অটোগ্রাফ সমাচার
৭১০ জনের ভোট থেকে আমরা দেখবো পাঠক অটোগ্রাফ চান কি না!
দেশের প্রখ্যাত ও সক্রিয় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রায়ই টিভির সামনে কিংবা মঞ্চ থেকে বলে উঠেন, “জনগণ এদের চায় না!” প্রতিবারই আমার মুখ চুলকাতে থাকে একটা নিরীহ প্রশ্ন করার জন্য। আমি বর্ষীয়ান সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে জানতে চাই, “জনগণ কি চায় আর কি চায় না তা কি আর আপনার জানা আছে, ম্যাম? সার্ভে কি করেছেন দু-চারটে?”
তা তিনি করেননি। তাহলে হয়তো বুঝতে পারতেন জনগণ কাকে চায় না।
এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের মতো একটি কাজ আমাদের বইয়ের দোকানগুলো করে থাকেন। তারা ঘোষণা দেন, “প্রি-অর্ডার করলেই পাচ্ছেন লেখকের অটোগ্রাফ কপি!”
তাদের উদ্দেশ্য অত্যন্ত সৎ ও পাঠকহিতকর তা নিয়ে সন্দেহ নেই, তবে একটা প্রোপার সার্ভে ছাড়া উদ্দেশ্যের সাথে বাস্তবায়নের ফারাকটা তো ঠিক উল্লেখ করা যাচ্ছে না। কে জানে, হয়তো পাঠকরা অটোগ্রাফের ঘোষণাতে বিরক্তই হচ্ছেন এবং বইয়ে অটোগ্রাফ ছাড়াই তারা প্রি-অর্ডার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই অপশন দেয়া-ই হয়নি বলে হয়তো পিছিয়ে গেলেন!
কিন্তু জনগণ ‘এদের’ চায় কি না তা তো আর জনগণ মুখ ফুটে বলবে না। বাংলাদেশে লেখক-কবিদের উদ্দেশ্যে সমালোচনা করলে লেখক কিংবা কবিটি নিজেই দা-খুন্তি নিয়ে তাড়া করে গায়ের দিকে ছুটে আসেন বলে অতীত উদাহরণ আছে। জনগণ ওই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ‘ভ্যানগার্ড’ নন, তারা হেলমেট পরেও তেমন একটা অভ্যস্ত নন, কাজেই কেন এই ঝুঁকি নেবেন? এই ঝুঁকিটি নিতে হবে আমার মতো কোন এক গদাধারী লেখককেই! কাজেই নিলাম।
ভোটের আয়োজন করলাম। আপনারা একদিনের মাথায় যে সাতশ’র বেশি মানুষ ভোট দেবেন তা আশা করিনি। আমি ভেবেছিলাম আমার স্যাম্পলের আকার হবে বড়জোর ৩০০ জনের। তবে আপনাদের আন্তরিকতার জন্য প্রথমেই ধন্যবাদ দিয়ে কাজের কথায় চলে আসি।
ভোট নেয়া হয়েছে কোথায় –
(১) আমার টাইমলাইন
(২) থ্রিলার পাঠকদের আসর গ্রুপে
আরেকটি গ্রুপে দিয়েছিলাম, তারা পোস্ট ডিক্লাইন করে দিয়েছিল। নইলে আরও কিছু স্যাম্পল কালেক্ট করা যেত। যাকগে।
ফলাফলটা বলি। আমার উপসংহার দিয়ে শুরু করবো।
উপসংহার –
অটোগ্রাফসহ বই দেবার ঘোষণা করা ব্যবসার জন্য বেশ ক্ষতিকর, যদি না তা খুবই রেপুটেবল কারো হয়। খুবই রেপুটেবল বলতে আমি বোঝাচ্ছি মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন প্রমুখের কথা। আমার কিংবা আমার থেকে সিনিয়র অনেক লেখকের ক্ষেত্রেও অটোগ্রাফসহ বই বিক্রি করার ঘোষণা করলে বই বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানের লাভ থেকে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা বেশি।
কার্যকারণ বর্ণনা –
অটোগ্রাফ পছন্দ করেন কি না?
সব ধরণের “হ্যাঁ” মিলিয়ে উত্তর দিয়েছেন ৪৪২ জন।
সব ধরণের “না” মিলিয়ে উত্তর দিয়েছেন ২৬৮ জন।
একজন বাজে স্ট্যাটিস্টিশিয়ান যদি এই জরিপ করতো তবে স্রেফ দুটো অপশন রাখতো, হ্যাঁ এবং না। এতে করে তার কাছে মনে হতো অটোগ্রাফ চান এমন লোক (৪৪২) তো চান না এমন লোকের (২৬৮) অনেক বেশি। অর্থাৎ অটোগ্রাফ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বই বিক্রি করা তার অনলাইন শপের জন্য ভালো হবে।
আসলে নয়। কারণ কে কোন পরিস্থিতিতে হ্যাঁ বলেছেন তা আমি আলাদা করেছি এবং এটা বাতাস থেকে করিনি। আমার টাইমলাইনের প্রথম ১২০ ভোটের ওপর ভিত্তি করে সেটা করা। ওখানে সবাই কমেন্ট করে ভোট দিয়েছেন। হ্যাঁ যারা বলেছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই কথা হচ্ছে লেখকের অটোগ্রাফ তারা চান তবে কেবল ও কেবল যদি তারা নোটেবল কেউ হন।
চূড়ান্ত হিসাবে ৪৪২ জনের মধ্যে ৩০৮ জনই বলেছেন আকাশে পৌঁছে যাওয়া লেখক কিংবা ব্যক্তিগতভাবে তারা যাকে আকাশে রাখেন – তাদের বাদে আর কারো অটোগ্রাফ তারা আসলে চান না বইয়ের সাথে।
মাত্র ১০৬ জন মানুষ বলেছেন যে কোন লেখকের অটোগ্রাফ পেতেই তাদের ভালো লাগে, তাদের মোটামুটি পছন্দ হলেই চললো। এটার ব্যাপকতা বোঝাতে আমি ওই এক্সপ্লোডেড পাই চার্টটি করেছি। পাইয়ের যে অংশটি কেটে আলাদা করা সেটুকুই হচ্ছে আপনার ক্রেতা যারা নিঃশর্ত অটোগ্রাফ চান। যেটা মোট জনসংখ্যার তুলনায় খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।
যারা বিক্রেতা, তারা কি স্রেফ ওই অংশটুকুকে সন্তুষ্ট করতে প্রি-অর্ডারের সাথে অটোগ্রাফের অফার জুড়ে দেবেন? আমার মনে হয় না আপনারা ওই অংশকে খুশি করতে গিয়ে বিশাল অংশকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চান। কারণ, ভোটারদের মধ্যে ৩৩ জন বলেছেন তারা উলটো বিরক্ত হন অটোগ্রাফ পেলে। এরা যে কোন লেখকের অটোগ্রাফ পেলেই বিরক্ত হন, কারণ বইটা নিয়ে তাদের একটা পরিকল্পনা থাকে আর তাতে পয়লা পাতায় একটা ধোবড়া স্বাক্ষর তারা চান না।
৩৩ অত্যন্ত ছোট্ট একটি সংখ্যা, তবে ওই যে হ্যাঁ বলা ৩০৮ জনের বিশাল সংখ্যাটি – তারাও কিন্তু যে লেখকের অটোগ্রাফ চাননি তারটা অনলাইন বুকশপ অটোগ্রাফসহ পাঠালে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠোনে নেমে এক পাক নাচেন না। বরং তাদের ভ্রুজোড়া বিরক্তিতে কুঁচকে যায় কিছুটা। আমার হাতে ডেটা নেই, তবে এই জরিপ থেকে বুঝতে পারছি অনেকগুলো প্রি-অর্ডার আপনারা মিস করেছেন স্রেফ প্রি-অর্ডার করলেই অটোগ্রাফ – এমন একটা আহ্লাদিত ঘোষণা দিয়ে। আপনাদের আহ্লাদ পাঠকদের একটা বড় অংশকে খুশি করতে পারেনি।
প্রতিকার –
এবার প্রতিকারের আলাপ করা যাক। আমাদের ছোট্ট এই স্টাডি থেকে আমরা জানলাম “প্রি-অর্ডার করলেই থাকছে অটোগ্রাফ”-জাতীয় ঘোষণা ব্যাকফায়ার করবে। আপনারা মনে করবেন পাঠককে কিছু দিচ্ছেন, কিন্তু উলটো তাদের অনেকে বিরক্ত হবেন। আবার অটোগ্রাফ একটা ভালো সেলিং পয়েন্ট, আপনার কাছে ৪৪২ জনের ভোট তো আছে। যদিও আপনি এদের মধ্যে ৩০৮ জনের মতিগতি ধরতে পারছেন না, তাদের কাছে এটা প্লাস হতে পারে, মাইনাসও হতে পারে। যে লেখকের বই নিয়ে পোস্ট দিলেন তিনি যদি আপনার পেইজ লাইকারদের আকাশে না থাকেন তবে? সমাধানটি সহজ। যখনই দ্বিধা থাকবে, তখনই সেখানে ক্রেতাকে চয়েজ দিতে হবে। অ্যাডভার্টাইজিংয়ের নতুন শিক্ষা এটাই।
কাজেই প্রতিকার হচ্ছে, লেখকের সাথে যদি অটোগ্রাফের আলাপ করে ফেলেন, তাহলে যে কোন বিক্রয় পোস্টে আপনারা অটোগ্রাফটাকে গলা বাড়িয়ে না বলে ফিসফিস করে বলুন। বইয়ের পোস্টটা পুরো লিখুন, তলে ছোট্ট করে লিখে দিন, “আগ্রহী পাঠকদের জন্য অটোগ্রাফের সু-ব্যবস্থা আছে। যারা অটোগ্রাফ চান তারা কোন নামে অটোগ্রাফ হবে তা উল্লেখ করে দিন।”
এতে করে ১০০% পপুলেশনকে আপনি ধরতে পারলেন।
ঘোষণা –
বাংলাদেশের বই নিয়ে যারা ব্যবসা করেন তাদের মধ্যে পরিসংখ্যানকে গুরুত্ব দেবার প্রবণতা বাড়াতে হবে। আমি বাংলাবাজারকে যতখানি বুঝেছি, প্রকাশক ও দোকানের মালিকরা ‘অভিজ্ঞতা’র ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দেখেছেন গত ৩ বছরে অমুক কর্মটি বেশি বই বিক্রি করেছে, কাজেই তিনি পরের তিন বছর অমুক করে যাবেন। অথচ তিনি কোন ডেটা কালেক্ট করেননি সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে, তা অ্যানালাইসিস করেননি। তার প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশনের সম্ভাবনা তিনি নিজেই গলা টিপে হত্যা করেছেন। আমার এই স্টাডি খুবই সস্তা একটি স্টাডি। এটা স্রেফ আমার অবসরের খোরাক, জাস্ট-ফর-ফান। প্রফেশনালি একই স্টাডি করলে মারদাঙ্গা কাজ করা যেত, তবে আমার তো এই মুহূর্তে তার ঠেকা নেই। তবে বইয়ের প্রকাশক ও বিক্রেতাদের আছে। তাদের প্রতি আহ্বান জানাই মারদাঙ্গা স্ট্যাটিস্টিকস ব্যবহার করুন। দুই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা স্ট্যাটিস্টিকস মেজরের ছেলে-মেয়েকে চাকরিও দিতে পারেন। আখেরে বই জগতেরই লাভ হবে এতে।
Leave a Reply