KP Imon

Words Crafted

আনফিক্সেবল

শান্ত দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে দূরের সাদা বাড়িটার দিকে। ওটার ভেতরই আটকে আছে লিতিসা।

মেয়েটির সর্বশেষ ফোনালাপের কথাগুলো এখনও কানে বাজে ওর। মনে পড়ে শেষ বিকেলে নিজেদের মাঝে হারিয়ে যেতে থাকা মুহূর্তগুলোকে। অথবা নীল শাড়িতে পরীর মত লাগতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকা শান্তের ঘোরলাগা দৃষ্টি!

প্রেমটি হয়েছিল নাটকীয়ভাবে। আর লিতিসার বিয়েটা আগামী তিনদিনের মাঝে হয়ে যেতে চলেছেও নাটকীয়ভাবে!

তবে শান্তর সাথে নয়।

ঠেকাতে হবে বিয়েটা। উদ্ধার করতে হবে লিতিসাকে। আর কিছু মাথায় কাজ করে না শান্তর।

পরিকল্পনা দরকার একটা।

নিখুঁত পরিকল্পনা!

*

‘বৃষ্টি পড়ার আর সময় পেল না!’ সখেদে বলেছিল তানজিল।

মাত্র কোচিং সেন্টার থেকে বের হয়েছিল ওরা। আর বাইরে নেমে গেছে ঝুম বৃষ্টি। ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করার উদ্দেশ্যে রোজ এভাবে ফার্মগেটে যেতে এবং আসতে হয় তানজিল আর শান্তকে। এইচএসসির রেজাল্ট হয়ে গেছে কয়েকদিন হয়ে গেল। এখন আর সময় নেই হাতে বেশি। কাজেই’লাফাংরামি’ করতে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরাও একেবারে সিধে হয়ে গেছে। দম নাকের ফুটোতে তুলে পড়াশোনায় ডুবে গেছে সবাই।

পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলোর কোন একটাতে নিজেদের স্থান করে নেওয়ার স্বপ্ন বুকে দেখেনি ওদের ব্যাচে এমন একটি ছেলেও নেই এখন সারাদেশে। প্রত্যেকের মাথাতে হিমালয়ের সমান চাপ! আর এদের এখন বৃষ্টির মর্জির ওপর নির্ভর করার মত মানসিকতা থাকার কথাও না। শান্ত ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে দেয়। ঝুম বৃষ্টির মাঝেই নেমে পড়ে রাস্তাতে।

পেছন থেকে তানজিল লাফিয়ে ওঠে, ’ভিজে যাবি তো!’

‘বৃষ্টিতে ভিজলে কেউ মরে না।’ বিরক্ত মুখে উত্তর দেয় শান্ত।

কাজেই লাফিয়ে শান্তর পাশে চলে আসা ছাড়া তানজিলের কোন উপায় থাকে না।

বন্ধুর এহেন পাগলামীর কারণটা বুঝতে পারছে ও। এইচএসসিতে চমৎকার রেজাল্ট করেছে ছেলেটা। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষাতে অংশ নিতেও পারবে। কিন্তু কোচিংয়ে এতদিনের প্রিপারেশন বলতে কিছুই নেই তার। কোচিংয়ের টেস্টগুলোতে এতদিন ১০০ তে ১২ এর ওপরে তুলতে পারেনি একদিনও। নিজের অবস্থান না বোঝার মত মানুষ ও নয়।

শান্ত বেশ বাস্তববাদী ছেলে। প্রতিযোগীতাতে বাকিরা যে এগিয়ে আছে ওর চেয়ে অনেকখানি সেটা বুঝতে ওর কষ্ট হয় না। নিজের পরাজয় যে সুনিশ্চিত সেটাও ও স্পষ্ট বুঝতে পারে।

এই সামনে থাকা পঁচিশ দিনের মাঝে এত বিশাল সিলেবাস কাভার করা সম্ভব না আর।

‘ভাবিস না। হাতে এখনও তো কয়েকটা দিন আছে। ঠান্ডা মাথাতে শুরু কর এক পাশ থেকে।’ শান্তের মনের কথা যেন পড়তে পারে তানজিল।

মাথা নাড়ে ও, ’ধ্যাৎ! ওসব নিয়ে চিন্তা করছে কে? বুয়েটে হবে না। এটাই মেনে নিয়েছি। ’

মুখে সেটা বললেও ভেতরে ভেতরে জানে, শেষ একটা ফাইট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ও।

চোখ আড়াল করে তানজিল প্রবল বৃষ্টির আক্রমণ সামলাতে, ’ফেসবুকে তুই চব্বিশ ঘন্টা থাকিস। এটা কমিয়ে ফেল। পারিস না কেন নিজেকে কন্ট্রোল করতে?’

মাথা নাড়ে শান্ত আবারও, ’আজ থেকে আর বসব না। ’

বলার পরই আবারও দ্বিধাতে পড়ে যায় শান্ত ফেসবুক অ্যাডিকশন থেকে কি সরে আসতে পারবে ও আসলেই? HSC পরীক্ষার পর থেকে ফেসবুকে এত বেশি সময় দিয়েছে আজ হয়ে গেছে এটা নেশা। এই ভয়ানক ওয়েবসাইটটা যে ওকে ডোবাবে একেবারে সেটা বুঝতে পারছে ও ভালোমতই। ছুটতে থাকা নিউ ভিশনটাকে চোখে পড়ে এই সময় তানজিলের। ঝট করে শান্তের দিকে ফেরে ও।

বৃষ্টির পানি চারপাশে ছিটকে পড়ে মাথার সাথে ওর চুলের ঝাঁকুনীতে।

‘কাম অন, দোস্ত! পাওয়া যখন গেছে ছাড়া যাবে না!’

আর সব সময় চলন্ত বাস দেখলে যে দুটো শব্দ উচ্চারণ করতে অভ্যস্ত শান্ত এবারেও তার ব্যাতিক্রম হল না, ’রান রান!’

বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে ভেদ করে তীরের মত ছুটছে দুটো ছেলে কাঁধের ব্যাগ থেকে পায়ের জুতো সব কিছু ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে।

নিউ ভিশনের গেটের সামনে বিশাল ভীড়।

সবাই নিজেদের মাথা বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে উঠার চেষ্টা  করছে ভেতরে। তানজিল একটু এগিয়ে থাকাতে আগে আগেই পৌঁছে গেল ওখানে।

লাফিয়ে তানজিলকে ঢুকতে দেখে শান্ত। কিন্তু প্রাণপনে চেষ্টা করেও পা রাখার স্পেসটুকু পায় না বেচারা।

আরও অন্তত ছয় জন ঝুলছে গেট থেকে। আর সীটিং সার্ভিস নিউভিশনও যেন লোকাল হয়ে গেছে! ধীরে ধীরে ঝুলন্ত মানুষগুলোকে বুকে নিয়ে ছেড়ে দেয় গাড়িটা। আর ভেতরে থাকা তানজিল চাইলেও নেমে আসতে পারে না বন্ধুর পাশে। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোই প্রতিবন্ধকতা।

শান্তও তাকায় একবার বাসটার দিকে।

যাহ শালা! মিস হয়ে গেল!

প্রায় শুন্য রাস্তাতে একা একা ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চলে ও। আজকের দিনটাই কুফা!

আজকের মডেল টেস্টেও বাঁশ। মাত্র আটটা পারত ও। বাকি বত্রিশটা ফাঁকা রেখে চলে এসেছে। জানে বুয়েট ভর্তি পরীক্ষাতেও এমন কিছুই হতে যাচ্ছে! হতাশায় রাস্তায় জমে থাকা পানিতে জোরে লাথি মেরে ভাসিয়ে দেয় পানিগুলোকে।

কানের পাশে তীক্ষ্ণ হর্ণের শব্দ জ্বলজ্বলে হেডলাইটের আলো রাস্তায় উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত!

চমকে ফিরে তাকায় শান্ত।

বিশাল ডাবল ডেকার বাসটি সোজাসুজি এগিয়ে আসছে ওর দিকেই।

মুহূর্তখানেক পরই পিষে দেবে ওকে মাটির সাথে!

দুই

কোমরের কাছে হ্যাচকা টান তারপরেই নিজেকে আবিষ্কার করল রাস্তার কোণে।

দূরে চলে যাচ্ছে বিআরটিসি বাসটি। আর এই প্রবল বর্ষণেও হেল্পারের মুখখিস্তি কান এড়ায় না শান্তর।

‘গরুর মত রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে কি করছিলেন?’ ধমকে ওঠে মেয়েটা।

এবার ভালোমত তাকিয়ে আর চোখ ফেরাতে পারে না শান্ত। নীল শাড়িতে মেয়েটিকে এমনিতেই চমৎকার লাগার কথা। অসাধারণ একটি মুখাবয়ব মেয়েটির। তার সাথে তীক্ষ্ণ চোখদুটোতে বুদ্ধির ছাপ। তারওপর বৃষ্টি এসে শাড়িটিকে শরীরের সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। চমৎকার দেহকাঠামোটি ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে।

‘থ্যা- থ্যাংকস।’ এতক্ষণে যেন গলাতে শব্দ ফিরে পায় শান্ত।

‘হা করে তাকিয়ে না থেকে যেখানে যাচ্ছিলেন যান। ভিজিয়ে দিলেন আমার সব।’ দূরে রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে আটকে থাকা ছাতাটার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বলে মেয়েটা।

ঘটনা বুঝতে পারে এবার সহজেই। ছাতার নীচেই ছিল এই সুন্দরী এবং শান্তর দ্বিতীয় জীবনদাত্রী। তবে শান্তকে সোৎসাহে ডাবল ডেকারের সামনে লাফিয়ে পড়তে দেখে ছাতা ফেলে উড়ে এসে ওকে সরিয়ে নিয়ে যায় ও। আর ছাতা হারিয়ে এই মুহূর্তে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে যাচ্ছে মেয়েটা।

ফার্মগেটের মত ব্যস্ত একটা জায়গাতে একটি মেয়ে সারা শরীর ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর লোকজন সেটা গোগ্রাসে গিলবে না তা কি হয়?

বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব মোটেও অস্বাভাবিক কোন ঘটনা হতে যাচ্ছে না।

হাত বাড়িয়ে দেয় শান্ত, ’আমি শান্ত। ’

ওটা ধরে হাল্কা চাপ দেয় তরুণী, ’লিতিসা। ’

হেঁটে দ্রুত ওভারব্রীজটার নিচে চলে আসে ওরা। বৃষ্টির ছাঁট থেকে সাময়িক মুক্তি!

‘আপনি এখানে দাঁড়ান। আমি ছাতা উদ্ধার করে আসি।’ বলেই রাস্তার মাঝে আটকে থাকা ছাতাটাকে আনার জন্য পা বাড়াতে চায় শান্ত।

খপ করে ওর হাত আবার ঠিক সময়ে ধরে ফেলল লিতিসা। শান্তের নাকের সামনে দিয়ে বিকল্প পরিবহণের বাসটা বুলেটের মত বের হয়ে যেতে বরফের মত ঠান্ডা হয়ে যায় ও। আরেকটু হলেই দ্বিতীয়বারের মত জানটা খোয়াতে গেছিল!

হয়েছেটা কি আজকে ওর?

‘আপনি কি হিজবুত তাহিরির সুইসাইড ফোর্সের সদস্য?’ কৌতুক ভরে জানতে চায় তরুণী।

ফ্যাকাসে মুখে রঙ ফিরে আসে শান্তের। পাল্টা হাসল ও। আর কি বলবে?

‘ছাতা আনার দরকার নেই। আপনি এই মাঝ রাস্তায় আত্মহত্যার পর্যায়ক্রমিক প্রচেষ্টা বাদ দিন। তাতেই চলবে। ’

‘দেরী হয়ে যাচ্ছে নিশ্চয় আপনার। আমার জন্যই -’

ওকে থামিয়ে দেয় লিতিসা, ’কোচিং থেকে বাসার দিকে যাচ্ছি দেরী হলেও কোন সমস্যা নেই। ’

ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় শান্ত, ’আপনি কি এবার এইচএসসি দিলেন নাকি?’

‘ইয়েপ। আপনিও?’

‘তুমি করে বলতে পারো। আমরা সেম ব্যাচ।’ আবার হাসে শান্ত।

ওভারব্রীজে দুই ঘন্টা আটকে পড়াটাই সব কিছু পাল্টে ফেলে ওদের জীবনের। দুটো জীবনের নাটকের নির্মাতা ওপর থেকে দেখে হাসেন। তারপর টুক করে মিলিয়ে দেন ওদের।

*

শান্তর পাশে বসে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে তানজিল।

বাসার কাছে চায়ের দোকানে বসে আছে ওরা।

হারামজাদা একটা সপ্তাহ ধরে কোচিং আসে না। এমনিতেই পাচ্ছে শ’য়ে ডজনখানেক নাম্বার। বাহাদুর হয়েছে খুব! কোথায় জীবন মরণ এক করে পড়বে তা না আরও অবহেলা চলছে!

অবশেষে বোধ হয় এক যুগ পর সাড়া পাওয়া যায় মাথা তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত।

ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তানজিল।

রেগুলার বারো পার্সেন্ট করে নাম্বার পেতে পেতেও যখন একটা ছেলে কোচিংয়ে আসা ছেড়ে দেয় এবং তারপর কাছের বন্ধুকে ডেকে এনে পাঁচ মিনিট বসিয়ে রেখে একটা বেনসন খাইয়ে চমৎকার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন ছেলেটির সমস্যা কোথায় সেটা বোঝার জন্য আর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।

সরাসরি কাজের কথাতে চলে আসে তানজিল, ’মেয়েটাকে জুটালি কোথায়?’

লাই পেয়ে মুখ খুলে যায় শান্তের। সেদিনের কোচিংয়ের কাহিনী থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব কিছু খুলে বলতে থাকে তানজিলকে। ওভারব্রীজের নিচেই নাম্বার নিয়েছিল ওরা একে অন্যের। তারপর থেকে শুরু হয় ম্যারাথন চ্যাট।

লিতিসা মেডিকেলের জন্য কোচিং করছে। প্রাইমেটে।

মাত্র একদিনের মাঝেই একে অন্যের নাড়ি নক্ষত্র জেনে যায় ওরা। লিতিসার বাবা ফর্মার মিলিটারি অফিসার। তিন ভাই এক বোন। ভাইয়েরা কোথায় কি করছে। লিতিসার স্কুল আর কলেজ কোনটা ছিল। সেখানকার ফ্রেন্ড সার্কেল কারা ছিল কিভাবে টাইফয়েডের মাঝে সে তার এইচএসসি দিয়েছিল কিভাবে সারাজীবনের স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ারিংকে বিসর্জন দিয়ে মেডিকেলের জন্য কোচিংয়ে ভর্তি হতে হয় ওকে কেন রেটিনা জামায়াতী ইসলামের প্রতিষ্ঠান বলে ভালো কোচিং সেন্টার হলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে প্রাইমেটে ভর্তি হয়েছিল সব গল্পই জানা হয়ে যায় শান্তের এই কয়দিনে।

কাহিনী শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় চায়ের দোকানদারেরও। অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে লোকটা।

মনোযোগ দিয়ে সব শুনে হুংকার ছাড়ে তানজিল, ’তাই বলে শালা কোচিং মিস দিচ্ছিস?’

একটু মাথা নাড়ে শান্ত, ’লিতিসা আমাকে ফেসবুকের নেশা থেকে বের করে এনেছে দোস্ত! বিলিভ ইট অর নট!’

‘দেখা যাবে। নেক্সট উইকের পরীক্ষাগুলো দিবি। দেখা যাক কপালে কি আছে। মাত্র আছেই আর আঠারো দিন!’ হতাশাতে নিজের পায়ে চাপড় মারে তানজিল।

‘তুই কি সাজেস্ট করিস?’ জানতে চায় শান্ত।

সাথে সাথেই উত্তর দেয় তানজিল, ’এই আঠারোটা দিন ডুব মেরে থাক। তারপর মেয়ে নিয়ে ভাবিস। ’

মাথা চুলকায় শান্ত, ’আমার বেটার একটা প্ল্যান আছে, দোস্ত। ’

ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে পরের সিগারেটটা ধরায় তানজিল।

‘বাসার ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে লিতিসা আমাকে। আজ ওকে ওর বাসার নিচেই প্রপোজ করব। আসবি আমার সাথে?’

তিন

লিতিসাদের বাসার নীচে সেদিন প্রপোজটা যদি না করত শান্ত তাহলে অনেক কিছুই হারাতে পারত ও।

কিন্তু তানজিলের বিস্ফোরিত চোখের সামনে শান্তের প্রপোজালকে হাসিমুখে শুধু গ্রহণই করে না লিতিসা আনন্দের আতিশয্যে রাস্তার মাঝেই তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ফেলে!

লজ্জায় লাল-টাল হয়ে অন্যদিকে তাকিয়েছিল তানজিল। একই সাথে ভাবছিল বন্ধুভাগ্যের কথা। রাজকন্যার মত মেয়েটিকে কি নাটকীয় ভাবেই না পেয়ে গেল ও!

তারপরই তাড়া দেয় লিতিসা, বাসার কাছে থাকাটা নিরাপদ ছিল না।

সাদা বাড়িটা চমৎকার।

তবে ভেতরে আছেন একজন এক্স-মিলিটারি, তাও আবার একমাত্র কন্যসন্তানের বাবা। কাজেই বাঘের খাঁচার চেয়ে এই স্থান ভয়ঙ্কর বলে ঘোষিত হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর মেয়ে কোন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুমু-টুমু খাচ্ছে এটা জানতে পারলে তানজিলের খুলি পর্যন্ত উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

লিতিসা ট্র্যাকে তুলে দেয় শান্তের জীবনটিকে।

তার মাঝে চমৎকারভাবে ভিসির পদত্যাগের দাবীতে মুখর হয়ে ওঠে বুয়েট। আর ভর্তি পরীক্ষাটাও একমাস পিছিয়ে যায়।

একটি মাস পর ৩৪ তম করে শান্তের বুয়েটে চান্স পাওয়ার খবর শুনে আনন্দে বন্ধুকে বুকে পিষে ফেলেছিল তানজিল।

তবে মুহূর্তের জন্যই।

মেডিকেলে চান্স পায় নি লিতিসা। বাবার জেদের কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্ন দেখতে থাকা মেয়েটা ব্যর্থ হয়ে গেল সারা জীবনের জন্য! তানজিল নিজেও চান্স পায়নি কোথাও। তখনও।

সামনে মাত্র চারটা পরীক্ষা বাকি ছিল। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তার মাঝে একমাত্র পরীক্ষা যেটাতে অংশ নেয় তানজিল।

একেবারে তূণের শেষ তীর দিয়েই গাঁথিয়ে নেয় তানজিল। ময়মনসিংহে চলে যায় ভর্তি হয়ে। শান্ত বুয়েটে ক্লাস শুরু করে। লিতিসার জীবনে অনিশ্চিয়তা নেমে আসে।

এভাবেই পার হয়ে যায় দুটো বছর। আর আজকে হেঁটে যাচ্ছে শান্ত পকেটে হাত দিয়ে।

পরিকল্পনা দরকার একটা।

নিখুঁত পরিকল্পনা!

*

ফোনটা ভাইব্রেট করছে। পড়ার বই থেকে মুখ তুলে সেদিকে তাকায় তানজিল।

শান্তর নাম্বার।

এত রাতে ফোন দিচ্ছে কেন? নির্ঘাত কোন সমস্যায় আছে। সমস্যাটা মানসিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর আগেও মেন্টাল স্ট্রেসে থাকলে ফোন দিয়ে তানজিলকে সেটা বলে কষ্ট লাঘব করেছে শান্ত। আজও তেমন কোন কেস?

‘দোস্ত, কেমন আছিস?’ ফোনটা রিসিভ করেই পূর্ণ উচ্ছ্বাসের সাথে জানতে চায় তানজিল।

ওপাশ থেকে শান্তের মনমরা কন্ঠটা ভেসে আসে, ’আমি শেষ রে। এবার আর কোন আশা নাই। ’

আস্তে করে উঠে দাঁড়ায় তানজিল, বারান্দাতে এসে দাঁড়ায়, ’কি হয়েছে? খুলে বল। ’

ঘটনা তেমন কিছু নয়।

প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় লিতিসাকে। বাবার ইচ্ছে মেয়ে ডাক্তারই হবে! পাবলিক আর প্রাইভেট!

তবে লিতিসার নিজস্বতা বলে আর কিছু থাকে না এবার। বাবার লাখ লাখ টাকা ধ্বংস করে পড়ছে ব্যাপারটা ওকে মানসিকভাবে ছোট করে রাখে সব সময়।

ওর স্বপ্ন ঠিকমত এগুলে পাবলিক মেডিকেল কলেজে ঢুকে যেতে পারত হয়ত। আর সেখানে নিজের সিদ্ধান্তগুলো বলার জন্য একটু হলেও বল পেত ও বুকে। যেটা প্রাইভেটে পড়ে আর পায় না লিতিসা।

যেকারণে বাবার পছন্দ করা ছেলেটি আমেরিকা থেকে আসছে শুনেও কিছু বলার ভাষা যোগাড় করতে পারেনি লিতিসা। ছেলেটির নাম রাশা এবং সে আসছে বিয়ে করে বউ নিয়ে আবার আমেরিকাতে ভেগে যেতে। শান্তকে আশার কোন বাণী শোনাতে পারে নি মেয়েটা।

‘তারপর?’ কানে ফোন চেপে ধরে জানতে চায় তানজিল, ’তুই ওকে পালিয়ে চলে আসতে বলিসনি?’

‘বলেছি তো।’ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায় শান্ত।

‘কি বলল ও?’ উদগ্রীব হয়ে জান্তে চায় তানজিল।

‘কিন্তু’ ইতস্তত করে শান্ত, ’বাবা শেষ জীবনের সব সম্পত্তি উড়িয়ে ওর মেডিকেল কলেজের খরচ জোগাড় করেছেন। ওর পক্ষে এখন কিভাবে চট করে না করা সম্ভব?’

‘কেন? দুই বছর প্রেম করার সময় মনে ছিল না?’ গর্জে ওঠে তানজিল।

‘না, মানে ও আমাকেই বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তের অমতে যাওয়ার সাহস অর্জনই করতে পারছে না বেচারি।’ মিন মিন করে উত্তর দেয় শান্ত।

‘তুই লিতিসার পক্ষ নিবি না। একদম চুপ করে থাক!’ ধমকে ওঠে তানজিল আবারও।

‘ওর ফোনটা কেড়ে নিয়েছে বাসা থেকে।’ আসল উদ্বেগটা কোথায় জানিয়ে দেয় শান্ত, ’আমার সাথে কনট্যাক্ট নাই গত কয়েকদিন ধরে। ’

এক মুহূর্ত দুইজনেই চুপ হয়ে যায়।

তারপর আবার মুখ খোলে তানজিলই, ’বাবার সিদ্ধান্তের অমতে যাওয়ার জন্য ওকে সাহস দেব আমরা। দেব প্রয়োজনীয় মশলা। ’

‘কিভাবে?’ জানতে চায় শান্ত।

জানত বন্ধুও এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছাবে।

কিন্তু কিভাবে?

এই প্রশ্নটা করার জন্যই রাতের বেলাতে ফোনটা দেওয়া।

‘কয়দিন পর বিয়ে?’ পাল্টা প্রশ্ন করে তানজিল।

‘তিন দিন!’ হাহাকারের মত শোনায় শান্তের উত্তর।

‘লিতিসাকে বাসা থেকে বের করে আনব আমরা। ও রাজি থাকুক আর না থাকুক। ’

*

পুরোনো সেই চায়ের দোকানে এসে বসে পড়ে তানজিল।

দোকানি দোকানটা বন্ধ করে রেখেছে এটা ওদের জন্য একটা প্লাসপয়েন্ট। তানজিলের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে শান্ত। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বন্ধুর হাতের চটের ব্যাগের দিকে।

শান্তের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তানজিল। তারপর ঝটপট খুলে ফেলে ব্যাগটা। শান্তের চোখ ছানা বড়া হয়ে যায়। দুটো পিস্তল চমৎকার ভাবে শুয়ে আছে চটের ভেতর।

দাঁত কেলিয়ে হেসে ব্যাখ্যা দেয় তানজিল, ’ময়মনসিংহে ছাত্র সংগঠনে জোস জোস সব ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়েছি। সিচুয়েশন বোঝাতেই দিয়ে দিল। একেবারে নিজের লোক আমার। ’

‘এসবের দরকার কি ছিল?’ মিন মিন করে জানতে চায় শান্ত।

‘অবশ্যই! ঝামেলা হতে পারে। গার্ড তো থাকে একটা। ওই ব্যাটাকে ঠান্ডা করতে হবে এটা দেখিয়ে। তারপর থাকে লিতিসার এক্স-মিলিটারি বাবা

কড়া চোখে তানিজিলের দিকে তাকায় শান্ত।

‘শ্বশুর মানুষ। উনাকে গুলি করলে আজীবন হেট করবে আমাকে লিতিসা। ’

‘চিল, ম্যান! উনার ক্ষতি করার ইচ্ছে নাই আমার।’ ওকে আশ্বস্ত করে তানজিল।

চোখ সরু করে তাকায় শান্ত, ’দুই দুটো পিস্তল নিয়ে যাচ্ছিস কেন তাহলে?’

‘এক্স-মিলিটারীর কাছে একটা হ্যান্ড গান থাকতেই পারে উনি সেটা নিয়ে অতিরিক্ত দুঃসাহসী না হয়ে যান সেটা দেখতে হবে আমাদের। ’

‘তাও ঠিক।’ বিড় বিড় করে শান্ত।

একটা পিস্তল বের করে বাড়িয়ে দেয় তানজিল শান্তের দিকে।

হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে গিয়েও হাত সরিয়ে নেয় শান্ত, ’ফিলিং বেটার উইদাউট দিস। ’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে চটের বস্তায় ওটা রেখে দেয় তানজিল।

‘গাড়িতে চল।’ শান্তের হাত ধরে টান দেয় অন্য হাতে পিস্তলটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে।

‘গাড়ি?’ অবাক হয়ে তাকায় শান্ত।

‘খালি পায়ে পালানো যাবে না ওখান থেকে। উই’ল নীড আ কার। ম্যানেজ করে রেখেছি আগেই। ’

আধঘন্টা পর তেরপল সরিয়ে কালো গাড়িটা বের করে ঝকঝকে হাসি দেয় তানজিল।

‘লেটস গো।’ লাফিয়ে উঠে পড়তে পড়তে বলে ও।

চার

রাত অনেক হয়েছে। গ্যারাজটা বিশাল এবং শুন্য। দূরে একটা টিমটিমে আলো ছাড়া আর কিছু নেই। এক্স-মিলিটারির তুলনায় বেশ হাল্কা নিরাপত্তা ব্যবস্থা! বুড়োর হাড়ে মনে হয় বয়েসের সাথে সাথে মরিচা পড়েছে!

শুন্য গ্যারেজে পা রেখে শিউরে উঠলো শান্ত।

কেন জানি চারপাশের গাঢ় ছায়া দেখে অদ্ভুত একটা অনুভূতি ছেয়ে ফেলে ওদের। মনে হচ্ছে আড়াল থেকে কেউ ওদের দেখছে! একই রকম অনুভূতি হচ্ছে তানজিলেরও। আড়ালের ছায়ার ভেতরে ওদের দৃষ্টি যায় না। কাজেই ভয়টা মানসিক। অজানা কিছুকে মানুষের ভয় এমনিতেই সহজাত। তারওপর এখানে এমনিতেই বিপদের আশঙ্কা আছে।

সবচেয়ে বড় কথা সিকিউরিটি গার্ডটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ব্যাটা ওত পেতে নেই তো কোথাও?

সাবধানে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে নেয় তানজিল। এখানে বিন্দুমাত্র অসতর্ক হয়ে তীরে এসে তরী ডোবাতে চায় না ও।

উদ্যত পিস্তলের পেছনে ওর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখটা উঁকি দেয়। আবছা আলোয় পা রেখে একটা টর্চ ছাড়াই এমন অভিযানে চলে আসার জন্য নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেয় তানজিল।

শান্ত বেশ উদ্বেগশুন্য মুখ নিয়েই হেঁটে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। আগের দিন রেকি করে গেছে, জানে এ বিল্ডিংয়ে এলিভেটর নষ্ট। কাজেই সিঁড়ি ছাড়া গতি কি?

চারপাশে শরীর তিনশ ষাট ডিগ্রী অ্যাংগেলে ঘোরাতে ঘোরাতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসে তানজিলও। অতিরিক্ত সতর্কতার প্রয়োজন আছে। শান্ত একটি সুযোগই পেতে যাচ্ছে এই এক্স-মিলিটারী  ম্যানের মেয়েকে উদ্ধার করার। এই সুযোগটা ওদের ভুলের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেলে স্রেফ পানিতে যাবে দুই বছরের প্রেম!

একেবারে আচমকাই বের হয়ে আসে লোকটা ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তীরবেগে ছুটে আসতে শুরু করেছে তবে দেখে ফেলল শান্ত।

‘তানজিল, সাবধান!’ হুংকার ছাড়ে ও। বদ্ধ গ্যারাজে গল গল করে ওঠে তার কন্ঠ!

ঝট করে ফিরে তাকায় তানজিল আর একই সাথে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গার্ড। গার্ডের হাতের ধাক্কায় পিস্তলটা উড়ে যায় ওর হাত থেকে। সেই সাথে শক্ত মেঝেতে আছড়ে পড়ে দুইজনই।

গার্ডটি অল্পবয়স্ক। পেশির সমাহার। চাপা কলার সমান আঙ্গুলগুলো মুঠো করে তীব্রবেগে নামিয়ে আনতে যাচ্ছে তানজিলের মাথার ওপর। একটা আছড়ে পড়লেই আর দেখতে হবে না!

তড়িৎ রিফ্লেক্সের সাহায্যে কোনমতে আঘাতটা এড়ায় তানজিল। দ্রুত সরে গেছে একফিট ডানে।

তানজিলের নড়াচড়াতে ওর ওপর থেকে নড়ে যায় গার্ড একই সাথে কাতরে ওঠে শক্ত মেঝের সাথে মোটা ঘুষিটা আছড়ে পড়াতে।

শেষ মুহূর্তে মাথা সরিয়ে নেওয়াতে তানজিলের মাথা খুঁজে না পেয়ে মেঝেতেই আছড়ে পড়েছে হাতটা।

এই ফাঁকে সাপের মত পিছলে বের হয়ে আসে তানজিল। গার্ড ওর অভিসন্ধি বুঝতে বেশি সময় নেয় না। চট করে এক পা বাড়িয়ে দেয়।

মাত্র দাঁড়িয়ে সরে যাচ্ছিল তানজিল গার্ডের নাগালের বাইরে দড়াম করে আবার আছড়ে পড়ে বেচারা মাটিতে।

এই সময়ে দ্বিতীয় গার্ডকে এগিয়ে আসতে দেখে ও।

একসাথে দুইজনকে সামলাতে পারবে না স্পষ্ট বুঝতে পারে তানজিল। ওদিকে শান্ত গাধাটা মারামারি দেখে ঘাবড়ে গেছে।

সিঁড়ির গোড়ায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে ও।

আচমকা ঝাঁপাঝাঁপিতে হতভম্ভ!

চেঁচিয়ে উঠে তানজিল, ’শান্ত, হেল্প!’

দ্বিতীয় গার্ড চোখের ইশারায় প্রথম গার্ডের অনুমতি চায় শান্তকে সামলানোর জন্য। ইশারাতে তাকে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় প্রথমজনও।

তারপর আবার ঝুঁকে পড়তে যাচ্ছে এই মাত্র পড়ে যাওয়া তানজিলকে শায়েস্তা করতে ব্যাঙের মত সামনের দিকে লাফ দেয় ও। তারপর হাতটা সোজা করতেই পিস্তলের বাঁটটা নাগালে পেয়ে যায়।  চট করে ওটা তুলে নিয়েই প্রথম গার্ডের মোটা মাথার দিকে কোনমতে তাক করে ও টিপে দেয় ট্রিগার।

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে সেই শব্দে।

টার্গেট পুরোপুরি সফল হয় নি কপালের ওপরের দিকে একাংশ উড়িয়ে নিয়ে গেছে গার্ডের। সেই সাথে প্রাণবায়ু বেড়িয়ে গেছে তার।

দ্বিতীয় গার্ড এখন শান্তর খুব কাছে, গুলির শব্দে হতভম্ভ হয়ে চট করে ফিরে তাকায় সে। বিন্দুমাত্র দেরী না করে আরও দুইবার গুলি চালায়। একবার পেটে আরেকবার বুকে।

ছিটকে মাটিতে পড়ল আরেকটা নিথর দেহ।

‘লেটস গো!’ হতভম্ভ শান্তের দিকে তাকিয়ে চিৎকার ছাড়ে তানজিল।

শান্তর চেহারা দেখে ওর মনে কথা পড়তে পারে তানজিল। এখানে কোন খুন হওয়ার কথা ছিল না।

সেখানে দুই দুইটি খুন হয়ে গেছে!

মাথা নেড়ে শান্তকে পাশ কাটিয়ে উঠতে থাকে তানজিল। ঘাপলাটা ও নিজেও বুঝতে পারছে। প্ল্যানের বাইরে চলে গেছে সবকিছু। এবার দ্রুত মেয়েটাকে নিয়ে কেটে পড়তে হবে। দুরদার করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে এসেছে ওরা তিনতলার বাসার দরজাটাই লক্ষ্য। গুলির শব্দ শহরের সবখানে চলে গেছে হয়তো! কাজেই কলিং বেল দিয়ে দরজা খোলানোর কথা স্বপ্নেও ভাবে না তানজিল।

এক গুলিতে দরজার নব উড়িয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে ভেতরে।

ড্রেসিং গাউন পড়া মানুষটা ছুটছিলেন বেডরুমের দিকে। এক্স-মিলিটারি আর কোথায় হ্যান্ডগান রাখে?

তবে ঘর কাঁপিয়ে হুংকার দেয় তানজিল, ’স্টপ দেয়ার, মিস্টার!’

কাজ হয় এতে থেমে যান ভদ্রলোক।

‘লিতিসা চল বেড়িয়ে যাই!’ বেডরুমের দরজাতে মাত্র উপস্থিত হওয়ার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে নিষ্কম্প কণ্ঠে বলল শান্ত। নড়লও না মেয়েটা। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। যেকোন সময় থানায় খবর চলে যাবে!

ধমকে ওঠে তানজিল, ’কথা কানে যায় না? বেরিয়ে আসো, মেয়ে!’

মেয়ে বের হয়ে এল, পিস্তলের নলটার দিকে ইতস্তত তাকাচ্ছে। দরকারে তাকে বন্দুকের ভয় দেখিয়েই বের করে নিতে হবে, এ নিয়ে শান্তর সাথে আলোচনা হয়ে গেছে ওর।

‘কোন কথা নয় নীচে চল।’ আরেক ধমক দিয়ে বলল তানজিল।

শান্তের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তার প্রেমিকা। কিন্তু এখন এসব আবেগ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। দুই বছর ধরে প্রেম করার সময় মনে ছিল না? দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে ওরা।

পেছনের সীটে বসিয়েছে ও শান্ত আর লিতিসাকে। মান অভিমান করুন প্রেমিকযুগল!

ছুটছে গাড়ি।

‘সাবাস ব্যাটা, আমরা না শুধু আমাদের নেক্সট জেনারেশনও তোর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে!’ পেছন থেকে বলে ওঠে শান্ত।

মুচকি হাসে তানজিল, ’আমাকে থ্যাংকস দেবে না, লিতিসা?’

একটা সেকেন্ড গাড়ির ভেতরটা চুপ হয়ে যায়।

তারপরই লিতিসার খনখনে কন্ঠটা কেঁপে ওঠে ভেতরে, ’ প্রথমতঃ কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে আবার থ্যাংকস চাচ্ছিস হারামজাদা? দ্বিতীয়তঃ ভালো করেই জানা আছে তোদের আমার নাম লিতিসা নয়! ঊর্মি!’

পাঁচ

ড. মাজেদুর রহমানের চেম্বার।

চিন্তিত মুখে বসে আছে তানজিল। প্রিয় বন্ধুর মাঝে এরকম একটা সমস্যা দেখা দিলে চিন্তাতে পড়ে যাওয়ার কথাই। লিতিসা বলে কেউ নেই! কোনদিন ছিলও না!

মাজেদুর রহমান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। ইনার খ্যাতি আছে। বাংলাদেশের বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্টও বলা হয়ে থাকে তাঁকে। এই কেসটা ইচ্ছে করেই নিজে হ্যান্ডেল করতে চেয়েছেন তিনি। এমন কেস খুব একটা পাওয়া যায় না এদেশে।

একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে মুখ খোলে তানজিল।

‘আমার বন্ধুটির ব্যাপারে যা বলার আপনাকে বলতে হবে আমাকেই। আর কেউ নেই তার জন্য আসার মত।’ নড়েচড়ে বসে ও। শান্তের মাথায় আগাগোড়াই সমস্যা ছিল কে জানত?

‘ওর সিজোফ্রেনিয়া ছিল, তাই নয় কি ডক্টর? যেকারণে কাল্পনিক একটা মেয়েকে ভেবে তার সাথে প্রেম করে এসেছে ও পুরোটা সময়?’

সরাসরি তানজিলের দিকে তাকান ডক্টর। চোখে বিষাদের ছায়া।

‘সিজোফ্রেনিয়া। একটি বিরল রোগ। এবং জটিলতম বলব আমি এটাকে। সব মনোরোগের মাঝে। ’

টেবিল থেকে পানির গ্লাসটি তুলে একচুমুক খেয়ে নামিয়ে রাখে তানজিল। ডক্টরের পরের কথাগুলো শোনার জন্য উদগ্রীব।

‘রোগটা এমন, রোগী বুঝতে পারে না বাস্তব কোনটা আর কল্পনা কোনটা। একই সাথে তার মাঝে দেখা দেয় অডিটরী অ্যান্ড ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন। এখানেই আসে প্যাঁচটা। রোগী দেখতে থাকে এবং শুনতে থাকে তারই মস্তিষ্কের একটি অংশের সৃষ্ট কাল্পনিক কোন চরিত্রকে। তার পক্ষে উপেক্ষা করার মত ব্যাপার এটা নয়। আপনি জানেন নিজের চোখ আর কানকে প্রাধান্য দেবে যে কোন মানুষ। আপনি যদি বলেন “তুমি যা দেখছ সবই ভুল ” সে বিশ্বাস করবে না। কারণ সে দেখে এসেছে মানুষটিকে। কথা শুনেছে তার। আপনার কথা সে কেন বিশ্বাস করবে?’

মাথা দোলায় তানজিল। মনে পড়ে যায় বন্ধু শান্ত কিভাবে দেখা করেছিল লিতিসার সাথে। বাসে উঠে যায় তানজিল তারপর একাকী দেখা হয় শান্তের সাথে লিতিসার। অর্থাৎ কোন লিতিসা ছিল না সেখানে। নিজেই ছুটে আসা বিআরটিসি বাসের পাশ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেছিল ও। এবং মস্তিষ্কের একাংশ কল্পনা করে নিয়েছিল মেয়েটিকে।

ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল ছেলেটা। স্বাভাবিক আর দশটা ছাত্রের চেয়ে অনেকগুণ বেশি চাপ নিয়েছিলো সে। ফেসবুক থেকে বের হওয়ার জন্য খুঁজছিল অনুপ্রেরণা। কাজেই অবচেতন মন নিজেকে রক্ষা করতে এনে দেয় ডাইভার্সন। লিতিসা নামক চমৎকার একটি নারী চরিত্র সৃষ্টি করে দেয় ওকে। কাজে দেয় সেটা ফেসবুক থেকে সরে যায় শান্ত বুয়েটে চান্সও পেয়ে যায়! কিন্তু রোগটা ততদিনে তাকে পেয়ে বসেছে!

ফোনে কথা বলে ও দিনরাত লিতিসার সাথে। আসলে মস্তিষ্কের একাংশ ওকে সাহায্য করছিল এই কাজটা করতে। তারপর বাসার একটি ঠিকানাও বানিয়ে নেয় নিজে নিজেই যেখানে লিতিসা থাকে! তবে দীর্ঘ দুই বছর পর নিশ্চয় খেলাটা খেলে যেতে যেতে তার মস্তিষ্কের অবচেতন অংশও ক্লান্ত হয়ে গেছিল হয়তো। সে চাইছিলো মুক্তি।

লিতিসাকে’ডিলেট’ করে দিতে নতুন ধরণের হ্যালুসিনেশন দেখে ও লিতিসার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! আর বন্ধুর ফোনটা পেয়ে লাফিয়ে ওঠে তানজিলও। ওর বোঝার কথা নয় লিতিসা কেবলই শান্তের অবচেতন মনের সৃষ্টি! বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে ঠেকাতে সর্বোচ্চ রিস্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে উদ্ধার করতে! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তানজিল। তারপর হেলান দেয় ও চেয়ারে।

‘ডক্টর, আমার ফ্রেন্ড শান্তকে কি রিকভার করার কোন উপায় নেই? সিজোফ্রেনিক হয়েই কি তাকে দিন কাটাতে হবে বাকি জীবন?’

মাথা নাড়েন ডক্টর, ’আপনাকে বুঝতে হবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন যে চরিত্রটিকে সিজোফ্রেনিক বাস্তব বলে ভাবছে তাকে কিভাবে মুছে ফেলতে পারে কেউ? সে দেখতে পায় মানুষটিকে। শুনতে পায় তার কথা। যদিও এগুলো মস্তিষ্কের একটা ইমপালস ব্যাতীত আর কিছুই নয় কিন্তু আপনি তাকে কিভাবে বোঝাবেন এসবই ভড়ং?’

‘চেষ্টা করতে হবে। আমার মনে হয় আমি শান্তের সাথে কথা বললে সে বুঝবে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানজিল।

‘রোগীকে অবশ্যই নিজে থেকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। নাহলে যতই উদ্দীপনা দেই আমরা বাইরে থেকে কাজ হবে না তাতে!’

আবারও আশ্বস্ত করে তানজিল, ’শান্তের সাথে আমি কথা বলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করব ব্যাপারটা, ডক্টর। ’

আস্তে করে উঠে দাঁড়ান এবারে ডক্টর, ধীর পায়ে দেওয়াল পর্যন্ত হেঁটে যান তিনি, তারপর ঘুরে সরাসরি তাকান তানজিলের দিকে।

‘দেয়ার ইজ নো শান্ত, মাই বয়। ’

শুন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তানজিল।

‘শান্ত নামের বন্ধু তোমার ছিল না কোনদিনও। শান্ত একটি হ্যালুসিনেশন, তানজিল। ’

দড়াম করে ঘুষি মারে তানজিল টেবিলের ওপর।

‘স্টপ ইট, ডক্টর। মজা করছেন আপনি আমার সাথে?’

‘শান্ত চরিত্রটি সম্ভবতঃ তুমি বানিয়েছ ক্লাস ফাইভে থাকতে। পাশের সাদা বাড়িটাতে শান্ত নামের একটা ছেলে কারেন্টের শক খেয়ে মারা যায় ছেলেটা তোমার সমবয়েসীই ছিল তার ব্যাপারে ভুলতে পারো নি তুমি। ওকে ধীরে ধীরে করে নিয়েছ একটি বন্ধু চরিত্র। শান্ত তোমার সাথে বড় হতে থাকে!’

‘না, বানিয়ে বলছেন আপনি বেশি বুঝে ফেলেছেন’ বিড় বিড় করে বলে তানজিল।

তানজিলের কথা শুনতেই পাননি এভাবে বলতে থাকেন ডক্টর মাজেদুর রহমান। ’ধীরে ধীরে শান্ত চরিত্রটি ডাল পালা মেলতে থাকে তোমার ভেতর। বয়ঃসন্ধিতে চলে আসার সাথে সাথে তোমার মনে হতে থাকে শান্তের একটা গার্লফ্রেন্ড তো দরকার! কাজেই এখানেই আনলে তুমি লিতিসাকে। বাসে ছুটে উঠে পড়লে সেদিন, কল্পনা করে নিলে কিভাবে ওদের প্রেম শুরু হল! তারপর শান্ত এসে তোমাকে একই কাহিনীর রিপিটেশন শোনাল আরেকদিন। যদিও ওখানে কেউ ছিল না। তুমি একাই বসে ছিলে। তবে নিজের কাছে চরিত্রের বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে এই কাজটা মস্তিষ্ক করেই থাকে!’

মনে পড়ে যায় তানজিলের, দোকানদার মামা প্রত্যেকবার কিভাবে তাকিয়ে থাকতেন যখন ও শান্তের সাথে কথা বলত। কেন?

ও একা থাকত ওখানে, তাই?

‘সিজোফ্রেনিয়ার মজা হল যতদূর সম্ভব বাস্তব করে তোলে এটা চরিত্রগুলোকে। কাজেই তোমার মস্তিষ্কপ্রসূত শান্ত বুয়েটে চান্স পাওয়ার পর তুমি কিছুদিনের জন্য ওকে আর দেখতে পেলে না। কারণ তুমি তখন ময়মনসিংহে। ’

‘দুই বছর, ’ বিড় বিড় করে তানজিল, ’দুই বছর আমি দেখিনি ওকে। ’

‘দীর্ঘ এই সময়টা না দেখে থাকা চরিত্রটিকে ফিরিয়ে আনতে চাইল তোমার অবচেতন মন আবার। ’

‘ফোন দেয় ও আমাকে সেরাতে’ মেলানোর চেষ্টা করছে তানজিল। ডক্টরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

‘কাজেই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা ফিরে আসো তুমি পিস্তল দুটো আনলেও ধরিয়ে দিতে পারো না শান্তকে। পুরো সময়টাতে সে ছিল প্যাসিভ ক্যারেকটার। সবকিছু করতে হয়েছে তোমাকেই

ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে কাচের গ্লাসটি ডক্টরের দিকে ছুঁড়ে মারে তানজিল।

আগেই প্রত্যাশিত ছিল ব্যাপারটা চট করে সরে গিয়ে আঘাত এড়ান তিনি।

‘ইউ লায়ার! আমাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণের চেষ্টা করবেন না ডক্টর! শান্ত ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অ্যান্ড হি ইজ রিয়েল। আপনি আমার হ্যালুসিনেশন হতে পারেন কিন্তু ও না!’

দুইজন রক্ষী এসে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায় তানজিলকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ডক্টর।

পরিশিষ্ট

একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে মুখ খুললো তানজিল।

‘আমার বন্ধুটির ব্যাপারে যা বলার আপনাকে বলতে হবে আমাকেই। আর কেউ নেই তার জন্য আসার মত।’ নড়েচড়ে বসে ও। শান্তের মাথায় আগাগোড়াই সমস্যা ছিল কে জানত?

‘ওর সিজোফ্রেনিয়া ছিল, তাই নয় কি ডক্টর? যেকারণে কাল্পনিক একটা মেয়েকে ভেবে তার সাথে প্রেম করে এসেছে ও পুরোটা সময়?’

সরাসরি তানজিলের দিকে তাকান ডক্টর। চোখে বিষাদের ছায়া।

এই ছেলেটিকে প্রতিদিন তিনি বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন শান্ত বলে কেউ ছিল না কোনদিনই!

কিন্তু কোন ইম্প্রুভমেন্ট নেই।

আড়চোখে একবার টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা দেখেন তিনি। রোগীর ভায়োলেন্স বোঝার জন্য এটা রাখা। ক্ষেপে উঠলে এটা ছুঁড়ে মারবে সে, তখনই তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হবে।

তানজিল ছেলেটার সিজোফ্রেনিয়া এতটাই গভীরে চলে গেছে একটি নয় একাধিক চরিত্র কল্পনা করতে শুরু করেছিল ছেলেটা। উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর। জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালেন। ভুল ভাবে কল্পনা করার জন্য দুই দুইটি খুন করে এসেছে এই নিষ্পাপ চেহারার ছেলেটি।

বিশ্বাস করা যায়?

ওদিকে চেয়ারে বসে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তানজিল। তারপর হেলান দেয় ও চেয়ারে।

‘ডক্টর, আমার ফ্রেন্ড শান্তকে কি রিকভার করার কোন উপায় নেই? সিজোফ্রেনিক হয়েই কি তাকে দিন কাটাতে হবে বাকি জীবন?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ডক্টর মাজেদুর রহমানও।

— ০ —

রচকানাল – এপ্রিল ২২, ২০১৪ 

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *