Skip to content
KP Imon
KP Imon

Words Crafted

  • গুহামুখ
  • সূচিপত্র
  • গল্প
    • রম্য
    • জীবনধর্মী থৃলার
    • সাইকোলজিক্যাল
    • রোমান্টিক
    • ক্রাইম
    • সাসপেন্স
    • জীবনধর্মী
  • নন-ফিকশন
    • থট প্রসেস
    • উচ্চশিক্ষা
    • আমেরিকা-নামা
    • জীবনোন্নয়ন
    • তাত্ত্বিক আলোচনা
    • ডায়েরি
  • প্রকাশিত বইসমূহ
    • প্রকাশিত বইসমূহ
    • যেসব গল্প সংকলনে আছে আমার গল্প
KP Imon
KP Imon

Words Crafted

ক্যাথি

Posted on February 13, 2023

‘আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো যা বেহায়া আর বেশরম হয়েছে না! বেতিয়ে সবার পাছা লাল করে দেওয়া উচিত।’
রাফিদ সাহেবের কথা শুনে ইকরাম সাহেব একটু গাল চুলকালেন। বেতানোর টপিকটাই ভয়ংকর। তার সাথে বিশেষ অঙ্গ লাল করার কথা থাকলে তো কথাই নেই! ইকরাম সাহেব নির্বিরোধী মানুষ। বেত-প্রসঙ্গে ইনি নেই। ওপরেও না। নীচেও না।
যদিও একই রুমে অফিসওয়র্ক করতে হয় বলে রাফিদ সাহেবের হুঙ্কার না শুনে আর কোন উপায় ইকরাম সাহেবের থাকে না। ইকরাম সাহেবের চুপচাপ থাকায় অবশ্য রাফিদ সাহেবের রাগ পড়ে গেল এমন নয়। টকটকে লাল চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলেন তিনি।
‘আর বলবেন না। আমার মেয়েটার কথা বলছি। সারা রাত জেগে জেগে তার ফুসুর ফাসুর।’
‘ছেলেটা কি করে?’ গলা খাকারি দিয়ে সাহস করে জানতে চেয়েই ফেললেন ইকরাম সাহেব।
‘আমার ছেলে?’ দ্বিগুণ তেজে জানতে চাইলেন মানুষটি।
‘না। যার সাথে ফুসুর ফাসুর।’ ক্লু ধরিয়ে দেন ইকরাম সাহেব।
‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইলেক্ট্রিক্যাল। ছোহ!’
রাফিদ সাহেবের চোখ মুখ কুঁচকে গেছে। কারণটা অবশ্য ভালোই বুঝতে পেরেছেন ইকরাম সাহেবের। ইনার মেয়ে ফারজানার সাথে তাঁর পরিচয় আছে।
চমৎকার দেখতে মেয়েটি। গানের গলা ভালো। সেই সাথে পড়ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী।
সেখানে ‘প্রাইভেট’ ভার্সিটি শুনেই রাফিদ সাহেবের নাক কুঁচকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না। নিজের ছোট ছেলে যে প্রাইভেট ভার্সিটিতেও কোর্স কমপ্লিট করতে পারেনি – মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছে – সে ব্যাপারে বলবে কে? বললেই রাফিদ সাহেব প্রাইভেট ভার্সিটি ছেড়ে দিয়ে জার্মানি চলে যাওয়ার উপকারিতা নিয়ে ছোটখাট লেকচার দিয়ে দেবেন না?
‘ভাবতে পারেন?’ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি, ’ওই ব্যাটা আমার গুনবতী মেয়েটাকে কিভাবে পটিয়ে, ফুসলিয়ে, সরিয়ে, ম্যানেজ করে নিয়েছে?’
‘এতসব জানলেন কখন?’ আস্তে করে জানতে চান ইকরাম সাহেব।
‘গতকাল হাতেনাতে ধরে ফেলেছি না? তখন জানতে চাইলাম। আর মিথ্যা বলে পার পাবে আমার সাথে? সব বের করে নিয়েছি!’
বেচারি বাচ্চা মেয়েটা – একেবারে আত্মা বের করে নিয়েছেন রাফিদ সাহেব নিঃসন্দেহে – ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে যায় ইকরাম সাহেবের। নড়েচড়ে বসেন তিনি।
‘ইলেক্ট্রিক্যাল খারাপ কি? দেশে ইলেক্ট্রিক্যালের তো জব স্ফেয়ার আছে অনেক বেশি। মেনে নিলেই তো পারেন। মানে ছেলের ব্যাপারে একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন – চরিত্র ভালো হলে আর সমস্যা কি?’
‘অসম্ভব!’ ছোট অফিস রুমটা কাঁপিয়ে দিয়ে হুংকার ছেড়ে বলেন রাফিদ সাহেব, ’ছেলের চরিত্র ভালো না খারাপ সেটা দিয়ে আমি কি করব? বিয়ের আগে সব ছেলেই একটু লাগাম ছাড়া থাকেই। পরে সবাই লাইনে চলে আসে।’
দুর্ধর্ষ লোকটির দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকেন ইকরাম সাহেব দুই মুহূর্ত, তারপর মৃদু হাসেন, ’তাহলে তো দেখাদেখিরও কিছু নেই। বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন। নাহলেও এংগেজমেন্টটা করাতে পারেন আপাতত। মেয়ে পড়া শেষ করুক। কি বলেন?’
‘ওহ! আপনি কি খুব সহজেই সবকিছু ভুলে যান নাকি? কিভাবে আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করতে পারি আমি একজন প্রাইভেট ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলের সাথে?’
‘তাহলে কার সাথে ঠিক করতে চাচ্ছেন?’ ইকরাম সাহেবের প্রশ্ন থামে না।
‘বুয়েট! এমআইএসটি! আইইউটি…’
আরও কি কি জানি বলে যাচ্ছিলেন মানুষটি, ইকরাম সাহেব হতাশ হয়ে চেয়ারে হেলান দেন, বিড় বিড় করে বলেন, ‘হুম, বিল গেটসের ছেলে – টম ক্রুজ, জেরেমি রেনার -’
ভাগ্যিস নিজের উচ্চকন্ঠের ধাক্কায় কথাগুলো কানে যায় না রাফিদ সাহেবের। নাহলে এখানেই একটা কেলেঙ্কারী হয়ে যেত!
*
ফারজানা হাতের মুঠোতে একটা পিঁপড়া নিয়ে বসে আছে।
পিঁপড়াটি ওর না। রাশেদের। রাশেদ একটা করে পিঁপড়া পোষে। পিপড়ার লাইফটাইম পর্যন্ত সেটার যত্ন নেয় প্রাণপনে।
ওটা মরে গেলে আরেকটা পিঁপড়া পোষে তখন।
ছোট্ট একটা কাচের জারে রাখে ও পিঁপড়াটাকে। সেটায় থাকে অনেক ছোট ছোট ফুটো।
তিনটা কম্পার্টমেন্ট। একটা খুলে খাবার দেয় ও। তখন ওটার বাকি দরজা থাকে বন্ধ। তারপর বাইরে থেকেই কম্পার্টমেন্টের দরজা লাগিয়ে দেয়। তখন পিঁপড়াটা খেতে পারে।
রাশেদ কোনদিনও পিঁপড়াটাকে বের করে না। তবে মাঝে মাঝে ফারজানার আগ্রহে ওকে রাখতে দেয় পিঁপড়াটাকে।
তখন এটাকে আর কাচের জারে আটকে রাখে না মেয়েটা। হাতে নিয়ে বসে থাকে।
পিঁপড়াটাও কি অদ্ভুত! মোটেও পালানোর চেষ্টা করেনা!
ফারজানার টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে ছোট্ট পিঁপড়াটা। বাবা একটু আগেই ডেকেছিলেন।
সুখবর দিতে।
প্রবাসী বন্ধু ফারুক এখন দেশে। বন্ধুটির ছেলে সিনেমার হিরোদের মত দেখতে। মাথার ভেতর মগজের জায়গাতে সম্ভবতঃ কপোট্রন বসানো। ম্যাসাচুয়েটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়াশোনা করছে। এরই মাঝে তিনটা পেটেন্ট আছে তার কাজের। দেশে এসেছে স্বদেশের মাটিতে পা রাখতে, স্বদেশকে হাল্কা চিনে যেতে।
আর রাফিদ সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে ফোনের অন্যপাশ থেকে টেলিফোন কাঁপানো হাসি দেন ফারুক চৌধুরী, ‘ছেলে জানে না – তবে এবার আমি নিজের আগ্রহেই ওকে দেশে টেনে আনছি কেন সেটা তোমাকে বলা যায়।’
ফোনের এপাশে চোখ টিপ দেন রাফিদ সাহেব, ’নির্ঘাত লাল টুকটুকে একটা বাঙালি বউ চাই তোমার?’ ওপাশে কাশির শব্দ শুনতেই দ্রুত কারেকশন দেন তিনি আবার, ’ছেলের জন্য আর কি!’
ফারুকের গলা থেকে আবারও টেলিফোন কাঁপানো হাসির শব্দ বের হয়, ’হাহাহাহা – একেবারে ঠিক ধরেছ। নাহলে দেখা যাবে বেলে মাছের মত চামড়ার কোন খ্রিস্টান মেয়ের সাথে ঝুলে গেছে। এই সমস্যা শুরু হওয়ার আগেই ঝেড়ে ফেলতে হবে। কি বল?’
‘তা তো অবশ্যই। আমার মেয়েটাও যা হচ্ছে, আর কয়েকদিন পর মেডিকেল থেকে বের হয়ে যাবে – এখনও বিয়ের কথা বললেই নাক কোঁচকায়!’
‘ওরই কি বা দোষ বল?’ মাথা নাড়ান ফারুক, ’এই দেশে ওর মত লক্ষী মেয়ের উপযোগী জামাই আসবেই বা কোথা থেকে? তোমার মেয়ে, বুঝলে রাফিদ, ওয়ান ইন আ মিলিয়ন!’
তখনই বাতাসে গন্ধ পেয়ে আনন্দে হৃৎপিন্ডটা লাফিয়ে ওঠে রাফিদ সাহেবের। কিসের বুয়েট! এই ছেলে একেবারে এমআইটির পাবলিক! সেটাকে উস্কে দেন ছেলের বাবা ফারুক সাহেব নিজেই, ’আমার ছেলে কিরণকে তো দেখেছই তুমি। মানে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ই-মেইল পাঠিয়েছিলাম – দেখেছ না?’
রাফিদ সাহেবকে স্বীকার করতেই হয় – তিনি দেখেছেন কিরণকে।
‘তোমার মেয়ের পাশে ওকে কেমন মানাবে বল দেখি?’
ফারুক সাহেবের গলা থেকে এতটুকু বের হওয়াই যথেষ্ট ছিল। তার আধ ঘন্টা পরই ফারজানার ডাক পড়ল বাবার ঘরে। বাবার সুখবর ফারজানার মাথাতে মিসাইলের মত আঘাত হানে। কোলে রাশেদের পিঁপড়া নিয়ে বসে আছে এজন্যই ও।
রাশেদকে পরের দিন ডেকে যে দেখা করবে – সে উপায় রাখছে বলেও মনে হয় না। আগামিকালই নাকি চলে আসবে ছেলেপক্ষ!
এই বাবা আর বাবার বন্ধু একেবারে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে। লোকটা ঘাঘু আছে। যেদিন বাসায় আসবে তার আগের রাতে ফোন দিয়েছে। প্ল্যান করার সময় তারা দেবে না ফারজানাকে। বাবার ওপর ফারজানার যা বিরক্তি লাগে বলার মত না। মানুষটা মাত্র কয়েকদিন আগে শুনল রাশেদের ব্যাপারে- আর এখন আবার নতুন বিয়ের কথা বলছে। মানে ডাক্তারি পড়েও নিজের সিদ্ধান্তে বিয়ে করার উপায়টুকু নেই ওর।
মা বেঁচে থাকলে হয়ত একটা চেষ্টা করা যেত তাকে দিয়ে বাবাকে প্রভাবিত করার। মা-টাও মরে ভূত হয়ে আছে সাত বছর ধরে!
মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। রাশেদের ফোন।
মেসেজে তাকে জানিয়েছিল ফারজানা – যে আগামীকাল দেখতে আসবে ওকে। এখন টনক নড়েছে তার।
এখন লাফিয়ে লাভ আছে?
বাবার সামনে ফারজানার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে যায়। নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া বা পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো তখন তাকে দিয়ে সম্ভব না।
আর ফারুক আংকেলকে দেখা যাচ্ছে একেবারে ডিটারমাইন্ড – এসে আংটি না পড়িয়ে যাবেন না। সুদূর আমেরিকা থেকে আজাইরা প্যাচাল পাড়তে তো আর আসেননি। বাংলাদেশে এখনও শিক্ষিত মেয়েদের পর্যন্ত সিদ্ধান্তের দাম দেওয়া হয় না কোথাও কোথাও!
এখানে কড়া কিছু না বললে কোনদিনও বিয়েটা থামানো সম্ভব হবে না – বাবার সামনে যেটা ফারজানাকে দিয়ে হবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করে ফারজানা।
রাশেদের চিন্তিত গলা শোনা যাচ্ছে। হাজারটা সমাধান দিয়ে যায় ও ফারজানাকে।
কিন্তু সব ক্ষেত্রেই একটা জায়গায় আটকে যায় মেয়েটা – বাবার সামনে ও যে ভীষণ ভয় পায় কিছু বলতে!
সারা রাত কথা বলেও কোন সমাধান পাওয়া গেল না।
*
‘ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট তুমি?’ অসম্ভব সুদর্শন ছেলেটা ফারজানাকে এই প্রশ্নটা করলে ওর দম আটকে আসে।
নিজেকে পন্য পন্য মনে হতে থাকলে দম থাকার কথা না। এখানে তার বাবা আর এই কিরণের বাবার প্যাঁচে পড়ে বিক্রি হয়ে যেতে হচ্ছে। খাড়া নাক আর হাল্কা খয়েরী চোখের এই ছেলেটাকেও তার রীতিমত ষড়যন্ত্রকারী বলে মনে হচ্ছে। দেবে নাকি নাকের ওপর একটা খামচি?
‘জ্বি। ফোর্থ ইয়ারে এবার।’ আস্তে করে বলে ফারজানা।
হাল্কা হাসে কিরণ, ’হেই, আমি তোমার প্রফেসর না। এত ফর্মাল কথা বলছ কেন?’
সোজাসুজি ছেলেটার দিকে তাকায় ফারজানা, ’ইনফর্মাল কথা বলার মত সম্পর্ক আমার-আপনার না। ভুলেও ভাববেন না সেরকম কিছু হতে চলেছে।’
বাবা আর ফারুক আংকেল বের হয়ে গেছে, সুযোগটা পূর্ণ কাজে লাগাচ্ছে ফারজানা। যেটা জানা দরকার এই ছেলের সেটা জানিয়ে দিয়েছে। কিরণের মুখটা ছাই বর্ণ হয়ে যায়।
‘তোমার কি মনে আছে আমরা ছেলেবেলায় একসাথে খেলতাম?’ ব্যথিত গলাতে জানতে চায় ও।
‘আছে! তাই বলে কি করতে হবে?’ বেশ রুক্ষ ভাবেই জানতে চায় ফারজানা।
‘সবচেয়ে পুরোনো বান্ধবীর কাছে আরেকটু সফট ব্যবহার আশা করেছিলাম – এই আর কি। আর কিছু করতে হবে না।’
‘সবচেয়ে পুরোনো বন্ধুর সাথে আরেকটু সফট বিহ্যাভ করার ইচ্ছে আমারও ছিল, মি. কিরণ। কিন্তু আমাদের বাবাদের খামখেয়ালীপনার জন্যই এরকম আচরণ করতে বাধ্য হচ্ছি আমি।’
এবার একটু বিভ্রান্ত দেখায় কিরণকে, ’বাবাদের খামখেয়ালীপনা?’
‘ইয়েপ! ন্যাকামি করবেন না। নাকি বলতে চান কিছুই জানেন না?’
‘কি ব্যাপারে?’ বাম হাতের কব্জি ডান হাত দিয়ে ঘষে জানতে চায় ছেলেটা।
‘আমাদের বিয়ের ব্যাপারে – অফকোর্স!’ গর গর করে জানায় ফারজানা।
‘এখানে বিয়ের টপিক আসল কি করে?’ হা হয়ে যায় কিরণ এক প্রকার।
‘এই যে আমাকে আপনাকে একা কথা বলতে দিয়ে চলে গেছে ওরা এর অর্থ কি বোঝেন?’
এবার আক্ষরিক অর্থেই অপ্রতিভ দেখায় কিরণকে। একবার মাথা চুলকেও নেয়, ’আসলে, বাংলাদেশী সমাজ নিয়ে খুব একটা জানি না আমি। পুরোনো দুই বন্ধু দেখা করতে এসে নিজেরা নিজেরা কথা বলতে বলতে চলে গেলে তাদের ছেলেমেয়ে যদি প্রাইভেসী পায় স্মৃতিচারণ করার জন্য – তাহলেই যে বিয়ের জন্য কথা চলছে বুঝতে হবে – সেটা ঠিক জানতাম না। আমি দুঃখিত। সত্যিই দুঃখিত।’
‘ফর হোয়াট!’ ঝামটে ওঠে ফারজানা।
‘আমি জানতাম না। বাবা আমাকে কিছুই বলেনি। বললে অবশ্যই এই ভুল বোঝাবুঝি থেকে রক্ষা পেতাম সবাই।’
‘সেক্ষেত্রে – বোঝাই যাচ্ছে এই বিয়ের ব্যাপারে কিছুই না জেনে মাঝে ঢুকে পড়েছ তুমি?’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানতে চায় ফারজানা।
দ্রুত মাথা ঝাঁকায় কিরণ, ’অবশ্যই। ছেলেবেলার বান্ধবীর সাথে দেখা করা ছাড়া আর কোন দুরভিসন্ধি ছিল না। বিশ্বাস করো!’
ছেলেটার ব্যস্ততা দেখে মুচকি হাসে ফারজানা, ’করেছি। নাহলে আগের সম্বোধনে ফিরে যেতাম না।’
‘আমিও তো বেঁচে গেলাম তুমি আগেভাগে জানালে তাই।’ ঝলমলে একটা হাসি দেয় কিরণ, ’নাহলে ক্যাথির ব্যাপারটা পরে ঝামেলার হয়ে যেত।’
‘ক্যাথি?’ হা হয়ে গেল এবার ফারজানা।
‘ইয়েপ। ক্যাথেরিন ডেমিয়েন। আমাদের ক্যাম্পাসের মেয়ে।’
‘গার্লফ্রেন্ড?’
‘অ্যাকচুয়ালি উই আর লিভিং টুগেদার।’
এবার মাথা চুলকায় ফারজানা, ’তোমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দাওনি?’
হাল্কা হাসে কিরণ, ’তোমার মাথা খারাপ? বাবা সেকেলে চিন্তাভাবনায় বিশ্বাসী। অযথাই ক্যাথির সাথে খারাপ ব্যবহার করে মনটা খারাপ করে দেবে মেয়েটার। বুঝতেই পারছ – মেয়েটা ক্রিশ্চিয়ান।’
‘তাও ঠিক।’ মাথা ঝাঁকায় ফারজানা।
‘তোমার ব্যাপারটা?’ আস্তে করে জানতে চায় কিরণ।
‘রাশেদ ওর নাম। ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বিএসসি করছে। আর দুই মাস পর বের হয়ে যাবে।’
‘বাহ – ভালোই তো।’ খুশি হয়ে ওঠে কিরণ, ’তবে এটাও ঠিক – তোমাকে চিন্তায় থাকতে হবে না। আমার নিজস্ব প্ল্যান আছে ক্যাথির ব্যাপারে। আর তোমার ব্যাপারটাও এখানে মিটে যাবে। বাবাকে আমি সামলাবো। বুঝতেই পারছ – তোমার বিয়ে নিয়ে কথা উঠলে এখানে দ্বি-পক্ষীয় ক্ষতি।’ চোখ টিপ দেয় কিরণ, ‘আমরা একই দলে।’
দুই বাবা এসে দেখতে পেলেন তাঁদের ছেলে-মেয়ে বেশ খোশ মেজাজেই আছে। হাসাহাসি করছে। একে অন্যকে খোঁচাও মারছে।
দুইজনই পরিতৃপ্তির হাসি দিলেন।
জানেন না – মাত্র দুই ঘন্টার মাঝে ওই হাসি উড়ে যাবে কোথায়!
*
‘কিছু কিছু পুরোনো বন্ধু আছে, বুঝলেন! ভাবের ঠেলায় চলে। মানুষকে ছোট করতে সুযোগ পেলে ছাড়ে না কখনও।’
রাফিদ সাহেবের বিরক্তিতে কুঁচকে থাকা মুখটা দেখে বেশ ভালো লাগে ইকরাম সাহেবের। নিজেও মনে মনে কিছুটা বিরক্ত।
আরে ব্যাটা অফিসে এসেছিস – কাজ কর। এখানে গুষ্ঠির প্যাঁচাল কেন পাড়বে?
‘আসলে বড় বড় প্রতিষ্ঠান মানুষের অহঙ্কার বাড়িয়ে দেয়। আরে – যে কথা দিয়ে কথাই রাখতে পারবি না সেটা দিতে আসবি কেন?’ গর গর করেন রাফিদ সাহেব।
‘কি হয়েছে, রাফিদ ভাই?’ এবার ইকরাম সাহেব আর না বলে থাকতে পারেন না।
লাই পেয়ে গলে গেলেন রাফিদ সাহেবও, ’আর বলবেন না – পুরোনো আমলের বন্ধু আমার – বলে কি না তার এমআইটি-তে পড়া ছেলের সাথে আমার মেয়ের সম্পর্ক করাতে চায়। ছেলে দেখতে শুনতে দারুণ। আর এমআইটি মানে তো বোঝেনই -’
আয়েশ করে হেলান দিয়ে আধ ঘন্টা ধরে মানুষটার বক্তব্য শুনলেন ইকরাম সাহেব। কিভাবে সব কথা বার্তা বলে দেখতে এসেও পরের দিনই তড়িঘড়ি করে দেশ থেকে চলে গেছে বাবা-ছেলে সেটা শুনে দুঃখের বদলে কৌতুক অনুভব করেন ইকরাম। তারপর আস্তে করে একটা চোখ খুললেন, ’সিদ্ধান্ত কি নিচ্ছেন তাহলে? মেয়েকে তো পড়া শেষ করতে দেবেন আগে, নাকি? আগে থেকেই বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলে একটু ঝামেলা হতেই পারে। কি বলেন?’
‘একেবারে খাঁটি বলেছেন। আগেই আপনার কথা শোনা উচিত ছিল। মেয়ের যদি দুই বছর পরও ওই ছেলেকে পছন্দ থাকে – আমি ওকে ওর সাথেই বিয়ে দেব। লাগবে না আমার বুয়েট- এমআইটি! মানুষ ভালো হলেই হল।’
মোবাইল দেখেন ইকরাম সাহেব।
‘আমাকে একটু বের হয়ে যেতে হচ্ছে, রাফিদ ভাই। মেডিকেল রিপোর্টটা নিয়ে আসি। ছেলে এসে দাঁড়িয়ে আছে নিচে। সামলাতে পারবেন তো? একেবারে চারটার দিকে ফিরব।’
ঘাড় নেড়ে সায় দেন রাফিদ সাহেব।
আর অফিস থেকে বের হয়ে যান ইকরাম। বিল্ডিংটা থেকে বের হতেই এয়ার কন্ডিশনড সিস্টেম থেকে সরাসরি রোদের গরমে চলে আসার যন্ত্রণাটা অনুভব করেন সবার আগে।
তারপরই দেখতে পান কালো গাড়িটা। দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর ছেলে।
বাবাকে দেখে দরজা খুলে দেয় সসম্মানে।
*
দুই ধরণের যানবাহনে ছুটে চলা দুই বাংলাদেশী যুবকের মনে এক রকম ঝড় উঠেছে।
বাবাকে নিয়ে ড্রাইভ করছে রাশেদ। বাবা বেরিয়েছেন তাঁর অফিস থেকে। কিন্তু ছেলের মনটা পড়ে আছে ওর সেখানেই। বাবার অফিসে।
ফারজানার বাবা ভেতরে বসে আছেন ভেতরে। সিদ্ধান্ত এতক্ষণে হয়ত পাল্টে ফেলেছেন।
মেয়েটির ব্যাপারে যতবারই ভাবছে রাশেদ – পরাজয়ের একটা তিক্ত গ্লানি গলাতে এসে ঠেকছে ওর।
গতকাল রাতে ফেসবুকে সার্চ দিয়ে কিরণকে বের করে মেসেজ দিয়েছিল ও। ফারজানা তার বাবার সামনে একটুও আপত্তি করতে পারবে না, তা ওর থেকে ভালো আর কে জানে। বিয়ের ঘটনাতে ‘সেকেন্ড বেস্ট ইফেক্টিভ’ মানুষটার সহায়তা দরকার ছিল ওর।
আর মানুষটা অবশ্যই কিরণ।
ছেলেটা চমৎকার।
বোঝাতেই বুঝেছে। এবং রাশেদকে কোন ধরণের দুশ্চিন্তা করতে মানা করে দিয়েছে।
কথা রাখতে জানে ছেলেটা। ফারজানা দেখাদেখির পর ওকে সুখবরই দিয়েছিল।
সব দিক থেকে সব কিছু ঠিক আছে। ফারজানা-কিরণের পরিচয় ছিল ওদের বয়েস যখন তিন। ছয় মাসের মত পাশাপাশি ফ্ল্যাটে ছিল তারা। কাজেই কিরণের ভালো মত মনেও নেই মেয়েটাকে। এমনিতেও হয়ত বিয়েটা হত না– তবুও সাবধানের মার রাখেনি রাশেদ।
কিন্তু আরেকটি ছেলের কাছে সাহায্য নিতে ইগোতে বাঁধছিল ওর। নিজের গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে ঠেকানোর জন্য তার হবু স্বামীর সাহায্য নিতে হলে সেটা একটা ছেলের জন্য কতটা আত্ম-অপমানজনক সেটা কেবল এই পরিস্থিতিতে আটকে পড়া একটা ছেলেই জানে।
আবার অন্যদিক বিবেচনা করলে, ফারজানাকে হারাতে পারে না রাশেদ কোন মূল্যেই – তাই আত্মসম্মানের হিসাব বাদ দিয়ে এগিয়ে গেছিল কথা বলতে। যে কারণে এখন প্রতিটা সেকেন্ড নিজের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ওর।
পাশ ফিরে তাকালেন ইকরাম সাহেব, ’কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে তোমাকে?’
‘ওহ – তেমন কিছু না বাবা।’ হাল্কা হাসি দিয়ে বলে রাশেদ।

প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে কিরণ। পাশে বাবাও আছে। ওরা চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ছেড়ে।
একদিনের নোটিশে আমেরিকার টিকেট পাওয়া কঠিন হত নিঃসন্দেহে। তবে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাথে কিরণের বাবার সম্পর্ক চতুর্মাত্রিক। ‘না’ করতে পারার মত না সেটা।
কিরণ আর একটা দিনও বাংলাদেশে থাকবে না। কাজেই ফারুক সাহেবও থাকার জন্য কোন লজিক দেখতে পারেননি।
‘সমস্যা কি? মেয়েটাকে একবার দেখার জন্য পাগল হয়ে ছিলি। এখন মনে হচ্ছে এই দেশ থেকে বের হয়ে যেতে পারলে বাঁচবি। কি এমন কথাবার্তা হল? মেয়েটা খারাপ কিছু বলেছে নাকি?’
মাথা নিচু করে কিরণ, ’মেয়েটা আমার জীবনের প্রথম মেয়ে বন্ধু ছিল বাবা। তাই আগ্রহ দেখিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু তুমি যে বিয়ের দিকে নিয়ে গেছ জিনিসটা আমি কিভাবে বুঝব? খুবই লজ্জার ব্যাপার। দ্যাট ওয়াজ টোটালি আনঅ্যাকসেপ্টেবল, ড্যাড!’
থম মেরে বসে থাকেন ফারুক সাহেব। রাগে কান জ্বলে যাচ্ছে তাঁর। ছেলেটাও ঠিকই বিজাতীয় ধারাতে চলে গেছে। আরে বাবা মা বিয়ে ঠিক করে দেবে – তোরা বিয়ে করবি – এত কথার কি আছে রে ব্যাটা?
তবে বোঝাই যাচ্ছে বাংলাদেশী সংস্কৃতির ওপর থেকে মন উঠে গেছে ছেলের। অবশ্য ফারজানা মেয়েটাকে দেখতে যে রকম খাঁচায় আটকে পড়া পাখির মত লাগছিল – তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারটা স্পষ্ট ফুটে ওঠার কথা কিরণের সামনে। আর ছেলেকে চেনেন তিনি। একটু বেশি পরিমাণে মানবতাবাদী।
‘তোর কি পছন্দের কেউ আছে?’ গুরুগম্ভীর গলাতে জানতে চান ফারুক সাহেব।
বাবার দিকে সরাসরি তাকায় কিরণ, ’হুঁ। মেয়েটার নাম ক্যাথি।’
‘ক্রিশ্চিয়ান?’ চেয়ার কাঁপিয়ে জানতে চান ফারুক সাহেব।
‘ক্যাথলিক।’
‘আস্তাগফিরুল্লাহ।’
‘ড্যাড’ আর কিছু বলেন না। কিরণও ঘাঁটায় না। বাবাকে আঘাত করতে চায় নি ও। কিন্তু আর কিছু করার ছিলও না। ছেলেদের এসব একটু আধটু আত্মত্যাগ করতেই হয়। এত বিচলিত হওয়ার মতও না ব্যাপারটা।
আস্তে করে নিজের সীটে হেলান দেয় কিরণ।

পরিশিষ্ট
ফারজানার মনটা আজকে একটু বেশিই খারাপ।
মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী।
বাবাকে লুকিয়ে একটা ডায়েরী পড়তে দেখে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে ও। মায়ের ডায়েরী।
যতই পড়ছে – বার বার চোখ ভিজে যায় ফারজানার। প্রায় পুরোটা জুড়েই ওর ব্যাপারে লেখা। জায়গায় জায়গায় আবার সাদাকালো ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবি। নিচে ক্যাপশন।
সেসব ছবির প্রায় সবই ফারজানার।
ক্যাপশনগুলো মজার।

বাবুটার আজ দুটো দাঁত উঠেছে।
আরও দুটো দাঁত।
জ’!!
ফারজানা এখন দাঁড়াতে পারে–
ফারজানা আজ প্রথম হাঁটল।

চোখ থেকে পানি মুছতে মুছতে একবার হাল্কা হাসে মেয়েটা। মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে হাসিটিতে।
ধীরে ধীরে সেটা মুছে যায় পরক্ষণে।
আরেকটি ছবির ক্যাপশনের দিকে তাকিয়ে আছে ফারজানা। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।
একটি দেবশিশুর মত সুন্দর ছেলেশিশুর সাথে তিন বছরের ফারজানা।
মায়ের নিজ হাতে লেখা ক্যাপশন : কিরণ ও ক্যাথি। (কিরণ নামের পিচ্চি এই ছেলেটা আমার বাবুটাকে কেন ক্যাথি বলে ডাকে কে জানে!)

 

গল্প জীবনধর্মী

Post navigation

Previous post
Next post

কিশোর পাশা ইমন

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Related Posts

ভালো বাসা

Posted on December 27, 2013June 24, 2022

মা অবশ্য আপত্তি করছেন না। হুজুর বাড়ি বন্ধ করলে ক্ষতিই বা কোথায়? আর বাড়িওয়ালা আংকেল তো রীতিমত উৎসাহিত এই সমাধানে। আমিও শত্রুপক্ষের সাথে তাল মেলালাম।

Read More

হেডহান্টারস

Posted on October 24, 2023

হেডফাইভস!
পাঁচজন মানুষ।
এরাই দাঁড় করিয়ে রেখেছে রাবেকের সব কার্যক্রম।

Read More

গরু

Posted on November 25, 2013June 20, 2022

কসাই মামা এখনও ছুরি ধার দিচ্ছে। গরুর লোভে অনেকেই এসেছে আজ এখানে। মেম্বারশিপের চাঁদার একটা গতি হল ভেবেই তারা খুশি। আর আজ যদি গরু না পায় তবে ওই ছুরির ব্যবহার কোথায় হতে পারে অনুমান করে হনুমান হয়ে গেলাম।

Read More

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সর্বশেষ লেখাগুলো

  • ওয়ান ফর মাই সৌল
  • আমার যত প্রকাশক
  • কেপির সেরা লেখা কোনটি – জরিপ ২০২২
  • আন্ডারএইজের বই পড়া
  • অমুক পড়ে আসেন… সমস্যাবলী

Analytics

009435
Total Users : 9435
Total views : 23711
Who's Online : 0
Powered By WPS Visitor Counter
©2025 KP Imon | WordPress Theme by SuperbThemes