KP Imon

Words Crafted

পোয়েটিক জাস্টিস

‘সিরাজ সাহেব!’

সিরাজ সাহেবের কলিগ এই নিয়ে ষষ্ঠবারের মত সিরাজ সাহেবের মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। সহকর্মীর ডাকে হঠাৎ-ই যেন নিজের মাঝে ফিরে আসেন সিরাজ আকবর।

‘জ্বী ভাই। বলেন।’
‘তো – যা বলছিলাম!’ বেশ বিরক্তির সাথে একবার সিরাজের দিকে তাকিয়ে বলেন রিজওয়ান রহিম , ‘ইয়ে – কি জানি বলছিলাম?’
‘আপনার ছোটভাইয়ের বিয়েতে আপনার স্ত্রীর মধ্যে একটি বানর ঢুকে পড়েছিল।’ চটপট রিজওয়ান সাহেবকে মনে করিয়ে দেন সিরাজসাহেব।
মহা খাপ্পা হয়ে তার দিকে তাকান রিজওয়ান, ‘এতক্ষণ এই শুনছিলেন? আমি বলেছিলাম আমার স্ত্রীর ছোটভাইয়ের বিয়ের মধ্যে একটি বানর ঢুকে পড়ে।’
‘ওহ!’ নিজের ভুলটি বুঝতে পেরে বলেন সিরাজ সাহেব। ‘তারপর?’
‘তারপর তো বোঝেনই – কি একটা হুলুস্থুল কান্ড বলুন দেখি…’

রিজওয়ান সাহেব তাঁর শ্যালকের বিয়েতে ঘটে যাওয়া হুলুস্থুল কারবারের ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সিরাজ সাহেব। এই মহাবাচাল কলিগ নিয়ে হয়েছে সমস্যা। সারাদিন অফিসে বসে বসে উষ্ঠুম ধুষ্ঠুম গল্প ছাড়া! কাজের বেলায় ঠন ঠন। সরকারী চাকরি – একটু ঢিমে তালে কাজ করলে কারই বা আসে যায়? তাই বলে তাকে জোর করে সেসব শোনাবার দরকারটা কী সেটাও তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। প্রবল বিরক্তি নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন তিনি।

এমন সময় জানালায় জিনিসটা দেখতে পেলেন সিরাজ সাহেব। একটা মানুষের মাথা, গলা, তারপর গোটা ধড়!
চোরের মত নিচ থেকে দেওয়াল বেয়ে বেয়ে উঠে এসেছে কেউ এই চারতলায়! আঁতকে ওঠেন সিরাজ সাহেব। জানালাতে কোন গ্রীল নেই। চোরটা ভেতরে ঢুকে যাবে তো!

কোন কথা না বলে সিরাজ সাহেব অফিসের জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন।
জানালা খুললেন।
এবং এক ধাক্কাতে চোরটাকে ছিটকে ফেলে দিলেন চারতলা থেকে নিচের দিকে।
হাহাকার করে উঠলেন রিজওয়ান সাহেব, ‘করলেন কি! করলেন কি!! মেরে ফেললেন তো মানুষটাকে!’

*
জানালা থেকে উঁকিঝুঁকি মারছেন দুইজন মাঝবয়েসী মানুষ।
নিচে একেবারে তিনভাঁজ হয়ে পড়ে আছে একটা চোর। সেটা দেখে সাত দিন কালোপতাকা উত্তোলনের ঘোষণা দিলেন রিজওয়ান সাহেব।

‘খুনই করে ফেললাম দেখছি!’ বেশ অবাক হয়ে বলেন সিরাজ সাহেব।
‘চমৎকারভাবে!’ তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন রিজওয়ান সাহেব, ‘আর বলবেন না, সেবার হয়েছিল বটে এমন একটা দুর্ঘটনা। রাতের বেলায় চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি নিয়ে ফিরছিল আমার বড় ছেলে। হঠাৎ দেখতে পায় – রাস্তার মাঝে এক নিঃসঙ্গ মেয়ে ওকে গাড়িটা থামানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে! বুঝলেন সিরাজ সাহেব – অন্ধকার রাস্তায় কখনও কারও কথায় গাড়ি থামাবেন না। আরে, আপনি তো জানেন না পথচারীটির মনে কি আছে – তাই না? ’

সিরাজ সাহেবের ইচ্ছে করছিল বাচালটার মুখ চেপে ধরতে।
শালার মুখ কয়টা? সারাদিন বক বক করেও কি এর মুখ ব্যথা করে না? নিচে একটা লাশ পড়ে আছে – ওটার ব্যবস্থা কি করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি – আর আরেকজন আছে ঢাকা-চিটাগং রোডের নিঃসঙ্গ মেয়ে নিয়ে!

ভাগ্য ভালো একটা কাভার্ড ভ্যানের ওপর পড়েছে মরাটা। নাহলে এতক্ষণে রাস্তার লোকজনের ত্রাহি ত্রাহি চিৎকারে এলাকা প্রকম্পিত হত!

পিয়ন তসলিমের ডাকে দুইজনই বাস্তব জগতে ফিরে আসেন।
‘স্যার? ভেতরে আসতে চান উনি।’
চট করে ঘুরে দাঁড়িয়েই জানতে চান সিরাজ সাহেব, ‘উনিটা কে?’
‘পুলিশের গোয়েন্দা স্যার। কী নাকি কইব আপনাদের।’

“ওরে খাইছে!” – হার্টবীট মিস করেন সিরাজ সাহেব। এরই মাঝে পুলিশের লোকও চলে এল!
এবার সব শেষ!
নিজ নিজ চেয়ারে ধপাধপ বসে পড়েন দুইজনই।

‘সিরাজ সাহেব, ধাক্কাখান কিন্তু আপনি দিয়েছেন। জানি না কিন্তু কিছু আমি।’ স্বার্থপরের মত বলেন রিজওয়ান।
‘কিয়ের ধাক্কা! বাইরে উনি খাড়ায়া আছেন। ডাকুম না?’ জানতে চায় পিয়ন।
‘আসতে বল।’ দুর্বল গলায় বলেন সিরাজ সাহেব। এখন একে ঢুকতে না দিলে আরও প্যাঁচগি লাগবে পরে – কোন সন্দেহ নেই।

দেখা গেল অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ভেতরে চলে এলো লোকটা। চোখ দিয়ে এঁকে মাপেন সিরাজ সাহেব। ছয়ফিটের কম হবে না লম্বায়। তারওপর দশাসই শরীর। সিরাজ সাহেব চোরের বদলে একে ওই অবস্থায় ধাক্কা মেরে ফেলতে পারতেন না জীবনেও। উল্টো নিজেই ছিটকে পড়তেন ভেতরে। সেই সাথে এর কুঁতকুঁতে চোখজোড়া। অফিসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেবারে লেজার টার্গেটের মত।
পুরাই পেশাদার! খুনের গন্ধেই চলে এসেছে!

‘ডিটেক্টিভ নিয়াজ। পুলিশের গোয়েন্দা আমি।’ নিজের পরিচয় দেন গোয়েন্দা মহাশয়।
‘জ্বি জ্বি!’ বলেন সিরাজ সাহেব।
‘আপনাদের অফিসেই এসেছে পেশাদার খুনী কিসমত। এটা আমাদের বিশ্বস্ত সূত্রের খবর।’
‘জ্বি জ্বি!’ এবার বলেন রিজওয়ান সাহেব।
‘ঘাবড়াবেন না। এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল। আমিও ওই ব্যাটার পিছু পিছু এসে পড়েছি না? দেখলাম দেওয়াল বেয়ে টপাটপ উঠে পড়ছে!’
‘জ্বি? জ্বি?’ এবার ভড়কে যাওয়া গলায় বলেন দুইজনই।

ব্যাটা দেখা যাচ্ছে আস্ত খুনী। চোর ভেবেই ভুল করেছিলেন ওঁরা।
ভেতরে ভেতরে বেশ স্বস্তি অনুভব করেন সিরাজ সাহেব। আগাগোড়া এক খুনী মানুষকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলাটা খারাপ কি? মরেছে বেশ হয়েছে!
তবে ডিটেক্টিভের ঠান্ডা চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের ফাঁসীর দড়ি দেখতে পান উনি।

নিয়াজ কিন্তু এর মাঝেই একটা ছবি বের করে ফেলেছে।
‘একে দেখেছেন? এ-ই হচ্ছে পেশাদার খুনী কিসমত। ডেঞ্জারাস লোক!’

ছবি দেখে চেনেন না অবশ্য দুইজনের কেউই। এত সময় পেয়েছেন নাকি তাঁরা? উঠতে না উঠতেই তো ব্যাটাকে এক ঝটকায় নিচে ফেলে মেরে ফেলেছেন।

‘দেখিনি একে।’ নিরুত্তাপ গলায় বলেন সিরাজ সাহেব।
‘দেখলে আপনাকে জানাব। খুনীটি যে এ বিল্ডিংয়েই ঢুকেছে তা আপনি একেবারে নিশ্চিত?’ আগ বাড়িয়ে জানতে চান রিজওয়ান সাহেব। বিস্ময়ের ধাক্কাটা কিছুটা হলেও সামলে নিয়েছেন ইনি।
‘হুঁ। আমার ফোর্সকে ডেকেছি অবশ্য। বিশ মিনিটের মাঝেই চলে আসবে আশা করি। বিল্ডিং ঘেরাও করে আজ ওকে খুঁজে বের করব। তবে এর মাঝে সে কেটে পড়লে তো সমস্যা। কাজেই আপনাদের ডিস্টার্ব দিচ্ছি।’ উঠে দাঁড়ায় গোয়েন্দা, বের হতে হতে আবার মাথা ঘুরায়, ‘সাবধানে থাকবেন। ওই চেহারার কাওকে দেখলে সাথে সাথে জানাবেন পুলিশকে। আমি অন্য রুমগুলো খুঁজে দেখি।’

ডিটেক্টিভ বের হয়ে যেতেই হুড়মুড় করে টেলিফোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন সিরাজ সাহেব।

‘ওপরের লেভেলে লোক আছে নাকি আপনার?’ অবাক হয়ে জানতে চান রিজওয়ান সাহেব।
‘না।’ স্বীকার করেন সিরাজ সাহেব, ‘তবে নিচের লেভেলে আছে!’

*
মিসেস সিরাজ চোরের মত পুরাতন ফ্রিজ থেকে একগাদা গরুর গোশত নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন। উদ্দেশ্য – আজকের রান্না তিনিই করবেন। কাজের বুয়াকে তো খেদিয়েছেনই – কাজের একটা ছেলে ছিল ; তাকেও বলে দিয়েছেন রান্না ঘরে ঘুর ঘুর না করতে। কাজেই কাজের ছেলেটা ডোরেমন দেখতে লেগে গিয়েছে মনের সুখে। আর মিসেস সিরাজ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রান্না নিয়ে।

ডোরেমনের এই এপিসোডটা আবার লুৎফরের দেখা।
প্রতিটি ক্যারেকটারের মুখ থেকে ডাবিংকৃত হিন্দী বের হচ্ছে – তার সাথে তাল দিচ্ছে সিরাজ সাহেবের বিশ্বস্ত কাজের ছেলে।
মনোযোগটা ধরে রাখতে পারলে তার আজকে আরও কিছু নতুন হিন্দী শব্দ শেখা হত – জানে লুৎফর ; কিন্তু ম্যাডামের চিৎকারে ধ্যানটা ভেঙে গেল তার।

‘ভিনেগারের বোতলটা ফ্রিজ থেকে নিয়ে আয় তো লুৎফর!’
বাংলাতে ‘চুল’ শব্দটাকে হিন্দীতে তিনবার ডাবিং করে হাঁটা দেয় ও। এই বাসার সবাই পেয়েছে একটা নাম – লুৎফর! কাজের বুয়া রহিমা পর্যন্ত কারণে অকারণে ওকে ডেকে ফরমায়েশ খাটায়। আরে – ছোট ছোট কাজ নিজে করে নিলে কি এমন ক্ষতি, অ্যাঁ? ভিনেগারের বোতল ফ্রিজ থেকে নিজে আনতে পারে না?
একদিন এই মহিলার ফ্রিজে আস্ত একটা লাশ ভরে রাখবে – প্রতিজ্ঞা করল চৌদ্দ বছরের লুৎফর।

ফ্রিজের ডালা তুলেই অবাক হয়ে যায় ছেলেটা! আবার দড়াম করে নামায় ওটা।
‘আম্মা!!’

ম্যাডামও দৌড়ে আসেন রান্নাঘর থেকে।
‘চিক্কুর পাড়স ক্যান?’ বিরক্তির চোটে খাস ভাষায় বলেন তিনি।
‘ঘরত চোর ঢুকছে!’
‘কি বলিস?’ হাতের কিচেন নাইফ দুলিয়ে বলেন মিসেস।
‘ফ্রিজের ভেতর!’
আর শুনতে চাইলেন না মিসেস সিরাজ, চট করে ছুরিটা লুৎফরের হাতে দিয়ে বললেন, ‘গেঁথে দে! গেঁথে দে! ফেঁড়ে ফেল ব্যাটাকে!’
*

ড্রাইভার মফিজ মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে স্যারের হাতের দশ হাজার টাকার নোটের বান্ডিলের দিকে।
তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা নেয় ও।

‘শুধু এটুকুই করন লাগবো আমার?’ অবাক হয়ে জানতে চায় মফিজ।
‘হ্যাঁ। এখন ভাগো তো!’ মহাবিরক্ত হয়ে বলেন সিরাজ সাহেব।
মাথা নিচু করে নিজের ট্রাকটা ছেড়ে চলে যেতে থাকে ড্রাইভার।

স্মরণশক্তিকে ধন্যবাদ দেন সিরাজ সাহেব। সকালেই মফিজের ট্রাকটাকে ওখানে দাঁড় করতে দেখেছিলেন বলে খোঁচা দিচ্ছিল তাঁর ব্রেইন। স্মৃতিটুকু ঠিকই ছিল। যেই ট্রাকের ওপর লাশটা পড়েছিল সেটা মফিজের ট্রাকই ছিল বটে। দ্রুত ওকে ফোন দিয়ে ট্রাক নিয়ে দুই ব্লক দূরে কেটে পড়তে বলেন তিনি – তবে ধীর গতিতে ড্রাইভ করে।
চাননি লাশের বাচ্চা লাশ পড়ে যাক মাটিতে।

তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে সেদিকে হাঁটা ধরেন সিরাজ সাহেব। এবং ড্রাইভার মফিজকে টাকাটা তুলে দেয়ার সময় বুঝতে পারেন ব্যাটা টেরই পায় নি কিছু। যদি জানত ছাদের ওপর একটা মরা নিয়ে যাচ্ছে, দশ হাজারে কখনোই রফা করত এই লোক! ড্রাইভিং সীটে উঠে বসে ট্রাকটা চালু করেন সিরাজ সাহেব। বাসায় নতুন কেনা ডীপ ফ্রিজটা একেবারে খালি।

ঠেলেঠুলে চেপে ঢুকালে এই মরাটা আঁটবে না?
আঁটা তো উচিত!

শান্তমুখে ড্রাইভ করতে বাসায় পৌঁছে গেলেন সিরাজ সাহেব।
ছাদের ওপর থেকে মরাটাকে নামানোটা এখন সময়ের দাবী। সেই সাথে ঝুঁকিপূর্ণও বটে।
তবুও বহু কসরত করে মরাটাকে নামালেন তিনি। চেহারা দেখে শীতল একটা অনুভূতি হয় তাঁর। একে চেনেন তিনি।
গোয়েন্দা নিয়াজ সকালে যার ছবি দেখিয়েছিল অফিসে – এই সেই লোক! কোন সন্দেহ নেই!

ডীপ ফ্রিজটার কানেকশন গতকালই দিয়েছিলেন। তবে ইচ্ছে করেই খালি রেখেছিলেন। আগে একদিন তো যাক!
একদিন যেতে না যেতেই উদ্বোধন হয়ে গেল অবশ্য! আস্ত একটা খুনীর খুন হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে।
ডীপ ফ্রিজে মরাটাকে পুঁতে কিছুক্ষণ ব্যাপারটার কাব্যিক দিকটা ভাবলেন তিনি।

তারপর সুড়ুৎ করে আবারও ট্রাকের ভেতর সেঁধিয়ে গেলেন। মফিজ এই ট্রাকের ড্রাইভার – মফিজকে ফেরত দিতে হবে গাড়িটা। ব্যাটাকে এত টাকা না দিলেও চলত!

সিরাজ সাহেব বাড়ি থেকে বের হতেই যে ঘটে গেল আরেক নাটক সেটা তিনি জানতেই পারলেন না!

*
‘হইন্নির ঘরের হইন্নি!’

এই নিয়ে দশবার মত বললেন মিসেস সিরাজ। মাথা নিচু করে শোনে লুৎফর।
‘হইন্নির পুতে কামটা করছে কি দেহ! এক্কেরে মাইরা ফালাইছে! হইন্নির ঘরের হইন্নি! খুন করে ফালাইলি যে এক্কেরে?’

মিসেস সিরাজের এহেন মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে পারে না লুৎফর, প্রতিবাদ জানায়, ‘আপনেই না কইলেন একেবারে গাঁইথা ফেলতে?’
‘না। আমি কই নাই।’ বেমালুম অস্বীকার করে বসেন এবার সিরাজ গিন্নী। সখ করে খুনের আসামী কে-ই বা হতে চায়? লুৎফরের হাতে খুন করা ছুরিটা – জেলে যাবে লুৎফর। তাঁর এতে মাথা ব্যাথা কি?

আহত দৃষ্টিতে মালকিনের মুখের দিকে তাকায় লুৎফর। এই শালি তাকে ডুবাবে জানলে এখানে কাজ করতে কে আসত? নেহায়েত একটা মাঝারি মানের বেতন পাওয়া যায় আর ডোরেমনটা দেখা যায় রেগুলার – তাই এখানে কাজ করতে আসা।
এখন দেখা যাচ্ছে এরা ভীষণ পল্টিবাজ মানুষ!

‘আঁই কি করতাম এহন?’ অবশেষে দিশেহারার মত বলে লুৎফর।
‘লাশটারে গুম কর, হইন্নির ঘরের হইন্নি!’ এমন চিৎকার ছাড়েন মিসেস সিরাজ যে আরেকটু হলেই ঘুম ভেঙ্গে যেত এমনকী মরাটারও!
ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে লুৎফর। লাশ গুম করার এতশত টেকনিক ও কি আর জানে?
এর চেয়ে এই ‘হইন্নি’ মালকিনকে খুন করে ফেলাটাই সহজ মনে হচ্ছে। শালির মুখের গর্ত বেশি বড় হয়েছে। খুন করিয়ে বলে কিছু করে নি! ‘হইন্নি’ কোথাকার!

হাত নিশপিশ করলেও নিজেকে ধরে রাখে লুৎফর। এই মহিলাকে গেঁথে ফেললে নির্ঘাত ওকে পুলিশ খুঁজবে। তার চেয়ে মালকিনের কথামত শালার লাশটা গুম করতে পারলে কাজ হয়ে যাবে, জ্বালাবে না কেউ সহজে।
ডেডবডি নাই মানে খুনও হয় নি। সোজা হিসেব।
কিন্তু এখন এই মরাটাকে ফেলা যায় কোথায়? দুইজন বেকুব মানুষ মগজের ধীরগতির কোষগুলো খাটিয়ে উপায় খুঁজতে থাকে!

*
সালাউদ্দীন বেশ রাত করে আজ বাড়ি ফিরল।
আজকের কাজটাতে আরেকটু হলেই ঘাপলা লেগে যাচ্ছিল! কোনমতে ফাঁড়া কেটে বেড়িয়ে এসেছে!

সালাউদ্দীন পেশায় খুনী। টাকা পেলেই লাশ নামিয়ে দেয়। এতদিন বেশ সফলতার কারণে মাছি মারতেও ওকে ভাড়া করা হয় – হাতি মারতেও ওকে ভাড়া করা যায়! তবে ও টার্গেটের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না – যতদিন টাকার অংক ঠিক থাকে।

আজ সরকারী কার্যালয়ের এক কর্মকর্তাকে ‘ফেলতে’ গিয়ে ধরা প্রায় পড়েই গেছিল আর কি!

সকাল সকাল ওখানে ঢুকে পড়তে কোন সমস্যা হয় নি। তিনতলায় টার্গেটের অফিস – কিন্তু ঝামেলা একটা ছিল। ওকে বাইরের পার্সোনাল সেক্রেটারির নাকের সামনে দিয়েই ঢুকতে হবে এবং বেরুতেও হবে। ঢোকা তো সমস্যা না – কিন্তু বের হলে একটা সমস্যা থেকেই যায় – দেখা যাবে ও বের হতেই কোন কাজে লাফিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল সেক্রেটারি মেয়েটা।
কিন্তু তাহলে খুনের মিনিট দুইয়ের মাঝেই বুঝে ফেলতে পারে ঝামেলা কিছু একটা হয়েছে!

আবার সালাউদ্দীন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর যদি সেক্রেটারি মেয়েটা ও ঘরে ঢোকে, তবে কোন সমস্যা নেই তার। ততক্ষণে সে পগার পার হয়ে যাবে। কিন্তু ও বেরিয়ে যাওয়ার দুই মিনিট পর যে ঢুকবে না তারই বা গ্যারান্টি কি? তখন চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলবে না? বিল্ডিং থেকে বেরুনো কঠিন হয়ে যাবে না সালাউদ্দীনের?

কাজেই হেভী পেপারওয়েট মেরে টার্গেটের মাথা অর্ধেক দাবিয়ে দেয়ার পর গ্রীলবিহীন জানালা দিয়ে ভেগে যাওয়ার প্ল্যানটা করে ফেলেছিল টার্গেটের রুমে ঢোকার পর। সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে ঢুকেছে – কাজেই টার্গেট ওকে মোটেও সন্দেহ করেনি। এবং তারপরেই হয়ে গেল ঝামেলা!
মাঝারি স্বাস্থ্যের মানুষটার চাঁদিতে পেপারওয়েটটা বসিয়ে দিতেই ব্যাটা দুটো লাফ দিয়ে জানালা গলে নিচের দিকে পড়ে গেল। উঁকি দিয়েই সালাউদ্দীন বুঝে যায় – ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে গেছে! খুন হয়ে মানুষটা পড়েছে একটা কাভার্ড ভ্যানের মাথায়!

পরিকল্পনা ঠিক রেখে তিনতলার জানালা দিয়ে টিকটিকির মত চারতলার দিকে উঠতে থাকে ও। উদ্দেশ্য – একটা ফাঁকা জানালা পেলেই ভেতরে ঢুকে যাবে এবং সেক্রেটারি মেয়েটাকে বুঝতে না দিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাবে ও। ওর অন্তর্ধান বুঝতে বুঝতে এক মাইল দূরে সটকে পড়তে পারবে সালাউদ্দীন।

তবে চারতলায় উঠেছে কি ওঠেনি – বেদম এক ধাক্কায় কার্নিশ থেকে হাতই ছুটে যায় বেচারার!

*
মফিজ কথা শুনেছে। কারও কাছে মুখ খুলবে না ছোকড়া।
ত্রিশ মিনিটের জন্য ট্রাক থেকে দূরে থাকলে যদি স্যার দশ হাজার টাকা দেয় তাহলে মন্দ কি? এই পরিমাণ টাকা তো ও ত্রিশ মিনিট ট্রাক চালিয়ে কোনদিনও রোজগার করেনি!

বেশ খুশি মনে একটা রিকশা নেন সিরাজ সাহেব। বাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত মাথাটার ছুটি। ওখানে দিয়েই ব্রেনটাকে দ্বিগুণ উৎসাহে খাটাতে হবে। একটা খুনীর খুন হয়ে যাওয়া শরীর সরাতে হবে ফ্রিজ থেকে!
রিকশাওয়ালাকে দশটা টাকা বেশিই ভাড়া দেন আজ।
মুখে গানের কলি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েন। দীর্ঘাঙ্গী অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে একগাল হেসে শুভেচ্ছাবাচক কিছুও বলেন।

প্রতিউত্তরে হাসেন স্ত্রীটিও। জানান, ‘গরুর গোশত রাঁনছি। খাবা আসো।’
‘তুমি যাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’ স্ত্রীকে এটা বললেও খটকা লাগে সিরাজ সাহেবের।
আজ তাঁর কোট খুলে নিয়ে কোটস্ট্যন্ডে না রেখে চট করে আয়েশার মুখে খাবারের কথা কেন? কিছু টের পেয়ে গেছে কি?

ফ্রিজের ডালা উঠাতেই উনার মেজাজ উঠে গেল তুঙ্গে! শালার মরাটা গেল কোথায়?
‘আয়শা!’ বিল্ডিং কাঁপিয়ে ডাকলেন সিরাজ সাহেব।
স্বামীপ্রবরের হুংকারে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন মিসেস সিরাজ। এবং ডালা তুলে কিছু খুঁজতে থাকা স্বামীটির দিকে একনজর তাকিয়েই যা বোঝার বুঝে ফেলেন তিনি।
‘আরে আরে চিল্লাও কম। হইন্নির পুতে চোর আছিল।’

অবাক হয়ে তাকান সিরাজ সাহেব। স্ত্রীটি ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে বোঝাচ্ছে – নতুন ডীপ ফ্রিজের ভেতর জমাট বাঁধা রক্ত দেখে অশান্ত হওয়ার কিছু নেই। এক চোর ভেতরে ঢুকে বসে ছিল বলেই তাকে লুৎফর ছুরি গাঁথিয়ে দিয়েছে! নিজেই যে ছেলেটাকে হুকুম করেছিলেন সে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ চেপে যান আয়েশা স্বামীর কাছে!

সিরাজ সাহেবও বেশ তিরস্কার করেন সবটা ‘শুনে’ – এবং নিজেই যে ধাক্কা দিয়ে ব্যাটাকে চারতলা থেকে মেরে ফেলে এখানে এনে গুম করেছেন সে ব্যাপারেও চেপে যান।

‘লাশটা কোথায়?’ খাবার টেবিলে বসে ভয়ে ভয়ে জানতে চান সিরাজ সাহেব।
তাঁর প্লেটে বড় দেখে একটুকরো গোশত তুলে দেন মিসেস সিরাজ। আর মিটি মিটি হাসেন শুধু।
এক কামড় দিয়েই ওদিকে সিরাজ সাহেবের সন্দেহ হতে শুরু করেছে ওই ব্যাটা খুনীকে নির্ঘাত রেঁধে ফেলেছে আয়েশা! ভালো রান্না পারার ব্যাপারে মহিলার সুখ্যাতি আছে।

ছোট ছোট পিস করে মানুষটাকে হাঁড়িতে চাপিয়ে দিলে কি সিরাজ সাহেব ধরতে পারবেন আসলেই? পারার তো কথা না। কাটার পর সব এক। কী মানুষ আর কী গরু!
সিরাজ সাহেব টের পেলেন তাঁর গলা দিয়ে ভাত নামছে না। তিনি ওই অবস্থাতেই আরেকবার ভাঙ্গা গলায় জানতে চান, ‘লাশটা কোথায়? আর লুৎফরকেও দেখছি না অনেকক্ষণ! ও কোথায়?’
‘লুৎফরকে ছাদে পাঠিয়েছি।’ মিটি মিটি হাসিটা ধরে রেখেই বলেন মিসেস সিরাজ।

*
সালাউদ্দীন বেশ আয়েশ করে পোশাক ছাড়ে।

কাঁধের কাছে ছড়ে গেছে। এটা কিভাবে হল সেটাও ভালো করেই জানে সালাউদ্দীন। চারতলা পর্যন্ত কোনমতে উঠতেই মোটকা এক লোক এসে চট করে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় নিচে!
বিশফিট নেমে গেছিল সালাউদ্দীন সাথে সাথেই! কোনমতে দোতলার কার্নিশটা ধরে রক্ষা পায় বটে ও – তবে নিচের লাশটা সরানোর বুদ্ধি তার মাথাতেও একটা চলে আসে ঝটপট!

বরাবর সেই দোতলার রুমে কেউ ছিল না তাই রক্ষে। সেখান দিয়ে বের হয়ে সোজা চারতলায় চলে আসে সালাউদ্দীন।
বাইরে এক পিয়নকে দেখা গেল, তাকে থামিয়ে নিজের গোয়েন্দা পরিচয় দেয় সালাউদ্দীন। ভেতরে ঢুকে অবশ্য বেশ মজাই পায়! লোক দুটো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে!
লোকদুটো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কেন ভয় পেয়ে গেছে বুঝে ও। ওরা ভেবেছে ধাক্কা দিয়ে সালাউদ্দীনকেই নিচে ফেলে মেরে ফেলেছে!

ভয়টা কাজে লাগিয়ে বেশ ভড়কে দেয় সালাউদ্দীন দুই সরকারী চাকুরিজীবিকে। টার্গেটের ছবি সাথে ছিল – ওটাও কাজে লাগায়!
ফলাফলও আশানুরূপ ছিল। ট্রাকটা চালিয়ে সরে যায় ড্রাইভার এভিডেন্স নিয়ে।
খুনটা কল্পনাতীতরকম সফল হল অবশেষে! লাশ গুমের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় আর কেউ নিয়ে নিয়েছে!

কড়মড় শব্দে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। লাফিয়ে উঠতে যাবে সালাউদ্দীন – ঘাড়ের ওপর জগদ্দল পাথরের মত পড়ে থাকা দেহটা নিয়ে নড়তেও পারে না!
ঘাড়ের ওপর থেকে মানুষটাকে নামিয়ে আঁতকে ওঠে সালাউদ্দীন। ওপরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায় টিনশেডের চালা ফুটো হয়ে গেছে একেবারে – সে পথেই নেমে এসেছে ওর ঘাড়ে পড়া লোকটা।

লোকটাকে ও চেনে। আজ সকালেই মেরে রেখে এসেছে ওর অফিসে গিয়ে।
মরাটা এখানে এল কিভাবে?
আতঙ্কে চোখে অন্ধকার দেখে সালাউদ্দীন।

*
রাত দুটো বাজে।
থানায় ঢিমে তালে কাজ চলছে। টহল ভ্যানগুলো আজ যেন কোন রিপোর্ট দিচ্ছে না। একেবারেই অপরাধশূন্য এই রাতটা।

ওসির রুমে এসে স্যালুট ঠুকল একজন কন্সটেবল। ‘স্যার?’
‘হুঁ?’ ভারিক্কী চালে বলেন ওসি।
‘বাইরে একজন লোক ছিল, স্যার!’
‘তাতে আমাদের কি? বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র!’ একটু বিরক্ত হন ওসি মানুষটা।
‘লোকটার কাঁধে একটা খুন করা ডেডবডি স্যার।’
‘হাজতে ঢোকাও নি এখন?’ লাফিয়ে দাঁড়ায় ওসি।
‘ঢুকিয়েছি।’
‘চলো, আমি দেখব ওকে!’

হাজতের সামনে এসে হতাশ হন ওসি। একেবারেই সাধারণ একটা মানুষ।
বিড় বিড় করে কি জানি বলছে!

কাছে এসে কান পাতেন ওসি, শুনতে পান একটা কথাই, ‘স্যার, আমারে ফাঁসী দেন স্যার! আমারে রহমতুল্লাহর ভূতে মাইরা ফালাইব স্যার। আমি ভূতের হাতে মরতে চাই না। আমারে ফাঁসী দেন স্যার!’

ঘাড়ের কাছে শির শির করে ওঠে ওসির।

===

রচনাকাল ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৪ 

চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *