KP Imon

Words Crafted

আমেরিকান বইপড়ুয়ারা

জেলিকসের বাইরে মাঝে মাঝে একটা রোলস রয়েস দাঁড়িয়ে থাকে। তিন গোয়েন্দা পড়ার সুবাদে আমাদের জানা আছে এই জিনিস কিশোর পাশা জিতেছিল দানা গুণে। আমার এক ইরানী বন্ধু একবার রোলস রয়েস দেখে বলেছিল, “ভাই, এটার সামনে একটা ছবি তুলে দিবা? এর সামনে ছবি না তুললে আমার জীবনই বৃথা।”

তুলে দিয়েছিলাম।

কালের পরিক্রমায় রোলস রয়েসের মালিক জন এখন আমার খুব কাছের বন্ধু। বয়েস তার ৬৫। জেলিকস বারে আমি ড্রিংক করেছি অন্তত ৪০০০ ইউএস ডলারের সমমূল্যে। কিন্তু আমার পকেট থেকে গেছে ২০০ ডলারও না। কারণ আমার একজন অসমবয়েসী বন্ধুর আছে দুটো রোলস রয়েস, আরেকজন হলো রিজুল কালা। নামে কালা হলেও ছেলে ধলা। এমপ্যাথ। তার সামনে মানিব্যাগ বের করলে পারলে ধরে মারে। ওদিকে জোড়া রোলস রয়েসের মালিকও রীতিমতো অফেন্ডেড হয়ে যায় কেউ বিল দেবার চেষ্টা করলে। এমন নয় যে আমি চেয়ে নিচ্ছি, কিছু বোঝার আগেই জিনিস হাজির। কী একটা বিপদ।

জেলিকস বারে এটা হচ্ছে আমার “দ্য বয়েজ” সার্কেল। মজার ব্যাপার হলো জন এতো লোককে এখানে চেনে, বলার মতো না। তবে সবাইকে ও টেবিলে ডাকে না। আমাকে পেলে কোথাও যেতে দেবে না। কারণও আছে অবশ্য।

কঠিন ঠাণ্ডার এক রাত ছিল ওটা, যেদিন জোড়া রোলস রয়েসের মালিক জনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম শালার পুত এক ভ্যাগাবন্ড। বোকাচোদার মতো জামাকাপড় পরে বসে ছিল এক কোণে । আমার সাথে দেখা হয়েছিল স্থানীয় ইয়ে-মানে-নাম-বলা-যাবে-না সংস্থার একজন অপারেটিভের সাথে। চৌকস সেই অপারেটিভ সাত ঘাটের জল ঘোলা করে আসা মানুষ। আমরা প্রায়শঃই বিশ্বরাজনীতি নিয়ে আলাপ করি। একদিন দেখলাম জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমার। পরিচিত হতে আমার আপত্তি নেই, হয়েছিলাম।

জন বোধহয় ট্রিলিয়নিয়ার। এই স্যান মার্কোসে কী করে জানি না। ওর এতোগুলো গাড়ি যে গোটা স্যান মার্কোসকে বিক্রি করে দিলেও তার দাম উঠবে না। আমি অতোকিছু জানতাম না তখন। সে রাতে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে অপারেটিভের মাধ্যমে। সে ভেগে যেতে চাইলো রাত দশটায়, অথচ ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে নয়টা। তারপর আমার সাথে পরিচয় হয়ে গেল বেচারা টেক্সান ‘শেখ’-এর। আর যাবে কোথায়।
দশটা পেরিয়ে এগারোটা, তারপর বারোটা।

অপারেটিভ বললো, “ভাই, যেতে হবে। কাল কাজ আছে।”

ও যখন বলে কাজ আছে, আমাদের কারো এত বড় বিচি নেই যে কাজটা কী জানতে চাইবো। হি ইজ আমেরিকান গভর্নমেন্ট হিমসেলফ। মাইক্রফট হোমসের মতো। আমরা জানতে চাইলাম না। কিন্তু জন বললো, “আমি আরেকটু থাকি। কেপির সাথে আরেকটু আলাপ করে যাই। ব্যাটা ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার।”

সেই রাতে যখন প্রায় দেড়টা বাজে, আমাকে বললো, “ভাই, তুমি বারে গেলে কি আমার জন্য একটা শাইনার বক আনতে পারবা?”

তারপর মানিব্যাগ বের করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
আমার তো বাঙালি হৃদয়। আমি ওকে চিনিও না। ভেবেছি কোন না কোন চুদির ভাই। হবে হয়তো হোমলেস কোন বোকাচোদা। কাজেই হা হা করে বললাম, “আরে ভাই, তোমাকে টাকা দিতে হবে না। আমি তোমার ড্রিংক নিয়ে আসছি।”

ঐ মুহূর্তে আমরা এতো দারুণ আলাপ করছিলাম মুভি আর লিটারেচার নিয়ে, যে বলার মতো না। আড্ডা যদি হোমলেসের সাথে হয় তো হলো, এটা মিস করা যাবে না। অথচ আমার ব্যাংকে তখন ১,৫০০ ডলারের ঋণ। ক্রেডিট। ফকিরেরও অধম। তাও আমি ওকে বিয়ার কিনে দেবো। নিতানত অপারগ না হলে একটা মানুষ কিছু চেলে তা দেব, এটাই আমার বাঙালি শিক্ষা।

দিলাম।
ও বললো, “ভাই, তুমি তো রেকর্ড করে ফেললা।”
আমি বললাম, “আরে ভাই, তোমাকে অফেন্ড করলাম নাকি, বাড়া? এটা আমার ধান্ধা ছিল না।”
জন বললো, “আমাকে কেউ কখনো ড্রিংক কিনে খাওয়ানোর সু্যোগ পায়নি। তোমার কাছে তো ঋণী হয়ে গেলাম।”
আমি পুরো বোকচোদ হয়ে গেছি। এ দেখি হেঁজিপেঁজি লোক নয়। বললাম, “আরে ভাই, এটা স্রেফ একটা শাইনার বক। এমন কিছুই না।”

পরের দিন দেখি ও দুটো রোলস রয়েসের মালিক।
ট্রিলিয়নিয়ার গাই। মলাট দেখে বই বিচার না করার শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল। আমাকে বারের আশেপাশে দেখলে যদি ধরে নিয়ে এসে নিজের পাশে না বসিয়েছে তো মদ-ই হজম হবে না তার।

যাকেই দেখবে তাকে ডেকে নিয়ে এসে বলবে, “হি ইজ ফ্রম ব্যাংলা-ফাকিং-ড্যাশ! সেরা মাল। কঠিন মাল, ভাই।”

এক রাতে ৬ ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে কেউ আমাকে এত পছন্দ করে ফেলতে পারে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। মাঝে মাঝে মন খুব ভালো হয়ে যায় বাংলাদেশের নামে সে এত ভালো ভালো কথা লোককে বলে তা দেখে।

মাঝে মাঝে চোখে পানি চলে আসে।
নিজেকে বলি, “চুদির ভাই, তুই না জাতীয়বাদে বিশ্বাস করিস না। ফোঁত ফোঁত করবি না। একেবারে ফোঁত ফোঁত ফোঁত করবি না।”

কিন্তু খুব একটা সুবিধে করা যায় না।

২.
আজকে বন্ধু রিজুল আমাকে পাছা থেকে গলা পর্যন্ত মদ খাইয়ে দিয়েছে। একটা পয়সাও খরচ করা গেল না। দিতে চাইলেও নেবে না। বললো, “বিজনেস মিটিং তো। পাঁচ বছর পর আমরা এই জেলিকস-ই কিনে নেবো। তখন সব টাকা উঠে আসবে।”

রিজুলের সাথে আমার রোজকার আড্ডায় একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আমরা একটা বিজনেস প্ল্যান করে ফেলেছি। ধান্ধা, পয়ত্রিশ বছরের মধ্যে নিজেদের কোম্পানি খুলে ফেলতে হবে। এতো শুয়োর চোদা যাবে না। অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করে আর যা-ই হওয়া যাক, বড়লোক হওয়া যায় না। বাড়ি-টাড়ি কেনার ধৈর্য বা প্রোফাইল আমাদের নাই। কাজেই আমরা সাধ্যের মধ্যে সবচেয়ে সেফ কিন্তু কার্যকর পথটা বেছে নিলাম। কুত্তার মতো পড়া লাগবে বটে, তবে একটা লাইসেন্স পাশ করতে পারলেই কেল্লা ফতে। নিজেদের বিজনেস খুলে আমেরিকার পাছা মেরে দেবো। এই হলো ধান্ধা।

সেই থেকে সে আমাকে একটা পয়সাও খরচ করতে দেবে না। অবশ্য জানে আমার কী অবস্থা। দেড় হাজার ডলারের ঋণ এতো সোজা ব্যাপার নয়। আমি তো বাইরে কোথাও বসতেই চাই না আর, কিন্তু আমার সাথে আলাপের সুযোগ সে ছাড়বে না। কাজেই বারে না এলে মাথায় বন্দুক ধরে আনবে।

আজকেও ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে আলাপ করতে হলো। আগামি বছর এই সময়ের মধ্যে আমার পরীক্ষায় বসতে হবে। পাশ করলেই এলাকা প্রকম্পিত করে ব্যবসা খুলে ফেলবো আমরা। তারপর ঘণ্টায় ৯০ ডলার। এ কেবল শুরু, ব্যবসা বড় হলে মাসে হান্ড্রেড থাউজ্যান্ড হয়ে যাবে নির্ঘাত। তবে সেটা হতে হতে আরও ৭ বছর লাগবে।

আমরা দুইজনই ঘাউড়া। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে অভ্যস্ত, তবে শর্ট টার্মে আমাদের দেখলে যে কেউ মনে করবে ভ্যাগাবন্ড। ঠিক ঐ জনের মতো। একই সাথে এটাও নির্ঘাত যে কোন কোম্পানিতে চাকরি করে কখনোই ৭ বছরের ব্যবধানে প্রতি মাসে হান্ড্রেড থাউজ্যান্ড কামানো যাবে না। জিন্দেগিতেও না।

রিজুল বিদায় হলো বটে, তারপর বাসায় ফিরে এলাম। বাজে মাত্র সাড়ে সাতটা। এপাশ ওপাশ করে বুঝলাম ঘুমের ঘ-ও আসবে না। ওদিকে এই শহরে যত মেয়ে আমার প্রতি আগ্রহী আছে সবাইকে ভূত দেখানো হয়েছে। এরা বলে ঘোস্টিং। কাজেই কাউকে নক-টক দেয়ার ঝামেলায় না গিয়ে কাঁধে ল্যাপটপটা নিয়ে ফিরে এলাম জেলিকসে। একটা বিয়ার নিয়ে বসে পরের উপন্যাসের পরের চ্যাপ্টারটা লিখে ফেলবো।

মন মেজাজ আজ বেশ ভালো।
প্রফেসরের সাথে গ্রুপ মিটিংয়ে তিনি বলেছেন, “আরেব্বাস, এটা তো একটা ব্রেকথ্রু!”

ওটা আসলে বালের ব্রেক-থ্রু। তবে প্রফেসর জানেন কচুটা। আমি জানি রিসার্চ কই যাচ্ছে। সামনে কী কী ঝামেলা হবে অক্ষরে অক্ষরে জানি আমি। আমার বোকাচোদা প্রফেসর তার বালও জানে না। তবে আজকের জন্য এটা একটা উইন।

কাজেই কাঁধে ফুলি চার্জড ল্যাপটপ নিয়ে বারে ফিরে আসলাম। গল্প লেখা যাক।

৩.
বেশিদূর যাওয়ার কপাল আমার ছিল না। কেউ একজন ডাকলো। তাকিয়ে দেখলাম জন নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে একটা বাঁদরের মতো লাফাচ্ছে। ডাকছে, “এই কেপি। আরে কেপি, এইদিকে!”

কী বিপদ। এগিয়ে গিয়ে ওর সাথে কোলাকুলি করতেই হলো। ট্রিলিয়নিয়ার মানুষ। উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই। তাছাড়া লোকটাকে আমার পছন্দ। টেক্সাসের পোলাপানের মতো ছাগল না। বয়স হয়েছে, তার সাথে মুভি, বই, মনস্তাত্ত্বিক আলাপ করা যায়। এসবে ছোকরাদের মধ্যে খুব বেশি মানুষের আগ্রহ নেই। মেয়ে কিছু আমার আশেপাশে থাকলেও কারো সাথে ঝুলে পড়ি না একই কারণে। আমি বরং রিজুল বা জনের সাথে দশ ঘণ্টা আড্ডা দেব, কিন্তু কোন বোকাচোদা মেয়ের সাথে আমি এক মিনিটও কথা বলবো না। যতই সুন্দর হোক আর হট।

কেউ আমাকে বোর করলেই আমি “বিদায়। খোদা হাফেজ। আলবিদা। গুড নাইট।” বলে উধাও হয়ে যাই।

জন এক ইন্টারেস্টিং চরিত্র। ডাকলো যখন, গেলাম। ওর সামনে বসে আছে দুই মেয়ে। ট্রিলিয়নিয়ারের সামনে মেয়ে থাকবে না তো জোকারের সামনে থাকবে? ওদের সাথে হাত মেলালাম।

জন বললো, “কোন চিপাচুপায় ভাইগা যেয়ো না। বিয়ারটা নিয়ে এইখানে ফিরে আসো। আলাপ করা দরকার।”

এলাম। ওদিকে জনের এক বন্ধু এসে হাজির। এই নতুন লোকটার বয়স ৬২ বছর। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো টেক্সান শেখ। যথারীতি প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বাকিদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, “হি ইজ ফ্রম ব্যাংলা-ফাকিং-ড্যাশ! সেরা মাল। কঠিন মাল, ভাই।”

আমি ভাবলাম, শালার এই কথাটা শুনতে এত ভালো লাগে কেন! কেন লাগে? বাংলাদেশ কিংবা ভারত, আমেরিকা কিংবা কানাডা – সব বর্ডারকেই তো আমি অস্বীকার করি। কেন লাগবে!

তার থেকেও ভয়ানক কথা, কোন দুঃখে এই এতগুলো মানুষ আমাকে এমন করে ভালোবাসবে? কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপ ছাড়া আর কী দিয়েছি আমি তাদের? কিচ্ছু না। অথচ আমাকে ফিরে আসতে হলো একটা বিয়ার নিয়ে। আমার খুব ভালো মতো জানা আছে বন্দুক তাক করলেও রোলস রয়েসের মালিক আমাদের কাউকে আর কিছু আনতে দেবে না। ইনার সার্কেলে যে ঢুকেছে তার বিল বারের কেউ নিলে তার গর্দান যাবে।

কিন্তু তার বন্ধুর সাথে আলাপ হওয়ার সাথে সাথে সে বললো, “বাংলাদেশ? তোমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলে না?”
আমি কোনরকম আমেরিকান ভব্যতার ধার না ধেরে বললাম, “তা ছিলাম। তবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পুটকি মেরে বেরিয়ে গেছি ভাই। লম্বা ইতিহাস।”

জনের বন্ধুটি দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বললো, “তা জানি। তুমি নাকি বইপত্র লেখ? কী ধরণের?”

দেখলাম আসলেই জানে, ভূগোল নিয়ে তার ধারণা আমার থেকে বেশি টনটনে। কথা এখান থেকে উঠে আসলো উপন্যাস লেখা থেকে শুরু করে আমার আবিষ্কৃত যাবতীয় লিটারেরি টুলের ব্যাপারে। আমার বইগুলো ৪০০ পৃষ্ঠা বা ৬০০ পৃষ্ঠার বেশি হয় শুনে বললো দুইশ পৃষ্ঠার বই লিখতে আমেরিকানদের জন্য। বড় বই নাকি এই পোলাপানের মনোযোগ আর রাখতে পারে না।

একটা মানুষ ১০০০ পৃষ্ঠার বই আর পড়ে না এখন প্রসঙ্গে বললাম, “আমি জানি, পড়ার কথা নয়। তাই আমি একটা নতুন লিটারেরি টুল ব্যবহার করি। এই জেন জি কিংবা ফেসবুক-টিকটকের যুগে অ্যাটেনশন স্প্যান যখন ছোট হয়ে এসেছে, আমাকে কিছু করতে হতো। আমার টুল বেশ কাজ করেছে বটে, এখন এই জেন জি আমার ১০০০ পৃষ্ঠার জাদুঘর সিরিজ পড়ে ফেলেছে।”

তারপর তাকে খুব ভালো মতো বুঝিয়ে বললাম এই টুলটার ব্যাপারে। এর সর্বোচ্চ প্রচার করা যাবে না বলে স্ট্যাটাসে অবশ্যই লিখবো না।

কথা প্রসঙ্গে চলে এলো জাদুঘরের ব্যাপারটা। আমাকে জন প্রশ্ন করলো, “বইটার নাম কী?”
খাস বাংলায় বললাম, “‘জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে’। দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে ‘এইখানে জাদুঘর পাতা আমাদের’।”
জনের বন্ধু জানতে চায়, “ইংরেজি করলে কী হবে?”

বললাম, “এটার ইংরেজি করা সহজ নয় এতো। এটা একটা নার্সারি রাইম থেকে নেয়া, প্যারোডি-”

শওকত আল বাশারের সাধারণ ছাত্র থেকে ভয়ঙ্কর এক চরিত্রে পরিণত হওয়ার গল্পটা বললাম তখনই। মনোযোগ দিয়ে শুনলো ওরা, আঁতকে উঠলো কখনো, কখনো চমৎকৃত হলো।

আমার মনে হলো, বইপত্র লেখা বাদ দিয়ে স্টোরিটেলার হয়ে গেলেই হতো। আমেরিকানদের সাথে প্রায় দুই বছর মিশে যাচ্ছি। স্রেফ আমেরিকায়-থাকা-মার্কা মেশা না, প্রতিদিনই ক্যাজুয়াল আর সোশাল এলাকায় দেখা হচ্ছে কয়েক ঘণ্টার জন্য। ক্লাসরুম আর ল্যাবের বাইরেও আমি অনেক কিছু করে থাকি। ওদের সত্যিকারের আঁতকে ওঠা আর স্রেফ উৎসাহ দিতে হ্যাঁ-হু করার পার্থক্য আমি বুঝি।

রাত তখন বাজে নয়টা, তবে আমি জানতাম, জেলিকস থেকে আজ আর রাত ২ টার আগে কেউ উঠতে দেবে না আমাকে। উঁহু, সম্ভবই না।

জনের বন্ধুর কাছে জানলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেনে। তার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আরেকজন বিখ্যাত ক্যারিবিয়ান লেখক। গীতাঞ্জলি কিনে রেখেছে। নামটা বললো অবশ্য ‘গিতালি?’

ঠিক করে দিলাম, “গীতাঞ্জলি। তবে কাছাকাছি গেছ। জন কিটস অনুবাদে সহায়তা করেছিলেন।”

সে চেনে সত্যজিত রায়কেও। ফেলুদার ব্যাপারে জানে। ফেলুদাকে মনে করতে পারছিল, কিন্তু সত্যজিতকে না। গুগল করে দেখাতেই হাততালি দিয়ে উঠলো। অরুন্ধতী রায়কেও চেয়ে সে। আমাকে একটা কাগজে তার নাম লিখে দেখানোর চেষ্টা করছিল। গুগল করে বের করে দিলাম। দ্য গড অফ স্মল থিংস।

আমি বললাম, “রবী ঠাকুর আর সত্যজিত রায় দু’জনেই বাঙালি ছিলেন। একজন জিতেছিলেন নোবেল প্রাইজ, আরেকজন অস্কার। বাঙালির ক্যালিবার ওটাই। তবে গত কয়েক দশকে অলসতার দরুণ আমরা বাইরের দেশে তেমন একটা আসতে পারিনি। এটা সমাধান করতেই আমি আমেরিকার মাটিতে পা রেখেছি।”

জনের বন্ধুটি বিদ্যাবাগীস বটে। নোবেল উইনার ওলগা তোকারচুকের একটা বই আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। বইটা পড়তেই আসলে বারে এসছিল সে, কিন্তু আমাদের পেয়ে আড্ডায় ঢুকে গেছে। বললো, “ভাই আমি সপ্তাহে পাঁচটা করে বই পড়ি। আমার এই রুটিনের কোন ব্যত্যয় হয়নি গত ৪০ বছরে।”

জানলাম। শিখলাম। ওর কাছে আরও পেলাম তাহির শাহের লেখা কিং সলোমন মাইনস। এই তাহির শাহের বাবা আবার বিখ্যাত ইরানি সুফি লেখক। তারপর ও দিলো আমাকে উত্তর আমেরিকার লেখক রবার্তো বোলানোর খবর। সবচেয়ে বিখ্যাত লেখা তার “দ্য স্যাভেজ ডিটেকটিভস”, তবে রেকমেন্ড করলো “২৬৬৬” বইটা। ওটা নাকি তার খোপরিই উড়িয়ে দিয়েছে! আরও বললো, “ভাই তোমার বইগুলোর কাহিনী শুনে আমার মনে হলো এর থেকে রিলেটেবল কাউকে পাবে না।”

রবার্তো বোলানোর ব্যাপারে এরপর বললো ত্রিশ মিনিট। আমি যত শুনছি ততো মনে হচ্ছে চিলির এই লেখক আমার কার্বন কপি। আর কিছু হতেই পারে না। এর মধ্যে আমাদের বের করে দেয়ার সময় হয়ে গেছে। প্রায় দুটো বাজে। দুটোয় এটা বন্ধ হবেই।

জন আমাদের বিদায় দিয়ে রোলস রয়েস ড্রাইভ করে চলে গেল। ওদিকে সেই রাত নয়টা থেকেই স্যামকে দেখতে পাচ্ছি। আমাকে দেখে একবার এগিয়ে এসে কথা বলেও গেছে। কিন্তু মেয়েটাকে পাত্তা দেবার মতো অবস্থায় আমরা কেউ নেই। এখন সাহিত্য নিয়ে কথা হচ্ছে, বয়েজ ব্যান্ড থেকে আমাকে কেউ হাতি দিয়েও তুলতে পারবে না। এই মুহূর্তে আমরা শুধু তাকেই গ্রহণ করবো যার সাহিত্যে দখল যথেষ্ট।

আমরা কথা বললাম ক্যাপোটি থেকে ম্যানসন ফ্যামিলি, কিছু সিরিয়াল কিলার, তা থেকে তারান্তিনো, ইয়ান ফ্লেমিং থেকে রবার্ট লুই স্টিভেনসন নিয়ে, বললাম জোনাথন সুইফট থেকে এরিক মারিয়া রেমার্ক নিয়ে। তারপর এলো বোলানো, এলো তোকারচুক, এলো গ্রেগরি ডেভিড রবার্টস।

গ্রেগরির ওপর আর কথা হতেই পারে না। অস্ট্রেলিয়ান লেখক। মুম্বাই নিয়ে খুঁটিনাটি সব জানেন। “শান্তারাম” নামে এক বই লিখে ফেললেন তিনি। মুম্বাইয়ের মাফিয়া নিয়ে তার থেকে ভালো কেউ জানে না। সে জিনিস নিয়ে নেটফ্লিক্সে নাকি মুভি না ওয়েব সিরিজও যেন চলে এসেছে, তবে সেটা নাকি ‘বাল’। পড়তে হবে বইটা, সেটিই সেরা।

কাহিনী যতই বলে যাচ্ছে জনের বইপড়ুয়া বন্ধু, আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠছে। এক পর্যায়ে মুম্বাই অ্যাটাকে চলে এল ওর আলাপ। এবার আর থাকতে না পেরে গুগল বের করে বললাম, “যে মাফিয়ার গল্প দিচ্ছ, দাউদ ইব্রাহিম এটা। এর লাইফ থেকে ইন্টারপ্রিট করেছে ওর গল্প।” তারপর বের করলাম সঞ্জয় দত্তের পেইজ, “আর এই সুপারহিট ভারতীয় নায়কের এখানে জড়িয়ে যাওয়ার কাহিনী-”

এই কাহিনীটা আমি জেনেছিলাম এক ভারতীয়র কাছ থেকে। ওকে ওটা আমার বলতেই হতো।

এই পর্যায়ে এসে আমাদের সামনে বসে থাকা মেয়ে দুটো বিদায় নিলো। বারে এসে বহু মাতাল দেখেছে, বহু ক্রিপ দেখেছে, আমাদের দুটোর মতো মাদারচোদ দেখেনি – যারা মেয়ে-মদ সব বাদ দিয়ে বই নিয়ে ফটর ফটর করে যাবে পাঁচ-ছয় ঘন্টা।

শুধু ওরা কেন? এক ঘণ্টা পার হয়েছে কি হয়নি, আরেক আপদ এসে হাজির!

কানের কাছে গেট কিপার এসে বললো, “কেপিদা, পায়ে পড়ি, বিদায় হও। বার তো বন্ধ করে দেবো।”
আমি আর জনের বন্ধু হা হা করে উঠলাম, বললাম, “অবশ্যই। এই যে যাচ্ছি।”

গেলাম ঠিকই। খিদেয় মারা যাচ্ছিলাম। রাত বাজে দুইটা পনেরো। বাসায় ঢোকার সময় মনে হলো ট্রিলিয়নিয়ারের বন্ধুটির নাম জানা হলো না।

নামে কী এসে যায়?
এমন বইপড়ুয়া কাউকে পাওয়া গেল এটাই অনেক। নামে কিছু এসে যায় না। নইলে আমার নাম কিশোর পাশা ইমন থেকে বদলে রাখতে পারতাম ভারিক্কী কিছু।

কিন্তু নয়।
নাম যা-ই হোক না কেন, গ্রেট থিংস করলে সেটা নিয়েই সেজদার পর সেজদা পড়ে যাবে।

আর কাজের কাজ কিছু করতে না পারলে নাম হুমায়ূন আহমেদ রেখেও লাভ নেই।

এখানের ৫% লোকও আমার নাম জানে না। কিন্তু ওরা আমাকে ভালোবেসেছে, জায়গা দিয়েছে ইনার সার্কেলে। এভরি সিঙ্গেল ওয়ান অফ দেম। যে কোন বয়েসের, যে কোন লিঙ্গের, যে কোন আগ্রহের লোকের সাথে কথা বলতে পেরেছি কয়েকমিনিট আর তার আমার সাথে ৫ ঘণ্টার আড্ডা জুড়ে দেয়নি এমন হয়নি।

তাই তো!
নামে কী এসে যায়!

** যারা মনে করে আমেরিকান মানেই রিটার্ড, বইপত্র পড়ে না, উচ্ছনে গেছে সব– তাদের জন্য এটা লেখা দরকার ছিল। আমেরিকানদের মধ্যে এমন এমন বইপোকা আছে, আমাদের ঢাকার ২০ জন বইপোকা জোড়া দিলেও তাদের একটার সমান হবে না।

স্মৃতিকথা – আমেরিকা-নামা
রচনা ও ঘটনাপ্রবাহ – ৮ই মার্চ, ২০২৩

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *