KP Imon

Words Crafted

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৪ – পথটা

টেক্সাসে প্রথম একলা বের হলাম। পুরো স্টেটটিই প্রাইভেট। অর্থাৎ সরকারি কিছু নেই। পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন সংখ্যা শূন্য। সবার-ই আছে গাড়ি, নইলে মারতে হচ্ছে উবার। যারা হোমলেস, অর্থাৎ দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন – তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে হাইওয়েতে, একটি আঙুল উঁচিয়ে – অবশ্যই সেটি মধ্যমা নয়, বৃদ্ধাঙ্গুলি; যেন কেউ তাদের লিফট দেয়।
পথটা সহজ নয়, নতুন কারো জন্য চট করে চিনে নেয়া তো প্রায় অসম্ভব। ভাইয়া প্রায় এক বছর হয়ে গেলো এখানে আছে, তবু তাকে গুগল ম্যাপস গাড়িতে সেট করে ড্রাইভ করতে হয়। সেই পথে আমি একা নেমে এলাম। আমার গাড়ি নেই, টেক্সাসে এসেছি মাত্র কয়েকদিন হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকার প্রশ্নই আসে না যে ভাইয়ার কোন এক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বো। বাস-রুটগুলোও এমন যে তাদের দিয়ে রাউন্ড রক (যে শহরে আমি ছিলাম) থেকে স্যান মার্কোস (আরেকটি শহর) পর্যন্ত তা দিয়ে যাওয়া যায় না। প্রতিটা শহর থেকেই যাওয়া যায় টেক্সাসের ক্যাপিটাল অস্টিনে। তবে সকালের একটি বাসে করে যদি আপনি অস্টিনে চলে যান, সেখানে যখন পৌঁছাবেন তখন দেখবেন স্যান মার্কোজের সকালের সব বাস এরই মধ্যে ছেড়ে গেছে। বিকালে আরেকটি বাস আছে হয়তো। তবে বিকালদিকে স্যান মার্কোজ নিয়েই বা আমার কাজ কী? ওখানে তো আমার কাজ সকালে – যতক্ষণ আমার ইউনিভার্সিটির অফিস খোলা আছে ততক্ষণ। অগত্যা উবারে প্রায় ৫০ ডলার দিয়ে যেতে হলো অস্টিন, সেখান থেকে একটি প্রাইভেট বাস (গ্রেহাউন্ড) ধরে স্যান মার্কোস।
বাস পরিবহণ ব্যবস্থাগুলো নিয়ে কিছু আলাপ করা যায়। এটি বাংলাদেশের মতো কোনোভাবেই নয়। তাদের বাস ট্রান্সপোর্টেশনের মধ্যে হাল্কা আছে এয়ারপোর্টগুলোর ছাপ, তবে “way বদখত”! অর্থাৎ তারা আপনাকে ঠিকমতো একটি টিকেট দেবে, যেখানে লেখা আছে কোন কাউন্টার থেকে উঠবেন এবং কোন সময় আপনাকে বোর্ডিং করতে হবে। একই সাথে অনলাইনে টিকেট কাটলে সেটা অথবা তার ছবি আপনার বোর্ডিং পাস হিসেবে ব্যবহৃত হবে। লাইনে দাঁড়াবেন। বাস আসলে তার জন্য গেটের সামনে লাইন দিবেন। তারপর যথারীতি অপেক্ষা করবেন কখন ড্রাইভার মহাশয় এসে কাউন্টারের সামনে গিয়ে নিজের চেহারা দেখিয়ে আসেন। তারপর লাইন ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবেন। সেই সাথে অপেক্ষা করবেন ড্রাইভার মহাশয়ের অ্যাপ্রুভালের। আনলাইক প্লেনস, যে কোন বাসে সর্বেসর্বা হলেন ড্রাইভার মহাশয়। তাকে মহাশয় বলার কারণটা আশা করি স্পষ্ট হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই নাইটহুড-প্রাপ্ত কিংবা সমপর্যায়ের কিছু একটি।
আমার প্রথম বাস জার্নির অভিজ্ঞতাতে আমার কপালে পড়লো আটফিট উঁচু এবং সমপরিমাণ চওড়া একজন আফ্রিকান আমেরিকান ভদ্রলোক। তিনিই ড্রাইভার। স্যার। মহাশয়। সর্বেসর্বা। অথরিটি। গুরুজন। সেনাপতি। প্রশাসন। তিনি টিকেট চেক করে সবাইকে তুললেন। ভদ্রলোককে সবগুলো দাঁত বের করে বললাম, “শুভ সকাল, স্যার।”
তিনি আমাকে চুদলেনও না।
বাসে উঠে একটা সীটে বসে পড়েছি। সাউন্ডবক্স ধরে ভেসে এলো মহাশয়ের কণ্ঠস্বর। তিনি সবাইকে সাধারণ ভদ্রতাবোধ বজায় রাখতে বললেন। সেই সাথে যোগ করে দিলেন, “পাশের যাত্রীর সাথে পিরিতের আলাপ চোদাইবা না কিন্তু, আগেই কইয়া রাখলাম। আর যদি মাতলামি করেছো দাদারা, গোয়া মেরে বাস থেকে নামিয়ে দেবো। হিসাব পরিষ্কার হয়েছে?”
কারো উত্তরের আশায় না থেকে তিনি বললেন, “নেক্সট স্টপ : স্যান মার্কোস।”
পরে নেট ঘেঁটে আর ইউটিউবারদের কাছে শুনলাম, এমনটা হয়ে থাকে। বাসে কেউ তেড়িবেড়ি করলে খোলা মাঠে তাদের নামিয়ে দেন ড্রাইভাররা। সবার সাথে যাওয়ার সুযোগ তোমাকে দেয়া হয়েছিলো। নিতে তো পারোনি। কাজেই, একলা চলো রে। পলকা বাস ড্রাইভার এজন্যই স্টেটসে খুব একটা দেখবেন না। দরকার হলে আপনাকে চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলতে পারে এমন লোকজনই সেখানে আছেন।স্যান মার্কোসে নেমে আসার পর আমার যেটা মনে হলো – এখানে ছোটবেলা থেকে যারা বড় হয়েছে তাদের জন্য বাসযাত্রা নিশ্চয় আমার মতো এতো অনিশ্চিত আর অস্বস্তিকর হবে না। কারণ, তারা জানে।
উচ্চশিক্ষার আবেদন করাও অনেকটা অমনই। শুরুতে একজন বিএসসি পাশ করা ছাত্র বা ছাত্রীর এ বিষয়ে কিছুই জানার কথা নয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এই জিনিস শেখায় না কেউ। অথচ রকেট সায়েন্স, এমন নয়। এখানে কেবল আছে পথটা চেনার একটিমাত্র ওয়েবসাইট বা সিলেবাসে অভাব। যে কারণে বিষয়টা সহজ হলেও, হতে পারে অনেকটা বিভ্রান্তিকর।
কখনো একশ’টি পথ থাকার কারণেই সমস্যা হতে পারে পথিকের।
তাই সবার আগে আমি আপনাদের একটা পথ দেখাবার চেষ্টা করবো। তবে পথিকের বিভ্রান্তি এড়াতে সেই একটি পথও সহায়ক হতে পারে!

সংক্ষেপে নিচে তালিকার মাধ্যমে পথটা দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি –
(এ কেবল একমাত্র পথ নয়, আরও পথ আছে, তবে একটি চেনা থাকলে বাকিদের চেনা সহজ হবে)
১। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে যাওয়া
২। যে প্রোগ্রামটিতে অ্যাপ্লাই করতে চাইছেন তার রিকুয়ার্মেন্টস পড়া। যদি আপনাকে নেবে মনে হয়, তাহলে অ্যাপ্লাই করা। যদি মনে হয় আপনার ব্যাকগ্রাউন্ডের থেকে বেশি চাইছে তাহলে ওদের গ্র্যাজুয়েট স্কুলের যার নাম পাওয়া যাবে, তাকে ইমেইল করে নিজের প্রোফাইল পাঠিয়ে বলা “অ্যাপ্লাই করবো নাকি এখানে পয়সা নষ্ট করা উচিত হবে না?”
(২) ক : অ্যাপ্লিকেশন করতে গেলে বেশ কিছু জিনিস আপনাকে সাবমিট করতে হবে। তাদের তালিকা দেয়া হলো নিচে –
১। ঠিকানা (বর্তমান ও স্থায়ী, বিস্তারিত জেনে রাখুন)
২। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, বিষয়, ঠিকানা, ফোন নাম্বার (শেষ দুটো প্যারাময়)
৩। চাকরির অভিজ্ঞতা (প্যারার, যদি একাধিক চাকরি করে থাকেন, সব সুপারভাইজারদের, এবং কোম্পানির নাম ও ঠিকানা/ফোন নাম্বার দিতে হবে)
৪। জিআরই (কয় তারিখে দিয়েছেন? কোন অংশে কতো পেয়েছেন? পার্সেন্টাইল? সব লাগবে)
৫। টোফেল (ঐ)
৬। দুনিয়ার রেজাল্ট (বেশিরভাগ জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়েরগুলোই চায়, তবে কেউ কেউ আদি থেকে অন্ত চেয়ে বসতে পারে, ফর্মের ধরণটাই অমন, কিছু করার নাই)
৭। রেকমেন্ডশন লেটার যাদের থেকে আসবে তাদের নাম, তাদের কর্মরত প্রতিষ্ঠানের নাম, তাদের ইমেইল অ্যাড্রেস, তাদের ফোন নাম্বার
৮। স্টেটমেন্ট অফ পারপাস তথা এসওপি (কখনো এর সাথে যুক্ত হতে পারে ব্যক্তিগত বয়ানের এক পত্র, তবে রেয়ার)
৯। আর যা যা আছে তা একেবারেই ব্যাসিক, হয়তো আপনাকে কোন ডকুমেন্টসও ফলো করতে হবে না। সরাসরি থাকবে মাথাতেই। যেমন আপনার ফার্স্ট নেইম, লাস্ট নেইম, ফোন নাম্বার, ইমেইল অ্যাড্রেস, ইত্যাদি ইত্যাদি, শতেক জিনিস। ওপরের আটটা আসল যোগাড়যন্ত্রের জায়গা, আমি বলতে চাইছি আপনাকে আপনার স্থায়ী ঠিকানার ওয়ার্ড নম্বর পর্যন্ত জেনে রাখতে হবে (যেটা সম্ভবতঃ ভিসা অ্যাপ্লিকেশনের সময় লাগে, না কই যেন, তবে আমাকে একবার দিতে হয়েছিলো), জেনে রাখতে হবে কোন মাসে এইচএসসির রেজাল্ট দিয়েছে। ওপরের যে ৮ টি বস্তু, তাদের সম্পর্কিত প্রতিটি খুঁটিনাটি আপনাকে জেনে রাখতে হবে

টিপস –
* আপনি একটি গুগল ডক খুলে রাখতে পারেন। যার ভেতর এই তথ্যগুলো সাজিয়ে রাখবেন। যখন অ্যাপ্লাই করবেন তখন চটপট এখান থেকে কপি করে করে ফর্মে পেস্ট করতে থাকবেন। হয়ে গেল। তাছাড়া একসাথে ৫-১০ জায়গায় অ্যাপ্লাই করতে হবে যখন, এটা দারুণ কাজে দেবে।
* এই দরকারি বিষয়গুলো থেকেই বোঝা যায় কেন কোন জিনিসটি লাগবে।
* সময়ের ব্যাপারটি এখান থেকে বোঝা সহজ হয়। অনেক সময় দেখা যায় অ্যাপ্লিকেশন ডেডলাইন পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ আপনি কথাই বলেননি কোন কোন স্যার বা ম্যাম আপনাকে রেকমেন্ডেশন দেবেন। এখন ফর্মটি পূরণ করার সময় আপনি কাদের নাম লিখবেন? তারা যদি পরে দিতে না চান?
* ঐ ডেডলাইনের মধ্যে ১-৮ আপনার নখদর্পণে না থাকলে কিংবা যোগাড় না হলে আপনি অ্যাপ্লাই করতে পারবেন না। কাজেই এদের সবগুলো কাভার করতে হবে। আর এদের কাভার করার জন্য আপনাকে কাভার করতে হবে GRE score, TOEFL score (or IELTS), রেডি রাখতে হবে পাসপোর্ট, এবং কেবলমাত্র প্রফেসরের রেকমেন্ডেশন নেয়া বাদে আর সবি আপনার নিজের কাজ। এদের এগিয়ে রাখুন। একি সাথে মাথায় রাখুন, প্রফেসরদের সাথে আলাপ করা ও রেকমেন্ডেশন নেয়া যেহেতু আপনাকে একা করতে হচ্ছে না, আপনার প্রফেসরও ইনভলড সেখানে, কাজেই অনেক বাড়তি সময় লাগবে। আপনি ইমেইল করলেন, হয়তো প্রফেসর রিপ্লাই দিলেন ৮ দিন পর। তার জবাবে আবার ইমেইল করলেন, তিনি জবাব দিলেন আর ৮ দিন পর। রেকমেন্ডেশন লেটার আপলোড করতে ভুলে গেলেন। আবার ইমেইল করলেন, আবার উত্তর পেলেন ৮ দিন পর। তাই ডেডলাইন যে তারিখে লেখা আছে তার অন্তত ২-৩ মাস আগে ব্যাচেলরের প্রফেসরদের সাথে যোগাযোগ করে ফেলুন, যেন সময়ে রেকমেন্ডেশন পাওয়া যায়।
* এই এক-ই কারণে আমি বলে থাকি, আপনার উচিত সঠিকতম ও নিখুঁততম GRE বা TOEFL এর জন্য অপেক্ষা না করা এবং দিয়ে ফেলা। কারণ ও ছাড়াও আপনার অ্যাপ্লিকেশন কীভাবে কমপ্লিট করবেন? অনেকেই প্রফেসরদের কাছে ইমেইল পাঠাতে এতই ব্যস্ত হয়ে যান যে এসেনশিয়াল অনেক কিছু মিস করতে থাকেন। এটি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা – আপনাকে যদি প্রফেসর ফুল ফান্ডিংয়ের প্রতিজ্ঞা করে, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই না করলে আপনাকে তিনি নিতে পারবেন না।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৫ – হোঁচট খাওয়ার মানেই, হেরে যাওয়া নয়

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *