KP Imon

Words Crafted

স্ল্যাং

‘শালার পুতেরে আজ ফাইড়া লামু।’
তুষারের ফুলে ওঠা নাকের দিকে চিন্তার সাথে তাকিয়ে থাকে রেজা। চিন্তিত মুখ হওয়ার কারণ আছে।
যাকে শালার পুত বলে সম্বোধন করা হচ্ছে সে ওদের কলেজেরই একজন ছাত্র এবং এই শালার পুতকে তুষার ফাঁড়তে পারবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সাইজে ওপরে এবং পাশে সে তুষারের দেড়গুণ করে এগিয়ে। মানুষটার নাম ইন্তিসার।
ঘরের মাঝে ফোঁত জাতীয় একটা শব্দ এই সময় হল। শব্দের মালিক নেই, তবে মালকিন আছে।
তন্বীকে দেখা যায় একটা সুন্দর টিস্যু বের করে নাকে হাল্কা ঘষা দিতে। মেয়েটার সব সুন্দর, নাকও সুন্দর। শুধু কান্না করার ধরণটা সুন্দর না। কেমন একটা পেঁচী পেঁচী ভাব এখন চলে এসেছে। রেজা ওদিকে তাকায় না।
‘থাক, মারামারি করার দরকার নাই।’ পেঁচীটা বলল।
ঘরের শেষ সদস্য হুমায়ূনপ্রেমী আসাদ মাথা নাড়ে এবার, ‘অবশ্যই দরকার আছে। একশবার দরকার আছে। নারী হল পবিত্র জাতি। মাতৃপ্রতিনিধি তারা। নবীজি বলেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সেই জাতিকে অপমান! ইন্তিসারের চামড়া আমরা খিঁচবো।’
‘এর মাঝে আবার খেঁচাখেঁচি কেন?’ আহ্লাদী কণ্ঠে তন্বী জানতেই চায়।
‘না না…’ ভুল ভাঙ্গাতে এগিয়ে আসে তুষারই, ‘ওটা হল চামড়া খেঁচা। মানে, ইন্তিসারের চামড়া- তুলে নেব আমরা। তারপর সেটাকে পা দিয়ে খুঁচব। চামড়া হবে খেঁচা।’
আসাদ কাজের কথায় চলে আসে, ‘এই বাবা-মার অবৈধ সন্তানকে আমরা পাচ্ছি কোথায়?’
হেঁচকি ওঠার মত একটা শব্দ করে তন্বীর কান্না থেমে যায়, ‘আংকেল-আন্টি – কিভাবে জানো তুমি?’
আবার এগিয়ে আসে তুষারই, ‘আরে ওই গদ্যকারের কথা ধরছ কেন? ও বলতে চেয়েছে হারামজাদা ছেলেটাকে পাচ্ছি কোথায়?’
‘ইন্তিসারের সাইজ দেখেছিস? ভোটকা হালায়। সহজে পারা যাবে না।’ প্রথমবারের মত রেজা মুখ খোলে এখানে।
‘মারামারির দরকার…’ তন্বী কথা শেষ হওয়ার আগেই আসাদ একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি দেয়। যার অর্থ, দরকার আছে।
‘রেঞ্চ বাইর কর। আংকেলের গ্যারাজে থাকতে পারে।’ পরামর্শ দেয় তুষার।
‘অস্থিমজ্জাতে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত পড়লে সেটা সহজে নিরাময় করা যায় না। যন্ত্রণা তাকে আমরা দেবো, আর ওটা থাকবে মাসব্যপী।’ আসাদের মন্তব্য।
চোখ পাকিয়ে তাকায় রেজা, ‘হাওয়ার নাতি – তুমি সোজাসাপ্টা কথা বলা শিখো। বইয়ের ভাষা টোটানো লাগবে না। বললে কি সমস্যা যে হাড্ডিতে রেঞ্জের বাড়ি পড়লে হালার পো একমাস নড়তে পারবে না?’
তন্বীর কানে নতুন শব্দটা ঘুরছে। চোখে আরেকবার টিস্যু চালিয়ে জানতে চায়, ‘টোটানো মানে কি?’
এদিক ওদিক তাকায় রেজা সাহায্যের আশাতে। এলিট মেয়েগুলো কী! ছেলেরা গালি ছাড়া কথা বলতে পারে নাকি? এর মাঝে এসে বসে থাকে। এরা আবার হয় অতি সভ্য। বাজে কথা বলতে নারাজ। শুনতেও। অনেক মেয়ে ছেলেদের ব্রাদারহুড সম্পর্কে কিছুই জানে না।
এখনও!
সাহায্যে আবারও তুষার, ‘ও কিছু না। একটা গালির কাছাকাছি শব্দ।’
আরেকটু ধরিয়ে দেয় আসাদ, ‘শুরুটা চ-বর্গের একটি অক্ষর দিয়ে।’
ঘাড় মটকায় রেজা, ‘প্রথমটা।’
পরিস্থিতি বুঝে তন্বী একেবারে চুপ।
আসাদদের বাসায় ওরা আছে। তাই নিশ্চিন্ত। ছেলেটার বাবা-মা প্রথম শ্রেণির। এখন ও যাচ্ছে রেঞ্চ আনতে। রেজাকে ‘ফাঁড়তে’ হবে।
আসাদের বাবা-মা ভাগ্য এতটাই ভালো, সহপাঠী থেকে শুরু করে এলাকাবাসী তাকে হিংসে করে। তার কোন কথায় তাঁদের অমত নেই। ছেলেটা গুন্ডা হতে পারতো, তা না করে সে হচ্ছে লেখক। সারাদিন লেখে। কাগজে-কলমে। হাজার চেষ্টা করেও তাকে কম্পিউটারে লেখা শেখানো যায়নি।
আসাদের যুক্তি, ‘টাইপ শিখতে আমার যে সময় লাগবে তাতে আরও দুটো ছোটগল্প আর এক উপন্যাসের অষ্টমাংশ লেখে ফেলা যাবে।’
এই মুহূর্তে আসাদ নিচের দিকে নেমে যায়। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। এত বড় মাপের বড়লোক ঘরের সন্তান হয়েও আসাদের মাঝে মধ্যবিত্তদের ছোঁয়াই বেশি কাজ করে। তাদের সাথেই সে ঘোরে। এমনকী সেরকম কলেজেই তাকে পড়ানো হয়। বাংলা মিডিয়াম। আসাদের বাবা নিজে মধ্যবিত্ত ছিলেন বলেই উচ্চশ্রেণিতে একটি নির্দিষ্ট বয়েসের আগে ছেলের প্রবেশ করেছেন নিষিদ্ধ।
ছেলে তুলনামূলক দরিদ্র ছেলেমেয়েদের সাথে চলবে। জীবন কতটা কঠিন শিখবে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবে উচ্চবিত্তের ছোঁয়াতে। তাহলে তার গোল্লায় যাওয়ার সুযোগ নেই।
এই মুহূর্তে আসাদের বাবার মুখ এজন্য হয়ে আছে গম্ভীর। ছেলের কাছে আজ এক মেয়ে এসেছে। যে ফেরারী মেয়েটি ড্রাইভ করেছে– সেটা উচ্চবিত্তের পরিচয় বহন করে। ছেলে কলেজে পড়ে এখন। যথেষ্ট বড় হয়েছে, একটা প্রেম সে করতেই পারে। থাকতে পারে একজন গার্লফ্রেন্ড।
এসব তিনি বোঝেন এবং মানেন। মেয়েটাকে যথেষ্ট আপসেট বলে মনে হয়েছে। সম্ভবতঃ প্রেম-বিষয়ক জটিলতা। কিন্তু এরকম একটি মেয়ের সাথে আসাদ চলবে কেন? বড়লোকের ছিঁচকাদুনী মেয়ে জীবনের কি বোঝে? ছেলে তো নষ্ট হবে দেখা যায়।
লোয়ার ক্লাস ফ্যামিলির সংগ্রামী মেয়ে কি ছিল না একটাও এদেশে?
ঠোকা না খেলে কেউ বড় হতে পারে না। ‘ঠোকা’টা যে আসাদ কবে খাবে! ছেলের ভবিষ্যত চিন্তাতে কালো হয়ে যায় আসাদের বাবার মুখটা। আরও কয়েক ডিগ্রী।
তবে মেয়েটা সুন্দর আছে। লম্বা এবং ফর্সা। চেহারার খাঁজে খাঁজে আভিজাত্য। এই কারণেই অবশ্য তিনি চান না ছেলের সাথে ওরকম কোন মেয়ের প্রেম হোক। কারণ এরা হল ‘পৃথিবী’ নামক গেমটির চীট-কোড সুন্দরী। অভিজাত বংশের মাঝে বিয়ে হয়ে হয়ে এদের জন্ম। ফিল্টারড। আর্য। চীটকোড দিয়ে খেলাটা রহমান সাহেবের পছন্দ না।
চায়ের কাপটা তিনি মাত্র টেবিলে রেখেছেন, চুপ চুপ করে তার পাশে এসে দাঁড়ায় আসাদ।
‘বাবা? ব্যস্ত?’ শুরুতেই জানতে চায় ছেলে।
একটু হাসেন রহমান সাহেব, ‘না রে। কিছু বলবি?’
‘বড় দেখে একটা রেঞ্চ লাগবে। তোমার গ্যারেজে আছে না?’
‘তা আছে। কেন?’ অবাক হন তিনি।
স্বাভাবিকভাবেই বলে আসাদ, ‘ইন্তিসার নামে আমাদের ক্লাসে এক ছেলে আছে। অনেক লম্বা আর স্বাস্থ্যবান।’
রহমান সাহেবের বুঝতে এবার আর সমস্যা হয় না, ‘ও, ছেলেটার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে? আমাদের ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দাও। ওর লোকেশন জানো তো?’
ঘাড় শক্ত হয়ে যায় আসাদের, ‘না। গাড়ি ওর ঠিক আছে। রেঞ্চ লাগত অন্য কারণে।’
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেব।
‘মানে, ওটা দিয়ে মারতাম আর কি।’ জানায় আসাদ।
রহমান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখে মুখে হতচকিত ভাব। তারপর ছেলেকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন বাড়ির বাইরের দিকে। গ্যারেজে ঢুকেও হাত ছাড়লেন না। তারপর টুলবক্স খুললেন। সবচেয়ে বড় রেঞ্চটা বের করে তুলে দিলেন আসাদের হাতে।
‘যা, ব্যাটা। ফাটিয়ে দে। একেবারে ফেঁড়ে ফেলবি!’ হুংকার দেন তিনি।
খুশির সাথেই হাতে রেঞ্চ নিয়ে বাসার দিকে রওনা দেয় আসাদ। এই না হলে বাবা!
পেছনে চমৎকার হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেবও। ছেলে ‘ঠোকা’ খেয়েছে। এটাই এখন সবচেয়ে বড় কথা।
নাহ, বড়লোকের মেয়েরা সবাই অকাজের হয় না দেখা যাচ্ছে। ধারণা পাল্টানোর শপথ নিতে নিতে মূল বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যান তিনি।

দুই
যাকে ফাটিয়ে আর ফেঁড়ে ফেলতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ তুষারের ‘শালার পুত’ ইন্তিসার এই মুহূর্তে একটা চায়ের দোকানে বসে আছে।
শার্টের ডান হাত গেছে ছিঁড়ে। বেকায়দাভাবে বাতাসে উড়ছে ওই অংশটা। সেই হাতে আধ-টুকরো কলা আর এক টুকরো রুটি। এটা খেলে দিনের প্রথম ও শেষ খাওয়াটা তার হয়ে যায়। এরপরে একটা সিগারেট। গোল্ডলীফই ইন্তিসারের পছন্দ। কিন্তু এই কলা আর রুটির দাম মেটাতে গেলে ওর আর গোল্ডলীফ কেনার টাকা থাকবে না। শেখ খেতে হবে মনে হচ্ছে আজকে।
টাকা মানুষকে শ্রেণিতে ভাগ করে। আর ক্ষুধা আনে এক কাতারে। ব্যাপারটা ইন্তিসার ভালোই টের পাচ্ছে। ওর সামনে বসে থাকা ছেলেটার নাম নিতাই। সে একটা বাসী রুটি খাচ্ছে। তার হাতেও একটা কলা। তবুও ছেলেটাকে যথেষ্ট সুখী দেখায়। ছোট ছোট চুল-সম্বলিত একটা মাথা এই ছেলের আছে।
কলাটা তার কাছে ছিল না। ওটা কিনে দিয়েছে ইন্তি। শুধু শুকনো রুটি খাচ্ছিল দেখে ওটুকু করতে তার তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল।
ইন্তিসার আজ দুই দিন ধরে পলাতক। প্রি-টেস্টের রেজাল্ট কলেজ দিয়েছে। আর তাতে ও করেছে দুই বিষয়ে ফেল। তাকে টেস্ট পরীক্ষা দিতে দেবে না আর।
কলেজ থেকে বাসাতে গিয়েই রেজাল্টের কথা ও বলে দিয়েছে। নিমেষেই মা ছেঁচকি নিয়ে তাড়া করে ওকে বের করে দেন। ছেঁচকির তাড়া খাওয়া খুব একটা সুখের ব্যাপার না। ছেঁচকির ভয়েই হোক আর আত্মসম্মানবোধের তাড়নায় – সেই থেকে ও বাসার বাইরে। সাথে ছিলই পঞ্চাশ টাকা। তিন দিনে সব শেষ।
আয়েশ করে সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল তারপর। এর পরে আর সিগারেট পাওয়া যাবে না সহজে।
কলেজ ড্রেস পরেই আছে। ওই অবস্থাতেই সে বিতাড়িত। সাথে আছে ব্যাগও। কাজেই গত তিনদিনই ক্লাস করতে সে গেছিল। কাজের কাজ কিছু হয় না। তবে সময় কাটে।
‘ভাইজান, আরেকটা কলা লইলাম?’
নিতাইয়ের ডাক শুনে তাকাতেই হয় ওকে, ছেলেটা ইন্তিসারের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই কলা ছিঁড়ে ফেলেছে আরেকটা। ওটার দাম কিভাবে দেবে সেটা এখন একটা ভালো প্রশ্ন হতে পারে – তবে তা নিয়ে ভাবতে ইন্তি চায় না।
‘তোর বাড়িতে আর কে কে আছে?’
কলায় রাক্ষসের মত কামড় দিয়ে পিচ্চিটা তাকায় পিটপিট করে, ‘একগা বাইয়ার মা।’
চোখ কুঁচকে যায় ইন্তির, ‘খেয়ে বল। মুখে খাবার নিয়ে কথা বলার দরকার তো নাই।’
‘একডা বাই আর মা।’ বলেই হাসে নিতাই।
ছোট্ট একটা নাকের দুই পাশে দুটো সুন্দর সুন্দর চোখ। ইন্তিসারের দেখতেই ভালো লাগে। তন্বীকে দেখাতে পারলে হত। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা একবার স্পর্শ করে ও। বের করে না। করে লাভ নেই। চার্জ পায় না আজ কয়েকদিন। চার্জারটাও বাসায়। নিতাই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে।
‘বাড়ি থেকে পলাইছেন নি?’
ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে ইন্তিসার, তারপর মৃদু ধমক দেয়, ‘একদম চুপ করে থাক। চুপচাপ কলা খেয়ে ভাগ চোখের সামনে থেকে।’
নিতাইয়ের হাসি এতে কমে না। ভাইজান লোক খারাপ না, এটা তার বোঝা হয়ে গেছে।
‘হাত ছিঁড়া জামা পিন্দে ঘুরে না কেউ। আপনেরে আমি কাইলকাও দেখছি। হাত ছিঁড়া জামা পিন্দে ঘুর ঘুর করতেছেন।’
‘আর তাতেই ধরে ফেললি আমি বাড়ি থেকে পালাইছি? থাপড়ায়ে তোর চাপা আলগা করে ফেলব।’
‘বাড়ি থেকে না পলাইলে কেউ রুটি আর কলা খায় না রাইত দশটায়।’ মুখ বাঁকায় নিতাই।
‘আমি খাই। ঠিক আছে?’
ইন্তিসারের রাগত চেহারার দিকে তাকিয়ে নিতাই থম মেরে যায়, ‘ঠিক আছে।’
দুইজন কিছুক্ষণ একেবারেই চুপ চাপ থাকে। কথাবার্তা ছাড়াই শেখে টান দিয়ে যাচ্ছে ইন্তিসার। একের পর এক।
নিতাইয়ের কলা খাওয়া শেষ। ছোট ছেলেটা আকাশের দিকে মুখ করে আছে। থুতনিটা সরাসরি ইন্তিসারের দিকে তাকিয়ে আছে যেন।
ইন্তিসারও আকাশের দিকে তাকায়। আজকের আকাশে মেঘ আছে। পাতলা মেঘ না, কালো মেঘ। চাঁদের একটা টুকরো দেখা গেলেও হতো। তাও দেখা যাচ্ছে না।
‘ভাইজান?’ নিতাইয়ের ডাকে আবার তাকাতে হয় ওকে।
‘তোর কলা খাওয়া হয়েছে?’
‘জ্বে।’
‘তাইলে ফোট।’
নিতাই ‘ফোটে’ না। আরেকটু কাছে সরে আসে, ‘ও ভাইজান।’
‘কিছু বলবি? টাকা শেষ কিন্তু – আবদার করলে রাখতে পারবো না।’
‘না ভাই। আবদার করতাম না। কইতেছিলাম, কাল রাইতে ছিলেন কই?’
পিচ্চি কি গোয়েন্দা নাকি? বিরক্ত লাগে ইন্তিসারের, তবুও উত্তর দেয়, ‘বড় মাঠের এক কোণে শুয়েছিলাম। রাস্তায় ধুলোবালি বেশি। মাঠে মশা অনেক জ্বালালেও ধুলো তো নেই।’
অনুনয় ভরা চোখ মেলে দেয় নিতাই, ‘আইজকা আমাগো বাড়িতে ঘুমাইবেন, চলেন।’
ইন্তিসার একবার ওই চোখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘না।’
শরীফ মামার কাছে আজ থেকে চা-সিগারেট খায় না ইন্তিসার। গত তিন বছরের বাঁধা কাস্টোমার। কাজেই একটা কলার দাম পরে দিতে চাওয়ার প্রস্তাবটা তিনি হাসিমুখেই মেনে নিলেন।
ইন্তিসার রাতের রাস্তায় হাঁটছে। পথ দেখাচ্ছে নিতাই। ওদের বাসাটা বস্তির ভেতর।
মুখে না বললেও ইন্তিসার সেখানেই যাচ্ছে। বাসার অবস্থা জানতে চাইলে নিতাই বলেছে, চারদিকে ‘বোড’ আর ওপরে ঢেউটিন। পানি-টানি নাকি ঢোকে না বৃষ্টির সময়। আকাশে যে মেঘ দেখে এসেছে আজ রাতে বৃষ্টি নামতেই পারে।
মাঠে শুয়ে বৃষ্টির পানি নিয়ে কান ভর্তি করে ফেলার চেয়ে নিতাইয়ের কুটিরে জায়গা নেওয়া ভালো কাজ।
ইন্তিসার রওনা হওয়ার দেড় মিনিট পরেই রেজা, তুষার আর আসাদরা গাড়ি থেকে নামে। শরীফ মামার দোকানে ইন্তিসারকে পাওয়া যাবে এটা তল্লাটের প্রত্যেকে জানে। কাজেই এতদূর আসতে তাদের কোন অসুবিধে হয়নি। শরীফ মামা জানালেন বন্ধুরা দেরী করে ফেলেছে। ইন্তিসার লক্ষার বস্তিতে গেছে। সাথে আছে নিতাই নামের এক হতচ্ছাড়া শিশু।
গাড়ির ভেতর থেকে তন্বী আরেকবার মিন মিন করে বলে, ‘মারামারির কি খুব দরকার ছিল?’
আসাদ একনজর তাকায়, ‘দরকার নিশ্চয় ছিল। সংবাদ শোননি? আমাদের শত্রু কীয়ৎকাল পূর্বেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে।’
ট্রান্সলেট করে দেয় তুষার, ‘হালারে সেইরাম ঘাড়ানো দরকার। ভাগতেছে হালায়!’
ইন্তিসার আর নিতাইকে খুঁজে পেতে ওদের বেশিদূর যাওয়া লাগল না। দৌড়ে এসে তিনদিক থেকে ওকে ঘিরে ফেলে ওরা।
তুষার ছুটে গিয়ে বড় সাইজের রেঞ্চটা দোলাতে দোলাতে পেছন থেকে আঘাত করে ওর মাথাতে।
মনোযোগ দিয়ে নিতাইয়ের কথা শুনছিল ইন্তিসার– মাথার ভেতরে যেন গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয় ওর। চরকির মত যন্ত্রণার উৎসের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই ওদের তিনজনকে চোখে পড়ে। রেঞ্চ তুলে আবারও আঘাত করতে যাচ্ছে তুষার।
এবার ইন্তিসার প্রস্তুত ছিল – খপ করে ধরে ফেলে রেঞ্চটা। মাথা ঝিম ঝিম করছে ওর। খুলির পেছনে অবর্ণনীয় একটা ব্যথার অনুভূতি। মাথাটা কি ফেটে গেছে?
একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মাথা কিভাবে ফাটাতে পারে?
তবুও শান্ত কণ্ঠেই প্রশ্ন করে ও, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তুষার?’
‘খানকির পোলা!’ দাঁতে দাঁত চেপে হুংকার ছাড়ে তুষার, ‘তন্বীকে বাজে বলার আগে তোর দুইবার ভাবা উচিত ছিল।’
দুই পা বাড়িয়ে ইন্তিসারের চোয়াল বরাবর ঘুষি হাঁকায় এবার রেজা। দুই হাতে তুষারের হাতের রেঞ্চ আটকে রাখাতে একেবারেই অরক্ষিত হয়ে ছিল ও – এবার ছিটকে পড়ে মাটিতে। হাত থেকে রেঞ্চ ছুটে গেছে।
ওটার দিকে আবারও হাত বাড়িয়েছে তুষার – কিন্তু তাকে বাঁধাই দিতে পারে না ইন্তিসার। মহিষের মত ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আসাদ। কাজেই তার দিকে মনোযোগ দেয় ও – প্রকাণ্ড ঘুষিতে কাঁপিয়ে দেয় আসাদকে।
সাহিত্যিকের খুলি নড়ে গেছে। পা ছড়িয়ে রাস্তাতে বসে পড়ে মানুষটা। এই ফাঁকে চট করে ঘুরে দাঁড়াতেই রেজার পরের ঘুষিটা আসতে দেখে ও।
ঝট করে একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়াল ও – কানের পাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে শক্তিশালী হাতটা, ওটার সাথে শরীরের সংযোগ যেখানে, তার একটু নিচে বুকের পাঁজরের ওপর পর পর দুইবার ঘুষি মারে ইন্তিসার।
রেজার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। ফুসফুস আঘাত সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে এখন। বড় করে হা হয়ে শ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টায় তাকে দেখায় ডাঙায় তোলা এক মাছের মতো। তার বুকে একটা জোর ধাক্কা দিতেই হুড় মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল ছেলেটা।
তুষারের রেঞ্চের আঘাতটা এবার ভয়ানক ছিল। গায়ের জোরে মেরেছে – ইন্তিসারের মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে।
আরও একবার হাত তোলে তুষার। মরণ আঘাতটা হানে তখনই। চোয়ালের ওপর আছড়ে পড়েছে রেঞ্চ। কড়কড় শব্দ শুনে ইন্তিসার বুঝে নেয় হাড় ওখানে কিছু ভাঙলো।
টলে উঠে ও মাটিতে শুয়ে পড়ে শক্ত শরীরটা নিয়ে। চলে যাচ্ছে না ওরা তিনজন? তন্বীকে নিয়ে কি বলেছে ও? ও হ্যাঁ – গালি দিয়েছিল। এজন্য মেয়েটা ওর পেছনে এদের লেলিয়ে দিয়েছে? ইন্তিসারের বিশ্বাস হতে চায় না।
পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে নিতাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে না?
‘ভাইজান! ভাইয়া – ও ভাই গো… ‘

তিন
থানা থেকে লোক এসে বসে আছে, শুনে নিচে নামতেই হল রহমান সাহেবকে।
ব্যাপারটা তিনি সাথে সাথেই বুঝে নিলেন। সুপুত্র আসাদ কারও মাথা ফাটিয়ে এসেছে।
রোজ একটা ছেলে কারও না কারও মাথা ফাটালে ওটা হতে পারে গুন্ডামি। কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের সাথে অবিচারের প্রতিবাদে বছরে একটা মাথা ফাটানো প্রশংসার দাবী রাখে। রহমান সাহেব এর মাঝে দোষ খুঁজে পান না। ব্যাপারটা হল, ছেলে পৃথিবীর মাঝে লড়াই করতে শিখছে। লড়াইয়ের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। খুব আছে।
কাজেই সন্তুষ্ট রহমান সাহেব নিচে নেমে আসলেন এবং ওসির সাথে নিজে কথা বললেন।
ওসি সাহেব এতক্ষণ অপেক্ষা করে চা-টুকু খেয়ে শেষ করে ফেলেছেন। একটু একটু করে চানাচুর মুখে দিচ্ছিলেন। চানাচুরটা টাটকা না। চারপাশে তাকিয়ে যতদূর দেখা যায় এবং চারপাশে কান পেতে যতটুকু শোনা যায় – রহমান সাহেব যথেষ্ট বড়লোক।
বড়লোকদের রান্নাঘরে কি বাসী চানাচুর থাকে? থাকার তো কথা না।
পরক্ষণেই জাঁদরেল ওসি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন, এরা নিঃসন্দেহে টাটকা চানাচুরের কিছু বয়াম দুই বছরের জন্য স্টোর রুমে ফেলে রাখে। এতে ওটা হয় বাসী। তারপর তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে রান্নাঘরে রাখা হয়। যখন এমন কোন মানুষ আসে বাসাতে যাকে সোজা বাংলাতে বলা হয় ‘অনাহূত অতিথি’ – তখন তাকে ওই বয়াম থেকে এক বাটি চানাচুর আর এক কাপ চিনি ছাড়া চা দিয়ে বোঝানো হয়, ‘তোমাকে আমরা চাই না। তুমি মারা খাও।’
বড়লোকরাও কি ‘মারা খাও’ টার্মটা ব্যবহার করে? আজকের তরুণ সমাজে সেই চলছে শব্দ দুটো। ওসি মাজহার আলম সন্দেহের মাঝে পড়ে যান।
এই মুহূর্তে তিনি তাকিয়ে আছেন রহমান সাহেবের দিকে। ভ্রু দুটো আছে বেশ কুঁচকে।
‘বুঝলেন তো। আসাদের ঝামেলাটা এড়ানো যাবে না মনে হচ্ছে।’
‘কেন?’ অবাক হয়ে গেলেন রহমান সাহেব, ‘কে কোন গলিতে মার খেয়ে পড়ে থাকলে সেটাতে আসাদের নাম কেন আসবে?’
‘আপনাদের একটা অডির গাড়ি ছিল। আইডেন্টিকাল জিনিস। এলাকাতে আর কারও তো নেই। বাংলাদেশেই আছে তিনটি। কাজেই কেসটা বেশ শক্ত হয়ে গেল।’
‘আমার নামে কেস করবেন আপনি?’ হাসির কোন কথা শুনেছেন এভাবে বলেন রহমান সাহেব।
‘ছি ছি। আপনার নামে কেস করতে পারি? কেসটা আসাদের নামে চলে যাবে মনে হচ্ছে। আর তার বন্ধুদেরও সমস্যা হবে। একটা মেয়ে বোধহয় ওখানে ছিল। তন্বী। আসলে, গাড়িটা না নিয়ে গেলে আমরা কেসটা ছেড়ে দিতে পারতাম। এখন তো সম্ভব না। অনেকে দেখে ফেলেছে।’
‘কয়জন দেখেছে?’ চোখ সরু করে অর্থপূর্ণভাবে জানতে চান রহমান সাহেব।
আমতা আমতা করেন ওসি, ‘মানে – দেখেছে কিভাবে বলি – কিন্তু, চারজন সাক্ষী দিয়েছে পুলিশকে।’
‘ধামাচাপা দেওয়া যাবে না?’ গলা নামিয়ে বলেন আসাদের বাবা।
ওসির গলাও নেমে যায়, ‘কিছু পাত্তি লাগবে স্যার। মুখ বন্ধ করতে হবে – পোস্ট-মর্টেমের রিপোর্ট এদিক ওদিক করে দিতে হবে – এইসব স্যার!’
‘পোস্ট-মর্টেম! হারামজাদা মরে গেছে নাকি? মার্ডার কেস? মারা খাইলাম দেখি!’ হড়বড় করে বলে ফেলেন রহমান সাহেব।
এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। ছেলে মারামারি করে এসেছে জেনে স্বাভাবিক ছিলেন। দেখা যাচ্ছে খুন করে ফেলেছে সে! খুনের কেস সহজে মেটে না, জানেন তিনি। ভয়টা এখানেই পেয়েছেন।
ওসি বড়লোক মানুষটাকে চিমসে যেতে দেখে একটু হাসলেন। এই লোক এবার মারা খেয়েছে। টাকা বের হয়ে আসার তো কথা।
‘ঠিক মারা যায়নি এখনও, তবে যাবে। প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে, পাবলিক এক হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে আছে শালা। যে কোন সময় মরে গিয়ে আমাদের কাজ বাড়াবে।’
‘ওকে তাড়াতাড়ি ভালো একটা ক্লিনিকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করুন। আর টাকা নিয়ে ভাববেন না। ধামাচাপা দিতেই হবে ব্যাপারটা। অল্প বয়েস – রক্ত গরম, বোঝেনই তো।’
ওসি মাথা নাড়লেন। তিনি এখন সব বুঝতে প্রস্তুত। আজগুবী অলৌকিক যাই বলে বসুন রহমান সাহেব, ওসি এখন তাই বুঝবেন। কারণ এখন টাকা কথা বলছে।
যখন টাকা কথা বলে, আর সবাই চুপ হয়ে যায়।

চার
‘তাহলে তোমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসো না?’ তৃতীয়বারের মত প্রশ্নটা করেন রহমান সাহেব।
তাঁর ভয় হচ্ছে ছেলে-মেয়ে দুটো একে অন্যকে পছন্দ করে কিন্তু সহজাত সামাজিক ভয়ে বাবাকে বলতে পারছে না। তিনি বাবা হলেও এসব ফালতু সংস্কার নিয়ে ভাবেন না – এটা তারা কবে বুঝবে?
‘আমরা বন্ধু। শুধুই বন্ধু। কিন্তু, কেন বাবা? এসব প্রশ্ন করছ কেন?’ অসহিষ্ণু হয়ে জানতে চায় আসাদের বাবা।
‘কারণ অডির গাড়িটা নিয়ে তোমার বের হওয়ার কারণে ফেঁসে গেছ তোমরা। বোঝা গেছে?’
চুপ হয়ে যায় আসাদ। রহমান সাহেব কড়া দৃষ্টি মেলে দেন তন্বীর দিকে। এই মেয়ে আসলেই অলুক্ষণে। জানে না দুনিয়ার হালচাল – ছেলেকে দিয়েছে উস্কিয়ে।
‘অ্যাই মেয়ে, তোমার নাম কি?’ রুক্ষভাবে জানতে চান রহমান সাহেব।
‘ত-তন্বী।’
‘যে ছেলেটাকে মারলি তোরা তার নাম কি?’
‘ইন্তিসার।’ দুইজনই বলে একসাথে।
‘সে কি করেছিল?’ চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করেন তিনি।
‘তন্বীকে বাজে কথা বলেছিল, বাবা। খুবই বাজে।’
‘শোনা যাক। কি বলেছিল? বলার অযোগ্য কিছু?’
মাথা নামায় তন্বী, ‘ইয়ে – ও বলেছিল আমার আম্মু নাকি ড্যাডি ছাড়া আর কেউ– ইয়ে – তারপর আমার জন্ম।’
চোখ কপালে উঠে যায় রহমান সাহেবের, ‘কেন একথা বলল সে?’
আমতা আমতা করে তন্বী আবারও, ‘আমি ওর শার্টের হাতা ছিঁড়ে দিয়েছিলাম। তাই।’
‘হায় রে দুচির ভাই! এত বদ ছেলের তো মরাই উচিত। এত অল্প ঘটনায় এভাবে বড়দের নিয়ে নোংরা কথা-’
কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। একটা ছেলে কেন এত সুন্দর একটা মেয়ের বাবা মাকে নিয়ে বাজে গল্প রটাবে চারপাশে? এমনটা তো ঠিক নয়। ব্যাপার তখন আসলেই পার্সোনাল হয়ে যায়। কাকে দোষ দেবেন তিনি এখন? ইন্তিসারকে না তার ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের?
ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না রহমান সাহেব।
‘এক সেকেন্ড!’ হাত তোলেন তিনি একটা দিক মনে হতেই, ‘ঘটনা তো এমন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে না। হিসাব আমার মেলেনি। ঠিক কি এই কথাই বলেছিল তোমাকে ইন্তিসার?’
মাথা নাড়ে মেয়েটা, ‘ঠিক তা না – একটা গালি দিয়েছিল।’
‘তারপর?’
‘আসাদের কাছে ছুটে আসলাম পুরো অর্থটা জানতে। ছেলেরা কোন কথা কেন বলে আমি আজ ঠিক মত বুঝে উঠতে পারিনি।’
‘ক্লাসে শুধু তুমি আসাদের সাথেই মেশো শুনেছিলাম। কেন? স্ট্যাটাস দেখে ফ্রেন্ডশিপে তুমি বিশ্বাসী?’
হঠাৎ রহমান সাহেবের প্রশ্নটা শুনে চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে তন্বী। এর উত্তর সে দেবে না।
মেনে নিয়ে মাথা দোলান আসাদের বাবাও, এজন্যই বড়লোকি দেখিয়ে বেড়ানো মেয়ে তাঁর পছন্দের না।
তন্বী চুপ হয়ে আছে তার পেছনে একাধিক কারণ আছে। আসলেই সে লোয়ার ক্লাসের মানুষকে পছন্দ করে না। তাদের মুখ থেকে গালি শুনতে সে নারাজ। দ্বিতীয়তঃ এই ছেলেকে রিফিউজ করার চেয়ে কঠিন মারের সাথে রিফিউজ করা ভালো। ইন্তিসারের তার প্রতি দুর্বলতা আছে। দুর্বলতা কাটাতে হবে এবং এভাবে কাটানোটাই সবচেয়ে ভালো পথ। অন্তত তন্বীর মতে।
‘সে যাকগে – তাহলে বলবে – ঠিক কি উচ্চারণ ইন্তিসার করেছিল। মানে তোমাকে বলা ইন্সাল্টিং বাক্যটা?’
‘উম – ও বলেছিল -’ একটু ভাবে তন্বী, ‘ও এরকম কিছু বলেছিল- “হারামজাদী, শার্টটা ছিঁড়ে দিলি যে!”’
অবাক হয়ে যান রহমান সাহেব এবার আসলেই, ‘ এতো আজকের তরুণ সমাজের স্বাভাবিক আচরণ। “আম্মুকে আংকেল” তত্ত্ব আসল কোথা থেকে তাহলে?’
‘আসাদকে হারামজাদীর মানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।’ বিড় বিড় করে জানায় তন্বী।
‘সে কি বলল?’ অগ্নি দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেব।
‘যদি কারও আম্মুকে তার আব্বু বাদে আর কেউ ‘ইয়ে’ করে আর তারপর তার জন্ম হয় – তবে সে হয় হারামজাদী।’
মাথায় হাত চাপড়িয়ে বসে পড়লেন রহমান সাহেব। আজকের দিনে যে ভাষা ছেলে-মেয়েরা ব্যবহার করে – তার তলা খুঁড়তে গেলে মহা ফ্যাসাদে পড়তেই হবে। ‘চ’-বর্গীয় গালির তো অভাবও নেই মাশাআল্লাহ, তার ওপর আছে দেদারসে ব্যবহার। বুৎপত্তিগত অর্থ খুঁজলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। আর তাই করেছে তাঁর গুণধর ছেলে।
‘আর এই জন্যই খুন করে ফেললি তোরা ছেলেটাকে?’ হুংকার ছাড়েন তিনি।
‘খুন?’আঁতকে ওঠে তন্বী।

পরিশিষ্ট
মাথায় নরম একটা হাত চুলে আদর করে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই টের পায় ইন্তিসার।
তন্বী কি বুঝতে পেরেছে ওকে তেমন কিছুই সে বলেনি। রাগে একটু ধমক দিয়েছে খালি। তাও তো দিতো না। দুইদিনের খিদে ছিল পেটে। তাই দিয়েছে।
ভালোবাসার মানুষটাকে কি আর মন থেকে গালি দেওয়া যায়?
নিজের ভুল বুঝেই কি হাসপাতালে এসেছে তন্বী ওকে দেখতে? চোখ বন্ধ করে ওর ওরকমই লাগে।
নরম হাতটা এবার ওর গালে এসে থামে। হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে ওকে।
‘তন্বী?’ চোখ মেলে ইন্তিসার অনেক কষ্টে।
নিতাইয়ের গম্ভীর মুখটা দেখা যায় সামনেই।
‘ভাইজান উঠতাছেন ক্যান? ঘুমায় থাকেন। আমি আপনেরে ঘুম পাড়ায় দেই?’
চারপাশে তাকায় ইন্তিসার। নতুন কোন জায়গা মনে হচ্ছে। ভালো কোন ক্লিনিক।
আসাদের বাবার কাজ হয়তো। ঝামেলা দেখে ওকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।
আঁতিপাতি করে তন্বীকে খোঁজে ইন্তিসারের চোখ দুটো। কিন্তু মেয়েটি নেই কোথাও। উচ্চবিত্তের একটি মেয়ে যখন নিজের ভুলে মধ্যবিত্তের একটি ছেলেকে মৃত্যুশয্যায় ঠেলে দেয় – তারা সেই শয্যার ধারে কাছে আসে না। ক্ষমা প্রার্থনা শব্দটি তাদের জন্য নয়। ছিল না কোনদিনও।
আস্তে করে শুয়ে পড়ে ও আবারও। নিতাইয়ের চোখে অনুনয়। আজও।
‘ঠিক আছে, নিতাই।’ বিড় বিড় করে বলে ইন্তিসার, ‘আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দে।’

— ০ —

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *