খারাপ মেয়ে

কোন রকম আগাম সংকেত না দিয়েই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে হোটেল রুমের দরজাটা। উজ্জ্বল টর্চের আলো ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ল চার-পাঁচজন মানুষ। প্রতিটা আলো ফেলা হয় ওদের চেহারাতে। ‘মাগীর হুক দেখো!’ গর্জন করে ওঠে ওদের একজন, ‘কাস্টোমার ছুইটা গেছে – সেই ফাঁকে ফ্রিতে ক্ষ্যাপ মারতাছে।’

মেয়েটার কাটা গলা থেকে এখনও দমকে দমকে রক্ত বের হচ্ছে।
ফর্সা গলাটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ক্যানভাসে আঁকা অদ্ভুত এক ছবিটার মত মনে হতে থাকে দৃশ্যটাকে। একটু আগে বের হতে থাকা রক্তগুলো হাল্কা জমাট বেঁধে থকথকে একধরণের ঘন তরলে পরিণত হয়েছে, রঙ পাল্টে হয়ে গেছে কালচে লাল। নতুন রক্তগুলো টকটকে লাল রঙের তবে আগের মত জোর এখন আর নেই। হৃৎপিণ্ড আর পাম্প করছে না তরল জীবনীশক্তিগুলোকে।
মরার আগে দুর্বলভাবে বার কয়েক পা ছোঁড়ে মেয়েটা। গলা থেকে অদ্ভুত রকম একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
শেষ লাথিটা চেয়ারের ওপর পড়ল। আস্তে করে কাত হয়ে যায় ওটা প্রথমে। তারপর দড়াম করে মাটিতে পড়ে যায়।

সে শব্দ কানে ঢোকে না হতভাগা মেয়েটির। তার আগেই চোখ থেকে সরে গেছে প্রাণের সব লক্ষণ।

১.

‘কোন মতিনের কথা বলতেছ? গালকাটা মতিন?’ হতাশ একটা ভঙ্গীতে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল রহমত মিয়া, ‘লোক খারাপ।’

চোরাই মালের কারবার যে লোক করে তার কাছ থেকে আরেকজনের ব্যাপারে ‘লোক খারাপ’ জাতীয় মন্তব্য শোনার পর সেটা হজম করতে সমস্যা হওয়ার কথা। তন্ময়েরও হজম হয় না। নাকের গোড়াটা হাল্কা কুঁচকে ওঠে বিরক্তিতে।
বিরক্তি প্রকাশ না করে হাল্কা মাথা দোলায় ও। চেহারা দুই সেকেন্ডের মাঝে স্বাভাবিক করে ফেলেছে।

‘মতিন ভাইকে পাওয়া যাবে কোথায় সেটা তাহলে বলতে পারছেন না, তাই তো?’ উঠে দাঁড়ায় তন্ময়, এই মানুষটাও লোক খারাপ। অযথা এখানে ঘুর ঘুর করার কোন মানে হতে পারে না।
পেছন থেকে রহমত মিয়ার কণ্ঠটা শুনে আবার থমকে দাঁড়াতে হয় ওকে, ‘চলে যাইতেছেন ভাই? সাবধানে থাইকেন।’
শুকনো গলাতে জানতে চায়, ‘কেন? সাবধানে কেন থাকতে হবে?’
‘নষ্টা মাইয়া নিয়ে মতিনের কারবার। হের লগে গ্যাঞ্জামে জড়াইয়েন না।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রহমত মিয়ার ডেরা থেকে বের হয়ে আসে ও।
মতিনের কারবার যে দৃষ্টিতেই দেখুক সমাজের মানুষ, তার সাথে গ্যাঞ্জামে জড়ানোর কোন ইচ্ছে তন্ময়ের নেই। বরং অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ওই লোকই গ্যাঞ্জামে জড়িয়ে পড়েছে। অস্বাভাবিক কিছু তো নয়।
লোক খারাপ।

বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশী বৃষ্টি এটা না। পুরো মেঘে মনে হয় মোটে এক চামচ পানি ছিলো। ওটাই গুঁড়ি গুঁড়ি করে ফেলা হচ্ছে এখন। সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও কান পর্যন্ত ভিজবে না।
মোবাইল ফোন বের করে অযথাই আরেকবার মতিন ভাইকে খোঁজার চেষ্টা করে ও। নাম্বার সেই আগের মতই বন্ধ।
রাস্তার পানি হাল্কা ছিটাতে ছিটাতে আসতে থাকা কালো গাড়িটা দেখে গত আধঘণ্টার মাঝে দ্বিতীয়বারের মত কুঁচকে যায় ওর ভ্রু। এখানে এই গাড়ি কেন?
আস্তে করে ওর পাশে থেমে যাওয়ার পর সাইড উইন্ডো ধীরে ধীরে নেমে যেতে থাকে। ইলোরার দিকে তাকিয়ে বোকার মত একটা হাসি দেওয়া ছাড়া ওর আর কিছুই করার থাকে না।

‘গাড়িতে উঠে পড়।’ পাল্টা হাসে না মেয়েটা, ‘কুইক।’

ভেজা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে গাড়িতে ওকে ওঠাই লাগে। ইলোরা অন্যপাশের জানালার দিকে পিছলে সরে যায়। এর মাঝেই একটা লিপসের প্যাকেট বের করে ফেলেছে। ফস করে আগুন ধরিয়ে ফেলে ও সিগারেটটাতে।
প্রত্যাশা নিয়ে তার দিকে তন্ময় তাকিয়ে থাকলেও টু শব্দ বেরুলো না মেয়েটার মুখ থেকে। মনোযোগ দিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সামনের ড্রাইভিং সীটে বসে থাকা মারুফ ভাইকেও রীতিমত শান্ত মনে হচ্ছে।

‘কিছু তো বলবি? কিছু তো হয়েছে বটেই। গাড়ি নিয়ে চলে আসতি না কিছু না হলে।’ নীরবতা অসহ্যকর মাত্রাতে চলে যাওয়ার আগেই সেটা ভেঙ্গে ফেলে তন্ময়।
‘তোর লিংক ধরে কিছু খুঁজে পাই নি।’ সোজাসাপ্টা বলে দেয় ইলোরা।
‘বিন্দু নামের একটা মেয়েকে পাওয়ার কথা ছিলো তোর। ভদ্রমহিলা কি ছিলেন না ওখানে?’
কটমট করে তাকায় ইলোরা, ‘ভদ্রমহিলা? প্রস্টিটিউটদের এখন থেকে এভাবেই ডাকা হবে নাকি?’
শক্ত মুখে সামনের দিকে তাকায় ও, ‘মারুফ ভাই, গাড়ি থামান। নেমে যাবো।’
হতচকিত মারুফ ভাই পেছনের দিকে তাকান সাথে সাথেই, ‘ম্যাম?’

‘ম্যাম’ খপ করে তন্ময়ের হাত চেপে ধরেছে ততক্ষণে। টানাটানি না করে আস্তে করে বলে ও, ‘হাত ছেড়ে দে। সব জেনেও যেভাবে কথা বলছিস – তাতে তোর সাথে কাজ করার রুচি হচ্ছে না আমার। জয়িতাকে আমি একাই খুঁজে বের করতে পারবো।’
‘মাথা গরম করিস না। ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে গেছে অলরেডি। তোর কি মনে হয় মনের সুখে তোর এদিকে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি?’

মারুফ ভাই এখনও রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে পেছনের সীটের দিকে তাকিয়ে আছেন। থামবেন কি চালিয়ে যাবেন সেটা বুঝতে পারছেন না।
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে তন্ময়। ইলোরার মুখের দিকে তাকায়, ‘কি ধরণের প্যাঁচ?’
‘তোর ঠিকানা অনুযায়ী ঠিকমতই গেছিলাম – হোটেলটায়– কিন্তু -’ কিছু একটা বলতে ইতস্ততঃ করে মেয়েটা।
অধৈর্যের মত চাপ দেয় ওকে তন্ময়, ‘রুম নম্বর ৩১৫। বিন্দুর একার থাকার কথা ছিল ওখানে। পাসনি তাকে?’
‘ইয়ে– মেয়েটা মারা গেছে রে।’

স্থির হয়ে যায় তন্ময় সাথে সাথে, ‘গতকালই ফোনে কথা বলেছি আমি ওর সাথে। দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক মনে হয়েছে -’
‘আজকে সকালে কেউ হোটেলের রুমেই জবাই করে ফেলে রেখে গেছে ওকে।’ ফিস ফিস করে বলে ইলোরা, ‘আমরা গিয়ে গলাকাটা লাশটা ছাড়া আর কিছুই পাই নি।’
‘হোয়াট?’
‘তুই মতিন ভাইকে খুঁজে পাচ্ছিস না গতকাল থেকে। আর আজকে জয়িতাকে চেনে এমন একমাত্র মানুষটা খুন হয়ে গেল, ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস?’

বাইরে বৃষ্টির বেগ আগের থেকে সামান্য বেড়েছে। সেদিকে তাকায় ছেলেটা।
চোখের শূন্য দৃষ্টি দেখতে দিতে চায় না ইলোরাকে।
ওভাবেই উত্তর দেয় মেয়েটার শেষ প্রশ্নের, ‘কেউ একজন চাচ্ছে না জয়িতাকে উদ্ধার করি আমি।’

জানালার কাঁচে জোরে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে বৃষ্টি – সাত মাসের আগের একটা দিনে ফিরে যায় তন্ময়।

২.
চারপাশে হাসির শব্দ। ছোট দোকানটাতে আজকে একটু বেশি মানুষই ভিড় জমিয়েছে।

বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়তে থাকলে এমনটা হয়। নিঃসঙ্গ দোকানগুলোর ওপর চাপটা পরে বেশি। দরজা শক্ত করে লাগানো ছিলো, দড়াম করে ওটা খুলে যেতে নিজের সীট থেকে ঘুম ঘুম চোখে সেদিকে তাকায় তন্ময়।

ময়মনসিংহের এই পোড়া শহরে পড়ে আছে। একদিন ধরে নয়। আজকের দিনটা পার হয়ে গেলে আটদিন হয়ে যাবে।
সামান্য একটা কাজ করতে রাসেল ভাই পাঠিয়েছেন – সেটা করতে অতিরিক্ত সময় লাগিয়ে দিচ্ছে বলে মনে হয় ওর নিজের কাছেই। রাসেল ভাই সন্তুষ্ট হবেন না।

দরজা খুলে ঢুকেছে যে মানুষটা – তাকে দেখে আবার পেশীতে ঢিল দিচ্ছিলো ও, এক মুহূর্তের মাঝেই ঘুম ঘুম ভাবটা সম্পূর্ণ কেটে যায় ওর। ভিজে একেবারে দাঁড়কাক হয়ে আছে বটে, সেজন্য দলের ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি তারেক আদনানকে চিনতে মোটেও ভুল হয়নি এবার। বাম হাতে একটা মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
শক্ত শরীরে কোমরের কাছে রাখা পিস্তলটার ওপর একবার আঙুল ছোঁয়ায় তন্ময়। মুখে ঘুম ঘুম ভাবটা ধরে রেখেছে এখনও। এখানে আটদিন পচা বৃষ্টির মাঝে অপেক্ষা করার ঝামেলাটা শেষ হতে যাচ্ছে।

নির্দিষ্ট একটা বয়েসের পর টাকা পয়সার জন্য বাবা-মার দিকে তাকিয়ে থাকা খুবই অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই বয়েসটা আঠারো থেকে তেইশের মাঝে থাকে। এর পর টাকার কথা পরিবারকে আর মুখ ফুটে বলা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে বগুড়ার গ্রামে পড়ে থাকা বাবা-মার কাছে টাকা চাওয়াটা তন্ময়ের কাছেও অসহ্যকর একটা ব্যাপার বলে মনে হত। বন্ধুরা টিউশনি করে পরিবারের ওপর থেকে চাপ কমায়। দেখাদেখি তন্ময়ও ধরেছিলো একটা।

ক্লাস নাইনের যে মেয়েটাকে পড়াতে যেত ও, তার নাম ছিল সুস্মিতা।

গোড়া থেকেই মেয়েটির চরিত্র খুব একটা সুবিধের মনে হয়নি তন্ময়ের। ঘর থেকে তার মা বের হয়ে যাওয়ার পর থেকেই যতসব অদ্ভুত রকমের ইঙ্গিত দিয়ে যেত সে প্রতিদিন।
তবে মাসে সাত হাজার টাকার মায়া বড় মায়া, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আর দশটা ছাত্রের মত তন্ময়ের পক্ষেও এই পরিমাণ টাকা সামান্য ঝুঁকির ভয়ে ফেলে দিতে মন চায় নি। এক লোডশেডিংয়ের রাতের আগ পর্যন্ত সবকিছু এভাবেই চলছিলো বটে।

সুস্মিতার মত বোকা মেয়ে সে দেখেনি। ঘরভর্তি মানুষ লোডশেডিংয়ের সাথে সাথে প্রথমেই ছুটে যাবে যে ঘরে ছোট মেয়েকে তার টিউটর পড়াচ্ছে সেখানে – এই সহজ যুক্তিটির কথা সে চিন্তাই করে নি।
টর্চ জ্বালিয়ে সুস্মিতার বাবা যখন দেখলেন, মেঝেতে শুয়ে আছে তন্ময়, অন্ধকারে তাকে পাকড়ে ফেলতে মেয়েটির তেমন কষ্ট করতে হয়নি – এটা অবশ্য তাঁর বোঝার কথা নয়। আর গুণধর টিউটরের বুকের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে তাঁর নিষ্পাপ মেয়ে।
তন্ময়কে তুলে ধরে টর্চ দিয়েই একের পর এক আঘাত করেছিলেন তিনি। সব দোষ এখানে নন্দঘোষের ঘাড়ে পড়েছিল। তবে লোহার শক্ত টর্চের আঘাত তন্ময় চুপচাপ গ্রহণ করতে পারে নি। ভদ্রলোককে জোরে একটা ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে কারেন্ট চলে আসে।

রক্তাক্ত ভদ্রলোকের নিথর দেহ প্রথমবারের মত চোখে পড়ে ওদের। ওয়ার্ডরোবের কিনারে মাথা লেগে একপাশ একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে। সম্ভবতঃ বুড়ো হাড়ে এই আঘাত সহ্য হয়নি তার। বাড়ি খেয়েই একেবারে শুয়ে পড়েছেন। হাত বাড়িয়ে নাড়ি দেখে চমকে উঠেছিলো তন্ময় – নেই।

দরজা খুলে উদভ্রান্তের মত ছুটে বেড়িয়ে গেছিলো ও। পরের রাতটা ছিল লুকিয়ে; এরপর দিন জাতীয় দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠাতে নিজের ব্যাপারে ছোট একটা খবর দেখে আতংক কয়েক গুণে বেড়ে যায় ওর।

“ঢাবির ছাত্র : টিউটর, ধর্ষক নাকি খুনী?”

তাকে খবরটিতে ‘জনৈক সুস্মিতা শারমিন(১৪)’-কে ধর্ষণের প্রচেষ্টা চালানো এক উদ্ধত যুবক হিসেবে দেখানো হয়েছে খবরে। স্পষ্ট করে লেখা হয়েছে টিউশনি করানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের ঘরে ডেকে আনাটা মোটেও নিরাপদ কিছু নয় বরং এরা গৃহকর্তাকে অনায়াসে খুন করে ফেলতে পারে কন্যা সন্তানটিকে ধর্ষণের সময় বাঁধা দিতে এলে।

তখনই বন্ধু রাফসানের মাধ্যমে রাসেল ভাইয়ের সাথে ওর পরিচয়, ভাই হেসে বলেছিলেন, ‘ক্যাম্পাসের ছোট ভাই তুমি। আমাকে আগে বলবা না? এসব কোন সমস্যা হইল?’

তন্ময় ধীরে ধীরে বোঝে এসব অভিযোগ সরিয়ে দেওয়া রাসেল ভাইয়ের কাছে কোন ব্যাপারই না। ক্ষমতায় আছে – এমন একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর বেশ উঁচু অবস্থান তাঁর, দলের ভেতরে। শুধু তন্ময়কে ছোট একটা কাজ করতে হবে। একটা ফর্ম পূরণ করতে হবে।

রাসেল ভাই মুচকি হেসে বললেন, ‘আরে তোমাদের মত ভালো ছেলেরা রাজনীতিতে নাই, আমি জানি। এটা শুধু একটা লিস্ট দেখানো দলের ভেতরে। এতজন আমাদের সাপোর্টে আছে – হ্যান তেন। তোমাকে কিছুই করতে হবে না, বুঝলা না? ফর্মালিটি জাস্ট। যখন ওদের জানাবো – তোমাকে হেল্প করতেছি, তখন দলের তোমার এন্ট্রির ব্যাপারে বলা লাগবে তো। তোমার কাজ হওয়া নিয়ে কথা। কি কও?’

মাথা দুলিয়েছিল তন্ময়। তবে বুঝতে পেরেছিল, এমনি এমনি তার ওপর থেকে খুনের অভিযোগ সরানো হচ্ছে না। পরবর্তীতে তাকে কিছু একটা করে এর প্রতিদান দিতে হবে দলের কাছে।
দশ মিনিট চিন্তা করে হাতে থাকা দুটো অপশনের মাঝে এই রাজনৈতিক দলের পুতুলে পরিণত হওয়াটাকেই ভালো মনে হতে থাকে ওর। অন্য অপশনটা সহজ – জেলখানাতে সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে যাওয়া– বগুড়ার কোণে পড়ে থাকা মা-বাবার মুখটা ভেসে উঠেছিল ওর মানসপটে।

ঠিকমত এই ঝামেলা থেকে বের হতে পারলে বাবা-মার চাপ ও কমাবেই একদিন। সেজন্য এই রাজনৈতিক দলের পুতুল হওয়া অনেক ভালো। জেলখানায় আছে ছেলে – এই খবর সহ্য করতে পারবে হার্টের রোগী বাবা?

মাস চারেকের মাঝেই মাঝারি সাতটা অপারেশনে পাঠানো হয় ওকে। এর মাঝে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলা হয়েছে ক্রিমিনাল রেকর্ড। পুলিশ সুস্মিতার বাবার মৃত্যুর কেসটা একেবারে দশমণি ফাইলের তলে চাপা দিয়ে রেখেছে। আগামী শতাব্দীতে ওটা আলোর মুখ দেখলেও দেখতে পারে। তবে সে সম্ভাবনা কম।

অষ্টম অপারেশনটা ছিলো রিজভী তরুণ নামে বিরোধীদলের এক পাতিনেতার কাছ থেকে তথ্য আদায় করা।
এতদিনে তন্ময়ের ভেতরের কোমল দিকগুলো সব সরে গেছে – ধাপে ধাপে নিষ্ঠুর কাজ করানো হয়েছে ওকে – সতর্কতার সাথে একটা অ্যাসেটে পরিণত করেছে ওকে দলটি। একবার খুনের অভিজ্ঞতা আছে – এমন কাওকে দিয়ে যে নোংরা কাজগুলো করিয়ে নেওয়া যায় – তা আর কাওকে দিয়ে করানো যায় না। বিবেকের দংশন তাদের এক ঘণ্টা দংশন করলে বাকি তেইশ ঘণ্টা করে রাখে বেপরোয়া। খুনের চেয়ে ছোট অপরাধগুলো তাকে আর স্পর্শ করে না। দলটি তন্ময়ের দিকে এজন্যই মনোযোগ দিয়েছিলো।
ব্যাপারটা অবশ্য ও টের পায় অনেক অনেক দেরিতে।

বিরোধীদলের পাতিনেতার শরীরের বারোটা হাড় ভাঙ্গার পরও যখন মুখ খোলানো যায় না – ছুরি দিয়ে গলা কেটে মানুষটার মাথা আলাদা করে ফেলেছিল তন্ময়।
অদ্ভুত ব্যাপার – এ ব্যাপারে বিবেকের দংশন সে আর অনুভব করেনি। নিজের দলের ক্ষতির কারণ হচ্ছে – এমন একজন শত্রুকে কমিয়ে দেওয়াতে অনুশোচনার কি আছে? দলের সক্রিয় কিলারে পরিণত হতে তার লেগেছে মাত্র চৌদ্দ মাস।

ভাবনাটাকে চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও – দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে দোকানটা থেকে – শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায়।
কোনরকম দ্বিধা না করেই ঘরভর্তি লোকের সামনে পিস্তলটা বের করে ফেলেছে। প্রতিক্রিয়া দেখানো সময় এসময় স্বাভাবিক মানুষেরা পায় না – বদ্ধ ঘর কাঁপিয়ে দিয়ে পর পর দুইবার গুলি করে ও।

তারেক আদনান বুকে আর গলাতে বুলেটের ক্ষত নিয়ে পড়ে যাচ্ছেন – তার মাঝেই দরজা পেরিয়ে গেছে তন্ময়। বাইরে থেকে হুড়কো তুলে ভেতরের প্রতিটা মানুষকে আটকে ফেলেছে ভেতরে।

৩.
মোটরসাইকেলটা যখন চতুর্থবারের চেষ্টাতেও স্টার্ট নিলো না – গলা শুকিয়ে এল তন্ময়ের।
দরজাটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না ভেতরের ওদের। আর ক্ষিপ্ত জনতা বের হলে খবর আছে। হাড়মাংস আর থাকবে না একটাও জায়গায়।

মোটরসাইকেল থেকে দ্রুত নেমে এসে দৌড় দেয় ও রাস্তার অন্যপাশের গলিটা ধরে। বৃষ্টির জন্য মনের ভুল হতে পারে – তবে বেশ পেছনে কিছু একটা ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শুনতে পেল কি ও? দরজাটা ভেঙ্গে ফেলেছে লোকজন?

তারেক আদনান তার নিজের দলের লোক, বিরোধি দলের নয়। ঢাকা মহানগরের সেক্রেটারি। মানুষটাকে খুন করা ছাড়া উপায় ছিলো না।
দলের স্বার্থে কাজটা করতে হল ওকে। সামান্য খারাপ যে লাগছে না তার – এমনটা না। কিন্তু এই ঘটনার পর সারা দেশ আঙুল তুলবে বিরোধী দলের দিকে। সামনের নির্বাচনে ভালো একটা প্রভাব ফেলবে ঘটনাটা।
তারেক আদনান নিজেও কিছু ভুল করে ফেলেছিল। বাল্যবন্ধুকে অতিমাত্রায় বিশ্বাস করে নির্বাচনী এজেন্ডার অনেককিছু শেয়ার সে করেছে। কাজটা ঠিক করেনি। জেনে শুনে শত্রুপক্ষকে তথ্য তুলে দেওয়ার কারণে বড় ধরণের পিছিয়ে গেছে দল।
তার মৃত্যুর মাঝ দিয়ে আবার আগের জায়গাতে ফিরিয়ে আনা হয়ত সম্ভব হতে পারে। তার কাজটা ঠিকমত করেছে তন্ময়।

বেশ পেছনে দুইজন পুলিশকে দেখতে পায় ও এই সময় আড়াল থেকে। অনুসরণ করছে কি না নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
পর পর তিনবার মোড় নেয় ও বোঝার জন্য। ঠাঁয় লেগে আছে পুলিশ।
রেস্টুরেন্টটা থেকে যদি এর মাঝে লোকজন বের হয়ে গিয়ে থাকে – তবে অর্ধেক শহর জেনে গেছে খুনের ব্যাপারটা। সেই সাথে পেয়েছে খুনির দৈহিক বর্ণনা। পুলিশ এই সময় পেছনে ঘুর ঘুর করার একটাই অর্থ হতে পারে। ঝুম ঝুমে বৃষ্টির মাঝে খুব বেশি মানুষ রাস্তাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে না – খুনের আসামী ধরার জন্য এর চেয়ে সহজ সিনারিও হতে পারে না। বৃষ্টি না থাকলে জনতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করা যেত। এখন সেটি সম্ভব নয়।

মোটরসাইকেলটা ঠিক থাকলে শহরের অন্যপাশে থাকত ও এতক্ষণে। তার বদলে ধরা খাওয়া থেকে মাত্র দশ মিনিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডা শরীরটা আরও ঠাণ্ডা হয়ে যেতে থাকে ওর। ঘামতে পারলে ভালো হত – মনে মনে ভাবে একবার। পিস্তলটা ডাম্প করার সময়ও পায়নি ও। ওটা কোমরে এখনও। পুলিশ শুধু সার্চ করে দেখতে চাইলেই কাজ হয়ে যাবে।

পেছনের পুলিশ দুইজন দূরত্ব কেন রাখছে সেটা ও বুঝতে পারে। গুলির ব্যাপারটা এতক্ষণে চাউর হয়ে যাওয়ার কথা। পুলিশগুলো এক্ষেত্রে গুড ফর নাথিং। খালি হাতে আছে। একটা করে ব্যাটন সম্বল এদের। এই অবস্থাতে সশস্ত্র লোকের সাথে লাগতে চাইছে না।

আর দুটো মোড় নেওয়ার পর একটা ল্যাম্পপোস্টের সামনে থেমে যায় ও। কানাগলি এটা। সামনে এগিয়ে আরেক গলিতে পড়বে সে উপায় নেই। না বুঝেই এখানে ঢুকে পড়াটা একেবারেই অনুচিত হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ায় ও। ভাবনা খানা – কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
প্রতিটা পেশিকে সচকিত করে রেখেছে একটা ঝামেলা দেখার জন্য। বিদ্যুৎচমকের মত রিঅ্যাক্ট করতে হবে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের দুইজনকে দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যেতে হবে।
পুলিশদুটো ঘাঘু আছে। তারাও সম্ভবতঃ তন্ময়ের মনোভাব বুঝতে পারে স্পষ্ট। গলির মোড়ে এসে ইতস্তত করতে শুরু করেছে দুইজনেই। ঢুকছে না।

মিনিট তিনেক লাগে তাদের একটা মতৈক্যে পৌঁছতে – পুরো সময়টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে তন্ময়। উদাস ভঙ্গীতে অন্যপাশের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে দুই আপদ এতক্ষণে এগিয়ে আসতে থাকে ওর দিকে।

‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’ কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই জানতে চাইলো ওদের একজন।
কিছুক্ষণ স্মৃতি হাতড়ায় তন্ময় – কোনকালে কোন পুলিশকে কি হাই-হ্যালো দিয়ে শুরু করতে দেখেছে একটা কথোপকথন? বাংলাদেশে? না।
পাল্টা প্রশ্ন করে তন্ময়, ‘তা জেনে আপনার কি কাজ?’

সাথে সাথে পুলিশের মুখের চেহারাই পাল্টে যায়, রীতিমত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে লোকটা। এভাবে পাল্টা প্রশ্ন সাধারণ মানুষের কাছে শুনে অভ্যস্ত নয়।
‘এক থাবড়ে কানপট্টি ছুটায়া দিমু শালা – প্রশ্ন করছি – উত্তর দে!’
শক্ত শরীরে দাঁড়ায় তন্ময়, ‘ভদ্র ভাষাতে কথা বলেন। আপনি একজন ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছেন।’
‘ওরে আমার ভদ্রলোক রে!’ দ্বিতীয় পুলিশ খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ করে, ‘কে ভাই আপনি? বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট?’
মাথা নাড়ে তন্ময়, ‘সাধারণ একজন ছাত্র।’
‘কোথায় পড়াশোনা করেন?’
‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি।’

পুলিশ দুইজন এ ওর মুখের দিকে তাকায়। ভার্সিটির নাম শুনে এমন করার কারণ কি? খুনী একজন মানুষ ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তেই পারে না – এমন একটা ধারণা নিয়ে আছে? নাকি আগে থেকেই পুলিশকে কেউ সতর্ক করে দিয়েছিল – ঢাবি থেকে কেউ আসতে পারে এখানে?
সেক্ষেত্রে আর কোন আশা নেই। হাত নামাতে থাকে ও পিস্তলের দিকে ।

তবে আচমকা কোমল হয়ে যায় পুলিশ দুটোর গলা, ‘এখানে কেন এসেছেন?’
‘বাঁধা কোথায়? উইকএন্ড চলে।’
‘না, মানে -’
‘বড্ড প্রশ্ন করেন আপনারা।’ কাঁধ ঝাঁকায় তন্ময়, ‘আমার প্রেমিকা ময়মনসিংহে থাকে। সকালের বাসে এসেছি– বিকেলের বাসে ঢাকা চলে যেতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন – সেটা স্পষ্ট হয়েছে এবার?’

রিকশাটা ওদের খুব কাছে থেমে যায় তখনই। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী মেয়েটি ফিরে তাকিয়েই বিস্ময়ে হা হয়ে যায়। পুলিশ দুইজনের চোখ এখন তার দিকে চলে গেছে।
এর মাঝেই তন্ময় ওকে একটা চমৎকার হাসি উপহার দেয়।

দ্রুত এগিয়ে আসে মেয়েটি, ‘তুমি কতক্ষণ হয়েছে এখানে? ইশ, ভিজে গেছ যে একেবারে!’
কাঁধ ঝাঁকায় তন্ময়, ‘ফোন তো ধর না। কি করব? বৃষ্টিতে মোবাইল এতবার বের করতেও পারছিলাম না -’

আর কিছু বলার আগেই মেয়েটা ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে, রাস্তার মাঝেই ওর ঠোঁটদুটো কামড়ে ধরে, তারপর মুখের ভেতর নিয়ে যায়। তন্ময়ের মনে হয় এই ভৌতিক চুম্বন কোনদিনও শেষ হবে না। মেয়েটির শরীর খুব কাছে চলে এসেছে ওর – মাতাল করা একটা বুনো গন্ধ পাচ্ছে ওখান থেকে। আস্তে করে মেয়েটাকে সরায় ও মিনিট তিনেক পর।

পুলিশ দুইজন হা করে তাকিয়ে আছে এখনও। মেয়েটি যেন এতক্ষণে সচকিত হয়, ‘ভাই, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন?’
তন্ময় অবশ্য অন্য কথা বলে, ‘ডিসট্যান্সড রিলেশন তো – দেড় মাস পর দেখা হল – সামলাতে পারিনি আমরা নিজেদের। কিছু মনে করবেন না। কি জানি জানতে চাইছিলেন?’

মাথা নাড়ে দুইজনই, ‘না না – ঠিক আছে। আপনারা যেতে পারেন।’

মেয়েটা একপাশ থেকে ওর হাত জড়িয়ে ধরেছে, পুলিশ দুটো ফিরে যেতে থাকে। একজনকে বলতে শোনে তন্ময়, ‘এই ছেলে দিয়ে রেস্টুরেন্ট ডাকাতি? হাহ!’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ও। মাত্র খুনটা হয়েছে – পুলিশ এখনও বুঝতেই পারেনি ঢাকা মহানগরীর সেক্রেটারি মারা গেছে এই মাত্র। তারা ভেবেছে সাধারণ কোন ডাকাতির কেস এটা হবে। নিশ্চয় যথেষ্ট তথ্য কালেক্ট করার আগেই বোকার মত তারা পিছু নিয়েছে সন্দেহজনক তন্ময়ের?

‘কেন করলে এটা? আমাকে বাঁচালে কেন?’ এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে গোলাপফুলের মত ফুটফুটে চেহারার মেয়েটাকে প্রশ্ন করে ও, গলা নামিয়ে রেখেছে।
‘জানোয়ারটা একমাসের জন্য আমাকে ভাড়া নিয়েছিলো।’ বিড় বিড় করে বলে অদ্ভুত মেয়েটা।
চিনে ফেলে তন্ময়, ‘তারেক আদনানের সাথে ছিলে তুমি রেস্টুরেন্টে।’
‘ভাগ্য ভালো একেবারে আমার ফ্ল্যাটের সামনে এসে থেমেছিলে। অবশ্য – ফ্ল্যাটটা আমার না। জানোয়ার তারেকের। আমাকে নিয়ে নিরিবিলিতে থাকা দরকার ছিলো তার।’
‘ফিরে এলে কেন?’
‘আমার জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে যত তাড়াতাড়ি পারি – পুলিশ এসব পেলে আমার পেছনেও লাগতে পারে।’

বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়ছে, দারোয়ান মুচকি একটা হাসি উপহার দেয় ওদের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা কয়েকদিন ধরে এখানে আছে। অজানা নয় এখন চেহারাটা।

‘তুমি আসছ কোথায়?’ ফিস ফিস করে প্রশ্ন করে তারেকের রক্ষিতা।
‘ঘরের ভেতর থেকে তোমার ট্রেস সরিয়ে ফেলতে আমাকে পাশে চাবে তুমি – বিশ্বাস কর। ওই কাজে আমার মত দক্ষ লোক এ তল্লাটে পাবে না।’
এক মুহূর্ত ভাবে মেয়েটা, তারপর রাজি হয়ে যায়, ‘এসো তবে।’ লিফটের সুইচে চাপ দিয়ে তাকার একবার ওর দিকে, ‘আমার নাম জয়িতা।’

‘ঠোঁটের মতই মিষ্টি একটা নাম।’ মুচকি হাসে তন্ময়, ‘আমি তন্ময়।’

৪.
রাতটা অন্য একটা হোটেলে কাটাতে হয় ওদের। আঁচরে তারেক আদনানের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সবকিছু বের করে এনেছিলো ওরা।
স্বয়ং তারেক আদনান মরা থেকে জ্যান্ত হয়ে যদি উঠে আসে – তবুও সে দাবী করতে পারবে না এখানে কোনদিন জয়িতা বলে কোন মেয়ে ছিলো। একটা চুলও ফেলে আসেনি ওরা ওখানে।

হোটেলের ছোট্ট ঘরটাতে টিভি চলছে – ক্লান্ত তন্ময়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে জয়িতা। অজান্তেই ওর কপালে হাত বুলিয়ে দেয় তন্ময়।
বড় বড় চোখ মেলে ওর দিকে তাকায় মেয়েটা, ‘তন্ময়?’
‘হুঁ।’
‘কাল চলে যাবে?’ মেয়েটার গলা এবার বিষণ্ণ শোনায়।
মাথা দোলায় ও, ‘যেতে হবে। ছোট একটা কাজ বাকি আছে। সেটা শেষ করেই চলে যাবো।’
গুটিসুটি মেরে তন্ময়ের আরও কাছে আসে জয়িতা, ‘কি কাজ?’
শক্ত হয়ে যায় তন্ময়ের মুখটা, ‘জানতে চেও না।’

ধমক খেয়ে হাসিখুশি ভাবটা মুখ যায় না জয়িতার, বরং উঠে বসে বিছানাতে। চেপে ধরে শুইয়ে দেয় তন্ময়কে। জোর করে নিজের কোলে তুলে নিয়েছে ওর মাথাটা।
‘আচ্ছা, জানতে চাইবো না। চুপচাপ শুয়ে থাকো তো – তোমার মাথায় বিলি কেটে দেই। ঘুমাও একটু।’

জয়িতাকে এই মুহূর্তে তন্ময়ের ঠিক ইলোরার মত লাগে।
এক ছাদের নিচে ওরা ছিলো তিন মাস। মেয়েটা এভাবে কোলে তুলে নিত ওর মাথাটা। তারপর এভাবেই বলত, ‘বিলি কেটে দেই, হুঁ?’
মেয়েটা হুট করে ওর জীবন থেকে সরে গেল কেন? ড্যাশিং একটা ছেলেই কি সব নাকি? বেটার চয়েজ দেখতে পেয়ে অপেক্ষা করার মত বোকা ইলোরা ছিলো না।
তন্ময়ের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

কাচ ভাঙ্গার মত শব্দ করে হাসে জয়িতা, ‘এক্স গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে করতে হবে না। ঘুমাও।’
চোখ খুলে যায় তন্ময়ের, চোখে বিস্ময়ের ছাপ। মেয়েটা জানে কিভাবে?
ওর বুকে হাত বোলায় জয়িতা, ‘আমার পেশাটাই এমন গো, পুরুষ চিনতে হয়। নিঃশ্বাসে পুরুষ চিনতে হয়, দীর্ঘশ্বাসেও চিনতে হয়। নইলে ধ্বংস হয়ে যেতাম।’
জয়িতার হাত সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসে তন্ময় ওর পাশে, মেয়েটার জন্য হঠাৎই খুব মায়া হতে থাকে ওর।

‘কাল থেকে তো আর আমাদের দেখা হবে না, তাই না?’ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায় মেয়েটা। তন্ময় জোর করে চোখ সরিয়ে নেয়।
‘হবেই না – কে বলতে পারে?’ প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে তন্ময়, ‘বাদ দাও তো – তোমার ব্যাপারে বল। তারেকের সাথে জুটলে কিভাবে?’
মাথা নাড়ে জয়িতা, ‘শুনতে তো তোমার ভালো লাগবে না।’
মুচকি হাসে তন্ময়, ‘ঘুম আসছে না। আপত্তি না থাকলে বল।’
‘ময়মনসিংহের সবচেয়ে বড় ব্রথেল থেকে এসেছি আমি – শাইনিং।’ ধীরে ধীরে বলে মেয়েটা, ‘নাম শুনবে না। এসব কাজ প্রকাশ্যে চলে না। শাইনিংয়ের সাথে সারাটা জীবন ধরে আছি আমি। কারণ, ওখানেই আমার জন্ম। আমার মা ছিলেন এলাকার টপ খানকি।’

স্তব্ধ হয়ে শোনে তন্ময়, বলে যাচ্ছে দুঃখী মেয়েটা, ‘আমাকে সারাজীবন একজন বেশ্যা হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ছোট থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত – নিখুঁত একজন বেশ্যা বানানো হয়েছে আমাকে ধাপে ধাপে। শাইনিংয়ে কোন মেয়ে প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে ছেলে সন্তান না মেয়ে সন্তান পেতে যাচ্ছে – সেটা নিশ্চিত হওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করে ওরা। মেয়ে হলে আমার মতই শিখিয়ে পড়িয়ে উন্নত মানের বেশ্যা তারা বানিয়ে ফেলে। জীবনটা ওখানে এরকমটাই স্বাভাবিক।’
টপ করে এক ফোঁটা পানি পড়ে মেয়েটার হাতের ওপর, ‘আমার কুমারী জীবন ছিলো এগারো বছরের। যখন মা আমাকে বলল আজ রাতে আমি আরেকজনের সাথে ঘুমাবো – তখন আমার বয়েস ছিলো মাত্র এগারো। বয়েস চৌদ্দ পেরুনোর আগেই পুরোদস্তুর বেশ্যা হয়ে গেলাম। পড়াশোনা যথেষ্ট শেখায় তারা ওখানে। ভদ্রোচিত একটা উপস্থাপনা করতে পারলে অনেক বেড়ে যায় খানকিদের দাম।’

সান্ত্বনা দেয় না তন্ময়, তবে মেয়েটার কষ্ট ওকে স্পর্শ করে। এক হাত বাড়িয়ে ওকে ছোঁয় সে, ‘আর এখান থেকেই তোমাকে ভাড়া করে নিয়ে গেছিলো তারেক আদনান?’
‘সাতদিন আগে।’ চোখ মোছে জয়িতা, ‘নতুন কিছু তো আর না। এরকম স্পেশাল অর্ডার আমরা মাঝে মাঝেই পাই। টাকাটা একটু বেশিই আসে। তবে কাজকর্মের কোন পার্থক্য নেই। পুরুষ মাত্রই জানোয়ার।’
ইতস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলে তন্ময়, ‘আমাকে সাহায্য করলে কেন? আমিও একজন পুরুষ।’

জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা। ঘরের ঠিক মধ্যখানে হেঁটে যায়। তারপর আস্তে করে জামার চেইন খুলে ফেলে।
কোমর পর্যন্ত খুলে গেছে মেয়েটার পোশাক। কালো রঙের বক্ষাবরণী ছাড়া ওপরে আর কিছুই নেই। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় ও তন্ময়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে।
শিউরে ওঠে তন্ময়, এত সুন্দর মেয়েটার পিঠ ওটা? বীভৎস ভাবে কুঁচকে গেছে চামড়া। সম্ভবতঃ কাগজ কাটার ছুরির অবদান। ফালা ফালা করে ফেলা হয়েছে পিঠে মেরে মেরে। পরক্ষণেই কোমর পর্যন্ত চলে যাওয়া একটা সাপের মত দাগ দেখে ভুল ভাঙ্গে ওর।
কাগজ কাটার ছুরি নয়, পুরুষালী বেল্টের দাগ! রক্ত শুকিয়ে আছে ওখানে। বেশিদিনের পুরোনো ক্ষত নয়।

খাট থেকে উঠে দাঁড়ায় হতভম্ব তন্ময়, বিষণ্ণ গলাতে বলে যাচ্ছে জয়িতা, ‘এগুলো, তারেক আদনান নামক একজন পুরুষের অবদান। তাকে গুলি করার মুহূর্ত থেকে পুরুষ জাতির সেই শ্রেণি থেকে সরে গেছ তুমি।’
ওর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে পড়ে তন্ময়, আলতো করে ছোঁয় ক্ষতগুলো। এই প্রথম তারেক আদনানকে গুলি করার জন্য মনের কোথাও কোন খারাপ লাগা অনুভূতি নেই ওর। বিবেক আগে থেকেই ওর হেডঅফিসের অনেক নিচু একটা পদে কাজ করে, এখন একেবারে চুপ হয়ে গেছে।

‘কিভাবে বুঝলে না মেয়েদের ক্ষেত্রে তারেক আদনানের সাথে আমার কোন পার্থক্য আছে কি নেই? ব্যবসায়িক কারণে মারা গেছে তারেক। তোমাকে নির্যাতন করার জন্য তাকে গুলি করিনি আমি।’

মুচকি হেসে ঘুরে দাঁড়ায় জয়িতা, সামান্য পোশাকে ওর সুন্দর মুখ আর সুগঠিত বুকের দিকে চোখ পড়তে তন্ময় নিজের অজান্তেই ঢোক গেলে। গলা শুকিয়ে আসছে ওর। মেয়েটা কি সুন্দর! অথচ, কি ভাগ্য নিয়েই না জন্মেছে!
‘ওই যে বলেছিলাম -’
গলা খাঁকারি দিয়ে কথাটা শেষ করে দেয় তন্ময়, ‘রাইট। রাইট – আমাদের নিঃশ্বাসে চিনে ফেল কে কেমন হতে পারে।’

আলতো করে মেয়েটার জামা আবার পরিয়ে দেয় তন্ময়, যত্ন করে চেইন লাগিয়ে দুই কাঁধ ধরে সামনে দাঁড় করায় ওকে, ‘এই জীবনে কেন আছো? আমার সাথে কাল তুমিও চলো ঢাকায়।’
অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জয়িতা, ‘মানে?’
‘আমার অনেক কানেকশন, অনেক লিংক এখন। আজকের পর থেকে আরও স্ট্রং একটা পজিশনে চলে যাবো। তোমাকে ভালো একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়াটা এখন আমার পক্ষে খুব একটা কঠিন কিছু না।’
‘কেন করবে সেটা জানতে পারি?’ আচমকা শক্ত হয়ে যায় জয়িতার কণ্ঠ।

অবাক হয়ে দুই সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে তার দিকে তন্ময়, তারপরই বুঝতে পারে তার ভয়। উচ্চস্বরে হেসে ওঠে ও, ‘বোকা মেয়ে, তোমাকে নিজের জন্য নিয়ে যাচ্ছি না। নিয়ে যেতে চাইছি বন্ধুত্বের দাবীতে। এখানে পচে মরার তো কোন কারণ দেখি না তোমার।’
কৃতজ্ঞ একটা দৃষ্টি ফোটে জয়িতার মুখে আর কয়েক সেকেন্ড পর, তন্ময়ের শিশুর মত মুখটাতে কোন রকম শঠতার চিহ্ন সে দেখে নি।
তবুও গলাটা বিষণ্ণ থাকে মেয়েটার, ‘আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব কিসের? আমার পরিচয় তোমার অজানা নয়। এমনও নয় যে আমাকে অনেকদিন ধরে চেন। কেবলই না পরিচয়!’
হাসিমুখটা ম্লান হয় না তন্ময়ের, থুতনি ধরে জয়িতাকে বাধ্য করে ওর দিকে তাকাতে, ‘তুমি না থাকলে এতক্ষণে আমি শক্ত রুটি খেতাম হাজতে বসে, সেটা অজানা না তোমার। আর বন্ধুত্বে কোন ছোট বড় নেই। বোঝা গেছে?’

জয়িতার চোখে আচমকা পানি চলে আসে। জীবনে তার দিকে একটা মানুষও তাকায়নি স্বাভাবিক কোন দৃষ্টিতে।
প্রত্যেকের চোখে শুধু ছিলো ভোগ, লালসা, কাম, ওকে দেখা হয়েছে স্রেফ একটা উপাদেয় খাবার হিসেবে। তন্ময় ছেলেটা একটু আগেই একটা মানুষকে ঠাণ্ডা মাথাতে দুই বার গুলি করেছে – কিন্তু ছেলেটার ওই একটা দিকই নেই।
অন্যদিকটার পরিচয় পেয়ে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে নি। চোখের পানিটা তাড়াতাড়ি মুখে ঘরের অন্য পাশে চলে যায় ও তাড়াতাড়ি।
তন্ময়কে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করছিলো হঠাৎ করেই। কাজটা করা যাবে না। ছেলেটা মেয়েদের ব্যাপারে ঠিক যেভাবে ভাবে বলে ধারণা করে ছিল, সে ওরকমই। এদের ছুঁয়ে দিতে হয় না, একটু দূরত্ব রেখে দেখতে হয়।
হঠাৎ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েটি বলে মনে হয় ওর।

ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ – তন্ময়ের নিঃশ্বাস নিজের ঘাড়ে অনুভব করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না ও। ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বুকে। একে অন্যের ঠোঁট খেয়ে ফেলার যে অসম প্রতিযোগিতা তারা লাগিয়ে দেয় পরমুহূর্তে – দাঁতগুলো ছাড়া আর কেউ তার সাক্ষী থাকে না।
অথবা তারা ওটাই ভেবেছিলো।

কোন রকম আগাম সংকেত না দিয়েই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে হোটেল রুমের দরজাটা।
উজ্জ্বল টর্চের আলো ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ল চার-পাঁচজন মানুষ। প্রতিটা আলো ফেলা হয় ওদের চেহারাতে।

‘মাগীর হুক দেখো!’ গর্জন করে ওঠে ওদের একজন, ‘কাস্টোমার ছুইটা গেছে – সেই ফাঁকে ফ্রিতে ক্ষ্যাপ মারতাছে।’

খপ করে জয়িতার হাত ধরে মেয়েটিকে সরিয়ে নেয় আরেকজন, ‘ফিইরা চল। যাইতে হবে আমাদের এখন।’

তন্ময়ের মাথাতে রক্ত উঠে যায় – এক পা এগিয়ে এসেছে বিদঘুটে লোকটার দিকে – একই সাথে নড়ে ওঠে দুই বিশালদেহী। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা শুধু অনুভব করার সময় পেল তন্ময়। তারপর পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে খেয়াল করলো হোটেলের পুরোনো জানালা তার ওজন নিতে পারেনি, ভেঙ্গে গেছে।

দুই তলা থেকে খসে পড়ছে ও নিচে!

৫.
বাইরের বৃষ্টি থেমে গেছে। কালো গাড়িটা থেকে হাল্কা পায়ে নেমে আসে তন্ময়। ইলোরার ফ্যাকাসে মুখটার দিকে তাকিয়ে হাল্কা হাসে।
‘ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন? যাবো আর আসবো।’
ড্রাইভিং সীট থেকে নেমে এসেছেন ইলোরার ড্রাইভার-কাম-বডিগার্ড মারুফ ভাই, ‘আমিও যাবো।’
কাঁধ ঝাঁকায় তন্ময়, ‘অযথা কষ্ট করছেন। মতিন ভাই আমাকে চেনেন। এখানে কোন ঝামেলাই হবে না।’
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয় ইলোরা, ‘অদ্ভুত কথা বলবি না তো। মতিন ভাই নিজেই ঝামেলায় আছে বলে আমার মনে হচ্ছে।’

চোখ মটকালেন মারুফ ভাই। এরপর আর আপত্তি করা যায় না।
ছোট কিন্তু ছিমছাম বাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়ে ওরা। দোতলা একটা বাড়ি। সাদা রঙের দেওয়ালগুলো আর ওপরের খয়েরী রঙের চালমত ছাদ দেখে মনে হতে পারে এটাকে স্রেফ ছবি থেকে তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে।

এত টাকা মতিন ভাই কিভাবে পেয়েছেন তা এলাকাবাসী পর্যন্ত জানে। বেশ্যা-ব্যবসা থেকে।

ময়মনসিংহ থেকে পরদিনই ঢাকাতে চলে আসতে হয়েছিলো তন্ময়কে। একে তো এর পরের কয়েকদিন দেশ গরম রাখার মত একটা খুন করে এসেছে। আবার ‘শাইনিং’-এ এসে ঝামেলা করলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। ঢাকায় ফেরার পর ও জেনেছে জয়িতার সাথে সেদিন কী ঘটেছিল।

মেয়েটির কন্ট্যাক্ট যে গুলি খেয়ে মারা গেছে – সেটা ‘ব্রথেল শাইনিং’ জানতে পেরেছিল তিন ঘণ্টার ভেতরই। তখনই তাদের মাথাব্যথার শুরু, তাদের টপ খানকি কি এই সুযোগে পালিয়ে গেল? নাকি ফ্রি-তে ‘ক্ষ্যাপ মারতে’ বের হয়েছে সে?
দুটোই শাইনিংয়ের জন্য ক্ষতির কারণ, খোঁজ খবর নিয়ে তন্ময়দের হোটেলে থাকার ব্যাপারে জানতে তাদের তেমন কষ্ট হয় না। হোটেলগুলোর সাথে সব সময়ই মাগিপাড়ার দহরম মহরম। দুটো ফোন দিয়েই বের করে ফেলা গেছে।

তারপর হোটেলে ঢুকে ওদের যে অবস্থায় তারা পেয়েছিল, লোকগুলো ধরেই নেয় জয়িতা ‘শাইনিং’কে বাটোয়ারা না দিয়ে শুধু নিজের জন্য দুই এক রাত রোজগার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কাজেই তাকে ধরে আবার শাইনিংয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে রেগুলার কাস্টোমারদের কাছে তার ডিমান্ড আছে। এক রাত তার বাইরে থাকা মানে বড় অঙ্কের ক্ষতি।

তন্ময় শাইনিংয়ে ফিরে এসেছিলো ঠিক দেড় মাস পর।
তবে জয়িতাকে ওখানে পায় নি। বড় অংকের টাকার টোপ ফেলার পর ম্যানেজার শুধু জানায় ঢাকাতে চালান করে দেওয়া হয়েছে তাকে। প্রস্টিটিউট-ট্রেডিং হয়েছিলো ‘রজনী ব্রথেলে’র সাথে। জয়িতার ডিমান্ড ময়মনসিংহে পড়ে আসছিল, কাজেই তার সাথে ‘লিয়া’ নামক আরেকজনে অদলবদল করেছিল ব্রথেল দুটো। আরেক বেশ্যা বিন্দুকেও ট্রেড করা হয়েছে লতিকার সাথে।

রজনী ব্রথেলে জয়িতাকে খুঁজেছে তন্ময়, পায়নি সেখানে। কাস্টোমারের বেশে এসে অন্য কোন এক ব্রথেল খুব ভালো প্রস্তাব দিয়েছিলো রজনীর চারজনকে। এক রাতে চারজনই পালিয়ে গেছে। কোথায় গেছে সেটা রজনীর ম্যানেজার জানে না।

সবচেয়ে লম্বা হাত যে মতিন ভাইয়ের – সে গালকাটা মতিন ভাইও গত কয়েকদিন ধরে লুকিয়ে আছেন। শাইনিংয়ের বিন্দু অবশ্য রজনীতেই ছিলো। ফোনে আলাপ করেছিলো তন্ময় তার সাথে। তবে ওটা যথেষ্ট হয়নি, কাজেই পাঠিয়েছিলো ইলোরাকে। এখন ইলোরা বলছে, ওখানে গিয়ে বিন্দুকে মৃত পেয়েছে সে!

এই মুহূর্তে মারুফ ভাইয়ের সাথে হাঁটতে হাঁটতে পিঠের কাছে শির শির করে ওঠে ওর। কেউ একজন অদৃশ্য থেকে যেন চাইছে না ও জয়িতাকে খুঁজে পাক। মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত ধরণের একটা টান অনুভব করেছে ও, সেই প্রথম চুমুর সময় থেকে। ইলোরা প্রথমে শুনে তো রীতিমত অপমান করেছিলো ওকে। এত থাকতে তন্ময়ের মত দারুণ একটা ছেলে কিভাবে একজন প্রস্টিটিউটের সাথে মাথা কুটে?

মেয়েটির সাথে আজকের বন্ধুত্ব নয় ওর। মাঝে লিভ টুগেদার করেছে বলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নি, বরং আরও হয়েছে গাঢ়। তন্ময়ের জীবনে এই জয়িতা মেয়েটার গুরুত্ব আছে, সেটা বুঝতে অবশ্য ইলোরার বেশি সময় লাগেনি। এসব ব্যাপারে ওদের হয়তো ষষ্ঠইন্দ্রীয় প্রখর হয়।

এদিকে ইলোরা বেশ্যাবৃত্তি একেবারেই দেখতে পারে না। জয়িতাকে তন্ময়ের জন্য বিশেষ ছাড় দিলেও জগতের আর বেশ্যাদের নাম শুনতে সে নারাজ। বিন্দুর সাথে কথা বলতে রাজি হওয়ায় তন্ময় খুশি হয়েছিল – ইলোরাকে পাঠাবার কারণ, বেশ্যাপাড়ার মেয়েদের পুরুষের প্রতি ঘৃণা। ইলোরাকে বিন্দু যত সহজে তথ্য দেবে, তন্ময়কে দেবে না। পুরুষ ঘৃণা করার যথেষ্ট কারণ তাদের আছে।

‘কলিং বেল তো নষ্ট দেখি।’ বিরক্ত হয়ে বললেন মারুফ ভাই।
বার দুই বেল চেপে দেখে তন্ময়ও, ‘তাই তো। আরেকটা রাস্তা বের করতে হবে।’
চারপাশে তাকায় ও বাড়িটার। একেবারে রাস্তার সাথে বানিয়েছে। দরজা ভাঙ্গতে গেলে নির্ঘাত লোকজন জড় হয়ে যাবে। আর বাই অ্যানি চান্স, মতিন ভাইয়ের অবস্থা বিন্দুর মত হলে পরিস্থিতি ওদের হাতে আর থাকবে না।

‘পেছনের দিকটা দেখে আসি, চলো।’ প্রস্তাব রাখেন মারুফ ভাই।
না মেনে উপায় কি? দরজা তো “চিচিং ফাঁক” বললেই খুলে যাচ্ছে না। দুইজন ঘুরে পেছনের দিকে চলে আসে।
রান্নাঘরের পাশের ছোট দরজাটা চোখে পড়তেই একে অন্যের দিকে তাকায় ওরা। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি।

‘পিস্তল এনেছ?’ জানতে চান মারুফ ভাই।
মাথা নাড়ে তন্ময়, ‘না। সকালে বের হয়েছি যখন, ভাবিনি দরকার পড়বে।’
‘আমার পেছনে থাকো। একটাতেই চলবে।’ কোমর থেকে একটা টানে অস্ত্রটা বের করেন মারুফ ভাই।

আস্তে করে একটা ঠেলা দিতেই দরজাটা হা করে খুলে যায়। কাওকে দেখা যাচ্ছে না এখান থেকে।
জুতোর কোন শব্দ না করে সাবধানে আরও ভেতরে ঢুকে যায় ওরা। পুরো বাড়িটা একেবারে শান্ত হয়ে আছে। বাইরে থেকে কিছু পাখির ডাক শোনা যায় – এছাড়া আর কোন শব্দ নেই কোথাও।
দোতলায় ভূতের মত নিঃশব্দে উঠে আসে ওরা। একেবারে উত্তর দিকের ঘরটাতে চোখ পড়তেই পা থমকে যায় তন্ময়ের। টকটকে লাল রঙের বের হয়ে এসেছে ঘরটা থেকে। খুবই সামান্য পরিমাণে। ভেতরে কি চলছে বোঝার জন্য জ্যোতিষী হবার কোন প্রয়োজন নেই – এক হাত বাড়িয়ে পিতলের ভাস্কর্যটা তুলে নেয় তন্ময়। একেবারে খালি হাতে যাওয়ার থেকে এ বরং–

দরজাটা পেরিয়ে প্রথম চোখে পড়ল মতিন ভাইয়ের দিকে। লোকটার নাম কবে তেকে ‘গালকাটা মতিন’ হয়েছে তা ওর জানা নেই। তবে এই অবস্থাতে কেউ দেখলে তাকে ‘গলাকাটা মতিন’ নামে অনায়াসে ডাকা শুরু করতে পারে।

দ্বিতীয় শরীরটার দিকে নজর পড়তে ওর হাত থেকে লম্বা পিতলের লাঠিটা পড়ে যায়।

একটা চেয়ার উল্টে পড়ে আছে।
হতভাগ্য মেয়েটা মৃত্যুর আগে ছটফট করার সময় চেয়ারে পা বাঁধিয়েছিল নিশ্চয় – তাতেই উল্টে গেছে ওটা।
ফর্সা গলাটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর ক্যানভাসে আঁকা অদ্ভুত এক ছবিটার মত মনে হচ্ছে দৃশ্যটাকে। কয়েক ঘণ্টা আগে বের হয়ে যাওয়া রক্তগুলো হাল্কা জমাট বেঁধে থকথকে একধরণের ঘন তরলে পরিণত হয়েছে, রঙ পাল্টে হয়ে গেছে কালচে লাল।

জয়িতা!

বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ওর – কাঁদতে চাইছে, ফোঁপাতে চাইছে, চিৎকার করতে চাইছে, সব কিছু ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে – কিন্তু কিছুই করতে পারে না ও।
পেছন থেকে মারুফ ভাইয়ের গুরুগম্ভীর গলাটা শোনা যায়, ‘বেডটাইম, শুয়োরের বাচ্চা।’

পিস্তলটা তুলে একবার আঘাত করেন তিনি তন্ময়ের ঘাড়ে।
কাটা কলাগাছের মত জয়িতার রক্তের ওপর শুয়ে পড়ে ও।

৬.
‘তোমার প্রেম দেখে তো আমারই চেতনাদণ্ড দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো।’ ঘোলা ঘোলা চোখে তাকানোর সাথে সাথে প্রথম এই কথাটাই শোনে তন্ময়।
দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে দেরী হয় না ওর, ‘অ্যান্টি পার্টি।’
ঘর কাঁপিয়ে হাসেন মারুফ ভাই, ‘আর কে? তোমার দুলাভাইকে আশা করনি নিশ্চয়?’
‘ধরেছেন কেন আমাকে?’

শান্ত গলাতে প্রশ্ন করে এখন তন্ময়। জয়িতাকে নিয়ে হা-হুতাশের সময় এটা নয়, স্পষ্ট বুঝতে পারছে কেন তাকে আটকে ফেলা হয়েছে। বিরোধী দলের লোক এই মারুফ ভাই, এটা এখন স্পষ্ট। আর তার প্রতি আক্রোশ থাকার কারণ একটাই হতে পারে। তন্ময়দের দলের সেক্রেটারির মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো বিরোধীদল।

তাদের ওপর এমন একটি দায় চাপিয়ে দিয়েছিল তন্ময়, যে অপরাধটি তারা করেনি। আঙুল তোলা হয়েছিলো, মামলা করা হয়েছিলো, বিরোধীপক্ষের ১৪ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে জেলখানায় ভরে দেয়া হয়েছে, ইমেজের বাজানো হয়েছিল বারোটা। এদের মধ্যে অন্তত ৫ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে, সবাই জানে।

সব মিলিয়ে মাজা ভেঙে দেয়ার সব কাজই সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলাফল হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে এবার তাদের হয়তো হারতে হবে। কোন অন্যায় না করেও মাথা পেতে নিতে হবে শাস্তি। কাজেই পালটা আঘাত হানতে চাওয়া দোষের কিছু নয়।

এখন মারুফ ভাই তাকে কেন চেয়ারের সাথে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে রেখেছেন সেটা বেশ ভালোই বোঝে ও। এভাবেই অষ্টম অপারেশনের সময় রিজভী নামক এক পাতিনেতাকে ধরেছিলো ওরা। নিজের দলের ওপর থেকে মিথ্যে অভিযোগ সরাতে স্বীকারোক্তি দরকার ছিলো।

মারুফ ভাইয়ের হাতের হাতুড়িটা দেখে বোঝা যায়, খুন তিনি করবেন না, তবে স্বীকারোক্তি আদায় করে ছাড়বেন।

প্রশ্নটাও তন্ময় জানে : “তারেক আদনানকে কে খুন করেছিলো?”

মারুফ ভাই মুচকি হাসছেন, ‘কেন তোমাকে ধরে এনেছি তা বুঝতে তো কষ্ট হওয়ার কথা না। জয়িতা নিয়ে তোমার অবসেশন আমাদের নজরে পড়েছে। মনে করছ, তোমাদের মাথামোটা তারেক আদনান যে এক বেশ্যার সাথে থাকতো ময়মনসিংহে – সেটা আমাদের জানা ছিলো না? ঠিক সেই বেশ্যার ব্যাপারেই কেন এত আগ্রহ দেখাবে আরেকজন একই দলের লোক?’
‘নাটকীয় পরিচয় ছিলো আমার আর জয়িতার।’ শুধু এতটুকুই বলল তন্ময়, পুরো ঘটনা শুধু ইলোরা জানে, এই লোকের কাছে ইলোরা ওকে বিক্রি করে দিয়েছে কি না তা ওর জানা নেই। তবে ধরে নেয়, দেয় নি। সুযোগ কাজে লাগিয়েছে মারুফ সম্ভবতঃ।
‘নিশ্চয়, অপারেশন – কিলিং তারেক আদনানের সময় সেই নাটকীয় পরিচয়? ডেট আমাদের কাছে কালেক্ট করা আছে। ওই সময় তুমি তার সাথেই ছিলে।’
কাঁধ ঝাঁকায় তন্ময়, ‘তারেক আদনান ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিলো। বিশেষ একটা মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে তখন দুইজনই ময়মনসিংহে ছিলাম।’
‘তাই?’ সরু চোখে তাকান মারুফ ভাই, ‘শেষ দিন তাহলে তারেকের মাগী তোমার বিছানাতে আসলো কী করে?’

চুপ হয়ে যায় তন্ময়।
এত কিছু জানার কথা নয় মারুফের। নিঃসন্দেহে ইলোরা সব বলে দিয়েছে। মেয়েটাও পার্টিতে ঢুকেছে নাকি?
তন্ময়ের জানা ছিলো না।
মারুফ ভাই হাতুড়ি নিয়ে এগিয়ে আসছেন। নির্যাতনটুকু হবে অবর্ণনীয়, জানে তন্ময়। ঠিক এভাবেই নির্যাতন করেছিলো ওরা পাতিনেতা রিজভীকে।

পিটিয়ে একটা একটা আঙুল ভেঙ্গে ফেলেছিলো ওরা। তারপর ইঞ্চি ইঞ্চি করে দুই হাতের চামড়া ছিলে ফেলেছিলো লোকটার। তারপরও কথা বলেনি হারামজাদা। তলপেটে দুইবার চাকু মেরেছিলো তন্ময় নিজ হাতে।
তার আধঘণ্টা পরও যখন অসহ্য গোঙ্গানী ছাড়া আর কিছু বের হয়নি লোকটার মুখ থেকে – রাগ সামলাতে না পেরে গলাতে চাকু লাথি মেরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ও।
আজ কি তার সাথে একই কাজ হতে যাচ্ছে? ওই পার্টির রিজভী সহ্য করেছিলো, তবুও স্বীকার করেনি।
আজ তন্ময় পারবে তো?

গলায় ছুরি নিয়ে ফোঁপানোর মত শব্দ করতে করতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে মারুফ ভাই, তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তন্ময়। তিক্ত সত্যটা মাত্র উপলব্ধি করতে পেরেছে।

পেছনে থর থর করে কাঁপছে ইলোরা।
কখন যেন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে, ঢুকে পড়েছে এই বাড়ির ভেতর। তার কাঁপাকাঁপির রহস্যও স্পষ্ট; এই মাত্র মারুফ ভাইয়ের গলায় আস্ত একটা চাকু গাঁথিয়ে দেওয়ার মানসিক ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি বোধহয়।

‘হাত খুলে দে। কুইক!’ চাপা কণ্ঠে হুংকার দেয় তন্ময়।

পরিশিষ্ট
জন্তুর মত চিৎকার করছে ইলোরা, কান পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে পড়লো তন্ময়ের। সুইয়ের মত চিকন শিকটা ওপর থেকে ঢুকিয়ে স্তনের নিচ দিয়ে বের করে আনল আবারও।
তড়পে উঠছে মেয়েটার পা দুটো, দেখে সামান্যতম অনুকম্পা হয় না তন্ময়ের মনে।

‘আমার স্বীকারোক্তি বের করতে সব নাটক সাজানো হয়েছে – এটা খুবই ভালো একটা গল্প। কিন্তু তার জন্য বিন্দু আর জয়িতাকে কেন খুন হতে হবে? গল্পের অসমাপ্ত প্রশ্ন যে থেকে যাচ্ছে, ডিয়ার ইলোরা।’
‘আমি জানি না – ওহ গড – আমি জানি না -’ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে ইলোরা, মেয়েটাকে এখন আরও সুন্দর লাগছে – মনে মনে স্বীকার করতেই হয় তন্ময়কে।

আচ্ছা, যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় কি মেয়েদের রূপ বেড়ে যায়?

‘মারুফ বেচারাকে পর্যন্ত টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছ তুমি, ইলোরা। জানতে তার মত সে এগিয়ে যাবে – পার্টির স্বার্থে দুটো বেশ্যা খুঁজে বের করা অথবা খুন করা তার জন্য ব্যাপারই না। তাছাড়া, মৃত্যুর আগে জয়িতার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিও নিতে পারছে সে। কিন্তু, জয়িতার গলাতে ছুরি চালানোর দরকার ছিল না। জ্যান্ত জয়িতা আদালতে ভালো সাক্ষী হতে পারতো। কার হাত ছিলো ওই ছুরিটার হাতলে?’
‘আমি জানি না, প্লিজ, তন্ময়। পাগল হয়ে গেছ তুমি – একটা প্রস্টিটিউটের মৃত্যুতে -’

বিদ্যুতবেগে বাম হাতে হাতুড়িটা তুলে এনে দড়াম করে আছড়ে ফেলে ও মেয়েটার বাম পায়ের আঙুল গুলোর ওপর।
বিশ্রী একটা কড়মড় শব্দে ভরে যায় মাটির নীচের ঘরটা। আজ বিকেলে এখানেই নিয়ে এসেছে ও ইলোরাকে।

মেয়েটার গলা ভেঙ্গে গেছে চেঁচাতে চেঁচাতে। কুমীরের নিঃশ্বাস নেওয়ার মত শব্দ বের হচ্ছে এখন তার মুখ দিয়ে। হাত তুলে অন্য পায়ের ওপর হাতুড়ি নিয়ে আসে তন্ময়, ‘কে ছুরি মেরেছিলো? সত্য স্বীকার করে নাও – মুক্তি দেবো তোমাকে। নাহলে প্রতিটা হাড় ভাঙ্গব আজ তোমার।’
ঠাণ্ডা কণ্ঠটা তেমন ছোঁয় না ইলোরাকে বরং ছুঁয়ে যায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা – বাম পায়ের নিচের দিকটা গরম হয়ে গেছে, ফুলছে। হাড়গুলো ভেঙ্গেই ক্ষান্ত দেয়নি – থেঁতলে গেছে মাংস।

হাতুড়িটা শক্তি দিয়ে ডান পায়ের ওপরও নামিয়ে আনে তন্ময়, চোখ থেকে ঝর্ণার মত পানি বের হয়ে আসে ইলোরার। সত্যটা বললে ওকে মেরেই ফেলবে তন্ময়, কিন্তু আর যে পারছে না যন্ত্রণা সহ্য করতে!

‘আমি। ওহ প্লিজ, তন্ময়, আমি মেরেছি মাগীকে। তোমার সাথে আর কাওকে সহ্য হয় না আমার – যা করেছি তোমাকে ভালোবেসে – মরে যাচ্ছি তন্ময়, খুব ব্যথা, আমাকে খুলে দাও?’ হাঁফায় মেয়েটা, তন্ময় কিছু বলে না।
‘মারুফের ব্যাপারটা কন্ট্রোলে রেখেছিলাম, তন্ময়, তোমার কোন ক্ষতি হতে দিতাম না আমি – কিন্তু ওই বেশ্যাকে তোমার হতে দিতে পারতাম না আমি – প্লিজ বোঝ একটু- ‘ চোখ দিয়ে পানি পড়ার যেন কোন বিরাম নেই – তার মাঝেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলাতে বলে ইলোরা, ‘আমাকে খুলে নামাও? অনেক ব্যথা যে! পিপাসা খুব – একটু পানি খেতাম -’

খুব কাছে চলে আসে তন্ময়, বার দুই গাঁথিয়ে দেয় হাতের চাকুটা ইলোরার তলপেটে।
হেঁচকি ওঠানোর মত শব্দ হচ্ছে এখন মেয়েটার মুখ দিয়ে।
মরবে ও, তবে অনেক সময় নিয়ে।

ওর সামনে থেকে ঘুরে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য এগোয় তন্ময়। পেছনে কাতরাচ্ছে ইলোরা – দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয় ও।
খারাপ একটা মেয়ের রক্ত লেগে আছে শরীরে, গোসল করতে হবে।

— ০ —
রচনাকাল – সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪

close
চতুরঙ্গ

আমার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে স্বাগতম!

সাপ্তাহিক চতুরঙ্গ ইনবক্সে পাওয়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন! এতে আপনি প্রতি সপ্তাহে পাচ্ছেন আমার বাছাইকৃত চার লেখা!

আপনার কাছে কোন স্প্যাম ইমেইল যাবে না। নিউজলেটার ইমেইল ইনবক্সে খুঁজে না পেলে স্প্যাম কিংবা প্রমোশনাল ফোল্ডার চেক করুন!

Default image
কিশোর পাশা ইমন

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Articles: 83