KP Imon

Words Crafted

মনস্তত্ত্ব

রাহাত বহু কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে আর বেশিক্ষণ পারবে না। মেয়েদের সাথে অশ্লীল ব্যাবহার তার মোটেই পছন্দ নয়।
পাশে দাঁড়ানো লোকটার মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তার বহুক্ষণ ধরেই হচ্ছে।
বাসে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত। ঢাকায় সিটিং সার্ভিস কয়টা আর কাজে সিটিং? দিনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলোয় – যখন চেকার বাসে উঠে – তখনই এরা ভদ্র হয়ে যায়। বাকি সময়গুলো হেল্পারদের ধান্ধা থাকে ড্রাইভারের কোল পর্যন্ত একটা মানুষ তোলার।
ভাগ্যকে মেনে নিয়ে রাহাতও দাঁড়িয়ে ছিল।
এক তরুণীকে রাহাতের মতই বাধ্য হয়ে দাঁড়াতেই হয়েছে। রাহাত সীট পেলে নিশ্চয় ছেড়ে দিত। পাশের লোকটা ভীড়ের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছে করেই মেয়েটার কোমরে হাত দিচ্ছে। যদিও মুখে ফুটিয়ে রেখেছে রাজ্যের সারল্য। আর ওদিকে লজ্জায়-অপমানে মেয়েটা লাল হয়ে আছে।
হঠাৎ বাসের রড বাম হাতে ধরে ব্যালেন্স ঠিক করে ডান হাতে সপাটে ঘুষি চালায় ও অভদ্রটার মুখ বরাবর। মটমট করে একটা শব্দের সাথে মুখ থেকে রক্তের সাথে বেড়িয়ে আসে দুটো দাঁত। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা।
‘ঘরে তোর মা-বোন ছিল না কখনও?’ দাঁতে দাঁত পিষে বলে রাহাত। ‘মেয়েদের সম্মান করতে শেখ, ****(প্রকাশের অযোগ্য)।’
বাসজুড়ে হট্টগোল পড়ে যায়। অন্যান্য যাত্রীরা উঠে সরিয়ে দেয় রাহাতকে। হেল্পার এগিয়ে আসে।
‘তুমি হালার পো কোন এলাকার মাস্তান?’ রাহাতের বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে। ‘নিরীহ একটা মানুষের মুখে এভাবে মারো?’
তাকে সায় দিয়ে ঘিরে ধরে আরও কয়েকজন।
*
মাঝপথে থেমে যায় বাসটা। ছুঁড়ে ফেলা হয় রাহাতকে।
রাস্তা থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় রাহাত। নাক থেকে গড়িয়ে আসা দু’ ফোঁটা রক্তের ফোঁটা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছে ফেলে।
নিস্ফল আক্রোশে লাথি দেয় রাস্তায়।
স্রেফ একটা মেয়েকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। অথচ কেউ সেটাকে পাত্তাই দিল না। তার কথা কেউ শোনার প্রয়োজনও মনে করল না! কোট-টাই পড়া অমানুষটাকেই সবার ভদ্রলোক বলে মনে হল?
আর মেয়েটা পুরো সময় ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ওই শালী কিছু বলতেই পারত! ‘যার জন্য করলাম চুরি – ’ বিড়বিড় করে রাহাত।
কটমট শব্দে ডানে বামে ঘাড় মটকে চায়ের দোকানে আসে ও। বড্ড লেগেছে। চলন্ত বাস থেকে ঘাড়ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়া কোন ছেলেখেলা নয়।
‘মামা, পানি দেন একগ্লাস।’
পানি রুমালে ঢেলে নাক থেকে রক্ত মোছে রাহাত। এই সময়ই প্রথম শোনে ও সুরেলা কন্ঠটা।
‘আপনার কি বেশি লেগেছে?’
ঘুরে দাঁড়িয়ে ও দেখতে পায় সেই তরুণীকে। ওকে বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলার সময়ই নিশ্চয় নেমে এসেছে! মেজাজ টং হয়ে যায় রাহাতের। ‘বাস ভর্তি মানুষ যখন আমাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছুঁড়ে ফেলছিল তখন একটা শব্দও মুখ থেকে বের হয়নি আর এখন এসেছ পিরীতির আলাপ করতে!’ মনে মনেই খেদ ঝাড়ে ও, সব কথা মুখে বলতে নেই।
‘না।’ কিছু একটা বলা লাগে তাই এতখানি বলল।
‘আমি খুবই দুঃখিত।’ আবার ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়েটা। ভাল ছিচকাঁদুনের পাল্লায় পড়া গেছে – ভাবে রাহাত।
‘আপনার দুঃখ নিয়ে আপনার পথে চলে গেলেই আমি খুশি হতাম।’ বেশ জোরেই বলে রাহাত, ‘প্লিজ!’
চায়ের দোকানদার আর কাস্টোমাররা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
ভাল তো!
রাস্তায় তরুণ-তরুণীকে দেখলেই বিশেষ লুক দেওয়া হয় এই দেশে। আর এ তো নাক থেকে রক্তের ফোঁটা মুছতে থাকা তরুণের হুংকার। তাকাবে – সন্দেহ কি তায়!
গ্লাসটা দোকানে ফেরত দিয়ে সামনে হাঁটা দেয় রাহাত। ভয়ে ভয়ে গ্লাস ফেরত নেয় দোকানীও।
মেয়েটার দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে রিকশা নেয় ও।
বাসায় যাওয়ার পথে একদফা নাটক হয়ে গেছে। আরেকবার বাসে উঠে ঝামেলায় যেতে চাইল না। একদিনের জন্য বাসে যথেষ্ট ওঠা হয়েছে!
*
কলিংবেলের শব্দ শুনেও পাত্তা দেয় না রাহাত। এই রাতের বেলা কারও আসার কথা না।
আর কেউ আসলেও সে এমন লাটসাহেব হয়ে যায়নি যে কলিং বেলের শব্দ শুনেই ছুটতে হবে।
এমনিতেই বাসায় কেউ নেই।
বাবা-মা আর ছোটভাইকে কয়েক মাস থেকে করা প্ল্যান অনুযায়ী গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে ও। রাহাতেরও যাওয়ার কথা ছিল – হরতালে পিছিয়ে যাওয়া সেমিস্টার ফাইনালের জন্য আটকে গেল। মা ওই অজুহাতেই বার বার গ্রামের বাড়ি যাওয়া পিছাচ্ছিল, এবার রাহাতের জোরাজুরিতে আর পারেনি। ও তো আর স্কুলের কচি খোকাটি নয় যে তার পরীক্ষার জন্য বাবা-মাকে বাড়ি বসে পাহারা দিতে হবে!
আধঘন্টা পর আবারও কলিং বেল।
এবার একটানা চারবার।
এবার টেবিল থেকে মুখ তোলে রাহাত। ঘড়ি দেখল, যথেষ্ট রাত হয়েছে। বাবার ব্যবসায়ী সুনাম এলাকার চোর-ছ্যাচ্চড়ের জানতে নিশ্চয় বাকি নেই। তিন বছর আগে ওরা সপরিবারে থাইল্যান্ড ট্যুরে যেবার গেল, চুরি হয়েছিল বাসায়।
পঞ্চমবার কলিং বেলটা বাজলো, দ্বিধা ছেড়ে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ায় রাহাত। বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকে আলমারির নিচের দেরাজটায় হাত দিতেই পাওয়া গেল ওটা।
বাবার পিস্তল!
জিনিসটা ও চালাতে জানে। বাবা-ই শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “অস্ত্র আমি ঘৃণা করি। তবে ব্যবসায়ীর ছেলে হিসেবে তোকে এই বাজে জিনিসটা শিখিয়ে রাখাই ভালো। নানা দিকে শত্রু। এদেশে খেটেখুটে কিছু করবি, তাতে শান্তি নেই। অন্যরা চেষ্টা করবে মুফতে তা নিয়ে যেতে!”
সেফটি ক্যাচ অফ করে রাহাত। সাবধানের মার নেই। রাতের বেলা এ এলাকায় ডাকাতি আগেও হয়েছে। দরজা খুলে হাল্কা ফাঁক করে রাহাত।
বিকালের সেই সমস্ত গন্ডগোলের হোতা মেয়েটা দাঁড়িয়ে।
‘আমার বাসা খুঁজে পেলে কি করে?’ কোমরের পিছে পিস্তলটা লুকোয় রাহাত। বেশ রুক্ষস্বরেই প্রশ্নটা করল এবার। বিষয়টা এবার হ্যারাসমেন্টের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
‘আপনাকে ফলো করেছিলাম। আই অ্যাম সরি। আজ আপনার সাথে যা হল সেজন্য সত্যিই খুব খারাপ লাগছে আমার। তাও আবার আমার জন্য।’ চেহারা দেখে মনে হচ্ছে খুবই ভয়ে আছে মেয়েটা, ‘আপনি ক্ষমা না করলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।’
‘আদর্শবতী!’ – রাগে দাঁত কিড়মিড় করে রাহাত। মুখে যদিও বলে ভিন্ন কথা –
‘আমি কিছু মনে করিনি। ওদের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ছিল। তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝি। পাবলিকলি কিছু বলতে পারনি। এটা নিয়ে প্লিজ আর চিন্তা করবে না। উই আর ইভেন।’
‘আসি তাহলে?’
‘জ্বী – আসতে পারেন।’ ‘তুমি’ থেকে আবার ‘আপনি’তে ডাইভার্ট হয়ে গেল রাহাত। একে খ্যাদানোটা প্রথম কথা।
‘ওহ – বাই দ্য ওয়ে, আমি তন্বী।’
‘আমি রাহাত।’ ভদ্রতা করেও ভেতরে ডাকে না রাহাত ওকে। কাজ পড়ে আছে।
‘আসি রাহাত ভাই। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব আমি।’
দরজা লাগায় রাহাত।
*
গত কয়েকদিন ধরে সাইকোলজির ওপর একটা নতুন থিওরি নিয়ে গবেষণা করছে রাহাত। যদিও ও কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র – সাইকোলজি বিষয়টা ওর প্যাশন।
তন্বীকে ভেতরে আমন্ত্রণ জানানোটা হয়ত ভদ্রতার দাবী রাখত – কিন্তু সারাদিনের অভিজ্ঞতা এবং নতুন গবেষণার ব্যাপারটা মিলিয়ে এতদিকে খেয়াল ছিল না ওর। প্রচুর পুরোনো পেপার পড়তে হচ্ছে ওকে। নিজেও সাক্ষাতকার নিচ্ছে বেশ কিছু মানুষের। সেসবের রেকর্ডিং থেকে করতে হচ্ছে ট্রান্সক্রাইব। বেশ সময়ের ব্যাপার। মনোসংযোগেরও!
আবার দ্রুত ফিরে এল রাহাত ওর রুমে। চিন্তা যেখানে থেমেছিল, সেখানে নিজেকে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করল তারপর। একবার মনোযোগ নিয়ে এসে ভেঙ্গে গেলে আবার ফিরিয়ে আনাটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
বেশ কয়েক মিনিট পর নিজের চিন্তায় ঢুকে পড়তেই খুট করে একটা শব্দ হয় ঘরের দরজার কাছে।
সেদিকে তাকিয়েই চমকে যায় রাহাত।
তন্বী এলোমেলো চুলে দাঁড়িয়ে আছে।
ও কোনদিক দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল?
‘তুমি এখানে কি করছ?’ কঠোর কন্ঠে বলতে গিয়েও থেমে যায় রাহাত।
শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাপড় ছেঁড়া মেয়েটার।
হাতে একটা কিচেন নাইফ।
মুখ দিয়ে একটা জান্তব শব্দ করে রাহাতের ওপর ছুরি বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটা।
বিদ্যুতবেগে গড়িয়ে সরে যায় রাহাত। বিছানায় গেঁথে যায় ছুরির ফলা।
টান দিয়ে বের করে আবার রাহাতের দিকে এগিয়ে আসে তন্বী।
লাথি দিয়ে চেয়ারটা ওর দিকে পাঠিয়ে দেয় রাহাত।
অপার্থিব একটা লাফ দিয়ে ওর সামনে চলে আসে তন্বী। কোন বাধা না পেয়ে খাটের সাথে ধাক্কা খায় চেয়ারটা।
এই প্রথমবারের মত আতঙ্ক অনুভব করে রাহাত।
মেয়েটা কি মানুষ? একটা আহত মেয়ে কিভাবে এক লাফে চারফুট ওপরে ওঠে?
জীবনবাজি রেখে ছুটে ঘর থেকে বের হয় ও।
পেছনে জান্তব শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসে তন্বী, যেন সাক্ষাৎ পিশাচিনী!
ডাইনিং টেবিল থেকে একটা গ্লাস ছুঁড়ে মারে রাহাত ওর দিকে।
স্রেফ বাতাসে ভেসে এড়িয়ে যায় মেয়েটা। বিকট শব্দে গ্লাসটা ভাঙ্গল দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে।
আর একমুহূর্ত নষ্ট না করে ছুট লাগায় রাহাত।
বাবা-মার ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকায়। ওখানেই রেখছিল তো?
হ্যাঁ। ভদ্র ভঙ্গীতে শুয়ে থাকা পিস্তলটার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাহাত।
হাতে ঠান্ডা – মসৃণ বাটটার ছোঁয়া পেতেই পেছনে দড়াম করে পুরোপুরি খুলে যায় দরজা।
মেয়েটার চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে , মুখ বেয়ে কষ গড়িয়ে পড়ছে।
পরের সেকেন্ডেই উদভ্রান্তের মত রাহাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তন্বী।
পাগলের মত গুলি চালায় রাহাত।
তিনটি গুলি বেরিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করে সবগুলো মিস করেছে তাড়াহুড়োয়।
ছুরি ধরা হাত মাথার ওপর তোলে মেয়েটা মরণ আঘাত হানতে।
পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে দুইবার গুলি করে রাহাত।
ছিটকে পেছনের দিকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যায় মেয়েটা। এবং পড়েই থাকে।
রক্তের ক্ষীণ একটা স্রোত বয়ে যায় রুমের মেঝেতে – তরলের নিম্নগামীতার সূত্র মেনে নিয়ে।
*
রাত ১২টা।
রাহাতদের রোডেই খালি একটা প্লট।
বেলচা দিয়ে যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে কবর খোঁড়ে রাহাত।
আলতো করে শুইয়ে দেয় মেয়েটাকে।
খুনটা করে ফেলার পরই তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করেছিল ওকে।
স্রেফ আত্মরক্ষার খাতিরেই কাজটা করতে হয়েছে ওকে – অথচ শান্তভাবে কিচ্ছুটি ভাবতে পারছিল না। কখনো একটা পিঁপড়েও মারেনি সে। সেখানে জ্বলজ্যান্ত একজন মানুষ…
আর কিছু ভাবতে পারেনি। লাশটাকে ঢেকে এখানে নিয়ে এসেছে।
নির্জন ছিল পুরো গলি। ডাকাতদল তো আর বিনা কারণে এই এলাকাকে বার বার তাক করে না! মনে হয় না কেউ গুলির শব্দ শুনেছে বা শুনলেও তা চিনতে পেরেছে। এলাকা সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ।
ও ছাড়া কোন সাক্ষী নেই, কেন ‘জলবৎ তরলং’ একটা ব্যাপারকে থানা-পুলিশের পর্যায়ে নিয়ে যাবে?
লাশটাকে মাটিচাপা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয় রাহাত। এই প্লটে আগামী বছরের আগে কাজ শুরু হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই – জানে রাহাত। সুলায়মান আংকেলের প্লট। বাবার সাথে তার খাতির বেশ। বছরখানেক পর এই লাশ কন্সট্রাকশনের লোকজন পেয়ে যাবে, তারপর কঙ্কাল উদ্ধার করে ছাই করে ফেলবে পুলিশ।
বাসার দিকে ক্লান্ত পায়ে ফিরে চলে ও। রক্তের দাগ পরিষ্কার করতে হবে।
*
এখানেই পুরো ঝামেলা শেষ হতে পারত – কিন্তু শেষ হওয়ার পরিবর্তে বেড়েই চলল তা।
পরদিন সকালে নাস্তা করতে বের হয়েছিল রাহাত। বাবা-মা না থাকলে নাস্তাটা বাইরেই সারে ও। সকাল সকাল রান্না করার ঝামেলায় যেতে কারই বা ভালো লাগে!
রাস্তায় পা রাখতেই ওপাশ থেকে হেঁটে এল তন্বী।
তীব্র আতঙ্কে জায়গাতে জমে যায় রাহাত।
হাসিমুখে ওকে পাশ কাটিয়ে রাস্তা দিয়ে মেয়েটা হেঁটে যায় উল্টোদিকে।
মাথা দুই হাতে ঢেকে বসে পড়ে রাহাত।
চারদিকে ঝলমলে দিনের আলো। এর মাঝে এসব ব্যাখ্যাহীন কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না ও মোটেও।
আধঘন্টা পর নিজেকে বোঝায় ও – তন্বীর মত দেখতে কেউ ছিল ওটা। মনের জোর একত্র করে নাস্তা সেরে আসে।
রোডের শেষ মাথায় স্পষ্টই তন্বীকে দেখে রাহাত। ছুটে যায় এবার ও বেপরোয়া হয়ে।
কিন্তু আগেই সরে গেছে মেয়েটা, যেন স্রেফ মিলিয়ে গেল বাতাসে! রোডের শেষ মাথায় পৌঁছে দুইপাশে কাওকে দেখে না ও।
*
এক মাস পেরিয়ে গেছে।
প্রথমদিকে দূরে দূরে দেখত ও মেয়েটাকে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে কাছে আসছে ওটা।
রাতে কিংবা দিনে এখন বাড়ির ভেতর দেখতে পায় তাকে।
সেদিন স্বপ্নে দেখে ওর সাথে তন্বীর বিয়ে হয়ে গেছে।
থাইল্যান্ডে ঘুরতে এসে নৌকা ভ্রমণে বেড়িয়েছে ওরা। হাসিতে মুখর নবদম্পতির প্রমোদতরী।
পাশ দিয়ে আরেকটা নৌকা চলে যায় – তাতে এক মা দাঁড়িয়ে আছে তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। স্বামীপ্রবর কিন্তু ঠিকই হাত নাড়ে। রাহাতও হাত নেড়ে সায় দেয়।
হিস হিস শব্দে ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য হয় রাহাত, ‘আমার ওরকম একটা বাচ্চা থাকতে পারত। তোর জন্য শুধু …’ জান্তব শব্দ করে এরপর মেয়েটা। নৌকার একাংশ ভেঙ্গে তার সাথেই পানিতে তলিয়ে যায় ওরা।
নৌকার বাকি অংশও ডুবে গেলে পানিতে পড়ে বৃথায় হাত-পা ছুঁড়ে রাহাত। সাঁতার পারে না ও।
দম আটকে আসায় হাত পা ছোঁড়ে – আর ঘুমটা তখনই ভেঙ্গে যায় ওর।
চোখ খুলতেই দেখতে পায় তন্বীকে। ওর গলা দুই হাতে টিপে ধরেছে।
জিহবা কিছুটা বের হয়ে আছে ওর। দুই চোখে জীঘাংসা।
হঠাৎ মা লাইট জ্বালান।
‘কি হয়েছে বাবা তোর? চিৎকার করছিস কেন?’ লাফ দিয়ে বসে রাহাত।
তন্বী নেই কোথাও।
*
তন্বীর সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা থেকে সব কিছুই খুলে বলে রাহাত একনাগাড়ে।
ড. সাদেক মন দিয়ে শোনেন। ভদ্রলোক সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টাল হেড। বাংলাদেশের সেরা সাইকোলজিস্টদের মধ্যে অন্যতম।
রাহাতের এখন ফাঁসীর দড়ি গলায় নিতেও আপত্তি নেই – ও শুধু মুক্তি চায় এই বিভীষিকার হাত থেকে।
সব শুনে রাহাতের চোখের দিকে তাকান ড. সাদেক।
‘রাহাত – তোমার ব্যাচমেট মিথিলার সাথে তোমার ঠিক কি ধরণের সম্পর্ক ছিল?’
‘স্যার?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রাহাত।
‘আমার কাছে লুকালে তোমাকে আমি কিভাবে সাহায্য করব বল?’
কিছুক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে রাহাত। তারপর মুখ খোলে, ‘আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম।’
‘মিথিলার সুইসাইডের কারণ তুমি জানতে রাহাত?’ তীরের মত পরের প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন ড. সাদেক।
চুপ করে থাকে রাহাত।
বাধ্য হয়ে আবারও মুখ খোলেন ড. সাদেক –
‘দেখ, বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সাইক্রিয়াস্টিক বলা হয় আমাকে। কেন, জানো? আমি প্রতিমুহূর্তে দেখা মানুষের মনের অবস্থা নিয়ে ভেবে যাই। এখন অনেক কিছুই বুঝে ফেলাটা আমার মুদ্রাদোষ হয়ে গেছে। তুমি বা মিথিলা কাওকে কিছু না বললেও অনেক কিছুই আমি জানি – যেটা আর কারও জানার কথা না। কিন্তু বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হলে আমার তোমার সাহায্য দরকার। এবং কেবল এভাবেই তোমাকে সাহায্য করা সম্ভব আমার পক্ষে।’
মিনিট দুয়েক চুপ থেকে তাকায় রাহাত, ‘মিথিলা অন্ত্বঃসত্তা ছিল। আমার সন্তান নিয়ে। ওটা ছিল একটা অ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু তখন আমরা কেবল সেকেন্ড ইয়ারে। বিয়ের ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য বলে মিথিলা আমাকে। আমি …’ চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি মোছে রাহাত।
‘আমি ফিরিয়ে দেই ওকে সেদিন। পরদিন শুনি আত্মহত্যা করেছে মিথিলা।’
‘তোমার বাসায় যাওয়া যাবে এখন, রাহাত?’ প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে ফেললেন ড. সাদেক।
*
বাবা-মা দুইজনই অফিসে। ছোট ভাইটা স্কুলে।
বাসা খালি দেখে স্বস্তি পায় রাহাত।
‘তোমার বাবা-মার ঘরে নিয়ে চল আমাকে।’ ভেতরে ঢুকেই বলেন ড. সাদেক।
ঘরটায় ঢুকে চারপাশে তাকান তিনি। বুকশেলফটা দেখেন। দেওয়ালগুলো খেয়াল করেন কাছ থেকে। তারপর ফিরে আসেন ড্রইং রুমে।
‘রাহাত – তোমার সিজোফ্রেনিয়া আছে। এটা অডিটরি এবং ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশনের সমন্বয়। যা আসলে ঘটছে না – এমন কিছু দেখতে পাও তুমি – শুনতে পাও। তোমার মস্তিষ্কের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করে এটা। তোমার অতীত ইতিহাস আরও ইন্ডিকেট করছে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারের, সেই সাথে প্রেমিকা তোমার সন্তান নিয়ে আত্মহত্যা করলে সেটা তোমার মানসিক স্বাস্থ্যের কোন উপকারে আসেনি। রোগটা ধীরে ধীরে ডেভেলপ করেছে হয়তো-’
‘স্যার আমি জানি সিজোফ্রেনিয়া কীভাবে ডেভেলপ করতে পারে। কিন্তু আপনি কিভাবে -’
‘মিথিলার ঘটনায় তুমি ভয়ানক আপসেট ছিলে। নিজেকে শাস্তির যোগ্য মনে করেছিলে। মিথিলা কোন নোট রেখে যায়নি। পোস্ট মর্টেমে তার পরিবার রাজি হয়নি। তুমিও মুখ খোলনি। কেউ জানে না আসলে মিথিলার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী, বরং তোমাকে সবাই সহানুভূতি জানিয়েছে। এজন্যই তন্বী নামের কাল্পনিক মেয়েটা তোমাকে স্বপ্নে সন্তানের কথা বলে অভিযোগ করেছে, এখন পর্যন্ত তোমাকে বিরক্ত করে আসছে। এটা তোমার নিজেকে দেওয়া নিজের পক্ষ থেকে শাস্তি।’
‘আমি নিজের হাতে গুলি করি তন্বীকে। ওকে একটা পশুর মত পুঁতে রাখি খালি প্লটে। ওর মৃত্যুর পর আমি যা দেখি তা সিজোফ্রেনিয়া হতেই পারে। কিন্তু স্যার আমি তন্বীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। হয়তো… হয়তো ওই মেয়েটাকে মেরে ফেলার পর আমার ব্রেকডাউন-’
‘না, রাহাত। তন্বী বলে কোন মেয়ের সাথে তোমার পরিচয় হয়নি। বাসের কেউ তোমার কথায় কান দেয়নি। চায়ের দোকানদার তোমার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। কারণ – তুমি বাতাসের সাথে কথা বলছিলে তখন।’
‘অসম্ভব – আমি ওকে গুলি করি…’
‘তুমি বলেছ – তুমি গুলি করেছিলে পাঁচবার। শেষ দুইবার লাগাতে পেরেছ। ’
‘এক্স্যাক্টলি, স্যার!’
‘অথচ বুকসেলফে পাঁচটা বুলেটই গেঁথে থাকতে দেখলাম আমি। বলতে চাও দুইটা গো-থ্রু উয়ন্ড একটা মেয়েকে ইন্সট্যান্টলি মেরে ফেলতে পারে? বুলেটে কথা বাদ দাও – তোমার ছোঁড়া গ্লাস অথবা চেয়ার কোনটাই নাগাল পায়নি মেয়েটার।’
‘তাহলে স্যার – আমি তন্বী – মানে খুনটা করিনি?’ বিশাল বোঝা নেমে যায় রাহাতের বুক থেকে।
‘না।’ মুচকি হাসেন ড. সাদেক, ‘আর মিথিলার ব্যাপারে তুমি যথেষ্ট অনুতপ্ত। কোন শাস্তি পাওয়ার মতো কাজ করেছ বলে আমি মনে করি না, তবে তুমি যতখানি অনুশোচনায় ভুগছো তাতে করে তোমার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাওয়ার কথা। আমি মনে করি সত্যটা আমাদের দুইজনের মধ্যেই চাপা থাকতে পারে।’
*
রাত ১২টা।
কোথাও একটা প্যাঁচা ডাকলো।
এই গলিটা আসলেই ভীষণ নির্জন!
রাহাতের বর্ণনা অনুযায়ী খালি প্লটটায় দাঁড়িয়ে আছেন ড. সাদেক।
কৌতুহলই তাকে টেনে এনেছে আজ এখানে। সকালে রাহাতকে দেওয়া ব্যাখ্যাটার সত্যতা জানার একটাই উপায়। বেলচা চালিয়ে নিঃশব্দে খুঁড়ে যান ড. সাদেক।
নরম কিছুতে বেলচা পড়তেই থমকে গেলেন ডক্টর।
আধপচা মেয়েলি একটা হাতের দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি।

৩রা ডিসেম্বর, ২০১৩

চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *