KP Imon

Words Crafted

নিশি-হণ্টক

আকাশে একটা নিঃসঙ্গ চাঁদ।

ওকে কি নিঃসঙ্গ বলা যায়? ছাড়া ছাড়া মেঘ ওটাকে সঙ্গ দিচ্ছে।

মেঘ আর চাঁদের দূরত্ব তো কম না। তাহলে নিঃসঙ্গ বলা কি চলে না ওকে?

হিসেব মেলাতে পারলাম না। মেলাতে চাচ্ছি তেমনটাও না।

এই মুহূর্তে চাঁদ ব্যাটা নিঃসঙ্গ থাক বা না থাক আমার নিঃসঙ্গতার একটু দরকার ছিল। রাস্তাঘাট রাতের এই সময়টায় ফাঁকাই থাকে। বারোটা বেজে পাঁচ। ভ্যাম্পায়ার গোত্রের মানুষ বাদে কাওকে দেখতে পাওয়ার কথা না।

আমি ভ্যাম্পায়ার গোত্রের মানুষ না। তবে বাবার শেষ উপদেশ আমি মেনে চলি।

মৃত্যুশয্যায় একজন বাবা ছেলেকে উপদেশ দিয়ে যেতে চান। যাতে তাঁর প্রস্থানের পর সন্তানের জীবন একটা সরলরেখায় চলে। এটা করবে, সেটা করবে না, অমুককে দেখবে, তমুককে ওটা দেবে হাবিজাবি। আর আমার বাবা চেয়েছিলেন বক্রপথের সন্ধান দিতে।

আমার উদ্দেশ্যে বাবার শেষ কথা ছিল, ’রাত বারোটার পর কখনও বাসায় থাকবি না। ’

বাবার শেষ ইচ্ছে আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি।

তিন মাস সাত দিন ধরে সারারাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। শহরের কোনও রাস্তা বাকি নেই যেখানে আমার পা পড়েনি।

এমন কোন ওভারব্রীজ নেই যেটার ওপর আমি উঠিনি।

সব হয়েছে রাতের বেলায়।

কম ঘটনার মুখোমুখী হতে হয় নি এজন্য। নৈশজীবনে অভ্যস্ত পঙ্কিল জীবনে ডুবে থাকা অসংখ্য মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে তাদের অনেকেই বিশাল হৃদয়ের উপস্থিতির পরিচয় দিয়েছেন।

পুলিশেও ধরেছে আমাকে এজন্য, ছয়বার।

প্রতিবারই ভোরের দিকে ছেড়ে দিতে দিতে সহকর্মীকে পেটমোটা পুলিশটা বলেছে, ’পাগল ছাগল মানুষ। অযথা আমাদের হয়রানী। ’

আর আমিও হয়রান পুলিশটির দিকে চমৎকার একটি হাসি দিয়ে বেড়িয়ে এসেছি।

‘তুর্য! অ্যাই তুর্য!’ নারীকন্ঠের চিৎকারে বাস্তবে ফিরলাম।

শব্দের উৎসের দিকে ফিরে তাকিয়ে ফারিহাকে দেখতে পাই। দাঁড়িয়ে আছে ফুটপাথের ওপরে। গাছের ছায়াতে।

পৃথিবীর সব শক্তিমান’ভালোমানুষেরা’ দিনের বেলায় গাছের নীচে ছায়া খোঁজে। আর ফারিহারা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় রাত হলে। যন্ত্রণা লাঘবের জন্য না। নতুন যন্ত্রণাকে আলিঙ্গন করে নিতে। মেয়েটার আসল নাম কি কে জানে? আমাকে অন্তত ওই নামই বলেছে।

নাম কি?

পরিচয় বই তো নয়! কাজেই আমিও ঘাটাঘাটি করিনি। করে কাজ কি?

‘হাঁটতে বের হয়েছ আজও?’ আমি কাছে যেতে মুক্তোর মত দাঁতগুলো বের করে বলে ফারিহা।

মেয়েটার হাসি এত প্রাঞ্জল ওকে এই পরিবেশে মানাচ্ছে না।

‘হুঁ। তোমার খবর কি?’ পাল্টা হাসি দিলাম। যদিও ব্যাঙের মত লাগল হাসিটা।

‘আজকে আমার ছুটি।’ লাফিয়ে ফুটপাথ থেকে নামে ফারিহা।

‘মানে?’ অবাক হলাম। রাতের বেলাতে ওদের ছুটি থাকে না কোনদিনই। বিশেষ সময় ছাড়া।

‘নিজেকে নিজেই ছুটি দিলাম।’ মুক্তোর মত দাঁতগুলো আরেকবার দেখায় ফারিহা।

‘জমা দেবে কি তাহলে?’ বিষন্ন মনে জানতে চাই। এদের জীবনের পরিণতি আমি মেনে নিতে পারি না।

‘আছে কিছু জমানো। দেব নাহয়।’ আমার দিকে সরাসরি তাকায় ফারিহা, ’কই, হাঁটো?’

একটা কুকুর এসে আমাদের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটার সারা শরীরে লোম নেই।

কমেডির হাস্যকর একটা দৃশ্যের মত দেখাচ্ছে নিশ্চয় আমাদের?

সরাসরি তাকাই আমিও, ’তুমিও আজকে আসছ নাকি?’

‘হুম। সমস্যা?’ কোমরে হাত রেখে জানতে চায় ফারিহা।

‘সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।’ ভ্রু কুঁচকে ভাবতে ভাবতে বলি আমি।

‘পিতৃদেবের কথা ভাবছ তো? তিনি তোমাকে রাতের বেলাতে হাঁটতে বলেছেন। একাকী হাঁটতে হবে সেরকম শর্ত ছিল বলে মনে করি না। ’

অকাট্য যুক্তি।

কাজেই ফারিহাকে পাশে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটির কৌতুহলের শেষ নেই। কোন গাছের পাতা না থাকলেও অপার আগ্রহে আমাকে প্রশ্ন করছে। আবার পাতা থাকলেও সম-আগ্রহেই প্রশ্ন করছে।

ফারিহার প্রশ্নগুলোর উত্তর মনের মত করে দিচ্ছি। শুন্য রাস্তায় আমাদের গলার শব্দ অদ্ভুত রকমের ভূতুড়ে শোনাচ্ছে মনে হয়। সেদিকে আমাদের নজর নেই। ফারিহা ডুবে আছে আমার কন্ঠনিসৃত ব্যখ্যার জন্য। আর আমি মনে মনে খুঁজছি ফারিহার লাইফস্টোরি।

মেয়েটা এই পেশাতে এল কি করে? কথাবার্তা শুনলে মনে হয় সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে।

প্রতিটি ট্র্যাজেডির পেছনেই কাহিনী থাকে। ফারিহার কাহিনী আমি কিছুতেই মেলাতে পারি না।

ও ঠিক এই পরিবেশের সাথে যায় না।

ফারিহার প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলাম , ’তুমি কি নিজেকে হিমু মনে কর?’

‘হিমুটা আবার কে?’ গলায় কৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়ে জানতে চাই আমি।

‘উফ! কোন দুনিয়ায় থাকো? হিমু আমার প্রিয় চরিত্র। যে কারণে তোমার প্রেমে পড়েছি আমি সেই কারণটার নামই হিমু। ’

ফারিহার এই ব্যাপারটাও আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগে। কি অবলীলাতেই না স্বীকার করে নিচ্ছে সবকিছু। পেশাগত জটিলতার কারণে কাজটা হয়ত ওদের জন্য সহজ। সমাজসিদ্ধ পরিবেশে বড় হওয়া মেয়েদের ক্ষেত্রেই’বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ নিয়ম প্রযোজ্য। ওদের জন্য নয়।

‘তা এই হিমুটা কি করে?’ প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাই আমি।

‘ও অনেক কিছুই করে।’ মুখ ভার করে বলে ফারিহা। আমি হিমুকে চিনি না ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না ও মোটেও।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলাম আমরা।

একটা নিঃসঙ্গ প্যাঁচাকে উড়তে দেখলাম আমি ঠান্ডা চোখে। পাথর মেরে ব্যাটাকে নামাতে পারলে হত।

উড়ার বেলাতে আছে! কি জটিলতাবিহীন একটা শান্ত জীবন তাদের!

হিংসাতে আমার চোখ মুখ কুঁচকে যায়।

ফারিহা ব্যাপারটাকে অন্য অর্থে নিল।

‘হিমু একজন মানুষ নয়। হিমু একটা আদর্শ বলতে পারো। এটা প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটি চরিত্র। আমার ফেভরিট। ’

‘ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে।’ মাথা দোলাই আমি, ’ব্যাটা খালি হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে হেঁটে বেড়ায়। আর পায়ে জুতো পড়ার বালাই রাখে না এই তো? বাবা তাকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিল। অথচ ও প্রমাণ করে দেখিয়েছে প্রতিটি মানুষের ভেতরেই একটি মহাপুরুষ বাস করে। তাই না?’

‘প্রতি মানুষের ভেতরে মহাপুরুষ প্রমাণ করল কবে হিমু?’ আকাশ থেকে পড়ে ফারিহা।

আকাশ থেকে তো আমিও পড়েছি। এই মেয়ে দেখা যায় বই-টইও ভালোই পড়ে। আবার পেশায় যৌনকর্মী।

মেয়েটিকে দেখে আমার বিস্মিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমি বিস্মিত হই না। আমার ভেতর যে অনুভূতিটা কাজ করছে তাকে মুগ্ধতা বলা যেতে পারে।

ফারিহা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লাইটপোস্টের হাল্কা আলোতে দেখতে পেলাম লালচে একটা আভা ওর গালে। আমার দৃষ্টিতে লেগে থাকা মুগ্ধতা নিশ্চয় ধরে ফেলেছে?

মেয়েদের ইন্দ্রীয় বোধহয় সাতটা।

‘হিমু নিজে মহাপুরুষ ছিল না। কিন্তু অনেক অনেক কাজ তার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যা মহাপুরুষ ছাড়া করা সম্ভব ছিল না। আমাদের এখানে দুটো সিদ্ধান্তে আসার উপায় আছে। এক, মহাপুরুষের সংজ্ঞা পাল্টে ফেলা। দুই, হিমু প্রমাণ করেছে প্রতিটি মানুষের মাঝেই একজন মহাপুরুষ বাস করে। ’

আমার কাছে কেউ বাংলা দ্বিতীয় পত্রের উত্তর আশা করবে এমনটা নয়। অমুক রচনার সারমর্ম লিখ, পূর্ণমান ১০। কাজেই দশটা সেকেন্ড চুপ করে থাকে ফারিহা। আমার মনে হল মেয়েটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছে।

কিন্তু তা না করে পাল্টা প্রশ্ন করল ও, ’তুমি কি হিমু গোত্রের?’

মাথা নাড়লাম, ’আমি হিমুগোত্রের না। আমার পায়ে জুতো আছে। গায়ে সাতদিনের পুরোনো একটা গেঞ্জিও আছে। বাবা আমার মহাপুরুষ সন্তান চাননি। তবে চেয়েছেন সন্তান রাতের বেলায় ঘর থেকে লম্বা দিক। ’

ফারিহা একটু সাহস পেল মনে হল এবার, ’তোমার হাতটা ধরা যাবে?’

মাথা নেড়ে ওকে’না’ বলতে যাব এই সময় সামনের মোড়ে সিগারেট হাতে আড্ডা দিতে থাকা দুর্বিনীত চেহারার তিন যুবককে আমাদের দুইজনেরই চোখে পড়ে।

অশ্লীল একটা দৃষ্টি চোখে নিয়ে আমাদের দেখছে নেতাগোছের মানুষটা। ফারিহার হাঁটার গতি আপনা থেকেই শ্লথ হয়ে গেল।

সরু চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। লিডারকে এবার আমার একটু চিন্তিত বলেই মনে হতে থাকে!

যুবক তিনজন উঠে পড়ল সাথে সাথে। আমাদের দিকে ধীর কিন্তু দৃঢ়পায়ে এগিয়ে আসছে তারা।

ফারিহার সাথে সাথে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার দিকে সামান্য ঘেঁষে এসেছে মেয়েটা।

হেডলাইটের তীব্র আলো এই সময় রাস্তার এই অংশটা আলোকিত করে দেয়।

গুন্ডাত্রয় থেমে গেছে।

পাঁচ সেকেন্ডের মাঝেই একটা গাড়ি আমাদের ঠিক পাশে এসে ব্রেক কষল। আমার দৃষ্টি ছিল গুন্ডাত্রয়ের দিকে। গাড়ির দিকে ফেরার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পুলিশের গাড়ি হলে বেশ বিরক্তিকর ব্যাপার হবে।

সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মত হাজতে বসে মশার কামড় খেতে হলে আমার জন্য জরুরী ভিত্তিতে দুই ব্যাগ বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা আছে!

গাড়িটিকে দেখার পর রক্তের প্রয়োজনীয়তা কেটে গেল। একটা সাদা রঙের গাড়ি। ড্রাইভিং সীটে মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। দাঁত কেলিয়ে বিশ্রী একটা হাসি দিচ্ছেন। চোখ ফারিহার দিকে নিবদ্ধ। তবে মুখের দিকে নয়।

‘তোমাকে কত খুঁজেছি, ফারিহা। তোমার জায়গায় আজ ছিলে না কেন?’ ফাঁটা বাঁশের মত গলা করে জানতে চান তিনি।

‘বন্ধুর সাথে হাঁটতে আসলাম তো, তাই।’ নিঃসংকোচে উত্তর দেয় ফারিহা।

‘যাবে? নাকি এরই মধ্যে নিয়ে নিয়েছে?’ আমার উদ্দেশ্যে অশ্লীল ইঙ্গিতটা দিয়ে হাহা করে হাসলেন ভদ্রলোক।

‘তোমার সাথে যেতে আপত্তি নেই।’ ঝকঝকে হাসি দিয়ে বলে ফারিহা, ’পরে দেখা হবে, তুর্য!’

লাফিয়ে তো ফ্রন্ট সীটে উঠে গেল মেয়েটা গাড়িটাও হুশ করে বেড়িয়ে যায় চোখের সামনে দিয়ে। আর আমার মনোযোগ ফিরে যায় গুন্ডাত্রয়ের দিকে।

বেশ হেলেদুলে এগিয়ে আসছে ওরা। আমার সামনে এসে লিডার মানুষটা থেমে গেল।

‘ভাই, আপনাকে কত খুঁজছি কইবার পারুম না।’ কটকটে গলাতে বলে’ট্যামা মিলন’। শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তার খ্যাতি আছে।

বিনয়ের হাসি দেই আমি, ‘সঙ্গী নিখোঁজ?’

মিলনের দুই পাশের সহচররা চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখছে। আগেই কিভাবে জেনে ফেললাম সেটা ভাবছে হয়ত।

এমনিতেই মিলনের ভ্রান্ত একটি বিশ্বাস আছে, আমার মাঝে অলৌকিক কিছু ক্ষমতা থাকার ব্যাপারে। ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হল, এবার লাই পেয়ে বিশ্বাসটা একেবারে চাঁদিতে উঠবে! এই লোকের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় একটা ধাওয়া দৃশ্যে।

মোড় ঘুরেই আজব দৃশ্যটা আমার চোখে পড়েছিল সেরাতে।

হাত পা নেড়ে দৌড়াচ্ছে মিলন। পেছনে ছয় ছয়জন তাগড়া জওয়ান। প্রত্যেকের হাতে কিরিচি। এবং একজনের হাতে কাটা রাইফেল।

কাটা রাইফেল দিয়ে ‘ট্যামা মিলন’কে পাখির মত গুলি করে নামিয়ে না দিয়ে কেন উর্ধ্বশ্বাসে তাড়া করছে সেই প্রশ্ন আজও আমার মনের মধ্যে আছে। কিন্তু আমি এত বাছাবাছির মধ্য দিয়ে গেলাম না।

মিলন আমার দিকেই ছুটে আসছিল। আমার থেকে যদিও ওরা পঞ্চাশ গজ মত সামনে।

কাজেই আমার পাশে পৌছানো পর্যন্ত সময়টুকু কাজে লাগালাম। প্যান্টের নিচের অংশটা গুঁজে বেল্ট টেনে ওপরে তুললাম।

তারপর ট্যামা মিলনের পাশে পৌঁছানো মাত্র তার পাশে পাশে প্রাণপণে আমিও দৌড়াতে থাকি!

মিলন দৌড়ের মাঝেই চোখের সাহায্যে একটা ‘?’ সাইন দিল আমার দিকে।

আমি তাকে পাল্টা ‘!’ সাইন দেই।

তীরের মত ছুটছি আমরা পেছনের জোয়ান ছয়জন দূরত্ব ক্রমশ কমিয়ে আনছে ঠিক এই সময়ে বড় রাস্তাতে উঠে আসতে পারলাম।

সামনে ঘ্যাচাং করে পুলিশের গাড়িটা ব্রেক কষতেই পেছনের ছয় জোয়ান একেবারে চিমশে যায়।

তারা কোথায় উধাও হল জানি না পুলিশ ব্যাটারা আমাদের চটপট গাড়িতে তুলে ফেলে।

হাজতে বসে মশার কামড় খাচ্ছি আমরা তারমাঝে মিলন একবার বলে, ’সারাজীবন আপনার সাগরেদ এই ট্যামা মিলন। সারা জীবন।’

তার দিকে ফিরে আমি মৃদু হাসি, ‘ব্যাটারা কি আপনাকে জবাই করে ফেলার জন্য তাড়ছিল নাকি? দৃশ্যটা চমৎকার ছিল, যা হোক।’

মিলন বিষণ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়।

রুটিনমত আমার থানায় প্রবেশের পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাঝেই ইউসুফ মামার ফোনকল। প্রভাবশালী এই মামার জন্য পুলিশ বাহিনী একদিন আচ্ছা করে আমাকে প্যাঁদানোর স্বপ্নটাকে স্বপ্নেই পূরণ করে থাকে।

এমপির কোঁদানি খেতে চায় কে সখ করে?

এবারে অবশ্য আমি গোঁ ধরলাম, ‘ট্যামা মিলনও আমার সাথে বের হচ্ছে।’

পুলিশটি হাহাকার করে ওঠে, ‘এই শালা মিলইন্যা একটা টপ টেরর। আপনারে ছাড়তে পারি হ্যারে ছাড়তে পারি না।’

আমি আয়েশ করে হাজতের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বলেছিলাম, ‘তাহলে আমিও থাকছি। কয়েল-টয়েল থাকলে দিন তো। মশারা বড্ড জ্বালাচ্ছে!’

মিলন বের হয়ে আসল আমার সাথে এবং তারপরই আমার অলৌকিক ক্ষমতার ব্যাপারে সে নিঃসংশয় হয়ে যায়!

‘আপনে জানতেন ঠিক ওই জায়গা দিয়াই পুলিশের গাড়ি যাইব! আপনে ক্যামনে জানেন?’

‘গত তিনমাসের প্রতিটা রাত আমি রাস্তায় পাক খাই। ব্যাটাদের টহল রুটিন আমার মুখস্থ।’ গোমর ফাঁস করে দেই আমি।

‘ঠিক সময়ে আইয়া পড়ছিলেন। আপনে জানতেন। আপনে অনেক ব্যাপার জানেন।’

মিলনকে আর তার ধারণা থেকে টলানো যায়নি। আমিও চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এই মুহূর্তে মিলনের মতই বিস্ময়াভূত হয়ে থাকতে দেখছি তার দুই সাগরেদকে।

আমিও বেশ বুঝতে পারছিলাম ঠিক জায়গাতেই টোকা দিয়েছি। তাই আবার জানতে চাইলাম, ’ঝামেলা তো খুলে বলবে। ’

মিলন আমাকে পাশের গলির দিকে নিতে থাকে, ’আপনারে আগে এক কাপ চা খাওয়াইতে দ্যান। খাইতে খাইতে শোনেন। জবরদস্ত চিপায় পড়ছি। এক্কেরে মাইনকার চিপা। ’

কাজেই রাত একটায় খোলা থাকা বিখ্যাত দোকান’মফিজ চা স্টল’-এ সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে গেলাম আমরা চারজন। ট্যামা মিলনকে দেখে মফিজ মিয়া তার শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থান চুলকাতে থাকে।

পরক্ষণেই মিলনের ধমকে একেবারে অ্যাটেনশন হয়ে যায়, ’ভাইরে ভালো করে পাত্তি দিয়া এক কাপ চা বানায় দে!’

সিগারেট থেকে আমি আজীবনই দূরে আছি। সেটা মিলন জানে। আমাকে অফার না করেই নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল।

এই কাজটা থেকেও ব্যাটা দূরে থাকত, ’আপনের সামনে সিগ্রেট ধরামু, কি কন এইটা, বস?’ প্রথম প্রথম এটাই বলত।

ধমকে লাইনে এনেছি।

আমার হাতে চা চলে আসল। মিলনের হাতে’সিগ্রেট’। আর বাকি দুই চ্যালার হাতে বাতাস।

পরিবেশটা বেশ থমথমে হয়ে যায় হঠাৎ করেই।

‘ডেলিভারীর একটা ব্যাপার ছিল, ভাউ।’ শুরু করে মিলন, ’এক ব্যাগ ভর্তি হিরোইন। ডেলিভারি দেবে তোতা মিয়া। শালাকে লোকেশন জানানো হইছে। কিন্তু, পাসকোড নিয়া একটা ক্যাচাল লাইগা গেছে, বস!’

‘বস’ তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে তাড়াতাড়ি যোগ করে মিলন, ’মাঝখানে পাসকোড পালটায় ফেলা হইছে। পুলিশে নাকি সাদা পোশাকে ফেউ লাগাইছে। পাসকোড হালারা জানে। ’

চারপাশে সুশীতল বাতাস বইছে। তার মাঝে আমি আরাম করে একবার চায়ের কাপে চুমুক দেই।

‘তোতা মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাউ কোথাও।’ ঠান্ডা গলায় বললেও তার উদ্বেগটা টের পাই , ’মোবাইল তো শালার বন্ধই তার উপ্রে কেউ কই পারে না হেয় কই। এখন পাসকোড জানাইতে পারতেছি না। হিরোইন চালান নেয়ার আগেই ব্যাটা আটকা পড়ব। ’

নিঃশব্দে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিলাম, ’নামেই তো গন্ডগোল। ’

ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তিন মাস্তান।

বিরক্তিতে মাথা দোলালাম, ’পাখির নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে কেন? উড়ে গেছে ব্যাটা। ’

‘গাদ্দারি করছে?’ ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা চোখ নিয়ে জানতে চায় মিলন।

‘না।’ মাথা নেড়ে একটা মুহূর্ত থম মেরে বসে থাকলাম, তারপর আবার বলি, ’খাঁচায় আটকেছে তোতাকে। ’

‘পুলিশ!’ হাহাকার করে ওঠে ওরা।

মাথা ঝাঁকাই আমি, ’পাসকোডটা আমাকে বল। আমি তোতাকে জানিয়ে দেব। ’

একটু দ্বিধায় পড়ে যায় এবার ওরা। আফটার অল, আমাকে মিলন গুরু মানলেও বাকি দুটো তো আর মানে না। মিলন আমাকে আরও এক ডিগ্রী বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এখন কিন্তু তোতার পুলিশের খাঁচায় থাকার হিসেবটা সহজ।

ট্যামা মিলনকে বেইমানী করার জন্য সাহসের দরকার। তোতা মিয়ার নামে মাঝে তেমন কিছু দেখলাম না। হিসেবে বলে, ব্যাটার যোগাযোগ না করার কারণ একটাই পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। যেহেতু’ফেউ’ লেগেছে এটা আরও স্বাভাবিক।

‘ফেসবুক।’ ফিস ফিস করে আমাকে জানায় মিলন।

‘পাসওয়ার্ড?’ নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘জ্বে।’ নির্মল হাসি দিয়ে বলে শীর্ষসন্ত্রাসী।

‘সব ঠিক আছে। তোতাকে বলে দেব।’ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিই আমি, ’এবার আমাকে একটা পিস্তল ম্যানেজ করে দাও তো। ’

ট্যামা মিলনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

‘কি করবেন ভাউ?’

‘মার্ডার করব।’ ঠান্ডা গলায় বলি আমি, ’বেশি না। একটা। এক বিচিতেই কাজ হয়ে যাবে। ’

চোখ ছানাবড়া অবস্থাতেই সম্মতি জানায় ও, ’ফুল লোড কইরাই দিমু নে। কিন্তু, কোন হারামজাদারে মার্ডার করা লাগব কন! লাশ ফালায় দিমু না। আপনার লগে ঘিরিঙ্গিবাজি!’

একটু হাসি আমি, তিক্ততার ছাপ পড়ে কি তাতে?

‘আমার সাথে না। এক বন্ধুর সাথে। তোমার কিছু করা লাগবে না। যা করার আমিই করব। ’

*

সকাল নয়টা।

ধবধবে সাদা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

ব্যাটা বাসায় আছে তো?

চারপাশটা বেশ ফাঁকা। বাড়িগুলো এখানে বেশ পরিকল্পনা করে বানানো হয়েছে।

আবাসিক এলাকা। কাজেই চারপাশে যেখানে সেখানে দোকানপাট আর মানুষের ভিড়ের ঝামেলাই নেই। গাছপালাও ভালই আছে। সবই পরিকল্পনামাফিক লাগানো বোধহয়।

বিভিন্ন জাতের পাখির ডাক আমাকে উদাস করে ফেলে। আর সব রাতের মত বাসাতে ফিরে এসে ঘুম দেইনি আমি। বরং সরাসরি চলে এসেছি এখানে। তিথি আমাকে এখানে দেখে ফেললে কি মনে করবে কে জানে?

তবে আমার হিসেবের মাঝে সবকিছু ঠিক থাকলে ওর আমাকে দেখতে পাওয়ার কথা না।

এই সময় দূর থেকে দেখতে পেলাম, সদর দরজা খুলে যাচ্ছে। চমৎকার স্যুট-টাই পড়ে ভদ্রলোক বের হচ্ছেন।

তিথিকেও চোখে পড়ল। বিদায় দিতে এগিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। এক মাসেই যথেষ্ট পতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে দেখা যাচ্ছে!

তিথি আমাকে বিয়ের আগের রাতে বলেছিল পালিয়ে যেতে। শুনিনি আমি। একবার স্ট্রোক করা তিথির বাবার ওপর জুয়ো খেলতে পারিনি। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।

বাড়িটা থেকে গ্যারাজের দুরত্ব বিশ ফিট। ভদ্রলোক সেদিকে হাঁটছেন।

ইনি চলে গেলে পুরো বাসাটায় শুধু তিথি একা থাকে। দোতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। এরকম প্রাচুর্য্যের মাঝে আমি কি কোনদিন তিথিকে রাখতে পারতাম?

উত্তরটা সহজ, পারতাম হয়ত, কিন্তু ততদিনে মেয়েটার স্বামীর সমান বয়স আমার হয়ে যেত!

গাড়িটা বের হয়ে আসছে। রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাখি দেখছি আমি।

আমার সামনে এসে বার দুই হর্ন দিতেই হয়। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। মেইন রোডের মত বড় রাস্তা তো আর নয় যে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে!

শান্ত ভাবে হেঁটে গাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। পিস্তলটা বের করে এনেছি।

প্রথমবারের মত টার্গেট করতেও আমার হাত একটুও কাঁপে না।

মাঝবয়েসী ভদ্রলোকের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ট্যামা মিলনের মতই।

বার দুই গুলি করলাম। পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে গুলির শব্দে।

ভদ্রলোকের চোখ এখনও বড় বড় হয়ে আছে। সেখানে প্রাণের চিহ্নটুকু ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

পাশের সীটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ফারিহা বসেছিল মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই সেখানে।

এই মাত্র প্রথমবারের মত মানুষ খুন করে আমার অবশ্য একটুও খারাপ লাগছে না।

ঘরে মাসখানেক আগে বিয়ে করা নতুন বউ, তিথির মত মিষ্টি একটা মেয়ে রেখে যেই স্বামী পতিতার কাছে ছোটে রাতের বেলায় সে কি আসলে মানুষ?

মেইন রোডের দিকে আগালেও উঠতে পারলাম না।

পুলিশের গাড়িটা কোথা থেকে এসে জানি আমাকে তুলে নিল। কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে নেওয়ার সময় চিকণ পুলিশটা একটা থাপ্পড় মারে ডান কানে।

মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল আমার।

*

চারজন মানুষ হাজতে ঘুমুচ্ছে। তাদের মাঝে আমাকে নিতান্ত অবহেলার সাথে ছুঁড়ে ফেলা হল।

কোনমতে সোজা হয়ে বসে শিস বাজাচ্ছি শুনতে পেয়ে কাছে থাকা পুলিশটা অশ্লীল একটা গালি দিয়ে উঠল। থানার সবার জানা হয়ে গেছে এই নিরীহ দর্শন বর্বর ছেলেটা এই মাত্র  একজন সভ্য নাগরিককে খুন করে এসেছে। হত্যাকান্ডের আসামীর চেয়ে ঘৃণ্য আর কি হতে পারে?

কে হতে পারে?

কিছুক্ষণ আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেছি। চোখে রাজ্যের ঘুম। অথচ ঘুম আসছে না।

ঘুমাতে থাকা মানুষ চারজনের শান্তি এখন আর সহ্য হচ্ছে না। কাজেই উঠে দাঁড়ালাম। দেওয়ালের দিকে পড়ে থাকা মানুষটাকেই পছন্দ হল।

এই ব্যাটার সারা শরীরে পুলিশী টর্চারের চিহ্ন স্পষ্ট।

ঠ্যাং লম্বা করে ঝেড়ে ব্যাটার পাছাতে একটা লাথি মারতেই ছটফট করে উঠে দাঁড়ায় মানুষটা।

‘তুই আবার কোথাকার গান্ডু?’ কোমরে হাত রেখে চট করে প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দেয় লোকটা।

‘তোতা মিয়া?’ সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করি আমি।

লোকটার মুখে এবার একটা সতর্ক ভাব ফুটে ওঠে, ’হুম। তো?’

‘পাসকোড পাল্টেছে। নতুন পাসকোড, ফেসবুক। ’

তোতা মিয়ার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টিটা মুখের ওপর টের পাচ্ছি, কিন্তু আমার চোখ আটকে আছে হাজতের গেটের দিকে।

চিকণ পুলিশটা ফিরে এসেছে।

এবং গেটের তালা খুলতে খুলতেই দ্রুত জানায়, ’সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে স্যার। ’

আমি ফেরেশতার মত মুখ করে হাসলাম, ’ইটস ওকে। ’

হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে লোকটা হাজতেই, ’বের হয়ে আসেন স্যার। ওসি স্যার আপনার সাথে চা খাবেন। ’

মাথা নেড়ে আস্তে করে হাজতের দেওয়ালে হেলান দেই আমি।

তারপর মুখ তুলে বললাম, ’তোতা মিয়াও আমার সাথে বের হচ্ছে। ’

 

রচনাকাল – মে ২, ২০১৪

চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *