KP Imon

Words Crafted

সামাজিক হিপনোটিজম

এক.
অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে আসার পর থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তিথির। শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রিদের বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কালচারাল শো ছিলো। সেখানে টানা তিনটি হিন্দী গান তোলার পর আর নিতে পারেনি সে। সোজা বের হয়ে চলে এসেছে। এয়ার কন্ডিশনড রুম থেকে আচমকা কড়া রোদে বেরিয়ে আসার কারণে সামান্য অস্বস্তিও হচ্ছে। গায়ে মাখলো না ওটুকু, তবে সামনের দৃশ্যে কিছু একটা ভুল রয়েছে এটা বুঝতে পারছে। এই বিষয়টা গায়ে না মেখে উপায় রইলো না তিথির।

বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে যাত্রিদের বসে থাকার জন্য রাখা হয়েছে সিমেন্টের সীট। তাতেই বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে একটা ছেলে। বসার জায়গাটায় পিঠ দিয়ে লটকে আছে, হেলান দেওয়ার অংশ বরাবর দুটো পা বাড়িয়ে দিয়েছে আকাশের দিকে। এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায় না। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে পা বাড়ালো তিথি।

আরেকটু কাছাকাছি আসতে ছেলেটাকে চিনতে পারলো ও, মেকানিক্যালের শুভ্র। সাধারণতঃ চশমা পরে, চশমা খোলা রাখায় একটু অদ্ভুত লাগছে তাকে। প্রথমে চেনা যায়নি তাই। ছেলেটা একটু পাগলাটে টাইপের। রোবোটিক্সের বিভিন্ন কম্পিটিশনে ধারাবাহিকভাবে পুরষ্কার পেয়ে এসেছে বলে কেউ তার পাগলামি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। কথায় আছে, জিনিয়াসেরা একটু পাগলাটে গোছের হয়। সেই তকমাটাই পিঠে নিয়ে মহানন্দে ক্যাম্পাসের এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে শুভ্র। বেশিদিন আগে নয়, জুনিয়র একটা মেয়েকে চলন্ত সাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। এরকম একটা মানুষকে সহজে কেউ ঘাঁটাতে চায় না। তারপরও তার পাশে গিয়ে বসে পড়লো তিথি।

শুভ্রের ঝলমলে চুলগুলো মধ্যাকর্ষণের টানে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, চোখ সরাসরি নিজের উর্ধ্বগামী পায়ের দিকে নিবদ্ধ।
তিথির দিকে একবারও না তাকিয়ে বললো, “তুমি তিথি না? ইলেক্ট্রিক্যালের।”

জিনিয়াস পাগল তাকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছে সেটা ভালো খবর কি খারাপ তা তিথি জানে না। কাজেই সামান্য ভ্রু নাচিয়ে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। চিনলে কিভাবে? আমাদের আগে দেখা হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না।”

চুলগুলোয় ঘূর্ণি তুলে সোজা হয়ে বসলো শুভ্র, বাদুড়ঝোলা অবস্থা থেকে সোজা হতে যথেষ্ট কসরত করা লাগলো তাকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা দু’জন স্কুলছাত্রি ফিকফিক করে হাসতে হাসতে চলে গেলো।
“আমাকে চেনো তুমি?” শুভ্র জানতে চাইলো।
একটা কাঁধ তুলে ছেড়ে দিলো তিথি, “তোমাকে ক্যাম্পাসের সবাই চেনে।”
হাসলো ছেলেটা, তিথি লক্ষ্য করলো তার হাসির মধ্যে ভালো লাগার মতো কিছু নেই। হয়তো অবজ্ঞা বা আত্মদম্ভের ভাবটুকু বোঝা যায় বলে এমনটা মনে হলো ওর। নিশ্চিত হতে পারলো না সে।
তিথির কথাটাকেই অবশ্য প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স ধরে নিলো শুভ্র। বললো, “এইটাই পয়েন্ট। এই ক্যাম্পাসের সবাই সবাইকে চেনে।”

ঠোঁটদুটোকে চেপে বিজ্ঞের মতো মাথা দোলালো তিথি। একমত হয়ে যাওয়াটাই হয়তো এখানে তার জন্য ভালো।

বুক পকেট থেকে চশমাটা বের করলো শুভ্র। বেশ মোটা কাঁচের চশমা। চোখটাকে ছেলেবেলা থেকেই খেয়েছে সে, তবে বাদুড় ঝোলার সময় অজ্ঞাত কোনো কারণে চশমা খুলে রেখেছিলো। চশমা চোখে দিতে দিতে বললো, “তবে তোমাকে চশমা ছাড়াও চিনতে পেরেছি অন্য একটা কারণে।”

আগ্রহ নিতে তার দিকে তাকালো তিথি।
“কোন কারণে?”
একটু কাশলো শুভ্র, “আসলে, ফার্স্ট সেমিস্টারে তোমার ওপর ক্রাশ খেয়েছিলাম।”
মৃদু হাসলো তিথি, “কিউট তো!”
“প্রোগ্রামে যাওনি?” প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো শুভ্র।
“গেছিলাম। একটার পর একটা-”
“হিন্দী ঝাড়ছে, তাই তো?” মিটিমিটি হাসে শুভ্র, “আমিও সেজন্য বেরিয়ে এসেছি। দেশে মনে হয় ভাষার খুব আকাল পড়েছে! নোয়াখালি, চিটাইঙ্গা, বরিশাইল্যা বা সিলেটিতে গান করলেও মেনে নিতাম। তারা বর্ডার পেরিয়ে যাবে। একেবারে সীমানা পেরিয়ে, ভারতমাতার আঁচল তলে।”

ক্ষুব্ধ শুভ্রকে ভালো লেগে যায় তিথির, একটু আগের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। খোলা মনের ছেলে, ক্রাশ খাওয়ার কথাটা ক্রাশের সামনে চটপট বলে ফেলে না নাহলে কেউ। তারওপর হিন্দী সহ্য করতে পারে না। রক্তাক্ত বায়ান্নোর পর বিজাতীয় ভাষাকে বাংলার ওপর প্রাধান্য দিলে কোনো সচেতন বাংলাদেশিই তার নিন্দা না করে পারে না। ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই।

“ভাবছি এই প্রোগ্রামই বর্জন করবো নাকি।” শুভ্রকে বললো ও।
ছেলেটা অবশ্য কোনো মন্তব্য করলো না। তিথির কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নজর বোলাচ্ছে। একটু অস্বস্তিই হলো ওর। পরক্ষণেই কেটে গেলো শুভ্রের কথাটা শুনতে পেয়ে,

“ধ্যাত, জিন্স পরোনি। নাহলে তুমিও বাদুড় হয়ে থাকতে পারতে এখানে।”
উঠে দাঁড়িয়ে ওপরে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গলো শুভ্র। পাশেই চা-সিগারেটের দোকান পেতে বসে আছেন রইসুদ্দি মামা। ভার্সিটির সবার প্রিয় মুখ। ব্রেক টাইমে অনেকেই এই কাউন্টারের সিটগুলোতে বসে আড্ডা দেয়। সেই সাথে রসদ নেয় রইসুদ্দি মামার দোকান থেকে। তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই একটা মার্লবোরো আর লাইটার হাতে চলে এলো শুভ্রর।

রোদের আক্রমণ থেকে চোখ বাঁচাতে অযথাই খানিক পিটপিট করলো সে। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে পরিমিত টান দিলো বারকয়েক। তাতেই এলাকা ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। তিথির দিকে তাকিয়ে মুখ নাচালো তারপর।
“প্রোগ্রাম বর্জন করবে যখন, চলো।” আবারও চোয়াল বাঁকিয়ে মুখ ঝাঁকালো শুভ্র, “বাসায় চলো।”
“ও হ্যাঁ, তুমি তো আবার লোকাল।” এতটুকুই বললো তিথি। ছেলেটার স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথা বার্তায় রীতিমতো স্তব্ধ সে।

একটু আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় হয়েছে তাদের। এর মধ্যে অনায়াসে তাকে জানিয়ে দিয়েছে একটা সময় (কিংবা হয়তো এখনও) তার প্রতি দুর্বল ছিলো সে। তারপর তাকে রীতিমতো ‘স্ক্যান’ করেছে। এবং এখন প্রস্তাব দিচ্ছে তার বাসায় যাওয়ার জন্য। শুভ্রের পরের কথাটা আরও চমকে দিলো তাকে।

“কই, চলো?” হাত বাড়িয়ে কাওকে ডাকলো সে, “একটা রিকশা নেই।”
রিকশাওয়ালা এসে গেছে, তিথি এখনও কিছু বলার সুযোগই পায়নি। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে তিথির সামনে এসে দাঁড়ালো শুভ্র। ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, “এসো। খুব দূরে না আমার বাসা।”

“তোমার বাসায় যাবো কি করতে?” না বলে আর থাকতে পারলো না তিথি, “এখানে থাকতেই ভালো লাগছে আমার।”
বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠলো শুভ্রের মুখে, “বুঝেছি। বাসায় গিয়ে তোমার সাথে কি করবো সেটা ভাবছো তো? আরে সেই ভয় নাই। একদম খালি বাসা। মম-ড্যাড গ্রামের দিকে গেছে। দুই তিন দিন পর আসবে হয়তো।”

রীতিমতো ক্ষেপে উঠলো তিথি। তবে কিছু বলতে পারলো না। শুভ্রের চোখে চোখ পড়তে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। ওর সাথে মজা করছে ক্যাম্পাসের জিনিয়াস পাগল! পিত্তি জ্বলে গেলো তিথির।

ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ালো এবার, “চলো।” রিকশাতে উঠে গেলো সরাসরি, “তোমার বাসাতেই যাবো এখন।”
ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে আর ফক ফক করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রিকশাতে উঠে পড়লো শুভ্রও।

দুই.
তিনতলা বাড়িটার সামনে থেমে গেলো রিকশা। ক্যাচ ধরে ধরে চাবির গোছাটা নিয়ে খেলছে শুভ্র। পাশে হেঁটে আসা তিথির দিকে যেনো কোনো নজরই নেই। বিশাল গ্যারেজের দরজার এক কোণে ছোটো দরজা, সেটা খুলে ফেললো নির্দিষ্ট চাবি ব্যবহার করে। তারপর ধরে থাকলো কিছুক্ষণ, তিথিকে ঢোকার সুযোগ করে দিচ্ছে। ভেতরে পা রেখে একটু চমকালো ও, গ্যারেজে যে চারটা গাড়ি আছে, তার তিনটার কোনটাই কয়েক কোটির কম দামের নয়। রেসিং কারই দুটো।

শুভ্রদের টাকা আছে, ভাবলো তিথি।

সিঁড়িঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুভ্র, তাকে একটু জোরে পা চালিয়ে ধরে ফেললো তিথি।
“তোমাদের গ্যারেজের ভেতরে যা যা আছে তা বিক্রি করে দিলেই তো আরেকটা অডিটোরিয়াম বানাতে পারবে ভার্সিটি।” কথার কথা হিসেবেই বললো যেনো তিথি।
হাহা করে হাসলো শুভ্র, “ফুটানি দেখানোর জন্য কিনেছিলো বাবা। এখন পড়ে আছে। ওই টাকাটা আমাকে দিলে দুনিয়ার স্যাটেলাইট হিস্টোরিই পাল্টায়ে দিতাম।”

আর কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিলো তিথি। দোতলার দরজায় এসে আরেকটা চাবি বের করলো শুভ্র। বড় একটা তালা ঝুলছে ওদের দরজায়। খটকা লাগলো তিথির। এতো মূল্যবান গাড়িগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য নিচে একজন মানুষও নেই। কেনো? দারোয়ান তো একজন রাখাই যেতো। তাছাড়া এই গাড়িগুলো বের করার সময় গ্যারেজের দরজা খোলা আর লাগানোর জন্য হলেও একজন গেট ম্যানের তো দরকার। কিন্তু কেউ ছিলো না নিচে। কেনো ছিলো না? আবার এখানে শুভ্র তার বাড়ির দরজা থেকে তালা খুলছে।

তাহলে, আসলেই তার বাসায় কেউ নেই।
ফাঁকা বাসায় তিথিকে নিয়ে এসেছে শুভ্র। কি তার উদ্দেশ্য?

এক পা পিছিয়ে গেলো তিথি। “তোমার বাসায় কেউ নাই?”
অবাক হতে ওর চোখে চোখ রাখলো শুভ্র, “তোমাকে না বললাম, বাসার সবাই গ্রামে গেছে?”
দুই হাত বুকের কাছে বাঁধলো তিথি। এবার সত্যিই রাগ হচ্ছে ওর।
“খালি বাসায় আমাকে আনলে কেনো?”
মুচকি হাসলো শুভ্র, “তোমার পর্ন ভিডিও বের করার জন্য। আমি এটাই করি। একা একটা মেয়েকে নিজের বাসায় এনে তার সাথে অনৈতিক কাজ কর্ম করি। আমার ক্ষুদে রোবটেরা তা ভিডিও করে। তারপর সেই সব ভিডিও চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়। আমার উদ্দেশ্য তোমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে?”

থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিথি। গনগনে আঁচ বের হচ্ছে যেনো মুখ থেকে। ফর্সা মুখটা এখন টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তিথির নিজেরই মনে হচ্ছে তার কান গরম হয়ে গেছে। রাগে না লজ্জায় তা সে বুঝতে পারছে না। সিঁড়িঘরের ভেতরটা খানিক অন্ধকার। কিন্তু কেনো জানি বন্দীত্বের অনুভূতি হচ্ছে না তার।

“চলে এসো ভেতরে।” ঢুকে পড়লো শুভ্র, তিথির ওপর আক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে, “আগেই তো বলেছি তোমার ওপর ফার্স্ট সেমিস্টারে ক্রাশ খাওয়া আমি। ভয় পাচ্ছো কেনো? খুব বেশি কিছু হলে জাপ্টে ধরে চুমু-টুমু খেয়ে ফেলতে পারি, এর বেশি আর কিছু ক্রাশের সঙ্গে করা যায় নাকি? তোমার ভয় পাওয়ার কিছু তো দেখি না।”

বিষয়টা তিথির কাছে ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। শুভ্রর মতো ছেলে সে জীবনে একটাও দেখেনি। তার ব্যাপারে অনেক প্রশংসা শুনেছে এতোদিন, তবে ব্যক্তিগতভাবে শুভ্রকে চেনে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ব্যক্তি শুভ্রকে চিনতে তিথির কেমন লাগছে সেটা সে বুঝতে পারছেন না। কখনো মনে হচ্ছে শুভ্রকে জানতে পারাটা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। আবার কখনো মনে হচ্ছে এটা আর এগিয়ে যেতে না দেওয়াটাই উচিত।

সামনে শুভ্রের বাসায় ঢোকার মূল দরজা হা করে খোলা। তাকে হাতছানি দিয়েছে শুভ্রও, তবে এর ভেতর ঢুকে পড়া উচিত হবে কি না তা সে বুঝতে পারছে না। ধীর ও কম্পিত পায়ে ঢুকে পড়লো তিথি। শুভ্রের হাতে মোবাইলফোন। একটা কিছু করতেই পেছনে দড়াম করে দরজাটা লেগে গেলো।

“অ্যান্ড্রয়েড একটা অ্যাপ বানিয়ে নিয়েছি। আমাদের সিকিউরিটি খুবই স্ট্রং।” সগর্বে বললো শুভ্র, “কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারবে না, যদি আমি না চাই।”
“তাহলে বাইরে পুরাতন আমলের অ্যানালগ লক ঝোলানোর দরকার কি ছিলো?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো তিথি।
“ওল্ড ইজ গোল্ড।” ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলো সে। তিথি কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা কাঁচের বোতল তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে সে। শুন্যে খপ করে ধরে ফেলতে ফেলতেও ফেলে দিচ্ছিলো তিথি, আরেকটু হলেই মেঝে ভেসে যেতো কোক আর কাঁচের টুকরোয়। অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে গেলো তার মুখ থেকে।
“আমার রুমে চলো।” সরসরি সামনে হাঁটা দিলো শুভ্র।

বদ্ধ এই দরজাটাও মোবাইলের সাহায্যে খুললো সে। তারপর সরে জায়গা করে দিলো তিথির ঢোকার জন্য। ছিমছাম ঘর। একটা ডাবল বেড, কম্পিউটার টেবিল আর একটা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। দেওয়ালের সাথে লাগিয়েই বানানো হয়েছে বইয়ের তাক। সেগুলোতে ঠাসা নানা ভাষার বই। ডাবল বেডের ঠিক মাথার কাছে দেওয়াল জুড়ে সাঁটা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ নগ্ন নারীদেহের ছবি। নারীটির মাথায় ঘন সোনালিচুল, দৃষ্টিনন্দন দেহসৌষ্ঠব। চেনা চেনা মনে হলেও তিথি নিশ্চিত হতে পারলো না।

“কিসা সিনস।” শুভ্র বললো খাটের পাশে দাঁড়িয়ে, “আমার প্রিয় পর্ন তারকা। জনি সিন্সের ওয়াইফ।”
মাথা দোলালো তিথি, “জনি সিন্স কে?”
“আরেকজন পর্ন স্টার।” অবাক হয়ে উত্তর দিলো শুভ্র, এতো সহজ প্রশ্ন যেনো জীবনে শোনেনি, “কিসা সিন্সের হাজব্যান্ড।”
“ও।” এতটুকুই বললো তিথি। স্কুলটা নদীর সামনে, আর নদীটা স্কুলের পেছনে জাতীয় উত্তর দেওয়া হলে আর কি বলার থাকে?
“তুমি বসো। আমার পিসিটা অন করি।” দেওয়ালের সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো সে। এর সঙ্গে মনে হয় অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সংযোগ রাখা যায়নি।

ডাবল বেডে বসে তিথির দেহে চনমনে একটা ভাব চলে আসলো। ঝকমকে ঘর, দেওয়ালে উত্তেজক পোস্টার আর শুভ্রের খোলামেলা কথা, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণ। তিথির মনে হলো সে সামান্য সম্মতি দিলেও এই ঘরে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে আজ। শুভ্র জানে, সে-ও জানে এমন কিছু আজ এখানে হবে না। অথচ সম্ভাবনা তো রয়েছে। বিন্দুমাত্র হলেও! সেটাই চনমনে অনুভূতিটার পেছনে কাজ করছে।

অবাক হয়ে তিথি লক্ষ্য করলো, শুভ্রকে সে বিশ্বাস করে। কেনো? এটা সে জানে না।

“আংকেল আন্টি কিছু বলে না?” গলা খাকারি দিয়ে জানতে চাইলো তিথি।
“কি বলবে?” সেই চিরায়ত অবাক অবাক দৃষ্টি এখন শুভ্রর চেহারায়। ও আবিষ্কার করলো এই অভিব্যক্তিতে ছেলেটাকে বেশ সুন্দর দেখায়।
“এই যে…” আরেকবার কাশলো তিথি, “কিসা সিনসের ন্যুড ফটোগ্রাফ বেডরুমে রেখেছো।”
কাঁধ ঝাঁকালো শুভ্র, “আরে আমার পেশাই তো ওই। মেয়েদের ধরে এনে এনে তাদের পর্ন ভিডিও বের করা। ওই খাটে কতোজনের ইজ্জত গেছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”

ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিথি, “সিরিয়াসলি? এসব লো ক্লাস জোকস ছেড়ে কি লাভ হচ্ছে, শুভ্র?”

ঝট করে মাথা ঘুরালো শুভ্র।
এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো তিথির চোখে চোখ রেখে। শিউরে উঠলো ও, অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা অনুভূতি হচ্ছে। এক সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে অনন্ত কাল। কালো চোখের তারায় অশুভ কিছু আছে ছেলেটার। সে যা বলছে সবই কি মীন করে বলেছে? তিথির এতো অনিশ্চিত লাগছে, এমন আগে কখনও হয়নি। অথচ চলে যেতে ইচ্ছে করছে না। ছেলেটা অন্যরকম। তার সান্নিধ্য ভালো লাগছে ওর।
ভীতিকরও লাগছে!

“এগুলো জোকস মনে করছো কেনো, তা কি তোমার জানা আছে তিথি?” কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র। অজান্তেই হাতে ধরে রাখা ঠাণ্ডা বোতলটা চেপে ধরলো ও। কিন্তু তার দিকে আসছে না ছেলেটা, দেওয়ালের কাছে একটা তাকের সামনে দাঁড়ালো। বটল ওপেনার বের করলো একটা। নিজের কোকটা খুলে তিথির দিকে ছুঁড়ে দিলো। এবার অল্পের জন্য কপাল কাটা থেকে রক্ষা পেলো ও।

“জিনিস ছুঁড়ে দেওয়ার অভ্যাসটা খুব খারাপ তোমার।” ঝাঁঝিয়ে উঠে কোকটা খুললো তিথি।
“আসলে, তুমি সামাজিক হিপনোটিজমে আটকে গেছো। দ্যাটস অল।” নিজের কথার খেই ধরলো শুভ্র, “সেজন্য আমি যাই বলি তোমার কাছে অন্যরকম লাগে। নতুবা ধরে নাও স্রেফ জোকস ছাড়ছি।”

খাটে উঠে তিথির মুখোমুখি বসলো সে। বোতলটা একটু সামনে এনে ঠুকে দিলো মেয়েটার বোতলে, “চিয়ার্স।”
শুভ্রের শরীরে গন্ধ পেলো ও, এখনও মাংসপেশি টান টান হয়ে আছে তিথির। সাবধানে চুমুক দিলো বোতলে।

হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলো শুভ্র, “ফাইন। আমি পর্ন-টর্ন বানাই এসব সত্যি না। ওসব লো ক্লাস জোকস-ই ছিলো।” তারপরই তিথির পিত্তি জ্বলে যাওয়ার মতো হাসি হাসলো সে, “কিন্তু সেই লো ক্লাস জোকসেই তোমার চেহারার যে দশা হয়েছিলো!” মেয়েটার উরুতে মাঝারি এক চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র, “টেনশনের কিছু নাই। কোকটা শেষ করো। আমি লাঞ্চের ব্যবস্থা করি। বিফে তোমার প্রবলেম আছে?”

কটমট করে তার দিকে তাকালো ও, “হ্যাঁ। আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে, জানো না?”
গাল চুলকাতে চুলকাতে কিচেনের দিকে চলে গেলো অদ্ভুত ছেলেটা।

তিন.
ক্লাস থেকে বের হতেই নেহালের সাথে দেখা হয়ে গেলো তিথির। কাঁধে ব্যাগ আর হাতের বোঝা সদৃশ খাতা নিয়ে হাঁসফাঁস করছে। ওদের সিআর (ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ)দ্বয়ের একজন এই ছেলেটা, তবে কাজের সময় তার আশেপাশে কাওকে দেখা যায় না। মায়াই হলো তিথির।

“দে, আমার হাতে দে কিছু।” এগিয়ে গিয়ে বললো ও।
করুণ একটা হাসি হাসলো নেহাল, একটা বান্ডিল ওর হাতে তুলে দিলো, “থ্যাংকস। কি খবর তোর?”
“তোর চেয়ে ভালো, যা দেখতে পাচ্ছি।” চোখ টিপলো তিথি।
“গর্তে পড়লে হাতিকে চামচিকাও লাথি মারে। পরীক্ষিত।” হতাশ কণ্ঠে বললো নেহাল।
“নিজেকে চামচিকা প্রমাণের চেষ্টা না করে অন্য সিআরটাকে একটু ঝাড়ি-টারি দিস। সব দায়িত্ব তো তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিদেয় হয় দেখি।” কপট রাগের সাথে বললো তিথি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলো ওরা। গন্তব্য, ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং। স্যারের রুমে সব খাতা জমা দিয়ে এসে শান্তি। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গতে মুখ খুললো নেহালই।
“শুভ্রর সাথে তো তোকে রেগুলার দেখা যাচ্ছে শুনলাম।” অর্থবোধক উচ্চারণে বললো নেহাল।
“তো? একসাথে রেগুলার বের হলে তো রেগুলারই দেখতে পাবি। অবাক হচ্ছিস যে?”
“অবাক হবো কি আর? জানতে চাইলাম, প্রেম ট্রেম করছিস কি না, তাই আরকি। করলেই আমাদের লাভ, স্বীকার করতে বাঁধা নাই।”
“আমি প্রেম করলে তোদের কি লাভ?”
“ট্রিট পাবো যে। গ্র্যান্ড ট্রিট।”

ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং থেকে ফেরার সময় ক্যাম্পাসের আগুন ধরানো সুন্দরী মেহজাবিনের সাথে দেখা হয়ে গেলো তিথির। মডেলিং-টডেলিংও করছে আজকাল। তিথিকে দেখতে পারে না এই মেয়ে, কেনো কে জানে। অবশ্য মেহজাবিন ক্যাম্পাসের কোনো সুন্দরী মেয়েকেই দেখতে পারে না। মুখে প্রকাশ না করলেও তার আচরণ তেমনটাই বলে। বরাবরের মতো তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিলো তিথি, পারলো না।

আগ্রহী মেহজাবিন গায়ে পড়ে কথা বলতে এলো আজ। “কি রে সুন্দরী, কি খবর তোর? তোকে কয়েকদিন ধরে খুঁজছি আমি।”
“আমাকে খুঁজছিস?” অবাক হয়ে গেলো তিথি। “কেনো?”

মেহজাবিন ওকে একটা কারণেই খুঁজতে পারে। হয়তো কোনো প্রতিযোগিতায় দুইজনই অ্যাটেম্পট নিয়েছিলো, তাতে তিথি বাদ পড়েছে তবে মেহজাবিন টিকে গেছে। তেমন কোনো খবর জানানোর জন্যই কেবল এই মেয়ে অন্য কোনো সুন্দরীকে খুঁজে। এসব তিথির জানা আছে। মনে করার চেষ্টা করলো, এর মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলো কি না। মনে তো হয় না।

“আরে, শুভ্র তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না?” শুরু করলো মেহজাবিন। একটু আগেই তিথির খবর জানতে চেয়েছিলো এবং তিথি যে সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি সেদিকে তার আর নজর নেই এখন। আসল কথা পাড়তে পারলে ফরমালিটিতে সময় নষ্ট করে কে? “শুভ্রর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তোকে। পরিচয় মানে ডেট। একটা ডেট ম্যানেজ করে দিবি তুই আমাকে। পারবি না?”
মুচকি হাসলো তিথি, “শুভ্র তোর সাথে ডেট করতে রাজি হবে কেনো?”
“হবে নাই বা কেনো? ভালো ছেলে ও, ফ্রি মাইন্ডেড। অরাজি হওয়ার তো কিছু দেখি না। অবশ্য তোকে এসব বলে কি লাভ? তুই ওকে আমার চেয়ে ভালো চিনিস।” তিথির হাতে চিমটি কাটলো মেহজাবিন, ন্যাকামি দেখে তিথির গা জ্বলে যেতে থাকলেও কিছু বলতে পারলো না।

মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললো মেহজাবিন, “পারবি তুই, আমি জানি। আর শোন্, ওকে কিন্তু ভালোমতো বানিয়ে দিতে হবে। বুঝিয়ে দিস আমি ওর ওয়ান নাইটার হতে চাইছি। সেক্স-টেক্স নিয়ে আমার কোনো বাড়তি কুসংস্কার নাই। এটা যেনো সে জেনে রাখে।”
তিথি কিছুই বুঝতে পারছে না এখন, “ওকে এক রাতের জন্য বিছানায় তুলে তোর কি লাভ?”
“তুই গাধা নাকি? ওর ডিজাইন করা স্যাটেলাইট যে ইউরেনাস যাচ্ছে সামনের বছর তা জানা আছে তোর?”
কাঁধ ঝাঁকালো তিথি, “জানবো না কেনো? দারুণ কাজ করেছে ও। বাংলাদেশের জন্য গর্বের হবে এটা।”
“সেইজন্যই ওকে আমার লাগবে রে। প্লিজ দোস্ত, ম্যানেজ করে দে না?” মেহজাবিন পারলে তিথির পায়ে পড়ে যায়, “অবজার্ভার টিভিতে কাজ করার সুযোগ পেতে যাচ্ছি আমি, শুনেছিস? আমার প্রোগ্রামে একবার শুভ্রকে নিয়ে যেতে পারলে কি হিট হবে চিন্তা করে দ্যাখ? ক্যারিয়ার আমার রকেটের বেগে ওপরের দিকে ছুটবে।”

আচ্ছা! এবার সবটা স্পষ্ট হলো তিথির কাছে। এখন শুভ্রর সাথে একরাত কাটাতে পারলে তার সঙ্গে একটা ইন্টিমেসি হবে। এরপর এক বছর পর শুভ্র হয়ে যাবে ন্যাশনাল হিরো। সঠিকভাবে বললে ইন্টারন্যাশনাল হিরো। গোটা দুনিয়ায় তাকে নিয়ে মাতামাতি হবে। এই ছেলে নাসাতে ঢুকে যাবে এটাও অনেকে নিশ্চিত। বাংলাদেশের সবাই ডক্টর ইউনুসের পর পরই চিনবে তাকে। বলাবলি করবে, ইউরেনাসকে চক্কর দিতে থাকা স্যাটেলাইটটা বানিয়েছে আমাদের একজন। একজন বাংলাদেশি। তখন সেই বাংলাদেশিকে নিয়ে স্টুডিওতে যাবে মেহজাবিন। একবছর পর। মেয়েটার দূরদর্শিতা দেখে চমৎকৃত হলো তিথি।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অবশ্য উল্টোটা বুঝলো মেহজাবিন, “কিরে, তোদের মধ্যে কি প্রেম চলে? তোর আর শুভ্রর?”
মাথা নাড়লো তিথি, “না রে। ও মুসলিম না? আমার সাথে প্রেম কিভাবে?”
“আরে বাদ দে। হিন্দু মুসলমান সে দেখে বলে মনে হয় না। আমার কি ধারণা জানিস? শুভ্র নাস্তিক। তুই জিজ্ঞাসা করে দেখিস একদিন। যাই হোক, প্রেম করছিস না দেখে ঝামেলা কমলো। নাহলে ওর সাথে শোয়ার জন্য তোর অনুমতিও লাগতো।”
মুচকি হাসলো তিথি, “এর আগে এই কাজ যাদের সাথে করেছিস সবার গার্লফ্রেন্ডের অনুমতি নিয়েছিলি?”
মাথা নাড়লো মেহজাবিন, “তাদের গার্লফ্রেন্ডদের কেউ আমার ফ্রেন্ড তো ছিলো না। অবশ্য শুভ্রকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না। এক রাত ওকে পেলে, ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবো একেবারে। এর পর আরও অনেকবার সে নিজে থেকেই আমার কাছে আসবে। ছেলেরা কি পছন্দ করে আমার জানা আছে। তুই শুধু ফার্স্ট নাইটের সেটআপটা করে দে। বাকিটা দেখছি। শুভ্রকে আমি হিট করে দেবো।”

সেই সাথে নিজেও হিট হবা, মনে মনেই বললো তিথি। সব কথা মেহজাবিনের মুখের ওপর বলতেই হবে এমন তো না। আরও কিছুক্ষণ বক বক করলো মেহজাবিন। পুরোটা সময় অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখলো তিথি। বিদায়ের সময়ও আদিখ্যেতার চূড়ান্ত করলো সে। ক্যাম্পাসের মাঝখানেই বেস্ট ফ্রেন্ডদের মতো তিথির গালে চুমু খেলো, তারপর দুই আঙুল নেড়ে টাটা দিলো তাকে। মেহজাবিনের সব কাজের পেছনেই স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। ক্যাম্পাসের কেউ এসব কাজে এখন আর পাত্তা দেয় না। তারপরও আড়ালে হাসলো কেউ কেউ।

সেদিন হলে ফেরার সময় শুভ্রের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটা মনে করলো তিথি, প্রায় একবছর হয়ে গেলো!
হ্যাঁ, খুব নার্ভাস ছিলো সে ওইদিন। অসহায়ও ছিলো। শুভ্রের সুরক্ষিত বাড়ির ভেতরে একদম কোণার ঘরে শুভ্রর সঙ্গে বন্দী। বাসায় আর কেউ ছিলো না। শুভ্র তার সঙ্গে যা ইচ্ছে করতে পারতো। কোনো সাক্ষী ছিলো না সেদিন। কিন্তু কিছুই করেনি সে। দু’বার ওকে স্পর্শ করেছে কেবল। হাসিচ্ছ্বলে একবার উরুতে চাপড় দিয়েছে ওকে বোকা বানিয়ে, আরেকবার ফিস্ট বাম্প করেছে, বিদায়ের সময়। আর কিচ্ছুটি না।

শুভ্র জানে না, ওই দুটো স্পর্শের সময়ই তিথির বুকে ঝড় উঠেছিলো।

চার.
মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কাজ করছে শুভ্র। মনিটরে দেখা যাচ্ছে অসম্পূর্ণ একটা ডিজাইন। কিসের, তা আরও অস্পষ্ট। তবে সেটা বোঝার চেষ্টাও করলো না তিথি। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রকে।

“তিথি নাকি?” মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই জানতে চাইলো শুভ্র, “তোকে খুব খুশি খুশি লাগছে মনে হচ্ছে।”
ওকে ছাড়লো না তিথি, “খুশি হওয়ার কারণ আছে। তোর কাজটা শেষ কর, আমরা বাইরে ডিনার করছি আজ।”
মাউস থেকে হাত সরিয়ে তিথির দিকে মুখ ফেরালো শুভ্র, নাকে নাক ঠেকে গেলো ওদের, “বাইরে কেনো রে? ঘরে অনেক খাবার আছে, মম রাতে স্পেশাল আইটেম করছে আজ। বাইরে যাওয়াই যাবে না।”

শুভ্রের কথা শেষ হওয়ার আগেই “মম” ঢুকে গেলেন ভেতরে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হবে ভদ্রমহিলার। দেখতে একেবারে বলিউডের কোনো বর্ষীয়ান হিরোইন। তিথি যতবার তাঁকে দেখে, ওর মনে হয় শুভ্রের চেহারার সৌন্দর্যটা হয়তো মায়ের দিক থেকেই এসেছে।

“কি? আমাকে নিয়ে কি ব্যাকটকিং করছিস তোরা?” হাসিমুখে জানতে চাইলেন তিনি।
শুভ্রকে জড়িয়েই রাখলো তিথি, “না আন্টি, তোমার প্রিন্সকে বাইরে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সে তো যেতেই চাইছে না। কি করা যায় বলো তো।”
“যাবে কি রে?” অবাক হয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি এখন মহিলার মুখে, ঠিক শুভ্রের মতো। তিথির হাসি পায় খুব, “আমি রান্না করছি আজ কতোদিন পর, আর তোরা বাইরে যাবি মানে? কোথাও যাওয়া চলবে না।”

আলতো করে মাথা ঝাঁকালো তিথি, এটা কোনো সমস্যা না। অন্য কোনোদিন গেলেই চলবে। মুখে শুধু বললো, “ওকে, আন্টি।”
বের হওয়ার সময় কিসা সিন্সের পোস্টারটার দিকে চোখ পড়লো আন্টির, “আর শুভ্র, তুই এই এক মেয়ের মধ্যে কি এমন পেয়েছিস রে? দেখতে দেখতে আমারই চোখ পচে গেলো। বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখেছিস, যত্তোসব! দুনিয়ায় আর মেয়ে নাই?”

গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি। হেসে ফেললো তিথি, কিসা সিন্সের যে পোস্টারটা এখন পুরো একটা দেওয়াল জুড়ে আছে তা অবশ্যই এক বছর আগের ছবিটি নয়। এর মধ্যে খুব সম্ভবতঃ সাতবার পোস্টার পাল্টেছে শুভ্র। প্রতিবারই কিসা সিন্সের ছবি ঝুলিয়েছে এবং প্রতিবারই সম্পূর্ণ নগ্ন সে ছবিগুলো। তবে এসবে ওদের পরিবারের কারও চোখ বা ভ্রু কুঁচকে যায় না। এগুলো তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবে নেন। আন্টির আপত্তি কিসা সিন্স নিয়ে। তার শরীর চোখের সামনে এতোবার পড়েছে তিনি আর মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারছেন না।

তিথি প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে পারতো না। একটু অস্বাভাবিক মনে হতো ওদের পরিবারটিকে। তবে এখন আর তেমনটা লাগে না। মনে হয় এটাই হয়তো সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি। ওরা সমাজে নিষিদ্ধ আর ‘অ’নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে একই পর্যায়ের খোলামেলা আলোচনা করেন। এজন্য তাদের সামনে তাদের ছেলেকে ছেলের বান্ধবী জড়িয়ে ধরতে পারে, নগ্ন পোস্টার দেখলে তাঁরা চোখ কপালে তুলে ফেলেন না। শুভ্রকে কখনও মেয়েদের প্রতি বাজে কোনো ধারণা রাখতে দেখেনি তিথি। তাদের ছোটো করতেও দেখেনি। পজেটিভ চিন্তাভাবনা গুলো হয়তো পরিবারের সুশিক্ষার কারণেই সে পেয়েছে। এখন আন্টি আর আংকেলের কাজটাকেই ঠিক মনে হয় তিথির।

“নতুন কিছু পেয়েছিস মনে হচ্ছে। আমাকে শোনাবি দেখে চলে এসেছিস। আর সেইটা বাইরে নিয়ে বলার জন্য ডিনার বাইরে করতে চাইছিস।” কম্পিউটার ছেড়ে সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে তিথির মুখোমুখি হলো শুভ্র, “তাই না?”
“তুই তো জিনিয়াস পাগল। তোর কাছে লুকানো সম্ভব না কিছু।” হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো তিথি।
“তাহলে বলেই ফ্যাল, এবারের হট নিউজটা কি?” চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো শুভ্র।

একটু পিছিয়ে গিয়ে ধপাস করে শুভ্রের খাটে শুয়ে পড়লো তিথি। দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে দুই পাশে, চুল এলিয়ে দিয়েছে পেছনে। পালকের তোষকের এই খাট খুবই আরামদায়ক। শুলেই ঘুম পায় ওর। আরামে চোখ বন্ধ করে বললো, “নিউজটা হট-ই। মেহজাবিন রিলেটেড।”
“কোন মেহজাবিন, আইপিই’র? প্র্যাক্টিক্যাল একটা মেয়ে। ভালো মেয়ে।” শুভ্র বললো।
চোখ খুলে গেলো তিথির, “কি রে? এতো অ্যাডজেক্টিভস? প্র্যাক্টিক্যাল, ভালো? আরে ব্যাটা ওই মেয়ে তোর সাথে একরাত কাটাতে চাইছে। পবিত্র মেয়ে তোমার, কুমারী নাম্বার ওয়ান।”

চোখ পিট পিট করলো শুভ্র, “তাতে কি হলো? অবজার্ভারে কাজ পেয়েছে ও, একটা সায়েন্স রিলেটেড শো-র অ্যাংকর। আমার সাথে মনে হয় ঐ স্যাটেলাইটের ব্যাপারটার জন্য রাত কাটাতে চাইছে। আগামী বছর লঞ্চ করবে স্যাটেলাইট, এটা নিয়ে সারা পৃথিবীতে খুব হই চই হবে। অবশ্য লাইম লাইটটা আমারও দরকার, বাংলাদেশের সোসাইটি নিয়ে আমার প্ল্যান আছে। দেশের মিডিয়া কাভারেজের একটা অংশ যদি মেহজাবিন দেয়, তাহলে খারাপ কি? ওর প্রস্তাবটা আমি ফেলবো না।”

উঠে বসলো তিথি, “মানে তুই ওর সাথে শুবি? ওরকম নষ্টা একটা মেয়ের-”
“ওকে নষ্টা বলছিস কেনো?” এক হাত তুলে তিথিকে থামিয়ে দিলো শুভ্র, “অনেকের সাথে সেক্স করে এসেছে এটাই তো অভিযোগ? একটু আগে ওকে অপবিত্রও বললি। আচ্ছা, একটা মেয়ে কয়েকজনের সাথে সেক্স করলেই কি সে অপবিত্র হয়ে যায়?”

তিথির চোখমুখ কঠিন হয়ে গেছে, “অবশ্যই হয়।”
“কেনো হয়? তার দেহের কোনো উপাদানে তো পরিবর্তন আসে না। তাহলে কেনো তাকে অপবিত্র ঘোষণা করা হয়?”
তিথি এর জবাব দিতে পারলো না। কিন্তু হার মানতে চাইলো না সে, জোর গলায় প্রতিবাদ করলো, “অবশ্যই কোনো না কোনো পরিবর্তন আসে। নাহলে বেশি মানুষের সাথে শুলে ছেলে বা মেয়ের যৌনরোগ হয় কেনো?”
“প্রটেকশন নেয় না তাই।” মুচকি হেসে বললো শুভ্র, তিথির কাছে বিষয়টা যতো সিরিয়াস, তার কাছে এটা ততোই হাস্যকর। একটি কৌতুক ছাড়া আর কিছু তো নয়। “প্রটেকশন থাকলে কোনো রোগও হয় না। অর্থাৎ প্রটেকশন থাকলে পবিত্রতা নষ্ট হয় না।”

“একটা মেয়ে তার সবকিছু আরেকজনকে এক রাতের জন্য দিয়ে দেবে অথচ তার পবিত্রতা নষ্ট হবে না?” ক্ষেপে উঠলো এবার তিথি, “ওই মেহজাবিন তো একটা মাগি। মাগির সাপোর্টে কতো কথা তোর! ওর সাথে শোয়ার খুব ইচ্ছা থাকলে শো না, যা। সেইটাকে পবিত্র করতে চাইছিস কেনো?”
“একরাতের জন্য তার সঙ্গে আমি যদি থাকি, কি হবে তুই জানিস তো?” মৃদু হাসিটা এখনও ধরে রেখেছে শুভ্র, “আমি তার সবকিছু দেখতে পাবো, স্পর্শের অধিকার পাবো, তার সঙ্গে সেক্সুয়াল ইন্টারঅ্যাক্ট হবে। এই দুটো ছাড়া আর কিছু তো নয়। একটা মানুষের লুকিয়ে রাখার আছেই বা কি। এতে করে তার দেহের গঠন পাল্টে যাচ্ছে না যেহেতু, আমার সাথে কাটানো রাতটার আগের দিন সে যতোটুকু পবিত্র ছিলো, পরের দিনও ততোটুকুই থাকবে। অন্য কারও সাথে রাত কাটানোয় একটা মেয়ের চরিত্র নষ্ট হয় না। পবিত্রতাও নষ্ট হয় না।”

লাল হয়ে এসেছে তিথির মুখ, “একটা কথা ঠিক বলেছিস অন্তত। মেহজাবিনের পবিত্রতা তোর সাথে শোয়ার আগে যা ছিলো পরেও তা থাকবে। আগাগোড়াই নষ্টা যে, তার পবিত্রতা তো নতুন করে যাওয়ার নাই। কিন্তু তোর মতামতে যদি এটা চরিত্র নষ্ট না করে, কোনটা করবে আর? কাকে তুই দুশ্চরিত্রা বলিস?”
খুব সহজ প্রশ্ন করা হয়েছে এভাবে তার দিকে তাকালো শুভ্র, “যে তার ম্যারেজ পার্টনারকে চিট করে সে-ই দুশ্চরিত্র। ধর, মেহজাবিন কাওকে বিয়ে করলো। তারপর সে আমার সাথে ওয়ান নাইটার হলো হাজব্যান্ডকে না জানিয়ে, তখন সে দুশ্চরিত্রা বলেই আমার কাছে পরিচয় পাবে। কারণ, তার ম্যারেজ পেপারে এ বিষয়ে একটা চুক্তি সে করে এসেছে। আদারওয়াইজ, শি ইজ আ নাইস গার্ল। প্র্যাক্টিক্যাল অ্যান্ড রেসপেক্ট্যাবল।”
“রেসপেক্ট্যাবল!”
“হুঁ।”
“জানিস ও কি বলেছিলো আমাকে? আমার সাথে তোর প্রেম চলে কি না তা জানতে চাইছিলো। আমাদের রিলেশন থাকলে সে আমার পারমিশন নিয়ে তোর সাথে শোবে, তাই।”
মাথা দোলালো শুভ্র, “এজন্যই তো আমি ওকে আর ওর মতো মানুষগুলোকে সম্মান করি। ওরা দারুণ মানুষ। মোটেও দুশ্চরিত্রা না। এটাই তোকে বোঝানো যায় না। এক বছরে কিচ্ছুটা শিখতে পারিসনি আমার কাছে।”

ছুটে আসা বালিশটা কোনোমতে এড়ালো শুভ্র। মুখ থেকে হাসি মোছেনি এখনও। ক্ষেপে বোমা হয়ে থাকা এলোমেলো চুলের তিথিকে দেখতে তার ভালোই লাগছে। রীতিমতো চিৎকার করছে এখন মেয়েটা।
“তুই যা। আজ রাতেই মাগির সাথে শুয়ে পর। পা ফাঁক করেই আছে মেহজাবিন মাগি। আমি এখনই ফোন করে বলে দিচ্ছি তুই রাজি। শালা…”

আরও কি কি জানি বলতে বলতে দরজার দিকে রওনা দিলো তিথি।
গলা চড়িয়ে ডাকলো শুভ্র, “আরে কই যাস? মম রান্না করছে। খেয়ে তো বের হ!”
কোনোভাবেই থামানো গেলো না তিথিকে। ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলো সে।
পেছন থেকে শুভ্রর গলায় শেষ যে কথাটা শুনতে পেয়েছিলো তা ওকে এই প্রথমবারের মতো শুনতে হয়নি।

“হিপটোনাইজড শালী!”

অন্ধকারে হলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটা লক্ষ্য করেছিলো, গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার।

পাঁচ.
আজ রাতেই ওরা শোবে।

বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে তিথি। ঘুম আসছে না। রুমমেট নাবিলা ওকে এরকম করতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছে। “কি রে, তোর শরীর খারাপ করছে নাকি?” বলে কপালে হাত বুলিয়েও দেখেছে। কিন্তু তিথির পড়ে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়ার রহস্য ভেদ করতে পারেনি। তিথির চোখে আজ ঘুম নেই কারণ আজ রাতেই ওরা শোবে। শুভ্র আর মেহজাবিন। শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য।

শুভ্রর সাথে পরিচয়ের পর পর ওর সাথে সামাজিকতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হতো তিথির। বাংলার সমাজ তার সদস্যদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, তার মধ্যে বড় একটা অংশ “সে নো টু…” দিয়ে পরিপূর্ণ। এটা করা যাবে না, ওটা করা খারাপ, এটা অপরাধ, ওটা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞাসমূহের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এমন সব কর্মকাণ্ডের তালিকা যেগুলো যথারীতি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতির কারণ নয়। তারপরও তারা অপরাধ।

“মূল্যবোধ আর নৈতিকতা কি?” জানতে চেয়েছিলো শুভ্র, “স্রেফ কতোগুলো ধ্যানধারণা। আর সেগুলো এসেছে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। অর্থাৎ, পূর্বপুরুষেরা যা করা সঠিক মনে করেছে তাই তারা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের চোখে যা করা ভুল, তা আমাদের চোখেও যেনো ভুলই হতে হবে। এর বাইরে তুমি যেতে পারবে না। গেলেই নৈতিকতা আর মূল্যবোধের প্রশ্ন আনা হবে।”

তখনও তিথির সঙ্গে শুভ্রর তুই-তোকারি শুরু হয়নি। শুভ্রের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলো ও। কিছু বুঝতে পারছিলো। আর কিছু বুঝতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো মানব সমাজের হাজার বছরের কুসংস্কার।

“আমার কাছে নৈতিকতা দুই রকমের,” বলে গেছিলো শুভ্র, “প্রকৃত নৈতিকতা, আর বানোয়াট নৈতিকতা। প্রকৃত নৈতিকতার মধ্যে পড়বে এমন সব কিছুই, যা অন্য কারও ব্যক্তিঅধিকারে প্রভাব ফেলে। ধরো, আমি একজনের ফাইলটা আটকে রাখলাম যেটা ছেড়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। সেটা নৈতিকতার অবক্ষয়। কারণ একজন মানুষ ন্যায্যভাবে যেটা পেতে চলেছিলো তা সে পাচ্ছে না। তাকে সেজন্য কেনো ঘুষ দিতে হবে? অথবা, ধরো আমি পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোনো মেয়েকে টিজ করে বসলাম। এটা নৈতিকতার অবক্ষয় হিসেবে আমি মেনে নেবো। এটা কিন্তু পূর্বপুরুষেরাও মানতেন, তাও আমি মানবো। কারণ কারও সঙ্গে কথোপকথনের গভিরতা দুই পক্ষের সম্মতিতে নির্ধারিত হয়। টিজিং এই ব্যক্তিঅধিকার লঙ্ঘন করে। তুমি আমাকে এধরণের যতো নৈতিকতা মেনে নিতে বলবে, আমি সহমত প্রকাশ করবো।”

“তাহলে সমাজের সঙ্গে তোমার সমস্যাটা কোথায়?” বিষয়টা স্পষ্ট করার জন্য জানতে চেয়েছিলো তিথি।

“ধরো, তুমি আজ সিগারেট খেতে খেতে ফুটপাতে হাঁটছো। কি দেখবে?”
“রাস্তার অর্ধেক লোক আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কানাঘুষো হবে। দুটো কথা শোনাতেও কেউ ছাড়বে না।” বিন্দুমাত্র দেরি না করে বলে ফেললো তিথি।
“অর্ধেক নয়, সবগুলো লোকই তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তোমাকে সদুপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব হবে না। এমনকি পুলিশি হ্যারাসমেন্টের শিকারও হতে পারো।”
“হ্যাঁ। কারণ, একটা মেয়ে ফুটপাতে হাঁটবে আর সিগারেট ফুঁকবে সেটা আমাদের সমাজে অ্যাকসেপ্টেড না।”
“অথচ পুরুষেরা এই কাজ অহরহ করে। কেউ চোখের পাতাটাও ফেলে না।” যোগ করলো শুভ্র, “তাহলে ভেবে দেখো, পুরুষ সিগারেট খেতে পারবে প্রকাশ্যে। অথচ নারী পারবে না। এই কুসংস্কার জন্ম নিলো কোথা থেকে?”

কাঁধ ঝাঁকালো তিথি, “এভাবে দেখলে তো হবে না। নারীরা সব কিছু পুরুষদের মতো করতে পারে তাই? তোমরা গরমের সময় খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে পারো। একটা মেয়ে কি জামা খুলে হাঁটতে পারবে?”
নিজের পায়ে থাপ্পড় দিয়ে উঠলো শুভ্র, পয়েন্টটা তিথি ধরে দেওয়াতে বেজায় খুশি হয়েছে সে, “এইটাকেই আমি বলি সামাজিক হিপনোটিজম, সিস্টার। সমাজ তোমাকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। সমাজ এই কোটি কোটি মানুষকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। তুমি একটা মেয়ে হয়েও সিগারেট খেতে না পারার ব্যাপারে মেয়ে সমাজের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে সমর্থন করতে পারছো না। ছেলেরা কি করে পারবে? ফুটপাতে সিগারেট খাওয়ার প্রসঙ্গ তুমি ডিফেন্ড করছো প্রকাশ্যে জামা খুলে ফেলার প্রসঙ্গ দিয়ে। কারণ, তুমি সমাজের হিপনোটিজমে পড়ে গেছো। ইউ আর হিপনোটাইজড, তিথি। ইউ অল আর।”

“তাহলে তুমি চাইছো সিগারেট খাওয়াটা সবার জন্য বৈধ হোক। এটা কি স্মোকিংকে উৎসাহ দিচ্ছে না? দেখো, পুরুষেরা স্মোক করলেও নারীরা করতে পারছে না। বা করলেও তাদের কম করতে হচ্ছে। এটা তো অনেকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হচ্ছে। পুরুষ আর নারীর সংখ্যা প্রায় সমান ধরা হয়। অর্থাৎ সমাজের অর্ধেক সদস্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা পাচ্ছে।” যুক্তি দেখিয়ে গেছিলো তিথি।

“আরেকটা হিপনোটাইজড উত্তর দিলে, সিস্টার।” হাসিমুখে বলেছিলো শুভ্র, “তোমার কি মনে হয় ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে একটা মেয়ে সিগারেট খেলে সেটার প্রতিবাদে এগিয়ে আসা পুরুষ এবং নারীদের প্রথম মাথাব্যথার কারণ নারীর স্বাস্থ্য হয়? স্বাস্থ্যরক্ষায় স্মোকিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, পুরুষ হোক আর নারী হোক, প্রকাশ্যে স্মোকিংয়ে বাঁধা দাও, আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকবো। এ বিষয়ে কিন্তু জরিমানার আইনও আছে। কিন্তু যতোক্ষণ ছেলেরা সিগারেট খাচ্ছে, কিছুই আসে যায় না কারও। কিন্তু একটা মেয়ে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলেই সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। এর পেছনে শুধুমাত্র আছে তোমাদের পুরুষশাষিত সমাজের ইগো। সমাজের হিপনোটিজম। মেয়েরা খেতে পারবে না সিগারেট। মেয়েরা খেলতে পারবে না খোলামেলা শরীরে খেলা কোনো খেলা। তাও মার্গারিটা মামুন নিয়ে মাতামাতি কম হয়নি। যাহোক, কারণ হিসেবে সমাজের হিপনোটিজমের অংশ হিসেবে দেখাবে ধর্মের অনুশাসন। কিন্তু ফুটবল খেলায় পুরুষের সতর ঢাকা না হলেও কেউ প্রতিবাদ করবে না, অথচ ধর্মে পুরুষের হাঁটু পর্যন্ত না ঢাকা আর নারীর স্লিভলেস পরা একই জিনিস। তাও শুধুমাত্র মেয়েদের দলকে হাফপ্যান্টে নামাতে গেলেই প্রচুর কথা আসবে। তোমরা মা বোনদের ন্যাংটা করে মাঠে নামাচ্ছো। ধর্মের অনুশাসনের দিক থেকে দেখলেও দুই পক্ষ করছে আইন ভঙ্গ। অথচ সমাজের চোখে পুরুষের সাত খুন মাফ। যতো সমস্যা তোমাদের মেয়েদের নিয়ে। এমনকি ক্রিকেটেও প্র্যাকটিসে হাফপ্যান্ট পরে পুরুষ ক্রিকেটারগণ নামলে কারও জাত যায় না। মেয়ে ফিজিও হাফপ্যান্ট পরে মাঠের মাঝে গেলে দর্শকদের উত্তেজিত শিসের শব্দ শোনা যায়। এখানেই আমার সমস্যা, পুরুষের ক্ষেত্রে সমান প্রতিবাদ আসলে আমি এগুলোকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে ধরে নিতাম। কিন্তু এখন আমি এই সব প্রথাকেই মনে করি সামাজিক অবক্ষয়। বুঝতে পারছো, সামাজিক হিপনোটিজমে আমরা সমাজের নৈতিকতাকে মানদণ্ড ধরে নিয়ে কতো বড় ভুল করেছি? এটা আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করেছে। নিরীহ নারীদের প্রকাশ্যে কুপিয়ে ফেলে যাচ্ছে ব্যর্থ প্রেমিক। একা পেলেই একটা মেয়ের শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করছে পুরুষ। ভরা রাস্তায়ও করছে, ভিড়ের সুযোগে। হিজাব করে আসা মেয়ে হোক আর না হোক, ছাড় কিন্তু কাওকে দেওয়া হচ্ছে না। একটা মেয়ে হাফপ্যান্ট আর টপস পরে রাস্তায় জগিং করতে নামলো বাংলাদেশের রাস্তায়। প্রতি পঞ্চাশ ফিটের মধ্যে একবার তাকে টিজ করা হবে। সবাই চেষ্টা করবে তার ভাঁজগুলোয় চোখ বোলানোর। ভুল কিছু বললাম?”

“কিছু পুরুষের জন্য সবার দোষ হতে যাবে কেনো?” তিথি গতানুগতিক সব যুক্তিই সেদিন চেষ্টা করেছিলো।

“সামাজিকভাবে হিপনোটাইড একটা মানুষ তুমি। এই ধরণের ডিফেন্স যারা দাঁড় করায় তাদের সবাই সামাজিক হিপনোটিজমের শিকার। তুমি কি জানো, এই ‘কিছু’ পুরুষের প্রকৃত সংখ্যাটা কতো?” তিক্ত একটা হাসি ফুটে উঠেছিলো শুভ্রের মুখে, “দুই কোটি মাত্র। মোট জনসংখ্যার আটভাগের একভাগ। মোট পুরুষ জনসংখ্যার ওয়ান-ফোর্থ। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ জনসংখ্যার অর্ধেক।”

“হোয়াট! এতো বেশি হতেই পারে না-” প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো তিথি। তাকে একটা হাত তুলে থামিয়ে দিলো শুভ্র।

“এরচেয়েও বেশি হতে পারে। এরা সবাই টিজ করে না, কিন্তু বন্ধুর আড্ডায় হলেও মেয়েদের খেলো করে দেখে। পরিচিত মেয়েদের অঙ্গ প্রতঙ্গ নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করে। সবই ব্যক্তিঅধিকার লঙ্ঘন। আর দুই কোটি মানুষ এরকম নারীদেহ ভোগের জন্য ব্যক্তিঅধিকার ছাড়িয়ে যাওয়া আচরণ করছে কেনো জানো তুমি?”
তিথি এবার কোনো কথাই বললো না।
“কারণ, সমাজ আমাদের হিপনোটাইজ করে এমন কিছু বিষয়কে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছে যেগুলো আমাদের মূল্যোবোধের বারোটা বাজিয়েছে। সমাজ আমাদের ব্যক্তিঅধিকারকে সম্মান করতে না শিখিয়ে শুধু শিখিয়েছে সংখ্যালঘুদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অসম্মান করতে। একজন স্বাধীনচেতা মেয়ে এদেশে বিকিনি পরে সুইমিংপুলে নিজের মোটরসাইকেল ড্রাইভ করে যেতে পারবে না। সমাজ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। কারণ, তারা ওই মেয়েটির দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দেখাতে প্রস্তুত নয়। কারণ সে সংখ্যালঘু। সমস্যাটা তুমি বুঝতে পারছো?”

“তুমি তাহলে সমাজের থেকে কি আশা করো?” হাল ছেড়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিলো তিথি।
“সিম্পল। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিঅধিকারকে সম্মান করতে শেখা হোক। ফালতু সব বিষয় থেকে ট্যাবু উঠিয়ে দেওয়া হোক। তুমি কি জানো, এদেশের পুরুষেরা স্লিভলেস জামা পরা মেয়ে দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যায় কেনো? এমনটা গোটা দুনিয়ার কোথাও দেখবে না তুমি। আমি চাই সমাজ এইসব সমস্যার সমাধান গোড়া থেকে করুক। অকাজের কিছু মূল্যবোধ ধরিয়ে তা চর্চা করে এইসব সমস্যা আরও বাড়িয়ে না তুলুক।”

“এসব সমস্যার গোড়া বলতে কি বোঝাচ্ছো?”
“ট্যাবু। মূল্যবোধ আর নৈতিকতার নাম করে একপালা আজাইরা ট্যাবুতে ভরে আছে সমাজ। এই ট্যাবুগুলো তুলে ফেলতে হবে। নারী অধিকার এদেশে সবখানে খর্বিত এইসব ট্যাবুর জন্য।”

“এদেশেও প্রচুর সফল নারী রয়েছেন।” যথারীতি দ্বিমত পোষণ করলো তিথি।

“আর সেসব প্রতিটি সফল নারী হাজারো টিজ হজম করে, হাজারো নারীত্বের অপমানের শিকার হয়ে, হাজারো পিছুকথার প্রসঙ্গ হয়ে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লাখ লাখ মানুষের চোখে স্রেফ একজন মাগি হয়েই সেই সফলতার চূড়োয় উঠেছেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো, তাঁকে লাখ লাখ মানুষের কাছে মাগি হতে হলো কেনো? তোমার আর তোমার মতো হিপনোটাইজড মানুষগুলোর জন্য। একদিন তুমিও সমাজে সফল একজন নারীকে মাগি বলে গালি দেবে। সেদিন হয়তো বুঝবে আমার কথার সার্থকতা। সফল সাংবাদিক, সফল আর্কিটেক্ট, সফল অভিনেত্রি, সফল চিকিৎসক, কোন নারীচরিত্রটিকে যুবসমাজের বড় একটা অংশ চরিত্রহীন মনে করে না?”

“ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেকেই চরিত্র খুঁইয়ে আসেন।” সোজাসাপ্টা বললো তিথি, “তো কি মনে করবে তাদের?”
“চরিত্র খুইয়ে আসে কিভাবে একজন মানুষ? বড়জোর আরেকজনের সঙ্গে শোয় কিংবা মিডিয়ার সামনে খোলামেলা হয়ে আসে, তাই তো? এটা কি করে চরিত্র খোয়ানো হলো? এখানে আরেকটা বড় প্রশ্ন চলে আসে, আসলেই যারা টাকার বিনিময়ে যৌনতায় অংশ নেয়, অর্থাৎ পতিতারা, তাদের কেনো সমাজ সম্মান করে না? মানুষের সম্মান তাদের কেনো দেওয়া হবে না?”
“এসব তর্ক অর্থহীন।” মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছিলো তিথির।
“না, হিপনোটাইজড মানুষগুলো এসব এড়িয়ে যায়। সবশেষে ক্ষতিটা হয় সমাজের। আরও একজন অসহায় নারীকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়। আরও একজন মানুষের পর্ন ভিডিও নিয়ে মানুষ মাতামাতি করে, আরও একজন মানুষকে মানুষ মাগি পরিচয় দিয়ে সমাজে অচ্ছুত করে দেয়। এটা সলিউশন না, আলোচনাটা এড়িয়ে যাওয়া কখনোই সমাধান না, তিথি।”

“সলিউশন তাহলে কি?”
“অকারণ ট্যাবু সরিয়ে ফেলা। দেশে কো-এডুকেশন কয়টা প্রতিষ্ঠানে হয় বলো তো? ছেলে আর মেয়েকে আলাদা জায়গায় রেখে পড়াশোনা করানোর অর্থটা পরিষ্কার। দুই লাখ বখাটে আর নারীলোলুপের জায়গায় দুই কোটি বখাটে এবং নারীলোলুপ জনসংখ্যার জন্ম দেওয়া।”
“তোমার মনে হয় এরা ছেলেমেয়ে একসাথে বড় হলে নারীদের প্রতি-”
“হ্যাঁ, তারা নারীদের সম্মান দিতে শিখতো। জানতো মেয়েরা তাদের মতোই মানুষ। জানতো মেয়েদের শরীর আর তাদের শরীরের বিশেষ পার্থক্য নেই। একটা মেয়ের কনুই দেখেই মাথা ঘুরে যেতো না তাদের। তারা জানতো একটা মেয়েকে যৌনতা ছাড়াও ছুঁয়ে দেওয়া যায়, যেভাবে একটা ছেলেকে ছোঁয়া যায় যৌনতা ছাড়া। বন্ধুর সঙ্গে হাত মেলানো যায়, জড়িয়ে ধরা যায় যেমন, তা বান্ধবীকেও করা যায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরার সঙ্গে কামুকতার সম্পর্ক নেই তাও তারা শিখতো। কিন্তু তারা শিখেনি কিছুই। হয় তারা তাদের দেবী বানিয়েছে, নয়তো বানিয়েছে সেক্স ডল। মানুষ হিসেবে নারীকে দেখেনি ওরা। তুমি জানো আমার প্রতিটা শব্দ সত্যি। শুধুমাত্র সামাজিক হিপনোটিজমের প্রভাবে স্বীকার করতে বাঁধবে তোমার।”

ছয়.
তিথি খেয়াল করলো চোখের পানিতে কখন বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে সে। হ্যাঁ, সেদিনই ও মেহজাবিনকে মাগি বলেছে। নিজে একজন মেয়ে হয়েও তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দিতে শেখেনি। তিথি মনের ভেতরে কোথাও জানে শুভ্রের প্রতিটা কথা সত্য। তুখোড় বুদ্ধিমত্তা দিয়ে হাজারবার এই দর্শনটাকে যাচাই করে তবেই সে মেনে নিয়েছে। স্রেফ আবেগের বশে অথবা কিছু নব্য সমাজবিরোধীদের মতো প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে এসব বুলি সে আওড়ায় না। তার কথা শুনে প্রাথমিকভাবে তিথি মনে করতো ছেলেটা মনে হয় ফ্রি-সেক্স প্রতিষ্ঠা করতে চায় এদেশে, হয়তো নিজের সুবিধার্থেই। একবছর তার সাথে থেকে এটুকু বুঝেছে, সেক্স নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণে অকারণে তিথিকে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টাও সে কখনো করেনি।

হ্যাঁ, তিথিকে শুভ্র ছুঁয়ে দেয় মাঝে মাঝে। তবে সেটা ঠিক ততোটাই যতোটা সে কোনো ছেলে বন্ধুর সঙ্গে করে। মেকানিক্যালের নাফিসকে সে যেভাবে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়, যেভাবে তার সঙ্গে হাই ফাইভ বিনিময় করে, তিথির সাথেও ততোটাই। শুভ্রের মধ্যে কামুক কোনো স্বভাব নেই। রয়েছে শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত মূল্যায়ন। ব্যক্তিজীবনের মূল্যহীন ট্যাবু এড়িয়ে চলা। তাই সে বাকিদের মতো লুকিয়ে পর্ন দেখে না। সাউন্ডবক্সে পর্ন প্লে করতে তার আপত্তি নেই, সঙ্কোচ নেই বেডরুমে কিসা সিন্সের নগ্ন ছবি টাঙ্গিয়ে রাখতে। এবং তার পরিবার হিপনোটিজম থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারাও এমনটাই আশা করে তার থেকে। যৌনতা আর ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ট্যাবু করার কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের এতো অবক্ষয় তা তারা মানে, তবে এর যথেচ্ছ প্রয়োগ কখনোই করে না। তারা যৌনতার লোকদেখানো স্বাধীনতা চায়নি কখনো, বরং সহজাত মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো লুকিয়ে রেখে সামাজিক অপরাধ প্রবণতা প্রকট করাতেই তাদের আপত্তি।

তিথি এখনও জানে না, এটাই এই ঘুণে ধরা সমাজের একমাত্র চিকিৎসা কি না। বাংলাদেশের আর সব মানুষের মতো তারও ধারণা ছিলো কেবলমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনই পারে সমাজকে সবার জন্য সহনীয় একটা স্থানে পরিণত করতে।

শুভ্র বলেছিলো, “এটা তুমি ঠিক বলেছো। ধর্ম সমাজটাকে সবার জন্য শান্তিপুর্ণ একটা স্থান বানাতে পারে। যখন প্রতিটা মানুষ ধর্মীয় অনুশাসণ মেনে চলতে প্রস্তুত, তখন। যখন মানুষ হৃদয়ে ধর্মকে ধারণ করে, আবেগে নয়, তখন। বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখো। কতোজন হৃদয়ে ধর্মকে ধারণ করে? চার শতাংশও কি হবে?”

একশ জনে চারজন? তিথি এটা মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদ করে বলেছিলো, “আমাদের দেশটা ধর্মপ্রাণ হিসেবে পরিচিত কিন্তু।”

“আবেগে আর কথায়। কাজে নয়। এটা এখনও এদেশি জনগণ বুঝে উঠতে পারেনি। এটা খুব খুবই হতাশাজনক।” বলেছিলো ও, “তুমি কি জানো, ইসলামে গান শোনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, গাইরে মাহরাম (বিয়ে নিষিদ্ধ) সম্পর্কের সব মেয়েদের দিকে তাকানো নিষিদ্ধ, বিবাহপূর্ব যৌনমিলনের শাস্তি আবশ্যকীয় ভাবে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড?”
“তো?”
“এদেশে কয়জন রাস্তায় বের হলে সামনে মেয়ে পড়লে চোখ সরিয়ে নেয়? তাকায় পর্যন্ত না তাদের দিকে? এদেশে কতোজন মানুষ গান শোনা ছেড়েছে ধর্মীয় কারণে? এদেশে কতোজন মানুষ বিয়ের আগে প্রেম করেনি? একশতে চারজন কি খুব বেশি হয়ে গেলো না? একশ’তে একজনও কি পাবে তুমি এমন?”
“মানছি, এতো সাধু সন্ত আমরা এক হাজারে একজন পাবো। কিন্তু তুমি ধর্মকে দায় দিচ্ছো কেনো? ধর্ম না মানা তো ব্যক্তির ব্যর্থতা।”

হেসে ফেললো শুভ্র, “আমি ধর্মকে দায় দিচ্ছি না। বরং সব সময় বলে এসেছি ধর্মীয় অনুশাসন একটি সমাধান। তুমি একটা সমাজে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে কোনো অনাচার চলবে না। পারফেক্ট সমাজ ব্যবস্থা সেটা।”
“তাহলে একটু আগে যে বললে-”
“আমি দায় দিচ্ছি বাংলাদেশের মানুষের। আমরা ছিলাম বৌদ্ধ, হয়েছি পরে পৌত্তলিক, তারপর হয়েছি মুসলিম, এরপর খেয়েছি ইংরেজের ধাতানি। আমাদের হৃদয়ে ধর্ম নেই, তিথি। বাংলাদেশের মানুষ হৃদয়ে ধার্মিক নয়, তারা কথায় বুলি ফোটায়। আবেগে জেহাদী জোশ দেখায়। হৃদয়টা ফাঁকা। একারণেই এদেশে জঙ্গি রিক্রুট করা এতো সহজ।”
“তুমি আশা করতে পারো না একটা প্রগতিশীল দেশের একশ জন মানুষের মধ্যে আশিজনই প্রবলভাবে ধার্মিক হবে।”

হেসেছিলো শুভ্র, “তুমি আমার কথার মূলভাবটাই ধরতে পারোনি। বেশিরভাগ মানুষই পারে না। এর পেছনেও আছে সামাজিক হিপনোটিজম। আমার বক্তব্যের একটা স্পষ্ট উদাহরণ দেই তোমাকে। কাল থেকে ঘোষণা করা হলো, কারও বাড়ির ভেতর থেকে গান-বাজনার আওয়াজ পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করে দশ বছরের জেল দেওয়া হবে। কেউ প্রেমিকার সাথে বিছানায় গেলে সেটা যদি ধরা পড়ে, প্রেমিক-প্রেমিকাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। চুরি করে কেউ ধরা পড়লেই তার হাত কেটে দেওয়া হবে। এগুলো কিন্তু এই ক্রাইমগুলো ঠেকাতে খুব কার্যকর। আমি এই আইনগুলোর প্রশংসা করি, কারণ এগুলো প্রচণ্ড ভীতি ছড়াতে পারে। অপরাধ কমে আসতে পারে এভাবে। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিলো, বাংলাদেশের মানুষ এটা নিতে পারবে কি না সেই প্রশ্নের ওপর। বাংলাদেশিরা কি রাজি হবে গান শুনতে ধরা খেলেই কারাগারে গিয়ে ঢুকতে? কিংবা প্রেমিকার সাথে শুয়ে মুণ্ডু হারাতে? তারা রাজি হবে না। একশজনের মধ্যে চারজনকেও এর সপক্ষে পাবে না তুমি। বাংলাদেশিরা বলবে, এসবই লঘু পাপে গুরু দণ্ড। যদি মুখে ধর্মীয় অনুশাসনের ভয়ে নাও বলে, বাংলাদেশি হৃদয় এসব আইন মেনে নিতে চায় না। তুমিই বলো, তোমার রুমমেটকে যদি পুলিশ এসে নিয়ে যায় তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে শোয়ার অপরাধে তারপর তাকে মেরে ফেলা হয়, তোমার মুসলিম বন্ধুদের কারও হৃদয় কি মেনে নেবে সেটা?”
মাথা নাড়লো তিথি, “না মনে হয়। ধর্মে আছে বলে হয়তো কিছু বলবে না, তবে মেনেও নিতে পারবে না।”
“আর তুমি মনে করছো ইসলামী অনুশাসন এই দেশের সমাজের জন্য অ্যাপ্লিকেবল? তুমি যেটা অ্যাপ্লাই করতেই পারবে না সেটা কি করে সামাজিক সমস্যার সমাধান হবে? সমাজ তো মানবগোষ্ঠী নিয়েই গঠিত। মানুষ যদি প্রস্তুত না থাকে তাহলে কি করে তুমি সেই সমাজে একটা সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধরে নেবে?”

“সেজন্য ধর্মীয় অনুশাসন সঠিক পদ্ধতি হলেও বাংলাদেশের জন্য কোনো সমাধান নয়।” মাথা দোলালো তিথি, “কথাগুলো তুমি সঠিক বলেছো, অন্তত।”

শুভ্র একটা সিগারেট ধরিয়েছিলো, “অথচ তুমি চাইলেই এদেশি জনগোষ্ঠীকে কো-এডুকেশনে পাঠাতে পারো। অযথা ট্যাবুগুলো তুলে ফেলতে পারো। মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নেওয়ার চেয়ে বেশি প্রস্তুত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে। বাংলাদেশের সমাজ থেকে নারীত্বের অবমাননা সরিয়ে নিতে এর চেয়ে নিখুঁত আর প্রয়োগযোগ্য আর কোনো সমাধান আমার চোখে পড়ে না। ধর্মীয় সমাজব্যবস্থাগুলো নিখুঁত, তবে বাংলাদেশি সমাজে প্রয়োগের অযোগ্য।”

এপাশ ওপাশ করতে শুভ্রের সঙ্গে হয়ে যাওয়া কথাগুলোই বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছে তিথি। ছেলেটার মাথা পরিষ্কার। বাংলাদেশী সমাজকে মেয়েদের জন্য সহনশীল করে তুলতে চেয়েছিলো ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান দেওয়ার মাধ্যমে। এর চেয়ে সহজ সমাধান আসলেই আর হয় না। শুধু প্রয়োজন প্র্যাকটিস। কোনো বাড়তি আইন মানার চাপ নয়, প্রাণ খোয়ানোর ভয়ে নতুন বিশৃঙ্খলা নয়, শুধু অপরজনকে সম্মান করতে শেখা। সহজাত মানববৃত্তীয় আচরণগুলোকে লুকিয়ে না রেখে প্রকাশ্য করে ফেলা। লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে দুই জাতির মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা।

তিথি কখনোই সেগুলো মেনে নিতে পারেনি।
হাজার বছরের হিপনোটিজম সে এড়িয়ে যেতে পারেনি। আজকে রাতে শুভ্র মেহজাবিনের সঙ্গে শুতে চলেছে সেটা সে একেবারেই মেনে নিতে পারছে না।

ফোনের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গলো ওর। চোখ মুছে হাতে তুলে নিলো যন্ত্রটিকে।
শুভ্র!

পরিশিষ্ট.
বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে এসে তিথিকে কিছু খুঁজতে হলো না। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে বসার জায়গায় পিঠ দিয়ে আকাশ পানে পা দুটো তুলে মূর্তিমান বাদুড় হয়ে আছে। প্রকাশ্য দিবালোকে এই পাগলামি, তিথির রাগ না উঠে কেনো জানি হাসি আসে। হারামজাদা সমাজের বিরুদ্ধে একেবারে মূর্তিমান এক বিদ্রোহ!

“তিথি।” চশমা ছাড়াই বললো শুভ্র, মুখে হাসি।
ওর পাশে ধপ করে বসে পড়লো ও, “খুব কেলাচ্ছিস? করলি না কেনো?”
চশমা পরলো না ছেলেটা, ঝলমলে চুল মধ্যাকর্ষণ শক্তিবলে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, “কি করলাম না?”

শুভ্রের চেহারায় এই অবাক হয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি দেখতে অসাধারণ লাগে তিথির। হা করে সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ও।

“মেহজাবিনের সাথে কালকে রাতে ডিনারে তো গেছিলিই, করলি না কেনো?”
হেসে ফেললো শুভ্র, “গাধীটা তোকে বলে দিয়েছে, তাই না?”
“আরে আমাকে দোষ দিয়ে গেছে সে। আমার দোহাই দিয়ে নাকি এড়িয়ে গেছিস। ছি ছি, তোর দর্শনের উল্টোদিকে গেলো না এসব?”
“কোথায়? আমি কি করবো তা তো আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় পড়ে। আমি আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা খাটিয়েছি।”
“মেহজাবিন তো বললো অন্য কথা।” হাত বাড়িয়ে শুভ্রের রেশমি চুল ছুঁয়ে দিলো তিথি, “তুই নাকি ওকে বলেছিস, অ্যানিথিং ফর তিথি’স ফ্রেন্ড।”
চোখ বন্ধ করে ফেললো শুভ্র, “হ্যাঁ। তিথির ফ্রেন্ড আমার ইন্টারভিউ নেবে, এতে আপত্তির কি আছে। যতোবার ডাকবে যাবো। এজন্য ওর সাথে বিছানায় যাওয়ার দরকার কি আমার ছিলো, বল্?”

একটু হেসে হাতব্যাগটা পাশে রেখে দিলো তিথি। শুভ্রের চোখ খুলে গেলো আবার। ঘোলা চোখেই তিথির কোমর থেকে পা পর্যন্ত চোখ বোলালো।

“জিন্স পরেছিস মনে হচ্ছে?”
“চুপ করে শুয়ে থাক। এতো পর্যবেক্ষণে কাজ কি তোর?”
দুষ্টু হাসি শুভ্রের মুখে, “বাদুড় হবি?”
“বাদুড় হওয়ার অধিকারই বা একলা তোকে দিয়েছে কে? প্রেসিডেন্ট স্যার ইস্যু করেছেন?”

খানিক বাদেই এলাকাবাসী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বাইশ-তেইশ বছরের দুই তরুণ তরুণী সিমেন্টের সিটের বসার জায়গায় পিঠ দিয়ে দুই জোড়া পা সরাসরি আকাশ পানে তুলে শুয়ে আছে।

মুখ ফিরিয়ে শুভ্রের দিকে তাকালো তিথি। ছেলেটাও তার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে, চশমা নেই চোখে। চুলগুলো চোখে এসে পড়ছে। হতাশ হলো তিথি, ছেলেদের এতো রেশমি চুল থাকতে নেই। অপার্থিব মায়ার জন্ম দেয় তারা।

“মেহজাবিনের সাথে তুই শুলে সেটা আমার সামাজিক হিপনোটিজমের জন্য খারাপ লাগতো না রে।” ফিসফিস করে বললো তিথি।
“জানি।” নির্বিকারভঙ্গিতে বললো শুভ্র।
তিথির সুন্দর ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেছে, “কিভাবে জানিস?”
“কারণ, মেহজাবিনের সাথে আমিও শুতে পারিনি অন্য একটা কারণে। সেই কারণটাও সামাজিক হিপনোটিজম না।”
“বাসিস?” কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে তিথির গলা।
“বাসি।”

কি সুন্দর পিটপিট করে তাকাচ্ছে এখন জিনিয়াস পাগলটা! তিথির ভেতরে গিয়ে লাগে চোখজোড়ার মায়া।

“ট্যাবু ভাঙ্গতে শুরু করি, চল্।” দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে উঠলো মেয়েটির চোখের তারায়।

অবাক বিস্ময়ের যেসব এলাকাবাসী এতোক্ষণ তাদের লক্ষ্য করছিলো, তাদের চোখগুলো কপালে তুলে দিতেই যেনো আরও কাছে চলে এলো বাদুড় হয়ে থাকা মানুষদুটোর মাথাজোড়া।
তারপর টুপ করে ডুবে গেলো একে অন্যের ঠোঁটের অতল গভিরতায়!

— ০ —

রচনাকাল – নভেম্বর ২২, ২০১৬

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *