয়ে মুচড়িয়ে মুচড়িয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে।”
অবশেষে গাড়ির ভেতরে পিনপতন নীরবতা প্রতিষ্ঠিত হলো।
৩.
জাহিদভাইয়ের কসাইখানায় বসে আছি। ইউনুস একটু বাইরে গেছে, সিগারেট কিনতে। সামান্য দূরে দুইজন মানুষ কবর খুঁড়ছে। এদের আমি চিনি, শম্ভু আর বগা। টাকা পেলে এরা মায়ের জন্যও কবর খুঁড়ে দেবে। তবে সচরাচর মায়ের জন্য নয়, শওকত আর তার দলের জন্য কবর খুঁড়ে অভ্যস্ত ওরা। মাঝে মধ্যে বিরোধী দলীয় নেতা-নেত্রী গুম হয়ে যায় বলে খবরে আসে। এদের সবাই সামনের চার কাঠার বাগানের এখানে ওখানে শুয়ে আছে। জায়গাটার ফর্মাল নামই ওই, “জাহিদভাইয়ের কসাইখানা”।
আজকে রাতের জন্য যে টাটকা কবরটা খোঁড়া হচ্ছে সেটায় পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে অধি-শায়িত হবে আমাদের বিশেষ অতিথি প্রকৌশলী মাহবুব চৌধুরী। নাবিলাকে যে লোকটা এক মাস পরে বিয়ে করতো। দোতলার জানা দিয়ে আমরা কবর খোঁড়া দেখছি। নিজের কবরের দিকে তাকিয়ে মাহবুব নামের লোকটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার দিকে জায়নামাজ আর টুপিটা এগিয়ে দিলাম।
“নামাজ পড়তে চাইলে পড়তে পারো। অনেকেই মরার আগে দুই রাকআত নামাজ পড়তে চায়। ফরজের খবর নাই।”
মাহবুব নামাজ পড়তে চাইলো না। তার ফোঁপানির শব্দ আরও বেড়েছে।
“তোমার জন্য আতরও নিয়ে এসেছি।”
ভেবেছিলাম আতর পাওয়ার খবর শুনে বিশেষ পুলকিত হবে, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা গেলো না। একমনে ফোঁপাচ্ছে। এতো বোরিং মানুষ খোদার দুনিয়ায় এই শতাব্দিতেও আছে সেটা এই লোককে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। তবে প্রকৃতি নিয়ম মেনে চলে, বোরিং এই মানুষটা আর বেশিক্ষণ এই দুনিয়ায় থাকছে না।
“চাইলে কুরআন শরীফও পড়তে পারো।” দেওয়ালের তাকে সাজানো বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের দিকে দেখালাম। বাইবেল, ত্রিপিটক, কুরআন সবই আছে। নানা ধর্মের লোক এখানে আসে, গুম করে ফেলার আগে এই ঘরে সবাইকেই আনা হয়। তাদের ধর্মগ্রন্থ পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এখানে কিছুক্ষণ হাত পা খোলা রাখা হয় বন্দীকে। বাইরে তিনজন সশস্ত্র গার্ড আছে, কাজেই এটা কোনো সমস্যা নয়। তবে মাহবুব চৌধুরীর মধ্যে পরকালের ভীতির চেয়ে মৃত্যুভীতিই বেশি দেখা যাচ্ছে। সে তওবা করার কোনো সুযোগই নিচ্ছে না।
“ভাই, আমার অপরাধটা বলবেন, প্লিজ?” আমার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় জানতে চাইলো মাহবুব। আমার একটুও মায়া হলো না। এই মানুষটা না থাকলে আজও নাবিলা আমারই থাকতো। পুরাতন সেই নাবিলা। ধনীর দুলালি হয়েও আমার জন্য আমার লাইফস্টাইলে চলাফেরা করতে শেখা নাবিলা। সুযোগ পেলেই আমার একঘরের ভাড়া বাসাটায় নিজেকে উজার করে দেওয়া সেই নাবিলা। ওই মেয়েটাকে আমি চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলতে চলেছি। সামনে বসে থাকা পানি চোখে সর্দি নাকে এই বিচ্ছিরি কিসিমের মানুষটা সেজন্য দায়ী।
তার অস্তিত্ব থাকলে আমার জীবনে নাবিলার অস্তিত্ব ত্থাকবে না। বিষয়টা এতোটাই সহজ।
“আমি তো কোনোদিনও কারও ক্ষতি করি নাই ভাই। আমার সাথে কেনো এরকম হচ্ছে?”
তারদিকে একটা তসবীহও এগিয়ে দিলাম, “চাইলে জিকিরও করতে পারো।” জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, “কাজ প্রায় শেষ ওদের। চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই কবর সাইজ করে দিতে পারে ওরা। দারুণ কাজের লোক।”
“অফিসেও কোনো শত্রু নাই আমার, ভার্সিটিতেও কারও সাথে শত্রুতা ছিলো না-” প্রলাপ বকার মতো বলে যাচ্ছে সে। বিরক্ত হয়ে তসবীহটা নামিয়ে রাখলাম।
“বাব্বা! স্বয়ং জরাথুস্ট্র! শত্রু ছিলো না, মহাত্মা গান্ধিজিও এই কথা শুনলে বুক খুলে দেখিয়ে দিতেন। বুঝলে? তার বুকেও তিনবার গুলি করা হয়েছিলো।”
“সত্যি বলছি ভাই-”
এবার বিরক্তির বদলে কৌতুক অনুভব করলাম।
“ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিলে নাকি?”
অবাক হয়ে গেছে মাহবুব। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
“আরে তোমার ব্যাংক ব্যালান্স জিজ্ঞাসা করি নাই। প্রশ্নটা সহজ। তোমাদের সময় স্কুলে ফাইভ আর এইটে বৃত্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিলো। ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিলে?”
“জ্বি…”
“ট্যালেন্টপুলে, না সাধারণ গ্রেডে?”
“ট্যাল-ট্যালেন্টপুলে-”
“ক্লাস এইটে?”
“জ্বি পেয়েছিলাম।”
দুই ভ্রু উঁচু করে ফেললাম, “ট্যালেন্টপুলে, আই গেস?”
“জ্বি।”
কান পর্যন্ত চওড়া হাসি উপহার দিলাম তাকে, “তারপর এসএসসিতে গোল্ডেন, নিশ্চয়?”
“জ্ব-”
“এইচএসসিতেও গোল্ডেন। তাই না?”
“জ্বি ভাই।”
“বুয়েটে পড়াশোনা। সিজিপিএ কতো ছিলো?”
“থ্রি পয়েন্ট নাইন সিক্স।” কাঁপতে কাঁপতে বললো সে।
আমার ইচ্ছে করলো, পাশের অ্যাটাচড বাথে ঢুকে ঠিকমতো ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতে। এই নিরামিষটাকে এতোক্ষণ দোষারোপ করে বড্ড ভুল করে ফেলেছি। এ তো দেখছি মানুষ না, পুরোদস্তুর একজন আঁতেল!
“হায়ার স্টাডির জন্য জার্মানি গেছিলে। পিএইচডি কমপ্লিট করতে কতো বছর লেগেছে?”
“সাড়ে… সাড়ে তি-” একটু কাশলো মাহবুব, “সাড়ে তিন বছর-”
তসবীহটার দিকে তাকালাম। তুলে নিয়ে জপতে শুরু করবো নাকি? সাড়ে তিনবছরে একজন মানুষ… মাথা থেকে জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিলাম।
“পড়াশোনা বাদ দিয়ে জীবনে আর কিছু করেছো?”
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো লোকটা।
“প্রেমও করো নাই? স্কুল কিংবা কলেজে?”
মাথা নাড়লো সে, “জ্বি না।”
“ভার্সিটিতে উঠেও না?”
“জ্বি না।”
“জার্মানিতে গিয়েও না?”
“জ্বি না, ভাই।”
“প্রেম করলে পড়াশোনায় ক্ষতি হয়। তাই তো?”
চোখের পানি মুছলো মাহবুব। তাকে এখন অনেকটাই সহজ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
“জ্বি, সেটা বলতে পারেন। আসলে, এভাবে ভাবিনি কখনও। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট পজিশন ধরে রাখা একটু কঠিন কাজ। অন্যদিকে মন দিলে সেটা হয় না-”
“তাহলে তুমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ছিলে…” বলেই নিজেকে গালি দিলাম মনে মনে, “থ্রি পয়েন্ট নাইন সিক্স। মেকস সেন্স। বলে যাও, জীবনটা আর কি কি বোরিং কাজে ব্যয় করেছো সেই ফিরিস্তি শুনি। কবরটা ততোক্ষণে খোঁড়া হোক। নামাজ-কালাম যখন পড়বা না, পুরোনো কাসুন্দিই ঘাঁটো।”
জানালা ভেদ করে একবার বাইরে তাকালেও তার চেহারায় আর পরিবর্তন এলো না। ভবিতব্য মেনে নিয়েছে, তেমন নয় বিষয়টা। আসলে এসব যে বাস্তবে ঘটছে সেটাই সে বুঝতে পারছে না। একধরণের শকের মধ্যে আছে।
তাকে মুখ খোলাতে প্রশ্ন করলাম, “জীবন তো উপভোগ করোনি কখনও। এভাবে একটা মানুষ কি করে বাঁচে?”
কাঁধ ঝাঁকালো সে, “দেখুন, এইচএসসির পর আমার মনে হতো বারো বছর ধরে পড়াশোনা করেই যাচ্ছি। এক যুগ ধরে। আর চারটা বছর ভালো করে পড়াশোনা করবো না? এতো ভালো করে এসে শেষ সময় খারাপ করলে আমার বিগত বারো বছরের সাধনা পানিতে পড়ছে।”
“সত্য বচন। খুবই সত্য বচন। তোমাকে ক্যাম্পাসে আঁতেল বলে ডাকা হয়নি এমন একটা দিনও কি ক্যালেন্ডারে এক্সিস্ট করে?”
অপমানটা গায়ে না মেখে বলে চললো মাহবুব, “তা তো বটেই। এসব গায়ে না মাখা শিখতে হয়েছে। ওদের জন্য তো আর আমার বারো বছরের সাধনা বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না।”
“বুয়েট থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে বের হলে। তারপরও তো জীবন উপভোগ করোনি।”
গাল ঘষলো মাহবুব, জানালার দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখলো। “ভালো স্কলারশিপ পেলাম, পছন্দের বিষয়ে কাজ করার সুযোগ। ভাবলাম ষোলো বছর ধরে পরিশ্রম করছি, আর চারটা বছর কেনো নয়-”
“তারপর দেশে ফিরে লাখ টাকা বেতনের চাকরি জোটানোর দেড় বছর পর তোমার মনে হলো এই ত্রিশ বছর বোরিং লাইফ কাটানোর পর ভরাট যৌবনের এক তেইশ বছরের সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে। সারাটা জীবন যেভাবে কাটিয়েছো তার পর কি তোমার এরকম একটা মেয়েকে ডিজার্ভ করা উচিত? তোমার মতো বোরিং একটা মানুষ কি সেটা ডিজার্ভ করে?”
থতমত খেয়ে মাহবুবের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেলো। আবারও ঘামছে সে। ঘন ঘন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দেখছে। ওখানে একমনে কবর খুঁড়ে চলেছে শম্ভু আর বগা।
“তোমার মতো মানুষগুলো মনে করে সবকিছু পড়াশোনা করে যোগাড় করে ফেলা যায়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে তুমি পড়াশোনা করে অনেক কিছু হয়তো দিয়েছো, মাহবুব, কিন্তু একজন মানুষকে সঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার জন্য তোমার বিশ বছরের পড়াশোনা একটা চুল পরিমাণও মূল্য রাখে না। এই সহজ সত্যটা তুমি কি কোনোদিনও দেখতে পাওনি?”
“আমি কাওকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে-”
“আরে বাল, তোমার সম্মান চাইছে কে এই জগতে? সব কি টিচার-স্টুডেন্ট রিলেশনশিপ নাকি দুনিয়ায়?”
আবারও চুপ হয়ে গেছে মাহবুব। আমার মেজাজ উত্তরোত্তর গরম হতে থাকে।
“তুমি একজন ধইঞ্চা। বিশ বছর ধরে পড়াশোনা করেছো। এতো সিরিয়াস হয়ে কাজটা করেছো যে কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাওনি। তারপর হুট করে একদিন তোমার মনে হলো, এবার জ্ঞানার্জন শেষ। ভালো ঘরের কোনো মেয়ের বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠাবে। আর মেয়ের বাবা তোমার জ্ঞানের কাছে তার মেয়ে বিক্রি করে দেবে। তোমার মনে হয় এই পুরো প্রসেসটা ফেয়ার?”
ঢোক গিললো মাহবুব।
“তোমার কি মন হয় একজন তেইশ বছরের মেয়েকে তুমি ডিজার্ভ করো?”
আবারও ঢোক গিললো মাহবুব।
“তুমি একটা প্রেম করার ক্ষমতা রাখো না। একটা মেয়ের মন জয় করার ক্ষমতা রাখো না। এটা তুমি মনের ভেতর থেকে জানো মাহবুব। কারণ সারা জীবন কোনো মেয়ের দিকে সরাসরি তাকাওনি, চোখে চোখ পর্যন্ত রাখোনি। তোমাদের টাইপটাকে আমার চেনা আছে। আজীবন বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে রাখবে, মেয়েদের ব্যাপারে শতভাগ অনভিজ্ঞ, একটা মেয়ের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো বুকের পাটা পর্যন্ত নেই, অথচ বিশাল ডিগ্রি নিয়ে বিশাল স্যালারির বেতন হাতে পেয়ে কচি কচি মেয়েদের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। মেয়ের মনের সাথে না, ডিল করবে মেয়ের বাবার সেন্টিমেন্টের সাথে। ওই অতটুকুই যোগ্যতা থাকে তোমাদের। বিজনেস ডিলে বেশ পাকা হয়ে ওঠো তো। এভাবে একটা মেয়েকে বিছানায় যে তোমরা তোলো, লজ্জা করে না তোমাদের?”
মাহবুব কুঁকড়ে গেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, নতুন খোঁড়া কবরটার পাশে দুটো বেলচা চিক চিক করছে। কোনো মানুষ নেই সেখানে।
“তোমাদের উচিত ত্রিশ বছর যেরকম মেয়েবিহীন থেকেছো বাকি জীবনটাও এরকম থেকে যাওয়া। জীবন যদি জ্ঞানার্জনে ডেডিকেট করেই থাকো, সঙ্গিনী জোটানোর প্রচেষ্টাই বা কেনো? আর যদি সঙ্গিনীর প্রয়োজন হয়েও থাকে, সমানে সমান কাওকে বেছে কেনো নিচ্ছো না?”
কোমর থেকে পিস্তল খুলে হাতে নিলাম। এর মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হবে বলে মনে হয় না।
“কারণ, কচি মেয়েকে নিয়মিত বিছানায় পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে কোনো পাকা ব্যবসায়ীই সমবয়সী মেয়েকে নির্বাচন করবে না।”
দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ হলো। তারপর শম্ভু আর বগা মুখ ঢুকিয়ে দিলো। কালো কালো মুখ দুটো পাথরের মতো।
“সার, কাজ শ্যাষ।”
“টাকা নিয়া যাও মিয়ারা। পাশের রুমে একটু বসো। শালার পুতেরে ফাইরা আইতাছি আমি।” ওদের নেটিভ টাং ব্যবহার করে বললাম। ঘুরে তাকালাম মাহবুবের দিকে, “চলো চলো। কবর খোঁড়া হয়ে গেছে। তোমার বিয়ে করার খুব সখ না? সেই সখ মিটিয়ে দেওয়ার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছে।”
সিনেমার ভিলেনদের মতো একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নরকের কীটটার প্যান্ট খারাপ করে ফেলতে হবে। মরার আগে যতো বেশি ভয় পাবে সেটুকুই আমার বোনাস। এই ছেলে নাবিলাকে ডিজার্ভ করে না। তারপরও বামুন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ালো কেনো?
মাহবুব নড়ছে না দেখে ওর কলার খামচে ধরতে হলো আমাকেই। টেনে সরিয়ে আনলাম চেয়ার থেকে। দরজা দিয়ে বের হওয়ার পর পেছনে তিনজন সশস্ত্র প্রহরীও আমাদের সঙ্গে আসতে থাকে। নড়তেই চাচ্ছে না মাহবুব, প্রায় হেঁচড়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। সে জানে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি আমি।
তার জন্য গত চল্লিশ মিনিট ধরে খোদা হয়েছে, এমন একটা কবরে!
“ভাই আমি উনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেই নাই ভাই-” পাগলের মতো চিৎকার করছে সে, “শরাফত আংকেলই আমার বাবাকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন- আপনি জিজ্ঞাসা করে দেখুন প্লিজ… আমি উনাকে প্রস্তাব দেই নাই ভাই-”
টানতে টানতে বাগানে নিয়ে এলাম ওকে। খোলামেলা একটা জায়গা এটা। গাজীপুরের টিঅ্যান্ডটি অফিসের সামান্য দূরে। এখনও বসতি গড়ে ওঠেনি। গুলি করে দিলেও খুব বেশি মানুষ শুনতে পারবে না। যারা শুনবে তারা গুলির শব্দ বলে এটাকে চিনতে পারবে বলে মনে হয় না।
“প্রস্তাবটা ভালো ছিলো দেখে বাবা রাজি হয়ে গেছিলো-” জানোয়ারটা এখন বার বার মাটিতে বসে পড়ছে, টেনে হেঁচড়ে মাটির ওপর দিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে আমার দম বেরিয়ে যেতে থাকে। শালা নাকি আবার দেশের শীর্ষ মেধাবী সন্তান। এই দামড়া শরীর নিয়ে একটা মেয়েও পটাতে পারেনি সারা জীবনে। “ভাই আমাকে প্লিজ ছেড়ে দেন। ভাই আমি এতো গভীরভাবে বিষয়টা ভাবি নাই- ভাই-”
ছোট ছোট ঘাস বাগানে। তাই মুঠো করে ধরে ফেলার চেষ্টা করলো মাহবুব। কবরের দিকে যেতে মহা আপত্তি। বিরক্তি হয়ে কলার ছেড়ে দিলাম। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলো লোকটা। দমাদম পিস্তলের বাট দিয়ে মুখে মারলাম তারপর। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানের মুখের এখানে ওখানে ফুলে গেলো সাথে সাথে। দরদর করে রক্ত বের হয়ে এসেছে। ইশারা করতেই বাকি তিনজন ওকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।
বাকি তিনজন ওকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে সদ্য খোঁড়া কালো আর অন্ধকার কবরটার দিকে।
কবরের গর্তে মাহবুবকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো। ইঁদুরকে পানিভর্তি বাটিতে ফেলে দিলে তারা যেভাবে দ্রুত সাঁতড়ে বাটির কিনারায় ওঠার চেষ্টা করে, ঠিক তেমনটাই করে যাচ্ছে মাহবুব। হাঁচড়ে পাঁচড়ে কবর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। এই দৃশ্য ওদের তিনজনের কাছে নতুন নয়। বেলচা নিয়ে প্রস্তুত তারা, উঠতে গেলেই বাড়ি মেরে কবরে ফেলে দিচ্ছে তাকে।
কবরের লম্বা এক কিনারায় দেবদূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। পিস্তলটা সরাসরি তাক করেছি একজন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্টের দিকে।
“তওবা করে নাও, মাহবুব। সব কিছু খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।”
ধপ করে কবরের ভেতরের নরম মাটিতে বসে পড়লো লোকটা, ক্ষত বিক্ষত মুখটা আর চেনা যাচ্ছে না।
“বিশ বছরের পরিশ্রম…”
সামনে বসে থাকা ভীষণ আহত মানুষটার প্রকৃত চেহারা ঠিক তখনই আমার চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কোম্পানির প্রচারের প্রচারের জন্য সস্তায় বিক্রি করা এনার্জি বাল্বের মতো সব কিছু আলোয় উদ্ভাসিত। এই লোকটা সারাটা জীবন পরিশ্রম করে গেছে একদিন প্রাপ্য পুরষ্কার হাতে ওঠানোর জন্য। শস্য বোনার সময় কৃষক মাঠে যে কারণে কঠোর পরিশ্রমের প্রেরণা পায়, একদিন ফসল উঠবে ঘরে। সে পরিশ্রম করে গেছে, জ্ঞানার্জন করে গেছে, কারণ তাকে সবাই শিখিয়েছে এটাই সঠিক জীবন।
সে আঁতেল হয়েছে। জীবনের সব সুখ-আহ্লাদ ত্যাগ করেছে ছাত্রজীবনের দোহাই দিয়ে। এই কঠোর তপস্যায় তার ব্যক্তিসত্তা আত্মসমর্পণ করেনি। বরং তাকে সেভাবে গড়ে নিয়েছে সমাজ।
দিনগুলো ফিরে এলো আমার স্মৃতির ভিড়ে। একটা সময় এই পথে হেঁটেছি আমিও।
হাঁটতে হয়েছে। সমাজ আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। কিভাবে জীবন গড়ে তোলা উচিত তা শিখেছি, কিভাবে জীবনটাকে একটা যুদ্ধ বানিয়ে সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তে হয় তা শিখেছি, কিভাবে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কয়েক লাখ বন্ধুকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলা যায় তা শিখেছি, শিখেছি ছাত্রজীবনে সবার সঙ্গে একটুকরো কাগজ অর্জনের জন্য মস্তিষ্কের যুদ্ধ করতে, শিখেছি চাকরিজীবন বলে একটা ফেজ মানুষকে পার করতে হয়, যেখানে আরও একবার প্রতিযোগিতায় অর্থহীনভাবে অংশ নিতে হয় আমাদের।
এগুলো করতে হবে, নতুবা তোমার পেটে খাবার জুটবে না, শিখিয়েছে সমাজ।
সমাজ দিয়েছে এই পথ অনুসরণ করার শিক্ষা।
সমাজ বলেছে এরকমটা সফল জীবন, বাকি সবই জীবনের ব্যর্থরূপ।
কিন্তু জীবনের অর্থটা সমাজ আমাকে শেখাতে পারেনি।
জীবন কি?
সামনে কালো কুচকুচে এক গহ্বরে রক্তাক্ত মুখে একজন দেশের কৃতি সন্তান, আজীবন সব পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আসা মানুষটা হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইছে।
আমার হাতে ধরা পিস্তলটা সরাসরি তার মাথার দিকে তাক করা। চেম্বারে রয়েছে মাত্র একটি গুলি। গত এক সপ্তাহ এই গুলিটা আমি বহন করেছি প্রতিহিংসার বশে অন্ধ হয়ে।
আমার লম্বা করে বাড়ানো হাত আর ঐ কৃতি সন্তানের মধ্যবর্তী দূরত্বটাই তো জীবন।
জীবন হলো পিস্তলের বিকট শব্দের শুরু আর জনৈক মাহবুব চৌধুরীর কপালের মাঝে এক অদ্ভুত বৃত্ত সৃষ্টি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কাল।
জীবন আমার সঙ্গে নাবিলার ছোট্ট ঘুপচি ঘরে বিশ্বাসের আত্মসমর্পণ।
নাবিলার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তার অসহায়ত্ব অসহ্য মনে হওয়ায় বন্ধুর কাছ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে একটা পিস্তল জোগাড় করাই হয়তো জীবন।
জীবন সাফল্য আর সুখ হয়তো না সব সময়। কখনও কখনও ব্যর্থতাই জীবনের প্রকৃত রূপ।
ধীরে ধীরে হাত নামিয়ে আনলাম। কবরের গর্তে ছটফট করতে থাকা মানুষটা জীবনের সংজ্ঞা জানে না। সমাজ তাকে জীবন নিয়ে অনেক গৎবাঁধা বুলি মুখস্থ করিয়েছে, তবে খুব সচেতনভাবে ভুলে গেছে জীবনের সংজ্ঞাটা শুরুতে শেখাতে।
সমাজ কাওকেই জীবনের সংজ্ঞা শেখাতে চায় না।
সমাজ যেটা পারেনি, সেটা আমি নিঃসন্দেহে পেরেছি। মাহবুব নামের মানুষটা কবরের গর্তে বসে শরীরের প্রতিটা কোষে কোষে অনুভব করছে, জীবন কি!
পিস্তলটা কোমরে গুঁজে রাখলাম।
হাত বাড়িয়ে দিলাম মাহবুব চৌধুরীর দিকে।
তিন গুণ্ডা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তাদের বিস্মিত দৃষ্টি পুরোপুরি উপেক্ষা করে মাহবুবকে টেনে তুললাম গর্ত থেকে। থর থর করে কাঁপছে কৃতি শিক্ষার্থী। কটু একটা গন্ধ আসছে তার প্যান্ট থেকে। তবে সেটা আমলে নিলাম না। তার অবস্থানে থাকলে আমার প্যান্ট শুকনো থাকতো কি না সেটার নিশ্চয়তা দেবে কে?
“ধন্যবাদ ভাই – ধন্য-”
“শাট আপ।” চুপ করিয়ে দিলাম তাকে। কালো কাপড়টা পকেট থেকে বের করে আবার চোখে বেঁধে দিলাম।
আশুলিয়া পার হওয়ার পরই এই কাপড় তার চোখে বাঁধা হয়েছে। সব মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত গুম হয়ে যাওয়া রাজনীতিবিদকেই এই প্রসেসের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বাগানবাড়ির অবস্থান কোনোমতেই ফাঁস করা চলবে না।
গেটের কাছে নতুন প্যাকেটের অর্ধেক শেষ করে দেওয়া অবস্থায় ইউনুসকে পাওয়া গেলো। আমাদের দেখে একটুও অবাক হলো না সে।
“বেয়াদবী মনে নিয়েন না ভাই-” বললো সে, “কিন্তু আমি আগেই বুঝসিলাম এই কাম আপনেরে দিয়া হইবো না-”
গাড়িতে ওঠার পর, এমনকি বিশ মিনিট ঢাকার পথে ড্রাইভ করার পরও মাহবুবের মুখ থেকে টু শব্দটাও বের করা গেলো না। আমার এক “শাট আপ”-এর প্রভাব এতো বেশি হবে কে জানতো!
“মাহবুব চৌধুরী।” ডাকলাম আমি।
“জ্বি স্যার।”
“ইউ আর গোইং হোম।”
“আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার ভাষা নাই-”
“এতো কিছু বলার দরকার দেখি না। আশা করছি আগামীকাল পুলিশের কাছে আমার আর ইউনুসের বর্ণনা দিতে তোমাকে দেখা যাবে না। সেক্ষেত্রে তোমাকে আবারও খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হবে না আমার। শেষ মুহূর্তে মত নাও পাল্টাতে পারি তখন।”
“আপনাদের কোনো ক্ষতি করবো আমি? মরে গেলেও না স্যার-”
খুক করে কাশির শব্দ করলাম। বেশি কথা বলে ফেলছে বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেলো মাহবুব চৌধুরী।
আমার মাথায় ঘুরছে অব্যক্ত সেই প্রশ্নটা। সমাজ যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। কোনো সমাজসংস্কারক কিংবা ধর্মপ্রচারক যে প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনও দিতে পারেননি। সবাই শুধু বলে গেছেন ওটা কেমন হওয়া উচিত।
হোয়াট শুড ইট বি।
আসল প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছে প্রত্যেকে।
ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগবে বেশ। পুরোটা সময় মুখে কুলুপ এটে বসে থাকার মানে হয় না।
গম্ভীর গলায় প্রশ্নটা মাহবুবকে করেই ফেললাম।
“নাউ টেল মি, মি. মাহবুব।” একটা সিগারেটও ধরিয়ে ফেলেছি সেই সঙ্গে, “হোয়াট ইজ লাইফ?”
— ০ —
রচনাকাল – নভেম্বর ২১, ২০১৬
Leave a Reply