টুকটাক অর্জন তো জীবনে কিছু ছিলো, কিন্তু আমি আমার সবচেয়ে গর্বের মুহূর্তগুলো যদি মনে করি সেটা আসলে এসেছে রিপ্রেজেন্টেশন থেকে। রুয়েট লাইফে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে কোন একটা সংখ্যার নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রী আমাকে বলেছে, তারা কুয়েট ও চুয়েটেও চান্স পেয়েছিল, রুয়েট বেছে নিয়েছে কারণ তারা জানে কেপি ভাই এখানে পড়ছে। আমাকে তেল দিতে বলেছে? আমার মনে হয় না। আমি র্যাগ দেয়া সিনিয়র ছিলাম না যে আমাকে তেল দিতে হবে। ওটা বলেছে কারণ আমি রুয়েটকে রিপ্রেজেন্ট করেছি।
অগমেডিক্সে কিছু সংখ্যক ব্রাদার-সিস্টার জয়েন করেছে, আমি থাকাকালে এবং চলে যাওয়ার পরও – কারণ কেপি ভাই এখানে কাজ করে গেছে। অগমেডিক্স ছিল আমেরিকান একটা প্রতিষ্ঠান, তেলবাজির কালচারই নেই। ওটা ওরা করেছে স্রেফ আমার রিপ্রেজেন্টেশন অনুসারে। স্মোকিং জোনে মজা করে শাফকাত ভাইকে বোধহয় বলেছিলাম, “এই সবগুলো পোলাপানের রেফারেল বোনাস আমার পাওয়া উচিত না? পাওয়া তো উচিত। হাহা।”
টেক্সাসে পা রাখার পর কিছু ছোটখাটো ব্যক্তিগত অর্জন হয়েছে। কোনটাই আমাকে তেমন গর্বিত করতে পারেনি। তবে আমেরিকান কোন ছেলে-মেয়ে যখন আমার কারণে বাংলাদেশ নিয়ে ভালো কথা বলে, তখন ভালো লাগে। সচরাচর আমাদের কমিউনিটির একটা ভিক্টিম প্লে কার্ড আছে, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়ার ছেলেমেয়েরা এসে মাঝে মাঝে বলে, ❛আরে ওরা বাইরের লোকজনকে গুরুত্ব দেয় না।❜
গুরুত্ব দেয়ানোর জন্য যে আমাদেরকেও ইম্প্যাক্ট ফেলতে হবে, তা আর তারা বলে না। পরীক্ষায় ছয় মারলে কোন ইম্প্যাক্ট পড়ে না। পারফর্ম্যান্সে ছয় মারলেও না। সেক্ষেত্রে একটা স্টেরিয়োটাইপ আসে কেবল, ❛ইন্ডিয়ানরা অঙ্কে ভালো❜ কিংবা ❛চাইনিজরা অনেক খাটে।❜ ওটা দিয়ে মিউচুয়াল রেসপেক্ট আদায় করা যায় না। সেটা আদায় করার জন্য চারিত্রিক ক্যারিজমা দেখাতে হয়, যেন আমাদের পার্সোনাল লেভেলে গিয়ে তারা ফিল করতে পারে।
এক লোকাল ছেলে যখন জানতে পারে বাংলাদেশে কাকের থেকে কবির সংখ্যা বেশি এবং জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য মানুষ সাহিত্যিক – সে নিজে নিজে গুগল টুগল করে এসে পরে বলে ❛তোমাদের মধ্যে ট্যাগোর নামে একজন দেখি নোবেলও পেয়েছে। তোমরা দেখি ভাই জিনিস। বই-টই অনুবাদ করো দ্রুত। পড়বো।❜
তখন ভালো লাগে। ওকে ট্যাগোর চিনতে আমি বন্দুক তাক করি নাই। বাংলাদেশ নিয়ে গুগল করতে প্যারা দেই নাই। আমার লেখালেখি নিয়েও আলাপ করি নাই আসলে। স্রেফ থেকেছি নিজের মতোই, তার কাছে আমার ক্যারেকটারটা ক্যারিজমাটিক মনে হয়েছে, সে আমার ব্যক্তিগত জীবন ও দেশ নিয়ে আগ্রহী হয়েছে। এটাই রিপ্রেজেন্টেশন।
লোকাল কোন মেয়ে যখন একেবারে নিজে থেকেই ব্যাপক আগ্রহী হয়ে যায়, ❛তোমার দেশ কোনটা যেন?❜ বাংলাদেশ জানার পর দ্রুত বলে, ❛দাঁড়াও দাঁড়াও, জিওগ্রাফির ক্লাস তো করেছিলাম, আগেই বলো না ওটা কোথায়। গ্লোবাল ম্যাপ মুখস্থ আছে কি না দেখি।❜ তারপর বাতাসে মানচিত্র এঁকে বাংলাদেশ খোঁজার চেষ্টা করে, ❛এইখানে আমেরিকা। সাগর টপকালে ইউরোপ। ওদিকে রাশিয়া, নিচে এই কোণে অস্ট্রেলিয়া। এই পাশে বিশাল আফ্রিকা। ইউরোপের নিচে তোমরা। ঠিক কি না?❜
আমি হাসি, ❛ইউরোপের নিচে মিডল ইস্ট। আমরা মিডল ইস্ট ডরাই, ভাই।❜
তখন প্রবল আগ্রহে সে যখন গুগল ম্যাপস বের করে খুঁজে বের করে বাংলাদেশ।
তারে কেউ বন্দুক দিয়ে বাংলাদেশ বের করতে বলে নাই। আমি বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ করার চেষ্টাও করিনি। এই আগ্রহ জেনুইন। তখন আমার গর্ব কিছু হয়েছে।
আমি যখন এখানে হাঁটি, আমি যা তা-ই বাংলাদেশ। আমার চোখেই ওরা বাংলাদেশ দেখে। বাংলাদেশকে রেসপেক্ট করে। আবার উলটো দৃশ্যও আছে, বাংলাদেশের ছেলে এসে যদি এখানকার মেয়ের পাছা দেখার চেষ্টা করে তখন দেশের ইজ্জতটা যায়। এমন মানুষও পেয়েছি যে বলেছে ❛কিছু মনে করো না, তোমার সাথে পরিচয়ের আগে আমার ধারণা ছিলো বাংলাদেশীরা স্বার্থপর টাইপের হয়ে থাকে।❜
এজন্য আমি হুমায়ূন ফরিদীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলে থাকি, ❛লাখ টাকার বাগান খায় এক টাকার ছাগলে।❜ মানুষকে মানুষের মতো দেখতে পয়সা লাগে না। মেয়েদের বুকের বা হাতের দিকে না তাকিয়ে তাদের স্রেফ মানুষ ভেবে চোখের দিকে তাকাতেও পয়সা লাগে না। স্রেফ কাজের কথা না বলে দুটো কৌতুক করতে, দুটো সাধারণ আলাপ করতেও পয়সা লাগে না। কিন্তু কেউ কেউ সেটা করবেন না। কীসের যেন এক জাতিগত বিদ্বেষ! লাখ টাকার বাগান খেয়ে দেবেন এক টাকার ছাগলের ভূমিকায় অভিনয় করে।
অনেক আগে বলেছিলাম, প্রতিষ্ঠান ছাত্রের বা কর্মীর ব্র্যান্ডিং করে না। ছাত্র বা কর্মীই প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং করে।
আমি ভালো একটা বই লিখলে যদি পশ্চিমবঙ্গের কোনও এক র্যান্ডম পাঠক কমেন্ট করেন (কিছু দেখেছিলাম এমন) “ভদ্রলোক রুয়েটে যন্ত্রকৌশল পড়েন,” (তখন পড়তাম) রুয়েটের নামটা ওখানে গেল আমার ব্র্যান্ডিংয়ে। নট দ্য আদার ওয়ে অ্যারাউন্ড।
রুয়েটের নাম শুনে কেউ হুড়হুড় করে আমার জন্য মাঠ খালি করে দেবে না।
কাজেই প্রতিষ্ঠানের নাম ধরে গর্ব করা মোটামুটি গাধা পর্যায়ের মানুষের কাজ।
“আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা এনেছে, আমি গর্বিত সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়ে” ধরণের বাণী অকার্যকর। তোমার ব্র্যান্ডিং আওয়ামী লীগ করছে না, বরং তুমিই আওয়ামী লীগের ব্র্যান্ডিং করছো।
তুমি কি করছো সেটাই ব্যাপার।
তুমি চুপ থাকো সব অন্যায়ে, বেশ, তোমার দল খারাপ। খারাপ কিছু করলে তো কথাই নাই। স্বাধীনতায় তোমার দলের অবদান দেখার দরকার কারও পড়ছে না।
ধর্মবিশ্বাসীদের ব্যাপারটাও তাই। ইসলাম কেমন মহৎ ধর্ম এইটা কোনও ব্যাপারই না। ইসলাম তোমার ব্র্যান্ডিং করে না। তুমিই ইসলামের ব্র্যান্ডিং করো। তোমার কাজ খারাপ তো তোমার ধর্মও খারাপ।
সব প্রতিষ্ঠানের, সব ধর্মেরই মূলনীতিতে ভালো ভালো কথা লেখা থাকে। এটা দিয়ে প্রমাণ হয় না একটা রাজনৈতিক দল ভালো কি না, একটা ধর্ম ভালো কি না, একটা দেশ ভালো কি না।
আগে কি কি ফাটাফাটি কাজ করে এসেছে তা দিয়েও প্রমাণ হয় না একটা রাজনৈতিক দল ভালো কি না, একটা ধর্ম ভালো কি না, একটা দেশ ভালো কি না।
প্রমাণ হয় তাদের প্রোডাক্টদের আচরণ থেকে।
একটা দেশের মানুষ, একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মী, একটা ধর্মের অনুসারীরা কি করছে তা থেকেই বোঝা যায় সেই দেশ, সেই প্রতিষ্ঠান, সেই ধর্ম ভালো না খারাপ।
আজকে যে জিনিস খারাপ, তা যে কালকে ভালো হবে না তেমন নয়। অধিবাসী বা অনুসারীর ব্র্যান্ডিং থেকেই ভালো-খারাপ নির্ধারিত হবে।
আমরা গর্বিত হতে পারি রিপ্রেজেন্ট করে।
স্রেফ বাংলাদেশে জন্মেছি বলে ফাউ গর্ব যেটা সেটা লজ্জার। এ নিয়ে আমার অরিজিনাল থিংকিং শেখাবার বই ❛থট প্রসেস❜-এ যা লিখেছিলাম তার মূলভাব এমন – ❛আপনি কিচ্ছু না করেই গর্বিত যার জন্য তার কোনটাই গর্বের কিছু নয়। যেমন বাংলাদেশি হয়ে যদি মনে করেন আপনি গর্বিত আপনি বাংলাদেশি, তাহলে সমস্যা। বরং বাংলাদেশি হয়ে এমন কিছু করুন যেন বাকিরা বাংলাদেশকে হাততালি দেয় এবং তারপর গর্বিত হওয়ার অধিকার আপনার। মুসলমান বলে গর্বিত হলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বরং আগে মুসলমান হয়ে এমন কিছু করুন যেন সবাই মুসলমানদের হাততালি দেয়, তারপর আপনি গর্বিত হওয়ার অধিকার অর্জন করলেন। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হিসেবেও গর্ব করার কিছু নাই। আপনার বাবা যুদ্ধ করেছে। আপনি কী করেছেন? আগে এমন কিছু করুন যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লোককে উদ্বুদ্ধ করে। তারপর আপনি গর্বিত হবেন। স্রেফ বার্থরাইট হিসেবে গর্ব করা যায় না কিছু নিয়ে।❜
মজার ব্যাপার হচ্ছে ওপরের সবাই হিন্দুধর্মের যারা বর্ণপ্রথা মানেন তাদের নিয়ে হাসাহাসি করেন। বাংলাদেশি হয়ে গর্ব, মুসলমান হয়ে গর্ব, বা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে গর্ব করা ওই বর্ণপ্রথাই।
স্রেফ জন্মেছে কী হিসেবে তা নিয়ে গর্ব করার থেকে লজ্জার কিছু নেই।
বরং এমন কিছু করার চেষ্টা করা উচিত যেন আপনার জাতির, ধর্মের, মতবাদের লোক আপনাকে দেখিয়ে আপনাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে।
তবে তবুও নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে পারবে না কিন্তু, কারণ নিজেদের নিয়ে গর্ব করতে হলে তাদেরও এমন কিছু করতে হবে যা নিয়ে তাদের জাতি গর্ব করবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমি গর্বিত, তবে মুক্তিযুদ্ধের দেশে জন্মেছি বলে কিন্তু আমি গর্বিত নই। আমি গর্বিত নই বাংলাদেশি হিসেবে। নিজের ধর্ম ছিলো ইসলাম – গর্ব দূরে থাকুক, এই ধর্মের লোকজন এত লজ্জার কাজ করেছে যে একসময় ভুল বুঝে এ থেকে দূরে সরেছি। নিজের পরিচয়ে এই পরিচয় বহনের মতো লজ্জা আমি নিতে রাজি নই।
আপনাদের কারোই বাংলাদেশি হিসেবে গর্বিত হওয়া উচিত নয়, যতক্ষণ না একজন বাংলাদেশি হিসেবে এমন কিছু করছেন যেন ঢাকার একটা ফকির মনে করতে পারে, ❛আমার দেশের লোক তো ভালো রে!❜
বা, একজন ভারতীয় মনে করতে পারে, ❛বাংলাদেশিরা রেসপেক্টেবল।❜
কিংবা একজন আমেরিকান একেবারে নিজের আগ্রহে বাংলাদেশ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে, যদিও আপনি বাংলাদেশ নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি।
আমি সেই চেষ্টাই করি। দেশের জন্য ভালো কথা বলার উপলক্ষ্য হতে চাই।
আমাদের গর্বিত আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী কি এভাবে চিন্তা করেন কি না তা জানতে খুব ইচ্ছে করে!
Leave a Reply