গোয়েন্দাগিরি
বিরক্তির সাথে চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।
“কখনও কি ভেবেছ বন্ধুর চেয়ে একটুখানি –”
ব্যাস! শেষ।
আর কিছু নেই লেখা।
বন্ধুর চেয়ে একটুখানি কি? বেশি নাকি কম?
ভ্রু কুঁচকে ও দু’সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে আরও। তারপর পাশে বসা জুয়েলের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়।
‘গুতাস ক্যারে?’ মোটাসোটা শরীরটা আরেকটু দুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে জুয়েল।
‘আরে কান্ডটা দ্যাখ!’ ওর হাতে গুঁজে দেয় কাগজের টুকরোটা।
‘কোথায় পাইলি?’
‘ব্যাগের মধ্যে ঢুকানো ছিল। কলম রাখি যে পকেটে।’
‘কে পাঠাইছে লেখা নাই তো।’
‘তুই বের করতে পারবি না?’
‘খাড়া খাড়া জিনিসটা বুইঝা লই।’ মোটা শরীরটা একটু ঘুরিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে জুয়েল।
বেশ কিছুক্ষণ কুঁতকুঁতে চোখ মেলে তাকিয়ে মিনিট পাঁচেক দেখে মাথা নাড়ে। আগ্রহের সাথে এই পর্যবেক্ষণ দেখছিল তাহমিদ। আর ধৈর্য রাখতে পারে না ও।
‘কিছু পেলি?’
‘হুম!’ মাথা তুলে জুয়েল।’ কিন্তু আগে বলুম না। তুইও দেখ। তারপর একলগে।’
তাহমিদও ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে আটকে দেখতে যাবে – এই সময় ক্লাসে ঢুকে পড়লেন দেবনাথ স্যার। ইনি ইংরেজী পড়ান। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়ে আবার বসে পড়ে।
কলেজে আধ-ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকের পর এই প্রথম ক্লাস। লাঞ্চ ব্রেকের আধ-ঘন্টার মাঝেই কেউ চালিয়ে দিয়েছে এই চিরকুট। দেবনাথ স্যার এখন অ্যাটেনডেন্স নেবেন।
নিজের রোলটা পার হয় যেতেই আবারও ঝুঁকে পড়ে তাহমিদ কাগজটার ওপর। হাতে আতশী কাচ। পাশের সারি থেকে ওদের ভাব ভঙ্গী দেখে মুচকি হাসে প্রিয়াংকা আর কেয়া।
‘উমম…’ মাথা তোলে এবার তাহমিদ।’ যদিও তুই-ই ক্লাসের একমাত্র গোয়েন্দা। তবুও আমিও চেষ্টা করে দেখি… ম্যাটাডোর কলমে লেখা, উমম… কাগজটা কাটা হয়েছে হাতে ছিড়ে… উহু, থুতুতে ভিজিয়ে, আর্দ্র কাগজের কোণা শক্ত হওয়ার লক্ষণ থেকে যায়… আর এইটা ডাক্তারী প্যাড থেকে ছেঁড়া একটা কাগজ। অ্যাম আই রাইট?’
‘সাবাশ!’ গোবদা হাত দিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দেয় জুয়েল।’ প্রায় সবকিছুই ধইরা ফেললি! আরেকটা জিনিস বাকি – লেখাটা একটা মাইয়ার। সম্ভবতঃ – হাতের লেখা পাল্টাইছে যে লেখছে। মানে তোর পরিচিত ওই মাইয়া। আর না পাল্টাইলে অন্য কাওরে দিয়ে লেখাইছে।’
জুয়েল কলেজে গোয়েন্দা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
একমাস আগে চুরি হয়ে যাওয়া মকসুদের মোবাইলটা বের করতে জুয়েলের লেগেছিল সাড়ে তেতাল্লিশ ঘন্টা। আর আড়াই দিন আগে বোর্ডে লেখা অশ্লীল বাক্যের রচয়িতাকে ওর বের করতে লেগেছিল আড়াই মিনিট। কিন্তু বেচারার ওজন একশ দশ কেজি। কলেজ শুরুর প্রথম কয়েক সপ্তাহে ওর নিকনেইম ‘ভোটকা’ হয়ে গেছিল, তবে কেসগুলো সমাধানের পর থেকে সবাই ওকে সমীহের চোখে দেখা শুরু করেছে। এই পর্যন্ত কলেজের সাতটি রহস্যের সমাধান করেছে সে। সমাধানের হার শতভাগ।
সেই জুয়েলের পাশে বসে তাহমিদের ব্যাগে অপরিচিত নোট লিখে যাবে কোন একজন – জুয়েলের ভাষায় – ‘মাইয়া’ – আর কালপ্রিটকে ধরতে পারবে না ওরা – এ তো সাংঘাতিক লজ্জার কথা। কিন্তু এই দফায় চ্যলেঞ্জ করতে বাধ্য হয় তাহমিদ।
‘কোন মেয়ের লেখা – আর তাও সেটা হাতের লেখা পাল্টে? এগুলো কিভাবে বললি?’
‘খেয়াল করলে তুইও পারতি।’ মামুলি কাজ করে ফেলেছে – এরকম ভাবে নাক-মুখ কোঁচকায় জুয়েল।’ হাতের লেখার ধাঁচ ওরকম মাইয়াগোরই হয়। লেখা নিয়ে সৌখিনতা পোলারা করে না এত… মানে, সাধারণতঃ। মাইয়াগো লেখা জঘন্য হলেও দেখবি একটা সাজানো-গোছানো ধরণ আছে। ওইটা দিয়া বোঝা যাইতেছে লেখছে একটা মাইয়া। আর অপরিণত ভাবটা খেয়াল কর – হয় ছোট বাচ্চায় লেখছে – অথবা মাইয়া নিজেই নিজের লেখা পাল্টানোর চেষ্টা করছে। শিওর!’
এবারে কিন্তু তাহমিদই অভিভূত হয়ে যায়।
‘সাবাশ দোস্ত!’ জুয়েলের পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলে ও।’ বেশ উন্নতি হয়েছে রে তোর -’
‘চমৎকার!’ দেবনাথ স্যারের গলায় প্রশংসার চাইতে ব্যাঙ্গই বেশি প্রকাশ পেল।’ ক্লাস শুরু হতেই পিঠ চুলকে দিচ্ছ একে অন্যের! কি মোহাব্বত! দাঁড়িয়ে থাক তোমরা দুইজন।’
‘ওহ শিট!’ বিড় বিড় করে তাহমিদ।
হেসে কুটি কুটি হয় প্রিয়াংকা আর কেয়া।
✭
কলেজ থেকে বের হয়ে জুয়েলের হাতে কাগজটা তুলে দেয় তাহমিদ।
‘দোস্ত এভিডেন্সটা তুই বাসায় রাখ। পরে কাজে লাগতে পারে।’
‘আমার কিন্তু এরই মধ্যে একজনরে সন্দেহ হয় দোস্ত।’
‘আরে আরও তথ্য প্রমাণ দরকার।’ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তাহমিদ।’ ওই যে প্রিয়াংকা চলে এসেছে। যা তুই। কাল দেখা হবে।’
হতাশায় মাথা নাড়ায় জুয়েল। জুয়েলের বাসা একদিকে আর বন্ধুবরের আরেকদিকে। আবার ওদিকে তাহমিদের পাশের বাসায় থাকে প্রিয়াংকা। কলেজে যাওয়া আসাটা তাই একসাথেই হয়। বাসে উঠে পাশাপাশি বসল ওরা। এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে খোঁচাতে ছাড়ে না প্রিয়াংকা।
‘ক্লাসে দেখলাম কি একটা কাগজ নিয়ে শার্লক হোমসগিরি ফলাচ্ছিস তোরা।’
‘কই না তো!’ আপত্তি করার চেষ্টা করে তাহমিদ।
‘কি ছিল রে? কেউ প্রেমপত্র দিয়েছে নাকি? বেনামী?’ মজা পায় প্রিয়াংকা ওকে বিব্রত হতে দেখে।
‘এক রকম। লাঞ্চ-টাইমে কেউ আমার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল।’ স্বীকার করতে বাধ্য হয় তাহমিদ। তারপরই লাফ দিয়ে সোজা হয়ে বসে।’ তুই জানলি কি করে? তোর কাজ এইটা?’
‘তোকে প্রেমপত্র দিতে বয়েই গেছে তো আমার!’ চোখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা চলে যায় প্রিয়াংকার।’ জানব কি করে? গেস করেছি। যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলি। তাছাড়া লাঞ্চ-টাইমের বেল বাজতেই ক্লাস থেকে কেয়ার সাথে বেরিয়ে যাই আমি।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, ‘তাইলে তো তোর এবার হয়েই যাবে।’
‘মানে কি! কি হবে আমার?’ সপ্তম আসমান থেকে পড়ে যেন তাহমিদ।
‘ওই চিঠি তোকে দিলে তো ক্লাসের কোন মেয়েই দিয়েছে তাই না? প্রেম হবে তোর।’
‘শোন!’ জোর গলায় বলে তাহমিদ, ‘যেই মেয়ের সামনে এসে বলার সাহস নাই – এরকম মুরগির কলিজাওয়ালা মেয়ের সাথে আমি প্রেম-ট্রেম করতে পারব না। আমার প্রেমিকা হবে অনেক সাহসী। হুহ!’
‘এহহ!’ তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ জানায় প্রিয়াংকা।’ যেই না উনার সাহস। আর চায় সাহসী প্রেমিকা!’
প্রিয়াংকাকে কিল দেয় তাহমিদ।
‘আবার মারেও অবলা একটা মেয়েকে।’ অভিমানী গলায় বলে ও।
আরেকটা কিল দেয় তাহমিদ।
বাস ছুটে চলে।
✭
পরদিন লাঞ্চ-টাইম থেকে ফিরে এসে ব্যাগ খুলে এবার রীতিমত আর্তচিৎকার করে ওঠে তাহমিদ।
‘ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন?’ বিরক্ত হয় জুয়েল।
‘আমি মোটেও চেঁচাচ্ছি না!’ ষাঁড়ের মতই চেঁচিয়ে বলে এবার তাহমিদ।’ এইটা দ্যাখ!’
বেশ বড় একটা খাম। তার মাঝে একটা মাত্র পাতার চিঠি। সেটা বড় কথা না। চিঠিটা রক্তে লেখা।
‘তাহমিদ,
এতদিন ধরে পাশে রেখেছ। বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবোনি কোনদিন। হয়ত বড়জোর আরও একটা বছর পাশে পাব তোমায়। কিন্তু আমি যে তোমায় বন্ধু ভাবতে পারি না আর। ভালোবাসি তোমায় এতটা। মুখে বলে বন্ধুত্বটা নষ্ট করে ফেলতে চাই না। তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। বন্ধুর থেকে বেশি না ভাব – আমি ভালোবেসে যাব তোমায় – আজীবন।’
‘আমি তো মাননীয় স্পীকার হইয়া গ্যালাম!’ নিজ ভাষায় বিড় বিড় করে জুয়েল। মোটাসোটা শরীরটা একেবারে পাথর হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়।
‘নাম নেই।’ চোখ তোলে তাহমিদ।’ কে হতে পারে।! কে? জানাটা দরকার। এত পাগলামী কেন করবে?’ একসেকেন্ড ভেবে ডাক দেয়, ‘মাননীয় স্পীকার!’
‘হ!’ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয় জুয়েল।
‘এই চিঠিকে এভিডেন্স ধরে কি পাচ্ছিস? আমাকে জানা।’
চিঠি ধরে উলটে পালটে দেখে জুয়েল। তারপর নিরাশ হয়ে মাথা নাড়ে।
‘ডিএনএ টেস্ট করা লাগব!’
‘বসে আছিস কেন? করে আন!’ তাড়া দেয় তাহমিদ।
‘আমারে কি তোর সিআইডির লোক মনে হয় দেইখা?’ ঝাড়ি মারে ওকে জুয়েল। হঠাৎ আগ্রহের সাথে খামটা তুলে নেয়।’ তয় – এই খাম আমগোরে লীড দিবার পারে।’
‘খামে কোন ঠিকানা ছিল না, মি. স্পীকার।’
‘ওই আমারে স্পীকার কইবি না। হইয়া গেছিলাম। এখন নাই আর।’ বলে জুয়েল গোবদা হাত দিয়ে পিঠে একটা চাপড়ও দেয় তাহমিদকে।
আবার বলে তারপর, ‘ঠিকানা নাই – কথা সত্য। কিন্তু খামে গন্ধ থাইকা যায়। শুইকা দেখ!’ তাহমিদের দিকে আগ্রহের সাথে খামটা বাড়িয়ে দেয় ও।
‘আমি বাবা রক্তের গন্ধ-টন্ধ শুঁকতে পারব না।’ নাক মুখ কোঁচকায় তাহমিদ।’ তোর মন চাইলে তুই নাক ডুবিয়ে বসে থাক!’
অক্ষরে অক্ষরে তাহমিদের নির্দেশ পালন করে জুয়েল। নাকটা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকে মিনিট তিনেক। তারপর মুখ তোলে।
‘একটা বডি পারফিউমের গন্ধ পাইছি। তুই শুইকা দেখ।’
‘মরলেও না!’ তারস্বরে প্রতিবাদ জানায় তাহমিদ।
হাতির পায়ের মত হাত দিয়ে ওকে চাপড়িয়ে উৎসাহ দেয় জুয়েল। শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই খামের গন্ধ শোঁকা উত্তম – হাত বাড়ায় তাহমিদ। একমিনিট পর মাথা তোলে।
‘গন্ধটা আমার পরিচিত। দোস্ত – কালকে তুই কাকে যেন সন্দেহের কথা বলছিলি?’
‘কইতাম কিন্তু রাগ করতে পারবিনা কইলাম!’ গ্যারান্টি চায় জুয়েল।
‘না করব না। বল?’
‘আমার তো প্রিয়াংকারে ধুমাইয়া সন্দেহ হইতেছে।’
‘আরে নাহ।’ আপত্তি জানায় তাহমিদ নিজেই।’ কাল ওকে চার্জ করেছিলাম। কিন্তু ও সবার আগেই লাঞ্চ করতে বের হয়ে যায়। আজও আমার সন্দেহ যায়নি – তাই খেয়াল করেছি – সবার আগে ও আর কেয়া বেড়িয়ে যায় ক্লাস রুম থেকে।’
‘আরে বলদা রে!’ তাহমিদের বুদ্ধির প্রশংসা করে জুয়েল।’ এরা বাইর হইয়া বাইরে ছিল কোথাও আশে পাশেই – আমরা বাইর হতেই আবারও লাফায়া ঢুকছে! ‘
‘হুম…’ টোকা দেয় তাহমিদ টেবিলে, ‘লাফিয়ে না ঢুকলেও – আমরা যাওয়ার পরে ঢুকতেই পারে…’
হঠাৎ জুয়েলের পাহাড়ের মত শরীরটা শক্ত হয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে, ‘তাহমিদ, দ্যাখ!! প্রিয়াংকার ডান হাতের দিকে তাকা!’
তাকিয়ে চমকে যায় তাহমিদ। প্রিয়াংকার ডান হাতের তর্জনী পেঁচিয়ে আছে ব্যান্ডেজে। হাত কেটে গেছে?
নাকি নিজে থেকে কেটে চিঠিটা লিখেছে ও?
✭
‘আজ পারলে প্রিয়াংকারে একটু গুঁতায়া বাইর করার চেষ্টা কর দোস্ত।’ সাজেশান দেয় জুয়েল ওকে।’ মুখে কইব না যখন তখন গুতাইন্নাই লাগব। হুদাই কষ্ট পাইব ক্যান?’
‘হুঁ।’ সায় দেয় তাহমিদ।
‘রক্তের চিঠিটাও কি আমি নিয়া যামু? এভিডেন্স তো।’
‘না। ওটা আমার কাছেই থাকুক।’
‘মাইয়াটারে আবার বাসে বেশি জেরা করিস না। যদি আমাদের সন্দেহ ভুল হয় তাইলে কিন্তু ইজ্জত মার্ডার।’
‘আচ্ছা।’ তাহমিদের গলার স্বর আজ পরিবর্তিত।
দেখে সন্তুষ্ট হয় জুয়েল। ছেলে প্রিয়াংকাকে জেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেসটা আনসলভড থেকে যাবে এই ভয়টা ছিল ওর। বাসে উঠে ওই ব্যাপারে প্রিয়াংকাকে খোঁচানোর কোন সুযোগই পেল না আজ তাহমিদ।
‘অ্যাই তোর হাত কিভাবে কেটেছে?’ সরাসরি প্রশ্ন করে ওকে।
‘কাল রাতে মাছ কাটতে গিয়ে। কাটাকাটি পারি না তো!’ হাই চেপে বলে মেয়েটা।
‘ওহ।’ কি বলবে ভেবে পায় না তাহমিদ।
‘কাল সারা রাত ঘুমাইনি রে।’ চোখ বোজে ও।’ আমি চোখ বন্ধ করে থাকি একটু।’
প্রিয়াংকার চোখ খোলার অপেক্ষায় থাকে তাহমিদ। কিন্তু কিসের কি! বলতে বলতেই পাঁচ মিনিটের মাঝেই ঘুম!
‘স্বাভাবিক। সারা রাত কেটেছ হাত।’ মনে মনে বলে তাহমিদ।’ গতকাল আমার সাহসী প্রেমিকা লাগবে বলাই উচিত হয় নাই।’
মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর। বাস তখন দাঁড়িয়ে জ্যামে। দশ মিনিটের দূরত্ব পার হতে এভাবেই লাগায় আধঘন্টা। আলতো করে প্রিয়াংকার ঘুমন্ত মাথাটা ঢলে পড়ে তাহমিদের কাঁধে।
সরাতে গিয়েও সরায় না ও।
খামের মধ্যে পাওয়া সুগন্ধটা তীব্রভাবে নাকে আসে ওর।
ঘুমন্ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ বড় মায়া হয় তাহমিদের। মুখ ঢেকে দেওয়া এক গুচ্ছ চুল সরিয়ে দেয় ও পরম মমতার সাথে।
✭
পরদিন সকাল।
লাইব্রেরীর এক নির্জন কোণা বেছে নিয়েছে প্রিয়াংকা আর তাহমিদ। আজ যা বলে ফেলতে চায় তাহমিদ ওকে। জুয়েলটাকেও আসতে বলেছে। কিন্তু হোৎকাটা দেরী করছে। অস্বাভাবিক কিছু না অবশ্য। “যতই স্থুল হবে তুমি – গতিবেগ ততই কমবে তোমার” – নীতিতে বিশ্বাসী তাহমিদ; জুয়েলের দেরী গ্রাহ্য না করে তাই আসল কথায় চলে এলো।
‘প্রিয়াংকা – তোর সাথে কিছু কথা ছিল।’
‘আমারও।’ কেমন যেন নিস্তেজ গলায় বলে প্রিয়াংকা আজ।
নিশ্চিত হওয়ার এই সুযোগ ছাড়ে না তাহমিদ। সন্দেহ ভুল হলে; অর্থাৎ প্রিয়াংকা ওই চিঠিগুলো না পাঠালে বেশ লজ্জার একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। তাহমিদ যে মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে – নিজের কাছে তো আর লুকাতে পারছে না। গতকাল বাসে বসে অনুভূতিটা বুকের ভেতর একেবারে লাফালাফি শুরু করেছিল। ভাগ্যিস – ঘুমাচ্ছিল প্রিয়াংকা। নইলে কেলেংকারী হয়ে যেত!
‘বল তাহলে।’ প্রিয়াংকাকে আগ বাড়িয়ে চাল দেবার আহবান জানায় তাহমিদ।
‘তোর দিকে আজকাল অনেক মেয়ে নজর দেয়।’ শ্রাবণের মেঘ জমে প্রিয়াংকার মুখে।’ আমার এসব একেবারে সহ্য হয় না।’
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।
‘তোকে ভালোবাসি আমি, তাহমিদ!’ মুক্তোর মত একফোঁটা পানি পড়ে প্রিয়াংকার গাল বেয়ে।
‘অ্যাই বোকা মেয়ে! কাঁদছিস কেন?’ তাড়াতাড়ি ওর হাত ছোঁয় তাহমিদ।’ তোকে এটা বলতেই আজ এখানে এনেছি। কখন জানি তোর প্রেমে পড়ে গেছি আমিও। দেখ তো কি রকম গাধা আমি!’
চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলে প্রিয়াংকা। এই সময় লাইব্রেরীতে ঢোকে জুয়েল। প্রিয়াংকার কান্না-হাসির সাথে ওদের হাতে হাত ধরে রাখা দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেলে ও। বিশাল শরীরের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র দাঁতগুলো ঝিলিক মারে। গোয়েন্দা জুয়েলের এতটা আনন্দিত চিত্র আগে কখনও দেখেনি কেউ।
‘তুই একটা পাগলি, প্রিয়াংকা!’ এবার আলতো ধমক দেয় ওকে তাহমিদ।’ আমাকে সরাসরি বলতেই পারতি। নোট রেখে গেছিস তাও মানা যায়। তাই বলে হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে চিঠি লিখাটা বাড়াবাড়ি করেছিস! এরপর যদি আর…’
প্রিয়াংকার মুখে নিখাদ বিস্ময় দেখে থেমে যায় তাহমিদ।
‘তুই ভাবিস আমি ওই চিঠি রেখে তোকে মিথ্যা করে বলেছি? আর কিসের রক্ত মাখা চিঠি?’
‘তুই লিখিসনি বলতে চাস…’ এক সেকেন্ড ভাবে তাহমিদ।’ তাই তো! আমি আগে কেন বুঝিনি?! স্বস্তি লেখা ছিল চিঠিতে।’ পকেট থেকে বের করে চিঠিটা।
“…তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না…” লাইনটা দেখায় প্রিয়াংকাকে ও।
‘কলম দিয়ে ‘স্বস্তি’ লেখাটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে। কিন্তু কেউ হাত কেটে স্বস্তি লিখবে না। প্যাঁচ দেখেছ? এরচেয়ে প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। এইটা এই মোটকুর কাজ। নির্ঘাত!’
একটা কলম বন্দুকের মত তাক করে ও জুয়েলের দিকে।
‘আরে আরে চ্যাতস ক্যারে?’ হাহাকার করে ওঠে জুয়েল।’ দেখলাম তোগোর ভিতরে ভালোবাসা পাঙ্খা মেলতেছে কিন্তু কইতেছস না একজন আরেকজনরে তাই ক্যাটালিস্ট দিছি জাস্ট।’
‘দাঁড়া বলিস না।’ হাত তুলে ওর দিকে তাহমিদ।’ আমার পিছে বের হওয়ার সময় তুই ভেতরে খাম ঢুকাইছিস এইটা তো পানির মত সোজা। আর লিখাইছিস তোর ছোটবোনকে দিয়ে, প্রথম চিঠিটা। আর রক্ত… উমম রক্তের ব্যাপারটা নিশ্চয় আঙ্কেলের কাছে ব্লাডব্যাগ হাতাইছিস। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। খামের মধ্যে বাসা থেকে পারফিউম মেরে এনেছিলি সেটা তো বোঝা সহজ। অ্যাম আই রাইট?’
‘পুরাই।’ মাথা নাড়ায় জুয়েল। ওর বাবা একজন বায়োলজিস্ট।’ ব্লাড ব্যাংকের কিছু নষ্ট হওয়া স্যাম্পল নিয়া বাবা কাজ করতাছিল। ওইদিন গেলাম দ্যাখা করতে। দেখি একটা থাইকা গেছে কাজ শেষেও। নিয়া আইতে চাইলাম। দিয়া দিল। তখন থেকেই মাথায় ঘুরতাছে প্ল্যানটা।’
‘ইয়াহ!’ আনন্দে মাথা ঝাঁকায় তাহমিদ। ‘এইটা আট নম্বর।’
‘দাঁড়া দাঁড়া!’ ধরে ফেলে প্রিয়াংকা, ‘কলেজ কেসগুলো তুই সব সলভ করেছিলি, তাই না তাহমিদ? তারপর জুয়েলকে দিয়ে বলাইছিলি? কেন?… ওহ!’ নিজেই ধরতে পারলো প্রিয়াংকা এই প্রশ্নের উত্তর, ‘ওকে যাতে সবাই সমীহ করতে বাধ্য হয় তাই–’ এক মুহূর্ত থেমে নতুন দৃষ্টিতে দেখে আজ প্রিয়াংকা তাহমিদকে। তবে ওই একমুহূর্তই।
‘তুই একটা ইবলিশ রে!’ প্রিয়াংকা তাহমিদকে কিল দেয় এবার।
‘তোর মাথা।’ এড়িয়ে যাতে চায় তাহমিদ।
আবার কিল দেয় ওকে প্রিয়াংকা।
এই দুইটা এইভাবে আজীবন খুনসুটি করুক।
একমুখ হাসি নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে আসে জুয়েল। বুকে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি।
রচনাকাল – ২৯শে ডিসেম্বর, ২০১৩
Leave a Reply