Skip to content
KP Imon
KP Imon

Words Crafted

  • গুহামুখ
  • সূচিপত্র
  • গল্প
    • রম্য
    • জীবনধর্মী থৃলার
    • সাইকোলজিক্যাল
    • রোমান্টিক
    • ক্রাইম
    • সাসপেন্স
    • জীবনধর্মী
  • নন-ফিকশন
    • থট প্রসেস
    • উচ্চশিক্ষা
    • আমেরিকা-নামা
    • জীবনোন্নয়ন
    • তাত্ত্বিক আলোচনা
    • ডায়েরি
  • প্রকাশিত বইসমূহ
    • প্রকাশিত বইসমূহ
    • যেসব গল্প সংকলনে আছে আমার গল্প
KP Imon
KP Imon

Words Crafted

ভালো বাসা

Posted on December 27, 2013June 24, 2022

বাড়িওয়ালার ড্রইং রুমে বসে আছি।

ভাড়ার টাকাটা দেওয়াই উদ্দেশ্য।

টেলিভিশনে টম এন্ড জেরীর কার্টুন চলছে। পিচ্চি একটা জেরী ফিজিক্সের সমস্ত আইন-কানুনের মাঝে নিউক্লিয়ার অ্যাটাক করে  বিভিন্ন কাজ করে বেড়াচ্ছে। বাড়িওয়ালার দেখা নেই – কাজেই আমি মহানন্দে ফিজিক্সের টান্ডি বাজানো দেখছি।

একগাল পান নিয়ে বাড়িওয়ালা আংকেলকে দোড়গোড়ায় দেখা গেল মিনিট পাঁচেক পর।

‘ইবা কন?’ রীতিমত অবাক হয়ে বলেন বাড়িওয়ালা। ’তুমি কে?’

‘আমাদের দেখা হয় নি আগে আংকেল।’ উঠে দাঁড়াই আমি, ’আপনাদের তিনতলায় ভাড়া থাকি আমরা। আমি মি. আহমদ শফিকের  বড় ছেলে -’

‘ও…’ হঠাৎই সব বুঝে ফেলেন যেন, ’উনার যে ছেলে রাজশাহীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে?’

‘জ্বী আংকেল। ’

অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দেওয়ার আগেই যে চিনে ফেলেছেন সেজন্য একটা স্বস্তির পরশ অনুভব করলাম শরীরে। আড়চোখে টমের অবস্থানটা দেখে নিলাম। এই পর্বটা আমি দেখিনি আগে। বেশ মজাদারই আছে। না দেখে যাওয়াটা উচিত হবে না।

‘বস বাবা।’ বিনয় উপচায় বাড়িওয়ালার গলায়, প্রথম পরিচয়ে এমন বিনয়’ডেলিভারী’  দেওয়াটা ইনার বৈশিষ্ট্য বটে। জেনেশুনেই কাজে নেমেছি কি না!’বাসা পছন্দ হইছে আশা করি। এই তো সিঁড়ি ঘরের ফিনিশিং দিলাম কয়দিন হল। ’

‘ওহ,আংকেল, ভাড়াটা নিয়ে এসেছিলাম।’ হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এভাবে বললাম তিরিশ সেকেন্ড পর। এভাবে আর তিনটে মিনিট পার করে দিতে পারলে আমার এই পার্টটা দেখা হয়ে যায়।

ঐ যে গেল ফিজিক্সের আরেকটা সূত্র! একটা চিঠির খাম ব্যবহার করে উড়ে যাচ্ছে জেরী। নিস্ফল টম তাকিয়ে আছে সেদিকে!

‘আংকেল’ ভাড়াটা গুণে গুণে নিলেন।

‘তুমি বাবা ফিজিক্সের সূত্রের উর্ধ্বে না’ মনে মনে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ’প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে… হুঁ হুঁ। ’

✭

এবার বাসায় এসেই শুনলাম গত কয়েকদিন ধরে বাড়িওয়ালার স্ত্রী আমার ছোট ভাইকে সামনে পেলেই অভিযোগ করছে ও নাকি রাতে শব্দ করে। আর আমাদের বাসা সরাসরি বাড়িওয়ালার ওপরের ফ্লোরেই।

আমিও বড়ভাই-য়ত্ব ফলিয়ে ওকে বেশ করে বকে দিলুম।

ছোটভাইটা মর্মাহত হল, ’না জেনে আমাকে বকলা তুমি? এরা এরকমই খারাপ। কিছু না করলেও অভিযোগ করে। ’

‘খারাপ-বাড়িওয়ালা’ নিয়ে অনেক গল্প শুনলেও এতদিন চোখের দেখা দেখিনি একজনকেও। তিনটি বাসাতে থেকে এসেছি আমরা – তবে বাড়িওয়ালাগুলো ছিলেন মাটির মানুষ একেবারে। কাজেই কৌতুহলী না হয়ে পারলাম না।

‘কেন? কেন?? কিছু না করলে অভিযোগ করবে কেন?’

‘নিজেরা যে এই বিল্ডিং-এর সর্বেসর্বা – সেটাই দেখায় আরকি। ’

‘আর সব ভাড়াটেদের সাথেও কি বাজে ব্যবহার করেছে?’

‘রোজ করছে! সেদিন পাশের বাসার তমা আপুকে অনেক করে বকল – ও নাকি খুব জোরে গান বাজায়! অথচ আপুটা অনেক ভালো। মোটেও জোরে গান বাজায় না। বাজালে তো আমাদের কানেই আগে আসত তাই না?’

‘হুঁ’ কথা সত্য – ভাবলাম।

‘আরও আছে -’ থামে না অপু। ’সেদিন রিয়া আপু ছাদে উঠতে চেয়েছিল। ওরা ছাদে সবসময় তালা দিয়ে রাখে। তাই ওদের কাছে চাবি চাওয়াতে বাড়িওয়ালী কি বলেছে জানো?’

‘কি?’

‘আমরা তোমাদের ঘর ভাড়া দিয়েছি ছাদ ভাড়া দেই নি। ’

‘এইটা কোন ধরণের ভদ্রতা?’ আমার চোখ কপালে উঠে গেল। ’উঠতে দেবে না ভালো কথা – বলার তো ধরণ আছে একটা নাকি?’

‘বোঝ তাহলে!’ আমার সাথে তাল মেলায় অপু। ’ইদানিং লেগেছে আমার সাথে। আমি নাকি রাতে শব্দ করি!’

‘হুম …’ ওকে বলেছিলাম, ’দাঁড়াও, আমি এসে যখন পড়েছি – এই সাতদিনেই একেবারে সিধে করে দিয়ে যাব। ’

অপুর চোখের দৃষ্টিতে তেমন ভরসা দেখলাম না।

✭

পরদিন সকালে নীচতলা থেকে মেশিনগানের গুলির শব্দে ঘুম ভাঙ্গল।

ঘুমের রেশ একটু কাটতে বুঝলাম ওটা মানুষেরই গলা।

আরও ভালো করে শুনে বুঝলাম, স্বয়ং বাড়িওয়ালার গলা’উহা’ – কিন্তু এ কী এলিয়েনটিক ভাষা রে বাবা! একটা শব্দের মানে আমি বুঝলাম না।

আমাদের এই বাড়িওয়ালা চট্টগ্রামের মানুষ। ক্ষেপে গেলে খাস ভাষা বেরিয়ে আসবে সেটাও স্বাভাবিক অবশ্য। দরজায় অপুকে দেখতে পেলাম এই সময়।

‘লোকটা চেঁচাচ্ছে ওর বাসাতে বেড়ালের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে তাই।’ আমাকে তর্জমা করে দিল ও।

‘তুমি কিভাবে জানো?’ আমার মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে যায়।

‘কয়েক মাস ধরে আছি না? একটু-আধটু বুঝি। ’

আরও এক পশলা গুলির শব্দ – বাড়িওয়ালা এলিয়েনের ভাষায় আরও কিছু বলল।

‘ওটা কি বলল?’ অপুই আমার ভরসা এখন।

‘যে বিড়াল পোষে তার আম্মুকে…’ হঠাৎ থেমে যায় অপু। ’সরি ভাইয়া, এইটা আমি বলতে পারব না। ’

উধাও হয়ে যায় ছোটভাইটা।

নিজের মাথায় হাত বোলালাম – কাহিনী দেখি সিরিয়াস।

অথচ বাসার ভিউ একেবারে সেই রকম। একপাশে তাকালে বেশ দূরে সমুদ্র দেখা যায়। আরেকপাশে একটা স্নিগ্ধ বাগান তার মাঝে সুন্দর একটা পুকুর। এত সুন্দর বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। অথচ বাড়িওয়ালাটাকে লাইনে আনতে না পারলে তাই করা লাগবে মনে হচ্ছে।

হাত মুখ ধুয়ে সোজা দুইতলায় নেমে গেলাম। নক করতেই বাড়িওয়ালী, যিনি অপুর ভাষায়’ডাইনি’ – দরজা খুলে দিলেন।

‘ইয়ে – আন্টি, ছাদে ওঠা যায় না?’ মুখে সরল একটা ভাব ফুটিয়ে রেখেছি, ’গিয়ে দেখলাম দরজায় তালা। ’

আসলে ডাহা মিথ্যা কথা। ছাদে উঠে কে? জানাই তো আছে দরজায় তালা।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হুট করে বাজে কথা বলতে বাধল মনে হয় ডাইনি বুড়ির। তাছাড়া আমার সাথে তাদের দেখা একবারই হয়েছে – এবং সেই সাক্ষাতে আমার হাত থেকে অনেকগুলো কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোট তাদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে – কাজেই আমার প্রতি মন কিছুটা প্রসন্ন থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

এসব সাত-পাঁচ ভেবেই হয়ত চাবিটা আমাকে এনে দিল। ওটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার ভান করতেই হল।

বাড়িওয়ালার দরজা লেগে যেতেই ছুটে নিচে নেমে পড়লাম।

আধ ঘন্টার মাঝেই ডাইনির কাছে চাবি ফেরত দিয়ে ডুপ্লিকেট ছয়টা চাবী নিয়ে ডিং ডং করতে করতে আমি বাসায় হাজির।

কিন্তু বিকেলেই পরিস্থিতি আবারও ঘোলাটে।

স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে অপু রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করল।

‘আকাশ ভাইয়া!’ অপুর রণহুংকার শুনে ঘাবড়েই গেলাম।

‘কি হয়েছে?’

‘ডাইনি বলে আমি নাকি কাল রাতেও শব্দ করেছি!’

‘কি! বুড়ির আম্মুকে আমি আন্টিও ডাকি না!’ মেজাজ এবার আমারও খারাপ হয়ে গেল। কাল রাতে আমি বাসাতেই ছিলাম। অপু যে শব্দ করেনি শুধু তাই নয় – কোন বিকট শব্দই শুনিনি আমি।

মিথ্যামিথ্যি অপবাদ দিয়ে ওদের কি লাভ সেটাই বুঝলাম না। কিছু মানুষের মনে হয় মস্তিষ্কই বিকৃত থাকে।

✭

রাত দশটাতে রান্নাঘর থেকে একটা খালি বিস্কুটের টিন চুরি করতে হল।

দশ মিনিট ঠুক ঠুক করে টিনের ওপরের অংশটা কেটে এটাকে একটা ইস্পাতের বালতি বানিয়ে ফেললাম।

সদ্য করা ফুটো দিয়ে দড়ি বেঁধে আমি প্রস্তুত। শব্দ কাকে বলে কতপ্রকার ও কি কি  – আজ দেখাচ্ছি!

কানে হেডফোন লাগিয়ে মহানন্দে ফেসবুকে চারঘন্টা বন্ধুদের সাথে চ্যাট করতে করতে দিব্যি রাত দুইটা বাজালাম।

‘এবার তোমাকে নিউটনের থার্ড ল’র একটা ব্যাবহারিক উদাহরণ দেওয়া যায়’ – বাড়িওয়ালা পরিবারের উদ্দেশ্যে বললাম মনে মনে।

আমার ট্রাভেলিং ব্যাগ থেকে দশ ইঞ্চি লম্বা আর সেই অনুযায়ী চওড়া পটকাটা বের করলাম। ভেবেছিলাম নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ফাটাব – তা আর ডাইনি ফ্যামিলি হতে দিল কই?

দীর্ঘশ্বাসটা চাপলাম।

বারান্দায় এসে সুতোতে আগুন দিয়ে বিস্কুটের টিনে নামিয়ে দিলাম পটকাটাকে। দড়ি ঝুলিয়ে বাড়িওয়ালা আংকেলের বেডরুম সংলগ্ন বারান্দার সামনে এনে পাঁচ সেকেন্ড অপেক্ষা করতেই –

প্রথমে শীতের রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আমার কানেরই পর্দা ঝালাপালা করে একটা বিকট শব্দ।

তারপর তড়িঘড়ি করে নিশব্দে টিন তুলে নিয়ে রুমে ফেরার আগেই সকালের মত দোতলা জুড়ে মেশিনগানের গুলি শুরু হয়ে গেল।

খাটের নীচে ’এভিডেন্স’ চালান করে মনিটরের পাওয়ার সুইচ অফ করে আমি লেপের তলায়।

তবে আজকের’শব্দ’টা অতিরিক্ত ছিল। বাবা-মাও জেগে গেছে শব্দের তীব্রতায়।

হুড়মুড় করে সিঁড়িঘরের দিক থেকে শব্দ – এবং পরমুহূর্তেই বাসায় কলিং বেলের মুহুর্মুহু শব্দে বাবা গেলেন দরজা খুলতে।

‘হতরত খতরম ভতরত অওয়জ হিকিরিক …’ বা এজাতীয় কিছু প্রাণপণে উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন বাড়িওয়ালা স্বয়ং।

‘আপনাদের ওখানে কি হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে বাবাও প্রশ্ন করলেন।

বাংলা ভাষা কানে পড়তে বাড়িওয়ালার খেয়াল হয়। ইনিও বাংলাতেই হুংকার ছাড়েন এবার – ’আপনার ছোট ছেলে রোজ শব্দ করে আপনি কিছু বলতে পারেন না তাকে? এই রাত দুটোতে এমন বিকট শব্দ …’

‘আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন।’ ঠান্ডা মেজাজের বাবাও রেগে যান এবার, ’আমি স্পষ্ট শুনেছি শব্দটা নীচ থেকে এসেছে।

‘আমিও স্পষ্ট শুনেছি  শব্দটা ওপর থেকে এসেছে!’ সমানে গলা মেলায় বাড়িওয়ালা।

এলোমেলো চুল আর ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে আমি এই পর্যায়ে এসে থামলাম ড্রইং রুমের দরজায়।

‘নীচে কি কোন টায়ার ফেটেছে? শব্দ শুনলাম একটা।’ সাধুর মত জানতে চাই আমি।

এবার দুইজনেই চুপ হয়ে যান।

বাবা নিশ্চিত শব্দটা নীচ থেকে হয়েছে। বাড়িওয়ালাও নিশ্চিত শব্দের উৎস ওপরে। আমার কথায় বাড়িওয়ালা এতক্ষণে যেন কিছুটা কনফিউজড হয়ে গেল।

‘কিছু ন বুজ্জুম ’ বাড়িওয়ালা বিড় বিড় করে এরকম কিছুই বলল।

‘কিছু বুঝবেন না মানে!’ মনে মনে বলি আমি। ’আরও বোঝার বাকি আছে তো আপনার। ’

বাড়িওয়ালা নিজের বাসায় ফিরে যেতেই আবারও লাফ দিয়ে মনিটরের সুইচ অন করে ফেসবুকে ফিরে গেলাম আমি।

আরও দুই ঘন্টা মহাসমারোহে চ্যাট করে রাত চারটা বাজতেই সংগ্রহে রাখা দ্বিতীয় পটকাটা  বের করলাম।

কত সখ ছিল এটাকেও নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ফাটাব!

ইস্পাতের টিনটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দ্বিতীয়বার পটকাটা ফাটাতেই রাস্তার তিন চারটা নেড়ি কুকুর প্রবলবেগে প্রতিবাদ জানিয়ে একসাথে ডেকে ওঠে।

*

রাত সোয়া চারটা।

আগের চেয়েও অগোছালো চুল নিয়ে আমি সন্তের [saint] মত বসে আছি ড্রইং রুমে। বাবা-মা আর বাড়িওয়ালা আংকেলও উপস্থিত।

রোজ রোজই বাড়িওয়ালার স্ত্রী শব্দ পেতেন আর আমরা পেতাম না।

আজ তো উৎপাত আরও বেড়ে গেছে।

‘এগুলো কি হচ্ছে রে,আকাশ?’ মা উদ্বিগ্ন গলায় আমার কাছে উত্তর খোঁজেন।

‘আমার মনে হয় বাসার ইলেক্ট্রিক্যাল লাইনটা একবার চেক করা দরকার আপনার।’ বাড়িওয়ালাকে পরামর্শ দেন বাবা।

‘হুজুর ডেকে বাড়ি বন্ধ করা লাগবে।’ আমার মুখ দিয়ে বের হতেই বাড়িওয়ালা আংকেল খুশি হয়ে গেলেন।

‘এই পুয়া একেবারে ঠিক বলছে। ইঞ্জিনিয়ার পুয়া – মাথাত বিরেন আছে। জিনত ঘরৎ [ঘরে] ইন্দি-উন্দি [এদিকে ওদিকে] শব্দ করবে – জিনক আঁতুর[খোঁড়া] ন করি তো আমি বাপের পুয়া না।’ চট্টগ্রামের ভাষা আর চলিত ভাষার জগাখিচুরী মেশিনগান চালিয়ে দিলেন।

বাবা মোটেও এই সমস্যার পক্ষপাতিত্ব করতে পারলেন না। মা অবশ্য আপত্তি করছেন না। হুজুর বাড়ি বন্ধ করলে ক্ষতিই বা কোথায়? আর বাড়িওয়ালা আংকেল তো রীতিমত উৎসাহিত এই সমাধানে।

আমিও শত্রুপক্ষের সাথে তাল মেলালাম।

আজ রাতের মত এটাই মীমাংসা হল – পরদিন জুম্মার পরে ইমাম সাহেবকে আসতে বলে দেবেন বাড়িওয়ালা আংকেল।

আপদটা বিদেয় হতেই বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই আমি।

✭

পরের দিন সকালে ছাদে উঠে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে মুখে দেশাত্মবোধক গান নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খোলা ছাদে।

সকালের মিষ্টি রোদে সমুদ্র দেখার মজাই আলাদা।

ভিউটা ছাদ থেকে এতই মাথা নষ্ট করা – ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম। মনটা আজ ফুরফুরে। বাড়িওয়ালার হম্বিতম্বি শোনা যায় নি আজ সকাল থেকে।

বুড়োটাকে ভয় দিতে পেরে বেশ শান্তি লাগছে মনে।

‘ম্যাচ হবে আপনার কাছে?’

কানের কাছে নারী কন্ঠটা এতই চমকে দিল আমাকে – গলায় ধোঁয়া আটকে কেশে ফেললাম।

সাদা টি-শার্টে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে আমার দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

অভিজ্ঞ চোখ একনজর দেখেই বলে দিল – ঠোঁটে ওটা ডানহিল। বাতাসে সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে – চোখদুটো ভীষণ কালো। ফরসা গাল দুটোতে কোন দাগের চিহ্নও নেই। খাড়া একটা নাকের সাথে গোলাপী ঠোঁটদুটো একেবারে মানিয়ে গেছে।

কাল রাতে জ্বীন জাতির সাথে ফাজলেমী করার জন্যই কি রিয়েল জ্বীনের পাল্লায় পড়লাম নাকি রে বাবা? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ম্যাচটা তুলে দিলাম মেয়েটার হাতে।

আগুনটা ধরিয়ে রেলিং-এ দুই হাত আড়াআড়ি করে রেখে দাঁড়ায় মেয়েটা।

‘আপনি নিশ্চয় আকাশ?’ সুন্দর ভ্রু দুইটা কুঁচকে জানতে চায় আমার কাছে।

‘ঠিক ধরেছেন।’ কিছুটা বিস্মিত না হয়ে পারি না। ’আপনি?’

‘আমি মিথিলা।’ ছাই ফেলে দক্ষ স্মোকারের মত রেলিং এর ওপাশে। ’আপনি রুয়েটে পড়ছেন?’

‘হুম।’ এতকিছু জানে কি করে- শুষ্ক গলায় ভাবি আমি। এই মেয়ে জ্বিন না হয়েই যায় না। ’আপনি?’

‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী নিয়ে পড়ছি।’ আমার গলার অবাক ভাবটা হয়ত এতক্ষণে খেয়াল করে মিথিলা, ’আমি দোতলায় থাকি। ’

এই মেয়ে জ্বীন হলেও এতটা আশ্চর্য হতাম না আমি। এইরকম রুক্ষ বাড়িওয়ালার এত ভদ্র আর সুন্দরী মেয়ে কিভাবে থাকে? তবে জ্বীনের সঙ্গ থেকে মানুষের সঙ্গ নিশ্চিত হতেই দ্রুত সিগারেটে টান দিলাম কয়েকটা। পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম এতক্ষণের’ক্ষতি’।

‘আচ্ছা!’ অবশেষে মুখ খুললাম, ’ছাদে স্মোক করেন – সমস্যা হয় না?’

‘উঁহু – বাবা ছাদে কখনই ওঠেন না। আর ভাড়াটেদের চাবি দেওয়া হয় না সাধারণতঃ – কে আসবে ছাদে আর?’

‘আমাকে ছাদে দেখে অবাক হলেন না যে তাহলে?’

আমার দিকে তাকায় মিথিলা, ’আচ্ছা, আমাকে দেখে কি আপনার নির্বোধ মনে হয়?’

‘বাপের মত হয়ে থাকলে শতভাগ নির্বোধই হতে পার হে!’ – মনে মনেই বললাম কথাটা। মুখে বললাম, ’এ প্রশ্ন কেন?’

‘গতকাল চাবি নিয়েছিলেন – নির্ঘাত ডুপ্লিকেট বানিয়েছেন। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না।’ সিগারেটে ধীরে-সুস্থে টান দেয় মেয়েটা। ’এই বাসায় জ্বীন আছে বলে আপনার মনে হয়?’

‘হুম।’ আর কিছু বললাম না। মেয়ে যথেষ্ট চালাক। এর বাপটা এরকম হলেই গেছিলাম আমি।

‘তারমানে পটকা ফাটানোটাও আপনার কাজ। জ্বীনে এত দৃঢ় বিশ্বাস থাকার আর কোন কারণ থাকতে পারে না। ’

এই রে – এই মেয়ে তো রীতিমত গোয়েন্দা। বিমর্ষ হয়ে সিগারেটে চুপচাপ টান দিতে থাকলাম। প্ল্যান সব ভেস্তে গেল।

মেয়ে যখন বের করে ফেলেছে – বাড়িওয়ালা বাবা কি আর জানবে না?

আড় চোখে মেয়েটাকে একবার দেখলাম।

কালো থ্রি-কোয়ার্টার আর সাদা টি-শার্ট পরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে এই অসাধারণ পরিবেশে একটা সুন্দরী মেয়ে ডানহিল খাবে আর আমি আড়চোখে তাকাব না – এতটা মহাপুরুষও হইনি এখনও!

মেয়েটার মুখে কৌতুকের আভাস তখনই খেয়াল করলাম।

‘ভাবছেন কেন বলছি না বাবাকে?’ আমার দিকে ফেরে মিথিলা। ’আপনাকে সিএনজি থেকে নামতে দেখলাম যখন জানালা দিয়ে তখনই মনে হচ্ছিল এরকম কিছু করতে যাচ্ছেন আপনি। বাকি ধারণাগুলো মেলে কি না দেখার আগ্রহ আছে। ’

‘আর কি কি ধারণা?’ টোকা দিয়ে সিগারেটের গোড়াটাকে চোখের সামনে দূর করলাম।

‘সেটা কি আমার বলার কথা?’ মিথিলার ডানহিলের গোড়াটাকে টোকা মারে ও-ও। আমারটার চেয়েও দূরে গিয়ে পড়ে ওটা।

‘না।’ তাড়াতাড়ি বললাম, ’আমার ধারণা, আপনি চান এই বাসার ভাড়াটে-বাড়িওয়ালা দূরত্ব কমে আসুক। ’

‘হয়তো। চলুন নামা যাক। ’

✭

নামাজ পড়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে বাসার সামনের রাস্তায় নজর রাখছি। বন্ধু নুরূলকে ফোনে ঘটনার গুরুত্ব বুঝিয়ে আসতে বলেছি সেই সকালে। হঠাৎ ইমাম সাহেবকে দেখতে পেলাম সরাসরি বাসার দিকেই আসছেন।

নামার জন্য প্রস্তুত হলাম।

ইমাম সাহেব বাউন্ডারীর গেইটে পা রাখার সাথে সাথে উনার গায়ে আছড়ে পড়লাম আমি।

ভুঁড়ি দুলিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন হুজুর – জাপ্টে ধরে উনার পতন রোধ করে গলায় ব্যাগ্রতা ঢেলে বললাম, ’ঢুকছেন কোথায়?? সময় থাকতে কেটে পড়ুন!’

‘কেন বাবা?’ আকাশ থেকে পড়েন হুজুর। ’এই বাড়ি আজ আমার বন্ধ করার কথা। ’

‘তিনতলার পাগলি মেয়েটা নেমে আসছে -’ গলায় ব্যাস্ততা বাড়িয়ে তুললাম, কিন্তু হুজুরের চেহারায়’কত পাগলি সারাইলাম’ ভাব দেখা গেল। ’-জামাকাপড় খুলে ফেলার হুমকি দিতে দিতে।’ বাক্য শেষ করলাম আমি।

‘আস্তাগফিরুল্লাহ!’ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুট লাগালেন হুজুর। ’নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক!’

ছুটন্ত হুজুরের পাশ দিয়ে একটা রিকশা এসে থামে বাসার সামনে।

‘ওই টা কে ছিল?’ গুরুগম্ভীর চেহারায় বলে নুরুল।

‘ঝামেলা। তবে দূর করা হয়েছে।’ সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওর মুখে লাগানো নকল দাঁড়ির দিকে তাকালাম। ’ভালোই ফিট করেছে তোকে। মনে আছে সিচুয়েশন কি?’

‘আরে পানির মত।’ হাসে নুরুল। ’সিরাজ-উদ-দৌলার রোল সামলে ফেলতে পারলাম আর এইটা সামান্য এক বুড়োকে পটানো! চল তো!’

*

‘ইমাম হুজুর ব্যস্ত তাই আমাকে পাঠিয়েছেন।’ বড় বড় চোখ মেলে বলে ইমাম সাহেবের রিপ্লেসমেন্ট।

খুশি মনেই তাকে বিশ্বাস করে বাড়িওয়ালা আংকেল। চট্টগ্রামের ভাষার মেশিনগান ছুটিয়ে পরিস্তিতি ব্যাখ্যা করেন নুরুলের কাছে।

‘ছাদ বন্ধ থাকায় জ্বীন বাসায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ গম্ভীর গলায় রায় দেয় হুজুর। ’ছাদের দরজা সবসময় খুলে রাখতে হবে। ’

‘কিন্তু, আমার মেয়েটা যে ছাদে উঠতে পছন্দ করে!’ বাড়িওয়ালার মোটেও পছন্দ হয় না এই রায়।

‘উঠবে।’ বিরক্তিভরে বলে হুজুর। ’তবে মেয়েছেলের বেশি ছাদে বের না হওয়াই ভালো। ’

কটমট করে তাকায় মিথিলা।

‘জ্বীনেরা সব বাসায় আসর করে না।’ এইমাত্র মিথিলার আম্মুর বানিয়ে দেওয়া পানটা মুখে পুড়ে নিয়ে একগাল হাসে নুরুল, ’যেসব বাসায় শান্তি থাকে সেখানে জ্বীন দেখবেন না কেউ। এই বাসায় নিশ্চয় ঝগরা বিবাদ লেগেই থাকে। না সাহেব?’ কড়া দৃষ্টিতে বাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকে নুরুল।

‘জ্বী হুজুর।’ পর্দার আড়াল থেকে বলে বাড়িওয়ালি, ’ মিথিলার আব্বু তো সারাদিন ক্যাটক্যাট করতেই থাকে ভাড়াটেদের সাথে। ’

‘আর তুমি?’ ক্ষেপে যান আংকেলও, ’তুমি তো রোজ রোজ বাচ্চা ছেলেটাকেও মিথ্যাই দোষ চাপাও!’

‘থামুন থামুন!’ হাত তোলে নুরুল, ’গোস্বা নেককাজসমূহ ধংস করে। রাগ করতে নেই। বাসাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাটা বাঞ্ছনীয়, সাহেব। একই কথা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বিবিসাহেবা। আর শরীয়াতের মতে – বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে সুপাত্র দেখে দিয়ে দেওয়াটা জরুরী। ’

এবার আমি কটমট করে তাকাই নুরুলের দিকে। ভেবড়ে যায় বেচারা।

‘থাক সে কথা। এখন আমি ঘর বন্ধ করব। আপনারা দোয়া দরুদ পড়ুন। আর আপনি আমার সঙ্গে আসুন।’ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে ও।

দরজা দিয়ে বেড়িয়েই ওর পশ্চাদ্দেশে দুটো লাথি ঝাড়লাম। ’শালা তুই মিথিলার বিয়ের কথা বলিস কোন সাহসে?’

পেছন থেকে ছোট্ট একটা কাশির শব্দে তৃতীয় লাথিটা দিতে গিয়েও থেমে যাই।

চৌকাঠে হেলান দিয়ে আমাদের দেখছে এবং শুনছে মিথিলা।

মুখে মিষ্টি একটা হাসি।

সে হাসিতে সম্মতির লক্ষণ!

মনটা ভালো হয়ে গেল আমার।

আমি আর নুরুল ছাদের দিকে রওনা হলাম বাড়ি’বন্ধ’ করার উদ্দেশ্যে …

 

রচনাকাল – ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩ 

গল্প রম্য রোমান্টিক

Post navigation

Previous post
Next post

কিশোর পাশা ইমন

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Related Posts

স্ল্যাং

Posted on February 20, 2023

টাকা মানুষকে শ্রেণিতে ভাগ করে। আর ক্ষুধা আনে এক কাতারে।

Read More

আর কিছু বলবে?

Posted on February 19, 2023

‘আর কিছু বলবে?’ হাতঘড়ি দেখে জানতে চায় ইভা।
মাথা নাড়লাম আমি। মেয়েটার একটা ডায়েরী আমার কাছে ছিল। ওটা দিতে এসেছি। আর কিছু বলার থাকে কিভাবে?
ভাষা জিনিসটাকেই কেউ কেড়ে দিয়েছে আমার। কই? ইভা তো আজ আমার চোখ দেখেই সব বুঝে ফেলল না!
কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়।

Read More

ঐক্য

Posted on October 12, 2022

“তা তো যাবেই।” অমায়িক হাসি হাসলো নির্ঝর, “বললাম না, আজ রাতে গোলাগুলি হবে।”

Read More

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সর্বশেষ লেখাগুলো

  • ওয়ান ফর মাই সৌল
  • আমার যত প্রকাশক
  • কেপির সেরা লেখা কোনটি – জরিপ ২০২২
  • আন্ডারএইজের বই পড়া
  • অমুক পড়ে আসেন… সমস্যাবলী

Analytics

009522
Total Users : 9522
Total views : 23962
Who's Online : 0
Powered By WPS Visitor Counter
©2025 KP Imon | WordPress Theme by SuperbThemes