KP Imon

Words Crafted

ত্রাণকর্তা

নির্জন গলিটায় ঢুকে তৃষ্ণার গা ছমছম করে উঠলো আজ। অথচ এখানে সে প্রতিদিনই আসে। গলির শেষ মাথায় তার গন্তব্য। কেমিস্ট্রি পড়তে এ গলিতে পা রাখতে হয় সপ্তাহে তিনদিন। মাত্র তিনমাস পর ওর এইচএসসি পরীক্ষা।

আজও পাঁচ মিনিট লেট! প্রতিদিন লেট করার ব্যাপারে তৃষ্ণার খ্যাতি আকাশছোঁয়া। অনেকক্ষণ ধরেই দ্রুত পা চালাচ্ছে, তবে এখন আরও জোরে ছুটলো। তখনই প্রথমবারের মত খেয়াল করল, গলিটা পুরোপুরি নির্জন নয়! পা চালিয়ে সামনের আড্ডারত তিন যুবকের পাশ কাটানোর চেষ্টা করতেই পাশ থেকে ঠান্ডা কন্ঠস্বরটা শোনা যায়।

‘তাড়া কিসের, সুন্দরী?’

ইভটিজারদের মুখের ওপর কিছু একটা না বলে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে – এমনটা তৃষ্ণার শত্রুও বলতে পারবে না। কড়া একটা জবাব দিতে ওদের দিকে ফিরেছিল সে, পরমুহূর্তে থমকে গেল। হ্যাংলা ধরণের যুবকের হাতে একটা পিস্তল।

‘ভ্যানিটিব্যাগটা আমাদের দিয়ে যেখানে খুশি যেতে পার। আমাদের সাথে আসলেও আপত্তি করব না।’ মিটি মিটি হাসে যুবক। পেশাই নয় শুধু – ছিনতাই এর নেশা – চোখই বলে দিচ্ছে।  দ্বিধা করল তৃষ্ণা। ব্যাগের ভেতর আড়াই হাজার টাকা আছে – সেজন্য নয় – ভেতরে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে ওর গ্যালাক্সি এস-থ্রি।

ক্রিক ক্রিক করে কাগজ কাটার ছুড়ি বের করে আরেক যুবক। ‘মনে হচ্ছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়নি এখনও আপনার কাছে, আপু।’

আলতো করে কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামায় বেচারি। কিন্তু ‘হ্যান্ডওভার’ করার লক্ষণ দেখা যায় না। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে কিনেছিল ও স্মার্টফোনটা। চোখে পানি চলে আসে তৃষ্ণার।

কাঁধের কাছে ভরাট একটা কন্ঠ শুনতে পায় এই সময়।

‘এখানে কোন সমস্যা?’

চারজনই ঘুরে তাকায় শব্দের উৎসের দিকে। পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে এক তরুণ। এলোমেলো সিল্কি চুল কপাল ঢেকে রেখেছে। চোখ দুইটায় শিশুর সারল্য। নির্ভীক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

‘কেটে পড় ছোকরা! তোমার মাথা ঘামানোর মত কিছু নয়।’ পিস্তল নাচায় প্রথম যুবক।

‘প্রাইভেট প্রোপার্টিতে দাঁড়িয়ে নাকি আমি?’ খুবই অবাক হয়েছে এমন ভাবে বলে তরুণ। ভয়ানক আত্মবিশ্বাসটা খুবই আকর্ষণীয় লাগে তৃষ্ণার, ‘কই? কোন সাইনবোর্ড তো দেখলাম না।’

এক পা আগায় পিস্তলধারী। চোখমুখ বিকৃত করে অনুচ্চস্বরে বলে, ‘হিরো দেখা যায়!’ তারপর হাত বাড়িয়ে পিস্তলটা তাক করে তরুণের মাথায়, “চান্দু – তোমার মানিব্যাগটাও বের কর। মেয়েদের সামনে তারপর যত মন চায় স্মার্টনেস দেখাতে পারবে। নাহলে আল্লাহর কসম – গুলি করব আমি।’

‘প্রথমতঃ আমি চান্দু নই–’ দুই পা আগায় ছেলেটা। একটু বামে সরে তৃষ্ণাকে আড়াল করল। ‘দ্বিতীয়তঃ-’ হঠাৎই পা চালাল সে ওপরের দিকে। পিস্তলধারীর হাতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানে ছেলেটার জুতোর ডগা, সেই সাথে হাতও চালিয়েছে তরুণ। পেটের নিচে বেমক্কা এক ঘুষিতে বাঁকা হয়ে গেছে হ্যাংলা পিস্তলধারী। তার সামনেই ঠকাস করে পরে গেল আগ্নেয়াস্ত্রটা। নিখুঁত এক লাথিতে ওটাকে খোলা ম্যানহোলের দিকে পাঠিয়ে দিল তরুণ – তারপর শেষ করল বাক্যটা, ‘পিস্তল থাকলে তো গুলি করবে।’

সবটা এত দ্রুত ঘটে গেল, তৃষ্ণা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

কলিগের(!) দুরবস্থা দেখে লাফিয়ে এগিয়ে আসে ছুরিধারী। বাতাসে সাঁই করে চালায় ছুরি। চোখ বন্ধ করে ফেলল ও।

কিন্তু একটুও ঘাবড়ায় না তরুণ। একটু সরে গিয়ে ব্যর্থ করে দেয় ছুরিধারির প্রচেষ্টা। গলায় মাপমত একটা কোপ দেয় ডান হাত বাড়িয়ে। ছুরি ফেলে দিয়ে নিজের গলা চেপে ধরে দ্বিতীয় ছিনতাইকারী। রীতিমতো ককাচ্ছে। তৃতীয়জনের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে ততক্ষণে। গলির শেষমাথা যেদিকে কাছে সেদিকে দুই পা খুলে ছুট লাগিয়েছে সে। তাকে রেসে হারানোর জন্য মরিয়া হয়ে ছোটে বাকি দুইজনও।

‘অ্যামেচার সব।’ হাসিতে ফেটে পড়ে তরুণ। পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করেছে সে – বোঝাই যায়।

‘থ্যা- মেনি মেনি থ্যাংকস!’ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে তৃষ্ণা। ‘আপনার কোথাও লাগে নি তো?’

‘আরে নাহ। দারুণ মজা পেলাম। আপনি যাচ্ছেন কোথায়?’

‘সামনেই। রিয়াজ স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়ি।’

‘আপনি চাইলে পৌঁছে দিতে পারি।’ প্রস্তাব দেয় ছেলেটা।

‘আসবেন? আসুন।’ ভয় যায় না তৃষ্ণার।

চুপচাপ হাঁটে ওরা কিছুক্ষণ , ‘ফিরে যাব কিভাবে ভাবছি।’

‘ব্যাচমেটদের সাথে বেরিয়ে পড়বেন। একা কাওকে ধরে না ওরা। ভয় পাবেন না।’

‘ওহ – পরিচয়ই দেওয়া হয় নি আপনাকে। আমি তৃষ্ণা।’

‘নাফীস। এটাই উনার বাসা?’

‘হু। মেনি মেনি থ্যাংকস ভাইয়া। আপনি না থাকলে কি হত ভাবতেও ভয় হচ্ছে।’

‘আরে ধুর। এত থ্যাংকস বলার মত কিছু না।’ হাসে নাফীস। ‘চলি তাহলে, ভালো থাকবেন।’

*

তিনদিন পর।

সানগ্লাসে চোখের সাথে মুখেরও অর্ধেকটা ঢেকে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে তৃষ্ণা।

কানে ইয়ারফোনে ফুল ভলিউমে গান চলছে। এই অপেক্ষার মুহূর্তগুলো রীতিমত বিরক্ত লাগে ওর কাছে। 

সোজা ওর দিকে ছুটে আসা মোটরসাইকেলটা চোখে পড়েনি ওর। রাস্তার মানুষের সতর্ক চিৎকারও কানে আসে না, চাপা পড়ে গেছে গানের বিকট শব্দে। শেষ মুহূর্তে তাকিয়ে দেখতে পায় মাথার-স্ক্রু-খুলে-যাওয়া বাইকারের ওর দিকে ছুটে আসা। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকে ও।

বলিষ্ঠ একটা হাত টান দিয়ে সরিয়ে নেয় ওকে। কান থেকে ইয়ারফোন সরিয়ে দিয়ে ধমকের সুরেই বলে, ‘বিপদের দিকে আপনার আকর্ষন একটু বেশি-ই মনে হয়?’

নাফীসকে চিনতে পারে এতক্ষণে তৃষ্ণা। মাত্র একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়ায় শরীরের কাঁপুনি লুকোয় ও কোনমতে।

‘আরে আপনি!’

‘সৌভাগ্যক্রমে।’

‘বিপদগ্রস্থের পাশে গায়েব থেকে চলে আসার ক্ষমতাও আপনার অসাধারণ।’ অপ্রতিভ ভাবটা কমাতেই তৃষ্ণা হাসে একটু, ‘দিন দিন আপনার প্রতি ঋণ আরও বেড়ে যাচ্ছে আমার।’

‘একটু সাবধানে চলা ফেরা না করলে তো সামনের জন্মদিন আর চোখে দেখবেন না।’ ভৎর্সনার সুরেই বলে নাফীস। ‘এখন যাচ্ছিলেন কোথায়? ফিজিক্স প্রাইভেট?’

‘না। পাইকপাড়ায়  আপুর বাসায় যাচ্ছিলাম।’ হেসে ফেলে তৃষ্ণা। ‘আপনি?’

‘সনি সিনেমা হলে বন্ধুরা ডাকল বলে বের হলাম। কিন্তু মাঝপথে আপনার সুইসাইড অ্যাটেম্পট দেখতে হবে ভাবিনি।’

‘অনেক রেগে আছেন মনে হচ্ছে। এই যে প্রমিজ করলাম, আর কোনদিন কানে ইয়ারফোন নিয়ে রাস্তাঘাটে বের হব না।’

একটা ভ্রু উঁচু করে নাফীস।

‘আচ্ছা – নির্জন গলিতে ছেলেদের জটলাও এড়িয়ে চলব। প্রমিজ।’

‘গুড। আপনার সামনের জন্মদিন দেখার ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বাস এসে পড়েছে। চলুন উঠা যাক।’

বাসে উঠে সমানে বকবক করে যায় দুইজনই। কথার ধাক্কায় কখন ‘আপনি’ থেকে দুইজনই ‘তুমি’তে নেমে এসেছে সেটা অবশ্য খেয়ালই করে  না কেউ।

এরই মধ্যে তৃষ্ণার জানা হয়ে গেছে নাফীসরা দুই ভাই। নাফীসের বাবা পিডিবির সিনিয়র অফিসার। নাফীস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নাফীসের প্রিয় রঙ কি – কোথায় ওর স্কুল কলেজ ছিল – কোথায় কোথায় ওর বাবা ট্রান্সফার হয়েছে – এখন কোথায় থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। নাফীসের জ্ঞানভান্ডারও যে কিছুটা সমৃদ্ধ হয়নি – তা নয়! নাফীসের একদম মামুলি কথাগুলোও তৃষ্ণার কাছে অনেক ইন্টারেস্টিং লাগে। অকারণেই হেসে কুটি কুটি হয় ও।

‘আপনার মোবাইল নম্বরটা দেওয়া যাবে? যদি সমস্যা না থাকে কোন?’ পাইকপাড়ার কাছাকাছি এসে জানতে চায় তৃষ্ণা।

‘ইন কেস ইউ আর ইন ট্রাবল।’ নম্বরটা বলে চোখ টিপ দেয় নাফীস।

*

সনিতে পৌঁছে লাফিয়ে নামে নাফীস। মৌরীতে বসে ছিল হামীম আর রিয়াদ।

বসে পড়ে নাফীসও। ‘ফয়সাল কোথায়?’

‘ঘুরপথে আসছে।’

বলতে বলতেই বাইক নিয়ে উপস্থিত ফয়সাল।

‘মামা – কাজ হয়ে গেছে।’ চোখ টিপ দেয় নাফীস। ‘তৃষ্ণা নম্বর দিয়ে গেছে বাসে।’

‘হুফফ!’ আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ে ফয়সাল। হাত তুলে দেয় হাই-ফাইভের জন্য। ‘আমাদের খাওয়ানোর পালা এইবার তোর! কেএফসির নিচে কথা নাই।’

*

তিনদিন আগে।

তৃষ্ণার বাসার দুই রোড পরে আড্ডা দিচ্ছিল ওরা।

‘নাফীস – তোর জান বাইর হয়ে যাচ্ছে।’ হঠাৎ হামীম বলে।

‘আমার জান আমার ভেতরেই আছে।’ মুখ বাঁকায় নাফীস।

‘মানে, তোর তৃষ্ণা বাইর হয়েছে।’ শয়তানী হাসি ফোটায় মুখে হামীম।

‘তুই আর কয় দিন দূর থেকে দেখবি!’ বিরক্ত হয় ফয়সাল। ‘এভাবে দেখতে থাকলে জুনিয়র তৃষ্ণাও দেখা লাগবে তোর। না বললে কিভাবে বুঝবে?’

‘ফার্স্ট ইম্প্রেশনই সব রে। সেইটা হঠাৎ করা উচিত না। প্ল্যান করা লাগবে।’ হঠাৎ চোখ জ্বলে ওঠে নাফীসের। ‘হু – প্ল্যান …’

‘কি হল?’ কৌতুহলী হয় ফয়সাল।

ব্যাকপ্যাক থেকে ছোটভাইটার জন্য কেনা খেলনা পিস্তলটা বের করে ওর দিকে ছুড়ে দেয় নাফীস। নিজেকে জেমস বন্ড ভাবে পিচ্চিটা। পিস্তলের কালেকশন কম না তার কাছে। ‘উড়াল দে বাইক নিয়ে। তৃষ্ণার কেমিস্ট্রি স্যারের রোডে গিয়া ওকে হাইজ্যাক কর।’ আরেকটা কাগজ কাটার ছুরি বের করে হামীমের দিকে ছুঁড়ে মারে ও। বাতাসের লুফে নেয় ওরা ওগুলো। ‘আমি আসছি ওকে উদ্ধার করতে।’

‘কিন্তু তোর ছোট ভাইয়ের পিস্তল – ’

‘আরে ওকে আরেকটা কিনে দেব।’ কথা শেষ করতে দেয় না রিয়াদকে।

তিনজন বাইক নিয়ে উধাও হয়ে যায়।

ছুট লাগায় নাফীস।

*

ফয়সালের উঠিয়ে রাখা হাতে হাই-ফাইভ দেয় নাফীস, ‘সিওর দোস্ত! কেএফসি কোন ম্যাটার না।’

হাসিতে ফেটে পড়ে চারজনই।

রচনাকাল – ১৪ই ডিসেম্বর, ২০১৩

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *