আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৩ – শুরু থেকে শেষটা ঝাপসা জানা
প্রথম রাতেই বেড়াল মারার যে আলাপ বাঙালি করেন, তা সব সময় সত্য হয় না। ঠিক যেমনটা করতে গিয়ে লটকে গেলো আমার রুমমেট উইল।
তখন আমেরিকায় আসার ৩ সপ্তাহ হয়ে গেছে আমার। এই ৩টি সপ্তাহ আমি একেবারেই বেকার কাটিয়েছি। উম, না। একেবারে বেকার কাটিয়েছি তা বলা যাবে না হয়তো। করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু আগের মতো নেই। আমাকে দুটো দফায় ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। সিভিএস ফার্মেসি থেকে প্রথম ডোজ নেয়ার জন্য যখন গেছিলাম, আমার ধারণা ছিলো লোকের ভিড় থাকবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া থাকলেও, আগের লোকেরা হয়তো দেরি করিয়ে দেবে কিছু। আর যদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিকভাবে রক্ষাও করতে পারে ওরা, কিছু লোকজন তো দেখবোই।
আমাকে হতাশ হতে হলো, কিংবা আনন্দিত। ভেতরে লোক ছিলো না একজনও। আমি একেলা। আমাকে বসিয়ে রাখলো উলটো ৪৫ মিনিট। তারপর আরেকজন আফ্রিকান-আমেরিকান ভদ্রমহিলা এলেন। মনে হলো দুটো অ্যাপয়েন্টমেন্ট এমন ছাড়া ছাড়াভাবে আছে বলেই উনারা মিলিয়ে নিলেন। “গুঁতো” খেয়ে ফিরে আসছি, ভাইয়া ড্রাইভ করছে, জিজ্ঞাসা করলাম, “এত কম কেন লোক? আমি তো ভেবেছিলাম এলাকা কাঁপিয়ে দেবে।”
ভাইয়া হাসলো। সে হাসিতে তিক্ততা। বললো, “গোঁড়ামি, উগ্রতা আমেরিকানদের মধ্যে আমাদের দেশের থেকে কম নয়, বরং বেশিও কিছু ক্ষেত্রে। রিপাবলিকানদের নিয়ে এই সমস্যা। তারা ভ্যাকসিন নেবে না। এজন্যই তোর ইউনিভার্সিটি রিমোট ক্লাস নিতে পারছে না। টেক্সাস ওদের এলাকা, আর তা যদি ওরা নেয়ার ঘোষণা দেয়, অনেকগুলো ভ্রু কুঁচকে যাবে। তারা ধরে নেবে এই প্রতিষ্ঠানের লোকজন ডেমোক্র্যাটদের ভক্ত। ভ্যাকসিন নিচ্ছে, অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছে। এটা এক ধরণের রাজনৈতিক ঝুঁকি। তুই বোধহয় জানিস না, এই কিছুদিন আগেও ওরা অনেকগুলো ভ্যাকসিন ফেলে দিয়েছে। ডেট এক্সপায়ারড হয়ে গেছিলো। কেউ নেয়নি।”
বুঝলাম। অকারণ এক দুঃখবোধ আমাকে ঘিরে ধরলো। এর একদিন আগেই খবরে পড়েছি ভ্যাকসিন নেবার জন্য আমাদের দেশে লোক হামলে পরেছিলো, কেলেঙ্কারিও হয়েছে কিছু। এত আগ্রহ নিয়ে এসেও সবাই ভ্যাকসিন পায়নি। আর এদের আছে, কিন্তু নেবে না। ফেলে দিচ্ছে। দেশের কথা ভেবে, দেশের মানুষের কথা ভেবে, আর এই এখানকার ওদের বিলাসীতা দেখে অক্ষম এক ক্রোধে মন বিষিয়ে উঠলো।
ভ্যাকসিন নেয়া হয়ে গেছে আমার দুটো। ইফতি ভাইদের সাথে সেদিন দেখা করার কথা। তারা মাত্রই নিউইয়র্ক ট্যুর সেরে এলো। সে কী আড্ডা, সিপ সাম থাই রেস্তোঁরায়। খেলামও চুটিয়ে। ২০শে আগস্ট, ২০২১। আমার সেদিন অ্যাপার্টমেন্টে উঠে যাবার কথা ছিলো। অথচ ভাইয়াদের এখানে বেসুমার খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি। ২৩ তারিখে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা, কাজেই তাড়াহুড়ো নেই। তবে আমার আর ৩ অ্যাপার্টমেন্ট-মেট তো আছে, তাদের একজন হচ্ছে উইল ক্র্যাগিট। ফিম্ল নিয়ে পড়াশোনা করছে টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। একদিন হলিউডে বড় বড় সিনেমা বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে চায় সে। এদিকে আমি লিখি উপন্যাস। একবারও দেখা না হওয়া সত্ত্বেও একে অন্যকে দারুণ পছন্দ করে ফেললাম। বেশ কিছু টেক্সট আদান প্রদান হয়েছিলো রুমসিংক অ্যাপে, কে কবে উঠছি ইত্যাদি নিয়ে হাল্কা আলোচনা করে ফেলা।
মনে পড়লো, আজ উইলেরও তো মুভ-ইনের ডেট। একটা টেক্সট দিয়ে দেখি তার কী খবর।
জানতে চাইলাম, “কী হে। উঠলে নাকি?”
জবাব এলো, “এখনো দু’ঘণ্টা দূরে আছি।”
বললাম, “দারুণ এগিয়ে আছো। আমি এখনো ১৭ ঘণ্টা দূরে আছি।”
নিউ ইয়র্কের চমৎকার বর্ণনা চাঁদনী আপু আর ইফতি ভাই আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাচ্ছি। তবে একটু পর তারা লুপে পরে গেলেন। কারণ, নিউইয়র্কের যাত্রা-বিবরণীতে নিউইয়র্কের বর্ণনা ২০ শতাংশ, আর খাবারের বর্ণনাই সিংহভাগ। আমাদের জন্যও হিসাব রাখা সুবিধে হয়ে গেল। যদি এক খানা থেকে আরেক খানার মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এই “নিউ-ইয়র্কনামা”কে আমরা একটি করে চ্যাপ্টার হিসেব করি, তবে তখন আমরা ছিলাম ১১৪ তম চ্যাপ্টারে। তেমনই এক গুরুতর মুহূর্তে উইল বললো, “ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়।”
জানতে চাইলাম, “মারাটা খেলে কোথায়?”
ফিল্মের ছাত্র ফিল্মি স্টাইলে বললো, “অফিস বন্ধ হইয়া গেছে মিয়া। মাল-সামানা নিয়া খোলা আকাশের তলে বন্দী হয়া আছি।”
এ দেখি আকাশ ভরা তারা, উইলের হোগা মারা সারা! নতুন একটি শহরে একজন ছাত্র এসেছে, যে এখানকার কাউকে চেনে না। এবং বাইরে আটকে আছে, এটা একটা বড় সমস্যা। কারণ একা নিজে রাস্তায় বাইরে আটকে গেলে কোনভাবে হয়তো পার করে দেবেন রাতটা। তবে এটা মুভ-ইন। অর্থাৎ ছাত্রটি তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নিয়েই এসেছে। এত দামী ও সস্তা জিনিস নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাত কাটানোটা খুব স্বস্তির ঘটনা হওয়ার কথা নয়।
বললাম, “অফিসে ফোন দিয়ে দেখো।”
উইল জানালো, ফোন দিয়েছে, তারা আবার তাকে আরেকজনের নাম্বার দিয়ে বলেছে কল করতে। ইনিও স্টাফ। তবে সে কল ধরছে না। কেন ধরছে না তা অনুমেয়। রাত প্রায় ১২ টা বাজে। আর টেক্সাসে লোকে ৮ টার দিকেই খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে। ১২ টা মানে তাদের কাছে গভীর রাত।
আমি তাকে দ্রুত নবীজির ফোন নাম্বার দিলাম। লিজ সাইন করার সময় যে কাগজটি ছিলো তা অনুসারে এরাই আমাদের ফ্ল্যাটমেট হওয়ার কথা। নবীজি শুনে নাক কোঁচকাবেন না, এই ছেলের নাম প্রফেট। বাবা-মা রেখেছে এমন নয়, বংশগত নাম। মানে আব্রাহামের বংশ। যে বংশের সবাই নবী। রাজতন্ত্রের সিলসিলা। নবী কেবল এক বংশেই আসবে। যত্তোসব!
খানিকবাদে উইল বললো, “নবীজিকে ফোন দিলাম। পেয়ারা নবী বলছেন ওদের অন্য রুম দিয়েছে। ওরা আমাদের রুমমেট না।”
দ্রুত পোর্টালে লগ ইন করে দেখলাম, রুমমেট বদলেছে। নবীজি এখন আলাদা রুমে। তার সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হলো না। নতুন সব রুমমেটদের তালিকা ঝুলছে এখন লিজ ডকুমেন্টসের নিচে।
সেখানেই পাওয়া গেল ইস্টনকে, টেক্সাস ষ্টেটের আরেকজন গর্ব। ছোকরার নাম্বার উইলকে দিলাম। নিজেও কল করলাম। রিসিভ কেউ করার নেই। রাত বারোটায় ছাত্ররা ঘুমিয়ে না পড়লেও “মাস্তি” নিশ্চয় করে। কল দিলেই ধরবে এমন হওয়ার সম্ভাবনা কম। মাস্তি যদি নাও করে, কুত্তার মতো পড়ছে তা নিয়ে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। ভয়েস মেসেজে বললাম, “দ্যাখো বাপু, আমি তোমার ফিউচার রুমমেট, আর দরজার বাইরে ভেটকি মেরে আছে আমাদের আরেকজন ফিউচার রুমমেট। তারে উদ্ধার করো। না না, ‘করোহ’।”
কানটা খাড়া করে শুনলাম ইফতি ভাইদের নিউ-ইয়র্ক কাহিনী তখন ১২৮ তম চ্যাপ্টারে। তারা এখন জানাচ্ছেন মার্কামারা এক ভারতীয় ডিশের কথা, নিউ ইয়র্কে গিয়ে তা ট্রাই না করলে নাকি জীবনই বৃথা। আমিও ধরেই নিলাম ইস্টন আর কল ব্যাক করছে না। হয় মুভ-ইনের ধকলে বিশাল ঘুম দিচ্ছে, নয়তো মদ খেয়ে চুর হয়ে আছে। অগত্যা মধুসূদন। উইলকে বললাম আপডেট জানাতে, এবং নিউইয়র্কের গল্পে মনোনিবেশ করলাম। ইফতি ভাইকে দেখলাম ১২৯ তম চ্যাপ্টারের দিকে মোড় নিচ্ছেন।
কে যেন জিজ্ঞাসা করলো, “ভাই, ছিলেন তো কেবল চারদিন। এতো খাইলেন কখন?”
প্রশ্নটিকে না শোনার ভান করে ইফতি ভাই তাদের দুর্ধর্ষ খাদক-অভিযানের কথা বলে যেতে লাগলেন। নিউ ইয়র্কবাসীর অবস্থা ছিলো এমন, “পড়েছে ইফতি পরিবারের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।” এসব বাজে প্রশ্নে মনোযোগ না দিয়ে আমিও কানটি খাড়া করে শুনে নিলাম যা শোনা যায়। ট্রাভেল ব্লগ না লিখলেও, কোনও এক গল্পে তো মেরে দেওয়াই যাবে তাদের অভিজ্ঞতা।
ইফতি দম্পতি যখন ১৩৫তম অধ্যায়ে, আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ইস্টন গিল।
ধরতেই হাহাকার করে উঠলো সে, “দরজা তো খুলে দেখলাম, বাইরে নেই কেউ।”
আমিও হাহাকার করে বললাম, “বাইরে মানে ঠিক বাইরে এমন তো নয়, এলাকাতেই আছে। দাঁড়াও আমি তাকে এখনই তোমাকে ফোন করতে বলছি।”
সৌভাগ্যক্রমে বিশ মিনিট পর উইল অন্তত আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে পেরেছিলো। তবে রুম পর্যন্ত নয়। রুমের চাবি তার কাছে নেই। তাকে ঘুমাতে হয়েছিলো লিভিং রুমের কাউচে।
উইল ক্র্যাগিট প্রথম রাতে বেড়াল মারতে পারেনি। বরং বেড়ালই উইল ক্র্যাগিটকে প্রথম রাতে মেরে দিয়েছে।
এই ঘটনাটির সাথে উচ্চশিক্ষার যে পথ, তার কিছু মিল আছে। উইল বিপদে পরেছিলো, কারণ সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারণা রাখেনি। সে শুধু জানতো ২০ তারিখ তাকে পৌঁছাতে হবে এখানে। তারপর যা করার অফিসই করবে। তবে পুরো প্রসেসটা সম্পর্কে ধারণা থাকলে সে জানতে পারতো কোন কোন গর্তে সে পড়তে পারে। যেমন – একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য : অফিস কয়টার সময় বন্ধ হয়ে যায় তা। আর আগে থেকেই সেসব গর্ত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সম্ভাবনা থাকতো।
উচ্চশিক্ষার পথটি বিশাল ও বিস্তৃত। তাই অনেকেই মনে করেন এতো দীর্ঘ পথে আমার খবর রেখে কাজ কী? বরং ওয়ান স্টেপ অ্যাট আ টাইম।
এটি চমৎকার চিন্তা। ওয়ান স্টেপ অ্যাট আ টাইম অবশ্যই ভাবা উচিত। তবে সঠিক চিন্তার প্রথম ধাপ এটা। তার আছে দুটো ধাপ। যে কোনো একটি ধাপ যদি মিস করেন, অনেক অকারণ ঝামেলায় সামনে পড়বেন। ঠিক বন্ধু উইলের মতো।
সঠিক চিন্তার ধাপ দুটো –
১। ওয়ান স্টেপ অ্যাট আ টাইম : বিস্তারিত জানার দরকার নেই সব ধাপ, তবে যখন যে ধাপে আছেন তার আদ্যোপান্ত জেনে নিন।
২। সব জানুন : সবগুলো ধাপ সম্পর্কে জানতে হবে, তবে প্রথমে কেবল ঝাপসা জানলেই চলবে। শুধু চলবে তাই নয়, এটিই ভালো। নতুবা আপনি হয়ত এতো এতো কাজ দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারেন।
এই দুটো ধাপের যে কোনো একটিতে আপনি যদি ঢুকতে যান, এবং অপরটিকে গুরুত্ব না দেন, তাহলে পুরো জার্নিটা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে আপনার। এমনকি মাঝপথে ডিমোটিভেটেড হয়ে ছেড়েও দিতে পারেন। বেশিরভাগই তাই করেন। যে কারণে প্রথম রাতে বেড়াল মারতে যাবেন না, বেড়াল-ই আপনাকে মেরে দেবে।
🇺🇸 নির্দেশনা 🇺🇸
পুরো প্রসেসটির আদ্যোপান্ত জেনে নিন, তবে সংক্ষেপাকারে। এতে করে অন্তত পাথওয়েটা সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকবে। দরকার হলে ৩ ধাপ সামনের কিছু করা লাগলে আগেভাগে করে রাখতে পারবেন। শুরুতেই আপনার কী কী জানার দরকার পড়বে তা নিয়ে আগামি অধ্যায়ে আলোচনা হবে।
পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৪ – পথটা
Leave a Reply