আমি জুনিয়র
ভার্সিটির পাশের টং-এ বসে চা-সিগারেট খাচ্ছিল ফরহাদরা। বিশ মিনিটের এই ব্রেকটা কাটাবার জন্য এর থেকে ভালো কোন উপায় ওরা আজও বের করতে পারেনি।
শাহরিয়ারই খেয়াল করে প্রথমে ব্যাপারটা।
‘দোস্ত, রাস্তার ওইপাশের পোলাটারে দ্যাখ! সিগারেটে জোশের সাথে টান মারতে মারতে আমাদের দিকে স্ট্রেইট তাকায়া আছে! এই পোলারে আমি চিনি। ফার্স্ট ইয়ারের। ’
‘কস কি!’ ফরহাদের মেজাজ লাফ দেয় ওপরের দিকে, ’র্যাগিং কি জিনিস বুঝে নাই তাইলে এখনও! ডাক এদিকে বেয়াদবটাকে। ’
‘আরে বাদ দে না তোরা!’ মৃদু আপত্তি তোলে নীরা।
নীরাকে অগ্রাহ্য করে হাত তুলে হালকা ইশারা করে শাহরিয়ার।
ফরহাদরা সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র-ছাত্রী। মাত্র কয়েকদিন হল নতুন ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়েছে। র্যাগিং- কি জিনিস রাস্তার ওপাড়ের ছেলে হয়ত টের পায় নি – কিন্তু হামেশাই সেটার প্রয়োগ করতে পেরে গত কয়েকটা দিন অসাধারণ কাটছে সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেদের।
চায়ের দোকানের বিল মিটিয়ে ধীর পায়ে এদিকে আসতে থাকে ফার্স্ট ইয়ারের ’বেয়াদব’টা। হাতে সিগারেট জ্বলছে এখনও। মনে মনে খুশি-ই হয় ফরহাদ, র্যাগিওমিটারের কাঁটা আরও কয়েক ডিগ্রী বাড়িয়ে দেয় মনে মনে।
‘আমাকে ডাকলেন নাকি, ভাইয়া?’ কাছে এসে রাজ্যের কৌতুহল চোখেমুখে ফোটায় ছেলেটা।
‘কোন ব্যাচ?’ থমথমে মুখে জানতে চায় ফরহাদ।
‘ ওয়ান-থ্রি। (এইচএসসি ২০১৩)।’ সিগারেটে উদাস ভঙ্গীতে টান মারে ও।
‘কি নাম?’ থমথমে ভঙ্গী বাড়ায় ফরহাদ।
‘তুর্য। আপনি?’
‘আমি ফরহাদ। আমাকে দেখে কোন ব্যাচ মনে হয়?’
‘ওয়ান-টু, সম্ভবতঃ?’ সিগারেটে আরেক টান দিয়ে মনোযোগ দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আকাশ দেখে তুর্য।
‘সিনিয়র ভাই জানার পরও সামনে সিগারেট খাচ্ছ – সরাসরি তাকিয়ে আছ – নিজেকে ওভারস্মার্ট মনে কর?’
অবাক হল যেন একটু ছেলেটা, ‘এই প্রসঙ্গ কেন। আমি কিছুই ভাবিনি। তাছাড়া – আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম না, ভাইয়া। ’
‘তাহলে কি দোকানদার মামারে দেখতেছিলা? ’ রাগের ঠেলায় উঠেই পড়ে শাহরিয়ার।
‘না ভাইয়া। উনাকে দেখছিলাম।’ চমকে ওঠা নীরার চোখের দিকে তাকায় তুর্য।
এবার আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না ফরহাদ। উঠে একদম গা ঘেষে দাঁড়ায় তুর্যের।
‘আবার বল তো শালা!’ ‘তুমি’ থেকে এক লাফে ‘তুই’ এ নেমে গেল ফরহাদ।
সরে এসে নীরার সামনে দাঁড়ায় তুর্য, ’আপনার চোখ আর চুল অনেক সুন্দর। না তাকিয়ে থাকতে পারিনি, দুঃখিত। আমি তুর্য। আপনার নামটা জানা হল না। ’
পাশ থেকে আহত বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে ফরহাদ। তুর্য ধাক্কা সামলাতে পারেনা। ছিটকে পড়ে মাটিতে। ওর ওপর এসে পড়ল ফরহাদ। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে যেন রাগে। একের পর এক ঘুষি মারছে এখন তুর্যের মুখে।
কেউ ঠেলে সরিয়ে দিল ওকে। তাকিয়ে নীরার রাগত মুখটা দেখতে পায় ফরহাদ।
‘দিস ইজ টু মাচ!’ চিৎকার ছাড়ে নীরা।
‘সর তুই। শালাকে রেসপেক্ট শিখাতে দে!’ রাগে ফোঁস ফোঁস করে ফরহাদ।
‘একটা বাচ্চা ছেলেকে এভাবে মারিস! আমার সামনে থেকে সর তুই! তোর চেহারা দেখাবি না আর আমাকে! ’
হতভম্ভ হয়ে তাকায় ফরহাদ। ততক্ষণে লোক জমে গেছে চারদিকে।
আস্তে করে উঠে বসে তুর্য। থুতু ফেলে রাস্তায়। অনেকটুকু রক্ত বেরিয়ে আসে তার সাথে।
‘তুমি আমার সাথে আসো। ফার্স্ট এইড দরকার তোমার।’ তুর্যকে ধরে টেনে তোলে নীরা।
আলতো করে নীরার হাতটি ছাড়িয়ে নেয় তুর্য। ’ইটস ওকে। ’
ফরহাদের মুখোমুখি দাঁড়ায় ও। ’ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিন। সিনিয়রদের প্রতি রেসপেক্ট জিনিসটা কিছুটা আছে। তবে আজ থেকে আপনার প্রতি আর থাকল না। ’
‘শালা আবার আমাকে থ্রেট দিস- ’ বলতে বলতে আবারও তুর্যের মুখ লক্ষ্য করে হাত ছোঁড়ে ফরহাদ।
বিদ্যুতবেগে রিঅ্যাক্ট করে তুর্যও। ফরহাদের হাত ধরে দ্রুত কয়েক জায়গা ছুঁয়ে দেয় ও।
যেন কিছুই হয়নি, এমন এক ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা রিকশা থামায় জুনিয়র ছেলেটা। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীরা।
হাত নড়ানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হল ফরহাদ। অবশ হয়ে গেছে ওর ডানহাত।
*
পরের দিন।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে নীরা দেখল দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য।
‘আপনার দুই মিনিট সময় হবে?’ বিনীত গলায় জানতে চায় ও।
তুর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নীরা। স্টিচ লাগানো ঠোঁটের পাশে।
‘তুমি কি পাগল?’ পালটা প্রশ্ন করে নীরা। ’একটা ভার্সিটিতে তোমাকে চারটা বছর থাকতে হবে! সিনিয়ররা সবাই তোমার ওপর ক্ষ্যাপা। মানি – তোমার সাহস আছে। কিন্তু টিকতে পারবা এরকম অ্যাটিচ্যুড নিয়ে চললে?’
‘ও নিয়ে ভাববেন না।’ হাসে তুর্য। ওর হাসিটা সুন্দর। ’কিন্তু গতকাল আপনার নামটা জানা হয়নি। ’
‘আমি নীরা। নাম জেনেছ – প্রাণে শান্তি লেগেছে এবার তোমার?’ রাগ করতে যেয়েও পারে না নীরা কেন যেন। ’তোমাকে একটা ভালো বুদ্ধি দেই – ফরহাদকে গিয়ে সরি বলে আসো। ছোটখাট র্যাগিং সহ্য করে নাও – সব ঠিক হয়ে যাবে। নাহলে সত্যি বলছি – তোমার কপালে যথেষ্ট খারাবি আছে। ’
‘অন্যায় করলে তো সরি বলব!’ খুব মজার কিছু বলেছে নীরা এভাবে হাসে তুর্য। ’আপনাকে কিন্তু আমি আপু-টাপু ডাকতে পারব না। মাইন্ড করবেন না আশা করি – কারণ করলেও কিছু করার নেই। আসি, নীরা। দুই মিনিট দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ’
‘কি ভয়ানক! সিনিয়র আপুর সাথে এভাবে কথা বল তোমার ভয় করে না?’ রাগতে যেয়ে এবার হেসেই ফেলে নীরা। ’কোথায় যাও? তোমার ক্লাস নাই?’
‘না। ভাইয়ারা হলে ডাকল। কালকের ব্যাপারের জন্য। দেখি কি বলে! ওখানে যাচ্ছি। ’
আৎকে ওঠে নীরা। ’তুর্য, লক্ষী ভাই আমার – ওখানে গিয়ে এরকম সাহস দেখিও না! স্রেফ দুই টুকরো করে ফেলবে!’
‘ধ্যাৎ! রাখো তো। ছাই করবে আমার। ’
‘পাগলামি রাখো! ওইখানে অন্তত ভদ্রভাবে কথা বলে আসো। অনুরোধ করছি তোমাকে। ’
‘এত ভীতু কেন তুমি?’ হাসে ছেলেটা। ’তোমার ল্যাব আছে! দেরী করো না। ’
হেঁটে চলে যায় তুর্য। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে তার – আরে! ওর শিডিউল তুর্য জানে কি করে?
কিন্তু তুর্য যে’আপনি’ থেকে ওকে’তুমি’ করে বলা শুরু করেছে – সেটা খেয়ালই করে না নীরা।
*
কামরুজ্জামান হল।
৪০৮ নম্বর রুম।
ছাত্রলীগের সভাপতি শাজাহান সিরাজের সামনে দন্ডায়মান তুর্য। সিরাজ ফোর্থ ইয়ারে। ফরহাদের আপন বড় ভাই।
রুমে আরও সাতজন সিনিয়র ভাই থাকলেও চোখেমুখে ঘাবড়ে যাওয়ার কোন লক্ষণই নেই তুর্যের ভেতরে।
‘বাড়ি কই তোমার?’ সিরাজ মুখ খুলল কি মেঘ গর্জন করল ঠিক বোঝা গেল না।
‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ’
‘বাবা কি করে?’
‘প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা। ’
‘অ, টিচারের ছেলে। তারপরও আদব-কায়দা কিছু শেখ নাই? সিনিয়র ভাইয়ের সামনে সিগারেট খাও! আপুদের সাথে টাংকি মারো!’
‘ভাইয়া – সিগারেট খাওয়ার মধ্যে বেয়াদবির কি আছে? আমরা কি বড় ভাইদের সামনে চা খাই না? ভাইয়ারা সামনে দিয়ে গেলে কি চা মাটিতে ফেলে দিয়ে সম্মান দেখাই?’ পালটা প্রশ্ন করে তুর্য।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সিরাজ। ছেলের কথায় যুক্তি আছে। সিগারেটের কি এমন দোষ যে একে ফেলে দিয়ে সম্মান দেখাতে হবে? এই ছেলের মধ্যে কিছু একটা আছে। ভয়-টয় পাবে না। পালটা কি বলে ফেলে জুনিয়রদের সামনে হাসির পাত্র করে ফেলবে।
‘বুঝলাম তোমার দৃষ্টিভঙ্গি।’ মেনে নেওয়ার ভঙ্গী করে সিরাজ। রুমের এক প্রান্তে অসন্তোষের নিঃশ্বাস ছাড়ে ফরহাদ, ’তাই বলে আপুদের সাথে টাংকি? সিগারেট নাহয় ছেড়ে দিলাম। আপুদের ফ্লার্ট করে বেড়াচ্ছ শুনলাম। সেটা খুবই প্রশংসাজনক কাজ বলতে চাও তো?’
‘নীরাকে আমার ভালো লাগে।’ আবারও লাফিয়ে উঠে ফরহাদ। হাতের ইশারায় তাকে বসিয়ে দেয় সিরাজ। বলে চলে তুর্য, ’ভালো লাগার কথা সামনাসামনি বলে ফেলাটাই সত্যিকারের পুরুষের কাজ বলে মনে হয় আমার। বন্ধুত্বের আড়াল নিয়ে তুই-তোকারি করে কথা বলে ভালো লাগার ব্যাপারটা অস্বীকার করে থাকার মাঝে কোন কৃতিত্ব দেখি না। ’
দ্বিগুন উৎসাহে লাফিয়ে ওঠে ফরহাদ। কিন্তু বড় ভাইয়ের ইশারায় আবারও বসে পড়তে হয় তাকে।
‘সিনিয়র ভাইয়ের গায়ে হাত তুলতেও বাধে নি তোমার …’
‘ওহ – ওটা সেলফ ডিফেন্স ছিল ভাইয়া। নাক মুখ সমান করে ফেলতে থাকলেই যে সমান করতে দিতে হবে তা তো নয়। রিফ্লেক্স পুরোটাই।’ আঙ্গুল দিয়ে স্টিচ দেখায় তুর্য। ’নাহয় এরকম আরও আধ-ডজন লাগাতে হত। থ্যাংক্স টু হিম। মাথা-টাথা ফেটে গেলে তো বিশাল খরচ, হাসপাতাল-’
আমসি মুখে বসে পড়ল এবার ফরহাদ। ঘরের সবাই বুঝতে পারছে ওকে ওভাবে মারতে থাকলে খারাপ একটা কিছু হয়ে যেতে পারতো। তুর্যের চোখ-মুখের ফাটা দশাই এর প্রমাণ। কাজেই কেউ তার সেলফ-ডিফেন্স তত্ত্ব একেবারে ফেলে দিতে পারলো না। এসব ব্যান্ডেজ নিয়ে প্রশাসনের কাছে চলে গেলে এই ঘরের সবার কপালে খারাবি আছে, জানে। তাই হয়তো সিনিয়র-ইগোটাকে আপাতত গিলে রাখতে হলো তাদের। তারা তাকিয়ে থাকলো নেতার দিকে।
‘শোন ছেলে – ’ মুখ খুলল সিরাজ। ’তোমার সাহসিকতা আর সোজাসাপ্টা দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি মুগ্ধ। কিন্তু একটা ব্যাপার তোমাকে মাথায় রাখা লাগবে – বেশির ভাগ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরেই ম্যানার জিনিসটাকে বিবেচনা করা হয়। পর্নোগ্রাফি জিনিসটা পর্নস্টারদের কাছে খারাপ না। তাই বলে সেটা সমাজে চালাতে চাইলেই তো হবে না, তাই না?’
মনে মনে আটটা পয়েন্ট দেখতে পায় তুর্য – তার আচরণের সাথে ভাইয়ার কথার অমিল ওগুলো। কিন্তু আর কথা বাড়ায় না। সবার সামনে স্ট্রেইটফরোয়ার্ড হয়ে ক্ষেপিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া এই ভাইয়া ওকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ফরহাদ বেকুবটার মত না।
‘মাত্র নতুন একটা ভার্সিটিতে আসছ – ভুল ত্রুটি হয়ে যায় দুই তরফ থেকেই। এগুলো ভুলে যেতে হয়। তুমি ছেলেটা খারাপ না। নাহলে এত কথা বলার কিছু ছিল না। তোমার ওয়ান-টু এর ভাইয়াদের কাছেই ছেড়ে দিতাম। কিন্তু তোমার ক্যারেকটারটা ইন্টারেস্টিং, ভাবলাম দেখা করি ছেলেটার সাথে। আশা করি যে সম্মানটা তোমাকে দিচ্ছি আমি – সেটার মর্যাদা তুমি রাখবে। আর ভাইয়ারাই দেখবা সব বিপদে সবার আগে উপস্থিত হবে। ভার্সিটিটা একটা ফ্যামিলির মত। থাকো – আস্তে আস্তে বুঝবা নিজেই।’ হাত বাড়ায় সিরাজ, ’আমি সিরাজ, মেকানিক্যাল ওয়ান -জিরো।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ হাত মেলায় তুর্য। ’অপ্রীতিকর কিছু শোনা লাগবে না আর আশা করি আপনাকে। ’
‘অ্যাই তোরা কোলাকুলি কর।’ ফরহাদকে বলে সিরাজ। ’ফ্যামিলিতেও ভাই-ভাইয়ের মিলে না সব সময়। ’
বর্জ্র্য আটুনি দিয়ে কোলাকুলি করেই ঝাল মেটাতে হয় বেচারা ফরহাদকে।
*
‘নীরা!’
লেডিস হোস্টেলের গেট দিয়ে ঢুকতে যেয়েও শব্দের উৎসের দিকে মাথা ঘোরাতে বাধ্য হয় নীরা। পাগল টাইপ জুনিয়র ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে গাছের সাথে হেলান দিয়ে। সাদা টি-শার্টের সাথে নীল জিন্সে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তুর্যকে।
‘কিছু বলবে?’ সিনিয়র-ভাবটা গলায় ফুটিয়ে তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হয় নীরা।
‘আমি এক অসহায় জুনিয়র। ’
কিছুটা ঘাবড়ায় নীরা। পাগলটা কি বলতে কি বলে কোন ঠিক নেই! সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তুর্যের দিকে।
‘ফিজিক্সের চোথা লাগবে। যদি কিছু রেখে থাকো এখনও।’ অবলীলায় ওকে তুমি করেই বলে তুর্য।
‘তোমার ভাইয়াদের কাছে নাই? আমার কাছে কেন?’
‘ভাইয়াদের কাছে গেলে তো তোমাকে দেখার বোনাসটা পাব না।’ অকপটে স্বীকারও করে তুর্য।
ওর সাহস দেখে শুধু অবাকই হয় নীরা। কিন্তু আশ্চর্য – রাগ উঠে না একটুও।
‘বিকেলের দিকে আসো তাহলে।’ কেন যেন রাজি হয়েও যায় নীরা।
‘ক্যাম্পাসের বাইরে?’ ব্যাপক আশা নিয়ে জানতে চাইল তুর্য।
‘না। এই গেইটেই।’ বেচারার আশাতে পানি ঢেলে দেয় নীরা। ’তোমার সমস্যা কি? এত এক্সট্রোভার্ট কেন?’
‘উপরওয়ালার দান।’ মোবাইল বের করে তুর্য, ‘নাম্বার তো দাও। আমি গেইটে আসার পর যদি তোমার মনে না থাকে?’
‘জ্বী না। আমার মনে থাকবে। তাছাড়া, আমি তো আসব না। দুপুরের মাঝেই মামাকে দিয়ে যাব। এসে আমার নাম বললেই দিয়ে দেবে। ’
ভেতরে ঢুকে যায় নীরা। আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় তুর্য।
*
দেখতে দেখতে একটা বছর ঠিকই পেরিয়ে যায়।
জুনিয়র–সিনিয়র প্রেম-প্রেম গন্ধ ক্যাম্পাসে রীতিমত সাড়া ফেলে দেয়। চায়ের কাপে ঝড় তুলতে তুলতে মাঝে মাঝে তুর্য–নীরার নাম নেওয়া হয় না তা নয়। যদিও নীরা তার দূরত্ব অটুটই রাখে।
এর মাঝে ফরহাদ নীরাকে প্রপোজ করে। এককথায় নাকচ করে দেয় নীরা। তুর্যের সাথে সেদিনের করা ব্যবহারের পর থেকে আসলেই ফরহাদের সামনে পড়েনি কখনও ও।
সবচেয়ে বেশি বিরক্ত থাকে নীরার বান্ধবীরা।
‘তুই এখনও ওকে পাত্তা দিস কেন আমি সেটাই বুঝি না।’ ভ্রু কুঁচকে বলে মালিহা।
মালিহার সম্পূর্ণ সাপোর্ট দেয় রিয়া। ’একদম ঠিক বলেছিস। আমি হলেও কান ধরে টেনে দুইটা থাপ্পড় লাগাতাম। পরের দিন থেকে রীতিমত আপু-আপুন্নি শুরু করত।’
‘ওর অনেক সাহস দোস্ত। এই জিনিসটা আমার ভালো লাগে। তাই কিছু বলি না। আমার মনে হয় ওর এই সাহসটা ভালো কোন কিছুর জন্যই আল্লাহ ওর ভিতরে দিয়ে পাঠিয়েছেন। নিরুৎসাহিত করতে ইচ্ছে করে না রে। ’
‘নিজেকে ফ্রাংকেনস্টাইনের স্রষ্টা ভাবা শুরু করেছিস দেখি একেবারে।’ নাক কোঁচকায় মালিহা।
লেডিস হোস্টেলের সামনের গাছটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরা। দুই সপ্তাহ ধরে তুর্য আসে না এখানে।
মাঝে মাঝেই ছোটখাট সাহায্য চাওয়ার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকত সে। নীরা বুঝত শুধু ওকে একটু দেখার জন্যই ওখানে আসত। আর কিছু নয়।
আড় চোখে একে অন্যের দিকে তাকায় মালিহা আর রিয়া।
‘মামাকে বলে দিয়েছিলাম ছেলেদের যাতে বাউন্ডারীর আশেপাশে দাঁড়াতে না দেয়।’ যেন রিয়াকে কথার কথা বলছে এভাবে জানায় মালিহা।
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে নীরা।
*
‘ওমা এইটা তো পুরাই Wall E!!’ এক মেয়ে খুশিতে হাততালি দেয়।
‘কথা বল! কথা বল!! কথা বলতে পারিস না?’ আরেক মেয়ে ’বস্তু’টাকে প্রশ্ন করে যায়।
‘অ্যাই তোর মালিক কোথায়?’
‘অ্যাই রোবট! চোখ খোল!! আমার দিকে তাকা!’
‘ইইইইইইইইইইইই!! আমি রোবট পুষব-ওওও।’ অতি আদরের কোন এক দুলালী একপাশ থেকে বলে।
লেডিস হোস্টেলের সামনে মেয়েদের একটা ভীড় লেগে গেছে। গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবটটার দিকেই সবার মনোযোগ। ছোট্ট একটা রোবট। ছোট্ট দুটো পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে পায়চারী করছে। আশেপাশের মেয়েদের টিটকারী ওর ধাতব গায়ে যেন স্পর্শই করছে না।
হঠাৎ থেমে যায় ওটা। স্পষ্ট উচ্চারণে বলে, ’ইমতিয়াজ উদ্দীন? সামনে আসুন।’
‘দারোয়ান মামাকে ডেকেছে! দারোয়ান মামাকে ডেকেছে!’ হাততালি রোগে আক্রান্ত মেয়ে হাততালি দেয় আবারও। সেই সাথে চলছে ধারাভাষ্য।
দারোয়ান সামনে আসতেই টিপটিপ করে চোখ খোলে ক্ষুদে রোবট।
‘আইডেন্টিফাইড। আমি ছেলে নই। রোবট। আমাকে খেদানোর চেষ্টা করলে ফলাফল শুভ হবে না। মাথায় রাখবেন।’
মাথায় কি রাখবে! মাথা কোথায় রেখেছে সেটা ভাবতে ভাবতেই হয়তো ওটা চুলকে একদিকে হাঁটা দিলেন দারোয়ান মামা।
‘অ্যাই নীরা।’ নীরার সামনে দাঁড়িয়ে অবিকল তুর্যের কন্ঠে বলে ওঠে রোবটটা। ’রোবট তোমাকে চেনায় ঘাবড়িও না। আমাকে আসতে দেয় না। তোমাকে দেখি না। একটা রোবট বানাতেই হল। ফেইস রিকগনাইজার আছে, ভড়কে যেয়ো না। মোবাইল নম্বর তো দিলা না। রোবট দিয়েই কাজ সাড়া লাগছে। শহীদ মিনারে বসে আছি। ইচ্ছে করলে আসো। ক্যাম্পাসে কি বলবে সেই ভয় পেলে এসো না। তোমাকে একটু দেখে চলে যেতাম। ’
ক্যাম্পাসের ভয়? তুর্যের ভেতর অসামান্য সাহস কেন দেওয়া হয়েছে এতদিনে যেন হঠাৎই বুঝে যায় নীরা। সাহস জিনিসটা সংক্রামক। একজন থেকে ছড়িয়ে যায় সবদিকে। জ্যামিতিক হারে বাড়ে তার পরিমাণ। সামনে পা বাড়ায় নীরা।
‘তুই একটা জুনিয়র ছেলের সাথে দেখা করতে যাবি!?’ মালিহা পাশ থেকে জানতে চায় একঝাঁক অসন্তোষ গলায় নিয়ে।
রহস্যময় একটা হাসি হেসে এগিয়ে যায় নীরা – যার অর্থ ’হ্যাঁ’ কিংবা ’না’ দুটোই হতে পারে …
রচনাকাল – ডিসেম্বর ৯, ২০১৩
Leave a Reply