ফ্লেমথ্রোয়ার
শোভনের হাত সুড় সুড় করছে সামনের মেয়েটার ব্যাগে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার জন্য।
মেয়েটা একেবারেই নিরপরাধী সেটাও না। কাজেই আগুন লাগানোর পরে কোন ধরণের অনুশোচনা অনুভব করবে কি না সে ব্যাপারে পঞ্চম বার নিজেকে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হল – অনুশোচনার ভয় এখানে নেই। বিবেক গ্রীণ সিগন্যাল দিচ্ছে।
বিবেককে একটা স্যালুট ঠুকে দিয়ে শোভন আস্তে করে ফ্লেমথ্রোয়ারটা বের করে।
নিজস্ব সৃষ্টি। কাজেই নিরাপদেই আগুন জ্বলে।
সুন্দরী হয়েছে বলে আর কাওকে মানুষ মনে না করার শিক্ষা এই মেয়েকে হাতেনাতে দেওয়া হবে।
ঘটনা আর কিছুই না। বাসে উঠে শোভন বাম দিকের নারী,শিশু আর প্রতিবন্ধিদের সীটগুলো সবসময়ই এড়িয়ে চলে। আজও সেই ধারা বজায় রেখে ডান দিকের একটি সীটে ভদ্র ছেলের মত বসে ছিল শোভন। মেয়েটা উঠেছে ওরও আগে। পাবলিক বাস – কাজেই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুড়হুড় করে যাত্রী বেড়ে যেতে লাগল।
তিন স্টপেজে যেতে না যেতেই বাসে লোক আর বসার জায়গা পাচ্ছে না। নতুন যারা উঠেছে সবাই দাঁড়িয়ে।
‘ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন? ঘরে কি মা-বোন নাই?’
নারীকন্ঠের সুতীক্ষ্ণ কন্ঠে শোভনের দুই কান থেকে বেশ কিছু পোকা একেবারে মিলিটারি স্টাইলের স্যালুট ঠুকতে ঠুকতে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে নিচু কন্ঠে একবার’হাস্তালা ভিস্তা’ বলে যেতে ওরা ভোলে না।
পরিস্থিতি বেশ কৌতুহলকর। কাজেই শোভন তাকায় এবার চিৎকারের মূলকারণ খুঁজে বের করতে।
শোভনের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা সম্ভবতঃ কলেজে পড়ে। একেবারেই আঁতেল প্রজাতির। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকানো এর কাজ না। অহেতুক সুন্দরীটা গোবেচারা ছেলেটাকে বকে দিয়ে বাসভর্তি লোকেদের জানালো –’আমার দিকে কিন্তু ছেলেরা তাকায়! হুঁ হুঁ। কেউ বাকি আছ নাকি আমাকে দেখতে? দেখে নাও তবে!’
তার ধারণা নির্ভুল। বাসের প্রত্যেকেই কম হলেও একবার করে তাকিয়েছে। শোভনই বা বাদ যাবে কেন?
হুঁ – দুধে আলতা চামড়া, কুচকুচে কালো চোখ আর সেই সাথে মানিয়ে গেছে কুচকুচে কালো চুল। মুখের গড়নটাও দেখার মত। অদ্ভুত সুন্দর।
মাথা দোলায় শোভন। আরে তুমি নাহয় বেশ দেখতে। তাই বলে আঁতেল সমাজের পেছনে লেগে নিজের খ্যাতি বাড়াবে নাকি? দুধে আলতা রঙের চামড়া নিয়ে বাহাদুরীর কি আছে? এই তো গত ঈদেই শোভনরা একটা গরু কোরবানী দিল – দুধে আলতা তার রঙ ছিল। একেবারে উড়ে গেছে না মুন্ডু? কোথায় ছুটে যাবে ভাব তখন!
সুযোগ পেতেই শোভন সুড়ুৎ করে মেয়েটার পেছনের সীটে চলে আসে। যাত্রীটি নেমে যাওয়ার জন্য উঠতে উঠতেই একলাফে সীট দখল।
ব্যাগের মাঝে ঘুমিয়ে আছে পিচ্চি একটা ফ্লেমথ্রোয়ার। আসলে কি জিনিস কে জানে? শোভন ওটাকে ওই নামেই ডাকে। বাকিদের নামকরণের দিকে এত কান দিলে হয়?
বন্ধু তন্ময় তো এক কথায় ওকে বলেই দিয়েছিল, ’তুই তো একটা কেশের হিন্দীরূপ বানিয়েছিস। একেবারেই সে জিনিস। ’
কিন্তু ওই নামকরণে তো আর ডাকা যায় না। তাই না? তাছাড়া যন্ত্রটা সাবলীলভাবে আগুনও মারতে পারে। কাজেই ফ্লেমথ্রোয়ার বলাই যায়। মাত্র তেইশ ইঞ্চি সামনে মেয়েটার হাতব্যাগ তার পাশেই পড়ে আছে সীটের ওপর।
ফস করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয় শোভন। ব্যাগের মাঝে ফ্লেমথ্রোয়ার লুকিয়ে দিব্যি বাইরের প্রকৃতি উপভোগ করতে থাকে। শহরের মাঝে আর প্রকৃতি কোথায় – ওই আর কি!
‘গরম লাগছে।’ সুন্দরীর বান্ধবী বলে।
‘হুঁ – মেকাপের ভাজে চেহারা লুকিয়ে ফেলেছিস তাই গরম লাগছে!’ চট করে তার বান্ধবীকেও ধমকে ওঠে সুন্দরী! অথচ নিজেই মেরে এসেছে দুই কেজি ময়দা, সে খেয়ালই নেই।
পরমুহূর্তেই দুইজন চেঁচিয়ে ওঠে –’আগুন। আগুন!’
বাসের মাঝে এই চিৎকারের প্রতিক্রিয়া হল দেখার মত!
ঘ্যাঁচ করে এক ব্রেকে বাস থামিয়ে দিল ড্রাইভার সাহেব। এবং পরক্ষণেই লুঙ্গি মালাকোচা করে ড্রাইভারের পাশের ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে একেবারে ব্যাঙের মত ঝাঁপ দিলেন ইনি বাইরের দিকে।
শোভন অবাক হয়ে লক্ষ্য করে ফেসবুকে থাকুক আর না থাকুক – বাস্তব জীবনে বাসড্রাইভারের ফলোয়ারের সংখ্যা নেহায়েত মন্দ নয়। বেশ কিছু জানালা খুলে গেল এবং বীরত্বের সাথে ফ্রি ফলের জন্য অনেকেই ডাইভ দিয়ে জানালা পেরুলেন। শুভ কাজে দেরী করতে নেই কি না!
সামনের সুন্দরী তরুণী – যার জন্য জাতির এই দুর্দশা এখন, সে অবশ্য জানালা মেথডে গেল না। একছুটে একেবারে দরজার দিকে। যাওয়ার সময় খামচি দিয়ে জ্বলন্ত ভ্যানিটিব্যাগটা নিতে ভোলেনি! বান্ধবীটির সাহস আছে। ইনিও জানালা দিয়ে গেলেন।
আগুন যখন ফ্লেমথ্রোয়ারের মাথা থেকে বের হয় – ভালোবাসা তখন জানালা গলে পালায়। কথাটার সত্যতা আজ হাড়ে হাড়ে প্রমাণিত। বেস্ট ফ্রেন্ডদুইজন কি না দুই ডিরেকশনে – ছি ছি!
অগত্যা শোভন পিছু নেয় অগ্নী-তরুণীর। নিজেকে পোড়ালেও ব্যাগ ছাড়বে বলে তো মনে হয় না। মানুষ হত্যার দায় তো নিতে পারবে না শোভন। উদ্দেশ্য পঙ্কিল হলেও ততটা পঙ্কিল নয়। কাজেই ঝড়ে বক মেরে দেওয়ার ইচ্ছে আপাতত স্থগিত রেখে মেয়েটার পিছে পিছে নেমে আসে ও বাস থেকে।
বহুদূরে লুঙ্গি খুলে দৌড়াতে দেখা যাচ্ছে বাসড্রাইভারকে। সাহসিকতার জন্য উনার নিশ্চয় ঘরভর্তি মেডাল আছে!
এক থাবা দিয়ে মেয়েটার হাত থেকে ব্যাগটা ফেলে দিয়ে সেটার ওপর ট্যাংগো নাচা শুরু করে শোভন। মেয়েটা তো বটেই – রাস্তার অন্যেরাও সেদিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে ওর নাচ দেখে। শোভন হাত নাড়িয়ে’কাম অন’ টাইপ একটা ভঙ্গি করলেও কেউ যোগ দেয় না তার সাথে। তবে তরুণীর দিকে আগ্রহ ভরে অনেকেই তাকায়। এই মেয়ে যোগ দিলে তারাও ট্যাংগো নাচে যোগ দেবে – এটাই যে তাদের মনের ইচ্ছে সেটা বুঝে নিতে মাইন্ড রিডার হওয়া লাগে না!
অবশেষে নাচ থামে শোভনের। মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায় ও ব্যাগের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে।
‘ট্যাংগো নাচা উদ্দেশ্য ছিল না। আগুনটা নেভাতে একটু দাঁপাদাঁপি করতে হল আর কি।’ বিনয় প্রকাশ করে শোভন।
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। তারপর হুট করে কেঁদে ফেলে।
পোস্ট-ট্রমা শক। মাত্র ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার আকস্মিকতার ফসল – ভাবল শোভন।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। চোখ থেকে পানি মুছে খেঁকিয়ে ওঠে মেয়েটা, ’খুব পাড়িয়েছেন! আমার আয়না আর সানগ্লাসটা ছিল না ব্যাগে?’
‘কিনে দেব আপনাকে। কথা দিলাম।’ ঝটপট বলে শোভন। চারপাশের জনতা একেবারে ক্ষেপে আছে নাচ দেখার জন্য। পায়নি। এখন মেয়ে ক্ষেপালে তো কথাই নেই। একেবারে পাটকাঠি বানিয়ে ফেলবে ওরা শোভনকে!
কিনের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পেলে আর কি চাই? একটা নির্মল হাসি ফুটে ওঠে মেয়েটার মুখে,হাত বাড়িয়ে আস্তে করে বলে, ’জুঁই। ’
হাত মেলায় ও, ’শোভন। আপনার বান্ধবী কোথায়?’
পিট পিট করে আসে জুঁই, ’আছে নাকি এতক্ষণে এখানে? বাসায় গিয়ে ডোরেমন দেখছে। যে মেয়ে তেলাপোকার বিষ্ঠা দেখলেই ভয় পায় সে আগুন দেখেও থাকে?’
চারপাশে খেয়াল করে শোভন। জনতা নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে।
‘তাহলে, ’ আসল প্রসঙ্গে চলে যায় জুঁই, ’কবে কিনে দিচ্ছেন?’
‘যেদিন বলবেন।’ দরাজ গলাতে বলে শোভন।
‘নম্বরটি দিন। এবং আমার কল যাওয়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকুন। পালাবেন উল্টোপাল্টা নাম্বার দিয়ে সেটি হচ্ছে না। ’
বিরক্তিকর বালিকা! তবুও ধৈর্য সহকারে নম্বর দেয় শোভন এবং দাঁড়িয়ে থাকে কলটা আসার আগ পর্যন্ত।
তারপর দুইজন দুইপথে।
কালো রঙের গাড়িটা পার্ক করা। ওটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে সন্দেহের দৃষ্টিতে একবার তাকায় শোভন।
সকালে বাসার পাশে এই গাড়িটাই ছিল না?
*
‘শোভন?’ অনেক দূর থেকে কেউ ডাকছে।
‘উম…’ ঘুম ঘুম চোখে বলে শোভন।
‘শোভন!’ এবার কানের পাশে একেবারে হাঁকের মত শোনায় ডাকটা।
চোখ মেলেই আৎকে ওঠে ও – একজন উল্টো হয়ে ঝুলছে সিলিং থেকে। দুই পা শক্ত করে বাঁধা। ঝলমলে চুলগুলো দুলছে মাথা থেকে – কিন্তু এ অবস্থাতেও চোখে হাসি।
‘ডোন্ট ওরি। তোমাকে তুলে এনেছে ভুল করে। ’
নড়ার চেষ্টা করে শোভন স্পষ্টই বুঝতে পারে – উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ওর না – ঝুলন্ত বাবুর আছে।
একটু ডানে নড়তে গিয়ে অবশ্য ঝুলন্ত বাবুর কথার সার্থকতাও টের পায়। হাত পেছনে চেয়ারের সাথে বাঁধা ওর। শোভনকে ধরে এনে বেঁধে ফেলার মানে কি?
ধীরে ধীরে অবশ্য সব মনে পড়ে ওর। বাসার দিকে ফিরে যাচ্ছিল পড়ন্ত বিকেলে। গলিটা ছিল নির্জন। চট করে গাড়িটা থেমে ওর ঘাড় বরাবর এক বাড়ি দিয়ে সমবেগেই তুলে নিয়েছিল ভেতরে। একেবারেই আচমকা এই ঘটনার ব্যাখ্যা ও পায়নি। অবশ্য ব্যাখ্যা খোঁজার সময়ই বা পেল কোথায়?
সামনের ঝুলন্ত মানুষটার দিকে তাকিয়ে তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাসল অযথাই। নিজেরই উড়ে গেছে আত্মা, আরেকজনকে আশ্বস্ত করবে কি? ব্যাঙাচির মত দেখালো হাসিটা।
তারপর প্রশ্ন করল, ’আমরা কোথায়?’
‘জানি না। ’
‘কারা আমাদের ধরে এনেছে?’ আবার জানতে চায় শোভন।
‘জানি না। ’
সব প্রশ্নের একই উত্তর নাকি? ত্যক্ত শোভন এবারে জানতে চায়’ঝুলতে কেমন লাগছে আপনার?’
‘ওহ! চমৎকার! চমৎকার!’ এক কথায় জানায় অচেনা মানুষটা।
কিছুক্ষণ দুইজনই চুপ। শোভনের ব্যস্ত চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা ধারালো কিছুর জন্য। হাত কেটে সোজা ভেগে যেতে হবে এখান থেকে। কালো গাড়ি নিয়ে ফুটানি দেখানোর কিছু নাই। শোভনের বাবারও আছে একটা। কালো গাড়ি থাকলেই চটপট মানুষকে তুলে নিতে হবে – এটা কোন কাজের কথা নয়।
‘লাভ নেই হে!’ শোভনের মতিগতি বুঝে নেয় ঝুলতে থাকা মানুষটা, ’কিছুই পাবে না যেটাতে তোমার উপকার হবে। এরা কাঁচা কাজ করে না। ’
‘কারা এরা?’ জানতে চায় শোভন দ্বিতীয়বারের মত।
‘যারা কাঁচা কাজ করে না।’ বলে লোকটা।
‘কারা কাঁচা কাজ করে না?’
‘প্রফেশনালস। ’
এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে শোভনেরও, গলা একটু চড়ে যায় –’সেটা আমি জানি। কিন্তু এদের তো নিজেদের একটা পরিচয় আছে?’
কথার জবাব না দিয়ে নিজের শরীর দোলাতে থাকে ঝুলে থাকা মানুষটা।
কচ জাতীয় একটা শব্দের সাথে সাথে দড়াম করে ওপর থেকে আছড়ে পড়ে নিচে। তারপর উঠে ঝেড়েঝুড়ে নিজের শরীর পরিষ্কার করতে থাকে। সেদিকে সরু চোখে তাকিয়ে থাকে শোভন।
‘নিজেকে অ্যামেচার বলে লোক হাসাবেন না প্লিজ।’ এর চেয়ে বেশি কিছু আসে না শোভনের মুখে।
‘না। তা বলব না। আমি রানা। মাসুদ রানা।’ শোভনের হাতের গিট্টু খুলে দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতে আসতে বলে রানা।
চোখ বড় বড় হয়ে যায় এবার শোভনের, ’বিসিআই?’
নাক কোঁচকায় রানা, ’কাজী আনোয়ার হোসেন। উফ!’
এবার অবাক হওয়ার পালা শোভনের, ’উনি আবার কি করলেন?’
‘লোকটার জ্বালায় আর পারা গেল না। কোথাও গেলেই হয়েছে। পরিচয় দিতেই ঝট করে জানতে চাইবে আমি বিসিআই কি না। আরে না বাবা। আমি শুধুই বিএটিএ। বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সী। ’
‘আগে নিশ্চয় বিসিআই-এ ছিলেন?’ চকচকে চোখে জানতে চায় শোভন।
‘আমি এখান থেকে বেড়িয়েই কাজী আনোয়ারের নামে মামলা করছি।’ ঘোষণা দিয়েই দেয় রানা।
‘ফাঁসালেন দেখি… কার পক্ষ নেব…’ বিড় বিড় করে বলতে বলতে শোভন দেখে রানা ঘরের একমাত্র দরজাটা পরীক্ষা করছে। মাছি বের হতে পারুক আর না পারুক – ইনি বের হচ্ছেন এখান থেকে খুব শীঘ্রই, এটা স্পষ্ট।
কয়েক পা পিছিয়ে আসে রানা। শোভনের দিকে ফিরে বলে, ’একপাশে সরে থাকো। ’
একছুটে কাঁধের প্রকান্ড ধাক্কায় দরজা কাঁপিয়ে দেয় রানা। তবে ভাঙ্গে না!
সাথে সাথেই দড়াম করে দরজা খুলে যায় – চামচিকের মত লোকটা ঢুকে আস্তে করে শুধু জানতে চায়, ’শব্দ কিসের? আর অ্যাই ছেলে – তুমি নেমেছ কেন! ঝুলিয়ে না রেখেছিলাম?’
মাথা চুলকায় রানা, ’ইয়ে – ঝুলে থাকতে ভালো লাগছিল না। অনেকক্ষণ হল তো। ’
একটু দ্বিধান্বিত হয় চামচিকেও, ’ও হ্যাঁ। তাও ঠিক। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। তা দরজা ধাক্কাচ্ছিলে কেন? আমার এককান ভর্তি গৃহপালিত পোকার যে ঘুমাতে সমস্যা হচ্ছিল সে খবর আছে? ওদের আবার সাইনাসের ব্যাথা ওঠে রীতিমত!’
‘হেহে’ জাতীয় একটা দুঃখপ্রকাশের শব্দ করে রানা। এত মিষ্টিমধুর কথোপকথন হওয়ার পেছনে কাজ করে চামচিকেমুখোর ডান হাতে থাকা ভীমদর্শন পিস্তলটা।
রানার থেকে চারফুট দূরে দাঁড়িয়ে নিষ্কম্প হাতে অস্ত্রটা তুলে রেখেছে ওরই দিকে। একচুল ত্যাড়ামির লক্ষণ দেখলেই সোজা ওপরে তুলে দেবে মই ছাড়াই।
‘সময় হয়েছে। বস আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। এবার শান্ত শিশুর মত আমার পেছনে পেছনে চলে আসুন। ’
মাসুদ রানা আর শান্ত শিশু! শোভন আর কিছু বলে না। ভাষা হারানোর জন্য ওকে সাহায্য করে আরও ছয়জন গার্ড – চামচিকে আর ওই ছয়গার্ডের মাঝে স্যান্ডউইচ হিসেবে প্রেজেন্ট করা হয় রানা আর শোভনকে।
হাত কচলাচ্ছে রানা। এত বিনয় ও ধরে কোথা থেকে?
অবাক হয়ে একবার ওর দিকে তাকিয়ে শোভনও হাত কচলাতে থাকে। দুইজন মিলে এগিয়ে যায় একটা বিশাল বদ্ধ দরজার দিকে।
*
মোটাসোটা নিতম্বটা বেশ ডাঁটের সাথেই চেয়ার থেকে তুলে এগিয়ে আসে মানুষটা।
‘আমি কর্ণেল রুস্তম। ’
‘সন্দেহ কি তায়!’ পাহলোয়ান মার্কা দেহটা দেখে শোভন আর কিছু বলতে পারে না।
এগিয়ে এসে হাত মেলায় রানা, ’আমি মেজর রানা। বাংলাদেশ আর্মি। কিন্তু আপনি কোন আর্মি?’
রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে যায় বিপ্লবী নেতার। সরাসরি অপমান করছে ওকে বন্দী। তবুও বুক উঁচিয়ে ঘোষণা দেয়, ’সর্বহারা বিপ্লবী বাহিনীর উচড়িঙ্গে রেজিমেন্টে ছিলাম হে! ছোট করার কিছু নেই!’
‘তা তো বটেই। তা তো বটেই।’ মাথা দোলায় রানা, ’সোলজার টু সোলজার। ’
উত্তরটা শুনে এতই খুশি হয়ে গেলেন কর্ণেল – একটা ক্ষুদ্র ইশারা দিতে দেরী করলেন না মোটেও।
আর ছয় গুন্ডার জন্য দেখা গেল ইশারাই কাফি! কর্ণেলের সামনে রাখা দারুণ সাইজের টেবিলটার দুইপাশে ওদের বসিয়ে চটপট করে বেঁধে ফেলা হল হাত দুটো টেবিলের সাথে। দশটা আঙ্গুল যখন টেবিলের সারফেসে আলতো করে পড়ে থাকে ওদের – অজান্তেই আঙ্গুলে একটা শিহরণ আসে। ওদের কব্জির ঠিক ওপর দিয়ে স্ট্র্যাপ আটকেছে কর্নেল বাবু। তারপর টেবিলের সাথে ওদের পাও বাঁধা হয়।
শোভন ভয়ে ভয়ে রানার দিকে একবার তাকায়। ভেঙ্গে পড়ল নাকি?
নাহ – একেবারে সটান বসে আছে – যেন বুদ্ধদেব ধ্যানের বসেছেন! শোভনের মনটা চাইল প্রাণের সুখে রানার পায়ে একটা লাথি মেরে ধ্যানটা ছোটায়। কিন্তু পা তো একেবারে জগদ্দল পাথর হয়ে গেছে – মানে, বানানো হয়েছে। অগত্যা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না ওর।
‘জুনিয়র এজেন্ট শোভন। অ্যাম আই রাইট?’ হাতের গরুর হাড্ডি কোপানোর মীট ক্লীভারটা নিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গীতেই জানতে চান কর্ণেল।
‘হোয়াট দ্যা টুট!’ একটা টুট দিয়েই মনের ভাবটাকে সেন্সর করে শোভন। একে তো কর্ণেল মানুষ – তার ওপর আবার গরু-কোপানি দা নাড়াচ্ছে! কাজেই সব কথা বলাটা তো উচিত না।
‘ও আমাদের এজেন্ট নয়, কর্ণেল রুস্তম। আমি আমাদের এজেন্সীর সবাইকে চিনি। ’
‘একটা সত্য কথার সাথে একটা মিথ্যা কথা বলে দিলে চমৎকারভাবে।’ খ্যাক খ্যাক করে হাসেন কর্ণেল বেজায় ফুর্তিতে।
তারপরই দা ধরে থাকা হাতটা উঠে গেল চট করে এবং নেমেও এল প্রচন্ড জোরে। আতঙ্কে চোখ প্রায় বন্ধই করে ফেলে শোভন। দড়াম শব্দটার পরেও যখন কেউ’আআআআআআআ’ – জাতীয় চিৎকার দেয় না তখনও চোখ খুলতে বেশ বেগ পেতে হয় শোভনকে। ’কল্লা’ উড়িয়ে দিল নাকি মাসুদ ভাইয়ের?
‘তাকাও হে ভীতুর ডিম। টেবিল ছাড়া আর কারও লাগেনি।’ হোৎকা নিতম্ব কাঁপিয়ে হাসলেন কর্ণেল।
তাকিয়ে সেটাই দেখে শোভন। টেবিলের দফারফা করে দিয়েছেন এক কোপে। বোঝাই গেল দশ আঙ্গুলের কি হবে ইনাকে তথ্য দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারলে!
‘জুনিয়র এজেন্ট শোভন!’ আবার আলোচনা শুরু করেন কর্ণেল।
‘আবারও বলছি – ও শোভন নয় -’ এবার আর রানাকে কথা শেষ করতে দেওয়া হয় না – ছয় গার্ডের একজন প্রাণের সুখ মিটিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত হানে রানার মুখে। ঠোঁট কেটে বেশ কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে নেমে আসতেই রানার জবান একেবারে বন্ধ!
তবুও তার দিকে খেঁকিয়ে ওঠে কর্ণেল, ’এই শালার বার্থ সার্টিফিকেট পর্যন্ত ম্যানেজ করে স্টাডি করা হয়েছে আর লিজেন্ড মাসুদ রানা ফট করে বলে ফেলল ও শোভন না। মীরাক্কেল পেয়েছ?’
‘আমি শোভন – তবে জুনিয়র এজেন্ট নই।’ শান্ত কন্ঠে কর্ণেলের রাগ প্রশমনের চেষ্টা করে ও।
‘একই কথা।’ ফড়াৎ করে নাক টেনে বলেন কর্ণেল।
‘গরুর ডিম দেখেছেন কখনও?’ আগ্রহের সাথে জানতে চায় শোভন।
‘কেন?’ জানতে চেয়েই বুঝতে পারে কর্ণেল – অযথা সময়ক্ষেপণ করছে ছেলেটা ওর।
সরাসরি কাজের কথায় চলে আসে কর্ণেল, ’ফ্লেমথ্রোয়ার কোথায়?’
‘ও জানে না কিছু।’ চট করে টেবিলের অন্যপাশ থেকে বলে বসে রানা।
আরেক পাশ থেকে রাইফেলের বাটের বাড়ি মারে দ্বিতীয় সৈনিক। রানা আবারও স্পিকটি নট।
‘ফ্লেমথ্রোয়ারের সাথে আমাকে ধরে আনার সম্পর্ক কি?’ বেশ অবাক হয়েই জানতে চায় শোভন।
‘আহা! ন্যাকা আর কি! ফ্লেমথ্রোয়ার কি জানে আর তাকে ধরে আনার সম্পর্ক জানে না!’ মুখ বাঁকান কর্ণেল।
‘ভণিতা না করে খুলে বলুন।’ শোভন বেশ আগ্রহই দেখালো এবার।
কিছুক্ষণ ওদের দিকে হতাশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন কর্ণেল।
তারপর মুখ খোলেন, ’লরা নামে একটা মেয়ে ছিল আমাদের সাথে। পাঁচ বছর টানা সার্ভিস দিয়ে গেছে আমাদের জন্য। পদোন্নতিটা খুব দ্রুত হয় ওর। জেনারেল সোহরাবের শয্যাসঙ্গীনি হওয়াটা এর একটা কারণ হতে পারে। তবে আসলে আমরা তাকে চিনতে ভুল করি। ’
একটা মেয়েকে চিনতে ভুল করার লজ্জায় মারা যাওয়ার মত চেহারা করে আবার বলতে শুরু করেন কর্ণেল, ’পাঁচ বছরে আমাদের সব ডাটা কালেক্ট করে ভেগে গেছে লরা। তাকে ধরে আনতে পাঠিয়েছিলাম আমাদের বেস্ট দুইজন এজেন্টকে এবং তারা চমৎকার ভাবে কাজটা সম্পন্ন করেছে – এতটাই চমৎকারভাবে, আমাদের বেশ ঝামেলায় পড়ে যেতে হল। ’
‘কেমনভাবে?’
‘ওরা মেরে এনেছিল লরাকে। বেশ একটা যুদ্ধ করে এক এজেন্টকে ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছিল লরা মেয়েটা কোন মই ছাড়াই! তারপরে দ্বিতীয়জন পারেনি নিজেকে সংবরণ করতে। লরার সাথে থাকা আমাদের সেই ডাটা থেকে গেছে এখনও আমাদের নাগালের বাইরে। আর কারও হাতে পড়ে গেলে আমাদের আন্দোলনের সখ করে আর কাজ হবে না। কুয়োর ইঁদুরের মত অবস্থা এখন আমাদের – বুঝতে পারছ? কাজেই অ্যানিহাও আমাদের দরকার ফ্লেমথ্রোয়ার। ’
‘একটা প্রশ্ন-’ মুখ খোলে আবার শোভন, ’এর মাঝে ফ্লেমথ্রোয়ার আসল কি করে? নেহায়েত খেলনা বই তো নয়। ’
‘মাথামোটা ছোকড়া!’ কটমট করে তাকায় তার দিকে কর্ণেল রুস্তম, ’ওই ডাটা ভর্তি ড্রাইভটাকে লরা ফ্লেমথ্রোয়ার বলেই ডাকত। এখন আমরাও তাই ডাকি। ’
*
চমৎকার একটা ভুল বোঝাবুঝির মাঝে পড়ে গেছে শোভন। পরিষ্কার বুঝতে পারে। নিজস্ব ফ্লেমথ্রোয়ার আবিষ্কারের ঝক্কি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন অ্যাংগেল থেকে পোহাতে হচ্ছে। কোথায় কাঁচা ভুট্টা পুড়িয়ে পপকর্ন বানিয়ে খেতে একটা জিনিস বানালো সেটার দিকেও সবার চোখ!
‘এখন চুপ করে আছ কেন? বল যে তুমি জুনিয়র এজেন্ট নও!’ দা এর আরেক কোপে টেবিল কাঁপান কর্ণেল।
‘আমি জুনিয়র এজেন্ট নই। ’
‘কিন্তু তোমার কাছে ফ্লেমথ্রোয়ার আছে। ’
‘না।’ অস্বীকার করে শোভন।
‘আমি নিশ্চিত।’ কর্ণেল কিন্তু শোভনের যুক্তিতে বিশ্বাস করেন না এত সহজে।
‘মারা খান।’ বেশ বিনয়ের সাথেই বলে শোভন।
এবার কর্ণেল একটা রেকর্ডার প্লে করে দেন।
শোভনের গলা ভেসে আসে ফোনে।
‘তন্ময়। কাজ শেষ। ’
‘কস কি? কোন কাজ?’
‘আরে ফ্লেমথ্রোয়ার। ’
‘ওহ! চরম দোস্ত। কাওকে বলার দরকার নাই। আগে আমার এখানে নিয়ে আয় – একসাথে জিনিসটা টেস্ট করি। ’
‘না। আগে আমি শিওর হয়ে নেই। ’
‘ওকে। ’
লাইন কেটে গেল।
‘চব্বিশ ঘন্টার সার্ভেইলান্সে রাখা হয়েছিল তোমাকে বাছা। এত সহজে পার পাওয়ার তো কথা না। তোমার ফোন ট্যাপ করা ছিল – মোবাইলের আরকাইভস লুট করা হয়েছে তোমার কল হিস্টরি জানতে।’ কটমট করে তাকান কর্ণেল।
‘আপনি ভুল বুঝছেন। এই ফ্লেমথ্রোয়ার আর আপনার ফ্লেমথ্রোয়ার আলাদা জিনিস।’ শান্ত থেকেই কর্ণেলকে বোঝানোর চেষ্টা করে শোভন, ’এটা আমার একটা আবিষ্কার। আগুন মারা যায় লিমিটেড আকারে। ’
‘বিজ্ঞানী, অ্যাঁ?’ ভারী দাটা বাড়িয়ে আস্তে করে কনুই আর কব্জির সংযোগস্থলে রাখেন কর্ণেল। লাল একটা রেখা জন্মায় ওখানে – তারপর গড়িয়ে পড়তে থাকে।
দাঁতে দাঁত চেপে সেটা সহ্য করে শোভন।
‘আমি কিছুই জানি না আপনাদের ক্যাচাল নিয়ে। আমার সায়েন্স প্রজেক্টের জন্য একটা ফ্লেমথ্রোয়ার বানিয়েছি – সেটা নিয়েই কথা বলেছি বিভিন্ন জায়গাতে। ’
‘একটা আঙুল কম থাকলেও মানুষ সহজেই বেঁচে থাকতে পারে। কি বল?’ মতামতের আশায় ওর দিকেতাকায় কর্ণেল।
চুপ করে থাকে শোভন।
‘বিয়োগ অংক কেমন পারো?’ ষড়যন্ত্রকারীর গলায় জানতে চান কর্ণেল।
এবারও চুপ থাকে শোভন।
‘আমি এরপর একটাই প্রশ্ন করব। প্রশ্নটা উচ্চারণের পর তিন সেকেন্ডে কোন উত্তর না পেলে তোমাকে আমি বিয়োগ অংক শেখাব। আঙুলের।’ আবারও ভারী নিতম্ব দুলতে থাকে কর্ণেলের হাসির দমকে।
তারপর একেবারেই হঠাৎ সবাই চুপ হয়ে যায়।
রুমের মাঝে কোন শব্দ নেই।
প্রশ্নটা করে ফেলল কর্ণেল, ’তোমার সারা শরীর চেক করা হয়েছে। যেটা খুঁজছিলাম সেটা পাইনি। ফ্লেমথ্রোয়ার কোথায়?’
‘একটা হাত খুলে দিলে দেখাতে পারি কোথায় আছে।’ বলে শোভন, তিন সেকেন্ডের আগেই। আঙুলের মায়া বড় মায়া।
‘ওটী হচ্ছে না। হাত খুলে দেই আর পাখি পগারপার?’ চোখ লাল করে বলেন কর্ণেল।
‘ইডিয়টের মত কথা বলছেন। ছয়টা রাইফেল তাক করে রেখেছেন। এত ভীতু হয়ে কর্ণেল পদ পেলেন কিভাবে!’
আঁতে ঘা লাগল বোধহয় কর্ণেলের এবার।
ঝট করে এক গার্ডকে আদেশ দেয় কর্ণেল, ’এই ব্যাটার এক খুলে দাও। ’
ছুরির এক আচড়েই হাতের দড়ি কেটে ফেলা হয় শোভনের।
আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকে কর্ণেল, শোভন ফ্লেমথ্রোয়ারের লোকেশন জানাতে চলেছে!
কিন্তু নিরাশই হতে হয় তাঁকে। ঝট করে মাঝখানের আঙ্গুলটা সোজা করে দেখিয়ে দেয় ও কর্ণেলকে।
তারপর সাবটাইটলস্বরূপ মুখেও বলে, ’মারা খান। ’
প্রচন্ড ক্রোধে দা উঠাচ্ছে কর্ণেল, আলাদা করে দেবে শোভনকে একেবারে – এক সেকেন্ডে ঘটে যায় অনেক কিছু।
গার্ড মাত্র দূরে সরে যাচ্ছিল – এক ঝটকায় তার ছুরিটা নিজের জিম্মায় নিয়ে এল শোভন – কর্ণেলের ডান কাঁধের তলে একটা উপর্যুপরী খোঁচা দেয় একই সাথে। বিভ্রান্ত কর্ণেলকে মারাত্মক আঘাতটা সহ্য করার সময় দিয়ে অন্য হাতটা কেটেই রানার দিকে ছুরিটা পাঠিয়ে দেয় ঝটপট – পুরো কাজটায় সময় লেগেছে এক সেকেন্ডের ষোল ভাগের এক ভাগ মাত্র।
পরক্ষণেই দুই পা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় উল্টোদিকে পড়ে যেতে থাকে শোভন। ওদিকে রাইফেল তুলছে প্রত্যেকে।
দড়াম করে মেঝেতে আছড়ে পড়ার সাথে সাথে টেবিলের কাভারটাও পেয়ে যায় শোভন। বুলেটগুলো অল্পের জন্য ওকে মিস করেছে। তবে এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। টেবিল ঘুরে এসে গুলি করলেই কাজ হয়ে যাবে।
তবে মাগনা পাওয়া বুলেটের সদ্ব্যবহার যখন গার্ডেরা করছিল – রানা ডান হাতে ছুরির হাতল ধরে বাম হাতের স্ট্র্যাপ কেটে হাত পালটে ডানহাতকেও মুক্ত করে ফেলেছে। সব গর্দভ শ্রেণীর গার্ড রাখাটা বোধহয় কর্ণেল রুস্তমের ট্রেডিশন! বা হাতে একটা ডেজার্ট ঈগল হাতিয়ে নেয় রানা বাম পাশে বীর বিক্রমে শোভনের দিকে গুলি চালাতে থাকা মানুষটার কোমর থেকে।
‘ঠুঘুম’ জাতীয় ছয়টা বুলেট বেড়িয়ে যাওয়ার শব্দের সাথে সাথে পৃথিবী জনসংখ্যা সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হল বলে রানা মনে করে। একই সাথে ক্লিক জাতীয় শব্দ করে ডেজার্ট ঈগল জানান দেয় – ওর পেট খালি হয়ে গেছে। রিলোডের অভাব নেই। আরেক মৃত গার্ডের কোমর খালি করে দেয় রানা।
কর্ণেল রুস্তম কিঞ্চিৎ কাঁপছেন।
মানুষটার রামদা বরাবর একটা মাত্র বুলেট পাঠিয়ে ওটা হাতছাড়া করে দেয় রানা। তারপর এগিয়ে যায় পড়ে থাকা শোভনের দিকে। পা দুটো চেয়ারের থেকে মুক্ত করে একহাত বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে।
তারপর কর্ণেলের মাথায় এসে পিস্তল ঠেকায় রানা, ’চলুন বস। আপনিই এখন আমাদের ফ্লেমথ্রোয়ার। ডাটা আপনার মাথায় কম আপলোড করেন নি এতদিন। আমাদের’প্যাদানী ডাউনলোড ম্যানেজার’ দিয়ে ওগুলো নামিয়ে নেব এখন। কাম অন। ’
বন্দীকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যায় ওরা বাইরের দিকে।
*
তন্ময়ের ভ্রু কুঁচকে আছে।
শোভন ওকে এতদিনের কষ্ট করে বানানো ফ্লেমথ্রোয়ারটা রাখতে দিয়েছে। বাড়ি ফেরার পথে বাবার দোকানে একবার থেমেছিলো ছেলেটা আজ, তখনই রেখে গেছে যন্ত্রটা। সেটা অবশ্য ভ্রু কুঁচকানোর কারণ নেই।
ফ্লেমথ্রোয়ারটা নিয়ে খুটখাট করছিল। তবে হাতলের নিচে হাল্কা একটা রাবার তুলে সুই ঢোকানোর মত একটা বিন্দু দেখে পাশেই আম্মুর সেলাই মেশিন থেকে একটা সুই বের করে খোঁচা মেরে দিয়েছিল ও। ঝট করে ফ্লেমথ্রোয়ারের হাতলের নিচের অংশ সরে যায় – বের হয়ে আসে কিছু পয়েন্ট। একেবারে এসডি কার্ডের মতই সেটা।
পরীক্ষা করতে ল্যাপটপে লাগাতেই একের পর এক ফোল্ডার খোলা শুরু করেছে।
সেই থেকে কুঁচকে আছে ওর ভ্রু।
ঝটপট ফাইলগুলো কপি করে রাখে ও আরেক জায়গাতে।
তারপর ধীরে সুস্থে ফোন দেয় শোভনকে, ওপাশ থেকে শোভনের গলা শোনা যায়, ’দোস্ত, বল। ’
‘ওই তোর ফ্লেমথ্রোয়ার নিবি না? সারাজীবন কি আমার কাছেই রেখে দেব নাকি?’
‘আরে আমি এখন জুঁইয়ের সাথে ব্যাটা। পরে ফোন দে ব্যাটা!’ চাপা ঝাড়ি মারে শোভন।
‘মারহাবা। মারহাবা।’ গলায় পিন রেখেই বলে তন্ময়।
‘আর ফ্লেমথ্রোয়ার নিতে রানা ভাই যাবে। উনারে দিয়া দিস। ’
তুমি মেয়ে নিয়ে মাস্তি করছ – কর! ভাবে তন্ময়। কিন্তু এই ডাটার মূল্য কতটুকু সেটা চেক করে দেখবে ও।
তেমন মূল্যবান হলে নির্দিষ্ট অংকের টাকাতে বিক্রি করেও দিতে পারবে।
সেটা পরে দেখা যাবে!
কলিং বেলের শব্দে সম্বিত ফিরে পায়। শোভনের রানা ভাই নাকি?
ফ্লেমথ্রোয়ারটাকে আগের মত চেহারাতে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যায় ও।
দরজা খুলতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ছয়ফিট লম্বা সুঠামদেহী যুবকের দিকে। চোখের মাঝে একই সাথে দুইটি অনুভূতি কাজ করছে। এতক্ষণ কোমল ছিল দৃষ্টি – এই মাত্র কঠোর হয়ে গেল।
‘তন্ময়?’
‘রানা ভাই?’
দুইজনই একই সাথে প্রশ্ন করে ফেলায় হাসে একটু।
তন্ময় হাত বাড়িয়ে ফিরিয়ে দেয় ফ্লেমথ্রোয়ারটা। হাতে নিয়েই ঘুরে দাঁড়ায় রানা।
‘ধন্যবাদ, চলি তাহলে। ’
‘জ্বি, ভাইয়া।’ কোনমতে দরজা লাগাতে পারলে বাঁচে আরকি তন্ময়।
তবে আবার ঘুরে দাঁড়ায় রানা।
‘ওহ! টেস্ট তো করা হল না। ’
তন্ময়ের অনুমতির তোয়াক্কা না করে সোজা ঢুকে পড়ে ও ভেতরে। পেছন থেকে হাহাকার করে ওঠে তন্ময়। বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে না এমনও নয়। কিন্তু একটা ট্রেনের সাথে ও পারবে কেন?
ছুটে ওর নিজের রুমে এসে দেখে রানা ফ্লেমথ্রোয়ার টেস্ট করছে।
ওর ল্যাপটপে।
তবে মেমরি কার্ডটা দিয়ে নয়। আক্ষরিক অর্থেই ফ্লেম বের করেছে এবার।
চোখের সামনেই নিজের ল্যাপটপের পুড়ে গলে যাওয়া দেখতে দেখতে সেই ধোঁয়াতেই কাশে তন্ময়।
রানার শাপশাপান্ত করে চলেছে সেই সাথে।
বিএটিএ এজেন্টের মুখে তখন একচিলতে হাসি। একটু আগেই কাজী আনোয়ার হোসেন নামক লোকটার নামে মামলা ঠুকে দিয়েছে – সেটা কি একটা কারণ হতে পারে?
হবে হয়ত!
ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪
Leave a Reply