আইরিশ ‘সাইকিক’ ও ভূতেদের দর্শন
স্যান মার্কোস কবরস্থানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ধান্ধাও ভূত খোঁজা। ভূত আসার আগেই মরবো মনে হচ্ছে অবশ্য। ঠাণ্ডায়। তখন তাপমাত্রা শুন্য ডিগ্রি। ফিলস লাইক মাইনাস ফাইভ।
আমার গায়ে একটা মেয়েদের জ্যাকেট। বিকাল বেলায় যখন বেরিয়েছিলাম, ওয়েদার ফোরকাস্ট বলেছিলো রাতে তাপমাত্রা পনেরো ডিগ্রির নিচে নামবে না। একটা শার্ট চাপিয়ে লাফিয়ে বেরিয়েছিলাম। এইসব দশ-পনেরো ডিগ্রি আমাদের কাছে ব্যাপার না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কেঁচে গেল রাত এগারোটা বাজতে বাজতে। ঠাণ্ডায় আর টেকা যাচ্ছিল না বাইরে।
বন্ধুবর রিজুল তখন বিদায় নিয়েছে কেবল। আমি আর এক বান্ধবী বাংলাদেশ আর আমেরিকার অর্থনীতি এবং রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছি। বেচারি বললো, “এখানে থাকলে তো বরফ হয়ে মরবো।”
বরফ হওয়ার আলাপে শিকাগোর কথা উঠে এলো। কনফারেন্সে শিকাগোতে গিয়ে ওরা দেখেছিল বিচি কাঁপানো ঠাণ্ডা। যারা শিকাগোর লোক তারা নেংটু হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টেক্সাসের জনগণ জবুথবু। অথচ আজ আমার হলো উলটো অনুভূতি।
এই ফ্রেন্ড টেক্সাসের মেয়ে। অথচ ওই রাতের ধাক্কা সে বেচারিও নিতে পারলো না। অবশ্য দোষ ওর-ও আছে। আমার মতোই ওয়েদার ফোরকাস্টের পাল্লায় পড়ে তার পরণে শর্ট জিনস। আর আমার বাংলাদেশী শরীরে এত বিরূপ আবহাওয়া সইবে কেন! হিহি করতে করতে বারের ভেতরে এসে বসতে হলো।
ফোন বের করে দেখলাম ১৮ ডিগ্রিতে বেরিয়েছিলাম তিন ঘণ্টা আগে। এখন ৫। তবে এখানে আগুন আছে। কাজেই বিশেষ চিন্তা না করে একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ফেললাম। বেরিয়ে মরবো নাকি? কাজেই আমরা আরও দুটো ড্রিংক নিয়ে এলাম।
মেয়েটা বললো, “ইউরোপ ট্যুরে গিয়ে ভূত দেখেছিলাম।”
ভুত-প্রেতের আলাপে আমার আগ্রহ অসীম। জানতে চাইলাম ঘটনা কীভাবে ঘটেছিল। জানালো, “আয়ারল্যান্ডে গিয়ে মান্ধাতা আমলের এক দুর্গে এয়ার বিএনবি করে থাকতে পারলাম। রাতে কিছু করার নাই। নেটফ্লিক্স দেখছি। পাশের ঘরে আব্বু এতো জোরে নাক ডাকাচ্ছে যে ব্যারন সাহেবের আত্মাও বাগানের কবরখানা থেকে বেরিয়ে ছুটে পালাবে। সবই ঠিক ছিলো। তারপর শুরু হলো উৎপাত।”
“কেমন?”
“লিভিং রুম থেকে দুড়দাড় করে একজোড়া পায়ের ছুটন্ত পদশব্দ। এসে আমার দরজায় এসে থামলো। অথচ এইদিকে কেউ নেই। আমাদের ওয়েস্ট উইংটা দেয়া হয়েছে। নিচতলাও খালি। বাড়ির বর্তমান কেয়ারটেকাররা থাকে ইস্ট উইং। আর দুইয়ের মাঝে ফুটবল মাঠের থেকে বড় গ্যাপ। ওদিকে আমি তখনো আব্বুর করাতকাটা নাক ডাকার শব্দ শুনতে পারছি। একটা মানুষ তো আর নাক ডাকতে ডাকতে দৌড়াতে পারে না। তাহলে দৌড়ালো কে?”
এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারলাম না।
“সেখানেই শেষ হয়ে গেলে হতো। এরপর শুরু হলো হোয়াইট নয়েজ। ক্যার ক্যার করে একটা শব্দ হচ্ছিল সব খান থেকে। এমন না যে কোন উৎস আছে এটার। এক নিমেষে ছড়িয়ে গেল যেন সবখানে। সেই সাথে গোটা বাড়িতে দাঁপিয়ে বেড়ানো তো আছেই! এর কী ব্যাখ্যা দেবে তুমি, বলো?”
এর কোন ব্যাখ্যা আমি দিতে পারলাম না।
মেয়েটা বললো, “আমার মনে হয় বিশেষ কোন ক্ষমতা আছে এসব ফিল করার। কারণ পরের দিন সকালে আব্বু বলেছে, ‘অতি চমৎকার ঘুম হয়েছে। খাসা।’ এসব উৎপাতের কিছুই সে টের পায়নি। অথচ সকালে নাস্তার টেবিলে বসে দেখলাম ওদের মেনুর নিচে লেখা, ‘আমাদের বাড়িতে একটা ভূত আছে বটে, তবে বন্ধুত্বপূর্ণ সে ভূত। ঘাবড়াবেন না।’ এর নিচে একটা ভূতের সিম্বল আঁকা।”
গল্পটা এবার ইন্টারেস্টিং হলো কিছুটা।
বান্ধবী জানালো, “আমি ওই কেয়ারটেকার ভদ্রমহিলাকে প্রশ্ন করলাম, ভূতের ব্যাপারটা কি? উনি বললেন, ‘ল্যাসি, কিছু গেস্ট বলেন উনারা ভূতের পাল্লায় পড়েন। তবে চিন্তার কারণ নেই। ভূতটা ভালো।’ জানতে চাইলাম, ‘তারা এসে আপনাকে বলেটা কী?’ মহিলা জানালো, ‘শব্দের উৎপাত। তারপর স্বপ্নে দেখে বড় একটা পার্টি। কিংবা আগুন।’”
ও যে গতকাল ঘুমানোর পর একটা বম্বিংয়ের স্বপ্ন দেখেছে, সেটা সে আর মহিলাকে জানালো না। মানে মানে কেটে পড়লো। পরে গুগল করে ও জেনেছিল, এই বাড়িতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক পার্টি চলাকালে বোমা এসে পড়েছিলো। ওয়েস্ট উইং পুরোটাই আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছিল। ওই পার্টিতে যারা ছিল কেউ বাঁচেনি প্রাণে।
গল্প শেষ করে চোখ নাচালো মেয়েটা, “বলেছিলাম না, আমার একটা ব্যাপার আছে। এসব ভূত-প্রেত টের পাই।”
আমরা দু’জনই বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী। কাজেই এত সহজে মেনে নিতে পারলাম না। একটু মাথা চুলকে বললাম, “তাহলে আমাদের কোন একটা হন্টেড হাউজে যাওয়া উচিত। নয়তো গোরস্থানে।”
মেয়েটাও চট করে রাজি হয়ে গেল। বললো, “আমাদের ক্যাম্পাসেই আছে তো সেমেটারি।” ঘড়ি দেখে বললো, “রাত এখন বাজে প্রায় দুটো। একেবারে মোক্ষম সময়। যাবে নাকি?”
দ্বিধা ছাড়াই বললাম, “যাবো। ক’টা ভূতকে শুনতে পাও দেখা যাবে তখন।”
বাইরে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে বিচি জমে গেল। অর্থনীতি আর ভূতের আলাপে কোনদিক দিয়ে চারটা ঘণ্টা চলে গেছে টের পাওয়া যায়নি। বাইরে এখন তাপমাত্রা শুন্য ডিগ্রি।
দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেতে খেতে ওর গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছালাম। ও বললো, “যাওয়ার পথে অ্যাপার্টমেন্টে থামবো। এইসব জামাকাপড় পরে কবরস্থানে গেলে আজ ঠাণ্ডাতেই মরে যাবো। ভূতের আর কিছু করা লাগবে না। তোমাকেও আমার একটা জ্যাকেট দেবো। নইলে মরবে।”
আমার তখন দাঁতে দাঁত এমনভাবে বাড়ি খাচ্ছে যে কথাই বলতে পারলাম না। কেবল দুর্বলভাবে মাথা দোলালাম।
২.
কাজেই গায়ে মেয়েদের একটা জ্যাকেট চাপিয়ে কবরস্থানের ভেতর দাঁড়িয়ে আছি। এক চোখ ভূতের দিকে। অন্য চোখ পুলিশের দিকে। এই রাত চারটার সময় কবরস্থানে হুমড়ি খেয়ে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখলে পুলিশের দল প্রথমেই ধরে নেবে গাঞ্জা খেতে এসেছে।
নয়তো খেয়ে এসেছে!
ওদিকে আমাদের সাইকিক তার কাজ করে যাচ্ছে। গলাভর্তি দরদ ধরে ভূতকে ডেকে যাচ্ছে সে।
“ঘোস্টি! লক্ষ্মী বাবারা, একটু দেখা দাও। আমরা ভালো নিয়তে এসেছি। একটা হাই বলো?” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি গজ গজ করে বললাম, “শেষ রাতে এসে কবর দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের ভালো নিয়ত মুচড়িয়ে মুচড়িয়ে আমাদের পেছন দিয়ে ভরে দেবে।”
ডাইনিটা বললো, “শুস। শব্দ করবা না।” তারপর আবার ভূতদের ডাকতে শুরু করলো সে।
এমন সময় আমি পরিষ্কার শুনলাম ফ্ল্যাগপোলটার ওপাশ থেকে কিছু মানুষ গুজগুজ করে কথা বলছে। কফিশপে যেমন বলে থাকে। কিংবা একটা বাজারে ঢুকলে যেমন শোনা যায়। তবে এই বিষয়ে কিছু বললাম না আইরিশটাকে। পরে দেখা যাবে আমার কথা থেকে তার হ্যালুসিনেশন হবে। আমাদের বিশাল অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে ধরে নেব।
মেয়ে তখনও ভূতেদের আকূল আবেদন করছে, “মাননীয় ভূত এবং ভূতনীরা, যথাযথ শ্রদ্ধানিবেদনপূর্বক জানাতে চাই, আমরা তোমাদের বন্ধু। তোমার যদি ওই কফিনের নিচ থেকে একটা হ্যালো করো তাহলে আমাদের খুব ভালো লাগবে। ইয়ে, ভূত স্যার-”
আমাদের ডান দিক থেকে অনেকটা দূরে, কবরস্থানের এক অন্ধকার কোণ থেকে অল্পবয়স্ক এক তরুণীর গলা থেকে শোনা গেল, “হাই।”
মেয়েটা যুগপৎ বিস্ময় নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো, “শুনলে, শুনলে তুমি?”
আমি বললাম, “ফ্ল্যাগপোল থেকে ক্যাচ ক্যাচ হচ্ছে। ওটাই মনে হয় কোনভাবে প্রতিধ্বনী হয়ে-টয়ে ওইদিক থেকে এমন হয়েছে।”
ওর গলায় এখন আর আগের জোর নেই। বিড়বিড় করে বললো, “ভূত ম্যাম, সাড়া দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার নাম অমুক। আপনাদের প্রেজেন্স পেয়ে যারপরনাই গর্বিত এবং আনন্দিত।”
তেল মেরে লাভ হলো না। ভূতের দল একেবারে চুপ করে আছে। ফোন বের করে একবার ঘড়ি দেখলাম। রাত প্রায় বাজে পাঁচটা। আঙুল আর একটাও অনুভব করতে পারছি না। এত ঠাণ্ডা। ফিলস লাইক মাইনাস ফাইভ। বান্ধবীর থেকে তিন তিনটা প্রটেকশন মেরে দিয়েছি। জ্যাকেটের তলে ওর দুইটা সোয়েটার। ওর ফ্রিজে দুটো বিয়ারের বোতল ছিল। তাও মেরে দিয়ে এসেছি বেরুবার আগে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে শীত আমার পাঁজর খামচে রেখেছে।
বললাম, “ভূতগুলো তো মাটির নিচে গরমে আরামেই আছে। আমরা মাঝ দিয়ে ঠাণ্ডায় মরবো।”
বান্ধবী এত সহজে হাল ছাড়তে নারাজ। বললো, “আর দশ মিনিট দেখি।”
ঘুঘুর মতো দাঁড়িয়ে কবরস্থান স্ক্যান করছি। বিচি বহু আগেই জমে গেছে। ঠাণ্ডাতে যতটা জমতে বাকি ছিলো সেটা ওই ভূতের ফিসুরফাসুরেই জমেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। যে পরিবেশে যে ঘটনা।
এমন সময় মেয়েটা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো। বললো, “শুনলে! শুনলে!”
আমি মাথা নাড়লাম, “না তো। কোনটা?”
“আরেকটা গলা বললো, ‘হেই!’ কিন্তু ভারী গলা, বাজে আর – ডিমনিক!”
আমি তাকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করি, “বেচারার হয়তো গলাটাই শয়তানের মতো। কিন্তু লোক হয়তো ভালো। একটা মানুষের গলা খারাপ এটা তো তার দোষ হতে পারে না।”
ও বললো, “তা ঠিক। তা ঠিক। ভূত স্যার, আপনাকে আমরা অবশ্যই বেনিফিট অফ ডাউট দেবো।”
আমি গজ গজ করে বললাম, “ভোর রাতে এসে ওদের বাড়ির উঠানে দাঁপাচ্ছো আবার দিচ্ছো বেনিফিট অফ ডাউট। ভূতের জায়গায় আমি থাকলে ঘাড় দুটোরই মটকে দিতাম।”
আমাদের ভূত শিকারের গল্প এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। ঠাণ্ডায় আর দাঁড়ানো যাচ্ছিলো না। এরপরের ছত্রিশ ঘণ্টায় পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছে। গতকাল বলা হয়েছিল রাউন্ড রক ক্যাম্পাস আজ বন্ধ থাকবে। তবে স্যান মার্কোস ক্যাম্পাস খুলবে। দেরিতে খুলবে, তবে খুলবে।
গতকাল রাতে ফিলস লাইক মাইনাস সেভেনে নেমে এলো তাপমাত্রা। সেই সাথে এলো সম্ভাব্য রেইন অ্যালার্ট। ফ্রিজিং টেম্পারেচারে বৃষ্টি পড়ার থেকে খারাপ কিছু নেই। পানি পড়ার খানিকবাদে বরফ হয়ে যায়। কাজেই আমাদের ক্যাম্পাসও আগামী দুটো দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
আমি টেক্সানদের কিছুটা চিনতে শিখেছি। আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠলে এরা সুপারশপের সব কিনে ফেলে। আমার ফ্রিজে খাবার নেই। গতকাল রাতে দ্রুত এইচ-ই-বি গেলাম। গিয়ে দেখি আলু আর মুরগি একেবারে সাফ করে ফেলেছে। কিছু বালমার্কা মুরগির প্যাকেট পাওয়া গেল। আর সবজির মধ্যে আছে কেবল ঢেঁড়স। আর সব লোপাট হয়ে গেছে। পেঁয়াজের র্যাকগুলোও ফকফকা। ভাগ্যিস সেটা ছিল।
টেক্সাস এমনই আনপ্রেডিক্টেবল। এই ফেব্রুয়ারি এসে এমন শীত আমরা কেউ আশা করিনি। এখন ধীরে ধীরে শীত কেটে যাওয়ার কথা ছিল।
সামনে কপালে বোধহয় খারাবী আছে।
তবে সৌভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে প্রফেসরের সাথে ফেইস-টু-ফেইস মিটিং ক্যানসেল হয়েছে। সেটি ঘটবে জুমের মাধ্যমে। প্রফেসর যদি জানতেন এই আবহাওয়ার ভেতর আমরা শশ্মানে-মশ্মানে ঘুরি তাহলে নির্ঘাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলতেন, “বন্ধুবান্ধব তো ঠিকই বিপদজনক আবহাওয়ায় ভূত দেখতে যাও। রিসার্চের কথা বললেই কেবল আবহাওয়ার দোহাই, অ্যাঁ!”
জানুয়ারি ৩১, ২০২৩
Leave a Reply