আমি ইরফান Posted on October 24, 2023 ১ অফিস থেকে বের হতেই অসংগতিটা ধরা পড়ল। ঢোকার সময় চারপাশে নজর বুলিয়ে ঢোকা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমার। মোড়ের একমাত্র চায়ের দোকানটায় একটা মুখ দ্বিতীয়বার দেখলাম। যখন ঢুকি তখনও ভর্তি ছিল দোকানটা। সবগুলো মুখের দিকে একবার নজর দিয়ে ভেতরে চলে গিয়েছিলাম। এখন বের হয়েও তখনকার একজন মানুষকে দেখলাম বসে থাকতে। টাকমাথা – পেটানো স্বাস্থ্যের সাথে অভিব্যক্তহীন মুখ। ধরণটা অনেকটা পেশাদার খুনীদের মত। আমার ওপর নজর রাখছে? অর জাস্ট হ্যাপেনড টু বি দেয়ার? নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। তবে সতর্কতার মাত্রা বাড়ালাম। ধীরে ধীরে মেইন রোডের দিকে এগুচ্ছি। বাম হাতে অবিচলভাবে ধরে রাখা স্যুটকেসটা হাঁটার তালে অল্প অল্প দুলছে। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি কাছেই। আমি আর ঈশিতা – দুইজন মানুষ। ভালোই চলে যায়। বাসে উঠে পড়লে পাঁচ মিনিটে পৌঁছে যাব। চাকরীটাও ছোট্ট। তবে বেআইনী কিছু নয়। ওই পথ থেকে সরে এসেছি প্রায় একবছর হয়ে গেল। ফারিহার সাথে তখন থেকেই পরিচয়। ওকে কিডন্যাপ করার কথা ছিল আমার। ওই কেসে প্রাণবিপন্ন হয় ঈশিতার। শেষ মুহূর্তে কোনভাবে ঈশিতাকে ওখান থেকে উদ্ধার করার পরই সিদ্ধান্ত নেই – এই পথে আর না। আমার এই জীবন যে কেবল আমার নয়, ঈশিতার জীবনকেও দুর্বিপাকে ফেলতে পারে তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তবে আজকের এই অসঙ্গতিটা চোখে আটকে চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার অতীত থেকে ফিরে আসা কেউ কি এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাকে? মেইন রোডে উঠতে উঠতে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করলাম। মিরর অ্যাপটা চালিয়ে দুইসেকেন্ডের জন্য পেছনটা দেখে নেই। পেছনে লেগে আছে টাকু। কোন কিছু খেয়াল করিনি এভাবেই রাস্তায় দাঁড়ালাম। যেন বাস আসলেই উঠে যাব। পেছনের টাকমাথা কিছুটা দ্বিধায় ভুগছে, এখন দাঁড়ালে আমার সন্দেহ জাগবে। আর আমাকে পার করে হেঁটে গেলে আমি বাসে উঠে ভ্যানিস হয়ে যাব। ওর দোটানা বুঝে মনে মনে হাসলাম। বাস এল। উঠে পড়তেই আস্তে করে ছেড়ে দেয় বাস। চলন্ত বাসটার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌঁড়ে কোনমতে বাস ধরে টাকমাথাও। ‘কাঁঠালের আঠা’টাকে খসানোর প্ল্যান আমারও আপাতত নেই। একে ঠেসে ধরতে হবে সুবিধেজনক কোন স্থানে। আমার বাসা যেখানে সেখানে নামলাম না আমি। অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায় টাকুর চেহারায়, পাকা খবর নিয়েই এসেছে তাহলে। বাসের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরও পাঁচমিনিট পর টাকুকে পাশ কাটিয়ে নেমে পড়লাম। টাকমাথা নামে না। ধীরে সুস্থে উলটো দিকে হাঁটছি। যেদিকে আমার বাসা। মিরর দিয়ে আরেকবার বাসটাকে দেখলাম। আবারও থেমে গেছে ওটা আমার চল্লিশ ফিট পেছনে। হন্তদন্ত হয়ে লাফিয়ে পড়ে টাকু আবারও। আবার আমার দিকে ধীরে ধীরে এগোয়। প্রেম এরকমই হওয়া উচিত- মনে মনে না ভেবে পারলাম না। যত যাই হোক ছুটানো যাবে না একে। পুরোদস্তুর সুপার-গ্লু! স্যুটকেসটা হাতবদল করে নিয়ে গলিতে ঢুকে পড়লাম এবার আমি। বামদিকের টিনশেড বাসাটার বাইরের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। এরকম বাসাগুলোতে বেশ কয়েকটা পরিবার থাকে। বাইরের দরজা এজন্য সবসময়ই থাকে খোলা। দরজার একচিলতে ফাঁক দিয়ে পরিস্থিতি দেখি আমি। দুই মিনিট পরই কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া গেল। বড় বড় দম ফেলতে ফেলতে টাকমাথা বুলেটের মত ঢুকে পড়ল গলিতে। জোর পা চালাচ্ছে গলি ধরে সামনের দিকে। গলিতে আমাকে না পেয়ে শেষমাথায় গিয়ে দেখতে চায় নিশ্চয়! দরজা খুলে আস্তে করে বেরিয়ে আসি আবার। তবে এবার আমিই ওর পেছনে! ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস নিতে থাকা আমার ‘অন্ধভক্তের’ টাকমাথায় স্যুটকেসটা সবেগে নামিয়ে আনতেই গুঙ্গিয়ে উঠে ফিরে তাকায় লোকটা। অনায়াসে বাম হাতের এক আপার কাটে নাকের ব্রীজ ভেঙ্গে দিলাম। বহুদিন এসব কাজে নামা হয় না বলে খুব যুতসই হল না আঘাত। আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ বরাবর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতটা চালায় টেকো। দ্রুতমাথা নামিয়ে আঘাতটা এড়িয়েই টেকোর অরক্ষিত বুকটায় দ্রুতবেগে কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দেই। বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়েছে যেন! দু’পা পিছিয়ে যায় পিছু নেওয়া মানুষটা। বিপুল উদ্দমে আবারও ছুটে এল। তার উৎসাহ দেখবার মত! বাতাস কেটে শরীর ঘুরিয়ে নেই আমি, সেই সাথে বিশেষভঙ্গীতে কনুই ভাঁজ করে ফেলেছি। উড়ে এসে কনুইয়ের ওপর পড়ল টেকোর বুক। পূর্ণগতি নিয়ে কনুইয়ের সুক্ষ কোণায় এসে পড়ায় চাপটা মূলত পড়ল একটা বিন্দুতে। পাঁজরের হাড় ভাঙ্গার বিচ্ছিরি শব্দটা মনে হয় গলির শেষ মাথা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সেই সাথে গতি জড়তা কাজে আসতে না পারায় দুই পা শুন্যে উঠে গেছে ফলোয়ারের – এক মুহূর্ত পরেই দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল। দেরী করে কাজ নেই। ম্যাটাডোর কলমটা ঝটপট বের করে মানুষটার হাতের তালুতে গেঁথে দিতেই আকাশ ফাঁটিয়ে চেঁচিয়ে উঠে টাকু। ‘কার নির্দেশে আমার পিছনে লেগেছ?’ ওর বুকের ওপর হাঁটু তুলে দিয়ে কলমটা মুচড়ে দিতে দিতে বলি আমি। গুঙ্গিয়েই যায় লোকটা। একে মুখ খোলানোর জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে না। উঠতি বয়েসের কিছু ছেলে আড্ডা ভেঙ্গে এদিকে এগিয়ে আসছে গলির ওইপাশ থেকে। দ্রুত আরেকহাতের তালুতেও কলম গেঁথে দেই আমি। ‘হু সেন্ট ইউ?’ মুখে ঘুষি মারি একটা, ‘অ্যানসার মি!’ চোখমুখ উলটে ফেলে হা করে লোকটা। কিন্তু ওখান থেকে কোন শব্দ পাওয়া যায় না। হঠাৎ-ই জিহবা দিয়ে একটা দাঁত খুলে গিলে ফেলে টেকো। পরক্ষণেই স্তব্ধ হয়ে যায় শরীরটা। ‘শিট!’ ওকে ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াই। ছেলেগুলো প্রায় চলে এসেছে। বিপরীত প্রান্তের দিকে হাঁটা দেই দ্রুত। জানি ওরাও শেষ মাথায় এসে মোড় ঘুরবে আমাকে ধরার জন্য। কিন্তু আমাকে আর দেখতে পাবে না কোথাও। * চিন্তায় মাথাটা ভারী হয়ে আছে। যতদ্রুত সম্ভব বাসার দিকে আগাচ্ছি। এ ফ্ল্যাটে আমি বা ঈশিতা কেউই নিরাপদ নই। অতীত ঝেড়ে ফেলা দেখছি ততটা সহজ নয়। নকল নাম নিয়ে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করি আমি – কাজেই আসল নাম নিয়ে সুস্থ জগতে ফিরে আসতে পেরে বেশ স্বস্তিবোধ করছিলাম। তারপরও আমাকে খুঁজে বের করে ফেলেছে! দ্রুত বাসা থেকে ঈশিতাকে বের করে নিয়ে সরে পড়তে হবে এখান থেকে। স্কুল ছুটি হয় বারোটায়। মর্নিং শিফট। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত বাসায় একাই থাকতে হয় বেচারিকে। এই পৃথিবীতে বোনটা ছাড়া কেউ নেই আমার, তাকেও সময় দিতে পারলাম আর কোথায়! তিনতলাতে উঠে শরীরটা শক্ত হয়ে গেল আমার। দরজাটা আধখোলা! নব ভেঙ্গে ছুটিয়ে ফেলা হয়েছে! নিজের হৃৎপিন্ডের ধুকধুকানী ছাড়া আর কিছু শুনতে পাই না। প্রতিটা পেশী সতর্ক হয়ে গেছে আমার, আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা পুরো খুলে ফেললাম। দেয়াল হাতড়ে লাইট অন করতেই সন্ধ্যার আবছা আঁধার কেটে যায়। ঘরের সবকিছু ওলট পালট হয়ে আছে। ভেতরে ছুটে ঢুকে পড়লাম। প্রতি মুহূর্তে ভয় কাজ করছে, এই মুহূর্তে হয়ত ঈশিতাকে দেখতে পাব। কি অবস্থায় দেখতে পাব – সেটা কল্পনা করতেই ভয়ে রক্ত হিম হয়ে আসছে। সেই সাথে দায়ী ব্যক্তির প্রতি রাগের একটা হল্কা অনুভব করছি। প্রতিটা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজি আমি। কোথাও ঈশিতা নেই। ২ বাইরে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হতেই সচকিত হয়ে উঠি আমি। ছুটে সিঁড়িঘরে বেড়িয়ে আসি। এই সময় বাসার সামনে থেমে যায় গাড়িটা। আমাকে নিয়ে কি চায় ওরা – জানি না। জানার জন্য কোনরকম বাড়তি কৌতুহল না দেখিয়ে ছাদ বরাবর উঠতে শুরু করলাম। ছয়তলা বিল্ডিং। ছাদ আরও তিনতলা ওপরে। ততক্ষণে সিঁড়িঘরে চলে এসেছে দুইজন। নিচতলা থেকে আমাকে দেখে হৈ হৈ করে ওঠে ওরা। হর্ষধ্বনি না শিকারকে হাতে পাওয়ার আনন্দে উৎফুল্ল – তা নিয়ে মাথা ঘামাই না, উঠতে থাকি। ছাদে পা রেখেই আগে থেকে দেখে রাখা এস্কেপরুটটা মনে করি। আলতো করে গলায় ঝোলানো চাবিটা ছুঁলাম। জায়গামতই আছে। কখনও এভাবে পালানোর চেষ্টা করে দেখিনি অবশ্য। আমার নতুন জীবনে এত দৌড়ঝাঁপ ছিল না। নির্দিষ্ট দিকের রেইলিং-এ গিয়ে ঝাঁপ দিলাম ছাদ থেকে। পেছনের ওই ওরা বেরিয়ে আসে সেই মুহূর্তে ছাদে। শূন্যে ভেসে ছয়ফিট দূরের পাঁচ তলা বিল্ডিংটার ছাদে গড়িয়ে পড়তেই পেছন থেকে ভোঁতা শব্দ শুনতে পাই। ঠাস করে ফেটে পড়ে ছাদের সখের বাগান হিসেবে রাখা ফুলগাছের টবটা। ওদিকে তাকানোর সময় নেই। ছুটে গিয়ে ছাদের আরেক কিনারে লাফ দেই। পরের বিল্ডিংটার ছাদ আরও একতলা নিচুতে। গড়িয়ে সোজা হয়ে গায়ের জোরে লাথি হাঁকাই ছাদের দরজাটায়। ভেতর থেকে তালা দেওয়া! আবারও প্রকান্ড একটা লাথি মারি ওতে। নিশ্চুপ চারপাশে কামানের গোলার মত শব্দ হয়। অবশ্য মাইন্ড করার কিছু নেই এতে। পাশের বিল্ডিং-এর ছাদের ধুপধাপ শব্দ শোনা যায়। আমার দোস্তরা নেমে আসছে– বুঝলাম। ওই বিল্ডিংটার ছাদের রেইলিং-এর কাছে দুটো ছায়ামূর্তি দেখা যায় আমার অনুমান নির্ভুল প্রমাণিত করে। এদের একজন আবারও কোমর থেকে কিছু একটা খুলে আমার দিকে তাক করতে থাকে। সেই সাথে তৃতীয় লাথিতে দরজার কব্জা ছুটিয়ে দেই আমি। লাফিয়ে ভেতরের অন্ধকারে ঢুকে পড়তেই বাইরে ঠং জাতীয় শব্দ ওঠে। সেদিকে কান না দিয়ে সিঁড়িঘর কাঁপিয়ে নামতে থাকি আমি। কিডন্যাপিং-এর পেশা থেকে সরে আসার পর থেকে সাথে আগ্নেয়াস্ত্র রাখি না। এই প্রথমবার সেটা নিয়ে আক্ষেপ হল। জানটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ছুটতে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই এই মুহূর্তে। ঈশিতার এখন আমাকে দরকার। এখানে গুলি খেয়ে পড়ে থাকাটা কোন কাজের কথা নয়। চারতলা বিল্ডিংটার গ্যারাজে পা রেখেই মনে শান্তি আসল আমার মটরসাইকেলটাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে। এই বিল্ডিং-এর গ্যারাজে মটরসাইকেলটা রাখার জন্য ভাড়া দিয়ে এসেছি গত আটটা মাস। ছোট গেইটটার লক খুলে ফেলি গলায় লকেটের মত ঝোলানো চাবিটা দিয়ে। ওদিকে মুখখিস্তি করতে করতে নেমে আসছে ওপরের ওরা। ওরা দোতলায় প্রায় – আমি স্টার্ট দেই ইঞ্জিন। নিস্ফল দুই মূর্তিকে পেছনে রেখে বাতাসের গতিতে বেড়িয়ে যাই হতচ্ছাড়া গ্যারাজটা থেকে। তবে এতেই বিপদ কেটে গেছে – এমনটা না। আমার বিল্ডিং-এর সামনের জীপটা স্টার্ট নেয় পরিস্থিতি বুঝে। বিপরীত দিকটা বেছে নিই আমি। ঝড়ের বেগে বাইক ছুটিয়েও পেছনে ফেলা যায় না ওদের। মোড়ের পর মোড় বাঁক নিচ্ছি – পেছনে রূপকথার দৈত্যের মত লেগে আছে জীপটা। মনে হচ্ছে আমার মৃত্যুর সাথে সাথে জাতীয় ছুটি ঘোষনা দেওয়া হবে। যেরকম ঘটা করে এগিয়ে আসছে ওরা! গন্তব্য পাল্টালাম। আর তিনটে বাঁক নিয়েই হঠাৎই ঢুকে পড়ি দুই বিল্ডিং-এর ফাঁক দিয়ে। দুপাশে মাত্র চারফিট জায়গা। জীপ ঢোকার কোনই উপায় নেই এখানে। অর্ধেকে পৌঁছে গেছি – এসময় জীপটাও গ্যাপটায় এসে থামে। আর মাত্র কয়েকফিট বাকি – তাড়া খাওয়ার পর এই প্রথম প্রার্থনা করলাম যাতে বেড়িয়ে যেতে পারি। পেছন থেকে সাইলেন্সারের বালাই না করে কড় কড় শব্দে গর্জে ওঠে একটা সাব-মেশিনগান। প্রথমে মটরসাইকেলের বাম দিকের আয়নাটা চুরমার হয়ে যায়। পরের সেকেন্ডেই গ্যাপটা থেকে বেরিয়ে আসে বাইক – সেই সাথে বাম কাঁধের নিচে ধাক্কা অনুভব করতেই কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছিলাম । শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়ে ছুটে যাই রাতের আঁধারে। * মিরপুরের এক ফার্মেসীতে এসে থামলাম একঘন্টা পর। বাইক থেকে পা মাটিতে নামিয়েছি, ভারসাম্য হারালাম। দাঁড়ানোর মত অবস্থা নেই। অত্যাধিক রক্তক্ষরণ কাবু করে ফেলেছে। আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বিনা বাক্যব্যায়ে ভেতরের চেম্বারে ঢুকিয়ে ফেলল মিনহাজ। বর্তমান পৃথিবীতে কেবলমাত্র এই ছেলেটাই আমাকে বাল্যকাল থেকে চেনে। নিজেও মাঝে ঢুকে গেছিল ড্রাগসের ব্যাবসায়। এখন মোটামুটি ছেড়ে দিয়েছে সব। ‘দোস্ত ওরা -’ বলতে যাচ্ছিলাম। ইশারায় আমাকে থামিয়ে দেয় ও। শার্ট খুলে ক্ষতটা পরীক্ষা করে চিমটা নিয়ে কাজে নেমে পড়ে। পাশের ট্রে-তে ঠং করে একটা বুলেট ফেলে ব্যান্ডেজ বাঁধা শুরু করল মিনহাজ। খানিকবাদে টের পেলাম, বুকের চারপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে ব্যান্ডেজটা যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। ‘তুই লাকি।’ অবশেষে মুখ খোলে স্বল্পভাষী মানুষটা। ‘বুলেট সরাসরি হাড়ে লাগেনি, পেশীর বারোটা বাজালেও ভাঙা হাড় সামলাতে হয়তো হবে না। এক্স-রে করা দরকার, তবে মনে হয় আপাতত সে চিন্তা না করাই ভালো হবে। কী বলিস?’ ‘আমাকে যেতে হবে।’ উঠে পড়ি। পকেট থেকে এই প্রথম বের করার সুযোগ পেলাম জিপিএস রিসিভারটা। ‘আগামী সাতদিন নড়াচড়া করবি না।’ ভ্রু কুঁচকে বলে মিনহাজ, ‘কতগুলো রক্ত গেছে সে ব্যাপারে ধারণা আমার থেকে তোর বেশি থাকার কথা।’ রিসিভারের স্ক্রীণে কোন ব্লিপ নেই। থাবা দেই যন্ত্রটাকে। ‘কাম অন!’ ‘কি হয়েছে?’ মিনহাজ কৌতুহলী হলেও মুখে ছাপ পড়ে না। ‘ঈশিতাকে নিয়ে গেছে ওরা।’ কোন ব্লিপ দেখি না এবারও। ‘ড্যাম ইট!’ হতাশ হয়ে একপাশে নামিয়ে রাখি রিসিভারটা। মিনহাজের মুখে বরাবরের মতই কোন ভাব পড়ে না। তবে আমি ওকে চিনি। জানি, ভেতরে ভেতরে এখন ও প্রস্তুত আমার যেকোন সাহায্যে নেমে পড়ার জন্য। ‘ঈশিতার গতবারের দুর্ঘটনার পর থেকে সতর্ক হয়ে গেছি আমি।’ ব্যাখ্যা দিলাম ওকে, ‘ওর সবগুলো জুতোয় জিপিএস ট্রান্সমিটার থাকে। রেঞ্জ নয় কিলোমিটার।’ যে ধরনের স্পাই ট্র্যাকের কথা বলছি তাদের ইন্টারনেটে সংযোগ দেয়ার ব্যবস্থা থাকে না। তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা। ‘এতটুকু সাইজে? হেভী কোয়ালিটি।’ মাথা দোলায় মিনহাজ। ‘কিন্তু কোন সিগন্যাল পাচ্ছিস না?’ ‘নট আ সিঙ্গেল ব্লিপ।’ ‘তুই তোদের বাড়িতে চলে যা। আমাকে দেখতে দে।’ হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা চায় মিনহাজ। ‘জুতোয় ট্রান্সমিটার বসিয়েছিস যে – ঈশিতা জানত?’ ‘না। ঢাকার বাইরে নিয়ে গেছে ওকে ওরা।’ বিহ্বল দৃষ্টি মেলে দেই আমি। ‘সেটা আমি দেখছি।’ একরকম জোর করেই রিসিভারটা নিয়ে নেয় মিনহাজ, ‘গোটা ঢাকায় একটা চক্কর দিয়ে দেখব কোথাও সিগনাল পায় কি না। তুই এই ফাঁকে বিশ্রাম নে একটু।’ টলতে টলতে বেরিয়ে আসি আমি মিনহাজের সাথে। ফার্মেসী বন্ধ করে নিজের বাইকটা স্টার্ট দিয়ে মোড়ের শেষপ্রান্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমিও বাইকে উঠি। * আস্তে করে চাবিটা ঘুরাতেই ঠং করে খুলে ওঠে মরচে পড়া তালাটা। গত চৌদ্দ বছরে দ্বিতীয়বারের মত পৈতৃক বাড়িটায় পা রাখলাম । যেখানে কেটেছে আমার শৈশবের শুরুটা। ৩ হতচ্ছাড়া একটা টিনশেড বাসা। সামনে লম্বা একটা উঠান। বিষন্ন চোখে তাকিয়ে থাকি সেদিকে। বাইকটা পাশেই পার্ক করে রেখেছি। বাবাকে আবছা মনে পড়ে। তবে মানুষটার ব্যাপারে কেন জানি স্মৃতি হাতড়ে তেমন কিছু পাই না। আবছা এক স্মৃতি। বাবাটা ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির। এতটুকু ঠিকই মনে পড়ে। পূর্বদিকের ঘরটায় চোখ পড়তে এতবছর পরেও মেরুদন্ডের কাছটা শিরশির করে ওঠে আমার। চৌদ্দ বছর আগে দশ বছরের আমি ঘুমাচ্ছিলাম পাঁচ বছরের ঈশিতাকে পাশে নিয়ে। সেইদিনই জীবনে প্রথম গুলির শব্দ শুনি আমি। মায়ের ছোট্ট একটা আর্তচিৎকার। আড়াল থেকে উঁকি দিয়েছিলাম। চারজন লোকের মাকে ঘিরে থাকা আর তাদের হাতের আগ্নেয়াস্ত্রের বার বার গর্জন – আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। শরীরের প্রতিটি রক্তকণা চাইছিল ছুটে গিয়ে মাকে ধরতে। কিন্তু তা না করে ঈশিতাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলি আমি। জানালা খুলে জীবন বাজি ধরে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর হাত ধরে। আমার মায়ের মৃত্যুটা রহস্যই থেকে যায়। * নিজের বাড়িতে ফেরা হয় না আর ছেলেটার। ভীতি দূরে সরিয়ে রাখে ওকে। একমাত্র বন্ধু ছিল মিনহাজ। তবে ছোট্টোটি তখন সে-ও। মাঝে মাঝে গিয়ে খবর নেয়া ছাড়া আর কোন উপকারে আসেনি। সেই ভয়ঙ্কর সময়ে টানা দু’দিন শিশুদুটো রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। খেয়েছে চেয়েচিন্তে। অবশেষে ছেলেটা মিনহাজের সাথে লুকিয়ে দেখা করে। জানতে চায় বাসার খবর। ‘তোর মায়ের চেহারা চেনা যায় নাই। গুলি মাইরা একেবারে ছাতু কইরা দিছে।’ মিনহাজের কথায় গোটা দুনিয়ার ওপর ক্রোধের একটা আগুন অনুভব করে দশ বছরের ছেলেটা। সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারলে হয়তো একটু শান্তি পাওয়া যেত! ‘তোর বাবারেও খুঁজে পাওয়া যায় নাই কোথাও। বাবা বলছে পুলিশেও তব্দা খাইছে। এমুন ঘটনা এই শহরে আগে কোনদিন হয় নাই। কী থেইকা কী হইয়া গ্যালো কেউ কইবার পারে না।’ মাথা নাড়তে নাড়তে সরে এসেছিল সেদিন ছেলেটা। প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল পৃথিবীর ওপর এর প্রতিশোধ তুলে নেবে। পরের তিনটি বছর কঠিন সংগ্রামে জীবন যায় শিশুদুটোর। সমাজের অন্ধকার দিকগুলো ঘোরা হয়ে গেছে ততদিনে ছেলেটার। অপরাধের জগতে পা রাখার পর এই প্রথম খেয়েপরে কিছু টাকা জমাতেও পারছে। বোনটাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয় ছেলেটা। তীব্র অভাবে দিন পার হলেও – বোনকে অনেক বড় বানাবে – এই স্বপ্ন সবসময় দেখেছিল। বস্তিতে থাকত ওরা। নিজের আস্ত একটা বাড়ি পড়ে আছে মিরপুরে – তবে সেদিকে আর পা বাড়ায়নি ভাইটা। ওখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। ‘ওস্তাদের’ সাথে ছিঁচকে ডাকাতিতেই বেশি উপার্জন হত ওদের। পিচ্চি ছেলেটা ওই বয়েসেই একটা বাসায় খুঁত বের করতে পারত নিখুঁতভাবে। যে কোন বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে সদর দরজা খুলে দেয়া তার জন্য হয়ে উঠলো হাতের মোয়া। এদিক বিবেচনায় ছেলেটা ছিল ভূতের মত। নিজেকে লুকিয়ে ফেলার একটার পর একটা অসামান্য কৌশল আবিষ্কার করতে থাকে সেই তের বছর বয়েসে। যেকোন বাসার নিরাপত্তা ব্যাবস্থার খুঁত ধরে ভেতরে চলে যাওয়ার দক্ষতা ছিল যে কারও চেয়ে বেশি। কারও অধীনে থেকে নয়, নিজের ব্যাবসার ক্ষেত্র নিজেই বানিয়ে ফেলতে চায় ছেলেটা। নিজের শৈশব পার করা এলাকায় কেবল মিনহাজের সাথে যোগাযোগ থাকে ওর। সেই সাথে নিজেও এক অখ্যাত স্কুলে ভর্তি হয়। এক বছর পানিতে ভেসে গেলেও অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এগার বছর তখন ঈশিতার। দিন দিন আরও সুন্দর হচ্ছে ও। এই প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো মেয়েটা। সেই সাথে কথাবার্তায় বড়লোকের মেয়েদের মতো চৌকস ও বাগ্মী। কে বলবে একটা বস্তিতে বড় হয়েছে সে? ছেলেটা খেয়াল করে বোনের দিকে ওস্তাদের দৃষ্টিটা আগের মতো নেই, দিন দিন পালটে যাচ্ছে। একদিন ওস্তাদকে বোনের শরীরে হাত দিতে দেখে ফেলে ও। মাত্রই রান্না বান্না সেরে ঘরের দিকে যাচ্ছিল ‘রাজুর মা’। বস্তি বাসা – সবাই একসাথে এভাবেই থাকে। বিদ্যুৎবেগে নড়ে উঠেছিল কিশোর। তার হাত থেকে বটিটা কেড়ে নিয়ে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দিয়েছিল দীক্ষাগুরুর। ওস্তাদের কোমর থেকে পিস্তলটা খুলে নিয়ে আবারও বোনের হাত ধরে ছুটে পালানো। এর মাঝেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। ছেলেটা ‘রাজাদের মাঝে গরীব’ অথবা ‘গরীবদের মাঝে রাজা’ হতে চায় না। ও চায় ‘রাজাদের রাজা’ হতে। সতের বছর বয়েসে লাভজনক ছিঁচকে ব্যবসাগুলোর দিকে চোখ না দিয়ে নিজের স্কিলগুলোর দিকে লক্ষ্য করে ও। নিজের দক্ষতা যে পেশায় কাজ দেবে সেদিকে গেলেই ওকে ঠেকাতে পারবে না কেউ – বোঝে ও ভালো মতই। এতদিনের অর্জিত স্কিলগুলো সবগুলো যথার্থভাবে ফিট করে একটা পেশায় – কিডন্যাপিং। পাঁচ বছরের একটা ছেলেকে ধানমন্ডি থেকে উধাও করে দিয়ে আগেরদিন চুরি করা মোবাইলটা কানে ঠেকিয়ে ফোন দেয় ছেলেটার বাবাকে, ‘হ্যালো মি. গোলাম মোস্তফা। আমি ইরফান বলছি।’ ‘ইরফান’ নামটা ও প্রতি কিডন্যাপিংয়েই ছড়িয়ে দেয় যতটা পারে। ডিমান্ড বেড়ে যেতে থাকে ওর। বিভিন্ন স্তরের ক্লায়েন্ট খুঁজে বেড়ায় ‘ইরফান’কে। ঢাকার সবচেয়ে দক্ষ কিডন্যাপার বলা হয় ওকে। বোনকে আস্তে করে নিজের কালো জীবন থেকে সরিয়ে দেয় ইরফান। টাকার সমস্যা ওদের আর ছিল না। বোর্ডিং স্কুলে তাকে পড়ানোর সঙ্গতি তার হয়েছে। এদিকে নিজের আসল নাম জনমন থেকে বিস্মৃত হয়েছে আগেই। বিশেষ দক্ষতার কারণে লোকে ওকে ডাকতে শুরু করে ‘ফ্যান্টম ইরফান’। টাকার অভাব হয়নি ওদের আর। ভুলেও ফেরেনি ইরফান তার বাবার বাড়িতে। এতগুলো বছর গেলেও রহস্যময় খুনটাকে কেন্দ্র করে পোড়োবাড়ি আখ্যায়িত হয়ে যাওয়ায় এই বাড়িটাও কেউ দখল নিতে চেষ্টা করেনি। আটমাস আগে এর ব্যত্যয় ঘটে। প্রথমবারের মত নিজের বাসায় ফিরে আসে ইরফান। * মা-বাবার ঘর ছিল এটা। ইটের টুকরোগুলো সরিয়ে বিশাল বাক্সটার ঢাকনাটা বের করলাম। আটমাস আগে অপরাধের পথ ছেড়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে সব ইকুয়েপমেন্ট এনে রাতের আঁধারে এখানেই লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি। এর থেকে সঠিক জায়গা আছে বলে আমার মনে হয়নি। প্রয়োজনীয় ইকুয়েপমেন্টগুলো বের করে সদ্য বাক্স থেকে বের করা স্পেশাল ব্যাকপ্যাকে ভরে রাখি। সবশেষে গ্লক২৩ টা একহাতে নিয়ে আরেকহাতে গান ক্লিনিং কিটটা সহ উঠানটায় এসে বসি। অস্ত্রটাকে আবারও ব্যাবহার উপযোগী করে তুলতে হবে। যেকোন সময় মিনহাজের ফোন আশা করছি। বিশাল উঠোনটায় বসে পিস্তলটার প্রতিটা পার্ট খুলতে থাকি আমি। গান অয়েলে চুবানি দিতে হবে এগুলোকে। আর দশটা পরিবারের মত আমাদের জীবনটা হলে এখানে চৌদ্দ বছরে হয়ত বহুতল ভবন উঠতে পারত – ভাবি আমি! ৪ ফোনটা বেজে উঠতেই খামচে ধরি ওটা। ‘হ্যালো!’ ‘দোস্ত, সিগন্যাল পেয়েছি।’ মিনহাজের গলাটা অতটা আশাবাদী বলে মনে হয় না। ‘লোকেশনটা জানা।’ ব্যাস্ত গলায় বলে উঠি আমি। ‘তুই নাঈমের স্পটে চলে আয়।’ ফোন কেটে দেয় মিনহাজ। অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকি। নাঈমের ওখান থেকেই অস্ত্রের সাপ্লাই পেতাম আমি। জায়গাটা এখান থেকে খুব একটা দূরেও না। মিনহাজ কি বলতে চাইছে ওই জায়গার আশেপাশেই ও সিগন্যাল পেয়েছে? ডান কাঁধে ব্যাকপ্যাকটা চাপাই। বাম কাঁধ আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে কিছুই করার নেই। পেইনকিলারের বালতি তুলে এনেছি মিনহাজের দোকান থেকে, নয়তো স্রেফ আড়ষ্ট নয়, প্রতিটা পেশীর নড়ে ওঠার সাথে আমার অবর্ণনীয় যন্ত্রণা অনুভব করার কথা। গুলি খাওয়া কোন সুখের ব্যাপার নয়। বিশমিনিটের মাঝেই পৌঁছে গেলাম নাঈমের ওখানে। আমাকে নিয়ে নাঈমের বাসায় ঢুকে পড়লো মিনহাজ। ঢাকায় সবচেয়ে বড় প্রাইভেট অস্ত্র ব্যবসায়ী আমাদের নাঈম। ডুপ্লেক্স বাড়িটার নিচে বেজমেন্টে ঢুকলে ওর অস্ত্রের কালেকশন দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। ‘এখানে কেন দোস্ত?’ ফিস ফিস করি আমি। বেজমেন্টে নেমে প্রাইভেসী দিতে দূরে সরে গেছে নাঈম। ‘তুই যেখানে ঢুকতে চাস – একটা হ্যান্ডগান নিয়ে ঢোকার কথা তুই ভাববি না।’ ‘ঈশিতা কোথায়?’ গলা কিছুটা কাঁপে এবার আমার। ‘রাবেকের নাম শুনেছিস?’ মিনহাজের কথায় স্থির হয়ে যাই আমি। রাবেক। দ্য ওয়ান অ্যান্ড ওয়ানলি গডফাদার অফ ঢাকা। একটা মিথ। একজন লিজেন্ড। তবে মজার ব্যাপার হল কেউ জানে না আসলেই রাবেক বলে কেউ আছে কি না। ‘ঢাকায় মাফিয়া নেই।’ মাথা নাড়াই আমি। ‘শুধুই গালগল্প। যা ছিল আগেই সেনাবাহিনীর সাথে লড়তে গিয়ে সব বেঘোরে মারা পড়েছে।’ ‘তুই কতটুকু জানিস?’ ভ্রু কুঁচকে বলে মিনহাজ। ‘শোনা কথা সবই মিথ্যা হয় না। শপিং কমপ্লেক্সের প্রতিটা মালিক জানে এই ঢাকাতেও তাদের লাভের নির্দিষ্ট একটা শতাংশ জমা দিতে হবে। খোঁজ নিলেই জানতে পারবি। কয়েকদিন আগে মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের মালিক অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে নিহত হল। কেন?’ জবাব দিতে পারি না আমি। আজকাল মাফিয়া মানেই সরকারী লোকের চাঁদা তোলা, ওসব থেকেই ধুম-ফটাক হওয়া এক জিনিস আর সত্যিকারের মাফিয়া আরেক জিনিস। এদিকে আমার নীরবতার সুযোগে বলে চলে মিনহাজ। ‘যে লোকেশনটা আজ আমি রিসিভারে পেয়েছি – ওদিকেই কোথাও রাবেকের হেডকোয়ার্টার বলে আন্ডারওয়ার্ল্ডে গুজব ছিল। তাছাড়া তোর ওপর যেভাবে হামলা হয়েছে; তোকে যেভাবে খুঁজে পেয়েছে সব ট্রেস লুকিয়ে তুই ডুব দেওয়ার পরও – যে কেউ নয়, তুই! রাবেকের কাজ হতেই পারে।’ ‘রাবেক একটা গুজব। এর বেশি কিছু না।’ তবুও মাথা নাড়াই আমি। ‘তাহলে ব্যাখ্যা দে, তুই তোর সমস্ত ট্রেস মুছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছিলি। এরপরেও আজকে শুধু তোকে খুঁজে বের করেছে তাই না, তোর বাসা পর্যন্ত খুঁজে বের করেছে। তুই তো আর যে কেউ নোস। আন্ডারওয়ার্ল্ড যখন ছিল তখন তোকে তারা ফ্যান্টম নাম দিয়েছিল। ঢাকায় তোর মতো লুকাতে পারে আর কে আমি জানি না। কিভাবে সম্ভব যে তোকে এভাবে টেক্কা দিল? ব্যক্তিগত শত্রু? না, তাহলে আমার কানে আসতো। মাফিয়া-নেটওয়ার্ক থাকলেই কেবল সম্ভব। কেন তোকে ফলো করা মানুষটা সুইসাইড করল? কার ভয়ে? এরকম ভীতির প্রকাশ মাফিয়া ছাড়া হয় না। এলাকার কোন মাস্তানের জন্য লোকে এমন করবে? কোন মন্ত্রীর জন্য? একটা নাম দেখা?’ ‘মানে,’ ওর যুক্তি ঠিক ধরে নিয়ে বলি আমি, ‘তুই বলতে চাইছিস – রাবেক দ্যা গডফাদার আমাকে দিয়ে কিছু একটা করাতে চাচ্ছে? সেজন্যই একমাত্র জীবিত আত্মীয়কে ধরে নিয়ে গেছে?’ ‘সারাদিনের ঘটনাপ্রবাহের একমাত্র লজিক্যাল এক্সপ্লেনেইশন।’ ‘আমার দিকে গুলি ছুঁড়েছিল ওরা।’ মানলাম না ওর কথা। ‘এমন কোন ক্ষতি করেনি যাতে তোকে হাসপাতালে ঢুকে যেতে হবে। ইচ্ছে করেই মিস করতে পারে।’ পালটা যুক্তি দেয় মিনহাজ। একমুহূর্ত ওর দিকে তাকালাম। তারপর হাত বাড়ালাম সাবমেশিনগানগুলোর দিকে। ওপেন বোল্ট সেমি-অটো ইন্টারডায়নামিক কেজি-নাইনটাই পছন্দ হল। ‘নাঈম!’ হাঁক ছাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্র ব্যাবসায়ীর দিকে। ‘আমার গ্লক২৩ এর ম্যাগ লাগবে কয়েকটা। পয়েন্ট ফর্ট স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন।’ * বাসাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কালো পোশাকে আমি আর মিনহাজ শুয়ে আছি আধমাইল দূরের কন্সট্রাকশন সাইটের ক্রেনের ওপর। আমার হাতে বাইনোকুলারস। ‘হোয়াটস দ্য প্ল্যান? কি করতে যাচ্ছিস?’ পাশ থেকে জানতে চায় মিনহাজ। ওকে অনেক চেষ্টা করেও খসাতে পারিনি। আসলই আমার সাথে। ‘ওয়ান থিং আ’ম বেস্ট অ্যাট।’ বিড় বিড় করে বলি আমি। ‘কিডন্যাপ।’ বিল্ডিংটা চারতলা। চারপাশে আর কোন বিল্ডিং নেই। একেবারে শহরের শেষ প্রান্ত। এখনও এদিকে দোকানপাট থেকে শুরু করে কোন নাগরিক সুবিধেই তেমন আসেনি। কাজেই অন্যান্য জমির মালিকেরা এখানে বাড়ি বানানোর চিন্তা করেনি এখনও। ‘এটা কিডন্যাপিং সিচুয়েশন না। রেসকিউং সিচুয়েশন।’ অবাক মিনহাজ বলে। ‘কখনও কখনও দুটো একই জিনিস।’ বলি আমি। জনমানুষ একেবারেই নেই তা না। ছাতে একজনকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে হেডকোয়ার্টার পাহড়া দিচ্ছে। রাবেকের অস্তিত্বে কিছুটা বিশ্বাস করতেই হল। ‘এত ভণিতা না করে খুলে বল!’ অধৈর্য্য হয়ে বলে মিনহাজ। ‘কাজের ধারা তো একই। ভেতর থেকে আমার কিডন্যাপ করতে হবে ঈশিতাকে। সে অনুযায়ী প্ল্যান দরকার।’ ‘সেটাই এতক্ষণ বলছিলাম। প্ল্যান ঠিক কর একটা। তারপর অ্যাকশন।’ ‘ঠিক করে ফেলেছি।’ নামার প্রস্তুতি নেই আমি। ধীরে ধীরে মাটিতে নামি আমি। ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নেই। ‘ওরা আমার আসার অপেক্ষায় আছে।’ মুখ খুলি এবার আমি। ‘আমার প্রোফাইল জানা আছে ওদের। কাজেই ওরা একদম প্রস্তুত। কাজেই হামলা চালানোটা কিছুটা ঝামেলার হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ওদের সুবিধেটাকেই ওদের উইকনেস বানিয়ে কাজ করতে চাইছি আমি।’ ‘আমি কি করব?’ মিনহাজ আস্তে করে কোমর থেকে ওর ম্যাকারভ পিএমফাইভটা বের করে। ছেলেটা এত থাকতে রাশিয়ান জিনিসের দিকে ঝোঁকে কেন সেটাই ভেবে পাই না আমি। ‘সোজা বাড়ি ফিরে যা।’ ওর পিঠে চাপড় দিলাম। ‘এটা তোর লড়াই নয়।’ ‘সেই ন্যাদা ছিলি তখন থেকে তোদের চিনি।’ মুখ ঝামটা মারে মিনহাজ, ‘ঈশিতা আমারও বোন না – এরকম কিছু একটা বলেই দ্যাখ!’ মুখটা দেখলাম। সংকল্প ঝিকমিক করছে। তাকে ফেরানোর সাধ্য আজ রাতে আমার হবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একটা। ‘তাহলে ঠিক যেভাবে বলব সেভাবেই কাজ করবি – ওকে?’ প্ল্যানটা আরেকটু উন্নত করে সাজাই আমি। ‘ফিরে আসার কথা ভাববি না।’ * মিনিট দশেক পর – বাসাটার সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে যায় ওয়াল্টনের একটা ঝরঝরে মটরসাইকেল। পার হওয়ার সময় ধাঁই ধাঁই করে গুলি ছোঁড়ে বিভিন্ন তলার জানালার কাঁচে। সাথে সাথে নির্ঘুম বাড়িটা যেন জেগে ওঠে। সামনের প্রতিটা জানালা থেকে নিদেনপক্ষে একজন মানুষ রাইফেল এবং সাবমেশিনগান নিয়ে প্রতিউত্তর দেয়। মুচকি হাসলাম, মিনহাজের মাফিয়া তত্ত্ব বিশ্বাস করতে শুরু করেছি অবশেষে। অস্ত্রের যে ঝনঝনানি দেখা গেল, খুব সম্ভব! সবার মনোযোগ সামনে সরে গেছে – এই ফাঁকে পেছনের পাইপ বেয়ে উঠতে শুরু করি আমি। ব্যাকপ্যাক নিয়ে উঠতে গিয়ে জান বের হয়ে যাচ্ছে বাম হাতের কাঁধের নীচের ক্ষতে। পেইনকিলার তো আর আজীবন ব্যথা ভুলিয়ে রাখবে না। ওখানে আবারও রক্তপাত শুরু হয়ে গেছে – নিঃসন্দেহে। ছাদ থেকে ভেতরে ঢোকা যাবে। গোলাগুলির শব্দ একেবারে চুপচাপ এখন। নিরাপদে মিনহাজ বেরিয়ে গেছে – এটা একটা স্বস্তি। বেড়ালের মত নিঃশব্দে হাতের তালুতে ভর দিয়ে রেইলিং টপকালাম। পরমুহূর্তেই হাতে উঠে এসেছে বিশ্বস্ত গ্লক২৩। সাইলেন্সারের সুবিধে নিয়ে যতদূর পারি যেতে হবে। আমার আসার কথা বুঝে ফেললে ঈশিতার ক্ষতি করার হুমকি দিতে পারে, তখন নিষ্ক্রিয় হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না আমার। সেক্ষেত্রে দু’জনই মরবো। ছাদে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ভাগ্যিস ওদিকেই তাকিয়ে ছিল – যেপথে এই মাত্র মিনহাজ গায়েব হয়ে গেছে। নিষ্কম্প হাতে লোকটার পেছন থেকে গুলি করলাম। কপাল ভেদ করে মগজের সাথে সাথে প্রাণবায়ুও বেরিয়ে গেছে ছোকড়ার। এখন ‘ফেয়ার অ্যান্ড স্কয়ার’ – টাইপ ফ্রেইস মুখস্থ করার সময় না। সর্বাগ্রে পরিবার। খটাস করে রাইফেলটা সহ পড়ে যেতেই মরাটার হাত থেকে গর্জে উঠল রাইফেল। অনবরত হাতুড়ির বাড়ি মারার মত শব্দটা ম্যাগাজিন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত হতে থাকে! নির্ঘাত গাধাটা ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে রেখেছিল! মিনহাজের তাণ্ডবের কারণে সেফটি অফ ছিল নির্ঘাত! ট্রিগারে আঙুলের চাপ পড়তেই কাজ হয়ে গেছে! ছাদে গোলাগুলির শব্দ শুরু হওয়ামাত্র নিচের ওদের আর নতুন নির্দেশ দেওয়া লাগলো না। ক্রুদ্ধ হুংকারের সাথে অনেকজন মানুষের ওপরে উঠে আসার শন্দ শুনতে পেলাম। ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে! দ্রুত সিঁড়িঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম বাইরে থেকে। গেল আমার ‘সারপ্রাইজিং এলিমেন্ট’! যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন এভাবেই আগাতে হবে। আমি সুপারহিরো না। কাজেই একসাথে এতজনের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। ছাদের দরজায় লাথির পর লাথি পড়ছে। উনিশশ’ কটকটি সালের দরজা বেশিক্ষণ টিকবে না বুঝলাম। ব্যাকপ্যাক থেকে লম্বা দড়িটা বের করতে হল। দ্রুত অ্যান্টেনার জন্য রাখা রডটায় বেঁধে কোমরে আটকে রাখা গ্রেনেড তিনটার একটা ছুঁড়ে মারলাম ছাদের দরজার দিকে। একই সাথে দড়ির আরেকমাথা ধরে পড়ে যাচ্ছি ছাদ থেকে বিশেষ একটা ভঙ্গিমায়। এক সেকেন্ড পর একই সাথে অনেক কিছু ঘটে যায়। রাবেকের বীরপুরুষদের লাথিতে ছুটে যায় দরজা। প্রায় সাথে সাথেই ফেটে যায় গ্রেনেডটা – প্রায় একই সাথে চারতলার জানালার গ্লাস ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ি আমি। এই ঘরে কাওকে দেখলাম না। সব বীরপুঙ্গব নিঃসন্দেহে ছাদের দিকে দৌড়েছে! ছুটে ঘরটা থেকে বের হতেই যন্ত্রণাকাতর শব্দে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল রাবেকের একজন সৈনিক। এর বুকের কাছে এক খাবলা গোস্ত বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। এই অবস্থাতেও পিস্তলটা আমার দিকে তাক করার প্রচেষ্টায় আছে। এক গুলিতে ওর খায়েশটা মিটিয়ে দিলাম। ছাদের কাছে এসে পড়ে থাকা দেহগুলোর ওপর কেজি-9 দিয়ে একপশলা গুলি ছুঁড়তেই সবার নড়া চড়া থেমে গেল। ম্যাগাজিন পালটে আবার নামা শুরু করি আমি। একছুটে চারতলার প্রতিটা ঘর পরীক্ষা করে আসি – কোথাও নেই ঈশিতা। নিচে নামতে হবে আমাকে। ৫ চারতলা পরীক্ষা করে সিঁড়িঘরে ফিরে আসতেই অতিউৎসাহী তিনজনকে দেখা গেল সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে। ‘ওপরটা-এত-চুপচাপ-কেন’ টাইপ একটা অভিব্যাক্তি সবার চোখে মুখে। ওদের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করি আমি। কেজি-নাইনের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম আরেকপশলা গুলির মাধ্যমে। পিছলে নিচে নেমে যায় লাশ তিনটে। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই লম্বা করিডোরে পড়লাম। ওপাশে সাতজন এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। একসাথে গর্জে ওঠে ওদের হাতের অস্ত্রগুলো। সিঁড়ি থেকে পা সরিয়েই নেহায়েত রিফ্লেক্সের বশে গেছি ছোট পিলারটার আড়ালে, নইলে আর দেখতে হত না। প্রাণের সুখ মিটিয়ে গুলি করে পিলার ওড়ায় ওই ওরা। এই সুযোগে আস্তে করে তাদের দিকে ঠেলে দেই একটা বিদায় উপহার। বাম কাঁধ তখন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে যেন আমার! এদেরই কারো সন্ধ্যাবেলার উপহার! চোখের সামনে পিছলে আসা গ্রেনেডটাকে দেখে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ছোটাছোটি শুরু করল ওরা। এতটুকু শুনেই কানে আঙ্গুল চাপা দিলাম। বদ্ধ জায়গায় প্রচুত শব্দ করে ফাটল গ্রেনেডটা। এক ঝটকায় বেড়িয়ে এলাম এবার, তবে কোন গুলি ছুঁড়তে হলো না। নিথর দেহগুলোকে দেখে মুখে হাসি ফোটে আমার। তিনতলার প্রতিটি ঘর খুঁজে দেখতে বেরিয়ে যায় আরও কয়েকটি মুহূর্ত। এখানেও নেই ঈশিতা। দোতলায় আরেক দফা বাঁধার সম্মুখীন হব ভেবেছিলাম। কিন্তু কাওকে দেখি না আমি। প্রতিটা ঘর পরীক্ষা করার সময় জানতাম নেই ঈশিতা এখানেও। ছুটে নেমে আসি নীচতলায়। জিপিএস রিসিভারে দেখেছি এখনও আমি ব্লিপের ওপরেই আছি। নীচতলার ঘরগুলো খুঁজেও কাওকে দেখলাম না। তাজ্জব ব্যাপার! যেন সবাই বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে! অথচ আমার রিসিভার বলছে এই বিল্ডিংয়েই ঈশিতা আছে। এর মানে একটাই – মাটির নিচে ঘর আছে আরও। কিন্তু নামার উপায় দেখলাম না। তন্নতন্ন করে খুঁজে অবশেষে রান্নাঘরে পাওয়া গেল ওটা। আস্তে করে ট্র্যাপডোরটা কয়েক ইঞ্চি তুলেছি, নীচ থেকে ছিটকে আসল একটা গ্রেনেড। ডোরটা ফেলে প্রাণপনে দরজার দিকে ছুট লাগালাম। তিন সেকেন্ডের টাইমার শেষ হওয়ার আগে কোন মতে কাভার নিতে পারলাম, ওদিকে রান্নাঘরের বাসনপত্র পুরো ঘর জুড়ে ছোটাছোটি করছে তখন বদ্ধ জায়গায় ফাটা গ্রেনেড বিস্ফোরণের তীব্রতায়। ট্র্যাপডোরটাও ধ্বসে গেছে। ভেতরের কথাবার্তা এখানে চলে আসছে খোলা ফোকড় বেয়ে। নীচের আলোচনা শুনে মনে হল ওপরে গিয়ে দেখার জন্য একজন আরেকজনকে ঠেলাঠেলি করছে, কিন্তু কেউই আসতে চাইছে না। কান পেতে শুনি আমি। চোখ ট্র্যাপডোরের দিকে। গ্লক থেকে ম্যাগাজিনটা বের করে আস্তে করে নতুন একটা ঢুকালাম শান্তভঙ্গিতে। নীচে কেউ একজন তীব্র গলায় প্রতিবাদ জানালো, ‘এত সাহস থাকলে আপনি গিয়ে দেখে আসেন!’ আচমকা নীচে একটা গুলির শব্দ। একটা দেহের পতন। আপত্তি করছিল যে সৈনিক তাকে উপযুক্ত শিক্ষাই দেয়া হল। ভরাট একটা বয়স্ক কন্ঠ স্পষ্টস্বরে বলে, ‘আর কেউ আছে নাকি?’ রাবেক! কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ চারপাশ। তারপর কেউ একজন উঠতে শুরু করে ওপরে। কপালটা দেখা যেতেই জায়গামত গুলি পাঠিয়ে দেই। হুড়মুড় করে নিচে পরে মৃতদেহটা। ‘বোমবাস্টিং’ খেলায় এবার আমার টার্ন। কোমর থেকে গ্রেনেডটা খুলে ট্র্যাপডোরের ফোকড় দিয়ে নীচে ভরে দিলাম। বিকট শব্দে ভেতরে ফাটে গ্রেনেডটা – ওটা ফাটার শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ি গর্ত বরাবর! ভেতরে বেশি বড় না জায়গাটা – ছোট্ট একটা করিডোরমত। সেখানে পড়ে আছে চারজনের মৃতদেহ। বয়েসে প্রত্যেকে তরুণ। এদের মাঝে রাবেক নেই। করিডোরের শেষ মাথায় একটি মাত্র দরজা। আস্তে করে দরজার নব খুলে উদ্যত পিস্তল হাতে ঢুকে পড়ি আমি। উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে ঈশিতা। আমাকে দেখে খুশির বদলে রীতিমত চমকে ওঠে ও। তার সামনে শটগান হাতে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তার মুখ বরাবর পিস্তল ধরেছি আমি, অথচ হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল আমার। এই কাঁপন শারীরিক কারণে নয়! ‘ইম্প্রেসিভ, রবিন!’ বলে ওঠে রাবেক। ‘বাবা?’ অস্ফূট কন্ঠে বলে উঠি আমি। সামনে মানুষটা আর কেউ নয়। আমার বাবা রাফসান বেগ কবীর। ৬ বিস্ময়ের ধাক্কাটা কাটানোর আগেই ঈশিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবার ওপর। এতখানি ডিসট্র্যাকশনই আমার দরকার ছিল। ‘ইউ লায়ার!’ বাজপাখির মতো চিৎকার করে উঠলো ঈশিতা। তার ধাক্কায় নড়ে যায় শটগানের নলের মুখ। এক লাথিতে সেটাকে ওর হাত থেকে ছুটিয়ে দিয়ে কপালে পিস্তলের নল চেপে ধরলাম আমি। ‘বসে পড়ুন লক্ষী ছেলের মত।’ কড়া গলায় বললাম। ‘বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই আমি।’ বসে পড়ে বৃদ্ধ মানুষটা। আমার পিস্তল ধরা হাত একচুলও নড়ে না। ‘তুমি বলেছিলে -’ ঈশিতার প্রতিক্রিয়া এখনও শেষ হয় নি, ‘আমার জীবন হুমকির মুখে! তুমি বলেছিলে রবিন ভাইয়ার ওপর প্রতিশোধ নিতে আমার ওপর হামলা চালানো হতে পারে! আসলে আমাকে টোপ হিসেবে ব্যাবহার করেছ শুধু!’ ‘আমি তোমার বাবা – ঈশিতা!’ আহত কন্ঠে বলে রাবেক। ‘তুমি আমার বাবার দায়িত্ব যতটুকু আর পালন করেছ! জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না! আজ দুপুরের আগে আমি জানতামও না তুমি আদৌ বেঁচে আছো কি না!’ অসহ্য ক্রোধে থর থর করে কাঁপে ঈশিতা, ‘আমার ভাইয়াই ছিল আমার বাবা, আমার ফ্যামিলি। ওই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে কোথায় ছিলে তুমি? এই মুহূর্তেই বা কেন এসেছ?’ ‘বেশ বেশ!’ মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে আমার। ‘চৌদ্দ বছর পর মেয়ের জন্য বেশ দায়িত্ব কর্তব্য ফুটে উঠেছে দেখছি! এখন আমি পুরো ঘটনা বিশ্লেষন করতে যাচ্ছি। আপনি শুনুন। ’ দম নিই আমি, পিস্তল সরাই না রাবেক দ্য গডফাদারের কপাল থেকে, ‘আপনার লোকজন নিয়ে আমার বাসায় আজ ঢুকে পড়ে নিজের পরিচয় দিয়ে ঈশিতাকে একরকম তুলে নিয়ে এসেছেন আপনি। বেশ কিছুক্ষণ ব্রেইনওয়াশও করেছেন মেয়েটার। কাজ হত না হয়ত এসব ছেঁদো কথাতে। তবে যখন গোলাগুলি শুরু হল – তখন ঈশিতা বিশ্বাস করে বিপদ আসলেই একটা ছিল ওর। মজার ব্যাপার হল – দুইপক্ষের কেউই ঈশিতার ক্ষতি করার চিন্তাও করেনি। তাই না? নিজের মেয়ের কখনই ক্ষতি করার চিন্তা করতে পারতেন না আপনি। রাবেক চুপ করে থাকে তবুও, কাজেই বলতে থাকি আমি, ‘যতদূর মনে হচ্ছে – বয়েস হয়েছে আপনার – গডফাদারের প্লেসটা নিজের রক্তের সম্পর্কের কাওকে দিয়ে যেতে চান বলেই এত নাটক। আমি ঈশিতাকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারা পড়লাম – আমার লাশটা লুকিয়ে ঈশিতাকে উল্টোসিধে বুঝিয়ে দিলেন – আপনিই হয়ে উঠতেন ওর একমাত্র অভিভাবক। সবই ঠিক আছে – যেটা মাথায় আসছে না – ছেলে হিসেবে আমাকেই আগে আপনার বেছে নেয়ার কথা। ঈশিতাকে কেন? ’ ‘ইউ আর নট মাই ব্লাড।’ এই প্রথম মুখ খুলে রাবেক। হাত কেঁপে ওঠে আমার। ‘ঠিকই শুনেছ, রবিন! নাকি তোমাকে এখন ইরফান বলে ডাকব? তুমি আমার ছেলে নও – কখনই ছিলে না।’ ঠাট্টার সুরে বলে মানুষটা। ‘তোমার বাবা আমার সাথে কাজ করত। তখনও মাফিয়া জিনিসটা শুরু হয়নি। তবে আমার মাথায় এরকম কিছু একটা আইডিয়ার বীজ যেটা, তা তখনই গজিয়েছিল। ছয়জন মিলে তখন এলাকার ঝামেলা সামলাতাম, কারও ঝামেলা হলে তাদের প্রটেকশন দিতাম নির্দিষ্ট অংকের বিনিময়ে আর অন্যান্য এলাকার সাথে লিংক তৈরীর কাজ শুরু করেছিলাম মাত্র। বিরোধী পক্ষ যে ছিল না ঠিক তা নয়। তাদের কারও হাতেই মারা গেল মাজেদ। তোমার বাবা। অন্ধকার গলি দিয়ে আসছিল। ওত পেতে ছিল ওরা। জবাই হয়ে যাওয়া তোমার বাবার লাশটা যখন তোমাদের বাসায় পৌঁছে দেই, স্বামীর শোকে ভেঙ্গে পড়া মেয়েটার প্রেমে তখনই পড়ে গেলাম। তোমার বয়স মাত্র তিন বছর তখন। ’ শুনতে থাকি আমি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে। ‘তোমার মা অমত করেনি। যখন প্রস্তাবটা আমি পাঠাই, তার চারপাশে তখন শ্বাপদরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা নিরাপত্তা তার দরকার ছিল। নিজের জন্য যতখানি, তোমার জন্য আরও বেশি।’ বলে চলে গডফাদার, ‘এরপর জন্ম হল ঈশিতার। নেটওয়ার্ক মাত্র স্টাবলিশ করা শুরু করেছি আমি। ঈশিতার মা তখনই প্রথম ভুলটা করে ফেলে। ভুল মানুষের হাতে তুলে দেয় ড্রাগসের একটা চালান।’ কথা কোনদিকে এগুচ্ছে বুঝতে পেরে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল! ‘মাত্র একসপ্তাহ আগে আমি নতুন নিয়ম জারি করেছি। যেকোন ভুলের পরিণতি মৃত্যুদন্ড।’ মাথা নীচু করে রাবেক। ‘ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের হাতে মৃত্যুদন্ড দিতে হয় আমার। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সেদিন সেই সিদ্ধান্তটা না নিলে আজকের এই সাম্রাজ্য গড়ে উঠত না। ওভাবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করাটাই ভীতি ছড়িয়ে দেয় প্রত্যেক সদস্যের মনে। আর জানোই তো ভীতি হল সকল ক্ষমতার উৎস।’ অমায়িক হাস রাবেক। আর শোনার প্রয়োজন মনে করি না আমি। পিস্তলের বাট নামিয়ে আনলাম পাষণ্ডটার মাথায়। হাত থরথর করে কাঁপে আমার। ‘ইউ বাস্টার্ড! ’ আরেকবার পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করি ওর মুখে। ‘সারাটা জীবন আমি আমার মায়ের মার্ডারারকে খুঁজে বেড়িয়েছি। তাকে সামনে পেলে কি করব ভেবেছি!’ ছাদের দিকে মুখ তুলে উন্মাদের মত হাসি আমি। ‘ফাইনালি! আমার প্রার্থনা কবুল হয়েছে।’ গ্লকটা বুড়োর মাথায় ঠেকাই। একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমার হাতটা চেপে ধরে ঈশিতা। ‘ভাইয়া, প্লিজ।’ ফিস ফিস করে বলল ও। ‘আর ইউ ব্লাইন্ড! হি কিল্ড মাই মাদার!’ ওর হাত সরিয়ে দেই আমি। ‘প্লিজ ভাইয়া!’ এবার একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে ঈশিতার চোখ থেকে, ‘যাই হোক আমি বাবার মৃত্যু দেখতে চাই না তোমার হাতে।’ সরাসরি তাকাই আমি রাবেকের চোখে। কি আশ্চর্য। অপলক চেয়ে আছে লোকটাও আমার চোখে। সে চোখে মৃত্যুভীতি নেই! কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে থাকি আমরা। আমার হাত ধরে কাঁদতে থাকে ঈশিতা। দীর্ঘ একযুগ পর যেন নড়ে উঠি আমি। কপালের ঘাম তখন থুতনীতে এসে ঠেকেছে। ‘অ্যানাদার ডে, রাবেক!’ পিস্তলটা বড় একটা শ্বাস নিয়ে সরিয়ে ফেলি আমি। ‘উই’ল সীল দ্যা ডীল অ্যানাদার ডে।’ ঈশিতাকে এক হাতে ধরে ঘরটা থেকে বের হয়ে আসি আমি। পেছনে বসে থাকে রাবেক দ্যা গডফাদার – এক চুল নড়ে না তার পেশী। পরিশিষ্ট বাইক থেকে শ্রান্ত পায়ে নেমে এলাম। টলে উঠতেই আমাকে ধরে ফেলল ফারিহা। ‘তোমার কি হয়েছে?’ আমাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে ও। ‘ঈশিতাকে লুকিয়ে রাখতে হবে, ফারিহা।’ আর কিছু বলতে পারলাম না আমি। আমার পৃথিবী দুলছে চারপাশে। এতক্ষণ চুপ থাকা রিজভী আকন্দ মুখ খোলেন এবার, ‘ছেলেটার সাথে কথা বলতে চেয়েছি কতদিন। ওর তো শুধু পালাই পালাই। আজ যখন এসেই পড়েছ – এত সহজে যেতে দিচ্ছি না আর। ’ ‘রাবেকের চোখের আড়াল করে রাখতে হবে ঈশিতাকে কয়েকদিনের জন্য, স্যার!’ সাবধানে নিজের পায়ে দাঁড়াই আমি। তবুও আমার হাত ছাড়ে না ফারিহা। ‘রাবেক তাহলে মিথ নয়?’ আমার টলোমলো অবস্থা আর শার্টের বাম দিক ভিজে থাকার দৃশ্য দেখেই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করেন তিনি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যে সঠিক সময় এই মুহূর্তটি নয়, তা সফল ব্যবসায়ী বুঝতে পারলেন। কেবল বললেন, ‘ইউ আর আ ব্রেভ ইয়ং ম্যান, রবিন। আর মনে হচ্ছে চাইলেও এক সপ্তাহের মাঝে কোথাও নড়ার অবস্থা নেই তোমার। এই সময়টা আমার তত্ত্বাবধায়নে তোমরা থাকলে রাবেকের দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে থাকতে পারবে অনায়াসে। আমিও শুনতে পারব তোমাদের অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা। ’ পরিবেশ হাল্কা করতে আলতো করে হাসেন তিনি। আপত্তি করে লাভ নেই। ফারিহা অলরেডী দুই হাতে আমাদের দুইজনকে ধরে হাঁটা শুরু করেছে। ‘সত্যি কি বাবা আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে?’ ফারিহার বাম দিক থেকে জানতে চায় ঈশিতা। তার কণ্ঠে ভীতি। ‘অবশ্যই।’ বলি আমি। ‘আমাদের দুইজনকেই তার দরকার। তোর নেতৃত্ব আর আমার সাথে পুরাতন হিসেব নিকেশ।’ ‘এসব কথা সাতটা দিন পরে বললে হয় না?’ মৃদু ধমক লাগায় ফারিহা। পারিবারিক চিকিৎসককে ফোন দিয়ে মাত্র মোবাইলটা পকেটে রাখলেন রিজভী আকন্দ। পেছন থেকে ওদের তিনজনকে গলাগলি করে যেতে মুচকি হাসেন তিনি। Please leave this field emptyচতুরঙ্গ আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম! সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা! আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন! Check your inbox or spam folder to confirm your subscription. ক্রাইম গল্প
অনিকেত মানব Posted on June 30, 2023June 30, 2023 কেউ একজন ঘরে ঢুকছে, খেয়াল করে সেদিকে মুখ ঘোরালাম। দমকা হাওয়ার মত কন্ট্রোল রুমে ঢুকে পড়া প্রাণিটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি আমি। মিনিওন অবশ্য স্বাভাবিকভাবে তার দিকে ঘুরে তাকায়, ‘ফ্রেয়লিন সিখিনিকুয়াস জিজিন রাতে, দ্রানিয়াল তিতিনা।’ প্রাণিটি আমার দিকে ঘুরে তাকায়, ‘দেনামি হায়রাতিন কিলিমনাজির?’ মিনিওন হাসার মত একটা শব্দ করল, ‘সারিফিনি ফ্রাতিন ভাবার।’ তারপর আমার দিকে ফিরে ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে জানালো, ‘দুঃখিত, আপনাকে উনি নিম্নপ্রজাতির রোবট ভেবেছিলেন।’ Read More
তারপর Posted on December 14, 2013November 25, 2022 স্বপ্ন কিছুতেই সত্যি হতে পারে না। ভাবনা থেকেই স্বপ্নের জন্ম। নিজেকে নিজেই আজ পঞ্চাশবারের মত বোঝায় ইমতিয়াজ। Read More
পোয়েটিক জাস্টিস Posted on February 27, 2014November 13, 2022 ‘ওপরের লেভেলে লোক আছে নাকি আপনার?’ অবাক হয়ে জানতে চান রিজওয়ান সাহেব। ‘না।’ স্বীকার করেন সিরাজ সাহেব, ’তবে নিচের লেভেলে আছে!’ Read More