আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৬ – এই পথ যদি না শেষ হয়
এমন একটি গান ছিল বটে, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?
কিছু পথ এমন আছে বটে। যেমন কিছু রোড ট্রিপে বের হলে আপনার মনে হবে এই পথ আর শেষ না হোক। চলতে থাকুক। ভালোই তো লাগছে। (যতক্ষণ না আপনাকে ড্রাইভ করতে হচ্ছে)। তবে সব পথ এমন নয় মোটেও। যেমন হায়ার স্টাডির অ্যাপ্লিকেশন এবং তার আনুষঙ্গিক আর যতোসব বিপদের কাজ।
তবে সবকিছুর শুরু থাকলেই, শেষও থাকবে। এরও আছে। আমরা এই পুরো জার্নিটিকে দেখবো একটা বাস্তব জীবনের ভ্রমণের মতোই। এমন হয়েছে না, যে আপনার অনেক সখের এক ট্যুরে গিয়ে দেখলেন অতি প্রয়োজনীয় অথচ খুবই পরিচিত কিছু জিনিস সঙ্গে আনতে ভুলে গেছেন। যেমন ধরুন – টুথব্রাশ। কারণ এটা এতই “অবভিয়াস” ছিল যে আপনি ভাবেন-ই নি একে প্যাক করার কথা। এটা হওয়া খুব-ই স্বাভাবিক। সচরাচর আমরা যে সব জিনিস ভুল করে নিয়ে যাই না, কিংবা হারিয়ে আসি, তারা হয়ে থাকে এমন-ই কিছু জিনিস। ঠিক একই ঘটনা আপনার সাথে ঘটতে পারে হায়ার স্টাডির যাত্রাতেও। এজন্যই এ নিয়ে আলাদা করে আলাপ করে রাখা হলে তা পরে আপনাকে হেল্প করতে পারবে। শেষ না হওয়ার মতো দীর্ঘ পথটিকেও হয়তো প্রায় বাঁধাবিঘ্ন ছাড়াই পার করে দিতে পারবেন।
এ তো “অবভিয়াস”
প্রথমেই আমরা আলোচনা করে নেবো অবভিয়াস সব জিনিসের ব্যাপারে। দেখে নিন এরা সবাই ঠিক আছে কি না।
১। পাসপোর্ট ও তার মেয়াদ : আপনার পাসপোর্ট কি ইস্যুড? তার মেয়াদ আছে তো, অন্তত ছয় মাস? দেখে নিন।
২। তারপর আছে আপনার একেবারেই “এও কী বলা লাগে?” ধরণের ডকুমেণ্টস – যেমন আপনার এসএসসির সার্টিফিকেটস, এইচএসসির সার্টিফিকেট, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডকুমেন্টস, বার্থ সার্টিফিকেট, ইত্যাদি। কখন কোনটা দরকার হবে কেউ বলতে পারবে না। এটা মেনশন করার কারণ হচ্ছে, আমার বাবা-মায়ের নাম তাদের এনআইডিতে যা আছে তা থেকে আমার সার্টিফিকেটসে একটু আলাদা ছিল। এসব ঠিক করতে আমার প্রায় ৬ মাস গেছে।
৩। আরও কিছু অবভিয়াস আছে। যেগুলো এতো সহজে মানুষ ভুলে যেতে পারে যে আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। মনে পড়া মাত্র এদের এখানে যোগ করে দেয়া হবে। (যখন ফাইনাল প্রোডাক্ট যোগ করতে পারবো ওয়েবসাইটে)
এবার অবভিয়াসদের মধ্যে আলোচনা করার চেষ্টা করবো আরেকটা জিনিস নিয়ে। অনেক সিনিয়র, বুড়ো লোকজনই এই অংশটি এড়িয়ে যেতে পারেন, কারণ তাদের কাছে এটা এটি অবভিয়াস যে মেনশন করার দরকার অনুভব করবেন না, তাই আমি একি ভুল করার আগেই গোড়া থেকে শুরু করার চেষ্টা করবো।
অ্যাপ্লিকেশন প্রসেস
১। অ্যাপ্লিকেশন করার সময় সবাই আপনাদের বলতে পারে যেন প্রফেসরদের ইমেইল করতে থাকেন, অথচ সেটি অফিশিয়াল অ্যাপ্লিকেশনের ধাপ হিসেবে প্রথম নয়। প্রথম ধাপটি হচ্ছে আপনাকে একটি পৃষ্ঠায় যেতে হবে (application page), যার মাধ্যমে আপনি নিজেকে নিবন্ধিত করতে পারবেন তাদের ওয়েবসাইটে, একজন নতুন অ্যাপ্লাই করা জনতা হিসেবে। এমন একটি স্ক্রিনশট আমি এই পোস্টের সাথে দিয়ে দিবো, যদি না হতচ্ছাড়া লোকেরা আমার ওয়েবসাইটটিকে বাকিদের জন্য বিপদজনক বানিয়ে না রাখতো, আমি এখানেই ওটা দিতাম। তবে মূল আলোচনা অনেকেই শুরু করেন কীভাবে আপনি আপনার পছন্দের ইউনিভার্সিটি পাবেন তার ওপর ভিত্তি করে। আমি তা করতে চাই না। বরং আমি বলবো যা যা অত্যন্ত অবভিয়াস আর সেজন্য বাকিরা সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন।
২। আমার মতো অনেক নতুন অ্যাপ্লিক্যান্টই জানেন না যে, আপনাকে প্রফেসর ইমেইল করার থেকেও ঝামেলার কাজ করতে হবে। আর তা হলো তাদের অ্যাপ্লিকেশন পোর্টালের সাথে নিজেকে আপডেট করা। এটা বরং আপনার জন্য বেশি দরকারি। কারণ আপনি কোনও এক ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লিকেশন পোর্টালে না থাকলে বা সময়মত সবকিছু জমা দিতে না পারলে আপনার জন্য কেউ কিছু করতে পারবে না। এবং এই কাজটি ঝামেলার কারণ এই কাজটি বেশ দীর্ঘ কিছু ফর্ম পার করে আসার। অনেকগুলো তথ্য আপনাকে দিতে হবে। যদি একাধিক ইউনিভারসিটিতে অ্যাপ্লাই করেন (যা আপনাদের প্রায় সবাই করবেন) তখন এটা লিটারেলি একটি “পেইন ইন দ্য অ্যাস” হবে।
৩। এই ধরণের আলোচনা আমরা আগেও করেছি, তবে এটা জরুরি বলেই বার বার বলতে হচ্ছে। অ্যাপিকেশন প্রসেস আসলে নিচের কিছু ধাপের মতো। ধরে নিচ্ছি, এমন কারো সাথে আমার আলাপ হচ্ছে যার ন্যুনতম আইডিয়াও নেই কীভাবে কী করতে হবে।
সংক্ষেপে ধাপসমূহ
১) বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকা (অ্যাডমিশন পাওয়া)
২) টাকাপয়সার ব্যাপারটা সর্ট করা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে নেবার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। তবে আমেরিকায় পড়াশোনার খরচ অতি-উচ্চ। যে কারণে আমেরিকান নাগরিকরাও এই পথে পা বাড়াবার সাহস করতে চায় না। সেই টাকা-পয়সার বিষয়টা সর্ট-আউট করার জন্যই আপনার দরকার প্রফেসর কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড। প্রায় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ই ফুল-ফ্রি স্কলারশিপ দিয়ে থাকে, তবে তা অতিমাত্রায় কম্পিটিটিভ। দারুণ প্রোফাইল থাকার পর তা না পেতে পারেন। তবে যদি আপনার ফ্যান্টাস্টিক প্রোফাইল থাকে, তবে চেষ্টা করতে পারেন। পেলে তো খুব-ই ভালো, আপনাকে অনেক আলবাল নিয়ে ভাবতে হবে না, একাডেমিকভাবে দারুণ কিছু করবেন তা গ্যারান্টিড; আর না পেলে, তা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। ফান্ডিংয়ের ব্যাপারটা অনেক দিক থেকেই আসতে পারে। যেমন তা আপনাকে পাইয়ে দিতে পারে স্কলারশিপ, তেমন-ই তা আসতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ড থেকে – যেটি তারা সেন্ট্রাল অ্যাডমিশনের সাথেই আপনাকে অফার করবে। আর তাছাড়া থাকতে পারে প্রফেসরদের গ্র্যান্ট, তারা নানা দিক থেকে নানা কাজ বাগিয়ে রাখেন সচরাচর এবং আপনি যদি তাদের হয়ে তাদের রিসার্চে সহযোগিতা করেন, তবে সম্ভাবনা আছে আপনাকে ওরা তা থেকে কিছুটা দেবে, যা আমাদের মতো ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট থেকে আসা ‘কিড’দের জন্য যথেষ্ট, বা যথেষ্ট না হলেও সার্ভাইভ করার মতো। এবং একারণেই একটি পপুলার মিথ হচ্ছে “প্রফেসরদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এবং এটি-ই একমাত্র পথ” – আসলে এটি পথদের মধ্যে একটি, তবে সবচেয়ে সহজে (যদি আদতে তা অতোটা সহজ নয়, প্রয়োজন পড়বে এক্সটেনসিভ রিসার্চের, এই রিসার্চ প্রফেসরদের তালিকা বানাবার এবং তাদের পটাবার) পাওয়ার মতো কিছু।
৩) আপনার “পাছাটা” – যেমনরা আমেরিকানরা বলে থাকে – বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া; কোভিডের সময় যা খুব ‘ইজি বিজনেস’ নয়।
ধাপসমূহ – আরেকটু বিস্তারিতভাবে বললে –
(১) পাসপোর্টের জন্য অ্যাপ্লাই করা
(২) GRE এবং TOEFL দেয়া
(৩) ইউনিভার্সিটি নিয়ে নিজস্ব রিসার্চ করা – এক্ষেত্রে আপনাকে সহায়তা করতে পারে ফেসবুকের কিছু গ্রুপ, সিনিয়র ভাই-ব্রাদার, ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট
(৪) প্রফেসরদের ইমেইল করা, যেন কেউ একজন আপনাকে তাদের ল্যাব/রিসার্চের জন্য মনোনয়ন করতে পারেন আর তাদের দেয়া ফান্ডিং দিয়ে আপনারা আপনাদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে পারেন।
(৫) ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে ঢোকা এবং – University web > Apply > Graduate Study
(৬) অ্যাডমিশন কমিটি আপনার অ্যাপ্লিকেশন পড়ে দেখবে, বাকি অ্যাপ্লিক্যান্টদেরও, তারপর তারা সিদ্ধান্ত জানাবে (অথবা জানাবে না, অনেকসময় তারা চুপ করে বসে থাকে আপনাকে বাদ দিয়ে, কাজেই যদি ৬ সপ্তাহের মধ্যে কোনও রেসপন্স না পেয়ে থাকেন, ধরে নিতে পারেন আপনাকে তারা নিচ্ছে না); এমনটা ঘটবে অ্যাপ্লিকেশন ডেডলাইন শেষ হয়ে যাওয়ার পর কিছু সপ্তাহ পরে। সচরাচর ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে তারা একটি ফলাফল জানিয়ে থাকেন।
(৭) অ্যাডমিশন লেটার – যদি আপনাকে তারা তাদের ভার্সিটিতে নেবার উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে আপনার ইমেইলে আসবে একটি অ্যাডমিশন লেটার।
(৮) ভিসা প্রসেসিং –
ভুলে ভাববেন না এবার আপনার যাত্রা শেষ। অ্যাডমিশন লেটার নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করতে পারেন, তবে তা দু’মিনিটের বেশি হলে সমস্যা। সামনে এখনো বহু রাস্তা পড়ে আছে; বিশেষ করে আপনি যদি কোভিড সময়ের একজন যাত্রী হয়ে থাকেন!
এরপরের ধাপগুলো নিম্নরূপ –
✍ ৮ (ক) I-20 request করা; I-20 কী জিনিস তা নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারটি আলাপ করা হবে, তবে এটা আপনার পাসপোর্ট থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ – আপাতত এটাই মনে রাখতে পারেন
✍ ৮ (খ) ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া
✍ ৮ (গ) ভিসা অফিসারকে পটানো
✍ ৮ (ঘ) ভিসা পেয়ে গেলে প্লেনের টিকেট করা
✍ ৮ (ঙ) উদ্বাহু নৃত্য করা – এবার আপনি এলিজিবল; তবে একটি ঝামেলা সেখানেও আসতে পারে, কোভিডের কারণে যে কোনও সময় আপনার এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের সকল ফ্লাইট বাতিল করে দিতে পারে। আমার ক্ষেত্রে তা হয়েছিলো। পরবর্তীতে আরেকটি এয়ারলাইন্সে টিকেট কেটে আসতে হয়েছে। আপনাদের ভয় দেখাবার জন্য বলছি না, তবে এটাই বাস্তবতা, যে কারণে অনেক মানুষকে আমি এমনকি জানাতে পারিনি যে এ বছর আমি হায়ার স্টাডির জন্য দেশ ছাড়ছি।
নির্দেশনা –
পথটা সম্পুর্ণ জানুন। ওপরে যা বললাম তা মোটামুটি এই অংশটাকে কাভার করে, তবে অবশ্যই বিস্তারিতভাবে নয়। আগামী অধ্যায়গুলোতে বিস্তারটি লেখা হবে। এখানে যে তালিকাটি দেয়া হয়েছে তা ভালোমতো বোঝার চেষ্টা করুন, এটি একটি পাথওয়ে।
পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৭ – উচ্চশিক্ষা কাদের দরকার
Leave a Reply