KP Imon

Words Crafted

আমি আবার তোমার আঙুল…

পিঠ চুলকাচ্ছে।
কিছুক্ষণ বিছানায় মোচড়ামুচড়ি করলাম। তারপর হাল ছেড়ে দিলাম। এভাবে হবে না।
মিনিট দশেক পর ছোটভাইটা কি একটা খুঁজতে যেন এ ঘরে এল। ওকে ডাক দিলাম।
“পিঠটা একটু চুলকে দাও তো।”
আমার দিকে তাকিয়েই ওর মুখটা গরুর মত হয়ে গেল। এটা হয়েছে আরেকটা সমস্যা, ওই ঘটনার পর থেকে আমাকে দেখলেই গরুর মত মুখ করে ফেলে সে। এজন্য ওকে দোষ দেই না অবশ্য। ছোট একটা ভাই থাকার সুবিধা লুটছি। সময়ে-অসময়ে পিঠ চুলকিয়ে নিচ্ছি ওকে দিয়ে। মন্দ কি?
“না না, আরেকটু ডানে।” নির্দেশনা দিলাম।
“একটু ওপরে। আর এত জোরে না। আস্তে। একটু আস্তে।” আবারও নতুন হুকুম। কোনদিনই ঠিক জায়গাটা চুলকাতে পারল না লিয়ন।
ওপরে চুলকাচ্ছে সে এখন, জানতে চাইল, “এখানে?”
কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলাম, ওখানেই কি না। তারপর বিরক্ত হয়ে বললাম, “বালামার!”
“কি হল?” বুঝতে পারল না ও।
“এখন আরেক জায়গায় চুলকাচ্ছে।”
ইতস্তত করল লিয়ন। এতক্ষণে খেয়াল করলাম ওর পরণে স্কুলের পোশাক। এখানে এসেছিল মনে হয় কাঁধের ব্যাজটা খুঁজতে। এসে আটকে গেছে।
ওকে বললাম, “স্কুলে চলে যাও। চুলকানি চলে গেছে।”
“চলে যাবেই তো। এটা ঠিক চুলকানি না। এটা হল-” কথাটা শেষ করল না সে। এতটুকু বলে ফেলার জন্যই অনেক দুঃখী মনে হল তাকে। মুখ ফস্কে বের হয়ে গেছে কথাটা।
গরুর মত মুখ নিয়ে চলে গেল লিয়ন। স্কুলে যাবে।
আমার ইউনিভার্সিটি নেই তেমনটি নয়। রুয়েট এখন খোলা, পুরোদমে ক্লাস চলছে। ল্যাবগুলো সামলাতে গিয়ে নাভিঃশ্বাস উঠে যাচ্ছে ক্লাসের আর সবার। এষার কথা মনে পড়ল খুব। আজ বিকেলে ওর আসার কথা। আমিই যাব কি না ভাবছি।
লিয়ন কোন কথাটা অর্ধেক বলে রেখেই চলে গেছে, তা আমার জানা আছে। যখন কারও হাত বেঁধে রাখা হয় তখন এমনিতেই চুলকায় শরীরের নানা স্থান। শারীরিক নয়, মনস্তাত্বিক চুলকানি। আমার শরীর চুলকানো অস্বাভাবিক না এখন। হাত বেঁধে রাখার চেয়েও চমৎকার পরিস্থিতি আমার।
কব্জির সামান্য ওপর থেকে দুই হাতই কাটা আমার।

১.
রাজশাহী শহরে অটো চলে বেশি। ট্যাক্সির বালাই নেই, সিএনজি কিছু আছে। আর আছে লাখ লাখ অটো। অটোর আন্তর্জাতিক অর্থ অটোমোবাইল, তবে এখানে যেসব বাহনকে অটো বলে ডাকা হয় তারা অনেকটা সিএনজির মত দেখতে, ব্যাটারিতে চলে। সিএনজি যদি “হাইবর্ন সান” হয়, তো অটোরা “বাস্টার্ড”।
এমন একটা অটোতে উঠে বসে আছি। এষার সাথে দেখা করার কথা আছে। ফুলহাতা শার্ট পরে আছি, সব সময় এমন কিছু পরেই বের হই। মানুষজন প্রথমে হাত-না-থাকার বিষয়টা খেয়াল করে না। রাস্তার সবাই ঘুরে ঘুরে তাকায়ও না। কানে ইয়ারফোন।
ইয়ারফোনে আমি গান শুনছি না। ওটা সব সময় কানেই থাকে। বিশেষ উপকার হয় এতে। বাইরে বের হলে আমার মোবাইলফোন পকেটে থাকে। ওটা বের করে আনা আমার পক্ষে সম্ভব না। কাজেই ইয়ারফোনটা কানে রাখা ভাল একটা পদ্ধতি। কাটা হাত দিয়ে চাপ দিয়ে ফোন রিসিভ করা যায়। ডায়াল করা যায় না, তবে ওটা খুব একটা দরকারি কোন কাজ নয়।
গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। অটোওয়ালাকে বললাম, “নামিয়ে দেন, মামা।”
অটোওয়ালা অটো থামিয়েছে।
নেমে তার দিকে পশ্চাদ্দেশ এগিয়ে দিলাম। বিহ্বল অটোওয়ালা অবশ্য এর অর্থ বুঝল না।
“মানিব্যাগটা বের করেন।” বলতেই হল তাকে।
অটোওয়ালাকে ‘পাছা দেখানো’র উপযুক্ত কারণ আছে। কাজটা আগে করতাম সহযাত্রীদের কারও সাহায্য নিয়ে। যাত্রী কমিউনিটির সদস্য হিসেবে চালকের আগে সাহায্যের জন্য যাত্রীদের কাছে যাওয়াটা তো বেশি যৌক্তিক, তাই না?
নিউমার্কেটে গেলাম সেদিন। আমার বয়েসী এক ছেলে পুরোটা রাস্তা ফটর-ফটর করতে করতে এল। কি সহানুভূতি তার! “ভাই, খান কি করে”, “ভাই, টয়লেটে যান কি করে”, “আহারে ভাই আপনার লাইফটা শ্যাষ হইয়া গেল”, ইত্যাদি ইত্যাদি। একেবারে পটে গেলাম। ফলাফলস্বরূপ নিউমার্কেটের সামনে নেমে তাকে পাছা দেখানো হল। আক্ষরিক অর্থেই মেরে দেবে জানলে অবশ্যই দেখাতাম না।
বললাম, “প্লিজ।”
সে শুধু বলল, “আরে ভাই, এটা আর বলা লাগে। উঠসেন কোথা থেকে?”
অটোওয়ালা বলল, “ভাড়া হইছে ৭ টাকা।”
এর ঠিক ছয় সেকেন্ডের মাথাতে আমি বাংলাদেশের উসাইন বোল্টকে দেখে ফেললাম। আমার বয়েসী এক ছেলে। শক্ত করে মানিব্যাগটা নিয়ে প্রানপনে ছুটছে রাস্তার অন্যপাশে। আমিও ছুটতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না।
হাত বাঁধা থাকলেই দৌড়ানো যায় না ঠিকমত, আমার তো হাতই নেই। দুটো সমানভাবে কাটলে একটা কথা ছিল। বাম হাত নয় ইঞ্চি কাটা। ডানহাত এক ফুট নাই। ব্যালেন্স পাই না। দৌড়াদৌড়ি করে জুত করা গেল না খুব।
অটোওয়ালা আমার দিকে গরুর মত মুখ করে তাকিয়ে থেকেছিল কিছুক্ষণ। তারপর বিমর্ষ মুখে বলেছিল, “ভাই, আপনের ভাড়া লাগবো না।”
নিউমার্কেট থেকে বাসা পর্যন্ত হেঁটে ফিরেছিলাম সেদিন। এরপর থেকে যাত্রী কমিউনিটির মাকে আমি আন্টি ডাকি। সরাসরি ড্রাইভারের সঙ্গে হয় লেনদেন। টাকাটা মানিব্যাগ থেকে বের করে নিল অটো ড্রাইভার। তারপর মানিব্যাগ ফেরত দিল পকেটে।
রাস্তার ভুল দিকে নেমেছিলাম। আরেকটু হলেই ধাক্কা দিয়েছিল এক সাইকেল-আরোহী। ক্ষমাপ্রার্থনার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল সে। আমিও মাথা হাল্কা দুলিয়ে “ইট’স ওকে” বুঝিয়ে দিলাম।
গায়ে বাতাস লাগিয়ে হাঁটলাম সামনের দিকে। গোলাপের মত ফুটফুটে চেহারার এক মেয়ের সাথে দেখা করার জন্য। হাত দুটো হারানোর পর থেকে অনেক কিছু হারিয়েছি আমি। এই একটা মানুষকে হারাইনি এখনও।
মোবাইল ভাইব্রেট করছে। ইয়ারফোন ব্যবহার করে রিসিভ করে ফেললাম।
এষার পরিচিত গলাটা শোনা গেল, “বাসায় আছো না তুমি? আসছি আমি।”
আমতা আমতা করে বললাম, “আমি তো ক্যাম্পাসে।”
পাশ দিয়ে দুটো মেয়ে চলে গেল। কলেজের ছাত্রী হবে খুব সম্ভব। একে অন্যকে গুঁতো দিয়ে বলল কিছু। শুনতে পাইনি এমন ভান করে হাঁটতে লাগলাম। এষা কোথায় আছে জানিয়েছে।
পথচারী মেয়েটা বলেছিল, “দ্যাখ দ্যাখ, ওই লোকটার দুইটা হাতই কাটা।”

২.
শহীদ মিনারের সামনে পাওয়া গেল এষাকে। বসে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। আমাকে দেখে থেমে গেল। থমথমে মুখ। শয়তানের মত হাসি দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। পাল্টা হাসল না সে।
“একা একা বের হয়েছ আবার?” মেঘের মত গলা ওর। মিষ্টি কণ্ঠের সাথে মেঘগলা যাবে না ভেবেছিলাম। দেখা গেল জানায় ভুল ছিল।
“এতে অভ্যস্ত হতে হবে তো।” ওর পাশে বসতে বসতে বললাম, “সব সময় সাথে কাওকে নিয়ে ঘুরব নাকি?”
কিছু না বলে আমার কনুইয়ের ওপরটা জড়াল ও।
ক্যাম্পাসের বড় ভাই-ছোট ভাই আমার দিকে তাকাচ্ছে দূর থেকে। ক্যাম্পাসে এখন আমি সেলিব্রেটি হয়ে গেছি। হলে থাকা হয়নি কখনও, কাজেই অনেক অপরিচিত মুখ রয়েছে ভেতরে। তাছাড়া লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকার কারণে আমার ভার্সিটি লাইফটা ঠিক আর দশজনের মত ছিল না। তেমন কেউ চিনতই না আমাকে। দুইবার ঘুরেও তাকাত না। এখন সবাই চেনে। সবাই ঘুরে তাকায়।
রুয়েটিয়ান উইদাউট হ্যান্ডস। সেলিব্রেটি(!) ফিগার। মানে, মুখ অথবা হাত দেখেই চেনে সবাই।
অথবা, হাত না দেখে!
করুণা মিশ্রিত একটা দৃষ্টি উপহার দিতে ভুলে গেছে এমন কোন মানুষ পাওয়া যায় না অবশ্য। বন্ধুদের ছোট্ট সার্কেল আর এই মেয়েটার কথা আলাদা।
“ক্লাস করতে আসো না কেন?” জানতে চাইল এষা।
বিষণ্ন একটা হাসি দিলাম। কিছু বললাম না।
“হাসবা না। একদম হাসবা না তুমি!” ঝাঁঝিয়ে উঠল মেয়েটা।
“আর কী করব?” হাসিটা মুছে গেল না আমার মুখ থেকে, “ক্লাসরুম তো আর ফিল্ম ফেস্টিভাল না, গিয়ে সামনের সারিতে বসে থাকব। দারুণ কোন দৃশ্য দেখে হাততালি দেওয়া যাবে।” একটু থমকে গেলাম, “মানে, পা-তালি দেওয়া যাবে।”
ঝাঁকিটা খেয়ে চমকালাম। এক হাতে আমাকে ধরে এত জোরে ঝাঁকি দিতে পারবে ছোটখাটো শরীরের একটা মেয়ে, তা ভাবিনি।
“মাঝপথে এসে ছেড়ে দিবি?” কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল সে, “দেড় বছর বাকি আর। মাত্র দেড় বছর!”
রেগে গেলে ও আমাকে তুই-তুই করে বলে। বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সূত্রপাত তো! এষা রেগে গেছে। দ্রুত হাসিটা সরালাম মুখ থেকে। এষার রাগ মানে আমার দুটো দিন খারাপ যাওয়া।
“তো? ক্লাস করে লাভ কি বল? লিখতে তো পারব না কিছু। পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না আমার আর। সামহাও পরীক্ষা দিতে পারলেও কাজের কাজ কিছু হত না। ম্যাথ-ট্যাথ কিছু পারতাম না। খাতায় প্র্যাকটিস না করে পারা যায় এসব বল?”
“সেটা তো পরের চিন্তা। তুই চেষ্টা করতে থাকলে স্যারেরা নিশ্চয় তোর জন্য আলাদা কিছু ব্যবস্থা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তোর ইচ্ছা আছে চেষ্টা করার?”
দুইপাশে মাথা নাড়লাম। মুখে উত্তর দেওয়ার মত কোন প্রশ্ন ছিল না ওটা।
আমার থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘোরাল ও, “তোমার সমস্যাটা আমি জানি।”
বুঝতে পারলাম না ওর কথা, “কোন সমস্যা?”
হাতের দিকে তাকালাম। মাথা নাড়ল ও, “উফ, ওইটা না। তুমি সব কিছু ছেড়ে দিয়েছ। আন্টির সাথে আমার কথা হয়েছে।”
আগে বাসায় ওর ব্যাপারে প্যাসিভ ভয়েসে আলাপ হতো আর যে কোন বাঙালি ছেলের মতো। তবে ঘটনার পর থেকে নিয়মিত বাসায় এসে আমাকে দেখে যায় এষা। আম্মুর সাথে কথা হবে এটাতে আশ্চর্যের কি? হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝুলিয়ে বসে থাকলাম।
“খাওয়া দাওয়া তো ছেড়েছই। ঘুমাও না! তারপর নাকি-”
“গোসলও করি না।” চট করে জানিয়ে দিলাম।
“সে তো আমি বুঝতেই পারছি। খাটাসের মত গন্ধ আসছে।” গজ গজ করে উঠল এষা।
“লাভ কি বল?”
“শোনো, তোমার এসব ন্যাকামি আমার একদম অসহ্য লাগছে বুঝছো? খাওয়া নাই, গোসল নাই, ঘুম নাই! সারাদিন চুপচাপ বিছানাতে শুয়ে থাকো। এইসব ফাইজলামির মানেটা আমাকে বলবা তুমি?”
“ফাইজলামির কি আছে? আমার করার মত কোন কাজ নেই। মানে, এমন কিছু তো নেই যেটা আমি করতে পারি!”
কৃত্রিম বিস্ময় ফোটানোর চেষ্টা করলাম চেহারাতে, ঠিক কি বলতে চাইছে সে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সেটা ওকে বোঝাতে দিতে চাই না। চাই ও প্রসঙ্গটা পাল্টে ফেলুক। এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে না হোক আমাদের।
“রাইট! তোমার মন-মেজাজ ভাল থাকে না সেজন্য নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ, তা আমার বোঝা হয়ে গেছে। টিপিক্যাল রোমিও! কিন্তু তুমি টিভি দেখ না, মুভি দেখ না, তোমার যে কাজটা সবচেয়ে প্রিয়, সেই গল্পের বইও পড় না। সারাদিন চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ফ্যান ঘোরা দেখ। এটা স্বাভাবিক না, কেপি!”
কিছু বললাম না। অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হইয়াছে।
জুরিদের রায় হওয়া উচিত : গিল্টি!
এষার চোখে পানি দেখলাম। গোপন করার চেষ্টা করল না সে। আমার হাতের কাটা অংশের সামান্য ওপরে শক্ত করে আটকালো নিজের হাত।
“তোমার সমস্যাটা শরীরে না। মনে।”
“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।” ওকে এতটূকুই বললাম।
“তোমার হাত-” একটু অপেক্ষা করে যথেষ্ট সাহস অর্জন করার চেষ্টা করল মেয়েটা। তারপর বলেই ফেলল, “তোমার হাত নেই দেখে সারাদিন শুয়ে আছ, এই কথা আমি বিশ্বাস করি না।”
“আর কোন কারণ থাকার দরকার আছে বলে তোমার মনে হয়?”
সন্ধ্যা নেমে আসছে ধীরে ধীরে। আলো কমে এসেছে। পাখিরা ডাকছে বেশি। পাখিদের হঠাৎ করে ঈর্ষা হল খুব। শালাদের হাত নেই, তাও দিব্যি শান্তিতে আছে। ডাকছে।
“তোমাকে আমি চিনি।” একটু থেমে বলল এষা, “তুমি বর্ন ফাইটার। চ্যালেঞ্জ ভালবাসো। চ্যালেঞ্জ না থাকলেই বোরিং ফীল কর। সেই তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটার সামনে এসে হার মেনে নিচ্ছ? প্রথম প্রথম তোমার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবতাম। কিন্তু তিন মাস পার হয়ে গেছে, কেপি। হাসপাতাল থেকে তিন মাস হল ফিরে এসেছ তুমি! অথচ ফাইট ব্যাক করার কোন চেষ্টা নেই… দ্যাটস সো …”
আগ্রহের সাথে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
“…নট ইউ।”
“কিছু কিছু চ্যালেঞ্জের সাথে লড়া যায় না, এষা।” ওকে বললাম, “কিছু কিছু পরিস্থিতির ক্ষমতা তোমার আমার ক্ষমতার চেয়ে বেশি।”
“তোমার স্ট্রেন্থের প্রশ্ন আসছে না এখানে। তোমার সমস্যা অন্য কোনখানে।” বিরক্ত হয়ে বলল ও, “কিছু একটা জ্বালাতন করছে তোমাকে। মেন্টালি। কি সেটা?”
একদম ঠিক জায়গাতে হাত দিয়েছে এষা। কয়েক সেকেন্ড ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। গালে এক ফোঁটা পানি। আমাকে জিততে দেখে অভ্যস্ত মেয়েটা আমার পরাজয় মেনে নিতে পারছে না।
“এষা …” মিনিট দুয়েক পর বললাম ওকে, “আমি আসলে … আমি আর লিখতে পারছি না।”

৩.
“বিড়ি দে।” রাহাতের দিকে তাকিয়ে রীতিমত দাবী করে বসলাম।
বিরক্ত হল ছেলেটা, “থাম না রে বাপ। অর্ধেকও টানতে দিবি না?”
হলে এসে বসে আছি। শহিদ হল। নীচতলার প্রথম ঘরটাই আমাদের। মাঝে মাঝে এখানে এসে আড্ডা দেওয়া হত। গত পাঁচ মাস ধরে তেমন আসা হয় না। ওরাই বরং আমার ওখানে গিয়ে গিয়ে দেখে এসেছিল। হাসপাতালে। বাসাতে। অনেকদিন পর ফিরে আসলাম এখানে।
আগ্রাসী ভঙ্গিতে “বিড়ি” চাওয়ার পেছনে যথাযোগ্য কারণ আছে। হাত হারানোর পর থেকে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না। খাওয়ার উপায় নেই, হাত ছাড়া একটা মানুষ আবার কি করে সিগারেট খায়? এই বন্ধুদের সাথে থাকলে একটু আধটু সিগারেট খাওয়া চলে।
“একটা প্রশ্ন দোস্ত,” ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে হাঁক ছেড়ে প্রশ্নটা করল আশিক, “গত কয়েক মাস ধরে প্রশ্নটা মাথায় নিইয়া ঘুরতেছি। জিজ্ঞাস করা হয় নাই তোকে।”
আশিকের ঘরের অন্যপ্রান্তে থাকার কারণটা মোটামুটি স্পষ্ট। কান পাতলে তার ল্যাপটপ থেকে অশ্লীল শব্দমালা শোনা যাবে। পর্ন অ্যাডিক্ট হিসেবে ছেলেটার সুখ্যাতি আছে। কথায় আছে, আশিক প্যান্ট আর এইচডি পর্নক্লিপ ছাড়া কোথাও যায় না। ঘরের এক কোণে গিয়ে একা একা সিগারেট খাওয়ার কারণও ওই একটাই।
রাজ্যের সারল্য মুখে তুলে জানতে চাইলাম, “করে ফ্যাল। পায়খানা আর প্রশ্ন পেটে নিয়ে ঘোরা উচিত না।”
সিগারেটে আরও দুটো টান দিল সে। “হাত তো নাই তোর…“
“হ, নাই তো।” সর্বাত্মকরণে একমত হলাম।
“তাহলে হাত মারিস ক্যামনে?”
ঘরের প্রত্যেকে বিভিন্ন স্কেলে অট্টহাসি দিল এবার। না হেসে পারলাম না আমিও। এই শালার প্রশ্নটা কৌন বনেগা ক্রোড়পতি অনুষ্ঠানে ঢুকিয়ে দিলে কোন শালাকে আর কোটি টাকা জেতা লাগবে না। প্যান্ট আর পর্নক্লিপ নিয়ে স্টুডিও থেকে বের হয়ে যাবে সরাসরি।
“শালা!” বললাম খালি, “আমি টয়লেট প্রবলেমের সলিউশন বের করতেই মাস দুয়েক লাগায় ফেললাম। আর এ শালা আছে হাত মারার ধান্ধাতে।”
বিড়ি হস্তান্তর করল রাহাত। ঠিক হস্তান্তর বলা চলে না। আমার মুখে ধরল, আমি টানলাম।
কৌতূহলে ছোট ছোট হয়ে গেছে রাহাতের চোখ, “ওই প্রবলেমের সলিউশন কিভাবে করলি?”
“ছোট বাথরুমের ঝামেলা কম। আই গো কমান্ডো।”
“কমান্ডো?” বড় বড় চোখ করে জানতে চাইল জাহিদ, ছেলেটার খুব সখ ছিল আর্মিতে যোগ দেবে, “টয়লেটে তুই কমান্ডো হয়ে যাস?”
ভ্রু কুঁচকে গেছে আশিকেরও, “লাইক আলাদিন সেইড… You go to the bathroom after Osama, you will realize the true meaning of terrorism.”
আলাদিন দ্য ডিক্টেটরকে সব অ্যাঙ্গেল থেকেই গুরু বলে মানে পর্ন-আশিক। সময়ে অসময়ে গড়গড় করে তার উদ্ধৃতি আওড়ানো পুরানো স্বভাব তার। আমরা কিছু মনে করলাম না।
“না, সিরিয়াসলি, হাও ক্যান আ ম্যান গো কমান্ডো ইন দ্য টয়লেট!” মিলিটারি-জাহিদের আগ্রহটুকু জেনুইন এবং বাস্তব।
জামা সামান্য তুলে দেখালাম ওদের।
“ওহ মাই ফাক!” দূর থেকেই চিৎকার দিল আশিক, “গ্রেনেড! পুরাই গ্রেনেড!”
ঝলমলে হাসি উপহার দিলাম ওকে, “রাইট। চেইনের সঙ্গে একটা চাবির রিঙ লাগিয়ে রাখতে হচ্ছে এখন। বাথরুমের দরজার প্রয়োজনমত হাইটে লাগিয়ে নিয়েছি ছোট্ট একটা রড। ওটাতে আটকে চেইন খুলতে হয় আরকি। কঠিন, কিন্তু অসম্ভব না। নিজের কাজ নিজের করতে পারছি।”
“কমান্ডো।” বিড়বিড় করে স্বপ্নালু চোখে বলল জাহিদ।
“ইয়েপ। তবে আসল চ্যালেঞ্জ হল বড়টা করা।” ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালাম।
“সেইটা কেমনে? একা একা তো পসিবল না…” রাহাত হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে।
“পসিবল। আমিও একটা সময় মনে করতাম পসিবল না।” দীর্ঘশ্বাস চাপলাম, “থ্যাংকস টু টিম গ্রিফিন।”
“টিম গ্রিফিন কে?” দূর থেকে গলা চড়িয়ে জানতে চাইল আশিক। তার ল্যাপটপের ভেতর নারীকণ্ঠের গলাও চড়ে যাচ্ছে। বুঝলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথে যোগ দেবে আশিক।
“লেট মি গেস…” রাহাত বলল, “কেপি একজনের নাম নিয়েছে, যাকে আমরা চিনি না। তারমানে টিম গ্রিফিন একজন রাইটার। বই লেখেছে ও শালা। সেখান থেকে পড়ে সে কমান্ডো হওয়া শিখেছে।”
হেসে ফেললাম, “দ্যাটস অ্যাবাউট রাইট। বই পড়ে কমান্ডো হতে শেখা প্রথম মানুষগুলোর মধ্যে আমিও একজন। টিম গ্রিফিন বই লিখেছেন সেটাও সত্য। সেখানে বড়টা করার জন্যও চমৎকার সলিউশন দেওয়া আছে।”
“ট্যালেন্টেড লোক নিঃসন্দেহে।” জাহিদ বলল, “হাত থাকতে হাতের মর্যাদা বোঝে না বাঙালি। নন-বাঙালি বলেই বুঝেছে হয়ত।”
দুইপাশে মাথা নাড়লাম, “হাত থাকতে হাতের মর্যাদা নন-বাঙালিও বোঝে না রে। টিম গ্রিফিনের দুটো হাতই অকেজো হয়ে গেছে। মোটর-নিউরন ডিজিজ। তারপরই বইটা লিখেছে সে।”
ঘরের মধ্যে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এল। মাথা খানিকটা চুলকাল জাহিদ। ঠিক সেই মুহূর্তে আমারও খুব ইচ্ছে করছিল মাথা চুলকাতে। সাইকোলজিকাল ইচ?
“ওয়েট আ সেকেন্ড। তাহলে তুইও লিখতে পারবি। আবার লেখালেখি শুরু করতে পারবি তুই।” পয়েন্টটা ধরল রাহাত, “শুধু জানতে হবে টিম গ্রিফিনের হাত নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সে লিখল কি করে?”
“আধুনিক প্রযুক্তি আর অসম্ভব চমৎকার এক আদর্শ স্ত্রীর ভূমিকা আছে তার পেছনে।” দুঃখী একটা হাসি হেসে বললাম আমি।
“কালকেই এষার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি।” পায়ে চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়াল আশিক। আমরা সবাই জানি ফুল লেন্থ ভিডিও দেখা শেষ হওয়ার সাথে তার ওই পা চাপড়ানোর সংযোগ আছে। “আর কোন আধুনিক প্রযুক্তি?”
“দুটোর কোনটাই পেতে যাচ্ছি না আমি। এষা আরও বেটার কাওকে ডিজার্ভ করে। আর…”
হঠাৎ খেয়াল করলাম ঘরের ভেতর হাল্কা পরিবেশটা আর নেই, “বাংলাতে লেখার জন্য নিখুঁত কোন স্পীচ-টু-টেক্সট সফটওয়ার নেই। ওই লেখক ব্যাটা ইংরেজিতে লিখতে পেরেছে কারণ ও ভাষার অনেক টেক সাপোর্ট।”
ঘরের আবহাওয়া আরও একটু নিরানন্দ হয়ে গেল এবার।
আশিকের দিকে তাকালাম।
নাক কুঁচকে বললাম, “আর শাওয়া তোমাদের হাত দিয়েই করতেছটা কি? খাচ্চর শালা।”
লজ্জিত মুখে কুঁচকি থেকে হাত বের করে আনল ও, “চুলকাচ্ছিল। এমন করিস ক্যান? জেলাস?”
হেসে ফেললাম। এই শালারা না থাকলে ছোট ছোট হাসির মুহূর্তগুলো থাকত আমার জীবনে?

৪.
“গল্প সংকলন-০১ ভালই চলছে।” প্রকাশক ভদ্রলোক জানালেন, “আলাদা বিজনেস চার্ম এসেছে, দ্য ম্যান উইদাউট হ্যান্ডস, পাঠকরা বলে। ভাবছি আগামী মাসে গল্প সংকলন-০২ বের করে ফেলব।”
শুকনো হাসলাম। এই আরেকটা মানুষ, যিনি আমার বাজে সময়ে আমাকে ছেড়ে যাননি। দুটো মাত্র উপন্যাস লিখতে পেরেছিলাম আমার রাইটিং ক্যারিয়ারে। তারপরই গেল হাতদুটো। অন্য কোন প্রকাশক হলে হয়ত দুটো সহানুভূতিসূচক কথা বলে ডুব মেরে যেতেন। ইনি যাননি। অনলাইন থেকে গল্পগুলোকে সংকলন বানাচ্ছেন। প্রতি সংকলনে ১৫টা করে গল্প। অনায়াসে ১৫টা বই বের করা যাবে ২৩০টা গল্প দিয়ে। গল্প সংকলন ১৫ পর্যন্ত। আইডিয়াটা আমি তাঁকে দেইনি। তিনিই নিজ থেকে এগিয়ে এসেছেন।
“গ্রেট। দ্যাট উইল বি গ্রেট।” বললাম।
“শরীর কেমন তোমার?” জানতে চাইলেন তিনি।
“খারাপ না স্যার। বেশ আছি।” মিথ্যে বললাম।
“নিজের খেয়াল রেখো। বাসায় তো আছ, নাকি হলে?”
“না, বাসাতেই।”
একটু নীরবতা। তারপর প্রশ্নটা করলেন তিনি, এতদিন পর।
“ঠিক কি ঘটেছিল আমাকে বলবে? অ্যাকসিডেন্টটা? … আসলে আমি এখনও জানি না।”
তিনি জানেন না সেটা আমিও জানি। কাওকে এ ব্যাপারে কিছু বলিনি। বলার মত মানসিক অবস্থা ছিল না অবশ্য। তবুও কিভাবে যেন রাষ্ট্র চাউর হয়ে গেল আমার হাত গেছে। গন ইন দ্য উইন্ড!
জাহিদের সঙ্গে সাইকেল চালাচ্ছিলাম আমি সেদিন। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেকদিনের। সেবার আমরা বাস্তবায়ন করছিলাম শুধু। দ্রুত সাইকেল না চালালে পৌঁছাতেই দুপুর হয়ে যাবে সেটা আমাদের জানা আছে, প্রাণপনে প্যাডেল মারছিলাম। চুল উড়ছিল বন্য বাতাসে, হাইওয়ের মুক্ত পরিবেশ।
হাতের পেশী ফুলে ছিল সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে থাকার কারণে। রীতিমত রেস করছিলাম আমরা। রেস করার জন্য এন্ডিং পয়েন্ট বের করাটা সহজ। “পরবর্তী চায়ের দোকান” হচ্ছিল আমাদের রেসিং এন্ডিং। এক চায়ের দোকান থেকে আরেক চায়ের দোকানের দূরত্ব কম না তো। বাইপাস পার হয়ে চাঁপাইয়ের পথে দোকানের ভালরকম আকাল আছে।
এর আগের দুই চায়ের দোকানে আমার আগে পৌঁছেছে জাহিদ। মিলিটারি ম্যান তো, তার জন্য সহজ হওয়ার কথা কাজটা, আমার চেয়ে শারীরিকভাবে বেশি ফিট সে। শালার স্ট্যামিনা আছে, টানা আধঘণ্টা মেশিনের মত প্যাডেল মেরেও সামান্য হাঁপায় না। ওর বউয়ের কথা চিন্তা করে আমার গলাই মাঝে মাঝে শুকিয়ে যায়।
ইজ্জতের প্রশ্ন এসে গেছে, পর পর তিন বার হেরে যাওয়া পুরুষ মানুষের জন্য অপমানের। শরীরের শেষ শক্তিবিন্দুটা খরচ করে সাইকেলের প্যাডেল মারছিলাম। এভাবে আর দশ সেকেন্ড চালিয়ে গেলেই জাহিদকে পার করে যাব। আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব কমে আসছিল দ্রুত।
বিপরীত দিক থেকে আসা ঢাকাগামী শ্যামলী আর দেশ ট্রাভেলসের মধ্যেও একই রকম রেস লক্ষ্য করা গেল। ওভারটেক করার জন্য পাগল হয়ে আছে শ্যামলীর বাস। আরেকটু হলেই আমার ওপর তুলে দিয়েছিল শালা ড্রাইভার।
প্রাণপনে বাসের গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনলাম। গতি কমে গেল অজান্তেই। সামনে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসল জাহিদ। আবারও পিছিয়ে পড়েছি আমি। ওকে দেখে মনে হল ঈদের চাঁদ দেখেছে পিচঢালা রাস্তাতে। দাঁতে দাঁত পিষে আবারও গতি বাড়াচ্ছি। পেছনে ভারী ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ট্রাক আসছে একটা। হর্নও দিল। ও শালাকে সাইড দেওয়ার মানসিকতা আমার নেই তখন।
“পারলে ওভারটেক করে যাও না বাপু, দেখছ না রেস করছি?” বিড়বিড় করে বললাম, “কানের পাশে পক পক করছ কেন?”
নিজের দুটো হাত আস্ত থাকা অবস্থাতে ওটাই ছিল আমার শেষ ভাবনা। পরের তিনটা সেকেন্ডই সবকিছু পাল্টে দিল। ধ্বংস করে দিল আমার পরিচিত পৃথিবীটা।
আচমকা সাইড রোড থেকে বের হয়ে এল মোটরসাইকেলটা। আঁতকে উঠেছে জাহিদ, পরিষ্কার শুনতে পেলাম। মোটরসাইকেল আরোহীও থতমত খেয়ে গেছে। জাহিদের সামনের চাকাতে প্রচণ্ড জোরে লাগল মোটরসাইকেলের সামনের চাকা। বাইক ঘোরাতে হল না আর, পুরো রাস্তা পার করে অন্যপাশের খাদে ছিটকে পড়ল ওটা, আরোহীসহ।
জাহিদ আছড়ে পড়েছে রাস্তার ওপরই, সাইকেলসমেত। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে তার দিকে ছুটে গেলাম আমিও। রিফ্লেক্সের বশে গতি পাল্টে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, কাজ হল না। সরাসরি ওর সাইকেলে আটকে গেল আমার সাইকেল। পরমুহূর্তে টের পেলাম বাতাসে ভাসছি। হেলমেট নেই মাথাতে, শুন্যে ভাসতে ভাসতেই হাত দুটো উঠে গেছে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে।
বেঁচে থাকার তাগিয়ে একটা কথাই ভাবতে পারলাম, মাথাটাকে রক্ষা করতে হবে। চিত হয়ে রাস্তাতে আছড়ে পড়লাম হাত এখনও মাথার ওপরে তোলা, যতদূর পেরেছি উল্টোদিকে বাকিয়ে নিয়েছিলাম, তালুর উল্টোপিঠটা রাস্তাতে পড়ল আগে, হাড় ভাঙ্গার বিচ্ছিরি শব্দটা কানের খুব কাছে শোনা গেল।
উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, মাথা থেকে রাস্তার মাঝে যথেষ্ট ক্লিয়ারেন্স ভলিউম দিতে পেরেছে আমার হাত। গতিজড়তাতে ছিটকে পিছিয়ে গেছে মাথা, মনে হল ঘাড় ভেঙ্গে যাবে। তবে রাস্তার শক্ত তলে ঠুকে গেল না খুলি। ক্লিয়ারেন্স ভলিউমটুকু কাজে দিয়েছে। হাত দুটো ভেঙ্গে গেলেও মাথা বাঁচিয়ে দিতে পেরেছি আমি। স্বস্তির নিঃশ্বাস আর যন্ত্রণার আর্তচিৎকার একসাথে ছাড়তে যাব, তখনই দুই হাতের ওপর দিয়ে উঠে গেল ট্রাকের সামনের চাকা।
অপার্থিব, নারকীয় এক যন্ত্রণা হল্কা দিয়ে উঠে এল হাতের আঙুলের ডগা থেকে থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। আর কিছু মনে নেই আমার।
“পরে অবশ্য শুনেছিলাম, রুটি বেলার মত অবস্থা হয়েছিল আমার হাতের। মানে…” কি বলব আর ভেবে পেলাম না, “তেমনটাই শুনেছিলাম আরকি…”
কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন প্রকাশক ভদ্রলোক।
“তুমি একটা কাজ কর, ইমন।” তারপর বললেন তিনি, “ঢাকায় চলে এসো।”
“ঢাকায়, স্যার?”
“ইয়েস, ঢাকায়। আমাদের প্রকাশনীতে স্টেনো টাইপিস্ট রাখার চিন্তাভাবনা চলছে। তোমার ওপর ডিপেন্ড করছে সবকিছু।”
“আমার ওপর, স্যার?” ঠিক বুঝলাম না উনার কথা।
“কাম অন! স্টেনোগ্রাফার রাখার সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তোমার জন্য নেওয়া হয়েছে।” কোমল গলাতে বললেন তিনি, “তুমি মুখে বলবে, সে টাইপ করবে। তোমার উপন্যাস চাই আমরা।”
এখনও বুঝলাম না উনার কথা, “আমার জন্য?”
মৃদু হাসলেন তিনি, “অবাক হচ্ছ কেন? ইউ আর ফ্যামিলি।”
জানি না কেন, চোখে পানি চলে আসল আমার।

৫.
ফ্যান ঘুরছে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। ফ্যানরা যখন ঘোরা শুরু করে, তখন বোঝা যায় তারা ক্লকওয়াইজ ঘুরছে না অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ। তবে খানিকক্ষণ পরে এটা বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। শুরুতে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ মুভমেন্ট পরিষ্কার বোঝা যায়। পরে … খুব একটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
আধঘণ্টা ধরে একটানা তাকিয়ে থেকে এই সিদ্ধান্তে মাত্র পৌঁছেছি, দরজাটা খুলে গেল। গন্ধ শুনেই বুঝলাম এষা এসেছে। ওর শরীরের গন্ধ আমি যে কোন পারফিউমের চেয়ে ভাল চিনি। যেমনটা চেনে ও আমার শরীরের গন্ধ।
“…আমি দেখছি, আন্টি।” মুখ ঘুরিয়ে আম্মুকে বলল সে।
উঠে বসতে হল। বিপদের আশঙ্কা করাটা খুব একটা অমূলক তো নয়। এর আগে একটা আলোচনা সে চালাচ্ছিল সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আম্মু অবশেষে এষাকে লেলিয়ে দিল? এই দৃশ্য দেখার জন্যই বেঁচে ছিলাম আমি!
“না না, তোমাকে আর উঠে বসতে হবে না।” ঝাঁঝালো গলাতে বলল এষা, “তুমি শুয়ে শুয়ে ফ্যান দেখো!”
দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে সে, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। শুকনো গলায় জানতে চাইলাম, “দরজা লাগাচ্ছ কেন?”
“রেপ করব না। ভয় পাওয়ার কিছু নাই তোর।” সাফ সাফ জানিয়ে দিল সে।
বেশিদিন নয়, বাইরের এক দেশে তিনজন যুবতী ধরে নিয়ে গিয়ে এক যুবককে রেপ করে রাস্তাতে নামিয়ে দিয়েছে। কাজেই ভয় পাওয়ার কিছু তো আছেই। তার ওপর আমি লুলা মানুষ। অবশ্য মুখ ফুটে কথাটা বললাম না তাকে। এর মধ্যেই তুই করে বলা শুরু করেছে। এর অর্থ রেগে বোম হয়ে আছে সে।
“কি? প্রতিবার এসেই তোর নামে একশ’ একটা অভিযোগ শোনা লাগে ক্যান?” বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে বলল এষা।
“আমি আবার কি করলাম?” বিড়বিড় করে নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলাম।
“আবার কি করলাম!” ভেংচে দিল এষা, “শালা, অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে নিজের হাত দুইটা খুইয়ে আসছিস ওইটাই কি যথেষ্ট ছিল না? হারামজাদা! এখন বাকি সবাইকে জ্বালিয়ে মারার আগ পর্যন্ত তোর শান্তি হবে না, নাকি?”
“কই, কাওকে জ্বালাই না তো।” আনমনে বললাম। ফ্যান দেখছি।
চেয়ার থেকে উঠে সুইচ বন্ধ করে দিল এষা। ফ্যানটা আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে।
“এবার পরিষ্কার বোঝা গেল ব্যাপারটা।” হাসিমুখে ওকে আমার আবিষ্কারের ব্যাপারে জানালাম।
“কি?” ভ্রু কুঁচকে আছে ওর।
“ফ্যানগুলো অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘুরে। একটু আগে ঘুরতে থাকা অবস্থাতে ক্লকওয়াইজ লাগছিল।”
হাতের কাছে একটা চোথা (ক্লাস লেকচার) পাওয়া গেল। দুই সেমিস্টার আগের মনে হয়। ওটাই গোল করে পাকিয়ে আমার মাথাতে মারল এষা, “চুপ করে বসে থাক, শয়তান কোথাকার!”
কপালের কাছটা চুলকাচ্ছে। কাগজ দিয়ে বাড়ি মারলে ব্যথা লাগে না। চুলকায়। আমার এখন কারণে-অকারণে চুলকায়। মারলে আরও চুলকায়। একটা কাটা হাত ওপরে তুলে কনুইয়ের কাছে কপাল ঘষে চুলকানোর চেষ্টা করলাম। এষা দেখল, কিন্তু সাহায্য করতে এল না। একপাশে ফেলে দিল চোথা।
“কাল সকাল থেকে কিছুই খাসনি, আন্টি বলল।” অবশেষে আসল কথাতে এল সে।
“আরে বাল, খিদা নাই।” বিরক্ত হলাম এবার। খাবারের কথা কেউ বললেই বিরক্ত লাগে।
“আমার সামনে বাল-বাল করবি না। একদম করবি না বাল-বাল!” আবারও মুখ ঝামটে বলল ও।
“চার এক্কে চার।”
“কিছু বললি?”
“আরে না।” তাড়াতাড়ি বললাম, “দ্যাখ, খাওয়া নিয়ে জ্বালাস না তো। আর কিছু নিয়ে কথা বললে বল।”
“আমি জ্বালাচ্ছি?” অবাক হয়ে গেল এষা, “ও, আমি জ্বালাচ্ছি এখন? তুই আন্টিকে জ্বালিয়ে শেষ করে দিচ্ছিস বুঝলি? তোর পেছন পেছন কি সারাদিন ঘুরবে আন্টি? খাইয়ে দিতে আসলে খেয়ে নিবি। এত জ্বালাস ক্যান?”
এই প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। কথাটা ঠিক। আম্মুকে এখন খাইয়ে দেওয়া লাগে। মাঝে মাঝে আমি নিজেই খাওয়ার চেষ্টা করি। কাজ হয় না। দুই হাত সমানভাবে কাটলে হয়ত সম্ভব হত। এক হাত ছোট এক হাত বড় তো, আবার তালুও নাই। তাই খেতে পারি না নিজে নিজে। গতকাল থেকে খাবারের ঝামেলা করার কথা মনে হলেই বমি লাগছে। লাইফ হল এটা একটা? মাসের পর মাস লোকজনের ঘাড়ে চেপে বসে আছি!
“কি হল, কিছু তো বলবা?” নরম হয়ে এসেছে এষার কণ্ঠ।
“নিজ হাতে খেতে ইচ্ছে করছে রে খুব।” শোনা যায় না এমনভাবে বললাম।
চেয়ার থেকে উঠে এসে বিছানাতে বসল ও। আমার হাত দুটো ধরল কাঁপা হাতে। ওর হাত কাঁপার কারণ আছে। এই হাত দুটো দিয়ে কতবার ধরেছি ওকে। জড়িয়েছি ওর হাত, নেড়ে দিয়েছি ওর চুল, ছুঁয়ে দিয়েছি ওর ঠোঁট। এই দুই হাত দিয়েই ওকে কতবার তুলে নিয়েছি শুন্যে। ভয় পেত ও প্রথমে। আমি হয়ত ওকে ফেলে দেব। আস্তে আস্তে বিশ্বাস করল আমাকে, আমি কোনদিনও ফেলে দেব না ওকে।
সেই আমি এখন হাতবিহীন এক অথর্ব। ওকে আর কোনদিনও দুই হাতে শুন্যে তুলে ফেলা হবে না। ওকে ফেলে দিয়েছি আমি। ফেলে দিয়েছি পুরো পরিবারটিকেই।
কোনরকম আগাম সংকেত না দিয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরল এষা। কাটা হাত দুটো ওর পিঠে আড়াআড়ি রাখলাম। কাঁপছে মেয়েটা। কাঁদছে কি? কাঁধের ওপর মাথা থাকার কারণে ঠিক বোঝা গেল না।
“একটা সময় বলেছিলাম না, আমার সবকিছু তোমার?” নিচু কণ্ঠে বলল ও।
“হুঁ।” বললাম, আমার গলাও ভারী হয়ে আসছে।
“আমার হাতদুটোও তোমার তাহলে, তাই না?”
কিছু বললাম না। মেয়েটা এত পাগল কেন?
“আমি খাইয়ে দিলে খাবা?”
কাটা হাত দিয়েই ওর চুল ছুঁয়ে দিলাম গভীর ভালবাসায়।
“খাবো।”

৬.
“কুত্তা নাকি তুই?” সবগুলো দাঁত বের করে বলল মাসুদ।
হাসলাম, এখনও আগের মতই আছে ছেলেটা। স্কুলজীবনের বেস্ট ফ্রেন্ড মাসুদ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি। ইয়ার ফাইনাল শেষ হতে এই গালিটা দেওয়ার জন্যই রাজশাহী পর্যন্ত বয়ে এসেছে।
“যাব্ব্যাটা।” বললাম, “খবর কি তোর?”
“আমার খবর? আরে শালা তোমার খবর কও আগে। বিবিসি-সিএনএন বন্ধ কইরা দৌড়ায় আসলাম এইটা শুনতে।”
“তা তো কইবাই। শুনলাম নতুন পিরিতি করতেছ?”
হেহে করে সলজ্জ হাসি দিল মাসুদ। পুরুষের আবার বিনয়!
“ওই আরকি।” কম্বলের দিকে তাকাল, “বাইর কর।”
চমকে উঠলাম, “অ্যা?”
বিরক্ত হল মাসুদ, “তোমার নধর শরীরখানা বের করতে বলি নাই। শালা, হাত বাইর কর। দেখব কি অবস্থা।”
কায়দা কসরত করে বের করে আনলাম দুইটাই, “ট্যামা হইয়া গেছে। আর কি দেখবি?”
“আরে জোস, ফাটাফাটি!” উৎফুল্ল হয়ে বলল মাসুদ, চোখে অবশ্য বিষাদের ছায়া, “শালা তোমার তো আর ফিন লাগবে না পানিতে নামলে। এই দুটা নাড়ায়াই মাছের মত সাঁতার দিবা।”
“কুত্তা তুই।” মুখ ভেংচে দিতে দিতে আবারও কম্বলের তলে হাত নিয়ে যেতে থাকলাম।
দরজা খুলে গেছে খেয়াল করিনি। আম্মু ঢুকল একটা ট্রে নিয়ে। দুই কাপ চা আর নাস্তা তাতে। হাত গেছে তবে চায়ের নেশা আমার যায়নি। মাসুদের একটা ভ্রু উঁচু হয়ে গেছে। এতসব আম্মু অবশ্য খেয়াল করল না।
“ছেলেটার মুখের ভাষার যে কি অবস্থা!” আমার দিকে একটা তির্যক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল আম্মু।
“সুন্দর করে দরজাটা লাগিয়ে দাও তো যাওয়ার সময়।” কাচুমাচু মুখে বললাম, “তাহলেই তো শোনা লাগে না এসব।”
দরজা লাগিয়ে দিয়েই গেল আম্মু। তবে মাসুদের ভ্রু তখনও সোজা হয়নি।
“তুই এখন চা খাস কি করে?” প্রশ্নটা করেই ফেলল সে।
কাপটা আমার সামনে নামিয়ে দিল, দেখার জন্যই হয়ত।
“ড্রয়ার খুলে দেখ, একটা স্ট্র-র প্যাকেট আছে। আমাকে একটা দে।” দাঁত বের করে বললাম, “হাত না থাকলে চা খাওয়া যায় না এটা কোন ধরণের যুক্তি হল রে? তাহলে কাকেরা চা খায় কি করে?”
“কাকেরা চা খায় না।” সোজাসুজি বলে দিল মাসুদ। হাত বাড়িয়ে আমার কাপে ডুবিয়েছে স্ট্র।
“তুই বেশি জানিস? সেইবার ফার্মগেটে …”
কথা বার্তা হঠাৎই থেমে গেল আমাদের। ফার্মগেটে এক দোকানের চায়ের আধোয়া কাপের ওপর কাক বসেছিল। চা খাচ্ছিল। তবে সেজন্য আমাদের কথা বন্ধ হয়ে যায়নি। ফার্মগেটে আমরা যেতাম একটা উদ্দেশ্যেই। অ্যাডমিশন কোচিং করতে। ওমেকা।
আচমকা বিষণ্নতার বন্যা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর। একই কথা ভাবছি দুইজনই।
“প্রতিদিন সকালে দৌড়ে গিয়ে নিউ ভিশন ধরতাম আমরা। আটটার ক্লাস ধরার জন্য।” তিক্ত একটা হাসি এখন আমার মুখে।
“হুঁ। আমার বাসা আরেকটু সামনে ছিল। সনি থেকে উঠতাম আমি।”
“হুঁ।”
পুরোনো দিনগুলোতে হারিয়ে যাইনি শুধু। সে সময় বলা কিছু কথা আমার কানে বাজছে। মাসুদেরও খুব সম্ভবতঃ।
“সেই সময় আমার হাতদুটোর যত্ন নিতাম খুব। মনে আছে তোর?” প্রসঙ্গটা তুললাম।
“তা নিতি। হাত আর মাথা …”
“হাত আর মাথা, রাইট। বলতাম এই দুইটা ঠিক থাকলেই চলবে আমার। দুনিয়ার আর কিছুর দরকার নাই। বাসের জানালা থেকে অনেক দূরে রাখতাম হাত।”
মাথা দোলাল মাসুদ, “ভুল করে হাত দিয়ে ফেলতি মাঝে মাঝে। জানালায় কনুই রাখা তো তোর পুরাতন অভ্যাস।”
“উঁহু, সাথে সাথেই ভেতরে টেনে নিতাম আবারও। পেছন থেকে কোন বাস এসে আমার হাত ভেঙ্গে দিয়ে যাবে এই ভয়ে থাকতাম সব সময়। বুয়েটের অ্যাডমিশন টেস্ট ডেট ছিল দেড় মাস পরে তো…”
“মনে আছে আমার। প্যারানয়েড ছিলি হাত নিয়ে। আমি আর তানভীর তোকে সেই লেভেলের পচানিও দিসিলাম একদিন।”
হাতের যত্ন নিয়েছি আমি সব সময়। মনে পড়ে যাচ্ছে যতবার হাতের যত্ন নিয়ে যতজনকে যত কথা বলেছিলাম সব। এক বছর আগে ঢাকাতে কলেজ বেস্ট ফ্রেন্ড সৈকতকে বলেছিলাম, হাত দুটো আস্ত থাকলেই আমাকে আর রুটি-রুজি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। পা ভাঙ্গলে সমস্যা নেই। সৃষ্টিকর্তা মনে হয় সেই কথাটাকেই ধরেছিলেন। আজকে আমার হাত বাদে আর সব কিছুই ঠিক আছে। শতভাগ ফাংশনাল।
স্ট্র দিয়ে চায়ের কাপ থেকে ‘সুড়ুৎ’ দিলাম।
প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার সুযোগ পেতে ছাড়ল না মাসুদ, “স্ট্র দিয়ে চা খেলে মুখ পুড়ে না?”
“হাতওয়ালাদের পুড়ে। হাত-ছাড়ারা শিখে নেয় মুখ না পুড়িয়ে খাওয়া।”
শুকনা হাসল মাসুদ, “পাগলামি -ছাগলামি করিস না কিন্তু। আন্টি বলল শুরুর দিকে নাকি সুইসাইডের চিন্তা-ভাবনা করতি।”
দ্যাট’স মাসুদ। ভাল লাগল যে কথাটা তোলার মত সাহস ওর আছে। পুরাতন বন্ধুদের ব্যাপারটাই আলাদা। বাকিরা ভয়ে তুলেইনি প্রসঙ্গটা। পাগলকে নৌকা ডুবাতে বলবে কে? আমি অবশ্য মাসুদের কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিলাম।
“কাম অন, ম্যান! আমি বর্ন ফাইটার। সুইসাইড করব আমি?”
চায়ের কাপে চুমুক দিল, “তাহলে শোন, এক লোক ছিল আমাদের ওদিকে। এক হাত কেটে গেছিল ট্রেনে।”
“লাকি বাস্টার্ড!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। হারামজাদার একটা হাত ছিল তো তাও!
“তোর অবস্থার প্রেক্ষিতে সেটা বলাই যায়।” মুচকি হাসল সে। “প্রথম প্রথম উনার মন সেই লেভেলের খারাপ থাকত। দিন রাত সুইসাইডের কথা চিন্তা করতেন। বউ-বাচ্চা আছে, তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।”
“বউ-বাচ্চা প্লাস একটা হাত।” মন্তব্য করলাম।
“প্রতিদিন বারান্দাতে বসে চিন্তা করেন তিনি। মাথাতে শুধু ঘুরে সুইসাইড। প্রক্রিয়াটাও ঠিক হয়ে গেল একদিন। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে জীবনটা শেষ করে দেবেন তিনি। তারপরই সামনের বাড়ির ছাদে মানুষটাকে দেখলেন তিনি।”
“কোন মানুষটাকে?”
“আরেকজন পঙ্গু। ছাদে উঠেছেন। ইনার দুই হাতই কাটা।”
“ওহ শিট!” বলতেই হল আমাকে, “উনার চোখের সামনে লাফ দিলেন ওই দুই হাত কাটা ভদ্রলোক?”
“আরে ধ্যাত! দুই হাত কাটা ভদ্রলোক খুশিতে লাফাচ্ছিলেন। ছাদের খোলা অংশটাতে অনেক বাতাস। তার মাঝে লুঙি কাঁপানো নাচ দিলেন তিনি। তারপর নেমে গেলেন আবারও।”
“হোয়াট দ্য-”
“আরে শোন। পরেরদিন এক হাত কাটা আংকেল বারান্দাতে আবারও বসেছেন। বিকালে ছাদে আবারও উঠলেন দুই হাত কাটা ভদ্রলোক। কি হাসি তাঁর। আর কি আনন্দ, খুশিতে লাফাচ্ছেন রীতিমত!”
“শালা পাগল শিওর!” বললাম আমি, “দুই হাত কাটার পর হাসে যে বাইনসূদ, তার ব্যাপারে আমার আর কোন মন্তব্য নাই।”
“পাগল তিনি ছিলেন না।” থমথমে মুখে জানাল মাসুদ।
“কিভাবে শিওর হচ্ছিস?”
“কারণ, ওই আংকেল তিন দিনের মাথায় গিয়ে উনাদের ছাদে অপেক্ষা করছিলেন। দুই হাত কাটা ভদ্রলোক উঠে আসতেই তাকে ধরলেন তিনি। বললেন, ‘ভাই, আমার এক হাত ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে কেটে গেছে। তারপর থেকে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে একেবারেই নেই। আত্মহত্যার কথা ভাবছি দিন রাত। থেরাপিস্ট দেখিয়েছি, কাজ হয়নি। আর আপনাকে দেখলাম সুখী জীবন কাটাচ্ছেন। দুই হাত না থাকার পরও আপনি খুশিতে লাফান। ট্রিকসটা কি জানানো যাবে, স্যার? নিজের জীবনে অ্যাপ্লাই করতাম। আমি বড়ই হতাশ।’ দুই হাত কাটা ভদ্রলোক তো ক্ষেপে উঠলেন রীতিমত।”
“কেন কেন?”
“উনি বললেন, ‘আরে রাখেন আপনার সুখী জীবন! বউটা মরে যাওয়ার পর থেকে পিঠ চুলকায়ে দেওয়ারও কেউ নাই। যখন খুব চুলকানি উঠে, তখন সহ্য করতে না পেরে ছাদে এসে কিছুক্ষণ লাফাই। আর আপনি বায়নোকুলারস মেরে দেখতেছেন! হোয়াট দ্য হ্যান্ড!’ ”
একটু হাসলাম, “হোয়াট দ্য হ্যান্ড। না, দুশ্চিন্তার কিছু নাই তোর। জীবন যখন যেমন। থেমে যাওয়ার ইচ্ছা নাই আমার।”
লম্বা করে আরেকটা চুমুক দিলাম কাপে। তারপর ষড়যন্ত্রকারীদের মত তাকালাম মাসুদের দিকে।
“ও কী! ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?”
“শালা কুত্তা, তুমি দুই হাত কাটাদের নিয়া জোকস ছাড়ো?” হুঙ্কার ছাড়লাম, “এখন আসো, আমার পিঠ চুলকায়া দাও!”
দরজার ওপাশ থেকে আম্মুর শাসনের গলা শোনা গেল, “ইমন!”

৭.
রোদ ঝলমল করছে চারপাশে। এমন একটা পরিস্থিতে জীবনটাকে সত্যিই ভালবাসতে ইচ্ছে করে। শহীদ মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমরা কয়েকজন। এষা, আমি, জাহিদ, রাহাত। জাহিদ ছেলেটা প্রথম দুইমাস নিজেকে অপরাধী মনে করত খুব। তার সাইকেলেই বেঁধেছিলাম আমি। তবে এখানে আসলে কারও কোন ভূমিকা নেই। নিয়তি! এই সহজ কথাটা বোঝাতে যথেষ্ট সময় লেগেছে আমার।
“তোর বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে গেছিলাম আমি।” রাহাত বলল, আমাদের সেকশনের সিআর সে।
“ডিএসডব্লিয়ের কাছে?” দুরুদুরু বুকে জানতে চাইলাম। এই আলোচনার কোন সুখকর সমাপ্তি নেই তা আমার জানা আছে।
“হ্যাঁ।” অন্যদিকে তাকিয়ে বলল রাহাত।
“কি বললেন তিনি?”
“তেমন কিছু না…” জাহিদ বলতে যাচ্ছিল, ওকে থামিয়ে দিলাম হাত তুলে।
রাহাত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল, “ইয়ে, বললেন যে কোন একটা ওয়ে খুঁজে বের করতে। কিভাবে তুই পরীক্ষা দিবি, বা কিভাবে তুই কোর্সগুলোর পাঠ্য অংশগুলো পারিস সেটা প্রুভ করবি এইটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।”
“দুই হাত না থাকলে বাংলাদেশের সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে যে অন্তত পরীক্ষা দেওয়ার উপায় নেই, তা তো জানেনই তিনি।” বিরক্ত হয়ে বললাম, “কিভাবে দেব? ভাইভা? নেভার উইল বি এনাফ। ম্যথমেটিকস আর ক্যালকুলেশন মুখে মুখে করা যায় না। আর শুধু ব্যাসিক পার্ট জানলে কোর্সে গ্রেড দেওয়ার মত বা পাশ করানোর মত এনাফ জানা হয় না। উপায় কোথায়?”
“ভাইভার ব্যাপারটা উনাকে বলেছি অলরেডি।” রাহাত বলল, “উনি বললেন এক্সেপশনাল কেস তো, ভাইভা নিয়ে তোকে একটা সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হয়েছিল। তাছাড়া তোর রেজাল্ট তো ভাল…”
“ভাই, আমার হাত নাই। রেজাল্ট ধুয়ে পানি খাওয়ার উপায় নাই এইটাও উনি ভাল করে জানেন। সোজা বাংলাতে সারমর্মটা বল।”
“উনি বললেন সব স্যারদের নিয়ে একটা মিটিং করে দেখবেন। তোকে একটা সার্টিফিকেট দেওয়া যায় কি না। তবে ভাইভা মেথডে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারটা উনারা কিভাবে দেখবেন তিনি জানেন না।”
“মিটিং না একটা হইছিলো গতকাল?” মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল আমার, “আবার কেন?”
“ইয়ে…”
“বল আমাকে, রাহাত।”
“ওই মিটিংয়ে স্যাররা বলেছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসির সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়ার জন্য একটা ভাইভা এনাফ না। তাছাড়া অ্যাকসিডেন্টটা ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটেছে। তাদের রেসপনসিবিলিটি ছিল না, নেইও। তোকে উনারা কোন সার্টিফিকেট দিতে পারবেন না এই ডিসিশন নিয়েছে সেজন্য। ডিএসডব্লিউ স্যার আরেকটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করানোর চেষ্টা করবেন বললেন আরকি।”
নাক কুঁচকালাম, “দরকার নাই। ইউনিভার্সিটি ফ্যামিলি থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে আরকি আনঅফিসিয়ালি। সোজা হিসাব।”
মাথা নাড়ল জাহিদ, “ঠিক ওরকম না…”
“ঠিক ওরকমই।” শক্ত মুখে বললাম আমি। “আমার কোন দায়ভার এই বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না। কারণ অ্যাকসিডেন্টটা ক্যাম্পাসের বাইরে ঘটেছে। চমৎকার যুক্তি। সার্টিফিকেট না দেওয়ার পেছনে অবশ্য ভাল যুক্তি আছে। ওই সার্টিফিকেট নিয়ে ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে বলে মনে হয় না।”
এষা এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি, ওর দিকে তাকালাম, “দেখলি তো, কেন ক্লাস করতে আসিনি আমি এখানে? হাত নাই, আমি ব্যানিশড। আই অ্যাম নো মোর ফ্যামিলি।”
শুকনা হাসি হাসলাম। ব্যথাভরা চোখে তাকাল এষা। কিছু বলল না। আমার কনুইয়ের নিচের দিকটা ধরে চাপ দিল একবার।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে আমার। ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার শেষ এখানেই।
তবে এর পেছনে কারো দোষ থাকলে তা আমারই। আমিই কেয়ারলেস ছিলাম। অ্যাকসিডেন্টটা আমি করেছি। বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করেছি এখন।
আমি পরাজিত।
হেরে গেছি, হেরে যাচ্ছি, হেরে যাব।
কিছুই করার নেই আমার।
শারীরিক অক্ষমতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয়নি।
বাস্তবতা মেনে নিতে শুরু করলাম।
হাতদুটো হারানোর আট মাস পর!

_ পরিশিষ্ট _
রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। পাথরের মধ্যে ভেজা ভেজা ভাব। গতকাল বৃষ্টি হয়েছিল মনে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আসার কথা আছে এদিকে। লাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালাম।
একবার ট্রেনে কাটা এক ছেলের লাশ দেখেছিলাম ইন্টারনেটে। একদম দুইভাগ করে দিয়েছিল তাকে ট্রেন। ভারতের কোথাকার ঘটনা যেন। কিছু মানুষ এসে তার মাথার দিকের অংশটা ধরে খাটিয়াতে তুলেছিল প্রথমে। তারপর আবারও গিয়ে পায়ের দিকের অংশটা তুলে এনেছিল খাটিয়াতে। দুটো টুকরো একসাথে করে পেঁচিয়ে দিয়েছিল চাদর। যাতে আলাদা হয়ে না পড়ে।
আমি কাটা পড়লে এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া কি হবে?
নিশ্চয় হাতের বাকি অংশগুলো ছিটকে কই গেল তা খুঁজে বের করার জন্য পাগল হয়ে যাবে তারা? ওরা তো আর জানবে না, ইনফেকশন থেকে বাঁচানোর জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররা আমার হাত দুটো আগেই কেটে আলাদা করে ফেলেছেন।
ওরা তো আর জানে না, আমার হাত দুটোকে আমি নিজে গিয়ে গ্রামের বাড়িতে কবর দিয়ে এসেছি। আমি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত একা একা থাকবে আমার হাত। অন্ধকার কবরের মধ্যে হাতদুটো পড়ে আছে। হাসি ঠাট্টার মধ্যে সময় পার করি আমি, বন্ধুরাও চেষ্টা করে সব সময় আমাকে হাল্কা একটা পরিবেশে রাখার জন্য। তবে বাস্তবতা এতে করে ভুলে থাকা চলে না। প্রতিদিন ওদের জন্য কি অদম্য টানই না অনুভব করি আমি! বন্ধুদের জন্য নয়, হাত দুটোর জন্য। আমার হাতদুটো একা একা পড়ে আছে।
আমার শরীরের অংশ!
ঝক ঝক শব্দ হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম।
ট্রেন আসছে।
“কেপি!” পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠটা শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম।
এষা।
মেয়েটা এখান পর্যন্ত এসে গেছে।
“কাজটা ঠিক করছিস না তুই।” গলার স্বর কঠিন নয়, তবে তুমি করেও বলছে না। কিসের সঙ্কেত বোঝার চেষ্টা করলাম।
“কোন কাজটা?” কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যাগটা পিঠের মাঝে আনার চেষ্টা করলাম।
“যাচ্ছিস কোথায়?” আরও কাছে এসেছে মেয়েটা।
“ঢাকায়। যেই ফ্যামিলি আমাকে এখনও ত্যাগ করেনি তাদের কাছে।”
“সেটা আমাকে কাল রাতে ফোনেও বলেছিস। আমি জানতে চাইছি, এখানে একা একা পড়ে থাকব আমি, এটা একবারও ভাবলি না তুই? স্টেনোগ্রাফার এখানে রেখেও কাজ করতে পারতি-”
দুইপাশে মাথা নাড়লাম আমি, “পারতাম না। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়। তোকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। ঠিকমত পড়াশোনা কর। আমি যেটা শেষ করতে পারিনি, সেটা শেষ কর। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে আয় রুয়েট থেকে।”
“আর তুই?” মেঘ জমেছে এষার কণ্ঠে।
“আমি সময়টাকে অন্য কোন কাজে লাগাতে যাচ্ছি।” হাসলাম একটু।
“স্টেনোগ্রাফারের সাথে ফ্লার্টিং?”
মুচকি হাসলাম ওর মুখে ঈর্ষার ছাপ দেখে, “আরে এই পোড়া দেশে ক’টা মেয়ে আর দ্রুত টাইপ করতে পারে? স্টেনোগ্রাফার কোন এক ছেলেই হবে। ফ্যাচ ফ্যাচ না করে হাসিমুখে বিদায় দাও। আবার কবে দেখা হবে কে জানে।”
আমাকে শক্ত আলিঙ্গনে আটকালো মেয়েটা। সঙ্কেতটা কিসের ছিল বুঝতে পারলাম তখন। বিদায় সঙ্কেত।
“যা চাও, তাই হবে।” ভাঙ্গা গলাতে বলল ও, “তুমি যা চাও তাই হবে।”
প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছে ঢাকাগামী আন্তনগর ট্রেন।
ভেতরে নতুন কোন শক্তির প্রবাহ অনুভব করতে শুরু করলাম।
লড়াকু সত্তাটার ঘুম ভাঙ্গতে শুরু করেছে মাত্র।
এষার কানে কানে বললাম, “আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই।”
— ০ —

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *