তারপর
১৫ই ডিসেম্বর, ২০১৩।
‘সন্ধ্যা ৭টার রাজশাহী-চট্টগ্রামের কোচ চলে এসেছে। যাত্রীরা বাসে উঠে পড়ুন।’
কিছুটা চমকায় ইমতি। লাগেজ নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। বক্সের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির হাতে তুলে দেয় ট্রাভেলিং ব্যাগটা।
‘টিকেট দেখান। কোথায় নামবে এটা?’ মাত্রই সানগ্লাস পড়া তরুণের ব্যাগটা ঠিকমত রেখে ইমতিয়াজের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় মানুষটি।
‘আই-ওয়ান। বিআরটিসি নামবে।’ শেষ মুহূর্তে এসে এই একটা সীটই খালি পেয়েছে বেচারা। চোখের সামনে ফ্ল্যাশ দেয় ওর আই-ওয়ান সীটের অবস্থান। মনে করার চেষ্টা করে দৃশ্যগুলো। জানালার ধারে পেছনের আগের সীটেই ছিল ও – সন্দেহ নেই। কিন্তু বামপাশে না ডানপাশে?
মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে ও চিন্তাগুলো। স্বপ্ন – কেবলমাত্র স্বপ্নই।
গত সপ্তাহে অন্তত চারবার দেখা স্বপ্নটাই ভাবাচ্ছে ওকে।
*
পেছনে জানালার ধারে বসে আছে ইমতিয়াজ। পাশের তরুণী হাস্যোজ্জ্বল মুখে কিছু বলছে ওকে। সামনে একটু কোণায় জানালার ঠিক পাশের সীটে বসে এক মুরুব্বী গোছের মানুষ। সুন্নতী লেবাস পরনে। মাঝে মাঝেই বিরক্তির সাথে এদিকে তাকাচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণীর হাসির সময়গুলোতে।
তরুণী আংটি দেখাচ্ছে ওকে। আংটির ভেতর থেকে এক্স-গার্লফ্রেন্ড রুবাইয়াত তাকিয়ে আছে ওর চোখের দিকে। শিউরে উঠে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে ইমতি।
ওরই সারির অপরপ্রান্তের জানালার পাশ থেকে মুখে কাটা দাগ নিয়ে ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে থাকা একটি শিশুর মুখ। হুড়মুড় করে উঠে আসা পুলিশবাহিনী আর দুর্বৃত্তের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময়।
ইমতিয়াজের হস্তক্ষেপে দুর্বৃত্তের পরাজয় – এবং ‘কাদের মোল্লা অমর হোক’ বলে চেঁচিয়ে ওঠা কাওকে ধাক্কা দিয়ে বাসের জানালা দিয়ে ইমতিয়াজের ফেলে দেওয়া – স্বপ্নের ডিটেইলস ভালো মত মনে না থাকলেও এধরণের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছিল কম-বেশি।
এবং তারপরের অংশটুকু সব স্বপ্নেই এক। সীট থেকে কোন কারণে উঠে যায় ইমতিয়াজ, রুবাইয়াত ফোন দেয় ওকে এসময়। ক্ষমাপ্রার্থনাসূচক কিছু বলছিল রুবাইয়াত – তবে সেদিকে খেয়াল থাকে না ইমতিয়াজের, বিকট শব্দে বোমা ফাটে কোথাও। বাসের ড্রাইভার পাগলের মত গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার চেষ্টা করে। এবং অমোঘ নিয়তির মত সামনে থেকে ছুটে আসা ট্রাকটার দিকে বুলেটের বেগে এগিয়ে যায় ইমতিয়াজদের বাস।
মস্তিষ্ক এরচেয়ে বেশি নিতে পারে না। প্রতিবারই এই অংশে এসে ঘুম ভেঙ্গে যায় ইমতিয়াজের।
সারা শরীর ঘামে ভেজা।
*
স্বপ্ন কিছুতেই সত্যি হতে পারে না। ভাবনা থেকেই স্বপ্নের জন্ম। নিজেকে নিজেই আজ পঞ্চাশবারের মত বোঝায় ইমতিয়াজ।
রুবাইয়াতের সাথে ওর ব্রেকআপ হয়েছে মাত্র আটদিন হল। একসাথে বারোটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিয়েছিল ইমতি। যদিও পেটে সহ্য হয়নি। বমি হয়ে বের হয়ে গেছিল সব। কিন্তু তারপর থেকে ওর এই স্বপ্ন দেখার শুরু। ঘুমের ওষুধ খাবার পর থেকে নয়, ব্রেক আপের পর থেকে। একে অস্বাভাবিক মনে করার কিছু নেই, ছ্যাঁকা খাওয়ার পর সবাই কম বেশি দুঃস্বপ্ন দেখে থাকে।
স্বপ্নের ভ্রমণে সীট আই-ওয়ান হওয়ার ব্যাখ্যা অতি সহজ। বাসে চলতে থাকা পুরো ঘটনা তার চোখের সামনে দেখার জন্য পেছনের সীটেই ওকে বসিয়েছিল কল্পনাপ্রবণ মন। পেছন থেকে সম্পূর্ণ বাসটাই দেখা যায় যেহেতু। পাশের সিটে তরুণী বসবে এটাও অনুমেয়, রুবাইয়াতের স্মৃতি ভুলে যেতে নতুন কোন মেয়েকে স্বপ্নে দেখায় রকেট সায়েন্স নেই। তবুও নিজেকে নিজেই শাসন করেছে ও মুরুব্বীর বক্রদৃষ্টির মাধ্যমে। এক দিন আগে ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরতে চেষ্টা করার পর নতুন মেয়েকে স্বপ্নে দেখলে স্ব-শাসন অতি স্বাভাবিক ঘটনা। মৃত্যুকে এভাবে স্মরণ করার একটাই কারণ ছিল – রুবাইয়াতের অনুপস্থিতি। এজন্যই স্বপ্নের শেষটায় রুবাইয়াতের কল রিসিভ করতে করতে একটা সম্যক অ্যাকসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছিল ওকে। আত্মহত্যাপ্রবণ মন!
‘আর বাকিটা – যেকোন স্বপ্নের মতই নিজেকে হিরোর জায়গায় দেখার ফল।’ চিন্তার শেষ বাক্যটা বিড়বিড় করে নিজেকে শোনায় ইমতি। বাসে উঠে পড়ে তারপর।
আই-ওয়ানে এসে দেখে আই-টুতে এরই মধ্যে একজন মধ্যবয়েসী ভদ্রলোক বসে আছেন।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কি ইমতিয়াজ?
স্বপ্ন অনুযায়ী ওর সীট আই-ওয়ান হলেও পাশের সীটে তরুণীর বসার কথা। মধ্যবয়েসী ভদ্রলোকের নয়। লোকটি এসে সব ভন্ডুল করে দেওয়ায় মনে মনে খুশি না হয়ে পারে না ও। তার ব্যাখ্যা নির্ভুল। স্বপ্ন দেখার পেছনে এক্স-গার্লফ্রেন্ডের ভূমিকা প্রবল ছিল।
সরে ওকে জায়গা করে দেন ভদ্রলোক। আয়েশ করে বসে ইমতিয়াজ। হাত ঘড়ির দিকে তাকায় – ছয়টা আটান্ন। আর দুই মিনিট মাত্র। স্বপ্নের গুষ্টি কিলিয়ে কানে ইয়ারফোন গেঁথে দেয় ও। শিরোনামহীনের ‘আবার হাসিমুখ’ শোনা যাক।
‘এই অবেলায় ফোটা কাশফুল – নিয়তির মত নির্ভুল’ পর্যন্ত আসতে আসতেই পিঠ সোজা করে বসে পড়ে ইমতি। মাত্র বাসে ওঠা নীল জামা পরা মেয়েটা সোজা এদিকেই এগিয়ে আসছে। কালো রেশমি চুলের সাথে দুধে আলতা মুখটাকে দেবীর মত লাগছে – তবে সেসব ছোঁয় না ইমতিকে। কান থেকে সরিয়ে ফেলেছে ইয়ারফোন।
ওর পাশের ভদ্রলোককে বেশ বিনীতভাবেই বলে মেয়েটা, ‘এক্সকিউজ মি। এই সীটটা সম্ভবতঃ আমার ছিল। আই-টু।’
টিকেট বের করে পাশের ভদ্রলোকও। ‘সরি আপু। আপনারই সীট। আমারটা জে-টু।’
উঠে পেছনে বসে পড়েন ভদ্রলোক। মেয়েটা ইমতির পাশে বসে পড়ে। তবুও তাকিয়ে থাকে ইমতিয়াজ। স্বপ্নভীতি জাঁকিয়ে ধরতে যাচ্ছে ওকে।
ওর একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকাটা চোখে পড়ে হয়ত মেয়েটারও। ঘুরে তাকায় ওর দিকে। ইমতিয়াজের ভয়ার্ত দৃষ্টি লক্ষ্য করে না মেয়েটা – হঠাৎ পুলকিত হয়ে ওঠে ও।
‘আপনি রাশেদের ফ্রেন্ড না?’ ঝলমলে একটা হাসি ফুটে মেয়েটার মুখে।
‘ওহ – হ্যাঁ। আর আপনি?’ বাস্তবে ফিরে আসতেই হল ইমতিকে।
‘রাশেদের রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ডসার্কেলের মাধ্যমে ওকে চিনি আসলে। আপনিও একদিন এসেছিলেন ওদের সাথে। আমাকে হয়ত মনে নেই আপনার। আমি লুবনা। আপনার নাম ভুলে গেছি।’ লজ্জিত হাসে লুবনা।
‘আমি ইমতিয়াজ। বন্ধুরা ইমতি ডাকে।’ লুবনাকে একটু মনে পড়ে ওরও। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি এন্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী।
‘ও – হ্যাঁ!’ হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এভাবে বলে লুবনা। ‘দ্যা গ্রেট ইমতি। রুয়েটের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট আপনি। রাশেদ মাঝে মাঝেই আপনার কথা বলে – জানেন না হয়ত। আপনার দাবা খেলার সীমাহীন দক্ষতা – অসাধারণ কবিতা লেখেন আপনি। সেটা থেকে আপনারা দুইজন টিউন দেন। এরকম একটা গেয়ে শুনিয়েছিল রাশেদ। মনে হয় ‘সেলুলয়েডের স্বাধীনতা’ – বা এজাতীয় কিছু টাইটেলে।’
রাশেদ ইমতির রুমমেট। মাথা নাড়ায় ও রাশেদের ছেলেমানুষীতে। ‘ওর কথাকে সত্য ধরে নেবেন না। আমার ব্যাপারে বাড়িয়ে বলার অভ্যাসটা ওর গেলই না।’
‘ভালোই হল পাশে আপনাকে পেয়ে। ভেবেছিলাম একা একা যেতে বোরিং লাগবে। ’
‘ব্যাচমেট এবং কমন ফ্রেন্ড সার্কেলের প্রেক্ষিতে বলতেই হচ্ছে – ‘আপনি’ শুনতে অড লাগছে। আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন। ’
‘সেক্ষেত্রে তোমারও ‘আপনি’ বলা ছাড়া লাগবে।’ আলতো করে হাসে লুবনা।
বাস ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে।
*
একঘন্টা পার হতেই খেয়াল হয় ইমতির। এতটা রিল্যাক্স মুডে এতক্ষণ লুবনার সাথে গল্প করে যাচ্ছে যে স্বপ্নের কথা একেবারেই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল। তরুণীর হাতে একটা আংটি থাকার কথা।
লুবনার হাতে কি আছে ওটা?
আড়চোখে দেখার চেষ্টা করে ইমতি। লাভ বলতে কিছু হয় না। নাইটকোচের যাত্রীদের আরামপ্রদ ভ্রমণের জন্য আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে। বাইরের আলোর সাথে ভেতরের আবছা অন্ধকারে লুবনার ফর্সা মুখটা ঝাপসা করে দেখা গেলেও হাতের দিকে তাকানোর কোন উপায় নেই। নিরেট অন্ধকারে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে ইমতি।
নিজেই নিজেকে চোখ রাঙ্গায় ও। আরে ব্যাটা এত স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর কি আছে? তুই তো আর সাধক হয়ে যাস নি যে স্বপ্নদ্রষ্ট সব কিছুই পই পই করে বাস্তবে চলে আসবে। নাহয়ে কপালগুণে পাশে সুন্দরী একটা মেয়ে পড়েই গেছে – তাই বলে স্বপ্নের সাথে সেটার মিল খোঁজার মানে কি?
আগামী দুইটা ঘন্টা সুযোগ সন্ধানে থাকলেও আংটির উপস্থিতি দেখার সৌভাগ্য হল না ইমতিয়াজের।
বাস তখন প্রায় সিরাজগঞ্জের হোটেলে। থামার প্রস্তুতি নিতে নিতে সবগুলো আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ঘুমন্ত যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ এতে হয় সহজ।
সুযোগটি ছাড়ে না ইমতি। একবার তাকিয়েই দেখতে পায় আংটিটা। লাল পাথরটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে!
‘চল, নামি।’ ইমতির দিকে তাকায় লুবনা, ‘হাতে কি দেখছ?’
‘তোমার এংগেজমেন্ট হয়ে গেল কি না ভাবছি।’ গলায় কৃত্রিম দুঃখের ভাব ফুটিয়ে বলে ইমতি।
হেসে ফেলে লুবনা। হাসির শব্দে ফিরে তাকায় সামনের এইচ-থ্রি সীটের সুন্নতী পোশাক পরা ভদ্রলোক। চোখ এড়ায় না ইমতির। অজান্তে ঢোক গেলে। লুবনার মুখ থেকে পরের বাক্যটা বের হতেই আতংকের একটা শিহরণ বয়ে যায় ওর শিঁড়দাড়া বেয়ে।
‘এটা রুবির আংটি। শখ করে পরি আমি।’
‘রু-রুবির?’ স্বপ্নে আংটির ভেতর রুবাইয়াত কিভাবে আসে সেব্যাপারে একটু হলেও ধারণা পায় ইমতি।
‘রুবি স্টোনের নাম শোননি?’ হাত বাড়িয়ে দেয় ও ইমতির দিকে। ‘দেখতে পার। আমার এদের কোমল ঝলকানিটা ভালো লাগে।’
কাছ থেকে দেখার ভান করতেই হয় বেচারাকে। ভেতরে ভেতরে যদিও হার্টবীট বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
‘চলো চলো – রাতের খাবার এখানে না খেলে সারারাত না খেয়েই থাকা লাগবে।’
লুবনার পিছনে নামল তো বাস থেকে ঠিকই – কিন্তু ইমতির মাথা ভারী হয়ে থাকে দুশ্চিন্তায়। এতগুলো স্বপ্নের দৃশ্য কাকতালীয়ভাবে মিলে যেতে পারে না। কোথাও নিশ্চয় ভুল হচ্ছে – অবশ্যই।
ও কি স্বপ্ন দেখছে? এখনও? এটা একটা সম্ভাবনা হতে পারত – কিন্তু ডিটেইলসগুলো খুবই পরিষ্কার – এতটা স্বপ্নে থাকে না। পরীক্ষা করে দেখতে লুবনার চোখ এড়িয়ে বাম হাতে চিমটি দেয় সজোড়ে। ব্যাথার অনুভূতি তীহ্ম।
বাস থেকে নেমে পড়েছে ওরা – কথাটা মাথায় আসতেই মুক্তির সম্ভাবনা দেখে ইমতি। এখান থেকে বাসে না উঠলেই হয়। চুপচাপ কেটে পড়তে হবে কোন একদিকে।
*
কিন্তু চুপচাপ কেটে পড়াটা ভাবনাতেই সহজ, করা কঠিন। লুবনা এখন ওর সাথে। ওকে কি জবাব দিবে?
ওকে বলবে, ‘একটা স্বপ্নের ভয়ে বাসে উঠব না। চল নেমে পড়ি?’
স্রেফ গাধা ভাববে ওকে মেয়েটা। মস্তিষ্কের সুস্থতা হয়ে যাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। এ নিয়ে বন্ধুমহলেও যে টিটকিরি দেবে না পরে তা বলা যায় না।
তাছাড়া – দেশে টানা অবরোধ লেগেই আছে।
ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে কোন দলই হরতাল/অবরোধ দেবে না – সে কারণেই আজ ১৫ই ডিসেম্বরের দিনটিতে বাস ছেড়েছে সপ্তাহে প্রথমবারের মত। আবারও ১৭ তারিখ থেকে লাগাতার হরতাল শুরু। শুধু শুধু তো আর শেষ সিটের টিকেট পায়নি ও, কিংবা লুবনা। মেয়েরা সচরাচর অত পেছনের সিটে ভ্রমণ করতে চায় না নাইট কোচে। ঠেকায় পড়ে করতে হচ্ছে। কাজেই বাস থেকে নেমে যাওয়ার পাগলামীতে লুবনার সমর্থন পাওয়ার কোনই আশা নেই। স্রেফ ওর কানে ধরে টেনে তুলবে ওকে মেয়েটা।
দ্বিতীয়তঃ আরেকটা কারণে বাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই ইমতির। স্বপ্নের শেষটা দেখতে পায়নি ও কখনওই। বোমা ফাটার শব্দে বাস নিয়ন্ত্রণ হারায়। তারপর হলুদ রঙের ট্রাকের দিকে ছুটে যায় ওদের বাস। সংঘর্ষ কি তারা এড়াতে পেরেছিল? নাকি এটাই ইমতিয়াজ আহমেদের শেষ সফর?
স্বপ্ন অনুযায়ী যদি সব কিছু এগিয়ে যায় – তবে জানার একটাই উপায়। বাসে ভ্রমণ চালিয়ে যাওয়া।
গত চারদিনই স্বপ্নভঙ্গের পর ওর মনে এই প্রশ্নটাই উঁকি দিয়েছে – ওদের বাস কি ট্রাকের সাথে ধাক্কা খায়? নাকি ড্রাইভার সরিয়ে নিতে পারে শেষ পর্যায়ে? না, বাস ছেড়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। স্বপ্নের শেষটা দেখতে হবে ওকে।
২০ মিনিটের স্বল্প যাত্রাবিরতি শেষে আবারও বাসে উঠে পড়ে যাত্রীরা। আবারও আই-1 এ ফিরে আসে ইমতি। ওর আর লুবনার পাশের দুটো সীটে বসেছে বাচ্চা একটা মেয়ে আর তার আম্মু।
‘আম্মু, ভাইয়াকে আইসক্রীম দেই?’ ইমতিকে চোখের ইশারায় দেখিয়ে বলে ছোট্ট মেয়েটা। হেসে ফেলে লুবনা।
‘ভাইয়া আইসক্রীম খাবে না মা। তুমি খাও।’ হাসে মেয়েটার আম্মুও।
আইসক্রীমে এক কামড় দিয়ে ইমতিয়াজের দিকে আরেকবার তাকায় পিচ্চিটা। তারপর গভীর মনোযোগ দিয়ে আইসক্রীমে ডুবে যায় একেবারে।
ঘেমে ওঠে ইমতির কপাল। স্বপ্নে শিশুটার মুখে কাটা দাগ ছিল না ওটা – আইসক্রীম লেগে ঠোঁটের চারপাশে চকলেটের একটা কালচে আবরণ পড়াতে ওরকমই লাগছে এখন পিচ্চিটাকে।
বাস ছেড়ে দেয় আবারও। লুবনার সাথে গল্পে এমনভাবে ডুবে যায় ইমতি – স্বপ্নের কথা আবছা হয়ে আসে ওর মনে। বান্ধবী হিসেবে লুবনা প্রথম শ্রেণীর। কেন যেন ওর কাছে রুবাইয়াতের কথা শেয়ার করে ইমতি। সব শুনে দুঃখ পায় মেয়েটা।
‘আমার মনে হয় তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ।’ স্বান্তনা দেয় ওকে লুবনা। ‘যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে দীর্ঘমেয়াদী কিছু টিকবে কি করে?’
‘হয়ত তুমিই ঠিক।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমতি। ‘তবে আমি দোটানায় ভুগি না, তা না।’
‘প্রথম প্রেম যেহেতু – এটা স্বাভাবিক, ইমতি।’ ওর দিকে তাকায় লুবনা। ‘পরবর্তীগুলোয় দোটানা ছাড়াই ব্রেকআপ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।’
‘তাই?’ হাসে ইমতি।
‘সত্যি! আমার এক বান্ধবী – নাম বলব না। ও শেষ বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ করেছে তিনদিন হল। কারণটা শুনবে?’
‘বয়ফ্রেন্ড আরও দু-চার জায়গায় পাশা খেলছিল?’ আন্দাজে বলে ইমতি।
‘আরে নাহ – ওর দোষ ঘুমের মধ্যে ও নাক ডাকায়! চিন্তা করতে পারো – এত্ত হ্যান্ডসাম আর ভালো ছেলেটার সাথে উনি ব্রেকআপ করেছেন নাক ডাকা নিয়ে!’
হেসে ফেলে দুইজনই। বাসের গতি ধীরে ধীরে কমে যায়।
নড়ে চড়ে ওঠে ইমতিয়াজ। সামনের পার্টটাও খুব ভালো মত জানে ও।
*
ধুপ ধাপ শব্দ তুলে চারজন পুলিশ অফিসার উঠে পড়ে বাসটায়। ব্যাগ চেক করতে থাকে শুরু থেকেই।
নারকোটিক বিভাগের সদস্য থাকে এদের সাথে। মাদকদ্রব্য সহ যেকোন নিষিদ্ধ বস্তু আটক করতে বাংলাদেশের সড়কে কাজ করে যাচ্ছে এরা বহুদিন ধরে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বাস থামায় ওরা। এখানেও হয়তো তেমন কিছু পেয়েছে।
ডি-রোতে যেতেই সমস্যাটা দেখতে পেল ইমতি। সানগ্লাস একটা ছেলে ব্যাগ খুলতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানাল। ছেলেটাকে চিনে ইমতি। ওর ঠিক আগে লাগেজ বক্সে লাগেজ রেখেছিল এই ছেলে।
‘ঝামেলা না করে খুলে ফেলুন। নাহলে আপনাকে নামিয়ে আলাদা করে সার্চ করতে বাধ্য হব আমরা।’ সার্চ পার্টির প্রধান যথেষ্ট ভদ্রতার সাথেই বলে।
কিন্তু ভদ্রতার ধার ধারে না ছোকড়া। চোখের পলকে নড়ে উঠল সে। ব্যাগটি ছুড়ে দেয় সার্চ পার্টির দিকে। একগাদা কাগজ বেরিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল।
সেই সাথে ডি-থ্রি থেকে প্রৌঢ় ভদ্রলোককে জাপটে ধরে ডানহাতে। বামহাতে ভোজবাজির মত উদয় হয়েছে একটা শর্ট ক্যালিবারের পিস্তল। ভদ্রলোকের মাথায় নল ছোঁয়ায় ছোকড়া।
আৎকে উঠে মুখে হাতচাপা দেয় লুবনা। পাশে ইমতির তখন রীতিমত সন্দেহ হয় এই পিস্তলে মাছি পর্যন্ত মরে কি না! কিন্তু সার্চ করতে এসে হোস্টেজ সিচুয়েশনে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশদের স্তম্ভতা দেখে ও নিশ্চিত হল – এটাও মারণাস্ত্র।
‘উত্তেজিত হবেন না। আপনি বলুন কি চান?’ সার্চপার্টির লীডার গড়পরতার চেয়েও নরম করে ফেলেন গলা।
‘সবাই সরে যান। বাস থেকে নেমে যান।’ ভদ্রলোককে জিম্মি করে দুর্বৃত্তের গলা ভালোই খুলেছে, ‘আমি কোন জায়গায় বাস থামাব – সেটা আমার ইচ্ছে। পুরো বাসটিকেই জিম্মি বিবেচনা করার জন্য আপনার ওপরের র্যাংকের ওদের বলে দেবেন।’
‘ওকে। ওকে। তবে দুইটি মিনিট সময় দিন। আমি বড়কর্তার সাথে একটু যোগাযোগ করে নেই।’
‘ওক্কে! জাস্ট দুই মিনিট। এরচেয়ে কম বেশি নয়।’ গলা চড়িয়ে হুমকি দেয় পিস্তলধারী।
‘কাকে সময় বেঁধে দিচ্ছ?’ ওর ঘাড়ের পেছনে থেকে বলে ইমতি, ‘তোমার নিজের আছে তো দুই মিনিট?’
শব্দের উৎসের দিকে পাঁই ঘোরে পিস্তলধারী। পিস্তলের নলটা সরে যায় প্রৌঢ়ের কপাল থেকে।
গায়ের জোরে ধাক্কা দেয় ইমতি; নল বন্দীর কপাল থেকে সরে যেতেই। বদ্ধ জায়গায় গুলির বিকট শব্দ হল। ছাদে লেগে পিছলে ই1-এর জানালার গ্লাস ভেঙ্গে বেড়িয়ে যায় বুলেট।
ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে পুলিশরাও। তাকে জাপ্টে ধরে নিয়ে যেতে যেতে ব্যাখ্যা দেয় সুপারভাইজারকে, ‘জামায়াত-শিবিরের পক্ষে রাজাকারকে ফাঁসীর প্রতিবাদে সহিংস হামলা চালানোর জন্য বোমা নিয়ে যাচ্ছে এ চট্টগ্রামে। বক্স খোলা লাগবে। নামুন।’
ইমতির কাজ শেষ। বোমা উদ্ধার হয়ে গেলে শেষ দৃশ্যে কী ফাটার কথা? সংশয়ে পড়ে যায় ইমতি – বোমা কি ঠিকমত উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারল ওরা? নাকি দ্বিতীয় কোন বোমা ছিল গাড়িতে?
সীটে ফিরে আসতে গিয়ে বাতাসে উড়ে ওর মুখে আটকে আসে একটা কাগজ। দূর থেকে এগুলোই বেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আত্মঘাতী ছেলেটার ব্যাগ থেকে।
পড়ে দেখে ইমতি। একটা লিফলেট।
সবার ওপরে লেখা – “শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা অমর হোক”। রাগে লাল হয়ে ওঠে ইমতির সুন্দর মুখটা। দলা পাকিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে মারে ও কাগজটাকে।
লুবনাকে মাথা সামনের সীটে রেখে বসে থাকতে দেখে ইমতি।
ওকে আসতে দেখে দুর্বলভাবে মাথা তোলে ও। ‘তোমার যদি লাগত? তুমি এত সাহস দেখাও কেন…’ আবার মাথা পড়ে যায় ওর সামনের সীটে।
‘খারাপ লাগছে?’ লুবনাকে ধরে বসায় ইমতি। ‘জানালার পাশে চলে যাও তুমি।’
আই-ওয়ানে ওকে বসিয়ে জানালা খুলে দেয় ইমতি।
দুর্বলভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকে লুবনা।
বাস ছুটতে শুরু করেছে ততক্ষণে আবারও।
লুবনার পাশে আই-2 তে বসে পড়তেই পকেটে ফোনের ভাইব্রেশন টের পায় ইমতি।
বুঝে ফেলে – চলে এসেছে মাহেন্দ্রক্ষণ।
ঘুমন্ত লুবনার মুখের দিকে তাকিয়ে কবার ইতস্ততঃ করে উঠে পড়ে ফোনটা নিয়ে। সামনের দিকে হাঁটা দিয়ে কলটা রিসিভ করে। যেকোন সময় বোমা ফাটার কথা।
‘ইমতি, তুমি কোথায়?’ রুবাইয়াতের কান্নাভেজা গলা শোনে ইমতিয়াজ।
‘বাসে। কিছু বলবে?’ আবেগশূন্য গলায় বলে ও।
‘জান, আমি অনেক অন্নেক সরি। তোমার সাথে যা করেছি আমার একদমই ঠিক হয়নি। আমি অনেক খারাপ, না? চাওয়ার অধিকার নাই আমার – তাও – আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায় আমাকে?’
বুম!
বিকট শব্দের সাথে দুলে ওঠে পুরো বাস।
ছিটকে সামনে চলে যায় ইমতি। সুপারভাইজারের চিৎকার শুনতে পায়, ‘শিট! টায়ার পাংকচার! রহমত ভাই – দেইখেন!’
পাগলা ঘোড়ার মত এদিক সেদিক ছুটে যেতে চাইছে বাসটা। অনেক কষ্টে রাস্তায় ধরে রেখেছে ড্রাইভার। গতি কমানোর সুযোগ হল না।
ড্রাইভার রহমতকে ছাড়িয়ে আরও দূরে চলে যায় ইমতির দৃষ্টি। হলুদ রঙের ট্রাকটা বিভীষিকার মত ছুটে আসছে ওদের দিকে।
স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে ইমতিয়াজ।
লেখকের কথা
১৫/১২/১৩ – আজ রাত ৭টায় আসলেই আমার বাস। রাজশাহী – চট্টগ্রাম। আমার সীট আই-1। তবে আসলেই কোন দুর্ঘটনা ঘটে যদি আমার মৃত্যু হয় – সেজন্য আগেই বলে রাখি – কল্পনাপ্রসূত এই গল্প। বাস্তবে কারও সাথে (এমনকী আমার মৃত্যুর সাথেও) মিল পাওয়া গেলে তা অনভিপ্রেত ও কাকতালমাত্র। স্বপ্ন দায়ী নয়।
রচনাকাল ১৪ই ডিসেম্বর, ২০১৩
Leave a Reply