সে ছিল
রাত বারোটাতে আবারও দেখা গেল তাকে। ঠাঁয় মাঠটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনতলা বাসাটার বারান্দা থেকে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি।
মেয়েটির চুল বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। কি ভয়ংকর বিষন্ন একটা ছবি!
রাত বারোটাতে এই মেয়ে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেন থাকে?
এখানে মাত্র কয়েকদিন হল এসেছি আমি। আগে ঢাকায় থাকতাম – ওখান থেকেই রাজশাহী চলে গেলাম রুয়েটে চান্স পেয়ে। আম্মুরা চলে আসল তখন চট্টগ্রামে। প্রথমবার এখানে পা রেখেছি – মাত্র সাতদিন হয়েছে সেটার।
এটা একটা হাউজিং ব্যবস্থা। উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এলাকাটাতে তারাই থাকে – যারা চট্টগ্রাম ইউরিয়া সারকারখানাতে কোন না কোন পদে কাজ করে। অফিসার থেকে কর্মচারী – সবাই তাদের র্যাংকের ক্যাটাগরি অনুযায়ী একটা করে বাসা পায়। চমৎকার বাসাগুলো, খেলার জন্য যথেষ্ট জায়গা রাখা হয়েছে এখানে, এদের একটাই আমার বাসার সামনে থাকা এই মাঠটা।
রাত বারোটাতে এখানে মেয়েরা বের হতে পারে, পুরো হাউজিংটিতেই টহল দেয় সিকিউরিটি গার্ডেরা। কাজেই নিরাপত্তা নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকার কথা না। তাই মেয়েটিকে এত রাতে দেখে আমি মোটেও অবাক হই না।
আমি অবাক হই তার নিঃসঙ্গতার গভীরতা আমার বুক ছুঁয়ে চলে যায় বলে। গতকাল যখন এখানে বসে ছিলাম আমি ঠান্ডা মেঝেতে – হতাশা আর নিঃসঙ্গতার তুঙ্গে আমার অনুভূতি – তখন ওকে প্রথমবার দেখি।
হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাওয়াটা নতুন কিছু না। আমি মানুষের মন নিয়ে খেলি। যখন মনে হয় মন নিয়ে খেলার ক্ষেত্রে আমি হেরে যাচ্ছি – তখন আমাকে হতাশা গ্রাস করে।
উঁহু, নিম্নমানের প্রতারক ভাববেন না আমাকে – টুকটাক গল্প লেখি। আর গল্প লেখার একটাই অর্থ – মানুষের মন আমাদের হাতের মুঠোতে থাকে। ওটা নিয়ে আমরা খেলার চেষ্টা করি, ওই মনে রোমাঞ্চের অনুভূতি জাগানো অথবা প্রবল ঝড়ো হাওয়ার মত মন খারাপ করিয়ে দেওয়া কোন অজানা অনুভূতি!
গতকাল রাতে আমার হতাশার পেছনে কাজ করছিল ‘চমকে দেওয়া’ বিষয়টার অনুপস্থিতি। সব ছিল নতুন লেখতে থাকা – রোমাঞ্চ, তথ্য, যুক্তি – কিন্তু কথা হল সবকিছু চলে যাচ্ছিল একটা নির্দিষ্ট দিকে। এভাবে চললে যেকোন নবীন পাঠকও ধরে ফেলবে আগেই – ঘটনা কি ছিল। সেটা হতে দিতে পারি না। কাজেই বারান্দাতে ছিলাম তখন।
ভাবার জন্য এই বারান্দা চমৎকার একটি স্থান। এখানে আজকের বাড়িগুলোর মত হাঁটু পর্যন্ত দেওয়াল তোলা নয় সামনের দিকে। বারান্দার তিনদিকে দেওয়াল থাকলে একদিক পুরোই খালি। যদিও শিক দিয়ে ওটাকে নিরাপদ বানানো হয়েছে – যাতে কেউ পড়ে না যায়। কিন্তু মেঝেতে বসে থাকলেও সামনের খোলা মাঠটা আমার চোখে পড়ে। দুটো ল্যাম্পপোস্ট আছে মাঠের কাছে পৌঁছানোর আগেই – এদের একটা কি অসাধারণ আর নরম হলুদ আলোই না দেয়! তারপর আছে একটা নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোস্ট।
গতকাল রাতে আমার হতাশাপূর্ণ গল্পটাকে আশার দিকে সরানোর জন্য যখন বারান্দাটাতে ছোট হয়ে বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছি – চোখে পড়ে ল্যাম্পপোস্টের পাশে ওই নারীমূর্তি। একাকী মেয়েটা ওখানে কি করছে? একাকী একজন মানুষকে যখনই আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি – আমার মাঝে প্রথমেই যেই অনুভূতিটা আসে – মানুষটির মন এখন প্রচন্ড খারাপ – আর তাই সে একা থাকতে চাচ্ছে।
এজন্যই দরজা খুলে সিঁড়িঘরের সিঁড়িগুলো ভেঙ্গে তার কাছে পৌঁছে গেলাম না। তবে ধোঁয়া ভেদ করে মেয়েটিকে বার কয়েক দেখেছি সেরাতে।
পরদিন সকালে আম্মুকে ধরলাম, ‘সামনের মাঠে একটি মেয়ে যে দাঁড়িয়ে থাকে – ব্যাপার কি?’
আম্মু যারপরনাই অবাক হয়, ‘কোন মেয়ে?’
মাথা চুলকালাম, ‘মোটামুটি লম্বা একটা মেয়ে, অনেক সিল্কি চুল, বাতাসে ওড়ে।’
আম্মু মুখ টিপে হাসলো, ‘ও তো মিথিলা। B4 এ থাকে।’
‘রাতের বেলাতে বের হওয়ার অভ্যাস কি আছে তার?’ জানতে চেলাম। পাগলামী কারও থাকলে গোটা হাউজিং বাসী জেনে যায় কিভাবে জানি। কাজেই সোর্স হিসেবে আম্মু মোটেও খারাপ হবে না।
মাথা নাড়ে আম্মু, ‘মেয়েটা তো অনেক ভদ্র। রাতে কেন বের হবে? ওকে দেখাই যায় না বাইরে!’
মেনে নিতে পারি না আমি, ‘আমার তো মনে হল গতকাল রাতে দেখলাম ওকে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে!’
আম্মু আবার হেসে ফেলে, ‘মিথিলার প্রেমে পড়েছ তুমি।’
এরপর আর এই বিষয়ে আলোচনা করা চলে না। আমি চুপচাপ একদিকে সরে পড়লাম।
*
আজকে রাতে আবারও বারোটা বাজার অপেক্ষাতেই আমি থাকি। গল্পের প্লটে আজ কোন ভুল নেই – তবুও সাবধানে বের হয়ে আসি বারান্দাতে। মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল না কাওকে।
গতকাল কি আমি তাহলে ভুল দেখেছি? ভুল হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। আমি আগে কখনও মিথিলার সাথে দেখা করিনি। যদি আমি আগে মিথিলার সাথে দেখা না করেই তাকে মাঠের মাঝে দেখে ফেলি – তার অর্থ মেয়েটা ওখানে দাঁড়িয়েছিল।
এই মুহূর্তে মাঠে কাওকে দেখা না গেলেও আস্তে করে সিগারেট ধরালাম একটা। আমার হাতে অফুরন্ত সময়। ভার্সিটি এখন বন্ধ। বাসাতে থাকা মানে দুই হাত এবং দুই পা আমার খালি। খালি হাতে সিগারেট ভালো মানায়, আর মানায় কী-বোর্ড। এই মুহূর্তে চোরের মত মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি প্রথমটাকে বেছে নিলাম।
সিগারেটটা আমাকে বেশ চুরি করেই খাওয়া লাগে। পাশের ঘরেই আছে আব্বু আর আম্মু। ধোঁয়ার গন্ধ আস্তে করে ওদিকে চলে যেতেই পারে। প্রতিপক্ষ আছে আমার। বাতাস।
ওরা সিগারেটের ঘোরতম বিরোধী। কাজেই ব্যাপারটা জানিয়ে তাদের মনে কষ্ট দিতে চাই না। প্রতিটি কুলাঙ্গারতম সন্তানেরও এতটুকু করাটা তো দরকার।
কাজেই লুকিয়ে নিজেকে একেবারে ছোট করে ফেলতে হল। বাতাসের গতিবিধি কয়েকদিন আগেও আমি কিছুই বুঝতাম না। এখন মোটামুটি গবেষণা করেই নিজের অবস্থান ঠিক করি – যাতে বাতাস আমার অনুকূলে কাজ করে।
তৃতীয়বার ফুস ফুস ভর্তি ধোঁয়া ছাড়ার সময় থমকে গেলাম। আম্মুদের রুম থেকে কাশির শব্দ আসছে।
সর্বনাশ করেছে! আম্মুর নাক খুবই তীক্ষ্ণ! ঢাকাতে থাকা অবস্থাতে একদিনের কথা মনে পড়ে গেল।
কলেজে পড়তাম। সিগারেট গুণে রাখার বাতিক আমার প্রথম থেকেই। তখন মোটে পাঁচশ মত টেনেছি। এমনই একদিন বাসাতে ঢোকার একঘন্টা আগে সর্বশেষ সিগারেট পুড়িয়ে হেঁটে যাই এক বন্ধুর সাথে।
বাসাতে ঢোকার আগে হারামজাদা আরেকটা ধরিয়ে ফেলল, আমি গায়ে মাখলাম না। একটু দূরে থাকলাম তার। তারপর ভদ্রসন্তানের মত বাসাতে ঢুকতেই আম্মুর নাক কুঁচকে গেল।
‘তুমি সিগারেট খেয়ে এসেছ নাকি?’ খটাস করে প্রশ্নটা করে ফেলেছিল আম্মু।
সেদিন আসলেই সিগারেট খেয়ে আসিনি, কাজটা করেছে কাছের বন্ধুটা, তার পিন্ডি চটকাতে চটকাতে মাথা নেড়ে তীব্র অসম্মতি জানালাম। অসম্মতিটাতে সত্য ছিল। কাজেই মেনে নিয়েছিল আম্মু।
আজও জেগে গেছে দেখা যাচ্ছে! কাশি দিচ্ছে! খবর আছে দরজাটা খুলে এখানে ঢুকলেই! নবে লক করে দিয়েছি ঠিকই – তবে চাবি তো আম্মুর কাছেই!
কি ভাবছেন? আহা – জানিয়ে সিগারেট খেতে না পারলে খাওয়ার দরকারটাই বা কি? আর খেতেই হলে জানিয়ে দেওয়াটাই ভালো না?
ওই যে বললাম – পরিবারকে কষ্ট কে দিতে চায়? আবার সিগারেট ছাড়াটাও সম্ভব না। বায়োলজিকালি সিগারেট ক্রিয়েটিভ কাজ করার ক্ষেত্রে সহায়ক। অনেকেই জানেন না হয়ত, চা মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোকে যতটা অনুরনণ দেয়, সিগারেট দেয় তার থেকেও ৭ গুণ বেশি!
উদ্দীপনার দরকার আছে কাজের ক্ষেত্রে। আমি সিগারেট খেতে কাওকে উৎসাহিত করছি না। তবে মানুষের মত বায়োলজিকাল একটি মেশিনের জন্য নিকোটিনের যে আসলেই একটা পজেটিভ ভূমিকাও আছে – সেটাই জানিয়ে রাখলাম।
এই মুহূর্তে আমার দ্বি-মুখী তত্ত্ব মাঠে মারা পড়তে যাচ্ছে ওই নিকোটিনের গন্ধেই। পাক মেরে সিগারেট ফেলে দিলেও বারান্দা জুড়ে থেকে যাওয়া গন্ধটা তো যাবে না। মনে মনে আমি যতই ধমক দেই ওদের, ‘ব্যাপন হ! ব্যাপন হ!!’ – কাজ কি দেবে সেটা?
দেবে না।
কাজেই ঠান্ডা হয়ে সিগারেটের ওপরই থাকি আমি। আর খেয়াল রাখি কখন দরজাটা খুট করে খুলে যায়। তখন হাত থেকে সিগারেটের পতন অবিশ্যম্ভাবি।
কাশির শব্দ আবার হল। আমি মনে মনে প্রার্থনা জানিয়ে চলেছি – ওই ঘরে আম্মু যাতে ঘুমিয়ে পড়ে সুন্দর করে।
কিন্তু ঘুমানোর কোন লক্ষণ কি আছে? কাশির শব্দ মাঝে মাঝেই হচ্ছে ।
ছেলে হিসেবে আমার এই মুহূর্তের করণীয় পাশের ঘরে গিয়ে মায়ের খোঁজখবর নিয়ে আসা। কিন্তু তা না করে আমি ঠাঁয় বসে থাকলাম। এই ধোঁয়ার গন্ধ নিয়ে আমি দরজা দিয়ে ঢুকলে আমাকে আম্মু জানালা দিয়ে বের করে দেবে।
সিগারেটের ৭৩% শেষ হয়ে গেছে – অনুমান করতে করতে বাকিটুকু শেষ করে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করছি – এই সময় ল্যাম্পপোস্টটার দিকে অনেকক্ষণ পর চোখ পড়ল আমার। কিছুটা চমকে উঠলাম। জানা ছিল এমনটা হবেই – তবুও।
কালো জামা পড়ে মেয়েটা আজও দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ঠিক যেখানে গতকাল রাতে আমি ওকে দেখেছিলাম!
রাতের বেলাতে এলাকা অন্ধকার হয় না কখনও। অসংখ্য ল্যাম্পপোস্টে অসংখ্য লাইট এই হাউজিংয়ে।
তারপরও মেয়েটিকে ছায়া ছায়া লাগছে। ফর্সা হাতদুটো কালো জামা থেকে বের হয়ে আসাতেই তাকে মানুষ বলে চেনা যায়। আমি সিগারেটের অবশিষ্ট ২৭% শেষ করলাম খুবই তাড়াতাড়ি, বাসা থেকে বের হলাম খুবই নিঃশব্দে।
বাসা থেকে নেমে পঁয়তাল্লিশ ফিট লম্বা রাস্তাটাকে আজ মনে হচ্ছে কতই না দূরের পথ! মাঠে এখনও মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, এটা একটা স্বস্তি। খুবই সাবধানে এগিয়ে যাই ওদিকে। এই রহস্য উদঘাটন করতে না পারলে আমার আর নতুন কোন গল্প লেখা লাগবে না।
*
‘ঘুম আসছে না?’ খুব কাছ থেকে প্রশ্নটা করি আমি।
ভেবেছিলাম চমকাবে, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ফিরে তাকায় মেয়েটা আমার দিকে, ‘জানতাম আপনি নেমে আসছেন।’
অবাক হলাম। এতটাই অবাক হলাম – হাতে বের করা নতুন সিগারেট স্টিকটাতে আগুন জ্বালানোর কথা ভুলে গেছি একেবারেই। ওটা হাতে নিয়েই তাকিয়ে থাকি মেয়েটির দিকে। চোখগুলো টানা টানা না, কিন্তু অসম্ভব মায়াবী ওদুটো। আমি নিশ্চিত, এই রাত বারোটাতে এই মেয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এক সেকেন্ডও ব্যায় করেনি – কিন্তু চোখের পাপড়িগুলো কি গভীর কালো!
ছোট্ট নাকটা যেন ওর চেহারাকে পূর্ণতা দিয়েছে। আরেকটু বড় হলে নির্ঘাত ডাইনীদের মত লাগত ওকে দেখতে। এখন পাতলা ঠোঁটদুটোর একটু আগেই শেষ হয়ে গেছে ওই নাকটা। গালদুটো মোটেও চ্যাপ্টা নয় – আবার গোলও না। মেয়েটাকে দেখে একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করবে যে কোন ছেলের, ‘আপু, আপনার একটা ছবি তুলতে পারি?’
আমি ওটা বললাম না। কর্কশ কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লাম।
‘কিভাবে জানলেন?’
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করে ও, ‘আপনি লেখালেখি করেন রাত জেগে, তাই না?’
এটাও তার জানার কথা না, গম্ভীর মুখে তবুও বললাম, ‘হুম।’
কিছুটা ধারণা আমি পেয়ে গেছি এতক্ষণে। আম্মুর কারসাজি সব। নির্ঘাত মিথিলার আম্মুর সাথে গল্পোচ্ছলে কিছু কথা লাগিয়েছে। যা থেকে এই মেয়ের কানে চলে গেছে। এই ছোট্ট কলোনীতে সবাই সবার ব্যপারে জানে। জানাটাই নিয়ম।
কিন্তু তাতে মেয়েটার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? রাত বারোটাতে এখানে দাঁড়ালে আমি দেখে ফেলব আর দেখে ফেলে নিচে নামব – এটা নিশ্চয় যুক্তি দিয়ে বুঝে সে বলেছে। কিন্তু জানা থাকার পরও সে দাঁড়াবে কেন?
‘এখানে যে কয়দিন আছেন, একটা কাজ কি করতে পারবেন?’ আমার দিকে আবেদনময় চোখদুটো মেলে তাকায় মিথিলা।
ওই চোখকে নেতিবাচক উত্তর দেওয়া অসম্ভব একটা কাজ, আস্তে করে জানালাম, ‘পারব।’
‘রাতগুলো জেগে থাকবেন, প্লিজ। ঘুমাবেন না।’
মিথিলা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওর বাসার দিকে চলে যাচ্ছে এখন। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
শেষ কথাটা কিসের জন্য বললো ও আমাকে? এটা কি আমাকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য বলা হল?
রাতে ঘুমালে কি হবে?
সন্নিগ্ধ ভঙ্গীতে আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে ফেলতে হল ওখানেই। সামনে খালি একটা মাঠ। মাঠের চারপাশের ল্যাপপোস্টগুলো মাঠের ঠিক মাঝখানে আলো দিতে পারে না। ওখানে একটা গর্ত আছে বলে মনে হতে থাকে।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ওই গর্তটা দেখি। তারপর ঘুরে বাসাতে চলে আসলাম। মিথিলা মেয়েটা আসলেই রহস্যময়ী। কিন্তু কোন জায়গাতে তার রহস্য তা আমি ধরতে পারছি না কোন কারণে।
সিগারেটটা মাঠের মাঝে ফেলে দিয়ে যখন বাসাতে ফিরে আসছি – ঘড়িতে তখন দুইটা বাজে। আর কিছুক্ষণ পর সাহরীর সাইরেন দেবে মসজিদ থেকে।
সাইরেনের শব্দটা শুরু হল আড়াইটা থেকে। নাজি বাহিনীর অ্যালার্মের মত কর্কশ না হলেও একটা মন খারাপ করা গন্ধ ওই শব্দ দেবেই। মন খারাপ করা গন্ধটাকে পাত্তা না দিয়ে ঝড়ের বেগে লেখে যাই আমি। কী-বোর্ড আমাকে ভুলিয়ে দেয় মিথিলার কথা, সামনে থাকা একটা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ফাইল ভুলিয়ে দেয় একটু আগে রহস্যময়ী কোন এক মেয়ের সাথে ব্যাখ্যার অযোগ্য কথা বার্তা বলে এসেছি আমি।
সব কিছু অতীত হয়ে যায় – আমি আর আমার কম্পিউটার আর আমার আঙুলগুলোর প্রজাপতির মত কী-বোর্ডের ওপর উড়ে বেড়ানো –
‘খেতে আসো।’ আম্মুর গলা শুনলাম দরজার কাছে।
*
বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। আম্মু আর আমার ছোটভাই এসে আমার ঘরে ঘুকে পড়ে।
কান থেকে হেডফোন নামালাম।
‘আমরা পাশের বাসাতে যাচ্ছি। ওই আন্টির সাথে কথা বলে আসি একটু।’
হেসে মাথা কাত করলাম। ইফতারী শেষ – এখন আম্মুর একটু ছুটি। আব্বুও বের হয়ে গেছে তারাবী পড়তে। আমি কুলাঙ্গার শ্রেণির ফাঁকি মারছি ঘরে বসে।
ওরা দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে যেতে আবার ঝুঁকে পড়ি আমি। হিব্রু ভাষা নিয়ে একটা অদ্ভুত রকমের ঝামেলাতে পড়ে গেছি এরই মাঝে।
আর যেকোন ভাষাকে ট্রান্সলেট করতে দিলে গুগল ট্রান্সলেটর সেটা ট্রান্সলেট করে দেয় – সাউন্ড ফাইল সহ। অথবা একটা অপশন থাকেই, ‘Read Phonetically’ – যাতে যিনি অর্থ খুঁজছেন তিনি একটা উচ্চারণও জানতে পারেন। অথচ হিব্রুর ক্ষেত্রে এটা নেই। অদ্ভুত না?
আছিউ গুগল ট্রান্সলেটে – যেটা ইহুদীদের সম্পত্তি। আর সেই গুগলে হিব্রু ভাষার উচ্চারণ জানার উপায় কেন থাকবে না?
ইন্টারনেটে সার্চ দিলাম। গুগল, ইয়াহু, বিং – একটা ডিকশনারীও নেই অনলাইনে যেখানে হিব্রু শব্দের উচ্চারণ সব অনুবাদ করে দেওয়া হয়!
ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা না আর কিছু আছে?
দরজাতে আলতো করে একবার কলিং বেল পড়তে উঠে দাঁড়ালাম। আম্মুরা এত তাড়াতাড়ি তো আসার কথা না। রাত নয়টার আগে আম্মুদের আড্ডা শেষ হবে বলে মনে হয় না। কে আসতে পারে ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে দেই।
একহাতে একটা বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিথিলা। হাতকাটা একটা জামা পড়েছে এখন। এগুলোকে কি বলে আমি জানি না – তবে এই মুহূর্তে মিথিলাকে ডানাকাটা পরীদের মত লাগছে – এতটুকু আমি জানি।
ডানাকাটা পরীটা এদিক ওদিক তাকায় বাসার ভেতর, ‘আন্টি নেই?’
‘ওহ -’ সম্বিত ফিরে পাই আমি, ‘ভেতরে আসুন। আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসছি আমি।’
ওকে ড্রইং রুমে বসাচ্ছি, মিষ্টি করে হাসে ও, ‘আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? আপনার চেয়ে দুই বছরের ছোট আমি।’
আমিও একটু হাসলাম, ‘আচ্ছা, আর বলব না।’
চারপাশটা কিভাবে জানি দেখে মিথিলা আমাদের বাসাতে ঢুকেই। আমার মনে হয় ও স্মৃতিরোমন্থন করছে।
আমার দিকে তাকিয়ে পরের যে কথাটা বলে তাতে আমার ধারণা নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়, ‘এখানে আমরা থাকতাম। আপনারা ওঠার আগে। তারপর পাশের বিল্ডিংয়ে চলে যাই।’
কৌতুহল হয় আমার, ওর সামনের সোফাতে বসে পড়লাম, ‘বি-টাইপ বাসাতেই তো ছিলে তাহলে। কেন? বাসা পাল্টালে কেন? তোমাদের B4 এর চেয়ে তো এই B3 এর ভিউ বেশি সুন্দর।’
মাথা নীচু করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মিথিলা। কিছু বলে না।
প্রশ্নটা করা আমার হয়ত উচিত ছিল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে পড়ি, ‘থাকো, আমি ডেকে আনছি আম্মুকে।’
ঝট করে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা, আমার গলা সমান হবে ও, ‘আপনাদের গেস্ট রুমটা একটু দেখতে পারি?’
এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলাম, তারপর মাথা ঝাঁকাই, ‘শিওর।’
গেস্ট রুমটাতে তেমন কিছু নেই। একটা বুক সেলফ, একটা খাট, দেওয়াল জুড়ে বড় একটা আয়না। আর ঘরের কোণে আইপিএস সেটা করাই আছে। যদিও এই হাউজিংয়ে নিজস্ব বিদ্যুতে চলে সব – কখনই কারেন্ট যায় না। ওটা কেনা হয়েছিল ঢাকাতে থাকতে।
আগে ঢুকল মিথিলা পরে আমি। ধীরে ধীরে একমাত্র খাটটির পাশের জানার গ্রিলে হাত রাখে ও। এখান থেকেও মাঠটা দেখা যায়। পাশের দেওয়াল সরিয়ে ফেললেই আমার ঘরের সাথে থাকা বারান্দাটাতে যাওয়া যাবে।
চারপাশে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছি – মিথিলাকে স্মৃতিচারণ করতে দেওয়া দরকার। ZFCL হাউজিংয়ের একটা বাসাতে পাঁচ বছর ছিলাম আমরা। ওতে আবার যদি ঢুকতে পারি – আমিও একটু একাকীত্ব চাবো।
দরজা পর্যন্ত পৌঁছতেই হাতে কারও হাত অনুভব করি। ফিরে তাকিয়ে মিথিলাকে দেখতে পেলাম। কিছুটা চমকাই – আমার খুব কাছে এসে গেছে ও এখন।
‘আই লাভ ইউ!’ ফিস ফিস করে বলল মেয়েটা।
ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে – নির্ঘাত! টেনে হাতটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম আমি , পারি না। এতটুকু একটা মেয়ে এত শক্তি পায় কোথা থেকে?
ধীরে ধীরে আমাকে জানালার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মিথিলা – কোনমতেই এড়াতে পারি না আমি সেটা।
টান দিয়ে আমাকে খাটের ওপর ফেলে দেয় মেয়েটা – গড়িয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম প্রাণপণে – পারি না। শক্ত করে আমাকে ধরে রেখেছে ও। জোর করেই আমার বাম হাতটা ওর বুকের ওপর রাখে মিথিলা।
ডানহাত দিয়ে সর্বশক্তিতে ওর গালে মারি আমি, অন্যহাতটাকে মুক্ত করতে চাই নরম কিন্তু অবৈধ একটা স্পর্শ থেকে।
‘তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, মিথিলা!’ ধমক উঠি আমি, ‘শান্ত ভাবে খুলে বলো কি হয়েছে?’
কিছু না বলে আমাকে নিচে ফেলে দেয় ও, তারপর চেষ্টা করতে থাকে ঠোঁটে কামড়ে ধরার – মাথা এপাশ থেকে ওপাশে সরিয়ে কোন মতে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি।
দুই হাতে আমার মাথা চেপে ধরে ও বুঝতে পেরে। তারপর কামড়ে ধরে আমার ঠোঁট। ব্যাথা পাচ্ছি আমি – কেটে ফেলেছে নিশ্চয় আমার নিচের ঠোঁট – কিন্তু নিস্তার পাই না।
ঠিক এই সময়ে আমার গলাটা চেপে ধরে ও মাথা ছেড়ে।
ধীরে ধীরে চাপ বাড়ছে ওই দুই হাতে
শক্ত মেঝেতে নিজের শরীর চেপে ধরে আমাকে আটকে রেখেছে ও – ঠোঁট নড়াতেও পারছি না – কাজেই চিৎকার দেওয়ার কোন উপায় নেই।
চাপ বাড়াতে থাকে মিথিলা – গলার আকছে তীব্র একটা খিঁচুনির মত অনুভব করি আমি। চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসে মিনিটখানেক পরই। দুই হাত মেঝেতে ছুঁড়ি আমি তীব্র যন্ত্রণাতে – উঠে বসার শেষ চেষ্টা করলাম – মেয়েটাকে দুই হাতে আমার ওপর থেকে নামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু শরীর দিয়ে আমাকে বন্দী করে রেখেছে মেয়েটা – একচুল নড়ানো গেল না তাকে।
চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঘোলা হয়ে যাচ্ছে আমার। কিন্তু কি আশ্চর্য! কানের শ্রবণশক্তি আরও অনেক বেড়ে গেছে!
বাইরে বৃষ্টির শব্দ মৃদু ঝিম ঝিম শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি, ছোট্ট ঝিঁ ঝিঁদের ডাক শুনতে পাচ্ছি – আর এর মাঝেই – নিজের ঘরেই খুন হয়ে যাচ্ছি আমি।
আরও মিইয়ে আসে আমার দৃষ্টিশক্তি – আরও বেড়ে যায় শ্রবণশক্তি – নিজের ঠোঁটে মিথিলার দাঁত ঢুকে যাওয়ার মৃদু কচ কচ শব্দও যেন আমি শুনতে পাই!
কলিং বেলের প্রচণ্ড শব্দটা আমার কানের পর্দা যেন ফাটিয়ে দেবে। কখন যেন মিথিলার শরীর আমাকে মুক্তি দেয় – গড়িয়ে সরে যাই আমি মেঝে থেকে। টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছি। এই মাত্র কি হল তার কোন ব্যাখ্যা আমার হাতে নেই। মিথিলার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার কিছুও নেই। গলাথেকে চাপ সরে যেতেই পাগলের মত কেশে উঠি আমি। দুনিয়ার সব বাতাস বুকে ঢুকিয়ে নিতে পাগল হয়ে উঠেছি!
দরজার ঠিক বাইরে আম্মু দাঁড়িয়ে আছে। দেরী করা যাবে না।
কোনমতে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে ওটা খুলে দেই আমি। আম্মুর আর ছোটভাই ফিরে এসেছে। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মিথিলাকে দেখে আম্মুর ভ্রু কুঁচকে যায়।
বইটা বাড়িয়ে দেয় মিথিলা, ‘আন্টি, বইটা দিতে এসেছিলাম। আপনাকে পেলাম না।’
একহাতে বইটা নেয় আম্মু। একবার ওর লাল হয়ে যাওয়া গাল আর একবার আমার রক্তাক্ত ঠোঁট দেখে চুপচাপ।
তারপরও ভদ্রতা বজায় রেখে আম্মু বলে, ‘এটা দিতে বৃষ্টিতে আসার কি দরকার ছিল? পরে দিতে। ঠান্ডা লাগবে তো।’
‘না, ঠিক আছে আন্টি!’
উড়ে পালালো মিথিলা।
একবার আমার ঠোঁটে স্পষ্ট কামড়ের দাগের দিকে বাঁকা চাহনী দিয়ে আম্মুও ঢুকে যায় ঘরের মাঝে।
*
ছোট ছোট পায়ে হাঁটছে মিথিলা। বিকেল এখন। আরেকটু পর সবাই যার যার ঘরে ঢুকে যাবে – ইফতারের সময় কাছিয়ে আসলেই।
বারান্দা দিয়ে ওকে দেখি আমি। আমার দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে তাকায় মেয়েটা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি আমিও।
‘জানি, একসাথে একটু হাঁটতে চাবেন এখন।’ আমার দিকে না তাকিয়েই বলে মেয়েটা।
টিশার্ট আর জিনসে চমৎকার লাগছে তাকে।
‘হাঁটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। কিছু কথা বলার ছিল।’ জানালাম।
দাঁড়িয়ে পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মিথিলা। ওর সুন্দর মুখটার দিকে তাকালাম, বাম গালে দাগ বসে গেছে আমার আঙুলের। সেজন্য অনুশোচনা হয় না অবশ্য। আরও কয়েকটা দেওয়া উচিত ছিল। নিজেও একটা ব্যান্ডেজ ঠোঁটে নিয়ে ঘুরছি।
‘কাল রাত নিয়ে প্রশ্ন করতে চান তো?’ , জানতে চায় ও।
‘না।’ দূরে তাকিয়ে দেখি, স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাউজিং পরিবেশ এমনই, আবার তাকাই মিথিলার দিকে, ‘বাসাটা সম্পর্কে জানতে চাই। কেন বাসাটা ছেড়ে গেলে তোমরা?’
‘কেন?’ সরু চোখে তাকায় ও আমার দিকে।
‘কারণ, প্রতিরাতে কাশির শব্দ শুনতে পাই আমি। ঠিক যেভাবে কেশেছিলাম গতকাল -’ বাকিটা বললাম না, মেয়েটার ওপর রাগ উঠছে প্রচন্ডভাবে, ‘গতকাল রাতে, বারান্দাতে আমার ঠিক পাশে শুনেছি ওই শব্দটা। কেন? কাশির শব্দ হবে কেন একটা বাসাতে?’
কাঁধ ঝাঁকায় মিথিলা, ‘তার আমি কি জানি? আমি তো কাশি না।’
রাগ সামলাতে পারলাম না, ওর দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেই প্রচণ্ডভাবে, ‘বলতে হবে। আর তোমাকেই বলতে হবে সেটা! কারণ, আমি মনে করি আমার সাথে যে কাজটা তুমি শেষ করতে পারো নি – ওই একই রুমে অন্য কোন ছেলের ক্ষেত্রে সেটা করেছ!’
‘ছাড়ুন, মানুষ দেখছে।’ অনুনয় করে মিথিলা।
ওকে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসলাম আমি, রাগে জ্বলছে দুই চোখ, ‘ইউ কিলড সামবডি ইন দ্যাট রুম! তারপর বাসা পাল্টেছে আংকেল। তাই না?’
গলা থেকে একটা রূপোলি চেইন খুলে দেয় আমাকে ও, ‘এটা আপুর গলাতে ছিল। এখন আমি পড়ে থাকি।’
হাতে নিলাম ওটা আমি, ‘আপু?’
‘নিহিলা আপু। আপনাদের ব্যাচের। আমার থেকে দুই বছরের বড় ছিল ও।’
‘আপু এখন কোথায়?’
আমার হাত থেকে আবার চেইনটা নিয়ে নেয় ও, ‘নেই তো। মরে গেছে সাত মাস আগে।’
অবাক হয়ে তাকাই আমি, ‘কিভাবে?’
আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার গলাতে পড়ে ফেলে ও চেইনটা, ‘আপু চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিল। বায়োকেমিস্ট্রি। আপুর মত ভালো মেয়ে হয় না জানেন? এত কিছু পারত ও, দারুণ ছবি আঁকত, গান করত অনেক সুন্দর করে। আপুকে মডেলিংয়ের অফারও দিয়েছিল বাংলালিংক। আব্বু রাজি হয়নি।’
কিছু না বলে শুনে যাই আমি। এবার অনেককিছুই স্পষ্ট হয়ে আসছে।
‘রিহান নামে এক ছেলেকে ভালোবাসত আপু। অথচ ছেলেটা প্লেবয় প্রজাতির। প্রতারক। যখন যে মেয়েকে ভালো লাগে তার সাথে থাকে। জিতে ফেলতে পারলেই চলে যায় তাকে ছেড়ে। আমরা জানতাম না। হাউজিংয়ের কোন মেয়ের দিকে সে আগে হাত বাড়ায় নি – সেজন্যই জানতাম না। ছেলেটার চোখ পড়ল আপুর দিকে।’
আমি শুধু শুনতে থাকি। মিথিলার চোখে ধীরে ধীরে পানি জমছে।
‘ছেলেটা বুয়েটে পড়ে। এখানে খুব কমই আসত। আপুর থেকেও এক বছরের সিনিয়র। যে কয়দিন আসত আপু পাগল হয়ে থাকত ওর সাথে সময় কাটানোর জন্য। আমিও সাহায্য করতাম। এরকম এক বন্ধ পেয়ে গেছিল রিহান সাত মাস আগে। কোন এক আন্দোলনে তাদের ক্লাস ছিল বন্ধ। আব্বু আম্মু শহরে গেছিল চেক-আপ করাতে। আপু আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে বলল, “তোর রিহান ভাই আসবে। আমাদের একটু সময় দিবি, বোন?” অন্য দিনের মত আমিও বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে। C-2 তে আমার বান্ধবী রিয়ারা থাকে। ওদের বাসাতে অযথাই গেলাম ক্লাস নোট তুলতে।’
চুপ হয়ে যায় মিথিলা এবার। বিষণ্ণ চোখ দুটো ফাঁকা মাঠটা দেখছে আর ওই মাঠের প্রতিবিম্ব এসে পড়ে ওর চোখের মণিতে। সাবধানে চোখ মুছে ফেলে ও।
‘তারপর?’ জানতে চেলাম আমি।
‘ফিরে এসে দেখি -’ থেমে যায় ও আবার, আরেকবার চোখ মুছতে হল ওকে এখানে, ‘ফিরে এসে দেখি দরজা খোলে না কেউ। একটা এক্সট্রা চাবি আমি সাথেই রাখি – ওটা দিয়ে সাবধানে মেইন গেট খুলে ফেললাম। গেস্ট রুমে পড়ে ছিল আপুর লাশ। শরীরে একটা সুতোও নেই – ব্লেড দিয়ে কেউ আপুর বুক পেট উরুতে ইচ্ছে মত কেটেছে। গলাতে রুমাল পেঁচিয়ে খুন করেছে কেউ তাকে।’
আমি চুপ হয়ে থাকি তবুও।
‘আব্বু সব জানল। কিন্তু রিহানের বিরুদ্ধে একটা আঙুল তুলল না। হাউজিংয়ের সবাই জানে এখানে সবার গল্প। নিহিলা আপু মরে গেছে – তবে মরেছে অসম্মানে। সেই সামাজিক অসম্মানকে অস্বীকার করে মৃতাকে সম্মান দেওয়া সাহস আব্বু-আম্মুর ছিল না, ইমন ভাইয়া।’ আমার দিকে হতাশ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় মিথিলা, ‘তাই কেসও করেনি তারা ওর নামে।’
‘প্রশ্নের জবাব তো পাইনি। বাসা ছাড়লে কেন?’ নির্বিকার ভঙ্গীতে জানতে চাই আমি।
‘আপুকে আমি দেখতে পাই ওই বাসাতে। আপুর সাথে কথা বলতাম। আপু শুধু কাশে। আমাকে বলে, “গলায় অনেক ব্যাথা রে। দ্যাখ গলাতে দাগ ফেলে দিয়েছে।” আমি দেখি। আদর করে দেই ওখানে হাত বুলিয়ে। কি ঠাণ্ডাই না হয়ে থাকে আপুর শরীর!’
‘আংকেল আন্টি তোমার কথা বলা মেনে নিল?’
‘না, বাসা পাল্টে ফেলল ওরা। আপনারা উঠলেন সেখানে। মাঠটা আপুর প্রিয় ছিল। এখানে আমরা দুইবোন ঘুরতাম। ঘাস ছিঁড়ে আমার জামার পিঠে ভরে দিত আপু দুষ্টুমি করলে। এখনও রাতে এখানে আমি আপুকে দেখতে পাই। আপুর সাথে কথা বলি।’
‘সেদিন যে আমি নেমে আসব সেটা -’
‘-আপু আমাকে বলেছিল। আপুকে তো জেগে থাকতে হয়। ঘুমুতে তো ও পারে না! আপনি জেগে জেগে গল্প লেখেন – সেগুলো ও পড়ে। আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে ওই সময়টাতে। এখন সময়গুলো ওর আগের চেয়ে ভালো কাটে। অনেক ভালো। আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’
‘সেজন্যই বলেছিলে রাতে জেগে থাকতে, তাই না?’
মাথা ঝাঁকায় মিথিলা, ‘আরেকটা কথা, গেস্ট রুমে রাতে ঢুকবেন না। আপু এরকম ক্ষেপে উঠবে জানলে আমিও যেতাম না।’
মাথা নাড়ি এবার আমি, ‘আমার মনে হয়, মিথিলা, আপু এমনিতে কাওকে স্পর্শ করতে পারে না। গেস্ট রুমে রাতে আমি আগেও ঢুকেছি। কিছু হয়নি। তোমার শরীরটাকে মিডিয়াম বানিয়ে আপু গতকাল আমাকে হামলা করেছিল – কারণ কাকতলীয়ভাবে রিহান আর আপুর মতই দৃশ্যপট সাজানো হয়ে গেছিল, যখন ঘরটাতে শুধু আমি আর তুমি ছিলাম।’
মাথা নাড়ে মিথিলা, ‘হয়ত। আমি দুঃখিত, ভাইয়া। ইচ্ছে করে -’
‘জানি।’ ওকে থামিয়ে হেঁটে আসি ওখান থেকে।
রিহান – রিহান ছেলেটা থাকে কোথায়?
*
C-1 বিল্ডিংটা রাস্তার পাশেই। তবে ভেতরের দিকে চলে আসলে সরাসরি কাওকে দেখা যায় না। আমি একেবারে সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে আছি।
এই জায়গাতে একজন সারাদিন লুকিয়ে থাকলেও তাকে দেখতে পাওয়ার কথা না কারও। কেউ সিঁড়ির নিচে এসে উঁকি দেয় না এই দেশে।
রিহান নামের ছেলেটা আমার পেছনেই ছিল। বাসার দিকে আগাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। গত পাঁচদিন ধরে একে ফলো করে গেছি আমি। আমার চেয়ে ভালো আর কে জানবে?
নিহিলার ছবি আমাকে একদিন দেখিয়েছিল মিথিলা। ওর থেকেও কয়েকগুণ বেশি সুন্দর মেয়েটা। বয়েসে আমার সমানই হবে। ছবিটার একটা কপি চেয়েছিলাম আমি। দিয়ে দিয়েছে মিথিলা।
একবার মোবাইল বের করে নিহিলাকে দেখলাম। এত মায়াবতী একটি মেয়েকে যে খুন করতে পারে সে কি মানুষ?
পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। একজন অমানুষের পায়ের শব্দ।
হাতে ধরে রাখা আটইঞ্চি ফলার ছুরিটাকে আদর করে দেই আমি অন্য হাত দিয়ে।
পায়ের শব্দ আরও কাছে আসছে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল রিহান?
ঝট করে নিচ থেকে বের হয়ে আসি আমি।
— ০ —
Leave a Reply