ঐক্য

“তা তো যাবেই।” অমায়িক হাসি হাসলো নির্ঝর, “বললাম না, আজ রাতে গোলাগুলি হবে।”

হলের ভেতর গুমোট একটা পরিবেশ। আজকে রাতে মনে হয় ঝামেলা হবে। এই হলের কাকে যেনো শাহ্‌ কুতুব হলের ছেলেরা টর্চ মেরে খুঁজছে। পেলেই ‘খিঁচে দেবে’। চারদিন পর সেমিস্টার ফাইনাল, পড়ার টেবিলে অযথাই কিছুক্ষণ উশখুস করলাম। দুটো দিন পড়ার টেবিলে জুত করে বসার আশা না করাই ভালো। ফিস্টের রাতে, আর যেদিন হলের মধ্যে কাওকে ‘খিঁচে দেওয়ার’ সম্ভাবনায় পরিবেশ গুমোট থাকে। সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে আজকে দুটো উপলক্ষ্যই ঘটেছে। রাতে ফিস্টের রমরমা খাওয়া সেরে এসে কান নেওয়া কথায় কান দিলাম। তারপর কি আর টেবিলে বসে থাকা যায়?

জানালার সামনে এসে একটা পাল্লা খুলে দিলাম। আতিকের টেবিলে পড়ে থাকা সিগারেটটা তুলে নিয়ে ধরিয়ে ফেললাম চট করে। হাহাকার করে উঠলো রুমমেট, বিড়ি-কিপটা বলে তার সুখ্যাতি ধরে রাখতে অতটুকু হাহাকার সে করেই থাকে, পাত্তা না দিয়ে বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পুকুরের পাড়ে কারও উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিপক বাহিনীর গুপ্তচর হতে পারে। আজকে রাতে হলের চারপাশে অদৃশ্য চোখের আনাগোনা না থাকলেই অবাক হতে হতো।

অর্ধেক হয়ে আসা সিগারেটটা কিপ্টা-আতিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে লম্বা পায়ে বের হয়ে আসলাম রুম থেকে। পড়াশোনা এখন হবে না। সময়টা অন্য কোনোভাবে কাজে লাগানো উচিত। তিনশ’ ছয়ে ঢুকেই গুলির প্রচণ্ড আওয়াজে বুকে থুতু দিয়ে বের হয়ে আসতে হলো। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে ঢুকেই পড়লাম, চারটা পিসিতে পুরোদমে চলছে যুদ্ধ। কাউন্টার স্ট্রাইকের প্রকোপে টেকা দায়। সিআর শাফকাতকে এর মধ্যেই বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দেখা গেলো। মোবাইলটা রুমে রেখে আসার জন্য এক আইসবার্গ পরিমাণ আক্ষেপ হলো এবার। এই একটা ছবি তুলে ফেলতে পারলেই পৃথিবীবিখ্যাত ট্রল বানিয়ে ফেলা যেতো। “সার্কেলের যেই বন্ধুটি কেয়ামত নেমে এলেও বই থেকে ওঠে না” – জাতীয় কিছু। সুড়ুৎ করে নাইন-গ্যাগে চলে যেতো!

শাফকাতের কানের পাশে গিয়ে হাঁক ছাড়লাম, “পড়ে তো ফাটায়া ফেলতেছোস, শাআআআলা!”

ধড়মড় করে সোজা হয়ে গেলো ছোকরা, তবে আমার হুঙ্কার এই প্রতিক্রিয়ার পেছনে দায়ী না। বইয়ের পাশে রাখা মোবাইলের আলো জ্বলে উঠেছে। আলো জ্বালানোর পেছনে কে আছে তা জানতে চাইলে আমরা কেউ বলতে পারবো না। শাফকাতের সাথে পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। কিন্তু ইদানিং ফেসবুকের হোমপেজে গেলেই স্কুল জীবনের বান্ধবীদের প্রোফাইল পিকচারেও তার লাইক-কমেন্ট দেখা যায়। বিশাল নেটওয়ার্ক।

“দাঁড়া।” আমাকে পজ করে দিয়ে মোবাইলে হামলে পড়লো শাফকাত।

ঘাড় বাঁকা করে মেসেজের সেন্ডারের নামটা দেখার চেষ্টা করলাম। পরশু আমার ছোটোবোন শ্রাবন্তীর ছবিতেও হারামজাদার লাইক দেখেছি, যদা সতর্ক তবঃ শয়তানমঃ। তবে বেশি সুবিধে করা গেলো না। নিপুণ দক্ষতার সাথে স্ক্রিণ বাঁকা করে মেসেজের রিপ্লাই দিলো ইবলিশটা। তারপর বিগলিত হাসি হেসে বললো, “কিরে? অবস্থা কী?”

সন্দেহটুকু গিলে ফেলে জানতে চাইলাম, “ষোলো নাম্বার চ্যাপ্টারটা তো স্যার টাচ করে নাই, তাই না?”

মাত্রই মরে যাওয়া গেমার বন্ধু দূর থেকে হাঁক ছাড়লো, “আসছে আরেক কেল্টু-চো*(পাবলিশ করার অযোগ্য)। ষোলো নাম্বার চ্যাপ্টার চো*(পাবলিশ করার অযোগ্য)ইতেছে। ওইদিকে দ্বিপকের গুষ্টি হলের সিঁড়িঘরে আইসা বইসা আছে আর তোমরা পড়াশোনা চো*(পাবলিশ করার অযোগ্য)।”

মহাবিরক্ত হলে জানতে চাইলাম, “আর তোমরা কি চো*(পাবলিশ করার অযোগ্য)তেছো?”

এখনও বেঁচে থাকা গেমার বন্ধুটি শুধু জানালো, “ওয়ার্ম আপ।”

বাকি দুইজন নিবিষ্ট মনে শত্রু খুঁজছে। তাদের মধ্য থেকে রাতুল শুধু বললো, “বিড়ি-টিড়ি থাকলে দে তো।”

দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বের হয়ে এলাম। নেহায়েত ল্যাপটপটা নষ্ট বলে, সার্ভিসিংয়ে দিয়ে এসেছি। নাহলে আজকে এহেন অপমানের শোধ গেমের স্ক্রিনে ঠিকই নিতাম।

করিডোরের শেষ প্রান্তে নির্ঝরের রুমের সামনে একটা ছায়া দেখা গেলো। ডাক দিলাম, “নির্ঝর!”

নির্ঝর থেমে গেছে। ঘুরে আমার জন্য অপেক্ষা করলো কতোক্ষণ, তারপর ঢুকে গেলো ভেতরে। তবে দরজায় ছিটকিনি তোলেনি। ওদিকে ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেলাম। নির্ঝরের রুমে আমি কদাচিৎ ঢুকি। হোমড়াচোমড়াদের আবাস। হাইপ্রোফাইল ছাত্রনেতা কনক ওই রুমেই থাকে।

আমার যতোদূর সন্দেহ আজকে রাতে দ্বীপক বাহিনী কনকের জন্যই হলে আক্রমণ করবে। ‘খিঁচে দেওয়ার’ মতো বিশিষ্ট প্রাণি এই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েই বা আছে কয়টা? কনক ছেলেটা আমাদের জুনিয়র, তবে “বিশ্ব–বেয়াদব” খেতাবপ্রাপ্ত হওয়ায় ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ। ক্যাম্পাস সিনিয়র-জুনিয়র দূরে থাকুক, রাজনৈতিক অঙ্গনেও সিনিয়রদের পাত্তা দেয় না। এসব জারিজুরি অবশ্য পাতিনেতাদের সাথেই। ওপরমহলকে আবার ঠিকই দাঁড়িয়ে স্যালুট দেয় ছেলেটা। নির্ঘাত দ্বিপকের সাথে বড় ধরণের কিছু ঘটিয়েছে। যাকে তাকে খিঁচে দেওয়ার মানুষই দ্বিপক না।

নির্ঝর ঘরে একা ছিলো। চারজনের রুম, থাকে ওরা কেবল দুইজন। নির্ঝর আর বিশ্ববেয়াদব কনক। নির্ঝরের সাথে কথা বলতেও সঙ্কোচ হয় এখন। অথচ ওকে সেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ থেকে চিনি আমি। কলেজটা আলাদা ছিলো, তারপর আবার একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়। আগের সেই নির্ঝর কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে এর মধ্যে। সুদীপ্তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নির্ঝর আর ছাত্রনেতা নির্ঝরের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। উঠতে বসতে সালাম পায় তামাম ক্যাম্পাসের। শিক্ষকরাও সমীহ করে চলেন বলে জেনেছি। তবে ওর ঘরে কনককে না দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ব্যাটা গেছে কোথায় কে জানে? দ্বিপক বাহিনীর ভয়ে গিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকেনি তো?

“দরজাটা লাগিয়ে দিস।” সম্ভাষণ না, প্রথমেই একটা আদেশবাক্য ছুঁড়ে দিলো নির্ঝর।

কথাটা শুনলাম।

“কি খবর তোর?” পরিচিত হাসিটা ফিরে এসেছে নির্ঝরের মুখে, “দেখা সাক্ষাত নাই অনেকদিন।”

কথাটা সত্য। তবে আমরা এক হলেই থাকি এখন। নেতাদের চিরন্তন সমস্যা, অতিব্যস্ত মানুষ।

“খবর তো কনস্ট্যান্ট। তোর খবর কি?” ইঙ্গিতপূর্ণভাবে পাশের খাটটা দেখিয়ে দিলাম, “ঘটনা কতোটা ঘোলা?”

হাসলো নির্ঝর, হাসলে ওকে বেশ ভালোমানুষের মতো দেখায়।

“ভালোই ঘোলা। আজকে রাতে গোলাগুলি হবে। ঘর থেকে বের হইস্‌ না বারোটার পর।”

নির্ভয় মুখটার দিকে তাকালাম, “ওরা কনককে খুঁজছে, তাই না?”

কাঁধ ঝাঁকালো প্রাচীনতম বন্ধু। তারপর বদ্ধ দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বালিশের ভেতর থেকে বের করে আনলো চকচকে একটা রিভলভার। দেখেই মনে হয় ওজনদার জিনিস।

“খুঁজলেই পাবে, তা তো না। আমি রেডি আছি।”

“লুতফুর ভাই কনককে শেলটার দিচ্ছেন তাহলে।” খেদযুক্ত হাসি হাসলাম।

“দিচ্ছেন না, বল্‌ দিয়েছেন। ঝামেলা কিছু হলে সেটা ভাইকে বললেই চলতো। ভাইকে ডিঙিয়ে হলে অ্যাটাক করবে মানে? শুয়োরের বাচ্চাগুলার একটারেও আজকে বাঁইচা ফিরতে দিমু না।” উত্তেজনায় আঞ্চলিক ভাষা বের হয়ে গেলো ওর মুখ থেকে। “জানোস তো, দ্বিপক লুতফুর ভাইয়ের চেয়ে পদের দিক থেকে পিছায়। এইসব বেয়াদবী না?”

দুর্বোধ্য একটা মুখভঙ্গি করলাম, যার অর্থ বেয়াদবটাকে উচিত সাজা দেওয়ার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে দুটোই হতে পারে।

“কনক কোথায়?”

আমার দিকে তাকালো নির্ঝর, অবিশ্বাসের ছোঁয়া তার চোখে। তারপর বললো, “ঠিক কোথায় আছে তা তোকেও বলা যাবে না। কিন্তু হলে নাই। সিস্টেম করে বের করে দিয়েছি।”

“তাহলে তোর ওপর দিয়ে যাবে পুরা ব্যাপারটা।” চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের ভর্তির পর থেকে এই ক্যাম্পাসে চার-চারটা লাশ পড়ে গেছে। আজ রাতে লাশের সংখ্যা দু’-একটা বাড়া অস্বাভাবিক কিছু হবে না।

“তা তো যাবেই।” অমায়িক হাসি হাসলো নির্ঝর, “বললাম না, আজ রাতে গোলাগুলি হবে।”

“হলের সামনে তো পুলিশের গাড়ি দেখলাম।” বলেই ফেললাম।

“ওইটা দ্বিপকই এনে রেখেছে। হল তো আমাদের, এখানে মাইর খেয়ে গেলে পুলিশ সামলাতে পারবে। নাহলে তো যা করার করেই ফেললো।”

ছোটো মাথাটা গ্যাঞ্জামের মতো বড় কিছুতে না ঢোকানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

“তোর থাকার দরকার কি, তুইও-”

আমার মুখের কথাটা মুখেই থেকে গেলো বদ্ধ দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেলো।

“কিরে নির্ঝর, ঘরে আছোস নাকি?”

ঘরের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত আছে, অথচ আমার হাত-পা জমে বরফ হয়ে আসে! ওই গলাটা আমি চিনি। সুজনের গলা ওটা। দ্বিপকের গ্রুপের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছেলে ওই সুজন!

২.

হলের প্রতিটা ঘর একই আকারের, তবে নির্ঝরের ঘরটা বেশ বড় বড় দেখায়। চারজনের জায়গায় দুইজন থাকে তো, খোলামেলা থাকার কারণে আকার খানিকটা বেড়ে যায় যেনো। তবে এই মুহূর্তে ঘরটা যেনো ছোটো হয়ে এসেছে।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছয়জন ভয়াল দর্শন তরুণের মাঝখানে একেবারে মধ্যমণি হয়ে আছি আমরা দু’জন। দেওয়ালে হেলান দিয়ে খাটে বসে আছে নির্ঝর, দরজা খোলার আগে ওই অবস্থানে চলে গেছে সে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, সামান্য অসতর্কতার সুযোগে বালিশের নিচ থেকে রিভলভারটা বের করে গুলি করবে। ডাবল অ্যাকশন রিভলভারে হ্যামার টানার ঝামেলা নেই। ঘোড়া টিপলেই কাজ হয়ে যাবে।

“কনক কোথায়?” কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইলো বেঁটেমতো এক ছেলে। এই ছেলে কনকের ব্যাচের। আমাদের জুনিয়র।

তার দিকে শান্তভঙ্গিতে মুখ ফেরালো নির্ঝর, “থার্ড ইয়ারে উঠ্‌সো, আদব-কায়দা তো শেখো নাই কিছু।”

বলার ভঙ্গিতে একটা কিছু ছিলো, দুর্ধর্ষ ছেলেটাও কেমন যেনো কাচুমাচু হয়ে গেলো।

সুজন আরও এক পা এগিয়ে গেলো খাটের দিকে, পরিস্থিতি সামলে নিচ্ছে দ্রুত, “দ্যাখ নির্ঝর, ঢঙ মারাস না। তুইও জানিস, আমরাও জানি এখানে আমরা কি করতে আসছি। কনক কই আছে কইয়া দে, যাইতেছি আমরা। তোর সাথে আমাদের কোনো সমস্যা নাই।”

হাসলো নির্ঝর, যেনো সে-ই ছ’জন সঙ্গি নিয়ে কথা বলছে সুজনের সাথে, “এবার একটা কাজের কথা বললি দোস্ত। চেয়ার নিয়ে বসে পড়। তোর সাথে আমার এই বিষয়ে কথা আছে। কনকের ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বল্‌ তো।”

সুজনের মুখের কৃত্রিম হাসিটা ধীরে ধীরে মুছে গেলো, রাতারাতি কুৎসিত হয়ে গেছে তার চেহারা, ক্রোধ আর জীঘাংসা সেখানে। “তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করতেছোস্‌-”

“তাই?” সবার মুখের দিকে একে একে তাকালো নির্ঝর, ভয়ের চিহ্নও নেই সেখানে, “আমার হলে ঢুকে মাঝরাতে আমার ঘরে তোরা ছয়জন দাঁড়াইয়া আছিস, আর বাড়াবাড়ি করতেছি আমি?”

বাম দিকের ছেলেটাও জুনিয়র, আচমকা এগিয়ে এসে নির্ঝরের মুখের ওপর চড়াৎ করে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো সে, “খানকির পোলা, কাহিনী প্যাঁচাও? কনককে কই লুকায় রাখছিস সেইটা ক, মাদার-”

মারলো নির্ঝর। অন্তত আমার মস্তিষ্ক তেমনটাই ব্যখ্যা দিলো ঘটনাটার। জুনিয়র ছেলেটার মাথা আচমকে পেছনে ছিটকে গেলো, তারপর ঘরের পেছনের দেওয়ালের কাছে টলোমলো পায়ে পিছু হটলো সে। দেওয়ালে আছড়ে পড়ে বসে পড়লো মাটিতে। অথচ নির্ঝর এখনও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি, কেবল ওঠার উপক্রম করছে।

একসঙ্গে বাকি পাঁচজনের হাত নড়ে উঠতে দেখলাম, তারা কেউ নির্ঝরের গায়ের দিকে হাত বাড়ালো না। এক মুহূর্ত পর চকচকে কুৎসিতদর্শন কিছু অস্ত্র এনার্জি লাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করতে শুরু করলো। এদের মধ্যে দুটো সরাসরি আমার মাথার দিকে তাক করে রাখা হয়েছে, আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো আমার। পেটের মধ্যে এখনও না হজম হওয়ার ফিস্টের খানাখাদ্য আলোড়ন তুলছে। নির্ঝরের বিশাল রিভলভারটা একেবারে সুজনের কপালে লাগানো। নিষ্ঠুরতম যুবক এখনও পিস্তলটা পজিশনে আনতে পারেনি।

এক মুহূর্তের জন্য ঘরটার ভেতরে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো।

ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলাম আমি। যে কোনো সময় একাধিক গুলির আওয়াজ পাবো, জানি। আজ রাতে প্রথমবারে শোনা গেমিংয়ের আওয়াজ নয় সেটা। সত্যিকারের বুলেট উড়িয়ে নিয়ে যাবে আমার সত্যিকারের খুলি।

নির্ঝর খুব শান্তিতেই মরবে বোঝা যাচ্ছে, প্রাণের শত্রু সুজনকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে তো। আমারই থেকে যাবে একবুক আক্ষেপ আর হতাশা। আগামীকাল প্রখ্যাত ছাত্রনেতাদের কাতারে আমারও নাম উঠে যাবে। পত্রিকাগুলোর যে বিচারবিবেচনা!

নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো বাইরে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়িটা। রাতের আকাশ চিরে দিয়ে তীক্ষ্ণ শব্দে সাইরেন দিতে দিতে ছুটে গেলো ওটা। দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সাইরেনের শব্দ। অদ্ভুত এক হাহাকারে ভরে উঠছে রাতের আকাশ।

চারপাশে অনেকগুলো দরজা খুলে যাওয়ার শব্দ শোনা গেলো তারপর। উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে হলের সব ছাত্র। দরজায় কড়া নাড়লো কেউ, গলাটা এবারও চিনলাম। পলাশ, গোবেচারা ধরণের এক ছেলে। এই অসময়ে মরতে এলো কেনো নির্ঝরের রুমে?

“দরজা খোল্‌ নির্ঝর, শিঘ্রি!”

জমে গেলাম ভেতরের আটজন মানুষ।

“ভিসি স্যারের বাসায় অ্যাটাক করছে জঙ্গিরা। সবাই হোস্টেজ, দারোয়ান স্পটডেড! দরজা খোল প্লিজ, জলদি!”

একে অন্যের দিকে তাকালো দুই পক্ষ। মেঝেতে পড়ে থাকা জুনিয়রটা একবার বসার চেষ্টা করে আবারও পড়ে গেলো। গালের একদিক ফুলে উঠেছে তার।

“বাইক নিয়া আসছিস না?” সুজনকে প্রশ্ন করলো নির্ঝর।

“হ।”

“চল, কুইক।” কোমরের পেছনে রিভলভারটা ঢুকিয়ে ফেললো সে, “কুইক!”

ভূতের মতো সবাই সবার অস্ত্র নামিয়ে ফেললো। দরজা খুলে বের হয়ে গেলো ওরা। হতভম্বের মতো পেছনে পেছনে বের হয়ে এলাম আমিও।

হলগুলো যেনো জ্বলছে, ফেটে পড়ছে। ক্রোধে দিশেহারা সবাই। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে জিম্মি করার ঘটনা তাদের ভেতরে ক্রোধের আগ্নেয়গিরি জন্ম দিয়েছে।

নির্ঝরকে তীব্র গলায় বলতে শুনলাম, “আজকের কাহিনী ভুলে গেলাম, এমন না। কিন্তু এইটা আমরা পরে সেটল করবো।”

কাঁধ ঝাঁকালো সুজন। ওদের গতি এখন এতো বেশি, তাল মেলাতে আমার দম বেরিয়ে যাচ্ছে।

প্রথমে বেয়াদবী করেছিলো যে বেঁটে ছেলেটা, তার দিকে ঘুরে তাকালো এবার নির্ঝর, “আর তুমি! দৌড় দিয়া চারতলায় যাওগা। চারশ সাতে কনক আছে, ওরে ডাক দিয়া নিয়া আসো ভিসি স্যারের বাসার সামনে। ওকে?”

মাথা দুলিয়ে দৌড় দিচ্ছিলো দ্বিপকের চ্যালা, তাকে থামিয়ে আবারও বললো নির্ঝর, “ওরে কইয়ো, খালি হাতে যেনো না আসে।”

রচনাকাল – আগস্ট ১৭, ২০১৬

শানে নুজুল – জুলাইয়ে গুলশান অ্যাটাকের পর আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। এরপর ফারাজকে নিয়ে বানানো আমার কন্টেন্ট নাইন গ্যাগে যায়। প্রথম আলোর আগে আমি-ই শুরু করেছিলাম ফারাজকে হিরো বানাবার ক্যাম্পেইন। জানতাম, এটা আদর্শের সাথে আদর্শের লড়াই। সন্ত্রাসের গল্পের বদলে আমরা যদি ছড়িয়ে দেই সাহসের গল্প, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জঙ্গিদের সবটা পরিকল্পনাই বানচাল করে দেবে। পরের মাস আগস্টে লেখা এই গল্পে আমার সেইসব উপলব্ধির অনেকটাই ফুটে উঠেছিল।

Default image
কিশোর পাশা ইমন

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Articles: 77