KP Imon

Words Crafted

হিমানন্দ

লাশটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাফা।
বিশ্বাসঘাতকটাকে দেখে ওর ভেতরে কোন অনুভূতি আসার কথা না। আসেওনি। কিচেন নাইফটা বুকে আমূল ঢুকিয়ে দিতেই ধড়মড় করে পড়ে গেল শিশির। হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরতে চাইছিল বোধহয়। প্রবল ঘৃণায় এক পা পিছিয়ে এসেছিল রাফা।
কলিং বেলের শব্দ।
মাথা গরম করলে চলবে না। টেনে শিশিরের শরীরটা সোফার নিচে ঢুকিয়ে দিল ভাল মত।
‘আসছি!’ একটা চিৎকার ছুড়ে ও বন্ধ দরজার উদ্দেশ্যে। শিশির যেখানে পড়েছিল সেখানে রক্তের ছাপ।
ওটা মোছার সময় নেই। ফ্রিজ থেকে একটা কেচাপের বোতল তুলে দরজার দিকে ছুটল ও।
এষা বাইরে থেকে একটা বোতল ভাঙ্গার শব্দ শুনে। তারপরই দরজা খুলে দেয় রাফা।
‘দোস্ত! তোকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি কতক্ষণ।’ দুঃখপ্রকাশের ভঙ্গী করে রাফা। ‘কিচেনে ছিলাম।’
‘আহা – তাই বলে এভাবে দৌড়ে আসবি? ঘরবাড়ি ভাঙ্গার স্বভাব তো যায় না তোর। ’ ড্রইং রুমের মাঝে কেচাপের ভাংঙ্গা বোতলের দিকে তাকিয়ে হাসে এষা।
‘বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলবি – ভেতরে আয় তো!’
‘না রে। ভার্সিটির দেরী হয়ে যাচ্ছে। তুই তোর ডিভিডিগুলো ধর। অস্থির ছিল! ড্যান ব্রাউনের কোন বইটা জানি দিতি আমাকে? ওটা দৌড় দিয়ে নিয়ে আয় তো।’
‘আনছি।’ হাত বাড়িয়ে হলিউড মুভির ডিভিডিগুলো নিলো রাফা। ‘তুই বস তো।’
বেডরুম থেকে বইটা নিয়ে ফিরে এসেই রাফা দেখল এষা ঠিক শিশিরের ওপরে বসে আছে, এষার পায়ের দুই ইঞ্চি দূরেই শিশিরের হাতের আঙ্গুল। কানে ইয়ারফোন ছিল এষার। গানের তালে তালে মেঝেতে পা ঠুকে চলেছে। ঢোক গেলে রাফা। পা আর দুই ইঞ্চি সরে গেলেই আর দেখতে হবে না।
রাফাকে দেখে থেমে গেল এষার পা ঠোকাঠুকি।
‘আংকেল কবে আসবে রে?’ কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বইটা হাতে নেয় এষা।
‘আগামী সপ্তাহে হয়ত। ’
‘ওক্কে দেন। থাক তুই। আমি দৌড়ালাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
দরজা লাগিয়ে হাঁফ ছাড়ে রাফা। বাঁচা গেল।
*
রাফার মা নেই। বাবা ব্যাবসায়িক কাজে সিঙ্গাপুর গেছেন কয়েকদিন আগে।
বাসায় রাফা ছিল একা। মাত্র ছয়দিন আগে ব্রেক-আপ হয়েছে শিশিরের সাথে।
পাঁচ বছরের রিলেশনের পর বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেয়া যায় না। শিশির রিয়ার সাথে গত একমাস ধরে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে সেটা শুনেও বিশ্বাস করতে পারেনি রাফা। হাতে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আসার পর ব্রেক-আপটা করেছিল। শিশির ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি ও। দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় ভোলার মতো মেয়ে সে কখনই ছিল না।
তাতে অবশ্য বুকের জ্বালা নেভে নি রাফার। তাকেই কেন মেনে নিতে হবে সবকিছু? মুক্ত বিহঙ্গের মত যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে শিশির। অন্যায় মেনে নিতে হবে রাফাকে!
গতকাল রাতে শিশিরের ফোন প্রথমবারের মত ধরে রাফা। শিশির অবাক হয় ওর বাসায় এসে কথা বলার আহ্বানে। ইনিয়ে বিনিয়ে অসুস্থতার বর্ণনা দিয়েছিল রাফা। জানত, আর কিছু দরকার পড়বে না। লম্পটটা হাজির হয়ে যাবে। হয়েছিলও।
ঘরে ঢুকে দরজা লাগানোর পর আর বেশি দেরী করেনি ও। বিশ্বাসঘাতকটাকে জীবিতদের কাতার থেকে একরকম আউট-ই করে দিয়েছে। কোনরকম অনুশোচনা তার মধ্যে কাজ করছে না। সোফার নীচ থেকে শিশিরের মৃতদেহটা বের করে আনল এখন। মরার পরও শয়তান শয়তান একটা হাসি লেগে আছে শিশিরের মুখে – অন্তত রাফার সেরকমই মনে হল।
একটা শয়তানকে মেরে ফেলার জন্য জেলে যেতে পারবে না রাফা। এই মরাটাকে স্রেফ ভ্যানিশ করে ফেলতে হবে।
অনেক কষ্টে টেনে মৃতদেহটা বাথটাব পর্যন্ত নিয়ে যায় রাফা।
রান্নাঘর থেকে ছুড়ি আর মীট ক্লিভারটা নিয়ে আসে।
*
চারদিন পর।
কলিং বেলের শব্দ।
দরজা খুলে ধূর্ত চেহারার একজন মাঝবয়েসী লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
‘অসময়ে বিনা নোটিশে এসে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আপনি কি মিস রাফা?’ চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। সায় দিতেই বলে ওঠে আবারও, ‘আমি আসিফ জামান। প্রাইভেট ডিটেক্টিভ। ব্যাপারটা আপনার এক্স-বয়ফ্রেন্ড শিশিরকে নিয়ে। ভেতরে আসতে পারি।’
‘নিশ্চয়।’ এখানে বাঁধা দিয়ে সন্দেহ বাড়িয়ে দিতে চায় না রাফা। ‘ তবে শিশিরের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। দশদিন আগে ওর সাথে ব্রেকআপ হয়ে গেছে আমার।’
‘মি. শিশির গত চারদিন ধরে নিখোঁজ। ’ ভ্রু কুঁচকে সরাসরি রাফার দিকে তাকায় আসিফ। ‘এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন?’
‘ওর নিখোঁজ থাকা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। অ্যাজ ফার অ্যাজ আ’ম কনসার্নড, চুলোয় যেতে পারে সে।’ মুখের ওপর বলে দিল রাফা। ‘তবে, শুধু মাত্র প্রসঙ্গক্রমে বলছি ওকে কয়েকদিন আগে আমার বাসায় আসার জন্য ফোন দিয়েছিলাম বটে। কিন্তু ও আসেনি। আসবে কী করে? বলার কিছু আছে নাকি ওর? লাগিয়ে বেড়াচ্ছিলো কোথায় কোথায় যেন! তাই উপেক্ষা করেছে কাওয়ার্ডটা। ’
‘কিন্তু আপনার বাসা থেকে মাত্র একশ গজ দূরে উনার গাড়ি পার্কড গত চারদিন ধরে। আপনি বলতে চাইছেন এ ব্যাপারে কিছু জানেন না আপনি?’
‘আপনাকে আমি বলেছি ও আমার বাসায় আসেনি।’
‘উড ইউ মাইন্ড ইফ আই চেক?’ পারমিশনের ধার না ধেরে উঠে পড়ে প্রাইভেট ডিটেক্টিভ।
তারস্বরে আপত্তি করতে করতে পিছে পিছে ছুটে রাফা। মাইন্ড তো তার অবশ্যই করার আছে, পুলিশও ওয়ারেন্ট ছাড়া কারো বাসায় ঢুকে এভাবে চেক করতে পারে না। অথচ কী আশ্চর্য! তার আপত্তিতে বিন্দুমাত্র কান না দিয়ে সবগুলো ঘর ঘুরে আসে বিচ্ছু ডিটেকটিভ। বাথরুমগুলোতেও উঁকি দেয়। অবশেষে ফিরে আসে ড্রইং রুমে। ডিটেকটিভের মুখের দিকে ধরে চামচ নাচায় রাফা রাগে।
‘আর ইউ হ্যাপী নাউ? আপনাকে বাসার ত্রি-সীমানায় দেখলে আমি পুলিশ ডাকব এর পরে। কথাটা মাথায় রাখলে খুশি হব।’
প্রায় উড়ে পালালো ডিটেকটিভ। দড়াম করে দরজা লাগায় ও।
*
শিশিরের পুরো শরীরটা টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতে সারা রাত পেরিয়ে গেছিল সেদিন রাফার। ছোট ছোট পলিব্যাগে করে রাখায় দেড় দিনের মধ্যে শক্ত হয়ে যায় ওর শিকার।
পরের দুই দিনে মোট ছয়বার বেরিয়ে বিভিন্ন ডাস্টবিনে ডাম্প করে রাফা শিশিরের দেহাবশেষ।
আর দুইবার বের হলেই কাজ শেষ হয়ে যেত ওর। এই সময় বেয়াদব ডিটেকটিভের আবির্ভাব , সন্ধ্যার পর আজই আরেকবার বের হতে হবে – ঠিক করে রাফা।
ওই ব্যাটা ঘাঘু লোক। এর পরের বার ভালো মত সার্চ করবে। পুলিশ-টুলিশ নিয়ে আসাও বিচিত্র নয়। শয়তানটার গাড়ি এত কাছে, যে কেউ তাকে সন্দদেহ করবে। তবে নো বডি, নো ক্রাইম। সন্দেহ দিয়ে দুনিয়া চলে না আজকের জমানায়। আজ রাতের প্রথম কাজ ব্লিচিং পাউডার দিয়ে রক্তের ছাপ সম্পূর্ণ দূর করা।
*
আসিফ জামান এ লাইনে নতুন। তবে প্রথম পাঁচটি কেসেই অভাবনীয় সাফল্যে তার নাম ডাক ভালই ছড়িয়েছে।
বাসায় এসেও মাথা থেকে ব্যাপারটা সরাতে পারছে না ও।
শিশির নামক ছেলেটার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কেসটা অনেক বোরিং মনে হলেও টাকার অংক ফেলনা ছিল না। কাজেই হাতে নিয়েছিল কেসটা, নেমেছিল মাঠে।
শিশিরের ব্যাকগ্রাউন্ড সুবিধের না। ড্রাগসের ব্যাপারে হালকা পাতলা কানেকশান দেখতে পেয়েছিল আসিফ। তবে এই এক্স-গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারটা ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে ব্যাপারটা।
আসিফের মনে বদ্ধমূল হল ধারণা – খুন হয়ে গেছে শিশির।
সাত দিনেও দেহ উদ্ধার করা না যাওয়ায় অফিশিয়ালি স্বীকার করা হচ্ছে না যদিও। খুবই ধূর্ততার পরিচয় দিয়েছে কেউ।
নো বডি – নো ক্রাইম – কথাটার সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আসিফ। এটাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে সেদিন গায়ের জোরে মেয়েটার বাসায় ঢুকেছে। লাশ না হোক, কোন রকম চিহ্ন পাওয়া গেলে ক্রিমিনালটাকে চেপে ধরা যেত। তবে ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েনি। উলটো ও নিজেই এখন মামলা খেয়ে যেতে পারে।
‘চা বানিয়েছি। দেব তোকে?’ দরজা থেকে জানতে চাইলেন মা।
‘দাও মা। চিনি বেশি দেবে না কিন্তু।’
আবার গভীর চিন্তায় ডুবে গেল আসিফ। এই সময় কিছু একটা মনে পড়ায় পিঠটা সোজা হয়ে যায় তার। মার চামচ হাতে ফ্রিজ খোলার দৃশ্য মাথায় এনে দেয় আইডিয়াটা।
‘দেয়ার ওয়াজ দ্যা বডি।’
উদ্ভাবনার আনন্দে চোখ চকচক করে ওঠে আসিফের।
‘মা, বের হচ্ছি আমি। এসে তোমার চা খাব।’
ছুট লাগায় আসিফ।
*
ছুড়ি আর হাড্ডি কোপানোর দাটা ভালো মত ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধোয় রাফা।
এগুলোর কাজ শেষ।
রিপ্লেসমেন্ট কিনে কিনে ফেলে দেওয়া যাবে ওগুলোও।
কলিং বেল বেজে ওঠে এসময়।
দরজা খুলে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে রাফার চেহারা, ‘বাবা! একটা ফোনও তো দিতে পারতে?’
‘সারপ্রাইজ, মামণি।’ সম উচ্ছ্বাসেই বলেন মি. ইমতিয়াজ।
বাবার সাথে কথা বলতে বলতে আড়চোখে একবার ডীপ ফ্রীজের দিকে তাকায় রাফা। ছোট ছোট পিসে আস্ত প্রাইভেট ডিটেকটিভটাই ঢুকে আছে।
বাবাকে না বুঝতে দিয়ে আগামী কয়কটা দিন ঘন ঘন বের হতে হবে ওকে।

রচনাকাল : ২রা ডিসেম্বর, ২০১৩

চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *