KP Imon

Words Crafted

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা | অধ্যায় ০৫ – হোঁচট খাওয়ার মানেই, হেরে যাওয়া নয়

বাজে ছাত্র আমি, এই হতাশা থেকে একবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। চারতলার ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে।
ক্লাস নাইনে পড়ি। ফিজিক্সে ফেল করলাম। আমার পরিবার তখন ঢাকায় মুভ করেছে দুবছর হলো। বাবার চাকরির উদ্দেশ্যে নয়, আমাদের পড়াশোনার জন্য। সবাই কম বেশি স্ট্রাগল করছে। লক্ষ্য একটাই, আমাদের জীবনে যেন আসে সফলতা। আর এদিকে আমি কী না মেরে বসলাম ফেল! টিনেজ বয়স, মাথা গরম। মনে হলো পরিবারকে ব্যর্থ করে দিয়েছি। স্কুলের রেজাল্ট আসার আগেই ফেল যে মেরেছি তা জেনে ফেললাম। বিসিআইসি স্কুলে আমাদের পদার্থবিজ্ঞান তখন পড়াতেন ফারুক স্যার। আমি তার কাছে প্রাইভেট পড়তাম না। তবে যারা পড়তো তারা ৫০ এ আমার ৮ পাওয়ার খবরটি নিয়ে এলো (মোট ৪৪ পেয়েছিলাম, তবে সব অংশে আলাদা করে পাশ করতে হবে। এটাই নিয়ম)। আমার একমাত্র প্রাইভেট তখন ম্যাথ, আযম স্যারের দরকারে। আমাকে ফেল করার খবরটি বন্ধুরা সেখানেই দিলো। তারপর সেদিন আমরা চারতলা বিল্ডিংটির ছাদে উঠেছিলাম। রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ালাম। নিচের দিকে তাকিয়ে মাটিকে বড় আপন মনে হলো। আমার মনে হচ্ছিলো, সঙ্গে আর কেউ না থাকলে আমি নির্ঘাত এখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তাম নিচে। ভবলীলা সাঙ্গ হতো।
আমেরিকায় মুভ করার পর স্যান মার্কোসে নতুন বাসায় উঠেছি। চারটি বেডরুম, প্রত্যেকের সাথে অ্যাটাচড বাথ। মাঝে সুবিশাল লিভিং রুম। সামনের ব্যালকনি থেকে পাওয়া যায় পুলের ভিউ। বেহেশতি পরিবেশ। চারতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালাম। কী আশ্চর্য! অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যটি নয় – আমার মাথার ভেতর দোলা দিয়ে গেলো ১২ বছর আগের কিছু স্মৃতি। ঠিক এই উচ্চতায় দাঁড়িয়েই আমার মনে হয়েছিলো ঝাঁপ দেয়া উচিত। আমি আমার পরিবারকে ফেইল করেছি। বাজেভাবে ফেইল করেছি! অথচ, আজ?
আজ আমার মন কানায় কানায় পরিপূর্ণ সফলতার স্পর্শে, কারণ আমি সঠিক দিকটিতেই এগুচ্ছি, যে যা-ই বলুক না কেন। চার বছরের পড়াশোনা আর তারপর নিরলস দক্ষতা-অর্জনের পর আমেরিকান এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাকে এখানে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে, সেই সাথে দিয়েছে চাকরি। চারতলার রেলিঙয়ে দাঁড়িয়ে লাফ দেবার বদলে আমি খুঁজে পাচ্ছি জীবনে এগিয়ে যাবার শক্তি! বিড়বিড় করে বললাম, “আই মেড ইট।”
গত বারোটি বছরে আমার সাথে যা যা হয়েছে তা বাংলাদেশে জন্মানো ও বড় হওয়া অনেক ছেলেমেয়ের সাথেই হয়নি। জীবনে কেবল পড়াশোনা, সংসার, পিচ্চি-উৎপাদন, ও মৃত্যু থাকবে – এমনটা আমি মেনে নিতে পারিনি। ফিজিক্সে ফেল করে আসা ছেলেটা বুয়েটের ওয়েটিং লিস্টে টিকলো, অগত্যা পড়তে শুরু করলো রুয়েটে। আট বছর আগে লেখালেখিটাকে সিরিয়াসলি নিলাম। লোকে বলে, গল্প আমি ভালোই লিখি। আন্ডারগ্র্যাডের চার বছর লেখালেখির পেছনে ভয়ানক পরিশ্রম করেছি, বিএসসিটা পাশ করে যখন বেরুচ্ছি – ১০টি বই প্রকাশিত হয়ে গেছে আমার। ফেল করিনি কোথাও, কোন কোর্সে। ভালো পারতাম ক্যাড ডিজাইন, আগ্রহ ছিল ইঞ্জিনে। হাড়ভাঙা এক প্রজেক্ট করার চেষ্টা করেছিলাম আন্ডারগ্র্যাডে, যেটা আমার মনমতো করতে পারিনি পয়সার অভাবে। এরপর একটি ফার্মের হয়ে সাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কিছুদিন কাজ করলাম পার্টেক্স পেট্রো লিমিটেডের এক প্রজেক্টে। তবে আমাদের প্রাইভেট ফার্মটি খুব একটা ওয়ার্ক রেগুলেশন মানতো না। অধিকার-সচেতন, বিদ্রোহী আমি ছেড়ে দিলাম ওটা।
তারপর প্রকৌশলবিদ্যা একেবারেই সরিয়ে রেখে ঢুকে পড়লাম হেলথকেয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে। ৪ মাস কড়া বায়োলজি পড়ানো হলো। পাশ করতে হলো ৯০% নম্বর নিয়ে। মানবদেহ নিয়ে দারুণ জ্ঞান নিয়ে শুরু করলাম মেডিকেল স্ক্রাইবের চাকরি। টাইপিং স্পিড ছিল ৬৭ শব্দ প্রতি মিনিট – সেখান থেকে উন্নীত হলো ৯০-১১০ শব্দ প্রতি মিনিটে। এরপর খেলাম নিদারুণ ছ্যাঁকা। একেবারে পাশা উল্টে গেলো। তারপর সোশাল মিডিয়াতে আমার একান্ত নিজস্ব মতামত অনেক উগ্রবাদী সংগঠনের পছন্দ হলো না। তারা আমাকে মেরে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লাগলো। দু’বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো আমাদের চৌকস আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারণে।
ওরকম একটা সময়ে যদি আপনি আমার জীবনের দিকে তাকাতেন, হয়তো বলতেন, “তুমি তোমার জীবন নিয়ে আসলে কী করছ?”
কেউ কেউ বলেছিলো।
আমি বলেছিলাম, “যাপন করছি। শিখছি, যা শিখতে ভালো লাগে। বলছি, যা বলতে ভালো লাগে। বাংলাদেশে ক’জনের সে সৌভাগ্য হয়?”
সৌভাগ্যের ব্যাপার আসলে নয়, এটা আদায় করে নেবার ব্যাপার। আসল কোথায় আসি। বাংলাদেশে বড় হতে থাকা একটি ছেলে বা মেয়ের জন্য তার পছন্দের সাবজেক্ট পড়া কঠিন বিষয়। আপনার বাবা-মা হয়তো চাবেন আপনি দারুণ অঙ্ক শিখবেন, ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিংবা ডাক্তার। সমাজের পছন্দে প্রেম করতে হবে, সমাজেরই পছন্দে বিয়ে। চাকরিটাও করতে হবে সমাজের দিকে তাকিয়ে। আপনার যদি দমকলকর্মী হওয়ার সখ ছেলেবেলা থেকে থাকে, হতে পারবেন না। মানুষ হাসবে পিছে। বলবে, “ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে দমকল হয়েছে।”
মানে, তাদের সখটি দেখুন। আমার মস্তিষ্কের ওপরও যেন তাদের একচেটিয়া অধিকার। লে বাবা। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আইকিউ যে ভদ্রলোকের ছিল, ধারণা করা হয় – আইনস্টাইনের থেকে স্মার্ট তিনি; একাডেমিক ও নন-একাডেমিক সবকাজেই শাইন করছিলেন তিনি। শিক্ষকদের থেকে বেশি জানতেন, “স্লো পড়াশোনা”র ওপর বিরক্ত হয়ে সেলফ-স্টাডির কারণে। তাঁকে নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি কেবল শুরু হয়েছিলো। অথচ ত্রিশ পার করেই ছেড়ে দিলেন সবকিছু। অনেকদিন পর এক বইয়ের দোকানে তাকে একজন চিনে ফেলে। জানতে চায়, “আপনার ঐ সুপার জিনিয়াস মাথাটা দিয়ে ইদানীং কী করছেন?”
তিনি তাকে জানিয়েছিলেন, “দমকলবাহিনীতে যোগ দিয়েছি।”
অবাক হয়ে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করেছিলো, “কিন্তু আপনাকে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে চাইছে শুনেছিলাম।”
কাঁধ ঝাঁকিয়েছিলেন তিনি, যার অর্থ – বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাঁপিয়ে দিতে পারার মতো একটা মাথা থাকলেই যে তা করতে হবে এমন তো নয়। দমকলকর্মী হতে পারার মধ্যেও সার্থকতা আছে যদি কেউ তা-ই হতে চান।
আসল কথাটি এটাই। এমন নয় যে আমার এই যেমন-ইচ্ছে-বাঁচার-অধিকার তত্ত্ব খুব দুর্বল হৃদয়ের কেউ নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারবেন। না। আপনাকে সমাজ আঘাত করবে। বক্সের ভেতরের যে কোন মানুষ এবং সিস্টেম আঘাত করবে। পরিবারের দুশ্চিন্তা থাকবে। সমাজের ভ্রুকুটি থাকবে। জঙ্গিদের হুমকি থাকবে। মেয়েদের তাচ্ছিল্য থাকবে। যে কোন সময় কোন এক মাথা গরম উগ্রবাদীর কোপে মরে-টরেও যেতে পারেন। তবে এই প্রাইস আপনাকে পে করতে হবে। তবেই পাবেন স্বাধীন জীবন। যা চাইবেন জীবনে তা-ই পাবেন। আবার অপরদিকে, গৎবাঁধা নিয়মনীতিতে থাকলে পাবেন সেটাই যা আপনার দাদা পেয়েছিলো, কিংবা তারও দাদা। ইউ হ্যাভ টু ব্রেক ফ্রি।
এবং এই মূল্যগুলো চুকাতে হবে যখন, হোঁচট খাবেন। হোঁচট খেতে থাকবেন। তবে, যেমনটা চমক হাসান বলেছিলেন – “হোঁচট খাওয়ার মানেই, হেরে যাওয়া নয়।”
যিনি জীবনে ঝুঁকি নিতে চান না। খারাপ কোনও কিছু হবে এই ভয়ে একশ’টা কাজ করেন না, ব্যর্থ হবেন এই ভয়ে জীবনটিকে যাপনই করেন না, জাহান্নামে যাবেন এই আতঙ্কে এতোই তটস্থ থাকেন যে “ভুল” করতে চান না – নিজের মাথাটা খাটাতে চান না – কেবল তাই করেন যা তাকে বলে দেয়া হয়েছে, এ-প্লাস ছুটে যাবে এই ভয়ে ভালো গানের গলা থাকার পরও গাইতে সময় দিতে চান না, সিজিপিএ কমে যেতে পারে সেই আতঙ্কে দারুণ লেখার হাত থাকলেও লিখতে বসেন না – এইসব মানুষকে অনুসরণ করবেন না। এরা ঝুঁকি নিতে চায় না, সেইফ খেলতে চায়, আবার রিটার্নও চায়। মনে রাখবে, ঝুঁকি ছাড়া রিটার্ন আসে না। অনুসরণ করবেন সবটুকু বাজি ধরে যারা বাঁচতে চায়, সেই হিম্মত যাদের আছে, তাদের। কারণ দিনশেষে, এদের পায়ের কাছেই এসে ধরা দেবে দুনিয়া।
হোঁচট খাওয়ার ভয়ে পথটা হাঁটা বন্ধ করলেই আপনার জীবন শেষ। ৩,০০০ বছর আগের লাইফস্টাইল ফলো করতে চায় যারা, তাদের অনুসরণ করতে গেলেই আপনার জীবন সফলভাবে ৩,০০০ বছরের আগের মানুষদের মতো ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। শেষ কথা হচ্ছে, জীবন একটু যুদ্ধ, আর প্রতিটি জয় বা পরাজয় সেই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নয়। কেবল একেকটি লড়াইয়ের জয় বা পরাজয়। নেভার বি অ্যাফ্রেইড টু লুজ সাম ব্যাটলস, টু উইন দ্য ওয়ার।
মোটিভেশনাল স্পিচ লেখার দরকার অধ্যায় পাঁচে ছিল। এই লেখাটিকে আমি সতর্কভাবে সাজিয়েছি। আগের অধ্যায়েই পুরো প্রসেসটা নিয়ে ঝাপসাভাবে আলোচনা করেছি। নতুন কাউকে ঘাবড়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। তার ওপর আমি আরও যোগ করতে চাইছি, এই এতো ধাপ পার করেও অসংখ্য ব্যর্থতার জায়গা এখানে আছে।

ব্যর্থতার জায়গা ০১ : আপনি ৩০০ প্রফেসরকে ইমেইল করেছেন, একজনও রিপ্লাই দেননি। ৪/৫ জন জেনেরিক রিপ্লাই দিয়েছেন, যা রিপ্লাই না দেবার থেকে বাজে।
ব্যর্থতার জায়গা ০২ : ৩/৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করে ফেলেছেন। কেউ ডাকলো না। মনে হচ্ছে এসব করে লাভ নেই। আপনাকে দিয়ে হবে না হায়ার স্টাডি।
ব্যর্থতার জায়গা ০৩ : যেসব জায়গায় অ্যাপ্লাই করেছেন তাদের একটি উত্তর দিয়েছে। বিনীতভাবে জানিয়েছে, আপনাকে তারা নেবে না। এমন ইমেইল পাওয়ার পর অনেকেরই মনে হয় “এসব বাল করে ৫০-৬০ ঘণ্টা হুদাই নষ্ট করলাম। বালের জীবন।”
এমন অবস্থা যদি আসে, হাল ছাড়া যাবে না। যা করছিলেন, তা করে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করতে থাকা, অ্যাপ্লাই করতে থাকা। মনে রাখতে হবে, যে সহে, সে রহে

(আমার ক্ষেত্রে ১০ টি আবেদনের জবাবে ৫ টি ইতিবাচক উত্তর এসেছিলো, ৫ টি নেতিবাচক। এদের মধ্যে দুটো আমি গ্রহণ করি। একটিতে ক্লাস শুরু করেছি। অপরটি আগামী সেমিস্টারের জন্য ডিফার করা, সেটি নিলে আগামী সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয় বদলে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, স্যান অ্যান্টনিও-তে পিএইচডি করতে চলে যাবো।)

 🇺🇸 নির্দেশনা 🇺🇸 
এই পথে নামলে আগে হোক আর পরে, আপনাকে কিছু সময় হোঁচট খেয়ে পার করতে হতে পারে। সেটি সবাইকেই খেতে হয়। এরপর লেগে থাকলো যে, সেই সুযোগ পায়। আর যে লেগে থাকলো না, সে বাদ পড়ে। হোঁচট খাওয়া সমস্যা নয়, বরং হোঁচট খেয়ে হাল ছেড়ে দেয়া সমস্যা। এটা খুব ক্যাজুয়ালি বলছি, তবে এই অধ্যায়টি, এই কথাগুলো সামগ্রিকভাবে পুরো লেখাটির থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এটার ওপর ভিত্তি করেই মানুষ আমেরিকা-ইংল্যান্ড যায় পড়াশোনা করতে, নয়তো যায় না। ট্রাস্ট মি অন্য দিস।

পরের অধ্যায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন – অধ্যায় ০৬ – এই পথ যদি না শেষ হয়

কিশোর পাশা ইমন

Website: http://kpwrites.link

১২টি ক্রাইম থৃলারের লেখক কিশোর পাশা ইমন রুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিলেন, এখন টেক্সাস ষ্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেছেন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে টেক্সাসের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ইউটি ডালাসে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির ছাত্র। ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, ও উপন্যাস লিখে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। তার লেখা প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে। তার বইগুলো নিয়ে জানতে "প্রকাশিত বইসমূহ" মেনু ভিজিট করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *