যীশুর মেয়ে
মসীহ ঈশার মতোই আমার নীতি হচ্ছে, আমি সব মানুষের সাথে চলি। টেক্সাসে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং দুই বান্ধবীর পার্সপেক্টিভ জানার সুযোগ এভাবেই হলো।
বান্ধবীর আলাপ আসছে, কারণ প্রেগন্যান্সি নিয়ে যে নাটক আমেরিকায় হয়েছে তা অনেকেই জেনে থাকবেন। বন্ধুর থেকে বান্ধবীর মতামত প্রকাশ বেশি জরুরী। ইউএসএ-তে মিড টার্ম ইলেকশন হলো। বিশেষ করে বেশিরভাগ মেয়ে দম আটকে দেখছিল এই ভোটে জনগণের মতামত কোনদিকে যায়।
প্রথম বান্ধবী হচ্ছে যীশুর মেয়ে। ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। আমাকে টেনে-হিঁচরে একদিন চার্চে নিয়ে গেল। এতগুলো ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানের মধ্যে জমপেশ একটা নাটক হয়ে গেল তারপর। গসপেল পাঠ করছিল যে ছেলেটা – তরুণদের ধর্মগুরু, তার পাশেই বসার জায়গা হলো আমার। সব রিচুয়াল শেষে সে আমাকে বললো, “কেমন বোধ করছো? তোমাকে বেশ চুপচাপ মনে হচ্ছে।”
আমি ওকে বললাম, “ইয়ে, আমার দুটো দোষ আছে।”
পুরো ঘরের স্পটলাইট দেখলাম আমার ওপর। সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
ব্লন্ড যে মেয়েটা বাইবেল পাঠ শেষ হওয়া মাত্র গিটারটা নিয়ে টুংটাং যীশুর বন্দনা শুরু করেছিল, তার গিটারও বন্ধ হয়ে গেল।
ধর্মগুরু শুধালেন, “আহা। কী সেটা?”
আমি বললাম, “আমার মুখের গর্তটা ফাঁকা হলে অনেকসময় সেটাকে মানুষ ভালোভাবে নেয় না।”
ধর্মগুরুর সাথে ঘরের সবাই হা হা করে উঠলো। বললো, “কোন চিন্তা নেই। এইখানে তুমি যা ইচ্ছে তাই বলতে পারো। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। সব মতামতই স্বাগত।”
আমি বিনয়ের সাথে তাদের ধন্যবাদ জানালাম।
ওদিকে বান্ধবী আমার ইন্ট্রোডাকশন করিয়ে দিয়েছে, “বাংলাদেশি” এবং “এই প্রথম চার্চে ঠ্যাং রেখেছে” হিসেবে। ঘরের পরিবেশ অত্যন্ত অনুকূল। সবার মাথায় কী চলছে তা আমার কাছে সুস্পষ্ট। যীশুর লুঙির তলে আমি ঢুকে পড়বো আজ অথবা কাল – এটাই তাদের চোখেমুখে পরিষ্কার।
ধর্মগুরু জানতে চাইলেন, “তা তুমি নিশ্চয় আমাদের ধর্মে বিশ্বাস করো না?”
আমি বললাম, “আজ্ঞে না। আমি অ্যাগনস্টিক।”
ধর্মগুরু এবার সুঁইয়ের মতো মিহি গলায় প্রশ্ন রাখলেন, “তা যীশুকে তোমার কেমন লাগে?”
আমি আরও বিনয়ের সাথে বললাম, “আমার দ্বিতীয় দোষটি আগে শুনুন, স্যার।”
ধর্মগুরুর সাথে ঘরের সবাই আবারও স্পটলাইট আমার দিকে ফেললো। কোনও লোক তার দোষ স্বীকার করছে এটার চেয়ে বিনোদন আর কিছু হতে পারে না চার্চে।
ধর্মগুরুর অশেষ ধৈর্য। তিনি জানতে চাইলেন, “বলে ফেল বাছা। বলে ফেল।”
আমি বিনয়ে নুয়ে পড়তে পড়তে বললাম, “জীবন-মরণ সমস্যা না থাকলে, কিংবা দেশের স্বার্থে না হলে আমি কখনো মিথ্যা বলি না।”
সবাই বা-বা করে উঠলো। ধর্মগুরু বললো, “একে দোষ বলছো কেন? এ তো ভালো জিনিস।”
আমি যথাসম্ভব নরম গলায় বলে ফেললাম, “এরকম একটা সেটিংয়ে যীশুকে আমার কেমন লাগে প্রশ্ন করা হলে এই ভালো জিনিসটা দোষ বৈকি।”
অনেকে একটু অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসলো। ওই ব্লন্ড যে আমাকে তার গিটার বাজিয়ে জীবনেও শোনাবে না তা আমি লিখে দিতে পারতাম তখন।
ওইখানে পরের ত্রিশটা মিনিট খুব মিনিংফুল আলাপ হলো আমার। থিওলজি, সাইকোলজি নিয়ে তুমুল আলোচনা। চার্চ থেকে বেরুবার সময় আমার খেয়াল হলো, এই কথা কোন বাংলাদেশের মসজিদে বললে মাথা আর জায়গামতো থাকতো না।*
তো এই হচ্ছে আমার ধার্মিক বান্ধবীর সার্কেল। এরকম আরও অসংখ্য সার্কেলে আমি ওর সাথে গেছি। ধর্মপ্রাণ মুসল্লি দিয়ে ভর্তি। এবং তাদের মাঝে গিয়ে বসে তাদের মেকানিজম আর সাইকোলজি বোঝাই আমার লক্ষ্য। টেক্সাসের এমন এমন ধার্মিক কমিউনিটির সাথে আমার ওর থ্রুতে পরিচয় হয়েছে যারা আমার মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে। ঈশ্বরের নাম নিতে নিতে মুখে ফেনা তুলে ফেলা জনতা আরকি। কী যে ভয়ানক ভয়ানক কুসংস্কার বিশ্বাস করে বললে ভাববেন গুল মারছি। অথচ এখানে যা বলেছি তা অক্ষরে অক্ষরে ঘটেছে। বাঙালির খ্রিস্টান ভার্সন – সোজা বাংলায়। যীশুর সন্তানেরা।
তো টেক্সাসে নির্বাচনে জিতেছে গ্রেগ অ্যাবট। লোকটা এমনই এক বদমাশ যে মেয়েদের মানুষ মনে করে না। অ্যাবরশন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সে এমন সব কথাবার্তা বলে থাকে যা শুনলেই বোঝা যাবে মেয়েরা তার কাছে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন। একেবারে খাটি ওয়াজি। সে আবার টেক্সাসের গভর্নর। এখানে তো ধর্মান্ধ লোকে ভর্তি, কাজেই উপযুক্ত লোকের হাতেই উঠেছে ঝাণ্ডা।
অ্যাবটের খুঁটিনাটি জানার ভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল ইলেকশনের রাতে। যে দুই বান্ধবী আজকের আলোচনায় মুখ্য তাদের দ্বিতীয়জন রাত তিনটায় আমাকে বেহুদা মেসেজ দিচ্ছিল। মেসেজের হালচাল দেখে বুঝলাম, ক্ষেপে আছে। ক্ষেপে আছে বললে কম হবে, আসলে বোমা হয়ে আছে। নির্বাচন নিয়ে চিন্তায় মারা যাচ্ছে। আবার ওদিকে তখন ভোট গোণা হচ্ছে। সবার গলার কাছে উঠে আছে হৃৎপিণ্ড। টেক্সটে কুলাচ্ছিল না, ও আমাকে ফোন দিলো। ধরামাত্র বুঝলাম অন্তত আটটা মদ পেটে চালান করে দিয়েছে। পুরা চোদ।
ফোন ধরা মাত্র ও একটা হুঙ্কার দিলো, “খানকির পোলা কী বলসে তোমারে বলি –”
যীশুর মেয়ের একদম একশ’ আশি ডিগ্রি দূরে ওর প্রোফাইল। ধর্ম গোণার সময় তার নাই, মদে আপত্তি নাই (ও-ই তো আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে খাঁটি স্যান মার্কোসের সন্তানেরা ডাউনটাউন হিট করে, এবং সেই রাতে আমাকে হামাগুড়ি দিয়ে বাসায় ফেরা লেগেছে), কনজারভেটিভ দেখতে পারে না, আদর্শ লিবারেল। পরের পঞ্চাশটা মিনিট অ্যাবট কেমন হারামজাদা তার ফিরিস্তি আমাকে বর্ণনা করলো ও। খুঁটিনাটি বোঝালো টেক্সাসের ভোটের। বর্ন অ্যান্ড রেইজড ইন টেক্সাস। সে ভোট দিতেই গেছে ওরা যেন অ্যাবরশন নিয়ে অত্যাচারী আইন বন্ধ করা যায় এবং মেয়েদের স্বাধীন করা যায় তাই।
টেক্সাসে যারা আছে সবাই ওই রাতে উৎকণ্ঠা নিয়ে জেগে ছিল। আমার মাথায় ইলেকশনের ব্যাপারটা থাকলেও তারিখটা ছিল না অবশ্য, তারিখ তো মনে থাকে না। তবে ওই রাতে আমরা বসে বসে ভোট গুণলাম। বান্ধবী একটার পর একটা বোতল খুলে গেল ওদিকে। অথচ পরে খারাপ মানুষটাই জিতে গেল। মদারুদের দোয়া কী আর কবুল হবে? কবুল হয়েছে খ্রিস্টানদের দোয়া। ৫১% এর ওপরে উঠে যাওয়ার পর আমরা আর নিতে পারলাম না। পরিষ্কার বুঝলাম ফোনের ওপাশে মেয়েটা আরেকটা বিয়ারের ক্যান খুলে ফেলেছে। খুব স্বাভাবিক। মানুষের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে তাদের সবার মন মেজাজ বিলা হয়ে গেছিল সে রাতে।
পরদিন যীশুর মেয়ের সাথে সন্ধ্যার দিকে দেখা হয়েছে। আমি নির্বাচনের কথা আর তুললামই না। ছুরি মোচড়াবার দরকার নেই ভাবলাম। একই সাথে যীশুর যে কোন সন্তানই নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হতে পারে এবং হবে – এই আশঙ্কা ছিল। বাংলাদেশে তো তাই। প্র্যাক্টিসিং মুসলমান মানেই নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী না। কারণ ধর্মেই বলা আছে পর্দা করতে হবে, স্বামীকে অমুক স্থান দিতে হবে, পিতার সম্পদের ভাগে ভাইয়ের অর্ধেক নিতে হবে, ইত্যাদি। কেউ প্র্যাকটিসিং মুসলমান হলে আর নারীকে স্বাধীনতা দূরে থাকুক, সমান অধিকার দিতে পারবে না। কেউ নারীর সমান অধিকারে বিশ্বাস করলে সে অবশ্যই মুরতাদ। ইসলামের আকিদা না মানা এক জিনিস আর অবিশ্বাস করা আরেক জিনিস। নারীর সমান অধিকার বিশ্বাস করার অর্থ আপনার ঈমান নেই। খ্রিস্টানরা এর থেকে ভালো হবে নাকি? আর যীশুর মেয়েকে তো আমি চিনি ভালোমতো।
রাত দেড়টার দিকে বাসায় ফিরছি। পুরোটা সময় ইলেকশনের ব্যাপারে আলাপ হয়নি। এখন ও বিদায় হবে, পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে দিচ্ছি কেবল। যীশুর মেয়ের সাথে মারামারি বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো গেছে ভেবে কেবল স্বস্তির নিঃশ্বাসটা ফেলবো, এমন সময় ও বলে ফেললো, “খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম গতকাল রাতে, বুঝলে?”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আরে, চার্চগোইং লিবারেল নাকি?
তারপর সে তার বাক্যটা শেষ করলো, “অ্যাবট হারলে সর্বনাশ হয়ে যেত।”
মনে মনে কেবল বললাম, “চুদসে আমারে।” মুখে বললাম, “কেন?”
ও জানালো, “ওর অফিসে আমার পীসতুতো ভাই কাজ করে তো। ভাইয়া তো ভদ্রলোকের ডানহাত। ওর চাকরিটা যেত হয়তো। যে গাড়িটা হাঁকাচ্ছে তার খরচা আর দেয়া লাগতো না পরের মাসে।”
আমার কান থেকে তখন ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
এবার কথাটা শেষ করলো সে, “তাই আমরা সবাই অ্যাবটকে ভোট দিয়েছি। তাছাড়া ভাইয়ার সুবাদে গেছি তো উনার অফিসে। দেখাসাক্ষাত হয়েছে বার কয়েক। উনারা জোস মানুষ।”
আমি বললাম, “ওই যে তোমার গাড়ি। গুড নাইট।”
এর বেশি কিছু বলতে গেলে আমার মুখ থেকে যা বের হবে তা যীশুর ক্ষমাশীল সন্তানরাও নিতে পারবে বলে আমার মনে হলো না।
টেক্সাসের লিবারেল আর কনজারভেটিভদের সাথে এবং তাদের সার্কেলে আমি যথাসম্ভব নিউট্রাল হয়ে মেশার চেষ্টা করেছি এতগুলো মাস। আগে থেকে কোন কিছুই ধরে নিতে চাইনি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে আসলেই ধর্মটা যতো নষ্টের গোড়া। ধার্মিক মানেই সে প্রো-গড, প্রো-গান, প্রো-লাইফ। এই তিন একেবারে প্যাকেজ, এবং সব্বোনাশ! মানে বন্দুক ছোঁড়ার জন্য চেঁচাবে, মেয়েদের অ্যাবরশন নিষিদ্ধ করার জন্য চেঁচাবে। যারা একটু নাস্তিক গোছের তারা বন্দুক ব্যান করার জন্য এবং মেয়েদের স্বাধীনতা দেয়ার জন্য চেঁচাবে।
দূর থেকে এমনটাই সবার ধারণা হয়। আমি তাই কাছে গিয়ে মিশেছি। মিশছি।
দেখছি আসলেও তাই।
বাংলাদেশেও তাই। যে ব্যাটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা ধার্মিক তার কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতার ভ্যালু নাই, সে অন্যের ওপর অত্যাচারী আইন-কানুন চাপাতে সব সময় ব্যস্ত। যারা মডারেট মুসলিম বা ধর্মচ্যুত – তারাই ভালো মানুষ। মডারেট খ্রিস্টান এবং মডারেট মুসলমান একই কাতারের লোক। বিবেকবুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে।
যারা প্রবল বিশ্বাসী তারা প্রত্যেকে এমপ্যাথিলেস, থটলেস, ডাম্ব।
আমি এই সমাজটাকে আরও কয়েকটা মাস দেখার সুযোগ পেলে হয়তো এর উলটো উপসংহারে পৌঁছাবো।
হয়তো আমি ভুল ভাবছি।
হয়তো আমি ভাবছি উলটো।
হয়তো যারা এমপ্যাথিলেস, থটলেস, ডাম্ব, তারাই প্রবল বিশ্বাসী!
* ধর্মগুরুর সাথে আমার পরে আরও আলাপ হয়েছে কফি শপে। ফ্রি হলেই ভদ্রলোক আমাকে টেক্সট করে ডাক দেয়। বলে, “এসো, আড্ডা হয়ে যাক।” মনের গহীনে সে হয়তো আমাকে কনভার্ট করার জন্য ডাকে, তবে আমাদের কানেকশনটা ভিন্ন। আমরা আদতে প্রিচার। সে যীশুর বানী প্রচার করে। আমি ভিন্ন বাণী প্রচার করি। কাজেই আমরা আলাপ করি জনতা কীভাবে কোন জিনিসটা নেয়, কী টেকনিক ব্যবহার করলে লোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে ইত্যাদি। সে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অ্যাঙ্গেল থেকে প্রিচিং নিয়ে আলাপ করে, আমি ‘জীবনবাদ’ প্রচারের লক্ষ্য থেকে প্রিচিং নিয়ে আলাপ করি। ও একমত হয় প্রচারের অনেক টেকনিক নিয়ে, অনেক সময় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলে কেমন ঝামেলা তমুক টেকনিকে আছে। এবং যেহেতু লম্বা একটা সময় সে জনতা নাচিয়ে বেড়াচ্ছে, আমি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি। নিজের ধর্ম প্রচার করার সময় এসব আমার কাজে লাগবে। প্রিচিং হলো গিয়ে প্রিচিং। আর লোকটা বেশ ভালো প্রিচার। গতকাল কয়েকশ ছেলেমেয়ের সামনে সে আগুনঝড়া সাইকোএনালিটিকাল বক্তব্য রেখে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেছে শুনলাম অন্যদের থেকে। আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল, আমি যেতে পারিনি। রিপোর্ট লিখতে বেশি ব্যস্ত ছিলাম। তবে এসব প্রিচার কীভাবে লোকের মাথা খায় তা শেখার প্রয়োজন আমার আছে।
Leave a Reply