লেখকদের উদ্দেশ্যে একটা ট্রিক

নতুন ও পুরাতন লেখকদের দেখেছি একটা ভুল পথে তাগ করতে। সেটা হচ্ছে বেচাবিক্রি বাড়াতে হবে – তবেই তো নেট ভ্যালু বাড়বে। এটা উলটো চিন্তা আসলে। এভাবে কাজ করে না জিনিসটা শো বিজে, কিংবা বুক ইন্ডাস্ট্রিতেও।
লেখকের নেট ভ্যালু বাড়াতে হবে তার মার্কেট প্রাইসের থেকে বেশি। মানে এই মুহূর্তে একজন লেখকের বাজারে থাকা সব বই বিক্রি করে ফেললে যদি সেটার অর্থমূল্য তিন কোটি টাকা হয়, তাহলে লেখকের কাজ হচ্ছে নিজের গুডউইল আট-নয় কোটি টাকায় তোলা।
সহজ ভাষায়, আপনার ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের চেয়ে ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের ভ্যালু বেশি রাখতে হবে সব সময়। আরও সহজ একটা উদাহরণ দেই, ইলন মাস্কের টেসলার প্রতিটা নাটবল্টু খুলে বিক্রি করে দিলে যত টাকা পাওয়া যাবে, লায়াবিলিটি অ্যাসেট হিসাব করে যত টাকার ওর্থ ওর কোম্পানির, বর্তমানে তার কোম্পানির দাম অনেক বেশি। এইটা কী করে হলো? সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, অনেক মানুষ বিশ্বাস করে ইলন যা করবে তার একটা ভ্যালু আছে। কাজেই ফাটাফাটি সায়েন্স নিয়ে আসা দুই যুবক যদি ওর থেকে ভালো ইভি মানে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বানায়, তাও ওকে কেউ টাকা দেবে না। ইলন যতই ভুল করুক, ওকে টাকা দেবে। ওর শেয়ার কিনবে লোকে। এটাকে বলা হয় ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট। সুনাম বা দুর্নাম। গুডউইল।
ম্যাটেরিয়াল ওয়ার্ল্ডে এটা কেমন গুরুত্বপূর্ণ আমি জানি না, তবে অ্যাবস্ট্রাক্ট জায়গায় এটাই সব। অ্যাবস্ট্রাক্ট মানে সাবজেক্টিভ জিনিসে – আর্ট, লিটারেচার, ভিজুয়াল কন্টেন্ট ইত্যাদিতে। এই জগতে আপনি যতই চেষ্টা করেন ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের দাম কখনো ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের ওপরে তুলতে পারবেন না। যার ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট দশ কোটি টাকার, তার বাস্তব অ্যাসেট আনা সম্ভব দশ কোটি টাকার। উলটাটা অকার্যকর – মানে বই বিক্রি করে নিজের দাম আপনি বাড়াতে পারবেন না।
এজন্য পিআর এত ইম্পর্ট্যান্ট এই জগতে। গুড পিআর ছাড়া কাউকে আপনি চেনেন না। এমনকি নিভৃতচারী লেখক বলে যাদের চেনেন তাদের মার্কেটিং টুল হলো ওই “নিভৃতচারী” শব্দটা। এটা কোন নির্দোষ শব্দ নয়।
কাজেই লেখকভ্রাতা ও ভগিনীরা, কেপি-প্রণীত নিম্নলিখিত অভিজ্ঞতা পাঠ ও বিবেচনা করলে আপনাদের উপকার বই ক্ষতি নাই মনে হয়।
(১) নিজেকে ব্যাখ্যা করা বন্ধ করুন। খুবই বাজে কাজ পিআরের জন্য। আপনার কর্মকান্ড নিয়ে যদি লোকে দশ রকম ব্যাখ্যা দেয়, দিক। লেখক, গায়ক, চিত্রকর, নায়ক – ইত্যাদি হবার পার্ট অফ দ্য গেম হচ্ছে আপনি হবেন ওয়াইডলি মিসআন্ডারস্টুড। সবার আগে এইটার সাথে নিজের পিস করতে হবে। বাপে ভুল বুঝবে, বন্ধু ভুল বুঝবে, বউয়ে ভুল বুঝবে। কারো ভুল ভাঙাতে যাবেন না। চ্যারিটি যেমন হোমে বিগিন হয়, তেমন পাবলিকের কাছে যাওয়ার আগে ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলির মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং প্রত্যক্ষ ও হজম করার অভ্যাস করতে হবে। তখন পাবলিক কী ভুল বুঝলো তা গায়ে লাগবে না। এটা বলার কারণ হচ্ছে প্রায়ই দেখি লেখকরা নিজের কর্মকাণ্ড জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছে। করবেন না।
(২) সস্তা আবেগ মারানো বন্ধ করুন। এটা ফেসবুকের থেকেও দ্রুত ফেলতে পারে আপনার ইনট্যাঞ্জিবল ভ্যালু। ধরেন অমুক বন্ধু আপনার গাঁড় মেরেছে। আপনি এসে এমন একটা হাহাকার করলেন যেন গাঁড় মারা যে হয় তাই জানতেন না। এটা আপনাকে মাস অডিয়েন্সের চোখে ভালো কোন অবস্থান এনে দেবে না। এটা বাংলাদেশে প্রচুর হয়। প্রতিদিনই হোমপেজে দেখি কোন না কোন লেখক ভেগলি আরেক লেখক বা প্রকাশক নিয়ে বলছেন, “কিছু কিছু মানুষ অমুক করে থাকেন।” – এতে করে ওই লেখক বা প্রকাশকের মান পড়ে না, আপনার মান পড়ে। কিছু বলার থাকলে সরাসরি বলুন, নয়তো পেটের মধ্যে রেখে দিন।
(৩) নিজের কিছু ট্রেইট ও আদর্শ ঠিক রাখুন। কোন স্পেসিফিক ট্রেইট না থাকাও ট্রেইট। এই ব্র্যান্ডিং লোকের আছে। তাতে তাদের ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট বেড়েছে। এই ট্রেইটকে বলা হয় “আনপ্রেডিক্টেবল ট্রেইট” – আমাদের দেশে ও বাইরে কিছু লোক এই ট্রেইটের কারণে বিখ্যাত হয়েছে। ঠিক নিভৃতচারীর মতোই। কিন্তু থাকতে হবে আপনার কিছু চরিত্র। জেলিফিশ হবেন না। জেলিফিশ মানে হচ্ছে আপনার নিজের কোন সে নাই – পপুলার অপিনিয়নে সব সময় মাথা দোলান বা কিছুই বলেন না।
(৪) কিছু গুজব বাতাসে ভাসতে দিন। আপনার নামে জলজ্যান্ত মিথ্যা পাবলিকলি ছড়িয়ে পড়েছে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে ওটাকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করবেন না। ৩ দ্রষ্টব্য। আপনি যদি নিজের একটা সলিড প্রোফাইল বানাতে পারেন তাহলে লং রানে এইসব ব্যাপার হবে না।
(৫) যা করেননি তার জন্য কখনো নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না। কেউ একজন এসে যদি বলে “এই আমার পেটে তো আপনার বাচ্চা” – আপনি যদি জানেন এইটা হাইলি আনলাইকলি, তাকে বলতে দেন। আদালত পর্যন্ত যা গড়াচ্ছে না তা নিয়ে কোন ফাইট করার দরকারই নাই। বরং দৃশ্যের পেছনে আপনি আপনার সৈনিক ডিপ্লয় করে দেন যাতে গুজবটাকে নিজের কাজে লাগানো যায়। আমি এইটা অনেকবার করেছি। ভুয়া আলাপ কেউ করলে আমি এটাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা না করে তলে তলে ওটাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের নামে কয়েকটা মিথ ও লিজেন্ড তৈরি করে দেই। এটা বোধহয় সান জুর বইয়ের একটা কৌশলও। যদি পরিস্থিতিকে নিজের কাজে লাগাবার মতো কিছু না থাকে, তাহলেও বইতে দেন বাতাস। মিথ্যা অপবাদের থেকে ভালো গুডউইল আর কিছু আনতে পারে না, কারণ আপনি এটা সময়মতো সলিড খণ্ডাতে পারবেন আর ভিক্টিম হিসেবে প্রচুর সমর্থন ও সুনাম কুড়াবেন। খণ্ডানোর সময় বি লাইক আ বস, একটা পোস্ট দেন ক্যাজুয়ালি। যেন এসব আপনি অতিকায় হস্তী আর এসব সামান্য বিষয়ে বিচলিত নন।
(৬) আপনার সামর্থ্য সম্পর্কে মানুষ যেন জানে, বই পড়ুক আর না পড়ুক। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ। আমার সবচেয়ে বড় অ্যাসেট কয়টা বই বিক্রি হলো আর কয়জন পাঠক আছে তার থেকে বেশি হচ্ছে এর দশ থেকে বিশগুণ মানুষ চায়ের আড্ডা থেকে ফেসবুক কমেন্টে বলে থাকেন, “এখনো উনার বই পড়ি নাই তবে শুনেছি বেশ ভালো লিখেন।”
(৭) এটা আমি সরাসরি পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ানের লাইন থেকে মেরে দিবো –
কমোডোর নরিংটন জ্যাক স্প্যারোকে প্রথম যখন ধরে, তখন বলে, “সন্দেহ নাই, যত পাইরেটের নাম শুনি, সবচেয়ে বোকচোদ পাইরেট তুমি, মিয়া।”
জ্যাক স্প্যারো মানে জনি ডেপ তখন একটা সরল হাসি হেসে বলে, “কিন্তু আমার নাম তুমি শুনেছো ঠিকই।”
আপনাকে লোকে সঠিকভাবে চিনুক বা ভুলভাবে চিনুক, চিনে – এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। কাজ করতে থাকলে যারা ভুলভাবে বা নেগেটিভভাবে চেনে তারা আগামিকাল পজেটিভভাবে চিনবে। আমার সাথে এটা অসংখ্যবার হয়েছে। ইনবক্সে লোকে জানিয়েছেন ৩টি বছর আগে আমাকে যুগপৎ ঘৃণা করতে করতে চিনেছেন। তারপর এখন আমাকে কিছুটা বোঝেন এবং পছন্দ করেন। এখানে ট্রিকটা হচ্ছে নিজেকে বাইরের জগতে ছুঁড়ে ফেলুন। আপনার ভেতর মাল থাকলে লোকে সময়মতো দাম দেবে। না থাকলে তো নাই-ই।
(৮) নিজের নাম কলুষিত করতে ভয় পাবেন না কখনো। সেটাও আসলে ওই নিভৃতচারী প্যারাডক্সের মতো একটা প্যারাডক্স। মনে রাখতে হবে যেই পেন্সিল কোন কাজ করে নাই ওটাই চকচক করে। কাজ করতে গেলে আপনি ভচকায়ে যাবেন, দেখতে সুন্দর লাগবে না আপনারে, আপনার নামে নানা বাজে কথা বলা হবে – সেটাই স্বাভাবিক।
(৯) স্ট্যান্ড ফর সামথিং। সামথিং বিগার দ্যান ইউ। যে কিছুর জন্য স্ট্যান্ড করেছে তার বন্ধু কী বললো, প্রকাশক কী বললো, সহলেখকরা কী বললো – এসব তুচ্ছ আর ফালতু জিনিস নিয়ে পক পক করার সময় নাই। আবার লোক দেখানো স্ট্যান্ড নিয়েন না। লোক দেখানো স্ট্যান্ড আপনার ইন্ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট এমনভাবে ধ্বংস করবে যেভাবে ধ্বংস হয়নি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিও! আপনি কিছু নিয়ে স্ট্যান্ড করলে তা নিয়ে লিখে আর ভিডিয়ো বানিয়েই কূল পাবেন না, চোগলখোরি করবেন কখন? চোগলখোর মানুষ দেখলে জনগণ বুঝে যায় এই লোকটা শ্যালো। এর কাছে কে কাকে সালাম দিলো তাই ইম্পর্ট্যান্ট। খুবই বাজে রেপুটেশনের জন্য।
(১০) ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট প্রমোট করতে শিখুন। আমার একটা স্কিল হচ্ছে জিনিস প্রমোট করতে জানা। একটা উদাহরণ দেই। অনার সোসাইটি ফাই কাপ্পা ফাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ টেন পার্সেন্টকে দাওয়াত দেয়া হয়। আমি এখানে আসার পর থেকে দেখেছি বড় ভাই, আপুরা সেটার দাওয়াত পেয়েছেন। ফেসবুকে, লিংকডইনে লিখেছেন “আমাকে ফাই কাপ্পা ফাই ওদের সোসাইটিতে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে!” আমি এ বছর ওদের থেকে আমন্ত্রণ পাওয়ার পর লিংকডইনে লিখেছি, “আমার হিরো জন গ্রিশাম আর স্টিভেন স্পিলবার্গ যে সোসাইটির সদস্য, তা থেকে দাওয়াত পেয়ে নিদারুণ গর্বিত! সংশয় ছাড়াই ফাই কাপ্পা ফাইয়ের দাওয়াত কবুল করলাম।” আপনার অ্যাচিভমেন্ট আপনি কীভাবে প্রেজেন্ট করেন তা ইম্পর্ট্যান্ট। একই অভিজ্ঞতা থেকে আমি এপিক লিখে ফেলতে পারি, অন্যরা মনে করেন এটা তো একটা স্বাভাবিক ঘটনা – এটাই তো আর্ট।
এত আলাপের মূল কারণ হচ্ছে, দয়া করে নিজেদের গুডউইলের বারোটা বাজানো একে অন্যকে চুলকানো পোস্ট দিয়ে নিজের ক্ষতি করবেন না। ফর্ম আর ক্লাস দুটোই পার্মানেন্ট। ফেসবুকে গালাগালি করেও ক্লাসি একটা পার্সোনা বানানো যায়, আবার সব সময় ভদ্র আলাপ করেও ওইসব চুলকা-চুলকির কারণে থার্ড ক্লাস পার্সোনা হয়ে যায় কারো কারো। এসব আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও এর একটা ফিনান্সিয়াল ক্ষতিও আছে লং রানে। ছ্যাচরামি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
বিষয়টা মনে করিয়ে দেয়া ফেলো রাইটার হিসেবে জানানো দরকার ছিলো, তাই জানালাম।
Leave a Reply