KP Imon

Words Crafted

সাইকিয়াট্রিস্ট নোরা এবং অন্যান্য

দুই বছরের বেশি সময় আমি ঘুমাতে পারিনি কখনো, চার ঘণ্টার বেশি। কখনো সেটা দুই ঘণ্টা। কখনো পাঁচ মিনিট।

ট্রমা কী জিনিস বোঝার জন্য, কিংবা আমাকে বোঝার জন্য এই ব্যাপারটা জানা থাকা বিশেষ দরকার ফর ফিউচার রেফারেন্সেস। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যারা চেনেন তারা আমার যতখানি দেখতে পান, তার সাথে প্রকৃত আমার একটা পার্থক্য তো আছেই, এটা এমন ইউনিক কিছু নয়। সবারই থাকে। আর সবার মতো আমিও আমার এই দিকটা যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি অন্য যে কারো থেকে। তবে জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার মনে হচ্ছে এটা পাবলিক করে দেয়া দরকার। কারণ, আমার ভোকাল হবার জায়গাগুলোর সাথে এর সম্পর্ক আছে।

ওই সময়টায় আমি যখনই ঘুমিয়েছি, প্রতিবারই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে উঠেছি। খুব কালেভদ্রে, প্রতি দুই সপ্তাহে হয়তো একবার দুঃস্বপ্ন ছাড়া ঘুম হয়েছে, সেসব রাত বা দিনকে আমার মনে হয়েছে ব্লেসিং। বেশিরভাগ স্বপ্নেই আমি অপঘাতে মরেছি। স্বপ্নে অপঘাতে মরা এমন কোন বড় ব্যাপার নয়, তবে ঘুমালেই যদি মরেন তাহলে একটু বিপদ তো বটেই। আশ্চর্যের বিষয়টা হলো এর মধ্যে লুসিড ড্রিম খুব কম, অর্থাৎ স্বপ্নে আমি কখনো টের পাইনি যে এটা স্বপ্ন। কাজেই প্রতিবারই ওই একটা হরর, একটা অবর্ণনীয় আতঙ্ক আমাকে হজম করতে হয়েছে।

আমার এই ট্রমার পেছনে বাস্তবজীবনের ট্র্যাজেডিরা ছিল। এটা একটা কারণ আমি দুঃখের গল্প লিখি না। এই ধারার গল্পের খুব চাহিদা দেশে। হুমায়ূন আহমেদ পড়ার পর চোখ ভিজিয়েছেন বলে অনেকে বলে থাকেন, কারণ তাদের দুঃখ হয়েছিল। দুঃখবোধকে গল্পে রাখা আমার পছন্দ নয়, কারণ জীবনে ও জিনিস অনেক আছে। আমার কল্পনার জগতে তার খুব একটা ভূমিকা না থাকলেও চলবে। তবে, স্বপ্নের একটা গতি করতে হতো আমাকে। নানা মানসিক সমস্যার মধ্যে এই ঘুমহীনতা নেয়া যাচ্ছিল না।

আমার ভাইয়ের অনুরোধে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালাম কয়েকবার। ভদ্রমহিলার নাম মেখলা সরকার। আপনারা অনেকে হয়তো চিনে থাকবেন। তার সাথে আমার অদ্ভুত কথোপকথন হতো। আমার ব্যাপারে বলতে গিয়ে আমি কারণও ব্যাখ্যা করতাম। বলতাম “অমুক যে আমার সাথে হচ্ছে তার পেছনে খুব সম্ভবতঃ তমুক কারণ আছে বলে আমার র‍্যাশনালি মনে হয়। তবে আমি সেটা ফিল করি না। র‍্যাশনালি বোঝা আর ফিল করা দুই ভিন্ন জিনিস, কাজেই আমি এটাকে ডিল করতেও পারছি না।” 

তিনি আমাকে এক পর্যায়ে একটা কথা বলেছিলেন, “আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। হয়তো আমার হেল্প ছাড়াই আপনি এসব ফিগার আউট করতে পারবেন। তখন আর আপনাকে এখানে আসতে হবে না।”

তবে আমাকে যেতে হতো প্রেসক্রাইবড ড্রাগসের কারণে। অ্যান্টি-সাইকোটিক আর অ্যান্টি-ডিপ্রেসিভ ওষুধপত্র আমার নামে প্রেসক্রাইবড ছিল। ওসব খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম এরা আমার ডিলিউশনাল দিকটিকে কমিয়ে দেয়। এটা আমার পোষাতো না। কারণ, আমি লিখি গল্প। এই মানসিক জটিলতার কারণেই কি না জানি না, আমার ক্ষেত্রে গল্প লেখা ঠিক কল্পনার বিষয় নয়। গল্প আমার কাছে মেমরি। বিষয়টা লিখে বোঝানো কঠিন। তবে ধরুন আপনি একটা গাছের নিচে বসে থাকা কিশোরীকে নিয়ে গল্প লিখবেন, সেটা আপনি কল্পনা করতেই পারেন। তবে আমি যদি লিখি তবে আমার মনে হয় আমি ওখানে আসলেই ছিলাম। সত্যি ঘটেছে ঘটনাটা, আমার জীবনে। একারণে হয়তো অনেকে মনে করেন আমার লেখায় একটা আকর্ষণ আছে, যেটা খুব বেশি লেখকের মধ্যে পাননি। কাজেই ওষুধ ছাড়তে হলো। তার বদলে আমাকে সৃষ্টি করে নিতে হলো নতুন রেজিমেন। আমি তখন আর আমার ইন্দ্রীয়দের বিশ্বাস করতে পারি না।

এক দুপুরে জানলাম আমাকে হত্যা করার জন্য এলাকার কুখ্যাত জঙ্গিসংগঠন আনসার-আল-ইসলাম এবং লোকাল হিজবুত তাহরি নাকি টর্চ জ্বালিয়ে আমাকে খুঁজে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আমার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো কিছু হলো না। ঘুমের অবস্থা অবশ্যই খারাপ হলো। যখন কেউ জানে তার যে কোন মুহূর্তে মরে-টরে যাওয়ার কথা, তাকে অবশ্যই আপনি মানসিকভাবে চাঙ্গা দেখবেন না।

আমার ট্রমাদের উৎপত্তি জঙ্গিবাহিনী নয়। ভিন্ন সব ঘটনা। তবে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য মূলতঃ দায়ী। যারা অত্যন্ত নিম্নচিন্তাসম্পন্ন মানুষ, তারা মনে করেন অমুক ক্ষতিটা তমুক মানুষ করেছে, অমুক দুঃখটা তমুক মানুষ দিয়েছে। তারপর তারা তাদের শত্রুজ্ঞান করেন। সত্যিকারের শত্রু তাদের চোখে আর ধরা দেয় না।

আমি বুদ্ধিশুদ্ধি কোন শিক্ষক বা ইমামের কথায় খুইয়ে আসিনি, তাদের বর্গাও দেইনি চিন্তা করার ক্ষমতা। কাজেই চিন্তা করে দেখলাম আমার যাবতীয় যন্ত্রণার জন্য দায়ী ভিন্ন একটি বিষয়। 

আমাদের ভুল চিন্তা দায়ী। যেভাবে আমরা চিন্তা করি ন্যায় কিংবা অন্যায়, যেভাবে আমরা দেখি প্রেম, যেভাবে আমরা দেখি জীবন এরাই আমার সমস্ত ট্রমার জন্য দায়ী, সমগ্র মানসিক অশান্তির জন্য, যন্ত্রণার জন্য। এবং এটা আমার জন্য নয় কেবল আপনাদের জন্যও সত্য।

যেভাবে আমরা আমাদের জগতকে স্বাভাবিক ধরে নেই তার জন্য আমাদের যন্ত্রণা পেতে হয়। আমি এখানে সিস্টেম চেঞ্জ করে উলটে দেবার কথা বলছি না। যে কোন সিস্টেমে, যে কোন পরিবেশ, যে কোন দেশ বা সমাজে আমার ফাইন্ডিংস অ্যাপ্লিকেবল। চেঞ্জ করতে হবে আমাদের দেখার ভঙ্গিটা।

যেভাবে আমরা দেখি সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা। যেভাবে আমরা দেখি প্রেমের বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। যেভাবে আমরা ডিফাইন করি লয়ালটি, কিংবা ট্রাস্ট। এগুলো আমাদের সাথে অপটিমাইজড নয়। 

মানুষ একটা বায়োলজিকাল বিইং। একটা প্রাণী। যেভাবে আমরা সমাজের ধারণা কিংবা নৈতিকতার ধারণা নিয়ে এসেছে, তা ফান্ডামেন্টালি আমাদের সত্তার সাথে যায় না। একটা সিংহকে যদি ধরে নিয়ে এসে আপনি প্রতিদিন দুই কেজি ঘাস দেন, তাহলে সিংহের কিছু সমস্যা হবে। আমাদের, অ্যাজ আ হোল, মানবজাতির এখন হয়েছে সেই সমস্যা। 

যেসব সিংহ চারপাশে তাকিয়ে আর দশটা সিংহকে ঘাস খেতে দেখে ভাবছে এটাই সত্য, তাদের জন্য কষ্ট করে চিবিয়ে ঘাসটা খেয়ে ফেলা সহজ। তারা চাকরি না পেলে মনে করে, “আরে ব্রিলিয়ান্ট ফার্স্ট বয়ের মতো পড়লে পাইতাম।” কিংবা তাদের গার্লফ্রেন্ড অন্য কারো সাথে প্রেম করলে তারা ভাবে, “আরে শালী একটা মাগী। চিট করলো আমাকে, সে খারাপ। তারে জীবন থেকে বের করে দেয়াই সমাধান।” এবং বন্ধু একটা বালের আলাপ করলে, সে ভাববে, “ওয়ান ফর অল, অল ফর ওয়ান।”

এই ধরণের যাবতীয় মুল্যবোধ আমাদের যন্ত্রণার এবং শান্তিধ্বংসের কারণ। আমার জীবনের ট্র্যাজেডিরা আমাকে প্রথমবারের মত এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, সত্য, তবে তারপর আমি নিজেকে ছাড়িয়ে আরও ব্রডার সেন্সে ব্যাপারটা ভাবতে শুরু করলাম। দেখলাম ঘটনা সত্য। ছেলেবেলা থেকে আমাদের অনেক ভুল মূল্যবোধ শিক্ষা দেয় ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র, যার কারণে আমরা জীবনের বড় একটা সময় বাজে কিছু ট্রমা নিয়ে যাই এবং নিজেরাও সে দিয়ে ড্রিভেন থাকি, যে কারণে করি ধ্বংস।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক, প্রায় সবার জীবনে খুঁজলে প্রেমঘটিত একটা বেদনার জায়গা পাওয়া যাবে। যেখানে তার পার্টনার তাকে হতাশ করেছে কিংবা অন্য কারো সাথে শুয়ে-টুয়ে পড়েছে। যাদের নেই তারা তো সৌভাগ্যবান, তবে যাদের আছে, তারা কিন্তু এটাকে প্রায় জীবনভর বয়ে বেড়ান। কেন? 

কারণ সমাজ তাকে ছোটবেলা থেকে মনোগ্যামাস সম্পর্ক দেখিয়েছে। ওর বয়স যখন দুই তখন সে দেখেছে সবার একটা আব্বু আর একটা আম্মু। একে অন্যের সাথে জীবন পার করে দিচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা ভাবেন ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের সমস্যা হয়। কেন হয়? কারণ তারা মনোগ্যামাস ফ্যামিলির জন্য ফিটেড একটা সমাজে বড় হয়েছে। ব্রোকেন ফ্যামিলি ডাল-ভাত হলে তাদের কোনরকমের বাড়তি মানসিক সমস্যা হতো না, কারণ তখন তাদের জন্য একটা সিস্টেম, সোশাল ইকুইলিব্রিয়াম দাঁড়াতো। অথচ তর্কসাপেক্ষে মানুষ একটা পলিগ্যামাস প্রানি। ব্রোকেন ফ্যামিলিই হওয়ার কথা মেজরিটির। সেটা আমরা আরোপিক সামাজিক স্ট্রাকচারের কারণে হতে দেইনি বলে পরবর্তীতে, আমাদের অ্যাডাল্ট লাইফে আমরা যে কোনও পলিগ্যামাস ইন্সিডেন্স খুব ডিপলি নেই। অথচ একটা চাকরির ইন্টারভিউয়ে রিজেকশন হলে যতখানি, ততখানিই আপনার অনুভূতি হওয়ার কথা ছিল প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে। তা হচ্ছে না কিন্তু। 

তারপর বন্ধুত্বের সম্পর্কে দেখুন। একই অবস্থা। অ্যানিমল কিংডমে মানুষের মতো যেসব প্রাণিরা আছে, যেমন বানর তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব আর ছ্যাঁকা নিয়ে এত নাটক আপনি দেখবেন না। অ্যাসাইনড রোল নিয়েও না, মানে আমাদের ক্ষেত্রে যেটা চাকরি-বাকরি আরকি। কারণ হচ্ছে, আমরা আমাদের ওপর এমন জিনিস চাপিয়েছি যা আসলে হবার কথা নয়। আর এসবই আমাদের ধ্বংস করেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে অনেকগুলো বাড়তি ঝামেলা।

ঝামেলাবিহীন জীবন আপনি পাবেন এমন নয়। তবে অদরকারি ঝামেলা আমরা ছেঁটে ফেলতে পারি সহজেই। কাজেই আমার লক্ষ্যবস্তু হলো না কিছু মানুষ, যার আমাকে হার্ট করেছিল। বরং আমার লক্ষ্যবস্তু হলো সেই মানুষগুলো কেন অন্যদের হার্ট করছে তার মূল কারণটা। 

তিনটি কারণ পাওয়া গেল। 

(১) সমাজ শিখিয়েছে

(২) ধর্ম শিখিয়েছে 

(৩) রাষ্ট্র শিখিয়েছে 

কাজেই আমি এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলাম যে কোন অনাকাঙ্খিত ঝামেলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে। অতি সহজ তিন উদাহরণ দেয়া যাক  

আপনি নিজের পয়সায় কেনা সিগারেট ক্যাম্পাসে ঢুকে সিনিয়রের বা স্যারের মুখের সামনে ধরাতে পারছেন না, কারণ ওটা একটা সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই অদরকারি বাঁধা আপনার জন্য আনফেয়ার। এসব অন্যায় সমাজ আপনার সাথে করছে, যার চেইন-অফ-ইভেন্টে আপনার সাথে ট্রমাটিক কিছু ঘটতে পারে। খেতে পারেন র‍্যাগ। পরদিন ক্লাসে যেতে ভয় পেতে পারেন। এসব দরকারি। এদের মুছে ফেলতে হবে। 

আপনি আর পাশের বাসার ছেলে/মেয়ের সাথে খুব জমিয়ে ভাব হয়ে গেছে। প্রেম করতে পারছেন না, কারণ সে হিন্দু আপনি মুসলমান। এসব অদরকারি ট্রমা, যন্ত্রণা ধর্ম সৃষ্টি করেছে, কাজেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দরকার আছে। 

রাষ্ট্র আপনাকে বলেছে সমকামী হলে আপনি অপরাধী। দুইজন দুইজনকে পছন্দ করছেন, কারো পাকা ধানে মই দিচ্ছেন না, তাও কি না আপনি আছেন ট্রমায়, যাতনায়। একারণে রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধঘোষণা করার দরকার আছে।  

তার মানে এই নয় যে আমি সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে বিলীন করে দেবার মিশনে আছি। বরং আমি, আপনাদের আর যে কারো মতই, এই তিন শত্রুর কিছু অন্যায় নিয়ম আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি। আপনারা জানেন ও বোঝেন কিন্তু তাও পালন করেন, আমি করি না। অন্যায় আবদার সেটা সমাজের মুরুব্বির মতামত হোক, কুরআনের বাণী হোক, কিংবা সংবিধানের ধারা আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যেসবের ডমিনো ইফেক্ট আমার দুঃস্বপ্নের কারণ হয়েছে তা অন্যদের যাতনার কারণ অবশ্যই হচ্ছে। কিন্তু সবাই সাফার করছে বিনা কারণে। এইসব ঠুনকো মূল্যবোধের কারণে মানুষকে সাফার করতে যেন না হয় তা নিশ্চিত করতেই আমার নানা বিষয়ে ভোকাল হওয়া। আয়রনি হচ্ছে, আপনি যদি আমার বিরুদ্ধমত ধারণ করেন, আপনারও সাফারিংস আছে। এবং এই সাফারিংস থেকে আপনাকে কুরআন বা সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারবে না। আপনারা যদিও বা ওদুটোকে আরও আঁকড়ে ধরতে চান মুক্তির নেশায়। অথচ তারা আপনার যন্ত্রণার মূল কারণ ইন দ্য ফার্স্ট প্লেস। 

আমি এ থেকে মানবজাতির মুক্তির পথ খুঁজি। তবে ধর্মগ্রন্থ বা সামাজিক মূল্যবোধ যে সে পথ নয় তা যেমন আমার জানা হয়েছে, আপনারাও তা জানেন। আমি নতুন কিছু বলছি না। যা বলছি এখানে তার সবই আপনি জীবনে একবার হলেও ফিল করেছেন, সচেতনভাবে কিংবা অবচেতনে।

আমি যে একজন ডিলিউশনাল মানুষ তা আপনাদের কারো সামনে লুকাবার চেষ্টা আমি করি না, তবে র‍্যাশনালি চিন্তা করার দিকটা যে অক্ষত আছে তা আমার একাডেমিক কিংবা ক্যারিয়ারের ফলাফল দেখলে বোঝা যায়। কাজেই আমার এই মতামতকে স্রেফ পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে যে পারবেন না তা আশা করা যায়। এ পর্যন্ত যারা পড়েছেন তারা অন্তত অবচেতনে এতখানি ফিল করেছেন যে, “ইট ডাজ মেক সেন্স।” অথচ স্বীকার করবেন কি না বা একেবারেই না দেখার ভান করে কেটে পড়বেন কি না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তা যেদিকেই যান না কেন, ক্ষতি নেই। আমি বহুমাস ধরে এমনিতেও এক পরাজিত সৈনিক। ইতিহাসে থাকে বিজেতার হুঙ্কার। 

ইদানিং স্বপ্ন দেখি বিশাল বিশাল সব গল্পাকারে। তাদের শুরু থাকে, শেষ থাকে। তাতে ভালোলাগা, দ্বেষ থাকে। মাঝের ছয়-সাত মাস আমার ছিলো এক ইমাজিনারি ফ্রেন্ড। সাইকিয়াট্রিস্ট নোরা। এই চরিত্রটি পরে “এইখানে জাদুঘর পাতা আমাদের” বইয়ের ভেতরে ঢুকে গেছিল। সাইকিয়াট্রিস্ট নোরার কাজ হচ্ছে রিয়েলিটি চেক দেয়া।

কখনো হয়তো দেখলাম, ঘুম ভাঙার পর থেকে আমার মাঝে বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আর অবশিষ্ট নেই। 

নোরা আমাকে বললো, “খুঁজো, কাহিনীটা কী।”

খুঁজলাম। পেয়েও গেলাম। 

নোরা শুধু কনফার্ম করলো, “ট্রিগারটা হচ্ছে স্বপ্ন থেকে। স্বপ্ন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করে নাকি তোমার মস্তিষ্ক স্বপ্নকে?”

নোরা সত্য বলেছে। অবশ্য নোরার পক্ষে মিথ্যে বলা সম্ভব নয়। সে আমারই মস্তিষ্কের অংশ। তবে কখনো কখনো আমি মিথ্যা বলি, নিজের সাথে। ওটা নোরা ধরে ফেলে। তারপর মুখের ওপর বলে দেয় তা।

পাঠকের কাছে এখন একটাই প্রশ্ন রাখবো।

সুস্থ-স্বাভাবিক একটা মানুষ থেকে যখন আপনি দুই বছরের দুঃস্বপ্ন আর ইমাজিনারি সাইকিয়াট্রিস্ট নোরাকে নিয়ে কোনমতে টিকে যাবেন, আপনার এই পরিণতির জন্য যারা দায়ী তাদের প্রতি আপনার মনোভাব কী হবে? 

না, ওই লোকের ওপর নয় যে আমার নামে কিল স্যাংকশন করেছিল। কিংবা ওই মেয়েটাকে নয় যে আমাকে বিশাল ছ্যাঁকা দিয়েছে, অথবা ওই বন্ধুকে নয় যে আমার বিশ্বাস রাখতে পারেনি, সেইসব আত্মীয়স্বজনকেও নয় যারা আমাকে হতাশ করেছে। তারা স্রেফ পুতুল। 

আসল সমস্যা আমাদের চিন্তার ভেতর, এবং আক্রমণ করতে যদি হয় কিছুকে, 

সেটা এই চিন্তাকেই  

সামাজিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাকে। 

আপনার যাবতীয় দুঃখদুর্দশার পেছনে বড় অংশে এই তিনটাই দায়ী।

এর বাইরেও নানা যাতনা আছে। ক্যান্সার হলে কী করবেন, কিংবা রোড অ্যাকসিডেন্ট? কিন্তু আমার মনে হয় যতখানি যাতনা আমরা নেই, তার অনেকটুকুই আমাদের নিতে হতো না। এ থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। 

আর যারা আমার বিরোধীতা করেন, কিংবা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান না, কথা বলেন না নিজের সার্কেলের ভেতর আয়রনিকভাবে তারা তাদের যন্ত্রণার মূল কারণকে আরও খাবার দেন।

একবার একটা ভদকার বোতলের ছবি পোস্ট করায় অত্যন্ত ধার্মিক লোক আমাকে খুব রোষ নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “নেশা করিস আর মেয়েমানুষ নিয়ে থাকিস!”

সামান্য একটা ভদকার বোতলের ছবি দেখে তার মাথায় নেশা এবং মেয়ে মানুষ চলে এসেছে, কারণ সে বেচারা হয়তো এসব করতে চায় কিন্তু পারে না। ধর্মে নিষেধ আছে যে, তাই।

সে যে নেশা করতে পারছে না বা মেয়ে মানুষের সাহচর্যে যেতে পারছে না, তার পেছনে শত্রু কিন্তু ওই ধর্ম। ধর্ম তাকে অহেতুক যন্ত্রণায় রেখেছে। কিন্তু তার রাগটা দেখুন। আমার ওপর।

সাকিবের বউ পর্দা করে না, হট অভিনেত্রী ছবি দেয় এসব নিয়ে বাঙালির রাগ কেন জানেন? কারণ সে মনে করে তার এমন হট বউ হবে না কখনো। এটা মনে করার পেছনে তার ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স। আমি চেষ্টা করি তাদের মনস্তত্ত্ব বদলে দিতে, এবং এই বদলটা এলে তারাও এই হট মেয়েদের সমাজে সমাদৃত হবে। কিন্তু তারা আমার পরামর্শ নেবে না, মানসিকতার উন্নয়ন না ঘটিয়ে মেয়েটার পেছনে লেগে থাকবে। কারণ সে জানে তার অতৃপ্তি পূরণের জন্য তাকে প্রথমে সংস্কার থেকে বের হতে হবে। সমাজ, ধর্ম, ইত্যাদি। কিন্তু সে সমাজের মূল্যবোধ আর ধর্মের শেকল ভাঙ্গতে পারছে না বলে তার পছন্দের মেয়েগুলো নাগালের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। ধর্ম বা সমাজকে গালি না দিয়ে সে এখন গালি দিচ্ছে ওই বেচারি মেয়েটাকে। “খানকি মাগী, হিজাব কই?”

যা অত্যন্ত স্বাভাবিক কার্যকলাপ এবং আপনার মনেও চায়, অথচ তা করতে পারেন না যখন খেয়াল করুন আক্রমণ সঠিক শত্রুকে করছেন কি না। যা-ই আপনাকে অস্থির করে, বিচলিত করে, যন্ত্রণা দেয়, বা দেয় অতৃপ্তির অনুভূতি তার পেছনের কারণটা খুঁজে বের করুন। কিশোর পাশা ইমন? সুন্দরী মডেল? মিয়া খলিফা? 

নাকি আপনার সামাজিক মূল্যোবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস? 

তারপর আক্রমণ করুন ওটাকে।

 

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *