KP Imon

Words Crafted

সামাজিক হিপনোটিজম

এক.
অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে আসার পর থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তিথির। শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রিদের বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কালচারাল শো ছিলো। সেখানে টানা তিনটি হিন্দী গান তোলার পর আর নিতে পারেনি সে। সোজা বের হয়ে চলে এসেছে। এয়ার কন্ডিশনড রুম থেকে আচমকা কড়া রোদে বেরিয়ে আসার কারণে সামান্য অস্বস্তিও হচ্ছে। গায়ে মাখলো না ওটুকু, তবে সামনের দৃশ্যে কিছু একটা ভুল রয়েছে এটা বুঝতে পারছে। এই বিষয়টা গায়ে না মেখে উপায় রইলো না তিথির।

বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে যাত্রিদের বসে থাকার জন্য রাখা হয়েছে সিমেন্টের সীট। তাতেই বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে একটা ছেলে। বসার জায়গাটায় পিঠ দিয়ে লটকে আছে, হেলান দেওয়ার অংশ বরাবর দুটো পা বাড়িয়ে দিয়েছে আকাশের দিকে। এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায় না। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে পা বাড়ালো তিথি।

আরেকটু কাছাকাছি আসতে ছেলেটাকে চিনতে পারলো ও, মেকানিক্যালের শুভ্র। সাধারণতঃ চশমা পরে, চশমা খোলা রাখায় একটু অদ্ভুত লাগছে তাকে। প্রথমে চেনা যায়নি তাই। ছেলেটা একটু পাগলাটে টাইপের। রোবোটিক্সের বিভিন্ন কম্পিটিশনে ধারাবাহিকভাবে পুরষ্কার পেয়ে এসেছে বলে কেউ তার পাগলামি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। কথায় আছে, জিনিয়াসেরা একটু পাগলাটে গোছের হয়। সেই তকমাটাই পিঠে নিয়ে মহানন্দে ক্যাম্পাসের এদিক থেকে ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে শুভ্র। বেশিদিন আগে নয়, জুনিয়র একটা মেয়েকে চলন্ত সাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। এরকম একটা মানুষকে সহজে কেউ ঘাঁটাতে চায় না। তারপরও তার পাশে গিয়ে বসে পড়লো তিথি।

শুভ্রের ঝলমলে চুলগুলো মধ্যাকর্ষণের টানে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, চোখ সরাসরি নিজের উর্ধ্বগামী পায়ের দিকে নিবদ্ধ।
তিথির দিকে একবারও না তাকিয়ে বললো, “তুমি তিথি না? ইলেক্ট্রিক্যালের।”

জিনিয়াস পাগল তাকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছে সেটা ভালো খবর কি খারাপ তা তিথি জানে না। কাজেই সামান্য ভ্রু নাচিয়ে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। চিনলে কিভাবে? আমাদের আগে দেখা হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না।”

চুলগুলোয় ঘূর্ণি তুলে সোজা হয়ে বসলো শুভ্র, বাদুড়ঝোলা অবস্থা থেকে সোজা হতে যথেষ্ট কসরত করা লাগলো তাকে। পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে থাকা দু’জন স্কুলছাত্রি ফিকফিক করে হাসতে হাসতে চলে গেলো।
“আমাকে চেনো তুমি?” শুভ্র জানতে চাইলো।
একটা কাঁধ তুলে ছেড়ে দিলো তিথি, “তোমাকে ক্যাম্পাসের সবাই চেনে।”
হাসলো ছেলেটা, তিথি লক্ষ্য করলো তার হাসির মধ্যে ভালো লাগার মতো কিছু নেই। হয়তো অবজ্ঞা বা আত্মদম্ভের ভাবটুকু বোঝা যায় বলে এমনটা মনে হলো ওর। নিশ্চিত হতে পারলো না সে।
তিথির কথাটাকেই অবশ্য প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স ধরে নিলো শুভ্র। বললো, “এইটাই পয়েন্ট। এই ক্যাম্পাসের সবাই সবাইকে চেনে।”

ঠোঁটদুটোকে চেপে বিজ্ঞের মতো মাথা দোলালো তিথি। একমত হয়ে যাওয়াটাই হয়তো এখানে তার জন্য ভালো।

বুক পকেট থেকে চশমাটা বের করলো শুভ্র। বেশ মোটা কাঁচের চশমা। চোখটাকে ছেলেবেলা থেকেই খেয়েছে সে, তবে বাদুড় ঝোলার সময় অজ্ঞাত কোনো কারণে চশমা খুলে রেখেছিলো। চশমা চোখে দিতে দিতে বললো, “তবে তোমাকে চশমা ছাড়াও চিনতে পেরেছি অন্য একটা কারণে।”

আগ্রহ নিতে তার দিকে তাকালো তিথি।
“কোন কারণে?”
একটু কাশলো শুভ্র, “আসলে, ফার্স্ট সেমিস্টারে তোমার ওপর ক্রাশ খেয়েছিলাম।”
মৃদু হাসলো তিথি, “কিউট তো!”
“প্রোগ্রামে যাওনি?” প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো শুভ্র।
“গেছিলাম। একটার পর একটা-”
“হিন্দী ঝাড়ছে, তাই তো?” মিটিমিটি হাসে শুভ্র, “আমিও সেজন্য বেরিয়ে এসেছি। দেশে মনে হয় ভাষার খুব আকাল পড়েছে! নোয়াখালি, চিটাইঙ্গা, বরিশাইল্যা বা সিলেটিতে গান করলেও মেনে নিতাম। তারা বর্ডার পেরিয়ে যাবে। একেবারে সীমানা পেরিয়ে, ভারতমাতার আঁচল তলে।”

ক্ষুব্ধ শুভ্রকে ভালো লেগে যায় তিথির, একটু আগের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। খোলা মনের ছেলে, ক্রাশ খাওয়ার কথাটা ক্রাশের সামনে চটপট বলে ফেলে না নাহলে কেউ। তারওপর হিন্দী সহ্য করতে পারে না। রক্তাক্ত বায়ান্নোর পর বিজাতীয় ভাষাকে বাংলার ওপর প্রাধান্য দিলে কোনো সচেতন বাংলাদেশিই তার নিন্দা না করে পারে না। ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই।

“ভাবছি এই প্রোগ্রামই বর্জন করবো নাকি।” শুভ্রকে বললো ও।
ছেলেটা অবশ্য কোনো মন্তব্য করলো না। তিথির কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নজর বোলাচ্ছে। একটু অস্বস্তিই হলো ওর। পরক্ষণেই কেটে গেলো শুভ্রের কথাটা শুনতে পেয়ে,

“ধ্যাত, জিন্স পরোনি। নাহলে তুমিও বাদুড় হয়ে থাকতে পারতে এখানে।”
উঠে দাঁড়িয়ে ওপরে হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গলো শুভ্র। পাশেই চা-সিগারেটের দোকান পেতে বসে আছেন রইসুদ্দি মামা। ভার্সিটির সবার প্রিয় মুখ। ব্রেক টাইমে অনেকেই এই কাউন্টারের সিটগুলোতে বসে আড্ডা দেয়। সেই সাথে রসদ নেয় রইসুদ্দি মামার দোকান থেকে। তার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই একটা মার্লবোরো আর লাইটার হাতে চলে এলো শুভ্রর।

রোদের আক্রমণ থেকে চোখ বাঁচাতে অযথাই খানিক পিটপিট করলো সে। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে পরিমিত টান দিলো বারকয়েক। তাতেই এলাকা ধোঁয়ায় ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। তিথির দিকে তাকিয়ে মুখ নাচালো তারপর।
“প্রোগ্রাম বর্জন করবে যখন, চলো।” আবারও চোয়াল বাঁকিয়ে মুখ ঝাঁকালো শুভ্র, “বাসায় চলো।”
“ও হ্যাঁ, তুমি তো আবার লোকাল।” এতটুকুই বললো তিথি। ছেলেটার স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথা বার্তায় রীতিমতো স্তব্ধ সে।

একটু আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় হয়েছে তাদের। এর মধ্যে অনায়াসে তাকে জানিয়ে দিয়েছে একটা সময় (কিংবা হয়তো এখনও) তার প্রতি দুর্বল ছিলো সে। তারপর তাকে রীতিমতো ‘স্ক্যান’ করেছে। এবং এখন প্রস্তাব দিচ্ছে তার বাসায় যাওয়ার জন্য। শুভ্রের পরের কথাটা আরও চমকে দিলো তাকে।

“কই, চলো?” হাত বাড়িয়ে কাওকে ডাকলো সে, “একটা রিকশা নেই।”
রিকশাওয়ালা এসে গেছে, তিথি এখনও কিছু বলার সুযোগই পায়নি। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে তিথির সামনে এসে দাঁড়ালো শুভ্র। ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, “এসো। খুব দূরে না আমার বাসা।”

“তোমার বাসায় যাবো কি করতে?” না বলে আর থাকতে পারলো না তিথি, “এখানে থাকতেই ভালো লাগছে আমার।”
বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠলো শুভ্রের মুখে, “বুঝেছি। বাসায় গিয়ে তোমার সাথে কি করবো সেটা ভাবছো তো? আরে সেই ভয় নাই। একদম খালি বাসা। মম-ড্যাড গ্রামের দিকে গেছে। দুই তিন দিন পর আসবে হয়তো।”

রীতিমতো ক্ষেপে উঠলো তিথি। তবে কিছু বলতে পারলো না। শুভ্রের চোখে চোখ পড়তে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। ওর সাথে মজা করছে ক্যাম্পাসের জিনিয়াস পাগল! পিত্তি জ্বলে গেলো তিথির।

ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ালো এবার, “চলো।” রিকশাতে উঠে গেলো সরাসরি, “তোমার বাসাতেই যাবো এখন।”
ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে আর ফক ফক করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রিকশাতে উঠে পড়লো শুভ্রও।

দুই.
তিনতলা বাড়িটার সামনে থেমে গেলো রিকশা। ক্যাচ ধরে ধরে চাবির গোছাটা নিয়ে খেলছে শুভ্র। পাশে হেঁটে আসা তিথির দিকে যেনো কোনো নজরই নেই। বিশাল গ্যারেজের দরজার এক কোণে ছোটো দরজা, সেটা খুলে ফেললো নির্দিষ্ট চাবি ব্যবহার করে। তারপর ধরে থাকলো কিছুক্ষণ, তিথিকে ঢোকার সুযোগ করে দিচ্ছে। ভেতরে পা রেখে একটু চমকালো ও, গ্যারেজে যে চারটা গাড়ি আছে, তার তিনটার কোনটাই কয়েক কোটির কম দামের নয়। রেসিং কারই দুটো।

শুভ্রদের টাকা আছে, ভাবলো তিথি।

সিঁড়িঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুভ্র, তাকে একটু জোরে পা চালিয়ে ধরে ফেললো তিথি।
“তোমাদের গ্যারেজের ভেতরে যা যা আছে তা বিক্রি করে দিলেই তো আরেকটা অডিটোরিয়াম বানাতে পারবে ভার্সিটি।” কথার কথা হিসেবেই বললো যেনো তিথি।
হাহা করে হাসলো শুভ্র, “ফুটানি দেখানোর জন্য কিনেছিলো বাবা। এখন পড়ে আছে। ওই টাকাটা আমাকে দিলে দুনিয়ার স্যাটেলাইট হিস্টোরিই পাল্টায়ে দিতাম।”

আর কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিলো তিথি। দোতলার দরজায় এসে আরেকটা চাবি বের করলো শুভ্র। বড় একটা তালা ঝুলছে ওদের দরজায়। খটকা লাগলো তিথির। এতো মূল্যবান গাড়িগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য নিচে একজন মানুষও নেই। কেনো? দারোয়ান তো একজন রাখাই যেতো। তাছাড়া এই গাড়িগুলো বের করার সময় গ্যারেজের দরজা খোলা আর লাগানোর জন্য হলেও একজন গেট ম্যানের তো দরকার। কিন্তু কেউ ছিলো না নিচে। কেনো ছিলো না? আবার এখানে শুভ্র তার বাড়ির দরজা থেকে তালা খুলছে।

তাহলে, আসলেই তার বাসায় কেউ নেই।
ফাঁকা বাসায় তিথিকে নিয়ে এসেছে শুভ্র। কি তার উদ্দেশ্য?

এক পা পিছিয়ে গেলো তিথি। “তোমার বাসায় কেউ নাই?”
অবাক হতে ওর চোখে চোখ রাখলো শুভ্র, “তোমাকে না বললাম, বাসার সবাই গ্রামে গেছে?”
দুই হাত বুকের কাছে বাঁধলো তিথি। এবার সত্যিই রাগ হচ্ছে ওর।
“খালি বাসায় আমাকে আনলে কেনো?”
মুচকি হাসলো শুভ্র, “তোমার পর্ন ভিডিও বের করার জন্য। আমি এটাই করি। একা একটা মেয়েকে নিজের বাসায় এনে তার সাথে অনৈতিক কাজ কর্ম করি। আমার ক্ষুদে রোবটেরা তা ভিডিও করে। তারপর সেই সব ভিডিও চড়া দামে বাজারে বিক্রি হয়। আমার উদ্দেশ্য তোমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে?”

থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিথি। গনগনে আঁচ বের হচ্ছে যেনো মুখ থেকে। ফর্সা মুখটা এখন টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তিথির নিজেরই মনে হচ্ছে তার কান গরম হয়ে গেছে। রাগে না লজ্জায় তা সে বুঝতে পারছে না। সিঁড়িঘরের ভেতরটা খানিক অন্ধকার। কিন্তু কেনো জানি বন্দীত্বের অনুভূতি হচ্ছে না তার।

“চলে এসো ভেতরে।” ঢুকে পড়লো শুভ্র, তিথির ওপর আক্রমণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে, “আগেই তো বলেছি তোমার ওপর ফার্স্ট সেমিস্টারে ক্রাশ খাওয়া আমি। ভয় পাচ্ছো কেনো? খুব বেশি কিছু হলে জাপ্টে ধরে চুমু-টুমু খেয়ে ফেলতে পারি, এর বেশি আর কিছু ক্রাশের সঙ্গে করা যায় নাকি? তোমার ভয় পাওয়ার কিছু তো দেখি না।”

বিষয়টা তিথির কাছে ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। শুভ্রর মতো ছেলে সে জীবনে একটাও দেখেনি। তার ব্যাপারে অনেক প্রশংসা শুনেছে এতোদিন, তবে ব্যক্তিগতভাবে শুভ্রকে চেনে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ব্যক্তি শুভ্রকে চিনতে তিথির কেমন লাগছে সেটা সে বুঝতে পারছেন না। কখনো মনে হচ্ছে শুভ্রকে জানতে পারাটা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। আবার কখনো মনে হচ্ছে এটা আর এগিয়ে যেতে না দেওয়াটাই উচিত।

সামনে শুভ্রের বাসায় ঢোকার মূল দরজা হা করে খোলা। তাকে হাতছানি দিয়েছে শুভ্রও, তবে এর ভেতর ঢুকে পড়া উচিত হবে কি না তা সে বুঝতে পারছে না। ধীর ও কম্পিত পায়ে ঢুকে পড়লো তিথি। শুভ্রের হাতে মোবাইলফোন। একটা কিছু করতেই পেছনে দড়াম করে দরজাটা লেগে গেলো।

“অ্যান্ড্রয়েড একটা অ্যাপ বানিয়ে নিয়েছি। আমাদের সিকিউরিটি খুবই স্ট্রং।” সগর্বে বললো শুভ্র, “কেউ ঢুকতে বা বের হতে পারবে না, যদি আমি না চাই।”
“তাহলে বাইরে পুরাতন আমলের অ্যানালগ লক ঝোলানোর দরকার কি ছিলো?” ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো তিথি।
“ওল্ড ইজ গোল্ড।” ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলো সে। তিথি কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা কাঁচের বোতল তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে সে। শুন্যে খপ করে ধরে ফেলতে ফেলতেও ফেলে দিচ্ছিলো তিথি, আরেকটু হলেই মেঝে ভেসে যেতো কোক আর কাঁচের টুকরোয়। অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে গেলো তার মুখ থেকে।
“আমার রুমে চলো।” সরসরি সামনে হাঁটা দিলো শুভ্র।

বদ্ধ এই দরজাটাও মোবাইলের সাহায্যে খুললো সে। তারপর সরে জায়গা করে দিলো তিথির ঢোকার জন্য। ছিমছাম ঘর। একটা ডাবল বেড, কম্পিউটার টেবিল আর একটা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। দেওয়ালের সাথে লাগিয়েই বানানো হয়েছে বইয়ের তাক। সেগুলোতে ঠাসা নানা ভাষার বই। ডাবল বেডের ঠিক মাথার কাছে দেওয়াল জুড়ে সাঁটা হয়েছে পূর্ণাঙ্গ নগ্ন নারীদেহের ছবি। নারীটির মাথায় ঘন সোনালিচুল, দৃষ্টিনন্দন দেহসৌষ্ঠব। চেনা চেনা মনে হলেও তিথি নিশ্চিত হতে পারলো না।

“কিসা সিনস।” শুভ্র বললো খাটের পাশে দাঁড়িয়ে, “আমার প্রিয় পর্ন তারকা। জনি সিন্সের ওয়াইফ।”
মাথা দোলালো তিথি, “জনি সিন্স কে?”
“আরেকজন পর্ন স্টার।” অবাক হয়ে উত্তর দিলো শুভ্র, এতো সহজ প্রশ্ন যেনো জীবনে শোনেনি, “কিসা সিন্সের হাজব্যান্ড।”
“ও।” এতটুকুই বললো তিথি। স্কুলটা নদীর সামনে, আর নদীটা স্কুলের পেছনে জাতীয় উত্তর দেওয়া হলে আর কি বলার থাকে?
“তুমি বসো। আমার পিসিটা অন করি।” দেওয়ালের সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো সে। এর সঙ্গে মনে হয় অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সংযোগ রাখা যায়নি।

ডাবল বেডে বসে তিথির দেহে চনমনে একটা ভাব চলে আসলো। ঝকমকে ঘর, দেওয়ালে উত্তেজক পোস্টার আর শুভ্রের খোলামেলা কথা, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক আকর্ষণ। তিথির মনে হলো সে সামান্য সম্মতি দিলেও এই ঘরে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে আজ। শুভ্র জানে, সে-ও জানে এমন কিছু আজ এখানে হবে না। অথচ সম্ভাবনা তো রয়েছে। বিন্দুমাত্র হলেও! সেটাই চনমনে অনুভূতিটার পেছনে কাজ করছে।

অবাক হয়ে তিথি লক্ষ্য করলো, শুভ্রকে সে বিশ্বাস করে। কেনো? এটা সে জানে না।

“আংকেল আন্টি কিছু বলে না?” গলা খাকারি দিয়ে জানতে চাইলো তিথি।
“কি বলবে?” সেই চিরায়ত অবাক অবাক দৃষ্টি এখন শুভ্রর চেহারায়। ও আবিষ্কার করলো এই অভিব্যক্তিতে ছেলেটাকে বেশ সুন্দর দেখায়।
“এই যে…” আরেকবার কাশলো তিথি, “কিসা সিনসের ন্যুড ফটোগ্রাফ বেডরুমে রেখেছো।”
কাঁধ ঝাঁকালো শুভ্র, “আরে আমার পেশাই তো ওই। মেয়েদের ধরে এনে এনে তাদের পর্ন ভিডিও বের করা। ওই খাটে কতোজনের ইজ্জত গেছে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”

ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিথি, “সিরিয়াসলি? এসব লো ক্লাস জোকস ছেড়ে কি লাভ হচ্ছে, শুভ্র?”

ঝট করে মাথা ঘুরালো শুভ্র।
এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো তিথির চোখে চোখ রেখে। শিউরে উঠলো ও, অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা অনুভূতি হচ্ছে। এক সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে অনন্ত কাল। কালো চোখের তারায় অশুভ কিছু আছে ছেলেটার। সে যা বলছে সবই কি মীন করে বলেছে? তিথির এতো অনিশ্চিত লাগছে, এমন আগে কখনও হয়নি। অথচ চলে যেতে ইচ্ছে করছে না। ছেলেটা অন্যরকম। তার সান্নিধ্য ভালো লাগছে ওর।
ভীতিকরও লাগছে!

“এগুলো জোকস মনে করছো কেনো, তা কি তোমার জানা আছে তিথি?” কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র। অজান্তেই হাতে ধরে রাখা ঠাণ্ডা বোতলটা চেপে ধরলো ও। কিন্তু তার দিকে আসছে না ছেলেটা, দেওয়ালের কাছে একটা তাকের সামনে দাঁড়ালো। বটল ওপেনার বের করলো একটা। নিজের কোকটা খুলে তিথির দিকে ছুঁড়ে দিলো। এবার অল্পের জন্য কপাল কাটা থেকে রক্ষা পেলো ও।

“জিনিস ছুঁড়ে দেওয়ার অভ্যাসটা খুব খারাপ তোমার।” ঝাঁঝিয়ে উঠে কোকটা খুললো তিথি।
“আসলে, তুমি সামাজিক হিপনোটিজমে আটকে গেছো। দ্যাটস অল।” নিজের কথার খেই ধরলো শুভ্র, “সেজন্য আমি যাই বলি তোমার কাছে অন্যরকম লাগে। নতুবা ধরে নাও স্রেফ জোকস ছাড়ছি।”

খাটে উঠে তিথির মুখোমুখি বসলো সে। বোতলটা একটু সামনে এনে ঠুকে দিলো মেয়েটার বোতলে, “চিয়ার্স।”
শুভ্রের শরীরে গন্ধ পেলো ও, এখনও মাংসপেশি টান টান হয়ে আছে তিথির। সাবধানে চুমুক দিলো বোতলে।

হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলো শুভ্র, “ফাইন। আমি পর্ন-টর্ন বানাই এসব সত্যি না। ওসব লো ক্লাস জোকস-ই ছিলো।” তারপরই তিথির পিত্তি জ্বলে যাওয়ার মতো হাসি হাসলো সে, “কিন্তু সেই লো ক্লাস জোকসেই তোমার চেহারার যে দশা হয়েছিলো!” মেয়েটার উরুতে মাঝারি এক চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র, “টেনশনের কিছু নাই। কোকটা শেষ করো। আমি লাঞ্চের ব্যবস্থা করি। বিফে তোমার প্রবলেম আছে?”

কটমট করে তার দিকে তাকালো ও, “হ্যাঁ। আমাদের ধর্মে নিষেধ আছে, জানো না?”
গাল চুলকাতে চুলকাতে কিচেনের দিকে চলে গেলো অদ্ভুত ছেলেটা।

তিন.
ক্লাস থেকে বের হতেই নেহালের সাথে দেখা হয়ে গেলো তিথির। কাঁধে ব্যাগ আর হাতের বোঝা সদৃশ খাতা নিয়ে হাঁসফাঁস করছে। ওদের সিআর (ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ)দ্বয়ের একজন এই ছেলেটা, তবে কাজের সময় তার আশেপাশে কাওকে দেখা যায় না। মায়াই হলো তিথির।

“দে, আমার হাতে দে কিছু।” এগিয়ে গিয়ে বললো ও।
করুণ একটা হাসি হাসলো নেহাল, একটা বান্ডিল ওর হাতে তুলে দিলো, “থ্যাংকস। কি খবর তোর?”
“তোর চেয়ে ভালো, যা দেখতে পাচ্ছি।” চোখ টিপলো তিথি।
“গর্তে পড়লে হাতিকে চামচিকাও লাথি মারে। পরীক্ষিত।” হতাশ কণ্ঠে বললো নেহাল।
“নিজেকে চামচিকা প্রমাণের চেষ্টা না করে অন্য সিআরটাকে একটু ঝাড়ি-টারি দিস। সব দায়িত্ব তো তোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিদেয় হয় দেখি।” কপট রাগের সাথে বললো তিথি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলো ওরা। গন্তব্য, ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং। স্যারের রুমে সব খাতা জমা দিয়ে এসে শান্তি। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গতে মুখ খুললো নেহালই।
“শুভ্রর সাথে তো তোকে রেগুলার দেখা যাচ্ছে শুনলাম।” অর্থবোধক উচ্চারণে বললো নেহাল।
“তো? একসাথে রেগুলার বের হলে তো রেগুলারই দেখতে পাবি। অবাক হচ্ছিস যে?”
“অবাক হবো কি আর? জানতে চাইলাম, প্রেম ট্রেম করছিস কি না, তাই আরকি। করলেই আমাদের লাভ, স্বীকার করতে বাঁধা নাই।”
“আমি প্রেম করলে তোদের কি লাভ?”
“ট্রিট পাবো যে। গ্র্যান্ড ট্রিট।”

ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং থেকে ফেরার সময় ক্যাম্পাসের আগুন ধরানো সুন্দরী মেহজাবিনের সাথে দেখা হয়ে গেলো তিথির। মডেলিং-টডেলিংও করছে আজকাল। তিথিকে দেখতে পারে না এই মেয়ে, কেনো কে জানে। অবশ্য মেহজাবিন ক্যাম্পাসের কোনো সুন্দরী মেয়েকেই দেখতে পারে না। মুখে প্রকাশ না করলেও তার আচরণ তেমনটাই বলে। বরাবরের মতো তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিলো তিথি, পারলো না।

আগ্রহী মেহজাবিন গায়ে পড়ে কথা বলতে এলো আজ। “কি রে সুন্দরী, কি খবর তোর? তোকে কয়েকদিন ধরে খুঁজছি আমি।”
“আমাকে খুঁজছিস?” অবাক হয়ে গেলো তিথি। “কেনো?”

মেহজাবিন ওকে একটা কারণেই খুঁজতে পারে। হয়তো কোনো প্রতিযোগিতায় দুইজনই অ্যাটেম্পট নিয়েছিলো, তাতে তিথি বাদ পড়েছে তবে মেহজাবিন টিকে গেছে। তেমন কোনো খবর জানানোর জন্যই কেবল এই মেয়ে অন্য কোনো সুন্দরীকে খুঁজে। এসব তিথির জানা আছে। মনে করার চেষ্টা করলো, এর মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলো কি না। মনে তো হয় না।

“আরে, শুভ্র তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না?” শুরু করলো মেহজাবিন। একটু আগেই তিথির খবর জানতে চেয়েছিলো এবং তিথি যে সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি সেদিকে তার আর নজর নেই এখন। আসল কথা পাড়তে পারলে ফরমালিটিতে সময় নষ্ট করে কে? “শুভ্রর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তোকে। পরিচয় মানে ডেট। একটা ডেট ম্যানেজ করে দিবি তুই আমাকে। পারবি না?”
মুচকি হাসলো তিথি, “শুভ্র তোর সাথে ডেট করতে রাজি হবে কেনো?”
“হবে নাই বা কেনো? ভালো ছেলে ও, ফ্রি মাইন্ডেড। অরাজি হওয়ার তো কিছু দেখি না। অবশ্য তোকে এসব বলে কি লাভ? তুই ওকে আমার চেয়ে ভালো চিনিস।” তিথির হাতে চিমটি কাটলো মেহজাবিন, ন্যাকামি দেখে তিথির গা জ্বলে যেতে থাকলেও কিছু বলতে পারলো না।

মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললো মেহজাবিন, “পারবি তুই, আমি জানি। আর শোন্, ওকে কিন্তু ভালোমতো বানিয়ে দিতে হবে। বুঝিয়ে দিস আমি ওর ওয়ান নাইটার হতে চাইছি। সেক্স-টেক্স নিয়ে আমার কোনো বাড়তি কুসংস্কার নাই। এটা যেনো সে জেনে রাখে।”
তিথি কিছুই বুঝতে পারছে না এখন, “ওকে এক রাতের জন্য বিছানায় তুলে তোর কি লাভ?”
“তুই গাধা নাকি? ওর ডিজাইন করা স্যাটেলাইট যে ইউরেনাস যাচ্ছে সামনের বছর তা জানা আছে তোর?”
কাঁধ ঝাঁকালো তিথি, “জানবো না কেনো? দারুণ কাজ করেছে ও। বাংলাদেশের জন্য গর্বের হবে এটা।”
“সেইজন্যই ওকে আমার লাগবে রে। প্লিজ দোস্ত, ম্যানেজ করে দে না?” মেহজাবিন পারলে তিথির পায়ে পড়ে যায়, “অবজার্ভার টিভিতে কাজ করার সুযোগ পেতে যাচ্ছি আমি, শুনেছিস? আমার প্রোগ্রামে একবার শুভ্রকে নিয়ে যেতে পারলে কি হিট হবে চিন্তা করে দ্যাখ? ক্যারিয়ার আমার রকেটের বেগে ওপরের দিকে ছুটবে।”

আচ্ছা! এবার সবটা স্পষ্ট হলো তিথির কাছে। এখন শুভ্রর সাথে একরাত কাটাতে পারলে তার সঙ্গে একটা ইন্টিমেসি হবে। এরপর এক বছর পর শুভ্র হয়ে যাবে ন্যাশনাল হিরো। সঠিকভাবে বললে ইন্টারন্যাশনাল হিরো। গোটা দুনিয়ায় তাকে নিয়ে মাতামাতি হবে। এই ছেলে নাসাতে ঢুকে যাবে এটাও অনেকে নিশ্চিত। বাংলাদেশের সবাই ডক্টর ইউনুসের পর পরই চিনবে তাকে। বলাবলি করবে, ইউরেনাসকে চক্কর দিতে থাকা স্যাটেলাইটটা বানিয়েছে আমাদের একজন। একজন বাংলাদেশি। তখন সেই বাংলাদেশিকে নিয়ে স্টুডিওতে যাবে মেহজাবিন। একবছর পর। মেয়েটার দূরদর্শিতা দেখে চমৎকৃত হলো তিথি।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অবশ্য উল্টোটা বুঝলো মেহজাবিন, “কিরে, তোদের মধ্যে কি প্রেম চলে? তোর আর শুভ্রর?”
মাথা নাড়লো তিথি, “না রে। ও মুসলিম না? আমার সাথে প্রেম কিভাবে?”
“আরে বাদ দে। হিন্দু মুসলমান সে দেখে বলে মনে হয় না। আমার কি ধারণা জানিস? শুভ্র নাস্তিক। তুই জিজ্ঞাসা করে দেখিস একদিন। যাই হোক, প্রেম করছিস না দেখে ঝামেলা কমলো। নাহলে ওর সাথে শোয়ার জন্য তোর অনুমতিও লাগতো।”
মুচকি হাসলো তিথি, “এর আগে এই কাজ যাদের সাথে করেছিস সবার গার্লফ্রেন্ডের অনুমতি নিয়েছিলি?”
মাথা নাড়লো মেহজাবিন, “তাদের গার্লফ্রেন্ডদের কেউ আমার ফ্রেন্ড তো ছিলো না। অবশ্য শুভ্রকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না। এক রাত ওকে পেলে, ছিবড়ে বানিয়ে ফেলবো একেবারে। এর পর আরও অনেকবার সে নিজে থেকেই আমার কাছে আসবে। ছেলেরা কি পছন্দ করে আমার জানা আছে। তুই শুধু ফার্স্ট নাইটের সেটআপটা করে দে। বাকিটা দেখছি। শুভ্রকে আমি হিট করে দেবো।”

সেই সাথে নিজেও হিট হবা, মনে মনেই বললো তিথি। সব কথা মেহজাবিনের মুখের ওপর বলতেই হবে এমন তো না। আরও কিছুক্ষণ বক বক করলো মেহজাবিন। পুরোটা সময় অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখলো তিথি। বিদায়ের সময়ও আদিখ্যেতার চূড়ান্ত করলো সে। ক্যাম্পাসের মাঝখানেই বেস্ট ফ্রেন্ডদের মতো তিথির গালে চুমু খেলো, তারপর দুই আঙুল নেড়ে টাটা দিলো তাকে। মেহজাবিনের সব কাজের পেছনেই স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। ক্যাম্পাসের কেউ এসব কাজে এখন আর পাত্তা দেয় না। তারপরও আড়ালে হাসলো কেউ কেউ।

সেদিন হলে ফেরার সময় শুভ্রের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটা মনে করলো তিথি, প্রায় একবছর হয়ে গেলো!
হ্যাঁ, খুব নার্ভাস ছিলো সে ওইদিন। অসহায়ও ছিলো। শুভ্রের সুরক্ষিত বাড়ির ভেতরে একদম কোণার ঘরে শুভ্রর সঙ্গে বন্দী। বাসায় আর কেউ ছিলো না। শুভ্র তার সঙ্গে যা ইচ্ছে করতে পারতো। কোনো সাক্ষী ছিলো না সেদিন। কিন্তু কিছুই করেনি সে। দু’বার ওকে স্পর্শ করেছে কেবল। হাসিচ্ছ্বলে একবার উরুতে চাপড় দিয়েছে ওকে বোকা বানিয়ে, আরেকবার ফিস্ট বাম্প করেছে, বিদায়ের সময়। আর কিচ্ছুটি না।

শুভ্র জানে না, ওই দুটো স্পর্শের সময়ই তিথির বুকে ঝড় উঠেছিলো।

চার.
মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটারে কাজ করছে শুভ্র। মনিটরে দেখা যাচ্ছে অসম্পূর্ণ একটা ডিজাইন। কিসের, তা আরও অস্পষ্ট। তবে সেটা বোঝার চেষ্টাও করলো না তিথি। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রকে।

“তিথি নাকি?” মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই জানতে চাইলো শুভ্র, “তোকে খুব খুশি খুশি লাগছে মনে হচ্ছে।”
ওকে ছাড়লো না তিথি, “খুশি হওয়ার কারণ আছে। তোর কাজটা শেষ কর, আমরা বাইরে ডিনার করছি আজ।”
মাউস থেকে হাত সরিয়ে তিথির দিকে মুখ ফেরালো শুভ্র, নাকে নাক ঠেকে গেলো ওদের, “বাইরে কেনো রে? ঘরে অনেক খাবার আছে, মম রাতে স্পেশাল আইটেম করছে আজ। বাইরে যাওয়াই যাবে না।”

শুভ্রের কথা শেষ হওয়ার আগেই “মম” ঢুকে গেলেন ভেতরে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হবে ভদ্রমহিলার। দেখতে একেবারে বলিউডের কোনো বর্ষীয়ান হিরোইন। তিথি যতবার তাঁকে দেখে, ওর মনে হয় শুভ্রের চেহারার সৌন্দর্যটা হয়তো মায়ের দিক থেকেই এসেছে।

“কি? আমাকে নিয়ে কি ব্যাকটকিং করছিস তোরা?” হাসিমুখে জানতে চাইলেন তিনি।
শুভ্রকে জড়িয়েই রাখলো তিথি, “না আন্টি, তোমার প্রিন্সকে বাইরে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সে তো যেতেই চাইছে না। কি করা যায় বলো তো।”
“যাবে কি রে?” অবাক হয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি এখন মহিলার মুখে, ঠিক শুভ্রের মতো। তিথির হাসি পায় খুব, “আমি রান্না করছি আজ কতোদিন পর, আর তোরা বাইরে যাবি মানে? কোথাও যাওয়া চলবে না।”

আলতো করে মাথা ঝাঁকালো তিথি, এটা কোনো সমস্যা না। অন্য কোনোদিন গেলেই চলবে। মুখে শুধু বললো, “ওকে, আন্টি।”
বের হওয়ার সময় কিসা সিন্সের পোস্টারটার দিকে চোখ পড়লো আন্টির, “আর শুভ্র, তুই এই এক মেয়ের মধ্যে কি এমন পেয়েছিস রে? দেখতে দেখতে আমারই চোখ পচে গেলো। বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখেছিস, যত্তোসব! দুনিয়ায় আর মেয়ে নাই?”

গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি। হেসে ফেললো তিথি, কিসা সিন্সের যে পোস্টারটা এখন পুরো একটা দেওয়াল জুড়ে আছে তা অবশ্যই এক বছর আগের ছবিটি নয়। এর মধ্যে খুব সম্ভবতঃ সাতবার পোস্টার পাল্টেছে শুভ্র। প্রতিবারই কিসা সিন্সের ছবি ঝুলিয়েছে এবং প্রতিবারই সম্পূর্ণ নগ্ন সে ছবিগুলো। তবে এসবে ওদের পরিবারের কারও চোখ বা ভ্রু কুঁচকে যায় না। এগুলো তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবে নেন। আন্টির আপত্তি কিসা সিন্স নিয়ে। তার শরীর চোখের সামনে এতোবার পড়েছে তিনি আর মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারছেন না।

তিথি প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে পারতো না। একটু অস্বাভাবিক মনে হতো ওদের পরিবারটিকে। তবে এখন আর তেমনটা লাগে না। মনে হয় এটাই হয়তো সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি। ওরা সমাজে নিষিদ্ধ আর ‘অ’নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে একই পর্যায়ের খোলামেলা আলোচনা করেন। এজন্য তাদের সামনে তাদের ছেলেকে ছেলের বান্ধবী জড়িয়ে ধরতে পারে, নগ্ন পোস্টার দেখলে তাঁরা চোখ কপালে তুলে ফেলেন না। শুভ্রকে কখনও মেয়েদের প্রতি বাজে কোনো ধারণা রাখতে দেখেনি তিথি। তাদের ছোটো করতেও দেখেনি। পজেটিভ চিন্তাভাবনা গুলো হয়তো পরিবারের সুশিক্ষার কারণেই সে পেয়েছে। এখন আন্টি আর আংকেলের কাজটাকেই ঠিক মনে হয় তিথির।

“নতুন কিছু পেয়েছিস মনে হচ্ছে। আমাকে শোনাবি দেখে চলে এসেছিস। আর সেইটা বাইরে নিয়ে বলার জন্য ডিনার বাইরে করতে চাইছিস।” কম্পিউটার ছেড়ে সুইভেল চেয়ার ঘুরিয়ে তিথির মুখোমুখি হলো শুভ্র, “তাই না?”
“তুই তো জিনিয়াস পাগল। তোর কাছে লুকানো সম্ভব না কিছু।” হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো তিথি।
“তাহলে বলেই ফ্যাল, এবারের হট নিউজটা কি?” চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো শুভ্র।

একটু পিছিয়ে গিয়ে ধপাস করে শুভ্রের খাটে শুয়ে পড়লো তিথি। দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে দুই পাশে, চুল এলিয়ে দিয়েছে পেছনে। পালকের তোষকের এই খাট খুবই আরামদায়ক। শুলেই ঘুম পায় ওর। আরামে চোখ বন্ধ করে বললো, “নিউজটা হট-ই। মেহজাবিন রিলেটেড।”
“কোন মেহজাবিন, আইপিই’র? প্র্যাক্টিক্যাল একটা মেয়ে। ভালো মেয়ে।” শুভ্র বললো।
চোখ খুলে গেলো তিথির, “কি রে? এতো অ্যাডজেক্টিভস? প্র্যাক্টিক্যাল, ভালো? আরে ব্যাটা ওই মেয়ে তোর সাথে একরাত কাটাতে চাইছে। পবিত্র মেয়ে তোমার, কুমারী নাম্বার ওয়ান।”

চোখ পিট পিট করলো শুভ্র, “তাতে কি হলো? অবজার্ভারে কাজ পেয়েছে ও, একটা সায়েন্স রিলেটেড শো-র অ্যাংকর। আমার সাথে মনে হয় ঐ স্যাটেলাইটের ব্যাপারটার জন্য রাত কাটাতে চাইছে। আগামী বছর লঞ্চ করবে স্যাটেলাইট, এটা নিয়ে সারা পৃথিবীতে খুব হই চই হবে। অবশ্য লাইম লাইটটা আমারও দরকার, বাংলাদেশের সোসাইটি নিয়ে আমার প্ল্যান আছে। দেশের মিডিয়া কাভারেজের একটা অংশ যদি মেহজাবিন দেয়, তাহলে খারাপ কি? ওর প্রস্তাবটা আমি ফেলবো না।”

উঠে বসলো তিথি, “মানে তুই ওর সাথে শুবি? ওরকম নষ্টা একটা মেয়ের-”
“ওকে নষ্টা বলছিস কেনো?” এক হাত তুলে তিথিকে থামিয়ে দিলো শুভ্র, “অনেকের সাথে সেক্স করে এসেছে এটাই তো অভিযোগ? একটু আগে ওকে অপবিত্রও বললি। আচ্ছা, একটা মেয়ে কয়েকজনের সাথে সেক্স করলেই কি সে অপবিত্র হয়ে যায়?”

তিথির চোখমুখ কঠিন হয়ে গেছে, “অবশ্যই হয়।”
“কেনো হয়? তার দেহের কোনো উপাদানে তো পরিবর্তন আসে না। তাহলে কেনো তাকে অপবিত্র ঘোষণা করা হয়?”
তিথি এর জবাব দিতে পারলো না। কিন্তু হার মানতে চাইলো না সে, জোর গলায় প্রতিবাদ করলো, “অবশ্যই কোনো না কোনো পরিবর্তন আসে। নাহলে বেশি মানুষের সাথে শুলে ছেলে বা মেয়ের যৌনরোগ হয় কেনো?”
“প্রটেকশন নেয় না তাই।” মুচকি হেসে বললো শুভ্র, তিথির কাছে বিষয়টা যতো সিরিয়াস, তার কাছে এটা ততোই হাস্যকর। একটি কৌতুক ছাড়া আর কিছু তো নয়। “প্রটেকশন থাকলে কোনো রোগও হয় না। অর্থাৎ প্রটেকশন থাকলে পবিত্রতা নষ্ট হয় না।”

“একটা মেয়ে তার সবকিছু আরেকজনকে এক রাতের জন্য দিয়ে দেবে অথচ তার পবিত্রতা নষ্ট হবে না?” ক্ষেপে উঠলো এবার তিথি, “ওই মেহজাবিন তো একটা মাগি। মাগির সাপোর্টে কতো কথা তোর! ওর সাথে শোয়ার খুব ইচ্ছা থাকলে শো না, যা। সেইটাকে পবিত্র করতে চাইছিস কেনো?”
“একরাতের জন্য তার সঙ্গে আমি যদি থাকি, কি হবে তুই জানিস তো?” মৃদু হাসিটা এখনও ধরে রেখেছে শুভ্র, “আমি তার সবকিছু দেখতে পাবো, স্পর্শের অধিকার পাবো, তার সঙ্গে সেক্সুয়াল ইন্টারঅ্যাক্ট হবে। এই দুটো ছাড়া আর কিছু তো নয়। একটা মানুষের লুকিয়ে রাখার আছেই বা কি। এতে করে তার দেহের গঠন পাল্টে যাচ্ছে না যেহেতু, আমার সাথে কাটানো রাতটার আগের দিন সে যতোটুকু পবিত্র ছিলো, পরের দিনও ততোটুকুই থাকবে। অন্য কারও সাথে রাত কাটানোয় একটা মেয়ের চরিত্র নষ্ট হয় না। পবিত্রতাও নষ্ট হয় না।”

লাল হয়ে এসেছে তিথির মুখ, “একটা কথা ঠিক বলেছিস অন্তত। মেহজাবিনের পবিত্রতা তোর সাথে শোয়ার আগে যা ছিলো পরেও তা থাকবে। আগাগোড়াই নষ্টা যে, তার পবিত্রতা তো নতুন করে যাওয়ার নাই। কিন্তু তোর মতামতে যদি এটা চরিত্র নষ্ট না করে, কোনটা করবে আর? কাকে তুই দুশ্চরিত্রা বলিস?”
খুব সহজ প্রশ্ন করা হয়েছে এভাবে তার দিকে তাকালো শুভ্র, “যে তার ম্যারেজ পার্টনারকে চিট করে সে-ই দুশ্চরিত্র। ধর, মেহজাবিন কাওকে বিয়ে করলো। তারপর সে আমার সাথে ওয়ান নাইটার হলো হাজব্যান্ডকে না জানিয়ে, তখন সে দুশ্চরিত্রা বলেই আমার কাছে পরিচয় পাবে। কারণ, তার ম্যারেজ পেপারে এ বিষয়ে একটা চুক্তি সে করে এসেছে। আদারওয়াইজ, শি ইজ আ নাইস গার্ল। প্র্যাক্টিক্যাল অ্যান্ড রেসপেক্ট্যাবল।”
“রেসপেক্ট্যাবল!”
“হুঁ।”
“জানিস ও কি বলেছিলো আমাকে? আমার সাথে তোর প্রেম চলে কি না তা জানতে চাইছিলো। আমাদের রিলেশন থাকলে সে আমার পারমিশন নিয়ে তোর সাথে শোবে, তাই।”
মাথা দোলালো শুভ্র, “এজন্যই তো আমি ওকে আর ওর মতো মানুষগুলোকে সম্মান করি। ওরা দারুণ মানুষ। মোটেও দুশ্চরিত্রা না। এটাই তোকে বোঝানো যায় না। এক বছরে কিচ্ছুটা শিখতে পারিসনি আমার কাছে।”

ছুটে আসা বালিশটা কোনোমতে এড়ালো শুভ্র। মুখ থেকে হাসি মোছেনি এখনও। ক্ষেপে বোমা হয়ে থাকা এলোমেলো চুলের তিথিকে দেখতে তার ভালোই লাগছে। রীতিমতো চিৎকার করছে এখন মেয়েটা।
“তুই যা। আজ রাতেই মাগির সাথে শুয়ে পর। পা ফাঁক করেই আছে মেহজাবিন মাগি। আমি এখনই ফোন করে বলে দিচ্ছি তুই রাজি। শালা…”

আরও কি কি জানি বলতে বলতে দরজার দিকে রওনা দিলো তিথি।
গলা চড়িয়ে ডাকলো শুভ্র, “আরে কই যাস? মম রান্না করছে। খেয়ে তো বের হ!”
কোনোভাবেই থামানো গেলো না তিথিকে। ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলো সে।
পেছন থেকে শুভ্রর গলায় শেষ যে কথাটা শুনতে পেয়েছিলো তা ওকে এই প্রথমবারের মতো শুনতে হয়নি।

“হিপটোনাইজড শালী!”

অন্ধকারে হলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটা লক্ষ্য করেছিলো, গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার।

পাঁচ.
আজ রাতেই ওরা শোবে।

বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে তিথি। ঘুম আসছে না। রুমমেট নাবিলা ওকে এরকম করতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছে। “কি রে, তোর শরীর খারাপ করছে নাকি?” বলে কপালে হাত বুলিয়েও দেখেছে। কিন্তু তিথির পড়ে পড়ে গড়াগড়ি খাওয়ার রহস্য ভেদ করতে পারেনি। তিথির চোখে আজ ঘুম নেই কারণ আজ রাতেই ওরা শোবে। শুভ্র আর মেহজাবিন। শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য।

শুভ্রর সাথে পরিচয়ের পর পর ওর সাথে সামাজিকতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হতো তিথির। বাংলার সমাজ তার সদস্যদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, তার মধ্যে বড় একটা অংশ “সে নো টু…” দিয়ে পরিপূর্ণ। এটা করা যাবে না, ওটা করা খারাপ, এটা অপরাধ, ওটা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞাসমূহের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এমন সব কর্মকাণ্ডের তালিকা যেগুলো যথারীতি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতির কারণ নয়। তারপরও তারা অপরাধ।

“মূল্যবোধ আর নৈতিকতা কি?” জানতে চেয়েছিলো শুভ্র, “স্রেফ কতোগুলো ধ্যানধারণা। আর সেগুলো এসেছে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। অর্থাৎ, পূর্বপুরুষেরা যা করা সঠিক মনে করেছে তাই তারা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তাদের চোখে যা করা ভুল, তা আমাদের চোখেও যেনো ভুলই হতে হবে। এর বাইরে তুমি যেতে পারবে না। গেলেই নৈতিকতা আর মূল্যবোধের প্রশ্ন আনা হবে।”

তখনও তিথির সঙ্গে শুভ্রর তুই-তোকারি শুরু হয়নি। শুভ্রের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলো ও। কিছু বুঝতে পারছিলো। আর কিছু বুঝতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো মানব সমাজের হাজার বছরের কুসংস্কার।

“আমার কাছে নৈতিকতা দুই রকমের,” বলে গেছিলো শুভ্র, “প্রকৃত নৈতিকতা, আর বানোয়াট নৈতিকতা। প্রকৃত নৈতিকতার মধ্যে পড়বে এমন সব কিছুই, যা অন্য কারও ব্যক্তিঅধিকারে প্রভাব ফেলে। ধরো, আমি একজনের ফাইলটা আটকে রাখলাম যেটা ছেড়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। সেটা নৈতিকতার অবক্ষয়। কারণ একজন মানুষ ন্যায্যভাবে যেটা পেতে চলেছিলো তা সে পাচ্ছে না। তাকে সেজন্য কেনো ঘুষ দিতে হবে? অথবা, ধরো আমি পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোনো মেয়েকে টিজ করে বসলাম। এটা নৈতিকতার অবক্ষয় হিসেবে আমি মেনে নেবো। এটা কিন্তু পূর্বপুরুষেরাও মানতেন, তাও আমি মানবো। কারণ কারও সঙ্গে কথোপকথনের গভিরতা দুই পক্ষের সম্মতিতে নির্ধারিত হয়। টিজিং এই ব্যক্তিঅধিকার লঙ্ঘন করে। তুমি আমাকে এধরণের যতো নৈতিকতা মেনে নিতে বলবে, আমি সহমত প্রকাশ করবো।”

“তাহলে সমাজের সঙ্গে তোমার সমস্যাটা কোথায়?” বিষয়টা স্পষ্ট করার জন্য জানতে চেয়েছিলো তিথি।

“ধরো, তুমি আজ সিগারেট খেতে খেতে ফুটপাতে হাঁটছো। কি দেখবে?”
“রাস্তার অর্ধেক লোক আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কানাঘুষো হবে। দুটো কথা শোনাতেও কেউ ছাড়বে না।” বিন্দুমাত্র দেরি না করে বলে ফেললো তিথি।
“অর্ধেক নয়, সবগুলো লোকই তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তোমাকে সদুপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব হবে না। এমনকি পুলিশি হ্যারাসমেন্টের শিকারও হতে পারো।”
“হ্যাঁ। কারণ, একটা মেয়ে ফুটপাতে হাঁটবে আর সিগারেট ফুঁকবে সেটা আমাদের সমাজে অ্যাকসেপ্টেড না।”
“অথচ পুরুষেরা এই কাজ অহরহ করে। কেউ চোখের পাতাটাও ফেলে না।” যোগ করলো শুভ্র, “তাহলে ভেবে দেখো, পুরুষ সিগারেট খেতে পারবে প্রকাশ্যে। অথচ নারী পারবে না। এই কুসংস্কার জন্ম নিলো কোথা থেকে?”

কাঁধ ঝাঁকালো তিথি, “এভাবে দেখলে তো হবে না। নারীরা সব কিছু পুরুষদের মতো করতে পারে তাই? তোমরা গরমের সময় খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে পারো। একটা মেয়ে কি জামা খুলে হাঁটতে পারবে?”
নিজের পায়ে থাপ্পড় দিয়ে উঠলো শুভ্র, পয়েন্টটা তিথি ধরে দেওয়াতে বেজায় খুশি হয়েছে সে, “এইটাকেই আমি বলি সামাজিক হিপনোটিজম, সিস্টার। সমাজ তোমাকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। সমাজ এই কোটি কোটি মানুষকে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। তুমি একটা মেয়ে হয়েও সিগারেট খেতে না পারার ব্যাপারে মেয়ে সমাজের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে সমর্থন করতে পারছো না। ছেলেরা কি করে পারবে? ফুটপাতে সিগারেট খাওয়ার প্রসঙ্গ তুমি ডিফেন্ড করছো প্রকাশ্যে জামা খুলে ফেলার প্রসঙ্গ দিয়ে। কারণ, তুমি সমাজের হিপনোটিজমে পড়ে গেছো। ইউ আর হিপনোটাইজড, তিথি। ইউ অল আর।”

“তাহলে তুমি চাইছো সিগারেট খাওয়াটা সবার জন্য বৈধ হোক। এটা কি স্মোকিংকে উৎসাহ দিচ্ছে না? দেখো, পুরুষেরা স্মোক করলেও নারীরা করতে পারছে না। বা করলেও তাদের কম করতে হচ্ছে। এটা তো অনেকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হচ্ছে। পুরুষ আর নারীর সংখ্যা প্রায় সমান ধরা হয়। অর্থাৎ সমাজের অর্ধেক সদস্য স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা পাচ্ছে।” যুক্তি দেখিয়ে গেছিলো তিথি।

“আরেকটা হিপনোটাইজড উত্তর দিলে, সিস্টার।” হাসিমুখে বলেছিলো শুভ্র, “তোমার কি মনে হয় ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে একটা মেয়ে সিগারেট খেলে সেটার প্রতিবাদে এগিয়ে আসা পুরুষ এবং নারীদের প্রথম মাথাব্যথার কারণ নারীর স্বাস্থ্য হয়? স্বাস্থ্যরক্ষায় স্মোকিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, পুরুষ হোক আর নারী হোক, প্রকাশ্যে স্মোকিংয়ে বাঁধা দাও, আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকবো। এ বিষয়ে কিন্তু জরিমানার আইনও আছে। কিন্তু যতোক্ষণ ছেলেরা সিগারেট খাচ্ছে, কিছুই আসে যায় না কারও। কিন্তু একটা মেয়ে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলেই সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। এর পেছনে শুধুমাত্র আছে তোমাদের পুরুষশাষিত সমাজের ইগো। সমাজের হিপনোটিজম। মেয়েরা খেতে পারবে না সিগারেট। মেয়েরা খেলতে পারবে না খোলামেলা শরীরে খেলা কোনো খেলা। তাও মার্গারিটা মামুন নিয়ে মাতামাতি কম হয়নি। যাহোক, কারণ হিসেবে সমাজের হিপনোটিজমের অংশ হিসেবে দেখাবে ধর্মের অনুশাসন। কিন্তু ফুটবল খেলায় পুরুষের সতর ঢাকা না হলেও কেউ প্রতিবাদ করবে না, অথচ ধর্মে পুরুষের হাঁটু পর্যন্ত না ঢাকা আর নারীর স্লিভলেস পরা একই জিনিস। তাও শুধুমাত্র মেয়েদের দলকে হাফপ্যান্টে নামাতে গেলেই প্রচুর কথা আসবে। তোমরা মা বোনদের ন্যাংটা করে মাঠে নামাচ্ছো। ধর্মের অনুশাসনের দিক থেকে দেখলেও দুই পক্ষ করছে আইন ভঙ্গ। অথচ সমাজের চোখে পুরুষের সাত খুন মাফ। যতো সমস্যা তোমাদের মেয়েদের নিয়ে। এমনকি ক্রিকেটেও প্র্যাকটিসে হাফপ্যান্ট পরে পুরুষ ক্রিকেটারগণ নামলে কারও জাত যায় না। মেয়ে ফিজিও হাফপ্যান্ট পরে মাঠের মাঝে গেলে দর্শকদের উত্তেজিত শিসের শব্দ শোনা যায়। এখানেই আমার সমস্যা, পুরুষের ক্ষেত্রে সমান প্রতিবাদ আসলে আমি এগুলোকে সামাজিক মূল্যবোধ বলে ধরে নিতাম। কিন্তু এখন আমি এই সব প্রথাকেই মনে করি সামাজিক অবক্ষয়। বুঝতে পারছো, সামাজিক হিপনোটিজমে আমরা সমাজের নৈতিকতাকে মানদণ্ড ধরে নিয়ে কতো বড় ভুল করেছি? এটা আমাদের মূল্যবোধ ধ্বংস করেছে। নিরীহ নারীদের প্রকাশ্যে কুপিয়ে ফেলে যাচ্ছে ব্যর্থ প্রেমিক। একা পেলেই একটা মেয়ের শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করছে পুরুষ। ভরা রাস্তায়ও করছে, ভিড়ের সুযোগে। হিজাব করে আসা মেয়ে হোক আর না হোক, ছাড় কিন্তু কাওকে দেওয়া হচ্ছে না। একটা মেয়ে হাফপ্যান্ট আর টপস পরে রাস্তায় জগিং করতে নামলো বাংলাদেশের রাস্তায়। প্রতি পঞ্চাশ ফিটের মধ্যে একবার তাকে টিজ করা হবে। সবাই চেষ্টা করবে তার ভাঁজগুলোয় চোখ বোলানোর। ভুল কিছু বললাম?”

“কিছু পুরুষের জন্য সবার দোষ হতে যাবে কেনো?” তিথি গতানুগতিক সব যুক্তিই সেদিন চেষ্টা করেছিলো।

“সামাজিকভাবে হিপনোটাইড একটা মানুষ তুমি। এই ধরণের ডিফেন্স যারা দাঁড় করায় তাদের সবাই সামাজিক হিপনোটিজমের শিকার। তুমি কি জানো, এই ‘কিছু’ পুরুষের প্রকৃত সংখ্যাটা কতো?” তিক্ত একটা হাসি ফুটে উঠেছিলো শুভ্রের মুখে, “দুই কোটি মাত্র। মোট জনসংখ্যার আটভাগের একভাগ। মোট পুরুষ জনসংখ্যার ওয়ান-ফোর্থ। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ জনসংখ্যার অর্ধেক।”

“হোয়াট! এতো বেশি হতেই পারে না-” প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো তিথি। তাকে একটা হাত তুলে থামিয়ে দিলো শুভ্র।

“এরচেয়েও বেশি হতে পারে। এরা সবাই টিজ করে না, কিন্তু বন্ধুর আড্ডায় হলেও মেয়েদের খেলো করে দেখে। পরিচিত মেয়েদের অঙ্গ প্রতঙ্গ নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করে। সবই ব্যক্তিঅধিকার লঙ্ঘন। আর দুই কোটি মানুষ এরকম নারীদেহ ভোগের জন্য ব্যক্তিঅধিকার ছাড়িয়ে যাওয়া আচরণ করছে কেনো জানো তুমি?”
তিথি এবার কোনো কথাই বললো না।
“কারণ, সমাজ আমাদের হিপনোটাইজ করে এমন কিছু বিষয়কে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছে যেগুলো আমাদের মূল্যোবোধের বারোটা বাজিয়েছে। সমাজ আমাদের ব্যক্তিঅধিকারকে সম্মান করতে না শিখিয়ে শুধু শিখিয়েছে সংখ্যালঘুদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অসম্মান করতে। একজন স্বাধীনচেতা মেয়ে এদেশে বিকিনি পরে সুইমিংপুলে নিজের মোটরসাইকেল ড্রাইভ করে যেতে পারবে না। সমাজ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। কারণ, তারা ওই মেয়েটির দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দেখাতে প্রস্তুত নয়। কারণ সে সংখ্যালঘু। সমস্যাটা তুমি বুঝতে পারছো?”

“তুমি তাহলে সমাজের থেকে কি আশা করো?” হাল ছেড়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিলো তিথি।
“সিম্পল। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিঅধিকারকে সম্মান করতে শেখা হোক। ফালতু সব বিষয় থেকে ট্যাবু উঠিয়ে দেওয়া হোক। তুমি কি জানো, এদেশের পুরুষেরা স্লিভলেস জামা পরা মেয়ে দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যায় কেনো? এমনটা গোটা দুনিয়ার কোথাও দেখবে না তুমি। আমি চাই সমাজ এইসব সমস্যার সমাধান গোড়া থেকে করুক। অকাজের কিছু মূল্যবোধ ধরিয়ে তা চর্চা করে এইসব সমস্যা আরও বাড়িয়ে না তুলুক।”

“এসব সমস্যার গোড়া বলতে কি বোঝাচ্ছো?”
“ট্যাবু। মূল্যবোধ আর নৈতিকতার নাম করে একপালা আজাইরা ট্যাবুতে ভরে আছে সমাজ। এই ট্যাবুগুলো তুলে ফেলতে হবে। নারী অধিকার এদেশে সবখানে খর্বিত এইসব ট্যাবুর জন্য।”

“এদেশেও প্রচুর সফল নারী রয়েছেন।” যথারীতি দ্বিমত পোষণ করলো তিথি।

“আর সেসব প্রতিটি সফল নারী হাজারো টিজ হজম করে, হাজারো নারীত্বের অপমানের শিকার হয়ে, হাজারো পিছুকথার প্রসঙ্গ হয়ে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লাখ লাখ মানুষের চোখে স্রেফ একজন মাগি হয়েই সেই সফলতার চূড়োয় উঠেছেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো, তাঁকে লাখ লাখ মানুষের কাছে মাগি হতে হলো কেনো? তোমার আর তোমার মতো হিপনোটাইজড মানুষগুলোর জন্য। একদিন তুমিও সমাজে সফল একজন নারীকে মাগি বলে গালি দেবে। সেদিন হয়তো বুঝবে আমার কথার সার্থকতা। সফল সাংবাদিক, সফল আর্কিটেক্ট, সফল অভিনেত্রি, সফল চিকিৎসক, কোন নারীচরিত্রটিকে যুবসমাজের বড় একটা অংশ চরিত্রহীন মনে করে না?”

“ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে অনেকেই চরিত্র খুঁইয়ে আসেন।” সোজাসাপ্টা বললো তিথি, “তো কি মনে করবে তাদের?”
“চরিত্র খুইয়ে আসে কিভাবে একজন মানুষ? বড়জোর আরেকজনের সঙ্গে শোয় কিংবা মিডিয়ার সামনে খোলামেলা হয়ে আসে, তাই তো? এটা কি করে চরিত্র খোয়ানো হলো? এখানে আরেকটা বড় প্রশ্ন চলে আসে, আসলেই যারা টাকার বিনিময়ে যৌনতায় অংশ নেয়, অর্থাৎ পতিতারা, তাদের কেনো সমাজ সম্মান করে না? মানুষের সম্মান তাদের কেনো দেওয়া হবে না?”
“এসব তর্ক অর্থহীন।” মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছিলো তিথির।
“না, হিপনোটাইজড মানুষগুলো এসব এড়িয়ে যায়। সবশেষে ক্ষতিটা হয় সমাজের। আরও একজন অসহায় নারীকে কুপিয়ে ফেলে রাখা হয়। আরও একজন মানুষের পর্ন ভিডিও নিয়ে মানুষ মাতামাতি করে, আরও একজন মানুষকে মানুষ মাগি পরিচয় দিয়ে সমাজে অচ্ছুত করে দেয়। এটা সলিউশন না, আলোচনাটা এড়িয়ে যাওয়া কখনোই সমাধান না, তিথি।”

“সলিউশন তাহলে কি?”
“অকারণ ট্যাবু সরিয়ে ফেলা। দেশে কো-এডুকেশন কয়টা প্রতিষ্ঠানে হয় বলো তো? ছেলে আর মেয়েকে আলাদা জায়গায় রেখে পড়াশোনা করানোর অর্থটা পরিষ্কার। দুই লাখ বখাটে আর নারীলোলুপের জায়গায় দুই কোটি বখাটে এবং নারীলোলুপ জনসংখ্যার জন্ম দেওয়া।”
“তোমার মনে হয় এরা ছেলেমেয়ে একসাথে বড় হলে নারীদের প্রতি-”
“হ্যাঁ, তারা নারীদের সম্মান দিতে শিখতো। জানতো মেয়েরা তাদের মতোই মানুষ। জানতো মেয়েদের শরীর আর তাদের শরীরের বিশেষ পার্থক্য নেই। একটা মেয়ের কনুই দেখেই মাথা ঘুরে যেতো না তাদের। তারা জানতো একটা মেয়েকে যৌনতা ছাড়াও ছুঁয়ে দেওয়া যায়, যেভাবে একটা ছেলেকে ছোঁয়া যায় যৌনতা ছাড়া। বন্ধুর সঙ্গে হাত মেলানো যায়, জড়িয়ে ধরা যায় যেমন, তা বান্ধবীকেও করা যায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরার সঙ্গে কামুকতার সম্পর্ক নেই তাও তারা শিখতো। কিন্তু তারা শিখেনি কিছুই। হয় তারা তাদের দেবী বানিয়েছে, নয়তো বানিয়েছে সেক্স ডল। মানুষ হিসেবে নারীকে দেখেনি ওরা। তুমি জানো আমার প্রতিটা শব্দ সত্যি। শুধুমাত্র সামাজিক হিপনোটিজমের প্রভাবে স্বীকার করতে বাঁধবে তোমার।”

ছয়.
তিথি খেয়াল করলো চোখের পানিতে কখন বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে সে। হ্যাঁ, সেদিনই ও মেহজাবিনকে মাগি বলেছে। নিজে একজন মেয়ে হয়েও তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান দিতে শেখেনি। তিথি মনের ভেতরে কোথাও জানে শুভ্রের প্রতিটা কথা সত্য। তুখোড় বুদ্ধিমত্তা দিয়ে হাজারবার এই দর্শনটাকে যাচাই করে তবেই সে মেনে নিয়েছে। স্রেফ আবেগের বশে অথবা কিছু নব্য সমাজবিরোধীদের মতো প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে এসব বুলি সে আওড়ায় না। তার কথা শুনে প্রাথমিকভাবে তিথি মনে করতো ছেলেটা মনে হয় ফ্রি-সেক্স প্রতিষ্ঠা করতে চায় এদেশে, হয়তো নিজের সুবিধার্থেই। একবছর তার সাথে থেকে এটুকু বুঝেছে, সেক্স নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণে অকারণে তিথিকে ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টাও সে কখনো করেনি।

হ্যাঁ, তিথিকে শুভ্র ছুঁয়ে দেয় মাঝে মাঝে। তবে সেটা ঠিক ততোটাই যতোটা সে কোনো ছেলে বন্ধুর সঙ্গে করে। মেকানিক্যালের নাফিসকে সে যেভাবে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়, যেভাবে তার সঙ্গে হাই ফাইভ বিনিময় করে, তিথির সাথেও ততোটাই। শুভ্রের মধ্যে কামুক কোনো স্বভাব নেই। রয়েছে শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত মূল্যায়ন। ব্যক্তিজীবনের মূল্যহীন ট্যাবু এড়িয়ে চলা। তাই সে বাকিদের মতো লুকিয়ে পর্ন দেখে না। সাউন্ডবক্সে পর্ন প্লে করতে তার আপত্তি নেই, সঙ্কোচ নেই বেডরুমে কিসা সিন্সের নগ্ন ছবি টাঙ্গিয়ে রাখতে। এবং তার পরিবার হিপনোটিজম থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারাও এমনটাই আশা করে তার থেকে। যৌনতা আর ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ট্যাবু করার কারণেই সামাজিক মূল্যবোধের এতো অবক্ষয় তা তারা মানে, তবে এর যথেচ্ছ প্রয়োগ কখনোই করে না। তারা যৌনতার লোকদেখানো স্বাধীনতা চায়নি কখনো, বরং সহজাত মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো লুকিয়ে রেখে সামাজিক অপরাধ প্রবণতা প্রকট করাতেই তাদের আপত্তি।

তিথি এখনও জানে না, এটাই এই ঘুণে ধরা সমাজের একমাত্র চিকিৎসা কি না। বাংলাদেশের আর সব মানুষের মতো তারও ধারণা ছিলো কেবলমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনই পারে সমাজকে সবার জন্য সহনীয় একটা স্থানে পরিণত করতে।

শুভ্র বলেছিলো, “এটা তুমি ঠিক বলেছো। ধর্ম সমাজটাকে সবার জন্য শান্তিপুর্ণ একটা স্থান বানাতে পারে। যখন প্রতিটা মানুষ ধর্মীয় অনুশাসণ মেনে চলতে প্রস্তুত, তখন। যখন মানুষ হৃদয়ে ধর্মকে ধারণ করে, আবেগে নয়, তখন। বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখো। কতোজন হৃদয়ে ধর্মকে ধারণ করে? চার শতাংশও কি হবে?”

একশ জনে চারজন? তিথি এটা মেনে নিতে পারেনি। প্রতিবাদ করে বলেছিলো, “আমাদের দেশটা ধর্মপ্রাণ হিসেবে পরিচিত কিন্তু।”

“আবেগে আর কথায়। কাজে নয়। এটা এখনও এদেশি জনগণ বুঝে উঠতে পারেনি। এটা খুব খুবই হতাশাজনক।” বলেছিলো ও, “তুমি কি জানো, ইসলামে গান শোনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, গাইরে মাহরাম (বিয়ে নিষিদ্ধ) সম্পর্কের সব মেয়েদের দিকে তাকানো নিষিদ্ধ, বিবাহপূর্ব যৌনমিলনের শাস্তি আবশ্যকীয় ভাবে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড?”
“তো?”
“এদেশে কয়জন রাস্তায় বের হলে সামনে মেয়ে পড়লে চোখ সরিয়ে নেয়? তাকায় পর্যন্ত না তাদের দিকে? এদেশে কতোজন মানুষ গান শোনা ছেড়েছে ধর্মীয় কারণে? এদেশে কতোজন মানুষ বিয়ের আগে প্রেম করেনি? একশতে চারজন কি খুব বেশি হয়ে গেলো না? একশ’তে একজনও কি পাবে তুমি এমন?”
“মানছি, এতো সাধু সন্ত আমরা এক হাজারে একজন পাবো। কিন্তু তুমি ধর্মকে দায় দিচ্ছো কেনো? ধর্ম না মানা তো ব্যক্তির ব্যর্থতা।”

হেসে ফেললো শুভ্র, “আমি ধর্মকে দায় দিচ্ছি না। বরং সব সময় বলে এসেছি ধর্মীয় অনুশাসন একটি সমাধান। তুমি একটা সমাজে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে কোনো অনাচার চলবে না। পারফেক্ট সমাজ ব্যবস্থা সেটা।”
“তাহলে একটু আগে যে বললে-”
“আমি দায় দিচ্ছি বাংলাদেশের মানুষের। আমরা ছিলাম বৌদ্ধ, হয়েছি পরে পৌত্তলিক, তারপর হয়েছি মুসলিম, এরপর খেয়েছি ইংরেজের ধাতানি। আমাদের হৃদয়ে ধর্ম নেই, তিথি। বাংলাদেশের মানুষ হৃদয়ে ধার্মিক নয়, তারা কথায় বুলি ফোটায়। আবেগে জেহাদী জোশ দেখায়। হৃদয়টা ফাঁকা। একারণেই এদেশে জঙ্গি রিক্রুট করা এতো সহজ।”
“তুমি আশা করতে পারো না একটা প্রগতিশীল দেশের একশ জন মানুষের মধ্যে আশিজনই প্রবলভাবে ধার্মিক হবে।”

হেসেছিলো শুভ্র, “তুমি আমার কথার মূলভাবটাই ধরতে পারোনি। বেশিরভাগ মানুষই পারে না। এর পেছনেও আছে সামাজিক হিপনোটিজম। আমার বক্তব্যের একটা স্পষ্ট উদাহরণ দেই তোমাকে। কাল থেকে ঘোষণা করা হলো, কারও বাড়ির ভেতর থেকে গান-বাজনার আওয়াজ পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করে দশ বছরের জেল দেওয়া হবে। কেউ প্রেমিকার সাথে বিছানায় গেলে সেটা যদি ধরা পড়ে, প্রেমিক-প্রেমিকাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। চুরি করে কেউ ধরা পড়লেই তার হাত কেটে দেওয়া হবে। এগুলো কিন্তু এই ক্রাইমগুলো ঠেকাতে খুব কার্যকর। আমি এই আইনগুলোর প্রশংসা করি, কারণ এগুলো প্রচণ্ড ভীতি ছড়াতে পারে। অপরাধ কমে আসতে পারে এভাবে। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিলো, বাংলাদেশের মানুষ এটা নিতে পারবে কি না সেই প্রশ্নের ওপর। বাংলাদেশিরা কি রাজি হবে গান শুনতে ধরা খেলেই কারাগারে গিয়ে ঢুকতে? কিংবা প্রেমিকার সাথে শুয়ে মুণ্ডু হারাতে? তারা রাজি হবে না। একশজনের মধ্যে চারজনকেও এর সপক্ষে পাবে না তুমি। বাংলাদেশিরা বলবে, এসবই লঘু পাপে গুরু দণ্ড। যদি মুখে ধর্মীয় অনুশাসনের ভয়ে নাও বলে, বাংলাদেশি হৃদয় এসব আইন মেনে নিতে চায় না। তুমিই বলো, তোমার রুমমেটকে যদি পুলিশ এসে নিয়ে যায় তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে শোয়ার অপরাধে তারপর তাকে মেরে ফেলা হয়, তোমার মুসলিম বন্ধুদের কারও হৃদয় কি মেনে নেবে সেটা?”
মাথা নাড়লো তিথি, “না মনে হয়। ধর্মে আছে বলে হয়তো কিছু বলবে না, তবে মেনেও নিতে পারবে না।”
“আর তুমি মনে করছো ইসলামী অনুশাসন এই দেশের সমাজের জন্য অ্যাপ্লিকেবল? তুমি যেটা অ্যাপ্লাই করতেই পারবে না সেটা কি করে সামাজিক সমস্যার সমাধান হবে? সমাজ তো মানবগোষ্ঠী নিয়েই গঠিত। মানুষ যদি প্রস্তুত না থাকে তাহলে কি করে তুমি সেই সমাজে একটা সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধরে নেবে?”

“সেজন্য ধর্মীয় অনুশাসন সঠিক পদ্ধতি হলেও বাংলাদেশের জন্য কোনো সমাধান নয়।” মাথা দোলালো তিথি, “কথাগুলো তুমি সঠিক বলেছো, অন্তত।”

শুভ্র একটা সিগারেট ধরিয়েছিলো, “অথচ তুমি চাইলেই এদেশি জনগোষ্ঠীকে কো-এডুকেশনে পাঠাতে পারো। অযথা ট্যাবুগুলো তুলে ফেলতে পারো। মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নেওয়ার চেয়ে বেশি প্রস্তুত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে। বাংলাদেশের সমাজ থেকে নারীত্বের অবমাননা সরিয়ে নিতে এর চেয়ে নিখুঁত আর প্রয়োগযোগ্য আর কোনো সমাধান আমার চোখে পড়ে না। ধর্মীয় সমাজব্যবস্থাগুলো নিখুঁত, তবে বাংলাদেশি সমাজে প্রয়োগের অযোগ্য।”

এপাশ ওপাশ করতে শুভ্রের সঙ্গে হয়ে যাওয়া কথাগুলোই বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবছে তিথি। ছেলেটার মাথা পরিষ্কার। বাংলাদেশী সমাজকে মেয়েদের জন্য সহনশীল করে তুলতে চেয়েছিলো ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান দেওয়ার মাধ্যমে। এর চেয়ে সহজ সমাধান আসলেই আর হয় না। শুধু প্রয়োজন প্র্যাকটিস। কোনো বাড়তি আইন মানার চাপ নয়, প্রাণ খোয়ানোর ভয়ে নতুন বিশৃঙ্খলা নয়, শুধু অপরজনকে সম্মান করতে শেখা। সহজাত মানববৃত্তীয় আচরণগুলোকে লুকিয়ে না রেখে প্রকাশ্য করে ফেলা। লিঙ্গ বৈষম্য কমাতে দুই জাতির মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা।

তিথি কখনোই সেগুলো মেনে নিতে পারেনি।
হাজার বছরের হিপনোটিজম সে এড়িয়ে যেতে পারেনি। আজকে রাতে শুভ্র মেহজাবিনের সঙ্গে শুতে চলেছে সেটা সে একেবারেই মেনে নিতে পারছে না।

ফোনের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গলো ওর। চোখ মুছে হাতে তুলে নিলো যন্ত্রটিকে।
শুভ্র!

পরিশিষ্ট.
বিআরটিসি কাউন্টারের সামনে এসে তিথিকে কিছু খুঁজতে হলো না। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে বসার জায়গায় পিঠ দিয়ে আকাশ পানে পা দুটো তুলে মূর্তিমান বাদুড় হয়ে আছে। প্রকাশ্য দিবালোকে এই পাগলামি, তিথির রাগ না উঠে কেনো জানি হাসি আসে। হারামজাদা সমাজের বিরুদ্ধে একেবারে মূর্তিমান এক বিদ্রোহ!

“তিথি।” চশমা ছাড়াই বললো শুভ্র, মুখে হাসি।
ওর পাশে ধপ করে বসে পড়লো ও, “খুব কেলাচ্ছিস? করলি না কেনো?”
চশমা পরলো না ছেলেটা, ঝলমলে চুল মধ্যাকর্ষণ শক্তিবলে নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে, “কি করলাম না?”

শুভ্রের চেহারায় এই অবাক হয়ে যাওয়ার অভিব্যক্তি দেখতে অসাধারণ লাগে তিথির। হা করে সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ও।

“মেহজাবিনের সাথে কালকে রাতে ডিনারে তো গেছিলিই, করলি না কেনো?”
হেসে ফেললো শুভ্র, “গাধীটা তোকে বলে দিয়েছে, তাই না?”
“আরে আমাকে দোষ দিয়ে গেছে সে। আমার দোহাই দিয়ে নাকি এড়িয়ে গেছিস। ছি ছি, তোর দর্শনের উল্টোদিকে গেলো না এসব?”
“কোথায়? আমি কি করবো তা তো আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় পড়ে। আমি আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা খাটিয়েছি।”
“মেহজাবিন তো বললো অন্য কথা।” হাত বাড়িয়ে শুভ্রের রেশমি চুল ছুঁয়ে দিলো তিথি, “তুই নাকি ওকে বলেছিস, অ্যানিথিং ফর তিথি’স ফ্রেন্ড।”
চোখ বন্ধ করে ফেললো শুভ্র, “হ্যাঁ। তিথির ফ্রেন্ড আমার ইন্টারভিউ নেবে, এতে আপত্তির কি আছে। যতোবার ডাকবে যাবো। এজন্য ওর সাথে বিছানায় যাওয়ার দরকার কি আমার ছিলো, বল্?”

একটু হেসে হাতব্যাগটা পাশে রেখে দিলো তিথি। শুভ্রের চোখ খুলে গেলো আবার। ঘোলা চোখেই তিথির কোমর থেকে পা পর্যন্ত চোখ বোলালো।

“জিন্স পরেছিস মনে হচ্ছে?”
“চুপ করে শুয়ে থাক। এতো পর্যবেক্ষণে কাজ কি তোর?”
দুষ্টু হাসি শুভ্রের মুখে, “বাদুড় হবি?”
“বাদুড় হওয়ার অধিকারই বা একলা তোকে দিয়েছে কে? প্রেসিডেন্ট স্যার ইস্যু করেছেন?”

খানিক বাদেই এলাকাবাসী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বাইশ-তেইশ বছরের দুই তরুণ তরুণী সিমেন্টের সিটের বসার জায়গায় পিঠ দিয়ে দুই জোড়া পা সরাসরি আকাশ পানে তুলে শুয়ে আছে।

মুখ ফিরিয়ে শুভ্রের দিকে তাকালো তিথি। ছেলেটাও তার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে, চশমা নেই চোখে। চুলগুলো চোখে এসে পড়ছে। হতাশ হলো তিথি, ছেলেদের এতো রেশমি চুল থাকতে নেই। অপার্থিব মায়ার জন্ম দেয় তারা।

“মেহজাবিনের সাথে তুই শুলে সেটা আমার সামাজিক হিপনোটিজমের জন্য খারাপ লাগতো না রে।” ফিসফিস করে বললো তিথি।
“জানি।” নির্বিকারভঙ্গিতে বললো শুভ্র।
তিথির সুন্দর ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেছে, “কিভাবে জানিস?”
“কারণ, মেহজাবিনের সাথে আমিও শুতে পারিনি অন্য একটা কারণে। সেই কারণটাও সামাজিক হিপনোটিজম না।”
“বাসিস?” কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে তিথির গলা।
“বাসি।”

কি সুন্দর পিটপিট করে তাকাচ্ছে এখন জিনিয়াস পাগলটা! তিথির ভেতরে গিয়ে লাগে চোখজোড়ার মায়া।

“ট্যাবু ভাঙ্গতে শুরু করি, চল্।” দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে উঠলো মেয়েটির চোখের তারায়।

অবাক বিস্ময়ের যেসব এলাকাবাসী এতোক্ষণ তাদের লক্ষ্য করছিলো, তাদের চোখগুলো কপালে তুলে দিতেই যেনো আরও কাছে চলে এলো বাদুড় হয়ে থাকা মানুষদুটোর মাথাজোড়া।
তারপর টুপ করে ডুবে গেলো একে অন্যের ঠোঁটের অতল গভিরতায়!

— ০ —

রচনাকাল – নভেম্বর ২২, ২০১৬

স্ল্যাং

‘শালার পুতেরে আজ ফাইড়া লামু।’
তুষারের ফুলে ওঠা নাকের দিকে চিন্তার সাথে তাকিয়ে থাকে রেজা। চিন্তিত মুখ হওয়ার কারণ আছে।
যাকে শালার পুত বলে সম্বোধন করা হচ্ছে সে ওদের কলেজেরই একজন ছাত্র এবং এই শালার পুতকে তুষার ফাঁড়তে পারবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সাইজে ওপরে এবং পাশে সে তুষারের দেড়গুণ করে এগিয়ে। মানুষটার নাম ইন্তিসার।
ঘরের মাঝে ফোঁত জাতীয় একটা শব্দ এই সময় হল। শব্দের মালিক নেই, তবে মালকিন আছে।
তন্বীকে দেখা যায় একটা সুন্দর টিস্যু বের করে নাকে হাল্কা ঘষা দিতে। মেয়েটার সব সুন্দর, নাকও সুন্দর। শুধু কান্না করার ধরণটা সুন্দর না। কেমন একটা পেঁচী পেঁচী ভাব এখন চলে এসেছে। রেজা ওদিকে তাকায় না।
‘থাক, মারামারি করার দরকার নাই।’ পেঁচীটা বলল।
ঘরের শেষ সদস্য হুমায়ূনপ্রেমী আসাদ মাথা নাড়ে এবার, ‘অবশ্যই দরকার আছে। একশবার দরকার আছে। নারী হল পবিত্র জাতি। মাতৃপ্রতিনিধি তারা। নবীজি বলেছেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সেই জাতিকে অপমান! ইন্তিসারের চামড়া আমরা খিঁচবো।’
‘এর মাঝে আবার খেঁচাখেঁচি কেন?’ আহ্লাদী কণ্ঠে তন্বী জানতেই চায়।
‘না না…’ ভুল ভাঙ্গাতে এগিয়ে আসে তুষারই, ‘ওটা হল চামড়া খেঁচা। মানে, ইন্তিসারের চামড়া- তুলে নেব আমরা। তারপর সেটাকে পা দিয়ে খুঁচব। চামড়া হবে খেঁচা।’
আসাদ কাজের কথায় চলে আসে, ‘এই বাবা-মার অবৈধ সন্তানকে আমরা পাচ্ছি কোথায়?’
হেঁচকি ওঠার মত একটা শব্দ করে তন্বীর কান্না থেমে যায়, ‘আংকেল-আন্টি – কিভাবে জানো তুমি?’
আবার এগিয়ে আসে তুষারই, ‘আরে ওই গদ্যকারের কথা ধরছ কেন? ও বলতে চেয়েছে হারামজাদা ছেলেটাকে পাচ্ছি কোথায়?’
‘ইন্তিসারের সাইজ দেখেছিস? ভোটকা হালায়। সহজে পারা যাবে না।’ প্রথমবারের মত রেজা মুখ খোলে এখানে।
‘মারামারির দরকার…’ তন্বী কথা শেষ হওয়ার আগেই আসাদ একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি দেয়। যার অর্থ, দরকার আছে।
‘রেঞ্চ বাইর কর। আংকেলের গ্যারাজে থাকতে পারে।’ পরামর্শ দেয় তুষার।
‘অস্থিমজ্জাতে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত পড়লে সেটা সহজে নিরাময় করা যায় না। যন্ত্রণা তাকে আমরা দেবো, আর ওটা থাকবে মাসব্যপী।’ আসাদের মন্তব্য।
চোখ পাকিয়ে তাকায় রেজা, ‘হাওয়ার নাতি – তুমি সোজাসাপ্টা কথা বলা শিখো। বইয়ের ভাষা টোটানো লাগবে না। বললে কি সমস্যা যে হাড্ডিতে রেঞ্জের বাড়ি পড়লে হালার পো একমাস নড়তে পারবে না?’
তন্বীর কানে নতুন শব্দটা ঘুরছে। চোখে আরেকবার টিস্যু চালিয়ে জানতে চায়, ‘টোটানো মানে কি?’
এদিক ওদিক তাকায় রেজা সাহায্যের আশাতে। এলিট মেয়েগুলো কী! ছেলেরা গালি ছাড়া কথা বলতে পারে নাকি? এর মাঝে এসে বসে থাকে। এরা আবার হয় অতি সভ্য। বাজে কথা বলতে নারাজ। শুনতেও। অনেক মেয়ে ছেলেদের ব্রাদারহুড সম্পর্কে কিছুই জানে না।
এখনও!
সাহায্যে আবারও তুষার, ‘ও কিছু না। একটা গালির কাছাকাছি শব্দ।’
আরেকটু ধরিয়ে দেয় আসাদ, ‘শুরুটা চ-বর্গের একটি অক্ষর দিয়ে।’
ঘাড় মটকায় রেজা, ‘প্রথমটা।’
পরিস্থিতি বুঝে তন্বী একেবারে চুপ।
আসাদদের বাসায় ওরা আছে। তাই নিশ্চিন্ত। ছেলেটার বাবা-মা প্রথম শ্রেণির। এখন ও যাচ্ছে রেঞ্চ আনতে। রেজাকে ‘ফাঁড়তে’ হবে।
আসাদের বাবা-মা ভাগ্য এতটাই ভালো, সহপাঠী থেকে শুরু করে এলাকাবাসী তাকে হিংসে করে। তার কোন কথায় তাঁদের অমত নেই। ছেলেটা গুন্ডা হতে পারতো, তা না করে সে হচ্ছে লেখক। সারাদিন লেখে। কাগজে-কলমে। হাজার চেষ্টা করেও তাকে কম্পিউটারে লেখা শেখানো যায়নি।
আসাদের যুক্তি, ‘টাইপ শিখতে আমার যে সময় লাগবে তাতে আরও দুটো ছোটগল্প আর এক উপন্যাসের অষ্টমাংশ লেখে ফেলা যাবে।’
এই মুহূর্তে আসাদ নিচের দিকে নেমে যায়। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। এত বড় মাপের বড়লোক ঘরের সন্তান হয়েও আসাদের মাঝে মধ্যবিত্তদের ছোঁয়াই বেশি কাজ করে। তাদের সাথেই সে ঘোরে। এমনকী সেরকম কলেজেই তাকে পড়ানো হয়। বাংলা মিডিয়াম। আসাদের বাবা নিজে মধ্যবিত্ত ছিলেন বলেই উচ্চশ্রেণিতে একটি নির্দিষ্ট বয়েসের আগে ছেলের প্রবেশ করেছেন নিষিদ্ধ।
ছেলে তুলনামূলক দরিদ্র ছেলেমেয়েদের সাথে চলবে। জীবন কতটা কঠিন শিখবে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবে উচ্চবিত্তের ছোঁয়াতে। তাহলে তার গোল্লায় যাওয়ার সুযোগ নেই।
এই মুহূর্তে আসাদের বাবার মুখ এজন্য হয়ে আছে গম্ভীর। ছেলের কাছে আজ এক মেয়ে এসেছে। যে ফেরারী মেয়েটি ড্রাইভ করেছে– সেটা উচ্চবিত্তের পরিচয় বহন করে। ছেলে কলেজে পড়ে এখন। যথেষ্ট বড় হয়েছে, একটা প্রেম সে করতেই পারে। থাকতে পারে একজন গার্লফ্রেন্ড।
এসব তিনি বোঝেন এবং মানেন। মেয়েটাকে যথেষ্ট আপসেট বলে মনে হয়েছে। সম্ভবতঃ প্রেম-বিষয়ক জটিলতা। কিন্তু এরকম একটি মেয়ের সাথে আসাদ চলবে কেন? বড়লোকের ছিঁচকাদুনী মেয়ে জীবনের কি বোঝে? ছেলে তো নষ্ট হবে দেখা যায়।
লোয়ার ক্লাস ফ্যামিলির সংগ্রামী মেয়ে কি ছিল না একটাও এদেশে?
ঠোকা না খেলে কেউ বড় হতে পারে না। ‘ঠোকা’টা যে আসাদ কবে খাবে! ছেলের ভবিষ্যত চিন্তাতে কালো হয়ে যায় আসাদের বাবার মুখটা। আরও কয়েক ডিগ্রী।
তবে মেয়েটা সুন্দর আছে। লম্বা এবং ফর্সা। চেহারার খাঁজে খাঁজে আভিজাত্য। এই কারণেই অবশ্য তিনি চান না ছেলের সাথে ওরকম কোন মেয়ের প্রেম হোক। কারণ এরা হল ‘পৃথিবী’ নামক গেমটির চীট-কোড সুন্দরী। অভিজাত বংশের মাঝে বিয়ে হয়ে হয়ে এদের জন্ম। ফিল্টারড। আর্য। চীটকোড দিয়ে খেলাটা রহমান সাহেবের পছন্দ না।
চায়ের কাপটা তিনি মাত্র টেবিলে রেখেছেন, চুপ চুপ করে তার পাশে এসে দাঁড়ায় আসাদ।
‘বাবা? ব্যস্ত?’ শুরুতেই জানতে চায় ছেলে।
একটু হাসেন রহমান সাহেব, ‘না রে। কিছু বলবি?’
‘বড় দেখে একটা রেঞ্চ লাগবে। তোমার গ্যারেজে আছে না?’
‘তা আছে। কেন?’ অবাক হন তিনি।
স্বাভাবিকভাবেই বলে আসাদ, ‘ইন্তিসার নামে আমাদের ক্লাসে এক ছেলে আছে। অনেক লম্বা আর স্বাস্থ্যবান।’
রহমান সাহেবের বুঝতে এবার আর সমস্যা হয় না, ‘ও, ছেলেটার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে? আমাদের ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দাও। ওর লোকেশন জানো তো?’
ঘাড় শক্ত হয়ে যায় আসাদের, ‘না। গাড়ি ওর ঠিক আছে। রেঞ্চ লাগত অন্য কারণে।’
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেব।
‘মানে, ওটা দিয়ে মারতাম আর কি।’ জানায় আসাদ।
রহমান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখে মুখে হতচকিত ভাব। তারপর ছেলেকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন বাড়ির বাইরের দিকে। গ্যারেজে ঢুকেও হাত ছাড়লেন না। তারপর টুলবক্স খুললেন। সবচেয়ে বড় রেঞ্চটা বের করে তুলে দিলেন আসাদের হাতে।
‘যা, ব্যাটা। ফাটিয়ে দে। একেবারে ফেঁড়ে ফেলবি!’ হুংকার দেন তিনি।
খুশির সাথেই হাতে রেঞ্চ নিয়ে বাসার দিকে রওনা দেয় আসাদ। এই না হলে বাবা!
পেছনে চমৎকার হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেবও। ছেলে ‘ঠোকা’ খেয়েছে। এটাই এখন সবচেয়ে বড় কথা।
নাহ, বড়লোকের মেয়েরা সবাই অকাজের হয় না দেখা যাচ্ছে। ধারণা পাল্টানোর শপথ নিতে নিতে মূল বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যান তিনি।

দুই
যাকে ফাটিয়ে আর ফেঁড়ে ফেলতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ তুষারের ‘শালার পুত’ ইন্তিসার এই মুহূর্তে একটা চায়ের দোকানে বসে আছে।
শার্টের ডান হাত গেছে ছিঁড়ে। বেকায়দাভাবে বাতাসে উড়ছে ওই অংশটা। সেই হাতে আধ-টুকরো কলা আর এক টুকরো রুটি। এটা খেলে দিনের প্রথম ও শেষ খাওয়াটা তার হয়ে যায়। এরপরে একটা সিগারেট। গোল্ডলীফই ইন্তিসারের পছন্দ। কিন্তু এই কলা আর রুটির দাম মেটাতে গেলে ওর আর গোল্ডলীফ কেনার টাকা থাকবে না। শেখ খেতে হবে মনে হচ্ছে আজকে।
টাকা মানুষকে শ্রেণিতে ভাগ করে। আর ক্ষুধা আনে এক কাতারে। ব্যাপারটা ইন্তিসার ভালোই টের পাচ্ছে। ওর সামনে বসে থাকা ছেলেটার নাম নিতাই। সে একটা বাসী রুটি খাচ্ছে। তার হাতেও একটা কলা। তবুও ছেলেটাকে যথেষ্ট সুখী দেখায়। ছোট ছোট চুল-সম্বলিত একটা মাথা এই ছেলের আছে।
কলাটা তার কাছে ছিল না। ওটা কিনে দিয়েছে ইন্তি। শুধু শুকনো রুটি খাচ্ছিল দেখে ওটুকু করতে তার তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল।
ইন্তিসার আজ দুই দিন ধরে পলাতক। প্রি-টেস্টের রেজাল্ট কলেজ দিয়েছে। আর তাতে ও করেছে দুই বিষয়ে ফেল। তাকে টেস্ট পরীক্ষা দিতে দেবে না আর।
কলেজ থেকে বাসাতে গিয়েই রেজাল্টের কথা ও বলে দিয়েছে। নিমেষেই মা ছেঁচকি নিয়ে তাড়া করে ওকে বের করে দেন। ছেঁচকির তাড়া খাওয়া খুব একটা সুখের ব্যাপার না। ছেঁচকির ভয়েই হোক আর আত্মসম্মানবোধের তাড়নায় – সেই থেকে ও বাসার বাইরে। সাথে ছিলই পঞ্চাশ টাকা। তিন দিনে সব শেষ।
আয়েশ করে সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল তারপর। এর পরে আর সিগারেট পাওয়া যাবে না সহজে।
কলেজ ড্রেস পরেই আছে। ওই অবস্থাতেই সে বিতাড়িত। সাথে আছে ব্যাগও। কাজেই গত তিনদিনই ক্লাস করতে সে গেছিল। কাজের কাজ কিছু হয় না। তবে সময় কাটে।
‘ভাইজান, আরেকটা কলা লইলাম?’
নিতাইয়ের ডাক শুনে তাকাতেই হয় ওকে, ছেলেটা ইন্তিসারের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই কলা ছিঁড়ে ফেলেছে আরেকটা। ওটার দাম কিভাবে দেবে সেটা এখন একটা ভালো প্রশ্ন হতে পারে – তবে তা নিয়ে ভাবতে ইন্তি চায় না।
‘তোর বাড়িতে আর কে কে আছে?’
কলায় রাক্ষসের মত কামড় দিয়ে পিচ্চিটা তাকায় পিটপিট করে, ‘একগা বাইয়ার মা।’
চোখ কুঁচকে যায় ইন্তির, ‘খেয়ে বল। মুখে খাবার নিয়ে কথা বলার দরকার তো নাই।’
‘একডা বাই আর মা।’ বলেই হাসে নিতাই।
ছোট্ট একটা নাকের দুই পাশে দুটো সুন্দর সুন্দর চোখ। ইন্তিসারের দেখতেই ভালো লাগে। তন্বীকে দেখাতে পারলে হত। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা একবার স্পর্শ করে ও। বের করে না। করে লাভ নেই। চার্জ পায় না আজ কয়েকদিন। চার্জারটাও বাসায়। নিতাই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে।
‘বাড়ি থেকে পলাইছেন নি?’
ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে ইন্তিসার, তারপর মৃদু ধমক দেয়, ‘একদম চুপ করে থাক। চুপচাপ কলা খেয়ে ভাগ চোখের সামনে থেকে।’
নিতাইয়ের হাসি এতে কমে না। ভাইজান লোক খারাপ না, এটা তার বোঝা হয়ে গেছে।
‘হাত ছিঁড়া জামা পিন্দে ঘুরে না কেউ। আপনেরে আমি কাইলকাও দেখছি। হাত ছিঁড়া জামা পিন্দে ঘুর ঘুর করতেছেন।’
‘আর তাতেই ধরে ফেললি আমি বাড়ি থেকে পালাইছি? থাপড়ায়ে তোর চাপা আলগা করে ফেলব।’
‘বাড়ি থেকে না পলাইলে কেউ রুটি আর কলা খায় না রাইত দশটায়।’ মুখ বাঁকায় নিতাই।
‘আমি খাই। ঠিক আছে?’
ইন্তিসারের রাগত চেহারার দিকে তাকিয়ে নিতাই থম মেরে যায়, ‘ঠিক আছে।’
দুইজন কিছুক্ষণ একেবারেই চুপ চাপ থাকে। কথাবার্তা ছাড়াই শেখে টান দিয়ে যাচ্ছে ইন্তিসার। একের পর এক।
নিতাইয়ের কলা খাওয়া শেষ। ছোট ছেলেটা আকাশের দিকে মুখ করে আছে। থুতনিটা সরাসরি ইন্তিসারের দিকে তাকিয়ে আছে যেন।
ইন্তিসারও আকাশের দিকে তাকায়। আজকের আকাশে মেঘ আছে। পাতলা মেঘ না, কালো মেঘ। চাঁদের একটা টুকরো দেখা গেলেও হতো। তাও দেখা যাচ্ছে না।
‘ভাইজান?’ নিতাইয়ের ডাকে আবার তাকাতে হয় ওকে।
‘তোর কলা খাওয়া হয়েছে?’
‘জ্বে।’
‘তাইলে ফোট।’
নিতাই ‘ফোটে’ না। আরেকটু কাছে সরে আসে, ‘ও ভাইজান।’
‘কিছু বলবি? টাকা শেষ কিন্তু – আবদার করলে রাখতে পারবো না।’
‘না ভাই। আবদার করতাম না। কইতেছিলাম, কাল রাইতে ছিলেন কই?’
পিচ্চি কি গোয়েন্দা নাকি? বিরক্ত লাগে ইন্তিসারের, তবুও উত্তর দেয়, ‘বড় মাঠের এক কোণে শুয়েছিলাম। রাস্তায় ধুলোবালি বেশি। মাঠে মশা অনেক জ্বালালেও ধুলো তো নেই।’
অনুনয় ভরা চোখ মেলে দেয় নিতাই, ‘আইজকা আমাগো বাড়িতে ঘুমাইবেন, চলেন।’
ইন্তিসার একবার ওই চোখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘না।’
শরীফ মামার কাছে আজ থেকে চা-সিগারেট খায় না ইন্তিসার। গত তিন বছরের বাঁধা কাস্টোমার। কাজেই একটা কলার দাম পরে দিতে চাওয়ার প্রস্তাবটা তিনি হাসিমুখেই মেনে নিলেন।
ইন্তিসার রাতের রাস্তায় হাঁটছে। পথ দেখাচ্ছে নিতাই। ওদের বাসাটা বস্তির ভেতর।
মুখে না বললেও ইন্তিসার সেখানেই যাচ্ছে। বাসার অবস্থা জানতে চাইলে নিতাই বলেছে, চারদিকে ‘বোড’ আর ওপরে ঢেউটিন। পানি-টানি নাকি ঢোকে না বৃষ্টির সময়। আকাশে যে মেঘ দেখে এসেছে আজ রাতে বৃষ্টি নামতেই পারে।
মাঠে শুয়ে বৃষ্টির পানি নিয়ে কান ভর্তি করে ফেলার চেয়ে নিতাইয়ের কুটিরে জায়গা নেওয়া ভালো কাজ।
ইন্তিসার রওনা হওয়ার দেড় মিনিট পরেই রেজা, তুষার আর আসাদরা গাড়ি থেকে নামে। শরীফ মামার দোকানে ইন্তিসারকে পাওয়া যাবে এটা তল্লাটের প্রত্যেকে জানে। কাজেই এতদূর আসতে তাদের কোন অসুবিধে হয়নি। শরীফ মামা জানালেন বন্ধুরা দেরী করে ফেলেছে। ইন্তিসার লক্ষার বস্তিতে গেছে। সাথে আছে নিতাই নামের এক হতচ্ছাড়া শিশু।
গাড়ির ভেতর থেকে তন্বী আরেকবার মিন মিন করে বলে, ‘মারামারির কি খুব দরকার ছিল?’
আসাদ একনজর তাকায়, ‘দরকার নিশ্চয় ছিল। সংবাদ শোননি? আমাদের শত্রু কীয়ৎকাল পূর্বেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে।’
ট্রান্সলেট করে দেয় তুষার, ‘হালারে সেইরাম ঘাড়ানো দরকার। ভাগতেছে হালায়!’
ইন্তিসার আর নিতাইকে খুঁজে পেতে ওদের বেশিদূর যাওয়া লাগল না। দৌড়ে এসে তিনদিক থেকে ওকে ঘিরে ফেলে ওরা।
তুষার ছুটে গিয়ে বড় সাইজের রেঞ্চটা দোলাতে দোলাতে পেছন থেকে আঘাত করে ওর মাথাতে।
মনোযোগ দিয়ে নিতাইয়ের কথা শুনছিল ইন্তিসার– মাথার ভেতরে যেন গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয় ওর। চরকির মত যন্ত্রণার উৎসের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই ওদের তিনজনকে চোখে পড়ে। রেঞ্চ তুলে আবারও আঘাত করতে যাচ্ছে তুষার।
এবার ইন্তিসার প্রস্তুত ছিল – খপ করে ধরে ফেলে রেঞ্চটা। মাথা ঝিম ঝিম করছে ওর। খুলির পেছনে অবর্ণনীয় একটা ব্যথার অনুভূতি। মাথাটা কি ফেটে গেছে?
একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মাথা কিভাবে ফাটাতে পারে?
তবুও শান্ত কণ্ঠেই প্রশ্ন করে ও, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তুষার?’
‘খানকির পোলা!’ দাঁতে দাঁত চেপে হুংকার ছাড়ে তুষার, ‘তন্বীকে বাজে বলার আগে তোর দুইবার ভাবা উচিত ছিল।’
দুই পা বাড়িয়ে ইন্তিসারের চোয়াল বরাবর ঘুষি হাঁকায় এবার রেজা। দুই হাতে তুষারের হাতের রেঞ্চ আটকে রাখাতে একেবারেই অরক্ষিত হয়ে ছিল ও – এবার ছিটকে পড়ে মাটিতে। হাত থেকে রেঞ্চ ছুটে গেছে।
ওটার দিকে আবারও হাত বাড়িয়েছে তুষার – কিন্তু তাকে বাঁধাই দিতে পারে না ইন্তিসার। মহিষের মত ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আসাদ। কাজেই তার দিকে মনোযোগ দেয় ও – প্রকাণ্ড ঘুষিতে কাঁপিয়ে দেয় আসাদকে।
সাহিত্যিকের খুলি নড়ে গেছে। পা ছড়িয়ে রাস্তাতে বসে পড়ে মানুষটা। এই ফাঁকে চট করে ঘুরে দাঁড়াতেই রেজার পরের ঘুষিটা আসতে দেখে ও।
ঝট করে একপাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়াল ও – কানের পাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে শক্তিশালী হাতটা, ওটার সাথে শরীরের সংযোগ যেখানে, তার একটু নিচে বুকের পাঁজরের ওপর পর পর দুইবার ঘুষি মারে ইন্তিসার।
রেজার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। ফুসফুস আঘাত সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে এখন। বড় করে হা হয়ে শ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টায় তাকে দেখায় ডাঙায় তোলা এক মাছের মতো। তার বুকে একটা জোর ধাক্কা দিতেই হুড় মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল ছেলেটা।
তুষারের রেঞ্চের আঘাতটা এবার ভয়ানক ছিল। গায়ের জোরে মেরেছে – ইন্তিসারের মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে।
আরও একবার হাত তোলে তুষার। মরণ আঘাতটা হানে তখনই। চোয়ালের ওপর আছড়ে পড়েছে রেঞ্চ। কড়কড় শব্দ শুনে ইন্তিসার বুঝে নেয় হাড় ওখানে কিছু ভাঙলো।
টলে উঠে ও মাটিতে শুয়ে পড়ে শক্ত শরীরটা নিয়ে। চলে যাচ্ছে না ওরা তিনজন? তন্বীকে নিয়ে কি বলেছে ও? ও হ্যাঁ – গালি দিয়েছিল। এজন্য মেয়েটা ওর পেছনে এদের লেলিয়ে দিয়েছে? ইন্তিসারের বিশ্বাস হতে চায় না।
পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে নিতাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে না?
‘ভাইজান! ভাইয়া – ও ভাই গো… ‘

তিন
থানা থেকে লোক এসে বসে আছে, শুনে নিচে নামতেই হল রহমান সাহেবকে।
ব্যাপারটা তিনি সাথে সাথেই বুঝে নিলেন। সুপুত্র আসাদ কারও মাথা ফাটিয়ে এসেছে।
রোজ একটা ছেলে কারও না কারও মাথা ফাটালে ওটা হতে পারে গুন্ডামি। কিন্তু গার্লফ্রেন্ডের সাথে অবিচারের প্রতিবাদে বছরে একটা মাথা ফাটানো প্রশংসার দাবী রাখে। রহমান সাহেব এর মাঝে দোষ খুঁজে পান না। ব্যাপারটা হল, ছেলে পৃথিবীর মাঝে লড়াই করতে শিখছে। লড়াইয়ের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। খুব আছে।
কাজেই সন্তুষ্ট রহমান সাহেব নিচে নেমে আসলেন এবং ওসির সাথে নিজে কথা বললেন।
ওসি সাহেব এতক্ষণ অপেক্ষা করে চা-টুকু খেয়ে শেষ করে ফেলেছেন। একটু একটু করে চানাচুর মুখে দিচ্ছিলেন। চানাচুরটা টাটকা না। চারপাশে তাকিয়ে যতদূর দেখা যায় এবং চারপাশে কান পেতে যতটুকু শোনা যায় – রহমান সাহেব যথেষ্ট বড়লোক।
বড়লোকদের রান্নাঘরে কি বাসী চানাচুর থাকে? থাকার তো কথা না।
পরক্ষণেই জাঁদরেল ওসি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন, এরা নিঃসন্দেহে টাটকা চানাচুরের কিছু বয়াম দুই বছরের জন্য স্টোর রুমে ফেলে রাখে। এতে ওটা হয় বাসী। তারপর তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে রান্নাঘরে রাখা হয়। যখন এমন কোন মানুষ আসে বাসাতে যাকে সোজা বাংলাতে বলা হয় ‘অনাহূত অতিথি’ – তখন তাকে ওই বয়াম থেকে এক বাটি চানাচুর আর এক কাপ চিনি ছাড়া চা দিয়ে বোঝানো হয়, ‘তোমাকে আমরা চাই না। তুমি মারা খাও।’
বড়লোকরাও কি ‘মারা খাও’ টার্মটা ব্যবহার করে? আজকের তরুণ সমাজে সেই চলছে শব্দ দুটো। ওসি মাজহার আলম সন্দেহের মাঝে পড়ে যান।
এই মুহূর্তে তিনি তাকিয়ে আছেন রহমান সাহেবের দিকে। ভ্রু দুটো আছে বেশ কুঁচকে।
‘বুঝলেন তো। আসাদের ঝামেলাটা এড়ানো যাবে না মনে হচ্ছে।’
‘কেন?’ অবাক হয়ে গেলেন রহমান সাহেব, ‘কে কোন গলিতে মার খেয়ে পড়ে থাকলে সেটাতে আসাদের নাম কেন আসবে?’
‘আপনাদের একটা অডির গাড়ি ছিল। আইডেন্টিকাল জিনিস। এলাকাতে আর কারও তো নেই। বাংলাদেশেই আছে তিনটি। কাজেই কেসটা বেশ শক্ত হয়ে গেল।’
‘আমার নামে কেস করবেন আপনি?’ হাসির কোন কথা শুনেছেন এভাবে বলেন রহমান সাহেব।
‘ছি ছি। আপনার নামে কেস করতে পারি? কেসটা আসাদের নামে চলে যাবে মনে হচ্ছে। আর তার বন্ধুদেরও সমস্যা হবে। একটা মেয়ে বোধহয় ওখানে ছিল। তন্বী। আসলে, গাড়িটা না নিয়ে গেলে আমরা কেসটা ছেড়ে দিতে পারতাম। এখন তো সম্ভব না। অনেকে দেখে ফেলেছে।’
‘কয়জন দেখেছে?’ চোখ সরু করে অর্থপূর্ণভাবে জানতে চান রহমান সাহেব।
আমতা আমতা করেন ওসি, ‘মানে – দেখেছে কিভাবে বলি – কিন্তু, চারজন সাক্ষী দিয়েছে পুলিশকে।’
‘ধামাচাপা দেওয়া যাবে না?’ গলা নামিয়ে বলেন আসাদের বাবা।
ওসির গলাও নেমে যায়, ‘কিছু পাত্তি লাগবে স্যার। মুখ বন্ধ করতে হবে – পোস্ট-মর্টেমের রিপোর্ট এদিক ওদিক করে দিতে হবে – এইসব স্যার!’
‘পোস্ট-মর্টেম! হারামজাদা মরে গেছে নাকি? মার্ডার কেস? মারা খাইলাম দেখি!’ হড়বড় করে বলে ফেলেন রহমান সাহেব।
এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। ছেলে মারামারি করে এসেছে জেনে স্বাভাবিক ছিলেন। দেখা যাচ্ছে খুন করে ফেলেছে সে! খুনের কেস সহজে মেটে না, জানেন তিনি। ভয়টা এখানেই পেয়েছেন।
ওসি বড়লোক মানুষটাকে চিমসে যেতে দেখে একটু হাসলেন। এই লোক এবার মারা খেয়েছে। টাকা বের হয়ে আসার তো কথা।
‘ঠিক মারা যায়নি এখনও, তবে যাবে। প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে, পাবলিক এক হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে আছে শালা। যে কোন সময় মরে গিয়ে আমাদের কাজ বাড়াবে।’
‘ওকে তাড়াতাড়ি ভালো একটা ক্লিনিকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করুন। আর টাকা নিয়ে ভাববেন না। ধামাচাপা দিতেই হবে ব্যাপারটা। অল্প বয়েস – রক্ত গরম, বোঝেনই তো।’
ওসি মাথা নাড়লেন। তিনি এখন সব বুঝতে প্রস্তুত। আজগুবী অলৌকিক যাই বলে বসুন রহমান সাহেব, ওসি এখন তাই বুঝবেন। কারণ এখন টাকা কথা বলছে।
যখন টাকা কথা বলে, আর সবাই চুপ হয়ে যায়।

চার
‘তাহলে তোমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসো না?’ তৃতীয়বারের মত প্রশ্নটা করেন রহমান সাহেব।
তাঁর ভয় হচ্ছে ছেলে-মেয়ে দুটো একে অন্যকে পছন্দ করে কিন্তু সহজাত সামাজিক ভয়ে বাবাকে বলতে পারছে না। তিনি বাবা হলেও এসব ফালতু সংস্কার নিয়ে ভাবেন না – এটা তারা কবে বুঝবে?
‘আমরা বন্ধু। শুধুই বন্ধু। কিন্তু, কেন বাবা? এসব প্রশ্ন করছ কেন?’ অসহিষ্ণু হয়ে জানতে চায় আসাদের বাবা।
‘কারণ অডির গাড়িটা নিয়ে তোমার বের হওয়ার কারণে ফেঁসে গেছ তোমরা। বোঝা গেছে?’
চুপ হয়ে যায় আসাদ। রহমান সাহেব কড়া দৃষ্টি মেলে দেন তন্বীর দিকে। এই মেয়ে আসলেই অলুক্ষণে। জানে না দুনিয়ার হালচাল – ছেলেকে দিয়েছে উস্কিয়ে।
‘অ্যাই মেয়ে, তোমার নাম কি?’ রুক্ষভাবে জানতে চান রহমান সাহেব।
‘ত-তন্বী।’
‘যে ছেলেটাকে মারলি তোরা তার নাম কি?’
‘ইন্তিসার।’ দুইজনই বলে একসাথে।
‘সে কি করেছিল?’ চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করেন তিনি।
‘তন্বীকে বাজে কথা বলেছিল, বাবা। খুবই বাজে।’
‘শোনা যাক। কি বলেছিল? বলার অযোগ্য কিছু?’
মাথা নামায় তন্বী, ‘ইয়ে – ও বলেছিল আমার আম্মু নাকি ড্যাডি ছাড়া আর কেউ– ইয়ে – তারপর আমার জন্ম।’
চোখ কপালে উঠে যায় রহমান সাহেবের, ‘কেন একথা বলল সে?’
আমতা আমতা করে তন্বী আবারও, ‘আমি ওর শার্টের হাতা ছিঁড়ে দিয়েছিলাম। তাই।’
‘হায় রে দুচির ভাই! এত বদ ছেলের তো মরাই উচিত। এত অল্প ঘটনায় এভাবে বড়দের নিয়ে নোংরা কথা-’
কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি। একটা ছেলে কেন এত সুন্দর একটা মেয়ের বাবা মাকে নিয়ে বাজে গল্প রটাবে চারপাশে? এমনটা তো ঠিক নয়। ব্যাপার তখন আসলেই পার্সোনাল হয়ে যায়। কাকে দোষ দেবেন তিনি এখন? ইন্তিসারকে না তার ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের?
ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না রহমান সাহেব।
‘এক সেকেন্ড!’ হাত তোলেন তিনি একটা দিক মনে হতেই, ‘ঘটনা তো এমন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে না। হিসাব আমার মেলেনি। ঠিক কি এই কথাই বলেছিল তোমাকে ইন্তিসার?’
মাথা নাড়ে মেয়েটা, ‘ঠিক তা না – একটা গালি দিয়েছিল।’
‘তারপর?’
‘আসাদের কাছে ছুটে আসলাম পুরো অর্থটা জানতে। ছেলেরা কোন কথা কেন বলে আমি আজ ঠিক মত বুঝে উঠতে পারিনি।’
‘ক্লাসে শুধু তুমি আসাদের সাথেই মেশো শুনেছিলাম। কেন? স্ট্যাটাস দেখে ফ্রেন্ডশিপে তুমি বিশ্বাসী?’
হঠাৎ রহমান সাহেবের প্রশ্নটা শুনে চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে তন্বী। এর উত্তর সে দেবে না।
মেনে নিয়ে মাথা দোলান আসাদের বাবাও, এজন্যই বড়লোকি দেখিয়ে বেড়ানো মেয়ে তাঁর পছন্দের না।
তন্বী চুপ হয়ে আছে তার পেছনে একাধিক কারণ আছে। আসলেই সে লোয়ার ক্লাসের মানুষকে পছন্দ করে না। তাদের মুখ থেকে গালি শুনতে সে নারাজ। দ্বিতীয়তঃ এই ছেলেকে রিফিউজ করার চেয়ে কঠিন মারের সাথে রিফিউজ করা ভালো। ইন্তিসারের তার প্রতি দুর্বলতা আছে। দুর্বলতা কাটাতে হবে এবং এভাবে কাটানোটাই সবচেয়ে ভালো পথ। অন্তত তন্বীর মতে।
‘সে যাকগে – তাহলে বলবে – ঠিক কি উচ্চারণ ইন্তিসার করেছিল। মানে তোমাকে বলা ইন্সাল্টিং বাক্যটা?’
‘উম – ও বলেছিল -’ একটু ভাবে তন্বী, ‘ও এরকম কিছু বলেছিল- “হারামজাদী, শার্টটা ছিঁড়ে দিলি যে!”’
অবাক হয়ে যান রহমান সাহেব এবার আসলেই, ‘ এতো আজকের তরুণ সমাজের স্বাভাবিক আচরণ। “আম্মুকে আংকেল” তত্ত্ব আসল কোথা থেকে তাহলে?’
‘আসাদকে হারামজাদীর মানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।’ বিড় বিড় করে জানায় তন্বী।
‘সে কি বলল?’ অগ্নি দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন রহমান সাহেব।
‘যদি কারও আম্মুকে তার আব্বু বাদে আর কেউ ‘ইয়ে’ করে আর তারপর তার জন্ম হয় – তবে সে হয় হারামজাদী।’
মাথায় হাত চাপড়িয়ে বসে পড়লেন রহমান সাহেব। আজকের দিনে যে ভাষা ছেলে-মেয়েরা ব্যবহার করে – তার তলা খুঁড়তে গেলে মহা ফ্যাসাদে পড়তেই হবে। ‘চ’-বর্গীয় গালির তো অভাবও নেই মাশাআল্লাহ, তার ওপর আছে দেদারসে ব্যবহার। বুৎপত্তিগত অর্থ খুঁজলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। আর তাই করেছে তাঁর গুণধর ছেলে।
‘আর এই জন্যই খুন করে ফেললি তোরা ছেলেটাকে?’ হুংকার ছাড়েন তিনি।
‘খুন?’আঁতকে ওঠে তন্বী।

পরিশিষ্ট
মাথায় নরম একটা হাত চুলে আদর করে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই টের পায় ইন্তিসার।
তন্বী কি বুঝতে পেরেছে ওকে তেমন কিছুই সে বলেনি। রাগে একটু ধমক দিয়েছে খালি। তাও তো দিতো না। দুইদিনের খিদে ছিল পেটে। তাই দিয়েছে।
ভালোবাসার মানুষটাকে কি আর মন থেকে গালি দেওয়া যায়?
নিজের ভুল বুঝেই কি হাসপাতালে এসেছে তন্বী ওকে দেখতে? চোখ বন্ধ করে ওর ওরকমই লাগে।
নরম হাতটা এবার ওর গালে এসে থামে। হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে ওকে।
‘তন্বী?’ চোখ মেলে ইন্তিসার অনেক কষ্টে।
নিতাইয়ের গম্ভীর মুখটা দেখা যায় সামনেই।
‘ভাইজান উঠতাছেন ক্যান? ঘুমায় থাকেন। আমি আপনেরে ঘুম পাড়ায় দেই?’
চারপাশে তাকায় ইন্তিসার। নতুন কোন জায়গা মনে হচ্ছে। ভালো কোন ক্লিনিক।
আসাদের বাবার কাজ হয়তো। ঝামেলা দেখে ওকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।
আঁতিপাতি করে তন্বীকে খোঁজে ইন্তিসারের চোখ দুটো। কিন্তু মেয়েটি নেই কোথাও। উচ্চবিত্তের একটি মেয়ে যখন নিজের ভুলে মধ্যবিত্তের একটি ছেলেকে মৃত্যুশয্যায় ঠেলে দেয় – তারা সেই শয্যার ধারে কাছে আসে না। ক্ষমা প্রার্থনা শব্দটি তাদের জন্য নয়। ছিল না কোনদিনও।
আস্তে করে শুয়ে পড়ে ও আবারও। নিতাইয়ের চোখে অনুনয়। আজও।
‘ঠিক আছে, নিতাই।’ বিড় বিড় করে বলে ইন্তিসার, ‘আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দে।’

— ০ —

হোয়াই ডু দে ডু ইট! 

শেষ পর্যন্ত ছ্যাঁকা খেয়েই গেলাম। অথচ কয়েকদিন আগেও যারা প্রেমে পড়ে নানা রকম পাগলামি-ছাগলামি করে তাদের কী নোংরা নোংরা গালিই না দিয়েছি। ব্যাটারা প্রেমে পড়তে শিখিসনি তো প্রেমে পড়বি কেন? যেমন আমার কলেজের বন্ধু আশরাফ। পড়লো কার প্রেমে? প্রতিরক্ষা মন্ত্রির মেয়ের! এদিকে আশরাফের চালচুলা নাই, পকেটে এই ইয়া বড় একটা ফুটা। শিক্ষাগত যোগ্যতা? ঠনঠন। এভাবে কি আর হয়?

আশরাফকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম জাভিয়াস ডাইনে। কোণের এক টেবিল দখল করে বলেছিলাম, “উপমন্ত্রির মেয়ে পিক করলেও একটা কথা ছিলো। হাত বাড়িয়েছিস একেবারে মন্ত্রির মেয়ের দিকে! আইফেল টাওয়ারে হাত বাড়া। একেবারে চাঁদের দিকে কেন রে ভাই?”

আশরাফ বলেছিলো, “বন্ধু মদ খাবো।”

আমি এই বন্ধুটিকে অত্যন্ত স্নেহ করি। তারপরও যুক্তির বাইরে কথা বলতে শুনলে আমার রাগ হতে থাকে খুব। স্বাভাবিকভাবেই রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেলো একেবারে।

বললাম, “বোকাচোদার মতো কথা বলবি না। মদ খাবি মানে? মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে জানি। তাই বলে মদ খাওয়া কি করে যুক্তিপূর্ণ হয়? তুই তোর শরীরের ভেতরের রাসায়ানিক দ্রব্যাদির জন্য কষ্ট পাচ্ছিস। মাথায় নানা রকম কেমিকেল নড়াচড়া করছে এখন তোর। সেগুলোই আসলে তোর ইমোশন। ওরা কুড়কুড় করে তোকে কষ্ট দিচ্ছে। মাথার ভেতরের কেমিকেলের দোষে তুই লিভারের বারোটা বাজাবি কেন?”

আশরাফ বলেছিলো, “গাঁজাবাবা ইয়াসিরের নাম্বারটা তোর কাছে আছে?”

আমার মেজাজ উত্তোরত্তর গরম হতে থাকে। রেস্তোরার এই প্রান্তটা কাঁপিয়ে ওকে একটা’রাম’-ধমক দিলাম। 

“গাঁজা খাবি কোন সাহসে?” গর গর করে উঠলাম আহত বাঘের মতো, “গাঁজা খেলে কি আর মেয়েটা ফিরে আসবে? ব্যাটা গাণ্ডু! যুক্তিপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত

আশরাফ আমার দিকে লাল লাল চোখে করে বলেছিলো, “যুক্তিবুদ্ধি তোর হুজ্ঞির মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো। ইয়াসিরের নাম্বার দে।”

আমি সেদিন-ই বুঝেছিলাম আশরাফের মতো গাধা একটা ছেলেকে দিয়ে জীবনে কোনো উন্নতি হবে না। নয়তো প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে এমন পাগলামি কেন করবে বাইশ-তেইশ বছরের একটা ছেলে? এসব কাজ করবে পনেরো-ষোলো বছরের কিশোর। চুপচাপ গাধাটাকে ইয়াসিরের নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। তোর লিভার আর তোর ফুসফুস। গাঁজা খেয়ে খেয়ে চালুনি বানিয়ে দে। আমার কি আসে যায়!

আশরাফের মতো ছেলেরা মনে করে মেয়েদের প্রেমে ওই ব্যাটারা একলাই পড়ে। দুনিয়ার আর সবাই সমকামী। কেন, আমি প্রেমে পড়িনি? ছ্যাঁকা খাইনি? অবশ্যই খেয়েছি। যে মেয়েটার সাথে জীবনের প্রথম বিছানায় গেছিলাম সে-ই ছ্যাঁকা দিয়ে দিলো। আমার তেমন কিছু তো মনে হয়নি তখন। মন খারাপ হয়েছে। মন তো খারাপ হবেই। একটা মেয়ের সাথে প্রতিদিন এভাবে মিশতাম, আর কখনও মেশা হবে না। এটা তো মন খারাপের ব্যাপারই।

কিন্তু আমার শত্রুও বলতে পারবে না ছ্যাঁকা খেয়ে আমি গাঁজায় টান দিয়েছি। মদ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছি। অশ্লীল আর আপত্তিকর একটা গালি দিয়ে গেল আমার যে বন্ধুটি, ওই আশরাফও বলতে পারবে না এমন কথা। কারণ আমি জানি আমার ওই কষ্টগুলো এসেছে মস্তিষ্ক থেকে। মস্তিষ্কের খেলায় বিভ্রান্ত হয়ে নিজের জীবনটা শেষ করে দেওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। কোনই যুক্তি নেই!

১.

ঘাপলাটা বাঁধলো বইমেলায়।

স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। একজন দুইজন পাঠক এসে অটোগ্রাফ চাইলে সেটাও দিচ্ছি। জায়ীফ নামের ছেলেটার বই এই বছর প্রথম প্রকাশ হয়েছে। কাজেই ওকে সমানে ক্যালানো হচ্ছে। বেচারা মুখ খোলার চেষ্টা করলেই আমরা উচ্চারণ করছি’ট্রিট’। ফোন বের করলেই একটু আগে বিশালবক্ষা যে তরুণীটি তার অটোগ্রাফ নিয়ে নিজের নাম্বার লিখে ওর বুকপকেটে রেখে গেছে তার ব্যাপারে মনে করিয়ে দিতে ভুলছি না। জায়ীফ একেবারে লাল হয়ে আছে। দেখতে একটু সুন্দর আর লেখক হলে এই দেশে দুই হাতে ঠেলেও মেয়েদের ভিড় সরানো যায় না। জায়ীফ সেই মুহূর্তে এসব উপভোগ করছিলো। হাত দিয়ে ঠেলছিলো না অবশ্য, লেখকদের স্ক্যান্ডাল খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই অঞ্চলে।

সতেরোকে আমি প্রথম দেখেছিলাম সেই মুহূর্তে। আসলে আমি আজ নিশ্চিত না কিভাবে কি হয়েছিলো। একটা হুড়ুমধাড়ুম ধরণের শব্দ হলো। তারপর মাটিতে অতি রূপবতী এক মেয়েকে দেখলাম গড়াগড়ি করছে। মেয়েটির সঙ্গে স্বামীপ্রবর সটান দণ্ডায়মান। তিনিও পড়লেন, স্ত্রীকে তুলতে গিয়ে। একেবারে কুমড়োর মতোই গড়িয়ে গেলো ওরা।

প্রকাশনীর এডিটর মাশরুর ভাই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। একটু দুশ্চিন্তায় পড়লে ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে যায়। কপাল থেকেই এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে তিনি চিৎকার জুড়ে দিলেন, “কি হয়েছে! কি হয়েছে?”

আমি কেবল বললাম, “জায়ীফের জন্য হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে একটা মেয়ে পড়ে গেছে।”

জায়ীফ কটমট করে আমার দিকে একবার তাকালো। আমাকে শায়েস্তা করার জন্য যথেষ্ট সময় তার ছিলো না। অতি রূপবতী কোনো মেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে যাবে আর জায়ীফ তার অতিবিনয়ী সার্ভিস দিতে সেদিকে ভদ্রতার হাসি হেসে যাবে না? এমন দিনও বাংলাকে দেখতে হয়নি আজতক।

খাঁটি নারী-শিকারীর মতো ব্যাটাকে এগিয়ে যেতে দেখলাম। পড়ে থাকা মেয়েটির দিকে দু’হাত বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়লো তরুণ লেখক, “ইশ, খুব লেগেছে মনে হচ্ছে। দেখে শুনে পা ফেলবেন না? বইমেলার রাস্তাঘাট তো হাইওয়ে না, আপু। এখানে ওখানে ইট-মিট বের হয়ে থাকে।”

মুখে আপু ডাক, আর বইমেলাকে গালির তুবড়ি ছোটানো, সবই জায়ীফের প্লে-স্ট্র্যাটেজি। এর মধ্যে যা করার করে ফেলেছে সে। সুন্দরীকে আধেক জড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পেছনে সুন্দরীর স্বামীপ্রবর এখনও মাটিতে। ভদ্রলোক কোমরে দারুণ ব্যথা পেয়েছেন বলে মনে হলো। জায়ীফের দিকে সাহায্যের আশায় একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনিও। তরুণ লেখক তাকে পাত্তাও দিলো না।

ভদ্রলোককে তোলার সময় খেয়াল করলাম জিনিসটা। আমাদের প্রকাশনীরই একটা স্পুল। কিভাবে যেন তার বেরিয়ে পড়েছে, রাস্তায় কিছুটা ছড়িয়ে ছিলো তাতেই পা বেঁধে কেলেঙ্কারী। সাধাসিদে ধরণের একজন মানুষ, আমাকে হাত থেকে ছাড়া পেতেই গা ঝাড়া শুরু করলেন, “কোমরটা মনে হয় গেছে।”

ঠিক তখনই বইটা দেখতে পেলাম। ভদ্রলোকের পাছার তলে পড়ে ছিলো এতোক্ষণ। ’রক্তক্ষরণ’, আমার লেখা বই। গত বছর প্রকাশিত, নতুনটা নয়। মলাটের বারোটা বেজে গেছে একেবারে। রূপবতী তরুণী এই দফায় হাহাকার করে উঠলো, “শেষ করে দিয়েছো তুমি একেবারে!”

স্বামীপ্রবর লজ্জিত একটা হাসি হাসলেন। তরুণী জায়ীফের বাহুডোর থেকে প্রজাপতিদের মতো উড়ে উড়ে চলে এলো মাটিতে পড়ে থাকা বইটির দিকে। ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেলো তার। লাল হয়ে গেলো সাথে সাথে।

আমিও বরফের মতো জমে গেলাম। ঘটনা এখন পরিষ্কার। দাঁতে দাঁত চেপে কোনোমতে শুধু বলতে পারলাম, “মাইরালসে আমারে। এক্কেরে মাইরালসে।”

মেয়েটা এতো কিছু খেয়াল করলো বলে মনে হলো না। আমার দিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়েছে সে এরই মধ্যে, ক্ষমাপ্রার্থনাস্বরূপ কি কি জানি বলে যাচ্ছে এখনও। তার মধ্যে আমি কেবল কোনমতে কলম বের করে জানতে চাইলাম, “কি নামে হবে?”

মেয়েটা বললো, “সতেরো।”

সতেরো কি কোনো মানুষের নাম হয়? এতো একটা সংখ্যা। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকলো। অটোগ্রাফ দিতে দিতে পেছনে কি কথা বার্তা হচ্ছে আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।

আমাদের সহজ-সরল এডিটর মাশরুর ভাই এখনও গলা তুলে হম্বিতম্বি করছেন, “কি হয়েছে! হচ্ছেটা কি এখানে!”

জায়ীফ তার দিকে মিষ্টি করে হেসে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে উত্তর দিলো, “লিয়নের জন্য হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে একটা মেয়ে পড়ে গেছে।”

২. 

এক সপ্তাহ পর সতেরো আমাকে নক করলো। আর সবাই যেমন বলে তেমনটাই বললো প্রথমে, “কি লিখেছেন! ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম ছাই। এখন এখান থেকে বের হতে পারছি না আর।”

আমিও আর সবাইকে যেমন বলি, তেমনটাই বললাম। “মতামত জানানোর জন্য ধন্যবাদ। হেহে।”

শেষের’হেহে’টা একটা বোকাচন্দ্র ধরণের ভার্চুয়াল বিনয়ের হাসি। এটা দিতে হয়। সেই সঙ্গে একটা শুষ্ক ধন্যবাদ। ভুলেও এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না। বেশি কিছু বলতে গেলে এক কথা থেকে দুই কথা হবে। আর যে সুন্দর একটা মেয়ে, দুই কথা থেকে হয়ে যাবে প্রেম। আর প্রেম তো করাই যাবে না পাঠিকার সাথে। লেখকদের স্ক্যান্ডাল খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই অঞ্চলে। লেখালেখির জগতে স্ট্রিক্ট রুল আছে দুই একটা। অলিখিত নিয়ম।

তাদের মধ্যে পয়লাটা হলো : পাঠিকার সাথে প্রেমঘটিত সম্পর্কে জড়ানো যাইবে না।

এর তৃতীয় অনুসিদ্ধান্তে বলা আছে : তোমার রচনা পাঠ করিয়া থাকে না এহেন গণনাতীত মনোহারী দুহিতা রহিয়াছে দুনিয়ায়, তাহাদের লগে প্রেম করিতে পারো।

পঞ্চম অনুসিদ্ধান্তে বলা আছে : লেখনীর জোরে নহে, ব্যক্তিত্বের জোরে নারী হৃদয় জয় করো।

নবম অনুসিদ্ধান্তে বলা হয়েছে : লেখনীর জোরে নারীহৃদয় জয় করে কাপুরুষ।

দশম অনুসিদ্ধান্তটা ভয়াবহ রকমের অশ্লীল। তাই প্রকাশ করার চেষ্টাও করলাম না।

একেবারে অস্বিত্বের সঙ্কট। পাঠিকার সাথে প্রেম করে পুরুষত্ব বিসর্জন দেওয়া যাবে না। কাজেই আমি সতেরোর সাথে কথা বলতে চাইছিলাম না। তারপরও কথা কিছু থেকে যায়। মেয়েটা এতো আগ্রহজাগানিয়া একটা চরিত্র, আর আমিও এক রহস্যোপন্যাস লেখক। দুই একটা প্রশ্ন করা তো উচিত।

পাঠিকার সাথে চ্যাট শুরু হওয়ার দশ মিনিটের মাথায় প্রশ্নটা করে ফেললাম, “আপনার নাম কি আসলেই সতেরো?”

ওপাশ থেকে এলো একটা দীর্ঘশ্বাসের ইমো। তারপর উত্তর, “হ্যাঁ। মা রেখেছিলো।”

“আপনারা কয় ভাই বোন?”

“আমার ছোট আছে একটা।”

“ওটার নাম কি আঠারো?” না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না।

অনেকগুলো হাসির ইমো এলো এবার। কল্পনার চোখে পরিষ্কার দেখলাম ঘরোয়া পোষাকে নিজেকে জড়িয়ে রাখা মেয়েটা হাসিতে ভেঙ্গে পড়েছে। সমস্যাটা ওখানেই হলো। কল্পনাশক্তি যদি আরেকটু দুর্বল হতো তাহলে এই সমস্যা হতো না। এই প্রথমবারের মতো কোনো পাঠিকার সাথে চ্যাটে মজে গেলাম। দিন রাত একাকার হয়ে গেলো এবার। আর মেয়েটার সাথে সব কিছু নিয়ে আলোচনা করা যায়। সাধারণ বাংলাদেশি মেয়েগুলোর মতো মোটা মাথার না যারা ছোট্ট একটা গণ্ডির বাইরে আর কিছু চিন্তা করতে পারে না। এতো এতো অনুসিদ্ধান্ত আর নীতি-নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও একে অন্যের সঙ্গে একটা ঘণ্টাও কথা না বলে থাকতে পারলাম না আগামি কয়েকটা দিন। তারপর কয়েকটা সপ্তাহ।

সেদিন আম্মু ঘরে ঢুকে শয়তানের মতো হেসে জানতে চাইলো, “মেয়েটা কে, লিয়ন?”

আমি ক্ষেপে গেলাম, “কোন মেয়ে? কিসের মেয়ে?”

টেবিলে চা রেখে যাওয়ার সময় আম্মুও খোঁচা দিতে ভুললো না, “গত এক মাস ধরে দেখেই যাচ্ছি! বই পড়ছিস না। লেখালেখি থামিয়ে রেখেছিস। তোর কীবোর্ডের শব্দে বাসায় টেকা যেতো না দুইদিন আগেও। এমনি এমনি তো আর চুল পাকেনি আমার!”

দরজার বাইরে গিয়ে আবার ফিরে এলো আম্মু। চোখ পাকিয়ে গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মতো জানতে চাইলো, “হিন্দু মেয়ে? হিন্দু হলেও সমস্যা নাই। নিয়ে আয় একদিন বাসায়!”

আম্মুটা যে কি ফাজিল হয়েছে!

৩. 

সমস্যা হলো মেয়েটা হিন্দুও না।

আমরা ইদানিং চ্যাটের বাইরে চলে এসেছি। এদিক ওদিক আমরা ঘুরে বেড়াই। সতেরোর মধ্যে একটা অভিযানপ্রিয় মন আছে। এমনটা আমি এদেশি মেয়েদের মধ্যে দেখিনি। যেমন সেদিন ওর মাথায় ভূত চাপলো রাতের ঢাকায় ঘুরে বেড়াবে। তা বেড়াক, বেশ তো। কিন্তু সফরসঙ্গী হিসেবে ওর আমাকেই চাই! এ কী মহাবিপদ।

মাতাল ছোকরাদের দলটা যখন দামাদামি করার পর সতেরোকে নিতে পারলো না (কারণ, আমি ইচ্ছে করেই ওর শরীরের দাম বাড়িয়ে বলেছি, যেনো নিতে না পারে), পুলিশদের ছোট্ট গ্রুপটা যখন আমাদের পেছনে প্রায় লেগে গিয়েছিলো তখন আমরা ইস্তফা দিয়েছিলাম নৈশভ্রমণের। ছুটতে ছুটতে কোনোমতে গাড়ির কাছে এসে পৌঁছেছি, হাসিতে ফেটে পড়লো সতেরো।

ওর দিকে রাগী রাগী মুখ করে তাকালাম, “আরেকটু হলেই তো রেপড হয়ে যেতি। এমন সব উদ্ভট সখ তোর, খোদা!”

এতে করে ওর হাসি কমলো তা নয়। ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো ড্রাইভিং সিটে উঠে। এই গাড়ি সতেরোর নিজস্ব। আমি হিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে ড্রাইভ করতে দেখি। গাড়ি চালানোটা শিখতে পারলাম না এখনও। অবশ্য শিখলেও লাভ হতো না তেমন। আমার তো গাড়িও নেই।

সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সতেরোর হাসি মিইয়ে এলো। আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকালো সে, “চল্‌আমরা সামনের সপ্তাহে বাংলামোটর যাই। ওখানে নাকি ছেলেদেরও ভাড়া পাওয়া যায়।”

আমার মুখ হা হয়ে গেলো এবার, “তুই সিরিয়াসলি আমাকে ভাড়া খাটাবি?”

অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত দেখলো সতেরো, “সমস্যা কি? আমার মনে হয় না তোর ডিমান্ড একেবারে কম হবে সেখানে। আর সমকামীরাও মনে হয়

দুম করে ওর কাঁধে একটা ঘুষি মেরে দিলাম, “চুপ!”

“এই! ড্রাইভ করছি তো!” মৃদু ধমক দিলো সতেরো, মুখে যদিও হাসি।

চুপচাপ কিছুক্ষণ চললাম আমরা, মসৃণ গতিতে। নীরবতার উপযুক্ত দাম দেওয়ার লক্ষ্যে একটা সিগারেটও ধরিয়ে ফেললাম। আমার দিকে খ্যাপাটে চাহনি উপহার দিলো সতেরো। কারণটা আমি জানি, মেয়েটা তার গাড়ির ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে। চায় না ভেতরে কেউ স্মোক করুক।

আরেকদিন আমরা হাতিরঝিলে স্টান্ট একটা দিলাম। ব্রিজের রেলিংয়ে কসরত করে উঠে গেলো সতেরো। জিন্স আর টিশার্টে ওকে দেখাচ্ছিলো হলিউডের টিনেজ রোমান্স ধরণের মুভিগুলোর নায়িকাদের মতো। সোজা হয়ে ব্রিজের রেলিংয়ে দাঁড়াতে ওকে বেগ পেতে হচ্ছিলো খুব, একটু দূরে দাঁড়ানো আমার বুক দুরু দুরু করতে থাকে। মনে হচ্ছিলো মেয়েটা ঝুপ করে পানিতে পড়ে যাবে। তারপর ডুবে মরে যাবে নিশ্চিতভাবেই। কারণটা ব্যাখ্যা করার জন্যই এই স্টান্টবাজির দরকার পড়েছিলো।

সতেরো এবার রেলিংয়ের ওপর থেকে উদাস কণ্ঠে বললো, “আমার পেটে শাহেদের বাচ্চা। আমি এই জীবন আর রাখবো না!”

প্রথম লাইনটা মেরে দিয়েছে আমারই লেখা এক গল্প থেকে। গল্পটার নাম ছিলো’সন্তান’। সিরিয়াস একটা মুহূর্তে দাঁড়িয়েও রাগে দাঁত কিড়মিড় করলাম। এতোগুলো লোক এখন ঘিরে দাঁড়িয়েছে সতেরোকে, কিন্তু কেউ একটু এগিয়ে গিয়ে ওকে রেলিং থেকে নামাচ্ছে না। কেউ কেউ মোবাইল তুলে ভিডিও করছে। আর বাকিরা সেই দৃষ্টি নিয়ে সতেরোর দিকে তাকিয়ে আছে যেমনটা এই দেশের সবাই করে থাকে ক্যানভাসওয়ালার কাছে “ঘছর ঘছর খাউজানি” ধরণের ভাষণ শোনার সময়। চিরায়ত বাঙালি দৃশ্য।

মিনিট দশেক পর সতেরোকে গণজাগরণ’সেতু’র কাছ থেকে উদ্ধার করে আনার সময় আমরা দু’জনই ক্ষেপে ছিলাম প্রচণ্ড। 

“শালারা আমাকে কেউ বাঁচাতে আসলো না।” মুখ কালো করে বলেছিলো ও। 

“পাবলিক এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে আসলে ঠিকই আছে। এমনটাই আসা উচিৎ ছিলো রেজাল্ট। কেউ বাঁচাতে আসতোও না আসলে তোকে। যখন কেউ কাওকে কুপিয়ে চলে যায় তখনই লোকজন এগিয়ে আসে না। এটা তো সামান্য আত্মহত্যার কেস।”

গাড়ির কাছে ফিরে এসেছিলাম কোনোরকম অঘটন ছাড়াই। ঝামেলাটা হলো তখন, যখন সতেরোর দক্ষ ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে সুযোগ পেলেই একে অন্যের হাত ধরে রাখছিলাম আমরা। এমনকি এই বিষয়ে আমাদের কখনও খোলামেলা আলাপও হয়নি। আমি ওকে কিংবা ও আমাকে ভালো লাগাও জানায়নি কখনও। ওকে ছুঁয়ে দেখতে আমার ভালো লাগে, এই ভালো লাগা অন্যরকম। ওর-ও ভালো লাগে আমি জানি। এমন ভালো লাগার সাথে হরমোনের ওতোপ্রোত সম্পর্ক আছে।

আমার মনে হচ্ছিলো বড় ধরণের কোনো সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। নিয়তির অমোঘ টানে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, এই সর্বনাশটার দিকে এগিয়ে যেতে আমার ভালোই লাগছিলো!

৪. 

সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হলো সতেরোর ফ্যাসিলিটির লিফটে। মেয়েটা বেসরকারী মেডিকেল কলেজের ছাত্রি। ইন্টার্নশিপে, মানবরক্ষার মহৎ ব্রতে ব্যস্ত। রাত তিনটার পর অনেকটা নিঝুম হয়ে যায় ওদের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সেদিনও আমরা বেরিয়েছিলাম কেলেঙ্কারি ঘটাতে, ইয়াবাখোরদের আখড়ায় গিয়ে ইচ্ছেমতো মদ খেয়েছিলাম দু’জন মিলে। কিছু গুটি কিনেও নিতে হয়েছে। নাহলে ইয়াসিরের মান আর থাকতো না, ওর মাধ্যমেই ঢুকেছিলাম তো। সতেরো তার স্বভাবসুলভ বদমায়েশি করেছে বরাবর। সুন্দর একটা মেয়ে বসে বসে নাক দিয়ে কি কি যেনো টানছিলো। ওই অ্যাডিক্টেডটাকে গিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে এসেছে বদ মেয়েটা। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, এই প্রস্তাবে ঐ অ্যাডিক্টেড মেয়েটারও আপত্তি ছিলো না কোনো। সতেরোকে নিয়ে কোণার এক ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। কোনমতে ওকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি।

লিফটে ঢুকেই আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম। রাতের এই সময়টায় লিফটগুলো নির্জন হয়। নির্জনতা তো কোনো নতুন ঘটনা না আমাদের জন্য। অথচ সেদিন আমাদের মনে হয় ভূতে ধরেছিলো। ভূতের দোষ অযথা দিয়ে লাভ নেই, সতেরোকে লিফটের দেওয়ালে চেপে ধরার দায়টা আসলে আমারই ছিলো। আমরা একে অন্যকে স্রেফ ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করতে থাকলাম ওখানে। লিফট দশতলায় দাঁড়িয়েছে, খুলে গেছে দরজা। নির্জন করিডোরটা দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার। যে কোনো সময় যে কেউ সেখানে বেরিয়ে আসতে পারে, অথচ আমরা নির্বিকারভাবে একে অন্যকে আঁচড়ে কামড়ে একাকার করে চলেছিলাম।

চুল ঠিক করতে করতে যখন করিডোরে পা রেখেছিলো সতেরো, দ্রুত হেঁটে ওর পাশে চলে আসি।

“এতোদিন এই বেহেশত সরিয়ে রেখে দূরে দূরে ছিলাম কেন আমরা?” বোকার মতো জানতে চাইলাম।

মুখ নিচু করে রেখেছে মেয়েটা, ওর মনের ভাব পড়তে পারলাম না। ছোট্ট করে কেবল বললো, “জানি না।”

নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের সামনে পৌঁছে আমাকে অকস্মাৎ জড়িয়ে ধরলো ও। এক সেকেন্ডের জন্য কেবল। আমি পরিষ্কার টের পেলাম এক বিদায়ী বার্তা। মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার মতোই এক বিদায় আলিঙ্গন যেনো। 

“আর এসো না। বাই বলো আমাকে?” নিচু গলায় আমাকে বললো সতেরো।

মাথা দোলালাম। ওর চুলগুলো গুছিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম একবার, “বাই।”

আর কেন এগিয়ে দিয়ে আসা যাবে না আমি জানি। দরজার ওপাশে ওয়ার্ডের ভেতর আছে ডা. রিশান। বইমেলায় কোমর ভাঙার মাধ্যমে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয়। তবে মানুষটার আরও একটা পরিচয় আছে। সতেরোর বাগদত্তা তিনি। রাত তিনটার সময় বাগদত্তার সঙ্গে তার পছন্দের লেখককে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে দেখতে চাইবেন না নিশ্চয়। অগত্যা, আমার প্রস্থান নিশ্চিত করতেই হতো। অ্যাবাউট টার্ন করে লিফটের দিকে ফিরে আসছিলাম যখন, অজান্তেই বার বার পেছনের শুন্য করিডোরের দিকে তাকাচ্ছিলাম।

ওয়ার্ডের ভেতর সতেরো কি তাকিয়েছিলো দরজার দিকে? একবারের জন্যও?

আমি জানি না।

৫.

পরদিন ওর গাড়িতে বসেই আমরা একজন আরেকজনকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিলাম। ঘন নিঃশ্বাস আর চুম্বনের মিষ্টি শব্দ থেমে আসার পর অদ্ভুত এক বিষণ্নতা ঘুরে বেড়াচ্ছিলো জানালার কাঁচে। আমার গালে আর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো ও। তার মধ্যেই নিচু গলায় বললো, “এগুলো বন্ধ করতে হবে আমাদের।”

মাথা দোলালাম। এগুলো বন্ধ করতে হবে এটা আমিও জানি। দুইদিন পর মেয়েটার বিয়ে। বেচারা রিশানের সঙ্গে ওর পনেরো বছরের প্রেম। সেই শৈশব থেকেই একসাথে বেড়ে উঠেছে ওরা। পাশাপাশি বাড়ি গুলশানে। ওদের মতো জুটি আসলে এই সম্পর্ক ভাঙা-গড়ার দিনে খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রথম প্রথম যখন আমাদের ফেসবুকে কথা হতো, আমি ওদের ভীষণ সম্মান করতাম এই রকম দীর্ঘ একটা ইনিংস খেলে আসার জন্য। ওদের পঞ্চদশ পরিচয়বার্ষিকীতে রিশান-সতেরোকে উৎসর্গ করে লিখেছিলাম গল্প। সুইট একটা কাপল।

মাঝ দিয়ে আমি সুড়ুৎ করে ঢুকে গেলাম, কোনো মানে হয় না। পনেরোটা বছর ধরে নির্বিঘ্ন প্রেম ওদের, ভাইরাসের মতো আমার এভাবে ঢুকে পড়া উচিত হয়নি। অথচ ভীষণ অনুচিত আরেকটা কাজ করে ফেললাম এসব ভাবতে ভাবতে। সতেরোর কোমল ঠোঁটজোড়ায় গভীরভাবে চুমু খেলাম।

আমার ঠোঁটে হাতচাপা দিলো মেয়েটা, “স্টপ। আমাদের উচিত কিছু দূরত্ব নিয়ে আসা। এগুলো একেবারেই উচিত হচ্ছে না।”

এসব বড় বড় কথা অবশ্য বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। ত্রিশ সেকেন্ড পর সতেরোকে দেখা গেলো আমার পিঠে ভয়াবহভাবে ওর সুতীক্ষ্ম নখগুলো অনেকটা দাবিয়ে দিয়ে হিংস্র বাঘিনীর মতো আমার ঠোঁটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে।

“উই শুডন’ট।”

“থামানো উচিত।”

এসব বলতে বলতেও রহস্যময়ভাবে আমরা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলাম সেইরাতে। এই এক রহস্য ভেদ করার ক্ষমতা আমার মতো মিস্ট্রি রাইটারকেও দেওয়া হয়নি। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো আমার। কিন্তু জানতাম না ওটা শেষ নয়। শেষের শুরু কেবল।

ভয়ঙ্কর অসহায়ত্বের পুরোটাই অপেক্ষা করছে সামনে!

৬.

সতেরো ধীরে ধীরে দূরত্ব ঠিকই আনতে পারলো। আমরা এখন আর আগের মতো রাতের বেলায় অভিযানে বের হই না। রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি না (রিশানের শিফট যখন চলে)। টেক্সট করার সময় “বাবু” “জান” এইধরণের কিছু শব্দমালাকে আর ব্যবহার করি না। সতেরো এখন আমার সাথে দেখা করার ক্ষেত্রে ওর গাড়ি কিংবা নির্জন লিফট এই গোত্রের সবগুলো এলাকা এড়িয়ে চলে।

আগে আমাদের দেখা হতো প্রতিদিন, এখন সপ্তাহে এক কি দুইদিন। তাও জনাকীর্ণ কোনো রেস্তোরায়। টেবিলের ওপর আমাদের হাতে হাত ছুঁয়ে যেন না যায় সেজন্য ভীষণ সতর্ক থাকে মেয়েটা। যেনো ছুঁলেই ভীষণ কোনো মহামারী ওকেও গ্রাস করে নেবে। আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায় ওকে এভাবে সঙ্কুচিত হয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু এই একটা পরিস্থিতিতে লেখক নীরব। একটা মেয়ের অধিকার আছে নিজের সংসার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করার।

চব্বিশ বছরের দীর্ঘ জীবনে আবিষ্কার করলাম, আমার ভেতর কোথায় যেন একটা স্টকার লুকিয়ে ছিলো। এই বিরহ যাতনায় ওটা সুরসুর করে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোয় ওর সাথে দেখা হয় না। তখন আমি শিডিউল ধরে ওর মেডিকেল কলেজের সামনে চলে আসি। এখানে একটা চায়ের দোকান আছে রাস্তার অন্যপাশে। রাঘু মিয়ার দোকান। দোকানদারের সাথে আমার মামা-মামা সম্পর্ক হয়ে গেছে এতোদিনে। একটা দুটো বেনসন আমি নিজেই খাওয়াই তাকে। কাস্টোমারের ট্রিট। এমন কাস্টোমারকে ভালো না বেসে দোকানদাররা পারে না। আমার উদ্দেশ্য অবশ্য বদ। ওখানে বসে বসে আমি সতেরোর গাড়িটার জন্য অপেক্ষা করি। পার্কিং লটটা সামনের দিকে। ওখানে গাড়ি রেখে মেয়েটা বের হয়ে আসে। একটু দেখা যায়। দূর থেকে অতোটুকুই দেখি, এর চেয়ে বেশি আর কিছু করার ছিলো না আমার।

কখনও কখনও সতেরোর সঙ্গে থাকে তার ফিয়ান্সে। ডা. রিশানের সাথে ওকে দারুণ মানায়। ভদ্রলোকের চেহারায় প্রজ্ঞার ছাপ আছে। আমি জানি, এই মানুষটা যতোভাবে নিখুঁত হতে পারে সে তা-ই। ছেলেটি কখনও রাস্তার ছেলেদের সাথে মেশেনি নিশ্চয়, শৈশবে যৌন হয়রানির শিকার হয়নি, কৈশোরে সংসারের হাল ধরেনি, পরিবার থাকা সত্বেও ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলেদের মতো মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠেনি, রাতের অন্ধকারে পরদিন কাকে শান্ত ভাবে ছুরি মারা হবে সেই আলোচনায় থাকেনি, এলাকার টপটেররের খুন করার একান্ত অভিজ্ঞতা শোনেনি, আমি বাজি ধরে বলতে পারবো এই ছেলেটির গলায় কেউ ব্লেড মারার চেষ্টা করেনি, তাকে ভবিষ্যতেও কেউ মেরে ফেলার জন্য খুঁজবে না।

ম্যারেজ ম্যাটেরিয়াল হিসেবে ভদ্রলোক একেবারে পরিপাটি বলেই নয়, রাঘু মিয়ার দোকানের বসে বাগদত্তাটিকে দেখতে দেখতে আমার মন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে একেবারেই খারাপ হয়ে গেলো। সত্য থেকে যতোই দূরে থাকার অভিনয় করে যাই, ভদ্রলোকের মতো ফ্রেশ স্টার্ট আমি কখনোই পাবো না। স্বাভাবিকভাবে, সতেরোর মতো মেয়েরা আমাদের জন্য নয় কখনোই।

আমার মতো মানুষগুলো দুর্নিবার, ঝড়ের মতো। গতি আছে, পরিণতি নেই। দেখেছি আমার সঙ্গে মেলামেশার মুহূর্তগুলো প্রতিটা মেয়েই উপভোগ করে। কিন্তু সাময়িক সে আনন্দ। আমাকে জড়িয়ে ফেলার মতো ভুল তারা করে না। করার কথাও নয়।

রাঘু মিয়াকে চা আর সিগারেটের দামটা দিতে দিতে নিজেকেই কড়া করে ধমক দিলাম, “বাস্তবতা বুঝতে শেখ, গাধা কোথাকার।”

৭.

বাস্তবতা এখন আমার নাকের সামনে মনুষ্যমূর্তি হয়ে দণ্ডায়মান। 

এডিটর মাশরুর ভাই কুঁতকুঁতে চোখে জানতে চাইলেন, “কি বালটা ছিঁড়ছো, ঠিক করে বলো তো?”

এতো ভালোবেসে যখন কেউ কিছু জানতে চায়, তাকে হুট করে জবাব দিতে নেই। আমি কুকুরের মতো হাই তুলতে তুলতে একটা সিগারেটের খোঁজে ড্রয়ার-ম্রয়ার হাতড়ালাম। পেলাম, এমন না। উত্তরায় ঘুপচিমতো একটা একরুমের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেছি। এখানে একবার খুঁজে সিগারেট পাওয়া না গেলে বোঝা যাবে ঘরে সিগারেট আসলেই নেই। চিপাচুপায় একটা দুটো আবিষ্কার করার মতো বড় নয় এই ঘুপচি।

“ঐগুলো কি? বোতল নাকি?” নাক মুখ কুঁচকে আমার ঘরের ভেতর একেবারে ঢুকেই পড়লেন মাশরুর ভাই। বুঝতে পারলাম, ব্যাটাকে দরজা খুলে দেওয়াই ঠিক হয়নি।

“জ্বি ভাই।” বিনয়ের অবতার হিসেবে এমন উত্তরই আশা করা হয় আমার থেকে।

“মাল খাচ্ছো, অ্যাঁ?” দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক, “এইসব খালি শুনতেছিলাম। বিশ্বাস করি নাই। না, না, লিয়ন তো এমন পোলা না। আমি ভাত টিপলেই চাউল বুঝি। এইসব তুমি করবা সেইটা আমি বিশ্বাস করি নাই একদম। বলছি আমি জায়ীফকে, ওরে ফোন দিয়া জিগাও, বলি নাই?”

“এটা একটা ফ্যাক্ট যে বাংলাদেশের দশ শতাংশ জনগণ নিয়মিত মদ্যপান করে।” চিঁচিঁ করে যুক্তির ঝাঁপি খুলে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মাশরুর ভাইয়ের রক্তচক্ষু দেখে থমকে যেতে হলো।

“তুমি ওই দশ শতাংশের মধ্যে থাকবা, সেইটা তো মানা করি নাই। আমি আসলে বুঝতেছি না তুমি মাল-টাল খাইয়া কি বালটা ছিঁড়তেছো। এমন তো না এইসব ছাইপাশ খাইতেছো আর ক্রিয়েটিভ কিছুও চলতেছে লগে। কই? তোমার স্ক্রিপ্ট কতদূর?”

কুকুরের মতো বিশাল একটা হাই তুললাম আবার, এবার সশব্দে। বললাম, “লিখি নাই, বাল।”

বর্জ্রাহতের মতো ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন মাশরুর ভাই, “জাজ মাল্টিমিডিয়ার অফার ফালায় দিসো?”

অযথাই হাতড়ে হাতড়ে সিগারেট খুঁজলাম ঘরের মধ্যে। জানি পাবো না, তাও। পেলাম চশমাটা, পরার পর মনে হলো ভুল করে ফেলেছি।

মাশরুর ভাই ক্ষেপেছেন। সত্যিই ক্ষেপেছেন এবার। এগিয়ে এসে আমার কলার ধরে বার দশেক ঝাঁকালেন অসুরের শক্তিতে। লোকটা জিম-টিম করে জানি, তাই বলে আমাকে হ্যারাস করা কেন? 

“এইসব সুযোগ কেউ রোজদিন একটা দুইটা করে পায় না। একটা হিস্টরিক মুভি লিখার সুযোগ হইছিলো তোমার, ইউ ইডিয়েট। এই বয়েসে কারও এমন একটা সুযোগ হইতে দেখি নাই আমি। অ্যান্ড ইউ ডিডন্ট ইভেন ট্রাই!”

আমাকে ছোট্ট খাটটার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মাশরুর ভাই। ওই বিশাল শরীরের সাথে আমার মতো প্যাকাটি পারবে কেন? মাথায় বেশ জোরেই বাড়ি খেলাম। ওতেই মনে হয় নেশাটা টুটে গেলো। টেবিলে ঠিক মনিটরের সামনেই একটা সিগারেট পড়ে আছে, এতোক্ষণে খেয়াল করলাম। লাফিয়ে উঠে ওটা ধরালাম আগে, ফিল্টারে হাত বুলিয়ে দিলাম আলতো করে, “মাই প্রেসিয়াস।”

“কি কইলা?” রক্তচক্ষু মেলেই জানতে চাইলেন মাশরুর ভাই।

“ভাই, ডিস্টার্ব দিয়েন না তো বাসায় আইসা।” বিরক্ত হয়ে বলতেই হলো আমাকে, গল গল করে ধোঁয়া ছাড়লাম, “মুভি লিখে কি বালটা হইতো আমার?”

মাথা দোলালেন এডিটর সাহেব। এই ভঙ্গিমা আমার চেনা। তিনি নতুন আক্রমণে যাচ্ছেন। আমার অনুমান অবশ্য নির্ভুল। জানতে চাইলেন, “নভেলের কি হাল? লিখতেছো না আগামী বছরেরটা?”

মাথা নাড়লাম, “কিছুই লিখতেছি না আমি।”

“সেইটাই আমার পয়েন্ট। মুভি লিখলে তো কোনো বালটা হবে না, খুবই ভালো কথা। কিন্তু তার বদলে কোন বালটা করতেছো সেটা আমাকে দেখাও এখন।” এদিক ওদিক তাকালেন তিনি, সব রাগ গিয়ে মনে হয় পড়লো মদের নিরীহ বোতলগুলোর ওপর। বিকট শব্দ তুলে জুতো তুলে এক লাথি মেরে বসলেন ওদের ওপর। ঝন ঝন করে বোতলের মুখ ভাঙার শব্দে ভরে গেলো আমার ছোট্ট ঘরটা।

“ইউ আর আ ওয়েস্ট।” আমার মুখের সামনে আঙুল নেড়ে চোখমুখ লাল করে বললেন মাশরুর ভাই। আরেকটু হলেই সিগারেট উড়ে যাচ্ছিলো আমার। “আ কমপ্লিট, আটার ওয়েস্ট। ইউ ডোন্ট অ্যাফোর্ড দিস। ইউ ডোন্ট।”

লোকটা চলে যাওয়ার পর আমার হাড় জুড়ালো যেন। যেভাবে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিলো, তোষকের নিচের পিস্তলটা বেরিয়ে পড়তেও পারতো। ইদানিং একটা মেশিন রাখা লাগে সাথে, মাশরুর ভাই দেখে ফেললে মান-ইজ্জত আর কিছু থাকতো না। ফোনটা বের করে ইয়াসিরকে একটা কল দিলাম। এখন কাজ কারবার তেমন করি না কিছু। ইয়াবার ডিলার হয়ে গেছি। কাজটা খুব একটা কঠিন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড হওয়ায় কাজটা আরও সহজ হয়েছে। ইয়াসির মাঝে মধ্যে আমাকে কিছু প্যাকেজ এদিক থেকে ওদিক আনতে বলে। আমি আনি। এগুলো কোনো ঝুঁকির কাজই না। খরচাপাতি মোটামুটি চলে আসে মাসের। চলছে খারাপ না।

খাট থেকে নামতে গিয়ে কচ করে পায়ের পাতায় একটুকরো কাঁচ ঢুকে গেলো। টকটকে লাল রক্ত ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। ওদিকে তাকিয়ে মাশরুর ভাইকে গাল দিয়ে উঠলাম, “খানকির পোলা একটা। মাদারচোত।”

৮.

আশরাফ ফিচফিচ করে হাসছে। ধর্ষকদের মতো বিচ্ছিরি একটা হাসি, এভাবে হাসা এই হারামজাদা শিখলো কোথা থেকে? ঘরে মা-বোন সব মরেছে নাকি? আমার পিত্তি জ্বলে গেলো একেবারে।

বললাম, “মাল নিয়ে বিদায় হ। তোর মুখে বানচোতের মতো ওই হাসিটা আমার সহ্য হচ্ছে না।”

আশরাফ বাম হাত বাড়িয়ে আগ্রহের সাথে’মাল’ নিলো। কিন্তু হাসিটা মুখ থেকে সরিয়ে ফেললো না। বরং আরও বিস্তৃত হয়েছে ওটা। আমার মনে হচ্ছে এভাবে বানচোতটা আর বেশিক্ষণ হাসলে ওর নাকে আমি মেরে দিবো। খুব জোরেই মারবো। শেষে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। 

আশরাফ বললো, “চল চল। নিচে চল। চা-টা খাই।”

গাঁ-গাঁ করে শুধু বললাম, “হোগাটা তুলে বিদায় হ।”

আশরাফ আমার কোনো কথাই শুনলো না। একহাতেই টেনে আমাকে নিচে নিয়ে গেলো। রাজলক্ষী পর্যন্ত চলে গেলাম রিকশা নিয়ে। আশরাফ এক হাতে মানিব্যাগ বের করার কসরত করছিলো খুব। ওকে থামালাম। ইয়াবার ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে আমার ইনকাম একেবারে খারাপ না। একহাতী বন্ধুকে কষ্ট দেওয়ার প্রয়োজন দেখছি না। বাদল মামার দোকানে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়লাম। দুই কাপ চা নাকের সামনে চলে আসলো। সিগারেট ধরালাম, আশরাফকেও একটা অফার করলাম। নিলো না, বললো, “মাঝে মধ্যে তোর ওটা নিয়েই দুই একটা টান দিবো।”

খুব অশ্লীল শোনালো কথাটা, তাই আর সাধলাম না। জানতে চাইলাম, “হাতটা হারালি কি করে?”

ফ্যাক ফ্যাক করে হাসলো আশরাফ, যেনো হাত একটা হারানোর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। চারপাশে একবার দেখে নিলো তারপর। পুলিশ-টুলিশই খুঁজলো মনে হয়। দেখা গেলো না ও জিনিস। গলা নামিয়ে উত্তর দিলো বন্ধুবর, “রেইডের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। বিড়াল মামারা গুল্লি মেরে দিলো।”

বিড়াল মামারা যে পুলিশ সেটা আমরা জানি। এরা কথায় কথায় গুলি চালানোর মতো প্রাণি না। আশরাফের মনে হচ্ছে কপালটাই খারাপ।

“গাঁজাবাবা ইয়াসিরের গায়ে ফুলের টোকাটাও লাগে নাই। শালার কপাল। আমার হাতটা ফালায় দিতে হইলো।”

মাথা দোলালাম। এমনি মাথা দোলানো, সহানুভূতি-ভূতি তেমন এলো না। আগেই বলেছিলাম শালাকে, উপমন্ত্রির মেয়েকে পছন্দ করতে। শোনে তো নি। এখন মায়া করার প্রশ্নই আসে না। কাঙালের কথা ফলে তখনই, যখন বাসী হয়।

“আগেই কইছিলাম প্রেমের যন্ত্রণা ঢাকার জন্য মদ-গাঁজার দিকে না যাইতে। এখন তো বাবাখোর হয়ে গেছিস। বাবা খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে হাত হারায় ফেললা। ভালো হইছে না?”

চোখ টিপ দিয়ে আরও কাছে এলো আশরাফ, “হাত না থাকায় সুবিধা আছে। সাহায্য টাহায্য তোলা যায়। ঐদিন এক অফিস যাওয়া লোককে গিয়া চোখমুখ কান্না-কান্না করে কইলাম, বাবার জন্য টাকা দরকার। বাবার এন্টিবায়োটিক কিনতে পারতেছি না, নীলক্ষেতের প্রেসক্রিপশনও দেখাইলাম। কইলাম যে কন্সট্রাকশন সাইটে কাম করতে গিয়া হাতটা গেছে। বোকাচোদা হাতটা দেখলো। বুঝলো যে মিথ্যা বলি নাই। টাকা দিয়া দিলো।” সিগারেটটা নিয়ে একটু টেনে আবার ফেরত দিলো আশরাফ, “মিথ্যা কিন্তু বলি নাই। বাবার জন্যই টাকা নিসিলাম।”

সন্দেহ কী তায়! আমার কাছ থেকেই তো নেয়। রোহিঙারাও এভাবে বাবা খায় বলে আমার মনে হয় না। ব্যাটা গাণ্ডু।

আশরাফ অবশ্য আমার দিকে গুটি চালিয়ে দিয়েছে এবার। ধর্ষকদের মতো হাসিটা তার মুখে ফিরে এসেছে বরাবর। বললো, “তুমি না আমারে কতো লেকচার চোদাইলা? নিজেই তো হইছো মালখোর। শুনলাম ভার্সিটি থেইকা বাইর হইয়া বাবার ডিলার হইছো। দেখতেছি তো। মাইয়াবাজি তো নিজেও করলা। অন্যরে বলার সময়

এবার আশরাফের হাসিটা আর ধর্ষকের মতো লাগলো না আমার কাছে। ঠিকই আছে। ফাঁদে পড়লে হাতিকেও লাথি মারে চামচিকা। আর এ তো এক আস্ত মানুষ। লাথি তো মারবেই।

বললাম, “আরে তখনও তো প্রেম-ট্রেম বুঝতে শিখি নাই। অল্পবয়েসে কি না কি বলছিলাম ধইরা রাখার মতো কিছু তো না এসব। এখনও মনে রাখছিস। গাণ্ডুগিরির লিমিট নাই তোর।”

কান ঝাঁ ঝাঁ করার মতো হাসলো আশরাফ, “ঘটনা কি? তুমি হাত বাড়াইছিলা কিয়ের দিকে? চান্দে কুলায় নাই, এক্কেরে সূর্যের ভিতরে?”

এবার আমিও হাসলাম। হাসা ছাড়া আর করার আছেটা কি? সংক্ষেপে বললাম ঘটনা। বাবাখোরদের মধ্যে গোপনীয়তার বালাই কম। আসলে আমার সর্বনাশটা হয়েছে সতেরোর সাথে প্রেমটা হয়নি বলে। প্রেম হয়, প্রেম ভাঙে সেটা মেনে নেওয়াটা সহজ। দু’জনের আপত্তি না থাকার পরও প্রেমটা হয়নি, বাস্তবতার কাছে হেরে গেছি আমরা। এটা থেকে রিকভার করতে পারিনি আর। ভেসে গেছি গাঙের জলে।

শুনতে শুনতে আশরাফের মুখ থেকেও হাসি মুছে গেলো। উদাস হয়ে কিছুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেললো বেচারা। পুরোনো ক্ষতমুখ খুলে দেওয়ায় আমার জুড়ি নেই। তারপর আশরাফ আমাকে এক কাপ চা আর আরেকটা সিগারেট খাওয়ালো। আমরা দুইজন দুইদিকে কেটে পড়লাম। আজকে অবশ্য ওই ঘুপচি ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলো না আমার। অনেকদিন ধরে বাড়িও যাওয়া হয় না। প্রায় দুই বছর! অথচ বাড়ির দিকেও রওনা দিলাম না আমি।

কোনোরকম অসুখ করেনি, তবুও একটা সিএনজি নিয়ে ছুটে চললাম নির্দিষ্ট এক হাসপাতালের দিকে।

৯. 

হাসপাতালের রিসেপশনের সামনে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেলো। সদ্য কৈশোর পেরুনো একটা মেয়ে কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমার সামনে এসে হাঁফাতে শুরু করলো। উৎসাহে চোখ ঝলমল করছে তার। আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো, “আপনি লিয়ন হাসান না?’রক্তক্ষরণ’, ’অবসাদ’-এর লিয়ন হাসান?”

মূর্তির মতো এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটা সময় এমন দিন ছিলো। টিএসসির মোড়ে গেছি অথচ অপরিচিত কেউ ছুটে এসে এই প্রশ্ন করেনি এমন হয়নি। নাজিমউদ্দিন রোড, মিরপুর দশ, শ্যামলী ঢাকার এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে হতে হয়নি। অমনটাই স্বাভাবিক মনে হতো তখন আমার। অথচ আজ মনে হলো এই মেয়েটা খুব নিষিদ্ধ আর অশ্লীল কোনো প্রশ্ন করে বসেছে আমাকে।

মাথা নেড়ে কেবল তাকে জানালাম, “আমি লিয়ন হাসান না। আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে।”

মেয়েটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি সরে এলাম। নির্দিষ্ট করিডোরটায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো। বিকেলের এই সময়টায় চারপাশে প্রচুর মানুষ। এটা একটা হাসপাতাল, দারুণ ছোটাছুটি চারপাশে। আমাকে অবশ্য এসব ব্যস্ততা স্পর্শ করছে না। মনে হচ্ছে এখানে আমি একা, করিডোরের মাঝে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার মতোই একা।

লিফটটার ভেতর এখন একজন লিফটম্যান থাকে। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। এই ব্যাটার চাকরি দিলো কে? অবশ্য সময় তো কম গড়ায়নি। দুটো বছর পার হয়ে গেছে। গুটি গুটি পায়ে লিফটের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। লিফটম্যান প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে আছে। বললাম, “নাইনথ।”

দশতলায় চলে এলাম। একদঙ্গল তরুণ-বুড়ো লিফট ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। আমি মোহাবিষ্টের মতো স্পর্শ করলাম লিফটের নির্দিষ্ট দেওয়ালটি। এখানেই সতেরোকে চেপে ধরেছিলাম সে রাতে। 

সতেরো! নামটা মনে পড়তেই রক্ত সরে গেলো মুখ থেকে। দুটো বছর পার হয়ে গেছে। প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম, ওরা ভুল করেছে।

ওরা সবাই আমাকে বুঝতে ভুল করেছে।

মাশরুর ভাই, আশরাফ, নিচে রিসেপশনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওই বোকা মেয়েটা। ওরা সবাই মনে করেছে আমি হারিয়ে গেছি! 

আমি হারিয়ে যাইনি। আমি শুধু আটকে গেছি একটা সময়ে। বাকিরা তাদের নির্দিষ্ট গতি ধরে এগিয়ে গেছে জীবনের পথ ধরে।

আমি আটকে আছি দুই বছর আগের একটা সময়ে!

হঠাৎ করেই লিফটের ভেতরটাকে আমার কাছে কারাগারের মতো মনে হতে থাকে। যেনো এখানেই গত দুটো বছর ধরে আটকে আছি আমি। এর মধ্যে একটা লাইনও লিখিনি, একটা অর্থবহ কাজও করিনি। চেষ্টা করেছি সময়কে থমকে দিতে, সময় থেমে থাকেনি। আমি একাই থমকে গেছি সময়ের সঙ্গে। লিফটম্যান আমাকে কি যেনো বলার চেষ্টা করছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি লোকটা একটা কিছু বলছে আমাকে, কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছি না আমি।

লোকটা কি আমাকে লিফট থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে? আমি তো এখান থেকে যাবো না।

বদ্ধ কুঠুরির মধ্যে এখনও পাচ্ছি সতেরোর চুলের মিষ্টি গন্ধ। একটা লিফটম্যানের কথায় আমি তো সতেরোকে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। 

কাঁধে লিফটম্যানের হাতটা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালাম। কোমর থেকে এক টানে বের করে আনলাম অস্ত্রটা। দেড় বছর ধরে আছে আমার সঙ্গে, একবারও ব্যবহার করতে হয়নি। পিস্তলটা কখন ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে গাঁজাবাবা ইয়াসিরের স্পষ্ট নির্দেশ ছিলো। টকটকে লাল চোখে ছেলেটা বলেছিলো, “পুঙ্গি মারা না খাইলে ইউজ করবি না।”

ওর কথা সম্পুর্ণভাবে অমান্য করলাম আমি। ট্রিগার টেনে ধরেছি। বদ্ধ জায়গায় গুলির শব্দ হচ্ছে প্রচণ্ড।

একটার পর একটা গুলির শব্দ শুনতে শুনতে আমি উদাস হয়ে গেলাম। মাথার ভেতরটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে।

লিফটটা ধীরে ধীরে নেমে চলেছে গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে। সেরাতের মতোই, নামার সময় লিফটের ভেতর আমি এখন সম্পূর্ণ একা।

যেন ফিরে এসেছি দুটো বছর পেছনে। ওপর থেকে সতেরো কি করিডোরের দিকে তাকাচ্ছে এখনও?

নিচতলায় যখন লিফটের দরজাটা খুলে গেলো, বাইরে হাসপাতালের নিজস্ব সিকিউরিটি বাহিনী অপেক্ষা করছিলো। খবরটা ওদের কানে পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। লিফটম্যান হতচ্ছাড়া নিশ্চয় বেরিয়েই ওদের কানে লাগিয়েছে। রক্তের ছোটখাটো এক পুকুরের ওপর বিহ্বলের মতো বসে রইলাম চুপচাপ।

পরিশিষ্ট 

ইন্টারভিউ বোর্ডের অন্যপাশ থেকে অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক বিচ্ছিরি অ্যাকসেন্টে প্রশ্ন করলেন, “প্রায় তিনটা বছর আপনি কিছুই করেননি।”

মৃদু হাসলাম। কিছু বললাম না। বলার আছেটাই বা কি?

অস্ট্রেলীয়টা শক্ত চিজের লোক। উত্তর না পেলে আমাকে ছেড়ে দেবে এমনটা মনে হলো না। 

আরও একবার প্রশ্নটা করলো সে, “ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলরস দুই হাজার আঠারোয় আর্ন করার পর আপনি ছিলেন কোথায় তিন বছর?”

এবার এড়ানোর চেষ্টা করলাম না, “আটকে ছিলাম আঠারোয়-ই।”

অস্ট্রেলীয়র চোখ সঙ্কুচিত হয়ে উঠেছে, “আপনার নামে তো ক্রিমিনাল রেকর্ডও আছে। দুই হাজার বিশের এপ্রিলে নিজের হাতে নিজেই গুলি করেছেন। আপনার ডিজেবিলিটি ওখান থেকেই।”

মাথা দোলালাম, “অবশ্যই।”

“রিটেনে আপনার মার্কস ভালো। কিন্তু এই ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকা কাওকে আমরা সুযোগ কেন দেবো বলতে পারেন? এটা কি আমাদের জন্য একটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে না?”

গুরুতর প্রশ্ন। আমার নষ্ট হয়ে ঝুলে থাকা বাম হাতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটার গুরুত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। মুখ তুলে দেখলাম ইন্টারভিউ বোর্ডের সাতজন ডাকসাইটে কর্মকর্তাই আমার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমার মতো ক্যান্ডিডেট মনে হয় প্রতিদিন আসে না এদের কাছে।

নির্মল একটা হাসি হাসলাম।

অস্ট্রেলীয়টার প্রশ্নের উত্তর আমি এখন জানি।

“কখনও কখনও সঠিক সিদ্ধান্তটাই মারাত্মক কোনো ভুল ছিলো বলে প্রমাণিত হয়, স্যার। আর ভুল সিদ্ধান্তটাই হয়ে যায় আর যে কোনো সিদ্ধান্ত থেকে সঠিক।”

ইন্টারভিউ বোর্ডের সাত সাতজন জাঁদরেল প্রফেশনালের মুখে বিরক্তির ছাপ দেখা গেলো। প্রকৌশলী নিয়োগ দিতে বসে দর্শন কপচানো ক্যান্ডিডেট পাওয়ার চেয়ে বিরক্তির কিছু নেই। তবে কেউ খুব ভালো করে তাকালে বুঝতে পারবে ওখানে বিরক্তির সঙ্গে মিশে ছিলো এক মুহূর্তের দ্বিধাও। আমার মনের ভেতরেও পাকিয়ে গেলো দ্বিধার নতুন জট। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এটা খোলার সাধ্য আমার নেই।

নিশি-হণ্টক

আকাশে একটা নিঃসঙ্গ চাঁদ।

ওকে কি নিঃসঙ্গ বলা যায়? ছাড়া ছাড়া মেঘ ওটাকে সঙ্গ দিচ্ছে।

মেঘ আর চাঁদের দূরত্ব তো কম না। তাহলে নিঃসঙ্গ বলা কি চলে না ওকে?

হিসেব মেলাতে পারলাম না। মেলাতে চাচ্ছি তেমনটাও না।

এই মুহূর্তে চাঁদ ব্যাটা নিঃসঙ্গ থাক বা না থাক আমার নিঃসঙ্গতার একটু দরকার ছিল। রাস্তাঘাট রাতের এই সময়টায় ফাঁকাই থাকে। বারোটা বেজে পাঁচ। ভ্যাম্পায়ার গোত্রের মানুষ বাদে কাওকে দেখতে পাওয়ার কথা না।

আমি ভ্যাম্পায়ার গোত্রের মানুষ না। তবে বাবার শেষ উপদেশ আমি মেনে চলি।

মৃত্যুশয্যায় একজন বাবা ছেলেকে উপদেশ দিয়ে যেতে চান। যাতে তাঁর প্রস্থানের পর সন্তানের জীবন একটা সরলরেখায় চলে। এটা করবে, সেটা করবে না, অমুককে দেখবে, তমুককে ওটা দেবে হাবিজাবি। আর আমার বাবা চেয়েছিলেন বক্রপথের সন্ধান দিতে।

আমার উদ্দেশ্যে বাবার শেষ কথা ছিল, ’রাত বারোটার পর কখনও বাসায় থাকবি না। ’

বাবার শেষ ইচ্ছে আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি।

তিন মাস সাত দিন ধরে সারারাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। শহরের কোনও রাস্তা বাকি নেই যেখানে আমার পা পড়েনি।

এমন কোন ওভারব্রীজ নেই যেটার ওপর আমি উঠিনি।

সব হয়েছে রাতের বেলায়।

কম ঘটনার মুখোমুখী হতে হয় নি এজন্য। নৈশজীবনে অভ্যস্ত পঙ্কিল জীবনে ডুবে থাকা অসংখ্য মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে তাদের অনেকেই বিশাল হৃদয়ের উপস্থিতির পরিচয় দিয়েছেন।

পুলিশেও ধরেছে আমাকে এজন্য, ছয়বার।

প্রতিবারই ভোরের দিকে ছেড়ে দিতে দিতে সহকর্মীকে পেটমোটা পুলিশটা বলেছে, ’পাগল ছাগল মানুষ। অযথা আমাদের হয়রানী। ’

আর আমিও হয়রান পুলিশটির দিকে চমৎকার একটি হাসি দিয়ে বেড়িয়ে এসেছি।

‘তুর্য! অ্যাই তুর্য!’ নারীকন্ঠের চিৎকারে বাস্তবে ফিরলাম।

শব্দের উৎসের দিকে ফিরে তাকিয়ে ফারিহাকে দেখতে পাই। দাঁড়িয়ে আছে ফুটপাথের ওপরে। গাছের ছায়াতে।

পৃথিবীর সব শক্তিমান’ভালোমানুষেরা’ দিনের বেলায় গাছের নীচে ছায়া খোঁজে। আর ফারিহারা গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় রাত হলে। যন্ত্রণা লাঘবের জন্য না। নতুন যন্ত্রণাকে আলিঙ্গন করে নিতে। মেয়েটার আসল নাম কি কে জানে? আমাকে অন্তত ওই নামই বলেছে।

নাম কি?

পরিচয় বই তো নয়! কাজেই আমিও ঘাটাঘাটি করিনি। করে কাজ কি?

‘হাঁটতে বের হয়েছ আজও?’ আমি কাছে যেতে মুক্তোর মত দাঁতগুলো বের করে বলে ফারিহা।

মেয়েটার হাসি এত প্রাঞ্জল ওকে এই পরিবেশে মানাচ্ছে না।

‘হুঁ। তোমার খবর কি?’ পাল্টা হাসি দিলাম। যদিও ব্যাঙের মত লাগল হাসিটা।

‘আজকে আমার ছুটি।’ লাফিয়ে ফুটপাথ থেকে নামে ফারিহা।

‘মানে?’ অবাক হলাম। রাতের বেলাতে ওদের ছুটি থাকে না কোনদিনই। বিশেষ সময় ছাড়া।

‘নিজেকে নিজেই ছুটি দিলাম।’ মুক্তোর মত দাঁতগুলো আরেকবার দেখায় ফারিহা।

‘জমা দেবে কি তাহলে?’ বিষন্ন মনে জানতে চাই। এদের জীবনের পরিণতি আমি মেনে নিতে পারি না।

‘আছে কিছু জমানো। দেব নাহয়।’ আমার দিকে সরাসরি তাকায় ফারিহা, ’কই, হাঁটো?’

একটা কুকুর এসে আমাদের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটার সারা শরীরে লোম নেই।

কমেডির হাস্যকর একটা দৃশ্যের মত দেখাচ্ছে নিশ্চয় আমাদের?

সরাসরি তাকাই আমিও, ’তুমিও আজকে আসছ নাকি?’

‘হুম। সমস্যা?’ কোমরে হাত রেখে জানতে চায় ফারিহা।

‘সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।’ ভ্রু কুঁচকে ভাবতে ভাবতে বলি আমি।

‘পিতৃদেবের কথা ভাবছ তো? তিনি তোমাকে রাতের বেলাতে হাঁটতে বলেছেন। একাকী হাঁটতে হবে সেরকম শর্ত ছিল বলে মনে করি না। ’

অকাট্য যুক্তি।

কাজেই ফারিহাকে পাশে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটির কৌতুহলের শেষ নেই। কোন গাছের পাতা না থাকলেও অপার আগ্রহে আমাকে প্রশ্ন করছে। আবার পাতা থাকলেও সম-আগ্রহেই প্রশ্ন করছে।

ফারিহার প্রশ্নগুলোর উত্তর মনের মত করে দিচ্ছি। শুন্য রাস্তায় আমাদের গলার শব্দ অদ্ভুত রকমের ভূতুড়ে শোনাচ্ছে মনে হয়। সেদিকে আমাদের নজর নেই। ফারিহা ডুবে আছে আমার কন্ঠনিসৃত ব্যখ্যার জন্য। আর আমি মনে মনে খুঁজছি ফারিহার লাইফস্টোরি।

মেয়েটা এই পেশাতে এল কি করে? কথাবার্তা শুনলে মনে হয় সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে।

প্রতিটি ট্র্যাজেডির পেছনেই কাহিনী থাকে। ফারিহার কাহিনী আমি কিছুতেই মেলাতে পারি না।

ও ঠিক এই পরিবেশের সাথে যায় না।

ফারিহার প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলাম , ’তুমি কি নিজেকে হিমু মনে কর?’

‘হিমুটা আবার কে?’ গলায় কৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়ে জানতে চাই আমি।

‘উফ! কোন দুনিয়ায় থাকো? হিমু আমার প্রিয় চরিত্র। যে কারণে তোমার প্রেমে পড়েছি আমি সেই কারণটার নামই হিমু। ’

ফারিহার এই ব্যাপারটাও আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগে। কি অবলীলাতেই না স্বীকার করে নিচ্ছে সবকিছু। পেশাগত জটিলতার কারণে কাজটা হয়ত ওদের জন্য সহজ। সমাজসিদ্ধ পরিবেশে বড় হওয়া মেয়েদের ক্ষেত্রেই’বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ নিয়ম প্রযোজ্য। ওদের জন্য নয়।

‘তা এই হিমুটা কি করে?’ প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাই আমি।

‘ও অনেক কিছুই করে।’ মুখ ভার করে বলে ফারিহা। আমি হিমুকে চিনি না ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না ও মোটেও।

কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটলাম আমরা।

একটা নিঃসঙ্গ প্যাঁচাকে উড়তে দেখলাম আমি ঠান্ডা চোখে। পাথর মেরে ব্যাটাকে নামাতে পারলে হত।

উড়ার বেলাতে আছে! কি জটিলতাবিহীন একটা শান্ত জীবন তাদের!

হিংসাতে আমার চোখ মুখ কুঁচকে যায়।

ফারিহা ব্যাপারটাকে অন্য অর্থে নিল।

‘হিমু একজন মানুষ নয়। হিমু একটা আদর্শ বলতে পারো। এটা প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটি চরিত্র। আমার ফেভরিট। ’

‘ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে।’ মাথা দোলাই আমি, ’ব্যাটা খালি হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে হেঁটে বেড়ায়। আর পায়ে জুতো পড়ার বালাই রাখে না এই তো? বাবা তাকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিল। অথচ ও প্রমাণ করে দেখিয়েছে প্রতিটি মানুষের ভেতরেই একটি মহাপুরুষ বাস করে। তাই না?’

‘প্রতি মানুষের ভেতরে মহাপুরুষ প্রমাণ করল কবে হিমু?’ আকাশ থেকে পড়ে ফারিহা।

আকাশ থেকে তো আমিও পড়েছি। এই মেয়ে দেখা যায় বই-টইও ভালোই পড়ে। আবার পেশায় যৌনকর্মী।

মেয়েটিকে দেখে আমার বিস্মিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমি বিস্মিত হই না। আমার ভেতর যে অনুভূতিটা কাজ করছে তাকে মুগ্ধতা বলা যেতে পারে।

ফারিহা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লাইটপোস্টের হাল্কা আলোতে দেখতে পেলাম লালচে একটা আভা ওর গালে। আমার দৃষ্টিতে লেগে থাকা মুগ্ধতা নিশ্চয় ধরে ফেলেছে?

মেয়েদের ইন্দ্রীয় বোধহয় সাতটা।

‘হিমু নিজে মহাপুরুষ ছিল না। কিন্তু অনেক অনেক কাজ তার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যা মহাপুরুষ ছাড়া করা সম্ভব ছিল না। আমাদের এখানে দুটো সিদ্ধান্তে আসার উপায় আছে। এক, মহাপুরুষের সংজ্ঞা পাল্টে ফেলা। দুই, হিমু প্রমাণ করেছে প্রতিটি মানুষের মাঝেই একজন মহাপুরুষ বাস করে। ’

আমার কাছে কেউ বাংলা দ্বিতীয় পত্রের উত্তর আশা করবে এমনটা নয়। অমুক রচনার সারমর্ম লিখ, পূর্ণমান ১০। কাজেই দশটা সেকেন্ড চুপ করে থাকে ফারিহা। আমার মনে হল মেয়েটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছে।

কিন্তু তা না করে পাল্টা প্রশ্ন করল ও, ’তুমি কি হিমু গোত্রের?’

মাথা নাড়লাম, ’আমি হিমুগোত্রের না। আমার পায়ে জুতো আছে। গায়ে সাতদিনের পুরোনো একটা গেঞ্জিও আছে। বাবা আমার মহাপুরুষ সন্তান চাননি। তবে চেয়েছেন সন্তান রাতের বেলায় ঘর থেকে লম্বা দিক। ’

ফারিহা একটু সাহস পেল মনে হল এবার, ’তোমার হাতটা ধরা যাবে?’

মাথা নেড়ে ওকে’না’ বলতে যাব এই সময় সামনের মোড়ে সিগারেট হাতে আড্ডা দিতে থাকা দুর্বিনীত চেহারার তিন যুবককে আমাদের দুইজনেরই চোখে পড়ে।

অশ্লীল একটা দৃষ্টি চোখে নিয়ে আমাদের দেখছে নেতাগোছের মানুষটা। ফারিহার হাঁটার গতি আপনা থেকেই শ্লথ হয়ে গেল।

সরু চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। লিডারকে এবার আমার একটু চিন্তিত বলেই মনে হতে থাকে!

যুবক তিনজন উঠে পড়ল সাথে সাথে। আমাদের দিকে ধীর কিন্তু দৃঢ়পায়ে এগিয়ে আসছে তারা।

ফারিহার সাথে সাথে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার দিকে সামান্য ঘেঁষে এসেছে মেয়েটা।

হেডলাইটের তীব্র আলো এই সময় রাস্তার এই অংশটা আলোকিত করে দেয়।

গুন্ডাত্রয় থেমে গেছে।

পাঁচ সেকেন্ডের মাঝেই একটা গাড়ি আমাদের ঠিক পাশে এসে ব্রেক কষল। আমার দৃষ্টি ছিল গুন্ডাত্রয়ের দিকে। গাড়ির দিকে ফেরার সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পুলিশের গাড়ি হলে বেশ বিরক্তিকর ব্যাপার হবে।

সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মত হাজতে বসে মশার কামড় খেতে হলে আমার জন্য জরুরী ভিত্তিতে দুই ব্যাগ বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা আছে!

গাড়িটিকে দেখার পর রক্তের প্রয়োজনীয়তা কেটে গেল। একটা সাদা রঙের গাড়ি। ড্রাইভিং সীটে মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। দাঁত কেলিয়ে বিশ্রী একটা হাসি দিচ্ছেন। চোখ ফারিহার দিকে নিবদ্ধ। তবে মুখের দিকে নয়।

‘তোমাকে কত খুঁজেছি, ফারিহা। তোমার জায়গায় আজ ছিলে না কেন?’ ফাঁটা বাঁশের মত গলা করে জানতে চান তিনি।

‘বন্ধুর সাথে হাঁটতে আসলাম তো, তাই।’ নিঃসংকোচে উত্তর দেয় ফারিহা।

‘যাবে? নাকি এরই মধ্যে নিয়ে নিয়েছে?’ আমার উদ্দেশ্যে অশ্লীল ইঙ্গিতটা দিয়ে হাহা করে হাসলেন ভদ্রলোক।

‘তোমার সাথে যেতে আপত্তি নেই।’ ঝকঝকে হাসি দিয়ে বলে ফারিহা, ’পরে দেখা হবে, তুর্য!’

লাফিয়ে তো ফ্রন্ট সীটে উঠে গেল মেয়েটা গাড়িটাও হুশ করে বেড়িয়ে যায় চোখের সামনে দিয়ে। আর আমার মনোযোগ ফিরে যায় গুন্ডাত্রয়ের দিকে।

বেশ হেলেদুলে এগিয়ে আসছে ওরা। আমার সামনে এসে লিডার মানুষটা থেমে গেল।

‘ভাই, আপনাকে কত খুঁজছি কইবার পারুম না।’ কটকটে গলাতে বলে’ট্যামা মিলন’। শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তার খ্যাতি আছে।

বিনয়ের হাসি দেই আমি, ‘সঙ্গী নিখোঁজ?’

মিলনের দুই পাশের সহচররা চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখছে। আগেই কিভাবে জেনে ফেললাম সেটা ভাবছে হয়ত।

এমনিতেই মিলনের ভ্রান্ত একটি বিশ্বাস আছে, আমার মাঝে অলৌকিক কিছু ক্ষমতা থাকার ব্যাপারে। ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হল, এবার লাই পেয়ে বিশ্বাসটা একেবারে চাঁদিতে উঠবে! এই লোকের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় একটা ধাওয়া দৃশ্যে।

মোড় ঘুরেই আজব দৃশ্যটা আমার চোখে পড়েছিল সেরাতে।

হাত পা নেড়ে দৌড়াচ্ছে মিলন। পেছনে ছয় ছয়জন তাগড়া জওয়ান। প্রত্যেকের হাতে কিরিচি। এবং একজনের হাতে কাটা রাইফেল।

কাটা রাইফেল দিয়ে ‘ট্যামা মিলন’কে পাখির মত গুলি করে নামিয়ে না দিয়ে কেন উর্ধ্বশ্বাসে তাড়া করছে সেই প্রশ্ন আজও আমার মনের মধ্যে আছে। কিন্তু আমি এত বাছাবাছির মধ্য দিয়ে গেলাম না।

মিলন আমার দিকেই ছুটে আসছিল। আমার থেকে যদিও ওরা পঞ্চাশ গজ মত সামনে।

কাজেই আমার পাশে পৌছানো পর্যন্ত সময়টুকু কাজে লাগালাম। প্যান্টের নিচের অংশটা গুঁজে বেল্ট টেনে ওপরে তুললাম।

তারপর ট্যামা মিলনের পাশে পৌঁছানো মাত্র তার পাশে পাশে প্রাণপণে আমিও দৌড়াতে থাকি!

মিলন দৌড়ের মাঝেই চোখের সাহায্যে একটা ‘?’ সাইন দিল আমার দিকে।

আমি তাকে পাল্টা ‘!’ সাইন দেই।

তীরের মত ছুটছি আমরা পেছনের জোয়ান ছয়জন দূরত্ব ক্রমশ কমিয়ে আনছে ঠিক এই সময়ে বড় রাস্তাতে উঠে আসতে পারলাম।

সামনে ঘ্যাচাং করে পুলিশের গাড়িটা ব্রেক কষতেই পেছনের ছয় জোয়ান একেবারে চিমশে যায়।

তারা কোথায় উধাও হল জানি না পুলিশ ব্যাটারা আমাদের চটপট গাড়িতে তুলে ফেলে।

হাজতে বসে মশার কামড় খাচ্ছি আমরা তারমাঝে মিলন একবার বলে, ’সারাজীবন আপনার সাগরেদ এই ট্যামা মিলন। সারা জীবন।’

তার দিকে ফিরে আমি মৃদু হাসি, ‘ব্যাটারা কি আপনাকে জবাই করে ফেলার জন্য তাড়ছিল নাকি? দৃশ্যটা চমৎকার ছিল, যা হোক।’

মিলন বিষণ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়।

রুটিনমত আমার থানায় প্রবেশের পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাঝেই ইউসুফ মামার ফোনকল। প্রভাবশালী এই মামার জন্য পুলিশ বাহিনী একদিন আচ্ছা করে আমাকে প্যাঁদানোর স্বপ্নটাকে স্বপ্নেই পূরণ করে থাকে।

এমপির কোঁদানি খেতে চায় কে সখ করে?

এবারে অবশ্য আমি গোঁ ধরলাম, ‘ট্যামা মিলনও আমার সাথে বের হচ্ছে।’

পুলিশটি হাহাকার করে ওঠে, ‘এই শালা মিলইন্যা একটা টপ টেরর। আপনারে ছাড়তে পারি হ্যারে ছাড়তে পারি না।’

আমি আয়েশ করে হাজতের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বলেছিলাম, ‘তাহলে আমিও থাকছি। কয়েল-টয়েল থাকলে দিন তো। মশারা বড্ড জ্বালাচ্ছে!’

মিলন বের হয়ে আসল আমার সাথে এবং তারপরই আমার অলৌকিক ক্ষমতার ব্যাপারে সে নিঃসংশয় হয়ে যায়!

‘আপনে জানতেন ঠিক ওই জায়গা দিয়াই পুলিশের গাড়ি যাইব! আপনে ক্যামনে জানেন?’

‘গত তিনমাসের প্রতিটা রাত আমি রাস্তায় পাক খাই। ব্যাটাদের টহল রুটিন আমার মুখস্থ।’ গোমর ফাঁস করে দেই আমি।

‘ঠিক সময়ে আইয়া পড়ছিলেন। আপনে জানতেন। আপনে অনেক ব্যাপার জানেন।’

মিলনকে আর তার ধারণা থেকে টলানো যায়নি। আমিও চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এই মুহূর্তে মিলনের মতই বিস্ময়াভূত হয়ে থাকতে দেখছি তার দুই সাগরেদকে।

আমিও বেশ বুঝতে পারছিলাম ঠিক জায়গাতেই টোকা দিয়েছি। তাই আবার জানতে চাইলাম, ’ঝামেলা তো খুলে বলবে। ’

মিলন আমাকে পাশের গলির দিকে নিতে থাকে, ’আপনারে আগে এক কাপ চা খাওয়াইতে দ্যান। খাইতে খাইতে শোনেন। জবরদস্ত চিপায় পড়ছি। এক্কেরে মাইনকার চিপা। ’

কাজেই রাত একটায় খোলা থাকা বিখ্যাত দোকান’মফিজ চা স্টল’-এ সুড়ুৎ করে সেঁধিয়ে গেলাম আমরা চারজন। ট্যামা মিলনকে দেখে মফিজ মিয়া তার শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থান চুলকাতে থাকে।

পরক্ষণেই মিলনের ধমকে একেবারে অ্যাটেনশন হয়ে যায়, ’ভাইরে ভালো করে পাত্তি দিয়া এক কাপ চা বানায় দে!’

সিগারেট থেকে আমি আজীবনই দূরে আছি। সেটা মিলন জানে। আমাকে অফার না করেই নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল।

এই কাজটা থেকেও ব্যাটা দূরে থাকত, ’আপনের সামনে সিগ্রেট ধরামু, কি কন এইটা, বস?’ প্রথম প্রথম এটাই বলত।

ধমকে লাইনে এনেছি।

আমার হাতে চা চলে আসল। মিলনের হাতে’সিগ্রেট’। আর বাকি দুই চ্যালার হাতে বাতাস।

পরিবেশটা বেশ থমথমে হয়ে যায় হঠাৎ করেই।

‘ডেলিভারীর একটা ব্যাপার ছিল, ভাউ।’ শুরু করে মিলন, ’এক ব্যাগ ভর্তি হিরোইন। ডেলিভারি দেবে তোতা মিয়া। শালাকে লোকেশন জানানো হইছে। কিন্তু, পাসকোড নিয়া একটা ক্যাচাল লাইগা গেছে, বস!’

‘বস’ তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে তাড়াতাড়ি যোগ করে মিলন, ’মাঝখানে পাসকোড পালটায় ফেলা হইছে। পুলিশে নাকি সাদা পোশাকে ফেউ লাগাইছে। পাসকোড হালারা জানে। ’

চারপাশে সুশীতল বাতাস বইছে। তার মাঝে আমি আরাম করে একবার চায়ের কাপে চুমুক দেই।

‘তোতা মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভাউ কোথাও।’ ঠান্ডা গলায় বললেও তার উদ্বেগটা টের পাই , ’মোবাইল তো শালার বন্ধই তার উপ্রে কেউ কই পারে না হেয় কই। এখন পাসকোড জানাইতে পারতেছি না। হিরোইন চালান নেয়ার আগেই ব্যাটা আটকা পড়ব। ’

নিঃশব্দে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিলাম, ’নামেই তো গন্ডগোল। ’

ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তিন মাস্তান।

বিরক্তিতে মাথা দোলালাম, ’পাখির নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে কেন? উড়ে গেছে ব্যাটা। ’

‘গাদ্দারি করছে?’ ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা চোখ নিয়ে জানতে চায় মিলন।

‘না।’ মাথা নেড়ে একটা মুহূর্ত থম মেরে বসে থাকলাম, তারপর আবার বলি, ’খাঁচায় আটকেছে তোতাকে। ’

‘পুলিশ!’ হাহাকার করে ওঠে ওরা।

মাথা ঝাঁকাই আমি, ’পাসকোডটা আমাকে বল। আমি তোতাকে জানিয়ে দেব। ’

একটু দ্বিধায় পড়ে যায় এবার ওরা। আফটার অল, আমাকে মিলন গুরু মানলেও বাকি দুটো তো আর মানে না। মিলন আমাকে আরও এক ডিগ্রী বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এখন কিন্তু তোতার পুলিশের খাঁচায় থাকার হিসেবটা সহজ।

ট্যামা মিলনকে বেইমানী করার জন্য সাহসের দরকার। তোতা মিয়ার নামে মাঝে তেমন কিছু দেখলাম না। হিসেবে বলে, ব্যাটার যোগাযোগ না করার কারণ একটাই পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। যেহেতু’ফেউ’ লেগেছে এটা আরও স্বাভাবিক।

‘ফেসবুক।’ ফিস ফিস করে আমাকে জানায় মিলন।

‘পাসওয়ার্ড?’ নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘জ্বে।’ নির্মল হাসি দিয়ে বলে শীর্ষসন্ত্রাসী।

‘সব ঠিক আছে। তোতাকে বলে দেব।’ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিই আমি, ’এবার আমাকে একটা পিস্তল ম্যানেজ করে দাও তো। ’

ট্যামা মিলনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

‘কি করবেন ভাউ?’

‘মার্ডার করব।’ ঠান্ডা গলায় বলি আমি, ’বেশি না। একটা। এক বিচিতেই কাজ হয়ে যাবে। ’

চোখ ছানাবড়া অবস্থাতেই সম্মতি জানায় ও, ’ফুল লোড কইরাই দিমু নে। কিন্তু, কোন হারামজাদারে মার্ডার করা লাগব কন! লাশ ফালায় দিমু না। আপনার লগে ঘিরিঙ্গিবাজি!’

একটু হাসি আমি, তিক্ততার ছাপ পড়ে কি তাতে?

‘আমার সাথে না। এক বন্ধুর সাথে। তোমার কিছু করা লাগবে না। যা করার আমিই করব। ’

*

সকাল নয়টা।

ধবধবে সাদা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

ব্যাটা বাসায় আছে তো?

চারপাশটা বেশ ফাঁকা। বাড়িগুলো এখানে বেশ পরিকল্পনা করে বানানো হয়েছে।

আবাসিক এলাকা। কাজেই চারপাশে যেখানে সেখানে দোকানপাট আর মানুষের ভিড়ের ঝামেলাই নেই। গাছপালাও ভালই আছে। সবই পরিকল্পনামাফিক লাগানো বোধহয়।

বিভিন্ন জাতের পাখির ডাক আমাকে উদাস করে ফেলে। আর সব রাতের মত বাসাতে ফিরে এসে ঘুম দেইনি আমি। বরং সরাসরি চলে এসেছি এখানে। তিথি আমাকে এখানে দেখে ফেললে কি মনে করবে কে জানে?

তবে আমার হিসেবের মাঝে সবকিছু ঠিক থাকলে ওর আমাকে দেখতে পাওয়ার কথা না।

এই সময় দূর থেকে দেখতে পেলাম, সদর দরজা খুলে যাচ্ছে। চমৎকার স্যুট-টাই পড়ে ভদ্রলোক বের হচ্ছেন।

তিথিকেও চোখে পড়ল। বিদায় দিতে এগিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। এক মাসেই যথেষ্ট পতিপরায়ণ হয়ে উঠেছে দেখা যাচ্ছে!

তিথি আমাকে বিয়ের আগের রাতে বলেছিল পালিয়ে যেতে। শুনিনি আমি। একবার স্ট্রোক করা তিথির বাবার ওপর জুয়ো খেলতে পারিনি। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।

বাড়িটা থেকে গ্যারাজের দুরত্ব বিশ ফিট। ভদ্রলোক সেদিকে হাঁটছেন।

ইনি চলে গেলে পুরো বাসাটায় শুধু তিথি একা থাকে। দোতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। এরকম প্রাচুর্য্যের মাঝে আমি কি কোনদিন তিথিকে রাখতে পারতাম?

উত্তরটা সহজ, পারতাম হয়ত, কিন্তু ততদিনে মেয়েটার স্বামীর সমান বয়স আমার হয়ে যেত!

গাড়িটা বের হয়ে আসছে। রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাখি দেখছি আমি।

আমার সামনে এসে বার দুই হর্ন দিতেই হয়। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। মেইন রোডের মত বড় রাস্তা তো আর নয় যে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে!

শান্ত ভাবে হেঁটে গাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। পিস্তলটা বের করে এনেছি।

প্রথমবারের মত টার্গেট করতেও আমার হাত একটুও কাঁপে না।

মাঝবয়েসী ভদ্রলোকের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ট্যামা মিলনের মতই।

বার দুই গুলি করলাম। পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে গুলির শব্দে।

ভদ্রলোকের চোখ এখনও বড় বড় হয়ে আছে। সেখানে প্রাণের চিহ্নটুকু ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

পাশের সীটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ফারিহা বসেছিল মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই সেখানে।

এই মাত্র প্রথমবারের মত মানুষ খুন করে আমার অবশ্য একটুও খারাপ লাগছে না।

ঘরে মাসখানেক আগে বিয়ে করা নতুন বউ, তিথির মত মিষ্টি একটা মেয়ে রেখে যেই স্বামী পতিতার কাছে ছোটে রাতের বেলায় সে কি আসলে মানুষ?

মেইন রোডের দিকে আগালেও উঠতে পারলাম না।

পুলিশের গাড়িটা কোথা থেকে এসে জানি আমাকে তুলে নিল। কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে নেওয়ার সময় চিকণ পুলিশটা একটা থাপ্পড় মারে ডান কানে।

মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল আমার।

*

চারজন মানুষ হাজতে ঘুমুচ্ছে। তাদের মাঝে আমাকে নিতান্ত অবহেলার সাথে ছুঁড়ে ফেলা হল।

কোনমতে সোজা হয়ে বসে শিস বাজাচ্ছি শুনতে পেয়ে কাছে থাকা পুলিশটা অশ্লীল একটা গালি দিয়ে উঠল। থানার সবার জানা হয়ে গেছে এই নিরীহ দর্শন বর্বর ছেলেটা এই মাত্র  একজন সভ্য নাগরিককে খুন করে এসেছে। হত্যাকান্ডের আসামীর চেয়ে ঘৃণ্য আর কি হতে পারে?

কে হতে পারে?

কিছুক্ষণ আমিও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেছি। চোখে রাজ্যের ঘুম। অথচ ঘুম আসছে না।

ঘুমাতে থাকা মানুষ চারজনের শান্তি এখন আর সহ্য হচ্ছে না। কাজেই উঠে দাঁড়ালাম। দেওয়ালের দিকে পড়ে থাকা মানুষটাকেই পছন্দ হল।

এই ব্যাটার সারা শরীরে পুলিশী টর্চারের চিহ্ন স্পষ্ট।

ঠ্যাং লম্বা করে ঝেড়ে ব্যাটার পাছাতে একটা লাথি মারতেই ছটফট করে উঠে দাঁড়ায় মানুষটা।

‘তুই আবার কোথাকার গান্ডু?’ কোমরে হাত রেখে চট করে প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দেয় লোকটা।

‘তোতা মিয়া?’ সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করি আমি।

লোকটার মুখে এবার একটা সতর্ক ভাব ফুটে ওঠে, ’হুম। তো?’

‘পাসকোড পাল্টেছে। নতুন পাসকোড, ফেসবুক। ’

তোতা মিয়ার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টিটা মুখের ওপর টের পাচ্ছি, কিন্তু আমার চোখ আটকে আছে হাজতের গেটের দিকে।

চিকণ পুলিশটা ফিরে এসেছে।

এবং গেটের তালা খুলতে খুলতেই দ্রুত জানায়, ’সরি স্যার। ভুল হয়ে গেছে স্যার। ’

আমি ফেরেশতার মত মুখ করে হাসলাম, ’ইটস ওকে। ’

হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে লোকটা হাজতেই, ’বের হয়ে আসেন স্যার। ওসি স্যার আপনার সাথে চা খাবেন। ’

মাথা নেড়ে আস্তে করে হাজতের দেওয়ালে হেলান দেই আমি।

তারপর মুখ তুলে বললাম, ’তোতা মিয়াও আমার সাথে বের হচ্ছে। ’

 

রচনাকাল – মে ২, ২০১৪

গোয়েন্দাগিরি 

বিরক্তির সাথে চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।

“কখনও কি ভেবেছ বন্ধুর চেয়ে একটুখানি

ব্যাস! শেষ।

আর কিছু নেই লেখা।

বন্ধুর চেয়ে একটুখানি কি? বেশি নাকি কম?

ভ্রু কুঁচকে ও দু’সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে আরও। তারপর পাশে বসা জুয়েলের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা দেয়।

‘গুতাস ক্যারে?’ মোটাসোটা শরীরটা আরেকটু দুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে জুয়েল।

‘আরে কান্ডটা দ্যাখ!’ ওর হাতে গুঁজে দেয় কাগজের টুকরোটা।

‘কোথায় পাইলি?’

‘ব্যাগের মধ্যে ঢুকানো ছিল। কলম রাখি যে পকেটে। ’

‘কে পাঠাইছে লেখা নাই তো। ’

‘তুই বের করতে পারবি না?’

‘খাড়া খাড়া জিনিসটা বুইঝা লই।’ মোটা শরীরটা একটু ঘুরিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে জুয়েল।

বেশ কিছুক্ষণ কুঁতকুঁতে চোখ মেলে তাকিয়ে মিনিট পাঁচেক দেখে মাথা নাড়ে। আগ্রহের সাথে এই পর্যবেক্ষণ দেখছিল তাহমিদ। আর ধৈর্য রাখতে পারে না ও।

‘কিছু পেলি?’

‘হুম!’ মাথা তুলে জুয়েল। ’কিন্তু আগে বলুম না। তুইও দেখ। তারপর একলগে। ’

তাহমিদও ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে আটকে দেখতে যাবে এই সময় ক্লাসে ঢুকে পড়লেন দেবনাথ স্যার। ইনি ইংরেজী পড়ান। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়ে আবার বসে পড়ে।

কলেজে আধ-ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেকের পর এই প্রথম ক্লাস। লাঞ্চ ব্রেকের আধ-ঘন্টার মাঝেই কেউ চালিয়ে দিয়েছে এই চিরকুট। দেবনাথ স্যার এখন অ্যাটেনডেন্স নেবেন।

নিজের রোলটা পার হয় যেতেই আবারও ঝুঁকে পড়ে তাহমিদ কাগজটার ওপর। হাতে আতশী কাচ। পাশের সারি থেকে ওদের ভাব ভঙ্গী দেখে মুচকি হাসে প্রিয়াংকা আর কেয়া।

‘উমম’ মাথা তোলে এবার তাহমিদ। ’যদিও তুই-ই ক্লাসের একমাত্র গোয়েন্দা। তবুও আমিও চেষ্টা করে দেখি ম্যাটাডোর কলমে লেখা, উমম কাগজটা কাটা হয়েছে হাতে ছিড়ে উহু,থুতুতে ভিজিয়ে, আর্দ্র কাগজের কোণা শক্ত হওয়ার লক্ষণ থেকে যায়আর এইটা ডাক্তারী প্যাড থেকে ছেঁড়া একটা কাগজ। অ্যাম আই রাইট?’

‘সাবাশ!’ গোবদা হাত দিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দেয় জুয়েল। ’প্রায় সবকিছুই ধইরা ফেললি! আরেকটা জিনিস বাকি লেখাটা একটা মাইয়ার। সম্ভবতঃ হাতের লেখা পাল্টাইছে যে লেখছে। মানে তোর পরিচিত ওই মাইয়া। আর না পাল্টাইলে অন্য কাওরে দিয়ে লেখাইছে। ’

জুয়েল কলেজে গোয়েন্দা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

একমাস আগে চুরি হয়ে যাওয়া মকসুদের মোবাইলটা বের করতে জুয়েলের লাগে সাড়ে তেতাল্লিশ ঘন্টা। আর আড়াই দিন আগে বোর্ডে লেখা অশ্লীল বাক্যের রচয়িতাকে ওর বের করতে লেগেছিল আড়াই মিনিট। কিন্তু বেচারার ওজন একশ দশ কেজি। কলেজ শুরুর প্রথম কয়েক সপ্তাহেই ওর নিকনেইম ভোটকা হয়ে গেছিল, তবে কেসগুলো সমাধানের পর থেকে সবাই ওকে সমীহের চোখে দেখা শুরু করেছে। এই পর্যন্ত কলেজের সাতটি রহস্যের সমাধান করে ও। সমাধানের হার শতভাগ।

সেই জুয়েলের পাশে বসে তাহমিদের ব্যাগে অপরিচিত নোট লিখে যাবে কোন একজন জুয়েলের ভাষায় ’মাইয়া’ আর কালপ্রিটকে ধরতে পারবে না ওরা এ তো সাংঘাতিক লজ্জার কথা। কিন্তু এই দফায় চ্যলেঞ্জ করতে বাধ্য হয় তাহমিদ।

‘কোন মেয়ের লেখা আর তাও সেটা পাল্টে? এগুলো কিভাবে বললি?’

‘খেয়াল করলে তুইও পারতি।’ মামুলি কাজ করে ফেলেছে এরকম ভাবে নাক-মুখ কোঁচকায় জুয়েল। ’হাতের লেখার ধাঁচ ওরকম মাইয়াগোরই হয়। লেখা নিয়ে সৌখিনতা পোলারা করে না এত। ওগো লেখা জঘন্য হলেও দেখবি একটা সাজানো গোছানো ধরণ আছে। ওইটা দিয়া বোঝা যাইতেছে লেখছে একটা মাইয়া। আর অপরিণত ভাবটা খেয়াল কর হয় ছোট বাচ্চায় লেখছে অথবা মাইয়া নিজেই নিজের লেখা পাল্টানোর চেষ্টা করছে। শিওর!’

এবারে কিন্তু তাহমিদই অভিভূত হয়ে যায়।

‘সাবাশ দোস্ত!’ জুয়েলের পিঠে চাপড়ে দিয়ে বলে ও। ’বেশ উন্নতি হয়েছে রে তোর -’

‘চমৎকার!’ দেবনাথ স্যারের গলায় প্রশংসার চাইতে ব্যাঙ্গই বেশি প্রকাশ পেল। ’ক্লাস শুরু হতেই পিঠ চুলকে দিচ্ছ একে অন্যের! কি মোহাব্বত! দাঁড়িয়ে থাক তোমরা দুইজন। ’

‘ওহ শিট!’ বিড় বিড় করে তাহমিদ।

হেসে কুটি কুটি হয় প্রিয়াংকা আর কেয়া।

কলেজ থেকে বের হয়ে জুয়েলের হাতে কাগজটা তুলে দেয় তাহমিদ।

‘দোস্ত এভিডেন্সটা তুই বাসায় রাখ। পরে কাজে লাগতে পারে। ’

‘আমার কিন্তু এরই মধ্যে একজনরে সন্দেহ হয় দোস্ত। ’

‘আরে আরও তথ্য প্রমাণ দরকার।’ গেটের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তাহমিদ। ’ওই যে প্রিয়াংকা চলে এসেছে। যা তুই। কাল দেখা হবে। ’

হতাশায় মাথা নাড়ায় জুয়েল। জুয়েলের বাসা একদিকে আর তাহমিদের আরেকদিকে। ওদের পাশের বাসায় থাকে প্রিয়াংকা। কলেজে যাওয়া আসাটা তাই একসাথেই হয়। বাসে উঠে পাশাপাশি বসল ওরা। এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে খোঁচাতে ছাড়ে না প্রিয়াংকা।

‘ক্লাসে দেখলাম কি একটা কাগজ নিয়ে শার্লক হোমসগিরি ফলাচ্ছিস তোরা। ’

‘কই না তো!’ আপত্তি করার চেষ্টা করে তাহমিদ।

‘কি ছিল রে? কেউ প্রেমপত্র দিয়েছে নাকি? বেনামী?’ মজা পায় প্রিয়াংকা ওকে বিব্রত হতে দেখে।

‘এক রকম। লাঞ্চ-টাইমে কেউ আমার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল।’ স্বীকার করতে বাধ্য হয় তাহমিদ। তারপরই লাফ দিয়ে সোজা হয়ে বসে। ’তুই জানলি কি করে? তোর কাজ এইটা?’

‘তোকে প্রেমপত্র দিতে বয়েই গেছে তো আমার!’ চোখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা চলে যায় প্রিয়াংকার। ’জানব কি করে? গেস করেছি। যেভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলি। তাছাড়া লাঞ্চ-টাইমের বেল বাজতেই ক্লাস থেকে কেয়ার সাথে বেরিয়ে যাই আমি।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে, ’তাইলে তো তোর এবার হয়েই যাবে। ’

‘মানে কি! কি হবে আমার?’ সপ্তম আসমান থেকে পড়ে যেন তাহমিদ।

‘দিলে তো ক্লাসের কোন মেয়েই দিয়েছে তাই না? প্রেম হবে তোর। ’

‘শোন!’ জোর গলায় বলে তাহমিদ, ’যেই মেয়ের সামনে এসে বলার সাহস নাই এরকম মুরগির কলিজাওয়ালা মেয়ের সাথে আমি প্রেম-ট্রেম করতে পারব না। আমার প্রেমিকা হবে অনেক সাহসী। হুহ!’

‘এহহ!’ তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ জানায় প্রিয়াংকা। ’যেই না উনার সাহস। আর চায় সাহসী প্রেমিকা!’

প্রিয়াংকাকে কিল দেয় তাহমিদ।

‘আবার মারেও অবলা একটা মেয়েকে।’ অভিমানী গলায় বলে ও।

আরেকটা কিল দেয় তাহমিদ।

বাস ছুটে চলে।

পরদিন লাঞ্চ-টাইম থেকে ফিরে এসে ব্যাগ খুলে এবার রীতিমত আর্তচিৎকার করে ওঠে তাহমিদ।

‘ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন?’ বিরক্ত হয় জুয়েল।

‘আমি মোটেও চেঁচাচ্ছি না!’ ষাঁড়ের মতই চেঁচিয়ে বলে এবার তাহমিদ। ’এইটা দ্যাখ!’

বেশ বড় একটা খাম। তার মাঝে একটা মাত্র পাতার চিঠি। সেটা বড় কথা না। চিঠিটা রক্তে লেখা।

‘তাহমিদ,

এতদিন ধরে পাশে রেখেছ। বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবোনি কোনদিন। জানি আরও একটা বছর পাশে পাব তোমায়। কিন্তু আমি যে তোমায় বন্ধু ভাবতে পারি না আর। ভালোবাসি তোমায় এতটা। মুখে বলে বন্ধুত্বটা নষ্ট করে ফেলতে চাই না। তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না। বন্ধুর থেকে বেশি না ভাব আমি ভালোবেসে যাব তোমায় আজীবন। ’

‘আমি তো মাননীয় স্পীকার হইয়া গ্যালাম!’ নিজ ভাষায় বিড় বিড় করে জুয়েল। মোটাসোটা শরীরটা একেবারে পাথর হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়।

‘নাম নেই।’ চোখ তোলে তাহমিদ। ’কে হতে পারে।! কে? জানাটা দরকার। এত পাগলামী কেন করবে?’ একসেকেন্ড ভেবে ডাক দেয়, ’মাননীয় স্পীকার!’

‘হ!’ তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয় জুয়েল।

‘এই চিঠিকে এভিডেন্স ধরে কি পাচ্ছিস? আমাকে জানা। ’

চিঠি ধরে উলটে পালটে দেখে জুয়েল। তারপর নিরাশ হয়ে মাথা নাড়ে।

‘ডিএনএ টেস্ট করা লাগব!’

‘বসে আছিস কেন? করে আন!’ তাড়া দেয় তাহমিদ।

‘আমারে কি তোর সিআইডির লোক মনে হয় দেইখা?’ ঝাড়ি মারে ওকে জুয়েল। হঠাৎ আগ্রহের সাথে খামটা তুলে নেয়। ’তয় এই খাম আমগোরে লীড দিবার পারে। ’

‘খামে কোন ঠিকানা ছিল না, মি. স্পীকার। ’

‘ওই আমারে স্পীকার কইবি না। হইয়া গেছিলাম। এখন নাই আর।’ বলে জুয়েল গোবদা হাত দিয়ে পিঠে একটা চাপড়ও দেয় তাহমিদকে।

আবার বলে তারপর, ’ঠিকানা নাই কথা সত্য। কিন্তু খামে গন্ধ থাইকা যায়। শুইকা দেখ!’ তাহমিদের দিকে আগ্রহের সাথে খামটা বাড়িয়ে দেয় ও।

‘আমি বাবা রক্তের গন্ধ-টন্ধ শুঁকতে পারব না।’ নাক মুখ কোঁচকায় তাহমিদ। ’তোর মন চাইলে তুই নাক ডুবিলে বসে থাক!’

অক্ষরে অক্ষরে তাহমিদের নির্দেশ পালন করে জুয়েল। নাকটা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকে মিনিট তিনেক। তারপর মুখ তোলে।

‘একটা বডি পারফিউমের গন্ধ পাইছি। তুই শুইকা দেখ। ’

‘মরলেও না’ তারস্বরে প্রতিবাদ জানায় তাহমিদ।

হাতির পায়ের মত হাত দিয়ে ওকে চাপড়িয়ে উৎসাহ দেয় জুয়েল। শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই খামের গন্ধ শোঁকা উত্তম হাত বাড়ায় তাহমিদ। একমিনিট পর মাথা তোলে।

‘গন্ধটা আমার পরিচিত। দোস্ত কালকে তুই কাকে যেন সন্দেহের কথা বলছিলি?’

‘কইতাম কিন্তু রাগ করতে পারবিনা কইলাম!’ গ্যারান্টী চায় জুয়েল।

‘না করব না। বল?’

‘আমার তো প্রিয়াংকারে ধুমাইয়া সন্দেহ হইতেছে। ’

‘আরে নাহ।’ আপত্তি জানায় তাহমিদ নিজেই। ’কাল ওকে চার্জ করেছিলাম। কিন্তু ও সবার আগেই লাঞ্চ করতে বের হয়ে যায়। আজও আমার সন্দেহ যায়নি তাই খেয়াল করেছি সবার আগে ও আর কেয়া বেড়িয়ে যায় ক্লাস রুম থেকে। ’

‘আরে বলদা রে!’ তাহমিদের বুদ্ধির প্রশংসা করে জুয়েল। ’এরা বাইর হইয়া বাইরে ছিল কোথাও আশে পাশেই আমরা বাইর হতেই আবারও লাফায়া ঢুকছে! ’

‘হুম ’ টোকা দেয় তাহমিদ টেবিলে, ’লাফিয়ে না ঢুকলেও আমরা যাওয়ার পরে ঢুকতেই পারে

হঠাৎ জুয়েলের পাহাড়ের মত শরীরটা শক্ত হয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে, ’তাহমিদ, দ্যাখ!! প্রিয়াংকার ডান হাতের দিকে তাকা!’

তাকিয়ে চমকে যায় তাহমিদ। প্রিয়াংকার ডান হাতের তর্জনী পেঁচিয়ে আছে ব্যান্ডেজে। হাত কেটে গেছে?

নাকি নিজে থেকে কেটে চিঠিটা লিখেছে ও?

‘আজ পারলে প্রিয়াংকারে একটু গুঁতায়া বাইর করার চেষ্টা কর দোস্ত।’ সাজেশান দেয় জুয়েল ওকে। ’মুখে কইব না যখন তখন গুতাইন্নাই লাগব। হুদাই কষ্ট পাইব ক্যান?’

‘হুঁ।’ সায় দেয় তাহমিদ।

‘রক্তের চিঠিটাও কি আমি নিয়া যামু? এভিডেন্স তো। ’

‘না। ওটা আমার কাছেই থাকুক। ’

‘মাইয়াটারে আবার বাসে বেশি জেরা করিস না। যদি আমাদের সন্দেহ ভুল হয় তাইলে কিন্তু ইজ্জত মার্ডার। ’

‘আচ্ছা।’ তাহমিদের গলার স্বর আজ পরিবর্তিত।

দেখে সন্তুষ্ট হয় জুয়েল। ছেলে প্রিয়াংকাকে জেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেসটা আনসলভড থেকে যাবে এই ভয়টা ছিল ওর। বাসে উঠে ওই ব্যাপারে প্রিয়াংকাকে খোঁচানোর কোন সুযোগই পেল না আজ তাহমিদ।

‘অ্যাই তোর হাত কিভাবে কেটেছে?’ সরাসরি প্রশ্ন করে ওকে।

‘কাল রাতে মাছ কাটতে গিয়ে। কাটাকাটি পারি না তো!’ হাই চেপে বলে মেয়েটা।

‘ওহ।’ কি বলবে ভেবে পায় না তাহমিদ।

‘কাল সারা রাত ঘুমাইনি রে।’ চোখ বোজে ও। ’আমি চোখ বন্ধ করে থাকি একটু। ’

প্রিয়াংকার চোখ খোলার অপেক্ষায় থাকে তাহমিদ। কিন্তু কিসের কি! বলতে বলতেই পাঁচ মিনিটের মাঝেই ঘুম!

‘স্বাভাবিক। সারা রাত কেটেছ হাত।’ মনে মনে বলে তাহমিদ। ’গতকাল আমার সাহসী প্রেমিকা লাগবে বলাই উচিত হয় নাই। ’

মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর। বাস তখন দাঁড়িয়ে জ্যামে। দশ মিনিটের দূরত্ব পার হতে এভাবেই লাগায় আধঘন্টা। আলতো করে প্রিয়াংকার ঘুমন্ত মাথাটা ঢলে পড়ে তাহমিদের কাঁধে।

সরাতে গিয়েও সরায় না ও।

খামের মধ্যে পাওয়া সুগন্ধটা তীব্রভাবে নাকে আসে ওর।

ঘুমন্ত মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আজ বড় মায়া হয় তাহমিদের। মুখ ঢেকে দেওয়া এক গুচ্ছ চুল সরিয়ে দেয় ও পরম মমতার সাথে।

পরদিন সকাল।।

লাইব্রেরীর এক নির্জন কোণা বেছে নিয়েছে প্রিয়াংকা আর তাহমিদ। আজ যা বলে ফেলতে চায় তাহমিদ ওকে। জুয়েলটাকেও আসতে বলেছে। কিন্তু হোৎকাটা দেরী করছে। অস্বাভাবিক কিছু না অবশ্য। “যতই স্থুল হবে তুমি গতিবেগ ততই কমবে তোমার” নীতিতে বিশ্বাসী তাহমিদ ; জুয়েলের দেরীকে গ্রাহ্য না করে তাই আসল কথায় চলে আসে।

‘প্রিয়াংকা তোর সাথে কিছু কথা ছিল। ’

‘আমারও।’ কেমন যেন নিস্তেজ গলায় বলে প্রিয়াংকা আজ।

নিশ্চিত হওয়ার এই সুযোগ ছাড়ে না তাহমিদ। সন্দেহ ভুল হলে; অর্থাৎ প্রিয়াংকা ওই চিঠিগুলো না পাঠালে বেশ লজ্জার একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। তাহমিদ যে মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে নিজের কাছে আর লুকাতে পারেনি ও। গতকাল বাসেই অনুভূতিটা বুকের ভেতর একেবারে লাফালাফি শুরু করেছিল। ভাগ্যিস ঘুমাচ্ছিল প্রিয়াংকা। নাহলে কেলেংকারী হয়ে যেত!

‘বল তাহলে।’ প্রিয়াংকাকে আগ বাড়িয়ে চাল দেবার আহবান জানায় তাহমিদ।

‘তোর দিকে আজকাল অনেক মেয়ে নজর দেয়।’ শ্রাবণের মেঘ জমে প্রিয়াংকার মুখে। ’আমার এসব একেবারে সহ্য হয় না। ’

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।

‘তোকে ভালোবাসি আমি, তাহমিদ!’ মুক্তোর মত একফোঁটা পানি পড়ে প্রিয়াংকার গাল বেয়ে।

‘অ্যাই বোকা মেয়ে! কাঁদছিস কেন?’ তাড়াতাড়ি ওর হাত ছোঁয় তাহমিদ। ’তোকে এটা বলতেই আজ এখানে এনেছি। কখন জানি তোর প্রেমে পড়ে গেছি আমিও। দেখ তো  কি রকম গাধা আমি!’

চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলে প্রিয়াংকা। এই সময় লাইব্রেরীতে ঢোকে জুয়েল। প্রিয়াংকার কান্না-হাসির সাথে ওদের হাতে হাত ধরে রাখা দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেলে ও। বিশাল শরীরের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র দাঁতগুলো ঝিলিক মারে। গোয়েন্দা জুয়েলের এতটা আনন্দিত চিত্র আগে কখনও দেখেনি কেউ।

‘তুই একটা পাগলি, প্রিয়াংকা!’ এবার আলতো ধমক দেয় ওকে তাহমিদ। ’আমাকে সরাসরি বলতেই পারতি। নোট রেখে গেছিস তাও মানা যায়। তাই বলে হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে চিঠি লিখাটা বাড়াবাড়ি করেছিস! এরপর যদি আর

প্রিয়াংকার মুখে নিখাদ বিস্ময় দেখে থেমে যায় তাহমিদ।

‘তুই ভাবিস আমি ওই চিঠি রেখে তোকে মিথ্যা করে বলেছি? আর কিসের রক্ত মাখা চিঠি?’

‘তুই লিখিসনি বলতে চাস’ এক সেকেন্ড ভাবে তাহমিদ। ’তাই তো! আমি আগে কেন বুঝিনি?? স্বস্তি লেখা ছিল চিঠিতে।’ পকেট থেকে বের করে চিঠিটা।

“তবুও তোমাকে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না” লাইনটা দেখায় প্রিয়াংকাকে ও।

‘কলম দিয়ে’স্বস্তি’ লেখাটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে। কিন্তু কেউ হাত কেটে স্বস্তি লিখবে না। প্যাঁচ দেখেছ? এরচেয়ে প্রতিশব্দ ব্যবহার করে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। এইটা এই মোটকুর কাজ। নির্ঘাত! ’

একটা কলম বন্দুকের মত তাক করে ও জুয়েলের দিকে।

‘আরে আরে চ্যাতস ক্যারে?’ হাহাকার করে ওঠে জুয়েল। ’দেখলাম তোগোর ভিতরে ভালোবাসা পাঙ্খা মেলতেছে কিন্তু কইতেছস না একজন আরেকজনরে তাই ক্যাটালিস্ট দিছি জাস্ট। ’

‘দাঁড়া বলিস না।’ হাত তুলে ওর দিকে তাহমিদ। ’আমার পিছে বের হওয়ার সময় তুই ভেতরে খাম ঢুকাইছিস এইটা তো পানির মত সোজা। আর লিখাইছিস তোর ছোটবোনকে দিয়ে, প্রথম চিঠিটা। আর রক্ত উমম রক্তের ব্যাপারটা নিশ্চয় আঙ্কেলের কাছে ব্লাডব্যাগ হাতাইছিস। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। খামের মধ্যে বাসা থেকে পারফিউম মেরে এনেছিলি সেটা তো বোঝা সহজ। অ্যাম আই রাইট?’

‘পুরাই।’ মাথা নাড়ায় জুয়েল। ওর বাবা একজন বায়োলজিস্ট। ’ব্লাড ব্যাংকের কিছু নষ্ট হওয়া স্যাম্পল নিয়া বাবা কাজ করতাছিল। ওইদিন গেলাম দ্যাখা করতে। দেখি একটা থাইকা গেছে কাজ শেষেও। নিয়া আইতে চাইলাম। দিয়া দিল। তখন থেকেই মাথায় ঘুরতাছে প্ল্যানটা। ’

‘ইয়াহ!’ আনন্দে মাথা ঝাঁকায় তাহমিদ। ’এইটা আট নম্বর। ’

‘দাঁড়া দাঁড়া!’  ধরে ফেলে প্রিয়াংকা, ’কলেজ কেসগুলো তুই সব সলভ করেছিলি, তাই না তাহমিদ? তারপর জুয়েলকে দিয়ে বলাইছিলি? কেন? ওকে যাতে সবাই সমীহ করতে বাধ্য হয় তাই’ এক মুহূর্ত থেমে নতুন দৃষ্টিতে দেখে আজ প্রিয়াংকা তাহমিদকে। তবে ওই একমুহূর্তই।

‘তুই একটা ইবলিশ রে!’ কিল দেয় প্রিয়াংকা তাহমিদকে এবার।

‘তোর মাথা।’ এড়িয়ে যাতে চায় তাহমিদ।

আবার কিল দেয় ওকে প্রিয়াংকা।

এই দুইটা এইভাবে আজীবন খুনসুটি করুক।

একমুখ হাসি নিয়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে আসে জুয়েল। বুকে একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি।

রচনাকাল ২৯শে ডিসেম্বর, ২০১৩

ভালো বাসা

বাড়িওয়ালার ড্রইং রুমে বসে আছি।

ভাড়ার টাকাটা দেওয়াই উদ্দেশ্য।

টেলিভিশনে টম এন্ড জেরীর কার্টুন চলছে। পিচ্চি একটা জেরী ফিজিক্সের সমস্ত আইন-কানুনের মাঝে নিউক্লিয়ার অ্যাটাক করে  বিভিন্ন কাজ করে বেড়াচ্ছে। বাড়িওয়ালার দেখা নেই কাজেই আমি মহানন্দে ফিজিক্সের টান্ডি বাজানো দেখছি।

একগাল পান নিয়ে বাড়িওয়ালা আংকেলকে দোড়গোড়ায় দেখা গেল মিনিট পাঁচেক পর।

‘ইবা কন?’ রীতিমত অবাক হয়ে বলেন বাড়িওয়ালা। ’তুমি কে?’

‘আমাদের দেখা হয় নি আগে আংকেল।’ উঠে দাঁড়াই আমি, ’আপনাদের তিনতলায় ভাড়া থাকি আমরা। আমি মি. আহমদ শফিকের  বড় ছেলে -’

‘ও’ হঠাৎই সব বুঝে ফেলেন যেন, ’উনার যে ছেলে রাজশাহীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে?’

‘জ্বী আংকেল। ’

অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দেওয়ার আগেই যে চিনে ফেলেছেন সেজন্য একটা স্বস্তির পরশ অনুভব করলাম শরীরে। আড়চোখে টমের অবস্থানটা দেখে নিলাম। এই পর্বটা আমি দেখিনি আগে। বেশ মজাদারই আছে। না দেখে যাওয়াটা উচিত হবে না।

‘বস বাবা।’ বিনয় উপচায় বাড়িওয়ালার গলায়, প্রথম পরিচয়ে এমন বিনয়’ডেলিভারী’  দেওয়াটা ইনার বৈশিষ্ট্য বটে। জেনেশুনেই কাজে নেমেছি কি না!’বাসা পছন্দ হইছে আশা করি। এই তো সিঁড়ি ঘরের ফিনিশিং দিলাম কয়দিন হল। ’

‘ওহ,আংকেল, ভাড়াটা নিয়ে এসেছিলাম।’ হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এভাবে বললাম তিরিশ সেকেন্ড পর। এভাবে আর তিনটে মিনিট পার করে দিতে পারলে আমার এই পার্টটা দেখা হয়ে যায়।

ঐ যে গেল ফিজিক্সের আরেকটা সূত্র! একটা চিঠির খাম ব্যবহার করে উড়ে যাচ্ছে জেরী। নিস্ফল টম তাকিয়ে আছে সেদিকে!

‘আংকেল’ ভাড়াটা গুণে গুণে নিলেন।

‘তুমি বাবা ফিজিক্সের সূত্রের উর্ধ্বে না’ মনে মনে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ’প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে হুঁ হুঁ। ’

এবার বাসায় এসেই শুনলাম গত কয়েকদিন ধরে বাড়িওয়ালার স্ত্রী আমার ছোট ভাইকে সামনে পেলেই অভিযোগ করছে ও নাকি রাতে শব্দ করে। আর আমাদের বাসা সরাসরি বাড়িওয়ালার ওপরের ফ্লোরেই।

আমিও বড়ভাই-য়ত্ব ফলিয়ে ওকে বেশ করে বকে দিলুম।

ছোটভাইটা মর্মাহত হল, ’না জেনে আমাকে বকলা তুমি? এরা এরকমই খারাপ। কিছু না করলেও অভিযোগ করে। ’

‘খারাপ-বাড়িওয়ালা’ নিয়ে অনেক গল্প শুনলেও এতদিন চোখের দেখা দেখিনি একজনকেও। তিনটি বাসাতে থেকে এসেছি আমরা তবে বাড়িওয়ালাগুলো ছিলেন মাটির মানুষ একেবারে। কাজেই কৌতুহলী না হয়ে পারলাম না।

‘কেন? কেন?? কিছু না করলে অভিযোগ করবে কেন?’

‘নিজেরা যে এই বিল্ডিং-এর সর্বেসর্বা সেটাই দেখায় আরকি। ’

‘আর সব ভাড়াটেদের সাথেও কি বাজে ব্যবহার করেছে?’

‘রোজ করছে! সেদিন পাশের বাসার তমা আপুকে অনেক করে বকল ও নাকি খুব জোরে গান বাজায়! অথচ আপুটা অনেক ভালো। মোটেও জোরে গান বাজায় না। বাজালে তো আমাদের কানেই আগে আসত তাই না?’

‘হুঁ’ কথা সত্য ভাবলাম।

‘আরও আছে -’ থামে না অপু। ’সেদিন রিয়া আপু ছাদে উঠতে চেয়েছিল। ওরা ছাদে সবসময় তালা দিয়ে রাখে। তাই ওদের কাছে চাবি চাওয়াতে বাড়িওয়ালী কি বলেছে জানো?’

‘কি?’

‘আমরা তোমাদের ঘর ভাড়া দিয়েছি ছাদ ভাড়া দেই নি। ’

‘এইটা কোন ধরণের ভদ্রতা?’ আমার চোখ কপালে উঠে গেল। ’উঠতে দেবে না ভালো কথা বলার তো ধরণ আছে একটা নাকি?’

‘বোঝ তাহলে!’ আমার সাথে তাল মেলায় অপু। ’ইদানিং লেগেছে আমার সাথে। আমি নাকি রাতে শব্দ করি!’

‘হুম ’ ওকে বলেছিলাম, ’দাঁড়াও, আমি এসে যখন পড়েছি এই সাতদিনেই একেবারে সিধে করে দিয়ে যাব। ’

অপুর চোখের দৃষ্টিতে তেমন ভরসা দেখলাম না।

পরদিন সকালে নীচতলা থেকে মেশিনগানের গুলির শব্দে ঘুম ভাঙ্গল।

ঘুমের রেশ একটু কাটতে বুঝলাম ওটা মানুষেরই গলা।

আরও ভালো করে শুনে বুঝলাম, স্বয়ং বাড়িওয়ালার গলা’উহা’ কিন্তু এ কী এলিয়েনটিক ভাষা রে বাবা! একটা শব্দের মানে আমি বুঝলাম না।

আমাদের এই বাড়িওয়ালা চট্টগ্রামের মানুষ। ক্ষেপে গেলে খাস ভাষা বেরিয়ে আসবে সেটাও স্বাভাবিক অবশ্য। দরজায় অপুকে দেখতে পেলাম এই সময়।

‘লোকটা চেঁচাচ্ছে ওর বাসাতে বেড়ালের পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে তাই।’ আমাকে তর্জমা করে দিল ও।

‘তুমি কিভাবে জানো?’ আমার মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে যায়।

‘কয়েক মাস ধরে আছি না? একটু-আধটু বুঝি। ’

আরও এক পশলা গুলির শব্দ বাড়িওয়ালা এলিয়েনের ভাষায় আরও কিছু বলল।

‘ওটা কি বলল?’ অপুই আমার ভরসা এখন।

‘যে বিড়াল পোষে তার আম্মুকে’ হঠাৎ থেমে যায় অপু। ’সরি ভাইয়া, এইটা আমি বলতে পারব না। ’

উধাও হয়ে যায় ছোটভাইটা।

নিজের মাথায় হাত বোলালাম কাহিনী দেখি সিরিয়াস।

অথচ বাসার ভিউ একেবারে সেই রকম। একপাশে তাকালে বেশ দূরে সমুদ্র দেখা যায়। আরেকপাশে একটা স্নিগ্ধ বাগান তার মাঝে সুন্দর একটা পুকুর। এত সুন্দর বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। অথচ বাড়িওয়ালাটাকে লাইনে আনতে না পারলে তাই করা লাগবে মনে হচ্ছে।

হাত মুখ ধুয়ে সোজা দুইতলায় নেমে গেলাম। নক করতেই বাড়িওয়ালী, যিনি অপুর ভাষায়’ডাইনি’ দরজা খুলে দিলেন।

‘ইয়ে আন্টি, ছাদে ওঠা যায় না?’ মুখে সরল একটা ভাব ফুটিয়ে রেখেছি, ’গিয়ে দেখলাম দরজায় তালা। ’

আসলে ডাহা মিথ্যা কথা। ছাদে উঠে কে? জানাই তো আছে দরজায় তালা।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হুট করে বাজে কথা বলতে বাধল মনে হয় ডাইনি বুড়ির। তাছাড়া আমার সাথে তাদের দেখা একবারই হয়েছে এবং সেই সাক্ষাতে আমার হাত থেকে অনেকগুলো কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোট তাদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে কাজেই আমার প্রতি মন কিছুটা প্রসন্ন থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

এসব সাত-পাঁচ ভেবেই হয়ত চাবিটা আমাকে এনে দিল। ওটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার ভান করতেই হল।

বাড়িওয়ালার দরজা লেগে যেতেই ছুটে নিচে নেমে পড়লাম।

আধ ঘন্টার মাঝেই ডাইনির কাছে চাবি ফেরত দিয়ে ডুপ্লিকেট ছয়টা চাবী নিয়ে ডিং ডং করতে করতে আমি বাসায় হাজির।

কিন্তু বিকেলেই পরিস্থিতি আবারও ঘোলাটে।

স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে অপু রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করল।

‘আকাশ ভাইয়া!’ অপুর রণহুংকার শুনে ঘাবড়েই গেলাম।

‘কি হয়েছে?’

‘ডাইনি বলে আমি নাকি কাল রাতেও শব্দ করেছি!’

‘কি! বুড়ির আম্মুকে আমি আন্টিও ডাকি না!’ মেজাজ এবার আমারও খারাপ হয়ে গেল। কাল রাতে আমি বাসাতেই ছিলাম। অপু যে শব্দ করেনি শুধু তাই নয় কোন বিকট শব্দই শুনিনি আমি।

মিথ্যামিথ্যি অপবাদ দিয়ে ওদের কি লাভ সেটাই বুঝলাম না। কিছু মানুষের মনে হয় মস্তিষ্কই বিকৃত থাকে।

রাত দশটাতে রান্নাঘর থেকে একটা খালি বিস্কুটের টিন চুরি করতে হল।

দশ মিনিট ঠুক ঠুক করে টিনের ওপরের অংশটা কেটে এটাকে একটা ইস্পাতের বালতি বানিয়ে ফেললাম।

সদ্য করা ফুটো দিয়ে দড়ি বেঁধে আমি প্রস্তুত। শব্দ কাকে বলে কতপ্রকার ও কি কি  আজ দেখাচ্ছি!

কানে হেডফোন লাগিয়ে মহানন্দে ফেসবুকে চারঘন্টা বন্ধুদের সাথে চ্যাট করতে করতে দিব্যি রাত দুইটা বাজালাম।

‘এবার তোমাকে নিউটনের থার্ড ল’র একটা ব্যাবহারিক উদাহরণ দেওয়া যায়’ বাড়িওয়ালা পরিবারের উদ্দেশ্যে বললাম মনে মনে।

আমার ট্রাভেলিং ব্যাগ থেকে দশ ইঞ্চি লম্বা আর সেই অনুযায়ী চওড়া পটকাটা বের করলাম। ভেবেছিলাম নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ফাটাব তা আর ডাইনি ফ্যামিলি হতে দিল কই?

দীর্ঘশ্বাসটা চাপলাম।

বারান্দায় এসে সুতোতে আগুন দিয়ে বিস্কুটের টিনে নামিয়ে দিলাম পটকাটাকে। দড়ি ঝুলিয়ে বাড়িওয়ালা আংকেলের বেডরুম সংলগ্ন বারান্দার সামনে এনে পাঁচ সেকেন্ড অপেক্ষা করতেই

প্রথমে শীতের রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আমার কানেরই পর্দা ঝালাপালা করে একটা বিকট শব্দ।

তারপর তড়িঘড়ি করে নিশব্দে টিন তুলে নিয়ে রুমে ফেরার আগেই সকালের মত দোতলা জুড়ে মেশিনগানের গুলি শুরু হয়ে গেল।

খাটের নীচে ’এভিডেন্স’ চালান করে মনিটরের পাওয়ার সুইচ অফ করে আমি লেপের তলায়।

তবে আজকের’শব্দ’টা অতিরিক্ত ছিল। বাবা-মাও জেগে গেছে শব্দের তীব্রতায়।

হুড়মুড় করে সিঁড়িঘরের দিক থেকে শব্দ এবং পরমুহূর্তেই বাসায় কলিং বেলের মুহুর্মুহু শব্দে বাবা গেলেন দরজা খুলতে।

‘হতরত খতরম ভতরত অওয়জ হিকিরিক ’ বা এজাতীয় কিছু প্রাণপণে উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন বাড়িওয়ালা স্বয়ং।

‘আপনাদের ওখানে কি হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে বাবাও প্রশ্ন করলেন।

বাংলা ভাষা কানে পড়তে বাড়িওয়ালার খেয়াল হয়। ইনিও বাংলাতেই হুংকার ছাড়েন এবার ’আপনার ছোট ছেলে রোজ শব্দ করে আপনি কিছু বলতে পারেন না তাকে? এই রাত দুটোতে এমন বিকট শব্দ

‘আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন।’ ঠান্ডা মেজাজের বাবাও রেগে যান এবার, ’আমি স্পষ্ট শুনেছি শব্দটা নীচ থেকে এসেছে।

‘আমিও স্পষ্ট শুনেছি  শব্দটা ওপর থেকে এসেছে!’ সমানে গলা মেলায় বাড়িওয়ালা।

এলোমেলো চুল আর ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে আমি এই পর্যায়ে এসে থামলাম ড্রইং রুমের দরজায়।

‘নীচে কি কোন টায়ার ফেটেছে? শব্দ শুনলাম একটা।’ সাধুর মত জানতে চাই আমি।

এবার দুইজনেই চুপ হয়ে যান।

বাবা নিশ্চিত শব্দটা নীচ থেকে হয়েছে। বাড়িওয়ালাও নিশ্চিত শব্দের উৎস ওপরে। আমার কথায় বাড়িওয়ালা এতক্ষণে যেন কিছুটা কনফিউজড হয়ে গেল।

‘কিছু ন বুজ্জুম ’ বাড়িওয়ালা বিড় বিড় করে এরকম কিছুই বলল।

‘কিছু বুঝবেন না মানে!’ মনে মনে বলি আমি। ’আরও বোঝার বাকি আছে তো আপনার। ’

বাড়িওয়ালা নিজের বাসায় ফিরে যেতেই আবারও লাফ দিয়ে মনিটরের সুইচ অন করে ফেসবুকে ফিরে গেলাম আমি।

আরও দুই ঘন্টা মহাসমারোহে চ্যাট করে রাত চারটা বাজতেই সংগ্রহে রাখা দ্বিতীয় পটকাটা  বের করলাম।

কত সখ ছিল এটাকেও নিউ ইয়ার উপলক্ষ্যে ফাটাব!

ইস্পাতের টিনটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দ্বিতীয়বার পটকাটা ফাটাতেই রাস্তার তিন চারটা নেড়ি কুকুর প্রবলবেগে প্রতিবাদ জানিয়ে একসাথে ডেকে ওঠে।

*

রাত সোয়া চারটা।

আগের চেয়েও অগোছালো চুল নিয়ে আমি সন্তের [saint] মত বসে আছি ড্রইং রুমে। বাবা-মা আর বাড়িওয়ালা আংকেলও উপস্থিত।

রোজ রোজই বাড়িওয়ালার স্ত্রী শব্দ পেতেন আর আমরা পেতাম না।

আজ তো উৎপাত আরও বেড়ে গেছে।

‘এগুলো কি হচ্ছে রে,আকাশ?’ মা উদ্বিগ্ন গলায় আমার কাছে উত্তর খোঁজেন।

‘আমার মনে হয় বাসার ইলেক্ট্রিক্যাল লাইনটা একবার চেক করা দরকার আপনার।’ বাড়িওয়ালাকে পরামর্শ দেন বাবা।

‘হুজুর ডেকে বাড়ি বন্ধ করা লাগবে।’ আমার মুখ দিয়ে বের হতেই বাড়িওয়ালা আংকেল খুশি হয়ে গেলেন।

‘এই পুয়া একেবারে ঠিক বলছে। ইঞ্জিনিয়ার পুয়া মাথাত বিরেন আছে। জিনত ঘরৎ [ঘরে] ইন্দি-উন্দি [এদিকে ওদিকে] শব্দ করবে জিনক আঁতুর[খোঁড়া] ন করি তো আমি বাপের পুয়া না।’ চট্টগ্রামের ভাষা আর চলিত ভাষার জগাখিচুরী মেশিনগান চালিয়ে দিলেন।

বাবা মোটেও এই সমস্যার পক্ষপাতিত্ব করতে পারলেন না। মা অবশ্য আপত্তি করছেন না। হুজুর বাড়ি বন্ধ করলে ক্ষতিই বা কোথায়? আর বাড়িওয়ালা আংকেল তো রীতিমত উৎসাহিত এই সমাধানে।

আমিও শত্রুপক্ষের সাথে তাল মেলালাম।

আজ রাতের মত এটাই মীমাংসা হল পরদিন জুম্মার পরে ইমাম সাহেবকে আসতে বলে দেবেন বাড়িওয়ালা আংকেল।

আপদটা বিদেয় হতেই বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই আমি।

পরের দিন সকালে ছাদে উঠে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে মুখে দেশাত্মবোধক গান নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খোলা ছাদে।

সকালের মিষ্টি রোদে সমুদ্র দেখার মজাই আলাদা।

ভিউটা ছাদ থেকে এতই মাথা নষ্ট করা ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম। মনটা আজ ফুরফুরে। বাড়িওয়ালার হম্বিতম্বি শোনা যায় নি আজ সকাল থেকে।

বুড়োটাকে ভয় দিতে পেরে বেশ শান্তি লাগছে মনে।

‘ম্যাচ হবে আপনার কাছে?’

কানের কাছে নারী কন্ঠটা এতই চমকে দিল আমাকে গলায় ধোঁয়া আটকে কেশে ফেললাম।

সাদা টি-শার্টে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে আমার দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

অভিজ্ঞ চোখ একনজর দেখেই বলে দিল ঠোঁটে ওটা ডানহিল। বাতাসে সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে চোখদুটো ভীষণ কালো। ফরসা গাল দুটোতে কোন দাগের চিহ্নও নেই। খাড়া একটা নাকের সাথে গোলাপী ঠোঁটদুটো একেবারে মানিয়ে গেছে।

কাল রাতে জ্বীন জাতির সাথে ফাজলেমী করার জন্যই কি রিয়েল জ্বীনের পাল্লায় পড়লাম নাকি রে বাবা? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ম্যাচটা তুলে দিলাম মেয়েটার হাতে।

আগুনটা ধরিয়ে রেলিং-এ দুই হাত আড়াআড়ি করে রেখে দাঁড়ায় মেয়েটা।

‘আপনি নিশ্চয় আকাশ?’ সুন্দর ভ্রু দুইটা কুঁচকে জানতে চায় আমার কাছে।

‘ঠিক ধরেছেন।’ কিছুটা বিস্মিত না হয়ে পারি না। ’আপনি?’

‘আমি মিথিলা।’ ছাই ফেলে দক্ষ স্মোকারের মত রেলিং এর ওপাশে। ’আপনি রুয়েটে পড়ছেন?’

‘হুম।’ এতকিছু জানে কি করে- শুষ্ক গলায় ভাবি আমি। এই মেয়ে জ্বিন না হয়েই যায় না। ’আপনি?’

‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী নিয়ে পড়ছি।’ আমার গলার অবাক ভাবটা হয়ত এতক্ষণে খেয়াল করে মিথিলা, ’আমি দোতলায় থাকি। ’

এই মেয়ে জ্বীন হলেও এতটা আশ্চর্য হতাম না আমি। এইরকম রুক্ষ বাড়িওয়ালার এত ভদ্র আর সুন্দরী মেয়ে কিভাবে থাকে? তবে জ্বীনের সঙ্গ থেকে মানুষের সঙ্গ নিশ্চিত হতেই দ্রুত সিগারেটে টান দিলাম কয়েকটা। পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম এতক্ষণের’ক্ষতি’।

‘আচ্ছা!’ অবশেষে মুখ খুললাম, ’ছাদে স্মোক করেন সমস্যা হয় না?’

‘উঁহু বাবা ছাদে কখনই ওঠেন না। আর ভাড়াটেদের চাবি দেওয়া হয় না সাধারণতঃ কে আসবে ছাদে আর?’

‘আমাকে ছাদে দেখে অবাক হলেন না যে তাহলে?’

আমার দিকে তাকায় মিথিলা, ’আচ্ছা, আমাকে দেখে কি আপনার নির্বোধ মনে হয়?’

‘বাপের মত হয়ে থাকলে শতভাগ নির্বোধই হতে পার হে!’ মনে মনেই বললাম কথাটা। মুখে বললাম, ’এ প্রশ্ন কেন?’

‘গতকাল চাবি নিয়েছিলেন নির্ঘাত ডুপ্লিকেট বানিয়েছেন। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না।’ সিগারেটে ধীরে-সুস্থে টান দেয় মেয়েটা। ’এই বাসায় জ্বীন আছে বলে আপনার মনে হয়?’

‘হুম।’ আর কিছু বললাম না। মেয়ে যথেষ্ট চালাক। এর বাপটা এরকম হলেই গেছিলাম আমি।

‘তারমানে পটকা ফাটানোটাও আপনার কাজ। জ্বীনে এত দৃঢ় বিশ্বাস থাকার আর কোন কারণ থাকতে পারে না। ’

এই রে এই মেয়ে তো রীতিমত গোয়েন্দা। বিমর্ষ হয়ে সিগারেটে চুপচাপ টান দিতে থাকলাম। প্ল্যান সব ভেস্তে গেল।

মেয়ে যখন বের করে ফেলেছে বাড়িওয়ালা বাবা কি আর জানবে না?

আড় চোখে মেয়েটাকে একবার দেখলাম।

কালো থ্রি-কোয়ার্টার আর সাদা টি-শার্ট পরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে এই অসাধারণ পরিবেশে একটা সুন্দরী মেয়ে ডানহিল খাবে আর আমি আড়চোখে তাকাব না এতটা মহাপুরুষও হইনি এখনও!

মেয়েটার মুখে কৌতুকের আভাস তখনই খেয়াল করলাম।

‘ভাবছেন কেন বলছি না বাবাকে?’ আমার দিকে ফেরে মিথিলা। ’আপনাকে সিএনজি থেকে নামতে দেখলাম যখন জানালা দিয়ে তখনই মনে হচ্ছিল এরকম কিছু করতে যাচ্ছেন আপনি। বাকি ধারণাগুলো মেলে কি না দেখার আগ্রহ আছে। ’

‘আর কি কি ধারণা?’ টোকা দিয়ে সিগারেটের গোড়াটাকে চোখের সামনে দূর করলাম।

‘সেটা কি আমার বলার কথা?’ মিথিলার ডানহিলের গোড়াটাকে টোকা মারে ও-ও। আমারটার চেয়েও দূরে গিয়ে পড়ে ওটা।

‘না।’ তাড়াতাড়ি বললাম, ’আমার ধারণা, আপনি চান এই বাসার ভাড়াটে-বাড়িওয়ালা দূরত্ব কমে আসুক। ’

‘হয়তো। চলুন নামা যাক। ’

নামাজ পড়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে বাসার সামনের রাস্তায় নজর রাখছি। বন্ধু নুরূলকে ফোনে ঘটনার গুরুত্ব বুঝিয়ে আসতে বলেছি সেই সকালে। হঠাৎ ইমাম সাহেবকে দেখতে পেলাম সরাসরি বাসার দিকেই আসছেন।

নামার জন্য প্রস্তুত হলাম।

ইমাম সাহেব বাউন্ডারীর গেইটে পা রাখার সাথে সাথে উনার গায়ে আছড়ে পড়লাম আমি।

ভুঁড়ি দুলিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন হুজুর জাপ্টে ধরে উনার পতন রোধ করে গলায় ব্যাগ্রতা ঢেলে বললাম, ’ঢুকছেন কোথায়?? সময় থাকতে কেটে পড়ুন!’

‘কেন বাবা?’ আকাশ থেকে পড়েন হুজুর। ’এই বাড়ি আজ আমার বন্ধ করার কথা। ’

‘তিনতলার পাগলি মেয়েটা নেমে আসছে -’ গলায় ব্যাস্ততা বাড়িয়ে তুললাম, কিন্তু হুজুরের চেহারায়’কত পাগলি সারাইলাম’ ভাব দেখা গেল। ’-জামাকাপড় খুলে ফেলার হুমকি দিতে দিতে।’ বাক্য শেষ করলাম আমি।

‘আস্তাগফিরুল্লাহ!’ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুট লাগালেন হুজুর। ’নাউযুবিল্লাহ মিন যালেক!’

ছুটন্ত হুজুরের পাশ দিয়ে একটা রিকশা এসে থামে বাসার সামনে।

‘ওই টা কে ছিল?’ গুরুগম্ভীর চেহারায় বলে নুরুল।

‘ঝামেলা। তবে দূর করা হয়েছে।’ সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওর মুখে লাগানো নকল দাঁড়ির দিকে তাকালাম। ’ভালোই ফিট করেছে তোকে। মনে আছে সিচুয়েশন কি?’

‘আরে পানির মত।’ হাসে নুরুল। ’সিরাজ-উদ-দৌলার রোল সামলে ফেলতে পারলাম আর এইটা সামান্য এক বুড়োকে পটানো! চল তো!’

*

‘ইমাম হুজুর ব্যস্ত তাই আমাকে পাঠিয়েছেন।’ বড় বড় চোখ মেলে বলে ইমাম সাহেবের রিপ্লেসমেন্ট।

খুশি মনেই তাকে বিশ্বাস করে বাড়িওয়ালা আংকেল। চট্টগ্রামের ভাষার মেশিনগান ছুটিয়ে পরিস্তিতি ব্যাখ্যা করেন নুরুলের কাছে।

‘ছাদ বন্ধ থাকায় জ্বীন বাসায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ গম্ভীর গলায় রায় দেয় হুজুর। ’ছাদের দরজা সবসময় খুলে রাখতে হবে। ’

‘কিন্তু, আমার মেয়েটা যে ছাদে উঠতে পছন্দ করে!’ বাড়িওয়ালার মোটেও পছন্দ হয় না এই রায়।

‘উঠবে।’ বিরক্তিভরে বলে হুজুর। ’তবে মেয়েছেলের বেশি ছাদে বের না হওয়াই ভালো। ’

কটমট করে তাকায় মিথিলা।

‘জ্বীনেরা সব বাসায় আসর করে না।’ এইমাত্র মিথিলার আম্মুর বানিয়ে দেওয়া পানটা মুখে পুড়ে নিয়ে একগাল হাসে নুরুল, ’যেসব বাসায় শান্তি থাকে সেখানে জ্বীন দেখবেন না কেউ। এই বাসায় নিশ্চয় ঝগরা বিবাদ লেগেই থাকে। না সাহেব?’ কড়া দৃষ্টিতে বাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকে নুরুল।

‘জ্বী হুজুর।’ পর্দার আড়াল থেকে বলে বাড়িওয়ালি, ’ মিথিলার আব্বু তো সারাদিন ক্যাটক্যাট করতেই থাকে ভাড়াটেদের সাথে। ’

‘আর তুমি?’ ক্ষেপে যান আংকেলও, ’তুমি তো রোজ রোজ বাচ্চা ছেলেটাকেও মিথ্যাই দোষ চাপাও!’

‘থামুন থামুন!’ হাত তোলে নুরুল, ’গোস্বা নেককাজসমূহ ধংস করে। রাগ করতে নেই। বাসাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাটা বাঞ্ছনীয়, সাহেব। একই কথা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বিবিসাহেবা। আর শরীয়াতের মতে বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে সুপাত্র দেখে দিয়ে দেওয়াটা জরুরী। ’

এবার আমি কটমট করে তাকাই নুরুলের দিকে। ভেবড়ে যায় বেচারা।

‘থাক সে কথা। এখন আমি ঘর বন্ধ করব। আপনারা দোয়া দরুদ পড়ুন। আর আপনি আমার সঙ্গে আসুন।’ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে ও।

দরজা দিয়ে বেড়িয়েই ওর পশ্চাদ্দেশে দুটো লাথি ঝাড়লাম। ’শালা তুই মিথিলার বিয়ের কথা বলিস কোন সাহসে?’

পেছন থেকে ছোট্ট একটা কাশির শব্দে তৃতীয় লাথিটা দিতে গিয়েও থেমে যাই।

চৌকাঠে হেলান দিয়ে আমাদের দেখছে এবং শুনছে মিথিলা।

মুখে মিষ্টি একটা হাসি।

সে হাসিতে সম্মতির লক্ষণ!

মনটা ভালো হয়ে গেল আমার।

আমি আর নুরুল ছাদের দিকে রওনা হলাম বাড়ি’বন্ধ’ করার উদ্দেশ্যে

 

রচনাকাল – ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩ 

আমি জুনিয়র

ভার্সিটির পাশের টং-এ বসে চা-সিগারেট খাচ্ছিল ফরহাদরা। বিশ মিনিটের এই ব্রেকটা কাটাবার জন্য এর থেকে ভালো কোন উপায় ওরা আজও বের করতে পারেনি।
শাহরিয়ারই খেয়াল করে প্রথমে ব্যাপারটা।
‘দোস্ত, রাস্তার ওইপাশের পোলাটারে দ্যাখ! সিগারেটে জোশের সাথে টান মারতে মারতে আমাদের দিকে স্ট্রেইট তাকায়া আছে! এই পোলারে আমি চিনি। ফার্স্ট ইয়ারের। ’
‘কস কি!’ ফরহাদের মেজাজ লাফ দেয় ওপরের দিকে, ’র‍্যাগিং কি জিনিস বুঝে নাই তাইলে এখনও! ডাক এদিকে বেয়াদবটাকে। ’
‘আরে বাদ দে না তোরা!’ মৃদু আপত্তি তোলে নীরা।
নীরাকে অগ্রাহ্য করে হাত তুলে হালকা ইশারা করে শাহরিয়ার।
ফরহাদরা সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র-ছাত্রী। মাত্র কয়েকদিন হল নতুন ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়েছে। র‍্যাগিং- কি জিনিস রাস্তার ওপাড়ের ছেলে হয়ত টের পায় নি – কিন্তু হামেশাই সেটার প্রয়োগ করতে পেরে গত কয়েকটা দিন অসাধারণ কাটছে সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেদের।
চায়ের দোকানের বিল মিটিয়ে ধীর পায়ে এদিকে আসতে থাকে ফার্স্ট ইয়ারের ’বেয়াদব’টা। হাতে সিগারেট জ্বলছে এখনও। মনে মনে খুশি-ই হয় ফরহাদ, র‍্যাগিওমিটারের কাঁটা আরও কয়েক ডিগ্রী বাড়িয়ে দেয় মনে মনে।
‘আমাকে ডাকলেন নাকি, ভাইয়া?’ কাছে এসে রাজ্যের কৌতুহল চোখেমুখে ফোটায় ছেলেটা।
‘কোন ব্যাচ?’ থমথমে মুখে জানতে চায় ফরহাদ।
‘ ওয়ান-থ্রি। (এইচএসসি ২০১৩)।’ সিগারেটে উদাস ভঙ্গীতে টান মারে ও।
‘কি নাম?’ থমথমে ভঙ্গী বাড়ায় ফরহাদ।
‘তুর্য। আপনি?’
‘আমি ফরহাদ। আমাকে দেখে কোন ব্যাচ মনে হয়?’
‘ওয়ান-টু, সম্ভবতঃ?’ সিগারেটে আরেক টান দিয়ে মনোযোগ দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আকাশ দেখে তুর্য।
‘সিনিয়র ভাই জানার পরও সামনে সিগারেট খাচ্ছ – সরাসরি তাকিয়ে আছ – নিজেকে ওভারস্মার্ট মনে কর?’
অবাক হল যেন একটু ছেলেটা, ‘এই প্রসঙ্গ কেন। আমি কিছুই ভাবিনি। তাছাড়া – আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম না, ভাইয়া। ’
‘তাহলে কি দোকানদার মামারে দেখতেছিলা? ’ রাগের ঠেলায় উঠেই পড়ে শাহরিয়ার।
‘না ভাইয়া। উনাকে দেখছিলাম।’ চমকে ওঠা নীরার চোখের দিকে তাকায় তুর্য।
এবার আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না ফরহাদ। উঠে একদম গা ঘেষে দাঁড়ায় তুর্যের।
‘আবার বল তো শালা!’ ‘তুমি’ থেকে এক লাফে ‘তুই’ এ নেমে গেল ফরহাদ।
সরে এসে নীরার সামনে দাঁড়ায় তুর্য, ’আপনার চোখ আর চুল অনেক সুন্দর। না তাকিয়ে থাকতে পারিনি, দুঃখিত। আমি তুর্য। আপনার নামটা জানা হল না। ’
পাশ থেকে আহত বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে ফরহাদ। তুর্য ধাক্কা সামলাতে পারেনা। ছিটকে পড়ে মাটিতে। ওর ওপর এসে পড়ল ফরহাদ। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে যেন রাগে। একের পর এক ঘুষি মারছে এখন তুর্যের মুখে।
কেউ ঠেলে সরিয়ে দিল ওকে। তাকিয়ে নীরার রাগত মুখটা দেখতে পায় ফরহাদ।
‘দিস ইজ টু মাচ!’ চিৎকার ছাড়ে নীরা।
‘সর তুই। শালাকে রেসপেক্ট শিখাতে দে!’ রাগে ফোঁস ফোঁস করে ফরহাদ।
‘একটা বাচ্চা ছেলেকে এভাবে মারিস! আমার সামনে থেকে সর তুই! তোর চেহারা দেখাবি না আর আমাকে! ’
হতভম্ভ হয়ে তাকায় ফরহাদ। ততক্ষণে লোক জমে গেছে চারদিকে।
আস্তে করে উঠে বসে তুর্য। থুতু ফেলে রাস্তায়। অনেকটুকু রক্ত বেরিয়ে আসে তার সাথে।
‘তুমি আমার সাথে আসো। ফার্স্ট এইড দরকার তোমার।’ তুর্যকে ধরে টেনে তোলে নীরা।
আলতো করে নীরার হাতটি ছাড়িয়ে নেয় তুর্য। ’ইটস ওকে। ’
ফরহাদের মুখোমুখি দাঁড়ায় ও। ’ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিন। সিনিয়রদের প্রতি রেসপেক্ট জিনিসটা কিছুটা আছে। তবে আজ থেকে আপনার প্রতি আর থাকল না। ’
‘শালা আবার আমাকে থ্রেট দিস- ’ বলতে বলতে আবারও তুর্যের মুখ লক্ষ্য করে হাত ছোঁড়ে ফরহাদ।
বিদ্যুতবেগে রিঅ্যাক্ট করে তুর্যও। ফরহাদের হাত ধরে দ্রুত কয়েক জায়গা ছুঁয়ে দেয় ও।
যেন কিছুই হয়নি, এমন এক ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা রিকশা থামায় জুনিয়র ছেলেটা। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীরা।
হাত নড়ানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হল ফরহাদ। অবশ হয়ে গেছে ওর ডানহাত।
*
পরের দিন।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে নীরা দেখল দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুর্য।
‘আপনার দুই মিনিট সময় হবে?’ বিনীত গলায় জানতে চায় ও।
তুর্যের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নীরা। স্টিচ লাগানো ঠোঁটের পাশে।
‘তুমি কি পাগল?’ পালটা প্রশ্ন করে নীরা। ’একটা ভার্সিটিতে তোমাকে চারটা বছর থাকতে হবে! সিনিয়ররা সবাই তোমার ওপর ক্ষ্যাপা। মানি – তোমার সাহস আছে। কিন্তু টিকতে পারবা এরকম অ্যাটিচ্যুড নিয়ে চললে?’
‘ও নিয়ে ভাববেন না।’ হাসে তুর্য। ওর হাসিটা সুন্দর। ’কিন্তু গতকাল আপনার নামটা জানা হয়নি। ’
‘আমি নীরা। নাম জেনেছ – প্রাণে শান্তি লেগেছে এবার তোমার?’ রাগ করতে যেয়েও পারে না নীরা কেন যেন। ’তোমাকে একটা ভালো বুদ্ধি দেই – ফরহাদকে গিয়ে সরি বলে আসো। ছোটখাট র‍্যাগিং সহ্য করে নাও – সব ঠিক হয়ে যাবে। নাহলে সত্যি বলছি – তোমার কপালে যথেষ্ট খারাবি আছে। ’
‘অন্যায় করলে তো সরি বলব!’ খুব মজার কিছু বলেছে নীরা এভাবে হাসে তুর্য। ’আপনাকে কিন্তু আমি আপু-টাপু ডাকতে পারব না। মাইন্ড করবেন না আশা করি – কারণ করলেও কিছু করার নেই। আসি, নীরা। দুই মিনিট দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ’
‘কি ভয়ানক! সিনিয়র আপুর সাথে এভাবে কথা বল তোমার ভয় করে না?’ রাগতে যেয়ে এবার হেসেই ফেলে নীরা। ’কোথায় যাও? তোমার ক্লাস নাই?’
‘না। ভাইয়ারা হলে ডাকল। কালকের ব্যাপারের জন্য। দেখি কি বলে! ওখানে যাচ্ছি। ’
আৎকে ওঠে নীরা। ’তুর্য, লক্ষী ভাই আমার – ওখানে গিয়ে এরকম সাহস দেখিও না! স্রেফ দুই টুকরো করে ফেলবে!’
‘ধ্যাৎ! রাখো তো। ছাই করবে আমার। ’
‘পাগলামি রাখো! ওইখানে অন্তত ভদ্রভাবে কথা বলে আসো। অনুরোধ করছি তোমাকে। ’
‘এত ভীতু কেন তুমি?’ হাসে ছেলেটা। ’তোমার ল্যাব আছে! দেরী করো না। ’
হেঁটে চলে যায় তুর্য। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে তার – আরে! ওর শিডিউল তুর্য জানে কি করে?
কিন্তু তুর্য যে’আপনি’ থেকে ওকে’তুমি’ করে বলা শুরু করেছে – সেটা খেয়ালই করে না নীরা।
*
কামরুজ্জামান হল।
৪০৮ নম্বর রুম।
ছাত্রলীগের সভাপতি শাজাহান সিরাজের সামনে দন্ডায়মান তুর্য। সিরাজ ফোর্থ ইয়ারে। ফরহাদের আপন বড় ভাই।
রুমে আরও সাতজন সিনিয়র ভাই থাকলেও চোখেমুখে ঘাবড়ে যাওয়ার কোন লক্ষণই নেই তুর্যের ভেতরে।
‘বাড়ি কই তোমার?’ সিরাজ মুখ খুলল কি মেঘ গর্জন করল ঠিক বোঝা গেল না।
‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ’
‘বাবা কি করে?’
‘প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতা। ’
‘অ, টিচারের ছেলে। তারপরও আদব-কায়দা কিছু শেখ নাই? সিনিয়র ভাইয়ের সামনে সিগারেট খাও! আপুদের সাথে টাংকি মারো!’
‘ভাইয়া – সিগারেট খাওয়ার মধ্যে বেয়াদবির কি আছে? আমরা কি বড় ভাইদের সামনে চা খাই না? ভাইয়ারা সামনে দিয়ে গেলে কি চা মাটিতে ফেলে দিয়ে সম্মান দেখাই?’ পালটা প্রশ্ন করে তুর্য।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সিরাজ। ছেলের কথায় যুক্তি আছে। সিগারেটের কি এমন দোষ যে একে ফেলে দিয়ে সম্মান দেখাতে হবে? এই ছেলের মধ্যে কিছু একটা আছে। ভয়-টয় পাবে না। পালটা কি বলে ফেলে জুনিয়রদের সামনে হাসির পাত্র করে ফেলবে।
‘বুঝলাম তোমার দৃষ্টিভঙ্গি।’ মেনে নেওয়ার ভঙ্গী করে সিরাজ। রুমের এক প্রান্তে অসন্তোষের নিঃশ্বাস ছাড়ে ফরহাদ, ’তাই বলে আপুদের সাথে টাংকি? সিগারেট নাহয় ছেড়ে দিলাম। আপুদের ফ্লার্ট করে বেড়াচ্ছ শুনলাম। সেটা খুবই প্রশংসাজনক কাজ বলতে চাও তো?’
‘নীরাকে আমার ভালো লাগে।’ আবারও লাফিয়ে উঠে ফরহাদ। হাতের ইশারায় তাকে বসিয়ে দেয় সিরাজ। বলে চলে তুর্য, ’ভালো লাগার কথা সামনাসামনি বলে ফেলাটাই সত্যিকারের পুরুষের কাজ বলে মনে হয় আমার। বন্ধুত্বের আড়াল নিয়ে তুই-তোকারি করে কথা বলে ভালো লাগার ব্যাপারটা অস্বীকার করে থাকার মাঝে কোন কৃতিত্ব দেখি না। ’
দ্বিগুন উৎসাহে লাফিয়ে ওঠে ফরহাদ। কিন্তু বড় ভাইয়ের ইশারায় আবারও বসে পড়তে হয় তাকে।
‘সিনিয়র ভাইয়ের গায়ে হাত তুলতেও বাধে নি তোমার …’
‘ওহ – ওটা সেলফ ডিফেন্স ছিল ভাইয়া। নাক মুখ সমান করে ফেলতে থাকলেই যে সমান করতে দিতে হবে তা তো নয়। রিফ্লেক্স পুরোটাই।’ আঙ্গুল দিয়ে স্টিচ দেখায় তুর্য। ’নাহয় এরকম আরও আধ-ডজন লাগাতে হত। থ্যাংক্স টু হিম। মাথা-টাথা ফেটে গেলে তো বিশাল খরচ, হাসপাতাল-’
আমসি মুখে বসে পড়ল এবার ফরহাদ। ঘরের সবাই বুঝতে পারছে ওকে ওভাবে মারতে থাকলে খারাপ একটা কিছু হয়ে যেতে পারতো। তুর্যের চোখ-মুখের ফাটা দশাই এর প্রমাণ। কাজেই কেউ তার সেলফ-ডিফেন্স তত্ত্ব একেবারে ফেলে দিতে পারলো না। এসব ব্যান্ডেজ নিয়ে প্রশাসনের কাছে চলে গেলে এই ঘরের সবার কপালে খারাবি আছে, জানে। তাই হয়তো সিনিয়র-ইগোটাকে আপাতত গিলে রাখতে হলো তাদের। তারা তাকিয়ে থাকলো নেতার দিকে।
‘শোন ছেলে – ’ মুখ খুলল সিরাজ। ’তোমার সাহসিকতা আর সোজাসাপ্টা দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি মুগ্ধ। কিন্তু একটা ব্যাপার তোমাকে মাথায় রাখা লাগবে – বেশির ভাগ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরেই ম্যানার জিনিসটাকে বিবেচনা করা হয়। পর্নোগ্রাফি জিনিসটা পর্নস্টারদের কাছে খারাপ না। তাই বলে সেটা সমাজে চালাতে চাইলেই তো হবে না, তাই না?’
মনে মনে আটটা পয়েন্ট দেখতে পায় তুর্য – তার আচরণের সাথে ভাইয়ার কথার অমিল ওগুলো। কিন্তু আর কথা বাড়ায় না। সবার সামনে স্ট্রেইটফরোয়ার্ড হয়ে ক্ষেপিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া এই ভাইয়া ওকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ফরহাদ বেকুবটার মত না।
‘মাত্র নতুন একটা ভার্সিটিতে আসছ – ভুল ত্রুটি হয়ে যায় দুই তরফ থেকেই। এগুলো ভুলে যেতে হয়। তুমি ছেলেটা খারাপ না। নাহলে এত কথা বলার কিছু ছিল না। তোমার ওয়ান-টু এর ভাইয়াদের কাছেই ছেড়ে দিতাম। কিন্তু তোমার ক্যারেকটারটা ইন্টারেস্টিং, ভাবলাম দেখা করি ছেলেটার সাথে। আশা করি যে সম্মানটা তোমাকে দিচ্ছি আমি – সেটার মর্যাদা তুমি রাখবে। আর ভাইয়ারাই দেখবা সব বিপদে সবার আগে উপস্থিত হবে। ভার্সিটিটা একটা ফ্যামিলির মত। থাকো – আস্তে আস্তে বুঝবা নিজেই।’ হাত বাড়ায় সিরাজ, ’আমি সিরাজ, মেকানিক্যাল ওয়ান -জিরো।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ হাত মেলায় তুর্য। ’অপ্রীতিকর কিছু শোনা লাগবে না আর আশা করি আপনাকে। ’
‘অ্যাই তোরা কোলাকুলি কর।’ ফরহাদকে বলে সিরাজ। ’ফ্যামিলিতেও ভাই-ভাইয়ের মিলে না সব সময়। ’
বর্জ্র্য আটুনি দিয়ে কোলাকুলি করেই ঝাল মেটাতে হয় বেচারা ফরহাদকে।
*
‘নীরা!’
লেডিস হোস্টেলের গেট দিয়ে ঢুকতে যেয়েও শব্দের উৎসের দিকে মাথা ঘোরাতে বাধ্য হয় নীরা। পাগল টাইপ জুনিয়র ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে গাছের সাথে হেলান দিয়ে। সাদা টি-শার্টের সাথে নীল জিন্সে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তুর্যকে।
‘কিছু বলবে?’ সিনিয়র-ভাবটা গলায় ফুটিয়ে তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হয় নীরা।
‘আমি এক অসহায় জুনিয়র। ’
কিছুটা ঘাবড়ায় নীরা। পাগলটা কি বলতে কি বলে কোন ঠিক নেই! সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তুর্যের দিকে।
‘ফিজিক্সের চোথা লাগবে। যদি কিছু রেখে থাকো এখনও।’ অবলীলায় ওকে তুমি করেই বলে তুর্য।
‘তোমার ভাইয়াদের কাছে নাই? আমার কাছে কেন?’
‘ভাইয়াদের কাছে গেলে তো তোমাকে দেখার বোনাসটা পাব না।’ অকপটে স্বীকারও করে তুর্য।
ওর সাহস দেখে শুধু অবাকই হয় নীরা। কিন্তু আশ্চর্য – রাগ উঠে না একটুও।
‘বিকেলের দিকে আসো তাহলে।’ কেন যেন রাজি হয়েও যায় নীরা।
‘ক্যাম্পাসের বাইরে?’ ব্যাপক আশা নিয়ে জানতে চাইল তুর্য।
‘না। এই গেইটেই।’ বেচারার আশাতে পানি ঢেলে দেয় নীরা। ’তোমার সমস্যা কি? এত এক্সট্রোভার্ট কেন?’
‘উপরওয়ালার দান।’ মোবাইল বের করে তুর্য, ‘নাম্বার তো দাও। আমি গেইটে আসার পর যদি তোমার মনে না থাকে?’
‘জ্বী না। আমার মনে থাকবে। তাছাড়া, আমি তো আসব না। দুপুরের মাঝেই মামাকে দিয়ে যাব। এসে আমার নাম বললেই দিয়ে দেবে। ’
ভেতরে ঢুকে যায় নীরা। আশা ভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় তুর্য।
*
দেখতে দেখতে একটা বছর ঠিকই পেরিয়ে যায়।
জুনিয়র–সিনিয়র প্রেম-প্রেম গন্ধ ক্যাম্পাসে রীতিমত সাড়া ফেলে দেয়। চায়ের কাপে ঝড় তুলতে তুলতে মাঝে মাঝে তুর্য–নীরার নাম নেওয়া হয় না তা নয়। যদিও নীরা তার দূরত্ব অটুটই রাখে।
এর মাঝে ফরহাদ নীরাকে প্রপোজ করে। এককথায় নাকচ করে দেয় নীরা। তুর্যের সাথে সেদিনের করা ব্যবহারের পর থেকে আসলেই ফরহাদের সামনে পড়েনি কখনও ও।
সবচেয়ে বেশি বিরক্ত থাকে নীরার বান্ধবীরা।
‘তুই এখনও ওকে পাত্তা দিস কেন আমি সেটাই বুঝি না।’ ভ্রু কুঁচকে বলে মালিহা।
মালিহার সম্পূর্ণ সাপোর্ট দেয় রিয়া। ’একদম ঠিক বলেছিস। আমি হলেও কান ধরে টেনে দুইটা থাপ্পড় লাগাতাম। পরের দিন থেকে রীতিমত আপু-আপুন্নি শুরু করত।’
‘ওর অনেক সাহস দোস্ত। এই জিনিসটা আমার ভালো লাগে। তাই কিছু বলি না। আমার মনে হয় ওর এই সাহসটা ভালো কোন কিছুর জন্যই আল্লাহ ওর ভিতরে দিয়ে পাঠিয়েছেন। নিরুৎসাহিত করতে ইচ্ছে করে না রে। ’
‘নিজেকে ফ্রাংকেনস্টাইনের স্রষ্টা ভাবা শুরু করেছিস দেখি একেবারে।’ নাক কোঁচকায় মালিহা।
লেডিস হোস্টেলের সামনের গাছটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরা। দুই সপ্তাহ ধরে তুর্য আসে না এখানে।
মাঝে মাঝেই ছোটখাট সাহায্য চাওয়ার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকত সে। নীরা বুঝত শুধু ওকে একটু দেখার জন্যই ওখানে আসত। আর কিছু নয়।
আড় চোখে একে অন্যের দিকে তাকায় মালিহা আর রিয়া।
‘মামাকে বলে দিয়েছিলাম ছেলেদের যাতে বাউন্ডারীর আশেপাশে দাঁড়াতে না দেয়।’ যেন রিয়াকে কথার কথা বলছে এভাবে জানায় মালিহা।
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে নীরা।
*
‘ওমা এইটা তো পুরাই Wall E!!’ এক মেয়ে খুশিতে হাততালি দেয়।
‘কথা বল! কথা বল!! কথা বলতে পারিস না?’ আরেক মেয়ে ’বস্তু’টাকে প্রশ্ন করে যায়।
‘অ্যাই তোর মালিক কোথায়?’
‘অ্যাই রোবট! চোখ খোল!! আমার দিকে তাকা!’
‘ইইইইইইইইইইইই!! আমি রোবট পুষব-ওওও।’ অতি আদরের কোন এক দুলালী একপাশ থেকে বলে।
লেডিস হোস্টেলের সামনে মেয়েদের একটা ভীড় লেগে গেছে। গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবটটার দিকেই সবার মনোযোগ। ছোট্ট একটা রোবট। ছোট্ট দুটো পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে পায়চারী করছে। আশেপাশের মেয়েদের টিটকারী ওর ধাতব গায়ে যেন স্পর্শই করছে না।
হঠাৎ থেমে যায় ওটা। স্পষ্ট উচ্চারণে বলে, ’ইমতিয়াজ উদ্দীন? সামনে আসুন।’
‘দারোয়ান মামাকে ডেকেছে! দারোয়ান মামাকে ডেকেছে!’ হাততালি রোগে আক্রান্ত মেয়ে হাততালি দেয় আবারও। সেই সাথে চলছে ধারাভাষ্য।
দারোয়ান সামনে আসতেই টিপটিপ করে চোখ খোলে ক্ষুদে রোবট।
‘আইডেন্টিফাইড। আমি ছেলে নই। রোবট। আমাকে খেদানোর চেষ্টা করলে ফলাফল শুভ হবে না। মাথায় রাখবেন।’
মাথায় কি রাখবে! মাথা কোথায় রেখেছে সেটা ভাবতে ভাবতেই হয়তো ওটা চুলকে একদিকে হাঁটা দিলেন দারোয়ান মামা।
‘অ্যাই নীরা।’ নীরার সামনে দাঁড়িয়ে অবিকল তুর্যের কন্ঠে বলে ওঠে রোবটটা। ’রোবট তোমাকে চেনায় ঘাবড়িও না। আমাকে আসতে দেয় না। তোমাকে দেখি না। একটা রোবট বানাতেই হল। ফেইস রিকগনাইজার আছে, ভড়কে যেয়ো না। মোবাইল নম্বর তো দিলা না। রোবট দিয়েই কাজ সাড়া লাগছে। শহীদ মিনারে বসে আছি। ইচ্ছে করলে আসো। ক্যাম্পাসে কি বলবে সেই ভয় পেলে এসো না। তোমাকে একটু দেখে চলে যেতাম। ’
ক্যাম্পাসের ভয়? তুর্যের ভেতর অসামান্য সাহস কেন দেওয়া হয়েছে এতদিনে যেন হঠাৎই বুঝে যায় নীরা। সাহস জিনিসটা সংক্রামক। একজন থেকে ছড়িয়ে যায় সবদিকে। জ্যামিতিক হারে বাড়ে তার পরিমাণ। সামনে পা বাড়ায় নীরা।
‘তুই একটা জুনিয়র ছেলের সাথে দেখা করতে যাবি!?’ মালিহা পাশ থেকে জানতে চায় একঝাঁক অসন্তোষ গলায় নিয়ে।
রহস্যময় একটা হাসি হেসে এগিয়ে যায় নীরা – যার অর্থ ’হ্যাঁ’ কিংবা ’না’ দুটোই হতে পারে …

রচনাকাল – ডিসেম্বর ৯, ২০১৩

চুইংগাম

‘হ্যালো?’ নিঃশ্বাসের ফাঁকে বলে ওঠে আনিকা।
‘হুঁ, বল।’ ঘুমজড়িত কন্ঠে জবাব দেয় রিদিত।
‘ও দেখা করতে চেয়েছে।’
‘আ-আ-আম-’
‘অ্যাই বেয়াদব! কি বলিস?’ ঝাড়ি দেয় আনিকা।
‘উম… যা দেখা কর। সাথে সার্টিফিকেট নিয়ে যা।’
‘কিসের সার্টিফিকেট?’
‘এইচএসসির। আর বার্থ সার্টিফিকেট। হা-আআ-আম।’ হাই তুলেই যায় বেচারা।
‘কেন?’
‘কনের বয়সের প্রমাণ। যদি পছন্দ হয় বিয়ে করে ফেলিস।’
‘ফাইজলামি করবি না বেয়াদব। উঠে বস। তারপর কথা বল! আসলেই যেতে বলছিস?’
জবাব দেয় না রিদিত। মোবাইলের এ প্রান্তে কড়মড় শব্দ শোনে শুধু আনিকা। আরেকটা রামঝাড়ি দেয় ও বেয়াদবটাকে।
‘অ্যাই কি করিস?’
‘বাদাম খাই।’
‘ঘরের মধ্যে বাদাম পেলি কই?’
‘বাদামের গাছ লাগিয়েছি। যখন মন চায় পেড়ে পেড়ে খাই।’
‘ওই!’ ভাষা হারালো আনিকা এক মুহূর্তের জন্য, ‘তোর বলা লাগবে না দেখা করব কি করব না। আগে বল বাদাম কোথায় পেয়েছিস?’
‘আরে – ছোটভাই এনেছিল। বাদাম খেতে খেতেই ঘুম চলে এসেছিল।’
‘বাদাম খেয়ে খেয়ে ভোটকা হ আরও! আমি টেনশনে মরি আর উনি বাদাম খাচ্ছে!’ সংযোগ কেটে মোবাইলটাকে একদিকে ছুঁড়ে ফেলল আনিকা।
রিদিতটা এরকমই।
ওদের বন্ধুত্ব সেই ছোট্টবেলা থেকে। ক্লাস টুতে পড়ত তখন ওরা। আনিকা যে সীটে বসত সে সীটে প্রতিদিন চুইংগাম লাগিয়ে রাখত রিদিত। বসে পড়ার পর বেচারি বুঝতে পারত কিছু একটা ঠিক নেই। উঠতে গেলেই চুইংগাম লম্বা হয়ে লেজ হয়ে যেত। আর সারা ক্লাস হেসে খেত গড়াগড়ি।
একদিন আর সহ্য হয়নি আনিকার। রিদিতের সামনে একটা স্টীলের স্কেল উচিয়ে হুংকার দেয়, ‘অ্যাই বেয়াদব, আমার সীটে চুইং গাম লাগাস কেন?’
‘ওটা গিলতে হয় না। আম্মু না করেছে।’ মিন মিন করে কৈফিয়ত দেয় শিশু রিদিত।
‘প্রতিদিন আমার সীটে লাগাস কেন, হতচ্ছাড়া!’
‘লাগালে কি করবি?’
‘পিট্টি দিব। হাত পাত।’
‘পিট্টি দিলেও লাগাব।’
‘কান ছিড়ে ফেলব। হাত পাত।’
‘মারবি? মার। তাও লাগাব। একশ বার লাগাব।’ রিদিতও জোরের সাথেই বলে।
পিট্টি খেয়েও রিদিত যখন চুইং গাম লাগানোর কাজ অব্যাহত রাখল তখন বাধ্য হয়েই আনিকা ভিন্ন পথ ধরে।
‘অ্যাই, তুই আমার বন্ধু হবি?’ একদিন রিদিতকে বলে ও।
‘হুঁ।’ ঘাড় শক্ত করে বলে রিদিত।
‘তাহলে কিন্তু আর সীটে চুইং গাম লাগাতে পারবি না।’
‘হুঁ।’ গলার জোর কম থাকে এবারের ‘হুঁ’তে।
ছোটবেলার ছেলেমানুষীর কথা ভেবে একটু হাসে আনিকা। তারপর স্কুল, কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিও যাওয়ার পথে। বন্ধুত্ব আছে সেই ছোটবেলার মতই অটুট। কিন্তু এই মুহূর্তে রিদিতটার পরামর্শ দরকার ছিল।
আজ আনিকার সাথে আকাশ দেখা করতে চেয়েছে। আকাশ হল আনিকার সিক্রেট ক্রাশ। আকাশের সাথে আনিকার পরিচয় ফেসবুকের মাধ্যমে। গত দুই বছর ওরা চ্যাট করে গেছে। ফোনেও কথা হয় কয়েকমাস ধরে। কিন্তু দেখা হয়নি। ছেলেটাকে আনিকার ভালোলাগা শুরু হয় ওর লেখা পড়ে পড়ে। কি অদ্ভুত সুন্দর করে ও মানুষের জীবনের অনুভূতিগুলোকে তুলে ধরতে পারে!
আকাশের একেকটা নোট আপলোড করার সাথে সাথেই পড়ে ফেলে আনিকা। তবে লাইক দেয়ার বেলায় আকাশের সামনে ও হাড়কেপ্পন। ছেলেটা বুঝে গেলেই তো শেষ। ছেলে জাতিটাকে চেনা আছে। বুঝিয়ে দাও তুমি দুর্বল – তোমার প্রতি আগ্রহ হাওয়া হয়ে যাবে সাথে সাথে। ভাব ধরে থাকতে হয়।
তবে চ্যাট যত বেশি হয় দূরত্ব ততই কমে আসে। আকাশের সাথে দেখা করার ইচ্ছা আনিকার অনেকদিনের। কিন্তু ওই যে, সময় হওয়ার আগে মুখে বলা যাবে না! ছেলে জাতি! কাল রাতে যখন কথা বলার এক পর্যায়ে আকাশ নিজে থেকেই দেখা করতে চাইল তখন আনিকা ‘ইনঅডিবল’ কয়েকটা চিৎকার ছাড়লেও দায়সারা ভাবে ওকে জানায় পরের দিন জানাবে।
কিন্তু জানানো আর হল কোথায়?
পরের দিন পর্যন্ত সময় চেয়েছিল-ই তো রিদিতের সিদ্ধান্ত জানতে।
ওদিকে কি না বেয়াদবটা বাদাম চিবাচ্ছে!
রিদিত সবই জানে। আকাশের নোট পড়ে যখন ‘পানি-খাব! পানি-খাব!’ ভাবভঙ্গী নিয়ে রিদিতকে কতবার ফোন দিয়েছে আনিকা! তখন ওকে অসংখ্যবার ছেলেটা পরামর্শ দিয়েছে আকাশকে প্রপোজ করার!
‘আর কোন ডাইনি কেড়ে নেয়ার আগেই তুই ঝাঁপিয়ে পড়। আফটার অল, অন্য কোন ডাইনির হাতে পড়ে গেলে ডাইনি-প্রধানের জন্য ওটা একটা ডিসক্রেডিট হয়ে যাবে রে…’ বলত রিদিত, তারপর খেত কিল!
কিন্তু আনিকা পারেনি। সব হারানোর ভয়ে আগলে রেখেছিল কিছু পাওয়ার স্বপ্ন।
একটা রজনীগন্ধার স্টিক হাতে নিয়ে পার্কে ঢোকে আনিকা। দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। বেয়াদব রিদিতটা ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক! বেশি করে ঘুমাক। ওর কাছে আলোচনা করার সময়টুকু পর্যন্ত দিল না।
ছেলেটার নাকি রজনীগন্ধা ভালো লাগে। সব কিছু নিয়েই অদ্ভুত রকম সব চিন্তাভাবনা আকাশের মধ্যে। এটাই অবশ্য আনিকার ভালো লাগে। যেখানে দেখা করার কথা ছিল সেখানে কাওকে দেখে না আনিকা। একটা ফোন কি দেবে ও আকাশকে?
না, দেবে না। ছেলে জাতি! আগ্রহ দেখানো যাবে না নির্ধারিত মুহূর্তের আগে।
কয়েক মিনিট অপেক্ষা করেও যখন আকাশের ফোনকলের কোন পাত্তা নেই – একটা বেঞ্চে বসে পড়ে আনিকা।
বসে পড়ার পর আনিকা বুঝতে পারল কিছু একটা ঠিক নেই।
লাফ দিয়ে উঠে চুইং গামের লেজের দিকে তাকায় আনিকা, তারপর ঘুরেই দেখতে পায় রিদিতকে। সব বুঝে ফেলল ও তখন।
সব!
‘তুই এত্তগুলা বেয়াদব! তোর ফেসবুক আইডি-ই নীল আকাশ! হারামী আমাকে আগে কেন বলিস নাই?’ রাগে নীল হয়ে বলে আনিকা।
‘তার আগেই যে তোর প্রেমে পড়ে গেলাম।’ বিষন্ন গলায় বলে রিদিত, প্রথমবারের মত ওকে সিরিয়াস হতে দেখে আনিকা।
‘চুপ করে থাক!’ রজনীগন্ধার স্টিক নাচায় ও ডানহাতে, ‘আমার সীটে চুইং গাম দিস – হাত পাত!’
‘মারবি? মার। তাও বলব। একশ বার বলব!’ ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি রিদিতের।
রজনীগন্ধা পড়ে থাকে একপাশে, রিদিতকে জড়িয়ে ধরে আনিকা, ‘অ্যাই, তুই আমাকে বিয়ে করবি?’
‘হুঁ।’ ঘাড় শক্ত করে বলে রিদিত।
‘তাহলে কিন্তু আর সীটে চুইং গাম লাগাতে পারবি না।’
‘হুঁ।’ গলার জোর কম থাকে এবারের ‘হুঁ’তে।
রিদিতের কাঁধে আলতো করে থুতনী ঠেকায় আনিকা। ছেলে জাতিটাকে যেমন ভাবত তেমনটা না বলেই তো মনে হচ্ছে…

রচনাকাল – ৭ই ডিসেম্বর, ২০১৩

গুডবাই

স্নিগ্ধার হাত ধরে কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকল রিয়াদ।
আজ রিয়াদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর বড়ভাইয়ের বিয়ে। চারপাশ নানারকম আলোয় ঝলমলে। দূর থেকেই ওদের দেখে ফেলল বন্ধু রাশেদ। এগিয়ে এসে উষ্ণ সম্ভাষণ জানাল সে।
‘কিরে! ভাইয়া তো ঝুলে গেল।’ স্বভাবসুলভ হাসিখুশি মুখ নিয়ে বলল রাশেদ। ‘তোরা ঝুলবি কবে?’
লজ্জিত হাসি দেয় স্নিগ্ধা।
‘সামনের বছর, যদি আল্লাহ সব কিছু ঠিক রাখে, দোস্ত।’ একটু হেসে বলে রিয়াদ। ‘চল, ভাইয়ার সাথে একটু টোকাটুকি করে আসি।’
হঠাৎ-ই হাসিটা ম্লান হয়ে যায় রিয়াদের মুখ থেকে।
ওটা তৃণা না? আরেকটা ছেলের হাত জড়িয়ে থাকতে দেখে ঈষৎ ঈর্ষার খোঁচা অনুভব করে ও বুকের ভেতর। তার থেকেও বেশি জ্বলে ওর ছেলেটার চেহারা দেখে। এই ব্যাটা দেখি একেবারে টম ক্রুজের বাংলাদেশি ভার্সন! রাশেদদের দিকেই এগিয়ে আসছে ওরা।
‘হেই রাশেদ!’ কাছাকাছি এসে ডাক দেয় ছেলেটা। ‘তরুণ ভাই আটকে গেছে। ভার্সিটিতে গ্যাঞ্জাম লেগে গেছে ওদের।’
‘ড্যাম!’ ঘুরে দাঁড়ায় রাশেদ। ‘যে করেই হোক বেরিয়ে চলে আসতে বল। দাঁড়াও আমিই ফোন দিচ্ছি।’
‘উঁহু – ভার্সিটিতে ভয়ানক আন্দোলন চলছে। ভিসি অপসারণের দাবী উঠে গেছে নাকি। আর এসব ক্ষেত্রে কাহিনী বুঝো না? ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছে পরিবেশ। ছাত্র কল্যান উপদেষ্টা হিসেবে উনি পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন। উনার ঘন্টা দুই দেরী হতে পারে। সিচুয়েশনটা একটু কুল ডাউন হলেই -’
‘কি আর করা।’ মন খারাপ করে বলে রাশেদ। তরুণ ভাই কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় – জানে রিয়াদ।
হঠাৎ মনে পরে যাওয়ায় বিব্রত হয় রাশেদ। ‘এই যাহ – পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় নি তোদের।’ রিয়াদদের বলে ও, ‘কাজিন রেজা এবং হবু ভাবী তৃণা। রেজাকে চিনছ তো? আরঅ্যান্ডটি গ্রুপ অফ ইন্ড্রাষ্ট্রিজটা ওরই।’
‘হবু ভাবী?’ কখন যে জোরে উচ্চারণ করে ফেলে রিয়াদ – নিজেই খেয়াল করে না।
‘বাগদত্তা।’ ছাগলের-মত-প্রশ্ন-করিস-কেন টাইপ লুক দেয় রাশেদ।
একটানে পাঁচ বছর অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় রিয়াদকে কিছু স্মৃতি।
*
তৃণাকে প্রথম দেখেছিল ইউনিভার্সিটির ফ্রেশারস ওয়েলকাম পার্টিতে। অসাধারণ সৌন্দর্য আর মার্জিত একটা উপস্থাপনা – এই দুটো চুম্বকেরর মতো আকর্ষণ করেছিল ওকে। ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী তৃণা। রিয়াদ কম্পিউটার সায়েন্সে।
দূরত্বটা কমিয়ে ফেলার পেছনে ভার্সিটির সবাই কৃতিত্ব দিবে রিয়াদকে। রিয়াদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার কাহিনী ভার্সিটির সব ব্যাচের স্টুডেন্টের কাছেই স্বীকৃত ছিল। অবশেষে দেবীর দয়া হল। আগস্টের আঠার তারিখ তৃণা সম্মতি জানায় ‘পূজো গ্রহণের’।
রিয়াদের জন্য পরের সাড়ে তিনটি বছর ছিল স্বর্গবাসের অভিজ্ঞতা। একসাথে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া, ছুটির দিনগুলোতে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরে বেড়ানো, সন্ধ্যারাতে ছাদে উঠে গালে গাল ঠেকিয়ে চাঁদ দেখা আর মাসে একবার করে নৌকা ভ্রমণ। মাসে দুই একবার ট্যুরের সাথে রাত্রিযাপন। পরীক্ষার আগে একজন আরেকজনকে গাইড দেওয়া – কমন কোর্সগুলোর ক্ষেত্রে গ্রুপ স্টাডি – মানে কি একাডেমিক, কি পার্সোনাল – রিয়াদের জীবন তৃণাময় ছিল।
কিছুটা সমস্যা যে ছিল না তাও নয় – প্রথম একটা বছর আবেগে অন্ধ হয়ে ছিল, এরপর ভবিষ্যৎ ভেবে মাঝে মাঝেই চিন্তিত না হয়ে পারত না রিয়াদ।
রিয়াদের বাবা একজন শিল্পপতি। সমাজের উচ্চস্তরের লোকজনের সাথে তাঁর উঠাবসা। অপরদিকে তৃণার বাবা সামান্য একজন স্কুলশিক্ষক। ন্যায়-নীতি, মান-মর্যাদার কথা বিবেচনা করে সমাজ তাঁকে অনেক ওপরে স্থান দিতে পারে – কিন্তু নিজের বাবাকে চেনে রিয়াদ। তাঁর পুত্রবধূর পরিচয় দিতে তিনি ‘স্কুলশিক্ষকের’ মেয়ের প্রসঙ্গ কোনদিনই মেনে নেবেন না। স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে চলেন তিনি। সমাজের মানদন্ড তাঁর কাছে অর্থ এবং শিক্ষা উভয়ই। পাল্লার দিকে অর্থই হয়ত একটু বেশি ভারী। আত্মীয়তা করার আগে অবশ্যই তিনি ক্লাস এবং স্ট্যাটাসের দিকে নজর দেবেন। তৃণার বাবা যেই মানদন্ডে কোনভাবেই রিয়াদের বাবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে না।
তারপরেও দিন তো চলে যাচ্ছিল! যতদিনে না থার্ড ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টারে উঠে ইন্টার-ইউনিভার্সিটি কম্পিটিশনে অংশ নেয় রিয়াদের গ্রুপ। কম্পিটিশনে রিয়াদদের প্রজেক্টই ফার্স্ট হয় – তবে রিয়াদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় কম্পিটিশনটা। রানার্স আপ গ্রুপের লিডারের দিকে চোখ আটকে যায় রিয়াদের। মেয়েটার কথা বলার মধ্যে আধুনিকতার একটা ছাপ ছিল যেটা তৃণার মাঝে কখনও পায়নি ও। পরিচিত হতে দেরী করে না রিয়াদ। মেয়েটার নাম স্নিগ্ধা ; দেশের প্রথম সারির প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী।
ওখান থেকেই শুরু হয় ওদের বন্ধুত্ব। তৃণার জন্য সময় কমে আসতে থাকে রিয়াদের। স্নিগ্ধাকে তৃণার ব্যাপারে কখনো কিছু জানায় নি রিয়াদ। তাছাড়া স্নিগ্ধার বাবার অবস্থান রিয়াদের বাবার থেকেও একধাপ ওপরে কি না!
একদিন ফোনে তিক্ততার চরমে পৌঁছে যায় রিয়াদ-তৃণার সম্পর্ক। তখন রিয়াদ-স্নিগ্ধা হাতিরঝিলে। স্নিগ্ধা থেকে একটু সরে এসে রিসিভ করে রিয়াদ।
‘হ্যালো! রিয়াদ তুমি পাইছোটা কি বল তো?’ আহত বাঘিনীর মত হুংকার দেয় তৃণা।
‘কি হয়েছে? চিল্লাচ্ছ কেন?’
‘তোমার আজ বিকালে আমার সাথে দেখা করার কথা ছিল না?’
‘ও হ্যাঁ, হঠাৎ নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ পড়ে গেল তাই আসতে পারিনি।’
‘আমাকে দুধের শিশু পাইছ? তুমি ক্যাম্পাস থেকে ওই ডাইনিটার সাথে বের হয়েছ – কি ভেবেছ কিছুই খোঁজ খবর রাখি না আমি??’
‘মুখ সামলে কথা বল।’ ওর বলার ভঙ্গিটা শুনে মেজাজ চড়ে গেল রিয়াদের।
‘আমার সাথে তুমি এভাবে কথা বলছ একটা প্রস্টিটিউটের জন্য? ওর জামাকাপড়ের অবস্থা দেখছ?’
‘শাট আপ!’ চোখ জ্বলে ওঠে রিয়াদের, চিবিয়ে চিবিয়ে তৃণাকে বলে ও, ‘শা-ট আ-প! একটা ভদ্রঘরের মেয়ের ব্যাপারে এভাবে কথা বলা তোমার মত মেয়ের মুখে সাজে না। ইটস ওভার, তৃণা। আর কোনদিন আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করবে না। ইউর রিয়াদ ইজ ডেড!’ কচ করে লাইনটা কেটে দিয়ে স্নিগ্ধার কাছে ফিরে আসে ও।
‘সরি – নতুন প্রজেক্টের ব্যাপারে ফোন দিয়েছিল ফ্রেন্ড।’ বিনীত একটা হাসি দিয়ে বলে রিয়াদ।
নিজের ইগো ছুঁড়ে ফেলে তৃণা বার বার ক্ষমা চায় রিয়াদের কাছে। স্নিগ্ধার ব্যাপারে করা মন্তব্যের জন্য স্নিগ্ধার কাছে ক্ষমা চাইতেও তার আপত্তি নেই, কাজটা যে ভুল করেছে তা ততক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে। তবে রিয়াদকে শতবার জানালেও কান দেয় না ও। ততদিনে রিয়াদ – স্নিগ্ধার সম্পর্ক আরও এগিয়েছে।
অসহায় মেয়েটা সবই বুঝতে পারে। তিলে তিলে রিয়াদকে হারানোর ধাক্কা সে নিতে পারেনি। এক রাতে এক পাতা স্লিপ পীল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তথৈবচ। ওর দেহ অতিরিক্ত বিষক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে, পেছনে অবশ্য আছে বর্তমান সময়ের ফার্মাসিউটিক্যাল পলেসি। তবুও মেডিকেলে রাখা হয় তৃণাকে দু’দিন, পর্যবেক্ষণের জন্য। রিয়াদ কিছুই জানতে পারে না। যে রাতে আত্মহত্যার পথই তৃণার কাছে স্বর্গীয় লেগেছিল সে রাতেই রিয়াদ প্রপোজ করছিল স্নিগ্ধাকে। রিলেশনের এক বছরের মধ্যেই বাবাকে তাদের সম্পর্কের কথা জানাতে দ্বিধা করতে হয়নি রিয়াদকে – যে স্থান তৃণা সাড়ে তিনটি বছরেও পায়নি।
দিন – মাস – করে বছরও পেরিয়ে যায় দুইটি। তৃণার স্মৃতি স্নিগ্ধার আড়ালে হারিয়ে যায় পুরোপুরি।
*
আজ আবার তৃণাকে সামনে দেখে সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে গেল রিয়াদের। এই কয় বছরে মেয়েটা আরও সুন্দর হয়েছে। স্নিগ্ধাও যথেষ্ট সুন্দরী – কিন্তু আধুনিক পোশাক ছাড়া স্নিগ্ধার সৌন্দর্য্য ম্লান হয়ে যায় – লক্ষ্য করেছে রিয়াদ।
অথচ তৃণার দিক থেকে বেচারার চোখ সরাতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। বাঙ্গালী মেয়ের মত শাড়ি পরে আজ এখানে এসেছে তৃণা – তাতে যেন ওর রূপ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আর ঘুরছে কার সাথে দেখো! আরঅ্যান্ডটির মালিকের সাথে – সবচেয়ে অল্পবয়সী ধনীদের একজন যে বাংলাদেশে। যে তৃণাকে স্ট্যাটাসের দোহাই দিয়ে একদিন দূরে ঠেলে দিয়েছিল সে এখন তার থেকে দেখতে এবং বিত্তে কয়েকগুণ ওপরের স্তরের ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে – দৃশ্যটা অসহ্যকর লাগল ওর। একটা টেবিল জুড়ে বসে রাশেদ, তৃণা , রিয়াদ আর স্নিগ্ধা। রেজা তখন পরিচিত এক বন্ধুর সাথে কথা বলতে উঠে গেছে।
কথা যা বলার ওরা তিনজনই বলছে। রিয়াদ হয়ে গেছে পাথরের মূর্তি।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
‘আমি-ই ওকে ডাম্প করেছিলাম। দ্যাট ওয়াজ মি!’ নিজেই নিজেকে বোঝায় ও। কিন্তু কাজ হল না। বুকের যন্ত্রণাটা কমার বদলে বাড়লো।
‘স্নিগ্ধা ভাবীকে তো আপুর সাথে পরিচয় করানোই হল না!’ হঠাৎ মনে পড়ে রাশেদের। ‘তোরা কথা বল। আমরা আপুর সাথে কথা বলে আসি।’
তৃণা আর রিয়াদ একা এখন। দীর্ঘ দুই বছর পরে।
‘কেমন আছ তুমি?’ প্রশ্ন করে রিয়াদ।
‘ভালো।’ এতটুকুতে যেন প্রকাশ করতে পারে না তৃণা, ‘জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় পার করছি। রেজার মত লাভিং একটা হাজব্যান্ড থেকে বড় চাওয়া একটা মেয়ের আর কি হতে পারে। ওকে দেখে গোমড়া মুখো মনে হচ্ছে না? আসলে কিন্তু তা না। ভীষণ মজার মানুষ।’ মুক্তোর মত দাঁত বের করে হাসে তৃণা। সুখী মানুষের হাসি। হঠাৎ লজ্জা পায়, ‘দেখেছ – নিজের কথাই বলে যাচ্ছি! তোমার কি খবর। শুনলাম তোমাদের নাকি সামনের বছর বিয়ে? তোমাদের দেখলেই এত হ্যাপী মনে হয় – জানো? ’
ঠিক আধঘন্টা পর স্নিগ্ধাকে নিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে রিয়াদ। রাশেদের সাথে যথেষ্ট খারাপ ব্যাবহারও করে। যথেষ্ট হয়েছে ওর জন্য। পাশের সীটে বসে থাকা স্নিগ্ধাকে রীতিমত বিরক্ত লাগছে এখন ওর।
তার ওপর কালকে আঠারোই আগস্ট। এত থাকতে আজই এমন এক সন্ধ্যা গেল!
আজকের চাঁদটা সুন্দর। আকাশেও মেঘ নেই।
গাড়ির জানালা দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে রিয়াদ – ‘হ্যাপী অ্যানিভার্সারি, তৃণা।’
*
বিয়েবাড়ির ভেতরে একা বসে থাকে তৃণা। বিষন্ন মুখ। রেজা এসে মুখোমুখি বসে। বুলেটের মত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় –
‘তাহলে এই ছেলের সাথেই প্রেম করতি তুই ইউনিভার্সিটি লাইফে?’
‘হুঁ।’
‘এই শালা তো টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। তোর কপাল ভালো। আপদ বিদায় হয়েছে, ভালো হয়েছে – এটাই বলব আমি।’
রাশেদ এসে যোগ দেয়।
‘অসাধারণ অভিনয়, ইমরান ভাই!!’ পিঠ চাপড়ে দেয় রেজা ওরফে ইমরানের।
প্রাণ খুলে হাসে ইমরান, ‘আরঅ্যান্ডটি এর মালিক, মানে- আসল রেজার সাথে গবেটটার দেখা না হলেই হয়।’
হাসিতে যোগ দেয় তৃণা আর রাশেদও। রাশেদের সাথে হাত মেলায় তৃণা। এখানে ওর কাজ শেষ।
‘থ্যাংকস এ লট রাশেদ ভাই। থ্যাংকস এ লট।’
তৃণাকে আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে রিয়াদ যখন স্নিগ্ধার হাত ধরে দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে গেছে – তৃণা ছয়টি মাস আচ্ছন্নের মত পার করেছিল। সারাটা দিন ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দী করে রাখা, ফ্যান, ফিতে, কিংবা মেডিসিন কেবিনেট দেখলেই জীবনটা শেষ করে দেয়ার এক তীব্র তাড়না অনুভব করা! অবশেষে প্রথম ধাপটা পেরুলো, আত্মহননের ইচ্ছেটাও ধীরে ধীরে কমে এলো। তার বদলে জায়গা করে নিলো প্রতিশোধের সুতীব্র বাসনা। পার্থিব মর্যাদার দোহাই দিয়ে ওকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে যেই ছেলে – তাকে সে দেখিয়ে দেবে তার থেকেও বেশি মর্যাদার কাওকে পেতে পারে ও।
রিয়াদের ইউনিভার্সিটি লাইফের বন্ধু রাশেদ কোনদিনই রিয়াদের আচরণকে ন্যায় বলে মানতে পারেনি। কাজেই এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা দেয় রাশেদ। খালাত ভাই ইমরানকে রেজার ভূমিকায় অভিনয় করার কথা বলতেই সানন্দে রাজি হয়ে যান ইমরান। বোনকে এবং পরিবারকে অসম্মান করে পার পেয়ে যাওয়া ছেলেটার বিরুদ্ধে কাজ করে পাওয়া আনন্দটাকে উপরি হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি।
চাঁদের দিকে তাকায় তৃণা।
আজকের চাঁদটা সুন্দর। আকাশেও মেঘ নেই।
বিড় বিড় করে বলে ও, ‘গুডবাই, রিয়াদ।’

রচনাকাল – ৩০শে নভেম্বর, ২০১৩

সিক্ততা

আন্টির বাসা থেকে বের হয়ে ছাতা ফুটিয়ে মাথায় দিতেই ফারিহা দেখল – ছেলেটা ভিজছে।

বর্ষাকাল।
যখন তখন ঝুম বৃষ্টি নেমে যায়। গবেট-শ্রেণির লোক দেখেও শেখে না – ঠেকেও শেখে না। ছাতা ছাড়াই বের হয়। এবং ভেজে। এই ছেলেটাকে তার গবেট শ্রেণির মনে হচ্ছে না।
রাস্তার পাশে ফারিহা একটু দাঁড়াল। ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টির দিনে রিকশা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রিকশাওয়ালারাও এই সুযোগে ভাড়া চারগুণের নিচে হাঁকে না।
ফুটপাতের কিনারায় কাকভেজা ছেলেটার দিকে চোখ পড়তে বাধ্য। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে স্বচ্ছল ঘরের সন্তান। হাতে একটি ফাইল। ইউনিভার্সিটির ছাত্র হবে হয়ত। চেহারা আকর্ষনীয়।
হঠাৎ বৃষ্টিতে বিভ্রান্ত মানুষগুলোর মত এ আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে না। মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ফারিহার ইচ্ছে করল ওকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়! রাস্তায় একটা রিকশা নেই – আর এদিকে ন্যাকামো হচ্ছে!
এমনিতেই আজ ওর মনটা বিক্ষিপ্ত। আন্টির সাথে দেখা করার পর মেজাজ আরও চড়ে আছে।
খালুর মামাতো ভাইয়ের ছেলে আমেরিকা থেকে বহুদিন পর বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। ঢাকায় এত লাখো বাড়ি থাকতে আপদটা কিনা এসে জুটেছে আন্টির বাসাতেই। আর আন্টির যেমন কান্ডজ্ঞান – মাথায় উনার ঘটকালি ঢুকেছে। ফারিহার গুণের সাতকাহন তিনি সেই ছেলের সামনে গেয়ে গেলেন। অপমানে পুরোটা সময় ফারিহার কান ঝাঁ ঝাঁ করেছে। তাকে খালা কী মনে করে? নিলামে তুলে বিক্রি করে দেবার মতো একটা দেহ কেবল? এই নাটক থেকে বেরিয়ে পথে নামতে না নামতেই দেখতে হচ্ছে এই ছেলের ন্যাকামি। রাগে ও দাঁতে দাঁত পিষল।
‘আপা, কই যাবেন?’ সম্বিত ফিরে পেল ও রিকশাওয়ালার ডাকে।
রিকশাওয়ালার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। মেয়ে প্যাসেঞ্জার সাধারণতঃ বৃষ্টির দিন ভাড়া নিয়ে গ্যাঞ্জাম করে না। আড়চোখে ফারিহা দেখতে পেল – ছেলেটা হাঁটতে শুরু করেছে।
রিকশাওয়ালাকে কোন জবাব না দিয়ে ফুটপাথ ধরল ও। ন্যাকাটার রহস্য ভেদ করতে হবে।
তবে এ সিদ্ধান্ত জটিলতা বাড়াল বই কমালো না।
ওভারব্রীজের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় সিঁড়িতে বসে থাকা বৃদ্ধা মহিলাটির হাতে নিজের মানিব্যাগটা ধরিয়ে দেয় ছেলেটা। কেবল একটা দশ বা বিশ টাকার নোট নয়। এমনকী পাঁচশ টাকার নোট পর্যন্ত না। পুরো মানিব্যাগটাই!
তারপর বিকারগ্রস্থের মত হেঁটে চলে সামনে।
হাতে ধরা ফাইলটি ছুঁড়ে ফেলে দিল রাস্তার পাশের ড্রেইনে।
আবারও রাগে দাঁত কিড়মিড় করে ফারিহা। ঢাকার সুয়্যারেজ লাইনের এমনিতেই যে অবস্থা! এর মাঝে আবার ফাইল ফেলা হচ্ছে। টাকা আছে – মানিব্যাগ দান করে দিচ্ছ বলে শহর তোমার বাবার?
আর সহ্য হল না ওর। লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে ছেলেটাকে ধরে ফেলে ফারিহা।
‘এক্সকিউজ মি?’
অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ছেলেটা, ‘আমাকে বলছেন?’
‘না! আমি বৃষ্টিকণার সাথে কথা বলছি!’ ঝাঁঝের সাথে বলে ফারিহা, ‘ড্রেইনের মধ্যে ফাইলটি ছুঁড়ে ফেললেন – মানে?’
ছেলেটার চোখ জ্বলে ওঠে, ‘যতদূর মনে পড়ে – আপনার কিছু ছুঁড়ে ফেলিনি।’
‘শহরটা আপনার বাবার সম্পত্তি? ড্রেইনে আজেবাজে জিনিস ছুঁড়ে ফেলবেন – আবার যুক্তি দেখাচ্ছেন?’
‘আমার ইচ্ছা। তোমার ভালো না লাগলে তুমি মুড়ি খাও।’ আবার সামনে হাঁটে ছেলেটা।
ফারিহা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এরকম ভাষায় প্রথম সাক্ষাতেই কোন ছেলে তাকে এভাবে বলবে এ তার কল্পনাতেও ছিল না।
*
প্রায় এক মাস পরের কথা।
লাইনে দাঁড়িয়ে ফারিহা। ফার্মগেট যেতে নিউ ভিশন ধরবে। পার্টটাইম জবের ব্যাপার আছে। লোকাল একটা ম্যাগাজিনে প্রুফ রিডিংয়ের কাজ। ভার্সিটির সিনিয়র ভাই তূর্য চেয়েছিল কাজটা ওকে দিতে। তূর্য ভাইয়ের সাথে দেখা করতেই যাচ্ছে এখন।
পর পর দুটো বাস চলে যাওয়ার পর লাইনের একেবারে সামনে চলে এলো ও। পরের বাসে উঠে প্রথম যে সীটটি ফাঁকা পায় বসে পড়ে। বাস আসাদগেট পৌঁছতেই ওর মনে হয় পাশের সারিতে বসা ছেলেটা ওকে দেখছে।
ফারিহার চেহারা যথেষ্ট সুন্দর – এবং সে বিষয়ে ও নিজেও ওয়াকিবহাল, তবে না তাকিয়েও ছেলেটির দৃষ্টিতে কৌতুহল অনুভব করে ও। মুগ্ধতা নয়! কাজেই আড়চোখে তাকাতেই হল। এক ঝলক দেখেই ও চিনতে পারে – বৃষ্টিতে ভেজা রহস্যময় ছেলেটিকে।
কোনরকম আগাম সঙ্কেত না দিয়ে মেজাজটা আবার টং হয়ে যায় ওর আবারও।
‘সেদিন বাজে কথা বলার সময় খেয়াল ছিল না! এখন তাকাচ্ছে।’ মনে মনে ভাবে ফারিহা।
দ্বিতীয় সাক্ষাতের কোন ইচ্ছেই ওর মধ্যে নেই। বাস থেকে লাফিয়ে নেমে সামনে হাঁটে ও।
এবং যা ভাবছিল – পেছন থেকে শুনতে পায়, ‘এক্সকিউজ মি-’
ঘুরে যতটা সম্ভব সেদিনের উচ্চারণ নকল করে ফারিহা, ‘আমাকে বলছেন?’
‘দেখুন, গতবারের ব্যবহারের জন্য আমি খুবই লজ্জিত। বিশেষ একটা কারণে সেদিন আমার মন এবং মেজাজ – কোনটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল না।’
ছেলে লাইনে এসেছে এবং নিজে থেকে ক্ষমা চাইছে, তার ওপর মায়াকাড়া একটা চেহারা – ঝগড়াঝাটির এখানেই ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ফারিহা।
‘সত্যি বলতে কি – সেদিন আমারও মন ভালো ছিল না। স্বীকার করতেই হচ্ছে – বাড়াবাড়ি আমিও কিছুটা করে ফেলেছি, মানে পায়ে পা বাঁধিয়ে ঝগড়া যাবে বলে …’
হেসে ফেলল ছেলেটা, বাড়িয়ে দিল হাত, ‘আমি তন্ময়।’
‘ফারিহা।’ হাত মেলায় ফারিহা।
*
এক মাস কেটে গেছে আরও।
তন্ময় আর ফারিহার নাম না জানা দশা পালটে গেছে গভীর বন্ধুত্বে।
ফার্মগেটেই নম্বর আদান-প্রদান করেছিল ওরা এবং সবিস্ময়ে ফারিহা লক্ষ্য করেছিল তার নিজের উৎসাহই বেশি ছিল। তন্ময়ের সেদিনের ব্যাবহারের তাৎপর্য জানার জন্যই হয়তো, তবে সে নিশ্চিতও হতে পারেনি।
ধীরে ধীরে তন্ময়কে আরও ভালো করে চিনেছে ফারিহা – যে তন্ময়ের সাথে প্রথমদিনের সেই তন্ময়ের কোন মিলই নেই।
‘১৫ই মার্চ – আমি ভুলিনি।’ মনে মনে ভাবে ফারিহা। ‘কয়দিন লুকাবা তুমি। ঠিকই জেনে নিব, হুঁ হুঁ।’
তার কাছে সরাসরি সেই বৃষ্টির দিনের ব্যাপারটা সে জানতে চায় নি – এমনটা নয়। কিন্তু প্রতিবারই এড়িয়ে গেছে তন্ময়।
এই যেমন আজ – জিয়া উদ্যানে হেঁটে বেড়াচ্ছে ওরা। কোন দিন কাজের অতিরিক্ত চাপ পড়লে খানিকটা সময় বের করে একসাথে কোথাও ঘুরতে বের হয় ওরা এখন। চাপটাকে তখন আর অসহনীয় লাগে না। এদিকে ফারিহার জীবনে বন্ধুদের সংখ্যা এমনিতেও কম, যে ক’জন আছে তাদের মধ্যেও তন্ময়ের মত খোলা মনের কেউ নেই। তন্ময়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমন – ফারিহার সাথে শেয়ার করে স্বস্তি পায় ও। দুইজনই একে অপরের মোবাইল নম্বর সেইভ করে রেখেছে বিএফএফ নামে। আজ ফারিহাই তোলে প্রসঙ্গটা। আবারও।
‘তুই আজ পর্যন্ত একটাবারও আমাকে বললি না আমাদের প্রথম পরিচয়ের দিন তোর কি হয়েছিল। ’
‘তোকে আমি আগেও কয়েকবার বলেছি – আমাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করবি না। আমি উত্তর দিতে পারব না। ’
‘ওকে!’ হাসে ফারিহা, ‘লেট মি গেস – তুই ছ্যাঁকা খেয়েছিলি।’
‘একরকম।’ অন্যদিকে তাকায় তন্ময়।
‘মেয়েটা নিশ্চয় অনেক বোকা। নাহলে তোর মত ছেলেকে ছেড়ে যাবে কেন?’
‘আমাকে খুঁচিয়ে তথ্য বের করতে চাইছিস তো?’ চোখ পাকালো তন্ময়, ‘ফাইজলামি বন্ধ! চল বাসায় ব্যাক করি। আমার ভালো লাগছে না।’
মাঝে মাঝে ভাবে ফারিহা বোকাটার কথা। মানুষ মনে হয় আর প্রেম করে ছ্যাঁকা খায় না?
এত রাখাঢাকির কি আছে? তবে একটা কথা ঠিক। তন্ময়ের কোনকিছুতেই পরাজয় পছন্দ না। ছেলেটা খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে। প্রথম প্রথম কিভাবে ‘উন্মাদ’ নামক ম্যাগাজিনটি ওর কার্টুনকে রিফিউজ করে দিয়েছিল আর তা ওর জন্য কত বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছিল সেই গল্প ফারিহার জানা।
হয়ত এ কারণেই ওর পরাজয়ের কথা ও লুকিয়ে রাখতে চায় নিজের কাছেই। ফারিহাকে বললে কি হত? সবই বলে ওকে তন্ময়।
‘গাধা একটা!’ বিড়বিড় করে তাকে গাল দেয় সে। তবে বিষয়টা তাকে এভাবে খোঁচাচ্ছে তা টের পেতে দেয় না বন্ধুকে।
একদিন তূর্য ওর কাছে জানতে চায়, ‘কিরে, তন্ময়ের সাথে জুটলি কিভাবে?’
অবাক হয় ফারিহা, ‘আপনি ওকে চেনেন কিভাবে? লং স্টোরি ভাইয়া।’
তূর্য অবাক হয়, ‘চিনব না! আমার কলেজের ছাত্র ছিল। আমার এলাকায় থাকে। আমার ক্লোজ ছোটভাই। আমাদের ম্যাগাজিনে ও আর্ট নিয়ে মাঝে মাঝে সাহায্যও করে।’
প্রশ্নটা করা ঠিক হবে কি হবে না – না বুঝেই করে ফেলে ও, ‘ভাইয়া ওকে কিছু একটা নিয়ে ডিস্টার্বড দেখি। ওর কি ইদানিং এর ভেতর ব্রেক আপ হয়েছে কারো সাথে? ’
ঘরের ছাদ কাঁপিয়ে হাসে তূর্য, ‘তন্ময় করবে প্রেম? ব্রেক আপ তো পরের কথা। আমার জানামতে ওর কোন বান্ধবীও ছিল না। তাই তো তোর কথা ওর মুখে শুনে অবাক হলাম। আরে শিল্পী মানুষের মাঝে মাঝে উদাস হতে হয়। ও নিয়ে ভাবিস না।’
লজ্জা পেয়ে সরে আসে ফারিহা। তূর্য ভাই নিশ্চয় ভেবেছে তন্ময়ের প্রেমে ও হাবুডুবু! আর ও-ও একটা যাচ্ছেতাই! এভাবে কেউ জানতে চায়? কিন্তু – নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে যায় ফারিহা। তন্ময়কে কি ও বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু করে পেতে চায় না? নাকি চায় না? নিজেকে বোঝা এত সহজ হলে তো আর গ্রিক দার্শনিক এই কাজটি করার জন্য উপদেশ দিয়ে যেতেন না মানবজাতিকে।
এত ভাবার জন্য নিজেকেও চোখ রাঙ্গায় ফারিহা। তন্ময় মনে হচ্ছে ওর মাথার ভেতর ঢুকে বসে আছে। কেন? কারণ ওই একটা অজানা প্রশ্ন। হয়তো ওরা শুধুই বন্ধু। ওই কৌতূহলটাই হয়েছে কাল। কিন্তু ভাবাভাবির ব্যাপারটা কি আর ওর হাতে তখন আছে?
পরের কয়েকটা দিন যতবার তন্ময়ের সাথে দেখা হয় ফারিহার – প্রতিবারই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় ওর। তন্ময়টাকে ছাড়তেই ইচ্ছে করে না। কোন কারণ ছাড়াই ওকে ফোন দিয়ে ডাক দেয় ও, ‘হ্যালো তন্ময় – মন ভালো না। চল কোথাও ঘুরে আসি।’
আসলে ছাই – তন্ময়কে দেখার ছুতো। আর পাগলটাও যা, ইদানিং সারাদিনই ছবি আঁকে। যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ছবি নিয়েই বকবক করে। ওর আবার ইদানিং বিশ্বকে চমকে দেওয়া একটা ছবি আঁকার ইচ্ছে হয়েছে। ফারিহার কি আর অতসব মাথায় ঢোকে? ও শুধু তন্ময়কে দেখে। ছেলেটার চোখ দুইটা এত্ত পরিষ্কার – ফারিহার ইচ্ছে করে ওখানে ডুবে মরতে। আর ও হাসলে তো ফারিহার মাথা হ্যাং করে যায় – এত সুন্দর করে একটা মানুষ হাসে কি করে?
প্রায় প্রতিদিনই দেখা করলেও ফারিহার সাহস হয় না ওর অনুভূতির কথা বলার।
না – তন্ময় ‘না’ করে দেবে সেই ভয়ে যতটা – তার থেকেও বড় ভয় তন্ময়ের প্রথম দিনের ব্যাখ্যার।
ও যে পাগল – হয়ত সেই মেয়েকে জেতার একটা জেদ নিয়ে বসে আছে আজও।
মাঝখান থেকে ফ্রেন্ডশিপে একটা দূরত্ব আসবে।
প্রতিদিন তন্ময়কে কিভাবে দেখবে ও তখন?
*
আরেকটি মাস প্রায় গড়িয়ে যায় এভাবে। এর মাঝে একদিন বহুদিন পর তন্ময়ের মুখে হাসি দেখে ফারিহা।
‘তোকে বলেছিলাম আমার একটা – মাত্র একটা ছবি আঁকার সখ ছিল। পৃথিবীকে চমকে দেওয়ার জন্য।’
‘তুই একটা পাগল। সব কিছুতেই তোর তাড়াহুড়ো।’ ওকে আলতো ঘুষি মারে ফারিহা।
‘ছবিটার কাজ শেষ,ফারিহা। আজ আমরা সেলিব্রেট করব।’ ঘুষি ফেরত দেয় তন্ময়।
‘কী খারাপ। কী খারাপ! আমাকে দেখাবি না?’ অনুযোগ করে ফারিহা।
‘অফকোর্স! আর মাত্র কয়েকটা দিন দোস্ত।’
কিন্তু কয়েকটা দিনের কথা বললেও আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ছবিটা দেখা হল না ফারিহার। কিংবা বলা যায় – একটা সপ্তাহ তন্ময়ের সাথে ভালোমত যোগাযোগও হল না ফারিহার।
মনে মনে গালি দিয়ে ওর ভূত ভাগায় ফারিহা – পাগলটার হয়ত ছবির কাজ বাকি ছিল – এখন আমাকে দেখাতে হবে তাই ডুব মেরে কাজ শেষ করছে – নিজেকে বোঝায় ও।
মোবাইলের রিংটোন বাজতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ও – কিন্তু তন্ময় না – তূর্য ভাইয়ার কল। বিরক্ত হয়েই ফোন রিসিভ করে ফারিহা।
‘তোকে কিভাবে ব্যাপারটা বলব বুঝতে পারছি না।’
‘ভাইয়া কি তন্ময়ের শেষ ছবিটার কথা বলছেন? অবাক হয়েছেন তো? আমি জানতাম ও এবার অসাধারণ কিছু একটার জন্ম দেবে। আমি অবশ্য এখনও দেখি নি -’
‘তন্ময় মারা গেছে ফারিহা। গত পরশু রাতে।’ কন্ঠ সিক্ত হয়ে আসে তূর্যের। ‘তার আগে আমাকে মেসেজ দিয়েছিল যেন তোকে বলি তোর ই-মেইল চেক করতে। আমি ভেবেছিলাম তোদের ঝগড়া – তাই। তখন যদি বুঝতাম রে …’
আরও কি কি বলে যায় অপরাধী কন্ঠ নিয়ে তূর্য ভাই – কানে কিচ্ছু শুনতে পায় না ফারিহা। হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায় আলতো করে। একটা যন্ত্রের মতই কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ে ও।
ফেসবুক এবং মোবাইল চেক করলেও ই-মেইল রোজ চেক করা হয় না।
একটি অ্যাটাচমেন্ট সহ একটী মাত্র আনরেড ই-মেইল।
প্রথমে ওর চোখ পড়ে ছবিটির ওপর।
ফারিহার একটা পোট্রেট। সম্পূর্ণ ডিটেইলস তন্ময় নিজের মাথা থেকে এঁকেছে। ফারিহার মুখে একটা অপার্থিব হাসি – যে হাসিতে একই সাথে ভালোবাসা – কান্না – সুখ এবং দুঃখের প্রতিচ্ছবি। একটি সাধারণ ছবি কিভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠে চোখের সামনে তা ফারিহা বুঝতে পারল না – তখন ওর চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে আসছে।
মেইলটা ওপেন করল ও ঝাপসা চোখেই।

‘ফারিহা,
তুই অনেক ভালো একটা মেয়ে। এবং অসাধারণ। পৃথিবীতে যদি এখনও একটা নিখুঁত মেয়ে থাকে – তবে নিঃসন্দেহে সেটা তুই।
আমি চিঠি লিখতে পারি না – লিখিনি কখনও। কিন্তু তোর কিছু কথা জানার অধিকার আছে – যে কথাগুলো আমি সামনে দাঁড়িয়ে তোকে কখনোই বলতে পারব না।
তুই সবসময় বলতি আমি বোকা। তোর কথা এতটা সত্য আমি নিজেও জানতাম না। তোর বন্ধুত্বের আড়ালে নিজেকে অনেক সুখী মনে হত – জীবনকে অনেক শান্ত। কখন যে বোকার মত তোর প্রেমে পড়ে গেলাম!
তুই আমাকে ভালোবাসতি সেটা আমি জানি – তুই আমাকে ফিরিয়ে দিতি না – সেটাও আমি জানি।
এখন হয়ত ভাবছিস – কেন তোকে বলিনি? আর কেনই বা তোকে আমার জীবনের সবকিছু শেয়ার করেছি শুধু আমাদের প্রথম দেখার দিনটি বাদ দিয়ে?
তারিখটি তোর মনে আছে কি না জানি না। তবে আমার আছে।
১৫ই মার্চ। যেদিন আমি হাতে পেলাম আমার ক্যাট স্ক্যানের রিপোর্ট।
মাথা আরও কয়েক মাস ধরেই হঠাৎ হঠাৎ প্রচন্ড রকম ব্যাথা করত। পাত্তা দেইনি। অনেক সময় নিয়ে ছবি আঁকতাম বলে ভাবতাম – চোখের ওপর বেশি প্রেশার দেওয়ার ফল। অবশেষে ডাক্তার দেখালাম। স্ক্যান করতে বলল আমাকে। স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে কন্সাল্টেশন সেন্টার থেকে মাত্র দুঃসংবাদটা নিয়ে বের হয়েছি – বড়জোর দুই থেকে আড়াই মাস বাঁচব আমি – ঠিক তখনই দেখিস তুই আমাকে।
টিউমারটা এতটাই গ্রো করেছিল আমার দশমিকের কোঠায়ও সুযোগ ছিল না।
আমাকে মাফ করে দিস ফারিহা। তোকে পেয়ে হারানোর বেদনা দিতে চাইনি।
আর – বেশি কাঁদিস না।
কথা দিচ্ছি – এই জন্মে হতে না পারলেও ওই জন্মে ঠিকই তোর হব।
– ফারিহার তন্ময়’

*
ফারিহার ফোনে রেসপন্স না পেয়ে তূর্য ওর বাসার সামনে গাড়ি থেকে নেমে দেখল –
মেয়েটা ভিজছে।

রচনাকাল : ২৯শে নভেম্বর, ২০১৩