KP Imon

Words Crafted

দ্য বিগেস্ট ডিল


পার্কের দূরবর্তী কোণে বসে ছিল জাহিদ আর ফারিহা।
জাহিদ ছেলেটার মাঝে কি যেন আছে। ওর আশেপাশে থাকলে নিজেকে অনেক নিরাপদ লাগে ফারিহার।
এই মুহূর্তে জাহিদের হাতে হাত তুলে দিয়ে ওর বুকে মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছে ফারিহা। কিছু কিছু সময় কথা বলার প্রয়োজন হয় না। কথার চেয়ে নিস্তব্ধতাকেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়।
আড়াল থেকে ওদের দেখছিলাম।
এবার বুক ভরে একটা শ্বাস নিলাম। এ লাইনে আমার এটাই সবচেয়ে বড় কাজ।
আস্তে করে বেল্টের পেছনে আটকে রাখা গ্লক২৩ টা স্পর্শ করলাম।
জিনিসটার দাম আছে, তবে আমার স্পন্সরও মালদার পার্টি।
আড়াল থেকে বের হয়ে ওদের দিকে হেঁটে যাই আমি।
আমাকে দেখে মেয়েটা সরে যায় ছেলেটার বুক থেকে। দুইজনই সরু চোখে তাকিয়ে আছে। মনোযোগ পুরোপুরি আমার দিকে। আমার দৃষ্টি সরাসরি ফারিহার ওপর নিবদ্ধ – সেটাও একটা কারণ হতে পারে।
মেয়েটা পাঁচ ফিট ছয়। বড় বড় চোখদুটো সাথে কপালে এসে পড়া চুলগুলোতে একেবারে রাজকন্যার মত লাগছে।
‘টাকা আর আভিজাত্যের সাথে সৌন্দর্যের সম্পর্ক কোথায় কে জানে’- মনে মনে ভাবলাম।
দার্শনিকতার সময় কিংবা সুযোগ অবশ্য ছিল না। ইটস শো টাইম।
‘ফারিহা!’ গলায় যুগপৎ বিস্ময় ঢেলে বললাম। ‘তুমি এখানে কি করছ?’
একটা দীর্ঘ মুহূর্ত পরও আমাকে চেনার কোন লক্ষণ দেখা যায় না ফারিহার মুখে।
‘রিজভী আংকেল আমার বাবার বন্ধু। আমাদের দেখা হয়েছে আগে। ভুলে গেছ নাকি? আমি ইরফান।’
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। তবে ছেলেটা ত্রস্ত্র পায়ে উঠে দাঁড়ায়। বয়েসে আমার জুনিয়র। লুকিয়ে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে এমন ভাব ওর চোখে মুখে।
‘ইরফান ভাই।’ হাত বাড়িয়ে দেয়। ‘আমি জাহিদ। ফারিহা আর আমি – ইয়ে আরকি।’
সব বুঝে ফেলেছি এভাবে একটা হাসি দিয়ে হাত মেলালাম ছেলেটার সাথে।
‘হু দ্য হেল আর ইউ?’ উঠে দাঁড়ায় ফারিহাও। ‘আমি কোন ইরফানকে চিনি না।’
অবাক হয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকাল জাহিদ।
ঘাড়ের পেছনে মাঝারি আকারের একটা রদ্দা মারতেই চোখ উলটে যায় ছেলেটার। কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেল মাটিতে।
চিৎকারটা চলে এসেছিল ফারিহার মুখে – ঝটপট পিস্তলটা ওর মুখ বরাবর ধরতেই ওটা গিলে ফেললো সে। প্রেমিকযুগলকে ধন্যবাদ – নির্জন একটা জায়গা বেছে নিয়েছিল ওরা। দেখার কেউ নেই।
‘আমার সাথে হাঁটো। যদি প্রাণের মায়া থাকে।’ কড়া গলায় ওকে বললাম।
আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফারিহা।
‘আর শোন মেয়ে – তোমাকে জীবন্ত ধরে নিয়ে যাওয়াটা আমার জন্য খুব জরুরী এমনটা ভাবলে ভুল করবে। তোমাকে মেরে ফেলার জন্যই যথেষ্ট টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য টাকার অংকটা ডাবল হয়ে যাচ্ছে বলেই এত কথা। নাহলে চোখের মাঝ দিয়ে বুলেট ঢুকিয়ে একটা ছবি তুলে চলে যেতাম। সুতরাং – কোন ধানাই পানাই নয়। বুঝেছ?’
একটা কথাও বলল না মেয়েটা। গা থেকে জ্যাকেটটা খুলি আমি। হাতের ওপর ফেলে এমনভাবে ফেলে রাখলাম যেন পিস্তলটা ঢাকা পড়ে যায়। ডানহাতে আড়াআড়ি ভাবে ওটা ধরে ফারিহাকে আবার বললাম, ‘আমার হাত ধরে হাঁটবে এখন।’
নড়ল না মেয়েটা একচুল। ‘নাউ!’ চাপা ধমক দেই। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এই অজ্ঞান দেহের আশে পাশে বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই সমস্যা। অবশ্য মেয়েটির ইতস্তত করার পেছনের কারণও ওটাই। বয়ফ্রেন্ডকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে তার বাঁধছে।
ফারিহা আমার বাম হাত জড়িয়ে ধরল, জ্যাকেটের নিচে আড়াআড়ি ডান হাতে ধরা পিস্তলটা একেবারে ওর বুক বরাবর থাকে। এটা বুঝতে অবশ্য ওরও কোন সমস্যা হচ্ছে না। কাজেই ভদ্র মেয়ের মতই হেঁটে যায় ও আমার সাথে। মেইন রোডে উঠতেই বাতাস কেটে ছুটে আসে গাড়িটা।
আস্তে করে ব্রেক কষে আমাদের সামনে।
পেছনের সীটের দরজা খুলে ফারিহাকে ঢুকিয়ে দেই।
তারপর নিজেও উঠে বসি আমি।
ড্রাইভিং সীট থেকে রাসেল হাস্যোজ্জ্বল মুখে একটা সিগারেট ধরায়।
‘ইজি মানি, হাহ?’ আমার উদ্দেশ্যে বলে ও।
‘আনন্দে ডিগবাজি না খেয়ে ঠিকমত ড্রাইভ করো, গর্দভ।’ নিশ্চিত হতে পারি না আমি। ‘সেফ হাউজে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আমরা কেউই নিরাপদ না।’
তবে আমার ধমকে হাসি মোছে না রাসেলের মুখ থেকে।
মেয়েটার দিকে চোখ রাখি আমি। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে ও। এই মেয়ের নার্ভ আছে- মনে মনে স্বীকার না করে পারলাম না। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে হাউ-কাউ লাগিয়ে দিত।
অবশেষে এক যুগ পরে আমাদের গাড়ি সেফ হাউজে এসে পৌঁছুলো। আমার অন্তত তাই মনে হল। জ্যাকেট হাতে ফেলে আবারও সেভাবে হেঁটে উঠে যাই আমরা।
বাসাটা আর সব বাসার মতই। ফারিহাকে কিডন্যাপ করার জন্য তিনতলাটা গত চারমাস ধরে ভাড়া নেয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, দোতলা আর চারতলাও ভাড়া নেয়া আছে গত চারমাস থেকে – মালদার পার্টির কাজ – যথেষ্ট প্রোফেশনাল এরা। কাজেই কারও সন্দেহ না তুলে ওকে সহজে রাখা যাবে এখানে।
রাসেলটাকে গাড়ি সহ ভাগিয়ে দিয়েছি।
বিশাল বেডরুমটায় এসে ঢুকি আমি আর ফারিহা। ওর কাঁধ থেকে ব্যাগটা সরিয়ে টেবিলে ছুঁড়ে মারি। একাকী অচেনা একজন কিডন্যাপারের সাথে এক রুমে ঢুকে ফারিহার মুখে ভীতির ছাপ পড়ল কি না খেয়াল করার চেষ্টা করলাম।
উঁহু – ভীতি নয়; অসহায়ত্বের ছাপ পড়েছে। এই মেয়ে কঠিন ধাতুতে গড়া।
বিশাল বিছানাটার এক প্রান্তে একটা হ্যান্ডকাফ লাগানো। এক প্রান্ত আটকে আছে বিছানার সাথে। আরেকপ্রান্ত খোলা।
ইশারা করে ওটা দেখালাম। ‘বাম হাতে পড়ে ফেল।’
চুপচাপ তাই করল ফারিহা। অবশ্য হাতে পড়ার আগে এক মুহূর্ত ইতস্তত করেছে। তারপর আমার ডান হাতের অকম্পিত পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে ওর মুখের অসহায়ত্ব আরেকটু বেড়েছিল। কিছু না বলে বাম হাতে আটকে ফেলে ও হ্যান্ড কাফটা।
টেবিলে খোলা ল্যাপটপটা অন করি আমি এবার। স্কাইপ থেকে একটা নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে ভিডিও কল দিলাম। ওপাশের ক্যামেরা অবশ্য বন্ধ করা। অর্থাৎ দেখা যাবে না কাকে কল করলাম – যদিও ওপাশ থেকে আমাদের দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট!
‘কাজ শেষ?’ ওপাশ থেকে ভরাট গলা ভেসে আসে।
‘হুম।’
‘মেয়েটাকে দেখাও।’
ওয়েব ক্যাম ঘুরিয়ে বিছানায় বন্দী ফারিহাকে দেখালাম।
‘গুড। ই-মেইল চেক করে দেখ।’
অফলাইনে চলে গেল ওপাশের আগন্তুক। কম কথার মানুষ। ই-মেইল চেক করে দেখলাম বিস্তারিত নির্দেশ দেয়া হয়ে গেছে।
ফোনকলটা দিতে হবে রাত বারোটায়। কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রেম করার হ্যাপা বুঝুক মেয়ে! এত বড়লোকের মেয়ে হয়ে আদাড়ে-বাঁদাড়ে প্রেম করছিল এক চালচুলোহীন ফকিরের সাথে। উচিত শিক্ষা হয়েছে!
পাঁচটার সময় কলেজ ছুটি, ছয়টার মাঝে তার বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা যোগাযোগ করব আরও ছয় ঘন্টা পর। এটা কিডন্যাপিং-এর একেবারে ব্যাসিক – যাকে বলে অ আ ক খ।
কিডন্যাপিংটা হয়ে যাওয়ার পর পরিবারকে দুশ্চিন্তায় ডুবে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দাও। তারপর যোগাযোগ কর। ওই মুহূর্তে যা চাওয়া হবে দিয়ে দেয়ার জন্য একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে পরিবার।
‘খিদে পেয়েছে?’ জানতে চাইলাম ফারিহার কাছে।
মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলে ও।
সেই তখন থেকে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি মেয়েটা।
‘খিদে পেলে বলবে।’ আর কি বলব বুঝতে পারলাম না।
‘আপনার বোনটা কোন ক্লাসে পড়ে?’ হঠাৎ – একেবারে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল ফারিহা।
এতটাই চমকে যাই আমি – আমার হাত কেঁপে ওঠে।
এক সেকেন্ড পরেই নিজেকে সামলে নেই অবশ্য। তবে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে গেছে ফারিহার।
নিজের ওপর রাগ হতে থাকে আমার। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল।
‘শাট আপ!’ দ্রুত এগিয়ে পিস্তলটা ওর মাথায় চেপে ধরি। ‘এরপর থেকে আমি প্রশ্ন করব যদি দরকার হয়। একটা প্রশ্ন না – বোঝা গেছে?’
বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে মেয়েটা।
সে দৃষ্টিতে ভীতি নেই – আহত একটা দৃষ্টি।
চোখ সরিয়ে নিলাম।
আমি কিডন্যাপার মানুষ – এত অনুভূতির কোন দাম নেই আমার কাছে।
চোখ সরালেও পিস্তল সরালাম না।
‘মোবাইল কোথায়?’
‘ব্যাগে।’ আর্দ্র গলায় বলে মেয়েটা।
কান্নাকাটি শুরু করলে বিপদ। মেয়েমানুষের ট্যা-ফোঁ একেবারেই অসহ্য আমার কাছে।
পিস্তলটা কোমরে গুঁজে টেবিল থেকে মোবাইলটা বের করলাম।
সুইচড অফ রাখতে হবে। তার আগে একটা ছোট্ট অ্যাপ ইনস্টল করে দেয়া আমার দায়িত্ব। বাকিটা মালদার পার্টি দেখবে। এই ফোনের ক্লোন এরপর গাজীপুরে রওনা হবে। পুলিশ কখনোই ডিভাইস ট্র্যাক করে এই বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারবে না। কাঁচা কাজের লোক ওরা নয়।
অথচ ফোনটার লক স্ক্রিন খোলার সাথে সাথে আমার ভ্রু কুঁচকে যায়।
মোবাইলের ডিসপ্লের ওপরে একটা ব্লিপ।
দ্রুত ফিরে যাই মেয়েটার কাছে। ‘এটা কি?’
‘আমি কি জানি?’
কষে একটা থাপ্পড় দিলাম মেয়েটার গালে।
ফরসা গাল সাথে সাথে টকটকে লাল হয়ে গেল।
‘হোয়াট – ইজ – দিস?’ দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করলাম।
‘যা ইচ্ছে কর তোমরা …’ এই প্রথম চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ে ফারিহার, ‘আমার জাহিদ আমাকে খুঁজে বের করবেই।’
সাথে সাথেই ঘন ঘন কলিং বেল পড়ে বাসায়।
ঝট করে পিস্তলটা বের করে ফেলি আমি।
জিপিএস ট্র্যাকার দিয়ে ট্র্যাক করে কি পুরো পুলিশ ফোর্সটাই চলে এসেছে আমাদের পেছনে?


দেয়ালের আড়াল নিয়ে ধীরে ধীরে মেইন গেটের দিকে যাই আমি।
কান বরাবর তুলে রেখেছি পিস্তলটা।
কলিংবেল আবারও বেজে ওঠে – বেশ অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে বেল দাবানো লোকটার আচরণে।
আলতো করে ছিটকিনিটা সরিয়ে দরজার হাতলে টোকা দিয়ে খুলে ফেলি দরজা।
আমি এখনো দেয়ালের আড়ালেই আছি। মেপে মেপে নিঃশ্বাস ফেলছি।
হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল দুইজন মানুষ।
হার্টটা লাফিয়ে এসেছিল গলার কাছে। আরেকটু হলেই গুলি বেড়িয়ে যেত!
রাসেল আর আরেকটা ছেলে।
রাসেল দ্রুত দরজাটা লাগিয়ে দেয়। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলি আমি।
অন্য ছেলেটাকে আমি চিনি।
জাহিদ।
*
‘আর কইস না!’ কপাল থেকে ঘাম মোছে রাসেল। ‘আমি বিল্ডিংয়ে ঢুকতছি– এই পোলারে দেখলাম মোবাইলে চোখ রাইখা আমার লগে লগে ঢুকতেছে। সন্দ হইল। কানে বয়রা দিয়ে মোবাইলটা লইলাম, বাকিটা বাইর হইয়া গেল আরকি দুই থাবড়ে।’
‘দারুণ কাজ দেখিয়েছিস।’ পিঠ চাপড়ে দেই ওর। তাকালাম জাহিদের দিকে। ‘তারপর? কি খবর লিটল হিরো? চলো – কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া লাগে যে!’
ভয়ে ছোটখাট হয়ে গেছে বেচারার মুখ।
ওই মুখে একটা মাঝারি মাপের ঘুষি বসালাম। এটা অ্যাডভান্স।
তাড়াতাড়ি মুখ খুলতে সাহায্য করবে ওকে।
বেডরুমে জাহিদের কলার ধরে ঢুকতেই ফারিহা ওর রক্তাক্ত মুখ দেখে আৎকে উঠলো।
‘পুলিশ আসছে।’ জাহিদ ফারিহাকে অভয় দিয়ে বলল। ‘ওদের খবর দিয়েই ঢুকেছি।’
চট করে ফারিহার দিকে তাকালাম।
মেয়েটার মুখে আশার কোন লক্ষণ দেখলাম না।
জাহিদকে ঘুরিয়ে আরেকটা ঘুষি মারলাম ওর মুখে। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল ছেলেটা।
‘প্লিজ!’ অনুনয় ঝরে পড়ে মেয়েটার চোখমুখে। ‘প্লিজ ওকে মারবেন না।’
‘শাট আপ!’ রুম কাঁপিয়ে ধমক দেই আমি। ‘রাসেল, প্লায়ার্স গরম কর। এই শালা মিথ্যা বলছে। পুলিশকে খবর দিয়ে ঢোকেনি। তবুও সাবধানের মার নেই।’
‘প্লায়ার্স দিয়ে কি করবেন?’ ফারিহার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে ভয়ে।
‘হারামজাদার আঙ্গুলের নখ তুলব একটা একটা করে। তখন মুখ দিয়ে সত্য কথা হড়হড় করে বের হবে।’
‘প্লিজ – এই কাজ করবেন না।’ কেঁদে ফেলে এবার মেয়েটা। ‘ও মিথ্যা বলেছে। ও মিথ্যা বললে আমি বুঝি। পুলিশে খবর দেয় নি ও। প্লিজ ওকে আর কষ্ট দেবেন না।’
মেঝেতে পড়ে থাকা জাহিদ মুখ তুলে ফারিহাকে ধমক দেয়, ‘তুমি চুপ কর ফারিহা।’ ওখান থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাকে যতখুশি টর্চার করুন – তাতে এখন আর পুলিশ আসা ঠেকাতে পারবেন না।’
দুইহাতে ওর কলার জাপ্টে ধরে দাঁড় করালাম ওকে। পেটে মাঝারি আকারের একটা ঘুষি বসাতেই বাঁকা হয়ে গেল জাহিদ।
‘আর কোন কথা না। শুধু আমি যা বলব তাই উত্তর দেবে। বোঝা গেছে?’
এই সময় রুমে ঢুকে রাসেল। ‘প্লায়ার্স গরম হচ্ছে।’ জানায় ও।
একেবারে আচমকাই নড়ে উঠে জাহিদ।
আমার পেটে দুবার হাত চালিয়ে মাথায় একটা জোরদার ঘুষি মারল ছোকরা।
এতটুকু ছেলের গায়ে এত জোর থাকে কি করে? মাটিতে ছিটকে পড়তে পড়তে ভাবলাম।
এই সময় সশব্দে ভেঙ্গে পড়ল ঘরের দূরবর্তী কোণার ফুলদানীটা।
রাসেল, জাহিদ এমনকী ফারিহাও অবাক হয়ে তাকায় ওদিকে।
হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝে ফেলি আমি – আতঙ্কে শীতল হয়ে এল রক্ত।
‘গেট ডাউন!’ চেঁচিয়ে উঠি রাসেল আর জাহিদের উদ্দেশ্যে।
সেই সাথে গড়িয়ে এসেছি একপাশের দেওয়ালের দিকে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পুরো খাটটাকে পায়ের ধাক্কায় কাত করে দিচ্ছি – আর্তচিৎকার দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে ফারিহা।
রাসেল আর জাহিদ আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে – মরিয়া হয়ে আবার চেঁচালাম, ‘গেট ডাউন ড্যাম ইট!’
হঠাৎ – একেবারেই হঠাৎ রাসেলের মুখমন্ডলের অর্ধেকটা গায়েব হয়ে যায়। রক্ত আর মগজ ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ল চারদিকে।
জাহিদ ততক্ষণে পরিস্থিতি বুঝে ফেলেছে। ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় ও মেঝের দিকে, জানালার গোবরাটের আড়াল নেবার ইচ্ছে। পরের বুলেটটা ওর মাথা মিস করলেও ঘাড়কে পেয়ে গেল। ঘাড় আর গলা অর্ধেক দ্বিখন্ডিত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে যায় জাহিদ। জবাই করা গোরুর মত তড়পাচ্ছে।
পায়ের ধাক্কায় খাটটাকে ততক্ষণে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। ফারিহার হ্যান্ডকাফ পড়ানো হাতটা চাপা পড়ে গেছে এর নিচে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলেও থেমে গেছে ও এখন।
মাত্র ছয়ফিট দূরে রক্তাক্ত বয়ফ্রেন্ডকে দেখতে পাচ্ছে ও।
ঘরটায় এখন শুনশান নীরবতা।
‘ইরফান ভাই।’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলে ওঠে জাহিদ, ‘পুলিশ ডাকতে পারিনি আমি। একাই এসেছিলাম …’
গলা থেমে যায় প্রায় ওর। কল কল করে রক্ত পড়ছে ক্ষত থেকে।
‘ফারিহাকে…’ বলার চেষ্টা করে ও কিছু একটা।
ক্রল করে গিয়ে ওর হাত ধরলাম। ‘আ’ম সরি ফর এভরিথিং, জাহিদ। আ’ম রিয়েলি …’
‘ফারিহাকে দেখে রাখবেন…’ কোনমতে বলে জাহিদ।
চোখদুটোর মাঝে প্রাণের আলো নিভে যায় ওর।
বুকে হেঁটেই খাটের ওপাশে ফারিহার দিকে চলে যাই। এখানে তাও খাটটা কাভার হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে।
হ্যান্ডকাফের চাবি বের করে আস্তে করে ফারিহাকে বলি, ‘তোমার হাত খুলে দিচ্ছি এখন। পাশের বিল্ডিং-এ একটা স্নাইপার আছে। পুলিশের লোক নয় ওরা। কাজেই, হাত খুলে দিলেই দৌড় দেবে না। বুকে হেঁটে বেরিয়ে যাব আমরা। বুঝতে পেরেছ?’
ফ্যাকাসে মুখে চেয়ে থাকে মেয়েটা। চেঁচাচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে এমনও নয়। একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
আফটার শক ট্রমা।
যা আছে কপালে – ওর হাত খুলে দিতে থাকি আমি।
নিজের এবং মেয়েটার জীবিত থাকাটাই এখন আমাদের ট্রাম্প কার্ড।
এখান থেকে যতদ্রুত সম্ভব বেড়িয়ে পড়তে হবে। তারপর ছাড়াতে হবে ঘটনার প্যাঁচ।
যা ঘটছে চারপাশে – তার সাথে বড় কোন কিছুর সম্পর্ক না থেকেই যায় না।
বড় কিছুটা কি সেটাই বের করতে হবে আমাকে।
মেয়েটার হাত ধরে ধীরে ধীরে ক্রল করে মেইন গেটের দিকে এগিয়ে যাই আমি।
গ্যারাজের মটরসাইকেলটার কাছে জ্যান্ত পৌঁছতে পারলে হয়…


মেঝেতে পড়ে থাকা রাসেল আর জাহিদের রক্তে আমাদের জামার সামনের দিকটা ভিজে আছে। ফারিহার চুলের একপাশ রক্ত লেগে থকথক করছে।
ওই অবস্থাতেই আস্তে করে দরজা খুলে বের হলাম। সিঁড়িঘরটা অন্য অ্যাংগেলে থাকায় আশা করছি – স্নাইপারদের নাগালের বাইরে এটা। যত বড় বান্দাই হোক, আমাদের একটা ঘরকে কাভার করতে দুটো-তিনটে স্নাইপার রাখার কথা নয়।
‘উঠে পড়।’ ফারিহার হাত ধরে টেনে তোলা লাগল। এখনো মরা লাশের মতো তার আচরণ।
বের হয়ে সাবধানে তাকালাম সিঁড়িঘরের চারপাশে। কোন নড়াচড়া নেই।
‘জাহিদকে নিয়ে আসি?’ আমার দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সাথে বলে ফারিহা।
মেয়েটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে আছে।
দোষ দিতে পারলাম না। এক দিনের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেছে ওর জন্য।
কোন কথা না বলে নিষ্ঠুরের মত ওকে টেনে নিয়ে লিফটে উঠে পড়লাম। মেয়েটা একটা হাত অবুঝ শিশুর মতো পেছনে আসা পথের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। জাহিদকে নিয়ে আসতে চায়।
তার কার্যক্রম নিষ্ঠুরের মতো উপেক্ষা করলাম, পিস্তলটা বের করে ফেলেছি।
লিফটটা গ্রাউন্ড লেভেলে নামতেই প্রস্তুত হলাম। বাইরে আরও আততায়ী থাকতে পারে।
দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেলেও গ্যারেজে কাওকে দেখা গেল না।
আজ সকালে নিজের মটরসাইকেলটা গ্যারেজে ইমার্জেন্সী এস্কেপের জন্য এনে রাখায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হল।
‘ফারিহা, লিসেন!’ মেয়েটার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করি আমি, আমার দিকে বিহ্বলদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে ও। ‘তোমার বাবার শত্রু আছে। আমাকে ভাড়া করা হয়েছিল তোমাকে কিডন্যাপ করতে। কিন্তু এখন তারা সম্ভবতঃ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে ওরা।’
যদিও যতদূর বুঝতে পারছি – ফারিহার ক্ষতি করার ইচ্ছে এদের নেই। এরা সম্ভবতঃ তৃতীয় পক্ষ।
আমাদের কষ্টার্জিত জিনিসটা সহজে নিজেদের করে নিতে চায়।
মুক্তিপণের টাকাটা কম নয়। একমাত্র মেয়ে কি না!
দশ কোটি টাকা!
এর জন্য আরও অনেক পার্টি হন্যে হয়ে থাকতেই পারে!
‘আমার জাহিদকে কেন মারল ওরা।’
প্রশ্ন নয় ঠিক – কি বলছে সেটা মেয়েটা নিজেও জানে কি না সন্দেহ হল আমার।
জাহিদের প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধ আমারও আছে। ঠিক সময়ে আমার মুখে ঘুষি মেরেছিল ছেলেটা। নইলে এতক্ষণে ঠান্ডা মাংস হয়ে পড়ে থাকতাম – সন্দেহ নেই। কিন্তু মেয়েটার এ বাড়ি থেকে সরাতে না পারলে আমরা কেউ-ই রাত পর্যন্ত বেঁচে থাকবো না।
‘পে অ্যাটেনশন!’ এবারে চেঁচিয়ে উঠি। কেঁপে ওঠে মেয়েটা। ‘এই বিল্ডিং-এ থাকা প্রতিটি সেকেন্ড আমাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। এই মুহূর্তে কেটে না পড়লে তোমার লাশটাও পড়ে থাকবে এখানে। আমি এখন এই মটরসাইকেলে করে বেড়িয়ে যাব। তুমি আমার সাথে আছ?’
কিছুটা বাস্তবে ফিরে এল যেন মেয়েটা। চারপাশে তাকাচ্ছে।
ভাল লক্ষণ। এতক্ষণ একেবারে মোমের পুতুল হয়ে ছিল।
মটরসাইকেল স্টার্ট দিলাম।
নিজে থেকেই এগিয়ে এসে আমার পিছে বসে পড়ল ফারিহা।
ছোট গেইটটা খোলা গ্যারেজের।
আমি নিশ্চিত ওদিকে স্নাইপার তাক করে বসে আছে আততায়ী!
কিন্তু – ঝুঁকিটা নিতে হচ্ছে, গড়গড় করে উঠল ইঞ্জিন ।
বুলেটের মত বেড়িয়ে এলাম আমরা পিচ্চি গেইটটা দিয়ে।
ভালোমানুষের মত মুখ করে তিনজন কোটধারী এগিয়ে আসছিল বিল্ডিংটার দিকে। আমাদের ছিটকে বেড়িয়ে আসতে দেখে একযোগে কোটের ভেতরে হাত ভরে ফেলল তিনজনই। ভেতর থেকে কি অমূল্য সম্পদ বের করে আনতে যাচ্ছিল সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম না।
ডান হাত হ্যান্ডেল থেকে সরিয়ে নিমেষে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে কয়েকটা গুলি পাঠিয়ে দিলাম ওদের দিকে। এদিক ওদিক ঝাঁপিয়ে পড়ে কাভার খুঁজছে তিন ভদ্রলোক – এই ফাঁকে বাম দিকের গলি ধরে ঢুকে পড়লাম আমরা।
কাঁধের কাছে খামচি দিয়ে ধরে আছে ফারিহা।
আমার মনে হল, দশ কোটি টাকা কাঁধ খামচে ধরে আছে আমার।
রক্তে ভেজা জামা নিয়ে তীব্রগতিতে বাইক ছোটাটে থাকা যুবক আর একটু আগে শোনা গুলির শব্দ – এলাকাবাসী দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে বেশি সময় নিল না মোটেও। এদিক ওদিক সরে যেতে থাকে সবাই আমাদের বাইক থেকে। একছুটে হতশ্রী বাড়িটার সামনে থামলাম আধঘন্টা পর।
গত ছয়মাস ধরে এটাই আমার হাইডআউট ছিল। এখন অবশ্য আর নিরাপদ নয়। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়েই কেটে পড়তে হবে। বেশি সময় পাওয়া যাবে না। ওই সেইফ হাউজের ঠিকানা জানলে আততায়ীর দল আমার হাইডআউটের কথাও জানে – এটা নিশ্চিত।
রাস্তার মানুষজন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। তাদের একেবারেই পাত্তা না দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে নেমে এলাম আমরা।
ফারিহাকে নিয়ে সোজা দোতলায় উঠে যাই।
অ্যাডভান্স তিনলাখ টাকার ব্রীফকেসটা খামচি দিয়ে তুলে নিলাম। তারপর বেডরুম থেকে আমার একটা টি-শার্ট এনে ছুঁড়ে দেই ফারিহার দিকে।
‘রক্তে ভেজা কাপড় পরে দৌড়াদৌড়ি করা যাবে না।’ ব্যাখ্যা দিলাম ওকে। ‘চেঞ্জ করে ফেলো।’
কোন কথা না বলে টি-শার্টটা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল ফারিহা।
দ্রুত আমার শার্টটা খুলে আরেকটা শার্ট চাপাই গায়ে।
পিস্তলটা টেবিলের ওপর রেখে কিচেনে গিয়ে ঢুকলাম তারপর। একটা বিস্কুটের টিন থেকে বের করলাম নয়টা ম্যাগাজিন। ফায়ার পাওয়ার এতখানি-ই সম্বল।
‘আরও কয়েকটা রাখতে পারলে ভালো হত…’ মনে মনে ভাবি আমি।
রুমে ফিরে এসে ব্যাকপ্যাকে টাকাগুলো ভরে তার ওপর ম্যাগাজিন সাতটা রাখলাম। দুটো ভরলাম কোটের পকেটে।
কাজে লাগতে পারে।
পেছনে খুট করে একটা শব্দ হতেই ফিরে তাকালাম আমি। বেরিয়ে এসেছে ফারিহা।
টি-শার্টে চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে। কিন্তু এইমাত্র টেবিল থেকে তুলে নেয়া গ্লকটার আমার বুক বরাবর তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা মোটেও চমৎকার লাগল না।
‘ইরফান-’ ঠান্ডা গলায় বলল মেয়েটা। ওর কণ্ঠে কিছু একটা ছিল, বরফ হয়ে যাই আমি। ‘এটা তোমার আসল নাম কি না আমি জানি না। তবে শোন – আমার মনে হয় না আর কোথাও যাওয়ার দরকার আছে। তোমাদের কিডন্যাপিং প্ল্যান ভেস্তে গেছে। এখন আমি যেদিকে ইচ্ছে সেদিকেই যেতে পারি। আর হ্যা – টিশার্টটার জন্য ধন্যবাদ।’
‘ফারিহা-’ খুব সাবধানে মুখ খুলি আমি, ‘বোঝার চেষ্টা কর। বাইরে তুমি নিরাপদ না।’
‘হাহ!’ খুব মজা পেয়েছে এভাবে বলে মেয়েটা। ‘তোমার সাথে আমি নিরাপদ?’ হঠাৎ খেপে ওঠে মেয়েটা – ‘ইউ বাস্টার্ড!’
নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছি আমি। ‘শুধু মাত্র তোর জন্য খুন হয়ে গেছে আমার জাহিদ। তুই যদি আমাকে তুলে না আনতি এখনও নিঃশ্বাস নিত ও। আই শূড কিল ইউ টু! ইউ মাদারফা-’
গালিটা সম্পূর্ণ দেয়ার আগেই আমাদের চারপাশে নরক ভেঙ্গে পড়ে।
বাসার দরজার ঠিক বাইরে বিদঘুটে একটা ভোঁতা শব্দ – সেই সাথে অনেকগুলো ফুটো হয়ে গেল দরজাতে।
সাইলেন্সড সাব-মেশিনগান!
চমকে উঠে ওদিকে ঘুরে যায় ফারিহা। বদ্ধ জায়গাতে কানে তালা লেগে যায় আমার।
ফারিহার কাঁপা হাত থেকে গুলি বেরিয়ে গেছে! একটা দুটো নয়- চোখ বন্ধ করে ছাত তাক করে ম্যাগাজিন খালি করে ফেললো ফারিহা!
দ্বিগুণ উৎসাহে দরজাকে মোরব্বা বানায় বাইরের ওই ওরা।
এক থাবা দিয়ে ওর থেকে আমার হাতে নিয়ে নিলাম পিস্তলটা।
ম্যাগাজিন সড়াৎ করে বের করে আরেকটা ঢুকিয়ে ফেলতে না ফেলতেই হুড়মুড় করে দরজাটা ভেঙ্গে পড়ে কারও লাথিতে।
পোশাকে-আশাকে ভদ্রলোক টাইপ দুই ষন্ডার চেহারা দেখতে পেয়ে আর দেরী করলাম না। তরমুজের মত মাথা দুইটায় দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিতেই বিল্ডিং কাঁপিয়ে পড়ে গেল দু’জনে।
পেছনে আরও লোক আছে – জানি।
তবে এরা ঢোকার আগে তিনবার ভেবে ঢুকবে।
ঝটপট ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে তুলে, আরেকহাতে ফারিহাকে টেনে এনে শেষপ্রান্তের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
ওকে ধরে বারান্দায় নিয়ে আসলাম। গ্রিলের সাথে ছোট জানালাটা খুলে আগে থেকেই লাগিয়ে রাখা দড়িটা খুলে দিলাম তারপর, যে পেশায় আছি আমি, ‘এস্কেপ রুটে’র কথা একটা সবসময় ভেবেই রাখতে হয়।
এই বিছানায় ঘুমাই প্রতিদিন – তবে বারান্দার গ্রিলের দড়িটা পরীক্ষা করতে কোন রাতে ভুল হয় না আমার। আজ কাজে দিল।
ভয়ে ছিলাম ফারিহা নামতে পারবে কি না।
ভয়টা সত্য করে বারান্দায় দড়িটা ধরে ইতস্তত করতে থাকে মেয়েটা।
এই সময় বেডরুমের দরজাতেও ছিদ্র হওয়া শুরু করল। আমার শেষ না দেখে ফিরে যাবে না – এই প্রতিজ্ঞা করে এসেছে এরা। আর দশ কোটি টাকা তো আমার সাথেই।
প্রাণের মায়া বড় মায়া – আমার চেয়েও দ্রুত নেমে পড়ল ফারিহা। নিচে পড়ে ককিয়ে ওঠে ও।
ব্যাগটা নিচে ফেলে দিয়ে ওকে ধরে তুললাম, ‘আর ইউ ওকে?’
ব্যাথার চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করে মাথা দোলায় মেয়েটা। গোড়ালি মচকেছে ওর – বুঝলাম।
সময় নষ্ট করা যাবে না – ব্যাকপ্যাকটা তুলে ছুটলাম। বাসার পেছনে এই মাটিগুলো আসলে ড্রেনের কাভার।
মোটামুটি ছয়ফিট গ্যাপ রেখে পরের বিল্ডিংটা তোলা হয়েছে। অর্থাৎ দুটো বিল্ডিং-এরই পিছন দিকে এই ড্রেনের জন্য রাখা ছয়ফিট জায়গা। সামনের দিকে যেন প্রত্যেকেই রাস্তা পায় সে ব্যবস্থা।
ফারিহার হাত ধরে ছোট লোহার বেড়াটার দিকে ছুটে যেতে থাকি আমি।
আজ সকালেই এই মেয়েটাকে আমার বন্দী করে রাখার কথা ছিল – মুক্তিপণের টাকা না পেলে মাথায় একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিল।
কে বলবে এখন আমাদের দেখে?


রাত আটটা।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে সাবধানে চারপাশে তাকাই।
আমার হাইডআউট থেকে বেরিয়ে এসে রাতের আঁধারে এই হোটেলে উঠেছি আমরা।
আসার পথে পেছনে ফেউ লেগে নেই নিশ্চিত করে খেয়ে নিয়েছি। সারাদিন আমার বা ফারিহার পেটে দানাপানি পড়েনি। এরপর মেয়েটা তার অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়েছে।
খাটে চাপা পড়ে হাত মচকে গেছিল এতক্ষণের উত্তেজনায় বোঝেনি সে। আর পায়ের ধাক্কা সামলাতে ওর আরও সপ্তাহ খানেক অন্তত লাগবে।
হোটেলে ওঠার আধ ঘন্টার মধ্যেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে যায় মেয়েটা। এরকম এক স্নায়ুবিধ্বংসী অভিজ্ঞতার পর কেউ যে ঘুমাতে পারে তা আমি ওকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
আস্তে করে বাইরে থেকে লক করে দিয়ে আসি ওকে। টেবিলে নোট রেখে গেছি – দেড় ঘন্টার মাঝেই ফিরে আসব আমি।
বাইরে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে। যখন পেছন থেকে ছুটে আসা বুলেটের ভয় না থাকে।
একটা ল্যাপটপ কিনে বাংলালায়নের কাছে গিয়ে মডেম নিয়ে আসলাম। ব্যাকপ্যাকে সব সময় অল্টারনেটিভ কাগজপত্র থাকেই। বেশিরভাগই জাল অবশ্য। ফিরে আসার সময় ফারিহার জন্য কয়েকটা ড্রেস কিনে আনলাম। মেয়েদের সাথে মেলামেশার তেমন সুযোগ হয়নি। সাইজে এসব জামা ওর হবে কি না কে জানে!
*
মাত্র ঘুম থেকে উঠে বিছানায় উঠে বসেছে ফারিহা, আড়মোড়া ভাঙছিল, এই সময় রুমে ঢুকি আমি।
ঘুম ঘুম চোখেও মেয়েটাকে পরীর মত লাগছে।
‘ঘুম কেমন হল?’ টেবিলে হাতের ব্যাগগুলো নামিয়ে জানতে চাইলাম আমি।
‘ইরফান?’ কোমল গলায় ডাকে ফারিহা। ‘যদিও তোমার আসল নাম এটা না…’
‘কিছু বলবে?’
‘থ্যাংকস ফর সেভিং মাই লাইফ।’ হাতের দিকে তাকাল মেয়েটা। বাঁ হাতের কব্জির কাছে ফুলে আছে।
তাকিয়ে থাকলাম আমি। আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলে ও, ‘টুয়াইস।’
কিছু একটা বলতে গেছিলাম – কিন্তু সুযোগ না দিয়ে আবারও বলে, ‘অ্যান্ড আই হেইট ইউ ফর ব্রিংগিং মি ইন দিস মেস।’
হেসে ফেললাম।
‘তোমার জন্য কয়েকটা ড্রেস এনেছি। দেখো তো লাগে কি না।’ ওর দিকে প্যাকেটগুলো ছুঁড়ে দিলাম।
ওগুলো ধরে আস্তে করে উঠে যায় ফারিহা।
ল্যাপটপটা অন করে নেট কানেক্ট করলাম।
এবার আমার টার্ন।
স্কাইপে ঢুকতেই পাওয়া গেল কন্ট্যাক্টকে।
‘দিস ওয়াজ নেভার অ্যাবাউট দ্যা মানি, ওয়াজ ইট?’ ওই পক্ষ ভয়েস কল রিসিভ করতেই ঠান্ডা গলায় জানতে চাই আমি।
‘হাহ হাহ হা।’ ওপাশ থেকে বেশ হাসিখুশি গলাতেই বলে ওঠে অচেনা মানুষটা। ‘ইরফান – অথবা যাই হোক তোমার নাম – ঘটে বুদ্ধি আছে দেখছি।’
‘ছেঁদো কথা রাখুন। সেইফ হাউজের কথা আর কারও জানার কথা নয়। আগেভাগেই স্নাইপার নিয়ে অ্যামবুশ করে থাকাটা তো আরও অসম্ভব – এক যদি না আপনার কাছ থেকে ইনফরমেশন পায়।’
‘হুমম – কিন্তু ওসব কিছুই হওয়ার কথা ছিল না।’ গম্ভীর হয়ে যায় গলাটা। ‘দোষ সম্পূর্ণ তোমাদের। থার্ড পার্টি ঢুকিয়েছ তোমরাই। তোমার আর তোমার সহযোগী ছাড়া সেইফ হাউজের লোকেশন কেউ জানবে না – এটাই শর্ত ছিল।’
বুঝলাম – জাহিদের কথা বোঝাচ্ছে ক্লায়েন্ট।
‘ওটা একটা ঝামেলা ছিল।’ মাথায় ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে আমার। ‘তবে আমাদের দুইজনকে সরিয়ে দেয়ার প্ল্যানটা আপনার ছিলই। জাহিদ এর মাঝে না আসলেও তাই করতেন। সম্ভবত রাত বারোটায় কলটা দেয়ার পরই আমাদের পাট চুকে যেত। কেন? সাধারণ কিডন্যাপিং এটা নয় – আমাকে নির্বোধ ভাববেন না। গোটা ব্যাপারটা আমি জানতে চাই। মনে রাখবেন, মেয়েটা এখনও আমার কাছে।’
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পেছনে বিছানায় বসে থাকা ফারিহাকে দেখিয়ে দিলাম ক্যামেরা ঘুরিয়ে।
এক মুহূর্ত নীরব থাকে ওপাশে।
‘ঠিক আছে। তোমাকে জানানো ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই আমার অবশ্য।’ অবশেষে মুখ খুলে কুটিল ক্লায়েন্ট। ‘দিস ওয়ান ইজ নট অ্যাবাউট কিডন্যাপিং – নট অ্যাবাউট মানি। দিস ওয়ান ইজ অ্যাবাউট রেইপ অ্যান্ড মার্ডার।’
বিস্ময়ের আঘাতটা এতটাই জোরে আসল, ভাষা হারালাম আমি।
‘ইয়ংম্যান! ঠিকই শুনছ তুমি।’ ওপাশ থেকে নিশ্চিত করল ক্লায়েন্ট। ‘তোমাদের দায়িত্ব ছিল কেবল কিডন্যাপ করে ফোনে টাকাটা চাওয়া। শোনা যায় – কিডন্যাপিং-এ এই শহরে বেস্ট হল ফ্যান্টম ইরফান। ফ্যান্টম কেন বলা হয় সেটাও সবাই জানে। তুমি অদৃশ্য থাকতে জানো। তোমার কিডন্যাপিংগুলো হয় শতভাগ নিঁখুত। কিন্তু মার্ডার জিনিসটা তোমার রক্তে নেই – প্রোফাইলে যা পড়েছি এতে সহজেই বোঝা যায়। নেহায়েত আত্মরক্ষার প্রয়োজন না হলে কারও দিকে অস্ত্র তোলেনি ফ্যান্টম ইরফান। কিছু নৈতিক নিয়ম মেনে চল তুমি, যা একজন কিডন্যাপারের মাঝে থাকতে নেই। তোমাকে দিয়ে যে রেইপ হবে না সেটা বোঝার জন্য অবশ্যই ইরফান-বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।’
‘ইউ আর ড্যাম রাইট মি. হুয়েভার ইউ আর!’ টেবিলে কিল বসাই আমি। ‘এই ডীল ক্যান্সেল করছি আমি। ফায়ারফাইটটুকু জাস্ট বিজনেস মেনে নিয়ে হয়ত এগিয়ে যেতাম আমি ডীল অনুযায়ী। কিন্তু যেটা আপনি চাচ্ছেন সেটা আমার তত্ত্বাবধায়নে হবে না। আমি কাউকে তুলে আনলে তাকে অক্ষত ফিরিয়ে দেই, দ্যাট’স মাই রেপুটেশন। আপনার বিকৃত মানসিকতার জন্য তো আর আমার রেপুটেশন নষ্ট করবো না। এরপরের বাচ্চাটাকে তুলে আনলে তখন পাগলা কুকুরের মতো আমাকে গুলি করে মারবে পুলিশ।’
‘তোমাদের দুইজনের পাওয়ার কথা ছিল দুই কোটি টাকা, ইরফান।’ ওপাশ থেকে একঘেয়ে গলায় বলে মানুষটা। ‘তুমি পেতে এককোটি। তোমার পার্টনার মারা গেছে। নতুন প্রস্তাব দিচ্ছি আমি – এই কাজের জন্য দুই নয়, সম্পূর্ণ দশ কোটি টাকা পাচ্ছ তুমি। কোন পার্টনারের সাথে শেয়ার করতে হবে না এক আধুলিও। সহজ কাজ ইরফান। ভিডিও অন রাখতে হবে পুরোটা সময়। তারপর কাজ শেষে কেবল একটা বুলেট। অথবা যে পদ্ধতিতে তুমি চাও মার্ডারটা করতে।’
‘কিপ ইয়োর মানি।’ চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আমার।
‘তোমাকে আধ-ঘন্টা সময় দিলাম।’ ওপাশ থেকে বলে আবারও। ‘তারপর তোমার সিদ্ধান্ত জানাও।’
লাইন কেটে গেল।
পেছনে ঘুরে ফারিহাকে দেখতে পেলাম আমি।
পুরো কথাবার্তাই শুনেছে ও নিঃসন্দেহে। আমাকে তাকাতে দেখে এই প্রথমবারের মত ওর চাউনীতে ভয় উঁকি দিল। ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম।
দশ কোটি টাকা। এত টাকা আমি জীবনেও চোখে দেখিনি।
আবার ভেবে দেখতে থাকি পুরো বিষয়টা। এটাই হতে পারে আমার এই জীবনের শেষ কাজ। এরপর এই ঘৃণ্য এবং সেই সাথে ঝুঁকিপূর্ণ পথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
দশ কোটি টাকা ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে কিডন্যাপিং ছেড়ে দেয়াটা সহজ।
নিরাপদ একটা জীবন সব অপরাধীরই কাম্য – ভাগ্যগুনে সেই সুযোগ আমার হাতে চলে এসেছে।
কাজটা কঠিন না মোটেও।
পরীর মত সুন্দর একটা মেয়েকে ধর্ষণ করতে হবে।
সেটা ভালো মত ভিডিও করে রাখতে হবে যাতে মেয়েটার চেহারা দেখা যায়।
তারপর যেভাবে আমার মন চায় মেরে ফেলতে হবে মেয়েটাকে।
একেবারেই ছেলেখেলা। ভিডিও জমা দিয়ে দিলেই আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে দশ কোটি টাকা।
মাথা নিচু করে রুমের মাঝে পায়চারী করছি।
হাতে পিস্তলটা নিয়েই।
ফারিহা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাড়া খাওয়া শিকারের মতো অভিব্যক্তি তার।
ওর দিকে ফিরলাম, ‘তোমার বাবার ব্যাপারে জানা লাগবে আমার, ফারিহা।’
‘কেন?’ ঠান্ডা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় মেয়েটা। ‘যতদূর বুঝলাম ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে।’
ওর কাটা কাটা উত্তর গায়ে মাখলাম না।
‘বলে যাও। বাবার প্রফেশনাল লাইফ সম্পর্কে যা যা জানো বলে যাও, প্লিজ।’ ওকে তাড়া দেই আমি।
মুখ খোলে মেয়েটা।
বলে যায় যতদূর পর্যন্ত ও জানে।
শুনি আর নিরাশ হই আমি। আর দশটা শিল্পপতির মতই জীবনযাত্রা ছিল রিজভী আকন্দের।
আধঘন্টা প্রায় পেরিয়ে এসেছে। বিচ্ছিরি শব্দে স্কাইপের ইনকামিং কলের শব্দ ভেসে আসছে কম্পিউটার থেকে।
ভয়েস কলটা রিসিভ করলাম।
‘কি সিদ্ধান্ত নিলে?’
‘আ’ম নট ডুইং দিস।’ স্পষ্ট উত্তর দিলাম ক্লায়েন্টকে।
‘জানতাম আমি।’ খোশমেজাজেই বলে লোকটা।
‘গুড নাইট মিস্টার।’ কল কেটে দিতে চাই আমি।
‘গুডনাইট, ইরফান।’ স্বাভাবিকভাবেই বলে লোকটা। ‘জাস্ট আ ফ্রেন্ডলি অ্যাডভাইস – তোমার ই-মেইল আইডিতে একটা ভিডিও পাঠানো হয়েছে। ওটা চেক করে দেখো।’
বেহুদা বক বক করে লাভ নেই।
কলটা কেটে দিলাম আমি।
‘হাত থেকে ফেলে দিলে কেন দশ কোটি টাকা?’ বিছানা থেকে স্বস্তি আর বিস্ময়ের সাথে বলে ফারিহা।
‘আমার নিজস্ব কিছু নীতি আছে – যেগুলো আমি ভাঙ্গি না কখনও।’ ই-মেইলে ঢুকি কৌতুহল মেটাতে।
‘বাহ।’ উঠে দাঁড়িয়ে আমার পাশে দাঁড়ায় মেয়েটা। ওর শরীরের মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে তীব্রভাবে লাগছে। ‘নীতিবান ক্রিমিনাল?’
আমার শরীর শক্ত হয়ে যায়।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ল্যাপটপের স্ক্রীনে তাকায় ফারিহা।
ছোট্ট একটা ভিডিও পাঠিয়েছে আমার ক্লায়েন্ট।
একটা মেয়েকে টান টান করে বেঁধে রাখা হয়েছে বিছানায়।
পাশেই টেবিলে কার্ড খেলছে চারজন ষন্ডা।
‘হু ইজ শী?’ ফিস ফিস করে বলে ফারিহা।
‘শী’জ মাই সিস্টার।’ কাঁপা গলাটা আমার – আমি নিজেই চিনতে পারি না।


‘মত পাল্টেছেন বলে মনে হচ্ছে?’ খ্যাক খ্যাক করে হাসে ওপাশের গলাটা।
‘ঈশিতাকে কোথায় পেয়েছ?’ গলা ঠান্ডা রাখইতে চাইলেও পারি না।
‘আজ দুপুরে যে গানফাইট তুমি দেখালে – আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। একটু তলা খুঁড়ে ফ্যামিলি হিস্টোরি বের করতেই হল তোমার। ও তেমন কিছু না আমার জন্য। তোমার আসল নামও এখন আমি জানি, ইরফান।’
‘ডীলটা কি?’ গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি আমি।
‘ইজি।’ খুবই আমোদের সাথে বলে ক্লায়েন্ট। ‘ফাক হার।’
চুপ করে থাকি এপাশে আমি।
‘ওহ কাম অন!’ অধৈর্য হয়ে বলে ওপাশের কন্ঠটা। ‘আর ইউ ইনকম্পিটেন্ট অর হোয়াট? এটাও ভেঙ্গে বলতে হবে না নিশ্চয় – হয় তুমি ফারিহার সাথে কাজটা করবে – নাহয় তোমার বোনের সাথে একই কাজ করা হবে। ফেয়ার, কি বল?’
ইচ্ছে করছিল মানুষটার গলা খালি হাতেই ছিঁড়ে ফেলতে।
‘ওকে।’ বড় করে শ্বাস টানি আমি। ‘ওকে! আমি করছি কাজটা।’
‘গুড বয়।’ স্বস্তির সাথে বলে ওপাশের মানুষটা। ‘তোমার জন্য সুখবর আছে ইরফান, এখন তুমি নিজেকে ভলান্টিয়ার করতে অতি উৎসাহী আমি জানি – তবুও কাজ শেষে তোমার অ্যাকাউন্টে দশ কোটি পৌঁছে যাবে। আর তোমাকে দুই ঘন্টা সময় দেয়া হল। এরমধ্যে রিপোর্ট এবং ভিডিও চাই আমি। নয়তো -’
‘ডীল।’
খটাস করে ল্যাপটপের ডালা নামাই আমি।
বিছানায় হাঁটুদুটো জোড়া লাগিয়ে ওখানে থুতনী ঠেকিয়ে বসে আছে ফারিহা।
আমার দিকে তাকিয়ে থাকা বড় বড় চোখ দুটোতে ভয়।
রুম জুড়ে পায়চারী করি আমি।
ঈশিতা ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ নেই আমার।
ওর কিছু হতে দেব না আমি।
কিন্তু বিনিময়ে যা করতে হবে – তা আমার নীতি বিরুদ্ধ। জানোয়ারটা আমার ব্যাপারে একটা কথা ঠিকই ধরেছিল, এ আমাকে দিয়ে সম্ভব না।
ফারিহার বাবারও একমাত্র জীবিত আত্মীয় ফারিহাই। ভাগ্য আজ আমাদের এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে – চাইছে একপক্ষের স্যাক্রিফাইস। পুরো ব্যাপারটা আবারও ভেবে দেখতে থাকি আমি।
ফারিহার বাবার প্রতি তীব্র আক্রোশ নিয়ে কেউ একজন চাইছে তার মেয়ের কিডন্যাপের টাকা পুরোটা তো নিতেই, এবং মেয়েটারও চূড়ান্ত ক্ষতি করতে।
এখানে টার্গেট মোটেও ফারিহা নয়। তাহলে তাকে মেরে ফেলা হত না।
ফারিহার বাবাকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করতে চায় কেউ।
আরেকটু ভাবতেই মজাটা বুঝে গেলাম আমি – পুরো ব্যাপারটার সাথে টাকার কোনই সম্পর্ক নেই।
দশ কোটি টাকা মুক্তিপণ হিসেবে আমাকে ধরতে বলা হয়নি। কারণ টাকা নেবার জন্য কিছু করার নির্দেশনা এবার আমার জন্য নেই। একটা ফোনকল পর্যন্ত না!
বরং ধর্ষণ এবং খুনের জঘন্য কাজটা শেষ করলেই আমাকে দশ কোটি টাকা নিজের পকেট থেকেই দিতে চাইছে এখন আমার ক্লায়েন্ট।
পুরো ব্যাপারটা শুধু ব্যাক্তিগত নয় – পুরো ব্যাপারটার একটাই মানে থাকতে পারে।
আমরা রিজভী আকন্দের সেই শত্রুকে খুঁজছি – যার মেয়েকে ধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছে।
ছুটে এসে ল্যাপটপ খুললাম আবারও।
সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ দিলামঃ Rizvee Akanda Scandal
কোন রেজাল্ট পেলাম না।
‘শিট … কাম অন …’ বুঝতে চেষ্টা করি আমি। ‘দেয়ার মাস্ট বি সামথিং …’
আবারও সার্চ দেইঃ Bangladeshi industrialist’s daughter raped & killed…
বেশ কয়েকটা সার্চ রেজাল্ট পেয়ে যাই এবার।
দ্রুত পড়ে দেখি।
শিল্পপতি ফারুক সিদ্দীকির মেয়েকে মাত্র ছয় মাস আগে কিডন্যাপ করা হয়।
দশ কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়ার পর দিয়ে দেন ফারুক সিদ্দীকি।
কিন্তু মেয়ে বন্যাকে ফিরে পান না এতে।
এক সপ্তাহ পর মেয়েকে পাওয়া যায়।
ধর্ষিত এবং মৃত।
মিলে গেছে সবকিছুই! শুধু আরেকটা ব্যাপার দেখা দরকার।
আবারও সার্চ দেইঃ Industrialist Faruque Siddiqie – video results
কিছু ভিডিওতে তার সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়।
গলাটা আমার অতি পরিচিত।
আজ সারাদিন এর সাথেই ডীল করেছি আমি!
‘দ্যাটস আওয়ার গাই, ফারিহা।’ লাফিয়ে উঠি আমি। ‘তুমি থাকো। আমি বের হচ্ছি।’
ল্যাপটপে ভেসে থাকা ভিডিওটার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে মেয়েটা।
‘ফারুক আংকেল বাবার সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু। আমিও আসছি তোমার সাথে।’
*
রেন্ট-আ-কার থেকে ভাড়া করা গাড়িটা নিয়ে ছুটে চলেছি আমরা ফারুক সিদ্দিকীর বাসার দিকে।
‘আই কান্ট বিলিভ দিস, ইরফান।’ পাশ থেকে মাথা নাড়ায় ফারিহা।
‘পুরো ব্যাপারটার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?’ মাথা নাড়াই আমি। ‘বন্যাকে চিনতে কেমন তুমি?’
‘আমরা সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধু ছিলাম। কিন্তু কয়েক মাস আগে এই অ্যাকসিডেন্ট – ’ মুখ ঢাকে ফারিহা।
‘তোমার বাবার জড়িত থাকার কোন সম্ভাবনা আছে এতে?’ সাবধানে জানতে চাই আমি। বাবার চরিত্রে কলংক দেওয়া হচ্ছে – ক্ষেপে যাওয়া স্বাভাবিক।
‘অ্যাবসার্ড!’ তীব্র গলায় বলে ফারিহা। ‘আমার বাবাই টাকার ব্যাপারটা দেখেন ওই সময়। ফারুক আংকেল তখন দেশের বাইরে। কিডন্যাপাররা টাকার যে ডেডলাইনটা বেঁধে দিয়েছিল তার মাঝে দেশে ফিরে আসা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ওরা টাকাটা চেয়েছিল ম্যানুয়ালি। নগদ টাকা – একজন মানুষ ড্রাইভ করে ভ্যানটাকে পার্ক করে সরে চলে আসবে। টাকা নিয়ে যাওয়ার পর সব ঠিক থাকলে একদিন পর বন্যাকে ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল।’
‘কোন সম্ভাবনা, তোমার বাবা টাকাটা কম দিয়েছিলেন। দশ কোটির কম?’
‘কেন দেবেন?’ মাথা নাড়ায় ফারিহা। ‘টাকাটা ব্যাপার ছিল না তখন। বন্যাকে আমার মতই স্নেহ করতেন বাবা।’
‘কিন্তু ডেফিনিটলি তোমার বাবাকেই দায়ী মনে করেছেন ফারুক সিদ্দিকী। এতে কোন সন্দেহ নেই। মুক্তিপণের দশ কোটি টাকা – আর তোমার ব্যাপারে নির্দেশ – সবকিছু খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে এখন।’
চুপচাপ ড্রাইভ করি কিছুক্ষণ।
‘আচ্ছা – ফারুক সিদ্দিকীর সিকিউরিটি কেমন থাকে?’
‘সিকিউরিটি বাদ দাও। আমাকে দেখলে গেইটে আর কিছু বলবে না। দারোয়ানরা আমাকে চেনে। আন্টির সাথে আমি বন্যার ঘটনার পরও বেশ কয়েকবার দেখা করেছি, নিয়মিত যাওয়া হয়েছে তখন। বন্যার অভাব আন্টি আমাকে দেখে কিছুটা পূরণ করতেন… ’
‘এই রাত বারোটাতেও?’
‘গভীর রাতেও কয়েকবার গেছি। আন্টিই আমাকে ডেকে পাঠাতেন মাঝে মাঝে, অসময়ে। ঠিক যেদিন একমাস হয় বন্যার লাশ পাওয়ার আমাকে ফোন করে রাতে তাঁর সাথে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এমন বেশ কয়েকবার হয়েছে। গেটে সন্দেহ করবে না।’
‘ফারুক সিদ্দিকীর কানে না দিয়েই ওর বাসায় ঢোকা যাবে তাহলে বলছ?’
‘অনায়াসে। আর আংকেলের সাথে আমার দেখা হয়েছে খুব কম। উনি সবসময় বাইরের কাজেই ব্যস্ত থাকেন। কাজেই ঢোকার জন্য আমাদের ওকে জানাতে হবে – এরকম না। আমার মনে হয় না আমাদের দেখলে দারোয়ান বাড়ির ভেতর ফোন করবে।’
‘দারুণ।’ মনে পড়ায় বলি, ‘জানতে চেয়েছিলে। ঈশিতা ক্লাস নাইনে পড়ে।’
ফারিহার দিকে অন্যমনস্ক হয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই। ‘দুপুরে আমার বোনের ব্যাপারে কিভাবে জানলে?
‘তোমার চোখ দেখে।’ হাসে একটু ফারিহা। ‘আমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলে সে দৃষ্টি বোনের দিকেই দেয় মানুষ। আর অচেনা একজন ভিক্টিমের দিকে কেন এভাবে তাকাবে তুমি? নিঃসন্দেহে তোমারও একটা বোন আছে।’
‘প্রে ফর হার, ফারিহা।’ জীবনে প্রথমবারের মত কাওকে এই কথা বললাম আমি। ‘প্রে ফর হার।’


গৃহ পরিচারিকা তাহমিনা ঘুম ঘুম চোখে আমাদের ভেতরে নিয়ে চললেন।
রাত বারোটা বাজলেও পরিচিত সিকিউরিটি গার্ডরা ফারিহাকে দেখে আর সন্দেহ করেনি।
অবশ্য মিসেস সিদ্দিকীকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের আগমনী বার্তা।
এতটুকু করা হবে সেটা স্বাভাবিক।
আমি কেবল আশা করছি, মিসেস ফোনটা ধরার পর ‘মিস্টার’কে জানাবেন না।
ফারিহা আর তাহমিনা বক বক করে যাচ্ছে।
‘আন্টির শারীরিক অবস্থা’ নিয়ে রীতিমত উদ্বিগ্ন কি না ফারিহা!
‘আংকেল কোথায়?’ কথার ফাঁকে জানতে চাইল ফারিহা।
‘স্টাডিতে ঢুকে বসে আছেন। রাতের বেলায় ঘুমান নাকি উনি। সারাক্ষণ আছেন তো কাজ নিয়ে।’
এতটুকুই শোনার দরকার ছিল আমার।
‘সরি ফারিহা।’ বাড়িটায় পা রাখার পর এই প্রথম কিছু বললাম আমি।
তাহমিনার ঘাড়ের বিশেষ জায়গায় একটা মাপমত কোপ দিতেই তাহমিনা আন্টিরও চোখ উলটে গেল।
ধীরে সুস্থে ইনাকে শুইয়ে দিয়ে ফারিহাকে ধরলাম। ‘স্টাডিটা কোথায়?’
ডিরেকশন দেয় আমাকে ও।
‘তুমি আন্টিকে নিয়ে স্টাডিতে চলে আসো। কুইক।’ ওকে ঠেলা দেই আমি।
‘আমি কি বলে এদিকে আনব আন্টিকে?’ অবাক হয় ফারিহা।
‘যা পারো – যেভাবে পারো – আন্টিকে স্টাডিতে চাই আমার।’
আজ্ঞা পালন করতে চলে যায় ফারিহা ওপরের দিকে।
আমি ফারিহার নির্দেশনা অনুযায়ী স্টাডিরুমের দিকে আগাই।
মিনিট পাঁচেকের মাঝে পেয়েও গেলাম।
মোবাইলটা বের করে সময় দেখি – ডেডলাইনের আর মাত্র একত্রিশ মিনিট বাকি।
ভেবেছিলাম ভেতর থেকে লাগানো থাকবে।
কিন্তু নব ঘুরাতেই খোলা পাওয়া গেল।
বিশাল রুমটার শেষ মাথায় একটা টেবিলের সামনে একটা ঝকঝকে ডেস্কটপের সামনে বসে আছেন শিল্পপতি ফারুক সিদ্দিকী।
*
আস্তে করে ইনার মাথায় পিস্তলটা ঠেকালাম।
চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরলেন ধীরে সুস্থে। আমাকে দেখে চেহারায় প্রথমে ভীতি , তারপর একে একে বিস্ময়, আতংক এবং সবশেষে স্বস্তি ফুটে ওঠে।
‘ইম্প্রেসিভ।’ হাসিমুখে বলে উঠলেন তিনি। নিজেকে আবারও ফিরে পেয়েছেন। ‘ফ্যান্টম ইরফান কেন বলা হয় তোমাকে আজ আমার কাছে স্পষ্ট। সাবাশ, ছেলে।’
‘মি. সিদ্দিকী।’ বরফ শীতল গলায় বলি আমি। ‘ডীলটা আরও সহজ করে দিচ্ছি আমি আপনার জন্য।’
আগ্রহের সাথে তাকিয়ে থাকেন ফারুক সিদ্দিকী।
‘আপনার জীবনের বিনিময়ে আমার বোনের জীবন। সসম্মানে ঈশিতাকে এখানে আপনার বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যাবস্থা করবেন আপনি। আমরা কি একমত?’
‘হাহ হাহ হা।’ মাঝারি হাসি দিলেন শিল্পপতি। ‘আমাকে গুলি করে মেরে ফেলে কি লাভ? তোমাকে দেয়া দুই ঘন্টার আর…’ ঘড়ি দেখেন তিনি, ‘আটাশ মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড অ্যান্ড কাউন্টিং … তারপর চারজনকে বলে দেয়াই আছে – এর মাঝে আমি তাদের ফোন না দিলে ওদের কর্তব্য কী।’
‘সেজন্যই আপনি ওদের এখন ফোন দিচ্ছেন।’ পিস্তলটা নাচাই আমি।
‘পিস্তল সরাও তো!’ বিরক্ত হয়ে বলেন আবার, ‘আমাকে মেরে ফেললেও রেজাল্ট পাল্টাচ্ছে না – জানো তুমি। এর চেয়ে আমার দোতলায় একটা ফাঁকা রুমে তুমি ফারিহাকে নিয়ে ঢুকে যাও। তোমার কাজ শেষ করার জন্য আটাশ মিনিট যথেষ্ট। লেটস গো ব্যাক টু দ্যা ফার্স্ট ডীল।’
স্টাডি রুমের ভেতর ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়েন এই সময় একজন মোটাসোটা প্রৌঢ়া।
পিছে ফারিহা।
ইনি নিঃসন্দেহে মিসেস সিদ্দিকী।
আমাকে স্বামীর মাথায় পিস্তল ধরে থাকতে দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না তিনি।
‘ফারুক!’ বাজপাখির মত হুংকার দেন মহিলা, ‘আমি কিছু প্রশ্নের জবাব চাই।’
‘সত্য-বলা-ছাড়া-আর-কোন-ভাল-উপায়-পেলাম-না’ টাইপ একটা লুক দেয় আমাকে ফারিহা।
‘ইউ বেটার অ্যানসার হার, মি. ফারুক।’ পিস্তলের খোঁচা দেই আমি ইনার মাথায়।
‘ফারিহাকে কিডন্যাপ করানোর জন্য তুমি নাকি এই ছেলেকে ভাড়া করেছ?’ চেঁচান আবার মহিলা, ‘এটা কি সত্যি?’
‘অফ কোর্স এটা সত্যি!’ দাঁড়িয়ে যান ফারুক সিদ্দিকী রাগে আর উত্তেজনায়। ‘তুমি কি মনে কর আমার একমাত্র মেয়ের এই পরিণতির জন্য যেই লোকটা দায়ী তাকে আমি কিছুই বলব না?’
‘রিজভী তোমার ভালো চেয়েছে আজীবন, ফারুক। তোমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও। ওরা… ফারিহা, আমাদের মেয়ের মতো! কন্যাশোকে পাগলামী করছ তুমি।’ বোঝানোর চেষ্টা করেন মিসেস সিদ্দিকী। ‘বন্যার টাকাটা নিজে ডেলিভারী দিয়ে এসেছিল ও। তার মেয়েকে তুমি -।’
‘টাকা ডেলিভারী দিয়ে বেশ করেছে!’ ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে হুংকার দেন ফারুক সিদ্দিকী। ‘উইদ-আ–ট্রাকিং–ডিভাইস!’
থমকে যাই আমরা সবাই।
‘ডীলটা ছিল দশ কোটি টাকার বিনিময় আমার বন্যাকে আমি ফিরে পাব। কিডন্যাপাররা বার বার বলেছিল তাদের দিকে বিন্দু মাত্র অ্যাপ্রোচ নেয়া হলেই ডীলটা আর থাকবে না। আমি নিজে বার বার বলে দেই রিজভীকে। বাট – হি ট্রাইড টু বি আ হিরো! কিডন্যাপারদের ধরার জন্য একটা জীবন বাজি ধরেছিল ও – বন্যার জীবন! পুরা রিস্কটা কার ওপর ছিল? আমার বন্যার ওপর। পুরো ধাক্কাটা কার ওপর দিয়ে গেল? আমার ওপর! আমার নিষ্পাপ মেয়েটার ওপর! সো ডোন্ট ট্রাই টু টেল দ্যাট আই অ্যাম রং! ’
বলে যান ফারুক সিদ্দিকী। ‘আমি ওই লোকটাকে একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিতে চাই – দশ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মেয়েকে সুস্থ স্বাভাবিক দেখার আশা করার পর রেইপড অ্যান্ড মার্ডারড মেয়েকে ফিরে পেতে তার কেমন লাগে। ফেয়ার!! ইজনট ইট?’
আড়চোখে ঘড়ি দেখি আমি।
আর মাত্র ষোল মিনিট বাকি আছে।
প্রচন্ড জোরে আঘাত হানি ফারুক সিদ্দিকীর মাথায়।
কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। আৎকে ওঠেন মিসেস সিদ্দিকী।
‘আপনাদের প্রতি আমার সিমপ্যাথি আছে মিসেস সিদ্দিকী।’ তাঁকে অভয় দেই। ‘কিন্তু আপনার সাইকোপ্যাথ স্বামী একটা ফোন কল না করলে আমার বোন ঈশিতার পরিণতি ঠিক বন্যার মতই হতে যাচ্ছে। আই অ্যাম সো সরি, মিসেস সিদ্দিকী।’
এগিয়ে এসে ভদ্রমহিলার মাথায় পিস্তলটা ঠেকাই।
‘আমি দশ গুণব। এর মাঝে আমার ফোনকলটা চাই। আপনার এই বাসায় ঈশিতাকে সসম্মানে জীবিতবস্থায় এনে দেওয়া হবে। নাহলে মিসেস সিদ্দিকীর মাথায় গুলি করে আপনাকেও ধ্বংস করে দেব মি. সিদ্দিকী । এটাই আমাদের ডীল।’ পকেট থেকে নতুন কেনা মোবাইলটা বের করে দেখাই। ‘ঢোকার আগেই রেকর্ডিংটা অন করে নিয়েছিলাম, স্যার। আপনার জবানবন্দী অনুযায়ী দুটি কিডন্যাপিং, দুইটি খুন এবং একটি অ্যাটেমপ্ট টু মার্ডারের আসামী আপনি। বাবার নিষ্ফল আক্রোশ অনুভব করেছেন, কিন্তু ভাইয়ের মরিয়া প্রচেষ্টা দেখেননি। ভুল মানুষের সাথে টক্কর লাগিয়েছেন আপনি মি. সিদ্দিকী। এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় … ’
ঝড়ের বেগে গুণে যাই আমি। সাইকোটা ভাবার জন্য বেশি সময় পাবে না এতে।
‘ডোন্ট শূট! ডোন্ট শূট।’
‘সাত … আট … নয় …’
ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোনটা তুলে নেন শিল্পপতি।
অক্ষরে অক্ষরে আমার দাবী পৌঁছে দেন ওপাশে।
পিস্তলটা সরিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি একটা আমি।
*
গাড়ি ছুটে চলেছে আমাদের।
বেরিয়ে পড়েছি আমরা ফারুক সিদ্দিকীর বিশাল বাড়িটার ত্রিসীমানা থেকে।
পেছনের সীটে ঈশিতা কাঁপছে থরথর করে – ওকে ধরে রেখেছে ফারিহা।

পরিশিষ্ট
গাড়ি থামালাম আস্তে করে। ঘুমিয়ে পড়েছে ঈশিতা।
নেমে এলাম আমি।
বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় ফারিহা। নেমে আসে ও-ও।
‘এটা আমাদের বাসা। চিনলে কিভাবে?’
‘ভুলে যাচ্ছ।’ হাসি আমি। ‘তোমাকে কিডন্যাপ করতেই আজ সকালে বের হয়েছিলাম আমি।’
‘চৌদ্দ ঘন্টার মাঝে কতকিছু তাই না?’ বিষন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় ফারিহা।
অপরূপ ওই বড় বড় চোখদুটোতে ডুবে মরতে ইচ্ছা করল আমার।
‘জাহিদের খুনীকে ছেড়ে দিলাম আমরা। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা কিছু হতে পারে না।’ বিষন্ন মুখটা আরও বিষন্ন হয়ে যায় ওর।
‘উহু। আমরা ছেড়ে দেইনি।’ বলি আমি, ‘শুধু একটা জবানবন্দী তার কাছে হস্তান্তর করেছি। আরও ট্রেইল থাকতে বাধ্য। আজকের সব ঘটনা মি. রিজভী যখন জানবেন – আশা করি সেসব ট্রেইল উনি বের করে আনবেন।’
‘ইরফান?’ কেমন করে জানি ডাকে আমাকে ফারিহা। আমার বুকে ঝড় ওঠে।
‘আমার আসল নাম ইরফান না, ফারিহা।’ আস্তে করে ওকে জানাই। ‘আমার নাম রবিন।’
মিষ্টি একটা হাসি ফুটে ফারিহার মুখে, ‘রবিন, তোমাকে সারাদিনের জন্য অসংখ্য থ্যাংকস।’
‘ধন্যবাদ তোমার পাওনা, ফারিহা। আমি ঈশিতাকে হারাতাম আজ তুমি না থাকলে।’
টুক করে আমার গালে চুমু খায় ফারিহা। ‘ধন্যবাদের বোঝা একে অন্যের ঘাড়ে থামানো বন্ধ করে ভেতরে এসো। বাবার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই।’
মাথা নাড়ি আমি, ‘আরেকদিন, ফারিহা।’
হাত বাড়িয়ে দেয় ফারিহা, ‘মোবাইল নাম্বার লিখে দাও। মোবাইল তো তোমার সেইফ হাউজে ফেলে এসেছি।’
মোবাইল নম্বরটা ওর হাতে লিখে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসি আমি। স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যাই হোটেলের দিকে।
পেছনে মিষ্টি একটা হাসি মুখে নিয়ে তাকিয়ে থাকে ফারিহা।
রুমটা ভাড়া আছে এখনও। আজ রাতটা ঈশিতাকে ওখানেই রাখার ইচ্ছে আমার।
কানে ভাসছে জাহিদের শেষ বাক্যটা, ‘ফারিহাকে দেখে রাখবেন…’
আকাশের দিকে তাকাই, ‘জাহিদ, কথা দিচ্ছি, মায়াবতী এই মেয়েটাকে দেখে রাখব আমি।’

চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *