KP Imon

Words Crafted

দ্য ফিফথ হেডফাইভ


ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হতেই কোলাহল কানে বাজল।
এতটা নীরব ছিল ভেতরে, বাইরের এইটুকুকেই মনে হল রীতিমতো চেঁচামেচি যেন! আদতে এমন শব্দ প্রতিনিয়তই শুনতে হয় সবাইকে।
শান্ত পায়ে হাঁটছি আমি। ঈশিতাকে টাকাটা পৌঁছে দিয়ে আরেকবার বের হতে হবে আজ। মিনহাজের জরুরী তলব আছে।
চকচকে কালো রঙের গাড়িটাকে পাশ কাটালাম। কড়া রোদ উঠেছে আজ।
দূরে দুইজনকে ঝগড়া করতে শোনা যাচ্ছে। এদের পেশা – ভিক্ষাবৃত্তি।
ঝগড়ার কারণটা চমৎকার! একটু আগে যাওয়া লোকটা পঞ্চাশ টাকার নোটটাকে ভাগাভাগি করে নিতে বলেছে – সেটা আরেকজন মেনে নিচ্ছে না।
হাসতে পারলাম না অবশ্য – চোখের কোণে একটা মৃদু নড়াচড়া ধরা পড়েছে।
সাইড রোড থেকে একেবারেই হঠাৎ বেরিয়ে এল একটি গাড়ি। চট করে বামদিকের রোডে নেমে পড়লাম। এরকম চকচকে কালো রঙের গাড়িকে একটু আগেই পাশ কাটিয়েছি। একই মডেল, একই মেক। মনে হচ্ছিল যেন একই গাড়ি। কাকতালীয় ঘটনা?
না বোধহয়। আমার মত জীবন যাদের তাদের জন্য কোন কাকতালীয় ঘটনা নেই। কোন দুর্ঘটনা নেই।
যা হয় তার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে বাধ্য।
গলিটার ভেতরে জোর কদমে অর্ধেকটা ঢুকে গেছি – এই সময় গলির মুখে কালো পোশাক পড়া দুইজনকে ঢুকে পড়তে দেখা গেল।
ফোনটা বের করে মিরর অ্যাপ চালিয়ে চট করে দেখে নেই – ফলোয়ার চিনতে এই অ্যাপের জুড়ি নেই।
হুম – কোটের ভেতর কি অমূল্য সম্পদ রেখেছে জানার উপায় নেই। তবে একটু করে ফুলে আছে দুইজনই।
ভারমুক্ত করা লাগবে দেখছি!
এত দ্রুত সরকারি এজেন্সী আমাকে পেয়ে গেল কি করে?
বেশি ভাবতে হয় না অবশ্য – ব্যাংকের প্রায় সবগুলো সিকিউরিটি ক্যামেরা এড়িয়ে গেলেও অন্তত একটা আমাকে ক্যাপচার করেছে নিঃসন্দেহে! দক্ষিণ কোণেরটা। আমার চেহারা আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে চলে যাওয়ার পর থেকে এমন তাড়া মাঝে মাঝেই খেতে হয় এখন আমাকে।
শালার রাবেক! – মনে মনে প্রাণখুলে গালি দেই ব্যাটাকে।
তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না অবশ্য! পেছনের দুইজন আঠার মত লেগে আছে!
সাথে গ্লকটা নেই। নয়তো ওজন কমিয়ে দিতে পারতাম দুটোরই! পেছনে ছোঁক ছোঁক করতে থাকা লোকজনকে অসহ্য লাগে আমার।
ব্যাংকে অস্ত্র নিয়ে ঢোকার কথা চিন্তাও করা যায় না! এসব জায়গা এজন্যই আমি এড়িয়ে চলি। অথচ আজ না এসে উপায় ছিল না।
তিনটি অ্যাকাউন্টের ব্যালান্সই ফাঁকা হয়ে গেছে। কিডন্যাপিং-এর পেশা ছেড়ে দেওয়ার পর ছোট একটা চাকরী ধরেছিলাম।
সার্টিফিকেট অনুযায়ী অন্তত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে যাওয়া উচিত আমার কোন কোম্পানিতে – কিন্তু অন্ধকার জগতে এত কামিয়েছি, কোথাও চাকরি নেওয়ার চেষ্টাও করিনি।
যে চাকরিটি শুরু করেছিলাম – সেটা ছেড়ে দিতে হয়েছিল কাভার ওড়ার পর।
দিন অনেকই পার হয়ে গেছে। তিনটি ব্যাংকে জমানো টাকা রাখা ছিল সিকিউরিটি হিসেবে। ম্যানুয়ালি ছাড়া নেওয়া অসম্ভব। এদের থেকে কার্ড নেইনি কখনো। সেটি নিতেও আমাকে সশরীরে যেতে হতো। সিস্টেমের বাইরে বহুদিন থাকার কুফল হচ্ছে, চট করে কোন ‘ওয়ার্ক-অ্যারাউন্ড’ পাওয়া সহজ নয়।
কাজেই খালি হাতে বের হতে হয়েছে আজ আমাকে। এখন পেছনের দুই সমস্যাকে ছুটানোটা একটু সমস্যা হয়ে গেল!
সামনের দিকে তাকালাম। গলিটি শেষ হয়ে আসছে। যেকোন সময় ওপাশ থেকে বেড়িয়ে আসবে একটি গাড়ি, বেশ বুঝতে পারছি। এভাবেই কাজ করে ওরা। দুইজনকে ওই দিক দিয়ে ঢুকিয়ে গাড়ি নিয়ে এসে অন্যপাশ থেকে ঢুকে গেলেই আমার জাড়িজুড়ি খতম একেবারে!
চোখদুটো দ্রুত নড়াচড়া করছে আমার।
রাস্তার দুইধারের একটা বাড়িতেও কি বহিরাগতদের ঢোকার উপায় নেই নাকি? সবগুলোর বাইরের গেটে তালা বসানো।
মানে, বাসিন্দাদের কাছে ওগুলোর চাবি থাকলেও আমার পকেট তো ফাঁকা!
ভালোই বুঝতে পারলাম – কঠিনতম চিপাতে পড়েছি! এস্কেপ প্ল্যান এখান থেকে করাটা প্রায় অসম্ভব।
কোন কিছুই নিজের অনুকূলে রাখার সুযোগ পাইনি। এই গলিতে না ঢুকে আরও বিশ ফিট এগিয়ে যেতে পারলে তিনদিকে কেটে পড়ার একটা পথ ছিল। কিন্তু খুব দ্রুত কাজ করেছে সরকারি এজেন্সী।
এই সময় দেখতে পেলাম আর মাত্র পনের ফিট দূরে লাল রঙের গেইট থেকে বের হল একটা মেয়ে।
মেয়েটাকে স্রেফ স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী বলে মনে হল আমার! মাথায় একসাথে কয়েকটা এস্কেপ প্ল্যান খুলে দিচ্ছে!
কিন্তু পরক্ষণেই নিরাশ হয়ে যাই! ক্লিক করে তালাটা লাগিয়ে দিল মেয়ে আবার – আমি তখনও দশ ফিট দূরে!
পেছনের ওরা কাছে চলে এসেছে আগের চেয়ে। অ্যানিটাইম সামনে থেকেও গাড়ি বের হয়ে আসবে বুঝতে পারলাম। কাজেই প্ল্যান বিতে চলে যেতে হল আমাকে বাধ্য হয়েই!
মেয়েটা পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিল – কেউ কিছু বোঝার আগেই একপাশ থেকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসি আমি ওকে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মাঝেই ওর এক হাত মুচড়ে থ্রি সিক্সটি ডিগ্রী অ্যাংগেল ঘুরে যাই – আমার সামনে নিজের অজান্তেই মানব-বর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা। কেউ গুলি ছুঁড়লে আমার আগে ওকে ফুঁড়বে – এটা বোঝে দুই কালো পোশাকও। তবুও নিমেষেই বের করে ফেলে পিস্তল।
আমার হাতেও বেড়িয়ে এসেছে কলমটা। ব্যাংকে এটা দিয়েই সাইন করেছিলাম। সুইচ টিপতেই তিন ইঞ্চির চিকন কিন্তু স্পাতদৃঢ় ফলাটা বের হয়ে এল ডগা থেকে, অগ্রভাগটা স্পর্শ করলাম মেয়েটার গলায়।
‘মেয়েটাকে ছেড়ে দাও, ইরফান।’ ঠান্ডা গলায় বলে ফলোয়ারদের একজন।
‘নিশ্চয়!’ পূর্ণ সমর্থন জানাই আমি তাকে। ‘দুইজনই অস্ত্র মাটিতে রেখে পা দিয়ে ঠেলে আমার দিকে পাঠিয়ে দাও। ছেড়ে দিচ্ছি ওকে।’
আমার হাতের নিচে ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়েটা। এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে নিশ্চয় ভাবেনি?
‘মাথা খাটাও, গর্দভ!’ হিস হিস করে বলে দ্বিতীয় মানুষটা। ‘তোমাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। যে কোন সময় আমাদের পোশাকে ভরে যাবে এলাকা।’
ওদের দিকে একটু লক্ষ্য করি। বাংলাদেশে আবার সিক্রেট সার্ভিস এল কবে থেকে? নাকি স্নিফার্স এরা?
স্নিফার্সই হবে! এই এজেন্সীটা সরকারি এবং বিনা বিচারে ক্লিনিংয়ে ওরা দক্ষ। ২০১২য় গঠিত।
তবে ওরাই কি না – নিশ্চিত হবার উপায় নেই। দূরত্ব মাপলাম আমি। অস্ত্র নামায় নি দুইজনের কেউই – তারওপর এগিয়ে আসছে। দূরত্ব কমছে আমাদের।
একেবারেই হঠাৎ অ্যাংগেলটা আবিষ্কার করলাম। একটু আগে পরে সামনে বাড়ার ফল! মেয়েটাকে দ্বিতীয় স্নিফার্সের দিকে ছুঁড়ে ফেলেই মাটিতে একটা ডিগবাজি দিলাম। হাত থেকে ফেলে দিয়েছি কলম। ওটার আর দরকার নেই। তবে এতক্ষণ অপেক্ষা করার মত মানুষ না প্রথম স্নিফার্স – সামনে থেকে হোস্টেজ সরে যেতেই প্রথম গুলিটি করে বসল লোকটা।
নিস্তব্ধ গলিটাতে প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সাথে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনীত হল গানশটের শব্দ!
ডিগবাজি খেয়ে সামনে এগিয়ে গেছি, কাজেই আমাকে ছোঁয় নি বুলেটটা। দেখলাম, দ্বিতীয় স্নিফার্সের বুকে আছড়ে পড়ছে হোস্টেজ মেয়েটা এবং দ্বিতীয় গুলি করার জন্য ট্রিগারে বসে যাচ্ছে প্রথম স্নিফার্সের আঙুল।
গুলিটা বেরিয়ে যায়, তবে তার আগেই ওর হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লাইন অফ ফায়ার সরিয়ে আকাশের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছি। হাত সমান করে নাকে একটা মারলাম সম্মানীস্বরূপ।
আধ ইঞ্চি দেবে গেল কি এর নাক?
দেখার সময় কোথায়? লোকটার ডান হাতের নার্ভ সেন্টারে একবার আঘাত করে সক্রিয় হাতটাকে অচল করে দিলাম এবার। দুই চোখে তীব্র মৃত্যুভয় ফুটে উঠেছে এবার। একই সময়ে ওর হাতের পিস্তলটা কব্জা করে নিয়েছি কি না!
দ্বিতীয় স্নিফার্সকে দেখা যায় মেয়েটাকে সামনে থেকে সরিয়ে অস্ত্র বাগাচ্ছে – সেই সাথে গলির অন্য পাশ থেকে তীব্র বেগে ছুটে আসছে একটা চকচকে কালো রঙের গাড়ি!
দিনের প্রথম গুলিটা ছুঁড়ে দ্বিতীয় স্নিফার্সের বাম কাঁধ গুড়িয়ে দেই – বাম কাঁধ পিছিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতেই ডান কাঁধ সামনে এগিয়ে আসে। আমার থেকে বেশ ডান দিয়ে বেড়িয়ে যায় বুলেটটা।
দ্বিতীয় গুলিতে ফেঁসে যায় কালো গাড়ির একটা টায়ার। সামনে পড়ে যাওয়া হোস্টেজ মেয়েটাকে এড়াতে বেশ কসরত করতে হল ড্রাইভার ভদ্রলোককে।
এতটুকু দেখেই আর থামলাম না আমি। একটু সামনে পাওয়া প্রথম টিনশেড বাসাটার দরজার তালা এক গুলিতে উড়িয়ে দড়াম করে লাথি বসালাম কবাটে। বিনা প্রতিবাদে এবার দরজাটা খুলে গেল আর আমিও হামলে পড়লাম ভেতরে।
সামনে একটা করিডোর। মাথার ওপর খোলা আকাশ।
কড়িডোরের শেষ মাথায় দেওয়াল। তার নিচে জমিয়ে রাখা ইটের স্তুপ রাখায় বাড়ির মালিককে ধন্যবাদ জানাই অন্তরের অন্তস্থল থেকে! তারপর ছুটন্ত গতি সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে এক চাপে নিজেকে ওপরের দিকে তুলে ফেলি। দেওয়ালটা টপকাতে পারলেই অন্য পাশের রোডে গিয়ে পড়া সম্ভব।
পেছন থেকে কে জানি গুলি করল – আমায় লাগলো না যেহেতু, আমলে নিলাম না। সময় নেই।
এক ঝাঁপে দেওয়ালের অন্য পাশে ল্যান্ড করে থমকে গেলাম। আর দৌড়ঝাঁপের মানে হয় না।
অন্তত পঁচিশ জন স্নিফার্স অপেক্ষা করছে এই রোডে।
আমাকে দেখেই অস্ত্র তুললো প্রত্যেকে।
আস্তে করে নিজের হাত থেকে সিগ-সাওয়ারটা ফেলে দিলাম। স্নিফার্সের প্রতি মেম্বারের হ্যান্ডগানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সাড়ে ছয়শ ডলার খরচ করে কিভাবে?
পুরোই অপচয়!
ছ’টাকে ধোঁকা দিয়ে আরেকটু হলে বেরিয়েই গিয়েছিলাম আমি।
আমার হাতে চটপট হাতকড়া পড়িয়ে দেওয়া হল। ওদিকে এই ফোর্সের লিড যে দিচ্ছে – তাকে দেখলাম ওয়াকিটকিতে কথা বলছে।
ফ্যান্টম ইরফান প্রথমবারের মত ধরা পড়েছে – বাহিনীর সবাই নিশ্চয় সাফল্যে উদ্বেলিত হয়ে ট্যাংগো ডান্স দিচ্ছে?
আরেকটা গাড়ি এসে থামল এই রোডে।
দরজা খুলে যিনি বের হলেন তাকে লক্ষ্য করলাম। একনজর দেখে বুঝতে পারলাম, ইনি কোন চুনোপুঁটি নন। আমাকে হাতকড়া পড়ানো স্নিফার্স আমার কানের পাশে মৃদু কন্ঠে জানিয়ে দেয়, ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ। ডিফেন্স অ্যাডভাইজার। কথাবার্তা ঠিকমত বলবে।’
সহবত শেখাচ্ছে?
সেটা নিয়ে ভাবি না অবশ্য, বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছি! ডিফেন্স অ্যাডভাইজার আমার কাছে কেন?
সামনে এসে আদেশের সুরে বলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ, ‘আনকাফ হিম।’
তারপর আমার দিকে ঘুরে তাকান, ‘উই নিড ইয়োর হেল্প, মি. ইরফান।’


ডিফেন্স অ্যাডভাইজারের পাশে বসে আছি গাড়িতে।
মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরছে – তবে মুখ ফুটে কিছুই বললাম না। সময় হলেই বলা হবে আমাকে – সেটা জানি।
দেরী করেন না অবশ্য তিনি, মুখ খোলেন, ‘আমাদের হাতে সময় নেই বেশি, মি. ইরফান। কাজেই রাস্তাতেই আপনাকে ব্রিফ দেব। আমাদের সাথে ছোট একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।’
কাজ?
আমার মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? না বলে পারলাম না, ‘আমি যদি ইন্টারেস্টেড না থাকি?’
একটু হাসেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ‘আপনি আমাদের কাজে ইন্টারেস্টেড না থাকলেও আপনার ব্যাপারে অনেকেই ইন্টারেস্টেড। পুলিশ, অ্যান্টিটেররিজম এজেন্সী, স্নিফার্স – সবারই যথেষ্ট আগ্রহ আছে আপনার ব্যাপারে। বুঝতেই পারছেন!’
বুঝতে পারলাম।
চৌদ্দ শিকের মাঝে চলে যাওয়া তো সময়ের ব্যাপার। তারপরে মাথা থাকবে না উড়ে যাবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই আমার। কতগুলো সত্য মামলা, আর অনেকগুলো মিথ্যে মামলা, থ্যাংকস টু রাবেক। ওদের সাথে তাল না মিলিয়ে উপায় নেই!
‘তাহলে, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আপনারা কোন গভীরতার গর্তে পড়েছেন সে ব্যাপারে আলোকপাত করুন।’ বলি আমি।
‘ইয়ে -’ বোঝাই যাচ্ছে নিজেদের অক্ষমতা সরাসরি প্রকাশে বাঁধছে মানুষটার, ‘এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল। শুধু আপনার কিছু মতামত জানা দরকার – ড্রিংক চলবে?’ মিনি ক্যাবিনেট থেকে একটা চ্যাপ্টা বোতল বের করে জানতে চান তিনি।
‘এতই আন্ডার কন্ট্রোলড থাকলে আমাকে ড্রিংক অফার করার দরকার হত বলে মনে হয় না।’ চাঁচাছোলা গলাতে বলে দেই আমি – মাহমুদের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল একথায়।
‘গতকাল সন্ধ্যায় হোম-মিনিস্টারের মেয়েকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।’ প্রতিটা শব্দ থেমে থেমে উচ্চারণ করেন তিনি, ‘কিডন্যাপিং-এ আপনার সমকক্ষ স্কিলের কাওকে বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন।’ একটু কেশে বললেন, ‘যদিও রিটায়ার্ড, তবে আপনার মতো এক্সপার্ট কারো সাথে কনসাল্ট করতে চাইছি আমরা। কাজটা করে দিন, এবারের মত ভুলে যাব ইরফান নামে কাওকে অ্যারেস্ট করতে হবে।’
মাথা দোলালাম। স্নিফার্সরা সরাসরি হোম মিনিস্টারের আন্ডারে চলে। এত আয়োজন করে আমাকে শুধু মাত্র ধরে আনার মানে এখন বেশ বুঝতে পারছি।
সবকিছু এখন পানির মতই পরিষ্কার!
*
স্নিফার্সের হেডকোয়ার্টারে বসে আছি।
হোমমিনিস্টারের সবচেয়ে ভরসা এই বাহিনীর ওপর। বাংলাদেশের আইন যা-ই বলুক, মন্ত্রী-মিনিস্টার সব সময় পুলিশকে নিজের লেঠেলের মতো ব্যবহার করেছে। কাজেই হোম-মিনিস্টার যে স্নিফার্সকে ব্যবহার করবে ব্যক্তিগত তৈজসপত্রের মতো তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যস্মিনদেশে যদাচার।
উদ্ধার করতে হবে সতের বছরের একটা মেয়েকে।
স্নিফার্সের ড্রেস পড়ার জন্য আমাকে বলা হয়েছিল। এককথায় প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছি।
কনুই পর্যন্ত হাতা গোটানো ফুলহাতা শার্টের সাথে কালো জিন্সেই যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করছি।
স্নিফার্সের ডিরেক্টর সালাউদ্দীন চৌধুরী ব্রিফ দিচ্ছেন এখন। প্রজেক্টরের সাহায্যে পর্দায় এক ফুটফুটে কিশোরীকে দেখা যাচ্ছে।
‘আনিকা তাবাসসুম রহমান। বাবা রায়হান রহমানের ব্যাপারে পরিচয় দেওয়ার নতুন কিছু নেই। মেয়েটির বয়েস সতের। বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রী, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। গতকাল সন্ধ্যার সময় কলেজ ছুটির পরে মেয়েটিকে কলেজে পায়নি ড্রাইভার। ধারণা করা হচ্ছে আনুমানিক বিকেল চারটা থেকে ছয়টার মাঝে কিডন্যাপ করা হয়েছে ওকে।’
আমার মাথায় চলে আসে বেশ কয়েক মাস আগের কিছু স্মৃতি, তখন কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করতে মাঠে নেমেছিলাম আমি নিজেই।
‘কিডন্যাপাররা মেয়েটির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছে গতকাল রাত বারোটায়।’ বলে চলেছেন সালাউদ্দীন চৌধুরী, ‘মুক্তিপণের পরিমাণটা জানিয়ে দেয় তারা। একশ কোটি টাকা। সময় তিনদিন। যার মাঝে মূল্যবান অর্ধদিন নষ্ট করে ফেলেছি আমরা। এগুতে পারিনি মোটেও।’
আড়চোখে একবার দেখলাম, চোখ গোল গোল হয়ে গেছে টীমের সবার।
মাত্র পাঁচজনকে নিয়ে গঠিত স্পেশাল এই টীমটার একজন সদস্য হিসেবে আমাকেও গোণায় ধরা হচ্ছে। বাকিদের মাঝে ড্যাম কেয়ার ভাব নিতে থাকা মৃধা, শান্ত মুখভঙ্গীর জন্য বিখ্যাত শুভ, সবসময়ই ছটফট করতে থাকা রিয়াদ আর খুনীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস যে ছেলেটার সেই রেজা – প্রত্যেকেরই চেহারা দেখার মত হয়েছে টাকার অংক শুনে।
মনে মনে ভাবি আমি, বেশ করেছে। টাকা তো যেখান থেকে পেরেছেন পকেটে ঢুকিয়েছেন – এখন সময় হয়েছে কিছু বের করার!
তবে সেটা নয়, মেয়েটার জীবনের নিরাপত্তা দেখছি না আমি। এটাই ভয়ের ব্যাপার।
উঠে দাঁড়াই আমি, ‘আমাদের সমস্যা এখানে টাকাটা না, গাইজ। সমস্যা হল, আজকের কিডন্যাপাররা টাকা পেয়ে যাওয়ার পর আর ফিরিয়ে দেয় না কিডন্যাপড পার্সনকে।’ আরও কত কি করে তরুণী মেয়েদের হাতে পেলে –মাথায় তেমন ঘটনা ফ্ল্যাশ দিয়ে যায় আমার। বন্যার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে সেসব বললাম না এদের সামনে। এমনিতেই কাতল মাছের মত মুখ করে রেখেছে, শুধু শুধু চাপ বাড়িয়ে লাভ নেই। ‘কাজেই টাকা দিয়েও মেয়েটাকে উদ্ধার করা সম্ভব নয় আমাদের। এই তিনদিনের, মানে আড়াইদিনের মাঝে মেয়েটার লোকেশন বের করতে পারাই আমাদের একমাত্র সমাধান। এব্যাপারে কতটুকু তথ্য দিতে পারবেন?’
গতকাল রাত থেকে কাজ করতে থাকা স্নিফার্সের ইনফরমেশনের আশায় তাকালাম। হাজার হলেও, আগে থেকে কাজ করছে এরা। প্রজেক্টর থেকে জানতে পারলাম, সহপাঠিদের সাথে আলাদা করে কথা বলে এরা জানতে পেরেছে মেয়েটি কলেজে ঢুকেছিল এটি নিশ্চিত। এরপর কেউ ঠিক করে কিছু বলতে পারেনি। বিজ্ঞানবিভাগের ছাত্রীদের ব্রেকের পর আরও তিনটি ক্লাস করতে হয়। ব্যবসাবিভাগের দুটো। এখানে নানা মত পাওয়া যাচ্ছে।
‘ধরলাম, বিকাল পাঁচটায় কমার্সের স্টুডেন্টদের সাথে বেরিয়ে এসেছে মেয়েটা। কলেজ লাইফে বাংক মারার ঘটনা তো আর কম ঘটে না। আর তখনই তাকে নিয়ে যায় ওরা।’ ধারণার কথা জানালেন সালাউদ্দীন চৌধুরী।
‘বয়ফ্রেন্ড?’ জানতে চাই আমি।
‘তাহের। ডেড। গুলি করা হয়েছে ওকে বিকাল পাঁচটার দিকে। যে কারণেই ওই সময়ের দিকে মনোযোগ চলে গেছে আমাদের।’ জানালেন সালাউদ্দীনই।
‘লোকেশন?’
ম্যাপ বের করে দেখান তিনি। পার্কটা চিনি আমি।
বিশেষত যেই পার্ক থেকে ফারিহাকে তুলে এনেছিলাম একেবারেই সেই পার্কটিতেই পাওয়া গেছে বয়ফ্রেন্ড তাহেরের ডেডবডি?
অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। কলেজ পড়ুয়া জুটিদের জন্য নিরাপদ ডেটিং প্লেস ওটা। কাজেই যেতেই পারে যে কেউ। গোটা ঢাকা থেকেই কলেজপড়ূয়া ছাত্রছাত্রী ওই পার্কে গিয়ে প্রেম করে।
আর এই যুগল সেখানে গিয়েই ফেঁসেছে!
গাল চুলকালাম একবার। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে নতুন কিছু শোনার আশায়। ওদের নিরাশ করতে পারলাম না।
‘মেয়েটার কলেজ শুরু হয় কখন?’ জানতে চাই আমি।
‘দুপুর বারোটা।’ বলেন সালাউদ্দীন।
‘আনিকা তাবাসসুম কিডন্যাপড হয়েছে বারোটার এদিক ওদিকে। আরও ঠিক করে বলতে গেলে একটার দিকে। বয়ফ্রেন্ড সহই তুলে নিয়ে যায় ওরা – তারপর পাঁচটার দিকে শুধু বয়ফ্রেন্ডটাকে নিয়ে ফিরে আসে। ঠান্ডা মাথায় ওকে গুলি করে একই পার্কে। আর আপনাদের চোখ সরে যায় পাঁচটার দিকে।’
খবরটা হজম করার চেষ্টা করে প্রত্যেকে।
তবে সালাউদ্দীনকে প্রভাবিত হতে দেখা যায় না। জানতে চান, ‘নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে?’
একটু হাসি আমি, ‘হোমমিনিস্টারের মেয়েকে কিডন্যাপ করতে গেলে এমন কিছুই প্ল্যান করতাম আমি।’
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবাই আমার দিকে।
বাইরে এসমন একটা হট্টগোল শোনা গেল। কেউ একজন কাউকে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারলো না।
দরজাটা ডাবল ডোর, প্রবল ধাক্কায় তা হা করে খুলে ফেললো সেই লোক। অনুমতি ছাড়াই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো মানুষটা। এর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।
অপারেটর মিথিলা।
‘স্যার – দ্বিতীয়বার ফোন করেছে ওরা। কথা বলছে এখন। টেক-রুমে আসুন।’
উঠে দাঁড়াই প্রত্যেকে। তবে সালাউদ্দীন শুধু আমাকে নিয়ে বাকিদের ইশারা দেন বসে পড়ার জন্য।
টেক রুমটা বেশ বড়। এই মুহূর্তে হোম মিনিস্টারের ব্যক্তিগত নাম্বারের সাথে সংযুক্ত আছে স্নিফার্স। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারী গলা শোনা গেল স্পিকারে।
‘ডীল কিন্তু এটা ছিল না, মিস্টার। আমার আরও আড়াই দিন পাওয়ার কথা। একশ কোটি টাকা মুখের কথা নয়।’
মনে মনে ভদ্রলোকের নার্ভের প্রশংসা না করে পারলাম না। যথেষ্ট কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলছেন এখনও।
‘আপনার পছন্দ হোক বা না হোক – সময় কমানো হয়েছে চব্বিশ ঘন্টা। আগামীকালের মাঝেই ডেলিভারি দেবেন। অথবা পাবেন। তবে প্রতিটা ডেলিভারিই নির্জীব বস্তুর – মনে রাখবেন।’
এক মুহূর্ত নিজের সাথে যুদ্ধ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রায়হান রহমান, তারপর অগত্যা আত্মসমর্পণ করলেন, ‘অ্যাকাউন্ট নাম্বারটি দিন। ট্রান্সফার করে দেব।’
ওপাশের শুষ্ক কন্ঠে একটা অদ্ভুত হাসি শোনা যায়। ‘একহাজার টাকার নোটে নগদ দিতে হবে টাকাটা। বড় আকারের কাভার্ড ভ্যানে। ভ্যানটা হবে নীল রঙের। জায়গার নাম পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। প্রস্তুত করতে থাকুন।’
‘একদিনে এই পরিমাণের টাকা কিভাবে আমি নগদ জোগাড় করব?’ হতাশায় চিৎকার দেন রায়হান রহমান।
‘সেজন্যই বললাম, সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পড়ুন। বেস্ট অফ লাক!’ লাইন কেটে দেওয়ার উপক্রম করল কিডন্যাপার।
‘ওয়েইট! ওয়েইট! ডেলিভারিটা আমি নিজে করতে চাই। মেয়েকে দেখবো, তবেই টাকা দেব। আপত্তি?’ দ্রুত জানতে চান হোমমিনিস্টার।
‘আপনি না। আপনার স্নিফার্স থেকে কাওকে পাঠাবেন। খুব তো পুষেছেন! আর ডেলিভারি ট্রাকের ওপর নজর রাখার চেষ্টা করবেন না। অন্যথায় ডীলটি আর থাকছে না।’ কচ করে লাইন কেটে গেল ওপাশ থেকে।
ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান সালাউদ্দীন।
লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নেই আমি। টাকাটা নিয়ে আমাকেই যাওয়া লাগবে মনে হচ্ছে।
মোবাইলটা একবার বের করে দেখি – মিনহাজের এত দেরী হচ্ছে কেন কে জানে!


‘বলতে চাইছিস ফিরোজ গ্রুপ উধাও?’ ভ্রু কুঁচকে মিনহাজকে ছুঁড়ে দেই প্রশ্নটা।
মাথা ঝাঁকায় মিনহাজ, ‘কমপ্লিটলি। একেবারে রাডারের নিচে আছে ওরা। গত ছয় মাস ধরে।’
‘হুম। হোম মিনিস্টারের মেয়েকে কিডন্যাপের প্ল্যান করার জন্য এতটুকু সময় লাগাটা স্বাভাবিক।’ একমত হলাম আমি।
মিনহাজ আর আমি খুব সাধারণ একটা চায়ের দোকানে বসে আছি। মিরপুরে চলে এসেছি ওর সাথে দেখা করতে।
স্নিফার্সের হেডকোয়ার্টারে ঢুকে মুঠোবার্তায় ওকে সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা দিয়েছিলাম, তিনটি কিডন্যাপার গ্রুপের খোঁজ নেওয়ার জন্য।
যেহেতু আমাদের হাতে কোন লিংক নেই, আর একটা মেয়ে নিয়ে কেউ লুকিয়ে পড়লে বাংলাদেশ ঢুঁড়ে খুঁজে বের করা একেবারেই অসম্ভব একটা কাজ; কাজেই অন্য দিক থেকে আগাতে চাইছিলাম আমি। এব্যাপারে অবশ্য ভূমিকা রেখেছে আমার অন্ধকার জীবন এবং তৎকালীন অভিজ্ঞতা কিংবা জানাশোনা।
হোমমিনিস্টারের মেয়েকে সুচারুভাবে কিডন্যাপ করতে পারবে – এমন গ্রুপ ঢাকায় বেশি নেই। যেনতেন কাজ নয় এটা। গোটা দেশে হোমমিনিস্টারের ক্ষমতা সব সময় প্রধানমন্ত্রীর ঠিক পর পর, আছে সব আইনশৃংখলা বাহিনীর পূর্ণ সহযোগীতা। সেই সাথে আমাদের এই মন্ত্রীমহোদয় স্নিফার্সের গোড়াপত্তন করেছে, কিডন্যাপাররা যেমন বললো, পেলে পুষে বড় করেছেন, অর্থাৎ নিজস্ব বাহিনী তার আছে। এখানে নাক ঢুকাতে ভয় পাবে বাঘা বাঘা কিডন্যাপাররাও।
নোমান গ্রুপ, জিহান গ্রুপ আর ফিরোজ গ্রুপের ছেলেমেয়েরা স্কিলড। উচ্চাকাঙ্খাও আছে। কাজটা করলে হয়তো এদের তিনগ্রুপের কেউ করে থাকতে পারে,। তাদের মধ্যে ফিরোজ গ্রুপটাকে মিসিং দেখা যাচ্ছে!
‘এদের লোকেশন জানার কোন উপায় নেই দোস্ত।’ মন খারাপ করে বলল মিনহাজ।
‘ফিরোজকে আমি পার্সোনালি চিনি।’ জানালাম মিনহাজকে। একই লাইনে কাজ করলে একটু আধটু চেনা লাগে সবাইকে।
‘তাতে লাভ?’ আশার আলো দেখে না মিনহাজ।
‘ফিরোজের বাসায় একবার গিয়েছিলাম। কয়েক বছর হল। কিডন্যাপিংয়ে নামেনি তখনও ছেলেটা। এই ছোটখাট মাস্তানীতে সীমাবদ্ধ ছিল ওর কাজ। চাঁদাবাজিটা ভালো করত।’
কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলো আমি কী বলতে চাইছি – ফিরোজের বাসা চিনলে কী লাভ? এ ধরনের মানুষের অনেক হাইডআউট থাকে। নিজের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকবে এমন নয়।
তারপরই জ্বলে উঠল মিনহাজের চোখ, বুঝতে পেরেছে!
‘দোস্ত, ইউ আর ব্রিলিয়ান্ট!’
*
মিতুকে দেখে শিস দিয়ে উঠল কলেজ পড়ুয়া ছেলেটা। অন্যদিকে তাকায় কিশোরী। গত বছর থেকে এসব শুরু হয়েছে। কারো নারীত্বের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে আর বাঙালি পুরুষ তাকে সুস্থ পরিবেশে বড় হতে দেবে এমন সুদিন দেশে আসেনি এখনো।
মিতুর কানজোড়া লাল। রাগ। অপমান। তবে লজ্জা নয় এটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা চারজন। এদের পাশ কাটিয়েই যেতে হবে ওকে। স্কুল থেকে বাসার দিকে যেতে এ রাস্তা ধরা লাগে। আর কোন পথ নেই।
শরীর সিঁটিয়ে আসতে চায় – ঘেন্নায়, সেভাবেই হেঁটে ওদের পাশ কাটানোর চেষ্টা করল মিতু।
শিস দেওয়া ছেলেটা মুখ খোলে এবার, ‘যৌবন তোমার লাল টমেটো -’
অপমানে – ক্রোধে আরও লাল হয়ে যায় মেয়েটা। কিন্তু করার কিছুই নেই।
ভাইয়া থাকলে কেউ ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও পায়নি। ভাইয়াটা যে কোথায় গেল হঠাৎ!
এলাকায় অনেকে বলাবলি করছে ভাইয়াকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মিতুর এত খারাপ লাগে বলার মত না!
ভাইয়া থাকলে এই বেয়াদবগুলোকে একেবারে সাইজ করে ফেলত না? আর এইসব বদমাশও টের পেয়েছে। মিতুকে রক্ষা করার কেউ নেই জানে বলেই এরা এখন এমনটা করছে।
সানক্যাপ পরা ছেলেটাকে তখনই প্রথম চোখে পড়ে মিতুর। ছেলেটা লম্বা – সেই সাথে মানানসই স্বাস্থ্য। বয়েসে মিতুর চেয়ে বেশ বড়ই হবে।
হাতে একটা কী-বোর্ডের প্যাকেট। পাশের কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজের দোকানটায় কী-বোর্ড কিনতে এসে এই টিজিংয়ের ঘটনা চোখে পড়ে গেছে যুবকের?
কোন রকম ভূমিকার মাঝে না গিয়ে টিজার ছেলেটার বুকে একটা ধাক্কা দিল মানুষটা।
আচমকা এই ধাক্কার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না বখাটে ছেলেটা – ঘুরে পড়ে যেতে যেতে সামলে নেয় নিজেকে।
বাকি তিনজন নিমেষেই চটে ওঠে এবার, অপেক্ষাকৃত পেশীবহুল ছেলেটা তো হুংকারই ছাড়ে ‘শালা তোর এতবড় সাহস আমার ফ্রেন্ডের গায়ে হাত তুলস…’
অবাক হয়ে মিতু খেয়াল করল চেঁচাতে থাকা ছেলেটার গলায় নির্বিচারে ডানহাতে একটা কোপ বসিয়ে দিয়েছে এইমাত্র আসা যুবক। বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করতে করতে মাটিতে বসে পড়ল ছেলেটা। টিজার-বখাটে সামলে নিয়েছে নিজে এর মাঝে অনেকটাই – ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার যুবকের ওপর।
এক পা পিছিয়ে একটু জায়গা করে নেয় যুবক। তারপর একটা সলিড ঘুষি বসিয়ে দেয় ছেলেটার মুখে – যেই বেগে সামনে এসেছিল সে বেগ বজায় রেখে পেছন দিকে ছিটকে পড়ল মাস্তান। দাঁত নিশ্চয় নড়ে গেছে দু-চারটে!
এসবই যুবক করছে এক হাতে কী-বোর্ডের প্যাকেট ধরে! অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই একহাতে ওদের দু’জনকে সামলে নিয়েছে রহস্যময় যুবক।
বাকি দুই মাস্তান যুবকের এমন মারমুখী ভঙ্গী দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না – আগাবে নাকি পেছাবে!
অবশেষে রণে ভঙ্গ দেওয়ার সিদ্ধান্তই নেয় তারা বুদ্ধিমানের মত। যাওয়ার সময় সাথে করে বাকি দুইজনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে ভোলে না।
মিতু এবার স্লিভগোটানো শার্ট পরে থাকা ছেলেটার দিকে এক পা এগিয়ে যায়।
‘ভাইয়া, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ রিনরিনে কন্ঠে বলে ও।
একটু হাসে ছেলেটা। দেবদূতের মত চেহারার সাথে চমৎকার মানালো হাসিটা, ‘ও কিছু না, আপু। আমারও বোন আছে একজন।’
এক সাথে হাঁটে ওরা।
‘নাম কি আপনার বোনের?’ জানতে চায় মিতু।
‘ঈশিতা।’ উত্তর দেয় যুবক।
‘এই যাহ। আপনার নামটাই জানা হল না।’ হেসে ছেলেটার দিকে তাকাল মিতু। ও কি এই অদ্ভুত ছেলেটার সাথে ফ্লার্ট করছে? জানে না, তবে মিতুর খারাপ লাগছিল না এর পাশে হাঁটতে।
‘ইরফান।’ শীতল কন্ঠে উত্তর দিল এবার ছেলেটা।
পাশে দাঁড়ানো টয়োটার একটা সাধারণ চেহারার গাড়ির দিকে দেখাই এবার মিতুকে, ‘এতে করেই এসেছি আমি।’
‘যাচ্ছেন আবার কোথাও?’ জানতে চায় মেয়েটা।
‘হুম। তোমাকে সাথে নিয়ে।’ বরফ শীতল কন্ঠে বললাম ওকে। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার।
আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভাবটা আরও বাড়ল, কীবোর্ডের প্যাকেটটা মডিফাইড, একটু খুলে ওকে দেখিয়ে দেই গ্লক২৩ এর চমৎকার চেহারাটি।
‘গেট ইন দ্য কার, মিতু।’


স্নিফার্সের অফিসে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদের সাথে।
বসে বসে স্টিক নাড়াচ্ছেন ইনি।
ইনার বাল্যবন্ধুর ছোটভাই বর্তমানে বাংলাদেশের হোমমিনিস্টার। তার মেয়েকে উদ্ধারের জন্য এমন মরিয়া প্রচেষ্টা আমি শুরুতে বুঝিনি। এসব ইতিহাস অফিসের এ ও আমাকে টুকটাক বলেছে। এখন সবকিছু স্পষ্ট।
আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন চটপট, ‘ইরফান! তোমার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করতে হবে নাকি আমাকে? কোথায় ছিলে? ডেলিভারি ডেডলাইনের মাত্র দুই ঘন্টা আছে!’
চোখে চোখে রেখেছিল আমাকে স্নিফার্স। মিনহাজের সাথে দেখা করার জন্য স্নিফার্সের হেডকোয়ার্টার থেকে ভাগাটা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ ছিল। টয়লেটে পাঁচ মিনিটের জন্য ঢুকে পঞ্চাশ মিনিটেও বের হইনি যখন– কাহিনী বুঝে ফেলেছিল ওরা নিশ্চয়?
পুরো একটা দিন পর এসে হাজির হয়েছি আমি আবার।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের দিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপের হাসি হাসলাম। এমন একটা হাসি সব সময় আমার মুখে লেগেই থাকে। আশেপাশে নিম্নবুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন লোকজন থাকলে এছাড়া করার আর কিছুই থাকে না। তাছাড়া জীবনটাই তো বড় একটা বিদ্রুপ!
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন স্নিফার্স ডিরেক্টর সালাউদ্দীনও।
‘থ্যাংকস গড! ইরফান ইজ ব্যাক! ডেলিভারি দেয়ার কথা ওর, অথচ দায়িত্বজ্ঞানের অবস্থা দ্যাখো! নতুন কাউকে পাঠানোই ভালো হবে বোঢহয়।’ খুব বিরক্ত হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে।
‘টাকা রেডি?’ জানতে চাই আমি।
সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন এবার ডিফেন্স অ্যাডভাইজার মাহমুদ, ‘একশ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাবে এই ছেলে। আমি লিখে দিতে পারি!’
গতকাল যেভাবে পালিয়েছি, এরপর এদের থেকে এর বেশি কিছু আশা করছিলামও না।
‘ঘাবড়াবেন না।’ তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন সালাউদ্দীন, ‘সাথে আমার বেস্ট এজেন্ট রেজাকে পাঠাচ্ছি। ভেগে যেতে দেখলে একটা বুলেট পাঠিয়ে দেবে জায়গা মত।’
মাথা দোলাই আমি। জানতাম এমন কিছু একটাই হবে। তাছাড়া স্নিফার্সের এদিকে রেকর্ড দুর্দান্ত। অপরাধীদের কাস্টডিতে না নিয়ে মাথায় বুলেট ঢোকাতেই স্নিফার্সের জন্ম। ইন্সট্যান্ট ডিসিশন নেওয়া লাগলে আমার মুখের দিকে তাকাবে এটা সত্য, তবে সেই দৃষ্টির নিচে হাতে ধরে থাকবে একটা সাড়ে ছয়শ ডলারের জিনিসও । সিগ সাওয়ার!
‘ভাববেন না। মেয়েটার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমার নিজস্ব উদ্বেগ আছে। কাজ শেষ না করে পালানোর ইচ্ছে আমার নেই, খুঁজলে দেখবেন, রেকর্ডও নেই। চাইলে অবশ্য আটকাতে পারতেন না।’ শান্ত কন্ঠে চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়ে দেই আমি।
‘হুঁ হুঁ। শুনেছি তোমার কথা আগেও। নীতিবান ক্রিমিনাল, তাই তো!’ শ্লেষমিশ্রিত গলায় বললেন মাহমুদ।
ঘাড় ফুটালাম আমি শুধু। যা বলে বলুক।
আমার মাথাব্যথা মেয়েটাকে নিয়ে। এই দুই বুড়ো ভামের জন্য এখানে কাজ করছি না আমি।
‘সবাই কমফারেন্স রুমে চলে আসো। ডেলিভারির ব্যাপারে ফাইনাল ব্রিফ দেব।’ এগিয়ে যান সালাউদ্দীন কনফারেন্স রুমের দিকে।
*
ট্রাকটা ড্রাইভ করার দায়িত্ব আমার ঘাড়েই বর্তেছে।
চুপচাপ ড্রাইভ করছি। সাথে একটা অস্ত্র রাখার অনুমতিও দেওয়া হয়নি আমাকে।
কিডন্যাপাররা আমাদের কপালে কী রেখেছে তা জানার উপায় নেই। সবসময় খুনের দৃষ্টি চোখে নিয়ে চলেফিরে বেড়ানো এজেন্ট রেজাকে দেখে মনে হল না সে বিন্দুমাত্র বিচলিত।
তার হাতে শোভা পাচ্ছে সিগসাওয়ার। একমুহূর্তের জন্যও আমার দিক থেকে সরাচ্ছে না সেটা।
‘রাস্তার যে অবস্থা – হাতের ওটা একটু সরিয়ে রাখ হে!’ না বলে পারলাম না এবার, ‘কাঁপুনীতেই ছ্যাদা করে দেবে দেখছি।’
‘বাজে কথা রাখ! জাস্ট ড্রাইভ।’ ঘেউ ঘেউ করে উঠল রেজা।
আমার কি? ফুটো হয়ে গেলে ট্রাকের সাথে চ্যাপ্টা হবে ওই ব্যাটাও। চুপচাপ ড্রাইভ করে যাই।
সামনে একটা চৌরাস্তার মোড় – এর পর রাস্তা অনেকটাই সোজা এগিয়ে গেছে। আর কোন বাঁধা নেই ডেস্টিনেশনের।
‘শেষ বিচারের দিন তোমার আর আমার অবস্থান এতটা কাছাকাছি না থাকলেই খুশি আমি।’ একটু হেসে বেয়াদবটাকে বললাম।
আড়চোখে দেখি বাম দিকের রাস্তা থেকে তীরবেগে ছুটে আসতে থাকা মটরসাইকেলটাকে।
অসঙ্গতিটা ধরা পড়ল রেজার চোখেও – মাথা একটু এগিয়ে মটরসাইকেলটার দিকে দেখল। চোখজোড়া কুঁচকে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে হিস হিস করে উঠল তারপর, ‘ইউ স্নেইক!’
আমাকে এড়িয়ে দুটো গুলি পাঠিয়ে দিল মটরসাইকেল আরোহীর দিকে।
এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে আরোহী – মুখে মুখোশ। তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে আমাদের সমান্তরালে চলে এল, তবে ইচ্ছে করেই পিছিয়ে আছে। রেজাকে মনমত ফায়ারিং অ্যাংগেল দিতে চায় না!
এদিকে জানালা দিয়ে শরীর একটু বের করল রেজা, জুতমত একটা শট খুঁজছে।
সুযোগটা নেই আমি, ওপাশের দরজাটা ড্রাইভারস সিট থেকে আনলক করলাম, তারপর চমৎকার এক লাথিতে ট্রাকের দরজাটাসহই রেজার পাছায় মাঝারি মানের এক গুঁতো দিতে চল্লিশ কিলোমিটার বেগে ছুটতে থাকা ট্রাক থেকে বেকায়দাভাবে রাস্তায় পড়ে গেল স্নিফার্সের গর্বিত সদস্য।
আমার পাশে চলে এসেছে মটরসাইকেল। দারুণভাবে একটা থাম্বস আপ সাইন দেখিয়ে পরের গলিতে ঢুকে যায় মিনহাজ। ডাইভার্সনটা চমৎকার ভাবেই দিয়েছে।
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম বেশ দূরে অপেক্ষমান তিনটি গাড়ি। কোর্স ধরে রাখলে একেবারে ওদের গায়েই গিয়ে পড়ার কথা আমাদের।
অ্যামবুশ!
আমিও ট্রাক ঢোকালাম মিনহাজের পিছু পিছু। অ্যামবুশ করে বসে থাকা মানুষগুলোকে হতাশ করতে পেরে আমার একটুও খারাপ লাগল না।
দ্রুত ইঞ্জিন স্টার্ট দিচ্ছে হয়ত ওরা। কিন্তু আমাকে ধরতে পারবে না– তার আগেই গায়েব হয়ে যেতে হবে আমাকে। হেডলাইট আর টেইললাইট নিভিয়ে ফেললাম। এদিক থেকে ঘুরে আরেক বড় রাস্তায় উঠব।
তারপর সোজা সেইফ হাউজ। পিঠে একশ কোটি টাকা নিয়ে ঘুরতে পারলে আর কিসের সমস্যা?
চল্লিশ মিনিট পর ট্রাকটাকে জায়গা মত রেখে মিনহাজের বাইকে চেপে বসলাম।
এবার হাইডআউট বরাবর একটা শর্ট রাইড!
*
আমাদের হাসাহাসি করে ঢুকতে দেখে খুব বিরক্ত মুখে তাকাল মেয়েটি। অ্যানিমেশন মুভি দেখার মাঝে এমন বাঁধা ওর অপছন্দ। ওকে জ্বালাতন না করে পাশের রুমে গিয়ে ঢুকলাম আমরা।
‘পায়ের কি অবস্থা, দোস্ত?’ জানতে চায় মিনহাজ।
‘ঠিক আছি।’ আশ্বস্ত করি ওকে।
আনরেজিস্টার্ড সিমটা ঢুকিয়ে মোবাইলটা অন করি।
একবার মাত্র রিং হতেই খপ করে ধরে ফেললেন ডিফেন্স অ্যাডভাইজার মাহমুদ, ‘হ্যালো?’
‘আমি ইরফান বলছি।’ ঠান্ডা গলায় বলি আমি।
‘ইউ বাস্টার্ড! একশ কোটি টাকা মেরে দিলি, শুয়োরের বাচ্চা? মেয়েটাকে এবার ওরা মেরে ফেলবে সন্দেহ নেই! তোকে আমি ছাড়ব না – পৃথিবীর যেইপ্রান্তে থাকিস না কেন খুঁজে বের করব!’
‘বাংলা ব্যকরণ পড়ানোর জন্য আপনাকে ফোন দেইনি। রাখলাম তাহলে।’ বিরক্ত হয়ে বলি আমি।
হাহাকার করে ওঠেন মাহমুদ এবার, ‘নো নীড। ফোন তো দিয়েছ কিছু বলতেই – সেটা কি?’
‘এখন না। আপনি স্নিফার্সের গর্ত থেকে বের হন আগে। তারপর বাইরের নাম্বার থেকে ফোন দিন। স্নিফার্সকে আমি বিশ্বাস করি না। ট্রেস করার পর্যাপ্ত সময় আমি দেব না। কাজেই দ্রুত কথা শেষ করবেন ওই ফোনকলে।’
জানি আমাদের প্রতিটা কথা কান পেতে শুনছে স্নিফার্স হেডকোয়ার্টারে থাকা প্রতিটা মানুষ।
আমার কথার তাৎপর্য স্পষ্ট বুঝতে পারলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ।
‘ওকে। বের হচ্ছি।’
লাইনটা কেটে দিলাম আমি।
মাহমুদের দিকে এগিয়ে দিলাম একটা ছোট পিনের মত জিনিস।
একটা মাইক্রোফোন। এটা কলারে গুঁজেই সকালে ঢুকেছিলাম স্নিফার্সের হেডকোয়ার্টারে। স্নিফার্সের প্ল্যান আর কিডন্যাপারদের ডেলিভারি লোকেশন জানতে পেরে বাকি প্ল্যানটা করা মিনহাজের জন্য ছিল ছেলে খেলা।
মাহমুদ ফোন দেবেন যে কোন সময়। কাজেই ফোনে আবার সিম বদল করলাম। আমার সিম ঢুকিয়ে ফোন অন করামাত্র একটা নতুন ইনবক্স। একটি ইনকামিং মেসেজ।
ঈশিতার মেসেজটা পড়ে ভ্রু কুঁচকে ওঠে আমার। চেহারার পরিবর্তনটা খেয়াল করল মিনহাজ।
আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে পড়ে ওর চেহারার অবস্থাও একই রকম হয়ে যায়।
‘ঈশিতা রাবেকের কাছে ফিরে যাচ্ছে। কিভাবে সম্ভব, ম্যান?’ কাকে প্রশ্নটা করে মিনহাজ – সম্ভবত সে নিজেও জানে না।
‘সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ও।’ মাথা নীচু করে বলি আমি।
‘রাবেকের মেয়ে তো আফটার অল।’ মন খারাপ করে বলল মিনহাজ।
প্রতিবাদ করতে গিয়েও করি না। ঈশিতা হয়ত রাবেকের আপন মেয়ে – কিন্তু স্বভাবচরিত্র মোটেও বাবার মত পায়নি মেয়েটা। একেবারে নিজ হাতে গড়েছি মেয়েটাকে – জানি কেমন মেয়ে ও। তবুও বাবার কাছে ফিরে যেতে চাওয়ার কারণ আমি বুঝে উঠতে পারি না। চাই না হয়ত! রাবেকের কাছে যাওয়ার অধিকার তার আছে। আমিও এমন কোন আহামরি বড়ভাই ছিলাম না গত দশ বছর ধরে। একা একাই বড় হতে হয়েছে তাকে। ওর পরিবারের কেউ-ই ওর পাশে ছিল না সব সময়। এমন সম্পর্কই যদি ওর কাছে স্বাভাবিক পরিবারের সংজ্ঞা হয়, তবে বাবা হিসেবে রাবেকই বা এমন কী অন্যায় করেছে?
তবে আমার দুশ্চিন্তা হল, মেয়েটা নিরাপদে থাকবে তো?
ইনকামিং কলের টোন শুনে চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলাম। আননোন নাম্বার।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ।


মিতু হাঁটুতে মুখ আটকে বসে আছে। একটু আগে ধরে এনে সেফহাউজে ভরেছি মেয়েটাকে। বিছানার সাথে হাত আটকে রেখেছি একটা হ্যান্ডকাফের সাহায্যে। আমার শিকার প্রতিটা মানুষকেই এই স্টেজ পার হতে হয়। আপনজনেরা যতদিনে টাকা দিতে রাজি না হয় আরকি।
গ্লকটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুন্যে ভাসিয়ে ক্যাচ ধরছি মাঝে মাঝে। সেদিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার দুই চোখের তারায় ফুটে ওঠে স্পষ্ট ভীতি। আমলেই নেই না আমি। মিতুর মায়ের নাম্বারে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। জানি ওতেই কাজ হবে।
মেয়েটার ভবিষ্যৎ তুলে দিয়েছি তার ভাইয়ের হাতে। হয় লুফে নাও – নাহলে মারা খাও।
ছেলেটা অলস, নয় অন্য কিছু নিয়ে চরম ব্যস্ত ছিল। রাত দুইটায় ফোন দিল গাধাটা।
অলস ভঙ্গীমাতে ফোন ধরেছিলাম আমি, ‘হ্যালো।’
ওপাশ থেকে একটা রাগত কন্ঠ শোনা গেল, ‘হালার ভাই – আমার নাম হুনসস? দুই দিনের চুটকা পোলা হয়ে আমার বইনের দিকে হাত বাড়াস ক্যমনে!’
একটু হেসে উত্তর দেই আমি, ‘আপনার নাম শুনেছি, ফিরোজ ভাই। এখন আপনি আমার নাম শুনবেন। মিতুর সাথে কথা বলতে চান?’
ওপাশ থেকে ফিরোজ শুধু একটা শব্দ দিয়েই বাক্য সম্পূর্ণ করল, ‘… [লেখার অযোগ্য] ’
‘আহা! কথা বলার ইচ্ছে না থাকলে এতক্ষণ কেন বাঁচিয়ে রাখলাম ছুঁড়িকে?’ আফসোস করে বলি আমি।
নরম হয়ে এল এবার ফিরোজ, ‘ওর কোন ক্ষতি করলে পুইতা লামু তোরে হারামজাদা! কি চাস বল।’
‘রঞ্জন মিত্রের ফাইলটা। যেটা পাঁচ বছর ধরে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিস।’ আপনি থেকে ধাম করে তুইয়ে ডিমোশন দিয়ে দিলাম ফিরোজকে।
থমকে গেল ফিরোজ। এই ব্যাপারে জানলাম কি করে ভাবছে হয়ত!
রঞ্জন মিত্র নামে এক লোকের বাসাতে ডাকাতি করেছিল ফিরোজ। শুধু সোনাদানা নয়, লোকটা গুরুত্বপূর্ণ এমন এক কথা চাউর ছিল এলাকায়। কাজেই বুদ্ধিমান ফিরোজ তার ফাইল কেবিনেটের সব ফাইলও সাথে করে নিয়ে আসে। পরে অবশ্য অধিকাংশই চুলোয় ফেলে দিয়েছে। শুধু একটা ফাইলের ভেতর অদ্ভুত সব স্কেচ ছিল, যেন খুব গোপনীয় নথি! ওটা সে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল মূল্যবান কোন তথ্য ভেবে। আজ পর্যন্ত ওটার কোন মূল্য আছে বলে আমার জানা হয়নি। বিশেষত্ব হচ্ছে, আমি ফিরোজের একান্ত আড্ডায় এই ফাইল আর তার ব্যাপারে অবসেশনের কথা জানি। এবং এটাও জানি, ওটা দিতে হলে হারামজাদাকে গর্ত থেকে বের হতে হবে। আনিকা তাবাসসুম কোথায় আছে তা আমরা জানি না। তবে ওখানে ফিরোজ অবশ্যই আছে।
শালাকে গর্ত থেকে বের করাটাই এখন প্রথম কাজ!
‘ওটার দাম আছে তাইলে আসলেই!’ বিস্ময়ে ভরা কন্ঠে বলল ফিরোজ।
‘না! মাগনা তো! তাই তো তোর বোনকে উঠিয়ে আনা লাগে আমার!’ বিরক্তির স্বরে বলি আমি।
‘ভাই ওটা লইয়া যান। মাগার বোনটারে ছাইড়া দ্যান!’ অনুনয় করে ফিরোজ।
‘ঠিক কাল সকাল দশটায় আসবি তাইলে যেখানে বলব। তুই আসবি। একা। আর কেউ না।’ সোজা সাপ্টা বলে দেই আমি।
‘ভাই, আটটায় আসলে হয় না?’ ফিরোজ একেবারে গলে গলে পড়ছে এখন।
একটু হাসি আমি মনে মনে। এই ব্যাটার হেফাজতেই আছে আনিকা রহমান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেয়ে। সেজন্যই এত টেনশন সকাল দশটায় আসতে বলায় এর এত দুশ্চিন্তা।
দুপুর একটায় টাকা ডেলিভারি দেওয়ার কথা – দশটায় এদিকে ছুটতে গিয়ে দেরী হয়ে যাওয়ার ভয়ে আছে!
‘না, দশটায় বলেছি। দশটাতেই। বোনকে আবার দেখতে চাস জীবনে?’ শীতল কন্ঠে বলি আমি।
‘আচ্ছা ভাই। কোনদিকে আসব বলেন।’ ফিরোজ আবার নরম হয়। মানে হতেই হয় তাকে।
যাত্রাবাড়ির একটা ঠিকানা বলতেই আবার হাউ মাউ করে ওঠে মানুষটা।
‘ভাই ওদিকে না। সবই তো মানলাম। ঢাকার অন্য সাইডে আইতে বলেন। আইয়া পড়ুম।’
পিতলা ঘুঘু, অ্যাঁ? আনিকা মেয়েটাকে ওপাশে রাখে নি তাহলে এরা।
‘মোহাম্মদপুর?’ জানতে চাই।
একটু গাঁইগুঁই করে এবার রাজি হল বেয়াদবটা।
‘মিতুর সাথে কথা বলায়ে দেবেন না?’ আবেদন জানায় এবার ও।
ফোনয়া মিতুর খোলা হাতের দিকে এগিয়ে দেই আমি।
কাজ অর্ধেক শেষ।
বাকিটা শেষ করতে পারলে কাল সাড়ে বারোটার মাঝে আনিকা রহমানকে উদ্ধার করে ফেলা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে!
*
সিগারেট টানছে ছোকড়া। তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। এর সাথে সাথেই ঢুকে পড়তে হবে দোতলা বাড়িটায়। একটু আগে ফিরোজকে ফলো করে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। ব্যাটা কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেছে ওখানে। তারপরই বের হয়ে এসেছে এই অল্পবয়েসী ছোকড়া।
মিনহাজকে পাঠিয়েছিলাম ফাইলটা নিতে।
একটু ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছে – পাঁচ বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছে। ফিরোজ দূর থেকে দেখেই আমাকে চিনে ফেলতে পারে, তাই সে ঝুঁকিতে যাইনি।
সিগারেট শেষ হয়েছে ছেলেটার। আবার দোতলা বাসাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও।
তির্যক একটা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করি আমিও। একই সাথে ফ্রন্ট গেটে পৌঁছলাম দুইজনে। ছেলেটা আমাকে এতটা কাছে আসতে দেখে একটু বিস্মিত হতে যাচ্ছিল কিন্তু ওকে শতভাগ বিস্মিত করে কোমরে ঠেকালাম গ্লকের শক্ত নলটা।
চোখ কপালে উঠে যায় ছোকড়ার।
‘কোনরকম শব্দ নয়। ভেতরে নিয়ে চলো আমাকে। নাহলে একাধিক গর্ত করে দেব তোমার শরীরে। বোঝা গেল?’
কি বুঝল কে জানে। কিন্তু আমাকে ভেতরে এনে ফ্রন্ট গেটটা লাগিয়ে দেয় ঠিকমত।
গার্ডরুমটা খালি। এখানে গার্ড রেখে সাক্ষীর সংখ্যা বাড়াতে চাইবে না অবশ্যই ওরা।
ত্রিশফিট দূরে দাঁড়িয়ে দোতলা বাড়িটা। ঢাকায় এমন বাড়ির সংখ্যা খুবই কম। সবাই একেবারে রোডের সাথে গা লাগিয়ে ধপাধপ বাড়ি তুলে ফেলতে চায়। সামনে লন রাখবে এমন রুচি অধিকাংশের নেই।
হেলেদুলে এগিয়ে গেলাম বাড়িটার দিকে। ভেতরে চমৎকার একটা ডুপ্লেক্স প্ল্যানিং আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দারুণ এক ডিজাইনের ডুপ্লেক্সে রাখা হয়েছে দেখা যায় হোমমিনিস্টারের মেয়েকে! মানীর মান রাখার ব্যাপার আছে হয়তো।
তবে ভালোমত দেখার সুযোগ পাওয়া গেল না।
বিশাল ড্রইং রুমটাতে আরাম করে চুরুট টানতে থাকা এক তরুণের চোখে পড়ে যাই আমরা। চৌকস অপরাধী। বিন্দুমাত্র সময়ক্ষেপণ না করে হাত বাড়াল সামনের টী-টেবিলে রাখা পিস্তলটার দিকে!
জিনিসটা একনজর দেখার সুযোগ পেলাম। হাহাকার উঠল আমার বুকের ভেতর। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাওয়ার মত অস্ত্র একটা। গ্র্যান্ডপাওয়ার কে১১০।
প্রেমে না পড়ে বরং ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমার জিম্মি ছোকড়ার পেছনে একটা লাথি কষে সামনে থেকে সরিয়ে ফেলার পর পর ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবচেয়ে কাছে থাকা পিলারটার আড়ালে।
মুহুর্মূহু গর্জে উঠল তরুণের হাতের অস্ত্র।
চোখ বন্ধ করলাম আমি।
গুণছি।


গুণে গুণে এক ডজন গুলি করল তরুণ কিডন্যাপার।
ওদিকে ছাড়া পাওয়া মাত্র সামনের দিকে ছুটেছে আমার হোস্টেজ। সন্দেহ নেই – কয়েক মুহূর্ত পরই আরেকটা অস্ত্র বাগিয়ে আমার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করবে অকৃতজ্ঞটা!
গ্র্যান্ডপাওয়ারধারীকে খেলাতে হবে। তাকে বেশিক্ষণ সময় দিলে নিজের মাথা উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই ষোলআনা।
হাত বাড়িয়ে বাম দিকে দেওয়াল থেকে পেইন্টিংটা নামিয়ে ফেললাম, অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ছুঁড়ে দিলাম ওই ব্যাটার অবস্থান বরাবর।
ডাবল রো ম্যাগাজিন লাগিয়ে বুলেটের ব্যবসায়ীদের পকেট ভর্তি করছ বটে। এবার দেখা যাবে কিভাবে সামলাও!
উড়ন্ত পেইন্টিংটার দিকে দ্রুম দ্রুম করে তিনটি বুলেট খরচ করল ছোকড়া – সন্তুষ্ট হলাম।
ডাবল রো ম্যাগাজিন থাকলে গ্র্যান্ডপাওয়ার কে১১০ –তে সতের রাউন্ড করে বুলেট রাখা সম্ভব। আর মাত্র দুটো বুলেট থাকার কথা এখন প্রতিপক্ষের চেম্বারে।
এক ডিগবাজি খেয়ে বেরিয়ে এলাম এবার, স্বভাবতই আচমকা উদয় হওয়া চলন্ত টার্গেটের দিকে প্রথম বুলেটটা মিস করল তরুণ। পরবর্তী ডিগবাজি খেয়ে আরও ডানে সরে যাচ্ছি – অন্য পিলারটার দিকে।
তাড়াহুড়োয় এই শটটাও মিস করল ছেলেটা।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এক গুলিতে উড়িয়ে দিলাম ব্যাটাকে। ঠিক তখুনি দেখা গেল দোতলা থেকে সাব মেশিনগান নিয়ে হাজির হয়ে গেছে আরেকজন। তার পিছেই আছে একটু আগের হোস্টেজ ছোকড়া।
আমার ধারণা ভুল নয়। একটা পিস্তল বাগিয়েছে কোত্থেকে জানি!
বৃষ্টিতে ভেজা আমার প্রিয় একটা কাজ। তবে বুলেটবৃষ্টি হলে আলাদা কথা!
চট করে পিলারের আড়ালে সরে এলাম আবারও।
গুলিতে বিরাম নেই – পিলার উড়িয়ে দিতে চায় যেন ওরা!
তবে সাবমেশিনগানের শব্দ থেমে যেতে বেশি সময় লাগল না। রিলোড করতে হবে এখন তাকে। কাভারে নিশ্চয় হোস্টেজ ছোকড়া?
একজনকে সামলাতে পারার আত্মবিশ্বাস বুকে নিয়ে পিলার থেকে সোফার দিকে ডাইভ দেই আমি – বাতাসে উড়ন্ত অবস্থায় হোস্টেজ ছেলেটার বুকের মাঝে গুলিটা পাঠিয়ে দিতে পেরে আত্মতৃপ্তি অনুভব করলাম।
একই সাথে বুঝে ফেলি – ভুল করে ফেলেছি!
ওপরে দুই নয় – তিনজন।
স্বয়ং ফিরোজ উপস্থিত হয়েছে সেখানে। মসবার্গ শটগানটা থেকে একবার মাত্র ফায়ার করে ফিরোজ। সকালের বোনকে ছাড়িয়ে আনার পর থেকে মেজাজ নিশ্চয় খিঁচড়ে আছে ওর!
পায়ের কাছে টান অনুভব করলাম।
দূরত্বটা যথেষ্টরও বেশি – তাও শেলগুলোর কোন একটা অংশ আমার শরীরে লেগেছে। দড়াম করে পড়ে গেলাম সোফার আড়ালে।
ওখান থেকেই একটু শরীর বের করে সাবমেশিনগানধারীর খুলি উড়িয়ে দেই আরেক গুলির সাহায্যে। গর্দভটা এতই মনোযোগ দিয়ে রিলোড করেছিল আমার অবস্থান পাল্টে যাওয়াটা খেয়ালই করেনি। পিলারের দিকে তাকিয়ে ছিল সরাসরি।
পুরো বিল্ডিংয়ে বোধহয় শুধু আমি আর ফিরোজ।
চারপাশে শুনশান নীরবতা।
মাটির কাছে মাথা পেতে এই মৃত্যুফাঁদ থেকে বের হওয়ার চিন্তায় ডুবে গেলাম। শরীর বের করলে শটগান দিয়ে ছ্যাঁদা করে দেবে নির্ঘাৎ! মিনিট দুই পর নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে ফিরোজ।
‘মেয়েটার ক্ষতি না চাইলে ভালোমানুষের মত বাইর হইয়া আহেন।’ গম গম করে বলে ও।
এরপরে আর কি করার থাকে?
আস্তে করে মাথা বের করে উঠে দাঁড়াই আমি।
ফিরোজের ডানহাতে একটা হ্যান্ডগান। বাম হাতে শক্ত করে ধরা আনিকার হাত।
ছবিতে দেখা মেয়েটার সাথে অনেক ফারাক এখন দেখা মেয়ের।
ভয়ে শুকিয়ে গেছে মুখ – সুন্দর চোখ দুটোর নিচে কালো ছোপ। কান্নাতে কাজল ধুয়ে যাওয়ার ছাপ।
আমার দিকে নিস্কম্প হাতে ধরে থাকে ফিরোজ অস্ত্রটা। রাগে ওর হাত তির তির করে কাঁপছে।
সহকর্মী তিনজনকে যমের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি – কাজেই রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে তার মাঝেও স্বাভাবিক সতর্কতা ভোলে না ফিরোজ।
‘হাতের পিস্তলটা ফালান। তারপর লাথি মাইরা দূরে সরান।’
কথা মত কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। কাজেই অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। এই পর্যায়ে এসে নিজের বা আনিকার মাথা উড়ে যাক – চাই না।
‘যা জিগামু জবাব দিবি।’ এ-ও সরাসরি আপনি থেকে তুইয়ে ডিমোশন দেয় আমাকে, ‘নাইলে হাঁটুতে গুলি কইরা উড়ায় দিমু বাটি।’
‘বাটি ওড়ানোর সখ আমার নেই। প্রশ্ন করতে পারো।’ কিছুটা সময় আদায় করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। সুযোগ আসতেও পারে!
‘কয়জন আছে তোর লগে?’ রক্তচক্ষু মেলে জানতে চায় ফিরোজ।
‘পাঁচজন।’ বিন্দুমাত্র দেরী না করে উত্তর দেই আমি।
‘মিথ্যা কইলি। হেতেরা কই তাইলে? একাই আইছস তুই।’ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় ফিরোজ।
‘উঁহু।’ একটু হাসি আমি। অস্ত্রের মুখে হাসার চেয়ে কষ্টের কাজ আছে কি? ‘স্নিফার্সের নাম শুনেছ? ওদের আরও চারজনকে লোকেশন জানানোর পরই ঢুকেছি। এনিটাইম পুরো ফোর্সটাই চলে আসবে এখানে।’
বলতে গিয়ে মনে পড়ে স্নিফার্সের টয়লেট থেকে পালানোর অভিজ্ঞতা। ব্যাটারা পেলে আমাকে কাঁচাই খেয়ে ফেলবে। তবে সেটা তো আর ফিরোজের জানার কথা নয়।
‘তাইলে হাতে সময় নাই একদম-’ কথাটা শেষ করেই গুলি করতে চেয়েছিল ফিরোজ। গলার সুরেই বুঝি আমি এবং ঝাঁপ দেই ডানদিক বরাবর। একই সাথে অবাক হয়ে লক্ষ্য করি ফিরোজকে কামড়ে দিয়েছে আনিকা! হাত কামড়ে একরকম ঝুলে আছে মেয়েটা।
বুলেটটা টার্গেটকে পায় না – ছাতের কোথাও লেগে পিছলে নেমে এসে আমার কানের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে যায় ওটা।
আবারও বামদিকে ঝাঁপিয়ে নিজের পিস্তলটা তুলে নিয়ে চিন্তাভাবনা ছাড়াই ফিরোজের বাম হাঁটুতে গুলি করি। পর পর দুইবার।
অবিশ্বাসের দৃষ্টি চোখে নিয়ে বসে পড়ছে ফিরোজ – হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় – ভারসাম্য হারিয়ে দড়াম করে পড়ে যায় মাটিতে। কে কার বাটি ওড়ালো তা তো দেখাই গেল!
ওপর থেকে মেয়েটা দৌড়ে নেমে আসছে। আমার কাছে এসে শুধু দুর্বল গলাতে জানতে চায়, ‘বাবা পাঠিয়েছে আপনাকে?’
মৃদু হাসি আমি, ‘না। থাকুক সেসব কথা। তোমার দরকার এখন ফ্রেশ একটা অ্যানিমেশন মুভি। ‘ফ্রোজেন’ দেখেছ?’
*
মাথা নিচে পা ওপরে দিয়ে ঝুলে আছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ।
মানে, তাকে ওভাবে ঝোলানো হয়েছে আর কি।
চকচকে একটা হাসি উপহার দেই উনাকে, ‘কেমন বোধ করছেন?’
‘বিট্রে করলে, ইরফান। এর ফল ভালো হবে না।’ হিস হিস করে বলেন বন্দী হিরো!
‘কোথায়? ফোনে বললাম অর্ধেক শেয়ার আপনি পাবেন আর লাফাতে লাফাতে চলে এলেন? বিনিময় করার মত কি আছে আপনার?’
‘স্নিফার্সকে তোমার টেইল থেকে সরিয়ে দিতাম। এটাই ডীল ছিল।’ ঝুলতে ঝুলতেই বলেন তিনি।
হেহ – জাতীয় একটা শব্দ করলাম আমি।
‘স্নিফার্স আমার জন্য মাথাব্যাথা নয় মি. মাহমুদ। আর বিট্রের কথা বলবেন না। হোমমিনিস্টারকে নিশ্চয় ভুলে যান নি?’
দরদর করে ঘামা শুরু করলেন মাহমুদ এবার।
‘আনিকার ব্যাপারে তথ্য এনে দিয়ে কিডন্যাপারদের কাজটা সহজ করে দিয়েছিলেন। তারওপর প্রশাসনের ভেতরের তথ্য দিয়েছেন তাদের, কিডন্যাপিং তো নয়, হলো কিছু জলবত তরলং ক্লকওয়ার্ক। আর ফিরোজের মতো একটা লোক মুফতে পঞ্চাশ কোটি পাওয়ার একটা সুযোগ পেলে নেবে না সেটা? আপনার পঞ্চাশ কোটি তো ফাউ। উদ্দেশ্য তো আর টাকা ছিল না আপনার।’
‘কোথা থেকে এসব ভিত্তিহীন কথা বলছ -’ দুর্বল কন্ঠে প্রতিবাদের চেষ্টা করেন মাহমুদ।
হাত নাড়ালাম কাঁকড়া তাড়াবার মত করে, ‘প্রাণে বেঁচে থাকবেন না তো আপনি আর বেশিক্ষণ। কাজেই স্বীকার করা বা না করায় যায় আসে না কিছু।’
‘রায়হান রহমানের মেয়ে কিডন্যাপড হলে আমাকে খোঁজা হবে – খুঁজবে হোমমিনিস্টারের স্নিফার্স। এটা আপনি জানতেন। কিছু ঘটানোর আগ পর্যন্ত আমার ব্যাপারে নিজে থেকে নাড়াচাড়া করে পরিচয় ফাঁস করে দিতে চান নি, তাই একটা উপলক্ষ্য বের করলেন। কিডন্যাপ করলেন হোমমিনিস্টারের মেয়েকে!’ বলেই যাচ্ছি আমি, ‘এরপর আমাকে খুঁজে বের করল স্নিফার্স, সরকারের পূর্ণ রিসোর্স কাজে লাগানোর সুযোগ পেলেন আপনি। এদিকে হোম-মিনিস্টারের সাথে পুরোনো বন্ধুত্ব, সহানুভূতি দেখিয়ে অফিশিয়ালি, আনঅফিশিয়ালি এই কিডন্যাপ কেসে একেবারে জড়িয়ে রাখলেন নিজেকে । স্নিফার্সের মাঝে নাক ডুবিয়ে এক সাথে কাজ করার নাম করে আমাকে কাছাকাছি দেখে যাচ্ছিলেন। আমার প্রতি এত প্রেম কবে থেকে জন্মালো আপনার, বলুন তো?’
নির্বাক ঝোলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।
‘পরিকল্পিত ভাবে কিডন্যাপারদের হাতে আমাকে মেরে ফেলে পথের কাঁটা দূর করে ফেলতে চেয়েছিলেন। ডেলিভারির শর্ত এমনভাবে জুড়েছেন যাতে আমাকেই নিতে হয় টাকাটা। আর – ওটা তো ইস্যু না। মাঝপথে অ্যামবুশ পেতে রেখেছিলেন আমার খুনটা নিশ্চিত করতে। অথচ দেখুন, যত যা-ই হোক, আপনার নাম জড়াচ্ছে না। অজ্ঞাতনামা কিডন্যাপারদের কাজ। কি চমৎকার প্ল্যান আপনার। ধরেন মাছ – না ছোঁন পানি!’
এবার হুংকার দেন মাহমুদ, ‘বেশি বাজে বকছ ছোকড়া! তোমাকে মেরে ফেলে আমার দুই পয়সার লাভ থাকার কথা না। এটুকু বোঝা তো উচিত, এত বোঝ যখন। কেন করব আমি এত ঝামেলা – শুধু তোমার মত একজন প্রাক্তন কিডন্যাপারের জন্য?’
হেসে ফেলি আমি এবার আসলেই, ‘নির্বোধ পেয়েছেন আমাকে, স্যার? কিডন্যাপিং প্লেস – ফারিহার কিডন্যাপিং প্লেস। মুক্তিপণের টাকা চেয়েছেন– বন্যার মুক্তিপণের মত। ফিরোজ গ্রুপকে পুষছেন ঠিক ছয়মাস আগ থেকে ঠিক যখন শেষ হয়েছিল হেডফাইভস নিয়ে আমাদের ঝামেলা। ক্লুটা আপনি ঠিকই দিতে চেয়েছিলেন – যাতে বুঝতে পারি আমি শেষ মুহূর্তে – কে আমার জীবন ধ্বংস করল। কিন্তু নিজেই ধরা খেয়ে যাবেন – সেটা ভাবেননি।’
একটু দম নেই আমি, ‘কেন করবেন আপনি এত ঝামেলা? কারণ মি. মাহমুদ। ইউ আর দ্য ফিফথ হেডফাইভ।’

পরিশিষ্ট
কয়েকটা ইঞ্জেকশন পুশ করে তব্দা খাইয়ে রেখে এসেছি শেষ হেডফাইভকে।
আর্মি পার্সোনেল – তারওপর বেশ উঁচু তাঁর পদ। এ কারণেই ডন রাবেকের পঞ্চম হেডফাইভের নাম আমরা হাজার ঘেঁটেও বের করতে পারিনি এতদিন। আমরা ধরে নিয়েছিলাম পঞ্চম হেডফাইভ রাবেক স্বয়ং।
শেষ হেডফাইভকে হাতের মুঠোয় জীবিত পেয়ে রাবেকের সাথে শত্রুতার ইতি টানার একটা উপায় দেখতে পাচ্ছি প্রথমবারের মত। যেমন বলে থাকে, টানেলের শেষপ্রান্তে আলোর ছটা!
বারবারের ব্যর্থতা আমাদের হতাশ করেছিল, গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মনোবল। আংশিক বিজয়ের পরও তিক্ত ভাবটা যাচ্ছে না অবশ্য, ঈশিতা ডন রাবেকের সাথে থেকে কাজ করছে, মনে পড়তেই অসহ্য লাগে সব কিছু।
মেয়েটা কেমন আছে কে জানে! মনে হচ্ছে একযুগ ধরে দেখা হয় না আমাদের! অথচ ঈশিতার সেই মেসেজের পর পার হয়েছে মাত্র সাতদিন। মেয়েটার বিপদাশঙ্কা বার বার ছেয়ে ফেলছে আমার মন। জানি, আন্ডারওয়ার্ল্ড কেমন অনিশ্চিত একটি জগত। ও জগতে আমি ছিলাম একসময়। আর একমাত্র ফ্যামিলি বলতে এই বোনটাই ছিল আমার কাছে, নিজেকে বড় অসহায় মনে হয় আমার।
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক চিড়ে।
আকাশের দিকে তাকাই আমি, ‘নিরাপদে থেক, ঈশিতা।’

চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *