সন্তান
১.
‘আমার পেটে শাহেদের বাচ্চা।’
লিনিতার মেসেজটা দেখে পাছার ধাক্কায় চেয়ার উল্টে ফেললাম।
ছুটির দিন বাসায় বসে আয়েস করে ফেসবুকে চক্কর দেওয়ার মাঝে যে আনন্দ সেটা ব্যাচেলর ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। মাথার ওপর বন বন করে ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস আর কানের মাঝে ঝনঝন করে বাজতে থাকা লিংকিন পার্কের ‘ক্রলিং’; ব্যাচেলর হৃদয় এসময়গুলোয় থাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত। ‘কেয়ামত নামিয়া আসিতেছে’ জাতীয় সমস্যাগুলো ছাড়া এর ব্যত্যয় ঘটে না।
ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর পেটে বন্ধুবরের বাচ্চা – এটা একটা কেয়ামত নেমে আসার মতো সমস্যা। চেয়ার উল্টে ফেলার জন্য মনের ভেতর কোনরকম পাপবোধ অনুভব করলাম না।
থাবড়ে থুবড়ে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি অফ হয়ে আছে। চার্জ শেষ হয়ে গেছে কখন জানি। পাঁচ বর্ণের একটা ছোট অথচ উপর্যুপরি নোংরা গালি দিয়ে ওটাকে চার্জারের সাথে লাগালাম। দ্রুত হাতে অন করছি ডিভাইসখানা।
লিনিতা এরকম কঠিন সমস্যায় পড়ে মোবাইলে ফোন না দিয়ে কেন ফেসবুকে মেসেজ দিয়েছে – ব্যাপারটা আমার কাছে এখন পানির মতই পরিষ্কার। মোবাইলের চার্জ ইত্যাদি নিয়ে গতকাল রাত থেকে খোঁজ খবর কিছু নেয়া হয়নি। শুধু গতকাল রাত বলে নয় – মোবাইল পাগলা বলে এককালে পরিচিত আমি গত একটি বছর ওই যন্ত্রটার ব্যবহার প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।
ওপাশে রিং হচ্ছে। প্রথমবারের পর দ্বিতীয় রিংটুকুর শব্দ আর হতে শোনা যায় না। লিনিতা রিসিভ করে ফেলেছে।
‘তুই কই?’ ফোন ধরতেই জানতে চাইলাম।
‘কাজী অফিসে রে। রাজাবাড়ীর কাজি অফিসে। তুই একটু দেখবি প্লিজ -’
‘শাহেদ কোথায়?’ পাল্টা জানতে চাইলাম আমি।
‘ও তো এখানে নাই – তুই একটু দেখবি ও কই? একা একা দাঁড়িয়ে আছি।’
‘ওখানে কি করছিস?’
‘আজকে আমাদের বিয়ে করার কথা ছিলো।’ ওপাশে ফোঁপানোর শব্দ শুনলাম। মেয়েটা কাঁদছে?
‘দাঁড়ায়ে থাক। আমি আসছি। পনের মিনিট দাঁড়া, ওকে? আর দেখছি শাহেদ্যা কোথায়। এসে শুনবো পুরো ঘটনা।’
লিনিতা কিছু বলতে চাইছিল হয়ত – ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। ঘটনা নিদারুণ প্যাঁচ খেয়েছে।
লিনিতার বাবার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির কথা আমার অজানা নয় – এর সাথে বিয়ের দিন ঠিক করে রেখে শাহেদের অন্তর্ধানটার ব্যাপারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সাবধানে আগানো দরকার। সব রিলেশনে ‘কাইজ্যা’ বাঁধে।
এবার লিনিতাদের রিলেশনে বেঁধেছে। ‘কাইজ্যা’র আকার নেহায়েত ছোট নয়। এটা ঠিকমত সামলাতে না পারলে মগডালে উঠে যাবে দুটোই। সাহায্যকারী হিসেবে আমি সেই গাছের তলে চাপা পড়বো।
শাহেদের প্রাণের বন্ধু মোস্তফাকে ফোন লাগালাম। সেই সাথে স্যান্ডোগেঞ্জির ভেতরে নিজেকে একটা সুইয়ের মত গলিয়ে দিচ্ছি। হাতে একেবারেই সময় নেই।
লিনিতা ওখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছে – বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। ওর পেটে কি আসলেই শাহেদের বাচ্চা? মাথা ঘুরেটুরে পড়ে যায় যদি?
মোস্তফা ফোন ধরছে না।
শালার পরবর্তী চৌদ্দগুষ্টির উদ্দেশ্য গুণে গুণে সতেরটা গালি দিয়ে ইমার্জেন্সী ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে এক লাফে বাসা থেকে বের হয়ে যাই।
গন্তব্য – রাজাবাড়ির কাজী অফিস।
অথবা, গন্তব্য – লিনিতা।
২.
লিনিতা আমাকে দেখে ক্লান্ত ভঙ্গীতে একটু হাসলো। তারপর টলে উঠে একবার।
রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলে মাঝে মাঝে টলবেই। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে একহাতে ধরে ফেললাম।
‘শাহেদ কোথায়?’ দুর্বল গলাতে জানতে চায় লিনিতা।
আমি হাল্কা করে মাথা নাড়লাম, ‘শাহেদকে খুঁজে পাচ্ছি না। শালার মোবাইল বন্ধ, শালার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই মনে হয় বিজি। তুই এখানে শাহেদের জন্য অপেক্ষা করবি?’
নিষ্পাপ শিশুর মত মাথা দোলায় লিনিতা। এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলাম।
এক বছরে আরও সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। পারফিউম দিয়ে এসেছে কি না বুঝতে পারছি না। তবে মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে আসছে। এটা স্মেল-গ্ল্যান্ড থেকেও আসতে পারে। নারীর বিশেষ গন্ধ শুধু ছেলেরাই পায়। তেমনটা হয়ত পাচ্ছি এখন আমি। কতদিন ওর সাথে এত কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলা হয় না!
‘শাহেদ এদিকে আসলে নিশ্চয় ফোন দেবে? তুই আমার সাথে চল তো। ছায়ায় বসা যাক।’
চারপাশে ইতিউঁতি তাকাই। দূরে নতুন রেস্টুরেন্টটা দেখা যাচ্ছে। লিনিতার হাত ধরে টান দিলাম, ‘চল, ওখানে ঢুকি।’
‘কিছু খাবো না তো।’ বিড় বিড় করে মেয়েটা।
‘লাচ্ছি খাওয়া যেতে পারে। রোদের মাঝে খুব বীরত্ব দেখাচ্ছিস। পিপাসা তো লাগার কথা।’
লিনিতা এবার আর আপত্তি করে না। দুইজন ওদিকে আগাচ্ছি, আড়চোখে লিনিতাকে একবার দেখে ‘কাইজ্যা’র গভীরতা মাপার চেষ্টা করলাম।
একহাতে একটা ডাফল ব্যাগ। ভ্যানিটি ব্যাগের সাইজও মাশাআল্লাহ – চায়ের আস্ত দুটো ফ্লাস্ক রাখা যাবে। সেই সাথে চোখ মুখের ক্লান্তি – একটা দিকই ইঙ্গিত করে।
বাসা থেকে এই মেয়ে ভেগে গেছে।
লিনিতার চোখে আড়চোখেই চোখ পড়ল। ওকেও দেখলাম আমাকে মাপছে। মুচকি একটা হাসি দেয় ও এবার।
‘কাঁধে ব্যাগ চড়িয়ে দৌড়াচ্ছিস কোথায়? যাচ্ছিলি নাকি কোথাও?’
‘যাচ্ছিলাম তো বটেই।’ সায় দেই আমি, ‘ভেগে যাচ্ছিলাম।’
‘আমার মেসেজ দেখেই বুঝে ফেলেছিস – বাসা থেকে পালাচ্ছি। তাই না?’
‘অতটুকুই। আর কিছু বোঝার সৌভাগ্য হয়নি আমার এখনও। তুই বোঝাবি – এই আশায় আছি।’
লিনিতার চলাফেরায় আগের মত উচ্ছ্বল ভাবটা লক্ষ্য করলাম না। ঢিলেঢালা পোশাক পরে আছে। বোঝার উপায় নেই তলপেটে আস্ত একটা বাচ্চা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে কি না। তবুও অসভ্যের মত কয়েকবার তাকালাম।
লিনিতা মজা করেনি তো বাচ্চা প্রসঙ্গে? লেট ম্যান হিসেবে আমার সুখ্যাতি আছে। সেটা এড়াতেই কি একটা মিথ্যা বলে আমাকে ঘর থেকে বের করেছে ও?
ঠান্ডা এক কোণের টেবিল দখল করতে করতে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, লিনিতার বাবুর ব্যাপারে আমার মাথা ব্যাথা কিসের? শাহেদের সাথে চুটিয়ে প্রেম করেছে একটা বছর ধরে – একটা উইকএন্ডেও রাতগুলো শাহেদের বাসার বাইরে কাটায়নি লিনিতা। ওর পেটে বাচ্চা আসবে না তো কি আমার পেটে আসবে?
বোকা মেয়েটা সতর্ক হতেও শেখেনি। এখন লেগেছে ‘কাইজ্যা’।
বোঝ এখন!
আমার দিকে ক্লান্ত ভঙ্গীতে তাকালো মেয়েটা। তারপর কী বিষণ্ণ একটা মুখ নিয়েই না হেলান দিল চেয়ারে।
‘দোষ আমার। পিল নিতে ভুলে গেছিলাম।’ আস্তে করে স্বীকার করে লিনিতা।
‘নিজেকে দোষ দিস নে।’ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম ওকে, ‘শুধু বল শাহেদের প্রতিক্রিয়া কি?’
উত্তরটা জানার জন্য আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। এরকম সময় ছেলেরা পল্টি মারে বলে শুনেছি। শাহেদ আমার বন্ধু, তবে খুব ঘনিষ্ঠ কেউ নয়।
তাছাড়া লিনিতার বয়ফ্রেন্ডের সাথে লুঙি শেয়ার করার মত বন্ধুত্ব হবে আমার – সেটাও আমি চাবো না কখনও।
সব মিলিয়ে শাহেদের মনের অবস্থা আমার বোঝার কথা নয়।
‘শাহেদ অনেক ভালো রে। মেনে নিয়েছে ও। তাছাড়া আগে থেকেই জানতাম কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না। টেস্ট করে আমার প্রেগনেন্সির ব্যাপারে আগেই জানতাম। মাসখানেক হয়ে গেল। কিন্তু তখন আমরা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম সবকিছু। এর মাঝেই বিয়েটা করে ফেললেই ঝামেলার একাংশ মিটে যেত।’
বিরক্তি আর চেপে রাখতে পারলাম না, ‘তাহলে একমাস পর কেন বিয়ের জন্য ঘুরছিস? এতদিনে তো তোর শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা।’
‘বাবা মেরে ফেলত শাহেদকে।’ শান্ত গলাতে বলে লিনিতা। আর আমি হয়ে যাই চুপ।
হাল্কা নাক টানে মেয়েটা। চমকে ওর মুখের দিকে তাকাতেই দেখি কাঁদছে ও।
আস্তে করে ওর হাত নিজের হাতে তুলে নিলাম।
একটুও শান্ত হল না এতে ও, ‘আপুর একবার হয়েছিল – জানিস – রাজন ভাইয়ের সাথে রিলেশন ছিল আপুর – বাবা ভাইয়াকে … ’
‘আচ্ছা,’ তিক্ত গলাতে বললাম আমি, ‘রাজন ভাই গত তিন বছর ধরে এজন্যই নিখোঁজ, অ্যাঁ? গুলি করে ফেলে রেখেছে কোথাও, তাই তো?’
ক্যাম্পাস আলোড়ন উঠিয়ে উধাও হয়ে গেছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্ট সিনিয়র রাজন ভাই। পলিটিকস করতেন না। তবে জার্নালিজমের ক্ষেত্রে কাওকে ছাড় দিতেন না। আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।
নির্দিষ্ট একটি দলের বিরুদ্ধে তাঁর লেখা জ্বালাময়ী কলামই উনার মৃত্যুর পেছনের একমাত্র কারণ – সে ব্যাপারে আমাদের মনে কোনই সন্দেহ ছিলো না। মানববন্ধন, আমরণ অনশন – সবই করা হয়েছিলো।
কাজে দেয়নি।
এখন দেখছি ঘটনা ভিন্ন!
রাজন ভাইকে নিয়ে লিনিতার মাথাব্যাথা তেমন দেখলাম না। আমার হাত আঁকড়ে ধরেছে ও এই মুহূর্তে।
‘আপুর অ্যাবোরশন করিয়েছিলো বাবা। আমি আমার বাবুটাকে ওদের হাতে খুন হতে দেবো না, নীরব। প্লিজ, আমাকে একটু সাহায্য করবি? বাবুটাকে নিয়ে পালিয়ে থাকতে হবে আমাকে কয়টা দিন।’
একজন মা তার অনাগত সন্তানের জন্য কতখানি মায়া অনুভব করে সেটা আমি আগে বুঝতে পারিনি কখনও। এখন সেটা লক্ষ্য করে খেয়াল করলাম বুকের কাছে কোথাও দলা পাকিয়ে উঠছে। চার বছর ধরে মেয়েটাকে ভালোবাসি – তবে আজকের মত অসীম মায়া কোনদিন অনুভব তো করিনি ওর জন্য!
শক্ত করে ওর হাত ধরে বললাম, ‘লিনি, আমি আছি। তোমার বাবুকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ না!’
পকেটের মাঝে মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। হাত বাড়িয়ে ওটা বের করে আনলাম।
মোস্তফার ফোনকল দেখে অন্তরের অন্তস্থল থেকে শান্তি অনুভব করলাম। এই ব্যাটার নাগাল পাওয়া গেলে শাহেদকেও পাওয়া যাবে। গার্লফ্রেন্ডের পেট বাঁধিয়ে ভেগে গেছে নাকি শালা?
ছেলেজাতিকে কোন বিশ্বাস নেই।
রিসিভ করতেই ওপাশে মোস্তফার মেয়েলী গলাটা শুনতে পেলাম, ‘কি রে, ফোন দিয়েছিলি নাকি? গডজিলা দেখতেছিলাম। বালের মুভি। সময়টাই নষ্ট করে-’
‘তোমার মুভির আলাপ শোনার জন্য ফোন দেই নাই আমি।’ ক্যাট ক্যাট করে উঠলাম।
লিনিতা চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়। বেশি জোরে তো বলিনি – তবুও চমকে গেছে।
নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে থাকি এবার। এত করেও মোস্তফার পরের কথা শুনে আমার মুখ থেকে বের হওয়া বাক্যটা বেশ জোরেই উচ্চারিত হল।
‘আর তুমি হাওয়ার নাতি আরাম করে মুভি দেখতেছ? শাওয়া!’ টেবিলে মোবাইল আছড়ে ফেললাম আমি।
‘কি হয়েছে?’ শিশুদের মত মুখ করে আমাকে প্রশ্নটা করে লিনিতা।
ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে হয় আমার।
ইচ্ছে হয় ওর ঘন রেশমী চুলে হাত ডুবাই।
শক্ত করে বুকে আটকে রেখে বলি, ‘কিছু হয় নি, লিনি সোনা। কিছু হয় নি, সব ঠিক আছে, তোমার বাবুটাকে আমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করব।’
কিন্তু এগুলোর কোনটাই করতে পারলাম না। শুধু শুকনো গলাতে বললাম, ‘গতকাল রাতে শাহেদকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। সম্ভবতঃ তোমার বাবার হাত আছে এর পেছনে।’
৩.
প্যাঁ-প্যুঁ করে লঞ্চটা ছেড়ে দিলো।
পারাবত – ১১।
গন্তব্য – বরিশাল।
বাইরে থেকে লিনিতার কেবিনে বার দুয়েক টোকা দিলাম। দরজা সাথে সাথে খুলে যাওয়ার কারণ নেই – রেইলিংয়ে এসে দাঁড়ালাম।
মিষ্টি বাতাস আমার মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বুড়িগঙ্গার করুণ হাল হতে পারে – লঞ্চগুলোকে বমি করে খোলা বড় নদীতে এই ছোট নদীটাই পাঠাচ্ছে। চারপাশে এর মাঝে আঁধার নেমে এসেছে। আগামীকাল সকাল নাগাদ পৌঁছে যাবো আমরা বরিশাল।
এই মুহূর্তে আর কোন ভালো সমাধান পেলাম না। বরিশালে আমার খালাতো ভাইটি আছে অনেকদিন ধরেই। কাশীপুরে থাকে, ব্রজমোহন কলেজের একজন নবাগত লেকচারার।
ভাইটির সাথে আমার বয়েসের পার্থক্য খুব বেশি না। বোঝালে পরিস্থিতি তিনি বুঝবেন বলেই মনে করেছি। আমার এখন আর আমাকে বা লিনিতাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে না। চিন্তা হচ্ছে শাহেদকে নিয়ে।
পুলিশের লোকেরা শাহেদকে নিয়ে সোজা লিনিতার প্রভাবশালী বাবার সামনে এনে ফেলবে সন্দেহ নেই।
তারপর কি হবে?
রাজন ভাইয়ের মত এই ছেলেও কি নিখোঁজ হয়ে যাবে না?
আমার মনের একটা অংশ গোটা ব্যাপারটায় পৈশাচিক একটা আনন্দ অনুভব করছে – বুঝে রীতিমত লজ্জায় ভরে গেল মনটা।
ছি ছি – এটা আমার ভাবা তো উচিত না। লিনিতার সন্তানটি এই শাহেদেরই – আর শাহেদেরই অধিকার সবচেয়ে বেশি লিনিতার ওপর। আড়াল থেকে মেয়েটিকে ভালোবাসতে পেরেছি এই তো যথেষ্ট।
দৃশ্যপট থেকে প্রেমিকার প্রেমিক সরে গেলে আনন্দে বগল বাজানোটা তো ছোটলোকি হয়ে যায়। আমি ওরকমটা কিভাবে করতে পারি?
তবে শাহেদ না আসলে আমার করণীয় কি সেটাও আমি জানি। আর একবছর পর জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাদের ব্যাচটাও বের হয়ে যাবে। নিজের একটা ভবিষ্যত আমি গড়ে তুলতে পারবো। আর তাতে থাকবে লিনিতা আর তার বাবুটা।
পেছন থেকে খুট করে দরজাটা খুলে যায়। চওড়া একটা হাসি উপহার দিলাম লিনিতার দিকে। তারপর সাবধানে ভেতরে ঢুকে যাই। কেবিনের ভেতরটা বেশি বড় নয়। তবে বেশ একটা ‘পানিতে আছি’ ‘পানিতে আছি’ ভাব টের পাওয়া যায় এখানে।
‘ভাবিস না। আর কয়েক ঘন্টার পর একেবারে রাডারের নিচে চলে যাবি। তোর বাবা তোকে জোনাকি পোকা জ্বালিয়েও খুঁজে পাবেন না।’ আশ্বস্ত করি ওকে, ‘কেমন লাগছে এখানে?’
আস্তে করে বাংকে পা দুলিয়ে বসে পড়ে মেয়েটা, ‘খারাপ লাগছে না। তুই আমার পাশে একটু বসবি?’
কোন কথা না বলে ওর পাশে বসে পড়ি। আস্তে করে আমার কাঁধে মুখ ঠেকায় মেয়েটা। তারপর একটু ঘুরে গাল ছুঁইয়ে রাখে।এক হাতে ওকে আমার সাথে জড়িয়ে রাখি আমিও। একটু কেঁপে কেঁপে ওঠে লিনিতার শরীর।
আমার দিকে বড় বড় চোখ দুটো মেলে দেয় তারপর, ‘গতকাল আমাকে আর শাহেদকে দেখে ফেলেছিল বাবার লোক।’
‘এজন্যই এতদিন পর তোরা ফাইনালি পালানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলি?’ বোঝার ভঙ্গী করলাম।
‘জানতাম তখনই। জানতাম, হাতে বেশি সময় নেই আর। কাল রাতেই যে বাবা ওকে ধরে ফেলবে সত্যি ভাবিনি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, ‘ভাবিস না। আমি ওকে মুক্ত করে আনবো।’
কিছু না বলে চুপচাপ আমাকে ধরে বসে থাকে মেয়েটা। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ও নিজেও ফেলে।
একটু করে চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম ওর। এই বড় পৃথিবীটায় বেচারির কেউ নেই এখন, আক্ষরিক অর্থেই।
‘তোকে ধরে আছি বলে আমাকে খারাপ ভাবলি?’ আস্তে করে জানতে চায় লিনিতা।
মাথা নাড়ি আমি, ‘তা কেন? তোর ওপর দিয়ে অনেক কিছু গেছে। এখন কিছু না ভেবে চুপচাপ বসে থাক তো।’
‘আমার খুব একা একা লাগছে।’ শোনা যায় না প্রায় – এভাবে বলে মেয়েটা।
ওর থুতনীতে হাত রেখে তুলে ধরলাম আমার দিকে, ‘ভয় করছে?’
পাখির বাবুর মত মাথা দোলায় লিনিতা।
ওর ছোট একটা নাক, লালচে দুটো গাল, হাল্কা ঘাম ঘাম কপাল আর কপালে জমে থাকা চুলগুলো আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। ওকে জড়িয়ে রাখি নিজের আরও কাছে। তলপেটটা একটু ফুলে আছে ওর, বাবুটা ওখানেই বেঁচে আছে নিশ্চয় – কি অদ্ভুত!
গলা নামিয়ে বললাম আমিও, ‘আমি তোর সাথে আছি। একটুও ভয় পাবি না তুই, হুঁ?’
সাথে সাথে চারপাশের আলো নিভে গেল দপ করে। চমকে উঠে আমাকে শক্ত করে খামচে ধরে লিনিতা।
ওর কপালে একটা চুমু খেলাম, ‘তুই চুপটি করে শুয়ে থাক। আমি দেখে আসছি।’
লিনিতা অনিচ্ছাস্বত্বেও আমাকে ছেড়ে দেয় আলিঙ্গন থেকে। ঠিক এই সময় দরজার ওপর জোরে আঘাত করে কেউ।
একবার।
দুইবার।
তিনবার।
এরপর ভেসে আসে ভারী গলাটা।
‘দরজা খুলুন, পুলিশ!’
চট করে একে অন্যের দিকে তাকাই আমরা। বাসা থেকে লিনিতার পালানোর পর প্রায় আঠারো ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে – কেউ কি দেখে ফেলেছে আমাদের এদিকে আসতে? লঞ্চে উঠতে খেয়াল করেছে লিনির বাবার কোন পোষা কর্মচারী?
এখন কি ওরা লিনিতাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে?
‘আমার বাবুটাকে ওরা মেরে ফেলবে!’ ফিস ফিস করে বলে লিনিতা।
অসহায়ের মত ওর দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।
৪.
কেবিনের ঠিক বাইরে বের করে এনে আমাকে লঞ্চের দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে রাখা হয়েছে। পকেট থেকে একে একে বের হয়ে আসে আমার চকচকে স্মার্টফোন, একটা মানিব্যাগ, আর বাসার চাবিটা।
‘চাবি নিয়ে ঘোরেন কেন?’ ছোট খাটো একটা হাতির সাথে যায় – এমন আকারের পুলিশটি প্রশ্ন করল আমাকে।
পেছনের বডি বিল্ডার পুলিশটির চাপে আমার দাঁত খুলে যেতে থাকে, তার মাঝেই কোনমতে উত্তর দেই, ‘তালা খোলার জন্য।’
‘চেহারা দেখে তো পাক্কা চোর লাগতেছে, স্যার। এরে দিয়া এর চেয়ে বড় কাজকাম কিছুই হইবো না।’
এই পুলিশটার দিকে ঘাড় বাঁকা করে তাকালাম। রেইলিংয়ে পশ্চাদ্দেশ ঠেকিয়ে ডান হাতের কানি আঙুল দিয়ে ঘষঘষ করে কান চুলকাচ্ছে। ইচ্ছে করছিল এক ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে রেইলিংটা পার করে পানিতে ফেলে দিতে।
কিন্তু পারলাম না।
‘এই শালার চেহারা সুবিধার লাগছে না।’ তিনজনের মাঝে নেতাগোছের পুলিশটি এবার বলে, ‘খিঁচে সার্চ কর তো, সোহরাব।’
সোহরাব আমাকে ‘জাতা’ মেরে দেওয়ালে এতক্ষণ চেপে রেখেছিলো নিশ্চয়। এবার তার হাত দুটো অসভ্যের মত আমার শরীরের ওপর ঘোরাফেরা করতে থাকে। ‘খিঁচে’ সার্চ করছে।
সমকামী নাকি?
কান চুলকানোর কাজ শেষ করে তৃতীয় পুলিশ আমার ব্যাগ নিয়ে পড়ল, ‘বিশ হাজার টাকা। নগদ। স্যার, এর মানে কি?’
‘স্যার’ দুই লাফে ব্যাগের কাছে চলে গেছেন ততক্ষণে, ‘আরে এই-ই তাহলে আমাদের সেই লোক।’
আমি ইঁদুরের মত শব্দ করে বললাম, ‘কোন লোক?’
‘শাট আপ!’ তড়পে উঠলেন পুলিশ ভদ্রলোক, ‘নগদ এত টাকা কেন? আর মাইয়া নিয়া চলতেছ – কিছুই বুঝি না?’
আমার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। লিনিতার পালানোর খবর এরা জেনে গেছে নির্ঘাত! আর এজন্যই একেবারে দলবল নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। মেয়েকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েই বাচ্চার বারোটা বাজিয়ে দেবে নিশ্চয় বাবা-মহাশয়। আর আমাকে ‘নাগর-প্রবর’ মনে করলে স্রেফ নাগরদোলায় চড়ানো হবে – এতেও সন্দেহের কিছু দেখলাম না।
আমাকে সার্চ করতে থাকা লোকটাকে বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললাম, ‘আর কত সার্চ করবেন? নগ্ন করে ফেলবেন নাকি?’
মুখ ঘষে নোংরা পুলিশটা, ‘হলে তো ভালোই হয়। অন্ধকারে সার্চ করা যায় না ঠিক মত।’
নেতা পুলিশটা আমার মাথার পেছনে রোলার দিয়ে একটা উপর্যুপরি গুঁতো দেয় এসময়, ‘ন্যাকামি হচ্ছে! বাচ্চাটা কই? অ্যাঁ? বাচ্চা কোথায়?’
মাথাতে এত জোরে আগে কেউ মারেনি আমাকে। গোঁ গোঁ করতে করতে পড়ে গেলাম।
লিনিতাকে দেখলাম শিউড়ে উঠেছে একেবারে। আমি মাটিতে শুয়ে পড়েছি ততক্ষণে। খুব বলতে চেষ্টা করলাম, ‘আমাকে মাফ করে দিস, লিনি!’
কিন্তু পারলাম না।
কান চুলকানি পুলিশ উঠে দাঁড়ায় আমার ব্যাগের ওপর থেকে। বলে, ‘বাচ্চা দেখলাম না, স্যার।’
স্যার মাথা দোলালেন, ‘টাকাটা রেখে দাও। শিওর তো?’
দাঁত কেলায় সোহরাব, ‘ওই কাজে আমরা কোনকালে শিওর ছিলাম না, স্যার?’
নেতা-পুলিশের অহংয়ে বাঁধল এবার, ভারী গলাতে বললেন, ‘আমি বাচ্চার কথা বলেছি।’
‘নাই, স্যর।’
মনে মনে আমি বললাম, ‘বাচ্চা তো লিনিতার পেটের ভেতর। ব্যাগের চিপাতে খুঁজে কে কবে পেয়েছে ওই জিনিস?’
মুখে কিছু বললাম না।
চিৎ হয়ে শুয়ে আছি – এই সময় কানে খাটো পুলিশটি স্যারের দিকে এগিয়ে যায়, ‘মোবাইলখান ভালো মাল স্যার।’
‘বেশি টেনো না, ইদরিস।’ সতর্ক করে লিডার-পুলিশ, ‘পরে ঝামেলায় পড়বে। টাকা নিয়েই আপাতত সন্তুষ্ট থাকো।’
আমার মোবাইল সম্ভবতঃ ওদের সাথে যেতে চাইছিল। হাহাকার করে রিংটোন বাজিয়ে ডেকে উঠলো ওটা।
আমি ধড়মড় করে উঠে বসছিলাম, তার আগেই নাফরমান পুলিশটা রিসিভ করে ফেলেছে। তাও আবার লাউডস্পীকারে।
আমি এখান থেকে রেজা ভাইয়ের গলাটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। ক্যাম্পাস সিনিয়র।
‘আরে মিয়া তুমি সারারাত ফোন অফ কইরা রাখছো! এখন আবার ফোন ধর না। কয়বার ফোন দিছি তোমারে?’
আমি মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছি রোলারের বাড়ি খেয়ে। কিভাবে রেজা ভাইকে বোঝাবো তখন আমি আমার স্বপ্নবালিকার হাত ধরে ছুটে পালাচ্ছিলাম। বালিকা পালাচ্ছিল তার বয়ফ্রেন্ডের বাচ্চা পেটে নিয়ে। মানে, বয়ফ্রেন্ডের অদৃশ্য হাত ধরে!
অভূতপূর্ব রোমান্টিক মুহূর্তগুলোয় রেজা ভাইয়ের ফোনকল কেটে দেওয়া ছাড়া আমার গতি ছিলো না। শালার পুলিশ – ধরেই ফেলল ফোনকলটা।
নেতাটি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘কথা বলেন।’
আমি খামচি দিয়ে ফোনটা ধরলাম, পুলিশ ইঙ্গিতে বলল ‘লাউডস্পীকার অন থাকুক’। চিংড়ির মত মুখ করে ফোনের সামনে মুখ নিতেই হল।
‘কি ব্যাপার, নীরব। কথা বলছ না কেন? মিউজিয়মে আমি প্রায় চার ঘণ্টা ধরে। তোমাকে সাথে করে আসতাম – তোমার খবর নেই কেন?’
আমি ফোন হাতে এবার বাঘ হয়ে গেলাম, ‘আমার গার্লফ্রেন্ড প্রেগনেন্ট। ওকে নিয়ে বরিশাল যাচ্ছি।’
পুলিশ তিনজন স্রেফ ‘দোচনা’ হয়ে গেছে। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে ওরা। আমি নিশ্চিত, ফোনের ওপাশে রেজা ভাইয়ের প্রেশারও কয়েক ডিগ্রী বেড়ে গেছে। আর সব সময় চমকালে তিনি যা করেন –চোখ স্রেফ কপালে তুলে ফেলেছেন।
‘লে হালুয়া।’ বিড় বিড় করে বললেন তিনি।
‘ভাই মহা ঝামেলাতে পড়ে গেছি। কথা তো শোনেনা শিরিন। পিল নিতে মনে না থাকলে আমার দোষ?’
‘না না , তোমার আর কি … আচ্ছা, সরি, ঝামেলা সামলাও। আমি এদিকটা দেখছি।’
ফোন রেখে দিতেই পুলিশ তিনজন আমাকে ধরে বসালো, লিডার হাতের কাছে রোলার রাখলেও এখন বেশ কোমল তাঁর চেহারা, ‘ইয়ে, ইনি কে ছিলেন?’
দেওয়ালেই হেলান দিলাম আমি, ‘ক্যাম্পাসের সিনিয়র। আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। একটা কেস স্টাডির জন্য ডেকেছিলেন। আমার যাওয়া হয় নি।’
‘কেস স্টাডি?’
‘আমরা জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের।’
পুলিশ তিনজনের চেহারা হয়েছে দেখার মত।
নিমেষে হুংকার ছাড়লেন নেতা-পুলিশ, ‘ভাইয়ের জিনিস ফেরত দে। দেখ, সবকিছু ঠিকমত দিয়েছিস কি না। ভাইরে দেখা সব ঠিক আছে কি না!’
সোহরাব হারামজাদাকে দেখলাম পাছার ভাঁজ থেকে আমার বিশ হাজার বের করে আবার ব্যাগে রাখছে। মনটা চাইলো কানের ওপরে আর নিচে একটা করে বসিয়ে দিতে। কিন্তু লিনিতার কম্পমান শরীর দেখে কিছু বললাম না।
মেয়েটাকে ওরা সার্চ করেনি ঠিকই – কিন্তু দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
পুলিশগুলো আমার জিনিস গুছিয়ে সাজিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেয়। তারপর একবার ক্ষমাপ্রার্থনা করতে তারা ভোলে না। নেতাটিকে দেখলাম দাঁত বের করে একটা নোংরা জোকস শুনিয়ে দিলো।
আমিও শুকনো হাসার ভান করলাম। একটু আগে যে মাথার পেছনে গর্ত করে দিয়েছে রোলার মেরে – তার কৌতুক শুনে প্রাণ খুলে হাসা যায় না।
ওদের সামনেই লিনিতাকে জড়িয়ে ধরি। কাঁপছে মেয়েটা।
কানে কানে বললাম, ‘ভয় নেই, লিনি। শান্ত হও।’
মেয়েটা আমাকে চুপচাপ জড়িয়ে থাকে। কাঁপুনি আগের চেয়ে কমে গেছে।
শুনতে পেলাম, কান চুলকানো পুলিশ গলা নামিয়ে বলছে, ‘আগেই কইছিলাম না, মাইয়া পোয়াতী?’
আমি গলা চড়িয়ে জানতে চাইলাম, ‘শুনুন?’
নেতা পুলিশ চমকে ফিরে তাকায়।
হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে যাই, ‘কারেন্ট চলে গেল কেন?’
হতভম্ব দেখায় এবার পুলিশকে, ‘আমি তো ঠিক জানি না। সম্ভবতঃ পাওয়ারে কোন সমস্যা হচ্ছে। দেখছি আমি।’
মাথা দুলিয়ে লিনিতার দিকে ফিরে আসছি – নীচে কোথাও প্রচণ্ড শব্দ হল। তারপরই চিমনি বেয়ে লক লক করে আকাশের দিকে ছুটে যায় আগুনের শিখা।
নিচে কিসের শব্দ হয়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। মেরুদণ্ড শীতল হয়ে যায় আমার ওতেই।
শব্দটা বিস্ফোরণের!
৫.
লঞ্চ ডুবছে।
লিনিতার হাত ধরে ছুটছি প্রানপণে। একেবারে মাঝ নদীতে ডুবতে থাকা লঞ্চের ভেতর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়।
সবাই ছুটছে – যার যেদিকে মন চায়।
এদের অধিকাংশই সাঁতার পারে না।
সাঁতার পারলেও খুব একটা কিছু আসে যায় না। লঞ্চ ডোবার সময় ডুবন্ত একটি মগ যেভাবে বালতির পানি টেনে নেয় – সেভাবে সবাইকে টেনে নিবে নিজের ভেতরে। তারপর ডুববে।
এটার চেয়ে বড় সমস্যা হল আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে। ছড়িয়ে আসছে এদিকে।
লিনিতার হাত শক্ত করে ধরে আছি। ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যেতে ওকে আমি দেব না। অনেক দিন অপেক্ষার পরে এই মেয়েটিকে পেয়েছি। আর হারাতে চাই না ওকে আমি।
শাহেদের ওপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। যেই ছেলে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না – তার কি কোন অধিকার আছে লিনিতার ভালোবাসা পাওয়ার?
মেয়েটার দিকে একবার আড়চোখে তাকাই – ভীত হরিণীর মত দেখাচ্ছে ওকে। আগুণের হলদে আভা তার চোখে মুখে পড়ছে। আরও বেশি সুন্দর লাগে ওকে আমার এই মুহূর্তে।
শাহেদ তো ওর জন্য কিছু করে নি। বিয়েটা পর্যন্ত করতে পারলো কোথায়? বরং সন্তানের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।
সতর্কতা গ্রহণের জন্য তার কি কোন পদক্ষেপ নেওয়ার ছিলো না?
আগুনে ডুবন্ত একটা লঞ্চ থেকে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে আমার লিনিতা – শাহেদ কোথায় এখন?
পাশের রেইলং টপকে এক মাঝ বয়েসী লোক পড়ে যেতে থাকে পানিতে – হয়ত কারও ধাক্কা লেগেছে, তাল সামলাতে পারেননি।
দৃশ্যটা আমাকে থমকে দেয়। লিনিতা পাশ থেকে তাড়া দেয়, ‘এগিয়ে চলো, নীরব। দাঁড়াবে না।’
ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম, ‘যাবো কোথায়?’
কিছু বলল না ও, হাঁফাচ্ছে। একে অন্যের দিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থাকি আমরা।
লঞ্চ আগের চেয়েও ডুবে গেছে এখন। আর আধঘণ্টার মাঝেই পানির তলে চলে যাবে একেবারে – যা মনে হচ্ছে।
কেউ একজন ফ্লেয়ার গান দিয়ে আকাশে একটা ফ্লেয়ার মারে। রাতের আকাশ কিছুটা আলোকিত হয়ে উঠেছে ওটার আলোতে।
কান না পাতলেও লঞ্চের যাত্রীদের চিৎকার, কান্না আর হাহাকারে পরিবেশ ভারী হয়ে আসতে শুরু করেছে এরই মাঝে। লিনিতা ঝট করে চোখ সরিয়ে নেয় ঠিক তখনই। আচমকা দৌড় দেয় সিঁড়ির দিকে।
সবাই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে এখন। ওপরের অংশ পরে ডুববে – ধারণাটাকে পুঁজি করে বাঁচার চেষ্টা একটা। সেই ভীরের মধ্য দিয়ে লিনিতা নিচের দিকে নামতে থাকে। কাজটা সহজ না – সবার ধাক্কা খাচ্ছে মেয়েটা।
বাবুটার গায়ে ওই ধাক্কাগুলো প্রভাব ফেলবে না?
ঠিকভাবে কিছু ভাবার আগেই ওর পিছু নিলাম।
ওপরের দিক থেকে দোতলা নেমে আসতেই সিঁড়ির গোড়ায় পানি দেখতে পাই। এই ফ্লোরে এখন একজন মানুষও নেই!
দূরে কোথাও চর চর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আগুনের ধ্বংসাত্মক শব্দ!
লিনিতা এরই মাঝে গোড়ালি ডোবানো নদীর পানিতে নেমে পড়েছে। এই ফ্লোর এখন নদীর সারফেস লেভেলেরও আট ইঞ্চি নিচে!
ছুটে গিয়ে ওকে ধরলাম আমি, ‘পাগল হয়ে গেছিস তুই? ওপরে চল, পাগলামি করিস না!’
লোহার বালতিটা এই সময় লিনিতার পায়ে বেঁধে যায়। পড়েই যাচ্ছিল – দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেললাম।
ভারসাম্য সামলে নিয়ে আমার দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটা। কেমন করুণ একটা অভিব্যক্তি ফুটে আছে ওর চোখে মুখে।
‘নীরব?’
‘ওপরে চল।’
‘আ’ম সরি…’
আচমকা পেছনের দিকে সরে গেছে লিনিতা – আমি নড়ে ওঠার আগেই বালতিটা তুলে এনে দড়াম করে আমার মাথাতে বসিয়ে দেয় ও। দুই পা পিছিয়ে গেছি – তারপর তৃতীয় পা পেছতে পারলাম না – সিঁড়িতে পা বেঁধে পড়ে গেলাম।
ঘোলা ঘোলা দেখতে পাচ্ছি – লিনিতা ওর ট্রাউজার খুলে ফেলছে। আমি নড়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মস্তিষ্কের কথা শুনছে না শরীর একদম। নদীটা ধীরে ধীরে উঠে আসছে ওপরের দিকে। আমার থুতনীর কাছে পানি চলে এসেছে এখন। লিনিতার নাভী পর্যন্ত ডুবে আছে।
টান দিয়ে কিছু একটা বের করছে ও ওখান থেকে।
আমি আঁতকে উঠি।
বাচ্চাটা মরে যাবে তো?
তারপর – অদ্ভুত এক অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমি। পড়ে যাচ্ছি যেন অসীম শুন্যতায়!
তার মাঝেই দূরে একটা ছোট নৌকা দেখতে পাই আমি। জনকন্যাকে তুলে নিচ্ছে ওটা তার বিশাল বুকে।
পরিশিষ্ট
কে জানি বলছে, ‘শালা, ভেবেছিলাম নীরবই নিউজ হইয়া গেছে!’
ব্যাঙের মত বার কয়েক শব্দ করে চোখ মেললাম।
আছি কোথায়?
চারপাশে নোংরা পরিবেশ আর দরজাতে সাদা পর্দা দেখে বুঝলাম, জায়গাটা সরকারী কোন হাসপাতাল।
‘নবাবের জ্ঞান ফিরেছে।’ রেজা ভাইয়ের কণ্ঠটা চিনতে পারি এখন আমি।
ধড়মড় করে উঠে বসি আমি, ‘লিনিতা-’
‘হাওয়া। আমাকে যদি আরেকটু আগে জানাইতা তোমার সাথে তথাকথিত গার্লফ্রেন্ড লিনিতা – তাইলে এতক্ষণে ফাটকে পুড়ে ফেলা যেত ওকে।’
‘দোষটা কি ওর?’ কিছুটা আগ্রহী হই এবার আমাই। আধশোয়া হলাম বালিশ টেনে এনে।
‘মিউজিয়মে পরশু রাতে চুরি হল না? আরে সব ভুলে যাও তো – জার্নালিজমে কিভাবে উন্নতি করবা? ২০ ক্যারটের প্রাচীন ডায়মন্ড সাফা করে দিয়েছে খবর শোনো নাই?’
হাই আসছিলো, তবে সেটা চেপে ধরতে দরতে রেজা ভাইয়ের দিকে তাকালাম, ‘ওখানেই নিতে চাইছিলেন আমাকে গতকাল?’
‘হুঁ। নিজে তো ডায়মন্ড-চোরের সাথে ভাইগা গেছো মিয়া।’
‘বুঝলাম না।’
‘তোমার ওই লিনিতার বয়ফ্রেন্ড শাহেদের মাস্টার প্ল্যানিং পুরো চুরির ব্যাপারটা। সিসি ক্যামে সে নিজেকে বাঁচাইছে। কিন্তু মিউজিয়ম থেকে বের হয়ে রাস্তার অপোজিট ক্যামেরাতে এসে ধরা খাইছে। তখন পালাইলেও পুলিশ ওরে মার্ক করে ফেলছিলো। রাতের বেলাতেই শালাকে ধইরা ফেলছে ওরা।’
‘ওহ… কাহিনী তাহলে এটাই!’ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে আমার।
‘আরে আরও আছে। শাহেদরে ধরলেও তো আর ডায়মন্ড পায় নাই। পুলিশ তো জানতো না শাহেদের অ্যাসিস্টেন্ট আছে একজন। বাইরে ছিলো কোথাও এই মাল, তারে মাল দিয়া শাহেদ ফুটছে আগেই।’
‘লিনিতা।’ বিড় বিড় করলাম।
‘পুলিশ শাহেদকে পিটায়া রুট বের করে ফেলছে। ডায়মন্ড ওখান থেকে সোজা যাবে বরিশাল। কিন্তু পুলিশ শুধু এটাই জানত না – কার হাত দিয়ে সেটা যাবে। ‘ চোখ বড় বড় করে বলেন রেজা ভাই।
‘এজন্য ঢালাউ সার্চের ব্যবস্থা তারা করেছিলো।’ মাথা দোলালাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রেজা ভাই, ‘এটা হল ফ্যাক্টস। তবে বাকি কাহিনী আমার হাইপোথিসিস অনুযায়ী কইতে পারি। হাসবা না কইলাম। আমি মাত্র বাইর হইতেছি জার্নালিজম থেকে।’
‘হাসবো না।’ বলেই মুচকি হেসে ফেলি।
‘লিনিতা একা ছিলো না। শালীর সাথে অন্তত একজন ছিলো আরও। ওই ব্যাটাই লঞ্চে উঠে এসেছিলো পাশে স্পীড বোট ঠেকিয়ে। বোমা মেরে তোমাদের লঞ্চের ইঞ্জিন রুম দিলো উড়াইয়া। লাভটা বুঝতেছ না?’
চিন্তিত মুখে বললাম, ‘ডুবন্ত লঞ্চের লোক উদ্ধারের জন্য পুলিশের দম বের হয়ে যাবে। ডায়মন্ড চোর খুঁজবে কে ওই রুটে?’
‘ঠিক তাই। নৌকাতে করে ভেগে গেল তোমার প্রেম – লিনিতা। ডায়মন্ড শুদ্ধ।’
হেসে ফেললাম এবার আসলেই, ‘লজ্জা দেবেন না তো। আমাকে পেলেন কোথায়?’
‘ডুইবা ডুইবা সেকেন্ড ডেকে পানি খাইতেছিলা – ওখান থেকে উদ্ধার করছে তোমাকে। পারাবত – ০৯ লঞ্চটা কাছেই ছিলো।’
মাথা দোলালাম আমি, ‘বাচ্চা খুঁজছিলো পুলিশ। আর লিনিতা ছদ্মবেশ নিয়েছিল গর্ভবতী মেয়ের। কো-ইন্সিডেন্স?’
ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন রেজা ভাই, ‘কি কও! লিনিতা প্রেগন্যান্ট মহিলার ছদ্মবেশ নিছিলো? স্রেফ রসিকতা – এই মাল পাচারের জন্য এর চেয়ে ভালা রসিকতা আর হয় না!’
‘কেন?’
’২০ ক্যারটের ডায়মন্ডটার নাম কি জানো? অফস্প্রিং। বাচ্চা এইটারে বলাই যায়।’
আস্তে করে বিছানাতে আবার শুয়ে পড়লাম।
অফস্প্রিং।
সন্তান।
বাচ্চা।
তাই তো – বলাই তো যায়।
পারাবত – ০৯ সময়মত চলে এসেছিলো দেখে নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম মনে মনে। জার্নালিজমে উন্নতি করতে পারবো না – কথাটা হয়ত একেবারে মিথ্যা নয় – কারণ, সুযোগের সদ্যবহার করতে আমি পারি । লিনিতার উচিত ছিলো আমার মাথাতে বালতি দিয়ে আরেকবার বাড়ি মারা।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যেন কয়েক ঘন্টা আগের দৃশ্যগুলো। মানিব্যাগে সব সময় রাখা ব্লেডটা খুব কাজে এসেছিলো। লিনিতার গলা ফাঁক করে দিতেই হারামজাদা বোট-ম্যানের চোখ কপালে উঠে গেছিল। আমার দিকে বোট থেকে নেমে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিল অবশ্য, শালার মুখের ওপর আস্ত বালতিটা ছুঁড়ে মেরেছিলাম। তারপর সব ঠাণ্ডা। উজ্জ্বল সার্চ লাইটের আলোতে ব্যাটার গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার যোগাড়।
পারাবত -০৯ নদী কাঁপিয়ে আসছিলো – আমাকে ওখানে রেখে প্রাণটা নিয়ে পালানো ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না ওর।
আস্তে করে বেল্টের নিচে গোপন পকেটটার ওপর হাত বোলালাম।
আমার সন্তান নিরাপদেই আছে!
— ০ —
[ চ্যালেঞ্জ মিটিয়ে দিলাম। 🙂
এই গল্পটা লেখার কোন ইচ্ছে আজকে ছিলো না। দুটো লেখার শিডিউল আগে থেকেই ছিলো আজকের জন্য। এর মাঝে চ্যালেঞ্জের জন্য বাধ্য হয়েই লিখতে হল আমাকে।
যদি খারাপ লেগে থাকে – তাহলে পাঠকের কাছে আমি দুঃখিত। এক গল্প লিখতে লিখতে ওটা থামিয়ে রেখে বাধ্য হয়েই আরেক গল্প লিখতে হয়েছে আমাকে এখানে। একসাথে দুই গল্প লেখার প্যাড়া লেখক মাত্রই বুঝবেন। দুইটি প্লটকে আলাদা করে একটা ধরে লিখতে হয় তাঁকে। মানসিক টর্চার ছাড়া কিছু না।
তবে আমি সময়ের ভান্ডার আছে, অফুরন্ত সময় সেই ভান্ডারে– এমন একজন ‘লেখকে’র লেখা পড়ার অপেক্ষাতে আছি। দশটায় তাঁরও একটা গল্প দেওয়ার কথা কি না…
উল্লেখ্য, অপর গল্পটি লিখছিলাম ‘শুধুই গল্প – সংকলন বইমেলা ২০১৫’ উদ্দেশ্যে। 😉 ]
রচনাকাল – সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪
Leave a Reply