ইলিউশন সাইকিয়াট্রিস্ট
মেয়েটা সুন্দরী, কিন্তু একা দাঁড়িয়ে আছে। পড়নের পোশাক আর অভিব্যক্তিতে আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে। সন্ধ্যাও নেমে আসছে চারপাশটা অন্ধকার করে দিতে দিতে।
এরকম একটা মালকে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
চুপচাপ গিয়ে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। একটু বিরক্ত হয় যেন ও। ভ্রু হাল্কা বাঁকিয়ে আরেকটু দূরে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দেয়। অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। ক্লান্ত হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কারও জন্য অপেক্ষা করছে? তাই হবে হয়ত। মোবাইলটা বের করে ঝড়ের বেগে ডিসপ্লেতে টাচ করতে শুরু করল এই মাত্র। নিশ্চয় যার আসার কথা – তার পিন্ডি চটকাচ্ছে?
এগিয়ে গিয়ে কোন কথা না বলে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলাম।
এতটাই হতচকিত হয়ে যায় মেয়ে – তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া করতে পারে না। মেয়েটার নিশ্বাস আমার গলায় অনুভব করতে পারছি স্পষ্টভাবে। বেশ ভারী নিশ্বাস পড়ছে এখন – আতঙ্ক? একমুহূর্ত পরেই সম্বিত ফিরে পায় অবশ্য – কিন্তু তখনও প্রতিক্রিয়া করে না।
আমার বাম হাতে বেড়িয়ে আসা ছুরিটাই যে এর কারণ সেটা বুঝে উঠতে বেশী জ্ঞানের দরকার নেই। একেবারে পেটের সামান্য ওপরে ধরেছি – মুখ দিয়ে কিছুই বলতে হয় না – আমার হাতটা চলে যায় তরুণীর হাতব্যাগের দিকে।
‘প্লিজ – ব্যাগটা নেবেন না।’ মিষ্টি অথচ ভয়ার্ত কন্ঠে প্রথমবারের মত মুখ খোলে মেয়েটা।
টান দিয়ে ব্যাগটা মেয়েটার হাত ছেড়ে ছাড়িয়ে নিতে হল। এমনিতে দেবে না যখন কি আর করা? গোলাপী ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরে সে হতাশায়। আস্তে করে ওর ওপর থেকে সরে আসি আমিও। চটপট আমার ব্যাকপ্যাকে গায়েব হয়ে যায় মেয়েটার হাতব্যাগ। একরাশ অপমান চোখে নিয়ে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
অতশত ভাবি না আমি। আমার ইয়াবার সাপ্লাই শেষ। অন্তত তিনহাজার টাকা পেলে তো দশটা কেনা যায়!
তিনদিনের জন্য একেবারে নিশ্চিত।
গলি ছেড়ে যখন বের হয়ে যাচ্ছি তখন একটু খটকা লাগে।
মেয়েটার দৃষ্টিতে কি আমি অপমান দেখে এসেছিলাম? নাকি ব্যর্থতা?
দুই
বাসে করে মিরপুর-১২ যাচ্ছি।
শফিক মামাকে পেলে হয়। আমার সাপ্লাই সেই কখন থেকে বন্ধ! ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে বেশ।
পাশের ঘাড়ে গর্দানে চেহারার লোকটা গল গল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। সে যে একটা পাবলিক বাসে আছে – কে বলবে এই লোককে দেখলে? ইচ্ছে করেই ভোটকাটার পা মাড়িয়ে দেই আমি। বাসের মাঝে বসে সিগারেট খাচ্ছে! আনন্দের তো সীমা থাকা উচিত একটা!
কড়া চোখে একবার তাকায় শুধু মোটকু। কিন্তু কিছু বলে না।
তারপর একেবারে হঠাৎ গলা নামিয়ে জানতে চায়, ’সঙ্কেত দেওয়া লাগবে না। রেশমা কোথায়?’
এবার আমার ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। রেশমা কে? যার ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে সটকে পড়েছি – তার নাম নাকি? এই ভোটকার সাথে তার সম্পর্ক কি? জানলই বা কি করে আমার কাছে মেয়েটার ব্যাগ আছে? কিন্তু, কিছু তো বলা লাগে।
বাসভর্তি মানুষের গণপিটুনী খেতে চাই না।
ভেবেচিন্তে গলা নামালাম আমিও, ’রেশমা আটকে গেছে।’
চুক চুক করে দুঃখপ্রকাশের শব্দ করল লোকটা, তারপর আমার দিকে না তাকিয়েই আস্তে করে আবার জানতে চায়, ’প্যাকেজ কার কাছে তাহলে?’
কোনকিছু না ভেবেই বলে দিলাম, ’আমার সাথেই।’
লোকটাও একথায় আশ্বস্ত হয় বেশ। আমার দিকে একটু ঘুরে জানায়, ’সামনের স্টপেজে নেমে যাব আমরা। রিফাজের লোকেরা পিছু নিয়েছে। একেবারে গলা ফাঁক করে দেবে নাগালে পেলে।’
এ তো দেখছি রীতিমত ঝামেলায় ফেলে দিল আমাকে! গলা কাটাকাটি কেন বাবা এর মাঝে আবার? আমি নিরীহ মানুষ। নেহায়েত ইয়াবার টাকাটার জন্যই মেয়েটাকে লুট করতে হল।
মেয়েটা কে ছিল?
সুবিধের কেউ ছিল না সেটা নিশ্চিত অন্তত। আগেই সন্দেহ হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন দাঁড়াবে ওভাবে? মেয়ের মাথায় কুচিন্তা না থেকেই যায় না!
মাফিয়াদের লোক?
পেছনে আবার জনৈক রিফাজের উপস্থিতি আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয় বৈকি!
‘কাম অন!’ বাস থেমে যেতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় লোকটা।
দুইজনই সুড় সুড় করে নেমে পড়লাম। এই লোককেও খুব একটা সুবিধের লাগছে না। কিন্তু অন্তত এই মুহূর্তে এ আমার গলার প্রটেক্টর।
বাস থেকে নেমে পড়তেই গলা খাদে নামিয়ে বলে লোকটা, ’তাড়াতাড়ি আমার হাতে প্যাকেজটা দাও। রিফাজের ওরা তোমাকে দেখলেই হামলা করবে। প্যাকেজ যে বাগিয়েছো, পিঠে টার্গেট মার্ক পড়ে গেছে তোমার। কিন্তু আমার দিকে লক্ষ্য করবে না।’
সখটা একবার দেখ! আমার গলা কেটে ফেলবে রিফাজবাহিনী – তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই উনার। আছেন প্যাকেজ নিয়ে! চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম। এলাকা সুবিধার না। চারপাশে মেইনরাস্তা থেকে ঢুকে যাওয়া গলিগুলো বেশ চিপা চিপা।
তারওপর নেমে এসেছে রাত।
বাবাটা ইয়াবার কথা জেনে ফেলার পর থেকেই শুরু হয়েছে এই হ্যাপা! টাকার উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কোন স্যারের প্রাইভেট না পড়েও টাকা মারি – জেনে ফেলেছে। নয়তো জীবনের প্রথম ছিনতাইটা করা লাগত না আজ আমার। আর ওরকম ঝামেলায় পড়তেও হত না।
বিমর্ষ মুখে লোকটার হাতে আমার ব্যাকপ্যাক তুলে দিতেই চটপট পড়ে ফেলল ওটা। ভালুকের মত শরীরের মানুষটার গায়ে আমার ব্যাকপ্যাক নেহায়েতই ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে!
‘ফলো মি! ফাইলটা নিতে পারলেই রিফাজবাহিনী একেবারে থেমে যাবে!’ বলে একটা কানাগলিতে ঢুকে যায় অদ্ভুত মানুষটা।
প্যাকেজ নিরাপদে রাখতে যাচ্ছে নিশ্চয়? আর ফাইলটা নিতে?
ভালো কথা, ফাইলটা কিসের?
আধো-অন্ধকারে গলির মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে থাকা ষন্ডামার্কা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলতে গিলতে ভালুকটার পেছন পেছন গলিতে ঢুকে পড়লাম আমিও।
তিন
আমার ব্যাগটা কাঁধে নেওয়া মানুষটা একজন ষাঁড়।
তবে গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর প্রত্যেকে দেড়জন ষাঁড়। কিন্তু তৃতীয়জন, এঁদের দলনেতা লোকটি বেশ প্যাকাটি গড়নের। প্যাকাটিটা সামনে আসল।
‘চমৎকার আব্রাহাম! নিজেই চলে এসেছ দেখছি!’ চিকণ মানুষটার মুখ থেকে কামানের গোলার মত গর্জন বের হয়ে আসে।
‘কি আর করা! ফাইলের তো আর পা নেই। তাই আমারগুলোকে ধার চেয়েছে কিছুক্ষণের জন্য।’ বেশ হাসিমুখেই বলে আব্রাহাম – পিঠে ঝোলানো আমার ব্যাগটার একটা স্ট্র্যাপ ধরল একহাতে।
‘কোন ফাইল?’ চোখ সরু সরু করে জানতে চায় চিকণা।
‘আহা! ন্যাকা আরকি!’ দাঁত খিঁচায় আব্রাহাম, ’তোমাদের বস ভেতরে আছে?’
এ কথায় পেছনের তিন দেড়জন করে সাড়ে চারজন ষাঁড় এগিয়ে আসে কিছুটা।
‘বস কারও সাথে দেখা করবেন না।’ চাছাছোলা গলায় জানিয়ে দেয় ভদ্র চেহারার একজন’বস’-এর বডিগার্ড।
চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে একবার ঘাড় মটকালো শুধু আব্রাহাম। আমি পিছিয়ে আসি দুইপা। ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই – দূরে সরে দাঁড়াই।
এবার প্যাকাটি দলপতি নিজেই এগিয়ে আসে।
‘গেট লস্ট, আব্রাহাম। ভাইয়ের সাথে দেখা করার আসা ছেড়ে দাও। আর যা ক্ষতি হয়েছে মেনে নাও। সাথে করে বাচ্চা পোলাপান নিয়ে এসেছ আমাদের ঘাঁটিতে সরাসরি? তোমার সাহস আছে বলতেই হচ্ছে।’
বাচ্চা পোলাপাইন আমার ঘাড় হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমাকেও দেখছি ওরা গোণায় ধরেছে! তিন ষন্ডার গঠন দেখে হাঁটুতে জোর পাচ্ছি না আর।
আল্লাহর কাছে একবার প্রার্থনা করলাম – এখান থেকে জ্যান্ত পালাতে পারলে ইয়াবার জগত ছেড়ে চলে আসব। এরই মাঝে দেখি আব্রাহাম প্যাকাটির পেট বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে!
প্যাকাটি-টাইপ মানুষটা উড়ে গিয়ে এক ষন্ডাকে সাথে নিয়েই মাটিতে পড়ে।
রইল বাকি দুই।
চমৎকার মুখভঙ্গী করে ছুটে আসছে ওই ষন্ডাদ্বয় – আমার নিজেরই গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হল, ’ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে!’
আব্রাহাম আমার ব্যাকপ্যাক এক ষন্ডার মুখের ওপর দড়াম করে ফেলে দিতেই’উহা’র গতিবেগ রহিত হয়ে গেল! অপর ষন্ডার মুখে আব্রাহাম আর ব্যাগ নয় – নিজের ছয়মনি হাতই ফেলে দিচ্ছে দেখতে পেলাম। একপাক ঘুরে এক ষন্ডার পতনের সাথে সাথেই আমার ব্যাগ একপাশে ফেলে দ্বিতীয় ষন্ডা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আব্রাহামের ওপর।
আব্রাহাম একটু কায়দা করে সরে যেতেই টার্গেটকে মিস করে সোজা আমার দিকেই ধেয়ে আসে দ্বিতীয় ষন্ডা। তবে কৌতুকপূর্ণ মুখ নিয়ে পেছন থেকে পা বাঁধিয়ে দেয় আব্রাহাম।
আমিও আব্রাহামের কাছে এইমাত্র শেখা কায়দাটা করে একটু সরে যেতেই ঝপাত করে একেবারে নর্দমার মাঝে আছড়ে পড়ল ষাঁড়টি।
তৃতীয় ষাঁড়ের দিকে নজর ফেরাতেই দেখতে পেলাম প্যাকাটি-দলপতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে এখনও ছেলে! আব্রাহাম সেদিকে নজর দিতেই দড়াম করে সামনের বাসাটার দরজাটা খুলে যায়। প্যাকাটি-দলনেতার’এল্ডার-ভার্সন’ বেড়িয়ে আসে ভেতর থেকে।
‘বাইরে এত হট্টোগোল কিসের, অ্যা?’ সরু গলা দিয়ে সিংহের মত গর্জন করে বলল লোকটা।
চার
এই মানুষটাই যে ওই প্যাকাটি ছোকড়ার ভাই – এটা বোঝার জন্য আমার তৃতীয়শ্রেণীর ঘিলুই যথেষ্ট। এর কাছেই তাহলে আছে একটা টপ সিক্রেট ফাইল! যেটা দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে পুরো রাফিজ বাহিনীকে। তবে এই লোক আমাদের ঠেকানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করল না।
‘আরে আব্রাহাম যে! এতদিন পর হঠাৎ কি মনে করে?’
‘ফাইলটা লাগবে আমার। দিয়ে দাও। চলে যাই।’ ঝটপট দরখাস্ত করে ফেলে আব্রাহাম।
‘তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না।’ গম্ভীর মুখে বলে দরজা লাগাতে শুরু করল প্যাকাটির বড় ভাই।
ঝট করে একটা পা বাড়িয়ে দরজার শেষ মাথা আটকে ফেলে আব্রাহাম, ’এত সহজে না, মাহমুদ। ভেতরে আসছি আমরা।’
মাহমুদের আপত্তি মোটেও কানে তোলা হল না।
বাইরের তৃতীয় ষন্ডা একেবারে থার্ড আম্পায়ারের মতই বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিতেই মাহমুদের কলার ধরে একটা ঝাঁকুনী দেয় আব্রাহাম।
‘সেনের ফাইলটা। কুইক!’
‘ওই ফাইল আমি পাবো কোথায়?’ অবাক হওয়ার ভান করতে করতে বলে মাহমুদ।
আমি শুধু নাটক দেখছি। আব্রাহামের মত বডি বিল্ড করতে পারলে হত। একাই দুটো ভোটকাকে শুইয়ে দিতে পারলে আমার ইয়াবার টাকার অভাব হত না আর।
পরক্ষণেই একটু আগে করা প্রার্থনার কথা মনে হতেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটলাম।
ফাঁড়া কেটেছে এই ঢের! এবার এখান থেকে বেরিয়েই বাবাকে বলে একটা রিহ্যাবে ঢুকে যাবো। রোজ রোজ মেয়েদের সম্পদ লুট করতে গিয়ে প্যাঁচে পড়ব নাকি?
‘আমি জানি না ওই ফাইল কোথায় গেছে। বহুদিন ধরেই মিসিং শুনেছি।’ বিড় বিড় করে বলে মাহমুদ।
‘তুমি ডিপার্টমেন্ট ছাড়ার পরদিন থেকেই মিসিং ওটা, মাহমুদ! বন্ধুত্বের খাতিরে তোমার দিকে নজর দেইনি এতদিন। কিন্তু এখন ফাইলটা আমার দরকার। আর একটা গান। নাহলে মারা পড়বে আরেকটা নিরপরাধ মেয়ে! মাস্টার তিরমিজির কথা মনে আছে নিশ্চয়? আর তাঁর ছোট মেয়ে ফাল্গুনীর কথা?’
ওদের কথা শুনে এবার আমার কান খাড়া হয়ে যায়। কাহিনীর প্যাঁচ ঘোরতর!
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহমুদ।
‘ফাইলটা নিতে পার। তবে মনে রেখ দিচ্ছি কেবল মাস্টার তিরমিজির কথা ভেবেই। আমার প্রাণরক্ষক তিনি।’
‘এখন তাঁর মেয়ের প্রাণভক্ষক হতে যেও না। রাফিজের চোখ কোনদিকে পড়েছে বুঝতে পারছ? ডাটা সব চলে যাবে একেবারে জায়গা মত। তুমি আমি অথবা মাস্টার তিরমিজি – কেউই রক্ষা পারবে না সেটা হলে।’
ভেতরে ঢুকে পড়ি আমরা মাহমুদকে ফলো করে। রান্নাঘরে এনে একটা মাটির নিচে যাওয়ার রাস্তা বের করে ফেলে মাহমুদ মেঝের এক অংশ সরিয়ে।
তারপর নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়।
একটু পর বের হতেই হাতের ঢাউস ফাইলটা চোখে পড়তে আমিও ভড়কে যাই।
‘পদ্মার বুকে মাস্টার তিরমিজি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন সেই ম্যাসিভ গানফাইটের মাঝেও। সেই ঋণের কিছুটা শোধ দেয়ার প্রচেষ্টা শুধু, আব্রাহাম। তবে লড়াইটা তোমার। আমি আর ফোকাসে আসতে চাই না।’
কোমর থেকে খুলে একটা পিস্তলও বাড়িয়ে দেয় মাহমুদ আব্রাহামের দিকে।
চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখি শুধু আমি।
পাঁচ
কোনমতে হেঁটে চলেছি আমি আব্রাহামের সাথে।
দুইজনেই চুপ একেবারে।
আমার মাথায় কিছুরই হিসেব মিলছে না। কোথা থেকে কি হয়ে গেল!
একটা মাত্র ভ্যানিটিব্যাগ চুরি করতে গিয়ে এত বড় ঝামেলায় পড়া লাগবে জানলে কি আর আগাই?
‘কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেওয়াই যায় তোমাকে।’ মুখ খোলে আব্রাহাম, ’ঘটনার সাথে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে জড়িয়ে পড়েছ তুমি। আমি, মাহমুদ – দুইজনই ছিলাম বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সীর সাথে। কিন্তু আর সবার মতই আমাদেরও একটা কালো অধ্যায় আছে। আমাদের সুপিরিয়র ছিলেন মাস্টার তিরমিজি। উনার প্ল্যান অনুযায়ী আমরা কাজ করতাম – যাকে বলে – ইয়ে আইনে অবৈধ।’
তাকিয়ে থাকি আমি।
‘যেসব অপরাধীদের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব থাকত, যাদের জেলে ভরে রাখা সম্ভব নয় – তাদের মাথাতে সোজা বুলেট ঢুকিয়ে দিতাম আমরা। অ্যারেস্ট করার ঝামেলায় যেতাম না।’
বলে কি! আমার তো রীতিমত গা গুলাচ্ছে। এই মানুষ এতবড় খুনী সেটাই বা কে জানত!
‘জেনে ফেলে শেষ শিকার অভিজিৎ সেন। পালটা আঘাত হানে সে তার লোকেদের নিয়ে। লোকটা ভূতের মত। ডিপার্টমেন্টের এজেন্টরা সিরিয়ালি মারা পড়ছিল – মরিয়া হয়ে আমরাও ডাটা কালেক্ট করতে শুরু করি। কিন্তু তার আগেই কাজ হয়ে যায় – মাস্টার তিরমিজির বাসায় হামলা চালিয়ে পার্সোনাল ড্রাইভ কেড়ে নেয় কেউ – যেটায় আমার আর মাহমুদের সিক্রেট কিলিং মিশনের ডাটাগুলো সবই আছে।’
‘তারপর?’ গোগ্রাসে আব্রাহামের কাহিনী গিলছি আমি।
‘প্রাণপনে হামলা চালাই আমরা সেনের ঘাঁটিতে। সেনকে হত্যা করে উদ্ধার করে আনি হার্ডড্রাইভটা। কিন্তু ততদিনে ডিপার্টমেন্ট সন্দেহ শুরু করেছে। আমাদের তিনজনই চাকরিচ্যুত হতাম – ফাঁসী-টাসীও হয়ে যাওয়াটা বিচিত্র ছিল না। কিন্তু উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে আমাদের খুনগুলোর বিচার ঠিকমত হল না। আমাদের ফিল্ড থেকে সরিয়ে ডেস্কজব দেওয়া হল। কিন্তু অফিস ছেড়ে চলে গেল মাহমুদ এরপর, রেজিগনেশন দিয়ে। সেই সাথে কারও চোখে না পড়লেও আমার চোখে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে সেনের ফাইল।’
‘ওই ফাইলের সাথে আজকের ছোটাছুটির সম্পর্ক কি?’ না জানতে চেয়ে পারলাম না।
‘সেনের ডানহাত রাফিজ এখন ক্ষমতায়, বাঁধন।’ হাঁটতে হাঁটতেই আমার নাম জেনে নিয়েছে আব্রাহাম।’গতপরশুই মাস্টার তিরমিজির মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে ওরা। আজ জমা দেয়ার কথা ছিল হার্ডড্রাইভটা। তবেই জীবিত ফিরে পাওয়ার কথা ছিল ফাল্গুনীকে। শর্ত একটাই – ফাল্গুনীর বোন অহনাকে নিয়ে যেতে হবে হার্ডড্রাইভ।’
‘কিডন্যাপাররা তাহলে মোবাইলে টেক্সটের মাধ্যমে যোগাযোগ করছিল?’ এবার বলি আমি। সবকিছু এখন স্পষ্ট।
যেই মেয়েকে ছিনতাই করেছি আমি, সে দেখা যাচ্ছে কিডন্যাপড ফাল্গুনীর বোন অহনা ছিল!
‘চালাক ছেলে। ঠিকই ধরে ফেলেছ।’
‘আপনাদের ডুবিয়ে দিয়ে কি লাভ রাফিজের?’
‘প্রতিশোধ! আমাদের কারণে ওদের অনেক সহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। রাফিজের বড় ভাই রিয়াদও মারা যায় মাহমুদের হাতে। যে করেই হোক আমাদের ডুবাবে ওরা। এর আগেই আমাদের ফাল্গুনীকে খুঁজে বের করতে হবে।’
‘আগাচ্ছেন কিভাবে?’ সন্দেহভরা কন্ঠে জানতে চাই আমি।
‘ফাইলের সব পৃষ্ঠার ছবি অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি। যথেষ্ট তথ্য আছে। মাহমুদ অহেতুক ভয় পেয়েছিল। সেনের ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে আমাদের কুকীর্তির কথা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য ফাইল সহই কেটে পড়েছিল ও। এখন দেখা যাক অফিস থেকে কোন লিড পাওয়া যায় কি না!’
‘ডেস্ক থেকে বেরিয়ে ছোটাছুটি করছেন কিভাবে?’ জানতে চেতেই হল।
‘স্পেশাল কোয়ালিফিকেশনের জন্য আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এই মিশনে। আমাদেরই কো-ওয়ার্কারের মেয়ের কিডন্যাপিং দেখে ডিপার্টমেন্ট তেঁতে রয়েছে। অবশ্য কিডন্যাপিংয়ের পেছনে কি রহস্য সেটা ওরা জানে না।’
‘তারমানে – মুক্তিপণ হার্ডড্রাইভটা দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল অহনা। ব্যাকআপ হিসেবে ছিলেন আপনি। তারমাঝেই হামলে পড়েছি গিয়ে আমি?’
‘হুঁ। শুধু তাই না – আস্ত হার্ডড্রাইভ নিয়ে সটকে পড়েছ। কাজেই তোমাকে ফলো করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার। আর বাসে একটু রহস্যের গন্ধ দিতেই একা একাই চলে আসলে সাথে। ধন্যবাদ তোমাকে।’
মোবাইল ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে আব্রাহামের।
‘গট দ্যা লোকেশন। তোমার ব্যাকপ্যাকটা ধার নিতে পারি? শেষ অ্যাকশনে যাচ্ছি। আশা করি ফাল্গুনীকে নিয়ে বের হয়ে আসতে পারব।’
‘আমি যাচ্ছি না সাথে?’ আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে তাকালাম আমি।
‘তোমার এসবে ট্রেইনিং নেই, বাঁধন। মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট করেছ তুমি। এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।’
রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকি আমি।
সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকা মানুষটা আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে।
বুঝিয়ে দিয়ে গেছে একটা ব্যাপার হয়ত তাঁর নিজের অজান্তেই!
জীবন মোটেও হেলাফেলায় কাটানোর মত জিনিস না। জীবন একটাই।
নিজের জীবনকে ঘুরিয়ে ফেলব আমি।
আর… ভবিষ্যতে বাংলাদেশ অ্যান্টি-টেররিজম এজেন্সীতে গিয়ে ঢোকার একটা ভালো চেষ্টা দিতেই হবে!
ইয়াবার গুষ্টি আমি কিলাই। আজই বাবাকে বলে সোজা রিহ্যাব!
ছয়
ভ্রু কুঁচকে বসে আছেন লিয়াকত হোসেন।
কুঞ্চিত ভ্রুর পেছনে অষ্টম স্কেলের কারণ বিদ্যমান। একটু পর তিনি রেজাল্ট পাবেন।
লিয়াকত হোসেনের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তবে তিনি কোন মেডিকেল চেক-আপের রেজাল্টের অপেক্ষাতে নেই। একমাত্র ছেলে শরীফ হোসেন বাঁধনের রেজাল্টের অপেক্ষায় আছেন। ছেলের বয়স কম – মাত্র কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে – তবে এরই মাঝে ইয়াবা ধরে ফেলেছে!
ইলিউশন-সাইকিয়াট্রিস্ট ফারদিন আহমেদ চৌধুরী তাঁর বাল্যজীবনের বন্ধুর ছেলে। এই একটা কারণেই তাকে একটা সুযোগ দিয়েছেন। কারণ ইলিউশনিস্ট মনোরোগ বিজ্ঞান বলে কোন বিজ্ঞান এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এটা ফারদিনের নিজের আবিষ্কার। আর তাতেই কি না নিজের ছেলেকে গিনিপিগ বানাতে সম্মত হয়েছেন লিয়াকত সাহেব!
বয়েসের সাথে কি তার বুদ্ধিশুদ্ধিরও লোপসাধন হচ্ছে?
‘নেশাগ্রস্থ ছেলেরা হতাশার আড়ালে লুকিয়ে আসলে অ্যাডভেঞ্চার খোঁজে।’ ফারদিন বলেছিল সেদিন, ’যদিও এই অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপারে তারা নিজেও জানে না। অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকে সেটা। অথচ অ্যাডিক্টের কোন আইডিয়াই নেই – ঠিক কোন কারণে নেশার অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে সে। জানতে চাবেন আপনি – ফট করে বলে দেবে, “আমার জীবন নিয়ে আমার অনেক হতাশা।” যতসব ফালতু কথা বার্তা। এই ছেলেকেই নিয়মিত হান্টিং রাইফেল দিয়ে শিকারে পাঠান – ঝটপট কমে যাবে ড্রাগস নেওয়ার পরিমাণ।’
‘তুমি সাজেস্ট করছ – বাঁধনকে আমি শিকারে পাঠাই?’ সামনে বসে থাকা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মনে রোগ আছে কি না সে ব্যাপারেই সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পরেন লিয়াকত সাহেব।
‘না, স্যার!’ হেসে ফেলে ফারদিন, ’এখানেই কাজ করব আমি। বাঁধনকে একটা চমৎকার ইলিউশন দেব। প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারের। এতে ও জীবনের বিস্তৃতিটা বুঝতে পারবে। আশা করি কাজ হয়ে যাবে। আমাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেন।’
‘তোমাদের মানে?’ ভারী গলায় জানতে চান লিয়াকত হোসেন।
‘আমাদের টিম আছে একটা। এটা নিয়ে কাজ করছি আমরা। আমি ছাড়া আরও পাঁচজন আছি। ইলিউশন দিতে হলে লোক তো কিছু লাগেই। আপনি শুধু বাঁধন বের হবে যখন – আমাকে একটা মেসেজ দেবেন। বাকিটা আমরা দেখব।’
ভরসা রেখে তো ভুল করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। সারাদিন বাঁধনের কোন পাত্তা নেই। যত্তসব অহেতুক তত্ত্ব!
উঠে দাঁড়ালেন লিয়াকত হোসেন। ছেলেটাকে রিহ্যাবে দেওয়াটা দরকার। কিন্তু নিজের ইচ্ছে না থাকলে দিয়ে কাজ হবে না। আবার বের হয়েই নেশাতে ডুবে যাবে!
খুট করে একটা শব্দ হয় পেছনে।
লিয়াকত হোসেন ঘুরে দেখতে পান তাঁর একমাত্র ছেলেকে। আজ ওর চোখে অন্যরকম একটা আভা – বাঁধন জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে!
*
পার্সটা উল্টে পালটে দেখছে ফারদিন। মেয়েটার নাম-ঠিকানা কিছু পাওয়া যায় কি না বের করা দরকার। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁধন ছেলেটার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে আছে ও। তবুও হাতের কিছু কাজ শেষ করতে হল।
রাত অনেক হলেও আজকের এক্সপেরিমেন্টটার রিপোর্ট লিখে ফেলেছে ও। প্রথম পরীক্ষাতেই সাফল্য!
বাঁধনের বয়েসী ছেলেদের জন্য বেশ কাজের হবে প্রক্রিয়াটা। এখন শুধু ছিনতাই করা পার্সটার মালিককে খুঁজে বের করলেই ওর কাজ শেষ। ভেতরে হাত দিতেই একটা হার্ডড্রাইভ উঠে আসে ওর হাতে।
সরু চোখে সেদিকে একমুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ফারদিন। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে ও একটা নামের জন্য।
ছোট একটা কাগজে নাম ঠিকানা আটকানো আছে ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতরের পিচ্চি পার্সটায়।
সেদিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় ফারদিন আহমেদ চৌধুরী।
‘অহনা তিরমিজি’ নামটা যেন জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে!
ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৪
Leave a Reply