আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গল্প লেখা শুরু করলে…
এই প্রশ্নটা এখন পর্যন্ত কয়েকবার শুনে ফেলেছি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গল্প লেখা শুরু করলে আমার মনোভাব কেমন হবে?
আমি বলেছি, “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তার খুশিতে লিখবে, আমি আমার খুশিতে লিখবো। এখানে তো আর প্রতিযোগিতা হচ্ছে না।”
অর্থনৈতিক হিসেবে দেখলে, হয়তো হচ্ছে। যেমন ধরুন মিডজার্নির ছবি চাইলে আপনি আপনার ড্রইংরুমে ঝোলাতে পারেন। তাই না? মানে, আগে যতখানি ইনকাম পৃথিবীর সব আর্টিস্টরা করে থাকতেন – এখন তাদের আয়ের একটা সংকুচিত উৎস – ওয়ালপেপার আঁকা, কমে যেতে পারে। মানুষ নিজের একেবারে পার্সোনালাইজড ছবি মিডজার্নি থেকে বের করে একটু ফটোশপ করে হাই ডেফিনিশন বানিয়ে দেয়ালের এমাথা থেকে ওমাথা ঝুলিয়ে রাখতে পারবে। আর্টিস্টকে টাকা কেন দেবে?
প্রচ্ছদশিল্পীদের ভাতের জায়গায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ঢুকে পড়তে পারে। লোক মিডজার্নি বা অনুরূপ সারভিস থেকে ছবি করে নিয়ে ওটা দিয়ে প্রচ্ছদ বানাতে পারবে। আগামি কিছু বইমেলায় আমরা প্রচুর মিডজার্নি প্রচ্ছদ দেখবো।
কিন্তু অপ্রচ্ছদশিল্পী কি রিপ্লেসড হয়ে যাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণে?
উঁহু। তারা বিবর্তিত হবে। হতে পারে তারাও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে পার্সোনালাইজেশনের নেক্সট লেভেলে চলে গেলেন। অথবা অন্য কিছু, তবে মানুষের কাজই বিবর্তিত হওয়া। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিবর্তিত হয় আর মানুষ নয়, তা কিন্তু না। মানুষের বিবর্তন ধীরগতির হতে পারে, তবে মানুষ একটা হিউম্যান টাচ, নতুন কোন অ্যাপ্লিকেশন সব সময় বের করে ফেলে।
ফালতু একটা উদাহরণ দেই। আগে পাংখাপুলার ছিল। যাদের কাজ ছিল ‘সাহাব’দের পাখা টানা। তারপর ফ্যান এলো। তারপর এলো এয়ার কন্ডিশনার। তারপর এলো এইচভ্যাক সিস্টেম। এখন এইচভ্যাকে কোটি কোটি টাকার ক্যারিয়ার বানানো সম্ভব।
হ্যাঁ, পাঙ্খাপুলারের চাকরি গেছে, কিন্তু মানুষের চাকরি যায়নি। মানুষ এখন হাতে পাখা না টানলেও, কীভাবে বাতাসের কোয়ালিটি ঠিক রেখে কম শক্তি খরচ করে পরিবেশ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়ে কাজ করছে। সভ্যতা সামনে গেলে সার্ভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট আবার চলে আসে, যে শিল্পীরা নতুন টেকনোলজি নিয়ে চিন্তা করবেন, কাজ করবেন ও নিজস্বতা যোগ করবেন, তারা এআই ব্যবহার করে নিজেদের কাজ অনন্য উচ্চতায় নিতে পারবেন সব সময়ই।
গল্পের উদাহরণে আসি। আগামি এক সময় হয়তো গল্পকার-বুদ্ধিমত্তা চলে আসবে (এখনকারগুলোর মতো নলা নয়, সত্যিকারের গল্পকার বুদ্ধিমত্তা) – যারা থিম দিলেই থৃলার গল্প লিখে দেবে ২০০০ পৃষ্ঠার। ৫ মিনিটে সে চার লাখ বই লিখে ফেলবে। তাহলে লেখকের মূল্য আর থাকলো কোথায়, এই তো?
লেখকের মূল্য তারপরও থাকবে। যেমন ধনীর ওয়ালপেপার মার্কেট ভ্যালু চিত্রকরের কমে গেছে তেমন বাসে বসে একটা বই পড়ে নেয়া জনগণের কাছে লেখকের ভ্যালু কমতে পারে, সেটা বড় সমস্যা নয়।
লেখকের বা শিল্পীর জীবন মানুষের কাছে রিলেটেবল – কারণ লেখক বা শিল্পীর মতো মানুষকে এক দিন এক দিন করে বাঁচতে হয়, একটা একটা করে চিন্তা করতে হয়, সীমিত সময়ে কাজ করতে হয়। কাজেই তার চোখে উঠে আসা স্ট্রাগলের কথা এআই যদি হুবহু কপি করতেও পারে, তবুও মানুষের জীবন মূল্যহীন হবে না। এটা পাঙ্খাপুলার জোন নয়, এটা অনুভূতির জায়গা। ধরুন ম্যান্ডেলার জীবন নিয়ে আপনি জানতে চান, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ম্যান্ডেলার মতো ৭ টা জীবনি লিখে দিলেও আপনার চাহিদা থাকবে। ইয়ান ফ্লেমিং নিজে স্পাই ছিলেন, জেমস বন্ড লিখেছেন – এই বন্ড আমরা পড়তে চাই কারণ ফ্লেমিংয়ের অভিজ্ঞতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দশগুণ ভালো স্পাই থৃলার লিখলে আমি অবশ্যই সেটা পড়বো থৃল নিতে, তবে ফ্লেমিংয়ের বন্ড পড়বো কারণ ওটা রিয়েল মানুষের রিয়েল স্ট্রাগল থেকে আসা – তাই।
এখানেই বিবর্তনের ব্যাপারটা আসবে। যেটা আমি অনেক আগ থেকেই বলি – শব্দের পর শব্দ লিখে কীভাবে থৃল দিতে হয় বা গল্প বানাতে হয় – এটা লেখক হবার একটা ক্ষুদ্র অংশ। অনেকে এইটুকু করেই মনে করেন লেখক হয়ে গেলেন। ওটা একটা যন্ত্রও পারবে, আগামি কয়েক বছরের মধ্যেই এমন অনেক যন্ত্র দেখবেন।
লেখক হতে হলে আপনার জীবনটাকে লেভারেজ করতে হবে। আপনার জীবনযাপন যদি ইন্টারেস্টিং এনাফ হয়, আপনাকে ঘিরে তৈরি হতে পারে লেজেন্ড – তবে আপনার গল্পের একটা আলাদা মুল্য থাকবে। এমনকি যিনি আপনার ব্যাপারে কিছুই জানেন না তিনিও আপনার লেখা পড়লে বুঝতে পারবে – এটা স্রেফ আর দশজনের কলম থেকে আসেনি।
ক্রিকেটার হতে হলে ভালো ছয় মারতে পারলেই হয়তো আপনি ব্যাটসম্যান। কিন্তু লেখক, চিত্রকর, মিউজিশিয়ান – স্রেফ জায়গামতো সুর তোলা আর কোন শব্দের পর কোন শব্দ বসবে তা জানাই যথেষ্ট নয়। ওতেও আপনাকে মাস্টারি আনতে হবে, তবে জীবনের একেবারে খাদহীন অনুভূতিগুলোর ভেতর দিয়ে না গেলে সেটার মূল্য শুন্য।
সোলায়মান সুখন অবশ্য বোঝেন নাই ব্যাপারটা। তিনি বা অনেকে মনে করেন দারিদ্র্যতা কবিত্ব বা লেখালেখির মূল উপযোগ আনে – আসলে তা নয়। এটা আনে নিরেট ও গভীর অনুভূতি। আর অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল হয়ে নিরেট ও গভীর অনুভূতি পাওয়া দুষ্কর।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স লেখালেখির জগতটা টেক ওভার করলে দুই ধরণের বিবর্তন লেখকদের গ্রহণ হবে।
(১) আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে ব্যবহার করা। একটা চ্যাপ্টার নিজে লেখার পাশাপাশি এআই দিয়ে ৫০০ টা একই চ্যাপ্টার লেখাবো আমি। তারপর সব পড়বো। তারপর আমার সিদ্ধান্ত নিবো কোনদিকে এই গল্প যাবে – আমার পার্সোনালাইজড ওয়েতে। কাজেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যে শত্রুই হবে এমন না, তাকে ব্যবহার করতে হবে।
(২) স্রেফ শব্দের পর শব্দ সাজানো যে সবটা নয় সেটা লেখকদের মাথায় ঢুকবে। তারা নিজেদের জীবনটাকে ঠিকমতো সাজাবে, যেন তার নির্যাস ভালো হয়। জীবনটাকে একটা পুষ্পশয্যা বানিয়ে রেখে বানোয়াট নির্যাস জনগণকে খাওয়ানোর চেষ্টা আর তারা করবে না। এতে করে আমাদের লেখকরা আরও চৌকস হয়ে উঠবে।
যেমন মিডজার্নির কারণে আর্টিস্টরা আরও চৌকস হবেন তা নিয়ে আমি নিশ্চিত। অনেকে হয়তো বিবর্তন-০১ এর মতো এআই থেকে এখন আইডিয়া নেবেন, যদিও তার নিজস্ব আইডিয়া ছিল। তবুও, যতগুলো সম্ভব হেল্প আমরা নেবো। যেমন বানান আপনি পারেন, তাও গ্রামার ও স্পেলিং চেকার ব্যবহার করেন কারণ যান্ত্রিক হেল্প নেবো না কেন?
দ্বিতীয়তঃ আর্টিস্টরা ইভলভ হবেন, যেন স্রেফ তুলির আচড় নয়, তাদের কাজে আরও কিছু থাকে। সত্যিকার জীবনের সত্যিকারের নির্যাস।
কাজেই, এআই আমার কাছে কখনোই কম্পিটিটর মনে হয় না।
যেমন মনে হয় না আরেকজন লেখককে।
উনি উনার মত লিখবেন, আমি আমার মত লিখবো।
আরেকজন মানুষ ভালো লেখক হলে তার সাথে আমি ফোনে কনসাল্ট করতে পারি লেখালেখি নিয়ে, একটা এআই দিনে দশ লাখ উপন্যাস লিখতে পারলে তার সাথেও আমি যোগাযোগ করতে পারছি, উপন্যাস লিখিয়ে নিয়ে। ক্ষতির কী আছে?
যন্ত্র বা মানুষ – কাউকে ঠেকিয়ে দেয়া যেন আমাদের লেখা বা ছবি বেশি চলে বা বেশি মনোযোগ পায় – এমনটা সত্যিকারের কোন আর্টিস্ট করেন না। এখনো অনেক লেখক লিখেন। মানুষ দশ হাজার লেখকের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে হুমড়ি খেয়ে থাকেন। যদি এই ৯,৯৯৯ লেখক না থাকতেন, তাহলে সব মনোযোগ আমি একাই পেতাম। তাই বলে কি আমি এখন এই ৯,৯৯৯ জনকে স্তব্ধ করে দিতে তাদের পরিবারদের অপহরণ করবো?
না।
তেমনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি সত্যিকারের মানুষকে টপকে ফেলে ভালো কন্টেন্ট দিতে থাকে, তবুও তার বিরুদ্ধে আমি কোন স্ট্যন্ড নেবো না। তাদের আমি আরেকটা মানুষ-লেখক বা মানুষ-শিল্পীর মতোই দেখি। ওরা ওদের মত লিখুক, আমি আমার মত লিখি। মিটে গেল।
এই কারণে অনেকে আমার ইন্টারপ্রিটেশনের ভুল মানে বোঝেন। ভবিষ্যতের বাংলার ছবি মিডজার্নি এআই বানিয়েছে, গ্রাম হয়ে গেছে ৪০২৩ব সালের ঢাকা। আমি বলেছিলাম এই ছবি থেকে আমার ইন্টারপ্রিটেশন হচ্ছে মিডজার্নি জানে আমরা উন্নত হতে হতে নিজেদের ধ্বংস করে ফেলবো, কাজেই ৪০০০ সালে মানুষ স্রেফ কৃষিকাজ করে কোনমতে বেঁচে থাকবে। তাই উঁচু বিল্ডিং নেই।
কেউ কেউ বললেন, “ভাই এভাবে তো এআই চিন্তা করতে পারে না।”
সে আমিও জানি। তবে অন্য এক শিল্পী এটা আঁকলেও আমি নিজের মতই ইন্টারপ্রিট করতাম। হয়তো শিল্পী এত কিছু ভাবেনই নাই। স্রেফ গ্রাম আর ধ্বংসস্তুপ এঁকে ভেবেছেন ৪০২৩ লিখে দেয়া যাক! লাল দরজার ছবি নিয়ে এমন জোকস অনেক আছে।
আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আঁকুক আর মানুষ, আর্টিসটকে একই সম্মান দেই।
গল্প লিখলেও সে আমার থেকে লেখকের সম্মানই পাবে। ওই ৯,৯৯৯ জনের মত।
তার ফোকাস আমি কেড়ে নিতে চাই না। তাকেও আমি লিখতে দিতে চাই।
যন্ত্রকে মানুষের সমান সম্মান দেয়া আমাদের উচিত।
আমি একটা চেয়ারের সাথে পা বেঁধে গেলে চেয়ারটাকে সশব্দে, “সরি, ইচ্ছে করে করিনি। লেগে গেল।” বলে থাকি। চেয়ারের প্রাণ নেই, তবুও। যন্ত্রেরও নেই।
তবে যন্ত্রের প্রতি, চেয়ারের প্রতি আমরা কীরকম আচরণ করি, তা আমাদের চরিত্র প্রকাশ করে। যন্ত্রের বা চেয়ারের নয়।
Leave a Reply